০১-০৫. শারিবার যখন বছর বারো বয়স

শারিবার যখন বছর বারো বয়স, তখন নানি লুবিনির সঙ্গে তার সখ্য গভীরতর হয়। কেননা তখন শারিবা সব বুঝতে শিখেছে, নিজের এবং নিজের লোকজনের চতুষ্পার্শ দেখতে শিখেছে। আর সেই সঙ্গে নানির কাছে শুনে শুনে বর্তমানের সাথে অতীতের যোগসূত্র রচনা করার চেষ্টাও সে করতে পারে তার অপুষ্ট বুদ্ধিতে।

এইভাবে শারিবা বড় হয়। নিচু দাওয়া, তালপাতার বেড়া দেওয়া ঘর, সরকারি ফরেস্ট থেকে চুরি করে আনা শনের চালা। সেই নিচু গুহার মতো ঘরের মধ্যে সন্ধ্যার পর স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘন তরলতায় জমে থাকে। লুবিনি তখন কাঁপা কাপা গলায় প্রাচীন কথা বলে।

লুবিনি বলে এক অজ্ঞাত দেশের কথা। সি দ্যাশ হামি নিজেই দেখি নাই, তোক আর কি কমো। সি দ্যাশের ভাষা বাজিকর নিজেই বিসসারণ হোই গিছে, তোক আর কি শিখামো!

সে এক অপরিচিত দেশ। যেখানে ঘর্ঘরা নামে এক পবিত্র নদী বয়ে যায়। সেখানে নাকি কবে এক শনিবারের ভূমিকম্পে সব ধূলিসাৎ হয়েছিল। ঘর্ঘরার বিশাল এক তীরভূমি ভূ-ত্বকে বসে গিয়ে নদীগর্ভের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আর তাতে মিশে গিয়েছিল গোরখপুরের বাজিকরদের জীর্ণ বাড়িঘর। ধ্বংস হয়েছিল বাজিকরদের প্রধান অবলম্বন অসংখ্য জানোয়ার।

সে এক কালো অন্ধকারের শনিবার, যা লুবিনি নিজে দেখেনি, যা সে তার নানাশ্বশুরের কাছে থেকে শুনেছে। তারপর যাযাবর বাজিকরের দল ঘর্ঘরার উত্তর তীরে আরো উত্তরে সরে গিয়ে নতুন বসতি তৈরি করে। নতুন করে ভাল্লুক বাঁদর সংগ্রহ করে, দূরবর্তী গ্রাম-শহরে গিয়ে গেরস্থ বাড়ি থেকে ‘ভঁইস’ চুরি করে আনে। আবার বছরের আট মাস দশ মাস দুনিয়া ঘুরে বেড়াবার নেশায় বেরিয়ে পড়ে তারা। তখন গলা লম্বা করে বাড়িয়ে দিয়ে মোষের সারি চলত রাস্তা দিয়ে, গ্রাম-শহরের ভিতর দিয়ে। সেই মোষের পিঠে থাকত বাচ্চারা আর বুড়ো-বুড়িরা। আর থাকত মাল। কোথাও গিয়ে তারা থামত। নদীর পাড়ে, শহরের বাইরের মাঠে, গ্রামের প্রাচীন বটের তলায়। ডুগডুগ করে ঢোলকে কাঠি পড়ত। জনপদের কুকুরগুলো তেড়ে তেড়ে আসত। বাজিকরদের কুকুরগুলো উত্তেজনায় শিকল ছিঁড়ে ফেলতে চাইত। চৌকিদার এসে সর্দারকে থানায় ডেকে নিয়ে যেত।

জী হুজুর, আমরা বাউদিয়া-বাজিকর বটি। জী মালিক, হামার নাম পীতেম বাজিকর। দলে পাঁচকুড়ি পাঁচজনা আদমি আছে। উসমে শোচ লিজিয়ে দেড়কুড়ি মরদ, দেড়কুড়ি আওরৎ, আর বাকি সব চেংড়া-বাচ্চা।

থানাঘরের বউ-বিবি-বাচ্চারা ভিড় করত। অসীম কৌতূহল সবার চোখে। কি খেলা আছে তোমাদের?

বান্দর আছে, ভাল্লু আছে, দড়ির খেলা আছে, ভান্‌মতি আছে, বহুৎ কিসিমের খেলা আছে।

সাপ নেই, সাপ?

নেহি মালকিন, বাজিকর সাপ ধরা জানে না।

দশ-পাঁচ টাকা থানাবাবুকে জল খেতে দিতে হয়। তারপরে ছাড়পত্র মেলে। ঠিক আছে, থাকো, কিন্তু কোনো নালিশ যেন না আসে।

নেহি জী, নালিশ কেন আসবে? হামার দলের কোনো বদনাম নেই, হুজুর। সেলাম মালিক, বান্দার নাম পীতেম বাজিকর। কোই দরকার লাগলে চৌকিদারকে ভেজে দেবেন।

কেমকা বুলি ক-ছেন তুই নানি, বুঝা পারি না। ওলা কি হামরাদের আগলা দ্যাশের বুলি?

না রে, শরিবা। এলা বুলি বাজিকর দ্যাশ দ্যাশ ঘুরে শিখা লয়। যেথায় ঘুরে সিথাকার বুলি ধরে লয়, সিথাকার ধরমকরম শিখ্যে লয়। সিটা তার আপন বুলিতে মিশাল করে লয়। বাজিকরের আপন কুনো ধরম নাই। করম এ্যাটা আছে বটে, তো সিটা হোল ভি-মাঙ্গার কাম। মুলুক মুলুক ঘুর্যে বান্দর লাচানো, ভাল্লু লাচানো, পিচ্‌লু-বুঢ়া পিচ্‌লু-বুঢ়ির কাঠের পুতলা লাচানো, ভান্‌মতির খেলা, বাঁশবাজি, দড়িবাজি, নররাক্ষস হয়া কঁচা হাঁস, কাঁচা মুরগা কড়মড় কড়মড় করে খাওয়া, নাচনা গাহানা–এলা সব বাজিকরের কাম। এলা সব ভিখ-মাঙ্গার কাম।

ভিখ-মাঙ্গার কাম!

হাঁ, ভিখ-মাঙ্গার কাম।

যাঃ।

শারিবার বিশ্বাস হয় না। অথবা, ভিখ-মাঙ্গা কথাটা যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য হয় না। খেলা দেখিয়ে পয়সা রোজগার, সেটা ভিখ-মাঙ্গা হবে কেন?

হাঁ, হামরা বলি ভি-মাঙ্গা। তোর নানা বলত ভিখ-মাঙ্গা। কাম হইল খেতির কাম, কলের কাম, কামার কুমার, চাষি, মজদুরের কাম। হামরা তো ওলা কাম কদাপি করি নাই। আমরা তো ওলা কাম জানি না।

তুই খেলা দেখাতিস, নানি?

দেখাতাম তো। পিচ্‌লু-বুঢ়া পিচ্‌লু-বুঢ়ির পুতলা তুই দেখিস নাই, শারিবা? হাতের উপর গামছা ঢাকা দিয়া সি পুতলা লাচাতাম। কাঠের ময়ুর লাচাতাম।

আর বাঁশবাজি, দড়িবাজি?

হাঁ, সিগ্‌লাও করতাম। বিশ হাত উঁচা বাঁশের মাথাৎ সিধা দাঁড়ায়া ছুঁচে সূতা পরাতাম। দুইধারে ঊইসের সিংএ দড়ি বাইন্ধে বাঁশ দিয়া ঠেল্যে সি দড়ি টনটনা হতো। ভুঁই থিকা বিশ হাত উঁচাতে বাঁশ হাতে হাঁটা চলা, লাচ দেখানো—সি ভয়ানক কঠিন খেলা রে, শারিবা!

শরিবা মনশ্চক্ষে নানির দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া দেখে, দোল দেওয়া দেশে, তারপরেই তার চমক ভাঙে।

ওয়ে হাটবা পারিস না তুই, দড়িতে হাঁটতি কো!

কল্পনায় সে এই লোলচর্ম কানিপরা নানিকেই দড়ির উপরে হাঁটতে দেখে, তাতেই চমক খায়। অথচ অবিশ্বাসও করতে পারে না। নানিকে তার প্রগাঢ় বিশ্বাস।

নানি ফোকলা দাঁতে প্রচুর হাসে।

হয় বাপু, নানি তোর এংকা বুঢ়াই আছিল নাকি চেরদিন। বাজিকরের বেটা, শারিবা, এংকা বেহেশই হয়। তোর দোষ নাই।

শারিবা লজ্জা পায়। দেওয়ালে, নিচু চালায় ছায়া কাপে। লক্ষ্যের আলো থেকে ধোয়া হয় বেশি। নানির শীর্ণ কুৎসিত অবয়ব দেয়ালে ভয়াবহ দেখায়, প্রেতিনীর মতো। বুড়ো কুকুরটা গুড়ি মেরে পায়ের কাছে শুয়ে আছে। বুড়ির কুকুর গোকো। গকোন বয়স বুঝি শারিবার মতোই। দীর্ঘ দেহ আর ঝোলানো কান নিয়ে গোকো অতীতকে পরে আছে। নাকি গোকোর মাথায় হাত রাখে। গোকো বুঢ়াটা হোই গলি, গোকা!’ গোকো হাই তোলে ও গুরগুর করে আদর উপভোগের স্বীকৃতি জানায়।

তারপর রাত বাড়ত। পাঁচবিবি গ্রামের বাইরে নদীর ধারে কুঁড়েঘরগুলোয় হঠাৎ দমকা হাওয়া লাগত। গোকোর কান খাড়া হতো। শারিবা নানির কোলের আরো কাছে ঘন হয়ে আসত। বাজিকর বোকা বটে। আশপাশের হিন্দু-মুসলমান সবার কাছে বাজিকর বোকা, বাজিকর বজ্জাত। ঘুমে ঢুলে পড়তে পড়তে শারিবা এসব চিন্তা করত বারো বছর বয়সে।

তারপর নদীর পাড়ে দুই কুন্‌ঠিবাড়ির কোনো একটার হাতি নামত জল খেতে। দুই জমিদারের কুন্‌ঠি ছিল পাঁচবিবিতে। লালকুন্‌ঠির হাতিটা ছিল মাকনা আর চৌধুরীকুন্‌ঠির হাতিটা দাঁতাল। দুই হাতি একসঙ্গে যদি কোনোদিন এসে পড়ত, তাহলেই সর্বনাশ হতো।

মরণবাঁচন লড়াই লাগত মানা আর দাঁতালে। আশপাশের গাছপালা ভাঙত। বাড়িঘর ভাঙত। মানুষ মরত। গ্রামে মানুষ মশাল জ্বেলে, টিন বাজিয়ে হাতিকে ভয় সেখাত। এপারের মানুষ, ওপারের মানুষ সবাই সন্ত্রস্ত এবং সজাগ থাকত। ভীষণ চিৎকার উঠত। গোকোকে তখন বেঁধে রাখতে হতো।

গোকো সেভাবেই মারা যায় হাতির পায়ের নিচে পড়ে। কেননা সবাই তখন পালিয়েছিল। দুটো মত্ত হাতি কোনো বাধাই মানছিল না। গোকো বাঁধা ছিল, ত্রাসে সে খেয়াল কারোই ছিল না, নানিরও না। হাতি ঘর ভাঙছে, শনের ঘর, তালপাতার বেড়া, বাঁশের খুঁটি। গোকো মারা পড়ে।

এভাবে তিনবার ঘর ভাঙার স্মৃতি শারিবার সারাজীবন থাকে। কেননা, তার নানা জামির বাজিকর স্থিতিবান হতে চেয়েছিল। জামিরের পিতামহ পীতেম পুবের এই দেশটাকে বোধহয় ভালোবেসেই ফেলেছিল। সে তার দলবল নিয়ে শেষবারের মতো গোরখপুর ত্যাগ করার পর এদিকেই এসেছিল।

পীতেমের আগেও বাজিকরেরা এদেশে আসত, কিন্তু সে করতে চাইল চিরস্থায়ী গৃহস্থী। পীতেমের পরে বালি, তারপর জামির দলের সর্দারি পায়। জামিরের বাপ ধন্দু অল্প বয়সে খুন হয়। কাজেই লুবিনির স্মৃতিতে সে খুব উজ্জ্বল নয়। বাজিকর এমন অঢেল জমি, ধান এবং জল তার পরিচিত ভূমণ্ডলে কোথাও দেখেনি, যদিও বাজিকরের পরিচিত ভূমণ্ডল খুব ছোট ছিল না।

কিন্তু সেই ভূমণ্ডলে শস্যদানার বড় অভাব। বিশেষত বাজিকরের সারা দিনমান জন্তু-জানোয়ার নাচাও, দড়িবাজি, বাঁশবাজি কর, সন্ধ্যায় সেই ভিমেঙ্গে পাওয়া (‘হাঁ, শারিবা, ভিখ্‌-মাঙ্গা’) শস্যদানা ছাইপাশ সব মিলিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসে ফুটিয়ে নেও। এই হল ধার্জিকরের খাওয়া। এসব নানির বলবার দরকার ছিল না, এসব শারিবা তখন নিজেই বুঝতে শিখেছে।

আর এজন্যই এর কিছুদিন পরেই শারিবা বুঝতে পারবে বাজিকর বাউদিয়ার স্বর্গে কেন এত অঢেল খাবার বন্দোবস্ত। নানি বলত, স্বর্গ শারিবা, সি এক আশ্চর্য জায়গা।

শারিবা বলবে, স্বর্গ কুনঠি?

নানি বলবে, সিটা তো জানা নাই, বাপ। জানা থাকলি তো কবিই চলি যাতাম। মরার পরে সেটি যাওয়া যায়।

তখন শারিবা একটা কথা বলবে, যা কোনদিন আর কোনো বাজিকর বাউদিয়া বলেনি।

শারিবা বলবে, তবি হামার ওঠি যাবার দরকার নাই, নানি। মরার পর আমার অঢেল খাবার খায়্যে কি হোবে?

এসব কথা অনেক পরের। তখনো গোকো মরেনি। তখনো চৌধুরী সাহেব “তুমরা হিন্দু না মোছলমান” এ প্রশ্ন তোলেনি। হিন্দুস্থান-পাকিস্তান হয়নি। তখনো লালকুন্‌ঠির ম্যানেজার মহিমবাবু “হাঁই বাপু, তোরা গরুও খাস, শুয়ারও খাস, ই কেম্‌কা জাত রে বাপো!” বলে আঁতকে ওঠেনি।

 

০২.

শনিবারের ভূমিকম্পের পর ঘর্ঘরার উত্তর তীরে সরে গিয়ে পীতেম আবার তার দলবল নিয়ে ডেরা তোলে। সে গ্রামটা ছিল গোয়ালাদের। তারা এসে বলে, বাজিকর, হেথায় থাকা চলবে না। তাদের হাতে মোটাসোটা বাঁশের লাঠি। সেই লাঠি দিয়ে তারা খেপা ষাঁড় ঠাণ্ডা করে, জঙ্গলের জানোয়ার তাড়ায়।

পীতেম বলে, বাজিকর তো স্থায়ী বসবাস করে না। দু-চার মাস থাকব, ফের ঠে যাব। তোমাদের জমি তো দখল হয়ে যাচ্ছে না।

সে কথা কেউ শুনল না। তারা বাজিকরদের তিনদিনের মধ্যে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিল। পীতেম বলল, ঠিক আছে, যাব। সারা দুনিয়া বাজিকরের। জায়গার অভাব?

কিন্তু অন্যরা বলল, কিন্তু ভঁইস? কিন্তু ঘোড়া? খাব কি? যাব কি করে?

পীতেম ভাবতে থাকে, কিন্তু ভঁইস। কিন্তু ঘোড়া? খাব কি? যাব কি করে দেশ-দেশান্তর? শনিবারের ভূমিকম্প কিছুই অবশিষ্ট রেখে যায়নি। দলকে এখন বাঁচানোই মুশকিল।

দু-রাত্তির ঘুম হল না পীতেমের। দৈবদুর্বিপাক তার মনটাকে দুর্বল করে দিয়েছিল। তৃতীয় রাতে অচেতুনের মতো ঘুমায় পীতেম। ঘুমের মধ্যে তার মরা বাণ দনু আসে তার কাছে।

শীতে হে, পীতেম?

বাপ?

চোখত্‌ পানি ক্যান বাপ?

পথেত্‌ যামো কেংকা বাপ? দল নষ্ট হোই যাবে, বাপ।

ক্যানে বাপ, তোর দুষ্টু কিসের?

ভঁইস কোই বাপ? ঘোড়া কই বাপ?

হাঁই দেখ, জঙ্গলের ধারে কত গাবতান ভৈঁসী ঘুরে বেড়ায়। হাঁই দেখ, কত জায়ান টাট্ট ঘুরে বেড়ায়। ওলা সব তুমার। দুনিয়ার বেবাক মাঠে চরা জানোয়ার তুমার।

বাপ!

পীতেম হে, পীতেম, পুবের দেশে যাও, বাপ। সিথায় তুমার নসিব।

পুবের দেশেত্‌?

পীতেম, হে পীতেম, রহু তুমার সহায় থাকুক।

পরদিন পীতেমের দল জঙ্গলের পথ ধরে দিগন্তের দিকে মিলিয়ে গেল। সঙ্গে গেল পাঁচটি গাবতান মোষ, পাঁচটি বাছাই টার্টু। পথে সেই মোষদের নধর বাছুর হল। দুধের বান ডাকল। সেই দুধ-ঘি বাজিকরের মেয়েরা রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করতে করতে চলল। সেইসব জানোয়ারের বংশ বাড়ল। বাজিকর তখন জানোয়ারও বেচত।

এইভাবে শারিবা, গোরখপুর থিকা, ডেহরিঘাট, সিথায় ক-বছর, তা-বাদে সিওয়ান, সিথায় ক-বছর, তা-বাদে দানাপুর, পাটনা, মুঙ্গের, কত দেশে তোর নানার নানা বসত করার চেষ্টা করল, হল না। তারপর এই পুবের দেশ। তা এখানেও কি স্বস্তি আছে? মানুষ চায়, বাউদিয়া বাউদিয়াই থাকুক, বাজিকর বাজিকরই থাকুক। তার আবার ঘর-গেরস্থালি কি? রাজমহল, মালদা, নমনকুড়ি, রাজশাহী, আমুনাড়া, পাঁচবিবি। সব শেষে এই পাঁচবিবি। আরো কত দ্যাশ ঘুরলো সি বাজিকরের দল, তোক আর কি কমো। সব কি কারো স্মরণ আছে?

বাউদিয়া-বাজিকর পিছনে যা ফেলে যায় তা জানোয়ারের বিষ্ঠা, কে তার কথা স্মরণ করে? যা পরিত্যাজ্য তাই পিছনে ফেলে যেতে হয়। তার কথা মনে রাখার কোনো কারণ নেই। তবুও পীতেম বৃদ্ধ বয়সে নাতবউ লুবিনির কাছে এসব কথা বলত। কেননা ধন্দু জোয়ান বয়সে খুন হয়েছিল। জামিরের বিয়ে হয়েছিল সতেরো বছর বয়সে, তখন লুবিনির বয়স দশ বছর। সেই দশ বছরের মেয়েকে সামলানোর দায় ছিল পীতেমের। বাজিকরের তাঁবুতে এত কম বয়সে বিয়ের রেওয়াজ ছিল না। কিন্তু এই পুবের দেশে সাহেবদের তখন বড় হাঁকডাক। কিভাবে যেন রটে গিয়েছিল, মহারানির রাজত্বে সোল বছরের ঊর্ধ্বে ছেলেমেয়েদের আর বিয়ে দেওয়া যাবে না। দিলে বে-আইনি হবে। এরকম গুজব হামেশাই রটত তখন। কেউ তলিয়ে ভাবত না, ভয় পেত। কাজেই একদিন পনেরো জোড়া বাজিকরের ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। তার মধ্যে জামির আর লুবিনিও ছিল।

তাই পীতেম সামলাত লুবিনিকে। পীতেম বলত শনিবারের ভূমিকম্পের কথা। পীতেম বলত ডেহরিঘাট, সিওয়ানের কথা। তারপর রাজমহলের কথা।

 

০৩.

রাজমহলের গঙ্গার ধারে বাজিকরের ছাউনি পড়ল সারি সারি। রাজমহল তখন গমগমা জায়গা। এখানে সেখানে রেলের লাইন বসছে। গঙ্গায় শয়ে শয়ে মহাজনি নৌকো। গোছগাছ হয়ে গেলে দলের লোকদের ডেকে পীতেম বলে, এ জায়গা মনে হচ্ছে পয়সার জায়গা। যে যার মতো কাজে লেগে পড়। বাপ আমাকে বলেছিল পূবের দেশে আসতে। এ হল সেই পুবের দেশ। গোরখপুরের ঠিকানা তো উঠেছে। নতুন ঠিকানা বানাতে হবে। এখন পয়সা কামাও।

কদিনের মধ্যেই খবর পেয়ে দারোগা এসে হাজির হয়। পীতেম বলে, চৌকিদার দিয়ে খবর পাঠালেই হতো, হুজুর। কষ্ট করলেন।

দারোগা প্রতি ছাউনিতে উঁকি দিয়ে দেখল। তারপর বলে, কোথা থেকে আসা হচ্ছে?

পীতেম মিথ্যা কথা বলে, কেননা, এরকমই নিয়ম।

দারোগা বলে, কতদিন থাকা হবে?

পীতমের অনির্দিষ্ট উত্তর, কেননা, এরকমই নিয়ম।

দারোগা তারপর জন্তু জানোয়ার দেখে এবং সবচেয়ে দামাল ঘোড়াটি পছন্দ করে।

পীতেম একটু বিপদে পড়ে, কারণ ঘোড়াটা ধন্দুর বড় আদরের এবং ধন্দুকেই সে সওয়ার হিসাবে সহ্য করে। সে বলে, হুজুর, ও বজ্জাতকে নিয়ে পোষাতে পারবেন না। ও হুকুম মানে না, পোষ মানে না। নিয়ে গেলেও পালিয়ে আসবে।

দারোগা এসব অজুহাত মনে করে। তাছাড়া ঘোড়াটা তার পছন্দ হয়েছে এবং ছেলের জন্য একটা তার দরকারও।

দারোগা বলে, দেখ, বাজিকর, জানোয়ারটা আমার চাই। পরে পাঠিয়ে দিও।

পীতেম তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে নানাভাবে। বলে, হুজুর, ও জানোয়ার অবাধ্য। আপনি আর চারটার মধ্যে যেটা হয় একটা বেছে নিন। না হলে পরে আমায় দোষী করবেন।

পীতেম এসব কথা বলছিল, এবং ধন্দুর দিকে নজর রাখছিল। ধন্দু গম্ভীর মুখে একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

দারোগা কথা না বাড়িয়ে লাফ দিয়ে নিজের ঘোড়ায় উঠে টাপটাপ শব্দে সামনে এগোয়। সঙ্গের চৌকিদার বলে, বাজিকর, ঘোড়া কাল সকালের মধ্যে পৌঁছায় যেন, না হলে তোর কপালে দুঃখ আছে।

ধন্দু হঠাৎ লাফ দিয়ে তার আদরের ঘোড়ায় উঠে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যেই সে গঙ্গার বালিয়াড়িতে নেমে পড়ে সামনের দিকে ঘোড়া হাঁকাতে থাকে পাগলের মতো। পীতেম শুধু তাকিয়ে থাকে, কিছু বলে না। ধন্দু দূরে মিলিয়ে যেতে থাকে। গঙ্গার বালিয়াড়িতে ধুলো ওড়ে, তার মধ্যে ধন্দুর মাথার লাল ফেট্টির ঝলক দেখা যায় শুধু। কিন্তু পীতেম জানে ঘোড়াটা দিতে হবে।

অনেক রাত হয়ে যাওয়ার পরেও ধন্দু ঘোড়া নিয়ে ফিরল না। বাজিকরদের খোলা আকাশের নিচের রাত্রিবেলার আহার শেষ। সব তাঁবুর সামনের আগুনই প্রায় নিবে এসেছে, কিন্তু ধন্দু ফিরল না।

মাঝরাতে পীতেম আরো তিন জোয়ান বাজিকরকে ডেকে ওঠাল। ধন্দুকে খুঁজে বের করতে হবে, কাল সকালে ঘোড়াটা দারোগাকে দিয়ে আসতে হবে।

চারটি টাটুতে চারজন সওয়ার হয়ে গঙ্গার পলি ভাঙতে থাকে।

পীতেম বলে, আমার বাপ বলেছিল, দুনিয়ার সব মাঠে-চরা জানোয়ার তোমার।

বালি নামে এক যুবক বলে, কিন্তু তার মধ্যের ভালোটা দারোগার।

জ্যোৎস্নালোকিত বালির চড়ায় চারজুন ঘোড়সওয়ার হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠে স্তব্ধতা ভাঙে।

পীতেম বলে, ধন্দুটা বোকা। ভালো ঘোড়া মাঠে আরো চরবে।

চাঁদের আলোয় বাঁ পাশে রুপোর মতো চঞ্চকে গঙ্গা রেখে দু ক্রোশ মতো পলি ভাঙে তারা। তারপর ধন্দুকে পায়। গঙ্গার দিকে পিছন দিয়ে সে বসেছিল। সামনে ঘোড়াটা দাঁড়িয়েছিল ছবির মতো।

এদের আসতে দেখে ধন্দু উঠে দাঁড়ায়। কোনো কথা না বলে নিজের ঘোড়ায় উঠে তাঁবুর দিকে চলতে শুরু করে। এরা চারজন নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করে।

কিছু সময় পরে পীতেম বলে, তোর নানা বলত, মাঠে যত জানোয়ার চরে তার সবই বাজিকরের।

আর ধন্দুও প্রায় বালির কথাটাই বলে। বলে, কিন্তু এটা দারোগার।

কিন্তু দারোগার মান তো রাখতেই হবে।

আজ রাতেই তো এখান থেকে চলে গেলে হয়।

পাগল!

তাহলে দারোগাকে তোমার অনেককিছু দিতে হবে, শুধু ঘোড়ায় হবে না।

পীতেম বলেছিল, এ দেশে পয়সা আছে। ভিখ-মাঙ্গা বাজিকরের কাছ থেকে আর কি নেবে দারোগা!

পরদিন দারোগার ছেলে এসে হাজির হয়েছিল সকাল-সকালই। বিশ-বাইশ বছরের ছোকরা। পীতেম বলেছিল, আসুন, ছোট হুজুর, বসুন।

ছোকরা বলে, বসতে আসিনি। কোথায়, আমার ঘোড়া কোথায়?

