আর তারপর যেন শুরু হল নরকগুলজার। চতুর্দিক থেকে ভেসে আসতে লাগল বহু মানুষের পায়ের আওয়াজ। ভয়ার্ত গোরু বাছুরের হাম্বা ধ্বনি। টোয়াবেনি এসে উপস্থিত হল চেঁচাতে চেঁচাতে। সেইসঙ্গে সেখানে ভিড় করল বহু নারী ও বালক-বালিকা, সিংহের মৃতদেহ নজরে আসামাত্র আবার পিছিয়ে গেল সভয়ে।
আত্তিলিও কুটিরের বাইরে খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ালেন। ইতিমধ্যে তিনি রাইফেলে আবার গুলি ভরে নিয়েছেন এবং তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মদাবুলির বাপ টোয়াবেনি। টোয়াবেনির জলন্ত দুই চোখের দিকে তাকিয়ে আত্তিলিওর মনে হল চোখ নয়, একজোড়া ধারালো ছুরির ফলা ঝকঝক করছে হত্যার আগ্রহে। তিক্ত কণ্ঠে আত্তিলিও প্রশ্ন করলেন, সিংহ ভিতরে এল । কী করে?
অবজ্ঞাসূচক ভঙ্গিতে উত্তর এল, জানি না। আমি কুটিরের ভিতরে ছিলাম। সিংহ কী করে এসেছে বলতে পারব না।
টোয়াবেনি একটু থামল, তার পাতলা নাকের উপর ফুটে উঠল কুঞ্চনরেখার চিহ্ন, বলল, গন্ধ পাচ্ছি, আমি ভয়ের গন্ধ পাচ্ছি।
.
সপ্তম পরিচ্ছেদ – রহস্যময় ঢাক ও নিগ্রোদের অজ্ঞতা
ভয়, টোয়াবেনি আবার বলল, আমি ভয়ের গন্ধ পাচ্ছি।
খুব অদ্ভুত কথা সন্দেহ নেই। ভয়ের আবার গন্ধ কী? কিন্তু শুধু যে কথাটাই অদ্ভুত তা নয়, টোয়াবেনির বলার ভঙ্গিও ছিল অদ্ভুত রহস্যময়।
আত্তিলিও বেড়ার গায়ে লাগানো দরজার দিকে চাইলেন। দরজাটা ঠিক মদাবুলির কুঁড়েঘরের দিকে–সব ঠিক আগের মতোই আছে? … না! সব ঠিক নেই। আত্তিলিও সাহেবের তীক্ষ্ণদৃষ্টি ইতিমধ্যে আবিষ্কার করেছে তাঁর জুতোপরা পায়ের ছাপগুলো ধুলোর উপর থেকে অদৃশ্য। খুব তাড়াতাড়ি কেউ ওই ছাপগুলো মুছে ফেলেছে!
কে? কেন? কোন উদ্দেশ্যে?
নীচু হয়ে ভালো করে জমি দেখতে লাগলেন আত্তিলিও–তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে একটা পায়ের ছাপ উক্ত ব্যক্তির দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সেই সবুট পদচিহ্নকে প্রায় লুপ্ত করে তার উপর আত্মপ্রকাশ করেছে আর একটা গুরুভার জীবের সুগভীর পদচিহ্ন–সিংহের পায়ের দাগ।
ব্যাপারটা এইবার আত্তিলিওর বোধগম্য হয়েছে। কোনো এক ব্যক্তি টোয়াবেনির আস্তানায় তার উপস্থিতির সব চিহ্ন মুছে ফেলতে চেয়েছিল বলেই জুতোর ছাপগুলো হয়েছে অদৃশ্য, উক্ত ব্যক্তির পরিচয় আর উদ্দেশ্যও এখন তার কাছে গোপন নেই।
সিংহের মুখে যদি তার দেহটা টোয়াবেনির ক্রাল ছেড়ে অদৃশ্য হত, তবে কারো পক্ষে সঠিক ঘটনার অনুমান করা সম্ভব ছিল না; কারণ, আত্তিলিও যে অকুস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন সে-কথা শুধু জানত টোয়াবেনি। হ্যাঁ, মৃন্দাবুলিও জানত আত্তিলিওর উপস্থিতি কিন্তু নরখাদক সিংহ তার নিকটস্থ দুটো মানুষকে জীবিত রাখত কি? অতএব দেখা যাচ্ছে জুতো পরা পায়ের ছাপগুলো যদি মুছে ফেলা যায়, তাহলে সিংহের কবলগ্রস্ত শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের উপস্থিতির আর প্রমাণ থাকে না তৃতীয় ব্যক্তির সম্মুখে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, বনের জানোয়ার মানুষের ইচ্ছা পূরণ করবে কেন? তা করবে না, কিন্তু বন্ধ দরজা যদি হঠাৎ খুলে গিয়ে