জিপোসোর নিজস্ব গুপ্তচর বিভাগ যে অতিশয় সক্রিয়, এই ঘটনা থেকেই তা বোঝা যায়। কারণ জিপোসোর আস্তানা বা ক্রালের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে অভিযাত্রীরা কোনো মানুষকে দেখতে পাননি, অথবা ঢাকের আওয়াজও তাদের শ্রুতিগোচর হয়নি–অথচ যথাস্থানে পৌঁছেই দেখলাম তাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক বিপুল জনতা। জুলুরা কীভাবে বাস করে সে-কথা আগেই বলেছি, কাজেই দূরদূরান্তে অবস্থিত বিভিন্ন কাল থেকে যে ওইসব মানুষকে যথাসময়ে ডেকে আনা হয়েছে, এ-কথা অনুমান করা কঠিন নয়।
ভিড়ের মধ্যে জুলুদের অধিনায়ক জিপোসো দাঁড়িয়েছিল জনতার ঠিক মাঝখানে। তার অঙ্গ বেষ্টন করে ঝুলছিল একটা লেপার্ডের চামড়া। কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য জানোয়ারের লেজ ওই লেপার্ড চর্মের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে জুলুসর্দারের অঙ্গের শোভা বর্ধন করছিল। তার কেশশূন্য মস্তকে উষ্ণীষের অভাব পূরণ করেছিল অনেকগুলো রঙিন পাখির পালক। বহু বর্ণে রঞ্জিত ওই পালকগুলো বাতাসের ধাক্কায় দুলছিল, আর সঙ্গেসঙ্গে প্রখর সূর্যালোকে জ্বলে জ্বলে উঠছিল দোদুল্যমান রামধনুর রঙিন সমারোহ।
জিপোসোর গায়ের রং কালো নয়–হালকা বাদামি। সেই বাদামি দেহের অপূর্ব ভঙ্গি, উন্নত মস্তক ও কালো দুই চোখের তীব্র উদ্ধত চাহনি যেন নীরব ভাষায় এক প্রচণ্ড পুরুষের ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করতে চাইছে–প্রথম দর্শনেই মনে হয়–হ্যাঁ, একটা পুরুষের মতো পুরুষ বটে সর্দার জিপোসো।
সালাগালে, আত্তিলিও বললেন, তুমি শান্তিতে থাক।
স্যাগাবোনা, জা বাব, স্মিতহাস্যে উজ্জ্বল হল জুলুসর্দারের মুখমণ্ডল, ফদার, তুমি শান্তিপ্রিয় মানুষ।
জার্মানি হাঁটু পেতে বসে সর্দারের সামনের ভূমিতে ললাট স্পর্শ করল। জিপোসো একবার তার দিকে তাকিয়ে জামানির অভিবাদন গ্রহণ করল, তারপর আত্তিলিওর দিকে ফিরল, আমি শুনেছি তুমি ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছ।
মুহূর্তের মধ্যে আত্তিলিও অনুভব করলেন প্রবল প্রতাপশালী এই জুলুসদারের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের বন্ধন স্থাপিত হয়েছে। জনতার প্রবল হর্ষধ্বনি থেকে বোঝা গেল, জুলুরাও অভিযাত্রীদের পছন্দ হয়েছে। আত্তিলিওর অনুচর জামানি কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে করমর্দন করল। যোদ্ধাদের হাতে বর্শাগুলো আনন্দের আবেগে শূন্যে দুলে উঠল বারংবার, সঙ্গেসঙ্গে সমবেত নারীকণ্ঠে জাগল তীব্র উল্লাসধ্বনি!