বালি ঘোড়াটার লাগাম ধরে কাছে নিয়ে আসে। ধন্দু সেই একই গাছের নিচে তির্যকভাবে দাঁড়িয়ে।

পীতেম বলে, ছোট হুজুর, ঘোড়াটা বড় বজ্জাত, ভয় হয়, আঘাত না করে। দারোগার ছেলে বলে, আমিও বজ্জাত। দেখা যাক কে বেশি বজ্জাত।

সে অত্যন্ত অভিজ্ঞ দাম্ভিক ভঙ্গিতে হাসে, যা দেখে পাতেম অবাক হয়।

ছোকরা লাগামটা হাতে নিয়ে হাতের চাবুকে হাওয়ায় আওয়াজ তোলে। ঘোড়াটা চমকে ওঠে। সব তাঁবু থেকে মানুষ বেরিয়ে এসেছে দারোগার ছেলেকে দেখতে। ছোকরা হঠাৎ লাফ দিয়ে নাঙ্গা পিঠে সওয়ার হয়।

ঘোড়াটা অবশ্যই বজ্জাত। ভীষণ ডাক ছেড়ে সে পিছনের পা জোড়া শূন্যে ছুঁড়তে থাকে। পরিষ্কার সওয়ারকে ফেলে দেওয়ার বাসনা। কিন্তু সওয়ার সহজে পড়ে না। দক্ষতায় সে আঁকড়ে থাকে ঘোড়ার পিঠ এবং শূন্যে চাবুকের শিস তোলে। জানোয়ারটা পরিত্রাহি চেঁচায় এবং এমনভাবে পিছনের পা ঘেঁড়ে যেন মনে হয় পায়ে তার সাপ জড়িয়েছে।

দারোগার ছেলে এবার ঘোড়াকে আঘাত করে। তাতে জানোয়ারটা আরো ক্ষিপ্ত হয়। যুবকের চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে উত্তেজনায়। সে আবার লাফ দিয়ে নামে ঘোড়া থেকে। লাগাম তার হাতেই থাকে। ধন্দু শব্দ করে হাসে। পীতেম কিছু বলতে যায়। যুবক লাগামে বারবার ঝটকা মেরে ঘোড়াটাকে আহত করার চেষ্টা করে, তারপর উন্মাদের মতো চাবুক চালাতে থাকে।

ঘোড়া প্রথমে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু দারোগার ছেলে গায়ে শক্তি রাখে। সে নিমর্মভাবে চাবুক চালায়। ঘোড়া এবার সামনের দু-পা তুলে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। ধন্দু চিৎকার করে ওঠে। বালি এবং আর একজন যুবক ধন্দুকে দুদিকে ধরে টেনে হিঁচড়ে তাঁবুর পিছন দিকে নিয়ে যায়।

সমস্ত শরীর রক্তাক্ত করে দিয়ে যুবক তার চাবুক থামায়। ঘোড়াটা সতর্ক স্থির হয়ে থাকে। তার সমস্ত শরীর থির থির করে। তার চোখ বিস্ফারিত। পীতেম নির্বোধের মতো তাকিয়ে থাকে।

যুবকটি আচমকা আবার লাফ দিয়ে ঘোড়ায় ওঠে। জানোয়ারটা এবার আর লাফায় না। শুধু পিছনের পা দুটো একটু নিচু করে সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে।

যুবক পা দিয়ে তলপেটে তো মারে। ঘোড়া চলতে শুরু করে। লাগাম টেনে দারোগার ছেলে ঘোড়ার মুখ ঘোরায়। তারপর পীতেমের দিকে তাকিয়ে হাত তোলে। বলে, চলি সর্দার।

ঘোড়া অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাস্তায় উঠে যায়।

 

০৪.

রাজমহল, বারহেট, তিনপাহাড়, সাহেবগঞ্জের হাটেবাজারে পীতেমের দল রঙিন কামিজ আর ঘাঘরা উড়িয়ে নতুন বিহ্বলতা আনে। মোষের শিঙে বাঁধা দড়ি দুপাশে বাঁশ দিয়ে ঠেলে টনটনা করা হয়। তার উপরে লম্বা বাঁশ হাতে যে রমণী চলে ফিরে আগুপিছু করে তার শরীর বড় টান টান, তার চোখমুখে আগুনে মসৃণতা, তার গায়ের চামড়া পাকা গমের রঙের। নিচের যে মানুষটা ঢোলক বাজায় তার মাথায় রঙিন ফেট্টি। আর একজন উপরআলির চলার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে বিচিত্র গান গায়, যে ভাষা কেউ বোঝে না, কিন্তু সুরের মাদকতা এড়াতে পারে না।

মাধোয়া ধাইর্‌ যারে
মাধোয়া ধাইর্‌ যারে
ছোটি ঘোটানি মাধোয়া ধাইর যা
তিলেক্‌ পঢ়োরে তিলে পঢ়োরে
ছোটি ছোটানি মাসোয় ধাইর যা
হেরছি ফকড়িয়ে হেরছি ফকড়িরে
ছোটি ছোটানি হেরছি ফক্‌ড়ি।

নতুন নতুন বসতি সব, নতুন নতুন মানুষ, উঠতি বড়লোক, জাঁকজমক, ঠাট, সবই নতুন। বাজিকর ভাবে, হ্যাঁ, এমন জায়গাই বাজিকরের উপযুক্ত বটে। সাহেব, পুলিশ, মুন্সি, মহাজন, শুড়ি, কয়াল, দোকানদার, মোদক, দালাল সব মিলে একটা ব্যাপক লুঠের বন্দোবস্ত। প্রথমে বোঝা যায় না কে লুঠ করে আর কে লুঠ হয়। এ ভারি মজার ব্যাপার। যে লুঠ করে তার উল্লাস বোঝা যায়। কিন্তু যে মানুষটা লুঠ হচ্ছে সে কেমন করে দিনের শেষে শুড়ির দোকানে হুল্লোড় করে? মোরগা-লড়াইয়ে বাজি রাখে হাটে আনা শেষ সম্বল?

পীতেম বলে, বাজিকরের বেটারা, চোখ কান খোলা রেখে চল। দেখেবুঝে চল। পয়সা তোমাদের হাতে আসবে। দুঃখ তোমাদের ঘুঁচবে।

হাটের মাঝখানে বাজিকর খেলোয়াড়ের খেলার আসর যখন জমে ওঠে তখন পীতেম তার কিছু লোককে ছড়িয়ে দেয় হাটের মধ্যে। তারা নানারকম মনোহারি জিনিস বিক্রি করে অবিশ্বাস্য বিনিময়-মাধ্যমে। একটা রঙিন পুঁতির মালার বদলে একঝুড়ি চাল পাওয়া যায়, একখানা গালার চিরুনিতে পাওয়া যায় পাঁচ সের সরষে, নেশার জিনিষের বদলে সর্বস্ব দিতেও মানুষ রাজি থাকে।

এসব দেয় কারা? এসব দেয় যারা দুর দূর গ্রাম থেকে গরুর গাড়িতে অথবা পিঠের বাঁকে শস্য নিয়ে আসে। যাদের কাখে গোঁজা একটি বাঁশি অবশ্যই হাত খালি হওয়ার অপেক্ষায় থাকে, যখন সে সমস্ত গ্লানি এবং শ্রমকে ভুলে সেই বাঁশিতে ফুঁ দেয়।

এই মানুষগুলো চকচকে কালো, উজ্জ্বল দাঁত তাদের, অফুরন্ত তাদের আনন্দ। পীতেম তাদের দেখেছিল বিস্ময়ের সঙ্গে। এরা বাদিয়া বাজিকরের মতো নয়, আবার এরা সাধারণ গৃহস্থের মতোও নয়। এরা পণ্ডিতও নয়, মূখও নয়। প্রকৃতির সছে একাত্ম, খেটে-খাওয়া মানুষ এরা। পাহাড় ভেঙে, জঙ্গল পরিষ্কার করে অবিশ্বাস নিষ্ঠায় তারা ফসলের জমি তৈরি করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা পরিশ্রম করে, তার পরেও গান গায় এবং নাচে, জীবনকে উপভোগ করে।

এই মানুষ হড়, এই মানুষ সাঁওতাল। পীতেম দেখেছিল রাজমহল, বারহেট, আমগাহিয়া, পিপড়া ইত্যাদি শহর-গ্রাম-হাটে এইসব মানুষ দ্রব্য বিক্রয় এবং বিনিময় যাই করুক না কেন, প্রায় সবসময়ই অর্তে প্রকারান্তর থাকে। যখন বেচে জন শতি থাকে একরকম, যার নাম ‘হাচ্‌কা’, অর্থাৎ ঝুড়িশুদ্ধ অথবা গাড়িশুদ্ধ, কখনোই ওজনের নয়। আর যখন ক্রয় করে, তখন গোলাদার, মহাজন অথবা যে-কোনো ক্রেতাই হোক না কেন, পদ্ধতিটা হয় ওজনের। সে সময় যে বাটখারা ব্যবহার করা হয় তার কোনো নির্দিষ্ট ওজন-মান নেই, নেই কোনো সাধারণ সর্বজনীতাও। যে যেমনভাবে পারে এই জটিলতাবর্জিত হড়কে বুঝ দিচ্ছে, তা ওজনে হোক কিংবা পয়সায় হোক। আর কী আশ্চর্য, এরা বুঝে যাচ্ছে, মেনে নিচ্ছে, খুব যে অখুশি তাও মনে হচ্ছে না।

সুতরাং পীতেম মনোযোগ দেয় কিছু সঞ্চয়ের দিকে। তার বহুদেশদর্শী ইন্দ্রিয় বলছিল, এ অবস্থা বেশিদিন চলবে না। কাজেই যতদিন চলে, যতদিন বাজার গরম থাকে, তার মধ্যেই তারা যাযাবরী ব্যবসায় অর্থোপার্জন করতে থাকে।

সে পরতাপ এবং জিল্লু এই দুই বাজিকরকে ঘোড়ায় করে মুর্শিদাবাদে পাঠায় সওদা আনতে। রূপা, তামা, পেতল, রাঙ এবং গালার নানান ধরনের গহনা এবং অন্যান্য মনোহারী জিনিসের চলন খুবই বেশি। এসবের বিনিময়ে পাওয়া যায় খাদ্যশস্য এবং তৈলবীজ। যা আবার গোলদার কিংবা যে-কোনো ব্যবসায়ীর কাছে নগদ টাকায় বেচা যায়। দাম ইদানীং খুবই ভালো। বিশ সের গম, পনেরো সের চাল অথবা দশ সের তৈলবীজের বদলে এক থেকে দেড় টাকা পাওয়া যায়। আর এইসব চাল, গম কিংবা তৈলবীজ চতুর মানুষের পক্ষে সংগ্রহ করা মোটেই কঠিন।

পীতেম বলে, উঁইসের বাচ্চাগুলোকে ভালো করে ঘাসজল দেও তোমরা। ওগুলোকে এবার হাটে তুলতে হবে।

বস্তুত পাঁচটি গাবতান ভঁহী পাঁচটি নধর শাবক দিয়েছিল। সেইসব শাবকেরা যথাসময়ে আবার বংশবৃদ্ধি করেছিল। বাজিকরেরা নিজেরাই এঁড়েগুলোকে খাসি করত। কেননা, বলদ-উঁইসের বাজার সব দেশে এবং সবসময়ই ভালো। এখন বাজিকরের তাঁবুতে অনেকগুলো বলদ-ইস আছে, যারা উঠতি জোয়ান। এক বছর শিক্ষিত মোষ কিংবা বলদের পিছন পিছন নবিশি করলে পরের বছর স্বাধীনভাবে কাজ করানো যাবে।

বাজিকরের ছাউনিতে জানোয়ার কিনতে মানুষ হামেশাই আসে। দয়ারাম ভকত নামে এক মহাজন মোষ কিনতে এসে পীতেমের সঙ্গে আলাপ জমায়। বাজিকরের হালচাল, ব্যবসাবাণিজ্য এবং ওষুধপত্তরের খোঁজ নেয়। প্রচুর সম্পত্তির মালিক দয়ারামের দেহে সুখ নেই। পীতেম জানে, দয়ারামের যা বয়েস তাতে দেহে নতুন করে সুখ আসা সম্ভব নয়। কিন্তু ঝানু মহাজন সমস্ত কিছু বুঝেও এ জিনিসটা বুঝতে পারবে না, এও পীতেম জানে। আর বুঝলে পরে বাজিকরেরই বা চলে কিসে?

কিন্তু দয়ারাম ব্যবসাদার, কাজেই মোষ কেনার ব্যাপারটাই সে প্রথমে উত্থাপন করে। গুহ্য ব্যাপার, যার সঙ্গে দুর্বলতা জড়িত, তা পরে প্রসঙ্গ হিসাবে রেখে দেয়। আবার পীতেমও জাত বাদিয়া। সেও জানে, এরপরে দয়ারামের কাছ থেকে কী প্রস্তাব স্বাভাবিকভাবে আসতে পারে। সে সালমাকে কাছাকাছি রাখে। সালমা প্রৌঢ়া, কিন্তু তার শরীর কোনো অজ্ঞাত কারণে টনটান এবং স্তনদ্বয় এখনো উদ্ধত।

দয়ারাম বলে, বাজিকর, তোমার এ দাফার উইসের দাম আশি টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।

পীতেম বলে, মহাজন আদমি আপনি, জানোয়ারের দাম আপনার থেকে ভালো জানবে কে? তবে কিনা মুঙ্গেরি ভঁইস, পুরা জোয়ান হলে একটা হাতির কাজ করবে।

মুঙ্গের? মুঙ্গেরে কি ভালো ভঁইস হয়! আমার জানা নেই, বাজিকর। তোমার দামটা শুনি।

মালিক, ঠিকঠাক যদি বলতে দেন, তো বলি, তিনশ’ টাকা এর দাম হয়।

বেচার দাম বল, বাজিকর। দয়ারাম ভকতকে এ তল্লাটে সবাই চেনে। জানোয়ার কিনব বলেই তোমার কাছে আসা। আর দশটা বাজে লোকের মতো তোমার ছাউনির আওরত দেখতে ছল করে আসিনি।

সুযোগ পেয়ে পীতেম একটু গম্ভীর হয়। বলে, মালিক, বাজিকরের আওরত হাটেবাজারে ঘুরে বেড়ায়, খেলা দেখায়, হাজার দ্রব্যের বেসাতি করে। তাকে দেখার জন্য ছাউনিতে আসতে হয় না। কিশনজির নাম নিয়ে বলেন যে দাম বললেন, তা নিয়ে আজকাল একটা ধাড়ি শুয়োরও কেনা যাবে কিনা?

আরে রাম, রাম! সকালবেলাটা ওই জানোয়ারের নাম নিয়ে দিনটা মাটি করলে আমার? ও জিনিস কখনো কিনিনি, তাই তার দামও জানি না। তবে এ কথা জানি বাজিকর, ও দাম দিয়ে একটা মানুষ কেনা যায়।

হাঁ, জংলি আদমি একটা কিনতে পারেন বটে, কিন্তু মুঙ্গেরি ভঁইস হবে না।

তবেই দেখো, একটা আদমির থেকে একটা ভঁইসের দাম তুমি বেশি বলছ, এটা কি ঠিক হচ্ছে?

সুযোগ বুঝে সালমা আসল জায়গায় ঘা মারে দয়ারামের। বলে, আদমির থেকে জানোয়ারের দাম সব সময়ই বেশি থাকে, জনমভর এমনই তো দেখে আসছি, ভকতজি। যেমন ধর, রাতের বেলা কোনো আওরতের কাছে তোমার দাম কী হবে?

দয়ারাম কথাটা গায়ে না মেখে রঙ্গচ্ছলে নেয়। বলে, সাবাস বলেছ, ভান্‌মতি। অস্বীকার করি না, আক্ষেপ কিছু আছে বটে দয়ারামের। জড়িবুটি, গুণ-তুকে তোমার নামও শুনেছি। দরকার আমার তোমার সঙ্গেও। আরো বলি, ভান্‌মতি, তুলনাটা তোমার লাগসই হল না।

তারপর মোষের দাম নিয়ে একটা ক্লান্তিকর টানাটানি করে শেষপর্যন্ত উভয়ে (পৌনে ৭শ টাকায় রাজি হয়।

ততক্ষণে সালমা উঠে চলে গেছে। দয়ারাম তার ছাউনি খুঁজে বার করে নেয়। সালমা তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। অথচ সে ভাব মুখে প্রকাশ করে না।

দয়ারাম বলে, ভাতি, তোমার গুণের কথা শুনেছি দু-চারজনের কাছে, তার মধ্যে জানকীরাম দারোগাও আছে। দারোগা আমার বন্ধুলোক।

তবে তো তোমাকে খাতির করতেই হয়, মালিক। সালমা বলে। সালমা এভাবেই কথা বলে। সব কথাতেই উদ্দিষ্ট একটা সরস তাচ্ছিল্য টের পেয়ে যায়।

বস্তুত, সালমা মানুষের অন্তরঙ্গ জীবন বড় বেশি দেখেছে, বিশেষ করে গৃহস্থ মানুষের। গৃহস্থ মানুষের যেসব বিচিত্র গোপনতা আছে, বাজিকরের মিল নেই তার সঙ্গে কিছুই। অথচ, সালমার কালো চোখের তারায় সামনে-বসা মানুষটির অনেক কিছুই ধরা পড়ে। সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে তার রহস্যময় মনের অন্ধকারে যেসব আকাঙ্ক্ষাগুলো নড়াচড়া করে।

দয়ারাম বলে, সময় যখন আছে, হাতটা তোমাকে দেখিয়ে যাই, ভান্‌মতি।

সালমা তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাতটা টেনে নেয়। নরম চর্বিযুক্ত হাত। তিনটে পাথর বসানো আংটি আঙুলে। কব্জির হাড় নরম। বাহুতে বিশেষ কোনো শিরা দেখা যায় না।

সালমা আবার তার মুখের দিকে, চোখের দিকে এবং দেহের অন্যত্র দ্রুত দৃষ্টিপাত করে দেখে নেয়। গলায় তুলসীর মালা। দয়ারামের দেহে অধিক মেদ নেই। মুখে আবছা লেগে থাকা কর্কশ বিরক্তি, লোভ, দাপট এবং দম্ভ।

সালমা তার হাত ছেড়ে দিয়ে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রইল। তীক্ষ অথচ অনির্দিষ্ট দৃষ্টি তার। তারপর দয়ারামের মুখের দিকে তাকিয়ে শুধায়, কি জানতে চাও মালিক?

সবই তো জানতে চাই, ভাতি, ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান—

আগে টাকা দেও।

দয়ারাম হেসে কোমরের গেঁজে থেকে দুটি টাকা বের করে সালমার হাতে দেয়।

সালমা বলে, দু-টাকায় হবে না, আরো দু-টাকা বের করো।

দয়ারাম তাই করে।

সালমা বলে, শোনো মালিক, দিন তোমার ভালো যাচ্ছে এখন, পয়সাও আসছে প্রচুর। কিন্তু মন ঠিক নেই, কারণ, শরীর আর কথা শুনছে না। একটি আদরের জিনিস অথবা জনকে হারিয়েছ সদ্য,শোক ভুলতে পারছ না। আবার কিছু করারও নেই, মেনে নিতে হচ্ছে। কি তাই নয়?

দয়ারাম সালমার হাত চেপে ধরে।

ঠিক বলেছ, ঠিক বলেছ তুমি, ভান্‌মতি।

সালমা হাত ছাড়িয়ে নেয়।

অন্যদিকে তাকিয়ে আবার বলে, দু-বছরের মধ্যে তোমার আরো দুর্দিন আসছে। তোমার এই ধনসম্পত্তি আর কোনো কাজে নাও লাগতে পারে।

দয়ারামের নাকের পাশে ঘাম জমে। আঁতকে উঠে সে বলে, কেন? কেন, ভাতি?

তা আমি বলতে পারব না। তবে আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার সুদিন স্থায়ী হবার নয়।

দুর্দিন কি করে কাটবে?

সালমা চোখ বুজে বসে থাকে।

তার পর বলে, আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না, আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

দয়ারাম অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে খাটিয়ায়। প্রকাশ্যেই ভয়ানক ঘাবড়ে গেছে সে। আঁতিপাঁতি করে নিজের অভ্যন্তরে এবং পারিপার্শ্বিকে খুঁজে কোনোরকম অদৃশ্য শত্রুকে আবিষ্কার করতে পারে না। কোম্পানির আমলে বাঘ-বকরি একত্রে জল খায়, আর সে-কোম্পানির থানা, পুলিশ, সাহেব হাকিম, সবই তার হাতে। সাহেবি আইনের বাইরে সে কিছু করেও না। তবে?

ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে তার। সে ভাবে বাজিকর রমণীর এ এক রকমের বুজরুকি। সে বলে, ভান্‌মতি, সে যা হবার তা হবে। এখন কিছু দাওয়াইয়ের ব্যবস্থা কর। জানকীরাম দারোগা তোমার দাওয়াইয়ের কথা আমাকে বলেছে।

সালমা উঠে যেতে যেতে বলে, দাওয়াই বানাতে হবে। দু’দিন বাদে লোক পাঠিয়ে দিও দু’টাকা দিয়ে।

সালমা উঠে চলে যায়। দয়ারামও ওঠে। তার চাকর মোষের দড়ি হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছিল তার জন্য। একজন সাঁওতাল। অদ্ভুত শান্ত আর নিরীহ দেখতে মানুষটাকে। এতক্ষণে কারুর সঙ্গে একটাও কথা বলেনি। লোকটা জোয়ান এবং বিষণ্ণ।

দয়ারাম গাছে বাঁধা ঘোড়ার কাছে গেলে সেই সাঁওতাল মোষের দড়ি ছেড়ে দিয়ে ঘোড়ার পায়ের কাছে উবু হয়ে বসে। দয়ারাম তার ঘাড়ের উপর পা দিয়ে ঘোড়ায় উঠে আড় হয়ে বসে। সে দু-দিকে পা ঝুলিয়ে বসতে পারে না।

দয়ারাম চলে গেলে সালমা পীতেমের কাছে আসে। পীতেম সালমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট। কিন্তু উভয়ের মধ্যে কিছু গোপনীয়তা আছে। ধন্দু, পেমা এবং পরতাপের মা যতদিন বেঁচে ছিল, ততদিনই ব্যাপারটা সত্যিকার গোপনীয়তার পর্যায়ে ছিল। কিন্তু সেই রুগ্ন স্ত্রীলোকটি পীতেমকে সময় থাকতেই রেহাই দিয়ে গিয়েছে। যক্ষ্মা রোগে অনেক অল্প বয়সেই সে মরেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সালমা-পীততমের সম্পর্ক স্বাভাবিকতার পর্যায়ে আসেনি। এর মধ্যেও কিছু অতীত কারণ বিদ্যমান।

কোন এক দূর অতীতে বাজিকর এবং বানজারা এই দুই যাযাবর গোষ্ঠী একই জায়গায় ছাউনি ফেলে। সেই সময়ে পীতেমের বাপ দনুর জোয়ান বয়স ছিল। দনু বানজারা যুবতীদের পাগল করেছিল। তারপর দুই দল যখন দু-দিকের রাস্তার ধরে, তখন দেখা গিয়েছিল বানজারাদের দলে এক যুবতী কম এবং বাজিকরের দলে এক যুবতী বেশি।

সেই যুবতী সালমার মা। দনুর নিজস্ব স্ত্রী-সন্তানাদি থাকতেও অতিরিক্ত হিসাবে সেও ছিল। সালমা তার প্রথম সন্তান। এ সন্তানের পিতৃত্বের দাবিদার কে, এ সম্পর্কে সালমার মায়েরই সংশয় ছিল। পরবর্তীকালে সেই যুবতী আরো দু-বার গর্ভবতী হয় দনুর সহায়তায়। প্রথমবারে সে মৃত সন্তান প্রসব করে আর দ্বিতীয়বারে সন্তানসহ নিজেই মারা যায়।

কাজেই দনুর সংসারে সালমা মানুষ হয়। কালক্রমে যৌবনবতী হয় এবং কোনো এক সময়ে তার থেকে পাঁচ বছরের ছোট পীতেমের উপরে দুর্বার আকর্ষণ বোধ করতে থাকে।

এর আগেই অবশ্য পীতেমের বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সালমার তখনো বিয়ে হয়নি। কারণ সালমা তখনো মনস্থির করতে পারেনি। বাজিকরের দলে এবং দলের বাইরেও তার পাণিপ্রার্থীর সংখ্য ছিল ভারি। ফলে সালমা হয়েছিল দাম্ভিক। এই ধরনের সুন্দরীদের স্তুতি করার জন্য অনেক মানুষ থাকে বলে অনেক সময় সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়।

যেমন সালমার। তার সারাজীবনে সিদ্ধান্ত নেওয়াই হল না।

শেষে ক্রমশ তার প্রেমিকরা হতাশ হতে হতে সংখ্যায় কমতে লাগল। সালমার দম্ভ তাকে সময় থাকতে এ-ব্যাপারে সতর্ক করেনি। তারপরে একসময় সে নিজেকে দেখেছিল নিঃসঙ্গ।

সেই সময়ই পীতেমের বিয়ে হয়, পীতেম তার স্ত্রীকে নিয়ে সালমার চোখের সামনে সারাক্ষণ মশগুল থাকে। সেই পীতেম, যার সঙ্গে সালমা একসঙ্গে বড় হয়েছে এবং চিরকাল জ্যেষ্ঠা হিসাবে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে, সেই পীতেম। এখন দু-জনে সম্পূর্ণ আলাদা জগতের হয়ে গেছে সালমার একাকিত্বকে আরো ভারি করে।

প্রথমত সালমার একটা অস্বস্তি ছিল, পরে সেই অস্বস্তি ঈর্ষায় পরিণত হয় এবং কখন নিজের অজান্তেই পীতেমের স্ত্রীকে সে প্রতিদ্বন্দ্বী করে ফেলে। শুরু হয় এক বিচিত্র অধ্যায় যা বাজিকরদের মধ্যেই সম্ভব।

পীতেমের স্ত্রী ছিল নরম চেহারার মানুষ, হয়ত যাযাবরী জীবনের উপযুক্ত নয়। ধন্দু জন্মাবার পরই তার শরীর ভাঙতে শুরু করে, পেমার জন্মের পর সে দীর্ঘদিন রোগভোগ করে, তারপর পরতাপ যখন তার পেটে তখনই ধরা পড়ে তার ক্ষয়রোগ।

এর উপরে ছিল সালমার কর্তৃত্বের যন্ত্রণা, যা সালমাকে তৃপ্তি দিত, পীতেমকে আহত করত এবং ধন্দুর মাকে জীবন সম্বন্ধে হতাশ করত। ক্রমশ রুগ্ন স্ত্রী যাযাবরের জীবনে অসহ্য হয়ে ওঠাতে পীতেম সালমার কাছে ধরা দেয়। যেহেতু তারা একসঙ্গে বড় হয়েছে তাই পরস্পরকে ভালো বুঝত। পীতেম সালমার কর্তৃত্বে শৈশব থেকে অভ্যস্ত, তাই এখন দলের সর্দার হয়েও সালমার কোনো কাজ কিংবা সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ করে না। আর এখন দীর্ঘকালের অভ্যাসবশত প্রায় সব বিষয়েই সালমার পরামর্শও নেয় পীতেম।

