- বইয়ের নামঃ শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্প
- লেখকের নামঃ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্প
০. ভূমিকা – শহিদুল আলম
ভূমিকা
উর্দু একটি ইন্দো-আর্য ভাষা যার উৎপত্তি গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে–দিল্লির আশপাশে। মোঘল রাজত্বকালেই উর্দুকে একটি পৃথক সাহিত্যিক ভাষা হিসেবে ব্যবহারের প্রয়াস লক্ষ করা গিয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে ১৯৪৭-এর দেশভাগের আগ পর্যন্ত উত্তর ভারতের কতিপয় অঞ্চলে উর্দু আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে হিন্দির পাশাপাশি ব্যবহৃত হত। বিভাগের পর উর্দুভাষী এক বিপুল জনগোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমায়, থেকেও যায় কিছু ভারতে। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত কলিয়ার’স এনসাইক্লোপেডিয়ার তথ্যানুযায়ী সমগ্র পাকিস্তানে উর্দুভাষী জনসংখ্যা প্রায় তিন লাখের মতো। আর ভারতে রয়েছে প্রায় আড়াই লাখের কাছাকাছি। এই সংখ্যা নিশ্চিত এখন বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তানের অন্যান্য প্রধান ভাষাগুলোর মধ্যে রয়েছে পাঞ্জাবি বেলুচি, সিন্ধি, পশতু ইত্যাদি।
তাহলে বলা যায়, বাংলাসাহিত্য বলতে যেমন আমাদের মনে বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার সাহিত্যের মিশ্র একটি চেহারা ভেসে ওঠে, উর্দু সাহিত্যের বেলায়ও ঠিক তাই। অর্থাৎ উর্দু ভাষায় শিল্পজ উল্কর্ষ ঘটেছে উভয় অঞ্চল–পাকিস্তান এবং উত্তর ভারতে। যে কারণে এই ভাষার সাহিত্যে আমরা পাই উভয় দেশের রাষ্ট্রীয় সীমারেখাকে উতরানো। বিচিত্র স্থান-কাল-পাত্রের বিচিত্রতর সমাবেশ।
মোটামুটিভাবে উর্দু সাহিত্যে আধুনিকতার উদ্ভব-পর্ব থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত প্রধান লেখক হিসেবে যারা নিজেদের ভাষা-বৃত্ত ডিঙিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন আমরা তাদেরকেই এই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করেছি। নির্বাচিত গল্পগুলোও সিংহভাগ ক্ষেত্রে যাতে লেখকদের প্রতিনিধিত্বকারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের শ্রেষ্ঠ রচনা হয় সেদিকে সম্ভাব্য সতর্ক দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। ফলত এটিকে উর্দু কথাসাহিত্যের একটি প্রামাণ্য বাংলা অনুবাদ সংকলন বললে অত্যুক্তি হবে না। বিব্রতকর ঠেকলেও এ-কথা সত্যি যে ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে যথার্থ অর্থে উর্দু-গদ্য সাহিত্যে কোনো কাজ হয়নি। এর প্রধান উৎকর্ষ ঘটে বিংশ শতাব্দীর জাতীয়তাবাদ, ইসলামি জাগরণ এবং সমাজতান্ত্রিক চেতনার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে। এই অনুভূতি ও বোধগুলোই এক পর্যায়ে উর্দু সাহিত্যের প্রগতিশীল আন্দোলনে রূপ নেয়। জনৈক উর্দু সাহিত্য সমালোচকের তথ্যানুযায়ী, এই আন্দোলন সোচ্চার হয়ে ওঠে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে অর্থাৎ যে বছর মুন্সী প্রেমচন্দের মৃত্যু হয় সেই থেকে এবং তুঙ্গে ওঠে ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ অবধি। এই সময় পর্যায়ে উর্দু সাহিত্যজগতে অনেক সমৃদ্ধ উপলব্ধির জন্ম হয়। এরপরে আন্দোলনের রূপ আর প্রকৃতির মধ্যে বিরোধ ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমের দরজা দিয়ে আরো কিছু নতুন উপাদান এসে এখানকার লেখকদের আলোড়িত করে।
এই তথ্য থেকে আমরা ধরে নিতে পারি যে, প্রেমচন্দ উর্দু সাহিত্যের বিরানভূমিতে। একা একা যে স্বর্ণোদ্যান রচনা করেছিলেন (বিশেষ করে উর্দু গল্প ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে), উর্দু সাহিত্যের আধুনিক লেখকরা তাকেই ভিত্তিভূমি ধরে নিয়ে সেখান থেকেই। তাদের যাত্রা শুরু করেছেন। এই ব্যাপারটা আরেকটু বিস্তৃত ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
প্রেমচন্দের নামোল্লেখের আগে-পিছে কিছু বিশেষণ যুক্ত করা হয় কেন? উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় উপত্যকায় মানুষের মাতৃভাষা (হিন্দি) উর্দু। বিশ শতকের গোড়াতেও এই ভাষার সাহিত্যে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি, গল্প-উপন্যাসের পটভূমিতে যুক্ত হয়নি সমকাল, না-মাটি না-মানুষ কোনো কিছুরই পরিচয় মেলেনি এখানকার সাহিত্যকর্মে। অতীতের অবক্ষয়ী রোমান্টিকতার অলীক অন্ধকারে ডুবে ছিল যেন সবাই, জীবনের সবটুকুকে আড়ালে রেখে এই সমাজের সাহিত্যিক ধারা যেন জীর্ণতায় ধুকপুক করছিল। প্রেমচন্দের আবির্ভাব এরই মধ্যে। বারাণসীর এক অখ্যাত গাঁয়ের নিম্ন-মধ্যবিত্ত কায়স্থ পরিবারে জন্মে, পঁচিশ টাকা বেতনের কেরানির চাকরি করতে করতে প্রেমচন্দ উর্দু সাহিত্যকে আধুনিক সাহিত্যের উপযোগী করে গড়ে তুললেন। সমকালীন মানুষগুলো, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের আটপৌরে কৃষক উর্দু সাহিত্যে এই প্রথমবারের মতো উঠে এল তাদের ভাবনা-বেদনা, সুখ, ভালোলাগা, মন্দলাগা, দোষ-গুণের সামগ্রিক পরিচয় নিয়ে–জীবনের অনাবিল প্রসন্ন স্রোতধারায় উর্দু সাহিত্যের নবজন্ম ঘটল। কথাটি হিন্দি সাহিত্যের বেলাতেও। প্রযোজ্য; কেননা এই পথিকৃৎ লেখক দুটো ভাষাতেই অবিরল লিখে গেছেন। তাই প্রেমচন্দ আধুনিক উর্দু (সঙ্গে সঙ্গে হিন্দি) সাহিত্যের ‘পিতৃস্থানীয়’। এই কাজগুলো তিনি সম্পাদন করেছিলেন ‘কফন’, ‘সদগতি’, ‘পৌষের রাত’-এর মতো বিস্ময়কর গল্প এবং ‘সেবাসদন’, কিংবা ‘গোদান’-এর মতো কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে। প্রবহমান তরল রোমান্টিক সেন্টিমেন্টের বিপরীতে তিনি রূঢ়, বর্ণহীন, কঠোর সামাজিক জীবনের প্রকৃত রূপকে মুখোমুখি দাঁড় করালেন পাঠকের। সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্ত করলেন মানুষের ওপর এক গভীরতম আস্থা : মানুষ মূলত ভালো, মূলত মহৎ, সে দৃঢ়পণ চেষ্টায় নিজেকে সকল সামাজিক পাপ-পঙ্কিলতার গ্লানি থেকে মুক্ত করে সার্থক হয়ে উঠতে পারে…।
এভাবেই তিনি পরবর্তী প্রজন্মের হাতে যে বলিষ্ঠ হাল তুলে দিয়ে গেলেন, সেই হাল ধরেই পালে বাতাস লাগিয়ে নবীন লেখকদের এগিয়ে যেতে আর বাধা রইল না।
প্রগতিশীল আন্দোলন উর্দু সাহিত্যে একঝাক মেধাবী লেখকের জন্ম দিয়েছিল। বয়সের দিক থেকে দু-এক বছর ছোট-বড় হলেও এরা সবাই মোটামুটি সমসাময়িক ছিলেন : কৃষণ চন্দর, রাজেন্দ্র সিংহ বেদী, ইসমত চুগতাই, সাদত হাসান মান্টো, খাজা আহমদ আব্বাস, কুররাতুল আইন হায়দার, কুদরতুল্লা শাহাব, গোলাম আব্বাস প্রমুখ। এদের অন্যতম। আজকের উর্দু কথাসাহিত্যের ভেতরে যে বৈচিত্র্যের বিবিধ আস্বাদ আমরা সাগ্রহে গ্রহণ করি তা এদেরই দান।
এই নবীন গোষ্ঠীর মধ্যে আবার কৃষণ চন্দর-এর নামটি নানা কারণে অধিক উচ্চারিত। তাঁর রচনার নৈপুণ্য, সহজ স্বচ্ছন্দ গতি, চিন্তার স্বচ্ছতা ও ক্ষিপ্রতা, বিষয়মাহাত্ম্য ও বাস্তবতা সহজেই সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করে। ৪৭-এর দেশভাগ, দাঙ্গা, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে লাঞ্ছিত-বঞ্চিতরাই তার লেখার একটি অতি প্রিয় বিষয়। পেশাদার লেখক ছিলেন বলেই যদিও বিস্তর লিখতে হয়েছে তাঁকে, তবু তেলেঙ্গানার পটভূমিতে লেখা কৃষক আন্দোলনের কাহিনী যব ক্ষেত জাগে দেশভাগের পটভূমিকার ‘গাদ্দার’ উপন্যাস, একই বিষয়ে লেখা ছোটগল্প ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’ পাঠকের মনে স্থায়ী দাগ। কেটে যায়। কৃষণ চন্দরের রাজনৈতিক চেতনা এবং ইতিহাসবোধ ছিল অত্যন্ত প্রখর, শানানো। নির্বাচিত অন্য দুটি গল্প ‘জঞ্জালবুড়ো’ এবং ‘জামগাছ’-এ কৃষণ চন্দরের সেই চেতনা ও বোধেরই পরিচয় মেলে।
রাজেন্দ্র সিংহ বেদীকে বলা হয় উর্দু সাহিত্যে মনস্তাত্ত্বিক ধারার প্রবর্তক। তাঁর গল্পের স্বর গাঢ় এবং গম্ভীর। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন, সেখানে বর্ণহীন বাস্তবতার প্রক্ষেপ আর মনস্তত্ত্বের চাপ সব মিলিয়ে যেখানে একটি সাধারণ মানুষ হয়ে ওঠে অচেনা মানুষ, সহজ সম্পর্ক হয়ে ওঠে অজানা সম্পর্ক… সেই জটিল ও অজানা-অচেনা মানুষজন রাজেন্দ্র সিংহ বেদীর প্রিয় বিষয়-আশয়।
উর্দু সাহিত্যে বহুল আলোচিত এবং বিতর্কিত লেখক হিসেবে সাদত হাসান মান্টোর খ্যাতি রয়েছে। হয়তো এই ব্যাপক পরিচিতির পেছনে আছে মান্টোর বিরুদ্ধে সেন্সরশিপের বারংবার মামলা দায়ের-এর ঘটনা। আশ্চর্য এই যে মান্টোর অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ লেখাগুলোই সেন্সরশিপের কোপানলে পড়েছিল। ‘ধোয়া’, ‘খুলে দাও’, ‘ঠাণ্ডা গোশত’, ‘গন্ধ’, এগুলো সবই অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত। এমনিতেও মান্টো সমাজের নিঃস্ব, রিক্ত, পতিতদের নিয়েই কাজ করতেন, অন্ধগলির পতিতাদের চরিত্র প্রকাশ্য আলোয় তুলে ধরতেন–যা কর্তাদের কর্তব্যনিষ্ঠ চোখে প্রায়ই দৃষ্টিকটু ঠেকত। ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে মান্টো মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে মারা যান।
সাদত হাসান মান্টোর নামের সঙ্গে সঙ্গে অবধারিতভাবেই উচ্চারিত হয় আরেকটি নাম–তিনি ইসমত চুগতাই। উর্দু সাহিত্যে দুজনের আগমন প্রায় এক সঙ্গে এবং আবির্ভাবের শুরুতে দুজনেই হুলুস্থুল তুলেছিলেন উর্দু সাহিত্যে। মান্টোর মতো ইসমত চুগতাই-কেও একাধিকবার অশ্লীলতার দায়ে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। দুজনের মামলা চেলেছে প্রায় একই সঙ্গে। ৩০-৪০-এর দশকে দুজনেই একসঙ্গে বোম্বাই সিনেমার গল্প লিখেছেন।
যাই হোক, ইসমত চুগতাই-এর মৌলিক হাত মূলত ছোটগল্পে। তার বিষয়বস্তু প্রত্যক্ষ-বাস্তবতা, লেখার ভঙ্গি নিরুচ্ছাস অথচ সংবেদনশীলতাই তাঁর গল্পকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। উত্তর ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের মেয়েদের অবস্থা এমন ব্যাপক ও স্পর্শকাতরভাবে ফুটিয়ে তুলতে খুব কম লেখকই পেরেছেন। এখানে তাঁর নির্বাচিত ‘দুই হাত’ গল্পটি ছাড়াও গুডডির নানী’ একটি উৎকৃষ্ট লেখা।
খাজা আহমদ আব্বাস (১৪ই জুন, ১৯১৪)-এর জন্ম ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের পানিপথে। ভাষার ব্যবহারে ইনি অত্যন্ত সহজ, সাদামাটা। শতাধিক ছোটগল্প লিখেছেন। ‘ইনকেলাব’ তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। বিশিষ্ট উর্দু লেখিকা কুররাতুল আইন হায়দারকে তিনি বিয়ে করেছিলেন যদিও তা দীর্ঘদিন টেকেনি। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি গল্প লেখার চাইতে চলচ্চিত্রের কাহিনী ও সংলাপ রচনা, চিত্র পরিচালনা ও চিত্র প্রযোজনায় মনোনিবেশ করেন।
উর্দু কথাসাহিত্যে আমরা উপরে আলোচিত লেখকদের সঙ্গে যেভাবে পরিচিত, কুররাতুল আইন হায়দার, কুদরতুল্লা শাহাব কিংবা গোলাম আব্বাস-এর সঙ্গে ঠিক সেভাবে পরিচিত নই। যদিও এই সংকলনভুক্ত তাঁদের গল্পগুলো স্ব-উজ্জ্বলতায় ভাস্বর এবং উর্দু গল্পের ধারাবাহিক আলোচনায় এরা এসে পড়েন অনিবার্যভাবেই।
এখানে একটি কথা উল্লেখ প্রয়োজন যে উর্দু সাহিত্যের এক ব্যাপক অংশ বাংলাদেশের বিভিন্ন লেখক অনুবাদ করেছেন। অথচ এই সংকলনের জন্য নির্বাচনকালে যখন অনুবাদ গ্রন্থগুলোর মুখোমুখি হলাম, আমরা দেখলাম অধিকাংশ অনুবাদকই ন্যূনতম কোনো শৃঙ্খলা মেনে চলেননি। ফলে ঘটনা ঘটেছে এরকম যে, পাঠক একজন উর্দু গল্পকারের অনেক গল্প পড়ছেন ঠিকই কিন্তু তার পাঠ থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে সেরা গল্পগুলো। দ্বিতীয়ত, রূপান্তরিত গল্পগুলোর কিছু কিছু জায়গায় আড়ষ্টতাও ধরা পড়েছে। তবু অনুবাদকদের মিলিত চেষ্টায় উর্দু ভাষার একটা ঐশ্বর্যময় সম্ভার বাংলা ভাষায় অনূদিত ছিল বলেই দুই খণ্ডে উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ গল্প বের করা সম্ভব ছিল। অনুবাদকদের কাছে আমাদের। ঋণ তাই অপরিশোধ্য। ভবিষ্যতে নতুন অনুবাদের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্পকে সম্পন্নতর করে তোলার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
এই গ্রন্থে উর্দু কথাসাহিত্যের সেরা লেখকদের সেরা গল্পগুলোর সন্নিবেশের ফলে পাঠক একটি সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন–আমরা এই আশা রাখি।
শহিদুল আলম
২২/২, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, হাতিরপুল, ঢাকা।
কফন – প্রেমচন্দ
ঝুপড়ির দরজায় বাপ-বেটা দুজনে নিভে যাওয়া আগুনটার সামনে চুপচাপ বসে। ওদিকে ঘরের ভেতরে ছেলের জোয়ান বউ বুধিয়া প্রসববেদনায় আছাড়পাছাড় খাচ্ছে। থেকে-থেকে ওর মুখ দিয়ে এমন কলজে-কাঁপানো আওয়াজ আসছে যে ওরা দুজন বুকে। পাথর চেপে কোনও মতে তা সহ্য করছে। শীতের রাত, প্রকৃতি নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে। সমস্ত গ্রামখানা মিশে গেছে অন্ধকারে।
ঘিসু বলে—’মনে হচ্ছে বাঁচবে না। সারাটা দিন দৌড়ঝাঁপ করেই কাটাল। যা না, গিয়ে একবারটি দেখে আয় না।’
মাধব ক্ষেপে দিয়ে বলে—’মরবেই যদি তো তাড়াতাড়ি মরে না কেন? দেখে করবটা কী?’
‘পরাণে তোর একটুও দরদ নেই রে! সারাটা বছর যার সঙ্গে সুখে-শান্তিতে ঘর করলি, তার সঙ্গেই অমন বেইমানি!’
‘আমি যে ওর ছটফটানি আর হাত-পা ছোঁড়া চোখে দেখতে পারছি না।’
চামার-বাড়ি; সারা গায়ে ওদের বদনাম। ঘিসু একদিন কাজে যায় তো তিনদিন ঘরে বসে থাকে। মাধবটা কাজে এত ফাঁকিবাজ যে আধঘণ্টা কাজ করে তো একঘণ্টা বসে ছিলিম টানে। তাই ওরা কোথাও মজুরি পায় না। ঘরে যদি একমুঠো খাবার থাকে তো ব্যস, ওরা যেন কাজ না-করার শপথ নেয়। দুচারটে উপোস দেবার পর ঘিসু গাছে উঠে কাঠকুটো ভেঙে আনে আর মাধব বাজারে গিয়ে বেচে আসে সেগুলোকে; তারপর যতক্ষণ সে পয়সা হাতে থাকে দু’জনে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। আবার যখন উপোস করার হাল হয়, তখন আবার হয় কাঠকুটো কুড়িয়ে আনে কিংবা জনমজুরির খোঁজে বের হয়। গায়ে কাজের কমতি নেই। চাষাভুষোর গাঁ, খেটে-খাওয়া মানুষের হাজার রকমের কাজ। তবু ওদের দুজনকে লোকে কেবল তখনি ডাকে যখন দুজনের মজুরি দিয়ে একজনের কাজটুকুতেই সন্তুষ্ট হওয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর থাকে না। এ দুজন যদি সাধু-সন্ন্যাসী হত, তবে সন্তোষ এবং ধৈর্যের জন্য কোনো সংযম-নিয়মেরই আবশ্যকতা হত না, কারণ এ-সব ছিল ওদের স্বভাবজাত। ছন্নছাড়া অদ্ভুত জীবন ওদের। ঘরে দুচারখানা মাটির বাসন ছাড়া সম্পত্তি বলতে কিছু নেই। ছেঁড়া কাপড় পরে নিজেদের নগ্নতাকে কোনোমতে ঢেকে জীবন কাটায়। সংসারের সব রকমের ভাবনাচিন্তা থেকে মুক্ত। ঋণে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। গালাগালি খায়, খায় মারধরও, তবুও কোনো দুঃখ নেই। গরিব এত যে, পরিশোধের আশা লেশমাত্র নেই জেনেও সবাই ওদের কিছু না-কিছু ধার দেয়। মটর বা আলুর সময় অন্যের ক্ষেত থেকে মটর কিংবা আলু চুরি করে তুলে নিয়ে এসে সেগুলোকে ভেজে বা পুড়িয়ে খেয়ে নেয়; কিংবা পাঁচদশ গাছা আখ ভেঙে এনে রাতের বেলা বসে-বসে চোষে। ঘিসু এই রকম আকাশবৃত্তিতেই ষাট-ষাটটা বছর কাটিয়ে দিয়েছে; আর মাধবও বাপের বেটা, অনুসরণ করে চলেছে তারই পদাঙ্ক; বরং বলা চলে বাপের নামকে আরও উজ্জ্বল করে চলেছে। এই যে এখন দুজনে আগুনের সামনে বসে আলুগুলো পোড়াচ্ছে তা-ও কারো-না-কারো ক্ষেত থেকে তুলে আনা। ঘিসুর বউটা তো অনেকদিন আগেই দেহরক্ষা করেছে। মাধবের বিয়ে হয়েছে এই গত বছর। মেয়েটি এদের ঘরে এসে পরিবারে একটা শৃঙ্খলা এনেছে। গম পিষেই হোক বা ঘাস তুলেই হোক সেরটাক আটার যোগাড় সে ঠিক করে নিত আর এই বেহায়াদুটোকে পিণ্ডি গেলাত। মেয়েটা ঘরে আসার পর এরা দু’জন আরও আলসে, আরও আরামপ্রিয় হয়ে উঠেছিল; বরং বলা চলে ওদের গুমরও যেন বেড়ে গিয়েছিল। কেউ কাজ করতে ডাকলে ইদানিং বিনাদ্বিধায় দুনো মজুরি হেঁকে বসত। এই মেয়েটিই আজ এদিকে প্রসববেদনায় মরে যাচ্ছে আর এরা দু’জন বোধকরি এই আশায় অপেক্ষা করে আছে যে, ও চোখ বুজলে আরাম করে ঘুমোতে পারবে।
ঘিলু আলু বের করে খোসা ছাড়াতে-ছাড়াতে বলে, ‘গিয়ে দেখ তো কী অবস্থা বেচারির! পেত্নীর নজর লেগেছে, তাছাড়া আর কি? এসব ঝাড়াতে-টাড়াতে তো ওঝা কম করেও একটা টাকা চাইবে!’
মাধবের ভয়, সে ঘরে ঢুকলে ঘিসু আলুগুলোর বেশির ভাগটা-না সাবাড় করে দেয়। বলে—’ওর কাছে যেতে আমার ভয় করছে।’
‘ভয় কিসের রে, আমি তো এখানে রয়েছিই!’
‘তাহলে তুই-ই গিয়ে দেখ না।‘
‘আমার বউ যখন মারা গিয়েছিল, আমি তিনদিন ওর কাছ থেকে নড়িনি। আর তাছাড়া আমাকে দেখলে ও লজ্জা পাবে না? কোনোদিন যার মুখ দেখিনি, আজ তার উদলা গা দেখব! ওর তো এখন গা-গতরের হুঁশ-টুশও নেই। আমাকে দেখে ফেললে ভালো করে হাত-পা-ও হুঁড়তে পারবে না।’
‘আমি ভাবছি যদি বাচ্চাটাচ্চা হয়ে পড়ে তাহলে কী হবে? শুঠ, গুড়, তেল কিছুই তো ঘরে নেই।’
‘সবই এসে যাবে। ভগবান দিক তো! যারা এখন একটা পয়সা দিচ্ছে না, তারাই কালকে যেচে এসে টাকা দেবে। আমার ননটা ছেলে হয়েছে, ঘরে তো কোনোদিন একটা কানাকড়িও ছিল না, তবু ভগবান কোনও-না-কোনও মতে কাজ তো চালিয়ে দিয়েছেন।’
.
যে-সমাজে দিনরাত খেটে-খাওয়া মানুষের হাল ওদের চাইতে বেশি কিছু ভালো নয়, যেখানে চাষিদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে যারা মুনাফা লোটে তারাই চাষিদের চেয়ে অনেক বেশি সংগতিপন্ন, সে-সমাজে এ-ধরনের মনোবৃত্তির সৃষ্টি হওয়া কিছু অবাক হবার মতো কথা নয়। বরং বলব ঘিলু চাষিদের চাইতে ঢের বেশি বুদ্ধিমান, তাই সে নির্বোধ চাষিদের পালে না-ভিড়ে আড্ডাবাজদের কুৎসিত দলে গিয়ে জুটেছিল। তবে হ্যাঁ, ওর মধ্যে এতটা ক্ষমতা ছিল না যে, আড্ডাবাজদের নিয়মকানুন ঠিকঠাক রপ্ত করে। তাই ওর দলভুক্ত অন্য সবাই যেখানে গাঁয়ের মাতব্বর কিংবা মোড়ল হয়ে গেছে, সেখানে সারা গাঁ ওর নিন্দে করে। তবু এ-সান্ত্বনাটুকু ওর আছে যে, ওর হাঁড়ির হাল খারাপ হলেও অন্ততপক্ষে ওকে ওসব চাষিদের মতো হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয় না। ওর সরলতা এবং নিরীহতা থেকে অন্যরা অনুচিত মুনাফা লুটতে পারে না।
দুজনে আলু বের করে-করে গরম-গরম খেয়ে চলে। কাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। তাই আলু ঠাণ্ডা হবার তর সইছে না। ফলে বারকয়েক দুজনেরই জিভ পুড়ে যায়। খোসা ছাড়ালে আলুর ওপরটা খুব বেশি গরম বলে মনে হয় না, কিন্তু দাঁতের নিচে পড়া মাত্রেই ভেতরটাকে, জিভ, গলা আর টাকরাকে পুড়িয়ে দেয়। ওই অঙ্গারটাকে তখন মুখে রাখার চাইতে অনেক বেশি ভালো পেটের ভেতরে পাচার করে দেয়া। সেখানে ওটাকে ঠাণ্ডা। করার মতো যথেষ্ট বস্তু রয়েছে। তাই দুজনে গপাগপ গিলে ফেলছে। যদিও এ করতে গিয়ে চোখে জল এসে পড়ছে ওদের।
খেতে-খেতে জমিদারের বিয়েতে বরযাত্রী যাবার কথা ঘিসুর মনে পড়ে যায়। বছর কুড়ি আগে সেই বরযাত্রী হয়ে গিয়েছিল। সেই ভোজ খেয়ে যে তৃপ্তি সে পেয়েছিল তা তার জীবনে মনে রাখার মতো ঘটনা, আজও সে স্মৃতি তার উজ্জ্বল হয়ে আছে। বলে—’ওই ভোজের কথা ভুলতে পারি না। তারপর সারা জীবনে অমন খাবার আর পেট পুরে খাইনি। মেয়ের বাড়ির লোকেরা সবাইকে পেট ভরে পুরি খাইয়েছিল, সব্বাইকে! ছোট-বড় সবাই পুরি খেয়েছিল, একেবারে খাঁটি ঘিয়ে ভাজা! চাটনি, রায়তা, তিন রকমের শুকনো তরকারি, একটা ঝোল, দই, মিষ্টি। কী বলব, এ-ভোজে সেদিন কী আস্বাদ পেয়েছিলাম! কোনও নিষেধ-মানা ছিল না। যে-জিনিস যত খুশি চেয়ে নাও, যত চাই খাও। সবাই অ্যাত্ত-অ্যাও খেয়েছিল যে, কেউ জল পর্যন্ত খেতে পারেনি। পরিবেশকরা পাতে গরম-গরম, গোল-গোল, সুগন্ধি কচুরি দিয়েই। চলছিল। যত মানা করি আর চাই না, পাতের উপর হাতচাপা দিয়ে রাখি, কিন্তু তবু ওরা দিয়ে যাচ্ছিল তো যাচ্ছিলই। তারপর যখন আঁচিয়ে এলাম, তখন পান-এলাচও পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার তখন পান খাবার হুঁশ কোথায়। দাঁড়িয়ে থাকতেই পারছিলাম না। চটপট গিয়ে আমার। কম্বল পেতে শুয়ে পড়েছিলাম। এত দিলদরিয়া ছিলেন ওঁরা।’
মাধব মনে-মনে জিনিসগুলোর স্বাদ কল্পনা করতে-করতে বলে—’আজকাল কেউ তো আর আমাদের অমন ভোজ খাওয়ায় না।’
‘আজকাল আর খাওয়াবে কে, খাওয়াবেই-বা কী? ওই জমানাটাই ছিল আলাদা। এখন তো সবাই পয়সা বাঁচানোর ধান্দাতেই আছে। বিয়ে-সাদিতে খরচ করে না, ক্রিয়া-করমে খরচ করে না। বলি গরিবগুলানের পয়সা লুটে-লুটে রাখবি কোথায়?’
লুটবার বেলায় ক্ষ্যামা নেই, শুধু খরচের বেলাতেই যত্ত হিসাব।
‘তুমি খানবিশেক পুরি খেয়েছিলে বোধহয়? ‘বিশখানার বেশিই খেয়েছিলাম।’
‘আমি হলে পঞ্চাশখানা সেঁটে ফেলতাম।’
‘খানপঞ্চাশের কম আমিও খাইনি। তাগড়া জোয়ানমদ্দ ছিলাম। তুই তো আমার আদ্দেকও নোস।’
আলু খাওয়া হয়ে গেলে দুজনেই জল খেয়ে ওখানেই আগুনের সামনে কাপড়ের খুঁট গায়ে জড়িয়ে পেটে পা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ে। যেন দুটো বড়-বড় অজগর কুণ্ডলি পাকিয়ে পড়ে আছে।
ওদিকে বুধিয়া সমানে ঝাঁকিয়ে চলেছে।
সকালে ঘরে ঢুকে মাধব দেখে বউটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ওর মুখের উপর মাছি ভন করছে। উপরদিকে চেয়ে রয়েছে পাথরের মতো স্থির নিশ্চল দুটি চোখ। সমস্ত শরীর ধুলোয় মাখামাখি। ওর পেটে বাচ্চাটা মরে গেছে।
মাধব ছুটতে-ছুটতে ঘিসুর কাছে যায়। তারপর দুজনে জোরে-জোরে হাহাকার করতে-করতে বুক চাপড়াতে থাকে। পাড়াপড়শিরা কান্নাকাটি শুনে ছুটতে-ছুটতে আসে এবং চিরাচরিত রীতি অনুসারে এই হতভাগা দু’জনকে সান্ত্বনা দেয়।
কিন্তু বেশি কান্নাকাটির সময় নেই। শবাচ্ছাদনের নতুন কাপড় আর কাঠের ভাবনা ভাবতে হবে। এদিকে ঘরে পয়সা তো যেমন চিলের বাসায় মাংস তেমনি শূন্য।
বাপ-বেটা দুজনে কাঁদতে-কাঁদতে গায়ের জমিদারের কাছে যায়। উনি এই দুজনের মুখই দেখতে পারেন না। বারকয়েক এ দুজনকে নিজের হাতে পিটুনি দিয়েছেন চুরি করেছে বলে কিংবা কথা দিয়ে ঠিকমতো কাজে আসেনি বলে। জিজ্ঞেস করেন—’কী হয়েছে রে ঘিলুয়া, কাঁদছিস কেন? আজকাল তো কোথাও তোর দেখা মেলা ভার। মনে হচ্ছে যেন এ গাঁয়ে থাকার ইচ্ছে নেই তোর।‘
ঘিসু মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে জলভরা চোখে বলে—’কত্তামশায় গো! বড় বিপদে পড়েছি! মাধবের বউটা কাল রাতে মরে গেছে। সারাটা রাত ছটফট করেছে কত্তা! আমরা দুজন ওর শিয়রে বসে ছিলাম। ওষুধবিমুদ যদুর পেরেছি, সব করেছি। তবুও বউটা আমাদের দাগা দিয়ে গেল, কত্তা। একখানা যে রুটি করে খাওয়াবে এমন কেউ আর রইল না। কত্তাবাবু! একেবারে পথে বসেছি। সংসারটা ছারখার হয়ে গেল, হুজুর। হুজুরের গোলাম আমরা। এ-বিপদে হুজুর আপনি ছাড়া কে ওর ঘাটের দায় উদ্ধার করবে? আমাদের হাতে যা কিছু দু-চার পয়সা ছিল, সব ওষুধ আর পথ্যিতে শেষ হয়ে গেছে। হুজুর যদি দয়া করেন তাহলেই ওকে ঘাটে তুলতে পারব। আপনি ছাড়া আর কার দোরে গিয়ে হাত পাতব, হুজুর!’
জমিদারবাবু দয়ালু। তবে ঘিসুকে দয়া করার মানে তো ভস্মে ঘি ঢালা। ইচ্ছে হল বলে দেন–ভাগ, দূর হ সামনে থেকে। এমনিতে তো ডেকে পাঠালেও আসিস না। আজ গুরজ পড়েছে, তাই এসে খোশামোদ করছিস। হারামদাজা, বদমাস কোথাকার! কিন্তু রাগ করার বা সাজা দেয়ার সময় এখন নয়। মনে-মনে গজগজ করতে-করতে দুটো টাকা বের করে ছুঁড়ে দেন। সান্ত্বনার একটি কথাও মুখ দিয়ে বের হয় না। ওদের দিকে ফিরেও তাকান না, যেন কোনোমতে ঘাড় থেকে আপদ দূর করেন।
জমিদারমশাই যখন দু’টাকা দিয়েছেন, তখন গাঁয়ের বেনে মহাজনেরা নিষেধ করে কী করে! ঘিসু জমিদারের নামের ঢাক পেটাতেও খুব ওস্তাদ! ওরা কেউ দেয় দু’আনা, কেউ চার আনা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঘিসুর হাতে টাকাপাঁচেকের মতো পুঁজি যোগাড় হয়ে যায়। এছাড়া কেউ গমটম দেয়, কেউ-বা কাঠ। তারপর দুপুরবেলা ঘিসু আর মাধব বাজার থেকে কফনের জন্য নতুন কাপড় আনতে যায়। এদিকে অন্যরা বাঁশ কাটতে শুরু করে।
গায়ের কোমলমনা মেয়েরা এসে মৃতাকে দেখে, বেচারির অসহায় অবস্থার কথা ভেবে দুফোঁটা চোখের জল ফেলে চলে যায়।
বাজারে এসে ঘিসু বলে–’ওকে জ্বালানোর মতো কাঠ তো যোগাড় হয়ে গেছে, তাই না রে মাধব?’
মাধব বলে—’হ্যাঁ, কাঠ তো অনেক হয়েছে, এখন কফন হলেই হয়।’
‘তাহলে চল সস্তা দেখে একখানা কফন কিনে নিই।‘
‘হ্যাঁ, তাছাড়া আর কী? মড়া তুলতে-তুলতে রাত হয়ে যাবে। রাতের বেলায় কফন অত কে দেখতে যাচ্ছে?’
‘কেমনতর যে বাজে নিয়ম সব, বেঁচে থাকতে গা ঢাকার জন্য একখানা ঘেঁড়া তেনাও
যে পায়নি মরলে তার নতুন কফন চাই।
‘কফনটা তো মড়ার সঙ্গেই পুড়ে যায়।’
‘তা না তো কি থেকে যায় নাকি? এই টাকা পাঁচটা আগে পেলে বউটাকে একটু ওষুধ-পথ্যি খাওয়াতে পারতাম।’
দুজনেই দুজনের মনের কথাটা টের পাচ্ছে। বাজারে এখানে-ওখানে ঘুরছে তো ঘুরছেই। কখনো এ দোকানে, কখনো ও-দোকানে। নানা রকমের কাপড়-রেশমি কাপড়, সুতি কাপড় সব দেখে, কিন্তু কোনোটাই পছন্দ হয় না। এই করতে-করতে সন্ধ্যা নামে। তখন দুজনেই এক দৈবী প্রেরণাবশে একটি পানশালার দরজায় এসে দাঁড়ায়, তারপর প্রায় পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা মতো ভেতরে ঢুকে পড়ে। ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ দুজনে অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর গদির সামনে গিয়ে ঘিসু বলে–’সাহজী, এক বোতল আমাদেরকেও দিন।’
এরপর কিছু চাট আসে, মাছভাজা আসে, আর ওরা দুজনে বারান্দায় বসে নিশ্চিন্ত মনে মদ গিলে চলে।
কয়েক ভাড় তড়বড় করে গেলবার পর দুজনেরই একটু-একটু নেশার আমেজ আসে। ঘিসু বলে–কফন দিলে হতটা কী? শেষঅব্দি পুড়েই তো যেত। বউয়ের সঙ্গে তো আর যেত না।’
মাধব আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন সব দেবতাকে তার নিষ্পাপ কাজের সাক্ষী মেনে বলে—’দুনিয়ার দস্তুরই যে এই, নইলে লোকে বামুনঠাকুরদের হাজার-হাজার টাকাই-বা দেয় কেন? কে দেখছে, পরলোকে কী পাচ্ছে না-পাচ্ছে।’
বড়লোকদের হাতে পয়সা আছে, ইচ্ছে হলে ওড়াক গে। আমাদের কাছে উড়িয়ে দেয়ার মতন আছেটা কী!
কিন্তু ওদের সবাইকে কী বলবি? ওরা জিজ্ঞেস করবে-না কফন কই? ঘিলু হাসে—’আরে ধ্যাৎ, বলব টাকা ট্যাক থেকে কোথায় যে খসে পড়ে গেছে, অনেক খুঁজেছি, পাইনি। ওরা বিশ্বাস করবে না ঠিকই, তবু ওরাই আবার টাকা দেবে।’
মাধবও হেসে ফেলে; এই অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যে বলে–’আহা! বড় ভালো ছিল গো বেচারি! মরেও খুব খাইয়ে গেল।
আধ বোতলের ওপর শেষ হয়ে যায়। ঘিষু দুসের পুরি আনিয়ে নেয়। সঙ্গে চাটনি, আচার, মোটর কারি। গুঁড়িখানার সামনেই দোকান। মাধব ছুটে গিয়ে দুটো ঠোঙায় করে সব জিনিস নিয়ে আসে। পুরো দেড়টি টাকা আরও খরচ হয়ে যায়। হাতে শুধু ক’টা পয়সা বাকি থাকে।
দুজনে এখন খোশমেজাজে বসে পুরি খাচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে যেন বনের বাঘ বনে বসে তার শিকার সাবাড় করছে। না-আছে জবাবদিহি করার ভয়, না-আছে বদনামের ভাবনা। এসব ভাবনাচিন্তাকে ওরা অনেক আগেই জয় করে নিয়েছে।
ঘিসু দার্শনিকের মতো বলে–এই যে আমাদের আত্মা খুশি হচ্ছে, এতে কি বউ আনন্দ পাবে না?
মাধব ভক্তিতে মাথা নুইয়ে সায় দেয়–‘খুব পাবে, আলবৎ পাবে। ভগবান, তুমি অন্তযামী। ওকে সগৃগে নিয়ে যেও। আমরা দুজনে মন খুলে আশীৰ্বাদ করছি। আজ যে খাওয়াটা খেলাম অমনটা সারাজীবনে কোনোদিন কপালে জোটেনি।
খানিক বাদে মাধবের মনে একটা সন্দেহ জাগে। বলে–’আচ্ছা বাবা, আমরাও তো একদিন ওখানে যাব।’
ঘিসু এই সোজা সহজ প্রশ্নটার কোনো জবাব দেয় না। পরলোকের কথা ভেবে এই আনন্দটাকে মাটি করতে চায় না সে।
‘যদি ও ওখানে আমাদের জিগ্যেস করে তোমরা আমাকে কফন দাওনি কেন, তাহলে কী বলবি?’
বলব, তোর মুণ্ডু।’
‘জিগ্যেস তো ঠিকই করবে।’
‘তোকে কে বলেছে যে ও কফন পাবে না? তুই কি আমাকে অমন গাধা ঠাউরেছিস? ষাটটা বছর কি দুনিয়াতে ঘোড়ার ঘাস কেটে আসছি। বউ কফন ঠিকই পাবে আর এর থেকে অনেক ভালো পাবে।’
মাধবের বিশ্বাস হয় না। বলে–’দেবেটা কে? পয়সা তো তুই খেয়ে ফেলেছিস। ও তো আমাকেই জিগ্যেস করবে। ওর সিথেয় সিঁদুর যে আমিই পরিয়েছি।’
ঘিসু গরম হয়ে বলে–’আমি বলছি ও কফন পাবে। তোর পেত্যয় হচ্ছে না কেন?
‘দেবেটা কে বলছিস-না কেন?
ও লোকগুলানই দেবে যারা এবার দিয়েছে। হ্যাঁ, তবে এর পরের টাকাটা আর আমাদের হাতে আসবে না।
যেমন অন্ধকার বেড়ে চলে, আকাশের তারাগুলোর দীপ্তি বাড়ে, মদের দোকানের রঙতামাশাও তেমনি বাড়তে থাকে। কেউ গান গায়, কেউ ডিগবাজি খায়, কেউ-বা তার সাথীর গলা জড়িয়ে ধরে। কেউ তার ইয়ারের মুখে মদের ভাড় তুলে দেয়।
এখানকার পরিবেশে মাদকতা, হাওয়াতে নেশা। কত লোক তো এখানে এসে এক টোক খেয়েই মাতাল হয়ে পড়ে। মদের থেকেও বেশি এখানকার হাওয়া ওদের নেশা ধরায়। জীবনের দুঃখ-কষ্ট ওদের এখানে টেনে আনে। কিছু সময়ের জন্য ওরা ভুলে থাকে ওরা বেঁচে আছে না মরে গেছে। নাকি বেঁচেও নেই, মরেও নেই।
বাপ-বেটা দুজনে এখনো মৌজ করে-করে চুমুক দিয়ে খাচ্ছে। সবার নজর ওদের দুজনের ওপর। কী ভাগ্য দুজনের! পুরো একটা বোতল ওদের মাঝখানে! পেট ভরে খেয়ে মাধব বেঁচে যাওয়া পুরির ঠোঙাটা নিয়ে গিয়ে একটি ভিখারিকে দিয়ে দিল।
ভিখারিটি দাঁড়িয়ে ওদের দিকে ক্ষুধাতুর চোখে তাকাচ্ছিল। দেয়ার গৌরব, আনন্দ আর উল্লাসে মাধব জীবনে এই প্রথম অনুভব করে।
ঘিসু বলে–’নে রে, যা ভালো করে খা আর আশীৰ্বাদ কর। যার দৌলতে খাওয়া ও তো মরে গেছে। তবু তোর আশীৰ্বাদ ওর কাছে পৌঁছবে। মন খুলে পরান খুলে আশীৰ্বাদ কর, বড় কষ্টের রোজগারের পয়সা রে!
মাধব আবার অকাশের দিকে তাকিয়ে বলে–ও ঠিক বৈকুণ্ঠে যাবে গো বাবা, ও বৈকুণ্ঠের রানী হবে।’
ঘিসু উঠে দাঁড়িয়ে যেন উল্লাসের তরঙ্গে সাঁতরাতে-সাঁতরাতে বলে–’হ্যাঁ বাবা, বৈকুণ্ঠেই যাবে বৈকি। কাউকে কষ্ট দেয়নি, দুখখু দেয়নি। মরতে-না-মরতে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সাধটি পুরিয়ে দিয়ে গেছে। ও যদি বৈকুণ্ঠে না-যাবে তো কি ওই ধুমসো-ধুমসো লোকগুলো যাবে যারা গরিবগুলোনরে দুহাতে লুটছে আর নিজেদের পাপ ধুয়ে ফেলতে গঙ্গায় গিয়ে চান করছে, মন্দিরে পুজো দিচ্ছে!’
ভক্তিশ্রদ্ধার এই অনুভূতিটি তাড়াতাড়ি বদলে যায়। অস্থিরতাই নেশার বৈশিষ্ট্য, এর পর দুঃখ আর হতাশা মনে ভর করে।
মাধব বলে–’বাবা, বেচারি কিন্তু জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। মরল, তা-ও কত যন্ত্রণা সয়ে।’
বলে চোখে হাত-চাপা দিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেয়। ভেউ-ভেউ করে কেঁদে ওঠে। ঘিলু বোঝায়–কাঁদছিস কেন বাবা, আনন্দ কর। বউ এই মায়া থেকে ছুটি পেয়ে গেছে। এই জঞ্জাল থেকে রেহাই পেয়েছে। বড় ভাগ্যিমানী ছিল রে, তাই তো এত তাড়াতাড়ি মায়ামমতা কাটিয়ে চলে গেছে।’
তারপর দুজনে উঠে দাঁড়িয়ে গান গাইতে শুরু করে দেয়– ঠগিনী, কেঁয়ো নৈনা ঝমকায়ৈ। ঠগিনী!’ সব মাতাল এদের দুজনকে দেখছে। এরা দুজনে মত্ত হয়ে গান গেয়ে চলে। তারপর দুজনে নাচতে শুরু করে দেয়। লাফ দেয়। ঝাঁপ দেয়। পড়েও যায়। উঠে হেলেদুলে। চলে। কতরকম ভাবভঙ্গি করে। অভিনয় করে। তারপর শেষ পর্যন্ত নেশায় চুরচুর হয়ে ওখানেই টলে পড়ে যায়।
পৌষের রাত – প্রেমচন্দ
এক
হলকু এসে বলে–পেয়াদাটা এসেছে। দাও, যে কটা টাকা রেখেছিলাম, দিয়ে দিই ওকে, আপদ বিদেয় হোক।
মুন্নি ঝাঁট দিচ্ছিল। পেছন ফিরে বলে–তিনটে তো মাত্তর টাকা, দিয়ে দিলে কম্বল কোত্থেকে আসবে শুনি? পৌষ-মাঘ মাসের রাতে ক্ষেতে কী করে কাটাবে? গিয়ে ওকে বলে দাও, ফসল উঠলে চুকিয়ে দেব। এখন নেই।
হলকু কিছুক্ষণ দ্বিধাগ্রস্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। পৌষ মাস মাথার ওপর এসে গেছে। কম্বল ছাড়া রাতে মাচায় কিছুতেই সে শুতে পারবে না। কিন্তু পেয়াদা যে শুনবে না, চোটপাট করবে, গালাগালি দেবে। মরুক গে, শীতে না-হয় মরব, আপদটা তো এখন বিদেয় হবে। এই ভেবে সে তার মোটাসোটা গতরটা নিয়ে (যা তার নামটাকে মিথ্যে প্রমাণিত করেছে।) বউয়ের কাছে গিয়ে খোশামোদ করে বলে–যা, এনে দে, ঝামেলা তো মিটুক। কম্বলের কিছু একটা উপায় করবই।
মুন্নি ওর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে–আর করেছ উপায়! শুনি। তো একটু, কী উপায় করবে? কেউ খয়রাত দেবে নাকি কম্বল? জানি না আর কত বাকি আছে, এ যেন কিছুতেই শোধ হচ্ছে না। বলি, তুমি চাষবাস ছেড়ে দাও না কেন? মরে-মরে কাজ করবে, তারপর যেই ফসল উঠবে অমনি বাকি বকেয়া চুকাবে, ব্যস শেষ। ধার শোধ করতেই যেন আমাদের জন্ম। পেট ভরাতে মজুরি কর। চুলোয় যাক। অমন চাষ-বাস। দেব না আমি টাকা–কিছুতেই দেব না।
হলকু বিষণভাবে বলে–তাহলে গালাগালি খাব?
মুন্নি তড়পে ওঠে–গালাগালি দেবে কেন? এ কি ওর রাজত্ব নাকি?
কথাটা বলে ফেলেই ওর কোঁচকানো ভুরু শিথিল হয়ে পড়ে। হল্কুর ঐ কথাগুলোর রূঢ় সত্যতা যেন একটি হিংস্র পশুর মতো চোখ পাকিয়ে দেখতে থাকে। গিয়ে তাকের উপর থেকে টাকা ক’টা বের করে এনে সে হলকুর হাতে তুলে দেয়। বলে–তুমি এবার চাষাবাদ ছেড়ে দাও। মজুরি করলে তবু শান্তিতে একখানা রুটি খেতে পাব। কারু ধমকানি তো শুনতে হবে না।
হলকু টাকা ক’টা হাতে নিয়ে এমনভাবে বাইরে যায় যেন সে তার কলজেটাকেই ছিঁড়ে দিতে যাচ্ছে। মজুরির রোজগার থেকে একটা-একটা করে পয়সা বাঁচিয়ে সে তিনটে টাকা জমিয়েছিল একটা কম্বল কিনবে বলে। সে টাকা ক’টাও আজ বেরিয়ে যাচ্ছে। এক-একটা পা ফেলছে আর মাথাটা যেন তার দৈন্যের ভারে নুয়ে-নুয়ে পড়ছে।
দুই
পৌষের অন্ধকার রাত। আকাশের তারাগুলোও যেন শীতে থরথর করে কাঁপছে। হলকু ক্ষেতের একপাশে আখের পাতার ছাউনির নিচে বাঁশের মাচার উপর তার পুরনো মোটা সুতির চাদরখানা মুড়ি দিয়ে পড়ে-পড়ে হিহি করে কাঁপছে। মাচার নিচে ওর সঙ্গী কুকুর জবরা মুখখানাকে পেটের মধ্যে খুঁজে শীতে কুঁ-কুঁ করে চলেছে। দুজনের কারোরই চোখে ঘুম নেই।
হাঁটুদুটোকে ঘাড়ের সঙ্গে চাপতে-চাপতে হলকু বলে–কিরে জবরা, শীত করছে? বলেছিলাম না, বাড়িতে খড়ের উপর শুয়ে থাক, তা এখানে কী করতে এসেছিস? ম এবার ঠাণ্ডায়। আমি কী করব? ভেবেছিলি আমি বোধহয় হালুয়া-পুরি খেতে আসছি, তাই ছুটতে-ছুটতে আগে-আগে চলে এসেছিস? এখন কাদ বসে-বসে।
জবরা শুয়ে-শুয়ে লেজ নাড়ে আর তার কুঁ..উঁ…শব্দটাকে দীর্ঘায়িত করে একটা হাই তুলে চুপ করে যায়। তার সারমেয়-বুদ্ধি বোধহয় মনে করে যে ও কুঁ…কুঁ…করছে বলে মনিবের ঘুম আসছে না।
হাত বের করে জবরার ঠাণ্ডা পিঠে হাত বুলোতে-বুলোতে হলকু বলে–কাল থেকে আমার সঙ্গে আর আসিসনে। এলে ঠাণ্ডায় জমে যাবি। এই শালার পশ্চিমা বাতাস কী। জানি কোত্থেকে বরফ বয়ে আনছে। দেখি উঠে আর এক ছিলিম তামাক খেয়ে নিই। কোনোমতে রাতটা তো কাটবে। আট ছিলিম টানা তো শেষ। এই হল গে চাষবাসের মজা। আবার এক-একজন এমন ভাগ্যবানও আছেন যাদের কাছে শীত গেলে ভয়ে পালাবে। মোটা-মোটা সব লেপ, তোষক, কম্বল। সাধ্য কি যে শীত পাত্তা পাবে! বরাতের জোর আর কি! খেটে মরব আমরা, মজা লুটবে অন্যে!
হলকু ওঠে। গর্ত থেকে খানিকটা আগুন বের করে কলকে সাজায়। জবরাও উঠে বসে! তামাক খেতে-খেতে হলকু বলে-খাবি তামাক? শীত আর কমে কই। হ্যাঁ, একটু যা মনটাকেই বুঝ দেওয়া।
জবরা ওর মুখের পানে স্নেহভরা চোখে তাকিয়ে থাকে।
হলকু–আজ একটু শীত সয়ে নে। কাল আমি এখানটায় খড় বিছিয়ে দেব। খড়ের ভেতর ঢুকে শুয়ে থাকিস, তাহলে শীত লাগবে না।
থাবাদুটোকে হলকুর হাঁটুর উপর তুলে দিয়ে হল্কুর মুখের কাছে মুখ নিয়ে যায় জবরা। হল্কুর গালে ওর গরম নিঃশ্বাস লাগে।
তামাক খেয়ে হলকু আবার শুয়ে পড়ে। এবার সংকল্প করে শোয় যে যত যাই হোক না কেন এবার ঘুমাবই। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর বুকের ভেতরে কাঁপুনি শুরু হয়ে। যায়। একবার এ-পাশ ফিরে শোয়, আবার ও-পাশ। কিন্তু শীত যেন পিশাচের মতো ওর বুকে চেপে বসে থাকে।
কিছুতেই আর থাকতে না-পেরে সে জবরাকে আস্তে করে তুলে কোলে টেনে নেয়। জবরার মাথাটাকে আস্তে-আস্তে চাপড়াতে থাকে। কুকুরটার গা থেকে না-জানি কেমন একটা দুর্গন্ধ আসে, তবু হলকু তাকে কোলে জাপটে ধরে এমন আরাম পায় যা সে ইদানীং কয়েকমাস পায়নি। জবরা বোধহয় ভাবে এই বুঝি স্বর্গ। হলকুর নিষ্পাপ মনে কুকুরটির। প্রতি লেশমাত্র ঘৃণাও নেই। সে তার কোনও অভিন্নহৃদয় বন্ধু বা ভাইকেও এমনি আগ্রহের সঙ্গেই আলিঙ্গন করত। আজকের এই দৈন্যদশা তার মনকে মোটেই আহত করেনি।
এই অদ্ভুত মিত্রতা তার হৃদয়ের সমস্ত দ্বারকে উন্মুক্ত করে দিয়ে হৃদয়ের প্রতিটি অণুকণাকে যেন আলোয় উদ্ভাসিত করে তুলেছে।
হঠাৎ জবরা জানোয়ারের পায়ের আওয়াজ পায়। অন্তরঙ্গ এই আত্মীয়তা তার মনে এক নতুন উন্মাদনা জাগিয়ে তোলে, যার কাছে ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপটও তুচ্ছ। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে সে ছাউনির বাইরে এসে ঘেউ-ঘেউ করে ওঠে। হলকু কয়েকবার চু-চু করে ডাকে। তবু সে তার কাছে ফিরে আসে না। ক্ষেতের চারপাশে ছুটে-ছুটে ডাকাডাকি করে চলে। কিছুক্ষণের জন্য এলেও তাড়াতাড়ি আবার ছুটে যায়। কর্তব্যভাবনা যেন ওর মনটাকে আকাক্ষার মতোই উথালপাথাল করে তোলে।
তিন
আরো একটা ঘণ্টা কাটে। রাত যেন শীতকে হাওয়ার ঝাঁপটা দিয়ে-দিয়ে আরো শাণিয়ে তোলে। হলকু উঠে বসে হাঁটুদুটোকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে দু-হাঁটুর মাঝখানে মাথাটা খুঁজে নেয়। তবুও শীত মানে না। মনে হচ্ছে যেন সব রক্ত জমে বরফ হয়ে গেছে। ধমনীতে রক্তের বদলে বরফ বইছে। সে ঝুঁকে আকাশের দিকে তাকায় রাত আর কত বাকি! সপ্তর্ষিমণ্ডল এখনো যে আকাশের অর্ধেকটাও ওঠেনি। উপরে উঠে এলেই তবে গিয়ে ভোর হবে। এখনো প্রহরখানেক রাত রয়েছে।
হলকুর ক্ষেত থেকে একটু দূরে আমবাগান। পাতাঝরা শুরু হয়ে গেছে। বাগানে রাশি-রাশি শুকনো পাতা। হল্কু ভাবে ওদিকে গিয়ে পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বেলে বেশ করে আগুন পোহায়। এত রাতে কেউ পাতা কুড়োতে দেখলে ভাববে ভূত। কে জানে কোনো জানোয়ার-টানোয়ার কোথাও লুকিয়ে বসে আছে কিনা; কিন্তু আর যে বসে থাকা যাচ্ছে না।
পাশের অড়হর ক্ষেতে গিয়ে কয়েকটা গাছ উপড়ে নিয়ে, তা দিয়ে একটা ঝড়র মতো বানিয়ে হাতে খুঁটে জ্বালিয়ে নিয়ে সে বাগানের দিকে যায়। জবরা তাকে দেখে কাছে এসে লেজ নাড়ে।
হলকু বলে, আর যে থাকতে পারছি না রে জবরু! চল, বাগানে পাতা কুড়িয়ে আগুন পোহাই। গা গরম করে নিয়ে এসে শোব। এখনো অনেক রাত। জবরা কু-কুঁ করে সম্মতি জানিয়ে সামনের বাগানের দিকে এগিয়ে যায়।
ঘুটঘুটি অন্ধকার বাগানে। অন্ধকারে দুরন্ত হাওয়া পাতাগুলোকে মাড়িয়ে দিয়ে যায়। গাছ থেকে শিশিরবিন্দু টুপটুপ করে নিচে ঝরে-ঝরে পড়ে।
হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া মেহেদি ফুলের গন্ধ বয়ে আনে।
হলকু বলে–কী মিষ্টি গন্ধ রে জবরু! তুইও নাকে সুগন্ধ পাচ্ছিস তো?
জবরা মাটিতে পড়ে থাকা এক টুকরো হাড় খুঁজে পায়, দাঁত দিয়ে সেটাকে চিবোতে শুরু করে।
মাটিতে আগুনটাকে রেখে হলকু পাতা জড়ো করতে লেগে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে একরাশ পাতা জমে ওঠে। ঠাণ্ডায় ওর হাত দুখানা কাপে। খালি পা দুটো যেন অবশ হয়ে পড়ে। পাতার পাহাড় সে খাড়া করেছে। শীতকে এই আগুনের কুণ্ডে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেবে সে।
খানিক বাদেই আগুন জ্বলে ওঠে। আগুনের শিখা উপরের গাছের পাতাগুলোকে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে যায়। সেই চঞ্চল আলোয় বাগানের বিরাট-বিরাট গাছগুলোকে মনে হয় অথৈ আঁধারকে কারা যেন মাথায় তুলে রেখেছে। অন্ধকারের এই সাগরে এই আলোটা যেন। একখানা নৌকোর মতো হেলতে-দুলতে থাকে।
হলকু আগুনের সামনে বসে ওম পোহায়। একটু পরেই গায়ের চাদর খুলে সে বগলদাবা করে রাখে। পা দুখানা মেলে দেয়, ভাবখানা যেন শীতকে ডেকে বলছে ‘দেখি কর, তোর যা খুশি।’ শীতের অসীম ক্ষমতাকে হারিয়ে দেয়ার বিজয়গর্বকে সে হৃদয়ে চেপে রাখতে পারছে না।
জবরাকে বলে, কী রে, আর শীত লাগছে-না তো?’
জবরা কুঁ-কুঁ করে যেন বলে–এখন কী করে আর শীত লাগবে?
আগে থাকতে কথাটা মনে আসেনি। নইলে কি আর শীতে এত ভুগতাম।
জবরা লেজ নাড়ে।
‘বেশ বাবা, এস তো দেখি এই আগুনটাকে টপকে পার হই। দেখি কে যেতে পারে? পুড়েটুড়ে গেলে বাবা, আমি কিন্তু ওষুধ দেব না।’
অগ্নিকুণ্ডটার দিকে কাতর নয়নে তাকিয়ে দেখে জবরা।
‘মুন্নিকে কাল আবার বলে দিও-না যেন তাহলে ঝগড়া করবে।’ বলে সে লাফ দিয়ে আগুনটার উপর দিয়ে টপকে যায়। পায়ে একটুখানি আঁচ লাগে বটে, তবে তা তেমন কিছু নয়। জবরা আগুনের পাশ দিয়ে ঘুরে ওর কাছে এসে দাঁড়ায়।
হলকু বলে–’উঁহু, এটা ঠিক হচ্ছে না। উপর দিয়ে টপকে এস’, বলে সে আবার লাফ দিয়ে আগুনের এ-পাশে চলে আসে।
চার
পাতা সব পুড়ে ছাই। বাগানে অন্ধকার আবার ছড়িয়ে পড়ে। ছাইয়ের নিচে কিছু-কিছু আগুন। রয়েছে, যা বাতাসের ঝাঁপটা এলে একটুখানি জ্বলে উঠে পরক্ষণেই আবার নিভে যায়।
হলকু আবার চাদর গায়ে জড়িয়ে নিয়ে গরম ছাইয়ের পাশে বসে গুনগুন করে একটা গান ধরে। গা-টা ওর গরম হয়েছে বটে, কিন্তু আস্তে-আস্তে আবার শীত যত বাড়ে ওকে তত আলসেমিতে পেয়ে বসে।
জোরে ঘেউঘেউ করে ক্ষেতের দিকে জবরা ছুটে যায়। হলকুর যেন মনে হয় একপাল জানোয়ার ওর ক্ষেতে এসে ঢুকেছে। বোধহয় নীলগাইয়ের পাল। ওদের দাপাদাপি, ছুটোছুটির আওয়াজও পরিষ্কার হলকুর কানে আসে। ওরা বোধহয় ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলছে। ওদের চিবানোর চড়চড় আওয়াজও শোনা যায়। হলকু মনে মনে বলে–নাহ্ জবরা থাকতে কোনো জানোয়ারের সাধ্যি নেই ক্ষেতে ঢুকবে। ও ছিঁড়েই ফেলবে। এ আমার মনের ভুল। কই, আর তো কিছু শুনতে পাচ্ছি না! আমিও কী যে ভুল শুনি!
জোর হাঁক পাড়ে সেজবরা, জবরা!
জবরা ঘেউ-ঘেউ করে চলে। হল্কুর ডাক শুনে কাছে আসে না।
আবার ক্ষেতের ফসল খাওয়ার আওয়াজ শোনা যায়। এবারে নিজের মনকে সে আর ধোকা দিতে পারে না। কিন্তু জায়গা ছেড়ে ওঠা যেন বিষের মতো লাগে। বেশ জুত করে গরম হয়ে বসেছিল। এই কনকনে শীতে ক্ষেতে যাওয়া, জানোয়ারগুলোর পেছনে ছুটোছুটি করা অসহ্য মনে হচ্ছে। নিজের জায়গা ছেড়ে সে একটুও নড়ে না।
জোরে হাঁক দিয়ে ওঠে সে-হিলো! হিলো!! হিলো!!!
জবরা আবার ঘেউ-ঘেউ করে ওঠে। জানোয়ারগুলো ক্ষেতটাকে শেষ করে ফেলছে। ফসল পেকে উঠেছে। এবার কী সুন্দর ফসল হয়েছিল! কিন্তু নচ্ছার এই জানোয়ারগুলো যে সব বরবাদ করে ফেলছে।
দৃঢ় সংকল্প করে হলকু উঠে দাঁড়ায়। দু’তিন পা এগিয়েও যায়; কিন্তু আচমকা একটা ঠাণ্ডা, উঁচ বেঁধানো, বিছের হুলের মতো বাতাসের ঝাঁপটা এসে ওর গায়ে লাগতেই ও আবার নিভুনিভু আগুনের কাছটাতে ফিরে এসে বসে পড়ে। ছাইগুলোকে খুঁচিয়ে দিয়ে গরম করতে বসে ঠাণ্ডা গা-টাকে।
ওদিকে গলা ফাটিয়ে ফেলছে জবরা। নীলগাইগুলো ক্ষেতটাকে শেষ করে ফেলছে। এদিকে হলকু গরম ছাইয়ের পাশে শান্ত হয়ে চুপচাপ বসে। অকর্মণ্যতা যেন দড়ির বাঁধনের মতো তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।
ছাইয়ের পাশে গরম মাটির উপর চাদরমুড়ি দিয়ে সে শুয়ে পড়ে।
সকালে ওর ঘুম ভাঙলে দেখে চারদিকে রোদ ঝলমল করছে। মুন্নি ডেকে বলছে– আজ কি তুমি শুয়েই থাকবে গো? এখানে এসে আরাম করে তুমি ঘুমিয়ে রয়েছ আর ওদিকে সারাটা ক্ষেত যে হতচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
হলকু উঠে বলে–তুই কি ক্ষেত হয়ে আসছিস নাকি?
মুন্নি বলে–হ্যাঁ, সারাটা ক্ষেত ছারখার হয়ে গেছে। আরে, এমন করেও কেউ ঘুমোয় গো? তোমার তাহলে এখানে টং বানিয়ে কী লাভটা হল?
হলকু ছুতো দেখায়–মরতে-মরতে যে আমি কোনোমতে বেঁচেছি সেই যথেষ্ট। আর তুই আছিস তোর ক্ষেতের চিন্তা নিয়ে। পেটে আমার সে যে কী যন্ত্রণা, এমন অসহ্য যন্ত্রণা যা কেবল আমিই টের পেয়েছি।
.
দুজনে ক্ষেতের আলে এসে দাঁড়ায়। দেখে, সারাটা ক্ষেত তছনছ হয়ে গেছে, জবরা মাচার নিচে চিত হয়ে শুয়ে, যেন তার ধড়ে প্রাণ নেই।
দুজনেই ক্ষেতের হাল দেখে। মুন্নির মুখে বেদনার ছায়া, হলকু কিন্তু খুশি।
চিন্তিত হয়ে মুন্নি বলে–এবার মজুরি করে জমির খাজনা শুধতে হবে।
খুশিমনে বলে হলকু–রাতে শীতে তো আর এখানে শুতে হবে না।
পেশোয়ার এক্সপ্রেস – কৃষণ চন্দর
যখন পেশোয়ার স্টেশন ছেড়ে আসি তখন আমি তৃপ্তিতে একদলা ধোঁয়া উগরে দিয়েছিলাম। আমার খোপে-খোপে ছিল সব হিন্দু আর শিখ শরণার্থীরা। তারা এসেছিল পেশোয়ার, হাটমর্দন, কোহাট, চরসরা, খাইবার, লাণ্ডি কোটাল, বানু, নওশেরা, মানশেরা সীমান্ত প্রদেশের এইসব জায়গা থেকে। স্টেশনটা খুব সুরক্ষিত এবং সেনাবাহিনীর অফিসারেরাও খুব সজাগ ও দক্ষ। তবে, যতক্ষণ-না সেই রোমান্টিক পঞ্চনদীর দেশের দিকে আমি রওনা দিলাম, তারা অস্বস্তিতেই ভুগছিল। অন্য আর পাঁচজন পাঠানদের থেকে অবশ্য এই শরণার্থীদের তফাত করা যাচ্ছিল না। তাদের চেহারা বেশ লম্বা ও সুদর্শন, শক্ত গড়নের হাত-পা, পরনে কুল্লা ও লুঙ্গি, কারো-বা শালোয়ার; তাদের ভাষা গাঁয়ের পুশতু। প্রত্যেক খোপে দুজন করে বালুচি সেপাই খাড়া পাহারায় ছিল। রাইফেল হাতে ওরা একটু করে হাসি বিলিয়ে যাচ্ছিল হিন্দু-পাঠান ও তাদের বৌ-বাচ্চাদের দিকে, যারা তাদের হাজার-হাজার বছরের বসবাসের ভূমি ছেড়ে পালাচ্ছে। এই পাহাড়ি জমি তাদের শক্তি জুগিয়েছে, তার তুষার-ঝরনা তাদের তৃষ্ণা মিটিয়েছে, এবং এই ভূমির রোদ-ঝলমল বাগান থেকে তোলা মিষ্টি আঙুরের স্বাদে ভরে গেছে তাদের প্রাণ। হঠাৎ একদিন এই দেশ-গা তাদের কাছে অপরিচিত হয়ে গেল; শরণার্থীরা, সম্ভবত অনিচ্ছুকভাবেই পাড়ি দিল গরম ক্রান্তিদেশীয় সমভূমির এক নতুন দেশে। ঈশ্বরের কাছে তারা কৃতজ্ঞ যে তাদের প্রাণ, ধনসম্পত্তি ও মেয়েদের ইজ্জত কোনোরকমে বাঁচিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু রাগে ও দুঃখে হৃদয়ে তাদের রক্তক্ষরণ হচ্ছিল যেন, আর তাদের চোখ যেন সাতপুরুষের ভিটের ঐ গ্রানাইট বুকের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে চলে গিয়ে অভিযোগে প্রশ্ন তুলেছিল : ‘মা, মাগো, নিজের সন্তানদের কেন এভাবে ফিরিয়ে দিলে? কেন তোমার বুকের উষ্ণ আশ্রয় থেকে নিজের মেয়েদের বঞ্চিত করলে? এইসব নিষ্পাপ কুমারীরা, যারা তোমার অঙ্গে আঙুরলতার মতো জড়িয়ে ছিল, কেন হঠাৎ তাদের টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিলে? মা, মাগো, কেন মা?’
উপত্যকার মধ্য দিয়ে আমি দ্রুত ছুটছিলাম, আর আমার গাড়িগুলোর মধ্য থেকে এই ক্যারাভানের দল সতৃষ্ণ বিষণ্ণ চোখ মেলে দেখে নিচ্ছিল বিলীয়মান মালভূমি, ছোট-বড় উপত্যকা ও তিরতির করে বয়ে-যাওয়া আঁকাবাকা ছোটো নদী। ঝাপসা চোখের জলে শেষবারের মতো বিদায় জানাচ্ছে যেন। প্রতিটি কোণা-খাজে যেন ওদের চোখ সেঁটে যাচ্ছে, চলে যাবার সময়ে বুকের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে যাবে যেন; আমারও কেমন মনে হল আমার চাকাগুলো বোধহয় ভারি হয়ে উঠেছে, দুঃখে ও লজ্জায় যেন আটকে যাচ্ছে তারা, আর যেন দুটবার শক্তি নেই আমার, আমি বোধহয় থেমেই পড়ব এবার।
হাসান আবদাল স্টেশনে আরো শরণার্থীরা এল। ওরা শিখ, পাঞ্জা সাহেব থেকে আসছে, সঙ্গে লম্বা কৃপাণ, ভয়ে মুখ ওদের পাশুটে; বড়-বড় ডাগর চোখের বাচ্চাগুলো পর্যন্ত যেন এক নাম-না-জানা ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে। ওরা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার খোপে ঢুকে পড়ল। একজনের ঘর-বাড়ি সব গেছে, আরেকজনকে পালিয়ে আসতে হয়েছে পরনের শালোয়ার-কামিজ মাত্র সম্বল করে; আর একজনের পায়ে কোনো জুতো নেই; ওই কোণার লোকটি এতটাই ভাগ্যবান যে সে তার সবকিছুই নিয়ে আসতে পেরেছে, মায় তার ভাঙা কাঠের তক্তপোশটা পর্যন্ত! যার সবকিছু গেছে সে বসে আছে শান্ত, চুপচাপ, গুম হয়ে, অন্যজন যে কিনা সারাজীবনে একটা পিঠের টুকরোও জোটাতে পারেনি সে-ও তার হারানো লাখ টাকার গল্প বলছে, আর নেড়েদের শাপশাপান্ত করছে। বালুচিসেনারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে মৃদু-মৃদু হাসছে।
তক্ষশিলায় আমাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। আমার গার্ডসাহেব স্টেশনমাস্টারকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘আশপাশের গ্রাম থেকে একদল হিন্দু শরণার্থী আসছে। তাদের জন্য এই ট্রেনটাকে অপেক্ষা করতেই হবে।’ এক ঘণ্টা কেটে গেল। আমার গাড়ির মধ্যেকার লোকজনেরা তাদের পোটলা-পুটলি খুলল এবং পালিয়ে আসার সময়ে যৎসামান্য যে যা আনতে পেরেছিল তাই খেতে আরম্ভ করল। বাচ্চারা হৈ-হল্লা করছিল আর তরুণী মেয়েরা শান্ত গভীর চোখে তাকিয়েছিল জানলার বাইরের দিকে। হঠাৎ দূরে ঢাকের আওয়াজ শোনা গেল। হিন্দু শরণার্থীদের এক জাঠ এদিকেই আসছে। জাঠ আরো কাছে এগিয়ে এল, স্লোগান দিতে দিতে। আরো কিছু সময় কাটল। এবারে দলটা স্টেশনের একেবারে কাছে এসে পড়ল। ঢাকের আওয়াজ আরো জোর হল আর একঝাক গুলিগোলার আওয়াজ এল কানে। তরুণী মেয়েরা ভয়ে জানলা থেকে সরে গেল। এই দলটা ছিল হিন্দু শরণার্থীদের এক জাঠ-প্রতিবেশী মুসলমানদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে যাদের নিয়ে আসা হয়েছে। প্রতিটি মুসলমানের কাঁধের উপরে ঝোলানো রয়েছে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করা এক-একজন কাফেরের মৃতদেহ। এ-রকম মৃতদেহের সংখ্যা দুশো, অত্যন্ত নিরাপদে তাদের স্টেশনে এনে বালুচি রক্ষকদের হাতে দিয়ে দেয়া হল। মুসলমান জনতা চাপ দিল যে, এই মৃত হিন্দু শরণার্থীদের যথোচিত সম্মানের সঙ্গে হিন্দুস্তানের গেট পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। বালুচি সৈন্যরা নিজেদের কাঁধে তুলে নিল তাদের তারপর প্রত্যেক গাড়ির মধ্যিখানে কয়েকটা করে মৃতদেহ রেখে দিল। এরপর মুসলমান জনতা আকাশের দিকে তাক করে গুলির আওয়াজ করল ও স্টেশনমাস্টারকে আদেশ দিল আমাকে প্ল্যাটফর্ম থেকে ছেড়ে দেবার জন্য। আমি সবেমাত্র চলতে শুরু করেছি এমন সময়ে কে একজন চেন টেনে আমাকে থামিয়ে ফেলল। তারপর মুসলমান জনতার দলপতি একটা গাড়ির কাছে এগিয়ে এসে বললেন যে, ঐ দুশোজন শরণার্থী চলে যাওয়ায় তাদের গ্রাম যেহেতু গোল্লায় যাবে, তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রেন থেকে দুশোজন হিন্দু ও শিখ নামিয়ে নিতে হবে; যাই হোক-না কেন, দেশের জনশক্তির ক্ষতিপূরণ করতেই হবে। বালুচি সৈন্যরা দেশপ্রেমের জন্য উচ্চকণ্ঠে তাঁদের জয়গান করল, এবং বিভিন্ন বগি থেকে দুশোজন শরণার্থীকে বেছে নিয়ে জনতার হাতে তুলে দিল।
‘সব কাফেররা সার দিয়ে দাঁড়াও!’ ওদের নেতা হুঙ্কার দিল; ঐ নেতাটি আশপাশের গ্রামের এক শাসালো সামন্তপ্রভু। শরণার্থীরা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল, মরে জমে গেছে যেন। জনতা কোনোমতে ওদের একটা সারি করে দাঁড় করিয়ে দিল। দুশো লোক… দুশো জীবন্ত মৃতদেহ…নগ্ন…ভয়ে মুখগুলো সব নীল….চোখের তারায় বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে রক্তলোলুপ তীর….
বালুচি সৈন্যরাই শুরু করল।
পনের জন শরণার্থী টলমল পায়ে শ্বাস টানতে-টানতে মরে পড়ে গেল।
এই জায়গাটা ছিল তক্ষশিলা।
আরো কুড়িজন পড়ল।
এখানেই ছিল এশিয়ার মহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে হাজার-হাজার বছর ধরে লক্ষ-লক্ষ ছাত্ররা মানুষের সভ্যতা বিষয়ে তাদের প্রথম পাঠ নিয়েছে।
আরো পঞ্চাশজন মুখ থুবড়ে পড়ল মরে।
তক্ষশিলার জাদুঘরে সুন্দর-সুন্দর মূর্তি ছিল, অলংকারের অতুলনীয় কারুকৃতি, দুর্লভ শিল্প ও ভাস্কর্যের নিদর্শন, আমাদের গর্বের সভ্যতার ছোটো-ছোটো উজ্জ্বল সব দীপশিখা।
তবুও আরো পঞ্চাশটি প্রাণ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল।
এ-সবের প্রেক্ষাপটে ছিল সিরকপের রাজপ্রাসাদ, খেলাধুলার জন্য এক বিরাট অ্যাম্ফিথিয়েটার আর তারো পেছনে অনেক মাইল জুড়ে একটা গৌরবান্বিত ও মহান এক নগরীর ধ্বংসাবশেষ।
আরো তিরিশজন মৃত।
এখানে রাজত্ব করতেন কণিক। ওঁর রাজত্বে প্রজাদের ছিল শান্তি, সমৃদ্ধি আর এক সাধারণ ভ্রাতৃত্বের বোধ।
তারা আরো কুড়িজনকে মেরে ফেলল।
এই গ্রামগুলোতেই একদিন বুদ্ধের সেই মহান সংগীতের গুঞ্জন শোনা যেত। ভিক্ষুরা এখানেই ভেবেছিলেন প্রেমের আর সত্যের আর সৌন্দর্যের কথা আর এক নতুন ধাচের জীবনের কথা।
এবং এখন সেই দুশো জনের শেষ কয়েকজন মাত্র তাদের অন্তিম লগ্নের জন্য অপেক্ষা করেছে।
ইসলামের বাঁকা চাঁদ প্রথম এখানকার দিগন্তেই তার আলো দিয়েছিল, সাম্যের, ভ্রাতৃত্বের ও মানবিকতার প্রতীক…
সবাই এখন মৃত। আল্লা-হুঁ-আকবর!
প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে গেল, এবং এত কাণ্ডের পরে যখন আমি আবার রওনা দিলাম আমার মনে হল যে, এমনকি আমার নিচেকার লোহার চাকাগুলো পর্যন্ত যেন পিছলে-পিছলে যাচ্ছে।
মৃত্যু স্পর্শ করেছে আমার সবকটা গাড়িকেই। মৃতদের শোয়ানো হয়েছিল মাঝখানে, আর চারপাশ ঘিরে জীবন্ত মৃতেরা। কোথাও একটা বাচ্চা কেঁদে উঠল; কোনো-এক কোণে কারো মা ফোঁপাতে লাগলেন; এক স্ত্রী তার মৃত স্বামীর দেহ আঁকড়ে ছিল। আমি দৌড় লাগালাম ভয়ে আর ত্রাসে এবং রাওয়ালপিণ্ডি স্টেশনে এসে পৌঁছলাম।
এখানে আমাদের জন্য কোনো শরণার্থী অপেক্ষা করছিল না। কেবল জনাকুড়ি পর্দানশীন মহিলাকে সঙ্গে করে নিয়ে কয়েকজন মুসলমান যুবক আমার একটা গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। যুবকদের সঙ্গে ছিল রাইফেল, তারা সঙ্গে করে অনেক বাক্স গোলাবারুদও এনেছিল। তারা আমাকে ঝিলম ও গুজর খার মাঝখানে থামিয়ে নিজেরা। নামতে লাগল। হঠাৎ সঙ্গের মহিলারা তাদের পর্দা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করতে আরম্ভ করল, ‘আমরা হিন্দু, আমরা শিখ, ওরা জোর করে আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে।’ যুবকেরা হেসে উঠল, ‘হ্যাঁ, ওদের আরামের ঘর থেকে জোর করেই ওদের এনেছি’, যুবকেরা বলল। ওরা তো আমাদের লুঠের ধন। সে রকমই সদ্ব্যবহার করা হবে এদের। কে বাধা দেয় দেখি?
দুজন হিন্দু পাঠান ওদের উদ্ধারের জন্য লাফ দিল। বালুচি সৈন্যরা ঠাণ্ডা মাথায় ওদের শেষ করে দিল। তবু আরো কয়েকজন চেষ্টা করল। তাদেরও কয়েক মিনিটের মধ্যে খতম করা হল। তারপর ঐ তরুণী মেয়েদের টানতে-টানতে কাছে এক বনের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হল, আর আমি কালো ধোঁয়ায় নিজের মুখ আড়াল করলাম এবং দৌড়ে পালিয়ে গেলাম ঐ জায়গা থেকে। মনে হল আমার লোহার ফুসফুস বোধহয় ফেটে যাবে, আর আমার মধ্যেকার লাল গনগনে আগুনের শিখা যেন গিলে ফেলবে এই বিরাট ঘন। অরণ্যকে, যা আমাদের লজ্জার সাক্ষী হয়ে রইল।
আমি লালা মুসার কাছাকাছি আসতে-আসতে মৃতদেহের দুর্গন্ধ এতটাই বাড়তে থাকল যে, বালুচি সৈন্যরা সিদ্ধান্ত নিল, ওগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হবে। ফেলে দেবার পদ্ধতিটাও চটপট বানিয়ে ফেলল তারা। যাদের মুখটা দেখতে ওদের পছন্দ হচ্ছে না এ-রকম একজনকে আদেশ করা হবে একটা মৃতদেহ গাড়ির দরজার কাছে আনতে, আর তারপরে সে দরজার কাছে এলে মৃতদেহসুদ্ধ তাকে ফেলে দেয়া হবে।
লালা মুসা থেকে আমি এলাম ওয়াজিরাবাদে। ওয়াজিরাবাদ হল পাঞ্জাবের এক অতি পরিচিত শহর। সারা ভারতের হিন্দুরা ও মুসলমানেরা যে ছুরি-ছোরা দিয়ে পরস্পরকে হত্যা করে তা এই ওয়াজিরাবাদ থেকেই রপ্তানি করা হয়। ওয়াজিরাবাদ অবশ্য খুব বড় বৈশাখী উৎসবের জন্যও বিখ্যাত। এই বৈশাখীতে হিন্দু-মুসলমানেরা নবান্নের উৎসবে মিলিত হন। তবে, আমি যখন ওয়াজিরাবাদে পৌঁছলাম তখন সেখানে দেখলাম শুধু শবদেহের মেলা। অনেক দূরে, ধোয়ার এক ঘন আস্তরণ শহরের উপরে ছেয়ে ছিল আর স্টেশনের কাছে শোনা যাচ্ছিল কাঁসর ঘন্টার ধ্বনি, উচ্চকিত হাসির রোল আর মত্ত জনতার উদ্দাম করতালি। এ নিশ্চয়ই বৈশাখী উৎসব। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জনতার ভিড় প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে এল, একদল উলঙ্গ স্ত্রীলোককে ঘিরে নাচতে-নাচতে ও গান গাইতে গাইতে। হ্যাঁ, তারা সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তাদের মধ্যে ছিল বৃদ্ধা ও তরুণী, ছিল বাচ্চারা, নগ্নতা নিয়ে যাদের কোনো ভয় নেই। ছিলেন দিদিমা ও নাতনি, ছিলেন মায়েরা ও বোনেরা আর মেয়েরা ও স্ত্রীরা, এবং কুমারীরা; এবং ওঁদের চারপাশ ঘিরে ঐ পুরুষেরা নাচছে ও গাইছে। মেয়েরা সব হিন্দু শিখ আর পুরুষেরা মুসলমান এবং তিন সম্প্রদায় মিলেই যেন এক বিচিত্র বৈশাখী উৎসব পালনের জন্য তারা মিলিত হয়েছে। মেয়েরা সোজা হয়ে হেঁটে চলল। তাদের চুল অবিন্যস্ত, শরীর বেইজ্জতে উলঙ্গ, কিন্তু তবুও তারা সোজা হয়ে সগর্বে হেঁটে চলল যেন হাজার শাড়িতে তাদের শরীর জড়ানো, যেন কালো করুণামেদুর মৃত্যুর ঘন ছায়ায় তাদের আত্মা আবৃত। তাদের চোখে নেই কোনো ঘৃণার প্রকাশ। লক্ষ-লক্ষ সীতার অকলঙ্ক অহংকারে তাদের চোখ জ্বলছে।
তাদের চারপাশ ঘিরে ঐ জনতার ঢেউয়ের চিৎকার ধ্বনি, পাকিস্তান জিন্দাবাদ! ইসলাম জিন্দাবাদ!! কয়েদ-ই-আজম মুহম্মদ আলি জিন্না জিন্দাবাদ!!!
নাচ-গানের এই হল্লা ছাপিয়ে বিচিত্র শোভাযাত্রা এখন সরাসরি গাড়ির মধ্যে জড়ো করা ঐ শরণার্থীদের ঠিক চোখের সামনে। মেয়েরা নিচু হয়ে আঁচলে তাদের মুখ লুকাল আর পুরুষেরা গাড়ির জানালা বন্ধ করতে লাগল।
‘জানালা বন্ধ কর না!’ বালুচিরা গর্জে উঠল। টাটকা হাওয়া ঢুকতে দাও।
কিন্তু ওরা গ্রাহ্য করল না। জানালাগুলো ওরা বন্ধ করে চলল।
সৈন্যরা গুলি চালাল। কয়েকজন শরণার্থী মরে পড়ে গেল; অন্যেরা তাদের জায়গা নিল এবং অল্পক্ষণের মধ্যে আর কোনো জানালাই বন্ধ রইল না।
ঐ উলঙ্গ স্ত্রীলোকদের বলা হল আমার ভেতরে উঠতে আর শরণার্থীদের মধ্যে বসে পড়তে, আর তারপর তারা ইসলাম জিন্দাবাদ’, ও ‘কয়েদ-ই-আজম মুহম্মদ আলি জিন্না জিন্দাবাদ’ চারপাশের এইসব মত্ত ধ্বনির মধ্যে আমাকে সহৃদয় বিদায় জানাল।
রোগা টিংটিঙে একটা ছোট বাচ্চা আস্তে-আস্তে একজন বৃদ্ধা নগ্ন স্ত্রীলোকের দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মা, তুমি কি এইমাত্র স্নান করেছ?
হ্যাঁ, বাবা, আজ আমার দেশের ছেলেরা, আমার নিজের ভাইয়েরা আমাকে স্নান করিয়েছে।’
তাহলে, তোমার জামা-কাপড় কই, মা?’
