- বইয়ের নামঃ এবং ইনকুইজিশন
- লেখকের নামঃ অভীক সরকার
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
ইনকুইজিশন
১৫৬০। অগাস্ট। গোয়া।
ঘনকালো অন্ধকারে মেঠো রাস্তা ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে পাগলের মতন দৌড়চ্ছিলেন। ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী।
আমোনা গাঁয়ের মহাবেতাল মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী। পাণ্ডিত্যে, প্রজ্ঞায়, সদাচরণ ও ধর্মবেত্তায় শুধু আমোনা নয়, শুধু গোয়াপুরী নয়; সমগ্র। দক্ষিণ কোঙ্কণে শ্রদ্ধার শীর্ষবিন্দুটি অধিকার করে আছেন। সুদূর গোপাকপত্তন থেকে কপর্দকদ্বীপ, সোপারা থেকে অঘনাশিনী নদীর তীর অবধি পণ্ডিতপ্রবর ত্রিলোচনের খ্যাতির আলোকে উদ্ভাসিত।
সেই সম্মানের দিন বোধহয় ফুরোলো। একটা আসান গাছের নীচে দাঁড়িয়ে একটু জিরিয়ে নিতে নিতে এই কথাটাই ভাবছিলেন উনি। প্রৌঢ় মানুষ, জীবনে দৌড়ঝাঁপ করেননি, শাস্ত্রালোচনাতেই কালাতিপাত করেছেন। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ দেহ দরদর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। চঞ্চল চোখে ব্যাকুল দৃষ্টিতে পিছনের দিকে তাকালেন একবার কেউ ধেয়ে আসছে না তো?
আবার দৌড়তে থাকেন প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ, রাত ফুরোবার আগেই ওঁকে সাত ক্রোশ দূরের কুশস্থলি পৌঁছাতে হবে। কোমরের কষিতে গুঁজে রাখা অমূল্য ধনটিকে পৌঁছে। দিতে হবে কুশস্থলির মঙ্গেশি মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের হাতে। তারপর সেই মহাপবিত্র, মহাশক্তির আধারখণ্ডটিকে লুকিয়ে রাখা হবে মন্দিরের মধ্যেই। আমোনা গ্রাম আর নিরাপদ নয়।
না, প্রধান মন্দির বা গর্ভগৃহের মধ্যে না। ওসব জায়গায় খোঁজাখুঁজির সম্ভাবনা প্রবল। তাছাড়া ভগবান রুদ্রের পবিত্র লিঙ্গ অস্ত্রদ্বারা স্পর্শ করার কথা কোনও গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণ স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না।
মন্দিরের মধ্যে নয়, মন্দিরের পেছনে আছে আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামদেবতা এবং কুলদেবতাদের ছোট মন্দির, যেমন বীরভদ্র, সানতেরি, লক্ষ্মীনারায়ণ, সূর্যনারায়ণ ও কালভৈরব।
মনস্থির করে ফেললেন ত্রিলোচন, কালভৈরবের মন্দিরটিই এই অমিত শক্তির আধারটিকে লুকিয়ে রাখার প্রকৃষ্ট স্থান। এই অলৌকিক বেতালশক্তিখণ্ড আর কেই-বা অবলীলাক্রমে ধারণ করতে পারেন, কালভৈরব ছাড়া?
