এ জন্য পৃথিবীতে যত পাপ সংঘটিত হয় তা সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যে হয়। কারণ, রাতের অন্ধকারে মানুষ সকল প্রকার পরিচিতির বন্ধন থেকে মুক্ত থাকে। সে সাহসী হয়ে ওঠে। যেমন– এখন আমায় কে দেখছে? বা এখন আমায় কে চিনবে?
মজিদ খানও এমন একজন যুবক হিসেবে পরিচিত যে, আভিজাত্যের ছোঁয়ায় নির্লিপ্ত। কারণ তার দৃষ্টিসীমা ছিল পরিচিতির নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ যা ছিন্ন করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যেদিন সে বুঝল তার আভিজাত্য আর নির্লিপ্ততা বেশ ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে, সেদিন তাকে বাধ্য হয়ে কুলসুমের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হতে হল। তার এ মনোভাবের দরুন পরে তাকে সাধারণ যুবকদের মনোবৃত্তি সংশোধনের উদ্দেশ্যে সংগঠিত আন্দোলনের সভাপতিও মনোনীত করা হয়েছিল। সভাপতি মনোনয়নের পর সাধারণ আলোচনা-সভার বিবরণী সংবাদপত্রে ছবি-সমেত ছাপা হয়। এতে করে সে শুধু শহরেই নয় এবং দেশের প্রতিটি মানুষের পরিচিত হয়ে ওঠে। শেষে মানুষের সাধারণ পরিচিতির বন্ধন এত নিবিড় হয়ে ওঠে যে তার পক্ষে রাতের অন্ধকারেও এ-বন্ধনকে উপেক্ষা করা দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তার আজো মনে আছে– গভীর রাত্রে সে একদা তার এক বন্ধুর সাথে বাড়ি ফিরছিল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে আবছাভাবে একটা গলির ভেতরে তার চোখ পড়ে। দেখে একটা নারী দাঁড়িয়ে আছে। তার বন্ধুটি ওই নারীটির কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছানোর সাথে সাথেই তার অন্তরাত্মা ধুক ধুক শুরু করে দেয়। শীতের ঠাণ্ডা রাতেও তার দেহ হতে দর দর করে ঘাম ছোটে। একটা দারুণ উত্তেজনায় তার পা দুটো থরথর করে কাঁপতে থাকে। তার ভেতর যেন একটা ভয়াবহ দানব নড়েচড়ে ওঠে– যা বছর বছর ধরে সুপ্ত ছিল। সেই বুঝি তাকে উস্কিয়ে দিচ্ছে– ‘ভয় করছ কেন? এমন ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে কে তোমায় চিনবে? কেই-বা তোমায় দেখছে?’
এ মনোভাবই তার পা দুটিকে ওই নারীটির দিকে ঠেলে দিল। ঠিক সে সময় দূর থেকে একখানা গাড়ি অন্য একটা গলি থেকে এদিকে মোড় নেয়। হঠাৎ একটা উজ্জ্বল আলোকে সমস্ত গলি ঝিকমিক করে ওঠে। আলো অত্যন্ত তীব্রগতিতে তার নিকটবর্তী হচ্ছে দেখে সে ভীত কুকুরের ন্যায় লেজ গুটিয়ে অন্য একটা গলিতে ঢুকে পড়ে। ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে। তিনি আলো দেখিয়ে তাকে পাপ থেকে মুক্ত করেছেন। কিন্তু সে-কৃতজ্ঞতার প্রকাশও অনেকটা লজ্জিত বিড়ালের থাম আঁচড়ানোর রূপ পরিগ্রহ করে।
এই একটিমাত্র ঘটনা। অনেকটা দুঃস্বপ্নের মতোই। আসলে মজিদ খানের জীবনে রাতের অন্ধকারে কুলসুম ছাড়া আর কিছুই করাচিতে তথা সমগ্র পাকিস্তানে ছিল না।