ধন্দুর মায়ের মৃত্যুর পর তাদের সম্পর্ক যখন বিশেষ কারো কাছেই অপ্রকাশ্য থাকে না, তখন দলে কথা ওঠে। দল মূলত এ বিষয়ের নীতির দিকটাই বিচার করছিল। দনু আবার পীতেমকে বিয়ে করার কথা বলেছিল, পীতেম রাজি হয়নি। রাজি হয়নি এ জন্য নয় যে, সালমা তার কাছে অপরিহার্য ছিল। রাজি হয়নি, কারণ শালমার নিঃসঙ্গতা তাকে ব্যথিত করত।

আবার সালমা এবং পীতেম উভয়ের মধ্যে যখন বিয়ের প্রসঙ্গ ওঠে তখন। দু-জনেই এ ব্যাপারে শিউরে উঠেছিল, কেননা দূ-জনের ধমনীতে একই রক্ত বইছে কিনা এ সম্পর্কে তারা নিঃসংশয় ছিল না।

কেননা, হাজার বছর আগে যখন তারা কোনো এক বিশাল নদীর ধারে স্থায়ী বসবাস করত, সেই সময়কার পৌরাণিক স্মৃতি তাদের ভারাক্রান্ত করত। যখন তাদের কোনো প্রাচীন পুরুষ পুরা এক নর্তকীর প্রতি আসক্ত হয় এবং তাকে বিয়ে করতে চায়। তারপর শুরু হয় সেই অন্তর্কলহ, যা তাদের স্থায়ী বসবাসকে ছিন্নভিন্ন করে। মানুষ তখন দুই দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। পুরার বিরুদ্ধবাদীরা দাবি তুলেছিল, এ বিয়ে হতে পারে না, কেননা পালি নামের সেই নর্তকী নাকি তার বোন। সুতরাং এ বিয়ে হবে অসামাজিক এবং অমঙ্গলময়।

পুরার সমর্থকরা বলেছিল, এ বিয়ে হবেই, কেননা পালি যে পুরার বোন এর কোনো প্রমাণ নেই।

তারপর পুরা ও পালির বিয়ে হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে দেবতার অভিশাপ নেমে আসে তাদের উপর। অন্তর্কলহে সমস্ত মানুষ নষ্ট হয়। পুরা ও পালি দেশ-দেশান্তরে পালিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। তারা কোথাও আশ্রয় পায় না এবং দেবতা তাদের অভিশাপ দিয়ে সম্পূর্ণ নিরাশ্রয় করে দেয়। তোমরা এক বৃক্ষের ফল দু-বার খেতে পারবে না, এক জলাশয়ের জল দু-বার পান করতে পারবে না, এক আচ্ছাদনের নিচে একাধিক রাত্রি বাস করতে পারবে না এবং সব থেকে ভয়ানক—এক মৃত্তিকায় দু-বার নৃত্য করা দূরে থাকুক, দু-বার পদপাত পর্যন্ত করতে পারবে না। এই ছিল দেবতার অভিশাপ।

সেই থেকে বাজিকর পথেপ্রান্তরে ঘুরছে। সেই থেকে সে দেবতা থেকে বঞ্চিত। গৃহস্থের গৃহের নিকট পর্যন্ত সে যায়, কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না।

সুতরাং বাজিকর এক ভিন্ন জীবন, এক অস্থির চলমান জীবনকে আশ্রয় করে আছে। সে নিজেকে ভুলিয়েছে নাচ গান এবং চিন্তাহীন সরল জীবনযাত্রায়। সে শিখেছে মানুষকে ঠকাতে এবং তা নিয়েই তার অহংকার। সে গ্রহণ করেছে বিচিত্র ভিক্ষাবৃত্তি, যার জন্য কোনো সংকোচ তার নেই।

তবুও প্রাচীন কিছু স্মৃতি কিংবা পাপবোধ কিংবা নিতান্তই বিশ্বাস তাকে এখনো চালিত করে, এখনো নিযুক্ত রাখে কিছু আস্তিক চিন্তায়। কিছু ভীতি অথবা দারুণ দুর্দিনের আশংকা তাদের সমস্ত বিধিহীন জীবনযাত্রাকেও বেঁধে রাখে নিয়মের নিগড়ে।

কিন্তু এই নিয়মের নিগড় থেকে বেগবান অন্য কিছু তাদের একজনকে অন্যের সঙ্গে যুক্ত রাখত। পীতেম কিংবা সালমা কেউ জানবে না তাদের পরবর্তী তৃতীয় এবং চতুর্থ পুরুষেই বিষয়টি নিয়মে পরিণত হবে বাধ্য হয়ে, যে বাধকতায় পুরা ও পালি আনীত অভিশাপ মূল্যহীন হয়ে যাবে।

সালমা বলে, মানুষটা লোভী ও বজ্জাত।

পীতেম বলে, তাতে তোর কি? তাতে বাজিকরের কি আসে যায়? পয়সা তো রোজগার হচ্ছে!

তুই আজকাল খুব পয়সা চিনেছিস। ভকত আর বেনিয়াদের মতো খালি পয়সার চিন্তা তোর।

পয়সা ছাড়া দল বাঁচবে না, তুই আমিও বাঁচব না।

ভয় হয়, এর পরে তুই কবে আবার ঘর-গেরস্থালির কথা ভাবতে শুরু করবি দলের জন্যে?

ঘর-গেরস্থালি? বাজিকরের?

নয় কেন? পয়সা চিনছিস না?

কি জানি? বাজিকর কেন পথে ঘোরে? বাজিকর কেন ঘর বাঁধে না? এসব আমার মাথায় আজকাল আসে মাঝে মাঝে।

আসে, না?

আসে।

ঘর বাঁধবি? তারপর রাতের পর রাত, সারাজীবন সেই এক ছাউনির নিচে থাকবি?

থাকলাম।

এক পুকুরের জল খাবি সারাজীবন?

খেলাম।

চেনা পথ হাঁটবি সারাজীবন?

হাঁটলাম।

কোন মানুষটা হবি তুই? দয়ারাম ভকত, না তার ঐ বাঁধা চাকরটা যার ঘাড়ের উপর পা রেখে ভকত ঘোড়ায় উঠল?

সালমা!

হাঁ, হাঁ, বল?

এত ভাবি নাই।

দলের সর্দার তুই, পীতেম, তোর ভাবা দরকার। বাদিয়া, বাজিকর, বানজারার জীবনে তো সবার জন্য একই রকম রাস্তা। কিন্তু এই গেরস্থের রাস্তা সবার আলাদা।

হাঁ, সেটাই ভয়। গেরস্থ হওয়া মানে বাঁধা জানোয়ার। আর জানোয়ার বাঁধা থাকতে তাকে দোয়ানো সোজা। দুইয়ে তার শেষ বিন্দু রক্তও বের করে নেওয়া যায়।

তবুও তুই বাঁধা জানোয়ার হওয়ার কথা ভাবছিস?

ভাবছি।

কেন?

বাজিকর-বাদিয়ার দিন বোধহয় শেষ হয়ে আসল। পশ্চিম থেকে পুবে এই যে ক্রমান্বয়ে হেঁটে যাওয়া, সেই পুবদিকের সীমানা বোধহয় অন্য কোনো পশ্চিমে গিয়ে ঠেকে যাবে।

কিন্তু দেখ, বাজিকরের পালাবার রাস্তা থাকবে না, সব রাস্তা সাহেবরা রেল দিয়ে বেঁধে ফেলেছে, দেখছিস না?

দু-জনেই খুব সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। দু-জনের ঝোক দুই বিপরীত মেরুতে, কিন্তু মজা এই, কারো কেঁকই খুব দৃঢ় নয়। শীতেম স্পষ্টত মানুষগুলোর অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নটি নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু সালমার তেমন কিছু নেই। তার কাছে স্থায়িত্ব খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়, আবার চলমানতাও এখন আর খুব ছন্দময় মনে হয় না।

অতঃপর তারা তাদের এই বহির্জগৎ সম্বন্ধে আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়। যদিও বাজিকরের জীবন পরিশ্রমহীন নয়, তবুও সতত উৎপাদনশীল জীবনযাত্রা তার অপরিচিত না হলেও, তার বিধি-উপকরণ সম্বন্ধে তার কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই।

যেমন পীতেম বলেছিল বাঁধা জানোয়ারকে দোয়ানো সহজ, এই বিষয়টা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত দশ বছরের মধ্যে দোহকের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজারে হাটে বাজিকরে সামান্য পণ্য বিক্রির সময়ও ভাগিদার এসে উপস্থিত হয়। দালাল যেন মাটি খুঁড়ে বের হয়। এমনকি নিতান্ত খেলা দেখিয়ে যে ভিক্ষাবৃত্তি, যা বাজিকরের একান্ত নিজস্ব, সেখানেও ভাগ দিতে হয়। ভাগ দিতে হয় দারোগা পুলিশকে, ভাগ দিতে হয় স্থানীয় বদমাশদের।

যেমন বাজিকর ভাবে, কেবলমাত্র যাযাবরই জীবনকে সঠিক জানে বা জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ করে। এ ভাবনা ঠিক কিনা, এখন এরকম সমস্যা কারো কারো মগজে আসতে পারে। বেশ কয়েক বছর আগে সালমাকে এক সন্ন্যাসী বলেছিল, ঈশ্বরের শরণাপন্ন হও, কেননা পাপ অধিক হলে এই দৃশ্যমান পৃথিবী ধ্বংস হবে। তখন পুণ্যাত্মারাই রেহাই পাবে, পাপীরা নয়।

সালমার ধারণা হয়েছিল, এ লোকটা তার রূপে মজেছে, তাই এসব তাকে দলে ভেড়াবার ফন্দি। সে হেসেছিল এবং অবজ্ঞা দেখিয়ে চলে এসেছিল। অথচ পরে অনেক চিন্তা করেও বুঝতে পারেনি, কী আকর্ষণে ঐ লোকটার কাছে সে গিয়েছিল। সে নিজে মানুষের হাত দেখে এবং ভূত-ভবিষ্যৎ বলে, ছক পেতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে, নিদান দেয় শুভ এবং অশুভের, কিন্তু এসবের সঙ্গে বাজিকরের কোনো সম্পর্ক নেই। অন্তত এতকাল তো ছিল না।

এই চমৎকার নিসর্গ, পিছনের গঙ্গা, যেখান থেকে বছরের এই সময় যখন খুশি দমকা হাওয়া উঠে এসে আছড়ে পড়তে পারে, নিয়ত-সঞ্চরণশীল নৌকোগুলোকে সন্ত্রস্ত করতে পারে। অথবা দুরের ঐ পাহাড়, এখন কী চমৎকার ঝকমকে, সবুজ মুহূর্তে তার রঙ বদল করতে পারে সম্পূর্ণ বিপরীতে। তবুও এই মুহূর্তে প্রাণবন্ত ও রঙিন এইসব প্রাকৃতিক দৃশ্য। আর যদি উঠে দাঁড়ানো যায়, তাহলেই ডান পাশের আমবাগানটার ভেতরেই চোখে পড়বে কুৎসিত বিবর্ণ সব মালখানা, আড়ত ও অস্থায়ী চালার সারি। যেখানে হরদম মাল এবং মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে, কুৎসিত আওয়াজ, ঝগড়া, হাসি ও কখনো কখনো দাঙ্গা এইসব প্রবহমানতায় মিশছে। অথবা, আরো একটু এগিয়ে, যেখানে ভারি মহাজনি ও গয়নার নৌকোয় মাল উঠছে। বিচিত্র সব পণ্য। খেত থেকে আসা, মানুষের উদ্ভাবনীতে ও নৈপুণ্যে বাস্তবায়িত শ্রম—ধান, তৈলবীজ, পাট অথবা, বস্ত্র, শিল্পসামগ্রী, অথবা আধারে আবদ্ধ পণ্য, এমনকি বধের জন্য নীত পশুর দঙ্গল এবং ক্রীতদাস ও বেশ্যা হওয়ার জন্য ক্রীত ও সংগৃহীত মানুষ। এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত মানুষ, যে ঘাম ফেলছে, যে হিসাব রাখছে, যে মস্তিঙ্কে লাভের অঙ্ক কষছে। এই যাবতীয় চাঞ্চল্য নিয়ে এক পৃথক জীবনযাত্রা। কোথায় অধিক উত্তাপ, জীবন, মুক্তি?

যেমন ধন্দুর মা বলেছিল, তোমাকে এর শাস্তি পেতে হবে। অথচ পীতেম অন্যদের সহায়তায় বাজিকর রীতিতে গর্ত খুঁজে শুধুমাত্র মানুষটাকে সমাহিত করেছিল। মাটি দিয়ে গর্ত বোঝাই করেছিল। তারপর দল নিয়ে আবার পথে বেরিয়ে পড়েছিল। সবকিছুই যেমনকার তেমন ছিল, তেমনিই চলছিল।

দয়ারামের সেই ভৃত্য যে নিজের ঘাড় পেতে দেয় প্রভুকে ঘোড়ায় উঠতে সাহায্য করার জন্য এবং সালমার নতুন পরিচিত সেই ক্রীতদাসী রমণী যাকে প্রতিরাতে আবিষ্কার করতে হয় তার প্রভুকে উত্তেজিত করবার পদ্ধতি, অথবা রাজমহল বাজারের গোলাদার, মহাজনের ঘরে ঘরে ঋণজালে আবদ্ধ কৃষ্ণকায় সাঁওতাল, অথবা সাহেবগঞ্জের রেলের রাস্তা পাতার কাজে নিযুক্ত শয়ে শয়ে কুলি—যারা কঠিন প্রহরায় পালাতে পর্যন্ত সাহস করে না ও অজ্ঞাত এক জ্বরের প্রকোপে মরে।

আবার দেখ, আদিম রক্ষণশীলতায় সমস্ত সামাজিক বন্ধনহীন বাজিকরও নিয়মবদ্ধ থাকে। যেমন সালমা আর পীতেমের পরিণতি।

এই যাবতীয় বিভ্রান্তির বিষয় পীতেমকে পীড়িত করে। শেষবারের মতো আসার আগে নানা একবার তার বাপের সঙ্গে এদেশে এসেছিল। সে সম্ভবত তার শৈশব কিংবা কৈশোরের কথা, এখন থেকে ষাট-সত্তর বছর আগের ঘটনাই হবে। সেবার বাজিকরের দল এখান থেকে পালিয়েছিল। কেননা তারা দেখেছিল মানুষ তখন যেভাবে মরে, তাতে পতঙ্গের মৃত্যুর মর্যাদাও সে পায়নি। অথচ, সেই মানুষই ফসল ফলিয়েছিল, যে যার নির্দিষ্ট নিয়মমতো শ্রম দিয়েছিল। আর সেইসব মানুষ, যারা এইসব শ্রমদায়ী মানুষের সর্বস্ব লুঠ করেছিল, তাদের মতো হৃদয়হীন যন্ত্র বাজিকর সমস্ত পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়বার দেখেনি। দেখতে চায় না। কে তখন বাজিকরের ভান্‌মতি দেখবে? তখন বাজিকর দেখেছে খাজনা না দিতে পারার জন্য গাছে ঝোলানো মানুষ, চুনের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ মানুষ, বিষ্ঠা ভক্ষণে বাধ্য মানুষ, বস্তাবন্দী জলমগ্ন মানুষ, আরো অসংখ্য অশ্লীল কদাচার যার নাম শাস্তি, যার নাম প্রজাকে শায়েস্তা করা। পৃথিবীর যাবতীয় ইন্দ্রজাল কিংবা ভানুমতির খে থেকে অনেক বেশি উত্তেজক ও বিস্ময় উদ্রেককারী এইসব ঘটনা। তখন পীতেমের নানার নানা বলেছিল, এ দেশের মানুষগুলোকে অবশ্যই দানোয় পেয়েছে, না হলে এমন হয় না, সুতরাং পালাও এখান থেকে।

আবার বাপ না বলল তাকে পূবের দেশে যাও, পীতেম?

পুবের দেশে জল আছে, ফল আছে, মানুষ আছে, জানোয়ার আছে।

তবে যে নানা বলেছিল, সেখানে দুর্ভিক্ষে আধা মানুষ মরে যায়?

আধ মানুষ থাকে, তারা আবার নতুন মানুষ বানায়।

কিন্তু আমার ভান্‌মতি দেখে কে? কে দেখে ভালুক আর বাঁদরের নাচ? কে কেনে সালমার ভবিষ্যৎবাণী? টোটকা, মাদুলি, কুহক বিদ্যা?

দৈত্যের মতো রেলের গাড়ি ভীষণ গতিতে শ’য়ে শ’য়ে মাইল ছুটে যায়। জলের উপর দিয়ে অতবড় লোহার নৌকো মালবোঝাই হয়ে দ্রুত এগোয়। টেলিগ্রাফের তার শহর ছেড়ে গ্রাম পেরিয়ে নতুন শহরের দিকে ছোটে।

বাপ, হে বাপ, আমার সওদা কে নেবে?

অত সময়ও নেই মানুষের। সাহেবরা নিত্য নতুন উত্তেজনার আমদানি করছে। সদাচঞ্চল, সদাকর্মব্যস্ত মানুষ। কেউ কি দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে বাজিকরনির নাচ দেখবে? দেখবে কি ঘাঘরার উপরে কাচ আর পুঁতির কারুকার্য?

দেখ, সালমা, কেউ তোকে না বাঁধলেও তুই বাঁধা পড়বি। যেন সারা দুনিয়া জুড়ে ফঁদ পাতা। সেই ফাঁদে অজস্র ফঁাক, তবু তুমি যেতে পারবে না, এমনই মজা। তোমাকে থাকতেও কেউ বলে না, যেতেও কেউ বলে না। মানুষ শুধু দুঃখ পায়।

সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যায় পীতেমের। অতি পরিচিত এবং অপরিচিত সমাজ, নিয়মশৃঙ্খলা, লোভ, পাপ, ক্ষুধা, ঘাম, রক্ত, ব্যক্তি, গোষ্ঠী কোন নিয়মে চলে! কেনই বা চলে! এসব বাজিকর বুঝতে চায় না, বোঝার দরকারও বোধ করে না। কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিহাসের মতো যে বিষয় তা হল, বাজিকরের অস্তিত্ব নির্ভর করে যেসব মানুষের উপর তারা বাজিকর নয়। তারা সব যুথবদ্ধ, শ্রেণীবদ্ধ, আপন আপন অঙ্গীকারে বদ্ধ মনুষ্যকুল। সেই মানুষের সময় আর অঞ্জ? নয়, সেই মানুষের উপকরণ আর যথেষ্ট নয়। যে মানুষ সারাদিনের শ্রমে শুধু অন্নবস্ত্রের সংস্থান করে তার অপরিহার্য বিষয়গুলো স্পষ্ট। কিন্তু যার গুদামে মালের পাহাড়, যার সিন্দুকে টাকার উপরের চাপে নিচের অংশের ধাতব বিকৃতি হয়, তার অভাববোধ অস্পষ্ট অথচ বাস্তব। আর এই যাবতীয় বিষয়ই এখন সমাজগ্রাহ্য নিয়মের অংশ।

এই নিয়মকেই যত ভয় পীতেমের। দেবতার অভিশাপে শিকড়হীন জীবনে অভ্যস্ত বাজিকর এখন সবদিকে বিস্তারী এক বৃক্ষের অজস্র শিকড়কে ঝুরির মতো নেমে পথরোধ করতে দেখে। যার বাইরে তার অস্তিত্ব বিপন্ন এবং ভিতরে অনিশ্চিত। সেজন্যই সম্ভবত সে শুনেছিল তার বাপকে বলতে, পীতেম হে, পুবের দেশে যাও।

 

০৫.

এইভাবে শীত পার হয়ে সূর্য উত্তপ্ত হতে থাকে। গঙ্গার পাড়ের বালি হল্কা হাওয়ায় দিগ্বিদিকে উড়তে থাকে। তারপর ক্রমশ গঙ্গার উপরে হঠাৎ হঠাৎ টুকরো মেঘের আবির্ভাব হয় এবং অচিরে তা ঝঞ্ঝার আকাশে ফেটে পড়ে, তাঁবুগুলোকে ছিঁড়ে উড়িয়ে নিয়ে যায়।

একসময় সবাই বোঝে গঙ্গাপাড়ে থাকা সম্ভব নয়। তখন পীতেম শহরের সংলগ্ন মাঠে তাঁবু ফেলে। তার জন্য আবার দারোগার অনুমতি নিতে হয়।

হাটে ও বাজারে এবারে শীতের মাঝ থেকেই অপর্যাপ্ত শস্য আসতে শুরু করেছে। সেইসব পণ্য বৃহদাকার জলযানে ও রেলগাড়িতে চেপে যায় মুর্শিদাবাদ, সিউড়ি ও কলকাতা নামক শহরগুলোতে। এই সময় হাটবাজার প্রাণবন্ত হয়।

এইসব প্রাণবন্ত হাটে পীতেমের দল বাঁদর ও ভালুক নাচায়, রহু চণ্ডালের হাড়ের ভেলকি দেখায়, বাঁশবাজি, দড়িবাজি দেখায়। কিন্তু সবাই টের পায় মানুষ আর আগের মতো বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায় না। বাজিকর রমণীরা চলতে ফিরতে বিচিত্র হিল্লোল এবং কটাক্ষ ছুঁড়ে যেসব পুরুষকে ঘায়েল করে—যা তাদের স্বভাবের অঙ্গ, যা সৎ-অসৎ কিংবা অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে না—সেইসব মানুষেরা কেউ কেউ বলদর্পী ও বেপরোয়া। কখনো কখনো তারা হামলা করে। তাতে কিছু অশান্তি হয় এবং পীতেমকে দলের মধ্যে কিছু নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রবর্তন করতে হয়, যা একান্তই নতুন।

তারপর ধন্দুর ছোট বোন পেমা একদিন দড়ির উপর থেকে ভিড়ের মধ্যে সওয়ারসহ ধন্দুর সেই ঘোড়াটাকে দেখে এবং উৎসাহে দুই আঙুল মুখে দিয়ে নিতান্তই যাযাবরী শিসধ্বনি বাতাসে ছুঁড়ে দেয়। ঘোড়াটি তাকে দেখে এবং সওয়ারের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে তোয়াক্কা না করে একটি উল্লাস-হ্রেষা তুলে পেমার দিকে ধাবমান হয়।

আরোহী দারোগাপুত্র আনন্দরাম কৌতুক বোধ করে ও ঘোড়াকে ইচ্ছামতো চলতে দেয়। ঘোড়া এসে বাজিকরের জটলার কাছে থামে এবং চঞ্চল হর্ষ প্রকাশ করে।

পেমা দড়ি থেকে নেমে এসে বলে, এ বাবু, ঘোড়া তোমার কথা শোনে?

আনন্দ হেসে বলে, না শুনলে মার খায়।

ঘোড়াটির দেহ আরো উজ্জ্বল হয়েছে। বোঝা যায় সে আদরযত্ন ভালোই পাচ্ছে। এত সুন্দর ঘোড়া এ অঞ্চলে দেখা যায় না। পেমা এবং অন্য মেয়েরা ঘোড়াকে ঘিরে ধরে এবং আনন্দর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের লঘু কৌতুক করে। কলহাস্য ওঠে।

এতগুলো রহস্যপ্রিয় উচ্ছল যুবতীর সান্নিধ্যে আনন্দ গর্ব বোধ করে। এইসব মেয়েদের চলতে ফিরতে সে অনেকবার দেখেছে বটে কিন্তু কখনো মনোযোগ দেয়নি। এখন কাছে থেকে ভালো করে এদের উদ্দামতা দেখে এবং নেশাগ্রস্ত হয়।

আনন্দ ফিরে যায়, কিন্তু মস্তিষ্কে পেমার যুবতী-শরীরের জন্য আক্ষেপ নিয়ে যায়। অবশ্য এই আক্ষেপ নিতান্তই আকাঙ্ক্ষার নামান্তর, কেননা তখন সময়টা ছিল দারুণ উত্তেজক ও আকাঙ্ক্ষিত বস্তু সমর্থ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে।

সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শ্রমদায়ী মানুষ তখন ছিল একেবারেই দুরভিসন্ধিহীন। এই জন্য অঘ্রান মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চতুর মানুষ, যারা দয়ারাম ভকতের গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, তারা ঘোড়া, বলদ ও মোষে টানা গাড়ি নিয়ে রাজমহল পাহাড়ের উত্রাইতে বসতি গ্রামগুলোতে হাজির থাকত। এর আগে শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন মাসে প্রয়োজনে ওকৌশলে তারা যে দাদন করে রেখেছিল সাঁওতাল গ্রামগুলোতে, এখন তার বহুগুণ তারা প্রাপ্য হিসাবে ফেরত পায়। আর তাদের পাল্লা ও বাটখারা দাদন এবং পরিশোধ এই দুই উপলক্ষে দু-রকম ব্যবহার করে। ফলে খাতকের দেনা শোধ একটা দর্শনীয় ব্যাপার। আবার প্রায়ই তা খাতকের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। তখন খাতক নিজেকে বাঁধা রেখে, অথবা স্ত্রী-পুত্র-কন্যা বাঁধা রেখে সেই দেনা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার প্রয়াস পায়। বস্তুত, ক্ষমতাশীল মানুষের কাছে সমস্ত বস্তু ও ব্যক্তি যে-কোনো উপায়েই তোক প্রাপ্য।

কাজেই আনন্দ নেশাগ্রস্ত হয় এবং পেমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে সার্থক করার চেষ্টা করতে থাকে। যে যেমন বাজিকরের ছাউনিতে গেল এবং বাছাই ঘোড়াটি নিয়ে এল, এই দ্বিতীয় ব্যাপারটি যে তেমনই হবে, এতে তার সামান্য সংশয় ছিল। একটা মাদি ঘোড়া আর এক বাজিকর যুবতী তার কাছে এই মুহূর্তে এক নয়।

তবে আনন্দ নিজের দৈহিক সৌন্দর্য ও ক্ষমতার উপরে যথেষ্ট আস্থাবান। আর এই ধরনের যুবকেরা প্রথমেই বলপ্রয়োগটা লজ্জাজনক মনে করে।

দু-একদিনের মধ্যে আনন্দের ঘোড়া বাজারে সওদা নিতে আসা পেমার রাস্তা আটকায়। পেমা আনন্দর আশানুরূপ ঝিলিক দিয়ে হাসে। আনন্দ এই যাযাবরীর চোখে আহ্বান দেখে এবং ভাবে এ কি যাযাবরী চোখের স্বাভাবিক দ্যুতি, না বিশেষ কম্পন?