‘আমার বৈধব্যের রক্তে ওই কাপড়ে দাগ লেগেছিল, বাবা! তাই আমার ভাইয়েরা সে-কাপড় নিয়ে নিয়েছে।’
আমি যখন দৌড়চ্ছি তখন দুই উলঙ্গ তরুণী আমার গাড়ির দরজা দিয়ে লাফ দিল, ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম আমি এবং রাত্রির মধ্যে দৌড়ে পালাতে লাগলাম যতক্ষণ-না লাহোর পৌঁছাই।
লাহোরে আমি এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে থামলাম। আমার ঠিক উল্টোদিকে দু-নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল অমৃতসর থেকে আসা একটা ট্রেন, পূর্ব পাঞ্জাব থেকে মুসলমান শরণার্থীদের বয়ে এনেছে সেটা। কিছুক্ষণের মধ্যে মুসলমান রক্ষীরা আমার গাড়িগুলোর শরণার্থীদের মধ্যে তল্লাশ চালাল। সমস্ত টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি ও অন্যান্য মূল্যবান যা-কিছু ছিল তারা সব নিয়ে গেল। তারপর ওরা চারশ শরণার্থীকে নির্বাচন করল বদলা হত্যার জন্য। ব্যাপারটা দাঁড়াল এই রকম : মুসলমান শরণার্থী বয়ে-আনা ঐ অমৃতসরের ট্রেনটাকে পথে আক্রমণ করা হয়েছিল এবং চারশ মুসলমান খুন ও পঞ্চাশজন স্ত্রীলোক লুট করা হয়েছিল। কাজেই এটাই তো উচিত যে ঠিক চারশ হিন্দু ও শিখ শরণার্থীকে হত্যা করতে হবে এবং পঞ্চাশজন হিন্দু ও শিখ রমণীর ইজ্জত নষ্ট করা হবে, যাতে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের মধ্যে সমতা বজায় থাকে।
মোগলপুরাতে রক্ষী বদল হল। বালুচিরা বদলে গিয়ে তাদের জায়গাতে এল শিখ, রাজপুত ও ডোগরারা। আতারি থেকে সমস্ত আবহাওয়াটা বদলে গেল। হিন্দু ও শিখ শরণার্থীরা মুসলমান শরণার্থীদের এত মৃতদেহ এখন দেখতে পাচ্ছে যে, সন্দেহ নেই, তারা স্বাধীন ভারতের সীমান্তের খুব কাছে এসে গেছে।
অমৃতসর থেকে চারজন ব্রাহ্মণ আমার মধ্যে উঠল। হরিদ্বারে যাচ্ছিল তারা। তাদের মাথা পরিষ্কার করে কামানো, ঠিক মাঝখানে লম্বা শিখা। কপালে তাদের তিলক কাটা, রামনাম ছাপা ধুতি পরে তারা তীর্থে বেরিয়েছে। অমৃতসর থেকে বন্দুক, বর্শা ও কৃপাণ হাতে দলে-দলে হিন্দু শিখেরা পূর্ব পাঞ্জাবে যাওয়া সমস্ত ট্রেনে চড়ে বসল। এরা বেরিয়েছে ‘শিকার’-এর খোঁজে। ঐ ব্রাহ্মণদের দেখে ঐ শিকারিদের একজনের সন্দেহ হল। সে জিজ্ঞেস করল, ব্রাহ্মণ দেব, যাওয়া হচ্ছে কোথায়?
‘হরিদ্বারে।
‘হরিদ্বারে, না পাকিস্তানে?’ সে মশকরার সুরে জিজ্ঞেস করল।
‘আল্লার নামে শপথ করে বলছি, আমরা হরিদ্বারে যাচ্ছি!
ঐ জাঠ হেসে উঠল, আল্লার নামে, বেশ! তাহলে এবার কোতল করে ফেলা যাক। সে তখন চিৎকার করে ডাকল, নাথা সিং, এদিকে এস, বড়ো শিকার মিলেছে! ওরা একজনকে হত্যা করল। অন্য তিনজন ব্রাহ্মণ’ পালাবার চেষ্টা করল, কিন্তু তাদের ধরে ফেলা হল। তোমরা তাহলে হরিদ্বারে যাচ্ছ’, নাথা সিং চিৎকার করে উঠল, এস, হরিদ্বারে যাবার আগে তোমাদের ডাক্তারি পরীক্ষা হবে।’
‘ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ল ওরা ঠিক যা আশা করেছিল তা-ই–সুন্নত।
ডাক্তারি পরীক্ষার পরে হত্যা করা হল তিনজন ব্রাহ্মণকেও।
হঠাৎ এক ঘন অরণ্যের ধারে থামানো হল আমাকে। সেখানে দু-এক মুহূর্তের মধ্যে আমি চিৎকার-ধ্বনি শুনলাম ‘সৎ শ্ৰী আকাল’ ও ‘হর-হর মহাদেও আর দেখতে পেলাম সৈন্যরা ও শিখ এবং হিন্দু শরণার্থীরা আমাকে ছেড়ে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম ওরা পালিয়ে যাচ্ছে মুসলমান দস্যুর ভয়ে। পরে দেখলাম সে আমার ভুল। ওরা দৌড়চ্ছিল–নিজেদের বাঁচাতে নয়,–কয়েকশ গরিব মুসলমান চাষিকে হত্যা করতে, যারা তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে এ জঙ্গলে লুকিয়েছিল। আধ ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সব শেষ। পরম আনন্দে বিজেতারা ফিরে আসছে। একজন জাঠ তার বর্শার ডগায় এক মুসলমান শিশুর শব দোলাতে-দোলাতে গান গাইছিল, ‘আল বৈশাখী, এই বৈশাখী, হো হো!’
জলন্ধরের কাছে পাঠান বসতির একটা গ্রাম ছিল। এখানে আবার আমাকে চেন টেনে থামানো হল, আর সবাই নেমে আবার ধাওয়া করল ঐ গ্রামটার দিকে। পাঠানরা খুব সাহসের সঙ্গে প্রতিরোধ করেছিল বটে, তবে আক্রমণকারীরা অস্ত্রশস্ত্রে ও সংখ্যায় অনেক বেশি জোরালো ছিল। গ্রামের পুরুষেরা সব এই যুদ্ধে প্রাণ দিল। তারপরে এল। স্ত্রীলোকদের পালা। এখানে এই বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে, পিপলু, শীষম ও সারিনগাছের তলায়, কেড়ে নেয়া হল তাদের ইজ্জত। এই হল পাঞ্জাবের সেইসব মাঠ যেখানে চাষিরা–হিন্দু, মুসলমান ও শিখ চাষিরা–একসঙ্গে মিলে সোনার শস্য ফলিয়েছে; যেখানে সরষের সবুজ পাতায় ও হলুদ ফুলে সমস্ত গ্রামাঞ্চল এক স্বপ্নের রাজ্যে পরিণত হত। এইসব পিপলু, শীষম ও সারিনগাছের নিচেই সারাদিনের কঠিন পরিশ্রমের পর স্বামীরা অপেক্ষা করত কখন তাদের প্রিয়তমা স্ত্রীরা লস্যি নিয়ে আসবে। ঐ তো, ঐ মাঠের পার দিয়ে, তারা লম্বা। সার বেঁধে আসছে, হাতের ঘড়ার মধ্যে লস্যি আর বয়ে আনছে মধু, মাখন আর সোনালি গমের চাপাটি। কী সতৃষ্ণ চোখে কিষাণেরা চেয়ে থাকত কিষাণী বধূর দিকে, আর ঐ চোখের চাহনিতে বউরাও কেঁপে-কেঁপে উঠত নরম পাতার মতো। এই তো পাঞ্জাবের বুকের কলজে। এখানেই জন্মেছিল সোনি আর মাহিওয়াল, হীর ও রঞ্জা! আর এখন! পঞ্চাশটা নেকড়ে, পঞ্চাশজন সোনি আর পাঁচশো মাহিওয়াল। এ-পৃথিবী আর-কখনোই আগের মতো হবে না। চেনাব আর কখনো তেমন তিরতির করে বয়ে যাবে না। হীর, রঞ্জা, সোনি, মাহিওয়াল ও মীর্জা সাহেবানের গান আর কখনো এই বুকে ঠিক তেমন করে। গুঞ্জন তুলবে না। লক্ষ-লক্ষ অভিশাপ নেমে আসুক সেইসব নেতাদের মাথায় আর তাদের সাত-সাতে উনপঞ্চাশ পুরুষের মাথায় যারা এই সৌন্দর্য, বীরধর্ম ও মর্যাদাময় ভূখশুকে অসম্মান, প্রতারণা ও হত্যার ছেঁড়াখোঁড়া টুকরোয় দাঁড় করিয়েছে, যারা এর আত্মায় সিফিলিসের বিষ ঢুকিয়েছে আর এর শরীরে ভরে দিয়েছে হত্যা, লুঠতরাজ ও ধর্ষণের জীবাণু। পাঞ্জাব আজ মরে গেছে। এর সংস্কৃতি মরে গেছে। এর ভাষা মরে গেছে। মরে গেছে এর সংগীত। এর সাহসী, সদাচারী, নিষ্পাপ প্রাণ মরে গেছে। আমার যদিও চোখ ও কান কিছুই নেই, তবু আমি এই মৃত্যু দেখতেও পেলাম, শুনতেও পেলাম।
শরণার্থীরা ও সৈন্যরা পাঠান নারী-পুরুষদের মৃতদেহ বহন করে ফিরে এল। আবার কয়েক মাইল আসার পরে একটা খাল পাওয়া গেল, এখানে আমাকে আবার থামানো হল। এই খালে শবদেহগুলোকে জড় করে ফেলা হল, এবং তারপর আমি আবার এগোলাম। যাত্রীরা সকলেই এখন ভীষণ খুশি! রক্ত ও ঘৃণার স্বাদ তারা পেয়েছে, এবং এখন দেশি মদের বোতল খুলে তারা ফুর্তি করতে লাগল।
আবার আমরা থামলাম লুধিয়ানায়। এখানে লুটেরারা শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ল ও মুসলমান মহল্লা ও দোকানগুলোকে আক্রমণ করল। ঘণ্টাদুয়েক বাদে তারা স্টেশনে ফিরে এল। সমস্ত পথ জুড়ে তাদের এই হত্যা ও লুঠ চলতেই থাকল। এবং এতক্ষণে আমার আত্মায় এত ক্ষত জমেছে এবং আমার কাঠের শরীরে রক্তের দাগে এত ময়লা পড়েছে। যে, আমার ভীষণ রকমভাবে স্নানের দরকার, কিন্তু আমি জানি যে, পথের মধ্যে আমাকে সে-সুযোগ দেবে না!
অনেক রাত্রে আমি আম্বালা পৌঁছলাম। এখানে একজন মুসলমান ডেপুটি কমিশনার, তাঁর স্ত্রী ও বাচ্চাদের সেনাবাহিনীর প্রহরায় এনে আমার একটা প্রথম শ্রেণীর গাড়িতে তুলে দেয়া হল। সৈন্যদের ওপর কঠোর আদেশ রইল এই মুসলমান কর্মচারীর জীবন ও সম্পত্তি সুরক্ষিত রাখবার।
রাত্রি দুটোয় আম্বালা ছাড়লাম। মাইলদশেকও বোধহয় আমি আসতে পারিনি এমন সময় কেউ আমার চেন টানল। মুসলমান কর্মচারী যে প্রথম শ্রেণীর গাড়িতে যাচ্ছিলেন তার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। কাজেই তারা জানলার কাঁচ ভাঙল। এখানে তারা ঐ মুসলমান ডেপুটি কমিশনার, তার স্ত্রী ও তিনটি ছোট বাচ্চাকে খুন করল। ডেপুটি কমিশনারের একটি অল্পবয়সী মেয়ে ছিল। সে খুবই সুন্দরী; তাই তারা ওকে বাঁচিয়ে রাখবার সিদ্ধান্ত নিল। ওরা মেয়েটিকে নিল, গয়নাগাটি ও ক্যাশবাক্স নিল, তারপর গাড়ি থেকে নেমে গেল জঙ্গলের দিকে। মেয়েটির হাতে একখানা বই ছিল।
জঙ্গলে গিয়ে ওরা অধিবেশনে বসল। মেয়েটিকে নিয়ে কী করা হবে? ওকে খুন করা হবে, না বাঁচিয়ে রাখা হবে? মেয়েটি বলল, আমাকে খুন করবার দরকার কী? আমাকে তোমাদের ধর্মে বদল করে নাও। আমি তোমাদের একজনকে বিয়ে করব।
তাই তো, ঠিক কথা,’ একজন তরুণ বলল, আমার মনে হয় ওকে আমাদের…’
আর-একজন তরুণ তাকে বাধা দিয়ে মেয়েটির পেটে একটা ছোরা বসিয়ে বলল, ‘আমার মনে হয় ওকে এখানেই খতম করে দেয়া উচিত। চল, ফেরা যাক। এ-সব গোলটেবিল বৈঠক ঢের হয়েছে।’
মেয়েটি মরে গেল, জঙ্গলের শুকনো ঘাসের উপরে আর ওর হাতের বইখানা ওরই রক্তের দাগে নোংরা হল। বইটা ছিল সমাজতন্ত্রের ওপর। হয়তো ও ছিল খুব বুদ্ধিমতী। মেয়ে, হয়তো দেশের ও জাতির সেবায় কাজ করবার এক জ্বলন্ত বাসনা ওর ছিল। হয়তো ভালোবাসার জন্য ওর আত্মা যন্ত্রণায় দীর্ণ ছিল, হয়তো কারো ভালোবাসা পাবার জন্যও, আদরের আলিঙ্গনে মিলিত হবার জন্য, নিজের সন্তানকে চুমো দেবার জন্য। ও তো ছিল মেয়ে, কারো প্রিয়তমা, কারো জননী, সৃষ্টির অজানা রহস্য; আর এখন এই জঙ্গলে ও মরে পড়ে রইল, শেয়ালে ও শকুনে ওর শব খেয়ে যাবে। সমাজতন্ত্র, তত্ত্ব ও প্রয়োগ…জন্তুরা এখন ওসব খেয়ে ফেলছে।
রাত্রির হতাশ অন্ধকারের মধ্যে আমি এগিয়ে চললাম, দেশি মদে মাতাল কিছু লোককে আমার গাড়ির মধ্যে বয়ে নিয়ে; তাদের গলায় চিৎকার, মহাত্মা গান্ধী কি জয়!’
অনেকদিন পরে আমি বোম্বাইতে এসেছি। এখানে ওরা আমাকে পরিষ্কার করেছে, ধুয়েছে এবং শেডের মধ্যে রেখেছে। আমার শরীরে এখন আর কোনো রক্তের দাগ নেই। খুনেদের রক্ত-জল-করা হাসির হুল্লোড় আর নেই। কিন্তু রাত্রে যখন আমি একলা থাকি, ভূতেরা সব জেগে ওঠে, মৃত আত্মারা যেন আবার প্রাণ ফিরে পায়, আহতরা জোরে চিৎকার করে, নারীরা ও শিশুরা ভয়ে ঝাঁকিয়ে ওঠে, আর আমি মনে-মনে কামনা করি ঐ ভয়ানক যাত্রায় আর যেন কেউ আমাকে নিয়ে না-যায়। ঐ ভয়ংকর যাত্রার জন্য আমি এই শেড আর কখনো ছাড়ব না। কিন্তু আমি অবশ্যই এই শেড ছেড়ে যাব দীর্ঘ ও সুন্দর যাত্রায় গাঁ-গঞ্জের মধ্য দিয়ে, যখন পাঞ্জাবের মাঠ আবার সোনার শস্যে ভরে উঠবে, যখন সরষে ফুল দেখে মনে হবে হীর ও রঙা অনন্ত প্রেমের গান গাইছে, যখন চাষিরা, হিন্দু-মুসলমান ও শিখ, সবাই আবার একসঙ্গে চাষ করবে, বীজ বুনবে ও ফসল তুলবে, এবং যখন তাদের হৃদয় আবার কানায়-কানায় ভরে উঠবে প্রেমে ও পূজায় ও নারীর প্রতি সম্মানে।
আমি সামান্য একটা কাঠের ট্রেন, কিন্তু প্রতিশোধ ও ঘৃণার ঐরকম ভারি বোঝা কেউ আমার ঘাড়ে আবার চাপিয়ে দিক এ আর আমি কোনোমতে চাই না! দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে আমাকে দিয়ে খাদ্য বওয়ানো হোক। শিল্পাঞ্চলের জন্য আমাকে দিয়ে কয়লা, লোহা ও তেল বওয়ানো হোক। গ্রামে আমাদের চাষিদের জন্য আমাকে দিয়ে সার ও ট্রাক্টর আনানো হোক। যেখানেই যাই-না কেন, সেখানে যেন আমাকে দিয়ে মৃত্যু ও ধ্বংস আর নিয়ে যাওয়া না-হয়। আমি চাই আমার গাড়ির খোপে-খোপে থাকুক সম্পন্ন চাষি ও শ্রমিকের দল ও তাদের সুখী বউ-বাচ্চারা, খুশিতে ভরপুর, পদ্মফুলের মতো হাসি তাদের মুখে; এইসব বাচ্চারাই তো এক নতুন জীবনের ধারা গড়ে তুলবে–যেখানে মানুষ হিন্দুও হবে না, মুসলমানও হবে না, হবে শুধু সেই আশ্চর্য সত্তা–মানুষ!!
জামগাছ – কৃষণ চন্দর
রাত্রে প্রচণ্ড ঝড় হয়ে গেছে। সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং-এর লনের জামগাছটা উপড়ে পড়েছে সেই ঝড়ে। ভোরে মালি দেখতে পেল গাছটার নিচে একজন মানুষ চাপা পড়ে আছে।
মালি ছুটতে-ছুটতে চাপরাসির কাছে গেল–চাপরাসি ছুটতে-ছুটতে গেল ক্লার্কের কাছে ক্লার্ক ছুটতে-ছুটতে গেল সুপারিনটেনডেন্টের কাছে।
সুপারিনটেনডেন্ট ছুটতে-ছুটতে বাইরে লনে এলেন। দেখলেন ঝড়ে উপড়েপড়া
গাছের নিচে যে মানুষটি চাপা পড়ে আছে তার চারদিকে বেশ ভিড় জমেছে।
একজন ক্লার্ক আক্ষেপ করে বলল, ‘আহা, এই জামগাছে কতই-না ফল ধরত।’ আর-একজন ক্লার্ক তাকে মনে করিয়ে দিল, আর এর জাম কী রসেই-না ভরপুর ছিল।’
তৃতীয় ক্লার্কটি বলল, ফলের মরসুমে আমি ঝোলা ভর্তি করে এই ফল নিয়ে যেতাম। আর আমার বাচ্চারা কত আনন্দেই-না এই জাম খেত।
মালি গাছের নিচে চাপাপড়া মানুষটির দিকে ইশারা করে বলল, ‘আর এই মানুষ?
হ্যাঁ, এই মানুষ…।’ সুপারিনটেনডেন্ট খুব চিন্তায় পড়লেন। একজন চাপরাসি জিজ্ঞেস করল, ‘জানি না এ বেঁচে আছে, না মরে গেছে।’
অন্য একজন চাপরাসি বলল, ‘বোধহয় মারা গেছে, এত বড় গাছ কোমরের উপর পড়লে কি মানুষ বাঁচতে পারে?’
গাছের নিচে চাপা-পড়া মানুষটি বেশ রুক্ষ স্বরেই বলল, না, আমি বেঁচে আছি।’ একজন বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ‘আরে, বেঁচে আছে!
মালি প্রত্যেকের উদ্দেশ্যে বলল, গাছটিকে সরিয়ে মানুষটিকে এর নিচ থেকে তাড়াতাড়ি বের করতে হবে।’
একজন ফাঁকিবাজ হৃষ্টপুষ্ট চাপরাসি ভারিক্কিচালে বলল, মনে হচ্ছে ব্যাপারটা অত সোজা নয়। গাছের গুঁড়িটি বেশ ভারিই হবে।’
মালি জিজ্ঞেস করল, ‘সোজা নয় কেন? সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব যদি হুকুম দেন, তবে আমরা পনের-বিশজন মালি-চাপরাসি আর ক্লার্ক মিলে গাছের নিচে থেকে মানুষটিকে অনায়াসে বের করে আনতে পারি।
বেশ কিছু ক্লার্ক মালিকে সমর্থন করে একসঙ্গে বলে উঠল, ‘হাঁ, হাঁ, মালি ঠিক বলেছে। আমরা তৈরি, হাত লাগাও।’
অনেকে গাছটিকে সরানোর জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল।
সুপারিনটেনডেন্ট হঠাৎ বাধা দিয়ে বললেন, দাঁড়াও, ‘আমি আন্ডার সেক্রেটারির কাছে একবার জিজ্ঞেস করে আসি।’
সুপারিনটেনডেন্ট আন্ডার সেক্রেটারির কাছে গেলেন। আন্ডার সেক্রেটারি গেলেন ডেপুটি সেক্রেটারির কাছে। ডেপুটি সেক্রেটারি গেলেন জয়েন্ট সেক্রেটারির কাছে। জয়েন্ট সেক্রেটারি চিফ সেক্রেটারির কাছে গেলেন। চিফ সেক্রেটারি মিনিস্টারের কাছে। মিনিস্টার চিফ সেক্রেটারিকে কিছু বললেন। চিফ সেক্রেটারি জয়েন্ট সেক্রেটারিকে কিছু বললেন। একইভাবে জয়েন্ট সেক্রেটারি ডেপুটি সেক্রেটারিকে এবং ডেপুটি সেক্রেটারি আন্ডার সেক্রেটারিকে কিছু বললেন। ফাইল চলতে লাগল–এর মধ্যে পার হল অর্ধেক দিন।
দুপুরের লাঞ্চের পর সেই চাপা-পড়া মানুষের চারদিকে আরো ভিড় বেড়ে গেল। নানা মানুষ নানা ধরনের কথা বলতে লাগল। কয়েকজন বিজ্ঞ ক্লার্ক সমস্যার সমাধান বের করে ফেললে নিজেরাই। বিনা হুকুমেই তারা যখন গাছ সরানোর পরিকল্পনা করছে ঠিক তখনই সুপারিনটেনডেন্ট ফাইল নিয়ে ছুটতে-ছুটতে হাজির হলেন। বললেন, আমরা এই গাছ আমাদের খেয়াল-খুশি মতো এখান থেকে সরাতে পারবে না। কারণ আমরা বাণিজ্য দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত, আর এই গাছ কৃষি দপ্তরের এক্তিয়ারে। আমি এই ফাইল আর্জেন্ট মার্ক করে এখনই কৃষি দপ্তরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেখান থেকে উত্তর আসার পর আমরা গাছ সরাব।
দ্বিতীয় দিন কৃষি বিভাগ থেকে উত্তর এল, এই গাছ বাণিজ্য দপ্তরের লনে পড়েছে, সুতরাং এই গাছ সরানোর দায়িত্ব বাণিজ্য দপ্তরের।
উত্তর পড়ে বাণিজ্য দপ্তর যারপরনাই চটে গেল। তারাও সঙ্গে-সঙ্গে দিল কড়া জবাব, এই গাছ সরানো বা না-সরানোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব কৃষি দপ্তরের। বাণিজ্য দপ্তরের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
পরের দিনও ফাইল চলতে আরম্ভ করল। সন্ধ্যার সময় জবাব এল, আমরা এই সমস্যা হার্টিকালচার ডিপার্টমেন্টে পাঠালাম। কারণ এ এক ফলদার গাছের ব্যাপার। এগ্রিকালচারাল ডিপার্টমেন্ট শাকসজি এবং খেত-খামার সম্পর্কিত সমস্যা সমাধান নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। জামগাছ ফল দেয়। সুতরাং এই ধরনের ফলদার গাছের ব্যাপার সম্পূর্ণভাবে হার্টিকালচার ডিপার্টমেন্টেরই অন্তর্গত।
রাত্রে মালি চাপা-পড়া মানুষটিকে ডাল-ভাত খাওয়াল। তার চারদিকে পুলিশের কড়া পাহারা বসেছে, কোনো মানুষ যেন নিজের হাতে কানুন তুলে নিয়ে গাছ সরানোর চেষ্টা না-করে। কিন্তু চাপা-পড়া মানুষটির প্রতি করুণা হয় একজন পুলিশের। সে মালিকে খাওয়ানোর অনুমতি দেয়।
মালি চাপাপড়া মানুষটিকে বলল তোমার ফাইল চলছে, মনে হচ্ছে কালকের মধ্যে একটা ফয়সালা হয়ে যাবে।
চাপাপাড়া মানুষটি মালির কথার কোনো জবাব দেয় না।
মালি গাছটির দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে বলল, ভাগ্যিস গাছটা তোমার কোমরের একদিকে পড়েছে, কোমরের মাঝখানে পড়লে তোমার শিরদাঁড়া ভেঙে যেত।’
চাপাপড়া মানুষটি কিন্তু মালির কথার কোনো জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে না।
মালি আবার বলল, তোমার যদি কোনো ওয়ারিশ থাকে তবে আমাকে তার ঠিকানা। বল, আমি তাকে খবর দেওয়ার চেষ্টা করব।
চাপাপড়া মানুষটি অনেক কষ্টে মালিকে বলল, আমি নিজেই বেওয়ারিশ।
মালি দুঃখ প্রকাশ করে চলে গেল।
তৃতীয় দিন হার্টিকালচার ডিপার্টমেন্ট খুব কড়া এবং ব্যঙ্গপূর্ণ জবাব দিল।
হার্টিকালচার ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি সাহিত্যদরদী বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি সাহিত্যিক ভাষায় লিখলেন, খুব আশ্চর্যের কথা যখন সমগ্র দেশে আমরা বৃক্ষ রোপণ করছি, তখনই আমাদের দেশে এমনকি সরকারি আইন আছে যার বলে বৃক্ষ কাটা যায়! বিশেষ করে এমন এক বৃক্ষ–যা ফল দেয়। আর এই বৃক্ষ হচ্ছে একটি জাম বৃক্ষ, যার ফল সবাই আনন্দের সঙ্গে আস্বাদন করে। আমাদের বিভাগ কোননামতেই এই ধরনের এক ফলদার বৃক্ষকে কাটার অনুমতি দিতে পারে না।
একজন রসিক মানুষ আপসোস করে বলল, এখন তবে কী করা যায়? যদি গাছ কাটা না যায় তবে মানুষটিকেই কেটে বের করা হোক।’ সে সবাইকে তার প্রস্তাব বুঝিয়ে দিল, ‘দেখুন, যদি মানুষটিকে এখান থেকে কাটা যায় তবে অর্ধেক মানুষ এদিকে বেরিয়ে আসবে, অর্ধেক ঐদিকে। আর গাছটিও যেমনকার তেমন থাকবে।’
চাপা-পড়া মানুষটি তার কথার প্রতিবাদ করে উঠল, কিন্তু আমি যে মারা যাব।’ একজন ক্লার্ক বলল, ‘হাঁ, একথাও ঠিক।
মানুষটিকে কাটার জন্য যিনি নিপুণ যুক্তি হাজির করছিলেন, তিনি সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, আপনি জানেন না, আজকাল প্লাস্টিক সার্জারি কত উন্নতি সাধন করেছে। একে যদি দুখণ্ড করে কেটে বের করা যায় তবে প্লাস্টিক সার্জারি করে আবার জোড়া লাগানো যাবে।’
এইবার ফাইল মেডিকেল ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হল। মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্ট এ্যাকশন নিল সঙ্গে-সঙ্গে। যেদিন তাদের ডিপার্টমেন্টে ফাইল পৌঁছল তার পরদিনই তারা ঐ ডিপার্টমেন্টের যোগ্যতম প্লাস্টিক সার্জনের কাছে পাঠিয়ে দিল। সার্জেন খুঁটিয়ে চাপাপড়া মানুষটির স্বাস্থ্য, রক্তচাপ, নাড়ির গতি, হার্ট এবং মাংস পরীক্ষা করে এক রিপোর্ট লিখলেন : হাঁ, প্লাস্টিক অপারেশন হতে পারে এবং অপারেশন সফলও হবে, তবে মানুষটি মারা যাবে।
সুতরাং এই ফয়সালাও আর গ্রহণ করা হল না। রাত্রে মালি চাপাপড়া মানুষটিকে খিচুড়ি খাওয়াতে-খাওয়াতে বলল, তোমার ব্যাপারটি ওপর মহলে গেছে। শুনেছি কালকে সেক্রেটারিয়েটের সমস্ত সেক্রেটারিদের মিটিং হবে। ঐ মিটিং-এ রাখা হবে তোমার কেস। মনে হচ্ছে সব ঠিক হয়ে যাবে।
চাপাপড়া মানুষটি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে বলল,
‘জানি আমাকে হয়তো অস্বীকার করবে না।
কিন্তু তোমার কাছে যখন খবর আসবে
তখন আমি পুড়ে ছাই হয়ে যাব।’
মালি আচমকা তার ঠোঁটে আঙুল রেখে আশ্চর্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি…তুমি কবি?
চাপাপড়া মানুষটি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল।
পরের দিন মালি চাপরাসিকে বলল, চাপরাসি বলল ক্লার্ককে, ক্লার্ক হেডক্লার্ককে, কিছুক্ষণের মধ্যে সারা সেক্রেটারিয়েটে খবর রটে গেল চাপাপড়া মানুষটি একজন কবি। আর দেখতে দেখতে কবিকে দেখার জন্য লোক ভেঙে পড়ল। এই খবর শহরেও পৌঁছে গেল। আর সন্ধ্যার মধ্যে শহরের অলিগলিতে যত কবি আছেন তারা এসে জমা হলেন। সেক্রেটারিয়েটের লন কবি, কবি আর কবিতে ভরে উঠল। চাপাপড়া মানুষটির চারদিকে কবি সম্মেলনের এক সুন্দর পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল। সেক্রেটারিয়েটের কয়েকজন ক্লার্ক এবং আন্ডার সেক্রেটারি–যারা সাহিত্য এবং কবিতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারাও থেমে গেলেন এখানে। কয়েকজন কবি চাপাপড়া মানুষটিকে তাদের কবিতা এবং দোহা শোনাতে শুরু করলেন। আর কয়েকজন ক্লার্ক তাকে তার নিজস্ব কবিতা সম্পর্কে আলোচনা করতে বললেন।
চাপাপড়া মানুষটি যে একজন কবি, এই খবর যখন সেক্রেটারিয়েটের সাব কমিটিতে পৌঁছুল, তখন তারা রায় দিলেন : চাপাপড়া মানুষটি একজন কবি, সুতরাং তার ব্যাপার ফয়সালা করতে হার্টিকালচার বা এগ্রিকালচার দপ্তর পারে না। এ সম্পূর্ণভাবে কালচারাল বিভাগের ব্যাপার। কালচারাল বিভাগকে অনুরোধ করা হল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হতভাগ্য
কবিকে চাপাপড়া ফলদার গাছ থেকে মুক্ত করা হোক।
ফাইল কালচারাল ডিপার্টমেন্টের এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগ ঘুরতে-ঘুরতে সাহিত্য একাডেমির সেক্রেটারির হাতে এল। বেচারা সেক্রেটারি ঠিক ঐ সময়েই গাড়িতে করে সেক্রেটারিয়েট এসে চাপাপড়া মানুষটির ইন্টারভিউ নিতে শুরু করলেন।
–তুমি কবি?
সে জবাব দিল, ‘আজ্ঞে হাঁ।’
–কোন নামে তুমি পরিচিত?
–ওস।
ওস? সেক্রেটারি বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলেন। ‘তুমি সেই ওস–যার পদ্য সংগ্রহ ‘ওসের ফুল’ নামে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে?’
চাপাপড়া মানুষটি রুক্ষ কণ্ঠে বলল, হাঁ।
সেক্রেটারি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমাদের একাডেমির মেম্বার?
–না।
সেক্রেটারি বললেন, আশ্চর্যের কথা। এত বড় কবি–’ওসের ফুলে’র লেখক আমাদের একাডেমির সদস্য নয়! আহা কী ভুল হয়ে গেছে আমার, কত বড় কবি, অথচ কী অন্ধকারের নিচে নাম চাপা পড়ে আছে!
–আজ্ঞে, নাম চাপা পড়ে নেই, আমি স্বয়ং এক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছি। দয়া করে আমাকে এখান থেকে তাড়াতাড়ি মুক্ত করুন।
‘এক্ষুণি করছি’ বলে সেক্রেটারি তখনই নিজের দপ্তরে রিপোর্ট করলেন।
পরের দিন সেক্রেটারি ছুটতে-ছুটতে কবির কাছে এলেন। বললেন, ‘নমস্কার, মিষ্টি খাওয়াও। আমাদের সাহিত্য একাডেমি তোমাকে কেন্দ্রীয় শাখার সদস্য করে নিয়েছে। এই নাও তোমার সদস্যপত্র।’
চাপাপড়া মানুষটি বেশ কঠোরতার সঙ্গে তাকে বলল, আমাকে তো আগে এই গাছের নিচ থেকে বের করুন। খুব ধীরে ধীরে তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বইছিল। তার চোখ দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন খুব কঠিন অসুখ আর দুঃখের মধ্যে পড়েছে।
সেক্রেটারি বললেন, এ ব্যাপারে আমার করার কিছুই নেই। আমি যা করতে পারি তা তা করে দিয়েছি। তুমি যদি মারা যাও তবে তোমার স্ত্রীকে পেনসন দিতে পারি।’
কবি থেমে-থেমে বলল, ‘আমি বেঁচে আছি, আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন।
সরকারের সাহিত্য একাডেমির সেক্রেটারি হাত কচলাতে-কচলাতে বললেন, ‘মুশকিল কী জান, আমার দপ্তর শুধুমাত্র কালচারের সঙ্গে যুক্ত। গাছ কাটাকাটির ব্যাপার তো আর দোয়াতকলমে হয় না–কুড়াল-কাটারির সঙ্গেই এর গভীর সম্পর্ক। আমি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে আর্জেন্ট লিখে দিয়েছি।’
সন্ধ্যার সময় মালি এসে চাপা-পড়া মানুষটিকে বলল, ‘কাল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক এসে গাছে কেটে দেবে, আর তুমিও বেঁচে যাবে!
মালি খুব খুশি। চাপাপড়া মানুষটির শরীরে আর কুলাচ্ছিল না। বাঁচার জন্যে সে যুঝে চলেছিল আপ্রাণ। কাল পর্যন্ত…কাল ভোর পর্যন্ত…যে কোনোভাবেই হোক কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হবে।
পরের দিন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের মানুষজন যখন কুড়াল-কাটারি নিয়ে গাছ কাটতে হাজির হল, তখন বৈদেশিক দপ্তর থেকে খবর এল, গাছ কাটা বন্ধ রাখ। কারণ দশ বছর আগে পিটোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী সেক্রেটারিয়েটের লনে এই গাছ লাগিয়েছিলেন। এখন যদি এই গাছ কাটা হয় তবে পিটোনিয়া সরকার অসন্তুষ্ট হতে পারেন।
একজন ক্লার্ক চিৎকার করে বলল, কিন্তু একজন মানুষের জীবনের প্রশ্ন যে জড়িত।’
আর একজন ক্লার্ক অন্য ক্লার্কটিকে বলল, আরে এ যে দু-দেশের সম্পর্কের প্রশ্ন। তুমি কি জান না পিটোনিয়া সরকার আমাদের দেশকে কীভাবে সহযোগিতা করছে। আমরা কি বন্ধুত্বের জন্য একজন মানুষের জীবন উৎসর্গ করতে পারি না!
–কবির মরে যাওয়া উচিত।
–নিশ্চয়ই।
আন্ডার সেক্রেটারি সুপারিনটেনডেন্টকে বললেন, ‘আজ প্রধানমন্ত্রী সফর শেষ করে ফিরছেন। বিকেল চারটায় বৈদেশিক দপ্তর এই গাছ সম্পর্কিত ফাইল তাঁর কাছে পেশ করবেন। উনি যা বলবেন তাই-ই হবে।’
বিকেল পাঁচটায় সেক্রেটারি স্বয়ং ফাইল নিয়ে হাজির হলেন। এই যে শুনছ। খুশিতে গদগদ তিনি ফাইল দোলাতে-দোলাতে বললেন, এই গাছ কাটার হুকুম দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সমস্ত আন্তর্জাতিক দায়-দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কালই এই গাছ কাটা হবে। আর তুমিও বেঁচে যাবে এই সমস্যা থেকে। আরে শুনছ কি! আজ তোমার ফাইল পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।’
কিন্তু কবির হাত তখন বরফের মতো ঠাণ্ডা। চোখের তারা স্থির। একসার পিঁপড়ে তার মুখের ভিতর ঢুকছিল।
তার জীবনের ফাইলও পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।
তোমার দুঃখ আমাকে দাও – রাজেন্দ্র সিংহ বেদী
মদন যেমন ভেবেছিল বিয়ের রাত ঠিক তেমনটি হয়নি।
চকলি বউদি মদনকে ফুসলিয়ে ঠেলে দিয়েছিল মাঝখানের ঘরে। ইন্দু সামনের শালুতে নিজেকে জড়িয়ে আঁধারেরই অংশ হয়ে বসেছিল। বাইরে চকলি বউদি, দরিয়াবাদী পিসি আর সব মহিলাদের হাসি রাতের শান্ত জলে মিছরির মতো ধীরে-ধীরে গলে যাচ্ছিল। মহিলারা বুঝেছিলেন যে, এত বয়স হওয়া সত্ত্বেও মদন কিচ্ছু জানে না, কারণ যখন তাকে মাঝরাতের ঘুম থেকে জাগানো হল তখন সে হড়বড় করে বলেছিল– ‘আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’
এই মহিলাদের দিন চলে গেছে। বিয়ের পহেলা রাতে তারা তাদের স্বামীদের যে-সব কথা বলেছিল আর শুনেছিল তার প্রতিধ্বনি আজ তাদের স্মৃতিতে নেই। তারা কেবল সংসার করেছে আর এখন নিজের অন্য এক বোনকে সংসারের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ধরিত্রীর এই মেয়েরা এ-কথাই বুঝেছিল যে, পুরুষরা হল মেঘখণ্ড–তাদের প্রতিটি বর্ষণের জন্য মুখ তুলে তাকিয়ে থাকতে হয়। যদি না-বর্ষে তো প্রার্থনা করতে হয়, পূজা দিতে হয়, জাদুমন্ত্র পড়তে হয়। যদিও কালকাজির এই নয়া বসতিতে মদন ঘরের সামনে খোলা উঠানে শুয়েছিল, তবু তারই জন্য অপেক্ষায় ছিল ওরা। এক অশুভ লক্ষণের মতো পড়শি সিবতের মোষটা মদনের খাটের কাছে বাঁধা ছিল। মোষটা বারবার ফু-ফু করে মদনকে শুকছিল আর মদন চেষ্টা করছিল হাত তুলে তাকে দূরে রাখার–এই অবস্থায় ঘুমোনোর সুযোগ কোথায়?
সাগরের তরঙ্গে দোলা আর মেয়েদের রক্তে ঢেউ-ভোলায় পারঙ্গম চাঁদ এক জানালা পথে অন্দরে চলে এসে দেখছিল, দরজার অন্য দিকে দাঁড়িয়ে মদন পরবর্তী পদক্ষেপ কোন দিকে ফেলে। মদনের নিজের ভিতরে মেঘ গর্জন করছিল। বিজলি-বাতির থামে কান পাতলে যেমন তার ভিভরে শনশন্ শব্দ শোনা যায় তেমনি শব্দ তার নিজেই ভিতরে শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর মদন এগিয়ে গিয়ে পালঙ্ক টেনে চাঁদের আলোয় নিয়ে এল যাতে করে নববধূর মুখ দেখা যায়। কিন্তু সে থমকে দাঁড়াল। সে তখনি ভাবল ইন্দু আমার বউ, পরস্ত্রী তো নয়, পরস্ত্রীকে স্পর্শ না-করার শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই সে পেয়ে এসেছে। শালুর মধ্যে সেঁধিয়ে-থাকা নববধূকে দেখতে-দেখতে মদন সিদ্ধান্তে এল যে, এইখানে ইন্দুর মুখ লুকিয়ে আছে। ভাবনামতো পাশে পড়ে থাকা গাটরিটা হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখল, সেখানেই ইন্দুর মুখ। মদন ভেবে ছিল যে, ইন্দু সহজে নিজে থেকে তার মুখ দেখতে দেবে না। কিন্তু ইন্দু এরকম কিছু করেনি। কেননা, কয়েকবছর আগে থেকে সে-ও এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল, অন্যদিকে কোনো কাল্পনিক মোষের শুঁকতে থাকার ফলে তারও ঘুম আসছিল না। চলে-যাওয়া ঘুম আর বন্ধ-করা চোখের বেদনা সমেত আঁধার ছাড়াও সামনে ধড়ফড়-করা কিছু একটা নজরে এল মদনের। চিবুক পর্যন্ত পৌঁছতে-পৌঁছতে মুখ সাধারণত লম্বা হয়ে যায় কিন্তু এখানে। সব কিছুই গোল দেখাচ্ছিল। চাঁদের আলোয় গাল আর ঠোঁটের মাঝে এক ছায়াদার টোল তৈরি হয়েছিল–যেমন সবুজ ক্ষেত আর সুন্দর টিলার মাঝখানে হয়ে থাকে। কপালটি তার ছোট, কিন্তু তার ওপর হঠাৎ গজিয়ে-ওঠা কুঞ্চিত কেশরাশি—
তখন ইন্দু তার মুখ সরিয়ে নিল। যেন সে মুখ দেখার অনুমতি দিয়েছিল তবে এতক্ষণ ধরে নয়। আর লজ্জার তো কোনো সীমা নেই। মদন কিছুটা শক্ত হাতেই হু-হুঁ করতে থাকা নববধূর মুখ ফের ওপরে তুলে মাতালের মতো গদৃগ কণ্ঠে বলল–’ইন্দু!’
ইন্দু কিছুটা ভয় পেয়েছিল। জীবনে এই প্রথমবার কোনো অপরিচিত পুরুষ এইভাবে তার নাম ধরে ডাকল আর সেই অপরিচিত পুরুষের দৈবী অধিকারের দাবিতে রাতের আঁধারে ধীরে-ধীরে একাকী বন্ধুহীন অসহায় নারীর আপন মানুষ হয়ে যাচ্ছিল সে। ইন্দু এই প্রথমবার একনজর ওপর দিকে তাকিয়ে, তারপর চোখ বন্ধ করে কেবল এটুকু বলেছিল– ‘জি।’…তার আপন কণ্ঠস্বর পাতাল থেকে উঠে আসা শব্দের মতো শুনিয়েছিল।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই কাটল। তারপর ধীরে-ধীরে কথাবার্তা হতে লাগল। এখন যে কথা চালানো সম্ভব তাই চলছিল। ইন্দু থামছিলই না। ইন্দুর বাবা, ইন্দুর মা, ইন্দুর ভাই, মদনের ভাই-বোন-বাপ, তার রেলের চাকরি, তার মেজাজ, জামা-কাপড়ের পছন্দ, খাওয়ার অভ্যাস–সব কিছুরই হিসাব নিচ্ছিল সে। মাঝে-মাঝে মদন ইন্দুর কথা থামিয়ে দিয়ে অন্য কিছু বলতে চাইলে ইন্দু এড়িয়ে যাচ্ছিল সীমাহীন অসহায় অবস্থায় মদন তার মায়ের কথা তুলল। মা তার সাত বছর বয়সে তাকে ছেড়ে খুব কষ্ট পেয়ে মারা গেছে। যতদিন পর্যন্ত বেচারি মা বেঁচেছিলেন’, মদন বলল–ততদিন বাবুজির হাতে ওষুধের শিশিই দেখতাম, আমি হাসপাতালের সিঁড়ির উপর আর পাশের ছোট ঘরে পিপড়ার সারির উপর শুয়ে থাকতাম, আর শেষে একদিন–২৮ মার্চের সন্ধেবেলায়…’ বলতে বলতে মদন চুপ করে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ক্রন্দন তার গলা ভরে যাওয়ায় এ-ধারে-ওধারে পৌঁছে গেল। ইন্দু ঘাবড়ে গিয়ে মদনের মাথা টেনে নিল নিজের বুকে। তার ক্রন্দনের মুহূর্ত-অবসরে ইন্দু নিজের এ-ধারে আর ও-ধারে ছড়িয়ে গেল (দূরের মানুষ কাছে হল)। মদন ইন্দুর সম্পর্কে আরো কিছু জানতে চাইলে ইন্দু তার হাত চেপে ধরে বলল–’আমি তো লেখাপড়া জানি না। জীবনে আমি দেখেছি মা আর বাবা, ভাই আর ভাই-বউ, আরো অনেক লোক দেখেছি, এ-কারণে আমি কিছু-কিছু বুঝি! আমি এখন তোমার। নিজের বদলে তোমার কাছে একটা জিনিস চাইছি…’।
কাঁদতে-কাঁদতে কান্নার নেশা ধরে যায়। মদন কিছুটা অধীরতা আর কিছুটা উদারতা মিলিয়ে বলল
কী চাইছ? তুমি যা চাইবে আমি তাই দেব।’
‘পাকা কথা?’ ইন্দু বলল।
মদন কিছুটা ব্যাকুল হয়ে বলল–
হ্যাঁ, হ্যাঁ, যা বলেছি তা পাকা কথা।’
কিন্তু এর মধ্যেই মদনের মনে এক ভাব এল। আমার কারবার আগের থেকেই মন্দা চলছে; যদি ইনু এমন কিছু জিনিস চায় যা আমার সামর্থ্যের বাইরে তা হলে কী হবে? কিন্তু ইন্দু মদনের শক্ত আর প্রসারিত হাত আপন নরম হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে তার গালে আপন গাল রেখে বলল–
‘তোমার দুঃখ আমাকে দিয়ে দাও।
মদন খুব হতাশ হয়ে গেল। সেইসঙ্গে তার ঘাড় থেকে এক বোঝা নেমে গেল বলে অনুভব করল। সে ফের চাঁদের আলোয় ইন্দুর মুখ দেখার চেষ্টা করল কিন্তু কিছু বুঝতে পারল না। মদন ভাবল মা অথবা কোনো সখির কাছে শেখা মুখস্থ প্রবাদ ইন্দু তাকে বলেছে। আর তখনি এক তপ্ত অশ্রুবিন্দু মদনের হাতের কবজির উপর পড়ল। সে ইন্দুকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে নিতে বলল–’দিলাম।’ এই-সব কথাবার্তা মদনকে অনেকটা স্বাভাবিক সহজ করে তুলল।
এক-এক করে সব অতিথি বিদায় নিল। চকলি বউদি দুই বাচ্চাকে দু হাত ধরে সিঁড়ির উঁচু-নিচু ধাপে নিজেকে সামলে চলে গেল। দরিয়াবাদী পিসি তার ন লাখ টাকার হার হারিয়ে গেছে বলে হৈ-চৈ লাগিয়ে দিয়েছিল। হাঙ্গামা করতে-করতে বেহুশ হয়ে গিয়েছিল; সেই হার পাওয়া গেল স্নানের ঘরে। যৌতুক থেকে তার প্রাপ্য তিনখানা শাড়ি নিয়ে পিসি চলে গেল। তারপর গেলেন খুড়োমশায়–জে. পি. হবার খবর মদনের মারফত পেয়ে এমনই কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলেন যে মদনের বদলে তিনি নববধূর মুখচুম্বন করতে যাচ্ছিলেন।
বাড়িতে থাকল কেবল বুড়ো বাপ আর ছোট ভাইবোন। ছোট্ট দুলারি তো সব-সময় বউদির গায়ে লেপটে থাকে। গুলি-মহল্লার কোনো বউ নববধূকে তাকিয়ে দেখে অথবা না-দেখে, যদি দেখে তো কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে, এই সব তার এখতিয়ারের মধ্যে ছিল। শেষ পর্যন্ত এই সবও মিটে গেলে ইন্দু ধীরে-ধীরে পুরনো হতে লাগল। কিন্তু কালকাজির। এই নয়া বসতিতে আজ পর্যন্ত লোক আসতে-যেতে মদনের বাড়ির সামনে থমকে যায় আর কোনো অছিলায় অন্দরে চলে আসে। ইন্দু তাদের দেখামাত্রই ঘোমটা টেনে দিত। কিন্তু ওই সামান্য অন্তরাল থেকেই যেটুকু দেখা যেত তা বিনা-ঘোমটায় দেখা যেতে পারত না।
মদনের কারবার ছিল দুর্গন্ধ বিরোজার। কোনো বড় সরবরাহকারীর দু-তিনটি জঙ্গলে চীড় আর দেবদারু গাছের জঙ্গলে আগুন ধরে যায় আর দাউদাউ করে জ্বলতে-জ্বলতে কালি হয়ে যায়। মহীশূর আর আসাম থেকে আনানো বিরোজার দাম বেশি পড়ে যেত। কিন্তু লোকে বেশি দামে তা কিনতে রাজি নয়। একে তো আমদানি কমে গিয়েছিল তার ওপর মদন তাড়াতাড়ি দোকান আর সংলগ্ন দফতর বন্ধ করে ঘরে চলে আসতঘরে পৌঁছে তার একমাত্র প্রয়াস ছিল যে, সকলে খাওয়া-দাওয়া করে যেন তাড়াতাড়ি আপন-আপন বিছানায় শুয়ে পড়ে। খাবার সময় সে নিজেই থালা তুলে বাপ আর বোনের সামনে রাখত আর তাদের খাওয়া হয়ে গেলে এঁটো বাসন সব গুছিয়ে নিয়ে কলের নিচে রেখে দিত। সবাই ভাবত, বধূ মদনের কানে যে কোনো মন্ত্র পড়ে দেওয়াতেই সে ঘরের কাজেকর্মে খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে। মদন ছিল সকলের চেয়ে বড়। কুন্দন তার ছোট, পাশী সবচেয়ে ছোট। যখন কুন্দন বউদির সঙ্গে একসঙ্গে বসে খাবার জেদ ধরত তখন বাপ ধনীরাম তাকে বকে দিতেন–’তুমি খাও’–বলতেন, বউ পরে খেয়ে নেবে। ধনীরাম রান্নাঘরের এদিক-ওদিক দেখতেন, আর যখন বউ খাওয়া-দাওয়া থেকে ছুটি পেত আর বাসনকোসনের প্রতি মনোযোগ দিত তখন বাবু ধনীরাম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলতেন–রেখে দাও বউমা, বাসনকোসন সকালে ধোয়া যাবে। ইন্দু বলত, না বাবুজি, আমি এখনি ধুয়ে দিচ্ছি।’ বাবু ধনীরাম কম্পিত কণ্ঠস্বরে বলতেন–মদনের মা যদি আজ থাকত বউমা, তা হলে সে কি তোমায় এসব করতে দিত?’ তখন ইন্দু একেবারে হাত গুটিয়ে নিত।
ছোট্ট পাশী বউদিকে দেখে লজ্জা পেত এ-কথা ভেবে যে, নববধূ খুব তাড়াতাড়ি গর্ভবতী হয়েছিল। চকলি বউদি আর দরিয়াবাদী পিসি রেওয়াজমতো পাশীকে ইন্দুর কোলে বসিয়ে দিয়েছিল। তখন থেকে ইন্দু তাকে কেবল দেওর নয়, নিজের ছেলের মতো দেখত। যখনি সে আদর করে পাশীকে দুহাতের মধ্যে নেয়ার চেষ্টা করত তখনি পাশী ঘাবড়ে দিয়ে হাত ছাড়িয়ে দুহাত দূরে দাঁড়িয়ে যেত, দেখত আর হাসত, কাছে আসত না, দূরেও পালাত না। এক আশ্চর্য যোগাযোগে ঠিক এই সময়েই বাবুজি প্রতিবার সেখানে হাজির হাতেন আর পাশীকে ধমক দিয়ে বলতেন,–’আরে যা না…বউদি আদর করে ডাকছে…তুই কি এখনি জোয়ান-মদ্দ হয়ে গেলি?’ … আর দুলারি তো পিছু ছাড়েই না। আমি বউদির কাছেই যোব’–তার এই জিদ বাবুজির মনের মধ্যে কোনো ‘জনার্দন’কে জাগিয়ে দিত। এক রাতে এই ব্যাপারে দুলারির ওপর জোরে চড় পড়ল আর
সে ঘরের আধা-কাঁচা আধা-পাকা নালিতে গিয়ে পড়ল। ইন্দু দৌড়ে গিয়ে ধরল তাকে তার মাথা থেকে উড়ে গেল দোপাট্টা, চুলের ফুল আর পাখি গেল পড়ে। মাথার সিঁদুর, কানের ফুল সব উন্মুক্ত হয়ে পড়ল। ‘বাবুজি!’ ইন্দু শ্বাস রুদ্ধ করে ডাকল। একই সঙ্গে দুলারিকে ধরতে গিয়ে আর মাথার উপরে দোপাট্টা ঢাকতে গিয়ে ঘাম বেরিয়ে গেল। মায়ের মতোই বাচ্চাকে বুকে নিয়ে ইন্দু মাথার দিকে–যেখানে অনেক বালিশ ছিল– সেখানে বিছানা করে তাকে শুইয়ে দিল। খাটের না ছিল প্রান্ত, না ছিল কাঠের বাজু। চোট তো একতরফা গেঁথে-যাওয়া জিনিস নয়। দুলারির শরীরে আহত অংশের উপর ইন্দু এমনভাবে আঙুল বুলিয়েছিল যে তাতে বেদনাও হচ্ছিল আবার তা আরামও দিচ্ছিল। দুলারির গালের ওপর বড় বড় টোল পড়ত। ওই সব টোলের তারিফ করে বলত ইন্দু
‘তোর শাশুড়ি মরুক … গালের ওপর কেমন সুন্দর টোল পড়ে। মুন্নি একেবারে খুকির মতো বলত–বউদি, তোমার গালেও তো টোল পড়ে …’ হ্যাঁ মুন্নি’, বলে ইন্দু দীর্ঘশ্বাস ফেলত।
কোনো কথায় মদনের রাগ হয়েছিল। সে পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিল সবকিছু। বলল– ‘আমি তো বলছি, একদিক থেকে ভালোই হয়েছে…’
‘কেন? ভালো কেন হয়েছে?’ ইন্দু প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ, বাঁশ যদি না-থাকে তো বাঁশি বাজে না … শাশুড়ি না-থাকে তো ঝগড়াও থাকে না। ইন্দু সহসা ক্রুদ্ধ হয়ে বলল–তুমি যাও তো, শুয়ে পড়ে গে, বড় এসেছেন … মানুষ বেঁচে থাকে বলেই তো লড়াই করে। শ্মশানের চুপ-চাপ থেকে ঝগড়া ভালো। যাও না, রান্নাঘরে তোমার কী কাজ?’।
মদন রাগ করে দাঁড়িয়ে রইল। বাবু ধনীরামের ধমকে আর সব বাচ্চারা আগেই আপন-আপন বিছানায় শুয়ে পড়েছিল–যেন ডাকঘরে চিঠি সর্ট হয়ে যে যার জায়গায় চলে গেছে। কিন্তু মদন দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। তার প্রয়োজন তাকে উদ্ধত আর লজ্জাহীন করে দিয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ে যখন ইন্দুও তাকে ধমকে দিল তখন সে কাঁদো-কাঁদো হয়ে অন্দরে চলে গেল।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত মদন বিছানায় পড়ে ছটফটাল। কিন্তু বাবুজির ভয়ে ইন্দুকে চেঁচিয়ে ডাকবার সাহস হল না তার। মদনের ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে গেল যখন মুন্নিকে ঘুম পাড়ানোর জন্য ইন্দু ঘুমপাড়ানি ছড়া গাইছিল।–’আয় ঘুম রানি, বৌরানি, মস্তানি’।
দুলারি মুন্নিকে যে ঘুমপাড়ানি ছড়া গেয়ে ইন্দু ঘুম পাড়াচ্ছিল, সেই ছড়া এদিকে ঘুম তাড়াচ্ছিল মদনের। নিজের প্রতি বিরক্ত হয়ে মদন সজোরে চাদর ধরে টানল। শাদা চাদর মাথায় ঢাকা দিয়ে শ্বাস বন্ধ করে খামোখা মড়ার মতো পড়ে রইল সে। মদনের মনে হল যে, সে মরে গেছে আর তার নববধূ ইন্দু তার পাশে বসে জোরে-জোরে মাথা কুটছে। দেয়ালে কবজির আঘাত করে চুড়ি ভাঙছে আর পড়তে-পড়তে কাঁদতে-কাঁদতে রান্নাঘরে গিয়ে চুলোর ছাই মাথায় দিচ্ছে, আবার বাইরে দৌড়ে এসে হাত তুলে মহল্লার লোকের কাছে নালিশ জানাচ্ছে–সকলে দেখ, আমি মারা গেছি। এখন তার দোপাট্টার পরোয়া নেই, জামাকাপড়ের পরোয়া নেই, মাথার সিঁদুর, কেশের ফুল আর পাখি সব উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে।
মদনের দুচোখ দিয়ে সবেগে অশ্রু বয়ে আসে, যদিও রান্নাঘরে বসে ইন্দু হাসছিল। মুহূর্তের মধ্যেই তার সৌভাগ্য বিনষ্ট হল আবার তার অজ্ঞাতেই সৌভাগ্য ফিরে এল। মদন যখন বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে এল তখন চোখের জল মুছতে-মুছতে নিজের পরেই হাসতে লাগল। ও-ধারে ইন্দু হাসছিলই। কিন্তু তা চাপা হাসি। বাবুজির উপস্থিতির কারণে সে কখনো উঁচু গলায় হাসত না, খিলখিল করে হাসিও একরকমের বেহায়াপনা, দোপাট্টা আর চেপে-চেপে হাসি ঘোমটার কাজ করত। মদন মনে-মনে ইন্দুর এক খেয়ালি মূর্তি বানিয়ে তার সঙ্গে অনেক কথাই বলেছিল। সে তাকে এমন আদর করেছিল যেমন আদর আজ পর্যন্ত করেনি। মদন আবার তার বাস্তব পরিবেশে ফিরে এসে দেখল পাশের বিছানা খালি পড়ে আছে। সে হালকা আওয়াজে ডেকেছিল ‘ইন্দু, তারপর চুপ করে গিয়েছিল। ওই ইতস্ততভাবের মধ্যে সে ঘুমের আবেশে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তার মনে যে বিয়ের রাতে পড়শি সিবতের মোষ তার মুখের কাছে ফোঁস-ফোঁস করছিল। মদন বিকল অবস্থায় উঠে বসল, তারপর রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকে দু-তিন বার আড়মোড়া ভেঙে শুয়ে পড়েছিল ফের। ঘুমিয়ে গিয়েছিল।
মদন কান খাড়া করে কোনো কিছু শোনার প্রত্যাশায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। বিছানার ভাঁজ দুরস্ত করতে গিয়ে ইন্দুর চুড়িগুলো ঝনঝন করে উঠলে মদন হড়বড় করে উঠে বসল। হঠাৎ জেগে যাওয়ায় তার মধ্যে প্রণয়ভাবনা হঠাৎ বেড়ে গেল। আরাম করে পাশ না ফিরে। লোকে ঘুমিয়ে গিয়ে হঠাৎ জেগে উঠলে প্রেমের দম ফুরিয়ে যায়। মদনের সারা শরীর ভিতরকার আগুনে জ্বলছিল আর সেজন্যই তার রাগ হয়েছিল। এবার সে ইন্দুকে বিরক্তির সঙ্গে বলল–
‘তা হলে তুমি এসে গেছ।’
‘হ্যাঁ।’
‘খুকি শুয়েছে, না মরেই গেল?
ইন্দু ঝুঁকে-পড়া অবস্থা থেকে একদম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। হায় রাম!’ নাকের উপর আঙুল রেখে সে বলল–
‘কী কথা বলছ? বেচারি মরবে কেন–মা-বাপের একমাত্র মেয়ে–’
‘হ্যাঁ’, মদন বলল–বউদির একমাত্র ননদ।’ তারপরই হুকুম দেয়ার স্বর আয়ত্ত করে বলল–’ওটাকে বেশি মাথায় তুল না।’
‘তাতে কোনো পাপ হবে?’
‘পাপ হবে, মদন রেগে গিয়ে বলল–’তোমার পিছু ছাড়ে না। যখনি দেখি জোকের মতো লেগে আছে। আমি তো কোনো সুযোগই পাই না …’
‘হায়। ইন্দু মদনের চারপাইয়ের উপর বসতে-বসতে বলল–’বোনদের আর মেয়েদের এভাবে দূর-দূর করা ঠিক নয়। বেচারি দু দিনের অতিথি। আজ নয়ত কাল, কাল নয় পরশু একদিন তো চলে যাবে …’ এ-বিষয়ে ইন্দু কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু সে চুপ করে গেল। মনশ্চক্ষুতে ইন্দু নিজের মা, বাপ, ভাই, বোন, খুড়ো, জেঠা, জেঠিমা সকলেই দেখা দিয়ে গেল একবার করে। কোনো একদিন সে তাদের আদরের পুতুল ছিল, চোখের পলকে সে তাদের থেকে স্বতন্ত্র হয়ে গেল, এখন দিনরাত তার বেরিয়ে যাওয়ার কথা হচ্ছে, যেন ঘরে কোনো বুড়ি শাশুড়ি আছে। কোনো ঘরে যদি সাপ থাকে, তা হলে যতক্ষণ পর্যন্ত-না ওই সাপকে তার গর্তে ধোয়া দিয়ে মেরে ফেলা যায় ততক্ষণ ঘরের লোক নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে না। দূর-দূরান্ত থেকে সাপকে খুঁটিগাড়ার, দড়ি দিয়ে বাঁধার, বিষদাত ভেঙে দেয়ার মাদারিদের ডেকে আনা হয়। বড় বড় ধন্বন্তরী আর মোতিসাগররা আসে–শেষে একদিন উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে লাল আঁধি এসে যায়। তা সাফ হয়ে যাবার পর একটি লরি এসে দাঁড়ায়–তাতে সলমা-চুমকিওয়ালা শাড়িতে জড়িয়ে থাকা এক নববধূ বসে থাকে। পিছনের ঘরে এক সুর বাজতে থাকে, সানাই-এর আওয়াজ শোনা যায়। তারপর এক ধাক্কায় লরি চলতে থাকে।
মদন কিছুটা রাগের সঙ্গে বলল—
‘তোমরা মেয়েছেলেরা খুব চালাক। গতকালই এ বাড়িতে এসেছ আর আজ এখানকার সব লোকের প্রতি আমার চেয়ে তোমার বেশি ভালোবাসা জন্মেছে?’
হ্যাঁ।’ ইন্দু বিশ্বাসের সঙ্গে বলল।
‘এ সব মিথ্যা। এ হতে পারে না।’
‘তোমার মতলব আমি…’
‘এ-সব শুধু লোক দেখানো…হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা জি। ইন্দুর চোখে জল এসে যায়, সে বলে–এ সব কিছুই আমার দেখানেনা?’ ইন্দু উঠে গিয়ে নিজের বিছানায় চলে যায় আর শিয়রের দিকে মুখ লুকিয়ে ফোঁপাতে থাকে। মদন তার অভিমান ভাঙাতে চায়, কিন্তু ইন্দু নিজেই উঠে মদনের কাছে আসে আর শক্ত করে তার হাত ধরে বলে–
‘তুমি সব সময় বিধিয়ে-বিধিয়ে কথা বলছ, তোমার হয়েছে কী?’
স্বামীর মতো রোয়াব দেখাবার সুযোগ মদন পেয়ে যায়–’যাও …যাও…শুয়ে পড়ো। গে’, মদন বলে–’তোমার কাছে আমার কিছুই নেওয়ার নেই…’
‘তোমার কিছু নেওয়ার নেই তো আমার নেওয়ার আছে, ইন্দু বলল–’সারা জীবন নেওয়ার আছে। সে মদনের সঙ্গে হাত কাড়াকাড়ি করতে থাকে। মদন তাকে ধু-ধুৎ করে আর সে মদনের গায়ে পড়ে মিশে যেতে চায়। সে ছিল সেই মাছের মতো যে স্রোতের সঙ্গে বহে যাবার বদলে ঝরনা খরস্রোতের বিপরীতে সাঁতরে উপরে পৌঁছতে চায়। সে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করল, হাত ধরল, কেঁদে-হেসে বলল–
‘ফের আমাকে একেবারে কুটনি বলবে?
সব মেয়েছেলেই তো তাই।
‘থাম…তোমার তো…’ মনে হল যেন ইন্দু কোনো গালি দিচ্ছে আর মুখে কী একটা গুনগুন করেছে। মদন দুরে বসে বলল–কী বললে? আর ইন্দু শোনবার মতো আওয়াজ করে ফের বলল সে-কথা। মদন খিলখিল করে হাসতে লাগল। পরক্ষণেই ইন্দু মদনের পাশে শুয়ে পড়ে বলছিল—
‘তোমরা পুরুষরা কী জান?–যার সঙ্গে ভালোবাসা হয় তার সব ছোটবড় আত্মীয়ের। সঙ্গেই ভালোবাসা হয়। কি বাপ, কি ভাই, আর কি বোন–’হঠাৎ দূরের দিকে তাকিয়ে ইন্দু বলে–
‘আমি দুলারি-খুকির বিয়ে দেব।
‘চূড়ান্ত হয়ে গেল, মদন বলল–’এখনো সে এক হাত লম্বা হয়নি, এখনি তার বিয়ের কথা ভাবছ…’
‘তুমি তো এক হাত দেখছ’, বলে ইন্দু নিজের দুহাত মদনের চোখের উপর রেখে বলতে থাকে একটু সময় চোখ বন্ধ করে আবার খোল’– মদন সত্যি-সত্যি চোখ বন্ধ করল, কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ খোলে না দেখে ইন্দু বলল–এখন তো খোল, এতক্ষণের মধ্যে আমি বুড়ি হয়ে যাব’–শুনে চোখ খুলল মদন। মুহূর্তের জন্য মদনের মনে হয়। সামনে ইন্দু নয়, আর কেউ বসে আছে। সে যেন হারিয়ে গেছে।
‘আমি তো এখন থেকেই চার স্যুট আর কিছু বাসনপত্র ওর জন্যে আলাদা করে। রেখেছি’, ইন্দু বলল। মদন কোনো জবাব দিল না দেখে আঁকি দিয়ে আবার বলল–তুমি কি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছ? নিজের ছেলেবেলার কথা মনে নেই?–তুমি তোমার দুঃখ আমাকে দিয়ে দিয়েছ…?
‘অ্যা!’ মদন চমকে উঠে বসল আর নিশ্চিত হয়ে গেল, কিন্তু সে যখন ইন্দুকে নিজের। সঙ্গে সাপটে মিশিয়ে নিল তখন সে আর একটি শরীর রইল না–সঙ্গে-সঙ্গে এক আত্মাও তার আত্মার সঙ্গে মিলে গেল।
মদনের কাছে ইন্দু হল আত্মার আত্মা। ইন্দুর ছিল সুন্দর শরীর কিন্তু হামেশা কোনো-না-কোনো কারণে সে মদনের আড়ালে থাকে। একটা পর্দার আড়ালে। স্বপ্নের সুতোয় বোনা, নিঃশ্বাসের ধোয়ায় রঙিন। উচ্চ হাসির সোনালি কিরণে উজ্জ্বল আলো ইন্দুকে ঢেকে রাখত। মদনের নজর আর তার হাতের দুঃশাসন বহু শতাব্দী ধরে ওই। দ্রৌপদীর–যাকে সাধারণত বউ বলা হয়–বস্ত্রহরণ করতে থাকে। কিন্তু হামেশা আসমান থেকে থানের পর থান, গজের পর গজ কাপড় তার উলঙ্গতা ঢাকবার জন্য নেমে আসে। দুঃশাসন শ্রান্ত হয়ে কোনো একখানে ঢলে পড়ে কিন্তু দ্রৌপদী সেখানেই দাঁড়িয়ে। থাকে। ইজ্জত আর শুচিতার শাদা শাড়ি-পরিহিতা সে নারী দেবীর মতো দেখায় আর–
…মদনের ফিরে আসা হাত লজ্জার ঘামে ভিজে যায়। তা শুকোবার জন্য সে হাত উপরে ওঠায় আর হাতের পাঞ্জা সম্পূর্ণ প্রসারিত করে দিয়ে আড়মোড়া ভেঙে আপন চোখের মণির সামনে মেলে ধরে। ফের আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখে ইন্দুর মর্মর শুভ্র গৌরবর্ণ আর কোমল শরীর সামনে পড়ে আছে। ভোগের জন্য সে-শরীর পাশেই আছে, বাসনার জন্যে দূরে…যদি কখনো ইন্দুর সঙ্গে কলহ হয়ে যায় তো এই রকমের মন্তব্য হয়–
হায় জি, ঘরে ছোট-বড় সবাই আছে…তারা কী বলবে?
মদন উত্তর দেয়–’ছোটরা বোঝে না …বড়রা বুঝে যায়।’
এর মধ্যে বাবু ধনীরাম সাহারানপুরে বদলি হয়ে গেলেন। সেখানে তিনি রেলের মেল সার্ভিসের সিলেকশন গ্রেডে হেড ক্লার্ক হয়ে গেলেন। এত বড় কোয়ার্টার পাওয়া গেল যে সেখানে আটটা পরিবার থাকতে পারে। কিন্তু বাবু ধনীরাম একাই সেখানে ঠ্যাং ছড়িয়ে পড়ে থাকতেন। সারা জীবনে তিনি কখনো বাচ্চাদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে থাকেননি। পুরো ঘরোয়া মেজাজের লোক ছিলেন। জীবনের শেষ অধ্যায়ে এই একাকিত্ব তার হৃদয়ে ওখান থেকে পালিয়ে যাবার বাসনা জাগিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু তিনি নাচার। সব ছেলেমেয়ে দিল্লিতে মদন আর ইন্দুর কাছে থেকে সেখানেই স্কুলে পড়ে। বছর শেষ হবার আগেই মাঝখানে নিয়ে এলে তাদের লেখাপড়া ভালো হত না। বাবুজির হৃদয়ে আঘাতের পর আঘাত পড়তে লাগল।
অবশেষে গরমের ছুটি হল। তিনি বারবার লেখায় মদন ইন্দুকে কুন্দন, পাশী আর দুলারির সঙ্গে সাহারানপুর পাঠিয়ে দিল। ধনীরামের দুনিয়া মুখরিত হয়ে উঠল আবার। কোথায় তার দফতরের কাজের পরে ছিল অবসরের পর অবসর, আর এখন কাজের পর কাজ। বাচ্চারা বাচ্চাদের মতোই যেখানে জামা-কাপড় খুলত সেখানেই ফেলে রাখত, আর বাবুজি তা গুছিয়ে রাখতেন। মদন থেকে দূরে থাকার ফলে আলস্যে-ভরা ইন্দু তো নিজের পোশাক সম্পর্কেও বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। সে রান্নাঘরে এমনভাবে ঘুরত-ফিরত যেন খোয়াড়ের গরু বাইরের দিকে মুখ তুলে আপন মালিককে খুঁজছে। কাজকর্মের পর সে কখনো অন্দরে ট্রাংকের উপরেই শুয়ে পড়ত, কখনো-বা বাইরে ‘কনের ফুলগাছের কাছে আবার কখনো-বা আমগাছের নিচে আঙিনায় বসে পড়ত। শত-শত হাজার-হাজার হৃদয়ে সে-আশ্রয় শীতলতা এনে দিত।
শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে আমের দিন চলে যায়। আঙিনা থেকে বাইরের দরজা খুললে দেখা যায় কুমারী আর নববিবাহিতা মেয়েরা দোলনায় দোল দিতে-দিতে গাইছে-’আমের শাখায় দোলনা কে বাধল’–আবার গানের তালের অনুসরণে দুলতে থাকে আর দোল দিতে থাকে–আর যদি চারজন একত্র হয় তো লুকোচুরি খেলে। প্রৌঢ়া আর বুড়ির দল একদিকে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে। ইন্দুর মনে হয় সে-ও যেন ওদেরই একজন হয়ে গেছে। তখন সে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমিয়ে পড়ে। বাবুজি কাছ দিয়ে যান তো তাকে জাগাতে কিংবা তুলতে একটুও চেষ্টা করেন না, পরন্তু সুযোগ পেয়ে তার সালোয়ার, যার বদলে বউ শাড়ি পরে আর যা হামেশা শাশুড়ির পুরনো চন্দন কাঠের সিন্দুকে তুলে রাখে, তা তুলে নিয়ে খুঁটিতে টাঙিয়ে দেন। এই কাজে তাকে সব নজর বাঁচিয়ে চলতে হয়; কিন্তু যখন সালোয়ার গুছিয়ে তুলতে গিয়ে তার নজর নিচের কোণে বধূর চোলির ওপর গিয়ে পড়ে, তখন তার সাহস চলে যেত। আর তিনি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যেতেন–যেন কোনো সাপের বাচ্চা গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারপর বারান্দা থেকে তাঁর কণ্ঠস্বর শোনা যেত–’ওম্ নম ভগবতে বাসুদেবায়’।
আশপাশের মহিলারা বাবুজির পুত্রবধূর সৌন্দর্যের বর্ণনা অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছিল। কোনো মহিলা বাবুজির সামনে বধূর সৌন্দর্যের আর সুডৌল শরীরের প্রশংসা করলে তিনি খুশিতে ফেটে পড়ে বলেন–’আমীচন্দের মা, আমি তো ধন্য হয়ে গেলাম। ঈশ্বরের দয়া, আমার ঘরে এক স্বাস্থ্যবতী মেয়ে এসেছে। আর এ-কথায় তার নজর অনেক দূর চলে যায় যেদিকে অসুখ, ওষুধের শিশি, হাসপাতালের সিঁড়ি আর পিঁপড়ের গর্ত। নজর কাছে এলে তিনি মোটাসোটা ভরা-শরীর বাচ্চাদের বগলে, কাঁধে, ঘাড়ে চড়বার নামবার অনুভূতিতে ভরে ওঠেন। আর তার মনে হয় আরো বাচ্চা আসছে। পাশে শুয়ে-থাকা বউয়ের কোমর মাটির সঙ্গে মিশে যায় আর কনুই ছাদের সঙ্গে লেগে থাকে আর তাদের বাচ্চাদের বয়সের মধ্যে কোনো তফাত থাকে না। কেউ বড় নয় কেউ ছোট নয়, সবাই একসঙ্গে জড়-সড়… নমামি, ওম্ নম ভগবতে…
আশপাশের সব লোক জেনে গিয়েছিল যে, ইন্দু বাবুজির স্নেহের পুত্রবধূ। দুধ আর ঘোলের ভাড় ধনীরামের ঘরে আসতে থাকে। একদিন সলামদিন গুজর ফরমায়েশ করে দেয়। ইন্দুকে বলে–’বিবি, আমার ছেলেটাকে আর.এম.এস.-এ কুলির কাজে রাখিয়ে দাও, আল্লা তোমাকে সুফল দেবেন। ইন্দুর ইশারায় কিছুদিনের মধ্যে সলামদিনের ছেলে কুলি হয়ে গেল–সে সর্টার হতে পারল না, তার ভাগ্য।
পুত্রবধূর খাওয়া-দাওয়া আর স্বাস্থ্যের প্রতি বাবুজি নিজেই খেয়াল রাখতেন। ইন্দু দুধ অপছন্দ করত। তিনি রাতের বেলা নিজেই বাটিতে দুধ ফুটিয়ে গ্লাসে ঢেলে বধূকে খাওয়াবার জন্যে তার খাঁটিয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেন। ইন্দু নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে বসত আর বলত-না বাবুজি, আমার দুধ খেতে ভালো লাগে না…।
‘তোর শ্বশুরও তো খাবে।’ তিনি মজা করে বলতেন।
তা হলে আপনিই খেয়ে নিন না। ইন্দু হেসে জবাব দিত আর বাবুজি ছদ্মরোষে ফেটে পড়তেন–তুই চাস যে পরে তোরও ওই অবস্থা হোক যা তোর শাশুড়ির হয়েছিল?
‘হুঁ…হুঁ……’ ইন্দু অভিমান করত। আর অভিমান কেনই-বা না করবে। তারাই অভিমান করে না যাদের অনুনয় করে ভোলাবার কেউ নেই। কিন্তু এখানে তো অনুনয়কারী সবাই, অভিমানকারী কেবল একজন। যখন ইন্দু বাবুজির হাত থেকে গ্লাস নিত না তখন উনি খাঁটিয়ার পাশে শিয়রের নিচে তা রেখে দিতেন–আর-’নে, এখানে রইল–তোর মর্জি হয় তো খানা হয় তো খাস না’–বলে চলে যেতেন।
আপন বিছানায় পৌঁছে ধনীরাম দুলারির সঙ্গে খেলা করতেন। দুলারি বাবুজির খালি গায়ে গা লাগিয়ে ঘষত আর তার পেটের ওপর মুখ লগিয়ে ফু-ফু করত,–এটাই তার অভ্যাস ছিল। আজ যখন বাবুজি আর খুকি এই খেলা খেলতে-খেলতে হাসছিল, তখন খুকি বউদির দিতে তাকিয়ে বলল–দুধ নষ্ট হয়ে যাবে বাবুজি, বউদি তো খাচ্ছে না।’
‘খাবে, নিশ্চয় খাবে বেটি’, বাবুজি অন্য হাতে পাশীকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিতে-নিতে বললেন—
‘মেয়েরা ঘরের কোনো জিনিস নষ্ট হওয়া দেখতে পারে না…’ এই মন্তব্য বাবুজির মুখ থেকে শোনা যেত। আর অন্যদিক থেকে ভেসে আসত ‘হুশ……ভাতারখাগী’ বধূ বিড়াল তাড়াচ্ছে–কিছুক্ষণ পরে ঢক্ শব্দে সবাই জেনে নিত যে বধূ-বৌদি দুধ খেয়ে নিয়েছে। তারপর কুন্দ বাবুজির কাছে এসে বলত–
‘বুজি…বৌদি কাঁদছে।‘
‘হায়।’ বাবুজি বলে ওঠেন আর উঠে পড়ে আঁধারে সেইদিকে তাকিয়ে দেখেন যে-দিকে বধূর চারপাই রয়েছে। কিছুক্ষণ সেখানেই বসে থাকার পর তিনি ফের শুয়ে পড়েন আর কিছু বুঝে নিয়ে কুন্দনকে বলেন–যা…তুই ঘুমিয়ে পড়, সে নিজে নিজেই ঘুমিয়ে পড়বে।
তারপর শুয়ে পড়ে বাবু ধনীরাম পরমাত্মার পুষ্পশোভিত বাগান দেখতে থাকেন আর আপনার মনে ভগবানকে শুধোন–রুপোর মতো এইসব খুলে-যাওয়া বন্ধু-যাওয়া ফুলের মধ্যে আমার ফুলটি কোথায়?’ সারা আকাশ তার কাছে এক বেদনার নদী-রূপে দেখা দেয় আর দুকানে অনবরত হায়-হায় আওয়াজ বেজে ওঠে, তা শুনতে-শুনতে তিনি বলে ওঠেন–’যেদিন থেকে দুনিয়া তৈরি হয়েছে সেদিন থেকে মানুষ কত কেঁদেছে।’
.
ইন্দুর যাবার বিশ-পঁচিশ দিনের মধ্যেই মদন ঝামেলা শুরু করে দেয়। সে লিখল– বাজারের রুটি খেতে-খেতে আমার বিরক্তি ধরে গেছে। কোষ্ঠাবদ্ধতা হয়েছে। তলপেটে বেদনা শুরু হয়েছে। তারপর যেমনভাবে দফতরের লোক ছুটির জন্য সার্টিফিকেট পেশ করে তেমনভাবে মদন বাবুজির এক দোস্তের সমর্থন-প্রাপ্ত চিঠি লিখিয়ে নিয়ে পাঠিয়ে দিল। তাতেও যখন কিছু হল না তখন এক ডবল তার–জবাবি টেলিগ্রাম।
জবাবি তারের পয়সা মারা গেল। কিন্তু তাতে কী। ইন্দু আর বাচ্চারা ফিরে এল। মদন দুদিন ইন্দুর সঙ্গে সোজাসুজি কথা বলেনি। ইন্দু খুব দুঃখ পেয়েছিল এতে। একদিন মদনকে একলা পেয়ে ধরে নিয়ে বসিয়ে বলেছিল—’এত মুখ ফুলিয়ে বসে আছ। আমি কী করেছি?’
মদন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিল—’ছাড়–দূর হয়ে যা হতচ্ছাড়ি, আমার চোখের সামনে থেকে…।’
‘এই কথা বলার জন্যে এতদূর থেকে ডেকে নিয়ে এলে?’
‘হ্যাঁ।’
‘ছোড় এসব।’
‘খবরদার–এ-সব তোমার তৈরি করা ঘটনা। তুমি যদি আসতে চাইতে তা হলে বাবুজি কি থামিয়ে দিত?’
ইন্দু বিহ্বলতার সঙ্গে বলল–হ্যায় জি, তুমি তো বাচ্চাদের মতো কথা বলছ। আমি নিজের থেকে কী করে ওকে এ কথা বলি? সত্যি কথা জানতে চাও তো বলি, আমাকে ডেকে নিয়ে এসে তুমি বাবুজির ওপর বড় জুলুম করলে।’
‘মতলবটা কী?’
‘মতলব কিছু নেই–বাচ্চাদের প্রতি ওঁর হৃদয়ের খুব আসক্তি জন্মেছিল…।’
‘আর আমার হৃদয়?’
‘তোমার হৃদয়? তুমি তো কোথাও আসক্তি জন্মাতে পার।’ ইন্দু বদমায়েশি করে বলল আর মদনের প্রতি এমনভাবে তাকিয়ে দেখল যে, ইন্দুর কাছ থেকে মদনের নিজেকে দূরে রাখার সব ক্ষমতাই শেষ হয়ে গেল। সে-ও কোনো নিপুণ ছলের খোঁজে ছিল।
সে ইন্দুকে ধরে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলল–’বাবুজি তোমার প্রতি খুব প্রসন্ন ছিলেন?’
‘হ্যাঁ, ইন্দু বলল–’একদিন আমি জেগে দেখি শিয়রে দাঁড়িয়ে উনি আমাকে দেখছেন।’
‘এ হতে পারে না।’
‘আমি কসম খেয়ে বলছি।‘
‘নিজের না, আমার কসম খেয়ে বল।’
‘তোমার কসম তো আমি খাই না…অন্যেরা খেলে খাক।’
‘হ্যাঁ’, মদন ভেবে বলল—’বইতে একে বলে সেক্স।’
‘সেক্স’ ইন্দু শুধাল–সেটা কী ব্যাপার?’
‘ওই ব্যাপার যা পুরুষ আর মেয়েমানুষের মধ্যে হয়।’
‘হায় রাম!’ ইন্দু একদম পিছু হটে গিয়ে বলল–’নোংরা কোথাকার। বাবুজির সম্পর্কে এরকম কথা ভাবতে পার, তোমার লজ্জা হয় না?’
‘তোমাকে দেখতে বাবুজির লজ্জা হয় না?’
‘কেন?’ ইন্দু বাবুজির পক্ষ নিয়ে বলল—’তিনি নিজের পুত্রবধূকে দেখে খুশি হয়েছিলেন।’
‘কেন নয়? যখন তোমার মতো সুন্দরী পুত্রবধূ?’
‘তোমার মন নোংরা’, ইন্দু ঘৃণার সঙ্গে বলল—’এই কারণে তো তোমার কারবারও হল দুর্গন্ধ বিরোজার। তোমার বইপত্র সব দুর্গন্ধে ভরা। তুমি আর তোমার বইপত্র–এছাড়া আর কিছু দেখতে পার না। আমি যখন বড় হয়ে গেলাম তখন আমার বাবা আমাকে অনেক বেশি আদর করতে শুরু করেছিলেন। তা হলে কি তিনিও…ছিলেন সেই হতভাগা যার নাম তুমি এখনি নিচ্ছিলে। ইন্দু ফের বলল–’বাবুজিকে এখানে আনিয়ে নাও। ওখানে তার ভালো লাগছে না। তিনি দুঃখী হলে তুমি কি দুঃখী হবে না?’
মদন তার বাবাকে খুবই ভালোবাসত। সংসারে মায়ের মৃত্যুর পর মদনের বড় হবার পেছনে সবচেয়ে বেশি কার্যকর প্রভাব তারই ছিল। সে-কথা মদন ভালো রকমই জানে। মায়ের রোগের শুরু থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছু যখনি মদনের মনে পড়ে যেত তখনি সে চোখ বুজে প্রার্থনা শুরু করে দিত–’ওম্ নম ভগবতে বাসুদেবায়, ওম্ নম…।’ এখন সে চাইছিল না বাপের ছত্রছায়া তার মাথার ওপর থেকে সরে যায়। বিশেষত এই কারণে যে সে এখন পর্যন্ত তার কারবার জমাতে পারেনি। সে অবিশ্বাসের কণ্ঠে ইন্দুকে কেবল এ-কথাই বলেছিল—’এখন বাবুজিকে ওখানেই থাকতে দাও। বিয়ের পর এই প্রথম আমরা দুজনে খুশিমতো এক সঙ্গে মিলতে পেরেছি।’
তৃতীয়-চতুর্থ দিনে বাবুজির অশ্রুসিক্ত চিঠি এল। আমার স্নেহের ‘মদন’ সম্বোধনে ‘আমার স্নেহের’ শব্দ চোখের জলে ধুয়ে গেছে। তিনি লিখেছেন—’বউমা এখানে থাকায় আমার পুরনো দিনগুলো ফিরে এসেছিল–তোমার মায়ের দিন, যখন আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছিল তখন সে-ও ওই রকম বেপরোয়া ছিল। এইভাবেই ছেড়ে-ফেলা কাপড় এদিকে-ওদিকে ফেলে দিত আর আমার পিতাজি তা গুছিয়ে তুলতেন। সেই তো মদনের সিন্দুক, সেই তো হাজার শান্তি…আমি বাজারে যাই, কিছু নয় তো দইবড়া আর রাবড়ি কিনে নিয়ে আসি। এখন ঘরে কেউ নেই। যেখানে চন্দনকাঠের সিন্দুক ছিল সে জায়গা খালি পড়ে আছে…।’ তারপর এক-আধ ছত্র ফের ধুয়ে গেছে। শেষে লিখেছেন–’দফতর থেকে এখানকার বড়-বড় আঁধার কামরায় ফিরে এলে আমার মনের মধ্যে বমির মতো ভাব ওঠে…আর–বৌমার যত্ন কর। তাকে কোনো যে-সে দাইয়ের হাতে সঁপে দিও না।‘
ইন্দু দুই হাতে চিঠি টেনে নিল। দম নিয়ে চোখ টান করে, লজ্জায় গলে যেতে-যেতে বলল–’আমি মরে গেলাম। বাবুজি কী করে বুঝতে পারলেন?’
