- বইয়ের নামঃ শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্প
- লেখকের নামঃ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্প
০. ভূমিকা – শহিদুল আলম
ভূমিকা
উর্দু একটি ইন্দো-আর্য ভাষা যার উৎপত্তি গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে–দিল্লির আশপাশে। মোঘল রাজত্বকালেই উর্দুকে একটি পৃথক সাহিত্যিক ভাষা হিসেবে ব্যবহারের প্রয়াস লক্ষ করা গিয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে ১৯৪৭-এর দেশভাগের আগ পর্যন্ত উত্তর ভারতের কতিপয় অঞ্চলে উর্দু আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে হিন্দির পাশাপাশি ব্যবহৃত হত। বিভাগের পর উর্দুভাষী এক বিপুল জনগোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমায়, থেকেও যায় কিছু ভারতে। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত কলিয়ার’স এনসাইক্লোপেডিয়ার তথ্যানুযায়ী সমগ্র পাকিস্তানে উর্দুভাষী জনসংখ্যা প্রায় তিন লাখের মতো। আর ভারতে রয়েছে প্রায় আড়াই লাখের কাছাকাছি। এই সংখ্যা নিশ্চিত এখন বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তানের অন্যান্য প্রধান ভাষাগুলোর মধ্যে রয়েছে পাঞ্জাবি বেলুচি, সিন্ধি, পশতু ইত্যাদি।
তাহলে বলা যায়, বাংলাসাহিত্য বলতে যেমন আমাদের মনে বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার সাহিত্যের মিশ্র একটি চেহারা ভেসে ওঠে, উর্দু সাহিত্যের বেলায়ও ঠিক তাই। অর্থাৎ উর্দু ভাষায় শিল্পজ উল্কর্ষ ঘটেছে উভয় অঞ্চল–পাকিস্তান এবং উত্তর ভারতে। যে কারণে এই ভাষার সাহিত্যে আমরা পাই উভয় দেশের রাষ্ট্রীয় সীমারেখাকে উতরানো। বিচিত্র স্থান-কাল-পাত্রের বিচিত্রতর সমাবেশ।
মোটামুটিভাবে উর্দু সাহিত্যে আধুনিকতার উদ্ভব-পর্ব থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত প্রধান লেখক হিসেবে যারা নিজেদের ভাষা-বৃত্ত ডিঙিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন আমরা তাদেরকেই এই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করেছি। নির্বাচিত গল্পগুলোও সিংহভাগ ক্ষেত্রে যাতে লেখকদের প্রতিনিধিত্বকারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের শ্রেষ্ঠ রচনা হয় সেদিকে সম্ভাব্য সতর্ক দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। ফলত এটিকে উর্দু কথাসাহিত্যের একটি প্রামাণ্য বাংলা অনুবাদ সংকলন বললে অত্যুক্তি হবে না। বিব্রতকর ঠেকলেও এ-কথা সত্যি যে ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে যথার্থ অর্থে উর্দু-গদ্য সাহিত্যে কোনো কাজ হয়নি। এর প্রধান উৎকর্ষ ঘটে বিংশ শতাব্দীর জাতীয়তাবাদ, ইসলামি জাগরণ এবং সমাজতান্ত্রিক চেতনার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে। এই অনুভূতি ও বোধগুলোই এক পর্যায়ে উর্দু সাহিত্যের প্রগতিশীল আন্দোলনে রূপ নেয়। জনৈক উর্দু সাহিত্য সমালোচকের তথ্যানুযায়ী, এই আন্দোলন সোচ্চার হয়ে ওঠে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে অর্থাৎ যে বছর মুন্সী প্রেমচন্দের মৃত্যু হয় সেই থেকে এবং তুঙ্গে ওঠে ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ অবধি। এই সময় পর্যায়ে উর্দু সাহিত্যজগতে অনেক সমৃদ্ধ উপলব্ধির জন্ম হয়। এরপরে আন্দোলনের রূপ আর প্রকৃতির মধ্যে বিরোধ ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমের দরজা দিয়ে আরো কিছু নতুন উপাদান এসে এখানকার লেখকদের আলোড়িত করে।
এই তথ্য থেকে আমরা ধরে নিতে পারি যে, প্রেমচন্দ উর্দু সাহিত্যের বিরানভূমিতে। একা একা যে স্বর্ণোদ্যান রচনা করেছিলেন (বিশেষ করে উর্দু গল্প ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে), উর্দু সাহিত্যের আধুনিক লেখকরা তাকেই ভিত্তিভূমি ধরে নিয়ে সেখান থেকেই। তাদের যাত্রা শুরু করেছেন। এই ব্যাপারটা আরেকটু বিস্তৃত ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
প্রেমচন্দের নামোল্লেখের আগে-পিছে কিছু বিশেষণ যুক্ত করা হয় কেন? উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় উপত্যকায় মানুষের মাতৃভাষা (হিন্দি) উর্দু। বিশ শতকের গোড়াতেও এই ভাষার সাহিত্যে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি, গল্প-উপন্যাসের পটভূমিতে যুক্ত হয়নি সমকাল, না-মাটি না-মানুষ কোনো কিছুরই পরিচয় মেলেনি এখানকার সাহিত্যকর্মে। অতীতের অবক্ষয়ী রোমান্টিকতার অলীক অন্ধকারে ডুবে ছিল যেন সবাই, জীবনের সবটুকুকে আড়ালে রেখে এই সমাজের সাহিত্যিক ধারা যেন জীর্ণতায় ধুকপুক করছিল। প্রেমচন্দের আবির্ভাব এরই মধ্যে। বারাণসীর এক অখ্যাত গাঁয়ের নিম্ন-মধ্যবিত্ত কায়স্থ পরিবারে জন্মে, পঁচিশ টাকা বেতনের কেরানির চাকরি করতে করতে প্রেমচন্দ উর্দু সাহিত্যকে আধুনিক সাহিত্যের উপযোগী করে গড়ে তুললেন। সমকালীন মানুষগুলো, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের আটপৌরে কৃষক উর্দু সাহিত্যে এই প্রথমবারের মতো উঠে এল তাদের ভাবনা-বেদনা, সুখ, ভালোলাগা, মন্দলাগা, দোষ-গুণের সামগ্রিক পরিচয় নিয়ে–জীবনের অনাবিল প্রসন্ন স্রোতধারায় উর্দু সাহিত্যের নবজন্ম ঘটল। কথাটি হিন্দি সাহিত্যের বেলাতেও। প্রযোজ্য; কেননা এই পথিকৃৎ লেখক দুটো ভাষাতেই অবিরল লিখে গেছেন। তাই প্রেমচন্দ আধুনিক উর্দু (সঙ্গে সঙ্গে হিন্দি) সাহিত্যের ‘পিতৃস্থানীয়’। এই কাজগুলো তিনি সম্পাদন করেছিলেন ‘কফন’, ‘সদগতি’, ‘পৌষের রাত’-এর মতো বিস্ময়কর গল্প এবং ‘সেবাসদন’, কিংবা ‘গোদান’-এর মতো কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে। প্রবহমান তরল রোমান্টিক সেন্টিমেন্টের বিপরীতে তিনি রূঢ়, বর্ণহীন, কঠোর সামাজিক জীবনের প্রকৃত রূপকে মুখোমুখি দাঁড় করালেন পাঠকের। সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্ত করলেন মানুষের ওপর এক গভীরতম আস্থা : মানুষ মূলত ভালো, মূলত মহৎ, সে দৃঢ়পণ চেষ্টায় নিজেকে সকল সামাজিক পাপ-পঙ্কিলতার গ্লানি থেকে মুক্ত করে সার্থক হয়ে উঠতে পারে…।
এভাবেই তিনি পরবর্তী প্রজন্মের হাতে যে বলিষ্ঠ হাল তুলে দিয়ে গেলেন, সেই হাল ধরেই পালে বাতাস লাগিয়ে নবীন লেখকদের এগিয়ে যেতে আর বাধা রইল না।
প্রগতিশীল আন্দোলন উর্দু সাহিত্যে একঝাক মেধাবী লেখকের জন্ম দিয়েছিল। বয়সের দিক থেকে দু-এক বছর ছোট-বড় হলেও এরা সবাই মোটামুটি সমসাময়িক ছিলেন : কৃষণ চন্দর, রাজেন্দ্র সিংহ বেদী, ইসমত চুগতাই, সাদত হাসান মান্টো, খাজা আহমদ আব্বাস, কুররাতুল আইন হায়দার, কুদরতুল্লা শাহাব, গোলাম আব্বাস প্রমুখ। এদের অন্যতম। আজকের উর্দু কথাসাহিত্যের ভেতরে যে বৈচিত্র্যের বিবিধ আস্বাদ আমরা সাগ্রহে গ্রহণ করি তা এদেরই দান।
এই নবীন গোষ্ঠীর মধ্যে আবার কৃষণ চন্দর-এর নামটি নানা কারণে অধিক উচ্চারিত। তাঁর রচনার নৈপুণ্য, সহজ স্বচ্ছন্দ গতি, চিন্তার স্বচ্ছতা ও ক্ষিপ্রতা, বিষয়মাহাত্ম্য ও বাস্তবতা সহজেই সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করে। ৪৭-এর দেশভাগ, দাঙ্গা, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে লাঞ্ছিত-বঞ্চিতরাই তার লেখার একটি অতি প্রিয় বিষয়। পেশাদার লেখক ছিলেন বলেই যদিও বিস্তর লিখতে হয়েছে তাঁকে, তবু তেলেঙ্গানার পটভূমিতে লেখা কৃষক আন্দোলনের কাহিনী যব ক্ষেত জাগে দেশভাগের পটভূমিকার ‘গাদ্দার’ উপন্যাস, একই বিষয়ে লেখা ছোটগল্প ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’ পাঠকের মনে স্থায়ী দাগ। কেটে যায়। কৃষণ চন্দরের রাজনৈতিক চেতনা এবং ইতিহাসবোধ ছিল অত্যন্ত প্রখর, শানানো। নির্বাচিত অন্য দুটি গল্প ‘জঞ্জালবুড়ো’ এবং ‘জামগাছ’-এ কৃষণ চন্দরের সেই চেতনা ও বোধেরই পরিচয় মেলে।
রাজেন্দ্র সিংহ বেদীকে বলা হয় উর্দু সাহিত্যে মনস্তাত্ত্বিক ধারার প্রবর্তক। তাঁর গল্পের স্বর গাঢ় এবং গম্ভীর। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন, সেখানে বর্ণহীন বাস্তবতার প্রক্ষেপ আর মনস্তত্ত্বের চাপ সব মিলিয়ে যেখানে একটি সাধারণ মানুষ হয়ে ওঠে অচেনা মানুষ, সহজ সম্পর্ক হয়ে ওঠে অজানা সম্পর্ক… সেই জটিল ও অজানা-অচেনা মানুষজন রাজেন্দ্র সিংহ বেদীর প্রিয় বিষয়-আশয়।
উর্দু সাহিত্যে বহুল আলোচিত এবং বিতর্কিত লেখক হিসেবে সাদত হাসান মান্টোর খ্যাতি রয়েছে। হয়তো এই ব্যাপক পরিচিতির পেছনে আছে মান্টোর বিরুদ্ধে সেন্সরশিপের বারংবার মামলা দায়ের-এর ঘটনা। আশ্চর্য এই যে মান্টোর অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ লেখাগুলোই সেন্সরশিপের কোপানলে পড়েছিল। ‘ধোয়া’, ‘খুলে দাও’, ‘ঠাণ্ডা গোশত’, ‘গন্ধ’, এগুলো সবই অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত। এমনিতেও মান্টো সমাজের নিঃস্ব, রিক্ত, পতিতদের নিয়েই কাজ করতেন, অন্ধগলির পতিতাদের চরিত্র প্রকাশ্য আলোয় তুলে ধরতেন–যা কর্তাদের কর্তব্যনিষ্ঠ চোখে প্রায়ই দৃষ্টিকটু ঠেকত। ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে মান্টো মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে মারা যান।
সাদত হাসান মান্টোর নামের সঙ্গে সঙ্গে অবধারিতভাবেই উচ্চারিত হয় আরেকটি নাম–তিনি ইসমত চুগতাই। উর্দু সাহিত্যে দুজনের আগমন প্রায় এক সঙ্গে এবং আবির্ভাবের শুরুতে দুজনেই হুলুস্থুল তুলেছিলেন উর্দু সাহিত্যে। মান্টোর মতো ইসমত চুগতাই-কেও একাধিকবার অশ্লীলতার দায়ে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। দুজনের মামলা চেলেছে প্রায় একই সঙ্গে। ৩০-৪০-এর দশকে দুজনেই একসঙ্গে বোম্বাই সিনেমার গল্প লিখেছেন।
যাই হোক, ইসমত চুগতাই-এর মৌলিক হাত মূলত ছোটগল্পে। তার বিষয়বস্তু প্রত্যক্ষ-বাস্তবতা, লেখার ভঙ্গি নিরুচ্ছাস অথচ সংবেদনশীলতাই তাঁর গল্পকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। উত্তর ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের মেয়েদের অবস্থা এমন ব্যাপক ও স্পর্শকাতরভাবে ফুটিয়ে তুলতে খুব কম লেখকই পেরেছেন। এখানে তাঁর নির্বাচিত ‘দুই হাত’ গল্পটি ছাড়াও গুডডির নানী’ একটি উৎকৃষ্ট লেখা।
খাজা আহমদ আব্বাস (১৪ই জুন, ১৯১৪)-এর জন্ম ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের পানিপথে। ভাষার ব্যবহারে ইনি অত্যন্ত সহজ, সাদামাটা। শতাধিক ছোটগল্প লিখেছেন। ‘ইনকেলাব’ তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। বিশিষ্ট উর্দু লেখিকা কুররাতুল আইন হায়দারকে তিনি বিয়ে করেছিলেন যদিও তা দীর্ঘদিন টেকেনি। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি গল্প লেখার চাইতে চলচ্চিত্রের কাহিনী ও সংলাপ রচনা, চিত্র পরিচালনা ও চিত্র প্রযোজনায় মনোনিবেশ করেন।
উর্দু কথাসাহিত্যে আমরা উপরে আলোচিত লেখকদের সঙ্গে যেভাবে পরিচিত, কুররাতুল আইন হায়দার, কুদরতুল্লা শাহাব কিংবা গোলাম আব্বাস-এর সঙ্গে ঠিক সেভাবে পরিচিত নই। যদিও এই সংকলনভুক্ত তাঁদের গল্পগুলো স্ব-উজ্জ্বলতায় ভাস্বর এবং উর্দু গল্পের ধারাবাহিক আলোচনায় এরা এসে পড়েন অনিবার্যভাবেই।
এখানে একটি কথা উল্লেখ প্রয়োজন যে উর্দু সাহিত্যের এক ব্যাপক অংশ বাংলাদেশের বিভিন্ন লেখক অনুবাদ করেছেন। অথচ এই সংকলনের জন্য নির্বাচনকালে যখন অনুবাদ গ্রন্থগুলোর মুখোমুখি হলাম, আমরা দেখলাম অধিকাংশ অনুবাদকই ন্যূনতম কোনো শৃঙ্খলা মেনে চলেননি। ফলে ঘটনা ঘটেছে এরকম যে, পাঠক একজন উর্দু গল্পকারের অনেক গল্প পড়ছেন ঠিকই কিন্তু তার পাঠ থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে সেরা গল্পগুলো। দ্বিতীয়ত, রূপান্তরিত গল্পগুলোর কিছু কিছু জায়গায় আড়ষ্টতাও ধরা পড়েছে। তবু অনুবাদকদের মিলিত চেষ্টায় উর্দু ভাষার একটা ঐশ্বর্যময় সম্ভার বাংলা ভাষায় অনূদিত ছিল বলেই দুই খণ্ডে উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ গল্প বের করা সম্ভব ছিল। অনুবাদকদের কাছে আমাদের। ঋণ তাই অপরিশোধ্য। ভবিষ্যতে নতুন অনুবাদের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্পকে সম্পন্নতর করে তোলার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
এই গ্রন্থে উর্দু কথাসাহিত্যের সেরা লেখকদের সেরা গল্পগুলোর সন্নিবেশের ফলে পাঠক একটি সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন–আমরা এই আশা রাখি।
শহিদুল আলম
২২/২, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, হাতিরপুল, ঢাকা।
কফন – প্রেমচন্দ
ঝুপড়ির দরজায় বাপ-বেটা দুজনে নিভে যাওয়া আগুনটার সামনে চুপচাপ বসে। ওদিকে ঘরের ভেতরে ছেলের জোয়ান বউ বুধিয়া প্রসববেদনায় আছাড়পাছাড় খাচ্ছে। থেকে-থেকে ওর মুখ দিয়ে এমন কলজে-কাঁপানো আওয়াজ আসছে যে ওরা দুজন বুকে। পাথর চেপে কোনও মতে তা সহ্য করছে। শীতের রাত, প্রকৃতি নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে। সমস্ত গ্রামখানা মিশে গেছে অন্ধকারে।
ঘিসু বলে—’মনে হচ্ছে বাঁচবে না। সারাটা দিন দৌড়ঝাঁপ করেই কাটাল। যা না, গিয়ে একবারটি দেখে আয় না।’
মাধব ক্ষেপে দিয়ে বলে—’মরবেই যদি তো তাড়াতাড়ি মরে না কেন? দেখে করবটা কী?’
‘পরাণে তোর একটুও দরদ নেই রে! সারাটা বছর যার সঙ্গে সুখে-শান্তিতে ঘর করলি, তার সঙ্গেই অমন বেইমানি!’
‘আমি যে ওর ছটফটানি আর হাত-পা ছোঁড়া চোখে দেখতে পারছি না।’
চামার-বাড়ি; সারা গায়ে ওদের বদনাম। ঘিসু একদিন কাজে যায় তো তিনদিন ঘরে বসে থাকে। মাধবটা কাজে এত ফাঁকিবাজ যে আধঘণ্টা কাজ করে তো একঘণ্টা বসে ছিলিম টানে। তাই ওরা কোথাও মজুরি পায় না। ঘরে যদি একমুঠো খাবার থাকে তো ব্যস, ওরা যেন কাজ না-করার শপথ নেয়। দুচারটে উপোস দেবার পর ঘিসু গাছে উঠে কাঠকুটো ভেঙে আনে আর মাধব বাজারে গিয়ে বেচে আসে সেগুলোকে; তারপর যতক্ষণ সে পয়সা হাতে থাকে দু’জনে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। আবার যখন উপোস করার হাল হয়, তখন আবার হয় কাঠকুটো কুড়িয়ে আনে কিংবা জনমজুরির খোঁজে বের হয়। গায়ে কাজের কমতি নেই। চাষাভুষোর গাঁ, খেটে-খাওয়া মানুষের হাজার রকমের কাজ। তবু ওদের দুজনকে লোকে কেবল তখনি ডাকে যখন দুজনের মজুরি দিয়ে একজনের কাজটুকুতেই সন্তুষ্ট হওয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর থাকে না। এ দুজন যদি সাধু-সন্ন্যাসী হত, তবে সন্তোষ এবং ধৈর্যের জন্য কোনো সংযম-নিয়মেরই আবশ্যকতা হত না, কারণ এ-সব ছিল ওদের স্বভাবজাত। ছন্নছাড়া অদ্ভুত জীবন ওদের। ঘরে দুচারখানা মাটির বাসন ছাড়া সম্পত্তি বলতে কিছু নেই। ছেঁড়া কাপড় পরে নিজেদের নগ্নতাকে কোনোমতে ঢেকে জীবন কাটায়। সংসারের সব রকমের ভাবনাচিন্তা থেকে মুক্ত। ঋণে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। গালাগালি খায়, খায় মারধরও, তবুও কোনো দুঃখ নেই। গরিব এত যে, পরিশোধের আশা লেশমাত্র নেই জেনেও সবাই ওদের কিছু না-কিছু ধার দেয়। মটর বা আলুর সময় অন্যের ক্ষেত থেকে মটর কিংবা আলু চুরি করে তুলে নিয়ে এসে সেগুলোকে ভেজে বা পুড়িয়ে খেয়ে নেয়; কিংবা পাঁচদশ গাছা আখ ভেঙে এনে রাতের বেলা বসে-বসে চোষে। ঘিসু এই রকম আকাশবৃত্তিতেই ষাট-ষাটটা বছর কাটিয়ে দিয়েছে; আর মাধবও বাপের বেটা, অনুসরণ করে চলেছে তারই পদাঙ্ক; বরং বলা চলে বাপের নামকে আরও উজ্জ্বল করে চলেছে। এই যে এখন দুজনে আগুনের সামনে বসে আলুগুলো পোড়াচ্ছে তা-ও কারো-না-কারো ক্ষেত থেকে তুলে আনা। ঘিসুর বউটা তো অনেকদিন আগেই দেহরক্ষা করেছে। মাধবের বিয়ে হয়েছে এই গত বছর। মেয়েটি এদের ঘরে এসে পরিবারে একটা শৃঙ্খলা এনেছে। গম পিষেই হোক বা ঘাস তুলেই হোক সেরটাক আটার যোগাড় সে ঠিক করে নিত আর এই বেহায়াদুটোকে পিণ্ডি গেলাত। মেয়েটা ঘরে আসার পর এরা দু’জন আরও আলসে, আরও আরামপ্রিয় হয়ে উঠেছিল; বরং বলা চলে ওদের গুমরও যেন বেড়ে গিয়েছিল। কেউ কাজ করতে ডাকলে ইদানিং বিনাদ্বিধায় দুনো মজুরি হেঁকে বসত। এই মেয়েটিই আজ এদিকে প্রসববেদনায় মরে যাচ্ছে আর এরা দু’জন বোধকরি এই আশায় অপেক্ষা করে আছে যে, ও চোখ বুজলে আরাম করে ঘুমোতে পারবে।
ঘিলু আলু বের করে খোসা ছাড়াতে-ছাড়াতে বলে, ‘গিয়ে দেখ তো কী অবস্থা বেচারির! পেত্নীর নজর লেগেছে, তাছাড়া আর কি? এসব ঝাড়াতে-টাড়াতে তো ওঝা কম করেও একটা টাকা চাইবে!’
মাধবের ভয়, সে ঘরে ঢুকলে ঘিসু আলুগুলোর বেশির ভাগটা-না সাবাড় করে দেয়। বলে—’ওর কাছে যেতে আমার ভয় করছে।’
‘ভয় কিসের রে, আমি তো এখানে রয়েছিই!’
‘তাহলে তুই-ই গিয়ে দেখ না।‘
‘আমার বউ যখন মারা গিয়েছিল, আমি তিনদিন ওর কাছ থেকে নড়িনি। আর তাছাড়া আমাকে দেখলে ও লজ্জা পাবে না? কোনোদিন যার মুখ দেখিনি, আজ তার উদলা গা দেখব! ওর তো এখন গা-গতরের হুঁশ-টুশও নেই। আমাকে দেখে ফেললে ভালো করে হাত-পা-ও হুঁড়তে পারবে না।’
‘আমি ভাবছি যদি বাচ্চাটাচ্চা হয়ে পড়ে তাহলে কী হবে? শুঠ, গুড়, তেল কিছুই তো ঘরে নেই।’
‘সবই এসে যাবে। ভগবান দিক তো! যারা এখন একটা পয়সা দিচ্ছে না, তারাই কালকে যেচে এসে টাকা দেবে। আমার ননটা ছেলে হয়েছে, ঘরে তো কোনোদিন একটা কানাকড়িও ছিল না, তবু ভগবান কোনও-না-কোনও মতে কাজ তো চালিয়ে দিয়েছেন।’
.
যে-সমাজে দিনরাত খেটে-খাওয়া মানুষের হাল ওদের চাইতে বেশি কিছু ভালো নয়, যেখানে চাষিদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে যারা মুনাফা লোটে তারাই চাষিদের চেয়ে অনেক বেশি সংগতিপন্ন, সে-সমাজে এ-ধরনের মনোবৃত্তির সৃষ্টি হওয়া কিছু অবাক হবার মতো কথা নয়। বরং বলব ঘিলু চাষিদের চাইতে ঢের বেশি বুদ্ধিমান, তাই সে নির্বোধ চাষিদের পালে না-ভিড়ে আড্ডাবাজদের কুৎসিত দলে গিয়ে জুটেছিল। তবে হ্যাঁ, ওর মধ্যে এতটা ক্ষমতা ছিল না যে, আড্ডাবাজদের নিয়মকানুন ঠিকঠাক রপ্ত করে। তাই ওর দলভুক্ত অন্য সবাই যেখানে গাঁয়ের মাতব্বর কিংবা মোড়ল হয়ে গেছে, সেখানে সারা গাঁ ওর নিন্দে করে। তবু এ-সান্ত্বনাটুকু ওর আছে যে, ওর হাঁড়ির হাল খারাপ হলেও অন্ততপক্ষে ওকে ওসব চাষিদের মতো হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয় না। ওর সরলতা এবং নিরীহতা থেকে অন্যরা অনুচিত মুনাফা লুটতে পারে না।
দুজনে আলু বের করে-করে গরম-গরম খেয়ে চলে। কাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। তাই আলু ঠাণ্ডা হবার তর সইছে না। ফলে বারকয়েক দুজনেরই জিভ পুড়ে যায়। খোসা ছাড়ালে আলুর ওপরটা খুব বেশি গরম বলে মনে হয় না, কিন্তু দাঁতের নিচে পড়া মাত্রেই ভেতরটাকে, জিভ, গলা আর টাকরাকে পুড়িয়ে দেয়। ওই অঙ্গারটাকে তখন মুখে রাখার চাইতে অনেক বেশি ভালো পেটের ভেতরে পাচার করে দেয়া। সেখানে ওটাকে ঠাণ্ডা। করার মতো যথেষ্ট বস্তু রয়েছে। তাই দুজনে গপাগপ গিলে ফেলছে। যদিও এ করতে গিয়ে চোখে জল এসে পড়ছে ওদের।
খেতে-খেতে জমিদারের বিয়েতে বরযাত্রী যাবার কথা ঘিসুর মনে পড়ে যায়। বছর কুড়ি আগে সেই বরযাত্রী হয়ে গিয়েছিল। সেই ভোজ খেয়ে যে তৃপ্তি সে পেয়েছিল তা তার জীবনে মনে রাখার মতো ঘটনা, আজও সে স্মৃতি তার উজ্জ্বল হয়ে আছে। বলে—’ওই ভোজের কথা ভুলতে পারি না। তারপর সারা জীবনে অমন খাবার আর পেট পুরে খাইনি। মেয়ের বাড়ির লোকেরা সবাইকে পেট ভরে পুরি খাইয়েছিল, সব্বাইকে! ছোট-বড় সবাই পুরি খেয়েছিল, একেবারে খাঁটি ঘিয়ে ভাজা! চাটনি, রায়তা, তিন রকমের শুকনো তরকারি, একটা ঝোল, দই, মিষ্টি। কী বলব, এ-ভোজে সেদিন কী আস্বাদ পেয়েছিলাম! কোনও নিষেধ-মানা ছিল না। যে-জিনিস যত খুশি চেয়ে নাও, যত চাই খাও। সবাই অ্যাত্ত-অ্যাও খেয়েছিল যে, কেউ জল পর্যন্ত খেতে পারেনি। পরিবেশকরা পাতে গরম-গরম, গোল-গোল, সুগন্ধি কচুরি দিয়েই। চলছিল। যত মানা করি আর চাই না, পাতের উপর হাতচাপা দিয়ে রাখি, কিন্তু তবু ওরা দিয়ে যাচ্ছিল তো যাচ্ছিলই। তারপর যখন আঁচিয়ে এলাম, তখন পান-এলাচও পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার তখন পান খাবার হুঁশ কোথায়। দাঁড়িয়ে থাকতেই পারছিলাম না। চটপট গিয়ে আমার। কম্বল পেতে শুয়ে পড়েছিলাম। এত দিলদরিয়া ছিলেন ওঁরা।’
মাধব মনে-মনে জিনিসগুলোর স্বাদ কল্পনা করতে-করতে বলে—’আজকাল কেউ তো আর আমাদের অমন ভোজ খাওয়ায় না।’
‘আজকাল আর খাওয়াবে কে, খাওয়াবেই-বা কী? ওই জমানাটাই ছিল আলাদা। এখন তো সবাই পয়সা বাঁচানোর ধান্দাতেই আছে। বিয়ে-সাদিতে খরচ করে না, ক্রিয়া-করমে খরচ করে না। বলি গরিবগুলানের পয়সা লুটে-লুটে রাখবি কোথায়?’
লুটবার বেলায় ক্ষ্যামা নেই, শুধু খরচের বেলাতেই যত্ত হিসাব।
‘তুমি খানবিশেক পুরি খেয়েছিলে বোধহয়? ‘বিশখানার বেশিই খেয়েছিলাম।’
‘আমি হলে পঞ্চাশখানা সেঁটে ফেলতাম।’
‘খানপঞ্চাশের কম আমিও খাইনি। তাগড়া জোয়ানমদ্দ ছিলাম। তুই তো আমার আদ্দেকও নোস।’
আলু খাওয়া হয়ে গেলে দুজনেই জল খেয়ে ওখানেই আগুনের সামনে কাপড়ের খুঁট গায়ে জড়িয়ে পেটে পা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ে। যেন দুটো বড়-বড় অজগর কুণ্ডলি পাকিয়ে পড়ে আছে।
ওদিকে বুধিয়া সমানে ঝাঁকিয়ে চলেছে।
সকালে ঘরে ঢুকে মাধব দেখে বউটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ওর মুখের উপর মাছি ভন করছে। উপরদিকে চেয়ে রয়েছে পাথরের মতো স্থির নিশ্চল দুটি চোখ। সমস্ত শরীর ধুলোয় মাখামাখি। ওর পেটে বাচ্চাটা মরে গেছে।
মাধব ছুটতে-ছুটতে ঘিসুর কাছে যায়। তারপর দুজনে জোরে-জোরে হাহাকার করতে-করতে বুক চাপড়াতে থাকে। পাড়াপড়শিরা কান্নাকাটি শুনে ছুটতে-ছুটতে আসে এবং চিরাচরিত রীতি অনুসারে এই হতভাগা দু’জনকে সান্ত্বনা দেয়।
কিন্তু বেশি কান্নাকাটির সময় নেই। শবাচ্ছাদনের নতুন কাপড় আর কাঠের ভাবনা ভাবতে হবে। এদিকে ঘরে পয়সা তো যেমন চিলের বাসায় মাংস তেমনি শূন্য।
বাপ-বেটা দুজনে কাঁদতে-কাঁদতে গায়ের জমিদারের কাছে যায়। উনি এই দুজনের মুখই দেখতে পারেন না। বারকয়েক এ দুজনকে নিজের হাতে পিটুনি দিয়েছেন চুরি করেছে বলে কিংবা কথা দিয়ে ঠিকমতো কাজে আসেনি বলে। জিজ্ঞেস করেন—’কী হয়েছে রে ঘিলুয়া, কাঁদছিস কেন? আজকাল তো কোথাও তোর দেখা মেলা ভার। মনে হচ্ছে যেন এ গাঁয়ে থাকার ইচ্ছে নেই তোর।‘
ঘিসু মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে জলভরা চোখে বলে—’কত্তামশায় গো! বড় বিপদে পড়েছি! মাধবের বউটা কাল রাতে মরে গেছে। সারাটা রাত ছটফট করেছে কত্তা! আমরা দুজন ওর শিয়রে বসে ছিলাম। ওষুধবিমুদ যদুর পেরেছি, সব করেছি। তবুও বউটা আমাদের দাগা দিয়ে গেল, কত্তা। একখানা যে রুটি করে খাওয়াবে এমন কেউ আর রইল না। কত্তাবাবু! একেবারে পথে বসেছি। সংসারটা ছারখার হয়ে গেল, হুজুর। হুজুরের গোলাম আমরা। এ-বিপদে হুজুর আপনি ছাড়া কে ওর ঘাটের দায় উদ্ধার করবে? আমাদের হাতে যা কিছু দু-চার পয়সা ছিল, সব ওষুধ আর পথ্যিতে শেষ হয়ে গেছে। হুজুর যদি দয়া করেন তাহলেই ওকে ঘাটে তুলতে পারব। আপনি ছাড়া আর কার দোরে গিয়ে হাত পাতব, হুজুর!’
জমিদারবাবু দয়ালু। তবে ঘিসুকে দয়া করার মানে তো ভস্মে ঘি ঢালা। ইচ্ছে হল বলে দেন–ভাগ, দূর হ সামনে থেকে। এমনিতে তো ডেকে পাঠালেও আসিস না। আজ গুরজ পড়েছে, তাই এসে খোশামোদ করছিস। হারামদাজা, বদমাস কোথাকার! কিন্তু রাগ করার বা সাজা দেয়ার সময় এখন নয়। মনে-মনে গজগজ করতে-করতে দুটো টাকা বের করে ছুঁড়ে দেন। সান্ত্বনার একটি কথাও মুখ দিয়ে বের হয় না। ওদের দিকে ফিরেও তাকান না, যেন কোনোমতে ঘাড় থেকে আপদ দূর করেন।
জমিদারমশাই যখন দু’টাকা দিয়েছেন, তখন গাঁয়ের বেনে মহাজনেরা নিষেধ করে কী করে! ঘিসু জমিদারের নামের ঢাক পেটাতেও খুব ওস্তাদ! ওরা কেউ দেয় দু’আনা, কেউ চার আনা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঘিসুর হাতে টাকাপাঁচেকের মতো পুঁজি যোগাড় হয়ে যায়। এছাড়া কেউ গমটম দেয়, কেউ-বা কাঠ। তারপর দুপুরবেলা ঘিসু আর মাধব বাজার থেকে কফনের জন্য নতুন কাপড় আনতে যায়। এদিকে অন্যরা বাঁশ কাটতে শুরু করে।
গায়ের কোমলমনা মেয়েরা এসে মৃতাকে দেখে, বেচারির অসহায় অবস্থার কথা ভেবে দুফোঁটা চোখের জল ফেলে চলে যায়।
বাজারে এসে ঘিসু বলে–’ওকে জ্বালানোর মতো কাঠ তো যোগাড় হয়ে গেছে, তাই না রে মাধব?’
মাধব বলে—’হ্যাঁ, কাঠ তো অনেক হয়েছে, এখন কফন হলেই হয়।’
‘তাহলে চল সস্তা দেখে একখানা কফন কিনে নিই।‘
‘হ্যাঁ, তাছাড়া আর কী? মড়া তুলতে-তুলতে রাত হয়ে যাবে। রাতের বেলায় কফন অত কে দেখতে যাচ্ছে?’
‘কেমনতর যে বাজে নিয়ম সব, বেঁচে থাকতে গা ঢাকার জন্য একখানা ঘেঁড়া তেনাও
যে পায়নি মরলে তার নতুন কফন চাই।
‘কফনটা তো মড়ার সঙ্গেই পুড়ে যায়।’
‘তা না তো কি থেকে যায় নাকি? এই টাকা পাঁচটা আগে পেলে বউটাকে একটু ওষুধ-পথ্যি খাওয়াতে পারতাম।’
দুজনেই দুজনের মনের কথাটা টের পাচ্ছে। বাজারে এখানে-ওখানে ঘুরছে তো ঘুরছেই। কখনো এ দোকানে, কখনো ও-দোকানে। নানা রকমের কাপড়-রেশমি কাপড়, সুতি কাপড় সব দেখে, কিন্তু কোনোটাই পছন্দ হয় না। এই করতে-করতে সন্ধ্যা নামে। তখন দুজনেই এক দৈবী প্রেরণাবশে একটি পানশালার দরজায় এসে দাঁড়ায়, তারপর প্রায় পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা মতো ভেতরে ঢুকে পড়ে। ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ দুজনে অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর গদির সামনে গিয়ে ঘিসু বলে–’সাহজী, এক বোতল আমাদেরকেও দিন।’
এরপর কিছু চাট আসে, মাছভাজা আসে, আর ওরা দুজনে বারান্দায় বসে নিশ্চিন্ত মনে মদ গিলে চলে।
কয়েক ভাড় তড়বড় করে গেলবার পর দুজনেরই একটু-একটু নেশার আমেজ আসে। ঘিসু বলে–কফন দিলে হতটা কী? শেষঅব্দি পুড়েই তো যেত। বউয়ের সঙ্গে তো আর যেত না।’
মাধব আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন সব দেবতাকে তার নিষ্পাপ কাজের সাক্ষী মেনে বলে—’দুনিয়ার দস্তুরই যে এই, নইলে লোকে বামুনঠাকুরদের হাজার-হাজার টাকাই-বা দেয় কেন? কে দেখছে, পরলোকে কী পাচ্ছে না-পাচ্ছে।’
বড়লোকদের হাতে পয়সা আছে, ইচ্ছে হলে ওড়াক গে। আমাদের কাছে উড়িয়ে দেয়ার মতন আছেটা কী!