পেমা অবশ্যই শহরের সেরা যুবকটির মনোহরণ করার কৃতিত্ব জাহির করে সঙ্গিনীদের কাছে। বিষয়টা যাযাবরীদের চিরকালের দম্ভ। কিন্তু রাজমহল পাহাড়ের উপত্যকায় তখন শুকনো পাতা বড় বেশি ঝরছিল, হাওয়া ছিল উদ্দাম। আর পীতেমেরও দল নিয়ে অন্যত্র সরে যাওয়ার ইচ্ছা বা পরিকল্পনা এত তাড়াতাড়ি ছিল না। কাজেই বাজিকর ছাউনিতে পেমা সমস্যা সৃষ্টি করে যখন সালমার কাছে সে আসে তার ভাগ্য গণনা করতে।

০৬-১০. পরতাপ এবং জিল্লু অঘ্রান মাসে

পরতাপ এবং জিল্লু অঘ্রান মাসে মুর্শিদাবাদের পথ ধরেছিল। আশা ছিল পনেরো-বিশ দিনের মধ্যে তারা ফিরে আসবে। কিন্তু এক মাসের মধ্যে যখন তারা ফিরে এল না, পীতেম তখন চিন্তায় পড়ে। এ অঞ্চলের রাস্তাঘাট এখনো বাজিকরদের কাছে তেমন পরিচিত নয়। তাছাড়া রাস্তা বিপদসংকুল। দল বেঁধে ছাড়া মানুষ একাকী কিংবা দু-একজনে রাস্তা চলাচল করে না। পীতমের চিন্তা অমূলক নয়। সে মুর্শিদাবাদ প্রত্যাগত ও চলাচলকারী ব্যবসায়ী মহাজনের কাছে খোঁজখবর করতে শুরু করে। কিন্তু কোনো সন্ধানই পাওয়া যায় না। কোনো পথিকের হদিশ না পাওয়া গেলে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে দস্যু-তস্করের হাতে সে খুন হয়েছে।

তিন-চার মাস যাওয়ার পর পীতেম ধরে নেয় জিল্লু কিংবা পরতাপকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে বিষণ্ণ হয় এবং দুই যুবকের স্ত্রীদের কাছে অপরাধী হয়ে থাকে। পরতাপ যেহেতু তার কনিষ্ঠ সন্তান সে প্রচণ্ড আঘাতও পায় এবং সালমার কাছে সান্ত্বনা খোঁজে।

এইভাবে ছ-মাস পার হয়ে যাবার পরে সবাই যখন একরকম স্থির করেই নিয়েছে যে জিল্লু কিংবা পরতাপের ফেরত আসার কোনো আশাই নেই এবং যখন এই দুই যুবকের স্ত্রীরা দৈনন্দিনতার সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে নতুন করে জীবন খুঁজতে শুরু করেছে, তখন তারা ফেরে।

দলের সব মানুষ ভিড় করে তাদের এই অজ্ঞাতবাসের বিবরণ শোনে। বস্তুত, তাদের পোশাক-আশাকে এবং হাবভাবেও কিছু নতুনত্ব ছিল। তারা শহরে ঢুকেছিল আকস্মিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে।

ত্রিশ-চল্লিশজন সাঁওতাল যুবকের সঙ্গে তারা মিছিল করে শহরে ঢুকেছিল। মিছিলের আগে ছিল আটজন বাহকের কাঁধে বাঁশে ঝোলানো একটি মৃত বাঘ। তার পিছনে দড়ির খাটিয়ায় আহত এক যুবক। এই যুবক খাটিয়াতে উপবিষ্ট ছিল। এবং চারজন বাহক তাকে বহন করছিল। যুবকের মাথায় পাগড়িতে রক্তের ছোপ, তার ডান দিকের গাল ক্ষত-বিক্ষত এবং ভীষণভাবে ফোলা, তবুও তার দৃষ্টি বীরত্বব্যঞ্জক। তার মাথার চুলের ভিতর দিয়ে আড়াআড়িভাবে একটি তির গোঁজা ছিল। তাতে তার অবয়বে একটা সমীহ আদায় করার ভঙ্গি ছিল। স্বভাবতই বোঝা যায় এই যুবকই বাঘটির শিকারী। খাটিয়ার দুই পাশে ছিল জিল্লু ও পরতাপ। পরতাপের হাতে ছিল রক্তমাখা একখানা পরশু এবং তার দৃষ্টিও যথেষ্ট দাম্ভিক ছিল। পরিষ্কার বোঝা যায় এই বৃহৎ শিকারে সেও অংশীদার।

বাজারের চত্বরে পৌঁছে দলের বেশ কিছু যুবক তুমদা ও ধামসা বাজিয়ে একটি শিকার-নৃত্য শুরু করে। বাজিকরদের চমকিত করে জিলুও সেই নৃত্যে সমান তালে পা মেলায়। অন্যরা ব্যবসাদার, মহাজন ও সাহেবদের কুন্‌ঠিতে কুন্‌ঠিতে বীরত্বের স্বীকৃতি বাবদ পুরস্কার আদায় করতে থাকে।

সমস্ত চত্বরে উৎসবের আলোড়ন ওঠে। রেশমের কারবারী উড সাহেবের কুন্‌ঠির সামনে আহতদের নিয়ে আসা হয়। উড কিছু চিকিৎসা জানত এবং এ অঞ্চলে সাহেবদের নিজস্ব কোনো চিকিৎসক না থাকাতে উডের এ কাজটা অতিরিক্ত ছিল।

শিকারী যুবকের নাম ডুমকা সোরেন। ডুমকার ক্ষত খুবই গুরুতর ছিল। উড চিকিৎসা শেষ না হলে তাকে স্থানত্যাগ করতে না করে। বাজিকরের ছাউনিতে সসম্মানে তার থাকার ব্যবস্থা হয়। তার সঙ্গে থাকে তার বাপ লক্ষণ।

পীতেম এই অপরিচিতদের সান্নিধ্যে আনন্দ বোধ করে। প্রথমত, হারানো দুই যুবকের এমন আকস্মিক ফিরে আসা তাকে এবং দলকে যেমন উদ্বেল করেছিল, তেমনি এই নতুন সম্পর্ক তার ভেতরে এক নতুন ভাবের উদ্রেক করে।

জিল্লু ও পরতাপ এই অপরিচিতদের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। প্রৌঢ় লক্ষ্মণ সোরেন বলিষ্ঠ ব্যক্তি এবং খুব সম্রমপূর্ণ তার আকৃতি ও ব্যবহার। পীতেম তার ভিতরে এমন এক আত্মমর্যাদা দেখে যা দীর্ঘকাল বিরাট সামাজিক কর্তৃত্বে থাকলেই আয়ত্ত করা সম্ভব।

বিষয়টি ভিখ-মাঙ্গা বাজিকরের কাছে বিস্ময়ের বটে। কেননা, এই মানুষেরা যে দৈন্য ও অভাব নিয়ে থাকে তাতে আর্থিক দিক দিয়ে বাজিকর গোষ্ঠীর থেকে তাদের স্বতন্ত্র করা যায় না। কিন্তু এই সম্রম ও মর্যাদা বাজিকরের চিন্তারই বাইরে। মানুষটিকে পীতেম যথাযোগ্য মর্যাদা দেয় এবং অতিথিদের বিরাট দলকে সে একসন্ধ্যায় আতিথেয়তার জন্য আমন্ত্রণ করে। এই উৎসবে বাজিকরেরা পাঁচ-ছুটি বাহাই শুয়োর মারে। সন্ধ্যার পরে তাঁবুর সামনে আগুন জ্বালিয়ে পীতেম লক্ষ্মণ সোরেনের সঙ্গে একত্রে বসে মদ্যপান করে এবং সবিস্ময়ে লক্ষ করে দলের অন্যান্যরা তার সঙ্গে ব্যবহারে অতিরিক্ত সম্রম দেখাচ্ছে। তার ভেতরে অংকুরিত হতে থাকে এক অনাস্বাদিত আকাঙ্ক্ষার বীজ।

ভোজন এবং পান যথেষ্ট হওয়াতে দুই প্রৌঢ় অত্যন্ত আন্তরিক ও উষ্ণ হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের গরমে দু-খানা খাটিয়া তাঁবুর বাইরে নিমগাছের নিচে দু-জনে প্রভূত আয়াসে টেনে নিয়ে আসে এবং এই কাজে তারা দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধুর মতো ব্যবহার করে। যেমন, খাটিয়া দু-হাতে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করতে লক্ষ্মণ পীতেমকে হাত দিয়ে আটকায়। বলে, তুমি রাখ সর্দার। নেশাটা তোমার বড় জবরই হয়েছে। আমি নিয়ে যাই।

পীতেমের মর্যাদায় লাগে। সে নেশাগ্রস্ত মস্তিষ্কে যতটা সম্ভব দৃঢ়তা এনে বলে, তুমি, একদম কথা বলবে না, পারগানা। এটা আমার কাজ, আর তুমি আমার অতিথি। ব্যাস্‌।

এবং দুটি খাটিয়া একসঙ্গে নেওয়ার প্রয়াসে পীতেম বেটাল হয়। লক্ষ্মণ এগিয়ে এসে তাকে সোজা রাখে এবং বলে, বলেছি না নেশাটা তোমার জবর হয়েছে। চুপচাপ এগুলো আমার কাছে ছেড়ে দাও।

যেন তোমারই কিছু কম নেশা হয়েছে।

দেখই না।

ঠিক আছে।

তারপর লক্ষ্মণ খাটিয়া দুটি ওঠাতে যায় এবং পীতেমের মতোই টাল খেয়ে পড়ে।

পীতেম বলে, বহোতখুব। যেন সাঁওতাল সর্দারকে চিনতে আমার কিছু বাকি wagi

নাঃ, নেশাতে নিশ্চয়ই কিছু তুক করেছ তোমরা।

হে পারগানা, এর নাম বয়েস, বুঝলে! তুমি পারতে ওই বাঘটাকে মারতে?

আমার বেটা মেরেছে!

তুমি তো খুব নির্লজ্জ, পারগানা! আমার বেটার নাম করছ না!

আলবাত! তোমার বটো না থাকলে আমার বেটার জান বাঁচত? খুব বাহাদুর বেটা তোমার।

তবে?

তবে কি?

তবে এই খাটিয়ার এদিকটা আমি ধরি, আর ওদিকটা তুমি ধর। তারপরে দেখি দুই বুড়োতে নিমগাছের নিচে নিয়ে যেতে পারি কিনা।

চমৎকার। তাই চল।

দু-জনে খাটিয়া দু-টি ধরাধরি করে গাছের নিচে নিয়ে যায়। এবং যেন খুব পরিশ্রান্ত এমন ভঙ্গিতে দুজনে মুখোমুখি বসে। তারপর দু-জনেই প্রায় একসঙ্গে শুয়ে পড়ে নিশ্ৰুপে আকাশ দেখে।

জ্যৈষ্ঠের পরিষ্কার আকাশে অসংখ্য তারা, ছায়াপথ, প্রাচীন পরিত্যক্ত পথের স্মৃতি। দুই দলের যুবকেরা দূরে উল্লাস ও নাচগান করছে। যুবতীরাও আছে তাদের সঙ্গে। ধামসা, তুমদা, ঢোল, বাঁশি এবং একটি নামগোত্রহীন তার যন্ত্রে বিচিত্র সুর উঠেছে।

না, বাজিকরের সঙ্গে গেরস্থ মানুষের বন্ধুত্ব হয় না, এটা ঠিক। আমরা তো পথের মানুষ। মিলমিশ যতটুকু হয়, সে শুধু উপরে উপরে।

লক্ষ্মণ গভীর শ্বাস ফেলে বলে, দিনকাল খুব খারাপ। না হলে, তোমাকে বলতাম আমাদের গ্রামে গিয়ে থাকতে। এখন আর একথা বলতে সাহস য় না। অথচ, পাঁচ বছর আগেও কত মানুষকে বসত করিয়েছি। জঙ্গল কেটে, পাথর চটিয়ে, চাষের জমি পত্তন করে দিয়েছি। এখন আর সে দিন নেই। সব জমির মাসিক তৈরি হয়ে গেছে। জঙ্গল কেটে জমি যেই খালাস হল তখনই মালিক এসে হাজির হবে। দেও, তখন তাকে ভাগ দেও। আর সে ভাগ ক্রমশ সর্বস্ব হয়ে যায়।

পারগানা, সেজন্যই বাজিকর জমিতে বসত করতে চায় না। জমিতে বড় দুঃখ।

লক্ষ্মণ ঝট করে উঠে বসে। হাত দুটোকে কোলের মধ্যে সশব্দে আছড়ে ফেলে বলে, তোমার মাথা। জমিতেই স্থিতি, জমিতেই স্থায়িত্ব, জমিতেই সুখ। জমি না থাকলে জীবনের শেনো অর্থই হয় না। তুমি জান জমিতে যখন ফসল ধরে তখন মানুষের মনের ভাব কেমন লাগে?

পীতেম তেমনি আকাশের দিকে তাকিয়ে। সংক্ষেপে বলে, না, জানি না।

তোমার বউয়ের পেটে যখন বেটাবেটিরা এসেঁছে তখন তোমার মনের ভাব নিশ্চয়ই মনে আছে?

আছে।

তবেই বোঝ।

লক্ষ্মণ আবার শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়েই সে বলে, তুমি মানুষটাকে আমার বড় ভালো লেগেছে। তোমাদের কি জাত, সরদার?

আমরা বাজিকর জাত।

বাজিকর কোনো জাত নয়।

হিন্দু-মুসলমান সমাজ আমাদের ডোম-চণ্ডালের জাত হিসাবে ধরে।

তামরা ডোম জাত আর তোমাদের জমির আকাঙ্ক্ষা নেই?

না।

হতেই পারে না।

আকাঙ্ক্ষা থাকলেই বা দেয় কে জমি?

আমি আবার কে দেবে? জমি নিজেকে হাসিল করে নিতে হবে।

এই না বললে দিনকাল বড় খারাপ?

তা তো খারাপই। তা বলে মানুষ থাকবে তার জমি থাকবে না! পুরুষমানুষের যেমন একজন মেয়েমানুষ চাইই, তেমনি সব মানুষেরই জমিও চাই।

তারপর তোমাদের মতো মালিকের বাঁধা গোলাম হই আর কি! ওর মধ্যে বাজিকর যায় না।

তা যাবে কেন? খালি লোক ঠকিয়ে খাবে!

লক্ষ্মণের উম্মায় পীতেম হাসে। বলে, ঠিক করে বল তো পারগানা, জমি থেকে যে ফসল তোল কজন তা থেকে খাবলা মারে?

ওঃ, তার কি হিসাব আছে। যেমন ধর, জোতদার, গাঁতিদার, পত্তনিদার, ঘাটোয়াল, জমিদার, সাহেব, পুলিশ, দারোগা, ব্রাহ্মণ, আড়তদার, গোলাদার, মহাজন–

থাক্ থাক্‌, ওরে ব্বাপ—

আরো আছে, শুনবে?

না, আর দরকার নেই। তবুও তুমি বলবে জমিতেই স্থিতি, জমিতেই সুখ? ও তুমি বুঝবে না। তবুও তোমাকে বলে রাখি, যদি কখনো মন কর থিতু হবে, গেরস্থ হবে, পারগানা লক্ষ্মণ সোরেনের নাম মনে রেখো। এখান থেকে বিশ ক্রোশ দক্ষিণে, গ্রামের নাম বহেরা, থানার নাম দিঘি।

পীতেম জানবে না আজ জ্যৈষ্ঠ মাসের এই নক্ষত্রখচিত রাতে খোলা আকাশের নিচে লক্ষ্মণ সোরেন যে বীজ তার অভ্যন্তরে প্রোথিত করল, তার অধস্তন তৃতীয় এবং চতুর্থ পুরুষে সে পল্লবিত হয়ে অনেক সমস্যা, আশা, আকাঙ্ক্ষা এবং দুঃখের জন্ম দেবে।

সে অভিভূত বোধ করে এবং বলে, মনে রাখব, ভাই।

ভাই? তুমি আমাকে ভাই বললে?

ভাই বললাম।

বাজিকর ছাউনির দু-টি বিশেষ তাঁবুতে আজকের রাতটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সে দু-টি বিশেষ তবু জিল্লু ও পরতাপের। বাঘের থাবার ঘায়ে পরতাপ কিছু আহত ছিল, কিন্তু সে কারণে তার বউ তাকে খাতির করে না। সারাদিনে নানা কথা হয়েছে কিন্তু কোনো একান্ত কথার অবকাশ হয়নি। আর এখন যখন অবকাশ হল তখন কথার কোনো প্রয়োজনই নেই যেন।

শেষরাতে ঘুম ভাঙলে পরতাপ বউয়ের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে সন্তর্পণে মুক্ত করে বাইরে আসে এবং ডুমকা সেরেনের তাঁবুতে আসে। উড় সাহেবের ওষুধে ডুমকা আজ তিন রাত্তির পর ঘুমায়। তার পাহারাদার ছেলেটিও ঘুমে অচৈতন্য।

সেখান থেকে পরতাপ বেরিয়ে আসে এবং তখনই আবছা অন্ধকারের মধ্যে পেমাকে গঙ্গার দিক থেকে সে সন্তর্পণে ফিরে আসতে দেখে। তার কিছু সংশয় ও সন্দেহ হয়। কিন্তু এতদিন অনুপস্থিতির ফলে কিছুটা দূরত্ব ও সংকোচ সে বোধ করে। ফলে চট করে পেমাকে কিছু বলতেও পারে না, আবার তাকে দেখাও দেয় না।

ছাউনিতে ফিরে এসে পরতাপ তার বউকে জাগ্রত দেখে।

বউ বলে, এত রাতে কোথায় গিয়েছিলে?

পরতাপ বলে, রাত কোথায়? গিয়েছিলাম ডুমকাকে দেখতে।

সে আবার বউয়ের পাশে শুয়ে পড়ে এবং সামান্য সময় পরে বলে, প্রেমাকে দেখলাম গঙ্গার দিক থেকে আসতে।

প্রেমার সঙ্গে আনন্দর সম্পর্ক গভীর হয়েছে। বিষয়টা আর গোপন নেই। যেহেত এটা বাজিকর ছাউনির ঘটনা তাই যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা সবাইকেই কেন্দ্র করে। দলকে ও পীতেমকে যে এ নিয়ে ভাবতে হবে, একথা সবাই জানে, জানে পেমাও। গোষ্ঠীবদ্ধ থাকার সুবিধা এবং অসুবিধা এই। পেমা যখন সালমার কাছে ভাগ্য গণনা করতে গিয়েছিল, সালমা তখন বুঝতে চেষ্টা করে যে সে কতখানি বাজি ধরেছে। পেমা যে অচিরে তলিয়ে যাবে, এ সম্পর্কে তার সংশয় থাকে না। সে গম্ভীর হয়ে বলেছিল, তুই তো সর্বনাশ করে বসে আছিস।

সর্বনাশ কেন? আমার মনে লাগলে সে মানুষের কাছে যেতে পারব না কেন?

তা বলে দলের বাইরের মানুষ? সে তোকে কি দেবে?

কি দেবে? কিছু কি চাই আছি? আমি কি বেশ্যা?

তুই বেশ্যা না হলেও বাইরের মানুষ বাদিয়ার বেটিকে বেশ্যা হিসাবেই চায়।

চাক না। বেশ্যা কেন, আমাকে যদি সে একটা মাদি ঘোড়ার মতো চায়, তবে আমি তাই হব।

সালমা খুব আশ্চর্য হয়। এই মেয়েটা, সেদিনের মেয়েটা কবে এমন দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হল? তারপরে ভাবে এক পুরনো আক্ষেপ। বাজিকর কখনো জাত যাযাবর নয়। জাত যাযাবর হল বানজারা। বাজিকরের ঘর-গেরস্থালির সঙ্গে সম্পর্ক করার একটা প্রবণতা সবসময়েই থাকে। এসবই রক্তের দোষ।

তারপর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভঙ্গিতে সালমা জিজ্ঞেস করে, মানুষটা কে?

বলব না।

তবে আমার কাছে এসেছিস কেন?

আমার কি হবে?

সে তো তুইই বলে দিলি। তুই ঘোড়ি হবি।

পেমা রাগ করে উঠে যায়। লোকটা কে জানতে সালমা বা অন্য কারো দেরি হয়নি। দারোগা ভয়ানক ক্ষমতাশালী মানুষ। কাজেই পীতেমের কানে কথাটা ওঠার পরও সে অনেক চিন্তা করেও স্থির করতে পারে না কি করে এ সমস্যার সমাধান করবে। সমস্যাটা অন্য সবার মগজেও ঘুরপাক খায়। কিন্তু এই দু-তিন মাসের মধ্যে নানা ব্যস্ততায়, তাছাড়া দলের দুই ব্যক্তির নিরুদ্দেশ হওয়ার দলের কেউই বিশেষ করে এ নিয়ে ভাববার অবকাশ পায়নি।

এখন পরতাপ পেমার প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে তার বউ একটু সমস্যায় পড়ে। জৈষ্ঠের শেষরাত্রির অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক ঠাণ্ডা বাতাস শরীরকে আরাম দিচ্ছে। তাছাড়া এতদিন পরে যে মানুষটা ফিরে এল তার কথা কিছুই শোনা হয়নি। কাজেই এই মুহূর্তে সে এ প্রসঙ্গ তুলতে চাইল না।

সে বলল, হবে হয়ত আড়ালে গিয়েছিল। তারপর কথা ঘুরিয়ে বলল, তোমার কথা তো কিছুই শোনা হয়নি কাল। কি করে ছিলে এতদিন আমাকে ভুলে?

পরতাপ তাদের অজ্ঞাতবাসের কথা বলে, যার প্রথম পর্ব গতানুগতিক। মুর্শিদাবাদ যাওয়ার পথেই ডাকাত তাদের ধরে। তারা লুণ্ঠিত ও আহত হয়। টাকাকড়ি ও ঘোড়া দু-টি দস্যুরা নিয়ে যায়। মাথায় আঘাত পেয়ে জিল্লু অচৈতন্য হয়ে পড়ে। পরতাপ হাঁসুয়ার কোপ হাত দিয়ে ঠেকাতে গিয়ে জখম হয় এবং দৌড়ে জঙ্গলে পালিয়ে বাঁচে।

পরদিন সকালে শিকার থেকে ফেরত একদল সাঁওতাল তাদের ওই অবস্থায় দেখে তুলে নিয়ে যায় নিজেদের গ্রামে।

সেই গ্রাম ডুমকাদের। পাহাড়ের উপত্যকায় সবুজ সেই গ্রামে মানুষ খুব প্রাণবন্তু, জীবন খুব বেগবান।

তাহলে সেখানে ভালোই ছিলে? আমাদের কথা যখন মনেই পড়েনি!

খারাপ ছিলাম কি করে বলি? সমস্ত ব্যাপারটাই নতুন তো।

সবই নতুন। পরতাপ ওজিল্লু সেখানে অনেক কিছু শিখেছে যার সঙ্গে বাজিকরের কোনো সম্পর্ক নেই। সেখানে তারা ধান কেটেছে, ধান মেরেছে। বলদ দিয়ে সর্ষেকলাইয়ের খেত চষেছে। দেখেছে কেমন করে বীজ অঙ্কুরিত হয়ে মাঠ সবুজ হয়ে যায় এবং তাতে শরীরের ভিতরে কেমন খুশি শিহরণ জাগে। সন্ধ্যার পরে তারা অন্য সবাইয়ের সঙ্গে উদ্দাম হয়ে নাচ গান করেছে, নেশা করেছে পচানি ও তালের রসের। আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দল বেঁধে শিকার খেলা। শিকারের উত্তেজনার কাছে কোনো কিছুই লাগে না। এমনকি বাজিকরের জানোয়ার চুরি করাও নয়। ধাবমান জানোয়ারকে তীরবিদ্ধ করা, আক্রমণােদ্যত জন্তুকে সাহসের সঙ্গে ঘায়েল করা এক বিরাট অভিজ্ঞতা। এইসব কাজে মানুষ নিজেকে চিনতে পারে, বুঝতে পারে মানুষের জন্মের কারণ এবং জীবনের অর্থ।

আর কিছু? আর কিছু?

কি আর?

কোনো সঙ্গিনী জোটেনি? এদ্দিন থাকলে?

কেন? তুমি জুটিয়েছ নাকি এর মধ্যে?

জোটাইনি। তবে ভাবছিলাম।

কি ভাবছিলে?

ভাবছিলাম, জীবন কিভাবে কাটবে? ভাবছিলাম, কি নিয়ে থাকব?

তাহলে, আমি ছাড়াও চলে?

কি দেখলে এত ঘুরে এসে? আমি ছাড়াও তো তোমার চলেছে। কাছে থাকলে মানুষ একরকম থাকে, দূরে গেলে আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়, ভুলে যায়। তুমি দুনিয়া ঘুরে এসে একথা বুঝলে, আর আমি তো একা এখানে বসে সেই কথা শিখলাম।

খুব ভেবেছ এ কয়মাস, না?

ভেবেছি, খুবই ভেবেছি প্রথম প্রথম।

তারপরে?

তারপরে সব আবার পুরনো হয়ে যায়। তখন আবার নতুন করে ভাবনা শুরু হয়।

তুমি অনেক বদলে গেছ।

তুমিও কি সেই মানুষ আছ? তা যাকগে, তারপর তোমার কথা বল। শুধু ভাবতে অবাক লাগছে যে, এত দীর্ঘ দিন না তোমাদের আটকে রাখল, সে কোন জিনিস?

পরতাপ যা বলতে পারে না তার নাম জীবন। সমস্ত যাযাবরী চাঞ্চল্যেও একসময় ক্লান্তি আসে। একঘেয়ে লাগে। যাযাবর তখন নতুন রাস্তায় পা বাড়ায়। কিন্তু সব রাস্তাই প্রাচীন এবং প্রথম চমক কেটে গেলে যাযাবর বোঝে সেই একই জায়গায় সে দাঁড়িয়ে আছে।

জিল্লু ও পরতাপ সেই একঘেয়েমি থেকে কিছুদিনের জন্য নিষ্কৃতি পেয়েছিল। সেজন্যই এই বিস্মরণ। আর যেখানে ছিল সেখানে জীবন অঢেল। মানুষের সঙ্গে মানুষের হৃদ্যতা অটুট। এমন চমৎকার একাত্মবোধ তারা সারা দুনিয়ার আর কোথাও দেখেনি।

 

০৭.

প্রায় এক মাস পরে দুমকা সম্পূর্ণ সুস্থ হলে লক্ষ্মণ তাকে নিয়ে নিজের গ্রামে চলে গেল। যাওয়ার সময় পীতেমকে বলল, যদি নেমন্তন্ন পাঠাই, যেতে হবে কিন্তু।

পীতেম বলে, কথাটার মানে বুঝলাম না। যদি নেমন্তন্ন পাঠাই’ মানে কি? ‘যদি কেন?

