তবে এইসব অসুবিধা সহ্য করতে জুলুদের বিশেষ আপত্তি ছিল না। তাদের আপত্তির কারণ অন্য। জুলুদের সামনেই অভিযাত্রীরা জামানির মুখের ছাপ নিলেন। জুলুরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমস্ত ব্যাপারটা দেখল, কিন্তু একজন মুখের ছাপ দিতে রাজি হল না। তাদের বক্তব্য হচ্ছে ওই ছাপ তুলতে দিলে তাদের দ্বিতীয় মুখ সাদা মানুষদের সঙ্গে থেকে যাবে এবং কোনো শত্রু যদি উক্ত দুই নম্বর মুখ-এ আঘাত করে তবে মুখের প্রকৃত অধিকারীর উপর সেই আঘাত এসে পড়বে। অতএব বহু মূল্যবান উপহারের বিনিময়েও তারা মুখের ছাপ তুলতে দিতে রাজি নয়।
কয়েকজন জাদুকর গম্ভীরভাবে জানাল, জাদুবিদ্যার সাহায্যে এমন অভিনব দুর্ঘটনা থেকে জুলুদের রক্ষা করার ক্ষমতা তাদের নেই। ব্যস! হয়ে গেল! জাদুকর যেখানে ভয় পায়, সেখানে এগিয়ে যাওয়ার সাহস আছে কার?…ইতিপূর্বেও কয়েকজন বৈজ্ঞানিকের প্রচেষ্টা সংস্কার-অন্ধ মানুষের কাছে পরাজিত হয়েছে, মনে হল আত্তিলিওর দলও কুসংস্কারের কাছে পরাজিত হবে। কিন্তু অভিযাত্রীরা জানতেন কুসংস্কারকে পরাস্ত করতে হলে তার বিরুদ্ধে অন্ধ-সংস্কারকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হয় অবশ্য যদি সে-রকম সুযোগ পাওয়া যায়।
সুযোগ এল অপ্রত্যাশিতভাবে।
বহু দূরবর্তী এক ক্রাল থেকে জনৈক জুলুযোদ্ধা অভিযাত্রীদের তাঁবু পরিদর্শন করতে এল। তার বাঁ-দিকের গাল ফুলেছে দেখে আত্তিলিও কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল বেচারা দাঁতের ব্যথায় ভুগছে, খারাপ দাঁতের জন্যই তার গণ্ডদেশের ওই দুরবস্থা। সিগারেট উপহার দিয়ে আত্তিলিও তার সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেললেন, তারপর দাঁতের চিকিৎসা করার জন্য এগিয়ে এলেন প্রফেসর।
লোকটিকে হাঁ করতে বলে প্রফেসর তার মুখের ভিতর একটা ক্ষতযুক্ত গর্ত দেখতে পেলেন। লবঙ্গ দিয়ে তৈরি একরকম চটচটে আঠার মতো ঘন পদার্থ দিয়ে ক্ষতটাকে ঢেকে দিলেন প্রফেসর। ওই অদ্ভুত চটচটে পদার্থটি প্রফেসরের নিজস্ব আবিষ্কার। যাতনাদায়ক দাঁতের রোগে ওই বস্তু ছিল অব্যর্থ ঔষধ। কিছুক্ষণের মধ্যে চটচটে জিনিসটা জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে যায়, আর তৎক্ষণাৎ দাঁত ব্যথার উপশম হয় মন্ত্রের মতো। লোকটাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দুজনে মিলে তাকে ক্যানভাসের উপর শুইয়ে ফেলে মুখে প্যারিস প্ল্যাস্টারের প্রলেপ লাগাতে শুরু করলেন। হঠাৎ দাঁতের যন্ত্রণা কমে যাওয়ায় লোকটাও অবাক হয়ে গিয়েছিল, বাদ-প্রতিবাদ না-করে সে প্রফেসর আর আত্তিলিওর হাতে আত্মসমর্পণ করল। কিছুক্ষণ পরে কাজ শেষ হয়ে যেতেই অভিযাত্রীরা তার মুখের উপর থেকে শক্ত প্লাস্টারের ছাপ, অর্থাৎ লোকটার মুখের ছাপ তুলে ফেললেন।
জুলুযোদ্ধা হতভম্ব হয়ে একবার গালের উপর হাত বুলিয়ে নিল, একবার হাঁ করল, তারপর আবার মুখটা বন্ধ করল। তার ভয়ানক দাঁতের ব্যথা এমন চটপট সেরে যাওয়ায় সে যে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। অভিযাত্রীরা তাকে কিছু উপহার দেবেন বলে প্রস্তুত হচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে প্রফেসরের হাতে একটা আসাগাই (বর্শা) গুঁজে দিল।–ডাক্তারের ফি।
