একজনের সাথে জরুরী কথা বলা দরকার।
.
অধ্যায় ২৬
সুরুত আলীর সানমুন হোটেলে বসে বসে সিগারেট ফুকছে আর আতরের জন্য অপেক্ষা করছে ছফা।
একটু আগে ইনফর্মার মাস্টারের ফোনসহ চিঠিপত্রগুলো নিয়ে চলে যাবার আগে তাকে আশ্বস্ত করে বলেছে, কিছুক্ষনের মধ্যেই মাস্টারের ফোন নাম্বারটা জোগাড় করে নিয়ে আসছে সে।
হাতঘড়িতে সময় দেখলো ছফা। বুঝতে পারছে না, আতর আলী কোত্থেকে মাস্টারের নাম্বারটা জোগাড় করবে। ধোঁয়ার কারণে ঘরটা গুমোট হয়ে গেছে, জানালাটা খুলে দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালো। এখন সে পুরোপুরি নিশ্চিত, মাস্টারের সাথে মুশকান জুবেরির যোগাযোগ আছে। তার অনুরোধেই লাইব্রেরিটার নাম রাখা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ। অথচ মাস্টার তার কাছে এটা স্বীকার করেননি। কী সব পুরনো ইতিহাস কপচে গেছেন।
দ্বিতীয় সিগারেটটা শেষ হবার আগেই আবারও তার রুমের দরজায় টোকা পড়লো।
“আসো।”
হাসিমুখে ঘরে ঢুকেই আতর আলী বলে উঠলো, “নম্বর তো পায়া গেছি, স্যার।”
“তাই নাকি?!” দারুণ অবাক হলো ছফা। “এতো দ্রুত কিভাবে জোগাড় করলে?”
দাঁত বের করে হাসলো ইনফর্মার, যেনো ছফার বিস্ময় উপভোগ করছে, সেই সাথে নিজের কেরামতি দেখাতে পেয়ে বেশ খুশি।
“মাস্টর ফোন লুকায়া রাখবার পারে, সিমও খুইল্যা রাখবার পারে,” রহস্য করা ভঙ্গিতে বলে যেতে লাগলো সে, “কিন্তু ফোনে তো টাকা ভরনই লাগে, লাগে না?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। তার মাথায় এটা আগে আসেনি। মনে মনে ইনফর্মারের বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারলো না। মুচকি হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে। ফোনে ব্যালান্স ভরার জন্য মাস্টারকে নাম্বারটা দিতেই হয়।
“তাইলেই বুঝেন।” হেসে ফেললো সুন্দরপুরের বিবিসিখ্যাত আতর আলী। “এইহানে তো ফোনের দোকান একটাই…আমাগো শামসু মিয়া চালায়, হের লগে আমার আবার হট টেরাম।”
মনে মনে আরেক বার ইনফর্মারের বুদ্ধির তারিফ না করে পারলো না সে।
“মাস্টরের একটা পোলা আছে, স্কুলে কাম করে, ঐ পোলায় মাজেমইদ্যে ফোনে টাকা ভরনের লাইগ্যা শামসুর দোকানে যায়। হের তো নিজের ফোন নাই…আমি পুরা শিওর, নম্বর দুইটা মাস্টরেরই হইবো।”
“দুটো নাম্বার?” আশাহত হলো ছফা।
“হ, স্যার। পোলাটা দুইটা নম্বরে ট্যাকা ভরে। ওয় হইলো মাস্টরের ডাইনহাত,” কথাটা বলেই ছোট্ট একটা ময়লা কাগজ বের করে ছফার দিকে বাড়িয়ে দিলো সে।
কাগজটা হাতে নিয়ে দুটো ফোন নাম্বারের দিকে তাকিয়ে রইলো নুরে ছফা। দুটোই একই টেলিকমের। তার মন বলছে, এই নাম্বার দুটোর একটা অবশ্যই মাস্টারের-আবার দুটো নাম্বারও তিনি ব্যবহার করতে পারেন। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে এই নাম্বার দুটো থেকেই জানা যাবে মুশকান জুবেরির ফোন নাম্বারটা-যদি মাস্টারের সাথে তার যোগাযোগ থেকে থাকে।
সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা বের করে তার সহকারী জাওয়াদের নাম্বারে ডায়াল করলো সে।
*
সুন্দরপুর ছাড়ার সময় হয়ে গেছে!
হন হন করে হেঁটে টাউনের বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেতে যেতে ভাবলো। বল্টু। কী ভয়টাই না পেয়েছিলো সে। রাতবিরাতে ভুতের সাথে দেখা হয়ে গেলেও এতোটা ভয় পেতো কিনা সন্দেহ। যে ঘরে কোনো মানুষ নেই, পুরো ফাঁকা দেখেছে, পনেরো-বিশ মিনিট পরই সেখানে মাস্টার কিভাবে চলে এলো সে জানে না।
একটু আগে আতর আলীর কাছ থেকে মাস্টারের ঘর থেকে চুরি করা জিনিসগুলো আবার রেখে যেতে গেছিলো জায়গামতো, তখনও সবই ঠিকঠাক ছিলো, পুরো ভিটেটা ছিলো সুনশান। কাজের সুবিধার্থে সে মাস্টারের ঘর আর ড্রয়ারের তালা দুটো আর লাগায়নি, ধরেই নিয়েছিলো এটা করার দরকার নেই, একটু পরই তো চুরি করা জিনিসগুলো জায়গামতো রেখে দিতে হবে। কিন্তু জিনিসগুলো জায়গামতো রেখে যেই না দরজা লাগাতে যাবে অমনি ঘরের ভেতর থেকে মাস্টারের গম্ভীর কণ্ঠটা বলে ওঠে, দরজা লাগানোর দরকার নেই।
এটা কিভাবে সম্ভব হলো?!
বল্টুর মাথায় ঢুকছে না। এখনও তার বুক ধরফর করছে। কী দৌড়টাই
দিয়েছিলো। পড়িমরি করে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গেছিলো সে, শরীরের কয়েক জায়গায় ছিলেও গেছে। কিছুক্ষণ তো মনেই হয়েছিলো, কণ্ঠটা মাস্টারের নয়, ভুতের!
বল্টুর স্পষ্ট মনে আছে, মাস্টারের ঘরে দ্বিতীয় বারের মতো যখন। ঢুকলো তখনও ঘরে কাউকে দেখেনি। মুহূর্তে কী করে ওখানে একজন চলে এলো?
কণ্ঠটা ভুত হলে তার বিপদ কমই হবে, কিন্তু সে ভালো করেই জানে। ওটা মাস্টারের কণ্ঠস্বর। তার মানে, আগামি কয়েক সপ্তাহ সুন্দরপুরে না থাকাই ভালো। সে এমন মানুষের ঘরে চুরি করেছে, যাকে এখানকার এমপি পর্যন্ত সালাম দেয়, সম্মান করে। এমপির ছেলেপেলেগুলো তার হাত-পা বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে বেদম পেটাচ্ছে-এরকম একটি দৃশ্য ভেসে উঠলো বল্টুর চোখে। নিশ্চয় তার মুখ থেকে সব কথা বের না করা পর্যন্ত চলবে এই পিটুনি। এক পর্যায়ে সব কিছু স্বীকার করতে বাধ্য হবে সে।
বাসস্টেশনে আসতেই তার মাথায় অন্য একটা চিন্তা চলে এলো পালিয়ে গেলে বিপদ কমবে না, বাড়বে। তারচেয়ে বরং সুন্দরপুরে ফিরে যাওয়াই ভালো। কী করলে এ যাত্রায় রেহাই পাবে সেই বুদ্ধিটাও চট করেই মাথায় এসে গেছে।
উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করলো বল্টু। মনে মনে একটাই প্রতীজ্ঞা করলো, এ জীবনে আর কখনও আতর আলীর কাজ করবে না।