বাংলাদেশের মতো শান্ত স্নিগ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ দেশটি উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে ধর্মান্ধতে, জঙ্গিতে। এই জঙ্গিদের যারাই তৈরি করেছে, কোনও ভালো উদ্দেশে করেনি। তারা দেশের এবং দেশের মানুষের স্বাধীনতা এবং স্বকীয়তায় বিশ্বাস করে না। যত বেশি ধর্মান্ধ হয়েছে মানুষ, তত বেশি সন্ত্রাসী হয়েছে। সন্ত্রাসের চর্চা চলতে থাকলে মানুষ বেপরোয়া হয়ে আত্মঘাতী সন্ত্রাসের পথে পা বাড়ায়।
মানুষের অনিষ্ট করে ধর্মের সেবা করার যে নিয়ম শুরু হয়েছে, তা শুরুতেই শেষ না করলে আমরা সব মরে শেষ হয়ে যাবো, পৃথিবীতে শুধু বেঁচে থাকবে দজ্জালের মতো কিছু খুনি। আমাদের কি তেমন এক পৃথিবীর দিকে এই পৃথিবীকে যেতে দেওয়া উচিত? রুখে দাঁড়াবার সময় কি এখনও আসেনি?
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৬ এপ্রিল, ২০১৭
বাংলাদেশ বদলে গেছে
প্রাচীন চীনের একটি দর্শন ছিলো, ‘এমন কিছু তুমি অন্যের সঙ্গে কোরো না, যা অন্য কেউ তোমার সঙ্গে করলে তোমার মোটেও ভালো লাগবে না। ’ এই দর্শনটিই ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট। এই দর্শন মেনে চললে নীতিবান এবং আদর্শবান হওয়ার জন্য আলাদা করে ধর্মের দরকার হয় না। ধর্ম মেনে চললে চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, খুন, লোক ঠকানো, মিথ্যে বলা, অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, ঘুষ খাওয়া, ঘুষ দেওয়া ইত্যাদি লোকে করে না। বারবার কিন্তু মানুষ প্রমাণ দিয়েছে, ধর্মে বিশ্বাস রেখেও মানুষ সব রকম অনাচারই করে বা করতে পারে। সমাজের মানুষকে কুকর্ম থেকে বিরত রাখার জন্য সবচেয়ে বড় যে নৈতিক শিক্ষা, তা যে ধর্ম থেকেই আহরণ করে সবাই তা নয়। ধর্ম না মেনেও মানুষ সৎ, উদার এবং সহিষ্ণু হয়। পাশ্চাত্যে যে মানবাধিকার, নারীর অধিকার, শিশুর অধিকার, পঙ্গুর অধিকার, পশুপাখির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা কিন্তু কোনও ধর্মগ্রন্থ থেকে পাওয়া নয়। বৈষম্য এবং বর্ণবাদবিরোধী আইন প্রতিষ্ঠা করার পেছনেও ধর্ম নয়, আছে বিবেকবান মানুষ।
ষাট-সত্তর দশকে যে বাংলাদেশ আমি দেখেছি, সেই বাংলাদেশে ধর্ম ছিল, কিন্তু ধর্ম নিয়ে আদিখ্যেতা, অতিরঞ্জন, চোখ রাঙানো, ছড়ি ঘোরানো, জোরজবরদস্তি ছিলো না। মুসলমানদের মধ্যে দাড়ি রাখা, টুপি পরা আর হিজাব-বোরখা পরা জনপ্রিয় ছিল না। নামাজের চলটা অবসরপ্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে ছিলো। এতে কিন্তু ধর্ম উবে যায়নি। ধর্ম থাকা সত্ত্বেও জোর করে সংবিধানে, সমাজের সর্বত্র, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই অতিরিক্ত ধর্ম আমদানির ফল যে ভালো হবে না, আশির দশকের শেষ দিকেই অনুমান করেছিলাম। এসব নিয়ে বলেছি বলে আমি মন্দ হয়েছি। আমাকে অন্যায়ভাবে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, আজ ২৪ বছর পার হচ্ছে, এখনো আমাকে কোনও