কিন্তু ওদের সবাইকে কী বলবি? ওরা জিজ্ঞেস করবে-না কফন কই? ঘিলু হাসে—’আরে ধ্যাৎ, বলব টাকা ট্যাক থেকে কোথায় যে খসে পড়ে গেছে, অনেক খুঁজেছি, পাইনি। ওরা বিশ্বাস করবে না ঠিকই, তবু ওরাই আবার টাকা দেবে।’
মাধবও হেসে ফেলে; এই অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যে বলে–’আহা! বড় ভালো ছিল গো বেচারি! মরেও খুব খাইয়ে গেল।
আধ বোতলের ওপর শেষ হয়ে যায়। ঘিষু দুসের পুরি আনিয়ে নেয়। সঙ্গে চাটনি, আচার, মোটর কারি। গুঁড়িখানার সামনেই দোকান। মাধব ছুটে গিয়ে দুটো ঠোঙায় করে সব জিনিস নিয়ে আসে। পুরো দেড়টি টাকা আরও খরচ হয়ে যায়। হাতে শুধু ক’টা পয়সা বাকি থাকে।
দুজনে এখন খোশমেজাজে বসে পুরি খাচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে যেন বনের বাঘ বনে বসে তার শিকার সাবাড় করছে। না-আছে জবাবদিহি করার ভয়, না-আছে বদনামের ভাবনা। এসব ভাবনাচিন্তাকে ওরা অনেক আগেই জয় করে নিয়েছে।
ঘিসু দার্শনিকের মতো বলে–এই যে আমাদের আত্মা খুশি হচ্ছে, এতে কি বউ আনন্দ পাবে না?
মাধব ভক্তিতে মাথা নুইয়ে সায় দেয়–‘খুব পাবে, আলবৎ পাবে। ভগবান, তুমি অন্তযামী। ওকে সগৃগে নিয়ে যেও। আমরা দুজনে মন খুলে আশীৰ্বাদ করছি। আজ যে খাওয়াটা খেলাম অমনটা সারাজীবনে কোনোদিন কপালে জোটেনি।
খানিক বাদে মাধবের মনে একটা সন্দেহ জাগে। বলে–’আচ্ছা বাবা, আমরাও তো একদিন ওখানে যাব।’
ঘিসু এই সোজা সহজ প্রশ্নটার কোনো জবাব দেয় না। পরলোকের কথা ভেবে এই আনন্দটাকে মাটি করতে চায় না সে।
‘যদি ও ওখানে আমাদের জিগ্যেস করে তোমরা আমাকে কফন দাওনি কেন, তাহলে কী বলবি?’
বলব, তোর মুণ্ডু।’
‘জিগ্যেস তো ঠিকই করবে।’
‘তোকে কে বলেছে যে ও কফন পাবে না? তুই কি আমাকে অমন গাধা ঠাউরেছিস? ষাটটা বছর কি দুনিয়াতে ঘোড়ার ঘাস কেটে আসছি। বউ কফন ঠিকই পাবে আর এর থেকে অনেক ভালো পাবে।’
মাধবের বিশ্বাস হয় না। বলে–’দেবেটা কে? পয়সা তো তুই খেয়ে ফেলেছিস। ও তো আমাকেই জিগ্যেস করবে। ওর সিথেয় সিঁদুর যে আমিই পরিয়েছি।’
ঘিসু গরম হয়ে বলে–’আমি বলছি ও কফন পাবে। তোর পেত্যয় হচ্ছে না কেন?
‘দেবেটা কে বলছিস-না কেন?
ও লোকগুলানই দেবে যারা এবার দিয়েছে। হ্যাঁ, তবে এর পরের টাকাটা আর আমাদের হাতে আসবে না।
যেমন অন্ধকার বেড়ে চলে, আকাশের তারাগুলোর দীপ্তি বাড়ে, মদের দোকানের রঙতামাশাও তেমনি বাড়তে থাকে। কেউ গান গায়, কেউ ডিগবাজি খায়, কেউ-বা তার সাথীর গলা জড়িয়ে ধরে। কেউ তার ইয়ারের মুখে মদের ভাড় তুলে দেয়।
এখানকার পরিবেশে মাদকতা, হাওয়াতে নেশা। কত লোক তো এখানে এসে এক টোক খেয়েই মাতাল হয়ে পড়ে। মদের থেকেও বেশি এখানকার হাওয়া ওদের নেশা ধরায়। জীবনের দুঃখ-কষ্ট ওদের এখানে টেনে আনে। কিছু সময়ের জন্য ওরা ভুলে থাকে ওরা বেঁচে আছে না মরে গেছে। নাকি বেঁচেও নেই, মরেও নেই।
বাপ-বেটা দুজনে এখনো মৌজ করে-করে চুমুক দিয়ে খাচ্ছে। সবার নজর ওদের দুজনের ওপর। কী ভাগ্য দুজনের! পুরো একটা বোতল ওদের মাঝখানে! পেট ভরে খেয়ে মাধব বেঁচে যাওয়া পুরির ঠোঙাটা নিয়ে গিয়ে একটি ভিখারিকে দিয়ে দিল।
ভিখারিটি দাঁড়িয়ে ওদের দিকে ক্ষুধাতুর চোখে তাকাচ্ছিল। দেয়ার গৌরব, আনন্দ আর উল্লাসে মাধব জীবনে এই প্রথম অনুভব করে।
ঘিসু বলে–’নে রে, যা ভালো করে খা আর আশীৰ্বাদ কর। যার দৌলতে খাওয়া ও তো মরে গেছে। তবু তোর আশীৰ্বাদ ওর কাছে পৌঁছবে। মন খুলে পরান খুলে আশীৰ্বাদ কর, বড় কষ্টের রোজগারের পয়সা রে!
মাধব আবার অকাশের দিকে তাকিয়ে বলে–ও ঠিক বৈকুণ্ঠে যাবে গো বাবা, ও বৈকুণ্ঠের রানী হবে।’
ঘিসু উঠে দাঁড়িয়ে যেন উল্লাসের তরঙ্গে সাঁতরাতে-সাঁতরাতে বলে–’হ্যাঁ বাবা, বৈকুণ্ঠেই যাবে বৈকি। কাউকে কষ্ট দেয়নি, দুখখু দেয়নি। মরতে-না-মরতে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সাধটি পুরিয়ে দিয়ে গেছে। ও যদি বৈকুণ্ঠে না-যাবে তো কি ওই ধুমসো-ধুমসো লোকগুলো যাবে যারা গরিবগুলোনরে দুহাতে লুটছে আর নিজেদের পাপ ধুয়ে ফেলতে গঙ্গায় গিয়ে চান করছে, মন্দিরে পুজো দিচ্ছে!’
ভক্তিশ্রদ্ধার এই অনুভূতিটি তাড়াতাড়ি বদলে যায়। অস্থিরতাই নেশার বৈশিষ্ট্য, এর পর দুঃখ আর হতাশা মনে ভর করে।
মাধব বলে–’বাবা, বেচারি কিন্তু জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। মরল, তা-ও কত যন্ত্রণা সয়ে।’
বলে চোখে হাত-চাপা দিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেয়। ভেউ-ভেউ করে কেঁদে ওঠে। ঘিলু বোঝায়–কাঁদছিস কেন বাবা, আনন্দ কর। বউ এই মায়া থেকে ছুটি পেয়ে গেছে। এই জঞ্জাল থেকে রেহাই পেয়েছে। বড় ভাগ্যিমানী ছিল রে, তাই তো এত তাড়াতাড়ি মায়ামমতা কাটিয়ে চলে গেছে।’
তারপর দুজনে উঠে দাঁড়িয়ে গান গাইতে শুরু করে দেয়– ঠগিনী, কেঁয়ো নৈনা ঝমকায়ৈ। ঠগিনী!’ সব মাতাল এদের দুজনকে দেখছে। এরা দুজনে মত্ত হয়ে গান গেয়ে চলে। তারপর দুজনে নাচতে শুরু করে দেয়। লাফ দেয়। ঝাঁপ দেয়। পড়েও যায়। উঠে হেলেদুলে। চলে। কতরকম ভাবভঙ্গি করে। অভিনয় করে। তারপর শেষ পর্যন্ত নেশায় চুরচুর হয়ে ওখানেই টলে পড়ে যায়।
পৌষের রাত – প্রেমচন্দ
এক
হলকু এসে বলে–পেয়াদাটা এসেছে। দাও, যে কটা টাকা রেখেছিলাম, দিয়ে দিই ওকে, আপদ বিদেয় হোক।
মুন্নি ঝাঁট দিচ্ছিল। পেছন ফিরে বলে–তিনটে তো মাত্তর টাকা, দিয়ে দিলে কম্বল কোত্থেকে আসবে শুনি? পৌষ-মাঘ মাসের রাতে ক্ষেতে কী করে কাটাবে? গিয়ে ওকে বলে দাও, ফসল উঠলে চুকিয়ে দেব। এখন নেই।
হলকু কিছুক্ষণ দ্বিধাগ্রস্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। পৌষ মাস মাথার ওপর এসে গেছে। কম্বল ছাড়া রাতে মাচায় কিছুতেই সে শুতে পারবে না। কিন্তু পেয়াদা যে শুনবে না, চোটপাট করবে, গালাগালি দেবে। মরুক গে, শীতে না-হয় মরব, আপদটা তো এখন বিদেয় হবে। এই ভেবে সে তার মোটাসোটা গতরটা নিয়ে (যা তার নামটাকে মিথ্যে প্রমাণিত করেছে।) বউয়ের কাছে গিয়ে খোশামোদ করে বলে–যা, এনে দে, ঝামেলা তো মিটুক। কম্বলের কিছু একটা উপায় করবই।
মুন্নি ওর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে–আর করেছ উপায়! শুনি। তো একটু, কী উপায় করবে? কেউ খয়রাত দেবে নাকি কম্বল? জানি না আর কত বাকি আছে, এ যেন কিছুতেই শোধ হচ্ছে না। বলি, তুমি চাষবাস ছেড়ে দাও না কেন? মরে-মরে কাজ করবে, তারপর যেই ফসল উঠবে অমনি বাকি বকেয়া চুকাবে, ব্যস শেষ। ধার শোধ করতেই যেন আমাদের জন্ম। পেট ভরাতে মজুরি কর। চুলোয় যাক। অমন চাষ-বাস। দেব না আমি টাকা–কিছুতেই দেব না।
হলকু বিষণভাবে বলে–তাহলে গালাগালি খাব?
মুন্নি তড়পে ওঠে–গালাগালি দেবে কেন? এ কি ওর রাজত্ব নাকি?
কথাটা বলে ফেলেই ওর কোঁচকানো ভুরু শিথিল হয়ে পড়ে। হল্কুর ঐ কথাগুলোর রূঢ় সত্যতা যেন একটি হিংস্র পশুর মতো চোখ পাকিয়ে দেখতে থাকে। গিয়ে তাকের উপর থেকে টাকা ক’টা বের করে এনে সে হলকুর হাতে তুলে দেয়। বলে–তুমি এবার চাষাবাদ ছেড়ে দাও। মজুরি করলে তবু শান্তিতে একখানা রুটি খেতে পাব। কারু ধমকানি তো শুনতে হবে না।
হলকু টাকা ক’টা হাতে নিয়ে এমনভাবে বাইরে যায় যেন সে তার কলজেটাকেই ছিঁড়ে দিতে যাচ্ছে। মজুরির রোজগার থেকে একটা-একটা করে পয়সা বাঁচিয়ে সে তিনটে টাকা জমিয়েছিল একটা কম্বল কিনবে বলে। সে টাকা ক’টাও আজ বেরিয়ে যাচ্ছে। এক-একটা পা ফেলছে আর মাথাটা যেন তার দৈন্যের ভারে নুয়ে-নুয়ে পড়ছে।
দুই
পৌষের অন্ধকার রাত। আকাশের তারাগুলোও যেন শীতে থরথর করে কাঁপছে। হলকু ক্ষেতের একপাশে আখের পাতার ছাউনির নিচে বাঁশের মাচার উপর তার পুরনো মোটা সুতির চাদরখানা মুড়ি দিয়ে পড়ে-পড়ে হিহি করে কাঁপছে। মাচার নিচে ওর সঙ্গী কুকুর জবরা মুখখানাকে পেটের মধ্যে খুঁজে শীতে কুঁ-কুঁ করে চলেছে। দুজনের কারোরই চোখে ঘুম নেই।
হাঁটুদুটোকে ঘাড়ের সঙ্গে চাপতে-চাপতে হলকু বলে–কিরে জবরা, শীত করছে? বলেছিলাম না, বাড়িতে খড়ের উপর শুয়ে থাক, তা এখানে কী করতে এসেছিস? ম এবার ঠাণ্ডায়। আমি কী করব? ভেবেছিলি আমি বোধহয় হালুয়া-পুরি খেতে আসছি, তাই ছুটতে-ছুটতে আগে-আগে চলে এসেছিস? এখন কাদ বসে-বসে।
জবরা শুয়ে-শুয়ে লেজ নাড়ে আর তার কুঁ..উঁ…শব্দটাকে দীর্ঘায়িত করে একটা হাই তুলে চুপ করে যায়। তার সারমেয়-বুদ্ধি বোধহয় মনে করে যে ও কুঁ…কুঁ…করছে বলে মনিবের ঘুম আসছে না।
হাত বের করে জবরার ঠাণ্ডা পিঠে হাত বুলোতে-বুলোতে হলকু বলে–কাল থেকে আমার সঙ্গে আর আসিসনে। এলে ঠাণ্ডায় জমে যাবি। এই শালার পশ্চিমা বাতাস কী। জানি কোত্থেকে বরফ বয়ে আনছে। দেখি উঠে আর এক ছিলিম তামাক খেয়ে নিই। কোনোমতে রাতটা তো কাটবে। আট ছিলিম টানা তো শেষ। এই হল গে চাষবাসের মজা। আবার এক-একজন এমন ভাগ্যবানও আছেন যাদের কাছে শীত গেলে ভয়ে পালাবে। মোটা-মোটা সব লেপ, তোষক, কম্বল। সাধ্য কি যে শীত পাত্তা পাবে! বরাতের জোর আর কি! খেটে মরব আমরা, মজা লুটবে অন্যে!
হলকু ওঠে। গর্ত থেকে খানিকটা আগুন বের করে কলকে সাজায়। জবরাও উঠে বসে! তামাক খেতে-খেতে হলকু বলে-খাবি তামাক? শীত আর কমে কই। হ্যাঁ, একটু যা মনটাকেই বুঝ দেওয়া।
জবরা ওর মুখের পানে স্নেহভরা চোখে তাকিয়ে থাকে।
হলকু–আজ একটু শীত সয়ে নে। কাল আমি এখানটায় খড় বিছিয়ে দেব। খড়ের ভেতর ঢুকে শুয়ে থাকিস, তাহলে শীত লাগবে না।
থাবাদুটোকে হলকুর হাঁটুর উপর তুলে দিয়ে হল্কুর মুখের কাছে মুখ নিয়ে যায় জবরা। হল্কুর গালে ওর গরম নিঃশ্বাস লাগে।
তামাক খেয়ে হলকু আবার শুয়ে পড়ে। এবার সংকল্প করে শোয় যে যত যাই হোক না কেন এবার ঘুমাবই। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর বুকের ভেতরে কাঁপুনি শুরু হয়ে। যায়। একবার এ-পাশ ফিরে শোয়, আবার ও-পাশ। কিন্তু শীত যেন পিশাচের মতো ওর বুকে চেপে বসে থাকে।
কিছুতেই আর থাকতে না-পেরে সে জবরাকে আস্তে করে তুলে কোলে টেনে নেয়। জবরার মাথাটাকে আস্তে-আস্তে চাপড়াতে থাকে। কুকুরটার গা থেকে না-জানি কেমন একটা দুর্গন্ধ আসে, তবু হলকু তাকে কোলে জাপটে ধরে এমন আরাম পায় যা সে ইদানীং কয়েকমাস পায়নি। জবরা বোধহয় ভাবে এই বুঝি স্বর্গ। হলকুর নিষ্পাপ মনে কুকুরটির। প্রতি লেশমাত্র ঘৃণাও নেই। সে তার কোনও অভিন্নহৃদয় বন্ধু বা ভাইকেও এমনি আগ্রহের সঙ্গেই আলিঙ্গন করত। আজকের এই দৈন্যদশা তার মনকে মোটেই আহত করেনি।
এই অদ্ভুত মিত্রতা তার হৃদয়ের সমস্ত দ্বারকে উন্মুক্ত করে দিয়ে হৃদয়ের প্রতিটি অণুকণাকে যেন আলোয় উদ্ভাসিত করে তুলেছে।
হঠাৎ জবরা জানোয়ারের পায়ের আওয়াজ পায়। অন্তরঙ্গ এই আত্মীয়তা তার মনে এক নতুন উন্মাদনা জাগিয়ে তোলে, যার কাছে ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপটও তুচ্ছ। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে সে ছাউনির বাইরে এসে ঘেউ-ঘেউ করে ওঠে। হলকু কয়েকবার চু-চু করে ডাকে। তবু সে তার কাছে ফিরে আসে না। ক্ষেতের চারপাশে ছুটে-ছুটে ডাকাডাকি করে চলে। কিছুক্ষণের জন্য এলেও তাড়াতাড়ি আবার ছুটে যায়। কর্তব্যভাবনা যেন ওর মনটাকে আকাক্ষার মতোই উথালপাথাল করে তোলে।
তিন
আরো একটা ঘণ্টা কাটে। রাত যেন শীতকে হাওয়ার ঝাঁপটা দিয়ে-দিয়ে আরো শাণিয়ে তোলে। হলকু উঠে বসে হাঁটুদুটোকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে দু-হাঁটুর মাঝখানে মাথাটা খুঁজে নেয়। তবুও শীত মানে না। মনে হচ্ছে যেন সব রক্ত জমে বরফ হয়ে গেছে। ধমনীতে রক্তের বদলে বরফ বইছে। সে ঝুঁকে আকাশের দিকে তাকায় রাত আর কত বাকি! সপ্তর্ষিমণ্ডল এখনো যে আকাশের অর্ধেকটাও ওঠেনি। উপরে উঠে এলেই তবে গিয়ে ভোর হবে। এখনো প্রহরখানেক রাত রয়েছে।
হলকুর ক্ষেত থেকে একটু দূরে আমবাগান। পাতাঝরা শুরু হয়ে গেছে। বাগানে রাশি-রাশি শুকনো পাতা। হল্কু ভাবে ওদিকে গিয়ে পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বেলে বেশ করে আগুন পোহায়। এত রাতে কেউ পাতা কুড়োতে দেখলে ভাববে ভূত। কে জানে কোনো জানোয়ার-টানোয়ার কোথাও লুকিয়ে বসে আছে কিনা; কিন্তু আর যে বসে থাকা যাচ্ছে না।
পাশের অড়হর ক্ষেতে গিয়ে কয়েকটা গাছ উপড়ে নিয়ে, তা দিয়ে একটা ঝড়র মতো বানিয়ে হাতে খুঁটে জ্বালিয়ে নিয়ে সে বাগানের দিকে যায়। জবরা তাকে দেখে কাছে এসে লেজ নাড়ে।
হলকু বলে, আর যে থাকতে পারছি না রে জবরু! চল, বাগানে পাতা কুড়িয়ে আগুন পোহাই। গা গরম করে নিয়ে এসে শোব। এখনো অনেক রাত। জবরা কু-কুঁ করে সম্মতি জানিয়ে সামনের বাগানের দিকে এগিয়ে যায়।
ঘুটঘুটি অন্ধকার বাগানে। অন্ধকারে দুরন্ত হাওয়া পাতাগুলোকে মাড়িয়ে দিয়ে যায়। গাছ থেকে শিশিরবিন্দু টুপটুপ করে নিচে ঝরে-ঝরে পড়ে।
হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া মেহেদি ফুলের গন্ধ বয়ে আনে।
হলকু বলে–কী মিষ্টি গন্ধ রে জবরু! তুইও নাকে সুগন্ধ পাচ্ছিস তো?
জবরা মাটিতে পড়ে থাকা এক টুকরো হাড় খুঁজে পায়, দাঁত দিয়ে সেটাকে চিবোতে শুরু করে।
মাটিতে আগুনটাকে রেখে হলকু পাতা জড়ো করতে লেগে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে একরাশ পাতা জমে ওঠে। ঠাণ্ডায় ওর হাত দুখানা কাপে। খালি পা দুটো যেন অবশ হয়ে পড়ে। পাতার পাহাড় সে খাড়া করেছে। শীতকে এই আগুনের কুণ্ডে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেবে সে।
খানিক বাদেই আগুন জ্বলে ওঠে। আগুনের শিখা উপরের গাছের পাতাগুলোকে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে যায়। সেই চঞ্চল আলোয় বাগানের বিরাট-বিরাট গাছগুলোকে মনে হয় অথৈ আঁধারকে কারা যেন মাথায় তুলে রেখেছে। অন্ধকারের এই সাগরে এই আলোটা যেন। একখানা নৌকোর মতো হেলতে-দুলতে থাকে।
হলকু আগুনের সামনে বসে ওম পোহায়। একটু পরেই গায়ের চাদর খুলে সে বগলদাবা করে রাখে। পা দুখানা মেলে দেয়, ভাবখানা যেন শীতকে ডেকে বলছে ‘দেখি কর, তোর যা খুশি।’ শীতের অসীম ক্ষমতাকে হারিয়ে দেয়ার বিজয়গর্বকে সে হৃদয়ে চেপে রাখতে পারছে না।
জবরাকে বলে, কী রে, আর শীত লাগছে-না তো?’
জবরা কুঁ-কুঁ করে যেন বলে–এখন কী করে আর শীত লাগবে?
আগে থাকতে কথাটা মনে আসেনি। নইলে কি আর শীতে এত ভুগতাম।
জবরা লেজ নাড়ে।
‘বেশ বাবা, এস তো দেখি এই আগুনটাকে টপকে পার হই। দেখি কে যেতে পারে? পুড়েটুড়ে গেলে বাবা, আমি কিন্তু ওষুধ দেব না।’
অগ্নিকুণ্ডটার দিকে কাতর নয়নে তাকিয়ে দেখে জবরা।
‘মুন্নিকে কাল আবার বলে দিও-না যেন তাহলে ঝগড়া করবে।’ বলে সে লাফ দিয়ে আগুনটার উপর দিয়ে টপকে যায়। পায়ে একটুখানি আঁচ লাগে বটে, তবে তা তেমন কিছু নয়। জবরা আগুনের পাশ দিয়ে ঘুরে ওর কাছে এসে দাঁড়ায়।
হলকু বলে–’উঁহু, এটা ঠিক হচ্ছে না। উপর দিয়ে টপকে এস’, বলে সে আবার লাফ দিয়ে আগুনের এ-পাশে চলে আসে।
চার
পাতা সব পুড়ে ছাই। বাগানে অন্ধকার আবার ছড়িয়ে পড়ে। ছাইয়ের নিচে কিছু-কিছু আগুন। রয়েছে, যা বাতাসের ঝাঁপটা এলে একটুখানি জ্বলে উঠে পরক্ষণেই আবার নিভে যায়।
হলকু আবার চাদর গায়ে জড়িয়ে নিয়ে গরম ছাইয়ের পাশে বসে গুনগুন করে একটা গান ধরে। গা-টা ওর গরম হয়েছে বটে, কিন্তু আস্তে-আস্তে আবার শীত যত বাড়ে ওকে তত আলসেমিতে পেয়ে বসে।
জোরে ঘেউঘেউ করে ক্ষেতের দিকে জবরা ছুটে যায়। হলকুর যেন মনে হয় একপাল জানোয়ার ওর ক্ষেতে এসে ঢুকেছে। বোধহয় নীলগাইয়ের পাল। ওদের দাপাদাপি, ছুটোছুটির আওয়াজও পরিষ্কার হলকুর কানে আসে। ওরা বোধহয় ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলছে। ওদের চিবানোর চড়চড় আওয়াজও শোনা যায়। হলকু মনে মনে বলে–নাহ্ জবরা থাকতে কোনো জানোয়ারের সাধ্যি নেই ক্ষেতে ঢুকবে। ও ছিঁড়েই ফেলবে। এ আমার মনের ভুল। কই, আর তো কিছু শুনতে পাচ্ছি না! আমিও কী যে ভুল শুনি!
জোর হাঁক পাড়ে সেজবরা, জবরা!
জবরা ঘেউ-ঘেউ করে চলে। হল্কুর ডাক শুনে কাছে আসে না।
আবার ক্ষেতের ফসল খাওয়ার আওয়াজ শোনা যায়। এবারে নিজের মনকে সে আর ধোকা দিতে পারে না। কিন্তু জায়গা ছেড়ে ওঠা যেন বিষের মতো লাগে। বেশ জুত করে গরম হয়ে বসেছিল। এই কনকনে শীতে ক্ষেতে যাওয়া, জানোয়ারগুলোর পেছনে ছুটোছুটি করা অসহ্য মনে হচ্ছে। নিজের জায়গা ছেড়ে সে একটুও নড়ে না।
জোরে হাঁক দিয়ে ওঠে সে-হিলো! হিলো!! হিলো!!!
জবরা আবার ঘেউ-ঘেউ করে ওঠে। জানোয়ারগুলো ক্ষেতটাকে শেষ করে ফেলছে। ফসল পেকে উঠেছে। এবার কী সুন্দর ফসল হয়েছিল! কিন্তু নচ্ছার এই জানোয়ারগুলো যে সব বরবাদ করে ফেলছে।
দৃঢ় সংকল্প করে হলকু উঠে দাঁড়ায়। দু’তিন পা এগিয়েও যায়; কিন্তু আচমকা একটা ঠাণ্ডা, উঁচ বেঁধানো, বিছের হুলের মতো বাতাসের ঝাঁপটা এসে ওর গায়ে লাগতেই ও আবার নিভুনিভু আগুনের কাছটাতে ফিরে এসে বসে পড়ে। ছাইগুলোকে খুঁচিয়ে দিয়ে গরম করতে বসে ঠাণ্ডা গা-টাকে।
ওদিকে গলা ফাটিয়ে ফেলছে জবরা। নীলগাইগুলো ক্ষেতটাকে শেষ করে ফেলছে। এদিকে হলকু গরম ছাইয়ের পাশে শান্ত হয়ে চুপচাপ বসে। অকর্মণ্যতা যেন দড়ির বাঁধনের মতো তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।
ছাইয়ের পাশে গরম মাটির উপর চাদরমুড়ি দিয়ে সে শুয়ে পড়ে।
সকালে ওর ঘুম ভাঙলে দেখে চারদিকে রোদ ঝলমল করছে। মুন্নি ডেকে বলছে– আজ কি তুমি শুয়েই থাকবে গো? এখানে এসে আরাম করে তুমি ঘুমিয়ে রয়েছ আর ওদিকে সারাটা ক্ষেত যে হতচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
হলকু উঠে বলে–তুই কি ক্ষেত হয়ে আসছিস নাকি?
মুন্নি বলে–হ্যাঁ, সারাটা ক্ষেত ছারখার হয়ে গেছে। আরে, এমন করেও কেউ ঘুমোয় গো? তোমার তাহলে এখানে টং বানিয়ে কী লাভটা হল?
হলকু ছুতো দেখায়–মরতে-মরতে যে আমি কোনোমতে বেঁচেছি সেই যথেষ্ট। আর তুই আছিস তোর ক্ষেতের চিন্তা নিয়ে। পেটে আমার সে যে কী যন্ত্রণা, এমন অসহ্য যন্ত্রণা যা কেবল আমিই টের পেয়েছি।
.
দুজনে ক্ষেতের আলে এসে দাঁড়ায়। দেখে, সারাটা ক্ষেত তছনছ হয়ে গেছে, জবরা মাচার নিচে চিত হয়ে শুয়ে, যেন তার ধড়ে প্রাণ নেই।
দুজনেই ক্ষেতের হাল দেখে। মুন্নির মুখে বেদনার ছায়া, হলকু কিন্তু খুশি।
চিন্তিত হয়ে মুন্নি বলে–এবার মজুরি করে জমির খাজনা শুধতে হবে।
খুশিমনে বলে হলকু–রাতে শীতে তো আর এখানে শুতে হবে না।
পেশোয়ার এক্সপ্রেস – কৃষণ চন্দর
যখন পেশোয়ার স্টেশন ছেড়ে আসি তখন আমি তৃপ্তিতে একদলা ধোঁয়া উগরে দিয়েছিলাম। আমার খোপে-খোপে ছিল সব হিন্দু আর শিখ শরণার্থীরা। তারা এসেছিল পেশোয়ার, হাটমর্দন, কোহাট, চরসরা, খাইবার, লাণ্ডি কোটাল, বানু, নওশেরা, মানশেরা সীমান্ত প্রদেশের এইসব জায়গা থেকে। স্টেশনটা খুব সুরক্ষিত এবং সেনাবাহিনীর অফিসারেরাও খুব সজাগ ও দক্ষ। তবে, যতক্ষণ-না সেই রোমান্টিক পঞ্চনদীর দেশের দিকে আমি রওনা দিলাম, তারা অস্বস্তিতেই ভুগছিল। অন্য আর পাঁচজন পাঠানদের থেকে অবশ্য এই শরণার্থীদের তফাত করা যাচ্ছিল না। তাদের চেহারা বেশ লম্বা ও সুদর্শন, শক্ত গড়নের হাত-পা, পরনে কুল্লা ও লুঙ্গি, কারো-বা শালোয়ার; তাদের ভাষা গাঁয়ের পুশতু। প্রত্যেক খোপে দুজন করে বালুচি সেপাই খাড়া পাহারায় ছিল। রাইফেল হাতে ওরা একটু করে হাসি বিলিয়ে যাচ্ছিল হিন্দু-পাঠান ও তাদের বৌ-বাচ্চাদের দিকে, যারা তাদের হাজার-হাজার বছরের বসবাসের ভূমি ছেড়ে পালাচ্ছে। এই পাহাড়ি জমি তাদের শক্তি জুগিয়েছে, তার তুষার-ঝরনা তাদের তৃষ্ণা মিটিয়েছে, এবং এই ভূমির রোদ-ঝলমল বাগান থেকে তোলা মিষ্টি আঙুরের স্বাদে ভরে গেছে তাদের প্রাণ। হঠাৎ একদিন এই দেশ-গা তাদের কাছে অপরিচিত হয়ে গেল; শরণার্থীরা, সম্ভবত অনিচ্ছুকভাবেই পাড়ি দিল গরম ক্রান্তিদেশীয় সমভূমির এক নতুন দেশে। ঈশ্বরের কাছে তারা কৃতজ্ঞ যে তাদের প্রাণ, ধনসম্পত্তি ও মেয়েদের ইজ্জত কোনোরকমে বাঁচিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু রাগে ও দুঃখে হৃদয়ে তাদের রক্তক্ষরণ হচ্ছিল যেন, আর তাদের চোখ যেন সাতপুরুষের ভিটের ঐ গ্রানাইট বুকের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে চলে গিয়ে অভিযোগে প্রশ্ন তুলেছিল : ‘মা, মাগো, নিজের সন্তানদের কেন এভাবে ফিরিয়ে দিলে? কেন তোমার বুকের উষ্ণ আশ্রয় থেকে নিজের মেয়েদের বঞ্চিত করলে? এইসব নিষ্পাপ কুমারীরা, যারা তোমার অঙ্গে আঙুরলতার মতো জড়িয়ে ছিল, কেন হঠাৎ তাদের টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিলে? মা, মাগো, কেন মা?’
উপত্যকার মধ্য দিয়ে আমি দ্রুত ছুটছিলাম, আর আমার গাড়িগুলোর মধ্য থেকে এই ক্যারাভানের দল সতৃষ্ণ বিষণ্ণ চোখ মেলে দেখে নিচ্ছিল বিলীয়মান মালভূমি, ছোট-বড় উপত্যকা ও তিরতির করে বয়ে-যাওয়া আঁকাবাকা ছোটো নদী। ঝাপসা চোখের জলে শেষবারের মতো বিদায় জানাচ্ছে যেন। প্রতিটি কোণা-খাজে যেন ওদের চোখ সেঁটে যাচ্ছে, চলে যাবার সময়ে বুকের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে যাবে যেন; আমারও কেমন মনে হল আমার চাকাগুলো বোধহয় ভারি হয়ে উঠেছে, দুঃখে ও লজ্জায় যেন আটকে যাচ্ছে তারা, আর যেন দুটবার শক্তি নেই আমার, আমি বোধহয় থেমেই পড়ব এবার।
হাসান আবদাল স্টেশনে আরো শরণার্থীরা এল। ওরা শিখ, পাঞ্জা সাহেব থেকে আসছে, সঙ্গে লম্বা কৃপাণ, ভয়ে মুখ ওদের পাশুটে; বড়-বড় ডাগর চোখের বাচ্চাগুলো পর্যন্ত যেন এক নাম-না-জানা ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে। ওরা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার খোপে ঢুকে পড়ল। একজনের ঘর-বাড়ি সব গেছে, আরেকজনকে পালিয়ে আসতে হয়েছে পরনের শালোয়ার-কামিজ মাত্র সম্বল করে; আর একজনের পায়ে কোনো জুতো নেই; ওই কোণার লোকটি এতটাই ভাগ্যবান যে সে তার সবকিছুই নিয়ে আসতে পেরেছে, মায় তার ভাঙা কাঠের তক্তপোশটা পর্যন্ত! যার সবকিছু গেছে সে বসে আছে শান্ত, চুপচাপ, গুম হয়ে, অন্যজন যে কিনা সারাজীবনে একটা পিঠের টুকরোও জোটাতে পারেনি সে-ও তার হারানো লাখ টাকার গল্প বলছে, আর নেড়েদের শাপশাপান্ত করছে। বালুচিসেনারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে মৃদু-মৃদু হাসছে।
তক্ষশিলায় আমাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। আমার গার্ডসাহেব স্টেশনমাস্টারকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘আশপাশের গ্রাম থেকে একদল হিন্দু শরণার্থী আসছে। তাদের জন্য এই ট্রেনটাকে অপেক্ষা করতেই হবে।’ এক ঘণ্টা কেটে গেল। আমার গাড়ির মধ্যেকার লোকজনেরা তাদের পোটলা-পুটলি খুলল এবং পালিয়ে আসার সময়ে যৎসামান্য যে যা আনতে পেরেছিল তাই খেতে আরম্ভ করল। বাচ্চারা হৈ-হল্লা করছিল আর তরুণী মেয়েরা শান্ত গভীর চোখে তাকিয়েছিল জানলার বাইরের দিকে। হঠাৎ দূরে ঢাকের আওয়াজ শোনা গেল। হিন্দু শরণার্থীদের এক জাঠ এদিকেই আসছে। জাঠ আরো কাছে এগিয়ে এল, স্লোগান দিতে দিতে। আরো কিছু সময় কাটল। এবারে দলটা স্টেশনের একেবারে কাছে এসে পড়ল। ঢাকের আওয়াজ আরো জোর হল আর একঝাক গুলিগোলার আওয়াজ এল কানে। তরুণী মেয়েরা ভয়ে জানলা থেকে সরে গেল। এই দলটা ছিল হিন্দু শরণার্থীদের এক জাঠ-প্রতিবেশী মুসলমানদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে যাদের নিয়ে আসা হয়েছে। প্রতিটি মুসলমানের কাঁধের উপরে ঝোলানো রয়েছে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করা এক-একজন কাফেরের মৃতদেহ। এ-রকম মৃতদেহের সংখ্যা দুশো, অত্যন্ত নিরাপদে তাদের স্টেশনে এনে বালুচি রক্ষকদের হাতে দিয়ে দেয়া হল। মুসলমান জনতা চাপ দিল যে, এই মৃত হিন্দু শরণার্থীদের যথোচিত সম্মানের সঙ্গে হিন্দুস্তানের গেট পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। বালুচি সৈন্যরা নিজেদের কাঁধে তুলে নিল তাদের তারপর প্রত্যেক গাড়ির মধ্যিখানে কয়েকটা করে মৃতদেহ রেখে দিল। এরপর মুসলমান জনতা আকাশের দিকে তাক করে গুলির আওয়াজ করল ও স্টেশনমাস্টারকে আদেশ দিল আমাকে প্ল্যাটফর্ম থেকে ছেড়ে দেবার জন্য। আমি সবেমাত্র চলতে শুরু করেছি এমন সময়ে কে একজন চেন টেনে আমাকে থামিয়ে ফেলল। তারপর মুসলমান জনতার দলপতি একটা গাড়ির কাছে এগিয়ে এসে বললেন যে, ঐ দুশোজন শরণার্থী চলে যাওয়ায় তাদের গ্রাম যেহেতু গোল্লায় যাবে, তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রেন থেকে দুশোজন হিন্দু ও শিখ নামিয়ে নিতে হবে; যাই হোক-না কেন, দেশের জনশক্তির ক্ষতিপূরণ করতেই হবে। বালুচি সৈন্যরা দেশপ্রেমের জন্য উচ্চকণ্ঠে তাঁদের জয়গান করল, এবং বিভিন্ন বগি থেকে দুশোজন শরণার্থীকে বেছে নিয়ে জনতার হাতে তুলে দিল।
‘সব কাফেররা সার দিয়ে দাঁড়াও!’ ওদের নেতা হুঙ্কার দিল; ঐ নেতাটি আশপাশের গ্রামের এক শাসালো সামন্তপ্রভু। শরণার্থীরা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল, মরে জমে গেছে যেন। জনতা কোনোমতে ওদের একটা সারি করে দাঁড় করিয়ে দিল। দুশো লোক… দুশো জীবন্ত মৃতদেহ…নগ্ন…ভয়ে মুখগুলো সব নীল….চোখের তারায় বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে রক্তলোলুপ তীর….
