- বইয়ের নামঃ কাব্যগ্রন্থ (অমিয় চক্রবর্তী)
- লেখকের নামঃ অমিয় চক্রবর্তী
- বিভাগসমূহঃকবিতা
এই বৃষ্টি
চিন্তার সমস্ত রং ধুয়ে গেছে শাদা হ’য়ে
মনের প্রহরী ভিজছে ছাতি হাতে নিঃকুম প্ৰহরে,
কুপকূপ বৃষ্টির গলিতে
বাসনার আলোগুলো বিমিয়ে ঝাপসা জলে পাশে ।
হে বিরতি
ঘন রাত্রে কোনখানে এক স্তব্ধ চেয়ে আছে :
মেঘে-মেঘে ভয়ংকর আসন্নতা,
বোবা বুক চিরে ঝলে বর্ষার বিজলি শঙ্কাহারা,
শুধু মেনে নেওয়া বেলা, প্রবাসে যেমন ৷।
বসন্তের মাঝামাঝি এই বর্ষাকাল,
প্ৰস্তুত ছিলো না, তবু এলো যেই, ব্যস্ত মন
রাজি হ’লো ঘোরাফেরা চেনার কল্পনা ফুল ভুলে,
ফেলে গিয়ে ঘরে-ফেরা সুদূর কাহিনী,
শুধু ভিজতে, খানিকক্ষণ ধারাবাহী মগ্ন অবকাশে ।
মাটির প্রতীক্ষা আর ঘাসের শ্যামতা সঞ্চারিত
নির্মান নতুন পাওয়া
অস্ফুট স্বদেশী ছাপ রেলিঙের ধারে৷।
এপারে
দেখলাম দু-চক্ষু ভ’রে, হে প্ৰভু ঈশ্বর মহাশয়
চৈতন্যে প্ৰসন্ন সূৰ্য,
খচিত রাত্রির দেয়া গান
রেডিয়ো নক্ষত্রে বাজিলো এই দেহে ঝিমঝিম দূরে
শিরায় জড়ানো নহবৎ ।
ইন্দ্ৰিয়ের চুর্ণ সুরে
জেগেছে সংসার প্রান্তে আদিম গায়িত্ৰীমন্ত্রময়
ভুভূবঃ স্বঃ।
হোক না স্বেচ্ছায় বন্দী প্ৰাণ
হঠাৎ মুক্তি সে পেল।
( কিছু বন্দীদশা ইচ্ছাতীত,
সে তর্কে নামবো না। আজ । )
মহাশয়, পার্থিবের দেশে
স্বীকার্য, অনেক হ’লো : সভ্যতা যতই পাপ কাজে
যুদ্ধে হানে জ্যোতিবুদ্ধি, রক্তবহ যন্ত্রণ সমাজে
গঙ্গোত্রীর ধারা নেমে বার-বার অলক্ষ্য রঙ্গিত
ধুয়ে মুছে দিয়ে গেলো মুহুর্তে অক্ষয় লোকালয়
কোটি মৃত্যু কান্না ছোয়া সমুদ্রের নীল নিরুদ্দেশে ।
শুধু আজ্ঞা দাও, যেন বুঝি
আয়ুকাব্য মহাময়
অধ্যায়ে-অধ্যায়ে খোলা অভাব্যের এই পরিচয়
গ্ৰন্থিবাধা তারি মধ্যে এসে আমি জন্মমৃত্যুপারে
আজো কোন খুজি বাসা,
এদিকে পঞ্চাশ হ’লো, দিন
এ যাত্ৰা সন্ধ্যায় ক্রমে সন্ধিক্ষণে হ’য়ে আসে। ক্ষীণ
পালা-বদলের বেলা,
মেলাবে কি যোগ অন্ধকারে
সৌর ধুলো তৈরি দেহ রাখি যবে, ঘরে-ফেরা বাঁশি–
বহু পথ এসেছি তো বস্টনে বাঙালি দূরবাসী ৷
এম্পান্যোল্
বঙ্কিম ভঙ্গিতে কাঁপা খেয়ালি পথের বেহালায়
দূর সমুদ্রের পথ চিনে
কেন এ ইস্পানি গান গাও এই কঠিন মার্কিনে ;
মধু তাল উত্তাল নৃত্যনীল সুরে মাতা’
রোদ্দুরে বিদ্যুতে গাঁথা
বাজাও স্পন্দিত ধ্বনি ক্যাস্টানেটে ।
হালকা খুশির ভান
অশ্রুতে করে আনচান
মেদ্রিদের অলিন্দের একাকী উৎসুক বুক ফেটে ;
ভিড়ে ছুঁলো সে লাবণী অনির্দেশ মেঘের ভাসান ।
এই গানে অলিভের ছায়া দোলে,
আঙুরের মিষ্টিতে সোনা মদরস ভ’রে তোলে,
আঙুলে মুদ্রার ভাষা, পায়ের নাচের তাল খোলে
এ-গানের যা-ই নাম দাও
এই গান
এই প্ৰেম, এই প্ৰাণ
কভু বাস্ক্, ক্যাটালনিয়ান্
