অনাবৃষ্টি যে জুলুদের পক্ষে কতখানি ক্ষতিকর, কতখানি প্রাণঘাতী সর্বনাশ যে ডেকে আনতে পারে বৃষ্টিবিহীন খরার জ্বলন্ত অভিশাপ–তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছিলেন অভিযাত্রীরা…
আত্তিলিও এবং তার দলবল জুলুল্যান্ডে পদার্পণ করার কয়েক মাস পরেই সেখানে অনাবৃষ্টির সূত্রপাত হয়। শুষ্ক বনভূমি থেকে আহার্য সংগ্রহ করতে না-পেরে বহু তৃণভোজী পশু মৃত্যুবরণ করল। যারা বাঁচল তারা অন্যত্র যাত্রা করল তৃণশ্যামল অরণ্যের সন্ধানে। দক্ষিণ দিকের পথে ছুটল ইম্পালা, অরিক্স, ইল্যান্ড,, জেব্রা, অ্যান্টিলোপ প্রভৃতি তৃণভোজী পশু। ধাবমান পশুদের খুরে খুরে ধুলো উড়ে দিগন্তকে আচ্ছন্ন করে দিল। পাহাড়ের চূড়ার বিভিন্ন আস্তানা থেকে জুলুরা সেই ধুলোর মেঘ লক্ষ করতে লাগল উদবিগ্ন চিত্তে। অনাবৃষ্টির দ্বিতীয় মাসের মাঝামাঝি সময়ে অদৃশ্য হল সেই ধুলোর মেঘ। সেইসঙ্গে অন্তর্ধান করল তৃণভোজী পশুর দল। বলিষ্ঠ সিংহের দলও তৃণভোজীদের সঙ্গে স্থান ত্যাগ করেছিল, কিন্তু সবচেয়ে বিপজ্জনক জন্তুগুলো থেকে গেল জুলুল্যান্ডের শুষ্ক অরণ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক একদল তরুণ সিংহ, অভিজ্ঞতার অভাবে যারা বেপরোয়া; বৃদ্ধ সিংহ, দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে যারা অশক্ত, কিন্তু অভিজ্ঞ শিকারির কৌশল ও চাতুর্যে যারা ভয়ংকর; এবং শাবক সমেত সিংহীর দল, যারা বাচ্চার জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখেও ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত।
ক্ষুধার্ত সিংহরা এইবার জুলুদের গোরুদের দিকে নজর দিল। বর্শাধারী জুলুযোদ্ধার দল সতর্কভাবে তাদের গোরু রক্ষা করতে সচেষ্ট হল। সিংহরা তখন মানুষের উপর হামলা শুরু করল। কয়েকবার নরমাংসের স্বাদ গ্রহণ করে জন্তুগুলো খেপে গেল। দলবদ্ধ নেকড়ের মতোই তারা মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, কুটিরের দরজা বন্ধ করেও কেউ আর নিরাপদ বোধ করে না–দরজা ভেঙে নরখাদক সিংহের দল মানুষ ধরতে আরম্ভ করল। সিংহের এমন অদ্ভুত ভয়ংকর আচরণ ইতিপূর্বে কখনো দেখা যায়নি।
এককভাবে চলাফেরা বন্ধ হয়ে গেল। জুলুরা দল বেঁধে অস্ত্র হাতে ভ্রমণ করত। কাটাগাছের বেড়া দিয়ে জুলুল্যান্ডের ক্রালগুলোকে ঘিরে ফেলা হল। ওইসব ক্রালের চারপাশে সারারাত আগুন জ্বলত। দৈবাৎ আগুন নিভে গেলেই হানা দেবে নরভুক শ্বাপদ। তাই শয্যা আশ্রয় করার আগে প্রত্যেক জুলু কুটিরের বহির্ভাগে অবস্থিত অগ্নিকুণ্ডে সারারাত জ্বলবার মতো কাঠ আছে। কি না দেখে নিত, ওইসঙ্গে কাটার বেড়ার মধ্যেও ফাঁক আছে কি নেই দেখতে তাদের ভুল হত না।
