- বইয়ের নামঃ পঞ্চানন মালাকরের গল্প
- লেখকের নামঃপঞ্চানন মালাকর
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
ভূমিকা – পঞ্চানন মালাকর
দরজা খুলেই অমলের পিছনের মানুষটিকে দেখে পাথর হয়ে গেল রমিতা। একদিন যাকে দেখলে তার মনের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউ উছলে পড়ত, সারা শরীরে কুল কুল করে বয়ে যেত এক শিহরণের নদী, সেই অনুতোষ এসেছে তারই কাছে। আর কেন এসেছে তাও রমিতা জানে। কয়েক মুহূর্ত কোনও কথা ফুটল না মুখে। অভ্যাগতদের অভ্যর্থনার কথাও ভুলে গেল যেন। স্থানকাল-পাত্র সবই বিস্মৃত হল। কী করবে ভাবতে পারছে না এই মুহূর্তে। তাকে নিশ্চল পাথর হতে দেখে, অবাক হল অমল। তাড়া দিয়ে বলল, কী হল মিতাদি! আমাদের বসতে বলবে না নাকি?
ও হ্যাঁ! এসো। দরজা থেকে অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় সরে দাঁড়ায় সে, আসুন।
দ্বিতীয় আহ্বান অনুতোষকে লক্ষ্য করে। আপনি সম্বোধন ছুঁড়ে দিয়েই তার মনের মধ্যে একটা হাসি খেলে গেল। যে মানুষটিকে একদিন প্রিয়তম সম্বোধনেই ডাকত, তার সঙ্গে আজ সহবতে সংযত হতে হয়। ওদের বসবার ঘরে বসিয়ে ভিতরে চলে যায় রমিতা। হয় তো এই আচমকা দেখা হওয়ার অপ্রস্তুত ভাবটাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য একটা আড়াল খোঁজে। বেশ কয়েক বস্ত্র পরে হলেও অনুতোষ তাকে হঠাৎ করে নাড়া দিল। বেশ ভুলে ছিল সেকথা। এভাবে আবার মুখোমুখি হয়ে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সামনে পড়তে হবে, ভাবেনি কোনও দিন। জীবনের একটা অধ্যায়কে সে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু মুছে ফেলতে চাইলেই সবকিছুকে কি মোছা যায়?
তা, প্রায় সাত-আট বছর আগের কথা। রমিতা বাইশ বছরের তরুণী। ঝকঝকে চেহারা। চালচলনে একটা উচ্ছলতা। সে সময়েই প্রথম পরিচয় অনুতোষের সঙ্গে। মফস্বল শহরের ছেলে। কলকাতায় ভাল চাকরি নিয়ে এসেছে। চেহারার মধ্যে একটা। মিষ্টি আকর্ষণ। তারই বন্ধুর দাদার সঙ্গে এসেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন রমিতা এম.এ পড়ে। একটা আড়ষ্টতা থাকলেও মানুষটিকে তার ভাল লেগেছিল। কলকাতার মেয়ে, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া রমিতা সেদিন খুব একটা ভাববার সময় পায়নি। অনুতোষের সঙ্গে আলাপ গাঢ়তর হয়ে গেল কয়েকদিনেই। তারপর অনেক গল্প, অনেক নির্জন অবসর। যৌবনের মুক্ত আনন্দের স্রোতে গড়ে নিয়েছিল এক স্বপ্নময় জগৎ। এভাবেই অনুতোষ তার জীবনের রঙ্গমঞ্চের নায়ক হয়ে গেল।
রমিতার মা ছাড়া সংসারে কেউই ছিল না। মা-ই নিজের রোজগারে তাকে মানুষ করছিলেন। একমাত্র মেয়ের সুখের ভাবনাই তার জীবনের লক্ষ্য। প্রথমে অনুতোষের সঙ্গে তার বিয়ের কথায় তিনি আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কঠিন হতে পারেননি। অনুতোষের সঙ্গে রমিতার বিয়ে হয়ে গেল। এর কিছুদিন পরেই অনুতোষ কলকাতা থেকে বদলি হয়ে চলে গেল নিজের শহরে।
