উত্তর রোডেশিয়া ত্যাগ করে এগারোজন নিগ্রো অনুচর নিয়ে অভিযাত্রীরা ইনিয়াতি পর্বতমালার দিকে অগ্রসর হলেন। পূর্বোক্ত নিগ্রোদের সংগ্রহ করেছিল জামানি নামক আত্তিলিওর বিশ্বস্ত অনুচর ও রাঁধুনি। সকলেই জানত যে, তাদের গন্তব্যস্থল হচ্ছে জুলুল্যান্ড।
জামানি জুলুল্যান্ডের অধিবাসী, অতএব স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেলে তার পক্ষে খুশি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা ভয়ানক সমস্যা তাকে এমনভাবে বিব্রত করে তুলেছিল যে দেশে ফেরার আনন্দ সে প্রথমে উপভোগ করতে পারেনি। সমস্যাটা হচ্ছে এই :
আত্তিলিওকে কায়নার ভয়াবহ গহ্বর থেকে উঠতে দেখেছিল জামানি, আর তৎক্ষণাৎ বুঝে নিয়েছিল প্রভুর মতো দেখতে ওই জীবটি হচ্ছে প্রভুর প্রেতাত্মা; কারণ, একটা নিঃসঙ্গ মানুষ মৃত্যুগহ্বরের অন্ধকার গর্ভে প্রবেশ করে আবার জীবিত অবস্থায় ফিরে আসতে পারে, এমন অসম্ভব কথা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়… কিন্তু কিছুদিন পরেই আবার জামানির মনে খটকা লাগল–একটা আস্ত ভূতের পক্ষে নিরেট রক্তমাংসের দেহ নিয়ে সবসময় চলাফেরা কি সম্ভব? আবার ঘর্মাক্ত হল জামানির মস্তিষ্ক… অবশেষে বিস্তর চিন্তা করে, বিস্তর মাথা ঘামিয়ে, আসল ব্যাপারটা সে ধরে ফেলল–আত্তিলিও হচ্ছেন, অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক প্রেত! না হলে, কায়নার মতো ভয়াবহ মৃত্যুগহ্বরের ভিতর থেকে একটা আস্ত মানুষ কি কখনো জ্যান্ত অবস্থায় ফিরতে পারে?…
যাই হোক, প্রেত-মানুষ যে তার প্রতি অত্যন্ত সদয় হয়ে তাকে মাতৃভূমিতে নিয়ে যাচ্ছে এই চমকপ্রদ তথ্যটি আবিষ্কার করার পরই মনের মেঘ কেটে গেল, উৎফুল্ল হয়ে উঠল জামানি।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – জুলুদের দেশে আত্তিলিও
আত্তিলিও তার অভিযাত্রীদল নিয়ে জুলুল্যান্ডের ভিতর এসে পৌঁছোলেন। তিনি জানতেন দলের নেতা হিসেবে দলীয় নিরাপত্তার গুরুদায়িত্ব এখন থেকে তাঁকেই বহন করতে হবে। শ্বেতাঙ্গ সরকার অভিযাত্রীদের জুলুল্যান্ডে প্রবেশের অনুমতি দিলেও তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে অসম্মত। সরকার স্পষ্ট জানিয়েছিলেন অভিযাত্রীরা জুলুল্যান্ডে প্রবেশ করার ফলে যদি কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তাহলে সেজন্য অভিযাত্রীরাই দায়ী হবেন–স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট জুলুদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কিছুতেই হস্তক্ষেপ করবেন না, অবশ্য বিদ্রোহ কিংবা গণহত্যা সংঘটিত হলে আলাদা কথা।
