আত্তিলিও চিন্তা করতে লাগলেন। একজন ইনডানা যেন একটু আগেই কী বলছিল.. কী বলছিল?… হা, হা মনে পড়েছে দু-ঘণ্টা পরেই দূরবর্তী অঞ্চল থেকে এই এলাকায় পদার্পণ করছে সর্দার জিপোসো এবং এলাকার মধ্যে এসে পড়লে সর্বাধিনায়ক তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্বন্ধে কতক্ষণ অজ্ঞ থাকবে বলা শক্ত–অতএব দু-ঘণ্টার মধ্যে কাজ শেষ করা উচিত বলে অভিমত প্রকাশ করেছিল উক্ত ইনডানা।
দু-ঘণ্টা? এই দু-ঘণ্টা যদি জনতাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেন আত্তিলিও তাহলে বোধ হয় নগোর প্রাণরক্ষা হয়। কিন্তু এই ক্ষিপ্ত জনতাকে কি অতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব? …আত্তিলিও দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন।
একটা তীব্র চিৎকার আত্তিলিওর কর্ণকুহরে প্রবেশ করল।
না, ন্গো নয়–চেঁচিয়ে উঠেছে জনতা! রক্তপাত শুরু হয়েছে! আঘাত মারাত্মক নয়, কিন্তু বর্শার আঘাতে গোর জানু থেকে গড়িয়ে নামছে রক্ত!
আর রক্ষা নেই–আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে উঠবে তারপর হৃৎপিণ্ড বিদীর্ণ করে একসময়ে নেমে আসবে মৃত্যু!
দাঁড়াও! থামো, চেঁচিয়ে উঠলেন আত্তিলিও। নাচ থেমে গেল। দারুণ বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল যোদ্ধার দল।
আত্তিলিও বললেন, দাঁড়াও, জুলুরা, দাঁড়াও! বর্ষার দেবতা আনজিয়ানা এখনই বৃষ্টি পাঠিয়ে দিচ্ছে।
এক-শো মানুষ মুখ তুলল আকাশের দিকে। পরক্ষণেই জাগল ক্রুদ্ধ গুঞ্জনধ্বনি। কোথায় বৃষ্টি? আসন্ন বৃষ্টিপাতের কোনো চিহ্নই নেই নীল আকাশের বুকে। কারো দিকে চাইলেন না আত্তিলিও, কারো কথায় কর্ণপাত করলেন না তিনি, সোজা এসে দাঁড়ালেন জনতার মাঝখানে।
একটু অপেক্ষা করো, ধৈর্য ধরে আমার কথা শোনো, যে ইনডানার সঙ্গে আত্তিলিওর বন্ধুত্ব ছিল, সেই লোকটি এবার এগিয়ে এল। জনতাকে উদ্দেশ করে সে যে আদেশ-বাণী উচ্চারণ করল, তার মর্মার্থ হচ্ছে ধৈর্যধারণ করে সাদা মানুষের ম্যাজিকের বাক্স কী করে সেইটা দেখাই এখন জুলুদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য।
আত্তিলিও ততক্ষণে তার ম্যাজিকের বাক্স অর্থাৎ ক্যামেরা বাগিয়ে ধরেছেন এবং অতি মন্থর পদে অগ্রসর হয়েছেন গোর দিকে। ক্যামেরার লেন্স গোর বুকের কাছে ধরে ফিসফিস করে আত্তিলিও বললেন, চেঁচাও।
জোরেই চেঁচিয়েছিল গো। এমন কর্ণভেদী মনুষ্যকণ্ঠের আর্তস্বর ইতিপূর্বে কখনো আত্তিলিওর শ্রুতিগোচর হয়নি।
দেখছ? বিজয়গর্বে ঘুরে দাঁড়ালেন আত্তিলিও জনতার দিকে, এক-শো বর্শার সামনে দাঁড়িয়ে যে ভয় পায়নি, সে এখন চেঁচিয়ে উঠেছে, এখন বুঝেছ আমার ক্ষমতা?
