- বইয়ের নামঃ রহু চণ্ডালের হাড়
- লেখকের নামঃ অভিজিৎ সেন
- প্রকাশনাঃ নান্দনিক
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১-০৫. শারিবার যখন বছর বারো বয়স
শারিবার যখন বছর বারো বয়স, তখন নানি লুবিনির সঙ্গে তার সখ্য গভীরতর হয়। কেননা তখন শারিবা সব বুঝতে শিখেছে, নিজের এবং নিজের লোকজনের চতুষ্পার্শ দেখতে শিখেছে। আর সেই সঙ্গে নানির কাছে শুনে শুনে বর্তমানের সাথে অতীতের যোগসূত্র রচনা করার চেষ্টাও সে করতে পারে তার অপুষ্ট বুদ্ধিতে।
এইভাবে শারিবা বড় হয়। নিচু দাওয়া, তালপাতার বেড়া দেওয়া ঘর, সরকারি ফরেস্ট থেকে চুরি করে আনা শনের চালা। সেই নিচু গুহার মতো ঘরের মধ্যে সন্ধ্যার পর স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘন তরলতায় জমে থাকে। লুবিনি তখন কাঁপা কাপা গলায় প্রাচীন কথা বলে।
লুবিনি বলে এক অজ্ঞাত দেশের কথা। সি দ্যাশ হামি নিজেই দেখি নাই, তোক আর কি কমো। সি দ্যাশের ভাষা বাজিকর নিজেই বিসসারণ হোই গিছে, তোক আর কি শিখামো!
সে এক অপরিচিত দেশ। যেখানে ঘর্ঘরা নামে এক পবিত্র নদী বয়ে যায়। সেখানে নাকি কবে এক শনিবারের ভূমিকম্পে সব ধূলিসাৎ হয়েছিল। ঘর্ঘরার বিশাল এক তীরভূমি ভূ-ত্বকে বসে গিয়ে নদীগর্ভের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আর তাতে মিশে গিয়েছিল গোরখপুরের বাজিকরদের জীর্ণ বাড়িঘর। ধ্বংস হয়েছিল বাজিকরদের প্রধান অবলম্বন অসংখ্য জানোয়ার।
সে এক কালো অন্ধকারের শনিবার, যা লুবিনি নিজে দেখেনি, যা সে তার নানাশ্বশুরের কাছে থেকে শুনেছে। তারপর যাযাবর বাজিকরের দল ঘর্ঘরার উত্তর তীরে আরো উত্তরে সরে গিয়ে নতুন বসতি তৈরি করে। নতুন করে ভাল্লুক বাঁদর সংগ্রহ করে, দূরবর্তী গ্রাম-শহরে গিয়ে গেরস্থ বাড়ি থেকে ‘ভঁইস’ চুরি করে আনে। আবার বছরের আট মাস দশ মাস দুনিয়া ঘুরে বেড়াবার নেশায় বেরিয়ে পড়ে তারা। তখন গলা লম্বা করে বাড়িয়ে দিয়ে মোষের সারি চলত রাস্তা দিয়ে, গ্রাম-শহরের ভিতর দিয়ে। সেই মোষের পিঠে থাকত বাচ্চারা আর বুড়ো-বুড়িরা। আর থাকত মাল। কোথাও গিয়ে তারা থামত। নদীর পাড়ে, শহরের বাইরের মাঠে, গ্রামের প্রাচীন বটের তলায়। ডুগডুগ করে ঢোলকে কাঠি পড়ত। জনপদের কুকুরগুলো তেড়ে তেড়ে আসত। বাজিকরদের কুকুরগুলো উত্তেজনায় শিকল ছিঁড়ে ফেলতে চাইত। চৌকিদার এসে সর্দারকে থানায় ডেকে নিয়ে যেত।
জী হুজুর, আমরা বাউদিয়া-বাজিকর বটি। জী মালিক, হামার নাম পীতেম বাজিকর। দলে পাঁচকুড়ি পাঁচজনা আদমি আছে। উসমে শোচ লিজিয়ে দেড়কুড়ি মরদ, দেড়কুড়ি আওরৎ, আর বাকি সব চেংড়া-বাচ্চা।
থানাঘরের বউ-বিবি-বাচ্চারা ভিড় করত। অসীম কৌতূহল সবার চোখে। কি খেলা আছে তোমাদের?
