জিপোসো এবং জ্ঞানী ব্যক্তিদের বিচারে টোয়াবেনিকে যে দোষী সাব্যস্ত করে জাদুকরের সম্মানিত পদ থেকে বিচ্যুত করা হয় তা শুনেছিলেন আত্তিলিও–অতএব তিনি সহজেই বুঝতে পারলেন সুকামবানার উল্লিখিত জাদুকরটি টোয়াবেনি ছাড়া আর কেউ নয়।
জামানির কাছ থেকে আরও একটি সংবাদ জানতে পারলেন আত্তিলিও। সংবাদটি হচ্ছে এই–
জিপোসো বিদ্রোহ দমনে যাত্রা করার আগে সুকামবানা গন্ধের সাহায্যে বিচার করার অনুমতি চেয়েছিল। জিপোশো অনুমতি দেয়নি। সে জানত গন্ধ বিচার অনিবার্যভাবেই নরহত্যা ঘটাবে, এমনকী গণহত্যার মতো বীভৎস কাণ্ড ঘটাও অসম্ভব নয়।
কিন্তু জিপোসো এখন অনুপস্থিত, সুকামবানা আর টোয়াবেনিকে বাধা দেবে কে? আত্তিলিও বললেন, তাহলে নিশ্চয়ই কাল ওরা গন্ধ বিচারের সভা ডাকছে।
না, না, কাল নয়, জামানি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, কাল নয় মাসাংগা, কাল কিছু হবে না।
তবে? কবে হবে ওই বিদঘুঁটে কাণ্ড?
জবাব নেই। জামানি আবার বোবা। মাসাংগার অনেক অনুরোধ-উপরোধেও তার মৌনভঙ্গ হল না।
পরের দিন কোথাও গেলেন না আত্তিলিও, তাবুতেই বসে থাকলেন। ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। আত্তিলিও ঢাকের ভাষা জানেন না, কিন্তু ঘন ঘন দ্রুততালে সেই ধ্বনিতরঙ্গের প্রবল উত্তেজনা তিনি অনুভব করতে পারলেন। ঢাক কী বলছে জানার জন্য তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। কিন্তু জানবেন কী করে? তাঁবুর নিগ্রোরা হঠাৎ ঢাকের ভাষা ভুলে গেছে! আত্তিলিওর বিশ্বস্ত অনুচর জামানিও ব্যতিক্রম নয়। বার বার প্রশ্ন করে একই উত্তর পেলেন আত্তিলিও–ঢাকের ভাষা তারা নাকি কিছুই বুঝতে পারছে না! এক রাতের মধ্যে আয়ত্ত-বিদ্যার এমন হঠাৎ বিলুপ্তি এবং স্মরণশক্তির এমন আকস্মিক বিপর্যয় দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন আত্তিলিও!…
.
অষ্টম পরিচ্ছেদ – গন্ধের বিচার
রাত এল। যথানিয়মে আবার এল প্রভাত। আজ আর ঢাক বাজছে না। আগের দিনের অবিরাম ধ্বনিতরঙ্গের পরে এই অস্বাভাবিক স্তব্ধতা যেন ভয়ংকর এক ঘটনার পূর্বাভাস।
আত্তিলিও উঠে দাঁড়ালেন, জামাকাপড় পরে প্রস্তুত হলেন, তারপর পদার্পণ করলেন তাঁবুর বাইরে। জামানিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, আমি টোয়াবেনির কাছে যাচ্ছি। তুমিও সঙ্গে চলো। আত্তিলিও যা ভেবেছিলেন তাই হল–জামানি তার আদেশ অমান্য করে দাঁড়িয়ে রইল এবং বার বার তাকে তাঁবু ছেড়ে বাইরে যেতে নিষেধ করল। সে এ-কথাও বলল, তার নিষেধ অগ্রাহ্য করা মাসাংগার উচিত নয়।
আত্তিলিও শুনলেন না। তিনি জানতেন জামানি তাকে ভালোবাসে, তার বিপদ হতে পারে বলেই সে তাকে কোথাও যেতে বারণ করছে। কিন্তু আত্তিলিওর কানে তখনও বাজছে জুলু বালিকার কাতর প্রার্থনা–জা বাব, আমি সাহায্য চাই।
