.
অষ্টম পরিচ্ছেদ – মৃত্যু-বিভীষিকা
মুখের উপর সজোরে চপেটাঘাত পড়তেই আত্তিলিও চোখ বন্ধ করে ফেললেন এবং তাড়াতাড়ি সামনে ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়িয়ে চেপে ধরলেন দড়িবাঁধা পাথরটাকে।
একটা মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে রইলেন তিনি, তারপর সম্মুখে দৃষ্টিপাত করে তিনি দেখলেন, আক্রমণকারী জীবটি হচ্ছে মস্ত বড়ো একটা নিশাচর পাখি! অন্ধকারে গহ্বরের ভিতর থেকে উড়ে আসার সময়ে তার মুখের উপর পাখিটার ডানার ঝাঁপটা লেগেছিল। অন্ধকারে অভ্যস্ত নিশাচর দিনের আলোর মধ্যে এসে প্রায় অন্ধ হয়ে পড়েছিল, গহ্বরের কাছেই একটা শুকনো গাছের ডালপালার মধ্যে চুপ করে বসে ছিল পাখিটা।
এই ঘটনাটা অবশ্য আত্তিলিওর পক্ষে মঙ্গলজনক হয়েছিল। পাখিটা তাকে ভবিষ্যতের ভয়াবহ সম্ভাবনা সম্পর্কে সাবধান করে দিল–জামানির উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করলে তার অবস্থা যে কতদূর শোচনীয় হতে পারে, এই ঘটনায় তার প্রমাণ পেলেন আত্তিলিও।
জামানির দিকে তাকিয়ে তিনি দেখতে পেলেন, সে দড়ি ছেড়ে মাটির উপর শুয়ে পড়েছে। হাত বাড়িয়ে পাথরটা না-ধরলে তার দেহটা ছিটকে পড়ত গহ্বরের ভিতর এবং তলদেশে পতিত হয়ে অথবা পাথরের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে তার অবস্থা যে হত নিতান্ত শোচনীয়, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।
আত্তিলিও ঠিক করলেন, গর্তের ভিতর নামার সময়ে তিনি আর জামানির উপর নির্ভর করে নিজের জীবনকে বিপন্ন করবেন না। জামানিকে ভূমিশয্যা ত্যাগ করতে বললেন তিনি। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে মাথা তুলল জামানি, তারপর বিস্ফারিত দুই চক্ষুর ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে চারদিক নিরীক্ষণ করতে লাগল।
ভূ-ভভূত! সহসা আর্তনাদ করে উঠল জামানি, তার ভীত দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে পূর্বোক্ত নিশাচর পক্ষীর উপর!
ভূতের নিকুচি করেছে! বলে আত্তিলিও একটা পাথর ছুঁড়ে মারলেন। মস্ত বড়ো পাখিটা ডানা ঝটপট করে শূন্যে লাফিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কী? দেখেছ?
আত্তিলিও জামানির মুখের দিকে তাকালেন। জামানি মাথা নেড়ে জানাল, দেখেছে। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি দেখেই আত্তিলিও বুঝলেন, উড়ন্ত জীবটির পক্ষিত্ব সম্বন্ধে জামানির সন্দেহ দূর হয়নি। খুব সম্ভব সে ভাবছিল, ওটা পাখি না হয়ে একটা ছদ্মবেশী প্রেতাত্মাও হতে পারে!