কলকাতা ছেড়ে যেতে তার খুব কষ্ট হয়েছিল। বিশেষ করে মাকে ছেড়ে যেতেতো মনের মধ্যে কষ্টের ঝড় উঠেছিল। তবুও সে অনুতোষের হাত ধরে গিয়ে উঠেছিল তাদের বাড়িতে।
সেই ওঠাই হল। জীবনের যে মধুর স্বপ্ন মনের আকাশকে রাঙিয়ে তুলেছিল, তার রঙ ফিকে হয়ে হারিয়ে গিয়েছিল অচিরেই। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মেয়ের সঙ্গে অনুতোষের পরিবারের মানুষরা কেউ মানিয়ে নিতে পারেনি। বিশেষ করে তার মা। আজ ভাবতেও অবাক লাগে। শিক্ষিত বউ ঘরে এনেছে বলে অনুতোষ তার মায়ের কাছে কম কথা শোনেনি। প্রথম প্রথম মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করত রমিতা। তবুও শেষ রক্ষা করতে পারল না। তাকে নিয়ে এমন একটি সমস্যা গড়ে উঠল, যার সমাধান কেউ খুঁজে পেল না। সাবেকি সংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হল তাকে। কিন্তু দেখল, যে মানুষটির সমর্থন সে পাবে ভেবেছিল, সে তাকে সমর্থন করল না। এনিয়ে অনুতোষের সঙ্গে তার খিটিমিটি লাগতে লাগল। বাপ মরা একমাত্র মেয়ে রমিত। মায়ের কাছে তাকে কোনওদিন কোনও বিষয়ে হাত পেতে বিমুখ হতে হয়নি। এই পরাজয় তার মনে বড় আঘাত হানল। সে অভিমানে অনুতোষদের ঘর ছেড়ে চলে এল।
তারই দেহের রক্তকণিকায় গড়া একমাত্র সন্তান, ফুলের মতো ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েটিকে জেদের বসে ছেড়ে এসেছিল সে। বুকের হৃৎপিণ্ড যেন ছিঁড়ে ফেলে এসেছিল সেদিন। মা হয়ে একমাত্র মেয়েকে ছেড়ে আসার যন্ত্রণা কারও কাছে কখনও বলতে পারেনি। রাতের পর রাত বালিশ ভিজিয়েছে চোখের জলে। তবুও তীব্র অভিমানে নিজের বুকে পাথর চেপে রেখেছিল। মেয়ের জন্য কোনও দাবি করেনি। মেয়ে তার বাবা আর ঠাকুমার কাছেই রয়ে গেল। আজ সে প্রায় ছ’বছরের হয়েছে। এখন দেখে হয়তো চিনতেও পারবে না। নিজের মেয়ে বলে সে কোনও দাবি করতে পারবে না। দাবি সে করেও না। জীবনে যে পাওয়াটুকু তার প্রাথমিক পাওনা ছিল, তাকেই ধরে রাখতে পারেনি, তার আবার সন্তান। নিজের কোনও ভবিষ্যৎ ছিল না বলেই মেয়েকে তার বাবার হাতেই রেখে এসেছিল। অনুতোষ ও তার মা সেটাই চেয়েছিলেন। রমিতাও মেনে নিয়েছিল। মেয়ে তার বাবার কাছেই ভাল থাকবে। এখনও মনের মধ্যে মেয়ের জন্য একটা কষ্ট হয়। সে কষ্ট তার একান্ত নিজের। বাইরের কেউ জানে না; জানবেও না।
এখন মনে হচ্ছে, তার মেয়ের জন্যই হয়তো তার কাছে এসেছে অনুতোষ। অনুতোষকে দেখেই ভেবেছিল, ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু পারছে না। মনের মধ্যে একটা ইচ্ছা বারবার উঁকি দিচ্ছে। নিজের মেয়েকে দেখতে পাওয়ার প্রবল আকাঙক্ষা। মেয়ে। হয়তো জানবে না; সে তার মা। তবু সে তো একবার দেখার সুযোগ পাবে। এমনি করে একটা পরীক্ষার সামনে পড়তে হবে ভাবেনি কখনও। আজ মনে হচ্ছে, সেদিন ওভাবে হুট করে চলে না এলেই বোধহয় ভাল হত। কিন্তু তখন রাগের মাথায় অন্য কিছু ভাববার অবকাশ পায়নি। সেসব কথা মনে হয় বিগত জন্মের গল্প।