মদন চিঠিটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল—’বাবুজি কি বাচ্চা ছেলে? দুনিয়া দেখেছেন, আমাদের জন্ম দিয়েছেন…’
‘হ্যাঁ।’ ইন্দু বলল—’এখন কত দিনই-বা হল?’
তারপর সে পেটের ওপর তীক্ষ্ণভাবে নজর দেয়। এখনো বাড়তে শুরুই করেনি, কিন্তু এর মধ্যেই বাবুজি আর কোনো-কোনো মানুষ তা দেখতে পেয়েছে। সে তার শাড়ির আঁচল পেটের ওপর টেনে নিয়ে কিছু ভাবতে থাকে। তার দেহে এক চমক, সে বলে– ‘তোমার শ্বশুরবাড়ি থেকে রনি আসবে।’
‘আমার শ্বশুরবাড়ি?…ও হ্যাঁ।’ মদন পথ খুঁজে পেয়ে বলল–কী লজ্জার কথা! এই ছ-আট মাস মাত্র বিয়ে হয়েছে, এর মধ্যেই চলে এল’–আর হেসে ইন্দুর পেটের দিকে ইশারা করল।
চলে এসেছে, না তুমি নিয়ে এসেছ?
‘তুমি…সব অপরাধ তোমার। কিছু কিছু মেয়েছেলে এরকমই হয়ে থাকে…।’
‘তোমার পছন্দ নয়? ‘একেবারে নয়। ‘কেন?’
‘জীবনের কয়েক দিন তো মজা করে নেয়া যাক।
‘কেন এ বুঝি জীবনের মজা নয়। ইন্দু দুঃখভরা কণ্ঠে বলল–’পুরুষমানুষ বিয়ে করে কিসের জন্যে? ভগবানের কাছে বিনা প্রার্থনায় তিনি দিয়েছেন বলেই তোমার বুঝি পছন্দ হচ্ছে না? যার ছেলেপুলে হয় না তাকে শুধাও। সে কী না করে? পীর-ফকিরের কাছে যায়। সমাধি, মাজারের ওপর পিপড়া খাওয়ায়, লজ্জা-হায়া ছেড়ে, নদীর তীরে উলঙ্গ হয়ে শরভঁটা কাটে, শ্মশানে মশান জাগায়…’
‘আচ্ছা, আচ্ছা।’ মদন বলল–’তুমি তো ব্যাখ্যা শুরু করে দিলে…জীবন কি কেবল বাচ্চার জন্যই?
‘ও যখন আসবে,’ ইন্দু বিষণ্ণভাবে আঙুল তুলে বলল–তখন তুমি তাকে ঘেঁবে না। সে তোমার নয়, আমার হবে। তোমার তাকে দরকার নেই, কিন্তু তার ঠাকুরদাদার খুব দরকার আছে। এ-কথা আমি জানি…।’
আবার কিছুটা শান্ত, কিছুটা দুঃখিত হয়ে ইন্দু দুই হাতে তার মুখ ঢাকল। সে ভাবছিল। যে, তার পেটের মধ্যে এই ছোট্ট প্রাণটিকে পালনের ব্যাপারে তার আপন লোক কেউ থাকলে কিছুটা দরদের সঙ্গে তাকে দেখবে। কিন্তু মদন বসেছিল চুপচাপ। তার মুখ থেকে একটি শব্দও বেরল না। ইন্দু মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে মদনের দিকে তাকিয়ে দেখল আর ভাবী প্রথম সন্তানবতীর ঢঙে বলল–’যা-কিছু বলেছি তা তো পরে হবে, তার আগে দেখ, আমি তো আর বাঁচব না…ছোটবেলা থেকেই এ-কথা আমার মনে হয়…’
মদন ভয় পেয়ে গেল। এই সুন্দর চিজ’ গর্ভবতী হবার পর আরো সুন্দর হয়েছে–এ মরে যাবে? সে পিছন দিক থেকে ইন্দুকে ধরে নিজের দু হাতের মধ্যে নিয়ে এসে বলল– ‘তোমার কিছু হবে না ইন্দু…তোমাকে আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসব…এখন সাবিত্রী নয়…সত্যবানেরই সাধনা’
মদনের সঙ্গে মিশে গিয়ে ইন্দু ভুলে গেল তার নিজের কোনো দুঃখ আছে…
তারপরে বাবুজি আর কোনো চিঠি লেখেননি। হঠাৎ সাহারানপুর থেকে এক সর্টার এল। সে কেবল এ কথাই জানাল যে, বাবুজির ফের হার্ট-অ্যাটাক হয়েছে। এক আক্রমণে তিনি প্রায় মরেই যাচ্ছিলেন। মদন ভয় পেয়ে গেল। কাঁদতে লাগল ইন্দু। সর্টার চলে যাবার পরে কিছুক্ষণ পরপরই মদন চোখ বুজে মনে-মনে পড়তে থাকে–’ওম নম ভগবতে…’ পরের দিন মদন বাপকে চিঠি লিখল–বাবুজি চলে আসুন। বাচ্চারা আপনার কথা খুব মনে করে, আপনার বৌমাও–’, কিন্তু চাকরি তো আছে। আসাটা কি নিজের আয়ত্তে ছিল তার? ধনীরামের পত্র অনুসারে সে ছুটির বন্দোবস্ত করছিল। তার ব্যাপারে মদনের অপরাধবোধ বাড়তে শুরু করল। আমি যদি ইন্দুকে থাকতে দিতাম তা হলে আমার কী ক্ষতি হত?
বিজয়া দশমীর আগের রাতে মদন ছটফট করতে-করতে মাঝের কামরার বাইরে বারান্দায় টহল দিচ্ছিল। তখনি ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজ এল আর সে চমকে উঠে দরজার দিকে দৌড়াল। বেগম দাই বাইরে এসে বলল–
‘বাবুজি খুশি হও…ছেলে হয়েছে।’
‘ছেলে?’ মদন বলল। উদ্বেগের স্বরে ফের জিজ্ঞেস করল–’বউ কেমন আছে?’
বেগম বলল–’ভগবানের দয়ায় ভালো আছে। এখন পর্যন্ত প্রসূতিকে ভালো রেখেছেন। পেটের ছেলে বেশি খুশি হয়ে গেলে ওর পেটের ফুল পড়ত না…’
‘ও। মদন বোকার মতো চোখ মিটকে বলল, আবার কামরার দিকে যাবার জন্যে এগোল। বেগম ওকে সেখানেই থামিয়ে দিয়ে বলল–’অন্দরে তোমার কী কাজ?’ তারপর হঠাৎ দরজা বন্ধ করে চট করে ভিতরে চলে গেল।
তখন পর্যন্ত মদনের পা কাঁপছিল। ভয়ের জন্য নয়, সান্ত্বনায়, আর বোধহয় এজন্য যে, এই দুনিয়ায় কোনো আগন্তুক এলে আশেপাশের লোকের এই অবস্থাই হয়। মদন শুনেছিল যখন ছেলে হয় তখন ঘরের দরজা আর দেয়াল কাঁপে। তখন ভয় হয় যে বড় হয়ে ওই ছেলে আমাকে বেচে দেবে, না রাখবে। মদন অনুভব করল যেন সত্যিসত্যি দেয়ালগুলো কাঁপছে। সূতিকাঘরে চকলি-বৌদি আসেনি, কারণ তার নিজের বাচ্চা খুবই ছোট ছিল। হাঁ, দরিয়াবাদী পিসি অবশ্যই পৌঁছেছিল। বাচ্চার জন্মের সময় সে রাম-রাম রাম-রাম রটনা করতে লাগল। আস্তে-আস্তে সে শব্দও ক্ষীণ হয়ে আসে।
সারা জীবনে আর কখনো মদনের এমন ব্যর্থ আর বেকার বলে মনে হয়নি নিজেকে। এর মধ্যে ফের দরজা খুলে পিসি বেরিয়ে এসেছিল। বারান্দায় বিজলিবাতির মৃদু আলোয় তাকে ভূতের চেহারার মতো একদম দুধ-শাদা দেখাচ্ছিল। মদন তার পথ আগলে বলল–’পিসি, ইন্দু ঠিক আছে, না?’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ পিসি তিন-চারবার বলে নিজের কম্পিত হাত মদনের মাথায় রেখে তাকে নামিয়ে আনল, চুমু খেল আর বাইরে চলে গেল দ্রুত।
বারান্দার দরজা থেকে পিসিকে বাইরে যেতে দেখা গেল। সে বৈঠকখানায় গিয়ে দেখল বাচ্চারা ঘুমিয়েছে। পিসি এক-এক করে প্রত্যেকের মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে ছাদের দিকে চোখ তুলে কিছু বলল, তারপর শ্রান্ত হয়ে খুকির পাশে শুয়ে পড়ল। তার দুটি ঠোঁটের ওঠা-নামা থেকে বোঝা যাচ্ছিল, সে কেমন করে কাঁদছে…মদন বিস্মিত হল…পিসি তো অনেক জায়গায় দিন কাটিয়েছে, তবে কেন আজ তার আত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠছে?
ওদিকের কামরা থেকে ধূনোর গন্ধ এসে ছেয়ে ফেলে মদনকে। বেগম দাই কাপড়ে কিছু জড়িয়ে নিয়ে বাইরে আসে। তাকে দেখে হতভম্ব হয়ে যায় মদন। তার খেয়াল ছিল না সে কোথায় রয়েছে। দু চোখ খুলে তাকিয়েছিল কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। এর মধ্যে ইন্দুর এক মরার মতো আর্তনাদ ভেসে এল—’হা…য়’। আবার বাচ্চার কান্নার শব্দ।
তিন-চার দিনের মধ্যে অনেক কিছু ঘটল। মদন ঘরের এক দিকে গর্ত খুঁড়ে ফুল পুঁতে ফেলল। অন্দরে কুকুরগুলোকে বাধা দিল আসতে। কিন্তু তার কিছুই খেয়াল ছিল না। তার মনে হয়েছিল ধূনোর গন্ধ মাথায় ঢুকে যাবার পর আজই তার হুঁশ ফিরে এসেছে। কামরায় একা সে আর ছিল ইন্দু, নন্দ আর যশোদা–আর অন্যদিকে ছিল নন্দলাল…ইন্দু বাচ্চার দিকে তাকিয়ে দেখে জানবার চেষ্টায় বলল–একেবারে ঠিক তোমার মতোই হয়েছে…’।
হতে পারে।’ মদন বাচ্চার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল–’আমি তো বলছি এ হল ভগবানের দয়া। তুমি বেঁচে গেছ।
‘হ্যাঁ, ইন্দু বলল–’আমি তা বুঝেছি…’
‘শুভ-শুভ বল’, মদন একদম ইন্দুর কথা কেটে দিয়ে বলল–এখানে যা-কিছু হবার হয়েছে, আমি তো তোমার কাছে আসব না।’ একথা বলে মদন দাঁতের তলায় কথা চেপে নিল।
‘চুপ কর।’ ইন্দু বলল।
মদন তা শুনে দু হাতে কান চেপে ধরল আর ইন্দু হাসতে লাগল হালকা আওয়াজে।
ছেলে হবার পর কয়েকদিন পর্যন্ত ইন্দুর নাভি ঠিক জায়গায় আসেনি। সে ফিরে-ফিরে ওই বাচ্চার এমন তদারকি করছিল যে, এর পরে ও বাইরের দুনিয়ায় গিয়ে নিজের আসল মাকে ভুলে গিয়েছিল।
এখন সবকিছু ঠিকঠাক। ইন্দু শান্তির সঙ্গে চারদিকে চোখ তুলে তাকায়। মনে হয়েছিল সে কেবল মদনের নয়, দুনিয়ার সকল অপরাধীকে মাফ করে দিয়েছে, আর লোকের ভালো হবার ওষুধ আর করুণা বিতরণ করছে। মদন ইন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে–এই সব রক্তস্রাবের পর ইন্দু কিছু দুর্বল হয়ে গিয়ে তাকে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। হঠাৎ ইন্দু দু হাত নিজের বুকের উপর রাখল।
‘কী হল?’ মদন শুধায়।
‘কিছু না।’ ইন্দু কিছুটা উঠে বসবার চেষ্টা করে বলল–’ওর খিদে পেয়েছে। বাচ্চার দিকে ইশারা করল ইন্দু।
‘এর–খিদে?’-মদন একবার বাচ্চার দিকে দেখে ইন্দুর দিকে তাকিয়ে বলল–’তুমি কী করে জানলে?’
‘দেখছ না’, ইন্দু নিচের দিকে নজর রেখে বলল–সব ভিজে গেল।’
মদন সতর্কভাবে ইন্দুর ঢিলে-ঢালা বুকের দিকে তাকাল। দুটি স্তনই দুধে ভরে আছে, আর গন্ধ আসছে। ইন্দু বাচ্চার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল–’ওকে আমার কাছে দিয়ে দাও।
মদন কড়াইয়ের আগুনের দিকে হাত বাড়িয়ে তার তাপ নিল। তারপর কিছুটা সাহসের সঙ্গে এগিয়ে বাচ্চাকে তুলে নিল যেন একটা মরা ইঁদুর। শেষ পর্যন্ত ইন্দুর কোলে বাচ্চাকে তুলে দিল। ইন্দু মদনের দিকে তাকিয়ে বলল–’তুমি বাইরে যাও!
‘কেন? বাইরে কেন যাব?’ মদন জিজ্ঞেস করে।
যাও না…’ ইন্দু কিছু গর্বের সঙ্গে, কিছুটা লজ্জিত হয়ে বলল–তোমার সামনে আমি বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারব না।’
‘আরে!’ মদনের বিস্ময় কণ্ঠে–’আমার সামনে খাওয়াতে পারবে না?’ তারপর অবুঝভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বাইরের দিকে চলে গেল। দরজার কাছাকাছি পৌঁছে সে আবার ইন্দুর দিকে তাকাল–আজ পর্যন্ত ইন্দুকে এত সুন্দর লাগেনি।
বাবু ধনীরাম ছুটিতে বাড়িতে ফিরে এলেন। তাঁকে আগের তুলনায় আধখানা দেখাচ্ছিল। ইন্দু তার কোলে বাচ্চাকে তুলে দিলে উনি খুশি হয়ে উঠলেন। তার পেটের ভিতর এমন এক ফোঁড়া হয়েছিল যা চব্বিশ ঘণ্টা তাকে শূলের ওপর চড়িয়ে রাখত। যদি বাচ্চা না-থাকত তবে বাবুজির দশগুণ বেশি খারাপ অবস্থা হত।
কয়েকবার চিকিৎসা করা হল। শেষ চিকিৎসায় ডাক্তার বাবুজিকে আধ আনা মাপের পনেরো-বিশটা গুলি রোজ খেতে দিয়েছিলেন। প্রথম দিনই তার এত ঘাম হয়েছিল যে, দিনে তিন-চারবার কাপড় বদলাতে হত। প্রতিবার মদন কাপড় খুলে নিয়ে বালতিতে নিঙড়াত। কেবল ঘামেই বালতির এক-চতুর্থাংশ ভরে যেত। রাতে তাঁর বমি-বমি ভাব হল আর তিনি চিৎকার করে বললেন–’বউমা, একটা দাঁতন দাও। জিভের স্বাদ বড় খারাপ লাগছে। বউমা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁতন নিয়ে এল। বাবুজি উঠে দাঁতন চিবোতে শুরু করলেন, এমন সময় বমি এল, বমির সঙ্গে রক্তও এল। তাড়াতাড়ি তাকে শিয়রের দিকে শুইয়ে দেয়া হল। তাঁর চোখের মণি উল্টে গেল। আর কয়েকবার দমকের পরেই তিনি আকাশের ফুলবাগানে পৌঁছে গেলেন, সেখানে তিনি নিজের ফুলটি চিনে নিয়েছিলেন।
বাচ্চার জন্ম হবার পর মোটে বিশ-পঁচিশ দিন হয়েছে। ইন্দু মুখ চাপড়ে কপাল আর বুক চাপড়ে বিবর্ণ করে তুলল নিজেকে। মদনের চোখের সামনে ছিল সেই দৃশ্য–যা রোজ তার খেয়ালে নিজের মৃত্যুর পরের দৃশ্য হয়ে উঠেছিল। তফাত এই ছিল যে, ইন্দু চুড়ি ভেঙে ফেলার বদলে খুলে রেখে দিয়েছিল। মাথায় ছাই দেয়নি। কিন্তু জমিতে আছড়ে পড়ে সারা শরীরে মাটি লেগে যাওয়ায় আর চুল ছড়িয়ে পড়ায় চেহারা ভয়ানক হয়ে গিয়েছিল ইন্দুর। সবাই দেখ আমি সব হারিয়েছি’-র বদলে সবাই দেখ আমরা সব হারিয়েছি’—
ঘরের বাইরের কত বোঝা তার ওপর এসে পড়েছিল, তার পুরো আন্দাজ মদনের ছিল না। সবাক থেকেই তার হৃৎপিণ্ড এক লাফে মুখে এসে গিয়েছিল। সে বোধহয় বাঁচতে পারত না যদি সে ঘরের বাইরে নালার ধারে ভিজে মাটির উপর উপুড় হয়ে শুয়ে নিজের হৃদয় নিজের জায়গায় নিয়ে না আসত। ছোট বাচ্চা কুন্দন, খুকি দুলারি আর পাশী এমনই চেঁচাচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল পাখির বাসায় শিক্রে বাজের আক্রমণে পাখির ছানাগুলো ঠোঁট তুলে চি-চি করছে। যদি কেউ তাদের পাখার নিচে সামলে রাখতে পারে তো সে ইন্দু–নালার ধারে পড়ে থেকে মদন ভাবছিল, এখন তো আমার কাছে এ দুনিয়া শেষ হয়ে গেল। কী, আমি কি আর বাঁচতে পারব? জীবনে আর কোনোদিন হাসতে পারব? সে উঠে ঘরের ভিতরে চলে গেল।
সিঁড়ির নিচে ছিল স্নানের ঘর। সেখানে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করতে-করতে মদন ফের একবার এই কথা মনে-মনে আওড়াল : আমি আর কখনো হাসতে পারব? আর সে খিলখিল করে হাসছিল, যদিও তার বাপের মৃতদেহ তখন পর্যন্ত বৈঠকখানায় পড়ে ছিল।
বাপকে আগুনে সঁপে দেয়ার আগে মদন মেজের উপর পড়ে থাকা মৃতদেহের সামনে দণ্ডবতের ভঙ্গিতে শুয়ে পড়েছিল। তার জন্মদাতার কাছে এই ছিল তার শেষ প্রণাম, তখন সে আর কাঁদল না। তার এই অবস্থা দেখে শোকের অংশীদার সব আত্মীয়স্বজন, পাড়ার লোক বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল।
তারপর হিন্দু প্রথা অনুসারে সর্বজ্যেষ্ঠ হবার কারণে মদনকেই চিতায় আগুন দিতে হল। জ্বলন্ত মাথার উপর কপাল-ক্রিয়ার লাঠি মারতে হল। মেয়েছেলেরা বাইরে শ্মশানের কূপের জলে স্নান করে ঘরে ফিরে গেল। যখন মদন ঘরে পৌঁছল তখন সে কাঁপছিল। ধরিত্রী-জননী কিছুক্ষণের জন্য যে শক্তি আপন সন্তানকে দিয়েছিলেন রাত এসে যাবার পর তা বিক্ষিপ্ততায় অবসিত হয়ে গেল… তার কোনো সাহায্য প্রয়োজন ছিল। কোনো এক রকম ভাবনার অনুষঙ্গ যা মৃত্যুর চেয়েও বড়। ওই সময় ধরিত্রী-জননীর কন্যা জনকতনয়া ইন্দু যেন কোনো ঘড়া থেকে জন্ম নিয়ে ওই রামকে নিজের দু-বাহুর মধ্যে টেনে নিল। এ রাতে যদি ইন্দু আপন অস্তিত্ব মদনের ওপর উৎসর্গ করে না-দিত তবে এত বড় দুঃখ মদনকে ডুবিয়ে দিত নির্ঘাত।
দশ মাসের মধ্যেই ইন্দুর দ্বিতীয় সন্তান চলে এল। স্ত্রীকে এই নরকের আগুনে ঠেলে দিয়ে মদন নিজের দুঃখ ভুলে গেল। কখনো কখনো তার মনে হয়েছে আমি যদি বিয়ের পর বাবুজির কাছ থেকে ইন্দুকে ডেকে নিয়ে না-আসতাম তবে বোধহয় এত শীঘ্র তিনি মারা যেতেন না। কিন্তু সে বাপের মৃত্যুতে যে লোকসান হয়েছে তা পূরণ করার কাজে লেগে গিয়েছিল। আগে অযত্নের ফলে কারবার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এ বিষয়ে মদনের বিবশতা চলে গেল।
একদিন বড় ছেলেকে মদনের কাছে রেখে দিয়ে ছোট বাচ্চাকে বুকে নিয়ে ইন্দু বাপের বাড়ি গেল। পরে মুন্না বারবার জিদ করলে মদন কখনো তা মেনে নিত, কখনো নিত না। বাপের বাড়ি থেকে ইলুর চিঠি এল–’আমার এখানে ছেলের কান্নার আওয়াজ আসছে। ওকে কেউ মারে না তো…?’ মদন বড় বিস্মিত হল, এক মূর্খ অশিক্ষিত স্ত্রীলোক … এরকম কথা কী করে লিখতে পারে? ফের সে নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিল–’এ-ও বোধহয় কোনো মুখস্থ-করা কথা।’
এভাবে এক বছর কাটল। কখনো এত আয় হয়নি যে তা দিয়ে কোনো আয়েশ করা যেতে পারে। কিন্তু সংসার-নির্বাহের মতো আয় নিশ্চয়ই হয়ে যেত। কষ্ট হত তখনি যখন কোনো বড় খরচ সামনে দেখা দিত। …কুন্দনকে স্কুলে ভর্তি করানো আছে, দুলারি- মুন্নিকে ভালো দিন দেখে পাঠানো হয়েছে। ওই সময় মদন মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকত, আর ইন্দু একদিক থেকে এসে মুচকি হেসে বলত–কেন দুঃখ করছ? মদন তার দিকে আশাভরা নজরে তাকিয়ে বলত–দুঃখী হবে না? কুন্দনের বি এ ক্লাশে ভর্তি করানো আছে …মুন্নি …’ ইনু ফের হেসে বলত, চল আমার সঙ্গে’–আর মদন ভেড়ার বাচ্চার মতো ইন্দুর পিছনে পেছনে চন্দনের সিন্দুক পর্যন্ত যেত। ওই সিন্দুকে মদন সমেত কারুরই হাত দেয়ার অনুমতি ছিল না। কখনো কখনো এই বিষয়ে ক্ষেপে গিয়ে মদন বলত–মরবে তো ওই সিন্দুক বুকে করে নিয়ে যাবে’, ইন্দু বলত–’হাঁ, নিয়ে যাব। তারপর ওই সিন্দুক থেকে প্রয়োজন মতো অর্থ বার করে রাখত সামনে।
‘এ টাকা কোথা থেকে এল?’
‘কোথাও-না-কোথাও থেকে এসেছে…তোমার আম খাওয়ার মতলব আছে কি…’
‘তারপর?’
আর যখন মদন বেশি জিদ করত তখন ইন্দু বলত–’আমি এক শেঠকে বন্ধু বানিয়েছি …’ বলে হাসতে শুরু করত। একথা মিথ্যা জেনেও মদনের এই মজা ভালো লাগত না। ইন্দু ফের বলত–আমি চোর-ডাকাত …তুমি জানো না, খুব বড় ডাকাত–যে এক হাতে লুঠ করে আর অন্য হাতে গরিব-গুর্বোকে দিয়ে দেয়…’ এই ভাবেই মুন্নির বিয়ে হয়ে গেল–এই বিয়েতে এই রকমই লুটের গয়না বিক্রি হয়ে গেল। ঋণ হল, আবার তা শোধও হয়ে গেল।
এইভাবেই কুন্দনের বিয়ে হয়ে গেল। এইসব বিয়েতে ইন্দু স্ত্রী-আচার পালন করত আর মায়ের ভূমিকায় দাঁড়াত। আকাশ থেকে বাবুজি আর মা দেখতেন ও পুষ্প-বৃষ্টি করতেন, যা কারুর নজরে আসত না। তারপর হল কী স্বর্গে মা-জি আর বাবুজির মধ্যে ঝগড়া হয়ে গেল। মা বাবুজিকে বললেন–’তুমি বউয়ের হাতের রান্না খেয়ে এসেছ, ওর সুখও দেখে এসেছ, আর আমি পোড়াকপালী কিছুই দেখিনি’–আর এই ঝগড়া বিষ্ণু ও শিবের কাছে পৌঁছল। তারা মায়ের পক্ষে রায় দিলেন–আর মা এই মৃত্যুলোকে এসে বউয়ের কোলে আশ্রয় নিলেন–আর এখানে ইন্দুর একটি মেয়ে হল। …
অবশ্য ইন্দু এই ধরনের দেবী ছিল না। যখন কোনো সিদ্ধান্তের কথা হত, ননদ-দেবর তো কী, খোদ মদনের সঙ্গেই ঝগড়া করত–মদন সত্যনিষ্ঠার এই পুতুলের ওপর রাগ করে তাকে ডাকত হরিশচন্দ্রের বেটি। ইন্দুর কথায় প্যাঁচ সত্ত্বেও সত্য আর ধর্ম দৃঢ়ভাবে থাকে বলে মদন আর পরিবারের বাকি সব লোকের দৃষ্টি ইন্দুর সামনে নোয়ানো থাকত। ঝগড়া বেড়ে গেলে, মদন স্বামী হবার গর্বে ইন্দুর কত কথাই রদ করে দিত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সকলেই শির ঝুঁকিয়ে ইন্দুরই শরণ নিত আর তার কাছে ক্ষমা চাইত।
নতুন-বউদি এলেন। বলতে হলে তিনিও বিবি ছিলেন, কিন্তু ইন্দুকেই সকলে বলত বিবি। ছোটবউদি রানিকে সকলে বলত কনে-বউ। রানির কারণে ভাইদের মধ্যে ঝগড়া হয়ে জে. পি. খুড়োর মাধ্যমে সম্পত্তি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল–যার মধ্যে একদিকে মা-বাপের সম্পত্তি আর অন্যদিকে ইন্দুর নিজের তৈরি জিনিসপত্র সব বিক্রি হয়ে গেলে ইন্দুর বুকে প্রবল আঘাত লেগেছিল।
সব-কিছু পেয়ে যাবার পর আর আলাদা হয়ে গিয়েও কুন্দন আর রানি ঠিকমতো সংসার পাততে না-পারায় ইন্দুর নিজের ঘর কিছুদিনের জন্য জমজমাট হয়ে থাকত।
মেয়েটার জন্মের পর ইন্দুর স্বাস্থ্য আগের মতো ছিল না। মেয়েটা সবসময় ইন্দুর বুকে লেগে থাকত। যখন সবাই ওই মাংসপিণ্ডের ওপর থু-থু করছিল তখন এক ইন্দুই তাকে বুকে নিয়ে ঘুরত, কিন্তু কখনো-কখনো নিজেও শ্রান্ত হয়ে মেয়েটাকে সামনের দোলনায় ফেলে দিয়ে বলত–’তুই আমাকে বাঁচতে দিবি কিনা?’
বাচ্চা মেয়ে আরো চেঁচিয়ে উঠত।
মদন ইন্দুকে এড়িয়ে যেত ইদানীং। বিয়ের থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মদন সেই নারী পায়নি যার সন্ধান সে করছিল। দুর্গন্ধ বিরোজা বেশ বিক্রি হচ্ছিল আর ইন্দুর। অজ্ঞাতে মদন অনেক টাকা বাইরে-বাইরে খরচ করতে শুরু করেছিল। বাবুজির মৃত্যুর পর জিজ্ঞেস করার মতো কেউ ছিল না। পুরো স্বাধীনতা ছিল মদনের।
পড়শি সিবতের মোষ ফের মদনের মুখের কাছে ফোঁস-ফোঁস শুরু করে। বিয়ের রাতের সেই মোষ তো বিক্রি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার মালিক ছিল বেঁচে। তার সঙ্গে এমন সব জায়গায় যেতে শুরু করেছিল যেখানে আলো আর ছায়া আজব কায়দার মূর্তি বানাত। কোণের দিকে কখনো আঁধারের ত্রিকোণ তৈরি হত, আবার ওপরে ফট করে আলোর এক চৌকোণ এসে কেটে দিত তাকে। কোনো ছবিই পুরো তৈরি হত না। মনে হত পাশ থেকে এক পাজামা বেরিয়ে এসে আকাশের দিকে উড়ে গেল। কোনো একটা কোট দর্শকের মুখ পুরোপুরি ঢেকে দিত। যদি কেউ শ্বাস নেয়ার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠে তখনি আলোর চৌকোণ এক চৌখুপি হয়ে যেত আর তার মধ্যে এক মূর্তি এসে দাঁড়িয়ে যেত। দর্শক যদি হাত বাড়ায় তবে সে আয়ত্তের বাইরে চলে যায়, আর সেখানে তখন। কিছুই থাকে না। পিছনে কোনো কুকুর কাঁদতে থাকে। উপরে তবলার আওয়াজ ওই কান্নাকে ডুবিয়ে দেয়…
মদন তার কল্পনার আকৃতি পেয়ে গিয়েছিল; কিন্তু প্রত্যেক জায়গাতে মনে হত কোথায় যেন শিল্পীর এক ত্রুটিপূর্ণ রেখা রয়ে গেছে। আর হাসির আওয়াজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত তীক্ষ্ণ হয়ে উঠত, মদন নিখুঁত শিল্পগত ভারসাম্যযুক্ত হাসির খোঁজে হারিয়ে যেত।
ওই বিষয়ে সিবতে নিজের বিবির সঙ্গে কথা বলেছিল। তার বেগম মদনকে আদর্শ স্বামীরূপে পেশ করেছিল সিবতের সামনে। কেবল পেশ করেনি, বরং মুখের ওপর ছুঁড়ে মেরেছিল। তাকে (ঐ আদর্শকে) তুলে নিয়ে সিতেও তার বেগমের মুখের ওপর ছুঁড়ে মেরেছিল। মনে হচ্ছিল তা কোনো তরমুজের ভিতরের অংশ–তার সূতোগুলো বেগমের নাক, চোখ, কানের ওপর লেগে গিয়েছিল। বিস্তর গাল দিতে দিতে বেগম স্মৃতির টুকরি থেকে ওই সব ভিতরের অংশ আর বিচি তুলে নিয়ে ইন্দুর সাফসুতরো আঙিনায় দিয়েছিল ছড়িয়ে।
এক ইন্দুর বদলে দুই ইন্দু হয়ে গেল। এক তো ছিল ইন্দু নিজেই আর দ্বিতীয় হল এক কম্পিত রেখা–যা ইন্দুর পুরো শরীরে থাকে অথচ নজরে আসে না।
মদন কোথাও গেলে দোকান থেকে ফিরে এসে যেত…স্নান করে ভালো কাপড় পরে, খুশবুদার কিমাম-দেয়া এক জোড়া মঘাই পান মুখে রেখে,…কিন্তু ওই দিন মদন যখন ঘরে ফিরে এল তখন ইন্দুর চেহারাই ছিল অন্য রকম। সে তার মুখের ওপর পাউডার মেখেছিল। গালে লাগিয়েছিল রুজ। লিপস্টিক ছিল না বলে মাথার সিঁদুর দিয়ে ঠোঁট রাঙিয়েছিল আর এমনভাবে চুল বেঁধেছিল যে, মদনের নজর তার মুখের ওপর আটকে গেল।
‘আজ কী ব্যাপার?’ মদন বিস্মিত।
‘কিছু না। ইন্দু মদনের নজর বাঁচিয়ে বলল–’আজ অবকাশ মিলেছে।‘
বিয়ের পর পনেরো বছর কেটে যাবার পর ইন্দুর আজ অবকাশ মিলেছে আর তা-ও যখন তার মুখের ওপর ছায়া পড়েছে। নাকের ওপর এক কালির মতো রেখা আর ব্লাউজের নিচে উন্মুক্ত পেটের কাছে কোমরে চর্বির দু-তিনটে স্তর দেখা যাচ্ছে। আজ ইন্দু এমন সাজগোজ করেছিল যাতে তার ত্রুটিগুলোর একটাও নজরে না-আসে। এইসব সাজ-গোজ, আঁটসাঁটভাবে তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। এ হতে পারে না’–মদন ভাবল আর এ-চিন্তা তাকে আঘাত করল। সে আরেকবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ইন্দুর দিকে–যেভাবে ঘোড়ার ব্যাপারি কোনো নামী ঘোড়ার দিকে তাকিয়ে দেখে। যেখানে যে গলদ ছিল মাতালের দৃষ্টিতে তা দেখা যাচ্ছিল না …ইন্দু সত্যিসত্যি সুন্দরী। পনেরো বছর বাদে আজ ফুলো, রশিদা, মিসেস রবার্ট আর তার বোনেরা তার সামনে জল ভরে নিচ্ছে…মদনের মনে দয়া এল, আর এল ভয়।
আকাশে মেঘ ছিল না কিন্তু বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছিল। ঘরের গঙ্গা বাড়তে শুরু করে তার জল কিনার ছাপিয়ে পুরো পার্বত্যভূমি আর পার্শ্ববর্তী বসতিগ্রাম আর শহরগুলোকে আপন গ্রাসের মধ্যে নিয়ে নিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই তীব্র গতিতে স্রোত প্রবাহিত হতে থাকলে কৈলাস পর্বতও ডুবে যাবে। …এদিকে ছোট মেয়েটা কাঁদতে শুরু করল। এমন কান্না সে কাঁদেনি।
মদন তার কান্নার আওয়াজে দু চোখ বন্ধ করে আবার যখন খুলল তখন ছোট মেয়েটা সামনে দাঁড়িয়েছিল–যুবতী হয়ে। না, না…ও তো ইন্দু। আপন মায়ের মেয়ে, আপন মেয়ের মাসে তাকে চোখের কোণে মুচকি হাসি নিয়ে দেখল, ঠোঁটের ফাঁকে হাসি নিয়ে দেখতে থাকল।
এই কামরায় ধুনোর ধোয়ায় একদিন মদনের মাথা ঘুরে গিয়েছিল। আজ ইন্দুর সাজগোজের সুগন্ধ তাকে পাগল করে দিল। হালকা বৃষ্টি ভারি বৃষ্টির চেয়ে বিপজ্জনক হয়ে থাকে। এইজন্য বাইরের জল ওপরের কোনো কড়িতে পড়ে ইন্দু আর মদনের মাঝখানে টপটপ করে পড়তে শুরু করল …কিন্তু মদন তো তখন মাতাল। এই নেশায় তার দু’চোখ ছোট হয়ে আসছিল আর শ্বাস পড়ছিল দ্রুত যেন তা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস নয়।
‘ইন্দু’ মদন বলল … তার কণ্ঠস্বর বিয়ের রাতের কণ্ঠস্বরের দুই গ্রাম ওপরে ছিল। ইন্দু দূরে চোখ মেলে বলল–’জি’, আর তার আওয়াজ ছিল দুই গ্রাম নিচে … আজ ছিল চাঁদনি রাতের বদলে অমাবস্যার রাত…
এর পরে মদন ইন্দুর দিকে হাত বাড়লে ইন্দু নিজেই মদনের সঙ্গে মিশে গেল। ফের মদন আপন হাতে ইন্দুর চিবুক তুলে ধরে দেখল, সে কী হারিয়েছে, কী পেয়েছে? ইন্দু মদনের কালী-হয়ে-যাওয়া মুখের দিকে এক নজর তাকিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে ফেলল … এ কী? মদন চকিত হয়ে বলল–’তোমার দু চোখ ফুলে গেছে।’
‘এমনিই’। ইন্দু ছোট মেয়ের দিকে ইশারা করে বলেছিল–এই হতভাগী আমায় সারা রাত জাগিয়ে রেখেছে…’
মেয়েটা এখন চুপ করে আছে। মনে হচ্ছে দম নিয়ে দেখছে এখন কী হতে পারে? আকাশ থেকে জল পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মদন ফের সযত্নে ইন্দুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল–’হাঁ…কিন্তু এই অশ্রু?’
‘খুশিতে।’ ইন্দু জবাব দিয়েছিল–’আজকের রাত আমার’–ফের এক অদ্ভুত হাসি হেসে সে মদনকে আঁকড়ে ধরেছিল। কেমন এক আনন্দের অনুভূতিতে বলল মদন–আজ অনেক বছর পরে আমার মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হল, ইন্দু। আমি হামেশা চেয়েছিলাম
‘কিন্তু তুমি তো বলনি।’ ইন্দু বলল, মনে আছে, বিয়ের রাতে আমি তোমার কাছে কিছু চেয়েছিলাম?
‘হ্যাঁ–মদন বলল–’তোমার দুঃখ আমাকে দাও।’
‘তুমি তো আমার কাছে কিছু চাওনি।’
‘আমি!’ মদন বিস্মিত হয়ে বলল–’আমি কী চাইব? আমি যা কিছু চাইতে পারতাম সবই তুমি আমায় দিয়েছ। আমার আত্মীয়জনের প্রতি ভালোবাসা–তাদের লেখাপড়া, বিয়েশাদি–এইসব সুন্দর বাচ্চা–এইসব কিছুই তো তুমি দিয়েছ।
‘আমিও তো তাই বুঝতাম।’ ইন্দু বলল–’কিন্তু এখন আমি জানতে পেরেছি, এইসব নয়।’
কী বলতে চাইছ?’
‘কিছু না ইন্দু থেমে গিয়ে ফের বলল—
‘আমি একটা জিনিস রেখেছি।’
‘কী জিনিস রেখেছ?’
ইন্দু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল–’আমার লজ্জা …আমার খুশি … ওই সময় তুমিও তো বলে দিতে পারতে … তোমার সুখ আমাকে দাও … তা হলে আমি …বলতে-বলতে ইন্দুর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল।
আর কিছুক্ষণ পরে ইন্দু বলল–’এখন তো আমার কাছে কিছুই রইল না।
মদনের ধরা-হাত শিথিল হয়ে গেল। সে যেন মিশে গেল মাটিতে–এই অশিক্ষিত স্ত্রীলোক–এ কি কোনো মুখস্থ করা কথা–?
তো … এ তো এখনি তার সামনে জীবনের ভাটি থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন তো তার ওপর বারবার হাতুড়ি পড়ছে আর চারিদিকে উড়ছে আগুনের ফুলকি …।
কিছুক্ষণ পরে মদনের হুঁশ ফিরে এলে সে বলল–’আমি বুঝেছি ইন্দু।’
তারপর কাঁদতে-কাঁদতে মদন আর ইন্দু পরস্পরের সঙ্গে মিশে গেল। ইন্দু মদনের হাত ধরে তাকে এমন দুনিয়ায় নিয়ে গেল যেখানে মানুষ মরে গিয়েই পৌঁছতে পারে।
অনুবাদ : ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
ঠাণ্ডা গোশত – সাদত হাসান মান্টো।
ঈশ্বরসিং হোটেলের কামরায় প্রবেশ করতেই, কুলবন্ত কাউর পালং থেকে উঠে দরজার খিল বন্ধ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। রাত তখন ১২টা। সারা শহরে নীরবতা
কিছুক্ষণ দেখে কুলবন্ত কাউর খাটের উপর ধপাস করে বসে পড়ে। ঈশ্বরসিং বিশ্রী এক চিন্তার ধকল থেকে মুক্তির চেষ্টা করছিল; কৃপাণ হাতে দাঁড়িয়ে ছিল এক কোণে। কিছু সময় কেটে গেল, কুলবন্তের উপবেশনের আসন মনঃপুত হওয়ায় সে দু পা পালং-এর নিচের দিকে ঝুলিয়ে নাড়তে থাকে। তবুও ঈশ্বরসিং-এর মুখে কোনো রা নেই।
কুলবন্ত কাউর মোটাসোটা গড়নের মহিলা। উজ্জ্বল দুটি চোখ। উপরের ঠোঁটে হালকা গোঁফের রেখা। একটু পরখ করলেই বোঝা যায় বড়ই রাশভারি মহিলা। ঈশ্বরসিং মাথা নিচু করে এককোণে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার পাগড়ি খসে পড়ার উপক্রম হয়েছে। হাতের মুষ্ঠিতে ধরে রাখা কৃপাণ ক্রমশ ঝুলে পড়ছে, অথচ তার দেহের গড়ন ও উচ্চতা দেখে মনে হয়, সে একজন সুঠাম দেহের অধিকারী যুবক। কিছুক্ষণ এমনি নীরবতায় অতিক্রান্ত হয়। কুলবন্তের উজ্জ্বল নয়নযুগল নেচে ওঠে। নীরবতা ভঙ্গ করে কুলবন্ত তাকে ডাকে, ঈশ্বর সিয়া।’ ঈশ্বরসিং চোখ তুলে তাকায়। কিন্তু কুলবন্তের তির্যক দৃষ্টির দিকে চেয়ে থাকা তার পক্ষে দুরূহ। তাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
কুলবন্ত চিৎকার করে উঠল, ‘ঈশ্বর সিয়!’ স্বরটা সামলে নিয়ে খাট থেকে উঠে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?’ ঈশ্বরসিং শুষ্কঠোঁটে জিহ্বা ঘষে নিয়ে উত্তর দেয়, আমি জানি না।’ কুলবন্ত রেগে ওঠে, এটা কি কোনো জবাব হল?
ঈশ্বরসিং কৃপাণ একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দেয় এবং খাটে সটান শুয়ে পড়ে। তাকে দেখে মনে হয় সে অনেক দিন যাবত রোগে ভুগছে। কুলবন্ত খাটের দিকে তাকাল, সেখানে ঈশ্বরসিং শুয়ে ছিল। কুলবন্তের মনে সহানুভূতি ও আবেগের সঞ্চার হল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মায়াভরা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে তোমার কী হয়েছে বল তো।’
ঈশ্বরসিং ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর কুলবন্তের দিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখে আর ডাকে, কুলবন্ত। তার কণ্ঠ বিষাদভরা।
কুলবন্তের চোখে প্রেমের আবেগ ফুটে ওঠে, জী, বল’, বলে সে সাড়া দেয়।
ঈশ্বরসিং পাগড়ি খুলে ফেলে। আশ্রয়কাতর দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকায়। মাংসল পেটে জোরে চড় মেরে, মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে বিড়বিড় করে বলে, ‘মাথা বিগড়ে গেছে। মাথায় ঝাঁকুনির ফলে তার চুলের খোঁপা খুলে যায়। কুলবন্ত হাতের আঙুলে স্বামীর চুল আঁচড়াতে থাকে। এমনিভাবে স্বামীর চুলে আঙুল চালিয়ে প্রীতিভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করে, ঈশ্বরসিং, এতদিন কোথায় ছিলে?’ কবিরে’, ঈশ্বরসিং কুলবন্ত কাউরকে ভীরু দৃষ্টিতে দেখতে থাকে এবং দু’হাতে তার দু বাহু জাপটে ধরে বলে, ‘গুরুর দিব্যি, তুমি অত্যন্ত বাজে মেয়ে!
কুলবন্ত কাউর এক পলকে ঝাঁকি দিয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, আমার দিব্যি, বল, কোথায় ছিলে, শহরে গিয়েছিলে?’ ঈশ্বর চুলের খোঁপা তৈরি করতে গিয়ে উত্তর দেয়, কোথাও না।
কুলবন্ত রেগে বলে, তুমি নিশ্চয় শহরে গিয়েছ, বহু টাকা লুট করেছ। এখন আমার কাছে লুকোবার চেষ্টা করছ।’
বাপের জন্ম নই যদি তোমার সঙ্গে মিথ্যে বলি।’ কুলবন্ত চুপসে যায়। কিন্তু আবার হঠাৎ রেগে ওঠে, আমার বোধগম্য হচ্ছে না, সে রাতে তোমার কী হয়েছিল। বেশ ভালোই ছিলে। শহর থেকে লুণ্ঠিত সব অলঙ্কারপত্র আমার পরনে। হঠাৎ কি জানি তুমি উঠে দাঁড়ালে আর জামাকাপড় পড়ে কোথায় বেরিয়ে পড়লে।
ঈশ্বরসিং-এর চেহারা ফ্যাকাশে আকার ধারণ করে। কুলবন্ত তার এই পরিবর্তন দেখে বলে, ‘দেখলে, তোমার চেহারার রঙ কেমন পাল্টে গেল। ঈশ্বর সিয়া, দিব্যি করে বলছি, নিশ্চয় কোনো রহস্য আছে।’
‘তোমার মাথার দিব্যি দিয়ে বলছি, সত্যিই কিছু হয়নি। ঈশ্বরসিং-এর কণ্ঠ প্রাণহীন। কুলবন্তের সন্দেহ আরও সুদৃঢ় হয়, ঠোঁট কামড়িয়ে জোরের সঙ্গে বলে, ঈশ্বর সিয়া, কী ব্যাপার বল তো, আটদিন আগে তুমি যেমন ছিলে এখন তো তেমন নেই।’
ঈশ্বরসিং উঠে বসে। যেন কেউ তাকে হামলা করেছে। কুলবন্তকে পাশে বসিয়ে বলে, কুলবন্ত আমার কোনো পরিবর্তন হয়নি।’
কুলবন্তের অভিযোগ শেষ হয় না, বলে, তুমি সেদিন রাতে বাইরে কেন গিয়েছিলে? জাহান্নামে! বলছনা কেন?’
‘কিছু হলে তো বলব।’
‘আমাকে নিজ হাতে পুড়িয়ে মার যদি মিথ্যে বল।
ঈশ্বরসিং দুই হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে এবং মুখখানি কানের কাছে নিয়ে গিয়ে চুপি-চুপি কী যেন বলে। গোঁফের কেশরাজি কুলবন্তের নাকে প্রবেশ করলে তার হাঁচি পায়। দুজনেই হেসে ওঠে।
ঈশ্বরসিং কুলবন্তকে স্নেহভরা দৃষ্টিতে দেখতে থাকে; এখন অতীতের কথা ভুলে যাও।’
কুলবন্ত কাউরের উপরের ঠোঁটে শিশিরের মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। এক বিচিত্র ভঙ্গিতে চোখের পুতলি ঘুরিয়ে বলে, চল সন্ধি করি।’
ঈশ্বরসিং তার সুডৌল বাহু ধরে জোরে চাপ দেয়। কুলবন্ত কাউর চটপট করে একদিকে সরে পড়ে, ‘সরে যাও ঈশ্বর সিয়া। ব্যথা পাই।’ ঈশ্বরসিং আবার কুলবন্ত কাউরকে পাকড়াও করে পাশে বসায় এবং মিষ্টি আলাপে তার হৃদয় কোমল করার চেষ্টা করে। কুলবন্ত এই ততশামোদে গলে মোম হয়ে যায়।
কুলবন্তের উপরের ঠোঁট মৃদু কাঁপছিল। ঈশ্বরসিং-এর মনে হিংস্রতা জেগে ওঠে। সজোরে তার বাহু ধরে কচলান দিয়ে বলে, কুলবন্ত গুরুজির দিব্যি করে বলছি, তুমি বড় ভালো।’
কুলবন্ত তার বাহুতে চাপ দেয়ার ফলে সৃষ্ট লাল দাগ দেখে বলল, তুমি বড় নিষ্ঠুর ঈশ্বর সিয়া।
ঈশ্বরসিং ঘন কালো গোঁফের আড়ালে মুচকি হাসে, তুমি কোনো অংশে কম নও।’ কুলবন্ত কাউর জ্বলন্ত আগুনে দেয়া কড়াইয়ের মতো জ্বলে ওঠে। অন্যদিকে ঈশ্বরসিং যেন কিসের ভাবনায় মগ্ন। সে কুলবন্তের উপস্থিতি পর্যন্ত ভুলে যায়। কুলবন্ত নিচু গলায় বলে ঈশ্বর সিয়া, তুমি কোন জগতে বিচরণ করছ?’
এ-কথা শুনে ঈশ্বরসিং-এর ধ্যান ভাঙে, যেন হাত থেকে সব তাসগুলো ছিটকে পড়েছে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দেখতে থাকে এদিক-ওদিক। তার মাথায় চুলের গোড়ায় ঘামের প্রলেপ দেখা দেয়। কুলবন্ত কাউর তাকে দৃষ্টি আকর্ষণের বহু চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তারপর খাট থেকে নিচে নেমে রেগে নাসা ফুলিয়ে বলে, ঈশ্বর সিয়া, কোন হারামজাদির কাছে। তুমি এতদিন ছিলে, কে আমার বুক থেকে তোমাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল?
ঈশ্বরসিং পালঙ্কে শুয়ে হাই তোলে। কুলবন্ত কাউর রাগে গরগর করতে থাকে, আমি জিজ্ঞাসা করছি সে কে? কে?’
ঈশ্বরসিং প্রাণহীন কণ্ঠে উত্তর দেয় ‘কেউ না, কুলবত্ত কেউ না।’ কুলবন্ত কোমরে হাত রেখে দৃঢ়তার সঙ্গে বলে, ‘ঈশ্বর সিয়া, আমি আজ সত্য-মিথ্যা যাচাই করবই। গুরুজির দিব্যি করে বল, তোমার কল্পনারাজ্যে কি কোনো নারীর ছবি নেই?
ঈশ্বরসিং কিছু বলার চেষ্টা করে। কিন্তু কুলবন্ত তার সুযোগ না-দিয়েই গর্জন করে ওঠে, কসম খাওয়ার আগে ভেবে দেখ, আমিও সরদার নেহালসিং-এর মেয়ে। মিথ্যা বললে কেটে টুকরো-টুকরো করে ফেলব। নাও, এবার গুরুজির কসম খাও…বলো তোমার চিন্তা-ভাবনা কোনো নারী নিয়ে কিনা?’
ঈশ্বরসিং বেদনার সঙ্গে সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে হ্যাঁ’ বলে। কুলবন্ত মুহূর্তের জন্য পাগল হয়ে যায়। লাফিয়ে গিয়ে ঘরের কোণায় রাখা কৃপাণ তুলে নেয় হাতে। কলার খোসার মতো কৃপাণের কভার ছুঁড়ে ফেলে ঈশ্বরের ঘাড়ের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে।
তড়িৎ ফিনকি দিয়ে রক্তের ফোয়ারা ছোটে।
এতেও কুলবন্তের সাধ মেটে না। ঈশ্বরের চুলের জটা ধরে টানতে-টানতে অশ্লীল ভাষায় সেই অদৃশ্য নারীকে তিরস্কার করতে থাকে। ঈশ্বরসিং কিছুক্ষণ পর দুর্বল কণ্ঠে আবেদন জানায়, কুলবন্ত ওসব ভুলে যাও।’ তার কণ্ঠে বেদনার অতলান্ত ছায়া। কুলবন্ত কাউর পেছনে সরে দাঁড়ায়। ঈশ্বরসিং-এর গলায় কৃপাণের আঘাতে সৃষ্ট ক্ষত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়িয়ে তার গোঁফের ওপর এসে পড়েছে। রক্তাক্ত ঈশ্বরসিং কৃতজ্ঞতা ও অভিযোগের মিশ্ৰদৃষ্টিতে কুলবন্তের দিকে চোখ তুলে তাকায়; কুলবন্ত, তুমি এত তাড়াতাড়ি এমন কাজ করলে! যাক যা হওয়ার হয়ে গেছে। কুলবন্ত আবার রেগে ওঠে, কিন্তু সে তোমার কোন আত্মীয়া বল?’ এবার রক্ত ঈশ্বরসিং-এর মুখে এসে পড়ে। রক্তের স্বাদ জিহ্বায় অনুভব করে। তার সারা দেহ শিউরে ওঠে। আর আমি … আমি এই কৃপাণ দিয়ে … ছয় জনকে খুন করেছি।’ মনে-মনে উচ্চারণ করে ঈশ্বরসিং।
কুলবন্তের মাথায় শুধু দ্বিতীয় মহিলার ছবি, আমি জিজ্ঞেস করছি কে সেই হারামজাদি?’ ঈশ্বরসিং-এর চোখ ঢুলুঢুলু করছিল। তার মুখ হালকা উজ্জ্বল দেখায়, সে কুলবন্তকে বলে, সেই নিপাপকে তিরস্কার কর না।’ কুলবন্ত চিৎকার করে ওঠে, আমি জানতে চাই, সে কে?
ঈশ্বরসিং-এর গলার স্বর জড়িয়ে আসে, ‘বলছি’। এরপর ঘাড়ে হাত বুলিয়ে তাজা রক্ত দেখে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। মানুষও এক বিচিত্র জীব।
কুলবন্ত তখনও তার উত্তরের প্রতীক্ষায় ছিল; ‘ঈশ্বর সিয়া, তুমি কাজের কথা বল। ঈশ্বরসিং রক্তাক্ত গোঁফের ফাঁকে আবার মুচকি হাসে, কাজের কথাই বলছি। আমার গলা ধরে আসছে–এখন ধীরে-ধীরে সব কথাই বলব।’ কথা বলার সময় তার মাথায় চুলের গোড়ায় শীতল ঘামের প্রলেপ দেখা দেয়।
‘কুলবন্ত, আমার প্রিয় … আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না, আমার কী হয়েছে? মানুষ এক বিচিত্র জীব। শহরে লুটতরাজের সময় আমিও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। গহনাপত্র ও টাকা যা লুট করে এনেছি, সব তোমার হাতে দিয়েছি। কিন্তু একটা কথা তোমাকে বলিনি।’ ঈশ্বরসিং কাটা ঘায়ের ব্যথায় ঝাঁকিয়ে ওঠে। কুলবন্ত কাউরের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই–বরং রূঢ়কণ্ঠে আবার প্রশ্ন করে, ‘কোন কথা?’
গোঁফে জমে যাওয়া রক্ত ফুঁ দিয়ে অপসারণ করে ঈশ্বরসিং বলে, ‘যে-বাড়িতে…আমি লুঠতরাজের মানসে প্রবেশ করেছিলাম…সেখানে সাতজন লোক ছিল। ছয়জনকে আমি খুন করি এই কৃপাণ দিয়ে; যেটা দিয়ে তুমি আমাকে … বাদ দাও সে সব কথা … শোনো … একটি সুন্দরী মেয়ে … তাকে তুলে আমি সঙ্গে নিয়ে আসি।’
কুলবন্ত কাউর নীরবে শুনতে থাকে। ঈশ্বরসিং আরেকবার ফুঁ দিয়ে গোঁফে জমাট রক্ত দূর করে বলে, কী বলব, দারুণ সুন্দরী মেয়েটি …তাকেও হত্যা করতাম। কিন্তু হায় …আমি তার রূপে মজে যাই।’ কুলবন্ত শুনে বলে, হু। এবং আমি তাকে তুলে নিয়ে চলতে থাকি রাস্তায় …কী জানি বলছিলাম? হ্যাঁ, রাস্তায় …নদীর তীরে একটি বৃক্ষের ছায়ায় তাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখি।’ এ কথা বলতে বলতে ঈশ্বরসিং-এর। গলা শুকিয়ে আসে।
কুলবন্ত ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিয়ে বলে, তারপর কী হল?
ঈশ্বরসিং অতিকষ্টে ধীরকণ্ঠে বলে, কিন্তু…তার স্বর তলিয়ে যায়; কুলবন্ত কাউর ধমক দিয়ে বলে, তারপর কী হল?
ঈশ্বরসিং তার বুজে আসা চোখ মেলে কুলবন্তের দিকে তাকায়; তার দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রাগে থরথর করে কাঁপছে। আসলে সে…মরে গিয়েছিল, সেটা ছিল তার মৃত লাশ…যেন ঠাণ্ডা গোশত…! কুলবন্ত আমাকে তোমার হাত ধরতে…দাও।’
কুলবন্ত কাউর নিজের হাত ঈশ্বরসিং-এর হাতে রাখে, তখন তার হাত বরফের চেয়ে অধিক ঠাণ্ডা, যেন ঠাণ্ডা গোশত।
আনন্দী – গোলাম আব্বাস
মিউনিসিপ্যালিটির সভা বেশ জমেছে। হল লোকে পরিপূর্ণ। অন্যান্য দিনের সাধারণ নিয়ম ভঙ্গ করে প্রতিটি সদস্য আজ উপস্থিত রয়েছেন। আলোচনার বিষয়–শহরের মধ্যস্থলে অবস্থিত বেশ্যাদেরকে শহর থেকে অপসারণ করা। কারণ, এরা মানবতা, সংস্কৃতি আর আভিজাত্যের পরিচ্ছন্ন পরিবেশে কলঙ্কের মতো বিরাজ করছে।
মিউনিসিপ্যালিটির একজন গম্ভীর সদস্য–যিনি নিজেকে দেশ আর জাতির খাঁটি খাদেম বলে দাবি করেন–অত্যন্ত জ্বালাময়ী ভাষায় বললেন–’ভদ্রমহোদয়গণ, একবার তাদের অবস্থিতি লক্ষ করুন। এটা যে শুধু শহরের মধ্যস্থল তা নয়, বরং এটা শহরের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র; অতএব প্রতিটি সম্মানিত ব্যক্তিকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও এই পথ দিয়ে চলাফেরা করতেই হয়। উপরন্তু অভিজাত ব্যক্তিবর্গের পুণ্যশীলা স্ত্রী-কন্যারা বিকিকিনির জন্য অহরহ এখানে আসতে বাধ্য হন। এসব নির্লজ্জ, অর্ধউলঙ্গ বেশ্যাদের সাজ-পোশাকের চাকচিক্য দেখে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনেও নানারকম রঙিন-রঙিন আকাঙ্ক্ষা মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ায়, আর ঘরে ফিরে এসে তাঁদের দরিদ্র স্বামীদের ওপর বিভিন্ন প্রসাধন দ্রব্য, নিত্যনতুন শাড়ি ইত্যাকার অনেক জিনিসের জন্য পীড়াপীড়ি করেন। ফলে সুখী-স্বচ্ছন্দ পরিবারগুলো অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়। ভদ্রমহোদয়গণের অবগতির জন্য আমি আরো একটি জিনিসের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমাদের কচি ছেলেরা জাতির ভবিষ্যৎ। জাতি তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে। জাতিকে কালের ঘূর্ণাবর্ত থেকে উদ্ধার করার দায়িত্ব এদেরই। এইসব ছেলেদের সকাল-সন্ধ্যা এই রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়। এসব বেশ্যারা সবসময় রকমারি মনমাতানো সাজ পরে। লোভনীয় প্রসাধনীর আবরণে নিজেদের ঢেকে সবাইকে রূপচর্চায় আমন্ত্রণ জানায়। এসব দেখেশুনে আমাদের অপরিণামদর্শী, আত্মভোলা ছেলেরা যৌবনের উন্মাদনায় বিহ্বল হয়ে নিজেদের এর ভেতর জড়িয়ে ফেলে। এ-অবস্থায় তাদের পক্ষে নিজেদের সৎস্বভাবকে পাপের বিষাক্ত ছোবল থেকে সরিয়ে রাখা কি সম্ভব? অতএব মহোদয়গণ, এসব রূপোপজীবীরা কি এদের জাতি গঠনমূলক কাজ থেকে বিমুখ করে তাদের মনে পাপ-বাসনা সৃষ্টি করে তাদের একটা বিশ্রী ব্যাকুলতা, চাঞ্চল্য আর উত্তেজনার শিকারে পরিণত করছে না?
এই সুযোগে যোগ-বিয়োগে সিদ্ধহস্ত একজন প্রাক্তন শিক্ষক বললেন–মহোদয়গণ, মনে রাখবেন–পরীক্ষায় ফেলের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় এবার দেড় গুণ বেড়ে গেছে।
অতঃপর একজন চশমাধারী সদস্য উঠলেন। তিনি একখানা সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক। বললেন–’আমাদের শহর থেকে দিন-দিন মর্যাদাবোধ, আভিজাত্য, পৌরুষ, পুণ্যশীলতা আর সংযম যাচ্ছে উঠে। এর বদলে হীনমন্যতা, কাপুরুষতা, বদমায়েশি, চৌর্যবৃত্তি বেড়ে যাচ্ছে। মানুষ দিন-দিন ধ্বংসের দুর্গম অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলেছে। হত্যা, লুণ্ঠন আর আত্মহত্যার ভেতর দিয়ে মানুষের এই রূপ প্রকট হয়ে উঠছে। এর একমাত্র কারণ এসব অস্পৃশ্য নারীদের আত্মঘাতী প্রভাব। আত্মভোলা শহরবাসীরা এসব ছলনাময়ী নারীদের রূপের শিকার হয়ে সিদ্ধ-অসিদ্ধ যে কোনো উপায় টাকা সংগ্রহ করে এদের পেছনে ঢালছে। মাঝে-মাঝে এ ব্যাপারে তারা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে, তারা মনুষ্যত্ববোধ পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে বসে, ফলে হয় তারা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দেয়, অথবা জেলখানার চার দেয়ালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।
একজন পেনশনপ্রাপ্ত সদস্য উঠলেন। তিনি একটি বিস্তৃত আর উন্নত বংশের পৃষ্ঠপোষক। পৃথিবীর ভাব ও মিঠেকড়ার সঙ্গে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। এখন জীবনের শেষপ্রান্তে এসে অবশিষ্ট দিনগুলো একটু আরাম-আয়েশে কাটিয়ে দিতে চান এবং বংশধরদের নিজের পক্ষপুটে উন্নত আর উদ্ধত দেখে যেতে চান। তিনি অত্যন্ত আবেগময়ী ভাষায় বললেন–জনাব, রাতের পর রাত এদের তবলার ডুগডুগি, গলাবাজি, এদের গ্রাহকদের হৈ-হল্লা, গালিগালাজ, শোরগোলের প্রচণ্ড শব্দ শুনতে-শুনতে আশেপাশের ভদ্রলোকদের কানে তালা লাগার উপক্রম হয়েছে। রাতের নিদ্রা, দিনের বিশ্রামকে পণ্ড করে প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুলেছে এরা। উপরন্তু এদের সর্বগ্রাসী প্রভাবে আমাদের বৌ-ঝিরা কীভাবে প্রভাবিত তা সকলেই অনুমান করতে পারেন…।’ শেষের অংশটুকু বলতে তার গলার শব্দ আবেগে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। ফলে তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বের হল না। সকল সদস্যেরই তার প্রতি গভীর সহানুভূতি ছিল। কারণ দুর্ভাগ্যবশত তার প্রাচীন বাড়িটি এসব রূপোপজীবীদের এলাকার একেবারে নিকটে।
এরপর একজন রক্ষণশীল সদস্য দণ্ডায়মান হলেন। রক্ষণশীলতা তাঁর কাছে নিজের সন্তান-সন্ততির মতোই প্রিয়। তিনি বললেন–’বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক ভ্রমণকারী আমাদের এই প্রসিদ্ধ শহর পরিদর্শনে আসেন। এসব দেখার পর তাদের মনে কী ধারণা জন্মে তা একবার ভেবে দেখুন।’
এবার মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান বক্তৃতা করতে উঠলেন। কাঠখোট্টা গোছের এই ভদ্রলোকটির ছোট-ছোট হাত-পা। কিন্তু তার মাথাটা বেশ বড়-সড় বলে খানিকটা গম্ভীর দেখায়। তিনি বললেন–বন্ধুগণ, এ-ব্যাপারে আংশিকভাবে আপনাদের সঙ্গে আমি একমত। সত্যিই এদের জন্যে আমাদের শহর, আমাদের সংস্কৃতি দারুণ সংকটের মুখোমুখি। কিন্তু মুশকিল বাধছে এর প্রতিকার নিয়ে। যদি এদের এই নীচ ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয় তা হলে প্রশ্ন উঠবে–এরা খাবে কী করে?
একজন সদস্য প্রশ্ন করলেন–’এরা বিয়ে করে না কেন?’
এ প্রশ্নে একটা তরল হাসির রোল উঠল। হলের থমথমে ভাব এতে বেশ খানিকটা লঘু হয়ে হলের প্রতিটি মানুষের মুখমণ্ডলে একটা সরস ভাব ফুটে উঠল।
অবস্থা খানিকটা শান্ত হলে সভাপতি সাহেব বললেন–বন্ধুগণ এই প্রস্তাব ইতিপূর্বে অনেকবার এদের সামনে তোলা হয়েছে। তাদের তরফ থেকে জবাব এসেছে–কোনো অভিজাত বংশের গৃহে এরা বধূ হিসেবে প্রবেশাধিকার পাবে না। আর যেসব দরিদ্র, নীচ বংশের লোক অর্থের লোভে এদের বিয়ে করতে চাইবে তাদের এরা পাত্তা দেবে না।’
এ কথা শুনে জনৈক সদস্য বললেন–এসব ব্যাপারে সদস্যদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই। তারা যেখানেই থাক-না কেন, আমাদের দায়িত্ব হল তাদের এই শহর থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া।’
সভাপতি বললেন–সেটিও অত সোজা কাজ নয়। এরা তো আর দশ-বিশ জন নয়, হাজারের ওপর এদের সংখ্যা। উপরন্তু এদের মধ্যে অনেকের নিজস্ব বাড়িঘরও রয়েছে।
ব্যাপারটি বেশ কয়েকমাস যাবত মিউনিসিপ্যালিটির আয়ত্তাধীনে থাকল। শেষে সদস্যদের সম্মিলিত মতে সাব্যস্ত হল যে, এসব দেহপসারিণীদের জায়গা-সম্পত্তি খরিদ করে নেয়া হবে এবং শহর থেকে বেশ দূরে পুনর্বাসন করা হবে এদের। মিউনিসিপ্যালিটির এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বেশ্যাদের ভেতর প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হল। অনেকে এই আদেশ অমান্য করে জরিমানা এবং জেল পর্যন্ত ভোগ করল। তবুও মিউনিসিপ্যালিটির বিরুদ্ধে তাদের কোনো দাবি টিকল না। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে মেনে নিতেই হল এই সিদ্ধান্ত।
এরপর অনেকদিন কেটে গেল এসব বাড়ির সীমানা নির্ধারণ আর গ্রাহক ঠিক করতে। বারবার এসব বাড়ি নিলামে উঠতে শুরু করল। বেশ্যাদের ছয়মাস পর্যন্ত তাদের পুরনো বাড়িতে থাকার অনুমতি দেয়া হল যাতে এই সময়ের মধ্যে ওরা নতুন স্থানে বাড়িঘর তুলবার সময় পায়।
.
শহর থেকে ছয় ক্রোশ দূরে এদের জন্য স্থান নির্বাচন করা হল। পাঁচ ক্রোশ পর্যন্ত পাকা রাস্তা, বাকি ক্রোশখানেক পথ কাঁচা। কোনোকালে হয়তো-বা এখানে জনবসতি ছিল কিন্তু এখন তার ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সাপ-বাদুড়ের দল এখানে বাসা বেধেছে। এই এলাকার কাছেই একটি গ্রাম। কাঁচা ছোট-ছোট বাড়িঘর। তা-ও এখান। থেকে দু-আড়াই মাইলের কম হবে না। এ গাঁয়ে যারা থাকে তারা সকলেই প্রায় কৃষক। ওরাই দিনের বেলায় ক্ষেত-খামারের কাজে বা এমনি ঘুরতে-ফিরতে এদিকে আসে। অন্যথায় সমগ্র জায়গাটাই গভীর নির্জনতার ভেতর ডুবে থাকে। এমনকি দিনে-দুপুরেও এখানে শৃগালের উপদ্রব দেখা যায়।
বেশ্যাদের মধ্যে চৌদ্দজন বেশ অবস্থাসম্পন্ন। তাদের পক্ষে যে কোনো কারণে সে নিজেদের প্রেমিকদের মনোরঞ্জনে অপারগ হয়ে হোক বা নিজেদেরই আত্মতুষ্টির তাগিদে হোক–শহরের আশেপাশে থাকা দুরূহ হয়ে পড়ল। অন্যান্যরা মনে করেছিল তারা শহরের বিভিন্ন হোটেলেই নিজেদের আস্তানা গেড়ে বসবে অথবা বাইরে ভদ্রবেশ ধারণ করে ভেতরে ভেতরে শহরের অভিজাত অঞ্চলে থেকে যাবে, অথবা অন্য কোনো শহরে চলে যাবে।
এই চৌদ্দজন বেশ্যা সত্যি-সত্যি অবস্থাসম্পন্ন। তার ওপর শহরের বাড়িঘরের দাম তারা উশুল করেই ফেলেছে, নতুন স্থানে জলের দরে জায়গাও পেয়েছে। উপরন্তু তাদের। প্রেমিকরাও মনে-প্রাণেই তাদের আর্থিক সাহায্য করতে প্রস্তুত। অতএব এখানে তারা মনোমতো অট্টালিকা তৈরি করতে মনস্থ করল। ভাঙাচোরা কতকগুলো কবর থেকে দূরে সমতল একখানা উঁচু স্থান ঠিক করল তারা। জায়গা পরিষ্কার করে নকশা-তৈরি করা হল। দিনকতক পরই শুরু হয়ে গেল নির্মাণের কাজ।
প্রত্যেকদিন ইট, মাটি, কড়িকাঠ ইত্যাদি ট্রাক, ঠেলাগাড়ি, খচ্চর, গাধা, মানুষ ইত্যাদির উপর বোঝাই হয়ে আসতে লাগল এখানে। মুন্সি তার খাতাপত্র নিয়ে এসব জিনিস গুণে-পড়ে খাতায় লিখতে লাগল। কন্ট্রাক্টর মাঝিদের আর মাঝিরা কুলিদের ফরমাস দিতে লাগল বিভিন্ন কাজে। বিভিন্ন কাজে কুলিরা মাঝিদের চড়া গলার নির্দেশ মতো কাজ করার জন্য চারদিকে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল। মোটের ওপর সমগ্র এলাকায় নতুন প্রাণস্পন্দন জাগল। গাঁয়ের কিষাণ আর বধূরা লোহালক্কর, ইট-পাটকেলের নতুন শব্দ শুনতে পেল।
এই ধ্বংসাবশেষের ভেতর একটা ভাঙাচোরা মসজিদের চিহ্নও ছিল। তার পাশেই একটা কুয়ো–যা আজ অকেজো পড়ে আছে। রাজমিস্ত্রিরা নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদে বা নামাজিদের সুবিধার জন্য প্রথমেই পরিষ্কার করল কুয়োটা। এটির প্রয়োজন ছিল আর পুণ্যের কাজ বলেও এ ব্যাপারে কেউ কোনো প্রতিবাদ করল না। দু-তিন দিনের ভেতর তৈরিও হয়ে গেল মসজিদ।
প্রত্যেকদিন বেলা বারটার সময় দুশ-আড়াইশ রাজমিস্ত্রি, কুলি, কন্ট্রাক্টর, মুন্সি আর বেশ্যাদের আত্মীয়-স্বজনেরা এসে জড়ো হতে লাগল। এই সময় স্থানটি সরগরম থাকত বেশ কিছুক্ষণের জন্য।
একদিন পার্শ্ববর্তী কোনো গ্রামের একজন বৃদ্ধা কৃষাণী এই বস্তির খবর পেয়ে বেড়াতে এল এখানে। তার সঙ্গে ছোট একটা ছেলে। এরা মসজিদের পার্শ্বে পান-বিড়ি ও ঘরে তৈরি বিভিন্ন রকম মিষ্টি বিক্রি শুরু করে দিল। বৃদ্ধাটির আগমনের পর দিনকতক যেতে-না-যেতেই এক বৃদ্ধ কিষাণ মাটির মটকা নিয়ে হাজির হল জায়গাটায়। আর কুয়ার পাশে ইটের চত্বর তৈরি করে পয়সায় দু’গ্লাস করে শরবত বিক্রি করতে শুরু করে দিল। একজন তরকারি-বিক্রেতা এই খবর পেয়ে একঝুড়ি ফলমূল নিয়ে বসে গেল বৃদ্ধার পাশে আর বিভিন্ন ভাব-ভঙ্গিমায় চিৎকার করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগল। একজন বাড়ি থেকে বিভিন্ন রকম খাবারের জিনিস রান্না করে এনে মজুরদের ভেতর থালাবাটিতে করে পরিবেশন করতে লাগল।
জোহর এবং আসরের সময় কন্ট্রাক্টর আর মাঝিদের কুলিদের সাহায্যে কুয়া থেকে পানি তুলে ওজু করতে দেখা যেতে লাগল। মসজিদে গিয়ে আজান দিত একজন। অতএব ইমাম তৈরি করা হল একজনকে। অন্যান্য সবাই তার পেছনে দাঁড়িয়ে নিয়মিত নামাজ পড়তে লাগল। পার্শ্ববর্তী গ্রামের একজন মোল্লার কানে এই খবর গিয়ে পৌঁছল। খবর পেয়েই তিনি কোরআন শরীফ, পাঞ্জসুরা ইত্যাদি সহ আরো কিছু ছোটখাট কিতাবপত্র নিয়ে এখানে এসে হাজির হলেন। অতঃপর আনুষ্ঠানিকভাবে তার ওপর ইমামতির দায়িত্বভার অর্পণ করা হল।
প্রতিদিন তৃতীয় প্রহর নাগাদ একজন কাবাবি মাথায় একটা টুকরি নিয়ে হাজির হত এখানে। সে প্রথম বৃদ্ধার পাশে মাটিতে একটি উনুন তৈরি করল; তারপর শিকে ভেজে কাবাব, কলিজা ইত্যাদি বিক্রি করতে লাগল মজুরদের ভেতর। এক কিষাণী এসব কাণ্ড দেখে-শুনে তার স্বামীকে নিয়ে হাজির হল এখানে। রোদ থেকে বাঁচার জন্যে মসজিদের পাশে একখানা ছোট্ট কুটির তৈরি করে গরম করতে লেগে গেল উনুন। কখনো-কখনো গ্রাম্য ক্ষৌরকারকে তার সাজ-সরঞ্জাম সমেত আনাগোনা করতে দেখা গেল।
বেশ্যাদের আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবরাই সাধারণত নির্মাণকার্য দেখাশোনা করত। কোনো-কোনোদিন দ্বিপ্রহরের দিকে নিজ-নিজ কাজ সেরে তারাও নিজ-নিজ প্রেমিকদের সাথে নিয়ে এখানে আসত আর চলে যেত সূর্যাস্তের আগে। এই সময় বেশ কিছু দরিদ্র লোক এসে জুটত। তারা যতক্ষণ পর্যন্ত-না কিছু পেত ততক্ষণ এমন নাকি কান্না চালিয়ে যেত যে, সবার পক্ষে সাধারণ আলাপ-আলোচনা করা দুরূহ হয়ে পড়ত। শহরের কিছুসংখ্যক লম্পট বসে থাকার চাইতে কিছু অকাজ করাও ভালো এই ধারণার বশবর্তী হয়ে এখানে এসে ভিড় জমাতে লাগল। তাদের আগমনের দিন বেশ্যারা এসে পড়লে তো আর কথাই নেই। তারা বেশ্যাদের কাছ থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে টহল দিতে থাকত। সেদিন বেশ জমে উঠত কাবাবের দোকান।
এ সব দেখে-শুনে–কিছুসংখ্যক ভণ্ড সাধু–বেশ্যাদের কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে মিতালি জমিয়ে তুলতে লাগল।
এই বস্তির পাশেই ছিল একখানা ভাঙাচোরা মাজার। দেখলে মনে হবে, হয়তো কোনো সিদ্ধপুরুষের মাজার। সে-মাজারেরও একদিন সংস্কার শুরু হয়ে গেল। মাজার সংস্কারের কাজ যখন অর্ধেকের চাইতেও বেশি এগিয়ে গেল তখন এক প্রভাতে মজুরেরা দেখল মাজারের পাশ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। ব্যাপার কী? সবাই দেখল লাল-লাল একজোড়া চোখ নিয়ে একজন লম্বাচওড়া অর্ধপাগল আর অর্ধউলঙ্গ মানুষ মাজারের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে আর ছোট-ছোট অঙ্গার নিক্ষেপ করছে এদিক-সেদিক। দ্বিপ্রহর নাগাদ সে লোকটা কলসি নিয়ে কুয়ার পাড়ে এল। জল তুলে মাজার ধোয়ার কাজে লেগে গেল। একবার সে কুয়ার পাড়ে কিছু মজুরের সাক্ষাৎ পেল। তাদেরকে দেখে আধ-পাগলের মতো লোকটা নির্লিপ্তভাবে বলল–’জান, এটা কার মাজার? ফড়ক শাহ পীর বাদশার মাজার এটা। আমার বাপ-দাদা তার খাদেম ছিলেন। এরপর সে হাসতে-হাসতে চোখের জল ফেলল কিছুক্ষণ আর ফড়ক শাহের কিছু কেরামতি মজুরদের কাছে বর্ণনা করল।
সন্ধ্যায় সে খুঁজে-মেগে জোগাড় করল মাটির একটি বাতি। তেল ভরে সেটি মাজারে জ্বেলে দিল। এর পর থেকে শেষরাতের দিকে মাঝে-মাঝে মাজার থেকে আল্লাহু’ শব্দ বাতাসে-বাতাসে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
ছ মাস যেতে-না-যেতেই চৌদ্দটি বাড়ি তৈরি হয়ে গেল। সবগুলো বাড়ি পাশাপাশি, দ্বিতল এবং একই ধরনের। একদিকে সাতটি অপর দিকে সাতটি। মাঝখানে চওড়া রাস্তা। প্রতিটি বাড়ির নিচের তলায় চারখানা করে দোকানঘর। ওপরের তলার সামনের দিক বাইরের দিকে উন্মুক্ত। জায়গাটাকে বিভিন্ন রকম দামি পাথরের কারুকার্য করে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হল। এর পেছনেই বেশ বড় ড্রইংরুম। চারদিকে সুন্দর কারুকার্যে পরিপূর্ণ। সুন্দর লাল রঙের চকচকে পাথরের মেঝে। মোটের ওপর অত্যন্ত পরিপাটিভাবে সম্পূর্ণ বাড়িগুলো সজ্জিত।
বুধবার এই গ্রামে স্থায়ীভাবে পদার্পণের দিন ধার্য করা হল। সেদিন বেশ্যারা মিলে বেশ ধুমধামের সঙ্গে উৎসব করল। খোলা মাঠে জমি পরিষ্কার করে টাঙানো হল সামিয়ানা। ডেকচির ঘড়ঘড় শব্দ, মাংস আর ঘৃতের সুঘ্রাণ পার্শ্ববর্তী সুদূর এলাকা থেকে ভিক্ষুক আর কুকুরদের আকর্ষণ করে নিয়ে এল। পীর ফড়ক শাহের মাজারের পাশেই খাদ্য বিতরণ করা হল। অনেক ভিক্ষুক জমা হয়ে গেল দুপুর নাগাদ। পীর ফড়ক শাহের মাজারকে চমৎকারভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হল, তার ওপর জড়িয়ে দেয়া হল ফুলের চাদর। অর্ধ-পাগল লোকটিকে নতুন কাপড় তৈরি করে দেয়া হলে সে পরেই তা ছিঁড়ে ফেলল।
সন্ধ্যায় সামিয়ানা টাঙিয়ে উজ্জ্বল আলোয় স্থানটিকে আলোকিত করা হল। বেশ জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে বস্তিটির উদ্বোধন পর্ব সমাপন করা হল। দূর-দূরান্তর থেকে অন্যান্য বেশ্যাদের আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। এরা স্থানীয়দের আত্মীয়-স্বজন। এদের বন্ধু-বান্ধবেরাও এল এদের সঙ্গে। তাদের জন্য আলাদাভাবে বসার বন্দোবস্ত করা হল। অসংখ্য গ্যাসবাতির আলোয় ঝলমল করে উঠল স্থানটি।
উৎসব চলল দু’তিন দিন যাবৎ। এবার বেশ্যারা বাড়িঘর সাজানোর কাজে মনোনিবেশ করল। ঝাড়লণ্ঠন, ড্রেসিং টেবিল, সুদৃশ্য পালঙ্ক এবং বিভিন্ন প্রকার চিত্র লাগিয়ে ভেতর-বাহির সজ্জিত করতে প্রায় আট দিন লেগে গেল।
এসব মেয়েরা দিনের বেশিরভাগ সময়ে শিক্ষকদের কাছে গান, বাজনা, গজল পাঠ, লেখাপড়া ইত্যাদি শিখত। অন্য সময়ে গ্রামোফোন, তাস, কেরাম ইত্যাদি নিয়ে মেতে থাকত। এরপর প্রত্যহ স্নানাগারে গিয়ে চাকর দিয়ে ভোলা জলে গোসল সেরে সাজসজ্জায় মেতে উঠত। এটি তাদের প্রাত্যহিক নিয়মে পরিণত হল।
রাতের অন্ধকার নামার সঙ্গে-সঙ্গেই গ্যাসের আলো জ্বলজ্বল করে উঠত। বিভিন্ন প্রকার মূল্যবান পাথরের গায়ে লেগে চকচক করে উঠত আলো। দরজা জানালার গায়ে বিভিন্ন রকম কারুকার্যখচিত কাঁচে আলো চকচক করলে অনেক দূর থেকেও মনোরম দেখা যেত। এরপর সাজসজ্জা করে লোকদের সঙ্গে মিলেমিশে খোশ-গল্পে মেতে উঠত বেশ্যারা। গলাগলি-ঢলাঢলি করে শ্রান্ত হয়ে পড়লে ধবধবে ফরাসের গায়ে হেলান দিয়ে। বসে পড়ত ওরা। রাত বেড়ে গেলে এদের সঙ্গে মিলনপ্রত্যাশীরা টুকরির ভেতর মদের। বোতল আর ফল-মূল নিয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মোটর বা টাঙায় চড়ে এসে জড় হত। তাদের পা পড়তেই বস্তিতে একটা আলাদা প্রাণস্পন্দন শুরু হত। গান-বাজনার। তালে-তালে নৃত্যের ঝংকারে একটা অদ্ভুত প্রাণমাতানো পরিবেশ সৃষ্টি হত। হৈ-হাঙ্গামার ভেতর কখন যে রাত কেটে যেত টেরও পেত না কেউ।
বেশ্যাদের আগমনের দিনকয়েকের মধ্যেই দোকানের ভাড়াটে জুটে গেল। বস্তি চালু করার জন্য এ-সব দোকানের ভাড়াও কম করে ধরা হয়ছিল। সেই বুড়িটিই প্রথম দোকানের ভাড়া নিল যে সবার আগে মসজিদের সামনে গাছের তলায় টুকরি নিয়ে বসেছিল। দোকান জাঁকালো দেখাবার জন্য তার ছেলে সিগারেটের খালি প্যাকেট এনে তাকের উপর সাজিয়ে রাখল। বোতলের ভেতরের রঙিন জল ভরে রাখতে লাগল সে। যাতে দেখলেই শরবত মনে হয়। বুড়ি নিজ খেয়ালমতো কাগজের ফুল আর সিগারেটের খালি প্যাকেটের সাহায্যে বিভিন্ন রকম সুদৃশ্য জিনিস তৈরি করে দোকান সাজাল। বিভিন্ন নামকরা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ছবি পুরাতন সিনেমা-মাসিক থেকে ছিঁড়ে দেয়ালে টাঙিয়ে দেয়া হল। দোকানের আসল মালের ভেতর মাত্র দু-তিন রকম সিগারেটের খান-তিনেক করে প্যাকেট আর আট-দশ বাভিল বিড়ি। কয়েক ডজন দিয়াশলাই, পানের একটা পাত্র, সামান্য তামাক আর কয়েক বান্ডিল মোমবাতি।
দ্বিতীয় দোকানে একজন শস্য ব্যবসায়ী, তৃতীয় দোকানে খাদ্য-বিক্রেতা, চতুর্থ দোকানে। কসাই, পঞ্চম দোকানে কাবাব প্রস্তুতকারী ও ষষ্ঠ দোকানে একজন তরিতরকারি বিক্রেতা বসে গেল। আশেপাশের গ্রাম থেকে কম মূল্যে কয়েক রকমের তরিতরকারি এনে এখানে। বেশ লাভে বিক্রি করত তরিতরকারিওয়ালা। সে এক-আধ টুকরি ফুলও রাখত, যাতে দোকানের সৌন্দর্য বাড়ে। একজন ফুলওয়ালা তার অংশীদার হল। সে দিনভর ফুলের মালা তৈরি করে একটা আংটায় বেঁধে বিভিন্ন ঘরে নিয়ে যেতে লাগল। লোকটা শুধু ফুলই বিক্রি করত না, মাঝে-মাঝে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা জমিয়ে তামাকও টানত। তার সামনে যদি কোনো পুরুষ বেশ্যাদের খোঁজে আসত তবে আড্ডা জমে উঠত আরো। তখন সে আর উঠবার নামও নিত না। কখনো রাত বেশি হয়ে গেলে আর ফুলের মালা বিক্রি করতে না-পারলে সেগুলো নিজের গলায় পরে ঘরে ফিরে আসত।
একটা দোকানে একজন বেশ্যার বাপ আর ভাই এসে জুটল। সেলাইয়ের কাজ জানত ওরা। মেশিন সংগ্রহ করে ওরা বেশ জাকিয়ে বসল। এভাবে একজন ক্ষৌরকারও এসে জুটল। তার সঙ্গে এল একজন রঙ করার লোকও। লোকটি বিভিন্ন রকম রঙে দোকানের সম্মুখভাগকে রঙিন করে রাখল।
দিনকতক পর একজন মনোহারি দোকানদার এখানে এল। শহরে তার একটা দোকান। ছিল। কিন্তু ব্যবসা মন্দার কারণে লোকটি এখানে দোকান খুলে বসল। বিভিন্ন রকম পাউডার, সাবান, চিরুনি, বোতাম, সুই-সুতা, লেস, ফিতা, সুগন্ধি তেল, রুমাল ইত্যাদি বিক্রি করতে লাগল সে।
এই বস্তির বাসিন্দাদের উৎসাহের ফলে অনেকগুলো ছোটখাট দোকানদার নিয়ত এখানে এসে ভিড়তে লাগল। এদের ব্যবসা মন্দার দিকে ছিল, কেননা শহরের ক্রমবর্ধমান ভাড়া দিতে অক্ষম ছিল তারা। এখানে এসে আশ্রয় নিয়ে বেশ জাকিয়ে বসল তারা।
একজন হেকিম সাহেব–যে হেকিমি শাস্ত্র সম্পর্কে কিছু খবরাখবর রাখত–এসে এখানে হাজির হল। শহরের কোলাহল পছন্দ করত না বলে নিজের শিষ্যদের নিয়ে লোকটি এখানে একখানা ঘর ভাড়া করে জেঁকে বসল। সারাদিন ধরে হেকিম সাহেব আর তার শিষ্যরা ওষুধের শিশি, শরবতের বোতল, মোরব্বা, চাইনি আর আচারের বয়াম সাজিয়ে রাখল সুন্দরভাবে। একটি তাকে হেকিমি শাস্ত্রের ওপর বিভিন্নরকম ভালো-ভালো বইও সাজিয়ে রাখা হল। আলমারিতে বিভিন্ন রঙ-বেরঙের জেলি আর কাগজপত্র ঠেসে দেয়া হল। প্রত্যেক দিন সকালে বেশ্যাদের চাকর-বাকরেরা এসে বিভিন্ন রকম শরবত আর ওষুধপত্র কিনে নিয়ে যেত। এভাবে তার ব্যবসারও বেশ পসার জমে উঠল।
যে-সব দোকানের ভাড়াটে পাওয়া গেল না, ওসব দোকানে বেশ্যাদের ভাই-বন্ধুরা চারপায়া বসিয়ে সারাদিন তাস-সতরঞ্জ পিটতে লাগল। মাঝে-মাঝে তারা শাকসবজি কুটতে-কুটতে হৈ-হুঁল্লাও করতে থাকল সেখানে।
বেশ্যাদের অনুগ্রহীতাদের একজন একটি দোকান খালি দেখে তার ভাইকে এনে বসাল। সে বিভিন্ন রকম বাদ্যযন্ত্র তৈরি করতে জানত। দোকানের দেয়ালের সঙ্গে পেরেক লাগিয়ে ভাঙাচোরা সারেঙ্গী, সেতার, তানপুরা ইত্যাদি সাজিয়ে রাখা হল। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানোতেও ওস্তাদ ছিল লোকটি। সন্ধ্যার পর-পরই সে সেতার বাজাত। সেতারের মিষ্টি। সুরে আকৃষ্ট হয়ে আশেপাশের দোকান থেকে লোকজন এসে জমায়েত হয়ে অনেকক্ষণ যাবৎ তার বাজনা শুনত। এই লোকটির শিষ্য ছিল একজন। সে রেলওয়েতে কেরানির চাকরি করত। সেতার শেখার দিকে তার বেশ ঝোঁক। অফিস ছুটি হলেই সে সাইকেলে চড়ে সোজা এই বস্তিতে চলে আসত। মোট কথা এই বাদকের প্রাণপ্রাচুর্যে সর্বদাই বস্তিটি সরগরম থাকত।
বস্তির নির্মাণকার্য চলাকালে মসজিদের মোল্লাজি রাত্রে গ্রামে চলে যেতেন কিন্তু এখন চারদিকে নিমন্ত্রণ বেড়ে যাওয়ায় তিনিও এখানেই থাকতে লাগলেন। ধীরে-ধীরে বিভিন্ন বেশ্যাদের ঘর থেকে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে আসতে শুরু করলে তার আমদানিও বেশ বেড়ে গেল।
একটি ছোটখাট ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার কোম্পানিও এখানে এসে জুটল এক সময়। শহরের ক্রমবর্ধমান ভাড়া আর অত্যল্প চাহিদার দরুন ওরা এখানে আসতে বাধ্য হল। বেশ্যাদের ঘর থেকে খানিকটা দূরে তাঁবু ফেলল এরা। এই কোম্পানির অভিনেতাদের শিল্প সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। পোশাক-পরিচ্ছদও ছেঁড়া। জোড়াতালি লাগানো। এরা খেলাধুলা যা দেখাত তা-ও মান্ধাতার আমলের। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই কোম্পানি বেশ চালু হয়ে গেল। কারণ থিয়েটারের প্রবেশমূল্য ধরা হয়েছিল অত্যন্ত কম। শহরের দিন-মজুর, কারখানার শ্রমিক, আর দরিদ্র জনসাধারণ সারাদিনের পরিশ্রমের পর এখানে এসে খানিকটা তৃপ্তি পেত। দূর-দূরান্তর থেকেও লোক এসে এ-সব দেখত, আর দেখত মনমাতানো নারীসৌন্দর্য যা মানুষকে অহরহ প্রলুব্ধ করে। থিয়েটার শুরু না-হওয়া পর্যন্ত কোম্পানির ভাঁড় বাইরে এসে বিভিন্ন রকম অঙ্গভঙ্গি করে খুশিতে মশগুল রাখত দর্শকদের।
এমনি করে ধীরে-ধীরে অনেকে এই বস্তিতে আসতে লাগল। অতএব শহরের বিভিন্ন স্থানে টাঙ্গার গাড়োয়ানরা হাঁকতে লাগল–নতুন শহর কে যাবে এস। শহর থেকে পাঁচ ক্রোশ পর্যন্ত পাকা রাস্তা। গাড়োয়ানের বকশিসের লোভে এই রাস্তার মাথা পর্যন্ত এসে যেত। সওয়ারির নির্দেশে তারা বেশ জোরেসোরে ঘোড়া হাকাত, সঙ্গে-সঙ্গে মুখে বিভিন্ন রকম শব্দ করত। এদের ভেতর চলতে থাকত প্রতিযোগিতা। যদি কোনো গাড়ি অন্য একখানাকে ফেলে আগে চলে যেত তা হলে আগের গাড়ির সওয়ারিরা মাথা উঁচিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠত। এই প্রতিযোগিতায় কাহিল হয়ে পড়ত নিরীহ ঘোড়াগুলো। ঘোড়ার গলার মালা থেকে সুগন্ধের বদলে ঘাসের দুর্গন্ধ বেরিয়ে আসত।
রিকশাওয়ালারাও টাঙ্গার পেছনে পড়ে রইল না। তারাও কম দামের সওয়ারি নিয়ে ঘুঙুরের শব্দে চারদিক মুখরিত করে এগিয়ে চলত। এ ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে শহরের স্কুল-কলেজের ছাত্ররা সাইকেলে চড়ে আসত এই রহস্যপূর্ণ বাজার পরিদর্শনে। তাদের ধারণা–অভিভাবকেরা অনর্থক এই বাজার দেখার সৌভাগ্য থেকে তাদের বঞ্চিত করছে।
দেখতে-দেখতে এই বস্তির খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে দোকান আর বাড়ির দামও বেড়ে গেল। যে-সব বেশ্যারা এখানে আসতে চায়নি তারাও এই বস্তির ক্রমবর্ধমান উন্নতি দেখে মনে-মনে নিজেদের বোকামির কথা চিন্তা করে অনুতাপ প্রকাশ করতে লাগল। কেউ-কেউ তাড়াতাড়ি জায়গাজমি কিনে বাড়িঘর তৈরি শুরু করে দিল। এ ছাড়াও শহরের কিছুসংখ্যক মহাজন বস্তির আশেপাশে জায়গা কিনে ঘর তুলে ফেলল ছোট-ছোট। ফল দাঁড়াল এই যে, যে-সব প্রগলভ মেয়েছেলেরা হোটেলে আর অভিজাত মহল্লায় মুখ ঢেকে ছিল তারাও সুযোগ পেয়ে পঙ্গপালের মতো বেরিয়ে এসে এ-সব বাড়িঘরে নিজেদের আড্ডা গেড়ে বসল। কিছু সংখ্যক সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজনসম্পন্ন মানুষও এখানে এসে ভাড়া করল দোকান। তারা রাত্রে দোকানে থাকত না।
এই বস্তির আজাদি তো স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেল কিন্তু এখনো বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা হল না। অতএব বেশ্যা এবং এই এলাকার বাসিন্দাদের তরফ থেকে বৈদ্যুতিক আলোর জন্য আবেদন করে সরকারের নিকট আরজি পেশ করা হল। দিনকয়েক পরেই মঞ্জুর হয়ে গেল তাদের আবেদন। সঙ্গে-সঙ্গে একটা ডাকঘরও খোলা হল। একজন মুন্সি মিয়া ডাকখানার বাইরে একটা সিন্দুক পুঁজি করে দোয়াত-কলম নিয়ে লিখে দিতে লাগল মানুষের চিঠিপত্র।
একবার মদখোরদের আড্ডায় এক জঘন্য ঝগড়া বেঁধে গেল। ঝগড়ায় সোডার বোতল ছোঁড়াছুড়ি আর ইটের যথেচ্ছ সদ্ব্যবহার করা হল। গুরুতররূপে আহত হল অনেকে। এতে সরকার বুঝল পুলিশ-স্টেশন খোলা অপরিহার্য এই বস্তিতে।
থিয়েটার কোম্পানি দু’মাস থেকে বেশ দু’পয়সা গুছিয়ে চলে গেল। শহরের একটি সিনেমার মালিক এই অবস্থা দেখে ভাবল–এখানে একখানা সিনেমা হল খুললে কেমন হয়? যেই ভাবনা অমনি কাজ। সে তাড়াতাড়ি একখানা ভালো জায়গা খুঁজে সিনেমা হল নির্মাণের কাজ শুরু করে দিল। কয়েক মাসের ভেতর সিনেমা হলের কাজ শেষ হয়ে গেল। হল এলাকার ভেতর তৈরি করা হল ছোট্ট একখানা বাগান–যাতে ছবি শুরু হবার আগে এসে পড়লে দর্শকেরা এখানে বিশ্রাম নিতে পারে। বস্তির লোকেরাও এখানে এসে নিত্য আড্ডা জমাতে লাগল। ফলে এটি পরিণত হল একটি প্রমোদ-উদ্যানে। মাঝে-মাঝে এক তেল মালিশওয়ালা ওয়াচ কোটের পকেটে বিভিন্ন রকম সুগন্ধিযুক্ত তেলের শিশি নিয়ে হাঁক ছাড়তে ছাড়তে মাথাব্যথাওয়ালাদের কাছে নিজের জারিজুরি দেখাতে লাগল।
দোকানগুলোর একটায় একজন লোক সোডাওয়াটারের ফ্যাক্টরি খুলল। এ ছাড়াও একজন লন্ড্রিওয়ালা, এক ফটোগ্রাফার, একজন সাইকেল মেরামতকারী, একজন। বুটপালিশওয়ালা ও একজন ডাক্তার ওষুধের দোকান সমেত এসে ভিড়ল। দেখতে-দেখতে একজন সরাইখানার মালিক মদের দোকান খোলার অনুমতি পেয়ে গেল। ফটোগ্রাফারের দোকানের বাইরে এককোণে একজন ঘড়ি মেরামতকারীও এসে খুলে বসল তার ব্যবসা। আর প্রত্যহ একটা ছোট আয়না চোখে লাগিয়ে দেখতে লাগল ঘড়ি।
এর কিছুদিন পর বস্তির আলো, জল ইত্যাদির সুবন্দোবস্তের দিকে দৃষ্টি দেয়া হল। সরকারি কর্মচারীরা লাল ঝাণ্ডা নিয়ে রাস্তাঘাট মেরামত করার জন্য বড় বড় ইঞ্জিন চালিয়ে দিল সশব্দে।…
.
