কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলার পর আত্তিলিও জানালেন মদাবুলির মুখে বিষাদের মেঘ তার ভালো লাগে না, তিনি তার হাসিমুখ দেখতে চান।
মদাবুলির মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা দিল। কিন্তু শুধু এক মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণেই দু-হাতে মুখ ঢেকে সে কেঁদে উঠল। তারপরই মেঝের উপর শুয়ে পড়ে সে ফোঁপাতে লাগল। কান্নার আবেগে তার দেহটা কাঁপতে লাগল থরথর করে।
আত্তিলিও হয়ে গেলেন হতভম্ব। টোয়াবেনি যদি এই কান্নার শব্দ শোনে তাহলে সে কী মনে করবে? …কথাটা চিন্তা করতেই আত্তিলিওর খারাপ লাগল। তিনি মনে মনে কামনা করলেন এই মুহূর্তে যেন কেউ এসে পড়ে, তাহলে এই অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতি থেকে তিনিও পরিত্রাণ পেতে পারেন। এই কথা মনে হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই দ্রুত ধাবমান পদশব্দ তার কানে এল। কিন্তু না–কেউ এল না। খুব সম্ভব আত্তিলিও ভুল শুনেছেন। একটা মোরগ ক্রুদ্ধস্বরে ডেকে উঠল, গোয়ালের বেষ্টনী থেকে ভেসে এল গোবৎসের করুণ কণ্ঠধ্বনি–তারপর আবার সব চুপচাপ।–কান্নার প্রথম আবেগ সামলে নিল মদাবুলি, দুএকবার ফুঁপিয়ে সে আত্মসংবরণ করল। অবশেষে মমর্যাতনার তীব্র উচ্ছ্বাস কেটে গেল, শান্ত সংযত স্বরে কথা বলতে পারল জুলু বালিকা, টোয়াবেনি ওকে খুন করবে কিংবা আমাকে।
আমাকে অর্থাৎ মদাবুলিকে খুন করা টোয়াবেনির মতো বাপের পক্ষে খুব অসম্ভব নয়, কিন্তু আত্তিলিওর জিজ্ঞাস্য হল এই ও কে?
ধীরে ধীরে সব কিছুই জানতে পারলেন আত্তিলিও। ও হচ্ছে এক তরুণ জুলুযোদ্ধা, নাম নগো। উক্ত জুলু যুবকের সঙ্গে আত্তিলিও ভালোভাবেই পরিচিত ছিলেন। মদাবুলি অসংকোচে জানাল সে আর নগো পরস্পরকে বিবাহ করতে চায়। টোয়াবেনিকে তিরিশটা গোরু কন্যাপণ হিসেবে দিতে চেয়েছিল গো, কিন্তু টোয়াবেনি তার সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিতে রাজি হয়নি।
এতগুলো গোরুর বিনিময়েও টোয়াবেনি কন্যাদান করতে রাজি হয়নি শুনে অবাক হয়ে গেলেন আত্তিলিও! নগোকে তিনি খুব ভালো করেই জানেন, পাত্র হিসাবে সে চমৎকার ছেলে তবে টোয়াবেনির রাজি না-হওয়ার কারণ কী?