আত্তিলিও আর জামানির সঙ্গে কথা বললেন না, নেমে পড়লেন গহ্বরের ভিতর। এইবার অবশ্য তিনি দড়িটাকে জামানির হাতে সমর্পণ করেননি; খুব সাবধানে ঝুলতে ঝুলতে তিনি নামতে শুরু করলেন দড়ি ধরে। যে-পাথরটার সঙ্গে আত্তিলিওর দেহসংলগ্ন দড়িটা বাঁধা ছিল, সেই পাথরটা ছিল খুবই গুরভার, অতএব তার দেহের ভারে পাথরটা স্থানচ্যুত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না।
আত্তিলিও নামছেন, নামছেন আর নামছেন…উপর থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ আলোর আভাসও ক্রমে লুপ্ত হয়ে গেল; তার মাথার উপর, পায়ের নীচে, সামনে পেছনে চতুর্দিকে বিরাজ করছে। এখন সীমাহীন অন্ধকার, অন্ধকার আর অন্ধকার…
গুহার প্রস্তর-প্রাচীর থেকে বেরিয়ে আসা একটা পাথরে আত্তিলিওর পা ঠেকল। পাথরটা খুব ধারালো, কিন্তু সেটার উপর দেহের ভার ছেড়ে দিয়ে নির্ভর করা যায়। আত্তিলিও কিছুক্ষণ সেই পাথরটার উপর পা রেখে বিশ্রাম করলেন, তারপর আবার দড়ি ধরে অবতরণ-পর্ব…
কয়েকটা আলগা পাথর আত্তিলিওর দেহের ধাক্কা খেয়ে সশব্দে ছিটকে পড়ল, কয়েকটা নিশাচর পক্ষী ডানা মেলে উড়ে গেল, তাদের ডানার শব্দ ভেসে এল আত্তিলিওর কানে।
গহ্বরের প্রস্তর-প্রাচীর থেকে বেরিয়ে-আসা পাথরগুলো পা দিয়ে অনুভব করছিলেন আত্তিলিও এবং মাঝে মাঝে ওই পাথরগুলোর উপর পা রেখে তিনি ক্লান্ত বাহু দুটিকে বিশ্রাম দিচ্ছিলেন। পর পর চারটে পাথরের উপর বিশ্রাম নিয়ে পঞ্চম পাথরটির উপর অবতীর্ণ হলেন আত্তিলিও। একহাতে দড়ি আঁকড়ে অন্য হাতে জ্বলন্ত টর্চ ধরে তিনি গুহার তলদেশ আবিষ্কার করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু গর্তের চারপাশের দেয়াল থেকে ছোটো-বড়ো অসংখ্য পাথর বেরিয়ে এসে দেয়ালটাকে এমন অসমান করে তুলেছে যে, টর্চের আলো সেই প্রস্তরের বেষ্টনী ভেদ করে গুহার তলায় পৌঁছাতে পারল না। আত্তিলিও সবিস্ময়ে ভাবতে লাগলেন : পঁচাত্তর ফিট দীর্ঘ রজুর দুই-তৃতীয়াংশ শেষ হয়ে গেছে, উপর থেকে তাঁর কণ্ঠস্বরে সাড়া দিয়ে জামানির উত্তরের রেশ অস্পষ্ট হয়ে দুজনের মধ্যে এক ভয়াবহ দূরত্বের আভাস দিচ্ছে, কিন্তু গহ্বরের তলায় পা দেওয়া তো দূরের কথা, তলদেশ এখনও রয়েছে তার দৃষ্টিসীমার বাইরে! গর্তটা নিশ্চয়ই অতল অসীম নয়, কিন্তু এই ভূতুড়ে গহ্বরের গভীরতা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে? কোথায় কত দূরে গেলে পাওয়া যাবে নীচের মাটি?
হঠাৎ আত্তিলিওর পায়ের তলায় পাথরটা নড়ে উঠল। চমকে উঠে তিনি দড়িটা চেপে ধরার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না–পাথরটা তার দেহের ভারে স্থানচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়ল; সঙ্গেসঙ্গে আত্তিলিও সাহেবও ছিটকে পড়লেন সীমাহারা শূন্যতার মাঝে!
তাঁর দেহটা দেয়াল থেকে দেয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে নীচের দিকে পড়তে লাগল, গুহার পাত্র-সংলগ্ন ধারালো পাথরগুলো ধারালো ছুরির মতোই নিষ্ঠুরভাবে তাঁকে দংশন করতে লাগল বারংবার, হঠাৎ এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে আত্তিলিওর দেহটা স্থির হয়ে গেল। পঁচাত্তর ফিট লম্বা দড়ির দৈর্ঘ্য শেষ হয়ে গেছে। রজ্জবদ্ধ অবস্থায় শূন্যে ঝুলতে লাগলেন আত্তিলিও, তাঁর মনে হল, কোমরে-দড়ি বাঁধা তাকে দু-টুকরো করে ভেঙে ফেলতে চাইছে।