অনুতোষ কয়েকবার তার সঙ্গে দেখা করেছিল। ফিরে যেতে অনুরোধও করেছিল। তার কোনও অনুরোধেই আর সাড়া দেয়নি সে। শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেল দু’বছরের মাথায়। নতুন এক অধ্যায়ের শুরু হল তার জীবনে। মেয়ের জন্য মনের কষ্টটাকে গলা টিপে মেরে ফেলে দিতে চেয়েছে। পারেনি। তবুও সে সব ভোলার জন্য অনেক চেষ্টায় একটা অফিসে চাকরি জুটিয়ে নিল। মা তাকে আবার বিয়ে করতে বলেছিল। রাজি হয়নি সে। পাছে সে ঘরও ভেঙে যায়। হয়তো সে ভয়ও একদিন থাকত না। তার আগেই মা অসুস্থ হয়ে তার ঘাড়ের বোঝা হয়ে রইল। এখন প্রায় অথর্ব। অসহায় বৃদ্ধার সে-ই একমাত্র সম্বল। মায়ের কথা ভেবেই আর বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে মাথা ঘামায়নি।
অনুতোষ তার জীবন থেকে হারিয়েই গিয়েছিল। ধরেই নিয়েছে, নতুন করে সংসার পেতে সুখেই আছে। আবার সে যে বদলি হয়ে কলকাতায় এসেছে খবরও তার জানার কথা নয়। জানার প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেছে তার কাছে। অসুস্থ মায়ের সেবা আর চাকরিটাই একমাত্র বর্তমান হয়ে আছে তার জীবনে। অতীতও নেই, ভবিষ্যৎ নেই।
তবুও কয়েকদিন আগে তার অফিসের সহকর্মী অমলের কাছ থেকে একটা অদ্ভুত প্রস্তাবে, নানা করেও রাজি হয়েছিল সে। অমল জানাল, তার এক পরিচিত ভদ্রলোক ছোট্ট একটি মেয়েকে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করতে চান। কিন্তু তিনি একটু বিপদে পড়েছেন।
রমিতা বলল, বিপদটা কী?
যে স্কুলটায় ভর্তি করাতে চাইছে, সেখানে মেয়ের মা বাবার একটা ইন্টারভিউ নেবে।
কেন? মা বাবার ইন্টারভিউ কেন?
ওঃ মিতাদি। তুমি আজকাল কোনও খবরই রাখে না দেখছি। অমল তাকে বুঝিয়ে বলল বিষয়টা। আজকাল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ছেলে মেয়েকে ভর্তি করাতে গেলে, বাবা-মাকেও তারা যাচাই করে দেখবে। দেখবে সেখানে ছেলে-মেয়ে পড়ানোর মতো শিক্ষা এবং কালচার তাদের আছে কিনা।
রমিতা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া মেয়ে। কিন্তু এখন তার ধরন ধারণ অনেক পালটে গেছে। সেসব খবর সত্যিই সে রাখে না। এখন ছেলে মেয়ের পড়াশোনার ক্ষেত্রে বাবা মায়ের ভূমিকা আগের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাবা মাকে যাচাই করবার দু-একটা ঘটনার কথা সে শুনেছে তবে ও নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি। অমলের কাছে শুনল ভদ্রলোক মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করতে চান। কিন্তু সেক্ষত্রে বিপদটা কোথায়? অমলের কথায় জানতে পারে, এই ভদ্রলোকের মেয়ের মা সেজে তাকে ইন্টারভিউ দিতে হবে। তাকে সাজতে হবে কেন? সন্দেহটাকে সে গোপন করতে পারেনি। অমলকে জিজ্ঞেস করে রমিতা, আমাকে সাজতে হবে কেন? মেয়েটির কি মা নেই?