পাহাড়ের নীল-কাটা আভা দৃষ্টি তাও
চেনা চেয়ে বেশি,
শুধু নয় মন্ত্র অন্যদেশী–
এর টুইটাং ঘণ্টা শাদা ধুলো রাস্তা বেয়ে
চঞ্চল চলন্ত কত জীবনীর ছায়া ছেয়ে
দাঁড়ায় মিনার তলে, পান্থশালা রঙিন বাজারে
প্ৰাচীন ইস্পানি খচা ভারি দরজা তারি ধারে ;
আজ আনে দু-দিনের রক্তে কোন আঁকাবাঁকা
যুগান্ত পৌঁছনো প্ৰাণ, বিস্মরণী ছাঁকনিতে ছাঁকা ।
হয়তো পেরিয়ে পিরেনিসে
বিদ্রোহীর ধ্যানে মিশে
কাসাল্স্ চেলোয় তাঁর নির্বাসিত বেদনার স্পেন
অগণ্যের ঘরে জাগা
নতুন প্ৰাণনী লাগা
শৈলাভ গ্রামের বুকে এ-গান নিলেন ৷।
ওক্লাহোমা
সাক্ষাত্ সন্ধান পেয়েছ কি ৩-টে ২৫-শে?
বিকেলের উইলো বনে রেড্ এরো ট্রেনের হুইসিল
শব্ দ শেষ ছুঁয়ে গাঁথে দূর শূণ্যে দ্রুত ধোঁয়া নীল ;
মার্কিন ডাঙার বুকে ঝোড়ো অবসান গেলো মিশে ||
অবসান গেল মিশে ||
মাথা নাড়ে ‘জানি’ ‘জানি’ ক্যাথলিক গির্জাচুড়া স্থির,
পুরোনো রোদ্দুরে ওড়া কাকের কাকলি পাখা ভিড় ;
অন্যমনস্ক মস্ত শহরে হঠাত্ কুয়াশায়
ইস্পাতি রেলের ধারে হুহু শীত-হাওয়া ট’লে যায়||
শীত হাওয়া ট’লে যায় ||
হৃত্পিণ্ডে রক্তের ধ্বনিযেখানে মনের শিরা ছিঁড়ে
যাত্রী চ’লে গেল পথে কোটি ওক্লাহোমা পারে লীন,
রক্ত ক্রুশে বিদ্ধ ক্ষণে গির্জে জ্বলে রাঙা সে-তিমিরে—
বিচ্ছেদের কল্পান্তরে প্রশ্ন ফিরে আসে চিরদিন ||
ফিরে আসে চির দিন ||
কোথায় চলছে পৃথিবী
তোমারও নেই ঘর
আছে ঘরের দিকে যাওয়া।
সমস্ত সংসার
হাওয়া
উঠছে নীল ধূলোয় সবুজ অদ্ভূত;
দিনের অগ্নিদূত
আবার কালো চক্ষে বর্ষার নামে ধার।
কৈলাস মানস সরোবর
অচেনা কলকাতা শহর—
হাঁটি ধারে ধারে
ফিরি মাটিতে মিলিয়ে
গাছ বীজ হাড় স্বপ্ন আশ্চর্য জানা
এবং তোমার আঙ্কিক অমোঘ অবেদন
আবর্তন
নিয়ে
কোথায় চলছে পৃথিবী।
আমারও নেই ঘর
আছে ঘরের দিকে যাওয়া।।
চার্লস নদীর ধারে
স্মরণাতীতের রৌদ্রভূমি
সেখানে এনেছো তুমি,
স্পষ্ট লেখা
নিবিড় ঘাসের গূঢ় রেখা
কচি নাচে
অঙ্গের আসঙ্গে ডুবে আছে
শ্যামতির মাঠে ;
মেঘোৰ্ত্তীর্ণ শূন্যের ললাটে
এক জোড়া পানকৌড়ি তীর বেগে দূরে যায়
মধ্যাহ্নে বার্নিশ করা আকাশের গায়,
মনোপারে তীর পায় ;
কানের অচেনা পটে ভাষার বুনুনি
ঝুমঝুমি আদি কথা শুনি
মানে যার অশব্দ কাকলি,–
যেটুকুতে কাজ চলে শুনি আর বলি।
যে-কোনো দু-জনে গল্পে চলে রাস্তা দিয়ে
ছলছল বুকে যায় আত্মীয় বুলিয়ে,–
ভাবি ডেকে প্রশ্ন করি অন্য কোন দিনের কুশল
কত কাল ভুলে যাওয়া জন্মফল ;
পাড়ার প্রত্যেক বাড়ি বিস্ময় আঙুল তুলে বলে :
অন্য সংসারের চিমনি তলে
কোন এ শীতের লগ্নে উৎসবের বেলা এলো ফের,–
ধোঁয়া ওঠে কুণ্ডলী প্রশ্নের ॥
পিঁপড়ে
আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে ঘুরুক দেখুক থাকুক
