সাহারার তপ্ত বালি আত্তিলিওর যক্ষ্মারোগ সারিয়ে দিল। গুলির আঘাতে তার দেহে যে-ক্ষত হয়েছিল, সেই ক্ষতস্থানও শুকিয়ে গেল। কিন্তু এইবার এক নতুন দুরারোগ্য ব্যাধি তাকে আক্রমণ করল। যক্ষ্মার চেয়েও মারাত্মক এই রোগের নাম আফ্রিকা-জ্বর। এই রোগে আক্রান্ত হলে মানুষ আফ্রিকাকে ভালোবেসে পাগল হয়–অরণ্য, পর্বত, নদী ও মরুভূমি-সজ্জিত এই বিশাল মহাদেশ তার দ্বিপদ ও চতুষ্পদ সন্তানদের নিয়ে বিদেশি মানুষকে এমন দুর্ভেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে ধরে যে, কিছুতেই তার নিস্তার থাকে না। আফ্রিকা-জ্বরে আক্রান্ত মানুষ পৃথিবীর কোনো স্থানেই স্বস্তি পায় না–বার বার সে ঘুরে ফিরে আসে আফ্রিকার বুকে, বন্য প্রকৃতির সাহচর্য উপভোগ করার জন্য। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন বিদেশি এই আফ্রিকা-জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন।
পূর্বোক্ত আফ্রিকা-জ্বর আত্তিলিও সাহেবকে আক্রমণ করেছিল। নিউইয়র্কে গিয়ে তিনি আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করার আয়োজন শুরু করলেন। উক্ত মহাদেশের বিষয়ে বিভিন্ন জ্ঞাতব্য তথ্য সংগ্রহ করার জন্য তিনি একটি অভিযান পরিচালনা করার সংকল্প করেন এবং ওই কাজে তাকে সাহায্য করার উপযুক্ত মানুষের সন্ধান করতে থাকেন। সেই সময়ে প্রফেসরের সঙ্গে আত্তিলিও গত্তির সাক্ষাৎ হয়। আত্তিলিওর অভিযানে বিজ্ঞান-বিষয়ক যেকোনো ব্যাপারেই প্রফেসরের সিদ্ধান্ত বা নির্দেশকে চূড়ান্ত বলে গণ্য করা হত। প্রফেসরের সম্পূর্ণ নাম উল্লেখ করেননি আত্তিলিও; তিনি ভদ্রলোককে প্রফেসর বলেই ডাকতেন, আমরাও তাই ডাকব। আত্তিলিওর লিখিত বিবরণী থেকে শুধু এইটুকু জানা যায় যে, প্রফেসর একজন ফরাসি চিকিৎসক।
এবার বিলের কথা বলছি। সংবাদপত্রে অভিযান-পরিচালনার কাজে সহকারীর জন্য যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন আত্তিলিও, সেই বিজ্ঞাপন দেখেই বিল আকৃষ্ট হয়। বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে বিল একটি আবেদনপত্র পাঠিয়েছিল। চিঠি পড়ে আত্তিলিও জানতে পারলেন যে, বিল মোটা মাহিনায় একটি হিসাব-পরীক্ষার প্রতিষ্ঠানে কার্যে নিযুক্ত আছে এবং অবসর সময়ে পড়াশুনা করে প্রত্নতত্ত্ব সম্বন্ধে কিছু জ্ঞান অর্জন করেছে। হিসাবপরীক্ষা ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে বিল যেটুকু জ্ঞান সঞ্চয় করেছে, সেই অভিজ্ঞতা আত্তিলিওর কাজে লাগতে পারে বলেই বিলের বিশ্বাস এবং আত্তিলিও যদি তাকে অভিযানে অংশগ্রহণ করার উপযুক্ত মনে করেন, তাহলে হিসাবপরীক্ষার অফিসে মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে সে যে সাগ্রহে অভিযানে যোগ দিতে রাজি আছে, এই কথাও জানিয়ে দিয়েছে বিল লিখিত আবেদনপত্রে।