তা ঠিক জানি না। অমল তাকে ঠিক সংবাদ দিতে পারে না, হয়তো ওর মা তেমন লেখাপড়া জানে না। তুমি রাজি হও মিতাদি। ভদ্রলোক খুব মুশকিলে পড়েছেন।
অমলের অনুরোধ এড়াতে পারেনি সে। ছেলেটিকে সে ছোট ভাইয়ের মতো। স্নেহ করে। তাতেই ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে অমল এসেছে তার কাছে। ভদ্রলোক যে অনুতোষ তা সে এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে কি তাকে তারই মেয়ের জন্য অভিনয় করতে হবে। অনুতোষ কি সত্যিই আর বিয়ে করেনি? না কি যাকে বিয়ে করেছে সে বেশি লেখাপড়া করেনি। কিছুই বুঝে উঠতে পারে না রমিতা। প্রথমে ভাবল, আমলকে ডেকে না করে দেয়। অনুতোষের সঙ্গে এভাবে আবার মুখোমুখি হতে ইচ্ছে নেই তার। পরক্ষণেই মনে হল, যদি তারই মেয়ের জন্য এসে থাকে? তার কি না করা সাজে? অনুতোষের সঙ্গে তার আজ আর কোনও সম্পর্ক না থাকলেও, মেয়েটি তো তার নিজের। মেয়ের ভাল করার দায়িত্ব তারও তো কম নয়। দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলায় মনটা দুলে ওঠে। কিন্তু যে মেয়েকে সে নিজের ভাবছে, সেকি তার নিজের আছে? সে কি তাকে মা বলে কোনও দিন স্বীকার করতে পারবে। হয়তো তার কাছে রমিতা আজ মৃত। মেয়ের কাছে তার অস্তিত্বই আর নেই। তবুও কোথাও যেন একটা দুরন্ত ইচ্ছা তাকে তিল তিল করে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে তার দৃঢ়তার আসন থেকে। না এভাবে সে হেরে যেতে চায় না। যে অবস্থার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তাকে আর অস্বীকার করার কোনও পথ নেই। মনকে গুছিয়ে নিল। কাজের মেয়েটিকে চায়ের কথা বলে বাইরের ঘরে এসে ঢুকল। অমল তাকে দেখেই বলল, এই যে মিতাদি! তোমাকে যার কথা বলেছি,—মিঃ গুহ। অনুতোষ গুহ। আর উনি মিতাদি!
হাত তুলে নমস্কার করল সে। অনুতোষও দ্বিধাগ্রস্তের মতো হাত তুলে নিশ্চল হয়ে বসে রইল। অনুতোষের দিকে চোখ ফেলে নিমেষে অনেককিছু দেখে নিল সে। আগের থেকে চেহারায় পরিবর্তন এসেছে। বয়সের ছাপ পড়েছে মুখের রেখায়। কানের পাশে চুলে সাদা রঙের ছোঁয়া লেগেছে। একটু হয়তো বা মুটিয়ে গেছে। অমলের কাছে শুনেছে চাকরিতে পদমর্যাদা বেড়েছে। না বাড়ার কোনও কারণ নেই; ছেলে হিসেবে অনুতোষ তো কোনওদিন খারাপ ছিল না।
ঘরের মধ্যে একটা অপ্রস্তুত নীরবতা। যাকে ঠিক সহ্য করতে পারছিল না সে। এভাবে সবার চুপ করে যাওয়া বেমানান। কী কথা বলবে? কীভাবে বলবে? ঠিক করে উঠতে পারে না রমিতা। একদিন ও মানুষটির সঙ্গে কলকাতার বহু জায়গায় ঘুরে ঘুরে কথা ফুরত না, অপ্রয়োজনীয় কথাও কত দরকারি মনে হত, আজ তার মুখোমুখি বসে প্রয়োজনীয় কথাই খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ এভবে বসে থাকার কোনও মানে নেই। কিছু একটা বলা দরকার। কে বলবে? কী বলবে? কীভাবে বলবে? ভাবতে ভাবতেই চা নিয়ে ঘরে ঢুকল কাজের মেয়েটি। রমিতা চায়ের কাপ এগিয়ে দিল দু’জনের দিকে। চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতেই কিছুটা স্বাভাবিক হল সে। অমলকে উদ্দেশ্য করে কথা বলল, চা খেতে খেতে কাজের কথা হোক! কী বল?