এভাবে কেটে গেল বিশটি বছর। বস্তি এখন ভরপুর শহরে রূপান্তরিত হয়েছে। রেলওয়ে স্টেশন থেকে শুরু করে টাউন হল, কোর্ট, জেলখানা সবই স্থাপিত হয়েছে এখানে। প্রায় আড়াই লক্ষ লোক এখন এই শহরের অধিবাসী। শহরে একটা কলেজ, ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক দুটো হাইস্কুল, আটটা অবৈতনিক প্রাইমারি স্কুল গড়ে উঠেছে। এছাড়াও খোলা হয়েছে ছ’টা সিনেমা হল, চারটা ব্যাঙ্ক। এসবের মধ্যে পৃথিবীর বড়-বড় দুখানা ব্যাঙ্কের শাখাও রয়েছে।
এই শহর থেকে দু’খানা দৈনিক, তিনখানা সাপ্তাহিক আর দশখানি মাসিক পত্রিকা নিয়মিত বের হচ্ছে। তার ভেতর চারখানা সাহিত্য সম্পর্কীয়, দু’খানা কৃষি সম্পৰ্কীয়, একখানা ডাক্তারি, একখানা মহিলা বিষয়ক ও একখানা ছোটদের পত্রিকা রয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে বিশটা মসজিদ, পনেরটা মন্দির ও ধর্মশালা, ছয়টি এতিমখানা, পাঁচটি অনাথ আশ্রম আর তিনটি বড়-বড় সরকারি হাসপাতাল খোলা হল। একটা হাসপাতাল শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট।
প্রথম কয়েক বছর শহরটি এর বাসিন্দাদের ইচ্ছামতো হুসনাবাদ’ নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু অনেকে এটাকে একটু রদবদল করে হাসনাবাদ’ রাখল। শেষে এটাও টিকল না। কারণ জনসাধারণ ‘হাসান’ আর হুসন-এর ভেতর কোনো পার্থক্য নির্ণয় করতে অপারগ। অতএব অনেক বড়-বড় বই-পুস্তক, দলিল-দস্তাবেজ ঘেটে এই বস্তির আসল নাম বের করা হল। হাজার-হাজার বছর আগের নামানুসারে এই শহরের নাম রাখা হল ‘আনন্দী নগরী।
এমনিতে সমগ্র শহরটাই ছিমছাম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর সুন্দর। কিন্তু সবচাইতে সুন্দর আর ব্যবসার আসল কেন্দ্রস্থল হচ্ছে–শহরের বেশ্যারা যেখানে থাকে সেই জায়গাটা।
.
‘আনন্দী নগরীর’ মিউনিসিপ্যালিটির সভা বেশ জমেছে। হল লোকে পরিপূর্ণ। অন্যান্য দিনের সাধারণ নিয়ম ভঙ্গ করে প্রতিটি সদস্যই আজ উপস্থিত রয়েছেন। আলোচনার বিষয় হল–শহরের মধ্যস্থলে অবস্থিত বেশ্যাদের শহর থেকে অপসারণ করা। কারণ এরা মানবতা, সংস্কৃতি আর আভিজাত্যের পরিচ্ছন্ন পরিবেশে কলঙ্কের মতো বিরাজ করছে।
একজন সুবক্তা বললেন–জানি না আমাদের পূর্বপুরুষেরা এমন কী দেখেছিলেন, যাতে করে এসব সমাজের কলঙ্কদের শহরের একেবারে মধ্যস্থলে স্থান করে দিয়েছিলেন?’
.
এবার এদের জন্য যে স্থানটি নির্ধারণ করা হল তা শহর থেকে বার ক্রোশ দূরে অবস্থিত।
চড়ুইপাখি – খাজা আহমদ আব্বাস
লোকটির নাম রহিম। রহিম খান। নামের বিপরীত তার কাজ। নিষ্ঠুরতায় তার জুড়ি নেই : এ অঞ্চলে। তার ভয়ে গ্রামটাও যেন কাপে। মানুষ বা পশু-কারো প্রতি বিন্দুমাত্র দরদ নেই তার। একদিন কর্মকারের ছেলেটা রহিম খানের বলদের লেজে কয়েকটা কাঁটাগাছ বেঁধে দিয়েছিল। ছেলেটাকে কী মার! মারের চোটে যখন রক্তারক্তি অবস্থা, রহিম তখন ছেড়ে দিয়েছিল ছোঁড়াটাকে। গাঁসুদ্ধ বলাবলি করে, ‘খোদার একটু ভয়ডর নেই দজ্জালটার। কচি বাচ্চাদের মারে যে, মূক পশুগুলোকে যে পিটুনি দেয়, এমন পাতকের কপালে নির্ঘাত দোজখ-বাস আছে।’
যত বলাবলি সবকিছু রহিম খানের পেছনে–অগোচরে। তারা সামনে কেউ খুলুক তো মুখ! বেচারা বুলু একদিন শুধু বলেছিল, ‘আহা, বাচ্চাদের এমন করে মারতে নেই আব্বা। আর যাবে কোথায়! রহিম ঝাঁপিয়ে পড়ে বুন্দুর ওপর। এমন মার খেল বুন্দু যে, পাড়ার প্রতিটি লোকে চমকে উঠল। পাছে রহিম বিরক্ত হয় তাই বুন্দুর কাছে কেউ সান্ত্বনা দিতেও ঘেষল না। গাঁ-সুদ্ধ সবাই বলাবলি করল ‘ও বেটার মাথা খারাপ হয়েছে; ওকে পাগলা গারদে পাঠাও।’ কিন্তু এ-সব কথাবার্তাও রহিম খানের পেছনে, নিভৃতেসামনে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না।
গ্রামের কেউ রহিম খানের সঙ্গে কথা বলে না। না-বলুক, রহিমের তাতে বিন্দুমাত্র আসে যায় না। কাঁধের উপর লাঙল নিয়ে সকালে সে মাঠে যায়। পথে কারো দেখা পেলে রহিম না-দেয় সালাম, না-করে কুশল জিজ্ঞাসা। দুটো বলদ তার। রহিম ওদের নাথু আর ছিদু বলে ডাকে। মাঠে পৌঁছে সে বলদদুটোর সঙ্গে কথা শুরু করে হাল দিতে-দিতে। হয়তো এক সময় চিৎকার করে ওঠে–
‘এই শালা নাথু, সোজা লাইন ধর, ধর বলছি। তোর বাপ এসে চাষ দিয়ে যাবে রে হারামজাদা? এই ছিদু। তোর আবার কী হল রে হারামি?’
হাতের পাঁচনটা দিয়ে তারপর রহিম দমাদম ছিদু-নাথুকে পেটাতে থাকে। প্রহারে-প্রহারে বলদদুটোর সারা পিঠে শুধু ক্ষতের চিহ্ন।
সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে বউ আর ছেলেদুটোকে নিয়ে রহিম খিস্তি শুরু করে। শাক-সবজি বা ভাজাভুজিতে বউ লবণ দিতে ভুলে গেছে তো আর রক্ষা নেই। কোনো ছেলে কোনো অপকর্ম করল তো রহিম তাকে পা উপরে বেঁধে গরুপেটা লাঠিটা দিয়ে পেটাতে থাকবে। বেহুশ না-হওয়া পর্যন্ত ছেলের নিস্তার নেই। প্রতিদিন এমনি একটা-না-একটা কিছু ঘটবেই ওই বাড়িতে। প্রায় প্রতি রাত্রে বউ-বাচ্চাদের ওপর গাল-খিস্তি মার-ধোর, …যন্ত্রণায় ওরা চিৎকার করতে থাকে। পাড়া-পড়শিরা দেখে-শুনেও কেউ আসে না। এগিয়ে এসে যে রহিমকে থামাবে, সে সাহস হয়ে ওঠে না কারো।
দিন-রাত মার খেয়ে বেচারি বউটা আধমরা হয়ে গেছে। বয়স ওর চল্লিশের কাছাকাছি হলেও বেচারিকে ষাট বছরের বুড়ির মতো লাগে। বাচ্চারা যতদিন ছোট ছিল, আচ্ছা মার খেয়েছে বাপের হাতে। বড় ছেলেটা যখন বাপের কোঠায়, একদিন কী কারণে বাপের হাতে একচোট বিষম মার খেল। মার খেয়ে সেই যে বাড়ি থেকে পালাল সেদিন, আর ফেরেনি।
কিছু দূরের এক গ্রামে ছেলেটার এক মামা থাকত। মামাই আশ্রয় দিল তাকে। বউ একদিন অনেক সাহস করে রহিমকে বলছিল, ‘হিলামপুর যদি কখনো যাও, পায়ে পড়ি, নুরুকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো।’ যেই-না বলা, শয়তান যেন তড়াক করে রহিমের ওপর ভর করল, কী বললি, হারামজাদাকে আমি ফিরিয়ে আনতে যাব।’ রাগে কাঁপতে থাকে রহিম খান–’শুনে রাখ, ও ব্যাটা কখনও ফিরে এলে আর আস্ত রাখব না।’
সে যাই হোক, এমন মৃত্যুর খামারে নুরু আর কখনো ফিরে আসেনি; আসার দরকারও বোধ করেনি। দু’বছর পর ছোট ছেলেটাও পালাল। ভাইয়ের কাছে গেল পালিয়ে। রহিমের প্রতিমুহূর্তের যন্ত্রণা সহ্য করতে এখন থাকল শুধু বউ। কিন্তু সে-ও একদিন এমন মার খেল যে, বাড়ি ছাড়া ভিন্ন আর কোনো গত্যন্তর রইল না। কতদিনের সংসারের মায়া–সে মায়াও ছিন্ন করতে বেচারি বাধ্য হল। রহিম মাঠে চাষ করতে গেছে, এই সুযোগে ভাইকে গোপনে ডাকিয়ে এনে তার সঙ্গে মা’র কাছে চলে গেল বউ।
সন্ধ্যায় রহিম ঘরে ফিরে এল। পাশের বাড়ির বউ অনেক ভেবেচিন্তে সাহস করে এগিয়ে এসে রহিম খানকে বউয়ের চলে যাবার খবর জানাল। কেন জানি, আজ রহিম ক্ষেপল না। চুপচাপ শুধু শুনে গেল। তারপর বলদদুটোকে রাত্রির জন্য বাঁধতে গেল ঘেরা-উঠানে। সে নিশ্চিত জানে বউ আর কখনো তার কাছে ফিরে আসবে না।
উঠোন থেকে রহিম ঘরে ফিরে এল। নির্জন, নিস্তব্ধ। না, একেবারে শব্দহীন নয়, একটা বিড়াল ম্যাও-মাও করে চলেছে। লেজ ধরে বিড়ালটাকে ছুঁড়ে মারল রহিম। তারপর চুলোর কাছে গেল। ঠাণ্ডা চুলো। রাজ্যের আলসেমি বোধ করতে লাগল সে। চুলো ধরিয়ে নিজ হাতে রান্না করা তার হল না। পেটে কিছু না-দিয়েই বিছানায় গড়িয়ে পড়ল রহিম। কিছুক্ষণ পর ঘুমে তলিয়ে গেল।
সূর্য ওঠার অল্প পরেই তার ঘুম ভাঙল। আজ কাজে যাওয়ার তাড়াহুড়া নেই। ছাগলগুলোর দুধ দুইয়ে তাই খেল সে। হুঁকোটা সাজিয়ে নিয়ে বসল বিছানায়। সূর্যের আলোয় ততক্ষণ ঘর ভরে গেছে। ঘরের কোণায় রহিম খান কতগুলো মাকড়সার জাল দেখতে পেল। ওগুলো সরানো দরকার। বাঁশের লাঠির আগায় কিছুটা ন্যাকড়া বেঁধে সে জাল ভাঙতে গেল। সিলিং-এ এক চড়ইয়ের বাসা হঠাৎ তার নজরে পড়ল। দুটো চড়ই উড়ে একবার করে বাসায় ঢুকছে আর বেরুচ্ছে।
এ বাসা ভাঙতে হবে প্রথম-প্রথম এমনি চিন্তায় রহিম থেমে গেল। একটা টুল নিয়ে এসে সে চড়ইয়ের বাসায় উঁকি মারল। হৃষ্টপুষ্ট দুটো বাচ্চা ভিতরে কিচিরমিচির করছে আর তাদের বাপ-মা মাথার উপর উড়ে-উড়ে তাদেরকে সম্ভাব্য আপদ-বালাই থেকে রক্ষা করছে। বাসার দিকে হাত বাড়াতেই মাদি চড়ই তার মাথায় ঝাঁপটা মারল সঙ্গে-সঙ্গে। ভ্যাবাচাকা খেয়ে রহিম হেসে উঠল, নচ্ছার। আমার চোখদুটো উপড়ে নিতে চাস?’ টুল থেকে নেমে পড়ল রহিম। বাসা ভাঙা হল না আর।
পরের দিন থেকে রহিম আবার মাঠের কাজে মন দিল। গ্রামের কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না। সারাটা দিন সে মাঠে হাল দেয়া, পানি সেচ দেয়া বা ফসল কাটায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে। কিন্তু সূর্য ডোবার আগেই সে এখন ঘরে ফিরে যায়। হুঁকা ধরিয়ে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে চড়ইগুলোর লাফ-ঝাঁপ দেখতে থাকে নিবিষ্ট মনে। বাচ্চাদুটো এখন উড়তে শিখেছে। ছেলেদের নামে একটা বাচ্চাকে সে নুরু, আরেকটাকে বুন্দু বলে ডাকে। পৃথিবীতে এখন রহিমের বন্ধু বলতে চারটি চড়ই। গ্রামের সবাই তাকে এড়িয়ে চলে সত্যি, কিন্তু হঠাৎ সবার খেয়ালে আসে, আজকাল রহিম তার বলদদুটোকে মারধর করে না। নাথু আর ছিদুও এখন ছাড়া পেয়ে খুব খুশি। ওদের পিঠের উপরের ক্ষতগুলো প্রায় সেরে গেছে। একদিন সকালেই রহিম খান মাঠ থেকে ফিরছিল। রাস্তায় কতকগুলো ছেলে খেলায় মত্ত। রহিমকে দেখেই ওরা জুতা-টুতা ফেলে ভোঁ-দৌড়। রহিম পেছনে-পেছনে দৌড়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে শোন, শোন। পালাস নে। মারব না তোদের, শোন। কে শোনে জালিমের কথা। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। শিগগিরই হয়তো বৃষ্টি নামবে। বাড়ির দিকে রহিম জোরে পা চালাল। বলদদুটোকে উঠোনে বেঁধেছে মাত্র, অমনি শোঁ-শোঁ ঝড় উঠল।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল রহিম খান। বাতিটি জ্বালাল প্রতিদিনের মতো। আজো সে কয়েক টুকরো রুটি চড়ইগুলোর কাছাকাছি একটি কুলুঙ্গিতে রেখে ডাকতে লাগল, ‘কই রে নুরু, কই রে বুন্দু।’ আজ নুরু-বুদু বাইরে এল না। ব্যাপার দেখতে রহিম চড়ইয়ের বাসায় উঁকি দিল। দেখল চারটা চড়ুই-ই ডানায় মাথা গুঁজে জড়াজড়ি করে বসে আছে। সিলিং-এর এক ছিদ্র দিয়ে আসা ফোঁটা-ফোঁটা পানি বাসাটা ভিজিয়ে ফেলেছে।
এমনভাবে পানির ফোঁটা পড়তে থাকলে বাসাটা পয়মাল হয়ে যাবে। বেচারাদের তখন মাথা গুঁজবার ঠাই থাকবে না।’ বৃষ্টি-মাথায় রহিম দেয়ালে মই লাগিয়ে চালে উঠল। চালের বৃষ্টি-চোয়ানো ছিদ্রটা বন্ধ করতে বেশ সময় নিল। আর ততক্ষণে সে নিজে ভিজে একাকার। ঠকঠক করে কাঁপছে ঠাণ্ডায়। ঘরে এসে বিছানায় বসতে-না-বসতেই হঠাৎ হাঁচির তোড় শুরু হল। রহিম খান ঘোড়াই তোয়াক্কা করে এই হাঁচির। পরদিন সকালে কিন্তু ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারল না সে। জ্বরে তার শরীর পুড়ে যাচ্ছে। আশেপাশে কেউ নেই যে তার ওষুধ এনে দেবে।
এমনিভাবে দুদিন কেটে গেল।
দুদিন রহিম খানকে মাঠে যেতে না-দেখে গ্রামবাসীরা কৌতূহল বোধ করল। চৌকিদার কয়েকজন চাষিকে সঙ্গে নিয়ে ওর ঘরে ঢুকল। বিছানায় শুয়ে রহিম আপন মনে বিড়বিড় করছে, ‘ওরে বুন্দু-নুরু, কোথায় গেলি তোরা? কে তোদের আজ খাবার দেবে? কেউ নাই রে!’ চারটা চড়ই তখন সিলিং-এর কাছে উড়ে ঘুরঘুর করছে।
কালু অর্থপূর্ণ মাথা নেড়ে বলল, ‘লোকটা পাগলই হয়ে গেল শেষে। সাত সকালেই কাল হাসপাতালে খবর পাঠাতে হবে। ওরা এসে মনে হলে না-হয় পাগলাগারদেই নিয়ে যাবে।
পরদিন গায়ের লোক হাসপাতালের এক কর্মচারীকে নিয়ে যখন রহিমের ঘরে ঢুকল, রহিম তখন বেঁচে নেই। ঘরের ভিতর চঞ্চল চারটা চড়ই শুধু ঘুরঘুর করে উড়ছে।
পর্যটক – কুররাতুল আইন হায়দার
গত বছর এক সন্ধ্যায় দরজায় ঘণ্টা বাজল। আমি বাইরে এলাম। এক লম্বা ছিপছিপে ইউরোপীয়ান ছেলে ক্যানভাসের থলে কাঁধে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ঝোলানো রয়েছে। দ্বিতীয় একটি থলে। পায়ে ধূলিমলিন পেশোয়ারি চপ্পল। আমাকে দেখে বিনীত হয়ে নাম জিজ্ঞেস করল। তারপর একটা খাম এগিয়ে দিলে বলল,
আপনার মামার চিঠি।
‘ভেতরে এস।’
আসান মামুর চিঠি। তিনি লিখেছেন, আমরা করাচি থেকে হায়দারাবাদ (সিন্ধু) ফিরে যাচ্ছিলাম। থাটের মাকালি হিলের কবরের মাঝে ছেলেটি বসেছিল। আংটি দেখিয়ে পাথেয় চাইলে আমরা তাকে বাড়ি নিয়ে এসেছি। ছেলেটি বিশ্ব-ভ্রমণে বেরিয়েছে। এখন ইভিয়াতে যাচ্ছে। অটো বড় ভালো ছেলে। আমি তাকে ভারতীয় আত্মীয়-স্বজনদের ঠিকানা লিখে দিয়েছি–সে তাদের কাছে থাকবে। তুমিও তাকে আতিথ্য দিও।
নোট : ওর কাছে সম্ভবত টাকাকড়ি নেই।
ছেলেটি কামরায় এসে মেঝেতে থলে রাখল। তারপর চোখ রগড়ে দেয়ালের ছবি দেখতে লাগল। এত লম্বা ছেলেটির মুখখানা বাচ্চার মতো ছোট। তার ওপর আবছা সোনালি দাড়ি-গোঁফে বড় আশ্চর্য লাগছে।
এ দেখছি আর এক আপদ। আমি একটু বাঁকা করে ভাবলাম। আসান মামুর মতো ফেরেশতা চরিত্রের লোকটা এর কজাতে পড়ে গেল কী করে? এরা হল বিশ্বপর্যটক। নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে পথিকদের বন্ধুত্ব পাতানোতে এরা বেশ ওস্তাদ।
‘শাহেদাও আপনাকে সালাম বলেছে।’ সে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে বলল।
‘শাহেদা?’
‘হ্যাঁ, আপনার কাজিন। বেনারসে আমি তাদের ওখানে ছিলাম। আর লক্ষ্ণৌতে আপনার ফুফুর বাড়িতে। চাটগাতে গিয়ে থাকব আপনার আঙ্কলের কাছে। আর যদি দাজিলিং যেতে পারি তো আপনার কাজিন তাহেরার ওখানে উঠব।’
সে পকেট থেকে আরো একটা লম্বা লেফাফা বের করল।
‘বসে যাও অটো, চা খাও।‘ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মনে পড়ল সেই দুজন ডাচ পর্যটকের কথা, যারা করাচি এসে হামেদ চাচার ওখানে ঘাঁটি করে বসেছিল। তাদেরও পয়সা-কড়িও শেষ হয়ে গিয়েছিল প্রায়।
‘আমি তুরস্ক এবং ইরান হয়ে এসেছি। জার্মানি থেকে এ-পর্যন্ত মোটর এবং লরিতে। লিফট পেয়েছি। এখন যাব লংকা। তারপর থাইল্যান্ড ইত্যাদি। সেখান থেকে কার্গো বোটে চড়ে জাপান, আমেরিকা। তারপর বাড়ি পৌঁছব। এখানে আমি আওরঙ্গাবাদ থেকে ট্রাকে চড়ে এসেছি।’
‘তোমার এ-সফর বেশ রোমাঞ্চকর দেখছি।’
‘হ্যাঁ, ইস্তাম্বুলে তিনরাত আমি গ্যালাটার পুলের নিচে ছিলাম। আর ইরানে–’
তারপর বিভিন্ন ছোটখাট এডভেঞ্চার শুনিয়ে বলল, ‘আমি কলোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি।
‘সেখানে সবাই আমার সঙ্গে কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে খুব বেশি রকম আলোচনা করে। অথচ এখানে কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের আলোচনা খুব কম হয়। এখানকার আসল সমস্যা হল–’
বলতে গিয়ে সে ভারতের সমস্যাবলি সম্পর্কে বিরাট বক্তৃতা দিয়ে ফেলল। তারপর একটু থেমে শুরু করল–
‘আমি ধনী পর্যটক এবং সাধারণ ইউরোপীয়দের মতো শুধু তাজমহল দেখতে আসিনি। আমি রাতভর দোকানের বারান্দায় শুয়ে থাকি। কৃষকদের ঝুপড়িতে কাটাই, মজুরদের সাথে ভাব করি–যদিও আমি তাদের ভাষা বুঝতে পারি না।
খাওয়ার পর সে বোম্বের মানচিত্র বের করে মেঝেতে রাখল।
‘বেচারি ইংরেজ বোম্বাইয়ের স্থাপত্যরীতিকে ভিকটোরিয়ান গথিক বলে ধরে নিয়েছে। এখানে কী কী দেখবার মতো আছে, বলুন দেখি।’
‘কেন, এলিফ্যান্টা–আপালু বন্দর আর…’
‘এ সব তো গাইড বুকেও আছে।’
সে অধৈর্য হয়ে আমার কথা কাটল এবং ভারতের জীবনব্যবস্থা ও রীতিনীতির ওপর বড় ভারি এবং উদাহরণ সমৃদ্ধ আলোচনা করে শোনাল।
‘অটো, তোমার বয়স কত?’–আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম। ‘একুশ। যখন জার্মানিতে গিয়ে পৌঁছব তখন হবে বাইশ। তার পরের বছর আমি ডকটরেট পাব। আমি জার্মানির গীতিকাব্যের ওপর গবেষণা করছি। জার্মানিতে শুধু ডকটরেট দেয়, যেমন আপনাদের এখানে বি.এ., এম.এ।’
এরপর বহুক্ষণ সে জার্মানির গীতিকাব্য, বিশ্ব রাজনীতি মায় ভারতের শিল্পকলার আলোচনায় মুখর হয়ে উঠল। সে নাকি ছবিও আঁকে। কী রকম ডাকসাইটে ছেলে–আমি মনে-মনে বললাম। জার্মানদের মতোই মার্জিত এবং স্বচ্ছ বুদ্ধিসম্পন্ন সে।
‘আমি রাত্রে শোবার আগে আপনার বইগুলো দেখতে পারি?’
‘অবশ্যই।’
রাতভর বসার ঘরে বাতি জ্বলল। সকাল তিনটায় গোসলখানায় পানি ঝরার শব্দে আমি জেগে উঠলাম। সে নেয়ে-ধুয়ে একদম সাফসাফাই, যাতে তার জন্যে বাড়ির কারো অসুবিধা না-হয়। নাস্তার সময় সে রাতভর পড়ে শেষ করা পুস্তকের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সম্পর্কে নানা মতামত ব্যক্ত করল। তারপর বোম্বের মানচিত্র বের করে বেরিয়ে পড়ল ভ্রমণে।
কামরা ঠিক করার সময় হঠাৎ তার থলেতে আমি চারটি বই দেখলাম : গ্যেটের ফাউস্ট, হাইনের কাব্য, রিলকে, ব্রেশট এবং পবিত্র ইঞ্জিল।
সন্ধ্যায় সে ভারি ক্লান্ত এবং বিবর্ণ হয়ে ফিরলে আমি বললাম, ‘অটো, কাল রাতে তুমি তো খোদার বিরুদ্ধে ছিলে–অথচ ইঞ্জিল সাথে নিয়ে ঘুরছ।’
একথা শুনে অটো খোদার ধ্যানে আবেগ-অন্ধ মানবিক বাধ্যতার ওপর এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়ে ফেলল।
‘অটো, তুমি এলিফ্যান্টা গিয়েছিল? সেখানকার ত্রিমূর্তি আর দেবতা–’
‘আমি কোথাও যাইনি। সারাদিন ভিকটোরিয়া গার্ডেনে বসে ভিড়-জমা মানুষদের দেখেছি। মানুষ–মানুষই সবচে বড় দেবতা।’
‘হ্যাঁ, তা তো বটে। কিন্তু তুমি খেয়েছ কোথায়?’
‘আমি এক ডজন কলা কিনে নিয়েছিলাম।
হঠাৎই আমি খুব লজ্জিত হলাম। যাবার সময় কিছু খাবার দিতে আমার কেন মনে ছিল না ভেবে লজ্জা লাগল। আসান মামুর কথাও মনে পড়ল, সম্ভবত ওর কাছে পয়সা-কড়ি নেই।
খাবার টেবিলে সে বলল, ‘আমি অনেক দিন পর পেটপুরে খাচ্ছি।’
আমি তার সঙ্গে জার্মানির আলোচনা করতে লাগলাম। বার্লিনের প্রাচীরের বর্ণনা দিতে গিয়ে সে জানিয়ে দিল যে, সে পাক্কা এন্টি-কমুনিস্ট।
বাড়িতে আমার মা আমার জন্যে মজার-মজার খাবার তৈরি করে। আপনি মাকে দেখলে খুব খুশি হতেন। মায়ের বয়স এখন বিয়াল্লিশ। নানান বিপদ-আপদ বেচারিকে অকালে বুড়িয়ে ফেলেছে। কিন্তু এখনো মা সুন্দরীদের একজন।
‘তুমি কি তার একমাত্র ছেলে?’
‘হ্যাঁ, আমার পিতা সৈন্যবিভাগের অফিসার ছিলেন। মায়ের বাড়ি প্রসা। মায়ের বয়স যখন সতেরো তখন বাবার সাথে বিয়ে হয় তার; এর কিছুদিন পরই বাবা পোল্যান্ডের যুদ্ধে নিহত হন। তার পরের মাসেই আমার জন্ম। বোমা বিস্ফোরণ থেকে বাঁচবার জন্যে মা আমাকে কাঁধে করে নানা জায়গায় ফিরতেন। আমাকে কোলে নিয়ে, মাথায় রুমালের ফলবুট পরে, সামান্য আসবাবপত্র প্রেম্বুলেটরে এঁটে গ্রামে-গ্রামে ঘুরতেন আর ক্ষেতখামারে লুকিয়ে থাকতেন। মা যখন পোল্যান্ডের এক গ্রামে লুকিয়ে ছিলেন তখন সৈন্যেরা ঘরে আসে। আমার বয়স তখন বছর চারেক। আমার শৈশবের অবিস্মরণীয় স্মৃতি এই ভীষণ রাতটা। ভয়ে আমি পালঙ্কের নিচে লুকালাম। লোকেরা যখন মাকে টেনে নিয়ে গেল আমি জোরে-জোরে কাঁদতে লাগলাম। মাকে ওরা টেনে-হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে গেল। এর পর মা ভয়ে ঝোপে-ঝাড়ে লুকিয়ে থেকে বেশ ক’দিন পর ফিরলেন। এদিকে আমি খালি ঘরে একা। বাইরের গোলাগুলির আওয়াজ ঘরের ভেতর ছমছম করে বেড়াত। বাবুর্চিখানা এবং ভাঁড়ারের আলমারি খুলে আমি খাবার তালাশ করতাম। যা কিছু পেতাম তাই ক্ষুধার জ্বালায় খেয়ে ফেলতাম। আলমারিগুলোর তাক ছিল অনেক উঁচুতে। সেখানে অনেক খাবারও ছিল। কিন্তু আমি নাগাল পেতাম না।’
এতটুকু বলে সে চুপসে গেল। খেতে থাকল নীরবে।
‘চালের খাবার খুব ভালো লাগে। কয়েক মিনিট পর সে আস্তে করে বলল, এই জন্যে পারলে আমি যুদ্ধের ধ্বংসকাহিনী পড়ি না। বড়দের কাছ থেকে শোনা এমনি আরো অসংখ্য বীভৎস কাহিনী শুনেছি। আমার সেই ফরাসি মেয়েটির কথা মনে পড়ছে, যে এই অটোরই স্বজাতি জার্মানদের মৃত্যুলীলার কাহিনী শুনিয়েছে। এই পোল্যান্ডেই যেখানে অটো এবং তার মায়ের এই দুরবস্থা হয়েছিল, নাৎসিরাও রাতদিন সেখানে কাজ করছে। সেখানে রোজ হাজারো ইহুদিদেরকে নিষ্ঠুর মৃত্যুযন্ত্রে নিক্ষেপ করা হত। ব্রিটিশের গোলা-বারুদ এ-অঞ্চলকে করে দিয়েছিল একেবারে ধ্বংসস্তূপ। আমার সেই রুশ বালিকার কাহিনীও মনে পড়ল। কে যেন শুনিয়েছিল কাহিনীটি। নিজের গোটা পরিবারকে জার্মানদের নির্মম মেশিনগানের সামনে আহুতি দিতে দেখে ভয়ে-বিভীষিকায় পলকের মধ্যে তার মাথার সব চুল শাদা হয়ে গিয়েছিল।
অথচ এরা সবাই উনিশ শ পঁয়তাল্লিশোত্তর ইউরোপের নবীন বংশধর।
মানবতার সেবক যিশুর অনুসারী পশ্চিম ইউরোপ তার সন্তানদেরকে উত্তরাধিকার সূত্রে কী দিয়েছে!
‘তোমার মা এখন কী করেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘তিনি এখন হাউস-কিপার। সামরিক বিধবা হিসেবে পেনশন পান। আমাদের দু কামরার ছোট ঘর। আমি সন্ধের শিফটে এক ফ্যাক্টরিতে কাজ করি। আমার মা খুব ভালো। এসট্রলজিতে পূর্ণ বিশ্বাসী, রীতিমতো গির্জায় যান। গত বছর আমি সাইকেলে সারা জার্মানি ভ্রমণ করেছি। জার্মানি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশ।
‘সব দেশই তার বাসিন্দাদের কাছে সুন্দর। কিন্তু তুমি নব্য-নাৎসি যেন না-হয়ে ওঠ।’
‘না আমি নাৎসি হব না। ইহুদিদের প্রতি আমার কোনো ঘৃণা নেই।’
সে সহজে বলল। আমার হাসি পেল।
‘আমার মাতুলরা এখনো পূর্ব জার্মানিতে রয়েছে। যেমন আপনাদের কিছু লোক এখানে, আর কিছু পাকিস্তানে।’ সে ম্যাপ দেখিয়ে বোঝাল।
দ্বিতীয় দিন সে কথা দিয়েছিল শহরের দর্শনীয় সব কিছু দেখবে। কিন্তু সে দিনও সারাক্ষণ সে রানিবাগে বসে কাটাল।
চতুর্থ দিন ছেলেটা ওয়ার্ডেন রোডে ভুলা ভাই দেশাই ইন্সটিটিউটের বারান্দায় বসে লাওস যুদ্ধ সম্পর্কিত প্রবন্ধ পড়ে দিনটা কাটিয়ে দিল।
ভেতরে মেয়েরা নাচ শিখছিল আর হলঘরে হুসেনের নতুন চিত্র প্রদর্শনী হচ্ছিল।
বোম্বের সব দূরত্ব সে পায়ে হেঁটে পার করত। ওয়ার্ডন রোড থেকে ফ্লোরা ফাউন্টেন অবধি সে পায়ে হেঁটে গেছে। আমার মনে হত, জার্মান জাত নিঃসন্দেহে জীন বা দেও জাত-সম্ভূত।
‘আমি আট আনা থেকে এক টাকা পর্যন্ত রোজ খরচ করি। প্রায়ই কলা খেয়ে থাকি। সবখানেই অতিথিপরায়ণ লোক মিলে যায়। কেমন আশ্চর্য দেখুন, মানুষ এককভাবে কত সাদাসিধে এবং নিষ্পাপ, অথচ সমষ্টির আবর্তে সে পশুর মতো।’
সে মুখ উঁচু করে বসল। সেদিন সে এক ট্রাক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে এসেছে। বাঙ্গালোর অবধি সে ট্রাকে চড়ে যাবে। খুব সকালে সে তার বই-পত্র, কাপড়-চোপড়, তাঁবু আর বিছানা দিয়ে থলে দুটি ভরে কাঁধে তুলে নিল। এবং খোদা হাফেজ বলে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির অফিস ফ্লোরা ফাউন্টেনে যাবার উদ্দেশে পায়ে হেঁটে রওনা দিল।
অটো চলে গেছে কয়েক মাস হল। আসান মামুর চিঠি এলে আমি তাকে অভিযোগ করে লিখলাম, অটো এখান থেকে সেই যে গেল আর একটা খবরও দিল না, সে এখন কোথায়-কোথায় ফিরছে। আসান মামুর চিঠি ডাকে দিয়ে ফিরতেই বিকেলের ডাকে অটোর চিঠি এল। খামে লাওসের রাজার ছবি। চিঠিতে লিখেছে–
‘সেই জার্মান ছেলেটি, যে আপনার বাড়িতে দিনকয় ছিল আপনাকে ভুলে যায়নি। আপনি আমার জন্য যথেষ্ট করেছেন। (মাফ করবেন, আমি ইংরেজিতে দুর্বল) আপনি। আমাকে বড় বোনের মতো স্নেহ দিয়েছেন। আমি ভালোবাসায় আস্থাবান। এর কারণ হয়তো আমি এখনো কমবয়সী। কিন্তু আপনি ঠিকই বলেছেন, পৃথিবীতে সে-সব লোকেরাই সুখী, যারা কোনো দিকে না-দেখে, প্রশ্ন না-করে সবকিছু মেনে নেয়। আমরা যতই প্রশ্ন করছি ততই মনে হচ্ছে যে, জীবনটা নিছক অর্থহীন।
লংকায় নিউরেলিয়া থেকে কেনেডি পর্যন্ত এক টুরিস্ট বাসে গিয়েছি। বাসে এক সিংহলি ছাত্রের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। সে আমাকে খাইয়েছে। নাম তার রাজা। সে আমার জন্যে পথ থেকে কিছু ফুলও কিনেছে। বাসে ক’টা ঢোল ছিল। রাজা সেগুলো বাজিয়ে গান গেয়েছে। আমার খুব ভালো লেগেছে সে গান। এক সময় রাজা আমাকে বলল, চল, স্নান করি। অথচ কয়েক মিনিট পরে সে মরে গেল। হঠাৎ পানিতে ডুবে গিয়েছিল। দু’ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর আমরা তার শব একটা বাকের নিচে পেলাম। এসব কী? আমি ভাবতে লাগলাম, এমন হল কেন? আমাদের কেউই রাজাকে বাঁচাতে পারল না। এটা কি ঘটনাচক্রে ঘটল, না এটাই তার ভাগ্য? রাজা মা-বাবার একমাত্র ছেলে। তার বোন এবং ভাইও পাঁচ থেকে পনের বছরের মধ্যে মরেছে। তার বাপ অন্ধ। মা-ও বড় রুগ্ণা, রাজাই তাদের একমাত্র ভরসা ছিল।
মাদ্রাজের এক যুবক কবি আমাকে জানাল, এই পৃথিবীর কারণে সে খুব দুঃখী। মাদ্রাজে আমি রেডিও ইন্টারভিউ দিয়ে কিছু টাকা উপার্জন করেছিলাম। সেখান থেকে আমি এসেছি পেনাং। খুব সুন্দর দ্বীপটা। এখানে অনেক চীনা থাকে।
এক মালগাড়ির শেষ ডাব্বায় চড়ে আমি ব্যাংককে পৌঁছেছি। এখানে এক বৌদ্ধ মন্দিরে থাকি। মন্দিরের যাজকদের সঙ্গে আমি খাবার খাই। দ্বিপ্রহরের সময় সুন্দরী মেয়েরা এবং মহিলারা নানা বেশ-ভূষায় তাদের ভাগ্য এবং ভবিষ্যৎ জানবার জন্যে যাজকের কাছে আসে।
বেশিরভাগ ভিক্ষুই প্রেম-পিয়াসী। দেদার তামাক টানে। কোনো কাজ করে না। ধর্মভীরু বৃদ্ধরা তাদের খাবার এবং পয়সা জোগায়। অনেক ভিক্ষুই মন্দিরে এসেছে পরিশ্রম ভালো লাগে না বলে। লোকগুলো ভারি দুর্বল। তাদের ধর্মে এই হীনতার এক সুস্পষ্ট বৈধতাও বিদ্যমান। এদের অনেকে যথানিয়মে শুচি হয়ে যোগসাধনায়ও বসে। বেশিরভাগ ভিক্ষুই খাওয়া এবং মেয়েদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া বাকি সময় শুয়ে-শুয়ে কাটায়।
নাংকাইতে আমি মেকং নদীতে স্নান করেছি। তারপর চলে এসেছি লাওসে।
দিয়েন ভিয়েন একটা বড় গ্রামের মতো। রৌদ্র বড় কড়া। সড়কগুলো ধুলোয় ধূসর। শুধু রাতগুলো বড় সুন্দর। অন্ধকার সব কদাচার, অত্যাচার, হানাহানি এবং রক্তপাত বুকে লুকিয়ে নেয়। এখানে মশা খুব বেশি।
সুফানা অবধি এক প্লেনে ফ্রি লিফট পেলাম। এখন আমি পাকশাতে আছি। তারপর যাব কম্বোডিয়া। আঙ্কল আহমদের ওখানে মানে চিটাগাংয়ে যেতে পারিনি। বর্মায় প্রবেশ করতে হিমশিম খেয়ে গেছি। আমি লালচীন এবং ভিয়েতনামের ভিসার জন্যে দরখাস্ত করেছি। পিকিং বা হ্যাঁনয়ে গিয়ে জবাব পেয়ে যাব। কাল আমি এখান থেকে দক্ষিণ ভিয়েতনাম যাচ্ছি।
আপনার চিরকৃতজ্ঞ
‘অটো’
.
উনিশ শ তেষট্টির এক বিদেশি পত্রিকার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ভিয়েতনামের অরণ্যপুরী’ শীর্ষক রঙিন সচিত্র প্রবন্ধ ছাপা হয়। তাতে রয়েছে গেরিলা সৈন্যদেরকে গুলি করে মারার দৃশ্য। নৌকায় করে গেরিলা কয়েদিদেরকে মেকং নদী পার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কৃষাণ মেয়েরা তীরে দাঁড়িয়ে দেখছে। ওপারে পৌঁছলে তাদেরকে গুলি করে মারা হবে। প্রবন্ধের শেষ দিকে দু পৃষ্ঠাব্যাপী রঙিন ছবি। তাতে সজীব ধানক্ষেতের দৃশ্য। ধানের শীষ হাওয়ায় দুলছে। প্রান্তসীমায় গাছের লম্বা পাতা দুলছে। সবুজ সতেজ বনানী আর তার পাশে ছলছল করা নদী। বড় মনোরম দৃশ্য। শিল্পী যা দেখে ছবি আঁকে, কবি কবিতা লেখে, আর গাল্পিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পটভূমিকায় গল্প লেখে ঠিক তাই। কিন্তু এ-ছবির শেষদিকে বিস্রস্ত বিবর্ণ অর্ধনগ্ন রক্তাক্ত এক যুবক পড়ে আছে। কিছু দূরে কালো রঙের যুদ্ধবিমান দাঁড়িয়ে আছে ভয়াল দানবের মতো। ছবির নিচে লেখা রয়েছে,
‘মৃত্যুর খামার’
একজন ভিয়েতকং গেরিলা, যাকে মেকং নদীর ধানক্ষেতে মারা হয়েছে, তার সঙ্গীরা একে অপরের সঙ্গে রশি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে এক কোণে। এই রক্তাক্ত খণ্ড-যুদ্ধের সময় এক পর্যটক যুবক মেকং নদী পার হয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনাম যাচ্ছিল। হঠাৎ ফসকে যাওয়া এক গুলি তাকে ভেদ করে যায়। এই সুন্দর দেশে ১৯৪৪ সাল থেকে যুদ্ধ চলে আসছে, এবং…।
সদগতি – প্রেমচন্দ
এক
বাড়ির দরজায় ঝাট দিচ্ছে দুখী চামার। ওর বৌ ঝুরিয়া গোবর দিয়ে ঘর নিকোচ্ছে। দু’জনেরই কাজ সারা হলে ঝুরিয়া দুখীকে বলল, এবার তাহলে তুই গিয়ে পণ্ডিতমশাইকে বলে আয়, উনি আবার অন্য কোথাও বেরিয়ে-টেরিয়ে যান।
দুখী–হ্যাঁ যাচ্ছি, কিন্তু ভেবে দেখ তো উনি বসবেন কিসে?
ঝুরিয়া–কোথাও একটা খাঁটিয়া-ফাটিয়া পাবি না? বামুনপাড়া থেকে না-হয় একটা চেয়ে নিয়ে আসিস।
দুখী–তুই মাঝেমাঝে এমন সব কথা বলিস যে, শুনলে পিত্তি জ্বলে যায়। বামুনপাড়ার ওনারা আমাকে খাঁটিয়া দেবে কেন! একটুকুন আগুন পর্যন্ত বাড়ি থেকে দেয় না, খাঁটিয়া দেবে! কুয়োর ধারে গিয়ে এক ঘটি জল চেয়ে পাই না, আর খাঁটিয়া দেবে! এ কি আমাদের খুঁটে, কঞ্চি, ভূষা কিংবা কাঠ যে, যার যেমন খুশি নিয়ে চলে যাবে। নে, আমাদের খাঁটিয়াটাকেই ধুয়েটুয়ে রেখে দে। গরমের দিন, ঠাকুরমশাই আসতে-আসতে শুকিয়ে যাবে।
ঝুরিয়া–আমাদের খাঁটিয়াতে উনি বসবেন না। দেখিসনি কী রকম আচারে-বিচারে থাকেন।
দুখী একটু চিন্তিত হয়ে বলল, তাও তো বটে। তাহলে মহুয়াপাতা পেড়ে এনে একটা আসন বানিয়ে নিলে হয় না। মহুয়া তো বড়-বড় লোকেরা খায়। মহুয়াপাতা পবিত্তর। দে তো লাঠিটা, ক’টা পাতা পেড়ে আনি।
ঝুরিয়া–পাতা দিয়ে আসন আমি বানিয়ে রাখবখন। তুই যা। আর হ্যাঁ, ঠাকুরমশাইয়ের জন্যে তো সিধেও নিতে হবে। আমাদের থালাটাতে সিধে সাজিয়ে রেখে দেব।
দুখী–কখনো অমন সব্বনাশটি করিস না। তাহলে সিধেও যাবে, থালাখানাও ভাঙা পড়বে। একটান মেরে বাবাঠাকুর থালাখানাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। ওনার বড় তাড়াতাড়ি রাগ চেপে যায়, রাগ চাপলে বামুনমাকেও ছেড়ে কথা কন না; ছেলেটাকে তো এই সেদিন এমন ঠ্যাঙানি ঠেঙিয়েছেন যে, বেচারা আজও ভাঙা হাত নিয়ে ঘুরছে। পাতাতে করেই সিধে দিস। হ্যাঁ, দেখিস তুই কিন্তু কিছু ছুঁস না। গোঁড়ের মেয়েকে ডেকে নিয়ে সাহুর দোকান থেকে সব জিনিস নিয়ে আসিস। সিধেতে সব জিনিস যেন ঠিক থাকে। সেখানেক আটা, আধ সের চাল, পোয়াটাক ডাল, আধপো ঘি, নুন-হলুদ না দিস আর পাতার এক কোণে চার আনা পয়সাও রেখে দিস। গোঁড়ের মেয়েকে না-পেলে তুই ভুর্জিনক হাতে-পায়ে ধরে ডেকে নিয়ে যাস। দেখিস তুই কিন্তু কিছু ঘঁস না, তাহলে সব্বনাশ হয়ে যাবে।
সব কথা ভালো করে বুঝিয়ে-পড়িয়ে দুখী লাঠিটা নিয়ে ঘাসের একটা বড়সড় গাঁটরি মাথায় চাপিয়ে পণ্ডিতমশাইকে খোশামুদি করতে চলল। খালি হাতে বাবাঠাকুরের সামনে যায় কোন মুখে। আর নজরানা বলতে ঘাস ছাড়া ওর কাছে আর কিই-বা আছে। ওকে খালি হাতে দেখলে ঠাকুরমশাই তফাৎ থেকেই যে দূর-দূর করে খেদিয়ে দেবেন।
দুই
পণ্ডিত ঘাসীরাম পরম ঈশ্বরভক্ত। ঘুম থেকে উঠেই পূজার্চনা নিয়ে পড়েন। হাতমুখ ধুতে-ধুতে আটটা বাজে। তারপর শুরু হয় পুজো। পুজোর প্রথম কাজ হল ভাঙ ঘোটা। তারপর আধঘণ্টা ধরে বসে চন্দন ঘষেন, আয়নার সামনে বসে একটা কাঠি দিয়ে কপালে তিলক আঁকেন। চন্দনের দুটো রেখার মাঝখানে সিদুরের লাল ফোঁটা কাটেন। একে-একে বুকে, হাতে, গোল-গোল মুদ্রা আঁকেন চন্দনের। এরপর ঠাকুরের বিগ্রহকে স্নান করান, চন্দন দিয়ে সাজান, সামনে ফুল দেন, আরতি করেন, ঘণ্টা বাজান। দশটা নাগাদ উনি পুজো সেরে ওঠেন। ভাঙের শরবত খেয়ে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। ততক্ষণে দু’-চারজন যজমান এসে পড়ে বাড়িতে। ঠাকুরপুজোর ফল হাতে-হাতে পেয়ে যান। এই হল ওঁর পেশা।
আজ ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে এসে উনি দেখেন দুখী চামার এক গাঁটরি ঘাস নিয়ে বসে আছে। দুখী ওকে দেখেই সাষ্টাঙ্গে দণ্ডবৎ করে জোড়হাতে উঠে দাঁড়ায়। বাবাঠাকুরের তেজোময় মূর্তি দেখে দুখীর হৃদয় শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে! আহা কী দিব্য মূর্তি। ছোটখাট গোলগাল চেহারা, মসৃণ ভাল, প্রসন্ন বদন, ব্রহ্মতেজে প্রদীপ্ত নয়ন। সিঁদুরে আর চন্দনরেখায় দেখাচ্ছে যেন দেবতা!
দুখীকে দেখে শ্রীমুখে বলে ওঠেন, আজ কী মনে করে এলি রে দুখীয়া!
দুখী মাথা হেঁট করে বলে, মেয়েটার বিয়ে দিচ্ছি বাবাঠাকুর! পাঁজিপুঁথি দেখে একটা শুভলগ্ন দেখে দিতে হবে যে। কখন দয়া হবে বাবা?
ঘাসী–আজ তো সময় হবে না রে। ঠিক আছে, না-হয় সন্ধে নাগাদ যাব।
দুখী–না না, বাবাঠাকুর, একটু তাড়াতাড়ি চলুন। আমি সব কিছু ঠিকঠাক করে রেখে এসেছি। এই ঘাসটা কোথায় রাখি?
ঘাসী–এই গরুটার সামনে দিয়ে দে ওটা। আর ঝাড়গাছা নিয়ে বাড়ির দরজাটা একটু ঝটপাট দিয়ে পরিষ্কার করে দে তো। বৈঠকখানাটাও আজ ক’দিন ধরে লেপা-পোঁচা হয়নি। ওটাকে একটু গোবর দিয়ে লেপে দে। আমি ততক্ষণে সেবাটেবা সেরে নিই। তারপর একটুখানি বিশ্রাম নিয়ে যাব। হ্যাঁ, এই কাঠটাকেও একটু চিরে দিস তো। আর শোন, খামারে ঝুড়ি চারেক ভূষি পড়ে আছে, ওগুলোকে নিয়ে এসে ভূষি রাখার ঘরটায় রেখে দিস, কেমন।
দুখী সঙ্গে-সঙ্গে হুকুম তামিল করতে শুরু করে দিল। দরজায় ঝাড় দিল, বৈঠকখানাকে নিকিয়ে দিল গোবর দিয়ে। এসব কাজ সারতে-সারতে বেলা বারোটা বেজে গেল। পণ্ডিতমশাই খেতে যান। দুখী সকাল থেকে কিছু খায়নি। জোর খিদে পেয়েছে ওরও; কিন্তু এখানে কে ওকে খেতে বলেন। বাড়ি এখান থেকে মাইলখানেক দূরে। বাড়ি খেতে গেলে পণ্ডিতমশাই যদি রাগ করেন। বেচারা খিদে চেপে কাঠ চিরতে শুরু করল। মোটা মতন একটা গাঁট, এর ওপর এর আগে কত-না শিষ্য তাদের শক্তি পরীক্ষা করছে। দুখীও একই শক্তি আর দৃঢ়তার সঙ্গে এই কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হল। দুখীর কাজ ঘাস কেটে বাজারে নিয়ে গিয়ে বেচা। কাঠ চোরার অভ্যাস আদৌ নেই তার। ঘাস ওর খুরপির সামনে মাথা নোয়ায়। দুখী ঠিকরে যায়। ঘেমে নেমে ওঠে দুখী, হাঁপাতে থাকে, অবসন্ন হয়ে বসে পড়ে, আবার উঠে দাঁড়ায়। হাত ওঠাতে গিয়ে ওঠাতে পারে না। পা দুটো কাঁপে, কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। চোখে আঁধার ঘনিয়ে আসে, মাথা ঝিমঝিম করে! তবুও সে কাজ করে চলে। ভাবে, এক ছিলিম তামাক যদি টানতে পেতাম হয়তো একটু তাগদ পেতাম। কিন্তু কলকে তামাক এখানে পাব কোথায়? বামুনদের পাড়া। বামুনরা তো আর। আমাদের নিচু জাতের মতন তামাক খায় না। হঠাৎ খেয়াল হয় এ-গাঁয়ে তো এক ঘর গোড়ও আছে। ওর কাছে গেলে ঠিকই কল্কে-তামাক পাওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে দুখী ছোটে ওর বাড়ি। যাক্, পরিশ্রম সার্থক হয় সে তামাক দেয়। কিন্তু আগুন পাওয়া গেল না সেখানে। দুখী বলে, আগুনের জন্য ভেব-না ভাই! আমি যাচ্ছি, পণ্ডিতমশাইয়ের বাড়ি থেকে চেয়ে নেব। ওঁর বাড়িতে তো এই একটু আগেও রান্না হচ্ছিল।
এই বলে জিনিস দুটো নিয়ে দুখী চলে আসে। পণ্ডিতমশাইয়ের বাড়ির দেউড়িতে দাঁড়িয়ে ডাকে, বাবাঠাকুর, একটুন আগুন যদি পেতাম এক ছিলিম তামাক টেনে নিতাম।
পণ্ডিতমশাই খেতে বসেছিল। বামুনগিন্নী জিজ্ঞেস করেন, আগুন চাইছে কে এটা?
পণ্ডিত–আরে ওই শালা দুখিয়া চামার। ওকে বলেছি কাঠটাকে একটু চিরে দিতে। আগুন তো রয়েছে, দাও-না একটু।
বামুনগিন্নী ভুরু কুঁচকে বলে ওঠেন, পুঁথিপত্তরের ফেরে পড়ে ধরম-করম সব কিছুর তো মাথা খেয়ে বসে আছ। চামার হোক, ধোপা হোক, নাপিত হোক, মাথা উঁচু করে একেবারে ভেতরবাড়িতে চলে আসবে! এ যেন হিন্দুর বাড়ি নয়, একটা সরাইখানা। বলে দাও পোড়ারমুখোকে চলে যেতে, না হলে এই পোড়াকাঠ দিয়ে মুখ পুড়িয়ে দেব। আগুন চাইতে এসেছে!
পণ্ডিতমশাই বুঝিয়ে বলেন, ভেতরে চলে এসেছে তো কী হয়েছে? তোমার তো। কোনো কিছু ছোঁয়নি। মাটি হল পবিত্র। একটুখানি আগুন দিয়ে দিচ্ছ-না কেন? কাজটা। তো আমাদেরই করছে। কোনো মজুর লাগিয়ে এই কাঠ চেলাতে গেলে কম করে চার আনা পয়সা তো নিত।
বামুনগিন্নি মুখঝামটা দিয়ে বলেন, ওটা বাড়িতে ঢুকেছে কেন?
হার মেনে বলেন পণ্ডিতমশাই-শালার কপাল খারাপ, এছাড়া আর কী?
বামুনগিন্নী–বেশ, এবারের মতো আগুন দিয়ে দিচ্ছি; কিন্তু আবার যদি এভাবে কোনো ব্যাটা বাড়িতে ঢোকে তো তার মুখে নুড়ো জ্বেলে দেব।
সব কথাই কানে আসে দুখীর। মনে-মনে পস্তাচ্ছে–কেন যে শুধু-শুধু এলাম। সত্যি কথাই তো। বামুনপণ্ডিতের বাড়ির ভেতরে চামার ঢোকে কী করে! বড় পবিত্তর এনারা, তাই তো দুনিয়ার সবাই এত খাতির করে, তাই তো এত মান্যিগন্যি। মুচি-চামার তো নয়। এই গাঁয়েই বুড়ো হলাম। আর এ আক্কেলটুকুন হল-না আমার। তাই বামুনগিন্নী আগুন নিয়ে বেরুলে দুখী যেন হাতে স্বর্গ পায়। জোড় হাত করে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বলে, মা-ঠাকরুণ, বড় ভুল হয়ে গেছে গো। বাড়ির ভেতরে চলে এসেছি। চামারের বুদ্ধি তো মা! এতটা মুখ্যসুখ্য যদি নাই হব, তাহলে লাথিঝেটা খাব কেন?
বামুনগিন্নী চিমটেয় ধরে আগুন এনেছেন। হাতপাঁচেক দূরে দাঁড়িয়ে ঘোমটার আড়াল থেকে আগুনটাকে দুখীর দিকে ছুঁড়ে দিলেন। বড় একটা আগুনের টুকরো এসে দুখীর মাথায় পড়ল। তাড়াতাড়ি পিছু হটে সে মাথা ঝাঁকাল। তার মন বলে উঠল, এ হল গে পবিত্তর বামুনের বাড়িকে অপবিত্তর করার সাজা। ভগবান হাতে-হাতে সাজা দিয়ে দিয়েছেন। এজন্যেই তো সারা দুনিয়া বামুনদের এত ভয় করে। অন্যসব লোকের টাকা-পয়সা মার যায়। কই বামুনদের পয়সা মেরে নিক তো কেউ। গুষ্টিসুষ্ঠু সবার সব্বনাশ হয়ে যাবে না, পা পচে-পড়ে খসে পড়বে-না!
বাইরে এসে সে তামাক খায়, তারপর আবার কুড়ল নিয়ে কাজে লেগে পড়ে। খটাখট আওয়াজ আসতে থাকে।
ওর গায়ে আগুন পড়েছে, তাই বামুনঠাকরুনের একটু মায়া হয় দুখীর ওপর। পণ্ডিতমশাই খেয়ে উঠলে বলেন, চামারটাকে একটু কিছু খেতেটেতে দাও, বেচারা সেই কখন থেকে কাজ করছে, খিদে থাকতেই পারে।
পণ্ডিতমশাই এই প্রস্তাবটার বাস্তব দিকটা উপলব্ধি করে জিজ্ঞেস করেন, রুটি আছে?
পণ্ডিতগিন্নী–দু’চারখানা হয়তো বেঁচে যাবে।
পণ্ডিত দু’চারখানা রুটিতে কী হবে? ব্যাটা চামার, কম করে সেরখানেক তো গিলবে।
পণ্ডিতগিন্নী কানে হাত দিয়ে বলেন, ওরে বাপ রে! সেরখানেক! তাহলে থাকগে।
পণ্ডিতমশাই এবার উল্টো চাপ দেন, বলেন–কিছু ভুষি-টুষি থাকলে আটার সঙ্গে মিশিয়ে দু’খানা মোটা চাপাটি সেঁকে দাও না, শালার পেট ভরে যাবে। ওই পাতলা-পাতলা রুটিতে এসব ছোটলোকের পেট ভরে না। এদের তো জোয়ারের মোটা চাপাটি চাই।
পণ্ডিতগিন্নী বলেন, ছাড়ো তো, এই দুপুর-রোদে কে মরতে যাবে ওসব করে।
তিন
দুখী তামাক খেয়ে আবার কুড়ল নেয়। দম নিয়ে হাতে একটু জোর পায়। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে একনাগাড়ে কুড়ল চালিয়ে যায়। তারপর অবসন্ন হয়ে সেখানে মাথাটা চেপে ধরে বসে পড়ে।
এর মধ্যে গোঁড় এসে পড়ে। বলে–কেন জানটা খোয়াচ্ছ বুড়োদাদা। কোপানিতে এই গাঁট ফাটবে না। শুধু-শুধু হয়রান হচ্ছ।
কপালের ঘাম মুছে দুখী বলে–এখনো একগাড়ি ভুষি বয়ে আনতে হবে রে ভাই।
গোঁড়–খেতে-টেতে কিছু দিয়েছে, না শুধু কাজই করিয়ে চলেছে। গিয়ে চেয়েটেয়ে কিছু নিচ্ছ-না কেন?
দুখী–বলছ কী চিখুরী! বামুনের অন্ন কি আমাদের পেটে হজম হবে?
গোঁড়া–হজম ঠিকই হবে, আগে পাও তো। গোঁফে তা দিয়ে তো ঠিকই খেয়ে নিয়ে তোমাকে কাঠ চেরার হুকুম দিয়ে আরাম করে ঘুমুচ্ছে, জমিদারও তো কিছু না-কিছু খেতে দেন। হাকিমও বেগার খাটালে কিছু না-কিছু মজুরি দেন। ইনি ওঁদেরও ছাড়িয়ে গেছেন। নিজেকে ধাম্মিক বলে জাহির করছেন।
দুখী–আস্তে-আস্তে বল্রে ভাই, শুনে-টুনে ফেললে বিপদ হবে। বলে দুখী আবার কুড়ল চালাতে লাগল। দুখীকে দেখে চিখুরীর দয়া হল। এগিয়ে এসে ওর হাত থেকে কুড়লখানাকে কেড়ে নিয়ে একনাগাড়ে আধঘণ্টা খুব জোরে-জোরে কুড়ল চালাল; কিন্তু গাঁটে একটুখানি ফাটও ধরল না। কুড়লটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে বলতে চাইলে–এ ঘাট চেরা তোমার কম্ম না, জান গেলেও পারবে না।
দুখী ভাবে–বাবাঠাকুর এই গাটটা পেলেন কোথায়, যাকে এত কুপিয়েও চেরা যাচ্ছে না। কোথাও একটুখানি চিড় পর্যন্ত খাচ্ছে না। আমি কতক্ষণ ধরে কোপাব এটাকে? ওদিকে বাড়িতে এখনও শতেক কাজ পড়ে রয়েছে। কাজকম্মের বাড়ি, একটা-না-একটা কাজ তো লেগেই আছে। কিন্তু এতে কার কী মাথাব্যথা! যাই ততক্ষণে না-হয় ভুষিগুলোই নিয়ে আসি। বলব, বাবাঠাকুর, আজ তো কাঠ চিরতে পারলাম না, কাল এসে না-হয় চিরে দেব।
ঝুড়ি মাথায় করে দুখী ভুষি বয়ে আনল। বাড়ি থেকে খামার দুফার্লংয়ের কম নয়। খুব চাপাচাপি করে ঝুড়ি যদি ভরে আনতে পারত তাহলে কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেত বটে, কিন্তু মাথায় তুলে দেবে কে ঝুড়ি। পুরোপুরি ঠাসা ঝুড়িটাকে একা মাথায় তুলতে পারে না। তাই অল্প-অল্প করেই আনে। চারটে নাগাদ ভুষি আনা তার শেষ হয়। পণ্ডিতমশাইয়েরও ঘুম ভাঙে। মুখ-হাত ধুয়ে, পান খেয়ে বাইরে আসেন। দেখেন ঝুড়ির ওপর মাথা রেখে দুখী ঘুমুচ্ছে। জোরে হাঁক দেন–ওরে ও দুখিয়া! বলি, ঘুমুচ্ছিস? কাঠ তো এখনো যেমনকার ঠিক তেমনি পড়ে রয়েছে। এতক্ষণ তুই করছিলি কী? একমুঠো ভূযো আনতেই দিন কাবার করে ফেললি। তার ওপর আবার পড়ে-পড়ে ঘুমুচ্ছিস? নে নে, তোল কুড়ল। কাঠটা চিরে দে! তোকে দিয়ে একটুখানি কাঠ চেরানোও যায় না। লগনও তাহলে তেমনি হবে বুঝলি, আমাকে কিন্তু তখন দুষতে পারবি না। সাধে বলে, ছোট জাতের ঘরে খাবার জুটল তো ব্যস ওদের মতিও পালটে গেল।
দুখী আবার কুড়ল হাতে নিল। যেকথা বলবে বলে ভেবে রেখেছিল, সেসব ভুলে গেল। পেট পিঠে লেগে গেছে। সেই সকাল থেকে জলটুকু পর্যন্ত খায়নি। সময়ই পায়নি। উঠে দাঁড়াতেই কষ্ট হচ্ছে। দেহ বসে যাচ্ছে। তবু মনটাকে শক্ত করে উঠে দাঁড়াল সে। পণ্ডিতমশাই শুভ সময়টা ঠিকমতো যদি না-দেখে দেন, তাহলে হয়তো সব্বনাশ হয়ে যাবে। এজন্যেই তো সংসারে তার এত খাতির, এত মান। শুভ মুহূর্তেরই তো সব খেলা। যাকে ইচ্ছে শেষ করে ফেলতে পারলে ইনি। পণ্ডিতমশাই কাঠটার কাছে এসে দাঁড়ান, আর উৎসাহ দিয়ে যান–মার কষে, আবার মার-কষে মার কী রে, মার। না রে জোরে–তোর হাতে তো যেন জোরই নেই–লাগা কষে, দাঁড়িয়ে ভাবছিস কী! হা হা, ব্যস্ এই তো ফাটল বলে! দে দে, ওই ফাটলতাতেই আবার দে।
দুখীর হুঁশ থাকে না! না-জানি কী এক গুপ্তশক্তি ওর বাহু দুটিতে ভর করেছে। ক্লান্তি, অবসাদ, ক্ষুধা সবই যেন উবে যায়। নিজের বাহুবলে নিজেই অবাক। এক-একটি আঘাত পড়ছে যেন বজ্রের মতো। আধঘণ্টা ধরে উন্মাদের মতো সে কুড়ল চালিয়ে যায়। শেষে কাঠখানাও মাঝখান দিয়ে ফেটে যায়। সেই সঙ্গে দুখীর হাত থেকে কুড়লটাও ছিটকে পড়ে। মাথা ঘুরে পড়ে যায় দুখী। ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় ক্লান্ত অবসন্ন শরীর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
পণ্ডিতমশাই ডাকেন–নে রে, উঠে দু’চার কোপ আরও দিয়ে দে। পাতলা-পাতলা চ্যালা করে দে। দুখী ওঠে না। পণ্ডিতমশাইও ওকে আর এখন বিরক্ত করা উচিত মনে করেন না। ভেতরে গিয়ে ভাঙের শরবত খান, শৌচকর্ম সারেন, স্নান করেন, তারপর পণ্ডিতমশাইয়ের পোশাকে সেজেগুজে বাইরে আসেন। দেখেন দুখী তখনো একইভাবে পড়ে রয়েছে। পণ্ডিতমশাই জোরে ডাক দেন–অ্যাই দুখী, তুই কি শুয়েই থাকবি রে, চল তোর বাড়িতেই যাচ্ছি। সব জিনিসটিনিস ঠিকঠাক জোগাড় করে রেখেছিস তো? দুঃখী কিন্তু তবু ওঠে না।
এবার পণ্ডিতমশাইয়ের মনে ভয় হয়। কাছে গিয়ে দেখেন, দুখী টানটান হয়ে পড়ে আছে। ভড়কে গিয়ে ভেতরে ছোটেন, গিয়ে বামুনগিন্নীকে বলেন, দুখিয়াটা মনে হচ্ছে মরে গেছে।
পণ্ডিতগিন্নী হকচকিয়ে বলেন–তো! এক্ষুণি তো কাঠ চিরছিল!
পণ্ডিত–হ্যাঁ, কাঠ চিরতে-চিরতে মরে গেছে। সর্বনাশ হয়েছে, এখন কী হবে?
পণ্ডিতগিন্নী ঠাণ্ডা গলায় বলেন–কী আবার হবে, চামারবস্তিতে খবর পাঠিয়ে দাও মড়া তুলে নিয়ে যাবে।
কিছুক্ষণের মধ্যে সারা গায়ে খবর রটে যায়। বামুনদেরই ঘর সব। কেবল এক ঘর গোঁড়। ওদিকের রাস্তা দিয়ে হাঁটা সবাই ছেড়ে দেয়। কুয়োতে যাবার রাস্তা ওদিক দিয়েই, জল আনবে কী করে! চামারের মড়ার পাশ দিয়ে জল আনতে যাবে কে? এক বুড়ি গিয়ে পণ্ডিতমশাইকে বলে, এখনো মড়াটা ফেলাচ্ছ না যে। গায়ে কেউ জলটল খাবে-না নাকি!
এদিকে চিখুরী চামারবস্তিতে গিয়ে সবাইকে সাবধান করে দিয়ে আসে–খবরদার, মড়া আনতে কেউ যাবি না। এক্ষুনি পুলিশ আসবে, তদন্ত হবে। মজা পেয়েছ নাকি যে একটি গরিব বেচারাকে এভাবে পরানে মেরে ফেলবে। পণ্ডিতই হন আর যেই হন, সে তো নিজের কাছে। লাশ যদি তোরা আনিস তবে পুলিশ তোদেরও বেঁধে নিয়ে যাবে।
তার কথার পর-পরই পণ্ডিতমশাই গিয়ে পৌঁছান। কিন্তু চামারবস্তির কোনও লোক লাশ তুলে আনতে রাজি হয় না। শুধু দুখীর বউটা আর মেয়েটা হাহাকার করতে-করতে ছুটে যায়। পণ্ডিতমশাইয়ের বাড়ির দরজায় গিয়ে ওরা কপাল চাপড়ে-চাপড়ে ডুকরে কাঁদতে থাকে। ওদের সঙ্গে আরও পাঁচ-দশটা চামার মেয়েছেলে–কেউ কাঁদছে, কেউ-বা ওদের সান্ত্বনা দিচ্ছে। চামার বেটাছেলে নেই কেউ। পণ্ডিতমশাই চামারদের ওপরে খুব চোটপাট করেন, বোঝান, কাকুতি-মিনতি করেন, কিন্তু চামারদের সবার মনে পুলিশের ভয় এতটা ছড়িয়ে পড়েছে যে, একজনও রাজি হয় না। শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে উনি ফিরে আসেন।
চার
মাঝরাত পর্যন্ত কান্নাকাটি চলে। ব্রাহ্মণ দেবতাদের পক্ষে ঘুমোনো মুশকিল হয়ে পড়ে। লাশ নিয়ে যেতে কোনও চামারই আসে না। এদিকে বামুনরাই-বা চামারের মড়া ছোঁবে কী করে। এমন কথাও কি কোনো শাস্ত্ৰ-পুরাণে লেখা আছে? কই, দেখিয়ে দিক তো কেউ!
পণ্ডিতগিন্নী গজর-গজর করেন–এই ডাইনিগুলো তো মাথা খেয়ে ফেললে। এগুলোর গলাও ব্যথা করে না!
পণ্ডিতমশাই বলেন–কাঁদুক পেত্নীগুলো, কতক্ষণ কাঁদবে? যদ্দিন বেঁচে ছিল, কেউ একবার পৌঁছেও নি। মরে গেছে, এখন চিল্লাচিল্লি করতে সবক’টা এসে জুটেছে।
পণ্ডিতগিন্নী–চামারের কান্না অলক্ষুণে নাকি গো?
পণ্ডিত–হ্যাঁ, বড্ড অমঙ্গলের।
পণ্ডিতগিন্নী–এখন থেকেই গন্ধ বেরুচ্ছে।
পণ্ডিত–চামার তো। খাদ্যাখাদ্যের কি কোনও বাছবিচার আছে ওগুলোর?
পণ্ডিতগিন্নী–ওগুলোর ঘেন্নাও করে না।
পণ্ডিত–সবকটা ভ্রষ্ট।
.
রাত তো কাটল কোনও মতে, কিন্তু সকালেও কোনও চামার এল না। চামার মেয়েছেলেরাও কেঁদেকেটে চলে গেছে। একটু-একটু করে ছড়াতে শুরু করেছে দুর্গন্ধ। পণ্ডিতমশাই একগাছি দড়ি নিয়ে আসেন। দড়ির ফাঁস বানিয়ে মড়ার পায়ে ছুঁড়ে দেন। তারপর টান মেরে কষে নেন ফাসটা। আবছা-আবছা অন্ধকার। পণ্ডিতমশাই দড়ি ধরে লাশটাকে টানতে শুরু করেন। টানতে-টানতে গাঁয়ের বাইরে টেনে নিয়ে যান। সেখান থেকে ফিরে এসে স্নান করে নেন চটপট, চণ্ডীপাঠ করেন। তারপর সারা বাড়িতে গঙ্গা জল ছিটিয়ে দেন।
ওদিকে দুখীর লাশটাকে শেয়াল, শকুন, কুকুর আর কাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। তার আজীবন ভক্তি, সেবা আর ধর্মনিষ্ঠার পুরস্কার!
জঞ্জাল-বুড়ো – কৃষণ চন্দর
যখন সে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল, তখন ওর পাদুটো কাঁপছে। ওর সারা শরীর ভেজা তুলোর মতো চুপসে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছিল। ওর মন চলতে চাইছিল না, ওই ফুটপাথে বসে পড়তে চাইছিল।
জেল-হাসপাতালে তার আরো এক মাস থাকা উচিত ছিল, কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওকে ছেড়ে দিলেন। হাসপাতালের প্রাইভেট ওয়ার্ডে সে সাড়ে চার মাস ছিল আর দেড় মাস ছিল জেনারেল ওয়ার্ডে। এই সময়ের মধ্যে তার একটি কিডনি অপারেশন করে বাদ দেয়া হয়েছে, আর অন্ত্রের এক অংশ কেটে দিয়ে তার অন্ত্রের-ক্রিয়া ঠিক করে দেয়া হয়েছে। এখনো তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া স্বাভাবিক হয়নি। তবু হাসপাতাল ছেড়ে ওকে চলে আসতে হল, কারণ তার চেয়েও খারাপ অবস্থার অন্য রোগীরা প্রতীক্ষা করছে।
ডাক্তার তার হাতে এক লম্বা প্রেসক্রিপশন দিয়ে বলেছিল, এই টনিক খেয়ো আর পুষ্টিকর খাদ্য খেয়ো। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে, এখন আর হাসপাতালে থাকার কোনো আবশ্যকতা নেই।’
ডাক্তার সাহেব, আমি আর হাঁটতে পারছি না। সে ক্ষীণকণ্ঠে বলেছিল।
‘ঘরে যাও, কিছুদিন বিবি সেবাযত্ন করবে, বিলকুল ঠিক হয়ে যাবে।’
খুব ধীরে-ধীরে টলমলে পদক্ষেপে ফুটপাত দিয়ে চলতে-চলতে সে ভাবল, ঘর!–কিন্তু আমার ঘর কোথায়?’
কিছুদিন আগেও আমার একটি ঘর নিশ্চয় ছিল–ছিল এক বিবিও; তার এক বাচ্চা হবার কথা ছিল। তারা দুজনে ঐ আগতপ্রায় বাচ্চার কল্পনায় কত খুশি হয়েছিল। দুনিয়ার জনসংখ্যা অনেক হতে পারে, কিন্তু সে তো তাদের দু’জনের প্রথম সন্তান। দুনিয়ায় তাদের প্রথম সন্তান জন্ম নিতে আসছিল।
দুলারি খুব সুন্দর জামা সেলাই করেছিল নিজের বাচ্চার জন্য। হাসপাতালে তা নিয়ে এসে দেখিয়েছিল। আর ওই জামায় হাত বুলিয়ে তার মনে হয়েছিল যে, সে তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করছে।
কিন্তু গত কয়েক মাসের মধ্যে তাকে অনেক কিছুই হারাতে হল। যখন তার কিডনির প্রথম অপারেশন হয় তখন দুলারি নিজের গয়না বেচে দিয়েছিল। কারণ, গয়না তো এই রকম সময়ের জন্যই। লোকে ভাবে গয়না স্ত্রীলোকের সৌন্দর্য বাড়াবার জন্য, কিন্তু আসলে অন্য প্রয়োজন মেটাবার জন্যই তার ব্যবহার হয়। পতির অপারেশন, বাচ্চাদের লেখাপড়া, মেয়ের বিয়ে–এইসব প্রয়োজনের জন্যই স্ত্রীলোকের গয়নার ব্যাংক খালি হয়। স্ত্রীলোক গয়নাগাটি সামলাতে ব্যস্ত থাকে, আর জীবনে বড়জোর-পাঁচ-ছ’বার এই গয়না পরবার সৌভাগ্য লাভ করে।
কিডনির দ্বিতীয় অপারেশনের আগে দুলারির বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেল। তা তো হবেই– দুলারিকে দিনরাত খুব খাটুনি পোয়াতে হচ্ছিল, তার জন্যে এই বিপদ গোড়াতেই জমা ছিল। মনে হয়েছিল যে, দুলারির একহারা উজ্জ্বল শরীর এই কড়া খাটুনির জন্য তৈরি হয়নি। এইজন্য ঐ বুদ্ধিমান বাচ্চা মাঝপথেই সরে পড়েছে। বিরূপ পরিবেশ আর বাপ-মায়ের দুর্দশা আঁচ করতে পেরে সে নিজেই বুঝেছিল জন্ম নেয়া উচিত হবে না। কোনো-কোনো বাচ্চা এরকম বুদ্ধিমান হয়ে থাকে। দুলারি কিছুদিন হাসপাতালে আসতে পারেনি। তারপর যখন এসে সে খবরটা দিল তখন দুলারির স্বামী খুব কেঁদেছিল। যদি তার জানা থাকত যে-ভবিষ্যতে তাকে আরো অনেক কাঁদতে হবে তাহলে এই ঘটনায় কান্নার বদলে সে সন্তোষ প্রকাশ করত।
কিডনির দ্বিতীয় অপারেশনের পর তার চাকরি চলে গেল। দীর্ঘকালীন রোগভোগে এইরকমই হয়, কে আর কতদিন অপেক্ষা করতে পারে। রোগ তো মানুষের নিজস্ব ব্যাপার। এই কারণে যদি সে চায় যে তার চাকরি বজায় থাকবে, তবে তার দীর্ঘদিনের রোগভোগে পড়া ঠিক হবে না। মানুষ যন্ত্রের মতোই। যদি কোনো যন্ত্র দীর্ঘকাল ধরে বিগড়ানো অবস্থায় থাকে, তাহলে তাকে এক ধারে ফেলে রেখে দেয়া হয় আর তার জায়গায় নতুন যন্ত্র এসে যায়। কারণ কাজ থেমে থাকতে পারে না, ব্যবসা বন্ধ হতে পারে না, আর সময় থেমে থাকতে পারে না। কাজেই যখন তার উপলব্ধি হল যে, তার চাকরি চলে যাচ্ছে, তখন দ্বিতীয়বার কিডনি অপারেশনের সময় যে-রকম ধাক্কা লেগেছিল সে-রকমই লাগল। এই ধাক্কায় তার চোখ দিয়ে জলও পড়েনি। সে অনুভব করেছিল, তার হৃদয়ের মধ্যে এক শূন্যতা বিরাজ করছে, পায়ের তলা থেকে সরে যাচ্ছে। মাটি আর নাড়িতে রক্তের বদলে দ্রুত প্রবাহিত হচ্ছে ভয়।
কিছুদিন যাবৎ আগামী দিনগুলোর কথা ভেবে ভয়ে সে ঘুমোতে পারেনি। অনেকদিনের রোগের চিকিৎসায় খরচও হল অনেক। এক-এক করে ঘরের সব দামি জিনিস বিক্রি হয়ে গেল, কিন্তু দুলারি হাল ছাড়েনি। সে তার স্বামীকে সাড়ে চার মাস প্রাইভেট ওয়ার্ডে রেখেছিল, সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা করিয়েছিল সে তার, এক-এক করে নিজের ঘরের সব জিনিস বেচে দিয়েছিল আর শেষ পর্যন্ত চাকরিও নিয়েছিল। দুলারি এক ফার্মে কর্মচারী হয়েছিল। একদিন তাদের ফার্মের মালিককে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিল দুলারি। মালিক এক রোগা-পাতলা বেঁটে মতো লোক, মাঝবয়েসী আর লাজুক। তাকে দেখতে-শুনতে কোনো ফার্মের মালিকের বদলে কোনো দোকানের। মালিক বলে মনে হয়। দুলারিকে ওই ফার্মে দু’শ’ টাকার মাসমাহিনার কর্মচারী হয়ে যেতে হল, কেননা সে খুব বেশি লেখাপড়া জানত না। তার কাজ ছিল খামের উপর ডাকটিকিট লাগানো।
দুলারির স্বামী বলল, ‘এ খুব সহজ কাজ।’
ফার্মের মালিক বললেন, ‘কাজ তো সোজাই, কিন্তু যেদিন পাঁচ-ছশ’ চিঠির খামের উপর টিকিট লাগাতে হয় সেদিন এই খুব সোজা কাজই খুব কঠিন মনে হয়।’
দুলারি মুচকি হেসে বলল, ‘সত্যি খুব হয়রান হয়ে যাই।’
ফার্মের মালিক তাকে বললেন, ‘তুমি সেরে ওঠ, তারপর তুমি তোমার বিবির বদলে খামে টিকিট লাগিয়ো, আমি এই কাজ তোমাকে দেব।’
যখন ফার্মের মালিক চলে যাচ্ছেন তখন দুলারিও তার সঙ্গে চলে গেল। দুলারির স্বামী অনুভব করল যে, আজ দুলারির পদক্ষেপে এক অদ্ভুত আত্মমর্যাদা প্রকাশ পাচ্ছে। দুলারির শরীর কোনো এক ফুলন্ত ডালের মতো নমনীয় হয়ে গেছে। ওয়ার্ডের বাইরে এসে মালিক দুলারির জন্যে এক হাতে দরজা খুলে ধরে দুলারিকে দরজার বাইরে যেতে সাহায্য করতে কিছুটা ঝুঁকে পড়লেন, আর এক মুহূর্তের জন্য তাঁর অপর হাত দুলারির কোমরের ওপর রাখলেন। ফার্মের মালিকের প্রথম হাতের ভঙ্গি দুলারির স্বামীর ভালো লেগেছিল কিন্তু দ্বিতীয় হাতের ভঙ্গি পছন্দ হয়নি। কিন্তু সে আপন মনকে এ-কথা বলে সান্ত্বনা দিয়েছিল যে, কখনো-কখনো এক হাত যা করে তা অপর হাত জানতে পারে না। আবার এ-ও তো হতে পারে যে, তার চোখের নজর ঠিক নেই–কেবল ভ্রম মাত্র– এ-কারণে সে বিশ্বাসের সঙ্গে নিজের চোখ দুটি বন্ধ করে নরম-নরম বালিশের ওপর মাথা রেখে ঘুকোজ ইনজেকশনের প্রতীক্ষা করেছিল।
তার তৃতীয় অপারেশন হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডে হয়েছিল। সে সময় দুলারি ফার্মের মালিকের সঙ্গে দার্জিলিং চলে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত কে আর কতদিন অপেক্ষা করতে পারে! জীবন ক্ষণস্থায়ী আর জীবনের বসন্ত তার চেয়েও ক্ষণস্থায়ী। যখন আবেগ প্রবল হয় আর চোখে নেশা লাগে, যখন আঙুলের ডগায় আগুনের জ্বলুনি অনুভূত হয় আর বুকে মিষ্টি-মিষ্টি বেদনা হতে থাকে, যখন চুম্বন ভ্রমরের মতো ওষ্ঠের পাপড়ির ওপর এসে পড়ে আর বঙ্কিম হংসগ্রীবা কারো গরম-গরম নিঃশ্বাসের মৃদু আঁচে ব্যাকুল হয়, তখন কে কতদিন পর্যন্ত ফিনাইল আর পেচ্ছাবের গন্ধ শুঁকতে পারে, থুতু, পুঁজ আর রক্তের রঙ দেখতে পারে আর মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে-আসা হেঁচকি শুনতে পারে? সহ্য করার একটা সীমা আছে; বিশ বছরের যুবতী সহ্য কি করেনি? যার বিয়ের পর দু’বছরও পেরোয়নি, যে আপন পতির সঙ্গে বিপদ ছাড়া আর কিছুই দেখেনি, সে যদি আপন স্বপ্নে ভর করে দার্জিলিং চলে যায় তবে তাতে কার কী দোষ?
দুলারি যখন বাড়ি থেকে চলে যায় তখন দুলারির স্বামী অন্য কাউকে দোষী বলার মতো অবস্থা থেকে চ্যুত হয়েছিল। তার ওপর একটার পর একটা আঘাত এসে তাকে পাগল করে তুলেছিল। এখন তার বিপদ আর কষ্টে কোনো ভাবনা বা অশ্রু ছিল না। বারবার হাতুড়ির চোট খেয়ে ধাতুর পাতের মতো হয়ে গিয়েছিল তার হৃদয়। এই কারণে আজ সে (দুলারির স্বামী) যখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল তখন সে ডাক্তারের কাছে কোনো মানসিক যন্ত্রণার কথা বলেনি। সে ডাক্তারকে বলেনি, এই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এখন সে কোথায় যাবে? এখন তার নেই কোনো ঘর, নেই বিবি, নেই বাচ্চা, নেই কোনো চাকরি, তার হৃদয় শূন্য, তার পকেট ফাঁকা; তার সামনে এক বিরাট শূন্য ভবিষ্যৎ।
কিন্তু তখন সে কোনো কথাই বলেনি, কেবল বলেছিল, ‘ডাক্তার সাহেব, আমি আর চলতে পারছি না।’
ওই একমাত্র সত্য তখন সে অনুভব করেছিল, বাকি সব কথা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল তার মন থেকে। এ সময় চলতে-চলতে সে কেবল অনুভব করতে পারল যে, তার শরীর ভিজে তুলো দিয়ে তৈরি, তার শিরদাঁড়া কোনো পুরনো ভাঙা চারপাইয়ের মতো খটখট করছে। রোদের তেজ খুব, আলো তীরের মতো চোখে বিধছে, আকাশে এক ময়লা হলুদ রঙের বার্নিশ লেপে দেয়া হয়েছে। সারা পরিবেশ কালো ঘোলাটে আর জড়ো-হওয়া নোংরা মাছির মতো ভনভন করছে। লোকের দৃষ্টি যেন তার গায়ের নোংরা রক্ত ও পুঁজের মতো তার শরীরে সেঁটে যাচ্ছে। তাকে কোথাও পালিয়ে যেতে হবে, দূরে কোথাও, লম্বা। লম্বা তার জড়ানো আলোর থামওয়ালা রাস্তা দিয়ে যেতে হবে, তার মধ্য দিয়ে ঘেঁষাঘেঁষি পথ ধরে পালিয়ে যেতে হবে অনেক দূরে। তার মনে পড়ল মরা মায়ের কথা, মরা বাপের কথা, তার আফ্রিকা চলে-যাওয়া ভাইয়ের কথা। শ-শ-শন্ শব্দ করে একখানা ট্রাম তার কাছ দিয়ে চলে গেল। ট্রামের বিজলির ট্রলি, বিজলির লম্বা তারে ঘষতে-ঘষতে যেন তার শরীরে ঢুকে যেতে লাগল। তার আপন শরীরে পুরো ট্রামটাই ঢুকে যাচ্ছে বলে সে অনুভব করল, মনে হল, সে যেন কোনো মানুষ নয়, যেন এক ক্ষয়ে যাওয়া রাস্তা।
নেকক্ষণ ধরে সে চলছিল, হাঁপিয়ে পড়ছিল আর চলছিল। আন্দাজে, এক অজানা দিকে–যেদিকে কোনো একদিন তার ঘর ছিল। এখন তার মনে হচ্ছে, তার কোনো ঘর নেই। কিন্তু এ কথা জেনেও সে ওই দিকেই চলছিল, ঘরে যাবার তাগিদে অসহায় হয়ে সে পথ চলছিল কেবল। কিন্তু রোদ খুব চড়া, তখন আর সে রাস্তাও ভুলে গেল। শরীরে এমন শক্তি ছিল না যে, সে কোনো পথিকের কাছে রাস্তার খোঁজ নেয়; জেনে নেয় শহরের এটা কোন অঞ্চল। ধীরে-ধীরে তার কানের মধ্যে ট্রাম আর বাসের আওয়াজ বাড়তে লাগল, চোখের সামনে বাঁকা হয়ে যেতে লাগল দেয়াল। বাড়িঘর ভেঙে পড়তে লাগল। বিজলিবাতির থামগুলো ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে যেতে লাগল কেমন। সে তার চোখের সামনে আঁধার আর পায়ের তলায় ভূমিকম্প অনুভব করল। আর হঠাৎই পড়ে গেল মাটিতে।
যখন তার হুশ ফিরে এল, তখন রাত হয়ে গেছে। এক ঠাণ্ডা আঁধার ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। সে চোখ খুলে দেখল, যে-জায়গায় সে পড়ে গিয়েছিল এখন পর্যন্ত সেই জায়গাতেই শুয়ে আছে। এটা ফুটপাথের এমন একটা মোড় যার পেছন দু’দিকে দুই দেয়াল খাড়া হয়ে আছে। এক দেয়াল ফুটপাতের গায়ে-গায়ে সোজা উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। অপর দেয়াল চলে গেছে উত্তর থেকে পশ্চিম দিকে। দুই দেয়ালের জোড়ের মুখে সে শুয়েছিল। এ দুই দেয়াল প্রায় চার ফুট উঁচু আর এই দেয়ালগুলোর পেছনে ছিল বাঁশঝাড় আর ম্যাগনোলিয়া লতার ঝাড়, পেয়ারা আর জামগাছ। ওইসব গাছের পেছনে কী ছিল তা সে দেখতে পায়নি। অন্যদিকে, পশ্চিম দিকের দেয়ালের সামনে পঁচিশ-তিরিশ ফুট ছেড়ে দিয়েছিল এক পুরনো বাড়ির পেছনের অংশ। বাড়িটি তিনতলা; প্রতি তলার পেছন দিকে একটি জানালা আর ছ’টি বড়-বড় পাইপ। পেছন দিকের পাইপ আর পশ্চিম দিকের দেয়ালের মাঝখানে এক পঁচিশ-তিরিশ ফুট চওড়া কানাগলি, তার তিনদিকে দেয়াল আর চতুর্থ দিকে পথ। দূরে কোথায় গির্জার ঘণ্টায় রাত তিনটে বাজল। সে ফুটপাতের উপর শুয়ে-শুয়ে কনুইয়ের ওপর জোর দিয়ে একটু উঁচু হয়ে এদিক-ওদিক দেখতে লাগল। পথ একেবারে খালি। সামনের দোকানগুলো বন্ধ আর ফুটপাথের আঁধারে ছায়ায় কোথাও কোথাও কমজোর বিজলিবাতি ঝলমল করছে। কিছুক্ষণের জন্য এই ঠাণ্ডা আধার তার খুব ভালো লাগল। কিছুক্ষণের জন্য সে নিজের চোখ দুটি বন্ধ করে ভাবল, সে বোধহয় কোনো দয়ার সমুদ্রের জলে ডুবে যাচ্ছে।
কিন্তু এই অনুভূতি দিয়ে সে কেবল নিজেকেই মুহূর্তের জন্য ধোকা দিচ্ছিল, কারণ এখন তার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য আরামদায়ক ঠাণ্ডা উপভোগের পর সে অনুভব করল তার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। তার অন্ত্রের অপারেশন হওয়ার পর থেকে তার খুব ক্ষিদে পায়। সে ভাবল ডাক্তার তার অন্ত্রের কাজ জাগিয়ে দিয়ে তার কোনো রকম উপকার করেননি। পেটের মধ্যে নাড়ি বিচিত্রভাবে পাক খাচ্ছিল আর অন্ত্রের একেবারে ভেতরে মোচড় দিচ্ছিল। এ সময়ে তার নাসিকা সভ্য নাগরিকের নাসিকার মতো কাজ করছিল না, বরং কোনো জংলি পশুর ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের মতো কাজ করছিল। তার নাকে আসছিল নানা বিচিত্র গন্ধ। সুগন্ধের এক ঐকতান তার চেতনায় ছড়িয়ে পড়েছিল। আর আশ্চর্যের কথা এই যে, সে এই সুগন্ধ-ঐকতানের এক-এক সুরের আলাদা-আলাদা অস্তিত্ব চিনে নিতে পারছিল। এই হল জামের গন্ধ, এটা হল পেয়ারার গন্ধ, এটা হল রজনীগন্ধার কলির গন্ধ, আর এ হল তেলেভাজা পুরীর গন্ধ। এটা হল পেঁয়াজ-রসুনে সাঁতলানো আলুর গন্ধ, এটা মুলোর গন্ধ, এটা টমেটোর গন্ধ, এটা হল কোনো পচা ফলের গন্ধ, এটা পেচ্ছাবের গন্ধ, এটা জলে ভেজা মাটির গন্ধ বোধহয় নানা গন্ধের সমাবেশ থেকেই গন্ধগুলো আসছিল। এইসব গন্ধের প্রতিটি রূপ, ধরন, গতি আর উগ্রতা পর্যন্ত সে অনুভব করতে পারছিল। হঠাৎ তার সম্বিৎ হল, আর কী অসম্ভব ক্ষিদে তার সুপ্ত ঘ্রাণশক্তিকে কীভাবে সজাগ করে দিয়েছে তা ভেবে সে চমকে উঠল। কিন্তু এই কথা নিয়ে বেশি ভাবনা-চিন্তা না-করে যেদিক থেকে তেলেভাজা পুরী আর রসুনে-সাঁতলানো আলুর গন্ধ আসছিল সেইদিকে শরীরটাকে ধীরে-ধীরে আঁধার গলির ভেতরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। কারণ নিজের শরীরে হাঁটবার সামর্থ্য সে একেবারেই পাচ্ছিল না। প্রতি মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল যে, সে গভীর জলে ডুবে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল যেন কোনো ধোপা তার পেটের অন্ত্রগুলোকে ধরে মোচড় দিচ্ছে। আবার তার নাসারন্ধ্রে পুরী আর আলুর ক্ষিদে-জাগানো গন্ধ এল। সে অধীর হয়ে আধ-বোজা চোখে নিজের প্রায় নির্জীব শরীরটাকে ঘেঁষে টেনে নিয়ে যেদিক থেকে আলুপুরীর গন্ধ আসছিল সে-দিকে যেতে চেষ্টা করল।
খানিকটা সময় পরে সে ওই স্থানে পৌঁছে দেখল, পশ্চিমের দেয়াল আর তার সামনের ইমারতের পেছন দিকের পাইপগুলোর মাঝখানে পঁচিশ-তিরিশ ফুট ব্যবধানে আবর্জনার একটা খুব বড় খোলা লোহার টব রয়েছে। এই টবটা পনেরো ফুট চওড়া আর তিরিশ ফুট লম্বা। রকমারি আবর্জনায় ভরা। পচাগলা ফলের খোসা, পাউরুটির ময়লা টুকরো, চায়ের পাতা, একটা পুরনো জ্যাকেট, বাচ্চাদের নোংরা ন্যাকড়া, ডিমের খোসা, খবরের কাগজের ভেঁড়া টুকরো, পত্রিকার ছেঁড়া পাতা, রুটির টুকরো, লোহার পাত, প্লাস্টিকের ভাঙা খেলনা, কড়াইশুটির খোসা, পুদিনার পাতা, কলার পাতায় কিছু এঁটো পুরী আর আলুর তরকারি। পুরী আর আলুর তরকারি দেখে তার পেটের মধ্যে। মোচড় দিল। কিছুক্ষণ সে তার অধীর হাতটাকে টেনে নিল, কিন্তু ওইসব সুগন্ধ যখন তার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করল তখন আগের পুরী আর তরকারির ক্ষিদে-জাগিয়ে-দেয়া সুগন্ধ তীব্র হয়ে উঠল। মনে হল ঐকতানের বিশেষ কোনো স্বর হঠাৎ খুব চড়া হয়ে বেজে উঠছে। হঠাৎই তার সংযমের শেষ প্রাচীর ভেঙে পড়ল। তখনি তার কম্পিত অধীর হাত কলার পাতা খাবলে নিল আর অমানুষিক ক্ষুধা অসহায় হয়ে ওই পুরীগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পুরী-তরকারি খেয়ে সে বারবার কলার পাতা চাটল। পাতাখানিকে চেটে এত সাফ করে দিল যে মনে হল তা গাছের নতুন পাতা। কলার পাতা চাটার পর সে নিজের আঙুল চাটল আর লম্বা-লম্বা নখের মধ্যে জমে থাকা আলুর তরকারি জিভের ডগা দিয়ে চেটে নিয়ে খেল। এতেও তার তৃপ্তি হল না। সে হাত বাড়িয়ে আবর্জনারাশি নেড়ে-চেড়ে তার থেকে পুদিনার পাতা বার করে খেল; মূলোর দুটি টুকরো আর আধখানা টমাটো মুখে দিয়ে তার রস খেল আরাম করে। আর সব যখন খাওয়া হয়ে গেল তখন তার সারা শরীরে নেমে এল আলস্যভরা ঘুমের ঢেউ। সে ওই টবের ধারেই ঘুমিয়ে পড়ল।
আট-দশ দিন এভাবেই আলস্যভরা ঘুম আর অর্ধচেতনার মধ্যে কেটে গেল। সে ঘষতে-ঘষতে টবের ধারে যেত। যা খাবার পাওয়া যেত খেয়ে নিত সবই। আর যখন ক্ষিদে-জাগানো গন্ধের তৃপ্তিসাধন হয়ে যেত তখন তা ছাপিয়ে অন্য নোংরা গন্ধ উঠত। তখন সে ঘষতে-ঘষতে টব থেকে দূরে ফুটপাতের মোড়ে চলে গিয়ে পেছনের দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত।
পনেরো-বিশ দিন পর ধীরে-ধীরে তার শরীরে বল ফিরে এল। ক্রমান্বয়ে সে নিজের পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হতে লাগল–জায়গাটা কেমন ভালো, এখানে রোদ নেই, আছে গাছের ছায়া, কখনো-কখনো পেছনের ইমারত থেকে কেউ জানালা খোলে আর। কেউ হাত ঘুরিয়ে নিচের টবে রোজ আবর্জনা ফেলে। এই আবর্জনা ছিল তার অন্নদাতা, তাকে দিনেরাতে আহার জোগাত। এ ছিল তার জীবনরক্ষক। দিনে পথ মুখরিত হয়ে উঠত, খুলত দোকানপাট, লোকজন ঘুরে বেড়াত, বাচ্চারা পাখির মতো কিচকিচ করতে-করতে যেত পথ দিয়ে, স্ত্রীলোকেরা রঙিন ঘুড়ির মতো হেলেদুলে চলে যেত– কিন্তু সে ছিল অন্য এক জগৎ। এই জগতের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না, এই জগতে কেউ ছিল না তার, আর সে-ও কারো ছিল না। এই দুনিয়ার প্রতি তার ছিল সীমাহীন ঘৃণা। এই দুনিয়া থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। শহরের গলি-বাজার-পথ তার কাছে হয়ে গিয়েছিল এক ধোয়াটে ছায়ায় তৈরি জগৎ। বাইরের মাঠ, ক্ষেত আর খোলা আকাশ তার কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক ব্যর্থ কল্পনা। ঘর-সংসার, কাজ-কর্ম, জীবন, সমাজ-সংঘর্ষ–এসব অর্থহীন শব্দ পচে-গলে আবর্জনারাশিতে গিয়ে মিশেছিল। ওই দূরের জগৎ থেকে সে ফিরিয়ে নিয়েছিল তার মুখ। পনের ফুট লম্বা আর তিরিশ ফুট চওড়া ওই টব–এই ছিল তার নিজের জগৎ।
ধীরে-ধীরে মাস আর বছর চলে গেল। সে ওই পথের মোড়ে বসে থাকত, স্মৃতিচিহ্নের মতো। কারোর সঙ্গে কথা বলত না, কাউকে সাহায্য করত না, কারোর কাছে ভিক্ষে চাইত না। কিন্তু যদি কোনোদিন সে উঠে চলে যেত তো সেখানকার প্রতিটি ব্যক্তি এতে বিস্মিত হত, আর বোধহয় কিছুটা দুঃখিতও হত।
সবাই তাকে বলত জঞ্জাল বুড়ো। কারণ সবাই জানত যে, সে কেবল জঞ্জালের টব থেকেই আপন আহার্য সংগ্রহ করে। আর যেদিন তা থেকে কিছু মিলত না, সেদিন সে না-খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ত। বছরের পর বছর ধরে পথিকেরা আর ইরানি রেস্তোরাঁওয়ালারা তার এই স্বভাবের কথা জেনেছিল। তার জন্য যা কিছু দেবার তারা প্রায়ই জঞ্জাল-স্তূপে ফেলে দিত। আবার ইমারতের পেছনের জানালা দিয়ে ময়লা-আবর্জনার অতিরিক্ত অন্য খাবার জিনিসও প্রায়ই লোকে ফেলে দিত। আস্ত-আস্ত পুরী, কাবাব, অনেকটা তরকারি, মাংসের টুকরো, আধখাওয়া আম, চাটনি, কাবাবের টুকরো আর ক্ষীরমাখানো কলাপাতা। খাওয়া-পরার সব ভালোমন্দ জিনিস জঞ্জাল-বুড়ো এই টবের মধ্যেই পেয়ে যেত। কখনো-কখনো ছেঁড়া পাজামা, ফেলে দেয়া জাঙিয়া, ছেঁড়া জামা, প্লাস্টিকের গেলাস। এ কি শুধুই আবর্জনার টব? তার জন্যে এটা ছিল এক খোলা বাজার–সেখানে সে দিনে দুপুরে সকলের চোখের সামনে গালগল্প করত। যে-দোকানে যে-সওদা প্রয়োজন তা সে বিনা পয়সায় পেত। এই বাজারের সে ছিল একমাত্র মালিক। গোড়ায়-গোড়ায় কয়েকটি ক্ষুধার্ত বিড়াল আর ঘেয়ো কুকুর তার সঙ্গে ঝগড়া করেছিল। কিন্তু মারমার করে সে তাদের ভাগিয়ে দিয়েছিল। এখন সে এই টবের একমাত্র অধীশ্বর। সবাই মেনে নিয়েছিল তার অধিকার। মাসে একবার মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা আসত আর এই টব খালি করে দিয়ে চলে যেত। জঞ্জাল-বুড়ো তার বিরোধিতা করত না। কারণ তার জানা ছিল পরদিন থেকেই টব আবার ভর্তি হতে শুরু করবে। তার বিশ্বাস ছিল যে, এই দুনিয়ার মঙ্গল শেষ হয়ে যেতে পারে, প্রেম শেষ হয়ে যেতে পারে, বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু আবর্জনা শেষ হয়ে যাবে না কোনোদিন। সারা দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সে বাঁচবার শেষ উপায় শিখে নিয়েছিল।
কিন্তু কথা এ নয় যে সে বাইরের দুনিয়ার খবর রাখত না। যখন শহরে চিনির দাম বেড়ে যেত তখন মাসের পর মাস আবর্জনার টবে মিঠাইয়ের টুকরোর চেহারা দেখা যেত না। আবার গমের দাম বেড়ে গেলে পাউরুটির একটি টুকরোও মিলত না। অন্যদিকে যখন সিগারেটের দাম বেড়ে যেত তখন এত ছোট সিগারেটের পোড়া টুকরো মিলত যে, তা ধরিয়ে ধূমপান করতে পারত না সে। যখন জমাদারেরা হরতাল করেছিল তখন দু’মাস ধরে টবের কোনো সাফাই হয়নি। আবার বকরিদের দিন যত মাংসের টুকরো মিলত তা অন্যদিন পাওয়া যেত না। দেয়ালীর দিন তো টবের আলাদা-আলাদা কোণে মিঠাইয়ের অনেক টুকরো পাওয়া যেত। বাইরের দুনিয়ার এমন কোনো ঘটনা ছিল না যার সন্ধান সে আবর্জনার টব থেকে না-পেত। গত মহাযুদ্ধ থেকে শুরু করে মেয়েদের গোপন ব্যাধি পর্যন্ত সবকিছুরই সন্ধান পেত সে। যদিও বাইরের দুনিয়ার প্রতি তার কোনো রুচি ছিল না।
পঁচিশ বছর ধরে সে এক আবর্জনার টবের ধারে বসে-বসে আপন জীবন কাটিয়ে দিল। দিনরাত, মাস-বছর তার মাথার উপর দিয়ে বায়ুতরঙ্গের মতো প্রবাহিত হয়ে গেল। তার মাথার চুল শুকিয়ে-শুকিয়ে ঝুলতে লাগল বটগাছের ঝুরির মতো। তার কালো দাড়ি শাদা হয়ে গেল। গায়ের রঙ হল তামাটে। নোংরা চুল, ছেঁড়া ন্যাকড়া আর দুর্গন্ধভরা শরীর নিয়ে পথচারীর কাছে সে নিজেই যেন একটা জঞ্জাল-টবের মতো প্রতিভাত হত। সে ছিল এমন একটা টব যা কখনো-কখনো অঙ্গভঙ্গি করে, আর অন্যের সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গে আর জঞ্জাল-টবের সঙ্গে কথা বলে।
জঞ্জাল-বুড়োকে জঞ্জাল-টবের সঙ্গে কথা বলতে দেখে লোকে আশ্চর্য হয়ে যেত। কিন্তু এতে আশ্চর্যের কী আছে? জঞ্জাল-বুড়ো লোকদের সঙ্গে কোনো কথা বলত না, কিন্তু এদের আশ্চর্য হতে দেখে মনে-মনে নিশ্চয় ভাবত যে, এই সংসারে কে আছে যে, অপরের সঙ্গে কথা বলে। বাস্তবে এই সংসারে যত কথাবার্তা হয় তা মানুষের মধ্যে হয়, হয় কেবল নিজের জাতের সঙ্গে আর তাদের কোনো স্বার্থের মধ্যেই। দুই বন্ধুর মধ্যে যে কথাবার্তা হয় তা বাস্তবে এক প্রকার স্বগত-কথন মাত্র। এই দুনিয়া একটা খুব বড় আবর্জনার স্তূপ। এখানে সব লোক আপন আপন স্বার্থের কোনো টুকরো, ব্যক্তিগত লাভের কোনো খোসা বা মুনাফার কোনো ন্যাকড়া খাবলানোর জন্যে সব সময় তৈরি হয়ে আছে। যারা আমাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বা নীচ মনে করে তারা মনের পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখুন–সেখানে কত-না ময়লা-আবর্জনা রয়েছে। ওই আবর্জনা কেবল যমরাজই উঠিয়ে নিতে যেতে পারে।
এইভাবে দিনের পর দিন যায়, কত দেশ স্বাধীন হল, কত দেশ পরাধীন হল, কত সরকার এল, কত গেল, কিন্তু জঞ্জালের এই টব যেখানে ছিল সেখানেই আছে আর তার কিনারে জঞ্জাল-বুড়ো ওইভাবেই অর্ধচেতনভাবে দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বসে, মনে-মনে বকবক করে, আর জঞ্জালের টব হাতড়ায়।
তারপর এক রাতে ওই আধার গলিতে যখন সে টব থেকে কয়েক ফুট দূরে দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে ছেঁড়া কাপড় গায়ে কুঁজো হয়ে ঘুমোচ্ছিল, তখন সে এক খুব তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে ঘাবড়ে গিয়ে জঞ্জাল-টবের দিকেই দৌড়ে গিয়েছিল। তারই ভেতর থেকে ওই তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা যাচ্ছিল।
জঞ্জালের টবের কাছে গিয়ে সে টব হাতড়াল। তার হাত নরম-নরম মাংসপিণ্ডে ধাক্কা খেল। আরেকবার শুনতে পেল সেই তীক্ষ্ণ চিৎকার। জঞ্জাল-বুড়ো দেখল টবের মধ্যে পাউরুটির টুকরো, চোষা হাড়, পুরনো জুতো, কাঁচের টুকরো, আমের খোসা, বাসি চাটনি আর টেড়াভাঙা বোতলের মাঝখানে এক নবজাত উলঙ্গ শিশু পড়ে আছে। হাত-পা নেড়ে নেড়ে তীক্ষ্ণ চিৎকার করছে সে।
কিছুক্ষণ জঞ্জাল-বুড়ো আশ্চর্য হয়ে এই মানবকটিকে দেখল। বাচ্চাটি নিজের ছোট্ট বুকের সব জোর দিয়ে নিজের আগমন ঘোষণা করছিল। বুড়ো চুপচাপ হতভম্ব হয়ে চোখ বড়-বড় করে এই দৃশ্য দেখতে লাগল। তারপর তাড়াতাড়ি সামনে ঝুঁকে পড়ে জঞ্জালের টব থেকে বাচ্চাকে নিজের বুকে তুলে নিয়ে তাকে ছেঁড়া ন্যাকড়া দিয়ে জড়িয়ে নিল।
কিন্তু বাচ্চা তার কোলে গিয়ে কোনোমতেই চুপ করে না। সে এ জীবনে সদ্য-সদ্য এসেছে, তারস্বরে ঘোষণা করছিল নিজের ক্ষুধা। সে এখনো বোঝেনি দারিদ্র্য কী হতে পারে, মমতা কতটা ভীরু হতে পারে, জীবন বিগড়ে যেতে পারে কীভাবে, জীবনকে কীভাবে ময়লা দুর্গন্ধময় হয়ে জঞ্জালের টবে ফেলে দেয়া যেতে পারে। এখন তার কিছুই জানা নেই। এখন সে কেবল ক্ষুধার্ত। সে কেঁদে-কেঁদে নিজের পেটে হাত। রাখছিল আর পা ছুড়ছিল।
জঞ্জাল-বুড়ো কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, সে কী করে এই বাচ্চাকে চুপ করাবে। তার কাছে কিছুই ছিল নানা দুধ, না চুষিকাঠি। তার তো কোনো ছড়াও জানা নেই। সে অস্থির হয়ে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে চাপড়াতে শুরু করল আর খুব হতাশ হয়ে রাতের আঁধারে চারদিকে চেয়ে দেখল এ সময়ে বাচ্চার জন্যে দুধ কোথায় পাওয়া যাবে। কিন্তু যখন তার মাথায় কিছু এল না তখন সে তাড়াতাড়ি জঞ্জালের টব থেকে একটা আমের আঁটি বার করে নিয়ে তার প্রান্তভাগ বাচ্চার মুখে দিয়ে দিল।
আধ-খাওয়া আমের মিষ্টি-মিষ্টি রস যখন বাচ্চার মুখে যেতে থাকল তখন সে কাঁদতে-কাঁদতে চুপ করে গেল আর চুপ করতে-করতে জঞ্জাল-বুড়োর কোলে ঘুমিয়ে পড়ল। আমের আঁটি পিছলে পড়ে গেল মাটিতে আর বাচ্চা তার কোলে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে রইল। আমের হলুদ-হলুদ রস তখন পর্যন্ত তার কোমল ঠোঁটের উপর লেগে ছিল। তার কচি-কচি হাত দিয়ে সে জঞ্জাল-বুডোর বুড়ো আঙুল খুব জোরে ধরে রেখেছিল।
এ মুহূর্তের জন্য জঞ্জাল-বুড়োর মনে হল বাচ্চাটাকে এখানে ফেলে দিয়ে কোথায় পালিয়ে যায়। ধীরে-ধীরে জঞ্জাল-বুড়ো বাচ্চার হাত থেকে নিজের বুড়ো আঙুল ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু বাচ্চা খুব জোরে ধরে রেখেছে তার হাত। জঞ্জাল-বুড়োর মনে হল, জীবন তাকে ফের ধরে ফেলেছে আর ধীরে-ধীরে ধাক্কা দিয়ে তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসছে। হঠাৎ তার দুলারির কথা মনে পড়ল। আর মনে পড়ল সেই বাচ্চার কথা, যে দুলারির গর্ভেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আর হঠাৎই জঞ্জাল-বুড়ো ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মনে হল, আজ সমুদ্র-জলে এত বুদ্বুদ নেই, যা তার চোখের জলে ছিল। গত পঁচিশ বছরে যত ময়লা আর নোংরা তার মনে জমে ছিল, আজ তা অশ্রুর তুফানে এক ধাক্কায় সাফ হয়ে গেল।
সারা রাত জঞ্জাল-বুড়ো ওই নবজাত শিশুকে নিজের কোলে নিয়ে অস্থির ও অশান্ত হয়ে ফুটপাতে পায়চারি করল। যখন সকাল হল, সূর্যের আলো দেখা দিল তখন লোকে দেখল জঞ্জাল-বুড়ো আজ জঞ্জালের টবের কাছাকাছি বসে নেই, বরং পথের ধারে তৈরি-হওয়া ইমারতের নিচে ইট বইছে, আর এই ইমারতের কাছে এক কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় ফুলের নকশাওলা কাপড়ে শুয়ে এক ছোট্ট শিশু মুখে দুধের চুষিকাঠি নিয়ে হাসছে।
মিথুন – রাজেন্দ্র সিংহ বেদী
বাজার হয়ে উঠেছিল মন্দা অথবা কারবার ছোট। মনে হচ্ছিল পশ্চিম দিকে যেখানে সড়ক কিছুটা উপরে উঠে আকাশকে ছুঁয়েছে আর শেষ পর্যন্ত একেবারে নিচে নেমে গেছে, ওখানেই দুনিয়ার শেষ প্রাপ্ত, সেখান থেকে এক লাফ দিতে হবে, এই জীবনকে বাঁচাবার জন্যেই এবার প্রাণটা দিতে হবে।
সারাদিন মাথা চাপড়ানোর পর মগন টকলা (রকমারি চিজ বিক্রিঅলা) মাত্র দুটো জিনিস হাতে পেল। এক, ফ্লোরেনটিন আর দুই, জেমিনি রায়। ফ্লোরেনটিনের মূর্তি হয়তো কোনো মাথা-মোটা ফিল্ম প্রডিউসার ভাড়া করে নিতে যেতে পারে, কিন্তু জেমিনি রায়? কোনো আপসোস নেই, আজ সে ওটিকে লুকিয়ে রেখে দিলে কাল তার নাতি-পুতিরা তা থেকে কোটি টাকা উপার্জন করবে–যেমন পশ্চিমি দুনিয়ায় আজও কারো কাছ থেকে লিওনার্দোর স্কেচ বেরুলে আর্টের বাজারে তার নিলাম-মূল্য লাখ টাকা পর্যন্ত পৌঁছায়। এই লাখ আর কোটি টাকার চিন্তায় মগন লালের দুচোখে বিজলি চমকায়। সে এ-কথা ভুলে গিয়েছিল যে, তার বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হয়ে গেছে। তাছাড়া তার মাথায় নেই একগাছি চুল, এমনকি তার বিয়েও হয়নি। সে-কারণে নাতি-পুতির কথাই ওঠে না। মগন করেই-বা কী? সে এক সাধারণ হিন্দু। সাধারণত তার চিন্তাগুলো এরকমই। তাছাড়া তার মন থেকে বেনে-ভাব যায়নি। কথায় সে ‘পয়সা-এ-তো মায়া’–এ-কথা বলে তা দূরে ঠেলে দেয়, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে পয়সার প্রতি তার প্রচণ্ড আসক্তি। দুনিয়ায় যদি কেউ পয়সার পূজা করে তো সে হিন্দু। আজ তার সামনে দেওয়ালির দিনের আলোকিত পূজাপাত্র থেকে দুধ-জলে স্নাত, সিঁদুর-চর্চিত টাকা পাওয়া যাবে। দশহরার দিনে তার গাড়ি গাঁদাফুলের মালায় ভরে যাবে আর সব স্ত্রী-পুরুষ মিলে লক্ষ্মী-মন্দিরে পূজা দিতে যাবে। পয়সার জন্যে সে ইউসুফের মতো ভাই আর পদ্মিনীর মতো পত্নীকেও বিক্রি করে দিতে পারে।
তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সিরাজা–ইবজ ব্যাটারির এজেন্ট। সিরাজার দোকান অশ্বথগাছের ঘেরের পেছনে। গরিব ল্যাৎপেতে হিন্দুরা সকালবেলায় অশ্বথের গোড়ায় জল-মেশানো দুধ ঢালত। দোকান আর সড়কের মাঝখানটা তাতে কাদা-কাদা হয়ে থাকত। দেশ-বিভাগের পরে হিন্দুস্থানে থেকে-যাওয়া সিরাজাকে গরিব হিন্দুদের এই থাকে খাতির করে চলতে হত। হ্যাঁ, না-করলে তো সে হয়ে যেত সেইসব বর্ণশংকর কুকুর, যেগুলো সারাদিন ঠ্যাঙ তুলে-তুলে ওই গাছের গায়ে পেচ্ছাব করত। এই গাছ সম্পর্কেই ভগবান বলেছেন, ‘গাছের মধ্যে আমি হলাম অশ্বথ।’ ওই কুকুর নিশ্চয়ই গতজন্মে ছিল মুসলমান–সাতচল্লিশ সনের দাঙ্গায় যে হিন্দুদের হাতে মারা গেছিল।
দেখা যেত সিরাজা হামেশা অশ্বথের ফল খাচ্ছে। তার কারণ মন্দা বাজার নয়, ক্ষুধাও নয়। সিরাজা সব সময় সেই জিনিস খেত যা বীর্যকে গাঢ় করে। হ্যাঁ, তার কাজই হল খাওয়া-দাওয়া আর ভোগ করা। মনের দিক থেকে সে ছিল ফালতু লডুয়ে যাযাবর যারা হিন্দুস্থানে থেকে পাকিস্তানের কথা বলে। আবার পাকিস্তানে থাকে তো বলে, ‘হে মোর প্রভু, আমায় মদিনায় ডেকে নাও।’ তার কোনোকিছুতেই আসক্তি নেই। মগন টকলা এ-নিয়ে কয়েকবার ভেবেছে, সিরাজার আল্লা দুনিয়ায় খুব আরাম করেন। আর মগনের আছে এক ভগবান যিনি নিচের দুনিয়ার বদলে উপরের ত্রিকূট পর্বতের আশপাশে দরবার লাগান। বোধ হয় সিরাজা না-জেনে-শুনেই এক তান্ত্রিক হয়ে বসে আছে, যে বীর্যবক্ষার জন্য কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগায় আর ঊর্ধ্বগামী পথ তৈরি করে। সে গর্বের সঙ্গে নারীসমাজের মাঝে থাকে, কিন্তু কোনোভাবেই জীবনের পরম তত্ত্বকে (অমৃতরূপ বীর্যকে) স্মলিত হতে দেয় না। ইচ্ছামতো উপায়ে মোক্ষপ্রাপ্তিকারী, নারীকে কেবল এক মাধ্যমরূপে ব্যবহারকারী এই ব্যক্তি কখনো ভেবে দেখেছে কি এর ফলে ওই বেচারি নারীদের হাল কী হতে পারে? তাদের অতৃপ্ত রুদ্যমান অস্থির অবস্থায় রেখে কেউ কি এ-ভাবে মোক্ষে পৌঁছতে পারে? আর বীর্য পতিত না-হওয়াতে যে মোক্ষ, তাতে পুরুষের বা নারীর কোনো মুক্তি ঘটবে? স্বাতী নক্ষত্রের জল তো মোতি নয়। ঝিনুকও মোতি নয়। ঝরে-পড়া জল যখন ঝিনুকের মধ্যে মুখবদ্ধ অবস্থায় থাকে, তখনই মোতির জন্ম হতে পারে।
রাত আসে দ্রুতগতিতে। বাইরের দুনিয়া আঁধার। তার সঙ্গে গুঁড়ি মেরে আসে আরো কিছু। রেশমওয়ালা বিলায়তিরাম, কাশ্মিরী বড়শাহ, এখানকার উড়পির চক্রপাণির দোকান পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। হতে পারে, মাসের দ্বিতীয় শনিবার হবার ফলে চক্রপাণির সব ইডলি দোসা, সাম্ভর, রওয়া কেসরি বিক্রি হয়ে গেছে। কেবল খোলা ছিল সিরাজার দোকান। কে জানে সে কোন মতলবে ছিল। বোধহয় এর জন্যে যে ব্যাটারির প্রয়োজন তা তো রাতেই হয়। কিন্তু ঝুটমুট সে সকালেই দোকান খুলে ফেলত–সকাল তো রাতেরই অংশ–তার শেষ অংশ, তা না-হলে সকাল কোথায়-বা কার। বোধহয় সিরাজা ট্যুরিস্ট এজেন্ট মাইকেলের অপেক্ষায় ছিল; ওরা দু’জনে মিলে আগামী কোনোদিনে আগ্রা বা খাজুরাহোর ভ্রমণসূচি তৈরি করে নেবে, আর তাতে কিছু পয়সাও উপায় হবে। না, সিরাজা পয়সার পেছনে দৌড়ত না। সে দৌড়াত পশ্চিমি মেয়েদের পেছনে। অনেক বিয়ে আর তালাকের কারণে ওইসব মেয়েরা ছিল অতৃপ্ত। এখানে এসে মমতাজের প্রেম নিয়ে এখানে-ওখানে কোনো শাহজাহান-চেহারাওয়ালা মরদের ওপর ভাগ্য পরীক্ষা করত। খাজুরাহোর মিথুনমূর্তিকে জীবন্ত করে তুলতে চাইত।
তখনই সিরাজার আওয়াজ মগনলালকে চমকে দিল, ‘হ্যালো সুইটি পাই।’
এমনিতে সিরাজা প্রায় অশিক্ষিত। কিন্তু ট্যুরিস্টের সঙ্গে থেকে থেকে সে এইসব ইংরেজি শব্দ শিখে ফেলেছিল। তার আওয়াজে মগন বুঝে নিল যে কীর্তি এসে গেছে।
সত্যি সত্যিই কীর্তি এসেছিল। বেঁটে, আঁটসাট বাঁধুনি, গভীর ভাঁজযুক্ত দেহ, বিষণ্ণ চেহারার যুবতী। তার রঙ ছিল পাকা। জাম রঙের শাড়ি পরত কীর্তি। সে এলে মনে হল আঁধারের কোনো টুকরো সাকার হয়ে সামনে এসেছে। কীর্তি সচরাচর রাতেই আসত। সে নিজেই নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইত। সিরাজা দাঁড়িয়েছিল তার দোকানের সামনে। কীর্তি প্রায়ই তার দিকে না-তাকিয়ে কথা না-বলে চলে যেত। তা সত্ত্বেও সিটি বাজাত সিরাজা।
কিন্তু কীর্তি কথাই-বা বলত কোথায়। এর সঙ্গে, ওর সঙ্গে, তার সঙ্গে–কারুর সঙ্গেই না। কথা বলার জন্যে সে এমনি সওয়াল গড়েপিটে নিত্য যার জবাব হত হা’ বা না’। কেবল উপর থেকে নিচে অথবা ডাইনে থেকে বায়ে মাথা হেলিয়ে কথা সেরে নিত কীর্তি। তাকে সিরাজার বিরক্ত করা মগনলালের পুরোপুরি অপছন্দ ছিল। সিরাজা কয়েকবার মগনকে বলেছিল–
‘ইয়ার, তুমি প্রেমের গোলকধাঁধায় পড়ে যাওনি তো? যুবতী মেয়েটাকে টেনে নাও। যদি বেশি এদিক-ওদিক কর তো কবুতরের মতো মেয়েটি উড়ে যাবে।’
কিন্তু মগন তাকে ধমকে দিয়েছে।
আসলে মগন টকলার ধান্দা ছিল বড় ঝামেলার। কীর্তি কাঠের কাজ বা মূর্তি তৈরি করে বিক্রির জন্য তার কাছে নিয়ে এলে মগন লাল তাতে অনেক খুঁত বের করত। কখনো বলত, এই ধরনের জিনিসের চাহিদা আজকাল নেই। আবার কখনো বলত, শিল্পকলার কষ্টিপাথরের বিচারে এ কাজ নিখুঁত হয়নি। কীর্তি মুখ আরো নামিয়ে নিত। যদিও এইসব কথায় মগন লালের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল যাতে একশ’ টাকার জিনিস পাঁচ-দশ টাকায় কীর্তি দিয়ে যায় আর তা রেখে দিয়ে সে একশ টাকায় বেচে।
কোনো আর্ট স্কুলে কীর্তি এই কাজ শেখেনি। তার বাপ নারায়ণ ছিল শিল্পী। ভাউ দাজী আর জেমস বর্গের্স প্রভৃতির সঙ্গে সে নেপাল আর হিন্দুস্থানের নানান জায়গায় শিল্প-উত্তরাধিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াত। সেসব শিল্পকীর্তি এখন লন্ডনের যাদুঘর, নিউইয়র্ক আর শিকাগোর অ্যান্টিক-দোকানগুলোকে অলঙ্কৃত করছে। প্রতিবছর আমাদের মন্দির আর মূর্তিঘরের শত-শত মূর্তি গায়েব হয়ে যেত আর হাজার-হাজার মাইল দূরে কিউরিও প্রভৃতির দোকানে দেখা যেত। বিরতিহীন সফরে বিরক্ত হয়ে নারায়ণ ফিরে এসে ঘরে বসেই শিল্পকর্ম নির্মাণ শুরু করে দিল এক সময়। কীর্তি গভীর মনোযোগে তার কাজ দেখত আর কাজের মাঝে হাতে খোদাইযন্ত্র এগিয়ে দিয়ে ‘রাফ ওয়ার্কে সাহায্য করত। ঘরে বসে গিয়ে নারায়ণ ভুলেই গিয়েছিল যে, লুপ্ত প্রাচীন শৈলীর শিল্পকর্ম বেশি দামে বিক্রি হয় আর সেসবের মূল্য দু’গুণ-চৌগুণ নয়, শতগুণ পাওয়া যায়। হয়তো সে তা জানত কিন্তু নারায়ণ ছিল সেই দলের মানুষ যারা পয়সার আশু প্রয়োজনই কেবল বুঝতে পারে, তাকে জীবনের প্রসারিত পটে দেখতে পারে না। সে শিল্পকর্ম তৈরি করে কষ্টে-সৃষ্টে রুটির পয়সা উপার্জন করত। শেষে একদিন রুটির পয়সা জোগাড় করতে-করতেই মৃত্যু হল নারায়ণের। তখন সে জগদম্বার মূর্তি বানাচ্ছিল। সে হঠাৎ ভুল করে তার খোদাইযন্ত্র দিয়ে নিজের হাতে আঘাত করায় তার ধনুষ্টঙ্কার হয়ে যায়। সে মারা যায় কাছেরই সামরিক হাসপাতালে। লোকেরা কানাকানি করত এই বলে যে সে নাকি কুকুরের মতো মরেছে। এইরকম মৃত্যু তার হবে নাই-বা কেন? সে যখন দেবীমূর্তি বানিয়েছে তখন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস দেবীর স্তনযুগল, নিতম্ব আর জঙ্ঘার ওপর-নিচে আটকে থেকেছে। ছোট মূর্তিতে স্তনযুগল শূন্যে ঘূর্ণায়মান লাটুর মতো দেখায়, কিন্তু বড় মূর্তিতে পা আর স্তনযুগল এক রকম ছোট ঘড়ার মতো দেখায়। আসল কথা, দুধের বড়-বড় বাটি যেন বুকের পরে রাখা হয়েছে, আর হস্তিনীর মাথার মতো নিতম্ব, যার নিচে একটি শুড়ের বদলে দুটি শুড় বেরিয়েছে। সে দুর্গামূর্তি বানাচ্ছিল। দুর্গা বড় জাঁকজমকভরা দেবী। এইরকম দেবীর মূর্তি যে বানাতে যাবে সে কুকুরের মতো মরবে না তো কি আমার-আপনার মতো মরবে?
‘কী এনেছ?’ মগন টকলা কীর্তিকে জিজ্ঞেস করল। কীর্তি শাড়ির আঁচল থেকে কাঠের কাজ’ বের করে মগনের সামনে টেবিলের ‘রোল টপে’র উপর ধীরে-ধীরে রাখল। উপরের ল্যাম্পের আলো ওখানেই কেন্দ্রীভূত ছিল বলে রাখল। কাজটা দেখার আগে মগন কীর্তির দিকে এক পুরনো কাজ-করা চেয়ার এগিয়ে দিল, কিন্তু কীর্তি আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইল।
‘তোমার মা কেমন আছে?’
কীর্তি কোনো জবাব দিল না। সে একবার পেছন ফিরে যেখানে সড়ক নিচের দিকে নেমে গেছে, সেদিকে তাকাল। তারপর যখন মগনের দিকে ফিরে দাঁড়াল তখনও তার চোখদুটি আনত।
কীর্তির মা তখন সামরিক হাসপাতালে। সেখানেই তার বাপ নারায়ণ মারা গিয়েছিল। বুড়ির ‘কিডনির রোগ ছিল। তার পেট ঘেঁদা করে নল লাগিয়ে একটা বোতল বেঁধে দেয়া হয়েছিল যাতে করে মলমূত্র নিচে যাবার বদলে ওপরের বোতলে চলে যায়। বোতল কোনো কারণে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এখন অন্য বোতলের জন্য পয়সা চাই। যদি সে মগনকে এ-কথা বলে দিত তো মগন অন্যভাবে কথা শুরু করত, কিন্তু ওই কাঠের কাজ দেখে সে চমকিত হয়ে গেল।
‘আবার ওই জিনিস?’ সে বলল–’আমি তোমাকে কয়েকবার বলেছি আজকাল এইসব জিনিস কেউ পছন্দ করে না… এই শায়িত বিষ্ণু, ওপরে শিষনাগ, আর তার পদসেবারত লক্ষ্মী…।’
কীর্তি বড়-বড় চোখে মগনের দিকে তাকাল–ওই দৃষ্টিতে কৌতূহলী প্রশ্ন–তবে কী বানাব?’
‘ওই সব যা আজকাল হচ্ছে।’
আজকাল কী হচ্ছে?’ কীর্তি শেষ পর্যন্ত মুখ খোলে। তার কণ্ঠস্বর প্রায় শোনাই যায় না, যেমন ক্যানারি পাখি ঠোঁট বাঁকিয়ে ডাকে কিন্তু তার আওয়াজ অস্ফুট।
মগন কথা বলার রাস্তা খুঁজে পেয়ে বলল, ‘আর কিছু না হয় তো গান্ধী বানাও… নেহরু বানাও…। ফের তার যেন কোনো ত্রুটি হয়ে গেছে এ-ভাব কাটিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘কোনো ন্যুড।’
‘ন্যুড?’
‘হ্যাঁ,… আজকাল লোকে ন্যুড পছন্দ করে।’
কীর্তি চুপ করে গেল। কুমারী বলে সে সংকুচিত হতে পারত, লজ্জা পেতে পারত, কিন্তু এইসব লজ্জা-সংকোচ তার মতো মেয়ের কাছে নেহায়েত বিলাসিতা। তার একমাত্র চিন্তা মগন ওই উডওয়ার্ক কিনবে কি-না, পয়সা দেবে কি-না? কিছুটা ভেবেচিন্তে সে বলল
‘আমি ঐ মূর্তি বানাই না…’
তফাত কী এদের মধ্যে?’ মগন টকলা বলল–’দেবীও তো নারী… তুমি ওই মূর্তিই বানাও, কিন্তু ভগবানের দোহাই, কোনো দেবমালা ওর সঙ্গে জুড়ে দিয়ো না… এইসব কারণেই তোমার বাবা ওভাবে মৃত্যুবরণ করেছে… স্বর্গবাসী হয়েছে…।’
কীর্তি নিজের জীবনের দিকে ফিরে তাকাল। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। কোনো এক বিপদাশঙ্কায় তার সারা শরীর কাঁপছিল। সেই বিপদের কথা সে ছাড়া দ্বিতীয় কেউ জানে না। সে চেয়ারে বসেনি। সেটাকে ধরে দাঁড়িয়েছিল। সেদিক থেকে তার শরীরের সুন্দর রেখাগুলো দেখাচ্ছিল এক আকর্ষণীয় ছবির মতো। এ কেমন শিল্প যা উপরের নয়, নিচের নারায়ণ বানিয়েছিলেন। মগনলালের হৃদয়ে তখন পছন্দ আর অপছন্দের দ্বন্দ্ব। সে
জানত-না যে, সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির হৃদয়ে বশ আর বিশের মধ্যে আপসে লড়াই চলছে। কীর্তির মুখখানি শুকিয়ে গিয়েছিল। থুতু গিলে নেবার চেষ্টা করে কীর্তি বলল,
‘আমি?…আমার কাছে তো মডেল নেই…’
মডেল?’ মগন তার কাছে এগিয়ে আসে।
‘শত-শত পাওয়া যায় … আজ কোনো যুবতী সুন্দরী মেয়েকে পয়সার ঝলক দেখাও তো সে একদম…’
কীর্তি কিছু বলেনি কিন্তু মগন শুনল, ‘পয়সা…’ মগন নিজেই বলল– ‘পয়সা খরচ করলে তবে তো পয়সা উপায় করবে…’
এই কথা কীর্তিকে আরো বিষণ্ণ করে তুলল। তার আত্মা জীবনের শক্ত চোয়ালের মধ্যে পড়ে ধড়ফড় করতে লাগল। তার চোখদুটি অশ্রুতে ভিজে উঠল। মেয়েদের এমনি দশা হয় যা দেখে পুরুষের অন্তরে পিতা আর স্বামীকে জাগিয়ে দেয়। সারকথা এই যে, মগনের ইচ্ছে হচ্ছিল হাত বাড়িয়ে তাকে আলিঙ্গন করে বুকে নিয়ে নেয়–
‘আমার প্রাণের পুতুল, তুমি চিন্তা করো না… আমি তো আছি।’
কিন্তু কীর্তি তাকে ধাক্কা দিল। বিব্রত হয়ে গেল মগন। সে এমন ভাব দেখাল যে, কিছুই ঘটেনি। তরুপের তাস তো তারই হাতে। টেবিলের ‘রোলটপ’ থেকে সে ওই ‘উড-ওয়ার্ক’টি তুলে নিল আর কীর্তির দিকে সেটা বাড়িয়ে ধরে বলল–
‘আমার এ-জিনিসের দরকার নেই।’
কীর্তিও কিছু-একটা ভেবে নিয়েছিল। সে প্রথমে নিচের দিকে দেখল তারপর সহসা . মাথা তুলে বলল–
‘আসছে-বার নুডই নিয়ে আসব। এখন তুমি এটাই নিয়ে নাও’…
শর্ত রইল। মগন মুচকি হেসে বলল।
কীর্তির মাথা নিচের দিকে নোয়ানো। মগন টকলা ভেবেছিল যে, কীর্তি হেসে উঠবে, কিন্তু সে আরো কিছুটা গম্ভীর হয়ে গেল। মগন ‘রোলটপ’ তুলে টেবিলের ভেতর থেকে একটা দশ টাকার চকচকে নোট বের করে কীর্তির দিকে বাড়িয়ে ধরল, নাও…’
দশ টাকা…’ কীর্তি বলল।
‘হাঁ, তুমি বলছ তাই, আমার কাছে এ মূর্তি বেকার। আমি আর দিতে পারব না…’
‘এতে তো…’ কীর্তি তার বাক্য শেষ করতে পারল না। তার ভেতরে কথা বলার শক্তি, শব্দ সব রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার অভিপ্রায় ছিল স্পষ্ট। মগন বুঝে নিল।
‘এতে তো ওষুধের বোতলও আসবে না… ওষুধের খরচ পুরো হবে না… রুটিও চলবে না…।’ এই ধরনের কথাই সব অসহায় আর গরিবরা বলে থাকে। তাদের সব কথাই বৃথা। মগন কীর্তির দিকে তাকিয়ে বলল–
‘আমাকে খুশি করে দাও, আমি তোমায় ভালো পয়সা দেব’…
আর এই কথা বলতে গিয়ে সে দু’আঙুল দিয়ে বৃত্ত বানাল। সে চোখ মারল যেমন করে ডোমেরা সজ্জিতা বেশ্যাদের তারিফ করে চোখ মারে।
কীর্তি দাঁতে ঠোঁট চেপে ধরে বাইরে চলে এল। ফেরার সময়ে সর্বদাই কীর্তি উল্টোদিকের পথে যায় যদিও এতে তাকে দেড় মাইল পথ ঘুরে যেতে হয়। সে চাইত না সিরাজার সঙ্গে তার দেখা হোক, কিন্তু আজ সেদিক দিয়েই সে গেল যেন তাতে তার বিপদাশঙ্কা সমাধানের অভিপ্রায় বলবতী হয়। এর মধ্যে মাইকেল চলে এসেছে আর সিরাজার সঙ্গে মিলে কিছু খাচ্ছে। এই সময় কীর্তি মুখ উপরে তুলে নাক ফুলিয়ে তার পাশ দিয়ে চলে গেল। সিরাজা কী একটা কথা বলল যা মগন শুনতে পেল না। কীর্তির মনে এক ধরনের বিদ্রোহের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে সেইসব দুঃখ-পীড়িতদেরই একজন–যাকে দুশমন পরিবৃত অবস্থায় বেঁচে থাকতে হচ্ছে। বোধহয় দুশমন থেকে কোনো উপকার আসতে পারে–অথবা হয়তো-বা নারীপ্রকৃতির এটাই বিশেষত্ব যে, নিজের পেছনে সে এমন একটা পুরুষকে লাগিয়ে রাখবে যার সঙ্গে তার কোনো লন-দেন নেই, তবু সে তা করবে কেবল এ-কারণেই যে, ওই পুরুষ তাকে দেখে একবার ‘সিটি’ বাজাবে আর সে নিজের বুকে হাত রেখে ঠাণ্ডা দীর্ঘশ্বাস ছাড়বে।
সিরাজা নিশ্চয় কোনো আফ্রোডিজিয়া খাচ্ছিল। হতে পারে মাইকেল তার জন্য ওটি নিয়ে এসেছে। হয়তো ওরা দু’জনে মিলে মগন টকলার কাছে এসে তার সঙ্গে ছদ্মব্যঙ্গে কথার ঘাত-প্রতিঘাত চালাত, কিন্তু ঠিক সেই সময় মগন বন্ধ করে নিল দোকান। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সে কীর্তির সেই উড-ওয়ার্কটিকে দেখল। শিল্পীকর্মটি বেশ উঁচু দরের। শেষনাগের নিম্নাংশ খুব সুন্দর, কিন্তু তার উপরাংশের চিত্রিত দেহচর্মে কীর্তি উল্কির ছাপ ও রঙে ভরে দিয়েছিল। বিষ্ণুমূর্তিটির মধ্যে এমন একটা ভাব ফুটে রয়েছে যা যে কোনো রমণী আস্থাবান পুরুষের মধ্যে দেখতে চায়। হ্যাঁ লক্ষ্মী হেলে পড়েছিল, তার শরীরের রেখাগুলোও স্পষ্ট ছিল না। বোধহয় কীর্তি লক্ষ্মীর আর কোনো রূপকে জানত না, যদিও তাকে রুচিগ্রাহ্য রূপে বানানো খুবই সোজা। যখন রমণী পা টেপবার জন্য ঝুঁকে পড়ে তখন তার হাতের বাজু দেখা যায়, শরীর থেকে তা আলাদা হয়ে আসে; ফলে তা রমণীকে তার বিশেষত্ব নিয়ে স্পষ্টরূপে ফুটিয়ে তোলে। আবার পাশের দিকে উপবিষ্টা উপরাসীন রমণীকে নিম্নাসীনার চেয়ে কত তফাত বলে মনে হয়। পুরুষের দৃষ্টিতে নারীশরীর কতই-না উঁচুনিচু রেখাময়। আবার এ-কথাও বলা যায়, কীর্তি নিজে রমণী বলেই হয়তো রমণীর তুলনায় সে পুরুষের প্রতি বেশি আগ্রহী, সে-কারণেই লক্ষ্মীমূর্তি নির্মাণে তার এই ক্রটি। রমণী আপন সৌন্দর্যের ব্যাপারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আত্মরতিতে ডুবে থাকে আর যখন তার এই আত্মরতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন কোনো পুরুষের সহায়তায় তা থেকে মুক্তি পায়।
কীর্তির ঐ ‘উড-ওয়ার্ক’ মগন এক হাতে ধরে অন্য হাতে ছুরি নিয়ে তার উপর ‘সিদ্ধম নমঃ’ অক্ষর খোদাই করে পেছনের ঘরে চলে গেল। সেখানে জমি কাঁচা মাটির। মাটি খুঁড়ে সে তার মধ্যে উড-ওয়ার্ক’টিকে রাখল। মাটির ভেতর থেকে আরেকটি মূর্তি বের করল সে, সেটাও কীর্তির বানানো। গর্তের মধ্যে মাটি দিয়ে তার মধ্যে খয়েরের জল ছিটিয়ে দিল। পুরনো মূর্তির ধুলো ঝেড়ে সে দেখতে পেল তাতে বড়-বড় ফাটা-দাগ হয়ে গেছে আর তা কয়েক শতাব্দীর পুরনো বলে মনে হচ্ছে। পরের দিন যখন সেটিকে নিয়ে মগন ট্যুরিস্টদের কাছে গেল তখন তারা খুশি হল খুব। মগন তাদের জানাল যে এই মূর্তির উল্লেখ কালিদাসের রঘুবংশে আছে। রঘু কোঙ্কণ দেশে ত্রিকূট নামে এক শহর স্থাপন করেছিলেন, সেখান থেকে ওই মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। এ-ধরনের কিছু মূর্তি মহীশূরের চামরাজা ওয়াডিয়ারের কাছে আছে। আর কিছু তার কাছে। এইভাবে মগন টকলা ঐ মূর্তিটিকে সাড়ে পাঁচশ’ টাকায় বেচে দিল। এটার জন্যে সে কীর্তিকে দিয়েছিল মাত্র পাঁচটি টাকা।
এই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে কীর্তি ন্যুড’ নিয়ে এল। তার মুখে আগের মতোই চিন্তার ছাপ। ওর মা অসুস্থ। সে নিজেও অসুস্থ বোধ করছিল। ওর প্রায় নিউমোনিয়া হয়ে গেছে। সে খকখক করে কাশছিল আর বারবার নিজের গলা ধরছিল। তুলোর পট্টি গলায় রেখে তা এক ফাটা-ছেঁড়া কাপড় দিয়ে বেঁধেছিল সে।
কীর্তি অন্যান্য দিনের মতোই মগন টকলার সামনে মূর্তিটি রেখে দিল। এই মূর্তি সে কাঠ দিয়ে নয়, পাথর দিয়ে বানিয়েছিল। আশা আর আশঙ্কার সঙ্গে কীর্তি মগন টকলার দিকে তাকিয়েছিল। মগন যদি অপছন্দ করে তবে তা অমার্জনীয় মিথ্যা কথা হবে। এ-কারণে মগন কেবল তা পছন্দই করেনি, পরন্তু প্রাণভরে তারিফ করেছিল। নিন্দা করেছিল এইমাত্র যে মূর্তিটি খুব ছোট হয়েছে। তার আফসোস এই যে, মূর্তিটি যদি প্রমাণ মানুষের উচ্চতাবিশিষ্ট হতো তবে কেবল কীর্তির নয়, মগনেরও অনেক উপকার হতো।
মগন যক্ষীমূর্তি হাতে নিয়ে সযত্নে দেখছিল। কীর্তি সত্যিসত্যি ন্যুড’ বানাতে পারেনি। মূর্তির মুখের উপর ছিল ভেজা কাপড়। আশ্চর্য ওই কাপড় থেকে এখনো পর্যন্ত জলবিন্দু ঝরে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে। সেই জলবিন্দুর কিছুটা মুখের সঙ্গে লেগে আছে, কিছুটা অন্যান্য জায়গায়। উপর থেকে মুখ ঢাকার চেষ্টায় ওই রমণীর দেহ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
মূর্তি থেকে নজর তুলে নিয়ে মগন টকলা কীর্তির দিকে তাকাতেই হঠাৎ তার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল–’বাহ’। কীর্তি লজ্জিত হয়ে নিজের জামদানি শাড়িটিকে কিছুটা সামনে টানল, কিছুটা দিয়ে পেছন দিকে ঢাকতে লাগল। কিন্তু মগন ঠিক বুঝে নিয়েছিল। যে, আয়নার সামনে নগ্ন হয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে ওই মূর্তি সে বানিয়েছে। এতবার তাকে কাপড় ভিজিয়ে নিজের মুখের উপর রাখতে হয়েছে যার ফলে তার ঠাণ্ডা লেগে গেছে আর সে এখন পর্যন্ত কাশছে। এ কেবল পয়সার কথা নয়। নারীর মধ্যে আত্মপ্রদর্শন আর আত্মসমর্পণের ভাবও তো আছে। মগন সবকিছু বুঝে ফেলেছিল। কিন্তু জেনে-বুঝে না-জানার ভান করে তাকে শুধিয়ে নিল–
মা কেমন আছে?’
এ-কথায় খুব চটে গিয়েছিল কীর্তি। তার কাশির দমক এসেছিল আর নিজেকে সামলাতে তার লেগেছিল বেশখানিকটা সময়। মগন ঘাবড়ে গিয়েছিল, আর লজ্জিতও হয়েছিল। তারপর মাথা হেলিয়ে যে প্রশ্ন সে করেছিল তা-ও জরুরি ছিল না–
‘তা হলে তুমি মডেল পেয়েছিলে?’
কীর্তি প্রথমে দৃষ্টি নত করেছিল, তারপর দোকানের বাইরে তাকিয়ে সেই দিকে দেখেছিল যেদিকে সড়ক আকাশ ছুঁতে গিয়ে হঠাৎ নিচে নেমে গেয়েছে। মগন চেয়েছিল কীর্তির দুর্বলতা ধরে ফেলে আর প্রাপ্য তারিফ তাকে দেয়, আর বোধহয় দিতে চেয়েছিলও। কিন্তু মগন ভাবল এতে মূর্তির দাম বেড়ে যাবে। সে মনে-মনে স্থির করেছিল এবার সে কীর্তিকে একশ’ টাকা দেবে। ওষুধের বোতল আর বাকি জিনিসপত্রের দাম একশ’ টাকা না-হলেও সে একশ’ টাকাই দেবে। ভেতরে-ভেতরে সে ভয় পাচ্ছিল, কীর্তি আরো বেশি টাকা-না চায়।
কী দাম দেব এর জন্য?’ সে হাল্কাভাবে প্রশ্ন করল।
কীর্তি চকিত নজরে তার দিকে দেখল আর বলল, ‘এবার আমি পঞ্চাশ টাকা নেব।’
‘পঞ্চাশ?’
‘হাঁ, এক পাই কম না…’
মগন হতাশভাবে ‘রোলটপ’ তুলল আর চল্লিশ টাকা বের করে কীর্তির সামনে রাখল আর বলল–
যা তুমি বল, কিন্তু এখন আমার কাছে চল্লিশ টাকাই আছে…দশ টাকা পরে নিয়ে যেয়ো…’।
কীর্তি টাকা হাতে নিল আর বলল—
‘আচ্ছা।
সে চলে যাচ্ছিল মগন তাকে থামাল–’শোনো।’
কীর্তি চলার মাঝে থেমে গিয়ে তার দিকে আমাকে সাহায্য কর’ এই ঢঙে। তাকিয়ে দেখল। কীর্তির চেহারায় বিষণ্ণতা, কিন্তু তা যখন ছড়িয়ে যাবার বদলে স্থির হয়ে গেল ঠিক তখনই মগন টকলা শুধাল–এই টাকায় তোমার কাজ হয়ে যাবে তো?
কীর্তি মাথা হেলিয়ে হাত ছড়িয়ে দিয়েছিল, যার অর্থ আর কী করা যায়?’–সে মুখে বলল, ‘মা’র অপারেশন এসে গেল, একশ’ টাকা লাগবে।’
কিছুক্ষণ পর কীর্তি ফের বলল, আমি তো বলেছি’; একটু থেমে বলল, মা যত শীঘ্র মরে যায় ততই ভালো।’ সেখানে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল কীর্তি।
শেষে কীর্তি নিজেই বলে উঠল, ‘এইভাবে ছুটে বেড়ানোর চেয়ে মরণও ভালো।
যতক্ষণ মগন চোখ খুলে না-তাকায় ততক্ষণ কীর্তিকে তার আঠারো-উনিশ বছরের মেয়ের বদলে পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছরের ভরন্ত রমণী বলে মনে হয়, সে জীবনের প্রত্যেক আঘাত নিজের ওপরে নিয়ে তাকে ব্যর্থ করে ফেলে দিচ্ছে।
একটা কথা বলি। টকলা কাছে এসে বলল, ‘তুমি মিথুন বানাও… অপারেশনের সব খরচ আমি দেব।’
‘মিথুন?’ কীর্তি বলে কেঁপে উঠল।
‘হ্যাঁ। ওর খুব চাহিদা আছে। টুরিস্টরা ওগুলোর জন্যে পাগল হয়ে ওঠে।
‘কিন্তু…’
বুঝতে পারছি।’ মগন মাথা হেলিয়ে বলল।
তুমি না-জানো তো একবার খাজুরাহো চলে গিয়ে দেখে এস। আমি তার জন্য তোমাকে রাহা-খরচ নিতে রাজি আছি…’
‘তুমি!’ কীর্তি ঘৃণার সঙ্গে তার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পরে বলল, তুমি তো বলেছ, তোমার কাছে আর পয়সা নেই…’
মগন ঝটপট মিথ্যা তৈরি করে নিল–
আমার কাছে সত্যি পয়সা নেই’, সে বলল, আমি দোকানের ভাড়া দেয়ার জন্য কিছু টাকা আলাদা করে রেখেছিলাম।’
সে ফের টাকা দেয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কীর্তি আপন অহংকারে তা না-নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। মগন টকলা ঘুরে দাঁড়িয়ে যক্ষী-মূর্তিটি দেখল। ছোট হাতুড়ি দিয়ে তার নাক ভেঙে দিল, ঠ্যাং ভেঙে দিল আর মূর্তির শিরের আভরণের উপর লঘুভাবে এমন করে আঘাত করল যাতে কিছু অংশ ভেঙে পড়ে যায়। তারপর ভেতরের ঘরে গিয়ে সে মূর্তিটিকে দড়িদড়া দিয়ে বেঁধে লবণের অ্যাসিড-জলে ডুবিয়ে রাখল। ফলে ধোয়া উড়ল খানিকটা। মগন দড়ি ধরে টেনে যক্ষীকে বার করে জলে ডুবোতে লাগল। তারপর যখন জল থেকে তাকে তুলে নিল তখন যক্ষীর সাজ-আভরণ মলিন হয়ে গেছে। মাঝে-মাঝে কোথাও হঠাৎ দেখা দিয়েছে গর্ত। এখন এই মূর্তি হাজার টাকায় বিক্রির জন্য তৈরি।
এবার কীর্তি যে মূর্তি নিয়ে এল তা মিথুন-মূর্তি। তা ছিল প্রমাণ মানুষের উচ্চতাবিশিষ্ট। মূর্তি একটি বস্তায় বাঁধা অবস্থায় ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে সে নিয়ে এল। কয়েকজন মজুর তা মগন টকলার দোকানে তুলে দিয়ে রেখে মজুরি নিয়ে চলে।
কীর্তি আর নিজেকে একা পেয়ে এক নিঃশ্বাসে মগন টকলা বস্তার দড়িদড়া কেটে ফেলল। কৌতূহলের সঙ্গে খুলে নিল মূর্তির আবরণ। এখন মূর্তিটি তার সামনে। ‘পারফেক্ট’–মগন মূর্তিকে দেখল, শুকিয়ে গেল তার গলা। সে ভেবেছিল যে কীর্তি তাকে নিজের সামনে ওই শিল্পমূর্তিকে দেখতে দেবে না। কিন্তু কীর্তি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তার সামনে, কোনোরকম আবেগ ছাড়াই শিল্পের নারীমূর্তি পূর্ণতাপ্রাপ্ত হল, আর পুরুষমূর্তি আত্মবিস্মৃত হয়ে তার দুই কাধ ধরে দাঁড়িয়ে রইল–মগন টকলা এই যুগলমূর্তিকে যত্নের সঙ্গে দেখল–সে বোধহয় নিভৃত অবসরে মূর্তিটাকে আরো ভালো করে দেখতে চাইছিল।
মগন দ্রুত জিজ্ঞেস করল।
অপারেশনের জন্যে কত টাকা চাই?
অপারেশনের জন্য নয়–নিজের জন্য।
‘নিজের জন্যে? … মা…’
কয়েক সপ্তাহ হল মারা গেছেন।
মগন তার নিজের চেহারায় দুঃখ আর আফসোসের ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিল কিন্তু কীর্তি তা চায়নি। তার দুই ঠোঁট চেপে বসেছিল। ওই রকমই বিষণ্ণভাবে সে বলেছিল, ‘আমি এর জন্যে হাজার টাকা নেব…’
মগন চকিত হয়ে গিয়েছিল। তার কথায় ছিল তোতলামি–এর জন্যে কেউ হাজার টাকা দিতে পারে?
‘হ্যাঁ।’ কীর্তি জবাব দিয়েছিল–’আমি কথা বলে এসেছি… বোধহয় আমি আরো বেশিই পাব … আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম তাই…।
‘আমি তো…আমি তো পাঁচশ’ টাকার বেশি দিতে পারব না।’
না।’ কীর্তি মজুরের সন্ধানে বাইরের দিকে দেখতে লাগল। মগন টকলা তাকে থামাল–’আর দুশ’ নিয়ে নাও।’
‘হাজারের চেয়ে কম এক টাকা নেব না।’
মগন হয়রান হয়ে কীর্তির দিকে তাকিয়ে রইল। আজ কীর্তির মেজাজ অন্যরকমও। ও কি খাজুরাহো গিয়েছিল? দেখা হয়েছিল ট্যুরিস্টদের সঙ্গে? যে-কোনো মূল্যে কলাকারকে তার মার্কেট থেকে দূরে সরিয়ে রাখা দরকার। কিন্তু… কিন্তু… সে ‘রোলটপ’ তুলে আটশ’ টাকার নোট গুণে কীর্তির সামনে রাখল। কীর্তি তাড়াতাড়ি তা গুণে দেখে মগনের মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলল।
‘আমি বলেছি–হাজার টাকার কম নেব না।’
‘আচ্ছা, নয়শ’ টাকা নাও…’
‘না।’
‘সাড়ে নয়শ’… নয়শ’ পঁচাত্তর..।’ কীর্তির দৃষ্টিতে অহংকারের ভাব দেখে সে এক শ’ টাকার দশখানা নোট তার হাতে দিয়ে নেশাগ্রস্তের মতো মিথুন-মূর্তির দিকে এগিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে ছিল কীর্তি। সে তার আপন শিল্পকর্মের তারিফ শোনার জন্য থেমে গিয়েছিল। মগন মিথুন-মূর্তির মধ্যে রমণী-মূর্তির দিকে তাকাল। সে মূর্তি কীর্তি নিজেই। তার চোখে জল কেন? সে কি আত্মতোষের গভীর অনুভূতির ফল অথবা কোনো জীবন-পীড়নের প্রতীক? তা কি দুঃখ আর সুখ, বেদনা আর বেদনা-উপশমের সম্পর্ক-জাত, যা থেকে পুরো সৃষ্টি উপস্থিত? মগন আবার পুরুষ-মূর্তির দিকে তাকাল–যে মূর্তি ওপর থেকে সুন্দর কিন্তু ভেতরে ছিল পুরো অসুন্দর। কীর্তি কেন পুরুষমানুষের কঠোরতার ওপর জোর দিল … এই মূর্তি হল মিথুন-মূর্তি, কিন্তু এ তো সে মিথুন নয় যা পুরুষ আর প্রকৃতির মিলনে হয়… ঠিক আছে … বিপরীত মূর্তিতে বেশি টাকা পাওয়া যাবে…।
মগন টকলা ওপরের দীপদান টেনে এনে পুরুষ-মূর্তির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠল–
‘এই… আমি এই মূর্তিকে কোথায় যেন দেখেছি?
কীর্তি কোনো জবাব দিল না।
‘তুমি।’ মগন যেন সবটাই বুঝে ফেলেছে—
‘তুমি সিরাজার সঙ্গেই বাইরে গিয়েছিলে?’
কীর্তি এগিয়ে এসে মগন টকলার মুখের ওপর সজোরে এক থাপ্পড় মেরে নোটগুলো হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
দুই হাত – ইসমত চুগতাই
রামঅওতার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসছে। বুড়ি মেথরানি চিঠি পড়িয়ে নেয়ার জন্য আব্বা মিঞার কাছে এসেছিল। রামঅওতারের ছুটি হয়ে গেছে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল তো! তাই তিন বছর বাদে রামঅওতার ফিরে আসছে। কৃতজ্ঞতাবশত সে দৌড়ে-দৌড়ে সকলের চরণ স্পর্শ করছে যেন এইসব চরণের মালিকেরাই তার একমাত্র পুত্রকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে জীবিত সুস্থ অবস্থায় ফেরত নিয়ে আসছে।
বুড়ির বয়স পঞ্চাশ বছর হয়েছে; কিন্তু তাকে সত্তর বছরের মতো দেখায়। দশ-বারোটা ছোট-বড় ছেলে জন্ম দিয়েছিল সে। তাদের মধ্যে কেবল রামঅওতারই অনেক মানত-টানত করার ফলে বেঁচে আছে। বিয়ে দেয়ার এক বছর পুরা না-হতেই, রামঅওতারের ডাক’ এসে গিয়েছিল। মেথরানি অনেক আপত্তি করেছিল; কিন্তু কোনো ফল হয়নি। কিন্তু যখন রামঅওতার উর্দি পরে শেষবারের মতো তার চরণ স্পর্শ করতে এল, তখন ছেলের দাপট দেখে বুড়িরও বুক ফুলে উঠেছিল, যেন তার ছেলে কর্নেলই হয়ে গেছে।
পেছনের মহলে চাকর-বাকররা হাসছিল। রামঅওতার ফিরে আসার পর যে ড্রামা হবার সম্ভাবনা, সবাই তা নিয়ে উৎসুক হয়ে বসে আছে। যদিও রামঅওতার যুদ্ধক্ষেত্রে কামান-বন্দুক ছুঁড়তে যায়নি, তবু সিপাহিদের পায়খানা সাফ করতে-করতেও তো তার মধ্যে কিছুটা সিপাহিয়ানা দেখা গেয়েছে। ধূসর উর্দি পরে সেই পুরনো রামঅওতার তো আর সেই লোকটি নেই যে সে গোরীর কার্যকলাপ চুপচাপ শুনবে, তার তরতাজা খুন বদনামির ওপর খেপে না-উঠবে।
বিয়ে করে আনার সময় গৌরীর যৌবন কত মচমচে ছিল। রামঅওতার যতদিন ছিল ততদিন তার ঘোমটা ছিল এক ফুট লম্বা। কেউ তার মুখের রূপ দেখতে পায়নি। যখন পতি বিদেশে গেল তখন সে ভেউ-ভেউ কেঁদেছিল–যেন তার সিথির সিঁদুর চিরকালের মতো মুছে যাচ্ছে। কিছুদিন কাঁদো-কাদো চোখে মাথা ঝুঁকিয়ে সে পায়খানার টব বহন করত। তারপর ধীরে-ধীরে তার ঘোমটার দৈর্ঘ্য কমতে শুরু করেছিল।
কিছু লোকের ধারণা যে, ঐ সময় মেয়েটার শরীরে বসন্ত ভর করেছিল। আর একধাপ এগিয়ে কেউ-কেউ বলেছিল, গোরী একটা ছিনাল। রামঅওতার চলে যাওয়াতেই আপদ এসে জুটেছিল। বদমাশ মেয়ে সব সময় ‘হি-হি’ করত, সব সময় যেন মদমত্তা হয়ে হাঁটত। কোমরে পায়খানার টব বসিয়ে কাঁসার কাকন ছনছ করে যেদিক দিয়ে সে চলে যেত সেদিকে লোকে বেহুঁশ হয়ে তাকিয়ে থাকত। ধোপার হাত থেকে সাবানের বাটি পিছলে চৌবাচ্চায় পড়ে যেত, তাওয়ার উপর ফুলে-ওঠা রুটি থেকে চলে যেত বাবুর্চির দৃষ্টি। ভিস্তির ডোল ডুবে যেত কুয়াতে। চাপরাশিদের ব্যাজ লাগানো পাগড়ি হেলে গিয়ে কাঁধে ঝুলতে থাকত। আর যখন এই আপদের প্রতিমা ঘোমটার আড়াল থেকে নয়ন-বাণ নিক্ষেপ করে চলে যেত তখন সারা পেছন-মহল এক নিষ্প্রাণ দেহের মতো স্থবির হয়ে পড়ত। আবার হঠাৎই চমকে উঠে একে অপরের দুর্গতি নিয়ে বিদ্রূপ করত তারা। ধোপানি প্রচণ্ড রাগে মাড়ের কড়াই উল্টে দিত। চাপরাশিনি বুকে চেপে-রাখা ছেলেকে ধমকে উঠত অকারণে। বাবুর্চির তৃতীয় পক্ষের বিবির হিস্টিরিয়া হয়ে যেত।
নামেই কেবল গোরী কিন্তু বদমাশ মেয়েটা কালো কুটকুটে–যেন উল্টানো তাওয়ার উপর কোনো নষ্ট মেয়ে পরোটা ভেজে চমকে উঠে রেখে দিয়েছে। চওড়া কুঁকদানির মতো নাক, ছড়ানো ঠোঁট। তার সাত পুরুষে দাঁত মাজার ফ্যাশন ছিল না। চোখে বিস্তর কাজল দেয়ার পরেও ডান চোখের টেরাভাব ঢাকা যেত না তার। ঐ টেরা চোখেই সে আবার এমন করে বিষ-মাখানো তীর ছুড়ত যে তা নিশানা ভেদ করত। মোষের চেয়ে চওড়া পা। যে দিক দিয়ে চলে যায় সে দিকে ছড়িয়ে যায় সর্ষের তেলের পচা গন্ধ। হাঁ, কণ্ঠস্বর ছিল আশ্চর্য রকমের মধুর। উৎসব-অনুষ্ঠানে যখন ভাবে বিভোর হয়ে কাজরি গাইত তখন তার কণ্ঠস্বর চলে যেত সবচেয়ে চড়ায়।
বুড়ি মেথরানি ওরফে তার শাশুড়ি, ছেলে চলে যাওয়ার পর গোরীর চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। উঠতে-বসতে তাকে রক্ষার জন্য গালি দিত। তার ওপর নজর রাখার জন্য পেছন-পেছন ঘুরত। কিন্তু এখন বুড়ির স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। চল্লিশ বছর পায়খানা বহন করার ফলে তার কোমর চিরকালের মতো এক দিকে বেঁকে গিয়ে থেকে। গিয়েছিল ওখানেই। সে আমাদের পুরনো মেথরানি। আমাদের জন্মের পরে সে-ই ফুল-নাড়ি ওই মাটিতে পুঁতে দিয়েছিল। মায়ের প্রসববেদনা উঠলে সে এসে বসত চৌকাঠের উপর। আর কখনো কখনো লেডি-ডাক্তারকেও অনেক দরকারি পরামর্শ দিত। টোটকা চিকিৎসার জন্য মন্ত্রপূত তাবিজও নিয়ে বেঁধে দিত পট্টিতে। মেথরানিদের ঘরে সে ছিল গুরুগম্ভীর বয়স্কের মর্যাদায় আসীন।
এমনি জনপ্রিয় মেথরানির পুত্রবধূ হঠাৎ একদিন লোকের চক্ষুশূল হয়ে গেল। চাপরাশিনি আর বাবুর্চিনির তো আরো অভিযোগ ছিল। আমাদের শান্ত-শিষ্ট বউদিদের মাথা তার ঢং দেখে থমকে যেত। আর যে-কামরায় তাদের স্বামীরা আছে সে-কামরা ঝাঁট দিতে যদি সে যেত, তাহলে তারা পড়িমরি করে বুক থেকে দুধের বাচ্চাদের মুখ সরিয়ে দৌড়ত সেখানে যাতে ঐ ডাইনি তাদের স্বামীদের ওপর টোটকা প্রয়োগ না করতে পারে!
