আত্তিলিওর পা দুটো তাকে ঘটনাস্থল থেকে টেনে নিয়ে যেতে চাইল সেইখানে, যেখানে পড়ে আছে তার রাইফেল–প্রবল ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে তিনি পলায়নের ইচ্ছা দমন করলেন।
ষোলো বছরের একটি বালিকা যদি এই ক্ষিপ্ত যোদ্ধাদের বিরুদ্ধাচরণে প্রবৃত্ত হয়, নিরপরাধ মানুষের প্রাণ রক্ষা করার জন্য ওইটুকু মেয়ে যদি চতুর্দিকে ভ্রাম্যমাণ শত শত নরখাদক সিংহের ভয়াবহ উপস্থিতি অগ্রাহ্য করতে পারে, তবে আত্তিলিওর মতো একজন সৈনিক পুরুষের পক্ষে পালিয়ে আত্মরক্ষার চিন্তা করাও অন্যায়।
তিনি পলায়নের ইচ্ছা দমন করে যেকোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হলেন।
চারপাশে দণ্ডায়মান জনতা ও গোর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন আত্তিলিও ক্রুদ্ধ জনতার আস্ফালন এখন থেমে গেছে, তারা ধীরভাবে অপেক্ষা করছে ইনডানাদের কথা শোনার জন্য। যতই রাগ হোক, জুলুরা ইনডানা উপাধিপ্রাপ্ত জ্ঞানী ব্যাক্তিদের মতামত কখনো অগ্রাহ্য করে না। সব সমেত তিনজন ইনডান সেখানে উপস্থিত ছিল।
প্রথমেই এগিয়ে এল সেই ইনডানা, যে প্রথমেই আত্তিলিওর সঙ্গে করমর্দন করেছিল। ওই লোকটি নগোর কাছে জানতে চাইল সে অপরাধ স্বীকার করতে রাজি আছে কি না। গো জানাল সে নিরপরাধ। ইনডানাটি তখন জনতাকে জিপোসোর জন্য অপেক্ষা করতে অনুরোধ করল। তার কথার ভঙ্গিতে বোঝা গেল গোর অপরাধ সম্বন্ধে সে নিজেও নিঃসন্দেহ নয়।
এইবার দুনম্বর ইনডানা তার অভিমত প্রকাশ করল। তার কথা হচ্ছে এই মুহূর্তে গাছের সঙ্গে বেঁধে গোকে মেরে ফেলা উচিত। জুলুদের প্রাচীন পদ্ধতি অনুসারে ধীরে ধীরে খুঁচিয়ে মারার পক্ষপাতী সে নয়, চটপট মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করতেই সে ব্যগ্র কারণ, জিপোস অকুস্থলে এসে পড়ে সব ওলটপালট করে দিতে পারে এমন সম্ভাবনার কথাও জনতাকে সে জানিয়ে দিল এবং শুভ কার্যে বিলম্ব না-করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে পরবর্তী বক্তাকে স্থান ছেড়ে দিল।
জনতার একাংশ প্রবল হর্ষধ্বনিতে সমর্থন জানাল, আর এক দলের তরফ থেকে শোনা গেল শ্লেষতিক্ত ব্যঙ্গধ্বনি!