বালুচি সৈন্যরাই শুরু করল।
পনের জন শরণার্থী টলমল পায়ে শ্বাস টানতে-টানতে মরে পড়ে গেল।
এই জায়গাটা ছিল তক্ষশিলা।
আরো কুড়িজন পড়ল।
এখানেই ছিল এশিয়ার মহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে হাজার-হাজার বছর ধরে লক্ষ-লক্ষ ছাত্ররা মানুষের সভ্যতা বিষয়ে তাদের প্রথম পাঠ নিয়েছে।
আরো পঞ্চাশজন মুখ থুবড়ে পড়ল মরে।
তক্ষশিলার জাদুঘরে সুন্দর-সুন্দর মূর্তি ছিল, অলংকারের অতুলনীয় কারুকৃতি, দুর্লভ শিল্প ও ভাস্কর্যের নিদর্শন, আমাদের গর্বের সভ্যতার ছোটো-ছোটো উজ্জ্বল সব দীপশিখা।
তবুও আরো পঞ্চাশটি প্রাণ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল।
এ-সবের প্রেক্ষাপটে ছিল সিরকপের রাজপ্রাসাদ, খেলাধুলার জন্য এক বিরাট অ্যাম্ফিথিয়েটার আর তারো পেছনে অনেক মাইল জুড়ে একটা গৌরবান্বিত ও মহান এক নগরীর ধ্বংসাবশেষ।
আরো তিরিশজন মৃত।
এখানে রাজত্ব করতেন কণিক। ওঁর রাজত্বে প্রজাদের ছিল শান্তি, সমৃদ্ধি আর এক সাধারণ ভ্রাতৃত্বের বোধ।
তারা আরো কুড়িজনকে মেরে ফেলল।
এই গ্রামগুলোতেই একদিন বুদ্ধের সেই মহান সংগীতের গুঞ্জন শোনা যেত। ভিক্ষুরা এখানেই ভেবেছিলেন প্রেমের আর সত্যের আর সৌন্দর্যের কথা আর এক নতুন ধাচের জীবনের কথা।
এবং এখন সেই দুশো জনের শেষ কয়েকজন মাত্র তাদের অন্তিম লগ্নের জন্য অপেক্ষা করেছে।
ইসলামের বাঁকা চাঁদ প্রথম এখানকার দিগন্তেই তার আলো দিয়েছিল, সাম্যের, ভ্রাতৃত্বের ও মানবিকতার প্রতীক…
সবাই এখন মৃত। আল্লা-হুঁ-আকবর!
প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে গেল, এবং এত কাণ্ডের পরে যখন আমি আবার রওনা দিলাম আমার মনে হল যে, এমনকি আমার নিচেকার লোহার চাকাগুলো পর্যন্ত যেন পিছলে-পিছলে যাচ্ছে।
মৃত্যু স্পর্শ করেছে আমার সবকটা গাড়িকেই। মৃতদের শোয়ানো হয়েছিল মাঝখানে, আর চারপাশ ঘিরে জীবন্ত মৃতেরা। কোথাও একটা বাচ্চা কেঁদে উঠল; কোনো-এক কোণে কারো মা ফোঁপাতে লাগলেন; এক স্ত্রী তার মৃত স্বামীর দেহ আঁকড়ে ছিল। আমি দৌড় লাগালাম ভয়ে আর ত্রাসে এবং রাওয়ালপিণ্ডি স্টেশনে এসে পৌঁছলাম।
এখানে আমাদের জন্য কোনো শরণার্থী অপেক্ষা করছিল না। কেবল জনাকুড়ি পর্দানশীন মহিলাকে সঙ্গে করে নিয়ে কয়েকজন মুসলমান যুবক আমার একটা গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। যুবকদের সঙ্গে ছিল রাইফেল, তারা সঙ্গে করে অনেক বাক্স গোলাবারুদও এনেছিল। তারা আমাকে ঝিলম ও গুজর খার মাঝখানে থামিয়ে নিজেরা। নামতে লাগল। হঠাৎ সঙ্গের মহিলারা তাদের পর্দা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করতে আরম্ভ করল, ‘আমরা হিন্দু, আমরা শিখ, ওরা জোর করে আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে।’ যুবকেরা হেসে উঠল, ‘হ্যাঁ, ওদের আরামের ঘর থেকে জোর করেই ওদের এনেছি’, যুবকেরা বলল। ওরা তো আমাদের লুঠের ধন। সে রকমই সদ্ব্যবহার করা হবে এদের। কে বাধা দেয় দেখি?
দুজন হিন্দু পাঠান ওদের উদ্ধারের জন্য লাফ দিল। বালুচি সৈন্যরা ঠাণ্ডা মাথায় ওদের শেষ করে দিল। তবু আরো কয়েকজন চেষ্টা করল। তাদেরও কয়েক মিনিটের মধ্যে খতম করা হল। তারপর ঐ তরুণী মেয়েদের টানতে-টানতে কাছে এক বনের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হল, আর আমি কালো ধোঁয়ায় নিজের মুখ আড়াল করলাম এবং দৌড়ে পালিয়ে গেলাম ঐ জায়গা থেকে। মনে হল আমার লোহার ফুসফুস বোধহয় ফেটে যাবে, আর আমার মধ্যেকার লাল গনগনে আগুনের শিখা যেন গিলে ফেলবে এই বিরাট ঘন। অরণ্যকে, যা আমাদের লজ্জার সাক্ষী হয়ে রইল।
আমি লালা মুসার কাছাকাছি আসতে-আসতে মৃতদেহের দুর্গন্ধ এতটাই বাড়তে থাকল যে, বালুচি সৈন্যরা সিদ্ধান্ত নিল, ওগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হবে। ফেলে দেবার পদ্ধতিটাও চটপট বানিয়ে ফেলল তারা। যাদের মুখটা দেখতে ওদের পছন্দ হচ্ছে না এ-রকম একজনকে আদেশ করা হবে একটা মৃতদেহ গাড়ির দরজার কাছে আনতে, আর তারপরে সে দরজার কাছে এলে মৃতদেহসুদ্ধ তাকে ফেলে দেয়া হবে।
লালা মুসা থেকে আমি এলাম ওয়াজিরাবাদে। ওয়াজিরাবাদ হল পাঞ্জাবের এক অতি পরিচিত শহর। সারা ভারতের হিন্দুরা ও মুসলমানেরা যে ছুরি-ছোরা দিয়ে পরস্পরকে হত্যা করে তা এই ওয়াজিরাবাদ থেকেই রপ্তানি করা হয়। ওয়াজিরাবাদ অবশ্য খুব বড় বৈশাখী উৎসবের জন্যও বিখ্যাত। এই বৈশাখীতে হিন্দু-মুসলমানেরা নবান্নের উৎসবে মিলিত হন। তবে, আমি যখন ওয়াজিরাবাদে পৌঁছলাম তখন সেখানে দেখলাম শুধু শবদেহের মেলা। অনেক দূরে, ধোয়ার এক ঘন আস্তরণ শহরের উপরে ছেয়ে ছিল আর স্টেশনের কাছে শোনা যাচ্ছিল কাঁসর ঘন্টার ধ্বনি, উচ্চকিত হাসির রোল আর মত্ত জনতার উদ্দাম করতালি। এ নিশ্চয়ই বৈশাখী উৎসব। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জনতার ভিড় প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে এল, একদল উলঙ্গ স্ত্রীলোককে ঘিরে নাচতে-নাচতে ও গান গাইতে গাইতে। হ্যাঁ, তারা সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তাদের মধ্যে ছিল বৃদ্ধা ও তরুণী, ছিল বাচ্চারা, নগ্নতা নিয়ে যাদের কোনো ভয় নেই। ছিলেন দিদিমা ও নাতনি, ছিলেন মায়েরা ও বোনেরা আর মেয়েরা ও স্ত্রীরা, এবং কুমারীরা; এবং ওঁদের চারপাশ ঘিরে ঐ পুরুষেরা নাচছে ও গাইছে। মেয়েরা সব হিন্দু শিখ আর পুরুষেরা মুসলমান এবং তিন সম্প্রদায় মিলেই যেন এক বিচিত্র বৈশাখী উৎসব পালনের জন্য তারা মিলিত হয়েছে। মেয়েরা সোজা হয়ে হেঁটে চলল। তাদের চুল অবিন্যস্ত, শরীর বেইজ্জতে উলঙ্গ, কিন্তু তবুও তারা সোজা হয়ে সগর্বে হেঁটে চলল যেন হাজার শাড়িতে তাদের শরীর জড়ানো, যেন কালো করুণামেদুর মৃত্যুর ঘন ছায়ায় তাদের আত্মা আবৃত। তাদের চোখে নেই কোনো ঘৃণার প্রকাশ। লক্ষ-লক্ষ সীতার অকলঙ্ক অহংকারে তাদের চোখ জ্বলছে।
তাদের চারপাশ ঘিরে ঐ জনতার ঢেউয়ের চিৎকার ধ্বনি, পাকিস্তান জিন্দাবাদ! ইসলাম জিন্দাবাদ!! কয়েদ-ই-আজম মুহম্মদ আলি জিন্না জিন্দাবাদ!!!
নাচ-গানের এই হল্লা ছাপিয়ে বিচিত্র শোভাযাত্রা এখন সরাসরি গাড়ির মধ্যে জড়ো করা ঐ শরণার্থীদের ঠিক চোখের সামনে। মেয়েরা নিচু হয়ে আঁচলে তাদের মুখ লুকাল আর পুরুষেরা গাড়ির জানালা বন্ধ করতে লাগল।
‘জানালা বন্ধ কর না!’ বালুচিরা গর্জে উঠল। টাটকা হাওয়া ঢুকতে দাও।
কিন্তু ওরা গ্রাহ্য করল না। জানালাগুলো ওরা বন্ধ করে চলল।
সৈন্যরা গুলি চালাল। কয়েকজন শরণার্থী মরে পড়ে গেল; অন্যেরা তাদের জায়গা নিল এবং অল্পক্ষণের মধ্যে আর কোনো জানালাই বন্ধ রইল না।
ঐ উলঙ্গ স্ত্রীলোকদের বলা হল আমার ভেতরে উঠতে আর শরণার্থীদের মধ্যে বসে পড়তে, আর তারপর তারা ইসলাম জিন্দাবাদ’, ও ‘কয়েদ-ই-আজম মুহম্মদ আলি জিন্না জিন্দাবাদ’ চারপাশের এইসব মত্ত ধ্বনির মধ্যে আমাকে সহৃদয় বিদায় জানাল।
রোগা টিংটিঙে একটা ছোট বাচ্চা আস্তে-আস্তে একজন বৃদ্ধা নগ্ন স্ত্রীলোকের দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মা, তুমি কি এইমাত্র স্নান করেছ?
হ্যাঁ, বাবা, আজ আমার দেশের ছেলেরা, আমার নিজের ভাইয়েরা আমাকে স্নান করিয়েছে।’
তাহলে, তোমার জামা-কাপড় কই, মা?’
‘আমার বৈধব্যের রক্তে ওই কাপড়ে দাগ লেগেছিল, বাবা! তাই আমার ভাইয়েরা সে-কাপড় নিয়ে নিয়েছে।’
আমি যখন দৌড়চ্ছি তখন দুই উলঙ্গ তরুণী আমার গাড়ির দরজা দিয়ে লাফ দিল, ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম আমি এবং রাত্রির মধ্যে দৌড়ে পালাতে লাগলাম যতক্ষণ-না লাহোর পৌঁছাই।
লাহোরে আমি এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে থামলাম। আমার ঠিক উল্টোদিকে দু-নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল অমৃতসর থেকে আসা একটা ট্রেন, পূর্ব পাঞ্জাব থেকে মুসলমান শরণার্থীদের বয়ে এনেছে সেটা। কিছুক্ষণের মধ্যে মুসলমান রক্ষীরা আমার গাড়িগুলোর শরণার্থীদের মধ্যে তল্লাশ চালাল। সমস্ত টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি ও অন্যান্য মূল্যবান যা-কিছু ছিল তারা সব নিয়ে গেল। তারপর ওরা চারশ শরণার্থীকে নির্বাচন করল বদলা হত্যার জন্য। ব্যাপারটা দাঁড়াল এই রকম : মুসলমান শরণার্থী বয়ে-আনা ঐ অমৃতসরের ট্রেনটাকে পথে আক্রমণ করা হয়েছিল এবং চারশ মুসলমান খুন ও পঞ্চাশজন স্ত্রীলোক লুট করা হয়েছিল। কাজেই এটাই তো উচিত যে ঠিক চারশ হিন্দু ও শিখ শরণার্থীকে হত্যা করতে হবে এবং পঞ্চাশজন হিন্দু ও শিখ রমণীর ইজ্জত নষ্ট করা হবে, যাতে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের মধ্যে সমতা বজায় থাকে।
মোগলপুরাতে রক্ষী বদল হল। বালুচিরা বদলে গিয়ে তাদের জায়গাতে এল শিখ, রাজপুত ও ডোগরারা। আতারি থেকে সমস্ত আবহাওয়াটা বদলে গেল। হিন্দু ও শিখ শরণার্থীরা মুসলমান শরণার্থীদের এত মৃতদেহ এখন দেখতে পাচ্ছে যে, সন্দেহ নেই, তারা স্বাধীন ভারতের সীমান্তের খুব কাছে এসে গেছে।
অমৃতসর থেকে চারজন ব্রাহ্মণ আমার মধ্যে উঠল। হরিদ্বারে যাচ্ছিল তারা। তাদের মাথা পরিষ্কার করে কামানো, ঠিক মাঝখানে লম্বা শিখা। কপালে তাদের তিলক কাটা, রামনাম ছাপা ধুতি পরে তারা তীর্থে বেরিয়েছে। অমৃতসর থেকে বন্দুক, বর্শা ও কৃপাণ হাতে দলে-দলে হিন্দু শিখেরা পূর্ব পাঞ্জাবে যাওয়া সমস্ত ট্রেনে চড়ে বসল। এরা বেরিয়েছে ‘শিকার’-এর খোঁজে। ঐ ব্রাহ্মণদের দেখে ঐ শিকারিদের একজনের সন্দেহ হল। সে জিজ্ঞেস করল, ব্রাহ্মণ দেব, যাওয়া হচ্ছে কোথায়?
‘হরিদ্বারে।
‘হরিদ্বারে, না পাকিস্তানে?’ সে মশকরার সুরে জিজ্ঞেস করল।
‘আল্লার নামে শপথ করে বলছি, আমরা হরিদ্বারে যাচ্ছি!
ঐ জাঠ হেসে উঠল, আল্লার নামে, বেশ! তাহলে এবার কোতল করে ফেলা যাক। সে তখন চিৎকার করে ডাকল, নাথা সিং, এদিকে এস, বড়ো শিকার মিলেছে! ওরা একজনকে হত্যা করল। অন্য তিনজন ব্রাহ্মণ’ পালাবার চেষ্টা করল, কিন্তু তাদের ধরে ফেলা হল। তোমরা তাহলে হরিদ্বারে যাচ্ছ’, নাথা সিং চিৎকার করে উঠল, এস, হরিদ্বারে যাবার আগে তোমাদের ডাক্তারি পরীক্ষা হবে।’
‘ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ল ওরা ঠিক যা আশা করেছিল তা-ই–সুন্নত।
ডাক্তারি পরীক্ষার পরে হত্যা করা হল তিনজন ব্রাহ্মণকেও।
হঠাৎ এক ঘন অরণ্যের ধারে থামানো হল আমাকে। সেখানে দু-এক মুহূর্তের মধ্যে আমি চিৎকার-ধ্বনি শুনলাম ‘সৎ শ্ৰী আকাল’ ও ‘হর-হর মহাদেও আর দেখতে পেলাম সৈন্যরা ও শিখ এবং হিন্দু শরণার্থীরা আমাকে ছেড়ে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম ওরা পালিয়ে যাচ্ছে মুসলমান দস্যুর ভয়ে। পরে দেখলাম সে আমার ভুল। ওরা দৌড়চ্ছিল–নিজেদের বাঁচাতে নয়,–কয়েকশ গরিব মুসলমান চাষিকে হত্যা করতে, যারা তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে এ জঙ্গলে লুকিয়েছিল। আধ ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সব শেষ। পরম আনন্দে বিজেতারা ফিরে আসছে। একজন জাঠ তার বর্শার ডগায় এক মুসলমান শিশুর শব দোলাতে-দোলাতে গান গাইছিল, ‘আল বৈশাখী, এই বৈশাখী, হো হো!’
জলন্ধরের কাছে পাঠান বসতির একটা গ্রাম ছিল। এখানে আবার আমাকে চেন টেনে থামানো হল, আর সবাই নেমে আবার ধাওয়া করল ঐ গ্রামটার দিকে। পাঠানরা খুব সাহসের সঙ্গে প্রতিরোধ করেছিল বটে, তবে আক্রমণকারীরা অস্ত্রশস্ত্রে ও সংখ্যায় অনেক বেশি জোরালো ছিল। গ্রামের পুরুষেরা সব এই যুদ্ধে প্রাণ দিল। তারপরে এল। স্ত্রীলোকদের পালা। এখানে এই বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে, পিপলু, শীষম ও সারিনগাছের তলায়, কেড়ে নেয়া হল তাদের ইজ্জত। এই হল পাঞ্জাবের সেইসব মাঠ যেখানে চাষিরা–হিন্দু, মুসলমান ও শিখ চাষিরা–একসঙ্গে মিলে সোনার শস্য ফলিয়েছে; যেখানে সরষের সবুজ পাতায় ও হলুদ ফুলে সমস্ত গ্রামাঞ্চল এক স্বপ্নের রাজ্যে পরিণত হত। এইসব পিপলু, শীষম ও সারিনগাছের নিচেই সারাদিনের কঠিন পরিশ্রমের পর স্বামীরা অপেক্ষা করত কখন তাদের প্রিয়তমা স্ত্রীরা লস্যি নিয়ে আসবে। ঐ তো, ঐ মাঠের পার দিয়ে, তারা লম্বা। সার বেঁধে আসছে, হাতের ঘড়ার মধ্যে লস্যি আর বয়ে আনছে মধু, মাখন আর সোনালি গমের চাপাটি। কী সতৃষ্ণ চোখে কিষাণেরা চেয়ে থাকত কিষাণী বধূর দিকে, আর ঐ চোখের চাহনিতে বউরাও কেঁপে-কেঁপে উঠত নরম পাতার মতো। এই তো পাঞ্জাবের বুকের কলজে। এখানেই জন্মেছিল সোনি আর মাহিওয়াল, হীর ও রঞ্জা! আর এখন! পঞ্চাশটা নেকড়ে, পঞ্চাশজন সোনি আর পাঁচশো মাহিওয়াল। এ-পৃথিবী আর-কখনোই আগের মতো হবে না। চেনাব আর কখনো তেমন তিরতির করে বয়ে যাবে না। হীর, রঞ্জা, সোনি, মাহিওয়াল ও মীর্জা সাহেবানের গান আর কখনো এই বুকে ঠিক তেমন করে। গুঞ্জন তুলবে না। লক্ষ-লক্ষ অভিশাপ নেমে আসুক সেইসব নেতাদের মাথায় আর তাদের সাত-সাতে উনপঞ্চাশ পুরুষের মাথায় যারা এই সৌন্দর্য, বীরধর্ম ও মর্যাদাময় ভূখশুকে অসম্মান, প্রতারণা ও হত্যার ছেঁড়াখোঁড়া টুকরোয় দাঁড় করিয়েছে, যারা এর আত্মায় সিফিলিসের বিষ ঢুকিয়েছে আর এর শরীরে ভরে দিয়েছে হত্যা, লুঠতরাজ ও ধর্ষণের জীবাণু। পাঞ্জাব আজ মরে গেছে। এর সংস্কৃতি মরে গেছে। এর ভাষা মরে গেছে। মরে গেছে এর সংগীত। এর সাহসী, সদাচারী, নিষ্পাপ প্রাণ মরে গেছে। আমার যদিও চোখ ও কান কিছুই নেই, তবু আমি এই মৃত্যু দেখতেও পেলাম, শুনতেও পেলাম।
শরণার্থীরা ও সৈন্যরা পাঠান নারী-পুরুষদের মৃতদেহ বহন করে ফিরে এল। আবার কয়েক মাইল আসার পরে একটা খাল পাওয়া গেল, এখানে আমাকে আবার থামানো হল। এই খালে শবদেহগুলোকে জড় করে ফেলা হল, এবং তারপর আমি আবার এগোলাম। যাত্রীরা সকলেই এখন ভীষণ খুশি! রক্ত ও ঘৃণার স্বাদ তারা পেয়েছে, এবং এখন দেশি মদের বোতল খুলে তারা ফুর্তি করতে লাগল।
আবার আমরা থামলাম লুধিয়ানায়। এখানে লুটেরারা শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ল ও মুসলমান মহল্লা ও দোকানগুলোকে আক্রমণ করল। ঘণ্টাদুয়েক বাদে তারা স্টেশনে ফিরে এল। সমস্ত পথ জুড়ে তাদের এই হত্যা ও লুঠ চলতেই থাকল। এবং এতক্ষণে আমার আত্মায় এত ক্ষত জমেছে এবং আমার কাঠের শরীরে রক্তের দাগে এত ময়লা পড়েছে। যে, আমার ভীষণ রকমভাবে স্নানের দরকার, কিন্তু আমি জানি যে, পথের মধ্যে আমাকে সে-সুযোগ দেবে না!
অনেক রাত্রে আমি আম্বালা পৌঁছলাম। এখানে একজন মুসলমান ডেপুটি কমিশনার, তাঁর স্ত্রী ও বাচ্চাদের সেনাবাহিনীর প্রহরায় এনে আমার একটা প্রথম শ্রেণীর গাড়িতে তুলে দেয়া হল। সৈন্যদের ওপর কঠোর আদেশ রইল এই মুসলমান কর্মচারীর জীবন ও সম্পত্তি সুরক্ষিত রাখবার।
রাত্রি দুটোয় আম্বালা ছাড়লাম। মাইলদশেকও বোধহয় আমি আসতে পারিনি এমন সময় কেউ আমার চেন টানল। মুসলমান কর্মচারী যে প্রথম শ্রেণীর গাড়িতে যাচ্ছিলেন তার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। কাজেই তারা জানলার কাঁচ ভাঙল। এখানে তারা ঐ মুসলমান ডেপুটি কমিশনার, তার স্ত্রী ও তিনটি ছোট বাচ্চাকে খুন করল। ডেপুটি কমিশনারের একটি অল্পবয়সী মেয়ে ছিল। সে খুবই সুন্দরী; তাই তারা ওকে বাঁচিয়ে রাখবার সিদ্ধান্ত নিল। ওরা মেয়েটিকে নিল, গয়নাগাটি ও ক্যাশবাক্স নিল, তারপর গাড়ি থেকে নেমে গেল জঙ্গলের দিকে। মেয়েটির হাতে একখানা বই ছিল।
জঙ্গলে গিয়ে ওরা অধিবেশনে বসল। মেয়েটিকে নিয়ে কী করা হবে? ওকে খুন করা হবে, না বাঁচিয়ে রাখা হবে? মেয়েটি বলল, আমাকে খুন করবার দরকার কী? আমাকে তোমাদের ধর্মে বদল করে নাও। আমি তোমাদের একজনকে বিয়ে করব।
তাই তো, ঠিক কথা,’ একজন তরুণ বলল, আমার মনে হয় ওকে আমাদের…’
আর-একজন তরুণ তাকে বাধা দিয়ে মেয়েটির পেটে একটা ছোরা বসিয়ে বলল, ‘আমার মনে হয় ওকে এখানেই খতম করে দেয়া উচিত। চল, ফেরা যাক। এ-সব গোলটেবিল বৈঠক ঢের হয়েছে।’
মেয়েটি মরে গেল, জঙ্গলের শুকনো ঘাসের উপরে আর ওর হাতের বইখানা ওরই রক্তের দাগে নোংরা হল। বইটা ছিল সমাজতন্ত্রের ওপর। হয়তো ও ছিল খুব বুদ্ধিমতী। মেয়ে, হয়তো দেশের ও জাতির সেবায় কাজ করবার এক জ্বলন্ত বাসনা ওর ছিল। হয়তো ভালোবাসার জন্য ওর আত্মা যন্ত্রণায় দীর্ণ ছিল, হয়তো কারো ভালোবাসা পাবার জন্যও, আদরের আলিঙ্গনে মিলিত হবার জন্য, নিজের সন্তানকে চুমো দেবার জন্য। ও তো ছিল মেয়ে, কারো প্রিয়তমা, কারো জননী, সৃষ্টির অজানা রহস্য; আর এখন এই জঙ্গলে ও মরে পড়ে রইল, শেয়ালে ও শকুনে ওর শব খেয়ে যাবে। সমাজতন্ত্র, তত্ত্ব ও প্রয়োগ…জন্তুরা এখন ওসব খেয়ে ফেলছে।
রাত্রির হতাশ অন্ধকারের মধ্যে আমি এগিয়ে চললাম, দেশি মদে মাতাল কিছু লোককে আমার গাড়ির মধ্যে বয়ে নিয়ে; তাদের গলায় চিৎকার, মহাত্মা গান্ধী কি জয়!’
অনেকদিন পরে আমি বোম্বাইতে এসেছি। এখানে ওরা আমাকে পরিষ্কার করেছে, ধুয়েছে এবং শেডের মধ্যে রেখেছে। আমার শরীরে এখন আর কোনো রক্তের দাগ নেই। খুনেদের রক্ত-জল-করা হাসির হুল্লোড় আর নেই। কিন্তু রাত্রে যখন আমি একলা থাকি, ভূতেরা সব জেগে ওঠে, মৃত আত্মারা যেন আবার প্রাণ ফিরে পায়, আহতরা জোরে চিৎকার করে, নারীরা ও শিশুরা ভয়ে ঝাঁকিয়ে ওঠে, আর আমি মনে-মনে কামনা করি ঐ ভয়ানক যাত্রায় আর যেন কেউ আমাকে নিয়ে না-যায়। ঐ ভয়ংকর যাত্রার জন্য আমি এই শেড আর কখনো ছাড়ব না। কিন্তু আমি অবশ্যই এই শেড ছেড়ে যাব দীর্ঘ ও সুন্দর যাত্রায় গাঁ-গঞ্জের মধ্য দিয়ে, যখন পাঞ্জাবের মাঠ আবার সোনার শস্যে ভরে উঠবে, যখন সরষে ফুল দেখে মনে হবে হীর ও রঙা অনন্ত প্রেমের গান গাইছে, যখন চাষিরা, হিন্দু-মুসলমান ও শিখ, সবাই আবার একসঙ্গে চাষ করবে, বীজ বুনবে ও ফসল তুলবে, এবং যখন তাদের হৃদয় আবার কানায়-কানায় ভরে উঠবে প্রেমে ও পূজায় ও নারীর প্রতি সম্মানে।
আমি সামান্য একটা কাঠের ট্রেন, কিন্তু প্রতিশোধ ও ঘৃণার ঐরকম ভারি বোঝা কেউ আমার ঘাড়ে আবার চাপিয়ে দিক এ আর আমি কোনোমতে চাই না! দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে আমাকে দিয়ে খাদ্য বওয়ানো হোক। শিল্পাঞ্চলের জন্য আমাকে দিয়ে কয়লা, লোহা ও তেল বওয়ানো হোক। গ্রামে আমাদের চাষিদের জন্য আমাকে দিয়ে সার ও ট্রাক্টর আনানো হোক। যেখানেই যাই-না কেন, সেখানে যেন আমাকে দিয়ে মৃত্যু ও ধ্বংস আর নিয়ে যাওয়া না-হয়। আমি চাই আমার গাড়ির খোপে-খোপে থাকুক সম্পন্ন চাষি ও শ্রমিকের দল ও তাদের সুখী বউ-বাচ্চারা, খুশিতে ভরপুর, পদ্মফুলের মতো হাসি তাদের মুখে; এইসব বাচ্চারাই তো এক নতুন জীবনের ধারা গড়ে তুলবে–যেখানে মানুষ হিন্দুও হবে না, মুসলমানও হবে না, হবে শুধু সেই আশ্চর্য সত্তা–মানুষ!!
জামগাছ – কৃষণ চন্দর
রাত্রে প্রচণ্ড ঝড় হয়ে গেছে। সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং-এর লনের জামগাছটা উপড়ে পড়েছে সেই ঝড়ে। ভোরে মালি দেখতে পেল গাছটার নিচে একজন মানুষ চাপা পড়ে আছে।
মালি ছুটতে-ছুটতে চাপরাসির কাছে গেল–চাপরাসি ছুটতে-ছুটতে গেল ক্লার্কের কাছে ক্লার্ক ছুটতে-ছুটতে গেল সুপারিনটেনডেন্টের কাছে।
সুপারিনটেনডেন্ট ছুটতে-ছুটতে বাইরে লনে এলেন। দেখলেন ঝড়ে উপড়েপড়া
গাছের নিচে যে মানুষটি চাপা পড়ে আছে তার চারদিকে বেশ ভিড় জমেছে।
একজন ক্লার্ক আক্ষেপ করে বলল, ‘আহা, এই জামগাছে কতই-না ফল ধরত।’ আর-একজন ক্লার্ক তাকে মনে করিয়ে দিল, আর এর জাম কী রসেই-না ভরপুর ছিল।’
তৃতীয় ক্লার্কটি বলল, ফলের মরসুমে আমি ঝোলা ভর্তি করে এই ফল নিয়ে যেতাম। আর আমার বাচ্চারা কত আনন্দেই-না এই জাম খেত।
মালি গাছের নিচে চাপাপড়া মানুষটির দিকে ইশারা করে বলল, ‘আর এই মানুষ?
হ্যাঁ, এই মানুষ…।’ সুপারিনটেনডেন্ট খুব চিন্তায় পড়লেন। একজন চাপরাসি জিজ্ঞেস করল, ‘জানি না এ বেঁচে আছে, না মরে গেছে।’
অন্য একজন চাপরাসি বলল, ‘বোধহয় মারা গেছে, এত বড় গাছ কোমরের উপর পড়লে কি মানুষ বাঁচতে পারে?’
গাছের নিচে চাপা-পড়া মানুষটি বেশ রুক্ষ স্বরেই বলল, না, আমি বেঁচে আছি।’ একজন বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ‘আরে, বেঁচে আছে!