এই একমাসে তাদের সম্পর্ক এমনই গভীর হয়েছে। প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ পীতেম লক্ষ্মণকে দিয়েছে একখানা অদ্ভুত আকৃতির হাঁসুয়া, যার হাতলটা ছোট কিন্তু ধাতব অংশটা চওড়া ও ভারি। ধারালো অস্ত্রটার এক কোপে একটা পশুর মাথা নামিয়ে দেওয়া যায়।

লক্ষ্মণ বলেছিল, ‘যদি’র মানে এই যে দিনকাল খারাপ। তারপরে একমাসের উপরে ঘরছাড়া। ওদিকের কি অবস্থা, কে জানে? তবুও কথা রইল, ডাক দিলে সাড়া দিও।

পীতেম বলেছিল, দেব।

তারপর রাজমহল শহরের উৎসবের মাস শেষ হলে লক্ষ্মণ সেরেনের নেমন্তন্ন এসেছিল। লক্ষ্মণ তাদের শহরায়ু উৎসবে যোগ দেবার জন্য পীতেমকে সদলে নেমন্তন্ন করেছিল।

বাজিকরেরা ইতিমধ্যে নিজেদের কিছু শ্রীবৃদ্ধি করেছিল। শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন এই তিন মাসে চাষি গৃহস্থের বড় দুঃসময় কাটে। এই সময় তাদের সঞ্চিত সম্পদ সব ব্যয় করতে হয়। কৃষকদের সঞ্চিত সম্পদ হল তার গৃহপালিত পশু। প্রথমে তারা এইসব পশু বেচে খায়, তারপর মহাজনের কাছে হাত পাতে।

কাজেই পশুর দাম এসময় একেবারে পড়ে যায়। বাজিকরেরা এবার অনেক পশু কিনেছে। পীতেমের দলে এখন ঘোড়াই আছে বারোটা, মোষ, শুয়োর, ভেড়া ইত্যাদিও অনেক। গরু ও বকরি তারা রাখে না, কারণ এই জানোয়ারগুলো তেমন কষ্টসহিষ্ণু নয় এবং রাস্তাঘাটের জীবনে অভ্যস্তও নয়।

পীতেমের জানোয়ারগুলো এখন রাজমহলের পাহাড়ের বর্ষার পরের অফুরন্ত সবুজ ঘাসে চরে ও স্বাস্থ্যবান হয়। স্বাস্থ্যবান জানোয়ারের মালিকানায় বাজিকরেরা বরাবরই খুব গর্বিত।

লক্ষ্মণের কাছ থেকে আমন্ত্রণ আসাতে পীতেম মনে মনে আনন্দ ও গর্ব বোধ করে। বাজিকরকে কেউ কোনোদিন নেমন্তন্ন করে না। তার সঙ্গে কুটুম্বিতা করার কথা কেউ ভাবে না। লক্ষ্মণ সেই মর্যাদা দিয়েছে তাদের, এ কি কম কথা?

কার্তিকের শেষে পীতেম, সালমা, পরতাপ, জিল্লু ইত্যাদি দশজন বাজিকর দশটি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বহেরা আসে।

রাস্তায় সাঁওতাল গ্রামগুলিতে ঢোকার মুখে তারা দেখল গাছের গায়ে গরুর চামড়া ও আড়াআড়ি একজোড়া বাঁশি টাঙানো। তারা দেখল মোড়ে মোড়ে পুঁতে রাখা ঝাণ্ডা, ঘণ্টা, ভাঙাকুলো।

গ্রামে ঢোকার আগেই বাধা পায় বাজিকরেরা। প্রথমত বিদেশি চেহারা, তার উপরে ঘোড়সওয়ার। পথ আটকায় সাঁওতাল মানুষ।

কে যায়?

আমরা বাজিকর।

কোথায় যাওয়া হবে?

যাব দিঘি থানার বহেরা গ্রামে।

সেখানে কি দরকার?

সেখানে পারগানা লক্ষ্মণ সোরেন আমাদের বন্ধু লোক, শহরায় নেমন্তন্ন আছে।

রাস্তা ছেড়ে দেয় মানুষ। পীর্তেমের দল অগ্রসর হয়। মাঠে মাঠে পাকা ধান এ শাটার অপেক্ষায়। বাসে তার সুঘ্রাণ। পাখপাখালি সারা মাঠে উল্লাস জুড়েছে। পরিচ্ছন্ন সাঁওতাল গ্রামগুলোতে শহরায়-এর উৎসব শুরু হয়ে গেছে। পাওমের ভারি ভালো লাগে।

সন্ধ্যা হয়ে গেলে কোনো গ্রামে তারা রাত্তিরের মতো আশ্রয় নেয়। গ্রামের সর্দারেরা পীতমের কথা জানে। হয়ত লক্ষ্মণের ব্যবস্থাই এই রকম।

কে যায়?

আমি পীতেম বাজিকর।

কোন পীতেম? পারগানা লক্ষ্মণ সেরেনের বন্ধু বটে?

তাই বটে।

বসো হে কুটুম। আজ রাতে এখানেই কুটুম কর, বিশ্রাম কর, খাও দাও, নাচ গান দেখো।

এরকম একটি নাচ-গানের আসরে পীতেমরা একটি অদ্ভুত গান শোনে। গানটি বড় বিষাদের। গানটিতে স্ত্রী তার স্বামীর উদ্দেশে বলছে।

বাবারা আর ভাইয়েরা শুয়োর বলি দিচ্ছে, সাদা মোরগ বলি দিচ্ছে, সব জামাইরা হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করছে, পানভোজনের আনন্দ উপভোগ করছে। হায়রে, হায়রে, একজন মানুষ শুধু ভকত দয়ারামকে পিঠের উপরে বয়ে বেড়াচ্ছে।

চকিতে বাজিকরদের সেই দৃশ্যটির কথা মনে পড়ে, যখন দয়ারাম ভকত মোষ কিনতে এসেছিল। সেই মানুষটির কথা মনে পড়ে, যার ঘাড়ে পা রেখে দয়ারাম ঘোড়র উপরে আড় হয়ে বসে।

বহেরা গ্রামে বাজিকরেরা পৌঁছালে, লক্ষ্মণ সোরেন সপরিবারে পীতেমের দলকে প্রত্যুদগমন করে। এমন রাজকীয় অভ্যর্থনা বাজিকরেরা কোনদিন পায়নি। সমস্ত ঘরবাড়ি নিপুণ করে নিকোনো, ঝকঝকে পরিষ্কার উঠোন। প্রবীণরা এসে সম্মান জানায় পীতেম, সালমা ইত্যাদি প্রবীণদের। পরতাপ এবং জিল্লু পুরনো সঙ্গীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে কলরব করে।

সন্ধ্যার পর লক্ষ্মণ সোরেন, তার স্ত্রী পীথা মুর্মু এবং অন্যান্য প্রবীণদের সঙ্গে পীতেম সালমা বসে শহরায় উৎসবের কথা শোনে। নিয়মমতো, কার্তিক মাসের অমাবস্যাতে শহরায় পূজা হয়। কিন্তু এখন আর সব নিয়ম ঠিকমতো মানা যাচ্ছে না। সাঁওতালরা মহাজন, মালিকের শোষণে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। ফলে ধান ওঠার আগে উৎসবের কথা কেউ ভাবতে পারে না। এখন তাই অঘ্রান মাসেই উৎসব হয়। উপায় কি? শহরায়ে যে ঠাকুর-ঠাকুরানের পূজা হয় তাঁরা শস্য ও পালিত পশুর শ্রীবৃদ্ধি করেন, নিরাপদে রাখেন। গোয়ালঘরে মারাংবুরু এবং ঠাকরানের পূজা হয়-আতপ চাল, মেথির গুঁড়া, তেল-সিঁদুর দিয়ে গোলাকার “খড়” সাজানো হয়। বলি দেওয়া হয় মোষ, শূকর, মোরগা। মোষ বলির চিন্তা এখন আর কেউ করে না, তবে শুয়োর ও কাটোল মুরগি বলি হয়। মানুষ প্রচুর নেশা করে। নাচ-গান চলে কয়েক দিন ধরে।

এবার যেসব নতুন গান বাঁধা হয়েছে, তার অধিকাংশই মানুষের দুঃখকে নিয়ে। একটি গানে বলেছে—

রাজমহল পাহাড়ে,
গাড়ি চলে লহরে,
চার হালের মোষ বেচে
হায়রে, হায়রে,
মরদ গেল শহরে।
হায়রে, হায়রে,–
গোমানীর জল গেল শুকিয়ে।

অথবা,

পারগানার কাছে নালিশ জানালাম,
পারগানা চুপ করে থাকে।
আমার বিচার করে দারোগা,
আমার বিচার করে মহাজন,
আমার বিচার করে
ঘোষা নালার ঘাটোয়াল।
পারগানা চুপ করে থাকে।

অথবা,

পারগানার কাছে আর্জি জানালাম,
হায়রে, হায়রে, মিছাপুর মেলায়,
কেনারাম দারোগা পেয়াদার জন্য
হায়রে, হায়রে! মিছাপুর মেলায়!
নির্দয় দারোগা, ধূর্ত পেয়াদা,
মনে প্রাণে সুখ নেই,
দারোগা ঘোড়ার উপর টাপটাপ যায়—
কোমরে পেতলের বেল্ট,
উজ্জ্বল পোশাক
আমার সুখ নেই।

পারগানা লক্ষ্মণ সোরেন এসব গান শুনে বিষণ্ণ হয়ে যায়। পীতেম তার পাত্রে মদ ঢেলে দেয়। লক্ষ্মণ ম্লান হেসে পানপাত্ৰ-মুখে তোলে। এক ঢোক খেয়ে, তারপর বলে, আমি কি করব বল? আমি এখনো বুঝতে পারছি না, আমার কি করবার আছে।

কথাবার্তা হয় আঞ্চলিক বাংলায়, বাজিকরেরা যে ভাষাটা ভালোই আয়ত্ত করেছে। গানগুলোর অর্থ বুঝিয়ে দিচ্ছে জিল্লু, যে আগেকার ছ-মাসে এদের ভাষাটা মোটামুটি ভালোই শিখেছে। বাজিকর অন্যদের ভাষা চট করে ধরে নিতে পারে। কিছু কিছু গান আবার বাংলাতে হয়, কিছু বাংলা ও সাঁওতালি মিশ্র ভাষায় হয়।

পরতাপ ও জিন্ধু সাঁওতাল যুবক-যুবতীর নাচের তালে তালে চমৎকার পা মেলাতে শিখেছে। এতে উভয় পক্ষই প্রচুর কৌতুক বোধ করে। ডুমকার মা পীথা একসময় সালমাকেও টেনে নামায়। বাজিকরদের কিছু নিজস্ব নাচও আছে। সালমা মাথায় রুমাল বেঁধে দলের আরো পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে হাততালি ও গান সহকারে নাচে। পীতেম জিল্লুর কাছ থেকে ঢোলক টেনে নিয়ে বোল তোলে।

প্রচুর উচ্ছ্বাস ও কোলাহল হয়। প্রবীণেরা পুনরুজ্জীবিত বোধ করে। দিন কেটে যায় অত্যন্ত দ্রুত। উৎসব তারপর স্তিমিত হয়ে আসে।

নতুন উৎসব শুরু হয় তারপরে। সে উৎসব ফসল কাটার। মানুষের পরিশ্রম যেন পরিশ্রমই নয়। সারাদিন মাঠের পর মাঠ ধান কাটা ও সেগুলো ঘরে বসে আনা। অফুরন্ত উৎসাহ। পীতেম অবাক হয়ে দেখে, জিল্লু ও পরতাপ এ কাজেও বেশ ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, এই নিতান্ত গেরস্থালি কাজটাতে তারা সমান উৎসাহ বোধ করছে।

তারপর বাজিকরেরা একদিন দেখতে পেল কাটা ধানের খেতের ভেতরের আল কেটে কেটে গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি ঢুকছে সার বেঁধে। গাড়িগুলো এ গ্রাম সে গ্রামে ঢুকে যাচ্ছে। বহেরাতে দশখানা গাড়ি এ গ্রাম সে গ্রামে ঢুকে যাচ্ছে। বহেরাতে দশখানা গাড়ি এল এক দিনেই।

পীতেম একসময় লক্ষ্মণকে জিজ্ঞেস করে, এসব ফসল তোমাদের নয়?

আমাদেরই, আবার আমাদেরও নয়ও।

কেমন?

মানুষ সব বাঁধা হয়ে আছে ধারে দেয়। এখন সেসব উশুল হবে। দেখছ, মহাজনরা সব এসে হাজির হয়েছে?

এরা সব মহাজন?

হ্যাঁ। ঐ যে কুঁজো মতো লোকটাকে দেখছ, ও হল পতিত সাউ। দশ বছর আগে বর্ধমান না কোথা থেকে যেন আসে এখানে। হাটে তামাক পাতার দোকান নিয়ে বসত। পাঁচ টাকার মালও রাখতে পারত না, এমন দুঃস্থ ছিল। এখন লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক।

কি করে হল?

সাঁওতালের রক্ত নিঙড়ে হল। বেশিদিনের কথা নয় সর্দার, এইসব জমি, যতদূর তোমার চোখ যায়, এইসব জমি’ আমরা জঙ্গল কেটে পাথর চটিয়ে খালাস করেছি। তখন কোনো ভাগীদার ছিল না। তারপরে পাকুড়ের রাজারা বেশি খাজনা পাবার আশায় সব জমি পত্তনি দিয়ে দেয়। পত্তনি গ্রাম গ্রাম ঘুরে আওয়াজ তোলে, যে চাষা টাকায় সিকি খাজনা এখন বেশি না দেবে তার সঙ্গে আর নতুন করে বন্দোবস্ত হবে না। তারপরে জরিপের জন্য যে রশি ফেলে তার মাপ পরিমাণ তারাই বোঝে, কি তারাও বোঝে না। এইভাবে পত্তনিদার আবার দরপত্তনিদার, ছে-পত্তনিদার, ইজারাদার, ছে-ইজারাদার নিয়োগ করে। সর্দার, চোখ বন্ধ করলে মানুষ নায়েব, গোমস্তা, তশিলদার, পাইক, চৌকিদার, দারোগা এসব চোখের সামনে দেখে। সবাই খালি হাত পেতে আছে। না দিলেই হুজ্জত। না দিলেই তোমার সর্বনাশ। অথচ আগে এমন ছিল না। আমার খাটনির ভাত আমিই খেতাম, আর কেউ নয়। এখন আমার খাটনির ভাত, আমি ছাড়া আর সবাই খায়!

পারগানা, তুমি এত বোঝ! আর রাজমহলের মানুষ বলে সাঁওতাল হল জংলি জাত, বোধভাষ্য নেই।

হাঁ, তারা এমন ভাবে বটে। পাঁচ শলি ধান মহাজনের কাছ থেকে সাঁওতাল ধার নিলে দেড় বছরে কত ফেরত দিতে হয় জান?

কত?

হিসাব করতে জান তুমি?

জানি।

তবে দুনা হিসাবে হিসাব কর।

দশ শলি।

হল না।

তবে?

দেড় বছরে—ধর, প্রথম সনে ধান দেওয়া গেল—হয় ফসল হয়নি বা অন্য কোনো কারণ। সুতরাং তার পরের বছর।

বিশ শলি?

হল না।

হিসাবে তো তাই হচ্ছে।

সর্দার হিসাবটা কার, সেটা দেখতে হবে।

কার হিসাব?

হিসাব পতিত সাউয়ের, হিসাব দয়ারাম ভকতের, হিসাব গোরাচাঁদ সেনের।

হিসাব তো একই হয়, হিসাব আবার আলাদা হয় নাকি?

হয় না? পতিত সাউয়ের হিসাবে এই বিশ শলি ধান তুমি আলাদা নিয়ে ওজন কর,!! 1. চল্লিশ শলি হবে। আবার অন্য দু-জনার ওজন করা ধান নিয়ে আলাদা ওজন কর, যা বলবে তার দেড় তো হবেই।

মানুষ দেয়।

সাঁওতাল দেয়।

বুঝে দেয়, না, না, না বুঝে দেয়?

বুঝেও দেয়, না বুঝেও দেয়।

কেন দেয়?

হায়রে সর্দার! আশপাশের দশটা গ্রামের পারগানা আমি। নিয়ম করে দিয়েছি, ধান উঠলে পরে শহরায় উৎসব হবে, কার্তিক মাসের অমাবস্যায় হবে না। কারণ কি?

কি?

পাঁচ টাকা বেনিয়ার কাছ থেকে কর্জ নিয়ে সারা জীবন বেগার দিয়েছে আমার এলাকার মঙ্গল মুর্মু, সেই দেনা এখনো শোধ হয়নি। দয়ারাম ভকতের ঘরে তার বেটা সুফল এখনো বাঁধা চাকর হয়ে আছে। সাঁওতাল কর্জ নিলে তা আর বংশসুদ্ধ মরে হেজে না গেলে, শোধ হয় না।

এসব কথাবার্তা হচ্ছিল লক্ষ্মণের বাড়ির উঠোনে বসে। তিন পাশে ধানের মরাই উঠেছে উঁচু হয়ে লক্ষ্মণের ছেলেরা এবং অন্য কয়েকজন পাটার উপর ধান মাড়াই করছে। একপাশে পীথা ও অন্য কয়েকজন রমণী কুলো দিয়ে বাতাস কেটে মরা ধান পরিষ্কার করছে। লক্ষ্মণের বাড়ির মুরগি ও শুয়োরগুলো সুযোগ পেলেই ধানে মুখ দিচ্ছে। বহেরায় লক্ষ্মণই একমাত্র ব্যক্তি যার কোনো ঋণ নেই। পীতেম এইসব গেরস্থালি কাজকর্ম নজর করে দেখছে ও লক্ষ্মণের কথা শুনছে।

এমন সময় গ্রামের অন্যপ্রান্তে একটা হৈ-চৈ শোনা যায়। উত্তেজিত গলা মানুষের। সবার উপরে একটা তীক্ষ্ণ চেরা গলার তর্জনগর্জন। লক্ষ্মণ উত্তর্ণ হয়ে শুনল। গণ্ডগোল ক্রমাগত বেড়ে চলায় তাকে উঠতে হল। পীতেমও তার সঙ্গে

একটা অপ্রশস্ত উঠোনে ধান মাপা হচ্ছে। গণ্ডগোল সেখানে। চেতন মাঝির বাড়ি সেটি। এখন উত্তেজনা অপেক্ষাকৃত শান্ত। কিন্তু লক্ষ্মণের সঙ্গে পীতেম সেখানে উপস্থিত হয়েই বোঝে, একটা চাপা ত্রস্ত ভাব স্থানীয়দের মধ্যে রয়েছে। একপাশে একটা খাটিয়ায় জিল্লু শুয়ে আছে, তার মাথায় ও গালে রক্ত। কয়েকজন সাঁওতাল যুবক তাকে নানাভাবে শুশ্রুষা করবার চেষ্টা করছে।

জিল্লুকে ঐ অবস্থায় দেখে পীতেম ও লক্ষ্মণ দুজনেই তার কাছে দৌড়ে আসে।

কি করে হল এসব?

পীতেম সমস্ত উঠানটা খুঁটিয়ে দেখে একপাশে আড়াআড়ি জোড়া বাঁশে ঝোলানো দাঁড়িপাল্লা। ওজন করার সিঁদুরের দাগ দেওয়া পাথর। লক্ষ্মণের পরিচিতি মতো পতিত সাউ দু-হাতে লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়ানো। তার সামনে ছ-জন লাঠিধারা। একজন বৃদ্ধ, সম্ভবত চেতন মাঝি, উবু হয়ে বসে। তার দুই হাঁটুর ভিতরে মাথা, দুইকানের উপর হাত।

পীতেমকে দেখে পতিত সাউ হুংকার দিয়ে ওঠে, পারগানা, এ ছোকরা কে?

লক্ষ্মণ সে কথার উত্তর দেয় না? জিল্লুর পাশে বসা ডুমকাকে সে জিজ্ঞেস করে, কি করে হল, এসব?

জিল্লু ওজনের কারচুপি ধরেছিল।

পতিত তার কথার উত্তর না পাওয়াতে সম্ভবত অপমান বোধ করে। সে এগিয়ে এসে বলে, আমি জানতে চাই এ ছোকরা কে, আর কেন আমার কাজে বাধা দেয়?

লক্ষ্মণ শান্ত অথচ গম্ভীরস্বরে বলে, এরা আমার অতিথি। তোমার নোক এদের গায়ে হাত দিয়ে ঠিক করেনি।

আরে যা যা, শালা জংলি সাঁওতাল। তোর কাছে জিজ্ঞেস করে তবে আমি কাজ করব?

জবাব সামলে রাখ, বাবু। গতবার তোমাকে বলেছিলাম সরকারি বাটখারা নিয়ে এসে ধান ওজন করবে, অথচ এবারও তুমি এই পাথরগুলো নিয়ে এসেছ।

এই পাথরগুলো আমার লক্ষ্মী, এ পাথর দিয়েই আমি ওজন করব। যার পোষাবে সে আমার সঙ্গে কারবার করবে, যার পোষাবে না, করবে না। এই, তোল, তোল ধান তোল—

থামো, কথা আমার শেষ হয়নি। এ পাথর তোমার লক্ষ্মী, আমরা জানি, কিন্তু ও পাথর সাঁওতালের দুশমন। আমার ঘরে পাঁচসেরি সরকারি বাটখারা আছে। এবার তোমাকে সেই বাটখারা দিয়ে ধান মেপে নিতে হবে। কি, রাজি?

পতিত সাউয়ের কণ্ঠস্বর নিমেষে চাপা তর্জনে নেমে আসে। সে কেটে কেটে বলে, লক্ষ্মণ সোরেন, এবার তোর মরণের পাখা গজিয়েছে। নিজের ভালো চাস তো আমার কাজে বাধা দিতে আসিস না।

এই শেষ কথার পর ডুমকা ঝট করে উঠে দাঁড়াল। লক্ষ্মণ হাত তুলে তাকে নিষেধ করে। লক্ষ্মণ পতিত সাউয়ের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। পতিত হঠাৎ যেন নিজের দুর্বলতা দেখে লজ্জা পায় এবং ওজনদারকে ধমক দিয়ে ওঠে, এই শালা, ধান তোল, ধান তোল।

খবরদার!

লক্ষ্মণ এবার প্রচণ্ড ধমকে সমস্ত চাঞ্চল্য স্তব্ধ করে দেয়। তার পিছনে গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছে। পতিত সাউ যেন উত্তেজিত শ্বাস-প্রশ্বাসও শুনতে পায়।

সে বলে, আচ্ছা, আমিও দেখব। এই চল সব।

দলবল নিয়ে সে ক্রুদ্ধ পশুর মতো ফিরে যায়। লক্ষ্মণ তারপর কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর একজন বয়স্ক মাঝিকে বলে, হাড়মা, সব মহাজনকে জানিয়ে দে এবার সরকারি বাটখারায় ধান মেপে নিতে হবে। আমার বাড়িতে লোহার বাটখারা আছে। তাতে রাজি না হলে, তারা এবার ধান নিতে পারবে না।

 

জিল্লুর আঘাত গুরুতর নয়। কানের পাশে একটা জায়গা লাঠির ঘায়ে থেঁতলে গেছে খানিকটা। ফেরার পথে পীতেমকে লক্ষ্মণ বলে, সর্দার, তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই আমার।

পীতেম বলে, ক্ষমা বরং আমিই চাইব, পারগানা। আমার লোকই তো এসব ঝামেলা বাধালো।

না, তা নয়, তা নয়। এ ঝামেলা বাধতই। কতদিন মানুষ সহ্য করে? তোমাদের ছেলে উপলক্ষ মাত্র। হয়ত, এ ভালোই হল। একটা মুখ দরকার ছিল বাঁধা ভাঙার। জিল্লু সেই মুখটা খুলে দিয়েছে। তবুও তোমার অপমান হল, এই আমার লজ্জা।

এ ঘটনার পর লক্ষ্মণ অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর হয়ে গেল। পীতেম লক্ষ করল, কয়েকজন যুবককে কি কি নির্দেশ দিয়ে সে বিভিন্ন গ্রামে খবর দিতে পাঠালো। একটা অস্বস্তিকর স্তব্ধতা।

তৃতীয় দিনে পীতেম বলল, আমরা এবার ফিরে যাব, পারগানা, অনুমতি কর।

লক্ষ্মণ বলে, বুদ্ধিমান লোক তুমি, তাই আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেছ, নয়?

কেমন?

ঢাকাঢাকির কোনো ব্যাপার নেই সর্দার। তোমার এখন যাওয়াই আমি চাচ্ছিলাম। বড় মুখ করে ডেকে এনে বিপদে ফেললাম তোমাকে। তোমার এখন যাওয়াই ভালো। পতিত সাউ, গোরাচাঁদ এরা আমাকে ছেড়ে দেবে না। পুলিশদারোগা এদের জাতভাই। তারা আসবে।

হুজ্জতি হবে?

হবে।

ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পীতেম বিদায় নেয়। কিন্তু গ্রাম আড়াল হতেই জিল্লুকে সে শাসন করে। কি দরকার ছিল তোর পারের বেপারে নাক গলানোর!

জিল্লু অবাক হয়, বাঃ, বোকা গেয়ে লোকগুলোকে ঠকাচ্ছে, দশ সেরকে পাঁচ সের বানাচ্ছে, কিছু বলব না।

না, বলবি না। আমরা হলাম বাজিকর। গেরস্থের হাল-হকিকতের আমরা কি বুঝি! আমাদের তো রাস্তাতেই থাকতে হবে।

 

০৮.

রাজমহলে ফিরে এসে পীতেম সংবাদ পায় পেমা পালিয়ে গেছে। ধন্দু জানায় পেমাকে আনন্দরাম শহরের মধ্যে একটা কোঠা বাড়িতে রেখেছে। বাইরের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। ধন্দু জানেও না পেমা সেখানে স্বেচ্ছায় আছে, না, জবরদস্তি আছে। তবে দরজায় পাহারা আছে চব্বিশ ঘণ্টাই।

বেপরোয়া পরতাপ এ খবরে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়। সে প্রকাশ্যেই বলতে থাকে যে দু-জনকেই খুন করবে। পীতেম ধমক দিয়ে তাকে থামাতে পরতাপ বউয়ের উপরে গিয়ে তন্বি করে। তুইই আমাকে মিথ্যা বলেছিলি। সেদিন আমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম।

সালমা পীতেমকে বলে, তাদের বাজিকরদের হালচালই এইরকম। সব সময় গেরস্থ মানুষের পানে নোলা বাড়ানো স্বভাব। পেমার দোষ দিয়ে লাভ কি? এ তো জাতের দোষ! দেখে আসলি না, কেমন সুখের কপাল গেরস্থ মানুষের!

তারপর অবশ্য সালমাই পেমার সঙ্গে দেখা করে আসে। পাহারাদারকে কথায় ভোলাতে তার সময় লাগে না বেশি।

পেমার সামনে এসে প্রথমে কথা বলে না সালমা। পেমা বলেছিল, আনন্দ যদি চায় আমি ঘোড়ি হই, তো আমি ঘোড়ি হব। সালমা দেখতে চায় পেমার সে তেজ এখনো আছে কিনা দেখে আশ্চর্য হয় যে সে তেমনি আছে।

পেমা হেসে বলে, খুব অবাক হচ্ছ পিসি?

