মুহূর্তের আবেগে পরিচালিত হলেন আত্তিলিও, হাতের রাইফেল মাটিতে নামিয়ে তিনি পাহাড় ভেঙে নীচের দিকে নামতে লাগলেন। আত্তিলিও ভেবেছিলেন, নিরস্ত্র অবস্থায় গেলে জুলুরা নিশ্চয়ই তার মনোভাব সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করবে না। তা ছাড়া রাইফেল এখন কোন কাজে লাগবে? অবস্থা যদি ঘোরালো হয়, তবে শ-খানেক বর্শার বিরুদ্ধে একটা রাইফেল নিয়ে তিনি কী করতে পারেন?
পাহাড়ের উপর থেকে নীচের দিকে নামতে তিনি যখন অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছেন সেই সময়ে হঠাৎ জনতার ভিতর থেকে একটা উত্তেজিত তীব্র স্বর সকলকে সাবধান করে দিল।
এক-শো লোকের জনতা এক মুহূর্তে চুপ, সকলের দৃষ্টি পড়েছে আত্তিলিওর দিকে! পাহাড়ের মাঝামাঝি নেমে এলেন আত্তিলিও। জনতা কথা কইল না, নিঃশব্দে তাঁকে লক্ষ করতে লাগল। নীচু জায়গাটা পার হয়ে পরবর্তী উচ্চভূমির উপর পা রাখলেন আত্তিলিও, সঙ্গেসঙ্গে মুখর হয়ে উঠল মৌন জনতা! সকলেই একসঙ্গে কথা বলতে চায়।
উঁচু জমি পার হয়ে এসে দাঁড়ালেন জুলুদের মাঝখানে–তৎক্ষণাৎ চিৎকার, গোলমাল, হইহই, ধুন্ধুমার কাণ্ড!
আত্তিলিও জুলুদের কাছে বিনীত ভদ্র ব্যবহার পেতে অভ্যস্ত, কিন্তু জনতার মধ্যে কেউ তাকে ভদ্রতাসূচক অভিবাদন জানিয়ে অভ্যর্থনা করল না। ভদ্রতা, শিষ্টতা প্রভৃতি সৌজন্যবোধ সেদিন জুলুদের ভিতর থেকে অন্তর্ধান করেছে সাদা মানুষের অনধিকার চর্চায় তারা বিরক্ত, কয়েকজন আবার বিরূপ মনোভাব গোপন করতেও চাইল না। আত্তিলিও দেখেও দেখলেন না, বুঝেও বুঝলেন না। সোল্লাসে হাত নেড়ে তিনি জুলুদের অভিবাদন জানালেন, সালাগাতলে!
একজন উত্তর দিল। সেই একজন অবশ্য খুব সাধারণ মানুষ নয়; যে-লোকটি আত্তিলিওর অভিবাদনে সাড়া দিয়েছিল সে হচ্ছে জুলুদের মধ্যে এক প্রাচীন ইনডানা (জ্ঞানী ব্যক্তি)। সাহস ও বীরত্বের জন্য সে যৌবনে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিল এবং জুলুদের সামাজিক ব্যাপারে তার মতামতের মূল্য ছিল খুব বেশি।
ওই বিশিষ্ট লোকটির সঙ্গে আত্তিলিও সাহেবের যে বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে কোনো তরফ থেকেই কৃত্রিমতার স্থান ছিল না।
স্খলিত চরণে এগিয়ে এসে পূর্বোক্ত ইনডানা আত্তিলিওর হাতে হাত দিয়ে করমর্দন করল।
আত্তিলিও বললেন, ওদের জানিয়ে দাও আমি এখানে দর্শক হিসাবে এসেছি। যা দেখব, যা শুনব, সে-কথা আমি শ্বেতাঙ্গ কর্তৃপক্ষের কাছে বলব না।