মালি প্রত্যেকের উদ্দেশ্যে বলল, গাছটিকে সরিয়ে মানুষটিকে এর নিচ থেকে তাড়াতাড়ি বের করতে হবে।’
একজন ফাঁকিবাজ হৃষ্টপুষ্ট চাপরাসি ভারিক্কিচালে বলল, মনে হচ্ছে ব্যাপারটা অত সোজা নয়। গাছের গুঁড়িটি বেশ ভারিই হবে।’
মালি জিজ্ঞেস করল, ‘সোজা নয় কেন? সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব যদি হুকুম দেন, তবে আমরা পনের-বিশজন মালি-চাপরাসি আর ক্লার্ক মিলে গাছের নিচে থেকে মানুষটিকে অনায়াসে বের করে আনতে পারি।
বেশ কিছু ক্লার্ক মালিকে সমর্থন করে একসঙ্গে বলে উঠল, ‘হাঁ, হাঁ, মালি ঠিক বলেছে। আমরা তৈরি, হাত লাগাও।’
অনেকে গাছটিকে সরানোর জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল।
সুপারিনটেনডেন্ট হঠাৎ বাধা দিয়ে বললেন, দাঁড়াও, ‘আমি আন্ডার সেক্রেটারির কাছে একবার জিজ্ঞেস করে আসি।’
সুপারিনটেনডেন্ট আন্ডার সেক্রেটারির কাছে গেলেন। আন্ডার সেক্রেটারি গেলেন ডেপুটি সেক্রেটারির কাছে। ডেপুটি সেক্রেটারি গেলেন জয়েন্ট সেক্রেটারির কাছে। জয়েন্ট সেক্রেটারি চিফ সেক্রেটারির কাছে গেলেন। চিফ সেক্রেটারি মিনিস্টারের কাছে। মিনিস্টার চিফ সেক্রেটারিকে কিছু বললেন। চিফ সেক্রেটারি জয়েন্ট সেক্রেটারিকে কিছু বললেন। একইভাবে জয়েন্ট সেক্রেটারি ডেপুটি সেক্রেটারিকে এবং ডেপুটি সেক্রেটারি আন্ডার সেক্রেটারিকে কিছু বললেন। ফাইল চলতে লাগল–এর মধ্যে পার হল অর্ধেক দিন।
দুপুরের লাঞ্চের পর সেই চাপা-পড়া মানুষের চারদিকে আরো ভিড় বেড়ে গেল। নানা মানুষ নানা ধরনের কথা বলতে লাগল। কয়েকজন বিজ্ঞ ক্লার্ক সমস্যার সমাধান বের করে ফেললে নিজেরাই। বিনা হুকুমেই তারা যখন গাছ সরানোর পরিকল্পনা করছে ঠিক তখনই সুপারিনটেনডেন্ট ফাইল নিয়ে ছুটতে-ছুটতে হাজির হলেন। বললেন, আমরা এই গাছ আমাদের খেয়াল-খুশি মতো এখান থেকে সরাতে পারবে না। কারণ আমরা বাণিজ্য দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত, আর এই গাছ কৃষি দপ্তরের এক্তিয়ারে। আমি এই ফাইল আর্জেন্ট মার্ক করে এখনই কৃষি দপ্তরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেখান থেকে উত্তর আসার পর আমরা গাছ সরাব।
দ্বিতীয় দিন কৃষি বিভাগ থেকে উত্তর এল, এই গাছ বাণিজ্য দপ্তরের লনে পড়েছে, সুতরাং এই গাছ সরানোর দায়িত্ব বাণিজ্য দপ্তরের।
উত্তর পড়ে বাণিজ্য দপ্তর যারপরনাই চটে গেল। তারাও সঙ্গে-সঙ্গে দিল কড়া জবাব, এই গাছ সরানো বা না-সরানোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব কৃষি দপ্তরের। বাণিজ্য দপ্তরের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
পরের দিনও ফাইল চলতে আরম্ভ করল। সন্ধ্যার সময় জবাব এল, আমরা এই সমস্যা হার্টিকালচার ডিপার্টমেন্টে পাঠালাম। কারণ এ এক ফলদার গাছের ব্যাপার। এগ্রিকালচারাল ডিপার্টমেন্ট শাকসজি এবং খেত-খামার সম্পর্কিত সমস্যা সমাধান নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। জামগাছ ফল দেয়। সুতরাং এই ধরনের ফলদার গাছের ব্যাপার সম্পূর্ণভাবে হার্টিকালচার ডিপার্টমেন্টেরই অন্তর্গত।
রাত্রে মালি চাপা-পড়া মানুষটিকে ডাল-ভাত খাওয়াল। তার চারদিকে পুলিশের কড়া পাহারা বসেছে, কোনো মানুষ যেন নিজের হাতে কানুন তুলে নিয়ে গাছ সরানোর চেষ্টা না-করে। কিন্তু চাপা-পড়া মানুষটির প্রতি করুণা হয় একজন পুলিশের। সে মালিকে খাওয়ানোর অনুমতি দেয়।
মালি চাপাপড়া মানুষটিকে বলল তোমার ফাইল চলছে, মনে হচ্ছে কালকের মধ্যে একটা ফয়সালা হয়ে যাবে।
চাপাপাড়া মানুষটি মালির কথার কোনো জবাব দেয় না।
মালি গাছটির দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে বলল, ভাগ্যিস গাছটা তোমার কোমরের একদিকে পড়েছে, কোমরের মাঝখানে পড়লে তোমার শিরদাঁড়া ভেঙে যেত।’
চাপাপড়া মানুষটি কিন্তু মালির কথার কোনো জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে না।
মালি আবার বলল, তোমার যদি কোনো ওয়ারিশ থাকে তবে আমাকে তার ঠিকানা। বল, আমি তাকে খবর দেওয়ার চেষ্টা করব।
চাপাপড়া মানুষটি অনেক কষ্টে মালিকে বলল, আমি নিজেই বেওয়ারিশ।
মালি দুঃখ প্রকাশ করে চলে গেল।
তৃতীয় দিন হার্টিকালচার ডিপার্টমেন্ট খুব কড়া এবং ব্যঙ্গপূর্ণ জবাব দিল।
হার্টিকালচার ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি সাহিত্যদরদী বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি সাহিত্যিক ভাষায় লিখলেন, খুব আশ্চর্যের কথা যখন সমগ্র দেশে আমরা বৃক্ষ রোপণ করছি, তখনই আমাদের দেশে এমনকি সরকারি আইন আছে যার বলে বৃক্ষ কাটা যায়! বিশেষ করে এমন এক বৃক্ষ–যা ফল দেয়। আর এই বৃক্ষ হচ্ছে একটি জাম বৃক্ষ, যার ফল সবাই আনন্দের সঙ্গে আস্বাদন করে। আমাদের বিভাগ কোননামতেই এই ধরনের এক ফলদার বৃক্ষকে কাটার অনুমতি দিতে পারে না।
একজন রসিক মানুষ আপসোস করে বলল, এখন তবে কী করা যায়? যদি গাছ কাটা না যায় তবে মানুষটিকেই কেটে বের করা হোক।’ সে সবাইকে তার প্রস্তাব বুঝিয়ে দিল, ‘দেখুন, যদি মানুষটিকে এখান থেকে কাটা যায় তবে অর্ধেক মানুষ এদিকে বেরিয়ে আসবে, অর্ধেক ঐদিকে। আর গাছটিও যেমনকার তেমন থাকবে।’
চাপা-পড়া মানুষটি তার কথার প্রতিবাদ করে উঠল, কিন্তু আমি যে মারা যাব।’ একজন ক্লার্ক বলল, ‘হাঁ, একথাও ঠিক।
মানুষটিকে কাটার জন্য যিনি নিপুণ যুক্তি হাজির করছিলেন, তিনি সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, আপনি জানেন না, আজকাল প্লাস্টিক সার্জারি কত উন্নতি সাধন করেছে। একে যদি দুখণ্ড করে কেটে বের করা যায় তবে প্লাস্টিক সার্জারি করে আবার জোড়া লাগানো যাবে।’
এইবার ফাইল মেডিকেল ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হল। মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্ট এ্যাকশন নিল সঙ্গে-সঙ্গে। যেদিন তাদের ডিপার্টমেন্টে ফাইল পৌঁছল তার পরদিনই তারা ঐ ডিপার্টমেন্টের যোগ্যতম প্লাস্টিক সার্জনের কাছে পাঠিয়ে দিল। সার্জেন খুঁটিয়ে চাপাপড়া মানুষটির স্বাস্থ্য, রক্তচাপ, নাড়ির গতি, হার্ট এবং মাংস পরীক্ষা করে এক রিপোর্ট লিখলেন : হাঁ, প্লাস্টিক অপারেশন হতে পারে এবং অপারেশন সফলও হবে, তবে মানুষটি মারা যাবে।
সুতরাং এই ফয়সালাও আর গ্রহণ করা হল না। রাত্রে মালি চাপাপড়া মানুষটিকে খিচুড়ি খাওয়াতে-খাওয়াতে বলল, তোমার ব্যাপারটি ওপর মহলে গেছে। শুনেছি কালকে সেক্রেটারিয়েটের সমস্ত সেক্রেটারিদের মিটিং হবে। ঐ মিটিং-এ রাখা হবে তোমার কেস। মনে হচ্ছে সব ঠিক হয়ে যাবে।
চাপাপড়া মানুষটি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে বলল,
‘জানি আমাকে হয়তো অস্বীকার করবে না।
কিন্তু তোমার কাছে যখন খবর আসবে
তখন আমি পুড়ে ছাই হয়ে যাব।’
মালি আচমকা তার ঠোঁটে আঙুল রেখে আশ্চর্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি…তুমি কবি?
চাপাপড়া মানুষটি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল।
পরের দিন মালি চাপরাসিকে বলল, চাপরাসি বলল ক্লার্ককে, ক্লার্ক হেডক্লার্ককে, কিছুক্ষণের মধ্যে সারা সেক্রেটারিয়েটে খবর রটে গেল চাপাপড়া মানুষটি একজন কবি। আর দেখতে দেখতে কবিকে দেখার জন্য লোক ভেঙে পড়ল। এই খবর শহরেও পৌঁছে গেল। আর সন্ধ্যার মধ্যে শহরের অলিগলিতে যত কবি আছেন তারা এসে জমা হলেন। সেক্রেটারিয়েটের লন কবি, কবি আর কবিতে ভরে উঠল। চাপাপড়া মানুষটির চারদিকে কবি সম্মেলনের এক সুন্দর পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল। সেক্রেটারিয়েটের কয়েকজন ক্লার্ক এবং আন্ডার সেক্রেটারি–যারা সাহিত্য এবং কবিতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারাও থেমে গেলেন এখানে। কয়েকজন কবি চাপাপড়া মানুষটিকে তাদের কবিতা এবং দোহা শোনাতে শুরু করলেন। আর কয়েকজন ক্লার্ক তাকে তার নিজস্ব কবিতা সম্পর্কে আলোচনা করতে বললেন।
চাপাপড়া মানুষটি যে একজন কবি, এই খবর যখন সেক্রেটারিয়েটের সাব কমিটিতে পৌঁছুল, তখন তারা রায় দিলেন : চাপাপড়া মানুষটি একজন কবি, সুতরাং তার ব্যাপার ফয়সালা করতে হার্টিকালচার বা এগ্রিকালচার দপ্তর পারে না। এ সম্পূর্ণভাবে কালচারাল বিভাগের ব্যাপার। কালচারাল বিভাগকে অনুরোধ করা হল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হতভাগ্য
কবিকে চাপাপড়া ফলদার গাছ থেকে মুক্ত করা হোক।
ফাইল কালচারাল ডিপার্টমেন্টের এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগ ঘুরতে-ঘুরতে সাহিত্য একাডেমির সেক্রেটারির হাতে এল। বেচারা সেক্রেটারি ঠিক ঐ সময়েই গাড়িতে করে সেক্রেটারিয়েট এসে চাপাপড়া মানুষটির ইন্টারভিউ নিতে শুরু করলেন।
–তুমি কবি?
সে জবাব দিল, ‘আজ্ঞে হাঁ।’
–কোন নামে তুমি পরিচিত?
–ওস।
ওস? সেক্রেটারি বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলেন। ‘তুমি সেই ওস–যার পদ্য সংগ্রহ ‘ওসের ফুল’ নামে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে?’
চাপাপড়া মানুষটি রুক্ষ কণ্ঠে বলল, হাঁ।
সেক্রেটারি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমাদের একাডেমির মেম্বার?
–না।
সেক্রেটারি বললেন, আশ্চর্যের কথা। এত বড় কবি–’ওসের ফুলে’র লেখক আমাদের একাডেমির সদস্য নয়! আহা কী ভুল হয়ে গেছে আমার, কত বড় কবি, অথচ কী অন্ধকারের নিচে নাম চাপা পড়ে আছে!
–আজ্ঞে, নাম চাপা পড়ে নেই, আমি স্বয়ং এক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছি। দয়া করে আমাকে এখান থেকে তাড়াতাড়ি মুক্ত করুন।
‘এক্ষুণি করছি’ বলে সেক্রেটারি তখনই নিজের দপ্তরে রিপোর্ট করলেন।
পরের দিন সেক্রেটারি ছুটতে-ছুটতে কবির কাছে এলেন। বললেন, ‘নমস্কার, মিষ্টি খাওয়াও। আমাদের সাহিত্য একাডেমি তোমাকে কেন্দ্রীয় শাখার সদস্য করে নিয়েছে। এই নাও তোমার সদস্যপত্র।’
চাপাপড়া মানুষটি বেশ কঠোরতার সঙ্গে তাকে বলল, আমাকে তো আগে এই গাছের নিচ থেকে বের করুন। খুব ধীরে ধীরে তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বইছিল। তার চোখ দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন খুব কঠিন অসুখ আর দুঃখের মধ্যে পড়েছে।
সেক্রেটারি বললেন, এ ব্যাপারে আমার করার কিছুই নেই। আমি যা করতে পারি তা তা করে দিয়েছি। তুমি যদি মারা যাও তবে তোমার স্ত্রীকে পেনসন দিতে পারি।’
কবি থেমে-থেমে বলল, ‘আমি বেঁচে আছি, আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন।
সরকারের সাহিত্য একাডেমির সেক্রেটারি হাত কচলাতে-কচলাতে বললেন, ‘মুশকিল কী জান, আমার দপ্তর শুধুমাত্র কালচারের সঙ্গে যুক্ত। গাছ কাটাকাটির ব্যাপার তো আর দোয়াতকলমে হয় না–কুড়াল-কাটারির সঙ্গেই এর গভীর সম্পর্ক। আমি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে আর্জেন্ট লিখে দিয়েছি।’
সন্ধ্যার সময় মালি এসে চাপা-পড়া মানুষটিকে বলল, ‘কাল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক এসে গাছে কেটে দেবে, আর তুমিও বেঁচে যাবে!
মালি খুব খুশি। চাপাপড়া মানুষটির শরীরে আর কুলাচ্ছিল না। বাঁচার জন্যে সে যুঝে চলেছিল আপ্রাণ। কাল পর্যন্ত…কাল ভোর পর্যন্ত…যে কোনোভাবেই হোক কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হবে।
পরের দিন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের মানুষজন যখন কুড়াল-কাটারি নিয়ে গাছ কাটতে হাজির হল, তখন বৈদেশিক দপ্তর থেকে খবর এল, গাছ কাটা বন্ধ রাখ। কারণ দশ বছর আগে পিটোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী সেক্রেটারিয়েটের লনে এই গাছ লাগিয়েছিলেন। এখন যদি এই গাছ কাটা হয় তবে পিটোনিয়া সরকার অসন্তুষ্ট হতে পারেন।
একজন ক্লার্ক চিৎকার করে বলল, কিন্তু একজন মানুষের জীবনের প্রশ্ন যে জড়িত।’
আর একজন ক্লার্ক অন্য ক্লার্কটিকে বলল, আরে এ যে দু-দেশের সম্পর্কের প্রশ্ন। তুমি কি জান না পিটোনিয়া সরকার আমাদের দেশকে কীভাবে সহযোগিতা করছে। আমরা কি বন্ধুত্বের জন্য একজন মানুষের জীবন উৎসর্গ করতে পারি না!
–কবির মরে যাওয়া উচিত।
–নিশ্চয়ই।
আন্ডার সেক্রেটারি সুপারিনটেনডেন্টকে বললেন, ‘আজ প্রধানমন্ত্রী সফর শেষ করে ফিরছেন। বিকেল চারটায় বৈদেশিক দপ্তর এই গাছ সম্পর্কিত ফাইল তাঁর কাছে পেশ করবেন। উনি যা বলবেন তাই-ই হবে।’
বিকেল পাঁচটায় সেক্রেটারি স্বয়ং ফাইল নিয়ে হাজির হলেন। এই যে শুনছ। খুশিতে গদগদ তিনি ফাইল দোলাতে-দোলাতে বললেন, এই গাছ কাটার হুকুম দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সমস্ত আন্তর্জাতিক দায়-দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কালই এই গাছ কাটা হবে। আর তুমিও বেঁচে যাবে এই সমস্যা থেকে। আরে শুনছ কি! আজ তোমার ফাইল পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।’
কিন্তু কবির হাত তখন বরফের মতো ঠাণ্ডা। চোখের তারা স্থির। একসার পিঁপড়ে তার মুখের ভিতর ঢুকছিল।
তার জীবনের ফাইলও পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।
তোমার দুঃখ আমাকে দাও – রাজেন্দ্র সিংহ বেদী
মদন যেমন ভেবেছিল বিয়ের রাত ঠিক তেমনটি হয়নি।
চকলি বউদি মদনকে ফুসলিয়ে ঠেলে দিয়েছিল মাঝখানের ঘরে। ইন্দু সামনের শালুতে নিজেকে জড়িয়ে আঁধারেরই অংশ হয়ে বসেছিল। বাইরে চকলি বউদি, দরিয়াবাদী পিসি আর সব মহিলাদের হাসি রাতের শান্ত জলে মিছরির মতো ধীরে-ধীরে গলে যাচ্ছিল। মহিলারা বুঝেছিলেন যে, এত বয়স হওয়া সত্ত্বেও মদন কিচ্ছু জানে না, কারণ যখন তাকে মাঝরাতের ঘুম থেকে জাগানো হল তখন সে হড়বড় করে বলেছিল– ‘আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’
এই মহিলাদের দিন চলে গেছে। বিয়ের পহেলা রাতে তারা তাদের স্বামীদের যে-সব কথা বলেছিল আর শুনেছিল তার প্রতিধ্বনি আজ তাদের স্মৃতিতে নেই। তারা কেবল সংসার করেছে আর এখন নিজের অন্য এক বোনকে সংসারের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ধরিত্রীর এই মেয়েরা এ-কথাই বুঝেছিল যে, পুরুষরা হল মেঘখণ্ড–তাদের প্রতিটি বর্ষণের জন্য মুখ তুলে তাকিয়ে থাকতে হয়। যদি না-বর্ষে তো প্রার্থনা করতে হয়, পূজা দিতে হয়, জাদুমন্ত্র পড়তে হয়। যদিও কালকাজির এই নয়া বসতিতে মদন ঘরের সামনে খোলা উঠানে শুয়েছিল, তবু তারই জন্য অপেক্ষায় ছিল ওরা। এক অশুভ লক্ষণের মতো পড়শি সিবতের মোষটা মদনের খাটের কাছে বাঁধা ছিল। মোষটা বারবার ফু-ফু করে মদনকে শুকছিল আর মদন চেষ্টা করছিল হাত তুলে তাকে দূরে রাখার–এই অবস্থায় ঘুমোনোর সুযোগ কোথায়?
সাগরের তরঙ্গে দোলা আর মেয়েদের রক্তে ঢেউ-ভোলায় পারঙ্গম চাঁদ এক জানালা পথে অন্দরে চলে এসে দেখছিল, দরজার অন্য দিকে দাঁড়িয়ে মদন পরবর্তী পদক্ষেপ কোন দিকে ফেলে। মদনের নিজের ভিতরে মেঘ গর্জন করছিল। বিজলি-বাতির থামে কান পাতলে যেমন তার ভিভরে শনশন্ শব্দ শোনা যায় তেমনি শব্দ তার নিজেই ভিতরে শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর মদন এগিয়ে গিয়ে পালঙ্ক টেনে চাঁদের আলোয় নিয়ে এল যাতে করে নববধূর মুখ দেখা যায়। কিন্তু সে থমকে দাঁড়াল। সে তখনি ভাবল ইন্দু আমার বউ, পরস্ত্রী তো নয়, পরস্ত্রীকে স্পর্শ না-করার শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই সে পেয়ে এসেছে। শালুর মধ্যে সেঁধিয়ে-থাকা নববধূকে দেখতে-দেখতে মদন সিদ্ধান্তে এল যে, এইখানে ইন্দুর মুখ লুকিয়ে আছে। ভাবনামতো পাশে পড়ে থাকা গাটরিটা হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখল, সেখানেই ইন্দুর মুখ। মদন ভেবে ছিল যে, ইন্দু সহজে নিজে থেকে তার মুখ দেখতে দেবে না। কিন্তু ইন্দু এরকম কিছু করেনি। কেননা, কয়েকবছর আগে থেকে সে-ও এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল, অন্যদিকে কোনো কাল্পনিক মোষের শুঁকতে থাকার ফলে তারও ঘুম আসছিল না। চলে-যাওয়া ঘুম আর বন্ধ-করা চোখের বেদনা সমেত আঁধার ছাড়াও সামনে ধড়ফড়-করা কিছু একটা নজরে এল মদনের। চিবুক পর্যন্ত পৌঁছতে-পৌঁছতে মুখ সাধারণত লম্বা হয়ে যায় কিন্তু এখানে। সব কিছুই গোল দেখাচ্ছিল। চাঁদের আলোয় গাল আর ঠোঁটের মাঝে এক ছায়াদার টোল তৈরি হয়েছিল–যেমন সবুজ ক্ষেত আর সুন্দর টিলার মাঝখানে হয়ে থাকে। কপালটি তার ছোট, কিন্তু তার ওপর হঠাৎ গজিয়ে-ওঠা কুঞ্চিত কেশরাশি—
তখন ইন্দু তার মুখ সরিয়ে নিল। যেন সে মুখ দেখার অনুমতি দিয়েছিল তবে এতক্ষণ ধরে নয়। আর লজ্জার তো কোনো সীমা নেই। মদন কিছুটা শক্ত হাতেই হু-হুঁ করতে থাকা নববধূর মুখ ফের ওপরে তুলে মাতালের মতো গদৃগ কণ্ঠে বলল–’ইন্দু!’
ইন্দু কিছুটা ভয় পেয়েছিল। জীবনে এই প্রথমবার কোনো অপরিচিত পুরুষ এইভাবে তার নাম ধরে ডাকল আর সেই অপরিচিত পুরুষের দৈবী অধিকারের দাবিতে রাতের আঁধারে ধীরে-ধীরে একাকী বন্ধুহীন অসহায় নারীর আপন মানুষ হয়ে যাচ্ছিল সে। ইন্দু এই প্রথমবার একনজর ওপর দিকে তাকিয়ে, তারপর চোখ বন্ধ করে কেবল এটুকু বলেছিল– ‘জি।’…তার আপন কণ্ঠস্বর পাতাল থেকে উঠে আসা শব্দের মতো শুনিয়েছিল।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই কাটল। তারপর ধীরে-ধীরে কথাবার্তা হতে লাগল। এখন যে কথা চালানো সম্ভব তাই চলছিল। ইন্দু থামছিলই না। ইন্দুর বাবা, ইন্দুর মা, ইন্দুর ভাই, মদনের ভাই-বোন-বাপ, তার রেলের চাকরি, তার মেজাজ, জামা-কাপড়ের পছন্দ, খাওয়ার অভ্যাস–সব কিছুরই হিসাব নিচ্ছিল সে। মাঝে-মাঝে মদন ইন্দুর কথা থামিয়ে দিয়ে অন্য কিছু বলতে চাইলে ইন্দু এড়িয়ে যাচ্ছিল সীমাহীন অসহায় অবস্থায় মদন তার মায়ের কথা তুলল। মা তার সাত বছর বয়সে তাকে ছেড়ে খুব কষ্ট পেয়ে মারা গেছে। যতদিন পর্যন্ত বেচারি মা বেঁচেছিলেন’, মদন বলল–ততদিন বাবুজির হাতে ওষুধের শিশিই দেখতাম, আমি হাসপাতালের সিঁড়ির উপর আর পাশের ছোট ঘরে পিপড়ার সারির উপর শুয়ে থাকতাম, আর শেষে একদিন–২৮ মার্চের সন্ধেবেলায়…’ বলতে বলতে মদন চুপ করে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ক্রন্দন তার গলা ভরে যাওয়ায় এ-ধারে-ওধারে পৌঁছে গেল। ইন্দু ঘাবড়ে গিয়ে মদনের মাথা টেনে নিল নিজের বুকে। তার ক্রন্দনের মুহূর্ত-অবসরে ইন্দু নিজের এ-ধারে আর ও-ধারে ছড়িয়ে গেল (দূরের মানুষ কাছে হল)। মদন ইন্দুর সম্পর্কে আরো কিছু জানতে চাইলে ইন্দু তার হাত চেপে ধরে বলল–’আমি তো লেখাপড়া জানি না। জীবনে আমি দেখেছি মা আর বাবা, ভাই আর ভাই-বউ, আরো অনেক লোক দেখেছি, এ-কারণে আমি কিছু-কিছু বুঝি! আমি এখন তোমার। নিজের বদলে তোমার কাছে একটা জিনিস চাইছি…’।
কাঁদতে-কাঁদতে কান্নার নেশা ধরে যায়। মদন কিছুটা অধীরতা আর কিছুটা উদারতা মিলিয়ে বলল
কী চাইছ? তুমি যা চাইবে আমি তাই দেব।’
‘পাকা কথা?’ ইন্দু বলল।
মদন কিছুটা ব্যাকুল হয়ে বলল–
হ্যাঁ, হ্যাঁ, যা বলেছি তা পাকা কথা।’
কিন্তু এর মধ্যেই মদনের মনে এক ভাব এল। আমার কারবার আগের থেকেই মন্দা চলছে; যদি ইনু এমন কিছু জিনিস চায় যা আমার সামর্থ্যের বাইরে তা হলে কী হবে? কিন্তু ইন্দু মদনের শক্ত আর প্রসারিত হাত আপন নরম হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে তার গালে আপন গাল রেখে বলল–
‘তোমার দুঃখ আমাকে দিয়ে দাও।
মদন খুব হতাশ হয়ে গেল। সেইসঙ্গে তার ঘাড় থেকে এক বোঝা নেমে গেল বলে অনুভব করল। সে ফের চাঁদের আলোয় ইন্দুর মুখ দেখার চেষ্টা করল কিন্তু কিছু বুঝতে পারল না। মদন ভাবল মা অথবা কোনো সখির কাছে শেখা মুখস্থ প্রবাদ ইন্দু তাকে বলেছে। আর তখনি এক তপ্ত অশ্রুবিন্দু মদনের হাতের কবজির উপর পড়ল। সে ইন্দুকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে নিতে বলল–’দিলাম।’ এই-সব কথাবার্তা মদনকে অনেকটা স্বাভাবিক সহজ করে তুলল।
এক-এক করে সব অতিথি বিদায় নিল। চকলি বউদি দুই বাচ্চাকে দু হাত ধরে সিঁড়ির উঁচু-নিচু ধাপে নিজেকে সামলে চলে গেল। দরিয়াবাদী পিসি তার ন লাখ টাকার হার হারিয়ে গেছে বলে হৈ-চৈ লাগিয়ে দিয়েছিল। হাঙ্গামা করতে-করতে বেহুশ হয়ে গিয়েছিল; সেই হার পাওয়া গেল স্নানের ঘরে। যৌতুক থেকে তার প্রাপ্য তিনখানা শাড়ি নিয়ে পিসি চলে গেল। তারপর গেলেন খুড়োমশায়–জে. পি. হবার খবর মদনের মারফত পেয়ে এমনই কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলেন যে মদনের বদলে তিনি নববধূর মুখচুম্বন করতে যাচ্ছিলেন।
বাড়িতে থাকল কেবল বুড়ো বাপ আর ছোট ভাইবোন। ছোট্ট দুলারি তো সব-সময় বউদির গায়ে লেপটে থাকে। গুলি-মহল্লার কোনো বউ নববধূকে তাকিয়ে দেখে অথবা না-দেখে, যদি দেখে তো কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে, এই সব তার এখতিয়ারের মধ্যে ছিল। শেষ পর্যন্ত এই সবও মিটে গেলে ইন্দু ধীরে-ধীরে পুরনো হতে লাগল। কিন্তু কালকাজির। এই নয়া বসতিতে আজ পর্যন্ত লোক আসতে-যেতে মদনের বাড়ির সামনে থমকে যায় আর কোনো অছিলায় অন্দরে চলে আসে। ইন্দু তাদের দেখামাত্রই ঘোমটা টেনে দিত। কিন্তু ওই সামান্য অন্তরাল থেকেই যেটুকু দেখা যেত তা বিনা-ঘোমটায় দেখা যেতে পারত না।
মদনের কারবার ছিল দুর্গন্ধ বিরোজার। কোনো বড় সরবরাহকারীর দু-তিনটি জঙ্গলে চীড় আর দেবদারু গাছের জঙ্গলে আগুন ধরে যায় আর দাউদাউ করে জ্বলতে-জ্বলতে কালি হয়ে যায়। মহীশূর আর আসাম থেকে আনানো বিরোজার দাম বেশি পড়ে যেত। কিন্তু লোকে বেশি দামে তা কিনতে রাজি নয়। একে তো আমদানি কমে গিয়েছিল তার ওপর মদন তাড়াতাড়ি দোকান আর সংলগ্ন দফতর বন্ধ করে ঘরে চলে আসতঘরে পৌঁছে তার একমাত্র প্রয়াস ছিল যে, সকলে খাওয়া-দাওয়া করে যেন তাড়াতাড়ি আপন-আপন বিছানায় শুয়ে পড়ে। খাবার সময় সে নিজেই থালা তুলে বাপ আর বোনের সামনে রাখত আর তাদের খাওয়া হয়ে গেলে এঁটো বাসন সব গুছিয়ে নিয়ে কলের নিচে রেখে দিত। সবাই ভাবত, বধূ মদনের কানে যে কোনো মন্ত্র পড়ে দেওয়াতেই সে ঘরের কাজেকর্মে খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে। মদন ছিল সকলের চেয়ে বড়। কুন্দন তার ছোট, পাশী সবচেয়ে ছোট। যখন কুন্দন বউদির সঙ্গে একসঙ্গে বসে খাবার জেদ ধরত তখন বাপ ধনীরাম তাকে বকে দিতেন–’তুমি খাও’–বলতেন, বউ পরে খেয়ে নেবে। ধনীরাম রান্নাঘরের এদিক-ওদিক দেখতেন, আর যখন বউ খাওয়া-দাওয়া থেকে ছুটি পেত আর বাসনকোসনের প্রতি মনোযোগ দিত তখন বাবু ধনীরাম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলতেন–রেখে দাও বউমা, বাসনকোসন সকালে ধোয়া যাবে। ইন্দু বলত, না বাবুজি, আমি এখনি ধুয়ে দিচ্ছি।’ বাবু ধনীরাম কম্পিত কণ্ঠস্বরে বলতেন–মদনের মা যদি আজ থাকত বউমা, তা হলে সে কি তোমায় এসব করতে দিত?’ তখন ইন্দু একেবারে হাত গুটিয়ে নিত।
ছোট্ট পাশী বউদিকে দেখে লজ্জা পেত এ-কথা ভেবে যে, নববধূ খুব তাড়াতাড়ি গর্ভবতী হয়েছিল। চকলি বউদি আর দরিয়াবাদী পিসি রেওয়াজমতো পাশীকে ইন্দুর কোলে বসিয়ে দিয়েছিল। তখন থেকে ইন্দু তাকে কেবল দেওর নয়, নিজের ছেলের মতো দেখত। যখনি সে আদর করে পাশীকে দুহাতের মধ্যে নেয়ার চেষ্টা করত তখনি পাশী ঘাবড়ে দিয়ে হাত ছাড়িয়ে দুহাত দূরে দাঁড়িয়ে যেত, দেখত আর হাসত, কাছে আসত না, দূরেও পালাত না। এক আশ্চর্য যোগাযোগে ঠিক এই সময়েই বাবুজি প্রতিবার সেখানে হাজির হাতেন আর পাশীকে ধমক দিয়ে বলতেন,–’আরে যা না…বউদি আদর করে ডাকছে…তুই কি এখনি জোয়ান-মদ্দ হয়ে গেলি?’ … আর দুলারি তো পিছু ছাড়েই না। আমি বউদির কাছেই যোব’–তার এই জিদ বাবুজির মনের মধ্যে কোনো ‘জনার্দন’কে জাগিয়ে দিত। এক রাতে এই ব্যাপারে দুলারির ওপর জোরে চড় পড়ল আর
সে ঘরের আধা-কাঁচা আধা-পাকা নালিতে গিয়ে পড়ল। ইন্দু দৌড়ে গিয়ে ধরল তাকে তার মাথা থেকে উড়ে গেল দোপাট্টা, চুলের ফুল আর পাখি গেল পড়ে। মাথার সিঁদুর, কানের ফুল সব উন্মুক্ত হয়ে পড়ল। ‘বাবুজি!’ ইন্দু শ্বাস রুদ্ধ করে ডাকল। একই সঙ্গে দুলারিকে ধরতে গিয়ে আর মাথার উপরে দোপাট্টা ঢাকতে গিয়ে ঘাম বেরিয়ে গেল। মায়ের মতোই বাচ্চাকে বুকে নিয়ে ইন্দু মাথার দিকে–যেখানে অনেক বালিশ ছিল– সেখানে বিছানা করে তাকে শুইয়ে দিল। খাটের না ছিল প্রান্ত, না ছিল কাঠের বাজু। চোট তো একতরফা গেঁথে-যাওয়া জিনিস নয়। দুলারির শরীরে আহত অংশের উপর ইন্দু এমনভাবে আঙুল বুলিয়েছিল যে তাতে বেদনাও হচ্ছিল আবার তা আরামও দিচ্ছিল। দুলারির গালের ওপর বড় বড় টোল পড়ত। ওই সব টোলের তারিফ করে বলত ইন্দু
‘তোর শাশুড়ি মরুক … গালের ওপর কেমন সুন্দর টোল পড়ে। মুন্নি একেবারে খুকির মতো বলত–বউদি, তোমার গালেও তো টোল পড়ে …’ হ্যাঁ মুন্নি’, বলে ইন্দু দীর্ঘশ্বাস ফেলত।
কোনো কথায় মদনের রাগ হয়েছিল। সে পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিল সবকিছু। বলল– ‘আমি তো বলছি, একদিক থেকে ভালোই হয়েছে…’
‘কেন? ভালো কেন হয়েছে?’ ইন্দু প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ, বাঁশ যদি না-থাকে তো বাঁশি বাজে না … শাশুড়ি না-থাকে তো ঝগড়াও থাকে না। ইন্দু সহসা ক্রুদ্ধ হয়ে বলল–তুমি যাও তো, শুয়ে পড়ে গে, বড় এসেছেন … মানুষ বেঁচে থাকে বলেই তো লড়াই করে। শ্মশানের চুপ-চাপ থেকে ঝগড়া ভালো। যাও না, রান্নাঘরে তোমার কী কাজ?’।
মদন রাগ করে দাঁড়িয়ে রইল। বাবু ধনীরামের ধমকে আর সব বাচ্চারা আগেই আপন-আপন বিছানায় শুয়ে পড়েছিল–যেন ডাকঘরে চিঠি সর্ট হয়ে যে যার জায়গায় চলে গেছে। কিন্তু মদন দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। তার প্রয়োজন তাকে উদ্ধত আর লজ্জাহীন করে দিয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ে যখন ইন্দুও তাকে ধমকে দিল তখন সে কাঁদো-কাঁদো হয়ে অন্দরে চলে গেল।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত মদন বিছানায় পড়ে ছটফটাল। কিন্তু বাবুজির ভয়ে ইন্দুকে চেঁচিয়ে ডাকবার সাহস হল না তার। মদনের ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে গেল যখন মুন্নিকে ঘুম পাড়ানোর জন্য ইন্দু ঘুমপাড়ানি ছড়া গাইছিল।–’আয় ঘুম রানি, বৌরানি, মস্তানি’।
দুলারি মুন্নিকে যে ঘুমপাড়ানি ছড়া গেয়ে ইন্দু ঘুম পাড়াচ্ছিল, সেই ছড়া এদিকে ঘুম তাড়াচ্ছিল মদনের। নিজের প্রতি বিরক্ত হয়ে মদন সজোরে চাদর ধরে টানল। শাদা চাদর মাথায় ঢাকা দিয়ে শ্বাস বন্ধ করে খামোখা মড়ার মতো পড়ে রইল সে। মদনের মনে হল যে, সে মরে গেছে আর তার নববধূ ইন্দু তার পাশে বসে জোরে-জোরে মাথা কুটছে। দেয়ালে কবজির আঘাত করে চুড়ি ভাঙছে আর পড়তে-পড়তে কাঁদতে-কাঁদতে রান্নাঘরে গিয়ে চুলোর ছাই মাথায় দিচ্ছে, আবার বাইরে দৌড়ে এসে হাত তুলে মহল্লার লোকের কাছে নালিশ জানাচ্ছে–সকলে দেখ, আমি মারা গেছি। এখন তার দোপাট্টার পরোয়া নেই, জামাকাপড়ের পরোয়া নেই, মাথার সিঁদুর, কেশের ফুল আর পাখি সব উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে।
মদনের দুচোখ দিয়ে সবেগে অশ্রু বয়ে আসে, যদিও রান্নাঘরে বসে ইন্দু হাসছিল। মুহূর্তের মধ্যেই তার সৌভাগ্য বিনষ্ট হল আবার তার অজ্ঞাতেই সৌভাগ্য ফিরে এল। মদন যখন বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে এল তখন চোখের জল মুছতে-মুছতে নিজের পরেই হাসতে লাগল। ও-ধারে ইন্দু হাসছিলই। কিন্তু তা চাপা হাসি। বাবুজির উপস্থিতির কারণে সে কখনো উঁচু গলায় হাসত না, খিলখিল করে হাসিও একরকমের বেহায়াপনা, দোপাট্টা আর চেপে-চেপে হাসি ঘোমটার কাজ করত। মদন মনে-মনে ইন্দুর এক খেয়ালি মূর্তি বানিয়ে তার সঙ্গে অনেক কথাই বলেছিল। সে তাকে এমন আদর করেছিল যেমন আদর আজ পর্যন্ত করেনি। মদন আবার তার বাস্তব পরিবেশে ফিরে এসে দেখল পাশের বিছানা খালি পড়ে আছে। সে হালকা আওয়াজে ডেকেছিল ‘ইন্দু, তারপর চুপ করে গিয়েছিল। ওই ইতস্ততভাবের মধ্যে সে ঘুমের আবেশে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তার মনে যে বিয়ের রাতে পড়শি সিবতের মোষ তার মুখের কাছে ফোঁস-ফোঁস করছিল। মদন বিকল অবস্থায় উঠে বসল, তারপর রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকে দু-তিন বার আড়মোড়া ভেঙে শুয়ে পড়েছিল ফের। ঘুমিয়ে গিয়েছিল।
মদন কান খাড়া করে কোনো কিছু শোনার প্রত্যাশায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। বিছানার ভাঁজ দুরস্ত করতে গিয়ে ইন্দুর চুড়িগুলো ঝনঝন করে উঠলে মদন হড়বড় করে উঠে বসল। হঠাৎ জেগে যাওয়ায় তার মধ্যে প্রণয়ভাবনা হঠাৎ বেড়ে গেল। আরাম করে পাশ না ফিরে। লোকে ঘুমিয়ে গিয়ে হঠাৎ জেগে উঠলে প্রেমের দম ফুরিয়ে যায়। মদনের সারা শরীর ভিতরকার আগুনে জ্বলছিল আর সেজন্যই তার রাগ হয়েছিল। এবার সে ইন্দুকে বিরক্তির সঙ্গে বলল–
‘তা হলে তুমি এসে গেছ।’
‘হ্যাঁ।’
‘খুকি শুয়েছে, না মরেই গেল?