গোরী যেন একটা মারকুটে লম্বা শিংওলা ষড়–যা এখানে-ওখানে দিব্যি ছুটে বেড়াত। মেয়েরা তাকে দেখলে নিজ-নিজ কাঁখের বাসন-গামলা দুই হাতে সামলে চেপে ধরত বুকে। আর যখন সে হাল্কা কোমল চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াত তখন পেছন-মহলের মহিলাদের এক হঠাৎ গড়ে-ওঠা প্রতিনিধি-মণ্ডল এসে হাজির হত। মায়ের দরবারে খুব চেঁচামেচি হত, ভাবী বিপদ আর তার সাংঘাতিক ফলাফল নিয়ে হত তর্কবিতর্ক। পতিরক্ষার জন্য এক কমিটি বানানো হয়েছিল তার কারণে, যাতে সব বউদিরা হৈ-চৈ করে ভোট দিল। মাকে দেয়া হয়েছিল ওই সমিতির সম্মানিত প্রধানের পদ। সব মহিলা নিজ-নিজ পদের মর্যাদা অনুযায়ী পিড়ি আর পালঙ্কের কিনারে বসল। পানের দোনা ভাগ করে দেয়া হল তাদের আর ডেকে পাঠানো হল বুড়িকে। বাচ্চাদের মুখে মাই দিয়ে সভায় নিস্তব্ধতা রক্ষা করা হল। পেশ করা হল মোকদ্দমা। আমাদের মা খুব রোয়াবের কণ্ঠে বলেছিলেন, কী রে চুড়েল! তুই বদমাশ বউকে কী এইজন্যে ছেড়ে রেখেছিস যাতে সে আমাদের বুকের উপরে শিল-নোড়া বাটে? তোর মতলবটা কী? মুখে কালি মাখাবি?’
মেথরানিও রেগে উঠল। ফেটে পড়ে বলল, ‘কী করব, বেগম সাহেবান? হারামখোরকে চার লাথি মেরে ছিলাম। রুটিও খেতে দিইনি; কিন্তু রাড়ি তো আমার কজায় নেই…’
.
‘আরে ওর কি রুটির কিছু কমতি আছে?’ বাবুর্চিনি ঢিল ছুড়ল। সাহারানপুরের খানদানি বাবুর্চি ঘরের মেয়ে সে, আবার তৃতীয় পক্ষের বিবি। আল্লার আশ্রয়, কেমন তেজ আর রাগ তার। অন্যদিকে চাপরাশিনি, মালিনী, ধোপানি–সবাই মোকদ্দমাকে আরো সঙিন করে তুলল। বেচারি মেথরানি বসে বসে সকলের লাথি-ঝাঁটা খেতে-খেতে নিজের চুলকানি-ভরা থলথলে গা চুলকাতে লাগল।
‘বেগম সাহেবান, আপনি যেমন বলবেন তেমন করতে দ্বিধা করব না। কিন্তু করব কী, মাগির গলা টিপে দেব?’
টেটিয়াকে শিক্ষা দেবার তীব্র অভিলাষে ঐ মহিলাদের মনে খুশির ঢেউ উঠছিল। আর সকলেরই মনে বুড়ির প্রতি সীমাহীন দরদ তখন…
মা রায় দিয়েছিলেন–মড়াটাকে ধরে বাপের বাড়িতে ছেড়ে দে।’
এ বেগম সাহেবান, এ কি কখনো হতে পারে?
মেথরানি জানিয়েছিল যে, বউ খালি হাতে আসেনি। সারা জীবনের কামাই পুরো দু’শ’ ফেললে তবে এই দামাল মাগী হাতে আসবে। বরং এই টাকায় দুটো গরু কেনা যাবে। অনায়াসে কলসিভরা দুধ দেবে। তখন এই রাড়িকে দুই লাথি দেয়া যাবে হয়তো। আর যদি গোরীকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া যায় তাহলে এর বাপ খুব তাড়াতাড়ি অন্য মেথরের হাতে বেচে দেবে একে। সে তো কেবল ছেলের শয্যা-শোভা নয়। দুই হাতওয়ালা মেয়েমানুষ, যে চারটে পুরুষ মানুষের কাজ করে ফেলে। রামঅওতার। যাওয়ার পর থেকে বুড়ি এত কাজ সামলাতে পারে না। এই বুড়ো বয়সে বউয়ের দুই হাতের সাহায্য নিয়েই চলছে তার।
মহিলারা কেউ অবুঝ নয়। মামলা সামাজিক চালচলন থেকে সরে এসে আর্থিক বাস্তব অবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে গেল তখন। সত্যি কথাই, বুড়ির জন্যে বউটা থাকাই দরকার। কার এমন দিল আছে দু’শ’ টাকা ফেলে দেবে। এই দু’শ টাকা ছাড়াও বিয়েতে বেণের কাছ থেকে নিয়ে খরচ করেছে, লোকজন খাইয়েছে। বেরাদরিকে রাজি করিয়েছে। এই সমস্ত খরচ আসবে কোথা থেকে। রামঅওতার যে বেতন পায় তা তো ধার শুধতেই বেরিয়ে যায়। এমন মোটা-তাজা বউ এখন তো চারশ’ টাকার কমে পাওয়া যায় না। পুরো সাফাইয়ের কাজের পর আশপাশের আরো চার কুঠিতে কাজ করে গোরী। মাগী কাজে চৌকস।
মা শেষ সওয়াল দিয়ে দিলেন–যদি ঐ লুচ্চির জলদি-জলদি কোনো ব্যবস্থা না-কর তো কুঠির হাতায় থাকতে দেওয়া হবে না…’
বুড়ি অনেক চেঁচামেচি করল আর ফিরে গিয়ে প্রাণ ভরে অনেক গালি দিল বউকে। চুল ধরে মারলও। বউ তার কেনা-বউ। সে পিটতে থাকল, হড়বড় করে বকতে থাকল তারপর একদিন সে সব চাকরদের ঘর তছনছ করে দিল প্রতিশোধ হিসেবে। বাবুর্চি, ভিশৃতি, ধোপা আর চাপরাশিরা নিজ-নিজ বউদের ধরে-ধরে খুব পিটল। এবারও মেথরানি বউয়ের মামলায় আমার সভ্যা বউদির দল ও সম্ভ্রান্ত ভাইদের মধ্যে খচাখচি হয়ে গেল আর বউদিদের বাপের বাড়িতে তার পাঠানো হতে থাকল। ফলে বউরা প্রতি ঘরে সই-পাখির কাটা হয়ে গেল।
দু-চারদিন পরে বুড়ি মেথরানির দেওরের ছেলে রতীরাম আপন জেঠিমার সঙ্গে দেখা করতে এসে ওখানেই থেকে গেল। দু’-চারটে কুঠিতে কাজ যা বেড়ে গিয়েছিল তা সে সামলে দিল। নিজের গায়ে তো নিষ্কর্মা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তার বউ এখনো নাবালিকা, এ-কারণে দ্বিরাগমন হয়নি।
রতীরাম আসায় মৌসুম উল্টে-পাল্টে একেবারে বদলে গেল; যেমন হাওয়ার দমকের সঙ্গে ঘন মেঘের দল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বউকে বলে-বলে সবাই চুপ হয়ে গিয়েছিল। কাঁসার কাকন মূক হয়ে গিয়েছিল। যেমন বেলুন থেকে হাওয়া বেরিয়ে গেলে সেটা চুপচাপ ঝুলতে থাকে তেমনভাবে বউয়ের ঘোমটা ঝুলতে-ঝুলতে নিচের দিকে বেড়েই চলল। এখন সে নাকে দড়ি-না-বাধা বলদের বদলে একেবারে লজ্জাবতী বধূ। পেছন-মহলের সব মহিলা সান্ত্বনার নিঃশ্বাস ফেলল। স্টাফের পুরুষরা তাকে খোঁচা দিলে সে লজ্জাবতী লতার মতো নুয়ে থাকত, আর কেউ বেশি চোখ মারলে সে ঘোমটার মধ্যে থেকে অশ্রু-ভেজা চোখের তেরছা নজরে রতীরামের দিকে দেখত, আর দৌড়ে বাহু চুলকাতে-চুলকাতে রতীরামের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যেত।
বুড়ি শান্ত হয়ে দেউড়িতে বসে আধ-খোলা চোখে এই মিলনান্ত নাটক দেখতে দেখতে গুড়গুড়িতে টান দিত। চারদিকেই শীতল শান্তি ছেয়ে গিয়েছিল–যেন সব ফেঁড়া থেকে পুঁজ বেরিয়ে গেছে।
এদিকে বউয়ের বিরুদ্ধে এক নতুন দল তৈরি হল আর তাতে যোগ দিল শার্গিদ-পেশার পুরুষেরা। কথায়-অকথায় যে বাবুর্চি একদিন তার পরোটা ভেজে দিত সে পায়খানার টব সাফ না-করার জন্যে গালি দিতে লাগল। ধোপার অভিযোগ সে মাড় লাগিয়ে কাপড় দড়িতে টাঙিয়ে দেয়, আর এই হারামজাদি ধুলো উড়িয়ে চলে যায়। যে ভিশৃতি তার হাত ধুইয়ে দেবার জন্য মশক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত আজ তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আঙিনায় জল ছিটাবার জন্যে বলে কিন্তু সে শোনে না, ফলে বউ শুকনো জমিতে ঝাড় দিয়ে দিলে চাপরাশি ধুলো ওড়ানোর জন্যে দোষারোপ করে তাকে গালি দিতে থাকে।
সে মাথা ঝুঁকিয়ে সকলের তিরস্কার এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। কে জানে বউ শাশুড়িকে গিয়ে কী বলে দিয়েছিল, ফলে বুড়ি ঠা-া করে সকলের মাথা খেয়ে ফেলত। এখন তার দৃষ্টিতে বউ একেবারে শুদ্ধ আর পুরোপুরি ভালো।
দাড়িওলা দারোগাজি হল সব চাকরদের সর্দার। বাবাকে সে আসল পরামর্শদাতা বলে মানত। সে একদিন বাবার কাছে হাজির হয়ে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে ভয়ানক বদমায়েশি আর শয়তানির কান্না কেঁদে বলল যে বউ আর রতীরাম অনুচিত সম্পর্ক সংস্থাপন করে সারা শার্গিদ-পেশাকে নোংরা করে দিয়েছে। বাবা মামলা সেশনে সোপর্দ করে দিলেন অর্থাৎ এতে লাগিয়ে দিলেন মাকে। মহিলাদের সভা ফের বসল আর বুড়িকে ডেকে আনিয়ে গালাগালি করা হল।
‘আরে হারামজাদি, তুই কি জানিস তোর ছিনাল-বউ কী বদমায়েশি করে বেড়াচ্ছে?’
মেথরানি এমনি ঝাপসাভাবে তাকাল যেন সে বুঝতেই পারছে না কার সম্পর্কে কথা হচ্ছে। আর যখন তাকে স্পষ্টাস্পষ্টি বলা হল যে চোখে-দেখা সাক্ষীদের বক্তব্য এই যে। বউ আর রতীরামের মধ্যে সম্পর্ক অশোভনীয় রকম খারাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে, দু’জনকে খুবই যাচ্ছেতাই অবস্থায় ধরা হয়েছে, তখন তার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষীদের ধন্যবাদ দেয়াই উচিত ছিল বুড়ির। উল্টে বিগড়ে গেল সে। ভারি ঝামেলা লাগিয়ে দিল। রামঅওতার আজ যদি এখানে থাকত তো যারা তার নিষ্কলঙ্ক বউয়ের ওপর কলঙ্ক লেপন করছে তাদের মজা দেখিয়ে দিত। বউ হারামজাদি তো এখন চুপচাপ, রামঅওতাদের কথা মনে করে চোখের জল ফেলছে। প্রাণ দিয়ে কাজকও করছে। কারুর কোনো অভিযোগ থাকতে পারে না। ঠাট্টা তো কেউ করছে না। লোকে নিছক তার দুশমন বনে গেছে। বুড়ি কাঁদতে শুরু করল। তাকে অনেক বোঝানো হল কিন্তু শোক করতে সে নিজেই এমন চোখ বুজে স্থির হয়ে আছে যেন সারা দুনিয়া তার জান নিতে উদ্যোগী হয়েছে। বুড়ি আর তার নিকলঙ্ক বউ লোকের কী ক্ষতিটা করেছে? সে তো কারোর কোনো-কিছুর মধ্যে নেই। বুড়ি নিজে তো সকলের সব রহস্য জানে কিন্তু আজ পর্যন্ত তো কারোর হাটে হাঁড়ি ভাঙেনি। তার কী দরকার কারোর ছিদ্র অন্বেষণ করার? কুঠিবাড়িগুলোর পেছনে কী-না হয়ে থাকে? মেথরানি কারোর ময়লা লুকিয়ে রাখে না। এই দুই বুড়ো হাতে বড়-বড় লোকের কত পাপ সে মাটিচাপা দিয়েছে। এই দুই হাত ইচ্ছে করলে এখন রানীর সিংহাসন উল্টে দিতে পারে। কিন্তু না। কারোর সঙ্গে তার কোনো শত্রুতা নেই। কিন্তু কেউ যদি তার গলায় ছুরি চালায় তো তাহলে সব-কিছু গড়বড় হয়ে যাবে, যেমন-তেমন কারো-না-কারো চাপা রহস্য আপন বুড়া কজে থেকে বের করে দেবার দরকার বোধ করি হবে না।
তার ভ্রুভঙ্গি দেখে শীঘ্রই ছুরি-চালানেওয়ালিদের হাত ঝুলে পড়ল। সব মহিলাই তার পক্ষ নিতে লাগল। বউ যাই করুক-না কেন তাদের নিজ-নিজ কেল্লা তো সুরক্ষিত আছে। তা হলে অভিযোগটা হয় কী করে? এবার কিছুদিনের জন্যে বউয়ের প্রেমটা কমে গেল। মানুষও ভুলে গেল ব্যাপারটা। কিন্তু রহস্যভেদকারীরা ধরে নিয়েছিল যে কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে। বউয়ের ভারিসারি শরীরও বেশিদিন গণ্ডগোল লুকিয়ে রাখতে পারল না। ফলে লোকে বুড়ির কাছে খুব হৈ-চৈ বাধিয়ে দিল। কিন্তু এই নতুন মামলায় বুড়ি বিলকুল হাবিজাবি বকতে লাগল। একেবারে এমনি হয়ে যেত যেন একদম শুনতেই পাচ্ছে না। এখন সে প্রায়ই খাটের উপর শুয়ে থেকে বউ আর রতীরামের ওপর হুকুম চালায়। কখনো কাশে, হাঁচে, বাইরে রোদে গিয়ে বসে। এখন ওরা দু’জনে বুড়ির এমনই দেখাশোনা করে যেন সে কোন পাটরানি।
ভালো-ভালো বউ-ঝিরা তাকে অনেক বুঝিয়েছে। রতীরামের মুখে কালি মাখাও। আর তারও আগে রামঅওতার ফিরে এসে বউয়ের চিকিৎসা করাক। সে তো নিজেই এই কৌশলে খুব নিপুণ। দু’দিনেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু বুড়ি কিছু বুঝতেই চাইল না। এদিকে-ওদিকে সকলের কাছে অভিযোগ করতে লাগল যে, তার হাঁটুতে আগের চেয়ে বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে। তার কারণ এইসব কুঠিবাড়িতে লোকে বেশি পরিমাণে নিষিদ্ধ দ্রব্য খেতে শুরু করেছে। কোনো-না-কোনো কুঠিতে পায়খানা লেগেই আছে। এতে টালমাটাল বুঝানোওয়ালারা জ্বলে-পুড়ে খাক হতে থাকে। মেনে নাও যে বউ মেয়েছেলের জাত, অজ্ঞ, বোকা। বড়-বড় সম্ভ্রান্ত মহিলার পদস্খলন হয়ে যায়, কিন্তু ওই বড়-বড় ঘরের ইজ্জতদার শাশুড়িরা তো কানে তেল দিয়ে বসে থাকে না। কিন্তু কে জানে কেন এই ষাট বছরের বুড়ি যে বিপদকে সে খুব সহজেই কুঠিবাড়ির জঞ্জালের নিচে কবর দিয়ে দিতে পারে, সে নিজেই এখন চোখ বুজে স্থির হয়ে আছে।
রামঅওতারের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় ছিল বুড়ি। সব সময়েই ধমক দিত– ‘রামঅওতারকে আসতে দাও। বলে দেব। তোদের হাড়মাস এক করে দেবে।’
আর এখন যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে রামঅওতার জীবন্ত ফিরে আসছে। সমস্ত পরিবেশটাই দম বন্ধ করে আছে। এক ভয়ংকর হাঙ্গামার অপেক্ষায় আছে লোকে।
কিন্তু লোকেদের খুব রাগ হল যখন বউ একটি ছেলের জন্ম দিল। কিন্তু তাকে বিষ দেবার বদলে বুড়ি খুব খুশি হয়ে উঠল। রামঅওতার চলে যাওয়ার দু’বছর বাদে ছেলে হবার পর বুড়ি একেবারেই চমকিত হয়নি। ঘরে ঘরে ফাটা-ছেঁড়া পুরনো কাপড় আর অভিনন্দন কুড়োতে লাগল সে। তার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষীরা তাকে হিসাব করে অনেক বুঝিয়েছিল যে, এই ছেলে রামঅওতারের হতেই পারে না, কিন্তু বুড়ি সবকিছু বুঝেও সব কথা নস্যাৎ করে দিল। বলল আষাঢ়ে রামঅওতার যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিল–তখন বুড়ি হলুদ কুঠির নয়া ঢঙের ইংরেজি পায়খানার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল, এখন চৈত্রমাস শুরু হয়েছে আর জ্যৈষ্ঠ মাসে বুড়িয়ার লু লেগেছিল কিন্তু খুব জোর বেঁচে গিয়েছিল সে। যখনই তার হাঁটুতে বেদনা বেড়ে যেত, সে বলত–বৈদ্যজি পুরো হারামি। ওষুধের মধ্যে খড়ি মিশিয়ে দেয়। এরপর সে আসল কথা থেকে সরে গিয়ে নষ্ট মেয়েছেলে আর বোকাদের মতো উল্টোপাল্টা বকতে শুরু করত। কারোর-কারো মাথায় এই কথা ঢুকেছিল যে, ওই চালাক বুড়িকে কিছুই বোঝানো যাবে না, কারণ সে না-বোঝার সিদ্ধান্ত করে বসে আছে।
ছেলেটা হবার পর সে রামঅওতারকে চিঠি লিখিয়েছিল। …রামঅওতার সমীপে, চুম্বন ও স্নেহ-সম্ভাষণের পরে অত্র সব কুশল জানিয়ে আর তোমার কুশল জানাইবে আর ভগবানের নিকট তোমার মঙ্গল প্রার্থনা করি আর তোমার ঘরে একটি পুত্রের জন্ম হইয়াছে সে-কারণে তুমি এই পত্রকে ‘তার বলিয়া জানিবে আর শীঘ্র আসিবে।’
লোকে ভেবেছিল রামঅওতার কিছুটা নারাজ হবে। কিন্তু সকলের আশায় ছাই পড়ল যখন রামঅওতারের খুশিতে ভরা পত্রে জানাল যে, সে ছেলের জন্য মোজা বেনিয়ান নিয়ে আসছে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল, এখনই তার আসার কথা। বুড়ি নাতিকে হাঁটুর ওপর শুইয়ে খাটের উপর বসে রাজত্ব করছিল। আচ্ছা, এর চেয়ে সুন্দর বার্ধক্য আর কী হতে পারে! সব কুঠির কাজ হয়ে যাচ্ছে ঝটপট। মহাজনের সুদ সময়মতো কায়দা-মাফিক চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে আর তার নাতি শুয়ে আছে হাঁটুর উপর।
শেষ পর্যন্ত লোকে ভেবে নিল, রামঅওতার যখন আসবে, আসল ব্যাপার বুঝতে পারবে, তখন দেখে নেয়া যাবে। এবার রামঅওতার যুদ্ধ জিতে আসছে। শেষতক ও তো সিপাহি বটে। রক্ত কেন গরম না-হবে? লোকের হৃদয় উৎসাহে ভরে উঠল। পেছনে মহলের বাতাবরণ বউয়ের সংকীর্ণ নজরের কারণে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। দু-চারটে খুন হবার আর নাক কাটবার আশায় জেগে উঠেছিল।
যখন রামঅওতার ফিরে এল তখন ছেলেটার বয়স বছরখানেক। পেছন হলে হৈ-চৈ লেগে গেল। বাবুর্চি হাঁড়িতে অনেক জল ঢেলে দিল, যাতে সে নিশ্চিন্ত হয়ে কচুক করে মজা খাকতে পারে। ধোপারা মাড়ের কড়াই নামিয়ে মাটিতে রেখে দিল আর ভিতি তার ডোল ফেলে দিল কুয়ার ধারে।
রামঅওতারকে দেখার সঙ্গে-সঙ্গেই বুড়ি তার কোমর ধরে চেঁচাতে শুরু করল। কিন্তু পরক্ষণেই দাঁত বের-করা ছেলেটাকে রামঅওতারের কোলে দিয়ে এমনি হাসতে শুরু করে দিল যেন সে কোনোদিন কাঁদেইনি।
রামঅওতার ছেলেটাকে দেখে এমন লজ্জা পেল যেন ছেলেটাই তার বাপ। ঝটপট বাক্স খুলে জিনিসপত্র নামাতে শুরু করেছিল সে। লোকে ভেবেছিল কুরি বা চাকু বের করছে কিন্তু সে যখন তা থেকে লাল বেনিয়ান আর হলদে মোজা বের করল, তখন সব চাকর-বাকরদের পৌরুষের ওপর যেন একটা জোর ঘা পড়ল।
‘ধেততেরিকে। শালা সিপাহি হয়েছে… আপাদমস্তক হিজড়া…।’ ওদিকে বউ সংকোচে এমনভাবে কুঁকড়ে ছিল যেন সে নববিবাহিতা বধূ। সে কাঁসার থালায় জল ভরে রামঅওতারের দুর্গন্ধভরা ফৌজি বুট খুলে নিয়ে পা ধুয়ে জল খেল।
রামঅওতারকে বুঝিয়েছিল লোকে। জ্রিপ করেছিল। তাকে বোকা-বুন্ধু বলেছিল, কিন্তু সে বোকার মতোই দাঁত বের করে থাকত যেন কিছুই সে বুঝতে পারছে না। রতীরামের দ্বিরাগমন হওয়ার কথা ছিল, সে দেরি না-করে চলে গেল।
রামঅওতারের এই কাজে লোকে যতটা আশ্চর্য হয়েছিল তার চেয়ে বেশি হয়েছিল ক্রুদ্ধ। আমাদের বাবা, যিনি সাধারণত চাকর-বাকরদের সম্পর্কে কৌতূহল দেখাতেন না, তিনিও কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলেন। সারা কানুনের জ্ঞান প্রয়োগ করে রামঅওতারকে জব্দ করার জন্যে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন।
‘কী রে, তুই তিন বছর পরে ফিরলি?’
‘হুজুর ঠিক খেয়াল নেই, কিছু কম-বেশি হতে পারে…’
‘আর তোর ছেলের বয়স বছরখানেক হবে।’
‘এতটাই তো মনে হয় হুজুর, কিন্তু শ্বশুর বড় বদমাশ…’
রামঅওতার লজ্জা পেয়েছিল।
‘আরে, তুই এখন হিসাব কর…’
‘হিসাব? কী হিসাব করব হুজুর?’ রামঅওতার মরা-মরা গলায় বলেছিল।
‘উল্লুকের বাচ্চা, এটা কী করে হল?’
‘আমি তা কেমন করে জানব, হুজুর। ভগবানের দান।‘
ভগবানের দান? তোর মাথা… এই ছেলে তোর হতে পারে না’… বাবা তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে জব্দ করতে চাইছিলেন, রামঅওতার ফের মরা-মরা গলায় বেকুবির সঙ্গে বলল–
তা আমি কী করব, হুজুর, হারামজাদিকে আমি খুব মেরেছি…’ ক্রোধভরে ছিটকে গিয়ে সে বলল।
‘আরে, তুই একেবারে উল্লুকের বাচ্চা… বদমায়েশ মাগীটাকে বাইরে বার করে দিসনি কেন?
‘না হুজুর, এ কি কখনো হতে পারে?’ রামঅওতার হে-হে করছিল।
‘কেন রে?’
হুজুর, আড়াইশ’-তিনশ’ টাকা আবার একটা বিয়ের জন্য কোথা থেকে আনব? আর ভাই-বেরাদারিকে খাওয়াতে একশ-দু’শ’ টাকা খরচা হয়ে যাবে…’
‘কেন রে, বেরাদারিকে কেন তোর খাওয়াতে হবে? বউয়ের বদমায়েশির জরিমানা কেন তোকে দিতে হবে?
তা আমি জানি না, হুজুর। আমাদের সমাজে এই রকমই হয়ে থাকে…’
‘কিন্তু ছেলেটা তোর নয়, রামঅওতার … ঐ হারামি রতীরামের।’ বাবা রেগে গিয়ে বোঝালেন।
তাতে কী হয়েছে, হজুর…রতীরাম আমার ভাইয়ের মতো–… অন্য কেউ তো নয়… নিজেরই রক্ত সম্পর্কের…
তুই একেবারে উলুকের বাচ্চা।’ বাবা খচে গিয়েছিল।
হুজুর, ছেলেটা বড় হয়ে আমার কাজ গুছিয়ে নেবে।’
রামঅওতার সবিনয়ে বোঝাল, ‘সে দুহাত লাগাবে, তখন বুড়ো বয়সের ভার কমে যাবে…’
রামঅওতারের মাথা লজ্জায় ঝুঁকে পড়ল। আর কে জানে কেন একদম রামঅওতারের সঙ্গে-সঙ্গে বাবার মাথাও ঝুঁকে গেল–যেন তার কাঠামোর ওপর লাখ-লাখ কোটি-কোটি হাত ছেয়ে গেল…এই হাতগুলো পাপপঙ্কিল নয়, শুদ্ধ। এ তো সেই জয়ী–সংগ্রামী হাত যা দুনিয়ার মুখ থেকে ময়লা ধুয়ে নিচ্ছে। তার বুড়ো বয়সের বোঝা তুলছে।
এই মাটিতে লেগে-থাকা কচি-কচি কালো হাত ধরিত্রীর সিথিতে সিঁদুর লাগিয়ে দিচ্ছে।
খুলে দাও – সাত হাসান মান্টো
অমৃতসর থেকে স্পেশাল ট্রেনটি দুপুর দু’টায় রওনা হয়ে আট ঘণ্টা পর মোঘলপুরা পৌঁছে। পথে কয়েকজন যাত্রী ক্রমাগত ট্রেনে হামলার ফলে প্রাণ হারায়; বহু যাত্রী হতাহত হয়। কিছুলোক দুষ্কৃতকারীদের হামলা থেকে কোনোমতে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে।
পরদিন সকাল ১০টা। আশ্রয়-শিবিরের ভিজে মাটিতে চোখ মেলে সিরাজউদ্দিন। চারদিকে অসংখ্য নারী-পুরুষ-শিশুদের ভিড় আর জনতার সমুদ্র দেখে তার চিন্তাশক্তি আরও শিথিল হয়ে পড়ে। অনেকক্ষণ সে এক-দৃষ্টিতে ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। উদ্বাস্তু শিবিরের হৈ-হল্লা কিছুই সিরাজউদ্দিনের কানে যায় না। তার স্মৃতিশক্তি বিলুপ্ত। কেউ তাকে দেখলে গভীর চিন্তায় মগ্ন বলে মনে করবে কিন্তু আসলে তা নয়; সে চারদিকের কোলাহলময় পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন অথচ সবকিছু যেন শূন্যে খেই হারিয়ে যাচ্ছে।
মেঘলা আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সিরাজউদ্দিন; সূর্যের আলোর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই তার দেহের অনুভূতিগুলো পুনঃসজীব ওঠে আর ফিরে আসে তার স্মৃতিশক্তি। তার চোখের সামনে দাঙ্গা, লুটতরাজ, আগুন, হুড়োহুড়ি, দৌড়, স্টেশন, গোলাগুলি অন্ধকার রাত্রি এবং মেয়ে সকিনা প্রভৃতি চিত্র একের পর এক ভেসে ওঠে। মুহূর্তে সিরাজউদ্দিন উঠে দাঁড়ায় এবং পাগলের মতো চারদিকে ইতস্তত জনতার ভিড়ে ঘুরতে থাকে।
তিন ঘণ্টা যাবৎ ‘সকিনা’ ‘সকিনা’ নাম ধরে ডেকে-ডেকে শিবিরে তোলপাড় করে চষে বেড়ায় সে। কিন্তু একমাত্র কন্যা সকিনার কোনো সন্ধান মেলে না। চারদিকে বিশৃঙ্খলা। কেউ তার সন্তানকে খুঁজছে, কেউ খুঁজছে মা, কেউ স্ত্রী বা কন্যাকে। সিরাজউদ্দিন পরাজিত ও ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে বসে পড়ে। কোথায় সে সকিনাকে হারিয়েছে তা স্মরণ করার চেষ্টা করে। তার স্ত্রীর মৃত্যুর ক্ষণটির কথা মনে পড়ে,–তার পেটের নাড়িভুড়ি বের হয়ে গিয়েছিল। এর বেশি সে ভাবতে পারে না।
সকিনার মা মারা গেছে। সে সিরাজউদ্দিনের চোখের সামনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। কিন্তু সকিনা কোথায়? মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর সকিনার মা মিনতি করেছে, আমার আশা ত্যাগ কর। সকিনাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালিয়ে যাও।’
সকিনা তার সঙ্গেই ছিল। দু’জনেই নগ্নপায়ে প্রাণ হাতে নিয়ে পালাচ্ছিল। সকিনার ওড়না পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। সিরাজউদ্দিন কুড়োতে গেলে সকিনা চিৎকার করে উঠেছিল, আব্বা, ওটা ছেড়ে দিন…।’ কিন্তু সে তবুও তা কুড়িয়ে নিয়ে কোটের পকেটে রেখেছিল। এ-সব কথা ভাবতে গিয়ে সে ধীরে-ধীরে পকেট থেকে সকিনার ওড়নাটা বের করে। এটা সকিনারই ওড়না; কিন্তু সে কোথায়?
সে শ্রান্ত স্মৃতিশক্তির ওপর অনেক চাপ দিয়েও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারল না। সে কি সকিনাকে তার সঙ্গে স্টেশন পর্যন্ত এনেছিল? তারা কি ট্রেনে উঠেছিল একসঙ্গে? পথে ট্রেন থেমেছে? গুণ্ডারা হামলা চালিয়েছে?
তার অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার সময় কি গুণ্ডারা সকিনাকে নিয়ে গেছে? মনে তার অনেক প্রশ্নের ভিড় জমে; কিন্তু তার কোনো জবাব পায় না সে।
তার সান্ত্বনার দরকার। কিন্তু চারদিকে হাজারো মানুষের প্রয়োজন একটি জিনিস, তা হল সান্ত্বনা। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে? সিরাজউদ্দিন কাঁদতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু হতভাগ্য চোখদুটি তাকে সাহায্য করে না। অশ্রু যেন শুকিয়ে গেছে।
ছয়দিন পর সিরাজের বোধশক্তি কিছুটা ফিরে আসে। এমন কয়েকজন লোকের সঙ্গে দেখা করে সে যারা তাকে সাহায্য করতে পারে; এরা আটজন যুবক। তাদের কাছে বন্দুক ও ট্রাক আছে। সিরাজউদ্দিন তাদের হাজার-হাজার আশীর্বাদ জানিয়ে সকিনার আকৃতি বর্ণনা করে, দেখতে ফর্সা, খুবই সুন্দরী, মায়ের সঙ্গে চেহারার মিল আছে… বয়স সতের’র কাছাকাছি, ডাগর-ডাগর চোখ… ডান গালে বড় একটি তিল… আমার একমাত্র কন্যা। ওকে খুঁজে দিলে খোদা তোমাদের মঙ্গল করবেন।’ তরুণ স্বেচ্ছাসেবকরা আবেগভরে বৃদ্ধকে আশ্বাসবাণী শোনায়, যদি তোমার মেয়ে বেঁচে থাকে, তাহলে কয়েকদিনের মধ্যে তাকে উদ্ধার করে তোমার কাছে হাজির করবই।’
একদিন ওরা অসহায়দের সাহায্যের জন্য অমৃতসর যাচ্ছিল; সড়কের উপর ‘ছেরাট্রার কাছে একটি তরুণীকে দেখতে পেল তারা। ট্রাকের শব্দ শুনে ভীত-সন্ত্রস্ত মেয়েটি পালিয়ে যেতে শুরু করল। স্বেচ্ছাসেবকরা গাড়ি থামিয়ে মেয়েটির পিছু ধাওয়া করল। কিছুদূর যাওয়ার পর মেয়েটাকে পাকড়াও করল একটি ক্ষেত থেকে। মেয়েটি সুন্দরী; ডান গালে মোটা কালো তিল। একজন স্বেচ্ছাসেবী প্রশ্ন করল, ভয় পেয়ো না, তোমার নাম কি সকিনা? মেয়েটির চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একটি বাক্যও তার মুখ দিয়ে বের হল না। স্বেচ্ছাসেবকরা ভরসা দিলে মেয়েটির ভয় দূর হল এবং স্বীকার করল সে সিরাজউদ্দিনের মেয়ে সকিনা।
আটজন স্বেচ্ছাসেবী যুবক তার জন্য অনেক কিছু করল। তাকে দুধ ও রুটি খেতে দিল, ট্রাকে তুলে নিল তারপর। দো-পাট্টার অভাবে সকিনা বারবার বাহু দিয়ে বুক ঢাকবার চেষ্টা করছিল দেখে একজন যুবক কোট খুলে সকিনাকে পরতে দিল।
বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। সিরাজউদ্দিন সকিনার কোনো সংবাদ পায়নি। সারাদিন ক্যাম্পে এবং বিভিন্ন অফিসে ঘুরঘুর করছে সে। কিন্তু কোনো খোঁজই পায়নি মেয়েটির। রাত গম্ভীর হলে সে স্বেচ্ছাসেবক দলটির সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করল। বেঁচে থাকলে তারা তার মেয়েকে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
একদিন সিরাজউদ্দিন স্বেচ্ছাসেবক দলটিকে ট্রাকে দেখতে পেল। ট্রাক তখন ছেড়েই। দিয়েছে; সে দৌড়ে গিয়ে তাদের কাছে জিজ্ঞেসা করল, বাবারা আমার, সকিনার কোনো খোঁজ পেয়েছ?’ তারা ট্রাক থামিয়ে সমস্বরে বলল, ‘চিন্তা কর না। চিন্তা কর না, পাওয়া যাবেই।’ ট্রাক ছেড়ে দিল।
সিরাজউদ্দিন আবার এই যুবকদের সাফল্যের জন্য মোনাজাত করল। এর ফলে তার মনটা অনেকখানি হাল্কা বোধ হল।
ক্যাম্পে সিরাজউদ্দিন বসে ছিল। পাশেই শোনা গেল কিসের হট্টগোল। চার জন লোক কী জানি বহন করে আনছে। জিজ্ঞাসার পর জানতে পারল, রেললাইনের ধারে অজ্ঞান অবস্থায় একটি মেয়ে পাওয়া গেছে। ওরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। সিরাজউদ্দিন তাদের পিছু পিছু হাসপাতালে গিয়ে হাজির হল। লোকগুলো হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে মেয়েটিকে ন্যস্ত করে চলে গেল।
বাইরে লাইটপোস্টে হেলান দিয়ে সিরাজউদ্দিন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধীরে-ধীরে হাসপাতালের ভেতরে গেল; কামরায় কেউ নেই। একটি স্ট্রেচারে মেয়েটির অচৈতন্য দেহ পড়ে আছে। হঠাৎ ঘরের বাতি জ্বলে উঠল। প্রাণহীন বিবর্ণ ডান গালে তিল দেখে সিরাজউদ্দিন চিৎকার করে উঠল সকিনা…।’
যে ডাক্তার ঘরে বাতি জ্বালিয়েছিলেন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার?’ উদ্বেলিত কণ্ঠে সিরাজ বলল, আমি… আমি ওর বাবা।
ডাক্তার স্ট্রেচারে শায়িতা মেয়েটির নাড়ি পরীক্ষা করে দেখলেন এবং সিরাজউদ্দিনকে নির্দেশ দিলেন, জানালা খুলে দাও। স্ট্রেচারে শায়িতা প্রাণহীন দেহ কেঁপে উঠল। কম্পিত হাতে ধীরে-ধীরে সে তার শওয়ারের দড়ির গিট খুলে নিচের দিকে নামিয়ে দিল।
বৃদ্ধ সিরাজউদ্দিন আনন্দে চিৎকার করে উঠল ‘ও বেঁচে আছে… আমার মেয়ে বেঁচে আছে। এই দৃশ্য দেখে ডাক্তারের আপাদমস্তক ঘামে ভিজে একাকার।
সর্দারজি – খাজা আহমদ আব্বাস।
খোদ দিল্লি আর তার আশপাশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চরমে উঠলে মুসলমানদের রক্তের কোনো মূল্য রইল না। আমি ভাবলাম, কী দুর্ভাগ্য! প্রতিবেশী প্রায় সবাই শিখ। ওদের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করব কি নিজের পেটেই কখন ছুরি চেপে বসে সেই ভয়ে সময় কাটতে লাগল। সত্যি কথা বলতে কি, শিখদের আমি খুব ভয় পাই, ঘৃণাও করি কিঞ্চিৎ। আমার মনে হয় ওরা এক অদ্ভুত জানোয়ার। এই মনে হওয়া সেই আমার ছোটবেলা থেকেই। তখন আমার বয়স বছর ছয়েক। একদিন এক শিখকে রোদে বসে চুল আঁচড়াতে দেখে চিৎকার করে উঠেছিলাম, দেখ, দেখ–মেয়েমানুষের মুখে কত লম্বা-লম্বা দাড়ি। বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে এই বোধ কেমন এক ধরনের ঘৃণায় রূপান্তরিত হয়। এই বোধটির অবশ্য পেছনে রয়েছে ১৮৫৭ সালের তিক্ত স্মৃতির স্মরণ। সে-সময় হিন্দু-মুসলমানের যৌথ স্বাধীনতা সংগ্রাম দমন করার জন্য পাঞ্জাবের শিখরাজ আর তাদের সেনাবাহিনী ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। এই কারণে একটা অস্পষ্ট ভীতি ও এক অদ্ভুত ধরনের ঘৃণা কেবল শিখ নয়, ইংরেজদের প্রতিও পোষণ করতাম। তবে শিখ-ঘৃণাটাই ছিল প্রবল; অন্যদিকে ইংরেজদের ভয় পেলেও তাদের প্রতি কিছুটা প্রতিবোধও ছিল আমার। মনে-প্রাণে আমি ইংরেজদের মতো কোর্ট-প্যান্ট পরতে চাইতাম। চাইতাম ওরা যেমন শ্লীলতাবোধশূন্য কথা-বার্তা চালিয়ে যায় সেভাবে। কথাবার্তা বলতে। তাছাড়া ওরা ছিল শাসক, আমিও চাইতাম ছোটখাটো একজন শাসক হতে। ওদের মতো কাটা-ছুরি-চামচ দিয়ে খাবার খাওয়ার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল খুব যাতে পৃথিবীর মানুষ আমাকেও কিছুটা সভ্যভব্য ভাবে। কিন্তু শিখদের যে ভয় করতাম সেটা ছিল অনেকটাই অবজ্ঞা-মিশ্রিত। অদ্ভুত সৃষ্টি এই শিখ–যারা পুরুষ হয়েও চুল রাখে মেয়েমানুষের মতো। ইংরেজি ফ্যাশনের অনুকরণে মাথার চুল ছোট অবশ্য আমি পছন্দ করি না–সেটা ভিন্ন কথা। আব্বা বলতেন, প্রতি শুক্রবার যেন মাথার চুল ছাঁট করি; তাহলে মাথায় খুস্কি হতে পারবে না। কিন্তু আমি সে কথা না-শুনে চুল এমন বড় করে রাখতাম যাতে তা হকি ও ফুটবল খেলার সময় ইংরেজ খেলোয়াড়দের মতো বাতাসে ওড়ে। আব্বা বলতেন, একি! তুই যে মেয়েদের মতো চুল লম্বা রেখেছিস! কিন্তু আব্বা তো পুরনো চিন্তাধারার মানুষ, তার কথা কে শোনে। তিনি তো পারলে ছোটবেলাতেই আমাদের মুখে দাড়ি গজিয়ে দেন। ও হ্যাঁ, মনে পড়ল, শিখদের আর একটা অদ্ভুত নিদর্শন হল তাদের দাড়ি। আমার দাদার দাড়ি ছিল কয়েক ফুট লম্বা। তিনি সে দাড়িতে চিরুনি ব্যবহার করতেন। কিন্তু দাদাজানের ব্যাপার ভিন্নতম। যতকিছুই হোক তিনি আমার দাদাজান, আর শিখরা শিখ।
ম্যাট্রিক পাস করার পর আমাকে পড়ালেখার জন্যে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। কলেজে যে-সব পাঞ্জাবি ছেলে পড়ত আমরা অর্থাৎ দিল্লি ইউপির ছেলেরা তাদেরকে নীচ, মূর্খ এবং বখাটে মনে করতাম। ওরা কথা বলার নিয়মও জানত না। পানাহারের মধ্যেও কোনো রুচিজ্ঞান ছিল না। সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। একগুঁয়ে অভদ্রের একশেষ। লাসসির বড়-বড় গ্লাস সাবাড়কারীরা কেওড়াদার ফালুদা ও সিফটন চায়ের স্বাদ কী বুঝবে! তাদের ভাষা নিতান্ত অমার্জিত। কথা বলার সময় মনে হয় যেন ঝগড়া করছে। কথায়-কথায় তুই-তোকারি এই-সেই। আমি সব সময় এসব পাঞ্জাবিদের এড়িয়ে চলতাম। কিন্তু আমাদের ওয়ার্ডেন সাহেব খোদা তার মঙ্গল করুন–হঠাৎ করেই আমার কামরায় একজন পাঞ্জাবি ছাত্রকে জায়গা। দিলেন। আমি ভাবলাম, কী আর করা, একত্রে যখন থাকতে হবে কিঞ্চিৎ ভাব পাতিয়েই থাকা যাক। এভাবে থাকতে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে তার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতাই গড়ে উঠল। তার নাম গোলাম রসুল। রাওয়ালপিন্ডিতে বাড়ি। বেশ রসিক ছেলে। আমাকে প্রায়ই চুটকি শোনাত।
আপনারা এখন বলবেন, সর্দার সাহেবের কথা শোনাতে গিয়ে আবার এই গোলাম রসুল কোথা থেকে এসে পড়ল। কিন্তু আসলে এ কাহিনীর সঙ্গে গোলাম রসুলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কথা হচ্ছে যে, গোলাম রসুল যে-সব চুটকি শোনাত সেগুলো প্রায়ই শিখদের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেসব চুটকি শুনে-শুনে শিখদের স্বভাব-চরিত্র রুচি-বৈশিষ্ট্য ও সামগ্রিক চরিত্র সম্পর্কে আমি যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করেছিলাম।
যেমন ধরুন গোলাম রসুল বলত, সব শিখই বেকুব এবং বুন্ধু। দুপুর বারোটা বাজলেই তাদের বিবেকবুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। এ-সম্পর্কে অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। যেমন একজন সর্দারজি সাইকেলে আরোহণ করে দুপুর বারোটায় অমৃতসরের হল বাজার দিয়ে যাচ্ছিল। চৌরাস্তায় একজন শিখ কনস্টেবল তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল তোমার সাইকেলের লাইট কোথায়? সাইকেল আরোহী সর্দারজি বিনয়ে বিগলিত কণ্ঠে বলল, জমাদার সাহেব, এই একটু আগে নিভে গেছে। বাড়ি থেকে তো জ্বালিয়েই বেরিয়েছিলাম! কনস্টেবলটি তখন সর্দারজিকে থানায় চালান দেয়ার হুমকি দিল।
অন্য একজন পথচারী শুভ্র-শ্মশ্রু শিখ সর্দারের মধ্যস্থতা করে বললেন, যাও ভাই, গোলমাল কর না। লাইট যদি নিভে গিয়ে থাকে এখন জ্বালিয়ে নাও, ব্যস।
এ ধরনের বহু গল্প গোলাম রসুলের জানা ছিল। পাঞ্জাবি ভাষার সংমিশ্রণে সে যখন এসব গল্প শোনাত তখন হাসতে-হাসতে আমাদের পেটে খিল ধরে যেত। আসলে পাঞ্জাবি ভাষায়ই সে-সব গল্প শুনে মজা পাওয়া যেত। কারণ, শিখদের অদ্ভুত ও উদ্ভট তৎপরতা বর্ণনা করার জন্যে পাঞ্জাবির মতো উটকো ভাষাই ছিল মানানসই।
সে থাকগে। অন্যের চালচলন নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা করে লাভ নেই! কিন্তু শিখদের সবচেয়ে বড় দোষ হল ওরা ঔদ্ধত-হঠকারিতা-মারদাঙ্গা করে মুসলমানদের মোকাবেলা করতে সাহস দেখাত। এখন তো পৃথিবী জেনেই গেছে যে, একজন মুসলমান দশজন হিন্দু বা শিখের সমান। কিন্তু মুসলমানদের এ শক্তিমত্তা তারা স্বীকার করত না। তারা কৃপাণ ঝুলিয়ে গোঁফে এমনকি দাড়িতে তা দিয়ে চলত। গোলাম রসুল বলত, ওদেরকে একদিন আমরা এমন শিক্ষা দেব যে, জীবনভর মনে থাকবে।
কলেজ ছাড়ার পর কয়েক বছর কেটে গেল। ছাত্র থেকে ক্লার্ক, ক্লার্ক থেকে হেড ক্লার্ক পদে উন্নীত হলাম। আলিগড় ছাত্রাবাস ছেড়ে নয়াদিল্লিতে একটা সরকারি কোয়ার্টারে থাকি। বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলে-মেয়েও হয়েছে। রাওয়ালপিন্ডি থেকে বদলি হয়ে আমার মুখোমুখি কোয়ার্টারে একজন শিখ সর্দার এসে উঠলে বহুদিন পর গোলাম রসুলের কথা আমার মনে পড়ল। গোলাম রসুলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী রাওয়ালপিভিতে শিখদের আচ্ছাসে ধোলাই দেয়া হয়েছে। মুজাহিদরা শিখদের নির্মূল অভিযান শুরু করেছিল। শিখরা সেখানে দারুণ দাপট দেখাচ্ছিল, মুসলমানদের সামনে সেসব দাপট টেকেনি। দাড়ি কামিয়ে অনেক শিখকে মুসলমান করা হয়েছে, অনেককে খত্না করিয়ে দেয়া হয়েছে জোর করে। হিন্দুদের সংবাদপত্রে মুসলমানদের দুর্নাম রটানোর জন্যে লেখা হচ্ছিল যে, মুসলমানেরা, শিখ নারী ও শিশুদেরকেও হত্যা করেছে। অথচ এটা ইসলামি ঐতিহ্য পরিপন্থী। মুসলিম মুজাহিদরা কখনো নারী ও শিশুদের ওপর হাত তোলেনি। হিন্দুদের সংবাদপত্রে যেসব শিখ নারী ও শিশুর ছবি ছাপা হয়েছে সেগুলো ছিল হয় জাল ছবি অথবা শিখরা মুসলমানদের দুর্নাম রটানোর জন্যে নিজেরাই নিজেদের নারী ও শিশুকে হত্যা করে পত্রিকায় ছেপেছিল। রাওয়ালপিন্ডি এবং পশ্চিম পাঞ্জাবের মুসলমানদের এ অপবাদও দেয়া হচ্ছিল যে, তারা হিন্দু ও শিখ মেয়েদের অপহরণ করেছে। অথচ ঘটনা এই যে, মুসলমানদের বীরত্ব দেখে শিখ মেয়েরা মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে তাদের সঙ্গে চলে গেছে। এমতাবস্থায় ওরা যদি মুসলমানদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় পালিয়ে যায় তাতে মুসলমানদের দোষটা কোথায়? তারা তো ইসলাম প্রচারের অংশ হিসেবেই সে সব মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছে।
সে যাই হোক, শিখদের তথাকথিত বীরত্বের চেহারা এখন পাল্টে গেছে। এখন কৃপাণ বের করে মুসলমানদের হুমকি দেয়া দূরে থাক রাওয়ালপিন্ডি থেকে পালিয়ে আসা সর্দারের দুরবস্থা দেখে ইসলামের গৌরবে বুক ফুলে উঠল আমার।
আমার প্রতিবেশী সর্দারজির বয়স ষাটের কাছাকাছি। দাড়ি সব শাদা হয়ে গেছে। তিনি মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এসেছেন। ভদ্রলোক সব সময় দাঁত বের করে হাসতেন। তাঁর এ হাসি দেখেই বুঝেছিলাম লোকটা আসলে বেকুব এবং নির্বোধ। প্রথম দিকে তিনি আমার সঙ্গে মিতালি পাতাতে চেয়েছিলেন। যাওয়া-আসার সময় গায়ে পড়ে আলাপ করা শিখদের এক আজব রীতি। সেদিন তো বাসায় প্রসাদের মিষ্টান্নই পাঠিয়ে দিলেন। (আমার স্ত্রী সে মিষ্টান্ত সঙ্গে-সঙ্গে মেথরানিকে দিয়ে দিয়েছে) আমি আর বন্ধুত্বের ফাঁদে ধরা দিইনি, কখনো কিছু জিজ্ঞেস করলে মামুলিভাবে দু-একটা কথা জবাব দিয়ে চুপচাপ কেটে পড়েছি। আমি জানতাম ভালোভাবে কথা বললে এ লোক আমার পিছু নেবে। আজ ভালোভাবে আলাপ করবে, কালই গালাগালি শুরু করবে। আপনারা তো জানেন। যে, গালাগালি শিখদের ডাল-রুটি। এ-ধরনের লোকের সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে কে নিজের মুখ খারাপ করবে? একদিন দুপুরে আমি গিন্নিকে শিখদের নির্বুদ্ধিতার কাহিনী শোনাচ্ছিলাম। বাস্তব প্রমাণ দেয়ার উদ্দেশ্যে আমি ঠিক বারোটায় আমার ভূত্যকে সর্দারজির বাসার ঘড়িতে কটা বাজে জিজ্ঞেস করার জন্যে পাঠালাম। সর্দারজি ভৃত্যকে বললেন, বারোটা দুমিনিট। আমি গিন্নিকে বললাম, দেখলে তো বারোটা বাজার নাম নিতেই ভয় পাচ্ছে। এ-কথা বলে আমি একচোট হাসলাম, গিন্নিও হাসল। আমি মাঝে-মাঝে অপ্রস্তুত করার জন্যে সর্দারজিকে জিজ্ঞেস করতাম, কেমন সর্দারজি, বারোটা বেজে গেছে? তিনি নির্লজ্জভাবে দাঁত বের করে জবাব দিতেন–জ্বী, আমাদের এখানে চব্বিশ ঘণ্টাই বারোটা বেজে থাকে। এ-কথা বলে খুব হাসতেন–যেন বড় একটা রসিকতা করতে পেরেছেন।
শিশুদের ব্যাপারে সব সময় ভয়ে-ভয়ে থাকতাম। একে তো কোনো শিখের ওপরই আস্থা রাখা যায় না। শিশুদের গলায় কখন কৃপাণ চালিয়ে দেবে কে জানে! তাছাড়া এরা রাওয়ালপিন্ডি থেকে এসেছে। মুসলমানদের প্রতি এমনিতেই মনে-মনে নিশ্চয়ই ঘৃণা পোষণ করে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে ওঁত পেতে থেকে সুযোগ খুঁজবে। স্ত্রীকে আমি সতর্ক করে দিয়েছিলাম শিশুদের যেন সর্দারজির কোয়ার্টারের দিকে যেতে দেয়া না হয়। কিন্তু শিশুরা তো শিশুই। ক’দিন পর দেখি, আমার ছেলে-মেয়েরা সর্দারজির ছোট মেয়ে মোহিনী এবং তার নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খেলা করছে। বড়জোর দশ বছর বয়সের মোহিনী আসলেই ছিল মোহিনী। গৌরবর্ণ চমৎকার চেহারা। হতভাগাদের মেয়েরা দারুণ সুন্দরীও হয়। আমার মনে পড়ল, গোলাম রসুল বলত, পাঞ্জাব থেকে শিখ পুরুষরা চলে গিয়ে যদি মেয়েদের রেখে যেত তাহলে হুর-এর সন্ধান করার প্রয়োজন হত না। আমার সন্তানদের সর্দারজির মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খেলতে দেখে আমি ওদের টেনে বাসায় নিয়ে এলাম। তারপর খুব মারলাম। এরপর অন্তত আমার চোখের সামনে কখনো ওদের আর ওদিকে যেতে দেখিনি।
খুব অল্প সময়ে শিখদের আসল চেহারা প্রকাশ হয়ে পড়ল। রাওয়ালপিন্ডি থেকে সুড়সুড় করে পালিয়ে এসে, পাঞ্জাবের মুসলমানদের সংখ্যায় কম পেয়ে তাদের ওপর নৃশংস অত্যাচার শুরু করে দিল। শত-শত এমনকি হাজার-হাজার মুসলমানকে তাদের হাতে শহীদ হতে হল। নদীর স্রোতের মতো প্রবাহিত হল মুসলমানকে রক্ত। হাজার-হাজার মুসলিম মেয়ে ও মহিলাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে মিছিল বের করল ওরা। এ-সব কারণে পূর্ব পাঞ্জাব থেকে বহুসংখ্যক মুসলমান দিল্লিতে আসতে শুরু করল। তার ঢেউ এই দিল্লিতে আমার এখানে এসে পৌঁছান ছিল নিতান্ত স্বাভাবিক। আমার পাকিস্তান যাওয়ার তখনো কয়েক সপ্তাহ বাকি। এ কারণে বড় ভাইয়ের সাথে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের বিমানযোগে করাচি পাঠিয়ে দিয়ে নিজে খোদা ভরসা করে থেকে গিয়েছিলাম। উড়োজাহাজে বেশি জিনিসপত্র নেয়া যায় না। এ-কারণে আমি একটা পুরো ওয়াগন বুক করেছিলাম। কিন্তু যেদিন জিনিসপত্র ওয়াগনে তুলব সেদিনই শুনলাম পাকিস্তানি গাড়িতে হামলা করা হচ্ছে। ফলে ঘরের জিনিসপত্র রইল ঘরেই।
১৫ আগস্ট স্বাধীনতা উৎসব পালন করা হল। কিন্তু এ স্বাধীনতার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি ছুটি পালন করলাম। সারাদিন শুয়ে-শুয়ে ‘ডন’ আর ‘পাকিস্তান টাইমস’ পড়ে কাটালাম। উভয় পত্রিকায় ভারতের এ তথাকথিত স্বাধীনতার তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। প্রমাণ দেয়া হয়েছে কী করে ইংরেজ ও হিন্দুরা যোগসাজশ করে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কেবল কায়েদে আজমের বুদ্ধিমত্তার কারণেই আমরা পাকিস্তান অর্জন করেছি। যদিও হিন্দু ও শিখদের চাপের মুখে ইংরেজরা অমৃতসর ভারতকে দিয়ে দিয়েছে তবু দুনিয়ার সবাই জানে যে-অমৃতসর খাঁটি ইসলামি শহর, এখানকার স্বর্ণ-মসজিদ বিশ্ববিখ্যাত। সেখানে কোনো গুরুদোয়ারা নেই যে, তাকে গোল্ডেন টেম্পল বলা যাবে। মসজিদ তো দিল্লিতেও রয়েছে; শুধু স্বর্ণ মসজিদই নয়, জামে মসজিদ, লালকেল্লা, নিজামুদ্দিন আওলিয়ার মাজার, হুমায়ুনের সমাধিসৌধ, সফদার জঙ্গ-এর মাদ্রাসা রয়েছে এখানে। মোটকথা দিল্লির আনাচে-কানাচে মুসলিম শাসনামলের নিদর্শনে ভরা। তবুও আজ সেই দিল্লি বরং বলা উচিত শাহজাহানাবাদে আজ হিন্দু সাম্রাজ্যবাদের পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে। আমি আবেগরুদ্ধ হৃদয়ে ভাবলাম, এই দিল্লি ছিল এক সময় মুসলমানদের রাজসিংহাসনের জায়গা, সভ্যতা-সংস্কৃতির পাদপীঠ। এই দিল্লি আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। আর আমাদের পাঠানো হচ্ছে পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান প্রভৃতি বিরান, অনুন্নত, অসংস্কৃত অঞ্চলসমূহে জোরপূর্বক। এ-সব এলাকায় মার্জিত উর্দুতে কেউ কথা পর্যন্ত বলতে জানে না। সালোয়ারের মতো হাস্যকর পোশাক পরে সেখানকার মানুষ। হালকা-পাতলা চাপাতির বদলে দু সের ওজনের নানরুটি খায়। এসব ভেবেও নিজের মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম যে, কায়েদে আজম এবং পাকিস্তানের জন্যে এ-ত্যাগ স্বীকার আমাদের করতেই হবে। কিন্তু তবুও দিল্লি হাত ছাড়া হওয়ার চিন্তায় মনটা বিষণ্ণ-বিমর্ষ হয়েই রইল। বিকেলে আমি বাইরে বেরোলাম। সর্দারজি দাঁত বের করে বললেন, কেমন বাবুজি, আজ উৎসব পালন করোনি? আমার ইচ্ছে হল তার দাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিই। শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতা গৌরবচিত্ত শিখদের মনে রং ধরাল। পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আগত উদ্বাস্তুর সংখ্যা হাজারের অঙ্ক ছেড়ে লাখের ঘরে গিয়ে পৌঁছুল। এসব লোক আসলে পাকিস্তানের দুর্নাম রটানোর জন্যে ঘর-বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ওখান থেকে পালিয়ে এসেছে। এখানে এসে সর্বত্র নিজেদের দুঃখের কাহিনী শোনাচ্ছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে কংগ্রেসি প্রোপাগান্ডা জোরেশোরে চলছে। কংগ্রেসিরা কৌশল গ্রহণ করেছে যে কংগ্রেসের নাম না-নিয়ে রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ এবং শহীদী দিল নাম নিয়ে কাজ করতে হবে। অথচ এটা তো সবাই জানে যে, এই হিন্দুরা কংগ্রেসী মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। পৃথিবীর মানুষকে ধোকা দেওয়ার জন্যে তারা প্রয়োজন হলে গান্ধী এবং জওহরলাল নেহরুকে লোক দেখানো গালি দিতেও দ্বিধা করে না।
একদিন সকালে খবর এল যে, দিল্লিতে মুসলিম গণহত্যা শুরু হয়ে গেছে। কুরলবাগ এলাকায় মুসলমানদের বহু বাড়ি-ঘর ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। চাঁদনি চকে মুসলমানদের দোকানপাট লুণ্ঠন করে তাদের পাইকারিভাবে হত্যা করা হয়েছে। এটা। হল কংগ্রেসের হিন্দু-রাজত্বের নমুনা। যাক সে কথা। আমি ভাবলাম নয়াদিল্লি তো বহুকাল ধরে ইংরেজদের শহর ছিল–লর্ড মাউন্টব্যাটেন, কমান্ডার-ইন-চিফ এখানে থাকেন। অন্ততপক্ষে তারা মুসলমানদের ওপর এ-ধরনের অত্যাচার হতে দেবেন না। এটা ভেবে আমি নিজের অফিসের পথে পা বাড়ালাম। সেদিন আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের। হিসাব হওয়ার কথা। আসলে এ-কারণেই আমি পাকিস্তানে যেতে দেরি করছিলাম। গোল মার্কেটের কাছে পৌঁছতেই অফিসের একজন হিন্দু বাবু বললেন, এ কী করছ, যাও, যাও বাসায় যাও, বাইরে বেরিয়ো না। কনট প্লেসে দাঙ্গাকারীরা মুসলমানদের মেরেছে। এ-কথা শুনে আমি বাসায় ফিরে এলাম।
বাসার সামনে আসতেই সর্দারজির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি বললেন, শেখজি, চিন্তা করবেন না। আমি যতক্ষণ সহি-সালামতে আছি, কেউ আপনাকে হাত লাগাতে পারবে না। আমি ভাবলাম, শিখের ওই দাড়ির আড়ালে কত শয়তানি লুকিয়ে আছে কে জানে। মনে-মনে খুব খুশি যে, মুসলমানদের পাইকারিভাবে নিধন করা হচ্ছে অথচ মৌখিক সহানুভূতি দেখিয়ে আমার প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করছে। আসলে আমাকে চটানোর জন্যেই এ-ধরনের কথা বলছে। কেননা এই এলাকায় আমিই একমাত্র মুসলমান।
কিন্তু আমি কাফেরদের কোনো অনুগ্রহের প্রত্যাশী নই। এটা ভেবে নিজের ঘরে এলাম। ভাবলাম যদি মরেও যাই দশ-বিশটাকে মেরে মরব। সোজা কামরায় প্রবেশ করে পালঙ্কের নিচে উঁকি দিলাম–সেখানে আমার দোলা শিকারি বন্দুক রয়েছে। দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর থেকে আমি প্রচুর গুলি ও কার্তুজ সংগ্রহ করে রেখেছি। কিন্তু এ ক! পালঙ্কের নিচে বন্দুক নেই। সব কামরা তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও বন্দুক পাওয়া গেল না।
হুজুর, আপনি কী খুঁজছেন। আমার অনুগত বিশ্বস্ত ভৃত্য মামদো জিজ্ঞেস করল।
আমার বন্দুক কোথায় গেল?
মামদো কোনো জবাব দিল না। কিন্তু তার মুখভাব বলে দিচ্ছিল, সে জানে বন্দুক কোথায় আছে। হয়তো সে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে।
বলছিস-না কেন? আমি ধমক দিয়ে বললাম।
ধমক দেয়ায় জানা গেল–মামদো আমার বন্দুক চুরি করে তার বন্ধুদের দিয়েছে। ওরা দরিয়াগঞ্জে মুসলমানদের হেফাজতের উদ্দেশ্যে অস্ত্র সংগ্রহ করছে।
আমাদের কাছে কয়েকশ’ বন্দুক আছে হুজুর। সাতটি আছে মেশিনগান। দশটি রিভলবার। একটি তোপ। কাফেরদের ভুনা করে ফেলব। ভুনা।
আমি বললাম, দরিয়াগঞ্জে আমার বন্দুক দিয়ে কাফেরদের ভুনা করলে এখানে আমার আত্মরক্ষার উপায় কীভাবে হবে? আমি তো এখানে কাফেরদের দঙ্গলের মধ্যে আটকা পড়ে আছি। এখানে আমাকে ধুনো দেয়া হলে কে দায়ী হবে?
মামদোকে বললাম, কোনো-না-কোনোভাবে চুপিসারে তুমি দরিয়াগঞ্জে যাও। সেখান থেকে আমার জন্যে একটা বন্দুক এবং শ’ দুয়েক কার্তুজ নিয়ে এস।
মামদো চলে যাওয়ার পর আমার স্থির বিশ্বাস হল যে, সে আর ফিরে আসবে না।
এখন আমি বাসায় সম্পূর্ণ একাকী। সামনের কার্নিশে স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের ফটো নীরবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে আমার চোখে পানি এসে গেল। ভাবলাম তাদের সাথে আর দেখা হবে কিনা কে জানে।
পরে এটুকু ভেবে স্বস্তিবোধ করলাম যে, তারা তো অন্তত ভালোয়-ভালোয় পাকিস্তান পৌঁছে গেছে। আমি যদি প্রভিডেন্ট ফান্ডের লোভ না-করে আগেই চলে যেতাম তাহলে কী ভালোই-না হতো! এখন আর আফসোস করে কী হবে?
সাতশ্রী আকাল হর হর মহাদেব!
দূর থেকে কোরাসকণ্ঠের আওয়াজ ক্রমেই নিকটতর হচ্ছিল। এরা দাঙ্গাকারী। আমার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। আহত হরিণের মতো আমি এদিক-ওদিক তাকালাম। সেই আহত হরিণ গুলিবিদ্ধ হয়েছে, তার পেছনে লেগে আছে শিকারি কুকুর। আত্মরক্ষার আর কোনো উপায় নেই। কামরার দরজা পাতলা কাঠের তৈরি। ওপরের দিকে গ্রাস ফিট করা। আমি দরজা বন্ধ করে বসে থাকলেও দু’মিনিটের মধ্যেই দাঙ্গাকারীরা দরজা ভেঙে ভেতরে চলে আসবে।
সাতশ্রী আকাল হর হর মহাদেব–এ-আওয়াজ ক্রমেই নিকটতর হচ্ছিল।
হঠাৎ দরজায় করাঘাত হল। সর্দারজি ভেতরে প্রবেশ করে বললেন, শেখজি, তুমি আমাদের ঘরে চল। তাড়াতাড়ি কর। কিছু চিন্তা-ভাবনা না-করেই সর্দারজিকে অনুসরণ করলাম। পেছনের দিকের বারান্দায় আমাকে লুকিয়ে রাখা হল। মৃত্যুর গুলি শন করে আমার মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। কারণ আমি সর্দারজির ঘরে প্রবেশ করার পর-পরই আমাদের বাসার সামনে এসে থামল একটা লরি। সে লরি থেকে দশ-পনেরো জন যুবক নামল। যুবকদের মধ্যে নেতা-গোছের একজনের হাতে টাইপ করা একটা কাগজে নামের তালিকা রয়েছে। ৮নং কোয়ার্টারে শেখ বোরহান উদ্দিন কাগজের উপর তাকিয়ে যুবনেতা উচ্চারণ করল। উচ্ছখল যুবকরা পরক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার কোয়ার্টারে। আমার চেয়ার, টেবিল, সিন্দুক, বই-পুস্তক ইত্যাদি এমনকি আমার ময়লা জামা-কাপড় সবকিছু লরিতে নিয়ে তোলা হয়।
.
ডাকাত!
লুটেরা!
দস্যু!
ভাবলাম সর্দারজি বাহ্যিক সহানুভূতি দেখিয়ে আমাকে যে এখানে নিয়ে এলেন তিনিই কি কম লুটেরা? তিনি দাঙ্গাকারীদের বললেন, থামো, থামো, এ-ঘরের ওপর আমার অধিকার বেশি রয়েছে। এ-লুণ্ঠনে অংশ নেয়ার অধিকার আমারও পাওয়া দরকার। এ-কথা বলেই তিনি নিজের ছেলে-মেয়েদের ইঙ্গিত করলেন। তারাও লুণ্ঠনে প্রবৃত্ত হল। কেউ প্যান্ট নিয়ে গেল, কেউ স্যুটকেস, কেউ আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের ছবি। এসব গনিমতের মাল সোজা অন্দরমহলে চলে যাচ্ছে।
মনে-মনে ভাবলাম যদি বেঁচে থাকি তবে, ওরে সর্দার, তোর সঙ্গে বোঝাপড়া হবে। কিন্তু এখন তো আমি টু শব্দও করতে পারছি না। সশস্ত্র দাঙ্গাকারীরা আমার কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে। যদি তারা জানতে পারে যে আমি এখানে আছি
‘এস, ভেতরে এস।’ হঠাৎ দেখি সর্দারজি নগ্ন তলোয়ার হাতে নিয়ে আমাকে বাড়ির ভেতরে ডাকছেন। আমি বৃদ্ধের চেহারার দিকে তাকালাম। লুটপাটে অংশ নেয়ার ছুটোছুটিতে তার চেহারা আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তার হাতের চকচক করা কৃপাণ আমাকে মৃত্যুর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
কথা বলার সময় নেই। যদি আমি কিছু বলি এবং দাঙ্গাকারীরা শুনতে পায় তাহলে একটা গুলি আমার বুক ভেদ করে যাবে।
কৃপাণ এবং বন্দুকের মধ্যে যে কোনো একটা বেছে নিতে হবে। দাঙ্গাবাজ দশটি যুবকের চেয়ে একজন বৃদ্ধের কৃপাণ অনেক ভালো। আমি নীরবে কামরায় প্রবেশ করলাম।
ওখানে নয়, ভেতরে এস।
আমি ভেতরের দিকের একটি কামরায় গেলাম। মনে হচ্ছিল, কসাইখানায় করি প্রবেশ করছে। আমার চোখ কৃপাণের তীক্ষ্ণ ধারে ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।
এই নাও তোমার জিনিসপত্র। এ-কথা বলে সর্দারজি নিজে এবং তার ছেলেমেয়েরা মিছেমিছি লুণ্ঠিত দ্রব্যাদি আমার সামনে এনে রাখল।
সর্দার-গিন্নি বললেন, বাবা তোমার কোনো জিনিসই বলতে গেলে রক্ষা করতে পারলাম না।
আমি কোনো কথা বললাম না। হঠাৎ বাইরে ঝনঝন শব্দ শোনা গেলে। সাঙ্গাকারীরা আমার লোহার আলমারি বাইরে বের করে সেটি ভাঙার চেষ্টা করছে।
একজন বলল, এর চাবি পাওয়া গেল সহজে ঝামেলা মিটে যেত। অন্যজন বলল, এর চাবি তো পাকিস্তানে পাওয়া যাবে। ভীরু তো, তাই পালিয়ে গেছে। মুসলমানের বাচ্চা হলে তো মোকাবেলা করত!
ছোট্ট মোহিনী আমার স্ত্রীর কয়েকটি রেশমি কামিজ এবং ঘাঘরা দাঙ্গাকারীদের কবল থেকে কেড়ে নিচ্ছিল। ওদের উক্তি শুনে সে বলল, হু হু! তোমরা বড় বাহাদুর বটে! শেখজি ভীরু হতে যাবেন কেন? তিনি তো পাকিস্তানে যাননি।’
একজন যুবক বলল, যদি না-ও গিয়ে থাকে তবে এখানে কোথাও মুখ কালো করে লুকিয়ে আছে।
মুখ কালো করে লুকোবে কেন, উনি তো আমাদের এখানে।
আমার হৃৎস্পন্দন মুহূর্তের জন্যে থেমে গেল। মোহিনী নিজের ভুল বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে রইল। কিন্তু দাঙ্গাবাজদের জন্যে এটুকু তথ্যই যথেষ্ট।
সর্দারজির মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল। তিনি আমাকে ভেতরের অন্য একটা কামরায় ঢুকিয়ে দিয়ে দরজায় হুক লাগিয়ে দিলেন। তারপর নিজের পুত্রকে কৃপাণ হাতে দরজায় রেখে নিজে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে কী হল আমি তখনো ভালোভাবে বুঝতে পারিনি। তবে চড়-থাপ্পড় এবং পরক্ষণে মোহিনীর কান্না শোনা গেল। তারপর পাঞ্জাবি ভাষায় সর্দারজির মুখ নিঃসৃত অশ্লীল খিস্তি-খেউড়। বুঝতে পারলাম যে, কাকে এবং কেন তিনি গালি দিচ্ছেন। আমি চারদিক থেকে বন্দি ছিলাম, এ কারণে সঠিক কিছু শুনতে পেলাম না।
কিছুক্ষণ পর গুলিবর্ষণের আওয়াজ শোনা গেল। সর্দার-গিন্নি তীব্র আর্তনাদ করে উঠলেন।
লরির ঘরঘর আওয়াজ শোনা গেল ক্ষণিক পরেই। সমগ্র বিল্ডিং এলাকায় নৈঃশব্দ ছেয়ে গেল। আমাকে কক্ষবন্দি অবস্থা থেকে বের করার পর দেখি সর্দারজি পালঙ্কের উপরে পড়ে আছেন, তার বুকের কাছাকাছি জায়গায় সাদা কামিজ ভেদ করে রক্তধারা গড়াচ্ছে। তার পুত্র প্রতিবেশীর বাসা থেকে ডাক্তারকে টেলিফোন করতে গেছে।
সর্দারজি! এ তুমি কী করলে? নিজের অজ্ঞাতেই আমার মুখ থেকে এ-কথা বেরিয়ে এল। আমি স্তব্ধ বিমূঢ় দাঁড়িয়ে রইলাম কেবল। আমার চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি লোপ পেয়ে গেছে তখন।
সর্দারজি, এ তুমি কী করলে?
আমার ঋণ পরিশোধ করলাম, খোকা!
ঋণ!
হ্যাঁ খোকা! রাওয়ালপিভিতে তোমার মতোই একজন মুসলমান নিজের জীবন দিয়ে আমার এবং আমার পরিবারের জীবন ও ইজ্জত রক্ষা করেছে।
তার নাম কী ছিল সর্দারজি?
গোলাম রসুল।
গোলাম রসুল? আমার মনে হল ভাগ্য যেন আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। দেয়ালের ঘড়িতে বারোটা বাজল। এক দুই তিন চার পাঁচ…।
সর্দারজি হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকালেন। তিনি যেন হাসছেন। আমার নিজের দাদার কথা মনে পড়ল। তার মুখে কয়েক ফুট লম্বা দাড়ি ছিল। সর্দারজির চেহারা তার চেহারার সাথে যেন মিলে যাচ্ছে। ছয় সাত আট নয়…।
সর্দারজি যেন হাসছিলেন। তার শাদা দাড়ি এবং খোলা চুল চেহারার চারদিকে একটি আলোক আভা তৈরি করেছে।
দশ এগারো বারো। মনে হল সর্দারজি যেন বলছেনজ্বী হ্যাঁ, আমাদের এখানে চব্বিশ ঘণ্টাই বারোটা বেজে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সর্দারজির দু’চোখ বুজে গেল।
দূর, বহু দূর থেকে যেন গোলাম রসুলের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল : আমি বলেছি না, বারোটা বাজলেই শিখদের বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়? এখন এই সর্দারজিকে দেখ। একজন মুসলমানের জন্যে নিজের জীবন দিলেন।
সর্দারজি সেদিন মারা যাননি, আমিই মরেছি।
প্রতিশোধ – খাজা আহমদ আব্বাস
দুটো রঙের বিভীষিকা। ভয়ঙ্করের প্রেতচ্ছায়া অদৃশ্য কায়াহীন পদসঞ্চারে পিছু নিয়েছে। তার দিনরাত্রির।
লাল, টক্টকে লাল; আর ফ্যাকাশে হলুদ, ভয়াবহ বিবর্ণতা।
লাল। মানুষের তাজা খুন যেন।
হলুদ। মড়ার মুখের রক্তশূন্য পাণ্ডুরতা!
লাল আর হলুদ, হলুদ আর লাল, বাতাসের গায়ে ভেসে বেড়াচ্ছে রঙ দুটোর বুদ্বুদ।
হলুদ আর লাল, লাল আর হলুদ–প্রেতায়িত সূর্যরশ্মির তীব্রতা তার চোখ ভেদ করে সোজা মগজে খোঁচা মারছে; হাজার হাজার অদৃশ্য সূচের মতো লাল আর হলুদ রশ্মির তীক্ষ্ণতা তার সমস্ত দেহ খুঁচিয়ে বিধছে।
দিনে-রাত্তিরে, কি জাগরণে, কি নিদ্রায়–হয়তো হাঁটছে, হয়তো-বা বসে রয়েছে– সবসময়েই চোখের সামনে বিভীষিকার ভয়ঙ্কর আবৃত রঙ দুটোর শিখা নাচতে থাকে নারকীয় দানবের অজস্র লকলকে জিভের মতো। শয়তানের অগ্নৎসবে কাঠের বদলে পোপাড়ানো হচ্ছে অগুণতি মড়া। হাজার শব জ্বলছে এক চিতায়; আর অসংখ্য অদেহী আত্মা চারদিক ঘিরে নাচছে মৃত্যুতাণ্ডবের অদৃশ্য নাচ। তাদের ভীতিসঞ্চারী গর্জনে ধ্বনিত হচ্ছে :
প্রতিশোধ!
প্রতিশোধ!!
প্রতিশোধ!!!
লাল আর হলুদ, হলুদ আর লাল রঙ দুটোর জ্বলন্ত পাবকশিখার তীক্ষ্ণতা বেঁধে ফেলছে তার দেহমন আত্মার সামগ্রিকতাকে। কি প্রভাতের অরুণিমায়, কি সূর্যাস্তের মৃত্যুগরিমায় রঙ দুটোর শিখা তার চোখের সামনে সবসময়েই জ্বলতে থাকে। শিরার ভেতরে প্রবাহিত হতে থাকে জ্বলন্ত আগুনের তরলতা। রক্ত কোথায়? প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে ভেসে আসে অগ্নিদাহের ধোয়ার গন্ধ। মাঝে মাঝে মনে হয় সে বুঝি মানুষী সত্তা হারিয়ে নরকের অদৃশ্য আগুনে প্রেতাত্মায় রূপান্তরিত হয়েছে।
সবাই জানে হরিদাস পাগল হয়ে গেছে। হরিদাসও কথা কয় না কারো সঙ্গে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব–কারো সঙ্গে নয়। এই নির্বাকতাই তার মস্তিষ্কবিকৃতির যথেষ্ট পরিচায়ক। তা নাহলে সে কথা কয় না কেন? রাজ্যের যত মজার মজার মুখরোচক উত্তেজক আলাপ-আলোচনার আসরে তার অমন বোবা ও গোমড়া মুখ কেন? না কারো বিয়ের গল্প, কি সিনেমার গল্প, কি এমনি গালগল্প, কুৎসা, নিন্দা, রাজনীতি, সাহিত্য–না, হরিদাস এইসব কিছুরই চৌহদ্দির বাইরে। এমনকি চোখে-মুখে পর্যন্ত ভাবান্তর নেই, সমাজ-সংসারের বহু ঊর্ধ্বে, একেবারে নির্লিপ্ত। যেন সে পাথর হয়ে গেছে।
কিংবা অন্ধ, বোবা, বধির। কিন্তু একবার শুধু দাঙ্গা আর খুনের গল্প উঠিয়ে দাও, তারপর দেখ–ঘৃণা আর ক্রোধের লেলিহান আগুনের ঝলকে ওর চোখ দুটো উঠেছে জ্বলে। নির্বাক হরিদাসের অগ্নিভয়ঙ্কর চোখজোড়া তখন যেন লড়াইয়ের হাঁক দেয় :
প্রতিশোধ!
প্রতিশোধ!!
প্রতিশোধ!!!