সালমা তুচ্ছার্থক ধ্বনি করে। বলে, অবাক হব কেন? বাজিকরের জাতটাই তো এমন, যে-কোনো ছুতোয় বাঁধা পড়তে চায়। কি সুখে আছিস এখানে?

কেন? দুঃখ কিসের আমার? চব্বিশ ঘণ্টার জন্য দু-জন মানুষ আমার সেবা করে। এই দেখ শাড়ি, এই দেখ কত গয়না।

আনন্দ পয়সা পায় কোথা এত?

জমিজমা আছে, মহাজনি কারবার আছে। দারোগা তো সেসব দেখাশুনা করে না, আনন্দই দেখে।

তবে ভালোই আছিস?

হ্যাঁ।

দারোগা কিছু বলে না?

বলবে কি? তার তো নিজের তিনজন মেয়েমানুষ আছে।

সালমা পেমার সর্বাঙ্গে তাকিয়ে তার অধঃপতন দেখে। শেষে একটু আতঙ্কিত হয়। বলে, তোর পেটে বাচ্চা এসেছে, মনে হয়?

পেমা সংকোচ বোধ করে না। বেহায়ার মতো হাসে। বলে, হ্যাঁ, এসেছে তোত।

এখন দাম্ভিক পেমা। অথবা, এখনো দাম্ভিক পেমা। যা সালমা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, তা এখন পেমা দেখতে পাচ্ছে না। দেখিয়ে দিলেও দেখবে না হঠাৎ সালমার মায়া হয়, যা তার কদাচিৎ হয়। সে বলে, আনন্দ জানে?

না। আরে সেটাই তো মজা! হেসে গড়িয়ে পড়ে পেমা। যেন ভারি মজার ব্যাপার সে লুকিয়ে একা উপভোগ করছে।

জানলে তোকে রাখবে?

রাখবে না? আমাকে ছাড়া একদিন বাঁচবে না আনন্দ।

তোকে বলেছে?

বলবে কেন? আমি বুঝতে পারি না?

আনন্দর ঘরে বউ আছে না?

থাকল, তাতে আমার কি?

সালমা বোঝে পেমার দম্ভ এখন যে স্তরে আছে, সেখানে আঘাত করলেও ফল হবে না। বস্তুত, বাজিকর মেয়েদের সতীত্বের তেমন বড়াই নেই। কেউ ভ্রষ্টা হলে, দল কিছু শাস্তি অবশ্যই বিধান করে, কিন্তু সে গেরস্থ সমাজের মতো নয়। কিন্তু যাযাবর রমণীরা বেশ্যা হতে কখনোই চায় না। সালমা সে কথাটাই বলে।

আনন্দ তোকে বেশ্যা বানিয়ে রেখেছে।

পিসি!

তবে কি সে তোকে ঘরের বউ করবে?

আনন্দ আমাকে ভালোবাসে।

ভালোবাসা? বাজিকরের বেটিকে গেরস্থ মানুষ ভালোবাসলে তাকে বাজিকর হতে হয়। আনন্দ তোকে রাখনি করেছে। নেশা কেটে গেলে লাথি মেরে তাড়িয়ে দেবে।

কখনো নয়।

নির্বোধ এই অল্প বয়সের মেয়েটার জন্য সামলার করুণা হয়। শেষবারের মতো বলে, দল এখান থেকে চলে যাবে ঠিক করেছে, তুই কি করবি?

আমি যাব না, আমি যাব না!

বেশ।

সালমা চলে আসে এবং গীতেমের কাছে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে। পীতেম দুঃখ পায়, কিন্তু এ অবস্থায় কি করণীয় তা স্থির করতে পারে না। সালমার কাছে বুদ্ধি চায় সে।

সালমা বলে, এখান থেকে উঠে চল।

পীতেম বলে, এত তাড়াতাড়ি? এখানে রোজগার ভালো হচ্ছিল।

তবে আর কি? থাক। এরপরে মানুষ মেয়েলোকের জন্য ছাউনিতে হামলে পড়বে। তখন কি করে সামলাবি?

এসব শুধু কথার কথা। বাজিকর ভাবে না। ছাউনিতে লোভী পুরুষ হামলে পড়লে ছুরি ঝলসে উঠতে পারে। আবার কোনো ব্যভিচারিণী নিজেই তার প্রেমাস্পদকে ছাউনিতে নিয়ে আসতে পারে। পুরুষেরা এসব দেখেও না দেখার ভান করতে পারে। দলের অন্য কেউ কিংবা বাপ মা-ও না দেখে থাকতে পারে কিন্তু ভাইরা প্রায়শ গণ্ডগোল করে। বিষয়টি বিচিত্র বটে।

কিন্তু পেমার উপাখ্যানে অভিনবত্ব আছে। দলছাড়া যাযাবর মেয়েপুরুষ নিজেকে সম্পূর্ণ অসহায় দেখে। দলত্যাগ করার কথা স্বপ্নেও কেউ ভাবে না। কিন্তু পেমা কি করে এর ব্যতিক্রম হল? পীতেম নিজের ভিতরেই এ প্রশ্নের উত্তর পেতে চায়। গভীর চিন্তা করেও সে কোনোরকম সুরাহা করতে পারে না এ সমস্যার। শেষে নিজেকে একসময় তার অত্যন্ত বৃদ্ধ ও অসমর্থ বোধ হয়। সে তখন সালমার কাছে আশ্রয় খোঁজে।

কিন্তু আশ্চর্য, এতেও সে পুরনো জায়গায় ফিরে আসে না। একসময় সালমা তার দেহের সান্নিধ্যে তাকে স্বস্তি ও উদ্যম দিতে পারত। এখন বয়স তার প্রয়োজনকে কমিয়ে দিয়েছে, কাজেই সে কিছুই ভুলে যেতে পারছে না। ফলে, সে চায় স্থিতি যার অন্য নাম অর্থোপার্জন।

 

০৯.

বাংলাদেশের বর্ষাকালের ভয়াবহতা সম্বন্ধে বাজিকরদের কোনো ধারণা ছিল না। যারা তাঁবুর নিচে থাকে, বর্ষা সব জায়গাতেই তাদের কাছে আতঙ্কের। গোরখপুরে মাটির ঘরে বর্ষার কয়েকটা মাস ছিল আপাত স্বস্তির। কিন্তু গোরখপুর থেকে চিরকালের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে আর একটি অনুরূপ বন্দোবস্তের কথা বাজিকর ভাবছিল প্রথম থেকেই। তারা চেয়েছিল এমন একটি জায়গা যেখানে সারা বছর ঘুরে বেড়াবার পর বর্ষার সময়টা অন্তত এসে বিশ্রাম মিলতে পারে। রাজমহলে এসে পীতেমের আশা হয়েছিল এখানে সেরকম একটা বন্দোবস্ত হতে পারে। চারপাশের জমি এখনো খালাস হচ্ছে, নতুন নতুন মানুষ বসতি করছে। যারা বন্দোবস্ত নিচ্ছে তারা প্রায় সবাই চাষি। জমি বন্দোবস্ত নিয়ে তারা জঙ্গল কেটে, জমি সমতল করে চাষের খেত বানাচ্ছে। কিন্তু বাজিকর তো আবাদ করে না, তাকে কে জমি দেবে?

তবুও এমন লোকও পাওয়া যায়। ঈশ্বরপুরের জমিদারির কিছু খাস ছিল রাজমহল পাহাড়ের গায়ে। জঙ্গলাকীর্ণ জমি। জমিদারের নায়েব শ্যামলাল মিশ্র এইসব জমির পাট্টা বিলি করতে শুরু করল রাজমহলের কুন্‌ঠিতে বসে। একেবারে নগদ কারবার। টাকা ফেলে চাষিরা পাট্টা নিয়ে নিচ্ছে।

খোঁজ পেয়ে পীতেও গিয়েছিল। আগের দু-একবারের অভিজ্ঞতার সঙ্গে এবারে কিছু তফাত ছিল। আগে দু-বার পীতেম এ ধরনের পাট্টা বিলিতে জমি নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সফল হয়নি। জমিদারের লোক জমি দিতে রাজি হয়নি। বাজিকর ঘুরে বেড়ানো জাত, তার কাছ থেকে খাজনা পাওয়ার কোনো স্থিরতা নেই।

কিন্তু শ্যামলাল মিশ্র এসব প্রশ্ন তুললই না। তার সম্পর্ক টাকার সঙ্গে কাছারিতে সারাদিন মানুষের আনাগোনা। পত্তনিদার, দালাল, মোসায়েব, গোমস্তা সবরকমের মানুষ জমিপ্রার্থী চাষির সঙ্গে চোটপাট করছে, পয়সা নিচ্ছে।

পয়সা খরচ করে পীতেম পাঁচ বিঘা জমির পত্তনি পেল। শীতেম এবার পেল, কেননা, ঈশ্বরপুরের জমি নিলামের ডাকের মতো ডাক উঠিয়ে তবে বন্দোবস্ত

তারপর পত্তনি জমির দখল দেওয়ার পালায় কাছারির গোমস্তারা তাদের কেরামতি দেখায়। এসব মাপজোখ ভালো ভালো চাষিরাই বোঝে না, বাজিকরের তা প্রশ্নই নেই। জমি মাপার রশির কোনো স্থিরতা নেই। আর থাকলেই বা কি, না থাকলেই বা কি। কাজেই হামেশা ষোল-সতেরো কাঠায় বিঘার প্রমাণ হয়। দশ বিঘার পত্তনি রশির মাপে বারো বিঘা দাঁড়িয়ে যায়।

পরতাপের এসব কাজে উৎসাহ বেশি। বহেরা গ্রামের কয়েক মাসের জীবনে (সে কি পেয়েছে কে জানে! গোমস্তা সীমানা নির্ধারণ করে দিলে জমির চৌহদ্দিতে পাপ গর্ত করে পাথর বসায়। সেই পাথর ধারালো অস্ত্রে খোদাই করে চিহ্ন রাখে।

পীতেম কিছুটা স্বস্তি বোধ করে। সালমা ঠাট্টা করলেও সে হাসে। বলে, বর্ষার সময় তাঁবুর নীচ দিয়ে যখন নদী বইবে, তখন বুঝবি।

বর্ষা আসার এখনো সাত-আট মাস দেরি। কাজেই পত্তনি জমিতে ধীরেসুস্থে তোলা যাবে। এরকম ভাবে পীতেম।

অন্যান্য বাজিকরদের মধ্যেও পরিবর্তনের ঢেউ আসে। পীতেম জানে না, গোপনে তার দলের অনেকেই ছোটখাটো মহাজনি কারবার শুরু করেছে। আশেপাশের গ্রামের গরিব মানুষ, বিশেষত সাঁওতাল চাষি গেরস্থ ছাউনিতে আসছিল, নানা ধরনের দাদন নিচ্ছিল। এক পীতেম যেদিন জানতে পারল সেদিন সে খুব হেসেছিল। বলেছিল, বা, বাহারে রহু! কি তোর কণ্ঠার হাড়ের কিসমৎ!—আসলে এভাবে সে জিনিসটা সমর্থনই করছিল। আর এইভাবে নিজের ভিতরে সে দ্বিতীয় আর একটি সত্তাকে ক্রমশ স্পষ্ট করে চিনছিল, যে মানুষটা সঞ্চয় চায়, স্থিতি চায়, মর্যাদা চায় এবং সালমার “চল বেরিয়ে পড়ি” কথাতে খুবই অবসন্ন বোধ করে।

বাজারের পাশের ময়দানে ধান ওঠার পরে কালীপুজো হয়। বিশাল কালীমূর্তি। আগে মূর্তি বানানো হয়, তারপর তার মণ্ডপ। সেই উপলক্ষ্যে মেলা।

তখন রাজমহল পাহাড়ের উপর শীত জাঁকিয়ে নামে। পীতেমও তখন তার সবের আয়োজন করে। মাঠের একটা দিক বেশ ভালো করে ঘিরে ফেলা হয়। সন্ধ্যার পর সেখানে অনেক আলো জ্বলে। বেশ খানিকটা দূরে দূরে বাঁশ পুঁতে মশাল জ্বালিয়ে একটা আলো-আঁধারির রহস্য তৈরি করা হয়। একপাশে মদের ভাঁটি বসে দু-দুটো। মিষ্টি ও ভাজার দোকান বসে। মাঝখানের প্রশস্ত জায়গায় বাজিকর যুবক-যুবতীরা শারীরিক কসরৎ দেখায়। চারপাশের আলাদা আলাদা তাঁবুতে আলাদা আলাদা খেলা। কোনোটায় রহু চণ্ডালের হাড়ের কেরামতি—নিমেষে টাকা দ্বিগুণ হচ্ছে, পিতল সোনা হচ্ছে। কোনোটায় নিছক ভাতি—যদুদণ্ডের ছোঁয়ায় যুবতীর লম্বা বিনুনি মাথার উপর খাড়া হয়ে উঠছে সোজা হয়ে, আবার কোথাও নিমেষে গাছ থেকে ফল, ফুল থেকে ফের গাছ তৈরি হচ্ছে। কোথাও বা বীভৎস নরকযন্ত্রণার মহড়া, যার বিষয়বস্তু বিশ্বাসহন্তার শাস্তি অথবা ব্যভিচারিণী স্ত্রীর কর্মফল। এইসব প্রযোজনায় একজন চতুর কথক থাকে, যে অতিদ্রুত দক্ষ বক্তৃতাবাজিকে তস্করবৃত্তি, বিশ্বাসভঙ্গ, স্বজনগমন ইত্যা অনাচার, লোভ, হিংসা যাবতীয় উত্তেজক ও নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে অনর্গল কথা বলে যায়, অভিনয় করে যা গ্রাম্য মানুষকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে।

সবচেয়ে উত্তেজক ও রোমহর্ষক খেলা বালি বাজিকরের তাঁবুতে (যে খেলার কথা দর্শকেরা বৃদ্ধবয়সে অধস্তন পুরুষের কাছেও গল্প করবে)। বালি একখানা চওড়া কাঠের পাটাতনের সামনে তার যুবতী বউকে চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে দেয়। চারপাশে তার মশালের আলো জ্বলে। দশ হাত দূর থেকে বালি অত্যন্ত দ্রুতলায়ে একের পর এক ধারালো ছুরি নিক্ষেপ করে ঐ কাঠের উপর তার বউয়ের শরীরের চারপাশে। এক একখানা ছুরি ছুটে যায় আর দর্শক শিউরে চোখ বন্ধ করে, তারপর আবার চোখ খোলে, ততক্ষণে আরেকখানা ছুরি বিদ্ধ হয়েছে নির্দিষ্ট জায়গায়।

পীতেম তার এই বড় খেলায় মানুষ আকর্ষণ করে বিস্তর। শহর ও তার আশপাশের লোকেরা তো আসেই, আসে গঙ্গাঘাটের মহাজনি নৌকোর বাঙালি, মুঘল ও সাহেব ব্যবসাদারেরা, আসে কাছের ও দূরের গ্রামগঞ্জের মানুষ। সমস্ত মাঠে একটা মেলার মতো আয়োজন চলে দশদিন ধরে। পীতেমের পয়সা রোজগার হয় ভালোই। দলের অন্য সবাইও ভালো রোজগার করে। এমনকি সালমাও তার বাণিজ্য ভালোই চালায়।

এর মধ্যেই একদিন দয়ারাম আবার এসেছিল সালমার কাছে। সালমার ওষুধে যে একেবারেই ফল ফলেনি সেকথা জোর দিয়ে দয়ারাম বলতে পারে না। তবে কিনা আরো একটু দ্রুত ফল সে চায়।

সালমা মোহিনী হাসে। দয়ারাম প্রগল্‌ভ হয়। গলা কাঁপে তার। তারপর সে ফিসফিস করে করুণ আর্তি জানায়, ভান্‌মতি, একটা উপায় করে দেও। অনেক টাকা দেব তোমায়। সে হাত ধরে সালমার।

সালমা হাত ছাড়িয়ে নেয়। কপট দুশ্চিন্তায় বলে, ভকত, বড় কঠিন ব্যাপার। মানুষ ঠকিয়ে অনেক পয়সা করেছ, সময়মতো ভোগ-আহ্লাদে মন দেওনি, এখন মনে হচ্ছে ঠকে গেছ, নয়?

ভাতি, পয়সার তো অভাব নেই? কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে সব শেষ হয়ে যাবে, ভাবিনি।

কি করে এত পয়সা করলে, ভকত?

আঃহা, কি করে পয়সা করলাম না? এই জংলির দেশে পয়সা করতে হলে কিছু বুদ্ধি লাগে শুধু। আর কিছু নয়। করবে তুমি পয়সা? শিখিয়ে দেব?

হ্যাঁ, হা, দু-একটা কৌশল শেখাও তো!

দয়ারাম এই বিষয়ান্তরেও সমান উৎসাহ পায়। সারাজীবন ধরে পয়সা রোজগারই তার প্রধান নেশা। পয়সার আলোচনাও তার ভালো লাগে।

সে বলে, ভাতি, এই দেখ শ্যামলাল নায়েবকে কেমন জমিদার বানিয়ে দিলাম। কত পয়সা কামালো লোকটা অবশ্য আমাকেও সিকি ভাগ দিয়েছে, কারণ,

কি, বুদ্ধিটা তো আমার!

শ্যামলাল নায়েবকে কী বুদ্ধি দিলে?

কী বুদ্ধি দিলাম? দেখছ জমির কেমন টান এখন মানুষের? আর শ্যামলাল বহুদিন ধরে নায়েবি করছে, এখন এই শেষ বয়সে একটু আরাম করতে চায় নিজে জমিদার হয়ে। তা সেজন্যই আমার কাছে এসেছিল। পুরানো বন্ধু লোক আমার। রাজমহল পাহাড়ের তিন হাজার বিঘা জমির পাট্টা বিলি হল আর মন্দার পাহাড়ের নাবালেও, তা কম করে আরো পাঁচ-ছ হাজার বিঘা জমির পাট্টা বিলি হল। ভালো সরেস জমি সব। দাম যা পেয়েছে তাতে জঙ্গিপুরে দেখ গিয়ে কেমন জমিদারি কিনে বসেছে।

নায়েব জমি বিক্রির টাকা মেরে দিয়েছে? জমিদারকে দেয়নি?

আঃ হা হা হা! মজা তো ঐখানেই। তোমর বাদিয়া লোক, জমির ব্যাপারে কিছুই বোঝ না। আরে জমি বিক্রি নয়, শ্যামলাল শুধু পাট্টা বিক্রি করেছে। আর কার জমি কে পাট্টা বিলি করে দেখ।

দয়ারাম প্রচুর উপভোগেরহাসি হাসে। সালমার কান তীক্ষ্ণ হয়, চোখের দৃষ্টি খর হতে সে নিজেকে শাসন করে। এই পাট্টা বিলির সঙ্গে বাজিকরেরাও যে জড়িত, একথা, দয়ারাম নিশ্চয়ই জানে না। জানলে এত আবেগ নিয়ে নিজের বুদ্ধিমত্তার কথা কখনোই বলত না, একথা সালমা বোঝে। সে মুখে কৌতুকের ভাণ করে। বলে, ব্যাপারটা একটু খোলস ছাড়িয়ে বল তো ভকত, যাতে বুঝতে পারি।

দয়ারাম আকর্ণ হাসে। বলে, দেখ ওই পাট্টা সব ভূয়া পাট্টা! ওতে জমিদারের দস্তখত নেই, নায়েবেরও নেই। শ্যামলাল চাকরি ছাড়ার পর ঈশ্বরপুরের জমিদার ব্যাপারটা জেনেছে। মন্দার পাহাড়ের জমি এর মধ্যেই লাঠিয়াল দিয়ে জমিদার আবার দখল নিয়েছে। রাজমহলেও দেখ না ক-দিনের মধ্যেই কেমন ধুন্দুমার লাগে।

পাট্টাতে দস্তখত নেই?

তবে আর বলছি কি?

সালমার মুখ নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। বলে, হাজার লোকের সঙ্গে এভাবে বেইমানি করলে?

পয়সা কি আর এমনিতে হয় সুন্দরী? পয়সা এমনি করেই হয়।

দয়ারাম আবেগে সালমার চিবুক নাড়িয়ে দেয়। সালমা ঝটকা দিয়ে হাতটা সরাতে গিয়ে নিজেকে সামলায়। চেষ্টা করে হাসে। তারপর বলে, সত্যি বাবা, তোমার বুদ্ধি বটে!

সবই আছে ভান্‌মতি, শুধু এক জায়গায়ই ঘাটতি। এখন শুধু তোমার করুণা।

সালমা উঠে গিয়ে ঝোলানো বাঁশের ভাড় নিয়ে আসে। ভাড় থেকে মদ ঢেলে দয়ারামের সামনে ধরে। বলে, খাও।

দয়ারাম বলে, খাব? বল কি? আমার যে কণ্ঠি।

আরে খাও, ভকত। কতদিন আর নিজেকে শুকিয়ে রাখবে?

সালমা নিজে গলায় পানীয় ঢালে। বিস্বাদ পানীয়, মুখ কুঁচকে ঢোক গেলে সে।

দয়ারাম বলে, তবে খাই?

সালমা ধমকের সুরে বলে, খাও।

দয়ারাম মদ পান করে। বলে, তোমার হাতেই সব ছেড়ে দিয়েছি, ভান্‌মতি। এখন তুমিই ভরসা।

খানিক সময় নিশ্ৰুপ যায়। দু-জনের রক্তেই আস্তে আস্তে নেশা লাগে। দয়ারামের মদের নেশা নেই। ফলে, অতিদ্রুত তার উত্তেজনা বাড়ে। প্রগম্ভ হাসিতে তার ঠোঁট বেঁকে যায়।

এ কি ওষুধ দিলে ভাতি, শরীর যে টানটান লাগে?

সালমা বলে, ও কিছু নয়, ভকত, ও শুধু আরকের নেশা। নেশা কেটে গেলে আবার পুরনো মানুষ হয়ে যাবে।

তাহলে নেশা কেটে দরকার নেই, ভাতি, দেও আমাকে আরো নেশা দেও।

সে আরো পান করে। দয়ারাম এরকম উত্তেজনা জীবনে ভোগ করেনি। সে এবার ফিসফিস করে বলে, ভান্‌মতি, একটু সুখ দেও আমাকে একটু সুখ।

সালমা বলে, ওখানে চুপ করে বস ভকত, আমার কথা শোন। তাকত যদি ফিরে পেতে চাও তাহলে একটাই উপায় আছে। কিন্তু সে কি তুমি পারবে?

পারব, পারব।

এসব বানজারা-বাজিকরের গুপ্তবিদ্যা, তোমাকেই শুধু শিখিয়ে দেব। মন দিয়ে শোন।

দয়ারাম উত্তেজিত মস্তিষ্কে যথাসম্ভব একাগ্র মনে সালমার নিদান শোনে না তেমন কিছু অসম্ভব মনে হয় না তার। এ আর এমন কি কঠিন ব্যাপার? খুব পারব খুব পারব, ভান্‌মতি।

সালমা কিছু শিকড়বাকড়ও দেয় তাকে। তারপর একজন লোক দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

 

১০.

পাট্টা বন্দোবস্তের টাকা শ্যামলাল মিত্র ও দয়ারামই শুধু খায়নি, খেয়েছিল আরো অনেক। শ্যামলাল এবং পাট্টাপ্রাপ্ত প্রজাদের মধ্যে ইজারাদার, দরপত্তনিদার, ছে-পত্তনিদার ইত্যাদি মধ্যবর্তীরাও ছিল। এ ছাড়াও ছিল সেরেস্তার গোমস্তা, তশিলদার ইত্যাদি আমলারা। যেসব জমিতে কোনোরকম জলের আয় আছে সেখানে বুভুক্ষু চাষিরা যেমন করেই হোক কলাই কিংবা তৈলবীজের চাষ করেছে। সেসব ফসল এখন সবে লকলকিয়ে উঠেছে।

ঠিক এই সময়েই কোনোরকম সাবধান না জানিয়ে ঈশ্বরপুরের জমিদারের লাঠিয়ালেরা সেইসব চাষিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেননা, নিয়মটা এমনই। দখল কিংবা বেদখল করতে হলে আচমকা সন্ত্রাস ছড়াতে হয়। জমি নিয়ে যাদের কারবার তারা এসব জানে।

কাজেই প্রথম চোটেই যে দু-চারজনের লাশ পড়ে তারা জানতেই পারে না তাদের অপরাধটা কি। ভূয়া পাট্টাপ্রাপ্ত কৃষিজীবীরা খবর পেয়ে এরপর লাঠি বল্লম নিয়ে এসে কেউ কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু সে অল্প কয়েকজন মাত্র এবং তারাও শুধুমাত্র তাদের সর্বস্ব যাওয়ার কথাই চিন্তা করেছিল, আর কিছু নয়। কাজেই তাদের প্রতিহত করা আক্রমণকারীদের বিশেষ অসুবিধার ছিল না, বরং এতে তাদের উৎসাহ বৃদ্ধি হয়। ফলে এরপর আক্রমণ হয় আশেপাশের গ্রামে এবং লাঠিয়ালেরা মাইনের উপরে ফাউ হিসাবে কয়েকশো গরু-মোষ ধরে নিয়ে চলে যায়।

পীতেম ও অন্য বাজিকরেরা দুরের থেকে এসব ঘটনা শুধু লক্ষ করেছিল, কোনোকিছু করার চেষ্টা করেনি। তারা অবশ্যই আগে থেকে এসব জানত। সালমা-দয়ারাম সংলাপ কারো কাছেই অজ্ঞাত ছিল না। সালমা আর একবার শুধু পীতেমকে অন্তরটিপুনি দিয়েছিল গেরস্থ হওয়ার দুরাকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত দিয়ে।

পীতেম ভয়ানক দমে যায় এই ঘটনায়। চাষিদের নালিশই কেউ শুনছে না, কাজেই বাজিকরকে আর কে পাত্তা দেয়। যাযাবরের নালিশ কেউ গ্রাহ্য করে না, একথা যাযাবরের থেকে আর বেশি কে জানে? সুতরাং পীতেম বিষয়টা একেবারে হজম করে ফেলে, এ নিয়ে আর দ্বিতীয় বার কথা তোলার অধিকার দেয় না কাউকে। এমনকি যখন মহী কর্মকার নামে একজন মানুষ গোপনে তার কাছ থেকে এ সম্পর্কে যখন বিস্তারিত জানতে চায় তখনো সহসা মুখ খোলে না পীতেম।

মহী তার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিল তারা কত টাকা দিয়ে কতটা জমির পত্তনি নিয়েছিল। জানতে চেয়েছিল, এই জমি পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে তারা রাজি আছে কিনা, কিংবা অন্যান্য কৃষকদের সঙ্গে সহযোগিতা করবে কিনা।

পীতেম দেওয়ালের মতো মুখ করে বলেছিল, না। এ সম্পর্কে আর কোনো আলোচনাই করতে সে রাজি হয়নি। কর্মকার মানুষটা এক সাহেব ডাক্তারের চাকর ছিল এককালে। সেই খানিকটা লেখাপড়া, নতুন আইনকানুন সম্পর্কে সামান্য কাণ্ডজ্ঞান এবং সরকারি মহলে ক্ষীণ একটা যোগাযোগ ইত্যাদির ভিত্তিতে কিছু চেষ্টা চালাতে চাইছিল, যাতে এই পাহাড়প্রমাণ অবিচারের কিছু সুরাহা হয়। পীতেমের বাস্তব অবস্থা, সে নিজে হতাশ হলেও, বোঝে এবং বলে যায় যে, যদি সফল হয় বাজিকরদের ভুলবে না। একথা শুনেও পীতেমের মুখের কোনো ভাবান্তর হয়নি।

 

মহী কর্মকার শেষপর্যন্ত খুন হয়েছিল। কিন্তু তার আগে কালেক্টর হ্যাচ সাহেবকে এ ঘটনার প্রতিকারের ব্যাপারে সে খানিকটা সচেষ্ট করতে পেরেছিল।

প্রজাদের নালিশ শুনে কালেক্টর হ্যাচ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বের করে জঙ্গিপুর থেকে শ্যামলাল মিশ্রকে গ্রেপ্তার করে মুর্শিদাবাদ আনে। তারপর মোকদ্দমা উঠল তার নামে। কিন্তু চতুর শ্যামলালকে বাগে আনা এত সহজ হল না। টাকা দিয়ে সে হ্যাচের সহকারীদের হাত করল। তার উপরে বড় কথা, ঈশ্বরপুরের জমিদারের রাজস্ব বাকি পড়েছিল পরপর দু’ সন। যদিও এর কারণ শ্যামলাল নিজে, কিন্তু সে প্রমাণ করতে পারল বকেয়া রাজস্ব জমিদারের খেয়ালখুশিতেই রাজসরকারে জমা হয়নি, সে নির্দোষ। হ্যাচের সহকারীরা গোপনে লাটসাহেবের কাছে। কালেক্টরের বিরুদ্ধে চিঠি দিল। হ্যাচের বিরুদ্ধে রাজস্ব আদায়ের গাফিলতির নালিশ ছিল। হ্যাচ কিন্তু খুব দমবার পাত্র ছিল না। মুর্শিদাবাদ থেকে শ্যামলালকে সে ভাগলপুর নিয়ে গিয়ে মামলা স্থানান্তর করল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। শ্যামলাল বেকসুর খালাস পেয়ে জঙ্গিপুরে জমিদারি করতে ফিরে গেল। এর পরে কয়েকদিনের মধ্যেই মহী কর্মকার খুন এবং তার বাড়িঘর লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়।

এসব নজির সালমা খুবই নির্মোহভাবে পীতেমকে দেখিয়েছিল। পতেম তবুও রাজমহল ছেড়ে যাবার কথা ভাবতে পারছিল না। তার ভিতরে যেন জড়ত্ব এসে গিয়েছিল। আগে সে সালমাকে বলেছিল, কয়েক মাসের মধ্যেই বর্ষা আসছে। তাঁবুর নিচে দিয়ে যখন নদী বইবে, তখন আমার কথা বুঝবি।

জলকে বড় ভয় যাযাবরের। তাই বর্ষা আসার আগে, পীতেম ভেবেছিল, পাহাড়ের ঢালে দুঃসময়ের স্থায়ী ঘর তুলতে পারবে। দল না হয় ঘুরলই সারা দুনিয়া, কিন্তু অসময়, বর্ষা এবং দলের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য থাকলই না হয় একটুকরো আশ্রয়। এসব সালমা বোঝে না। অধিকন্তু পক্ষপাতদুষ্ট আরো সব ঘটনা ঘটতে থাকে যা পীতেমকে বেশি বেশি করে আহত করে। সালমার যুক্তির কাছে সে দাঁড়াতেই পারে না। আসলে, সালমা তো কোনো যুক্তি বিশেষ দেখায় না। শুধু ইঙ্গিত দেয় সে, শুধু ছোটোখাটো দু-একটা মন্তব্য করে। সে-ই বা কী করে, ঘটনা যে ঘটছেই।

যেমন লক্ষ্মণ সোরেনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় বালির। শুনে পীতেম অধোবদন হয়ে ছিল অনেকক্ষণ। বিস্তারিত বিবরণ জানতে চায় তার অনেক পরে। হায় রে হায়, ঐরকম মানী লোকের হাতে হাতকড়া, পায়ে শেকল! কেন, কেন রে বালি? কিবা তার দোষ?

বালি দেখেছিল শৃঙ্খলিত লক্ষ্মণকে আমগাছির হাটে। সে হাটে তো সাঁওতাল মানুষই বেশি? তবে? হ্যাঁ, হাট সেদিন থমথমা ছিল। কালো কালো মানুষগুলো বোবা হয়েছিল। মদের ঠেকে, তাড়ির গদিতে, মোরগ-লড়াইয়ের জুয়ায় জনপ্রাণী নেই। হাটের বিক্রিবাটাও যেন বন্ধই। একটা পিপুল গাছের নিচে দারোগা বিশ্রাম করছিল। দু-জন চৌকিদার দুটো ঘোড়াকে দানাপানি দিচ্ছে। একপাশে ক্লান্ত অবসন্ন এবং শৃঙ্খলিত লক্ষ্মণ আধশোয়া। পাথরের মতো মানুষটার শরীর যেন ভেঙে পড়েছে। শিকলের ঘষায় পায়ে লাল দগদগে ঘা। মাছিও তাড়াতে পারছে

লক্ষণ। গাছটা থেকে বেশ খানিকটা নিরাপদ দূরত্বে মানুষের ভিড়, যার মধ্যে অধিকাংশই সাঁওতাল। লক্ষ্মণ তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল অথচ দৃষ্টি তার অনির্দিষ্ট। সিপাইরা মাঝেমাঝেই ভিড় দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল।

বালি ভিড়ের ভেতরে নিজেকে গুপ্ত রেখে এসব দেখছিল। হঠাৎ একজন যুবক ভিড় ঠেলে দৌড়ে লক্ষ্মণের কাছে যায় এবং তার হাঁটু দু’হাত দিয়ে ছোঁয়, হাঁটুতে মাথা রাখে। একজন সিপাই ঘাড় ধরে তাকে ছিটকে ফেলে এবং ঠেলে দুরে সরিয়ে দেয়, চড়চাপড় মারে। আর কেউ এগোয় না। হঠাৎ লক্ষ্মণ উঠে দাঁড়ায়, তার শিকলে আওয়াজ হয় ঠনঠন করে। তার বুক ঘন ঘন ওঠানামা করতে থাকে। সে আচমকা চিৎকার করে ওঠে, আমি দেখতে চাই এই দারোগার কত শিকল আছে! আমি দেখতে চাই এই দারোগা সমস্ত সাঁওতাল জাতকে শিকল দিয়ে বাঁধতে পারে কিনা!

দারোগা একটু সতর্ক হয়। সিপাইরা লাঠি তুলে ভিড়ের কাছাকাছি গিয়ে হম্বিতম্বি করে। মানুষ দূরে সরে যায়। তারপর দারোগা এবং সিপাই ঘোড়ায় ওঠে, অন্যরা লক্ষ্মণের কোমরের শিকল ধরে টেনে নিয়ে যায় শহরের পথে।

হাট তারপরে আর জমেনি। মানুষ ক্রমশ সরব হয়ে দলে দলে ফিরে যেতে থাকে। শুধুমাত্র লক্ষ্মণের হাঁটুস্পর্শকারী সেই যুবক গাছটার নিচে একাকী অনেকক্ষণ বসে থাকে।

ফাঁক বুঝে বালি একসময় তার কাছে যায় এবং পাশে বসে। যুবকটি প্রথমে চমকে ওঠে, তারপর বিরক্ত হয়।

কি চাই?

কিছু চাই না, ভাই। পারগানার বাড়িতে আমরা একবার কুটুম হয়েছিলাম। তাই ঘটনাটা একটু জানতে চাই।

ও, তোমরা সেই বাজিকর?

হ্যাঁ।

তাহলে আর কি জানতে চাচ্ছ? এসব ঘটনার গোড়ায় তো তোমরাই।

হ্যাঁ, বহেরায় থাকতে অঘ্রান মাসে একটা গণ্ডগোল হয়েছিল বটে, কিন্তু—

কিন্ত আবার কি? তোমরা ঝামেলা না করলে আজ–

না, ভাই, পারগানা কিন্তু এমন কথা বলেনি। মানুষ তোমাদের ঠকিয়ে খায়, তোমরা বাধা দেও না। আমরা বাধা দিয়েছিলাম, তাও তো মুখে।

তাই বা করতে গেলে কেন?

বালি ম্লান হাসে। বলে, আরে ভাই, অন্যায় আমাদের হয়েছে, মানছি। কিন্তু তোমাদের সঙ্গে ওদের বাধতই। এক্ষেত্রে আমরা শুধু নিমিত্ত হয়েছি।

যুবকটি অন্যদিকে তাকিয়ে কি যেন চিন্তা করে খানিকক্ষণ। তারপর বলে, হয়ত ঠিকই বলেছ। পারগানাও এমন কথা বলত।

তারপর বালি তার কাছ থেকে বিস্তারিত বিবরণ শোনে। পতিত সাউ মিথ্যাই শাসিয়ে আসেনি। বরং এই ঘটনায় তার লাভই হয়েছিল। কেননা লক্ষ্মণকে দাদন নিতে হতো না অন্যদের মতো। বহেরাতে পারগানা লক্ষ্মণই ছিল দাদনের ব্যাপারে একমাত্র ব্যতিক্রম। থাকলেই সে হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং লক্ষ্মণ পারগানা হিসাবে তা করতও। তাছাড়া বহেরার বাছাই জমি ক-খানাও ছিল লক্ষ্মণের পরিবারের বিভিন্ন জনের হাতে। এই জমির উপরেও পতিত সাউ এবং তার সহব্যবসায়ীদের লোভ ছিল। কাজেই এই সুযোগে সে হাতছাড়া করতে চাইল না। তারা ভালো করে জানে সাঁওতাল জাত বড় নিরীহ জাত। ফুর্তিতে থাকতেই তারা পছন্দ করে। মন ভারাক্রান্ত হয়, ঝামেলা হয়, কিংবা রক্তপাত হয় এমন কাজে তাই তারা মোটেই থাকে না। উত্তেজনা সঞ্চয় করে রাখে শিকার খেলার জন্য, নাচগান ও নেশার জন্য। এসব পতিত সাউরা ভালোমতোই জানত। কিন্তু এই পারগানা কিছুটা যেন অন্য ধাঁচের মানুষ। অনেক কিছুই বুঝত এবং যা বুঝত তাও তলিয়ে দেখতে চাইত। লক্ষ্মণ সোরেনই গ্রামের প্রথম ব্যক্তি যে ওজন ও পয়সার হিসাব বুঝতে শেখে। সুতরাং প্রতিপক্ষের কাছে সে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল।

আর ঈশ্বরপ্রদত্ত সুযোগ বহন করে আনল এক বাজিকরের ছোকরা। পতিত সাউকে হিসাব বোঝাতে গেল! পতিত সাউ দারোগাকে কেন, দারোগা পতিত সাউকে কেনে। কি বা মোকদ্দমা, কে জানে রে ভাই? পারগানা জানতেই পারল না, অথচ তার ধান চাল গরু মোষ ক্রোক হয়ে গেল। হায়রে, হায়রে, কোন্ লোহারে বানাল এ শিকল? ঘোড়ার পিঠে সওয়ার দারোগা টাপ টাপ যায়।

এ কাহিনী শুনে পীতেম বিষাদগ্রস্ত হয়। আহারে এমন মানুষ, এমন মর্যাদাবান মানুষ। কোনো বাজিকর যা কোনোদিন পায়নি, লক্ষ্মণ পীতেমকে তাই দিয়েছিল। লক্ষ্মণ দিয়েছিল সম্রমপূর্ণ ব্যবহার। এমনকি সালমা পর্যন্ত চুপ করে থাকে। বহেরার সব মানুষ তাকেও জোহর করেছিল এক অপরিচিত অথচ সম্রান্ত ভঙ্গিতে।

আর সেই মানুষ! অনেকক্ষণ দু-জনে চুপচাপ বসে থাকে। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে দু-জনকেই ঢেকে দেয়। তখন সেই অন্ধকারের মধ্যে সালমা বলে, হাজার নাগ-নাগিনী আসছে মানুষকে গিলে খাবার জন্য! কি তাদের হিসহিস শব্দ! তাদের জিভ লক লক করে! তাদের চোখ থেকে আগুন বের হয়। পীতেম এ দেশ থেকে পালিয়ে চল।

 ১১-১৫. যেমনটি সালমা এবং অন্য বাজিকরেরা

যেমনটি সালমা এবং অন্য বাজিকরেরা আশা করেছিল ঠিক তেমনটি হয়। পেমার তলপেট যত স্কুল হতে থাকে আনন্দর আসা-যাওয়াও তত কমে। তারপর পেটের চামড়া যখন একেবারে টানটান হয়ে নাভিকে পর্যন্ত সমতল করে দিল, তখন আনন্দর আসা একেবারেই বন্ধ হল।

আর মালিকের পছন্দ-অপছন্দ সব থেকে আগে বোঝে চাকরবাকরেরা। পেমার দেখাশোনার জন্য যে দু-জন চাকরানি ছিল, প্রথমে তারা তাকে অবহেলা দেখাতে শুরু করে, তারপরে অবাধ্য হতে থাকে এবং সবশেষে অপমান করতে শুরু করে।

সালমা যখন আকারে ইঙ্গিতে এসব কথা বলেছিল তখন যে পেমা বোঝেনি এমন নয়। সে বয়সে নিতান্ত বালিকা হলেও সালমা বলার আগেই সে এসব চিন্তা করেছিল। কিন্তু এসব চিন্তাকে আমল দেওয়ার কোনো কারণ সে তার যাযাবরী রক্তে খুঁজে পায়নি। সালমা যা চিন্তা করেছিল তা হল, বয়সের অভিজ্ঞতা, যে অভিজ্ঞতায় মানুষ পেমার মতো অপরিণামদর্শী যুবতীকে মূখ মনে করে। বয়সের অভিজ্ঞতা ও তজ্জনিত উপলব্ধি অন্য একটা বয়সের আবেগ এবং উপলব্ধিকে তির্যকভাবে দেখে। সালমা যখন পেমাকে সাবধান করে তখন সে নিজের যৌবনের কথা, তার মায়ের যৌবনের কখা, সবই ভুলে থাকে।

তাছাড়া পেমা প্রেমে উন্মাদ হয়েছিল। আনন্দর রাজকীয় চেহারা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। যতদিন সে দলে ছিল সেই ক-দিনের গোপন অভিসার তার সারা জীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে। আর এখন যে সমস্যা, তার সমাধান এখনই করতে হবে। এসব আগে থাকতে কিছুতেই স্থির করা যাবে না। আনন্দর অদর্শনে সে কষ্ট পায়, কাঁদে এবং পরিচারিকাদের অনুরোধ করে, ঘুষ দিয়ে আনন্দকে ডাকতে পাঠায়।

আনন্দ বিরক্ত হয়ে আসে, সামান্য সময় বসে কিন্তু কথাবার্তার বিশেষ উত্তর দেয় না। পেমা আহত এবং অপমানিত বোধ করে, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়।

তারপর বহুদিন আনন্দ আসে না। পেমা বারবার খবর দেওয়া সত্ত্বেও আসে। খরচ-পত্তরও নিয়মিত পাঠায় না। সে। দু-জন পরিচারিকার একজন এবং দারোয়ান চলে যায় কোন অজ্ঞাত নির্দেশে। বস্তুত, আনন্দ আর এই আয়োজনের অর্থও খুঁজে পায় না। এ কথা ঠিক, এই বিদেশি মেয়েটা তাকে অস্বাভাবিক নেশাগ্রস্ত করেছিল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে একে নিয়ে সারাজীবন কাটাতে হবে। এসব নিয়মে নেই। তবুও একেবারে তাড়িয়ে দিতে পারছে না আনন্দ। সামান্য একটা দুর্বলতা এখনো রয়েছে তার।

শেষপর্যন্ত পেমা তার পরিচারিকাকে শেষবারের মতো আনন্দর কাছে পাঠায়। বলে দেয়, যদি সে না আসে, তাহলে আমিই তার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হব, এ কথা মনে রাখে যেন।

সুতরাং আনন্দ আসে। এবার শুধু বিরক্ত নয়, ক্রুদ্ধও সে। বলে, কি ব্যাপার, তুই যে বিয়ে করা মাগের মতো দাবি করছিস?

এখানে আস না কেন?

এখানে এসে কি হবে? আমার আর কাজকর্ম নেই?

তা বলে একেবারেই আসতে পার না?

তোর যদি এখানে ভালো না লাগে, তাহলে দলে ফিরে যা।

তার মানে?

তার মানে, তোকে যে সারাজীবন পুষতে হবে এমন কি কথা আছে?

সে কথাই তো ছিল।

না, সে কথা ছিল না, আর তোকে আমি ডেকে নিয়ে আসিনি। তুই নিজেই এসেছিলি। আমার এখন অন্য কাজ আছে, এসব ঝামেলা আর পোয়াতে পারব না, বুঝলি?

পেমা দপ করে জ্বলে ওঠে। চিঙ্কার করে বলে, বেইমান, এখন আমাকে চলে যেতে বলছিস, তো, এটার কি হবে, এটার? সে তার পেটের উপর চড় মারতে থাকে উন্মাদের মতো। জঠরের শিশু মোচড় মেরে ওঠে। পেমা অস্বস্তি ও যন্ত্রণায় মাটির উপরেই বসে পড়ে।

আনন্দ বলে, ওটার আমি কি জানি? বাজিকরের ছাউনিতে অমন বেজম্মা অনেক আছে। আজই এ ঘর খালি করে দিবি।

পরিচারিকাকে ডেনে আনন্দ বলে, এ যদি সন্ধ্যার মধ্যে ঘর ছেড়ে না যায় তবে ঘাড় ধরে বের করে দিবি। না হলে, তোদেরই তাড়িয়ে দেব, মনে রাখিস।

পেমা লাফিয়ে উঠে ক্ষিপ্তের মতো আক্রমণ করে আনন্দকে। দাঁতে নখে ঘায়েল করতে চায় সে। সঙ্গে অশ্লীল গালিগালাজ।

আনন্দ বলশালী পুরুষ। এক হাতে পেমার আক্রমণ সামলে অন্য হাতে মুখের উপর আঘাত করে বারবার। তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

পেমা দরজার উপর থুথু ছিটায়, মা-বাপ তুলে খিস্তি করে, কাঁদে, তারপর বিছানার তলা থেকে একখানা ছুরি ঝট করে টেনে বের করে। বাজিকরের কামারশালার তৈরি ছুরি, মাথা ভারি, বাঁট ছোট। সে ছুটে যায় দরজার দিকে। পরিচারিকা তাকে আটকাতে সাহস পায় না।

আনন্দ তখন উঠোনে তার ঘোড়র কাছে। পিছনের চিৎকারে সে কান পাতে। তীক্ষ্ণ চিৎকার করে পেমা ছুরি ছুঁড়ে মারে। ছুরিটা বিদ্যুৎ গতিতে আনন্দকে পাশ কাটিয়ে ঘোড়ার পিছনের নরম মাংসে বিদ্ধ হয়। ত্রাসে আনন্দ পিছন ফিরে তাকায় আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষিপ্ত ঘোড়ার পিছনের পায়ের চাট খায় পরপর দু-বার। একটি আঘাতে তার মাথার খুলির খানিকটা ছিটকে বেরিয়ে যায়, সে সেখানেই পড়ে থাকে।

কয়েক মুহূর্ত পেমা হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর পরিচারিকার চিঙ্কারে তার চমক ভাঙে। আনন্দর দেহটা ছটফট করে এখন স্থির হয়ে আছে। ঘোড়াটি দড়ি ছিঁড়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। ভয়ংকর চোখে পেমা অপর স্ত্রীলোকটির দিকে এগোয়া। তার যাযাবরী রক্ত এবং ইন্দ্রিয় এবার পুরোপুরি ক্রিয়াশীল। স্ত্রীলোকটি ভয়ে পিছনের দরজা দিয়ে ছুটে যায় চিৎকার করতে করতে।

 

পেমা তারপর দ্রুত তার অলংকার ও টাকা-পয়সা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। তার গন্তব্য এখন পীতেমের ছাউনি। যাযাবর কি দলছাড়া বাঁচতে পারে?

পেমা যখন ছাউনিতে পৌঁছায় তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। দলের কেউ কেউ তাকে দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসতে দেখে, কিন্তু কথা বলে না। পেমা সালমার ছাউনিতে গিয়ে ঢোকে।

সালমা তাকে লক্ষ করতে থাকে কিন্তু কিছু বলে না। পেমা বসেও তার অস্থিরতা দূর করতে পারে না। অবশেষে সালমা বলে, কি হল?

আনন্দ খুন হয়েছে।

কি করে?

পেমা সবকিছুই বলে। সালমা ধৈর্য ধরে শোনে, কোনোরকম অধীরতা দেখায়। তারপর পেমাকে ছাউনিতে রেখে সে পীতেমের কাছে যায়।

 

১২.

শীত শেষ না হতেই সে বছর হাওয়া উঠেছিল দুরন্ত। সূর্য যত চড়া হতে থাকে হাওয়াও বাড়তে থাকে। ফাল্গুন মাসে এত তাপ কেউ কখনো দেখেনি।

হাটে-বাজারে ফসল আসছিল অজস্র, কিন্তু নিমেষে সেসব উধাও হয়ে যাচ্ছে। গঙ্গার ঘাটে সারাদিন হাজার হাজার মণ মাল, যার প্রায় সবটুকুই খাদ্যশস্য ও তৈলবীজ। সেসব নৌকোয় বোঝাই হয়। এছাড়া চালান যায় রেশম ও তাঁতবস্ত্র। এত অজস্র উপকরণ, তবু মানুষ ধুকছে। রেশম, তাঁত, ধান, নীল প্রভৃতি সমস্ত উৎপাদন প্রচুর পরিমাণ দাদনের আওতায়। রাজকর্মচারীরাও ব্যক্তিগত ব্যবসায় প্রচুর দাদন খাটাচ্ছে। গঙ্গার ওপারে মালদার কালেক্টরের সঙ্গে লবণ ও বস্তুব্যবসায়ী সাহেবদের বিরোধ বাধে। কতকগুলো লবণের নৌকো বিভিন্ন জায়গায় জমিদারেরা আটকে দিয়েছিল। তাদের দাবি জমিদারকে খাজনা না দিয়ে জমিদারিতে লবণের ব্যবসা করা চলবে না। আবার অন্য এক জায়গায় দাদন নেওয়া তাঁতিদের উপর জমিদার খাজনা বৃদ্ধি করলে ব্যবসায়ী সাহেবরা কালেক্টরের উপর এসবের জন্য কৈফিয়ৎ ও ক্ষতিপূরণ দাবি করে। কোন সাহেব কত ক্ষমতাশালী, কালেক্টর বড় না ব্যবসাদারেরা বড় এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন জায়গায়। সেইসব বিরোধ কলকাতা পর্যন্ত গড়ায় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোম্পানির কর্তারা কালেক্টরকেই অপদার্থ প্রতিপন্ন করে। কালেক্টরের সবচেয়ে বড় ত্রুটি রাজস্ব আদায়ে ধরা পড়ে। এ এমনই একটি কাজ যাতে কোনো কর্তৃপক্ষকে কখনো খুশি করা যায় না।

এ ছাড়া স্থানে স্থানে ছোটখাটো প্ৰজাবিদ্রোহ লেগেই আছে। আছে ছোট বড় জমিদার ও তাদের নায়েবদের হাতে আইনের ব্যাপারে কালেক্টরের নাস্তানাবুদ নানারকম ঘটনা। সবার উপরে সমস্ত দামিন-ই-কো, ভাগলপুর, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম প্রভৃতি জায়গার সাঁওতালদের সংঘবদ্ধতার খবর।

প্রতিদিনই কিছু না কিছু নতুন গুজব ছড়ায়। যে কথা সালমা একদিন ঘোরের মধ্যে উচ্চারণ করেছিল, কি করে যেন সেটা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। হয়ত সালমা আরো কারো কাছে কথাটা বলেছিল, এখন সে কথা সাঁওতাল গ্রামে মুখে মুখে ফেরে। হাজার হাজার নাগ-নাগিনী উড়ে আসছে। তাদের নিশ্বাসে বিষ। সেই বিষ-নিশ্বাসে সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এসব কথা মানুষ বিশ্বাস করত।

বাজিকরের ছাউনিতে এখন ঘোর দুর্দিন। চতুর্দিকে এত বিশৃঙ্খলা যে দল আর এখানে-সেখানে ঘুরে, খেলা দেখিয়ে বিশেষ কিছু রোজগার করতে পারছে না। যে যার সঞ্চয় খেয়ে শেষ করছে। অথচ নতুন রাস্তায় পা বাড়াতেও সাহস করছে না।

সালমা যখন পীতেমের কাছে এসে পেমা-আনন্দ বৃত্তান্ত বলে, তখন সে আশা করেছিল, পীতেম বোধহয় এবার তার প্রস্তাবে রাজি হবে। সে প্রস্তাব দিয়েছিল, সেই রাত্রেই পালিয়ে যাবার। সে ভেবেছিল, বাপ হিসাবে পীতেম হয়ত পেমাকে বাঁচাবার কথা ভেবে তার মতে সায় দেবে। কিন্তু পীতেম রাজি হয়নি। সে গৃহী মানুষের মতো আতঙ্কিত হয়েছিল। কোথায় যাব পালিয়ে? কোম্পানির রাজত্বে পালাবার জায়গা নেই। গর্ত করে ঢুকে থাকলে বেতআঁকড়া দিয়ে সেখান থেকে টেনে বের করে নিয়ে আসবে।

কাজেই সে জানকীরামের অপেক্ষুম্ভ ছিল। জানকীরাম আসেনি। কিন্তু অন্য পুলিশ এসে বাজিকর ছাউনি তছনছ করেছিল। পীতেম, ধন্দু, পরতাপও গ্রেপ্তার হয়েছিল পেমার সঙ্গে। অত্যাচার চলেছিল সারারাত ধরে। পীতেম কিংবা কেউই জানত না এ সমস্যার সমাধান কোন পথে।

সমাধান পেমাই করে দেয়। চরম শাস্তি হিসাবে পেমাকে রাখা হয়েছিল দাগি কয়েদিদের সঙ্গে। দারোগার ছেলে খুন, যে-সে অপরাধ নয়। সারারাত ধরে পেমার চিৎকার শোনা গিয়েছিল। ছ’দিন পরে পেমা মৃত সন্তান প্রসব করে এবং প্রচুর রক্তপাতে নিজেও মরে যায়। পীতেম, ধন্দু ও পরতাপ ছাড়া পায় সেদিনই।

এর থেকে আর স্বস্তির সমাধান কিছু ছিল না পীতেমের কাছে। পেমাকে যদি ছেড়ে যেতে হতো, তাহলে সারাজীবন একটা কাঁটা বুকের কাছে খচখচ করত।

এবার সে নিজেই সালমাকে বলে, গোছ জিনিসপত্র, গোটা তাঁবু, চল বেরিয়ে পড়ি।

 

১৩.

