উদবিগ্ন চিত্তে তাবুর দিকে পা চালালেন আত্তিলিও। পথের মধ্যে আর কোনো সিংহের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। অন্যদিনের মতো সিংহ শিকারের চেষ্টা করলেন না তিনি। সিংহের আকস্মিক আক্রমণ তাকে ভিতরে ভিতরে যথেষ্ট দুর্বল করে দিয়েছিল–অন্তত সেদিনটা তিনি ওই ভয়ংকর জীবের মারাত্মক সান্নিধ্য এড়িয়ে চলতে চেয়েছিলেন। নরখাদকের চাইতে নরঘাতকের দুরভিসন্ধির কথা ভেবেই তিনি বেশি উদবিগ্ন বোধ করেছিলেন তিনি বুঝেছিলেন মদাবুলি আর নগো এখন মোটেই নিরাপদ নয়। যেকোনো মুহূর্তে শয়তানের চক্রান্তে তাদের প্রাণহানি ঘটতে পারে। আত্তিলিও যে তার শয়তানি ধরে ফেলেছিলেন, সিংহের আবির্ভাবের রহস্য যে তার কাছে গোপনীয় নেই, সে-কথা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে টোয়াবেনি–অতএব আত্তিলিওর উপরেও সে হামলা চালাতে পারে যখন-তখন এবং সেই ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা যে কমান্ডার সাহেবের মনে উঁকি দেয়নি তা নয়।
কাল সকালে উঠে আমার প্রথম কাজ হচ্ছে জিপোসোর সঙ্গে দেখা করা–আত্তিলিও মনে মনে বললেন। তিনি জানতেন সর্বাধিনায়ক তার কথা বিশ্বাস করবে।
তাবুতে ঢুকতেই জামানি তাকে জানাল পরিস্থিতি খুব খারাপ। সারাদিন ধরে টমটম (ঢাক) বেজেছে। ওই শব্দের সূত্র ধরে জানা গেছে যে, দলবদ্ধ সিংহের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে জুলুদের দুটি আস্তানা। বিল আর প্রফেসর বিশ্রাম নিতে তাবুতেও এসেছিলেন, সিংহ-ঘটিত দুঃসংবাদ কর্ণগোচর হওয়ামাত্র তারা ওষুধপত্র আর রাইফেল নিয়ে অকুস্থলের দিকে ছুটে গেছেন। তবে আরও খারাপ খবর আছে–জুলুল্যান্ডের পশ্চিম অংশে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে।
বিদ্রোহ! কার বিরুদ্ধে? চমকে প্রশ্ন করলেন আত্তিলিও।
জাতির মাতব্বর আর জাদুকরদের বিরুদ্ধে, জামানি বলল, ওরা সিম্বাদের (সিংহদের) থামাতে পারছে না বা থামাচ্ছে না। একজন জুলু-সর্দারকে তির ছুঁড়ে মেরে ফেলা হয়েছে। জিপোসোর হয়ে খাজনা আদায় করতে গিয়েছিল ওই সর্দার। তার অনুচরকে তির মেরে খুন করা হয়েছে শুনে জিপোসো ভয়ানক খেপে উঠেছে, সে চলে গেছে হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে সঙ্গে গেছে জুলুল্যান্ডের সেরা দু-শো যোদ্ধা।
বাঃ। চমৎকার, আত্তিলিও ভাবলেন, জিপোসোর কাছ থেকে এখন আর কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে না।
আর সুকামবানা–জামানি আবার বলতে শুরু করেছিল, কিন্তু হঠাৎ থেমে গিয়ে সে রান্নাঘরের দিকে ছুটে চলে গেল।
সুকামবানা নামক লোকটিকে চিনতেন আত্তিলিও। সে ছিল জুলু-শিকারিদের জাদুকর, অত্যন্ত বেয়াড়া ধরনের লোক টোয়াবেনির স্বল্প সংখ্যক বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম। ধাঁ করে আত্তিলিওর মাথার ভিতর একটা ভয়াবহ সম্ভাবনা বিদ্যুতের মতো চমকে উঠল–সুকামবনা আর টোয়াবেনির অশুভ যোগাযোগ কোনো ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের সূচনা করছে না তো?..
নৈশভোজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আত্তিলিও তাঁর তাঁবুতে জামানিকে ডেকে পাঠালেন। জামানি সহজভাবেই তার সঙ্গে দেখা করতে এল, কারণ, প্রত্যেক রাতেই পরের দিনের কর্মসূচি সে আত্তিলিওর কাছে জানতে পারত। কিন্তু সেসব কথা না-তুলে মাসাংগা যখন তাকে সুকামবানার কথা জিজ্ঞাসা করলেন, তখন সে ঘাবড়ে গেল। মুখ ফসকে দু-একটা কথা বেরিয়ে যাওয়ার জন্য জামানি তখন মনে মনে নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছে, কিন্তু এখন আর আত্তিলিও তাকে ছাড়তে রাজি নন–জেরার মুখে সে আরও কয়েকটা গোপনীয় কথা ফাঁস করে ফেলল। শেষকালে আত্তিলিও যখন শপথ করে বললেন সর্বাধিনায়ক জিপোসোকে তিনি কিছু বলবেন না, তখনই সব কিছু খুলে বলতে রাজি হল জামানি।
জামানির বক্তব্য সংক্ষেপে পরিবেশিত হলে যা হয় তা হচ্ছে এই
বর্ষার দেবতা আনজিয়ানা জুলুদের পূজা প্রার্থনাআর কাকুতিমিনতি শুনেও অবিচলিত; বৃষ্টির নাম নেই, খরদাহে জ্বলছে জুলুদের দেশ, সিংহরা সংখ্যায় বাড়ছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে তাদের সাহস আর ঔদ্ধত্য জন্তুগুলো এখন আর মানুষকে ভয় করে না। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য জুলুল্যান্ডের মানুষ অতীন্দ্রিয় জগৎকে অর্থাৎ প্রেতাত্মাদের দায়ী করছে। আত্তিলিওর কাছে টোয়াবেনি বলেছিল তার ছেলেরা নাকি টোয়াবেনির এক ভাই-এর কালে গেছে একটা বেড়া বাঁধার কাজে সাহায্য করতে–কথাটা আদপেই সত্যি নয়। একদল ক্ষিপ্ত জুলুকে সংঘবদ্ধ করার জন্য টোয়াবেনির ছেলেরা যেখানে গিয়েছিল সেটি হচ্ছে আর এক শয়তানের আস্তানা–সুকামবানার ক্রাল!
জামানির বক্তব্য থেকে আরও একটি তথ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হলেন আত্তিলিও সুকামবানার সঙ্গে নাকি জরুরি পরামর্শ করেছেন আনজিয়ানা স্বয়ং! এই অতি মূল্যবান সংবাদটি অবশ্য সুকামবানা নিজেই জুলুদের জানিয়েছে, জামানিও বাদ যায়নি।
এই পর্যন্ত বলেই জামানি হঠাৎ কাঁপতে শুরু করল, তার কথাগুলো মুখের ভিতর আটকে যেতে লাগল বার বার; ভাঙা ভাঙা গলায় ফিস ফিস করে ভয়ার্ত জামানি যা বলল তা থেকে আত্তিলিও বুঝলেন সুকামবানা নাকি সবাইকে বলেছে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী হচ্ছে এক জুলুযোদ্ধা! সুকামবানার মতে উক্ত জুলুযোদ্ধার চোখ দুটির সঙ্গে জড়িত রয়েছে অমঙ্গলের অভিশাপ এবং এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে উদ্ধার লাভ করতে হলে অবিলম্বে অভিশপ্ত চক্ষুবিশিষ্ট ওই মানুষটিকে শাস্তি দেওয়া দরকার কিন্তু অনেক মানুষের ভিড়ের ভিতর থেকে প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে হলে গন্ধ বিচারের সভায় যে-মানুষটি ওইভাবে বিচার করতে সক্ষম, সেই অদ্বিতীয় জাদুকরকে তার অধিকৃত পদ থেকে খারিজ করে তার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে ঈর্ষাকাতর জ্ঞানী ব্যক্তিদের সভা এবং সর্দার জিপোসো। বর্ষার দেবতা আনজিয়ানা এই অবিচারে ক্রুদ্ধ হয়েছেন, অনাবৃষ্টির জন্য জিপোসোর অবিচারও কিছুটা দায়ী বলে মতপ্রকাশ করেছে সুকামবানা।