ওসব কথা শুনে ঘাবড়ে যাওয়ার পাত্র নন আত্তিলিও। তিনি আফ্রিকার বিভিন্ন জাতির মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারতেন; জুলুদের ভাষা তিনি এমনভাবে আয়ত্ত করেছিলেন যে, ওই ভাষা বলতে বা বুঝতে তার কিছুমাত্র অসুবিধা হত না। আত্তিলিও তার জুলু-অনুচর জামানির কাছে যা শুনেছিলেন, তা থেকে জুলুদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে তাঁর মোটামুটি একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল। তিনি বুঝেছিলেন যে জাত্যভিমানে গর্বিত জুলুজাতি অতিশয় সাহসী ও সহজ-সরল আধুনিক জীবনযাত্রার পদ্ধতি তাদের পছন্দ নয়, তারা অনুসরণ করে পূর্বপুরুষদের প্রচলিত রীতিনীতি। আফ্রিকার প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত জাতিদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জুলুজাতি।
সব কিছু শুনে আত্তিলিওর মনে হয়েছিল জুলুল্যান্ডে তাদের বিশেষ কিছু অসুবিধা হবে না। নিশ্চিন্ত মনে দলবল নিয়ে তিনি একটা বৃত্তাকার পর্বতচূড়ার দিকে অগ্রসর হলেন। উক্ত পাহাড়ের উপর অবস্থান করছিল অনেকগুলো কুটির। সেই কুটিরগুলোই ছিল আত্তিলিওর লক্ষ্যস্থল। এখানে বাস করে জুলুদের সর্বাধিনায়ক জিপোসো। শ্বেতাঙ্গ সরকার কখনো তার কথার উপর কথা বলেন না; স্থানীয় ব্যাপারে জিপোসো হচ্ছে জুলুরাজ্যের মুকুটহীন রাজা।
দেখো, প্রফেসর বললেন, সর্দারের নিশ্চয়ই চল্লিশটি বউ আছে।
ঠিকই বলেছেন প্রফেসর। তবে সর্দার-পত্নীদের সঠিক সংখ্যা অনুমান করার জন্য প্রফেসরকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করলে ভুল হবে জুলুজাতির সামাজিক ব্যবস্থা সম্বন্ধে যারা অবহিত, তাদের পক্ষে যেকোনো জুলু-পুরুষের আস্তানার সম্মুখীন হয়ে উক্ত ব্যক্তির স্ত্রীর সংখ্যা বলে দেওয়া খুবই সহজ। জুলুরা গ্রামবাসী নয়; প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ তার বউদের নিয়ে স্বতন্ত্রভাব বাস করে সবচেয়ে বড়ো কুটিরটাতে বাস করে কর্তা স্বয়ং এবং গোরু রাখার জন্য যে বিস্তীর্ণ স্থানটিকে বেড়ার সাহায্যে ঘিরে ফেলা হয়, সেই ঘেরা-জায়গার চারপাশে মালিকের স্ত্রীদের প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট থাকে একটি করে কুটির। পূর্বোক্ত পত্নীরা তাদের নিজস্ব সন্তানসন্ততি নিয়ে ওইসব কুটিরে বাস করে। অতএব বৃহত্তম কুটিরটির আশেপাশে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র কুটিরগুলোর সংখ্যা দেখে অনায়াসেই আস্তানার মালিকের স্ত্রীর সংখ্যা নির্ণয় করা যায়। বহু কুটির নিয়ে গঠিত জুলুদের এই আস্তানাকে বলে ক্রাল। একটি ক্রাল থেকে আর একটি ক্রালের দূরত্ব খুব কম নয়। বেশ কয়েক মাইল দূরে দূরে অবস্থিত কাল প্রায়ই দেখা যায় জুলুদের দেশে।
প্রফেসর বললেন, দেখো, ওরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
হ্যাঁ, ওরা অপেক্ষা করছিল। পুরুষদের নিয়ে গঠিত এক বৃহৎ জুলু জনতা নির্বাক হয়ে অপেক্ষা করছিল। তাদের চারপাশে দণ্ডায়মান জুলু মেয়েরা কলকণ্ঠে উত্তেজনা প্রকাশ করলেও পুরুষরা ছিল প্রস্তরমূর্তির মতো নিশ্চল, নীরব।