সমতল জায়গাটার একপাশে দুটো মস্ত পাথর আত্তিলিওর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করল। তিনি সেদিকে এগিয়ে গেলেন।
পাথর দুটোর মাঝখানে দেখা গেল একটা গর্ত। গর্তটা প্রায় গোলাকার, চওড়ায় সেটা বারো ফুটেরও বেশি।
কায়না?…
কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু আত্তিলিওর দৃঢ় ধারণা হল, গর্তটাই কায়না। নিজের চোখকে তিনি প্রায় বিশ্বাস করতে পারছিলেন না–মাসের পর মাস যার জন্য কষ্ট সহ্য করেছেন অভিযাত্রীরা, নিদারুণ বিপদের মুখে প্রাণ বিপন্ন করেছেন বারংবার সেই মৃত্যুগহ্বর আজ আত্তিলিওর পায়ের তলায়।
একবার উঁকি দিয়ে গর্তের ভিতর দৃষ্টিকে চালনা করলেন আত্তিলিও। কিন্তু দেখা গেল না। দুর্ভেদ্য অন্ধকারের ভিতর থেকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ তার নাকে ধাক্কা মারল। আত্তিলিও সেই গন্ধটা সহ্য করতে পারলেন না, পিছিয়ে এলেন।
গহ্বরের নিবিড় অন্ধকারের ভিতর কিছুই চোখে পড়ছে না। কিন্তু গর্তটা কি খুব গভীর? পাথরটা এক দেয়াল থেকে আর এক দেয়ালে বাড়ি খেতে খেতে অনেকগুলো শব্দতরঙ্গের সৃষ্টি করল, কিন্তু একেবারে তলা থেকে পাথরটার পতনজনিত শব্দ শুনতে পেলেন না তিনি। এবার একটা বড়ো পাথর তিনি ছুঁড়ে দিলেন। একটা অস্পষ্ট শব্দ গর্তের তলা থেকে ভেসে এল। আত্তিলিও বুঝলেন পাথরটা নীচে পৌঁছোল।
জামানি, আত্তিলিও বললেন, এইবার তুমি নিশ্চয়ই টুপিটা পাবে।
নিতান্ত কর্তব্যবোধেই জামানি ধন্যবাদ দিল। তার চোখে-মুখে উৎসাহ বা আনন্দের কোনো চিহ্ন আত্তিলিও দেখতে পেলেন না।
জামানির দোষ নেই। স্বয়ং আত্তিলিও সাহেবই কি খুব উৎসাহ বোধ করছিলেন? ওই অন্ধকার গহ্বরের ভিতর কোনো অজ্ঞাত বিভীষিকা লুকিয়ে আছে কি না কে জানে! এটাই যে কায়না এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই, শুধু অনুমানের উপর নির্ভর করে একটা রহস্যময় গহ্বরের অন্ধকার গর্ভে প্রবেশ করা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে?
সাফল্যের মুখে এসে থমকে দাঁড়িয়েছেন আত্তিলিও। বর্তমানে তার অবস্থাটা হল, যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এই মুহূর্তে তার কর্তব্য কী হতে পারে সেটাই তিনি বুঝতে পারছিলেন না। একবার ভাবলেন শূন্যে রাইফেলের আওয়াজ করে প্রফেসর আর বিলকে ডাকলে হয়? তারপর মনে হল, ওরা এখন কোথায় আছে কে জানে! যদি অনেক দূরে থাকে, তাহলে তো গুলির শব্দ শুনতে পেলেও আত্তিলিও যে তাদের ডাকছেন এই কথাটা বুঝতে পারবে কি? গুলি তো কত কারণেই চালানো হয়। তারপর মাম্বোয়া-সর্দার? সেও তো এক সমস্যা। বিল আর প্রফেসরের সঙ্গে মাম্বোয়া-সর্দারও তো তার দলবল নিয়ে আসবে। তারা যে সুবোধ বালকের মতো দাঁড়িয়ে বিদেশিদের মৃত্যুগহ্বরের ভিতর ঢুকতে দেবে, এমন তো মনে হয় না!
