ভয়াবহ পরিস্থিতি। দরজার ওপাশে অপেক্ষা করছে ক্ষুধিত শ্বাপদ! যেকোনো মুহূর্তেই সে ভিতরে প্রবেশ করতে পারে!
সতৃষ্ণ নয়নে রাইফেলটার দিকে তাকালেন আত্তিলিও। ছায়া দেখে বোঝা যায় সিংহ ওত পেতে বসে আছে দরজার বাইরে বাঁ-দিকে। ডান দিক দিয়ে ঘুরে রাইফেল তুলতে গেলে অস্ত্র তুলে নেবার আগেই সিংহ তাকে দেখতে পাবে এবং তৎক্ষণাৎ ঝাঁপিয়ে পড়বে। বাঁ-দিক দিয়ে ঘুরে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রাইফেলের নল ধরে সেটাকে আনা যায় বটে, কিন্তু ওইভাবে অস্ত্রটাকে বাগাতে হলে সিংহের খুব কাছাকাছি যেতে হয়।
আত্তিলিও শেষোক্ত উপায় অবলম্বন করতে চাইলেন। তিনি বসে ছিলেন, এইবার উঠে দাঁড়ালেন; আস্তে আস্তে, নিঃশব্দে।
দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন আত্তিলিও। কাটাগাছ ঘেরা অতি উঁচু বেড়াটাকে যে জানোয়ার লাফ মেরে ডিঙিয়ে আসতে পেরেছে, সে নিশ্চয়ই অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও বৃহৎ দেহের অধিকারী। দারুণ ক্ষুধার্ত না হলে সিংহ এমন দুঃসাহসের পরিচয় দেয় না–আত্তিলিও বুঝলেন সিংহকে হত্যা না করতে পারলে আজ মৃত্যু তার নিশ্চিত।
কিন্তু ঘরের মেঝেতে বিছানো মাদুরটাই গোলমাল বাধাল। প্রতি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে কট কট শব্দে প্রতিবাদ জানাতে লাগল মাদুর! আত্তিলিও মনে মনে মাদুরটাকে অভিশাপ দিলেন। কুটিরের ভিতর বদ্ধ স্থানে ওই কট কট শব্দটা তার কানে পিস্তলের আওয়াজের মতো আঘাত করছিল, অপেক্ষমাণ শ্বাপদ যে ওই আওয়াজ থেকেই শত্রুর গতিবিধি বুঝতে পারছে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু অন্য উপায় না-থাকায় আত্তিলিও ওইভাবেই এগিয়ে চললেন। তিনি জানতেন, উজ্জ্বল দিবালোকের ভিতর দাঁড়িয়ে কুটিরের ম্লান অন্ধকারে জন্তুটা ভালো দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু একটু পরে অন্ধকারটা সহ্য হয়ে গেলেই সে ভিতরে ঢুকে পড়বে। ইতিমধ্যে যদি তিনি কিছু না করতে পারেন, তবে সিংহের কবলে তার এবং মদাবুলির অবস্থা যে কতদূর শোচনীয় হতে পারে সে-কথা চিন্তা করে শিউরে উঠলেন আত্তিলিও।
মদাবুলির সমস্ত শরীর তখন আড়ষ্ট। চোখে না-দেখেও সে বুঝতে পেরেছে একটা ভয়ংকর ঘটনার প্রস্তুতি চলেছে তার পিছনে। বালিকার ভীতিবিহ্বল দুই চক্ষু লক্ষ করছে আত্তিলিওর গতিবিধি এবং তার জিহ্বা হয়ে গেছে মৌন, নির্বাক। খুব ধীরে ধীরে তাকে পেরিয়ে দরজার কাছে দাঁড়ালেন আত্তিলিও সাহেব।
প্রবেশপথের মুখেই দাঁড়িয়ে আছে সিংহ। তার দেহটা আত্তিলিওর চোখের আড়ালে, অদৃশ্য, দৃষ্টিগোচর হচ্ছে শুধু ছায়া আর কর্ণগোচর হচ্ছে দেয়ালের ওপার থেকে ভেসে আসা নিশ্বাস-প্রশ্বাসের গভীর জান্তব শব্দ।