তারপর সর্দার জিপোসোর আদেশে মহামান্য অতিথিদের জন্য এল মেহগনি কাঠের আসন, খাদ্য, পানীয়। সকলে মিলে একসঙ্গে পানভোজন করতে করতে গল্পগুজব আরম্ভ করলেন।
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – প্রফেসরের কীর্তি
জামানি কাজের লোক। অভিযাত্রীরা যেদিন জুলুদের দেশে পদার্পণ করলেন, সেইদিনই রাতের দিকে তাদের বসবাসের উপযুক্ত একটা সুন্দর উপত্যকা আবিষ্কার করে ফেলল জামানি। এক সপ্তাহ লাগল সব গুছিয়ে ঠিকঠাক করতে, ইতিমধ্যে কুলির সাহায্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসার ব্যবস্থাও হয়েছিল–তারপর স্থায়ীভাবে একটা তাঁবু খাঁটিয়ে বেশ কিছুদিন জুলুদের দেশে থাকার বন্দোবস্ত করলেন অভিযাত্রীরা।
স্থায়ী আস্তানা পেতে ফেলার পরই ম্যাজিক, জাদুবিদ্যা, ডাকিনী-তন্ত্র প্রভৃতি অলৌকিক ঘটনার সঙ্গে অভিযাত্রীদের পরিচয় হতে লাগল প্রতিদিন। জুলুরা অলৌকিক কার্যকলাপে বিশ্বাসী। তাদের ধারণা প্রতিদিনে ছোটোখাটো ব্যাপার থেকে শুরু করে যাবতীয় আকস্মিক ঘটনা বা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী পূর্বপুরুষের প্রেতাত্মার দল। প্রেতাত্মার রোষ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা বিভিন্ন জাদুকরের সাহায্যপ্রার্থী হয়। জুলুদের উপর তাই জাদুকরদের প্রভাব খুব বেশি।
আত্তিলিও এবং তার দুই বন্ধু আফ্রিকার বিভিন্ন জাতির মানুষ, জীবজন্তু ও উদ্ভিদ সম্বন্ধে গবেষণা করতে এসেছিলেন, তাই জুলুজাতির গড়পড়তা দৈহিক পরিমাপ দরকার ছিল। মাপ দেওয়ার আগে প্রত্যেক জুলু তার পছন্দসই জাদুকরের কাছ থেকে কবচ বা তাবিজ সংগ্রহ করেছিল–ওই কবচ নাকি তাদের সাদা মানুষের ম্যাজিক থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু মাপ নেওয়া ব্যাপারটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর অভিযাত্রীদের কাছ থেকে তামার তার, টম্বাকো (তামাক), দেশলাই, ছোরা প্রভৃতি উপহার পেয়ে তারা স্তম্ভিত হয়ে গেল। জিনিসগুলো তাদের যে সত্যি সত্যি দিয়ে দেওয়া হল, সে-কথা তারা প্রথমে বুঝতে পারল না–এমন মূল্যবান সব উপহার কেন তাদের দেওয়া হচ্ছে? তারা তো সাদা মানুষদের জন্য কিছুই করেনি! তবে?… অবশেয়ে যখন তারা বুঝল ওইসব জিনিস তাদের উপহার দেওয়া হয়েছে এবং এগুলো আর ফেরত নেওয়া হবে না, তখন তারা ভারি আশ্চর্য হয়ে গেল। বিস্ময়ের চমক কেটে যেতেই জাগল আনন্দের প্রবল উচ্ছ্বাস। উত্তেজিত আনন্দিত জুলুদের সশব্দ হাস্যধ্বনি শুনে অভিযাত্রীরাও খুশি।
কিন্তু অভিযাত্রীরা যখন প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে মুখের ছাপ নেবার চেষ্টা করলেন, তখন তারা দেখলেন এই ব্যাপারটা আগের মতো সহজে হওয়ার নয়। প্যারিস প্লাস্টারের ছাপ তোলার হাঙ্গামা যথেষ্ট। ঘন আঠার মতো অর্ধতরল জিনিসটা যখন ব্যক্তিবিশেষের মুখের উপর মাখানো হয়, তখন সেই লোকটির নাকের দুই ফুটো দিয়ে দুটি বড়ো খড় চালিয়ে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয় এবং পূর্বোক্ত তরল প্লাস্টার শুকিয়ে শক্ত না হওয়া পর্যন্ত ওই লোকটির একটুও নড়াচড়া করার উপায় থাকে না। মুখের গোঁফদাড়ি প্রভৃতি ছাপ তোলার আগে তেল দিয়ে ভিজিয়ে নিতে হয়; কিন্তু তেলের পরিমাণ কম হলে প্লাস্টারের ছাঁচ বা মুখোশ টেনে নেওয়ার সময় মুখের গোঁফদাড়ি ছিঁড়ে মুখের ছাপের সঙ্গে উঠে আসে! ব্যাপারটা মোটেই আরামদায়ক নয়।