মৃত্যুগহ্বরের ভিতর যেসব মানুষ মৃত্যুবরণ করছে, তাদের কথা মনে হতেই শিউরে উঠলেন আত্তিলিও। অনাহারে আর তৃষ্ণায় ছটফট করতে করতে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুযাতনা ভোগ করেছে। ওইসব হতভাগ্যের দল, তিল তিল করে শুকিয়ে তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছে মৃত্যুর দিকে। সেইজন্যই এই গুহার নাম দেওয়া হয়েছে কায়না অর্থাৎ যাতনাদায়ক মৃত্যগহ্বর।
নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য যুগ যুগ ধরে মাম্বোয়া-সর্দাররা এই প্রথা বাঁচিয়ে রেখে জনসাধারণের উপর নিষ্ঠুর সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। মাম্বোয়া জাতির মাতব্বরদের এই নৃশংসতায় আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই–পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় সর্বদেশে সর্বক্ষেত্রে এই ধরনের একদল লোক সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে ব্যক্তিগত কায়েমি স্বার্থকে বজায় রাখার জন্য।
আত্তিলিও হঠাৎ চমকে উঠলেন : এসব তিনি কী ভাবছেন? মানুষের দুঃখকষ্টের কথা না-ভেবে তার নিজের কথাই এখন চিন্তা করা উচিত। মাম্বোয়াদের মধ্যে প্রচলিত একটা ভয়ানক প্রবাদবাক্য তাঁর মনে পড়ল–এখানে যে প্রবেশ করে, তার উদ্ধারের আশা নেই!
আত্তিলিওর মনে হল, মূখের মতো অন্য মানুষের দুঃখের কথা ভেবে তিনি মূল্যবান সময়ের অপচয় করছেন। যদি এই গহ্বরের বাইরে তিনি না যেতে পারেন, তবে তার দেহের কঙ্কালটিও একদিন এই গুহার অস্থিস্তূপের মধ্যে পড়ে থাকবে। আত্তিলিও এইবার মৃত্যুগহ্বরের গর্ভ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।
দড়িটা উপরে ঝুলছিল। আত্তিলিও সেটাকে লক্ষ করে লাফ মারলেন। বৃথা চেষ্টা, লাফিয়ে ওই দড়িটাকে করায়ত্ত করা সম্ভব নয়। তিনি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেন, প্রতিধ্বনি তাঁকে বিদ্রূপ করল, উপর থেকে জার্মানির কণ্ঠস্বরে কোনো উত্তর এসে পৌঁছাল না তার কাছে।
আত্তিলিও এইবার অন্য উপায় অবলম্বন করলেন। অনেকগুলো পাথর আর নরকঙ্কাল টেনে জড়ো করলেন দড়িটার নীচে, তারপর ওই পাথর আর হাড়ের স্তূপের উপর আরোহণ করে এক সময়ে দড়িটাকে স্পর্শ করতে সক্ষম হলেন।
কিন্তু এখনও ঝামেলা অনেক–দড়ির শেষ প্রান্তে যে গিট আছে সেটাকে না-খুললে চলবে না। ইতিমধ্যে টর্চের ব্যাটারি শেষ হয়ে এসেছে, আলোটা কাঁপতে শুরু করল। আত্তিলিওর সমস্ত শরীর তখন অবসাদে ভেঙে পড়তে চাইছে, কেবল দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি তাকে দু-পায়ের উপর খাড়া করে রেখেছিল! কম্পিত হস্তে দড়ির গিটটা একসময়ে খুলে ফেললেন আত্তিলিও। পিস্তল আর টর্চ ব্যবহারের যোগ্য ছিল না, তাই সে দুটির পরিবর্তে কয়েকটা