সেই ভাল। অমল চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, বলার তো কিছু নেই। তোমাকে তো আগেই বলেছি। এবার তুমি মিঃ গুহর সঙ্গে কথা বলে নাও। কবে যেতে হবে, কী করত হবে? কী বলেন মিঃ গুহ।
হ্যাঁ! মানে…নিজেকে সামলানোর প্রচেষ্টা অনুতোষের কণ্ঠে। এতক্ষণে সে পরিস্থিতির সঙ্গে অনেকটা মানিয়ে নিয়েছে বোঝা গেল। নিজেকে সংযত করে বলল, আমার মেয়ের স্কুলে ভর্তির জন্য একদিন আপনাকে ওর মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে।
অভিনয়! কথাটা কানে একটা বিদ্রুপের খোঁচা দিল। আমার মেয়ে বলে অনুতোষ যেন তাকে একটু আঘাতও করল। আজ মেয়েটি শুধুই অনুতোষের। রমিতার কোনও অধিকারই সেখানে নেই। সে অনুতোষের চোখে চোখ রাখল। অনুতোষের অপরাধী দৃষ্টি জানালার বাইরে যেন আড়াল খুঁজতে চাইছে। রমিতা মনে মনে ভাবল, অভিনয় তো বটেই। এখন অনুতোষ আর সে তো অভিনয়ই করছে। তারা দুজন সুদক্ষ অভিনেতা অভিনেত্রী, আর অমন তদর সামনে বসে আছে অজ্ঞ দর্শকের মতো। রমিতা ভাবল, মানুষ তার মনের দিক থেকে কত নিরাপদ। এখন অনুতোষ আর তার কথা অমল কিছুই জানতে পারছে না। সেই কি জানতে পারছে অনুতোষের কথা? নাকি কোনও দিন পেরেছে? মানুষ তার মনের মধ্যে সম্পূর্ণ একা। সেখানে কারও ঢোকার ক্ষমতা নেই। সকলেই এক একটা মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে। রমিতা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কেন? আপনার স্ত্রী! মানে মেয়ের মা পারবেন না ইন্টারভিউ দিতে?
রমিতার প্রশ্নে চোখ তোলে অনুতোষ। ইঙ্গিতটা বুঝতে একটু সময় নেয়। তারপর ধীর কণ্ঠে জবাব দেয়, ওর মা এখানে নেই। সেসব অন্য কথা। আপনি যদি এই কাজটা করে দেন, আমি উপকৃত হব।
উনি তোমাকে তোমার পারিশ্রমিক দেবেন। অমল মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করে।
পারিশ্রমিক! রমিতার কণ্ঠে একটু বিদ্রূপ খেলে যায়। অনুতোষ তার মেয়ের জন্য আজ তাকে টাকা দিতে চায়। পারিশ্রমিক। হ্যাঁ তাতো দিতেই পারে, তাদের মধ্যে তো এখন তার কোনও সম্পর্ক নেই। তারা পরস্পরের কাছে অচেনা, অজানা।
হ্যাঁ। তোমার কথা মতো বলেছি। উনি তাতে রাজি।
কত দেবেন? প্রশ্নটা অমলকে করলেও বাঁকা দৃষ্টি একবার অনুতোষকে ছুঁয়ে যায়। অনুতোষ চুপ করে থাকে। কথা বলে অমল, কত চান?
মূল্য দিয়ে মানুষের সব প্রয়োজন মেটে কিনা জানেনা রমিতা। কিন্তু তার মনে পারিশ্রমিকের প্রসঙ্গে একটা অভিমান খেলা করে। নিজের কথা মনে করে তার জেদি স্বভাবের ঘোড়াটা যেন তীব্রবেগে ছুটতে তাকে। ছুটতে ছুটতে তা এক সময়ে ঘৃণায় পরিণত হয়। মনের উপরে একটা কঠোর আবরণ টেনে দিয়ে বলে, পাঁচশো টাকা।
বেশ তাই হবে। অনুতোষ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চাইল। পারিশ্রমিকের কথা বলে রমিতা নিজের চাহিদা প্রকাশ করায় তার আড়ষ্টতা কেটে গেল। কথা আর বেশি দূর এগোল না। ইন্টারভিউয়ের দিন, ঠিক সময়ে এসে রমিতাকে তার গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবে অনুতোষ। আবার কাজের শেষে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবে। ওরা উঠল। রমিতার বুকের মধ্য একটা পুরনো ঘা থেকে টুপটাপ করে নিঃশব্দে রক্ত ঝরতে লাগল।
***
সকাল সাড়ে দশটায় অনুতোষ গাড়ি নিয়ে এল। রমিতা তৈরি হয়েই ছিল। পায়ে পায়ে গাড়ির কাছে এগিয়ে গেল। গাড়ির পিছনের সিটে ছোট্ট মেয়েটিকে বসে থাকতে দেখেই তার বুকটা দুলে উঠল। এই কি তার মেয়ে? জানে না সে! জানলেও চেনা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অনুতোষ মেয়েকে ডেকে বলল, রণি! তামার মা! রণির চোখে অবিশ্বাস আর সন্দেহ একই সঙ্গে তাকে যাচাই করতে চাইল, অনুতোষ রমিতাকে বলল, তোমার মেয়ে রমিতা।
রমিতার মনে একটা মৃদু কম্পন খেয়ে যায়। তার মেয়ে। আজ তার মেয়েকে তারই সঙ্গে পরিচয় দিয়ে চিনিয়ে দিতে হচ্ছে। বেশ মিষ্টি চেহারা। বাবার আদল পেয়েছে ঠিক। নামটা তারই নামের সঙ্গে মিলিয়ে রেখেছে। না রাখলেও কোনও ক্ষতি ছিল না। কিন্তু এই সামান্য কারণে কোথায় যেন অনুতোষের হৃদয়ের স্পর্শ অনুভব করল মনে মনে।
অনুতোষের আচরণে আজ কোনও জড়তা নেই। অনেকটা সহজেই আগের এলে ‘তুমি’ সম্বোধন করল। রমিতা হাসতে চেষ্টা করল, তবে সে হাসি রণিতার সন্দিগ্ধ চোখের দিকে তাকাতেই কেমন শুকিয়ে গেল। অনুতোষ মেয়ের দিকে ঝুঁকে বলল, রণি! সত্যিই তোমার মা। একটু সরে মাকে বসতে দাও।
না! আমি একলাই বসব। রণিতার কণ্ঠে তীব্র জেদ। তার মতোই জেদি হয়েছে মেয়েটা। রমিতা সহজ হতে চাইল, থাক না। আমি সামনেই বসছি।
রমিতা সামনে উঠে বসল। একবার পিছন ফিরে দেখল। রণিতা বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে মনটা যে এদিকে তা বোঝা যায়। অতটুকু মেয়ে হলেও সে নিশ্চয়ই জেনে গেছে, রমিতা একদিনের জন্যই তার মা সাজতে এসেছে। অনুতোষ গাড়িতে স্টার্ট দিল। রমিতা পথ চলার অস্বস্তিকে ভেঙে দিতে চাইল, তোমার আর ছেলে-মেয়ে?
তুমি হয়তো জান না, আমি আর বিয়ে করিনি।
যা স্বাভাবিক, তার বিরুদ্ধ ধারণায় মানুষ হোঁচট খায়। রমিতা ভেবেছিল, অনুতোষ আবার বিয়ে করে থাকবে। হয়তো স্ত্রী দেশের বাড়িতে থাকে। এবার তার কণ্ঠে সহানুভূতি ফোটে, কেন? এভাবে জীবন কাটানোর চেয়ে একটা বিয়ে করলেই পারতে!
তা পারতাম। তবে রণির কথা ভেবে আর করিনি।
রমিতা কী বলবে খুঁজে পেল না। অনুতোষ আগের থেকে অনেক সহজ, তুমিও তো করোনি?