ইন্দু ঝুঁকে-পড়া অবস্থা থেকে একদম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। হায় রাম!’ নাকের উপর আঙুল রেখে সে বলল–
‘কী কথা বলছ? বেচারি মরবে কেন–মা-বাপের একমাত্র মেয়ে–’
‘হ্যাঁ’, মদন বলল–বউদির একমাত্র ননদ।’ তারপরই হুকুম দেয়ার স্বর আয়ত্ত করে বলল–’ওটাকে বেশি মাথায় তুল না।’
‘তাতে কোনো পাপ হবে?’
‘পাপ হবে, মদন রেগে গিয়ে বলল–’তোমার পিছু ছাড়ে না। যখনি দেখি জোকের মতো লেগে আছে। আমি তো কোনো সুযোগই পাই না …’
‘হায়। ইন্দু মদনের চারপাইয়ের উপর বসতে-বসতে বলল–’বোনদের আর মেয়েদের এভাবে দূর-দূর করা ঠিক নয়। বেচারি দু দিনের অতিথি। আজ নয়ত কাল, কাল নয় পরশু একদিন তো চলে যাবে …’ এ-বিষয়ে ইন্দু কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু সে চুপ করে গেল। মনশ্চক্ষুতে ইন্দু নিজের মা, বাপ, ভাই, বোন, খুড়ো, জেঠা, জেঠিমা সকলেই দেখা দিয়ে গেল একবার করে। কোনো একদিন সে তাদের আদরের পুতুল ছিল, চোখের পলকে সে তাদের থেকে স্বতন্ত্র হয়ে গেল, এখন দিনরাত তার বেরিয়ে যাওয়ার কথা হচ্ছে, যেন ঘরে কোনো বুড়ি শাশুড়ি আছে। কোনো ঘরে যদি সাপ থাকে, তা হলে যতক্ষণ পর্যন্ত-না ওই সাপকে তার গর্তে ধোয়া দিয়ে মেরে ফেলা যায় ততক্ষণ ঘরের লোক নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে না। দূর-দূরান্ত থেকে সাপকে খুঁটিগাড়ার, দড়ি দিয়ে বাঁধার, বিষদাত ভেঙে দেয়ার মাদারিদের ডেকে আনা হয়। বড় বড় ধন্বন্তরী আর মোতিসাগররা আসে–শেষে একদিন উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে লাল আঁধি এসে যায়। তা সাফ হয়ে যাবার পর একটি লরি এসে দাঁড়ায়–তাতে সলমা-চুমকিওয়ালা শাড়িতে জড়িয়ে থাকা এক নববধূ বসে থাকে। পিছনের ঘরে এক সুর বাজতে থাকে, সানাই-এর আওয়াজ শোনা যায়। তারপর এক ধাক্কায় লরি চলতে থাকে।
মদন কিছুটা রাগের সঙ্গে বলল—
‘তোমরা মেয়েছেলেরা খুব চালাক। গতকালই এ বাড়িতে এসেছ আর আজ এখানকার সব লোকের প্রতি আমার চেয়ে তোমার বেশি ভালোবাসা জন্মেছে?’
হ্যাঁ।’ ইন্দু বিশ্বাসের সঙ্গে বলল।
‘এ সব মিথ্যা। এ হতে পারে না।’
‘তোমার মতলব আমি…’
‘এ-সব শুধু লোক দেখানো…হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা জি। ইন্দুর চোখে জল এসে যায়, সে বলে–এ সব কিছুই আমার দেখানেনা?’ ইন্দু উঠে গিয়ে নিজের বিছানায় চলে যায় আর শিয়রের দিকে মুখ লুকিয়ে ফোঁপাতে থাকে। মদন তার অভিমান ভাঙাতে চায়, কিন্তু ইন্দু নিজেই উঠে মদনের কাছে আসে আর শক্ত করে তার হাত ধরে বলে–
‘তুমি সব সময় বিধিয়ে-বিধিয়ে কথা বলছ, তোমার হয়েছে কী?’
স্বামীর মতো রোয়াব দেখাবার সুযোগ মদন পেয়ে যায়–’যাও …যাও…শুয়ে পড়ো। গে’, মদন বলে–’তোমার কাছে আমার কিছুই নেওয়ার নেই…’
‘তোমার কিছু নেওয়ার নেই তো আমার নেওয়ার আছে, ইন্দু বলল–’সারা জীবন নেওয়ার আছে। সে মদনের সঙ্গে হাত কাড়াকাড়ি করতে থাকে। মদন তাকে ধু-ধুৎ করে আর সে মদনের গায়ে পড়ে মিশে যেতে চায়। সে ছিল সেই মাছের মতো যে স্রোতের সঙ্গে বহে যাবার বদলে ঝরনা খরস্রোতের বিপরীতে সাঁতরে উপরে পৌঁছতে চায়। সে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করল, হাত ধরল, কেঁদে-হেসে বলল–
‘ফের আমাকে একেবারে কুটনি বলবে?
সব মেয়েছেলেই তো তাই।
‘থাম…তোমার তো…’ মনে হল যেন ইন্দু কোনো গালি দিচ্ছে আর মুখে কী একটা গুনগুন করেছে। মদন দুরে বসে বলল–কী বললে? আর ইন্দু শোনবার মতো আওয়াজ করে ফের বলল সে-কথা। মদন খিলখিল করে হাসতে লাগল। পরক্ষণেই ইন্দু মদনের পাশে শুয়ে পড়ে বলছিল—
‘তোমরা পুরুষরা কী জান?–যার সঙ্গে ভালোবাসা হয় তার সব ছোটবড় আত্মীয়ের। সঙ্গেই ভালোবাসা হয়। কি বাপ, কি ভাই, আর কি বোন–’হঠাৎ দূরের দিকে তাকিয়ে ইন্দু বলে–
‘আমি দুলারি-খুকির বিয়ে দেব।
‘চূড়ান্ত হয়ে গেল, মদন বলল–’এখনো সে এক হাত লম্বা হয়নি, এখনি তার বিয়ের কথা ভাবছ…’
‘তুমি তো এক হাত দেখছ’, বলে ইন্দু নিজের দুহাত মদনের চোখের উপর রেখে বলতে থাকে একটু সময় চোখ বন্ধ করে আবার খোল’– মদন সত্যি-সত্যি চোখ বন্ধ করল, কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ খোলে না দেখে ইন্দু বলল–এখন তো খোল, এতক্ষণের মধ্যে আমি বুড়ি হয়ে যাব’–শুনে চোখ খুলল মদন। মুহূর্তের জন্য মদনের মনে হয়। সামনে ইন্দু নয়, আর কেউ বসে আছে। সে যেন হারিয়ে গেছে।
‘আমি তো এখন থেকেই চার স্যুট আর কিছু বাসনপত্র ওর জন্যে আলাদা করে। রেখেছি’, ইন্দু বলল। মদন কোনো জবাব দিল না দেখে আঁকি দিয়ে আবার বলল–তুমি কি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছ? নিজের ছেলেবেলার কথা মনে নেই?–তুমি তোমার দুঃখ আমাকে দিয়ে দিয়েছ…?
‘অ্যা!’ মদন চমকে উঠে বসল আর নিশ্চিত হয়ে গেল, কিন্তু সে যখন ইন্দুকে নিজের। সঙ্গে সাপটে মিশিয়ে নিল তখন সে আর একটি শরীর রইল না–সঙ্গে-সঙ্গে এক আত্মাও তার আত্মার সঙ্গে মিলে গেল।
মদনের কাছে ইন্দু হল আত্মার আত্মা। ইন্দুর ছিল সুন্দর শরীর কিন্তু হামেশা কোনো-না-কোনো কারণে সে মদনের আড়ালে থাকে। একটা পর্দার আড়ালে। স্বপ্নের সুতোয় বোনা, নিঃশ্বাসের ধোয়ায় রঙিন। উচ্চ হাসির সোনালি কিরণে উজ্জ্বল আলো ইন্দুকে ঢেকে রাখত। মদনের নজর আর তার হাতের দুঃশাসন বহু শতাব্দী ধরে ওই। দ্রৌপদীর–যাকে সাধারণত বউ বলা হয়–বস্ত্রহরণ করতে থাকে। কিন্তু হামেশা আসমান থেকে থানের পর থান, গজের পর গজ কাপড় তার উলঙ্গতা ঢাকবার জন্য নেমে আসে। দুঃশাসন শ্রান্ত হয়ে কোনো একখানে ঢলে পড়ে কিন্তু দ্রৌপদী সেখানেই দাঁড়িয়ে। থাকে। ইজ্জত আর শুচিতার শাদা শাড়ি-পরিহিতা সে নারী দেবীর মতো দেখায় আর–
…মদনের ফিরে আসা হাত লজ্জার ঘামে ভিজে যায়। তা শুকোবার জন্য সে হাত উপরে ওঠায় আর হাতের পাঞ্জা সম্পূর্ণ প্রসারিত করে দিয়ে আড়মোড়া ভেঙে আপন চোখের মণির সামনে মেলে ধরে। ফের আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখে ইন্দুর মর্মর শুভ্র গৌরবর্ণ আর কোমল শরীর সামনে পড়ে আছে। ভোগের জন্য সে-শরীর পাশেই আছে, বাসনার জন্যে দূরে…যদি কখনো ইন্দুর সঙ্গে কলহ হয়ে যায় তো এই রকমের মন্তব্য হয়–
হায় জি, ঘরে ছোট-বড় সবাই আছে…তারা কী বলবে?
মদন উত্তর দেয়–’ছোটরা বোঝে না …বড়রা বুঝে যায়।’
এর মধ্যে বাবু ধনীরাম সাহারানপুরে বদলি হয়ে গেলেন। সেখানে তিনি রেলের মেল সার্ভিসের সিলেকশন গ্রেডে হেড ক্লার্ক হয়ে গেলেন। এত বড় কোয়ার্টার পাওয়া গেল যে সেখানে আটটা পরিবার থাকতে পারে। কিন্তু বাবু ধনীরাম একাই সেখানে ঠ্যাং ছড়িয়ে পড়ে থাকতেন। সারা জীবনে তিনি কখনো বাচ্চাদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে থাকেননি। পুরো ঘরোয়া মেজাজের লোক ছিলেন। জীবনের শেষ অধ্যায়ে এই একাকিত্ব তার হৃদয়ে ওখান থেকে পালিয়ে যাবার বাসনা জাগিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু তিনি নাচার। সব ছেলেমেয়ে দিল্লিতে মদন আর ইন্দুর কাছে থেকে সেখানেই স্কুলে পড়ে। বছর শেষ হবার আগেই মাঝখানে নিয়ে এলে তাদের লেখাপড়া ভালো হত না। বাবুজির হৃদয়ে আঘাতের পর আঘাত পড়তে লাগল।
অবশেষে গরমের ছুটি হল। তিনি বারবার লেখায় মদন ইন্দুকে কুন্দন, পাশী আর দুলারির সঙ্গে সাহারানপুর পাঠিয়ে দিল। ধনীরামের দুনিয়া মুখরিত হয়ে উঠল আবার। কোথায় তার দফতরের কাজের পরে ছিল অবসরের পর অবসর, আর এখন কাজের পর কাজ। বাচ্চারা বাচ্চাদের মতোই যেখানে জামা-কাপড় খুলত সেখানেই ফেলে রাখত, আর বাবুজি তা গুছিয়ে রাখতেন। মদন থেকে দূরে থাকার ফলে আলস্যে-ভরা ইন্দু তো নিজের পোশাক সম্পর্কেও বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। সে রান্নাঘরে এমনভাবে ঘুরত-ফিরত যেন খোয়াড়ের গরু বাইরের দিকে মুখ তুলে আপন মালিককে খুঁজছে। কাজকর্মের পর সে কখনো অন্দরে ট্রাংকের উপরেই শুয়ে পড়ত, কখনো-বা বাইরে ‘কনের ফুলগাছের কাছে আবার কখনো-বা আমগাছের নিচে আঙিনায় বসে পড়ত। শত-শত হাজার-হাজার হৃদয়ে সে-আশ্রয় শীতলতা এনে দিত।
শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে আমের দিন চলে যায়। আঙিনা থেকে বাইরের দরজা খুললে দেখা যায় কুমারী আর নববিবাহিতা মেয়েরা দোলনায় দোল দিতে-দিতে গাইছে-’আমের শাখায় দোলনা কে বাধল’–আবার গানের তালের অনুসরণে দুলতে থাকে আর দোল দিতে থাকে–আর যদি চারজন একত্র হয় তো লুকোচুরি খেলে। প্রৌঢ়া আর বুড়ির দল একদিকে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে। ইন্দুর মনে হয় সে-ও যেন ওদেরই একজন হয়ে গেছে। তখন সে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমিয়ে পড়ে। বাবুজি কাছ দিয়ে যান তো তাকে জাগাতে কিংবা তুলতে একটুও চেষ্টা করেন না, পরন্তু সুযোগ পেয়ে তার সালোয়ার, যার বদলে বউ শাড়ি পরে আর যা হামেশা শাশুড়ির পুরনো চন্দন কাঠের সিন্দুকে তুলে রাখে, তা তুলে নিয়ে খুঁটিতে টাঙিয়ে দেন। এই কাজে তাকে সব নজর বাঁচিয়ে চলতে হয়; কিন্তু যখন সালোয়ার গুছিয়ে তুলতে গিয়ে তার নজর নিচের কোণে বধূর চোলির ওপর গিয়ে পড়ে, তখন তার সাহস চলে যেত। আর তিনি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যেতেন–যেন কোনো সাপের বাচ্চা গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারপর বারান্দা থেকে তাঁর কণ্ঠস্বর শোনা যেত–’ওম্ নম ভগবতে বাসুদেবায়’।
আশপাশের মহিলারা বাবুজির পুত্রবধূর সৌন্দর্যের বর্ণনা অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছিল। কোনো মহিলা বাবুজির সামনে বধূর সৌন্দর্যের আর সুডৌল শরীরের প্রশংসা করলে তিনি খুশিতে ফেটে পড়ে বলেন–’আমীচন্দের মা, আমি তো ধন্য হয়ে গেলাম। ঈশ্বরের দয়া, আমার ঘরে এক স্বাস্থ্যবতী মেয়ে এসেছে। আর এ-কথায় তার নজর অনেক দূর চলে যায় যেদিকে অসুখ, ওষুধের শিশি, হাসপাতালের সিঁড়ি আর পিঁপড়ের গর্ত। নজর কাছে এলে তিনি মোটাসোটা ভরা-শরীর বাচ্চাদের বগলে, কাঁধে, ঘাড়ে চড়বার নামবার অনুভূতিতে ভরে ওঠেন। আর তার মনে হয় আরো বাচ্চা আসছে। পাশে শুয়ে-থাকা বউয়ের কোমর মাটির সঙ্গে মিশে যায় আর কনুই ছাদের সঙ্গে লেগে থাকে আর তাদের বাচ্চাদের বয়সের মধ্যে কোনো তফাত থাকে না। কেউ বড় নয় কেউ ছোট নয়, সবাই একসঙ্গে জড়-সড়… নমামি, ওম্ নম ভগবতে…
আশপাশের সব লোক জেনে গিয়েছিল যে, ইন্দু বাবুজির স্নেহের পুত্রবধূ। দুধ আর ঘোলের ভাড় ধনীরামের ঘরে আসতে থাকে। একদিন সলামদিন গুজর ফরমায়েশ করে দেয়। ইন্দুকে বলে–’বিবি, আমার ছেলেটাকে আর.এম.এস.-এ কুলির কাজে রাখিয়ে দাও, আল্লা তোমাকে সুফল দেবেন। ইন্দুর ইশারায় কিছুদিনের মধ্যে সলামদিনের ছেলে কুলি হয়ে গেল–সে সর্টার হতে পারল না, তার ভাগ্য।
পুত্রবধূর খাওয়া-দাওয়া আর স্বাস্থ্যের প্রতি বাবুজি নিজেই খেয়াল রাখতেন। ইন্দু দুধ অপছন্দ করত। তিনি রাতের বেলা নিজেই বাটিতে দুধ ফুটিয়ে গ্লাসে ঢেলে বধূকে খাওয়াবার জন্যে তার খাঁটিয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেন। ইন্দু নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে বসত আর বলত-না বাবুজি, আমার দুধ খেতে ভালো লাগে না…।
‘তোর শ্বশুরও তো খাবে।’ তিনি মজা করে বলতেন।
তা হলে আপনিই খেয়ে নিন না। ইন্দু হেসে জবাব দিত আর বাবুজি ছদ্মরোষে ফেটে পড়তেন–তুই চাস যে পরে তোরও ওই অবস্থা হোক যা তোর শাশুড়ির হয়েছিল?
‘হুঁ…হুঁ……’ ইন্দু অভিমান করত। আর অভিমান কেনই-বা না করবে। তারাই অভিমান করে না যাদের অনুনয় করে ভোলাবার কেউ নেই। কিন্তু এখানে তো অনুনয়কারী সবাই, অভিমানকারী কেবল একজন। যখন ইন্দু বাবুজির হাত থেকে গ্লাস নিত না তখন উনি খাঁটিয়ার পাশে শিয়রের নিচে তা রেখে দিতেন–আর-’নে, এখানে রইল–তোর মর্জি হয় তো খানা হয় তো খাস না’–বলে চলে যেতেন।
আপন বিছানায় পৌঁছে ধনীরাম দুলারির সঙ্গে খেলা করতেন। দুলারি বাবুজির খালি গায়ে গা লাগিয়ে ঘষত আর তার পেটের ওপর মুখ লগিয়ে ফু-ফু করত,–এটাই তার অভ্যাস ছিল। আজ যখন বাবুজি আর খুকি এই খেলা খেলতে-খেলতে হাসছিল, তখন খুকি বউদির দিতে তাকিয়ে বলল–দুধ নষ্ট হয়ে যাবে বাবুজি, বউদি তো খাচ্ছে না।’
‘খাবে, নিশ্চয় খাবে বেটি’, বাবুজি অন্য হাতে পাশীকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিতে-নিতে বললেন—
‘মেয়েরা ঘরের কোনো জিনিস নষ্ট হওয়া দেখতে পারে না…’ এই মন্তব্য বাবুজির মুখ থেকে শোনা যেত। আর অন্যদিক থেকে ভেসে আসত ‘হুশ……ভাতারখাগী’ বধূ বিড়াল তাড়াচ্ছে–কিছুক্ষণ পরে ঢক্ শব্দে সবাই জেনে নিত যে বধূ-বৌদি দুধ খেয়ে নিয়েছে। তারপর কুন্দ বাবুজির কাছে এসে বলত–
‘বুজি…বৌদি কাঁদছে।‘
‘হায়।’ বাবুজি বলে ওঠেন আর উঠে পড়ে আঁধারে সেইদিকে তাকিয়ে দেখেন যে-দিকে বধূর চারপাই রয়েছে। কিছুক্ষণ সেখানেই বসে থাকার পর তিনি ফের শুয়ে পড়েন আর কিছু বুঝে নিয়ে কুন্দনকে বলেন–যা…তুই ঘুমিয়ে পড়, সে নিজে নিজেই ঘুমিয়ে পড়বে।
তারপর শুয়ে পড়ে বাবু ধনীরাম পরমাত্মার পুষ্পশোভিত বাগান দেখতে থাকেন আর আপনার মনে ভগবানকে শুধোন–রুপোর মতো এইসব খুলে-যাওয়া বন্ধু-যাওয়া ফুলের মধ্যে আমার ফুলটি কোথায়?’ সারা আকাশ তার কাছে এক বেদনার নদী-রূপে দেখা দেয় আর দুকানে অনবরত হায়-হায় আওয়াজ বেজে ওঠে, তা শুনতে-শুনতে তিনি বলে ওঠেন–’যেদিন থেকে দুনিয়া তৈরি হয়েছে সেদিন থেকে মানুষ কত কেঁদেছে।’
.
ইন্দুর যাবার বিশ-পঁচিশ দিনের মধ্যেই মদন ঝামেলা শুরু করে দেয়। সে লিখল– বাজারের রুটি খেতে-খেতে আমার বিরক্তি ধরে গেছে। কোষ্ঠাবদ্ধতা হয়েছে। তলপেটে বেদনা শুরু হয়েছে। তারপর যেমনভাবে দফতরের লোক ছুটির জন্য সার্টিফিকেট পেশ করে তেমনভাবে মদন বাবুজির এক দোস্তের সমর্থন-প্রাপ্ত চিঠি লিখিয়ে নিয়ে পাঠিয়ে দিল। তাতেও যখন কিছু হল না তখন এক ডবল তার–জবাবি টেলিগ্রাম।
জবাবি তারের পয়সা মারা গেল। কিন্তু তাতে কী। ইন্দু আর বাচ্চারা ফিরে এল। মদন দুদিন ইন্দুর সঙ্গে সোজাসুজি কথা বলেনি। ইন্দু খুব দুঃখ পেয়েছিল এতে। একদিন মদনকে একলা পেয়ে ধরে নিয়ে বসিয়ে বলেছিল—’এত মুখ ফুলিয়ে বসে আছ। আমি কী করেছি?’
মদন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিল—’ছাড়–দূর হয়ে যা হতচ্ছাড়ি, আমার চোখের সামনে থেকে…।’
‘এই কথা বলার জন্যে এতদূর থেকে ডেকে নিয়ে এলে?’
‘হ্যাঁ।’
‘ছোড় এসব।’
‘খবরদার–এ-সব তোমার তৈরি করা ঘটনা। তুমি যদি আসতে চাইতে তা হলে বাবুজি কি থামিয়ে দিত?’
ইন্দু বিহ্বলতার সঙ্গে বলল–হ্যায় জি, তুমি তো বাচ্চাদের মতো কথা বলছ। আমি নিজের থেকে কী করে ওকে এ কথা বলি? সত্যি কথা জানতে চাও তো বলি, আমাকে ডেকে নিয়ে এসে তুমি বাবুজির ওপর বড় জুলুম করলে।’
‘মতলবটা কী?’
‘মতলব কিছু নেই–বাচ্চাদের প্রতি ওঁর হৃদয়ের খুব আসক্তি জন্মেছিল…।’
‘আর আমার হৃদয়?’
‘তোমার হৃদয়? তুমি তো কোথাও আসক্তি জন্মাতে পার।’ ইন্দু বদমায়েশি করে বলল আর মদনের প্রতি এমনভাবে তাকিয়ে দেখল যে, ইন্দুর কাছ থেকে মদনের নিজেকে দূরে রাখার সব ক্ষমতাই শেষ হয়ে গেল। সে-ও কোনো নিপুণ ছলের খোঁজে ছিল।
সে ইন্দুকে ধরে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলল–’বাবুজি তোমার প্রতি খুব প্রসন্ন ছিলেন?’
‘হ্যাঁ, ইন্দু বলল–’একদিন আমি জেগে দেখি শিয়রে দাঁড়িয়ে উনি আমাকে দেখছেন।’
‘এ হতে পারে না।’
‘আমি কসম খেয়ে বলছি।‘
‘নিজের না, আমার কসম খেয়ে বল।’
‘তোমার কসম তো আমি খাই না…অন্যেরা খেলে খাক।’
‘হ্যাঁ’, মদন ভেবে বলল—’বইতে একে বলে সেক্স।’
‘সেক্স’ ইন্দু শুধাল–সেটা কী ব্যাপার?’
‘ওই ব্যাপার যা পুরুষ আর মেয়েমানুষের মধ্যে হয়।’
‘হায় রাম!’ ইন্দু একদম পিছু হটে গিয়ে বলল–’নোংরা কোথাকার। বাবুজির সম্পর্কে এরকম কথা ভাবতে পার, তোমার লজ্জা হয় না?’
‘তোমাকে দেখতে বাবুজির লজ্জা হয় না?’
‘কেন?’ ইন্দু বাবুজির পক্ষ নিয়ে বলল—’তিনি নিজের পুত্রবধূকে দেখে খুশি হয়েছিলেন।’
‘কেন নয়? যখন তোমার মতো সুন্দরী পুত্রবধূ?’
‘তোমার মন নোংরা’, ইন্দু ঘৃণার সঙ্গে বলল—’এই কারণে তো তোমার কারবারও হল দুর্গন্ধ বিরোজার। তোমার বইপত্র সব দুর্গন্ধে ভরা। তুমি আর তোমার বইপত্র–এছাড়া আর কিছু দেখতে পার না। আমি যখন বড় হয়ে গেলাম তখন আমার বাবা আমাকে অনেক বেশি আদর করতে শুরু করেছিলেন। তা হলে কি তিনিও…ছিলেন সেই হতভাগা যার নাম তুমি এখনি নিচ্ছিলে। ইন্দু ফের বলল–’বাবুজিকে এখানে আনিয়ে নাও। ওখানে তার ভালো লাগছে না। তিনি দুঃখী হলে তুমি কি দুঃখী হবে না?’
মদন তার বাবাকে খুবই ভালোবাসত। সংসারে মায়ের মৃত্যুর পর মদনের বড় হবার পেছনে সবচেয়ে বেশি কার্যকর প্রভাব তারই ছিল। সে-কথা মদন ভালো রকমই জানে। মায়ের রোগের শুরু থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছু যখনি মদনের মনে পড়ে যেত তখনি সে চোখ বুজে প্রার্থনা শুরু করে দিত–’ওম্ নম ভগবতে বাসুদেবায়, ওম্ নম…।’ এখন সে চাইছিল না বাপের ছত্রছায়া তার মাথার ওপর থেকে সরে যায়। বিশেষত এই কারণে যে সে এখন পর্যন্ত তার কারবার জমাতে পারেনি। সে অবিশ্বাসের কণ্ঠে ইন্দুকে কেবল এ-কথাই বলেছিল—’এখন বাবুজিকে ওখানেই থাকতে দাও। বিয়ের পর এই প্রথম আমরা দুজনে খুশিমতো এক সঙ্গে মিলতে পেরেছি।’
তৃতীয়-চতুর্থ দিনে বাবুজির অশ্রুসিক্ত চিঠি এল। আমার স্নেহের ‘মদন’ সম্বোধনে ‘আমার স্নেহের’ শব্দ চোখের জলে ধুয়ে গেছে। তিনি লিখেছেন—’বউমা এখানে থাকায় আমার পুরনো দিনগুলো ফিরে এসেছিল–তোমার মায়ের দিন, যখন আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছিল তখন সে-ও ওই রকম বেপরোয়া ছিল। এইভাবেই ছেড়ে-ফেলা কাপড় এদিকে-ওদিকে ফেলে দিত আর আমার পিতাজি তা গুছিয়ে তুলতেন। সেই তো মদনের সিন্দুক, সেই তো হাজার শান্তি…আমি বাজারে যাই, কিছু নয় তো দইবড়া আর রাবড়ি কিনে নিয়ে আসি। এখন ঘরে কেউ নেই। যেখানে চন্দনকাঠের সিন্দুক ছিল সে জায়গা খালি পড়ে আছে…।’ তারপর এক-আধ ছত্র ফের ধুয়ে গেছে। শেষে লিখেছেন–’দফতর থেকে এখানকার বড়-বড় আঁধার কামরায় ফিরে এলে আমার মনের মধ্যে বমির মতো ভাব ওঠে…আর–বৌমার যত্ন কর। তাকে কোনো যে-সে দাইয়ের হাতে সঁপে দিও না।‘
ইন্দু দুই হাতে চিঠি টেনে নিল। দম নিয়ে চোখ টান করে, লজ্জায় গলে যেতে-যেতে বলল–’আমি মরে গেলাম। বাবুজি কী করে বুঝতে পারলেন?’
মদন চিঠিটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল—’বাবুজি কি বাচ্চা ছেলে? দুনিয়া দেখেছেন, আমাদের জন্ম দিয়েছেন…’
‘হ্যাঁ।’ ইন্দু বলল—’এখন কত দিনই-বা হল?’
তারপর সে পেটের ওপর তীক্ষ্ণভাবে নজর দেয়। এখনো বাড়তে শুরুই করেনি, কিন্তু এর মধ্যেই বাবুজি আর কোনো-কোনো মানুষ তা দেখতে পেয়েছে। সে তার শাড়ির আঁচল পেটের ওপর টেনে নিয়ে কিছু ভাবতে থাকে। তার দেহে এক চমক, সে বলে– ‘তোমার শ্বশুরবাড়ি থেকে রনি আসবে।’
‘আমার শ্বশুরবাড়ি?…ও হ্যাঁ।’ মদন পথ খুঁজে পেয়ে বলল–কী লজ্জার কথা! এই ছ-আট মাস মাত্র বিয়ে হয়েছে, এর মধ্যেই চলে এল’–আর হেসে ইন্দুর পেটের দিকে ইশারা করল।
চলে এসেছে, না তুমি নিয়ে এসেছ?
‘তুমি…সব অপরাধ তোমার। কিছু কিছু মেয়েছেলে এরকমই হয়ে থাকে…।’
‘তোমার পছন্দ নয়? ‘একেবারে নয়। ‘কেন?’
‘জীবনের কয়েক দিন তো মজা করে নেয়া যাক।
‘কেন এ বুঝি জীবনের মজা নয়। ইন্দু দুঃখভরা কণ্ঠে বলল–’পুরুষমানুষ বিয়ে করে কিসের জন্যে? ভগবানের কাছে বিনা প্রার্থনায় তিনি দিয়েছেন বলেই তোমার বুঝি পছন্দ হচ্ছে না? যার ছেলেপুলে হয় না তাকে শুধাও। সে কী না করে? পীর-ফকিরের কাছে যায়। সমাধি, মাজারের ওপর পিপড়া খাওয়ায়, লজ্জা-হায়া ছেড়ে, নদীর তীরে উলঙ্গ হয়ে শরভঁটা কাটে, শ্মশানে মশান জাগায়…’
‘আচ্ছা, আচ্ছা।’ মদন বলল–’তুমি তো ব্যাখ্যা শুরু করে দিলে…জীবন কি কেবল বাচ্চার জন্যই?
‘ও যখন আসবে,’ ইন্দু বিষণ্ণভাবে আঙুল তুলে বলল–তখন তুমি তাকে ঘেঁবে না। সে তোমার নয়, আমার হবে। তোমার তাকে দরকার নেই, কিন্তু তার ঠাকুরদাদার খুব দরকার আছে। এ-কথা আমি জানি…।’
আবার কিছুটা শান্ত, কিছুটা দুঃখিত হয়ে ইন্দু দুই হাতে তার মুখ ঢাকল। সে ভাবছিল। যে, তার পেটের মধ্যে এই ছোট্ট প্রাণটিকে পালনের ব্যাপারে তার আপন লোক কেউ থাকলে কিছুটা দরদের সঙ্গে তাকে দেখবে। কিন্তু মদন বসেছিল চুপচাপ। তার মুখ থেকে একটি শব্দও বেরল না। ইন্দু মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে মদনের দিকে তাকিয়ে দেখল আর ভাবী প্রথম সন্তানবতীর ঢঙে বলল–’যা-কিছু বলেছি তা তো পরে হবে, তার আগে দেখ, আমি তো আর বাঁচব না…ছোটবেলা থেকেই এ-কথা আমার মনে হয়…’
মদন ভয় পেয়ে গেল। এই সুন্দর চিজ’ গর্ভবতী হবার পর আরো সুন্দর হয়েছে–এ মরে যাবে? সে পিছন দিক থেকে ইন্দুকে ধরে নিজের দু হাতের মধ্যে নিয়ে এসে বলল– ‘তোমার কিছু হবে না ইন্দু…তোমাকে আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসব…এখন সাবিত্রী নয়…সত্যবানেরই সাধনা’
মদনের সঙ্গে মিশে গিয়ে ইন্দু ভুলে গেল তার নিজের কোনো দুঃখ আছে…
তারপরে বাবুজি আর কোনো চিঠি লেখেননি। হঠাৎ সাহারানপুর থেকে এক সর্টার এল। সে কেবল এ কথাই জানাল যে, বাবুজির ফের হার্ট-অ্যাটাক হয়েছে। এক আক্রমণে তিনি প্রায় মরেই যাচ্ছিলেন। মদন ভয় পেয়ে গেল। কাঁদতে লাগল ইন্দু। সর্টার চলে যাবার পরে কিছুক্ষণ পরপরই মদন চোখ বুজে মনে-মনে পড়তে থাকে–’ওম নম ভগবতে…’ পরের দিন মদন বাপকে চিঠি লিখল–বাবুজি চলে আসুন। বাচ্চারা আপনার কথা খুব মনে করে, আপনার বৌমাও–’, কিন্তু চাকরি তো আছে। আসাটা কি নিজের আয়ত্তে ছিল তার? ধনীরামের পত্র অনুসারে সে ছুটির বন্দোবস্ত করছিল। তার ব্যাপারে মদনের অপরাধবোধ বাড়তে শুরু করল। আমি যদি ইন্দুকে থাকতে দিতাম তা হলে আমার কী ক্ষতি হত?
বিজয়া দশমীর আগের রাতে মদন ছটফট করতে-করতে মাঝের কামরার বাইরে বারান্দায় টহল দিচ্ছিল। তখনি ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজ এল আর সে চমকে উঠে দরজার দিকে দৌড়াল। বেগম দাই বাইরে এসে বলল–
‘বাবুজি খুশি হও…ছেলে হয়েছে।’
‘ছেলে?’ মদন বলল। উদ্বেগের স্বরে ফের জিজ্ঞেস করল–’বউ কেমন আছে?’
বেগম বলল–’ভগবানের দয়ায় ভালো আছে। এখন পর্যন্ত প্রসূতিকে ভালো রেখেছেন। পেটের ছেলে বেশি খুশি হয়ে গেলে ওর পেটের ফুল পড়ত না…’
‘ও। মদন বোকার মতো চোখ মিটকে বলল, আবার কামরার দিকে যাবার জন্যে এগোল। বেগম ওকে সেখানেই থামিয়ে দিয়ে বলল–’অন্দরে তোমার কী কাজ?’ তারপর হঠাৎ দরজা বন্ধ করে চট করে ভিতরে চলে গেল।
তখন পর্যন্ত মদনের পা কাঁপছিল। ভয়ের জন্য নয়, সান্ত্বনায়, আর বোধহয় এজন্য যে, এই দুনিয়ায় কোনো আগন্তুক এলে আশেপাশের লোকের এই অবস্থাই হয়। মদন শুনেছিল যখন ছেলে হয় তখন ঘরের দরজা আর দেয়াল কাঁপে। তখন ভয় হয় যে বড় হয়ে ওই ছেলে আমাকে বেচে দেবে, না রাখবে। মদন অনুভব করল যেন সত্যিসত্যি দেয়ালগুলো কাঁপছে। সূতিকাঘরে চকলি-বৌদি আসেনি, কারণ তার নিজের বাচ্চা খুবই ছোট ছিল। হাঁ, দরিয়াবাদী পিসি অবশ্যই পৌঁছেছিল। বাচ্চার জন্মের সময় সে রাম-রাম রাম-রাম রটনা করতে লাগল। আস্তে-আস্তে সে শব্দও ক্ষীণ হয়ে আসে।
সারা জীবনে আর কখনো মদনের এমন ব্যর্থ আর বেকার বলে মনে হয়নি নিজেকে। এর মধ্যে ফের দরজা খুলে পিসি বেরিয়ে এসেছিল। বারান্দায় বিজলিবাতির মৃদু আলোয় তাকে ভূতের চেহারার মতো একদম দুধ-শাদা দেখাচ্ছিল। মদন তার পথ আগলে বলল–’পিসি, ইন্দু ঠিক আছে, না?’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ পিসি তিন-চারবার বলে নিজের কম্পিত হাত মদনের মাথায় রেখে তাকে নামিয়ে আনল, চুমু খেল আর বাইরে চলে গেল দ্রুত।
বারান্দার দরজা থেকে পিসিকে বাইরে যেতে দেখা গেল। সে বৈঠকখানায় গিয়ে দেখল বাচ্চারা ঘুমিয়েছে। পিসি এক-এক করে প্রত্যেকের মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে ছাদের দিকে চোখ তুলে কিছু বলল, তারপর শ্রান্ত হয়ে খুকির পাশে শুয়ে পড়ল। তার দুটি ঠোঁটের ওঠা-নামা থেকে বোঝা যাচ্ছিল, সে কেমন করে কাঁদছে…মদন বিস্মিত হল…পিসি তো অনেক জায়গায় দিন কাটিয়েছে, তবে কেন আজ তার আত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠছে?