ভীষণ চেঁচামেচি গোলমাল হচ্ছিল। হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে বলল ইনডানা। কয়েক মিনিট ধরে নির্বাক জুলুজনতাকে উদ্দেশ করে সে কথা বলল। প্রথমেই সে জনতাকে জানিয়ে দিল সাদা মানুষের সঙ্গে ম্যাজিকের বাক্স (ক্যামেরা) ছাড়া কোনো অস্ত্রশস্ত্র নেই, অতএব তার উদ্দেশ্য খারাপ নয়। তারপর অভিযাত্রীদের সততা ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের প্রমাণ হিসেবে সাদা মানুষদের বিভিন্ন কীর্তিকলাপের কথা বলতে আরম্ভ করল–সিংহের আক্রমণে আহত জুলুদের চিকিৎসা করে অভিযাত্রীরা যে অনেককে বাঁচিয়ে তুলেছেন সেইসব কথা সে উল্লেখ করল, সিংহ শিকারের কথা, দাঁতের ব্যথা উপশম করে জুলুদের আরাম দেওয়ার ইতিহাস প্রভৃতি সব ঘটনার কথাই সে বলেছিল এবং পরিশেষে সাদা মানুষদের কাছ থেকে প্রাপ্ত মূল্যবান উপহারগুলোর কথাও সে জনতাকে স্মরণ করিয়ে দিতে ভুলল না।
ইনডানার কথা শেষ হল। সঙ্গেসঙ্গে মুখ খুলল সুকামবানা। ঝড়ের বেগে সে অনেক কথাই বলে গেল। উচ্চকণ্ঠে উচ্চারিত সেই দ্রুত বাক্যঝটিকার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য হচ্ছে–
চুলোয় যাক সাদা মানুষরা!
জনতা এইবার একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। জনতার এক অংশ জানাল আত্তিলিওর উপস্থিতি তাদের কাছে আপত্তিকর নয়, অপর অংশ বিদেশিকে ঘটনাস্থলে থাকতে দিতে অসম্মত। আত্তিলিও কোনোদিকে নজর দিলেন না, নির্লিপ্তভাবে তিনি ম্যাজিকের বাক্স হাতে ফটো তুলতে শুরু করলেন।
সুখের বিষয় অকুস্থলে টোয়াবেনি উপস্থিত ছিল না। সে থাকলে হাওয়া বদলে যেত। আত্তিলিও পূর্বোক্ত ইনডানাকে ভোটের সাহায্যে সমস্যার সমাধান করতে বললেন। ভোট নেওয়া হল। শূন্যে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে জ্বলে জ্বলে উঠল অনেকগুলো বর্শাফলক অধিকাংশ মানুষই হাতের অস্ত্র তুলে ধরে আত্তিলিওর স্বপক্ষে রায় দিল। যারা বিদেশির উপস্থিতি চায়নি, তারা বিনা বাক্যব্যয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের দাবি মেনে নিল। এই ব্যাপারে সুকামবানার আর কিছু বলার উপায় থাকল না। জনতাকে উদ্দেশ করে সে একটি হুকুম দিল, সঙ্গেসঙ্গে আত্তিলিওর উপস্থিতি ভুলে গেল জনতা–সুকামবানা আর জ্ঞানী ব্যক্তিদের মাঝখানে রেখে তারা গোল হয়ে বসে পড়ল।
তারপর বৃত্তাকারে উপবিষ্ট জনতার ভিতর থেকে জাগল মিলিত কণ্ঠে সংগীতধ্বনি। খুব ধীরে ধীরে মৃদুস্বরে গান গাইছে জনতা। ঐকতান সংগীত শুরু হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই কুটির থেকে বেরিয়ে এল টোয়াবেনি! চতুর্দিকে দণ্ডায়মান জুলু-মেয়েরা ব্যস্ত হয়ে সরে দাঁড়াল, বৃত্তাকারে উপবিষ্ট পুরুষরা বৃত্ত ভেঙে তাকে মধ্যস্থলে প্রবেশ করার পথ ছেড়ে দিল। টোয়াবেনি কারো দিকে চাইল না, তার গতিবিধি এখন সম্মোহিত ব্যক্তির মতোই আড়ষ্ট এবং তার ভাবলেশহীন চক্ষু দুটির দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে একটা শানিত বর্শাফলকের উপর। ওই বর্শাটাকে মাটিতে পুঁতে তার চারপাশে গোল হয়ে বসেছিল পুরুষের দল।