এত সতর্ক হওয়া সত্ত্বেও প্রতিদিন ঢাকের আওয়াজে দুর্ঘটনার সংবাদ ভেসে আসতে লাগল। দিনে-রাতে, যেখানে সেখানে, যখন-তখন সিংহরা আক্রমণ চালাতে শুরু করল। নিরস্ত্র বালিকা থেকে শুরু করে দুর্ধর্ষ অস্ত্রধারী যোদ্ধা পর্যন্ত কোনো মানুষকেই রেয়াত করত না হিংস্র শ্বাপদ। দলবদ্ধ সিংহের সঙ্গে বর্শা হাতেই লড়াই করে প্রাণ দিল বহু জুলুযোদ্ধা। তাদের সাহস ও বীরত্বের তুলনা হয় না, কিন্তু ক্ষিপ্ত সিংহদের নিরস্ত করা গেল না কিছুতেই সমগ্র জুলুল্যান্ডের উপর মাংসলোলুপ শ্বাপদের নখদন্তে সৃষ্ট হল সন্ত্রাস ও বিভীষিকার রাজত্ব।
অভিযাত্রীদের কাজকর্মও ব্যাহত হল। জুলুদের পক্ষে দূরদূরান্তের ক্রাল থেকে এখন আর অভিযাত্রীদের তাবুতে আসা সম্ভব নয়। কিন্তু অভিযাত্রীরা জুলুদের সাহায্য করতে প্রস্তুত হলেন। প্রফেসর বিলকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে ঘুরে সিংহের কবল থেকে উদ্ধারপ্রাপ্ত মুষ্টিমেয় হতভাগ্যের চিকিৎসা করতে শুরু করলেন। অনেকে তাঁর চিকিৎসার গুণে বেঁচে গিয়েছিল।
আত্তিলিও গত্তি চিকিৎসার বিষয়ে একেবারে আনাড়ি। কিন্তু তিনিও জুলুদের সাহায্য করতে সচেষ্ট হলেন। তবে ঔষধপত্র বা শল্যচিকিৎসকের ছুরির পরিবর্তে তার হাতে ছিল গুলিভরা রাইফেল। বিলকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন প্রফেসর তার চিকিৎসা কার্যে সাহায্য করার জন্য, সুতরাং সম্পূর্ণ এককভাবেই সিংহ-নিধনে নিযুক্ত হলেন আত্তিলিও। খরার তৃতীয় মাসের মধ্যেই তার রাইফেলের অগ্নিবর্ষী মহিমায় স্তব্ধ হয়ে গেল তিরিশটা সিংহের গর্জিত কণ্ঠ।
কিন্তু তারপরই বিপদ এল অতর্কিতে।
এক শয়তানের চক্রান্তে প্রাণ হারাতে বসেছিলেন আত্তিলিও।
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – দুয়ারে মৃত্যুর ছায়া
টোয়াবেনি ছিল জুলুল্যান্ডের আতঙ্ক। কেউ তার সঙ্গে কথা বলতে চাইত না। সে নিজেও লোকের সঙ্গে মেলামেশা করার আগ্রহ প্রকাশ করত না। অভিযাত্রীরা অনেকবার জামানিকে পাঠিয়ে উক্ত ব্যক্তিকে তাদের তাঁবুতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, কিন্তু টোয়াবেনি সাড়া দেয়নি। দুর্দান্ত প্রতাপশালী জিপোসা সর্দার পর্যন্ত টোয়াবেনিকে এড়িয়ে চলত। আত্তিলিও যখন নিজেই এগিয়ে গিয়ে টোয়াবেনির সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন তখন তাঁর সঙ্গী হল জুলুদের সর্বাধিনায়ক জিপোসো স্বয়ং। স্পষ্টই বোঝা যায় টোয়াবেনির আস্তানার মধ্যে আত্তিলিওর নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হতে পারে বলেই জিপোসো তার সঙ্গে গিয়েছিল।
আত্তিলিও একটা কম্বল নিয়ে গিয়েছিলেন টোয়াবেনিকে উপহার দেবার জন্যে। টোয়াবেনি একবার আত্তিলিওর দিকে দৃষ্টিপাত করল, পরক্ষণেই কম্বলটা টান মেরে ছিনিয়ে নিয়ে সে সবচেয়ে বড়ো কুঁড়েঘরটার ভিতর ঢুকে গেল। একটু পরেই অবশ্য কুটিরের বাইরে এসে আত্তিলিওকে উপহারের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছিল টোয়াবেনি। সেইসঙ্গে ভদ্রতা করে একথাও জানালে যে, তার ক্রাল সর্বদাই আত্তিলিওকে অভ্যর্থনা করতে প্রস্তুত। ইচ্ছে হলেই তিনি যেন তার আস্তানায় চলে আসেন।