এই বিভ্রান্তি আরো বাড়ে যখন দেখা যায় তথাকথিত বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিরা শুধু দলগতভাবে ধর্মীয় অপশক্তির সঙ্গে আঁতাত গড়ার উদাহরণ সৃষ্টি করা নয়, ব্যক্তিগতভাবেও ধর্ম ও ধর্মাচরণকে অনুসরণ করেন। মুখে মার্কসীয় দর্শনের কথা বলেও এবং বামপন্থী দলের কমী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেও, যখন নেতৃস্থানীয় বা বিরল দু’ চারজন বাদে, বাকী সবাই পূজাআচ্চায় অংশগ্রহণ করা বা উৎসাহ দেওয়ার সঙ্গে, শ্ৰাদ্ধ-’শুভ’ বিবাহ-উপনয়ন-পৈতে-কোরান খানিনামাজ জাতীয় নানাবিধ ব্যক্তিগত ক্রিয়াকাণ্ডে নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মানুষ্ঠান করেন (অন্তত তার সক্রিয় প্রতিবাদ করেন না, বরং সমর্থনে নানা যুক্তি দেখান) এবং নিজের প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম পরিচয়কেও দূর করেন না, তখন অন্য মানুষ এদের বস্তুবাদী দর্শন ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে খুব একটা আমল যে দেবেন না তাতে কোন সন্দেহ নেই। পাশাপাশি দেখা যায়, যে ব্যক্তিত্বের উদাহরণ লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারত, পশ্চিমবঙ্গের সেই মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী, তার অতীত সংগ্রাম ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব সত্ত্বেও, ডঃ পাচু গোপাল রায়ের ভাষায়, ‘রিলিজিয়াস ওয়াইফ’ ও ‘ক্যাপিট্যালিস্ট সন’-কে সপ্ৰেমে-সস্নেহে মদত দিয়ে যান। অবশ্যই তাঁর সহকমী নেতৃত্বের অনেকেই এই ধাৰ্মিকতা ও পুঁজিলোভী মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। কিন্তু কারোর ব্যক্তিগত আচরণ ও বিশ্বাসে আঘাত না করার নাম করে, সর্বোচ্চ নেতৃত্বের এমন দু একজনের এবং তার ঘনিষ্ঠতমদের মধ্যেও এমন আচরণ ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই না করাটা বামপন্থার অন্তঃসারশূন্যতার দিকে ইঙ্গিত করতে যথেষ্ট। এ অবস্থায় ধর্মের জনবিরোধী অপব্যবহারের বিরুদ্ধে এবং ভাববাদী দর্শনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা তথা বস্তুবাদী দর্শনে অন্যদের শিক্ষিত করার কাজের ভিত্তিটিই আলগা হয়ে যায়। বামপন্থীদের এমন রিলিজিয়াস ওয়াইফ’-রা মৌলবাদী নিশ্চয়ই নন, হয়তো হবেনও না, কিন্তু তা সাধারণ মানুষকে রিলিজিয়াস’ না হওয়ায় অনুপ্রাণিত অন্তত করে না। এবং এরা যদি ধর্মান্ধতা-সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তির শিকার হন তবেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গে বলা যায়, সংগঠিত বামপন্থী দলের এহেন উদাহরণ এবং অন্যান্য বামপন্থীদের অসংগঠিত অবস্থানের সঙ্গে, প্রায় দু দশক ধরে তথাকথিত বাম-শাসনের পরেও এখানকার জনগণের নানা সমস্যার এমন কিছু গুণগত কোন পরিবর্তন ঘটে নি, বরং বাড়ছে। ব্যাপারটি অবশ্যই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা জটিলতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বিচ্ছিন্নভাবে একটি দেশের একটি রাজ্যে জনগণের সব সমস্যার সমাধান ঘটে যাবে, এটি ভাবাটাও হাস্যকর। কিন্তু সমস্ত কয়েমী স্বার্থগুলিকে প্ৰতিহত করে জনগণকে সংগঠিত করার এবং সংগঠনের সর্বস্তরে বস্তুবাদী দার্শনিক প্রচারের কাজও নিতান্তই অবহেলিত, অন্তত সংগঠন বাড়ানো ও ভোট কুড়ানোর উদ্যোগের তুলনায়। এ অবস্থার একটি ভয়াবহ পরিণতি হল, বিজেপি-র মত ধর্মীয় মৌলবাদীদের পশ্চিমবঙ্গের মত ‘বামপন্থী’, ‘আলোকিত রাজ্যেরও তৃণমূল অব্দি সংগঠনের বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হওয়া-তা সে যত দুর্বল ভাবেই হোক না কেন। এই বিস্তারকে উপেক্ষা করার ভবিষ্যৎ পরিণাম ভয়াবহ হতে বাধ্য।
ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ প্রতিরোধে বামপন্থা ও বামপন্থীদের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি বলেই ব্যাপারটি বেশি নাড়া দেয়। ভারতের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সহ অন্যান্য দক্ষিণপন্থীদের থেকে এ প্রত্যাশা অনেক কম, তার বড় কারণ তারা বস্তুবাদী দর্শনের কথাই বলে না, এবং ভাববাদের বিরুদ্ধে লড়াইটিও তাদের কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত নয়। তবু ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেও এই দক্ষিণপন্থী নেতৃত্বকে দেখা যায় সাইবাবার মত ম্যাজিসিয়ানধর্মব্যবসায়ীদের বা চন্দ্ৰস্বামীর মত ধান্দাবাজ ধৰ্মজীবীদের পেছনে পেছনে ঘুরতে, মন্দির-মসজিদ-গীর্জার ঐশ্বরিক শক্তির কাছে নতজানু হতে, যজ্ঞ ও জ্যোতিষসহ নানা অপবৈজ্ঞানিক ক্রিয়াকাণ্ডের সাহায্য নিতে। এমনকি আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কথা বলা প্ৰয়াত রাজীব গান্ধীও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। এদের কেউ এসব করেন নিজস্ব বিশ্বাস থেকে, কেউ বা ভোটের বাক্সের দিকে তাকিয়ে। আর জাতপাতের রাজনীতি তো বাম-ডান সব রাজনৈতিক দলেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধর্ম ও জাতপাতের অস্তিত্ব সমাজে আছে বলেই রাজনীতিতে তা প্রতিফলিত হয়। কিন্তু তা অবশ্যম্ভাবী। নয়। সচেতন শুভ ইচ্ছায় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিও করা সম্ভব এবং তাইই কাম্য, তাইই সুস্থ। আসলে অৰ্জ্জুন যেমন জলে মাছের ছায়া দেখে মাছকে বাণবিদ্ধ করে দ্ৰৌপদীকে লাভ করেছিলেন, এইসব ক্ষমতালিঙ্গু রাজনৈতিক দলগুলিও ভোটারদের ধর্মবিশ্বাসের দিকে লক্ষ্য রেখে ধর্মের বাণে তাদের হৃদয়বিদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এবং লাভ করতে চান আকাঙ্খিত গদিটি।
এইসব রাজনৈতিক দলগুলির কাজের পদ্ধতিতেও ধর্মীয় মৌলবাদীদের মত রাজনৈতিক সংকীর্ণতার আভাষ পাওয়া যায়। এতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা সাধারণ মানুষ ধর্মীয় মৌলবাদীদের কথাবার্তাতেও খুব একটা অস্বাভাবিকত্ব খুঁজে পায় না। সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদ যেমন মানুষের মানুষ পরিচয়ের চেয়ে ধর্মীয় বা সম্প্রদায়গত পরিচয়কেই প্রধান বলে গণ্য করে, উগ্র-অনুগ্র ‘কম্যুনিষ্ট’ বা কংগ্রেসসহ নানা রাজনৈতিক দলও একই ভাবে মানুষের মানুষ পরিচয় ভুলিয়ে দিয়ে কে কোন পার্টি করে বা কোন পার্টির কাছাকাছি-এইটিকেই প্রধান বিবেচ্য বলে মনে করে। শত্ৰু-মিত্ৰ চেনা বা শ্রেণীবিভাজন করা অবশ্যই দরকার, কিন্তু যখন তার নাম করে ভিন্ন রাজনৈতিক দলের দরিদ্র এক ছাপোষা মানুষ বা কৃষক-শ্রমিককেও শত্রুর পর্যায়ে ফেলে দেওয়া হয় কিংবা হত দরিদ্র এক কনস্টেবল ট্রাফিক পুলিশকে শ্রেণীশত্রু হিসেবে গণ্য করে হত্যা করা হয় (এবং বিরাট বৈপ্লবিক কাজ করা হল বলে তৃপ্ত হওয়া যায়), তখন তার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদের সংকীর্ণতার খুব একটা তফাৎ পাওয়া যায় না।