টোয়াবেনির ব্যবহার ছিল বেশ স্বাভাবিক ও ভদ্র, কিন্তু আত্তিলিওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে ওই লোকটির সম্বন্ধে বার বার সাবধান করে দিল–অন্তরের অন্তস্থলে তিনি অনুভব করলেন টোয়াবেনি তাকে পছন্দ করছে না, সুযোগ পেলেই সে শত্রুতা করবে। অবশ্য প্রথম সাক্ষাৎকারের পর বেশ কয়েকবার আত্তিলিও তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তবে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটেনি। দুটি মানুষের মধ্যে বার বার দেখাসাক্ষাৎ ঘটলে সাধারণত ঘনিষ্ঠতা হয়, কিন্তু নিস্পৃহ ঔদাসীন্যে টোয়াবেনি নিজেকে সর্বদাই স্বতন্ত্র করে রেখেছে, মন খুলে কখনো সে কথা বলেনি আত্তিলিওর সঙ্গে।
চোদ্দোটি স্ত্রীর স্বামী এবং তিরিশটি কন্যার পিতা ছিল টোয়াবেনি। তার পরিবারবর্গের মধ্যে কারো সঙ্গেই আত্তিলিওর বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল না, কিন্তু টোয়াবেনির ষোলো বছরের মেয়ে দাবুলি আত্তিলিওর প্রতি আকৃষ্ট হল। খুব সম্ভব বনবালা মদাবুলি তার সহজাত সংস্কার দিয়ে আত্তিলিওর মধ্যে এক সহানুভূতিসম্পন্ন বন্ধুকে আবিষ্কার করেছিলেন। মেয়েটির জীবনে যে একটি সত্যিকারের বন্ধুর দরকার হয়েছিল, পরবর্তী ঘটনাস্রোত থেকে আমরা শীঘ্রই তা জানতে পারব।
একদিন মধ্যাহ্নে জলন্ত আফ্রিকার সূর্য যখন আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে সেইসময় রাইফেল হাতে আত্তিলিও এলেন টোয়াবেনির ক্রালে। সিংহের আক্রমণ থেকে তার ক্রালকে নিরাপদ রাখার জন্য টোয়াবেনি কী ব্যবস্থা করেছে সেইটা দেখাই ছিল আত্তিলিওর উদ্দেশ্য। টোয়াবেনির আস্তানার সামনে গিয়ে আত্তিলিও অবাক হয়ে গেলেন–ক্রালটাকে বেষ্টন করে বিরাজ করছে কণ্টকসজ্জিত গাছপালার এক বিরাট দুর্ভেদ্য ন্যূহ, এবং ব্যুহের চারপাশ ঘিরে সারারাত ধরে জ্বলবার জন্যে সংগৃহীত হয়েছে রাশি রাশি শুকনো কাঠ–একবার তাকিয়েই বোঝা যায় শতাধিক লোকের সাহায্য ছাড়া এমন প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
আত্তিলিও আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন দিনদুপুরে লোকজন, গোরুবাছুর এমনভাবে বেড়ার আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে কেন? সিংহগুলো কি এখানে প্রখর দিবালোকের মধ্যেই হানা দিতে শুরু করেছে?… পানীয় জল আনতে গোরুবাছুর চরাতে মানুষজন নিশ্চয়ই বেড়ার বাইরে যাতায়াত করে কিন্তু কোন পথে? কণ্টক-শোভিত ব্যুহের কোথাও তো এতটুকু কঁক দেখা যাচ্ছে না।…
একটা পথের রেখা পাওয়া গেল। আত্তিলিওর মনে হল ওই পথেই লোক চলাচল করে। সন্ধিগ্ধ চিত্তে সেই পথ ধরে বেড়ার দিকে অগ্রসর হলেন আত্তিলিও, আর হঠাৎ তার সামনে প্রায় দশ ফুট জায়গা ফাঁক হয়ে গেল এবং বিভক্ত ফাঁকে আত্মপ্রকাশ করল স্বয়ং টোয়াবেনি!
