আত্তিলিও সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে একটা আঠার মতো ঘন চটচটে বস্তুর উষ্ণ অস্তিত্ব অনুভব করলেন : রক্ত। ধারালো পাথরগুলো খোঁচা মেরে তাঁর পতনোন্মুখ শরীরটাকে রক্তাক্ত করে তুলেছে। কিন্তু রক্তাক্ত ক্ষতগুলোর চাইতে তাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে দড়িটা। কোমরের উপর, পাঁজরের দু-পাশে শক্ত দড়ি যেন কেটে কেটে বসছে। তবে সৌভাগ্যের বিষয় আত্তিলিওর শরীরটা এখনও আস্ত আছে, ভগ্নাংশে পরিণত হয়নি। বুকের সঙ্গে বাঁধা থলির ভিতর থেকে টর্চটা বার করে আত্তিলিও সেটাকে জ্বেলে ফেললেন এবং চারদিকে দৃষ্টি চালনা করে অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করলেন। গুহাটা মোটামুটি বৃত্তাকার। তার আনুমানিক ব্যাস প্রায় চল্লিশ ফিট। গুহার ছাদ এবং ভূমির ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় শূন্যে দোল খাচ্ছেন আত্তিলিও; পূর্বোক্ত দুটি স্থানের দূরত্ব তার দেহের থেকে প্রায় দশ-বারো ফুট হবে। গুহার নীচে মাটি প্রায় দেখা যাচ্ছে না, অগণিত নরকঙ্কাল ও অস্থিময় নরমুণ্ডের আবরণে গুহার তলদেশের মৃত্তিকা প্রায় অদৃশ্য। অস্থিপঞ্জরগুলো কোথাও ধবধবে সাদা, কোথাও-বা সময়ের স্পর্শে হলুদ হয়ে এসেছে।
ঝুলতে ঝুলতে আর দুলতে দুলতে আত্তিলিও টর্চের আলোটাকে গুহা-গহ্বরের কিনারাতে ফেললেন।
গুহার দেয়াল যেখানে নেমে এসে গুহাভূমিকে স্পর্শ করেছে, সেইখানেই মেঝের উপর এক জায়গায় আত্তিলিওর দৃষ্টি আকৃষ্ট হল; হাড়ের স্তূপের মধ্যে কিছু যেন নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে।
সচল বস্তুগুলোর স্বরূপ নির্ণয় করার জন্য উৎসুক হয়ে উঠলেন আত্তিলিও। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওই জায়গাটা তিনি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।
অকস্মাৎ দারুণ আতঙ্কে তার শরীরের রক্ত যেন বরফ হয়ে গেল। স্তূপীকৃত অস্থিপঞ্জর আর কঙ্কাল-করোটির মধ্যে বিচরণ করছে কয়েকটা কেউটে সাপ! আত্তিলিও গুনে দেখলেন, সেখানে অবস্থান করছে সাত-সাতটি বিষধর সরীসৃপ।
টর্চের আলোতে বিরক্ত হয়ে কেউটেগুলো অনধিকার প্রবেশকারীকে সন্ধান করছে। তাদের দীর্ঘ মসৃণ দেহ কুণ্ডলী পাকাচ্ছে। আবার খুলে খুলে যাচ্ছে।
সাপগুলো বুঝতে পারল, তাদের বিরক্তির কারণটি কোথায় অবস্থান করছে। শত্রুর নাগাল না-পেয়ে হিংস্র আক্রোশে ফণা তুলে তারা দুলতে লাগল একবার পেলে হয়।
অনেকের ধারণা, কেবলমাত্র ভারতবর্ষের মাটিতেই কেউটে সাপের বাস দেখা যায়। ওই ধারণ ভুল। কেউটে পরিবারের অন্তর্গত অন্তত চারটি বিভিন্ন জাতের সাপ আফ্রিকাতে বাস করে। উপযুক্ত ভয়াবহ তথ্য আত্তিলিও সাহেবের অজ্ঞাত ছিল না; তিনি এ-কথাও জানতেন যে, দেহের যেকোনো স্থানে কেউটের ছোবল পড়লে তাকে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরলোকের যাত্রী হতে হবে।
আত্মরক্ষার জন্য তিনি যা করলেন, তা পরবর্তীকালে তার নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। বাঁ-হাতের টর্চ ঘুরিয়ে তিনি সাপগুলোর উপর আলো ফেললেন এবং ডান হাতের পিস্তল থেকে গুলিবর্ষণ করতে শুরু করলেন। পরপর ছয়বার অগ্নি-উদ্গার করে গর্জে উঠল পিস্তল, প্রত্যেকটি গুলি অভ্রান্ত লক্ষ্যে ছয়টি সরীসৃপের দেহ বিদ্ধ করল–একটিও গুলি ব্যর্থ হল না।