ওদিকের কামরা থেকে ধূনোর গন্ধ এসে ছেয়ে ফেলে মদনকে। বেগম দাই কাপড়ে কিছু জড়িয়ে নিয়ে বাইরে আসে। তাকে দেখে হতভম্ব হয়ে যায় মদন। তার খেয়াল ছিল না সে কোথায় রয়েছে। দু চোখ খুলে তাকিয়েছিল কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। এর মধ্যে ইন্দুর এক মরার মতো আর্তনাদ ভেসে এল—’হা…য়’। আবার বাচ্চার কান্নার শব্দ।
তিন-চার দিনের মধ্যে অনেক কিছু ঘটল। মদন ঘরের এক দিকে গর্ত খুঁড়ে ফুল পুঁতে ফেলল। অন্দরে কুকুরগুলোকে বাধা দিল আসতে। কিন্তু তার কিছুই খেয়াল ছিল না। তার মনে হয়েছিল ধূনোর গন্ধ মাথায় ঢুকে যাবার পর আজই তার হুঁশ ফিরে এসেছে। কামরায় একা সে আর ছিল ইন্দু, নন্দ আর যশোদা–আর অন্যদিকে ছিল নন্দলাল…ইন্দু বাচ্চার দিকে তাকিয়ে দেখে জানবার চেষ্টায় বলল–একেবারে ঠিক তোমার মতোই হয়েছে…’।
হতে পারে।’ মদন বাচ্চার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল–’আমি তো বলছি এ হল ভগবানের দয়া। তুমি বেঁচে গেছ।
‘হ্যাঁ, ইন্দু বলল–’আমি তা বুঝেছি…’
‘শুভ-শুভ বল’, মদন একদম ইন্দুর কথা কেটে দিয়ে বলল–এখানে যা-কিছু হবার হয়েছে, আমি তো তোমার কাছে আসব না।’ একথা বলে মদন দাঁতের তলায় কথা চেপে নিল।
‘চুপ কর।’ ইন্দু বলল।
মদন তা শুনে দু হাতে কান চেপে ধরল আর ইন্দু হাসতে লাগল হালকা আওয়াজে।
ছেলে হবার পর কয়েকদিন পর্যন্ত ইন্দুর নাভি ঠিক জায়গায় আসেনি। সে ফিরে-ফিরে ওই বাচ্চার এমন তদারকি করছিল যে, এর পরে ও বাইরের দুনিয়ায় গিয়ে নিজের আসল মাকে ভুলে গিয়েছিল।
এখন সবকিছু ঠিকঠাক। ইন্দু শান্তির সঙ্গে চারদিকে চোখ তুলে তাকায়। মনে হয়েছিল সে কেবল মদনের নয়, দুনিয়ার সকল অপরাধীকে মাফ করে দিয়েছে, আর লোকের ভালো হবার ওষুধ আর করুণা বিতরণ করছে। মদন ইন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে–এই সব রক্তস্রাবের পর ইন্দু কিছু দুর্বল হয়ে গিয়ে তাকে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। হঠাৎ ইন্দু দু হাত নিজের বুকের উপর রাখল।
‘কী হল?’ মদন শুধায়।
‘কিছু না।’ ইন্দু কিছুটা উঠে বসবার চেষ্টা করে বলল–’ওর খিদে পেয়েছে। বাচ্চার দিকে ইশারা করল ইন্দু।
‘এর–খিদে?’-মদন একবার বাচ্চার দিকে দেখে ইন্দুর দিকে তাকিয়ে বলল–’তুমি কী করে জানলে?’
‘দেখছ না’, ইন্দু নিচের দিকে নজর রেখে বলল–সব ভিজে গেল।’
মদন সতর্কভাবে ইন্দুর ঢিলে-ঢালা বুকের দিকে তাকাল। দুটি স্তনই দুধে ভরে আছে, আর গন্ধ আসছে। ইন্দু বাচ্চার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল–’ওকে আমার কাছে দিয়ে দাও।
মদন কড়াইয়ের আগুনের দিকে হাত বাড়িয়ে তার তাপ নিল। তারপর কিছুটা সাহসের সঙ্গে এগিয়ে বাচ্চাকে তুলে নিল যেন একটা মরা ইঁদুর। শেষ পর্যন্ত ইন্দুর কোলে বাচ্চাকে তুলে দিল। ইন্দু মদনের দিকে তাকিয়ে বলল–’তুমি বাইরে যাও!
‘কেন? বাইরে কেন যাব?’ মদন জিজ্ঞেস করে।
যাও না…’ ইন্দু কিছু গর্বের সঙ্গে, কিছুটা লজ্জিত হয়ে বলল–তোমার সামনে আমি বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারব না।’
‘আরে!’ মদনের বিস্ময় কণ্ঠে–’আমার সামনে খাওয়াতে পারবে না?’ তারপর অবুঝভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বাইরের দিকে চলে গেল। দরজার কাছাকাছি পৌঁছে সে আবার ইন্দুর দিকে তাকাল–আজ পর্যন্ত ইন্দুকে এত সুন্দর লাগেনি।
বাবু ধনীরাম ছুটিতে বাড়িতে ফিরে এলেন। তাঁকে আগের তুলনায় আধখানা দেখাচ্ছিল। ইন্দু তার কোলে বাচ্চাকে তুলে দিলে উনি খুশি হয়ে উঠলেন। তার পেটের ভিতর এমন এক ফোঁড়া হয়েছিল যা চব্বিশ ঘণ্টা তাকে শূলের ওপর চড়িয়ে রাখত। যদি বাচ্চা না-থাকত তবে বাবুজির দশগুণ বেশি খারাপ অবস্থা হত।
কয়েকবার চিকিৎসা করা হল। শেষ চিকিৎসায় ডাক্তার বাবুজিকে আধ আনা মাপের পনেরো-বিশটা গুলি রোজ খেতে দিয়েছিলেন। প্রথম দিনই তার এত ঘাম হয়েছিল যে, দিনে তিন-চারবার কাপড় বদলাতে হত। প্রতিবার মদন কাপড় খুলে নিয়ে বালতিতে নিঙড়াত। কেবল ঘামেই বালতির এক-চতুর্থাংশ ভরে যেত। রাতে তাঁর বমি-বমি ভাব হল আর তিনি চিৎকার করে বললেন–’বউমা, একটা দাঁতন দাও। জিভের স্বাদ বড় খারাপ লাগছে। বউমা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁতন নিয়ে এল। বাবুজি উঠে দাঁতন চিবোতে শুরু করলেন, এমন সময় বমি এল, বমির সঙ্গে রক্তও এল। তাড়াতাড়ি তাকে শিয়রের দিকে শুইয়ে দেয়া হল। তাঁর চোখের মণি উল্টে গেল। আর কয়েকবার দমকের পরেই তিনি আকাশের ফুলবাগানে পৌঁছে গেলেন, সেখানে তিনি নিজের ফুলটি চিনে নিয়েছিলেন।
বাচ্চার জন্ম হবার পর মোটে বিশ-পঁচিশ দিন হয়েছে। ইন্দু মুখ চাপড়ে কপাল আর বুক চাপড়ে বিবর্ণ করে তুলল নিজেকে। মদনের চোখের সামনে ছিল সেই দৃশ্য–যা রোজ তার খেয়ালে নিজের মৃত্যুর পরের দৃশ্য হয়ে উঠেছিল। তফাত এই ছিল যে, ইন্দু চুড়ি ভেঙে ফেলার বদলে খুলে রেখে দিয়েছিল। মাথায় ছাই দেয়নি। কিন্তু জমিতে আছড়ে পড়ে সারা শরীরে মাটি লেগে যাওয়ায় আর চুল ছড়িয়ে পড়ায় চেহারা ভয়ানক হয়ে গিয়েছিল ইন্দুর। সবাই দেখ আমি সব হারিয়েছি’-র বদলে সবাই দেখ আমরা সব হারিয়েছি’—
ঘরের বাইরের কত বোঝা তার ওপর এসে পড়েছিল, তার পুরো আন্দাজ মদনের ছিল না। সবাক থেকেই তার হৃৎপিণ্ড এক লাফে মুখে এসে গিয়েছিল। সে বোধহয় বাঁচতে পারত না যদি সে ঘরের বাইরে নালার ধারে ভিজে মাটির উপর উপুড় হয়ে শুয়ে নিজের হৃদয় নিজের জায়গায় নিয়ে না আসত। ছোট বাচ্চা কুন্দন, খুকি দুলারি আর পাশী এমনই চেঁচাচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল পাখির বাসায় শিক্রে বাজের আক্রমণে পাখির ছানাগুলো ঠোঁট তুলে চি-চি করছে। যদি কেউ তাদের পাখার নিচে সামলে রাখতে পারে তো সে ইন্দু–নালার ধারে পড়ে থেকে মদন ভাবছিল, এখন তো আমার কাছে এ দুনিয়া শেষ হয়ে গেল। কী, আমি কি আর বাঁচতে পারব? জীবনে আর কোনোদিন হাসতে পারব? সে উঠে ঘরের ভিতরে চলে গেল।
সিঁড়ির নিচে ছিল স্নানের ঘর। সেখানে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করতে-করতে মদন ফের একবার এই কথা মনে-মনে আওড়াল : আমি আর কখনো হাসতে পারব? আর সে খিলখিল করে হাসছিল, যদিও তার বাপের মৃতদেহ তখন পর্যন্ত বৈঠকখানায় পড়ে ছিল।
বাপকে আগুনে সঁপে দেয়ার আগে মদন মেজের উপর পড়ে থাকা মৃতদেহের সামনে দণ্ডবতের ভঙ্গিতে শুয়ে পড়েছিল। তার জন্মদাতার কাছে এই ছিল তার শেষ প্রণাম, তখন সে আর কাঁদল না। তার এই অবস্থা দেখে শোকের অংশীদার সব আত্মীয়স্বজন, পাড়ার লোক বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল।
তারপর হিন্দু প্রথা অনুসারে সর্বজ্যেষ্ঠ হবার কারণে মদনকেই চিতায় আগুন দিতে হল। জ্বলন্ত মাথার উপর কপাল-ক্রিয়ার লাঠি মারতে হল। মেয়েছেলেরা বাইরে শ্মশানের কূপের জলে স্নান করে ঘরে ফিরে গেল। যখন মদন ঘরে পৌঁছল তখন সে কাঁপছিল। ধরিত্রী-জননী কিছুক্ষণের জন্য যে শক্তি আপন সন্তানকে দিয়েছিলেন রাত এসে যাবার পর তা বিক্ষিপ্ততায় অবসিত হয়ে গেল… তার কোনো সাহায্য প্রয়োজন ছিল। কোনো এক রকম ভাবনার অনুষঙ্গ যা মৃত্যুর চেয়েও বড়। ওই সময় ধরিত্রী-জননীর কন্যা জনকতনয়া ইন্দু যেন কোনো ঘড়া থেকে জন্ম নিয়ে ওই রামকে নিজের দু-বাহুর মধ্যে টেনে নিল। এ রাতে যদি ইন্দু আপন অস্তিত্ব মদনের ওপর উৎসর্গ করে না-দিত তবে এত বড় দুঃখ মদনকে ডুবিয়ে দিত নির্ঘাত।
দশ মাসের মধ্যেই ইন্দুর দ্বিতীয় সন্তান চলে এল। স্ত্রীকে এই নরকের আগুনে ঠেলে দিয়ে মদন নিজের দুঃখ ভুলে গেল। কখনো কখনো তার মনে হয়েছে আমি যদি বিয়ের পর বাবুজির কাছ থেকে ইন্দুকে ডেকে নিয়ে না-আসতাম তবে বোধহয় এত শীঘ্র তিনি মারা যেতেন না। কিন্তু সে বাপের মৃত্যুতে যে লোকসান হয়েছে তা পূরণ করার কাজে লেগে গিয়েছিল। আগে অযত্নের ফলে কারবার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এ বিষয়ে মদনের বিবশতা চলে গেল।
একদিন বড় ছেলেকে মদনের কাছে রেখে দিয়ে ছোট বাচ্চাকে বুকে নিয়ে ইন্দু বাপের বাড়ি গেল। পরে মুন্না বারবার জিদ করলে মদন কখনো তা মেনে নিত, কখনো নিত না। বাপের বাড়ি থেকে ইলুর চিঠি এল–’আমার এখানে ছেলের কান্নার আওয়াজ আসছে। ওকে কেউ মারে না তো…?’ মদন বড় বিস্মিত হল, এক মূর্খ অশিক্ষিত স্ত্রীলোক … এরকম কথা কী করে লিখতে পারে? ফের সে নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিল–’এ-ও বোধহয় কোনো মুখস্থ-করা কথা।’
এভাবে এক বছর কাটল। কখনো এত আয় হয়নি যে তা দিয়ে কোনো আয়েশ করা যেতে পারে। কিন্তু সংসার-নির্বাহের মতো আয় নিশ্চয়ই হয়ে যেত। কষ্ট হত তখনি যখন কোনো বড় খরচ সামনে দেখা দিত। …কুন্দনকে স্কুলে ভর্তি করানো আছে, দুলারি- মুন্নিকে ভালো দিন দেখে পাঠানো হয়েছে। ওই সময় মদন মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকত, আর ইন্দু একদিক থেকে এসে মুচকি হেসে বলত–কেন দুঃখ করছ? মদন তার দিকে আশাভরা নজরে তাকিয়ে বলত–দুঃখী হবে না? কুন্দনের বি এ ক্লাশে ভর্তি করানো আছে …মুন্নি …’ ইনু ফের হেসে বলত, চল আমার সঙ্গে’–আর মদন ভেড়ার বাচ্চার মতো ইন্দুর পিছনে পেছনে চন্দনের সিন্দুক পর্যন্ত যেত। ওই সিন্দুকে মদন সমেত কারুরই হাত দেয়ার অনুমতি ছিল না। কখনো কখনো এই বিষয়ে ক্ষেপে গিয়ে মদন বলত–মরবে তো ওই সিন্দুক বুকে করে নিয়ে যাবে’, ইন্দু বলত–’হাঁ, নিয়ে যাব। তারপর ওই সিন্দুক থেকে প্রয়োজন মতো অর্থ বার করে রাখত সামনে।
‘এ টাকা কোথা থেকে এল?’
‘কোথাও-না-কোথাও থেকে এসেছে…তোমার আম খাওয়ার মতলব আছে কি…’
‘তারপর?’
আর যখন মদন বেশি জিদ করত তখন ইন্দু বলত–’আমি এক শেঠকে বন্ধু বানিয়েছি …’ বলে হাসতে শুরু করত। একথা মিথ্যা জেনেও মদনের এই মজা ভালো লাগত না। ইন্দু ফের বলত–আমি চোর-ডাকাত …তুমি জানো না, খুব বড় ডাকাত–যে এক হাতে লুঠ করে আর অন্য হাতে গরিব-গুর্বোকে দিয়ে দেয়…’ এই ভাবেই মুন্নির বিয়ে হয়ে গেল–এই বিয়েতে এই রকমই লুটের গয়না বিক্রি হয়ে গেল। ঋণ হল, আবার তা শোধও হয়ে গেল।
এইভাবেই কুন্দনের বিয়ে হয়ে গেল। এইসব বিয়েতে ইন্দু স্ত্রী-আচার পালন করত আর মায়ের ভূমিকায় দাঁড়াত। আকাশ থেকে বাবুজি আর মা দেখতেন ও পুষ্প-বৃষ্টি করতেন, যা কারুর নজরে আসত না। তারপর হল কী স্বর্গে মা-জি আর বাবুজির মধ্যে ঝগড়া হয়ে গেল। মা বাবুজিকে বললেন–’তুমি বউয়ের হাতের রান্না খেয়ে এসেছ, ওর সুখও দেখে এসেছ, আর আমি পোড়াকপালী কিছুই দেখিনি’–আর এই ঝগড়া বিষ্ণু ও শিবের কাছে পৌঁছল। তারা মায়ের পক্ষে রায় দিলেন–আর মা এই মৃত্যুলোকে এসে বউয়ের কোলে আশ্রয় নিলেন–আর এখানে ইন্দুর একটি মেয়ে হল। …
অবশ্য ইন্দু এই ধরনের দেবী ছিল না। যখন কোনো সিদ্ধান্তের কথা হত, ননদ-দেবর তো কী, খোদ মদনের সঙ্গেই ঝগড়া করত–মদন সত্যনিষ্ঠার এই পুতুলের ওপর রাগ করে তাকে ডাকত হরিশচন্দ্রের বেটি। ইন্দুর কথায় প্যাঁচ সত্ত্বেও সত্য আর ধর্ম দৃঢ়ভাবে থাকে বলে মদন আর পরিবারের বাকি সব লোকের দৃষ্টি ইন্দুর সামনে নোয়ানো থাকত। ঝগড়া বেড়ে গেলে, মদন স্বামী হবার গর্বে ইন্দুর কত কথাই রদ করে দিত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সকলেই শির ঝুঁকিয়ে ইন্দুরই শরণ নিত আর তার কাছে ক্ষমা চাইত।
নতুন-বউদি এলেন। বলতে হলে তিনিও বিবি ছিলেন, কিন্তু ইন্দুকেই সকলে বলত বিবি। ছোটবউদি রানিকে সকলে বলত কনে-বউ। রানির কারণে ভাইদের মধ্যে ঝগড়া হয়ে জে. পি. খুড়োর মাধ্যমে সম্পত্তি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল–যার মধ্যে একদিকে মা-বাপের সম্পত্তি আর অন্যদিকে ইন্দুর নিজের তৈরি জিনিসপত্র সব বিক্রি হয়ে গেলে ইন্দুর বুকে প্রবল আঘাত লেগেছিল।
সব-কিছু পেয়ে যাবার পর আর আলাদা হয়ে গিয়েও কুন্দন আর রানি ঠিকমতো সংসার পাততে না-পারায় ইন্দুর নিজের ঘর কিছুদিনের জন্য জমজমাট হয়ে থাকত।
মেয়েটার জন্মের পর ইন্দুর স্বাস্থ্য আগের মতো ছিল না। মেয়েটা সবসময় ইন্দুর বুকে লেগে থাকত। যখন সবাই ওই মাংসপিণ্ডের ওপর থু-থু করছিল তখন এক ইন্দুই তাকে বুকে নিয়ে ঘুরত, কিন্তু কখনো-কখনো নিজেও শ্রান্ত হয়ে মেয়েটাকে সামনের দোলনায় ফেলে দিয়ে বলত–’তুই আমাকে বাঁচতে দিবি কিনা?’
বাচ্চা মেয়ে আরো চেঁচিয়ে উঠত।
মদন ইন্দুকে এড়িয়ে যেত ইদানীং। বিয়ের থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মদন সেই নারী পায়নি যার সন্ধান সে করছিল। দুর্গন্ধ বিরোজা বেশ বিক্রি হচ্ছিল আর ইন্দুর। অজ্ঞাতে মদন অনেক টাকা বাইরে-বাইরে খরচ করতে শুরু করেছিল। বাবুজির মৃত্যুর পর জিজ্ঞেস করার মতো কেউ ছিল না। পুরো স্বাধীনতা ছিল মদনের।
পড়শি সিবতের মোষ ফের মদনের মুখের কাছে ফোঁস-ফোঁস শুরু করে। বিয়ের রাতের সেই মোষ তো বিক্রি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার মালিক ছিল বেঁচে। তার সঙ্গে এমন সব জায়গায় যেতে শুরু করেছিল যেখানে আলো আর ছায়া আজব কায়দার মূর্তি বানাত। কোণের দিকে কখনো আঁধারের ত্রিকোণ তৈরি হত, আবার ওপরে ফট করে আলোর এক চৌকোণ এসে কেটে দিত তাকে। কোনো ছবিই পুরো তৈরি হত না। মনে হত পাশ থেকে এক পাজামা বেরিয়ে এসে আকাশের দিকে উড়ে গেল। কোনো একটা কোট দর্শকের মুখ পুরোপুরি ঢেকে দিত। যদি কেউ শ্বাস নেয়ার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠে তখনি আলোর চৌকোণ এক চৌখুপি হয়ে যেত আর তার মধ্যে এক মূর্তি এসে দাঁড়িয়ে যেত। দর্শক যদি হাত বাড়ায় তবে সে আয়ত্তের বাইরে চলে যায়, আর সেখানে তখন। কিছুই থাকে না। পিছনে কোনো কুকুর কাঁদতে থাকে। উপরে তবলার আওয়াজ ওই কান্নাকে ডুবিয়ে দেয়…
মদন তার কল্পনার আকৃতি পেয়ে গিয়েছিল; কিন্তু প্রত্যেক জায়গাতে মনে হত কোথায় যেন শিল্পীর এক ত্রুটিপূর্ণ রেখা রয়ে গেছে। আর হাসির আওয়াজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত তীক্ষ্ণ হয়ে উঠত, মদন নিখুঁত শিল্পগত ভারসাম্যযুক্ত হাসির খোঁজে হারিয়ে যেত।
ওই বিষয়ে সিবতে নিজের বিবির সঙ্গে কথা বলেছিল। তার বেগম মদনকে আদর্শ স্বামীরূপে পেশ করেছিল সিবতের সামনে। কেবল পেশ করেনি, বরং মুখের ওপর ছুঁড়ে মেরেছিল। তাকে (ঐ আদর্শকে) তুলে নিয়ে সিতেও তার বেগমের মুখের ওপর ছুঁড়ে মেরেছিল। মনে হচ্ছিল তা কোনো তরমুজের ভিতরের অংশ–তার সূতোগুলো বেগমের নাক, চোখ, কানের ওপর লেগে গিয়েছিল। বিস্তর গাল দিতে দিতে বেগম স্মৃতির টুকরি থেকে ওই সব ভিতরের অংশ আর বিচি তুলে নিয়ে ইন্দুর সাফসুতরো আঙিনায় দিয়েছিল ছড়িয়ে।
এক ইন্দুর বদলে দুই ইন্দু হয়ে গেল। এক তো ছিল ইন্দু নিজেই আর দ্বিতীয় হল এক কম্পিত রেখা–যা ইন্দুর পুরো শরীরে থাকে অথচ নজরে আসে না।
মদন কোথাও গেলে দোকান থেকে ফিরে এসে যেত…স্নান করে ভালো কাপড় পরে, খুশবুদার কিমাম-দেয়া এক জোড়া মঘাই পান মুখে রেখে,…কিন্তু ওই দিন মদন যখন ঘরে ফিরে এল তখন ইন্দুর চেহারাই ছিল অন্য রকম। সে তার মুখের ওপর পাউডার মেখেছিল। গালে লাগিয়েছিল রুজ। লিপস্টিক ছিল না বলে মাথার সিঁদুর দিয়ে ঠোঁট রাঙিয়েছিল আর এমনভাবে চুল বেঁধেছিল যে, মদনের নজর তার মুখের ওপর আটকে গেল।
‘আজ কী ব্যাপার?’ মদন বিস্মিত।
‘কিছু না। ইন্দু মদনের নজর বাঁচিয়ে বলল–’আজ অবকাশ মিলেছে।‘
বিয়ের পর পনেরো বছর কেটে যাবার পর ইন্দুর আজ অবকাশ মিলেছে আর তা-ও যখন তার মুখের ওপর ছায়া পড়েছে। নাকের ওপর এক কালির মতো রেখা আর ব্লাউজের নিচে উন্মুক্ত পেটের কাছে কোমরে চর্বির দু-তিনটে স্তর দেখা যাচ্ছে। আজ ইন্দু এমন সাজগোজ করেছিল যাতে তার ত্রুটিগুলোর একটাও নজরে না-আসে। এইসব সাজ-গোজ, আঁটসাঁটভাবে তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। এ হতে পারে না’–মদন ভাবল আর এ-চিন্তা তাকে আঘাত করল। সে আরেকবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ইন্দুর দিকে–যেভাবে ঘোড়ার ব্যাপারি কোনো নামী ঘোড়ার দিকে তাকিয়ে দেখে। যেখানে যে গলদ ছিল মাতালের দৃষ্টিতে তা দেখা যাচ্ছিল না …ইন্দু সত্যিসত্যি সুন্দরী। পনেরো বছর বাদে আজ ফুলো, রশিদা, মিসেস রবার্ট আর তার বোনেরা তার সামনে জল ভরে নিচ্ছে…মদনের মনে দয়া এল, আর এল ভয়।
আকাশে মেঘ ছিল না কিন্তু বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছিল। ঘরের গঙ্গা বাড়তে শুরু করে তার জল কিনার ছাপিয়ে পুরো পার্বত্যভূমি আর পার্শ্ববর্তী বসতিগ্রাম আর শহরগুলোকে আপন গ্রাসের মধ্যে নিয়ে নিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই তীব্র গতিতে স্রোত প্রবাহিত হতে থাকলে কৈলাস পর্বতও ডুবে যাবে। …এদিকে ছোট মেয়েটা কাঁদতে শুরু করল। এমন কান্না সে কাঁদেনি।
মদন তার কান্নার আওয়াজে দু চোখ বন্ধ করে আবার যখন খুলল তখন ছোট মেয়েটা সামনে দাঁড়িয়েছিল–যুবতী হয়ে। না, না…ও তো ইন্দু। আপন মায়ের মেয়ে, আপন মেয়ের মাসে তাকে চোখের কোণে মুচকি হাসি নিয়ে দেখল, ঠোঁটের ফাঁকে হাসি নিয়ে দেখতে থাকল।
এই কামরায় ধুনোর ধোয়ায় একদিন মদনের মাথা ঘুরে গিয়েছিল। আজ ইন্দুর সাজগোজের সুগন্ধ তাকে পাগল করে দিল। হালকা বৃষ্টি ভারি বৃষ্টির চেয়ে বিপজ্জনক হয়ে থাকে। এইজন্য বাইরের জল ওপরের কোনো কড়িতে পড়ে ইন্দু আর মদনের মাঝখানে টপটপ করে পড়তে শুরু করল …কিন্তু মদন তো তখন মাতাল। এই নেশায় তার দু’চোখ ছোট হয়ে আসছিল আর শ্বাস পড়ছিল দ্রুত যেন তা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস নয়।
‘ইন্দু’ মদন বলল … তার কণ্ঠস্বর বিয়ের রাতের কণ্ঠস্বরের দুই গ্রাম ওপরে ছিল। ইন্দু দূরে চোখ মেলে বলল–’জি’, আর তার আওয়াজ ছিল দুই গ্রাম নিচে … আজ ছিল চাঁদনি রাতের বদলে অমাবস্যার রাত…
এর পরে মদন ইন্দুর দিকে হাত বাড়লে ইন্দু নিজেই মদনের সঙ্গে মিশে গেল। ফের মদন আপন হাতে ইন্দুর চিবুক তুলে ধরে দেখল, সে কী হারিয়েছে, কী পেয়েছে? ইন্দু মদনের কালী-হয়ে-যাওয়া মুখের দিকে এক নজর তাকিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে ফেলল … এ কী? মদন চকিত হয়ে বলল–’তোমার দু চোখ ফুলে গেছে।’
‘এমনিই’। ইন্দু ছোট মেয়ের দিকে ইশারা করে বলেছিল–এই হতভাগী আমায় সারা রাত জাগিয়ে রেখেছে…’
মেয়েটা এখন চুপ করে আছে। মনে হচ্ছে দম নিয়ে দেখছে এখন কী হতে পারে? আকাশ থেকে জল পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মদন ফের সযত্নে ইন্দুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল–’হাঁ…কিন্তু এই অশ্রু?’
‘খুশিতে।’ ইন্দু জবাব দিয়েছিল–’আজকের রাত আমার’–ফের এক অদ্ভুত হাসি হেসে সে মদনকে আঁকড়ে ধরেছিল। কেমন এক আনন্দের অনুভূতিতে বলল মদন–আজ অনেক বছর পরে আমার মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হল, ইন্দু। আমি হামেশা চেয়েছিলাম
‘কিন্তু তুমি তো বলনি।’ ইন্দু বলল, মনে আছে, বিয়ের রাতে আমি তোমার কাছে কিছু চেয়েছিলাম?
‘হ্যাঁ–মদন বলল–’তোমার দুঃখ আমাকে দাও।’
‘তুমি তো আমার কাছে কিছু চাওনি।’
‘আমি!’ মদন বিস্মিত হয়ে বলল–’আমি কী চাইব? আমি যা কিছু চাইতে পারতাম সবই তুমি আমায় দিয়েছ। আমার আত্মীয়জনের প্রতি ভালোবাসা–তাদের লেখাপড়া, বিয়েশাদি–এইসব সুন্দর বাচ্চা–এইসব কিছুই তো তুমি দিয়েছ।
‘আমিও তো তাই বুঝতাম।’ ইন্দু বলল–’কিন্তু এখন আমি জানতে পেরেছি, এইসব নয়।’
কী বলতে চাইছ?’
‘কিছু না ইন্দু থেমে গিয়ে ফের বলল—
‘আমি একটা জিনিস রেখেছি।’
‘কী জিনিস রেখেছ?’
ইন্দু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল–’আমার লজ্জা …আমার খুশি … ওই সময় তুমিও তো বলে দিতে পারতে … তোমার সুখ আমাকে দাও … তা হলে আমি …বলতে-বলতে ইন্দুর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল।
আর কিছুক্ষণ পরে ইন্দু বলল–’এখন তো আমার কাছে কিছুই রইল না।
মদনের ধরা-হাত শিথিল হয়ে গেল। সে যেন মিশে গেল মাটিতে–এই অশিক্ষিত স্ত্রীলোক–এ কি কোনো মুখস্থ করা কথা–?
তো … এ তো এখনি তার সামনে জীবনের ভাটি থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন তো তার ওপর বারবার হাতুড়ি পড়ছে আর চারিদিকে উড়ছে আগুনের ফুলকি …।
কিছুক্ষণ পরে মদনের হুঁশ ফিরে এলে সে বলল–’আমি বুঝেছি ইন্দু।’
তারপর কাঁদতে-কাঁদতে মদন আর ইন্দু পরস্পরের সঙ্গে মিশে গেল। ইন্দু মদনের হাত ধরে তাকে এমন দুনিয়ায় নিয়ে গেল যেখানে মানুষ মরে গিয়েই পৌঁছতে পারে।
অনুবাদ : ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
ঠাণ্ডা গোশত – সাদত হাসান মান্টো।
ঈশ্বরসিং হোটেলের কামরায় প্রবেশ করতেই, কুলবন্ত কাউর পালং থেকে উঠে দরজার খিল বন্ধ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। রাত তখন ১২টা। সারা শহরে নীরবতা
কিছুক্ষণ দেখে কুলবন্ত কাউর খাটের উপর ধপাস করে বসে পড়ে। ঈশ্বরসিং বিশ্রী এক চিন্তার ধকল থেকে মুক্তির চেষ্টা করছিল; কৃপাণ হাতে দাঁড়িয়ে ছিল এক কোণে। কিছু সময় কেটে গেল, কুলবন্তের উপবেশনের আসন মনঃপুত হওয়ায় সে দু পা পালং-এর নিচের দিকে ঝুলিয়ে নাড়তে থাকে। তবুও ঈশ্বরসিং-এর মুখে কোনো রা নেই।
কুলবন্ত কাউর মোটাসোটা গড়নের মহিলা। উজ্জ্বল দুটি চোখ। উপরের ঠোঁটে হালকা গোঁফের রেখা। একটু পরখ করলেই বোঝা যায় বড়ই রাশভারি মহিলা। ঈশ্বরসিং মাথা নিচু করে এককোণে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার পাগড়ি খসে পড়ার উপক্রম হয়েছে। হাতের মুষ্ঠিতে ধরে রাখা কৃপাণ ক্রমশ ঝুলে পড়ছে, অথচ তার দেহের গড়ন ও উচ্চতা দেখে মনে হয়, সে একজন সুঠাম দেহের অধিকারী যুবক। কিছুক্ষণ এমনি নীরবতায় অতিক্রান্ত হয়। কুলবন্তের উজ্জ্বল নয়নযুগল নেচে ওঠে। নীরবতা ভঙ্গ করে কুলবন্ত তাকে ডাকে, ঈশ্বর সিয়া।’ ঈশ্বরসিং চোখ তুলে তাকায়। কিন্তু কুলবন্তের তির্যক দৃষ্টির দিকে চেয়ে থাকা তার পক্ষে দুরূহ। তাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
কুলবন্ত চিৎকার করে উঠল, ‘ঈশ্বর সিয়!’ স্বরটা সামলে নিয়ে খাট থেকে উঠে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?’ ঈশ্বরসিং শুষ্কঠোঁটে জিহ্বা ঘষে নিয়ে উত্তর দেয়, আমি জানি না।’ কুলবন্ত রেগে ওঠে, এটা কি কোনো জবাব হল?
ঈশ্বরসিং কৃপাণ একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দেয় এবং খাটে সটান শুয়ে পড়ে। তাকে দেখে মনে হয় সে অনেক দিন যাবত রোগে ভুগছে। কুলবন্ত খাটের দিকে তাকাল, সেখানে ঈশ্বরসিং শুয়ে ছিল। কুলবন্তের মনে সহানুভূতি ও আবেগের সঞ্চার হল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মায়াভরা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে তোমার কী হয়েছে বল তো।’
ঈশ্বরসিং ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর কুলবন্তের দিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখে আর ডাকে, কুলবন্ত। তার কণ্ঠ বিষাদভরা।
কুলবন্তের চোখে প্রেমের আবেগ ফুটে ওঠে, জী, বল’, বলে সে সাড়া দেয়।
ঈশ্বরসিং পাগড়ি খুলে ফেলে। আশ্রয়কাতর দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকায়। মাংসল পেটে জোরে চড় মেরে, মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে বিড়বিড় করে বলে, ‘মাথা বিগড়ে গেছে। মাথায় ঝাঁকুনির ফলে তার চুলের খোঁপা খুলে যায়। কুলবন্ত হাতের আঙুলে স্বামীর চুল আঁচড়াতে থাকে। এমনিভাবে স্বামীর চুলে আঙুল চালিয়ে প্রীতিভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করে, ঈশ্বরসিং, এতদিন কোথায় ছিলে?’ কবিরে’, ঈশ্বরসিং কুলবন্ত কাউরকে ভীরু দৃষ্টিতে দেখতে থাকে এবং দু’হাতে তার দু বাহু জাপটে ধরে বলে, ‘গুরুর দিব্যি, তুমি অত্যন্ত বাজে মেয়ে!
কুলবন্ত কাউর এক পলকে ঝাঁকি দিয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, আমার দিব্যি, বল, কোথায় ছিলে, শহরে গিয়েছিলে?’ ঈশ্বর চুলের খোঁপা তৈরি করতে গিয়ে উত্তর দেয়, কোথাও না।
কুলবন্ত রেগে বলে, তুমি নিশ্চয় শহরে গিয়েছ, বহু টাকা লুট করেছ। এখন আমার কাছে লুকোবার চেষ্টা করছ।’
বাপের জন্ম নই যদি তোমার সঙ্গে মিথ্যে বলি।’ কুলবন্ত চুপসে যায়। কিন্তু আবার হঠাৎ রেগে ওঠে, আমার বোধগম্য হচ্ছে না, সে রাতে তোমার কী হয়েছিল। বেশ ভালোই ছিলে। শহর থেকে লুণ্ঠিত সব অলঙ্কারপত্র আমার পরনে। হঠাৎ কি জানি তুমি উঠে দাঁড়ালে আর জামাকাপড় পড়ে কোথায় বেরিয়ে পড়লে।
ঈশ্বরসিং-এর চেহারা ফ্যাকাশে আকার ধারণ করে। কুলবন্ত তার এই পরিবর্তন দেখে বলে, ‘দেখলে, তোমার চেহারার রঙ কেমন পাল্টে গেল। ঈশ্বর সিয়া, দিব্যি করে বলছি, নিশ্চয় কোনো রহস্য আছে।’
‘তোমার মাথার দিব্যি দিয়ে বলছি, সত্যিই কিছু হয়নি। ঈশ্বরসিং-এর কণ্ঠ প্রাণহীন। কুলবন্তের সন্দেহ আরও সুদৃঢ় হয়, ঠোঁট কামড়িয়ে জোরের সঙ্গে বলে, ঈশ্বর সিয়া, কী ব্যাপার বল তো, আটদিন আগে তুমি যেমন ছিলে এখন তো তেমন নেই।’
ঈশ্বরসিং উঠে বসে। যেন কেউ তাকে হামলা করেছে। কুলবন্তকে পাশে বসিয়ে বলে, কুলবন্ত আমার কোনো পরিবর্তন হয়নি।’
কুলবন্তের অভিযোগ শেষ হয় না, বলে, তুমি সেদিন রাতে বাইরে কেন গিয়েছিলে? জাহান্নামে! বলছনা কেন?’
