বাবা মা দুজনই রামেন্দু-বাবা বা গুরুজী বলতে অজ্ঞান। চাকরিটা যে বাবার এখনও হচ্ছে না, তা নিয়েও বাবার মাথাব্যাথা নেই। বাবা মা এখন আর বাবা মা নেই। গুরুজী যা বলে তাই অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করে। ‘সাশাকে গলা টিপে মেরে ফেলো’, গুরুজী এই আদেশ করলে আমার বিশ্বাস, বাবা মা ঠিক ঠিকই আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলবে। যত যাই ঘটুক বাড়িতে, আমি যে কিছুতেই যাবো না রামেন্দু-বাবার কাছে আর, জোর করলে পুলিশ ডাকবো, তা ঘোষণা করে দিই। এও বলি, ‘আমি যাবো না, যদি যেতেই হয়, আমার লাশের ওপর দিয়ে আমি যাবো’।
এরপর পেটে বাচ্চা এলো, বললাম মা’কে। মা বিলাপ শুরু করলো। বাবাকে জানালো, বাবা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। দুজনেরই দৃঢ় বিশ্বাস বাচ্চা অগ্নির। অগ্নির সঙ্গে আমার কোনও শারীরিক সম্পর্ক নেই, তারপরও ওদের অভিযোগগুলো চুপচাপ শুনতে হয় বসে বসে। যতবারই বলি প্রেগনেন্ট হয়েছি রামেন্দু-বাবার ধর্ষণের কারণে, বাবা আর মা দুজনই আমাকে অসভ্যের মতো মারতে শুরু করে, কেউ বিশ্বাস করে না রামেন্দু-বাবা আমার শরীর স্পর্শ করেছে। পেটের বাচ্চা নষ্ট করবো, জানিয়ে দেওয়ার পরও কেউ এগিয়ে আসে না। কোনো উৎসাহই যেন নেই আমাকে নিয়ে আর। আমার জীবন নিয়ে আমি যেন যা ইচ্ছে তাই করি। আমার মুখ তারা দেখতে চায় না। আমি তাদের মান ইজ্জত সব নষ্ট করে দিয়েছি। কোথাও আর তাদের মুখ দেখানোর জো নেই।
শেষ অবদি অগ্নিকে বলি আসতে। অগ্নিকে সব বলার পর অগ্নি ক্লিনিকে নিয়ে অ্যাবরসন করিয়ে আনে। টাকাটা ওই দেয়। অ্যাবরসন করার পর দু’সপ্তাহ আমাকে শুয়ে থাকতে হয়। অগ্নির বাড়িতে আসা বারণ। মা বাবা এখন আর কেউ চায় না যে অগ্নি আসুক আমার কাছে। পরনির্ভর এই অবস্থায় বাড়ি থেকে বেরিয়েও যেতে পারি না। একটা স্নেহের ভালোবাসার সংসার তছনছ হয়ে গেল। অগ্নিকে যে বলবো, বাড়ি থেকে চলে যাবো, অগ্নির সঙ্গে থাকবো, তাও বলছি না। অগ্নি নিজেই এখনও কলেজে পরছে, ছোট জাত বলে, গরিব বলে অবহেলা অপমান পায় চারদিকে, ও পড়ালেখা শেষ করে ভালো কিছু কাজ করুক। ওর কাঁধে চড়ে বসে ওর স্বপ্নকে মেরে ফেলতে আমি চাই না। আমাদের ফোনে কথা হয় প্রতিদিন।
পুরোপুরি সুস্থ হইনি, এরমধ্যে একদিন অগ্নির কাছে শুনি, আমার বাবা অগ্নির বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেছে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, অগ্নি আপাতত পালিয়ে যাচ্ছে শহর ছেড়ে। অগ্নির জন্য আমার খুব কষ্ট হতে থাকে। একবার মনে হয় আত্মহত্যা করি। কিন্তু সে পথে না গিয়ে আমি নিজেকে বোঝাই, একটু সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলে পুলিশ স্টেশনে গিয়ে রামেন্দু-বাবার বিরুদ্ধে মামলাটা আমি নিজেই করবো, পুলিশ যদি কথা না শোনে, তাহলে সোজাসুজি মিডিয়ায় যাবো। বসে বসে চোখের জল ফেলার চেয়ে জল টল মুছে একটু রুখে দাঁড়ানোই ভালো। এইসব ধর্ষক বাবাদের মুখোশখানা এখন না খোলা হলে কবে আর খোলা হবে!