সাত নম্বর কেউটের দিকে ফাঁকা পিস্তলটা ছুঁড়ে মারলেন আত্তিলিও, সাপটা চট করে গুহার গায়ে একটা ফাটলের ভিতর ঢুকে অদৃশ্য হল।
দড়িটা আত্তিলিওর কোমরে কেটে বসছিল, সেই যন্ত্রণা আর তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। যা থাকে বরাতে মনে করে শরীরটাকে রজ্জ্বর বন্ধন থেকে মুক্ত করে তিনি লাফিয়ে পড়লেন গুহার মেঝের উপর। সাপগুলো তখনও মৃত্যুযাতনায় ছটফট করছিল, আত্তিলিও জুতো-পরা পায়ের লাথি চালিয়ে সেগুলোকে নিরাপদ ব্যবধানে পাঠিয়ে দিলেন। তারপরই একটা অস্থিময় নরমুণ্ডের উপর হোঁচট খেয়ে তিনি পড়ে গেলেন!…
কতক্ষণ মূৰ্জিত হয়ে পড়েছিলেন সে-কথা আত্তিলিও নিজেও বলতে পারবেন না। জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি ধীরে ধীরে আহত ও রক্তাক্ত শরীরের পরিচর্যায় মনোনিবেশ করলেন। উপর থেকে ছিটকে পড়ার সময়ে পাথরের খোঁচা লেগে যেসব জায়গা কেটেকুটে গিয়েছিল, সেই ক্ষতস্থানগুলোর উপর তিনি ব্যান্ডেজ বেঁধে ফেললেন। অবশ্য সেইজন্য তাঁকে পরনের শার্টটা ছিঁড়ে ফেলতে হয়েছিল। গহ্বরের গায়ে যে-ফোকরটার ভিতর দিয়ে সাত নম্বর সাপটা অন্তর্ধান করেছিল, সেই ফুটোটার কাছে গিয়ে আত্তিলিও লক্ষ করলেন বাইরের বাতাস পূর্বোক্ত গর্তটার ভিতর দিয়ে সশব্দে গুহার ভিতর প্রবেশ করছে। আত্তিলিও এইবার বুঝলেন, আশি ফিট গভীর এই গহ্বরের ভিতর সাপগুলো কোন পথে এসেছে। স্তূপীকৃত অস্থিপঞ্জরের ভিতর থেকে একটা হাড় নিয়ে তিনি চটপট ওই ফোকরটার মুখ বন্ধ করে দিলেন।
এতক্ষণে আত্তিলিও সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তার দেহে রক্ত চলাচল করছে স্বাভাবিকভাবে। এই ভয়ানক গহ্বরটা যে কায়না, এ-বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই তার।
মাম্বোয়া-সর্দারদের আদেশে এই সুগভীর গহ্বরের মধ্যে অপরাধীদের নিক্ষেপ করা হত। অপরাধের গুরুত্ব সবসময় খুব বিবেচ্য নয়, মাম্বোয়া-সর্দার বা মাতব্বরদের অপ্রীতিভাজন হলেই উক্ত ব্যক্তিকে বিসর্জন দেওয়া হত কায়নার গর্ভে। মাম্বোয়ারা এই রীতি পছন্দ করত না, কিন্তু তারা জানত কেউ যদি শ্বেতাঙ্গদের কাছে মৃত্যুগহ্বরের সন্ধান দেয়, তবে মাম্বোয়া-সর্দারদের আদেশে সেই ব্যক্তির মৃত্যু অনিবার্য। সেইজন্যই তারা মুখ খুলত না। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু যখন কাছে এগিয়ে এসেছে তখনই তারা মুখ খুলতে চেয়েছে। আত্তিলিওর মনে পড়ল নিগ্রো পুলিশম্যান ও স্থানীয় বৃদ্ধা স্ত্রীলোকটির কথা। মরার আগে তারা মৃত্যুগহ্বরের রহস্য ফাঁস করে দিতে চেয়েছিল, কারণ তারা বুঝেছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মাম্বোয়া-সর্দারদের নাগালের বাইরে চলে যাবে। দুর্ভাগ্যক্রমে কোনো প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরার করার আগেই মৃত্যুর স্পর্শে তাদের জিহ্বা হয়ে যায় স্তব্ধ। ওইসব ঘটনাগুলো বার বার আত্তিলিওর মনে পড়তে লাগল।