হাড়ের টুকরো আত্তিলিও তাঁর হাতের থলির মধ্যে ভরে নিলেন। শ্রান্ত দেহে অনেকটা দূরত্ব তাকে দড়ি ধরে অতিক্রম করতে হবে, ওই অবস্থায় হাড়গোড় দিয়ে ওজন বাড়িয়ে নিজেকে ভারগ্রস্ত করলে বিপদের সম্ভাবনা আছে বুঝেও মৃত্যুগহ্বর থেকে কিছু নিয়ে যাওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারেননি আত্তিলিও। জীবনের আশা তিনি ত্যাগ করেছিলেন, তবু যদি জীবিত অবস্থায় কায়নার বাইরে পদার্পণ করতে পারেন, তবে ওই হাড়গুলো বিল আর প্রফেসরের সামনে প্রমাণস্বরূপ দাখিল করতে পারবেন ভেবেই আত্তিলিও বাড়তি ওজনের ঝাট বহন করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
হাত আর পায়ের সাহায্যে যেভাবে মানুষ সাধারণত দড়ি বেয়ে উপরে উঠে, সেইভাবে চেষ্টা করলে খুব সম্ভব আত্তিলিও ব্যর্থ হতেন। শ্রান্ত-ক্লান্ত বাহু ও পায়ের মাংসপেশি সুদীর্ঘ রজ্জুপথে বেশিক্ষণ তার দেহভার বহন করতে পারত কি না সন্দেহ। তাই আত্তিলিও একটা কৌশল অবলম্বন করলেন। দড়িটাকে তিনি দক্ষিণ উরুর তলা দিয়ে চালিয়ে দিলেন, তারপর যে-অংশটা তিনি অতিক্রম করছিলেন, দড়ির সেই অংশটুকু ডান দিকের ঊরুর তলা দিয়ে ঘুরিয়ে দক্ষিণ বাহুর ঊর্ধাংশের উপর ফেলে দিচ্ছিলেন। এইভাবে যে দড়ির বেষ্টনী তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে ডান পা ঝুলিয়ে রেখে বাঁ-পা দিয়ে গুহার দেয়ালে বেরিয়ে-আসা পাথরের মাঝে মাঝে ধাক্কা মেরে উপরে উঠেছিলেন আত্তিলিও। দোদুল্যমান রঞ্জুর দুটি অংশ পরস্পরের সঙ্গে এবং আত্তিলিওর দুই পায়ের মাঝখানে ঘর্ষিত হয়ে শূন্য পথে ভাসমান দেহের ভারসাম্য রক্ষা করছিল; ফলে ক্লান্ত শরীরটা অল্প আয়াসেই ঝুলিয়ে রেখে মাঝে মাঝে দম নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলেন তিনি।….
তবু মাঝে মাঝে ক্লান্ত মুঠির বাঁধন খুলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, মাঝে মাঝেই দড়ির উপর শিথিল হয়ে এসেছে হাতের আঙুলগুলো, কিন্তু কিছুতেই হাত ছাড়েননি আত্তিলিও, শক্ত করে বার বার আঁকড়ে ধরেছেন দড়িটাকে…
গহ্বরের উপরদিকে তিনি যত উঠছিলেন, নিরেট অন্ধকার ততই হালকা হয়ে গহ্বরের বহির্দেশে উজ্জ্বল সূর্যালোকের অস্তিত্ব ঘোষণা করছিল। সেই আলোর আভাসই প্রেরণা দিয়েছে, শিথিল আঙুলের বাঁধন খুলে যেতে আবার দড়িটাকে চেপে ধরেছেন দৃঢ় মুষ্টিতে।
আত্তিলিও উপরে উঠতে লাগলেন অতি কষ্টে, ধীরে ধীরে, অতি সন্তর্পণে…
অবশেষে এক সময় তিনি গহ্বরের মুখে এসে পৌঁছালেন। মাথাটা গর্তের বাইরে ঠেলে দিয়ে সামনে দৃষ্টিপাত করলেন : ভগবানকে ধন্যবাদ, জামানি যথাস্থানেই অবস্থান করছে।
আত্তিলিওকে দেখামাত্রই জামানির দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল, ওষ্ঠাধর হল বিভক্ত এবং সর্বশরীরে জাগল কম্পিত শিহরন!