‘কিছু হলে তো বলব।’
‘আমাকে নিজ হাতে পুড়িয়ে মার যদি মিথ্যে বল।
ঈশ্বরসিং দুই হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে এবং মুখখানি কানের কাছে নিয়ে গিয়ে চুপি-চুপি কী যেন বলে। গোঁফের কেশরাজি কুলবন্তের নাকে প্রবেশ করলে তার হাঁচি পায়। দুজনেই হেসে ওঠে।
ঈশ্বরসিং কুলবন্তকে স্নেহভরা দৃষ্টিতে দেখতে থাকে; এখন অতীতের কথা ভুলে যাও।’
কুলবন্ত কাউরের উপরের ঠোঁটে শিশিরের মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। এক বিচিত্র ভঙ্গিতে চোখের পুতলি ঘুরিয়ে বলে, চল সন্ধি করি।’
ঈশ্বরসিং তার সুডৌল বাহু ধরে জোরে চাপ দেয়। কুলবন্ত কাউর চটপট করে একদিকে সরে পড়ে, ‘সরে যাও ঈশ্বর সিয়া। ব্যথা পাই।’ ঈশ্বরসিং আবার কুলবন্ত কাউরকে পাকড়াও করে পাশে বসায় এবং মিষ্টি আলাপে তার হৃদয় কোমল করার চেষ্টা করে। কুলবন্ত এই ততশামোদে গলে মোম হয়ে যায়।
কুলবন্তের উপরের ঠোঁট মৃদু কাঁপছিল। ঈশ্বরসিং-এর মনে হিংস্রতা জেগে ওঠে। সজোরে তার বাহু ধরে কচলান দিয়ে বলে, কুলবন্ত গুরুজির দিব্যি করে বলছি, তুমি বড় ভালো।’
কুলবন্ত তার বাহুতে চাপ দেয়ার ফলে সৃষ্ট লাল দাগ দেখে বলল, তুমি বড় নিষ্ঠুর ঈশ্বর সিয়া।
ঈশ্বরসিং ঘন কালো গোঁফের আড়ালে মুচকি হাসে, তুমি কোনো অংশে কম নও।’ কুলবন্ত কাউর জ্বলন্ত আগুনে দেয়া কড়াইয়ের মতো জ্বলে ওঠে। অন্যদিকে ঈশ্বরসিং যেন কিসের ভাবনায় মগ্ন। সে কুলবন্তের উপস্থিতি পর্যন্ত ভুলে যায়। কুলবন্ত নিচু গলায় বলে ঈশ্বর সিয়া, তুমি কোন জগতে বিচরণ করছ?’
এ-কথা শুনে ঈশ্বরসিং-এর ধ্যান ভাঙে, যেন হাত থেকে সব তাসগুলো ছিটকে পড়েছে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দেখতে থাকে এদিক-ওদিক। তার মাথায় চুলের গোড়ায় ঘামের প্রলেপ দেখা দেয়। কুলবন্ত কাউর তাকে দৃষ্টি আকর্ষণের বহু চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তারপর খাট থেকে নিচে নেমে রেগে নাসা ফুলিয়ে বলে, ঈশ্বর সিয়া, কোন হারামজাদির কাছে। তুমি এতদিন ছিলে, কে আমার বুক থেকে তোমাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল?
ঈশ্বরসিং পালঙ্কে শুয়ে হাই তোলে। কুলবন্ত কাউর রাগে গরগর করতে থাকে, আমি জিজ্ঞাসা করছি সে কে? কে?’
ঈশ্বরসিং প্রাণহীন কণ্ঠে উত্তর দেয় ‘কেউ না, কুলবত্ত কেউ না।’ কুলবন্ত কোমরে হাত রেখে দৃঢ়তার সঙ্গে বলে, ‘ঈশ্বর সিয়া, আমি আজ সত্য-মিথ্যা যাচাই করবই। গুরুজির দিব্যি করে বল, তোমার কল্পনারাজ্যে কি কোনো নারীর ছবি নেই?
ঈশ্বরসিং কিছু বলার চেষ্টা করে। কিন্তু কুলবন্ত তার সুযোগ না-দিয়েই গর্জন করে ওঠে, কসম খাওয়ার আগে ভেবে দেখ, আমিও সরদার নেহালসিং-এর মেয়ে। মিথ্যা বললে কেটে টুকরো-টুকরো করে ফেলব। নাও, এবার গুরুজির কসম খাও…বলো তোমার চিন্তা-ভাবনা কোনো নারী নিয়ে কিনা?’
ঈশ্বরসিং বেদনার সঙ্গে সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে হ্যাঁ’ বলে। কুলবন্ত মুহূর্তের জন্য পাগল হয়ে যায়। লাফিয়ে গিয়ে ঘরের কোণায় রাখা কৃপাণ তুলে নেয় হাতে। কলার খোসার মতো কৃপাণের কভার ছুঁড়ে ফেলে ঈশ্বরের ঘাড়ের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে।
তড়িৎ ফিনকি দিয়ে রক্তের ফোয়ারা ছোটে।
এতেও কুলবন্তের সাধ মেটে না। ঈশ্বরের চুলের জটা ধরে টানতে-টানতে অশ্লীল ভাষায় সেই অদৃশ্য নারীকে তিরস্কার করতে থাকে। ঈশ্বরসিং কিছুক্ষণ পর দুর্বল কণ্ঠে আবেদন জানায়, কুলবন্ত ওসব ভুলে যাও।’ তার কণ্ঠে বেদনার অতলান্ত ছায়া। কুলবন্ত কাউর পেছনে সরে দাঁড়ায়। ঈশ্বরসিং-এর গলায় কৃপাণের আঘাতে সৃষ্ট ক্ষত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়িয়ে তার গোঁফের ওপর এসে পড়েছে। রক্তাক্ত ঈশ্বরসিং কৃতজ্ঞতা ও অভিযোগের মিশ্ৰদৃষ্টিতে কুলবন্তের দিকে চোখ তুলে তাকায়; কুলবন্ত, তুমি এত তাড়াতাড়ি এমন কাজ করলে! যাক যা হওয়ার হয়ে গেছে। কুলবন্ত আবার রেগে ওঠে, কিন্তু সে তোমার কোন আত্মীয়া বল?’ এবার রক্ত ঈশ্বরসিং-এর মুখে এসে পড়ে। রক্তের স্বাদ জিহ্বায় অনুভব করে। তার সারা দেহ শিউরে ওঠে। আর আমি … আমি এই কৃপাণ দিয়ে … ছয় জনকে খুন করেছি।’ মনে-মনে উচ্চারণ করে ঈশ্বরসিং।
কুলবন্তের মাথায় শুধু দ্বিতীয় মহিলার ছবি, আমি জিজ্ঞেস করছি কে সেই হারামজাদি?’ ঈশ্বরসিং-এর চোখ ঢুলুঢুলু করছিল। তার মুখ হালকা উজ্জ্বল দেখায়, সে কুলবন্তকে বলে, সেই নিপাপকে তিরস্কার কর না।’ কুলবন্ত চিৎকার করে ওঠে, আমি জানতে চাই, সে কে?
ঈশ্বরসিং-এর গলার স্বর জড়িয়ে আসে, ‘বলছি’। এরপর ঘাড়ে হাত বুলিয়ে তাজা রক্ত দেখে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। মানুষও এক বিচিত্র জীব।
কুলবন্ত তখনও তার উত্তরের প্রতীক্ষায় ছিল; ‘ঈশ্বর সিয়া, তুমি কাজের কথা বল। ঈশ্বরসিং রক্তাক্ত গোঁফের ফাঁকে আবার মুচকি হাসে, কাজের কথাই বলছি। আমার গলা ধরে আসছে–এখন ধীরে-ধীরে সব কথাই বলব।’ কথা বলার সময় তার মাথায় চুলের গোড়ায় শীতল ঘামের প্রলেপ দেখা দেয়।
‘কুলবন্ত, আমার প্রিয় … আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না, আমার কী হয়েছে? মানুষ এক বিচিত্র জীব। শহরে লুটতরাজের সময় আমিও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। গহনাপত্র ও টাকা যা লুট করে এনেছি, সব তোমার হাতে দিয়েছি। কিন্তু একটা কথা তোমাকে বলিনি।’ ঈশ্বরসিং কাটা ঘায়ের ব্যথায় ঝাঁকিয়ে ওঠে। কুলবন্ত কাউরের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই–বরং রূঢ়কণ্ঠে আবার প্রশ্ন করে, ‘কোন কথা?’
গোঁফে জমে যাওয়া রক্ত ফুঁ দিয়ে অপসারণ করে ঈশ্বরসিং বলে, ‘যে-বাড়িতে…আমি লুঠতরাজের মানসে প্রবেশ করেছিলাম…সেখানে সাতজন লোক ছিল। ছয়জনকে আমি খুন করি এই কৃপাণ দিয়ে; যেটা দিয়ে তুমি আমাকে … বাদ দাও সে সব কথা … শোনো … একটি সুন্দরী মেয়ে … তাকে তুলে আমি সঙ্গে নিয়ে আসি।’
কুলবন্ত কাউর নীরবে শুনতে থাকে। ঈশ্বরসিং আরেকবার ফুঁ দিয়ে গোঁফে জমাট রক্ত দূর করে বলে, কী বলব, দারুণ সুন্দরী মেয়েটি …তাকেও হত্যা করতাম। কিন্তু হায় …আমি তার রূপে মজে যাই।’ কুলবন্ত শুনে বলে, হু। এবং আমি তাকে তুলে নিয়ে চলতে থাকি রাস্তায় …কী জানি বলছিলাম? হ্যাঁ, রাস্তায় …নদীর তীরে একটি বৃক্ষের ছায়ায় তাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখি।’ এ কথা বলতে বলতে ঈশ্বরসিং-এর। গলা শুকিয়ে আসে।
কুলবন্ত ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিয়ে বলে, তারপর কী হল?
ঈশ্বরসিং অতিকষ্টে ধীরকণ্ঠে বলে, কিন্তু…তার স্বর তলিয়ে যায়; কুলবন্ত কাউর ধমক দিয়ে বলে, তারপর কী হল?
ঈশ্বরসিং তার বুজে আসা চোখ মেলে কুলবন্তের দিকে তাকায়; তার দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রাগে থরথর করে কাঁপছে। আসলে সে…মরে গিয়েছিল, সেটা ছিল তার মৃত লাশ…যেন ঠাণ্ডা গোশত…! কুলবন্ত আমাকে তোমার হাত ধরতে…দাও।’
কুলবন্ত কাউর নিজের হাত ঈশ্বরসিং-এর হাতে রাখে, তখন তার হাত বরফের চেয়ে অধিক ঠাণ্ডা, যেন ঠাণ্ডা গোশত।
আনন্দী – গোলাম আব্বাস
মিউনিসিপ্যালিটির সভা বেশ জমেছে। হল লোকে পরিপূর্ণ। অন্যান্য দিনের সাধারণ নিয়ম ভঙ্গ করে প্রতিটি সদস্য আজ উপস্থিত রয়েছেন। আলোচনার বিষয়–শহরের মধ্যস্থলে অবস্থিত বেশ্যাদেরকে শহর থেকে অপসারণ করা। কারণ, এরা মানবতা, সংস্কৃতি আর আভিজাত্যের পরিচ্ছন্ন পরিবেশে কলঙ্কের মতো বিরাজ করছে।
মিউনিসিপ্যালিটির একজন গম্ভীর সদস্য–যিনি নিজেকে দেশ আর জাতির খাঁটি খাদেম বলে দাবি করেন–অত্যন্ত জ্বালাময়ী ভাষায় বললেন–’ভদ্রমহোদয়গণ, একবার তাদের অবস্থিতি লক্ষ করুন। এটা যে শুধু শহরের মধ্যস্থল তা নয়, বরং এটা শহরের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র; অতএব প্রতিটি সম্মানিত ব্যক্তিকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও এই পথ দিয়ে চলাফেরা করতেই হয়। উপরন্তু অভিজাত ব্যক্তিবর্গের পুণ্যশীলা স্ত্রী-কন্যারা বিকিকিনির জন্য অহরহ এখানে আসতে বাধ্য হন। এসব নির্লজ্জ, অর্ধউলঙ্গ বেশ্যাদের সাজ-পোশাকের চাকচিক্য দেখে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনেও নানারকম রঙিন-রঙিন আকাঙ্ক্ষা মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ায়, আর ঘরে ফিরে এসে তাঁদের দরিদ্র স্বামীদের ওপর বিভিন্ন প্রসাধন দ্রব্য, নিত্যনতুন শাড়ি ইত্যাকার অনেক জিনিসের জন্য পীড়াপীড়ি করেন। ফলে সুখী-স্বচ্ছন্দ পরিবারগুলো অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়। ভদ্রমহোদয়গণের অবগতির জন্য আমি আরো একটি জিনিসের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমাদের কচি ছেলেরা জাতির ভবিষ্যৎ। জাতি তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে। জাতিকে কালের ঘূর্ণাবর্ত থেকে উদ্ধার করার দায়িত্ব এদেরই। এইসব ছেলেদের সকাল-সন্ধ্যা এই রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়। এসব বেশ্যারা সবসময় রকমারি মনমাতানো সাজ পরে। লোভনীয় প্রসাধনীর আবরণে নিজেদের ঢেকে সবাইকে রূপচর্চায় আমন্ত্রণ জানায়। এসব দেখেশুনে আমাদের অপরিণামদর্শী, আত্মভোলা ছেলেরা যৌবনের উন্মাদনায় বিহ্বল হয়ে নিজেদের এর ভেতর জড়িয়ে ফেলে। এ-অবস্থায় তাদের পক্ষে নিজেদের সৎস্বভাবকে পাপের বিষাক্ত ছোবল থেকে সরিয়ে রাখা কি সম্ভব? অতএব মহোদয়গণ, এসব রূপোপজীবীরা কি এদের জাতি গঠনমূলক কাজ থেকে বিমুখ করে তাদের মনে পাপ-বাসনা সৃষ্টি করে তাদের একটা বিশ্রী ব্যাকুলতা, চাঞ্চল্য আর উত্তেজনার শিকারে পরিণত করছে না?
এই সুযোগে যোগ-বিয়োগে সিদ্ধহস্ত একজন প্রাক্তন শিক্ষক বললেন–মহোদয়গণ, মনে রাখবেন–পরীক্ষায় ফেলের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় এবার দেড় গুণ বেড়ে গেছে।
অতঃপর একজন চশমাধারী সদস্য উঠলেন। তিনি একখানা সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক। বললেন–’আমাদের শহর থেকে দিন-দিন মর্যাদাবোধ, আভিজাত্য, পৌরুষ, পুণ্যশীলতা আর সংযম যাচ্ছে উঠে। এর বদলে হীনমন্যতা, কাপুরুষতা, বদমায়েশি, চৌর্যবৃত্তি বেড়ে যাচ্ছে। মানুষ দিন-দিন ধ্বংসের দুর্গম অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলেছে। হত্যা, লুণ্ঠন আর আত্মহত্যার ভেতর দিয়ে মানুষের এই রূপ প্রকট হয়ে উঠছে। এর একমাত্র কারণ এসব অস্পৃশ্য নারীদের আত্মঘাতী প্রভাব। আত্মভোলা শহরবাসীরা এসব ছলনাময়ী নারীদের রূপের শিকার হয়ে সিদ্ধ-অসিদ্ধ যে কোনো উপায় টাকা সংগ্রহ করে এদের পেছনে ঢালছে। মাঝে-মাঝে এ ব্যাপারে তারা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে, তারা মনুষ্যত্ববোধ পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে বসে, ফলে হয় তারা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দেয়, অথবা জেলখানার চার দেয়ালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।
একজন পেনশনপ্রাপ্ত সদস্য উঠলেন। তিনি একটি বিস্তৃত আর উন্নত বংশের পৃষ্ঠপোষক। পৃথিবীর ভাব ও মিঠেকড়ার সঙ্গে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। এখন জীবনের শেষপ্রান্তে এসে অবশিষ্ট দিনগুলো একটু আরাম-আয়েশে কাটিয়ে দিতে চান এবং বংশধরদের নিজের পক্ষপুটে উন্নত আর উদ্ধত দেখে যেতে চান। তিনি অত্যন্ত আবেগময়ী ভাষায় বললেন–জনাব, রাতের পর রাত এদের তবলার ডুগডুগি, গলাবাজি, এদের গ্রাহকদের হৈ-হল্লা, গালিগালাজ, শোরগোলের প্রচণ্ড শব্দ শুনতে-শুনতে আশেপাশের ভদ্রলোকদের কানে তালা লাগার উপক্রম হয়েছে। রাতের নিদ্রা, দিনের বিশ্রামকে পণ্ড করে প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুলেছে এরা। উপরন্তু এদের সর্বগ্রাসী প্রভাবে আমাদের বৌ-ঝিরা কীভাবে প্রভাবিত তা সকলেই অনুমান করতে পারেন…।’ শেষের অংশটুকু বলতে তার গলার শব্দ আবেগে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। ফলে তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বের হল না। সকল সদস্যেরই তার প্রতি গভীর সহানুভূতি ছিল। কারণ দুর্ভাগ্যবশত তার প্রাচীন বাড়িটি এসব রূপোপজীবীদের এলাকার একেবারে নিকটে।
এরপর একজন রক্ষণশীল সদস্য দণ্ডায়মান হলেন। রক্ষণশীলতা তাঁর কাছে নিজের সন্তান-সন্ততির মতোই প্রিয়। তিনি বললেন–’বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক ভ্রমণকারী আমাদের এই প্রসিদ্ধ শহর পরিদর্শনে আসেন। এসব দেখার পর তাদের মনে কী ধারণা জন্মে তা একবার ভেবে দেখুন।’
এবার মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান বক্তৃতা করতে উঠলেন। কাঠখোট্টা গোছের এই ভদ্রলোকটির ছোট-ছোট হাত-পা। কিন্তু তার মাথাটা বেশ বড়-সড় বলে খানিকটা গম্ভীর দেখায়। তিনি বললেন–বন্ধুগণ, এ-ব্যাপারে আংশিকভাবে আপনাদের সঙ্গে আমি একমত। সত্যিই এদের জন্যে আমাদের শহর, আমাদের সংস্কৃতি দারুণ সংকটের মুখোমুখি। কিন্তু মুশকিল বাধছে এর প্রতিকার নিয়ে। যদি এদের এই নীচ ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয় তা হলে প্রশ্ন উঠবে–এরা খাবে কী করে?
একজন সদস্য প্রশ্ন করলেন–’এরা বিয়ে করে না কেন?’
এ প্রশ্নে একটা তরল হাসির রোল উঠল। হলের থমথমে ভাব এতে বেশ খানিকটা লঘু হয়ে হলের প্রতিটি মানুষের মুখমণ্ডলে একটা সরস ভাব ফুটে উঠল।
অবস্থা খানিকটা শান্ত হলে সভাপতি সাহেব বললেন–বন্ধুগণ এই প্রস্তাব ইতিপূর্বে অনেকবার এদের সামনে তোলা হয়েছে। তাদের তরফ থেকে জবাব এসেছে–কোনো অভিজাত বংশের গৃহে এরা বধূ হিসেবে প্রবেশাধিকার পাবে না। আর যেসব দরিদ্র, নীচ বংশের লোক অর্থের লোভে এদের বিয়ে করতে চাইবে তাদের এরা পাত্তা দেবে না।’
এ কথা শুনে জনৈক সদস্য বললেন–এসব ব্যাপারে সদস্যদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই। তারা যেখানেই থাক-না কেন, আমাদের দায়িত্ব হল তাদের এই শহর থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া।’
সভাপতি বললেন–সেটিও অত সোজা কাজ নয়। এরা তো আর দশ-বিশ জন নয়, হাজারের ওপর এদের সংখ্যা। উপরন্তু এদের মধ্যে অনেকের নিজস্ব বাড়িঘরও রয়েছে।
ব্যাপারটি বেশ কয়েকমাস যাবত মিউনিসিপ্যালিটির আয়ত্তাধীনে থাকল। শেষে সদস্যদের সম্মিলিত মতে সাব্যস্ত হল যে, এসব দেহপসারিণীদের জায়গা-সম্পত্তি খরিদ করে নেয়া হবে এবং শহর থেকে বেশ দূরে পুনর্বাসন করা হবে এদের। মিউনিসিপ্যালিটির এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বেশ্যাদের ভেতর প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হল। অনেকে এই আদেশ অমান্য করে জরিমানা এবং জেল পর্যন্ত ভোগ করল। তবুও মিউনিসিপ্যালিটির বিরুদ্ধে তাদের কোনো দাবি টিকল না। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে মেনে নিতেই হল এই সিদ্ধান্ত।
এরপর অনেকদিন কেটে গেল এসব বাড়ির সীমানা নির্ধারণ আর গ্রাহক ঠিক করতে। বারবার এসব বাড়ি নিলামে উঠতে শুরু করল। বেশ্যাদের ছয়মাস পর্যন্ত তাদের পুরনো বাড়িতে থাকার অনুমতি দেয়া হল যাতে এই সময়ের মধ্যে ওরা নতুন স্থানে বাড়িঘর তুলবার সময় পায়।
.
শহর থেকে ছয় ক্রোশ দূরে এদের জন্য স্থান নির্বাচন করা হল। পাঁচ ক্রোশ পর্যন্ত পাকা রাস্তা, বাকি ক্রোশখানেক পথ কাঁচা। কোনোকালে হয়তো-বা এখানে জনবসতি ছিল কিন্তু এখন তার ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সাপ-বাদুড়ের দল এখানে বাসা বেধেছে। এই এলাকার কাছেই একটি গ্রাম। কাঁচা ছোট-ছোট বাড়িঘর। তা-ও এখান। থেকে দু-আড়াই মাইলের কম হবে না। এ গাঁয়ে যারা থাকে তারা সকলেই প্রায় কৃষক। ওরাই দিনের বেলায় ক্ষেত-খামারের কাজে বা এমনি ঘুরতে-ফিরতে এদিকে আসে। অন্যথায় সমগ্র জায়গাটাই গভীর নির্জনতার ভেতর ডুবে থাকে। এমনকি দিনে-দুপুরেও এখানে শৃগালের উপদ্রব দেখা যায়।
বেশ্যাদের মধ্যে চৌদ্দজন বেশ অবস্থাসম্পন্ন। তাদের পক্ষে যে কোনো কারণে সে নিজেদের প্রেমিকদের মনোরঞ্জনে অপারগ হয়ে হোক বা নিজেদেরই আত্মতুষ্টির তাগিদে হোক–শহরের আশেপাশে থাকা দুরূহ হয়ে পড়ল। অন্যান্যরা মনে করেছিল তারা শহরের বিভিন্ন হোটেলেই নিজেদের আস্তানা গেড়ে বসবে অথবা বাইরে ভদ্রবেশ ধারণ করে ভেতরে ভেতরে শহরের অভিজাত অঞ্চলে থেকে যাবে, অথবা অন্য কোনো শহরে চলে যাবে।
এই চৌদ্দজন বেশ্যা সত্যি-সত্যি অবস্থাসম্পন্ন। তার ওপর শহরের বাড়িঘরের দাম তারা উশুল করেই ফেলেছে, নতুন স্থানে জলের দরে জায়গাও পেয়েছে। উপরন্তু তাদের। প্রেমিকরাও মনে-প্রাণেই তাদের আর্থিক সাহায্য করতে প্রস্তুত। অতএব এখানে তারা মনোমতো অট্টালিকা তৈরি করতে মনস্থ করল। ভাঙাচোরা কতকগুলো কবর থেকে দূরে সমতল একখানা উঁচু স্থান ঠিক করল তারা। জায়গা পরিষ্কার করে নকশা-তৈরি করা হল। দিনকতক পরই শুরু হয়ে গেল নির্মাণের কাজ।
প্রত্যেকদিন ইট, মাটি, কড়িকাঠ ইত্যাদি ট্রাক, ঠেলাগাড়ি, খচ্চর, গাধা, মানুষ ইত্যাদির উপর বোঝাই হয়ে আসতে লাগল এখানে। মুন্সি তার খাতাপত্র নিয়ে এসব জিনিস গুণে-পড়ে খাতায় লিখতে লাগল। কন্ট্রাক্টর মাঝিদের আর মাঝিরা কুলিদের ফরমাস দিতে লাগল বিভিন্ন কাজে। বিভিন্ন কাজে কুলিরা মাঝিদের চড়া গলার নির্দেশ মতো কাজ করার জন্য চারদিকে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল। মোটের ওপর সমগ্র এলাকায় নতুন প্রাণস্পন্দন জাগল। গাঁয়ের কিষাণ আর বধূরা লোহালক্কর, ইট-পাটকেলের নতুন শব্দ শুনতে পেল।
এই ধ্বংসাবশেষের ভেতর একটা ভাঙাচোরা মসজিদের চিহ্নও ছিল। তার পাশেই একটা কুয়ো–যা আজ অকেজো পড়ে আছে। রাজমিস্ত্রিরা নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদে বা নামাজিদের সুবিধার জন্য প্রথমেই পরিষ্কার করল কুয়োটা। এটির প্রয়োজন ছিল আর পুণ্যের কাজ বলেও এ ব্যাপারে কেউ কোনো প্রতিবাদ করল না। দু-তিন দিনের ভেতর তৈরিও হয়ে গেল মসজিদ।
প্রত্যেকদিন বেলা বারটার সময় দুশ-আড়াইশ রাজমিস্ত্রি, কুলি, কন্ট্রাক্টর, মুন্সি আর বেশ্যাদের আত্মীয়-স্বজনেরা এসে জড়ো হতে লাগল। এই সময় স্থানটি সরগরম থাকত বেশ কিছুক্ষণের জন্য।
একদিন পার্শ্ববর্তী কোনো গ্রামের একজন বৃদ্ধা কৃষাণী এই বস্তির খবর পেয়ে বেড়াতে এল এখানে। তার সঙ্গে ছোট একটা ছেলে। এরা মসজিদের পার্শ্বে পান-বিড়ি ও ঘরে তৈরি বিভিন্ন রকম মিষ্টি বিক্রি শুরু করে দিল। বৃদ্ধাটির আগমনের পর দিনকতক যেতে-না-যেতেই এক বৃদ্ধ কিষাণ মাটির মটকা নিয়ে হাজির হল জায়গাটায়। আর কুয়ার পাশে ইটের চত্বর তৈরি করে পয়সায় দু’গ্লাস করে শরবত বিক্রি করতে শুরু করে দিল। একজন তরকারি-বিক্রেতা এই খবর পেয়ে একঝুড়ি ফলমূল নিয়ে বসে গেল বৃদ্ধার পাশে আর বিভিন্ন ভাব-ভঙ্গিমায় চিৎকার করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগল। একজন বাড়ি থেকে বিভিন্ন রকম খাবারের জিনিস রান্না করে এনে মজুরদের ভেতর থালাবাটিতে করে পরিবেশন করতে লাগল।
জোহর এবং আসরের সময় কন্ট্রাক্টর আর মাঝিদের কুলিদের সাহায্যে কুয়া থেকে পানি তুলে ওজু করতে দেখা যেতে লাগল। মসজিদে গিয়ে আজান দিত একজন। অতএব ইমাম তৈরি করা হল একজনকে। অন্যান্য সবাই তার পেছনে দাঁড়িয়ে নিয়মিত নামাজ পড়তে লাগল। পার্শ্ববর্তী গ্রামের একজন মোল্লার কানে এই খবর গিয়ে পৌঁছল। খবর পেয়েই তিনি কোরআন শরীফ, পাঞ্জসুরা ইত্যাদি সহ আরো কিছু ছোটখাট কিতাবপত্র নিয়ে এখানে এসে হাজির হলেন। অতঃপর আনুষ্ঠানিকভাবে তার ওপর ইমামতির দায়িত্বভার অর্পণ করা হল।
প্রতিদিন তৃতীয় প্রহর নাগাদ একজন কাবাবি মাথায় একটা টুকরি নিয়ে হাজির হত এখানে। সে প্রথম বৃদ্ধার পাশে মাটিতে একটি উনুন তৈরি করল; তারপর শিকে ভেজে কাবাব, কলিজা ইত্যাদি বিক্রি করতে লাগল মজুরদের ভেতর। এক কিষাণী এসব কাণ্ড দেখে-শুনে তার স্বামীকে নিয়ে হাজির হল এখানে। রোদ থেকে বাঁচার জন্যে মসজিদের পাশে একখানা ছোট্ট কুটির তৈরি করে গরম করতে লেগে গেল উনুন। কখনো-কখনো গ্রাম্য ক্ষৌরকারকে তার সাজ-সরঞ্জাম সমেত আনাগোনা করতে দেখা গেল।
বেশ্যাদের আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবরাই সাধারণত নির্মাণকার্য দেখাশোনা করত। কোনো-কোনোদিন দ্বিপ্রহরের দিকে নিজ-নিজ কাজ সেরে তারাও নিজ-নিজ প্রেমিকদের সাথে নিয়ে এখানে আসত আর চলে যেত সূর্যাস্তের আগে। এই সময় বেশ কিছু দরিদ্র লোক এসে জুটত। তারা যতক্ষণ পর্যন্ত-না কিছু পেত ততক্ষণ এমন নাকি কান্না চালিয়ে যেত যে, সবার পক্ষে সাধারণ আলাপ-আলোচনা করা দুরূহ হয়ে পড়ত। শহরের কিছুসংখ্যক লম্পট বসে থাকার চাইতে কিছু অকাজ করাও ভালো এই ধারণার বশবর্তী হয়ে এখানে এসে ভিড় জমাতে লাগল। তাদের আগমনের দিন বেশ্যারা এসে পড়লে তো আর কথাই নেই। তারা বেশ্যাদের কাছ থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে টহল দিতে থাকত। সেদিন বেশ জমে উঠত কাবাবের দোকান।
এ সব দেখে-শুনে–কিছুসংখ্যক ভণ্ড সাধু–বেশ্যাদের কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে মিতালি জমিয়ে তুলতে লাগল।
এই বস্তির পাশেই ছিল একখানা ভাঙাচোরা মাজার। দেখলে মনে হবে, হয়তো কোনো সিদ্ধপুরুষের মাজার। সে-মাজারেরও একদিন সংস্কার শুরু হয়ে গেল। মাজার সংস্কারের কাজ যখন অর্ধেকের চাইতেও বেশি এগিয়ে গেল তখন এক প্রভাতে মজুরেরা দেখল মাজারের পাশ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। ব্যাপার কী? সবাই দেখল লাল-লাল একজোড়া চোখ নিয়ে একজন লম্বাচওড়া অর্ধপাগল আর অর্ধউলঙ্গ মানুষ মাজারের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে আর ছোট-ছোট অঙ্গার নিক্ষেপ করছে এদিক-সেদিক। দ্বিপ্রহর নাগাদ সে লোকটা কলসি নিয়ে কুয়ার পাড়ে এল। জল তুলে মাজার ধোয়ার কাজে লেগে গেল। একবার সে কুয়ার পাড়ে কিছু মজুরের সাক্ষাৎ পেল। তাদেরকে দেখে আধ-পাগলের মতো লোকটা নির্লিপ্তভাবে বলল–’জান, এটা কার মাজার? ফড়ক শাহ পীর বাদশার মাজার এটা। আমার বাপ-দাদা তার খাদেম ছিলেন। এরপর সে হাসতে-হাসতে চোখের জল ফেলল কিছুক্ষণ আর ফড়ক শাহের কিছু কেরামতি মজুরদের কাছে বর্ণনা করল।
সন্ধ্যায় সে খুঁজে-মেগে জোগাড় করল মাটির একটি বাতি। তেল ভরে সেটি মাজারে জ্বেলে দিল। এর পর থেকে শেষরাতের দিকে মাঝে-মাঝে মাজার থেকে আল্লাহু’ শব্দ বাতাসে-বাতাসে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
ছ মাস যেতে-না-যেতেই চৌদ্দটি বাড়ি তৈরি হয়ে গেল। সবগুলো বাড়ি পাশাপাশি, দ্বিতল এবং একই ধরনের। একদিকে সাতটি অপর দিকে সাতটি। মাঝখানে চওড়া রাস্তা। প্রতিটি বাড়ির নিচের তলায় চারখানা করে দোকানঘর। ওপরের তলার সামনের দিক বাইরের দিকে উন্মুক্ত। জায়গাটাকে বিভিন্ন রকম দামি পাথরের কারুকার্য করে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হল। এর পেছনেই বেশ বড় ড্রইংরুম। চারদিকে সুন্দর কারুকার্যে পরিপূর্ণ। সুন্দর লাল রঙের চকচকে পাথরের মেঝে। মোটের ওপর অত্যন্ত পরিপাটিভাবে সম্পূর্ণ বাড়িগুলো সজ্জিত।
বুধবার এই গ্রামে স্থায়ীভাবে পদার্পণের দিন ধার্য করা হল। সেদিন বেশ্যারা মিলে বেশ ধুমধামের সঙ্গে উৎসব করল। খোলা মাঠে জমি পরিষ্কার করে টাঙানো হল সামিয়ানা। ডেকচির ঘড়ঘড় শব্দ, মাংস আর ঘৃতের সুঘ্রাণ পার্শ্ববর্তী সুদূর এলাকা থেকে ভিক্ষুক আর কুকুরদের আকর্ষণ করে নিয়ে এল। পীর ফড়ক শাহের মাজারের পাশেই খাদ্য বিতরণ করা হল। অনেক ভিক্ষুক জমা হয়ে গেল দুপুর নাগাদ। পীর ফড়ক শাহের মাজারকে চমৎকারভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হল, তার ওপর জড়িয়ে দেয়া হল ফুলের চাদর। অর্ধ-পাগল লোকটিকে নতুন কাপড় তৈরি করে দেয়া হলে সে পরেই তা ছিঁড়ে ফেলল।
সন্ধ্যায় সামিয়ানা টাঙিয়ে উজ্জ্বল আলোয় স্থানটিকে আলোকিত করা হল। বেশ জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে বস্তিটির উদ্বোধন পর্ব সমাপন করা হল। দূর-দূরান্তর থেকে অন্যান্য বেশ্যাদের আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। এরা স্থানীয়দের আত্মীয়-স্বজন। এদের বন্ধু-বান্ধবেরাও এল এদের সঙ্গে। তাদের জন্য আলাদাভাবে বসার বন্দোবস্ত করা হল। অসংখ্য গ্যাসবাতির আলোয় ঝলমল করে উঠল স্থানটি।
উৎসব চলল দু’তিন দিন যাবৎ। এবার বেশ্যারা বাড়িঘর সাজানোর কাজে মনোনিবেশ করল। ঝাড়লণ্ঠন, ড্রেসিং টেবিল, সুদৃশ্য পালঙ্ক এবং বিভিন্ন প্রকার চিত্র লাগিয়ে ভেতর-বাহির সজ্জিত করতে প্রায় আট দিন লেগে গেল।