জুলুরা চমৎকৃত! সত্যি কি ভয়ংকর ওই ম্যাজিকের বাক্স? আরও ভয়ংকর ওই বাক্সের চোখটা (লেন্স)?
এইবার একটা লম্বা বক্তৃতা শুরু করলেন আত্তিলিও। অভিভূত জুলু-অভিনেতা স্তম্ভিত বিস্ময়ে সেই আজগুবি, অদ্ভুত আর অসম্ভব কথাগুলো শুনতে লাগল। যত রকমের বিদঘুঁটে অবিশ্বাস্য বিষয়বস্তু আত্তিলিও ভাবতে পেরেছিলেন, সবগুলিই তিনি পরিবেশন করেছিলেন সেই বক্তৃতার মধ্যে।
টোয়াবেনি আর সুকামনা রাগে কাঁপছিল। তাদের দিকে নাটকীয়ভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন আত্তিলিও, কী হে! এইবার? তোমরা কী বলতে চাও?
অনেক কিছুই হয়তো বলার ছিল। কিন্তু শয়তান চুপ করে রইল। তারা জানত জুলুরা এখন তাদের কোনো কথায় কর্ণপাত করবে না–সাদা মানুষের ম্যাজিকের বাক্স, আর জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা এখন তাদের অভিভূত করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে আত্তিলিও আর এক কাজ করেছেন–পকেট থেকে সিগারেট বার করে বিলিয়ে দিয়েছেন জুলুদের মধ্যে। জুলুল্যান্ডে সিগারেট অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য আর লোভনীয় বস্তু। অধিকাংশ লোকই সিগারেট নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল হত্যার আগ্রহে যারা একটু আগেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল তারাই এখন ধোঁয়া ওড়াচ্ছে নির্বিকারভাবে!
আত্তিলিও জানতেন এই পরিবর্তন নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। আবার খেপে উঠবে জনতা। তবে কিছুটা সময় তো পাওয়া গেল। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই আত্তিলিওর উর্বর মস্তিষ্কে জন্ম নিয়েছে এক নতুন পরিকল্পনা–দেখছি? আত্তিলিও কম্পাস বার করে সকলের সামনে ধরলেন, এই দেখ, ছোট্ট বর্শাটা (কম্পাসের কাটা) কেমন কাঁপছে? এর মানে কী জান?
জুলুরা মাথা নাড়ল–না, সাদা মানুষের ভেলকি তারা বুঝতে পারে না। এর মানে হচ্ছে, আত্তিলিও বললেন, এখনই বৃষ্টি শুরু হবে। সামনের গাছটার ছায়া এই জায়গায় পড়লেই বৃষ্টি নামবে।
আত্তিলিও তার ডান পায়ের গোড়ালি মাটিতে ঠুকে জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন। জনতা এখন আর হিংস্র নয়। তাদের অস্বাভাবিক উন্মাদনা কেটে গেছে। আত্তিলিও জুলুদের স্বভাব জানতেন। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন উপস্থিত জনতার মধ্যে অনেক মানুষই এখন সর্বাধিনায়ক জিপোসোর আইন ভঙ্গ করার শোচনীয় পরিণাম সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছে। আত্তিলিও হয়েতো জনতার শুভ বুদ্ধিকে জাগিয়ে তুলে নগোকে রক্ষা করতে পারতেন, কিন্তু টোয়াবেনি আর সুকামবানা তাকে সেই সুযোগ দিল না। শান্ত জনতাকে আবার তারা উত্তেজিত করে তুলল।
…মধ্যাহ্নের প্রখর সূর্য আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে… গাছের ছায়াটা সরে সরে এসে আত্তিলিওর চিহ্নিত স্থানের খুব কাছেই এসে পড়েছে।
চাপা গলায় গর্জে উঠল টোয়াবেনি, ছায়াটা ঠিক জায়গায় এসে পড়লেই বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার কথা। যদি তা না হয় তবে গোকে হত্যা করা হবে। একটু থামল টোয়াবেনি, তার অবরুদ্ধ কণ্ঠ সাপের মতো হিস হিস করে উঠল, তারপর সাদা মানুষের পালা।