রক্তে আঁকা ভোর
০০১. আমার এই দেশেতে জন্ম
রক্তে আঁকা ভোর – আনিসুল হক
প্রথম প্রকাশ : ভাদ্র ১৪২৮, সেপ্টেম্বর ২০২১
উৎসর্গ
মুক্তিসংগ্রামে আত্মদানকারী ত্রিশ লাখ
শহীদের পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশে
.
জরুরি প্রসঙ্গ
যারা ভোর এনেছিল, উষার দুয়ারে, আলো-আঁধারের যাত্রী, এই পথে আলো জ্বেলে, এখানে থেমো না–এই পাঁচটি বইয়ের পর এই বই, রক্তে আঁকা ভোর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়পর্ব এই ডকু-ফিকশনের পটভূমি।
এই বই রচনার জন্য বিভিন্ন গ্রন্থ, সংবাদপত্র, প্রামাণ্যচিত্র থেকে ব্যাপক সাহায্য নেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও কোনো কোনো বই থেকে প্রায় হুবহু উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। ফলে এই গ্রন্থকারের একটা কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে সংকলকের, সংগ্রাহকের বা সম্পাদকের। কোন অংশ কোন বই থেকে নেওয়া হয়েছে, তার সূত্র বা উৎস নির্দেশ করতে গেলে টীকা-টিপ্পনী, তারকাচিহ্ন আর সংখ্যায় বইটি কণ্টকিত দেখাত, কিংবা সমৃদ্ধ হতো। কিন্তু তাতে উপাখ্যান হিসেবে বইটি পাঠ করাটা হয়ে পড়ত কঠিন। তাতে সত্যের দাবির প্রতি সম্মান দেখানো যেত, কিন্তু হৃদয়ের দাবি হতো উপেক্ষিত। পরিস্থিতি বোঝাতে একটা উদাহরণ দিই। আনিসুজ্জামান স্যার এই বইয়ের একটি চরিত্র। তাঁর মনের অনেক কথা, অনেক সংলাপ লিখতে সাহায্য নেওয়া হয়েছে তাঁর লেখা আমার একাত্তর বইয়ের।
১৯৭১ সাল এত বড় একটা ব্যাপার যে লক্ষ পৃষ্ঠা লিখলেও এর পরিপূর্ণ অবয়বের একটা রেখাচিত্রও সম্পূর্ণভাবে দাঁড় করানো যাবে না। সাড়ে সাত কোটি মানুষ যদি সাড়ে সাত কোটি গ্রন্থ রচনা করেন, তাহলেও বহু কথা।–বলাই থেকে যাবে। তারপরও বলব, নতুন প্রজন্মের সদস্যরা যদি রক্তে আঁকা ভোর পড়েন, তাহলে তারা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিপুল মহাসমুদ্রের বিশালতা সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করতে পারবেন। স্বাধীনতাসংগ্রামের একাত্তর পর্বের বিভিন্ন টুকরা-টাকরা অংশকে একত্র করার চেষ্টা করা হয়েছে এখানে। সবটা জোড়া দিলে একটা ছবি হয়তো দাঁড়িয়ে যায়।
আবারও বলছি, বইটি অন্য অনেক বই, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সংবাদ, প্রামাণ্যচিত্র থেকে সংগ্রহ করা ও বর্জন করা অসংখ্য টুকরো ছবির একটা সংযুক্তি। একজন সৃজনশীল লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরা ইতিহাসের একটা পর্ব, যার প্রধান উপাদান মানুষ–ছোট-বড় অসংখ্য মানুষ, দেশি-বিদেশি নানা কুশীলব।
এই গ্রন্থ পাঠ করতে হবে উপন্যাস হিসেবে, ইতিহাস হিসেবে নয়। এই প্রয়াসের সার্থকতা-ব্যর্থতা নিরূপণের ভার ভবিষ্যতের হাতে তোলা রইল।
সবাইকে ধন্যবাদ।
আনিসুল হক
ঢাকা, আগস্ট ২০২১
১
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি–ডি এল রায়ের গানের চরণ কেন মনে পড়ছে মুজিবের! তিনি কি মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছেন! মৃত্যুর গন্ধ, নাকি ভয়! ভয়ডর জিনিসটা তো টুঙ্গিপাড়ার বাইগার-মধুমতীতীরের মানুষটার দিলের মধ্যে আল্লাহ তাআলা দেননি। মৃত্যুর মতো সত্য পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। জন্ম অনিশ্চিত ব্যাপার, কিন্তু একবার জন্ম নিলে একটা পরিণতিই তারপর একেবারে নিশ্চিত, অনিবার্য, অপরিহার্য-তার নাম মৃত্যু। মৃত্যু আসবেই। মৃত্যুকে বরণ করতে পারতে হবে হাসিমুখে! তবে মৃত্যুও কাম্য, সুন্দর, কাঙ্ক্ষিত, বরণীয় হয়ে উঠতে পারে, তা যদি বড় কোনো উদ্দেশ্যের জন্য, লক্ষ্যের জন্য হয়। আব্বার ভাষায় সিনসিয়ার এবং অনেস্ট পারপাজের জন্য হয়। তার জীবনে আর কোনো আফসোস নেই। কোনো খেদ নেই। ১৯৪৭ থেকে তাঁর জীবনের একটাই লক্ষ্য–বাংলার স্বাধীনতা। সেই লক্ষ্য পূরণ এখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। তাকে হত্যা করা হবে কি হবে না, এটা তিনি জানেন না। দুটি ঘটনা ঘটতে পারে। তাকে হত্যা করা হবে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন। অথবা তাকে হত্যা করা হবে না, তাহলেও দেশ স্বাধীন। এই কথা গত ১৮টা ঘণ্টা ধরে তার বারবার মনে হয়েছে। কথাটা আজ সন্ধ্যার পর রেনুও বলেছেন, তিনিও উচ্চারণ করছেন।
দেশ স্বাধীন–কথাটা মনে হওয়ামাত্রই তাঁর মুখ একটা প্রশান্ত হাসিতে ভরে ওঠে। আজ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে, মোর চোখ হাসে, মোর মুখ হাসে, মোর টগবগিয়ে খুন হাসে। এই সৃষ্টি স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি। এই সৃষ্টি একটা নতুন দেশের সৃষ্টি। আজ সন্ধ্যার পর যখন তিনি নিশ্চিত হলেন, মিলিটারি আক্রমণ করতে আসছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পালিয়ে যাচ্ছেন, তখন থেকেই তিনি আপনমনে, পাগলের প্রায় হাসছিলেন। আই হ্যাভ গিভেন ইউ ফ্রিডম, নাউ গো, অ্যান্ড প্রিজারভ ইট। তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এরা, কে জানে! ফায়ারিং স্কোয়াডে নেওয়া হতে পারে, ফাঁসিতে ঝোলানো হতে পারে। মৃত্যু যদি আসেই, হাসিমুখে বীরের মতোই বরণ করে নেবেন তিনি, কারণ তাঁর জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তবে তিনি চান, তার মৃত্যু বাংলার মাটিতেই হোক। বাংলার মাটিতেই হোক তার শেষ আশ্রয়। বাংলা মায়ের কোলেই যেন তিনি, শেখ মুজিবুর রহমান, অনন্তের ঘুম। ঘুমাতে পারেন। শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রনেতারা তাকে অভিধা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু, মানুষ তাকে এই নামে ডাকে, পত্রপত্রিকায় তাঁর নামের আগে বঙ্গবন্ধু লেখা হয়, মার্চের শুরু থেকেই ছাত্ররা তাঁকে ডাকতে শুরু করেছে জাতির পিতা বলে; তাঁর আব্বা এখনো তাকে ডাকেন খোকা নামে, মা-ও তাই; রেনুর কাছে তিনি হাছুর আব্বা, ছেলেমেয়েদের কাছে আব্বা; তাজউদ্দীন থেকে শুরু করে তরুণতর ছাত্রনেতা–রাজ্জাক, সিরাজ, তোফায়েল, শাহ মোয়াজ্জেমদের কাছে মুজিব ভাই, বহু মানুষের কাছে শেখ সাহেব। কিন্তু নিজের কাছে কী তিনি?
বন্দুক, কামান, ট্যাংকের গর্জন, গুলি-বোমার অস্তিত্ব চুরমার করা আওয়াজ, শ্রুতিকে বধির করা হুংকার, একটু আগে রাসেলকে ফিডারে দুধ খাওয়ানোর ফলে হাতে লেগে থাকা দুধের গন্ধ, সেই গন্ধের সঙ্গে মেশা বারুদের গন্ধ, পেট্রলের গন্ধ, ঘরপোড়া ছাইয়ের গন্ধ–এই সবকিছুর মধ্যে তিনি বসে আছেন মিলিটারি ট্রাকে, যাচ্ছেন অচেনা ব্যক্তিগত গন্তব্যে, আর বাংলার সুনিশ্চিত স্বাধীনতার অনিবার্য গন্তব্যের অনিশ্চিত পথরেখা ধরে। তার মনের মধ্যে অকারণেই এই প্রশ্ন জাগে, নিজের কাছে তিনি কী! এর জবাবে একটুখানি হাসির প্রভা তাঁর উদ্বিগ্ন-ক্লান্ত মুখটাকে প্রসন্ন করে তোলে : কিছুই তো করতে পারলাম না, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছিমাত্র। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য, নীতি ও আদর্শের জন্য, তিনি একজন সামান্য ত্যাগ স্বীকারকারী মাত্র!
বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয়, যদি কেন, স্বাধীন তো হয়েই গেছে, তার মুখের হাসি উজ্জ্বলতর হয়–লক্ষকোটি বছর ধরে গড়ে ওঠা হিমালয় থেকে ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ধলেশ্বরী, মধুমতী বয়ে পলি পড়ে পড়ে গড়ে উঠেছে যে বদ্বীপ, যে বদ্বীপের মানুষেরা চিরটাকাল কেবল শোষিত হয়েই এসেছে, অথচ একদিন যা ছিল সোনার বাংলা, মধুকর ডিঙা নিয়ে লখিন্দরেরা যে বাংলার নদী-সমুদ্র বেয়ে বাণিজ্যতরি নিয়ে ভাসানে যেত, মসলিনে, মসলায়, ধানে, শস্যে যে বাংলা ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী এলাকা, বিদেশি শোষণে-শাসনে যে সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণতপ্রায়, সেই বাংলার জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন হবে স্বাধীনতা। বাংলার মানুষ স্বাধীন হবে, বাংলার মানুষ মুক্তি পাবে–হয়তো তিনিই তখন থাকবেন না। তাঁকে যদি হত্যা করা হয়, তাঁকে যেন বাংলার মাটিতে অনন্তশয্যায় শায়িত রাখা হয়। আমার এই মাটিতে জন্ম যেন এই মাটিতে মরি…
বিপরীত দিকে বেঞ্চিতে বসা একজন সৈনিক তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কোত্থেকে আসা একটা চকিত আলোর ঝলকানিতে তিনি দেখতে পান। সৈনিকটির হেলমেট-ছায়াচ্ছন্ন মুখ। সম্ভবত মুজিবের মুখে হাসি দেখে সে। বিস্মিত। একা একা হাসছে একটা লোক। তা-ও মিলিটারি ট্রাকে সশস্ত্র। শত্রুসৈন্যদের মাঝখানে বসে থেকে, ব্যাপারটা কী! সৈন্যটি কি তাকে পাগল ঠাওরাচ্ছে!
তার দুই পাশে খাকি পোশাক পরা অস্ত্রধারী সৈনিক। বিপরীত দিকেও বেঞ্চিতে সৈন্যরা বসা। এই ট্রাকের সামনের দিকে একটা ভারী অস্ত্র বসিয়ে সদা প্রস্তুত আরেকটা সৈনিক। ওই অস্ত্রটা কী? এলএমজি? রকেট লঞ্চার? শেখ মুজিব তা জানেন না। তার ৫১ বছরের জীবনে কোনো দিন তিনি। অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেননি। গোলাবারুদ, বন্দুক, কামান তার অস্ত্র নয়। তার অস্ত্র ন্যায্যতা। তার অস্ত্র মানুষের ঐক্য। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।
মাঝেমধ্যেই গোলাগুলির শব্দ কানে আসছে। সামরিক কনভয় চলার ভটভট শব্দ ভেদ করে দূর থেকে ভেসে আসছে জনতার চিৎকার। স্লোগান। তাকে বহনকারী গাড়ির সামনে আরেকটা ট্রাক, পেছনে আরেকটা। হেডলাইট নেভানো। শেখ মুজিব পকেট হাতড়ে লাইটার বের করলেন। ব্যথা অনুভব করলেন ডান হাতে। তার বডিগার্ড মহিউদ্দিনের সঙ্গে সৈন্যদের ধস্তাধস্তির সময় মুজিব এগিয়ে গিয়েছিলেন মহিউদ্দিনকে বাঁচাতে। সৈনিকদের একজনের একটা আঘাত তাঁর ডান কাঁধে লেগেছিল। তিনি যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন, তখন সৈন্যরা ছিল ঠিক তার পেছনে। তারা তাদের অস্ত্রের বাট দিয়ে তার পেছনে আঘাত করছিল। সে সময় টের পাননি, এখন পাইপে অগ্নিসংযোগ করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, বুড়ো আঙুলে জোর পাচ্ছেন না। তিনি বাঁ হাতে লাইটারটা নিলেন। একজন মেজর বলল, নো লাইট স্যার। নো ফায়ার।
শেখ মুজিব তাদের মনোভাবটা আঁচ করার চেষ্টা করছেন। তারা আলো ভয় পায়। বাংলার মানুষ যদি টের পায় যে এই গাড়িতে তাদের নেতা শেখ মুজিব আছেন, তারা পতঙ্গের মতো ছুটে আসবে। তারা মরবে, তবু শেখ মুজিবকে নিয়ে যেতে দেবে না।
শেখ মুজিব তাঁর কাজ করেছেন। তিনি তাঁর ওয়্যারলেস বার্তা পৌঁছে। দিতে পেরেছেন। হয়তো এই আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। হাজি মোরশেদের কাছে ফোনকল এসেছিল। বলধা গার্ডেন থেকে বলছি, মেসেজ পাঠানো হয়ে গেছে। ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হক তাঁর কাজ করেছেন। আশা করা যায়, ওয়্যারলেস যন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করেছে। বার্তা প্রচারের পর তারা জানতে চেয়েছে যন্ত্র কী করব? তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যন্ত্র ধ্বংস করে পালিয়ে যেতে।
সেনাবাহিনীর এই ট্রাকটা ক্যানভাস দিয়ে ঢাকা। আকাশ দেখা যাচ্ছে না। তার বা পাশে বসা সৈনিকটির মুখ তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু ভাবভঙ্গি থেকে অনুমান করা যাচ্ছে যে মুজিবের পাশে সে ঠিকঠাকমতো বসতে পারছে না। সংকোচ বোধ করছে। গাড়ির গতি ধীর। তাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায় এরা?
মুজিবের মনে হলো, এরা তাঁকে হত্যা করবে না। তার কাছে খবর ছিল, তিনি যদি পালানোর চেষ্টা করেন, তবে সেই গাড়িতে বোমা মারা হবে। গাড়িতে পলায়নরত অবস্থায় মরে পড়ে থাকবেন, এটা তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। তিনি ভেবেছেন, মারলে তাকে বাড়িতেই মারুক। প্রথম দফাতে যখন মারেনি, তখন তাকে আপাতত এরা হয়তো খুন করবে না। ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে সার্জেন্ট জহুরুল হকের মতো পেছন থেকে গুলি করে মারতে পারে কি?
আপাতত নিজের জীবন নিয়ে তিনি ভাবিত নন। নিজের জীবন, নিজের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি কমই ভেবেছেন জীবনে। এত গোলাগুলির আওয়াজ আসছে! কত মানুষই না মারা পড়ছে! বহু মানুষ রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিল। তাদের কি নির্বিচার গুলি করা হচ্ছে?
এত শব্দ কেন? এত গর্জন কেন? এত আগুন কেন? এত বোমা-বারুদ ট্যাংক। বাংলাদেশের মানুষ তো অস্ত্র হাতে তুলে নেয়নি। এবার নেবে। বাঙালি পুলিশ, বাঙালি আনসারের হাতে অস্ত্র ও গোলা বিকেলের মধ্যেই তুলে দেওয়ার নির্দেশ তিনি দিয়ে রেখেছেন। বাঙালি ইপিআরও প্রস্তুত। বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করতে চায়, এই খবর তাঁর কাছে অনেকবার এসেছে। আর যদি একটা গুলি চলে…যদি বাংলার মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। নির্দেশ পরিষ্কার। ১৪ মার্চ ৩৫টি নির্দেশনা লিখিতভাবে জারি করা হয়েছিল, তাতে তো লিখিতভাবেই বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের শাসনভার হাতে তুলে নেওয়া হলো। বলা হয়েছিল, আই অ্যাপিল টু দ্য পিপল টু রিমেইন রেডি ফর অ্যানি স্যাক্রিফাইস অ্যান্ড শুড ফোর্স বি আনলিশড অ্যাগেইনস্ট দেম, টু রেজিস্ট ইট বাই অলমিনস। যদি হামলা হয়, সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করতে হবে।
রেনু এখন কী করছে? রাসেল কি ফিডারের দুধ শেষ করতে পেরেছিল? হাসিনা, রেহানা, ওয়াজেদ মিয়া অন্য বাড়িতে। ওরা কি নিরাপদে আছে? কামাল কি এখনো রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছে? যে হারে গুলি হচ্ছে, কামাল বেঁচে থাকবে কি না সন্দেহ!
এরা কি ভেবেছে? গুলি করে আমার মানুষদের স্তব্ধ করে দেবে? এটা হয়? আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবে না।
গাড়ি নির্মীয়মাণ পার্লামেন্ট হাউসের সামনে এসেছে সম্ভবত। ক্যানভাসের ছাউনির নিচে দুই সৈনিকের মধ্যখানের ফোকর দিয়ে বাইরের গাছপালা ঘরবাড়ি দেখে তিনি তাদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলেন। ট্রাকের সামনে পেছনে তাকিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, লুই কানের নকশা করা পার্লামেন্ট ভবনের সামনেই তারা এখন অবস্থান করছেন।
ফার্মগেটের দিক থেকে স্লোগান শোনা যেতে লাগল উচ্চ স্বরে। আর মানুষের দৌড়ের আওয়াজ। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তারের নেতৃত্ব দেওয়া লে. কর্নেল জেড এ খান প্রমাদ গুনলেন। জনতা নিশ্চয়ই শেখ মুজিবকে উদ্ধার করতে আসছে। তিনি সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন, হাতিয়ার তোলো। ফায়ার করার জন্য প্রস্তুত হও।
দূর থেকেই ভেসে এল গুলির শব্দ। পায়ের আওয়াজ। জনতা পালাচ্ছে। একটু পরে জেড এ খান জানতে পারলেন, জনতা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছিল। কামান, এলএমজি, রকেট লঞ্চারের তোপের মুখে পড়িমরি পালিয়েছে। পালানোর আগে মরেছে, দৌড়ে পালাতে পালাতে পড়ে গেছে।
গাড়িবহর ক্যান্টনমেন্টের দিকে গেল না। নির্মাণাধীন অ্যাসেম্বলি ভবনের সামনে দাঁড়াল। সৈন্যরা এক সারি আগে নামল। তারপর শেখ মুজিবকে। বলল, আপনাকেও নামতে হবে। মুজিব ট্রাক থেকে নামলেন। সিঁড়ির ওপরে পা রাখলেন।
সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন তাঁরা। অনেকগুলো সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরের দিকে। বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না এই সিঁড়িগুলো এতটা ওপরে উঠে গেছে। একের পর এক সিঁড়ি বেয়ে ভবনের বাইরে জনচক্ষুর আড়ালে একটা জায়গা বাছাই করে থামলেন তাঁরা।
জিপ থেকে খুলে নিয়ে আসা একটা গদি পেতে সিঁড়িতেই তাকে বসতে দেওয়া হলো। খোলা আকাশের নিচে তারা। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। চৈত্রের আকাশে অনেক তারা। এক কোণে মেঘ। আকাশে কোনো চাঁদ নেই। বসন্তের বাতাস বইছে। বাতাসে ফুলের গন্ধ নয়, বারুদ, আগুন, ছাই, রক্তের গন্ধ। তা সত্ত্বেও ঘর্মাক্ত শরীরে এই দখিনা বাতাস যেন মমতার স্পর্শ বুলিয়ে দিতে চাইছে।
আকাশে ট্রেসার বুলেট জ্বলছে। কালো আকাশ বিদ্যুৎ-চমকিত হয়ে পুড়ে যাচ্ছে। বোমা বিস্ফোরণের শব্দে রাতের ঘুম ভেঙে কাক উড়তে শুরু করেছে আকাশে। হঠাৎ সেই আকাশে তিনি দেখতে পেলেন যেন আব্বার জ্যোতির্ময় মুখ। শেখ লুত্যর রহমান যেন তাকে বললেন, অনেস্টি অব দ্য পারপাজ আর সিনসিয়ারিটি অব দ্য পারপাজ তোমার আছে। তুমি বিজয়ী হবে। বাংলার মানুষ বিজয়ী হবে।
২
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটগাছের ডালে বসে থাকতে পারে না। চারদিকে আগুন, চারদিকে গুলির শব্দ, চারদিকে মানুষের আর্তনাদ, মানুষের পালানোর পায়ের শব্দ। ট্যাংকের ঘর্ঘর আওয়াজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবাস লক্ষ করে কামান দাগা হচ্ছে। শিক্ষকদের কোয়ার্টারে গিয়ে নাম ধরে ধরে শিক্ষকদের ডেকে নিয়ে ব্রাশফায়ার করা হচ্ছে। জগন্নাথ হল থেকে ছাত্রদের ধরে এনে মাঠে লাইন করে দাঁড় করিয়ে চালানো হচ্ছে গুলি। জ্বলছে বস্তিগুলো। জ্বলছে ঘরবাড়ি। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশেরা ট্যাংক, কামান, রিকোয়েললেস রাইফেল, এলএমজির গোলাগুলির বিরুদ্ধে তাদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করছে। আমৃত্যু মরিয়া প্রতিবাদ। জ্বলছে পিলখানা। লাশ আর লাশ। আগুন আর আগুন। গোলা আর বারুদ। নরকের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে বাংলায়। আক্রমণ চলছে বাঙালি পুলিশদের ওপর। থানায় টেবিলের ওপারে ডিউটিতে বসে থাকা পুলিশ আকস্মিক আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকছে টেবিলের ওপরেই, বহু জায়গায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঘুমন্ত সৈনিক এবং তাদের পরিবার-পরিজন নারী-শিশুদের ওপরে চালানো হচ্ছে গুলি, বিছানা বালিশের ওপরে পড়ে থাকছে রক্তাক্ত নারী, শিশু, বৃদ্ধের লাশ।
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি ত্রিকালদর্শী। কিন্তু জাহান্নামের আগুনকে হার মানানো এই পরিস্থিতিতে তারাও স্তম্ভিত। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে তারা। আশ্রয় নেয় রামপুরা বিল পেরিয়ে এক হিজলগাছের ডালে। বিলের একধারে বস্তির আগুনে আকাশ লাল হয়ে আছে। আর তারই আভায় নিচে পানিতে দেখা যাচ্ছে লাশ আর রক্তের স্রোত। সেখানেই-বা ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি থাকে কী করে? তারা বলে, চলো আবার যাই বটগাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটগাছে। বটগাছটার মায়া তারা ছাড়তে পারে না।
ব্যাঙ্গমা বলে, বঙ্গবন্ধুরে গাড়িতে তুইলা মেজর জেড এ খানের মনে। পইড়া যায়, তারে হুকুম দেওয়া হইছে শেখ মুজিবরে অ্যারেস্ট করার। কিন্তু ধরার পর কই লইয়া যাইতে হইব, এইটা তো কওয়া হয় নাই।
ব্যাঙ্গমি বলে, ৩২ নম্বরে গোলাগুলি, বোমাবাজি কইরা শেখ মুজিবরে পাইয়াই তারা ওয়্যারলেসে জানায় দিছিল, বড় পাখিটারে পাওয়া গেছে।
ব্যাঙ্গমা বলে, লে. কর্নেল জেড এ খান শেখ সাহেবরে অ্যাসেম্বলি ভবনের সিঁড়িতে বসায়া রাইখা গেলেন ক্যান্টনমেন্টে। লে. জেনারেল টিক্কা খানের লগে দেখা করলেন। টিক্কা খান বহুত খুশদিল। শেখ মুজিবরে ধরা হইছে, সারা ঢাকা জ্বালায়া দেওয়া হইতেছে। বহুত খুব। শেখ মুজিবের ওয়্যারলেস বার্তা রেডিওতে ধরা পড়ছে, টিক্কা খানের সহকারী একটা রেডিও নিয়া ছুঁইটা আইছিল, স্যার স্যার শোনেন, শেখ মুজিব ওয়্যারলেসে মেসেজ দিতাছে। রেডিওতে ধরা পড়ছে। এইবার ব্যাটা নিজেই ধরা পড়ছে। মুজিবরে ধইরাই মেজর ওয়্যারলেসে জানান দিছে, বিগ বার্ড ইজ ইন দ্য কেজ।
জেড এ খান বুট টুইকা স্যালুট মারলেন। মনে মনে কইলেন, আমি হালায় গোলাগুলির মধ্যে অ্যাকশন কইরা আইলাম, আর আপনে আরাম কইরা চেয়ারে বইসা গুনগুন কইরা গান গাইতাছেন। দেই আপনের শান্তি নষ্ট কইরা।
টিক্কা খান জিগায়, শেখ মুজিবরে অ্যারেস্ট করছ?
আমি তো ঠিক শিওর না। একটা লোকরে আনছি। দেখতে মজিবরের মতন। কিন্তু মজিবরই কি না কেমনে কই? বাঙালিরা বিচ্ছু জাত, মজিবরের মতো দেখতে বসায়া রাইখা মজিবররে সরায়া রাখতে পারে।
টিক্কা খান সিট থাইকা ছিটকায়া পড়ল।
.
টিক্কা খান পাঠালেন কর্নেল এস ডি আহমদকে। যাও, দেখে এসো, ঠিকঠাক লোককে ধরা হয়েছে কি না।
এস ডি আহমেদ গেলেন অ্যাসেম্বলি ভবনের সিঁড়িতে। চারদিকে সশস্ত্র পাহারা। তার মধ্যে জিপের সবুজ সিটে বসা দীর্ঘাঙ্গী একজন মানুষ। তার গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, পরনে সাদা পায়জামা। মুখে জ্বলন্ত পাইপ।
দেখামাত্রই এস ডি আহমেদ চিনে ফেললেন শেখ মুজিবকে।
তাঁকে সালাম জানিয়ে বললেন, স্যার। আপনার এখানে তো আসার কথা প্রধানমন্ত্রী হয়ে। অথচ আপনাকে আনা হলো কয়েদি হিসেবে।
মুজিব বললেন, আমার জীবনে এটা তো নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে জিপের গদিতে বসা একটা নতুন ঘটনা!
কর্নেল বললেন, আপনি কি চা খেতে চান? আমি ব্যবস্থা করতে পারি।
মুজিব হাসলেন। বললেন, চমৎকার হবে। চা দেন। আমার জীবনে চা খাবার জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর আসেনি। ওয়ান্ডারফুল। ওয়ান্ডারফুল। দিস ইজ দ্য বেস্ট টাইম অব মাই লাইফ টু হ্যাভ টি।
কর্নেল এস ডি আহমেদ ফিরে গেলেন জেনারেল টিক্কা খানের কাছে। ঠিক লোককেই ধরা হয়েছে।
মেজর জেড এ খান বললেন, স্যার, তাহলে শেখ সাহেবকে আমরা কোথায় রাখব?
টিক্কা খান পিঠ চুলকানোর জন্য তাঁর বেতের লাঠিটা হাতে ধরলেন। বেকায়দা জায়গায় চুলকাচ্ছে। তাই তো। সব ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবকে কোথায় রাখা হবে, সেটা তো ঠিক করা হয়নি।
কর্নেল এস ডি খান বললেন, স্যার। অফিসার্স মেসে রাখলে কী হয়? আগরতলা মামলায় তো সেখানেই রাখা হয়েছিল।
বহুত খুব।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা হলো সেই মেসে। একটা রাত রাখা হলো তাঁকে সেখানে।
ভোররাতে টিক্কা খান হাঁক পাড়লেন, এই কে আছিস? কর্নেল এস ডি খানকে বোলাও। আমাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে যে সেই পুরোনো মেসে মুজিবকে রাখা হয়েছে। জনতা যদি টের পায় মুজিব এখানে, হাজারে হাজারে আসবে, লাখে লাখে আসবে। ছিনিয়ে নিয়ে যাবে তাদের নেতাকে। সরাও তাঁকে।
সকাল সকাল শেখ মুজিবকে তারা সরিয়ে নিল ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে আদমজী স্কুলে।
হেডমাস্টারের রুমে আনা হলো তাকে। রুমে একটা ইজিচেয়ার আছে। বড় টেবিল আছে। সামনে বসার জন্য অনেকগুলো হাতলওয়ালা চেয়ার আছে। কিন্তু কোনো বিছানা-বালিশ নেই। বাথরুম নেই।
অফিসার বললেন, স্যার, আপনি এই ইজিচেয়ারে আরাম করুন। আমরা বিছানা-বালিশের ব্যবস্থা করছি।
মুজিব বললেন, আরাম করব?
ইয়েস স্যার।
মুজিব বললেন, শোনেন অফিসার। আপনি হুকুমের চাকর। আপনাকে আমি কিছু বলব না। শুধু একটা কথা আমি বলি। এই জীবনে অত্যাচার আমি। অনেক সহ্য করেছি। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে জুলুম করছেন। কিন্তু আমি অপমান সইতে পারি না। আপনারা বাঙালিদের শুধু জুলুম করেন নাই, অপমানও করেছেন। এর শাস্তি আপনারা পাবেন। সমস্ত বাংলাদেশ কামান, ট্যাংক, বন্দুকের বোমা, গোলা, আগুনে ধ্বংস করে দিয়ে আপনি বলছেন আমাকে ইজিচেয়ারে আরাম করতে। আপনি যদি আমার সামনে থেকে সরে যান, কেবল তাহলেই আমি আরাম পেতে পারি। বুঝেছেন?
ইয়েস স্যার। স্যালুট দিয়ে অফিসার রুম থেকে বিদায় নিলেন। বাথরুম এই রুমের বাইরে, টানা বারান্দার মাথায়। শেখ মুজিব রুম থেকে বের হয়ে বাথরুমে যাচ্ছেন। হঠাই চিৎকার, মামা গো!
একটা ঘর থেকে এই নারীকন্ঠের চিৎকার আসছে। ঘরের জানালা দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে শেখ মুজিব দেখতে পেলেন, আম্বিয়ার মা ও মামা গো বলে গলার রগ ফুলিয়ে চিৎকার করছে। ভেতরে আরও আছে রমা, ফরিদ, নিয়াজ, আজিজ মিয়া–তাঁর বাড়ির কাজের লোকেরা। মুজিব রেগে গেলেন। সেন্ট্রিদের বললেন, এই, তোমাদের অফিসার কে আছে, ডাকো তো এক্ষুনি।
অফিসার এলেন। মুজিব রাগতস্বরে ইংরেজিতে বললেন, আমাকে এনেছ এনেছ। তোমরা আমার বাড়ির কাজের লোকদের কেন এনেছ? এই বুড়িকে আনার মানে কী? এক্ষুনি এদের ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।
২৮ মার্চ একটা ট্রাকে করে বাড়ির গৃহকর্মীদের তুলে নিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয়। মিরপুর রোডে, আইয়ুব গেটের কাছে।
৩
ব্যাঙ্গমা বলে, বিবিসি লন্ডন ২৬ মার্চ রাত দশটায় এই খবর প্রচার করে।
ব্যাঙ্গমি বলে, খবরটা ইংরেজি। তুমি বাংলা কইরা শোনাও। ব্যাঙ্গমা বাংলায় বিবিসির ২৬ মার্চের খবর শোনায় :
বিবিসি লন্ডন। ২৬ মার্চ ১৯৭১। এ.৪৩। ২২.০০ পাকিস্তান-ওয়ান।
ইয়াহিয়া খান তাঁর সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার পর এবং ভারত থেকে পাওয়া খবর অনুসারে শেখ মুজিবুর রহমান প্রদেশকে স্বাধীন বলে ঘোষণা দেওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক যুদ্ধের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকায় আমেরিকান কনসাল জেনারেল বলেন, বিদ্রোহ দমনের জন্য ট্যাংক ব্যবহার করা হয়েছে। ভারত থেকে পাওয়া আগের খবর হলো, একটা গুপ্ত বেতার থেকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে।
৪
আমি ভেতরে, তাজউদ্দীন বাইরে-মুজিব ভাইয়ের বহু বছর আগে বলা। কথাটা হঠাৎই তার কানে আসে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৪৮ সালে শেখ মুজিব বড় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, ১১ মার্চ হরতালে পিকেটিং করছিলেন, জিপ নিয়ে পুলিশ তাকে ধাওয়া করছিল, আর তিনিও সাইকেলে চড়ে রাস্তার এক মোড়ের সমাবেশ থেকে আরেক সমাবেশে যাচ্ছিলেন, জিপিওর সামনে থেকে গেলেন ইডেন বিল্ডিংয়ে, তোপখানা রোডের সচিবালয়ের সামনে, মুজিব ভাইকে পুলিশ এখনই গ্রেপ্তার করবে, মুজিব ভাই ইঙ্গিত করলেন, তাজউদ্দীন, তুমি গ্রেপ্তার এড়াও। আমি ভেতরে, তুমি বাইরে। তাজউদ্দীন খবরের কাগজের রিপোর্টার সেজে পকেট থেকে নোটবই বের করে নোট করতে লাগলেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার না করে মুজিব ভাই এবং অন্যদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে চলে গেল।
কাঠের চৌকিতে একটা চাদর পেতে শুয়ে আছেন তাজউদ্দীন। পাশে আমীর-উল ইসলাম। আমীর ডান কাত হয়ে শুয়ে ছিলেন। চিত হওয়ার চেষ্টা করছেন শব্দ না করে। কিন্তু দুর্বল চৌকি কাঁচ কাঁচ করে আর্তনাদ করল।
ঘুম তো কিছুতেই আসে না। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় কে ঘুমাতে পেরেছে?
রাতে বাড়ি থেকে লুঙ্গির ওপরে পাঞ্জাবি পরে নিয়ে একটা রাইফেল, একটা রিভলবার, একটা কাঁধে ঝোলানো থলে নিয়ে বেরিয়েছেন তাজউদ্দীন। আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে কামাল হোসেনও ছিলেন। কামাল হোসেন ধানমন্ডির ১৩ নম্বর সড়কে তার এক আত্মীয়ের বাড়ির গেটে নেমে গেছেন। তাজউদ্দীন আর আমীর-উল এগিয়ে যাচ্ছেন, উত্তরের দিকে, ইচ্ছা আছে, কোনোরকমে পশ্চিমের নদীর ধারে চলে যাওয়া। আলপথ ধরে জলাজঙ্গল পেরিয়ে একটা নৌকা যদি রাতের অন্ধকারে জোগাড় করে ফেলা যায়, তাহলে হয়তো আপাতত গ্রেপ্তার এড়ানো সম্ভব হবে। কিন্তু উত্তর দিক থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আসছে মিলিটারি কনভয়। গাড়ি ডানে ঘুরিয়ে ফেলে তারা ঢুকে পড়লেন লালমাটিয়ার মধ্যে।
আমীর-উল চালককে বললেন, গফুর সাহেবের বাড়ির সামনে আমাদের নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে ভেগে যাও।
রেলওয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাড়ির পাশের বাড়িটাই লালমাটিয়ার সংগ্রাম পরিষদের বাড়ি। ছেলেরা তখনো ওই বাড়িতে ভিড় করে আছে। তাজউদ্দীন ছেলেদের ডাকলেন। বললেন, এই বাড়ির বাতি নিভিয়ে দাও। পতাকা নামিয়ে ফেলো। তোমরা এখনই নিরাপদ জায়গায় চলে যাও। সরে থাকো। গ্রেপ্তার এড়াও। যাও।
ছেলেরা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কথা শুনল। তারা পতাকা নামাল। বাতি নিভিয়ে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করল। ততক্ষণে গুলির শব্দ, বোমার শব্দ কানে আসতে শুরু করেছে।
.
ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে তাজউদ্দীন বেল টিপলেন। মনে মনে তারা আল্লাহকে ডাকছেন যেন গফুর সাহেব বাড়ি থাকেন। দরজা খুলে গেল। তাজউদ্দীন বললেন, গফুর সাহেব, আপনার বাড়িতে মেহমান এসে গেছে। তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলুন।
আসেন আসেন। বাড়িতে কোনো মহিলা নাই। আমরা দুই চাচা ভাতিজা। আরও দুইজন পুরুষ মানুষ আরামে থাকতে পারবেন। তবে অসুবিধা হলো কোনোরকমে একটা চৌকি আছে। আপনাদের ওই চৌকিতেই থাকতে হবে। ফার্নিচার কেনার সময়-সুযোগ-মন কোনোটাই অসহযোগের মধ্যে ছিল না।
তাজউদ্দীন বললেন, এর মধ্যে আর খাট আর চৌকি। একটা আশ্রয় পেলেই হলো।
আবদুল গফুর সাহেব দরজা বন্ধ করে জানালার পর্দা টেনে দিয়ে বললেন, এত গোলাগুলি। কী পরিস্থিতি, তাজউদ্দীন সাহেব?
তাজউদ্দীন বললেন, পাকিস্তানি মিলিটারি অ্যাটাক করেছে। মুজিব ভাই চট্টগ্রামে মেসেজ পাঠিয়েছেন রেজিস্ট্যান্স গড়ে তোলার জন্য। দেশের অন্য। জায়গাগুলোতে ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা মেসেজ করেছেন। ইনডিপেনডেনস হ্যাঁজ বিন ডিক্লেয়ারড। তবে আমি তার হাঁটু ধরে বলেছি, সরে যান। বাড়ি ছাড়েন। তিনি আমাদের চলে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু নিজে কোথাও যাবেন না। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন। আল্লাহ জানে তার কী অবস্থা হবে!
চৌকিতে বসেছেন তাজউদ্দীন আর আমীর।
বাইরে প্রচণ্ড শব্দ হলো, এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণ হলো, মনে হচ্ছে আকাশ ভেঙে পড়ছে মাথার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে চৌকির চার পা আত্মসমর্পণ করল, আর চৌকিটা বিকট শব্দ করে ভেঙে পড়ল নিচে। আমীর ও তাজউদ্দীন চৌকি থেকে ছিটকে পড়লেন। চারদিক থেকে একযোগে গুলির শব্দ আসছে। গুলির শব্দ, গোলার শব্দ, ট্যাংকের চাকার ঘর্ঘর আওয়াজ আসছে পুবে ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে, দক্ষিণে পিলখানার দিক থেকে, দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিক থেকে, আরও কোন কোন দিক থেকে, কীভাবে হিসাব মেলাবেন তাজউদ্দীন! তাঁরা বাড়ির ছাদে উঠলেন। অমাবস্যার অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে আকাশে ফাটছে ট্রেসার বুলেট, আগুনে আলোয় বিজুলিতে, শব্দে, গর্জনে, আর্তনাদে কিয়ামত নেমে এসেছে ঢাকায়। ওই ওদিকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা বুঝি কামান-ট্যাংকের গোলায় মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুরান ঢাকা বোধ হচ্ছে গোটাটাই পুড়ছে। আকাশ গনগনে লাল। কোথাও কোথাও থেকে জনতার স্লোগান আসছে, জয় বাংলা। মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্প এলাকা থেকে শোনা যাচ্ছে পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি। তারপর সব স্লোগান থেমে গেল। রইল শুধু থেমে থেমে গুলির আওয়াজ। গোলার আওয়াজ। হঠাৎ হঠাৎ গাড়ির শব্দ। ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার এই বাড়ির অদূরে। আর্মি সেখানে ক্যাম্প করছে, অন্ধকারের মধ্যেও তা বোঝা যাচ্ছে।
২৬ মার্চ সকাল হলো। তাজউদ্দীন একটা জানালার পাল্লা একটুখানি খুলে দিলেন, অমনি ঘরপোড়া ছাইয়ের পাশুটে গন্ধ তার নাকে এসে লাগল। তিনি আবার জানালা বন্ধ করে দিলেন। আমীর-উল ইসলাম বললেন, তাজউদ্দীন ভাই, একটা কাজ করি। দাড়ি কেটে আসি। তাজউদ্দীন ভালো করে শুনলেন সেই কথা। মানুষের জীবনে এমন সময় আসে, যখন একমুহূর্তে এক লক্ষ ভাবনা মস্তিষ্কের কোষে হানা দিতে পারে! মুজিব ভাই কি বেঁচে আছেন, থাকলে কোথায় আছেন? লিলি, রিমি, রিপি, মিমি কেমন আছে? ঢাকাবাসীর কতজন বেঁচে আছে? কতজন মারা গেছে? কতজন গুলিবিদ্ধ, অগ্নিদগ্ধ হয়ে এখনো কাতরাচ্ছে যন্ত্রণায়?
আমীর-উল বাথরুম থেকে বেরোলেন। তার গাল-চিবুক নিকোনো উঠোনের মতো পরিষ্কার। তাঁকে চেনাই যাচ্ছে না। তাজউদ্দীন বললেন, একেবারে নতুন একজন মানুষকে দেখছি। আপনাকে তো চেনাই যাচ্ছে না।
ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে আর্মি ক্যাম্পে ওয়াচ টাওয়ার বসানো হয়েছে। এই বাড়িটা তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে।
গফুর সাহেব উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে এই ঘরে ঢুকলেন। তার গেঞ্জির গলাটা অকারণে বড়, লুঙ্গির অনেকটাই ঝুলন্ত গেঞ্জি ঢেকে রেখেছে। তার হাতে একটা গামলা। গামলায় কিছু মুড়ি। বললেন, শুকনা মুড়ি গলা দিয়ে ঢুকবে না। মুড়ি ভিজায়ে আনি। গুড় আছে। গুড় দিয়ে মেখে খাই।
.
আমীর-উল ইসলাম বললেন, তাজউদ্দীন ভাই, আমাকে তো আর চেনা যাচ্ছে না। আমার নাম আজ থেকে রহমত আলী। আমি পাবনা থাকি। গফুর সাহেবের বাড়ি বেড়াতে এসেছি।
তাজউদ্দীন বললেন, আমার নাম মোহাম্মদ আলী। গফুর ভাই, আপনি কন্ট্রাক্টর। আমি আপনার ঠিকাদারি কাজ দেখাশোনা করি।
পানিতে ভেজানো মুড়ি এসে গেল। কিন্তু তাজউদ্দীনের গলা দিয়ে সেই মুড়িও নামতে চাইছে না।
রেডিওতে ঘোষণা শোনা গেল–কারফিউ। দিনের বেলাতেও থেমে থেমে গুলির আওয়াজ আসছে। রোদে পোড়া একটা অসহ্য অকথ্য দিন পেরিয়ে গেল। রাতের বেলা রেডিওর পাশে বসে আছেন চারজন শ্রোতা। থ্রিব্যান্ড রেডিও। রেডিও অস্ট্রেলিয়া, বিবিসি, আকাশবাণী জানাল, পাকিস্তানি মিলিটারি ট্যাংক কামান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপরে হিংস্র শ্বাপদের মতো আক্রমণ করেছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, নির্বিচার গণহত্যা চালাচ্ছে। তাজউদ্দীন আহমদের চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। কী করা উচিত, কী করা কর্তব্য–তিনি ভাবছেন। তার মনে পড়ছে, মুজিব ভাই তাকে এবং কজন ছাত্রনেতাকে ডেকে ১৮ জানুয়ারি কলকাতার একটা ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন। ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, মণি, রাজ্জাক, তোফায়েল ছিলেন। ছাত্রনেতাদের বলেছিলেন, আমার অবর্তমানে তাজউদ্দীনের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করবা। কলকাতার ঠিকানাটা মুখস্থ আছে তো! ২৬ রাজেন্দ্র প্রসাদ রোড, ভবানীপুর, কলকাতা। চিত্তরঞ্জন সুতার হলো কন্ট্যাক্ট পারসন। তাঁর কাছে যাবা।
.
এই বাড়ি থেকে লালমাটিয়ার পানির ট্যাংক দেখা যাচ্ছে। মিলিটারির লোকজন এগিয়ে গেল পানির ট্যাংকের কাছে। তারা দারোয়ানকে বেদম প্রহার করছে। দারোয়ান চাবি নিয়ে পানি ছাড়তে গেল। সব দেখা যাচ্ছে। স্পষ্ট। সব বোঝা যাচ্ছে। এই বাড়িতে থাকা আর নিরাপদ মনে হচ্ছে না। তারা পর্দা টেনে দরজা-জানালা বন্ধ করে রইলেন।
রেডিওতে ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শুনতে হলো। রেডিওর ঘর্ঘর শব্দের সঙ্গে ইয়াহিয়া মদ-ভারী কণ্ঠে বলছেন :
মাই ডিয়ার কান্ট্রিমেন,
আসোলামু আলাইকুম…
শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলন মুসলিম দেশ পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলার উদ্দেশ্যে হিংসাত্মক কার্যকলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণা করা হলো। আসলে আরও কয়েক সপ্তাহ আগেই শেখ মুজিব ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। শেখ মুজিব এবং তার দল পাকিস্তানের শত্রু, তারা পূর্ব পাকিস্তানকে দেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। তিনি দেশের ঐক্য ও সংহতিকে আক্রমণ করেছেন। এ অপরাধের শাস্তি তাঁকে পেতেই হবে। হিজ ক্রাইম উইল নট গো আনপানিশড।
উই উইল নট অ্যালাউ সাম পাওয়ার-হাঙ্গরি অ্যান্ড আনপ্যাট্রিয়াটিক পিপল টু ডেস্ট্রয় দিস কান্ট্রি অ্যান্ড প্লে উইথ দ্য ডেসটিনি অব ১২০ মিলিয়ন পিপল।
পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ।
পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত বাজানো হচ্ছে।
.
প্রচণ্ড গরম। একটা জানালা একটু খুলে দিলে হয়। গফুর সাহেব জানালা খুললেন। বাতাসের ঝাঁপটা এসে জানালার পর্দা দোলাতে লাগল। ছাইগন্ধ, বারুদের গন্ধ, পেট্রলের গন্ধের মধ্যেও তাজউদ্দীনের ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে এসে ধরা পড়ল আমের মুকুলের গন্ধ। মুজিব ভাইয়ের প্রিয় গান আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসিতে একটা লাইন আছে, ও মা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে…পাক সার জমিন সাদ বাদ নিভন্ত দীপের মতো ম্লান হয়ে এল, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসির সুর আচ্ছন্ন করে ফেলল তাজউদ্দীনের সমস্ত ইন্দ্রিয়।
৫
সারা রাত ঘুমাতে পারলেন না হাসিনা। শরীরের ভেতরে সন্তানের নড়াচড়া টের পাচ্ছিলেন। শরীরটা তত ভালো নয়। তার চেয়েও বড় কথা, সমস্তটা মন। আচ্ছন্ন করে রেখেছে ভয়, শঙ্কা, দুশ্চিন্তা। রাতভরে আকাশ যেন জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। গোলাগুলি, চিৎকারের শব্দে কানে তালা লাগার উপক্রম। গুলির ছররা এসে লাগছে বাড়ির দেয়ালে। মেঝেতে তোশক পেতে শুয়ে ছিলেন তাঁরা। শেখ হাসিনা, রেহানা, আর ওয়াজেদ মিয়া, রেহানাদের খালাতো বোন শেখ ফরিদা ওরফে জেলি। আরও আছে ৩২ নম্বরের বাড়ির পুরোনো পরিচারক ওয়াহিদার রহমান পাগলা। তারা ঘুমাতে পারেননি কেউ। আল্লাহকে ডেকেছেন। সাতমসজিদ রোডের ওপরে ধানমন্ডি ১৫ নম্বরের ভাড়া বাসা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ওয়াজেদ মিয়া এই বাসাটা ভাড়া নিয়ে রেখেছিলেন। তাঁরই নির্দেশে ২৫ মার্চ রাতে তাঁরা এসে উঠেছেন আসবাববিহীন এই বাড়িতে। অদূরেই ইপিআর সদর, পিলখানা। গোলাগুলির অন্ত ছিল না। সকালের দিকে গোলাগুলির শব্দ কমে এল। মাইকে শোনা যেতে লাগল অবাঙালি কণ্ঠে ভাঙা ভাঙা বাংলার ঘোষণা :
সারা ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হইয়াছে। কেহ ঘরের বাহিরে আসিবেন না। বাহিরে কাহাকে দেখা গেলে দেখামাত্র গুলি করা হইবে। যাহাদের বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা দেখা যাইবে, তাহাদিগের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা লওয়া হইবে।
ভোর হলো। আজান শোনা গেল না। পাখিরা ডাকল না। শুধু মাইকে এই ঘোষণা। সকাল হলো।
রেহানা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন। জানালায় পর্দা নেই। তিনি বললেন, আমাদের বাসার দিক থেকে গুলির শব্দ এসেছিল। আব্বা-মা না জানি কেমন আছে? কেমন আছে রাসেল? কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি। কান্না এসে কণ্ঠ রোধ করতে চাইছে।
জেলি বললেন, হাসুবুর জন্য যত চিন্তা। ওনার তো খাওয়া দরকার।
রেহানা বললেন, দুলাভাই, আপার তো খাওয়া দরকার। কী ব্যবস্থা করা যায়? আব্বা আমাকে সকালে বাসায় যেতে বলেছেন। আমি দেখি যাওয়া যায় কি না।
ওয়াজেদ মিয়া বললেন, রেহানা, পাগলের মতো কথা বলিস না। ওরা বলছে দেখামাত্রই গুলি। আর তুই কিনা কারফিউয়ের মধ্যে বাইরে যেতে চাস! চুপচাপ বসে থাক। পাগলা, খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা কী করা যায়?
পাগলা বলল, চাউল আছে। ডাল আছে। খিচুড়ি পাক করা যায়। এই বাড়িতে কি চুলা আছে?
ওয়াজেদ মিয়া বললেন, কেরাসিনের স্টোভ তো আছে একটা।
পাগলা খিচুড়ি বসাতে গেল। জেলি এগিয়ে গেলেন তাকে সাহায্য করতে। হাসিনাও উঠে একবার গেলেন রান্নাঘরের দিকে। পুরা বাড়িতে কোনো আসবাব নেই। বাসনকোসন নেই।
পেঁয়াজ কাটার মতো কোনো চাকু-ছুরি-বঁটিও নেই।
পাগলা দরজার পাল্লার ফাঁকে পেঁয়াজ ধরে পেঁয়াজ থেতলা করতে লাগল।
হাসিনার চোখ এমনিতেই জ্বলছিল। এবার অঝোর ধারায় বর্ষণ শুরু হলো।
রেহানা আবার বারান্দায়। কীভাবে ৩২ নম্বর যাওয়া যায়? এই পথ ধরে এক দৌড় দিলে কত মিনিট লাগবে? বড় রাস্তাটা পার হতে পারলেই তো ভেতরের রাস্তা। সেখানেও কি মিলিটারি থাকবে?
একটা চড়ুই পাখি মাথার ওপরে চক্কর খাচ্ছে। পাখিটা একটা ভেন্টিলেটরে বসল। আরেকটা চড়ুই পাখি কোত্থেকে এসে কিচিরমিচির করে ডাকতে লাগল। নিচে খড়কুটা পড়ে আছে। বোধ হয় পাখিগুলো বাসা বানাবে।
রেহানা, এই রেহানা–কিশোরী কণ্ঠের ডাকে চমকে উঠলেন রেহানা। আরে এ যে স্বপ্ন! ওর বাসা যে পাশেরটাই, রাতের অন্ধকারে তা ঠাওর করে উঠতে পারেননি রেহানা। এখন দিনের আলোয় এই কথাটা তার মনে পড়ল! বন্ধু স্বপ্নদের বাড়িই তো ওইটা!
আয় আয়, ভেতরে আয়-রেহানা দরজা খুলে দিলেন। সালোয়ার-কামিজ পরা স্বপ্নারও চোখের নিচে কালি। গোলাগুলির শব্দে ওরও নিশ্চয়ই ঘুম হয়নি।
স্বপ্ন ভেতরে এলেন। আপা দ্যাখো। স্বপ্না এসেছে। ওর বাসা তো পাশেরটাই, রেহানা বললেন। স্বপ্ন এসেছিস, খুব ভালো হয়েছে, এই বাড়িতে একটা ছুরি বা বঁটি কিছুই নাই। তোর বাসা থেকে একটা ছুরি বা বঁটি এনে দে না।
হাসিনা বললেন, না না, স্বপ্ন। পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ। আর্মিরা পাগলের মতো করছে।
ঠিক এই সময় আবারও গুলির গুড়ুম গুডুম শব্দ কান ফাটিয়ে ফেলতে লাগল। জানালার কাঁচ কেঁপে উঠল। একঝক কাক বাড়ির চারপাশজুড়ে কা কা করে ডাকতে লাগল ভয়ার্ত স্বরে।
হাসিনা কথা শেষ করার আগেই স্বপ্ন বললেন, না বাবা, আমি যাই। স্বপ্ন দৌড় ধরলেন নিজের বাড়ির দিকে।
পাগলা খিচুড়ি বসিয়েছে। চাল-ডাল সেদ্ধ হওয়ার গন্ধ আসছে। হাসিনার গলা পর্যন্ত জ্বলছে সম্ভবত অ্যাসিডিটির কারণে।
সময় যেতে চায় না। শঙ্কাকুল একেকটা হৃদয় দেয়ালের ওপারের মুকুলভরা আমগাছের পাতার মতো কাপে। তবু সময় বয়ে যায়। বিকেলে দরজায় হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ।
সবার বুক ধড়াক করে ওঠে। কে এল? মিলিটারি নাকি?
রেহানা উঠলেন দরজা খুলতে। হাসিনা তাকে টেনে ধরলেন, তুই যাস না। মিলিটারি যদি আসে!
আবারও দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ঠক ঠক ঠক ঠক। রেহানা একটুখানি দরজাটা ফাঁক করলেন। না, মিলিটারি না। আরেকটু খুললে দেখতে পেলেন, ওমর ভাই। কামাল ভাইয়ের বন্ধু। আপা। ওমর ভাই।
রেহানা দরজা খুললেন। ওমর ভেতরে ঢুকে কবাট বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন। তিনি হাঁপাচ্ছেন। ওমর ভাই কামাল ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। ৩২ নম্বরে বাড়ির লনে বহুদিন ক্রিকেট খেলেছেন। রেহানা তাদের বল-ব্যাট বয়ে দিয়েছেন কত!
ওমর বললেন, কামাল আমাকে পাঠাল। ও বলল, যাও, আমার বোনেরা পাগল হয়ে রাস্তায় বার হয়ে পড়বে। যাও, খবর দিয়া আসো। তাই আসলাম। ওরে বাপ রে! আসা যায়। রাস্তা অ্যাভয়েড করে বাড়িগুলোর ভিতর দিয়া আসলাম। বাইশটা ওয়াল টপকাতে হলো।
হাসিনা উঠে দাঁড়িয়েছেন। ওমরকে ঘিরে আছেন সবাই। ওয়াজেদ মিয়া, হাসিনা, রেহানা, জেলি এবং পাগলা।
হাসিনা বললেন, ওমর। আর কী খবর? আমাদের বাসার সবাই কেমন আছেন? আব্বা? মা? জামাল? রাসেল?
ওমরের পরনে একটা গ্যাবারডিনের প্যান্ট, গায়ে পোলো শার্ট, পায়ে বাটার স্যান্ডেল শু। একটুখানি শ্বাস টেনে দম নিয়ে মুখটা বিষাদে ভরে তুলে তিনি বললেন, খালুকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে। খালাম্মা, জামাল, রাসেল গেছে বাবুদের বাড়িতে। ডাক্তার আঙ্কেলের বাড়িতে।
হাসিনা রোদন করে উঠলেন, মা তো কখনো বাড়ি থেকে বের হন না। মা বাড়ি ছাড়ল কেন? কী করেছে ওরা? আব্বার কোনো ক্ষতি হয় নাই তো?
ধরে নিয়ে গেছে। এতটুকুন জানি। খালাম্মা, জামাল, রাসেল ভালো আছে। বাড়ির অন্য সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে।
সবাই কাঁদছে। চিৎকার করে কেঁদে উঠল পাগলা। সাহেব সাহেব, আম্মা আম্মা।
ওমর বললেন, আমি যাই। আবার কেউ দেখে ফেললে আপনাদেরও ক্ষতি হতে পারে।
ওমর চলে গেলেন।
রেহানা বললেন, আমি যাব। আমি যাব ৩২ নম্বরে। আব্বা কাল রাতে আমাকে বলে দিয়েছেন সকাল সকাল যেতে!
ওয়াজেদ বললেন, পাগলামো করিস না, রেহানা।
.
বাদুড়ের পাখায় ভর করে রাত নেমে আসতে লাগল ধানমন্ডিতে। নতুন বাকা চাঁদ উঠল ধানমন্ডি লেকের তরুসারির ওপরে। সৈন্যদের কনভয় ছুটে যাচ্ছে। কুকুর আর্তস্বরে ডাকছে। আবারও খিচুড়ি রাঁধছে পাগলা। ডাল-চালের মিশ্রণে তেল নুন-পেঁয়াজ পড়ায় একটা গন্ধও আসছে বলক ওঠা হাঁড়ি থেকে। রেহানা রেডিওর নব ঘোরাচ্ছেন। কোথাও যদি জানা যায় আব্বার খবর! হাসিনা তোশকে আধশোয়া। একটা পত্রিকা জোগাড় করে তাকে বাতাস করছেন জেলি।
৬
২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দীন বাসা ছেড়ে চলে গেলেন আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে, গাড়িতে। বুকটা হঠাই পাখি উড়ে যাওয়া দরজা খোলা খাঁচার মতো শূন্য মনে হতে লাগল লিলির। বাসায় রিমি, রিপিও নেই। তাঁতীবাজারে ওদের খালার বাড়িতে গেছে। ছোট্ট মিমি আর দুধের বাচ্চা ১৪ মাস বয়সী সোহেল আছে এই বাড়িতে। পিলখানার দিক থেকে তখন গুলির শব্দ আসছে। বাসাটা একেবারে সাতমসজিদ রোডের ওপরে। আর্মি নেমে গেছে। এই খবর তো জানাই। তাজউদ্দীনের খোঁজে যে আর্মিরা এই বাড়িতে আসবে, কোনো সন্দেহ নেই। তাজউদ্দীনকে না পেলে তার স্ত্রীকে ছেড়ে দেবে, তা না-ও হতে পারে। বাড়ির সামনে গাছগাছালির নিচে দাঁড়িয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন জোহরা তাজউদ্দীন ওরফে লিলি। এখনই মিমি আর সোহেলকে নিয়ে মগবাজারে চলে যেতে হবে। আব্বা এই বাড়িতে আছেন। তিনি থেকে যেতে চান। থাকলে থাকবেন। আছে ভাগনে আর ভাতিজা দুজন। ওরা তো আর্মির টার্গেট হতে পারে না। যদিও কারোরই এই বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয়। বেশি চিন্তা করতে পারছেন না লিলি। ড্রাইভারকে বললেন, গাড়ি স্টার্ট দাও।
ড্রাইভার গাড়ি রেডি করে ফেলল।
এবার তিনি বাচ্চাদের এনে গাড়িতে উঠবেন। তখনই আকাশ ভেঙে বজ্রপাতের মতো শব্দ আর আলো বর্ষিত হলো যেন। ফ্লেয়ার ছুড়ছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। আর ছুড়ছে অবিশ্রান্ত গুলি। তারা এই দিকেই ছুটে আসছে।
লিলি তাড়াতাড়ি মিমিকে এক হাতে ধরে আরেক হাতে ঘুমন্ত সোহেলকে কোলে তুলে ছুটলেন দোতলার দিকে।
লিলির আব্বা তার রুম থেকে বের হয়ে এসেছেন। গোলাগুলির শব্দের মধ্যে তিনি হতভম্ব। লিলি বললেন, বাড়িতে আর্মি আসছে। আমি দোতলায় গেলাম। আমি ভাড়াটিয়া সেজে থাকব।
দোতলার ভাড়াটে আবদুল আজিজ বাগমার। আর আছেন তাঁর স্ত্রী আতিয়া।
.
আবদুল আজিজ বাগমারের প্রসঙ্গ এলে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি তাঁর পরিচয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করে দেয়।
ব্যাঙ্গমা বলে, আবদুল আজিজ বাগমার তাজউদ্দীনের বাড়ির দোতলার ভাড়াইটা, এতটুকুন কইলে হইব না।
ব্যাঙ্গমি বলে, তা তো হইবই না।
ব্যাঙ্গমা বলে, বাগমার ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আছিলেন। তোলারাম কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ইলেকটেড হইছিলেন।
ব্যাঙ্গমি বলে, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনে বাগমার পুরাপুরি জড়িত আছিলেন। ওই সময়ই তারা গইড়া তুলছিলেন অপূর্ব সংসদ। অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার। সংক্ষেপে অপূর্ব সংসদ। এই সংসদের সভাপতি আছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। সেক্রেটারি হইছিলেন বাগমার নিজে। বাংলারে স্বাধীন করতে। হইব–এই রকম চিন্তাভাবনা তারা করতে আছিলেন।
ব্যাঙ্গমা বলে, তাগো লিফলেটে আমার সোনার বাংলা গানটা ইউজ করা হইছিল। আর সেই লিফলেট লেইখা দিছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আহমদ শরীফ।
ব্যাঙ্গমি বলে, পরে বাগমার ব্যারিস্টারি পড়তে চইলা যান লন্ডন। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালে বাংলা স্বাধীন করার লাইগা ইন্টারন্যাশনাল কানেকশনের খোঁজে লন্ডন যান। তখন শেখ সাহেবের লগে লগে আছিলেন বাগমার। শেখ সাহেবের ৬ দফার মাঝেই বাগমার বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার উপায় খুঁইজা পাইলেন।
ব্যাঙ্গমা বলে, এবার ব্যারিস্টার হইয়া বাগমার দ্যাশে আইছেন। ব্যারিস্টারি করেন। শেখ মুজিব তার লিডার। বঙ্গবন্ধু কইলেন, বাগমার, দ্যাশে থাকো। দ্যাশের কাজ করো। বাগমার আওয়ামী লীগের কাজে ঝাপায়া পড়লেন। ইলেকশনের কাজ। শেখ মুজিব কইলেন, শোনো, তাজউদ্দীনের বাড়ির দোতলা ভাড়া হইব। পলিটিক্যাল লিডারের বাড়ি কেউ ভাড়া নিতে চায় না। তুমি ওই বাসা ভাড়া লও। মুজিবের কথা মানেই আদেশ। বাগমার গিয়া উঠলেন তাজউদ্দীন আহমদের বাসার দোতলায়। ৭৫১ সাতমসজিদ রোড। বাগমার তাঁর বইয়ে লেখছেন, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত বৃহত্তর ঢাকা জেলায় ছয় দফার ব্যাখ্যা ইত্যাদি বিষয় নিয়া তিনি মোট ৩০২টা জনসভা করছিলেন। একবার তাজউদ্দীনের লগে জনসভা করতে গিয়া সাত দিন পর বাড়ি ফেরেন। আইসা তাজউদ্দীনের ওয়াইফ জোহরা ভাবি ওরফে লিলির কাছ থাইকা জানতে পারেন, তাঁর স্ত্রী আতিয়া রাগ কইরা লন্ডন চইলা গেছে। রাগ ভাঙায়া তারে লন্ডন থাইকা দেশে ফিরায়া আনতে বাগমারকে নানা কসরত করতে হইছিল। আতিয়ার সাথে বাগমারের প্রেমের বিয়া। লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়া প্রেম করছেন। বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু হইয়া লন্ডন সফর করেন, শেখ হাসিনা, ওয়াজেদ মিয়া তার লগে একই হোটেলে থাকলেন, ওই সময় আতিয়া আর বাগমারের প্রেম দেইখা হাসিনা ঠাট্টা-রসিকতা করতেন, কইতেন, প্রেম অনেক দেখছি, এই রকমের প্রেম দেখি নাই।
.
দোতলায় আবদুল আজিজ বাগমার, তাঁর স্ত্রী আতিয়া নিজেদের বেডরুম ছেড়ে দিয়েছেন লিলি আর তার দুই শিশুসন্তানকে। লিলি এই বাড়িতে এসেই শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার-কামিজ পরে নিয়েছেন। এই বাড়ির আরেকটা বেডরুমে আছেন অধ্যাপক হাবিবুর রহমান, তাঁর নতুন বিবাহিত স্ত্রী শামীম বানু। তাঁরা বেড়াতে এসেছেন, মেহমান। আরেকটা ঘরে লিলু। ক্লাস ফোরের ছাত্র। রেসিডেনসিয়ালে ভর্তি হয়েছে। বাগমারের ভাইয়ের ছেলে। এই বাসা থেকেই ক্লাস করবে, তেমনি কথা।
বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। শব্দের চোটে কান ফেটে যাওয়ার জোগাড়। আর দরজা-জানালার ফাঁক গলে আসছে বাইরের আলো আর আগুনের ঝলকানি। ফ্লেয়ারের আলোয় পিলখানা, মোহাম্মদপুর, সাতমসজিদ রোড ঝলসে যাচ্ছে।
লিলি কানে হাত দিয়ে শব্দের আঘাত থেকে বাঁচতে চাইছেন। ছয় বছরের ছোট্ট মিমি ঘুমাচ্ছে। শব্দে আলোয় সোহেলের ঘুম ভেঙে গেছে। সে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। ভাগ্যিস রিমি, রিপি তাঁতীবাজারে। ১৭ মার্চ থেকেই তারা তাদের সেজ খালার বাসায় আছে। এমন গোলাগুলি শুরু হলো কেন? আজ রাতেই কি রোজ কিয়ামত হয়ে যাবে?
তাজউদ্দীন যে কই গেলেন? আমীর আছেন সঙ্গে। ড. কামাল আছেন। নিশ্চয়ই নিরাপদ কোনো গোপন জায়গাতেই থাকবেন। কিন্তু পৌঁছাতে পারবেন তো ঠিক জায়গায়।
৩২ নম্বর থেকেও গোলাগুলির শব্দ আসছে। মুজিব ভাই, ভাবি, ছেলেমেয়েরা ভালো আছে তো? লিলির বুক থরথরিয়ে কাঁপছে।
নিচে গাড়ির ভটভট শব্দ। গুলির ব্রহ্মাণ্ডবিদারী আওয়াজ। দানবেরা এসে গেছে। লিলি বিছানা থেকে দ্রুত নামার চেষ্টা করলেন। কিছুদিন আগে তিনি পা ভেঙে বিছানায় পড়ে ছিলেন। এখনো পা পুরো সারেনি। কিন্তু যখন নিচতলা ঘিরে ফেলেছে শত শত সৈন্য, গুলি আঘাত করছে বাড়ির দেয়ালে, তখন পায়ের ব্যথার কথা কারই-বা মনে থাকবে!
লিলি দরজা খুলে বৈঠকখানায় গেলেন। সামনে হতবিহ্বল বাগমার ও আতিয়া। বাগমার বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে আত্মগোপন করতে চেয়েছিলেন, আতিয়া তাকে বাড়ি ছাড়তে দেননি।
লিলি বললেন, আজরাইল এসে গেছে। আতিয়া তুমি আমার সাথে আসো। আমরা ওই ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকি।
লিলি আর আতিয়া বেডরুমে গেলেন। দরজা বন্ধ করলেন।
নিচতলায় প্রচণ্ড শব্দ হলো। বিস্ফোরণ হলো। মিলিটারি প্রবেশ করল দরজা উড়িয়ে দিয়ে। পুরো বাড়ি আর্মিরা ঘিরে রেখেছে।
.
পাকিস্তানি মিলিটারি দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতরে। সামনে পড়ল কাজের ছেলে কিশোর বয়সী দিদার।
তারা তাকে জিজ্ঞেস করল, তাজউদ্দীন কই?
দিদারের সামনে বন্দুক উঁচিয়ে ধরে আছে আজরাইলের মতো কয়েকজন ভয়ংকরদর্শন দস্যু। বালক বলল, সাহেব, মেমসাহেব দুপুরবেলাই ছেলেমেয়ে লইয়া বাড়ি ছাইড়া চইলা গেছে গা। কই গেছে কইয়া যায় নাই।
রুমে রুমে সার্চ করা শুরু হলো। এক রুমে শুয়ে আছেন রিমি-রিপিদের নানা। তিনি বিছানায় উঠে বসেছেন। দরজায় বুটের লাথি পড়লে তা আপনা আপনি খুলে গেল।
হোয়ার ইজ তাজউদ্দীন?
আই হ্যাভ নো আইডিয়া!
তাজউদ্দীন কিধার হ্যায়?
মুঝে নেহি পাতা।
আটাত্তর বছর বয়সী ভদ্রলোক সৈয়দ সেরাজুল হক বুক বরাবর ধরে রাখা স্টেনগানের নলের দিকে একবার তাকিয়ে সৈন্যদের মুখের দিকে তাকালেন। উর্দু-ইংরেজি মিলিয়ে জবাব দিতে লাগলেন।
সৈন্যরা তাকে হুকুম দিল শুয়ে পড়বার। তিনি ভাবলেন, এই শোয়াই শেষ শোয়া। তারা গুলি করবে এরপর। তিনি জোরে জোরে কলেমা পড়তে পড়তে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ…
সৈন্যরা বাড়ি সার্চ করে পেল তাজউদ্দীনের ভাগনে হাসান, ভাতিজা তফাজ্জল, বাড়ির কেয়ারটেকার বারেক মিয়াকে। তাদের বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে এক জায়গায় করা হলো।
বুটের শব্দে বাড়ি কাঁপিয়ে তারা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল দোতলায়।
.
আর্মিরা ওপরে উঠছে।
লিলি আর আতিয়া ঠিক করেছেন, তারা পরিচয় দেবেন তারা বিহারি। এই বাড়িতে ভাড়া থাকেন। দুজনের পরনেই সালোয়ার-কামিজ। লিলির। কোলে এক বছর বয়সী শিশুপুত্র সোহেল।
মিলিটারি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে উঠে গেল দোতলায়।
বাগমার বৈঠকখানায়। চারদিকে গুলির শব্দ। পুরো বাড়িতে আলো আর আলো। যেন আকাশের সব বজ্র একই সঙ্গে নেমে এসেছে এই বাড়িতে। তিনি টের পাচ্ছেন, বাড়ির চারদিকে মিলিটারি। সাতমসজিদ সড়কের পাশে খেলার মাঠের দিক থেকে শত শত সৈন্য তাদের আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর নল ধানমন্ডি ১৫ নম্বরের এই বাড়ির দিকে তাক করে রেখেছে।
তিনি টের পাচ্ছেন আর্মিরা দোতলায় উঠেছে। বুটের শব্দ হচ্ছে খটখট।
দরজা খুলতে হলো না। গুলি করে দরজা ভেঙে একদল সৈন্য অস্ত্র উঁচিয়ে ঢুকে পড়ল দোতলার ঘরের ভেতরে। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল দেয়াল।
তারা সঙিন উঁচিয়ে উর্দুতে বলল, তাজউদ্দীন কিধার হ্যায়? বাগমার উর্দু জানতেন। উর্দু জানেন লিলি আর আতিয়াও।
বাগমার জবাব দিলেন, উপর সব কেরায়াদার রেহতে হ্যায়…ওপরে সব ভাড়াটে। উয়ো গ্রাউন্ডফ্লোর মে হ্যায়…উনি নিচের তলায়।
সঙ্গে সঙ্গে একরাশ গুলি ছাদের পলেস্তারা খসিয়ে ফেলল। শব্দ আর আলোয় বাগমারের দৃষ্টি-শ্রুতি বিদীর্ণ হওয়ার জোগাড়।
ইয়ে বাতাও। তাজউদ্দীন কিধার হ্যায়?
তিনি সাহস হারালেন না, বললেন, আমরা ভাড়াটে। নিচের বাড়িওয়ালা কোথায়, আমরা জানব কী করে?
বাগমার আর লিলুকে বারান্দায় নেওয়া হলো। তাঁদের ঘিরে রইল গোটা দশ-বারো সৈন্য।
এবার সৈন্যরা গেল বেডরুমে। দরজা ধাক্কা দিতে লাগল ভয়ংকরভাবে। চিৎকার করে বলতে লাগল, দরওয়াজা খোল দো। নেহি তো গোলিছে উড়া দেঙ্গে।
আতিয়া পাল্টা চিৎকার করে উঠলেন, কৌন হ্যায়?
ফৌজি।
আতিয়া দরজা খুললেন, মালুম হ্যায় কিতনি রাত হুই? ইতনি রাত গ্যায়ে ইধার কিউ আয়ে?
সৈন্যরা দ্বিধাগ্রস্ত। এ তো দেখা যাচ্ছে উর্দুওয়ালা ফ্যামিলি। তারা বলল, হামলোগ কওমকি দুশমন তাজউদ্দীনকে তালাশ মে হ্যায়। কেয়া ও ইধার হ্যায় জি?
আতিয়া বিরক্তির অভিনয় করলেন। ঠোঁট উল্টে বললেন, হামলোগ কেরায়াদার হ্যায়। তাজউদ্দীন এতনে রাত মে এধার কিউ আয়েগা? ঠিক হ্যায়, আপ আন্দর আইয়ে আওর খুদ দেখ লিজিয়ে। এতনে রাত গ্যায়ে আপকা ইয়ে কাম গলত হ্যায়।
লিলির মনে ভয়, নিচের দেয়ালে তাঁদের ফটো ফ্রেমে বাঁধাই করা আছে, তাকে না মিলিটারিরা চিনে ফেলে। সোহেলকে মুখের কাছে ধরে মুখটা ঢেকে রেখে তিনি আতিয়ার উদ্দেশে বললেন, আরে জি তুমহে তো প্যাহেলে হি মানা কিয়েথে ইয়ে সাব পলিটিশিয়ানকে ঘর কেরায়া নেহি লেনা, আখের এহি থা নাসিবমে…তোমাকে আগেই বারবার করে মানা করেছিলাম, রাজনীতি করা লোকের বাড়ি ভাড়া নিয়ো না। এখন বুঝলে তো। আমাদের কপালে এই দুর্ভোগ ছিল। কালকেই টিকিট কেটে করাচি চলে যাব। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন…।
হামসে গালতি হো গ্যায়া। আপলোগ ইতমিনান সে রাহিয়ে, মুঝে অওর কুছ। নেহি কারনা। বলে সৈন্যরা বেডরুমে ঢুকে বিছানার নিচ, আলমারি, বাথরুম সব তালাশ করল। বারান্দায় তন্ন তন্ন করে খুঁজল তাজউদ্দীনকে পাওয়া যায় কি না।
পাওয়া গেল না। তারা বেরোনোর সময় বলল, ব্যাহেন, আপকো তকলিফ দিয়া। হামলোগকো মাফ কর দিজিয়ে। মিমির ঘুম ভেঙে গেছে। সে উঠে বসল। আতিয়া তাকে আবার শুইয়ে দিয়ে বললেন, সো যাও মেরা বাচ্চা, ঘাবড়ানেকা কোই বাত নেহি।
আর্মিরা এবার আরেকটা বেডরুমের দরজা ধাক্কাতে লাগল। আতিয়াকে বলল, ব্যাহেন, এই রুমে কারা আছে?
আতিয়া বললেন, মেহমান হ্যায় জি। নয়া শাদিশুদা মেহমান। নববিবাহিত মেহমান। আতিয়া ডাকলেন, শামীম, দরওয়াজা খোল দো।
শামীম বানু দরজা খুললেন। শামীমও ভালো উর্দু জানেন। উর্দুতে জানালেন, তাঁরা মেহমান। বিয়ের পর শখ করে ঢাকা বেড়াতে এসেছেন।
বুটের শব্দ তুলে সঙিন উঁচিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে সৈন্যরা প্রতিটি ইঞ্চি তল্লাশি করে দেখল কোথাও তাজউদ্দীনের দেখা মেলে কি না।
লিলুকে আর আজিজ বাগমারকে এক জায়গায় রাখা হয়েছে। তাদের নিচে নামানো হচ্ছে বন্দুকের গুঁতো মেরে মেরে।
আতিয়া বললেন, বাচ্চেকো কিউ লে যা রহে হো?
বাগমার আর লিলুকে আনা হলো বৈঠকখানায়। দরজার জায়গাটা একটা বিশাল গহ্বর। সিমেন্ট, কাঠ, ইটের টুকরাটাকরা ধ্বংসস্তূপটাকে ভয়াবহ দেখাচ্ছে।
আতিয়ার মনে ভয়, ওই ওপাশের টেবিলের কাগজে বাগমার বোমা বানানোর ফর্মুলা ইংরেজিতে লিখে রেখেছেন। সেদিকে না নজর যায়। সৈন্যদের নজর গেল দেয়ালে ঝোলানো রবীন্দ্রনাথের ফটোর দিকে। এই বুঝি সবাই ধরা পড়ে যান যে এরা উর্দুভাষী নন। কমান্ডার প্রশ্ন করল, ইয়ে কৌন হ্যায় জি?
আতিয়া জবাব দিলেন, ও হামারি পীর ছাহেব হ্যায়। মগর জিন্দা নেহি হ্যায়। কমান্ডার ডান পা তুলে মেঝেতে বুট ঠুকে স্যালুট করল পীর সাহেবকে।
আর্মিরা ওপর থেকে টেনেহিঁচড়ে নামাল আজিজ বাগমারকে, লিলুকে, তাঁদের বাবুর্চি আবদুলকে। নিচের তলা থেকে তফাজ্জল, হাসান, বারেক মিয়াকে বন্দুকের মুখে এক জায়গায় জড়ো করল। বালক দিদারকে তারা ছেড়ে দিল। আর ছেড়ে দিল লিলুকে। বাচ্চে তুম উপর ওয়াপস চলে যাও। লিলুও বুঝে ফেলল, বাংলায় কথা বলা যাবে না। সে চাচাকে চোখের ভাষায় জিজ্ঞেস করল ওপরে যাবে কি না। বাগমার তাকে ইশারা করলেন ওপরে যেতে।
বাকিদের তারা বন্দুকের বাড়ি দিতে দিতে তুলে ফেলল ট্রাকে। বাগমার ট্রাকে উঠলেন।
বিকট শব্দ হলো। একটা গুলি তাঁর মাথার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর ঝকড়া লম্বা চুলের অনেকটা পুড়িয়ে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। চুলপোড়া গন্ধ বেরোতে লাগল।
আতিয়ার অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি গিয়ে পড়ল ফ্লেয়ারের আলোয় হঠাৎ ঝলসে ওঠা আবদুল আজিজ বাগমারের উদ্বিগ্ন মুখে।
আতিয়া কাঁদতে লাগলেন শব্দ করে। চারদিকে গোলাগুলির আওয়াজের মধ্যে সেই কান্না হারিয়ে গেল মহাকালের অতলে।
দিদার রিমিদের নানার ঘরে গেল। দেখল, ভয়ার্ত নানা তখনো জোরে জোরে পাঠ করে চলেছেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু…
.