চট করে থাবা চালিয়ে দিলেই এখন সিংহ আত্তিলিওকে ধরে ফেলতে পারে। কিন্তু রাইফেলটা এসে গেছে তার হাতের নাগালের মধ্যে যা করতে হয় এখনই করতে হবে, সময় নেই–আত্তিলিও হাত বাড়ালেন।
তাঁর ঘর্মাক্ত হাতের মুঠি রাইফেলের ঠান্ডা নলটাকে স্পর্শ করল। সঙ্গেসঙ্গে কানে এল শ্বাপদ কণ্ঠের গর্জনধ্বনি। রাইফেল উঠে এল হাতে। একটা সোনালি বাদামি দেহ চমকে উঠল বিদ্যুৎ ঝলকের মতো–
প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়লেন আত্তিলিও! পশুরাজ ভারসাম্য রাখতে পারল না, সংঘাতের . ফলে সেও মাটির উপর গড়িয়ে পড়ল।
সিংহ আবার উঠে আক্রমণ করার আগেই আত্তিলিও গড়াতে গড়াতে খোলা দরজা দিয়ে কুটিরের বাইরে চলে গেলেন। আকস্মিক বিপদে আত্তিলিওর বুদ্ধিভ্রংশ হয়নি, গড়াগড়ি দেবার সময়ে চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছিলেন তিনি অন্ধকার কুটির থেকে বাইরে তীব্র সূর্যালোকের মধ্যে এসে তাঁর চক্ষু যে সাময়িক দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলতে পারে সেই ভয়াবহ তথ্য চরম মুহূর্তেও তিনি ভুলে যাননি, হাতের রাইফেলটাও তিনি হস্তচ্যুত হতে দেননি–অস্ত্রটাকে তিনি ধরে রেখেছিলেন শক্ত মুঠিতে।
আত্তিলিও যে-মুহূর্তে রোদের দিকে পিছন ফিরে রাইফেল তুলে কুটিরের ভিতর দৃষ্টিপাত করলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে সিংহও ধরাশয্যা ত্যাগ করে উঠে পড়ল এবং চূড়ান্ত ফয়সালা করার জন্য তাকে লক্ষ করে লাফ দিতে উদ্যত হল–হাঁটু পেতে বসে রাইফেল উঁচিয়ে বললেন আত্তিলিও, শুয়ে পড়ো মদাবুলি।
বিনা বাক্যব্যয়ে শুয়ে পড়ল মদাবুলি। সঙ্গেসঙ্গে প্রচণ্ড সিংহনাদ। রাইফেলের কর্কশ ধমক। বারুদের উগ্র গন্ধের সঙ্গে মিশল শ্বাপদ-দেহের দুর্গন্ধ এবং রক্তাক্ত গন্ধ!
আবার জাগল শ্বাপদ কণ্ঠের ভৈরব হুংকার! রক্তাক্ত শরীরে গর্জে উঠল আহত সিংহ, মাথার উপর দুলে দুলে উঠল ঝাকড়া কেশর; তার জ্বলন্ত দৃষ্টি একবার পড়ছে ধরাশায়ী াবুলির দিকে, আবার ঘুরে যাচ্ছে কুটিরের বাইরে উপবিষ্ট অস্ত্রধারী মানুষটার দিকে সে এখনও ঠিক করতে পারছে না কার উপর প্রথম ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত। সিংহ মনস্থির করার আগেই আত্তিলিওর রাইফেল আবার অগ্নিবর্ষণ করল। লক্ষ্য ব্যর্থ হল না, চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল সিংহের মাথার খুলি সব শেষ! পশুরাজ আর কোনোদিন নরমাংস খেতে চাইবে না।
…কিন্তু মদাবুলি? সে কথা কইছে না কেন? বালিকার দেহের উপর ঝুঁকে পড়লেন আত্তিলিও। সিংহ তার দেহস্পর্শ করতে পারেনি। সে অজ্ঞানও হয়নি, দারুণ আতঙ্ক সাময়িকভাবে তার বাশক্তি ও চলৎশক্তিকে লুপ্ত করে দিয়েছে, কিন্তু তার চেতনা সম্পূর্ণ জাগ্রত দুই চোখের নীরব ভাষায় বালিকা আত্তিলিওকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করল।