এই ধরনের বহু চিঠি আসত প্রতিদিন, কিন্তু বিলের চিঠি হঠাৎ আত্তিলিওর খুব ভালো লেগে গেল। পত্রযোগে তিনি বিলকে তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। প্রথম দর্শনেই তিনি বিলকে পছন্দ করলেন, কয়েক মিনিট কথা বলেই তিনি বুঝলেন, ঠিক বিলের মতো মানুষকেই তার প্রয়োজন। বিলের পূর্বজীবন সম্বন্ধে আলোচনা করে আত্তিলিও জানলেন, মাত্র পাঁচ বৎসর বয়সেই এক দুর্ঘটনার ফলে সে পিতৃমাতৃহীন হয়েছিল। বিলের এক আত্মীয়া তাকে সন্তানস্নেহে পালন করেছিলেন, তাঁর যত্নেই বিল মানুষ হয়েছে। যে-দুর্ঘটনার ফলে বিল তার মা-বাবাকে হারিয়েছিল, সেই ঘটনার কথা সে আত্তিলিওকে বলেনি। পরে অবশ্য বলেছিল, কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে অবশ্যম্ভাবী ভয়াবহ পরিণাম সম্বন্ধে অবহিত থাকলেও নিয়তির নিষ্ঠুর চক্রান্তকে বাধা দিতে পারেননি আত্তিলিও। যে-দুর্ঘটনার ফলে বিল প্রথমে মা এবং পরে বাবাকে হারিয়েছিল, সেই ঘটনার বিশদ বিবরণ আগে শুনলে হাতিশিকারের জন্য বিলের অস্বাভাবিক আগ্রহের কারণ অনুমান করে আত্তিলিও সাবধান হতেন, কিছুতেই তাকে আফ্রিকায় নিয়ে যেতেন না।
বিলের মা-বাবা যে অভাবিত ঘটনার শিকার হয়েছিলেন, নিউইয়র্কে সংঘটিত সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা হচ্ছে বাস্তব জীবনের এক ভয়াবহ নাটক; এবং সেই নাটকের রক্তরঞ্জিত শেষ দৃশ্যের যবনিকা পড়েছিল অরণ্য-আবৃত আফ্রিকার অন্তঃপুরে।
যথাসময়ে সেই কাহিনি আমরা জানতে পারব।
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – নাম-মাহাত্ম্য
গভর্নরের বাড়ি থেকে নৈশভোজে আপ্যায়িত হয়ে নিজেদের আস্তানায় ফিরে আসার পথে তিন বন্ধুর মধ্যে যে আলোচনা হয়েছিল এবং সেই আলোচনার ফলে তারা যে মৃত্যুগহ্বরের সন্ধানে অভিযান চালানোর সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন, সে-কথা আগেই বলেছি, এখন দেখা যাক পরবর্তী ঘটনার স্রোত তিন বন্ধুকে কোন পথে নিয়ে যায়।
কয়েকদিন পরের কথা। সন্ধ্যার পর তাঁবুতে বসে আছেন তিন বন্ধু। তাঁবুর পর্দা সরিয়ে রাতের খানা নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল একটি ছোকরা চাকর। তিন বন্ধু লুব্ধ দৃষ্টিতে দেখলেন, ছোকরার হাতের উপর মস্ত বড়ো থালাতে ঝোলের মধ্যে শুয়ে একটা মুরগি, সর্বাঙ্গ থেকে ধূম-উদগিরণ করছে। চিকেনকারি! গরম!
তিন বন্ধুর রসনা সজল হয়ে উঠল।
হঠাৎ কী খেয়াল হল, প্রফেসর বলে উঠলেন, কায়না!
ঝনঝনাৎ! অ্যালুমিনিয়ামের থালাটা ছোকরার হাত থেকে ছিটকে পড়ল মাটির উপর!
দারুণ ক্রোধে চেঁচিয়ে ওঠার উপক্রম করলেন আত্তিলিও, কিন্তু তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরিয়ে আসার আগেই চাকরটা তিরবেগে তাঁবুর বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আত্তিলিও তৎক্ষণাৎ চাকরদের তাঁবুর দিকে পা চালিয়ে দিলেন। কিন্তু যথাস্থানে পৌঁছোনোর আগেই তিনি শুনতে পেলেন কয়েকটা উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, পরক্ষণেই দ্রুত ধাবমান পায়ের আওয়াজ।…