নারী যদি থাকে তো শুধু কুলসুম; রাত যদি থাকে তো তা-ও কুলসুম। কিন্তু আজ কুলসুম থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে হংকংয়ের গভীর পাহাড়ের ভেতর যখন সূর্য অস্ত গেল হঠাৎ কুইন্স রোডের উপর একটি হিংস্র অন্ধকার মজিদ খানের সমগ্র সত্তাকে ঘিরে ফেলল।
করাচি বিমানবন্দর থেকে যে-মুহূর্তেই সে হাওয়ায় ভর দিয়ে উঠেছে সেই মুহূর্তেই তার সকল প্রকার পিরীতির বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে। অতএব সে এখন কুইন্স রোডের উপর সম্পূর্ণ মুক্ত। এখানে তাকে বলবার বা জানবার কেউ নেই। অতএব সে যা-খুশি তাই করতে পারে। কোনো বন্দি যেদিন বছর-বছরের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ করে সেদিন তার মনে প্রথম আকাঙ্ক্ষা জাগে কখন সূর্য অস্ত যাবে। বেশ কিছুক্ষণ আগে সূর্য অস্ত গেছে; কিন্তু রাতের তো নাম-নিশানাও নেই। মজিদ খান এই অজ্ঞাত অন্ধকারে ক্ষুধিত পশুর ন্যায় হাত-পা ছুড়ছে যেন। এমনিতে বিদেশির কাছে অন্ধকার বড় পীড়াদায়ক হয়; তা-ও আবার শীতের অন্ধকার। গভীর আর বিস্তৃত, অতএব ভীষণ। তার ওপরে বিদেশ-বিভুঁই, যেখানে মানুষ সকল প্রকার বাধ্যবাধকতা হতে মুক্ত।
তবুও মজিদ খান পাপকে ভয় করে। কারণ?
রাত পাপের জননী। অন্ধকারের গর্ভ হতে পাপের জন্ম হয়। আর সে অন্ধকারই মজিদ খানকে ঘিরে ফেলেছে।
খানিকটা ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হংকংয়ের রাস্তায় মজিদ খান কোনো অবলম্বন খোঁজে। সে ভাবে– কোনো রিকশাওয়ালা, ট্যাক্সি ড্রাইভার বা কোনো রাতের দালালের যদি খোঁজ পাওয়া যায়, বা, স্ট্রিটল্যাম্পের নিচে একটি রাত যদি পাওয়া যায় যাতে ভর দিয়ে এই শীতল আর অজ্ঞাত অন্ধকারের হাত হতে নিষ্কৃতি পাওয়া যেতে পারে।
আলোর নিচে রাত।
মজিদ খান তার এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর মুখে শুনেছিল– সূর্যাস্তের পর হংকংয়ের স্ট্রিট-ল্যাম্পের নিচে অসংখ্য রাত জমায়েত হয়।
রাত্রির শহর হংকং। কারণ পূর্বের হংকং পশ্চিমের কলঙ্কের শেষ নিদর্শন স্বরূপ বিরাজ করছে– প্রাচ্যে ইংরেজের শেষ কলোনি। প্রশান্ত মহাসাগরে ইংরেজের শেষ যুদ্ধঘাঁটি। যার সঙ্গিন আর তোপ প্রথমে জাপানের দিকে উঁচানো ছিল, এখন চীনের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। হংকং চীনের প্রথম বার। এখানে ইংরেজ এবং আমেরিকা পরস্পরের সাহায্যে চীনা কম্যুনিজমকে ঠেকিয়ে রেখেছে। পূর্বে ইংরেজদের সূর্য শুধুমাত্র হংকংয়ের পাহাড়ে উদিত হত। আর অন্যান্য প্রাচ্য দেশে ইংরেজদের সূর্য অনেক আগে গঙ্গায়, ইরাবতিতে আর মেকংয়ে অস্ত গেছে। তাই লাখ লাখ, কোটি কোটি সৈন্য প্ৰশান্ত মহাসাগরের এই পর্বতসঙ্কুল দ্বীপে মাথা খুঁড়ে মরছে– যাতে-না এখানে ইংরেজের শেষ সূর্য প্যারল সাগরে অস্তাচলগামী হয়।