সাহায্য করো, আত্তিলিও ভগ্নস্বরে বললেন, তাড়াতাড়ি করো!
জামানি অবরুদ্ধ কণ্ঠে আর্তনাদ করে, মাসাংগা! তোমার নিজের আত্মা!
আত্তিলিওর হাত ধরার চেষ্টা না-করে সে ধপাস করে মাটির উপর পড়ে গেল।
আত্তিলিও পড়ে যাচ্ছিলেন, কোনোরকমে হাত বাড়িয়ে গহ্বরের মুখে দড়ি বাঁধা পাথরটা চেপে ধরে পতন থেকে আত্মরক্ষা করলেন। তারপর শেষ শক্তি দিয়ে নিজের পতনোন্মুখ দেহটাকে টেনে আনলেন গহ্বরের বাইরে। শ্রান্ত ও অবসন্ন শরীরে অতি কষ্টে শ্বাস টানতে টানতে আত্তিলিও শুনলেন জামানির আর্তনাদ–মাসাংগা! তুমি মরে গেছ! আমি জানি, তুমি মরে গেছ! মরে তুমি ভূত হয়েছ। তবে কেন থলির মধ্যে তোমার মুণ্ডু আর হাড়গুলো নিয়ে এলে আমার কাছে! মাসাংগা! আমি তোমার বিশ্বস্ত অনুচর, আমার সঙ্গে তোমার এ কী ব্যবহার, মাসাংগা!
আত্তিলিও হাসে নি!
হেসে ওঠার ক্ষমতা তার তখন ছিল না।
২. শয়তানের ফাঁদ
সৈনিকের দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা
শয়তানের ফাঁদ
প্রথম পরিচ্ছেদ – অর্ধেক মানব আর অর্ধেক দানব
প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি নামক মিত্রপক্ষের জনৈক সেনাধ্যক্ষ আফ্রিকা মহাদেশ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে উদযোগী হন। ওই কাজে তার প্রধান সহায় ছিল তার দুই বন্ধু প্রফেসর ও বিল। প্রথমোক্ত ব্যক্তি ফরাসি বৈজ্ঞানিক, দ্বিতীয় মানুষটি হচ্ছে আমেরিকার এক অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় দুঃসাহসী যুবক। বন্ধু দুটিকে নিয়ে যে অঞ্চলে প্রথম পদার্পণ করলেন আত্তিলিও, সেই জায়গাটি হল আফ্রিকার অন্তর্গত উত্তর রোডেশিয়া। পূর্বোক্ত স্থানে কায়না নামে এক ভয়াবহ মৃত্যুগহ্বরের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে অভিযাত্রীরা স্থানীয় সরকারকে অবাক করে দিয়েছিলেন। কায়নার গহ্বর থেকে অসংখ্য নরকঙ্কাল, করোটি, পাথরের গয়না এবং জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছিল। ওইসব জিনিস উপহার হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম নীচে দেওয়া হল :
গভর্নমেন্ট অব নর্দার্ন রোডেশিয়া, আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি, আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়, রয়্যাল অ্যানথ্রোপলজিক্যাল মিউজিয়াম অব ফ্লোরেন্স এবং জোহানেসবার্গের উইটওয়াটারসর্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
উত্তর রোডেশিয়াতে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণাকর্মে সাফল্য অর্জন করার ফলে অভিযাত্রীদের সামনে দক্ষিণ রোডেশিয়ার রুদ্ধদ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেল। দক্ষিণ রোডেশিয়া সরকার সাধারণত বিদেশিদের প্রবেশ করার অনুমতি দেন না, কিন্তু অভিযাত্রীদের বিভিন্ন গবেষণাকার্যের সাফল্যে খুশি হয়েই পূর্বোক্ত গভর্নমেন্ট নিয়ম ভঙ্গ করেছিলেন। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও বিবরণ পাঠকদের কাছে নীরস লাগবে বলে আত্তিলিও ওইসব বিজ্ঞান-বিষয়ক তথ্য ও তত্ত্ব এখানে পরিবেশন করেননি, লিপিবদ্ধ করেছেন তার অ্যাডভেঞ্চারের রোমাঞ্চকর কাহিনি।
দক্ষিণ রোডেশিয়াতে ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিলেন আত্তিলিও। তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে, সেখানে গিয়ে এক বিপজ্জজনক নাটকের মধ্যে তাকে অংশগ্রহণ করতে হবে।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে ভয়াবহ নাটকের স্মৃতি আত্তিলিওর মানসপটে দুঃস্বপ্নের মতো জেগে থাকবে। সেই বন্য-নাটকে একাধিক ভিলেন বা খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল প্রকাণ্ড এক নরখাদক সিংহ, এক শয়তান জাদুকর এবং ক্রোধে উন্মত্ত এক-শো জুলুযোদ্ধা!
নায়কের ভূমিকায় ছিল পেশিবহুল বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী এক সুদর্শন জুলুযোদ্ধা, নায়িকার স্থান নিয়েছিল এক ষোড়শী জুলুবালিকা।
উল্লিখিত প্রধান চরিত্রগুলো ছাড়া কিছু কিছু এক্সট্রা অর্থাৎ অতিরিক্ত চরিত্রের উপস্থিতি নাটকটিকে জমিয়ে তুলেছিল, যেমন–প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জুলু সর্দার, নরমাংস-লোলুপ শত শত সিংহ, এবং আত্তিলিও, বিল, প্রফেসর প্রভৃতি অনিচ্ছুক অভিনেতার দল।
মূল নাটকে আত্তিলিওর ভূমিকা ছিল খুবই ছোটো, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুটি মানুষের জীবন মরণ নির্ভর করছিল তার অভিনয়ের সাফল্যের উপর; এবং ওই দুটি মানুষের একজন হলেন স্বয়ং আত্তিলিও! তবে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও তিনি ঘাবড়ে যাননি, বেশ ভালো হয়েছিল তার অভিনয়। না, ভালো বললে কিছুই বলা হয় না–এমন চমৎকার, এমন মর্মস্পর্শী হয়েছিল তার অভিনয় যে, সমস্ত ঘটনা শোনার পর মনে হল সৈনিকের পেশা গ্রহণ না-করে পেশাদার অভিনেতার বৃত্তি অবলম্বন করলে অনেক বেশি যশ ও খ্যাতির অধিকারী হতে পারতেন কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি।
কমান্ডার সাহেব প্রথমে তার অভ্যাস অনুযায়ী রাইফেল হাতেই আসরে নেমেছিলেন, কিন্তু নাটকের প্রয়োজনে অস্ত্রত্যাগ করে তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন জাদুকরের ভূমিকায় রাইফেলের পরিবর্তে তখন তার হাতে ম্যাজিকের বাক্স! সেসব ঘটনার বিবরণ যথাস্থানে দেওয়া হবে।
পূর্বোক্ত নাটকের বিবরণী দেওয়ার আগে যখন এত কথাই বললাম, তখন যে পটভূমির উপর নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল সেই রঙ্গমঞ্চটি সম্বন্ধেও পাঠককে অবহিত করা প্রয়োজন।
মঞ্চটি ছিল ওই অভিনব নাটকেরই উপযুক্ত–আয়তনে বিশাল এবং চমকপ্রদ দৃশ্যসজ্জায় সুশোভিত। জুলুল্যান্ডের উত্তর অংশে বিরাজমান ইনিয়াতি পর্বতমালার অরণ্যসজ্জিত বিপুল বিস্তৃতি নিয়ে গঠিত হয়েছিল উল্লিখিত নাটকের স্টেজ বা মঞ্চ।