টোয়াবেনির উপস্থিতির সঙ্গেসঙ্গে সম্মিলিত কণ্ঠের মৃদু সংগীতধ্বনি বেজে উঠল। টোয়াবেনির পাতলা ছিপছিপে শরীরটা দুলতে লাগল একবার সামনে, একবার পিছনে… তীব্রতম পর্যায়ে উঠে গেল গায়কদের কণ্ঠস্বর… উদারা, মুদারা, তারা… তারপর আবার নীচের দিকে নেমে আসতে লাগল সুরের ঢেউ, মৃদু থেকে হল মৃদুতর, অস্পষ্ট এবং পরিশেষে বিরাম লাভ করল স্তব্ধতার গর্ভে। গান থামল। এখন মৌন জনতার নির্নিমেষ দৃষ্টির একমাত্র লক্ষ্য হল টোয়াবেনি। আত্তিলিও অনুভব করলেন এক ভয়ংকর প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছে নির্বাক মানুষগুলো।
টোয়াবেনির নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত; তার দেহে বুঝি ভর করছে প্রেতাত্মা। আচম্বিতে এক প্রকাণ্ড লাফ মেরে সে ভূপৃষ্ঠে প্রোথিত বর্শার কাছ থেকে ছিটকে অনেক দূরে এসে পড়ল, তারপর ঘুরে ঘুরে প্রত্যেক জুলু-যোদ্ধার দেহের ঘ্রাণ গ্রহণ করল। আবার ঘুরে এসে সে লাফিয়ে লাফিয়ে যোদ্ধাদের কাছে গিয়ে শুঁকতে লাগল। এক একটি লোককে দু-বার, তিনবার করে সে কল, তবু শেষ হল না গন্ধের বিচার এবং ক্লান্ত হল না টোয়াবেনি, যন্ত্রের মতো লাফাতে লাফাতে সে যোদ্ধাদের দেহের ঘ্রাণ গ্রহণ করতে লাগল বারংবার…
আত্তিলিও অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন এইভাবে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হবে কী করে? অনেকেই, বিশেষ করে অভিজ্ঞ শিকারিরা জানেন, মানুষ অথবা জানোয়ার ভয় পেলে তাদের শরীর থেকে এক ধরনের গন্ধ নির্গত হয় কিন্তু সেই গন্ধকে আবিষ্কার করতে পারে বিশেষ কয়েক শ্রেণির পশুর ঘ্রাণ-ইন্দ্রিয়। হয়তো দীর্ঘকাল অনুশীলন করার ফলে বন্য পরিবেশের মানুষ টোয়াবেনি ওই বিদ্যাকে আয়ত্ত করেছে, হয়তো সত্যিকার অপরাধীর দেহনিঃসৃত ঘামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে ভয়ের গন্ধ এবং অনুশীলন করে যদি কেউ ওই গন্ধের স্বরূপ নির্ণয় করতে পারে তার পক্ষে অপরাধীকে শনাক্ত করা খুবই সহজ। কিন্তু অনাবৃষ্টির জন্য কোনো মানুষ অপরাধ বোধ করে ভয়ার্ত হয়ে উঠবে না, কাজেই গন্ধের বিচার এখানে একবারেই অকেজো। জুলুদের পক্ষে সব কিছুই বিশ্বাস করা সম্ভব হলেও আত্তিলিওর পক্ষে এমন কড়া গাঁজা হজম করা দুঃসাধ্য।
ওই যে! ওই যে সেই লোক, যার দুই চোখে জড়িয়ে আছে অমঙ্গলের অভিশাপ তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে উঠল টোয়াবেনি। জনতা চিৎকার করে উঠল।
শূন্যে লাফিয়ে উঠল এক-শো যোদ্ধা, তাদের ঘর্মাক্ত দেহে চকচক করে উঠল সূর্যরশ্মি। একটি লোকের হাত চেপে ধরল টোয়াবেনি, শুরু হল ধস্তাধস্তি। জনতা ছুটে এসে দুজনকে ঘিরে ফেলল। অত লোকের হুটোপুটির ভিতর ধৃত ব্যক্তির চেহারা দেখতে পেলেন না আত্তিলিও, তবে বুঝলেন গন্ধের বিচার শেষ হয়েছে–
ধরা পড়েছে অপরাধী!
