জামানি প্রথমে আত্তিলিও কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারেনি, পরে যখন বুঝল, তখন তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তবে জুলু জাতির আদর্শ পুরুষের মতো পুরুষ হলে তো মাম্বোয়াদের কায়নাকে ভয় করা চলে না, তাই বুক ঠুকে শপথ করে জামানি বলল, কায়না অভিযানে সে মাসাংগাকে সাহায্য করবে। মাম্বোয়াদের কথাবার্তা সে শুনতে চেষ্টা করবে এবং কোনো প্রয়োজনীয় তথ্য শ্রুতিগোচর হলে সেই সংবাদ সে আত্তিলিওকে জানাবে।
আত্তিলিও অবশ্য ভালোভাবেই জানতেন, কোনো গোপন রহস্যের সন্ধান পেলেও জামানি চট করে তাঁকে সংবাদ দেবে না। কিন্তু তার জুলু অনুচরটি তাদের সবাইকে ভালোবাসত, কাজেই নানারকম ছলছুতোয় সে যে তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করবে, সেই ভরসা তিনি রাখতেন। বিশেষ করে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল, জুলুল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেলে সে হয়তো কিছুটা দুঃসাহস প্রকাশ করতে পারে। আর একটা ছোটোখাটো বিষয়কেও বোধ হয় জামানি উপেক্ষা করবে না–অপেরা হ্যাট টুপিটার প্রলোভন খুব তুচ্ছ নয় তার কাছে।
.
সপ্তম পরিচ্ছেদ – ভয়াবহ পর্বত
১৯২৮ সালের ২৯ নভেম্বর সকাল বেলা আত্তিলিও ঘোষণা করলেন নিহত পাইথনের গুহাটাকে তিনি আর একবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন।
পূর্বোক্ত গুহার সামনে এসে বিল ও প্রফেসর দুটো ভিন্ন পথ অনুসরণ করলেন। অজানা পথে হয়তো তারা বিপদে পড়তে পারেন, তাই অত্যন্ত উদবিগ্ন হয়ে তার দলের সবচেয়ে বলিষ্ঠ লোকগুলোকে নিয়ে মাম্বোয়া-সর্দার তাদের সাহায্য করতে অগ্রসর হল।
আত্তিলিও বর্তমানে পাইথনের গুহার খুব কাছাকাছি থাকতেন, অতএব তাকে সাহায্য করার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে করেনি মাম্বোয়া-সর্দার। তবু সাবধানের মার নেই, তাই সর্দারের আদেশে ছয়জন মাম্বোয়া আত্তিলিওর সঙ্গে থেকে গেল। ওই লোকগুলো ছিল দুর্বল ও ব্যক্তিত্বহীন। নিতান্ত নিয়মরক্ষার জন্যই তারা আত্তিলিওর সঙ্গে ছিল। এক নজরে লোকগুলোর চেহারা জরিপ করে আত্তিলিও বুঝে নিলেন নিষিদ্ধ এলাকায় জোর করে প্রবেশ করতে চাইলে এরা তাঁকে বাধা দিতে পারবে না।
হঠাৎ জামানি বলে উঠল, ওই যে মাসাংগা! তুমি একটা বুনো শুয়োর চাইছিলে না? ওই দেখো, একটা শুয়োরের পায়ের ছাপ।
কোনোদিনই শুয়োর মারতে চাননি আত্তিলিও সাহেব, বিশেষ করে সেই মুহূর্তে আফ্রিকার বৃহত্তম বন্য শূকরও তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারত না। কিন্তু তিনি জামানির অব্যক্ত ইশারা বুঝতে পারলেন। জমির উপর সত্যি সত্যিই ওয়ার্ট হগ নামক বন্য শূকরের টাটকা পায়ের ছাপ ছিল। পদচিহ্নগুলো এগিয়ে গেছে নিষিদ্ধ এলাকাটার দিকে। মাম্বোয়ারা পায়ের ছাপগুলো দেখেছিল, তারা সন্ত্রস্তভাবে পরস্পরের সঙ্গে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করল। আত্তিলিও সেদিকে দেখেও দেখলেন না। এমন উৎসাহের সঙ্গে তিনি মাম্বোয়াদের ঠেলতে ঠেলতে শূকরের পায়ের ছাপগুলোর দিকে এগিয়ে চললেন যে, তারা কোনো ছুতো ধরে আপত্তি করারও সময় পেল না। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পরে তাঁদের চোখে পড়ল একটা পাহাড়। ভীষণ-দর্শন, প্রস্তরবহুল ওই পাহাড়টা দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্র মাম্বোয়ারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কী হল? শিকার কোথায়?–আত্তিলিও প্রশ্ন করলেন।
ওই যে। অনেক দূরে একটা কম্পিত ঘাসঝোঁপের দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করল একজন মাম্বোয়া।
এগিয়ে চলো। জামানি হুকুম দিল।
কিন্তু কেউ আর এক পা নড়ল না।
চলে এসো আমার সঙ্গে, ধমকে উঠলেন আত্তিলিও, তোমরা কি পুরুষমানুষ, না আর। কিছু?
পুরুষমানুষরা এবার পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে সামনে এগিয়ে গেল। আবার থামল। যে-লোকটি আত্তিলিওর দুই নম্বর বাড়তি বন্দুকটা বহন করছিল, সে অস্পষ্ট জড়িতস্বরে কী যেন বলল। বলার সঙ্গেসঙ্গে সে হাতের বন্দুক মাটিতে নামিয়ে রাখল। তৎক্ষণাৎ তার পাশে যে লোকটি দড়ির বান্ডিল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সে দড়িটাকে মাটিতে ফেলে দিল। তৃতীয় ব্যক্তি খাদ্য ও বিভিন্ন সরঞ্জামপূর্ণ থলিটাকে ফেলে ভারমুক্ত হল। পরক্ষণেই তারা একসঙ্গে ছুটতে শুরু করল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আত্তিলিওর দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে অদৃশ্য হল ছয়টি ধাবমান মনুষ্য-মূর্তি।
আত্তিলিও এইবার পারিপার্শ্বিক অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করলেন। পাশে ভয়ার্ত জামানি। অদূরে পাহাড়–পাথরে পাথরে রুক্ষ, শ্রীহীন, অনুর্বর। চারিদিক চুপচাপ শান্ত। কোথাও জীবনের সাড়া নেই, একটি পাখি পর্যন্ত ডাকছে না। এই নীরবতা অস্বস্তিকর। মানুষের মন এমন জায়গায় আনন্দ পায় না! আফ্রিকার পরিবেশ এখানে প্রস্তরসজ্জায় রুক্ষ, স্তব্ধতায় ভয়ংকর।
জামানি মাম্বোয়াদের ফেলে দেওয়া জিনিসগুলো মাটি থেকে তুলে নিল। দারুণ আতঙ্কে তার দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি হচ্ছিল।
চলে এসো পাহাড়ের উপর,–ধমকে উঠলেন আত্তিলিও, তুমি না জুলু-যোদ্ধা?
মনে হল জামানি মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে যাবে। কিন্তু আত্তিলিও তার গর্বে ঘা দিয়েছেন–একটিও কথা না-বলে সে সোজা পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেল।
পাহাড়ের তলায় অনেকগুলো বড়ো বড়ো পাথর ছিল। পাথরগুলোর ভিতর থেকে একটা সংকীর্ণ গিরিপথের সন্ধান পাওয়া গেল। ওই পথ বেয়ে উপরে উঠে আত্তিলিও দেখলেন, তাঁরা দুজন যেখানে এসে পৌঁছেছেন, সেটা হচ্ছে পাহাড়ের চূড়ার উপর অবস্থিত একটা প্রশান্ত প্রশস্ত সমতল জায়গা।