থেমে একবার আকাশের দিকে তাকালেন ত্রিলোচন। বিড়বিড় করে নিজের। কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করলেন, দেবাদিদেব মহাদেব যদি সুদিন দেন, তা হলে তিনি, মহাজ্ঞানী বেতালসিদ্ধ তন্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী, নিজের হাতে সপ্তসিন্ধু আর সপ্তনদীর জলে শোধন করে, মহা আড়ম্বরে এই শক্তিখণ্ড মহাবেতালমন্দিরে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন। হাতদুটো মুঠো করে কপালে ঠেকিয়ে নেন একবার, তারপর আবার দৌড়তে থাকেন।
সামনেই মাণ্ডবী নদী। ঘাটে দ্রুত নেমে যান উনি। একটা নৌকা থাকার কথা এখন। কিন্তু কিছু দেখা যাচ্ছে না কেন? থমকে দাঁড়ান ত্রিলোচন, ধরা পড়ে গেল নাকি সবাই? ধরা পড়ে গেলেন নাকি তিনি? বুকটা ধড়ফড় করতে থাকে প্রৌঢ়ের। নিজের জন্যে ভয় করেন না উনি, কিন্তু যে মহাশক্তিশালী আধারখণ্ডটি নিয়ে যাচ্ছেন, তার সামান্য অপব্যবহারে প্রলয় আসতে পারে যে!– নাঃ, ওই তো, একটা ছায়ামূর্তি যেন অন্ধকার থেকেই উদয় হয় ওঁর সামনে, সামান্য ঝুঁকে প্রণাম করে, প্রণাম হই জ্যেঠঠাকুর, এদিকে আসুন, আজ আপনাকে ওপারে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব এই অধমের ওপরে।
গলাটা চিনতে কষ্ট হয় না, তাই আশ্বস্ত হন ত্রিলোচন; আশীবাদের ভঙ্গিতে হাতটা তুলে স্বস্তিবচন উচ্চারণ করেন, অভীষ্ট পূর্ণ হোক বিঘ্ননাশ, কিন্তু তোমার নাও কোথায়?
একটু কষ্ট করে এদিকে আসতে হবে ঠাকুর, কেউ যাতে দেখতে না পায়, তাই ঘাটের পাশে লুকিয়ে রেখেছি। এইদিকে, সাবধানে আসবেন ঠাকুর, বর্ষার সময়, ঝোপেঝাড়ে সাপ থাকতে পারে…
এত বলার দরকারই ছিল না, শিয়রে মহাসর্বনাশ উপস্থিত থাকলে অনেক দুরূহ কাজই মানুষ প্রতিবর্তক্রিয়ায় এমন অনায়াসে করে ফেলে, যা হয়তো সে স্বাভাবিক অবস্থায় নিজে করার কথা ভাবতেই পারত না। কোনওরকমে হাঁচড়পাঁচড় করে নাওতে উঠে চিত হয়ে পড়লেন ত্রিলোচন। কোমরের গেজেতে হাত দিয়ে দেখলেন নাহ ঠিকই আছে সব।
নাও চলতে থাকে, চিত হয়েই শুয়ে থাকেন ত্রিলোচন। আকাশের মেঘ ছিঁড়ে নীল আকাশ অনেকটা বেরিয়ে পড়েছে। ঘনকৃষ্ণ রাতের আকাশ। দু-একটা তারা দেখা যাছে। ওই তো শুক্র আর বৃহস্পতি, এই সময়ে বড় কাছাকাছি আসে। ওটা কি বীণা নক্ষত্র? আহা! ওই যে, ধনুরাশি। মনটা স্ত্রী আর ষোড়শবর্ষীয় পুত্রটির জন্যে বড় ব্যাকুল হয়ে ওঠে ত্রিলোচনের। মন্দিরে নিত্যপূজায় ব্যস্ত ছিলেন উনি। যবনেরা মন্দির অপবিত্র করতে আসছে শুনেই মহাশক্তিটি বিশেষ ক্রিয়ায় তুলে নিয়ে মন্দিরের পেছনের দরজা দিয়ে দ্রুত দৌড়ে বেরিয়েছেন, স্ত্রী-পুত্রকে খবর দেবার সময় পাননি। তবে ওরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে সব জেনে গেছে। পূর্বনির্ধারিত নিরাপদ পথে পালাতে পেরেছে কি তা সবই তো বলে দেওয়া ছিল। আশা করা যায় নিশ্চয়ই পেরেছে। বুদ্ধিমান ছেলে ওঁর। নিজেই মৃদু হাসেন ত্রিলোচন। সামান্য বেশি বয়সেই একে পেয়েছেন উনি, তাও বিশেষ বেতালসাধনার পর। রূপে, গুণে, বুদ্ধিতে, স্থৈর্যে এ ছেলের জুড়ি গোটা গোয়াপুরীতে নেই, এ বিষয়ে স্থির নিশ্চিত উনি।