আত্তিলিও অনুমান করেছিলেন মদাবুলি আর গোর সর্বনাশ করার জন্য এক চক্রান্তের জাল বুনছে দুই শয়তান টোয়াবেনি ও সুকামবানা। চক্রান্তকারীদের কী করে বাধা দেবেন সে-কথা আত্তিলিও নিজেও ভাবতে পারেননি, বিশেষত ষড়যন্ত্রের চেহারাটা তখন পর্যন্ত তার কাছে অস্পষ্ট–কিন্তু যে ভয়াবহ বিপদের ফলে দুটি নিরাপরাধ মানুষের জীবন বিপন্ন হতে চলেছে, তাতে যথাসাধ্য বাধা দেওয়া উচিত মনে করেই তিনি টোয়াবেনির আস্তানা লক্ষ করে যাত্রা করেছিলেন। সঙ্গে ছিল নিত্যসঙ্গী রাইফেল আর ক্যামেরা। পথে যেতে একটা সিংহের দেখা পেয়েছিলেন তিনি। ক্যামেরার সাহায্যে পশুরাজের আলোকচিত্র গ্রহণ করতেও তার ভুল হয়নি। সিংহটা তাকে আক্রমণের চেষ্টা না-করে বিলক্ষণ সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিল। সেদিন সকালে গুলির আওয়াজে জুলুদের কাছে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করতে রাজি ছিলেন না আত্তিলিও।
প্রায় এক ঘণ্টা হেঁটে তিনি টোয়াবেনির ক্রালের নিকটে অবস্থিত পাহাড়ের উপর এসে পৌঁছালেন। সেখান থেকে চারদিকে দৃষ্টিসঞ্চালন করে তিনি দেখলেন তার উলটোদিকে যে পাহাড়টার উপর এই সময়ে টোয়াবেনির গোরুগুলো ঘাস খেয়ে বেড়ায়, সেখানে তারা নেই–গোরুগুলোকে কালের ভিতর তাদের নির্দিষ্ট আবেষ্টনীর মধ্যে আজ বন্দি করে রাখা হয়েছে। আস্তানার দরজাটা খোলা এবং সেই উন্মুক্ত প্রবেশপথের মুখে ভিড় করেছে জুলু-রমণীর দল। দ্বারের বাইরে ছোটো ছোটো কয়েকটা দলে বিভক্ত হয়ে উত্তেজিত স্বরে কথা কইছে প্রায় শ-খানেক পুরুষ। বিস্তীর্ণ মাঠের এখানে ওখানে কালো কালো ছাপ দেখে আত্তিলিও বুঝলেন, যেসব ঝোঁপঝাড় বা শুষ্ক নালার মধ্যে সিংহের লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা ছিল, সেই জায়গাগুলো জুলুরা আগুনে পুড়িয়ে সাফ করে ফেলেছে।
দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন আত্তিলিও। এই মুহূর্তে পিছন ফিরে তিনি যদি যাত্রা করেন তাহলে সেটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। যেখানে আছেন, সেখান দাঁড়িয়ে থাকলে বিপদের ভয় নেই। কিন্তু অত দূর থেকে কিছু দেখা বা শোনার আশা তাহলে একেবারেই ত্যাগ করতে হয়। সামনে এগিয়ে গেলে অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, তবে এটুকু বিপদের ঝুঁকি নিলে হয়তো তিনি এমন দৃশ্য দেখতে পাবেন যা ইতিপূর্বে ইউরোপ বা আমেরিকাবাসী কোনো শ্বেতাঙ্গের দৃষ্টিগোচর হয়নি। হয়তো এসব দুর্লভ দৃশ্যের আলোকচিত্র গ্রহণ করার সুযোগও পেতে পারেন তিনি, এবং–
এবং বরাত ভালো থাকলে রক্তারক্তির ভয়াবহ সম্ভাবনাকেও হয়তো রোধ করতে পারবেন।