তার প্রশ্নের উত্তরে বালিকা জানাল টোয়াবেনি একসময়ে প্রভাবশালী জাদুকর ছিল। টোয়াবেনির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচার করে সর্দার জিপোসো এবং ইনডানাদের সভা (জ্ঞানী ব্যাক্তিদের সভা) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জাদুকরের সম্মানিত পদ থেকে খারিজ করে দেয়। এই ঘটনা ঘটেছিল কয়েক বছর আগে। অভিযোগ যে এনেছিল সে হচ্ছে জুলুদের এক ছোটোখাটো নেতা, গো তারই পুত্র। কিছুদিন আগে অভিযোগকারী–অর্থাৎ, গোর পিতা সিংহের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে। শত্রু হিংহের কবলে মারা গেছে বটে কিন্তু টোয়াবেনির বিদ্বেষ আজও জাগ্রত যার অভিযোগের ফলে টোয়াবেনি পদমর্যাদা হারিয়েছে, তার পুত্রের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেওয়ার কথা সে ভাবতেই পারে না।
টোয়াবেনির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বক্তব্য কী ছিল, অথবা কোন ধরনের ছিল–এই সব প্রশ্নের উত্তর না-দিয়ে বার বার আত্তিলিওকে এক কথা বলতে লাগল, বাবা বলেছে গোর। সঙ্গে মেয়ের বিয়ের সম্মতি দেবার আগে সে মেয়ের আর গোর মরা মুখ দেখবে।
আত্তিলিও জুলুদের নিয়মকানুন যেটুকু জানেন, তা থেকে বুঝলেন এই বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়।
জা বাব, মদাবুলি বলল, আমি তোমার সাহায্য চাই।
তা তো বুঝলুম, আত্তিলিও মনে মনে বললেন, কিন্তু আমি বিদেশি মানুষ, জুলুদের সামাজিক ব্যাপারে হাত দেব কী করে?
তাঁর মৌনব্রত দেখে মন্দাবুলি নিরস্ত হল না। সে আত্তিলিওকে এই ব্যাপারে টোয়াবেনির সঙ্গে কথা কইতে অনুরোধ করল। সে এ-কথাও বলল আত্তিলিও যদি জিপোশোকে এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে বলেন, তাহলে হয়তো মনস্কামনা পূর্ণ হতে পারে সর্বাধিনায়ক জিপোসো যদি চায় তাহলে টোয়াবেনির ইচ্ছার বিরুদ্ধেও এই বিবাহ হওয়া সম্ভব, জুলুল্যান্ডে জিপোসোর কথার উপর কথা বলার ক্ষমতা তারও নেই।
অশ্রুসজল চক্ষে বালিকা বার বার তার সাহায্য প্রার্থনা করতে লাগল, তার বিশ্বাস আত্তিলিও যদি হস্তক্ষেপ না-করেন তাহলে তার মৃত্যু নিশ্চিত।
এই মেয়েটিকে তিনি কী উপায়ে সাহায্য করতে পারেন সেই কথাই ভাবছিলেন আত্তিলিও, হঠাৎ তার চোখের সামনে মদাবুলির সমস্ত শরীর হল আড়ষ্ট, মুখ হল রক্তহীন, বিবর্ণ ও বিকৃত!
আত্তিলিও চমকে উঠলেন, বিদ্যুৎ ঝলকের মতো এক ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা তার মনে এল, নিশ্চয়ই ওকে অজান্তে বিষ খাওয়ানো হয়েছে?
আর ঠিক সেই মুহূর্তে মদাবুলির পিছনে ছায়া-আচ্ছন্ন কুটিরের যে জায়গায় মধ্যাহ্নের সূর্যালোক প্রবেশ করেছিল, সেই আলোক-উজ্জ্বল স্থানে আবির্ভূত হল দ্রুত ধাবমান এক ছায়া!
আত্তিলিও বুঝলেন বিষ-টিষ কিছু নয়; অতিজাগ্রত ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের প্রখর অনুভূতি দিয়ে আসন্ন বিপদের আভাস পেয়েছে বনবালা দারুলি তাই এই ভাবান্তর।
বালিকার পিছনে, এই ছ-ফিট দূরে কুটিরের প্রবেশপথে নড়ে উঠেছে সর্পিল ছায়া।
.
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – বিপদ
সাপের মতো লম্বা দোদুল্যমান ছায়াটা যে একটি আন্দোলিত লাঙ্গুলের ছায়া ছাড়া আর কিছুই নয়, এ-কথা সহজেই বুঝলেন আত্তিলিও, সঙ্গেসঙ্গে ছায়ার পিছনে অবস্থিত নিরেট কায়ার স্বরূপ নির্ণয় করতেও তাঁর ভুল হল না–সমগ্র আফ্রিকাতে ওইভাবে চাবুকের মতো লেজ আছড়াতে পারে একটিমাত্র জীব–সিংহ!