পরক্ষণেই দেখা গেল দারুণ আনন্দে চিৎকার করতে করতে জুলুযোদ্ধা তিরবেগে ছুটছে! অসহ্য যন্ত্রণা থেকে এমন আকস্মিকভাবে মুক্তি পেয়ে তার উল্লাস যেন ফেটে পড়তে চাইছে…
পরের দিন অভিযাত্রীরা দেখলেন দ্বিতীয় মুখ সম্বন্ধে জুলুদের ভয় ভেঙে গেছে একদিনের মধ্যেই। স্ত্রী-পুরুষ নিয়ে সর্বসমেত উশটি জুলু এসে অভিযাত্রীদের জানাল, দাঁতের ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মুখের ছাপ তুলে চিকিৎসা করাতে তাদের আর আপত্তি নেই। আরোগ্যলাভ করতে পারলেই তারা খুশি, দ্বিতীয় মুখ নিয়ে তারা মাথা ঘামাতে চায় না!…
চিকিৎসার ফল হল অতীব সন্তোষজনক। জুলুরা নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্র, বাদ্যযন্ত্র, হাতে তৈরি সুন্দর সুন্দর কাঠের জিনিস ও আসন অভিযাত্রীদের উপহার দিল। ইতিপূর্বে ওইসব জিনিস দাম দিয়েও কিনতে পারেননি অভিযাত্রীরা বিনীতভাবে, কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে অসম্মতি জানিয়েছিল জুলুরা। এখন সম্পূর্ণ বিনামূল্যেই ওইসব বস্তু উপহার দিয়ে রোগমুক্ত জুলুরা অভিযাত্রীদের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল। অভিযাত্রীরা যে শুধু নানারকম ভালো ভালো উপহারই পেয়েছিলেন তা নয়, শতাধিক স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বের বন্ধন স্থাপিত হয়েছিল। এইজন্য অবশ্য প্রফেসরকেই ধন্যবাদ দিতে হয় তাঁর দাঁতের রোগের অব্যর্থ দাওয়াই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিল।
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সন্ত্রাস ও বিভীষিকা
জুলুদের দেশে বৃষ্টিপাত একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বৃষ্টিপাতের ফলে বিস্তীর্ণ প্রান্তরগুলো হয়ে ওঠে সবুজ ঘাসের রাজত্ব এবং ওই ঘাসজমি থেকে আহার্য সংগ্রহ করে জুলুদের গৃহপালিত গোরুর পাল মনের আনন্দে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। গোরু হচ্ছে জুলুদের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ। গোরুর বিনিময়ে তারা পত্নী সংগ্রহ করতে পারে, তা ছাড়া গোমাংস ও গোদুগ্ধ তাদের উদরের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতেও সাহায্য করে।
বর্ষার জল যে শুধু জুলুদের গো-সম্পদ বৃদ্ধি করে তা নয়, অবিশ্রান্ত ধারাপাত দেশের শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখে। বৃষ্টিপাতের ফলে শ্যাম-সবুজ অরণ্যের বুক থেকে আহার্য সংগ্রহ করে তৃণভোজী জেব্রা, অ্যান্টিলোপ প্রভৃতি জন্তু বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয় এবং ওইসব পশুর মাংসে জীবনধারণ করে জুলুল্যান্ডের অগণিত সিংহের দল। কিন্তু বৃষ্টি না হলে বন্য পশুরা শুষ্ক বনভূমি ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়, আর ক্ষুধার্ত সিংহরা আকৃষ্ট হয় গোমাংস ও নরমাংসের প্রতি ফলে জুলুল্যান্ডের স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ধ্বংস করে শুরু হয় ভয়াবহ বিভীষিকার রক্তাক্ত তাণ্ডব।