আমার দেহ নিয়ে আমি যা খুশি করব
তেরো বছর বয়স আমার তখন। এক দিন শুনি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র হঠাৎ মেয়ে হয়ে গেছে। নাম ছিল আবুল হোসেন, মেয়ে হওয়ার পর নাম হোসনে আরা।ক’দিন পরই লাল বেনারসি পরে হোসনে আরা বিয়ে করে ফেলল তার হোস্টেলের রুমমেটকে। খবরের কাগজে আবুল হোসেন আর হোসনে আরা-র ছবি পাশাপাশি ছাপা হত।
আবুল হোসেন সব সময় মৌলানাদের স্কার্ফের মতো একটা স্কার্ফ পরত, বুক আড়াল করার জন্য। ভেতরে ভেতরে মেয়েই ছিল সে, কিন্তু জন্মের পর আত্মীয়স্বজন ভেবেছিল সে ছেলে, ভাবার নিশ্চয়ই কোনও কারণ ছিল। বড় হয়ে আবুল হোসেন বুঝতে পরেছিল সে ছেলে নয়।
লজ্জায় ভয়ে অনেক বছর কাউকে কিছু বলেনি। ছেলেদের হোস্টেলে থাকত, সবাই তাকে ছেলে বলেই জানত। কিন্তু এক সময় অস্বস্তির চরমে পৌঁছে ডাক্তারের শরণাপন্ন হল। ডাক্তার কী একটা অপারেশন করলেন, ব্যস, আবুল হোসেন মেয়ে হয়ে গেল। খবরটা পড়ে আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল হঠাৎ এক দিন ছেলে হয়ে যেতে।
কিন্তু বুঝতাম, আবুল হোসেনের শরীরটা যেমন ভেতরে ভেতরে মেয়ের শরীর ছিল, আমার শরীরটা ভেতরে ভেতরে ছেলের শরীর নয়। আসলে মেয়েদের ওপর পারিবারিক সামাজিক ধার্মিক রাষ্ট্রিক অত্যাচার এত বেশি হত যে ছেলেতে রূপান্তরিত হয়ে এ সব থেকে বাঁচতে চাইতাম।
অন্য কোনও কারণ ছিল না।লিঙ্গ কিন্তু তত সহজ নয়, যত সহজ বলে একে ভাবা হয়। লিঙ্গ শুধু শারীরিক নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানসিক, মনস্তাত্ত্বিকও। অধিকাংশ লোক ভাবে, জগতের সব সুস্থ মানুষই বুঝি শরীরে পুরুষ, মনেও পুরুষ; অথবা শরীরে নারী, মনেও নারী।
কিন্তু এর ব্যতিক্রমও আছে। ব্যতিক্রমটা বুঝতে হলে জেন্ডার বা মনোলিঙ্গ বুঝতে হবে। শরীরে যেমন লিঙ্গ থাকে, মনেও এক ধরনের লিঙ্গ থাকে, লিঙ্গবোধ থাকে।
যাদের শারীরিক জৈবলিঙ্গের সঙ্গে মনোলিঙ্গের কোনও বিরোধ নেই, তাদের আজকাল ‘সিসজেন্ডার’ বলা হয়। জগতের সবাই সিসজেন্ডার নয়, অনেকে ট্রান্সজেন্ডার, সিসজেন্ডারের ঠিক উলটো। পুরুষের শরীর নিয়ে জন্মেছে, কিন্তু মনে করে না যে সে পুরুষ, মনে করে সে নারী;
আবার ও দিকে নারীর শরীর নিয়ে জন্মেছে, কিন্তু মোটেও সে বিশ্বাস করে না যে সে নারী, তার দৃঢ় বিশ্বাস সে পুরুষ। এই ট্রান্সজেন্ডাররা বা রূপান্তরকামীরা নড়নচড়নহীন রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ‘পেন ইন দি অ্যাস’।