হঠাৎই মনে পড়ল, একদিন নয়নার সঙ্গে তো ওর এক বন্ধু এসেছিল–ওর সঙ্গে একই হস্টেলে থাকে! কী যেন নাম মেয়েটির? কী যেন…?
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। রোজি…রোজি আচারিয়া।
সুতরাং রীণাকে এড়াতে সিগারেট কিনতে যাওয়ার ছলে বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় এলাম। বেরিয়ে এসেই মনে পড়ল, মাস ছয়েক হল সিগারেট খাওয়া আমি ছেড়ে দিয়েছি–ডাক্তারের বারণ। রীণাও সেটা জানে। নাঃ, ক্রমশ একরাশ কমজোরি মিথ্যের জালে আমি জড়িয়ে পড়ছি।
সুবিধে মতো জায়গা বেছে নিয়ে ফোন করতে দেরি হল না।
উত্তর দিল সেই একই মেয়ে।
একটু উদ্ধতভাবেই প্রশ্ন করলাম, রোজি আচারিয়া আছেন?
একমিনিট…ধরুন।
বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন ফাঁকা ঠেকল। আগে কখনও ফোন করার পর একমিনিট ধরতে হয়নি। সঙ্গে-সঙ্গেই যাকে চাই তাকে পেয়ে গেছি। তা ছাড়া কৃতান্তর কাছেই শুনেছি, নয়না আর রোজি কম করে দু-বছর ধরে ও-বাড়িতে আছে।
সরি, একটু পরেই মেয়েটির গলা শুনতে পেলাম, ও-নামে এখানে কেউ থাকে না।
ওঃ গড!
কী হল? কিছু বলছেন?
নয়না বোস, রোজি আচারিয়া, কেউই এখানে থাকে না?
আপনিই কি একটু আগে ফোন করেছিলেন?
হ্যাঁ।
দেখুন, এরকম বাজে ইয়ার্কি করে…।
ইয়ার্কি! কাল রাতেই আপনি আমাকে বলেছেন, মিস বোস এখন বাড়িতে নেই, কোনও খবর দেওয়ার থাকলে আমি আপনাকে দিতে পারি। আমি পরে ফোন করব বলে ছেড়ে দিয়েছি। আর এখন আপনি বলছেন, ও নামে এখানে কেউ থাকে না!
দেখুন, জানি না কীভাবে আপনাকে বোঝাব। কাল রাতের সব ফোন আমিই ধরেছিলাম, কিন্তু আপনার ফোনটার কথা আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। যদি বলেন, তা হলে আর-একবার খোঁজ করতে পারি!
না, থাক দরকার নেই। রিসিভার নামিয়ে রাখলাম।
তারপর ফোন করলাম কৃতান্তকে। ওকে বাড়িতে পেলাম না। ওর স্ত্রী, কামিনী, বলল, কোথায় যেন বেরিয়েছে। কোথায় গেছে জিগ্যেস করতে জবাব পেলাম, বোধহয় ছাইপাঁশ গিলতে।
ফোন নামিয়ে রেখে বুঝলাম, আমি ভয় পেয়েছি।
মঙ্গলবার। রাত।
আজ রাতে রীণা পাশের ফ্ল্যাটে গল্পগুজব করতে গিয়েছিল। সেই সুযোগে ঘর থেকেই ফোন করলাম কৃতান্তকে। জিগ্যেস করলাম রোজির কথা।
কে?
রোজি, রোজি।
কে রোজি? ও জানতে চাইল।
শালা, তুই ভালোভাবেই জানিস কোন রোজি! ন্যাকামো হচ্ছে।
কী ব্যাপার? তুই কি ঠাট্টা করছিস নাকি? কৃতান্ত রুক্ষ স্বরে প্রশ্ন করল।
নকশা ছেড়ে পথে আয়। কী ইয়ার্কি করছিস!
একটা প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দে দেখি! বলল কৃতান্ত, এই রোজি-টা কে?
রোজি আচারিয়াকে তুই চিনিস নানয়নার ক্লোজ ফ্রেন্ড?
না। কে সে?
তুই কোনওদিন রোজি, নয়না বোস আর আমার সঙ্গে কোথাও যাসনি?
নয়না বোস! কী উলটোপালটা বকছিস!
নয়না বোসকেও তুই চিনিস না?