পাঞ্জাব বিভাগের সময় হরিদাস ছিল লায়ালপুরের একজন ডাকসাইটে উকিল। তখন কেবল বিভক্ত পাঞ্জাবের টুকরো দুটোকে নৃশংস ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের অগ্নিশ্রাবী কড়াইয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। লায়ালপুরের বাস্তুত্যাগীরা বলেছে, দাঙ্গায় হরিদাসের গোটা পরিবারটাই খুন হয়ে গেছে। তারপর কেটে গেছে লম্বা দশ মাস। কাল নাকি সর্বদুঃখহরা। সেই মারাত্মক স্মৃতিও ধীরে ধীরে আবছা হয়ে এসেছে। তাছাড়া সঠিক কেউ জানতও না কীভাবে তার স্ত্রী আর কন্যা মারা গেছে। আরও হাজার হাজার জনের মতো নদীতে ঝাঁপ দিয়ে, না গৃহদাহে, না খুনখার ছুরির আঘাতে। হরিদাস কাউকে বলেনি সে-কথা।
হরিদাস পাগল হয়নি; অথচ মাঝে মাঝে পাগল হবার ইচ্ছাই তাকে পেয়ে বসে। তাহলে সবকিছু ভুলে যাওয়া যেত। হৃদয়বিদারী ভয়াবহ স্মৃতির অহর্নিশ নিপীড়ন অসহ্য–কীভাবে বাড়ি লুঠ হল, কীভাবে তার স্ত্রী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরল, কীভাবে প্রতিবেশী-বন্ধুরা নিহত হল–এইসব। সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে কন্যা জানকীর স্মৃতি। উঃ, ঘিলুতে কী যেন কামড়াতে থাকে। মনের পর্দায় মর্মান্তিক ছবিগুলো ভেসে ওঠে বিশৃঙ্খলভাবে।
সেইসব ছবি। সুন্দর ছবি। ভয়ঙ্করও বটে।
জানকী, সতেরো বছরের জানকী। মায়ের বুকের ধন, বাপের চোখের মণি।
গোলাপের পাপড়ির মতো কোমল গায়ের রঙ। আর চোখ, নার্গিস ফুল কোথায় লাগে! ছিপছিপে লতিয়ে ওঠা দেহবল্লরী। ভয় হয় মৃদুতম স্পর্শেই কুঁকড়ে যেতে পারে। গোটা লায়ালপুরে সবচেয়ে সুন্দরী, সবচেয়ে বুদ্ধিমতী মেয়ে জানকী।
মুখখানা কী চমৎকার! সারল্যের প্রলেপ রয়েছে তার ওপরে।
পাশাপাশি আরেকটা ছবি ঝিলিক মেরে ওঠে।
কয়েকটি কুৎসিত ভয়াবহ মুখাবয়ব। চোখে পাশব কামনার সর্বধ্বংসী অগ্নিশিখা। ওষ্ঠের কুঞ্চনে শয়তানের নারকীয় হাসি।
সূর্যালোকে চকচক করছে ছুরির শাণিত ধার। বন্দুকের অদৃশ্য কালো কালো চোখ দ্যুতিময়তায় জ্বলছে। সেই ভয়ঙ্কর মুখগুলো এগিয়ে আসে জানকীর দিকে ভয়ঙ্করের পদক্ষেপ ফেলে।
এখনও, দশমাস পরেও, হরিদাস নিজের অনুনয়-ভারাক্রান্ত কাতর ভিক্ষা প্রার্থনার প্রতিধ্বনি শুনতে পায়।
: মার আমাকে, মেরে ফেল–শুধু–শুধু আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও। ফের এগিয়ে আসে ওরা জানকীর দিকে। বিভীষিকার কালো কালো ছায়া-রঙ ওদের মুখে।
: আমি মুসলমান হতে রাজি আছি। আমার মেয়েও হবে। শুধু দয়া কর, দয়া কর– ওকে বাঁচাও।
নৃশংস বিকট মুখগুলোতে কোনোরকম কারুণ্যের ছায়া নেই। কামনা-ভয়ঙ্কর চোখগুলো জানকীর দিকে এগোতে থাকে। গোখরো সাপ যেন এগোচ্ছে সম্মোহিত শিকারের দিকে।
: আমার মেয়ের কচি বয়স ও সুন্দরী। দেখতেই পাচ্ছ। তোমরা যে কেউ ওকে মুসলমান করে বিয়ে কর, কেবল জীবনটা নিয়ে না।
একটা মুখ। এতগুলো ভয়াবহ মুখের ভেতরে সেটা আরও ভয়ঙ্কর। হলদে ময়লা দাঁত, চোখ-ভরা বিকট কামনা। ক্ষুধার বিশ্বগ্রাসী দাবানল। উল্লাসে আর উত্তেজনায় ঘন কালো দাড়ি কাঁপছে তার। তার মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরেই জানকীর ফুলের মতো সৌন্দর্য। পরমুহূর্তে হরিদাসের দৃষ্টি আবছা হয়ে আসে। প্রেতায়িত কালো মেঘ যেন চাঁদ ঢেকে ফেলেছে। কিন্তু বর্বরের পাশব আক্রমণে জানকী গুঁড়িয়ে যাবার আগেই হরিদাসের দৃষ্টি আটকে যায়।
জানকীর চোখে ছড়িয়ে রয়েছে অদ্ভুত ভীতি-ব্যাকুলতার ছায়া। ভীতি, ঘৃণা, অসহায়তা, নৈরাশ্য, নিষ্ফল করুণা ভিক্ষা–সবকিছু মিশিয়ে। সামনেই বাপকে বাঁধা হয়েছে একটা গাছের সঙ্গে। মেয়ের ইজ্জতহানি স্বচক্ষে দেখবার জন্যেই তাকে রাখা হয়েছে জিইয়ে। বীভৎস সে দৃশ্য। অসহ্য! হরিদাসের চোখের পাতা মুদে আসে।
স্মৃতির পর্দায় দৃশ্যটা ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আপনিই তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। হায়, কান দুটোও যদি একেবারে বধির হয়ে যেত। তাহলে তো ঐ মর্মভেদী বিকট আর্তনাদ শুনতে হত না। শুনতে হত না গায়ের কাপড় নির্দয় হাতে ফড়ফড় করে টেনে ছেঁড়ার শব্দ, শয়তানটার কামার্ত নিঃশ্বাসের ভারি শব্দ, জানকীর মরণ চিৎকার, গোঙানি, কান্না। এখনও সে-সব কানে বাজে।
এমনকি মনের এতগুলো পাতা ডিঙিয়েও সেই ভয়ানক মুখগুলো একটার পর একটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ… পরপর মুখগুলো ভেসে উঠছে যতক্ষণ-না সেই অসহায় কান্নাকে মৃত্যুর স্তব্ধতা শুষে নেয়। এ স্তব্ধতা আরো ভয়ঙ্কর, রক্ত ঘনতায় জমাট বাঁধা আর্তনাদের চেয়েও। তারপর সে চোখ খোলে…
ফুলের মতো জানকীর মুখখানা। ফুলটা যেন মাড়িয়ে নিষ্পিষ্ট করে দেয়া হয়েছে মাটির সঙ্গে। বিবর্ণ, সৌরভ্যুত, প্রাণহীন ফুল। আলুলায়িত কেশসম্ভারে অত্যাচারের বিশৃঙ্খলা। কপোলতটে নৃশংস দংশনের স্পষ্ট গভীরতা। ক্ষতমুখ থেকে রক্ত বেরোচ্ছে ফিনকি দিয়ে।
মৃত পাণ্ডুর মুখে যেন রুজের রক্তিম লালিমা। গারের পাপড়িরাঙা চামড়া কেটে রক্ত বেরোচ্ছে। নিষ্ঠুর ধারাল দাঁতের আঘাত স্পষ্ট। সমস্ত শরীরের ক্ষতমুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। গাল, কান, নাক এমনকি খোলা বুক থেকেও। জন্মের মতো, হ্যাঁ, যতদিন বাঁচবে ততদিনের জন্য হরিদাসের মনের ক্যানভাসে শয়তান রক্তের আখরে এঁকে দিয়েছে এ ছবিখানা। এ ছবি চির-অম্লান। কিছুতেই ভুলবার নয়। অসম্ভব!
নিজের হাতে হরিদাস সাজিয়েছে মেয়ের চিতা। দেখতে দেখতে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে জানকী। অগ্নিদেব তার কোমল, সুন্দর দেহ-নৈবেদ্য গ্রহণ করেছেন। পবিত্র নিষ্পাপ দেহনির্মাল্য। আহত, অপমানিত, ধর্ষিত সে দেহ। হরিদাস এখনও সেই চিতার অগ্নিশিখা দেখতে পায়। শিখাগুলো নাচছে তার চোখের সামনে। লাল আর হলুদ ঊর্ধ্বমুখী শিখা। তার মনে হয়েছিল জানকীর নয়, হিন্দুস্থানের ইজ্জত দাহ করা হচ্ছে। চিতাগ্নিশিখার সঙ্গে মানবতা উবে যাচ্ছে। সৌন্দর্য, দয়াধর্ম আর সহানুভূতি পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।
চিতার আগুন একসময়ে নিভল। কিন্তু প্রতিহিংসার আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল হরিদাসের মনে। এ আগুন নিভবার নয়। না… না… কখনো না… অন্তত… যতদিন-না হরিদাস প্রতিশোধ নিতে পারে একটি মুসলমান মেয়ের নগ্ন বুকে ছুরিকাঘাত করে। তাই হরিদাস বেঁচে রয়েছে এখনো। একবার, শুধু একবার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে তার পরমুহূর্তেই মৃত্যুকে জড়িয়ে ধরবে সে।
প্রতিশোধ!
প্রতিশোধ!!
কোটের নিচে ধারাল ছুরি লুকানো রয়েছে। কিন্তু কোথায় সুন্দরী মুসলমান মেয়ে? জিঘাংসু হরিদাসের অতৃপ্ত আত্মা খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে। দিল্লির মুসলমানদের অনেকে দাঙ্গায় নিহত হয়েছে। কেউ কেউ পাকিস্তানে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে। যারা এখনও রয়ে গেছে, তারা তো পথে বেরাতেই সাহস করে না। কাপুরুষ কোথাকার, ভীতুর দল!
ভাগ্য হরিদাসের সঙ্গে অদ্ভুত খেলা শুরু করেছে। বাস্তুত্যাগী পুনর্বসতি সাহায্য তহবিল থেকে সে তিনশ’ টাকা পেয়েছে। এত টাকা দিয়ে কী করবে? কেউই তো নেই আর–না গৃহ, না পরিবার। আহার-পরিচ্ছদের দরকার নেই। এমনকি বাঁচবার পর্যন্ত ইচ্ছে নেই। কী করবে হরিদাস অত টাকা দিয়ে! ভাবতে ভাবতে নয়াদিল্লি আর পুরনো দিল্লির পথে পথে ঘুরে বেড়াতে থাকে সে।
কনট প্লেস থেকে চাঁদনি চক। চাঁদনি থেকে জামে মসজিদ। মসজিদের সরু সরু মিনার। সাদা গম্বুজের ওপর নজর পড়লে ফের জেগে ওঠে প্রতিহিংসার সঙ্কল্প। মুসলমানদের বিরুদ্ধে, গোটা মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে। জামে মসজিদ থেকে দরিয়াগঞ্জ–তারপর রাজঘাট। এমনকি রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিও তার মন থেকে প্রতিহিংসার অগ্নিশিখা নির্বাপিত করতে পারে না।
গান্ধীজী মহাত্মা ছিলেন। ঋষি। কিন্তু আমি যে সাধারণ লোক। তিনি পারেন শত্রুকে ক্ষমা করতে, আমি পারি না।
সেখান থেকে এডওয়ার্ড পার্ক। পার্কে রাজার পাথরের মূর্তি। ঘোড়ার পিঠে বসে রয়েছে।
: বাহ্, হুজুর বাহ্। চলে তো গেলে, এদিকে আমাদের ঠেলে দিলে এক মৃত্যুঘাতী দুর্দশায়।
ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। ঘুরতে ঘুরতে সে একটা অচেনা জায়গায় এসে পড়ল। তারই মতো অসংখ্য বাস্তুত্যাগী ঘুমোচ্ছে পাকা রাস্তার ওপর। বাতাসের সঙ্গে মিশে রয়েছে ভারি তীব্র গন্ধ। সেন্ট, ঘাম, ভ্যাপসা মাটি, প্রস্রাব, ফুল, ফিনাইল, পেট্রোলের গন্ধ। বাঁ ধারে একসার দোকান। মিঠাইয়ের দোকান, দুধের দোকান। হোটেল এখনও খোলা রয়েছে। বাকিগুলো বন্ধ। প্রতিটি পথিকের দৃষ্টি একতলার আলোকিত ব্যালকনিতে নিবদ্ধ। আলোয় উজ্জ্বল রশ্মিতে আমন্ত্রণের পত্ররেখা। বায়ুতরঙ্গের ছন্দে সঙ্গীত ঝঙ্কার। জায়গাটা?
: বাবুজি!
আচমকা সম্বোধন। একটা লোক, তার তির্যক দৃষ্টিতে প্রশ্ন।
: বাবুজি হুকুম করেন তো খাশা চিজ দেখাতে পারি।
কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে না-পেরে হরিদাস এগোতে থাকে। কিন্তু লোকটা এত সহজে ছাড়বার পাত্র নয়।
: খুশি না-হলে আপনার বখশিসের সব পয়সা হারাম।
কথার আবছা অংশ পরিষ্কার হয়ে গেল তার মুখের ইঙ্গিত থেকে।
: ভাই আমি একজন বাস্তুত্যাগী। হরিদাস বলল।
: আমিও তাই বাবুজি। আমরা তো একই দলের, আসুন-না আমার সাথে, একটা মুসলমান মেয়ে আছে…। পাকিস্তানের খেসারত নেবার এই তো সুযোগ, পাকিস্তানি হুর ভোগ করার সুযোগ।
মুসলমান মেয়ে! পাকিস্তানি হুর!!
প্রতিহিংসার লাল আর হলদে শিখা হরিদাসের চোখের সামনে নাচছে প্রেতায়িত নাচ। যেতে যেতে লোকটা আপনা থেকেই বলতে লাগল, বাবুজি, এমন মেয়ে হাজারেও একটা মেলে না। বয়েস কতই-বা হবে–বড়জোর সতের কি আঠারো।
তারপর এদিক-ওদিক ইতস্তত তাকাতে তাকাতে ফিসফিস করে বলল, আমরা ওকে জলন্ধর থেকে নিয়ে এসেছি। মশহুর লোকের মেয়ে। কী বলব বাবুজি-ওকে রাজি করিয়ে ব্যবসায়ে নামাতে পাক্কা দশ মাস সময় লেগেছে।
জানকীরও কি একই বয়েস ছিল না? জানকীও কি নামজাদা লোকের মেয়ে নয়? তবু সেই বীভৎস ভয়ঙ্কর মুখগুলো একবর্ণ দয়াও দেখায়নি। এক দুই তিন চার পাঁচ…যতক্ষণ পর্যন্ত-না অনাঘ্রাত পবিত্র ফুলটা মাটির সঙ্গে নিষ্পিষ্ট হয়ে গেছে।
: তাহলে আমিই-বা কেন দয়া দেখাতে যাব? হরিদাস ভাবল। তার হাত কোটের ভেতরে রাখা ছুরিটা একবার ছুঁয়ে এল।
বেশ্যাবাড়ির সাধারণ বৈঠকখানা। মেঝেতে ময়লা সাদা চাদর বিছানো। সিলিং থেকে ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে। দেয়ালে শস্তা তৈলচিত্র টাঙানো। ভগবান কৃষ্ণ, রাজা রামচন্দ্র, সতী সীতা, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী আর পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু। দুটো বড় বড় আয়না। ঘরের এককোণে বসে পান তৈরি করছে স্থূলকায়া কুৎসিৎ একটা প্রৌঢ়া। মুখে ব্রণের দাগ। সমস্ত কিছুর ওপরে তার বিচক্ষণ দৃষ্টি। বাজনার যন্ত্র, গায়ক আর বাজনদারদের মাঝখানে রয়েছে সেই পাকিস্তানি হুর। গান গাইছে সে।
হরিদাস হুর দেখেনি কখনো, কিন্তু শুনেছে চেহারার বিবরণ। মেয়েটি হুরই বটে! গায়ের রঙ জানকীর চেয়েও সুন্দর, তবে রক্তহীনতার বিবর্ণতা স্পষ্ট। দেহসৌষ্ঠবে মঞ্জুরিত লতার কৃশতা আর সৌকুমার্য। কালো আয়ত চোখ। তবে এ চোখে সুস্থতার জ্যোতি বা জীবনের ছায়া নেই। যেমনটি জানকীর ছিল। তার বদলে নৈরাশ্যের অন্ধকার প্রকাশমান।
হরিদাস দেখছিল মেয়েটি গাইছে, কিন্তু কানে বিন্দুবিসর্গ গানের বুলিও ঢুকছে না। ঘর বোঝাই শ্রোতা। হরিদাসের চোখ এ জনতার অস্তিত্ব অনুভব করছে। কিন্তু তারা কি ধনী, দরিদ্র, ভদ্রলোক, না বদলোক এ স্তরবিন্যাস বুঝবার মতো দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা চোখে নেই। এক কোণায় ঘুপটি মেরে বসে সে গভীরভাবে তাকিয়ে ছিল পাকিস্তানি হুরটির দিকে। সে দৃষ্টিতে কামনার লাম্পট্য ছিল না। কেবল প্রতিহিংসার লাল আর হলুদ শিখা কাঁপছে।
লোকটা বলেছিল মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তখন ঘর ফাঁকা হয়ে যাবে। গোটা রাতের জন্যে দর ঠিক হয়েছে দু’শ’ টাকা। মাত্র দু’শ’। বাকি টাকা তাহলে কী করবে! বাকি টাকার দরকার আর নেই। পরের দিন বাঁচবার আর কোনো ইচ্ছেই নেই। তার। আজকেরটাই জীবনের শেষ রাত। কাল থেকে সে মুক্ত। সবকিছু থেকে মুক্ত। টাকা-পয়সা, দৌলত, প্রতিশোধ, জীবন, সবকিছু থেকে। দশ টাকা করে একশ’ টাকাই মেয়েটাকে বখশিস দিয়ে দিল। পায়ের কাছ থেকে দশ টাকার নোট কুড়িয়ে নেবার সময় মেয়েটা প্রতিবার তাকে সালাম করল। যাক, এতেও বিক্ষুব্ধ মন কিছুটা অন্তত সান্ত্বনা পাচ্ছে! একটি মুসলমান মেয়েকে এভাবে অপমান করে হরিদাস অন্তত এটুকু ভাবতে পারছে যে তার অপমানিতা মেয়ের প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিন্তু এ তো সামান্য মাত্র!
নিষ্পলক স্থির চোখে হরিদাস মেয়েটির প্রতিটি গতিবিধি লক্ষ করতে লাগল। সে বুঝতে পেরেছিল মেয়েটি জাত ব্যবসায়ী নয়। ওর সব অঙ্গভঙ্গিই যান্ত্রিক। অনুভূতিহীন। নগ্নবাহু দুলিয়ে গানের সঙ্গে অপাঙ্গদৃষ্টি ছুঁড়ে ব্যবসার কায়দা প্রদর্শন ওর অপটুতাই ধরিয়ে দিচ্ছিল। দম-দেয়া ঘড়ির মতো মেয়েটা। হরিদাসের সারা শরীরে একটা ভৌতিক রহস্যময় অনুভূতি কিলবিল করে বয়ে গেল মুহূর্তে। মনে হল, এ জীবন্ত মানুষ নয়। একটা মড়ার দেহ জাদুকরের মায়ায় কেমন করে যেন সাময়িক জীবন পেয়েছে।
আর-একটা জিনিস নজরে পড়ল। টাকা বখশিস দেয়ার অছিলায় যখনই কেউ ওকে ছুঁতে চেষ্টা করছে তখুনি মেয়েটা ছিটকে প্রসারিত হাত সরিয়ে নিচ্ছে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো! আশ্চর্য, মুখে কিন্তু তার এই অনিচ্ছার কোনো ভাবান্তরই নেই। রোষ কি বিরক্তি কিছুই নয় টাকা-নোট যা কিছুই পাচ্ছিল তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সেগুলো ছুঁড়ে দিচ্ছিল ঘরের কোণায়। সেখানে বসেছিল স্থূলকায়া প্রৌঢ়াটি। এ অবহেলা প্রৌঢ়ার মুখে দাগ কাটেনি। কিন্তু টাকাগুলো ছুঁড়ে দেবার সময়কার কব্জির ঝাঁকুনিতে অসহ্য ঘৃণার প্রকাশ স্পষ্ট। মেয়েটি যেন বলতে চাইছিল–
: নাও টাকা, নাও, যে টাকার জন্যে এই বাজারে আমায় বিক্রি করছ। এই নাও, তারপর রেহাই দাও আমাকে। নাও…নাও… খুশি হও।
ওর নিপীড়িত নিরীহতা কেমন করে যেন হরিদাসের মনে ভাবান্তর সৃষ্টি করল। হরিদাসের স্থির বিশ্বাস জন্মাল, মেয়েটির জন্ম ভদ্র, ধনী মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারে। পরিষ্কার সুস্পষ্ট সুরজ্ঞান আর উচ্চারণভঙ্গিতে সুশিক্ষার পরিচয় প্রকাশমান। মোটমাট জানকীর ইজ্জতহানির প্রতিশোধ নেয়ার উপযুক্ত পাত্রই বটে।
রাত দুপুর হল। একে একে সবাই চলে গেল। মেয়েটিও চলে গেল শোবার ঘরে। এমনকি একবারও তাকাল না হরিদাসের দিকে, ওর বাকি রাতের একমাত্র খদ্দের। হরিদাস সেই লোকটাকে দু’শ টাকা দিয়ে ওঠাল। লোকটা টাকাগুলো চালান করল কুৎসিৎ চেহারার প্রৌঢ়া বাড়িউলির কাছে। প্রৌঢ়া টাকাগুলো দেখতে লাগল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলোর নিচে। তারপর খুশি হয়ে দশ টাকার একটা নোট তুলে দিল লোকটার হাতে। লোকটা সালাম করে চলে গেল। ময়লা, পায়োরিয়ায় খাওয়া বিচ্ছিরি দাঁত বের করে প্রৌঢ়া চোখ টিপে হরিদাসকে বলল–
: বাবুজি, এবার যান ভেতরে। তবে একটু সাবধান। মেয়েটা নতুন কি না–আপনি তো জানেন সবকিছু।
পরমুহূর্তে হরিদাস ঢুকে পড়ল ঘরে।
সতর্কতার সঙ্গে ভালো করে দরজার আগল লাগাল সে। দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে মেয়েটি বসেছিল খাটের উপরে চিন্তাকুলভাবে। হরিদাস এগোল সেদিকে। হরিদাসকে দেখেই মেয়েটি সমসহকারে উঠে পড়ল। দৃষ্টি মেঝেয় নিবদ্ধ। তারপর জুতোর ফিতে খুলে দিতে বসল। হয়তো এই হুকুম ছিল বাড়িউলির।
: ছেড়ে দাও–
কর্কশর হরিদাসের কণ্ঠে। পায়ের কাছে নতজানু হয়ে বসা একটা মুসলমান। মেয়েকে দেখে বেশ তৃপ্তি বোধ করছে সে।
: গায়ের কাপড় সরাও—
কম্পিত হাতে মেয়েটি শাড়ি খুলে ফেলল। কেবল রইল পেটিকোট আর ব্লাউজ।
: এগুলোও–
অসহায় লজ্জায় ও দেয়ালের দিকে মুখ ফেরাল। … পেটিকোটটা ঝুপ করে মাটিতে খসে পড়ল। হরিদাসের হাত পকেটের ছুরির ওপর।
: তোমাকে সম্পূর্ণ ন্যাংটো দেখতে চাই। বুঝেছ? … এখানো হয়নি। দু’শ’ টাকা নগদ দিয়েছি তার জন্যে।
মেয়েটি মুখ ফেরাল। চোখে অব্যক্ত ভিক্ষার নিদারুণ কারুণ্য। আশা ঐ মধ্যবয়সী খদ্দেরটার যদি দয়া হয়। হয়তো তার মনে দয়া হতে পারে, ওর সম্পূর্ণ নগ্নতার ওপরে জেদ না-ও করতে পারে।
: জলদি কর হরিদাস গর্জে উঠল নির্দয়ভাবে। আমার সময় নেই।
পকেটের ভেতরে ছুরির ধার পরীক্ষা করছে তার হাত। মেয়েটি সুইচের দিকে এগোবার চেষ্টা করল।
: না–পথরোধ করে দাঁড়াল হরিদাস।
: অন্ধকার নয়–
জানকীর কী হয়েছিল? খোলা রাস্তার ওপরে দিনের আলোয় কি তার ইজ্জতহানি করা হয়নি?
ব্লাউজ খুলল মেয়েটি। সুগঠিত স্তনযুগলের যৌবন-রেখার স্পষ্টতা ঢাকা রয়েছে। কাঁচুলির তলায়।
: এটাও…
ছুরি প্রস্তুত। আবার মেয়েটি তাকাল তার দিকে। চোখে করুণ ভিক্ষার আবেদন।
এইভাবেই জানকী তাকিয়েছিল হৃদয়হীন পশুগুলোর দিকে। কিন্তু তারা কণামাত্র দয়াও দেখায়নি। না, হরিদাসও দেখাবে না।
হাতের আঁজলা দিয়ে মেয়েটি মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল। কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল স্তনের ওপর।
হরিদাসের ডান হাতে ঝকমক করে উঠল ছুরিটা, মৃত্যু আঘাত হানতে উদ্যত। অপর হাতে মেয়েটির হাত দুটো হিঁচড়ে নামাল মুখ থেকে। ও দেখুক হরিদাস কী করতে যাচ্ছে। জানকীও তো দেখেছে। এই মুহূর্তটির জন্যেই তার দীর্ঘ দশ মাসের অধীর প্রতীক্ষা। লাল আর হলুদ শিখা নাচছে উল্লাসভরে।
হরিদাসের এক হাতে উদ্যত ছুরি আর অপর হাত পাশব ভঙিতে বুকের কাঁচুলির দিকে এগিয়ে আসতে দেখেই মেয়েটি আর্তনাদ করে উঠল। করুণ, তীব্র, মরণ আর্তনাদ। চোখে মৃত্যুভীতির গাঢ় ছায়া।
হরিদাস দেখল সে চোখে আরও কিছু আছে-ভীতির সঙ্গে ঘৃণা আছে। করুণা ভিক্ষার আবেদন স্পষ্ট, আর রয়েছে সম্পূর্ণ অসহায়তা। ঠিক জানকীর চোখের দৃষ্টি। কিন্তু তবু সে দৃষ্টি জানকীকে বাঁচাতে পারেনি। বিদ্যুৎচমকের ক্ষিপ্রতায় হরিদাসের বাঁ হাত স্পর্শ করল মেয়েটির কাঁচুলি। এ কি, কাঁচুলি এত ভারি ঠেকছে কেন? তবু হ্যাঁচকা টান মারল কাঁচুলিটায়। আর এর সঙ্গে…
ছুরিটা শূন্যেই উদ্যত হয়ে রইল। লজ্জায় হরিদাস চোখ ফেরাল। মাত্র একটি কথা শব্দ হয়ে ফসকে বেরিয়ে এল তার নিবদ্ধ ঠোঁট দুটোর কাছ থেকে :
‘বেটি!
কাঁচুলির নিচে যেখানে সে ছুরির আঘাত করতে যাচ্ছিল সেখানে দেখল স্তন দুটো নেই। মিলিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। সেখানে কিছুই নেই…কিছুই নেই…
[অনুবাদক : অজ্ঞাত]
মা – কুদরতুল্লাহ শাহাব।
মায়ের জন্মতারিখ সঠিক জানা যায়নি।
যে সময় লায়ালপুর জেলায় নতুন আবাদি বসেছিল, পাঞ্জাবের প্রত্যেক গাঁও থেকে ভূমিহীন লোকেরা জমি পাওয়ার আশায় এই নতুন কলোনির দিকে দলে-দলে ছুটে এসেছিল তখন। সাধারণ লোকেরা তখন লায়ালপুর এবং সারগোদা প্রভৃতি অঞ্চল বার এলাকা নামে চিনত। সে সময়ে মায়ের বয়স ছিল দশ-বারো বছর। এই হিসাবে মায়ের জন্মতারিখ গত শতাব্দীর শেষভাগের দশ-পনেরো বছরের যে-কোনো এক সময়ে হয়ে থাকবে।
মায়ের বাপের বাড়ি আম্বালা জেলার রুপোড় মহলকুমার মেনিলা গ্রামে। সেখানে তাদের কিছু জমি-জমা ছিল। তখন রুপোড়ে শ থেকে সেরহিন্দ খাল খনন করা হচ্ছিল। নানাজির জমি পড়ে গেল সেই খালের মধ্যে। রুপোড়ের ইংরেজ কর্তৃপক্ষের দফতর থেকে এ-সব জমির ক্ষতিপূরণ দেয়া হত। নানাজিও দু’-তিনবার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য শহরে গেলেন; কিন্তু সোজা লোক ছিলেন তো, জানতেন না কর্তার। দফতর কোথায় আর ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হলে কী করতে হয়। শেষে খোদাকে শোকর জানিয়ে চুপ করে বসে রইলেন এবং খাল খননে মজুরের কাজ করতে লাগলেন।
এই সময়ে খবর পাওয়া গেল যে, বার এলাকায় নতুন আবাদি হচ্ছে আর বিনামূল্যে জমি দেয়া হচ্ছে নতুন বসতি স্থাপনকারীদের। নানাজি তাঁর স্ত্রী, দুটো ছোট ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে লায়ালপুর রওনা হলেন। যানবাহনের সংস্থান ছিল না, তাই হেঁটেই চললেন।
পথ চলতে কায়িক পরিশ্রম করে পেট চালাতেন। পথে যেতে-যেতে নানাজি এখানে ওখানে কুলির কাজ করতেন কিংবা কারো কাঠ কেটে দিতেন। নানি আর মা কারো সুতো কেটে দিতেন অথবা বাড়ির উঠান, ঘরের দেয়াল লেপে দিতেন। লায়ালপুরের সোজা পথ কারো জানা ছিল না। তাই ঘুরে-ফিরে জিজ্ঞাসাবাদ করে দিনের পথ সপ্তায় অতিক্রম করে চললেন তারা। অবশেষে দেড়-দু’মাস চলার পর তারা জিরানওয়ালায় পৌঁছলেন। একে পায়ে হেঁটে চলা, তার ওপর দৈহিক পরিশ্রম সব মিলে সকলেরই শরীর নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। পা ফুলে উঠেছিল কারো-কারো। ফলে কয়েক মাস তারা এখানে থাকলেন। নানাজি সারাদিন শস্যের গুদামে বস্তা বইতেন, নানি চরকায় সুতো কেটে বিক্রি করতেন। আর মা চালাতেন সংসার–যে সংসার একটা ছোট কুঁড়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তখন।
বকরা ঈদের উৎসব এল। নানাজির কাছে টাকা জমেছিল কিছু। তিনি মাকে তা থেকে তিন আনা পয়সা দিলেন। ঈদের উপহার। জীবনে মা এই প্রথম হাতে এত পয়সা পেলেন; অনেক ভাবলেন তিনি। কিন্তু এই পয়সা খরচ করার কোনো উপায় বের করতে পারলেন না। দিনে এক-আধটা রুটিনুন-লঙ্কার চাটনি দিয়ে খাবার ব্যবস্থা থাকলে অতিরিক্ত পয়সার আর দরকার কী? এই প্রশ্নের জবাব সারা জীবনেও মা খুঁজে পাননি। মৃত্যুকালে তার বয়স আশি বছরেরও বেশি হয়েছিল। কিন্তু তখনো একশ’ টাকা, দশ টাকা এবং পাঁচ টাকার নোট তিনি ঠিক চিনে উঠতে পারতেন না।
ঈদ উপলক্ষে পাওয়া তিন আনা পয়সা কয়েকদিন পর্যন্ত মায়ের ওড়নার কোণায় বাধা রইল। যেদিন জিরানওয়ালা থেকে বিদায় হলেন সেদিন মা এগারো পয়সার তেল কিনে মসজিদের চেরাগে ঢেলে দিয়ে এলেন। বাকি পয়সাটা রাখলেন নিজের কাছে। এরপর যখনই তাঁর কাছে পুরো এগারো পয়সা হত অমনি তিনি তেল কিনে পাঠিয়ে দিতেন মসজিদে। জীবনভর তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এই নিয়ম পালন করে গেছেন। ক্রমে অনেক মসজিদে বৈদ্যুতিক আলো এল। কিন্তু লাহোর ও করাচির মতো শহরেও কোনো কোনো মসজিদের তেলের প্রদীপ জ্বলত সেকথা জানা ছিল তাঁর। মৃত্যুর রাতেও তার শিয়রে মলমলের রুমালে বাঁধা ছিল কয়েক আনা পয়সা! সম্ভবত এগুলোও তিনি কোনো মসজিদে তেল দেয়ার জন্য রেখেছিলেন। যেহেতু সে রাতও বৃহস্পতিবারের রাত ছিল।
এই কয়েক আনা ছাড়া মায়ের কাছে আর কোনো টাকা-পয়সা বা গয়না ছিল না। সংসারের আসবাবপত্রের মধ্যে যা ছিল তা অতি সামান্য। তিন জোড়া সুতি কাপড়, এক জোড়া দেশি জুতো, এক জোড়া রবারের চপ্পল, একটা চশমা, একটা আংটি–তাতে তিনটে ছোট-ছোট ফিরোজা বসানো, একটা জায়নামাজ, একটা তসবিহ আর বাকি আল্লাহ্ আল্লাহ্।
তিন জোড়া পরিধেয় তিনি বিশেষ যত্নের সঙ্গে রাখতেন সব সময়। এক জোড়া তিনি পরতেন, দ্বিতীয় জোড়া ধুয়ে বালিশের নিচে ভাজ করে রাখতেন, যাতে চাপ খেয়ে ইস্তিরি হয়ে যায়। তৃতীয় জোড়া ধোয়ার জন্য তৈরি থাকত। যদি চতুর্থ জোড়া তার কাছে আসত কখনো–তিনি সেটা গোপনে কাউকে দিয়ে দিতেন। তাই সারাজীবনে তাঁর স্যুটকেসের কোনো প্রয়োজন হয়নি। যত দূরের যাত্রা হোক-না কেন, তার তৈরি হতে কয়েক মিনিটের বেশি সময় লাগত না! কাপড় পুটুলি করে জায়নামাজ দিয়ে পেঁচিয়ে রওনা হয়ে যেতেন। শীতে গরম চাদর আর গ্রীষ্মে মলমলের পাতলা ওড়না–এই নিয়েই যেখানে খুশি যেতেন তিনি। জীবনের শেষ যাত্রাও তিনি সাদাসিদেভাবেই সম্পন্ন করেছেন। ময়লা কাপড় নিজহাতে ধুয়ে বালিশের নিচে রেখেছেন তিনি, নেয়ে-ধুয়ে চুল শুকিয়েছেন এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই জীবনের সবচেয়ে শেষ ও সবচেয়ে লম্বা সফরে রওনা হয়ে গেছেন। যেমন নীরবতার সঙ্গে এই দুনিয়ায় বাস করতেন তেমনি নীরবেই তিনি পরপারে রওনা হয়েছেন। সম্ভবত এজন্যেই তিনি প্রায়ই প্রার্থনা করতেন, ‘আল্লা, হাত-পা সচল থাকতে উঠিয়ে নিও। আন্না, কখনো কারো মুখাপেক্ষী আমায় করো না।’
খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তিনি কাপড়-চোপড়ের চেয়েও সরল ও নিরাসক্ত ছিলেন। তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় খাদ্য ছিল মকাই-এর রুটি ও ধনে বা পুদিনার চাটনি। আর সব খাবারও আনন্দের সঙ্গে খেতেন; প্রায় প্রতি গ্রাসেই তিনি আল্লার শুকরিয়া আদায় করতেন। কেউ ফল খাওয়ানোর জন্য খুব জেদ করলে, তিনি কোনো-কোনো সময় কলার কথা বলতেন। তবে নাশতার সময় দু’পেয়ালা চা এবং বিকেলবেলা এক পেয়ালা লাল চা তার চাই। একবার মাত্র খাবার খেতেন তিনি–তা-ও বেশিরভাগ দুপুরবেলা– রাতের বেলা প্রায় খেতেনই না। গরমের দিনে সাধারণত মাখন-তোলা দুধের হাল্কা লোনা লাচ্ছির সঙ্গে এক-আধটা চাপাতি তার প্রিয় খাদ্য ছিল। কাউকে আগ্রহের সঙ্গে কোনো কিছু খেতে দেখলে খুব খুশি হতেন তিনি। সব সময় দোয়া করতেন। সকলের ভালো হোক–সকলের পরে আমারো ভালো হোক। নিজের জন্য বা নিজের সন্তানের জন্য তিনি সোজাসুজি কোনো প্রার্থনা করতেন না। প্রথমে অপরের জন্য দোয়া করতেন, তারপর খোদার সৃষ্ট জীবসমূহের সুখ-সমৃদ্ধি কামনার মাধ্যমে নিজ সন্তান বা আত্মীয়-স্বজনের মঙ্গল কামনা করতেন। নিজ পুত্র-কন্যাদের তিনি, কখনো আমার ছেলে’ বা ‘আমার মেয়ে’ বলতেন না–সব সময় তাদের বলতেন আল্লাহর দান।
কাউকে দিয়ে কোনো কাজ করানো মায়ের কাছে খুব কঠিন মনে হত। নিজের সব কাজই তিনি নিজ হাতে করতেন–যদি কোনো চাকর-বাকর এসে জবরদস্তি করে তার কাজ করে দিত, তাহলে এক অভূতপূর্ব লজ্জা আর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সমস্ত দিন দোয়া করতেন তাকে।
সরলতা ও তিতিক্ষার এই বৈশিষ্ট্য কিছুটা প্রকৃতিগতভাবেই মায়ের চরিত্রে ছিল, কিছুটা এসেছিল জীবনের ঘাত-সংঘাত থেকে।
জিরানওয়ালায় কিছুদিন অবস্থানের পর তিনি যখন তার বাপ-মা ও ছোট ভাইদের নিয়ে জমির খোঁজে লায়ালপুর রওনা হলেন, তখন তাদের জানা ছিল না যে, তাদের কোথায় যেতে হবে এবং জমি পেতে গেলে কী পন্থা অবলম্বন করতে হবে। মা বলতেন, সেকালে তার মনে কলোনির কল্পনা একজন ফেরেশতা স্বভাবের মহাত্মার চিত্র হয়ে ভেসে উঠত, যিনি উঁচু বেদীর উপর বসে জমি-জিরাত বণ্টন করছেন।
কয়েক সপ্তাহ ধরে এই ছোট্ট কাফেলাটা লায়ালপুর এলাকায় ঘুরে বেড়াল; কিন্তু কোনো পথচারীর চেহারায় কলোনির মহাত্মাসুলভ চিত্র ফুটে উঠল না। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ৩৯২ নম্বর চকে–সে সময় সেখানে নতুন আবাদি বসছিল–ডেরা ফেলল তারা। দলে-দলে লোক এসে সেখানে ঘর বাঁধছিল–নানাজি তার সোজা বুদ্ধিতে বুঝলেন যে, কলোনিতে বসবাস করবার হয়তো এটা একটা নতুন নিয়ম। সুতরাং তিনি খানিকটা জায়গা ঘিরে নিয়ে ঘাসপাতা দিয়ে একটা কুড়ে তৈরি করে ফেললেন এবং পতিত দেখে এক টুকরো জমি খুঁজে নিয়ে চাষ করবার বন্দোবস্ত করতে লাগলেন। সেই সময়ই রাজস্ব বিভাগের একজন কর্মচারী পর্যবেক্ষণের জন্য এসে দেখলেন যে, নানাজির কাছে এলটমেন্টের দলিলপত্র নেই। ফলে তাঁকে চক থেকে বের করে দেয়া হল : অধিকন্তু সরকারি জমিতে বে-আইনিভাবে কুঁড়েঘর বানানোর জন্য তাঁর বাসন-কোসন ও বিছানা-পত্র ক্রোক করা হল। কর্মচারীদের একজন মায়ের কানের দুটো রুপোর বালি খুলে নিয়ে গেল। একটা বালি খুলতে দেরি হওয়ায় সে এমন জোরে টান মারল, যার ফলে মায়ের বা কানের লতিটা সাংঘাতিকভাবে কেটে গেল।
৩৯২নং চক থেকে বিতাড়িত হয়ে যে রাস্তা ধরে সামনে পেলেন সেই রাস্তা বেয়ে চললেন। গরমের দিন তখন–সারাদিন লু-হাওয়া বইছে। পানি রাখবার জন্য একটা মাটির ভাঁড়ও ছিল না তাদের। কোথাও কোনো কুয়া দেখলেই মা তার ওড়না ভিজিয়ে নিতেন, যাতে তৃষ্ণা পেলে ছোট ভাইদের চোষানো যায়। এভাবে চলতে-চলতে তারা ৫০৭ নম্বর চকে পৌঁছলেন। সেখানে একজন চেনাশোনা বসতি স্থাপনকারী নানাজিকে কামলা রাখল। নানাজি হাল বাইতেন, নানি গরু-মোষ চরাতেন, মা ক্ষেত থেকে ঘাস আর চারা কেটে জমিদারের গরু-মোষের খাবার জোগাতেন, তখন তাঁদের এতটুকু সঙ্গতিও ছিল না যা দিয়ে পেটভরে একবেলার খাবার খেতে পারেন। কখনো বুনো ফল খেয়ে থাকতেন সবাই। কখনো খেতেন কুড়িয়ে পাওয়া তরমুজের খোসা। কখনো বা কারো ক্ষেতে পড়ে থাকা টক ফুল কুড়িয়ে এনে তার চাটনি করা হত। একদিন কোত্থেকে যেন কলতা শাক পাওয়া গেল, নানা কাজ-কর্মে ব্যস্ত ছিলেন। মা চুলোয় শাক চাপিয়ে যখন একেবারে সিদ্ধ করে এনেছেন, এবার শাকটা নেড়ে-চেড়ে ঘাঁটতে হবে, সেই সময় হাতা দিয়ে নাড়তে গিয়ে হাড়িতে এত জোরে ঘা লাগল যে হাঁড়ির তলাটা গেল ভেঙে। সব শাক পড়ে গেল চুলোর মধ্যে। নানি এসে মাকে ধমকালেন এবং মারলেনও। সে-রাতে গোটা পরিবার চুলোর ভেতরে পোড়া কাঠে লেগে থাকা শাক কোনোমতে আঙুল দিয়ে চেটে-চেটে খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্তি করল।
৫০৭ নম্বর চকে নানাজির ভাগ্য ফিরে গেল। কয়েক মাস কঠোর পরিশ্রমের পর পুনর্বাসনের সূত্রে সাজে কিস্তিতে তিনিও একখণ্ড জমি পেয়ে গেলেন। আস্তে-আস্তে সুদিন আসতে লাগল এবং দু’তিন বছরের মধ্যেই নানাজি গ্রামের সচ্ছল লোকদের মধ্যে গণ্য হয়ে গেলেন। এমনি দিন-দিন যখন সচ্ছলতা বেড়ে চলল পিতৃভূমির কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। সুতরাং সচ্ছলতার চার-পাঁচ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর সমস্ত পরিবার নিয়ে রেলে চড়ে মেনিলা রওনা হলেন। রেল-ভ্রমণে মা খুব আনন্দ পেলেন। সারা পথ তিনি জানালা দিয়ে মুখ বের করে তাকিয়েছিলেন; এর ফলে বেশ কিছু কয়লার গুঁড়ো তাঁর চোখে পড়ে। কয়েকদিন চোখের পীড়ায় ভুগতে হয় তাকে। এই অভিজ্ঞতার কারণে তিনি সারাজীবনে তার ছেলেদের কোনোদিনই রেলগাড়ির জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে বাইরে দেখবার অনুমতি দেননি। মা রেলের তৃতীয় শ্রেণীতে সফর করতে পারলেই খুব সন্তুষ্ট থাকতেন। সহযাত্রিনী মেয়ে ও ছোট ছেলেদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নিতেন খুব তাড়াতাড়ি। পথের ক্লান্তি আর ধুলোবালিতে তার কোনো অসুবিধা হত না। প্রথম শ্রেণীতে বরং ভ্রমণেই তিনি কষ্ট পেতেন বেশি। দু’একবার যখন তাঁকে এয়ারকন্ডিশন্ড গাড়িতে ভ্রমণে বাধ্য হতে হয়েছিল, তখন তিনি ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছিলেন। মনে হয়েছিল সারাক্ষণ যেন জেলখানার কষ্ট ভোগ করছেন।
মেনিলায় পৌঁছে নানাজি তার পরিত্যক্ত পৈতৃক বাড়ি ঠিকঠাক করলেন। আত্মীয় স্বজনদের নানা উপহার দিলেন, দাওয়াত করে খাওয়ালেন সবাইকে। তারপর মায়ের জন্য বর খোঁজা শুরু করলেন।
সে-যুগে জমিওয়ালাদের প্রভূত সম্মান ছিল। ভাগ্যবান এবং সম্মানিত বলে পরিগণিত হতেন তারা। সুতরাং চারদিক থেকে মায়ের জন্য বিয়ের খবর আসতে লাগল। এমনিতেও মায়ের জাঁকজমক ছিল; তার ওপর বরপক্ষের আকর্ষণ বাড়াবার জন্য নানি তাকে রোজ নতুন-নতুন কাপড় পরিয়ে নতুন বউ-এর মতো সাজিয়ে রাখতেন।
কখনো-কখনো মা স্মৃতিরোমন্থন করতে গিয়ে বলতেন, ‘সে-সময় তো আমার বাড়ি থেকে বের হওয়া মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। যে-পথ দিয়ে আমি যেতাম সে পথের লোকজন আমাকে দেখে হতভম্ব হয়ে যেত এবং পরস্পর বলাবলি করত, ‘ঐ যে, খেয়াল বখৃশ জমিদারের মেয়ে যাচ্ছে। না জানি কোন ভাগ্যবান তাকে বিয়ে করবে।’
‘মা, আপনার নজরে এমন কোনো ভাগ্যবান ছিল না?’ আমরা কৌতূহলী হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করতাম।
‘আরে বাপ, তউবা, তউবা।’ মা হাত দিয়ে কান ঢাকতেন, ‘আমার নজরে কেউ কী করে থাকবে। তবে হ্যাঁ, আমার অন্তরে এই সামান্য আশাটুকু ছিল যে, যেন আমি এমন কাউকে পাই, যে কিছুটা লেখাপড়া জানে–তা হলেই খোদার অপার অনুগ্রহ মনে করব।’
সারাজীবন এই একটি আকাক্ষাই মায়ের মনে তার নিজের জন্য রক্ষিত ছিল; সে আকাক্ষা খোদা এমনভাবে পূর্ণ করলেন যে, সেই বছরেই আবদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে মায়ের বিয়ে হয়ে গেল।
সেকালে ওই অঞ্চলে আব্দুল্লাহ্ সাহেবের খুব নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের একমাত্র সন্তান। কিন্তু পাঁচ-ছ বছর বয়সেই তিনি পিতৃহীন হয়ে পড়েন। অবস্থাও খুব খারাপ হয়ে পড়ে। বাপ মারা যাওয়ার পরই জানা গেল যে, তার সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তি বন্ধক দেয়া আছে। সুতরাং আবদুল্লাহ সাহেব তার মাকে নিয়ে একটা কুঁড়েঘরে আশ্রয় নিলেন। ধন-সম্পদের এই পরিণতি দেখে তিনি এমন এক সম্পদ আহরণ করতে দৃঢ় সংকল্প হলেন, যা কোনো মহাজনের কাছে বন্ধক দেয়া সম্ভব নয়। তাই আবদুল্লাহ্ সাহেব মনপ্রাণ দিয়ে লেখাপড়া করতে লাগলেন। বৃত্তির পর বৃত্তি লাভ করে, দু বছরের পরীক্ষা এক বছরে পাস করে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটিতে ম্যাট্রিকুলেশনে প্রথম হলেন। সেকালে সম্ভবত এই প্রথমবার কোনো মুসলমান ছাত্র ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় রেকর্ড স্থাপন করে।
উড়তে-উড়তে এই খবর স্যার সৈয়দের কানে গিয়ে পৌঁছল। তিনি তখন আলিগড় কলেজ পত্তন করেছেন। তিনি তার একজন বিশিষ্ট কর্মচারীকে গ্রামে পাঠালেন এবং আব্দুল্লাহ্ সাহেবকে বৃত্তি দিয়ে নিয়ে এলেন আলিগড়ে। এখানে এসে আবদুল্লাহ্ সাহেব অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়ে মাত্র উনিশ বছর বয়সে বিএ পাস করে সেখানেই ইংরেজি, আরবি, দর্শন ও অঙ্কের অধ্যাপক নিযুক্ত হলেন।
স্যার সৈয়দের কামনা ছিল মুসলমান যুবকরা অধিকতর সংখ্যায় উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত হোক। তাই তিনি আবদুল্লাহ সাহেবের জন্য বৃত্তি আদায় করে আইসিএস পরীক্ষা দেবার জন্য বিলেত যাবার বন্দোবস্ত করে দিলেন।
গত শতাব্দীর মুরুব্বিরা সাত সমুদ্র পারের যাত্রাকে খুব বিপজ্জনক মনে করতেন। সঙ্গত কারণে আবদুল্লাহ সাহেবের মা-ও তাকে নিষেধ করলেন বিলেত যেতে। আবদুল্লাহ্ সাহেবের ভাগ্য হল অপ্রসন্ন, তিনি বৃত্তি প্রত্যাখ্যান করলেন।
এ-কথা শুনে স্যার সৈয়দের রাগ এবং দুঃখ হল। তিনি অনেক করে বোঝালেন, ভয় দেখালেন, ধমক দিলেন; কিন্তু আবদুল্লাহ সাহেব না’ থেকে ‘হ্যাঁ’-তে এলেন না।
.
তুমি কি জাতীয় স্বার্থের চেয়ে তোমার বুড়ি মা’র কথাকে বড় মনে কর। স্যার সৈয়দ গর্জে উঠলেন।
‘জী হা।’ জবাব দিলেন আবদুল্লাহ সাহেব।
জবাব শুনে স্যার সৈয়দ রাগে আর সংযত রাখতে পারলেন না নিজেকে। কামরার দরজা বন্ধ করে প্রথমে তাকে চড় থাপ্পড় মারলেন। তারপর কলেজের চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দিয়ে বললেন, এখন তুমি এমন জায়গায় গিয়ে মর, যেখান থেকে আমি আর তোমার নামও যেন শুনতে না-পাই।’
আবদুল্লাহ সাহেব যেমন সুবোধ ছেলে ছিলেন, তেমনি ছাত্র হিসেবেও ছিলেন প্রতিভাবান। ম্যাপে তিনি সবচেয়ে দূরে গিলগিট শহর দেখতে পেলেন। সুতরাং, নাক বরাবর চলে গিয়ে সেখানে হাজির হলেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই সেখানে গভর্নর নিযুক্ত হলেন।
.
যে সময়ে মায়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছিল, সে-সময়ে আবদুল্লাহ্ সাহেবও ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন। অদৃষ্টের লেখন ছিল, তাই তার সঙ্গেই বিয়ের বাগদান হয়ে গেল। এক মাস পর বিয়ের তারিখও ঠিক হল, যাতে আবদুল্লাহ সাহেব বউ নিয়ে গিলগিট যেতে পারেন।
বাগদানের পর একদিন মা তার সইদের সঙ্গে নিয়ে পাশের গায়ে এক মেলায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে কিংবা সম্ভবত জ্ঞাতসারে আবদুল্লাহ্ সাহেবও সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
মায়ের সইরা তাঁকে ঘিরে ধরল। সবাই তাঁকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে পাঁচ টাকা করে আদায় করল। আবদুল্লাহ্ সাহেব মাকেও অনেক টাকা দিতে চাইলেন, কিন্তু তিনি নিলেন না। যখন খুব অনুরোধ করা হল, তখন নিরুপায় হয়ে মা এগারো পয়সার ফরমাশ করলেন।
‘এত বড় মেলায় এগারো পয়সা দিয়ে কী করবে?’ আবদুল্লাহ্ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
‘আগামী বৃহস্পতিবারে আপনার নামে মসজিদে তেল পাঠাব।’ মা জবাব দিলেন।
জীবনের মেলায়ও আবদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে মায়ের লেনদেন মাত্র বৃহস্পতিবারের এগারো পয়সার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তার চেয়ে বেশি পয়সা তিনি কোনোদিন চাননি এবং নিজের কাছে রাখেননি।
গিলগিটে আবদুল্লাহ সাহেবের খুব শান-শওকত ছিল। সুন্দর সাজানো বাংলো, প্রশস্ত বাগান, চাকর-বাকর, দরজায় প্রহরী। যখন আবদুল্লাহ্ সাহেব বাইরে টুরে যেতেন বা ফিরে আসতেন, তখন সাতটা তোপধ্বনি করে তাঁকে অভিনন্দন জানানো হত। এমনিতেও গিলগিটের গভর্নর হিসেবে সামাজিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন তিনি কিন্তু মায়ের ওপর এসব ক্ষমতা ও পূর্বের কণামাত্রও প্রভাব পড়েনি। কোনো প্রকারের ছোট-বড় পরিবেশও তাঁকে প্রভাবিত করতে পারত না। বরং মায়ের সরলতা ও আত্মনির্ভরশীলতা প্রত্যেক পরিবেশকেই গাম্ভীর্যমণ্ডিত করে তুলত।
সে সময়ে স্যার ম্যালকন হ্যাঁলি গিলগিটের রুশ ও চীন সীমান্তের ব্রিটিশ পক্ষীয় পলিটিক্যাল এজেন্ট নিযুক্ত হন। একদিন লেডি হ্যাঁলি ও তার কন্যা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাদের পরনে ফ্রক ছিল। হাঁটু থেকে গোড়ালি খোলা। এই নির্লজ্জতা মা পছন্দ করলেন না। তিনি রেডি হ্যাঁলিকে বললেন, ‘তোমার জীবন তো যেভাবে হোক কেটেই গেছে। এখন মেয়েটার জীবনটা তার নষ্ট কর না।’ এ-কথা বলে তিনি মিস্ হ্যাঁলিকে তার কাছে রেখে দিলেন। তাকে রান্না, বাসন মাজা, কাপড় সেলাই করা সব শিখিয়ে তার বাপমায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
যখন রুশ বিপ্লব শুরু হয়, তখন লর্ড কিসেজ গিলগিট সীমান্ত পরিদর্শনে আগমন করেন। তার সম্মানার্থে গভর্নরের পক্ষে থেকে এক ভোজসভার আয়োজন করা হয়। মা নিজের হাতে দশ-বারো রকমের খাবার তৈরি করেন। অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার। খাওয়ার শেষে লর্ড কিসেজ তার বক্তৃতায় বলেন, ‘মিস্টার গভর্নর, যে খানসামা এই খাবার রান্না করেছে অনুগ্রহপূর্বক আপনি আমার তরফ থেকে তার হাত চুম্বন করুন।’
ভোজ শেষে আবদুল্লাহ্ সাহেব খুশি মনে বাড়ি ফিরে দেখলেন মা রান্নাঘরের এক কোণে একটা মাদুর পেতে বসে লবণ ও মরিচের চাটনি দিয়ে মকাই-এর রুটি খাচ্ছেন।
একজন গভর্নরের মতোই আবদুল্লাহ সাহেব মায়ের হাতে চুমু দিলেন এবং বললেন, ‘যদি লর্ড কিসেজ এই আদেশ দিতেন যে, তিনি স্বয়ং খানসামার হস্ত চুম্বন করবেন, তাহলে তুমি কী করতে?’
‘আমি?’ মা ভ্রুকুটি করে বললেন, ‘আমি তার গোঁফ হেচকা টানে ছিঁড়ে নিতাম। তারপর আপনি কী করতেন?’
‘আমি?’ আবদুল্লাহ সাহেব নাটকীয় ভঙিতে বললেন, ‘আমি সেই গোঁফ তুলো দিয়ে বেঁধে ভাইসরস-এর কাছে পাঠিয়ে দিতাম। তারপর পালিয়ে যেতাম তোমাকে নিয়ে। যেমন করে পালিয়ে এসেছি স্যার সৈয়দের কাছ থেকে।’
মা এ-সব কথা গ্রাহ্যও করতেন না। কিন্তু একবার, শুধু একবার তিনিও হিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে মরেছিলেন–যা মেয়েদের একমাত্র উত্তরাধিকার।
গিগিটের আইন সংক্রান্ত আদেশাবলিকে ‘গভর্নরি’ বলা হতো। এ-কথা যখন মায়ের কানে গেল, তখন তিনি আবদুল্লাহ্ সাহেবকে অভিযোগ করলেন :
‘রাজত্ব তো করছেন আপনি; কিন্তু লোকে ‘গভর্নরি’, ‘গভর্নরি’ বলে আমাকে খামোখা মাঝখানে টানাটানি করে কেন?’
আবদুল্লাহ্ সাহেব ছিলেন আলিগড়ের ছাত্র। রসিকতা করবার জন্য মেতে উঠলেন তিনি। সরস কণ্ঠে বললেন : ‘ভাগ্যবতী, এ গভর্নরি তোমার নাম নয়। গভর্নরি হল তোমার সতীনের নাম–যে সব সময় আমার পেছনে ধাওয়া করছে।’
রসিকতার চূড়ান্ত। আবদুল্লাহ্ সাহেব বুঝলেন, কথার সমাপ্তি হয়ে গেল এখানেই। কিন্তু মায়ের মনে দুঃখ দানা বেঁধে গেল। তিনি কথাটা নিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলেন।
কিছুদিন পর কাশ্মীরের মহারাজা প্রতাপ সিং মহারানীকে সঙ্গে নিয়ে গিলগিট বেড়াতে এলেন। মা তার মনের ব্যথা মহারানীকে শোনালেন। মহারানীও ছিলেন অত্যন্ত সরল প্রকৃতির। তিনি উদ্বেলিত কণ্ঠে বললেন : ‘হায়-হায়, আমার রাজ্যে এই অত্যাচার? আমি আজই মহারাজাকে বলব, তিনি আবদুল্লাহ্ সাহেবকে দেখে নেবেন।’
ব্যাপারটা যখন মহারাজার কানে গেল, তিনি আবদুল্লাহ সাহেবকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। আবদুল্লাহ্ সাহেবও স্তম্ভিত হয়ে ভাবলেন এ কী বিপদ। কিন্তু ব্যাপারটা সম্বন্ধে যখন আরো খোঁজ নেয়া হল, তখন উভয়েই খুব করে হাসলেন। দু’জনেই বুদ্ধিমান। সুতরাং মহারাজা আদেশ দিলেন যে, এবার থেকে গিগিটের গভর্নরপত্নীকে ভবিষ্যতে ওজারত ও গভর্নরকে উজিরে ওজারত বলে সম্বোধন করা হবে। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত গিলগিটে এই সরকারি নির্দেশই প্রচলিত ছিল।
এই হুকুমনামা শুনে মহারানী মাকে ডেকে সুসংবাদ দিলেন যে, মহারাজ ‘গভর্নরি’কে দেশ থেকে বহিষ্কার করে দিয়েছেন।
মহারানীর কোনো সন্তান ছিল না। এজন্যে প্রায়ই তিনি মাকে দোয়া করতে বলতেন। মা নিজে অবশ্য বলতেন তাঁর মতো সৌভাগ্যশালী মা পৃথিবীতে কমই আছে। কিন্তু ধৈর্য, তুষ্টি এবং সব কিছু মেনে নেয়ার, সব কিছু সহ্য করার ক্ষমতা, চশমাজোড়া খুলে ফেলে যদি দেখা যেত তা হলে সেই সৌভাগ্যের পর্দার অন্তরালে কত দুঃখ, কত বিষাদ এবং কত আঘাত যে লুকানো ছিল তা প্রকট হয়ে ধরা পড়ত।
আল্লাহতালা মাকে তিনটি মেয়ে ও তিনটি ছেলে দান করেন। দুই মেয়ে বিয়ের কিছুকাল পরে একে-একে মারা যায়। বড় ছেলেও যৌবনের প্রারম্ভে বিলেতে গিয়ে মারা যায়।
মুখে অবশ্য বলতেন যে, আল্লাহ্র মাল, আল্লাহ্ নিয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি কি একা-একা কোনো সময়ই লুকিয়ে তাদের কথা মনে করে অশ্রুপাত করতেন না? যখন আবদুল্লাহ্ সাহেব ইন্তেকাল করেন, তখন তার বয়স ছিল বাষট্টি বছর ও মায়ের বয়স পঞ্চান্ন বছর। আবদুল্লাহ সাহেব দড়ির খাটে রোজকার মতো বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। মা পায়ের কাছে বসে চাকু দিয়ে আখ কেটে-কেটে তাঁকে দিচ্ছিলেন। তখন বিকেল। আবদুল্লাহ্ সাহেব মজা করে আখ চুষছিলেন আর মেতে ছিলেন হাসি-তামাশায়। তারপর অকস্মাৎ তিনি গম্ভীর হয়ে মাকে বললেন, ‘হায় আল্লা, বিয়ের আগে মেলায় তুমি যে আমার কাছ থেকে এগারো পয়সা নিয়েছিলে, তা কি শোধ দেয়ার সময় এখনও হয়নি?’
মা নববধূর মতো মাথা নামিয়ে আখ কাটতে লাগলেন। তাঁর বুকে একসঙ্গে অনেক কথা গুমরে উঠল।
‘সময় এখনো হল কোথায় প্রিয়? বিয়ের আগের এগোরো পয়সার ঋণ তো বইছিই। কিন্তু বিয়ের পরে যেমন করে তুমি আমাকে আদর-যত্ন করেছ সেজন্য তোমার পা ধুয়ে পানি খেতে হয়। আমার গায়ের চামড়া দিয়ে জুতো বানিয়ে তোমাকে পরানো উচিত। আমার। এখনই কি শোধ করবার সেই সময় এসেছে!’
কিন্তু আজরাইলের খাতায় সময় এসে পড়েছিল। মা যখন মাথা তুললেন, তখন আবদুল্লাহ সাহেব আখের টুকরো মুখে নিয়ে পাশবালিশের উপর ঢলে পড়েছেন। মা তাঁকে ডাকলেন, নাড়া দিলেন, সুড়সুড়ি দিলেন; কিন্তু আবদুল্লাহ্ সাহেব এমন ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন যে, তা থেকে জাগানো কিয়ামতের আগে কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
.
মা তাঁর অবশিষ্ট দুই ছেলে ও এক মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিলেন : ‘বাছারা, কেঁদো না–তোমাদের আব্বা যেমন শান্তিতে এই দুনিয়ায় বাস করতেন, তেমনি শান্তিতেই এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। কেঁদো না, কাঁদলে তার আত্মা কষ্ট পাবে।’
মুখে তো মা বললেন, তোমাদের আব্বার কথা মনে করে কেঁদো না, তাহলে তাঁর কষ্ট হবে। কিন্তু তিনি কি তার স্বামীর কথা স্মরণ করে বাকি জীবনে একটুও কাঁদেননি?
যখন তিনি নিজেও বিদায় নিলেন, তখন তার সন্তানদের মনে এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেলেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত তাদের মনের মণিকোঠায় অক্ষয় হয়ে থাকবে।
যদি মায়ের নামে কিছু দান করতে যাই, তাহলে এগারো পয়সার বেশি দিতে সাহস হয় না, অথচ মসজিদের মোল্লা তো বিস্মিত হয়ে বলেন যে, বিজলির রেট বেড়ে যাচ্ছে– তেলের দামও বাড়ছে।
মায়ের নামে যদি ফাতেহা দিতে চাই, তাহলে মকাই-এর রুটি আর লবণ-মরিচের চাটনির কথা মনে পড়ে। যাকে খাওয়াই সে বলে ফাতেহা দরুদে তো পোলাও-জরদা হওয়াই উচিত।
মায়ের কথা মনে এলেই বাঁধ ভেঙে কান্না আসে। কিন্তু যদি কাঁদি তাহলে ভয় হয়, পাছে মায়ের রুহের কষ্ট হয়, আর যদি কান্না দমন করতে যাই–খোদার কসম, কান্না থামানো যায় না।
৩. শ্ৰেষ্ঠ উর্দু গল্প – ৩য় খণ্ড
ভূমিকা
বর্তমানে পাকিস্তান আর ভারত মিলিয়ে উর্দুভাষী জনসংখ্যা ৭ কোটির ওপরে। উর্দু ভাষা এবং সাহিত্যের উৎকর্ষ তাই এই দুদেশের মিলিত প্রয়াসে।
১৯৪৭-পূর্ববর্তী উর্দু ছোটগল্পের প্রধান বিষয়বস্তু মূলত রাজনৈতিক আন্দোলন, সামাজিক জাগরণ কিংবা নারী-পুরুষের মিলন। কিন্তু দেশবিভাগের পরবর্তীতে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটল ছোটগল্পে– সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কিংবা পরাধীন কাশ্মিরের কাহিনীতে মানুষের নীচতা আর নির্যাতনকে ছাপিয়ে মর্মস্পর্শী হয়ে উঠল মানবতাবোধ; বিদ্বেষ বিতৃষ্ণা হতাশা ছাপিয়ে উঠে এল প্রেম আর আশার উচ্চকিত উচ্চারণ। ক্রমশ স্থিরতা এল সমাজ ও মানবজীবনে– প্রতিদিনের তুচ্ছ সাধারণ ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হল অন্তরের বিচিত্র সূক্ষ্ম অনুভূতির অনবদ্য অতলস্পর্শী রূপ।
উর্দু ছোটগল্পের এই সৌন্দর্য পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে ইতোপূর্বে নাতিদীর্ঘ ভূমিকাসহ প্রকাশিত হয়েছে শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্পের দুটি সংকলন। খণ্ড দুটিতে উর্দু সাহিত্যে আধুনিকতার উদ্ভব-পর্ব থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত প্রধান লেখক হিশেবে যাঁরা নিজেদের ভাষা-বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন তাঁদের লেখাই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নির্বাচিত গল্পগুলো লেখকদের প্রতিনিধিত্বকারী ও শ্রেষ্ঠ রচনা, ফলে খণ্ড দুটিকে উর্দু কথাসাহিত্যের প্রামাণ্য বাংলা সংকলন হিশেবে সহজেই চেনা যায়। কিন্তু উর্দু ছোটগল্পের বিপুল ঐশ্বর্যের সামান্য অংশই ধরা সম্ভব হয়েছে খণ্ড দুটির স্বল্প পরিসরে। তাই ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পরবর্তীকাল থেকে এ পর্যন্ত অনূদিত– আশ্চর্যজনক হলেও ১৯৭১-পরবর্তীতে যা গুণগত মানে না হলেও পরিমাণে বিপুলতর– রচনা থেকে বাছাইকৃত সেরা রচনাগুলো দিয়ে আরও তিনটি খণ্ডে (তৃতীয় থেকে পঞ্চম) প্রকাশিত হল শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্প নামে। প্রতিটি খণ্ডেই রয়েছে বিচিত্র স্বাদের অনন্য কিছু গল্প। এখানে অনেক চেনা, নামী লেখকের পাশে স্থান পেয়েছে অজানা কিংবা প্রায়-অনামা লেখকের বিস্ময়কর সাহিত্যগুণসম্পন্ন রচনা; ধরা পড়েছে মানবিকতা, হাস্যরস, মনোবিশ্লেষণ, জীবনবোধ কিংবা প্রতীকী গল্পের মধ্যে দিয়ে উর্দু ছোটগল্পের ঋদ্ধ বিস্তৃত ভুবন।
জাহিদ হাসান
গোঁফ – হামিদ কাশ্মিরি
স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে, ফটক পর্যন্ত এসে দিলাওয়ার খান কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকল। রাস্তায় এত লোক। সবাই তো পায়ে হেঁটে চলেছে। প্রত্যেকটি চলমান লোকের মুখের ওপর সে একবার করে গভীর দৃষ্টি ফেলল। শহরে তার এই প্রথম আসা। তা-ও এত বড় শহর। কাজেই শহর দেখতে যে অদ্ভুত লাগবে, সেরকম একটা ধারণা মনে মনে পোষণ করে রেখেছিল আগেই থেকেই। কিন্তু এ শহর যে এত অদ্ভুত, তা সে আগে কখনো ভাবেনি।
শুধু শহর নয়– শহরের মানুষগুলোও অদ্ভুত। এমন একটা মানুষও তো দিলাওয়ার খান গ্রামে কখনো দেখেনি। এদের পোশাক কেমন বিচিত্র। মাথায় তার মতো কেউই পাগড়ি জড়ায়নি। গ্রামের যারা গরীব লোক, যারা চল্লিশ গজি পাগড়ির পয়সা যোগাতে পারে না, তারাও কখনো মাথা খালি রাখে না। আর কিছু না-হোক একটা লুঙ্গি হলেও তাই মাথায় জড়িয়ে নিয়ে তবে বাড়ির বাইরে বেরোয়। আর, এ শহরের মানুষ টুপিটা পর্যন্ত মাথায় চাপায়নি। সবারই মাথা উলঙ্গ। তার ওপর আবার মর্দানা আর জানানা চেনা দায়। কোনো কোনো মেয়েলোকের চুল পুরুষ মানুষের মতো করে ছাঁটা, আর শরীরের অর্ধেকের বেশি বেআবরু। আবার অনেক পুরুষ জানানা পোশাক পরেছে।
সবচাইতে তাজ্জবের ব্যাপার, কোনো পুরুষেরই মুখে গোঁফ নেই। তার মতো অমন লম্বা-চওড়া গোঁফ দূরের কথা– কারও নাকের নিচে সামান্য গোঁফের রেখাটুকু পর্যন্ত লক্ষ করা যায় না। দুই পাশে তা দিয়ে দিয়ে পাকিয়ে রাখা তার মতো অমন জমকালো গোঁফ তাদের গ্রামের সবারই যে রয়েছে, এমন কথা সে বলতে চায় না। কিন্তু একেবারেই গোঁফ নেই, এমন তো কখনো হতে দেখেনি সে।
দাড়ি কেউ রাখে, কেউ রাখে না; কিন্তু গোঁফ প্রত্যেকেই রাখে যার যার সাধ্য আর সামর্থ্য মতো। যার ছাতিতে যত তাকত, তার গোঁফ তত জমকালো। নিজের গ্রামে দিলাওয়ার খানের গোঁফ সবচাইতে বড় বলেই-না তার এত খাতির। তার গোঁফের খ্যাতি আশপাশের চৌদ্দটা গ্রামের মধ্যেও বিস্তার লাভ করেছে। গোঁফের এই মর্যাদা কোনোদিনও ক্ষুণ্ন হতে দেয়নি সে, তার সাহস আর বীরত্বকে যেমন দেয়নি কখনো ম্লান হতে। গ্রামের সবাই আগে তাকেই সালাম দেয়। তাই বলে সে দাম্ভিক নয়। আগে সে সালাম করতে চাইলেও গ্রামের লোকরাই সে সুযোগ দেয় না কখনো। যাই হোক, এ তার প্রাপ্য সম্মান। এমন সম্মান জুটতে পারে খুব কম লোকের ভাগ্যেই।
শহরের এইসব অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করে দিলাওয়ার খান অবাক হল। তারপর সে লক্ষ করল, তার গোঁফের দিকে যার চোখ পড়ছে, সেই যেন ভয় পেয়ে যাচ্ছে। সেই জন্যই এই গোঁফ দেখছে তারা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে।
তার মধ্যে একটা ছেলে– যার জামাটা মেয়েদের মতো গায়ের সঙ্গে সেঁটে রয়েছে আর সে জামায় ফুল-পাতায় নকশা কাটা– যেন খানিক মশকরার ভঙ্গিতে বেশকিছুটা কাছে থেকে দিলাওয়ার খানের গোঁফ দেখছিল। চাল-চলন, হাব-ভাব দেখে ছেলেটাকে দিব্যি জানানা বলেই বোধ হচ্ছে। এই কারণে তার এইভাবে তাকিয়ে থাকাকে সে গুরুত্ব দিল না। ভাবল, গোঁফ দেখার শখ মিটলেই চলে যাবে সে। কিন্তু ছেলেটা চলে যাওয়া দূরে থাক– এখন তার এক সঙ্গীর কাঁধের উপর কনুই রেখে হেলান দেওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আরও মজা করে দেখতে লাগল, আর দেখার মধ্যে আগের মতো তেমনি মশকরার ভাব। দিলাওয়ার খান আর সহ্য করতে পারল না। তখন সে ঘাড় টান করে দাঁড়াল। এক মুহূর্ত চোখ ফেলল। গোঁফে সামান্য একটু কাঁপুনি দিল। এই গোঁফ নড়ানো দেখেই ছেলেটা তার সঙ্গীকে নিয়ে এমন এক দৌড় মারল যে, আর ফিরেও তাকাল না। মনে মনে মুচকি হেসে আস্তে আস্তে রাস্তায় নেমে পড়ল দিলাওয়ার খান।
রাস্তায় নেমেও সেই এক কাণ্ড! লুকিয়ে লুকিয়ে কিংবা প্রকাশ্যে, আড়চোখে কিংবা পেছন ফিরে, দূরে থেকে কিংবা কাছ থেকে একবার, দুবার, তিনবার করে প্রত্যেকে তার গোঁফ দেখছে। লোকগুলো যেন ভাবছে, রাজ্যের যত গোঁফ সবই দিলাওয়ার খানের নাকের নিচে এসে জড় হয়েছে। দিলাওয়ার খান ভাবল, তার কাছে যেমন শহরটা অদ্ভুত সেও তেমনি অদ্ভুত এই শহুরে লোকগুলোর কাছে।
যাই হোক, সে আনন্দিত যে, সবাই তার আগমন উপলব্ধি করছে। কত লোকই তো এই শহরে প্রতিদিন আসে, কিন্তু কেউ কি তাদের এইরকম ভয়ের চোখে দেখে! গ্রামের লোকরাও তাকে ভয় করে চলে। অবশ্য সেজন্য তাকে যথেষ্ট খাটতে হয়েছে। যথেষ্ট শক্তির পরীক্ষা দিতে হয়েছে। কত ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছে তাকে। কিন্তু শহরে এসে সেরকম কিছুই করতে হল না। বিনা খাটুনিতেই লাভ করল এমন মর্যাদার আসন। সুতরাং, দাঁড়িয়ে পড়ে একবার সে ভালো করে গোঁফে একটা তা দিয়ে নিল। ছাতিটা টান করল। গর্দান উঁচু করল। মনেই থাকল না কোথায় তাকে যেতে হবে। ভুলেই গেল, কেউ তাকে স্টেশনে নিতে আসেনি কেন।
যখন মনে পড়ল, তখন ভারি দুঃখ হল। ভাবল, হয়তো তার চিঠি এখনো পৌঁছায়নি। তারপর নোটবুকে লেখা ঠিকানা দেখে নিল। কিন্তু কেমন করে সেখানে যেতে হবে, তা সে জানে না। সামনের ফুটপাতে মিনমিনে ধরনের একটা লোককে দেখতে পেয়ে তার দিকে এগুলো জিগ্যেস করার জন্য। লোকটা আগে থেকেই তার গোঁফের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে দিলাওয়ার খানকে তার দিকে এগুতে দেখে ভয় পেয়ে এলোপাথাড়ি দৌড় মারতে শুরু করে দিল।
‘আখো, বুদিল।’ লোকটাকে গালি দিল সে কাপুরুষ বলে। তারপর, অন্য একজনের কাছে ঠিকানা জানতে চাইল সে। এবারের লোকটা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল না। দিলাওয়ার খানকে সে বুঝিয়ে দিল যে ওই বাস-স্ট্যান্ডে গিয়ে বাসে চাপলে চৌরঙ্গি পৌঁছানো যাবে, সেখানে থেকে অন্য বাস ধরলে চলে যেতে পারবে গন্তব্যস্থলে।
বাস-স্ট্যান্ডে বিরাট একটা লাইন লেগেছিল। এই লাইনের মর্ম দিলাওয়ার খানের জানা নেই। জানবার চেষ্টাও সে করল না। লাইনের বাইরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চালগোজা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে খেতে লাগল আর বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। সবাই লুকিয়ে লুকিয়ে, আড়চোখে তাকে দেখছে। সামনে এসে দাঁড়ানোর সাহস নেই কারও মনে এইভাবে সর্ববিধ দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হতে পারায় তার মনে যদিও গর্বের অন্ত ছিল না, কিন্তু বাস-স্ট্যান্ডে আসার পর এই দেখার মাত্রা এত বেড়েছে যে, এখন সে বিরক্তি অনুভব করতে আরম্ভ করল। কাজেই ব্যাপারটাকে আর আদৌ আমল না দিয়ে আপন মনে চালগোজা চিবোতে থাকল সে। এমন সময় একটা বাস এল, আর সঙ্গে সঙ্গে সে বাসের দিকে ধাবিত হল। কিন্তু তার পৌঁছানোর আগেই বিরাট লাইনের একটা দিক বাসের ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করে দিয়েছে। এই অবস্থা’ দেখে সে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে থাকল। তারপর যখন বুঝল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে– বাস প্রায় ভরে গেছে। কাজেই আর সময় নষ্ট না করে সামনের দিকে লাইনের এক জায়গায় সে ঢুকে পড়ল। পেছনের লোকরা অস্বস্তি অনুভব করল, কিন্তু কারও সাহস হল না প্রতিবাদ করার।
বাস একদম ভরে গেছে। দিলাওয়ার খান অনেক পরে ঢুকেছে বলে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হল। ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে থেকে কারও কেবল গা দেখা যাচ্ছে, কারো কেবল পা।
গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কন্ডাক্টর টিকিট কাটতে লাগল। নিয়মমতো, একজনের কাছে একবারের জায়গায় পাঁচবার চাইলে তবে টিকিটের পয়সা পাওয়া যায়। কন্ডাক্টর প্রথমে বসে-থাকা লোকদের টিকিট কেটে গেল। তারপর দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের সম্বোধন করতে লাগল তার চিরাচরিত ভাষায় ‘টিকিট।’
‘ও ভাই, টিকিট।’
‘টুপিঅলা ভাই, টিকিট।’
‘গামছাঅলা ভাই, টিকিট!’
‘শেরওয়ানিঅলা ভাই, টিকিট।’
‘ও ভাই, গোঁ-ও-ও-ফ…’
দিলাওয়ার খানের গোঁফ পাশ থেকে সামান্য এক শতাংশ দেখেই সে এই সম্বোধন করতে যাচ্ছিল। কিন্তু যেই পুরো দেখেছে, অমনি তার মুখের মধ্যেই কথাটা আটকে থেকে গেল, বেরুতে পারল না। দিলাওয়ার খানের আগুন ঠিকরানো চোখ দেখে সে রীতিমতো ভড়কে গেল ভয় পেয়ে। ভয়ে তার সর্বশরীর কাঁপতে লাগল থরথর করে। ওদিকে দিলাওয়ার খানও তার সেই ভয়ঙ্কর দৃষ্টি কিছুতেই সরিয়ে নিচ্ছে না কন্ডাক্টরের ওপর থেকে। যারা দেখেছে, তারাও প্রত্যেকে চুপ মেরে গেছে। গোটা বাসে একটা থমথমে নীরবতা। মনে হচ্ছিল, কন্ডাক্টারকে এখনই খুন করে ফেলবে দিলাওয়ার খান। তারই মধ্যে একজন সদাশয় ব্যক্তি বলে উঠলেন, ‘খান সাহেব, যাত্রা মাফ করে দাও ওকে। দেখছ না, ও একটা পাগল, বদ্ধ পাগল। ওকে ছেড়ে দিয়ে আমাকেই না হয় দুটো গাল দিয়ে দাও, খান সাহেব।’
‘আখো, জানানা, মরদের বাচ্চা গাল দেয় না।’ এই বলে সে সত্যি সত্যি মাফ করে দিয়ে অন্য দিকে মুখ ফেরাল।
চৌরঙ্গি পৌঁছে বাস থেকে নেমেই প্রথমে তার চোখ পড়ল একটা চুল-কাটা সেলুনের ওপর। তার মনে পড়ল, তিন দিনের সফরে তার গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজিয়েছে। গালে হাত বুলিয়ে সে তা অনুভব করল। সেলুনে ঢুকে দাড়ি চেঁছে নেবে কিনা, তাই সে ভাবতে লাগল। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, তাছাড়া বাস এসে চলে যেতে পারে মনে করে তাকে ইচ্ছা পালটাতে হল। তাছাড়া, এখানকার নাপিত আনাড়ি হলে গোঁফের গড়ন নষ্ট করে ফেলতে পারে। গ্রামের কালু নাপিত তার দাড়ি কাটতে কাটতে কেমন হাত পাকিয়ে ফেলেছে। এই কারণে প্রতি দফা দাড়ি কাটার পর দিলাওয়ার খান তাকে এক সের আনাজ দিয়ে দেয়। কালু নাপিত এইরকম দাক্ষিণ্য অন্য কারও দাড়ি কেটে কখনো আশাই করতে পারে না।
দাড়ি কাটার ইচ্ছাটা সকাল পর্যন্ত স্থগিত রেখে দিলাওয়ার খান বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। এখানে আগের মতো লাইন করে লোক দাঁড়ায়নি। কিন্তু একটা জিনিস বোঝা গেল যে, বাস বেশ দেরিতে আসে। সুতরাং, সে পায়চারি করে বেড়াতে লাগল ফুটপাতের উপর। এখানেও আগের মতোই পথচারীদের কাছে সে দর্শনীয় বস্তু। কিন্তু গোঁফহীন চেহারা দেখে দেখে সে এই শহরের লোকদের ওপর এত বেশি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে যে, তাদের দিকে চোখ তুলে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করছে না আর। পুরুষ হয়েও গোঁফ নেই। এ শহরের লোকগুলো যেন পুরুষ নয়, হিজড়ে। যে শহরে একসঙ্গে এত হিজড়ে বাস করে, শহরের প্রতি কোনোরকমের আকর্ষণ অনুভব করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সত্যি, তার খুব দুঃখ হতে লাগল এইসব হিজড়ে-মার্কা পুরুষের জন্য।
এইভাবে আরও কত কী সে চিন্তা করছিল, এমন সময় হঠাৎ এই হিজড়ের শহরে সে একটা পুরুষমানুষ দেখে ফেলল। দিলাওয়ার খানের কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে বিরাট স্বাস্থ্যবান এক জোয়ান মর্দ এসে দাঁড়াল। শুধু চেহারা নয়– সেই চেহারায় চটকদার গোঁফও রয়েছে। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে দিলাওয়ার খানের গোঁফের চাইতে কিছু কম হলেও সে গোঁফের বাহার রয়েছে। চোখে চোখ পড়তেই দুজনেই দুজনকে বিস্মিত হয়ে দেখতে লাগল। লোকটা এমনভাবে দিলাওয়ার খানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, যেন এই শহরে এই প্রথম একটা মর্দের মতো মর্দের সন্ধান পেয়েছে। হিজড়ের শহরে এমন একটা মর্দকে পেয়ে দিলাওয়ার খান মনে মনে খুশিই হচ্ছিল; কিন্তু পরক্ষণেই একটা জিনিস লক্ষ করে সে হুঁশিয়ার হয়ে উঠল। মনে হতে লাগল, লোকটা কেবল তাকিয়ে নেই– থাকবে কেন। লোকটা মাঝে মাঝে ডান চোখ বন্ধ করে বাঁ চোখ দিয়ে গুলি ছুড়ছে আর গোঁফের ডগায় থেকে তা দিচ্ছে। দিলাওয়ার খান স্পষ্ট বুঝে ফেলল, লোকটার গোলমাল করার ইচ্ছা রয়েছে।
নতুন শহরে এসে সে একটা অপ্রীতিকর ঘটনার কারণ হতে চায়নি। কিন্তু কেউ তার বাহাদুরিকে টিটকারি দেবে, তাই-বা সে সহ্য করে কেমন করে। সুতরাং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সে নিজেকে যে-কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য প্রস্তুত করে নিল। চ্যালেঞ্জের জবাব চ্যালেঞ্জ। সে-ও আগুন ছুঁড়ে মারতে লাগল, তার চোখ দিয়ে।
চোখের ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই লোকটা দিলাওয়ার খানের দিকে আস্তে আস্তে অগ্রসর হতে লাগল। দিলাওয়ার খান পরিষ্কার দেখল, পালনের পকেটে হাত দিয়ে লোকটা কী একটা খুঁজছে।
ধারালো জিনিস দিলাওয়ার খানের কাছেও রয়েছে। চট করে সে-ও গোপন জায়গায় রক্ষিত ছুরিতে স্পর্শ গ্রহণ করে নিশ্চিন্ত হল। কিন্তু সাব্যস্ত করল, কিছুতেই সে আগে আক্রমণ করবে না।
ওদিকে লোকটা আরও কয়েক পা দিলাওয়ার খানের দিকে এগিয়ে এসেছে। সুতরাং, দিলাওয়ার খান আরও খানিকটা সতর্ক হয়ে শক্তভাবে দাঁড়াল। দেখে মনে হতে লাগল যেন দুই ষাঁড় পরস্পর মুখোমুখি হয়েছে লড়াইয়ের জন্য। দূরত্ব ক্রমেই কমতে লাগল। তারপর, অল্পক্ষণের মধ্যেই লোকটা দিলাওয়ার খানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাতটা তখনো পকেটেই। সেই হাত ছুরিসহ কখন পকেট থেকে বের হয়, তার জন্য দিলাওয়ার খান সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কিছুতেই সে আগে আক্রমণ করবে না। এটা তার নিজের শহর নয়। ভিন জায়গায় এসে কিছুতেই সে কলঙ্কিত হতে চায় না।
কিন্তু কী আশ্চর্য, লোকটার হাত তো কই নড়ল না। তার বদলে নড়ল কেবল ঠোঁট দুটো। সেই ঠোঁট দিলাওয়ার খানের একেবারে কানের কাছে নিয়ে এসে লোকটা জিগ্যেস করল মোলায়েম করে, ‘খান সাহেব, মাল-টাল লাগবে?’
‘আখো! কিসের মাল! কেমন মাল।’ কিছুতেই বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করল দিলাওয়ার। ‘খান সাহেব, যেমন বলবেন, তেমনি মাল। একেবারে টাটকা মাল। কাশ্মিরি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, হিন্দুস্তানি, বাঙালি, পাঠান মাল, পাহাড়ি মাল। একেবারে বেড়ে খাসা মাল।’
দিলওয়ার খানের মনে হল, গোটা একটা বিরাট পাহাড় যেন দেখতে দেখতে ব্যাঙে পরিণত হয়ে গেল। রাগে তার সর্বশরীর কাঁপতে লাগল থরথর করে। সারা শরীরের শিরা-উপশিরা টানটান হল। একটা কথা না বলে সে রাস্তায় এপাশে-ওপাশে তাকাতে লাগল। অমনি চোখে পড়ল চুল-কাটা সেলুনটা। পাগলের মতো হয়ে লাফাতে লাফাতে সেখানে গিয়ে ঢুকে পড়ল। হাঁপাতে হাঁপাতে চেয়ারের উপর গিয়ে বসল। ভয়ে ভয়ে গোঁফের দিকে তাকাতে তাকাতে ক্ষৌরিক দাঁড়াল কাছে এসে। তারপর, সম্ভ্রমে প্রশ্ন করল, ‘বলুন, খানসাহেব, দাড়ি কাটবেন?’