বান্দর আছে, ভাল্লু আছে, দড়ির খেলা আছে, ভান্মতি আছে, বহুৎ কিসিমের খেলা আছে।
সাপ নেই, সাপ?
নেহি মালকিন, বাজিকর সাপ ধরা জানে না।
দশ-পাঁচ টাকা থানাবাবুকে জল খেতে দিতে হয়। তারপরে ছাড়পত্র মেলে। ঠিক আছে, থাকো, কিন্তু কোনো নালিশ যেন না আসে।
নেহি জী, নালিশ কেন আসবে? হামার দলের কোনো বদনাম নেই, হুজুর। সেলাম মালিক, বান্দার নাম পীতেম বাজিকর। কোই দরকার লাগলে চৌকিদারকে ভেজে দেবেন।
কেমকা বুলি ক-ছেন তুই নানি, বুঝা পারি না। ওলা কি হামরাদের আগলা দ্যাশের বুলি?
না রে, শরিবা। এলা বুলি বাজিকর দ্যাশ দ্যাশ ঘুরে শিখা লয়। যেথায় ঘুরে সিথাকার বুলি ধরে লয়, সিথাকার ধরমকরম শিখ্যে লয়। সিটা তার আপন বুলিতে মিশাল করে লয়। বাজিকরের আপন কুনো ধরম নাই। করম এ্যাটা আছে বটে, তো সিটা হোল ভি-মাঙ্গার কাম। মুলুক মুলুক ঘুর্যে বান্দর লাচানো, ভাল্লু লাচানো, পিচ্লু-বুঢ়া পিচ্লু-বুঢ়ির কাঠের পুতলা লাচানো, ভান্মতির খেলা, বাঁশবাজি, দড়িবাজি, নররাক্ষস হয়া কঁচা হাঁস, কাঁচা মুরগা কড়মড় কড়মড় করে খাওয়া, নাচনা গাহানা–এলা সব বাজিকরের কাম। এলা সব ভিখ-মাঙ্গার কাম।
ভিখ-মাঙ্গার কাম!
হাঁ, ভিখ-মাঙ্গার কাম।
যাঃ।
শারিবার বিশ্বাস হয় না। অথবা, ভিখ-মাঙ্গা কথাটা যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য হয় না। খেলা দেখিয়ে পয়সা রোজগার, সেটা ভিখ-মাঙ্গা হবে কেন?
হাঁ, হামরা বলি ভি-মাঙ্গা। তোর নানা বলত ভিখ-মাঙ্গা। কাম হইল খেতির কাম, কলের কাম, কামার কুমার, চাষি, মজদুরের কাম। হামরা তো ওলা কাম কদাপি করি নাই। আমরা তো ওলা কাম জানি না।
তুই খেলা দেখাতিস, নানি?
দেখাতাম তো। পিচ্লু-বুঢ়া পিচ্লু-বুঢ়ির পুতলা তুই দেখিস নাই, শারিবা? হাতের উপর গামছা ঢাকা দিয়া সি পুতলা লাচাতাম। কাঠের ময়ুর লাচাতাম।
আর বাঁশবাজি, দড়িবাজি?
হাঁ, সিগ্লাও করতাম। বিশ হাত উঁচা বাঁশের মাথাৎ সিধা দাঁড়ায়া ছুঁচে সূতা পরাতাম। দুইধারে ঊইসের সিংএ দড়ি বাইন্ধে বাঁশ দিয়া ঠেল্যে সি দড়ি টনটনা হতো। ভুঁই থিকা বিশ হাত উঁচাতে বাঁশ হাতে হাঁটা চলা, লাচ দেখানো—সি ভয়ানক কঠিন খেলা রে, শারিবা!
শরিবা মনশ্চক্ষে নানির দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া দেখে, দোল দেওয়া দেশে, তারপরেই তার চমক ভাঙে।
ওয়ে হাটবা পারিস না তুই, দড়িতে হাঁটতি কো!
কল্পনায় সে এই লোলচর্ম কানিপরা নানিকেই দড়ির উপরে হাঁটতে দেখে, তাতেই চমক খায়। অথচ অবিশ্বাসও করতে পারে না। নানিকে তার প্রগাঢ় বিশ্বাস।
নানি ফোকলা দাঁতে প্রচুর হাসে।
হয় বাপু, নানি তোর এংকা বুঢ়াই আছিল নাকি চেরদিন। বাজিকরের বেটা, শারিবা, এংকা বেহেশই হয়। তোর দোষ নাই।