মি. হুইংক্রির কথা শুনে প্রফেসর ও বিল দুজনেই দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তারা দুজনেই উৎসাহের সঙ্গে জানালেন যে, ওই অঞ্চলের বিচিত্র নিসর্গ-দৃশ্য দেখে তাদের ধারণা হয়েছে প্রকৃতি দেবীর বহু গোপন তথ্য সেখানে লুকানো আছে এবং আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে তাদের পক্ষে সেই গোপন রহস্যগুলো আবিষ্কার করা খুব কঠিন হবে না। আত্তিলিও কোনো কথা বলেননি, সঙ্গীদের সঙ্গে তিনি একমত হতে পারেননি তখন পর্যন্ত–ওই ধরনের অভিযানের সাফল্য সম্বন্ধে তাঁর দ্বিধা ছিল, তাই কোনো মন্তব্য প্রকাশ করেননি আত্তিলিও সাহেব।
মি. হুইংক্রি হঠাৎ বলে উঠলেন, আপনারা যদি মৃত্যুগহ্বর আবিষ্কার করতে পারেন, তাহলে একটা কাজের মতো কাজ হয় বটে!
মৃত্যুগহ্বর! সে আবার কী?
তিন বন্ধুই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
কমিশনার মি. হুইংক্লি তখন যা বললেন তার সারমর্ম হচ্ছে–কায়না নামক এক মৃত্যুগহ্বরের কথা স্থানীয় অধিবাসীদের মুখে শোনা যায় বটে, কিন্তু বাস্তব জগতে উক্ত স্থানের সত্যিই কোনো অস্তিত্ব আছে কি না সে-বিষয়ে তিনি খুব নিঃসন্দেহ নন। হয়তো সবটাই গুজব অথবা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন স্থানীয় মানুষের কল্পনার ব্যাপার। তবে পর পর দু-বার কায়না শব্দটি যে মি. হুইংক্লির শ্রুতিগোচর হয়েছিল সে-কথাও তিনি জানিয়ে দিলেন এবং তারপর পুলিশ কর্মচারী ও বৃদ্ধার মৃত্যু নিয়ে যে আলোচনা হয়েছিল সেই আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ এই কাহিনির শুরুতেই বলা হয়েছে।
সব কথা শুনে বিল আর প্রফেসর ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। সম্ভব হলে সেই মুহূর্তেই তারা মৃত্যুগহ্বরের সন্ধানে যাত্রা করতে প্রস্তুত! আত্তিলিও বন্ধুদের কথায় খুব উৎসাহ প্রকাশ না-করলেও কায়না-অভিযানে তার আপত্তি ছিল না। শেষকালে অবশ্য বিপদের গুরুত্ব বুঝে প্রফেসর ও বিল পিছিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মহাযুদ্ধের সৈনিক আত্তিলিও গত্তি একবার কাজ শুরু করে পিছিয়ে আসতে রাজি হলেন না–উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বার বার তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে।
সেসব কথা ক্রমশ প্রকাশ্য।
গভর্নরের বাড়ি থেকে নিজেদের আস্তানায় ফিরে আসতেই তিন বন্ধু অভিযানের পরিকল্পনা স্থির করে ফেললেন। তারা জানতেন স্থানীয় সরকার তাদের সাহায্য করবেন। কিন্তু সরকারের সাহায্য পেলেই সব সমস্যার সমাধান হয় না। কাজটা খুবই কঠিন। মাম্বোয়া জাতির প্রধান ব্যক্তিরা অভিযাত্রীদের উদ্দেশ্য জানতে পারলে বিভিন্ন উপায়ে তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবে এবং সেই বাধাবিপত্তি জয় করে প্রায় ৩০,০০০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে শ্বাপদসংকুল অজানা স্থানে এক গোপন গুহার অস্তিত্ব আবিষ্কার করা যে কতখানি কঠিন, সে-কথা অন্তত আত্তিলিওর অজ্ঞাত ছিল না বিপদের গুরুত্ব বুঝেই তিনি এই অভিযান সম্পর্কে প্রথমে বিশেষ উৎসাহ দেখাননি। কিন্তু অভিযানের দায়িত্ব গ্রহণ করে আত্তিলিওর মনের ভাব বদলে গেল। বাস্তব জগতে যদি সত্যিই মৃত্যুগুহার অস্তিত্ব থাকে, তবে যেমন করেই হোক ওই জায়গাটা খুঁজে বের করার, প্রতিজ্ঞা করলেন আত্তিলিও।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ত্রয়ী
কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি যে প্রথম মহাযুদ্ধে মিত্রপক্ষের বাহিনীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে আফ্রিকা মহাদেশ সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করার জন্যই আফ্রিকা ভ্রমণে উদযোগী হয়ে উওর রোডেশিয়াতে পদার্পণ করেছিলেন, সে-কথা এই কাহিনির প্রথম পরিচ্ছেদেই বলা হয়েছে।
কিন্তু সেনাবাহিনীর মানুষটি হঠাৎ সৈনিকের ভূমিকা ত্যাগ করে পর্যটকের ভূমিকা গ্রহণ করতে উৎসুক হয়ে উঠলেন কেন সে-কথা জানতে হলে কমান্ডার সাহেবের পূর্বজীবন নিয়ে একটু আলোচনা করা দরকার। প্রফেসর ও বিল নামে আত্তিলিওর যে দুজন বন্ধুর নাম ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের সঙ্গেও বর্তমান কাহিনির পাঠকদের বিশেষ পরিচয় হওয়ার প্রয়োজন আছে।
প্রথমেই ধরা যাক আত্তিলিওর কথা, কারণ তিনি হলেন এই কাহিনির নায়ক।
সুদীর্ঘ চার বৎসর ধরে জ্বলতে জ্বলতে প্রথম মহাযুদ্ধের সর্বগ্রাসী অগ্নি যখন নির্বাণলাভের উপক্রম করছে–অর্থাৎ যুদ্ধের শেষ দিকে–হঠাৎ আহত হলেন আত্তিলিও সাহেব। চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে মিশরে পাঠানো হল। আত্তিলিওর বুকে গুলি লেগেছিল; তার উপর ফ্লু রোগের আক্রমণ তাকে যক্ষ্মার কবলে ঠেলে দিল। মাত্র তেইশ বছর বয়সে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে আত্তিলিও খুবই বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন। চিকিৎসক তাকে বললেন, সাহারা মরুভূমিতে সূর্যের তাপে উত্তপ্ত বালির মধ্যে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকলে আত্তিলিওর অসুখ ভালো হয়ে যাবে।
আত্তিলিও ডাক্তারের উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। গরম বালির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে তিনি বসে থাকতেন। মাত্র একমাস পরেই তিনি সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন, তাঁর দেহ রোগমুক্ত হয়েছে এবং তিনি সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
ইতিমধ্যে বিস্তর আরব-বেদুইনের সঙ্গে তিনি ভাব জমিয়ে ফেলেছেন। মরুভূমির মধ্যে একটা সজীব নরমুণ্ড দেখে তারা কৌতূহলী হয়ে ছুটে আসত এবং লুপ্ত বালুকার গর্ভে আত্তিলিওকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে খুবই আশ্চর্য হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তাকে পর্যবেক্ষণ করত। ওই সময়ে আরবি ভাষার সঙ্গে আত্তিলিওর পরিচয় হয়।