জা বাব, ভিতরে এসো টোয়াবেনি বলল, তাড়াতাড়ি করো। চারপাশে ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে বসে আছে সিংহরা। আমরা ওদের দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু ওরা আমাদের লক্ষ করছে।
আত্তিলিও ভিতরে প্রবেশ করলেন। এমন চমৎকার প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং বিস্ময়কর দ্বারপথের আবিষ্কার করার জন্য টোয়াবেনির বুদ্ধির তারিফ করলেন আত্তিলিও।
প্রশংসা শুনে খুশি হলেন টোয়াবেনি। এতদিনের মধ্যে সেইদিনই শুধু তার কণ্ঠস্বরে বন্ধুত্বের আভাস পাওয়া গেল–দেখো, কত সহজে কোনো শব্দ না-করে এটা খোলা যায় আর বন্ধ করা যায়।
আত্তিলিও দেখলেন দুটি দড়ির সাহায্যে টোয়াবেনি তার নিরাপদ আশ্রয়ের ভিতর থেকেই কুটিরের ভিতর অবস্থিত দরজাকে ইচ্ছানুযায়ী খুলতে পারে। প্রতিরোধের এমন কৌশল যার মগজ থেকে উৎপন্ন হয়, সেই মগজের অধিকারী যে অতিশয় বুদ্ধিমান সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। টোয়াবেনি জানাল একটু আগেই দরজাটা আর একবার ব্যবহার করার দরকার হয়েছিল। আত্তিলিও ঘটনার বিশদ বিবরণ শুনতে চাইলেন।
আমার গোরুর দল মাঠে ঘাস খাচ্ছিল, হঠাৎ সিংহ তাদের আক্রমণ করল, টোয়াবেনি বলতে লাগল আমি ঘরের ভিতর থেকে দড়ি টেনে দরজা খুলে দিতেই আমার ছেলেরা গোরুগুলোকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। দুটো বাছুর এর মধ্যেই সিংহের আক্রমণে মারা পড়েছিল। সিংহেরা যখন বাছুর দুটোর মাংস খেতে ব্যস্ত, সেই সময়টুকুর সুযোগ নিয়েই আমার ছেলেরা ভিতরে ঢুকতে পেরেছিল–আর তারা ভিতরে আসামাত্রই আমি আমার দড়ি টেনে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ঠিক সময়মতোই দরজাটা আমি বন্ধ করেছিলাম। কারণ, খিদের প্রথম ঝোঁক কেটে গেলেই সিংহগুলো ভিতরে আসার চেষ্টা করত। ওই পাহাড়টার ওপারে আমার ভাই-এর আস্তানায় ছেলেরা এখন চলে গেছে। ভাই-এর ক্রালটাকে ঘিরে এইরকম একটা বেড়া দেওয়া দরকার, তাকে সাহায্য করবার জন্যই রওনা হয়েছে আমার ছেলেরা।
কথা শেষ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেল টোয়াবেনি। তার মুখের উপর ফুটে উঠল। নিস্পৃহ ঔদাসীন্যের পরিচিত ভঙ্গি আর একটি কথাও না-বলে সে হঠাৎ পিছন ফিরে অদৃশ্য হল তার নিজস্ব কুটিরের ভিতরে।
সঙ্গেসঙ্গে বেড়ার সবচেয়ে নিকটে অবস্থিত কুটিরের ভিতর থেকে একটা মুখ বাইরে উঁকি দিল।
মদাবুলি!
আত্তিলিও দেখলেন জুলু বালিকার মুখে আজ আনন্দের চিহ্ন নেই। বিষণ্ণভাবে সে আত্তিলিওকে তার কুটিরের ভিতরে আসতে ইঙ্গিত করল।
আত্তিলিও ভিতরে ঢুকলেন। মদাবুলি জানাল তার মা গেছে সপত্নীদের সঙ্গে গল্প করতে অন্য কুটিরে। মায়ের অনুপস্থিতিতে শিষ্টাচারের ত্রুটি হতে দেয়নি মেয়ে বসবার জন্য অতিথিকে একটা কাঠের আসন এনে দিল মদাবুলি।