সময় পাথর হয়ে জমে থাকে। সময় অগ্নিকুণ্ড হয়ে জ্বলে। সময় আগ্নেয়গিরির লাভার মতো বয়েও যায়। লিলি জানেন না কী করে ২৫ মার্চ রাতটা কেটে গিয়ে ২৬ মার্চের ভোর এল। কামানের গর্জন, মর্টারের গোলা। আগুন, বারুদ, বিস্ফোরণ। সমস্ত আকাশ কাল রাতে পুড়ে গেছে। কাল রাতের আকাশ ছিল গনগনে জ্বলন্ত গলন্ত লোহার মতো লাল। ভোরবেলায়। গোলাগুলির শব্দ একটু কমে এসেছে। রাস্তায় মিলিটারি ট্রাক, মিলিটারি জিপ মাইক লাগিয়ে ঘোষণা করছে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ। লিলি একবার। ঘুমন্ত মিমির দিকে তাকালেন। ওর কপালে ঘাম, জানালা গলে আসা আলোয় দেখা যাচ্ছে ঘামের মধ্যে ওর পাতলা চুল আটকে আছে। সোহেলের এক হাত শরীরের নিচে চাপা পড়ে আছে, তিনি বাচ্চাটাকে আলতো করে ধরে হাতটা মুক্ত করে নিলেন। রিমি, রিপি ভাগ্যিস এই বাড়িতে নেই, তাই ওরা হয়তো ভালোই আছে। তাজউদ্দীন রাইফেল আর পিস্তল হাতে করে চলে গেছেন কোনো অন্ধকার অনির্দিষ্ট পথে, হয়তো আলোকিত ভোর আনবেন বলে। কিন্তু এই বাড়িতে থাকা কি নিরাপদ হবে? তাজউদ্দীনের খোঁজে মিলিটারিরা কি আবার আসবে না? তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের জিম্মি করে রাখবে না, যাতে পাখি। স্বেচ্ছায় এসে ধরা দেয়! না, এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত নয়। লিলি বিছানা। ছাড়লেন। ভাঙা দরজা, ধ্বংসচূর্ণ, কাঁচ, কাঠ, সিমেন্টের জঞ্জাল পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেন তিনি। বাইরে মিলিটারির গাড়ি চলাচল করছে।
আবারও দূরে গর্জন শোনা গেল। কোথাও কামানের তোপ দাগা হচ্ছে। এই বাড়ি ছেড়ে পালাতেই হবে। লিলি ভাবলেন।
তিনি নিচতলার দরজা খুলে পেছনের বাগানে গেলেন। মাধবীলতার ঝাড় থেকে আসা একটা বুনো গন্ধ বারুদের গন্ধকে পরাজিত করে তার নাকে এসে লাগল। তিনি বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের এপাশ-এপাশ নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। বাসার দক্ষিণ দিকে একতলা বাড়ি। গাছগাছড়ায় ঢাকা। বাড়িওয়ালা থাকেন না বাড়িতে। থাকেন এক ব্যবসায়ী ভাড়াটে। মার্চের শুরু থেকেই তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন গ্রামে। রেখে গেছেন এক বয়স্কা মহিলাকে, বাড়িটা দেখভাল করার জন্য। বাড়িতে কিছু হাঁস-মুরগি আছে, গাছগাছালি আছে, সেসব দেখারও তো লোক লাগে। সেই মহিলাকে দেখা গেল সকালবেলা। ঘরের বাইরে এসে হাঁস-মুরগির খোয়াড়ের কপাট খুলে দিলেন। একটা লাল রঙের মোরগ দৌড়ে বেরিয়ে এসে গলা বাড়িয়ে মাথা উঁচু করে ডেকে উঠল কুকুরুকু। মুরগিগুলো শুরু করে দিল ছোটাছুটি।
লিলি বললেন, এই শোনেন, একটা টুল আপনাদের দেয়ালের ওই পারে রাখেন তো। আমি আপনাদের বাসায় আসব। বাচ্চা দুইটাকে নিয়ে আসব।
মা গো মা, বাড়িত কেউ নাই, আমি তো বাড়ির ভিতরে থাহি না, আমি ঘরের বাহিরে থাহি। বলে এক দৌড়ে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
লিলি প্রমাদ গুনলেন। বাস্তবতা খুব নিষ্ঠুর। অবশ্য মহিলাকে দোষও দেওয়া যাবে না। তিনি নিজেই পরের বাড়িতে থাকেন। তা-ও বাহির বাটিতে। তিনি কী করে বাইরের মানুষকে আশ্রয় দিতে পারবেন? পরাশ্রিতরা কখনো আরেকজনকে আশ্রয় দিতে পারে না। দিতে চায়ও না।
কিছুক্ষণের জন্য হয়তো একটু আনমনা ছিলেন লিলি। উত্তর দিকের বাসায় থাকেন একজন বিদেশি কূটনীতিক। যুগোস্লাভিয়ার প্রতিনিধি। এ মুহূর্তে তিনি একাই আছেন। স্ত্রী-সন্তানদের মাসের শুরুতেই পাঠিয়ে দিয়েছেন তাঁর স্বদেশে। সেই ভদ্রলোককে দেখা গেল একটা বাদামি রঙের স্লিপিং গাউন পরে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছেন। লিলির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ভদ্রলোককে দেখা গেল উত্তেজিত। গত রাতের গোলাগুলির পর তিনি হয়তো আশা করেননি যে পাশের বাড়ির কর্তী বেঁচে থাকবেন। তিনি এগিয়ে এলেন। ইশারায় জানতে চাইলেন, ডু ইউ নিড হেল্প। ডু ইউ নিড শেল্টার। ইউ ক্যান কাম হিয়ার।
লিলি বাইরের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন। রাস্তার ওপরেই মিলিটারি প্রহরা। ওই বাড়ির দেয়াল অনেক উঁচু। সেটা পার হওয়া অসম্ভব। আর গেট দিয়ে বের হওয়ামাত্র পড়তে হবে মিলিটারির কবলে। হঠাৎ লিলির চোখে পড়ল তাদের বাসার একটা জানালার সানশেডের ওপরে। ও মা! একি! একটা ওয়্যারলেস বসিয়ে রেখে গেছে মনে হচ্ছে। সব কথা এখান থেকে চলে যাচ্ছে মিলিটারির কাছে?
এই ভোরবেলাতেই লিলি একটা কাজ করিয়েছেন দিদারকে দিয়ে। তার যত ছবি ছিল ঘরের দেয়ালে, সব কটি সরিয়ে দিয়েছেন।
লিলি আবার দোতলায় গেলেন। যাওয়ার আগে নিজের ঘরের শূন্য দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পা এখনো পুরোপুরি সারেনি। একটু কষ্টই হয় সিঁড়ি ভাঙতে।
দোতলায় গিয়ে ডাইনিংয়ে একটা চেয়ারে বসলেন লিলি। আতিয়াও এসে পাশের চেয়ারে বসলেন। তাকে দেখাচ্ছে ছিন্নভিন্ন। হাবিব সাহেবরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হঠাৎ দরজায় ধাক্কা আর কলবেলের কর্ণবিদারী শব্দ। বাইরে গাড়ির আওয়াজ। বুটের খটখট পিলে চমকানো শব্দ।
লিলির আব্বা সেরাজুল হক সাহেব দরজার কাছে গেলেন। তারা তাকে হুকুম করল, বাড়ির ছাদে কালো পতাকা কেন, পতাকা নামাও।
সেরাজুল হক সাহেব ভদ্রভাবে বললেন, জি। কালো পতাকা নামানো হবে।
মিলিটারিরা চলে গেল। দিদার ছুটল পতাকা নামাতে। পতাকা নামিয়ে দিদার ট্রে-ভর্তি খাবার নিয়ে এসেছে দোতলায়। ঘড়িতে তখন আটটা। লিলি ধমক দিলেন, এই তুই ক্যানো খাবার নিয়ে ওপরে উঠেছিস। আমরা তো দোতলার ভাড়াটে। নিচতলার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। লিলি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, তিনি উর্দুতে কথা বলছেন। দিদার এই উর্দুর কিছুই না বুঝে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আগের রাতে একটা আকিকার দাওয়াত ছিল। সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। কিন্তু মেজবানরা খাবার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই খাবার সেরাজুল হক সাহেব ওপরে পাঠিয়েছেন।
কে খাবে খাবার? কার গলা দিয়ে এখন খাবার নামবে? খাবার পড়ে রইল টেবিলে। টেবিলের পাশে বসে আছেন আতিয়া। তার শরীর এলায়িত। একরাশ হতাশা মেঘের মতো ছেয়ে রেখেছে মুখখানা। বসে আছে মিমি। সোহেল লিলির কোলে। চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছেন হাবিব আর তাঁর স্ত্রী। কেউই খাচ্ছেন না।
টেবিলের ওপরে একটা রেডিও। তাতে একটা কাপড়ের ঢাকনা। লিলি রেডিওর নব ঘোরাতে লাগলেন। ঢাকা কেন্দ্র বন্ধ। নব ঘুরিয়ে এ কেন্দ্র ও কেন্দ্র ছুঁড়ে শোনা গেল বিকৃত বাংলা। তার মানে হলো, কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যায়নি। উর্দুওয়ালাদের ধরে এনে রেডিও চালানোর চেষ্টা চলছে।
আতিয়া বললেন, ভাবি, আজিজ কখন ফিরবে?
কে জানে এই প্রশ্নের উত্তর। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকাল আটটার সময় কার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর আছে যে ২৫ মার্চ রাতে যাকে ধরা হয়েছে, সে কবে ছাড়া পাবে পাকিস্তানিদের দোজখখানা থেকে?
লিলি বললেন, কারফিউ আর কতক্ষণ। কারফিউ তুলে নেবে। আর আজিজও চলে আসবে। ভেবো না আতিয়া।
আতিয়া বললেন, ফিরে আসবে, না? আসেন তাহলে নাশতা খাই।
আতিয়া হাসলেন। প্রত্যুত্তরে হাসলেন লিলিও। তাঁরা জানেন পরস্পর পরস্পরকে ঠকাচ্ছেন। নিজের অন্তরকেও প্রবোধ দিচ্ছেন। তারা নাশতা খেতে আরম্ভ করলেন।
লিলির মনে হলো, কাল রাতে তিনি তাজউদ্দীনের জন্যও টেবিলে খাবার বেড়ে রেখেছিলেন। প্লেট সাজিয়েছিলেন। তা না খেয়েই চলে গেছেন। তাজউদ্দীন।
আবার রেডিওর বোতাম ঘোরাচ্ছেন লিলি। এবার শোনা গেল আকাশবাণী কলকাতা। তারা বলছে, পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ভয় নেই। ভারত আপনাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।
ভয়ে, উত্তেজনায়, উদ্বেগে, উৎকণ্ঠায় দুপুর গড়িয়ে এল বিকেল। লিলি এবার উঠে দাঁড়ালেন। তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন। আর এই বাড়িতে থাকা নয়। তাঁকে পালাতেই হবে। তিনি নিচে গেলেন। আবার চারপাশটা ভালো করে খেয়াল করে দেখতে লাগলেন।
পাশের বাড়ির সাকিবার আব্বাও বারান্দায়। মিসেস তাজউদ্দীনকে দেখে তিনি অনুচ্চ স্বরে ডাকলেন, ভাবি, ভাবি, আপনি আমাদের বাসায় চলে আসেন।
লিলি একটা মুহূর্ত নিলেন ভেবে নেওয়ার জন্য। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বাড়িতে আর্মি আবার আসবে। এখানে থাকা কিছুতেই নিরাপদ না।
তিনি উঠলেন দোতলায়। আতিয়াকে ডেকে বললেন, আতিয়া। আমি সাকিবাদের বাড়ি যাই। তোমার নিজেরই বিপদ। আমি থাকলে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। নিচে আব্বা আছেন। তিনি তোমার দেখাশোনা করবেন।
আতিয়া কেবল এই প্রস্তাবে সায় দিলেন তা-ই নয়, একটুখানি গোছগাছ করে নিতে সাহায্য করলেন লিলিকে। লিলির কোলে সোহেল, আতিয়ার কোলে মিমি। তারা নিচে নামলেন।
লিলি গেলেন তার আব্বার ঘরে। তাঁর পিতা স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। লিলি বাবাকে কদমবুসি করলেন। বললেন, আব্বা, আমি পাশের বাসায় যাচ্ছি।
সেরাজুল হকের চোখের নিচে পিঁচুটি। গলায় শ্লেষ্ম জমে গেছে। ঘর্ঘরে গলায় তিনি বললেন, কারফিউ তো। কীভাবে যাবি?
রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে না। দেয়াল টপকাব।
মিলিটারি দেখলে গুলি করবে।
সাবধানে যাব। যখন দেখব রাস্তায় আর্মির গাড়ি নাই, তখন দেয়াল টপকাব।
লিলি আর সময় নেবেন না। দ্রুত আব্বার সামনে থেকে সরে যেতে হবে। না হলে মায়া এসে জড়িয়ে ধরবে। আব্বা এখানে কার সঙ্গে থাকবেন? কে তাকে খাবার দেবে? বিপদে-আপদে কে তাকে দেখবে, এসব কথা ভাবতে গেলেই পা আটকে যাবে শিকলে। আগে সটকে পড়তে হবে। পরের চিন্তা পরে।
পাশের বাড়িটি মুবিন সাহেবের। এর আগে পরিচয় হয়নি লিলির। বাড়ির পেছনের দিকে দেয়ালের পাশে আসতেই দেখা গেল ওই বাড়ির লোকজন তাদের সাহায্য করার জন্য সবাই উপস্থিত। এ পাশে উঁচু টুল পাতা হলো। ও পাশে মই। আতিয়া সাহায্য করলেন এই পারে। ওই পারে মুবিন সাহেব বললেন, মা, সাবধানে পার হও। তাড়াহুড়া নেই। রাস্তা থেকে জায়গাটা দেখা যাচ্ছে না।
.
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলবে :
এই মুবিন সাহেব হলেন সিলেটের মানুষ, আবদুল মুবিন চৌধুরী। তাঁর ছেলে শমসের মুবিন চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে যাবেন, বীর বিক্রম খেতাব অর্জন করবেন। সে-ও তো যুদ্ধদিনের কথা, যুদ্ধ শেষের কথা।
.
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি স্মরণ করবে :
৩২ নম্বরে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে নির্যাতিত ও আটককৃত অচেতন হাজি মোরশেদকে প্রথমে সংসদ ভবনের সিঁড়িতে, তারপর আদমজী স্কুলের রুমে রাখা হয়, তারপর নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় সামরিক হাসপাতালে। আবদুল আজিজ বাগমারসহ তাজউদ্দীন আহমদের বাড়ি থেকে ধরে আনা লোকদের প্রথমে সংসদ ভবনের সিঁড়ি, তারপর ক্যান্টনমেন্টের কচুক্ষেত এলাকার একটা গুদামে এনে ঢোকানো হলো। ওইখানে সার বেঁধে ৫টা গুদাম। গুদামের গেটে লেখা : পি ডব্লিউ কেইজ। প্রিজনার্স অব ওয়ার কেইজ। তার আগে তাদের মেরে-পিটিয়ে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত করা হয়। এই খাঁচাতেও তাঁদের ওপরে চলে নিয়ম করে ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন। মোহাম্মদপুর থানার বাঙালি পুলিশদেরও আনা হয়েছিল একই খাঁচায়। মারতে মারতে তাদের মেরেই ফেলা হয়েছিল। এর মধ্যে হাসপাতাল থেকে বের করে এনে হাজি মোরশেদকেও এই হায়েনার খাঁচায় এনে পোরা হলো। তাজউদ্দীন আহমদের বাড়িতে ধরা পড়া আবদুল আজিজ বাগমারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে ধরা পড়া হাজি মোরশেদের।
হাজি মোরশেদ দুর্বল শরীরে অস্ফুট স্বরে বললেন, মুজিব ভাইকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে।
বাগমার ফিসফিস করে বললেন, তাজউদ্দীন ভাই মিলিটারি আসার আগে আগেই আমীর-উল ইসলাম, কামাল হোসেনের সঙ্গে গাড়ি করে বাড়ি ছেড়েছেন। কোথায় আছেন, কেমন আছেন–আর কিছু জানি না।
হাজি মোরশেদ কাতর কণ্ঠে বললেন, আমাকে পিটিয়ে তো শেষ করে ফেলেছে। আরও নির্যাতন নিশ্চয়ই করবে।
বাগমার ব্যথিত গলায় বললেন, আমাদেরও অমানুষিক নির্যাতন করছে।
হাজি মোরশেদ চোয়াল শক্ত করে বললেন, বাগমার ভাই, আমাকে মেরে ফেললেও আমি স্বীকার করব না যে আমি আপনাকে চিনি। আপনিও কোনো কিছু স্বীকার করবেন না। দোয়া করি যেন বেঁচে থাকেন।
বাগমারও দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, আপনার জন্য আমি অন্তর থেকে দোয়া করি। আপনার এই কথা যে আমাকে কত সাহস দিল, আপনাকে বোঝাতে পারব না।
৭
ব্যাঙ্গমা বলল, ২৫ মার্চ থাইকা পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকাসহ সারা বাংলায় দোজখের আগুন ছড়ায়া দেয়।
ব্যাঙ্গমি বলল, ট্যাংক, কামান, মর্টার, এলএমজি, মেশিনগানের অবিরাম তোেপবর্ষণ, ছাত্রাবাস, বস্তি, পুলিশ ব্যারাক, ইপিআর ঘাটি, আনসার ঘাঁটি, লোকালয়, জনপদে অগ্নিসংযোগ আর নির্বিচার মানুষ হত্যা। তালিকা ধইরা ধইরা ছাত্র শিক্ষক বুদ্ধিজীবী স্বাধীনতাকামী মানুষের ঘরে ঘরে গিয়া গুলি কইরা হত্যা। জগন্নাথ হল থাইকা ছাত্রদের ধইরা আইনা মাঠে লাইন কইরা দাঁড় করায়া ব্রাশফায়ার। গর্ত কইরা সব লাশ চাপা দেওয়া মাটির তলায়। এই সবের বর্ণনা কি শেষ করা যায়! কারও পক্ষে সম্ভব পুরা নরকের ছবিটা আঁকা? ভাষায় ধারণ করা?
ব্যাঙ্গমা বলে, ২৫ মার্চ রাইতের হত্যা, ধর্ষণ, মৃত্যু, আগুন, গোলাবর্ষণের বিবরণ কারও পক্ষেই কুনুদিনও দেওয়া সম্ভব হইব না।
ব্যাঙ্গমি বলে, কারও পক্ষেই কুনুদিন সম্ভব না। আমরা এক কাম করতে পারি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ : দলিলপত্র বইয়ের অষ্টম খণ্ড থাইকা ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির সুইপার ইন্সপেক্টর সাহেব আলীর বিবরণ অবলম্বন করার লাইগা তারে ফলো করতে পারি।
.
সাহেব আলী সুইপারদের ইন্সপেক্টর। রাতে আছেন প্রসন্ন প্রসাদ লেনে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর বাড়িতে। সন্ধ্যার দিকে বেরিয়েছিলেন ডিউটিতে। রাতের বেলা ঢাকা শহরের রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া তাদের কাজ। তিনি ইন্সপেক্টর। নিজের হাতে ঝাড় দিতে হয় না। তার দলের লোকেরা ঝাড়ু দেয়। তিনি দেখভাল করেন। মুখে একটা পান পুরে ২৫ মার্চ সন্ধ্যাতেও ডিউটি সেরেছেন। রাস্তায় জনতা ব্যারিকেড দিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ পুরান ঢাকার রাস্তা দখল করে রেখেছে। রাত নয়টার পর পরিস্থিতি থমথমে হতে লাগল। সাহেব আলী জানতে পারলেন, পাকিস্তানি মিলিটারি রাতে হামলা করতে পারে। তাই জনতা বেশি করে ব্যারিকেড দিচ্ছে। আলোচনা ভেঙে গেল। সাহেব আলী মন খারাপ করে এসেছেন ছোট বউয়ের কাছে।
ঠিকমতো খেতে পারলেন না। ছোট বউ যত্ন করে মুরগির গোশত দিয়ে বুটের ডাল বেঁধেছেন। নিজ হাতে আটা ছেনে বেলনা দিয়ে বেলে রুটি বানাচ্ছেন আর গরম-গরম তার পাতে তুলে দিচ্ছেন। কিন্তু সাহেব আলীর হাত রুটি ছিঁড়তে পারছে না।
বউ বললেন, কী হইল। কার কথা ভাবেন? বড় বউয়ের কথা?
সাহেব আলী বললেন, কিছু জিগাইলা? মনটার মধ্যে কু-ডাক দিতাছে। আজ রাইতে না জানি কী হয়!
খানিক পরেই গোলাগুলির শব্দ শুরু হলো। সাহেব আলী বাড়ি থেকে বের হলেন।
বউ বললেন, করেন কী! কই যান?
সাহেব আলী বললেন, কোথাও যামু না। ঘটনা কী, মালুম কইরা আহি।
সাহেব আলী একটু একটু করে এগোচ্ছেন। জনতা চিৎকার করছে জয় বাংলা। গলির মুখে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলেন, পুরা ঢাকার রাতের আকাশ আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। তার মনে হলো, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, মালিবাগ গোয়েন্দা অফিস, বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ভীষণ গোলাগুলি হচ্ছে। আর সব বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সাহেব আলীর শরীর কাঁপতে লাগল। তিনি সুইপার কলোনির দোতলায় গেলেন। বড় বউ আর ছেলেপুলেদের বললেন, হুঁশিয়ার থাকো। সবাই মাটিতে শুইয়া থাকো।
আপনেও আহেন। আল্লার দোহাই লাগে, বাইরে যায়েন না।
না। যামু না। একটু বুঝার চেষ্টা করি, কুনহানে কী হইবার লাগছে।
সারা রাত মেঝেতে শুয়ে থেকে কিয়ামতের প্রলয়কাণ্ডের খানিকটা টের পেলেন। শব্দ, আগুন, চিৎকার। ঘুমাতে পারলেন না। এর মধ্যে ছোট ছেলেটা বারবার করে কেঁদে উঠছে। ডর লাগে। ডর লাগে। তার মা তাকে বুকের মধ্যে ঠেসে ধরে থাকেন।
ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহেব আলী বের হলেন। বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির দিক থেকে রাতে অনেক গোলাগুলির শব্দ এসেছিল। দেখে আসা দরকার। ফাঁড়ির পুলিশদের সঙ্গে তাঁর বিশেষ খাতির। রোজ রাতে ডিউটি করার সময় তাদের সঙ্গে দেখা হয়। লাশ উদ্ধার করে মর্গে নেওয়ার সময়ও সাহেব আলীদের ডাক পড়ে।
অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। পুবের আকাশ ফরসা হচ্ছে। পুরান ঢাকার গলির মধ্যে হোটেলগুলোর ছাদে কাক ভিড় করে হল্লাচিল্লা করতে শুরু করেছে। কুকুরের দল ছোটাছুটি করছে অকারণে। বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির দৃশ্য না দেখাই ভালো ছিল। ১০ জন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ পড়ে আছে। তাদের শরীর ক্ষতবিক্ষত। রক্তাক্ত। সেই রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। মেঝেতে রক্ত। চেয়ারে-টেবিলে রক্ত। দেয়ালে গুলিতে ঝাঁঝরা।
সাহেব আলী জানেন না যে বাইরে কারফিউ। তিনি তাঁর সহকর্মীদের ডাকলেন। ঠেলাগাড়ি আনালেন। লাশগুলো তুললেন ঠেলাগাড়িতে। ঠেলে নিয়ে গেলেন মিটফোর্ড হাসপাতালে। সেখানকার লাশঘরে স্তূপ করে রাখলেন মানুষের মৃতদেহ।
শাঁখারীবাজারে এলেন। রাস্তায় লাশ পড়ে আছে। রিকশার পাশে পড়ে আছে রিকশাওয়ালার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ। রাস্তার ধারে হাতে ভিক্ষার থালা ধরে পড়ে আছে ভিখারির পা না-থাকা দেহ। জজকোর্টের কোনায় হোটেল রেস্টুরেন্টের সামনে পড়ে আছে লাশ। সব গুলিবিদ্ধ। সুইপারদের সঙ্গে মহল্লাবাসী তরুণ-যুবক-ছাত্ররাও এসে হাত লাগাল। তারা লাশ তুলে রাখলেন। ঠেলাগাড়িতে নিয়ে নামিয়ে দিয়ে এলেন হাসপাতালের লাশঘরে।
রাস্তায় জনতার ভিড় বাড়তে থাকল। এবার মাইকে ঘোষণা আসতে লাগল–কারফিউ। সেনাবাহিনীর গাড়ি অস্ত্র উঁচিয়ে আসতে লাগল পুরান ঢাকাতেও। সাহেব আলী রাস্তা থেকে সরে পড়লেন। সুইপার কলোনিতে গেলেন। গোসল সেরে নিলেন। বিকেল ৫টার দিকে দেখতে পেলেন, তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, কোর্ট হাউস এলাকায় মিলিটারিরা সার বেঁধে অস্ত্র উঁচিয়ে যাচ্ছে আর গুলিবর্ষণ করছে নির্বিচার, ফায়ারগান দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে সামনে যা পাচ্ছে তাতেই। সারা রাত গুলিবর্ষণ চলল। চলল। আগুন লাগানো। রাতের পুরান ঢাকা জ্বলে-পুড়ে অগ্নিকুণ্ড হয়ে গেল। দোজখেও এত আগুন আছে কি না, সাহেব আলীর মনে সন্দেহ।
২৭ মার্চ বেলা একটায় নবাবপুর রোড, ইংলিশ রোডের দোকানে দোকানে আগুন দিতে লাগল মিলিটারিরা। মানুষ ছুটে পালাতে লাগল আগুনের দাহ থেকে বাঁচতে। অমনি চলল গুলি। তাঁতীবাজারের কাছের মন্দিরে শেল বর্ষণ করে সেটাকে গুঁড়িয়ে দিল আর্মিরা।
আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। ইংলিশ রোডের আগুন ঘরবাড়ি, দোকান পুড়িয়ে এগিয়ে আসছে সুইপার কলোনির দিকে। সাহেব আলী সব সুইপারকে নিয়ে পানি জমাতে শুরু করলেন। কিন্তু একটু পরে মিলিটারি এদিকায় এসে গুলিবর্ষণ করতে শুরু করলে নারী-পুরুষ-শিশু সবাই পালাতে শুরু করল।
২৮ মার্চ। রেডিওতে ঘোষণা আসছে, সব সরকারি কর্মচারীকে যোগ দিতে হবে কাজে।
২৯ মার্চ কাল ১০টার সময় ঢাকা পৌরসভা অফিসে গিয়ে ডিউটি রিপোর্ট করলেন সাহেব আলী। কনজারভেন্সি অফিসার ইদ্রিস বললেন, সাহেব আলী। ডোমদের নিয়ে বার হও। রাস্তায় রাস্তায় লাশ পইড়া আছে। চায়া আছ। ক্যান। সাহেব আলী, বাইর হয়া পড়ো, বাঁচবার চাও তো বারায়া পড়ো। কেউ বাঁচব না, তুমি না আমি না। কাউরে রাখা হইব না, সবগুলানরে কুত্তা বিলাইয়ের লাহান মাইরা ফেলা হইব।
পৌরসভার চেয়ারম্যান মেজর সালামত আলী খান। তার গলার স্বর আরও চড়া। মেজাজ কামানের মতো গরম। এই হারামজাদারা, চেয়ে আছ। কেন? বের হও। নিকলো, বাহার যাও।
সাহেব আলী বের হলেন। সুইপার ইন্সপেক্টর আলাউদ্দিন, সুইপার ইন্সপেক্টর কালীচরণ, সুইপার সুপারভাইজার পাঞ্চাম, সুইপার ইন্সপেক্টর আওলাদ হোসেন–পাঁচজন অফিস থেকে বের হলেন। সাহেব আলীর ডিউটি পড়ল ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে লাশ তুলে স্বামীবাগ আউটফলে ফেলার। তিনি পরদেশি ডোম, মন্টু ডোম, লেমু ডোম, গোলাপ চান ডোম, দুঘিলা ডোম ও মধু ডোমকে নিয়ে কাজে লেগে পড়লেন। ২৯ মার্চ ১৯৭১। সাহেব আলীর দল লাশ তুলছে। যেমন করে ঢাকার সোয়ারীঘাটে সকালবেলা ট্রাকে ট্রাকে ইলিশ মাছ আসে, একসঙ্গে ডালা ভরে মাছ নামানো হয়, ট্রাকে রিকশায়-ভ্যানে তোলা হয়, তেমনি করে ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশঘর থেকে সাহেব আলী অন্য ডোমদের নিয়ে লাশ বের করে করে ট্রাকে তুলতে লাগলেন। মানুষের লাশ। দুই ট্রাক লাশ তারা তুললেন। সাহেব আলী একটা করে লাশ তুলছেন, আর বোঝার চেষ্টা করছেন, এঁরা কে কী করতেন। তার মনে হলো, কেউ সরকারি কর্মচারী। পুলিশ, আনসার ও পাওয়ারম্যানদের খাকি পোশাক পরা লাশগুলো এরই মধ্যে বিকৃত হয়ে গেছে। লাশ তুলতে তুলতে পরদেশি ডোমের হাতে এক কিশোরীর লাশ উঠল। সম্পূর্ণ নগ্ন। তার শরীরে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন, তার বুক থেকে স্তন কেটে তুলে নেওয়া হয়েছে, লজ্জাস্থান ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে, নিতম্বের মাংসও কাটা। এরপর আরেকটা নগ্ন ক্ষতবিক্ষত শরীর। বছর দশেক বয়সী একটা বালিকার উলঙ্গ ক্ষতবিক্ষত লাশ। সারা দেহে বুলেটের আঘাত।
১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকে এক মেজর ফোন করেছেন পৌরসভায়। রোকেয়া হলের চারদিকে মানুষের লাশের পচা গন্ধ। বসা যাচ্ছে না। এখনই ডোম পাঠিয়ে লাশ তুলে ফেলা হোক।
সাহেব আলীকে বলা হলো, যাও। রোকেয়া হল এলাকায় যাও। ছয়জন ডোম নিয়ে রোকেয়া হলে গেলেন সাহেব আলী। রোকেয়া হলের রুমগুলোয় তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোনো লাশ পেলেন না। চারতলার ছাদের ওপর গিয়ে এক তরুণীর উলঙ্গ লাশ দেখতে পেলেন। সাহেব আলীর সঙ্গে ছিল মিলিটারি সোলজার। সাহেব আলী বললেন, এই ছাত্রীর বডিতে কোনো গুলির চিহ্ন নেই, মাগার মারা ভি গেছে ক্যামনে? সৈন্যটি বিকট শব্দে হেসে উঠল। বোঝে না। আমরা পাকিস্তানিরা এখানে এসেছি তোমাদের কওমের চেহারা বদলে দিতে। আমরা সারা রাত ওকে…
তার দুই দিকের গালে পশুদের কামড়ের চিহ্ন, বুকে দংশনের ক্ষতচিহ্ন। সাহেব আলী একটা রুম থেকে একটা চাদর নিয়ে এলেন। লাশটি ঢেকে দিয়ে নিচে নামালেন। রোকেয়া হলের সার্ভেন্ট কোয়ার্টারের ভেতরে ঢুকে দেখলেন, পাঁচজন নারীর লাশ আর আটজন পুরুষের লাশ পড়ে আছে। লাশ দেখে মনে হলো মৃত্যুর আগে সবাই বিছানায় শুয়ে ছিল। ডোমরা সেই লাশগুলো তুলল।
তারা ট্রাক নিয়ে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ির সামনে। তিনতলায় অধ্যাপকের কোয়ার্টার। চারটা লাশ পড়ে আছে। সাহেব আলীর মনে হলো, এসব হিন্দু অধ্যাপক, তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলের লাশ। আশপাশের লোকেরা ফিসফিস করে বলল, তার দুই মেয়ে বুলেটবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে আছেন।
লাশগুলো স্বামীবাগ আউটকলে ফেলে দিয়ে তারা ট্রাক নিয়ে চললেন বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে। ভাসমান হাত-পা, চোখবাধা অসংখ্য যুবকের লাশ পানিতে ভাসছে। ৩০ মার্চ বুড়িগঙ্গা নদী থেকে তিন ট্রাক লাশ তুলে স্বামীবাগ আউটকলে ফেলেছে সাহেব আলীর দল। পাকিস্তানি সেনারা শ্রমিক লাগিয়ে আগেই সেখানে বিরাট বিরাট গর্ত করে রেখেছিল। ৩১ মার্চ সাহেব আলীর দল মোহাম্মদপুর এলাকার জয়েন্ট কলোনির কাছ থেকে সাতটা পচা-ফোলা লাশ তুলল। ইকবাল হলে কোনো লাশ পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল লাশপোড়া ছাইভস্ম। পাকিস্তানি সেনারা আগেই ইকবাল হলের লাশ পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিয়ে রেখেছে। তারা আরও দশটা লাশ তুলেছে জগন্নাথ হল এলাকায়। সাহেব আলীর মনে হয়েছে, এরা বস্তি এলাকা থেকে জগন্নাথ হলে আশ্রয়ের জন্য ছুটে এসেছিল। কিন্তু বাঁচতে পারেনি।
ফেরার পথে ঢাকা হলের ভেতর থেকে চারজন ছাত্রের উলঙ্গ লাশ তুললেন তারা। ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল কচুক্ষেত, ড্রাম ফ্যাক্টরি, তেজগাঁও, ইন্দিরা রোড, দ্বিতীয় রাজধানী এলাকার ঢাকা বিমানবন্দরের ভেতরের এলাকায়, ঢাকা স্টেডিয়ামের মসজিদের পূর্ব-দক্ষিণ দিক থেকে কয়েকটা পচা লাশ তুলেছিলেন।
এরপর প্রতিদিন তাদের তুলতে হয়েছে লাশ। প্রতিদিন। বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় থেকে হাত-পা, চোখবাধা অসংখ্য মানুষের লাশ তাঁরা তুলতেন। মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল কলেজের হল থেকে ১০ জন ছাত্রের ক্ষতবিক্ষত লাশ তুলেছেন। রায়েরবাজার রাস্তা, পিলখানা, গণকটুলী, ধানমন্ডি, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, এয়ারপোর্ট রোডের পার্শ্ববর্তী এলাকা, তেজগাঁও মাদ্রাসা থেকে অসংখ্য মানুষের পচা-ফোলা লাশ তাদের তুলতে হয়েছে। তার মনে থাকবে যে অনেক লাশের হাত-পা পেয়েছিলেন, মাথা পাননি। মেয়েদের লাশগুলো ছিল উলঙ্গ ও ক্ষতবিক্ষত।
একদিন তাকে হুকুম করা হলো সাধনা ঔষধালয়ে যেতে হবে। লাশ সরাতে হবে। সাহেব আলী ডোমদের নিয়ে গেলেন স্বামীবাগের সাধনা ঔষধালয়ের কারখানায়। গিয়ে দেখতে পেলেন, ঔষধালয়ের মালিক প্রফেসর যোগেশ চন্দ্রের লাশ। বেয়নেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত তাজা লাশ তুলে কাঁদতে কাঁদতে তারা স্বামীবাগ ফেলে দিয়ে এলেন। যোগেশবাবুর লাশ জিব বের করে হাঁ হয়ে ছিল। গায়ে ছিল ধুতি আর গেঞ্জি।
রাতের বেলা বড় বউয়ের কাছে গিয়ে সাহেব আলী হাঁসফাঁস করেন। ছোট বউয়ের কাছে এলেও ঘুমাতে পারেন না। উঠে বসে থাকেন।
ছোট বউ বলেন, কী হইল আপনার। তড়পান ক্যান?
সাহেব আলী কথা বলেন না।
ও গো। তোমার হইছেটা কী? আমারে কও।
সাহেব আলী বলেন, বিবি, লাশ।
আরে মরার কথা হুনো। তুমি সুইপার। ডোম গো লইয়া তোমার কাম। তুমি লাশ দেখবা না।
সাহেব আলী কাঁদতে থাকেন, লাশ আর লাশ। মরদ পোলার লাশ, জোয়ান পোলার লাশ, যুবতী মাইয়া গো উলঙ্গ লাশ। লাশে লাশে নদীর পানি পুরা ঢাইকা রইছে। পানি দেখা যায় না। খালি লাশ আর লাশ। জন্তু জানোয়ারের না। মাইনষের লাশ…।
বউ নরম হন, কাইন্দেন না গো। কাইন্দেন না। আল্লাহর কাছে বিচার দ্যান। আল্লাহ বিচার করব। আল্লাহ বিচার করব।
৮
মমিনুল হক খোকা মোহাম্মদপুরের বাসায় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন শেষ রাতে। ক্যালেন্ডারে তখন ২৭ মার্চ ১৯৭১। তাঁর স্ত্রী মমতাজও ঘুমাতে পারছিলেন না। এই রাতে ঘুমানো যায়?
উঠে পড়লা যে? মমতাজ অন্ধকারের মধ্যে জ্বলতে থাকা টেবিলঘড়ির রেডিয়াম কাটার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন কটা বাজে।
ঘুমাতে পারছি না। অস্থির লাগছে। খোকা বিছানায় বসে দুই পা মেঝেতে রেখে বললেন।
আমারও ভালো লাগছে না। বুকটা কাঁপছে।
কাল রাতে বিবিসিতে বলল, মিয়া ভাই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।
হ্যাঁ। আমিও তো শুনলাম।
৩২ নম্বরের দিকে অনেক গোলাগুলি হয়েছে। জানি না মিয়া ভাই কেমন আছেন। ভাবি কেমন আছে। ছেলেমেয়েগুলান কে কেমন আছে। বেঁচে আছে। নাকি মারা গেছে।
আল্লাহ মাফ করুক। মারা যাবে কেন।
মিয়া ভাই আমাকে বলেছে ভাবি-ছেলেমেয়েদের দেখতে। আমি যাই।
কই যাবা?
৩২ নম্বরে।
কারফিউ না বাইরে?
বড় রাস্তা দিয়া যাব না। গলির ভিতর দিয়া দিয়া যাব।
যাবা যদি, একটা টুপি পরে নাও। আর্মি ধরলে বলবা, নামাজ পড়তে যাচ্ছ।
আচ্ছা। দাও একটা টুপি। ওই যে আলনার বাম দিকে দেখো।
মমিনুল হক খোকা মোহাম্মদপুরের নিউ কলোনি থেকে বের হলেন। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঢুকে পড়লেন লালমাটিয়ার রাস্তায়। আকাশ তখনো অন্ধকার। রাস্তার লাইটপোস্টের ঝুলে থাকা বাল্ব সেই অন্ধকার তাড়াতে পারছে না। আকাশে মেঘ। একটু ঠান্ডা বাতাস বইছে। রাস্তায় কুকুরেরা হল্লা করছে। তিনি একটা গলির ভেতরে ঢুকে গেলেন। পুরো ভুতুড়ে পরিবেশ। কোথাও জনমানুষের কোনো চিহ্ন নেই। খোকা রাস্তা ছেড়ে একটা দেয়াল টপকে একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। তারপর সেই বাড়ির লন উঠান পেছনের বাগান পেরিয়ে আবার টপকালেন আরেকটা প্রাচীর।
এইভাবে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি। লালমাটিয়া থেকে এবার যেতে হবে ধানমন্ডি এলাকায়। মধ্যখানে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের বড় রাস্তা। এটা পার হওয়াই কঠিন। তিনি ডানে তাকালেন। বাঁয়ে তাকালেন। রাস্তার একটা জায়গায় বাতি নেই। অন্ধকারটা ওই জায়গায় বেশ গাঢ় হয়ে আছে। ওই জায়গা দিয়েই দ্রুত রাস্তাটা পার হতে হবে তাকে।
দেয়াল টপকে টপকে অন্ধকার জায়গাটায় গিয়ে বড় রাস্তার উত্তর পাশে একটা গাছের আড়ালে আশ্রয় নিলেন খোকা। তার বুকের শব্দ তিনি নিজেই শুনতে পাচ্ছেন। দম নিলেন। ডানে-বায়ে তাকিয়ে দেখলেন, কেউ নেই। এই সুযোগ। আল্লাহর নাম নিয়ে মাথা নিচু করে তিনি এক দৌড়ে রাস্তার দক্ষিণ পাশের বাড়ির সামনে প্রাচীরের ধারে কামিনী ফুলের ঝাড়ের নিচে আশ্রয় নিলেন।
.
ধানমন্ডির বেশির ভাগ বাড়ি এক বিঘা জমির ওপরে। চারদিকে অনুচ্চ পাঁচিল। গাছপালা, বাগান। একতলা বাড়িই বেশির ভাগ। সেসব দেয়াল টপকানো তেমন কষ্টের কিছু নয়। শুধু ভয়, বাড়িতে না আবার কুকুর থাকে! বিওয়্যার অব ডগস দেখলে সেই বাড়ি এড়াতে হবে।
এইভাবে অতিকষ্টে প্রথমে তিনি পৌঁছালেন আহমেদ ফজলুর রহমানের বাসায়। ততক্ষণে আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। কাকেরা ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে। খানিকক্ষণ দম নিয়ে খোকা গলি-ঘুপচি, বিভিন্ন বাড়ির কোমর অবধি বানানো দেয়াল, বাড়ির সামনে-পেছনে, চারদিকে বিস্তারিত বাগানের গাছপালার আড়াল ধরে ৩২ নম্বর সড়কে বাহাউদ্দিন সাহেবের বাড়ি গিয়ে পৌঁছালেন। তারা জেগে উঠেছেন।
মিসেস বাহাউদ্দিন ভয় পাওয়া গলায় বললেন, কে?
ভাবি, আমি খোকা। মমিনুল হক খোকা।
আপনি? কই যান?
মুজিব ভাইয়ের বাড়ি যাওয়ার জন্য বের হয়েছি।
ঘরে আসেন। কথা আছে!
মমিনুল হক খোকা এগিয়ে গেলেন। একটার পর একটা পাঁচিল টপকানোর ধকলে তিনি ক্লান্ত এবং ঘর্মাক্ত। মিসেস বাহাউদ্দিনের চোখের নিচে কালি। ঘরে পরা শাড়ির আঁচল সামলাতে সামলাতে তিনি ফিসফিস করে বললেন, খোকা ভাই। রাতের বেলা কামাল এসেছিল। মহিউদ্দিন এসেছিল। দেয়াল টপকে টপকে ভেতর দিয়ে ভেতর দিয়ে এসেছিল। রাতে আমার এখানে ছিল। ভোরবেলা চলে গেল। কোথায় গেল তা তো বলে গেল না!
খোকা খানিকক্ষণ বসলেন। দম নিলেন। মিসেস বাহাউদ্দিন তাকে পানি এনে দিলে তিনি ঢক ঢক করে গেলাস খালি করলেন। তারপর উঠলেন। আবারও দেয়াল টপকে টপকে বড় রাস্তা এড়িয়ে ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে যাওয়ার অভিযানে নেমে পড়লেন তিনি।
৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ির পাশের বাড়িতে এসে পৌঁছালেন মমিনুল হক খোকা। এই বাড়িটা গাছগাছালিতে ঢাকা। আমগাছের নিচে মুকুল ঝরে পড়ে আছে। একটা বুনো ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। এদিক ওদিক তাকালেন তিনি। কোথাও আর্মি-পুলিশ দেখলেন না। আরেকটা দেয়াল টপকে গেলেন মিয়া ভাইয়ের ৬৭৭ নম্বর দোতলা বাড়িটির সামনে। পোড়োবাড়ির মতো পড়ে আছে বাড়িটা। গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন খোকা। এগিয়ে গেলেন। দরজা খোলা। বারান্দা পেরোলেন। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলেন জিনিসপত্র লন্ডভন্ড। এখানে-ওখানে গুলির খোসা। দেয়ালে গুলির দাগ। বারান্দায় শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ।
বাড়িতে কেউ নেই। নিজের পায়ের আওয়াজ নিজেই পাচ্ছেন।
বাইরে এলেন। কবুতরগুলো বাকবাকুম করছে। তাকে দেখামাত্র জামালের কুকুর দুটো ছুটে এল। তার পায়ের কাছে এসে মিনতি করে কী যেন বলতে চাইল। আর দেখতে পেলেন খাঁচার মধ্যে একটা বানর। কাল পুরোটা দিন গেছে, ২৬ মার্চ, এদের কেউ খেতে দেয়নি। খোকাকে দেখে বানরটা কুঁই কুঁই করতে লাগল। তার চোখে মিনতি। খোকা কেঁদে ফেললেন। বাড়িতে কেউ নেই। কে কোথায়? কামাল গিয়েছিল বাহাউদ্দিনের বাড়িতে। সে জীবিত আছে। মিয়া ভাই কোথায়? ভাবিরা কে কোথায়?
পাশের বাসার লোকজনের কাছ থেকে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে। তিনি ডা. সামাদের বাড়ির দেয়াল টপকে তাতে ঢুকে পড়লেন। এগিয়ে গেলেন। বাড়ির নিচতলার প্রবেশমুখে। ভেতরে প্রাণের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
সামাদ সাহেবের ছেলে বাবু এগিয়ে এলেন। বললেন, চাচা, আপনি দেয়াল টপকে আসছেন কেন? কারফিউ তো এখন উইথড্র করেছে। চারটা পর্যন্ত কারফিউ থাকবে না। তারপর আবার কারফিউ।
খোকা বললেন, ভাবিদের খোঁজে এসেছি।
ওনারা আমাদের বাসায় আছেন। আসেন। বাবু শার্টের বোতাম ঠিক করতে করতে বললেন।
ভাবিরা এই বাসায় আছে! খোকার ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এল। তিনি এগিয়ে গেলেন।
আকাশ গুমোট। গাছগাছড়ায় বাড়ির নিচতলা অন্ধকার। বাইরের ঘরেই বসে আছেন রেনু, জামাল, রাসেল।
খোকাকে দেখেই রেনু হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন, ভাইডি, তুই আসছিস!
রেনুর কান্না আর থামে না। ভাইডি, কত যে গোলাগুলি করল বাড়িতে, তোর মিয়া ভাইকে ধরে নিয়ে গেল!
জামাল বললেন, এই বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না।
রেনু বললেন, ভাইডি। আমরা কোথায় যাব?
খোকা বললেন, কারফিউ তুলে নিয়েছে চারটা পর্যন্ত। আমি তাহলে আমার গাড়িটা আনি। আপনাদের নিয়ে যাই।
জামাল বললেন, কই নিয়ে যাবেন। আপনার বাসাও নিরাপদ হবে না। রেডিওতে শুনলাম, সারা দেশে মিলিটারি পাগলা কুকুরের মতো মানুষ মারছে। সবাইকে অ্যারেস্ট করছে। আপনার বাড়িতেও মিলিটারি হামলা করবে।
খোকা বললেন, গাড়ি নিয়ে আসি। জাকি ভাইয়ের বাড়িতে আমার গাড়ি আছে। আমি যখন এসে গেছি, আর কোনো চিন্তা করিস না।
খোকা উঠলেন। দ্রুতপায়ে হেঁটে ৩২ নম্বরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। রিকশা-বেবিট্যাক্সি কিছুই নেই।
এই সময় রাস্তায় একটা গাড়ি দেখা গেল। গাড়িটা এদিকেই আসছে। খোকার সামনে এসে গাড়িটা ভটভট শব্দ তুলে থামল। ড্রাইভিং সিটের পাশের জানালা দিয়ে মাথা বের করে দিলেন তারেক। খোকা চিনতে পারলেন গাড়ির চালককে, শেখ কামালের বন্ধু। তিনি বললেন, চাচা, কোথায় যাবেন? চলেন আমি নামিয়ে দিয়ে আসি।
তারেক। জামাল, রাসেল, ভাবি আছে। তাদেরকে নিয়ে চলো তো একটু ধানমন্ডি ২ নম্বর রোডের দিকে যাই।
আচ্ছা। চলেন।
খোকা দৌড়ে ডা. সামাদ সাহেবের বাড়ির ভেতরে গেলেন। বললেন, ভাবি, একটা গাড়ি পাওয়া গেছে। আসেন আসেন। তাড়াতাড়ি আসেন।
রেনু, জামাল, রাসেল বসল গাড়ির পেছনে। সামনে তারেকের পাশে বসলেন খোকা। বললেন, ২ নম্বরের দিকে চলো।
খোকার চিন্তাটা হলো, ২ নম্বরে তার বন্ধু ও আত্মীয় মোরশেদ মাহমুদের বাসা। সেখানে যাওয়া যেতে পারে।
তারেক ধানমন্ডি ২ নম্বর সড়কে মোরশেদ মাহমুদের বাসার সামনে তাঁদের নামিয়ে দিয়ে সালাম দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
খোকা বাড়ির দোরঘণ্টি বাজালেন।
মোরশেদ মাহমুদ দরজা খুললেন। তারা ভেতরে ঢুকে দেখলেন, সবাই বাক্সপেটরা বাধছে। ঢাকা ছেড়ে চলে যাবে।
রেনু অসহায়ের মতো তাকালেন খোকার দিকে। এরা নিজেরাই তো চলে যাচ্ছে। আমরা কী করে থাকব, ভাইডি।
খোকা বললেন, আপনারা এই বাসাতেই একটু বসেন। আমি আমার গাড়িটা আনি।
খোকা গাড়ি আনতে গেলেন। রেনুর মনে দুশ্চিন্তা কত রকমের। হাসুর আব্বা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কেউ জানে না। হাসু-রেহানাই-বা কোথায় আছে, কী করছে! কামাল রাতের বেলা একবার এসেছিল। ২৭ মার্চ ভোর রাতের দিকে। এ-বাড়ি ও-বাড়ির দেয়াল টপকে, মানুষের বাড়ির পেছন দিয়ে, বাগানের গাছগাছালির ভেতর দিয়ে সে প্রথমে নিজেদের বাড়িতে গিয়েছিল। গিয়ে যখন সে দেখতে পেয়েছিল, বাড়িতে কেউ নেই, তখন বুদ্ধি করে সে চলে এসেছিল ডাক্তার সাহেবের বাসায়। সেখানে গিয়ে সে মা, জামাল আর রাসেলের দেখা পেয়েছিল।
এরপর একসময় কামাল বলেছিল, মা, বাসায় কিছু জরুরি জিনিসপত্র আছে। আমি একটু আমার ঘরে যাই। জিনিসপত্রগুলো নিয়ে আসি।
তখন কারফিউ চলছে। কামাল দেয়াল টপকে ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে ঢুকেছিল। তার পরপরই বাড়ি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেল। বাইরে পাকিস্তানি মিলিটারির বহর পাহারা দিচ্ছিল। বাড়ির ভেতরে মানুষের নড়াচড়া টের পেয়ে তারা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে দিয়েছিল।
রেনু তখন ডাক্তার সাহেবের বাড়িতে জায়নামাজে বসে আল্লাহকে ডাকছেন, হে আল্লাহ, কামালকে রক্ষা করো। হে আল্লাহ, কামালকে রক্ষা করো। কিছুক্ষণ পরে গোলাগুলি থেমে গিয়েছিল।
জামাল আর সঙ্গী কিশোর বয়সী গৃহপরিচারক আবদুল ডাক্তার সাহেবদের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। বোঝার চেষ্টা করছিল মিলিটারি আছে কি নেই। আবদুলের সাহস বেশি। দেখতেও সে ছোটখাটো। সে আরেকটু সামনে এগিয়েছিল। একটা বকুল ফুলের ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে এদিক-ওদিকে তাকিয়ে সে বলেছিল, না, সামনে কেউ নেই। মিলিটারিরা চলে গেছে। জামাল গুলির খোসা কুড়াচ্ছিলেন।
রেনু বলেছিলেন, এই জামাল, কী করিস। ঘরের ভেতরে আয়।
জামাল বলেছিলেন, কত গুলি যে করেছে। ঝরাপাতার মতো আমাদের বাড়ির চারদিকে গুলির খোসা পড়ে আছে। কিছু কুড়ায়া রাখি।
রেনু বলেছিলেন, পাগল নাকি। কখন আর্মি এসে পড়ে। ঘরে আয়।
জামাল বলেছিলেন, আর্মির গাড়ি চলে গেছে। শুধু দূরে গার্লস স্কুলের ছাদে এলএমজি ফিট করে রেখেছে।
রেনু বলেছিলেন, তাইলে আমি একটু বাসায় ঢুকব। কামাল জিনিসপত্র নেওয়ার জন্য বাসার দিকে যে গেল, তারপরেই তো গুলি শুরু হলো। জানি
সে বাইচে আছে নাকি মারা গেছে। কথাটা বলতে গিয়ে তার বুকটা কেঁপে উঠেছিল, গলায় কান্না চলে এসে দলা পাকাচ্ছিল। কী ভয়াবহ উকণ্ঠাভরা মুহূর্ত একেকটা। তপ্ত লোহা গলে গলে পড়ে যেমন করে, তেমনি করে যেন একেকটা সেকেন্ড তার মনের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। কামাল ওই বাসায়, আর গগনবিদারী শব্দ করে গুলির এসে বিদ্ধ করছে তাদেরই সেই বাসার দেয়াল, ভেঙে পড়ছে কাঁচের জানালা। সেলাই মেশিনের সুইয়ের মতো গুলি এফেঁড়-ওফোড় করছে তাদের বাড়ির দেয়াল, দরজা, জানালা, ছাদবারান্দা।
রেনু দেয়াল টপকে নিজেদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। দরজা সিলগালা করে দিয়ে গেছে। তিনি এ-ঘর ও-ঘরের বারান্দা দিয়ে ভেতরে তাকিয়েছিলেন। কামালের ঘরের জানালার কাঁচ নেই। কাঁচের গুড়া পড়ে আছে বারান্দায়। তিনি ভেতরে খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখছিলেন। না, কোথাও কামাল নেই। তিনি মেঝেতে বিছানায় ভালো করে তাকালেন। কোথাও লাশ পড়ে নেই তো! এই চিন্তা করার সঙ্গে সঙ্গে শরীর-মন অবশ। হয়ে গিয়েছিল। না, লাশের মতো কিছু দেখা যায়নি। রক্তের দাগও না। শুধু ২৫ মার্চ রাতের রক্তচিহ্নগুলো শুকিয়ে কালো হয়ে ছিল নিচতলায়। নতুন করে রক্তপাত ঘটেনি এ বাড়িতে।
.
কামাল কোথায় গেল? এই দুর্ভাবনা অক্টোপাসের মতো রেনুকে চারপাশ থেকে জাপটে ধরে থাকে। মোরশেদ মাহমুদের বাসার ড্রয়িংরুমে সোফায় রাসেলকে কোলে করে বসে আছেন তিনি। ওদের বাঁধাছাদা, তৈরি হওয়ার ব্যস্ততার দিকে একবারের জন্য অসহায় দৃষ্টি মেলে ধরে নিজের ভাবনার জগতে ডুবে থাকেন রেনু। এত উদ্বেগ, এত অনিশ্চয়তা, এত আতঙ্ক। মাথা ঠিক রেখে কোনো কিছু চিন্তাও তো করা যাচ্ছে না।
খোকা গাড়ি নিয়ে এসেছেন, ভাবি, ওঠেন।
ভাইয়েরা, তাহলে আসি। মোরশেদ মাহমুদের বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মমিনুল হক খোকার গাড়িতে উঠলেন রেনু, জামাল, রাসেল।
রেনু বললেন, কামাল বেঁচে আছে না মরে গেছে, কিছুই জানি না। তোর কি মনে হয় ভাইডি, কামাল বেঁচে আছে তো, তাই না?
খোকা বললেন, আল্লাহকে ডাকেন ভাবি। নিশ্চয়ই বেঁচে আছে।
রেনু বললেন, আবদুলকে বলেছি বানরটাকে আর গরুগুলোকে ছেড়ে দিতে।
জামাল বললেন, আবদুল গরু ছেড়ে দিয়েছে। বানরটাকেও ছেড়ে দিয়েছে। বানরটাকে আমরা আমাদের সাথে আনতে পারতাম।
রেনু বললেন, মানুষই বাঁচে না আর বানর। ছেড়ে দিলে বানরটা হয়তো বাঁচবে। আমাদের সাথে থাকলি না-ও বাঁচতে পারে।
গাড়ি চলছে। ঢাকার রাস্তায় মানুষ বনপোড়া হরিণপালের মতো দৌড়াচ্ছে। যে যেখানে পারছে, সরে যাচ্ছে।
জামাল বললেন, চাচা, আমরা কই যাব?
মমিনুল হক খোকার স্টিয়ারিংয়ে এক হাত, গিয়ারে আরেক হাত, তিনি বা হাতটা শূন্যে নেড়ে বললেন, জানি না রে। একটা কাজ করতে পারি। রহমানের বাসা যেতে পারি। ১৫ নম্বরে থাকে।
রেনু বললেন, বশীরের ওখানে?
মমিনুল হক খোকা মাথা নাড়লেন, জি ভাবি।
.
ব্যাঙ্গমা বলল, এইহানে আমরা বানরটার কথা খানিক কইয়া লইতে পারি।
ব্যাঙ্গমি বলল, হ। তা তো পারিই।
ব্যাঙ্গমা বলল, শেখ মুজিবের বাড়ির সাথেই আরেকটা বাড়ি আছিল, জাপানি কনসাল জেনারেলের বাড়ি। তার নাম আছিল হিগাকি। হিগাকি তো ২৫ মার্চ-২৬ মার্চের গোলাগুলির মধ্যে পইড়া ভ্যাবাচেকা খাইছেন। একটাই সুবিধা আছিল, বউ-বাচ্চারে আগেই জাপান পাঠায়া দিছিলেন। ২৭ তারিখে কারফিউ তুইলা দিলে তিনি উঁকিঝুঁকি মারা শুরু করলেন। ৬৭৭ নম্বর বাড়ি থাইকা শেখ সাহেবরে ধইরা নিয়া গেছে, এইটা তিনি খোঁজখবর পাইলেন নিজের বাড়ির কাজের লোক, ড্রাইভার, নানাজনের কাছ থাইকা।
এইবার তিনি ছাদে উইঠা শেখ সাহেবের বাড়ি আগাগোড়া নিরীক্ষণ করলেন। গুলির খোসা তার বাড়ির ছাদেও পাওয়া গেল। শেখ সাহেবের বাড়ির পায়রাগুলো উড়তাছে, ছাদে বসতাছে, সানশেডে বসতাছে, তারা তাগো মালিকরে খুঁজতাছে। আহা! রোজ শেখ সাহেব কবুতরগুলারে খাইতে দিতেন। হিগাকি নিচে তাকাইলেন। গরুগুলা নাই। ওই ওইখানে বাথানে গরু বান্ধা থাকে। ওই চাড়িতে গরুগুলান পানি-খইল খায়। হঠাৎ তার চোখে পড়ল একটা বাঁদর। একটা সানশেডে বইসা অসহায়ভাবে তাঁর দিকে চায়া আছে।
তিনি কইলেন, আবুল কাশেম। একটা কাজ করো। ওই বানরটা শেখ সাহেবের বড় প্রিয় ছিল আমি জানি। না খেতে পেয়ে বানরটা মারা যাবে–এটা আমি চাই না। ওকে আমাদের মেহমান করে নিয়ে এসো।
চৌকিদার আবুল কাশেম তাই করল। দুটো পাকা কলা (দুদিন আগে কেনা, পাইকা গইলা গেছে) হাতে নিয়া দেয়াল টপকায়া নাইমা গেল পোড়োবাড়ি ৬৭৭-এ। বানরটার দিকে আবুল কাশেম কলা বাড়ায়া ধরতেই সে দুই লাফে সানশেড থাইকা নাইমা আবুল কাশেমের বাড়ায়া ধরা হাতে বসল।
এরপর থাইকা বানরটা জাপানি কনসাল জেনারেল হিগাকি সাহেবের কাছেই থাইকা যায়। মেহমান হিসেবে বানরটা ভালোই খাতির-যত্ন লাভ করে।
ব্যাঙ্গমি বলল, কিন্তু হিগাকি সাহেব জানেন না, তার বাড়ির ভিতরে একটা তেঁতুলগাছ আছিল, ভীষণ ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছ, তার তলাটা আছিল ঘন অন্ধকার, সেই অন্ধকার গাছের নিচে আরও আরও গাছপালা, লতাগুল্মের মধ্যে দুই ঘণ্টা নিজেরে লুকায়া রাখছিলেন শেখ কামাল। নিজের বাড়িতে যাওনের পর যখন মিলিটারির গুলির মধ্যে পড়লেন, তিনি লাফায়া দোতলা থাইকা প্রথমে একতলার ছোট ছাদে নামেন। সেইখান থাইকা আরেক লাফ দিয়া নামেন গ্যারেজের ছাদে। তারপর আরেক লাফ দিয়া রান্নাঘরের চাল। সেইখান থাইকা আরেক লাফ দিয়া তিনি নামেন জাপানি কনসালের বাড়ির ভিতরে। সেইখানে তেঁতুলগাছের গায়ের সাথে গা লাগায়া তিনি বইসা থাকেন টানা দুই ঘণ্টা। তখন মাথার ওপর দিয়া শা শাঁ কইরা গুলি উইড়া যাইতাছে।
.
মমিনুল হক খোকা গাড়ি ঘোরালেন ধানমন্ডি ১৫ নম্বর সড়কের ক্যাপ্টেন বশীর রহমানের বাড়ির গেটের দিকে। গেটে দারোয়ান ছিল, উঁকি দিল, খোকা গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে দিলে দারোয়ান তাকে চিনতে পারল, লোহার গেট ঠেলে খুলে দিল। খোকা গাড়ি বাড়ির ভেতরে নিলেন।
গাড়ি থেকে নামলেন রেনু, জামাল, রাসেল, খোকা। বেল টিপতেই বেরিয়ে এলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন রহমান। তিনি এঁদের আগে থেকেই চিনতেন, সাদরে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
এরই মধ্যে দারোয়ানের মুখে শোনা গেল, ধানমন্ডি ৮ নম্বর ব্রিজের কাছে পড়ে আছে একটা লাশ। কার লাশ কেউ বলতে পারে না। তবে লোকে বলাবলি করছে, শেখ কামাল মারা গেছে।
শুনে রেনু মেঝেতে গড়াগড়ি করে কাঁদতে আরম্ভ করলেন, কামাল রে, তুই কই গেলি রে…।
মমিনুল হক বের হলেন ঘটনা কী তা জানার জন্য। বললেন, ভাবি, আমি খোঁজ নিতে বের হচ্ছি, কামাল কই আছে, সেটাও বের করব। হাসিনা রেহানাদের ওখানেই যাই। ওদের খবরও তো জানা দরকার।
৯
হাসিনার তো ভালো খাবারদাবার দরকার। একটু বিশ্রাম দরকার। ভালো রকমের একটা বিছানা পেলেও তো তিনি খানিকটা জিরিয়ে নিতে পারতেন। ওয়াজেদ মিয়া উদ্বিগ্ন বোধ করেন। কাল সারাটা দিন গেছে একই খিচুড়ি খেয়ে। আজকে সকালেও আর কোনো উপায় নেই। খিচুড়িই চুলায় বসাচ্ছে। পাগলা।
রেহানা বারবার বারান্দায় যাচ্ছেন। আকাশ মেঘলা। বাইরের আকাশ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই, বেলা বাড়ছে। হঠাৎই ডোরবেল বাজার শব্দ।
রেহানা এগিয়ে গেলেন। দেখতে পেলেন স্বপ্ন দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে একটা জগ। বললেন, মা পাঠিয়েছেন। হাসিনা আপার জন্য। দুধ।
রেহানা দরজা খুললেন।
স্বপ্ন বললেন, কারফিউ উইথড্র করেছে।
ওয়াজেদ মিয়াও এগিয়ে এসেছেন। তিনি বললেন, কারফিউ উইথড্র করেছে! তাহলে চলো, আমরা ৩২ নম্বরে যাই।
হাসিনা বললেন, হ্যাঁ। সেটাই ভালো।
জেলি বললেন, আমি একটু দুধটা গরম করে দিই।
স্বপ্ন বললেন, গরম করতে হবে না। জ্বাল দেওয়া দুধ।
পাগলা একটা গেলাস এগিয়ে দিল। স্বপ্ন তাতে দুধ ঢেলে হাসিনার দিকে। এগিয়ে ধরলেন।
পাগলা বলল, কারফিউ নাই। আমি ৩২ নম্বর গেলাম। আম্মা, রাসেল ভাই আর সাহেবের খবর আগে লই। তারপর বাকি কথা। সে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
ওয়াজেদ মিয়া বাইরে বের হয়ে একটা ধাক্কামতো খেলেন। গেটের সামনে দুটো মিলিটারি জিপ। জলপাই রঙের জিপে সশস্ত্র সৈনিকদের মনে হচ্ছে যমদূত। গাড়িটা গ্যারেজে। সেখানে যেতে হলে গেটের বাইরে মিলিটারি জিপ পার হয়ে যেতে হবে। ওয়াজেদ মিয়া সাহস করে এগোলেন। মিলিটারিদের বললেন, এই গ্যারেজে আমার গাড়ি আছে।
মিলিটারিরা তাঁকে যাওয়ার অনুমতি দিল।
ওয়াজেদ মিয়া গ্যারেজের দরজা খুললেন। ভেতরে গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা আর কাঁচের মধ্যে জয় বাংলা পোস্টার। বাড়ির ভেতর থেকে পানি আর ন্যাকড়া এনে পোস্টার তুললেন ঘষে ঘষে। বাংলাদেশের পতাকা খুলে ফেললেন। তারপর গাড়ি এনে রাখলেন বাড়ির সিঁড়ির সামনে।
হাসিনা, রেহানা, জেলি গাড়িতে উঠে বসলে ওয়াজেদ মিয়া গাড়ি স্টার্ট দিলেন। প্রথমে তারা গেলেন ৩২ নম্বরের বাড়ির সামনে। বাড়ি সিলগালা করা। ভেতরে ঢোকা গেল না।
গাড়ির শব্দ পেয়ে ডাক্তার সাহেবের বড় ছেলে বেরিয়ে এলেন তাঁদের বাসা থেকে। বললেন, আপনারা বাসার ভেতরে আসুন।
ডাক্তার সাহেব ছিলেন। তিনি বললেন, মিনিট পাঁচেক আগে খোকা ভাই এসেছিলেন। তিনি ভাবি, জামাল, রাসেলকে নিয়ে গেছেন। ধানমন্ডি ২ নম্বরের দিকে গেছেন।
রেহানা বললেন, খোকা চাচার বন্ধুদের বাসা আমি চিনি। ২ নম্বর রোডে তাঁর খুব খাতিরের বন্ধু আছে। চলেন আমরা সেখানে যাই। যদি খোঁজ পাওয়া যায়।
২ নম্বরে ঠিক বাসাতেই গেলেন ওয়াজেদ মিয়া। শুনতে পেলেন একটু আগে খোকা এখান থেকে চলে গেছেন বেগম মুজিবদের নিয়ে। এইখানে তো সারা রাত গোলাগুলি হয়েছে। কাছেই পিলখানা। একেবারে যুদ্ধক্ষেত্র। হয়ে গিয়েছিল এই রাস্তাটা। আমরা চলে যাচ্ছি গ্রামে।
একজন বললেন, কামাল ভাই মারা গেছে জানো। ৮ নম্বরে লাশ পড়ে আছে।
আরেকজন বললেন, না না। ওইটা কামাল না। পানাউল্লাহ সাহেবের ছেলে খোকনের লাশ। ও রাতে ওখানে ব্যারিকেড দিচ্ছিল। তখন মারা গেছে।
হাসিনা, রেহানা, জেলি পরস্পরের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। তাঁদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে যে কামাল মারা যাননি। কারণ, ওমর ভাই খোঁজ দিয়ে গেছেন। কামাল ভাই-ই তাকে পাঠিয়েছিলেন।
হাসিনা বললেন, মা তো আমাদের খোঁজে আমাদের ভাড়া করা বাড়িতেও যেতে পারে। চলো, ওই বাড়ির দিকে যাই।
রেহানা বললেন, হ্যাঁ। তা-ই হতে পারে। মা আগে আমাদের খোঁজ নিশ্চয়ই নিতে যাবেন।
ওয়াজেদ মিয়া গাড়ি চালাতে শুরু করলেন।
১৫ নম্বর সড়কের ভাড়া বাসার কাছে যেতেই হঠাৎ চিৎকার শোনা গেল, হাছু আপা, দেনা আপা, দুলাভাই…
রাসেলের গলা। ওয়াজেদ মিয়া ব্রেক কষলেন। ১৫ নম্বরে ক্যাপ্টেন রহমান সাহেবের দোতলায় রাসেল।
সামনে দেখা গেল খোকা চাচার গাড়ি।
সবাই গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দোতলায় গেলেন।
বেগম মুজিব ওরফে রেনু মেঝেতে শুয়ে আছেন। তিনি প্রলাপ বকছেন। ওয়াজেদ সাহেবকে দেখে তিনি বললেন, বাবা, ওরা কামালকে মেরে ফেলেছে।
রেহানা বললেন, মা, যে লাশটাকে সবাই কামাল ভাই ভাবছে, ওইটা কামাল ভাই না। খোকন ভাই। তুমি কান্নাকাটি কোরো না। কামাল ভাই খবর দিয়ে ওমর ভাইকে পাঠিয়েছিলেন। উনি ভালো আছেন।
রেনু বললেন, ও বাসায় ঢোকার পর যা গুলি করেছে, কেমনে বেঁচে থাকে!
ঠিক এই সময় আবার ডোরবেল বেজে উঠল। দেখা গেল, কামাল এসেছেন।
রেনু মেঝেতে শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন। জড়িয়ে ধরলেন কামালকে। বললেন, তোদের আব্বাকে তো আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ করতে পাঠাইছি, তোরা আমার বুকটা খালি করিস না।
ক্যাপ্টেন রহমান তার স্ত্রীকে বললেন, সবার জন্য নাশতার আয়োজন করো। এই জয়নাল, দ্যাখ তো দোকানপাট কিছু খুলছে নাকি। দুইটা রেজর কিনে আন। না পেলে ব্লেড আন। কামাল, খোকা, তোমরা তোমাদের গোঁফ শেভ করে ফ্যালো।
একটু পরে এলেন বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিব আমিনুল হক বাদশা।
.
ওয়াজেদ মিয়ার চিন্তা হলো, কে কোথায় থাকবে। সবাই একসঙ্গে থাকা যাবে না।
খোকা বললেন, ভাবি রাসেল জামালকে নিয়ে আমি ওয়ারীতে যাই। শ্বশুরবাড়িতে উঠি। পরে চিন্তা করে বের করা যাবে কোথায় আশ্রয় নেওয়া যাবে।
রেহানা বললেন, আমিও মার সঙ্গে থাকব। মাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না।
ওয়াজেদ মিয়া বললেন, আমার অফিসের কলিগ ড. মোজাম্মেলের বাসা আছে খিলগাঁওয়ে। গ্রামের দিকের ওই বাসায় সহজে মিলিটারি যাবে না। আমি, হাসিনা ওই বাসায় থাকতে পারি। আমি একটু গিয়ে দেখে আসি, ওই বাসার কী অবস্থা।
হাসিনা বললেন, আচ্ছা যাও। দেখে আসো।
ওয়াজেদ মিয়া বের হলেন। টেবিলে নাশতা সাজানো হচ্ছিল। তা খাওয়ার সময় নেই। বিকেল ৪টা থেকে আবার কারফিউ।
ওয়াজেদ মিয়া রাস্তা ধরে এগোচ্ছেন। মানুষ ছুটছে। মানুষ পালাচ্ছে। বোচকাঁপাতি নিয়ে, সন্তান কোলে, বাক্সপেটরা ঘাড়ে চেপে, হেঁটে, রিকশায়, ঠেলাগাড়িতে, গরুর গাড়িতে, গাড়িতে, বেবিট্যাক্সিতে, ট্রাকে, বাসে মানুষ পালাচ্ছে। দুই ধারে পোড়া ঘরবাড়ি। এখানে-ওখানে পড়ে আছে লাশ।
রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার পুড়ে ছাই। এখনো কোনো কোনো কাঠ থেকে, কয়লা থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। পোড়া গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। পেট্রলপোড়া গন্ধ, বোমা-বারুদের গন্ধ, বাড়িঘর পোড়া গন্ধ, মানুষপোড়া গন্ধ।
ওয়াজেদ সাহেব গাড়ি চালাচ্ছেন। তার শরীর শিউরে উঠছে দুপাশের নারকীয় পরিস্থিতি দেখে।
খিলগাঁওয়ের রাস্তার দুই ধারে ধানখেত, কলাবাগান। দু-চারটা সদ্য ওঠা বাড়ি। ওয়াজেদ মিয়া তার সহকর্মী ড. মোজাম্মেলের বাড়ির সামনে গাড়ি রাখলেন। ভেতরে ঢুকলেন। এই বাড়িতে মোজাম্মেল সাহেব থাকেন, তাঁর আব্বা-আম্মা থাকেন, আর থাকেন ওয়াজেদ মিয়াদের আরেক কলিগ ড. ফয়জুর রহমান, একটা রুমে। তিনি মোজাম্মেল সাহেবের বোনাই হন।
.
ওয়াজেদ সাহেবের গাড়ি দেখেই সবাই ছুটে এলেন, বঙ্গবন্ধু এখন কোথায়? সবার প্রশ্ন। ওয়াজেদ সাহেব সংক্ষেপে পরিস্থিতি খুলে বললেন। তাঁর স্ত্রী শেখ হাসিনা সন্তানসম্ভবা, তার একটা নিরাপদ আশ্রয় দরকার, এখানে তারা থাকতে পারবেন কি না, এই হলো প্রশ্ন। ফয়জুর রহমান বললেন, ওয়াজেদ ভাই, আপনি এখনই ভাবিকে নিয়ে চলে আসুন। আমার ঘরটা আমি ছেড়ে দিচ্ছি। একদম অসুবিধা হবে না।
ওয়াজেদ সাহেব তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন ক্যাপ্টেন রহমান সাহেবের বাড়িতে।
হাসিনা, জেলি, চটপট উঠে পড়ো গাড়িতে। আমরা খিলগাঁওই যাচ্ছি। সব ব্যবস্থা করে এসেছি। ফয়জুর সাহেব ঘর ছেড়ে দিয়েছেন আমাদের। জন্য।
হাসিনা উঠলেন। চলাফেরায় কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু সেটা তিনি কাউকে বলবেন না। মা চিন্তা করবেন।
আপার হাত ধরে কাঁদতে শুরু করে দিলেন রেহানা, আপা, তুমি কোথায় যাচ্ছ। আমরা কোথায় যাচ্ছি। কিছুই তো জানি না। আর কীভাবে দেখা হবে। কীভাবে খোঁজ পাব?
হাসিনা ঠিক করেছেন তিনি কাঁদবেন না। এটা কাদার সময় নয়। তিনি বললেন, মাকে দেখে রাখিস। জেলি, চল।
হাসিনা, জেলি গাড়িতে উঠলেন। ওয়াজেদ মিয়া গাড়ি স্টার্ট দিলেন। রওনা হলেন খিলগাঁওয়ের দিকে। হাসিনাকে মিলিটারি চিনে ফেলতে পারে। আবার রাস্তায় চেকপোস্টে তল্লাশিও হতে পারে। সামনের সিটে ওয়াজেদ মিয়ার পাশে বসেছেন জেলি। পেছনের আসনে লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে
আছেন হাসিনা। নানা ঘুরপথে ওয়াজেদ মিয়া কারফিউয়ের আগেই। খিলগাঁওয়ে মোজাম্মেল সাহেবের বাড়িতে পৌঁছাতে সমর্থ হলেন।
.
রাতের বেলা মাদুর পেতে একসঙ্গে খেতে বসেছেন তারা। মোজাম্মেল সাহেবের বোন একটা সাংঘাতিক কথা বললেন–
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান আর্মি তাদের কন্ট্রোল রুম থেকে বিভিন্ন ইউনিটকে যে সমস্ত ওয়্যারলেস মেসেজ দিয়েছিল, সেই সবকিছুই তিনি রেকর্ড করে রেখেছেন। তাঁর কাছ থেকে আরও জানা গেল, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। বিভিন্ন দেশের রেডিওতে সেই ঘোষণা আসছে। চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকেও বলা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।
ব্যাঙ্গমা বলে, মোজাম্মেল সাহেবের বোন যেমন নিজের রেডিওতে শুইনা ফালাইছিলেন পাকিস্তানি মিলিটারি গো ওয়্যারলেস মেসেজ, টিক্কা খানের অ্যাসিস্ট্যান্টও তেমনি শুইনা ফালাইছিলেন শেখ সাহেবের ওয়্যারলেস মেসেজ, নিজের রেডিওতে। সেই রেডিও লইয়া তিনি দৌড়ায়া গেছিলেন টিক্কা খানের কাছে।
.
ওয়াজেদ মিয়া মুখের ভাত চিবুতে পারছেন না। স্বাধীনতা আসছে। স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে হয়। তাঁর মনে পড়ল, গাড়ি নিয়ে চলাচল করার সময় কত অগ্নিদগ্ধ ঘরবাড়ি দেখেছেন। দেখেছেন রাস্তার পাশে পড়ে আছে মানুষের লাশ।
হাসিনা মাদুরে বসতে পারছেন না। তাকে একটা টুল দেওয়া হয়েছে। হারিকেনের আলোয় তার মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। তিনি বললেন, আব্বা। ওয়্যারলেসে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী এবং এম আর সিদ্দিকীকে মেসেজ পাঠানোর ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।
ওয়াজেদ মিয়া বললেন, হ্যাঁ। কামাল হোসেন সাহেবরা একটা ইংরেজি মেসেজ রেডি করছিলেন, আর সিরাজুল আলম খানদের সঙ্গেও উনি একটা বার্তা রেডি করে রাখা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। ওরাও বোধ হয় একটা ড্রাফট ওনাকে দিয়েছিলেন।
হাসিনা বললেন, একটা আশ্চর্য ঘটনা আছে জানো! আমরা একবার চট্টগ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আজ থেকে বছর দশেক আগে হবে। ওখানকার আওয়ামী লীগ নেতা আজিজ সাহেব তো আব্বার খুব বন্ধু ছিলেন। আজিজ কাকার ছেলে মঞ্জু, মেয়ে বিলকিস, আমি, কামাল–আমরা খুব বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা খুব বেড়াতাম জানো। প্রথমবার চট্টগ্রামে গেছি। পাহাড় দেখছি। পাহাড়ে উঠতাম। আমরা প্লেইন ল্যান্ডের মানুষ। পাহাড় আমাদের খুব টানে। পাহাড় দেখে আশ্চর্য হই। কীভাবে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে। কীভাবে ঘুরে ঘুরে পাহাড়ের ওপরে রাস্তা উঠে গেছে! আবার চট্টগ্রাম সম্পর্কে কত কাহিনি বইয়ে পড়েছি। কত কথা শুনেছি। কত ইতিহাস। এই চট্টগ্রামে মাস্টারদা সূর্য সেন বিপ্লব করেছিলেন। প্রীতিলতা জীবন দিয়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুটের কাহিনি কত পড়েছি লুকিয়ে লুকিয়ে। এই সব বই পড়া তো নিষিদ্ধ। আজিজ কাকা আমাদের টাইগার পাস দেখাতে নিয়ে গেলেন। বললেন, দেখো মা, আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ এখান থেকেই শুরু হবে। তারপর তিনি নিয়ে গেলেন কালুর ঘাট বেতার দেখাতে। চারদিক ফাঁকা। কেবল একটা বিল্ডিং। আজিজ কাকু বললেন, আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা আমরা প্রচার করব এই বেতার থেকে।
ওয়াজেদ মিয়া বললেন, আজিজ সাহেব তো মারা গেছেন?
হ্যাঁ। ১৯৬৯-এ মারা গেছেন।
আশ্চর্য তো। তিনি কী করে এই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারলেন?
পৃথিবীতে কত আশ্চর্য ঘটনা ঘটে।
.
ব্যাঙ্গমা বলবে, চট্টগ্রামের পাহাড় থাইকাই আসলে স্বাধীনতার যুদ্ধ এক অর্থে শুরু হইছিল।
ব্যাঙ্গমি বলবে, ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিক ২৪ মার্চেই রেলওয়ে বিল্ডিংয়ের পাহাড়ে তাঁর সদর দপ্তর স্থাপন করছিলেন।
.
ওয়াজেদ মিয়ার মনের মধ্যে দুই বিপরীত চিন্তা একসঙ্গে কাজ করতে শুরু করল। শ্বশুর সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। বিশ্ববাসী সে খবর জেনে গেছে। এই ঘোষণা বাংলার মানুষকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে প্রেরণা জোগাবে। কিন্তু শ্বশুরসাহেবকে তো ধরে নিয়ে গেছে মিলিটারিরা। তার বিচার করা হবে, ইয়াহিয়া খান ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি আর ফিরবেন কি না, কে জানে? স্বাধীনতার মূল্য না জানি কত বেশি দিতে হয়!
০১০. সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে
সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। দুপুর গড়িয়ে পড়ছে। হেলে পড়া মার্চের সূর্য ধানমন্ডি লেকের ধারের শিরীষগাছগুলোর পাতায় পাতায় হলদেটে হতে শুরু করেছে। খোকা বললেন, ভাবি, চলেন ওয়ারীতে যাই। অনেক দূরের পথ।
রেনু বললেন, রাসেলকে একটু খাওয়ায়ে নিই।
তাঁকে ধ্বস্ত দেখাচ্ছে। চোখের নিচে কালো দাগ। সদা প্রশান্ত হাসিমুখ ভাবটা উধাও।
জামাল এক কাপড়েই আছেন দুই দিন। তাঁর দাড়ি বড় হয়ে গেছে।
ধানমন্ডি থেকে খোকার গাড়িতে বেরোলেন রেনু, জামাল, রেহানা, রাসেল। রেনু অনেক বড় করে ঘোমটা দিয়ে ঢেকে রেখেছেন মুখখানা। রেহানাও ওড়না পেঁচিয়ে নিলেন মাথার ওপরে, ঘাড়ে। তারা যাবেন ওয়ারী। রাস্তায় লোকজন পড়িমরি ছুটছে। যেন মড়কে গ্রাম উজাড় হবে। পাকমোটরের কাছে এসে তারা দেখতে পেলেন রাস্তায় জনস্রোত। গাড়ি চলারই জায়গা নেই। সবাই ছুটছে বুড়িগঙ্গা অভিমুখে। নদী পার হতে পারলেই যেন প্রাণে বেঁচে যাবে মানুষেরা।
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি ত্রিকালদর্শী, তারা বলবে :
নদী পার হইয়াও বহু মানুষ বাঁচতে পারে নাই, এপ্রিলের শুরুর দিকে পাকিস্তানি মিলিটারি হামলা করে নদীর ওইপারে, কামান দাগায়া ছুটন্ত মানুষ, মানুষগো উড়ায়া দেয়, নারী-পুরুষ-শিশু হাজারে হাজারে ছুটতে গিয়া গুলি খায়, গুলি খায়া দৌড়াইতে থাকে, মরা মানুষ ছোটে, মাথা ছাড়া শরীলও দৌড়াইতে থাকে, মাথা উইড়া যাইতে যাইতে চিৎকার কইরা উঠে, জয় বাংলা।
.
গাড়ি নিয়ে এগোনো যাচ্ছে না।
শহীদ মিনারের পাশে গিয়ে রেহানা বললেন, মা দেখো।
রেনু বললেন, কী।
শহীদ মিনার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। রাস্তা দিয়ে চলা যাচ্ছে না। গলি উপগলি ধরে যাওয়ার চেষ্টা করা হলো।
খোকা বললেন, ভাবি, মনে হয় না কারফিউয়ের আগে ওয়ারী পৌঁছাতে পারব।
রেনুর কণ্ঠে একরাশ উকণ্ঠা, তাইলে উপায় কী হবি?
আমার ভাগনির বাড়ি আছে কাছে। সেখানে যাই।
ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের উল্টো দিকে সাকুরার কাছে পিপল পত্রিকার অফিস। পুড়িয়ে ছাই করে ফেলেছে পাকিস্তানি মিলিটারি। পত্রিকাটার অপরাধ, তারা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে ছিল। পুরা মার্চ তাদের কলম থেকে ঝরেছিল আগুন।
গুড়ুম গুড়ুম। গোলাবর্ষণ শুরু হলো। কোন দিক থেকে গুলি আসছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। খোকা ভয় পাচ্ছেন। গাড়ির মেঝেতে বসা রাসেল কেঁদে উঠল।
খোকা বললেন, মগবাজারের গলিতে সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার আলী সাহেবের ফ্ল্যাটবাড়ি। ওই সব ফ্ল্যাটে সব আমাদের লোকেরাই থাকে। ওইখানে ঢুকে পড়ি।
তা-ই করা হলো। ওই ফ্ল্যাটে থাকেন চলচ্চিত্র পরিচালক আলমগীর কবীর, অভিনেতা আলী আহসান সিডনি–এই রকম বিখ্যাত মানুষেরা। ফ্ল্যাট বিল্ডিংয়ে ঢুকে পড়ার পর দেখা গেল মোরশেদ মাহমুদও পরিবার নিয়ে এখানেই উঠেছেন। উঠেছেন অভিনেতা আবুল খায়ের, যিনি ৭ মার্চের ভাষণ ধারণ ও প্রচার করেছিলেন। ৩২ নম্বরে তার আসা-যাওয়া ছিল নিয়মিত।
বেগম মুজিব এসেছেন, সবাই ভিড় করে এল দেখতে। ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল, কে কার চেয়ে বেশি আদর-আপ্যায়ন করতে পারবেন।
একটা রেডিও চলে এল। এতে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী রেডিও শোনা যাচ্ছে। চট্টগ্রামের নেতা হান্নান সাহেব বঙ্গবন্ধুর বার্তা পড়ে পড়ে শোনাচ্ছেন। ভালো করে শোনাও যায় না। শুধু বোঝা যায়, জয় বাংলা।
জয় বাংলা রেডিওর ঘোষণার উত্তেজনা, চট্টগ্রাম এখনো শত্রুমুক্ত, এসব খবরের মধ্যে আসতে লাগল মারাত্মক সব সংবাদ।
মোরশেদ মাহমুদের ভাই মাহমুদুর রহমান বেনু এলেন। ঘরের মধ্যে অনেক মানুষ। বেগম মুজিব আছেন, খোকা আছেন, মোরশেদ আছেন, আলমগীর কবীর আছেন। এক কোণে রেহানা, জামালও আছেন।
বেনু বললেন, মিলিটারিরা শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে লিখে রেখেছে, মসজিদ।
একজন বললেন, কী সর্বনাশ।
আলমগীর কবীর বললেন, প্রফেসর গোবিন্দচন্দ্র দেব নাকি জগন্নাথ হলের সামনে ছুটে গিয়েছিলেন। মিলিটারিদের বলছিলেন, এদের মেরো না। এরা সবাই হিন্দু। উনি হয়তো ভেবেছিলেন, মাইনরিটির কথা শুনলে মিলিটারিরা আর ছাত্রদের মারবে না। মাইনরিটিকে রক্ষা করা তো মেজরিটির পবিত্র কর্তব্য। কিন্তু তাতে কোনো কিছুই রক্ষা করা যায়নি। জি সি দেবকেও ওরা মেরে ফেলেছে। জগন্নাথ হলের ছাত্রদের বের করে মাঠে নিয়ে গিয়ে লাইন করে গুলি করে হত্যা করেছে।
বেনু বললেন, আগরতলা মামলার আসামি কমান্ডার মোয়াজ্জেমকে বাড়ি গিয়ে হত্যা করেছে। তাকে বলেছিল, বল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতা জিন্দাবাদ, এক দফা জিন্দাবাদ।
আরেকজন জানালেন, ইকবাল হলের ছাত্রদের তো মেরেছেই, কর্মচারীদেরও মেরেছে। ইকবাল হলের দারোয়ান মশারির নিচে স্ত্রীসহ মরে পড়ে আছে।
মধুদাকে মেরেছে। মধুদার বাড়ির সবাইকে গুলি করেছে।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির আরও আরও টিচারকে মেরে ফেলেছে।
জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার অচেতন শরীর স্ট্যাটিসটিকসের প্রফেসর মনিরুজ্জামান আর ছেলেদের গুলিবিদ্ধ লাশের নিচে পড়ে ছিল। দুই রাত বাড়িতে রেখে তার ফ্যামিলি নাকি তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠাতে পেরেছে। মনে হয়, তিনিও বাঁচবেন না।
জগন্নাথের সহকারী টিউটর অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকেও মেরেছে।
১০ জনের মতো শিক্ষক, তাঁদের পরিবার-পরিজন, বহু কর্মচারী আর অসংখ্য ছাত্রকে মেরে ফেলেছে মিলিটারিরা। হামলা করেছে রোকেয়া হলেও।
.
আরও আরও হত্যা, মৃত্যু, আগুন, ধ্বংসের খবর উচ্চারিত হতে হতে একসময় সবাই চুপ হয়ে যায়।
পুরো ঘর স্তব্ধ হয়ে আসে। পুরো চরাচর যেন স্তব্ধ। কবরের নীরবতা নেমে এসেছে এই পৃথিবীতে আজ।
১১
৪১ বছর বয়সী ফারুক আজিজ খান মনোমুগ্ধকর পাহাড়-ঝরনা সরোবরশোভিত ছোট্ট শহর কাপ্তাইয়ের একটা চমৎকার কাঠের বাংলোয় ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। রাত এগারোটা। বাইরে ঝিঁঝি ডাকছে, পাহাড়ি গাছগাছড়ায় জোনাকির মেলা বসেছে, কুকুর এবং শিয়ালের ডাকও শোনা যাচ্ছে–এসবের সঙ্গে ফারুক খান আজ আড়াই বছর ধরেই অভ্যস্ত। ইসলামাবাদের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিয়েটের সহকারী বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টার পদ থেকে তাঁকে ১৯৬৮ সালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে, সুইডিশ-পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির পরিচালক করে। দুই শিশুপুত্র আর স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ক্যাম্পাসের ভেতরে তাঁর ছবির মতো বাংলোটিতে থাকেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এই বাড়িতে আরও আছে। বারো বছর বয়সের বাদশা মিয়া, ছোটখাটো কাজের তদারকি করে থাকে সে। আছেন ফারুক খানের চাচাশ্বশুর, এসেছেন পর্যটন এলাকায় বেড়াতে।
সবাই বিছানায় শুয়ে আছেন, যার যার মতো করে। আর আছেন একজন বয়স্ক গৃহপরিচারিকা।
ফারুক খান জানেন, যেকোনো সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করতে শুরু করে দেবে। গোটা মার্চই তো আগুনঝরানো। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এই শহরেও সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা হয়েছে। রাজপথগুলো দিনের বেলা থাকে মানুষের মিছিলের পদভারে কম্পিত। মানুষের হাতে হাতে লাঠিসোটাসমেত নানা ধরনের প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্র। ছাদে ছাদে বাংলাদেশের লাল-সবুজ-হলুদ পতাকা। মিলিটারি শহরের বন্দুকের দোকানগুলো থেকে অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদ জব্দ করেছে।
যদি যুদ্ধ শুরুই হয়ে যায়, এই কাঠের তৈরি বাংলো, তাতে আবার কাঁচের অনেক জানালা, সেখানে কি আদৌ বেঁচে থাকা যাবে? ফারুক আজিজ খান ভাবছিলেন, আর তাঁর চোখের ঘুম উবে যাচ্ছিল।
ক্রিং ক্রিং। তীব্র শব্দে বেজে উঠল টেলিফোন।
তাঁর স্ত্রী মাথা তুললেন সবার আগে। কী হয়েছে? এত রাতে ফোন কেন?
ফারুক ফোনের রিসিভার তুললেন, বললেন, হ্যালো।
স্যার। আমি মুজিবুল হক স্যার। ফারুক খানের পিএসের কণ্ঠস্বর।
হ্যাঁ, মুজিব বলো!
স্যার। চট্টগ্রাম থেকে এইমাত্র ফোন এসেছে স্যার। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
কে এই খবর দিয়েছে?
চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি হান্নান সাহেব স্যার।
ইপিআরের ক্যাপ্টেন হারুনকে খবরটা দিয়েছ?
খবর নিয়ে লোক গেছে স্যার। একজন বাঙালি সুবেদারকে পাঠানো হয়েছে।
আচ্ছা।
আমরা কী করব স্যার?
তুমি আগের মতোই টেলিফোন এক্সচেঞ্জ মনিটর করো। এরপর কিছু করতে হলে আমি বলব।
ফারুক খান ফোন রেখে দিলেন। এরপর কী করতে হবে, তিনি যদি জানতেন!
তাঁর স্ত্রী এরই মধ্যে বিছানায় উঠে বসেছেন। আরেকটা খাটে তার দুই সন্তান ঘুমুচ্ছে।
স্ত্রী বললেন, কার ফোন? কী বলল?
মুজিবুল ফোন করেছিল। শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।
ঘড়ির কাঁটা তখন ১২টা পার হয়ে গেছে। ২৬ মার্চ শুরু হয়ে গেছে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মতে। রেডিয়ামজ্বলা হাতঘড়ি তুলে নিয়ে দেখলেন ফারুক খান।
তাঁর স্ত্রী আর্তনাদ করে উঠলেন। তারপর আলো জ্বালিয়ে কোরআন শরিফ নিয়ে পড়তে শুরু করে দিলেন।
ফোনের শব্দ শুনে ফারুক খানের চাচাশ্বশুরও জেগে গেছেন। তিনিও জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর?
শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
তাঁর কাছে টুপি ছিল না। তিনি অজু করে মাথায় একটা রুমাল বেঁধে নামাজে বসে গেলেন।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন গৃহপরিচারিকা। তিনি বুঝতে পারলেন মারাত্মক কিছু একটা ঘটে গেছে। তাঁর রোদন করা উচিত। তিনি সশব্দে কান্না জুড়ে দিলেন।
বাদশা মিয়া বলল, স্যার, আঁই কী করতাম?
তা বটে। এটা একটা প্রশ্ন বটে। এই বালক এখন কী করবে? ফারুক আজিজ খান বললেন, তুমি এক কাজ করো। জানালা দিয়ে ইপিআর ক্যাম্পটার দিকে নজর রাখো। মাথা অল্প তুলবে। যা দেখছ, আমাকে বলো।
.
ক্যাপ্টেন হারুনের কাছে খবর গেল। এম এ হান্নানের কল এসেছে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এই এলাকার ইপিআরের তিনি সেকেন্ড ইন কমান্ড। প্রধান কমান্ডিং অফিসার মেজর পীর মোহাম্মদ একজন পাকিস্তানি। হারুন দ্রুত অ্যাকশনে গেলেন। বাঙালি জওয়ানদের নিয়ে পীর মোহাম্মদকে সবার আগে অ্যারেস্ট করে ফেললেন। এরপর আর যারা পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য ছিল, তাদের নিরস্ত্র করে বেঁধে একটা হলঘরে রাখার ব্যবস্থা করা হলো।
.
ব্যাঙ্গমা বলে, ঢাকা থাইকা অনেক দূরে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের খবর হইল এই।
ব্যাঙ্গমি বলে, সারা দেশের অনেক জায়গাতেই এই রকমের ঘটনা ঘটতে থাকে। থানায়, পোস্ট অফিসে, ইপিআরের ওয়্যারলেসে আসতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ। প্রতিরোধ করো। আজ থাইকা বাংলাদেশ স্বাধীন। বাঙালি সৈন্যরা, ইপিআর, পুলিশ, আনসার বিদ্রোহ করতে থাকে। বাঙালি ডিসি, এসপি, পুলিশ, আর্মি, ইপিআর, আনসার একযোগে নানান জেলায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন কায়েম করতে থাকে। তাগো নেতৃত্বে থাকে সংগ্রাম পরিষদ। লগে লাঠিসোটা, বল্লম, বন্দুক হাতে যোগ দেয় ছাত্র-জনতা। বঙ্গবন্ধুর মেসেজ ঢাকার বাইরে অনেক জায়গায় পৌঁছায়, বহু জায়গায় পৌঁছায় নাই। রাজারবাগে হামলা হইছে, পিলখানায় হামলা হইছে, অথবা স্থানীয় ক্যান্টনমেন্টে পশ্চিমারা বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতাছে, নানাভাবে খবর পাইয়া ২৫ মার্চ রাত থাইকাই বিভিন্ন জায়গায় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ, লড়াই, প্রতিরোধ শুরু হইয়া যায়। বিভিন্ন জায়গায় বাঙালি ইপিআর, বাঙালি সৈন্য, বাঙালি পুলিশ, বাঙালি আনসার, বাঙালি অফিসাররা বিদ্রোহ কইরা প্রতিরোধযুদ্ধে শামিল হন।
একজন আরেকজনরে জানায়া দেয় ওয়্যারলেসে, আমরা বিদ্রোহ করতাছি। তোমরাও করো। আর অন্যদিকে পাকিস্তানি অফিসার সৈন্যরা বাঙালি অফিসার সৈন্যদের নিরস্ত্র কইরা গুলি কইরা মারতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইয়া যায়। একটা অহিংস স্বাধীনতাসংগ্রাম বারুদের স্কুপে অগ্নিসংযোগ হওয়ামাত্র বিস্ফোরিত হইয়া মুক্তিযুদ্ধে উত্তীর্ণ হইয়া যায়।
১২
আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক। ৩৪-৩৫ বছর। বয়স। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোরবেলা। তাঁর বাড়ির ফোন বেজে উঠল।
হ্যালো। তন্দ্রাজড়িত কণ্ঠে ফোন ধরলেন তিনি। রাতে দেরি করে ফিরেছেন। উপাচার্যের কার্যালয়ে ছিলেন প্রায় ভোররাত তিনটা-চারটা পর্যন্ত। ঢাকা থেকে নানা ধরনের খবর আসছে। ঢাকায় ভয়াবহ কিছু একটা ঘটেছে। ঠিক কী ঘটেছে, তা জানার জন্য ঢাকার বিভিন্ন নম্বরে ফোন করেছেন তাঁরা। সব ফোনই প্রায় ছিল ব্যস্ত। কোনো লাইন পাওয়া যাচ্ছিল না। ইত্তেফাক অফিস, পূর্বদেশ অফিস পাওয়া গেল। জানা গেল, রাস্তায় রাস্তায় ট্যাংক বেরিয়েছে। কারফিউ জারি করা হয়েছে। রাত ১২টার পর টেলিফোন সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তারা তবু উপাচার্যের কক্ষে বসে রইলেন। যদি কিছু জানা যায়। আনিসুজ্জামান বাড়ি ফিরলেন ম্যালা রাতে।
বাড়িতে তাঁর স্ত্রী বেবি তো আছেনই, আছে দুই কন্যা সাড়ে ছয় বছরের রুচি আর দেড় বছরের শুচি। বেবির ভাই আজিজুল ওয়াহাব, তাঁর স্ত্রী রুবা, তাদের ছোট্ট একটা মেয়েও এসেছে মেহমান হিসেবে। সবার চোখেমুখেই উদ্বেগের ছায়া।
এরই মধ্যে এল এই ফোন।
স্যার, আমি খোকন বলছি স্যার। আবদুল আলী খোকন?
হ্যাঁ। খোকন! বলো, কোনো খবর আছে?
জি স্যার। আছে স্যার। বলো। তুমি কোথায়?
স্যার। আমি সিআরবি পাহাড়ে স্যার।
হ্যাঁ। কী অবস্থা ওখানে!
অবস্থা স্যার ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিক যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন স্যার। কাল রাত থেকেই স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে স্যার।
বলো কী?
স্যার। ক্যাপ্টেন রফিক সাহেব আমার সামনে আছেন। আপনি কথা বলেন স্যার। আমি দিচ্ছি স্যার।
আচ্ছা দাও।
ফোনে শোনা গেল ক্যাপ্টেন রফিকের কণ্ঠ, স্যার। সালাম আলায়কুম স্যার।
ওয়ালাইকুম আসোলাম।
স্যার আমি ক্যাপ্টেন রফিক স্যার।
জি। আনিসুজ্জামান বলছি।
স্যার আমরা ইপিআর গত রাত থেকেই স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছি স্যার। হালিশহরে পাকিস্তানি সবাইকে বন্দী করা হয়েছে। ইপিআরের নিয়ন্ত্রণ আমরা নিয়ে নিয়েছি। যুদ্ধ চলছে। আপনাকে ফোন করেছি এই কথা বলার জন্য, সবাইকে জানিয়ে দেন, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব। মরব, কিন্তু লড়াই থামাব না। আমাদের লড়াই বিজয় অর্জিত না হওয়া। পর্যন্ত চলবে।
মুহূর্তে আনিসুজ্জামানের রক্ত যেন উষ্ণ হয়ে উঠল।
স্যার। আপনারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্যান্টনমেন্টের ওপরে নজর রাখুন। কোনো কিছু দেখলে আমাদের জানাবেন। আলীকে জানালেই স্যার আমরা খবর পেয়ে যাব।
আচ্ছা। আমি অবশ্যই জানাব।
স্যার। আমি অনেক ব্যস্ত। এখন রাখি স্যার?
ঠিক আছে।
বেবি ঘুম থেকে উঠেছেন। আজিজও। তাঁরা আনিসুজ্জামানের মুখের দিকে জিজ্ঞাসু নয়নে তাকিয়ে আছেন।
কী খবর? আজিজ জানতে চাইলেন।
যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
বেবি তাড়াতাড়ি টেবিলে নাশতা সাজাতে লাগলেন। পাউরুটি, মাখন, ডিম, চা।
আজিজের মেয়েটা উঠে পড়েছে। রুবা তাকে নিয়ে আরেক ঘরে ব্যস্ত। বাচ্চাটা একবার কেঁদে উঠল।
আজিজ বললেন, দরকারি জিনিস কিন্তু কিনে রাখতে হবে। বিশেষ করে বাচ্চাদের দুধ। পরে আর কেনার সুযোগ না-ও পাওয়া যেতে পারে।
আনিসুজ্জামান রেডিওর নব ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, হ্যাঁ। দেখি একবার বাজারে যেতে হবে।
রেডিওতে সামরিক ফরমান শোনানো হচ্ছে। উর্দুঘেঁষা কণ্ঠের পাঠ। ফরমান এক। ফরমান দো। পরিস্থিতি যে ভয়াবহ, বেশ বোঝা যাচ্ছে।
আবারও টেলিফোন এল। এবার উপাচার্যের অফিস থেকে। স্যার, ভিসি স্যার সালাম দিয়েছেন।
আচ্ছা আমি আসছি।
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আনিসুজ্জামান তাঁর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
বেবি বললেন, বঙ্গবন্ধু কেমন আছেন? কিছু জানতে পারলে?
না বেবি। নানা গুজব। আসলে কী ঘটছে, কে বলতে পারে?
.
গাড়ি পার্ক করে আনিসুজ্জামান ভিসির অফিস কক্ষে ঢুকলেন। বিশাল কক্ষ। বড় টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারে অধ্যাপক করিম, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান বসে আছেন। সালাম দিয়ে আনিসুজ্জামানও একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। ক্যাপ্টেন রফিকের খবরটা জানানো দরকার।
এরই মধ্যে অধ্যাপক আর আই চৌধুরী, মোহাম্মদ আলীও এসে গেছেন।
উপাচার্য এ আর মল্লিক বললেন, আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। এম এ হান্নান, এম আর সিদ্দিকীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। সন্ধ্যার সময় এম আর সিদ্দিকীর কাছে বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন নির্দেশ এসেছে। তিনি বলেছেন, আলোচনা ফেইল করেছে। পাকিস্তানি আর্মি অ্যাটাক করছে। আস্ক বেঙ্গলি আর্মি, ইপিআর, পুলিশ নট টু সারেন্ডার অ্যান্ড গিভ আ কল টু পিপল টু গিভ রেজিস্ট্যান্স।
আনিসুজ্জামান বললেন, ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। সিআরবি পাহাড়ে আছেন তারা।
এ আর মল্লিক বললেন, হ্যাঁ। এম আর সিদ্দিকী সাহেব জানালেন। চট্টগ্রাম ডাকবাংলো, চট্টগ্রাম রেলওয়ে রেস্টহাউস সংগ্রাম পরিষদের হাতে।
আনিসুজ্জামান বললেন, ক্যাপ্টেন রফিক ক্যান্টনমেন্টের ওপর নজর রাখতে বলেছেন। কোনো মুভমেন্ট হলে তাঁকে জানাতে বলেছেন।
এ আর মল্লিক বললেন, আমাদের সিএসআইআরের কাছে। বাইনোকুলার আছে না?
থাকা উচিত। একজন বললেন। সায়েন্টিফিক রিসার্চ সেন্টার বলে কথা।
ক্রিং ক্রিং। উপাচার্যের ফোন বেজে উঠল। তিনি ফোন ধরলেন।
ফোন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার সিদ্দিকী সাহেব, স্যার, আমার বাসায় ইপিআরের কয়েকজন সোলজার এসেছেন। সঙ্গে আরও কিছু সংগ্রাম কমিটির লোকজন।
কেন?
তারা বলছে, এই বাসা থেকে ক্যান্টনমেন্টের ওপরে নজর রাখতে সুবিধা হবে। আমাকে বাসা ছেড়ে দিতে বলে। কী করব?
বাঙালি?
জি। বাঙালি।
হাতে অস্ত্রশস্ত্র আছে?
জি আছে।
ইপিআরের ইউনিফর্ম আছে?
জি আছে।
আচ্ছা, তাহলে বাসা ছেড়ে দেন। আমরা বাইনোকুলার দিচ্ছি রিসার্চ সেন্টার থেকে।
স্যার, বাসা ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু ওদের খাওয়াদাওয়ার তো ব্যবস্থা করতে হবে।
আচ্ছা আমি দেখছি।
.
ভিসির কার্যালয় এই এলাকার সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটু পরে গোলাগুলির শব্দ। অধ্যাপকেরা সচকিত হলেন। ভিসি ফোন করলেন ট্রেজারার সিদ্দিকীর বাসার নম্বরে। ফোনে ওদের একজনকে পাওয়া গেল।
গোলাগুলির শব্দ কোত্থেকে আসছে?
আমাদের দিকেই বাইরে থেকে গুলি আসছে স্যার।
বাইরে মানে কোন দিক থেকে?
উল্টা দিকে কতগুলো পশ্চিম পাকিস্তানির বাড়ি আছে। কোনো একটা বাড়ি থেকে হবে স্যার।
আচ্ছা। ভালো করে ওয়াচ করেন। বাইনোকুলার কাজ করছে তো?
জি স্যার। স্যার আমরা কি আক্রমণ করব স্যার। আমরা বের হয়ে গিয়ে ওই বাড়ি উড়ায়া দিয়া আসতে পারি।
না না। তার প্রয়োজন দেখছি না।
.
এ আর মল্লিক সাহেব আর উপাচার্য থাকলেন না, সেই মুহূর্তে সেনা কমান্ডারের স্থান অধিকার কইরা লইলেন। কোথায় আক্রমণ করতে হইব, কোথায় প্রতিরক্ষা, সে নির্দেশও তিনি দিতে লাগলেন-ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি টিপ্পনী কাটল।
.
ভিসি বললেন, তোমরা বাড়ি থেকে বের হবে না।
স্যার গুলিতে সামনের রাস্তার ইলেকট্রিক লাইনের তার ছিঁড়ে গেল স্যার।
একটু পরে ওই বাড়ির সঙ্গে টেলিফোন লাইনও কেটে গেল।
আনিসুজ্জামান বেরিয়ে গেলেন উপাচার্যের কক্ষ থেকে। তাকে বাজারে যেতে হবে। বাসায় শিশু আছে। দুধ অন্তত কেনা দরকার।
তিনি গাড়ি নিয়ে গেলেন হাটহাজারী বাজারে। বাজারে বেশ ভিড়। সবাই কেনাকাটা নিয়েই ব্যস্ত। সবারই চোখেমুখে একটা অজানা শঙ্কার ছাপ যেন দেখা যাচ্ছে। কী হয় না হয়, অনিশ্চয়তার ছায়া। তবে যাকে বলে প্যানিক বায়িং, তা হচ্ছে না। কারণ, আজ মাসের মোটে ২৬, লোকের হাতে টাকাপয়সা তেমন নেই। শুক্রবার। ব্যাংক বন্ধ। শুধু গাড়িতে তেল ভর্তি করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, পেট্রল কম কম করে দেওয়া হচ্ছে।
বাজারে পুলিশ সদস্যরা দাঁড়িয়ে আছেন। খাকি ইউনিফর্ম পরা। আনিসুজ্জামানকে দেখে তারা সালাম দিলেন।
আনিসুজ্জামান বললেন, ঢাকার খবর শুনেছেন কিছু?
জি স্যার। কিছু কিছু শুনেছি।
রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হামলা করেছে, শুনেছেন?
জি স্যার শুনেছি। খুব চিন্তা হচ্ছে স্যার।
.
ভিসি চট্টগ্রাম শহর সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
এম এ হান্নান সাহেব ফোনে বললেন, ভিসি সাহেব, বঙ্গবন্ধুর মেসেজ আমরা পেয়েছি। এটা প্রচার করছি। এইখানে ডাকবাংলোতে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষকে মাইকে পড়ে শোনালাম।
ভিসি বললেন, মেসেজটা কী?
হান্নান সাহেব পড়তে লাগলেন :
Today Bangladesh is a sovereign and independent country. On Thursday night [March 25, 1971], West Pakistan armed forces suddenly attacked the police barracks at Razarbagh and the EPR headquarters at Pilkhana in Dhaka. Many innocent and unarmed have been killed in Dhaka city and other places of Bangladesh. Violent clashes between EPR and police on the one hand and the armed forces of Pakistan on the other are going on. The Bangalees are fighting the enemy with great courage for an independent Bangladesh. May Allah aid us in our fight for freedom. Joy Bangla.
ভিসি মন দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বার্তাটা শুনলেন।
.
আনিসুজ্জামান তাঁর বাসায় বাজার-সদাই নিয়ে ফিরলেন। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর ঘুমে চোখ বুজে আসছে। কাল মোটামুটি সারা রাত নিঘুম গেছে। খেতে বসে পাঞ্জাবিতে ঝোল লেগে গেছে। বেবি সাবান-পানি এনে বললেন, একটু ভিজিয়ে দিই। তা না হলে হলুদের দাগ যাবে না।
আনিসুজ্জামান পাঞ্জাবি খুলে দিয়ে বললেন, ওই জায়গাটাই শুধু ভেজাও।
শরীরটা এলিয়ে পড়ছে। একটু শুয়ে ঘুমিয়ে নেবেন নাকি, আনিসুজ্জামান ভাবছেন।
তোমাকে খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে। একটু শুয়ে রেস্ট নাও।
হুম।
বঙ্গবন্ধুর কোনো খবর জানতে পারলে?
না।
আমার কিন্তু খুব ভয় হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর কোনো ক্ষতি করার সাহস তো ওদের হওয়ার কথা না।
আচ্ছা তুমি একটু শুয়ে চোখ বন্ধ করো।
আনিসুজ্জামান চোখ বন্ধ করলেন। মুহূর্তে ঘুম এসে তাকে নিয়ে গেল। স্বপ্নের জগতে। রুচি বলছে, শেখ মুজিব এসেছে, আসাদ আসে নাই?
ক্রিং ক্রিং। ফোন বেজে চলেছে। রুচিই ফোন ধরল, হ্যালো।
ড. আনিসুজ্জামান নেই?
আছেন।
একটু ডেকে দেওয়া যাবে।
আপনি কে বলছেন?
আমার নাম রফিকুল আনোয়ার।
ফোনের শব্দে আনিসুজ্জামানের ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি উঠলেন। মেয়ে। বলছে, বাবা, তোমার ফোন।
কে?
রফিকুল আনোয়ার।
আনিসুজ্জামান তাকে চিনতে পারলেন সহজেই। ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন, এখন সংগ্রাম পরিষদের নেতা।
হ্যালো।
স্যার সালাম আলায়কুম। স্যার একটা জরুরি মেসেজ আছে। কাগজ কলম নিয়ে লিখে নিন।
কিসের জরুরি মেসেজ।
বঙ্গবন্ধুর মেসেজ।
আচ্ছা। আমি লিখে নিচ্ছি। তুমি বলো।
ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধুর বার্তা পড়ে শোনালেন আনোয়ার। তারপর বললেন, স্যার, আপনি একটু যদি এটা তাড়াতাড়ি করে বাংলায় অনুবাদ করে দেন।
তারপর ক্যাম্পাসে বিলি করার ব্যবস্থা করেন।
আচ্ছা আমি করছি।
আনিসুজ্জামান কাগজ-কলম নিয়ে বার্তাটা অনুবাদ করলেন। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।
পাঞ্জাবিটার একটা জায়গা ভেজা। সেইটাই পরে নিয়ে তিনি বের হলেন ঘর থেকে। তিনি তার অফিসে গেলেন।
এইটা সাইক্লোস্টাইল করা দরকার।
টাইপিস্ট ওখানেই ছিলেন। তিনি কাগজটা নিয়ে টাইপ করতে আরম্ভ করলেন।
তার অফিস সহকারীরা বলতে লাগল, এম এ হান্নান চট্টগ্রাম রেডিওর ফ্রিকোয়েন্সি থেকে বঙ্গবন্ধুর এই মেসেজটা বাংলাতেই পড়েছেন। মাঝেমধ্যে এই ঘোষণা রেডিও থেকে শোনা যাচ্ছে। এটার নাম দিয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।
আনিসুজ্জামান সহজে আবেগাপ্লুত হন না। কিন্তু তার শরীরে রোমাঞ্চ জাগছে। স্বাধীন বাংলা বেতার হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণা পড়া হচ্ছে। তখন অপরাহু। সূর্যের আলো হেলে পড়ছে। মাঠে ঘূর্ণিবায়ুতে চৈত্রের ঝরাপাতা পাক খেতে খেতে আকাশে উড়ছে। এই বাংলাদেশ স্বাধীন হতে চলেছে। সংগ্রাম চলছে। সংগ্রাম ক্রমশ যুদ্ধের রূপ নিচ্ছে।
.
ব্যাঙ্গমা বলে, এম এ হান্নান আছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
ব্যাঙ্গমি বলে, তিনি আলফা ইনস্যুরেন্সের ম্যানেজারও আছিলেন। কাজেই শেখ সাহেবের লগে যে তার খাতির খুবই আছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ব্যাঙ্গমা বলে, ২৫ মার্চ রাতে, সাড়ে ১১টার দিকে, চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর বাড়ির ফোন বাইজা উঠে। ক্রিং ক্রিং। ফোন ধরলেন ডা. নুরুন্নাহার জহুর। জহুর সাহেবের ওয়াইফ। মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী।
ব্যাঙ্গমি বলে, নুরুন্নাহার ফোন ধরলে উল্টা পাশ থাইকা কয়, একটা মেসেজ আছে। লেইখা নেন। নুরুন্নাহার ছেলেরে কন, কাগজ-কলম দ্যাও তো। ছেলে কাগজ-কলম আগায়া দেয়। ডাক্তারের বাড়িতে ওষুধ কোম্পানির দেওয়া কাগজ আর একটা পেটে কালি ভরা ঝরনা কলম তৈরিই আছিল।
নুরুন্নাহার কাগজ-কলম লইয়া লেখতে থাকেন : মেসেজ টু দ্য পিপল অব দ্য বাংলাদেশ অ্যান্ড পিপল অব দ্য ওয়ার্ল্ড। পাক আর্মি সাডেনলি অ্যাটাকড…
ব্যাঙ্গমি বলে, ২৬ তারিখ সকালবেলা আন্দরকিল্লায় আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে ভিড়। গোলাগুলির আওয়াজ রাত থাইকাই আসতাছে। জনতা রাস্তা ছাড়তাছে না। সেই ভিড়ের মধ্যে হকার চিল্লাইতাছে, টেলিগ্রাম টেলিগ্রাম টেলিগ্রাম, ঢাকা শহরত এক লাখ লোক মারি ফেলিয়ে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ডিক্লেয়ার করি দিয়ে…
ব্যাঙ্গমা বলে, দুপুরে এম এ হান্নান সংগ্রাম পরিষদের লোকজনরে লইয়া গেলেন চট্টগ্রাম রেডিওর রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ার মির্জা নাসিরউদ্দীনের বাসায়। তারা মির্জারে কইলেন, চলেন, রেডিও ট্রান্সমিটার অন করতে হইব। মির্জা কয়, মাথা খারাপ। আমি তো রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ার। ট্রান্সমিশন অন করতে হইলে রিজিওনাল ডাইরেক্টরের অর্ডার লাগব।
তারে আমরা পামু কই। চলেন।
তিনি বলেন, আমারে বিপদে ফেলবেন না ভাই।
জনতার ভিড় হইয়া গেছে মির্জা সাহেবের বাড়ির সামনে। নেতারা তারে ধমক দিলেন। ওই মিয়া আপনে উঠবেন না আমরা অ্যাকশনে যামু? মির্জার বউ-বাচ্চারা কানতে লাগল। একরকম জোর কইরাই তারে ধইরা তোলা হইল গাড়িতে। নেওয়া হইল রেডিও স্টেশনে। সম্প্রচার যন্ত্র চালু কইরা আবদুল। হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা পইড়া শুনাইলেন। রেডিওতে প্রচার হইল। চট্টগ্রাম আর তার আশপাশের এলাকার মানুষজন শুনতে পাইল।
পরের দিন সারা দুনিয়ার কাগজে বাইর হইল, রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারিত হইল : শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে সিভিল ওয়ার শুরু হইয়া গেছে।
১৩
২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম স্টেশন রোডের রেস্টহাউসের বাইরে লাঠিধারী কড়া প্রহরা, তিনজন রেডিও কর্মীকে তাঁরা কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে দেবেন না। সংগ্রাম পরিষদের অফিস। ভেতরে আছেন আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী। আগের রাতে তার বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর বার্তা। এসেছে, রাতেই তা সাইক্লোস্টাইল করে বিলি করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, ভেতরে রেস্টহাউসের বারান্দায় গিজগিজ করছে মানুষ, খবর এসেছে, ইপিআর বিদ্রোহ করেছে; বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করছে চারদিকে, দেশের এখানে-ওখানে, বীর চট্টগ্রামবাসী লাঠি, সড়কি, বন্দুক, পিস্তল–যা হাতের কাছে পাচ্ছে, তা-ই নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরোনোর পথ রুদ্ধ করে মানবদুর্গ রচনা করে বসে আছে। এই সময়ে তিনজন লোক এসেছেন–একজন বেলাল মোহাম্মদ-লম্বা, হালকা, পাঞ্জাবি পরা, পায়ে হাওয়াই চপ্পল, মানে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। কবিতা লেখেন, ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, একটি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন, উদাসীনতা তাঁর ঝাঁকড়া চুলে বসন্ত বাতাসে উড়ছে, পাঞ্জাবির বুকপকেটে কলমের কালির অসাবধান দাগ। তিনি কাজ করেন চট্টগ্রাম বেতারে, স্টাফ রাইটার। চুক্তিভিত্তিক চাকরি যদিও। আছেন আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, ফটিকছড়ি কলেজের সহ-অধ্যক্ষ। আছেন সদা তৎপর ভঙ্গি নিয়ে বেতারের নতুন প্রযোজক আবদুল্লাহ আল ফারুক। তার হাওয়াই শার্টের হাতা গোটানো। তিনি যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারেন, এমনকি দেশ স্বাধীন করতে বললে তিনি জিজ্ঞেস করবেন, এখনই করে ফেলব? জাস্ট কোত্থেকে শুরু করব, বলুন। সন্দ্বীপ দুই বছর ছিলেন বেলাল মোহাম্মদের বাসাতেই, ফটিকছড়ির চাকরির ফাঁকে প্রায়ই আসেন চট্টগ্রামে, থাকেন বেলাল মোহাম্মদের বাসায়। একজোড়া ঝোলানো ওড়ানো গোঁফ তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার মতো উড়িয়ে দিয়েছেন ঠোঁটের দুই পাশে। বেলাল মোহাম্মদ অসহযোগের দিনগুলোয় নিজের বাসায় তালা দিয়ে উঠেছেন ডাক্তার মোহাম্মদ শফীর বাসা মুশতারী লজে। আগ্রাবাদের সরকারি কলোনির বাসা ফাঁকা, দারাপুত্ৰপরিবার। গ্রামের বাড়িতে কাটাচ্ছে অসহযোগের দিনগুলো। বেগম মুশতারী শফী মহিলাদের মাসিক পত্রিকা বান্ধবী সম্পাদনা করেন, জয় বাংলা বলে স্লোগান। দেন রাস্তায়, এক দফা এক দাবি বাংলার স্বাধীনতা বলে ছড়া লেখেন, আর সব অ্যাকটিভিস্টের জন্য নিজের বাড়ির মেঝেতে তোশক বিছিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করেন, আবার হাঁড়ি ভরে ভাত রান্না করে রাখেন। সন্দ্বীপও সেই গণরুমের বাসিন্দা ও ফ্রি হোটেলের আহারী। ২৬ মার্চ সকালে সেই মেঝেতে বসে বেলাল রেডিওর নব ঘোরাচ্ছিলেন, আর ঢাকা কেন্দ্র থেকে শুনছিলেন উর্দুমিশ্রিত ফরমান, কিন্তু চট্টগ্রাম রেডিও সাড়াশব্দহীন। দরজায় বেল বাজল, কে এসেছে, দেখার জন্য বেলাল পা বাড়াতেই ঘরে ঢুকলেন আবদুল্লাহ ফারুক। বললেন, রেডিওতে যাচ্ছিলাম, রাস্তায় মিছিল, লোকজন সব লাঠিসোটা হাতে ক্যান্টনমেন্ট পাহারা দিয়ে রাখতে যাচ্ছে; ভাবলাম রেডিওতে না গিয়ে আপনার কাছেই আসি।
বেগম মুশতারী শফী শাড়ির আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে এই ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন।
বেলাল মোহাম্মদ বললেন, রেডিও বন্ধ। এটা কি ঠিক হচ্ছে?
ফারুক বললেন, আপনি যাননি, আমি যাইনি, খুলবে কে?
মুশতারী বললেন, খুললে কিন্তু ভালো হতো। আমরা সাতই মার্চের ভাষণ প্রচার করতে পারতাম। উদ্দীপনামূলক কথিকা পড়ে শোনাতে পারতাম।
সন্দ্বীপ বললেন, ঠিক বেলাল ভাই। চলেন সংগ্রাম পরিষদ অফিসে যাই।
তাই তো বেরিয়ে পড়া সংগ্রাম পরিষদ অফিসের দিকে।
রেস্টহাউসের গেটে পাহারা তো রাখতেই হবে। শত্রুরা তো হামলা করতেই পারে। তাই বলে এই তিনজন জয় বাংলার লোককে ঢুকতে দেবে না, এ-ও কি হয়।
অনেক দেনদরবারের পর শুধু বেলাল মোহাম্মদ ঢুকতে পারলেন রেস্টহাউসের ভেতরে। বারান্দায় লোকে গিজগিজ করছে। একজন একটা সাইক্লোস্টাইল কাগজ থেকে ইংরেজিতে পড়ে শোনালেন বঙ্গবন্ধুর বার্তা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলেন বেলাল। তার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল।
একজন সেটা আবার বাংলা অনুবাদ করে পড়ে শোনাচ্ছেন। তাঁর গলার রগ ফুলে ফুলে উঠছে।
বেলাল এই উত্তেজিত সদা ব্যস্ত নেতা-কর্মীদের কাউকে যে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে নিজের মনের কথাটা পাড়বেন, সে উপায় নেই! প্রত্যেকেই ব্যস্ত। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, রাস্তা দখল রাখতে হবে, আর্মিকে ক্যান্টনমেন্টে আটকে রাখতে হবে, কাজ কি কম!
সামনে পাওয়া গেল অ্যাডভোকেট রফিককে।
রফিক ভাই, বেলাল মোহাম্মদ বললেন।
জি বলেন।
একটা খুব জরুরি কথা আছে।
জি বলেন।
আমাকে কয়েকজন লড়াকু কর্মী দেন। হাতে লাঠিসোটা আর যা যা। আছে, তা-ই নিয়ে তারা চলুক আমার সঙ্গে। আমরা বেতার দখল করব। আগ্রাবাদ বেতার ভবন আর কালুরঘাট ট্রান্সমিটার দখল করে রাখতে হবে। আমরা বেতারে আমাদের প্রোগ্রাম প্রচার করতে পারব। বঙ্গবন্ধুর মেসেজটা তো রেডিওতে প্রচার করা দরকার।
অ্যাডভোকেট রফিক একে ডাকলেন, ওকে ডাকলেন। কেউ কোনো কথা শুনতে চাইছে না। সবাই দেশ স্বাধীন করবে। সবার অনেক কাজ।
বেলাল মোহাম্মদের চোখেমুখে হতাশা। বারান্দায় হঠাৎ করে চৈতালি বাতাস বইল, তার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম শুকিয়ে নিয়ে আরামের স্পর্শ দিল, তিনি বারান্দার ভিড় ঠেলে নিচে নামছেন, এই সময় বসন্তের বাতাসের মতোই দমক দিয়ে সামনে দাঁড়ালেন মমতাজউদ্দীন আহমদ। শিক্ষক এবং আন্দোলনরত বুদ্ধিজীবী। দিন দশেক আগে লালদীঘি ময়দানে তিনি নাটক মঞ্চস্থ করেছেন–এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
আরে বেলাল ভাই।
মমতাজ ভাই। শোনেন। একটা কাজের কাজ করার আছে। কাউকে পাচ্ছি না যাকে বলব। হেল্প পাব। চট্টগ্রাম রেডিও বন্ধ আছে। আমরা সেটা। দখল করে আমাদের প্রোগ্রাম চালু করতে পারি।
তাই তো। আমি তো আমাদের বেতারের জন্য প্রোগ্রাম লিখতে পারি। কথিকা পড়তে পারি। টক দিতে পারি। দারুণ আইডিয়া।
কিন্তু একটা সমস্যা আছে। আমরা প্রোগ্রাম করা শুরু করামাত্রই আর্মি অ্যাটাক হতে পারে। এটা আমাদের পাহারা দিয়ে রাখতে হবে। লাঠি হাতে গোটা কুড়ি কর্মী যদি পাওয়া যেত।
মমতাজউদ্দীন হাসতে লাগলেন। চন্দ্রাহত মানুষের হাসি। তার চোখ এই জগতে নেই, তার দৃষ্টি ওই দূরে মেঘলা আকাশের মেঘের সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। তাঁর চোখ গনগনে লাল, বোঝাই যাচ্ছে তিনি সারা রাত ঘুমাননি। তিনি বললেন, লাঠি দিয়ে তো বেতারকেন্দ্র পাহারা দেওয়া যাবে না। অস্ত্র লাগবে। সৈন্য লাগবে! সশস্ত্র সৈনিক!
বেলাল বললেন, কিন্তু আমরা সশস্ত্র সৈনিক কোথায় পাব?
হা হা হা। মমতাজউদ্দীন আবার হাসলেন, ঘটনা ঘটে গেছে। লড়াই শুরু হয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন রফিক, বেলাল ভাই, ক্যাপ্টেন রফিক। ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিক মুভ করেছেন। পাঞ্জাবিদের সব বন্দী করেছেন। ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। আপনি কোনো খবরই রাখেন না। উই হ্যাভ আওয়ার আর্মি নাউ। উইথ আর্মস। রফিক ইজ দ্য ম্যান। এখন ক্যান্টনমেন্টের বাঙালি সৈন্য অফিসাররাও বিদ্রোহ করছে। আমাদের সাথে যোগ দিচ্ছে। চলুন, বেলাল ভাই, আমরা ক্যাপ্টেন রফিকের কাছে যাই। রেলওয়ে পাহাড়ে আছেন তিনি।
যাব তো বটেই। কিন্তু যাব কীভাবে? সময় নষ্ট করা যাবে না।
আবারও হাসলেন মমতাজউদ্দীন। হালকা-পাতলা মানুষ, টিপিক্যাল বাঙালি চেহারা, নাকের নিচে চার্লি চাপলিন গোঁফ, চোখ দুটো বুদ্ধির দীপ্তিতে জ্বলজ্বলে। তিনি বললেন, আমার নাম মমতাজউদ্দীন, যেখানে উপায় নেই, সেখানেই গোলাম হোসেনকে দিয়ে আমি উপায় বের করে থাকি। বাইরে একটা জিপ দেখা যাচ্ছে। ওই জিপটা ওই যে সাদা-পাকা সাহেব, ওঁর। সাদা-পাকা সাহেব, কাম হিয়ার প্লিজ। আমাদের রক্ত দিন, আমি আপনাদের স্বাধীনতা দিব। কে বলেছেন? নেতাজি সুভাষ বসু। সাদা-পাকা সাহেব, আপনি এবার আপনার জিপটা দিন, আমি আপনাদেরকে স্বাধীনতার রেডিও দেব। বুঝলেন তো। কুইক। ড্রাইভারকে ডাকুন। বলুন, জিপটা আমাদের কথামতো তেজি ঘোড়ার মতো চলবে।
জিপ জোগাড় হলো। চার আরোহী–মমতাজ, বেলাল, ফারুক, সন্দ্বীপ ছুটে চলেছেন ক্যাপ্টেন রফিকের উদ্দেশে, রেলওয়ে পাহাড়ে।
ক্যাপ্টেন রফিককে পাওয়া গেল। ভীষণ ব্যস্ত তিনি। নিজে তো বিদ্রোহ করেছেনই, সেনাবাহিনীর ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের বাঙালি সৈন্য ও অফিসারদের সঙ্গে সমন্বয় করা, তাদের সঠিক তথ্য দেওয়া, তাদের বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ করা আর বালুচ রেজিমেন্টের আক্রমণ থেকে বাঙালি সৈন্যদের বাঁচানোর চেষ্টা করার কঠিন কঠিন সব কাজে তাকে ব্যস্ততার অধিক ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।
.
ব্যাঙ্গমা বলল, ক্যাপ্টেন রফিক লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বা আ টেল অব মিলিয়নস বইতে ২৫ মার্চ রাতে তাঁর বিদ্রোহের এবং ওই রাতের চট্টগ্রাম ঘটনার বিবরণ লেইখা রাখছেন।
ব্যাঙ্গমি বলল, হ লেখা আছে তার বইয়ে। সেই কথায় আমরা পরে যাই। ওইটা আগের রাইতের ঘটনা। অহন আমরা ২৬ মার্চ রেলওয়ে পাহাড়ে রফিকের লগে মমতাজউদ্দীন, বেলাল মোহাম্মদ, ফারুক আর সন্দ্বীপের বাতচিতে আছি।
.
মমতাজউদ্দীন বললেন, ক্যাপ্টেন সাহেব। আসল লোক এসে গেছেন।
ক্যাপ্টেন রফিকের পাতলা ঠোঁট, পাতলা নাক, ছোট করে ছাঁটা চুল মাকড়সার হালকা জালের মতো রেশম কোমল, তাঁর মুখে ক্লান্তি, চোয়ালে দৃঢ়তা, চোখে আশা আর প্রতিজ্ঞার ঝিলিক। তিনি বললেন, আসল লোক মানে?
মমতাজউদ্দীন দিগন্তবিস্তারী হাসি ফুটিয়ে বললেন, রেডিওর লোক। রেডিও সেন্টার চালাবে। জয় বাংলা রেডিও।
ক্যাপ্টেন রফিক বললেন, রাইট স্যার। রেডিও, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল করার জন্য আমি আমার সৈন্যদের অলরেডি রাতের বেলাতেই পাঠিয়ে দিয়েছি।
বেলাল মোহাম্মদ বললেন, শুধু আগ্রাবাদ পাহারা দিলে হবে না। কালুরঘাটে ট্রান্সমিটার। সেখানেও পাহারা লাগবে।
রফিক বললেন, ২০ জন জওয়ান থাকবে আগ্রাবাদে, ১৫ জন। কালুরঘাটে। আপনারা যান। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে সব ব্যবস্থা করছি।
মমতাজউদ্দীন বললেন, শাবাশ ক্যাপ্টেন। আপনি আমাদের স্বাধীনতার বীর সৈনিক। আপনার অবদান আমাদের ইতিহাসে সোনার আখরে লেখা থাকবে। বেলাল ভাই, চলুন যাওয়া যাক পরের অভিযানে। ফরোয়ার্ড মার্চ।
বেলাল মোহাম্মদ, মমতাজউদ্দীন, ফারুক, সন্দ্বীপ উঠে বসলেন জিপে। জিপ চলছে। চুল উড়ছে। পাঞ্জাবির প্রান্ত উড়ছে। কিন্তু বেলাল মোহাম্মদ জানেন, আসল কাজটা প্রকৌশলীদের। টেকনিক্যাল কাজ। ইঞ্জিনিয়ারদের সহযোগিতা না পেলে চলবে না।
ইঞ্জিনিয়ারদের কারও বাড়ির ঠিকানা বেলালের জানা নেই। একজন আছেন, মাহবুব হাসান, চুক্তিভিত্তিক কর্মী, কারিগরি কাজ নিজে নিজে শিখে নিয়েছেন, তাঁর কাছে যাওয়া যায়। তার মাধ্যমে অন্য ইঞ্জিনিয়ারদের খোঁজও মিলে যেতে পারে।
গাড়ি গিয়ে মাহবুবের বাড়িতে থামে। রাবেয়া খাতুন লেনে গাড়ি রেখে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তেই দেখা গেল মাহবুব বা হাতে দরজা খুলছেন, ডান হাতে তার ভাত, আসেন বেলাল ভাই, ভাত খান।
সঙ্গে ছিলেন মমতাজউদ্দীন, তিনি বললেন, খেলে তো ভায়া বেলাল একা খাবে না, মমতাজউদ্দীনও অনাহারী, দুপুরে ভাত খেতে অপছন্দ করে না।
ভাত ঝটপট খেয়ে নিলেন তিনজনই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তারপর গাড়ি যেতে লাগল একেকজন প্রকৌশলীর বাসায়।
দুজন প্রকৌশলী মোসলেম খান আর দেলওয়ার হোসেনকে জিপে তুলে তারা ছুটলেন কালুরঘাটের দিকে। কালুরঘাট ট্রান্সমিটার অন করা হলো। ইঞ্জিনিয়ার দুজনকে রেখে মাহবুব হাসান, মমতাজউদ্দীন আহমদ, বেলাল এবার ছুটলেন আগ্রাবাদের দিকে। পথে মমতাজউদ্দীন নেমে গেলেন–সারা রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রমে একে তো তিনি ধ্বস্ত, তার মধ্যে তাঁর মাথায় এসেছে একটা স্ক্রিপ্টের প্লট। রেডিও খুললেই তো হবে না। তাতে প্রচারের জন্য ম্যাটেরিয়াল দিতে হবে।
গাড়ি ছুটছে। বাতাসে রোদের গন্ধ। বাতাসে লাশের গন্ধ। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে হাজারের বেশি বাঙালি সৈন্য এবং তাদের পরিবার পরিজনকে হত্যা করেছে ২০ বালুচ বেঙ্গলের সৈন্যরা।
আগ্রাবাদে পথে পথে ব্যারিকেড। পাকিস্তানি অস্ত্রসমেত জাহাজ এসেছে বন্দরে। সোয়াত। খবর পেয়ে বন্দর অভিমুখী সড়কে বাঙালিরা ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। অস্ত্র খালাস করতে দেবে না তারা। পিচের ড্রাম এনে রাখা হয়েছে, ইট, কাঠ, পাথর, পানির ট্যাংক, গাছের গুঁড়ি–ব্যারিকেডের স্তূপগুলো বৈচিত্র্যপূর্ণ। পিচের ড্রামে আগুন দেওয়া হয়েছে, পিচপোড়া গন্ধ, ধোয়া, আগুনে রাস্তা দিয়ে চলাও মুশকিল।
বাদামতলী ব্যারিকেডে গাড়ি রেখে দৌড়ে আগ্রাবাদ বেতারকেন্দ্রে গেলেন বেলাল আর মাহবুব। বেতার ভবনের গেটে কোনো প্রহরা নেই…পুরো এলাকাটা পোড়োবাড়ির মতো নির্জন। তারা সেই ভুতুড়ে বাতি না জ্বালানো ভবনে ঢুকে খুঁজে পেতে সুইচ অন করে বাতি জ্বালালেন। প্রধান নিয়ন্ত্রণকক্ষের দরজা খুললেন।
ফোন বেজে উঠল। কালুরঘাট থেকে ফোন। দুই ইঞ্জিনিয়ার চলে যেতে চান। আঞ্চলিক পরিচালক, আঞ্চলিক প্রকৌশলী অর্ডার না দিলে তারা ট্রান্সমিটার অন করতে পারেন না।
বেলাল মোহাম্মদ বললেন, ওয়েট। আপনারা দশ মিনিটের মধ্যে অর্ডার পেয়ে যাবেন ওনাদের কাছ থেকে।
ভাই মৌখিক অনুমতিতে হবে না। লিখিত অর্ডার লাগবে।
আচ্ছা তা-ই আনছি।
বললেন বটে, কিন্তু আঞ্চলিক পরিচালকই-বা কোথায় আর ইঞ্জিনিয়ারই বা কোথায়। ফোন করলেন আঞ্চলিক প্রকৌশলী মির্জা নাসিরউদ্দীনকে।
হ্যালো আমি বেলাল মোহাম্মদ বলছি। আপনার কাছে আসছি। আপনি লিখিত অর্ডার দেবেন। বেতার চালু করতে হবে।
ভাই আমাকে কেন বিপদে ফেলছেন। দুপুরে এম এ হান্নান সাহেব জোর করে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ট্রান্সমিটার চালু করেছেন। শেখ সাহেবের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে শোনালেন। এরপর তিনি তো চলে গেছেন। আমাদের চাকরি কি আর থাকবে? চাকরি যেমন-তেমন, বালবাচ্চাসহ নিজেরা বাঁচব তো!
কী বলেন। দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে। আপনাদের প্রমোশন হবে।
ভাই, আর্মি এসে তো আমাদের স্রেফ গুলি করে মেরে ফেলবে।
তা হবে না। কমান্ডার রফিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা বেতার ভবন পাহারা দেওয়ার জন্য বাঙালি সৈন্য পাচ্ছি।
ভাই আমাকে ক্ষমা করেন। আমার বউ-বাচ্চা আছে। আমি তো অর্ডার দেওয়ার লোক না। অর্ডার দিতে পারেন আঞ্চলিক পরিচালক। তাঁকে বলুন। তিনি বললেই হবে। আমি বললে হবে না।
ওনাকে যে ফোন করব, ওনার নতুন কোয়ার্টারে এখনো ফোন লাগেনি।
উনি এআরডি ওয়ানের বাসায়। আমার সঙ্গে এখনই ফোনে কথা। হয়েছে। আপনি ফোন করুন। পাবেন।
এর মধ্যে সন্দ্বীপ ও ফারুকও এসে হাজির কন্ট্রোল রুমে।
বেলাল মোহাম্মদ সাদা রঙের ফোনটার পেটের নম্বর ঘোরাতে লাগলেন। এআরডি ওয়ান কাহার সাহেব। পরিচালক নাজমুল আলম সাহেব। দুজনেই ওই বাড়িতে আছেন। ফোন ধরলেন কাহার।
রিসিভার এ পাশে দেওয়া হয়েছে সন্দ্বীপের হাতে।
কাহার জিজ্ঞেস করলেন, কে আছে ওখানে?
সন্দ্বীপ বললেন, বেলাল সাহেব আছেন।
বেলাল সাহেবকে দিন।
হ্যালো-বেলাল মোহাম্মদ বললেন।
শোনেন, বেলাল সাহেব-কাহার সাহেব বললেন-আপনারা সম্প্রচার করতে চান করুন। শুধু একটা বুদ্ধি দিই। আগ্রাবাদ থেকে করতে যাওয়ার দরকার নেই। কারণ, এখান থেকে ক্যান্টনমেন্ট কাছে। নৌবাহিনীর বেস কাছে। আর্মি অ্যাটাক করলে মারা পড়বেন। আপনারা কালুরঘাট যান। কালুরঘাটে স্টুডিও আছে একটা। কোনো অসুবিধা হবে না।
আপনি কালুরঘাটের ইঞ্জিনিয়ারদের ফোন করে এখনই বলে দেন যে আমরা যাচ্ছি। আমাদের যেন সহযোগিতা করে।
আচ্ছা। বলে দিচ্ছি।
যাক। অর্ডার পাওয়া যাচ্ছে। বেলাল মোহাম্মদ, ফারুক, সন্দ্বীপ উঠলেন।
দীর্ঘ করিডর। তাঁদের পায়ের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে নিজেদেরই কানে। তাঁরা চমকে চমকে উঠছেন।
কিন্তু আরও চমকে উঠলেন নারীকণ্ঠ শুনে। তাকিয়ে দেখতে পেলেন। অনুষ্ঠান ঘোষিকা হোসনে আরাকে। তার সঙ্গে আরেকজন ভদ্রলোক। হোসনে আরা বললেন, উনি আমার চাচা। ওনার নাম ডা. আনোয়ার আলী। আওয়ামী লীগের কর্মী।
আনোয়ার আলী বললেন, আপনারা বেতার চালু করবেন। প্রচার করবেন কী? এই নিন।
তিনি এগিয়ে দিলে একটা সাইক্লোস্টাইল করা কাগজ। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বর্বর পাকিস্তানি আর্মি অকস্মাৎ পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ করেছে…স্বাক্ষর শেখ মুজিবুর রহমান…
.
কাগজটা পেয়ে বেলাল মোহাম্মদ পড়তে লাগলেন। তাঁর শরীরে আগুনের পরশমণির ছোঁয়া লাগল যেন। থ্যাংক ইউ ডাক্তার সাহেব। এটাই হবে আমাদের প্রথম ঘোষণা।
মাহবুব হাসান বললেন, চলেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বাসায় যাই। লিখিত অর্ডারটা নিয়ে আসি।
তাঁরা গেলেন মির্জা নাসিরের কাছে। তিনি ফোন করে অর্ডার দিলেন কালুরঘাটকে। হ্যালো, ট্রান্সমিটার চালু করেন…বেলাল মোহাম্মদ সাহেবরা যাচ্ছেন…
ফোন রেখে তিনি বললেন, আপনারা ইপিআর জওয়ান নিয়ে যান। এমন ভাব করবেন যেন ভবিষ্যতে ওরা বলতে পারে বন্দুকের মুখে ওদের কাজটা করতে হয়েছিল। ভবিষ্যতে কী হবে কেউ কি বলতে পারে বলেন…।
.
ইঞ্জিনিয়ারের বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে এসে দেখেন জিপ নেই। এখন উপায়?
এগিয়ে এলেন ডাক্তার আলী। বললেন, আমার সঙ্গে পিকআপ আছে। সেটা নিয়ে যাই চলেন।
ডাক্তার আনোয়ার আলী গাড়িটা পেয়েছেন ওয়াপদার ইঞ্জিনিয়ার আশিকুল ইসলামের কাছ থেকে। গাড়ির নম্বর চট্টগ্রাম ট ৯৬১৫। বিদ্রোহী ইপিআর সদস্য আর সেনাদের জন্য খাবার রসদ সরবরাহ আর আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সকাল থেকেই চট্টগ্রামের আপামর জনগণ তৎপর হয়ে উঠেছে। সকালবেলা জনতার ভিড়ের মধ্যেই হকার টেলিগ্রাম বিলি করছিল, বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা, বাংলাদেশ স্বাধীন…তিনি গাড়ি থামিয়ে সেই টেলিগ্রামের একটা সঙ্গে নিয়েছিলেন।
গাড়ি নিয়ে তারা ছুটছেন কালুরঘাটের দিকে। পথে গাড়ি আটকালেন একজন। তার মাথার চুল এলোমেলো। পাঞ্জাবি ময়লা। বয়স্ক এই মানুষটাকে চট্টগ্রামের সবাই চেনে। কবি আবদুস সালাম। তিনি বলতে লাগলেন, নাতি, আমি একটা কথিকা লিখছি। এইটা প্রচারের ব্যবস্থা করতে পারবা?
পারব। আপনি ওঠেন গাড়িতে।
.
দুই ইঞ্জিনিয়ার মোসলেম খান আর দেলোয়ার একটা রিকশায়, তারা ট্রান্সমিশন অফিস ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ব্রেক ব্রেক। টায়ারে শব্দ তুলে জিপ থামল। বেলাল। মোহাম্মদ লাফ দিয়ে নেমে রিকশার সামনে দাঁড়ালেন। কই যান?
ভাই আমাদের মাফ করে দেন। আমরা পারব না।
পারবেন না মানে। আপনাদের না আরই ফোন করলেন?
তিনি আবার ফোন করেছেন। বলেছেন, যদি বেতার চালু করতে চাও, নিজ দায়িত্বে করো। আমি দায়িত্ব নিতে পারব না।
আপনাদের তো যাওয়া চলবে না। আপনাদের আমরা জোর করে আটকে রাখব।
ডা. আলী বললেন, আপনারা দাঁড়ান। আমি ব্যবস্থা করছি।
তিনি গাড়ি ঘোরালেন। গাড়ি ছোটালেন রেলওয়ে পাহাড়ের দিকে। ক্যাপ্টেন রফিককে লাগবে। এখনই কয়েকজন জওয়ান নিয়ে আসতে হবে। তিনি নিজের গাড়িতে করে কয়েকজন ইপিআর সদস্যকে নিয়ে এলেন। এরপর দুই ইঞ্জিনিয়ার গেলেন ট্রান্সমিটার ভবনে।
ট্রান্সমিটার ভবনের অফিসকক্ষে বসলেন বেলাল মোহাম্মদরা। কাগজ কলম নিলেন। বেলাল মোহাম্মদ লিখলেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।
সন্দ্বীপ বললেন, বেলাল ভাই, বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র দেন। বিপ্লবটা থাকুক।
আচ্ছা। তুমি যখন বলছ।
এর মধ্যে সুলতানুল ইসলাম এসে গেছেন। তিনি নিয়মিত ঘোষক। দুপুরে রেডিওতে এম এ হান্নান সাহেবের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের পর তার বন্ধুরা বলতে লাগল, তুমি বসে আছ কেন, যাও রেডিওতে। তিনি একটা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চলে এসেছেন কালুরঘাটে। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ করতে চান।
সন্দ্বীপ বেলালকে বললেন, বেলাল ভাই, সুলতানকে দিয়ে তো আপনি বিপ্লবী কথাটা বলাতে পারবেন না।
কেন?
ও তো কনজারভেটিভ। বিপ্লব জিনিসটা ও মানতে পারবে না।
আরে আমি যা লিখব তা-ই পড়বে।
না, আগে আপনি বা আমি রেডিওর নাম ঘোষণা করে দিই। তারপর সুলতানকে দেন।
তাহলে তুমি আরম্ভ করো।
এর মধ্যে ফোন এসে গেল। ফোন করেছেন চট্টগ্রাম রেডিওর নিউজ এডিটর। তার নাম সুলতান আলী। তিনি ফিসফিস করে বললেন, এই আপনারা দেরি করছেন কেন। রাত পৌনে আটটায় বিবিসি। সবাই বিবিসি। শুনবে। এখনই শুরু করে দেন। এরই মধ্যে সাড়ে সাতটা পার হয়ে গেছে। আর দেরি করা যায় না।
১৯৭১ সাল। ২৬ মার্চ। সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল, পাঠ করতে শুরু করলেন, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।
ডা. আলীর সঙ্গে তার ভাতিজি হোসনে আরা। তিনি নিয়মিত ঘোষক। বেলাল বললেন, হোসনে আরা, আপনি কিছু মনে করবেন না, আপনাকে কথা বলতে দেওয়া যাবে না। কারণ, এটা তো গোপন বিপ্লবী বেতার। আপনার কণ্ঠ শুনলে লোকে ধরে ফেলতে পারবে আমরা কোথায় আছি। আপনি কাইন্ডলি কিছু মনে করবেন না।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কাগজটা বারবার করে পড়া হলো। কবি আবদুস সালামের কথিকাটা কবি নিজে পড়লেন। এতে কোরআন শরিফ থেকে উদ্ধৃতি আছে, মুক্তির যুদ্ধ যে ইসলাম ধর্মের আলোয় ন্যায়সংগত সে সম্পর্কে যুক্তি আছে। তিনি পড়ছিলেন :
নাহমাদুহু ওয়ানু সাল্লিহি আলা রাসুলিহিল করিম।…আসোলামু আলায়কুম। প্রিয় বাংলার বীর জননীর বিপ্লবী সন্তানেরা। স্বাধীনতাহীন জীবনকে ইসলাম ধিক্কার দিয়েছে। আমরা আজ শোষক প্রভুত্বলোভীদের সাথে সর্বাত্মক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছি। এই গৌরবোজ্জ্বল স্বাধিকার আদায়ের যুদ্ধে, আমাদের ভবিষ্যৎ জাতির মুক্তিযুদ্ধে মরণকে বরণ করে যে জানমাল আমরা কোরবানি দিচ্ছি, কোরআনে করিমের ভাষায় তারা মৃত নহে, অমর। দেশবাসী ভাইবোনেরা আজ আমরা বাংলার স্বাধীনতাসংগ্রাম করছি।…নাসরুম মিনাল্লাহে ওয়া ফাতহুন কারিব। জয় বাংলা।
আবদুল্লাহ ফারুক, সুলতানুল ইসলামের কণ্ঠেও বঙ্গবন্ধুর নামাঙ্কিত জরুরি ঘোষণা পঠিত হলো বারবার।
একটু পর স্টুডিওর গেটে নক। ইশারায় ডাক। ডাকছেন ডাক্তার আবু জাফর। বেলাল বাইরে গেলেন। দেখলেন, আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, আমি বঙ্গবন্ধুর মেসেজটা পড়ব।
আসুন ভেতরে আসুন। আপনি তো দুপুরে পড়েছেন। এখন আবার পড়বেন। তবে একটা শর্ত। আপনার নাম বলা যাবে না।
কেন?
এটা গোপন বেতার। অবস্থান জানাতে চাই না। পাকিস্তানিরা এয়ার অ্যাটাক করতে পারে। আপনি পড়েন। চট্টগ্রামের সবাই আপনার গলা চেনে।
হান্নান বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তিনি আবারও বঙ্গবন্ধুর নামে আসা। সাইক্লোস্টাইল ঘোষণাটা পাঠ করলেন।
প্রায় আধঘণ্টা অধিবেশন চলল।
তারও আগে ডা. আলী ভাতিজিকে নিয়ে গাড়িতে চলে গেছেন।
আগামীকাল সকাল ৭টায় আবার অধিবেশন বসবে। ঘোষণা দিয়ে সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে বাইরে এলেন সন্দ্বীপ, সুলতান, বেলাল। এসে দেখেন, কোথাও কেউ নেই।
ইঞ্জিনিয়াররা নেই। ইপিআর জওয়ানেরা নেই।
শুধু হান্নান সাহেবের জিপ স্টার্ট দিচ্ছে।
বেলাল মোহাম্মদেরা গেলেন জিপের কাছে। আমরা শহরে যাব। আমাদের নিয়ে যান।
জিপে তো তিনজনের জায়গা হবে না। হান্নান সাহেবের জিপ অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
অন্ধকার।
জোনাকি জ্বলছে।
তিনজন হাঁটছেন। হাঁটতে হাঁটতেই তাঁরা ফিরলেন মুশতারী লজে।
.
ব্যাঙ্গমা বলে, বেলাল মোহাম্মদ ১৯৭৩ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের দৈনিক স্বাধীন পত্রিকায় একটা কবিতা লিখছিলেন।
ব্যাঙ্গমি বলে, হ লিখছিলেন তো। কবিতাটা কও তো শুনি। ব্যাঙ্গমা কবিতাটা মুখস্থ বলে :
এই দিনটি আমার দিন
হান্নানের দিন
সালামের দিন
কাসেমের দিন, ফারুকের দিন–
এই দিনটিতে কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে
একটি ছিন্নপত্রে আমি
লিখেছিলাম একটি নাম :
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র–
মাইকের সামনে কাসেমকে সেটা পড়তে দিয়েছিলাম।
হান্নান ঘোষণা করেছিলেন।
সালাম ভাষণ দিয়েছিলেন।
১৯৭১-এর এই দিনটির পর পটিয়া থেকে
আমি ডেকে এনেছিলাম ট্রান্সমিটারে
মেজর জিয়াকে–তারপর এসেছিল
একে একে আমাদের হাবিবুদ্দীন,
আমিন, রাশেদ, শারফুজ্জামান,
শাকের, মুস্তফা, রেজাউল।
কিন্তু আল্লার কসম, সেদিন
মি জানতাম না, এ দিনটি
হবে একটা দেশের স্বাধীনতা দিবস (১৮.৩.৭৩)।
ব্যাঙ্গমা বলে, বেলাল মোহাম্মদ এই কবিতা প্রকাশ করছেন ১৯৭৩। সালে। তখন বঙ্গবন্ধুও বাঁইচা, জিয়াউর রহমানও বাইচা।
১৪
সারা রাত নির্ঘম কাটিয়ে ভোরের দিকে একটুখানি তন্দ্রামতো এল ক্যাপ্টেন রফিকের। চট্টগ্রাম সিআরবি হিলে এসে উঠেছেন তারা।
লাল রঙের রেল ভবন ব্রিটিশ স্থাপত্যের সৌন্দর্য আর ঔপনিবেশিকতার চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা আবাসিক ভবনের নিচতলায় তাঁর অস্থায়ী সদর দপ্তর। সেখানেই একটা চেয়ারে বসে আছেন তিনি। শুয়ে ঘুমানোর প্রশ্নই আসে না।
এই ভবনটিতে রেলের কর্মকর্তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করেন। রেলওয়ে হিলে ক্যাপ্টেন রফিক তার জওয়ানদের নিয়ে যখন আসেন, ২৫ মার্চ বেশি রাতে, তখন এই পরিবারগুলো–নারী-পুরুষ-শিশুরা–তাঁদের হাততালি দিয়ে শুধু অভিনন্দন জানাননি, তাদের খাবার দিয়ে, পানি দিয়ে সাহায্য করেছেন। এমনকি ট্রেঞ্চ খুঁড়তে নিজেরা কোদাল ধরেছেন। গাড়ি থেকে জিনিসপত্র নিজেরা নামিয়ে দিয়েছেন। নতুন টেলিফোন লাইন লাগিয়ে দিয়েছেন রেলের কর্মচারীরা। খাবার তৈরি করতে হাত লাগিয়েছেন।
সৈনিকেরা ট্রেঞ্চে পজিশন নিয়ে আছে। সম্ভাব্য আক্রমণের যেন জবাব দেওয়া যায়। ক্যাপ্টেন রফিক ঘুরে ঘুরে দেখেছেন ট্রেঞ্চের পজিশন। ৩ ইঞ্চি মর্টার বসানো হয়েছে।
রফিক আশ্চর্য হয়ে একটা কথা ভাবছেন। পাকিস্তানি আর্মি আক্রমণ করলে যাতে অসামরিক লোকেরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে জন্য তিনি সবাইকে বলেছেন, এই এলাকা ছেড়ে তারা যেন নিরাপদ জায়গায় চলে যান। নারী শিশুরা অনেকেই রাতে আবাসিক এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। পুরুষেরা, তরুণেরা, এমনকি কিশোরেরা যায়নি। তারা বলেছে, আমরা থাকব। আপনাদের পাশে থাকব। সাহায্য করব। যুদ্ধ করব। রফিক আশ্বস্ত বোধ করেছেন। এই দেশ স্বাধীন হবেই। এই যুদ্ধে আমরা বিজয়ী হবই।
দেশের মানুষ সবাই একদেহ একমন হয়ে উঠেছে। এই জাতিকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটা মনে পড়ে রফিকের। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।
.
একটা গাড়ি ওপরে উঠছে। সব গাড়ির ওপরে ওঠার কথা নয়। কে এল?
২৬ মার্চ সকালবেলা রেলওয়ে হিলে একটা চেয়ারে বসে তন্দ্রাজড়িত চোখে রফিক গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। গাড়ি থেকে নামছেন ডা. জাফর।
রফিক মার্চ মাসের শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। বাঙালি মিলিটারি অফিসারদের সঙ্গেও কথা বলছেন। চট্টগ্রামে আছে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। সেখানে বাঙালি সৈন্য বেশি। পুলিশ ইপিআর আর্মি একসঙ্গে অপারেশন শুরু করলে পুরো চট্টগ্রাম এলাকাই বাঙালিরা মুক্ত রাখতে পারবে, এই ছিল রফিকের মত এবং পরিকল্পনা। সেটা নিয়ে তিনি অনেকবারই কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে, মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে, লে. কর্নেল এম আর চৌধুরীর সঙ্গে। শেষের দুজন তার কথার সঙ্গে একমত হননি। তাদের মত ছিল, আর্মির শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা যাবে না, আর বড় ধরনের গণহত্যায় পাকিস্তান আর্মি যাবে না।
রফিকের সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের অনেক নেতারই যোগাযোগ। সবচেয়ে বেশি খাতির ডা. জাফরের সঙ্গে। চোখের ডাক্তার এ কে জাফর। আওয়ামী। লীগের নেতা। ছয় দফার নামে পাগল ছিলেন। এখন উন্মত্ত এক দফা নিয়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন করতে হবে। তবে তিনি ঠান্ডা মাথার লোক। ক্যাপ্টেন রফিকের চোখ দেখানোর দরকার পড়ত। তাই তিনি যেতেন ডা. জাফরের কাছে। তার চেম্বারের দেয়ালে চোখের রেটিনার ছবির পাশে বঙ্গবন্ধুর ক্যালেন্ডার। হাত উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধু। পাশে লেখা ৬ দফা।
চোখ পরীক্ষা করতে করতে জাফর বলতেন, কী মনে করেন, ইয়াহিয়া খান কি ক্ষমতা দেবে?
রফিক আস্তে আস্তে নিজের হৃদয়টাকে উন্মোচিত করতে শুরু করেন ডা. জাফরের সামনে। চোখের মধ্যে টর্চ ধরে ডা. জাফর বলতেন, ওপরের দিকে তাকান? কী? জয় বাংলা দেখতে পান?
চোখ দেখে কি মন পড়ে ফেলা যায় নাকি।
ক্যাপ্টেন রফিক বলতেন, ডাক্তার সাহেব, আমার পরনে উর্দি থাকে। কিন্তু মনটা থাকে কাঁটাতারের বাইরে।
আচ্ছা বাম চোখটা একটু মেলুন। চোখে এক ফোঁটা ওষুধ দিতে দিতে ডা. জাফর বলতেন, সেটা কী রকম?
আমি তো ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিকসে পড়তাম। মোতাহার হোসেন সাহেব আমার টিচার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী পালন। থেকে শুরু করে ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনে আমি যুক্ত ছিলাম।
আপনার চোখে সেসব লেখা আছে। আমি পড়ে ফেলছি। ডাক্তার জাফর প্রসন্ন একটা হাসি দিলেন। রফিকের চোখ থেকে জল ঝরছে তখন।
চোখ কিন্তু মনের কথা বলে। আমি আপনার মন পড়ে ফেলছি, রফিক সাহেব।
তাহলে সর্বনাশ। আমি যে যশোের থাকার সময় ১৯৬৯-এ বিদ্রোহ করার চেষ্টা করছিলাম, সেটা আবার আপনি পড়ে ফেলছেন না তো! যশোর ক্যান্টনমেন্টে আমি তখন রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্ট।
সেটা না করে ভালো করেছেন। বঙ্গবন্ধু ইলেকশনটা করেছেনই জনগণের ম্যান্ডেট পৃথিবীবাসীকে দেখানোর জন্য। তিনি জানতেন একবার নির্বাচন হলে জনগণ কী চায় সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া সামরিক বিদ্রোহ দিয়ে তো পৃথিবীর কোনো দেশ স্বাধীন হতে পারেনি। বায়াফ্রার উদাহরণ তো আমাদের সামনে আছেই।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু আলোচনা করে কোনো ফল পাবেন বলে মনে হয় না।
সেটা বঙ্গবন্ধু জানেন বলেই মনে হয়।
.
ডা. জাফর গাড়ি থেকে নেমে এলেন। তার দুই হাতে সসপ্যান। সঙ্গে আরও আছেন আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান কায়সার। আরও দুজন নেতাকে নামতে দেখা গেল। সবাই হাতে করে গামলা-সসপ্যান আনছেন। রফিক উঠলেন। সালাম জানালেন।
ডা. জাফর বললেন, আপনাদের জন্য সকালের নাশতা এনেছি।
ফ্লাস্কে করে তাঁরা চা-ও এনেছেন। ক্যাপ্টেন রফিক তাঁর তদারককারীকে ডেকে বললেন, জওয়ানদের মধ্যে নাশতা ডিস্ট্রিবিউট করে দাও।
ডা. এ কে জাফর, আতাউর রহমান কায়সারের সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে বসলেন ক্যাপ্টেন রফিক।
সকালের আলো ফুটছে। যদিও আকাশটা মেঘলা মেঘলা। পাহাড়ের ওপরে গাছগাছড়ায় ঢাকা এই জায়গায় পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ডা. জাফর আর আতাউর রহমান কায়সারের মতো আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ক্যাপ্টেন রফিকের যোগাযোগটা তো আজকের নয়। সেটা তো শুধু রফিকের চোখ দেখানোর জন্য নয়।
.
৩ মার্চ চট্টগ্রামে মিছিল বেরিয়েছে। সেই মিছিল যেন ছিল উত্তাল বাঁধভাঙা নদী। সমস্ত রাজপথ প্রকম্পিত ছিল স্লোগানে স্লোগানে : এক দফা এক দাবি বাংলার স্বাধীনতা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। ওয়্যারলেস কলোনিতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বাস। সেখান থেকে গুলি হলো। রক্তে ভেসে গেল মিছিল। দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে গেল।
আশ্চর্য যে সেখানে ডিউটি দিচ্ছে ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা।
ক্যাপ্টেন রফিক গেলেন ঘটনাস্থলে। দেখা পেলেন পুলিশ সুপার শামসুল হক সাহেবের।
রফিক বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে আর্মি কেন? এদের কে ডেকেছে?
পুলিশ সুপার অসহায় কণ্ঠে বললেন, কেউ না।
এইখানে অবাঙালি কলোনিতে যে অনেক বালুচ সৈন্য সিভিল পোশাকে আছে, আপনি আশা করি জানেন। রফিক বললেন।
জানি।
কোনো বেসামরিক লোকের কাছে এখন রাইফেল থাকার কথা নয়, তা-ও আপনি জানেন।
জানি।
বিনা উসকানিতে মিছিলে গুলি করেছে বালুচ সৈন্যরা। বুঝতে পারছেন।
পারছি। বহু মানুষ মারা গেছে।
যারা মারা গেছে, তারা সবাই বাঙালি?
হ্যাঁ। যারা মারা গেছে, তারা সবাই বাঙালি।
আমরা কি কাউকে অ্যারেস্ট করেছি। ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিকের ভ্র কুঁচকে গেছে। তিনি বুকের মধ্যে একটা কষ্ট অনুভব করছেন।
না। আমরা কাউকে গ্রেপ্তার করিনি। বালুচ সৈন্যরা একশ জন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে গেছে। আটক সবাই বাঙালি।
সামনে দিয়ে একজন বালুচ মেজর হেঁটে যাচ্ছেন। একবার তিনি তাকালেন রফিক আর এসপি সাহেবের দিকে। তাঁর চোখেমুখে জাতিবিদ্বেষ। ঘৃণার আগুন তার মুখটাকে বিকৃত করে রেখেছে।
রফিকের মনের মধ্যে ঝড় বইতে লাগল। কিছু একটা করতে হবে। করতেই হবে। কী করা যায়? ডা. জাফর বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া সামরিক বিদ্রোহ দিয়ে হবে না। কথা তিনিও মানেন বটে। তবে এ কথার সঙ্গে তিনি এটাও যুক্ত করতে চান, তিনি পাকিস্তানি মিলিটারিদের মনোভাবটা জানেন। এদের মতো নিষ্ঠুর-নৃশংস গোষ্ঠী পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা নেই। একটা মার্শাল সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াইটা চলছে। এই লড়াইয়ে জিততে হলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামরিক পদক্ষেপও লাগবে। ঠিক সময়ে সঠিকতম পদক্ষেপ। রফিকের দুই কান দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে। তিনি ফিরে এলেন তার সারসন রোডের বাসায়। ডায়াল ঘোরাতে লাগলেন। এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে কল করতে হয়। এক্সচেঞ্জকে জানালেন ডা. জাফরের বাসায় ফোনটা দিতে।
হ্যালো…ডা. জাফর আছেন…
জি আছেন।
আমি রফিক। ওনাকে একটু ফোনটা দেবেন?
জি।
জাফর ভাই, ভালো মাছ একটা রান্না হয়েছে। আপনি কি একটু সারসন রোডের বাসায় আসবেন। আমার বাবুর্চি আপনার প্রশংসা শুনতে খুব ভালোবাসে।
কী মাছ?
বড় মাছ জাফর ভাই। অনেক বড় মাছ।
ডা. এ কে জাফর এই কোড ভাষাটা বুঝতে পারলেন। পরিস্থিতি নিশ্চয়ই খুবই জটিল। আলোচনা করতে হবে ব্যাপারটা।
তিনি বললেন, ওকে। আমি আসছি। আপনি তরকারি বাড়তে বলেন। মাছ ঠান্ডা খাওয়া যাবে। তবে ভাতটা গরম চাই।
.
ডা. জাফর এলেন ক্যাপ্টেন রফিকের বাসায়। ৩ মার্চ ১৯৭১ রাতের বেলা।
তাঁরা দুজন পাশাপাশি বেতের সোফায় বসলেন।
দুজনে গভীরভাবে শ্বাস নিচ্ছেন। তারা জানেন, যেসব কথা হবে, সেসব যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বিপজ্জনক। বিপদ শুধু নিজেদের নয়, দেশের মানুষের। যা করতে হবে, বিপদ মাথায় নিয়েই করতে হবে বটে, তবে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে করতে হবে, যাতে লক্ষ্য হাসিল হয়।
জাফর ভাই। বালুচ সৈন্যদের দিয়ে আজকে এতগুলো মানুষ মারল। আমার কাছে খবর আছে। ২২ বালুচ রেজিমেন্টের একটা রেজিমেন্ট ঢাকায় আনা হয়েছে। ওরা তো সৈন্য আনছে। অস্ত্র আনছে। আমাদের একটা কিছু করা উচিত।
ডা. জাফর ঝিম মেরে গেলেন। অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। রফিকের মুখের দিকে। যেন রফিকের মুখের মধ্যে আছে রুটম্যাপ, সেই রুটম্যাপ পাঠ করে এগোতে হবে সামনের দিকে…আজকে ওয়্যারলেস কলোনিতে যা ঘটল, সেটা আমাদের আগের ভাবনাকেই রিকনফার্ম করে। রফিক সাহেব, আমরা আর পাঞ্জাবিদের সঙ্গে থাকতে পারব না। আমাদের আলাদা হতে হবে।
ইয়েস জাফর ভাই। আমাদের স্বাধীন হতে হবে।
ঢাকায় স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের পতাকা বানানো হয়েছে। আমরা স্বাধীনতার দিকেই এগোচ্ছি।
আসেন জাফর ভাই, আমরা একসঙ্গে কাজ করি। আমি জানি না ডিফেন্সে আর যারা বাঙালি সৈন্য অফিসার আছেন, তারা আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন কি না। কিন্তু আমার আন্ডারে আছে দেড় হাজার ইপিআর। তাদের দিয়ে আমি চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম এক মাস মুক্ত করে রাখতে পারব। এই এক মাসের মধ্যে আপনার দলকে বলেন বন্ধুরাষ্ট্রগুলো থেকে আমাদের জন্য সাপোর্ট আনানোর ব্যাকআপ রাখতে।
ওয়েল। আমি আপনার পয়েন্টটা বুঝতে পারছি। অনেক সেনসিটিভ এবং ভেরি ভেরি ইম্পরট্যান্ট ইস্যু। আমি একটু এম আর সিদ্দিকী ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলি।
আপনি একটা মিটিং অ্যারেঞ্জ করে দেন।
ঠিক আছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
৫ মার্চ সন্ধ্যা। চোখ দেখানোর কথা বলে রফিক গেলেন ডাক্তার জাফরের চেম্বারে। সেখানে গাড়ি রেখে বেবিট্যাক্সি নিয়ে তারা গেলেন এম আর সিদ্দিকীর বাসায়। আওয়ামী লীগ সভাপতির বাড়ির বৈঠকখানার দেয়ালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পোস্টার। পিতলের তৈরি নৌকা। আর বঙ্গবন্ধুর ছবিওয়ালা বড় পোস্টার। গেট ঠেলে যখন তারা দুজন ঢুকছিলেন বাড়ির ভেতরে, রাতের বেলা কোকিল ডেকে উঠেছিল। বারুদে তাতানো শহরেও কোকিল ডাকে, বসন্ত বাতাসের একটা পশলা গায়ে মেখে রফিক ভেবেছিলেন।
লিডার। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আসছে। ওরা আমাদের আক্রমণ করবে। যেভাবে মানুষ মারছে, তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেশ স্বাধীন করা ছাড়া উপায় নেই। আর তা করতে হলে আমাদের সামরিক প্ল্যান লাগবে। রফিক বললেন।
আপনার কথা ঠিক। স্বাধীনতা ছাড়া উপায় নেই। দেখা যাক বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ কী বলেন। আর্মির মনের ইচ্ছাটা কী, সেটাও বোঝা দরকার। এম আর সিদ্দিকী বললেন ধীরে ধীরে।
আচ্ছা। আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব। আপনি আপনার লিডারকে বলেন, আমরা প্রস্তুত। অন্তত আমি রফিক আর আমার ১৫০০ ইপিআর জওয়ান রেডি। বললেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব। আমরা জীবন দিতে প্রস্তুত আছি।
আচ্ছা। আমি আপনাকে অবশ্যই জানাব।
রফিক ঘটনাপঞ্জি অনুসরণ করতে লাগলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ থেকে তিনি টুকে নিলেন প্রয়োজনীয় নির্দেশটুকু, যদি আমাদের খতম করবার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমার এ দেশের মানুষের অধিকার চাই, আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমরা সবকিছু বন্ধ করে দেবে, আর যদি একটা গুলি চলে, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ৮ মার্চ রেডিওর সামনে বসে রফিক কথাগুলো লিখে নিলেন ঠিকঠাক।
বাতাস উষ্ণ। বাতাস গরম। বাতাসে স্বাধীনতার গন্ধ। প্রতিটা গাছের পাতা যেন ফিসফিস করে বলছে : স্বাধীনতা, স্বাধীনতা।
রফিক ১৫ মার্চের দৈনিক পাকিস্তান-এর শিরোনাম পড়লেন : শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, বাঙালিদের স্বাধীনতার উদ্দীপনা কেউ দমাতে পারবে না। তার মনের মধ্যে সেই কথাটা যেন বারবার করে বেজে উঠল, কেউ দমাতে পারবে না, কেউ দমাতে পারবে না।
.
১৭ মার্চ সন্ধ্যা। গাড়ি ছুটে চলেছে চট্টগ্রামের পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে। হেডলাইটের আলো দুপাশের গাছের ওপরে পড়ে পড়ে সরে সরে যাচ্ছে। রাতের আঁকাবাকা রাস্তার সমস্যা হলো, হেডলাইটের আলো রাস্তায় পড়ে না, পড়ে আশপাশে। রফিকের মনে হলো, তাদের পথটা এই রকমই। পথ আছে। তাতে আলো পড়ছে না। আলো পড়ছে রেইনট্রি সেগুন শালগাছে। কিন্তু পথ আছে। সামনে এগিয়ে যাওয়াই হলো আসল কথা। গাড়িতে আরও আছেন ডা. জাফর, আতাউর রহমান কায়সার। আরও একটা গাড়ি আছে পেছনে পেছনে। তাতে আছেন ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন হারুন, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মবিন। ছোট্ট ভক্সওয়াগনটি হারুনের, এই গুরুত্বপূর্ণ অফিসারদের নিয়ে পেছন পেছনে একটা অলৌকিক ব্যাঙের মতো এগিয়ে চলেছে।
তাঁরা গেলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। লাইব্রেরিয়ান আলমের বাসায়।
পশ্চিমারা তো শক্তি বৃদ্ধি করছে।
হ্যাঁ। সেটা বোঝাই যাচ্ছে।
আসলে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান তারা চায় না। তারা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রাইট।
তারা পূর্ণশক্তি সমবেত করার আগেই আমাদেরই উচিত আক্রমণ করা।
তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়।
রফিক বললেন, আমার ১৫০০ ইপিআর আছে। আমি আক্রমণ চালাব। আমি আপনাদের সিগন্যাল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনারাও আক্রমণ চালাবেন। আর এসে আমার সঙ্গে জয়েন করবেন। তাহলে ওরা আর আমাদের সঙ্গে অন্তত চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামে পেরে উঠবে না।
ঠিক আছে।
সমন্বয় করবেন ডাক্তার জাফর। তাঁর কাছে চোখ দেখাতে গেলে কেউ কিছু মনে করবে না।
ঠিক আছে। রাতের অন্ধকারে ডাক্তার সাহেবের গাড়িতে করে নিজের বাড়িতে ফিরে গেলেন রফিক। কিন্তু ঘুম আসে না। বিদ্রোহ করবেন, দেশ স্বাধীন করবেন, এই চিন্তা যার মাথায়, তার ঘুম আসবে কী করে।
পরের দিন গেলেন মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে। লে. কর্নেল এম আর চৌধুরীও আছেন সেখানে।
জিয়াউর রহমান ৮ ইস্ট বেঙ্গলের সবচেয়ে বড় অফিসার। তাঁর কমান্ডে আছে ৩০০ জন বাঙালি সৈন্য। এম আর চৌধুরী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের সবচেয়ে বড় বাঙালি অফিসার। তার ওখানে আছে ৩ হাজার বাঙালি সৈন্য। অন্য দিকে ২০ বালুচ রেজিমেন্টে আছে আনুমানিক ৩০০ বালুচ সেনা। তাদের পরাজিত করা সহজেই সম্ভব। দরকার হলে ইপিআর। থেকেও একটা কোম্পানি দেওয়া যাবে।
রফিক দুই অফিসারকে বললেন সেই সম্ভাবনার কথা। ধরা যাক, যুদ্ধ লেগেই গেল, আপনারা কী করবেন। আমরা তো সহজেই বালুচ সেনাদের নিউট্রালাইজ করে ফেলতে পারব। আমি এক্সচেঞ্জ, বেতার, পোর্ট, বিমানবন্দর, নৌবন্দর, নৌবাহিনীর সদর দপ্তর দখল করে ফেলতে পারব। আপনারা শুধু ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিয়ে বালুচগুলাকে শাটডাউন করবেন।
জিয়া বললেন, না না। আমাদের দিক থেকে মিলিটারি অ্যাকশনে যেতে হবে, এইটা আমার মনে হয় না। পলিটিক্যালি সবকিছু সেটেল হবে।
লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী বললেন, শোনেন। তেমন কিছু যদি ঘটেই, আমরা দেশের মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। আমরা অবশ্যই বের হয়ে এসে জনতার কাতারে যোগ দেব।
২৩ মার্চ রফিক গেলেন এম আর সিদ্দিকী সাহেবের কাছে। সঙ্গে ডা. জাফর। এম আর সিদ্দিকীকে বললেন, আপনি শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা যান। তাকে বলেন, চট্টগ্রাম হবে তার কেন্দ্রীয় দপ্তর। এখানে তিনি চলে আসুন। আমরা চট্টগ্রামকে মুক্ত রাখতে পারব। এখান থেকে তিনি সারা দেশের মুক্তির অভিযানে নেতৃত্ব দিতে পারবেন।
এম আর সিদ্দিকী বিষণ্ণ হাসি হাসলেন। বললেন, মুজিব ভাই সাড়ে সাত। কোটি মানুষের নির্বাচিত নেতা। পাকিস্তানের জনগণের একমাত্র মেজরিটি পার্টির ইলেকটেড লিডার। তিনি কেন ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে এসে নেতৃত্ব দেবেন। এটা হয় না। তবে পরিস্থিতি বোঝাতে আমি অবশ্যই তার সঙ্গে কথা বলব। তাকে যেমন বোঝাব, তেমনি তাঁর নির্দেশও আমাদের লাগবে। তাঁর নির্দেশ আমি আপনাকে অবশ্যই জানাব।
রফিক ২৪ মার্চ ভীষণ উত্তেজিত। কারণ, এমভি সোয়াতে এসেছে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ। জনতা বন্দরের রাস্তা ঘেরাও করে রেখেছে। ব্যারিকেড দিয়েছে। এই অস্ত্র কিছুতেই নামাতে দেবে না। শ্রমিকেরা অস্ত্র নামাবে না। তারা ধর্মঘট করল। রাস্তা উত্তাল মিছিলে মিছিলে।
অস্ত্র খালাসের দায়িত্ব ছিল বাঙালি ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদারের ওপরে। তিনি নিজে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলেন সামরিক বিদ্রোহের জন্য। আগে আক্রমণ করার জন্য। জাহাজ থেকে অস্ত্র নামানোর কোনো ইচ্ছাই তাঁর ছিল না।
ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার আসে। তাতে অবতীর্ণ হন পশ্চিমা মেজর জেনারেল আবুবকর ওসমান মিঠঠা। আরও কয়েকজন অফিসার তার সঙ্গে। তারা ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে হেলিকপ্টারে তোলে। প্রথমে তারা অবতরণ করে চট্টগ্রাম বন্দরে। সেখানে মজুমদারকে মিঠঠা বলেন, মজুমদার, সোয়াতের অস্ত্র আনলোড করো।
ব্রিগেডিয়ার মজুমদার বলেন, আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়নি। শ্রমিকেরা ধর্মঘট করেছে। রাস্তা জনতার দখলে। ব্যারিকেড সব বড় বড়। আমি এখানে অস্ত্র নামানো শুরু করলেই আগুন জ্বলে যাবে। ক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা পুরা বন্দর জ্বালিয়ে দেবে। জাহাজে জাহাজে আগুন জ্বলবে।
মিঠঠা বলেন, যদি পুরোটা দেশ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, যদি পুরো
কর্ণফুলী নদী রক্তে ভেসে যায়, তাহলেও অস্ত্র খালাস করতেই হবে।
ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে বন্দর থেকে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত দিতে দেরি হচ্ছিল। বাঙালি সৈনিক ও অফিসাররা তখনই বিদ্রোহ করার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে মিথ্যা কথা বলে, অন্য ডিউটি আছে বলে, ঢাকায় নেওয়া হয়।
মজুমদারের বদলে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে নিয়োগ দেওয়া হলো সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে। শ্রমিকেরা কাজ করছে না, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে আসা পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের লাগিয়ে দেওয়া হলো জাহাজ থেকে বাক্স নামানোর কাজে। বাঙালি জনতা উত্তাল হয়ে উঠল। তারা পথে পথে ব্যারিকেড বসাতে শুরু করল। চলল গুলি। গুলিতে যে কতজন মারা গেল, কতজন আহত হলো, রফিক তার হিসাব কষে কুলিয়ে উঠতে পারেন না।
২৪ মার্চ কেন এত তাড়াহুড়া করে অস্ত্রগুলো নামানো হচ্ছিল, ২৬ মার্চ সকালে রফিক খানিকটা বোঝার চেষ্টা করেন। কারণ, ২৫ মার্চ রাত থেকেই হাজার হাজার বাঙালিকে মারার জন্য হাজার হাজার বুলেট দরকার ছিল।
কিন্তু রফিক ২৪ মার্চেই অবস্থান নিলেন তাঁর পরিকল্পিত সদর দপ্তর রেলওয়ে হিলে। রেলের হক সাহেবের ফোন থেকে তিনি তার জওয়ানদের জানিয়ে দিলেন দুটো সংকেত। তার বার্তা ঠিকভাবে পৌঁছেছে তো। ২৪ মার্চ রাতে রফিক যখন অস্থিরচিত্তে অপেক্ষা করছিলেন, তখন একটা বড় গাছের নিচে মাটিতে বসে তিনি একটা কঞ্চি দিয়ে মাটিতে হিজিবিজি আঁকছিলেন। সেই সময় দেখা গেল একটা লাইট জ্বালিয়ে একটা যন্ত্রযান আসছে। কাছে এলে ভটভট আওয়াজে বোঝা গেল এটা একটা বেবিট্যাক্সি। রাস্তার এক পাশে কর্ণফুলী নদীর স্রোতকল্লোল সেই বেবিট্যাক্সির ভটভট আওয়াজে খানিকটা বাধাপ্রাপ্ত হলো। বেবিট্যাক্সি থেকে নামলেন লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী আর মেজর জিয়াউর রহমান। তাদের পেছনে দেখা যাচ্ছে আগ্রাবাদের ভবনগুলোর আলো। বন্দরের বাতিগুলো রাতের নদীর ধারে অমরাবতীর মতো জ্বলছে।
রফিক তাদের স্যালুট করলেন।
তারপর বললেন, স্যার। ওরা মারাত্মক গণহত্যার পরিকল্পনা করছে। আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। বাঁচার একটাই উপায়, বিদ্রোহ করা। আমরা আগে ওদের নিরস্ত্র করব। তা না হলে ওরা আমাদের স্রেফ গুলি করে মেরে ফেলবে।
এম আর চৌধুরী বললেন, ঢাকার সঙ্গে কথা হয়েছে। চরম আঘাত হানার কোনো পরিকল্পনা আর্মির নেই।
জিয়া বললেন, আর্মির চেইন অব কমান্ড ভাঙা ঠিক হবে না। ঢাকা থেকে আমাদের কাছে বিশেষভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, রফিক যেন পাগলামো না করে। ওর পাগলামোর কারণে অন্য সবার বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
২৬ মার্চ সকালে ডা. জাফর আর আতাউর রহমান কায়সারের সঙ্গে নাশতা খেতে খেতে রফিক মাথার চুল ধরে টানতে থাকেন।
২৪ মার্চ রাতে চট্টগ্রামে বাঙালি সৈনিকেরা আগে আক্রমণ করলে যুদ্ধ অনেক সহজ হতো। এমনকি ২৫ মার্চ যদি কর্নেল এম আর চৌধুরী আর মেজর জিয়া তার পরামর্শমতো অ্যাকশনে যেতেন, তাহলে চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে হাজারো বাঙালি সৈনিককে এক রাতেই শহীদ হতে হতো না।
.
ব্যাঙ্গমা বলল, ২৪-২৫ মার্চ হেলিকপ্টারে কইরা ক্যান্টনমেন্ট থাইকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি মেজর জেনারেল ইফতেখার জানজুয়া, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল খাদেম হুসেন রাজা একটা কইরা মুখবন্ধ খাম লইয়া যান। প্রতিটা ক্যান্টনমেন্টে তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং সেনাবাহিনী প্রধান হামিদের অর্ডার পৌঁছাইয়া দেন যে আজকের রাইতটাই সেই রাত। আজকার রাইতেই অপারেশন সার্চলাইট পরিচালিত হইব।
ব্যাঙ্গমি বলল, রাইত আটটার সময় নয়ীম গহর গেছিলেন বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। ভিড় ঠেইলা ঢুকছিলেন ভিতরে। শেখ সাহেবের বডিগার্ড মহিউদ্দীন তাঁরে ভিতরে নিয়া গেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তারে দেইখা কইছিলেন, আমি তোমার লাইগা ওয়েট করতেছিলাম। আলোচনা ফেইল করছে। ইয়াহিয়া উইড়া চইলা গেছে। রাস্তায় ট্যাংক বাইরাইতাছে। অরা যদি অ্যাটাক করে, আমরাও অ্যাটাক করব। চট্টগ্রামকে বলো, ডোন্ট সারেন্ডার। লিবারেট চিটাগাং অ্যান্ড প্রসিড টুয়ার্ডস কুমিল্লা।
ব্যাঙ্গমা বলল, হ। সেইটা তো আগেই কইছি। নয়ীম গহর গেলেন বঙ্গবন্ধুর পাশের বাড়ি মোশাররফ সাহেবের বাড়িতে। মোশাররফ আবার চিটাগাংয়ের এম আর সিদ্দিকীর ভায়রা। সেইখান থাইকা নয়ীম ফোন করলেন এম আর সিদ্দিকীরে। বঙ্গবন্ধুর হুকুম। ডোন্ট সারেন্ডার…।
.
২৫ মার্চ ১৯৭১। ক্যাপ্টেন রফিকের বাসায় এলেন ডা. জাফর। তখন বিকেল। সূর্যের আলো গাছের চূড়ায় চূড়ায়। আমের মুকুলগুলো বিকেলের হলুদ আলোয় সোনাঝুরির মতো লাগছে। রফিক আর জাফর পুরো পরিস্থিতি আলোচনা করলেন। পাকিস্তানিরা সব বাঙালি সৈন্যকে বলছে, অস্ত্র গোলাবারুদ জমা দিয়ে দিতে। তারা সিগন্যাল পোস্টগুলোতে শুধু অবাঙালিদের বসাচ্ছে। লক্ষণ খুব খারাপ। যেকোনো সময় পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করতে পারে।
ডা. জাফর সব শুনলেন। এখানে-ওখানে ফোন করলেন। সন্ধ্যার দিকে জাফর বললেন, রফিক সাহেব। আমি একটু আওয়ামী লীগ অফিস ঘুরে আসি। কোনো খবর এসেছে কি না নিজে চেক করে আসি।
তিনি পার্টি অফিসে গেলে রাত আটটার দিকে এম আর সিদ্দিকীর বাড়ি থেকে ফোন এল, জরুরি খবর আছে। বাসায় চলে আসেন।
জাফরসহ নেতারা ছুটলেন এম আর সিদ্দিকীর বাসায়।
সিদ্দিকী সাহেব দরজা বন্ধ করলেন। বললেন, এইমাত্র নয়ীম গহর ফোন করেছিল মোশাররফ হোসেনের ফোন থেকে। আলোচনা ভেঙে গেছে। ঢাকার রাস্তায় ট্যাংক আসছে। ইয়াহিয়া খান পালিয়ে গেছে। মুজিব ভাই বলে দিয়েছেন, আমাদের আর্মি, পুলিশ, ইপিআরদের তার হুকুম, ডোন্ট সারেন্ডার। অকুপাই চিটাগাং। প্রসিড টুয়ার্ডস কুমিল্লা।
এইটা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ? জাফর জিজ্ঞেস করলেন।
ইয়েস। অ্যাজ আই হার্ড ফ্রম দ্য মাউথ অব নয়ীম গহর।
তাহলে আমাকে এখুনি যেতে হবে। জাফর বেরিয়ে পড়লেন।
.
জাফর চলে যাওয়ার পর ক্যাপ্টেন রফিক খেতে বসলেন। আর্লি ডিনার। সঙ্গে আরেক ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দীন। খাওয়া কেবল শুরু করেছেন তিনি। ভাতের মধ্যে একটা মুরগির মাংস নিয়ে ঝোল তোলার জন্য চামচ ডুবিয়েছেন। বাটিতে। অমনি রুমে ঢুকে গেলেন জাফর। সঙ্গে আরেকজন কর্মী।
তাঁরা দুজনেই ভয়াবহ উত্তেজিত। তাদের মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। গাড়ি করে আসা সত্ত্বেও জাফর হাঁপাচ্ছেন।
কী হয়েছে বলেন। বসেন। হাত ধোন। ভাত খান।
না রফিক সাহেব। ভাত খাওয়ার সময় এটা নয়। আলোচনা ফেইল করেছে। ইয়াহিয়া খান পিন্ডি চলে গেছে। ঢাকার রাস্তায় ট্যাংক বের হয়ে পড়ছে। বঙ্গবন্ধু অর্ডার দিয়েছেন, চট্টগ্রাম দখল করতে। আপনাদের সারেন্ডার করতে নিষেধ করেছেন। চট্টগ্রাম দখল করে কুমিল্লার দিকে এগোতে বলেছেন। অর্ডারটা হচ্ছে ওরা যদি অ্যাটাক করে, আমরাও অ্যাটাক করব।
রফিক ভাতের থালা ফেলে উঠলেন। পাঁচক আহমদ জিজ্ঞেস করলেন, স্যার ভাত খাইলেন না যে। পাক কি ভালো হয় নাই? ক্যাপ্টেন রফিকের চোখের সামনে একমুহূর্তে তার সমস্তটা জীবন, ২৮ বছরের জীবন, তার ছাত্রজীবন, তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন, তার ৬১-এর রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনে অংশ নেওয়া, তার ১৯৬৯-এর বিদ্রোহের চেষ্টা যেন ঝলসে উঠল। ঝলসে উঠল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, আমরা যখন মরতে শিখেছি, কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না। যদি আমাদের খতম করবার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন। আর যদি একটা গুলি চলে…
রফিক বললেন, জাফর সাহেব, আমি যদি বাঁচতে চাই, আর আমার সৈনিকদের বাঁচাতে চাই, আর যদি আমাদের জনগণকে বাঁচাতে চাই, একটাই পথ আছে। আমি আমার ইপিআর সেনাদের তৈরি করে রেখেছি। আমরা যুদ্ধে যাচ্ছি। আপনারা একটা কাজ করুন। আপনারা একটু ষোলশহরে যান। আর ক্যান্টনমেন্টে যান। বাঙালি সৈন্যদের বলুন আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে। তাদের সঙ্গে কথা বলে এসে আমার সঙ্গে রেলওয়ে হিলে আমার সদর দপ্তরে এসে দেখা করেন।
রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে শেষবারের মতো সারসন রোডের বাড়ি ছাড়লেন ক্যাপ্টেন রফিক। তার মনে প্রশ্ন :
আমি তো যাচ্ছি দেশের জন্য যুদ্ধ করতে। কিন্তু আমার সঙ্গে অন্যান্য বাঙালি সৈন্য যোগ দেবে তো?
শেখ সাহেব ঢাকায় নিজেকে বাঁচাতে পারবেন তো?
এই যুদ্ধের পরিণতি কী হবে? যদি হেরে যাই মৃত্যু। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবে তো! আমার প্রাণের বিনিময়ে যদি দেশ স্বাধীন করে যেতে পারি, তার চেয়ে বড় কাজ আর কী হতে পারে!
রফিক গাড়িতে উঠলেন। পাশে ড্রাইভার কালাম। সঙ্গে দুজন রক্ষী। রফিকের হাতে স্টেনগান। তিনি ম্যাগাজিনে গুলি লোড করে নিয়েছেন। সমুদ্রের ধার দিয়ে গাড়ি চলছে। বঙ্গোপসাগর শীতল বাতাস পাঠিয়ে আদর বুলিয়ে দিচ্ছে রফিকদের দেহমনে। ভেতরে-ভেতরে সবাই উত্তেজিত। সবার আগে যেতে হবে ওয়্যারলেস কলোনির দিকে। রাতের অন্ধকার চিরেও দেখা যাচ্ছে ওয়্যারলেসের অ্যানটেনা। এইখানে পশ্চিম পাকিস্তানিরা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি।
তবু ওয়্যারলেস দখল করতে না পারলে যোগাযোগ করা যাবে না। পাকিস্তানিরা জেনে যাবে তাদের পরিকল্পনা।
ওয়্যারলেস কলোনির গেটে পাহারা দিচ্ছে বাঙালি সেন্ট্রি। সে রফিকদের গাড়ি ঢুকতে দিল। মেসে রফিক সাবধানে পা ফেলে গেলেন হায়াতের রুমে। নক করলেন। হ্যালো হায়াত ঘুমিয়েছ?
না স্যার। কেবল একটু শুয়েছি। সে আলো জ্বালাল। বালিশের নিচ থেকে রিভলবার বের করে নিয়ে তার পোশাকের ভেতরে রাখল।
সব ঠিকঠাক আছে তো।
জি স্যার বলে হায়াত দরজা খুলতেই তার বুক বরাবর রফিকের স্টেনগান নল বাড়িয়ে দিল : দুঃখিত হায়াত। তোমাকে গ্রেপ্তার করতে হলো।
হায়াত রিভলবারে হাত দেওয়ার চেষ্টা করতেই তার মাথায় বাড়ি মারলেন। রফিক। বাড়ি মারল ড্রাইভার কালামও। তারপর তার হাত বাঁধা হলো। মুখ বাধা হলো। টেলিফোনের লাইন কেটে দিয়ে পরের অবাঙালি সুবেদারকে গ্রেপ্তার করার অ্যাকশন শুরু হলো।
রফিকের নির্দেশ পেয়ে বিভিন্ন পোস্টের বাঙালি ইপিআর নিজ নিজ এলাকার অবাঙালি অফিসার সোলজারদের নিউট্রালাইজ করা শুরু করে দিল।
রফিকের সিগন্যাল পেয়ে ইপিআর সদস্যরা তাদের অ্যাকশন সুচারুভাবেই সম্পন্ন করতে পেরেছে।
ডা. জাফর, আতাউর রহমান কায়সারদের সঙ্গে এই সব নিয়েই কথা বলছিলেন রফিক।
.
ব্যাঙ্গমা বলে, আর রফিক আফসোস করেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে বাঙালি সৈনিক ও তাগো পরিবারের হাজারো মানুষকে ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা যে নির্মমভাবে হত্যা করল, সেই ঘটনা লইয়া।
ব্যাঙ্গমি বলে, রফিকুল ইসলাম, পরে যিনি বীর উত্তম খেতাব পান, তাঁর বই লক্ষ প্রাণের বিনিময়েতে আফসোস করবেন, দুঃখের সঙ্গে স্মরণ করবেন :
চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে কিন্তু অন্য ঘটনা ঘটে গেল। রাত প্রায় ১১টা ৩০ মিনিটের দিকে ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা তাদের ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এসে ইবিআরসির বাঙালি সৈন্যদের অতর্কিত আক্রমণ করে বসল। প্রথমেই তারা অস্ত্রাগার দখল করে নেয় এবং সেখানে গার্ড ডিউটিতে থাকা বাঙালি সবাইকে হত্যা করে ফেলে। অন্য বাঙালি সৈন্যরা সে সময় ঘুমিয়ে ছিল। অস্ত্রাগার দখলের পর ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা হত্যার পর বীভৎস উন্মাদনায় মেতে উঠল। সেই রাতে তারা ১০০০-এর বেশি বাঙালি সৈন্যকে। হত্যা করে। তারপর তারা বাঙালি সৈন্যদের ফ্যামিলি কোয়ার্টার এলাকায় চলে যায় এবং সেখানে নাগালে পাওয়া সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করে।
এই হত্যাযজ্ঞ থেকে যেসব বাঙালি সৈন্য বাঁচতে পেরেছিল, তারা রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন দিকে পালিয়ে চলে যায়। এদের কয়েকজন আমার হেডকোয়ার্টারে এসে এই লোমহর্ষ ঘটনার সবকিছু বর্ণনা করে। অন্যরা চলে যায় ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এই রেজিমেন্টের অনেক অফিসার এবং সৈন্যের সবাই ছিল বাঙালি।
১৫
২৭ মার্চ ১৯৭১। স্থান পটিয়া থানা। পুলিশ স্টেশন। বেলাল মোহাম্মদ তাঁর তিন সঙ্গী নিয়ে এসেছেন থানায়। বারান্দা পেরিয়ে ওসির রুমে ঢোকা কঠিন। বাইরে পুলিশের পাশাপাশি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানরাও সঙিন হাতে প্রহরারত।
দরজা পেরিয়ে টেবিলের ওপারের মুখটির দিকে তাকালেন বেলাল। ওসির চেয়ারে ইনি কে?
তার মুখের হাসি চওড়া হচ্ছে।
বেলাল বলে উঠলেন, আরে আপনি! বেগম মুশতারী শফীর আপনি মামা হন না!
জি। মুশতারী আমার ভাগনি।
আপনার নাম তো মানিক মিয়া?
জি। আপনারা কী মনে করে?
এখানে বাঙালি মিলিটারির লোকজন এসেছেন। ওনাদের সিনিয়র অফিসার কে আছেন?
মেজর জিয়াউর রহমান।
আছেন উনি?
কেন বলুন তো!
ওনার সঙ্গে একটু দেখা করা দরকার।
আছেন। দেখা করতে চান কেন?
আমরা তো স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার করেছি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি শুনেছি। ভালোই হচ্ছে আপনাদের অনুষ্ঠান। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অনুষ্ঠানটার রেকর্ড নেই আপনাদের কাছে? সেটা বাজান। কাল রাতে তো শুনলাম আবার ১০টার দিকে ইংরেজিতেও একটা আপিল হলো।
অ্যাপিল টু দ্য ম্যানকাইন্ড। বললেন বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে আসা মাহমুদ হোসেন। তিনি হাসছেন। কারণ, গতকাল ২৬ মার্চ রাত ১০টায় তিনিও রেডিও ট্রান্সমিটার দখল করেছিলেন। রিভলবার নিয়ে গিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ারদের বাড়িতে। দুই-দুজন ইঞ্জিনিয়ারকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নিয়ে চলে এসেছিলেন কালুরঘাটে। তারপর নিজেই ৫ মিনিটের একটা ইংরেজি আবেদন সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে তিনি পাঠ করে শোনান, হে পৃথিবীর মানুষ, তোমরা শোনো। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছি। মাহমুদ হোসেন লোকটা বেশ রহস্যময়। দেড়-দুই মাস হলো এসে উঠেছেন আগ্রাবাদ হোটেলে। ফ্রান্সে গানের রেকর্ড বের করেন। হরে কৃষ্ণ নামের একটা লং প্লে রেকর্ড নাকি লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। বাংলা গানের রেকর্ডও বের করেন। চট্টগ্রামে এসেছেন কারখানা গড়বেন বলে। মালামাল আসছে। রেডিওতে প্রায়ই যেতেন। বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে রেডিওর ক্যানটিনে দুপুরে মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতেন। অসহযোগ শুরু হলে তিনি বললেন, বেলাল ভাই, একটা গীতিনকশা লেখেন। মঞ্চে আনি। বেলাল মোহাম্মদ লিখেছিলেন গীতিনাট্য : জয় বাংলা। সেটার রিহার্সাল হলো কয়েক দিন। তার স্ত্রীর নাম নাকি ভাস্করপ্রভা। লন্ডনে পরিচয়। লন্ডনেই বিয়ে। তাঁদের দুটো নাকি সন্তানও আছে। ভাস্করপ্রভার কাকা হলেন ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মোরারজি দেশাই। মাহমুদ হোসেনও চেয়েছেন বিদ্রোহী সেনাদের কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি তার সাহায্য নিয়ে বর্ডার পার হয়ে ভারত চলে যেতে চান। ভারতে গিয়ে তিনি বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে ভারত সরকারের সাহায্য চাইবেন। ভারতের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করে উঠতে পারবেন বলেই তার বিশ্বাস। এই মাহমুদ হোসেনের কাছে বেলাল মোহাম্মদ গাড়ি চেয়েছিলেন পটিয়া থানা পর্যন্ত আসা-যাওয়ার জন্য। মাহমুদ হোসেনই ২৭ মার্চ সকাল সকাল ট্যাক্সি ভাড়া করে মুশতারী লজ থেকে বেলাল মোহাম্মদকে তুলে নিয়ে এসেছেন। তার সঙ্গে লোক ছিল দুজন। বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গেও। ট্যাক্সিতে তাই বড় ঠাসাঠাসি করে আসতে হয়েছে।
বেলাল বললেন, আমাদের কালুরঘাট ট্রান্সমিশন ভবনটা অরক্ষিত পড়ে আছে। এটা পাহারা দেওয়া দরকার। যে কেউ ঢুকে পড়ে ক্ষতি করতে পারে। অ্যাটাক হতে পারে যেকোনো সময়। মেজর সাহেবের কাছে একটু হেল্প চাইতাম।
আচ্ছা আপনারা একটু বসেন। আমি ভেতরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসে জানাচ্ছি।
ওসি সাহেব তার রুম ছেড়ে থানার ভেতরের দিকে ঢুকলেন। একটু পরে এসে বললেন, চলেন আপনারা। দুজন আসেন।
বেলাল মোহাম্মদ আর মাহমুদ হোসেন ভেতরে গেলেন। একটা মাঝারি আকারের রুমে এক পাশে চেয়ার-টেবিলের পাশে বসে আছেন মেজর জিয়া। ইউনিফর্ম পরনে। বোঝাই যাচ্ছে, ঘুম নেই, বিশ্রাম নেই। চোখেমুখে বিশ্রামহীনতার চিহ্ন।
.
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলাবলি করবে :
জিয়াউর রহমানের বয়স তখন ৩৫। বগুড়ার গাবতলী থানার একটা গ্রামে জন্ম। তার বাবা কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিংয়ে কাজ করতেন কেমিস্ট হিসেবে। জিয়া পড়েছেন বগুড়ার গ্রামে, বগুড়া জিলা স্কুলে, ১০ বছর বয়সের পর কলকাতায়। ১৯৪৬-৪৭ দুই বছর কলকাতার স্কুলে পড়ার পর ভারত পাকিস্তান ভাগ হলো। তারা পাকিস্তানে চলে এলেন। তার বাবা মনসুর রহমানের পোস্টিং হলো করাচিতে। জিয়াও ১১ বছর বয়সে ক্লাস সিক্সে। করাচির স্কুলে ভর্তি হলেন। স্কুল-কলেজ সেরে যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। ১৯৫৫ সালে ১৯ বছর বয়সে কমিশনপ্রাপ্ত হন। কাবুলে মিলিটারি একাডেমিতে ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন, ট্রেনিংয়ে জার্মানিতে গেছেন। ১৯৭০ সাল থেকে চট্টগ্রামের ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কাজ করছেন।
২৫ মার্চ রাতে তার ডিউটি পড়েছিল সোয়াত জাহাজের অস্ত্র খালাসে সাহায্য করার। তাঁর কমান্ডিং অফিসার পশ্চিম পাকিস্তানি লে. কর্নেল জানজুয়া তাঁকে ট্রাকে উঠিয়ে দিয়েছেন, রওনা করিয়ে দিয়েছেন বন্দরের দিকে। তাঁর। ড্রাইভার পাকিস্তানি। সঙ্গে আছে আরেক পাকিস্তানি অফিসার। জিয়া বন্দরে পৌঁছাতে পারছিলেন না, কারণ পথে পথে ছিল ছাত্র-জনতার দেওয়া। ব্যারিকেড। আর বন্দরে তার জন্য অপেক্ষা করছেন পশ্চিমা ব্রিগেডিয়ার আনসারি। জিয়ার মনে শঙ্কা, এই ব্রিগেডিয়ার হয়তো তাকে পরপারে পাঠানোর জন্যই অপেক্ষা করছেন। বন্দরে যাওয়ার পথে ব্যারিকেডে থামতে হলো, জিয়া ট্রাকের সামনের আসন থেকে অন্ধকার রাস্তায় নামলেন। বাঙালি জনতা ব্যারিকেড মজবুত করছে, তাদের হাতে লাঠিসোটা, চোখেমুখে। রোষানল, কণ্ঠে স্লোগান–জয় বাংলা। এই ব্যারিকেড অপসারণ করতে গেলে বাঙালি হয়ে বাঙালির বুকে গুলি চালাতে হবে।
একটা গাড়ি এসে থামল সেখানে। গাড়ি থেকে কে নামলেন ওটা? মেজর খালেকুজ্জামান চৌধুরী। তিনি দৌড়ে আসছেন জিয়ার দিকে। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, একটু কথা আছে।
তারা পাকিস্তানিদের কাছ থেকে সরে গেলেন। খালেক বললেন, ক্যাপ্টেন। অলি আহমদের কাছ থেকে মেসেজ এসেছে। ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানিরা হামলা করেছে। বহু বাঙালিকে হত্যা করেছে।
জিয়া শুনলেন। এই শঙ্কাই তাঁরা করছিলেন। অলি আহমদসহ অন্য অফিসারদের সঙ্গে এর আগে গোপনে মিটিংও করে রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ। মুজিবুর রহমান তো বলেই দিয়েছেন, আর যদি একটা গুলি চলে, তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। শেখ মুজিব ৭ মার্চেই গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে রেখেছেন। কাজেই বিদ্রোহ করার এখনই সময়।
জিয়া বললেন, তাহলে আমি আর জাহাজে যাচ্ছি না। আমাদের এখনই বিদ্রোহ করতে হবে। তিনি ট্রাকে ফিরে এসে পাকিস্তানি ড্রাইভারকে বললেন, গাড়ি ঘোরাও। বন্দরে যেতে হবে না। ড্রাইভার আদেশ পালন করল। সঙ্গের পশ্চিমা অফিসারও কিছু আপত্তি করল না। ট্রাক চলল ষোলশহরের ক্যান্টনমেন্টের দিকে। ষোলশহর বাজারে বাঙালি সৈন্যরা জড়ো হয়েছে। এখানে পৌঁছানোমাত্র মেজর জিয়া লাফ দিয়ে ট্রাক থেকে নামলেন। বাঙালি। অফিসার ও জওয়ানরা এগিয়ে এল। জিয়া রাইফেল হাতে নিয়ে পাকিস্তানি অফিসারের বুক বরাবর তুলে বললেন, তোমাকে অ্যারেস্ট করা হলো। জিয়া ও বাঙালি অফিসাররা নৌবাহিনীর পাকিস্তানি ৮ জওয়ানকে নিরস্ত্র করলেন, কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়ার বাড়িতে গিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। পরে লে. কর্নেল জানজুয়াকে জিয়ার সৈন্যরা হত্যা করে।
এই সময় জিয়া চেষ্টা করেন কমান্ডার রফিকের সঙ্গে যোগাযোগের। জিয়া। পরে লিখেছেন, তারা যোগাযোগ করতে পারেননি। আর রফিক লিখেছেন, আওয়ামী লীগ নেতারা জিয়াকে রফিকের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। রফিক চেয়েছিলেন, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা ইবিআরসিতে ছুটে চলে যাক, তাদের পাশে দাঁড়াক, ২০ বালুচ রেজিমেন্টকে আক্রমণ করে ঘুমন্ত বাঙালি জওয়ান ও তাদের পরিবারকে বাঁচাক। তাঁদের তরুণ অফিসাররাও তা-ই করতে চেয়েছিলেন। সিনিয়র অফিসাররা ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া বালুচ রেজিমেন্টকে আক্রমণ করতে যাওয়া আত্মঘাতী হবে বলে সিদ্ধান্ত নেন এবং পটিয়ার দিকে সরে যান।
.
এখন জিয়াউর রহমান পটিয়া থানায় অবস্থান করছেন। বেলাল মোহাম্মদ আর রেডিওর লোকেরা তাঁর সামনে।
বেলাল মোহাম্মদ বললেন, আমরা একটা বেতার চালাচ্ছি। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র।
জিয়া বললেন, হ্যাঁ। কাল রাতে আমি আপনাদের রেডিও শুনেছি। বাংলাটাও শুনেছি। রাত ১০টার দিকে ইংলিশ প্রোগ্রামটাও শুনেছি। হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?
বেলাল বললেন, দুইটা সাহায্য আপনার কাছ থেকে প্রত্যাশা করি। এক. আমাদের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবনটায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। ফোর্স দিতে হবে। দুই, আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন। আপনিও আমাদের বেতারকেন্দ্রে কথা বলুন। আপনার মুখ থেকে কথা শুনলে সেটার একটা আলাদা গুরুত্ব থাকবে। লোকে বুঝবে যে বাঙালি মিলিটারিরা স্বাধীনতার সংগ্রামে যোগ দিয়েছে।
জিয়াউর রহমান একটুক্ষণ ভাবলেন। বললেন, আপনারা দুপুরে খেয়েছেন?
না। খাইনি।
আগে খেয়ে নেন।
আমাদের সঙ্গে আরও মানুষ আছে।
ওনাদের ভেতরে আনেন। খাবার নিতে বলেন।
কক্ষটা বড়সড়ই বলতে হবে। এক পাশে একটা টেবিল। টেবিলের ওপরে নানা রকমের খাবার। পাউরুটি, রুটি, পোলাও, ভাজা মাছ, মুরগির রোস্ট, ডাল। এলাকাবাসী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াইরত সৈনিকদের জন্য যে যা পেরেছে, খাবার দিয়ে যাচ্ছে। একটু পর সৈনিকেরা এই ঘরে আসা যাওয়া করছে। বিভিন্ন জিনিস রেখেও যাচ্ছে।
টেবিল থেকে প্লেটে করে খাবার তুলে নিয়ে দাঁড়িয়েই খেয়ে নিলেন। সবাই। মাহমুদ হোসেন তাঁর কথাটা পাড়লেন জিয়ার কাছে, আমি বর্ডার পার হতে চাই। মোরারজি দেশাই আমার কাকাশ্বশুর। ইন্ডিয়াতে গেলে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করতে পারব। আর্ম অ্যামুনিশেন পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারব।
জিয়া চিন্তিত মুখে বললেন, আর্মস অ্যামুনিশেন আমাদের খুব দরকার।
মাহমুদ বললেন, আপনি আমাকে একটা চিঠি দিয়ে দেন, যাতে রাস্তায় বাঙালি পুলিশ, ইপিআর আমাকে না আটকায়।
জিয়া বললেন, আমার কাছে তো প্যাড নেই, সিল নেই।
মাহমুদ বললেন, আপনি শুধু সাদা কাগজে একটু লিখে দেন। এ আমাদের লোক। একে সাহায্য করো। তারপর আপনার সই। যথেষ্ট হবে।
.
খাওয়ার পর কালুরঘাটের দিকে যাত্রারম্ভ।
সামনে তিন ট্রাক জওয়ান। একটার পর একটা ট্রাক ছাড়ল। একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে।
তারপর জিয়া উঠলেন একটা জিপে। বসলেন ড্রাইভারের পাশের আসনে। ওই গাড়িতে আরও উঠলেন ক্যাপ্টেন অলি আহমদ। পেছনে সেন্ট্রিরা। তার পেছনে ট্যাক্সিতে উঠলেন বেলাল মোহাম্মদ, মাহমুদ হোসেন এবং তাদের দলবল।
গাড়িগুলো চলেছে পটিয়া থেকে কালুরঘাটের দিকে। রাস্তায় মানুষজন চলছে বিপরীত মুখে। শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। নিরাপত্তার সন্ধানে ছুটছে গ্রামের দিকে। কেউবা রিকশায়, কেউবা গরুর গাড়িতে, কেউবা হেঁটে। মাথায় বোঝা, কাঁধে পোটলা, হাতে বড় বড় ব্যাগ, কোলে-কাখে শিশুসন্তান। একটা বছর ছয়েকের ছেলে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে খাঁচায় ভরা পোষা পাখি, একজন। বৃদ্ধা পিঠে নিয়েছে ছাগলছানা।
জিয়াউর রহমান মানুষের জটলা দেখলেই গাড়ি থামাচ্ছেন। মানুষের উদ্দেশে বলছেন, আপনারা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন কেন? আমরা শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করে দেব। ভয়ের কিছু নেই। দুই দিন লাগবে ওদের বিতাড়িত করতে।
কালুরঘাট পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেজে গেল বিকেল ৫টা।
তাঁরা ছোট্ট স্টুডিওতে বসেছেন। জিয়াউর রহমান একটা বক্তব্য লিখলেন : আই, মেজর জিয়া, হেয়ারবাই ডিক্লেয়ার দ্য ইনডিপেনডেনস অব বাংলাদেশ।
বেলাল বললেন, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কথাটা যোগ করা দরকার।
জিয়া বললেন, নিশ্চয়ই। তাই তো করতে হবে। এবার জিনিসটা দাঁড়াল, আই, মেজর জিয়া, হেয়ারবাই ডু ডিক্লেয়ার দ্য ইনডিপেনডেনস অব। বাংলাদেশ অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জয় বাংলা।
তার এই ঘোষণায় পাকিস্তানিদের হাতে থাকা কতগুলো অস্ত্রশস্ত্রের নাম আছে। নামগুলো নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিয়া ক্যাপ্টেন অলি আহমদকে ডেকে নিলেন স্টুডিওর ভেতরে।
বেলাল মোহাম্মদের মনে হলো, এই বক্তব্যটার বাংলা অনুবাদ হওয়া দরকার। অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন আহমদ তখন ট্রান্সমিশন ভবনে। তাঁকে বলা হলো, অনুবাদ করে দিতে। তিনি অনুবাদ করে দিলেন।
জিয়াউর রহমান পাঠ করলেন বিবৃতিটি।
বাংলা অনুবাদও পাঠ করে শোনানো হলো। খবরের সময় বলা হলো, মেজর জিয়া একটি বিবৃতি পাঠ করেছেন। সেই বিবৃতিতে তিনি জানিয়েছেন, মহান জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলো। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই শত্রুকে পরাজিত করা যাবে। দেশ-বিদেশের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র সাহায্য প্রয়োজন। ইত্যাদি…
মাহমুদ হোসেন মেজর জিয়ার কাছ থেকে একটা স্বাক্ষর করা চিরকুট নিলেন। পরিচিতিপত্র ধরনের চিরকুট।
.
ব্যাঙ্গমা বলবে, সেই পরিচয়পত্র কোনো কাজে লাগে নাই। কয় দিন পর সীমান্তের দিকে তিনি যাত্রা করেন। সিআইএর চর সন্দেহে জনতা তারে মাইরা ফালায়। জিয়াউর রহমানের সই তখন তার কোনো কাজে লাগে নাই।
জিয়াউর রহমান এরপর আরও দুই দিন রেডিওতে বিবৃতি দিতে আসেন।
ব্যাঙ্গমি বলে, বেলাল মোহাম্মদ পরে একটা বই লেখেন, সেই বই অনুসারে মেজর জিয়ার প্রথম ঘোষণা গ্রেট ন্যাশনাল লিডার শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। তবে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এ আর মল্লিকের স্মৃতিকথা থাইকা মনে হয়, মেজর জিয়া প্রথম সুযোগেই নিজেরে বাংলাদেশের প্রভিশনাল হেড বা অস্থায়ী প্রধান ঘোষণা করছিলেন। যা-ই হোক, প্রথমে হোক, দ্বিতীয়বারে হোক, জিয়া একবার নিজেরে স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী প্রধান হিসেবে যে ডিক্লেয়ার করছিলেন, এটা সত্য।
জিয়া যখন নিজেরে প্রভিশনাল হেড অব স্বাধীন বাংলা বইলা ঘোষণা দেন, সেইটা প্রচারিত হইলে জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ আর মল্লিক যোগাযোগ করেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নানের লগে। লেখক শিক্ষক আবুল ফজলও আওয়ামী লীগ নেতাগো লগে যোগাযোগ কইরা কন, জিয়া এইটা কী করল! একজন মেজর এই কথা কইলে সেটা কু্য হইয়া যায়, স্বাধীনতা হয় না। দেশে-বিদেশে কেউ এইটারে আর সমর্থন দিবে না।
।আওয়ামী লীগ নেতারা জিয়াউর রহমানের লগে যোগাযোগ কইরা সেই ঘোষণা সংশোধন করতে কন। তখন জিয়া আবার রেডিওতে যাইয়া মহান জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশেই সব হইতাছে এই মর্মে কথিকা পাঠ করেন। তিনি ইয়াহিয়া খানের ২৬ মার্চের ভাষণের সমালোচনা করেন। দেশের মানুষের নির্বাচিত মেজরিটি পার্টি কী কইরা দেশের শত্রু হয়, এই প্রশ্ন তোলেন। বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানান বাংলাদেশের পাশে আইসা দাঁড়াইতে।
আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। জয় বাংলা বইলা তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন।
ব্যাঙ্গমি বলে, ইংরেজি বিবৃতিটা ইউটিউবে আছে, যে কেউ শুইনা দেখতে পারেন। বিভিন্ন বইপত্রেও আছে।
ব্যাঙ্গমা বলে, জিয়া ফাইনালি কইছিলেন :
I, Major Zia, on behalf of our great Leader, the Supreme Commander of Bangladesh, Sheikh Mujibur Rahman, do hereby proclaim the independence of Bangla Desh and that the government headed by Sheikh Mujibur Rahman has already been formed.
It is further proclaimed that Sheikh Mujibur Rahman is the sole leader of the elected representatives of 75 million people of Bangla Desh and the government headed by him is the only legitimate government of the people of the independent sovereign state of Bangla Desh, which is legally and constitutionally formed and is worthy of being recognised by all the governments of the world.
I, therefore, appeal on behalf of our great Leader Sheikh Mujibur Rahman to the governments of all the democratic countries of the world, especially the Big Powers and the neighbouring countries, to recognise the legal government of Bangla Desh and take effective steps to stop immediately the awful genocide that has been carried on by the army of occupation from Pakistan.
To dub us, the elected representatives of the majority of the people, as secessionists, is a cruel joke and should befool none.
The guiding principle of the new state will be, first, neutrality; second, peace; third, friendship to all and enmity to none.
May Allah help us.
Joi Bangla!
ব্যাঙ্গমা বলে, আনিসুজ্জামান পরে আমার একাত্তর বইয়ে (সাহিত্যপ্রকাশ) লেখবেন :
২৭ মার্চ জানা গেল, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। আমি নিজে অবশ্য সে ঘোষণা শুনিনি, তবে ক্যাম্পাসের অনেকেই শুনেছিলেন। এ সংবাদে আমরা সবাই খুব উল্লসিত হলাম, প্রেরণা ও ভরসা লাভ করলাম। ড. মল্লিক অবশ্য বললেন যে, মেজর জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করেছেন–এতে দেশ বিদেশে ভুল-বোঝাবুঝি হবে। তিনি অনেক কষ্টে হান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে কথাটা বলেন। তখই জানা যায় যে, চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া হয়েছে। পরে শুনতে পাই যে, সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ কে খান একটা নতুন খসড়া রচনা করে দেন এবং মেজর জিয়া তা বেতারে পাঠ করেন ২৮ মার্চে। এই ভাষণে জিয়া বলেছিলেন যে, তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে। এই ঘোষণাটি বেতারে আমি শুনেছিলাম।
১৬
২৭ মার্চের সকালে আমীর-উল ইসলাম তাজউদ্দীন আহমদকে বললেন, বাইরে তো দেখা যাচ্ছে লোকজন একটু একটু করে বের হচ্ছে। বস্তির লোকজন কলসি-বালতি নিয়ে পানি আনতে যাচ্ছে কলতলায়।
তাজউদ্দীন আহমদ জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। বললেন, জীবন তো আর থেমে থাকে না। পানি না থাকলে পানি আনতে যেতেই হবে। সে কারফিউ থাকুক আর না থাকুক।
আমীর-উল ইসলাম ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় গেলেন। আরেকটু বাইরের দিকে উঁকি দিলেন। বললেন, রাস্তায় তো দেখা যাচ্ছে দোকানও বসেছে দু-একটা। লোকজন কেনাকাটাও করছে।
গফুর সাহেব বললেন, বাসায় তো কোনো খাবারও নাই। আজকে আমরাই-বা খাব কী!
আমীর বললেন, আচ্ছা, আমি একটু বাইরে থেকে পরিস্থিতিটা বুঝে আসি। আমীর মাথায় একটা টুপি চাপালেন। তারপর গেটটা খুলে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন।
বাতাসে পোড়া ছাইয়ের গন্ধ, বারুদের গন্ধ। তবু ফুটপাতের ওপরে একটা গাছে নতুন সবুজ পাতা যেন জীবনের প্রতীক হয়ে একটু একটু করে মাথা ঝাঁকাচ্ছে।
বাড়ির সামনে একজন টুপি-দাড়িওয়ালা পাঞ্জাবি পরা প্রবীণ মানুষকে পাওয়া গেল।
আমীর ভাবলেন, গলি ছেড়ে বড় রাস্তায় যাওয়ার আগে এই চাচার কাছেই শুনে নিই না কেন পরিস্থিতিটা কী! বললেন, আসোলামু আলাইকুম, চাচা!
ওয়ালাইকুম আসোলাম।
চাচা কি আশপাশেই থাকেন?
জি বাবা!
পরিস্থিতি কী বুঝছেন?
না বাবা। বুঝতেছি না। কারফিউ তো চলতেছে। দুই দিন যা গজব গেল, বাড়িঘর পোড়ায়া দিছে, গোলাগুলি…আল্লাহ মাবুদ জানে বাবা। বাবা আপনাকে তো চিনলাম না।
আমীর মুশকিলে পড়লেন। তিনি নাম নিয়েছেন রহমত আলী। বাড়ি পাবনা। তা-ই তাঁকে বলতে হলো। আমার নাম রহমত আলী। আমি এই এলাকার রাস্তাঘাট কিছু চিনি না। পাবনা থেকে এসেছি।
আমার বাড়িও তো বাবা পাবনা।
এই এলাকায় তো অনেক দিন ধরে আছেন।
জি বাবা। নিজের বাড়ি।
আপনি কি এই এলাকায় কুষ্টিয়ার আতাউল হককে চেনেন?
চিনি তো।
কোন বাসা? অনেক দূরে, নাকি কাছে?
না, বেশি দূরে না।
আমাকে একটু বাড়িটা দেখায় দিতে পারবেন?
জি বাবা, পারব। আপনি আমার জেলার মানুষ। চলেন।
আমীর ভাবছেন এখন পাবনা জেলার বিশদ বিবরণ জিজ্ঞাসা করা শুরু হলে তো তিনি মুশকিলে পড়বেন। পাবনার সুজানগর ছাড়া আর কোনো এলাকাই তো তিনি চেনেন না। কাজেই চাচা মিয়াকে বরং প্রশ্নের মধ্যে রাখা ভালো!
কী বুঝছেন চাচা, বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন?
কিছু বুঝতেছি না বাবা। ইয়াহিয়া খান তো বলে দিয়েছে তার বিচার করবে।
হ্যাঁ। তা-ই তো বলল। কিন্তু বিচারের নামে এগুলো কী হলো? এত গোলাগুলি এত আগুন।
এইটা অবিচার বাবা। আল্লাহ তাআলা সহ্য করবেন না।
আতাউল হক সাহেবের বাড়ি পাওয়া গেল। টিনে ছাওয়া বাড়ি। অর্ধেক ইটের দেয়াল। তার ওপরে আবার টিনের বেড়া অর্ধেক। দরজায় কড়া নাড়া হলে আতাউল হক বেরিয়ে এলেন। আরে ভাই, কোথা থেকে এই বিপদের মধ্যে?
আর বলবেন না। আমীর-উল ইসলাম চোখ টিপলেন। মুসল্লি মুরব্বিকে বললেন, চাচা, এক মিনিট। আমি ভেতর থেকে একটু ভাবিকে সালাম করে আসছি।
ভেতরে গিয়ে আমীর-উল বললেন, ওই চাচাকে রাস্তায় পেয়েছি। আপনার বাড়ি চেনেন কি না জিজ্ঞেস করলাম, বললেন চেনেন। তাই তাঁকে। এনেছি। তাকে বলেছি আমার নাম রহমত আলী।
এদিকে ততক্ষণে আতাউল হকের স্ত্রীও সামনে এসে হাজির।
আমীর বললেন, আমার সঙ্গে তাজউদ্দীন সাহেব আছেন। আমরা যে বাড়িটায় রাতে ছিলাম, সেটা থেকে ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার সরাসরি দেখা যায়। ওই বাড়ি আমাদের জন্য নিরাপদ না। আর পরশু রাতে যখন উঠি, তখন অনেকেই দেখেছে যে আমরা ওই বাড়িতে আছি। যে কেউ জেরার মুখে এই বাড়ি দেখিয়ে দেবে।
আতাউল হক বললেন, ওনাকে নিয়ে আসেন।
আচ্ছা চাচাকে বলি ওনাকে আনতে। আমীর বাসা থেকে বেরিয়ে প্রবীণ মানুষটাকে বললেন, চাচা, দয়া করে একটা কাজ করবেন? আমরা যে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, ওই বাড়িতে মোহাম্মদ আলী নামের একজন আছেন। তাঁকে গিয়ে বলবেন, রহমত আলী আপনাকে সবকিছু নিয়ে এই বাড়িতে আসতে বলেছে। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন।
আমীর তাকে পাঠিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। তাজউদ্দীন সাহেব একজন। অপরিচিত লোকের সঙ্গে আসবেন তো!
পনেরো মিনিটের মধ্যে দেখা গেল লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, টুপি পরা তাজউদ্দীন সাহেব আসছেন। প্রবীণ মুসল্লি ভদ্রলোককে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে তারা এই বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন। হক সাহেবের স্ত্রী তাদের জন্য নাশতা বানাতে লেগে পড়লেন।
তখনো কারফিউ চলছে। বাড়ির ওই প্রান্তে বস্তি। আরেক পাশে মসজিদ। হঠাৎ হইচই। কয়েকজন লোককে দেখা গেল, মুখ রুমালে ঢেকে মাথায় খাকি রঙের পট্টি বেঁধে বস্তিগুলোতে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন দিচ্ছে। নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে আসছে। তখনই শুরু হলো মেশিনগানের অবিশ্রান্ত গুলি।
তাজউদ্দীন, আমীর, আতাউল হক, তার স্ত্রী মেঝেতে শুয়ে পড়লেন। আগুন, গুলি থেকে যে মানুষেরা বাঁচতে পেরেছে, তারা কেউ মসজিদের ভেতরে, কেউ এই বাড়ির পাঁচ ইঞ্চি দেয়ালের পাশে শুয়ে পড়ল। চারদিকে আর্তনাদ, গুলির শব্দ, মানুষের মরণচিৎকার, কান্না…
তাজউদ্দীনদের মাথার ওপর দিয়ে টিনের বেড়া ফুটো করে গুলি বেরিয়ে যেতে লাগল। স্বাধীনতা বড় বেশি দাম চাইছে। কত মৃত্যু, কত রক্ত, কত লাশ মুক্তির সোপানতলে উৎসর্গিত হলে তবে আসবে স্বাধীনতা? তাজউদ্দীন ভাবছেন।
একটু পর গোলাগুলির শব্দ কমে এল। কমে এল আগুনের আঁচ।
আমীর বললেন, এই বাড়িটার মধ্যে থাকলে যেকোনো সময় গুলি লাগবে। আমি পাশের বাড়ির ভেতরে ঢুকব।
আতাউল হক বললেন, পাশের বাড়ির চাবি কিন্তু আমার কাছে আছে! যাবেন? বাড়ির পেছনের দেয়াল টপকালেই হবে।
আমীর বললেন, যাব।
তাজউদ্দীন বললেন, আপনি যেতে পারেন। আমি আর এখান থেকে নড়ছি না।
একটু পরে অনেকটাই নীরবতা নেমে এল। আতাউল হক সাহেবের রেডিওতে ঘোষণা এল, কারফিউ বিকেল ৪টা পর্যন্ত শিথিল।
আমীর-উল ইসলাম এই বাড়িতে ফিরে এলেন। তাজউদ্দীন বললেন, চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক।
তাঁরা বের হলেন। তাজউদ্দীন রাইফেলটা আর সঙ্গে নিলেন না। রিভলবার নিলেন পাঞ্জাবির ভেতরের লুকানো পকেটে। মাথায় টুপি, পরনে লুঙ্গি, গায়ে পাঞ্জাবি, হাতে বাজারের থলে। বের হয়ে প্রথম কাজ হবে সাতমসজিদ রোডটা পার হওয়া। এই রাস্তা দিয়ে মিলিটারি জিপ, ট্রাক যাতায়াত করছে। সেসব যানের সামনে মেশিনগান বসানো।
তাঁরা বের হয়ে এগোচ্ছেন। বড় রাস্তায় আর্মির ট্রাক দেখা গেল। একটা মসজিদে ঢুকে পড়লেন তারা। তবু নিজেকে নিরাপদ মনে হলো না। মনে হলো, মসজিদে অবাঙালি লোক বেশি।
আবার বের হলেন। একটা গলির মুখে আশ্রয় নিলেন। এরই মধ্যে একজন-দুজন করে ছাত্র চলে এসেছে সেই গলির মুখে। তারাও বড় রাস্তায় কী ঘটছে, সে ব্যাপারে কৌতূহলী। আর কী করা কর্তব্য, তা-ও জানতে চায়। তারা অনেকেই টের পেয়ে গেল যে এখানেই তাজউদ্দীন আছেন। তারা এসে এসে খবর দিতে লাগল, কোথায় কী ঘটেছে।
তাজউদ্দীন বললেন, রহমত আলী সাহেব, যে করেই হোক, সাতমসজিদ রোডটা পার হতে হবে। চলুন।
আমীর বললেন, জি চলুন।
একজন ছাত্র আগে আগে গেল।
তাঁরা সাতমসজিদ রোডে উঠতেই দূরে দেখা গেল একটা মিলিটারি গাড়ি। রাস্তার ওপরে প্রথম যে বাড়িটার গেট, সেটা খুলে তাঁরা ভেতরে ঢুকে
পড়লেন।
আমীর বললেন, এই বাড়ির লোক যদি জিজ্ঞেস করে, কেন তাদের বাড়ি এসেছি, কী বলব?
তাজউদ্দীন বললেন, বলব যে একটা টেলিফোন করতে পারি কি? খুব জরুরি একটা কল করা দরকার।
মিলিটারি গাড়ি চলে গেল। তারা আবার বেরোলেন। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দৌড়ে পার হয়ে গেলেন বিপজ্জনক সড়কটি। তারপর আরও খানিকটা হাঁটতে হবে। একটা গলিতে ঢুকে পড়তে পারলে পরে রায়েরবাজারের রাস্তা ধরা যাবে। তাঁরা ধানমন্ডি ১৯-এ ঢুকে পড়লেন।
তাজউদ্দীন বললেন, আমাদের বাসায় একবার যাব নাকি? লিলি কেমন আছে, সোহেল, মিমি কেমন আছে, একটু জেনে যাওয়া যায়। আর বিদায়ও তো নিতে হবে।
আমীর বললেন, এর চেয়ে বড় আত্মঘাতী কাজ আর দ্বিতীয়টা হবে।
আপনি তাই মনে করেন?
হ্যাঁ। ইয়াহিয়া খান ভাষণে বললেন যে পাকিস্তানের এক নম্বর শত্রু হলো শেখ মুজিব আর আওয়ামী লীগ। শেখ সাহেবের পরে আওয়ামী লীগের এক নম্বর ব্যক্তি কে? তাঁর বাড়িতে আর্মি, পুলিশ, গোয়েন্দা, টিকটিকি থাকবে না, এটা হয়!
শংকর হয়ে হেঁটে হেঁটে তারা পৌঁছে গেলেন রায়েরবাজার। হাঁটা তাজউদ্দীনের অভ্যাস আছে। ছোটবেলা থেকেই বহু পথ হেঁটেই তাঁরা চলাচল করেছেন। আর রাজনীতি করতে গিয়ে হাঁটতে হয়েছে মাইলের পর মাইল। নির্বাচনের সময় তো কথাই নেই। দুয়ারে দুয়ারে গেছেন হেঁটে হেঁটে। ইদানীং একটু ডায়াবেটিসের সমস্যাও হচ্ছে। তাই ডাক্তারের পরামর্শে যখনই সুযোগ পান, হাঁটেন। মুজিব ভাইয়ের বাড়িতে যাওয়া-আসা প্রায়ই হেঁটেই সারার চেষ্টা করেন।
রায়েরবাজার খানিকটা স্বাভাবিক। এখানে মিলিটারি ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন নেই।
তবে পথে সর্বত্র এক দৃশ্য। মানুষজন দলে দলে ছুটে যাচ্ছে গ্রামের দিকে। পালাচ্ছে উধ্বশ্বাসে। পরিবার-পরিজন, বাক্সপেটরা নিয়ে ছুটছে তারা। তাদের চোখেমুখে ভয়, অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক।
তাজউদ্দীনকে চিনতে পারলেন এলাকার নেতা-কর্মীরা। তাঁরা তাঁদের নিয়ে গেলেন রায়েরবাজার সংগ্রাম পরিষদ অফিসে। অফিসের সামনে রাইফেল হাতে একজন কর্মী পাহারা দিচ্ছে।
তারা তাদের বসতে দিল। নাশতা এনে খেতে দিল। তাজউদ্দীন এই সাহসী মানুষগুলোকে বাস্তব পরিস্থিতি কী করে বলবেন?
একজনকে তিনি ভেতরে নিয়ে গেলেন। বললেন, শোনো। একজন। একটা রাইফেল দিয়ে সেনাবাহিনীর ট্যাংক, কামান, মেশিনগানের বিরুদ্ধে লড়তে পারবে না। সবাই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাও। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা কে কোথায় আছে, তাদের সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলো। তারপর গেরিলা কায়দায় হঠাৎ হঠাৎ করে মিলিটারির ওপরে আক্রমণ করে আবার জনগণের মধ্যে লুকিয়ে পড়তে হবে। আগে পরিস্থিতি দেখো। ওই রাইফেলধারী কর্মীকে সরে যেতে বলো।
তাদের পায়ে হাঁটার উপযোগী জুতা নেই।
ছেলেরা বলল, আপনাদের কী লাগবে, বলেন?
তাজউদ্দীন বললেন, দুইজনকে দুই জোড়া শক্তপোক্ত স্যান্ডেল শু এনে দিতে যদি পারো, খুব ভালো হয়। ছেলেরা ছুটল স্যান্ডেল শুর খোঁজে।
আমীর বললেন, কাগজ-কলম দাও। একটা জরুরি চিঠি লিখতে হবে। তাজউদ্দীন বললেন, আমাকেও লিখতে হবে।
কাগজ-কলম চলে এল। নেতাদের কাজে লাগতে পেরে কর্মীরা নিজেদের ধন্য মনে করছে।
তাজউদ্দীন আর আমীর দুজনেই দুটো চিরকুট লিখতে বসলেন।
তাজউদ্দীন লিখলেন :
লিলি, আমি চলে গেলাম। আসার সময় কিছু বলে আসতে পারিনি। মাফ করে দিয়ো। আবার কবে দেখা হবে জানি না…মুক্তির পর। তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে মিশে যেয়ো।–দোলনচাঁপা।
একটুখানি আবেগে যেন কেঁপে উঠল তাজউদ্দীনের হৃদয়। দোলনচাঁপা মানে কেউ না বুঝুক, লিলি ঠিকই বুঝবেন।
আমীর-উল ইসলাম লিখলেন লীলার উদ্দেশে। লীলার গর্ভে বেড়ে উঠছে তাঁদের সন্তান। আর তিনি বেরিয়ে পড়েছেন অজানার উদ্দেশে। তিনি জানেন না, তিনি আর ফিরবেন কি না। আমীর-উল লিখলেন :
প্রিয় লীলা,
আমি চলে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি, কবে ফিরব কিছুই জানি না। শুধু জানি, একটা শোষণমুক্ত, শৃঙ্খলমুক্ত, পরাধীনতার নিগড়মুক্ত সুন্দর একটা রাজ্যের স্বপ্ন নিয়ে যাচ্ছি। তুমি ভালো থেকো। সাবধানে থেকো। কোলজুড়ে আসুক আমাদের অনাগত নতুন প্রজন্ম। তার জন্যই তো চাই মুক্ত একটা স্বদেশ।
ইতি তোমারই…
.
ব্যাঙ্গমা বলে, তাজউদ্দীনের চিরকুটটা পৌঁছাইছিল লিলির কাছে। আমীর-উল ইসলামের চিঠিটা লীলার কাছে পৌঁছায় নাই।
.
দুজনই চিরকুট ভাঁজ করে ঠিকানা লিখে দিলেন কাগজের ওপর পিঠে। বিশ্বস্ত কর্মী স্থানীয় নেতা নাসরুল্লা দায়িত্ব নিল সুবিধামতো ঠিকঠাক ঠিকানায় চিরকুট দুটো পৌঁছানোর।
ততক্ষণে তাদের জন্য দুই জোড়া স্যান্ডেল শু এসে গেছে। পায়ে চমৎকার জুতে গেল। পায়ে ব্যথাও লাগছে না, আবার মনে হচ্ছে, সহজে ছিঁড়বে না।
.
ব্যাঙ্গমা বলল, তাজউদ্দীন সেই স্যান্ডেল ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশেও পরতেন।
ব্যাঙ্গমি বলল, জয় বাংলার জুতা তো। সহজে ছিঁড়ে না।
এবার সবার কাছ থেকে বিদায় নিলেন তারা। একজন মাত্র কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দীন আর আমীর গেলেন খেয়াঘাটে। ছোট্ট একটা নদী। কিন্তু নদী তো। পার হওয়া যাবে কী করে? শত শত মানুষ নদী পার হয়ে যাচ্ছে। ঘাটে অপেক্ষা করছে অনেকে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী রেজার চাচা নৌকা নিয়ে এলেন ঘাটে। সেটাতে রেজা তুলে দিল তাজউদ্দীন আর আমীরকে। আরও লোকজন উঠল। নৌকা চলছে। আকাশে একখণ্ড কালো মেঘ বড় আকার নিচ্ছে। তবে সূর্যও প্রখর। মনে হয় ঝড়বৃষ্টি হবে। তাজউদ্দীন একবার নদীর দিকে, একবার আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর তাকালেন তীরের মানুষগুলোর মুখে। তাকালেন তাঁদের সঙ্গে নৌকায় ওঠা নারী-পুরুষ, শিশুদের দিকে। গরিব মানুষ। পুষ্টিহীন মানুষ। ভাঙাচোরা মুখ। তাদের সম্পদ বলতেও কিছু নেই। সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে কাপড়ের পোঁটলা। হাঁড়িকুড়ি। হাঁস-মুরগি। একজনের কোলে একটা ছাগল। এই মানুষগুলো দুই দিন ধরে ছিল আর্মির প্রধান নিশানা। নির্বিচার বস্তিতে বস্তিতে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন দিয়ে গুলি করা হয়েছে। তাদের অপরাধ, তারা স্বাধীনতা চেয়েছিল। তাদের অপরাধ, তারা মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল।
তাজউদ্দীন পানির দিকে তাকালেন। জলের পোকা পানিতে একটা অপূর্ব নকশা আঁকছে। কালো জলে আকাশের ছায়া পড়েছে। মুজিব ভাইয়ের মুখটা কেন যেন মনে পড়ছে তার।
নৌকা নদীর অপর পারে ভিড়ল। নতুন পাওয়া স্যান্ডেল হাতে ধরে তাজউদ্দীন নামলেন কাদাভরা ঘাটে। মানুষের পা পড়ে পড়ে ঘাট কর্দমাক্ত হয়ে পড়েছে। মানুষের সারি চলেছে ঘাট থেকে। গ্রামে হাটের দিনে সাধারণত এই দৃশ্য দেখা যায়।
নদীর পারে আঁটির বাজার। বাজারে পৌঁছাতেই মানুষজন ঘিরে ধরল তাজউদ্দীন আর আমীর-উলকে। তাজউদ্দীনের পূর্বপরিচিত কর্মী সিরাজ এগিয়ে এলেন, তাজউদ্দীন ভাই, ঢাকার খবর কী? বঙ্গবন্ধু কুনহানে? আমরা অহন কী করুম? কত প্রশ্ন সিরাজের! তাঁর এলোমেলো চুলের নিচে কোটরাগত চোখ দুটোর উজ্জ্বল তারা থেকে, তার সাদা হাওয়াই শার্টের গোটা হাতার নিচের পেশল হাতের প্রান্তে দুটো পাঞ্জা থেকে কত যে প্রশ্ন ঝরে পড়ছে!
তাজউদ্দীন কী উত্তর দেবেন। কী উত্তরই-বা আছে তাঁর কাছে।
সিরাজ বললেন, একটা মিনিট খাড়ান। আমি একটু বাড়িত থাইকা আইতাছি। সিরাজ দৌড়াতে লাগলেন। তার চেক লুঙ্গিটা ভাজ করে হাঁটুর ওপরে তুলে তিনি পাড়ি দিচ্ছেন কলাইয়ের খেত।
সিরাজ ফিরে এলেন। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখের তারা আরও উজ্জ্বল। তিনি দুটো ৫০ টাকার নোট বের করে তাজউদ্দীনের হাতে দিলেন।
এইটা একটু রাখতে হইব, না করবার পারবেন না।
আরে কী বলো।
আপনে কই না কই যাইতাছেন। পকেটে টাকা লওনের টাইম পাইছেন। নাকি পান নাই! ঢাকায় মানুষ মাইরা সাফ করছে, সেইটা তো আমরা জানি। নদী দিয়া লাশ ভাইসা যাইতাছে। আপনে এইটা লন। এইটা আমার জয় বাংলা ফান্ডে আমি দিলাম। কিন্তু এই টাকা আপনে পথে খরচ করবেন। গাড়িগুড়ি ভাড়া করবেন। হাইটা আর কত দূর যাইবেন। লন।
আমীর আর তাজউদ্দীনের বড় মায়া বোধ হয়। পথে পথে এই দৃশ্য। গ্রামের মানুষ সব শহরের মানুষদের বরণ করে নেওয়ার জন্য, সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা চিড়া, মুড়ি, গুড়, পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতপাখা এনে বাতাস করছেন। আহা আমার সোনার বাংলা! ভায়ের-মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ!
সিরাজ একটা মোটরবাইক জোগাড় করে ফেললেন। তারপর বললেন, এই ফিফটি হোন্ডায় তো তিনজন টানতে পারব না। এক কাজ করি। প্রথম তাজউদ্দীন ভাইরে লই। একটান দিয়া লইয়া যামু মতিউর রহমান ভাইয়ের বাড়ি। তারপর তাঁরে ওইখানে রাখুম। হাত-পা ধুইয়া চা-পানি খাইতে খাইতে আরেকটান দিয়া লইয়া যামু ব্যারিস্টার সাবরে।
তাই করতে শুরু করলেন সিরাজ। মোটরসাইকেলের পেছনে। তাজউদ্দীনকে বসিয়ে ভটভট আওয়াজ তুলে চললেন তিনি। লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় হোন্ডায় চড়া কঠিন–এটা আবিষ্কার করলেন তাজউদ্দীন। কিন্তু সিরাজও তো লুঙ্গি পরা। তার তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না!
সিরাজ তাজউদ্দীনকে নামালেন একটা পাটখড়ির বেড়া দেওয়া ঘরের সামনে। চালের ওপরে গাছগাছালি। একটা কামরাঙাগাছের নিচে হলুদ পাতা পড়ে আছে। উঠোনে মোরগ-মুরগি চরছে।
মতিউর এগিয়ে এলেন। সিরাজ বললেন, মতিউর ভাই, চিনছেন তো ভাইরে। তাজউদ্দীন ভাই। আরে আমগো নেতা তাজউদ্দীন ভাই।
মতিউর রহমানের চোখে চশমা। তিনি চশমাটা ঠিকঠাকভাবে নাকে বসিয়ে নিয়ে পানের পিক ফেলে তাকিয়ে বললেন, চিনুম না ক্যান, চিনছি ঠিকই, বিশ্বাস করতে পারি নাই, এত বড় নেতা… এই চেয়ার আন। পানি দে। আপনে বসেন…
সিরাজ বললেন, আমি ব্যারিস্টার সাবরে আনতে গেলাম।
তাজউদ্দীন বললেন, আচ্ছা। যাও তুমি তাড়াতাড়ি। আমি এইখানে একটু বসি। ছায়াঘেরা জায়গাটা বড় শান্তির বলে মনে হচ্ছে।
বাড়ির দাওয়ায় একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসলেন তাজউদ্দীন।
বাড়িতে দৌড়াদৌড়ি শুরু হলো। হাতলওয়ালা সেগুন কাঠের চেয়ার এল। কাঁসার বদনায় পানি। ধোয়া গামছা।
একটু একটু করে ভিড় হচ্ছে। এর মধ্যে হঠাৎ করে দেখা হয়ে গেল রুস্তমের সঙ্গে।
তাজউদ্দীনই চিনতে পারলেন আগে, আরে রুস্তম, তুমি!
আপনে আসছেন শুইনা চইলা আসলাম।
রুস্তম বাবুবাজারের পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল।
সে বলল, স্যার। কী কমু স্যার। হায়াত আছে বইলা আমি বাইচা পলায়া আসছি। আমগো ফড়ির আর কেউ বাইচা নাই স্যার।
কী বলো?
২৫ তারিখ রাইতে স্যার আমরা ফাঁড়িতে ঘুমায়া আছিলাম। লুঙ্গি পইরা। খালি গাও। যে গরম! এর মধ্যে কোথাইকা আজরাইলের মতন মিলিটারি আসল। দরজা ভাইঙ্গা ঢুইকাই স্ট্রেট ব্রাশফায়ার। মেশিনগানের গুলিতে সক্কলে ওই বিছানাতেই মইরা শ্যাষ। ফাড়ির ডিউটিতে যারা আছিল, তারা ইউনিফর্ম লইয়াই কেউ টেবিলে উপুড় হইয়া পইড়া মইরা আছে, কেউ মাটিত মইরা পইড়া আছে। একজন তো থানার মধ্যে ওয়ালের সাথে গুলিতে গাইথা আছে। আমি মরার ভান কইরা পইড়া থাকলাম। রক্ত আমার উপর দিয়া ভাইসা যাইতে লাগল। মানুষের রক্ত স্যার সেই রকম গরম! মিলিটারি চইলা গেলে কোনোরকমে উইঠা নদীতে ঝাঁপায়া পড়লাম। সাঁতরায়া নদী পার হইয়া বাইচা আইছি।
তাজউদ্দীন স্তব্ধ। তাজউদ্দীন মর্মাহত। এটা কোন ধরনের আচরণ? এটা কোন ধরনের পাশবিকতা? হিটলার কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের ওপর এই রকম নিষ্ঠুরতার বুলডোজার চালাতে পেরেছিল?
আমীরকে নিয়ে সিরাজের মোটরসাইকেল এসে গেল শব্দ আর ধুলো ছড়াতে ছড়াতে।
তাজউদ্দীন বললেন, ব্যারিস্টার সাহেব। রুস্তমের কাছ থেকে শুনুন তার বেঁচে ফিরে আসার কাহিনি। এইভাবে কেউ ঘুমন্ত মানুষকে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলতে পারে?
.
বিকেল নেমে আসছে। বাড়ির পাশে একটা সুন্দর পুকুর। টলটল করছে জল। কতগুলো হাঁস পানিতে সারবদ্ধভাবে সাঁতার কাটছে। পানি দেখে তাজউদ্দীন আর স্থির থাকতে পারলেন না। বললেন, আমি গোসল করব।
মতিউর সাহেব বললেন, আমি ধোয়া লুঙ্গি আইনা দিতাছি। আপনে নামেন পুকুরে।
তাজউদ্দীন পুকুরের শীতল জলে ডুব দিয়ে নিজের ক্লান্তি, উদ্বেগ, রাগ, ক্ষোভ, হতাশা ধুয়ে ফেলতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু মানবতার এই অবমাননার অবসান ঘটবে কী করে? এই অপমানের এই লাঞ্ছনার শোধ নেওয়া যাবে কীভাবে?
আমীর গোসল সারলেন তোলা পানিতে। হারিকেনের আলোয় রাতের খাওয়া সেরে তাঁরা পাটখড়ির বেড়ার ঘরে বড় চকিতে চাদর পেতে শুয়ে পড়লেন।
ভোরবেলা আলো ফোঁটার আগেই বাইরে মোটরবাইকের শব্দ পাওয়া গেল। আবদুল আজিজ মণ্ডল মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছেন। এই মোটরসাইকেলটার পাওয়ার বেশি। এটাতে একসঙ্গে তিনজন ওঠা যাবে। ভোরের বাতাস চিরে মোটরসাইকেলে চলতে গিয়ে চোখেমুখে বাতাসের স্পর্শ অনুভব করলেন তাজউদ্দীন। বোধ হয় কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। ক্যালেন্ডারে দিনটা ২৮ মার্চ ১৯৭১।
.
ব্যাঙ্গমা বলে, মোটরসাইকেল দুইজনরে লইয়া গেল দোহারের এমপিএ সুবেদ আলী টিপুর বাড়ি।
ব্যাঙ্গমি বলে, তারপর আবার মোটরসাইকেলে উইঠা তাঁরা গেলেন জয়পাড়া। আশরাফ আলী চৌধুরীর দোতলা কাঠের বাড়িতে খানিকক্ষণ জিরাইলেন। গরুর গরম দুধ খাইলেন। স্কুলের পিয়ন মোটরসাইকেলের পেছনে চড়ায়া তাগো লয়া গেলেন পদ্মা নদীর পাড়।
ব্যাঙ্গমা বলে, যখন তারা নদীর তীরে আইলেন, তখন আকাশ ঘন কালো। জোরে বাতাস বইতাছে। বিকেলেই সাঁঝবেলা হইয়া আইল। শুরু হইল বাতাসের দাপাদাপি।
এ মাঝি যাইবা নাকি?
কুনো মাঝি রাজি হয় না।
শেষে তারা উঠলেন একটা তাঁতি পরিবারে। শুকুর মিয়ার বাড়িতে রাতে থাকলেন দুইজন। টিউবওয়েলের পানিতে গোসল সারলেন।
২৯ মার্চ আবার সকাল সকাল হেরা দুইজন ঘাটে গিয়া হাজির। এইবার শক্তপোক্ত নৌকা বাইছা লওয়া হইল। মাঝি আল্লাহর নামে উত্তাল পদ্মার বুক চিইড়া নৌকা ছাড়ল। বইঠা বায়। পাল উড়ায়। হাল ধইরা থাকে। নৌকা ধীরে ধীরে আউগায়। যেইখানে ঢেউ বেশি সেইখানে দোল খায়। যেইখানে পাক বেশি সেইখানে মাঝি শক্ত কইরা হাল ধইরা থাকে। নদীর পানিতে সকালবেলার আলো পইড়া সদ্য ধার দেওয়া ছুরির মতন ঝলকানি ওঠে। তিন। ঘণ্টা পর নৌকা নদীর পশ্চিম পাড়ে নাড়ারটেক ঘাটে ভিড়ে।
ঘাটে নাইমা তারা আওয়ামী লীগ কর্মী গো দেখা পাইলেন।
তারা জানাইল মিলিটারি অহনও ফরিদপুর আহে নাই। তয় আইতে কতক্ষণ। আর যদি আহে, এই ঘাট দিয়াই আইব।
তাড়াতাড়ি ফরিদপুর শহর চইলা যান। কর্মীরা পরামর্শ দিল।
তয় যাওনের কোনো উপায় নাই। একমাত্র উপায় হইল ঘোড়ায় চইড়া যাওয়া।
তখন আমীর একখান আর তাজউদ্দীন আর একখান ঘোড়ায় উঠলেন। তাগো দড়ি ধইরা ছুটতে লাগল দুইজন।
শহরের কাছাকাছি গিয়া দেখা গেল রিকশা আছে। ঘোড়া ছাইড়া তারা রিকশায় উঠলেন।
গেলেন আওয়ামী লীগ কর্মী ইমামউদ্দীন আহমদের বাড়ি। তিনি আছিলেন না। তার স্ত্রী হাসি তাগো দুপুরের খাওয়া খাইতে বসাইলেন। বাড়িতে রেডিও আছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনা যাইতে লাগল। তাজউদ্দীন শুনলেন, আমীর-উল শুনলেন, মেজর জিয়া কইতাছেন, মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হইল। বিশ্ববাসী সাহায্য করেন। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হইল সবার লগে বন্ধুত্ব, কারও লগে শত্রুতা নয়।
আমীর-উল কইলেন, ভালো। আমগো মিলিটারি বিদ্রোহ করছে। এইটা বড়ই আশার সংবাদ।
তাজউদ্দীন কইলেন, হ। আশার সংবাদ। তয় হে আবার পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করে ক্যান। কইল তো মুজিব ভাইয়ের নেতৃত্বে সরকার হইছে। অহন না আবার সরকার বানায় ফেলে। দেশের মানুষ আওয়ামী লীগ আর তার নেতৃত্বে আস্থা রাখে। সামরিক সরকারের ওপরে না। পৃথিবীর মানুষও মুজিব ভাইরে ইলেকটেড প্রতিনিধি হিসেবে জানে, জনগণের নেতা হিসেবে জানে। মিলিটারিগো না।
ব্যাঙ্গমা বলে, তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থাইকা নোট নিয়া রাখছিলেন আজিজ আহমেদ বাগমার। সেই নোট থাইকা তিনি লেখা বানাইছিলেন। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ সেইটা দৈনিক আজকের কাগজ-এ প্রকাশিত হইছে।
ব্যাঙ্গমি বলে, বাগমারের লেখা স্বাধীনতার স্বপ্ন : উন্মেষ আর অর্জন বইতেও তাজউদ্দীনের জবানিতে এই কথা লেখা হইছে।
.
তাজউদ্দীন বলেছিলেন, ভাবি, বেশি কিছু করতে যাবেন না। শুধু ডাল আর ভাত। এই আমাদের জন্য যথেষ্ট।
তাজউদ্দীন এটা বলেছিলেন, যাতে হাসি ভাবির কষ্ট কম হয়, তিনি যেন বাড়তি কিছু আয়োজনের চেষ্টা করতে ব্যস্ত হয়ে না পড়েন। কিন্তু ফল হলো উল্টো। হাঁড়িতে ভাত রান্না করা ছিলই, সে ভাত গরমই, কেবল চুলা থেকে নামানো হয়েছে। সে যুগে সবাই বেশি করে ভাত রাঁধতেন, ভাত বেঁচে গেলে পান্তা করা যায়, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিকেও খাওয়ানো যায় কিন্তু কেউ না কেউ হুট করে এসেই পড়ে, ভাত মেপে রাধলে তখন অসুবিধা হয়। কাজেই গরম ভাত রেডি, কিন্তু ডাল তো আজ রাধা হয়নি। হাসি তাই তাজউদ্দীন আর আমীরকে বললেন, আপনারা খেতে বসেন। হাত-মুখ ধুয়ে নেন। বাড়ির কাজের লোক পানি তুলে দিয়েছে। মেহমানরা হাতমুখ ধুচ্ছেন বারান্দাতেই, পানি গড়িয়ে পড়ছে উঠানে। এই সুযোগে হাসি চুলায় ডাল চড়িয়ে দিলেন। কতক্ষণ আর লাগবে।
তাঁরা দুজন হাতমুখ ধোয়া শেষ করে গামছা দিয়ে হাতমুখ মুছে আস্তেধীরে এসে বারান্দায় মাদুরে বসলেন খেতে। চুলায় ডাল সেদ্ধ হচ্ছে, পাটখড়ি বেশি করে চুলার মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে পাশের বাড়ি থেকে আসা শেফালির মাকে সেটা দেখতে বলে হাসি ভাত বাড়লেন। আলমারি থেকে কাঁচের প্লেট বের করে মাদুরে রাখলেন। ছোট মাছ, লাউ দিয়ে টাকি মাছ করাই ছিল। চটপট আরেকটা চুলায় দুটো ডিমও ভাজা হয়ে গেল। এখন ডালটুকু হলেই হয়।
হাসি মাথায় নীল রঙের শাড়ির আঁচল টেনে ঘোমটাটা বড় করে নিয়ে বললেন, আপনারা খেতে বসেন। আস্তে আস্তে খান। ডাল হতে কতক্ষণ। সিদ্ধ হলেই বাগার দিয়ে দিব।
এর মধ্যে ফরিদপুরের কর্মীরা উঁকি দিতে শুরু করেছে। কেউ একজন ছুটে এল। তার শরীর ঘর্মাক্ত, মুখে রাজ্যের উদ্বেগ, সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মিলিটারি আসতেছে। মিলিটারি।
তাজউদ্দীন ঠান্ডা মাথায় আরেক লোকমা ভাত মুখে পুরে মাছের টুকরার কাটা বাছতে বাছতে বললেন, মিলিটারি আসুক আর না আসুক, আমি ডাল ভাত খেয়েই যাব।
ভাত খাওয়া হয়ে গেল। কিন্তু ডালটা তখনো সেদ্ধ হয়নি। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছে। খড়ি সব ভেজা। শেফালির মা বাঁশের চোঙা দিয়ে ফুঁ দিতে দিতে চোখ লাল করে ফেলেছেন।
ডাল চুলাতেই রইল।
তাজউদ্দীন আর আমীর আবার যাত্রা শুরু করলেন।
১৭
ব্যাঙ্গমা বলে, পুরো বাংলায় যখন জাহান্নামের আগুন, পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্বিচার গণহত্যা চালায়া যাইতাছে আর বাঙালিরা চেষ্টা করতাছে প্রতিরোধ গইড়া তুলতে, যার যা কিছু আছে তাই লইয়াই, তখন কী করতাছেন আমেরিকার সাহেবেরা? কী করতাছেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন আর কিসিঞ্জার!
ব্যাঙ্গমি বলে, হ, চলো, এটু হোয়াইট হাউস ঘুইরা আহি।
.
হোয়াইট হাউসে বসে প্রেসিডেন্ট নিক্সন আর তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা গল্পগুজব করেন। বিষয় : পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর অভিযান।
মার্চের ২৯, ১৯৭১। কিসিঞ্জার বলেন, মনে হচ্ছে, ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন।
গুড। নিক্সন মাথা নাড়েন।
অনেক সময় শক্তি প্রয়োগে কাজ হয়। বিরূপ পরিস্থিতিতে কাজ হয়। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, ৩০ হাজারকে দিয়ে সাড়ে সাত কোটিকে কন্ট্রোল করা যায় না। হয়তো ভবিষ্যতে কথাটা ঠিক বলে প্রমাণিত হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সবকিছু ঠান্ডা মেরে গেছে। কিসিঞ্জার বলেন।
নিক্সন বলেন, হয়তো এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। কিন্তু ইতিহাসে অনেক জাতির বেলাতেই দেখা গেছে ৩০ হাজার প্রশিক্ষিত মানুষ সাড়ে সাত কোটি মানুষকে দমাতে পেরেছে। স্প্যানিশদের দেখুন, তারা কজন মাত্র এল আর ইনকাদের দখল করে ফেলল। ব্রিটিশরাও অল্প কজনই গেছে ভারতে এবং ভারতকে দখল করেছে।
একদম ঠিক। কিসিঞ্জার বললেন। নিক্সন বললেন, যা-ই হোক। আমি ইয়াহিয়ার ভালো চাই। তার মানে। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার চেয়ে না ভাঙা ভালো। তবে আসল কথা হলো, তারা কি এই ঈশ্বরবর্জিত দেশটাকে আসলেই চালাতে পারবে।
কিসিঞ্জার বললেন, তা অবশ্য ঠিক। ইতিহাসে দেখা গেছে, বাঙালিদের শাসন করা সব সময়ই কঠিন।
তারা তাদের কর্তব্য ঠিক করেন। আমরা কিছু করব না। প্রেসিডেন্ট বলেন, বায়াফ্রায় যেমন আমরা কিছুই করিনি, ঠিক সে রকম এবারও আমরা কিছুই করব না। যেমন আমরা বায়াফ্রার ক্ষুধার্ত মানুষকে গুলি করা পছন্দ করি নাই। তবু কিছুই করি নাই।
ঠিক ঠিক। কিসিঞ্জার বললেন।
ঠিক ঠিক বলাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিসিঞ্জার জানেন। রুল নম্বর ওয়ান : দ্য বস ইজ অলওয়েজ রাইট। রুল নম্বর টু : ইফ দ্য বস ইজ রং, সি রুল নম্বর ওয়ান।
২৬ মার্চ বিকেলে কিসিঞ্জার বসেছিলেন ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ নিয়ে। বিষয় পূর্ব পাকিস্তান। পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্তা ভ্যান হেলেন বলেছিলেন, মিলিটারি দেশটার ভাগ হওয়া বন্ধ করতে একটা চেষ্টা নেবেই, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা শেষ পর্যন্ত তাদের কম্মো নয়।
তখন কিসিঞ্জার বলেছিলেন, আমি তো আজ সকালেও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলেছি, তিনি কিছুই না করবার পক্ষে। তিনি এমন একটা অবস্থান না নেওয়ার পক্ষে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ তাকে পাকিস্তান ভাঙার কাজে উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারে। তিনি কোনো অ্যাকটিভ পলিসির পক্ষে না। এর মানে এই যে যুদ্ধ করতে আমরা ইয়াহিয়াকে নিষেধ করব না। তার এই কথায় পুরো গ্রুপ সায় দিয়েছে। মাথা নেড়েছে। মাথা তাদের নাড়তেই হবে। দ্য বস ইজ অলওয়েজ রাইট।
.
আমেরিকান দুই কূটনীতিক–ঢাকা থেকে আর্চার ব্লাড এবং দিল্লি থেকে রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং-ওয়াশিংটনে তারবার্তা পাঠাচ্ছেন বাংলাদেশের ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে। নির্বাচিত গণহত্যা (সিলেকটিভ জেনোসাইড) কথাটা তাঁরা ব্যবহার করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের হত্যা করা হয়েছে, ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে। এই খবরও পেয়েছেন কিসিঞ্জার। তিনি সিআইএর একজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তারা কি অধ্যাপক রাজ্জাককেও হত্যা করেছে?
মনে হয়। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককেই হত্যা করেছে।
এবার কিসিঞ্জার চুপ করে গেলেন। তাঁর মনে পড়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের পরিচিত মুখটাকে, যার নাম রাজ্জাক। যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। তিনি স্তব্ধ হয়ে রইলেন।
১৮
মমিনুল হক খোকা গাড়ি চালাচ্ছেন। পাশে জামাল। পেছনে রেনু, রেহানা, জেলি। গাড়ির মেঝেতে রাসেল। রেনু বড় করে ঘোমটা দিয়ে রেখেছেন, যেন কেউ চিনতে না পারে। গাড়ি চলেছে মগবাজার থেকে ওয়ারীর দিকে। ওয়ারী বলধা গার্ডেনের পাশে বাবু ভিলা। খোকার শ্বশুরবাড়ি। সেখানেই থাকবেন। বেগম মুজিব এবং তাঁর সন্তানেরা।
গাড়ি চলছে। দুই ধারে ধ্বংসযজ্ঞ। রাস্তার ধারে লাশ পড়ে আছে। কুকুর আর কাক লাশ নিয়ে টানাটানি করছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন একটা। পোড়া বস্তি।
ইত্তেফাক ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো আগুন পুরোপুরি নেভেনি। নিউজপ্রিন্টের স্তূপ থেকে এখনো আগুনের শিখা এবং ধোঁয়া বের। হচ্ছে। বাতাসে ছাই উড়ছে। দেখে শিউরে উঠলেন রেনু। মানিক মিয়ার ইত্তেফাক। হাসুর আব্বার সবচেয়ে বড় সমর্থক। বাঙালির অধিকার আদায়ের সবচেয়ে বড় কণ্ঠস্বর। কত প্রিয় পরিচিতজনই তো ইত্তেফাক-এ কাজ করেন। ২৫ মার্চ রাতেও তো কাজ করছিলেন। তারা কি বেঁচে আছেন?
বাবু ভিলার সামনে গাড়ি দাঁড়াল। গাছপালাঢাকা এক সুন্দর বাড়ি। আরোহীরা গাড়ি থেকে নামলেন।
গাড়ির শব্দ শুনে বেরিয়ে এলেন খোকার শাশুড়ি। খোকার শ্যালকেরা। তারা বেগম মুজিবকে পেয়ে আত্মহারা হয়ে পড়লেন। কী করবেন, কোথায় রাখবেন, কী খাওয়াবেন, কী করলে তাদের যোগ্য সমাদর হবে, এই নিয়ে তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। খোকার শাশুড়ি বললেন রেনুকে, মা, তুমি একদম দুশ্চিন্তা করবে না। নিশ্চিন্ত মনে এখানে থাকবে। আমরা তোমাদের। কোনো অযত্ন হতে দেব না। আর আমার ছেলেগুলোকে দেখেছ। সব তো। পাহাড়ি সাইজ। ওরা লাঠি হাতে পালা করে পাহারা দেবে। কেউ তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
তারা দিনে এই বাড়িতে থাকবেন। রাতে তাদের রাখা হবে পেছনের একটা ফাঁকা বাড়িতে। পেছনের বাড়িতে যেতে হলে দেয়াল টপকাতে হবে। মইয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
খোকার শাশুড়ি বললেন, অসম্ভব। বউমাকে কিছুতেই আমি দেয়াল। টপকাতে দেব না। পাঁচিল ভাঙো।
মিস্ত্রি ডেকে দুই বাড়ির মধ্যকার দেয়াল ভেঙে রাস্তা বানানো হলো।
কিন্তু পাড়াপড়শিরা জেনে গেলেন যে শেখ মুজিবের পরিবার এই বাড়িতে থাকেন। তারা যেমন নিজেদের জন্য ভয় পেতে লাগলেন, তেমনি বেগম মুজিবও এই বাড়িতে থাকাটা নিরাপদ বলে মনে করলেন না। তিনি খোকাকে বললেন, বাড়ি খোজো। এই বাড়ি তো আমার শেষ আশ্রয় হিসেবে থাকলই। আপাতত অন্য কোথাও যাই।
খোকা চেনেন তাঁর ভাবিকে। ভাবি যখন বলেছেন, তখন তাঁর কথা শুনতেই হবে। বাসা একটা দেখতেই হবে। বিশেষ করে পড়শিদের চোখে মুখে ভয়, এটা খোকার শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য যে বিব্রতকর, ভাবি তা অনুভব করতে পারছেন। তাঁর জন্য আরেকটা ফ্যামিলি কথা শুনুক, এটা তিনি হতে দেবেনই না। রেনু বললেন, খোকা, হাসুর কাছাকাছি থাকতে হবে। মালিবাগের দিকে চল।
খোকা একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে গেলেন মালিবাগের দিকে। বহু বাড়িতে টু-লেট দেখা ঝুলছে। ট্যাক্সি থেকে নেমে নেমে বাড়ি দেখলেন। একটা বাসা বেশ পছন্দ হওয়ারই মতো। বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বললেন খোকা। ভাড়া কত, শর্ত কী কী, সব পাকা হলো।
খোকা খুশি। এই রকম একটা বাড়ি হলে কথাই নেই। এখানে হাসুদেরও এনে রাখা যাবে। যে বেবিট্যাক্সি নিয়ে গিয়েছিলেন, সেটা নিয়েই ফিরে এলেন ওয়ারীতে।
রেনু বিদায় নিলেন খোকার শাশুড়িদের কাছ থেকে, মাওইমা, আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করলেন। আসি মাওইমা। ভালো থাকবেন। রেনু, জামাল, রাসেল, রেহানা গাড়িতে গিয়ে বসলেন। গাড়ি চলছে। ততক্ষণে রোদ মরে এসেছে, বিকেল হয়ে গেছে। মালিবাগ পৌঁছাতে পৌঁছাতে রোদ সিঁদুরে আমের মতো লাল হয়ে এল।
মালিবাগ তখন অজপাড়াগা। বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই কোত্থেকে ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ এসে ভিড় করল। গাড়ি ঘিরে দাঁড়াল। ঢাকা শহরে তো গাড়ির সংখ্যা এমনিতেই কম। তার মধ্যে এই জলো-জংলা জায়গা। এখানকার মানুষ কি এর আগে গাড়ি দেখেনি নাকি?
এখন এর মধ্যে তারা গাড়ি থেকে নামবেন কী করে? নামার সঙ্গে সঙ্গে লোকে চিনে ফেলবে যে বেগম মুজিব নামলেন। তারা দেখে ফেলবে তারা কোন বাসায় উঠলেন। জানাজানি হয়ে যাবে। মিলিটারি চলে আসবে। এ তো এক ভয়াবহ ব্যাপার হলো।
এদিকে সন্ধ্যা তার কালো মশারি নামিয়ে ফেলছে। অন্ধকার হয়ে আসছে চারপাশ। একটু পরে শুরু হয়ে যাবে কারফিউ। তখন তো গাড়ি নিয়েও চলা যাবে না। এখন? ফেরার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
রেনু বললেন, ভাইডি। আগে গাড়ি এখান থেকে নড়াও।
খোকা গাড়ির ব্রেক থেকে পা সরালেন। গিয়ারে হাত দিয়ে গিয়ার বদলে বাঁ পায়ে ক্লাচ চেপে ধরে ডান পা রাখলেন অ্যাক্সিলারেটরে। গাড়ি চলতে শুরু করল।
অন্ধকার নেমে এসেছে। গাড়ির হেডলাইট জ্বালাতে হলো। বড় রাস্তায় ওঠা মানেই বিপদ। বড় রাস্তায় কারফিউ।
মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার রাস্তায় গাড়ি চলছে। ফাঁকা ফাঁকা ঘরবাড়ি। প্লটে প্লটে বড় বড় ঘাস। কাশবন। রাস্তায় কোনো লোক নেই। লোকজন থাকার প্রশ্নও আসে না। কারফিউ।
এর মধ্যে বিপরীত দিক থেকে হেডলাইট জ্বালিয়ে একটা গাড়ি আসছে দেখা গেল। রেহানা বললেন, চাচা, ওইটা মিলিটারির গাড়ি না তো।
রেনু বললেন, খোকা, গাড়ি গলির মধ্যে ঢোকা।
খোকা সামনে ডানে-বাঁয়ে আর কোনো গলি দেখেন না। বাঁয়ে একটা পলেস্তারা খসা দোতলা বাড়ি। বড় বাউন্ডারি। গেট খোলা। একমাত্র উপায় এই বাউন্ডারির ভেতরে গাড়ি ঢুকিয়ে দেওয়া। তা-ই করলেন তিনি। অচেনা অজানা একটা বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে গাড়ি ঢুকিয়ে হেডলাইট নিভিয়ে দিলেন। হেঁটে এসে পেছনের গেটটা দিলেন বন্ধ করে।
রেনু বললেন, কেউ যদি আপত্তি না করে, তাইলে আমরা রাতটা গাড়িতেই কাটায়ে দিব খোকা। তুই ভাইডি একদম চিন্তা করবি নে।
খোকা বললেন, আমি একটু দেখি, মনে হচ্ছে ঘরবাড়ি ফাঁকা। মানুষজন
থাকলে ঘরের ভেতরেই থাকা যাবে। দেখে আসি।
খোকা পোড়ো বাড়িটার নিচতলায় উঠলেন। এ ঘর ফাঁকা। ও ঘর ফাঁকা। অন্ধকারে ফাঁকা ঘরগুলোয় মনে হচ্ছে অশরীরী ছায়া পাখা বিস্তার করে আছে। নিজের পায়ের শব্দে নিজেই চমকে উঠছেন খোকা।
দোতলাও মনে হচ্ছে ফাঁকা। তবে একটু যেন প্রাণের সাড়া, একটুখানি নড়াচড়া টের পাওয়া যাচ্ছে। আচ্ছা, উঠেই দেখি না দোতলাটা। একটা একটা করে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠলেন। একটা ঘরে কেউ নেই। আরেকটা ঘরে মনে হচ্ছে মানুষ আছে। একটুখানি আলোও জ্বলছে। তিনি দরজায় নক করলেন। তারপর ভেতরে কেউ আছেন বলে কপাট ঠেললেন।
ও মা এ কী? এ-ও কি সম্ভব?
মামা! আপনি! বলে ছুটে আসছেন পলি। বঙ্গবন্ধুর ছোট বোনের মেয়ে। পাশেই দেখা গেল তার স্বামী ওদুদকে।
খোকা নিচে গেলেন। বললেন, ভাবি আসেন। ওপরে পলি আছে। ওদুদ আছে। চলেন চলেন।
বলিস কী? রেনু ওপরে উঠলেন। মামিকে পেয়ে পলি জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। দুই নারী কাঁদতে লাগলেন অঝোরে। দুজনের অশ্রুধারা একধারায় বইতে লাগল।
পলিরা এই বাড়িতে আজই উঠেছেন। আসবাব নেই। বাসনকোসনও নেই। আজকের রাতটা কোনোরকমে কাটিয়ে কাল তারা বাজারসদাই করবেন। চাদর বিছিয়ে কোনোরকমে আছেন। তবে তার শ্বশুর-শাশুড়ি দুজন। এই বাড়িতে থাকেন। কাজেই তেমন অসুবিধা হবে না।
বাড়িতে খাবার নেই। রাসেলের মুখটা এরই মধ্যে শুকিয়ে গেছে।
পলি বললেন, মামি, এই ছিল আমাদের কপালে। ফাঁকা বাড়িতে আপনাদের তুলতে হলো! এই বাড়িতে তো আমরা থাকি না। আমরা ভয়ে এই বাড়িতে এসে উঠেছি।
রেনু বললেন, আমাদের আর কী কষ্ট! ভেবে দ্যাখ, তোর মামা কোথায় আছে, কেমন আছে, বেঁচে আছে কি না, আমরা তো কিছুই জানি না। সে কী খাচ্ছে, কোথায় ঘুমাচ্ছে। আল্লাহর কাছে চাই শুধু মানুষটা যেন বেঁচে থাকে!
পলি বলল, ঠিক কথা মামি। আল্লাহর কাছে সেই দোয়াই করি। মাকে কাঁদতে দেখে কাঁদছেন রেহানা। কাঁদতে লাগল রাসেলও। জামাল তাকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, চলো রাসেল, ওই দেখো নিচে থোকা চাচার গাড়ি!
রাসেল কোল থেকে নামতে চাইছে। সে বড় হয়ে গেছে। সে জানে, একটা বড় ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একজন বড় মানুষ হিসেবেই সে এই ঝড়টাকে সামলাতে চাইছে। মা কাঁদছেন বলেই তারও কান্না পাচ্ছে। আর আব্বার কথা উঠল যে! আব্বা এখন কোথায় আছে? বেঁচে আছে কি না! সেই ভয়াবহ রাতে গুলির শব্দের মধ্যে আগুন, আলো, ভয়ের মধ্যে আব্বা তো তাকেই দুধ খাওয়াচ্ছিলেন। তারপর আব্বাকে ধরে নিয়ে গেল। কত কান্নাকাটি, কত আগুন, কত গোলাগুলি, কত রক্ত, কত এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে চলা।
রাসেল বলল, জামাল ভাই, আব্বা কোথায়? চলো না আব্বাকে খুঁজতে যাই!
এইবার জামালেরও চোখ মোছার পালা!
১৯
হাসির বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকশায় উঠেছিলেন তাজউদ্দীন ও আমীর। কিন্তু রিকশা বেশি দূর যেতে পারল না। পথে পথে ব্যারিকেড। রিকশা ছেড়ে হাঁটতে হচ্ছে।
বিপরীত দিক থেকে একটা জিপ আসছে। সবুজ রঙের জিপ। ভয়াবহ ব্যাপার! তাজউদ্দীন, আমীর-উল একটা গাছের আড়ালে নিজেদের আড়াল করলেন। জিপটাতে তো দেখা যাচ্ছে সাদাপোশাকের বেসামরিক লোকদেরই। তারা রাস্তায় উঠলেন। হাত নেড়ে ইশারা করলেন জিপ থামাতে।
জিপটা থামল। আমীর জিজ্ঞাসা করলেন ড্রাইভারকে, জিপে কে যাচ্ছেন?
এসডিও সাহেব। ড্রাইভার বলল।
পাশের আরোহী বললেন, আমি শাহ মোহাম্মদ ফরিদ। রাজবাড়ীর এসডিও।
আচ্ছা, কী খবর? কোত্থেকে আসছেন? আমীর বললেন।
শাহ মোহাম্মদ ফরিদ বললেন, আমি তো চুয়াডাঙ্গা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। খবর ভালো। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর–সবখানে প্রতিরোধসংগ্রাম খুব ভালোভাবে চলছে। চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর মুক্ত হয়ে গেছে। এখন কুষ্টিয়া দখলের প্রস্তুতি চলছে।
আমীর বললেন, বর্ডারের দিকের কী খবর। বর্ডার পর্যন্ত যাওয়া যাবে?
যাবে স্যার। কোনো অসুবিধা নাই।
আচ্ছা আমরা তাহলে চলি। আমীর আর কথা বাড়ালেন না। প্রতিটা মুহূর্ত মূল্যবান।
জিপও চলে গেল। আমীর বললেন, তাজউদ্দীন ভাই, এসডিও মনে হয় আমাদের চিনতে পারে নাই।
তাজউদ্দীন বললেন, না চেনাই ভালো।
হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ আসার পর পাওয়া গেল একটা বাস। দুজনে বাসে উঠে বসলেন। যাক। খানিকটা তো বসা গেল। সেই বাসও বেশি দূর যেতে পারল না। রাস্তায় বিশাল বিশাল গাছ কেটে রাখা হয়েছে। সেই গাছ সরিয়ে এগোনোর সাধ্য কারও নেই।
তাঁরা দুজন বাস থেকে নামলেন। গাছের ব্যারিকেডের ওপরে উঠলেন। পায়ের ফোঁসকা কষ্ট দিচ্ছে। কী আর করা! হাঁটা অব্যাহত রইল।
.
এভাবে হেঁটে রিকশায়-বাসে চড়ে আবার হেঁটে দুজন এসে পৌঁছেছেন মধুমতী নদীর পারে। ততক্ষণে আকাশ কালো হয়ে গেছে। যেকোনো সময় ঝড়বৃষ্টি হতে পারে। সন্ধ্যাও নেমে আসছে দ্রুত। কামারখালী ঘাটে একটা দোকানে। রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র চলছে। ঘোষণা আসছে : আপনারা সাবধান থাকুন। পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ডোরা বিভিন্ন জায়গায় ঘাপটি মেরে আছে। তারা আক্রমণ করতে পারে।
নৌকা দরকার। নদী পার হতে হবে। ঘাটে নৌকা বাঁধা। কিন্তু কোনো মাঝি রাজি হয় না। এর মধ্যে শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। আমীর ভিজছেন। তাজউদ্দীন ভিজছেন। এই পারে থাকা মানে মূল্যবান সময়ের অপচয়। আজকের রাতটা তাঁরা পথ চলতে চান। যত দ্রুত সম্ভব এগিয়ে যেতে হবে। তাজউদ্দীন ভাবছেন, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারে নানা ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে। এগুলো কে দিচ্ছে, কে জানে। সমন্বয় দরকার। তা না হলে দেখা যাবে, চার জায়গায় চারটা সরকার। চার রকমের ঘোষণা।
একজন বলল, আপনেরা ওই বুড়া মিয়াকে ধরেন। ওনার বাড়ি ওই পারে। ওনাকে তো বাড়ি যেতেই হবে। ধরেন ওনাকে।
আমীর এগিয়ে গেলেন, চাচা! আপনার বাড়ি নদীর ওই পারে?
জি বাবা।
আমারও বাড়ি নদীর ওই পারে। চলেন, আল্লাহর নামে চলে যাই। শুধু। তো বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড় তো আর হচ্ছে না।
যাবেন। ভরসা পান?
জি চাচা চলেন। নদীর পানি তো শান্ত আছে। ঢেউ তো নাই।
আচ্ছা চলেন, আল্লাহর নামে পাড়ি দেই।
তারা উঠলেন নৌকায়। মাঝনদীতে বৃষ্টি থেমে গেল। তবে ঘনঘোর অন্ধকার। শুধু নদীর কল্লোল আর বইঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওই পারে ঘাটে আলো আছে। সেই আলো অভিমুখে চলছে এই নৌকা। একসময় নৌকা ঘাটে এসে পৌঁছাল। মাঝির হাতে পাড়ানির টাকা তুলে দিয়ে দুজন ঘাটে নামলেন।
নদীর পশ্চিম পারে আরও কিছুসংখ্যক মানুষ যানবাহনের খোঁজ করছে। এখান থেকে মাগুরা শহর প্রায় আট মাইল দূরে। কোনো যানবাহন নেই। ২৫-৩০ জন মানুষ একসঙ্গে রওনা হলেন। আমীর আর তাজউদ্দীনও হাঁটছেন। সেই কাফেলা ধরে।
বৃষ্টিতে রাস্তার অবস্থা খারাপ। এখানে-ওখানে কাদা। হাঁটতে হাঁটতে আমীর আর তাজউদ্দীনের ভেজা কাপড় শরীরেই শুকাল।
সামনে ছোট্ট একটা খাল। খালের ওপরে আগুন জ্বলছে। কী ব্যাপার? একটা কাঠের সেতু ছিল। প্রতিরোধকামী জনতা সেটাতে আগুন দিয়েছে, যাতে ঢাকা বা ফরিদপুর থেকে পাকিস্তানি সৈন্য এসে পৌঁছাতে না পারে। সংগ্রাম পরিষদের ছেলেরা খাল পাহারা দিচ্ছে। এই ২৫-৩০ জনের দলের প্রত্যেককে তারা দেহতল্লাশি করল।
তাজউদ্দীন আহমদের পাঞ্জাবির ভেতরে বুকের কাছে এক গোপন পকেটে পাওয়া গেল পিস্তল।
সেটাতে হাত দিয়েই আওয়ামী লীগের কর্মী টর্চলাইটের আলো ধরলেন তাজউদ্দীনের মুখের দিকে। ভালো করে নিরীক্ষণ করলেন তার মুখটাকে। তিন দিনের না কামানো দাড়ি। পরনে লুঙ্গি। লোকটা কে? তাঁর বুকপকেটে পিস্তল কেন? একমুহূর্ত নিলেন তিনি ভাবতে, তারপর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন, লিডার। আপনাকে চিনতে পারছি। আপনি তাজুদ্দীন ভাই। ভাই, আমি ওয়াহেদ।
ওয়াহেদ, বেশি আওয়াজ দিয়ো না। চুপচাপ আমাদের ওই পারে নিয়ে চলো। আমাদের পরিচয় কারও কাছে প্রকাশ কোরো না।
নৌকা লাগানো হলো ঘাটে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। নৌকা চলতে আরম্ভ করল। ওপাশ থেকে চিৎকার : কে আসে?
বন্ধু।
ঠিক আছে, আসো।
ওই পারে দেখা গেল, রীতিমতো মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে। বন্দুক কাঁধে ছেলেরা পাহারা দিচ্ছে। আনসার বাহিনীর সদস্যরা আছে।
তাজউদ্দীন বললেন, সোহরাব সাহেবের বাড়িতে যাব। সোহরাব সাহেব কোথায়?
সোহরাব সাহেব তো বাড়ি নাই। তবে তার বাড়ি যাওয়ার পথেই তার দেখা আপনেরা পাবেন। চলেন আমি সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি।
রিকশাও জোগাড় হয়ে গেল।
রাত তিনটায় তাঁরা পৌঁছালেন মাগুরায় সোহরাব হোসেনের বাড়ি। গোসল সারলেন। রাতের বেলা ভাত চড়ানো হলো চুলায়। খেতে বসলেন। চারটায়। ৩০ মার্চ ১৯৭১। ভোর হচ্ছে।
ঘণ্টা দুয়েক তারা একটুখানি ঘুমিয়ে নিলেন। সকাল সাতটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লেন পথে। এইবার সোহরাব হোসেনের জোগাড় করা জিপে।
সোহরাব হোসেনই বললেন, মাগুরার এসডিও কামাল সিদ্দিকী খুব ভালো কাজ করছেন। ইপিআর, পুলিশ, আনসার, সবাইকে নিয়ে বাহিনী গড়ে তুলেছেন। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা সমন্বয় করছেন। ইনশা আল্লাহ জয় আমাদের হবেই।
গাড়ি মাগুরা-ঝিনাইদহ সদর রাস্তা দিয়ে না গিয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা দিয়ে চলতে লাগল।
সকালবেলা রোদ উঠেছে। গ্রাম-গ্রামান্তরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। সোহরাব আর আমীর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছেন।
তাজউদ্দীন চুপ করে আছেন। কী সুন্দর নীলাকাশ। কী সুন্দর সবুজ বিস্তৃত মাঠ। কলাইয়ের খেত। কোথাওবা চষা জমি। জল-জঙ্গল-বিল। হাঁস যাচ্ছে দল বেঁধে, সড়কের ওপর দিয়ে। একটা ছাগলের দড়ি ধরে টানছে একটা কিশোরী। গাড়ি দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। একপাল আধা ন্যাংটো ছেলে দৌড়ে আসছে জিপের পিছু পিছু। কলাগাছের ফাঁকে একটা বেগুনি শাড়ি পরা বধূ ঘোমটা বাড়িয়ে দিয়ে গাড়ির ধূলি ওড়ানো দেখছে।
তাজউদ্দীন ভাবছেন, রবীন্দ্রনাথের লিপিকায় পড়েছেন–
এই তো পায়ে চলার পথ।
এসেছে বনের মধ্যে দিয়ে মাঠে, মাঠের মধ্যে দিয়ে নদীর ধারে, খেয়াঘাটের পাশে বটগাছের তলায়। তার পরে ও পারের ভাঙা ঘাট থেকে বেঁকে চলে গেছে গ্রামের মধ্যে; তার পরে তিসির ক্ষেতের ধার দিয়ে, আমবাগানের ছায়া দিয়ে, পদ্মদিঘির পাড় দিয়ে, রথতলার পাশ দিয়ে কোন্ গায়ে গিয়ে পৌচেছে জানিনে।
এই পথে কত মানুষ কেউ বা আমার পাশ দিয়ে চলে গেছে, কেউ বা সঙ্গ নিয়েছে, কাউকে বা দূর থেকে দেখা গেল; কারো বা ঘোমটা আছে, কারো বা নেই; কেউ বা জল ভরতে চলেছে, কেউ বা জল নিয়ে ফিরে এল।
২. এখন দিন গিয়েছে, অন্ধকার হয়ে আসে।
একদিন এই পথকে মনে হয়েছিল আমারই পথ, একান্তই আমার; এখন দেখছি কেবল একটিবার মাত্র এই পথ দিয়ে চলার হুকুম নিয়ে এসেছি, আর নয়।
নেবুতলা উজিয়ে সেই পুকুরপাড়, দ্বাদশ দেউলের ঘাট, নদীর চর, গোয়ালবাড়ি, ধানের গোলা পেরিয়ে সেই চেনা চাউনি, চেনা কথা, চেনা মুখের মহলে আর একটিবারও ফিরে গিয়ে বলা হবে না, এই যে! এ পথ যে চলার পথ, ফেরার পথ নয়।
তাজউদ্দীন ভাবছেন, এ যেন তাঁর শুধু চলার পথ না হয়, যেন তাঁর ফেরার পথও হয়। তা হতেই হবে। তা না হলে এই শাশ্বত বাংলা যে আর থাকবে না!
১০টা ৩০ মিনিটে গাড়ি গিয়ে থামল ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি আজিজ সাহেবের বাড়ির প্রাঙ্গণে। তিনি এলাকার সংসদ সদস্যও। বাড়ির সেই ভোলাজুড়ে অনেক কবুতর। সাদা, কালো, বাদামি কবুতরগুলো গাড়ি দেখেও সাইড দিচ্ছিল না। শেষে নিতান্ত অনিচ্ছায় একটুখানি উড়ে একটুখানি সরে গিয়ে জায়গা করে দিল।
আজিজ ছুটে এলেন। আসেন আসেন। এই দুর্দিনে কী সৌভাগ্য আমার। স্বয়ং তাজউদ্দীন ভাই। ব্যারিস্টার ভাই। আসেন আসেন।
আমীর বললেন, আমাদের আসল নাম বলবেন না কাউকে। ওনার নাম মোহাম্মদ আলী, আর আমার নাম রহমত আলী।
আজিজ সাহেব বললেন, জি আমীর ভাই জি, কাউকে নাম বলব না।
ঝিনাইদহের সাবডিভিশনাল পুলিশ অফিসার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ। মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক-ই-ইলাহী। এই দুজনকে আজিজ সাহেব খবর পাঠালেন। তারা গাড়ি নিয়ে চলে এলেন।
মাহবুব বললেন, কী অবস্থা হয়েছে যে আপনাদের চেহারার। আমি তো চিনতেই পারছিলাম না।
আমীর বললেন, আপনি পুলিশ হয়ে না চিনলে চলবে? গ্রামে-গঞ্জে লোকেরা কিন্তু আমাদের ঠিকই চিনে ফেলেছে।
তাজউদ্দীন বললেন, কেউ না চিনুক, সেই রকম বেশ নিতেই তো চেয়েছি। কী অবস্থা এখানে বলেন।
তৌফিক-ই-ইলাহী মানুষটা ছোটখাটো। কিন্তু কথায় স্পষ্ট। কাজে নিখুঁত। তিনি পুরো পরিস্থিতির একটা ছবি তুলে ধরলেন।
বললেন, এখানে ইপিআরের মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। তিনি তাঁর পুরো বাহিনী নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। মাহবুব সাহেবের নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গার পুলিশ, কুষ্টিয়ার পুলিশ, মেহেরপুরের পুলিশ, আনসার-সব আমাদের সঙ্গে।
মাহবুব বললেন, আজকেও কুষ্টিয়ায় যুদ্ধ হচ্ছে। আমাদের বাহিনী হাজার হাজার মানুষ সঙ্গে নিয়ে কুষ্টিয়া সার্কিট হাউস ঘেরাও করেছে। তবে যশোর ক্যান্টনমেন্টে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের পাকিস্তানিরা নিরস্ত্র করে। ২৮ মার্চ ঘুমন্ত বাঙালি সৈনিক আর তাদের পরিবার-পরিজন, নারী শিশু সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলে। ওদেরকে বলা হয়েছিল, আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে। ওরা বাইরেই ছিল। চৌগাছা ছিল। ওসমান সাহেব চিঠি দিয়েছিলেন। ওরা বোকার মতো ফিরে গিয়ে অস্ত্র জমা দেয়। তারপর সবাই মিলে মারা পড়ে। দুধের শিশু পর্যন্ত রক্ষা পায়নি।
কুষ্টিয়ার নেতা ডা. আসহাব-উল হক জোয়ারদার এলেন।
আরও দু-চারজন নেতা এসেছেন।
তাঁদের সবার কথা, অস্ত্র দেন। গোলাবারুদ দেন। আমরা যশোর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করব। যশোর পুরাটাই দখল করে নেব।
বোঝা গেল, এদের সঙ্গে পরামর্শ করা যাবে। মাহবুব এবং তৌফিক-ই ইলাহীকে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাজউদ্দীন বললেন, তোমাদের এক কাজ করতে হবে। আমাদের একটু বর্ডারে নিয়ে যেতে হবে। মুজিব ভাই আমাদের একটা ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন। কলকাতার। সেখানে গেলে সাপোর্ট পাওয়া যাবে। এটা মুজিব ভাইয়ের আদেশ। তিনি বলেছেন, ওই ঠিকানায় যোগাযোগ করলে অস্ত্র-গোলাবারুদ-ট্রেনিং পাওয়া যাবে। তোমরা কী বলো?
মাহবুব এবং তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, আমাদের অস্ত্র দরকার। গোলাবারুদ দরকার। তাহলে আমরা কয়েক দিনের মধ্যেই পুরো দক্ষিণ পশ্চিম বাংলা মুক্ত করে ফেলতে পারব। আমি এরই মধ্যে বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তাদের কাছে অস্ত্র চেয়ে চিঠি দিয়েছি। ওরা আমাদের কাছে জানতে চায়, রাজনৈতিক নেতারা আমাদের সঙ্গে আছে কি না। শুধু অফিসারের চিঠির ওপরে ওরা ভরসা করতে পারছে না। আপনারা দুজন যদি বিএসএফের সঙ্গে কথা বলেন, ওরা অস্ত্রশস্ত্র দেবে। বিএসএফের আইজি গোলোক মজুমদার জাতীয় নেতা কাউকে খুঁজছেন। আপনারা চলেন আমাদের সঙ্গে বর্ডারে।
ঝিনাইদহ ছেড়ে যাচ্ছে গাড়ি। দেখা গেল, হাজার হাজার মানুষ দা, কুড়াল, বল্লম, শাবল নিয়ে ট্রাকে করে করে যাচ্ছে, তাদের মুখে স্লোগান, যশোর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। জয় বাংলা। মাহবুব বললেন, জনতা যশোর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে রেখেছে। কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘেরাও করে রেখেছে মুক্তিকামী জনতা। দুপক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে ডিসি সাহেব মারা গেছেন।
সামনের জিপে তৌফিক-ই-ইলাহী। ওই গাড়ি ড্রাইভার চালাচ্ছে। পেছনে জিপে ড্রাইভারের পাশে বসেছেন মাহবুব। পেছনের আসনে তাজউদ্দীন আর আমীর। তারা প্রথমে গেলেন চুয়াডাঙ্গা। সার্কিট হাউসের সামনে গাড়ি দাঁড়াল। মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর সামরিক সদর দপ্তর। তিনি বেরিয়ে এসে জিপের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে কথা বলে নিলেন দুই নেতার সঙ্গে। দ্রুত বেলা পড়ে আসছে। আবার রওনা দেওয়া দরকার।
আবার স্টার্ট নিল দুই জিপ। তাজউদ্দীনের পরনে তেমনি লুঙ্গি-পাঞ্জাবি। ময়লা হয়ে সেসবের আদি রং আর বোঝা যাচ্ছে না।
তাঁরা পৌঁছালেন জীবননগর থানায়। এটা সীমান্তের সবচেয়ে নিকটবর্তী থানা। সেখান থেকে তারা এগিয়ে গেলেন বেতনাপুর সীমান্তচৌকির দিকে।
সীমান্তের কাছাকাছি একটা জায়গায় গিয়ে গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হলো।
এবার তাঁরা হাঁটতে লাগলেন ভারত সীমান্তের দিকে। নো ম্যানস ল্যান্ডে গিয়ে তাজউদ্দীন এবং আমীর একটা কালভার্টের ওপরে গিয়ে বসলেন। রোদ মরে আসছে। আকাশের মেঘে মেঘে হলুদ, লাল, খয়েরি তুলির টান। ছোট্ট খাল। খালে পানি নেই। কচুরিপানা কাদামাটিতে বেগুনি রঙের ফুল ফুটিয়ে রেখেছে। কাটাগুল্মের আড়ালে একটা বেজি দুপায়ে দাঁড়িয়ে মাথা বাড়িয়ে আগন্তুকদের নিরীক্ষণ করছে।
মাহবুব আর তৌফিক তাজউদ্দীনের সামনে। অস্তগামী সূর্যের লাল আভা পড়েছে দুই যুবকের চোখে-মুখে-চুলে।
তাজউদ্দীন বললেন, মাহবুব-তৌফিক, তোমরা বর্ডার পার হও। তোমরা স্বাধীন দেশের অফিসার। তোমাদের পাঠানো হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে। আমাদের স্বাধীন দেশের নেতা হিসেবে ওয়েলকাম জানাতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা ভারতে ঢুকব। তা না হলে জনগণের মধ্যে থেকে জনগণকে সঙ্গে নিয়েই লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাব।
জি আচ্ছা স্যার। বললেন দুজনেই। সরকারি অফিসার হিসেবে স্যার বলাটা তাদের অভ্যাসের অংশ। আর ১ মার্চ থেকে দেশ যে ৩২ নম্বর থেকে পরিচালিত হয়েছে, আর আদেশগুলো যে তাজউদ্দীন লিখতেন, সেসব খবর তো এই দুজনের অজানা নয়।
তাঁরা দুজন ধীরে ধীরে সীমান্তের দিকে চলে গেলেন।
তাজউদ্দীন ও আমীর-উল ইসলাম অপেক্ষা করছেন।
সূর্য ডুবে গেল। আকাশে তবু আভা। তাদের শরীর ক্লান্ত। তারা দুজন দুই রেলিংয়ের ওপরে শুয়ে পড়লেন।
তাজউদ্দীনের মনে হলো :
কে লইবে মোর কার্য কহে সন্ধ্যারবি
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।
.
মাহবুব আর তৌফিক হাঁটছেন। অন্ধকার নেমে আসছে। তারা যাচ্ছেন অচেনা বিওপির দিকে। নিজেদের পায়ের শব্দে নিজেরাই চমকে উঠছেন। হঠাৎ চিৎকার শোনা গেল : হুকুমদার! (হু কামস দেয়ার!)।
মাহবুব বললেন, ফ্রেন্ডস!
হ্যান্ডস আপ!
দুজনেই হাত মাথার ওপরে তুললেন।
এগিয়ে এলেন এক নবীন বিএসএফ অফিসার। তিনি পরিচয় দিলেন, আই অ্যাম মহাপাত্র, বিএসএফ।
ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন তৌফিক। মুক্তিবাহিনী। বাংলাদেশ।
.
আকাশের আভা নিভে যাচ্ছে। তারা উঠছে। জোনাকির আলো জ্বলছে-নিভছে মাথার ওপরে।
কী হলো, তাজউদ্দীন ভাই, ওরা যে আর ফেরে না। আমীর বললেন।
তাজউদ্দীন বললেন, হয়তো ওরা কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। হয়তো ওরা দিল্লিকে জানাচ্ছে।
প্রচণ্ড গরম। একটু একটু করে বসন্তের বাতাস বইতে শুরু করল। হঠাৎ ঝোঁপের ভেতর থেকে অন্ধকারের মধ্যে ধপধপ বুটের আওয়াজ।
ড্রাইভার ছুটে এল আগে আগে। বলল, একজন মেজর আসছেন।
তাজউদ্দীন আর আমীর উঠে বসলেন। মেজর এসে স্যালুট দিলেন দুজনকে।
সঙ্গে এলেন মাহবুব আর তৌফিক।
মাহবুব ফিসফিস করে বললেন, গোলোক মজুমদারের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। উনি শুনেছেন যে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের দুজন। এসেছেন। শেখ মুজিবও হতে পারেন। বিএসএফের গোয়েন্দারা তাঁকে আগে থেকেই ইনফর্ম করে রেখেছিল। তাই তিনি নিজেই আপনাদের খোঁজে এই দিকটায় আসছিলেন…
আমি তাকে আপনাদের পরিচয় দিয়েছি। বলেছি, আপনারা ভারতে আসতে নারাজ। দেশের ভেতরে থেকেই সংগ্রাম করতে চান। তিনি আমাদের অনেক করে বোঝালেন। দেশে মুসলিম লীগার আছে, জামায়াত আছে, শত্রু কম নয়। ওদের এপারে চলে আসতে বলুন। আমরা বলেছি, ওরা আসবেন। গার্ড অব অনার দিতে হবে। সেই ব্যবস্থাও হয়েছে।
বিএসএফের অফিসার বললেন, স্যার, ইউ আর ইনভাইটেড টু আওয়ার ক্যাম্প। আমাদের বিএসএফের ইস্টার্ন জোনের আইজি গোলোক মজুমদার আসছেন, আপনাদের রিসিভ করার জন্য।
তাঁরা দুজন হাঁটতে লাগলেন। হেঁটে নো ম্যানস ল্যান্ড পার হলেন। তাজউদ্দীনের বুক ব্যথা করছে। একটা অসহ্য চাপ। নিজের দেশের মাটির বাইরে তিনি পা রাখছেন। অন্ধকারের ভেতর। অজানার ভেতর। রাতের অন্ধকারে শুধু সাধ্যমতো আলো দিয়ে যাচ্ছে জোনাকি। আহা আমার দেশ! আহা আমার দেশের মাটি!
সীমান্তের ওপারে তাজউদ্দীন ও আমীরকে গার্ড অব অনার দেওয়া হলো। সারিবদ্ধ বিএসএফ জওয়ানদের বড় বড় ছায়া পড়েছে মাটিতে।
আলো জ্বলছে ক্যাম্পের সামনে। সালাম গ্রহণ করে তারা ক্যাম্পে গিয়ে বসলেন। তাঁদের অভ্যর্থনা জানালেন কর্নেল চক্রবর্তী। চা-বিস্কুট-ফল দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো।
আমাদের আইজি আসছেন-কর্নেল চক্রবর্তী জানালেন।
বিএসএফ অফিসারদের একজন বললেন, শেখ সাহেবের মেসেজ আমাদের কাছে আছে। টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে মেসেজ এসেছে। আমাদের কাছে প্রিন্ট আছে। তখন তারা একটা কাগজ দেখালেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা। তাজউদ্দীন আহমদ টেলেক্স বার্তাটা বারবার করে পড়লেন। একটুখানি শিহরিত হলেন। একটুখানি উদ্বেগও। মুজিব ভাই এখন কোথায় কে জানে? কোন অকূল পাথারে। তাজউদ্দীন তরি ভাসাতে যাচ্ছেন!
.
গোলোক মজুমদার এলেন। পশ্চিমবঙ্গ বিএসএফের আইজি। বছর ৪৫ এর মতো বয়স। ধারালো নাক, তীক্ষ্ণ চিবুক, জ্বলজ্বলে চোখ। পরনে বিএসএফের তারকাখচিত ইউনিফরম। দুহাত জোড় করে নমস্কার জানালেন। বললেন, একেবারে কৃষকের বেশ নিয়ে এসেছেন। কে বলবে যে ইনি আওয়ামী লীগের সেকেন্ড ইন কমান্ড শেখ মুজিবের ডান হাত তাজউদ্দীন।
ব্যারিস্টার আমীর নিজের পরিচয় দিলেন।
তাজউদ্দীন বললেন, মুজিব ভাই আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে। লড়াই চালিয়ে যেতে। তবে তিনি বের হতে পেরেছেন। কি না জানি না। তিনি কোথায় আছেন কেমন আছেন, আদৌ বেঁচে আছেন কি না, আমরা কেউই সেটা বলতে পারছি না। এই নিয়েই আমার খুবই দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তবে মুজিব ভাই আমাদের বলে রেখেছেন, ভারত আমাদের শেষ ভরসা। আগেই ভরসার জায়গাটা নষ্ট কোরো না। ওদের বিব্রত কোরো না। তাই আমরা দেশেই ফিরে যাব।
না না। ভারত একদম বিব্রত হবে না। আপনাদের পাশে ভারত আছে। আমাদের পার্লামেন্টে এ নিয়ে কথা হয়েছে।
আমাদের এখন অস্ত্র-গোলাবারুদ দরকার। আপনি অস্ত্র-গোলাবারুদের ব্যবস্থা করুন। আপনি কথা দিন যে আপনারা অস্ত্র দেবেন। আর তা দেবেন। এখনই। অস্ত্র-গোলাবারুদ পেলেই আমরা সারা বাংলাদেশ থেকে একযোগে ঢাকায় ঢুকে পড়তে পারব এবং ঢাকা দখল করতে পারব। লক্ষ লক্ষ মানুষ আমাদের সঙ্গে যাবে। বলুন, আপনারা অস্ত্রশস্ত্র দেবেন?
গোলোক মজুমদার বললেন, আপনাদের এই প্রশ্নের জবাব মাত্র একজনের কাছে আছে। তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাজি। আপনি চাইলে আমি তাঁর সঙ্গে আপনার দেখা করিয়ে দিতে পারব! আপনারা আমার সঙ্গে চলুন।
কোথায়?
প্রথমে যাব দমদম এয়ারপোর্ট। বিএসএফের ডিজি রুস্তমজি আসছেন দিল্লি থেকে। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতেই। চলুন।
তাজউদ্দীনের জীবনে সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখন। মুজিব ভাই বলেছেন, ভারতকে বিব্রত কোরো না। আবার মুজিব ভাই-ই তাকে পাঠিয়েছিলেন ঢাকার ভারতীয় উপহাইকমিশনে, মার্চের প্রথম সপ্তাহে, প্রস্তাবটা ছিল এই যে, মুজিব যদি ইউনিল্যাটেরাল ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেনস করেন, যদি একপক্ষীয়ভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, ভারত বাংলাদেশকে কীভাবে সাহায্য করবে? তারা কি বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেবে? তারা কি অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং দরকার হলে ট্রেনিং দেবে? কাজেই মুজিব ভাইয়ের পক্ষ থেকে এটা পাওয়ার ব্যাপারে অনাগ্রহ ছিল না তো বটেই, বরং অনুরোধই ছিল। ১৪ মার্চে বঙ্গবন্ধু আবার পাঠিয়েছিলেন। সুজাত আলীকে, ভারতের কাছ থেকে এই সংকটময় মুহূর্তে দরকারি সাহায্য চাওয়ার বার্তা নিয়ে। তাজউদ্দীন তা-ও জানেন। কাজেই যদি অস্ত্র, গোলাবারুদ সবকিছু পেতে হয়, তাহলে ভারতে যেতে হবে, আর যেহেতু গোলোক মজুমদার বলছেন যে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার দেখা করিয়ে দেবেন, এই সুযোগ ছাড়া উচিত হবে না। কাজেই তিনি এই সুযোগটা নিতে চান। সে ক্ষেত্রে তার উচিত হবে তাঁর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে একবার পরামর্শ করে নেওয়া।
তিনি বললেন, তাহলে আমি একটু দেশের ভেতরে যাই। আমাদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে আসি।
ঠিক আছে। আসুন।
তাজউদ্দীন ও আমীর-উল আবার সীমান্ত অতিক্রম করলেন। তৌফিক আর মাহবুব তো ছিলেনই। বিএসএফের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে অন্য নেতাদের খবর দেওয়া হলো। স্থানীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ এলেন। নির্বাচিত পরিষদ সদস্য আসহাব-উল হক এলেন। সবার সঙ্গে আলাপে তাজউদ্দীন খোলাখুলিভাবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে লাগলেন : আমাদের অস্ত্র লাগবে। ট্রেনিং লাগবে। সরকার লাগবে। হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষ নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করলে কোনো লাভ হবে না। কেবল মৃত্যুর সংখ্যাই বাড়বে। আপনারা অনুমতি দিলে আমি কলকাতা যাব, দিল্লি যাব, অস্ত্র, গোলাবারুদ চাইব। আপনারা কী বলেন।
সংসদ সদস্যরা এবং অফিসাররা তখন অস্ত্র আর গোলাবারুদের জন্য। মরিয়া হয়ে আছেন। আজকে কুষ্টিয়ার লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনী জয়লাভ করেছে, আগামীকাল কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে মিলিটারি ক্যাম্প দখল করা হবে। অস্ত্র চাই। অস্ত্র। আর অস্ত্র পেলে যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করা কোনো ব্যাপারই নয়।
সবাই বললেন, আপনি ভারতে যান। আমাদের জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ পাঠান। আমরা লড়াই করব।
জয় বাংলা বলে সবার কাছ থেকে অশ্রুসিক্ত বিদায় নিয়ে আবারও তাজউদ্দীন এবং আমীর-উল ফিরে এলেন নদীয়া জেলার টুঙ্গি সীমান্তচৌকিতে।
গোলোক মজুমদারের সঙ্গে তারা এক গাড়িতে উঠলেন। আরও আছেন কর্নেল চক্রবর্তী। গাড়ি চলেছে দমদম এয়ারপোর্টের দিকে।
.
ব্যাঙ্গমা বলল, অহন আমারে কও। বিএসএফের ডিজি ছুঁইটা আসতাছেন। বিএসএফের আইজি আইসা বইসা আছেন বর্ডারে তাজউদ্দীনরে রিসিভ করবার জন্য। এইটা কি বিএসএফ নিজে নিজে করল? নাকি এইটা একটা পলিটিক্যাল ডিসিশন আছিল ভারতের!
ব্যাঙ্গমি বলল, ভারত একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাগো বিএসএফ দিল্লির গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া নিজেরা নড়াচড়া করা শুরু করল, এই রকম ভাবা একদম বোকামি হইব। হয়তো তারা ভাবছিল, শেখ সাহেব নিজেই আইছেন। তাগো গোয়েন্দারা তাগো ভুল খবর দিছিল। কিন্তু এইটা হইতেই পারে না যে দিল্লির অতি উচ্চ পর্যায় থাইকা হুকুম না পাইয়াই রুস্তমজি ছুঁইটা আসতেছেন দিল্লি থাইকা।
.
গাড়ি ছুটছে। অন্ধকার পথ ধরে এগিয়ে। সামনে-পেছনে বিএসএফের আরও আরও এসকর্ট গাড়ি। পেছনের গাড়ির হেডলাইট এই গাড়িতে পড়ছে। এই গাড়ির হেডলাইট সামনের গাড়িতে পড়ছে। পূর্ব বাংলা আর পশ্চিম বাংলার দৃশ্যপটে খানিকটা পার্থক্য আছে। জল-জঙ্গল, বন-বনানী পশ্চিমে কম।
গোলোক মজুমদার বললেন, বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুবৃত্ত। বাংলায় চিরকাল বর্গিরা হানা দিয়েছে, কিন্তু কোনো দিনও এইখানে বাংলার মানুষের বীরত্বের সঙ্গে পারেনি। মানসিংহ এসে হার মেনেছেন ঈশা খাঁর তরবারির কাছে। আজকে পাঞ্জাবিরা এসেছে আপনাদের ধ্বংস করবে বলে, কিন্তু তারাও পারবে না। হার তাদের স্বীকার করতেই হবে। জয় বাংলার জয় হবেই।
দমদম এয়ারপোর্টে ভিআইপি লাউঞ্জে গেলেন তারা। তাজউদ্দীন আর আমীর–দুজনের পোশাক লুঙ্গি-পাঞ্জাবি। গোলোক মজুমদার নির্দেশ দিলেন, এঁদের জন্য পোশাকের ব্যবস্থা করো। পোশাক এল। দাড়ি কামানোর রেজর এল, সাবান এল, ব্রাশ এল। ভিআইপি লাউঞ্জের বাথরুমে ঢুকে দুজনেই ভদ্রস্থ হয়ে এলেন। তাজউদ্দীন সবচেয়ে বেশি অনুভব করছিলেন চশমার অভাব। কাছের জিনিস দেখতে পারছিলেন না ঠিকমতো। রিডিং গ্লাস চলে এল।
রাত ১১টা ৪৫। দমদম বিমানবন্দর। ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের একটা বিমান এসে বিমানবন্দরে ল্যান্ড করল। বিমান থেকে নেমে এলেন কে এফ রুস্তমজি। বিএসএফের ডিজি। একটা কালো অ্যাম্বাসেডর গাড়ি এল। রুস্তমজি প্রায় ছয় ফুটের মতো লম্বা। তিনি সোজা এলেন গোলোক মজুমদার, তাজউদ্দীন ও আমীর-উলের কাছে। হাত বাড়িয়ে দিলেন। করমর্দন শেষে তারা অ্যাম্বাসেডরে উঠলেন।
গাড়ি গিয়ে থামল কলকাতার অসম হাউসে।
০২০. বাড়ি খুঁজতে যাই
জামাল বললেন, আমিও বাড়ি খুঁজতে যাই।
ওদুদ বললেন, জামালের সঙ্গে আমিও যাই।
খোকা বললেন, চলো, তিনজন বের হই। আমি এক রাস্তায় হাঁটি। তোমরা দুজন আরেক রাস্তায় হাঁটো।
একটা রাত ভুতুড়ে বাড়িতে কেটেছে। সবাই মেঝেতে শুয়ে কোনোরকমে রাতটা কাটিয়েছে। বিছানা-বালিশের তো ঠিকঠিকানা নাইই, মশারির তো প্রশ্নই আসে না। বাচ্চাদেরও খাওয়া হয়নি। রাসেলের জন্য হলেও খাবার কিনতে সকাল সকাল বেরিয়েছিলেন খোকা আর ওদুদ। কারফিউ প্রত্যাহার করার সঙ্গে সঙ্গে তারা বেরিয়ে গেছেন খাবারের সন্ধানে।
এ ধরনের পরিস্থিতি সামলানোতে রেনুর জুড়ি নেই। তিনি এরই মধ্যে চাল-ডাল বসিয়ে খিচুড়ি বেঁধে ডিম ভেজে তুলে দিলেন সবার হাতে হাতে। কেউবা খেল সসপ্যানে, কেউবা হাঁড়ি থেকে তুলে নিয়েই সরাসরি চালান করতে লাগল মুখে। রেহানা বললেন, মা, খিচুড়িটা খুব টেস্টি হয়েছে।
খুঁজতে বেরিয়ে বাড়ি পেলেন মুমিনুল হক খোকাই। ঘর্মাক্ত কলেবরে পলির শ্বশুরবাড়িতে এসে বললেন, ভাবি। বাড়ি পাওয়া গেছে?
রেনু এগিয়ে এলেন। রেহানাও কাছে দাঁড়ালেন। রেহানা বললেন, কোথায় পেলেন, কাকু?
এই তো চৌধুরীপাড়াতেই। গোলচত্বরের কাছে। ফ্ল্যাটবাড়ি। বাড়িওয়ালি তো আমার আগের পরিচিত। কমলাপুর জাহাজবাড়ির মালিক। ওদের বাড়িতে আগে তো আমি ভাড়া থাকতাম।
বাসা ভালো? রেনু বললেন।
হ্যাঁ। ভালো। চলেন দেখে আসি।
তুই দেখেছিস। তোর পছন্দ হয়েছে। আর দেখতে হবে না নে। ভাড়া কত?
পাঁচ শ টাকা।
এত টাকা কই পাব?
ভাবি। আমি তো আছি, ভাবি। মিয়া ভাই আমাকে বলে গেছেন, আপনাদের দায়িত্ব আমার।
অগ্রিম দিতে হবে?
না। এক মাসের ভাড়া দিয়ে এসেছি।
চল, তাহলে উঠে যাই।
পলির শাশুড়ি দিলেন চাদর। কিছু হাঁড়িকুঁড়িও দিয়ে দিলেন। খোকার গাড়ি করে রেনু, জামাল, রেহানা, রাসেল উঠলেন নতুন বাসায়। বাসাটা বড়সড়। বেশ পছন্দই হলো রেনুর। খোকার বাড়িতে ফরিদ নামের একজন গৃহপরিচারক ছিলেন, দেখতে একেবারে চীনাদের মতো, সবাই তাকে ডাকত টুংফুং বলে, তাকে বলাই হয়েছিল, বাসা পেলে চলে এসো। সে চলে এল। সঙ্গে এল কাজের ছেলে আবদুলও। চুপচাপ তারা নতুন বাড়িতে উঠলেন। যেন কেউ টের না পায় কোন ভাড়াটে এসে উঠেছে এখানে।
আবদুল গেল কলাবাগান। রেহানাদের ফুফুর বাড়িতে। রেনুই পাঠিয়েছেন তাকে। যা তো খবর নিয়ে আয় ডলি, রোজী, ওরা কেমন আছে। লিলি কেমন আছে।
কলাবাগানে বঙ্গবন্ধুর বোন লিলির বাড়ি এসে আবদুলের চোখ ছানাবড়া। আবদুর রহমান রমা, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাজের লোক, যাকে কিনা ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের সময়ে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে যায়, সে এই বাড়িতে! লিলি যখন শুনলেন, রেনু ভাবি বাড়ি পেয়ে গেছেন, তখন তার দুই মেয়ে ডলি আর রোজীকে পাঠিয়ে দিলেন সেই বাড়িতে। কারণ, ৩২ নম্বরের খুব কাছের এই বাড়িটি যে শেখ সাহেবের বোনের, সেটা সবারই জানা। এই বাড়িতে দুই তরুণীকে রাখা মোটেও নিরাপদ নয়।
৩২ নম্বরের আরেক পরিচারক, ২৫ মার্চ রাতে মিলিটারির হাতে ধরা পড়া রমা এল চৌধুরীপাড়ার বাড়িতে। সবাই তাকে ঘিরে ধরলেন।
রমা, কী খবর? আব্বা কোথায়? রেহানা জিজ্ঞেস করলেন।
সাহেবকে তো আমাদের সাথে একটা স্কুলে রাখছিল।
তোমরা আব্বাকে দেখলা কীভাবে?
সাহেব বাথরুমে যাচ্ছিল। তখন বুড়ি চিৎকার করে ওঠে তাকে দেখে। আমরাও দেখি। স্যার তখন ইংরেজিতে অনেক গালি দিল। আমাকে এনেছ, এনেছ, এদেরকে কেন এনেছ। তখন আমাদেরকে ছেড়ে দেয়।
কত তারিখে ছাড়ে?
তিন রাইত আছিলাম তো ওইখানে।
কেমনে ছাড়ল?
আমাদেরকে ট্রাকে তুলে আইয়ুব গেটের কাছে নামায় দিয়ে গাড়ি চইলা যায়!
আব্বা এখন কোথায় জানো?
না তো জানি না।
আব্বা বেঁচে আছে, মা, আব্বা বেঁচে আছে। কাঁদতে কাঁদতে রেহানা জড়িয়ে ধরলেন মাকে। রেনু চোখ মুছতে লাগলেন আঁচল দিয়ে। বললেন, আজিজ কই?
আজিজ মিয়া যে কই গেল, জানি না। রমা বলল।
আম্বিয়ার মা কোথায়?
অর মাইয়াদের লগে কলাবাগানে গিয়া উঠছে।
টুংফুং (ফরিদ, বয়স ১৭) একটা আস্ত হাঁস নিয়ে এসেছে। তাকে পাঠানো হয়েছিল চাল-ডাল কিনতে। এরই মধ্যে রব উঠল মিলিটারি আসছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেনু দেখতে পেলেন, লোকজন ছুটে গ্রামের দিকে যাচ্ছে। খিলগাঁও, মালিবাগ, চৌধুরীপাড়া এলাকাটা আধা শহর, আধা গ্রাম। তারপরও মানুষ আরও গ্রামের দিকে ছুটছে।
রেনু ভয় পেয়ে গেলেন। ফরিদ বাইরে। না জানি কী হয়।
খানিক পরে ফরিদ এল। খোকার শাশুড়ি মাওইমা তো বলেই দিয়েছিলেন, ও চটপটে। ওকে নিয়ে যাও। আসলেই ছেলে চটপটে। চাল ডাল তো কিনে এনেছে। আবার লোকেরা যখন পালাচ্ছিল, একজনের হাতে ছিল হাঁস। সে দুই টাকা দিয়ে সেই হাঁস কিনে এনেছে।
রাসেল বলল, মা, হাঁস পুষব।
রেনু বললেন, বাবা! হাঁস পুষতে তো পানি লাগবে। আমাদের ৩২ নম্বরের বাসায় কত হাঁস ছিল! আবদুল তো হাঁস-মুরগিগুলোর খাঁচা খুলে দিছিল। গরুগুলোর দড়ি খুলে দিছিল। জানি না, সেগুলো বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে।
রাসেল বলল, বাথরুমে বালতিতে পানি ভরব। তার মধ্যে হাঁসটাকে রাখব!
রেনু বললেন, এত বড় হাঁস, বালতির পানিতে থাকবে কী করে?
এই বাড়িতে এখন মমিনুল হক খোকার বউ মমতাজও এসে গেছেন। তাঁর সঙ্গে ছোট্ট বাচ্চা, পুতুল। আর আছে ছোট্ট দুই খোকা টিটো আর সাব্বির। লিলির মেয়ে ডলি আর রোজী আছে। হাসিনা আর ওয়াজেদের ওখান থেকে চলে এসেছে জেলিও।
রেনু দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। হাসুর এখন শরীরের দিকে যত্ন নেওয়া দরকার। বিশ্রাম দরকার। মন ভালো রাখা দরকার। অথচ একা একা মেয়েটা মানুষের বাসায় আশ্রিতের মতো না জানি কত কষ্ট করেই আছে। যাক, তবু তো বেঁচে আছে। কিন্তু কামালের যে কোনো খবর নেই। কামাল ভালো আছে তো!
হাসুর আব্বাই-বা কোথায় আছেন? রমার কাছ থেকে জানা গেল, বেঁচে ছিলেন। ক্যান্টনমেন্টে রেখেছে।
এই বাসায় কবে যে মিলিটারি হামলা করে ঠিক নেই। সারা রাত রেনু আর মমতাজ জেগে থাকেন। বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখেন। মিলিটারি এল কি না। জামাল আর খোকা বাড়ির পেছনের বারান্দা পরখ করে রেখেছে। একটা গাছ আছে। পানির পাইপ আছে। দিব্যি পাইপ বেয়ে নামা যাবে। মিলিটারি এলে ওরা দুজন পাইপ বেয়ে নেমে পালিয়ে যাবে।
চারদিক থেকে শুধু খারাপ খবর আসে। মানুষ মেরে ওরা রাস্তার ধারে ফেলে রেখেছে। বাসভর্তি মানুষকে বাস থেকে নামিয়ে লাইন ধরে গুলি করে মেরেছে। তবে আকাশবাণী থেকে, বিবিসি থেকে ভালো সংবাদও আসে। চট্টগ্রাম এখনো মুক্ত। কুষ্টিয়া মুক্ত। বগুড়া মুক্ত। ওখানকার মুক্তিবাহিনী। ভালো লড়াই করছে।
বিকেলবেলা রেহানা দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দায়। মা তখনো রান্নাঘরে। এতগুলো মানুষের খাওয়া কেবল শেষ হলো। সবকিছু গোছগাছ করতে তিনি সাহায্য করছেন আবদুলদের। বাসার সামনে একটা আমগাছ। গাছটা দোতলা পর্যন্ত উঠে এসেছে। আমের ছোট ছোট গুটি এসেছে গাছে। যা সুন্দর লাগছে। দেখতে। দুই দিন আগের বৃষ্টিতে পাতাগুলো ধোয়া হয়ে গেছে। পাতাগুলো সবুজ আর বেশ পুষ্ট দেখাচ্ছে।
বাড়ির সামনে একটা মোটরসাইকেল এসে দাঁড়াল। দুজন আরোহী তাতে। তরুণ বয়সী বলেই মনে হয়। একজন তাঁদের বাড়ির সামনেই থাকলেন। আরেকজন মোটরবাইকটা নিয়ে রাস্তার উল্টো পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।
রেহানার গভীর সন্দেহ হচ্ছে। এই দুজন কারা? কেন তারা এই বাড়ির সামনেই এসে দাঁড়াল?
একটু পরে রঙিন জামা পরা, মাথার মধ্যখানে সিঁথি, দাড়িগোঁফবিহীন। ছেলেটা এসে ঢুকে পড়ল বাসায়। তারপর সোজা চলে গেল রেনুর কাছে। মা বলে জড়িয়ে ধরল তাঁকে।
মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন, কামাল, কই ছিলি বাবা এত দিন?
কামাল আস্তে আস্তে মুখ খুললেন। একটা সুইডিশ ফ্যামিলির সাথে ছিলাম। গোঁফ তো আগেই কেটেছি। হেয়ারস্টাইলও বদলে ফেলেছি। দেখছ না কেমন লাল ফুলওয়ালা জামা পরেছি। যাতে কেউ চিনতে না পারে।
রেহানা বললেন, আমিই তো চিনতে পারি নাই। কামাল ভাই, মোটরসাইকেল চালাচ্ছে কে?
তারেক।
রেনু বললেন, তারেককে ওপরে ডেকে নিয়ে আয়।
তারেক এলেন। দেখা করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। মা ছেলের জন্য ভাত বাড়লেন। কামাল আস্তে আস্তে ভাত খাচ্ছেন। রেহানাও পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।
কামাল খোকা কাকুর গাড়ি নিয়ে বের হলেন। সবাই খুব উদ্বিগ্ন। রেনু বারবার করে বলতে লাগলেন, ভাইডি, কাজটা কি তুই ঠিক করলি? অরে গাড়ির চাবি দিলি ক্যান?
ও চাইলে আমি না করি কী করে?
এখন সেই যে গেল। আসতেছি বলে গেল। আসে না তো। রাস্তায় মিলিটারি চেকপোস্ট। চেক করলেই তো ওকে ধরে ফেলবে।
সবার চোখেমুখে উদ্বেগের ছায়া এসে ভর করল। রেহানা বারান্দায় কামাল ভাইয়ের পথ চেয়ে তাকিয়ে রইলেন। কোনো গাড়ি যদি এদিকটায় আসে, তাহলে তো চোখে পড়বেই। জামালও উদ্বিগ্ন। কামাল ভাই যে কী করে না? গাড়ি নিয়ে যাওয়ার দরকার কী! জামাল বললেন।
সন্ধ্যার দিকে কামাল ফিরলেন। বললেন, আমি চলে যাব মা।
কই যাবি?
আপাতত টুঙ্গিপাড়া যাব। ঢাকায় থাকা একদম নিরাপদ নয়।
মা বললেন, আচ্ছা যা।
কামাল বললেন, রেহানা, ওই ব্যাগটা আন। খোল। দ্যাখ ভিতরে একটা টু ইন ওয়ান আছে। আমার হোস্ট ফ্যামিলি আমাকে গিফট করেছে। এটা তুই রাখ। দেশ-বিদেশের খবর শুনতে পারবি। গানও শুনতে পারবি। আর শোন, পাকিস্তানি মিলিটারি যদি আসে, খবরদার ধরা দিবি না। হয় পালিয়ে যাবি, না হলে মারা যাবি।
রেনু বললেন, এগুলো কী ধরনের কথা?
কামাল বললেন, যা রিয়েল, তাই বললাম। পাকিস্তানি সৈন্যরা তো মানুষ না, পশু।
কামাল বেরিয়ে পড়লেন। লঞ্চ ধরতে হবে। সদরঘাট যেতে হবে। নিচে তারেক দাঁড়িয়ে আছেন মোটরসাইকেলসমেত।
রেহানার ইচ্ছা হলো, নিচে গিয়ে ভাইকে বিদায় দিয়ে আসেন। কিন্তু সম্ভব নয়। তারা এখানে আছেন নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে। পাড়া প্রতিবেশীকে তাঁরা জানাতে চান না নিজেদের পরিচয়।
সবাই বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। হেডলাইট জ্বালিয়ে ভটভট শব্দ তুলে কামালকে পেছনে তুলে নিয়ে তারেকের মোটরবাইক অদৃশ্য হয়ে গেল।
রেনু বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
পরের দিন বাড়িতে এলেন কয়েকজন মহিলা। তাঁরা বললেন, আমরা এসেছি আশপাশের বাসা থেকে।
তাঁরা রেনুকে বললেন, আপনারা নাকি শেখ সাহেবের আত্মীয়।
সবাই চুপ করে আছেন। কী বলবেন এই প্রশ্নের উত্তরে।
কালকে নাকি শেখ সাহেবের ছেলে কামাল এই বাড়িতে এসেছিল? আপনারা আপা প্লিজ এই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। জানেনই তো ৩২ নম্বরের বাড়িতে মিলিটারিরা হামলা চালিয়েছে। শেখ সাহেব চলে যাওয়ার পরও মিলিটারি গিয়ে পুরা বাড়িতে গুলি করেছে। জিনিসপত্র তছনছ করেছে। আপনারা এই বাড়িতে আছেন জানলে এই বাড়িতেও কামান দাগাবে। আপনারা চলে যান প্লিজ।
রেনু বললেন, আচ্ছা, একটা দিন সময় অন্তত দেন।
এরই মধ্যে রেহানার ছোট ফুফু খবর পাঠালেন, তিনি গ্রামের বাড়ি চলে যাবেন। রেনু বললেন, তাহলে জেলি, রোজী, ডলি এদেরকেও নিয়ে যা। ঘরে মেয়েদের রাখা বড়ই বিপদের কথা।
খোকাকে বললেন, ভাইডি, ওদের একটু সদরঘাট পৌঁছায়ে দাও না।
ভাবির কথা খোকার জন্যে অলঙ্ঘনীয় হুকুম। কী সর্বনাশের কথা! সদরঘাটের রাস্তায় গাড়ি নিয়ে গেলে রক্ষা আছে? তবু আল্লাহর নাম নিয়ে খোকা বের হলেন জেলি, রোজী, ডলি, তাদের মাকে নিয়ে সদরঘাটের দিকে।
আরেকটা বাড়ি খুঁজে বের করতে হবে। একটা সমাধান আপনাপনিই পাওয়া গেল। বদরুন্নেসা আর নূরুদ্দিন ভারত চলে গেছেন। তাঁদের মগবাজারের বাড়ির চাবি রেখে গেছেন। খবর দিয়েছেন, মুজিব ভাই নেই, এই দুঃসময়ে বাসা ভাড়া করে থাকার দরকার কী। আমাদের মগবাজারের বাড়িতে থাকুন।
এত দিন ওই বাড়ির কথা রেনু ভাবতে চাননি, বাড়িটা একেবারে বড় রাস্তার ওপরে। ১ নম্বর সার্কুলার রোড। এখন আর উপায় কী?
তারা গিয়ে মগবাজারের বাড়িতেই উঠলেন।
.
ব্যাঙ্গমা বলে, এই ছিল তাগো বরাতে।
ব্যাঙ্গমি বলে, ২৫ মার্চ রাত থাইকা তারা কয়টা বাড়িতে গেলেন? ১. ডা. সামাদের বাড়ি. ২. মোরশেদের বাড়ি. ৩. ক্যাপ্টেন রহমানের বাড়ি ৪. মগবাজারের ইঞ্জিনিয়ার আলী সাহেবের বাড়ি। ৫. বলধা গার্ডেনে খোকার শ্বশুরবাড়ি ৬. খিলগাঁও পলির শ্বশুরবাড়ি ৭. চৌধুরীপাড়ার ভাড়া বাড়ি ৮. মগবাজারের ১ নম্বর সার্কুলার রোডের বাড়ি।
ব্যাঙ্গমা বলে, এইটাই শেষ নয়।
ব্যাঙ্গমি বলে, হ। এইটাই শেষ নয়। সেই গল্পে আমরা পরে আসতাছি…
২১
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটগাছ ছেড়ে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি কোথাও যাবে না। এই ছিল তাদের প্রতিজ্ঞা। কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা তারা ধরে রাখতে পারে না।
তারা দেখতে পায়, পাকিস্তানি মিলিটারি ট্রাকে করে ধরে এনেছে কাঠুরে, ইলেকট্রিক করাত, আর তারা কেটে ফেলছে বটগাছটাকে।
ব্যাঙ্গমা বলে, দ্যাখো, মানুষের জিঘাংসার আগুন কত ভয়াবহ হতে পারে! পাকিস্তানি মিলিটারিরা শুধু মানুষ মারছে, তা-ই না, তারা পুড়ায়া দিতেছে বস্তি, তারা গুঁড়ায়া দিতেছে মন্দির আর শহীদ মিনার। জগন্নাথ হলের মাঠে লাইন কইরা মানুষ মাইরা তাগো জিঘাংসা চরিতার্থ হয় নাই, চট্টগ্রামে, রংপুরে, কুমিল্লায়, যশোরে ক্যান্টনমেন্টে ঘুমন্ত বাঙালি সৈন্য আর তাগো স্ত্রী পুত্র-কন্যা-পরিজনদের গুলি কইরা বেয়নেট চার্জ কইরা মাইরা তাগো রক্তের তৃষ্ণা মেটে নাই, তারা এবার হত্যা করতে এসেছে একটা বটগাছকে।
৪ এপ্রিল ১৯৭১।
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি আকাশে ওড়ে আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, পাকিস্তানি মিলিটারিদের আনা শ্রমিকেরা করাত চালাচ্ছে তাদের আশ্রয় বটগাছটার ওপরে। বটগাছ থেকে কাঠের গুঁড়ো নয়, যেন হলুদ রক্ত বেরোচ্ছে। গলগল করে। বটগাছের পাতারা আর্তনাদ করে উঠছে, গাছে আশ্রয় নেওয়া পরগাছারা অশ্রুপাত করছে, গাছের ডালে বাসা বানিয়েছিল যে পাখি আর পতঙ্গ তারা চিৎকার করছে, কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার তো কোনো দ্বিতীয় উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না এই পৃথিবীতে। পুরো গাছটাকে ধরাশায়ী করে টুকরো টুকরো কেটে তারপর রাগ কিছুটা কমে হয়তো দায়িত্ব পাওয়া মেজরের আর সৈন্যদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটগাছ বলতে আর কিছু রইল না, এখন কোথায় তোরা আন্দোলন করবি, বেইমান বেজন্মা বাঙালির বাচ্চারা!
ব্যাঙ্গমা বলে, এখন আমরা কই যামু?
ব্যাঙ্গমি বলে, চলো তাইলে আমরা রমনা পার্কের পাকুড়গাছটায় গিয়া বসি।
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি উড়ে গিয়ে বসল রমনার অশ্বথশাখায়।
২২
এই মাটি ছাইড়া আমি কোথাও যামু না। কারে বলে দ্যাশ? এই মাটিই আমার দ্যাশ। কুমিল্লার বাড়িতে লাগানো সুপুরিগাছের গোড়ার মাটিতে খুরপি চালাতে চালাতে তিনি আপনমনে বিড়বিড় করছিলেন। নিজ হাতে কতগুলো নারকেল আর সুপুরির চারা লাগিয়েছেন কিছুদিন আগে। এগুলো এখনো মাটিতে শিকড় ছড়িয়ে শক্তপোক্ত হয়নি। এই গাছগুলোকে বাঁচাতে পরিচর্যা দরকার। কিন্তু সেই যে চারপাশে এত আম, জাম, কাঁঠাল, কদম, হিজলগাছ আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে, মাটির গভীরে শিকড় ছড়িয়েছে, এদেরকে যদি জিজ্ঞেস করি, তোমাদের দেশ কী, ও গাছ ভাইয়েরা, ওরা কী বলবে? যাবে তোমরা নিজের দেশে? একটাই দেশ ছিল, এখন ভাগ হয়ে গেছে। এইটা আর তোমাদের দেশ না? ও বকুলগাছ দিদি, ও অশ্বত্থ দাদা, যাইবা আমগো সাথে, ওই পারে?
১৯৪৭ সালে একষট্টি বছরের বৃদ্ধ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হাসেন। তাঁর সাদা চুল। যেন বকুলগাছ নয়, তার হাসি বকুল ঝরায়। এই মাটি ছাইড়া আমি কোথাও যামু না। এই মাটিই আমার দ্যাশ। এই আমার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটি, এই আমার কুমিল্লার মাটি। এই আমার পূর্ব বাংলার মাটি। রমেশ পানির ঝাঁঝরি এনে তাঁর পাশে দাঁড়ালে তিনি গাছের গোড়ায় পানি ঢালেন, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গাছের পাতাতেও পানি ঢালেন। গাছের পাতারা জলের সোহাগ পেয়ে ঝকমকিয়ে ওঠে, ধীরেন্দ্রনাথ সেই হাসিটুকু যেন দেখতে পান।
রমেশ লোকটা তার পুরোনো ভূত্য, ঘাড়ে গামছা, পরনে ধুতি, কুচকুচে কালো গায়ের রং, চামড়া ফাটা, তার বয়স পঁয়তাল্লিশও হতে পারে, পঁয়ত্রিশও হতে পারে, সে তার বাবুর এই স্বভাব জানে, গাছের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে কথা কন তিনি। ধীরেন্দ্রনাথ বলেন, রমেশ, এই যে ছোট সুপারিগাছের চারা, নারকেলগাছের চারা, এইগুলান তুইলা লইয়া গিয়া কলকাতায় মাটিতে লাগাইলে বাঁচব না?
বাঁচতেও পারে বাবু।
কিন্তু বড়গুলানরে লইয়া যাওন যাইব? ওই বটগাছটারে যদি তুইলা লইয়া যাই?
রমেশ হাসে। তাঁর দাঁত কালো, পান-তামাক নানা কিছু খেয়ে দাঁতের বারোটা বাজিয়েছে সে।
বড়গাছ কি আর তোলন যাইব বাবু! কাইটা-চিইরা তক্তা লইয়া যান।
তাইলে আমরা বড় মানুষগুলান, কই যামু? এইহানে থাকুম নাহি কলকাতা যামু?
রমেশ আবার দাঁত বের করে। বড় কালো ওর দাঁতগুলো।
শোনো, করাচি গেছিলাম না? মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণটা শুইনা, কইলজাটা ঠান্ডা হইছে। আসলে তো হেও কংগ্রেসই করত। শিক্ষিত লোক। সেকুলার আছে।
জিন্নাহ কী কইছে? রমেশ নারকেলগাছের চারার ওপরে পানি ঢালতে ঢালতে শুধায়।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মনে পড়ে জিন্নাহর প্রথম বক্তৃতাটা। করাচিতে গণপরিষদ সম্মেলনে তিনি প্রথম দিয়েছিলেন এই ভাষণটা। যা-ই হোক না কেন, পাকিস্তান কখনোই এমন ধর্মরাষ্ট্রের পরিণত হবে না, যা কিনা ধর্মযাজকেরা পারলৌকিক মিশন নিয়ে শাসন করে থাকে। আমাদের আছে অনেক অমুসলিম-হিন্দু, খ্রিষ্টান, পারসি, কিন্তু তারা সবাই পাকিস্তানি। তারা অন্যদের মতো সমান অধিকার ভোগ করবে এবং পাকিস্তান বিষয়ে তারা পূর্ণ অধিকার নিয়ে ভূমিকা পালন করবে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমরা শুরু করছি এমন একটা কালে, যখন কোনো বৈষম্য নেই, কোনো সম্প্রদায়ের তুলনায় আরেকটা সম্প্রদায়কে আলাদা করা হয় না, বর্ণের কারণে, গোত্রের কারণে কারও প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা হয় না। আমরা শুরু করতে যাচ্ছি এই মৌলনীতি অবলম্বন করে যে আমরা সবাই একটা রাষ্ট্রের নাগরিক এবং সম অধিকারসম্পন্ন নাগরিক।
এই কথা শুনে আসার পরে ধীরেন্দ্রনাথ কি এই কুমিল্লা ছেড়ে, এই পূর্ব বাংলা ছেড়ে কলকাতা যেতে পারেন?
আমি এই মাটির পোলা, আমি এই আমগাছের মতো, এই বটগাছের মতো, আমারে তোমরা আর কোথাও লইতে পারবা না। আমি এই মাটির সাথে হামাগুড়ি দিয়া মাটি ধইরা আঁকড়াইয়া থাকুম।
রমেশ আবার তার কালো দাঁত বের করে।
মাটির কথাই ধীরেন্দ্রনাথকে বলতে হয়। কংগ্রেসি ছিলেন তিনি। গান্ধীবাদী ছিলেন। জেল খেটেছেন স্বদেশি করতে গিয়ে। স্বদেশ হিসেবে পেয়েছেন পাকিস্তানকে। মাটির গন্ধ তার গা থেকে যায় না। পাস করা উকিল। ওকালতিই তার ব্যবসা। কিন্তু কথা বলতেন মাটির টানমাখা বুলিতে।
মাটি অথবা মা-টি। দুটোই তো মা। ভাষা, সে-ও তো মা-ই। মায়ের ভাষা–আমরা বলি না?
তো, ১৯৪৮ সালের বসন্তকালে, ফাল্গুন মাসে, কুমিল্লায় কি ঢাকায় যখন। পলাশ ফুটেছে, কোকিল ডাকছে, দক্ষিণা সমীরণ বইছে, তখন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য, তাঁর মাটির কথা, কিংবা মা-টির কথা পেড়ে বসলেন পার্লামেন্টে। জিন্নাহ তখন সভাপতিত্ব করছিলেন গণপরিষদে। পার্লামেন্টে একটা বিধির প্রস্তাব করা হয়েছে। বিধিটা কী?
গণপরিষদে সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজির সঙ্গে উর্দুও বিবেচিত হবে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নোটিশ দিলেন। একটা ছোট্ট, খুবই ছোট্ট সংশোধনী আছে তার। ফ্লোর পেলেন দুদিন পর।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। পায়ের নিচে তাঁর করাচির গণপরিষদ ভবনের পাথুরে মেঝে, কিন্তু কেথেকে যেন তিনি পাচ্ছেন তাঁর কুমিল্লার মাটির গন্ধ, তার মনে হলো, তিনি বৃক্ষ হয়ে উঠছেন, এবার তার শিকড় তার পায়ের নিচে চাড়া দিচ্ছে, জানান দিচ্ছে তার পায়ের নিচে মাটি আছে, তার রক্তের মধ্যে মা আছে, ভাষা আছে–তিনি বললেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, স্যার, আমার সংশোধনী : ২৯ নম্বর বিধির ১ নম্বর উপবিধির ২ নম্বর লাইনে ইংরেজি শব্দের পর অথবা বাংলা শব্দ দুটি যুক্ত করা হোক।
বাংলার বসন্তকালের সমস্ত শিমুল আর পলাশ আর আম আর জামগাছের মুকুলগন্ধমাখা ডালপালা-পাতার ফাঁক থেকে এক কোটি কোকিল কুহু কুহু বলে ডেকে উঠল।
ধীরেন্দ্রনাথ বললেন, আমি এই সংশোধনীটা ক্ষুদ্র প্রাদেশিকতার মানসিকতা থেকে উত্থাপন করিনি। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ছ কোটি নব্বই লাখ। এর মধ্যে চার কোটি চল্লিশ লাখ কথা বলে বাংলায়। তাহলে স্যার দেশের রাষ্ট্রভাষা কোনটি হওয়া বাঞ্ছনীয়।…স্যার, এই জন্য আমি সারা দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মনোভাবের পক্ষে সোচ্চার হয়েছি। বাংলাকে একটা প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে গণ্য করা যাবে না। এই বাংলা ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
পূর্ববঙ্গের সাধারণ সদস্য প্রেমহরি বর্মণ তাকে সমর্থন করলেন।
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর বক্তব্য হলো, এটা আসলে কোনো নিরীহ সংশোধনী নয়, এটা হলো পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে যে ইস্পাতকঠিন ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা বিনষ্ট করা। পাকিস্তান একটা মুসলিম রাষ্ট্র। এ জন্য মুসলিম জাতির ভাষা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।
উঠে দাঁড়ালেন ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত। তিনিও পূর্ববঙ্গের সদস্য। বললেন, প্রধানমন্ত্রী এমন কিছু মন্তব্য বেছে বেছে করেছেন, যা তিনি না করলেও পারতেন।
পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন বললেন, আমি নিশ্চিত, পাকিস্তানের বিপুল জনগোষ্ঠী উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে।
পূর্ববঙ্গের শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বললেন, পাকিস্তান একটা মুসলিম রাষ্ট্র, এই কথাটা পরিষদের নেতার মুখে শুনে দুঃখ পেয়েছি খুব। এত দিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল, পাকিস্তান গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র, এই রাষ্ট্রে মুসলিম আর অমুসলিমদের সমান অধিকার।
ভোটে উঠল সংশোধনীটা। পরিষদের সভাপতি মোহামদ আলী জিন্নাহ। তিনি কণ্ঠভোটে দিলেন প্রস্তাবটা। মোট সদস্য ৭৯ জন। ৪৪ জন পূর্ব বাংলার।
কিন্তু কণ্ঠভোটে ধীরেন্দ্রনাথের প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেল।
এক কোটি কোকিল তীব্রস্বরে ডেকে উঠল পূর্ব বাংলায়। এক লাখ শিমুল মাথা ঝাঁকাল। এক লাখ পলাশ পাপড়িতে আগুন জ্বালাল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল আর পুরান ঢাকার নানা স্কুল থেকে ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে পড়তে লাগল স্লোগান দিতে দিতে–পাখির ঠোঁটে ঠোঁটে বার্তা রটে গেল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। সেই ১৯৪৮-এর ফাল্গুনেই। ১১ মার্চ হরতাল। পিকেটিং করতে হবে। ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের জলদগম্ভীর কণ্ঠ বেজে উঠলে অলি আহাদ সমর্থন দিলেন। তোয়াহা, শওকত, শামসুল হক, অধ্যাপক আবুল কাশেম, নাইমুদ্দিন, আবদুর রহমান চৌধুরী, কামরুদ্দীন, তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল-হরতালের দিনে কে কোন জায়গায় পিকেটিং করবেন, দায়িত্ব ভাগাভাগি হয়ে গেল।
মাটির টানটা ধীরেন্দ্রনাথের কথাবার্তায় ছিল সর্বক্ষণই। ৪৮ সালেই ময়মনসিংহ শহরে এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে আগের বক্তা মালেক সাহেবের দেশে আরেকটা তুলাধুনার ব্যবস্থা হওয়া উচিত এই বক্তব্যের পরে তিনি বললেন, এই তো মাত্র দেশে বহুত তুলাধুনা হইয়া গেল, কিন্তু তার রেশ তো এখনো শেষ হইল না। কাজেই এমন ব্যবস্থা করতে হইবে, যাতে হিন্দু মুসলমান, আমরা বরাবর যে রকম মিইলা-মিইশা কাজ কইরা যাইতাছি, ইংরেজের বিরুদ্ধে মিইলা-মিইশা সংগ্রাম কইরা তারারে তাড়াইছি, এইভাবে মিইলা-মিইশাই আমরা আগাইয়া যাইব, এই সম্প্রীতি কিছুতেই নষ্ট হইতে দেওন যাইব না।
কথায় মাটি গন্ধ। মগজে মাটির নেশা। কতজন উকিল কুমিল্লা ছেড়ে চলে গেল কলকাতায়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গেলেন না। মন্ত্রী হয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমানের মন্ত্রিসভায়, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। তো মন্ত্রী তো তিনি কলকাতাতেও হতে পারতেন। হয়তো মুখ্যমন্ত্রী হতে পারতেন, ডেপুটি লিডার ছিলেন কংগ্রেসের। মুখ্যমন্ত্রী না হলেও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তো হতে পারতেনই।
কিন্তু কুমিল্লার মাটি, মেঘনা কি তিতাসের জল তাকে আবিষ্ট করে রাখল। এই মাটিই যে তার দেশ।
১৯৭০-এ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা বলল, কলকাতায় চলে যাও। মেয়ে পুতুল বলল, বাবা, দেশে যদি একটা কিছু ঘটে যায়, তোমাকেই তো বাবা সবার আগে মারবে।
তিনি বললেন, তোরা শুনবি তোগো বাবারে গুলি কইরা রাস্তায় ফেইলা রাখা হইছে। শকুনি আমার দেহটা খাইতাছে। তবু তো ভালো প্রাণীর খাদ্য হমু। জীবন এইভাবে শেষ হইলে তবু একটা মূল্য থাকে।
সেই কথা শুনে রমেশ কেঁদে উঠেছিল। পুতুল বলেছিল, কাকু, কেঁদো না তো। বাবাকে তো চেনোই। সেই স্বদেশি আমল থেকে জেলখাটা মানুষ।
রমেশ বলল, কোথাও সইরা থাকলেই তো হয়।
এই মাটি ছাইড়া আমি কই যামু রমেশ? ৮৫ বছরের বৃদ্ধ অকম্পিত স্বরে বললেন।
২৯ মার্চ ১৯৭১। কুমিল্লা শহরে কারফিউ। চারদিকে নিস্তব্ধতা। শিমুল ফুল ফেটে গিয়ে তুলো বীজ উড়ছে, তার শব্দও যেন পাওয়া যাবে, এমনই নিস্তব্ধতা। থেকে থেকে ফৌজি গাড়ি ছুটছে আর তার পেছনে ধেয়ে যাচ্ছে নেড়িকুকুরের দল।
ধীরেন্দ্রনাথকে আজ বড় শান্ত দেখায়। তিনি সন্ধ্যার সময় মাথা ধুলেন। নাতনিকে ডেকে এনে বললেন, ওই কালো চামড়ায় মোড়া বইটা দাও তো দিদি। বইটা এনে দিল নাতনি। তিনি পাতা ওলটালেন। লাল পেনসিল দিয়ে দাগ দিলেন কয়েকটা বাক্যে। বললেন, শোনো, কী লেখা এখানে, দেশের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিলে সে মরে না, সে শহীদ হয়। সে অবিনশ্বর, তার আত্মা অমর।
পুত্র আর পুত্রবধূদের ডাকলেন তিনি। বললেন, আজ রাতেই ওরা আমাকে নিয়ে যাবে। রমেশের চোখ দিয়ে দরদরিয়ে জল গড়াতে লাগল। সুপুরিগাছগুলো বড় হয়েছে। নারকেলগাছে নারকেল ধরেছে।
রাত বাড়ছে। কুকুরের আর্তনাদ আসছে কানে। রাত দেড়টায় বাড়ির সামনে এসে থামল পাকিস্তানি সৈন্যদের ট্রাক। ধরে নিয়ে গেল ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আর তাঁর ছোট ছেলে দিলীপ দত্তকে।
ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হলো তাদের। ওটা ততক্ষণে কসাইখানায় পরিণত হয়েছে। বাঙালি সৈন্য ও অফিসারদের মারা হয়েছে। নৃশংসভাবে।
নির্যাতন শুরু হলো ৮৫ বছরের ওই বৃদ্ধের ওপরে। এই বৃদ্ধই সব নষ্টের গোড়া। আজ থেকে ২৪ বছর আগে করাচির পার্লামেন্টে এই মালাউনই প্রথম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তোলে। এ বছর, ১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারিতেও শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে বেইমান শেখ মুজিব এই ধীরেন্দ্রনাথের নাম নিয়েছে। ওকে পেটাও।
বেশি প্রহার দরকার ছিল না। হাঁটুর হাড় মড়মড় করে ভেঙে গেল। তবু থামে না নির্যাতন। চোখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো কলম। যেন এই চোখে সে আর কোনো দিনও বাংলা বর্ণমালা দেখতে না পায়। দুহাতের নখ উপড়ে ফেলা হলো। চোখের পাতা টেনে ছিঁড়ে ফেলা হলো।
ক্যান্টনমেন্টের একজন নাপিত দেখতে পেল, বুড়ো মানুষটি হামাগুড়ি দিচ্ছেন, একটু আড়ালে সরে যাচ্ছেন মলত্যাগ করবেন বলে। একাত্তরের বসন্তে, চৈত্রের শেষ দিনে নাকি পয়লা বৈশাখে তিনি হামাগুড়ি দিয়ে পাকা শান ছেড়ে চলে এলেন মাটিতে। মাটি আঁচড়ালেন। মাটি মাখলেন চোখে মুখে-মাথায়।
নাপিতটা ভাবল, মলত্যাগ করতেই এসেছেন। কিন্তু এবার তিনি মলত্যাগ করতে আসেননি। তিনি বিড়বিড় করলেন। বললেন, এই মাটিই আমার মা। এই মাটিই আমার দেশ। এই মাটি আমার মা-টি। তাঁর ভাষাই আমার মায়ের ভাষা। মাটি, আমি তোমারে নিলাম। মা-টি, তুমি আমারে লও।
তিনি মাটিতে দেহ রাখলেন।
পাকিস্তানি সৈন্যরা আরও আরও বাঙালি সৈন্য আর বেসামরিক মানুষের সঙ্গে তাকে পুঁতে ফেলল মাটিতেই।
রমেশ আর্তনাদ করে। কোনোরকমে কুমিল্লা ছেড়ে আগরতলা পাড়ি দিয়ে রমেশ নিজের প্রাণটা বাঁচায়। তারও বয়স হয়েছে। চোখে ঠিকমতো দেখতে পায় না। দাঁত পড়ে গেছে। কিন্তু সে তো বেঁচে আছে। তার মনিব ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে মাটিতে হামাগুড়ি দিয়েছিল, সেই কথাটা আকাশে-বাতাসে ১৯৭১-এ। খুব শোনা গেল। রমেশও শুনল। কতজনের মুখ থেকে! তারা বলল, উনি হামাগুড়ি দিতেন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য, আড়াল খোঁজার জন্য।
রমেশ বিড়বিড় করে বলল, আমি জানি ক্যান বাবু হামাগুড়ি দিচ্ছিল। মাটি ধরার জন্য। ভগবান তাঁর ইচ্ছা পূরণ কইরাছে, তিনি মাটিতেই মিইশা গেছেন।
২৩
স্যার, আপনাকে আসতে হবে।
দুজন অফিসার এসে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসের তার কক্ষটির সামনে। তিন রাত স্কুলের একটা ঘরে ছিলেন তিনি। এরপর তাঁকে আনা হয় এই হাউসে। এখানকার পরিচ্ছন্ন ঘরের পরিচ্ছন্ন বিছানায় তিনি থাকছিলেন, আর কখন তার বিচার শুরু হবে, সে জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বিচারের জন্য তাঁকে ক্যান্টনমেন্টে আনা তো আজকেই প্রথম নয়।
শেখ মুজিব তার পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে নিলেন। এপ্রিলের গরমের মধ্যেও ওপরে পরলেন মুজিব কোটটি। হাতে পাইপ, পকেটে তামাকের কৌটা, লাইটার নিয়ে তিনি বললেন, আমি রেডি।
জনাব। আমরা আপনার ব্যাগটি সঙ্গে নিচ্ছি। আপনাকে আরেক জায়গায়। রাখতে নিয়ে যাওয়া হবে।
সৈনিকেরাই তার ছোট্ট জেলখানার থলেটি সঙ্গে নিল। সামনে-পেছনে সৈন্য পরিবেষ্টিত অবস্থায় তিনি ফ্ল্যাগ হাউসের লম্বা বারান্দা হেঁটে পার হলেন। প্রথম তিন রাত প্রায় নিঘুম কাটানোর পর ফ্ল্যাগ হাউসের তিন দিন তিন রাত তুলনামূলকভাবে ছিল অনেকটাই স্বস্তিদায়ক। এখন এরা আবার তাঁকে কোথায় নিচ্ছে কে জানে? রাত আটটার মতো বাজে। বারান্দার বাতিগুলো জ্বলছে, আর তাতে পোকা ঘিরে আছে। শেখ মুজিব এগোচ্ছেন, একটার পর একটা লাইটের আলোয় তার চারদিকে অনেকগুলো ছায়া একবার ছোট হচ্ছে, একবার বড় হচ্ছে।
তিনি বারান্দার সিঁড়ির কাছে এসে দেখলেন তিনটি গাড়ি। সামনের দুটো লরি। তাতে সৈন্যরা এলএমজি বসিয়ে সদা প্রস্তুত। মাঝখানেরটা একটা সেডান গাড়ি। তাঁকে মাঝখানের কারেই ওঠানো হলো। গাড়ির কাঁচ পুরোটাই পর্দা দিয়ে ঢাকা। তার দুপাশে দুজন সৈনিক বসল। সামনে ড্রাইভার আর একজন সৈনিক। বেশিক্ষণ চলল না গাড়ি। দরজা খুলে গেল। তাঁকে বলা হলো, নামুন। তিনি নামলেন।
বুঝতে পারলেন তাকে এয়ারপোর্টে নেওয়া হয়েছে। সামনে একটা উড়োজাহাজ। পিআইএর মনোগ্রাম আঁকা আছে প্লেনের গায়ে। তিনি বিমানের সিঁড়িতে পা রাখলেন। তারপর তাকালেন আকাশের দিকে। কালো আকাশে অনেক তারা। একপশলা বাতাস এসে মুজিবের পাঞ্জাবির হাতা ওড়াতে লাগল। মুজিব প্লেনের ভেতরে গিয়ে ঢুকলেন। পুরো প্লেন ফাঁকা। তিনি ছাড়া আর কোনো যাত্রী নেই। তবে প্রহরী আছে কয়েকজন। তিনি একটা সিটে গিয়ে বসলেন। জানালা দিয়ে বিমানবন্দরের আলো দেখতে পেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমান নড়তে শুরু করল। তিনি বিমানের জানালা দিয়ে অপস্রিয়মাণ গাছগাছড়া, আলোকস্তম্ভ, দূরের টার্মিনাল ভবনের আলো দেখতে লাগলেন। বিমান দ্রুততর হলো। আকাশে উড়ে গেল। তিনি নিচে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন ঢাকার কী অবস্থা।
বিস্ময়করভাবে তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা কিংবা বৃদ্ধ আব্বা-আম্মার কথা তাঁর মনে পড়ল না। তিনি একটা অদ্ভুত দৃশ্য কল্পনায় দেখতে পেলেন : রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ জনপদে ঢুকে পড়েছে। একের পর মানুষের ওপরে থাবা বসাচ্ছে। তখন গ্রামবাসী জেগে উঠছে। যার যা কিছু আছে–লাঠিসোটা, বন্দুক, বল্লম, জাল, ঢাকঢোল, মশাল–নিয়ে হাজার হাজার মানুষ তাড়া করছে বাঘটাকেই।
প্লেন প্রথমে গেল কলম্বো। সেখানে ঘণ্টা দেড়েক দাঁড়িয়ে আবারও উড়াল। একঘেয়ে বিরক্তিকর ফ্লাইট। একসময় মুজিব ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘণ্টা দেড়েক ঘুমানোর পর জাগলেন। এই সময় একজন ক্রু তাঁর কাছে এল এবং বলল, তিনি সকালের ব্রেকফাস্ট করবেন কি না। তিনি মাথা নাড়লেন। বিমানের নাশতার একটা রেডিমেড প্যাকেট গরম করে তাঁকে দিয়ে দেওয়া হলো। ভেতরে তিনি একটা রুটি, ডাল এবং ডিম দেখতে পেলেন। সেটা সামনে নিয়ে তিনি বসে রইলেন। চা বা কফি কিছু খাবেন? তিনি কফির কথা বললেন। এই সময় হঠাৎ করে তার মনে হলো তাঁর বাড়ির পোষা কবুতরগুলোর কথা। তিনি প্রায়ই কবুতরগুলোকে গম, খুদ ইত্যাদি খেতে দিতেন। ২৫ মার্চ রাতে যে হারে গুলির শব্দ আর আগুন তিনি দেখেছেন, তাতে বাড়ির মানুষ সব বেঁচে আছে কি না, আল্লাহ জানেন, আর কবুতরগুলোর কী পরিণতি হয়েছে, সে খবর কে রাখবে।
প্লেনটা অবতরণ করছে। ধীরে ধীরে আকাশ থেকে নিচের দিকে নামছে। বেশ খানিকটা ঝাঁকুনি খেয়ে আবার শান্তভাবেই বিমান নিচের দিকে নামতে লাগল। এরা তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে আনছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু পাকিস্তানের কোন এয়ারপোর্ট এটা? সমুদ্র দেখে তিনি অনুমান করতে পারলেন যে এটা করাচি। বিমান অবতরণ করে দৌড় ধরল। শেষে গাড়ির মতো চলে যথাস্থানে থামল। বেশ খানিকক্ষণ তিনি বসে রইলেন আসনে।
পরে দরজা খুলে গেল। সিঁড়ি বেয়ে নেমে তিনি সৈন্যভরা গাড়িতে উঠে টার্মিনালের ভিআইপি লাউঞ্জে গেলেন। বাইরে আকাশে তীব্র রোদ।
তাঁকে বসানো হলো সোফায়। তারপর এল ক্যামেরাম্যান। তাঁর ছবি তোলা হলো। তাঁকে কফি পান করতে দেওয়া হলো। এরপর আবারও একটা সামরিক বিমানে তোলা হলো তাকে। নেওয়া হলো রাওয়ালপিন্ডিতে। সেই প্লেন থেকে নামিয়ে একটা হেলিকপ্টারে তোলা হলো তাকে। এক ঘণ্টার মতো উড়ে হেলিকপ্টার সোজা গিয়ে নামল একটা কারাগারের ভেতরে।
শেখ মুজিবকে নেওয়া হলো একটা ছোট্ট ঘরে। সেই ঘরে একটামাত্র ছোট্ট গবাক্ষ। একটা নোংরা বিছানা। তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। নিঃসঙ্গ কারাবাসের অভিজ্ঞতা তার আছে? তাই বলে এই রকম একটা বদ্ধ কেটলির মতো ঘরে! তিনি তাকিয়ে দেখলেন, ঘরে কোনো ফ্যানও নেই। আর ততক্ষণে প্রচণ্ড গরমে তাঁর সেদ্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। তাঁকে এই প্রকোষ্ঠের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো।
তিনি স্তম্ভিত হয়ে রইলেন। তারপর নোংরা বিছানাতেই বসলেন। গায়ের কোটটা খুললেন। একটু পর লোহার দরজা খোলা হলো।
.
ব্যাঙ্গমা বলল, বঙ্গবন্ধুরে লওয়া হয় পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি জেলে।
ব্যাঙ্গমি বলল, নারীদের কারাগারের পাশে তার লাইগা একটা বিশেষ সেল তৈরি করা হয়।
ব্যাঙ্গমি বলল, একটা ছোট্ট ঘরে রাতের বেলা তালা বন্ধ কইরা রাখা হইত তারে।
ব্যাঙ্গমা বলল, দিনের বেলা একটা সময় তারে হাঁটার সুযোগ দেওয়া হইত। সেই জায়গাটাও আছিল উঁচা দেওয়াল দিয়া ঘেরা। চল্লিশ ফুট বাই দশ ফুট একটা জায়গায় তিনি হাঁটতেন।
ব্যাঙ্গমি বলল, বাথরুম আছিল নোংরা।
পুরা জায়গার বাতাস থিকাথিকা হইয়া আছিল শুকনা মলমূত্রের গন্ধ। দিয়া।
তার সেলের চারপাশে থাকত সৈন্যদের সশস্ত্র পাহারা।
কেউ তার সাথে কথা কইত না। তিনিও কারও লগে কথা কইতেন না। খাওয়াদাওয়া আছিল খুবই খারাপ।
২৪
ব্যাঙ্গমা বলল, ইতিহাসের মধ্যে কতকগুলান সুইট কো-ইনসিডেনস ঘটে।
ব্যাঙ্গমি বলল, এই যেমন এখন ঘটল।
ব্যাঙ্গমা বলল, হ। এই যেমন এখন ঘটল। অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান এবং আনিসুর রহমান আর্মির তাড়া খাইয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া হইয়া আগরতলা গেলেন। সেইখান থাইকা প্লেনে তুইলা আগরতলার মুখ্যমন্ত্রী তাগো লইয়া আইলেন দিল্লি। আর ব্যারিস্টার আমীর আর তাজউদ্দীন চুয়াডাঙ্গা দিয়া বর্ডার পার হইয়া কলকাতা দিয়া আইসা হাজির হইলেন দিল্লি। তাগো লইয়া গেলেন বিএসএফ প্রধান রুস্তমজি। এই চারজনের দেখা হইয়া গেল।
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলাবলি করে :
তাজউদ্দীন আহমদ কী করে সীমান্ত অতিক্রম করলেন, সেটা আমরা মোটামুটি জানি। রেহমান সোবহান আর আনিসুর রহমানের বর্ডার পার হওয়ার গল্পটা স্মরণ করা যেতে পারে।
.
২৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকায় কারফিউ স্থগিত করা হলে রেহমান সোবহানের গুলশানের বাড়ি গিয়ে হাজির হন মোজাফফর ন্যাপের পক্ষ থেকে সত্তরের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নৌকা মার্কার কাছে পরাজয় বরণ করা ৩৬ বছর বয়সী সাংবাদিক, লেখক কাম রাজনীতিবিদ মঈদুল হাসান। রেহমান সোবহানের ফোরাম পত্রিকায় তিনি ৩১ জানুয়ারি ১৯৭০ লেখেন দ্য স্ট্র্যাটেজি ফর ইকোনমি শীর্ষক প্রবন্ধ। ফোরাম পত্রিকার সম্পাদক রেহমান সোবহান বেঁচে আছেন কি না, থাকলে তাকে বাঁচানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায় কি না, এই হলো মঈদুল হাসানের আগমনের উদ্দেশ্য। রেহমান সোবহান বাইরে ছিলেন, তিনি না আসা পর্যন্ত মঈদুল অপেক্ষা করেন।
তিনি এলে মঈদুল তাকে বললেন, তোমাকে এখনই বাড়ি ছাড়তে হবে!
রেহমান সোবহান, দুই অর্থনীতি তত্ত্বের প্রবক্তা, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, স্বাধীন বাংলাদেশের তাত্ত্বিক রূপরেখা নির্মাণে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও পরামর্শে যিনি তাজউদ্দীনের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন, যার বাবা মুর্শিদাবাদের বাঙালি, মা লক্ষ্ণৌর। ড. রেহমান সোবহান কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে এসেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, মায়ের সূত্রে তিনি খাজা পরিবারের আত্মীয়, খাজা নাজিমউদ্দিন তাঁর নানির ভাই। রেহমান সোবহান বললেন, আমাকে কেন বাড়ি ছাড়তে হবে?
কারণ, পাকিস্তানি আর্মি নির্বিচার মানুষ খুন করছে। আবার তালিকা ধরে খুঁজে খুঁজেও মানুষ মারছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জি সি দেব, মনিরুজ্জামানসহ অনেক অধ্যাপককে মেরেছে। শোনা যাচ্ছে, রাজ্জাক স্যারকেও মেরে ফেলেছে। তোমাকে মারবে না কেন? তুমি তো শেখ সাহেবের ঘনিষ্ঠজন।
আমাকে মারবে না কারণ, আমি রাজনীতি করি না।
জি সি দেব স্যারও রাজনীতি করতেন না।
আমার ধারণা তারা ধানমন্ডি এলাকায় আওয়ামী লীগারদের খুঁজবে। গুলশান এলাকায় আসবে না।
আমি তর্ক করব না। আমি শুধু একটা কথা বলব, তুমি যদি বাঁচতে চাও, তুমি আমার সঙ্গে এখনই গাড়িতে ওঠো। একমুহূর্তও দেরি করা চলবে না।
রেহমান সোবহান তার স্ত্রী সালমার সঙ্গে কথা বলে নিজের কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে মঈদুলের গাড়িতে উঠলেন।
মঈদুল তাকে নিয়ে গেলেন সিধু মিয়ার গুলশানের বাড়িতে।
.
এইখানে আবার ব্যাঙ্গমা কথা বলে উঠল, সিধু মিয়া হইলেন মোখলেসুর রহমান সিধু। রংপুর থাইকা আসা মানুষটা ন্যাপ নেতা মশিউর রহমান যাদু মিয়ার ভাই, তথ্যের খাতিরে এইটাও উল্লেখ করতে হয়। তিনি আছিলেন সফল ব্যবসায়ী, আর প্রগতিশীল সংস্কৃতিসংগঠক। ছায়ানটের তিনি অন্যতম। উদ্যোক্তা।
.
ব্যাঙ্গমি বলে, এইটাও কইয়া ফেলা ভালো যে ফ্যাশন-উদ্যোক্তা মডেল হিসেবে যিনি স্বাধীনতার পরে নব্বইয়ের দশকে দেশে-বিদেশে বিখ্যাত হইবেন, সেই বিবি রাসেলের তিনি বাবা।
.
সিধুর স্ত্রী রোজ। এই এক আশ্চর্য মানবী। একাত্তর সালের এই ঘোর দুঃসময়ে তাদের বাড়িতে পলায়নপর মানুষেরা আশ্রয় নিয়ে কেবল ঘর ভরে তুলেছিল তা নয়, রোজ নিজে গাড়ি চালিয়ে শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তীর মতো মানুষদের বর্ডার পার করিয়ে দিয়ে এসেছিলেন।
সিধু মিয়া বললেন, আমাদের বাসা আপনার জন্য নিরাপদ না। আপনারা এক কাজ করুন, নদী পার হয়ে রোজের বাপের বাড়ি বেরাইদে চলে যান। আমি সঙ্গে লোক দিয়ে দিচ্ছি।
রোজ ড. রেহমানকে খাইয়েদাইয়ে রওনা করিয়ে দিলেন।
পথে নেমে রেহমান সোবহান দেখতে পেলেন, পুরা পথই জনস্রোত। শত শত মানুষ হেঁটে, রিকশায় যে যেভাবে পারছে শহর ছাড়ছে। তিনি জনস্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিলেন।
মানুষের মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে রেহমান পেয়ে গেলেন আরেক অর্থনীতিবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনিসুর রহমানকে।
তিনি কথা বলে উঠলেন, ড. আনিস!
সোবহান।
আপনিও ঢাকা ছাড়ছেন?
সোবহান জানেন না আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারে কী হয়েছে? কোনোরকমে বেঁচে গেছি স্যার। জাস্ট একটা তালার জোরে।
মানে?
জানেনই তো আমাদের কোয়ার্টারে দুটা করে দরজা সামনের দিকে। একটা দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিয়ে আরেকটা দরজায় ছিটকিনি দিয়ে রেখেছিলাম। ২৫ তারিখ রাতে তারা বিল্ডিংয়ে আসে। নিচের তলার বাসিন্দা জি সি দেব, ওপরের তলার অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকে গুলি করে মেরে ফেলে।
কোন মনিরুজ্জামান?
স্ট্যাটিস্টিকসের। সম্ভবত তারা নাম গুলিয়ে ফেলেছে। তারা বাংলার মনিরুজ্জামানকে খুঁজতে এসে স্ট্যাটিস্টিকসের নিরীহ মনিরুজ্জামানকে মেরে ফেলেছে।
রাজ্জাক সাহেব কি বেঁচে আছেন?
হ্যাঁ। তার ফ্ল্যাটে সৈনিকেরা নক করে। তিনি দরজা খুলতে দেরি করেন। অধৈর্য সৈন্যরা বাড়িতে কেউ নেই ভেবে চলে যায়।
আর আপনারা কীভাবে বাঁচলেন?
আমার বাড়িতে তালা দেখে তারা আর নক করেনি। আমরা সারা রাত মেঝেতে শুয়ে ছিলাম। ২৫ মার্চ-২৬ মার্চ এইভাবেই কেটেছে। কারণ, মিলিটারি আবার এসে লাশগুলো টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেছে।
রোজের বাবা মতিন সাহেবের বেরাইদের বাড়িতে গিয়ে উঠলেন রেহমান সোবহান ও আনিসুর রহমান। সেখানে ভিড়। ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা মানুষেরা সিধু ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন।
এর মধ্যে পাওয়া গেল টেলিভিশনের প্রযোজক মুস্তাফা মনোয়ারকে।
এখন প্রশ্ন, তাঁরা কি ঢাকা ফিরে যাবেন নাকি অন্য কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকবেন। তখনই খবর এল, রেহমান সোবহানের বাড়ি মিলিটারি ঘিরে রেখেছে। এরপর আর ঢাকা ফেরার প্রশ্নই আসে না। সাব্যস্ত হলো, তাঁরা আগরতলা যাবেন।
৩০ মার্চ তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশে রওনা হলেন। রেহমান সোবহানকে। বলা হলো লুঙ্গি পরতে হবে। রেহমান সোবহান জীবনে কোনো দিন লুঙ্গি পরেননি। এই সমস্যার সমাধানে রোজ তাকে একটা বেল্ট এনে দিলেন। রেহমান সোবহান ওপরে খদ্দরের একটা কুর্তা, নিচে চকচকে নতুন লুঙ্গি, কোমরে বেল্ট পরে যাত্রারম্ভ করলেন। তিনি বেরোনোর আগে আয়নায় নিজেকে দেখে আনিসুর রহমানকে বললেন, আনিস, আমাকে কেমন দেখাচ্ছে।
আনিস সেই দুঃখের মধ্যেও হাসি সংবরণ করতে পারলেন না।
রেহমান বললেন, আমি আপনার হাসির কারণ জানি। আমাকে পুরান ঢাকার কসাই সরদারদের মতো দেখা যাচ্ছে।
সিধু ভাই নিজে তাঁদের সঙ্গে হাঁটতে লাগলেন। রেহমান, আনিস, মুস্তাফা মনোয়ারের সঙ্গে পথপ্রদর্শক হিসেবে রইলেন দুজন, কলেজছাত্র রহমত উল্লাহ, আর স্কুলশিক্ষক আ. রশিদ।
ব্যাঙ্গমা বলবে, এই রহমত উল্লাহ ১৯৮৬ সাল থাইকা চারবারের এমপি রহমত আলী।
তাঁরা নৌকায় নদী পার হলেন, তারপর বাসে চড়ে চললেন নরসিংদী। বাসেও পলায়নপর মানুষ সব। নরসিংদী থেকে তারা উঠলেন লঞ্চে। যাবেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কিন্তু লঞ্চেই রেহমান সোবহানের অদ্ভুত পোশাক, অতি ফরসা লম্বা দেহাকৃতি যাত্রীদের সন্দেহের উদ্রেক করে। এদিকে আনিসুর রহমানের পরামর্শে তারা নাম বদলে ফেলেছেন, আনিস হয়েছেন আবদুর রশীদ, আর রেহমান সোবহানের নতুন নামকরণ করা হয়েছে দীন মোহাম্মদ। দীন মোহাম্মদ নিজের নাম মনে রাখতে পারছেন না। তার ওপর তিনি কথা বলতে পারেন ইংরেজিতে, ছোটবেলায় পড়েছেন দার্জিলিংয়ের বোর্ডিং স্কুলে, আর তার মা উর্দুওয়ালা। তিনি কথা বলতে পারেন উর্দুতেও। মুখ খুললেই তিনি ধরা পড়ে যাবেন যে তিনি বাংলাভাষী নন। আবার নিজেদের পরিচয়ও তারা ঠিকমতো দিতে পারছেন না এই জন্য যে লঞ্চে পাকিস্তানি চর থাকতে পারে।
উত্তেজিত জনতা তাকে একটা ঘাটে নামিয়ে নিল। সঙ্গে আনিসুর রহমান এবং মুস্তাফা মনোয়ারও আছেন। কথাবার্তায় সন্দেহজনক এই লোকগুলো নিশ্চয়ই পাকিস্তানি চর, কাজেই এদের মুখ খোলাতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে মাইরের ওপরে ওষুধ নাই। আনিসুর রহমানের ওপরে পড়ল কয়েক ঘা, রেহমান সোবহানের মুখে একটাই আঘাত পড়েছিল, তা-ই তার জন্য যথেষ্ট ছিল, কারণ এরপর তিন দিন তিনি ভাত চিবুতে পারেননি। ঘা খেয়েই আনিসুর রহমান মুখ খুললেন, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শুধু মুখ খুললেন না, তিনি গলাও খুললেন। রবীন্দ্রসংগীত জানেন ভালো, তিনি গলা ছেড়ে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেন যে তিনি বাঙালি। মুস্তাফা মনোয়ার বললেন, এদের আমি ভালো করে চিনি, তোমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ছাত্রকে ডেকে আনো, তাহলে জানবে যে এঁরা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই নন, শেখ সাহেবের অতিঘনিষ্ঠ সহকর্মী। এই সময় অক্সফোর্ড প্রেসের একজন পিয়ন রেহমান সোবহান স্যারকে চিনতে পারল। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র ঘটনার বিবরণ শুনে দৌড়ে চলে এসেছে, কারণ তারা বুঝতে পেরেছে, বাংলা বলতে না পারা লম্বা-ফরসা মানুষটি আর কেউ নন, তাদের প্রিয় শিক্ষক রেহমান সোবহান। তারা এসে বলল, ভাই, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ লোক, আওয়ামী লীগের নেতা এঁরা দুজন। আপনারা এঁদের কাছে মাফ চান। তখন তাদের জনতা ঘাড়ে তুলল, ফুলের মালা পরাল এবং ঘাড়ে করেই নিয়ে গেল স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে। কিন্তু এলাকায় খবর ছড়িয়ে পড়ল যে বঙ্গবন্ধু এই বাড়িতে এসেছেন। শত শত মানুষ শেখ মুজিবের নামের মোহে বাড়িতে ছুটে এসে আরেক দৃশ্য রচনা করে ফেলল।
এরপর দুই ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে তিনজন নৌকায় করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছালেন। তাঁদের নিয়ে যাওয়া হলো তিতাস গ্যাসের গেস্টহাউসে। সেখানে রেহমান সোবহান, আনিস, মুস্তাফা মনোয়ার দেখতে পেলেন হলিউডের এক হিরোকে। হাফহাতা চেক শার্ট, খাকি প্যান্ট, কোমরে পিস্তল, বছর ত্রিশের এক যুবক। তাঁর পরিচয় জানা গেল। মেজর খালেদ মোশাররফ।
তিনি এসে নিজের পরিচয় দিলেন। বললেন, ঢাকায় সেনা আক্রমণের খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একজন পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ান কমান্ডিং অফিসারসহ আরও দুজন অফিসারকে গ্রেপ্তার করেন। তাদের বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
মেজর খালেদ মোশাররফ তাঁদের জিপে করে নিয়ে গেলেন তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের গেস্টহাউসে। গাছগাছালির নিচে এই জায়গাটাকে তিনি হেডকোয়ার্টার বানিয়েছেন, যাতে বিমান হামলা না হতে পারে।
রাতের বেলা, চা-বাগানের ঝিঁঝিডাকা বারান্দায় বসে, চা পান করতে করতে এই তিনজন শুনলেন খালেদ মোশাররফের কাহিনি।
খালেদ বললেন, কুমিল্লায় সব বাঙালি অফিসার সৈনিকদের পাকিস্তানিরা গুলি করে মেরে ফেলেছে।
বললেন, আমরা কিন্তু পাকিস্তানের চোখে বিদ্রোহী, অভ্যুত্থানকারী। কাজেই আমাদের ফেরার আর কোনো পথ নেই। একমাত্র উপায় হলো, যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা। কিন্তু শুধু সৈনিকেরা যুদ্ধ করলে কোনো লাভ হবে না। রাজনৈতিক সরকার দরকার। আপনার কাইন্ডলি আগরতলা যান। সেখানে নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা যেন একটা বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। আরেকটা কথা। সেই সরকার যেন আমাদের মিলিটারিদের তাদের সরকারে আবার রিক্রুট করে। তাহলে আমরা একটা বৈধ সেনাবাহিনীর লোক হিসেবে গণ্য হব। আমাদের বিদ্রোহ তখন বিদ্রোহ থাকবে না, হবে যুদ্ধ। আমরা জেনেভা কনভেনশনের গ্যারান্টি পাব। তা না হলে ঢাকায় আমাদের পরিবার-পরিজন আছে, কারোরই নিরাপত্তা থাকবে না। দ্বিতীয় আমাদের যে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ আছে, তা দিয়ে বেশি দিন আমরা পাকিস্তানি মিলিটারিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারব না। আমাদের যেন আর্ম অ্যান্ড অ্যামুনিশেন ঠিকভাবে দেওয়া হয়।
রেহমান সোবহান একটা কাগজে পুরোটা নোট নিলেন।
আগরতলায় পৌঁছালেন তারা। সেখানে তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ সভাপতি এম আর সিদ্দিকীর। তাঁকে ধরেছেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী। দিল্লি চলুন। শরণার্থীতে আগরতলা ছেয়ে যাচ্ছে। দিল্লিকে বোঝাতে হবে পূর্ব বাংলার আসল চিত্র। এম আর সিদ্দিকী বলছেন, আমি তো এর আগে দিল্লি যাইনি। আর আমি চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতিমাত্র, আমি কী করে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করব? দুই অর্থনীতিবিদকে পেয়ে তিনি পায়ের তলায় মাটি পেলেন। তিনি বললেন, আপনারা আমার সঙ্গে চলুন দিল্লি।
নিজেদের দরিদ্র বেশ ছেড়ে তারা ধার করা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে দাড়ি কামিয়ে স্নান করে বিমানে উঠে পড়লেন। ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অশোক মিত্রের মাধ্যমে তারা গেলেন ভারতের। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ডান হাত, মুখ্য সচিব পি এন হাকসারের বাড়িতে। হাকসার সম্পর্কে রেহমান সোবহান আগে থেকেই ধারণা রাখেন। তাঁকে সমীহই করেন। তিনি কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ, বামপন্থী। সোভিয়েতঘেঁষা। ১৯৩০-এর দশকে লন্ডনে তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। তাঁর পড়াশোনা, বিদ্যা, বুদ্ধি, বিচক্ষণতার কথা প্রবাদের মতো ছড়িয়ে আছে, যা রেহমান সোবহানের ভালোমতোই জানা। ড্রয়িংরুমের নরম গদিওয়ালা বিশাল সোফায় বসে আসামিজ চা খেতে খেতে হাকসার বললেন, কী হলো বলুন তো!
আনিসুর রহমান প্রথমে মুখ খুললেন, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি মিলিটারি ইউনিভার্সিটিতে আমাদের কোয়ার্টারে এল। দরজায় নক করে মেরে ফেলল প্রফেসর জি সি দেবকে। মেরে ফেলল প্রফেসর মনিরুজ্জামানকে। আমরা দুই রাত মেঝেতে লুকিয়ে থাকলাম। তারা কামান দাগাল ইকবাল হলে। জগন্নাথ হল থেকে বের করে নিয়ে গেল ছাত্র-শিক্ষকদের। মাঠে নিয়ে গিয়ে লাইন করে গুলি করে মারল।
রেহমান সোবহান বলতে শুরু করলেন গোটা কাহিনির প্রেক্ষাপট, নির্বাচন হলো। আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। আলোচনা শুরু হলো। ইয়াহিয়া খান এলেন। অ্যাসেম্বলি অধিবেশন বাতিল করা হলো। আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিজের হাতে তুলে নিল। পুরো বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ শেখ মুজিবের কথায় চলল।
তারপর রাতের অন্ধকারে প্রেসিডেন্ট পালিয়ে গেলেন। লোকালয়ে ঢুকে কামান, ট্যাংক দিয়ে আক্রমণ চালানো হলো নিরস্ত্র মানুষের ওপর। পুলিশ, ইপিআর ঘাঁটিতে গিয়ে কামান দেগে ঘুমন্ত পুলিশ, ইপিআরদের হত্যা করা হলো। বস্তিতে বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলো। হাকসার বলতে লাগলেন, কী বলছেন এসব?
হাকসার বলতে লাগলেন, কী বলছেন এসব?
রেহমান সোবহান বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, পাশের দেশ পূর্ব বাংলায় কী হচ্ছে, এরা কত কম জানেন!
হাকসার জিজ্ঞেস করলেন, শেখ সাহেবের পরে আওয়ামী লীগের নেতা কে? হু ইজ নাম্বার টু ইন আওয়ামী লীগ?
রেহমান সোবহান বললেন, শেখ সাহেবের ডান হাত হলেন তাজউদ্দীন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
কী নাম বললেন?
তাজউদ্দীন।
হাকসার নামটা নোট করে নিলেন।
আর কে আছে?
সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সহসভাপতি, আওয়ামী লীগ। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামারুজ্জামান। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। আর খন্দকার মোশতাক। এঁদেরকে বলা হয় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। তবে যদি একটা নাম চান, আমি বলব তাজউদ্দীন। আনিসুর রহমান বললেন।
রেহমান সোবহানও মাথা নাড়লেন, শেখ সাহেবের পরে সবচেয়ে যোগ্য, মেধাবী, পরিশ্রমী আর ডেডিকেটেড তাজউদ্দীন। শেখ সাহেব তার ওপরে ভরসা করতেন।
ওকে। কালকে আপনাদের সকালে এক জায়গায় যেতে হবে। রেডি থাকবেন।
পরের দিন সকালবেলা একটা গাড়ি এল, এলেন একজন ভারতীয় কর্মকর্তা। আপনাদের একটা বাড়িতে নিয়ে যাব। চলুন।
তারা চড়লেন গাড়িতে। অ্যাম্বাসেডর গাড়ি মেড ইন ইন্ডিয়া, একটু ঝরঝরে ধরনের হলেও শক্তপোক্ত, ভেতরে জায়গাও বেশ। যে বাড়িটিতে তারা গেলেন সেখানে ঢুকে রেহমান সোবহান আর আনিসুর রহমানের মুখটা প্রশান্তির হাসিতে ভরে উঠল। তাঁদের সামনে বসে আছেন তাজউদ্দীন আহমদ।
তাজউদ্দীন আহমদকে তারা জড়িয়ে ধরলেন। তাঁরা বললেন, তাজউদ্দীন ভাই, আপনি এসে গেছেন। আমাদের আর কোনো চিন্তা নেই। কিন্তু আপনার সঙ্গে উনি কে?
আমি আমীর। ব্যারিস্টার আমীর!
রেহমান সোবহান বললেন, তোমার পাইরেট মার্কা দাড়ি-গোঁফ কই গেল?
পালিয়ে আসার জন্য হেঁটে ফেলতে হয়েছে। আমীর জানালেন।
.
রেহমান সোবহান আর আনিসুর রহমান জানতেন না, তাজউদ্দীনের সঙ্গে তাদের এই দেখাটা ইগলের চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন ভারতের কর্মকর্তারা। তাজউদ্দীনই এই লোক কি না, আর তিনি আসলেই শেখ সাহেবের ডান হাত কি না, তারা যাচাই করছেন। তাঁরা এ-ও জানেন না, আগরতলা হয়ে দিল্লি আসা আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকী, অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের কাছ থেকেও তাজউদ্দীন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়।
তাঁরা সবাই তাজউদ্দীন সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন আর তা ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন।
দিনের বাকি সময়টা তাজউদ্দীন, আমীর, রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান একসঙ্গে কাটালেন।
.
ব্যাঙ্গমা বলল, তাজউদ্দীন আর আমীর ক্যামনে আইল দিল্লি সেইটার একটু বিবরণ দেও।
ব্যাঙ্গমি বলল, কথাটার কী মানে? তারা আইছে বিমানে।
ব্যাঙ্গমা বলল, তারপরও কোন বিমান, কেমন তার ব্যবস্থা, কয় তারিখে উড়াল দিলেন, কও না গো।
.
তাজউদ্দীন আর আমীর দিল্লি এসেছেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটা কার্গো বিমানে চড়ে। ১ এপ্রিল ১৯৭১-এ। তাদের সঙ্গে একই বিমানে এসেছেন। বিএসএফের গোলোক মজুমদার। বিমানে ওঠার আগেই দুজনকে দেওয়া হয়েছে একটা স্যুটকেস, একটা ব্যাগ। সে দুটোয় আছে কাপড়চোপড়, খাতা কলম, তোয়ালে, সাবান। রাত ১০টায় তাদের কলকাতা দমদম বিমানবন্দরে আনা হয় গোপনে। মালবাহী বিমানে উঠতে হয়েছে মইয়ে করে। বসার জন্য দেওয়া হয়েছে মালবহনকারী বিশাল গহ্বরে দড়ির বানানো আসন। তাতে বসতে হবে ক্যানভাসের বেল্ট পরে। তাদের আসনের পরে বেশ কিছু মালপত্র। তারপর পেছনের পুরোটা খোলা। ভীষণ গরম। পুরোনো রুশ বিমান আকাশে উঠল পুরো পৃথিবীকে জানান দিয়ে যে আমি উঠছি। কানে তালা লাগার উপক্রম এর শব্দে। তাজউদ্দীন আর পারলেন না। বিমানের মেঝেতে পিঠ দিয়ে শুয়ে পড়লেন। দেখাদেখি আমীর-উল ইসলামও তাঁর পাশে শয্যা নিলেন। সারা রাত ধরে বিমান চলল। ভোরে তাঁরা পৌঁছলেন দিল্লির সামরিক বিমানঘাঁটিতে। সেখান থেকে তাদের আনা হলো বিএসএফের একটা অতিথিশালায়।
তাজউদ্দীন বললেন, মিসেস গান্ধীর সঙ্গে আমাদের বৈঠক হবে। আমি সেখানে নিজেকে কী বলে পরিচয় দেব?
ব্যারিস্টার আমীর বললেন, আপনি বলবেন, শেখ সাহেব ২৫ মার্চ রাতে আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্বাধীনতাসংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। শেখ সাহেবের অনুপস্থিতিতে আপনিই তাঁকেই প্রতিনিধিত্ব করছেন।
কিন্তু আমি আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় নেতা নই। সৈয়দ নজরুল সাহেব আছেন। তিনি আমাদের পার্লামেন্টারি পার্টির ডেপুটি লিডার। হেনা ভাই অল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আমি তো কেবল আঞ্চলিক সাধারণ সম্পাদক। সিনিয়রিটির দিক থেকে মোশতাক সাহেব, মনসুর আলী সাহেব আমার চেয়ে এগিয়ে। নজরুল সাহেব, মনসুর আলী। সাহেব, মোশতাক–তারা আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তাঁরা মুজিব ভাইয়েরও ঘনিষ্ঠ।
আমীর বললেন, আপনি অবশ্যই নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেবেন। প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যদি অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট। তাহলে আর সমস্যা হবে না।
আনিসুর রহমানও একমত হলেন। তাঁরা ৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান। প্রণয়নের সময় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গোপনে অনেক কাজ করেছেন। তারা জানেন বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনের ওপরে কতটা নির্ভর করতেন। তাজউদ্দীনকে তিনি কতটা স্নেহ করতেন, কতটা বিশ্বাস করতেন।
এটাই ঠিক হলো। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে তাজউদ্দীন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেবেন। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট।
তাজউদ্দীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মুজিব ভাই যে কোথায় আছেন, কেমন আছেন! আজকে মুজিব ভাই থাকলে কি আমাকে এই কঠিন পরীক্ষায় পড়তে হতো?
২৫
ইন্দিরা গান্ধীর ঘুম ভেঙেছে ভোরবেলা। তিনি তাড়াতাড়িই বিছানা ছেড়েছেন। রোজ যেমন ছাড়েন। চোখমুখ ধুয়ে তিনি এক গেলাস পানি পান করলেন। খালি পেটে পানি পান করা তাঁর শান্তিনিকেতনের দিনগুলো থেকে অভ্যাস। দিল্লির প্রধানমন্ত্রীর সাদা বাংলোর বারান্দায় তিনি এসে একটা চেয়ারে বসলেন।
একটু পরে সূর্য উঠবে। আকাশ ভরসা হতে শুরু করেছে। দিল্লির এই জায়গাটা গাছগাছালিতে ঢাকা। বিশেষ করে তার এই বাড়িটা। অনেক পাখি। আসে বাড়িটাতে। তারা ডাকতে শুরু করেছে। পাখিডাকা ভোর।
তার মাথাটা ধরা ধরা। রাতে ঘুম ভালো হয়নি। পাকিস্তানের ঘটনা নিয়ে তিনি বেশ চিন্তিত।
সকালের নাশতাটা তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে করেন। রাজীব আছে, তাঁর ইতালিয়ান স্ত্রী সোনিয়া আছে, তাদের দুধের শিশু রাহুল আছে। সঞ্জয় আছে। সোনিয়া তো শাড়ি পরে রীতিমতো ভারতীয় বনে গেছে।
স্নান সেরে সুন্দর শাড়ি পরে নাশতার টেবিলে এলেন সোনিয়া। পরিচারিকা রাহুলকে নিয়ে কাছে এল। সোনিয়া আশা করছেন, ইন্দিরা মা-জি রাহুলকে এখন কিছুক্ষণ কোলে রাখবেন। কিন্তু ইন্দিরা মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। কাগজে পূর্ব পাকিস্তানের খবর বড় বড় করে ছাপা হয়েছে।
ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব বাংলা নিয়ে সত্যি চিন্তিত। কতগুলো বাস্তব সমস্যা আছে। এক হলো পশ্চিম বাংলায় নকশালরা খুবই যন্ত্রণা করছে। চীন তাদের সমর্থন দিচ্ছে। এখন পূর্ব বাংলা স্বাধীনতার সংগ্রামে চলে গেলে দুই বাংলা না। চীনা বিপ্লবীদের চারণক্ষেত্র হয়ে যায়। বাংলা চিরকালই বিদ্রোহের জায়গা। বিপ্লবের সূতিকাগার। দুই হলো, পাকিস্তান জাতিসংঘের সদস্য। এখন পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা নিয়ে ভারত কিছু করতে গেলেই সেটা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলে গণ্য হবে। পাকিস্তান অবশ্য মিজো গেরিলাদের সাহায্য করে। ট্রেনিং দেয়। অস্ত্র দেয়। সেই রকমভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সীমিত আকারে ট্রেনিং অস্ত্র দেওয়া যেতে পারে। বিএসএফের মাধ্যমে করা হবে তা। আপাতত সেটাই নির্দেশ। এর। চেয়ে বেশি কিছু কি করা যেতে পারে? আরেকটা সমস্যা আছে। কাশ্মীর। আজকে তারা যদি পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলাকে আলাদা হতে সাহায্য করেন, তাহলে কাশ্মীরকে আজাদ করতে কি পাকিস্তান চাইতে পারে না? সমস্যা হচ্ছে, দেশের ভেতরে বাংলাদেশকে সাহায্য করার প্রচণ্ড চাপ। বিরোধী দলগুলো বাংলাদেশের সমর্থনে জনমত সংগঠিত করছে। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে ইন্দিরা একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন। বিরোধীদের পায়ের নিচের মাটি নরম। তারা সেটাকে শক্ত করার জন্য বাংলাদেশ ইস্যুকে ব্যবহার করতে চাইছে। তাই ৩১ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় একটা সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হতে দিয়েছেন; তাতে বলা হয়েছে : এই আইনসভা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই ঐতিহাসিক উত্থান বিজয়ে রূপ নেবে। এই আইনসভা তাদের আশ্বস্ত করতে চায় যে তাদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রতি ভারতের জনগণের হৃদয় থেকে উৎসারিত সহানুভূতি ও সমর্থন রয়েছে।
রাজীব এসেছেন। সঞ্জয় এসেছেন। টেবিলে ব্রেকফাস্ট দেওয়া হচ্ছে। উর্দি পরা আরদালি পরিবেশন করছে। ইংলিশ ব্রেকফাস্ট।
ইন্দিরা গান্ধীর সেদিকে মন নেই। আজকে আওয়ামী লীগের নেতা আসবেন। তাঁর নাম তাজউদ্দীন। তাঁর সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রতিবেদন দিয়েছে। তিনি সেটা পড়তে আরম্ভ করলেন।
তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে গাড়ি ১ নম্বর সফদরজঙ্গ সড়কের বাড়ির
জানালেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে না এনে তাঁকে বাসভবনে আনার সিদ্ধান্তও ভেবেচিন্তে নেওয়া। বাড়ি হলো অনানুষ্ঠানিক জায়গা। অফিস হলো অফিশিয়াল। স্বাধীনতাসংগ্রামীদের একজন প্রতিনিধিকে তিনি এখনই অফিশিয়ালি অভ্যর্থনা করতে পারেন না।
তাজউদ্দীন বৈঠকখানায় বসামাত্র ইন্দিরা গান্ধী জিজ্ঞেস করলেন, শেখ মুজিব কেমন আছেন?
সোফায় বসে আছেন রুস্তমজি, পি এন হাকসার, প্রতিরক্ষামন্ত্রী মি. জগজীবনরাম আর র-এর শংকরণ আয়ার (কর্নেল মেনন)।
তাজউদ্দীন বললেন, তার সঙ্গে আমার সর্বশেষ দেখা হয়েছে ২৫ মার্চ রাতে। আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি বাড়ি থেকে চলে আসতে বললেন। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এরপর তো শুরু হয়ে গেল পাকিস্তানি মিলিটারির নৃশংস আক্রমণ। হাজার হাজার মানুষকে বিনা বিচারে গুলি করে মারল। পুলিশ, ইপিআর, বিশ্ববিদ্যালয়, বস্তি, বাড়িঘরে কামান দাগাল, আগুন দিল, মানুষ মেরে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিল। ২৭ মার্চ কারফিউ উইথড্র হলে আমি বর্ডারের দিকে রওনা হলাম। তার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি।
আমরা তার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।
আমরাও খুব চিন্তিত। তবে তিনি আমাদের সরকার গঠন করতে বলেছেন। আওয়ামী লীগের একটা হাইকমান্ড আছে। শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবসহ মোট ৫ জন। আমাদের এই ৫ জন মিলেই আমাদের বাংলাদেশ সরকার। আমাদের বাঙালি সৈনিক, পুলিশ, আনসার, ইপিআর, ছাত্র-জনতা প্রতিরোধযুদ্ধ করছে। দেশের বহু এলাকা এখনো আমাদের দখলে। তবে আমাদের হাতে অস্ত্র আর গোলাবারুদ নেই। ভারত যদি আমাদের স্বীকৃতি দেয় এবং অস্ত্র, গোলাবারুদ দেয়, তাহলে আমরা অল্প কদিনের মধ্যেই পাকিস্তানি মিলিটারিকে পরাজিত করব এবং দেশ শত্রুমুক্ত করতে পারব।
ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আপনাদের বিজয়ের জন্য আমরা সম্ভবপর সবকিছু করব। আপনারা সরকার গঠনের ব্যাপারটা ঠিক কী করবেন, ঠিক করে কালকে আবার আসুন।
.
সেদিন রাতের খাবারের সময়ও ইন্দিরা গান্ধী অন্যমনস্ক রইলেন।
সোনিয়া বললেন, মা-জি, খুব বড় কোনো সমস্যা?
ইন্দিরা হাসলেন। হাসি তার মুখে কমই দেখা যায়। ছোটবেলা থেকেই অসুখে ভুগেছেন। লন্ডন থেকে চিকিৎসার জন্য বারবার তাঁকে সুইজারল্যান্ড যেতে হতো। অক্সফোর্ডের পরীক্ষায় তিনি পাস করতে পারতেন না। সব সাবজেক্টে ভালো করতেন। ল্যাটিন পরীক্ষায় ফেইল। সব সাবজেক্টে পাস না করলে সে ছাত্র পাস করে না। ফিরোজ গান্ধীর সঙ্গে মেলামেশার দিন কটাতেই তাকে হাসিখুশি দেখা যেত। তাঁর কৈশোরেই, ১৩-১৪ বছর বয়সে ফিরোজের সঙ্গে তার দেখা হয়। ২৬ বছর বয়সে, আজ থেকে ৩০ বছর আগে ফিরোজ তাকে প্রপোজ করে। সেটা ছিল প্যারিসে মমার্তের সিঁড়িতে। ফিরোজ পারসি। ফ্যামিলির প্রবীণেরা আপত্তি করেছিলেন। বলেছিলেন, ও তোমাকে খাওয়াতে পারবে কি? আহা। ফিরোজও অল্প বয়সে চলে গেলেন। ছেলেরা তাঁকে মিস করে। ইন্দিরা ছোটবেলায় পুতুল নিয়ে খেলতেন। তবে সেই পুতুলেরা বিদ্রোহ করত। জেলে যেত। স্লোগান দিত। ইন্দিরা কিন্তু অনেক ছেলেমেয়ে চেয়েছিলেন। ১০টা-১২টা। ফিরোজই চায়নি। ইন্দিরা বলেন, তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত হলো রাজীবের জন্মের মুহূর্তটি। ১৯৪৪ সালে রাজীব জন্ম নেয়। তখন ইন্দিরার বয়স ২৭। এখন, ১৯৭১ সালে, ইন্দিরার বয়স ৫৪।
সোনিয়ার প্রশ্নের উত্তরে বললেন, সমস্যা ভাবলেই সমস্যা। যা তোমাকে মেরে ফেলছে না, তা তোমাকে স্ট্রং করবে। যেকোনো দুর্যোগই একটা সুযোগ। কোনো অসুবিধা নেই। আমাকে আমার নাতিকে দাও। ওকে কি একটু স্যুপ খাওয়াব?
বলে তিনি হাত বাড়িয়ে রাহুলকে কোলে নিলেন। রাজীব এসে গেলেন। সঞ্জয়ও এলেন। সঞ্জয় কী একটা সবার জন্য গাড়ি প্রকল্প করছে। মারুতি গাড়ি কোম্পানির সঙ্গে কী একটা প্রকল্প করে এমডি হয়েছে। না জানি কোন ঝামেলায় সে জড়িয়ে পড়ে।
তিনি ভারতীয় নারীদের মতো অতিরিক্ত গল্পগুজব পছন্দ করেন না। মিটিংয়ের শুরুতে জিজ্ঞেস করেন না কে কেমন আছে, শরীর-স্বাস্থ্য ভালো, কাল ক্রিকেট খেলা কেমন জমেছিল। তিনি সরাসরি কাজের কথায় আসেন।
তিনি বললেন, এসো, আমরা ডিনার সেরে নিই।
.
তাজউদ্দীন দিল্লির বিএসএফের গেস্টহাউসের নিরাপদ গৃহে ফিরে এলেন। আনিসুর রহমান, রেহমান সোবহান, আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। কাগজ-কলম নিয়ে বসে গেলেন সরকার গঠন করতে।
প্রেসিডেন্ট : শেখ মুজিবুর রহমান।
ভাইস প্রেসিডেন্ট : সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
প্রধানমন্ত্রী : তাজউদ্দীন আহমদ।
মন্ত্রী : ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ।
জাতীয় পতাকা : এটা নিয়ে ভাবতে হলো না। ছাত্ররা আগেই জাতীয় পতাকা বানিয়ে ফেলেছে, মুজিব ভাই সেটা উত্তোলন করেছেন, সেই পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করতে গেছেন। সবুজের মধ্যে লাল বৃত্ত, বৃত্তের মধ্যে সোনালি পূর্ব বাংলার মানচিত্র। পতাকার নকশা ভারতীয়দের আশ্বস্ত করল। কারণ তাতে পশ্চিম বাংলাকে যে নেওয়া হয়নি, তা স্পষ্ট।
জাতীয় সংগীত : এটাও বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই বাছাই করে রেখেছেন। তাঁর খুবই প্রিয় গান। সব অনুষ্ঠানে এটা গাইতে বলতেন। ৭ মার্চের জনসভাতেও এটা গাওয়া হয়েছে। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…
পরের দিন তাজউদ্দীন আহমদ আবারও গেলেন সফদরজঙ্গের ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে। ইন্দিরা প্রথম যে কথাটা বললেন, শেখ সাহেবকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। তিনি মিলিটারি কাস্টডিতে আছেন।
তাজউদ্দীন আহমদের চোখে পানি চলে এল। মুজিব ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে?
তাজউদ্দীন বললেন, তাঁর মুক্তির জন্য চাপ সৃষ্টি করতেও আপনার সাহায্য দরকার হবে।
বেশ খানিকক্ষণ আলাপ হলো। নিজের স্বভাবের বাইরে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধী জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ফ্যামিলিতে কে আছে।
তাজউদ্দীন বললেন, আমার স্ত্রী আছে, চারটা ছেলেমেয়ে আছে। তিনটা মেয়ে। ছোটটা ছেলে। সবাই ছোট।
ইন্দিরা বললেন, তারা কোথায়?
আমি জানি না। আমি তাদের বলে এসেছি, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে। সবার যা হবে, তোমাদেরও তা হবে।
ইন্দিরা বললেন, আপনাদের ডেডিকেশনে আমরা ইমপ্রেসড। তবে সাংগঠনিকভাবে অনেক কাজ বাকি। আমরা আপনাদের সব রকমের সাহায্য করব।
আমরা সরকার গঠন করছি। শপথ নেব বাংলার মুক্তাঞ্চলে। রেডিওতে ভাষণ দেব। এরপর ভারত আমাদের স্বীকৃতি দেবে, এটা আমাদের প্রত্যাশা।
আমরা সব করব। তবে একটার পর একটা। ঠিক যখন যা করার তা-ই করা হবে। আপনারা একদম এটা নিয়ে দুর্ভাবনা করবেন না। ঐক্য ধরে রাখুন, সব দলমতকে সঙ্গে নিন। শুধু বাইরের কোনো শক্তি যেন আপনাদের সংগ্রামকে হাইজ্যাক করতে না পারে, সেদিকেও লক্ষ রাখবেন।
তাজউদ্দীন আশ্বস্ত হলেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর মন খুলেছেন।
.
তাজউদ্দীন বিএসএফের দিল্লির বাড়িতে বসে আমীর-উল ইসলাম, রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমানদের বললেন, কাইন্ডলি একটা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মুসাবিদা করুন।
আর আমি একটা রেডিও ভাষণ দেব। সেই ভাষণটাও তৈরি করে ফেলতে হবে।
আমীর-উল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা সামনে নিলেন। রেহমান সোবহান প্রজাতন্ত্রের আগে একটা গণ বসাতে অনুরোধ করলেন। বাংলাদেশের নাম রাখা হলো : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
দিল্লিতেই, বিএসএফের বাড়িতে, রেডিওর রেকর্ডার এল। তাজউদ্দীনের ভাষণ রেকর্ড করা হবে।
তাজউদ্দীন দুদিন ধরে বক্তৃতাটা তৈরি করেছেন। রেহমান সোবহান, আমীর, আনিসুর রহমানকে বারবার পড়িয়েছেন। রেহমান সোবহানের মনে হলো, ফাইনালি স্পিচটা এক্সিলেন্ট হয়েছে।
তাজউদ্দীন আহমদ রেকর্ডারের সামনে বসেছেন। তার সামনে বসে আছেন আকাশবাণীর একজন নারী কর্মী। তাজউদ্দীন এক গেলাস পানি খেয়ে নিলেন।
রেহমান সোবহান, আমীর, আনিস তাঁকে চোখের ইশারায় উৎসাহিত করছেন।
তাজউদ্দীন বললেন, আমি চিরটাকাল ড্রাফট করেছি। মাইক্রোফোনের সামনে গেছেন মুজিব ভাই। মুজিব ভাই থাকলে…
রেহমান সোবহান বললেন, আমি আপনার জনসভাতেও গেছি। আপনার এলাকায় আপনার ভাষণ শুনেছি। ইউ আর আ ভেরি গুড অরাটর। দেখে লিখিত ভাষণ পড়বেন। আরম্ভ করুন।
তাজউদ্দীন আরেক গেলাস পানি খেলেন। তাঁর মনে পড়ল, সত্তরের নির্বাচনের আগে মুজিব ভাই টেলিভিশন রেডিওতে ভাষণ দিয়েছিলেন।
তিনি বললেন, স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাইবোনেরা।
স্বাধীন। বাংলাদেশ। বীর। বলার সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর রোমাঞ্চিত হলো, চিবুক শক্ত হচ্ছে। বুক ফুলে উঠছে। তিনি কোত্থেকে এই পৃথিবীর সমান সাহস আর বিশ্বাস নিজের বুকের মধ্যে যেন ধারণ করে উঠতে পারলেন–
সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি।
বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কণ্ঠস্বর বিপুল সমুদ্রের কল্লোলকে যেন ধারণ করে উঠল।
তিনি বলতে লাগলেন, ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খানের রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনী নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দেওয়া হলে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মোশাররফ, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী অঞ্চলে মেজর জিয়াউর রহমান, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলে মেজর সফিউল্লাহ যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। এবং তারা স্থানীয় কিছু শত্রুশিবির নিপাত করে শিগগিরই একযোগে ঢাকা আক্রমণ করার জন্য বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। কুষ্টিয়া, যশোর জেলার যুদ্ধ পরিচালনা করছেন মেজর ওসমান। উত্তরবঙ্গ মুক্তিবাহিনী পরিচালনা করছেন মেজর আহমদ, মেজর নজরুল সৈয়দপুরে, মেজর নওয়াজেশ রংপুরে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
তিনি আরও বললেন, একদিকে যেমন হাজার হাজার মানুষ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে, তেমনি শত্রুর আত্মসমর্পণের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। আর একই সঙ্গে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসছে শত্রুর কেড়ে নেওয়া হাতিয়ার। এই প্রাথমিক বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়াউর রহমান একটি বেতারকেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কণ্ঠস্বর। এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। পূর্বাঞ্চলের জন্য সিলেট-কুমিল্লা এলাকায় আরেকটা কার্যালয় করা হয়েছে।
তাজউদ্দীন শেষ করলেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম বেতার ভাষণ এই দিয়ে যারা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছে বাংলাদেশের মাটি, যেখানে উৎকর্ষিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা; গণমানুষের। কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তিপ্রস্তরে লেখা থোক জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
২৬
ব্যাঙ্গমা বলল, তাজউদ্দীন আহমদ যখন দিল্লিতে সরকার গঠন করা লইয়া। ব্যস্ত, তখন সিলেটের তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসাররা একসঙ্গে বসলেন।
ব্যাঙ্গমি বলল, ৪ এপ্রিল এই বৈঠকে কর্নেল ওসমানী, লে. কর্নেল রব, লে. কর্নেল নুরুজ্জামান, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, নাসিম, মঈনুল হোসেন চৌধুরী, নুরুল ইসলাম শিশু–এই রকম অফিসাররা জয়েন করছিলেন। এই সময় তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, ওসমানী সাহেব প্রধান সেনাপতি হইবেন।
আলোচনা হইল, সামরিক বিদ্রোহ সামরিক বিদ্রোহই থাইকা যাইব। যদি সরকার গঠন করা হয় অসামরিক লোক দিয়া। রাজনৈতিক সরকার গঠিত হইলেই এই বিদ্রোহ স্বাধীনতাযুদ্ধ হিসাবে স্বীকৃতি পাইব।
খালেদ মোশাররফের কাছ থাইকা একই বার্তা লইয়া রেহমান সোবহান সাহেবও তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে পৌঁছায়া দিছিলেন।
ব্যাঙ্গমি বলল, মেজর জিয়া আসে ৫ এপ্রিলে। মেজর সফিউল্লাহর ব্যাটালিয়ন থাইকা সৈন্য লওনের লাইগা। সফিউল্লাহ আর খালেদ এক। কোম্পানি কইরা সৈন্য দিছিলেন জিয়ার ৮ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টরে।
২৭
ঢাকায় আমেরিকান কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড ওয়াশিংটন সরকারের অবস্থান মেনে নিতে পারছেন না।
পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে নরক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যাংক, কামান নিয়ে ঢুকে ছাত্রাবাসে আক্রমণ করা হয়েছে, পুলিশ, ইপিআর, হেডকোয়ার্টার বোমা-গোলায় ধ্বস্ত, জনপদে জনপদে আগুন দিয়ে পলায়নরত মানুষদের করা হয়েছে গুলি।
রাস্তায় রাস্তায় পড়ে আছে মানুষের লাশ।
জনপদের পর জনপদে পড়ে আছে পোড়া ছাই।
ঢাকার আমেরিকান কনস্যুলেটে কর্মরত আমেরিকান কর্তাদের বাড়িতে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে ভীতসন্ত্রস্ত বাঙালি কর্মচারীদের পরিবার।
আর আমেরিকান সরকার পক্ষ নিচ্ছে ইয়াহিয়া খানের। আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে নিরীহ মানুষ হত্যায়। নির্বাচিত গণহত্যায়।
তার অনুলিপি যাচ্ছে ইসলামাবাদে, দিল্লিতে, কলকাতায়, আমেরিকান কূটনৈতিক মিশনগুলোতে। কিন্তু নিক্সন ও কিসিঞ্জারের এক কথা–আমরা আছি আমাদের বন্ধু ইয়াহিয়ার পাশে। তিনি খুব ভালো মানুষ।
ক্ষোভে-দুঃখে নিজের হাত কামড়াচ্ছেন ঢাকার আমেরিকানরা। এর মধ্যে ইউএসএআইডির মিশন পরিচালকও আছেন।
তারা সমবেত হলেন এবং বললেন, মানবতার ওপর এই আঘাত আমরা চুপচাপ মেনে নিতে পারি না। আমাদের কি বিবেক বলে কিছু নেই?
তারা, ২০ জন আমেরিকান, তাঁদের মধ্যে আছেন ইউএসআইএসের প্রধান, আছেন এইডের প্রধান, আর্চার কে ব্লাডের ডেপুটি, আছেন অর্থনীতি কনস্যুলার ও প্রশাসনের প্রধানেরা, একসঙ্গে বসে একটা বিবৃতি তৈরি করলেন।
নিক্সন সরকার ভিয়েতনাম বিপর্যয়ের পর একটা নতুন নিয়ম চালু করেছে। আমেরিকান সরকার যদি কোনো ভুল নীতি গ্রহণ করে, কোনো সরকারি কর্মকর্তার যদি মনে হয় এটা ভুল, তাহলে সে তার আপত্তি জানাতে পারবে। ডিসেন্ট চ্যানেল বা ভিন্নমত প্রকাশের একটা চ্যানেল খোলা হয়েছে। এই ২০ অফিসার ঠিক করলেন, তারা ভিন্নমত প্রকাশ করবেন। পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে আমেরিকান সরকার বড় ভুল করছে, অন্যায় করছে, তারা তার প্রতিবাদ না করে থাকতেই পারেন না।
তারা একটা বিবৃতি মুসাবিদা করলেন।
২০ জন মার্কিন কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত ওই টেলিগ্রাম ডিসেন্ট ফ্রম ইউএস পলিসি টুওয়ার্ড ইস্ট পাকিস্তান : জয়েন্ট স্টেট/এইড/ইউএসআইএস মেসেজ।
তাঁরা বললেন, আমেরিকার সরকার গণতন্ত্রকে দলিত-মথিত করার ঘটনাকে নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে।
তাঁরা বললেন, তাঁদের সরকার ব্যর্থ হয়েছে নৃশংসতার নিন্দা করতে।
তাঁরা বললেন, তাঁদের সরকার গণহত্যাকে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা বলে গণ্য করছে। এবং নিপীড়নকারীদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এটা চরম দেউলেপনা। এখানকার বেসরকারি আমেরিকানরা আমেরিকান সরকারের ওপর চরম বিরক্ত। আমরা আমাদের ভিন্নমত প্রকাশ করছি।
আর্চার ব্লাড সেই বিবৃতিকে সমর্থন করে নিজের কথাও লিখলেন।
এবং এ কথাও লিখলেন যে, বাঙালিদের এই লড়াইয়ের ফল হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। পরাজিতদের পক্ষ নেওয়া হবে চরম বোকামি।
আর্চার ব্লাড জানেন, এটার প্রতিক্রিয়া তার চাকরিজীবনের জন্য ভালো হবে না। কিন্তু একটা সময় আসে, যখন মানুষকে জীবিকার চেয়ে বিবেকের দিকেই বেশি তাকাতে হয়।
তিনি টেলিগ্রামটা পাঠিয়ে দিলেন ওয়াশিংটনে, পাকিস্তানের আমেরিকান দূতাবাসে এবং দিল্লিতে।
সচেতনভাবে এটাকে কম গোপনীয় হিসেবে দেখানো হয়। নিক্সন আর হেনরি কিসিঞ্জার খুব খেপে গেলেন। এটা এখন সংবাদমাধ্যমে চলে যাবে, আর চলে যাবে কেনেডিদের কাছে, এই ছিল তাঁর রাগের কারণ।
তারা আর্চার ব্লাডকে পাগল বলে গালিগালাজ করতে লাগলেন।
কিন্তু এই টেলিগ্রামও নিক্সন ও কিসিঞ্জারকে তাঁদের ইয়াহিয়াপ্রীতি থেকে নড়াতে পারল না।
প্রেম কি তাতে কমে? বরং আরও বেড়েই গেল।
২৮
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদ খান ডেকে পাঠিয়েছেন লে. জে. এ কে নিয়াজিকে।
তোমাকে ইস্টার্ন কমান্ডের দায়িত্ব নিতে হবে।
স্যার।
টিক্কা খান তো পারছে না। তুমি গিয়ে দায়িত্ব নাও। টিক্কা খানকে গভর্নর করে দেব।
স্যার।
তোমার কোনো প্রশ্ন আছে?
জি না স্যার। আপনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। এটা মান্য করাই সৈনিক হিসেবে আমার কাজ, স্যার।
নিয়াজি নিজেকে বলতেন টাইগার নিয়াজি। জেনারেল হামিদের কথায় তিনি নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে গেলেন। অথচ এর আগে দুজন জেনারেলকে এই হুকুম দিয়েছেন হামিদ, দুজনেই নানা অজুহাত দেখিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার আদেশ অমান্য করেছেন।
নিয়াজি ঢাকা গেলেন। টিক্কা খান প্রদেশের সেনাপ্রধানের বাড়ি ছাড়তে চান না। গুল হাসানকে দিয়ে তিনি টিক্কা খানকে রাজি করালেন গভর্নর হাউসে উঠতে।
মেজর জেনারেল মিঠঠা ছিলেন টিক্কার সহযোগী। তিনি হেডকোয়ার্টার্সে চিঠি লিখেছিলেন :
এ অপারেশন এখন রূপ নিয়েছে একটি গৃহযুদ্ধে। দূরে যাওয়া যায় না, রেলগাড়িও ব্যবহার করা সম্ভব নয়। কোনো ফেরি অথবা নৌকা পাওয়া যাচ্ছে না। সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রে চলাচলই এখন প্রধান বাধা। এ অবস্থা আরও কিছুদিন চলবে। সশস্ত্র বাহিনীকে নিজেদের বাহনেই চলতে পারতে হবে। আমি প্রস্তাব করছি : ১. চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য নেভির পোর্ট অপারেটিং ব্যাটালিয়ন ২. আর্মি, নেভি বা ইঞ্জিনিয়ার রিভার ট্রান্সপোর্ট ব্যাটালিয়ন। তিন. নেভির কার্গো ও ট্যাংকার ফ্লোটিলা। রসদ ও সৈন্য চলাচলের জন্য আরও হেলিকপ্টার অপরিহার্য।
এর কিছুই তারা পায়নি।
নিয়াজির মনে হলো, পুরো পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানি সৈন্যদের জন্য একটা মৃত্যুফাঁদ। তারা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী অবস্থায় থাকে। অনেকে মিলে পূর্ণ প্রস্তুতি ছাড়া বাইরে যেতে পারে না। বাইরে বেরোনো মানেই মৃত্যু। পুরোটা দেশ বেদখল হয়ে আছে, ক্যান্টনমেন্টগুলো ছাড়া। আর সীমান্ত বলতে তো কিছুই নেই।
নিয়াজি তার দায়িত্ব বুঝে নিলেন। এই ছোটখাটো কালো বাঙালিকে দমন করতে কেন বেগ পেতে হচ্ছে, এই নিয়ে তার মনে অনেক ক্ষোভ। তাঁর কোমরে একটা পিস্তল গোঁজা। অপারেশন রুমে সবাই সমবেত হয়েছে। টিক্কা খানও আছেন।
নিয়াজি ঢুকেই বললেন, মেয় এই হারামজাদি কৌম কি নাসাল বদল দুঙ্গা। ইয়ে মুঝে কিয়া সমঝতে হায়! (আমি এই বেজন্মা জাতির চেহারা বদলে দেব। ওরা আমাকে কী ভেবেছে!) আমি আমার সৈন্যদের ছেড়ে দেব এদের নারীদের ওপরে। তারা সন্তান উৎপাদন করবে। পরের প্রজন্ম নতুন চেহারার নতুন জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে।
এর পরের দিন মেজর জেনারেল খাদিম রাজার সঙ্গে নিয়াজি যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান নিয়ে আলাপ করতে লাগলেন। খাদিম তাঁকে বিশদ বর্ণনা দিচ্ছেন, এই সময় নিয়াজি বলে উঠলেন, ইয়ার, লড়াই কি ফিকর নাহি করো, ওঁ তো হাম কার লেঙ্গে। আভি তো মুঝে বেঙ্গলি গার্লফ্রেন্ডস কা ফোন নম্বর দো। বন্ধু, যুদ্ধ নিয়ে চিন্তা কোরো না, সে আমি সামলাব, তুমি তোমার বাঙালি। বান্ধবীদের ফোন নম্বর দাও।
খাদিম রাজা তার পরের দিন ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গেলেন।
আকাশে উড়তে উড়তে তিনি শেষবারের মতো জলমগ্ন পূর্ব পাকিস্তানের দিকে তাকালেন। পূর্ব পাকিস্তান। তোমাকে নিয়াজির হাতে রেখে এলাম। লাহোরের গুলবাগে একটা পতিতালয় আছে। নাম সিনোরিটা হোম। সেখানে যৌনকর্মীরা থাকে। সেটা চালান মিসেস সায়িদা বুখারি। জেনারেল নিয়াজির বান্ধবী তিনি। নিয়াজি লাহোরের জিওসি ও কোর কমান্ডার থাকার সময় যে টাকাপয়সা খেতেন, যে উৎকোচ গ্রহণ করতেন, সায়িদা তা গ্রহণ করতেন। নিয়াজির পক্ষ থেকে।
নিয়াজি ঢাকায় এসে পানের চোরাচালান শুরু করলেন। ঢাকা থেকে পান যেত সায়িদার কাছে।
নিয়াজি ঢাকার সেনানিবাসে তাঁর বাড়িটিতে নিয়মিত আসর বসান বাইজি নাচের। বাইজিরা আসে। জেনারেলরা আসেন। আসর জমে ওঠে মধ্যরাতে। এই যৌনকর্মীরা নিয়াজির তিন তারকাখচিত পতাকাওয়ালা গাড়িতে আসা যাওয়া করে।
যখন বলা হলো, পাকিস্তানি সৈন্যরা ঠিকমতো খেতে পাচ্ছে না, লঙ্গরখানায় ঠিকভাবে খাবার যাচ্ছে না, নিয়াজি বললেন, এ কী কথা, পূর্ব পাকিস্তানের মাঠে কি কোনো গরু চরছে না, গোয়ালে কোনো গরু-ছাগল নেই, মানুষের গোলায় কি ধান-গম নেই?
যখন এই অভিযোগ উঠল যে পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্যাপকভাবে ধর্ষণ করছে। অধিকৃত বাংলায়, তখন নিয়াজি বললেন, একজন সৈন্য থাকবে পূর্ব পাকিস্তানে, লড়াই করবে, মারা যাবে এবং সেক্স করতে যাবে ঝিলম–এটা তো আপনি আশা করতে পারেন না।
পাকিস্তানে হামুদুর রহমান কমিশনে লে. কর্নেল আজিজ খান এক বছর পরেই এই সাক্ষ্য দিয়ে বলবেন, যখন কমান্ডার নিজেই একজন ধর্ষক, তখন তাঁর অধীন সৈন্যরা কী করবেন, তা বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না।
২৯
মগবাজারের বাড়িতে নিচতলায় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন রেহানা। বাইরে ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। বাঁ দিকে একটা মাধবীলতার ঝাড়। বৃষ্টির ফোঁটায় গাছের পাতাগুলো একবার ডানে একবার বাঁয়ে মাথা নাড়ছে। একটা কুকুর ওই ও বাড়ির সানশেড ঘেঁষে শুয়ে বৃষ্টির ছাট থেকে গা বাঁচানোর চেষ্টা করল। একবার চারপায়ে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে গা-মাথা-লেজ নেড়ে গায়ের পানি ঝাড়ল।
বদরুন্নেছা ফুফুদের বাড়ি এটা। এই বাড়িতে থাকার একট সুবিধা হলো, ভাড়া লাগবে না। ঘরে আসবাবপত্র নেই, মেঝেতে চাদর বিছিয়ে তারা ঘুমান।
বাড়ির পেছনে বদরুন ফুফুর মামা থাকেন। খুব ফরসা, খুব লম্বা একজন মানুষ। দেখলে মনে হবে জিন। তো জিন দাদা একদিন এই বাড়িতে উঁকি দিয়ে দেখলেন, বাড়িতে কোনো ফার্নিচার নেই। তিনি দুটো চেয়ার, একটা টেবিল, একটা খাট পাঠিয়ে দিলেন।
ভালোই বাড়িটা। বড়সড়ই আছে। তবে অসুবিধা একটাই। ১ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের এই বাড়ি একেবারেই সদর রাস্তার ওপরে। রাস্তা দিয়ে মিলিটারি গাড়ি যায়। দেখামাত্র বুকটা ধপাস করে ওঠে।
.
হাসু আপাও এখন এই বাড়িতে।
একদিন বাইরে গাড়ি দাঁড়ানোর শব্দ। কে এল, দেখ তো আবদুল।
রেহানাই দৌড়ে গেলেন গেটের দিকে।
চেঁচিয়ে বললেন, মা মা, আপা এসেছে। দুলাভাই এসেছে।
রেহানা গেট খুলে বাইরে গিয়ে গাড়ির দরজা খুললেন। আপা বের হলেন। আপার হাত ধরে রেহানা তাকে ঘরে নিয়ে এলেন। দুলাভাই এলেন। পেছনে পেছনে। আবদুল গিয়ে জিনিসপাতি নামাতে লাগল। জিনিসপাতিও তো বেশি কিছু নয়। ৩২ নম্বর থেকে বেরোনোর সময় বেশি কিছু তো তারা সঙ্গে নিয়ে বেরোতে পারেননি।
শাশুড়িকে কদমবুসি করলেন ওয়াজেদ মিয়া।
রেনু বললেন, আসো বাবা, বসো। বসতে যে দিব সোফা তো নাই। দুইটা চেয়ার আছে, দুইজন বসো।
হাসিনার দিকে তাকিয়ে বললেন, হাসুর মুখটা ছোট হয়ে গেছে। এইভাবে কি আর হয়? এই সময় দরকার রেস্ট। দরকার একটু ভালো খাওয়াদাওয়া। মনটা রাখতে হয় ভালো। আর এর মধ্যে আল্লার গজব নেমে এসেছে। কোথায় ছিলি, কেমন ছিলি! আমার কী যে চিন্তা হতো!
হাসিনা বললেন, মা, আমি তোমাদের চিন্তাই করতাম। রাসেল সোনার চিন্তা করতাম। আব্বাকে নিয়ে তো চিন্তার শেষ নাই-ই। রাসেল, কাছে। আসো। শার্ট খেয়ো না। আসো। তোমার জন্য চকলেট এনেছি তো!
ওয়াজেদ মিয়া বসলেন একটা চেয়ারে। হাসিনা আরেকটা চেয়ারে।
রেনু বললেন, ওয়াজেদও তো শুকায়া গেছ। কী বলব? আমাদেরই থাকার ঠিক নাই। এই বাড়ি এক রাত, ওই ঘর এক রাত। বিছানা নাই, বালিশ নাই, চাদর বিছায়া ঘুম। জামাল আর আবদুল তো ছাদেও ঘুমাত।
হাসিনা বললেন, আমরা তো তবু আছি। আব্বা… রেনু বললেন, তোর আব্বা তো আজকেই প্রথম জেলে যাচ্ছে না।
ওয়াজেদ বললেন, এবারের পরিস্থিতি আর আগের পরিস্থিতি তো এক নয়। এবার তো যুদ্ধ।
রেনু বললেন, আগরতলা মামলার সময়ও তো ফাঁসিই হয়ে যেত। তবু জানা গেছল কোথায় আছে। এবার তো কোনো খবর নাই…আল্লাহকে শুধু ডাকি, আল্লাহকে বিচার দেই…ওয়াজেদ তুমি হাত-পা ধুয়ে নাও, আমি খাবার দিচ্ছি। এইভাবেই হাতে নিয়ে খেতে হবে…
ওয়াজেদ বাথরুমে গেলেন। হাসিনা উঠে মাকে জড়িয়ে ধরলেন। মা, আমি তোমাকে মিস করেছি মা। তোমাদের ছেড়ে বিদেশে ছিলাম। কিন্তু…
রেনু বললেন, নিজে মা হওয়ার আগে মেয়েরা নিজের মাকে পাশে পেতে চায় মা। আমি জানি…, তিনি হাসিনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, যাই, ওয়াজেদের প্লেটে খাবার বেড়ে দেই…
খাটটা হাসু আপাকে দেওয়া হলো। দুলাভাই মাঝেমধ্যে এই বাসায়। থাকেন, মাঝেমধ্যে আগের আশ্রয়ে যান।
জামাল ভাই বাড়ি থেকে বের হওয়া শুরু করেছেন। কারফিউ এখন। দিনের বেলা আর দেওয়া হয় না। জামাল ভাইয়ের পেছনে পেছনে তার পোষা কুকুর দুটো টমি আর টিকলি এসে হাজির হলো এই বাসায়। বাইরে কুকুরের ডাক শুনে রেহানা বেরোলেন বারান্দায়, উঁকি দিয়ে দেখলেন গেটের বাইরে টমি আর টিকলি। তিনি জামালকে ডাকতে লাগলেন, জামাল ভাই, জামাল ভাই। দেখে যাও, কারা এসেছে!
জামাল, ১৭ বছরের কিশোর, ছুটে বেরিয়ে এলেন। টমি টিকলি…কীভাবে বাসা চিনলি… জামাল বাইরে গিয়ে টমি-টিকলির মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন।
ছুটে এল সেলিম ওরফে আবদুল। জামালের সমবয়সী। টমিকে গেটের ভেতরে এনে আদর করতে লাগলেন জামাল। আবদুলকে বললেন, আবদুল, টোস্ট বিস্কিট আন। আর দ্যাখ তো, একটু গোশতটোশত পাস কি না! রোজি এলেন। বললেন, জামাল ভাই, তোমার টমি কিন্তু আমাদের কলাবাগানের বাসায় গিয়ে দুপুরে খেয়ে আসত!
জামাল বললেন, অবাক কাণ্ড। আমি তো ৩২ নম্বরের বাড়ির সামনে যাই নাই। টমি আমার গন্ধ পেল কীভাবে? আমি তো রিকশায় এসেছি ৩৩ নম্বর থেকে। ওখান থেকে আমার গন্ধ পেয়ে পেছনে পেছনে চলে এসেছে!
কিন্তু এই বাড়িতে কুকুর রাখার জায়গা কই! ৩২ নম্বরে তো জায়গা ছিল। এটা একেবারে রাস্তাঘেঁষা বাড়ি। ঘর থেকে বের হলেই বাউন্ডারি হাফওয়াল। গেট পেরোলে রাস্তা।
রেনু বললেন, আবদুল, যা, টমি-টিকলিকে বস্তায় ভরে আবার ৩২ নম্বরের কাছে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে আয়!
রেহানা সেই কথা মনে করে এখন মন খারাপ করছেন। খুব মন খারাপ। কিন্তু কান্না চলবে না। তিনি হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি হাতে নিলেন। হাতটা ভিজে উঠলে ভেজা হাত দিয়ে মুখ মুছলেন। আব্বা কোথায় তারা জানেন না। কামাল ভাই বাড়ি যাবেন বলে বেরিয়ে গেছেন, কোথায় গেছেন, কেমন আছেন, কোনো খবর নেই। ৩২ নম্বরে ২৫ মার্চের রাতে হাজি মোরশেদ চাচাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে অজ্ঞান করে তুলে নিয়ে গেল, লোকটা বেঁচে আছে কি মারা গেছে, কে বলতে পারে। রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকে। মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়ার করুণ কাহিনি সব শোনা যায়। এর মধ্যে এই কুকুর দুটোকে বস্তায় ভরে নিয়ে যাওয়া হলো বলে কোনো ১৪ বছরের মেয়ে কাঁদতে পারে! না, আমার চোখের নিচে অশ্রু নয়, এ হলো বৃষ্টির পানি! রেহানা বিড়বিড় করলেন।
এর মধ্যে একদিন মিছিল বেরোল। নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর। শান্তি মিছিল। জেনারেল রাও ফরমান আলী, পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব যার ওপর, তিনি শান্তি কমিটি করে দিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগের লোকেরা শান্তি কমিটির নেতা। শান্তি মিছিল হচ্ছে। অথচ রোজ মানুষ মারছে পাকিস্তানিরা। এপ্রিলের শুরুতে জিঞ্জিরায় রক্তগঙ্গা তারা বইয়ে দিয়েছে। সেসব খবর কিছু কিছু করে পাওয়া যায়।
রেহানা দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তার বিপরীত দিকের জানালায়। রাস্তার দিকে যাওয়া তাঁর বারণ। কামাল ভাই বলে গেছেন, মরে যাবি, তবু পাকিস্তানিদের হাতে ধরা দিবি না। মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, অত্যাচার করছে–এই খবর। চাপা থাকছে না।
একদিন সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেছে রেহানার।
রাসেল এসে তার পাশে দাঁড়াল। দেনাপু, চলো, আব্বার বাড়ি যাই।
আব্বার বাড়ি মানে জেলখানা। আব্বাকে ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু কোথায় রেখেছে, তারা কিছুই জানেন না। শুধু আবদুর রহমান রমার কাছ থেকে এতটুকুন জানা গেছে, আব্বা বেঁচে ছিলেন। তাঁকে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের ভেতরে রেখেছিল।
এসো, বাইরে কাক ডাকছে। কাক দেখি।
তাকে নিয়ে বাড়ির সামনের দিকটাতে এলেন রেহানা।
খবরের কাগজের হকার কাগজ হাতে হাঁটছে। সে হাঁকছে : শেখ মুজিবের খবর। শেখ মুজিবের খবর।
সব ভুলে ছুটে গেলেন ১৪ বছরের রেহানা। হকারের কাছ থেকে কাগজটা কেড়ে নিয়ে বাড়ির ভেতরে এসে মাকে বলতে লাগলেন, মা, মা, পয়সা দাও। আব্বার খবর।
মা পয়সা বের করে দিলেন। রেহানা হকারকে দাম দিয়ে দ্রুত গেট বন্ধ করে দিলেন।
করাচির কাগজ ডন-এ ছাপা হয়েছে একটা খবর। শেখ মুজিব রাওয়ালপিন্ডি এয়ারপোর্টের ভিআইপি লাউঞ্জে।
পাঞ্জাবি, পায়জামা, মুজিবকোট পরিহিত। চোখে চশমা। তাঁর মুখটা আগের মতো সংকল্পবদ্ধ। পেছনে দাঁড়িয়ে দুজন সৈনিক।
একটা কাগজ নিয়ে একবার রেনু দেখেন, একবার হাসিনা দেখেন, একবার জামাল দেখেন। তারপর দেখে রাসেল। রাসেল তার আব্বার ছবিতে চুমু খায়।
রেনু দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। হাসিনা চোখ মুছতে লাগলেন শাড়ির আঁচল দিয়ে।
০৩০. একটা ছোট্ট ডাকোটা প্লেন
একটা ছোট্ট ডাকোটা প্লেন। ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্লেন। এই উড়োজাহাজের বাইরের রংটা অদ্ভুত। সামনে-পেছনে জলপাই সবুজ, মাঝখানে গেরুয়া। দেখলেই বোঝা যায়, বিমানবাহিনীর প্লেন। এই প্লেনটা ইন্দিরা গান্ধী দিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদের ব্যবহারের জন্য। এখন এই প্লেনে উঠেছেন তাজউদ্দীন, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আমীর-উল ইসলাম, শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ আর গোলোক মজুমদার। তারা। বেরিয়েছেন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের খোঁজে। বিশেষ রকম দরকার সৈয়দ নজরুল ইসলামকে।
তাজউদ্দীনের মনটা ভার। তবে মাথাটা ঠান্ডা। তিনি জানেন, আওয়ামী লীগ হলো বহু নেতার বহু মতের একটা সমাবেশ। মুজিব ভাই বিভিন্ন অংশকে বিভিন্ন কাজ দিয়ে, কারও কাঁধে হাত রেখে, কাউকে বাড়িতে ড্রয়িংরুমে চা খাইয়ে, কাউকে ডাইনিংয়ে ভাত খাইয়ে, কাউকে দোতলার শোবার ঘর পর্যন্ত নিয়ে নির্ভুল ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যবস্থা করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটা বিশাল পাজল, সেই পাজলের একেকটা টুকরা একেকজনের কাছে, আর প্রত্যেকে ভাবছে, সে-ই সব। একমাত্র শেখ মুজিব জানতেন, সবটা একসঙ্গে করলে কীভাবে একটা পরিপূর্ণ অবয়ব দেখা দেবে। তাজউদ্দীন আহমদ সেই পাজলের অল্প কটা অংশ সম্পর্কেই জানেন। তাজউদ্দীনকে তিনি পাঠিয়েছিলেন ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে। তিনি যে আরও কাউকে কাউকে এই কাজে নিযুক্ত রাখেননি, তা হওয়ার নয়।
.
ব্যাঙ্গমা বলাবলি করবে :
শেখ ফজলুল হক মণিকে দিয়ে ডেকে এনে সিরাজগঞ্জের ডা. আবু হেনাকে শেখ মুজিব পাঠিয়েছিলেন কলকাতায়। ভারত কানেকশন তৈরি করার জন্য। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ শেখ সাহেব তাঁকে এই দায়িত্ব দেন।
.
তাজউদ্দীন ডাকোটার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। প্লেন কলকাতা থেকে উড়েছে। খুব নিচ দিয়ে যাচ্ছে। নিচের সবুজ বন-বনানী পাহাড় দেখা যাচ্ছে। এমনকি দেখা যাচ্ছে গরু-ছাগলও। প্রথমে তারা নামলেন ধুবড়িতে। গোলোক মজুমদার বিএসএফের মাধ্যমে আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন, বর্ডারে কোনো আওয়ামী লীগ নেতা বা বাঙালি মিলিটারি অফিসার থাকলে তাদের সমবেত করে রাখতে। ধুবড়িতে কাউকে পাওয়া গেল না। প্লেন। আবার উঠল, থামল শিলিগুড়িতে। সেখানে একটা ডাকবাংলোতে নিয়ে যাওয়া হলো তাদের।
বিএসএফ ব্যাপক তৎপর।
গোলোক মজুমদার একে নিজে বাঙালি, বাংলাদেশ আন্দোলনে তাঁর সমর্থন হৃদয় থেকে উৎসারিত, এখন রুস্তমজির নির্দেশ পেয়ে তিনি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দ্বিগুণ উৎসাহে।
শিলিগুড়ির ডাকবাংলোয় এসেছেন লে. কর্নেল নুরুজ্জামান আর আবদুর রউফ। তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললেন তাজউদ্দীন। নুরুজ্জামান সাহেব, আপনি একটা সেক্টর পরিচালনা করবেন। আমরা একটা বক্তৃতা রেডি করেছি। সেটা রেডিওতে প্রচার করা হবে। তাতে সেক্টরের কথা বলা আছে।
ফজলুল হক মণি বললেন, মামা, একটু কথা আছে।
তাজউদ্দীন এর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, চলেন। ওই ঘরে যাই।
তাজউদ্দীনের মনে পড়ল সেই দিনটির কথা, যেদিন মুজিব ভাই তাদের পাঁচজন–শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান এবং আবদুর রাজ্জাকসমেত তাজউদ্দীনকে ডেকে তার বাসার এক কোনায় নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, কলকাতার ঠিকানাটা মুখস্থ আছে তো…
কলকাতায় এসে সেই ঠিকানায় বিএসএফের লোক পাঠানো হয়েছিল। সেই ঠিকানায় কোনো বাড়ি পাওয়া যায়নি। টেলিফোন ডিরেক্টরিতে চিত্ত সুতার বলেও কেউ নেই।
মণি, তোফায়েল এসে চিত্ত সুতারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এইটা র-এর (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা) লিংক। তারা যখন র-এর মাধ্যমে জানতে পারেন, তাজউদ্দীন এরই মধ্যে দিল্লি চলে গেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন, তখন তারা ক্ষিপ্ত হন।
দিল্লি থেকে কলকাতা ফিরে তাজউদ্দীন ভবানীপুর রাজেন্দ্র রোডের এক বাড়িতে সবার সঙ্গে দেখা করলেন। আওয়ামী লীগের নেতা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যারা কলকাতায় আসতে পেরেছেন, তারা উপস্থিত থাকলেন।
সেখানে কামারুজ্জামান আছেন, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আছেন। সবাই। ক্ষিপ্ত। তাজউদ্দীন কেন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর সামনে। হাজির করলেন?
মণি বললেন, এটা সরকার গঠনের সময় না। একটা বিপ্লবী কাউন্সিল করুন। সরকার না।
আমীর যুক্তি দিলেন, আমরা, নির্বাচিত বৈধ গণপ্রতিনিধিরা, সংবিধান তৈরির জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত। আমরা কেন বিপ্লবী পরিষদ গঠন করব। আমরা সরকার করব। সংবিধান রচনা করব। জনগণ আমাদের সে ক্ষমতা দিয়েছে। আমাদের সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করবে। আমাদের সামরিক অফিসাররা সবাই আমাদের সেই রিকোয়েস্ট করছেন। সরকার ছাড়া তাদের বিদ্রোহ অবৈধ অভ্যুত্থানমাত্র। সরকার থাকলে তাঁদের বিদ্রোহ দাঁড়ায় মুক্তিযুদ্ধ। সরকার গঠন করলে ভারত আমাদের স্বীকৃতি দেবে। আমরা সারা পৃথিবীকে একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা নিয়ে আবেদন জানাতে পারব আমাদের পাশে কি নিজেদের স্বাধীন করতে পেরেছে? আমরা তো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করছি। না, আমরা স্বাধীনতার সংগ্রাম করছি।
এ অবস্থায় সবার আগে ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে উঠে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। তিনি বললেন, আমরা একটা যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে আছি। আমরা অন্য একটা দেশে এসেছি। আমাদের একজনই নেতা। তিনি বঙ্গবন্ধু। তাঁকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে গেছে। তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন আমরা জানি না। তিনিই আমাদের সর্বাধিনায়ক। তিনিই। প্রেসিডেন্ট। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী কে হলো না হলো তা নিয়ে নিজেরা বিবাদ করলে আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব। লক্ষ শহীদের অবমাননা করব। এর চেয়ে যা হয়েছে, তা আমরা মেনে নিই। দেশ শত্রুমুক্ত করি। বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনি। কামারুজ্জামান তাঁকে সমর্থন দিলেন। যুব নেতারাও নরম হলেন। তাঁরা রাজি হলেন তাজউদ্দীনের সঙ্গে বেরিয়ে পড়বেন সীমান্তে সীমান্তে।
.
শিলিগুড়ির বাংলোয় তখন সন্ধ্যা। অনেক গাছপালাঘেরা বাংলোটা একটা টিলার ওপরে। শেখ ফজলুল হক মণি আর তাজউদ্দীন একটা ঘরে। ঘরের দেয়ালের দুই দিকে দুইটা গোল বাল্ব হলুদ আলো দিচ্ছে। মাথার ওপরে একটা ফ্যান ঘুরছে।
মণি বললেন, মামা, আপনার রেডিওর বক্তৃতাটা থামান।
তাজউদ্দীন বললেন, বক্তৃতার কপি আমার কাছে আছে। তুমি দেখে দিতে পার।
মণি বললেন, আপনার ভাষণ ভালো হবে। এতে আমার কোনো সন্দেহ নাই। আপনি তো ড্রাফট কম করেন নাই। মামার বহু বিবৃতি আপনার লেখা। সমস্যা হলো, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সভা না ডেকে, বিশেষ করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মামার মত না নিয়ে আপনি তো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার পরিচয় প্রকাশ করতে পারেন না। নজরুল মামা তো ডেপুটি লিডার। বঙ্গবন্ধু লিডার।
তাজউদ্দীন লাল হয়ে গেলেন। হলুদ আলোয় তাঁর রক্তিম গণ্ডদ্বয় খয়েরি দেখা গেল।
তিনি বললেন, আচ্ছা, আমি বলছি গোলোক মজুমদারকে। ভাষণ থামাতে।
গোলোক মজুমদার এরই মধ্যে টেপ নিয়ে চলে গেছেন।
আমীর তাঁকে ফোন করলেন। টেপ কোথায়?
যেখানে যাওয়ার সেখানে গেছে।
এটা থামাতে হবে।
কেন।
সবার সঙ্গে কথা না বলে তো তাজউদ্দীন ভাই নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন না।
শোনেন। আপনার দেশের মানুষ আপনাদের সরকার গঠনের সংবাদের জন্য কান পেতে আছে। মুক্তিযোদ্ধা মিলিটারিরা সরকার গঠন ছাড়া আস্থা পাচ্ছে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাজিকে আপনারা জানিয়েছেন। তাজউদ্দীনই সেকেন্ড ইন কমান্ড। এখন আপনাদের রাজনৈতিক দলাদলি তো আমি সৈনিক বুঝব না। আমি আমার সরকারের কথামতো চলব। আমি ভাষণ প্রচার করে দেব। তাতে আপনাদের দলাদলি নিজে নিজেই থেমে যাবে।
আচ্ছা, আমি আমার অনুরোধ আপনাকে রাখলাম। আপনি এবার বুঝুন কী করতে হবে।
আমীর এলেন মণি-তাজউদ্দীনের কাছে। বললেন, টেপ চলে গেছে। গোলোক মজুমদার ফেরানোর চেষ্টা করবেন। দেখা যাক।
রাতের খাবার ভালো। তিস্তা নদীর বড় মাছ। ভাত, ডাল। সবজি। তারা খেতে বসলেন। তাজউদ্দীন এরই মধ্যে ঠিক করেছেন, দেশ স্বাধীন করবেন বলে পরাশ্রিত থেকে তিনি বিলাসী জীবন যাপন করবেন না। তিনি কৃচ্ছ সাধনা করবেন। তিনি স্বল্পাহারী হবেন।
খেতে বসেছেন তিনজন। মণি, আমীর, তাজউদ্দীন। মনসুর আলীর জ্বর। তিনি শুয়ে পড়েছেন। তোফায়েল আহমেদেরও জ্বর। তিনি চলে গেছেন কলকাতা।
খাওয়া ভালোই চলছে।
এমন সময় শিলিগুড়ি বেতার থেকে ঘোষণা এল : এবার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ প্রচার করা হবে। কণ্ঠস্বর আমীর-উল ইসলামের। দিল্লির গেস্টহাউসে বেতারকর্মীরা আমীরের কাছ থেকে এ ঘোষণাটাও রেকর্ড করে নিয়েছিল।
রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে তাজউদ্দীনের ভাষণ বাজছে। কেউ কোনো কথা বলছেন না।
পরের দিন তাজউদ্দীনরা আবার সেই ডাকোটা প্লেনে। প্লেন থামল একটা ছোট্ট বিমানঘাঁটিতে। সেখান থেকে তাঁরা গাড়িতে এলেন তুড়া পাহাড়ে। গাড়ি থেকে নামলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মান্নান বেরিয়ে এলেন। বারান্দায়। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁরা। সে এক অপূর্ব দৃশ্য।
সৈয়দ নজরুল জানালেন ২৫ মার্চের পর তিনি কীভাবে পালিয়ে চলে আসেন ময়মনসিংহ। তাঁকে নারীর ছদ্মবেশ নিতে হয়েছিল। তিনি পরচুলা পরেছিলেন। সালোয়ার-কামিজ পরেছিলেন। তারপর একটা বোরকা পরে উঠেছিলেন গাড়িতে। ঢাকা থেকে প্রথমে যান ময়মনসিংহ। সেখান থেকে হাঁটাপথে গারো পাহাড় পেরিয়ে এসে পৌঁছেছেন এখানে।
সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সব খুলে বললেন তাজউদ্দীন। জানালেন, সরকার হবে রাষ্ট্রপতিশাসিত। সব ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আপনিই ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম মানুষ হিসেবে সজ্জন, রাজনীতিবিদ হিসেবে ঝানু। তিনি বললেন, মুজিব ভাই আমেরিকান কনসাল জেনারেলের সামনে বলেছেন, আমার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুলই আওয়ামী লীগের সেকেন্ডম্যান। কাজেই ঘটনা ঠিক আছে। আমার পর বঙ্গবন্ধুর সেক্রেটারি তো তাজউদ্দীনই। কোনো অসুবিধা নাই। লেটস মুভ ফরোয়ার্ড।
তাঁরা গেলেন আগরতলা। একই প্লেনে। প্লেন থেকে নেমে সোজা একটা। সরকারি গেস্টহাউসে। সেখানে একটা বড় সভাকক্ষে আওয়ামী লীগ নেতারা অপেক্ষা করছিলেন। চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা এলাকার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ছিলেন। কর্নেল ওসমানী, এম আর সিদ্দিকী আছেন। আর আছেন খন্দকার মোশতাক আহমদ।
ওসমানীর সঙ্গে কথা বললেন তাজউদ্দীন।
ওসমানী জানালেন, মেজরদের সঙ্গে তিনি বসেছিলেন। কীভাবে যুদ্ধ। পরিচালনা করা যাবে, তার পরিকল্পনা তিনি পেশ করলেন। দুই ডিভিশন সৈন্য দাঁড় করাবেন। তারপর ঢাকা অভিযানে যাবেন।
তাজউদ্দীন বললেন, আপাতত সেটা করা যাবে না। কারণ এটা জনযুদ্ধ। জনগণকে তার যুদ্ধ করতে দিতে হবে। মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলুন। ট্রেনিং দিন। দেশের ভেতরে গেরিলা পাঠান। গেরিলাযুদ্ধ করে শত্রুদের ছিন্নভিন্ন করে ফেলুন। ভারতের গেরিলাযুদ্ধ বিশেষজ্ঞ জেনারেল নগেন্দ্র সিংয়ের সঙ্গে তাজউদ্দীন বসিয়ে দিলেন ওসমানীকে। সঙ্গে রইলেন আমীর।
এরপর এমপিদের সঙ্গে বৈঠক। প্রথমেই কথা পাড়লেন মোশতাক।আমার শরীর ভালো না। টি হোসেন ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন। আমি ক্লিনিকে ভর্তি ছিলাম। রেডিওতে শুনলাম সরকার হয়ে গেছে। তখন চলে আসতে বাধ্য হলাম।
.
ব্যাঙ্গমা ও ব্যাঙ্গমি বলাবলি করবে :
খন্দকার মোশতাক ২৫ মার্চের পর ঢাকার ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কের সিটি নার্সিং হোমে একটা ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছিলেন। সেটা ছিল ডা. টি হোসেনের ক্লিনিক। চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীনের ভাষণ প্রচারিত হওয়ার পর ভারতের খবরে বলা হতে থাকে মন্ত্রিপরিষদের নাম। তাতে খন্দকার মোশতাকের নাম মন্ত্রী হিসেবে উচ্চারিত হওয়ায় তিনি প্রমাদ গোনেন। টি হোসেন তাঁকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আগরতলার উদ্দেশে রওনা দেন।
.
মোশতাক বললেন, আমি মন্ত্রী হতে পারব না। শরীর ভালো না। বয়স হয়েছে। শেষ বয়সে এসে আমার এই আর এই ধকল সইবে না। তোমরা আমাকে টিকিট করে দাও। আমি মক্কা শরিফ চলে যাব।
আমীর ধরলেন ডা. টি হোসেনকে। আপনি মোশতাক ভাইকে রাজি করান।
টি হোসেন বললেন, মোশতাক সাহেব, এখন মন খারাপ করার সময় নয়। সরকার হয়েছে। এ তো ভালো কথা।
অনেকক্ষণ ঝিম মেরে থেকে মোশতাক বললেন, আমাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করলে তাহলে আমি রাজি।
তাজউদ্দীন বললেন, ঠিক আছে। উনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীই হবেন।
মনসুর আলী আছেন। মোশতাক আছেন। তাজউদ্দীন আছেন। আছেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল। পুরা ক্যাবিনেট আছে, কামারুজ্জামান ছাড়া। কামারুজ্জামান কলকাতায়। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী হিলি দিয়ে ভারতে ঢোকেন, কামারুজ্জামান তার দুই দিন আগে একই পথে কলকাতা গেছেন। তার সঙ্গে কথা হয়েছে আগেই। কলকাতার সভায় তাজউদ্দীন আহমদের নেওয়া উদ্যোগকে সমর্থন করে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী বক্তৃতা দিলে মনসুর আলীর কথাকেই কামারুজ্জামান নিজের কথা বলে সমর্থন দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম থেকে আসা জহুর আহমেদ চৌধুরী মোনাজাত ধরলেন। আধা ঘণ্টার সেই মোনাজাতের ভাষা বড়ই মর্মস্পর্শী। হে আল্লাহ, আমাদের বাবা মা, ভাইবোন, স্ত্রী-পুত্র-পরিজন দেশ-মাটি সব ছেড়ে আমরা এখানে এসেছি। আমরা জানি না আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেমন আছেন। হে আল্লাহ, আমরা যেন স্বাধীন দেশে আবার একসঙ্গে ফিরতে পারি। সেই তৌফিক আমাদের দিন।
উপস্থিত সবাই দরদর করে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।
৩১
মওলানা ভাসানী নৌকায় উঠলেন। মাঝি তিনজন। একজন মাঝি, দুজন মাল্লা। একজন কিশোর বয়সী। তার সামনের দাঁত দুটো বেরিয়ে থাকে। মনে হয়, সব সময় হাসছে। আরেকজন প্রবীণ। তবে তার চেহারা দেখলে বোঝা যায় না বয়স কত। পিঠ ধনুকের মতো বাঁকা। তৃতীয়জন মাঝবয়সী, তার চোখ বাদামি রঙের। গায়ের রং তিনজনেরই রোদে পোড়া। ওরা রোদে বসে নৌকা চালায়, হাল ধরে, দাঁড় টানে আবার নৌকা থেকে নেমে গুন টানে। তিনজনের পরনে লুঙ্গি। প্রবীণ মাঝির ঘাড়ে গামছা। গামছার আদি রং বোঝার কোনো উপায় নেই। নৌকাখানি মাঝারি আকারের। হাল আছে, পাল আছে। দাঁড় আছে, লগি আছে। বড় ছই আছে। নৌকার মধ্যে রান্নার ব্যবস্থা আছে। ঘুমানোর জায়গা আছে।
মওলানা ভাসানীর গায়ে একটা গেঞ্জি। পরনে পাঞ্জাবি। মুখে উদ্বেগের চিহ্ন, চোখে আগুন এবং অশ্রু।
১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের একটা দিন। চৈত্রের বিকেলে রোদের রংটা সেদিন ছিল হলুদ, হলুদ আলো ধানকাটা হয়ে যাওয়া বিস্তীর্ণ মাঠে একটা বিশাল আলোয়ানের মতো পড়ে আছে। খালের পাশে কাশবন। কোনো খেতে কেবল পাট লাগানো হয়েছে। ছোট ছোট পাটগাছ। ধঞ্চের বড় বড় গাছও আছে। কোনো কোনো খেতে আউশ ধানের ছোট্ট চারা। তিনি নৌকায় উঠেছেন। মাঝি নৌকা ভাসিয়ে দিল। জোরে জোরে বইঠা বাইতে লাগল, লগি ঠেলতে লাগল। একটু পরে বাতাস অনুকূল হওয়ায় পাল তুলে দিল।
মওলানা ভাসানী একটু আগে ছিলেন বিন্যাফৈরে। এটা তার সন্তোষের বাড়ি থেকে মাইল দুয়েক দূরে। পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৫ মার্চের পর টাঙ্গাইল এলাকায় প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পড়ে। দেশের বহু জেলা-মহকুমার মতো টাঙ্গাইল ছিল সংগ্রাম পরিষদের দখলে। হাজার হাজার মানুষ দা-কুড়াল, লগি-বইঠা, কাস্তে-শাবল, কোদাল-বাঁক, সড়কি-বল্লম, দেশি বন্দুক, এয়ারগান, বাড়িতে বানানো হাতবোমা, স্কুলের রসায়নাগারে বানানো বাল্বের মধ্যে অ্যাসিড রাখা বোমা, বাংলাদেশের পতাকা ইত্যাদি নিয়ে দখল করে রাখে। সার্কিট হাউসে পাকিস্তানি সৈন্য ছিল, সেই একটা জায়গায় উড়ছিল পাকিস্তানের পতাকা। বাকি সব ঘরে, দোকানে, অফিসে উড়ছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ-হলুদ পতাকা। মার্চের শুরু থেকেই ছাত্রলীগের নির্দেশে জয় বাংলা বাহিনী গঠন করে আনসারদের কাছ থেকে অস্ত্র এনে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল। ২৫ মার্চের পর আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আনোয়ার-উল আলম শহীদ, কাদের সিদ্দিকী এবং আওয়ামী লীগ যুব লীগ সংগ্রাম পরিষদ সাকিট হাউসের মিলিটারি পোস্টে আক্রমণ করে। পরে জানা যায়, ভেতরের সৈন্যরা বাঙালি, তাদের মাইকযোগে জনতার সঙ্গে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হলে তারা সেই আহ্বানে সাড়া দেয় এবং বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেয়। মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে বিদ্রোহী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা ময়মনসিংহ থেকে পিছিয়ে এসে টাঙ্গাইলের জয় বাংলা বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়।
৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা টাঙ্গাইল শহরে ঢুকে পড়ে। সেনাবাহিনীর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে কিছুদিন চাকরি করে চাকরি ছেড়ে দেওয়া কাদের সিদ্দিকীর স্বতঃস্ফুর্ত নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মাটিয়াচরায় পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধা দিয়েছিল, ১৬ জন সাথি সেখানে শহীদ হয়। পাকিস্তানিদের বহু সৈন্য হতাহত হলেও তারা পিছু হটেনি।
পাখি মারার মতো অবিরাম গুলি ছুঁড়তে থাকে তারা, বাড়িঘরে আগুন দেয়। তারপর তারা এগোতে থাকে সন্তোষের দিকে। মওলানা ভাসানীকে আটক করতে হবে।
মওলানা ভাসানী তখন বিন্যাফৈরের বাড়িতে বসে রেডিও শুনছিলেন। দুজন অবাঙালি মোহাজের, যাদের আদিবাড়ি ভারতের মোজাফফরবাদ, তাদের তিনি জনরোষ থেকে বাঁচিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। রাশেদ খান মেনন আর হায়দার আকবর খান রনোরা শিবপুর নরসিংদীতে একটা প্রতিরোধকেন্দ্র গড়ে তুলে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করার প্রয়াসের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার বাড়ি ওখানে, তিনিই নেতা। রনো আর মেননকে বলা হলো, যাও, টাঙ্গাইলে গিয়ে ভাসানীর সঙ্গে দেখা করো। তারা সন্তোষে গেলেন, মওলানা সেখানে নেই, কাজেই তারা বিন্যাফৈরে গেলেন। মওলানা তাঁদের নির্দেশ দিলেন, কাগজ-কলম লও, জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে টেলিগ্রাম লেখো। এর মধ্যেই দেখা গেল, সন্তোষের বাড়িতে আগুন জ্বলছে, আকাশ লাল করে সেই শিখা দাউ দাউ করে একেকবার অনেক ওপরে উঠছে আর কালো ধোঁয়ায় দিগন্ত ছেয়ে ফেলছে। মেনন আর রননা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হুজুর, সরে যাবেন না?
ভাসানী বললেন, সইরা গেলে তো ইন্ডিয়া যাইতে হয়। নেহরু আমার বন্ধু আছিল। তার মাইয়া ইন্দিরা আমারে যত্ন কইরাই রাখব, কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসু তো বিদেশে গিয়া কিছু করতে পারে নাই।
আর শোনো, তিনি তাঁর পাশের কয়েকজন মুরিদকে ডেকে বললেন, এই দুই মোহাজেররে আমি তোমগো জিম্মায় রাইখা গেলাম। অগো য্যান কোনো ক্ষতি না হয়।
সন্তোষ গ্রামেই শুধু ৬ জন বৃদ্ধ, ১৪টি গরু ঘরপোড়ানো আগুনে মারা গেছে। মওলানা ভাসানীর সেক্রেটারি ইরফানুল হক জানালেন, আপনার ইসলামী ইউনিভার্সিটির আটটা শণ আর টিনের ঘর, আর বিল্ডিংগুলা সব পুড়ায়া দিছে।
শুনে মওলানা বললেন, সিন্দুকে আওরঙ্গজেবের হাতের লেখা একটা কোরান শরিফ আছিল, সেইটাও পুইড়া গেল। মেনন, রনো দ্যাখো তো, আমার সন্তোষের আগুন অহনও দেখা যায় নাকি!
মেনন ও রনো ঘরের বাইরে এসে পায়ের আঙুলে দাঁড়িয়ে দূরের ধোয়া আগুন দেখছিলেন। হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেলেন, মওলানা লুঙ্গিটা। এক হাতে উঁচু করে ধরে ধানখেত, পাটখেত ধরে হেঁটে গিয়ে ধঞ্চেখেতের আড়ালে হারিয়ে গেলেন।
নৌকা নিয়ে যমুনা বেয়ে ভাসানী গেলেন সিরাজগঞ্জের ঘাটে।
বাড়িতে ট্রেসার বুলেট বর্ষণ করে আগুন লাগিয়ে দেয়। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি করতে থাকে, কাফের মওলানা কিধার হ্যায়। প্রতিটা বাড়িতে তারা উন্মত্তের মতো আগুন দেয়।
ভাসানীর দারাপুত্র-পরিবার আরও শত শত পরিবারের সঙ্গে নদীর বালুচরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সারা রাত খোলা আকাশের নিচে কাপড় বিছিয়ে
পড়ে থাকে তারা।
মওলানা ভাসানী সিরাজগঞ্জের ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে খবর পাঠালেন। ন্যাপের (মোজাফফর) সিরাজগঞ্জের সভাপতি সাইফুলকে। আর মোরাদ নামের একজন যুবকর্মীকে।
সাইফুল গেলেন যমুনার ঘাটে। সাইকেলে চড়ে।
ভাসানী বললেন, সাইফুল আইছ। আমি ভারতে যাইতাছি। তুমিও আমার সাথে চলো। লও উইঠা পড়ো।
সাইফুল বললেন, আমি করি অন্য দল। আমার নেতা মোজাফফর সাহেব। আমরা ইলেকশনে অংশ লইছি। আপনে করেন অন্য দল। দুইটাই ন্যাপ হতে পারে, আপনার লাইন আমার লাইন তো আলাদা। কেমনে নৌকায় উঠি?
মওলানা ভাসানী বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। পেছনে বড় ছই। ছইয়ে একটা হাত রেখে বললেন, খামোশ। এইটা তুমি কী কইলা? অন্য দল! অহন একটাই দল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এই কথাটা কি মানলা?
জি এই কথা তো মানিই। আমি তো লড়াই-সংগ্রামের মধ্যেই আছি। পুরা সিরাজগঞ্জ বলক দেওয়া ভাতের মতো ফুটতেছে। আমরা ন্যাপ কর্মীরা থানা লুট করে অস্ত্র আনছিলাম। আওয়ামী লীগ সব কেড়ে নিয়ে গেছে। তাতে কী! আমরা পাইপ কেটে অস্ত্র বানাইছি। আমার তো দল আছে। এখন মিটিং থেকে আপনার ডাকে আসলাম।
ভাসানী নদীর পানির দিকে একবার তাকালেন। একবার তাকালেন আকাশের দিকে। বললেন, আরও বড় কাজ আছে সাইফুল। প্রথমে দ্যাশটারে স্বাধীন করন লাগব। এর জইন্য লাখ লাখ গেরিলা লাগব। বিদেশি সমর্থন লাগব। দেশে দেশে চিঠি লেখন লাগব। দ্যাশ স্বাধীন হইলে আবার লড়াই করন লাগব সমাজতন্ত্রের লাইগা। সমাজতন্ত্র তো কেউ তোমারে চামুচে তুইলা মুখে পুরায় দিব না। আসো। নৌকায় ওঠো।
আপনি কী বলেন। আমার একটু প্রিপারেশন লাগবে না? আচ্ছা আমি বলে-কয়ে বিদায় নিয়ে আসি।
ঘণ্টাখানেক পরে সাইফুল একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে এলেন। নৌকায় উঠলেন। ছইয়ের ওই পারে মোরাদ।
উজানে ভাসাও মাঝি–আল্লাহর নামে রওনা দেও। ভাসানি নির্দেশ দিলেন। মাঝি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল নৌকা। বুক বরাবর খুঁটি ধরে টেনে তুলল নৌকার বুক থেকে। তারপর দড়ি ছাড়িয়ে বিসমিল্লাহ বলে যাত্রারম্ভ করল।
আকাশে একটু একটু করে মেঘ জমছে।
ভাসানী বললেন, সাইফুল, কার কাছ থাইকা বিদায় নিলা?
সাইফুল বললেন, মা আছে। স্ত্রী আছে।
ছেলেপুলে নাই।
নাই। তবে হবে। প্রেগন্যান্ট। কবে বিয়া করছিলা?
৬৯ সালে।
বউ কী কইল?
বউ কী বলবে। মা কান্নাকাটি করল। বউকে বললাম, আমি চললাম। যদি মেয়ে হয়, তোমার আঁচলে বেঁধে রেখো। আর ছেলে হলে আমার খোঁজে পাঠায়া দিয়ো। হাতে একটা কবচ বেঁধে দিয়ো। হালকা কথা বললাম আরকি। শুনে মা বললেন, সাইফুল সব সময়ই নিষ্ঠুর।
মা তোমারে নিষ্ঠুর কয় ক্যান?
আমি তো পলিটিকস করব বলে ছোটবেলায় বাড়ি ছাড়ছি। আব্বা রাগ করছিলেন। কুড়ি বছর আর বাড়ির সাথে যোগাযোগ রাখি নাই।
অ। দ্যাখো সাইফুল। আমগো পলিটিশিয়ানদের কী অবস্থা। তুমি বউ ছাইড়া চইলা আইলা। বউয়ের বাচ্চা হইব। আমিও বউ-বাচ্চা সব ফেলায়া চইলা আইলাম। মোরাদ তো আইছে একবস্ত্রে। ও অবশ্য আমগো আগায়া দিতে আইছে। অরে একটা ভালো নিরাপদ জায়গা দেইখা নামায়া দেওন লাগব।
প্রচণ্ড ঝড় শুরু হলো বেলা তিনটার দিকে। আকাশ ছেয়ে এল কালো মেঘে। দমকা বাতাস। নৌকা বুঝি ডুবেই যায়। পানি দুলছে। নৌকা দুলছে। তিনজন মাঝি হাতে লগি নিয়ে ঠেসে ধরে আছে। নৌকা একটা কাশবনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে বাতাসের দাপুটে ঝাঁপটা কম লাগছে না। বরং কাশগাছগুলো এসে নৌকার ছইয়ে বাড়ি খাচ্ছে।
তিনজন সওয়ারি ভাসানী, সাইফুল, মোরাদ ছইয়ের মধ্যে বসে আছেন। চৈত্রের ঝড় থেমে গেল।
তারা আবার চলতে শুরু করলেন। বিকেলটা ঝকঝক করছে বৃষ্টির পর। নদীর জল যদিও এখনো বেশ কালো। দূরে রোদ পড়ে যমুনার জলে একটা রুপালি বুটিদার চাদর চোখ ঝলসে দিতে চাইছে।
দূরে দিগন্তে দেখা গেল ধোয়া। অনেক দূরে দূরে অনেকগুলো জায়গা থেকে ধোঁয়া উঠছে।
মোরাদ বললেন, সব ছারখার করে দিল।
ভাসানী বললেন, কী ছারখার করল?
মোরাদ বললেন, ওই দ্যাখেন। আগুন। পাকিস্তানি মিলিটারিরা আগুন। দিয়া সারা দেশ জ্বালায়া দিল।
সাইফুল বললেন, ওরা তো বলেইছে, মিট্টি মাংতা আদমি নেহি মাংতা।
ভাসানী ছইয়ের বাইরে এলেন। দাঁড়ালেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, ওইটা আসামের আগুন। জুম চাষ করব। আগুন লাগায়া জঙ্গল সাফ কইরা সেইখানে আবাদ করব।
নৌকা চলছে। রাতে নৌকা দাঁড় করানো হয়। খাওয়াদাওয়া সেরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। আবার ভোর থেকে নৌকা চলে।
নৌকা ঘাটে ভিড়লেই মুশকিল। একজন যদি দেখেন হুজুর ভাসানী নৌকায়, অমনি গ্রামে খবর হয়ে যায়। লোকজন দল বেঁধে চলে আসে। ভাসানী কথা বলতে শুরু করেন। কেউ কেউ ভাসানীকে কদমবুসি করতে চায়। কেউবা পানিপড়া চায়।
সাইফুল বলে দিয়েছেন, মাঝি, নৌকা ভিড়াবা না।
মাঝিরা একসময় জানাল যে নৌকায় চালডাল আছে। কিন্তু আগুন নেই। মালসাতে আগুন ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে নিভে গেছে। তামাক খেতে পারছে না তারা। কাজেই নৌকা ভেড়াতেই হবে। জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে হবে। দেশলাই লাগবে।
সাইফুল ভাবলেন, আরও কিছু শাকসবজি সংগ্রহ করতে পারলে ভালো।
হাঁড়িভাঙার চরে নৌকা থামল। সাইফুল নৌকা থেকে নেমে চরের ভেতরের নেমে দেশলাই খুঁজতে লাগলেন। দোকান পাওয়া গেল। কিছু কাঁচা তরিতরকারিও কিনলেন তিনি।
ফিরে এসে সাইফুল দেখলেন, নৌকা ঘিরে ভিড়।
সাইফুল বললেন, তাড়াতাড়ি নৌকা ছাড়ো মাঝি।
ভাসানী বললেন, আকাশের অবস্থা দ্যাখছ? মুখটা ব্যাজার কইরা রইছে। নৌকা ছাড়া কি ঠিক হইব।
সাইফুল বললেন, এই পাড়ে ফুলছড়ি, ওই পাড়ে বাহাদুরাবাদ, আর্মির ক্যাম্প। এই লোকগুলার মধ্যে একটা-দুইটা মুসলিম লীগার, জামাতি থাকবেই। গিয়া খবর দিবে। আপনি জানেন আপনি আর্মির কত বড় টার্গেট?
মোরাদ বললেন, ভাসানীরে পাইলেই গুলি, এইটাই অর্ডার। টিক্কা খান বইলা দিছে, লাশ চাই। মওলানার লাশ চাই।
সাইফুল বললেন, হুজুর। আপনি কোনো কথা বলতে পারবেন না। আর ছইয়ের ভিতর থেকে বের হতে পারবেন না।
ভাসানী উদাস হয়ে গেলেন।
তারপর বললেন, আচ্ছা। তোমরা যা ভালো মনে করো, করো।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি আবার কথা বলা শুরু করলেন, আমারে মৌনব্রত করতে বলো। মহাত্মা গান্ধী করতেন। সপ্তাহে এক দিন চুপ কইরা থাকতেন।… শুরু হলো গল্প। গান্ধী, দেশবন্ধু, সুভাষ বোস, মওলানা আজাদ…গল্পের অবিরল ধারা বয়েই চলেছে…আর বয়ে চলেছে যমুনা…
এর মধ্যে এক সন্ধ্যায় রেডিওতে শোনা গেল, তাজউদ্দীনের ভাষণ। তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের রক্তিম শুভেচ্ছা।
সাইফুল বললেন, হুজুর, সরকার তো গঠন কইরা ফেলছে। আপনে তো লেট হইয়া গেলেন।
ভাসানী বললেন, চলো কলকাতা যাই। অনেক কিছু করনের আছে!
.
ব্যাঙ্গমা বলবে, এই যাত্রার বিবরণ এবং ১৯৭১ সালে ভারতে মওলানা ভাসানীর অবস্থান লইয়া সুন্দর একটা বই আছে, সাইফুল ইসলামের লেখা স্বাধীনতা ভাসানী ভারত।
ব্যাঙ্গমি বলবে, সেই বই থাইকাই আমরা ভাসানীর এই সব কাহিনি স্মরণ করছি।
ব্যাঙ্গমা বলবে, হ। আমগো এই স্মরণের মধ্যে বেশির ভাগটাই নানান বই থাইকা নেওয়া। এইটা য্যান মনে রাখা হয়।
.
ধল্লাই নদের নামাজের চরে মওলানা ভাসানীর নৌকা তীরে বেঁধে রাখা হয়েছে। চর ধরে হাঁটতে শুরু করলেই সীমান্ত। সাইফুল আর মোরাদ চলেছেন চরের পথ বেয়ে। আলপথ। বালুচর। গাছগাছড়া। বড় বড় কাশ। ভাসানী বলে দিয়েছেন, নাক বরাবর যাবা। গেলে পাবা সামাদের বাড়ি। সামাদ আমার মুরিদ। আমার কথা কওনের সাথে সাথে বাকিটা দেখবা সে-ই কইরা দিব।
নাক বরাবরই হাঁটছেন দুজন। এর মধ্যে এসে গেল সীমান্ত। সীমান্তের খুঁটিগুলো আছে। আর কিছু নেই। সীমান্তচৌকিতে ইপিআর কেউ নেই। বেশির ভাগ ইপিআর জওয়ান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লড়াই করতে গেছে। বিএসএফের লোকেরা থাকতে পারত। তাদেরও কাউকে দেখা গেল না। সীমান্তচৌকি আছে। টং আছে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে। আকাশ অন্ধকারে ছেয়ে আসছে। শুধু একটুখানি লালের পোচ এখনো আকাশের গায়ে। রাতচর পাখিরা বেরোতে শুরু করেছে। নীড়সন্ধানী পাখিরা নীড়ে ফিরে গেছে।
নিজেদের পায়ের আওয়াজে নিজেরাই চমকে উঠলেন সাইফুল আর মোরাদ। আবদুস সামাদের বাড়ি পাওয়া গেল। সামাদ মিয়াকেও।
সাইফুল বললেন, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এসেছেন।
সামাদ সজোরে বলে উঠলেন, হুজুর আসছেন? কী কন? উনি কই? আমারে নিয়া চলেন। নিয়া আসি।
কিন্তু বর্ডার পার হওয়া কি উচিত হবে? আসাম পুলিশ ধরবে না। তাঁকে?
তা-ও তো কথা। হুজুর আবার আসামরে পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ঢুকানোর কথা কইছিলেন। আসামের নেতারা তার উপরে ম্যালা খ্যাপ্লা। আচ্ছা চলেন গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে যাই।
.
ব্যাঙ্গমা বলবে, পঞ্চায়েতপ্রধান ভাসানীকে আসতে দিতে নারাজ। তার জিজ্ঞাসা আছিল, কোন দল? ন্যাপ? তাইলে ঢোকা যাইব না। শুধু আওয়ামী লীগ হইলে যাইব!
.
সাইফুলের পাল্টা প্রশ্ন, পাকিস্তানি মিলিটারিরা মারার সময় আওয়ামী লীগ ন্যাপ আলাদা করে না। বাঁচার জন্য সবাই তো ইন্ডিয়া যাইতেছে। শরণার্থীদের আবার আওয়ামী লীগ, ন্যাপ কী?
মোরাদকে নৌকায় পাঠিয়ে সাইফুল রয়ে গেলেন আসামে, সামাদ মিয়ার বাড়িতে। কারণ, পরের দিন এই এলাকায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী আসবেন।
সাইফুল আর সামাদ মিয়া মন্ত্রীর সভার উদ্দেশে বের হলেন দুপুরবেলা। মূল রাস্তা ছেড়ে পাথারের মধ্য দিয়ে লোকচক্ষু এড়িয়ে গিয়ে সভাস্থলে পৌঁছালেন তাঁরা। সেখানে অনেক বাঙালি। আর আলাদা করে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হলো না।
মন্ত্রী একটা স্কুলঘরে বসেছেন। সাইফুল কাউকে কিছু না বলে জোর করে গিয়ে ঢুকে পড়লেন মইনুল হক চৌধুরীর ঘরে। বললেন, আমি এসেছি মওলানা ভাসানীর পক্ষ থেকে!
মওলানা ভাসানী? কই তিনি?
নামাজের চরে।
মইনুল বললেন, আপনি আমার জিপে ওঠেন। জিপে ওঠার পর তিনি বললেন, মওলানা সাহেব ছিলেন এইখানকার মুসলিম লীগের সভাপতি, আমি ছিলাম সাধারণ সম্পাদক। বুঝতে পারছেন?
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গেলেন স্থানীয় একটা রেস্টহাউসে, ফুলবাড়ি রেস্টহাউস। যেখানে ফোন আছে। তিনি ফোন করলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। একটু পর এসে সাইফুলকে বললেন, জিপ নিয়ে যান। মওলানা সাহেবকে নিয়ে আসুন।
সামাদ সাহেব গেলেন হুজুরকে আনতে। আনতে আনতে রাত ভোর হয়ে গেল। কারণ, খবর রটে গেছে যে হুজুর কেবলা জিন্দাপীর এসেছেন। লোকজন ঘিরে ধরল তার আগমনের পথ। সবাইকে ফুঁ দিয়ে পানিপড়া দিয়ে দোয়া করে আসতে আসতে ভাসানী রাত কাবার করে দিলেন।
পরের দিন মওলানা ভাসানী সাইফুল মোরাদ বিশেষ কার্গো বিমানে চড়ে কলকাতা দমদম এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে গোয়েন্দা প্রহরায় সোজা কোহিনুর প্যালেস। পার্ক সার্কাসের পার্ক স্ট্রিটে।
পাঁচতলার একটা ফ্ল্যাটে দুটো রুম। বড়টাতে রইলেন ভাসানী আর মোরাদ। ছোটটায় সাইফুল। মোরাদের নৌকা থেকে নেমে যাওয়ার কথা ছিল। তিনি নামতে পারেননি। তবে তিনি ভাসানীর কাঁথাটা ফেলে দিয়ে এসেছেন। সঙ্গে এনেছেন তাঁর রংচটা স্যুটকেসটা। সাইফুলকে মোরাদ বললেন, এইটা হুজুরের বিয়ার যৌতুক। এইটার সাথে স্মৃতি জড়িত। ফেলা ঠিক হবে না।
৩২
আম্মা আম্মা, দ্যাখো আকাশে কত বড় চাঁদ উঠেছে? ও মা! চাঁদটা না তালপিঠার মতো! কত বড়! আম্মা মনে হচ্ছে, চাঁদটাকে খেয়ে ফেলি! ১২ বছরের রিপি বলল।
চৈতালি পূর্ণিমা। শাল-গজারি, তাল-নারকেল-সুপুরি, আম-জাম-কাঁঠাল বাঁশঝাড়ঘেরা বাড়িটার উঠানে চাঁদের আলো পড়ে উঠানটাকেই মনে হচ্ছে। একটা কচ্ছপের পিঠ। নাম না-জানা ফুলের গন্ধ আসছে।
রিমি আর রিপি একটা ফেলে রাখা গাছের গুঁড়ির ওপরে বসে আপনমনে খেলছিল। ও পাশে একটা টুলে বসে আছেন ওদের মা লিলি, তার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মিমি। আরেকটা টুলে বসে আছেন রিপিদের কাকিমা। মফিজ কাকার স্ত্রী। তার কোলে ছোট্ট সোহেল।
রিমি-রিপিদের সঙ্গে খেলায় যোগ দিয়েছে সমবয়সী চাচাতো বোন ইপি আর দিপি।
ওরা একটু আগে ছিল খড়ের গাদার আড়ালে। উঠোনের পশ্চিম দিকে খড়ের গাদা। দক্ষিণ দিকে ধান শুকানোর বড় খুলি। খড়ের গাদার পাশে বাঁশঝাড়ের নিচে গোয়ালঘর। গোয়ালঘর ঘেঁষে গরুর চাড়ি, বাঁশের বেড়া আর মাটি দিয়ে মাচান করে বাধা। চাড়িতে মাড় দেওয়া হয়, পানি দেওয়া হয়, খইল দেওয়া হয়। ওইটা গরুদের ডাইনিং টেবিল, রিপি বলেছিল।
এখন উঠানে রাখা গজারিগাছের গুঁড়িতে বসে হঠাই রিপির চোখ গেল চাঁদের দিকে।
১০ বছরের রিমি ছুটে গেল সোহেল আর মিমির কাছে। সে ছড়া বলতে লাগল, আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।
সে একবার টিপ দিচ্ছে মিমির কপালে, একবার সোহেলের কপালে। মিমি ছড়া শুনে নিজেই চাঁদকে ডাকতে লাগল, আয় আয়…
তাজউদ্দীনের গ্রামের বাড়ি দরদরিয়ায় এখন তারা। ২৫ মার্চের পর কী করে রিমি, রিপি আর আম্মু, সোহেল, মিমি একখানে হলো, আর অবশেষে এই গ্রামের বাড়িটায় আসতে পারল, সে কথা রিমি, রিপি কিংবা তাদের মা জোহরা ওরফে লিলি কোনো দিনও আর ভুলতে পারবেন না।
রিমি বলে, তাঁতীবাজারে খালার বাসায় আমরা তো ভালোই ছিলাম। হরতাল। অসহযোগ। স্কুল নাই। পড়াশোনা নাই।
রিপি বলে, ২৫ মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত তো আমরা খেলছিলাম।
রিমি বলে, আমি ঘুড়ি বানানো শিখে গেলাম।
রিপি বলে, আমি তো সুতোয় মাঞ্জা দেওয়াতে এক্সপার্ট হয়ে গেলাম। বাজার থেকে সুতোর গুটি কিনে এনে ছাদে এ মাথা থেকে ও মাথায় টেনে মেলে ধরতে হয়। তারপর ভাতের মাড়, আঠা, রং আর কাঁচের গুঁড়ো দিতে হয়। খুব সাবধানে দিতে হবে কিন্তু, না হলে হাত কেটে যাবে, রক্ত বের হবে।
রিমি বলে, কত ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হলো। চৈত্র মাস। বাতাস ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য পারফেক্ট। ছাদে ছাদে ঘুড়ি।
রিপি বলে, আর চক দিয়ে দেয়াল ভরে আমরা লিখতে লাগলাম, জয় বাংলা। আঁকতে লাগলাম নৌকার ছবি।
রিমি বলে, আর একটা বানর পিঠে একটা বাচ্চা নিয়ে ওই বাড়ির ছাদ থেকে এসে গেল এই বাড়ির ছাদে। আমি চিৎকার করে উঠলাম। বানরটা ভয় না পেয়ে আমাকে ভেংচি কাটতে লাগল।
রিপি বলে, সারা দিন খেলাধুলা করে মাথার চুলভরা ঘাম নিয়ে আমরা ঘুমুতে গেলাম। খালা তো বকা দেবেন না।
রিমি বলে, ঘুম ভেঙে গেল মধ্যরাতে। গুলির শব্দ। মানুষের চিৎকার। আমরা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, চারদিকে আগুন আর আগুন। খালু ছাদ থেকে এসে বললেন, নয়াবাজার, শাঁখারীপট্টি, তাঁতীবাজার সব জ্বলছে। মহল্লায় মহল্লায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘুমন্ত মানুষ ঘর থেকে বের হতেই পড়ছে গুলির মুখে।
রিপি বলে, কী ভয়ঙ্কর ছিল সেই রাত।
রিমি বলে, ভয়ে আমি আধমরা হয়ে গেলাম।
রিপি বলে, সারা রাত গোলাগুলি আর মানুষের চিৎকারে দুচোখের পাতা এক করতে পারলাম না।
রিমি বলে, ২৬ মার্চ দিনের বেলাতেও, ও মা, কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটল!
রিপি বলে, পাশেই ছিল সিনেমা হল নাগরমহল। বাড়িপোড়া অসহায় মানুষগুলো এসে ঢুকেছিল ওই সিনেমা হলে। দিনের বেলা আগুন লাগিয়ে দিল সিনেমা হলটিতে।
রিমি বলে, কী বিশ্রী ধোঁয়া! কালো। দম আটকানো। খালার বাড়িও ধোঁয়ায় ভরে গেল।
রিপি বলে, খালু আমাদের বললেন, এই তোমাদের বাবার নাম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। কেউ এসে যদি জিজ্ঞেস করে, তাজউদ্দীন কে হয়, বলবে কেউ হয় না। আমরা এই বাড়ির মেয়ে।
রিমি বলে, আর অমনি তুমি বললে, না, আমার আব্বার নাম কেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী হবে! আমার আব্বার নাম তাজউদ্দীন।
রিপি বলে, কারফিউ উঠে গেলে বড় মামু এলেন। আমাদের নিয়ে গেলেন মগবাজারে। ছোট মামুর বাড়িতে।
রিমি বলে, সেখান থেকে আনার আপার বাড়িতে আবার নিয়ে গেলেন আমাদের সাইদুল দুলাভাই। আনার আপা তো আমাদের নিজেদেরই বোন। কিন্তু আব্ব, আম্মু, সোহেল, মিমির কোনো খবর তো পাই না।
রিপি বলে, তারপর মার্চের ৩০ তারিখে বড় মামু আর সাইদ ভাই আমাদের নিয়ে আবার বের হলেন সকাল সকাল। মগবাজার মোড়ে দেখতে পেলাম বড় মামুর লাল হিলম্যান গাড়ি। আমাদের গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। ঢুকে দেখি, আম্মু, সোহেল, মিমি। আমরা যেন আমাদের ধড়ে জান ফিরে পেলাম।
মিমি বলে, আম্মু কেমন করে এইখানে এলেন সেটাও আম্মু এতবার বলেছেন যে আমাদের মুখস্থ। আম্মু আমাদের সাতমসজিদ রোডের বাড়ি ছেড়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কারফিউ উঠে গেলে বড় মামু আম্মুর খোঁজে বেরিয়ে পাশের বাড়িতে খোঁজ নিলে আম্মুর দেখা পান। তাকে নিয়ে গেলেন তার ধানমন্ডি ১৩/২ বাড়িতে। দুপুরের পর মুসা সাহেব নিয়ে এলেন। একটা চিঠি। আব্দুর চিঠি। আব্বু লিখেছেন, লিলি আমি চলে গেলাম…
রিপি বলে, আম্মু সেই চিঠি পড়ে স্তব্ধ হয়ে রইলেন। চোখের জলে তাঁর কাপড় ভিজে যেতে লাগল।
রিমি বলে, আম্মু আর মামুর একটা করুণ ঘটনাও আছে। ২৭ মার্চের পর আম্মু এ-বাড়ি ও-বাড়ি আশ্রয়ের চেষ্টা করছেন। এক রাতে একটা বাড়িতে। আশ্রয় মিলল। খানিকক্ষণ পর বাড়ির লোক বলল, ভাবি, এই বাড়িতে ছেলেমেয়ে বেশি। বিপদ হতে পারে। চলেন পাশের বাড়িতে নিয়ে যাই। ওইটা একটু ভেতরে। ওই বাড়িতে বিপদ কম। সোহেল, মিমিকে নিয়ে আম্মু তার সঙ্গে বের হলেন। রাতের বেলা। চারদিকে ভয়। আলো নাই। অন্ধকার। মিলিটারির গাড়ির শব্দ। কুকুরের চিৎকার। এর মধ্যে লোকটা বলল, ভাবি, একটা জিনিস ফেলে এসেছি। আপনারা দাঁড়ান। নিয়ে আসছি। বলে তিনি বাড়ির ভেতরে গেলেন। আর আসেন না। গেটে তালা দিয়ে দিয়েছেন। দুইটা বাচ্চা নিয়ে আম্মু আড়াল খুঁজছেন।
রিপি বলে, আম্মু বাড়ির পেছনে গেলেন। অনেক ইট পালা করে রাখা। দুই পালা ইটের মধ্যে তিনি দুই বাচ্চাসহ সারা রাত মাটিতে বসে রইলেন।
.
ব্যাঙ্গমা বলবে, এই ভদ্রলোক ১৯৭২ সালের পর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে দরখাস্ত করছিলেন প্রমোশনের লাইগা।
ব্যাঙ্গমি বলবে, এই ভদ্রলোক একজন কর কর্মকর্তা। তিনি দরখাস্ত করলেন তাঁর প্রমোশনের লাইগা। তাজউদ্দীন ফাইল দেখতে আছিলেন হেয়ার রোডের মন্ত্রিবাড়িতে। লিলিরে ডাকলেন। কইলেন, লিলি, তারে প্রমোশন দিয়া দিলাম। লিলি কইলেন, তুমি মন্ত্রী, কারে প্রমোশন দিবা না দিবা তোমার ব্যাপার। তাজউদ্দীন কইলেন, এটার লগে তুমিও জড়িত। ওই যে তোমারে ঘরের বাইর কইরা গেট লাগায়া দিছিল, সেই মানুষ। তুমি সারা রাত খোলা আকাশের নিচে সোহেল-মিমিরে লইয়া আছিলা…লিলি কইলেন, এইটা তোমার ব্যাপার…তাজউদ্দীন কইলেন, আমার ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা দুর্ঘটনা দিয়া তো অফিশিয়াল ব্যাপার বিচার করা যায় না…
.
রিপি বলে, তারপর সেই হিলম্যান গাড়িতে আম্মুর ঘাড়ে মাথা রেখে আমরা
এসে পৌঁছালাম টিকাটুলীর মোড়।
রিমি বলে, গাড়ি ছেড়ে দিয়ে আমরা বেবিট্যাক্সি নিলাম। গেলাম ডেরমাঘাট পর্যন্ত।
রিপি বলে, ডেরমা না রে ডেমরা।
রিমি বলে, ডেমরা। ডেমরাঘাট থেকে লঞ্চে চড়ে আমরা গেলাম পাগলা আফতাব চাচার বাড়িতে।
রিপি বলে, গ্রামের এই বাড়িটা আমার খুব পছন্দ হলো। চারদিকে আমবাগান। ঝড় এল। আমরা আম কুড়াতে গেলাম। আম্মুকে বললাম, আম্মু আমরা এখানেই থেকে যাই।
রিমি বলে, আম্মু হেসে ফেললেন।
রিপি বলে, আমরা খুশি হলাম। আম্মু হেসেছেন।
রিমি বলে, সেখানেও থাকা নিরাপদ নয়। সবাই জেনে গেছে তাজউদ্দীনের ফ্যামিলি আছে এই বাড়িতে।
রিপি বলে, নৌকায় চড়ে আমরা এসে পৌঁছালাম দাদাবাড়িতে। উঠলাম মফিজ কাকুর ঘরে।
রিমি বলে, কী সুন্দর দোতলা কাঠের বাড়ি। নিচতলায় থাকেন কাকুরা। দোতলায় থাকি আমরা।
.
এখন আম্মু ডাকছেন। রিমি, রিপি এদিকে এসো। তোমার কাকুকেও ডেকে আনো।
কেন আম্মু?
রেডিওতে বলছে, তোমার আব্দুর ভাষণ প্রচার করবে।
আকাশবাণী কলকাতা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ গতকাল একটি গোপন বেতার থেকে ভাষণ দেন। এখন সেই ভাষণের রেকর্ড প্রচার করা হচ্ছে।
দোতলার কাঠের ঘরে সবাই উপস্থিত। মফিজ কাকু। হোসনে আরা কাকিমা। লিলি। রিমি। ইপি। দিপি।
তাজউদ্দীনের গলা শোনা গেল :
স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাইবোনেরা,
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদেরকে আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি…
সোহেল কথা বলে উঠল।
রিমি বলল, সোহেলবাবু কথা বোলো না। আব্দুর কথা শোনো…।
লিলির চোখ ভিজে যাচ্ছে। যাক। মানুষটা বেঁচে আছে। আর বেঁচে আছে বাঙালির স্বাধীনতার আশা। সরকার হয়েছে। এখন মুজিব ভাই না জানি কোথায়?
৩৩
২৬ বছর বয়সী তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে পেশা শুরু করে এখন সিএসপি অফিসার। লড়াই করছেন স্বাধীন বাংলাদেশের হয়ে, সেই ২৫ মার্চ রাত থেকে। পুলিশ, আনসার, ইপিআর, সংগ্রাম পরিষদের লোকজন মিলে তাঁর বাহিনী। কাঁধে স্টেনগান নিয়ে তিনি চলাফেরা করেন।
মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, ঝিনাইদহ মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে দুই হাজার মুক্তিসেনা। পুলিশ, আনসার, ইপিআর আর সাধারণ মানুষ মিলে।
ইপিআরের মেজর আবু ওসমান চৌধুরী তার হাজারো ইপিআর নিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। বাঙালি সৈনিক, বাঙালি পুলিশ, ইপিআর, আনসার আর হাজার হাজার ছাত্র শ্রমিক সাধারণ মানুষ মিলে মার্চের মধ্যে পদ্মার পশ্চিম পারকে পাকিস্তানি দখলমুক্ত করেই ফেলেছিলেন। কিন্তু দখল ধরে রাখা যাচ্ছে না। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের শক্তিবৃদ্ধি করে এগিয়ে আসছে, তাদের সমর্থন দিচ্ছে পাকিস্তান বিমানবাহিনী। একের পর এক জেলা মহকুমা সদর ছেড়ে দিয়ে ক্রমাগত। পিছু হটছে মুক্তিবাহিনী।
এই হতাশার মধ্যে বিএসএফের নেটওয়ার্কে তৌফিকের কাছে ফোন এল। বৈদ্যনাথতলায় হবে বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। স্ট্রিকট সিক্রেট।
১৬ এপ্রিল ১৯৭১ বৈদ্যনাথ তলায় মাহবুব আর তৌফিক এলেন জিপ নিয়ে। এখানে আসা খুবই কষ্টকর। রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা।
মাহবুব বলেছিলেন, জায়গাটা কিন্তু ভালোই বাছাই করেছে।
তৌফিক বললেন, চুয়াডাঙ্গায় করতে চেয়েছিল। পাকিস্তানি মিলিটারি টের পেয়ে সেখানে ব্যাপক এয়ার অ্যাটাক করে। বম্বিং করে।
মাহবুব বললেন, সেই তুলনায় এই জায়গাটা সব দিক থেকে সেফ। এটা একটা এনক্লেভের মতো। তিন দিকেই ইন্ডিয়া। বিমান হামলা করতে গেলে বিমান ইন্ডিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন করবে। পাকিস্তানিরা এত বড় বোকামো করবে না। ইন্ডিয়ান সৈন্য ইনভাইট করে আনবে না। আর এত গাছ যে ঠিক কোন জায়গাটায় প্রোগ্রাম হচ্ছে, আকাশ থেকে বোঝাও যাবে না।
তৌফিক বললেন, আর সড়কপথে মিলিটারি এই জায়গাটাতে এসে পৌঁছাতেও পারবে না। মেহেরপুর দিয়ে আসতে হবে। মেহেরপুর এখনো মুক্তিবাহিনীর দখলে। সেই সাহস পাকিস্তানি মিলিটারির হবে না। শক্তিতেও কুলাতে পারবে না।
দুই দিন আগেই তাজউদ্দীন আহমদ এখানে নাকি লোক পাঠিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন বিএসএফের অফিসার। তাঁর সঙ্গে সাদাপোশাকের আরও লোকজন। তারা পুরো এলাকাটা রেকি করে গিয়েছেন।
তৌফিক ও মাহবুবকে দেখে একজন-দুজন এলাকার মানুষ ভিড় করতে শুরু করেছে।
এলাকার সংগ্রাম পরিষদের নেতা কে? জানতে চাইলেন তৌফিক।
রুস্তম আলী নামের একজন কলেজছাত্র এগিয়ে এলেন। বললেন, আমি এখানকার সংগ্রাম কমিটিতে আছি।
আপনাদের লোকজনকে ডাকুন।
আবদুল মোমিন চৌধুরী, দোয়াজ উদ্দীন মাস্টার, আইয়ুব হোসেন, রুস্তম আলী, রফিকুল ইসলাম, জামাতী আলী, সৈয়দ আলী–গ্রামের যুবকেরা এগিয়ে এলেন। তাঁরা বললেন, তাঁরা এই এলাকার সংগ্রাম কমিটির নেতা। ২৬ মার্চেই তারা ইপিআর পোস্টে এসে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তুলেছেন। পুরা এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।
সীমান্তচৌকিতে প্রহরারত পুলিশ, আনসার সদস্যরাও এগিয়ে এলেন।
বলা হলো, এখানে নেতারা আসবেন। একটা মিটিং করবেন। আমবাগানের নিচের একটা জায়গা পরিষ্কার করতে হবে।
মানুষের তখন উৎসাহের কোনো অভাব নেই। এলাকার লোকজন বৈদ্যনাথ আমতলার একটা জায়গার জঙ্গল কেটে সাফসুতরো করে ফেলল।
সন্ধ্যার মধ্যে পাশের ইতালীয় মিশনের চার্চ থেকে চৌকি আনা হলো। জোড়া দিয়ে দিয়ে একটা মঞ্চ খাড়া হয়ে গেল। বাংলাদেশের পতাকার জন্য স্ট্যান্ড লাগানো হলো। সেখানে বাঁশের খুঁটি পোতা হলো পতাকার জন্য।
বৈদ্যনাথতলার এই জায়গায় একটা ইপিআর পোস্ট আছে। কিন্তু ইপিআর জওয়ানরা চলে গেছেন মেজর ওসমানের দলে। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছেন। তার বদলে এই পোস্টে এখন ডিউটি করছে আনসার আর পুলিশের একটা দল। তারা তাঁবু গেড়ে পাহারায় রইল। মেহেরপুর থেকে মাইক আসছে। মাহবুব ওয়্যারলেসে খোঁজ নিলেন। রাতের মধ্যেই মাইক রেডি থাকবে।
তৌফিক ও মাহবুব রাতে গেলেন দেই। ভারতের অভ্যন্তরে বিএসএফ ক্যাম্পে। বৈদ্যনাথতলা থেকে বারো মাইল দূরে।
রাতের বেলা প্রচণ্ড ঝড় হলো। দেতাই বিএসএফ ক্যাম্পে শুয়ে তাঁরা আর ঘুমুতে পারলেন না। ঝড়ে মনে হচ্ছে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে।
.
১৭ এপ্রিল ৫টায় পশ্চিমবঙ্গের দেতাই বিএসএফ পোস্ট থেকে রওনা দিয়ে ভোর ৬টার মধ্যেই দুজন–মাহবুব আর তৌফিক-দুই গাড়িতে হাজির বৈদ্যনাথতলায়। রাস্তায় তারা সূর্যোদয় দেখতে পেলেন। সূর্য দেখে তৌফিকের মনটা ভালো হয়ে গেল। গতকাল এখান থেকে চলে যাওয়ার পর রাতে খুব ঝড়বৃষ্টি হয়েছে।
সকাল সকাল বৈদ্যনাথতলায় এসে তো তারা অবাক। ঝড়বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর গ্রামবাসী সারা রাত জেগে দেবদারুর পাতা দিয়ে তোরণ বানিয়েছে। তাতে বাংলা আর ইংরেজিতে লেখা ওয়েলকাম, স্বাগতম। জয় বাংলা। মিশনের সিস্টাররা সারা রাত জেগে কাপড়ে তুলা আঠা দিয়ে লাগিয়েছে। ফাদার ফ্রান্সিসও খুবই ব্যস্ত। এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার, সংগ্রাম কমিটির লোকেরা খুবই ব্যস্ত। বহু আমগাছ ঝড়ে পড়ে গেছে। তারা সভাস্থল আবারও পরিষ্কার করে ফেলেছেন।
বিএসএফ সাদাপোশাকে পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে। রাস্তায় রাস্তায় তারা ইনফরমার রেখেছে, যদি কোথাও শত্রুবাহিনী হামলা করে, খবর দেবে। পাল্টা আক্রমণ করার ফোর্সও তারা সীমানার ভেতরে তৈরি করে রেখেছে।
মুক্তিযোদ্ধারাও দুই মাইল ব্যাসার্ধ করে একটা বৃত্ত রচনা করে অবস্থান নিয়েছে। তৌফিক আর মাহবুব সেই ব্যাপারটাও চেক করে নিলেন। ওয়্যারলেস দিয়ে ইনফরমার রাখা হয়েছে। কোনো রকমের হামলা হলে আগে থেকেই টের পাওয়া যাবে।
গাছে গাছে মাইক টাঙানো হয়েছে। তৌফিক মাইকে ফুঁ দিলেন। হ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টিং। জয় বাংলা, জয় বাংলা। মাইক ঠিক আছে!
এর মধ্যে তৌফিকের খিদে পেয়ে গেছে। মাহবুবকে তিনি বললেন, সকালবেলা তো খেয়ে বের হইনি। এখন তো খিদে পেয়ে গেল। কী করা যায়।
দাঁড়া দেখি। মাহবুব একজন আনসারকে ডেকে বললেন, এই তোমাদের ক্যাম্পে তোমরা খাওয়ার ব্যবস্থা কী করেছ?
স্যার। শুধু ডাল আর ভাত। তবে স্যার গরম-গরম। এখনই চুলা থেকে নামল।
তৌফিক বললেন, ভেরি গুড। আমাদের দুজনকেও একটু ভাগ দাও।
আপনাদের সাথে আর যারা এসেছেন, তাঁদেরও খেতে বলেন। আমরা বেশি করে চাল দিয়েছি। আর ডালে পানি মেশালেই পরিমাণে বাড়বে।
তৌফিক-মাহবুব ক্যাম্পে গিয়ে দুইটা টিনের থালায় গরম ভাত আর ডাল খেলেন। ক্ষুধার্ত পেটে সেই ধোঁয়া ওঠা মাড়ভরা নরম ভাতের স্বাদ তাঁর মুখে চিরদিনের জন্য লেগে থাকবে। যেন অমৃত!
খাওয়ার পর হাত ধুতে ধুতে তৌফিক বললেন, মাহবুব, জাতীয় পতাকা?
মাহবুব বললেন, সেটা তো আনার কথা খেয়াল নাই।
এলাকার চেয়ারম্যান এসে হাজির হয়েছেন। তাঁর নাম সোলেমান বিশ্বাস। তার সঙ্গে মোটরসাইকেল আছে।
তৌফিক বললেন, সোলেমান সাহেব, আপনাকে একটা বিশাল কাজ দেব। বাংলাদেশের জন্য এই কাজটা আপনাকে যেভাবেই হোক করতে হবে।
সোলেমান বিশ্বাস বলেন, জি স্যার। অবশ্যই করব।
এসডিও সাহেবের কাঁধে একটা স্টেনগান। তিনি নিজে এখন যুদ্ধ করছেন। আমরাও যুদ্ধ করছি। সোলেমান বিশ্বাস ভাবলেন।
তৌফিক বললেন, আশপাশের স্কুলগুলোতে যান। বাংলাদেশের পতাকা আনবেন। কী বুঝলেন? কোন পতাকা আনবেন?
বাংলাদেশের পতাকা?
সেইটা কেমন? কী রং?
সেটা সবুজের মধ্যে লাল। লাল গোলের মধ্যে বাংলাদেশের ম্যাপ। সোনার বাংলার ম্যাপ।
একদম ঠিক আছে। সেই পতাকা আনবেন। যান।
সোলেমান বিশ্বাস মোটরবাইক স্টার্ট দিলেন। আনন্দবাস হাইস্কুল, আনন্দবাস প্রাইমারি স্কুল, আনন্দবাস ইউনিয়ন পরিষদে যেতে হবে। বাংলার পতাকা তাঁকে আনতেই হবে।
মাহবুব, মেজর ওসমান চৌধুরীর আসার কথা তার একটা দল নিয়ে। তাঁদেরই গার্ড অব অনার দেবার কথা। এখনো যে তারা আসছেন না? তৌফিক-ই-ইলাহী বললেন উদ্বিগ্ন স্বরে।
কী করতে বলিস? মাহবুব বললেন।
তুই তোর কয়েকজন পুলিশকে নিয়ে গার্ড অব অনার দেবার জন্য তৈরি হ।
আমি তো গার্ড অব অনার কতই নিই। কাজেই কীভাবে দিতে হয় জানি। কিন্তু এই পুলিশেরা কি পারবে? সারদায় ট্রেনিংয়ের সময় শেখানো হয়েছিল। আর তো প্র্যাকটিস নাই।
তুই এখনই ট্রেনিং দে। তারপর এর মধ্যে যদি ওসমান সাহেব আসেন, তাহলে তো আর কথাই নাই।
মাহবুব ডাকলেন তাঁবু গেড়ে রাতে থাকা আনসার-পুলিশদের। বললেন, ইউনিফর্ম পরে চলে আসেন। আমরা গার্ড অব অনার দেব।
স্যার কতজন লাগবে?
দুই সারিতে ১৬ জন হলে ভালো।
মাহবুব নিজের পোশাকের দিকে তাকালেন। তিন সপ্তাহ ধরে একটাই পোশাক তার পরনে। খাকি ড্রেস। সেটা ধুলায়-কাদায় এমন বিবর্ণ হয়ে গেছে। যে আদিতে আসলে এর রং কী ছিল আর বোঝা যাচ্ছে না। মেজর ওসমান। তাঁকে ক্যাপ্টেনের ব্যাজ পরিয়ে দিয়েছেন। সেটা দেখা যাচ্ছে।
১৬ জন পুলিশ তো পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু জুতা আছে, বেল্ট আছে, টুপি আছে, এই রকম ১৬ জন পুলিশ হয় না। কেউ-বা পরে আছে লুঙ্গি। কারও পায়ে রবারের জুতা। কারও পায়ে লাল কেডস।
মাহবুবের বুক ভেঙে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তার নিজেরই ড্রেসের ঠিক নেই। অন্যদের কথা তিনি কী বলবেন। তার মাথায় সবুজ বেরেট, পায়ে জঙ্গল বুট। শুধু ক্যাপ্টেনের ব্যাজটা ঠিক আছে।
মাহবুব মোটামুটি চলতে পারে, এমন বারোজনকে আলাদা করলেন। তাদের সামনে দাঁড়ালেন একজন আনসার। হাতে রাইফেল আছে। রাইফেলসহ কীভাবে গার্ড অব অনার দিতে হবে, তিনি দেখিয়ে দিলেন। বারবার প্র্যাকটিস করে ব্যাপারটা যখন রপ্ত হয়ে গেল, তখন মাহবুব ঘর্মাক্ত কলেবরে এসে তৌফিককে জানালেন, হয়ে গেছে। তোর কী অবস্থা?
এখনো জাতীয় পতাকা পাই নাই। তৌফিক বললেন।
এরই মধ্যে সোলেমান বিশ্বাসের মোটরবাইক এসে গেল। সোলেমান বিশ্বাস দুইটা জাতীয় পতাকা আনতে পেরেছেন।
তৌফিকের মুখটা প্রশান্ত হাসিতে ভরে গেল।
সংগ্রাম পরিষদের নেতারা খুবই ব্যস্ত। আশপাশের গ্রাম ভেঙে লোক আসছে। আসছেন আশপাশের মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তারাও।
চেয়ার দেওয়া হয়েছে গ্রামবাসীর কাছ থেকে ধার করে। স্কুল থেকে আনা হয়েছে, আর হয়েছে মিশন থেকে। গাছে গাছে মাইক। আবার সিস্টারদের বানানো ব্যানারে বাংলা আর ইংরেজিতে লেখা : জয় বাংলা। মঞ্চের ওপরে কার্পেট, শতরঞ্জি বসানো হয়েছে, তা-ও দিয়েছেন এলাকাবাসী।
পতাকাস্ট্যান্ডে পতাকা লাগানো হলো। দড়ি আগে থেকেই বাঁধাই ছিল।
নয়টার দিকে একটা গাড়ি এল ভারতের দিক থেকে। গাড়ি থেকে নামলেন ছাত্রনেতা আবদুর রাজ্জাক, আ স ম আবদুর রব।
রাজ্জাককে দেখে ছুটে গেলেন শাহাবুদ্দীন আহমেদ সেন্টু। রাজ্জাক সেন্টুকে আগে থেকে চেনেন। সেন্টু পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে, প্রথম বর্ষে। শেখ কামালের সঙ্গে খেলাধুলা করেন, বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে গান শেখেন, মার্চ থেকে ধানমন্ডি খেলার মাঠে শেখ কামালের সঙ্গে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছেন। ট্রেনিং দিয়েছেন কর্নেল শওকত আলী। ট্রেনিং নিয়েছেন হারুন, নুর আলী, বাচ্চু, তারেক, তান্না, ইকবাল ১, ইকবাল ২ প্রমুখ। সেন্টু মার্চের অসহযোগে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের হয়ে গান করে বেড়িয়েছেন ঢাকার রাজপথে, শহীদ মিনারে। ২৫ মার্চের পর চলে আসেন মেহেরপুর এলাকায়, হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে তিনিও প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নিতে থাকেন। এরপর চলে আসেন তাঁর বাড়িতে। বৈদ্যনাথতলার আমবাগান থেকে বাড়ি মাত্র মাইলখানেক দূরে।
রাজ্জাক বললেন, সেন্টু, তুই এখানে কী করিস?
সেন্টু বললেন, রাজ্জাক ভাই, যুদ্ধ করতে গ্রামে এসেছি। শেখ কামাল আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, যার যার এলাকায় যাও। সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে মিলে এলাকায় এলাকায় প্রতিরোধ গড়ো।
রাজ্জাক বললেন, তোর বাড়ি এখানে নাকি?
হ্যাঁ। এই তো বাগোয়ান। এক মাইল দূরে হবে। তবে এই যে দেখতেছেন সুপারিগাছ, ওই যে, ওই বাড়িটা আমার চাচার বাড়ি।
আ স ম আবদুর রব বললেন, চলো তাহলে তোমার চাচার বাড়ি যাই। খুব খিদে পেয়েছে। কিছু খাওয়া যায় কি না।
রাজ্জাক বললেন, সেন্টু, তোকে পেয়েছি। খুব ভালো হয়েছে। তুই না। রবীন্দ্রসংগীত শিখেছিস?
হ্যাঁ। এখনো শিখি।
আমার সোনার বাংলা শিখেছিস তো?
হ্যাঁ। সারা মার্চ মাসে শহীদ মিনারে তো রোজ একবার করে গাইতে হয়েছে।
শোন। এখানে তো স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা শপথ নেবে। অনুষ্ঠানে তো জাতীয় সংগীত গাইতে হবে। তুই অ্যারেঞ্জ কর।
জি আচ্ছা।
সেন্টু লেগে পড়লেন। ভবের চরের স্টিফেন পিন্টু ঘোষ ভালো গায়, তিনি জানেন। সেন্টু বলেন, রামনগরের মনসুর মোল্লা কই। কুইক। মোটরসাইকেল নিয়ে যাও। আর শোনো, মিশন থেকে হারমোনিয়াম আর তবলা আনো। দরিয়াপুরের আসাদুল হককে ডাকো। সবাই তখন ওই আমবাগানে হাজির হয়েছে।
পাঁচজন বসলেন আমবাগানের পশ্চিমে। একটা গাছের নিচে। একটু রিহার্সাল করে নেওয়া দরকার। রিহার্সাল শুরু হলে আ স ম আবদুর রবও এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন।
.
দশটার দিকে গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল।
কলকাতা থেকে ডজন ডজন গাড়ি এসেছে।
ব্যারিস্টার আমীর আর আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মান্নান ১৬ তারিখ রাতে কলকাতা প্রেসক্লাবে গিয়ে সাংবাদিকদের দাওয়াত দিয়ে এসেছেন। বলেছেন, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের একটা বিশেষ অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হবে। ভোর সাড়ে ৫টার মধ্যে প্রেসক্লাবে থাকতে হবে। ৬টার মধ্যে গাড়ি ছেড়ে দেবে।
কেন? কোথায় যাব আমরা?
এটা আমরা কালকে বলব। আজকে আপনারা আর কোনো প্রশ্ন করবেন। না। আর আজকে যে আমরা এসেছি, কালকে ভোরে রওনা দিচ্ছি, এটাও আজ আর কারও সঙ্গে শেয়ার করবেন না।
আওয়ামী লীগের এমপিএ-এমএনএ যারা কলকাতায় আছেন, তাঁদের নেওয়ার জন্য গাড়ি দাঁড়াল সিনহা রোডে।
সকাল ছয়টার মধ্যে ভারতীয় সাংবাদিক, পশ্চিমা সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান দিয়ে ভরে গেল কলকাতা প্রেসক্লাব। সবাইকে নিয়ে ঠিক সময়ে গাড়ি ছেড়ে দিল। বাংলাদেশের নেতারাও যথাসময়ে উঠে গেলেন গাড়িতে। মোটামুটি ৫০টার মতো অ্যাম্বাসেডর গাড়ি এসে আমবাগানের বিভিন্ন জায়গায় গাছের আড়ালে দাঁড়াল। কলকাতা থেকে বৈদ্যনাথতলা পর্যন্ত আসতে তাদের লাগল প্রায় চার ঘণ্টা।
সবার মধ্যে একটু ব্যস্তসমস্ত ভাব। শুধু অবিচল ভঙ্গি দেখা যাচ্ছে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আর তাজউদ্দীনের। কামারুজ্জামান সাহেব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কাজেই তিনি খানিকটা তৎপর হলেন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে সাদা পাঞ্জাবি, ঢোলা পায়জামা, কালো চশমায় আরও লম্বা দেখা যাচ্ছে।
কলকাতা সিনহা রোডে সৈয়দ নজরুল গাড়িতে ওঠার আগে টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মান্নানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মান্নান, চিরুনি নিয়েছ?
হ্যাঁ। মান্নান জানালেন। সৈয়দ নজরুল আবারও বললেন, চিরুনি নিয়েছ? হ্যাঁ। তিনবার তিনি এক প্রশ্ন করলেন। তখন পাশের আরেক নেতা বলে উঠলেন, লিডার, আপনি চিরুনি দিয়ে কী করবেন? আপনার মাথাতে চুলই নাই।
না, কে বলল নাই। সামনে না থাকলেও পাশে তো আছে।
সব নেতা এসেছেন সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে। খন্দকার মোশতাক এসেছেন লম্বা কোট-প্যান্ট-টুপি পরে। এম এ জি ওসমানী এখানে আসবেন। কিন্তু তার পরার মতো ইউনিফর্ম নেই। তার জন্য আগের রাতে ড্রেস বানানো হয়েছে। কারণ বিএসএফ যা দিচ্ছিল, সবই তাঁর পরনে বড় আর ঢোলা হচ্ছিল।
নেতারা এসে গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের গায়ে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে স্বাগত জানাল জনতা। তাঁরা সভাস্থলের পাশে পুলিশ ফাঁড়ির কাছাকাছি চেয়ার নিয়ে বসলেন।
শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান। এসেছেন। তারা ঘুরে ঘুরে ব্যবস্থা দেখতে লাগলেন। অনেক কাঠের চেয়ার। কোনো চেয়ার ভাঙা। বেঞ্চি। দুটো মঞ্চ। একটা বড়। আরেকটা ছোট্ট ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড। দড়ি দিয়ে সভামঞ্চের সামনের দিকটা ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। মানুষ এসে ভরে যাচ্ছে পুরো আমতলা।
তাজউদ্দীন বললেন, তৌফিক সাহেব, কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করতে পারবেন কে, ঠিক হলো?
জি স্যার। বাকের আলী, এদিকে এসো।
কলেজছাত্র বাকের আলী এগিয়ে এল (পরে তিনি স্থানীয় কলেজের অধ্যাপক হবেন)। তার স্কুলশিক্ষক দোয়াজ উদ্দীন জানতেন, স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে বাকের আলী কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করত। দোয়াজ উদ্দীনরা দুই দিন ধরে আম্রকাননের সভাস্থলে বড় খাটছেন।
তাজউদ্দীন বললেন, তোমার নাম কী ভাই?
বাকের আলী।
কী করো?
কলেজে পড়ি।
কোন আয়াতটা পড়বা, একটু শোনাব।
বাকের আলী টুপি মাথায় দিয়ে তিলাওয়াত করল। তাজউদ্দীন হাফেজে কোরআন। তিনি বললেন, ঠিক আছে। এইটাই কোরো।
নেতারা আগে এসেছেন। একটু পরে এসেছেন কলকাতা প্রেসক্লাব থেকে গাড়িতে ওঠা সাংবাদিকেরা।
ব্যারিস্টার আমীর সাংবাদিকদের সামলাচ্ছেন।
তাজউদ্দীন আহমদ সব চেক করে নিলেন। নির্বাচিত এমপিএ, এমএনএরা এসেছেন। গুরুত্বপূর্ণ নেতারা এসেছেন। আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন। এসেছেন। অধ্যাপক ইউসুফ আলী চিফ হুইপ। তিনি শপথ পরিচালনা করবেন। এসেছেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। পাশে বসে আছেন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, মোশতাক আহমদ। আছেন। মুক্তিবাহিনীর প্রধান এম এ জি ওসমানী। আছেন। তৌফিক, শুরু করে দিন। যত তাড়াতাড়ি শুরু করা যায়, ততই মঙ্গল।
তৌফিকও সেটা জানেন। আক্রমণের শঙ্কা সব সময়ই আছে। পাকিস্তানি মিলিটারি টের পেয়ে গেলে প্লেন নিয়ে মাথার ওপরে একটা চক্কর তো দিতেই পারে। আবার সড়কপথেও তারা আক্রমণ করে বসতে পারে। তাড়াতাড়ি করতে হবে। মাহবুব, চল, শুরু কর।
মাহবুব আরেকবার পথের দিকে তাকালেন। ওসমান সাহেবের বিশাল বাহিনী কি এসে পৌঁছাবে না? গার্ড অব অনার তাকেই দিতে হবে?
না। আর সময় নেওয়া ঠিক হবে না।
১১ জন পুলিশ দুই সারিতে দাঁড়ালেন। সামনে একজন তাদের নেতা। আনসার ইয়াদ আলী। তার কাঁধে লেখা আনসার। মুখে দাড়ি।
.
সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন আহমদ, কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর, মোশতাক, কর্নেল ওসমানী মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। মঞ্চের পাটাতনে মিশনারি গির্জা থেকে আনা কার্পেট। নিচে চকি। তার নিচে বাংলার মাটি।
হাজার হাজার আমগাছ। আগের দিন বৃষ্টি হওয়ায় আকাশ পরিষ্কার। বৈশাখের এই মধ্যদুপুর আলোয় আলোয় ঝকঝক করছে। বৃষ্টিধোয়া আমপাতাগুলো কী যে সবুজ। আবার অনেক গাছে ছোট ছোট আম ঝুলে আছে। সভাস্থলে অনেকগুলো বড় শিরীষগাছ, সেগুনগাছও আছে। বৃষ্টির পানি কোথাও কোথাও জমে আছে, তাতে আকাশ-আলো-সবুজ পাতার প্রতিবিম্ব পড়ে সামান্য বাতাসে একটু একটু করে দুলছে।
মাহবুব চলে গেলেন তাঁর ১২ জনের গার্ড অব অনার দলের কাছে। ইয়াদ আলী পেছনে গেলেন। মাহবুব সামনে দাঁড়িয়ে কমান্ড করলেন, অ্যাটেনশন।
পুলিশ সদস্যরা পা ঠুকে অ্যাটেনশন হলো।
শোল্ডার আর্মস। তারা কাঁধে রাইফেল তুলল।
এবার তিনি দেহের সব শক্তি মুখে এনে বললেন, প্রেজেন্ট আর্মস। সৈন্যরা বুকের সামনে অস্ত্র উঁচিয়ে ধরল। মাহবুব স্যালুট করলেন।
এই সময় সেন্টু, পিন্টু, আসাদুল, মনসুর হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইতে শুরু করলেন :
আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস আমার প্রাণে
ও মা আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি…
গান গাইছেন তারা সমস্ত দরদ ঢেলে দিয়ে।
.
ব্যাঙ্গমা বলবে, এত সুন্দর কইরা এত মায়া দিয়া আমার সোনার বাংলা আর কেউ কখনো গাইছে কি না আমগো জানা নাই।
ব্যাঙ্গমি বলবে, হ। তুমি ঠিকই কইছ।
.
জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হচ্ছে।
মঞ্চে সবার চোখ ভিজে আসছে। দর্শকসারিতে বসা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, পুলিশ ইপিআর সৈনিক আমলা যারা কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, নড়াইল থেকে এসে পৌঁছাতে পেরেছেন, উপস্থিত গ্রামবাসী–সবার চোখ দিয়ে জল ঝরতে লাগল। পুরো এলাকার পরিবেশ মুহূর্তে গেল পাল্টে। পরে গোলোক মজুমদার রুস্তমজিকে রিপোের্ট করবেন, যখন আমার সোনার বাংলা গানটা হচ্ছিল, পুরো সভার দশ হাজার মানুষ যেন বিদ্যুতায়িত হলো। ইলেকট্রিফায়েড। ও মা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে–গাইতে গাইতে সবাই কাঁদছেন, সৈয়দ নজরুল কাঁদছেন, তাজউদ্দীন কাঁদছেন, কামারুজ্জামান কাঁদছেন, ক্যাপ্টেন মনসুর কাঁদছেন, ওসমানী কাঁদছেন, মিজান চৌধুরী কাঁদছেন, মান্নান কাঁদছেন, শেখ মণি, রাজ্জাক, আ স ম আবদুর রব, তোফায়েল, সিরাজুল আলম খান, শাজাহান সিরাজ, উপস্থিত এমপিএরা, এমএনএরা, আমীর, উপস্থিত সরকারি কর্মকর্তারা, মাহবুব, তৌফিক, নুরুল কাদের, উপস্থিত মেজররা, কর্নেলরা, পুলিশ, আনসার, ইপিআর, মুজাহিদ–সবাই দরদর করে কাঁদছেন। কাঁদছে সমবেত হাজার হাজার লুঙ্গি পরা, গেঞ্জি পরা, পাঞ্জাবি পরা, শার্ট পরা, খালি গা, খালি পা, স্যান্ডেল পা গ্রামবাসী। এমনকি সেই আমের বাগানে গাছে। গাছে পাখিরাও যেন নিজেদের গান ভুলে কণ্ঠ মেলাতে লাগল ওই আমার সোনার বাংলার সঙ্গে। যখন শিল্পীরা গাইছেন, মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি…তখন কুড়ি হাজার চোখ অশ্রুর প্লাবনে ভেসে যেতে লাগল! সাদা বিদেশি সাংবাদিকেরা কলকাতার বাঙালি সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করলেন, সবাই কাঁদছে কেন? কলকাতার বাঙালি সাংবাদিক বললেন, ওরা ওদের জাতীয় সংগীত গাইছে। জাতীয় সংগীত গাইবার সময় কাঁদতে হবে। কেন? এটা তুমি বুঝবে না। এটা কেবল বাঙালিরাই বুঝতে পারে। বলে কলকাতার সাংবাদিক নিজেই চোখ মুছতে লাগলেন।
মাহবুব লেফট-রাইট করে এলেন মঞ্চের সামনে। স্যার, প্যারেড পরিদর্শনের জন্য দল প্রস্তুত স্যার।
সৈয়দ নজরুল আর কর্নেল ওসমানী তাঁর সঙ্গে চললেন। প্যারেড পরিদর্শন করলেন। ওসমানীর পরনে নতুন পোশাক। গতকাল নিউমার্কেট থেকে কাপড় কিনে দরজিকে দিয়ে বানানো হয়েছে। নতুন পোশাকে তাঁকে বেশ প্রত্যয়ী মনে হচ্ছে।
প্যারেড পরিদর্শন শেষে সৈয়দ নজরুল মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালেন। মার্চপাস্ট করে তাদের সালাম জানিয়ে পুলিশ-আনসারের দলটা অনুষ্ঠান চত্বরের প্রান্তে গেল। মাহবুব ঘোষণা দিলেন : হল্ট। ডিসমিস…আনসার-পুলিশরা জনতার সঙ্গে মিশে গেলেন।
কোরআন শরিফ থেকে পাঠ হলো। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী :
মুজিবনগর, বাংলাদেশ
তারিখ : ১০ এপ্রিল ১৯৭১
যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল; এবং
যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগদলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল; এবং
যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন; এবং
যেহেতু তিনি আহূত এই অধিবেশন স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন; এবং
যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতিবহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন; এবং
যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান; এবং
যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। এবং এখনো বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে; এবং
যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্যা এবং নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের পক্ষে একত্রিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব করে তুলেছে; এবং
যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে;
সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি।
এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি…
ইউসুফ আলী শপথ করালেন। উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীরা শপথ নিলেন। সৈয়দ নজরুল ভাষণ দিলেন, তাজউদ্দীন বক্তৃতা করলেন।
দেশি-বিদেশি সাংবাদিকেরা ছবি তুলল, চলচ্চিত্র ধারণ করল, এলাকার মানুষের কথা রেকর্ড করে নিল। হাজারও মানুষ চেয়ারে বসে, চারদিকে দাঁড়িয়ে থেকে, আমগাছের ডালে উঠে বসে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটাকে প্রত্যক্ষ করল।
এরই মধ্যে মেজর ওসমানের ইপিআর দল চলে এসেছে। তারাও একবার মার্চপাস্ট করে সালাম জানালেন নতুন সরকারের নেতৃবৃন্দকে।
অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের কাছে গেলেন নেতারা। তাজউদ্দীন সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন উপরাষ্ট্রপতি আর মন্ত্রীদের। এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, জায়গার নাম কী?
তাজউদ্দীন বললেন, মুজিবনগর।
সাংবাদিকদের গাড়িতে তুলে আবার কলকাতার উদ্দেশে রওনা করিয়ে দেওয়া হলো।
নেতারা আরও খানিকক্ষণ থাকলেন। এলাকাবাসী মুড়ি, চিড়া, পানি, ভাত-রুটি যে যেভাবে পারে, এনে নেতাদের খাওয়াতে লাগলেন। তারা নেতাদের জড়িয়ে ধরলেন, পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন, আর কাঁদতে লাগলেন।
তাঁদের চোখের পানি নেতাদের চোখের পানির সঙ্গে মিশে পড়তে লাগল বৈদ্যনাথতলার মাটিতে।
তাজউদ্দীনরা গাড়িতে উঠছেন। তৌফিক, মাহবুব, ওসমান তাঁদের বিদায় জানাচ্ছেন। তৌফিক বললেন, স্যার, আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ আপনারা আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ দিলেন।
তাজউদ্দীন বললেন, তোমরা ইতিহাসের সাক্ষী নও। তোমরা ইতিহাসের নির্মাতা।
.
একে একে নেতারা গাড়িতে উঠে কলকাতার দিকে চলে গেলেন।
মাহবুব, তৌফিক, এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা, এলাকাবাসী রয়ে গেলেন। তাদের সামনে অনেক কাজ। যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ চলবে। তারা পাকিস্তানি বাহিনীকে কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা এলাকা থেকে বিতাড়িত করবেনই।
৩৪
বাংকারে এলএমজি পোস্টে মোস্তফা। ২২ বছরের সুঠাম যুবক। ৮০০ গুলি আছে। তিনি চালাতে থাকবেন গুলি। ততক্ষণে তার সঙ্গীরা নিরাপদে সরে যেতে পারবে।
কুমিল্লা, আখাউড়া রেললাইনের ধারে অবস্থান নিয়েছেন তারা। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে সকাল থেকেই।
১৮ এপ্রিল ১৯৭১।
মোহাম্মদ মোস্তফা জাত সৈনিক। পাকিস্তানের চেয়ে এক বছরের ছোট। ১৯৪৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর জন্ম। ভোলার দৌলতখানের হাজীপুর গ্রামে জন্ম তার। তার বাবাও ছিলেন মিলিটারি। সবাই তাঁদের বাড়িটাকে বলত, হাবিব মিলিটারির বাড়ি। বাবার মতো মোস্তফাও মিলিটারি হতে চেয়েছেন ছোটবেলা থেকেই। হাবিলদার বাবার সঙ্গে বালক মোস্তফা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টেও থেকেছেন। তাঁরা ছিল দুই ভাই, তিন বোন। মোস্তফাই বড়। বাবার গল্প তাঁকে গর্বিত করে। বাবা ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ করেছেন। সেই সময়ই গ্রামে এসে মালেকা বেগমকে বিয়ে করেন। বিয়ের পরপরই চলে যান যুদ্ধক্ষেত্রে। বাবার সঙ্গে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে থাকার সময় বালক ছোট্ট মোস্তফা দেখেছেন। কুচকাওয়াজ। বিশেষ করে ব্যান্ডদল যখন বাদ্য বাজাত, আর সৈন্যরা মার্চপাস্ট করত, খুব ভালো লাগত মোস্তফার। ১৯৬৬ সালে মোস্তফার বিয়ে হলো ভোলার গ্রামে, স্ত্রী পেয়ারা বেগম। কিন্তু বিয়ের পরই ছেলে নিখোঁজ। মোস্তফা ফিরেছিলেন ১৯৬৮ সালে, জানিয়েছিলেন, আর্মিতে জয়েন করেছেন।
এলএমজির ট্রিগারে হাত রেখে গুলি চালাতে চালাতে মোস্তফার মনে পড়ছে তার স্ত্রী পেয়ারা বেগমের কথা। বউটা পোয়াতি। তাঁকে বাড়ি রেখে তিনি বাড়ি ছেড়েছেন ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর। তারপর তো দেশেই ঘূর্ণিঝড় লেগে গেল। নির্বাচন হলো। আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। মার্চ মাস ধরে অসহযোগ।
৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি তার। মেজর শাফায়াত জামিলের সঙ্গে তাঁরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছিলেন মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে। খবর আসছে, পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি সৈন্যদের ওপরে আক্রমণ করবে। মেজর খালেদ মোশাররফকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো হয়, সেখান থেকে আলফা কোম্পানিসহ তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শমসেরনগরের দিকে। শমসেরনগরে মেজর শাফায়াত জামিল আর মেজর খালেদ মোশাররফ বৈঠক করলেন। যুদ্ধ আসন্ন। তাঁরা বিদ্রোহ করবেন।
.
২৫ মার্চের পর কুমিল্লায় পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করে ঘুমন্ত বাঙালি সৈন্যদের হত্যা করে। আর শমসেরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন খালেদ মোশাররফ আর শাফায়াত জামিল। এপ্রিলের শুরুতে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সব কোম্পানি একত্র হয়। মেঘনার পশ্চিমে তারা শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তোলে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী বিপুল শক্তি সংগ্রহ করে হেলিকপ্টার, যুদ্ধবিমান, গানশিপসহ এমন আক্রমণ করে যে পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া মুক্তিবাহিনীর কোনো উপায় থাকে না। এরপর তারা আখাউড়াতে তাদের ডিফেন্স লাইন গড়ে তোলে।
১৬ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী আখাউড়া আক্রমণ করতে এলে যুদ্ধ শুরু হয়। একটা পুকুরপাড়ে সর্বডানে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে মোস্তফা কামাল এলএমজি নিয়ে প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত। ১৭ এপ্রিল ব্যাপক গোলাগুলি হয়।
১৮ এপ্রিল প্রচণ্ড বৃষ্টি। পাকিস্তানি সৈন্যদের গোলাগুলিও থেমে গেছে। তবে কি তারা ফিরে গেছে ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে।
কিন্তু না। একটু পরে শুরু হয় প্রচণ্ড আক্রমণ। দুই দিক থেকে আক্রমণ আসছে। মোগড়াপাড়া, গঙ্গাসাগরের দিক থেকে। দরুইন গ্রামের এই ডিফেন্স পোস্টে ১০ জনের প্লাটুনের কমান্ডার মোস্তফা। মেজর শাফায়াত জামিল তাকে ল্যান্স নায়েকের ব্যাজ পরিয়ে দিয়েছিলেন, সেটা পরেই তিনি এখন যুদ্ধরত।
দুই দিক থেকে আসা একযোগে আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা চাপে পড়ে গেছে। তাদের পিছিয়ে যেতে হবে। পেছানোর জন্যও কভার দিতে হবে।
মোস্তফা বললেন, আমি এলএমজি চালাচ্ছি। তোমরা সরে যাও।
এলএমজির নল প্রচণ্ড গরম। গুলি বের হওয়ার সময় মাটি পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। পাকিস্তানি বাহিনী এগোচ্ছে সার বেঁধে। তাদের অনেকের হাতেই এলএমজি। এমনকি মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ করছে তারা।
মোস্তফা তাঁর কাজ জানেন। কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে হবে শত্রুদের। তারপর তিনিও পিছিয়ে যাবেন।
ঠিক এ সময়ে তার মনে পড়তে লাগল তাঁর বাবার মুখ। বাবা ছিলেন বীর। তিনটা মেডেল পেয়েছেন বিশ্বযুদ্ধের সময়। মনে পড়ে মায়ের মুখ। মা বলছিলেন, বাবা, আবার কবে আসবা? সাইক্লোনে সব ভাসায়া নিয়া গেছে, তবু আমরা তো বাঁচিয়া আছি।
ভোলা থেকে আসার পর চিঠি এসেছে বাবার। বাবা মোহাম্মদ মোস্তফা। তোমার স্ত্রী গর্ভবতী। একবার আসিয়া দেখিয়া যাইয়ো।
মোস্তফা ভাবলেন, আমার বাবা ছিলেন সৈনিক। আমিও হয়েছি সৈনিক। আমার ছেলেও সৈনিক হবে। তবে সে হবে স্বাধীন দেশের সৈনিক।
ছেলের নাম কী রাখা হবে?
আমি ছেলেকে দেখতে যাব। তবে যখন যাব, তখন এই দেশ শত্রুমুক্ত। স্বাধীন বাংলাদেশ।
মোস্তফা গুলি চালাচ্ছেন তিন দিকে। একবার দক্ষিণে, একবার পশ্চিমে, একবার উত্তরে।
একজন সহযোদ্ধা বললেন, মোস্তফা চইলা আহো।
মোস্তফা বললেন, তোমরা তাড়াতাড়ি যাও। আমি আসতেছি।
গুলি শেষ হয়ে এসেছে। আর থাকার মানে হয় না। বাংকার থেকে বেরোতে যাবেন, অমনি একটা গুলি এসে লাগল তার কাঁধে। উড়ে গেল কাঁধ। পড়ে গেলেন তিনি। বাংলার মাটিতে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি। বৃষ্টিতে রক্ত ধুয়ে যাচ্ছে। এই পানি কি মিশে যাবে মেঘনার স্রোতে?
পাকিস্তানি মিলিটারি চলে এসেছে এই এলএমজি পোস্টে। দেখল, একটা বাঙালি সৈন্য তখনো নড়ছে। এ তো বেঁচে আছে। বেয়নেট চালাল তারা।
মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে গেছে তাদের ক্যাম্পে।
পড়ে রইল মোস্তফার নিস্পন্দ শরীর। গুলিবিদ্ধ, বেয়নেট-চেরা।
পরে সৈন্যরা চলে গেলে দরুইন গ্রামের চাষা আর শ্রমিকেরা আসে সেখানে। মোস্তফা কামালকে সমাহিত করে সেই জায়গাতেই।
বড় ছেলে মোস্তফার মৃত্যুসংবাদ ভোলার সেই টিনে ছাওয়া বেড়ার ঘরের বাড়িতে কবে এসে পৌঁছায়, তার মা মালেকা বেগম কবে ডুকরে কেঁদে ওঠেন, আর কবে পেটের ভেতরে সন্তান নিয়ে পেয়ারা নির্বাক হয়ে ঘরের খুঁটি ধরে দাঁড়ান, কে তার খোঁজ রাখে!
জুলাই মাসে পেয়ারা বেগমের সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো। ছেলে। ছেলের নাম রাখা হলো মোশাররফ হোসেন। দাদা হাবিলদার হাবিব তাঁকে ডাকেন বাচ্চু বলে। তা থেকেই ছেলের নাম হয়ে গেল মোশাররফ হোসেন বাচ্চু।
.
ব্যাঙ্গমা বলবে, মো. মোস্তফাকে স্বাধীনতার পর বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেওয়া হইল। নামের লগে যুক্ত কইরা দেওয়া হইল কামাল। বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল।
৩৫
ফজরের আজান হচ্ছে টুঙ্গিপাড়া মসজিদে। আকাশ তখনো অন্ধকার। মোরগ ডেকে উঠছে শেখ বাড়ির মুরগির খুপরিগুলোতে। সারা রাত ভ্যাপসা গরমের পর ভোরবেলাটা একটু ঠান্ডা।
শেখ কামাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন। নিজের ছোট্ট ব্যাগটা রেডি করে নিয়ে তিনি গেলেন দাদা-দাদির ঘরে।
শেখ কামাল শুনেছেন তাজউদ্দীনের বেতার ভাষণ। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে সেই ভাষণ পুনঃপ্রচারিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এক গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে এই ভাষণ প্রচার করা হয়েছিল। সেটার রেকর্ড এখন। প্রচার করা হচ্ছে। শেখ কামালের রক্তের ভেতর যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, বর্ডার পার হতে হবে। আকাশবাণী, বিবিসি শুনে বুঝতে পারলেন, যুদ্ধের সন্ধানে যেতে হবে ওপারে।
দাদা বারান্দায় এসেছেন। অজু করবেন। বাড়ির দেখভাল করেন আরশাদ মামু, তিনি কাসার বদনায় পানি এনে দিয়েছেন।
কামাল দাদা লুত্যর রহমানকে কদমবুসি করলেন। দাদিও বেরিয়ে এসেছেন বারান্দায়। তিনিও অজু করবেন। কামাল দাদিকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, দোয়া করেন। আমি যাচ্ছি।
কই যাও? দাদা বললেন।
কামাল বললেন, যুদ্ধ করতে যাই।
দাদা বললেন, দ্যাখো। তোমার আব্বা মানুষের জন্য দেশের জন্য সংগ্রাম করতে গেছে, আমি কোনো দিনও বাধা দেই নাই। তুমি আজকে দেশের জন্য সংগ্রাম করতে যেতে চাচ্ছ, তোমাকেও আমি বাধা দেব না।
কামাল বললেন, দোয়া করেন।
দাদা বললেন, দোয়া করি। ভালো থাকো। সুস্থ থাকো। নিরাপদ থাকো।
কামাল বললেন, আপনারাও ভালো থাকবেন।
দাদা বললেন, এইখানে থাকা আসলে নিরাপদ না। এইটা শেখ মজিবরের বাড়ি। এইখানেও মিলিটারি আসবে। তুমি যাও। সেইটাই ভালো। আমি বৃদ্ধ মানুষ। আমার সাথে তো কারও শত্রুতা নাই। আমি থাকি।
কামাল, ২১ থেকে বয়স ২২-এর দিকে যাচ্ছে, এরই মধ্যে গোঁফ হেঁটে ফেলেছেন, চুলে দিয়েছেন কদমছাট, পরনে একটা ফতুয়া, যাতে কিছুতেই তাকে চেনা না যায়। সঙ্গে তোক ঠিক করা আছে, তাঁরা চললেন বর্ডারের উদ্দেশে। সূর্য ওঠার আগেই রওনা দিতে হবে। বেলা এগারোটার মধ্যে যতটুকু পারা যায়, এগিয়ে যেতে হবে। তা না হলে যা রোদ, ভীষণ কষ্ট হবে। প্রথমে যেতে হবে কাশিয়ানী থানা। সেইখানে চাপতাবাজারে বর্ডারের লোক আছে। বাকি পথ সেই লোক গাইড করে নিয়ে যাবেন। খালাতো ভাই শেখ শহীদও ঢাকা থেকে এসেছেন টুঙ্গিপাড়া। দুই ভাই একই সঙ্গে যাবেন ওপারে।
শহীদ বলেন, কামাল হাঁটতে পারবি তো!
কামাল বলেন, আমি যে স্পোর্টসম্যান, সে সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নাই। আমি ক্রিকেট খেলি, ফুটবল খেলি, বাস্কেটবল খেলি। ইউনিভার্সিটিতে আমি দৌড় প্রতিযোগিতা করে মেডেল পাইছি। তোমার দেখি আমার সম্পর্কে কোনো ধারণাই নাই।
তোকে তো কোনো দিন হাঁটতে দেখি না। সারাক্ষণ তো তুই গাড়িই চালাস।
কামাল বলেন, গাড়ি চালাই বলে হাঁটতে ভুলে গেছি, ব্যাপার তা নয়।
আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। পাখিরা গাছগাছালিতে প্রাণপণে ডাকছে। লোকজন ঘুম থেকে উঠছে। গরু বের করছে গোয়াল থেকে। মাঠেও যাচ্ছে কৃষকেরা। যত তাড়াতাড়ি যত দূরে চলে যাওয়া যায়, ততই ভালো। না হলে পথে দেখা হলেই লোকে জিজ্ঞেস করে, কোন বাড়ির পোলা? শেখ বাড়ির না?
তারা দ্রুত হাঁটেন। সূর্য উঠছে। সূর্যটাকে পূর্ব দিগন্তে একটা আস্ত ডিম পোচের মতো দেখাচ্ছে। আহা, এই সময় বাজাতে হয় পূরবী রাগ। অদৃশ্য সেতারের তারে আঙুল বোলান কামাল।
এগারোটা পর্যন্ত একটানা হাঁটলেন। সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে একাকার। একটা রাস্তার ধারের টিউবওয়েলের মুখে মুখ রেখে পানি পান করলেন পেট ভরে। তারপর বসলেন একটা গ্রাম্য বাজারে। চা খাওয়া দরকার। টোস্ট বিস্কুট পাওয়া গেল বড় বড়। টোস্ট বিস্কুট কিনে ভাঙা কাপের চায়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেলেন।
এখানে ঘোড়া ভাড়া পাওয়া যায়। কামাল বললেন, আর কত মাইল আছে। কাশিয়ানী?
আরও ১৫ মাইল।
তাইলে চলো ঘোড়া ভাড়া করি।
পারবি তুই ঘোড়ায় চড়ে চলতি? পড়েটড়ে যাবি না তো!
আরে কী বলো তুমি। দ্যাখো পারি, না না পারি।
কাশিয়ানীর আগে আগে তারা ঘোড়া ছেড়ে দিলেন। রিকশা দেখা যাচ্ছে। তাঁরা রিকশা ভাড়া করলেন। কাশিয়ানী বিপজ্জনক জায়গা। ওয়্যারলেস পোস্ট আছে। পাকিস্তানি মিলিটারির জন্য এইটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মিলিটারি থাকতে পারে।
ওড়াকান্দি গ্রামের ঠাকুরবাড়িতে উঠলেন তাঁরা। ততক্ষণে সূর্য হেলে পড়েছে। পেটও খিদেয় চো চো করছে। রাস্তায় কলা কিনে খেয়েছেন, একটা বাজারে থেমে খেয়েছেন গুড়ের জিলাপিও। কিন্তু ভালোমতো সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার তো আর খাওয়া হয়নি।
পুকুরের পানিতে গোসল সেরে নিয়ে টিনে ছাওয়া বারান্দায় পাতা সেগুন কাঠের হাই বেঞ্চি লো বেঞ্চিতে যখন তাদের কাঁসার থালায় ভাপ ওঠা গরম ভাত দেওয়া হলো, সঙ্গে শুরুতেই সেদ্ধ ডিমের ভর্তা, তখন কামালের জিবে পানি চলে এল। যেন কত দিন তিনি খাননি।
বাড়ির লোকেরা কামাল আর শহীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল সবুজ লুঙ্গি পরা এক লোকের সঙ্গে–এই যে আরশাদ আলী, ইনিই আপনাদের নিয়ে যাবেন বর্ডার পর্যন্ত।
রাতের বেলা বাড়ির লোকজনের সঙ্গে গল্প করতে করতে তার ব্যাগ থেকে ছোট্ট ট্রানজিস্টর রেডিও বের করে বিবিসির খবর ধরলেন কামাল। তারা। আকাশবাণী শুনলেন। তারপর প্রচণ্ড ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লেন পাটের স্তূপের পাশে একটা বড় পালঙ্কে। পাশে শহীদের নাক শঙ্খের মতো ডাকছে।
আরশাদ আলীকে নিয়ে কামাল আর শহীদ বেরিয়ে পড়লেন পরদিন খুব ভোরবেলা। সকালের নাশতার চেয়ে রোদ ওঠার আগে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছানো জরুরি। অন্ধকারের মধ্যেই তারা হাঁটতে শুরু করলেন। গাজীর হাট হয়ে দৌলত শরাফপুর পাইকগাছা হয়ে কাটাখালী। সেখানে এসে তাদের আটকালেন একজন ষন্ডামার্কা লোক। তার হাতে বন্দুক। সঙ্গে আরও লোকজন।
কে উনি?
মকবুল চেয়ারম্যান।
কোন মার্কা?
মুসলিম লীগ। হারিকেনের সাপোর্টার।
মুসলিম লীগের এই স্বঘোষিত রাজাকাররা আটকে ফেলল এই তিনজনকে। তোমরা কারা?
আরশাদ আলী বললেন, যা বলার আমিই বলবনে। আপনারা চুপ কইরে থাকেন।
আরশাদ আলী বললেন, আমরা সাতক্ষীরার মানুষ। গোপালগঞ্জ এসেছিলাম। এখন আবার সাতক্ষীরা যেতে চাচ্ছি।
কেন, যেতে চাচ্ছ কেন?
এইখেনে আর কত দিন থাকপ? যেতে হবি না নে! চেয়ারম্যান সাব, দু কুড়ি টাকা আছে। নিয়ে নেন। আমাদের ছেড়ে দেন দিকিনি।
ছয় কুড়ি টাকা নিয়ে মকবুল চেয়ারম্যান ছেড়ে দিলেন ওদের। নৌকা নিয়ে তারা আবারও চলতে শুরু করলেন।
বহু পথ হেঁটে রিকশায়, ঘোড়ার গাড়িতে, নৌকায়, মোষের গাড়িতে চড়ে শেষতক কালীগঞ্জের পাইকাড়া গ্রামের ঠাণ্ডাই গাজীর বাড়িতে এসে উঠলেন তারা। তত দিনে শেখ কামালের শরীরটা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছে। বারবার বমি করছেন। এই বাড়িতে থাকলেন কদিন। শরীরটা একটু শক্তপোক্ত হলো। এরাও খুব যত্ন করলেন। শেখ সাহেবের ছেলে শুনে তারা বন্দুক নিয়ে তিন ভাই পালা করে বাড়ি পাহারা দিতেন।
তারপর একদিন বিকেলবেলা রওনা হলেন তারা। প্রথমে দেবহাটা থানার নংলা গ্রামে আশ্রয় নিলেন। সেখান থেকে ছুটিরপুর দিনে দিনে। রাতের অন্ধকারে সীমানা পেরিয়ে বর্ডারের ওপারে চলে গেলেন। পশ্চিম বাংলার হাসনাবাদে তখন সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন এম নুরুল হুদা। তিনি শেখ সাহেবের ছেলেকে কাছে পেয়ে আবেগে জড়িয়ে ধরলেন।
তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনার আব্বার কোনো খোঁজখবর পাওয়া গেল?
করাচি নিয়ে গেছে শুনলাম। এর চেয়ে বেশি কিছু তো জানি না। কামাল বললেন।
হাসনাবাদে ভালো জায়গায় রাখা হলো কামাল আর শহীদকে। রাতের বেলা গোসল করে গরম ভাত খেতে পারলেন।
পরের দিন গাড়ি করে তাদের নামিয়ে দেওয়া হলো বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ৫৭/৮ বাড়িটির সামনে।
বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ে। বিএসএফের পাহারা পেরিয়ে নিচতলা থেকে সোজা দোতলায় উঠে গেলেন কামাল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম চাচার ঘরে। তিনি ছিলেন না। এরপর গেলেন তাজউদ্দীন চাচার ঘরে।
তাজউদ্দীন গভীর মন দিয়ে একটা কিছু লিখছিলেন। কামালকে দেখামাত্র উঠে এলেন। এত দিনে কামালের মুখে দাড়ি গজিয়েছে, গোঁফও বড় হয়ে গেছে। ফলে চিনতে একটু দেরি হলেও না চেনার কিছু ছিল না। তাজউদ্দীন শেখ কামালকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। কামাল সাধারণত আবেগ প্রকাশ করেন না। কিন্তু এখন কাদা ছাড়া কীই-বা করার আছে। দুজনে কাঁদলেন অনেকক্ষণ ধরে।
তাজউদ্দীন জিজ্ঞেস করলেন, ভাবি কেমন আছেন? বাড়ির আর সবাই কে কেমন আছে?
কামাল বললেন, আমি তো বাড়ি ছেড়েছি অনেক দিন আগে। একটার পর একটা বাসা বদল করছিলেন মা। কে কোথায় কীভাবে এখন আছে, সেই খবরটা জানি না। ঢাকা ছাড়ার আগে দেখা করে এসেছিলাম। সেও তো অনেক দিন আগের ঘটনা।
মুজিব ভাইকে করাচি নিয়ে গেছে। জানো?
জি শুনেছি।
তুমি এসেছ। খুব ভালো হয়েছে। আমাদের সঙ্গে বসো। তোমাকে আমাদের খুবই প্রয়োজন।
আমি কিন্তু চাচা ট্রেনিং নিয়ে ফ্রন্টে চলে যাব। যুদ্ধ করব। টেবিলে কাজ করব না।
তা করতে চাইলে সেটাও করা যাবে। আগে তোমার থাকার ব্যবস্থা করি।
আমি নজরুল চাচার সঙ্গে একটু দেখা করে আসি।
হ্যাঁ। খুব ভালো হয়! যাও।
তাজউদ্দীন আহমদ একটা গভীর আশ্বাসের স্পর্শ যেন লাভ করলেন। শেখ মণিসহ যুবনেতা ছাত্রনেতারা তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়া থেকে শুরু করে তাদের সরকার গঠনটাকে মেনে নিতে পারেননি। শেখ কামাল যদি ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে বসেন, কিংবা ফ্রিডম ফাইটারের ট্রেনিংও নেন, তাহলে সেটা তাঁদের জন্য একটা বড় সমর্থন ও স্বীকৃতি হিসেবে অন্যদের সামনে দেখা দেবে। শেখ মণি যদিও তার ফুফাতো ভাই, তবু দুজনের চলাফেরা, মেলামেশা এমনকি উচ্চাশাও আলাদা। কামাল খুবই সংস্কৃতিমনা। খেলাপাগল। তিনি চাইলে কালচারাল ফ্রন্টে লড়তে পারেন। ক্রীড়াক্ষেত্রেও করার আছে অনেক কিছু! বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের নিয়ে একটা স্বাধীন বাংলা খেলোয়াড় দল টাইপ কিছু তো তিনি তৈরি করতেই পারেন। সংগঠক হিসেবে তাঁর সুনাম আছে।
কামাল যুদ্ধে যাবেনই। তাকে আপাতত কাজ দেওয়া হলো, প্রধান সেনাপতি আতাউল গনি ওসমানীর এডিসি (এইড-ডে-ক্যাম্প) হিসেবে কাজ করতে হবে।
কামাল আবারও দেখা করলেন তাজউদ্দীনের সঙ্গে, চাচা, আমি কিন্তু ফ্রন্টে গিয়ে হাতে অস্ত্র নিয়ে লড়াই করতে চাই।
তাজউদ্দীন বলেন, বাবা, যুদ্ধ অনেক দীর্ঘস্থায়ী হবে। আমি অবশ্যই তোমার জন্য ভালো ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে ভালো জায়গায় পোস্টিং দেব। আপাতত তুমি মুজিবনগরে বসো। তোমার উপস্থিতি আমাদের সাহস দেবে, প্রেরণা দেবে। টু স্পিক দ্য ট্রুথ, এইটা একটা এনডোর্সমেন্ট। তুমি দেখো, মুজিব ভাই নাই। রাম যখন ছিলেন না, তখন তাঁর জুতা সিংহাসনে রেখে ভরত রাজ্য পরিচালনা করেন। আমিও বঙ্গবন্ধুর ছবি সামনে রেখে কাজটা করছি। তোমার আমার পাশে থাকাটা কত জরুরি বুঝছ তো! তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, তুমি সহজেই বুঝবে।
কামাল কথাটার মানে বুঝলেন। কলকাতা এসে তিনি নানান কথা শুনছেন। মণি ভাই নাকি বলছেন, তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে ধরিয়ে দিয়েছেন। কামাল ভেবে পান না, আব্বা যদি দেশের কথা ভেবে নিজের জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিজে না নিতেন, তাহলে কি তাজউদ্দীনের পরামর্শে তিনি টলতেন! এই সিদ্ধান্ত আব্বার নিজের, আব্বা একজনের সঙ্গেই পরামর্শ করেছেন, তা হলো মা। মায়ের এই সব বিষয়ে সিক্সথ সেন্স প্রবল। মা বলেছেন, তুমি কেন পালাবে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা তো ইয়াহিয়া খানের ভয়ে পালিয়ে যেতে পারে না। তোমার মতো নেতা পালিয়ে বেড়াচ্ছে, দেশের বাইরে যাচ্ছে, এটা হতেই পারে না। এটা তোমার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় না। তোমাকে যদি ইয়াহিয়া খান মেরে ফেলে, তাহলেও দেশ স্বাধীন। যদি বাঁচিয়ে রাখে, তাহলেও দেশ স্বাধীন। মায়ের সঙ্গে এর মধ্যে দুবার দেখা হয়েছে, বিলাপের সঙ্গে মা এই সব কথা বলতেন।
৩৬
মিয়ানওয়ালি কারাগার পাঞ্জাবে, রাওয়ালপিন্ডি রোডে, মিয়ানওয়ালি শহর থেকে মাইল পাঁচেক দূরে। ১৯০৪ সাল থেকে এই জেলখানা চালু আছে, ১৭২ একর জমিজুড়ে কৃষিখামার, জেল এরিয়া, আর হাই সিকিউরিটি এরিয়া। মিয়ানওয়ালি এলাকাটাই প্রচণ্ড গরম, এপ্রিল, মে, জুনে এখানে। পিচ গলে যায় রাস্তায়, মাঠ থেকে আগুনের হল্কা ওঠে, ছাদের ওপরে রাস্তায় গরম বাতাস আগুনসমুদ্রের মতো ঢেউ তোলে; দৃশ্য এখানে গরম বাতাসে কাঁপতে থাকে। মগজ-গলানো সেই গ্রীষ্মে শেখ মুজিবকে রাখা হয়েছে একটা ছোট্ট সেলে, জানালা নেই, অনেক উঁচুতে একটা ছোট্ট গবাক্ষ আছে মাত্র। সেই গবাক্ষ দিয়ে আকাশের একটা ক্ষুদ্র অংশ দেখা। যায়।
এই সেলে মুজিব একা থাকেন। গরমে সেদ্ধ হন। তাকে খাবার দেওয়া হয় খুবই খারাপ, বিছানা-বালিশ দেওয়া হয়েছে অপর্যাপ্ত। তারও চেয়ে বড় কথা, তাঁর সঙ্গে কাউকে কথা বলতে দেওয়া হয় না।
তবে বিকেলে চল্লিশ মিনিটের জন্য তাঁকে সেল থেকে বের হতে দেওয়া হয়। সেলের সামনে চল্লিশ গজের চিলতে একটা পরিসরে তিনি হাঁটেন। এই সময় তিনি আকাশ দেখতে পান। তারপর পাশে তাকাতেই বিশাল বড় দেয়াল তাঁর শ্বাসরোধ করে ফেলতে চায়।
অবশেষে তাকে একটা ফ্যান দেওয়া হয়। সেই ফ্যানটা ছোট্ট ভ্যাপসা গরমে তেতে ওঠা ঘরের উত্তপ্ত বাতাসকে আরও গরম করে তুলতমাত্র।
তাঁর কাছে একবার দেখা করতে আসেন একজন ছোটখাটো মানুষ। বলেন, আমি এখানকার জেলার। আম