এইবার রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হল তিন নম্বর ইনডানা। তার বক্তব্য হচ্ছে, চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী বিচার না-করলে অন্যায় হবে; অতএব গরম জলের সাহায্যে অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ নির্ণয়ের যে প্রাচীন প্রথা আছে, সেই প্রথা অনুসারেই গোর বিচার হওয়া দরকার। গোর ডান হাত ফুটন্ত জলে ডুবিয়ে দিয়ে যদি দেখা যায় সে অক্ষত আছে, তবেই বোঝা যায় সে নির্দোষ।
জনতা সোল্লাসে চিৎকার করে এই প্রস্তাব সমর্থন করল। সঙ্গেসঙ্গে কুটিরের ভিতর থেকে একটা মস্ত বড় হাঁড়ি নিয়ে এল টোয়াবেনি। আত্তিলিও বুঝলেন, শয়তানটা আগে সব ঠিক করে রেখেছিল। গোর সামনে ফুটন্ত গরম জলের হাঁড়ি রাখা হল। সে পিছিয়ে আসার চেষ্টা করল, কিন্তু শয়তান টোয়াবেনি বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরে গোর ডান হাতটা ঢুকিয়ে দিল হাঁড়ির ভিতর।
কয়েক মুহূর্ত… গোর হাত ছেড়ে দিল টোয়াবেনি… সঙ্গেসঙ্গে বাঁ-হাত দিয়ে ডান হাত চেপে ধরে মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল নগো–গরম জল তার হাতটাকে ঝলসে দিয়েছে।
ওই হচ্ছে অপরাধী, চেঁচিয়ে উঠল সুকামবানা, বেঁধে ফেলো ওকে গাছের সঙ্গেতারপর ধীরে ধীরে বর্শা দিয়ে খুঁচিয়ে ওকে শেষ করে দাও। শয়তান গোই বৃষ্টি বন্ধ করেছে আর সিম্বাদের (সিংহদের) লেলিয়ে দিয়েছে আমাদের উপর।
তৎক্ষণাৎ জন বারো বলিষ্ঠ যোদ্দা নগোকে ধরে গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলল। তারপর তাকে ঘিরে শুরু হল উদ্দাম নৃত্য। নাচতে নাচতে বর্শাধারী যোদ্ধারা গোল হয়ে ঘুরতে লাগল গোকে মাঝখানে রেখে। গোর সামনে দিয়ে ঘুরে যাওয়ার সময়ে প্রত্যেক যোদ্ধা তার দেহ লক্ষ করে সজোরে বর্শা চালনা করতে লাগল এবং এমন অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে চালিত বর্শা ফলকের গতিবেগ তারা রোধ করছিল যে, লক্ষ্যস্থলের মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে এসেই থেমে যাচ্ছিল অস্ত্রের শানিত ফলক!
এখন সময় হয়নি–
ধীরে ধীরে কমে আসবে লক্ষ্যস্থলে ও দংশন-উদ্যত বর্শাফলকের মধ্যবর্তী দূরত্ব, মৃদু আঘাতে রক্ত পান করবে একটির পর একটি শানিত বর্শা, অজস্র অগভীর ক্ষত থেকে ঝরতে থাকবে রক্তের ধারা, তারপর এক সময়ে প্রচণ্ড আঘাতে বিদীর্ণ হয়ে যাবে হতভাগ্য গোর হৃৎপিণ্ড। কিন্তু
কিন্তু নির্বাক ও নিশ্চেষ্ট হয়ে এই বীভৎস্য দৃশ্য দেখার জন্যই কি অপেক্ষা করছেন আত্তিলিও?
.
দশম পরিচ্ছেদ – জাদুকরের ভূমিকায় আত্তিলিও
অনাবৃষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, চিরস্থায়ী হতে পারে না। আত্তিলিও আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন না, কোনো আশা নেই, এখানে সেখানে কিছু কিছু মেঘ দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু বৃষ্টি সুদূর পরাহত।
পকেট ব্যারোমিটার নামক যে ছোটো যন্ত্রটি সর্বদা আত্তিলিওর সঙ্গী, সেই যন্ত্রটির দিকে দৃষ্টিপাত করলেন তিনি। ব্যারোমিটারের কাঁটা দেখে বোঝা যাচ্ছে বৃষ্টি আসন্ন, খুব সম্ভব দু-চারদিনের মধ্যেই বর্ষণ শুরু হবে। কিন্তু আত্তিলিওর তো দু-দিন পরে হলে চলবে না, এই মুহূর্তে বৃষ্টির দরকার–তবে?…
আত্তিলিও ঘড়ি দেখলেন। ঠিক এগারোটা বেজেছে। প্রায় এক ঘণ্টা হল মদাবুলি চলে গেছে। এখান থেকে। সমবেত কণ্ঠে ঐকতান সংগীত বেজে উঠেছে তীব্র শব্দে, দ্রুততর হয়ে উঠছে নৃত্যের ছন্দ–বর্শা গুলো কিন্তু এখনও গোর দেহ স্পর্শ করেনি। গোর দিকে তাকালেন আত্তিলিও। একটুও বিচলিত হয়নি সে। তার সুশ্রী মুখণ্ডলে গভীর অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের চিহ্ন!…