.
নবম পরিচ্ছেদ – ক্রুদ্ধ জনতা
আত্তিলিও অবাক হয়ে ভাবছেন টোয়াবেনির ষড়যন্ত্রের শিকার কে হতে পারে, হঠাৎ তার পাশ কাটিয়ে কেউ যেন ছুটে বেরিয়ে গেল। তিনি ঘুরে দেখলেন একটি মেয়ে। সে ছুটছিল তিরবেগে, পিছন থেকে তার মুখ দেখতে পেলেন না আত্তিলিও, তবু মেয়েটিকে তিনি চিনতে পারলেন মন্দাবুলি! তাকে চেঁচিয়ে ডাকতে গিয়ে থেমে গেলেন আত্তেলিও; তাকে কেউ দেখতে পায়নি সকলেরই ব্যগ্র দৃষ্টি সেইখানে, যেখানে জুলুদের মাঝখানে টোয়াবেনির সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে। একটি হতভাগ্য মানুষ! জনারণ্যের ভিতর থেকে তার চেহারা দেখতে না-পেলেও মদাবুলির আচরণেই আত্তিলিও বুঝে গেছেন টোয়াবেনির কবলে পড়ে যে-মানুষটি ছটফট করছে সে গো ছাড়া আর কেউ নয়। আর সঙ্গেসঙ্গে ধাবমান জুলু বালিকার উদ্দেশ্যও তিনি ধরে ফেলেছেন–সে ছুটে চলেছে সর্বাধিনায়ক জিপোসোর সঙ্গে দেখা করার জন্য।
আত্তিলিওর ভ্রূ কুঞ্চিত হল।
চারদিকে অগণিত নরখাদক সিংহের ক্ষুধার্ত দৃষ্টি এড়িয়ে অরণ্য-প্রান্তর ও পর্বতের দুস্তর বাধা ভেদ করে বালিকা কি জিপোসোর সঙ্গে দেখা করতে পারবে? পারবে কি সেই লোকটাকে বাঁচাতে যে এখন ছটফট করছে ক্ষিপ্ত কুসংস্কার-অন্ধ জনতার মধ্যে?…
হ্যাঁ, ছটফট করছে গো, তাকে চেপে ধরেছে ক্রুদ্ধ জনতা। একদল জুলুযোদ্ধা তাকে শূন্যে তুলে ফেলল, তারপর হাতে হাতে তুলে নিয়ে এল একটা মস্ত গাছের নীচে। আত্তিলিও গাছটার দিকে তাকালেন, পত্রবিহীন ওই বিশাল শুষ্ক বৃক্ষটির নাম তিনি শুনেছেন–যাতনাদায়ক বৃক্ষ। তার জুলু অনুচর জামানি একদিন তাকে পূর্বোক্ত গাছটির নাম এবং কার্যকারিতা সবিস্তার জানিয়ে দিয়েছিল। জামানির মুখ থেকেই আত্তিলিও শুনেছেন যে, গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বেঁধে প্রাচীনকালে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হত–রজ্জবদ্ধ অপরাধীর চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচগান চালাত বর্শাধারী যোদ্ধার দল এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে খুঁচিয়ে মারত ওই হতভাগ্য মানুষটিকে…।
আত্তিলিও সচমকে ভাবলেন তাকেও কি আজ ওইরকম বীভৎস হত্যাকাণ্ডের দর্শক হতে হবে? তা ছাড়া আর একটা ভীষণ সম্ভাবনার কথা তার মনে হল।
নরমাংসের স্বাদ গ্রহণ করলেই সিংহ যেমন মানুষখেকো হয়ে যায়, ঠিক তেমনিভাবেই মানুষের ভিতরকার পশুও রক্তপাতের জন্য হন্যে হয়ে উঠে নগোর রক্তপাতে উল্লসিত। জনতার মধ্যে যদি রক্তের তৃষ্ণা জাগে, তাগলে তারা কি আত্তিলিওকে রেহাই দেবে?…
ইতিমধ্যেই তাদের পরিবর্তন এসেছে। শান্তশিষ্ট মানুষগুলো বন্য পশুর মতোই ভয়ংকর হয়ে উঠছে, তাদের চোখে-মুখে এখন রক্তলোলুপ শ্বাপদের হিংস্র অভিব্যক্তি!