সরকারই দেশে প্রবেশ করার অনুমতি দিচ্ছে না। সেই যে বলেছিলাম ধর্মের অতি- চাষ কিন্তু ভালো ফল দেবে না, বাংলাদেশ কিন্তু তার প্রমাণ পাচ্ছে। ধর্মীয় সন্ত্রাসীতে এবং সন্ত্রাসী-সমর্থকে দেশ ছেয়ে গেছে। অতিরিক্ত ধর্ম কোনওকালেই ভালো কিছুর জন্ম দেয়নি। ধর্ম যখন ব্যক্তিগত বিশ্বাসের আওতা থেকে বেরিয়ে রাজনীতিতে পৌঁছে যায়, তখনই ধর্ম আর ধর্ম থাকে না, তখন সেটি হয়ে যায় রাজনৈতিক ধর্ম। রাজনৈতিক ধর্মের উদ্দেশ্য মানুষকে বোকা বানিয়ে ফায়দা হাসিল করা। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নামাজ পড়তে জানতেন না, রোজা করতেন না, মদ আর শূকরের মাংস খেতেন, সূরা-আয়াত জানতেন না। তিনি যে ভারত থেকে মুসলমানদের আলাদা করে পাকিস্তান নামের একটি দেশ বানিয়ে ফেললেন, তিনি কিন্তু ইসলাম ধর্মকে ধর্ম হিসেবে নয়, রাজনীতি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ক্ষমতা দখলের জন্য। সেই থেকে পাকিস্তানে এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে আর কিছু নয়, রাজনীতিই হচ্ছে। নৈতিকভাবে সৎ মানুষ হওয়া এখন আর ধর্ম নয়, ধর্ম চলে এসেছে পোশাকে-লেবাসে, হিজাবে-বোরখায়, টুপি-দাড়িতে, আলখাল্লায় অথবা পাজামা-পাঞ্জাবিতে। ধর্ম এখন আর আর্তের সেবায় নয়, ধর্ম এখন সংযমে নয়, ধর্ম এখন ধনীদের অতিভোজনে, অতিবিলাসিতায়, পাড়ায় সাতটি থাকলেও আরও দশটি মাদ্রাসা গড়ে দেওয়ায়। মানুষ এখন অন্যের জন্য কিছুই গড়ে না, যা গড়ে নিজের জন্য গড়ে। পরকালে বেহেস্ত পাওয়ার আশায় গড়ে। যারা আজ ধর্মপ্রাণ বা ধার্মিক বলে সম্মান পাচ্ছে, তাদের অনেকেই যদি জানে যে পরকাল বলে কিছু নেই, রাতারাতি পালটে যাবে। নামাজ রোজা বাদ দিয়ে দেবে, আল্লাহর ইবাদতে ইতি টানবে, মসজিদ-মাদ্রাসা কিছু গড়বে না, এমন কোনও অন্যায় নেই যে করবে না। এরা যদি ভালো কাজ করে, করে দোযখের ভয়ে, আর বেহেস্তের লোভে। এরা ভালো কাজ করার জন্য ভালো কাজ করে না। মানুষের উপকারের জন্য, সমাজের উন্নতির জন্য ভালো কাজ করার কোনও আগ্রহ এদের নেই। এদেরকে কি কোনও কারণে ভালো মানুষ বলা যায়? আসলে তারাই সত্যিকারের ভালো মানুষ, তারাই সত্যিকারের ধর্মপ্রাণ, যারা কোনও কিছুর লোভে নয়, যারা ভালো কাজ করে অন্যের ভালোর জন্য। নিঃস্বার্থ মানুষের সংখ্যা সমাজে খুব বেশি নেই। বেশি নেই বলেই ধর্ম নিয়ে এত অধর্ম হচ্ছে।
জঙ্গিরাও, গবেষণা করে দেখা গেছে, বেহেস্তে যাওয়ার লক্ষ্যেই জঙ্গিবিদ্যায় দীক্ষা নিয়েছে। এখানেও কাজ করছে লোভ। লোভ অতি বেশি হওয়ায় তারা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছে। মানুষ হত্যা করতে তাদের হাত কাঁপে না, আত্মঘাতী বোমা গায়ে পরতে ভয় হয় না, মৃত্যুকে পরোয়া করছে না, মরিয়া হয়ে উঠেছে মানুষ মারার জন্য। বিশ্বাস করছে যত বেশি কাফের আর বিধর্মী মারবে, তত পোক্ত হবে বেহেস্তে তাদের আসন। এই স্থূল বিশ্বাস ঠিক কজন মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে আমার জানা নেই।