ভিসিয়েন্তের চোখে যে অসহায় কষ্টের দৃষ্টি দেখেছিল লিও, সেই দৃষ্টি দেখা যায়। শুধুমাত্র ডুবে মরার আগের মুহূর্তে মানুষের চোখেমুখে। কোনোরকমে, ঘাড়টা এদিকে বাঁকানোর ফলে লিওকে দেখতে পায় সে, আর ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরতে চায় সেমনই শরীরের শেষ শক্তি জড়ো করে লিওনার্দোর নাম ধরে চেঁচিয়ে ওঠে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই তিন মূর্তির মাথা এদিকে ফেরে।
সেই তিনজনের চোখে ক্রুর জিঘাংসার যে অমানুষিক ছাপ দেখে লিও– তাতে তার প্রাণ উড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রায় টিকটিকির মতই দেওয়াল ধরে সে অন্য ধারে এসে পড়ে এবং দৌড় লাগায় স্কুলের মাঠের কোনাকুনি বরাবর, আর জর্জির নাম ধরে চেঁচাতে থাকে। কিন্তু বেশিদূর যেতে হয় না তাকে। ধর এই বেজন্মার বাচ্চাটাকে, যেন পালাতে না পারে, বলতে বলতে একটা বলিষ্ঠ হাত এসে লিওনার্দোর ঘাড় ধরে শূন্যে তুলে ফেলে, এটাই সেই পাগলা জর্জির ভাইটা না? ভালোই হল বেচারি ভিসিয়েন্তেকে আর একাই তিনজনকে সুখ দেওয়ার কষ্ট করতে হবে না, হিসহিসিয়ে বলতে থাকে আরেকজন। মাটিতে নামাতেই একটা চড় এসে পড়ে লিওনার্দোর গালে, আর তারস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে সে। লিওর চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যাবে বলে পিছন ফিরেছে তারা, এমন সময় পেছন থেকে রূঢ় কর্কশ আদেশ ভেসে আসে, এই হারামজাদার দল। ওর। গায়ে হাত দিয়েছিস, এত সাহস তোদের? সাহস থাকলে আমার মুখোমুখি হয়ে দেখ বেজন্মার বাচ্চারা, কুত্তার মতন পিটিয়ে যদি না মেরেছি…
সবাই একসঙ্গে পেছন ফেরে। সামনে দাঁড়িয়ে জর্জিনহো।
দাদাকে দেখে ভয়ে আঁতকে ওঠে লিও।হিংস্র নেকডের মতন ফলে উঠছে জর্জির। শরীর। চোখ দুটো লাল, মাথার চুল উসকোখুসকো হয়ে উড়ছে। আর ঠোঁটের কোণে হাসি।
এহহাসিটাইযে-কারও অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ডানদিকে সামান্য ঠোঁট বাঁকিয়ে অন্তরের যাবতীয় ক্রোধ, অশ্রদ্ধা আর ক্রুর যে দগদগে হাসিতে কারও বুকে গেঁথে দেওয়া যায়, আগে না দেখলে বিশ্বাস হত না লিওর।
একধাক্কায় লিওকে পাশে ঠেলে ফেলে দেয় একজন। তারপর শিকারি কুকুরের মতন জর্জির তিনদিকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পরে তারা।
আজ তোকে বাগে পেয়েছি শয়তানের বাচ্চা, অনেকদিন ধরে সুযোগ খুঁজছিলাম তোকে হাতে পাওয়ার। আজ তোর সব শয়তানি আর কালাজাদুর শখ ঘুচিয়ে দেব শুয়ার, বলতে বলতে তিনজন এগোয় জর্জির দিকে। ঠিক যেভাবে শিকারের দিকে এগোয় হায়েনার দল।
এরপর ঠিক কী হয় সেটা পুরোটা লিওর স্মরণে নেই। শুধু মনে আছে হঠাৎ করে জর্জির চোখ দুটো ভয়াবহ ভাবে উলটে যায়, মুখ থেকে উচ্চারিত হতে থাকে দুর্বোধ্য মন্ত্রসমষ্টি এবং হাতদুটো এক আশ্চর্য মুদ্রায় হাওয়ায় আঁকে অশনিসংকেত। আর সেই তিন মূর্তিমান পাপকে হঠাৎই যেন হাওয়ায় তৈরি ময়াল সাপেদের দল এসে শূন্যে তুলে ফেলে।
আগেই স্নায়ু যথেষ্ট উত্তেজিত ছিল লিওর। এই অপার্থিব দৃশ্য দেখার পর স্বাভাবিকভাবেই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।
ঠিক কী ঘটেছিল সেটা পরে অবশ্য শুনতে হয়েছিল তাকে। ঘটনার সময় এক অশিক্ষক কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। তিনি এসে দেখেন তিনটি ছেলে ঊর্ধ্বপদ হেঁটমুণ্ড হয়ে বাতাসে ঝুলছে। শুধু ঝুলছে না, শূন্যে ঝুলতে ঝুলতেই সারা স্কুলপ্রাঙ্গন প্রদক্ষিণ করছে। প্রাঙ্গনের ঠিক মাঝখানে জর্জিনহো, তার ডান সামনে তোলা, বাঁ হাত দিয়ে ধরে আছে ডানহাতের কনুই। আর ডানহাতের কবজি থেকে তর্জনী অবধি অস্বাভাবিক নমনীয়তার সঙ্গে দ্রুত ঘুরে চলেছে। ছেলে তিনটির কিন্তু হুশ নেই, মৃতদেহের মতন। তাদের হাতগুলো নীচে ঝুলছে, পা গুলো কিন্তু টানটান, কে যেন দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে ওপরে!
যথারীতি ভদ্রলোক অ্যাঁ অ্যাঁ করে আর্তচিৎকার শুরু করেন। সেই শুনে দৌড়ে আসেন উপস্থিত শিক্ষকটি।তিনি প্রথমে এই কাণ্ড দেখে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েন। তারপর গলায় ঝোলানো ক্রুশ বার করে হাঁটু গেড়ে বসে বাইবেল আওড়াতে থাকেন।
পুরো ব্যাপারটা অবশ্য পাঁচ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয়নি। এরপরই ছেলে তিনটেকে মাটিতে নামিয়ে লিওকে কোলে তুলে চম্পট দেয় জর্জিনহো।
সেইবার ভাঁজ পরিবারকে একটা বড় ধরনের ঝামেলায় পড়তে হয়। খুবই স্বাভাবিক ছিল ঝামেলায় জড়ানোটা, কারণ ছেলে তিনটি এরপর সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যায়। আইন অনুযায়ী জর্জিনহোর কপালে দুঃখ ছিল, কিন্তু ত্রাতা হয়ে দাঁড়ায় আরেকজন। ভিসিয়েন্তে।
তারই সাক্ষ্যের জোরে বড়ো কোনও শাস্তির হাত থেকে বেঁচে গেলেও একবারে রেহাই পেল না জর্জি। তিন তিনটি প্রভাবশালী পরিবার তাদের এতবড় ক্ষতি মেনে। নেবে, এটা ভাবার স্বভাবতই কোনো কারণ নেই। তারা তো পারলে জর্জিনহোকে ছিঁড়েই খায় কী জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে। এমনকি তিন পরিবারে মিলে গুপ্তঘাতকও নিয়োগ করে। বলে গোপনসূত্রে খবর পান অগাস্তিনহো। সে নিয়ে আবার মন্ত্রীপরিষদের কাছে নালিশ জানান তিনি। শেষে অশান্তি যখন চরমে উঠেছে, স্বয়ং সম্রাট পঞ্চম জনের মধ্যস্থতায়। ব্যাপারটার মিটমাট হয়। বিনিময়ে ভাঁজ পরিবারকে মেনে নিতে হয় যে ভূতপ্রেতের খপ্পরে পড়েছে তাদের ছেলে। যথারীতি চার্চ থেকে জর্জিকে এক্সরসিজ করার জন্যে ফতোয়া বেরোয়।