কিন্তু ‘চল’ বললেই যাওয়া যায় না। চারদিকে তখন যেসব ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে, তার উপরে করোরই কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না না! বাজিকর ছাউনিতে তখন অভাবটা সংকটের আকার ধারণ করেছে। গৃহস্থদের দেখাদেখি যা ছিল তার কতক বেচে খাওয়া হয়েছে, কতক বেচে পুলিশের হুজ্জতি বন্ধ করা হয়েছে।

এরই মধ্যে একদিন শোনা গেল কোথায় নাকি সাঁওতালরা সভা করেছে, তার পরে এক দারোগাকে সদলবলে খুন করে বন্দীদের ছিনিয়ে নিয়েছে। রাজমহলে তখন সরকারি মহলে ভীষণ চাঞ্চল্য শুরু হয়। থানা পুলিশ বন্দুক লাঠি সব জোরদার করা হতে লাগল। কেননা মানুষের স্মৃতিতে বাবা তিলকা মাঝির বিদ্রোহের কথা তখনো জাগ্রত ছিল।

হাওয়ায় গুজব এত ছড়াচ্ছিল যে পীতেম যেদিন শুনল দয়ারাম ভকত গাধার পায়ের চাট খেয়ে মরেছে, সে বিশ্বাস করেনি। সে ভেবেছিল বজ্জাত লোকটা বেঘোরে মরেছে কোনোরকমে, আর মানুষ রটাচ্ছে এই রকম। কেননা দারোগার ছেলের ঘোড়ার চাট খাওয়া ব্যাপারটা দুরদূরান্তের সবাই জেনে গিয়েছিল। কাজেই চাট খাওয়াটা মানুষ একটা সাধারণ ব্যাপার করে ফেলেছে। তাছাড়া, গাধা কখনো চাট মারে, এ কখনো কেউ শুনেছে? তবুও খোঁজ নিতে গিয়ে সে খুবই তাজ্জব বনে যায়। ঘটনাটা সত্যি। দয়ারামের খামারবাড়িতে দয়ারাম মরে পড়েছিল তার নতুন কেনা গাধার পায়ের কাছে। এত কাছে একটা মৃতদেহ মরে থাকাতে গাধাটা নাকি ভয়ে সারারাত চিৎকার করেছে। পরদিন মানুষ বিরক্ত হয়ে সেই খামার বাড়িতে গিয়ে দয়ারামের মৃতদেহ আবিষ্কার করেছে। কেউ বলছে দয়ারাম গাধার পায়ের চাট খেয়ে মরেছে, কেউ বলছে তার চাকর সুফল তাকে খুন করে পালিয়েছে। সবিস্তারে সব শুনে পীতেম সালমার কাছে এসেছিল।

দয়ারামের মরার খবর শুনেছিস?

শুনেছি।

সালমার মুখে কোনোরকম ঔৎসুক্য ছিল না। কিন্তু পীতেম এত সহজে নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। এই আশ্চর্য ঘটনার পেছনে সালমার হাত সে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। অথচ সালমা যেন কিছুই জানে না।

পীতেম, সালমা, বা অন্য কেউই জানত না সেদিন দয়ারামের নতুন কেনা মাদি গাধাটা আরেকজন মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল। সে মানুষটা দয়ারামের সেই বাঁধা দাস সফুল মুর্মু। খামারবাড়িতে গাধা নিয়ে মালিক ব্যস্ত ছিল, তখন সে বন্ধ দরজায় মালিকের নির্দেশমতো পাহারা ছিল। কিছু একটা সন্দেহ হওয়াতে ফোকর দিয়ে উঁকি দিয়ে সে যা দেখেছিল, তা তার জাতের কেউ কখনো দেখেনি। তারপর চা খেয়ে জলচৌকির উপর থেকে মালিককে ছিটকে পড়তে দেখেছিল সে। তারপর আবার আবার চাট। তখনো সে ভেতরে ঢোকেনি, কেননা, না ডাকলে ভেতরে ঢোকা নিষেধ ছিল মালিকের। শেষে একসময় নিঃসন্দেহ হয় যে, মালিক আর ডাকবে না।

তখনো সে ঢোকেনি। সে ভেবছিল, গাধাও গা-জোয়ারী কিংবা বদমাইসি সহ্য করে না, অথচ সে সুফল মুর্মু আজ দশ বছর ধরে এই জানোয়ারের অধম মানুষটাকে সহ্য করে যাচ্ছে। সে ভেবেছিল, পরপর সাতদিন স্বর্গের ঠাকুর আকাশ থেকে সিদুকানুর ঘরে এসে নেমেছিল, নির্দেশ দিয়েছিল। সে ভেবেছিল, তার ঘরের উঠোনে নিশ্চয়ই আগাছা আর ঘাসের জঙ্গল হয়ে আছে। যদি সেই অমঙ্গল চিহ্নিত মোষ আর কোথাও চরার জায়গা না পায়, তবে তার উঠোনে নিশ্চয়ই জেঁকে বসবে এবং ঘাস খাবে। কেননা তখন সব সাঁওতাল জানত এরকম মোষ আসছে। কোথা থেকে আসছে কেউ জানত না। তবু গ্রামে গ্রামে খবর রটে গিয়েছিল এবং প্রত্যেকটি বাড়িতে উঠোন চেঁছে গোবরজল দিয়ে সবাই পরিষ্কার করে রেখেছিল। কেননা ঘাস দেখলেই সেই অমঙ্গল বহনকারী মোষ তাতে চরবে, ঘাস খাবে। আর তাতে সবংশে সে বাড়ির মানুষ ধ্বংস হবে। সুফল মমুর বাড়ি আছে, বংশের মানুষও আছে, কিন্তু এখন আর কেউই সেই বাড়িতে থাকে না।

সে ভেবেছিল, তার বাড়ি তিন মাথার মোড়ে। সেখানে গাছের গায়ে গরুর চামড়া, জোড়া বাঁশি এবং শালপল্লব সাজিয়ে রাখার দায়িত্ব ছিল তার, যাতে প্রমাণ হয় এ বাড়িটা সাঁওতালের, এ গ্রাম সাঁওতালের, তা না হলে বাঁচি না কোথায় যে নেতা জন্মে বড় হয়েছে যে যদি এসে এসব দেখতে না পায়, তাহলে ক্রুদ্ধ হয়ে সবাইকে হত্যা করতে পারে। সে মনে করেছিল, যেসব যুবক সাঁওতাল এখন পায়ে ঘুঙর বেঁধে টামাং নিয়ে গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে প্রচার করছে এবং অন্যকে প্রচারে উদ্বুদ্ধ করছে, তাদের দলে তার থাকা অবশ্যই উচিত ছিল। তার মনে হল, সে তো এক মায়ের এক বেটা, আর এখন সব এক বেটার মায়েরা পরস্পর সই পাতাচ্ছে। হয়ত, তার মাকে সবাই অবহেলা করছে এবং সই না পাতিয়ে নিঃসঙ্গ করে রেখেছে। কেননা সে তত অন্যসব এক মায়ের এক বেটাদের মতো নির্ভীক হয়ে এগিয়ে যেতে পারেনি।

এসব চিন্তা করার পর মাদি গাধাটাকে তার খুব ময়ীয়সী মনে হয়। সে তারপর মালিকের ঘোড়াটার বাঁধন খুলে তাতে সওয়ার হয়ে বসে। ঘোড়াটা দীর্ঘকাল সওয়ারকে এককাতে বসিয়ে আস্তে চলতে অভ্যস্ত। এখন দু-পা ঝোলানো সওয়ারী পেয়ে একটু বেকায়দা বোধ করে। সুফল দু-গা চাবুক চালিয়ে বলে, চল বেটা, আজ মনের আনন্দে ছোট। ঘোড়া গ্রামের পথে ছুটতে শুরু করে।

 

১৪.

দলের হালচাল সম্বন্ধে অনেকদিন ধরেই পীতেম আর মনোযোগ দেয় না। নানা ধরনের আপদ-বিপদে একেই তার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিল, অবশেষে পেমার মৃত্যু তাকে মারাত্মক আঘাত দিয়ে যায়। তাছাড়া অনেক চিন্তা করেও দলের মতিগতি এবং অবস্থা ফেরাবার মতো কোনো বুদ্ধি তার মাথায় আসেনি।

সেই মেলার সময় যে বড় খেলা হয়েছিল তখন ইউসুফ নামে এক মুসলমান যুবক একদিন খেলার শেষে হাত ধরে বালিকে একধারে টেনে এনেছিল। হাত দু-খানা একত্র করে ঝুঁকে পড়ে সে চুম্বন করেছিল। মুখে অকুণ্ঠ বাহবা ছিল তার।

ইউসুফ বলেছিল, কি হাতই বানিয়েছ ওস্তাদ, ইচ্ছে হয় সোনা দিয়ে মুড়ে রাখি।

এসব বীরাচারের স্তুতিতে সব বীরেরাই বিগলিত হয়। বালিও হয়েছিল। তারপর ইউসুফের সঙ্গে দোস্তি হতে তার দেরি হয়নি।

কিন্তু ইউসুফের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। দু-একদিনের মধ্যেই সে কথাটা পাড়ে বালির কাছে। বালির মতো এক-আধজন লোক তার দরকার। এসব ডুগডুগি বাজানো হেঁচড়া কাজে বালির মতো ওস্তাদের সময় নষ্ট করা অন্যায়। বড় কাজ কিছু করতে চায় তো বালি আসুকর সঙ্গে। যে কাজে সাহস লাগে, উত্তেজনা ও পয়সাও ভালো আছে।

বালি বলেছিল, আদরে-পাদারে ঢিল না ছুঁড়ে আসল কথাটি বল। আমার ছুরি কেমন সোজা এবং জায়গামতো যায়, দেখেছ তো? আমি মানুষটাও সেরকম।

তারপর ইউসুফ মনের কথা খুলে বলেছিল। গঙ্গায় আছে অনেক মহাজনি নৌকো। দেশবিদেশের ব্যবসাদারেরা। এখানে হরেকরকমের মাল বোঝাই করে। প্রশস্ত গঙ্গার অন্ধকার রাতগুলো ইউসুফের। মানুষ আজকাল ভীষণ ত্রাসে থাকে। পাহারাদারগুলো টের পেলেও রা কাড়ে না। সেখান থেকে পাঁচ-দশ পেটি মাল সরালে দিব্যি মাসখানেক নিশ্চিন্তে বসে খাওয়া যায়। আর এসব কাজের সুসন্ধান ইউসুফের ভালোই জানা আছে। যা করার সেই করবে। বালি শুধু সঙ্গে থাকবে তার।

প্রস্তাব শুনে বালি ভয় পেয়েছিল। সে বলেছিল, না ভাই, দলে থেকে এসব হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়তে চাই না। আমার একার দোষে দল নষ্ট হবে, এ ঠিক নয়।

ইউসুফ অবশ্য বেশি পেড়াপিড়ি করেনি। যাওয়ার সময়ে বলে গিয়েছিল, গেলে ভালো করতে, না যাও, ইউসুফ মিয়ার আটকাবে না। এ দুনিয়ার বোকা লোকেরা খেটে মরে আর বুদ্ধিমানেরা বসে খায়। আর আমার মতো তোমার মতো, যারা খাটতেও চায় না আবার পয়সা রোজগার করার মতো অনেক বুদ্ধিও নেই তারা সাহস দিয়ে রোজগার করে। কথাটা তোমার কাছে ভোলা রইল, ভালো মনে কর, খবর দিও একসময়।

বালি কথাটা তখন ভালো মনে করেনি। এখন এই দুর্দিনে কথাটা ভালো মনে করলেও একেবারে ফেলনা মনে হয় না। কাজেই সেই ইউসুফের খোঁজ লাগায়।

অস্থিরতার সময় সব ধান্দাবাজরা শহরেই থাকে। ইউসুফও তার ব্যতিক্রম নয়। কাজেই তাকে খুঁজতে বালির বেগ পেতে হয় না।

ইউসুফ বলে, আমি জানতাম তুমি আসবে। খুব ভালো সময়ে এসেছে। ঘাটে নৌকো রাখার জায়গা নেই। গুদামগুলো ভর্তি। সাঁওতাল হাঙ্গামার ভয়ে কোনো মহাজনই এখন নৌকো ভাসাতে রাজি নয়। তার উপরে দেখ কেন, ঘাটের দিকে থানা পুলিশ পাহারাদারের নজর নেই। নজর এখন সবার গ্রামের দিকে। সবারই ভয় কোন দিক দিয়ে কখন এসে জংলিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে।

প্রথমে বালি একা, তারপরে ধন্দু, পরুপ, জিল্লু ইত্যাদিরাও এসে যোগ দেয়। অন্ধকারের মধ্যে বোঝাই নৌকো থেকে মালের পেটি তুলে নিজের নৌকোয় তোল। তারপর ভাঁটির দিকে তরতর করে বেয়ে যাও। মাইল দুয়েক তফাতে বড় বজরা অপেক্ষা করে থাকে। সেখানে মাল ফেলে দিলেই ছুটি আর নগদ টাকা।

এভাবে চলছিল সেই গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত। পীতেম আফিঙের নেশা করত এবং ঝিমোত। নতুন করে কিছু চিন্তা করার কথা আর তার মাথায় আসত না। হাজত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আস্তে আস্তে সে একেবারেই গম্ভীর হয়ে যায়। জাগ্রত ও ঘুমন্ত দুই অবস্থাতেই তার কানে সারারাতব্যাপী পেমার আর্তনাদ এসে আঘাত করত। সে ছটফট করত, তাঁবুর বাইরে সারারাত পায়চারি করত এবং একা বিড়বিড় করত। সে কারো সঙ্গে কোনরকম পরামর্শ করত না এবং কথাও সারাদিনে মাত্র দু-একটা বলত। তাঁবুর সামনে একটা গাছের গোড়ায় সে প্রায় সারাক্ষণই বসে থাকত।

তারপর সালমা তাকে আফিং খাওয়ানো শুরু করল। আফিঙের নেশায় সে খানিটা স্বস্তি পেয়েছিল। দিনরাত একটা আচ্ছন্ন একাকিত্বের সে বিভোর হয়ে থাকত। তার চুল দাড়ি ক্রমশ বড় এবং ঝকড়া হয়ে তাকে ক্রমশ এক বিজ্ঞ প্রবীণ মানুষ বানিয়ে দেয়। আফিং খাওয়ার অনুষঙ্গ হিসাবে সে স্নানও করত না, ফলে তার গায়ের রঙ একটা সবুজ শ্যাওলার ভাব এসে পড়ে।

এরকম সময় একদিন দারোগা জানকীরাম ছাউনিতে এসে হাজির হয়। পীতেম অর্ধনিমীলিত চোখে তাকে দেখে। তার দৃষ্টিতে পরিচিতির কোনো লক্ষণ নেই। সুতরাং এগিয়ে সে কথা বলতে হয় সালমাকেই।

বেশ কয়েকজন ইংরেজ সাহেব তখন শহরে ছিল। তাদের মধ্যে একজন মেজর বারোজ। সাঁওতালদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য লোকজন সংগ্রহ চলছে। সে কাজ বারোজ সাহেব নিজে তত্ত্বাবধান করছে। জানকীরামের আসার উদ্দেশ্য ঘোড়ার খিদমৎ করার জন শিক্ষিত লোক অন্বেষণ। বাজিকরদের থেকে সে কাজ আর ভালো কে জানে। সুতরাং তোক দিতে হবে।

সালমা বলতে চেষ্টা করেছিল কয়েকটা কথা কিন্তু শোনে কে? দারোগা বলে, কথা বলার এবং শোনার সময় আমার নেই। এমনি যদি না যেতে চাও, বেঁধে নিয়ে যাব, তাও না যেতে চাও, আগুড় দিয়ে সমস্ত ছাউনি পুড়িয়ে দেব।

ধন্দু, বালি, পরতাপ, পিয়ারবক্স এবং জিল্লু এই পাঁচজন মনোনীত হয়। বারোজ তাদের নিজে পছন্দ করে। বাজিকরদের পাঁচ সেরা যুবক যুদ্ধে যায়।

তবু ছেড়ে যাওয়ার আগে তারা সবাই গাছতলায় পীতেমের কাছে এসে দাঁড়ায়। পীতেমের সেই একই অনির্দিষ্ট অর্থহীন দৃষ্টি। যেন সে কানেও শোনে

এমনভাবে সালমা তার কানের কাছে চিৎকার করে, সাহেবরা ছেলেদের যুদ্ধে নিয়ে যাচ্ছে। পীতেম, শুনতে পাচ্ছিস। সাঁওতালদের সঙ্গে সাহেবদের যুদ্ধ হচ্ছে।

পীতেম মাথা নাড়ে, তার শরীর থেকে প্রাচীন রহস্যময় গন্ধ ছড়ায়, সে আবার ঝিমোয়, যেন কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না।

যুবকেরা একে একে তার পা স্পর্শ করে, পীতেম টেরই পায় না যেন। তার পর তারা বিদায় নেয়।

 

১৫.

উত্তরে গঙ্গা এবং দক্ষিণে বনভূমি অঞ্চল। মাঝে মাঝে অনতিউচ্চ গিরিমালা। এমন জায়গায় গ্রীষ্মের আবহাওয়া বড় অকরুণ হয়। ইংরেজ বাহিনী সাঁওতালদের মুখখামুখি হওয়ার জন্য শিবির করেছে এমনই একটি জায়গায়। স্থানটির নাম পিয়ালাপুর। পিয়ালাপুরের পুবে রাজমহল এবং পশ্চিমে ভাগলপুর প্রায় সমান দূরত্বে। ভাগলপুরের কমিশনার চায় এখানে সাঁওতালদের একটা মারণ আঘাত হানতে। কারণ এখানে যদি বিদ্রোহীদের আটকানো না যায়, তাহলে ভাগলপুর রক্ষা করা যাবে না। বাহিনীর নেতৃত্ব করছে ছজন ইংরেজ অফিসার, তারা হল মেজর বারোজ, মেজর স্টুয়ার্ট, কর্নেল জোন্স, চার্লস ইজারটন, জেমস পস্টেট এবং এডেন।

পিয়ালাপুরে অস্থায়ী ঘাঁটি হল। পথপ্রদর্শক হিসাবে এক বৃদ্ধ সাঁওতালকে বন্দী করে আনা হয়েছিল। সংবাদ ছিল যে পীরপৈতি গিরিসংকটে সাঁওতালদের ঘাঁটি। ঘাঁটিতে রসদ ও খাবারদাবারসহ কিছু সৈন্যকে অপেক্ষায় রেখে ঠিক দুপুরবেলায় মেজর বারোজ গিরিসংকটে প্রবেশ করে সৈন্যসমাবেশ করল। রাস্তা অত্যন্ত দুর্গম, পাথর ও আগাছার জঙ্গলে ঢাকা। পাহাড়ের নিচে আছে একটা নালা। আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি হলে তার যাবতীয় জল প্রবল বেগে বেরিয়ে যায় সেই নালা দিয়ে। পাহাড়ের উপর দিকে কোনোরকম চাঞ্চল্য নেই। যতটা সম্ভব অগ্রসর হয়ে মেজর বারোজ কামান পাতল স্থানে স্থানে।

পিয়ালাপুরের অস্থায়ী ঘাঁটিতে জিল্লু এবং পরতাপ তখন বৃদ্ধ বন্দীর সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। জিল্লু বলেছিল, বুড়ো তুমি বেইমানি করলে? রাস্তা দেখিয়ে দিলে সাহেবদের? বৃদ্ধ এতক্ষণ দূরের দিকে তাকিয়ে আপনমনেই হাসছিল। তার হাত-পায়ের শৃঙ্খলকে সে যেন আমলেই আনছিল না।

জিল্লুর কথা শুনে সে বলে, হা, রাস্তা চিনিয়ে দিয়েছি, একেবারে যমের দক্ষিণ দুয়ার।

বৃদ্ধের দড়ির মতো শীর্ণকায় চেহারা, খোঁচা খোঁচা কয়েকটা মাত্র দাড়ি, অযত্নবর্ধিত চুল সারা মুখে ছড়ানো।

সে হঠাৎ জিল্লুর দিকে তীব্রভাবে তাকায়। তারপর বলে, ওখানে কে আছে, জানিস?

কে?

ওখানে যে আছে, তাকে দেখলে বাঘ রাস্তা ছেড়ে দেয়। তার নাম চাঁদ রাই। আর পশ্চিমের ঘাঁটিতে আছে শ্যাম পারগানা, যার নাম তোর সাহেবরা গোরে যাওয়ার সময় পর্যন্ত মনে রাখবে। শ্যামের বাঁয়ে আছে ডুমকা সোরেন, যার ছোঁড়া তিরের ঢপলা যেখানেই বিধুক তা বাইরের আলো দেখবেই। বুঝলি? যা এখন, কানের পিছনের ঘা তো শুকিয়েছে, এবার সাহেবদের কাছে বলে আয়।

বৃদ্ধের নাটকীয় কথাবার্তায় জিল্লু ও পরতাপ পা পর্যন্ত চমকায়। কে এ মানুষটা? তারা দুজনে কাছে এসে ভালো করে দেখে। হায়রে, এই সেই মানুষ! এমন নাটক বুঝি যুদ্ধক্ষেত্রেই হয়!

সেই মানুষ, যার ধান ওজনের কারচুপিতে জিল্লু প্রতিবাদ করে মাথায় চোট খেয়েছিল। হাঁ, এ সেই চেতন মাঝিই বটে!

জিল্লু, পরতাপ দু-জনে আশপাশ দেখে নিয়ে কাছে এসে হাঁটু ছোঁয় তার।

চেতন মাঝি শৃঙ্খলিত হাত দিয়ে ঝটকা দেয়, থাক্ থাক্‌, সাঁওতাল মারতে এসেছিস!

নিজের ইচ্ছায় আসিনি মাঝি, জোর করে নিয়ে এসেছে।

জোর করে আবার কি আনে রে? মরদ নোস তোরা?

মাঝি ভীষণ উত্তেজিত হয়। বালি বলে, এই ধরো যেমন তোমাকে এনেছে। জোর করেই তো এনেছে? নিজের ইচ্ছায় তো আর আসনি?

চেতন মাঝি বালির দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকায়, তারপর হঠাৎ হেসে ফেলে। বলে একে দেকো, তার উপর বাজিকর। তোদের সাথে কথায় পারে কে? তবে লড়াইতে পারবি না। সাঁওতালরা তোদের কচুকাটা করবে!

পরতাপ বলে, লড়াই থোড়াই করব আমরা। তুমি সত্যি বলছ, কাকা, ওখানে ডুমকা আছে?

আছে না?

ডুমকা আর আমি বাঘের সঙ্গে লড়াই করেছিলাম। মনে আছে?

চেতন মাঝি অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তার দৃষ্টি পীরপৈতি পাহাড়ের দিকে। সে আর কথা বলে না।

ঠিক এই সময় প্রথমবার কামানের গম্ভীর গর্জন শোনা যায়। চেতন মাঝি চঞ্চল হয়ে ওঠে। শিকল ঝনঝন করে শব্দ করে। উত্তেজনায় সে উঠে দাঁড়ায়। পাঁচ বাজিকরের চোখে যুদ্ধের চেহারা পাল্টে যায়।

মেজর বারোজ চিন্তাই করতে পারেনি তার সমরসজ্জার এত কাছে সাঁওতালরা। প্রত্যেকটা পাথর, প্রত্যেকটা ঝোপ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ঝাকে ঝাকে ছুটে আসে তির। মেজর স্টুয়ার্ট তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে একেবারে ফাঁকা জায়গায়। দু-দিকে কাঁটাগাছের জঙ্গল। গাছের ও পাথরের আড়াল থেকে তির আসছে বৃষ্টিধারার মতো।

দু-পক্ষের প্রবল রণহুংকার এবং আর্তনাদ বহুদূর থেকে শোনা যাচ্ছে। পাহাড়ের নিচে অপেক্ষমাণ ঘোড়াগুলো পা দাপাচ্ছে। নালার কাছে সৈন্যরা তীরবিদ্ধ হয়ে পালাতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে। ইংরেজদের আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে সাঁওতালরা উন্মাদের মতো ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তির-ধনুক আর টাঙ্গি-বল্লম নিয়ে।

চেতন মাঝি এবং পাঁচজন যুবক দূর থেকে দেখল পাহাড়ের মাথার উপর মেঘ জমেছে ঘন কালো রঙের। জ্যৈষ্ঠ মাসের গরম হাওয়া প্রবল বেগে সেদিকে ধেয়ে চলল। চেতন তার ভারি শিকল নিয়ে নাচতে শুরু করল—নাম, নাম, আকাশ ভেঙে নাম!

কামানের গর্জনকে ছাপিয়ে মেঘের গর্জন উঠল। বাজ পড়তে লাগল মুহুর্মুহু। বারুদের ও গন্ধকের গন্ধে বাতাসকে ভারি করে মুষলধারে বৃষ্টি নামে। পীরপৈতির নালা দিয়ে প্রবলবেগে ঘোলা জল গর্জন করে হতাহত ইংরেজ সৈন্যকে ভাসিয়ে ছুটে চলল। মেজর বারোজ এ অবস্থায় আর যুদ্ধ চালানো নিরাপদ মনে না করে পিছু হটতে শুরু করে। এদিকে সাঁওতাল বাহিনী পিঁপড়ের সারির মতো পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে। ইংরেজ সৈন্য দ্রুত পিছিয়ে এসে পিয়ালাপুরের রাস্তায় উঠল। তারপর পলায়ন।

সাঁওতালরা কিছুদূর পশ্চাদ্ধাবন করে ফিরে গেল। কেননা পাহাড়ের উপরে আহত ও নিহতদের ব্যবস্থা করতে হবে। যার মধ্যে আছে বীর শ্যাম পারগানা।

পরাজিত ইংরেজ বাহিনী পিয়ালাপুরে এসে আর বিশ্রাম করতেও সাহস পেল all

ভাগলপুর ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হল। আকাশে যেমন ঘনঘটা তেমনি অন্ধকার। ঝড় ও বৃষ্টিতে দিকনির্ণয় করা যায় না। তখন খোঁজ পড়ে চেতন মাঝি নামে সেই বন্দীর।

মশালের আলোয় অস্থায়ী আস্তাবলে দেখা যায় আরেক দৃশ্য। ছুরিবিদ্ধ চারজন সিপাই মৃত। একটু দূরে বন্দুকের গুলিতে নিহত ধন্দু বাজিকর। পাঁচটি ঘোড়া এবং বন্দীকে নিয়ে চার বাজিকর যুবক দুর্যোগ ও অন্ধকারের মধ্যে কোথা মিলিয়ে গেছে।