‘আখো! দাড়ি চলে গেছে জাহান্নাম। তুমি আগে আমার গোঁফ মুড়িয়ে দাও। এদিকে শালার কেবল খেমটাউলির ভেড়ুয়ারাই গোঁফ রাখে।’
ক্ষৌরিক ক্ষুর চালাবার আগেই দিলাওয়ার খানের দুচোখ বেয়ে দরদর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু বহু কষ্টে সে সংবরণ করে নিল তার বুক-ভাঙা কান্নার জোয়ার।
মৌন – শফিকুর রহমান
বছরের শেষ দিন। শেষ দিনের শেষ রাত।
ফ্রন্ট থেকে কয়েক শো মাইল দূরে কোনো এক হোটেলে আমরা নাচ দেখছি। আমি, ডন আর নিক। আমরা এই তিনজন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। হোটেলের এক কোনার এই টেবিলটা সবসময় ব্যবহার করি আমরা। এই টেবিল আমাদের পছন্দ, আমাদের খুবই প্রিয়।
চারটা চেয়ারের তিনটায় আমরা বসেছি। একটা খালি পড়ে রয়েছে। ওটা জিফের। জিফ ফ্রন্ট থেকে ফিরে আসেনি। জিফের জাহাজ নিখোঁজ রয়েছে। কিছুদিন আগে জিফকেও নিখোঁজ ঘোষণা করা হয়েছে।
মাত্র কয়েক বছর হল গড়ে উঠেছে আমাদের বন্ধুত্ব। কিন্তু এ বন্ধুত্ব সুদৃঢ়। যুদ্ধের ভয়াবহতা দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ দিয়েছে ঘুচিয়ে। জিফ এখন আমাদের সঙ্গে নেই; কিন্তু আমরা এই চারজন যেন এক সত্তা।
নিউজিল্যান্ডের ডন, ক্যানাডার নিক, আমেরিকার জিফ আর আমি একসঙ্গে চলাফেরা করি, একসঙ্গে খাই এবং যথাসম্ভব একসঙ্গে ছুটি নেওয়ারও চেষ্টা করি। ছুটি পেলেই আমরা এই হোটেলে এসে উঠি। এখানকার নাচ উপভোগ করার জন্য এই নির্দিষ্ট টেবিলটায় বসি। এবারেও বড়দিনের ছুটি পেয়ে আমরা এখানে চলে এসেছি। আর, পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করব বলে এখানে এসে জুটেছি। আমরা সবাই এসেছি, কেবল জিফ আমাদের সঙ্গে নেই।
জিফ আমাদের সঙ্গে নেই। এমন দিনে তার অনুপস্থিতি আমাদের মনে বড় বাজছে। এখানে এসেই নিকের কাছে জিফের খবরটা প্রথম শুনলাম। আমি তার জন্য আমার বরাদ্দ চকোলেট সঞ্চয় করে রেখেছিলাম। সেই চকোলেট আমি সঙ্গে এনেছি। কিন্তু জিফ নেই। জিফ চকোলেট খেতে খুব ভালোবাসে।
বছরের শেষ রাত। একই রাত্রে একটা বছর শেষ হয়ে অন্য বছর শুরু হবে। হোটেল সেই জন্য বিশেষভাবে আলোকসজ্জিত। এত আলো যে, দিন না রাত, বুঝবার উপায় নেই। ইতালীয় বালা মাইক্রোফোনে গান গাচ্ছে। অর্কেস্ট্রায় সুরের ঝঙ্কার। গান শেষ হলে একে একে দেশ-বিদেশের নাচিয়ে মেয়েরা নাচ দেখাচ্ছে। কখনো একা। কখনো একসঙ্গে অনেকে। এত আলো, এত আনন্দ, এত উল্লাস– অল্পক্ষণের জন্য হলেও মানুষ সব দুঃখ-বেদনা নিঃশেষে ভুলে যায়। আজকের গানের সুর ভিন্নতর। আজকের নাচের ছন্দ অনেক বেশি প্রাণ-উচ্ছল।
আজকে নাচ-ঘরে যারা এসেছে, তাদের বেশির ভাগই আমাদের মতো সৈনিক।
ডন বলল, ‘আমাদের কাছে এমন একটা ছবি নেই, যাতে একসঙ্গে আমরা চারজন রয়েছি। কোনোটাতে দুজন, কোনোটাতে তিনজন। জিফকে নিয়ে আমাদের চারজনের একটা গ্রুপ-ফোটো তুলে রাখা উচিত ছিল।’
নিক বলল, ‘আমার মন বলছে, জিফ মরেনি। জিফ বেঁচে থাকার জন্যেই এ দুনিয়াতে এসেছে। জিফ মরবার মতো ছেলে নয়। আমার মন বলছে, জিফ আবার আসবে।’
তারপর, জিফকে নিয়ে আমাদের আলোচনা অনেক দূর গড়িয়ে গেল। এক-এক সময় মনে হতে লাগল, জিফ যেন আমাদের মধ্যেই বসে রয়েছে। তার হাসবার, হাসবার কায়দা, তার কথা বলবার ঢং, তার বাঁধ-ভাঙা প্রাণের জোয়ার, তার নাক-চোখ-মুখ, তার দুর্বার সাহসের কথা– সবই একে একে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ছায়াছবির মতো ভেসে যেতে লাগল।
ডন বলল, ‘জিফকে আমি কোনোবারই কিছু দিতে পারলাম না। একবার দোকানে একটা দামি ঘড়ি দেখে তার খুব লোভ হয়েছিল। কিন্তু তার কাছে অত টাকা নেই। আমার কাছে সে টাকা চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, এত দামি ঘড়ি কেনার কোনো মানে হয় না। আমি তাকে টাকা দিইনি। আজকে আমার মনটা কেমন খচ্খচ্ করছে। আজকে যদি সে এখানে থাকত, ঘড়িটা কিনে আমি তাকে দিয়ে দিতাম বড়দিনের উপহার হিসেবে।’
নিক বলল, ‘জিফের মতো বন্ধু হয় না। কতবার রুষ্ট হয়েছি, কতবার গালাগালি দিয়েছি, কতবার এমন হয়েছে যে, মাসের পর মাস চিঠি লিখিনি, কিন্তু জিফ কখনো তা মনে রাখেনি। দেখা হলেই তেমনি উদার হাসি দিয়ে সে আপায়ন করেছে।– এমনি দিনে কোথাও বসে বসে জিফও হয়তো আমাদের কথা ভাবছে।’
হোটেলের প্রৌঢ় ইংরেজ মালিক আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। আমাদের কুশল জানতে চাইলেন। কিছুক্ষণ কথা বললেন আমাদের সঙ্গে। তারপর, আমাদের টেবিলে বয়কে ডেকে দিয়ে চলে গেলেন।
জাজ্ বাজতে শুরু করেছে। জোড়ায় জোড়ায় নারী-পুরুষ নাচতে আরম্ভ করল।
নিক তার নিজের ইউনিটের কথা শোনাতে লাগল। তাদের ফ্রন্টে প্রত্যেকদিন বোমা পড়েছে। তাদের ইউনিটের একজন অসীম সাহসী তরুণের কথা সে শোনাল। বলল, আমি অমন সাহসী সৈনিক দেখিনি। সবসময় সবার আগে সে। চতুর্দিক থেকে গুলি আসছে, তারই মাঝখান দিয়ে তাকে আমি নিরাপদে বেরিয়ে আসতে দেখেছি। আমি তাকে এমন জায়গায় একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি, সেখানে তার চারপাশে বোমা পড়ছে। সব অবস্থাতে সবসময় তার মুখে হাসিটুকু লেগেই রয়েছে। আমি কোনো সময় তাকে হাসি-ছাড়া পাইনি। তার সম্বন্ধে আমার মনে বদ্ধমূল ধারণা, এই যুদ্ধে কোনো অস্ত্রের আঘাতই তাকে কাবু করতে পারবে না। আমি নিজেকেও তার সঙ্গে থাকলে নিরাপদ মনে করেছি। তার সাহস আমাকেও সাহসী করে তুলেছে। একদিন আমাদের ইউনিটের একটা অংশের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ হয়েছিল। শুনলাম, এই আক্রমণে আমাদের খুব ক্ষতি হয়েছে। দেখতে গেলাম। মৃতদেহ শনাক্ত হচ্ছিল। সেই লাশের স্তূপের মধ্যে আমি তাকে দেখলাম। দেখেও আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। সে মরে গেছে। কিন্তু তার ঠোঁটের কোনায় তেমনি হাসি– অনির্বাণ। মরা মানুষের হাসি আমি জীবনে কোনোদিনও ভুলতে পারব না।’
‘আর একটা জিনিস কখনো লক্ষ করেছ?’ ডন বলল, ‘যখন চারিদিকে বোমা ফাটে কিংবা মুষলধারে গুলি বর্ষে, তখন সারা শরীরে একরকমের উত্তাপ এসে যায়, সমস্ত ভয় মন থেকে দূরে চলে যায়। কিন্তু প্রচণ্ড ভয় লাগে তখন, যখন চারিদিকে ছড়িয়ে থাকে স্তব্ধতা, নীরবতা, মৌনতা, যখন এক দফা ঝড় উঠে থেমে গেছে আর দ্বিতীয় দফা ঝড়ের জন্যে অপেক্ষা করছি। এই স্তব্ধতা কেন এত ভয়াবহ, বলতে পার? বলতে পার, এর এক-একটি মুহূর্ত কেন এক-একটা যুগ বলে মনে হয়?’
হোটেলের মালিক আবার এলেন। এসে বললেন, ‘ছেলেরা, তোমরা এত বিষণ্ণ কেন? আজকের রাত্রে দুঃখ করতে নেই। সবাই নাচছে, আর তোমরা বসে রয়েছ। ওই যে তিনটি মেয়ে, অনেকক্ষণ থেকে একাকী বসে বসে সঙ্গী খুঁজছে। আমি ডেকে দিই?’
হোটেলের মালিক দিল-দরিয়া মানুষ। অনুমতির অপেক্ষা না করেই তিনি চলে গেলেন মেয়েদের ডাকতে।
আমার সঙ্গে যে মেয়েটি নাচল, তার চুল লাল, চোখ লাল, ঠোঁট লাল। দীর্ঘ, লীলায়িত দেহ। সুন্দরী। যৌবনবতী। তার লাল চুল এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত। মুখে মদের গন্ধ। চোখে প্রেমের নেশা টইটম্বুর।
বলল, ‘তুমি যেন বোবা, কথা বলছ না কেন?
কথা বললাম।
আবার বলল, ‘তুমি যেন নিস্তেজ, অত আস্তে আস্তে নাছে কেন?’
জোরে জোরে নাচলাম।
বলল, ‘উফ্, তোমার হাত কী ঠাণ্ডা। চল মদ খেয়ে আসি।’
গেলাম। মেয়েটি মদ খেল। আমি খেলাম না। অনেক পীড়াপীড়ি করল। জানতে
চাইল, কেন খাব না। বললাম এখনো ধরিনি। যখন ধরব তখন থেকে খাওয়া যাবে। তখন আমার ভাগটুকুও নিজেই খেয়ে ফেলল।
এমনি করে কয়েক দফা মেয়েটি আমার সঙ্গে নাচল। প্রতি দফা নাচ শেষ হলে আমাকে নিয়ে মদ খেতে গেল। প্রতি দফা সে আমাকে খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করল। প্রতি দফা আমার ভাগটুকুও নিজেই খেয়ে ফেলল সে।
তারপর, মেয়েটি যখন আর নাচতে পারছিল না, যখন তার পা আর মন আর আদৌ তার বশে নেই, তখন তার কামরায় রেখে আসতে সে আমাকে অনুরোধ করল। সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় তার পা খুব বেশিরকম টলতে লাগল। তখন বলল, ‘আমাকে ধরছ না কেন। আমি যদি পড়ে যাই। তোমাকে আমি সঙ্গে আনলাম তাহলে কী জন্যে।’
আমি তার হাত চেপে ধরলাম। ধরে ধরে উপরে নিয়ে গেলাম।
বলল, ‘তুমি অত ভয়ে ভয়ে আমাকে ধরেছ কেন। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেও আমি কিছুই মনে করব না।
দরজার কাছে পৌঁছে দিয়ে বললাম, ‘আমি তাহলে যাই। এখন তো আর তোমার কোনো অসুবিধে হবে না।’
মেয়েটি দরজার চাবি আমার হাতে দিল। বলল, ‘তোমার কালো চুল আর কালো চোখ আমার খুব ভালো লাগছে। আর তোমার এই ধর্মপরায়ণতা তোমার প্রতি আমার মনকে টেনে নিয়েছে। আমার মন চাইছে তুমি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধর। একজন ভদ্রমহিলার অনুরোধ তুমি রাখবে না?– দরজা খোলো।’
দরজা খুললাম।
বলল, ‘আমাকে খারাপ ভেবো না। তোমাকে আমার ভালো লাগছে, তার মধ্যে কোনো পাপ খুঁজো না। তোমাকে আমার আরও ভালো লাগবে যদি তোমার প্রথম মদের গ্লাস তুমি আমার মুখ থেকে নিয়ে খাও। এস, একটু বস। এই যে আলমারিতে মদের বোতল। এই ফ্লাস্কে বরফ। এস, আমার কাছে একটুখানি বস।’
মেয়েটির আঙুলের আংটির প্রতি আমি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম।
বলল, ‘হ্যাঁ, আমি বাগদত্তা। শিগগিরই আমাদের বিয়ে হবে। আমার বর অন্য মহাদেশে এখন যুদ্ধ করছে। কিন্তু আমরা এই দূরত্বকে দূরত্ব মনে করি না। আমরা ঘন-ঘন চিঠি লিখি। তার ছবি আমার বুকের উপর ঝুলছে। এই দেখ।’
সে আমাকে লকেট বের করে দেখাল। তাতে তার বরের ছোট একটি ছবি। ভারি সুন্দর, সুপুরুষ।
বলল, ‘ওকে আমি খুব ভালোবাসি।’
মেয়েটির ভালোবাসার জয় কামনা করে বললাম, দূর বিদেশে হয়তো কোনো জঙ্গলে বসে এখন সে তোমার কথাই ভাবছে।’
‘হয়তো ভাবছে। যদি ভাববার সময় পায়, তাহলে নিশ্চয় ভাবছে। আর, বড়দিনের ছুটি পেয়ে থাকলে এমনি একটা হোটেলে ঢুকে এমনি আমার মতো প্রচুর মদ খাচ্ছে। হয়তো কোনো মেয়ের কোলে মাথা রেখে পকেট থেকে আমার ছবি বের করে তাকে দেখাচ্ছে। আর বলছে, সে আমাকে খুব ভালোবাসে।’
শুভরাত্রি জানিয়ে আবার বললাম, ‘তোমাদের ভালোবাসা অক্ষয় হোক।’
বলল, ‘না, না। তুমি এখনি যেও না। একটু বস। তোমার কালো চুল আর কালো চোখ আমার খুব ভালো লাগছে। আমার মন চাইছে, তুমি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধর। একজন ভদ্রমহিলা যদি কিছুক্ষণের জন্যে তোমার সঙ্গ চায়, তুমি তার অনুরোধ রাখবে না?’
আমরা তিনজন একত্র হয়ে আবার সেই টেবিলে গিয়ে বসলাম।
ডন সিগারেট ধরাল। একই দিয়াশলাইয়ের আগুনে দ্বিতীয় সিগারেট জ্বালিয়ে সে আগুন নিভিয়ে দিল। এটা তার চিরাচরিত অভ্যাস। তৃতীয় সিগারেটের জন্য সে আরও একটা দিয়াশলাই জ্বালল। ডনের এই স্বভাবকে নিক বলে বোকামি। ডন বলে, এক আগুনে তিনটা সিগারেট ধরানো অশুভ।
সে বলে, আগের বারের যুদ্ধের নাকি ঘটনা এটা। ফ্রন্টে রাত্রির অন্ধকারে তিন সৈনিক সিগারেট ধরাচ্ছিল। প্রথম সিগারেট ধরানোর সময় শত্রু-পক্ষ দূর থেকে আগুন দেখে হুঁশিয়ার হয়ে গেল। দ্বিতীয় সিগারেট ধরানোর সময় তারা তাক্ করল। তৃতীয় সিগারেট ধরানোর সময় তারা গুলি ছুড়ল। এক বন্ধু মারা গেল সেই গুলিতে।
ইতালীয় বালা মাইক্রোফোনে আবার গান গাইছে। গান শেষ হলে নাচ শুরু হচ্ছে। কখনো একসঙ্গে অনেক মেয়ে। কখনো একটা মেয়ে একা নাচছে।
ডন ইঙ্গিতে দেখাল, এক পাশ থাকে পর্দা একটুখানি ফাঁক করে হোটেলের বাবুর্চিখানার একটা কর্মচারী লুকিয়ে লুকিয়ে নাচ দেখছে।
আমরা দেখলাম, দূরে একটা টেবিলে এক বৃদ্ধ অনেক মদ খেয়ে এখন টেবিল পিটিয়ে পিটিয়ে বেতালা সুরে গান গাইছে।
সব টেবিলেই মদ, আনন্দ, উল্লাস। যেন পরাজয় না মানার একটা নকল চেষ্টা। যেন এই সাময়িক কোলাহল দিয়েই শাশ্বত বেদনাকে ঢেকে রাখা যাবে। দুঃখ-ভারাক্রান্ত, পর্যুদস্ত মূল্যবোধের ভারবাহী এই মানুষেরা কেন এত হাস্যাস্পদ হতে চায় নিজেদেরই কাছে। কী কঠিন যাত্রায় রওনা হয়েছে তারা। কী দুর্গম তাদের পথ। কী দুর্লক্ষ্য তাদের মঞ্জিল। কী নিষ্ঠুর তাদের ভাগ্যের লিখন।
নিক বলল, ‘ডন, তুমিই না একবার বলেছিলে, জীবন হচ্ছে একটা মহাশূন্য। এই মহাশূন্যকে কে কতখানি আনন্দ দিয়ে, গান দিয়ে, হাসি দিয়ে ভরে রাখতে পারে, তারই ওপর নির্ভর করছে তার জীবনের সার্থকতা। তুমি বলেছিলে, মৃত্যু জীবনের মতো সত্য। বীমা কোম্পানির দালাল মৃত্যু দিয়ে তার ব্যবসায়ী কথার সূচনা করে। আর, আমরা করি জীবনকে হাওয়ার সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে। আমরা যখন বেঁচে থাকি, মৃত্যুর কথা ভাবি না। আমরা যখন মরে যাই, তখন জীবনের কথা আমাদের মনে থাকে না।’
ডন শূন্য দৃষ্টি সদর দরজার পানে মেলে ধরে বলল, ‘হ্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু আমি জানি না, কেন আমি সৈনিক হয়েছি। আমি এত ভাবপ্রবণ, সৈনিক হওয়া আমার উচিত হয়নি।’
সদর দরজার পর্দা নড়ল। প্রবেশ করল একটা নিগ্রো সৈনিক। কিছুক্ষণ সে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হলটাকে দেখে নিল। তারপর, এককোনায় একলা বসল। বসেই মদ আনিয়ে কয়েক চুমুকে অর্ধেক বোতল খালি করে দিল।
জিফের শূন্য চেয়ারটার ওপর ডনের দৃষ্টি গেল। বলল, নিগ্রোটাকে এখানে এনে বসালে কেমন হয়।
এ প্রস্তাবে কেউ আপত্তি করল না। নিগ্রো সৈনিক জিফের চেয়ারে বসে নিজের পরিচয় দিল, ‘আমার নাম ডার্লিং।’
ডন বলল, ‘বাহ্, চমৎকার নাম তো! মেয়েপুরুষ নির্বিশেষে সবাই তাহলে আপনাকে ‘ডার্লিং’ বলেই ডাকে?’
‘না, তা ডাকবে কেন। মেয়েরা সাধারণত ‘মিস্টার ডার্লিং’ বলে ডাকে। আর, একান্ত আপনজন হলে ‘মিস্টার’ যোগ না করে আমার নামটাকে দুবার উচ্চারণ করে দেয়, ব্যস্। তবে অনেকে ‘ডার্কি’ বলেও ডাকে। তাতে আমি অপরাধ নিই না। গায়ের রংটা তো আর আমার নিজের দেওয়া নয়।’
ডার্লিং জানাল, আজ সন্ধ্যায় তার জাহাজ এখানে ভিড়েছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ছুটি পেয়েছে সে। কাল সকালে আবার ফ্রন্টে চলে যাবে।
বলতে বলতে প্রথম বোতল শেষ করে দ্বিতীয় বোতল আনিয়ে নিল। আমাদেরও খাওয়াতে চাইল। কিন্তু আমরা আপত্তি জানালে কয়েক চুমুকে অর্ধেক বোতল শেষ করে গল্প জুড়ে দিল ডার্লিং।
মাত্র কয়েক বছর হল সে বাহিনীতে ঢুকেছে। এই কয়েক বছরেই দুনিয়ার সমস্ত ছোট-বড় দেশ, বিখ্যাত শহর তার দেখা হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম ভালোই লাগত। নতুন নতুন মহাদেশ, নতুন নতুন শহর, নতুন নতুন মানুষ। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই সাধ পূর্ণ হয়ে গেল। সারা দুনিয়া ঘুরে ডার্লিং দেখতে পেল মাত্র চারটা জিনিস : সমুদ্র, পাহাড়, জঙ্গল আর মাঠ। যেখানেই যাও, ঘুরে-ফিরে সেই একই জিনিস। কোনো শহর একটা থেকে অন্যটা ভিন্ন বলে মনে হয় না। একইরকম রাস্তা, রাস্তায় একইরকম মোটরগাড়ি, গাড়িতে একইরকম মানুষ। সব শহরেই পার্কে, চৌরাস্তায় মরে-যাওয়া মানুষের মূর্তি। সব শহরে একইকরম হোটেল, হোটেলে একইরকম মেয়েলোক, সব মেয়েলোক একই ভাষায় প্রেমনিবেদন করে। একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি দেখে দেখে ডার্লিং-এর মনে ঘেন্না ধরে গেছে। যুদ্ধ থামলেই সে দেশে চলে যাবে– একেবারে নিজের গ্রামে, যে-গ্রামকে আগে সে ঘৃণা করত, অবজ্ঞার চোখে দেখত, যে-গ্রাম থেকে একবার বেরুতে পারলে আর সে কখনো গ্রামে ফিরবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল। এখন সে নতুন করে শপথ নিয়েছে, এই গ্রামে ফিরে যাওয়ার আবার যদি কখনো সুযোগ আসে, তাহলে যতদিন বেঁচে থাকবে, কখনো সে আর গ্রাম ছাড়বে না।
তারপর, হঠাৎ সে প্রশ্ন করে বসল, ‘আমার সম্বন্ধে তোমাদের কিরকম ধারণা হল?’
বললাম, ‘আপনার সম্বন্ধে আমাদের খারাপ ধারণা হওয়ার কোনো হেতু নেই। আপনি চমৎকার লোক।
‘ভুল। সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি মিথ্যেবাদী। আমি কখনো সত্য কথা বলি না। আমি কাপুরুষ। আমি যুদ্ধকে ভয় করি। আমি যুদ্ধকে ভয় করি বলেই পালিয়ে যেতে চাই। গ্রামে ফিরে যেতে চাই।’
ডার্লিং ঘন-ঘন চুমুক দিয়ে বোতলটা শেষ করল। তারপর, আমাদের প্রতি সম্পূর্ণ অমনোযোগী হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। একটি মেয়েকে কাছে ডেকে তার সঙ্গে নাচতে চাইল। তারপর নাচতে চলে গেল ডার্লিং।
যখন ফিরল, হোটেলের প্রৌঢ় মালিক তার সঙ্গে ছিলেন। তিনি অন্য টেবিল থেকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আমাদের সঙ্গে বসলেন। ডার্লিং আরও একটা বোতল আনাল। মালিক বললেন, ‘ডার্লিং-এর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। আমার জ্যাককে ও চেনে। ওরা দুজন একই ইউনিটে একসঙ্গে যুদ্ধ করেছে। জ্যাক আমার একমাত্র সন্তান।’ তারপর ডার্লিংকে প্রশ্ন করলেন, ‘আমার ছেলে এখন কোথায়, কিছুই কি বলতে পার না?’
‘কয়েক মাস থেকে আমি ইউনিটের বাইরে।’
‘জ্যাক আমার একমাত্র ছেলে। কলেজে পড়তে পড়তেই যুদ্ধে চলে গেল। একেবারে ছেলেমানুষ। বাচ্চা। আপনভোলা! জ্যাকের মা আর আমি ওরই জন্যে এখনো বেঁচে রয়েছি। এখন আমার বিশ্রাম নেয়ার সময়। কিন্তু জ্যাকের জন্যেই এখনো খেটে চলেছি। আমি এখানে, আর ওর মা দেশে। দু-বছর আগে একবার সে সামরিক পোশাকে ফিরেছিল ছুটি পেয়ে। আমরা চিনতেই পারিনি। একেবারে জোয়ান হয়ে উঠেছে। কতটুকু ছিল আর এই এক বছরে কত বড়টা হয়েছে। কতরকম সান্ত্বনা-বাক্য দিয়ে সে তার মায়ের কান্না থামাল। বলল, মা, তুমি মোটেও চিন্তা কর না। তোমার দেওয়া বাইবেল আমার বুক-পকেটে সবসময় থাকে। অমন ভালো ছেলে আর হয় না। মা মেরি নিশ্চয় তাকে রক্ষা করবেন।…শেষ কবে তার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল, ডার্লিং?’
‘অনেক দিন আগে। দু-তিন মাস থেকে আমি ইউনিটের বাইরে।’
‘ছোট থেকেই জ্যাক ভারি বুদ্ধিমান, মেধাবী। আজ পর্যন্ত কখনো সে একগুঁয়েমি দেখায়নি, আমাদের সামনে কখনো কড়া কথা বলেনি। আমার কত কাজ সে করে দিয়েছে। সকালে উঠে তার হাসি-মাখা মুখখানি দেখলেই আমি সব দুঃখ ভুলে যেতাম। মনে হত, যেন আমি নতুন সূর্যের আলো দেখলাম। কতবার যে কত দুর্ঘটনা থেকে সে অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে। একবার মোটর সাইকেল থেকে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল। কিন্তু ওর কিছুই হল না। তার আগে একবার খুব ছোটবেলায় সমুদ্রের ধারে জ্যাক হারিয়ে গিয়েছিল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সারারাত তাকে পাওয়া যায়নি। রাত্রে খুব ঠাণ্ডা পড়েছিল আর ঝড় উঠেছিল। পরের দিন সকালবেলায় তাকে একদম ভালো অবস্থায় পাওয়া গেল। এমনি আরও একবার কঠিন একটা মোটর অ্যাক্সিডেন্ট থেকে সে বেঁচে গিয়েছিল। …গত বছর সে তার মা-কে চিঠি লিখেছে, অমুক তারিখ আমি উড়োজাহাজ হাঁকিয়ে তোমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাব। মায়ের সঙ্গে হয়তো এটা তার মশকরা। কিন্তু জ্যাকের মা বেচারি সারাদিন আকাশপানে চেয়ে থাকল। কত জাহাজ এল, গেল, কিন্তু কোনটা যে তার ছেলের জাহাজ, তা সে কিছুতেই ঠাওর করতে পারল না। জ্যাক লিখেছিল, শিগগিরই সে বাড়ি ফিরবে। তার ঘরটা যেন তৈরি রাখা হয়। বাড়ি ফিরে সে রোজ রাত্রে শোয়ার আগে মায়ের হাতের একগ্লাস করে গরম দুধ খাবে আর সকালে উঠে তুলোর তৈরি মোলায়েম স্লিপার পরবে। জ্যাকের মা প্রত্যেকদিন জ্যাকের ঘর সাজিয়ে রাখে। প্রত্যেক রাত্রে দুধ গরম করা থাকে। বিছানার কাছেই রেখে দেওয়া হয় জ্যাকের মোলায়েম স্লিপার। আমাদের পুরনো কুকুরটা মরে গেল। জ্যাকের মা কিছুতেই অন্য একটা কুকুর রাখবে না। বলবে, জ্যাক এলে নতুন কুকুর ওকে বাইরের লোক ভেবে চিৎকার জুড়ে দেবে। জ্যাকের মা বেশিক্ষণের জন্যে বাইরে পর্যন্ত যায় না, পাছে জ্যাককে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।…
ডার্লিং ঘন-ঘন ঘড়ি দেখছিল। ওর বোধহয় ছুটির মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। পকেট থেকে টাকা বের করে বিলের দিকে সে তাকাল।
হোটেলের মালিক বললেন, ‘তুমি জ্যাকের বন্ধু। তুমি তাই আজ আমার অতিথি। তোমার কাছ থেকে আমি টাকা নিতে পারব না। জ্যাকের সঙ্গে দেখা হলে তাকে আমাদের নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিও।’ তিনি চলে গেলেন।
ডার্লিং বলল, ‘দেখেছ, কেমন মিথ্যে বললাম, সারাজীবন আমাকে এমনি মিথ্যে বলে যেতে হবে।’
ডন জিগ্যেস করল, ‘কেন, কেন, কী হয়েছে?’
‘জ্যাক কিছুদিন আগে মারা গেছে। আমরা একসঙ্গেই ছিলাম। গুলি ওর হৃৎপিণ্ড ভেদ করে গেছে। ওর বুক-পকেটে রাখা বাইবেল সুদ্ধ ছ্যাঁদা হয়ে গেছে।’ আর একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ডার্লিং চলে গেল।
পুরনো বছর শেষ হয়ে নতুন বছর শুরু হওয়ার মুহূর্তটি এসে গেল। হৈচৈ পড়ে গেল সারা হল-ঘরে। উন্মাদনা-সৃষ্টিকারী নাচে-গানে-বাজনায় সারা পরিবেশ মুখরিত হয়ে উঠল। নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে লাগল সবাই।
নতুন বছরের মুহূর্তগুলো একে একে কাটতে লাগল। নেশায় ঢুলু-ঢুলু চোখ, টলমল পা– দাঁড়িয়ে থাকার সাধ্য নেই অনেকের। তারা কোনোরকমে টেবিলে বসে ঝিমোচ্ছে। তাদের এক-একটি আচরণ হাস্যকর। আর, সেই হাস্যকর আচরণ দেখে সবাই ঠাট্টা- মশকরায় মেতে উঠেছে। হাততালি দিচ্ছে। পরামর্শ দিচ্ছে আরও এক বোতল মদ খাওয়ার। হঠাৎ একটা টেবিলের দিকে অনেকে অঙ্গুলি-সঙ্কেত করল। সেখানকার তামাশাটা আরও মজার। এত বেশি টেনেছে যে, সব কাণ্ডজ্ঞানই লোপ পেয়েছে লোকটার।
তার প্রতিটি আচরণে সারা হল-ঘর হাসির পটকা ফুটতে লাগল।
লোকটা কফি খাওয়ার চেষ্টা করছে। পরম নিশ্চিন্তে চামচ দিয়ে চিনি তুলে দুধের পটে ঢেলে দিচ্ছে। খালি কাপটা তুলে নিয়ে দুধ ঢালার কায়দায় দুধের পটে উপুড় করছে। চামচ দিয়ে দুধের পট নাড়া দিচ্ছে। তাই দেখে কেউ হাসলে চামচ তুলে নিয়ে টেবিলের উপর রাখছে।
কিছুক্ষণ থেকে আবার দুই চামচ দুধ নিয়ে গ্লাসে দিচ্ছে। সেই গ্লাসে খানিক কফি ঢেলে চামচ খুঁজছে। সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিয়ে উঠছে দর্শকমণ্ডলী। কিছুক্ষণ থেমে লোকটা আবার শুরু করছে। সমস্ত কফি টেবিলের উপর ঢেলে দিচ্ছে। হাসির অট্টরোল উঠলে তাড়াতাড়ি রুমাল বের করে টেবিল মুছবার চেষ্টা করছে।
হঠাৎ লোকটা উঠে দাঁড়াল। শূন্যদৃষ্টি মেলে এদিক-ওদিক চাইল। হৈচৈ একদম থেমে গেল।
লোকটা বলতে শুরু করল, ‘ভাই আমার, বন্ধু আমার, আমাকে মাফ করে দাও… আমি অন্ধ। আমি কিছুই দেখতে পাই না। বোমার টুকরো এসে আমার চোখে লেগেছিল। আমি অন্ধ হয়ে গেছি। আমি কিচ্ছু দেখতে পাই না। নইলে আমি কখনো এমন করতাম না। আমাকে মাফ করে দাও, ভাই আমার… বন্ধু আমার…’
পাশের ঘর থেকে একটা লোক এসে ওর হাত ধরল। ধরে ধরে বাইরে নিয়ে গেল। অর্কেস্ট্রায় আর সুর উঠছে না। নাচের পা আর একটুও নড়ল না। মশকরায় মত্ত লোকগুলোর মুখ হাঁ হয়ে রয়ে গেল। কারও মুখে কোনো কথা ফুটল না।
বহুক্ষণ যাবৎ গোলাগুলি চলার পর হঠাৎ তা থেমে গেলে যেমন হয়, তেমনি নিস্তব্ধতা– ভয়াবহ নিস্তব্ধতা যেন সবাইকে গ্রাস করে ফেলেছে।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
সাহেব গোলাম – রাজিয়া ফসিহ্ আহমদ
নদিম যখন বাংলো ছেড়ে গাড়ির পানে রওনা হল, তখন তার আগে আগে গেল মাত্র একটা হোল্ডল আর একটা স্যুটকেস্। গাড়ির পেছনের সিটে কিছু বই-পুস্তক, পত্রিকা ছড়িয়ে রয়েছে। পুরো বাংলো তার পেছনে পড়ে থাকল খোলা অবস্থায়।
সাহেব কতদিন বাইরে থাকবেন, নানা কারণেই এ কথাটা জেনে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল বেয়ারা। কাজেই কত দূরে সাহেব যাচ্ছেন, তা অনুমান করার জন্য সে কায়দা করে প্রশ্ন করল, ‘সাব, যদি কোনো জরুরি খবর-টবর আসে, তাহলে কোথায় জানাতে হবে?’
‘কোথাও না।’ নদিমের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
চালাকিটা একেবারেই ভেস্তে যাচ্ছে দেখে বেয়ারা মরিয়া হয়ে প্রত্যক্ষভাবেই প্রশ্ন করে বসল, ‘কবে নাগাদ ফিরবেন, সাব?’
‘জানি না।’
‘তা এক মাস, দুমাস লাগতে পারে?’ বেয়ারার এ প্রশ্ন যেন সাহেবকে নয়- নিজেকেই করা।
নদিম কোনো উত্তর দিল না। বিরাট চাকর-বাহিনীর সালাম ঠোকা আরম্ভ হল। নদিম পকেট থেকে মনি-ব্যাগ বের করে একটা করে মুদ্রা তাদের হাতে হাতে ফেলে দিল। তারপর গাড়িতে এসে বসল, আর সঙ্গে সঙ্গে ভোঁ হয়ে গেল।
চাকররা উঁকি মেরে, ছাদে উঠে, রাস্তার মোড় পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে জানবার যথাসাধ্য চেষ্টা করল, সাহেবের গাড়ির গতি কোনদিকে। কিন্তু এর চাইতে বেশি কিছুই জানা গেল না যে, রাস্তাটা রাওয়ালপিণ্ডির দিকে গেছে; আর যে গাড়ি রাওয়ালপিণ্ডি গেল, সে গাড়ি ইচ্ছা করলে পেশাওয়ার পর্যন্তও যেতে পারে।
যাই হোক, সাহেবের চলে যাওয়াটা সুনিশ্চিত। কাজেই চাকররা সবাই একটা করে গভীর স্বস্তির শ্বাস ফেলল। তারপর, সবাই ড্রয়িং-রুমে এসে এলোপাথাড়ি হয়ে সোফার
উপর বসে পড়ল। তাদের এখনকার কর্তব্য, সাহেব কবে নাগাদ ফিরতে পারেন, তাই নিয়ে জরুরি সভায় মিলিত হওয়া।
প্রৌঢ় খানসামা প্রথমে শুরু করল, ‘সাব কয়টা কাপড় নিয়েছে?’ তার এই প্রশ্নের মধ্যে দার্শনিকতার স্পষ্ট আভাস।
‘বললেন, একটা স্যুটকেসে যয়টা কাপড় আঁটে, রেখে দে!’ উত্তর দিল বেয়ারা। ‘তবেই হয়েছে রে।’ ড্রাইভার তার নিজের অভিজ্ঞতার নির্যাস ব্যক্ত করে দিল, ‘মনে হচ্ছে, সায়েব এক হপ্তার মধ্যেই ফিরে আসছে।’
মসলা আর ধুলো-মাটি মাখা পা দুটো সোফার উপর তুলে দিল খানসামা। ড্রাইভারের মত সে সমর্থন করতে পারে না, এমনি একটা ভাব দেখিয়ে প্রশ্ন করল, ‘অন্যান্য বারে কয়টা কাপড় নিয়ে যান?’ তার এই প্রশ্নের অর্থ যেন এই যে, চট্ করে রায় না দিয়ে বরং আরও গবেষণা করা উচিত।
বেয়ারা বলল, ‘তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কেন, মনে পড়ছে না, সেবার এক কাপড়ে গিয়েছিল এক রাত থাকব বলে, তারপর দুই মাস কাটিয়ে এল? সঙ্গে বিছানা ছিল না, কিচ্ছু ছিল না।’
খানসামা আবার তেমনি ভারিক্কি একটা রায় ছাড়ল, ‘আজকাল টাকা থাকলে আর বিছানা লাগে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুমি যা হুকুম করবে, তাই পাবে। কী বলছ বিছানা আর কাপড়ের কথা! ছোঃ! টাকা থাকলে গোটা একটা বালাখানা পাওয়া যায় রেডিমেড বিবি সুদ্ধ।’
এ কথায় গাম্ভীর্যে খানিকটা আনন্দের আমেজ মিশ খেল। যে-যার রসবোধ অনুযায়ী হাসল। বেয়ারা বসে যোগদান দেওয়ার চেষ্টা করে বলল, ‘সেদিন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে শুনছিলাম, সায়েবের দোস্ত সায়েবকে বলছিল, এবারে যখন ফিরবে, একটা বিবি সঙ্গে নিয়ে ফিরো।
‘তাহলেই হয়েছে।’ খানসামা কৃত্রিম আতঙ্ক প্রকাশ করে বলল, ‘সায়েব সত্যি সত্যি যদি বিবি নিয়ে ফেরে, তাহলে বুঝে নিও, আমি আর নেই, বাবা। সব ঘরে তালা পড়বে বুঝেছ? কোর্মা-পোলাও আর খেতে হবে না– তখন কেবল বাইরে বাইরে হাওয়া খেয়ে বেড়িও। আমার একটা রেকট আছে, বুঝলে? যে-ঘরেই চাকরি করতে গিয়েছি, আগে বলেছি, আমি কিচেন আর প্যান্ট্রি দেখব, তারপর কথা। তারপর কোনো আলমারিতে তালা দেখলেই বলে দিয়েছি, কাল থেকে কাজ করতে আসছি। কিন্তু আর আসতে হয়নি। ব্যস্, খতম। বুঝলে?’
সামনে দূরে দাঁড়িয়ে বয় এতক্ষণ চুপ-চাপ শুনছিল। এবারে সে-ও তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে লাগল, ‘আর বল কেন! আমিও এক বেগম সায়েবের পাল্লায় পড়েছিলাম বটে। বেগম সায়েবের ছিল ইঁদুরের মতো ছোট মন। কোনোদিন যদি একটা টেডি পয়সা হাতে ধরে দিয়ে থাকে।
অনেকক্ষণ পরে ড্রাইভার আবার মুখ খুলল, ‘সায়েব বিয়ে করলে আমাকেও নতুন চাকরি খুঁজতে হবে। পার্ট-টাইম চাকরিটা তো আর থাকবে না।’
খানসামা মুরুব্বির চালে জবাব দিল, ‘মুফতের ড্রাইভারি করছ। সবসময় তো সায়েবই গাড়ি চালায়। আর, তুমি করে বেড়াও পার্ট-টাইম। বেগম সায়েব এলে তো আর সেটি চলবে না। এদিকে মিছামিছি পেট্রলের বিল, রিপিয়ার আর এই-সেই করে আরও খানিক কামিয়ে নিচ্ছ।’
‘কী করব বল। গরিব মানুষ, আর আটটা খানেওয়ালা। কিন্তু খানসামা ভাই, তুমিই-বা আর কম যাও কার চাইতে। গোটা ঘিয়ের টিন দু-দিনেই খতম। আর আস্ত আস্ত আটার বস্তা…।’
‘এখন থামাও এসব কথা। আমরা সবাই আল্লার দেওয়া রুজি কামাই করি আর খাই। অন্যের রুজি কি আর একজনে খেতে পারে!’ এই কথা বলে খানসামা এখন সোফার উপরে হাত-পা ছড়িয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর, হাঁক ছাড়ল, ‘বয়, তাড়াতাড়ি চা বানিয়ে আন্। আর, শোন, সেই সঙ্গে কিছু ঘিয়ে-ভাজা পুরি। বুঝলি? তাড়াতাড়ি।’ রীতিমতো সাহেবের অনুকরণ শুরু করে দিল খানসামা।
জমাদার এতক্ষণ মেঝের উপর বসে বসে এইসব শুনছিল। ঝাড়ুটাকে বালিশ বানিয়ে সে-ও লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল ফরাশের উপর।
বেয়ারা কোলের উপর একটা কুশন টেনে নিয়ে বলল, ‘আমার মাথায় একটা ভারি মজার খেয়াল এসেছে।
‘কী, কী! বল, বল!’ সবাই একসঙ্গে আগ্রহ প্রকাশ করল।
‘আমরা সবাই মিলে একটা পার্টি দিই, এস।’
‘পার্টি! ভোজের পার্টি নাকি?’ খানসামা বিস্ময় প্রকাশ করল, ‘তোমার তো সাহস কম নয় হে! তাহলে কেমন পার্টি, বল দেখি, বাপু, শুনি।’
‘হ্যাঁ দোস্ত, ভালোই খেলেছে তোমার মাথাখানা। হয়েই যাক একটা পার্টি।’ ড্রাইভার প্রথম সায় জানাল।
‘কিন্তু সায়েব না থাকলে তো আমাদের রোজই পার্টি চলে, ফুর্তি চলে। তাহলে আর নতুন ব্যাপারটা কী হতে যাচ্ছে?’
বেয়ারা বলল, ‘সেরকম নয়, খানসামা সায়েব। এ হবে স্পেশাল ডিনার-পার্টি। আমরা স্যুট পরব। অনেক মেহমান আসবে। টেবিল জুড়ে থাকবে কোর্মা, পোলাও, জর্দা। রেডিও বাজবে। বক্তিমে হবে।’ কিছুক্ষণ থেমে আবার সে বলল, ‘কিন্তু আমি ভাবছি, পার্টিটা মিক্স হবে, না সিঙ্গেল!’
‘সেটা আবার কী জিনিস?’
‘বুঝলে না? মানে, পার্টিতে শুধু সায়েবরাই থাকবেন না, বেগম সায়েবদেরও আনা হবে?’ ড্রাইভার বলল, ‘না ভাই, বেগম সায়েবদের সঙ্গে করে আনলে আবার নানা ঝামেলা বাধবে। পর্দা কর, এই কর, সেই কর। তার চাইতে আমরা, মানে শুধু সায়েবরাই ঠিক আছি।’
‘তাহলে তো দেখছি, সব ঝক্কি আমাকেই সামলাতে হবে।’ খানসামা আসল কথাটা পেড়ে বসল, ‘তা ঠিক আছে, তোমরা যখন বলছ, তখন করতে হবে বৈকি!’
‘কিন্তু খানসামা সায়েব, মনে থাকে যেন, গণ্যমান্য সব অতিথিরা আসবেন। ভালো খানা হওয়া চাই কিন্তু।’
‘সে আর তোমাকে বলতে হবে না। এমন খানাটাই খাওয়াব যে, জিন্দিগি-ভর মনে থাকবে।’
‘তাহলে একটা দিন-ক্ষণ ঠিক হয়ে যাক।’
‘কাল।’
‘বেশ, কাল রাত্রেই তাহলে হোক। ডিনারের দাওয়াত সব জায়গায় পৌঁছে দাও।’
‘আর শোনো, মেহমানরা সব হুড়দ্দুম যেন ডাইনিং-হলে ঢুকে না পড়ে। সবাই আগে ড্রেসিং-রুমে আসবে, ফিটফাট কাপড় পরবে। তারপর আবার বাইরে যাবে। বাইরে গিয়ে ওই সামনের দিক থেকে এসে ড্রয়িংরুমে ঢুকবে। ড্রয়িংরুম থেকে তারপর ডাইনিং-হল।’
‘আর হ্যাঁ, মালিবাবাকে ডাকো। ওকে বলে দাও, যেন চমৎকার করে কয়েকটা ফুলের তোড়া বানিয়ে রাখে।
এমন সময় বয় ট্রেতে করে চা নিয়ে এল। আর, গরম গরম পুরি ভাজা। বেয়ারা কোথাও থেকে ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেটের টিন নিয়ে এল বের করে। সবাইকে দিল একটা করে। বয় চা পরিবেশন করল। চায়ের পেয়ালায় আরও অনেকক্ষণ ধরে রাজনৈতিক এবং অন্যবিধ আলাপ-আলোচনা চলল। তারপর, সবাই একে একে যে-যার ঘরের দিকে চলে গেল। সাহেবই যখন নেই, তখন কাজেরও কোনো প্রশ্ন ওঠে না। বেয়ারা বয়কে দিয়ে চায়ের পেয়ালা ইত্যাদি সরাল। তারপর, ঘরে তালা লাগিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ল বাইরে।
.
পরদিন সকাল থেকেই ডিনার-পার্টির আয়োজন শুরু হয়ে গেল। আগেই ঠিক হয়েছিল যে, প্রত্যেকে একজন করে ঘনিষ্ঠ, নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য আত্মীয় বা বন্ধুকে দাওয়াত দিতে পারবে। সে এমন হবে, যেন পার্টির কথা একটা তার মুখ থেকে বাইরে না বেরোয়।
খানসামা মহাব্যস্ত। তার চাইতে ব্যস্ত করে রেখেছে সে বয়কে। তাকে সে বাঁদর-নাচ নাচাচ্ছে। বয় আবার খুব করে খাঁটিয়ে নিচ্ছে জমাদারকে। এরাই এখন এ বাড়ির সর্বেসর্বা।
ধোপাকে ডেকে এনে সব কাপড়ে ইস্তিরি করিয়ে নেওয়া হল। তারপর, ধোপাকেও দাওয়াত দেওয়া হল ডিনার খাওয়ার।
মালিবাবা সকাল থেকে ফুলের তোড়া তৈরি করছে নিবিষ্ট মনে
জমাদার সমস্ত ঘর-দোর ঝেড়ে-ঝুড়ে পরিষ্কার, ফিটফাট করে তুলল।
বয় একা পেরে উঠছে না বলে খানসামা আরও একজন অ্যাসিস্টেন্ট নিয়ে এল বাইরে থেকে। বয় আর নতুন অ্যাসিস্টেন্ট মেশিনের মতো কাজ করে যাচ্ছে। একের পর এক মুরগি জবাই করে ওরা দুজন দ্রুত হাত চালিয়ে সেই মুরগি ছাড়িয়ে চলেছে। নতুন অ্যাসিস্টেন্টকেও ডিনার পার্টির দাওয়াত দেওয়া হল।
সন্ধ্যায় মেহমানদের আগমন শুরু হওয়ার আগেই খাবার টেবিলে ধপধপে সাদা কাপড় বিছিয়ে তার উপর ডিনার সেট, চকচকে ছুরি-কাঁটা, সুন্দর করে সাজানো ফুলদানি সাজিয়ে রাখা হল। গ্লাসে গ্লাসে সাদা ন্যাপকিনের সারি লেগে গেল, যা দেখতে মনে হল সারিবদ্ধ বলাকার মতো।
টেবিলের পরিচর্যা শেষ হলে পর সবার আগে বেয়ারা কেতা-দুরস্ত পোশাকে সেজে নিল। সমস্ত মেহমানের জন্যও যার যার পদমর্যাদার দিকে খেয়াল রেখে ওয়ার্ড-রোব থেকে বের করে করে এগিয়ে দেওয়া হল স্যুট, জ্যাকেট, শেরওয়ানি, চুড়িদার ইত্যাদি। বেয়ারা নিজে পরল ডিনার স্যুট– সাদা শার্টের উপর ডিনার-জ্যাকেট, গলায় কালো বো, বুক-পকেটে বের করে রাখা সাদা রুমাল, পায়ে আলো-ঠিকরানো কালো জুতো আর বাটন-হোলে সুইট-পি ফুল গুঁজে যখন সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তখন নিজের কাছেই সে একটা লাটসাহেব বলে বোধ হতে লাগল। আর, তাই দেখে খানসামা মন্তব্য করল, ‘যা না, একবার মালিবাবার কাছে গিয়ে দাঁড়া। তোকে যদি সায়েব মনে করে একটা সালাম না ঠোকে, তো আমায় বলিস।’
সবার যখন মোটামুটি সাজাগোজা শেষ হয়েছে, তখন ড্রেসিং-রুমের জৌলুস দেখে খানসামা একেবারে আত্মহারা। কিন্তু সেই আত্মহারা অবস্থাতেও তার মাথায় একটা বুদ্ধি গজাল। ভাবল, এমন জৌলুস, ছবি তুলে ধরে না রাখলেই নয়। পার্টির শেষ হওয়ার পর সেই ছবি সবাইকে দেখিয়ে বেড়ানো যাবে। চিরকাল সে ছবি হয়ে থাকবে সারাজীবনের একটা মনোরম স্মৃতি। কাজেই খানসামা টেলিফোন করে ফোটোগ্রাফারকে আসার জন্য ডাকতে চলে গেল।
নিজের দৈনন্দিন কাজ শেষ করে মালিবাবাও এসে গেল তৈরি হতে। হাত-পায়ের কাদা ছাড়ানোর জন্য সে গোটা একটা খোশবুদার সাবান ঘষে ঘষে শেষ করল। তারপর গরম আর ঠাণ্ডা পানি মেশানো বাথটাবে শুয়ে থাকল কিছুক্ষণ। মালিবাবার দেরি হচ্ছে দেখে বেয়ারা যখন হাঁক ছাড়ল, তখন মানুষ-সমান লম্বা তোয়ালেতে সারা শরীর ঢেকে সে বাইরে বেরিয়ে এল। চুড়িদার পাজামা আর শেরওয়ানি পরল। মাথার উপর বাঁকা করে জিন্না-টুপি চাপাল। পায়ে দিল সলিম-শাহি পাদুকা। তারপর, আয়নার সামনে যখন দাঁড়াল, তখন তাকে মনে হতে লাগল স্বপ্নপুরীর রাজপুত্র বলে। তাই-না দেখে বেরিয়ে পড়ল তার বত্রিশ-পাটি দাঁত, আর সে দাঁত সারাসন্ধ্যা বেরিয়েই থাকল– কিছুতেই ভেতরে করা গেল না। বারবার শেরওয়ানিতে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে তার মসৃণতা অনুভব করতে লাগল। মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল সেই আল্লার দরবারে, যিনি তাকে একদিনের সুলতান করেছেন।
ড্রাইভার মাথায় একটা সাদা পাগড়ি জড়িয়ে নবাব সাজল।
বেয়ারা মাথায় দিয়েছে তার সাহেবের ফেল্ট হ্যাটটা।
বয় বেচারা সবচাইতে বেঁটে। কোনো কাপড়ই তার গায়ে ফিট্ করে না। যেটাই পরে, সেটাতেই হারিয়ে যায় সে। তখন সবার পরামর্শে তাকে পরানো হল একটা সিল্কের পাঞ্জাবি আর একটা সাদা লুঙ্গি। পাঞ্জাবির আস্তিন খানিকটা গুটিয়ে দেওয়া হল আর লুঙ্গি মাজায় খানিক জড়িয়ে দেওয়া হল তবে গিয়ে সে কিছুটা মানুষ-মানুষ বোধ হতে লাগল।
মুকিল হল জমাদারকে নিয়ে। স্যুট-কোট-হ্যাট তার পছন্দ নয়। শেরওয়ানিও সে পরবে না। তার চোখ সাহেবের স্লিপিং গাউনের দিকে। তার এই ইচ্ছায় বাধা দেওয়া কারো যুক্তিসঙ্গত মনে হল না। কিন্তু মালিবাবার পরামর্শে সেই গাউনের উপর সে আবার যোগ করল একটা নতুন ফ্যাশন। দেড়শো টাকা দামের নতুন শৌখিন কম্বলটা সে জড়িয়ে নিল গাউনের উপর
ডিনার-পার্টিতে বাইরের মেহমানরা তো মেহমানই; কিন্তু ভেতরের যারা, তারাও মেহমান বলে কেউ কাউকে খাবার পরিবেশন করবে না। সুতরাং, খাদ্য-সামগ্রী আগে থেকে টেবিলে সাজিয়ে রাখা হল।
পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে তারা সবাই বাইরে এল। ভেতরে থাকল কেবল বেয়ারা। তারপর, সামনের দরজায় একে একে বেলটিপে এমনভাবে তারা ভেতরে ঢুকল, যেমন ঢোকে যথার্থ মেহমানরা। বেয়ারা এগিয়ে এসে, করমর্দন করে তাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। পকেট থেকে ফাইভ ফিফটি ফাইভের টিন বের করে মেলে ধরল সামনে। কুশল-বিনিময় চলতে লাগল পরিমিত ভাষায়। ব্যাগ্রাউন্ডে রেকর্ড-প্লেয়ার থেকে বাজতে লাগল স্পেনীয় সংগীত।
ডিনার শুরু হয়ে গেল। বেয়ারা বিরাট একটা গামলায় করে গরম গরম সুপ এনে রাখল। যার যার পাত্রে ঢেলে নিয়ে কেউ ঢুঁ মেরে আর কেউ নুলো ডুবিয়ে খেয়ে ফেলল সেই সুপ।
জমাদারকে দেওয়া হল প্রথম খানা তুলবার সম্মান। তারপর, প্রত্যেকে যার যার পাতে খানা তুলে নিল। প্রথম গ্রাস খানা মুখে তুলবার সম্মানও আবার দেওয়া হল জমাদারকেই তখন জমাদার কাঁটা-চামচ টেবিলের মাঝখানে সরিয়ে রাখল। রেখে হাত দিয়েই অতি দ্রুত গোগ্রাসে গিলতে আরম্ভ করে দিল। বেয়ারা মনে করল এটাকে হাভাতেপনা বলে।
ডিনার-পার্টির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা উচিত নয় ভেবে অতি অল্প পরিমাণে প্লেটে খানা নিল সে। কোলের উপর ন্যাপকিন বিছিয়ে নিল, ঠিক যেমন ভদ্রলোকদের নেওয়া উচিত, তেমনি করে। তারপর ফিশ-ফ্রাই-এ ছুরি-কাঁটা চালাতে লাগল আস্তে করে। নির্ভুল কায়দায় সে ছুরি-কাঁটা ধরেছে। কিন্তু অনভ্যস্ততা হেতু মাঝে মাঝে পিছলে যাচ্ছে, আর পিছলে যাওয়ার জন্য মাছের টুকরো পড়ে যাচ্ছে নিচে।
বেয়ারার দেখাদেখি অন্য সবাইও কাঁটা-চামচ ধরল। কিন্তু তাদের কেউ কেউ এমনভাবে ধরল যে, ছুরি নিয়ে যেন শত্রুকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে। কাঁটার ঘায়ে কারও কারও জিবে লাগল খোঁচা। কেউ কেউ মাংসের টুকরো হাত দিয়ে ছিঁড়ে, চামচে রেখে বা কাঁটায় বিঁধিয়ে মুখে ঢোকাল। বলাকার ঝাঁক হয় গ্লাসেই রয়ে গেল, না হয় ছড়িয়ে পড়ল টেবিলের উপর। সারা ডাইনিং-হল জুড়ে বিরাজ করতে লাগল কাঁটা-চামচ-প্লেটের ছন্দহীন ধ্বনি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে চপ্চপ্, সুড়ুৎ-সাড়ুৎ ইত্যাদি শব্দ। সবাই গিলছে গোগ্রাসে, ব্যস্তসমস্ত হয়ে। কথা বলার কারো ফুরসত নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেকে বুঝল, কাঁটা-চামচের ঝকমারি ডিনারের সমস্ত স্বাদ নষ্ট করে ফেলছে। তখন তারা অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করে হাতের সদ্ব্যবহারে মনোযোগী হল। একমাত্র বেয়ারাই শেষ পর্যন্ত কৌলীন্য বজায় রাখল। এই কারণে তাকে বেশ খানিক অতৃপ্ত, অর্ধভুক্ত থাকতে হল।
একটা টানতে গিয়ে অন্যটায় ধাক্কা লেগে যাওয়ায় কিছু প্লাস, প্লেট নিচে পড়ে ভাঙল। অনেক দূরের জিনিস হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়ে জমাদারের কম্বলের কোনা ঝোলের স্বাদ টের পেল।
এইভাবে খাওয়া শেষ হলে ঢেকুর তোলার শব্দ উঠতে লাগল। স্পেনীয় সংগীতের সঙ্গে মিশে সেই শব্দ নতুন এক সুরের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে লাগল। গ্লাসের পানি খেতে গিয়ে ন্যাকিনগুলো টেবিলের তলায় চলে গেছে। কাজেই অনেকে টেবিলের চাদরেই হাত মুছে নিল। কেউ গেল বাথরুমে হাত ধুতে। বাদবাকি সবাই কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে কাজ সম্পন্ন করে নিল।
শেষে বয় চা পরিবেশন করল। সবাই ঠোঁটের কোণায় ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেট ঝোলাল। কেবল খানসামা তার পোশাকের গাম্ভীর্যের দিকে লক্ষ রেখে একটা চুরুট ধরাল।
এমন সময় বেয়ারা দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল, ‘এবার খানসামা সায়েব আমাদের ডিনার-পার্টির ওপর একটা বক্তিমে দেবেন।’
খানসামা চুরুটটা হাতে নিয়ে ঠিক বক্তার মতো পোজ্ করে দাঁড়াল। তারপর একটুও চিন্তা-ভাবনা না করে বলতে শুরু করে দিল, ‘ভাইসব, আমরা বহুত দিন পর আজকে গোলাম থেকে সায়েব হয়েছি। নিজেরাই যা-খুশি রান্না করেছি– নিজেদের হাতে যেমন-করে-খুশি খেয়েছি। আহা, ইংরেজ সায়েবদের কথা আজকে আমার মনে পড়ছে। তেনারা ছিল খাঁটি সায়েব। আজকে যেমন আপনারা সায়েব হয়ে খেয়েছ, ওই সময় আমরা প্রত্যেকদিন সায়েবি খানা খেয়েছি, ভাইসব। এক মাস, দু-মাস মাত্র পরে কোট- পালুন সায়েবরা অমনি দিয়ে দিয়েছেন। মেম-সায়েবরা মুড়ি-ভাজার মতো দুহাতে পয়সা বিলিয়েছে। ফাস্টো ক্লাস বিয়ারের বোতল আমরা সাবাড় করেছি। আয়াদের সঙ্গে কত ঠাট্টা-দিল্লাগি করেছি। তারপর পাকিস্তান হলেন, আমাদের দেশ স্বাধীন হলেন। কিন্তু আমরা গোলাম হয়ে গেলাম, ভাইসব। ইংরেজ সায়েবরা কুত্তারও কত খাতির করতেন। দিশি সায়েবরা মানুষকে কুত্তার অধম ভাবলেন। একটা টেডি পয়সা এদিক-ওদিক হলে ধমক খেতে হচ্ছেন। আপনারা এখন সারা জিন্দেগিতে একদিন ছুটি পাও না। আমাদের সায়েব কিন্তু খারাব লোক নয়। ইংরেজ সায়েবদের মতো আমার সায়েব কুকুর রাখে না, ঘোড়া রাখে না, মেম রাখে না, আর…’
খানসামার বক্তৃতা তখনো চলছে, কিন্তু বেয়ারা তাতে মজা পাচ্ছে না। এসব কথা সে প্রত্যেকদিনই শোনে। এখন তার খেয়াল অন্য দিকে। দুই-দুবার ফোটোগ্রাফারকে টেলিফোন করা হল এখনো সে আসছে না কেন, এই চিন্তায় সে মনে মনে ভারি ব্যস্ত। খানসামার ভাষণ শেষ হয়ে আসছে মনে করে বেয়ারা ইঙ্গিতে তাকে জানিয়ে দিল শেষ না করতে।
ঠিক এমনি সময়ে বাইরে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। বেয়ারা বয়কে ইঙ্গিতে বলে দিল ফোটোগ্রাফারকে তাড়াতাড়ি ভেতরে নিয়ে আসতে। বয় চলে গেল।
খানসামা বেয়ারার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বক্তৃতার উপসংহারটাকে আর একটু লম্বা করল, ‘ভাইসব আমাদের সায়েবের জন্য আমরা দোয়া করি– আল্লা যেন তেনাকে আরও একশো বছর বাঁচিয়ে রাখে। আমাদের সায়েব যে কত ভালো লোক, তা আপনারা আজকের এই খানা-পিনা থেকেই বুঝতে পারছ।…‘
এমন সময় ডাইনিং-হলের দরজার পর্দা নড়ল। খানসামা ফোটোগ্রাফারের জন্য বক্তৃতার পোজটাকে আর একটু আকর্ষণীয় করে নিল। উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলীও যে-যার দৈহিক ও চেহারাগত আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠল। কিন্তু যার যেমন পোজ, তেমনিই থেকে গেল। খানাসামার বক্তৃতার শেষ শব্দটি অর্ধোচ্চারিত রয়ে গেল। মুখ হাঁ হয়েই থাকল, সে হাঁ আর বন্ধ হল না। সবাই যেন পাথরের মূর্তি– কেউ নড়ল না, কেউ নিশ্বাসটুকুও ফেলল না, যেন সবাই জমে গেছে। যে দাঁড়িয়েছিল, সে দাঁড়িয়ে থাকল। যে বসেছিল, সে বসে থাকল। যে চুলকাতে যাচ্ছিল, তার হাত থেমে গেল অর্ধপথে। সবাই স্থবির। কেবল বয় এর ব্যতিক্রম। সে নড়ছিল, থরথর করে কাঁপছিল নদিমের পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
নদিম ভালো করে একবার অবস্থাটা দেখে নিল। হলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত নজর বুলাল। তারপর বলল, আজ থেকে তোমাদের সবারই চাকরি নট্। বলে সে দ্রুত পায়ে শোয়ার ঘরে চলে গেল।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
পুতুল – মমতাজ মুফতি
সাদা বাংলোর অধিবাসীদের সবাইকে যেন ভূতে ধরেছে। অথচ, এ বাড়ির আসবাবপত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি। রেশমের পর্দা আগের মতোই ঝুলছে। গালিচার উজ্জ্বল রং এখনো আগের মতো আলো ঠিকরায়।
সাদা বাংলোর মানুষগুলো সবাই শো-কেসে সাজানো পুতুলের মতো। চাবি ঘুরিয়ে দিলেই সে পুতুল থপথপ্ করে হাঁটে।
কিন্তু সাদা বাংলোর পুতুলগুলো আগে যেমন করে হাসত, কথা বলত, এখন আর তেমন করে পারে না। ওদের সবাইকে যেন ভূতে ধরেছে। সন্ধ্যা হতে-না-হতেই পুতুলদের মুখে তালা-চাবি পড়ে যায়। রাত্রির নিস্তব্ধতা যত বাড়ে, ভৌতিক নীরবতা তত বাড়ে। খুট্ করে একটা কিছুর শব্দ হলেও সবাই একসঙ্গে চমকে ওঠে।
সাদা বাংলোর যে কাউকে গিয়ে জিগ্যেস করুন এর কারণ, কেউ বলবে না, বলতে পারবে না।
কাকে আপনি জিগ্যেস করবেন? ফওজিয়াকে? তার ঘোলাটে চোখ দেখলে আপনারই ভয় করবে। সে নিজেই এর কারণ হলে কী হবে– সে তো জানে না, কী সে কারণ; তাহলে কেমন করে বলবে সে!
নওয়াজিশকে জিগ্যেস করে দেখুন। গোঁফে তা দিয়ে গম্ভীর হয়ে যাবে, কিছুই বলবে না। বেশি পীড়াপীড়ি করলে গাম্ভীর্য আরও বাড়বে। এই গাম্ভীর্যের অর্থ : সে ড্রাইভার হলেও শুধু ড্রাইভার নয়– আরও অনেক কিছু, বরং সবকিছু। আরও পীড়াপীড়ি করলে কিছু একটা হয়তো বলবে, কিন্তু তার অর্থোদ্ধার করা মুশকিল। তারপর যদি বলেন, ‘তারপর?’ তাহলে নওয়াজিশ বলবে, ‘তারপর? রাত-জাগতে হয়, এই আর কি। তাতে আমার তেমন কোনো অসুবিধে নেই। সারাটা জীবনই তো রাত জেগে জেগে কাটালাম।
ফওজিয়ার মাকে জিগ্যেস করে দেখবেন একবার? তিনি ব্যস্তসমস্ত হয়ে পালঙ্ক থেকে নামবেন– যেন শুয়ে থেকে এতক্ষণ তিনি বড় অন্যায় করেছেন। তারপর বলবেন, ‘হ্যাঁ, কিছু একটা হয়েছে বৈকি! কিন্তু কী হয়েছে, তা তো ডাক্তারেই ঠিকমতো বলতে পারে না, তা আমি কেমন করে বলব, বাপু! যাই হোক, আল্লার হাজার শুকর, জান্টা তো বেঁচেছে!’ ডাক্তারকে প্রশ্ন করলে বলবেন, ‘ওয়েল, ওয়েল, শি ইজ অলরাইট। সামান্য একটু শক্ পেয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে।’
ছোট বোন আসিয়াকে জিগ্যেস করলে সে কিছুই বলবে না। দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে সে শুধু কাঁদবে ডুকরে ডুকরে।
তারপর, চাকর-চাকরানিদের জিগ্যেস করে কী লাভ। তারা কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে বোবা বনে যাবে। কিছুই বলবে না, বলতে পারবে না।
মাঝরাত্রে রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে খান-খান হয়ে যায় যখন ফওজিয়ার শয়ন-কক্ষ থেকে চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসে। এমন উলঙ্গ চিৎকার কেউ কখনো শোনেনি। রেশমের কাপড় দিয়ে ঢাকা মরা পুতুল যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। পুতুল চিৎকার করে ডাকছে, ‘নওয়াজিশ, নওয়াজিশ!’ ভদ্রঘরের কোনো মহিলার এইভাবে তারস্বরে ডাকা, তা-ও আবার সে বাড়ির ড্রাইভারের নাম ধরে ধরে– খুবই বেমানান। কিন্তু সেই ডাকে কেন এত কাকুতি, ভিক্ষার সুর।
ফওজিয়ার চিৎকার শুনে মা জেগে যান। মুখে কেবল বলেন, ‘আবার আজকে!’ নিচের ঠোঁটটা কেঁপে ওঠে। বুকের ভেতরটা দুলে ওঠে। কিন্তু একটুও নড়েন না। ফওজিয়ার শোয়ার ঘরে যাওয়ার চেষ্টা করেন না। কারণ তিনি জানেন, এতক্ষণে সেখানে নওয়াজিশ চলে গেছে। মামুলি একটা ড্রাইভার নওয়াজিশ। সেই নওয়াজিশ ফওজিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোঁফে তা দিচ্ছে। উফ্!
ছোট বোন আসিয়৷ ধড়ফড় করে জেগে ওঠে। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে আবার সে চোখ বোজে। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে সে শুধু কাঁদে ডুকরে ডুকরে।
নার্স এই চিৎকার শুনে রাত-জাগার উপন্যাস থেকে চোখ তোলে। সেখানে কাগজের চিহ্ন রেখে বইটা বন্ধ করে দেয়। তারপর, পা টিপে টিপে ফওজিয়ার শয়ন-কক্ষের দরজা পর্যন্ত গিয়ে ছিটকিনি খোলে। আবার পা টিপে টিপে চেয়ারে এসে বসে। তারপর, নিশ্চিন্ত মনে আবার উপন্যাস পড়তে আরম্ভ করে দেয়। ফওজিয়ার এই চিৎকারে যেন কোনো অস্বাভাবিকতা নেই– নৈমিত্তিক ব্যাপার।
চিৎকারে নওয়াজিশেরও স্বাভাবিকভাবেই ঘুম ভেঙে যায়। একবার চোখ ঘষে নিয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেয়। ঘন, দীর্ঘ গোঁফের ফাঁকে অদ্ভুতভাবে হাসে। তারপর, ওভারকোটটা ফেলে নেয় কাঁধে। গোঁফে তা দিতে দিতে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলতে থাকে ফওজিয়ার ঘরের দিকে।
শয়ন-কক্ষে ভারিক্কি চালে বেগম সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে নওয়াজিশ। তারপর গুরুগম্ভীর গলায় বলে, চিন্তা করবেন না বেগম সাহেব; নওয়াজিশ আপনার কাছেই আছে; সবসময় থাকবে।’ এইটুকু বলে আবার সে গোঁফে তা দিতে আরম্ভ করে।
নওয়াজিশের কথায় ফওজিয়ার চিৎকার বন্ধ হয়। চাপা গলায় বলতে থাকে, ‘নওয়াজিশ, নওয়াজিশ, ওই যে আসছে, ওরা আসছে।’ এই বলে সে উঠবার চেষ্টা করে।
‘শুয়ে থাকুন, বেগম সাহেব, শুয়ে থাকুন!’ নওয়াজিশের কণ্ঠে এবারে আদেশের সুর। ‘নওয়াজিশ থাকতে আপনার কোনো ভয় নেই। কেউ আপনাকে কিছু বলতে পারবে না।
‘নওয়াজিশ, নওয়াজিশ, নওয়াজিশ…!’ বলতে বলতে ফওজিয়ার গলা নরম হয়ে আসে। আরও কী-যেন সে বলতে চায়– যেন কোনো গোপন কথা– কিন্তু বলতে পারে না। নাম উচ্চারণ করতে করতে চোখ জুড়িয়ে আসে। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে। সাদা বাংলোয় ভূতের নাচ থেমে যায়। আবার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে নীরবতা, নিঃঝুম রাত্রির নিস্তব্ধতা।
নওয়াজিশ আরও কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে যেমন গম্ভীরভাবে এসেছিল, তেমনি গম্ভীরভাবে ফিরে যায়। নার্স পা টিপে টিপে এসে, দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। তারপর, নির্দিষ্ট জায়গায় পা টিপে টিপে ফিরে গিয়ে রাত-জাগবার উপন্যাস পড়তে শুরু করে দেয় আবার।
মা নিজের ঘরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়েন। আসিয়া কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায়। আর, নওয়াজিশ নিজের কামরায় ফিরে গিয়ে লেপের তলায় উপুড় হয়ে শুয়ে সিগারেট ধরায়। দুই আঙুলের ফাঁকে চেপে ধরে, মুঠো বেঁধে, হুঁকো খাওয়ার কায়দায় জোরে জোরে টান দেয় সিগারেটে। বৃদ্ধা আর অনামিকায় চুটকি বাজিয়ে ঘন-ঘন ছাই ফেলতে থাকে, আর বায়স্কোপের গানের একটা কলি, গাইতে থাকে গুনগুন করে, ‘আব্ কওন্ তুঝে সঝায়ে…।’
সাদা বাংলোর প্রত্যেকে চিন্তিত। এমনকি, সাদা বাংলোর বাইরের লোক ডাক্তারও গভীর চিন্তামগ্ন– যদিও তাঁর কথা থেকে সেটা বুঝবার উপায় নেই। ডাক্তারের মুখে ওই এক কথা, ‘শি ইজ্ অল্রাইট। সামান্য একটু শক্ পেয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে।’ তিনি প্রত্যেকদিন আসেন। রুগীর নাড়ি টেপেন। জিবের রং দেখেন। টেথিস্কোপ লাগান। দু-একটা প্রশ্ন করেন। তারপর ইঞ্জেকশন লাগিয়ে দিয়ে, নার্সকে উপদেশ দিয়ে, হাত-বাক্সটা তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন।
বাইরে সবাই দাঁড়িয়ে, অপেক্ষায়। মা সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেন, ‘আজকে কেমন দেখলেন, ডাক্তার সাহেব?’
‘হুঁ।’ ডাক্তার যেন নতুন করে কেইসটা পরীক্ষা করছেন, এইরকম একটা ভঙ্গি। তারপর, মাথা তুলে বলেন, ‘ভালো হয়ে যাবে, ভালো হয়ে যাবে। আপনারা ঘাবড়াবেন না। এখনো শকের ইফেক্ট্ কাটেনি। কাল আবার আসব। খোদা হাফেজ।’
.
এই ঘটনার পাত্র-পাত্রী মাত্র তিনজন। সারা মুখ পাউডার দিয়ে ঢেকে রাখা একটি মেয়ে-পুতুল, নিষ্প্রাণ একটা ছেলে-পুতুল আর সজীব প্রাণবন্ত একটা ড্রাইভার।
পুতুল শুধু পাউডার ঘষে, তাই নয়– কথাও বলে। মল্ রোডের কেনা-কাটায় অহরহ যেমন অনেক পুতুল দেখতে পাওয়া যায়, সে-ও তাদেরই মতো একজন। ঠোঁটে মাখানো থাকে পুরু করে কৃত্রিম লালিমা– যেন অসংখ্য পুতুলের মধ্যে থেকে সে কারো দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। গাড়ি থেকে নীরবে নেমে ভারিক্কি চালে এদিক-ওদিক দেখে নেয়। যারা তার ওপর চোখ ফেলে চোখ সরায় না, তাদের দিকে তাকিয়ে সে নাক-সিটকায় ঘৃণায়। সময় নষ্ট না করে অচিরে মগ্ন হয়ে যায় কেনা-কাটায়। কখনো ভেবে দেখে না, কেন সে এত আকর্ষণ করে লোকজনকে। কেনই-বা ভাববে! স্বামী বিত্তবান। নিজস্ব প্রাসাদতুল্য বাংলো। মূল্যবান আসবাবপত্র দিয়ে সে বাংলো সাজানো। গাড়ি। টেবিলে আপনা-আপনি খাবার লেগে যায়। পার্সে টাকা সবসময় গিজগিজ্ করে। মরা-মরা, ময়লা, নোংরা লোকগুলো কেন যে তার দিকে অমন করে তাকিয়ে থাকে। পাউডার মাখে সে চামড়া নরম রাখার জন্য। চোখে কাজল দেয় চোখের জ্যোতি বাড়ে বলে। ঠোঁটে লালিমা মাখায়– তা সে যে জন্যই হোক, তাতে কার কী! সব কাজেরই যে ব্যাখ্যা দিতে হবে, তেমন কোনো শর্তে সে আবদ্ধ নয় কারো সঙ্গে। তার ইচ্ছা, সে মাখবে।
মল্ রোডের পুতুল শুধু সামাজিকভাবে নয়– মানসিকভাবেও একটা পুতুলই। পুতুল-ঘরের শিক্ষা তার মানসিকতাকে আবদ্ধ করে রেখে দিয়েছে। তার দেহের রূপ আর মনের শিক্ষা শান্ত একটা বিলের মতো– তাতে ঢেউ ওঠে, কিন্তু তরঙ্গ কখনো বিক্ষুব্ধ হয় না।
শো-কেসে সাজিয়ে রাখা পুতুলের মতোই পরিবারের সবাই ওরা উঠেছে, বসেছে, চলা-ফেরা করেছে। ঠিক সময়টিতে যুৎসই কথা বলা, ঠিক সময়ে বাইরে যাওয়া, ঠিক সময়েই পুতুলের মতো শো-কেসে বন্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়া। কখন কোন কথাটুকু বলতে হবে, তা যেন মুখস্থ করা। ঠিক সময়ে, ঠিকমতো সেই মুখস্থ-করা কথা ছেড়ে দিলেই পুতুলের শিক্ষা সম্পূর্ণ হল।
যে পুতুল-ঘরে ফওজিয়া বড় হয়েছে, তার বাইরে দশ পা হেঁটে গেলে জীবন্ত রক্ত-মাংসের মানুষরাও ছিল। কিন্তু পুতুল-ঘরের শিক্ষা তাদের দিকে চোখ তুলে তাকানোর অনুমতি দেয়নি। তারা সব নফর-মানুষ, চৌকিদার-মানুষ, খেটে-খাওয়া মানুষ। তাদের জীবন মনোযোগ দিয়ে দেখবার মতো নয়। ‘মনোযোগ দিয়ে দেখা’ কথাটাই পুতুল-ঘরের শাস্ত্রে নেই। শুধু নফর মানুষ কেন– অন্য কাউকেও, এমনকি নিজের আত্মীয়-স্বজনদেরও মনোযোগ দিয়ে দেখা অভদ্রতা। শাস্ত্রের বাইরে কিছু বললেই সেটা হবে কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ। কাজেই অন্যকে দেখার চাইতে নিজেকে দেখানোর গুরুত্ব পুতুল-ঘরে বেশি। তাই সবসময় চেষ্টা, যেন নিজেকে সুন্দর দেখায়, অন্যের কাছে নিজেকে যেন সুপ্রিয় করে তোলা যায়।
ফওজিয়া জন্ম থেকে এইসব শিক্ষাই পেয়ে এসেছে। সকাল-সকাল টবের মধ্যে গরম পানিতে স্নান করিয়ে চুলে রিবন লাগিয়ে, মুখে পাউডার ঘষে ফিটফাট ফ্রক পরিয়ে তৈরি করে দেওয়া হত। নিজেরই মতো ফুটফুটে একটা পুতুল নিয়ে সে প্যারালেটারে গিয়ে বসত। সেই বাহন ঠেলতে ঠেলতে অন্য একজনে নিয়ে যেত বাগানে। সেখানে গিয়ে বসত বিশেষভাবে তৈরি করা, কুশন-আঁটা একটা বেতের চেয়ারে। মাটিতে কখনো পা ঠেকত না।
ড্রয়িং-রুমে বলার জন্য একরকম ভাষা তাকে শেখানো হয়েছিল। ‘থ্যাঙ্ক ইউ’, ‘হাউ ডু ইউ ডু’, ‘মামি, ড্যাডি’, কিংবা ইংরেজি কোনো কবিতা। ফুরফুরে বাতাসের মতো নরম করে হাঁটা। সারাদিন ভুরভুরে গন্ধ ছড়িয়ে এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যাওয়া। তারপর, রাত হলে মোলায়েম রেশমের শো-কেসে আট্কা পড়া। এই ছিল জীবন পুতুল-ঘরের।
তারপর, যৌবনের পদার্পণেও সে-জীবনে বিশেষ পরিবর্তন আসেনি। পরিবর্তন এসেছে শুধু দেহের ভাঁজে ভাঁজে। শরীর ফুলেছে, ফেঁপেছে। চুল বাঁধার স্টাইল গেছে বদলে। ছক-কাটা ভাষায় কথা বলার সীমানা কিছু প্রসারিত হয়েছে। প্রশস্ত হয়েছে ড্রয়িংরুম। যাতায়াতের পুতুলের সংখ্যাও বেড়েছে। মেয়েদের কাছে আসে পুরুষ-পুতুল, পুরুষদের কাছে যায় মেয়ে-পুতুল। তাদের হাসিতে ছুরিকার ধার।
এইভাবে একদিন এক পুরুষ-পুতুল ফওজিয়াদের ড্রয়িংরুমে এল। ফওজিয়ার দিকে তার সে কী চাহনি! প্রথম প্রথম সে ভয় পেয়েছিল এই দৃষ্টি দেখে। কিন্তু ভয়ের সঙ্গে মেশানো ছিল আনন্দের দোলা। নিরিবিলিতে ডেকে নিয়ে গিয়ে সেই পুতুল এমন সব-কথা বলল, যা এর আগে ফওজিয়া কখনো শোনেনি, শেখেনি। ছকের বাইরে যেন কথাগুলো। ভারি আনন্দের, ভারি মজার। তার সামনে নতুন একটা গোটা জগৎ উন্মোচিত হয়ে গেল।
আরো অনেক পুতুলের আনাগোনা ছিল। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই ফরুখের সঙ্গে ফওজিয়ার বিয়ে হয়ে গেল বলে আরও অনেক নতুন জগৎ উন্মোচিত হতে পারল না। ফররুখের মুখের কথাও অমনি ছক-কাটা পুতুলের মতো। তার দেখাও দেখবার জন্য নয়– দেখানোর জন্য। সে-ও এসব আয়ত্ত করেছে অন্য এক পুতুল-ঘরের পরিমণ্ডলে থেকে।
বিয়ের পরেও ফওজিয়ার পুতুল-জীবনে বিশেষ কোনো পরিবর্তন এল না। পরিবর্তন হল কেবল এটুকুই যে, এক পুতুল-ঘর থেকে অন্য পুতুল-ঘরে গিয়ে নামল সে। সেখানেও রেশমের পর্দা, দামি দামি আসবাবপত্র, ঘুমোনার জন্য শো-কেস্ আর তেমনি বাগান। বিয়ের পরে সে একেবারে একলা হয়ে গেল। আগে যেখানে দাস-দাসীরা তার কাজ করে যেত, এখন সে জায়গায় যোগ হল আরও একজন– ফরুখ। ফরুখ তার জন্য দরজা খুলে দেয়, চেয়ার এগিয়ে দেয়, কোট পরিয়ে দেয়, পার্স তুলে দেয়। ডাক পড়লেই ‘ডার্লিং’ বলে ছুটে আসে। বিয়ের পরে নাম হয়ে গেল বেগম ফওজিয়া। কিন্তু ফররুখ ডাকে ফিজি বলে। আর, সে তার ফিজিকে এমন আগলে আগলে, ঢেকে ঢেকে রাখে, যেন অস্থাবর সম্পত্তি– কেউ টুক করে চুরি করে নিয়ে পালাবে। ফওজিয়া যেন কাঁচের জিনিস– পুট্ করে ভেঙে যাবে, তাই ফররুখ তাকে আলতো করে গাড়িতে চাপায়, আলতো করে গাড়ি থেকে নামায়। যত সাবধানতা, ভেঙে পড়ার আশঙ্কা যে ততই বেশি, সে-বোধ তার মনে জাগেনি কখনো।
নতুন পুতুল-ঘরে এসেই প্রথম ফওজিয়া নওয়াজিশকে দেখেছে। নওয়াজিশকে দেখেছে, সেটা এমন কোনো ঘটনা নয়। নেহাত দেখছে, এই যা। নওয়াজিশ হয়েছে তার কাছে শোফার মাত্র– নওয়াজিশ নয়। সে হচ্ছে নফর মানুষ, খেটে-খাওয়া মানুষ। তার দিকে দেখার মতো করে তাকানো শাস্ত্রে লেখা নেই। যদি থাকত, তাহলে ফওজিয়া দেখতে পেত শোফারকে নয়– নওয়াজিশকে, দীর্ঘ শক্ত যার দেহখানা, প্রশস্ত যার ছাতি, ঘন দীর্ঘ গোঁফের ফাঁকে যার সবসময়ই লেগে থাকে অকৃত্রিম, স্বভাবসিদ্ধ হাসি, আর যার অস্বাভাবিক উজ্জ্বল চোখের গভীরতা থেকে অবিরাম বিচ্ছুরিত হয় বিদ্যুতের ছটা।
সাধারণভাবে নওয়াজিশের সঙ্গে কখনো কথা বলার দরকার হয় না ফওজিয়ার। কারণ, কাজে-অকাজে সবসময় উপস্থিত থাকে ফরুখ। সেই-ই সব কাজ করে দেয় কিংবা করিয়ে দেয়। কিন্তু সম্পত্তির খবরদারি করতে মাঝে মাঝে ফরুখকে যখন করাচি চলে যেতে হয়, তখন ফওজিয়া পুতুল-ঘরে একলা থাকে। নওয়াজিশকে দরকার পড়লে বাইরে পেরির্চে দাঁড়িয়ে ডাক দেয়, ‘শোফা, এ শোফা!’
নওয়াজিশ এই ডাক শুনে ব্যস্ততার কোনো ভাব দেখায় না। ধীরে-সুস্থে সিগারেটে শেষ কয়টা টান দিয়ে নেয়। তারপর ওভারকোটটা কাঁধে ফেলে শিস্ কাটতে কাটতে চলে যায় গ্যারাজের দিকে। গাড়ি নিয়ে পেরির্চে এসে থামায়। অতিরিক্ত কথা দূরে থাক প্রয়োজনীয় কথাও কম বলে। যখন যা হুকুম হয়, তামিল করে যায় নীরবে, ধীরে নিরুদ্বেগে।
নওয়াজিশ স্বভাবগতভাবে ড্রাইভার। কিন্তু চিন্তায় আর মানসিকতায় সবসময় একটা বড়লোকি ভাব। তার হাঁটা দেখলে মনে হবে পবন-দেব মাটিতে নেমেছেন। তার মোটর চালানো দেখলে মনে হবে, এটা গাড়ি নয়– একটা খেলনা। সে কখনো মনে করে না, সে কোনো সাহেবের বা বেগম সাহেবের ড্রাইভার, বরং মনে করে, সে মোটরগাড়ির ড্রাইভার। তার স্বভাবের মধ্যে যে অবাধ্যতার ভাব, তা তার ঘাড় টান করে চলা দেখলেই অনুভব করা যায়। কিন্তু এই অবাধ্যতা দাম্ভিকতা নয়। এ যেন স্বাভাবিক, জন্মগত একটা অধিকার। তাই পুতুল-ঘরের বেগম সাহেবকে সে কখনো মনোযোগ দিয়ে দেখেনি, দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি।
ফওজিয়া তার এই নিরাভরণ অবাধ্য-ভাব লক্ষ করেনি, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কিন্তু লক্ষ যে করেছে, তা সে বুঝতে দেয়নি কখনো। কারণ, বুঝতে দেওয়া মানেই নফর মানুষকে স্বীকৃতি দেওয়া। পুতুলদের শিক্ষায় সে জিনিসের অনুমতি নেই। সে সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছিল। মারমুখো জনতা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আহমদিয়া-বিরোধী ধ্বনি দিতে দিতে। রাত্রে গোলমাল আরও বেড়ে গেল। উত্তেজনাকর ধ্বনি দিয়ে বেড়াচ্ছে দাঙ্গাকারীরা আর ‘মারো মারো, কাটো কাটো’ রব উঠছে। বাহ্যত ভয়ের কোনো কারণ ছিল না, তবু এইসব দেখেশুনে ভয়কে একেবারে মন থেকে তাড়ানোও যাচ্ছিল না। ফররুখ দাঙ্গাকারীদের ‘জংলি, অসভ্য’ ইত্যাদি বলে গালাগালি দিচ্ছিল। বলছিল, ওদের গুলি মেরে উড়িয়