না। চিনি না। আর তোর এই বেয়াড়া জোক কিন্তু এবার তেতো হয়ে উঠছে। জানি না তোর মতলব কী, কিন্তু এবার দয়া করে ক্ষান্ত দে। তুই ভালোভাবেই জানিস, আমরা দুজনেই…।
শোন! রিসিভারে মুখ লাগিয়ে চিৎকার করে উঠলাম তিন সপ্তাহ আগে শনিবার রাতে তুই কোথায় ছিলি?
এক মুহূর্ত ও চুপচাপ রইল। তারপর বলল, কেন, সে-রাতে আমি আর তুই সাকিতে একটু ইয়ে খেতে গিয়েছিলাম। মনে নেই?
হ্যাঁ, মনে আছে। তবে তার আগে নয়না আর রোজির সঙ্গে আমরা কিছুক্ষণ ম্যাড্রাস টিফিন-এ বসে আড্ডা দিয়েছিলাম, তোর মনে নেই?
না তো! আমাদের সঙ্গে তো আর কেউ ছিল না।
কোনও মেয়ে ছিল না? নয়না? রোজি?
ওহহো, আবার সেই এক কথা। হয়রান সুরে বলল কৃতান্ত, আচ্ছা, কী ব্যাপার বল তো? কী হয়েছে তোর?
মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল। পাশের দেওয়ালে হাত রেখে নিজেকে সামলে নিলাম।
উঁহু কিছু হয়নি– নীচু গলায় জবাব দিলাম।
তোর শরীর ঠিক আছে তো? কথাবার্তা শুনে তো মনে হচ্ছে ভীষণ আপসেট হয়ে পড়েছিস!
ফোন নামিয়ে রাখলাম। সত্যিই আমি আপসেট হয়ে পড়েছি। মনে হচ্ছে যেন সাতদিন ধরে উপোস করছি, অথচ সারা পৃথিবীতে মুখে দেওয়ার মতো কোনও খাবার নেই। কেউ যেন একরাশ হাওয়া আমার শরীরে, মাথায়, জোর করে ঢুকিয়ে দিচ্ছে–দিয়ে চলেছে।
আমার হলটা কী?
বুধবার। বিকেল।
রোজি আর নয়না সত্যি-সত্যিই উধাও হয়ে গেছে কি না, সেটা যাচাই করে দেখার একটাই মাত্র পথ রয়েছে।
নয়নার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল কলেজের এক বন্ধুর মারফত সুধাকর…সুধাকর নন্দী। সুধাকরের বাড়ি ছিল ওদেরই পাড়ায় হিন্দুস্থান পার্কে। নয়না যে পরে আস্তানা বদল করে রাসেল স্ট্রিটে এসেছে তা জানতাম না। জেনেছি কৃতান্তকে সঙ্গে নিয়ে সেই সন্ধেবেলা ওর সঙ্গে সেকেন্ড টাইম দেখা হওয়ার পর। সুধাকর প্রথম আলাপ করিয়ে দেওয়ার সময় বলেছিল, নয়না কিন্তু খুব ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর জেদি। তার ওপর একটু খামখেয়ালি টাইপ…।
সেইজন্যেই হয়তো এতদিন পরেও ওর নাম আর মুখ আমি ভুলিনি। কে জানে, হয়তো পরে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝগড়া-টগরা করে হস্টেলে গিয়ে উঠেছে।
সুধাকরের সঙ্গে কলেজের পর যোগাযোগ নেই আজ বহুবছর। তার মেইন কারণ, পড়াশোনা শেষ করে ও চাকরি নিয়ে দিল্লি চলে গিয়েছিল। আর যাওয়ার আগে দিল্লির ঠিকানা ও আমাকে দিয়ে যেতে ভোলেনি।
এত সব ভাবনাচিন্তার পর এই কথাটাই মনে আসে ও নয়না আর রোজির ব্যাপারটা মোটেও আমার কল্পনা নয়। আমি জানি ওরা রিয়েল–অন্তত একদিন ছিল।
সুতরাং ঠিক করলাম, আজ সুধাকরকে একটা ফোন করব। বলব, কী হয়েছে। ওকে রিকোয়েস্ট করব, নয়না সম্পর্কে কিছু খোঁজখবর নিয়ে আমাকে জানাতে, যাতে আমি এই মিস্ট্রিটাকে হালকা রসিকতা অথবা কাকতালীয় বলে মেনে নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারি।