মানবতন্ত্র
ধর্ম ও রাষ্ট্র
ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা ও বাদানুবাদের অন্ত নেই। আর সমস্যাটা হালেরও নয়, বহু পুরোনো। একটাকে আর একটার ওপর নির্ভরশীল করে তুললে–ধর্ম বা রাষ্ট্র কোনো পক্ষের ফায়দা হয়েছে কিনা, হচ্ছে কিনা, হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু তা বিচার করতে হলে নিরপেক্ষ সত্যসন্ধিৎসা অত্যাবশ্যক। কিন্তু আমাদের দেশে ধর্ম বা রাষ্ট্র কোনো ব্যাপারেই নির্ভেজাল সত্যসন্ধিৎসা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র পরিচালকদের অসহিষ্ণুতার প্রকাশ্য মোকাবিলা এক রকম অসম্ভব বললেই চলে। তাই এ সম্বন্ধে সত্যসন্ধিৎসুর সচেতন বুদ্ধিজীবীরাও চুপ থাকতে বাধ্য। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় এ পরিবেশের জন্যই আমাদের দেশে শ’, রাসেল কী হাক্সলির মতো বুদ্ধিজীবীর আবির্ভাব কল্পনাই করা যায় না।
ধর্মের সঙ্গে এমন একটা বুদ্ধি-বিচারহীন অন্ধ আবেগ মিশে রয়েছে যে, তাকে উপেক্ষা করার সাহস কেউই সঞ্চয় করতে পারছে না। গণতন্ত্রকে যদি রাষ্ট্রীয় আদর্শ বলে মেনে নেওয়া হয় তাহলে জনসাধারণ যত স্থল ও বিচারবুদ্ধিহীন আর তাদের দাবি যতই যুক্তিহীন হোক না কেন রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে উচ্চাভিলাষীরা তাদের দাবি যে শুধু মেনে নেবে তা নয়, পদে পদেই দেবে ওইসব দাবিকে প্রশ্রয়। স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে এ প্রশ্রয়ের নজির অনেক বেশি খোলাসা। অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীর কোনো রকম রাষ্ট্রীয় উচ্চাভিলাষ হয়তো নেই, কিন্তু দেহটার মায়া তো আছে। তাই আত্মঘাতী জেনেও অন্ধ আবেগকে সমীহ না করে তাদেরও উপায় নেই। ফলে এ দুই শ্রেণী–রাষ্ট্রবিদ ও বুদ্ধিজীবীকে পদে পদেই গোঁজামিলের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। গোঁজামিল দিয়ে কোনো রকমে টিকে থাকা যায় বটে, কিন্তু বড় কিছু করা যায় না–না রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে, না সাহিত্য শিল্পের ক্ষেত্রে, না মননশীলতায়। ধর্ম যাকে বলে স্টেটিক, অচল-অনড় একটা অচলায়তনের নিগড়ে তা আবদ্ধ–ধর্মকে বলা হয় অলৌকিক অপৌরুষের খোদায়ী! অত্যন্ত অসন্দিন্ধ ভাষায় বলা হয়েছে হযরত মোহাম্মদ শেষ নবী, কোরানের পর আর কোনো ঐশী কেতাব নাজেল হবে না।
কাজেই এক অলঙ্ঘনীয় সীমা ও গণ্ডি টেনে দেওয়া হয়েছে মানুষের সামনে–ধর্মের ক্ষেত্রে এর বাইরে পা বাড়াবার অধিকার মানুষের নেই। এর ভালোমন্দ যাচাইয়ের বা এ-সম্বন্ধে মতামত দেওয়ার অধিকার থেকেও মানুষ বঞ্চিত। ধর্মের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে এক ও সুনির্দিষ্ট। আমার যতটুকু ধারণা, ধর্মের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য মানুষের মনে আধ্যাত্মিক চেতনা জাগিয়ে তোলা, তাকে ভেতরে-বাইরে সৎ ও আল্লাভক্ত রূপে গড়ে তোলা। ‘সৎ’ কথাটা নিয়েই মুশকিল। আধ্যাত্মিকতা বা আল্লা ভক্তি এমন একটা অশরীরী ব্যাপার যে তাকে ধরা-ছোঁওয়া, দেখা-শোনা, বাছ-বিচার কী পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায়–কিছুতেই আনা যায় না।
এ সব ক্ষেত্রে শুধু মানুষ, সমাজ বা রাষ্ট্রকে যে ফাঁকি দেওয়া যায় তা নয়, নিজের মনকেও চোখ ঠারানো যায় সহজে। কিন্তু সৎ ও সজ্জীবনের দাবি এমনি প্রত্যক্ষ ও লক্ষ্যগোচর যে, তাতে নিজেকে কিছুটা ফাঁকি দেওয়া গেলেও সচেতন মানুষ বা সমাজকে ফাঁকি দেওয়ার কোনো উপায়ই থাকে না। লোকটা সৎ কিনা, সঞ্জীবন যাপন করে কিনা তা সহজেই বিচার করে দেখা যেতে পারে। কারণ, সঞ্জীবন ব্যক্তিবিশেষের ব্যবহারিক জীবনেরই ফুল। কিন্তু আধ্যাত্মিকতা বা খোদাভক্তির ব্যাপারে তা কি বলা। যায়? যে লোক আল্লার একত্বে আর নবীদের প্রেরিতত্বে বিশ্বাস করে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, রমজানে রোজা রাখে, সামর্থ থাকলে কোরবানি আর হজ্ব করে ও যাকাত দেয়–তাকে প্রচলিত অর্থে ধার্মিক বা খোদাভক্ত বলে স্বীকার করতেই হয়। কিন্তু এমন লোক সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় অর্থে সৎ নাও হতে পারে। নিরপেক্ষ বিচারে এমন লোকও কি অহরহ দণ্ডিত হচ্ছে না? অর্থাৎ দণ্ডের উপযুক্ত অপরাধ কি করছে না? মানুষকে ধার্মিক বা খোদাভক্ত করে তোলার জন্য প্রত্যেক ধর্মেই নির্দিষ্ট বিধি-বিধানের ব্যবস্থা আছে, যারা তা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে তাদের ধার্মিক বা খোদাভক্ত না বলে উপায় নেই কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে পালনীয় নীতি-নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পর্কহীন এই আনুষ্ঠানিক স্বধর্মনিষ্ঠার মূল্য কতটুকু? আমাদের প্রত্যেক কোর্ট-কাছারির সঙ্গে বা ধারে কাছে এক বা একাধিক মসজিদ আছে। এসব মসজিদে যাদের নিয়মিত দেখা যায় তাদের অনেককে আবার আসামির কাঠগড়ায়ও কি দেখতে পাওয়া যায় না? এও কি এক রকম গোঁজামিলের। ফল নয়? রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এ গোঁজামিলের নজির আরো ব্যাপক। উদাহরণ দিয়ে নিজের ও সমকালের বিপদ ডেকে আনতে চাই না। আগে যে একবার দেহের মায়ার কথা বলেছি হয়ত সে মায়ায় আমিও এখানে গোঁজামিল দিতে বাধ্য হচ্ছি। মোটকথা ধর্মে, সাহিত্যে, রাষ্ট্রে সর্বত্রই আজ গোঁজামিলের রাজত্ব। আমরা যারা লিখে থাকি আমরাও, গোঁজামিল দিয়ে দিয়েই লিখি। আনুষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে সঞ্জীবনের মিল হলে তা যে সোনায় সোহাগা হয় তাতে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সোনার সঙ্গে সোহাগ মেশাবে কে? রাষ্ট্র? এটিই আমার এক বড় প্রশ্ন। রাষ্ট্র যদি যে অন্ধ আবেগের কথা সূচনায় বলেছি, তার খপ্পরে পড়ে এ দায়িত্ব গ্রহণে এগিয়ে আসে–সে দায়িত্ব রাষ্ট্র আদৌ পালন করতে পারবে কিনা, পারা সম্ভব কিনা? পারলে কতটুকু পারবে? এসব সঙ্গত প্রশ্নের উত্তরের সম্মুখীন না হয়ে এড়িয়ে চললে অধিকতর গোঁজামিলের আশ্রয় নিতে আমরা বাধ্য হবো। তাতে ধর্ম বা রাষ্ট্র কারো ফায়দা হবে না। মানুষ হবে নাজেহাল।
ধর্ম এক নয়, কিন্তু এখন সব সভ্য ধর্মই স্রষ্টার একত্বে বিশ্বাস করে। তবে এ একত্বের স্বরূপ ভিন্নতর। মুসলমানের আল্লাহ্ সম্বন্ধে ধারণা ও উপলব্ধির সঙ্গে হিন্দুর ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণা ও উপলব্ধির যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে, তেমনি খ্রিস্টানদের গডের ধারণা আর উপলব্ধিও অন্যরকম। আবার বৌদ্ধরা তো বুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো অশরীরী শক্তিকেই আমল দেয় না। সম্ভবত এক সৌদি আরব ছাড়া পৃথিবীতে এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যেখানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোক বাস করে না। আশ্চর্য এমন সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সৌদি আরব তাদের রাষ্ট্রের নামের আগে ‘ইসলামি’ বিশেষণ যোগ করে নি। ইসলামের জন্মস্থান ও তার ধর্মীয় কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও আরবের রাজা ও রাজকুমারদের জীবনযাত্রার যে সব চমকপ্রদ কাহিনী শোনা যায় ও কাগজপত্রে পড়া যায় তা আংশিক সত্য হলেও তার সঙ্গে ইসলামের বিধি-বিধানের বিশেষ যে মিল নেই তা সহজেই অনুমেয়। তাঁদের জীবন আর ধর্মের মধ্যে যে আত্মবিরোধ রয়েছে তারা হয়ত তা বুঝে গোঁজামিলের শিকার হতে চান নি। এটুকু আন্তরিকতা আর কাণ্ডজ্ঞানের জন্য তারা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য।
গণতন্ত্র মানে সংখ্যা। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করতে গেলে নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের যে ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বেশি তাদের ধর্মানুসারেই রাষ্ট্রকে গড়ে তুলতে হবে। সে ধর্মই হবে রাষ্ট্রের ধর্ম–রাষ্ট্রীয় আদর্শের প্রতিভূ। সে হিসেবে পাকিস্তানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র বিশেষিত করা সঙ্গতই হয়েছে। কিন্তু নামকরণ এক কথা আর নামের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে বাস্তবায়িত করা অন্য কথা। যে কোনো নাস্তিকেরও নাম নূরুল ইসলাম কি শামসুল ইসলাম হতে পারে; কিন্তু তাই বলে নামের বরকতে সে যে একদিন পাকাপোক্ত মুসলমান হয়ে উঠবে এমন ভবিষ্যদ্বাণী কি করা যায়? খোদাবক্সও যে খোদাভক্ত হয় না তার নজির দেদার। বিশেষত, রাষ্ট্র একটি সমষ্টিগত ব্যাপার, অগণিত মানুষের জীবনের সঙ্গে তার সম্পর্ক। আর আজকের দিনের কোনো সভ্য রাষ্ট্রই বিচ্ছিন্ন ও একক নয়–তাবৎ পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগাযোগ ও আদান-প্রদানের সম্বন্ধ। যে মানুষ ও মানুষের জীবন নিয়ে রাষ্ট্রের কারবার সে মানুষ ও তার জীবন চলিষ্ণু, পরিবর্তনশীল ও জঙ্গম। অথচ ধর্ম হচ্ছে তার বিপরীত। চোদ্দ শত বছর আগেও ধর্ম যা ছিল এখনো তাই আছে, চোদ্দ শত বছর পরেও তাই থাকবে। যে কোরান-হাদিসের নির্দেশ মতো রাষ্ট্রীয় আইন কানুন প্রণয়নের দাবি উঠেছে, মানুষের জীবনে সহস্র রদবদল ঘটলেও তার রদবদল ঘটানো মানুষের সাধ্যাতীত। অথচ আজকের মানুষ আর চোদ্দ শত বছর আগের মানুষ কখনো এক নয় এবং চোদ্দ শত বছর পরের মানুষও এ মানুষ থাকবে না। তাদের জীবনের প্রয়োজন ও চাহিদা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, রুচি ও মূল্যবোধ স্বতন্ত্র হতে বাধ্য। জীবনের সমস্যাও হবে ভিন্নতর।
ইসলামের বিধি-নিষেধের দূরতম ব্যাখ্যার দ্বারাও প্রচলিত সিনেমা ইত্যাদিকে সমর্থন করা যায় না, তবুও এসব কি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায় নি, পাচ্ছে না? রাষ্ট্রের নাম ইসলামি করার দাবি যারা তুলেছেন তারাও এ যাবৎ সিনেমাকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান নি। অর্থাৎ এখানেও সে গোঁজামিল।
আমাদের শাসনতন্ত্র রচিয়তা আর রাষ্ট্র পরিচালকগণ কেউই ইসলামি ধর্মশাস্ত্রে সুপণ্ডিত নন, কিন্তু তারা অনেকেই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে সুপরিচিত। তাই তারা পাকিস্তানকে আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ওপরই জোর দিচ্ছেন অথচ এদিকে গণতন্ত্রের ভয়ে ধর্মীয় আবেগের কাছে নতি স্বীকার না করেও পারছেন না। তাই রাষ্ট্রের নামে ইসলামি বিশেষণ বার বার জোড়া ও ছাড়া হচ্ছে। যারা ছাড়ছেন তারাই আবার জুড়ছেন। এ শুধু অন্তর্দ্বন্দ্ব বা গোঁজামিলের নিদর্শন নয়–ধর্মকে রাষ্ট্র ও সামাজিক ব্যাপারে টেনে নিয়ে এলে এ রকম গোঁজামিলের আশ্রয় নিতেই হবে এবং তার সংখ্যা দিন দিনই বেড়ে যাবে। রাষ্ট্র শাসিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় কতগুলি আইন ও বিধি-বিধানের দ্বারা, যার রচয়িতা মানুষ। আর এ সব আইন ও বিধি-বিধান রচিত হয়েছে রাষ্ট্রের অন্তর্গত মানুষের সুখ-সুবিধা-নিরাপত্তা ও ক্রমোন্নতির দিকে লক্ষ্য রেখে। বলা বাহুল্য, এ সম্পূর্ণভাবে জাগতিক পার্থিব ব্যাপার, এর সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কোনো সম্পর্কই নেই। আগেই বলেছি, আধ্যাত্মিকতা অশরীরী ব্যাপার। অশরীরী কোনো বিষয়ে রাষ্ট্রের হাত দিতে যাওয়া মানে চোরাবালিতে পা দেওয়া–গোঁজামিলের আড়ালে উটপাখি হওয়া। ভূত-পরী ও দেও-জ্বীনকে কি আইনের এক্তিয়ারভুক্ত করা সম্ভব?
একটা দৃষ্টান্তের সাহায্যে ব্যাপারটি বুঝতে চেষ্টা করা যাক। আমাদের শাসনতন্ত্রের মূলসূত্র ও আদর্শ বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, পৃথিবীর তথা পাকিস্তানের যাবতীয় ধন-সম্পদের একমাত্র মালিক আল্লাহ। কথাটা অতি উত্তম–শুনতেও মধুর। এক শ্ৰেণীর ধর্মীয় আবেগের এ এক চরম অভিব্যক্তি। তবে অধিকাংশ সস্তা বুলির মতো এও কি এক অবাস্তব উক্তি নয়? কথাটা মিথ্যা বলছি না। আল্লাহ সমস্ত বিশ্বের স্রষ্টা ও মালিক এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অন্তত ঈমান ও বিশ্বাসের দিক থেকে এ বিষয়ে বোধ করি কোনো মুসলমানের মনেই দ্বিমত আশা করা যায় না। কিন্তু শাসনতন্ত্র তো ব্যবহারিক জীবনের জন্য–তার ঘোষিত বিধি-বিধান ও উদ্দেশ্য যদি বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা না যায়, অন্তত প্রয়োগের ব্যবস্থা করা না হয় তা হলে এ সব ঘোষণা ও উক্তি কি ফাঁকা বুলিতে পর্যবসিত হয় না? বিশ্বের ওপর আমাদের যখন কোনো কর্তত্ব নেই, বিশ্বের কথা আপাতত মুলতুবিই থাক। পাকিস্তানের যাবতীয় সম্পদের মালিক যদি আল্লাহই হন আর তা যদি আমরা রাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্রে স্বীকার করে নেই তা হলে যুক্তিসঙ্গতভাবে আমাদের এ-ও স্বীকার করে নিতে হয় যে, আল্লাহর যে সব বান্দা পাকিস্তানে বাস করে তাদের সকলেরই পাকিস্তানের যাবতীয় সম্পদের ওপর সমান হক ও অধিকার রয়েছে। এ না মানলে পূর্বোক্ত ঘোষণা কি অর্থহীন হয়ে পড়ে না? আর শাসনতন্ত্রের বিধি-বিধান ও আইনের দ্বারা তাকে বাস্তবায়নের যদি ব্যবস্থা করা না হয় তা হলে স্বভাবতই বুঝতে হবে নেহাত ফাঁকি আর গোজামিল দিয়ে জনগণের অন্ধ আবেগকে পরিতৃপ্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে শুধু ওই উচ্চরোল ঘোষণার মারফত; আর বুঝতে হবে শাসনতন্ত্রের মূল সূত্র ও আদর্শকে বাস্তবায়নের মতলব কারো নেই–না শাসনতন্ত্র রচয়িতাদের, না যারা এ শাসনতন্ত্রকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁদের। অথবা এ যত বড় মহৎ আদর্শই হোক, একে বাস্তবায়ন যে কোনো রাষ্ট্রেরই সাধ্যাতীত। কোনটা সত্য?
আমার বিশ্বাস, মূল সূত্র ও আদর্শের সঙ্গে যদি শাসনতন্ত্রের সঙ্গতি থাকতো তা হলে তাকে বাস্তবায়নের বিধিবিধানও শাসনতন্ত্রে সন্নিবিষ্ট হতো এবং পাকিস্তানের সমস্ত ধনসম্পদকে নাগরিকদের মধ্যে সমভাবে ভাগ করে দেওয়ার জন্য যথোপযুক্ত আইন কানুনও এতদিনে রচিত হতো। অন্তত তার আলামত দেখা যেতো। ধন বণ্টনের পাঁচসালা। কি দশমালা পরিকল্পনার চেহারা আমরা নিশ্চয় দেখতে পেতাম। এতদিনে কোনো নির্বাচিত গ্রাম কি থানা বা জেলার অথবা কোনো প্রশাসনিক বিভাগে এ সমতা বিধানের অর্থাৎ আল্লাহর সম্পদকে সকল বান্দার মধ্যে সমভাবে ভাগ করে দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে যেতো! কিন্তু তার কোনো পরিচয় বা আভাস কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে কি? বরং দেখতে পাওয়া যাচ্ছে অতি অল্পসংখ্যক লোক, ঘটনাচক্রে যারা রাষ্ট্রের ওপরতলায় স্থান পেয়েছেন, তারা যে আইন বা রোজগারের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন অধিকাংশ নাগরিক তার শতাংশ থেকেও বঞ্চিত। এ অবস্থার রদ-বদলের কোনো পরিকল্পনাই যেখানে নেই, সেখানে সব ধনসম্পদের মালিক আল্লাহ্–এ কথা ঘোষণার কোনো মানে হয় কি? স্রেফ এ ঘোষণার দ্বারা আল্লাহ বা আল্লাহর বান্দা কারো ফায়দা হচ্ছে কিনা তাও জিজ্ঞাস্য। অবশ্য এটুকু ফাঁকা কথায় অনেকের ধর্মীয় আবেগ যে চরিতার্থ হয়েছে ও হচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই।
ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্কে কিছুটা বিশদভাবে বুঝতে চেষ্টা করলে ধর্মকে কীভাবে ফাঁকি ও গোঁজামিলের হাতিয়ার করে তোলা হয়েছে তা আরো বেশি করে ধরা পড়বে। ইসলাম অশরীরী, খেয়ালি বা ভৌতিক কিছু নয়। ঈমান অর্থাৎ আল্লাহর একত্বে ও নবীর প্রেরিতত্বে বিশ্বাস ইসলামের সর্বপ্রধান শর্ত এবং একমাত্র এটিই অপ্রত্যক্ষ অর্থাৎ এটাকে চোখে দেখে সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের কোনো উপায় নেই। ফলে, ফাঁকি দেওয়াও সহজ। এমন ফাঁকিবাজ বা মুনাফেকদের কথা কোরানে একাধিক জায়গায় উল্লেখিত হয়েছে। আল্লাহ বিশ্বের তাবৎ সম্পত্তির মালিক–ঈমানের মতো এটাও একটা অপ্রত্যক্ষ বিশ্বাসের কথা। রাষ্ট্রীয় আইনের সাহায্যে এ বিশ্বাসকে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা না করলে এখানেও ফাঁকির ক্ষেত্র থেকে যায় প্রশস্ত। এ কথা ওপরে একবার উল্লেখ করা হয়েছে। ধনসম্পদকে আইন করে বণ্টন করা এমন অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু যেটা নিছক বিশ্বাসের ব্যাপার তাকে আইন বা রাষ্ট্রীয় বিধির আওতায় আনা কিছুতেই সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত স্বীকৃতি ছাড়া এ বিষয়ে অন্য রকম সাক্ষী বা প্রমাণও অচল। অথচ ব্যক্তিগত স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির ওপর আইন বা দণ্ডবিধি নির্ভর করতে পারে না। অন্য সাক্ষী-প্রমাণ থাকলে চোরের অস্বীকৃতির ওপর নির্ভর করে তাকে চৌর্যাপরাধ থেকে অব্যাহতি কোনো দেশের আইনই দেবে না। কি ঈমান বা বিশ্বাসের বেলায় তেমন সাক্ষী-প্রমাণের সুযোগ কোথায়? আর তেমন অপরাধের স্তরবিভাগও করা যাবে কী করে? ধরুন, কোনো রাষ্ট্রে যদি এমন আইন করা হয়, যে পাঁচ-ওয়াক্ত নামাজ পড়বে না সে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে। সে জাতীয় পরিষদের সদস্য হতে পারবে না এবং পারবে না মন্ত্রী হতে। তাহলে অবস্থাটা কেমন দাঁড়াবে একবার ভেবে দেখা যেতে পারে। যে কোনো ইসলামি রাষ্ট্রে এমন আইন যে শুধু যুক্তিসঙ্গত তা নয়, অত্যন্ত বাঞ্ছনীয়ও। রাষ্ট্রের নাম ইসলামি দিয়ে বাহবা কুড়াবেন অথচ যে বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের ওপর ইসলামের প্রতিষ্ঠা তাকে আইন ও রাষ্ট্র বিধানে আমল দেবেন না, একি এক মস্ত স্ববিরোধী ব্যাপার নয়? দিলেও বিপদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে কি? আল্লাহ রসুলে একদম বিশ্বাস করেন না এমন নাম মাত্র মুসলমান, মুসলমান সমাজেও কম নেই–আর তাঁরাও যে জাতীয় পরিষদ সদস্য ও মন্ত্রী হতে চাইবেন তাও অত্যন্ত স্বাভাবিক। আর তা হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য তারা যে শুধু নামাজ পড়বেন তা নয়, পাঁচ-ওয়াক্ত নামাজ তারা জমাতের সঙ্গেই পড়বেন এবং আমি জোর করে বলতে পারি পল্টন-ময়দানের জমাতে তারা বিনা অজুতেও শরিক হবেন। তারা যে বাড়ি থেকে অজু করে আসেন নি তা আপনি প্রমাণ করবেন কী করে? এ আইন প্রয়োগের জন্য আলাদা একটা আই বি ডিপার্টমেন্ট খুললেও সন্তোষজনক ফল পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
শুনেছি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অব্যবহিত পরে ওলেমাদের এক প্রতিনিধিদল কায়েদে আজমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নামাজকে সারা পাকিস্তানে অর্ডিনেন্সের সাহায্যে বাধ্যতামূলক করার দাবি জানিয়েছিলেন। পাকিস্তান যখন মুসলিম রাষ্ট্র তখন তাকে ইসলামি আদর্শে গড়ে তুলতে হলে ইসলামের প্রধান স্তম্ভ নামাজকে বাধ্যতামূলক করা উচিত–এটাই ছিল তাদের প্রধান যুক্তি। উত্তরে কায়েদে আজম নাকি বলেছিলেন, এ করতে গেলে এ নতুন রাষ্ট্রের সব উন্নয়ন ও গঠনমূলক কাজ বন্ধ করে দিয়ে রাষ্ট্রের সমস্ত শক্তি এ অর্ডিনেন্স প্রয়োগেই নিয়োগ করতে হবে আর শহরে-বন্দরে, গ্রামে মহল্লায় সর্বত্র খালি জেলখানাই তৈরি করতে হবে আর মোতায়েন করতে হবে পুলিশ। তার সহজ কাণ্ডজ্ঞানের দ্বারা কায়েদে আজম সেদিন এভাবে ওলেমাদের ধর্মীয় আবেগ নিবৃত্ত করেছিলেন। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতার অসাধারণ জনপ্রিয়তা ও তার অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিত্ব সেদিন তার সহায় হয়েছিল। যদি তর্কের খাতির আমরা মেনেও নেই যে, অর্ডিনেন্স বা আইনের সাহায্যে নামাজকে যদি বাধ্যতামূলক করা হয়, তা হলে পাকিস্তানের সব মুসলিম নাগরিকই নামাজ পড়তে শুরু করবেন–আল্লাহর ভয়ে না হলেও আইনের ভয়ে তো বটেই। তা হলেও সমস্যা অন্যদিক থেকে দেখা দেবে, অত লোকের নামাজের জায়গা কোথায়? নামাজের বয়সী অন্তত পাঁচ ছ কোটি লোকও যদি থাকেন আর তারা যদি নামাজ পড়তে চান তা হলে কতটা মসজিদ দরকার তা একবার ভেবে দেখুন। রাষ্ট্রের সমস্ত রাজস্ব এ খাতে ব্যয় করলেও তাতে কুলাবে কিনা বিবেচ্য। নামাজ অবশ্য ঘরেও পড়া যায় কিন্তু তা হলেও ঘরে ঘরে পুলিশ মোতায়েন কি সম্ভবপর? যে কোনো আইন মানা ও প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা তা তদারকের ব্যবস্থা না থাকলে দু দিনেই তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। চুরি-ডাকাতি, খুন-জখম ইত্যাদি অপরাধ সম্পর্কীয় আইন তদারক করার জন্য যদি পুলিশ, থানা, বিচার ও দণ্ডের ব্যবস্থা না থাকত তবে এসব অপরাধ কীভাবে বেড়ে যেত একবার কল্পনা করে দেখা যেতে পারে। এ সব অপরাধ সম্বন্ধে কোরান-হাদিসে নিষেধ আর হুঁশিয়ারির তো অন্ত নেই। তাতে কুলাচ্ছে না বলেই তো আইনের আশ্রয় গ্রহণ। নামাজের বেলায় কি তা হবে না?
নামাজকে আইনের এক্তেয়ারভুক্ত করলে (তা না করলে ইসলামি রাষ্ট্র যা অনৈসলামিক রাষ্ট্রও তা, কারণ কোরান-হাদিসের নিদের্শ সব দেশেই সমান প্রযোজ্য) রাষ্ট্রকে কী রকম অসাধ্য অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে তার যে ইঙ্গিত ওপরে দিয়েছি তা কাল্পনিক বিবেচিত হতে পারে এবং আপাতত তা যে কাল্পনিক আমি নিজেও তা স্বীকার করছি। কিন্তু হজ্বের ব্যাপার তো মোটেও কাল্পনিক নয়, আর হজ্বও তো ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ, সক্ষম ও সমর্থ মুসলমানের অন্যতম অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। সে হজুও কি আজ মানুষ অবাধে পালন করতে পারছে? রাষ্ট্র নিজেই কি তার এক বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় নি? ধরুন পাকিস্তানের আট কোটি মুসলমানের মধ্যে অন্তত বিশ লক্ষ লোকের ওপরও যদি হজ্ব ফরজ বা অবশ্য পালনীয় ধময়ি কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়–ইচ্ছা ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তারা সবাই হজ্ব করার সুযোগ পাবে কিনা সন্দেহ। এ দশ বছরে এদের এক মোটা অংশ যে মারা যাবে তাও বোধ করি সহজে অনুমান করা যায়। ইসলামি রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েও স্রেফ রাষ্ট্রীয় বাধার ফলে এরা যে ইসলামের অবশ্য পালনীয় একটি ধর্মীয় কর্তব্য করতে পারল না, আল্লাহর কাছে তার জন্যে যদি জবাবদিহি করতে হয় তা কে করবে? রাষ্ট্র না সে গুনাহগার বান্দা? কিন্তু এ গুনাহর জন্য সে তো মোটেও দায়ী নয়। সে তো অত্যন্ত আহাল দিলেই হজে যাওয়ার জন্যে দরখাস্ত করেছিল, (এমন কি শরিয়তের নিষেধ অমান্য করে পাসপোর্ট সাইজ ফটোও তুলেছিল) প্রয়োজনীয় টাকা সরকারি ব্যাঙ্কে দিয়েছিল জমা, তবুও হজ্ব করার অনুমতি মিলল না তার। কোরান হাদিসের নির্দেশে ধর্ম-কাজ করার জন্যে সরকারি কর্মচারীর কাছে (যার অধিকাংশই হয়তো শরিয়ত মোতাবেক জীবন-যাপন করে না) দরখাস্ত করা তথা অনুমতি ভিক্ষা কি ধর্মের সঙ্গে একটা বড় রকমের রাষ্ট্রীয় পরিহাস নয়? স্বাধীন ইসলামি রাষ্ট্রের নাগরিকরা যদি স্বেচ্ছামতো স্বাধীনভাবে ইসলামের নির্দেশ পালনে রাষ্ট্রের কাছ থেকেই বাধা পায় তা হলে ‘স্বাধীন’ আর ‘ইসলামি’ কথাটার অর্থ হয় কী? আসল কথা ধর্মকে রাষ্ট্রের সঙ্গে আর রাষ্ট্রকে ধর্মের সঙ্গে জুড়ে দিতে গেলেই এ অদ্ভুত গোঁজামিল ও স্ববিরোধিতার সম্মুখীন হতেই হবে। কারণ, ধর্ম অলঙ্ঘনীয়, তার নির্দেশ ও বিধান অপরিবর্তনীয়। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র স্থাণু নয়–প্রগতিশীল বলেই তা পরিবর্তনশীল। আর বিচ্ছিন্ন নয় বলে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে নানা স্বার্থে ও বিচিত্র আইন-কানুনে তা শৃঙ্খলিত। পাসপোর্ট, ভিসা, যানবাহন সমস্যা, বৈদেশিক মুদ্রা ইত্যাদি সব কিছুই আধুনিক রাষ্ট্রের এক একটি শৃঙ্খল। আধুনিক রাষ্ট্র অনায়াসে ধর্মের শৃঙ্খল বা বিধিবিধান ভেঙে চুরমার করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিধানে বিশেষ করে যে সব বিধানের সঙ্গে অন্য দেশের রাষ্ট্রীয় নীতির সম্পর্ক রয়েছে তার পান থেকে চুন খসাতেও অক্ষম। হজ্বের ব্যাপার তার একটি প্রত্যক্ষ প্রমাণ। অথচ পাকিস্তান ও সৌদি আরব দুইই মুসলিম রাষ্ট্র।
নামাজ এবং রোজাকেও আইনের আওতায় আনতে গেলে ওই একই সমস্যা দেখা দেবে। বলা বহুল্য, যে কোনো রচিত আইনের প্রতি রাষ্ট্রের যদি কিছুমাত্র শ্রদ্ধা থাকে তাহলে এ দুপক্ষের মোকাবিলা রাষ্ট্রকে করতেই হবে। এক পক্ষের জন্য গ্রামে গ্রামে বানাতে হবে মসজিদ আর অন্য পক্ষের জন্য জেলখানা। আর লোক-সংখ্যানুপাতে মোতায়েন করতে হবে পুলিশ–এ আইন পালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য। ফলে এমন অবস্থাও হতে পারে যে, দেশের অর্ধেক লোক জেলে আর অর্ধেক নেবে পুলিশের চাকরি। এ করে দেশে ইসলামি শাসন কায়েম হবে কিনা জানি না; তবে দেশের মানুষের খাওয়া-পরার সমস্যা যে অনেকখানি চুকে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। দেশে তখন কয়েদি আর পুলিশ এ দুই শ্রেণী ছাড়া যে লোক থাকবে তার সংখ্যা নেহাত নগণ্য হতে বাধ্য। আধুনিক রাষ্ট্র এক জটিল ব্যাপার, তার আইন-কানুনও জটিলতর। পঁচিশ ত্রিশ বছর আগে হজ্বে যেতে হলে পাসপোর্ট ভিসা কি বৈদেশিক মুদ্রার সমস্যার মোকাবিলা করতে হতো না কারো। তখন যানবাহনের সমস্যা ও তার আইন-কানুন ছিল না এত তীব্র ও কঠোর। আজকের দিনে যা সমস্যা তা আধুনিক রাষ্ট্রের সমস্যা। আধুনিক রাষ্ট্র এসব সমস্যা কিছুতেই এড়াতে পারে না। পারে না বলেই হজ্বের মতো ধর্মীয় ব্যাপারেও পাকিস্তান রাষ্ট্র (ইসলামি হয়েও) নানা বিধি-বিষেধ আরোপ করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে, ফটো ও লটারির মতো শরিয়ত-বিরোধী পথে না গিয়ে মানুষ আজ অবশ্য পালনীয় শরিয়ত কর্মও করতে পারছে না।
অন্য ধর্মের মতো ইসলামেও সম্প্রদায়ের অন্ত নেই এবং এদের মধ্যে ধর্মীয় আচার। অনুষ্ঠানের তারতম্যও কম নয়। তবুও দেশের রাষ্ট্রবিদরা যখন কোরান-হাদিসের দোহাই দিচ্ছেন তখন ধরে নিতে হবে তারা এবং দেশের অধিকাংশ মানুষ কোরান-হাদিসের ইসলামকেই পাকিস্তানে বাস্তবায়িত হতে দেখতে চান। ওপরে ইসলামের যে পাঁচ স্তম্ভের কথা বলেছি তা নিশ্চয়ই কোরান-হাদিস সমর্থিত ও নির্দেশিত এবং এগুলির বাইরে বা এগুলিকে বাদ দিয়ে কোনো ইসলামের ধারণা করতে আমি অন্তত অক্ষম। ইসলামি শাসন মানে, আমি মনে করি, ইসলামের এই পাঁচ হুকুম আহকামকে জীবনে রূপায়িত করা, কোরান-হাদিসের নির্দেশ অনুসারে দেশের যাবতীয় আইন প্রণয়ন করে সে আইনের দ্বারা দেশকে শাসন করা অর্থাৎ কোরান-হাদিসে যে যে অপরাধে যে যে দণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেভাবে দেশের দণ্ডবিধিকে সংশোধন করে তা প্রয়োগ করা। এর বাইরে ইসলাম কী বস্তু তা আমার জানা নেই। এ সবকে বাদ দিয়ে ইসলামি রাষ্ট্র সোনার পাথর-বাটির চেয়েও স্ববিরোধী উক্তি বলেই আমার বিশ্বাস। আশ্চর্য, ইসলামে যাকে, পঞ্চখুঁটি বলা হয় তার সঙ্গে যাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই তারাই আজ মোটা গলায় দাবি তুলেছেন ইসলামি রাষ্ট্রের। এঁরা ইসলামি রাষ্ট্র বলে দাবি করছেন বটে; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই স্বাভাবিক দাবিটুকু করছেন না যে, শাসনতন্ত্র রচনা করবেন আর শাসনতন্ত্রকে যারা বাস্তবায়িত করবেন, এ রাষ্ট্রের এ ইসলামি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক যন্ত্রকে যারা দিনে দিনে পরিচালিত করবেন তাদের সকলকেই কোরান-হাদিস অনুসারে জীবন যাপন করতে হবে। অন্তত ইসলামের যে পাঁচ রোকন তা যাঁরা পালন করবেন না তাঁরা কোনো রাষ্ট্রীয় পদেই বহাল থাকতে পারবেন না।
অথচ তেমন দাবি উঠেছে বলে এ যাবৎ শুনি নি এবং তেমন আইন-কানুন রচিত হয়েছে বা রচনার উদ্যোগ চলছে বলেও জানা যায় নি। খাঁটি মুসলমান ছাড়া ইসলামি শাসন বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে কে? যে হাকিম নিজে নামাজ পড়ে না সে হাকিম নামাজ না পড়ার জন্য শান্তি দেবে অন্যকে–কথাটা এক বড় রকমের পরিহাস নয় কি? দাবি জানানো হচ্ছে কোরান-হাদিসের পরিপন্থী কোনো আইন করা চলবে না। এও তো এক নেতিবাচক কথা। যদি দাবি করা হতো পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র ও আইন-কানুন সব কিছু কোরান হাদিসের নির্দেশানুসারেই রচিত হবে বা রচিত হোক তা হলেই অধিকতর সঙ্গত হতো। আগেই বলেছি, আমাদের রাষ্ট্রবিদরা প্রায় সকলেই অল্পবিস্তর আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত। তাঁরা মনে মনে ভালো করেই জানেন, এ যুগে শাস্ত্রীয় নির্দেশানুসারে কোনো রাষ্ট্রের আইন ও শাসনবিধি রচিত হলে তার সঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনায় বাধা ও সংঘর্ষ অনিবার্য। তাই ফাঁকি ও গোঁজামিলের মুখোশ পরে জনসাধারণের তথাকথিত ধর্মীয় আবেগকে ঘুম পাড়িয়ে তারা সস্তায় কাজ হাসিল করতে চান। এ না হলে তাদের রাজনৈতিক জীবনই যে ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। তারা ভাল করেই জানেন নামাজি-কালামি হওয়ার চেয়ে মন্ত্রী হওয়ার মূল্য ঢের বেশি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজির চেয়ে বেনামাজি মন্ত্রীর দাপট যে কতখানি বেশি তা কারও অজানা বা অদেখা নয়। বলেছি আধুনিক রাষ্ট্রীয় নীতি ও ধারণার সঙ্গে ধর্মীয় বিধিবিধানের সংঘর্ষ অনিবার্য। এ সংঘর্ষের স্বরূপ আমরা হজের বেলায় দেখেছি, আরো বেশি যদি দেখতে চান তো সুদের বেলায়, সিনেমা ও নাচগানের বেলায়ও দেখতে পাবেন। এ সবই পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। সুদও তো আমাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির এক অপরিহার্য অঙ্গ। ব্যক্তিগতের সীমা ছাড়িয়ে নামাজ-রোজাকেও রাষ্ট্রীয় আইনের এক্তেয়ারে নিয়ে এলে তাও নতুন নতুন সংঘর্ষেরই সৃষ্টি করবে। আমাদের ছাত্রাবস্থায় একবার রমজান মাসে সলিমউল্লাহ মুসলিম হলের ডাইনিং হল বন্ধ করে দেওয়ার বিরুদ্ধে এক নাছোড়বান্দা ছাত্র আদালতে নালিশ করেছিল। যতদূর মনে পড়ে, বিচারে ছাত্রটিরই জয় হয়েছিল। আধুনিক কালে আইনের সাহায্যে জোর করে ধর্ম পালন করা যাবে কিনা এও এক রীতিমতো বিরাট প্রশ্ন। একদিকে বছর বছর ঘটা করে মানবাধিকার দিবস পালন করা অন্যদিকে নামাজ-রোজাকে রাষ্ট্রীয় আইনের সাহায্যে বাধ্যতামূলক করা হলে তাতে মতামত ও উপাসনার স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষিত হবে কিনা, বিশ্ব রাজনীতির পটভূমিতে সে প্রশ্নও উঠতে পারে।
আজ প্রায় সব সভ্য রাষ্ট্রই বিশ্ব জাতি সংস্থার (U. N. O) সদস্য আর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ সব আইন কোনো ধর্ম শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসরণ করে রচিত হয় নি–রচিত হয়েছে আধুনিক জীবনের চাহিদা ও প্রয়োজনানুসারে এবং এসবই আধুনিক রাষ্ট্রীয় আর্দশ ও ধারণার পরিপূরক। ইংল্যান্ডের রাজা বা রাণী খ্রিস্টান, অধিকাংশ নাগরিকও খ্রিস্টান–এ অজুহাতে হঠাৎ যদি সেখানে আইন করা হয় যে, সব ইংরেজকেই প্রতি রবিবার গির্জায় হাজির হতে হবে এবং মানতে হবে যিশুখ্রিস্ট ঈশ্বরের সন্তান তা হলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অধিকাংশ ইংরেজ শুধু যে বিদ্রোহ করবে তা নয়–আন্তর্জাতিক আদালতে এ আইনের বিরুদ্ধে নালিশও উঠতে পারে। সে আদালতের অধিকাংশ বিচারক খ্রিস্টান হলেও তাতে বাইবেলের নির্দেশ যে হালে পানি পাবে না। তাও সুনিশ্চিত। ভারতে হিন্দু ধর্মানুসারে পূজা-অর্চনা আর পাকিস্তানে নামাজ-রোজা আইনের সাহায্যে বাধ্যতামূলক করলেও একই অবস্থার বরং এর চেয়েও খারাপ অবস্থার সম্মুখীন হতে হবেই। আসল কথা, এ যুগে কোনো রাষ্ট্রই ধর্মভিত্তিক হতে পারে না, পারবে না। করতে গেলেই ধর্মকে ফাঁকি ও গোঁজামিলের আড়ালে মুখ ঢাকতে হবে। তাই আমার বিশ্বাস, ধর্ম ও তার ফাঁকি ও শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ নিয়ে আধুনিক কোনো রাষ্ট্রই হালে পানি পাবে না। দুষ্টান্ত আগেও দিয়েছি, আরো দিচ্ছি। সুদ, প্রাণীর ছবি, মদ, বেশ্যা–এ সবই কোরান-হাদিসে সুকঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মুসলিম বা ইসলামি রাষ্ট্র’ হয়েও পাকিস্তানে এ সব রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। রাষ্ট্রীয় অনুমতি ছাড়া নগ্ন বা অর্ধনগ্ন কোনো ছবিই আমদানি করা যায় না, তেমনি লাইসেন্স ছাড়া মদ আমদানি বা বিক্রিও অসম্ভব। বহু শহরে-বন্দরে যে সব বেশ্যা নিবাস রয়েছে তাও রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা স্বীকৃত–অনুমোদিত। বলা বাহুল্য, এ সবই আধুনিক রাষ্ট্রের অনুষঙ্গ। ধর্মের দোহাই বা নির্দেশ এগুলিকে কিছুতেই বাতিল করতে পারে না। পারলে রাষ্ট্রের নামের সঙ্গে ‘ইসলামি’ বিশেষণ যোগ করার আগে পাকিস্তানে কোরান-হাদিসের বরখেলাপকারী সব কিছুকে নিশ্চিহ্ন করা উচিত ছিল। তা করা কি সম্ভব? ( রাষ্ট্রীয় দফতর থেকে যে খতিয়ান বের হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানের মদের পরিমাণ বছর বছর বেড়েই চলেছে–সরকারি অনুমতি ছাড়া একি সম্ভব?) তা করতে হলে সমস্ত পৃথিবীটাকেই নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে–করতে হবে নতুন সমাজ বিন্যাস, বিশেষ করে বর্তমান অর্থনীতিকে বদলাতে হবে গোড়া থেকে আগা অবধি। বর্তমানে স্বাধীন দুনিয়ার কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে এ করার ক্ষমতা আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে পাকিস্তানের যে সে ক্ষমতা নেই সে সম্বন্ধে আমি সুনিশ্চিত।
কোরান-হাদিসের বাইরে যে ইসলাম, সে ইসলাম সম্বন্ধে আমার ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। আমার ধারণা সত্য, ন্যায়, সামাজিক সুবিচার, ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সাম্য ইত্যাদি যে সব বড় বড় বুলি শোনা যায় এর কোনোটাই ইসলামের একচেটিয়া নয়। সব ধর্ম ও সব রাষ্ট্রেই এগুলি স্বীকৃত–এমন কি কাফিরি রাষ্ট্রেও ‘মিথ্যা’ শুধু নিন্দনীয় নয়, দণ্ডনীয়ও। খ্রিস্টানি মুলুক ইংল্যান্ড-আমেরিকা আজ ‘মাঙ্গলিক’ দেশে পরিণত, যেখানে ধনী-দরিদ্র কারো চিকিৎসার খরচ লাগে না। আর পাকিস্তানে ইসলামের সামাজিক ন্যায় বিচার এখনো রাষ্ট্রবিদদের উচ্চরোল বক্তৃতা আর কেতাব-কোরানেই সীমাবদ্ধ। চিকিৎসার মতো মানবীয় ব্যাপারেও পাকিস্তানে ধনী-দরিদ্রের সুযোগ-সুবিধার আসমান-জমিন পার্থক্য বোধ করি কারো নজর এড়ানোর কথা নয়। ইসলামি ভ্রাতৃত্ব, ইসলামি সুবিচার ইত্যাদি জীবন ও বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন বড় বড় বুলি না আউড়িয়ে যা কিছু সর্বমানবীয় সত্য তার দিকে আমাদের রাষ্ট্রের পদক্ষেপ হলে একই সঙ্গে রাষ্ট্র ও নাগরিক উভয়েরই মঙ্গল হতো। তা ছাড়া ছোট-বড় সব বুলিই ফাঁকা ও ফাঁকি হতে বাধ্য। কারণ তার সঙ্গে ব্যবহারিক জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। কথার বাইরে তার অস্তিত্ব অনুপস্থিত।
‘স্বর্গ-রাজ্য’, ‘ধর্ম-রাজ্য’, ‘রাম-রাজ্য’, ইত্যাদি বহু বুলিই শোনা গেছে। এ সবের কী অর্থ আমি প্রশ্ন করে এ যাবৎ কোন সদুত্তর পাই নি। যারা এ সব বুলি আওড়ান তাদের নিজেদেরও এ সব বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ও সঠিক ধারণা নেই। ঢাকায় একবার এক সেমিনারে জনৈক সুপণ্ডিত অধ্যক্ষ এক প্রবন্ধ পড়েছিলেন। প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে আশা প্রকাশ করেছিলেন—’অচিরে পাকিস্তান স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে।’ সভাশেষে তাকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম–ভাই, স্বর্গরাজ্য কাকে বলে? তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চেয়েই রইলেন আমার দিকে, কোনো উত্তরই দিতে পারলেন না। মোট কথা, স্বর্গরাজ্য সম্বন্ধে তার নিজেরই কোনো ধারণা নেই–না থাকারই কথা। স্বর্গরাজ্য আমি যেমন দেখি নি তিনিও দেখেন নি। একটা ‘পবিত্র আশা’ প্রকাশ করতে হবে তাই করা। আসলে ওই বুলি একটা আকাশকুসুম মাত্র। ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ কথাটাও যাঁরা বলেন তাদের মনেও ওই রাষ্ট্র সম্বন্ধে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা যে আছে তা নয়, তারাও ওই শব্দ দুটির আড়ালে আর এক রকম আকাশকুসুমেরই চাষ করে থাকেন। এর সঙ্গে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ জড়িত রয়েছে বলে আপাতত এর চাষ জমছে ভালো।
[‘ধর্ম ও রাষ্ট্র’ প্রথম প্রকাশিত হয় সমকাল পত্রিকার বৈশাখ ১৩৭০ সংখ্যায়। পরে এটি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন এবং মানবতন্ত্র গ্রন্থে স্থান পায়।]
ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাপ্রসঙ্গে
এক
ধর্ম কথাটার মধ্যে একটা অসম্ভব মোহ রয়েছে। ফলে যে কোনো কিছুর সঙ্গে ধর্মকে তথা ধর্ম শব্দটাকে যখন জুড়ে দেওয়া হয় তখন তা হয়ে পড়ে স্রেফ আবেগের বিষয়। কোনো রকম যুক্তি-বিবেচনা তাতে আর ঠাঁই পায় না। এমন কি বুদ্ধি বা যুক্তি দিয়ে বিচার করে দেখার সাহসটুকুও যেন মানুষ তখন হারিয়ে বসে। কেউ কেউ তা করাকে মনে করে রীতিমতো বড় রকমের এক গুনাহ! যারা আরো এক ডিগ্রি বেশি গোঁড়া, তারা মনে করে স্রেফ নাস্তিকতা। বলা বাহুল্য, তারাই গোঁড়া, যারা বিচার-বিমুখ আর পরিচালিত হয় অন্ধ আবেগে। সামাজিক জীবনে এসব মানুষ অত্যন্ত বিপজ্জনক, কারণ, স্বভাবে এরা হয়ে থাকে চরম অসহিষ্ণু। ধর্মে পরমতসহিষ্ণুতার সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও এরা ধর্মের নামেই অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে থাকে সবচেয়ে বেশি। পরমতসহিষ্ণুতা শুধু-যে সত্যিকারের ধর্ম-জীবনের লক্ষণ তা নয়, সভ্য-জীবনেরও এক প্রধান শর্ত, সমাজ-জীবনেরও বুনিয়াদ। এ ছাড়া সমাজ-জীবন দুদিনেই মগের মুল্লুক না হয়ে যায় না। আমাদের মতো অনুন্নত দেশে ধর্মের বুলি, ধর্মের ভেক আর বাহ্যিক ধার্মিকতার একটা জনপ্রিয় লোক-ভোলানো আবেদন রয়েছে। তাই মানুষ সহজে এ খপ্পরে না পড়ে পারে না, এ কারণে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের এ হয়ে পড়েছে এক মোক্ষম অস্ত্র। ফলে, ধর্ম এখন এদের হাতে সব রকম আধ্যাত্মিক আবেদন হারিয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতি তথা রাজনৈতিক হাতিয়ার।
সম্প্রতি আমাদের দেশে ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাসম্বন্ধে একচোট উত্তেজক আলোচনা হয়ে গেছে। এ আলোচনা ভবিষ্যতে আরো যে অধিকতর উত্তেজক হয়ে উঠবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, আমরা নাকি অতি বেশি ধর্মপ্রাণ জাতি। খাঁটি অর্থে আমরা কতখানি ধর্মপ্রাণ তা সঠিকভাবে বলার উপায় নেই, তবে ধর্মের নামে আমরা যে প্রাণ দিতে আর নিতে জানি তার দেদার নজির আমাদের ইতিহাসে রয়েছে। আজো সমাপ্তি ঘটে নি সে ইতিহাসের।
.
কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা যায় ধর্মের নামে এই যে আমরা প্রাণ দেওয়া-নেওয়া করেছি, সে। কার সঙ্গে? কোনো বিধর্মীর সঙ্গে কি? ইতিহাস বলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের সঙ্গেই। একদল মুসলমানের সঙ্গেই। ওপরে শিক্ষা নিয়ে যে-উত্তেজক আলোচনার কথা বলেছি তাতেও সীমিতভাবে প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঘটেছে এবং ঘটেছে নিজেদের মধ্যেই। যে ধর্মের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ভ্রাতৃত্ব-প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষীদের হাতে সে ধর্ম হয়ে পড়েছে এখন ভ্রাতৃহননের হাতিয়ার! আশ্চর্য, আমাদের তথাকথিত ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা কিন্তু একবারও ভেবে কিংবা বিচার করে দেখে না যে, এতে কার কতটুকু ফায়দা হয়েছে। নিজের ধর্মের, নিজের দেশের, নিজের সমাজের, এমন কি ব্যক্তিগত পর্যায়েও কোনো লাভ হয়েছে কি কারো? বলেছি, তথাকথিত ধর্মপ্রাণরা স্বভাবতই বিচার-বিমুখ হয়ে থাকে। এসব সে বিচারবিমুখীনতারই শোচনীয় পরিণতি। না হয় সেই খোলাফা-এ-রাশেদিনের আমল থেকে ধর্মের নামে যে ভ্রাত হনন শুরু হয়েছে ইতিহাসের বিচিত্র পর্বে যা খারেজি-শিয়া-সুন্নি-ওহাবি-কাদিয়ানি-ফরায়েজি-লা-মজহাবি ইত্যাদি নানা নামে চিহ্নিত হয়ে বর্তমানে আমাদের দেশে ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার বহছে এসে ঠেকেছে, তাতে একবিন্দু ফায়দাও আমি লক্ষ করি নি কোথাও। বরং লক্ষ করেছি এতে ইসলামের নাম হয়েছে কলঙ্কিত, মুসলমান হয়েছে দুর্বল, দ্বিধা-বিভক্ত আর খণ্ডিত; আর ধর্মের আসল উদ্দেশ্য হয়েছে পদে পদে ব্যর্থ।
.
আমার ধারণা, ধর্ম এক অতি সহজ সরল ব্যাপার, তাতে কোনো রকম হেঁয়ালি কিংবা জটিলতার স্থান নেই। কথাগুলি অতি সোজা, অতি সুস্পষ্ট ও সহজে বোধগম্য। বিশ্বাস পোষণ আর তার আনুষঙ্গিক ধর্মীয় নির্দেশ–যেমন, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি পালনের মধ্যেই ধর্ম-জীবন সীমিত। এসব কোনো অর্থেই জটিল কিংবা দুর্বোধ্য নয়। এসবে মতভেদের তেমন অবসর আছে বলেও আমার মনে হয় না। ছেলেমেয়ে আর পোষ্যদের এসব শিক্ষা দেওয়া মুসলমান পরিবারের এক চিরকেলে রেওয়াজ। এখন সে রেওয়াজ যদি অধিকাংশ ক্ষেত্রে লজ্জিত হয়ে থাকে তার জন্য আধুনিক জীবন-সমস্যাই দায়ী–যে জীবনকে অস্বীকার করা এখন কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। বলা বাহুল্য, এ জীবন তথা আধুনিক জীবনের বেশির ভাগই জুড়ে আছে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেওয়া সোজা, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার ফল প্রত্যাখ্যান করা কারো পক্ষেই আজ সম্ভব নয়। এ কারণে দেখা যায়, জন-মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যে মুখে যারা অহরহ ধর্মভিত্তিক শিক্ষার জিকির করে থাকেন ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োজনের সময় তারাও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাজাত ফলগ্রহণে এতটুকু অরুচির পরিচয় দেন না। অত্যন্ত সোৎসাহে বৈদ্যুতিক পাখার হাওয়া এখন ধর্মপ্রাণরাও ভোগ করে থাকেন। অথচ তারা খুব ভালো করেই জানেন ওই বস্তুটা মোটেও ধর্মভিত্তিক শিক্ষার ফল নয়। ওর সবটাই সম্পূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষারই ফলশ্রুতি। বাস্তব জীবনে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার নানা ফল ভোগ করা আর স্রেফ লোক ভোলানোর জন্যে মুখে ওই শিক্ষার বিরোধিতা করাকে ঠিক সাধু আচরণ বলা যায় না। এর নাম মানসিক সততা নয়।
আমাদের যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি ধর্মভিত্তিক শিক্ষার দাবিতে অতিমাত্রায় সোচ্চার কিছুদিন আগে সে প্রতিষ্ঠানের আমিরে আজম চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র লন্ডনে। লন্ডনে তার অপারেশন করেছেন ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষায় শিক্ষিত ডাক্তারেরাই, সেবা করেছেন ওই শিক্ষায় শিক্ষিত নার্সরাই। অধিকন্তু ওই নার্সরা যে বেপর্দায় চলে তাও সকলের জানা কথা। ওই সব ডাক্তার আর নার্সরা যে নিষিদ্ধ তথা হারাম আর পানীয়ও খেয়ে থাকে তাতেও বোধ করি সন্দেহ নেই। তবুও ধর্মভিত্তিক শিক্ষার এমন জেহাদি দাবিদারেরাও চিকিৎসার জন্য সেখানে গেলেন কেন? যান এ কারণে যে, তারাও মনে মনে জানেন, রাজনৈতিক উদ্দশ্য হাসিলের জন্য মুখে যাই বলা হোক না কেন, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা তথা সে শিক্ষাজাত ফল গ্রহণ না করে তাদেরও নিস্তার নেই। এসব রাজনৈতিক আলেমরা যদি জান বাঁচানো ফরজ এ ফতোয়ার দোহাই দিয়ে সেকুলারিজমের ফল গ্রহণকে জায়েজ মনে করেন, তা হলে তাঁদের ‘জেহাদি’ সংকল্পের চেহারাটাই তো অত্যন্ত করুণ হয়ে ওঠে। জেহাদি সঙ্কল্পের অর্থ তো প্রাণ যায় যাক। প্রাণের মায়ায় যদি সেকুলারিজমের তথা ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্যার আশ্রয় নিতেই হয় তাহলে ধর্মভিত্তিক শিক্ষার চেয়ে সেকুলার তথা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা যে উকৃষ্টতর তা স্বীকার করে নেওয়া হয় না? ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার দাবি যারা করেন তাদেরও তো এ দাবি। আসলে ধর্মভিত্তিক শিক্ষার দাবিদারেরা ধর্মনিরপেক্ষতার বাসন থেকে গ্রাসটা তুলে হাতটাকে মাথার চারদিকে লন্ডন-প্যারিস ঘুরিয়ে এনে মুখে পুরেছেন মাত্র, আর ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা গ্রাসটি বাসন থেকে তুলে সরাসরি দিচ্ছেন মুখে। তফাতটা শুধু এখানে। না হয় এ রকম বহু নজির দিয়ে দেখানো যেতে পারে যে, ধর্মভিত্তিক শিক্ষার দাবিদারেরা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাকে বাদ দিয়ে এ জীবনে এক পাও অগ্রসর হতে পারবেন না এবং পারছেন না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ইহলোকে বেঁচে থাকা, জীবনের বিকাশ সাধন করা। যে যুগে, যে দেশে জন্মগ্রহণ। করা গেছে সে যুগ আর সে দেশের চাহিদা, প্রয়োজন আর সমস্যার মোকাবেলা করে বেঁচে থাকা। স্রেফ ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষা দ্বারা এ হওয়ার নয়। হলে নেজামে ইসলামের সম্পাদক নিজের ছেলেকে ক্যাডেট কলেজে না পাঠিয়ে পাঠাতেন মাদ্রাসা আলিয়ায়। অক্সফোর্ড কেমব্রিজের পরিবেশ আর অধ্যয়ন-অধ্যাপনা সর্বতোভাবেই সেকুলার তবুও ওইখানে। শিক্ষা গ্রহণে সুযোগ পেলে আমাদের মৌলবি মওলানাদের ছেলেজামাইও দেখেছি কৃতার্থ বোধ করেন, এমন কি ওইসব ছেলে-জামাই এর বাপ-শ্বশুররাও মনে করেন যেন হাতে, চাঁদ পাওয়া গেল। এমনতর উৎসাহ নিয়ে এঁরা কখনো নিজের ছেলে কি জামাইকে শিক্ষার জন্য মক্কা-মদিনা কিংবা বাগদাদ-দামেস্ক বা মিসরে পাঠান না। দেশের উচ্চ মাদ্রাসাগুলিতে কি পাঠান? ধর্মভিত্তিক শিক্ষা যদি ভালো হয় তা ষোলআনাই ভালো এ কথা না মেনে উপায় নেই। সে ষোল আনা শিক্ষা আমাদের মক্তব-মাদ্রাসাগুলিতে আবহমানকাল ধরেই চলেছে। কিন্তু সে শিক্ষায় শিক্ষিতদের আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের কোথাও কোনো গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় কি? দেশের প্রশাসন-ক্ষেত্রে কোথাও তো তাদের স্থান। নেই, দেশরক্ষায় তারা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, আজাদী আন্দোলনেও তাদের ভূমিকা ছিল কিঞ্চিতকর। মোটকথা, আধুনিক রাষ্ট্রীয় দাবি আর জীবনের মোকাবেলায় তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ প্রমাণিত। বৃহত্তর সমাজেরও যে এ সত্য জানা নেই তা নয়, জানা আছে বলেই দেশের সেকুলার শিক্ষালয়ে তার সিকি পরিমাণ ভিড়ও দেখা যায় না। আজ শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা সেকুলার বিদ্যালয় আর সেকুলার বিষয়ে ভর্তির সমস্যা। প্রতি বছর হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ওইসব বিদ্যাকেন্দ্রে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে লেখাপড়াই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। চিকিৎসা আর প্রকৌশল ক্ষেত্রে অবস্থা আরো জটিল। অন্য দিকে ধর্মভিত্তিক শিক্ষা কেন্দ্র মাদ্রাসাগুলিতে অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। সেখানে কোনো ছাত্র ভর্তির সুযোগ পায় না তেমন কোনো কথা আজো শোনা যায় না।
দুই
আমাদের দেশ ধর্ম বা ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার সুযোগের কোনো অভাব আছে বলে মনে হয় না। মক্তব মাদ্রাসার কথা বাদ দিলেও নিউ স্কিম মাদ্রাসাগুলি রয়েছে, যেখানে ইংরেজি, বাংলা, অঙ্কের সাথে সাথে প্রচুর ধর্মশিক্ষারও ব্যবস্থা আছে। তবুও শোনা যায় সে সব মাদ্রাসায়ও এখন ছাত্র সংখ্যা দিন দিন কমে এসেছে। যে-কোনো ধরনের মাদ্রাসা আর সেকুলার হাই স্কুলের আর ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের সঙ্গে সেক্যুলার। ইন্টারমিডিয়েট কলেজের তুলনা করে দেখলে এ সত্যটাই প্রকট হয় যে, দেশে ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষার তেমন কোনো চাহিদা নেই। আমাদের প্রায় সব কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম তথা ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। তার জন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য সেকুলার বিভাগের সঙ্গে তুলনা করে দেখলেও দেখা যায়, ওই বিভাগে ছাত্রসংখ্যা অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে কম।
সম্প্রতি ছাত্র ভর্তির প্রবল চাহিদা আর চাপ এড়াতে না পেরে বাধ্য হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন বিভাগে সিটের সংখ্যা কিছু কিছু বাড়িয়েছে। এ সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তিতে যে পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে তা নিম্নরূপ:
বিষয় –সিটের সাবেক সংখ্যা –এখন বাড়িয়ে যা করা হয়েছে
ইংরেজি – ৭৫ –৯০
বাংলা – ১০০ –১২০
অর্থনীতি – ১৫০ –১৬০
ইতিহাস – ৭৫ –৮৫
সমাজবিজ্ঞান – ৭৫ –৯০
দর্শন – ৬০–৮০
রাষ্ট্রবিজ্ঞান – ১৫০ –১৮০
বাণিজ্য – ১৫০ –১৭০
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক – ২৫ –৪০
মনস্তত্ত্ব – ৪০ –৪৫
ইসলামের ইতিহাস আর সংস্কৃতি – ৪০ –৬০
আরবি – ১৫ –২০
ইসলামিক স্টাডিজ – ২৫ –৬০
এসব বিষয়ে সিটের মোট সংখ্যা ছিল আগে ৮১৫, এখন বেড়ে তা হয়েছে ১১৭০।
ইসলামের ইতিহাস আর সংস্কৃতিকে ঠিক ধর্ম-ভিত্তিক বিষয় বলা যায় না, বরং সার্বিক ইতিহাসের অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য শাখা এটি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বিষয়ের অধ্যাপক একজন হিন্দু। কাজেই আরবি আর ইসলামিক স্টাডিজকেই শুধু ধর্ম-ভিত্তিক বিদ্যা বলা চলে। এ দুই বিষয়ে সিটের সংখ্যাল্পতা কি প্রমাণ করে না যে, দেশে ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষার তেমন চাহিদা নেই? থাকলে এ দুই বিষয়ের এমন শোচনীয় দশা ঘটতো না। শোনা যায়, এসব সিটের জন্যও তেমন কোনো প্রতিযোগিতা হয় না। অন্যদিকে, ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়গুলিতে ভর্তির জন্য কী রকম প্রতিযোগিতা ঘটে, তা কারো অজানা নয়। স্থান আর প্রয়োজনীয় সংখ্যক অধ্যাপকের অভাবে প্রবল দাবি থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে সিট বাড়ানো সম্ভব হয় নি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে। বিজ্ঞান শুধু যে ধর্মনিরপেক্ষ তা নয়, বিজ্ঞানের বহু থিওরি আর মতবাদের সঙ্গেও ধর্মের রীতিমতো বিরোধ রয়েছে। তবুও ধর্ম বা ধর্মভিত্তিক শিক্ষার চেয়ে বিজ্ঞানশিক্ষার চাহিদা দেশে অনেক বেশি। প্রতিবছর বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে বহু ছাত্র যে স্রেফ সিটের অভাবে ভর্তির সুযোগ পায় না, এ এক সার্বজনীন সত্য। দেশের ক্ষেত্রে এই তো বাস্তব অবস্থা। এ অবস্থায় ধর্মভিত্তিক শিক্ষার ধুয়া তুলে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত আর পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়ার কোনো মানে হয় কি? আশ্চর্য, চোখের সামনে সারা মধ্যপ্রাচ্যের শোচনীয় আর করুণ দশা দেখেও আমাদের একশ্রেণীর রাজনৈতিক নেতাদের চোখ খোলে না। একবারও এঁরা তাকিয়ে দেখেন না। বাস্তবের কঠিন মাটির দিকে, যে মাটিতে তারা পা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথ যে একবার বলেছিলেন : ‘ধর্ম-মোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভাল,’ মনে হয় কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়। ধর্মান্ধতার চেয়ে বড় অন্ধতা আর নেই। চোখের অন্ধতা শুধুমাত্র দৃষ্টিশক্তিই হরণ করে, কিন্তু ধর্মান্ধতা হরণ করে বুদ্ধি-যুক্তি-বিচার-বিবেক আর সব রকম মূল্যবোধ।
আরবদের মাতৃভাষা আরবি-কোরান-হাদিস, ফেকা-উসুল-তফসির ইত্যাদি যা কিছুকে এক কথায় ইসলামি ধর্ম-বিদ্যা বলা হয় তা সবই আরবিতে। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই আরবেরা এসবের সঙ্গে পরিচিত (এ সবকে বাদ দিয়ে ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষা আর কাকে বলা হয় আমার জানা নেই। তবুও শ্রেষ্ঠ ধার্মিকের আদর্শ কি এ যুগের আরবরা? তা যদি হতো আমার বিশ্বাস তাদের অবস্থা কখনো এমন শোচনীয় হতো না। ক্ষুদ্র এক শক্তির হাতে তারা যে শুধু পদে পদে পরাজিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে তা নয় তাদের জীবনমানও এখন সর্বনিম্নস্তরে। এত নিম্নে যে, ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার দাবিদারেরাও দৈহিক আরোগ্যের জন্য যেমন তাদের কাছে যায় না তেমনি পাঠায় না নিজেদের ছেলেমেয়েকে মানসিক সম্পদ তথা জ্ঞান আহরণের জন্যও ওইসব দেশে। ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষার অভাবেই কি এ পরিণতি? মনে হয় না। বরং আধুনিক শিক্ষা আর সেই শিক্ষাজাত দৃষ্টিভঙ্গির অভাবেরই এ ফল। কোনো ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষাই এ অধঃপতিত অবস্থা থেকে ওদের উদ্ধার করতে পারবে না। উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র উপায় মনেপ্রাণে আধুনিক শিক্ষাকে গ্রহণ করে সর্বতোভাবে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান আর যন্ত্রবিদ্যাকে আয়ত্ব করা, পরমুখাপেক্ষিতা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা। এ করা হলে, আমার বিশ্বাস, দশ কোটি মানুষ পৃথিবীতে আবারও অসাধ্য সাধন করতে পারে। তাদের চোখের সামনে ক্ষুদ্র ইসরাইল তার এক জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। জ্ঞানী শত্রুর কাছ থেকেও সব নিয়ে থাকে। আরবদেরও তা নেওয়া উচিত। ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার কোনো অভাব আরব দেশে নেই, ছিলও না ইসলামের আবির্ভাবের কাল থেকে। জামে আজহার নাকি প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় আর ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষাই যে ওখানে দেওয়া হয় তাতে বোধ করি সন্দেহ নেই। তবুও সে-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তেমন কোনো কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পারেন না। আরবদের এখন একমাত্র অভাব ধর্মনিরপেক্ষ তথা সেকুলার শিক্ষার। আমাদের দেশেও ধর্ম বা ধর্মভিত্তিক শিক্ষার সুযোগের কিছুমাত্র অভাব নেই। অসংখ্য মক্তব-মাদ্রাসা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে, যাতে ধর্মীয় শিক্ষার দরাজ ব্যবস্থা রয়েছে। তদুপরি আমাদের প্রায় সব কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতম স্তর পর্যন্ত ধর্মভিত্তিক তথা সব রকম ধর্মীয় বিদ্যা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা আছে। যারা ধর্মভিত্তিক শিক্ষার দাবির সমর্থনে জান দেওয়া নেওয়ার হুমকি দিয়ে থাকেন, তাঁরাও কি এসব সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে থাকেন? করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সিট তথা ছাত্র পরিসংখ্যান এমন বিপরীত তথ্য পরিবেশন করতো না।
তিন
ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষা যারা চান তাদের কথা আর কাজে স্ববিরোধিতা দেখেই সবচেয়ে বেশি অবাক হতে হয়। আমার এক অধ্যাপক বন্ধুকে যিনি নিজে ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষা পেয়েছেন এবং ধর্মীয় বিষয়েই সারাজীবন অধ্যাপনা করেছেন–একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম: একজন বেনামাজি, ধর্মকর্মে সম্পূর্ণ উদাসীন এমন সি.এস.পি. যদি তোমার মেয়ের পাণিপ্রার্থী হয় তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবে, না একজন নামাজি-কালামি পরহেজগার আলেম প্রার্থীর সঙ্গে দেবে? বন্ধুবর ধর্মভিত্তিক শিক্ষার দাবিদার, তাই তাকে এমনতরো প্রশ্ন করা। শুনে অবাক হলাম, তিনি বিনা দ্বিধায় মুহূর্তে বলে ফেললেন, ‘সি.এস.পির সঙ্গেই দেবো।’ তিনি তার এক ছেলেকে পড়িয়েছেন অর্থনীতি, অন্য ছেলেকে বাণিজ্য, এক মেয়েকে বাংলা, অন্য মেয়েকে ইংরেজি। কোনো ছেলেমেয়েকেই ধর্মভিত্তিক শিক্ষা দেন নি, তেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠান নি। মনে হয় এরা যে-ধর্মভিত্তিক শিক্ষা চান সে শুধু পরের ছেলের জন্যই, নিজের ছেলেমেয়ের জন্য নয়। যে শিক্ষাপদ্ধতি এঁরা নিজের ছেলেমেয়ের জন্য অকেজো আর অনাবশ্যক মনে করেন সে শিক্ষা-পদ্ধতি এরা দাবি করছেন পরের ছেলেমেয়েদের জন্য। আমার আপত্তি আর প্রতিবাদ এঁদের এ স্ববিরোধিতার প্রতিই, না হয় বিলাতে নাসারাদের মুলুকে অপারেশনের জন্য যাওয়া বা ক্যাডেট কলেজে ছেলেকে ভর্তি করানো কিংবা অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতির মতো ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় অধ্যয়নে আমার কোনো আপত্তি তো নেইই বরং আন্তরিক সমর্থন আছে। এমন কি আমার স্পর্শবাদী অধ্যাপক বন্ধুটির সিদ্ধান্তকেও আমি স্বাগত জানাই। (বিশেষত এ কারণে যে, গলার সব জোর দিয়ে ধর্মভিত্তিক শিক্ষার দাবি করলেও তিনিও এ বাস্তব সত্যটুকু ভালো করেই জানেন যে, পরহেজগার আলেমের সাথে মেয়ের বিয়ে হলে মেয়েটির সারা জীবন একটিবার সিনেমা দেখার সুযোগ পাবে না। আর সি.এস.পি’র সঙ্গে বিয়ে হলে ইচ্ছা করলে বসে বসে বিনা পয়সায় রোজই তো দেখতে পারবে।) মোটকথা, মেয়ে-জামাই-এর পরকাল সম্বন্ধে তাঁর কোনো দুশ্চিন্তা নেই, তার চিন্তা ওদের ইহজীবনের সুখ-সুবিধা নিয়েই। বলা বাহুল্য, ইহজীবনের সুখ-সুবিধারই তো এক নাম ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজম।
এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে স্মরণীয়, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা মানে ধর্মহীন শিক্ষা নয়। তা হলে সেকুলার দেশগুলিতে এত সব মহাপ্রাণ ধার্মিকের আবির্ভাব ঘটতো না। মানব কল্যাণে উৎসর্গিত-প্রাণ যত মানুষ ওইসব দেশে দেখা যায়, আমাদের মতো ধর্মপ্রাণ জাতিতে তার সিকি পরিমাণও তো দেখা যায় না। সেকুলার দেশেও ধর্ম আছে, ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হয়। ধর্ম ও ধর্মানুষ্ঠান পালিত হয়। ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার যারা পক্ষপাতী তাদের একমাত্র দাবি তো ধর্ম-শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বাধীনে না আনার। ধর্ম-শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি চালু থাক, তার সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম স্তর পর্যন্ত অধ্যয়নের সুযোগ যেমন আছে তা অব্যাহত থাক তাতে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার পক্ষপাতীদের কিছুমাত্র আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতায়। ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাই ধর্ম-শিক্ষাকে সব উন্নত দেশেই পারিবারিক আর বেসরকারি আয়ত্বে রাখা হয়। কারণ, ধর্ম আর রাষ্ট্রের ভূমিকায় যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্য স্বীকার না করলে ধর্মই ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবচেয়ে বেশি। ধর্মের প্রধান কাজ মানুষকে পরলোকের অনন্ত জীবনের জন্য তৈরি করা। সে পথের হদিস বাতলানো। বলা বাহুল্য, পরলোকে বিশ্বাস না থাকলে ধর্মের আবেগ মুহূর্তে নিঃশেষিত। রাষ্ট্র সর্বতোভাবে ইহলৌকিক ব্যাপার। ইহলোকে মানুষের যে সীমিত জীবন, সে জীবনের প্রয়োজন মেটানো আর তার দায়িত্ব গ্রহণ আর পালনই রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য। মানুষের পারলৌকিক জীবনের ভার গ্রহণ কিংবা মানুষকে ধার্মিক বানানো কোনো অর্থেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়, বরং তা করতে গেলে ধর্মের সমূহ ক্ষতি না হয়ে যায় না। ধর্মীয় ব্যাপারে (ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষাও এর অন্তর্গত) রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ মানে রাজনীতিবিদদের হস্তক্ষেপ। আমার বিশ্বাস, কোনো। প্রকৃত ধার্মিকই তা কাম্য মনে করতে পারেন না। রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র পরিচালকরা সব সময় রাষ্ট্রের এবং নিজেদের ইহলৌকিক স্বার্থের দিকে নজর রেখেই রাষ্ট্রীয় সব কিছু, শিক্ষা তো বটেই, পরিচালনা আর নিয়ন্ত্রণ যে করবে এবং করতে চাইবে এ প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। সব দেশেই এ ঘটে, ঘটে চলেছে। এ কারণে অনেক সময় খাঁটি ধার্মিক আর শাস্ত্র পণ্ডিতেরা রাষ্ট্রপ্রধান বা রাষ্ট্র পরিচালক হতে চান না–এমন কি কেউ কেউ প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতেও যে অস্বীকার করছেন তেমন নজির ইসলামের ইতিহাসেও বিরল নয়।
রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে শিক্ষা ব্যবস্থা তার প্রধান লক্ষ্যই থাকে উপযুক্ত নাগরিক তৈরি করা, যে নাগরিক পারবে যথাযথ যোগ্যতার সাথে রাষ্ট্রের সব রকম দায়িত্ব গ্রহণ। আর পালন করতে। ধর্মীয় ব্যাপার সে দায়িত্বের আওতায় পড়ে না–সে দায়িত্ব পরিবার আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আর সংস্থার। ধর্ম মানুষের সর্বাপেক্ষা পবিত্রতম আর সর্বাপেক্ষা স্বাধীন এলাকা। রাষ্ট্রের, বিশেষ করে আধুনিক রাষ্ট্রের প্রবণতাই হলো সব ব্যাপারে নাক গলানো, মানুষের সব কিছুতেই হস্তক্ষেপ করা। ধর্মীয় ব্যাপারেও যদি রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ঘটে তা হলে ধর্মের পবিত্রতা আর স্বাধীনতা দুইই খর্বিত আর লঙ্ঘিত হবে। পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রই ধার্মিক তৈরির উদ্দেশ্যে শিক্ষাপদ্ধতি প্রণয়ন করে না–করতে চাইলে ও ফল সম্পূর্ণ বিপরীতই হবে। কারণ, রাষ্ট্র নিজের স্বার্থেই তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, চালাবে, প্রয়োজনমতো দোমড়াবে, মোচড়াবে। ধর্মের ঋজু-সারল্য তখন আর থাকবে না, হয়ে পড়বে তা রাজনৈতিক দাবা খেলার গুটি।
তখন পরলোকমুখীনতা ছেড়ে ধর্মও হয়ে উঠবে ইহলোকমুখী আর ইহলোকমুখীনতা মানে সেকুলারিজম। এখন আমাদের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির যে দশা হয়েছে তখন ধর্ম-শিক্ষারও সে দশা হবে। জমায়াতে ইসলাম বা নেজামে ইসলাম এখন ধর্মের কথা যত না বলে তার চেয়ে অন্তত শতগুণ বেশি বলে নির্বাচনের কথা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতালাভের কথা। ওদের সর্বশক্তি এখন সেদিকেই নিয়োজিত। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের হাতে ধর্মের এ দুর্দশা না হয়ে যায় না। এ অবস্থায় ধর্মের যে আসল উদ্দেশ্য মানুষকে আল্লায় নিবেদিতপ্রাণ করে তোলা, সে ভূমিকা তখন আর থাকবে না। ধর্মকে তখন ইচ্ছামতো রাজনৈতিক তথা দুনিয়ালোভী উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হবে। তাই ধর্মের নামে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান করার আমি ঘোর বিরোধী–এমন কি মসজিদে, মিলাদে, ঈদের জমায়াতে আর যে কোন ধর্মসভায়ও রাজনৈতিক আলোচনা কিংবা রাজনীতি নিয়ে আসারও আমি পক্ষপাতী নই।
ধর্মের একটা শাশ্বত ভূমিকা আছে। পারলৌকিক জীবনের প্রস্তুতি ছাড়াও মানুষের আত্মার বিকাশ সাধনও ধর্মের উদ্দেশ্য আর ভূমিকা। রাষ্ট্রের এলাকা এসবের বাইরে। পরলোক আর আত্মা নিয়ে রাষ্ট্র মাথা ঘামায় না। ঘামাতে গেলেই রাষ্ট্র আর ধর্ম দুইই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অধিকন্তু তখন ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরোধ নির্ঘাত আর একটা কারবালা ঘটাবে। ঐতিহাসিকদের অজানা নয়, আগের কারবালাটাও ঘটেছিল ধর্ম আর রাষ্ট্রশক্তির বিরোধের ফলেই। ধর্ম সনাতন, চিরন্তন আর অচল, রাষ্ট্র সচল, ক্ৰম-পরিবর্তনশীল, তাবত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয় রাষ্ট্রকে। এ ছাড়া আজকের দিনে রাষ্ট্রের পক্ষে অস্তিত্ব রক্ষা অসম্ভব। এ কারণেই ‘ইসলামি’ নাম শিরে বহন করেও পাকিস্তানকে একদিকে কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রের সঙ্গে, অন্য দিকে কাট্টা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সাথে দোস্তি করে চলতে হচ্ছে।
ধর্ম আর রাষ্ট্রের ভূমিকা যে সম্পূর্ণ আলাদা এ কথা ওপরেও একবার উল্লেখ করেছি। এ সত্যটা অনেক সময় ভুলে থাকা হয় বলে এ দুইকে মিলিয়ে এক বিভ্রান্তিকর অবস্থা ডেকে আনা হয় আমাদের দেশে। ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা নিয়ে যে বিতর্ক, তাও এ বিভ্রান্তিরই নতিজা। ধর্ম যদি মানুষের মনে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার আর পারলৌকিক জীবনের নির্দেশকের ভূমিকা ছেড়ে রাষ্ট্রের মতো এক স্কুল জাগতিক তথা সেকুলার বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে আর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নেয় তাহলে ধর্ম স্বধর্মচ্যুত না হয়ে পারে না। সে সঙ্গে রাষ্ট্রও হবে ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ, রাষ্ট্র তখন তার চলিষ্ণুতা হারাতে বাধ্য হবে। সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নীতি নির্ধারণ তখন অসম্ভব হয়ে পড়বে রাষ্ট্রের পক্ষে। রাষ্ট্রের স্বার্থে ধর্মীয় নির্দেশ যুগের প্রয়োজন মেনে চলবে না কোনোদিন। অন্যদিকে রাষ্ট্রকে হতে হয় যুগোপযোগী। ফলে ছোট ছোট ব্যাপারেও তখন দেখা দেবে বহু তর্কযুদ্ধ–অহিংসায় যার সমাপ্তি ঘটবে না কোনো দিনই। পাক-সৈন্যদের প্যান্ট হাফ হবে কি ফুল হবে, য়ুরোপীয় হ্যাটের অনুকরণে তৈরি হেলমেট পরা আমাদের পুলিশের পক্ষে জায়েজ কিনা ইত্যাদি হাজারো বছরের দরজা তখন খুলে দেওয়া হবে, যা প্যানডোরার বাক্সকেও হার মানাবে!
ধর্ম এক নয়, বহু। আবার প্রতি ধর্মের রয়েছে হাজারো ফেরকা। ইসলামও তার ব্যতিক্রম নয়। এক এক ধর্ম এক এক বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য। রাষ্ট্র কিন্তু তা নয়, দেশের ভৌগোলিক সীমার অন্তর্গত সব সম্প্রদায় আর সব মানুষের জন্যই রাষ্ট্র। এমন কি ধর্মহীন অবিশ্বাসীর জন্যও; ধার্মিকরা যাদের ‘কাফের’ বলে তাদের জন্যও। নাস্তিককে রাষ্ট্র অস্বীকার করতে কিংবা কুফরি কি নাস্তিকতার অভিযোগে পারে না দণ্ড দিতে। ধর্ম কিন্তু পারে, দিয়ে থাকে দণ্ড। ধর্ম অবিশ্বাসীকে ইহলোকে একঘরে করতে পারে আর পরকালের জন্য পারে নরকের ব্যবস্থা করে দিতে। রাষ্ট্র এ ধরনের কিছুই পারে না করতে, করলে ওই দেশ রাষ্ট্র নামের যোগ্যতাই হারাবে। আমার বিশ্বাস, ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্রের আর রাষ্ট্র দিয়ে ধর্মের কাজ কখনো পুরোপুরি চলতে পারে না। চালাতে গেলেই বিরোধ আর সংঘর্ষ অনিবার্য। স্রেফ মুসলিম রাষ্ট্রেও এ সম্ভব নয়। কারণ, মুসলমানদের মধ্যেও ফেরকার কোনো অন্ত নেই। শিয়া, সুন্নি, আহমদি, কাদিয়ানি, ওহাবি-মজহাবি লামজহাবি ইত্যাদি ফেরকার কোনো সীমা নেই। ধর্মীয় ব্যাপারে সব ফেরকারই ধ্যান ধারণা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস আলাদা। ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার নামে প্যানডোরার বাক্সেরও মুখ খুলে দেওয়া হলে প্রথম সমস্যাই দেখা দেবে কোন ফেরকার বিশ্বাস আর আকিদা অনুসারে পাঠ্যসূচি তৈরি করা হবে? রাষ্ট্র স্রেফ সংখ্যার দাবিতে কারো ধর্মীয় দাবি অস্বীকার করতে পারে না। শুধু কোরান-হাদিসের দোহাই দিয়েও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কারণ, কোরান-হাদিসের ভাষ্য আর ব্যাখ্যা নিয়েই তো ফেরকার উৎপত্তি। মোটকথা, ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষাকে সব দেশের মতো আমাদের দেশেও বেসরকারি পর্যায়ে বেসরকারি নিয়ন্ত্রণেই রাখতে হবে। ধর্ম-শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ আমার মতে কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়। তাতে সমস্যা আরো জটিল হয়ে দাঁড়াবে। এ বিতর্কের সূচনায় যে-বিরোধ আর সংঘর্ষ দেখা গেছে তা আরো বৃদ্ধি পাবে। আর এ বিরোধ আর সংঘর্ষ ঘটবে মুসলমানে মুসলমানে, পাকিস্তানিতে পাকিস্তানিতে।
[‘ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধটি গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৭০-এ সমকালীন চিন্তা গ্রন্থে।]
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিপদ
আমি রাজনীতিবিদ নই, কোনো রকম রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষাও আমার নেই। এ কথা ইতোপূর্বেও আমি উল্লেখ করেছি। তবুও আমি যে রাজনীতি বা রাজনৈতিক কোনো কোনো সমস্যা-সম্বন্ধে আমার মতামত ব্যক্ত করে থাকি তার কারণ, আমি বিশ্বাস করি যখনই দেশের সামনে কিংবা ব্যাপক অর্থে মানুষের সামনে কোনো সমস্যা দেখা দেয়, সে সম্বন্ধে ভাবা, চিন্তা করা আর সে ভাব আর চিন্তাকে দেশ আর মানুষের সামনে তুলে ধরা লেখকের এক প্রধান দায়িত্ব। লেখক সমাজ-বিচ্ছিন্ন নন, সমাজ-বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেন না। তার চিন্তা আর ভাব জনগণ গ্রহণ করবে কি করবে না সে স্বতন্ত্র কথা–তা লেখকের বিবেচ্য নয়। লেখকের দায়িত্ব নিজের উপলব্ধ সত্যকে প্রকাশ করা। এ না। করা মানে নিজের দায়িত্বের প্রতি চোখ বুজে থাকা। আবার প্রচারক নন বলে নিজের মতামত কারো ওপর চেপে দিতেও তিনি অনিচ্ছুক। তার প্রকাশিত মতামত-সম্বন্ধে পাঠক একটুখানি ভেবে দেখুক এই তার সর্বোচ্চ কামনা। লেখকের একটা ভূমিকা সম্বন্ধে এই আমার ধারণা, এ ধারণার বশবর্তী হয়ে আমি দেশের সাম্প্রতিক ঘটনা আর রাজনীতি-সম্বন্ধেও লিখে থাকি। আগেও লিখেছি। এ প্রবন্ধে আলোচ্য বিষয় সম্বন্ধেও ইতোপূর্বে আমি যে একাধিকবার লিখি নি তা নয়। কিন্তু আমার বিশ্বাস, বিষয়টি যেভাবে দিন দিন জটিলতর হয়ে উঠেছে তাতে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা যে শুধু বিঘ্নিত হবে তা নয়; প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাতমুখিতাই পেয়ে যাবে প্রশ্রয়। দেশের অগ্রগতি হবে পদে পদে ব্যাহত। তাই এসব আলোচনা পুনরাবৃত্তির দাবি রাখে। আমার বিশ্বাস, ধর্ম আর রাজনীতি সম্পূর্ণ আলাদা বস্তু। রাজনীতির প্রধান কাজ রাষ্ট্রপরিচালনা, রাষ্ট্রপরিচালনায় রাজনীতিকে পদে পদে আপোস করে চলতে হয়, কিন্তু ধর্ম তার সম্পূর্ণ বিপরীত, কোনো অবস্থানেই ধর্ম আপোস করতে রাজি নয়, আপোস করতে গেলেই ধর্ম তার খাঁটি রূপ বা অকৃত্রিমতা বজায় রাখতে পারবে না কিছুতেই। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যে কোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান চলে, কিন্তু ধর্মীয় কোনো ব্যাপারে এ পদ্ধতি অচল। গণ ভোটে ধর্মীয় বিষয়ের মীমাংসা করা হলে ধর্ম আর ধর্ম থাকবে না। আমরা আমাদের দেশের জন্য গণতন্ত্রকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছি (ধর্মীয় দলগুলিও এ চায়), কাজেই আমাদের রাজনীতির চেহারা আর চরিত্র হবে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম খাপ খায় না, শুধু গণতান্ত্রিক কেন, কোনো রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম খাপ খেতে পারে না। রাজনীতি, বিশেষ করে আধুনিক রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে সেকুলার, কিন্তু ধর্মকে আধুনিক বা অনাধুনিক নামে কিছুতেই চিহ্নিত করা যায় না। ধর্ম চিরন্তন–সে চিরন্তনের সঙ্গে দিনে দিনে পরিবর্তনশীল রাজনীতির নেকাহ্ দিতে গেলে সুখের দাম্পত্য-জীবন অকল্পনীয়। আমার আপত্তির প্রধান কারণ এখানে। এবার আমার বক্তব্য নিবেদন করছি।
ইদানিং ‘ইসলামি শাসন’ কথাটা আমাদের এক শ্রেণীর নেতা আর কর্মীর মুখে খুব একটা জনপ্রিয় তথা লোক-ভোলানো বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে লোক ভোলানো অতি সহজ এ কারণে যে, এর পেছনে একটা অন্ধ আবেগ রয়েছে, যে-আবেগ বুদ্ধিদীপ্ত কিংবা বাস্তব-ভিত্তিক নয় মোটেও। দেখা গেছে, ধর্মের নামে মানুষ কখনো যুক্তি বিচারের ধার ধারে না, স্রেফ একটা উত্তেজিত আবেগের স্রোতে যায় ভেসে। আমাদের দেশে যে সব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ধর্ম-ভিত্তিক শাসনের দাবি করা হচ্ছে, আদতে ধর্মের খেদমত বা ধর্ম প্রচার ওই সব প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা। সে ক্ষমতা দখল সহজ হবে মনে করেই এসব প্রতিষ্ঠান ধর্ম বা ইসলামকে করে নিয়েছে একমাত্র মূলধন। কারণ, এ মূলধনের সাহায্যে ধর্মপ্রাণ জনগণকে সহজেই উত্তেজিত করে তোলা যায়, যায় বিভ্রান্ত করা।
না হয় এসব প্রতিষ্ঠানের নেতারাও জানেন ‘ইসলাম’ বা অন্য যে কোনো ধর্ম রাজনীতির ঊর্ধ্বে, ধর্ম মোটেও রাজনীতির বিষয় হতে পারে না। বিশেষত ভূগোল ভিত্তিক যে রাজনীতি, ‘ইসলাম’কে তেমন রাজনীতিতে ব্যবহার করা হলে ইসলামকে খাটোই করা হয়। ধর্ম হিসেবে ইসলাম ভূগোল মানে না, পক্ষান্তরে, রাজনীতি শুধু যে ভূগোল মানে তা নয়, বরং ভৌগোলিক অবস্থান আর প্রয়োজন বোধে রাজনীতি অহরহ রূপ থেকে রূপান্তরে আবর্তিত হতে থাকে। এ কারণে মুসলমানপ্রধান দেশগুলিতেও রাজনীতি ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়েছে, নিতে বাধ্য হয়েছে। রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, গণতন্ত্র, এমন কি সমাজতন্ত্র ও মুসলমানপ্রধান দেশ ও অঞ্চলে বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে এ যুগেও। অধিকন্তু ইসলামকে রাজনীতির বিষয় করে তোলা হলে তাতে আঞ্চলিকতার প্রবেশ না ঘটে পারে না, অথচ ইসলাম কোনো অর্থেই আঞ্চলিক নয়। ধর্ম হিসেবে ইসলাম এক বিশ্ব-ধর্ম, বিশ্বের তাবত মানুষের ধর্ম। যার ইচ্ছা এ ধর্ম গ্রহণ করে, এ ধর্মের বিধিবিধান অনুসরণ করে জীবনযাপন করতে পারে। কিন্তু যে কোনো মুসলমান পাকিস্তানি বনতে পারে না রাতারাতি। রাজনৈতিক বহু আট-ঘাট পার হয়েই তবে তাকে হতে হয় পাকিস্তানি। কিন্তু মুসলমান হতে তার এক মিনিটও দেরি লাগে না। ধর্ম আর রাজনীতির ভূমিকা এত আলাদা যে, খাঁটি ধার্মিক আর খাঁটি রাজনীতিককে বুঝিয়ে বলার কোনো প্রয়োজনই নেই। ডালে-চালে মিশিয়ে খিচুড়ি হয়; কিন্তু ধর্ম আর রাজনীতি মিশিয়ে ধর্মীয় রাজনীতি হয় না। স্রেফ ভাওতা দেওয়া চলে শুধু ওই রাজনীতির নামে। আরো একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র। তবুও যে কোনো মুসলমান পাকিস্তানের নাগরিক হতে পারে না। এমন কি বিনা পাসপোর্টে পারে না প্রবেশ করতেও। তা করতে হলে আরো শর্ত পূরণ করা চাই। পাসপোর্টের অভাবে বহু মুসলমান ইসলামের জন্মস্থানে গিয়ে হজ্বের মতো ধর্মীয় কাজও যে করতে পারে না, তা বোধ করি কারো অজানা নয়। কাজেই এটা এক চক্ষুগ্রাহ্য সত্য যে, ইসলাম এক মুসলমান অন্য (বলা বাহুল্য, রাজনীতিতে অদৃশ্য দলীয় কারবারের কোনো স্থান নেই)। দেশগত রাজনীতি মুসলমানের জন্য, ইসলামের জন্য তা হতেই পারে না, দেশগত রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে ইসলামকে নিয়ে আসা হলে তা কিছুতেই তার ধর্মীয় অকৃত্রিমতা বজায় রাখতে পারবে না। পাসপোর্ট-ভিসা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ব্যাপার, ভূগোল-ভিত্তিক আধুনিক রাজনীতিরই এ এক আবিষ্কার। খাঁটি ধর্মীয় বিধানের দিক থেকে দেখলে একে ইসলাম-বিরোধী না বলে উপায় নেই। কারণ ধর্মীয় বিধি-বিধানের যেমন, নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি ব্যাপারে ইসলামে সরকারি বা বেসরকারি নিয়ন্ত্রণের কোনো হুকুম নেই বলেই আমার বিশ্বাস। থাকলে তা আলেমদের জানা থাকার কথা। পাকিস্তান নামে ইসলামি রাষ্ট্র হলেও শাসিত হয় আধুনিক রাষ্ট্রনীতির সাহায্যে। তাই ধর্মীয় বিধিবিধানের কথা কিছুমাত্র আমলে না এনেই, অন্যান্য আধুনিক রাষ্ট্রের মতো পাকিস্তানও পাসপোর্ট-ভিসা প্রবর্তন করেছে, করেছে ইসলাম-ধর্মাবলম্বীর জন্যও।
বলেছি ইসলাম আর মুসলমান আলাদা। অন্তত রাজনীতি ক্ষেত্রে তাই। মুসলমানকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা যায় কিন্তু ইসলামকে যায় না। তাই রাজনৈতিক অর্থে ধর্মীয় শাসন কথাটা অর্থহীন। ইংল্যান্ডে ইসলামি শাসন নেই কিন্তু বহু মুসলমান আছে, আমেরিকায়ও তাই। ইন্দোনেশিয়ায় মুসলমানেরাই সংখ্যা-প্রধান কিন্তু ইসলামি শাসন নেই। এভাবে অসংখ্য দেশের নাম করা যায় যেখানে ইসলামি শাসন’ নেই, কিন্তু বহু সৎ ও ধার্মিক মুসলমান রয়েছে। রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে জাগতিক ব্যাপার, ধর্ম তা নয়। রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য রাষ্ট্রের অন্তর্গত সব মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি, সামাজিক অর্থনৈতিক আর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিধান। দেশের রাজনৈতিক দলগুলি এর জন্য রচনা করে বিভিন্ন পরিকল্পনা, কর্মসূচি, খসড়া ইত্যাদি। আর চেষ্টা করে সেসবকে বাস্তবায়িত করতে নিজেরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে। এর অনেক কিছুই ধর্মীয় বিধি-বিধানের বাইরে। যেসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল এসব বিষয়ে কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা অতীতে যেমন তেমনি বর্তমানেও দেশের সামনে পেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে, এখন সেসব দলই পাকিস্তানের রাজনীতির ক্ষেত্রে ইসলাম’ আর ইসলামি শাসনের ধুয়া তুলেছে। আমার মতে, ইসলামি শাসন যদি প্রবর্তন করতে হয় তা সর্বাগ্রে করা উচিত ইসলামের জন্মস্থান মক্কা-মদিনায়। আর সেখান থেকে যদি দাবিটা উত্থাপিত হয় তাহলে তা অতি সহজে প্রচারিত হয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়তে পারবে। কারণ, সেখানে বিনা দাওয়াতে, বিনা দলীয় খরচে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান প্রতি বছর হজ্বের সময় সমবেত হয়ে থাকে। ইসলামি শাসনের আন্দোলনটা যদি সেখানেই দানা বেঁধে ওঠে, তাহলে ইসলামের মতো ইসলামি শাসনের দাবিও সূর্যকিরণের মতো সেখানে থেকেই দিকে দিকে, দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ার একটা অপূর্ব সুযোগ লাভ করবে আর সেটাই হবে অধিকতর কার্যকরী। ইসলাম যেমন বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, তেমনি ‘ইসলামি শাসনও বিচ্ছিন্ন ব্যাপার হতে পারে না। অন্তত মুসলমানপ্রধান দেশগুলিতে একে সার্বিক করে তুলতে হলে এর সূচনা ইসলামের জন্মস্থান থেকে হওয়াই উচিত। কিন্তু আশ্চর্য, আমাদের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলি আজো তেমন কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে শুনি নি। আসলে এদেরও উদ্দেশ্য ইসলামি শাসন’ নয়, ইসলামের নাম করে কোনো রকমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা। কারণ, অন্তত দিলে দিলে তারাও জানেন, ইসলামি শাসন পাকিস্তানে এককভাবে কায়েম হতে পারে না। ইসলামের সূচনা যেখানে সেখান থেকে হওয়াই কি অধিকতর স্বাভাবিক নয়? তাহলে বিভিন্ন দেশের মুসলমানেরা, ইসলামি শাসন জনগণের জীবনে কতখানি সুফলপ্রসূ হয়েছে, তা সহজে দেখতে পেতো এবং নিজেদের দেশেও ‘ইসলামি শাসনে’র সপক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলতে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত বোধ করতো। পাকিস্তান বহু ধর্মাবলম্বীর দেশ। এখানে যথাযথভাবে ধর্মীয় শাসন চালাতে গেলে সঙ্কট অনিবার্য। এমন কি সে সঙ্কটের ফলে দেশের রাজনৈতিক নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হতে পারে। কায়েদে আজমের এ সত্য জানা ছিল, তাই গোড়াতেই তিনি জাতির উদ্দেশ্যে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন : ‘Now I think we should keep that in front of us as our ideal, and you will find that in course of time Hindus would cease to be Hindus and Muslims would cease to be Muslims, not in the religious sense, because that is the personal faith of each individual, but in the political sense as the citizens of the state.’ (পাকিস্তান সংবিধান সভায় কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উদ্বোধনী ভাষণ দ্রষ্টব্য।)
আমাদের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নেতাদের যদি ‘political sense’ বা রাজনৈতিক বোধ থাকতো তাহলে তারা কখনো ধর্মীয় শাসনের এ অসম্ভব দাবি তুলতেন না। ধমীয় শাসন আধুনিক রাষ্ট্রে সম্ভবপর হলে কায়েদে আজম নিজেই তার প্রতি স্বীকৃতি জানাতেন। তার চেয়ে বড় রাজনীতিবিদ আর তার চেয়ে বড় মুসলিম নেতা এদেশে আজও জন্মায় নি। মুসলমান এখন কবরে আর ইসলাম শুধু কেতাবে উক্তিটা কার সঠিক মনে পড়ছে না। খুব সম্ভব আল্লামা ইকবালের। যারই হোক মনে। হয় কথাটা সত্য। খাঁটি মুসলমানরা এখন সব পরলোকে, দেশে তথাকথিত ইসলামি শাসন না থাকা সত্ত্বেও তারা কোরআন-হাদিস মোতাবেক খাঁটি মুসলমানের মতো জীবন যাপন করে এখন শেষ বিচার দিনের অপেক্ষায় আছেন কবরে শায়িত থেকে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে ওইসব লোকদের নিয়ে, যাদের ইসলাম কেতাবেই আবদ্ধ, প্রতিদিনের জীবনের অঙ্গ নয়। এরা কেতাবি ইসলামকে মস্তিষ্ক দিয়ে গ্রহণ আর হৃদয়। দিয়ে উপলব্ধি না করে স্রেফ মুখের বুলি আর স্লোগানের বিষয় করে নিয়েছেন। এরা ইসলামকে ব্যবহার করেন তোতা পাখির মতো। এঁদের জানা উচিত, ইসলাম সব মুসলমানের জন্যই কিন্তু রাজনীতি স্রেফ রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক কর্মী আর রাজনীতি সচেতনদের জন্যই।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ধর্ম আর রাজনীতি কখনো এক সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশতে পারে না, জোর করে মেশাতে গেলে দুয়েরই ক্ষতি অনিবার্য। দুয়ের স্বভাবে রয়েছে দুস্তর ব্যবধান। ধর্ম মিলনমূলক, মিলনধর্মী। রাজনীতি বিরোধমূলক বা বিরোধধর্মী। ধর্ম মানুষকে এক জমাতে মিলতে বলে এবং মেলায়। রাজনীতি তার বিপরীত। ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে রাজনীতিতেও অস্থায়ী সমঝোতা বা যুক্তফ্রন্ট হয় বটে, কিন্তু সেটাকে কিছুতেই সত্যিকার অর্থে মিলন বা ভ্রাতৃত্ব বন্ধন বলা যায় না, যা ধর্মের ক্ষেত্রে সম্ভব। অধিকন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতি সম্পূর্ণ দলভিত্তিক, এ রাজনীতি মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত করে। বিভক্ত করাই এর স্বভাব। এমন কি কর্মসূচি আর লক্ষ্য এক হলেও রাজনীতির ক্ষেত্রে মিলন ঘটে না। এ কারণে দেখা যায়, আমাদের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যেও বিরোধের অন্ত নেই।
এর বড় কারণ, এ সব প্রতিষ্ঠান আর নেতারা ইসলামের নাম ব্যবহার করেন বটে, কিন্তু তাঁদের আসল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা। আগেই বলেছি, রাজনীতি হচ্ছে স্বভাবে বিরোধধর্মী, তাই রাজনীতির ক্ষেত্রে আলেমে আলেমেও মিল হয় না। দুই মসজিদের ইমামে ইমামে, রাজনীতির প্রভাবমুক্ত দুই মাদ্রাসার মোদাররেসে মোদাররেসে অতি সহজে মিল হয়ে থাকে, কিন্তু দুই রাজনৈতিক দলের আলেমে আলেমে মিল হওয়া দূরের কথা, বরং একে অপরের বিরুদ্ধে কুফরির ফতোয়া দিতেও দ্বিধা করে না। ধর্মের ক্ষেত্রে বা ধর্মের নামে রাজনীতি করতে গেলে এ পরিণতি না হয়ে যায় না। রাজনীতির বিরোধধর্মী স্বভাব এভাবে ধর্মীয় নেতাদেরও গ্রাস করে নেয়।
দুধের সঙ্গে পানি বা পানির সঙ্গে দুধ মেশালে যেমন একটা জলো বস্তুই তৈরি হয়, যাতে খাঁটি দুধ বা খাঁটি পানির কোনো স্বাদই থাকে না; তেমনি ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি বা রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম মেশালে সে একই পরিণতি না ঘটে পারে না। তখন ধর্মও যেমন ‘জলো’ হয়ে পড়বে, তেমনি ‘জলো’ হয়ে পড়বে রাজনীতিও। ফলে ধর্ম ও রাজনীতির যে আসল উদ্দেশ্য তা হয়ে যাবে ব্যর্থ। রাজনীতির সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক অচ্ছেদ্য বলে এ রকম অবস্থায় সর্বাগ্রে ধর্মই হয় ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষমতার জোরে বা মোহে তখন রাজনীতিই হয়ে পড়বে সর্বেসর্বা। যেমন খ্রিস্টীয় জগতে হয়েছে। ওখানেও ধর্মের প্রতিভূ চার্চ আর রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বে রাষ্ট্রই হয়েছে জয়ী। কারণ, ক্ষমতার মালিক আর নিয়ন্তা হচ্ছে রাষ্ট্র আর পরিচালনা করে রাজনীতিবিদরা। এ ব্যাপারে আমাদের দেশেও ভিন্নতর পরিণতি হওয়ার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করতে গেলে ধর্মকে আপস করতেই হবে পদে পদে। নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা যায় : আমাদের দেশে এখন যে আইন চালু রয়েছে তা যে কোরান আর সুন্নাহ মোতাবেক রচিত নয় তা সবারই জানা। আর এও অজানা নয় যে, ইসলামে সুদ দেওয়া-নেওয়া শুধু নয়, সুদের হিসেবপত্র লেখাও হারাম। এতদসত্ত্বেও দেখা যায়, আমাদের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির অনেক সদস্য এ আইনের সাহায্যে ব্যবসা করে জীবিকা অর্জন করে থাকেন। অনেকে চাকরি করেন বিভিন্ন ব্যাঙ্কে, যেখানে অহরহ চলছে সুদের লেন-দেন, তবু এসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের এসব সদস্যের পদত্যাগের বা ওইসব পেশা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বলে শোনা যায় নি এ যাবত। দিলেও এমন নির্দেশ কেউ মানবে বলেও মনে হয় না। এ সত্য আমার চেয়েও ওইসব প্রতিষ্ঠানের ‘আমির’ আর ‘নাজিম’রা আরো বেশি করে জানেন। তার চেয়েও তারা বেশি জানেন ওইসব লোক দলত্যাগ করলে বা ওদের বহিষ্কার করা হলে গোটা প্রতিষ্ঠানই হয়ে পড়বে দুর্বল। দুর্বল হয়ে পড়বে রাজনৈতিক অর্থেই। না হয় শরিয়ত বরখেলাপকারীদের বাদ দিয়ে একদম খাঁটি শরিয়তপন্থীদের নিয়ে যদি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয় তাহলে ধর্মের দিক দিয়ে এই প্রতিষ্ঠান খুবই মজবুত হওয়ার কথা। কিন্তু এরা তা করবেন না, কারণ ইসলামের নাম ব্যবহার করলেও খাঁটি ইসলামকে এঁরা যতখানি চান তার চেয়ে অনেক বেশি চান রাজনৈতিক ক্ষমতা। তাই শরিয়তের বরখেলাপ কাজে যারা লিপ্ত তাদেরও নিজেদের প্রতিষ্ঠানের সদস্য করতে ও রাখতে এঁদের ধর্মীয় বিবেকে বাধে না। এভাবে ধর্ম রাজনীতির সঙ্গে আপোস করে চলেছে আর এ আপোস করা হচ্ছে রাজনীতির সপক্ষে আর ধর্মের প্রতিকূলে। তাই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি স্রেফ ভাওতা ছাড়া কিছু না। এ ভাওতার ফলে ধর্মই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। কারণ, এদের হাতে পড়ে দিন দিন ধর্ম হারাচ্ছে তার আসল স্বরূপ। তাই খাঁটি ধার্মিকদের, যারা সত্যি সত্যি ধর্মকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসেন তাদের সাবধান হওয়া উচিত। অন্যদিকে রাজনীতিও রীতিমতো ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। ধর্ম আর রাজনীতির ভূমিকা যে সম্পূর্ণ আলাদা, এ জ্ঞান। জনসাধারণের থাকার কথা নয়। ফলে অতি সহজে এরা ঘোলাটে জলের মাছ হয়ে পড়ে, তখন ভাওতাবাজরাই পেয়ে যায় শিকারের এক অপূর্ব সুযোগ। তাই খাঁটি ধার্মিকের মতো খাঁটি রাজনীতিবিদদেরও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সম্বন্ধে হুঁশিয়ার থাকা উচিত। এদের হাতে ধর্ম যেমন কিছুতেই নির্ভেজাল খাঁটি থাকবে না, তেমনি এঁদের খপ্পরে পড়ে রাজনীতিও সুষ্ঠু আর সুস্থভাবে, আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পথ ধরে পারবে না গড়ে উঠতে। দেশের রাজনীতি সব সময় থেকে যাবে ঘোলাটে। এ অবস্থায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আরো দীর্ঘকাল থেকে যাবে জনগণের নাগালের বাইরে। ধর্ম নিজে গণতান্ত্রিক নয় বলে ধর্মীয় মালমসলা দিয়ে কিছুতেই গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় সৌধ গড়া যেতে পারে না। এও স্মরণীয়, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পাকিস্তানের বাইরের মুসলমানের জন্যও এক বড় রকমের বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারে। মুসলমান শুধু পাকিস্তানে বাস করে না, পৃথিবীর বহু দেশেই মুসলমান ছড়িয়ে আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মুসলমানরা সংখ্যালঘু। ভারতের পঞ্চাশ কোটি লোকের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা নাকি প্রায় পাঁচ কোটির মতো। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র যদি ভালো হয় তাহলে তা যে সব দেশ সব জাতির জন্যই ভালো তা না মেনে উপায় নেই। আমাদের তেমন ‘ভালো’ নজিরটা যদি ভারতও গ্রহণ করে অর্থাৎ তারাও যদি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তাহলে ওখানকার মুসলমানের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? স্বভাবতই ওরাও আমাদের মতো লোকসংখ্যার সংখ্যাপ্রধান অংশের ধর্মের ভিত্তিতেই তাদের রাষ্ট্রকে গড়ে তুলতে চাইবে। আমাদের ধর্ম আর সংস্কৃতি যেমন তৌহিদভিত্তিক, ওদের ধর্ম ও সংস্কৃতি তেমন প্রতিমাভিত্তিক। এ উভয় ধারণার মধ্যে শুধু যে ব্যবধান রয়েছে তা নয়, বরং রয়েছে প্রচণ্ডতম বিরোধ। শিক্ষিত হিন্দু সমাজের আচার-বিচার আর বিশ্বাস এখন যাই হোক না কেন, হিন্দু ধর্ম আর সংস্কৃতির সাথে প্রতিমার যে একটা অচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে তা অস্বীকার করা যায় না। এ সবই ইসলামি ধর্ম-বিশ্বাসের পরিপন্থী। যে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রকে গড়ে তোলা হবে সে ধর্মের বিধি-বিধান, আচার-বিচার, ধ্যান-ধারণা ইত্যাদি নিঃসন্দেহে শিক্ষা-দীক্ষা আর সমাজ-জীবনেও প্রতিফলিত হবে। না হয়ে পারে না। ভারত আর পাকিস্তান নিকটতম প্রতিবেশী। এ অবস্থায় একের প্রভাব অন্যের ওপর পড়বে না, এ ভাবা যায়। বলা বাহুল্য, ধর্মীয় আবেগও কলেরা-বসন্তের চেয়ে কম ছোঁয়াচে নয়। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র যদি এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানেও একদল যে ওইরকম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উঠে পড়ে লাগবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তখন পঁয়তাল্লিশ কোটি মানুষের ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক প্লাবনে পাঁচ কোটির ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের যদি বিলুপ্তির সম্ভাবনা দেখা দেয় তখন মামুলি প্রতিবাদ করার মুখও তো থাকবে না আমাদের। এখানেও অনুরূপভাবে সংখ্যালঘুর সাংস্কৃতিক জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা যে দেখা দেবে না তা নয়। সর্বত্রই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তথা রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধানতম শিকার হবে সংখ্যালঘুরাই। দৈহিক অর্থে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন না হলেও ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব বিপন্ন না হয়ে পারে না। মুসলমানরা যত দেশে সংখ্যাপ্রধান সে তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক দেশে তারা সংখ্যালঘু। তাই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি মুসলমানেরই ক্ষতির কারণ হবে সবচেয়ে বেশি। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও বর্ণভিত্তিক রাজনীতিরই দোসর–এ রাজনীতি মানুষকে মেলায় না, বিভক্ত করে, মানুষকে বন্ধু করে না, বরং বন্ধুকে শত্রু বানায়। পাকিস্তানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি প্রশ্রয় পেলে তা বহু দেশের মুসলমানের জন্যও এক অকারণ বিপদ ডেকে আনবে।
[‘ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিপদ’ প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় সমকালীন চিন্তা গ্রন্থে।]