আমার ব্যাপারটা অন্য। ইচ্ছে করলেও আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। মা অথর্ব হয়ে আমার কাঁধে ভর করেই বেঁচে আছে। তাছাড়া মনকে মানিয়ে নিতে পারতাম না বলেই ওসব চিন্তা ছেড়ে দিয়েছি।
পিছনে না তাকালেও বুঝতে পারছে, পিছনের সিটে বসা ছোট্ট রণিতা তাদের কথা শুনছে। কৌতূহল দমন করতে না পেরে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। সঙ্গে সঙ্গে রণিতা চোখ দুটোকে বাইরে পাঠিয়ে দিল। তবুও তার মুখে কেমন একটা বিস্ময় খেলা করতে দেখল। হয়তো এই দু’জন নরনারীর কী সম্পর্ক তা ভাববার চেষ্টা করছে। শিশুদের মন সব বিষয়েই বেশ সচেতন তা সে অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করেছে।
নিজের কথা ভেবেও রমিতা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। আজ একই গাড়ির যাত্রী হয়েও সে তার নিজের সন্তানকে ছুঁতে পারে না। আদর করে কোলে নিতে পারে না। মা বলে কোনও দাবি করতে পারে না। তবুও তো ওই শিশু তারই সন্তান। আর অনুতোষ! অনুতোষের সঙ্গেও এই মুহূর্তে তার কোনও সম্পর্ক নেই। একদিন যে অনুতোষের সঙ্গে তার সবচেয়ে মধুর সম্পর্ক ছিল, আজ তারই পাশে বসে আছে সম্পর্কহীন পরিচয়ে। এসব ভাবতে ভাবতে, হতাশায় ভাঙতে থাকে সে। এক সময়ে গাড়ি এসে পৌঁছে যায় স্কুলের সামনে।
স্কুলের কাজ মিটে যায় সহজেই। রণিতা তার সঙ্গে কথা বলেনি একটাও। সেও বুঝতে পেরেছে তাদের তিনজনের মধ্যে একটা নাটকের অভিনয় চলছে। যাকে ছোটবেলা থেকে কোনওদিন দেখেনি, তাকেই হঠাৎ মা বলে হাজির করানোর মধ্যে সে একটা মিথ্যে সাজানো ঘটনার আঁচ পেয়ে গেছে।
মা বাবা সম্পর্কে সে স্কুলের অধ্যক্ষার কাছে সন্তোষজনক উত্তর দিলেও, রমিতাকে মেনে নেয়নি। একটা দূরত্ব থেকে গেছে তার আচরণে। কাজ মিটে যাবার পরে অনুতোষের অনুরোধে তার ফ্ল্যাটে যাওয়ায় আপত্তি করেনি রমিতা। মনের মধ্যে মেয়ের সান্নিধ্য পাওয়ার ইচ্ছাটাকে দমন করতে পারেনি।
অনুতোষের ফ্ল্যাট বেশ বড়ই। উচ্চ-পদস্থ কর্মীর ফ্লাট যেমন হয়। আভিজাত্যের ছাপ সর্বত্র। আধুনিক আসবাবপত্রে একটা বৈভবের ছায়া। বসবার ঘরটিতে ঢুকেই বুঝতে পারে অনুতোষ এখন অনেক উপরে উঠে গেছে।
তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনুতোষের কণ্ঠে মৃদু অনুরোধ ঝরে, তুমি বোসো! আমি চায়ের কথা বলে আসছি।
বলেই ভিতরে চলে যায় সে। রণিতা এক পাশে দাঁড়িয়ে। তার চোখের সন্দেহ এখনও প্রকট। রমিতা সহজ হতে চেষ্টা করে তাকে কাছে ডাকে, এসো। তোমার সঙ্গে গল্প করি।
রণিতা তার ডাকে সাড়া দেয় না। তেমনি দূরেই দাঁড়িয়ে থাকে। রমিতা তাকে দ্বিতীয়বার ডাকতে সাহস পায় না। সে বুঝতে পারছে, ওই ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গে এখন তার দূরত্ব অনেক। সেই দূরত্ব কমানোর ক্ষমতা তার নেই। মা হিসেবে তার কোনও দাবি ওর কাছে নেই। ওরা যেন দুই ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ভিতরে চলে যায় রণিতা। সে বুঝে গেছে এই মহিলাকে তার বাবা স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে নিয়ে এসেছে, সে কাজ শেষ। এরপরেই তার চলে যাওয়ার সময় এসেছে। এর বেশি প্রয়োজনীয়তা রমিতার নেই। আর পাঁচজন অচেনা মহিলার মতো সেও এদের কাছে অচেনা, অজানা।