কেমন যেন চেনা লাগে ব্যস্ত মধুর চলা —
স্তব্ ধ শুধু চলায় কথা বলা —
আলোয় গন্ধে ছুঁয়ে তার ঐ ভুবন ভ’রে রাখুক,
আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে ধুলোর রেণু মাখুক ||
ভয় করে তাই আজ সরিয়ে দিতে
কাউকে, ওকে চাইনে দুঃখ দিতে |
কে জানে প্রাণ আনলো কেন ওর পরিচয় কিছু,
গাছের তলায় হাওয়ার ভোরে কোথায় চলে নিচু —
আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে সেই অতলে ডাকুক |
মাটির বুকে যারাই আছি এই দুদিনের ঘরে
তার স্মরণে সবাইকে আজ ঘিরেছে আদরে ||
বিনিময়
তার বদলে পেলে—
সমস্ত ঐ স্তব্ ধ পুকুর
নীল-বাঁধানো স্বচ্ছ মুকুর
আলোয় ভরা জল—
ফুলে নোয়ানো ছায়া-ডালটা
বেগনি মেঘের ওড়া পালটা
ভরলো হৃদয়তল—
একলা বুকে সবই মেলে ||তার বদলে পেলে—
শাদা ভাবনা কিছুই-না-এর
খোলা রাস্তা ধুলো-পায়ের
কান্না-হারা হাওয়া—
চেনা কণ্ঠে ডাকলো দূরে
সব-হারানো এই দুপুরে
ফিরে কেউ-না-চাওয়া |
এও কি রেখে গেলে ||
বৃষ্টি
কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে।
ফাল্গুন বিকেলে বৃষ্টি নামে।
শহরের পথে দ্রুত অন্ধকার।
লুটোয় পাথরে জল, হাওয়া তমস্বিনী;
আকাশে বিদ্যুৎজ্বলা বর্শা হানে
ইন্দ্রমেঘ;
কালো দিন গলির রাস্তায়।
কেঁদেও পাবে না তাকে অজস্র বর্ষার জলধারে।
নিবিষ্ট ক্রান্তির স্বর ঝরঝর বুকে
অবারিত।
চকিত গলির প্রান্তে লাল আভা দুরন্ত সিঁদুরে
পরায় মূহুর্ত টিপ,
নিভে যায় চোখে
কম্পিত নগরশীর্ষে বাড়ির জটিল বোবা রেখা।
বিরাম স্তম্ভিত লগ্ন ভেঙে
আবার ঘনায় জল।
বলে নাম, বলে নাম, অবিশ্রাম ঘুরে-ঘুরে হাওয়া
খুঁজেও পাবে না যাকে বর্ষায় অজস্র জলধারে।
আদিম বর্ষণ জল, হাওয়া, পৃথিবীর।
মত্ত দিন, মুগ্ধ ক্ষণ, প্রথম ঝঙ্কার
অবিরহ,
সেই সৃষ্টিক্ষণ
স্রোত:স্বনা
মৃত্তিকার সত্তা স্মৃতিহীনা
প্রশস্ত প্রচীর নামে নিবিড় সন্ধ্যায়,
এক আর্দ্র চৈতন্যের স্তব্ধ তটে।
ভেসে মুছে ধুয়ে ঢাকা সৃষ্টির আকাশে দৃষ্টিলোক।
কী বিহ্বল মাটি গাছ, দাঁড়ানো মানুষ দরজায়
গুহার আঁধারে চিত্র , ঝড়ে উতরোল
বারে-বারে পাওয়া, হাওয়া, হারানো নিরন্ত ফিরে-ফিরে-
ঘনমেঘলীন
কেঁদেও পাবে না যাকে বর্ষায় অজস্র জলধারে।
বে-স্টেট রোডে
ঠিক তাই ; ধারে-আসা। একটি কথার প্রতি ধাপে
শব্দ যেই স্তব্ধ হ’য়ে ভাবনা আভার নীলে ঠেকে
সেখানে সিঁড়িতে বসা, পাশে দেখা পশ্চিমী পাতার
লাল তামা আসন্নত নবেম্বরে, রঙা অশ্রুভার
অন্যতার প্রান্ত-নিঃশ্বসিত ; ট্রাফিকের ভিড় থেকে
কেম্ব্রিজের ব্রিজে শোনা সমস্ত নগর দূরে কাঁপে
একটি গুঞ্জন জনতার ; বারে-বারে শীর্ষে থামা,
ঊর্ধ্বে জ্বলে বৌদ্ধতারা, বহুরাত্রিপারে দৃষ্টিনাম ॥