অবশ্য এত সব ভাবনাচিন্তা না-করে আত্তিলিও তাবুতে ফিরে গিয়ে বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করতে পারতেন এবং পরের দিন তাদের নিয়ে এখানে চলে আসতে পারতেন অনায়াসে। এই সহজ উপায়টা যে তাঁর মাথায় আসেনি, তা নয়। কিন্তু উপায়টা মনে হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই তিনি সেটাকে নাকচ করেছেন। কী বলবেন তিনি বন্ধুদের কাছে? মৃত্যুগহ্বর আবিষ্কার করেও তার ভিতর তিনি একা প্রবেশ করতে সাহস পাননি? বন্ধুদের সাহায্য গ্রহণ করা জন্য ফিরে এসেছেন? এমন কথা বলতে পারবে না মহাযুদ্ধের প্রাক্তন সৈনিক কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি।
অতএব আত্তিলিও ঠিক করলেন, ওই গহ্বরের ভিতর ঢুকে আজই তিনি ভিতরটা দেখবেন। দড়িটাকে তিনি হস্তগত করলেন, তারপর গর্তের মুখে অবস্থিত প্রকাণ্ড পাথর দুটোর মধ্যে একটার সঙ্গে দড়িটা বাঁধলেন। দড়ির একপ্রান্ত পাথরের সঙ্গে বাঁধা হল, অপর প্রান্তটা তিনি বাঁধলেন নিজের কোমরের সঙ্গে। যে-থলিটার মধ্যে খাবারদাবার এবং নানা ধরনের যন্ত্রপাতি ছিল, সেটার ভিতর থেকে সব কিছু তিনি বের করে ফেললেন। তারপর সেই থলিটা বুকে ঝুলিয়ে তিনি প্রস্তুত হলেন মৃত্যুগহ্বরের ভিতর অবতরণ করার জন্য। থলিটা অবশ্য একেবারে শূন্যগর্ভ ছিল না, দুটি নিতান্ত প্রয়োজনীয় বস্তুকে থলির মধ্যে ভরেছিলেন আত্তিলিও টর্চ এবং পিস্তল।
জামানিকে ডেকে আত্তিলিও বললেন, সে যেন কোনো কারণেই স্থানত্যাগ না করে। তারপর তিনি তাকে দেখিয়ে দিলেন কীভাবে দড়ি ধরে তাকে ধীরে ধীরে গর্তের ভিতর নামাতে হবে। জামানির ওষ্ঠাধর নড়ে উঠল। কিন্তু শব্দ শোনা গেল না। সম্মতিসূচক ইয়েস, মাসাংগা কথাটা তার ঠোঁটের ভিতরেই জমে গেল, উচ্চারিত হল না। দারুণ আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল জামানি, তবু সে নির্দেশ-অনুযায়ী দড়িটা ধরল। সাবধানে আস্তে আস্তে, তাকে দড়ি ছাড়তে বললেন আত্তিলিও। লাটাই থেকে যেভাবে সুতো ছেড়ে ঘুড়ি ওড়ানো হয়, ঠিক সেইভাবেই জামানিকে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে ঘুড়ি ওঠে উপরদিকে, এখানে আত্তিলিও নামছেন নীচের দিকে এবং সুতোর স্থান নিয়েছে জামানির হাতের দড়ি আর লাটায়ের স্থান গ্রহণ করেছে একটা মস্ত পাথর।
খুব সন্তর্পণে আত্তিলিও নামতে শুরু করলেন। গর্তের মুখে পা রাখতে-না-রাখতেই কয়েকটা পাথর তার পায়ের ধাক্কায় গর্তের মধ্যে ছিটকে পড়ল সশব্দে। সেই শব্দে সাড়া দিয়েই যেন অন্ধকার গহ্বরের ভিতর থেকে কী-একটা বস্তু ছুটে এল। আর পরক্ষণেই
পরক্ষণেই আত্তিলিওর মুখের উপর পড়ল এক প্রচণ্ড থাপ্পড়! সঙ্গেসঙ্গে কানের পর্দা ফাটিয়ে এক তীব্র চিৎকার!