একটু পরেই ফিরে আসে অনুতোষ। কাজের মেয়েটা জলখাবার নিয়ে ঘরে ঢোকে। রমিতা এখন অনুতোষের বাড়িতে অতিথি। অথচ একদিন এই সংসারে তার অধিকার ছিল স্বীকৃত। যন্ত্রের মতো চায়ের কাপ তুলে নেয় সে। অনুতোষের কণ্ঠে অনুযোগ ফোটে, একী! একটু কিছু মুখে দাও।
না শুধু চা-ই ভাল।
অনুতোষ দ্বিতীয়বার অনুরোধ করতে পারে না। তাদের মধ্যে একটা আড়ষ্টতা কাজ করে। নিঃশব্দে চায়ের কাপে চুমুক দেয় দুজনে। তাদের জীবনের সব কথা যেন শেষ হয়ে গেছে। মনের দরজায় তালা পড়ে গেছে। শত চেষ্টা করেও তার চাবি খুঁজে পায় না কেউ। বয়সের ভারে অভিজ্ঞ দুটি মন আজ একটি নিরেট কাঁচের দেয়ালের দু’পাশে বসে আছে। কারোর মধ্যে সে দেয়াল ভেঙে ফেলার মতো কোনও শক্তিও নেই, প্রচেষ্টাও নেই। বয়সের সঙ্গেই মানুষ তার উৎসাহ আর উদ্যমকে হারিয়ে ফেলে। তারাও আজ তেমনি নিঃস্ব দুটি মন। তাদের যেন করার কিছুই নেই।
চা শেষ হয়। রমিতা এবার উঠে দাঁড়ায়। তার যাবার সময় হল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, অনেক সময় কেটে গেছে। অনুতোষের কাছে অনুমতি চাওয়ার মতো করে বলল, এবার আমি উঠি।
ও হ্যাঁ! অনুতোষও উঠে দাঁড়ায়। তারপর হঠাৎ মনে পড়ার মতো করে বলে, দাঁড়াও তোমার টাকাটা।
কিসের টাকা?
তোমার পারিশ্রমিক।
পারিশ্রমিক দিতে চাইছ! একটা ম্লান হাসি ফুটে ওঠে রমিতার কণ্ঠে, এটা তুমি ভাবলে কী করে?
না! মানে, সে রকমই তো কথা ছিল। কিছুটা দ্বিধায় পড়ে বলে অনুতোষ, তুমি নিজেই তো…
কথা শেষ করতে পারে না সে। তার আগেই রমিতা কথা বলে, আমি বলেছিলাম। দেখলাম তুমি আমার মেয়ের জন্য কতটা ভাব। আর তখন তো আমি শিওর ছিলাম নারণিতা আমারই মেয়ে। নিজের মেয়ের মা সাজার জন্য টাকাটা নাই বা নিলাম।
দরজার পাশ থেকে ছোট্ট একটা ছায়া যেন সরে গেল। রমিতা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, মেয়ের প্রতি আমার কোনো দাবি নেই। সেদিন যেভাবে তাকে ছেড়ে যেতে হয়েছিল, তাতে আমার অযোগ্যতাই প্রমাণিত। তবুও তো আমি ওর মা-ই। কিন্তু মা হিসেবে ওর কাছে আমার কোনও জায়গা নেই আমি জানি। আমার সত্যিকারের পরিচয় ওকে না-ই বা দিলে। ওকে বোলো, ওর মা মরে গেছে। আমি কখনই ওর সামনে মায়ের দাবি নিয়ে আসব না। ও একমাত্র তোমার মেয়ে হয়েই বেঁচে থাকুক।
কান্নায় রমিতার গলা বুজে এল। অনুতোষ কথা বলতে পারে না। সেদিনের সেই জেদি তরুণীকে খুঁজে পায় না কোথাও। আজকের রমিতার মধ্যে প্রাজিত মাতৃহৃদয়ের বিষাদ ঘনিয়ে আসতে দেখল আনুতোষ। সেদিনের সেই ঔদ্ধত্য যেন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অনুতোষের করার কিছু নেই। সেও আজ শক্তিহীন। অসহায় অথর্ব মানুষ হয়ে গেছে কখন, বুঝতেই পারেনি। নিশ্চল আনুতোষকে ও কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায় রমিতা। দরজার চৌকাঠেতে পা রাখতেই সে নিশ্চল মূর্তির মতো থেমে গেল হঠাৎ। বদ্বার ঘরের ভেতরের দরজায় তখন একখানি কচি মুখের উপর দুটি কালো ছলছলে চোখ নিয়ে রণিতার কণ্ঠ আছড়ে পড়েছে মা তুমি যেও না। আমি সব শুনেছি। তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না মা। আমি সব জানি। তোমাকে আমি কিছুতেই যেতে দেব না।
রণিতার কণ্ঠে সেই জেদ, সেই অভিমান। যা এক আনন্দধ্বনির মধ্যে রমিতার হারানো অধিকারকে ফিরিয়ে দিতে চাইছে।