খাদ্যসংগ্রহের পথ উন্মুক্ত করে দেয়, তবে সবচেয়ে কাছাকাছি জ্যান্ত খাবারের দিকেই এগিয়ে আসবে মাংসলোলুপ শ্বাপদ এবং মন্দাবুলির যে কুঁড়েঘরটাতে আত্তিলিও ঢুকেছিলেন সেটা যে দরজার সবচেয়ে নিকটবর্তী কুটির সে-কথা আগেই বলা হয়েছে। সমস্ত পরিকল্পনাটি নিখুঁত। গোলমাল শুনে অন্যান্য কুটির থেকে বেরিয়ে এসে জুলুরা কেউ আত্তিলিওর জুতোর ছাপ দেখতে পেত না। আত্তিলিও যদি সিংহের মুখে উধাও হতেন, তবে তো কথাই নেই–কিন্তু যদি তাকে ফেলে মৃন্দাবুলিকে তুলে নিত তাহলেও নিকটেই অবস্থিত আত্তিলিওকে নিশ্চয়ই সে জ্যান্ত রাখত না, এবং নখে দন্তে ছিন্নভিন্ন অভিযাত্রীর মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে টোয়াবেনি যখন শপথ করে বলত তার অজ্ঞাতসারে সাদা মানুষটি মদাবুলির কুটিরে প্রবেশ করেছে, তখন তার কথাই অভ্রান্ত সত্য বলে গৃহীত হত–এমনকী সর্বাধিনায়ক
জিপোসোর মতো বুদ্ধিমান মানুষও আত্তিলিওর মৃত্যুর জন্য নরখাদক সিংহকেই দায়ী করত–কাটার বেড়াতে ঘেরা আস্তানার মধ্যে সিংহের অনুপ্রবেশ কী করে ঘটল তাই নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না।
আর একটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল, আত্তিলিওর ব্যঙ্গোক্তি শোনা গেল, তবে ওই দরজাটা চমৎকার। খুবই কার্যকরী দরজা। এবার ওটা দয়া করে খুলে দাও, আমি বাইরে যাব।
আত্তিলিও ভেবেছিলেন টোয়াবেনি ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে, চিৎকার করে অভিশাপ দেবে, হাতের বর্শা তুলে মারতে আসবে কিন্তু না। সে-রকম কিছুই সে করল না। এক গাল হেসে দড়ি ধরে টান মারল টোয়াবেনি, দরজা খুলে গেল আর দরজা খোলার সময়ে তার একটা পা এসে পড়ল অবশিষ্ট একমাত্র জুতোর ছাপটার উপর। •
ওই ছাপটাকে অবহেলা করা ঠিক হয়নি, আত্তিলিও বললেন, কিন্তু বড়ো দেরি হয়ে গেছে, ওটা আমি দেখে ফেলেছি।
এখন সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন আত্তিলিও–তিনি আর মন্দাবুলি যখন কথা বলছিলেন তখন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চুপি চুপি মেয়ের কথা শুনেছে টোয়াবেনি, তারপর ফিরে গিয়ে নিজস্ব কুটিরের নিরাপদ স্থান থেকে দড়ি টেনে দরজা খুলে দিয়ে ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করেছে ক্ষুধার্ত সিংহের জন্য–সে জানত চারদিকে ওত পেতে বসে আছে দলে দলে নরখাদক শ্বাপদ, দরজা খোলা থাকলে এক বা একাধিক সিংহের আবির্ভাব ঘটবেই ঘটবে। টোয়াবেনি যা ভেবেছিল তাই হল। খোলা দরজা দিয়ে একসময়ে প্রবেশ করেছে পূর্বোক্ত সিংহ; শয়তান জাদুকরও সঙ্গেসঙ্গে দরজা বন্ধ করতে একটুও দেরি করেনি! তারপর সে অবাধ্য কন্যা ও পরচর্চায় নিযুক্ত সাদা মানুষটার অপঘাত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করেছে সাগ্রহে! সিংহ তার শিকার নিয়ে মন্দাবুলির কুটির থেকে বেরিয়ে এলেই সে আবার দড়ি টেনে শ্বাপদের পলায়নের পথ মুক্ত করে দিত কিন্তু এমন চমৎকার পরিকল্পনাটা নষ্ট হয়ে গেল রাইফেলের অগ্নিবর্ষী মহিমায়। গুলির আওয়াজ শুনেই বেরিয়ে এসেছে টোয়াবেনি–সঙ্গেসঙ্গে সে বুঝেছে সর্বনাশ হয়েছে, সব কিছু ভেস্তে দিয়েছে সাদা মানুষের রাইফেল…।