এসব মেয়েরা দিনের বেশিরভাগ সময়ে শিক্ষকদের কাছে গান, বাজনা, গজল পাঠ, লেখাপড়া ইত্যাদি শিখত। অন্য সময়ে গ্রামোফোন, তাস, কেরাম ইত্যাদি নিয়ে মেতে থাকত। এরপর প্রত্যহ স্নানাগারে গিয়ে চাকর দিয়ে ভোলা জলে গোসল সেরে সাজসজ্জায় মেতে উঠত। এটি তাদের প্রাত্যহিক নিয়মে পরিণত হল।
রাতের অন্ধকার নামার সঙ্গে-সঙ্গেই গ্যাসের আলো জ্বলজ্বল করে উঠত। বিভিন্ন প্রকার মূল্যবান পাথরের গায়ে লেগে চকচক করে উঠত আলো। দরজা জানালার গায়ে বিভিন্ন রকম কারুকার্যখচিত কাঁচে আলো চকচক করলে অনেক দূর থেকেও মনোরম দেখা যেত। এরপর সাজসজ্জা করে লোকদের সঙ্গে মিলেমিশে খোশ-গল্পে মেতে উঠত বেশ্যারা। গলাগলি-ঢলাঢলি করে শ্রান্ত হয়ে পড়লে ধবধবে ফরাসের গায়ে হেলান দিয়ে। বসে পড়ত ওরা। রাত বেড়ে গেলে এদের সঙ্গে মিলনপ্রত্যাশীরা টুকরির ভেতর মদের। বোতল আর ফল-মূল নিয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মোটর বা টাঙায় চড়ে এসে জড় হত। তাদের পা পড়তেই বস্তিতে একটা আলাদা প্রাণস্পন্দন শুরু হত। গান-বাজনার। তালে-তালে নৃত্যের ঝংকারে একটা অদ্ভুত প্রাণমাতানো পরিবেশ সৃষ্টি হত। হৈ-হাঙ্গামার ভেতর কখন যে রাত কেটে যেত টেরও পেত না কেউ।
বেশ্যাদের আগমনের দিনকয়েকের মধ্যেই দোকানের ভাড়াটে জুটে গেল। বস্তি চালু করার জন্য এ-সব দোকানের ভাড়াও কম করে ধরা হয়ছিল। সেই বুড়িটিই প্রথম দোকানের ভাড়া নিল যে সবার আগে মসজিদের সামনে গাছের তলায় টুকরি নিয়ে বসেছিল। দোকান জাঁকালো দেখাবার জন্য তার ছেলে সিগারেটের খালি প্যাকেট এনে তাকের উপর সাজিয়ে রাখল। বোতলের ভেতরের রঙিন জল ভরে রাখতে লাগল সে। যাতে দেখলেই শরবত মনে হয়। বুড়ি নিজ খেয়ালমতো কাগজের ফুল আর সিগারেটের খালি প্যাকেটের সাহায্যে বিভিন্ন রকম সুদৃশ্য জিনিস তৈরি করে দোকান সাজাল। বিভিন্ন নামকরা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ছবি পুরাতন সিনেমা-মাসিক থেকে ছিঁড়ে দেয়ালে টাঙিয়ে দেয়া হল। দোকানের আসল মালের ভেতর মাত্র দু-তিন রকম সিগারেটের খান-তিনেক করে প্যাকেট আর আট-দশ বাভিল বিড়ি। কয়েক ডজন দিয়াশলাই, পানের একটা পাত্র, সামান্য তামাক আর কয়েক বান্ডিল মোমবাতি।
দ্বিতীয় দোকানে একজন শস্য ব্যবসায়ী, তৃতীয় দোকানে খাদ্য-বিক্রেতা, চতুর্থ দোকানে। কসাই, পঞ্চম দোকানে কাবাব প্রস্তুতকারী ও ষষ্ঠ দোকানে একজন তরিতরকারি বিক্রেতা বসে গেল। আশেপাশের গ্রাম থেকে কম মূল্যে কয়েক রকমের তরিতরকারি এনে এখানে। বেশ লাভে বিক্রি করত তরিতরকারিওয়ালা। সে এক-আধ টুকরি ফুলও রাখত, যাতে দোকানের সৌন্দর্য বাড়ে। একজন ফুলওয়ালা তার অংশীদার হল। সে দিনভর ফুলের মালা তৈরি করে একটা আংটায় বেঁধে বিভিন্ন ঘরে নিয়ে যেতে লাগল। লোকটা শুধু ফুলই বিক্রি করত না, মাঝে-মাঝে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা জমিয়ে তামাকও টানত। তার সামনে যদি কোনো পুরুষ বেশ্যাদের খোঁজে আসত তবে আড্ডা জমে উঠত আরো। তখন সে আর উঠবার নামও নিত না। কখনো রাত বেশি হয়ে গেলে আর ফুলের মালা বিক্রি করতে না-পারলে সেগুলো নিজের গলায় পরে ঘরে ফিরে আসত।
একটা দোকানে একজন বেশ্যার বাপ আর ভাই এসে জুটল। সেলাইয়ের কাজ জানত ওরা। মেশিন সংগ্রহ করে ওরা বেশ জাকিয়ে বসল। এভাবে একজন ক্ষৌরকারও এসে জুটল। তার সঙ্গে এল একজন রঙ করার লোকও। লোকটি বিভিন্ন রকম রঙে দোকানের সম্মুখভাগকে রঙিন করে রাখল।
দিনকতক পর একজন মনোহারি দোকানদার এখানে এল। শহরে তার একটা দোকান। ছিল। কিন্তু ব্যবসা মন্দার কারণে লোকটি এখানে দোকান খুলে বসল। বিভিন্ন রকম পাউডার, সাবান, চিরুনি, বোতাম, সুই-সুতা, লেস, ফিতা, সুগন্ধি তেল, রুমাল ইত্যাদি বিক্রি করতে লাগল সে।
এই বস্তির বাসিন্দাদের উৎসাহের ফলে অনেকগুলো ছোটখাট দোকানদার নিয়ত এখানে এসে ভিড়তে লাগল। এদের ব্যবসা মন্দার দিকে ছিল, কেননা শহরের ক্রমবর্ধমান ভাড়া দিতে অক্ষম ছিল তারা। এখানে এসে আশ্রয় নিয়ে বেশ জাকিয়ে বসল তারা।
একজন হেকিম সাহেব–যে হেকিমি শাস্ত্র সম্পর্কে কিছু খবরাখবর রাখত–এসে এখানে হাজির হল। শহরের কোলাহল পছন্দ করত না বলে নিজের শিষ্যদের নিয়ে লোকটি এখানে একখানা ঘর ভাড়া করে জেঁকে বসল। সারাদিন ধরে হেকিম সাহেব আর তার শিষ্যরা ওষুধের শিশি, শরবতের বোতল, মোরব্বা, চাইনি আর আচারের বয়াম সাজিয়ে রাখল সুন্দরভাবে। একটি তাকে হেকিমি শাস্ত্রের ওপর বিভিন্নরকম ভালো-ভালো বইও সাজিয়ে রাখা হল। আলমারিতে বিভিন্ন রঙ-বেরঙের জেলি আর কাগজপত্র ঠেসে দেয়া হল। প্রত্যেক দিন সকালে বেশ্যাদের চাকর-বাকরেরা এসে বিভিন্ন রকম শরবত আর ওষুধপত্র কিনে নিয়ে যেত। এভাবে তার ব্যবসারও বেশ পসার জমে উঠল।
যে-সব দোকানের ভাড়াটে পাওয়া গেল না, ওসব দোকানে বেশ্যাদের ভাই-বন্ধুরা চারপায়া বসিয়ে সারাদিন তাস-সতরঞ্জ পিটতে লাগল। মাঝে-মাঝে তারা শাকসবজি কুটতে-কুটতে হৈ-হুঁল্লাও করতে থাকল সেখানে।
বেশ্যাদের অনুগ্রহীতাদের একজন একটি দোকান খালি দেখে তার ভাইকে এনে বসাল। সে বিভিন্ন রকম বাদ্যযন্ত্র তৈরি করতে জানত। দোকানের দেয়ালের সঙ্গে পেরেক লাগিয়ে ভাঙাচোরা সারেঙ্গী, সেতার, তানপুরা ইত্যাদি সাজিয়ে রাখা হল। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানোতেও ওস্তাদ ছিল লোকটি। সন্ধ্যার পর-পরই সে সেতার বাজাত। সেতারের মিষ্টি। সুরে আকৃষ্ট হয়ে আশেপাশের দোকান থেকে লোকজন এসে জমায়েত হয়ে অনেকক্ষণ যাবৎ তার বাজনা শুনত। এই লোকটির শিষ্য ছিল একজন। সে রেলওয়েতে কেরানির চাকরি করত। সেতার শেখার দিকে তার বেশ ঝোঁক। অফিস ছুটি হলেই সে সাইকেলে চড়ে সোজা এই বস্তিতে চলে আসত। মোট কথা এই বাদকের প্রাণপ্রাচুর্যে সর্বদাই বস্তিটি সরগরম থাকত।
বস্তির নির্মাণকার্য চলাকালে মসজিদের মোল্লাজি রাত্রে গ্রামে চলে যেতেন কিন্তু এখন চারদিকে নিমন্ত্রণ বেড়ে যাওয়ায় তিনিও এখানেই থাকতে লাগলেন। ধীরে-ধীরে বিভিন্ন বেশ্যাদের ঘর থেকে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে আসতে শুরু করলে তার আমদানিও বেশ বেড়ে গেল।
একটি ছোটখাট ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার কোম্পানিও এখানে এসে জুটল এক সময়। শহরের ক্রমবর্ধমান ভাড়া আর অত্যল্প চাহিদার দরুন ওরা এখানে আসতে বাধ্য হল। বেশ্যাদের ঘর থেকে খানিকটা দূরে তাঁবু ফেলল এরা। এই কোম্পানির অভিনেতাদের শিল্প সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। পোশাক-পরিচ্ছদও ছেঁড়া। জোড়াতালি লাগানো। এরা খেলাধুলা যা দেখাত তা-ও মান্ধাতার আমলের। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই কোম্পানি বেশ চালু হয়ে গেল। কারণ থিয়েটারের প্রবেশমূল্য ধরা হয়েছিল অত্যন্ত কম। শহরের দিন-মজুর, কারখানার শ্রমিক, আর দরিদ্র জনসাধারণ সারাদিনের পরিশ্রমের পর এখানে এসে খানিকটা তৃপ্তি পেত। দূর-দূরান্তর থেকেও লোক এসে এ-সব দেখত, আর দেখত মনমাতানো নারীসৌন্দর্য যা মানুষকে অহরহ প্রলুব্ধ করে। থিয়েটার শুরু না-হওয়া পর্যন্ত কোম্পানির ভাঁড় বাইরে এসে বিভিন্ন রকম অঙ্গভঙ্গি করে খুশিতে মশগুল রাখত দর্শকদের।
এমনি করে ধীরে-ধীরে অনেকে এই বস্তিতে আসতে লাগল। অতএব শহরের বিভিন্ন স্থানে টাঙ্গার গাড়োয়ানরা হাঁকতে লাগল–নতুন শহর কে যাবে এস। শহর থেকে পাঁচ ক্রোশ পর্যন্ত পাকা রাস্তা। গাড়োয়ানের বকশিসের লোভে এই রাস্তার মাথা পর্যন্ত এসে যেত। সওয়ারির নির্দেশে তারা বেশ জোরেসোরে ঘোড়া হাকাত, সঙ্গে-সঙ্গে মুখে বিভিন্ন রকম শব্দ করত। এদের ভেতর চলতে থাকত প্রতিযোগিতা। যদি কোনো গাড়ি অন্য একখানাকে ফেলে আগে চলে যেত তা হলে আগের গাড়ির সওয়ারিরা মাথা উঁচিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠত। এই প্রতিযোগিতায় কাহিল হয়ে পড়ত নিরীহ ঘোড়াগুলো। ঘোড়ার গলার মালা থেকে সুগন্ধের বদলে ঘাসের দুর্গন্ধ বেরিয়ে আসত।
রিকশাওয়ালারাও টাঙ্গার পেছনে পড়ে রইল না। তারাও কম দামের সওয়ারি নিয়ে ঘুঙুরের শব্দে চারদিক মুখরিত করে এগিয়ে চলত। এ ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে শহরের স্কুল-কলেজের ছাত্ররা সাইকেলে চড়ে আসত এই রহস্যপূর্ণ বাজার পরিদর্শনে। তাদের ধারণা–অভিভাবকেরা অনর্থক এই বাজার দেখার সৌভাগ্য থেকে তাদের বঞ্চিত করছে।
দেখতে-দেখতে এই বস্তির খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে দোকান আর বাড়ির দামও বেড়ে গেল। যে-সব বেশ্যারা এখানে আসতে চায়নি তারাও এই বস্তির ক্রমবর্ধমান উন্নতি দেখে মনে-মনে নিজেদের বোকামির কথা চিন্তা করে অনুতাপ প্রকাশ করতে লাগল। কেউ-কেউ তাড়াতাড়ি জায়গাজমি কিনে বাড়িঘর তৈরি শুরু করে দিল। এ ছাড়াও শহরের কিছুসংখ্যক মহাজন বস্তির আশেপাশে জায়গা কিনে ঘর তুলে ফেলল ছোট-ছোট। ফল দাঁড়াল এই যে, যে-সব প্রগলভ মেয়েছেলেরা হোটেলে আর অভিজাত মহল্লায় মুখ ঢেকে ছিল তারাও সুযোগ পেয়ে পঙ্গপালের মতো বেরিয়ে এসে এ-সব বাড়িঘরে নিজেদের আড্ডা গেড়ে বসল। কিছু সংখ্যক সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজনসম্পন্ন মানুষও এখানে এসে ভাড়া করল দোকান। তারা রাত্রে দোকানে থাকত না।
এই বস্তির আজাদি তো স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেল কিন্তু এখনো বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা হল না। অতএব বেশ্যা এবং এই এলাকার বাসিন্দাদের তরফ থেকে বৈদ্যুতিক আলোর জন্য আবেদন করে সরকারের নিকট আরজি পেশ করা হল। দিনকয়েক পরেই মঞ্জুর হয়ে গেল তাদের আবেদন। সঙ্গে-সঙ্গে একটা ডাকঘরও খোলা হল। একজন মুন্সি মিয়া ডাকখানার বাইরে একটা সিন্দুক পুঁজি করে দোয়াত-কলম নিয়ে লিখে দিতে লাগল মানুষের চিঠিপত্র।
একবার মদখোরদের আড্ডায় এক জঘন্য ঝগড়া বেঁধে গেল। ঝগড়ায় সোডার বোতল ছোঁড়াছুড়ি আর ইটের যথেচ্ছ সদ্ব্যবহার করা হল। গুরুতররূপে আহত হল অনেকে। এতে সরকার বুঝল পুলিশ-স্টেশন খোলা অপরিহার্য এই বস্তিতে।
থিয়েটার কোম্পানি দু’মাস থেকে বেশ দু’পয়সা গুছিয়ে চলে গেল। শহরের একটি সিনেমার মালিক এই অবস্থা দেখে ভাবল–এখানে একখানা সিনেমা হল খুললে কেমন হয়? যেই ভাবনা অমনি কাজ। সে তাড়াতাড়ি একখানা ভালো জায়গা খুঁজে সিনেমা হল নির্মাণের কাজ শুরু করে দিল। কয়েক মাসের ভেতর সিনেমা হলের কাজ শেষ হয়ে গেল। হল এলাকার ভেতর তৈরি করা হল ছোট্ট একখানা বাগান–যাতে ছবি শুরু হবার আগে এসে পড়লে দর্শকেরা এখানে বিশ্রাম নিতে পারে। বস্তির লোকেরাও এখানে এসে নিত্য আড্ডা জমাতে লাগল। ফলে এটি পরিণত হল একটি প্রমোদ-উদ্যানে। মাঝে-মাঝে এক তেল মালিশওয়ালা ওয়াচ কোটের পকেটে বিভিন্ন রকম সুগন্ধিযুক্ত তেলের শিশি নিয়ে হাঁক ছাড়তে ছাড়তে মাথাব্যথাওয়ালাদের কাছে নিজের জারিজুরি দেখাতে লাগল।
দোকানগুলোর একটায় একজন লোক সোডাওয়াটারের ফ্যাক্টরি খুলল। এ ছাড়াও একজন লন্ড্রিওয়ালা, এক ফটোগ্রাফার, একজন সাইকেল মেরামতকারী, একজন। বুটপালিশওয়ালা ও একজন ডাক্তার ওষুধের দোকান সমেত এসে ভিড়ল। দেখতে-দেখতে একজন সরাইখানার মালিক মদের দোকান খোলার অনুমতি পেয়ে গেল। ফটোগ্রাফারের দোকানের বাইরে এককোণে একজন ঘড়ি মেরামতকারীও এসে খুলে বসল তার ব্যবসা। আর প্রত্যহ একটা ছোট আয়না চোখে লাগিয়ে দেখতে লাগল ঘড়ি।
এর কিছুদিন পর বস্তির আলো, জল ইত্যাদির সুবন্দোবস্তের দিকে দৃষ্টি দেয়া হল। সরকারি কর্মচারীরা লাল ঝাণ্ডা নিয়ে রাস্তাঘাট মেরামত করার জন্য বড় বড় ইঞ্জিন চালিয়ে দিল সশব্দে।…
.
এভাবে কেটে গেল বিশটি বছর। বস্তি এখন ভরপুর শহরে রূপান্তরিত হয়েছে। রেলওয়ে স্টেশন থেকে শুরু করে টাউন হল, কোর্ট, জেলখানা সবই স্থাপিত হয়েছে এখানে। প্রায় আড়াই লক্ষ লোক এখন এই শহরের অধিবাসী। শহরে একটা কলেজ, ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক দুটো হাইস্কুল, আটটা অবৈতনিক প্রাইমারি স্কুল গড়ে উঠেছে। এছাড়াও খোলা হয়েছে ছ’টা সিনেমা হল, চারটা ব্যাঙ্ক। এসবের মধ্যে পৃথিবীর বড়-বড় দুখানা ব্যাঙ্কের শাখাও রয়েছে।
এই শহর থেকে দু’খানা দৈনিক, তিনখানা সাপ্তাহিক আর দশখানি মাসিক পত্রিকা নিয়মিত বের হচ্ছে। তার ভেতর চারখানা সাহিত্য সম্পর্কীয়, দু’খানা কৃষি সম্পৰ্কীয়, একখানা ডাক্তারি, একখানা মহিলা বিষয়ক ও একখানা ছোটদের পত্রিকা রয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে বিশটা মসজিদ, পনেরটা মন্দির ও ধর্মশালা, ছয়টি এতিমখানা, পাঁচটি অনাথ আশ্রম আর তিনটি বড়-বড় সরকারি হাসপাতাল খোলা হল। একটা হাসপাতাল শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট।
প্রথম কয়েক বছর শহরটি এর বাসিন্দাদের ইচ্ছামতো হুসনাবাদ’ নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু অনেকে এটাকে একটু রদবদল করে হাসনাবাদ’ রাখল। শেষে এটাও টিকল না। কারণ জনসাধারণ ‘হাসান’ আর হুসন-এর ভেতর কোনো পার্থক্য নির্ণয় করতে অপারগ। অতএব অনেক বড়-বড় বই-পুস্তক, দলিল-দস্তাবেজ ঘেটে এই বস্তির আসল নাম বের করা হল। হাজার-হাজার বছর আগের নামানুসারে এই শহরের নাম রাখা হল ‘আনন্দী নগরী।
এমনিতে সমগ্র শহরটাই ছিমছাম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর সুন্দর। কিন্তু সবচাইতে সুন্দর আর ব্যবসার আসল কেন্দ্রস্থল হচ্ছে–শহরের বেশ্যারা যেখানে থাকে সেই জায়গাটা।
.
‘আনন্দী নগরীর’ মিউনিসিপ্যালিটির সভা বেশ জমেছে। হল লোকে পরিপূর্ণ। অন্যান্য দিনের সাধারণ নিয়ম ভঙ্গ করে প্রতিটি সদস্যই আজ উপস্থিত রয়েছেন। আলোচনার বিষয় হল–শহরের মধ্যস্থলে অবস্থিত বেশ্যাদের শহর থেকে অপসারণ করা। কারণ এরা মানবতা, সংস্কৃতি আর আভিজাত্যের পরিচ্ছন্ন পরিবেশে কলঙ্কের মতো বিরাজ করছে।
একজন সুবক্তা বললেন–জানি না আমাদের পূর্বপুরুষেরা এমন কী দেখেছিলেন, যাতে করে এসব সমাজের কলঙ্কদের শহরের একেবারে মধ্যস্থলে স্থান করে দিয়েছিলেন?’
.
এবার এদের জন্য যে স্থানটি নির্ধারণ করা হল তা শহর থেকে বার ক্রোশ দূরে অবস্থিত।
চড়ুইপাখি – খাজা আহমদ আব্বাস
লোকটির নাম রহিম। রহিম খান। নামের বিপরীত তার কাজ। নিষ্ঠুরতায় তার জুড়ি নেই : এ অঞ্চলে। তার ভয়ে গ্রামটাও যেন কাপে। মানুষ বা পশু-কারো প্রতি বিন্দুমাত্র দরদ নেই তার। একদিন কর্মকারের ছেলেটা রহিম খানের বলদের লেজে কয়েকটা কাঁটাগাছ বেঁধে দিয়েছিল। ছেলেটাকে কী মার! মারের চোটে যখন রক্তারক্তি অবস্থা, রহিম তখন ছেড়ে দিয়েছিল ছোঁড়াটাকে। গাঁসুদ্ধ বলাবলি করে, ‘খোদার একটু ভয়ডর নেই দজ্জালটার। কচি বাচ্চাদের মারে যে, মূক পশুগুলোকে যে পিটুনি দেয়, এমন পাতকের কপালে নির্ঘাত দোজখ-বাস আছে।’
যত বলাবলি সবকিছু রহিম খানের পেছনে–অগোচরে। তারা সামনে কেউ খুলুক তো মুখ! বেচারা বুলু একদিন শুধু বলেছিল, ‘আহা, বাচ্চাদের এমন করে মারতে নেই আব্বা। আর যাবে কোথায়! রহিম ঝাঁপিয়ে পড়ে বুন্দুর ওপর। এমন মার খেল বুন্দু যে, পাড়ার প্রতিটি লোকে চমকে উঠল। পাছে রহিম বিরক্ত হয় তাই বুন্দুর কাছে কেউ সান্ত্বনা দিতেও ঘেষল না। গাঁ-সুদ্ধ সবাই বলাবলি করল ‘ও বেটার মাথা খারাপ হয়েছে; ওকে পাগলা গারদে পাঠাও।’ কিন্তু এ-সব কথাবার্তাও রহিম খানের পেছনে, নিভৃতেসামনে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না।
গ্রামের কেউ রহিম খানের সঙ্গে কথা বলে না। না-বলুক, রহিমের তাতে বিন্দুমাত্র আসে যায় না। কাঁধের উপর লাঙল নিয়ে সকালে সে মাঠে যায়। পথে কারো দেখা পেলে রহিম না-দেয় সালাম, না-করে কুশল জিজ্ঞাসা। দুটো বলদ তার। রহিম ওদের নাথু আর ছিদু বলে ডাকে। মাঠে পৌঁছে সে বলদদুটোর সঙ্গে কথা শুরু করে হাল দিতে-দিতে। হয়তো এক সময় চিৎকার করে ওঠে–
‘এই শালা নাথু, সোজা লাইন ধর, ধর বলছি। তোর বাপ এসে চাষ দিয়ে যাবে রে হারামজাদা? এই ছিদু। তোর আবার কী হল রে হারামি?’
হাতের পাঁচনটা দিয়ে তারপর রহিম দমাদম ছিদু-নাথুকে পেটাতে থাকে। প্রহারে-প্রহারে বলদদুটোর সারা পিঠে শুধু ক্ষতের চিহ্ন।
সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে বউ আর ছেলেদুটোকে নিয়ে রহিম খিস্তি শুরু করে। শাক-সবজি বা ভাজাভুজিতে বউ লবণ দিতে ভুলে গেছে তো আর রক্ষা নেই। কোনো ছেলে কোনো অপকর্ম করল তো রহিম তাকে পা উপরে বেঁধে গরুপেটা লাঠিটা দিয়ে পেটাতে থাকবে। বেহুশ না-হওয়া পর্যন্ত ছেলের নিস্তার নেই। প্রতিদিন এমনি একটা-না-একটা কিছু ঘটবেই ওই বাড়িতে। প্রায় প্রতি রাত্রে বউ-বাচ্চাদের ওপর গাল-খিস্তি মার-ধোর, …যন্ত্রণায় ওরা চিৎকার করতে থাকে। পাড়া-পড়শিরা দেখে-শুনেও কেউ আসে না। এগিয়ে এসে যে রহিমকে থামাবে, সে সাহস হয়ে ওঠে না কারো।
দিন-রাত মার খেয়ে বেচারি বউটা আধমরা হয়ে গেছে। বয়স ওর চল্লিশের কাছাকাছি হলেও বেচারিকে ষাট বছরের বুড়ির মতো লাগে। বাচ্চারা যতদিন ছোট ছিল, আচ্ছা মার খেয়েছে বাপের হাতে। বড় ছেলেটা যখন বাপের কোঠায়, একদিন কী কারণে বাপের হাতে একচোট বিষম মার খেল। মার খেয়ে সেই যে বাড়ি থেকে পালাল সেদিন, আর ফেরেনি।
কিছু দূরের এক গ্রামে ছেলেটার এক মামা থাকত। মামাই আশ্রয় দিল তাকে। বউ একদিন অনেক সাহস করে রহিমকে বলছিল, ‘হিলামপুর যদি কখনো যাও, পায়ে পড়ি, নুরুকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো।’ যেই-না বলা, শয়তান যেন তড়াক করে রহিমের ওপর ভর করল, কী বললি, হারামজাদাকে আমি ফিরিয়ে আনতে যাব।’ রাগে কাঁপতে থাকে রহিম খান–’শুনে রাখ, ও ব্যাটা কখনও ফিরে এলে আর আস্ত রাখব না।’
সে যাই হোক, এমন মৃত্যুর খামারে নুরু আর কখনো ফিরে আসেনি; আসার দরকারও বোধ করেনি। দু’বছর পর ছোট ছেলেটাও পালাল। ভাইয়ের কাছে গেল পালিয়ে। রহিমের প্রতিমুহূর্তের যন্ত্রণা সহ্য করতে এখন থাকল শুধু বউ। কিন্তু সে-ও একদিন এমন মার খেল যে, বাড়ি ছাড়া ভিন্ন আর কোনো গত্যন্তর রইল না। কতদিনের সংসারের মায়া–সে মায়াও ছিন্ন করতে বেচারি বাধ্য হল। রহিম মাঠে চাষ করতে গেছে, এই সুযোগে ভাইকে গোপনে ডাকিয়ে এনে তার সঙ্গে মা’র কাছে চলে গেল বউ।
সন্ধ্যায় রহিম ঘরে ফিরে এল। পাশের বাড়ির বউ অনেক ভেবেচিন্তে সাহস করে এগিয়ে এসে রহিম খানকে বউয়ের চলে যাবার খবর জানাল। কেন জানি, আজ রহিম ক্ষেপল না। চুপচাপ শুধু শুনে গেল। তারপর বলদদুটোকে রাত্রির জন্য বাঁধতে গেল ঘেরা-উঠানে। সে নিশ্চিত জানে বউ আর কখনো তার কাছে ফিরে আসবে না।
উঠোন থেকে রহিম ঘরে ফিরে এল। নির্জন, নিস্তব্ধ। না, একেবারে শব্দহীন নয়, একটা বিড়াল ম্যাও-মাও করে চলেছে। লেজ ধরে বিড়ালটাকে ছুঁড়ে মারল রহিম। তারপর চুলোর কাছে গেল। ঠাণ্ডা চুলো। রাজ্যের আলসেমি বোধ করতে লাগল সে। চুলো ধরিয়ে নিজ হাতে রান্না করা তার হল না। পেটে কিছু না-দিয়েই বিছানায় গড়িয়ে পড়ল রহিম। কিছুক্ষণ পর ঘুমে তলিয়ে গেল।
সূর্য ওঠার অল্প পরেই তার ঘুম ভাঙল। আজ কাজে যাওয়ার তাড়াহুড়া নেই। ছাগলগুলোর দুধ দুইয়ে তাই খেল সে। হুঁকোটা সাজিয়ে নিয়ে বসল বিছানায়। সূর্যের আলোয় ততক্ষণ ঘর ভরে গেছে। ঘরের কোণায় রহিম খান কতগুলো মাকড়সার জাল দেখতে পেল। ওগুলো সরানো দরকার। বাঁশের লাঠির আগায় কিছুটা ন্যাকড়া বেঁধে সে জাল ভাঙতে গেল। সিলিং-এ এক চড়ইয়ের বাসা হঠাৎ তার নজরে পড়ল। দুটো চড়ই উড়ে একবার করে বাসায় ঢুকছে আর বেরুচ্ছে।
এ বাসা ভাঙতে হবে প্রথম-প্রথম এমনি চিন্তায় রহিম থেমে গেল। একটা টুল নিয়ে এসে সে চড়ইয়ের বাসায় উঁকি মারল। হৃষ্টপুষ্ট দুটো বাচ্চা ভিতরে কিচিরমিচির করছে আর তাদের বাপ-মা মাথার উপর উড়ে-উড়ে তাদেরকে সম্ভাব্য আপদ-বালাই থেকে রক্ষা করছে। বাসার দিকে হাত বাড়াতেই মাদি চড়ই তার মাথায় ঝাঁপটা মারল সঙ্গে-সঙ্গে। ভ্যাবাচাকা খেয়ে রহিম হেসে উঠল, নচ্ছার। আমার চোখদুটো উপড়ে নিতে চাস?’ টুল থেকে নেমে পড়ল রহিম। বাসা ভাঙা হল না আর।
পরের দিন থেকে রহিম আবার মাঠের কাজে মন দিল। গ্রামের কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না। সারাটা দিন সে মাঠে হাল দেয়া, পানি সেচ দেয়া বা ফসল কাটায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে। কিন্তু সূর্য ডোবার আগেই সে এখন ঘরে ফিরে যায়। হুঁকা ধরিয়ে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে চড়ইগুলোর লাফ-ঝাঁপ দেখতে থাকে নিবিষ্ট মনে। বাচ্চাদুটো এখন উড়তে শিখেছে। ছেলেদের নামে একটা বাচ্চাকে সে নুরু, আরেকটাকে বুন্দু বলে ডাকে। পৃথিবীতে এখন রহিমের বন্ধু বলতে চারটি চড়ই। গ্রামের সবাই তাকে এড়িয়ে চলে সত্যি, কিন্তু হঠাৎ সবার খেয়ালে আসে, আজকাল রহিম তার বলদদুটোকে মারধর করে না। নাথু আর ছিদুও এখন ছাড়া পেয়ে খুব খুশি। ওদের পিঠের উপরের ক্ষতগুলো প্রায় সেরে গেছে। একদিন সকালেই রহিম খান মাঠ থেকে ফিরছিল। রাস্তায় কতকগুলো ছেলে খেলায় মত্ত। রহিমকে দেখেই ওরা জুতা-টুতা ফেলে ভোঁ-দৌড়। রহিম পেছনে-পেছনে দৌড়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে শোন, শোন। পালাস নে। মারব না তোদের, শোন। কে শোনে জালিমের কথা। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। শিগগিরই হয়তো বৃষ্টি নামবে। বাড়ির দিকে রহিম জোরে পা চালাল। বলদদুটোকে উঠোনে বেঁধেছে মাত্র, অমনি শোঁ-শোঁ ঝড় উঠল।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল রহিম খান। বাতিটি জ্বালাল প্রতিদিনের মতো। আজো সে কয়েক টুকরো রুটি চড়ইগুলোর কাছাকাছি একটি কুলুঙ্গিতে রেখে ডাকতে লাগল, ‘কই রে নুরু, কই রে বুন্দু।’ আজ নুরু-বুদু বাইরে এল না। ব্যাপার দেখতে রহিম চড়ইয়ের বাসায় উঁকি দিল। দেখল চারটা চড়ুই-ই ডানায় মাথা গুঁজে জড়াজড়ি করে বসে আছে। সিলিং-এর এক ছিদ্র দিয়ে আসা ফোঁটা-ফোঁটা পানি বাসাটা ভিজিয়ে ফেলেছে।
এমনভাবে পানির ফোঁটা পড়তে থাকলে বাসাটা পয়মাল হয়ে যাবে। বেচারাদের তখন মাথা গুঁজবার ঠাই থাকবে না।’ বৃষ্টি-মাথায় রহিম দেয়ালে মই লাগিয়ে চালে উঠল। চালের বৃষ্টি-চোয়ানো ছিদ্রটা বন্ধ করতে বেশ সময় নিল। আর ততক্ষণে সে নিজে ভিজে একাকার। ঠকঠক করে কাঁপছে ঠাণ্ডায়। ঘরে এসে বিছানায় বসতে-না-বসতেই হঠাৎ হাঁচির তোড় শুরু হল। রহিম খান ঘোড়াই তোয়াক্কা করে এই হাঁচির। পরদিন সকালে কিন্তু ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারল না সে। জ্বরে তার শরীর পুড়ে যাচ্ছে। আশেপাশে কেউ নেই যে তার ওষুধ এনে দেবে।
এমনিভাবে দুদিন কেটে গেল।
দুদিন রহিম খানকে মাঠে যেতে না-দেখে গ্রামবাসীরা কৌতূহল বোধ করল। চৌকিদার কয়েকজন চাষিকে সঙ্গে নিয়ে ওর ঘরে ঢুকল। বিছানায় শুয়ে রহিম আপন মনে বিড়বিড় করছে, ‘ওরে বুন্দু-নুরু, কোথায় গেলি তোরা? কে তোদের আজ খাবার দেবে? কেউ নাই রে!’ চারটা চড়ই তখন সিলিং-এর কাছে উড়ে ঘুরঘুর করছে।
কালু অর্থপূর্ণ মাথা নেড়ে বলল, ‘লোকটা পাগলই হয়ে গেল শেষে। সাত সকালেই কাল হাসপাতালে খবর পাঠাতে হবে। ওরা এসে মনে হলে না-হয় পাগলাগারদেই নিয়ে যাবে।
পরদিন গায়ের লোক হাসপাতালের এক কর্মচারীকে নিয়ে যখন রহিমের ঘরে ঢুকল, রহিম তখন বেঁচে নেই। ঘরের ভিতর চঞ্চল চারটা চড়ই শুধু ঘুরঘুর করে উড়ছে।
পর্যটক – কুররাতুল আইন হায়দার
গত বছর এক সন্ধ্যায় দরজায় ঘণ্টা বাজল। আমি বাইরে এলাম। এক লম্বা ছিপছিপে ইউরোপীয়ান ছেলে ক্যানভাসের থলে কাঁধে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ঝোলানো রয়েছে। দ্বিতীয় একটি থলে। পায়ে ধূলিমলিন পেশোয়ারি চপ্পল। আমাকে দেখে বিনীত হয়ে নাম জিজ্ঞেস করল। তারপর একটা খাম এগিয়ে দিলে বলল,
আপনার মামার চিঠি।
‘ভেতরে এস।’
আসান মামুর চিঠি। তিনি লিখেছেন, আমরা করাচি থেকে হায়দারাবাদ (সিন্ধু) ফিরে যাচ্ছিলাম। থাটের মাকালি হিলের কবরের মাঝে ছেলেটি বসেছিল। আংটি দেখিয়ে পাথেয় চাইলে আমরা তাকে বাড়ি নিয়ে এসেছি। ছেলেটি বিশ্ব-ভ্রমণে বেরিয়েছে। এখন ইভিয়াতে যাচ্ছে। অটো বড় ভালো ছেলে। আমি তাকে ভারতীয় আত্মীয়-স্বজনদের ঠিকানা লিখে দিয়েছি–সে তাদের কাছে থাকবে। তুমিও তাকে আতিথ্য দিও।
নোট : ওর কাছে সম্ভবত টাকাকড়ি নেই।
ছেলেটি কামরায় এসে মেঝেতে থলে রাখল। তারপর চোখ রগড়ে দেয়ালের ছবি দেখতে লাগল। এত লম্বা ছেলেটির মুখখানা বাচ্চার মতো ছোট। তার ওপর আবছা সোনালি দাড়ি-গোঁফে বড় আশ্চর্য লাগছে।
এ দেখছি আর এক আপদ। আমি একটু বাঁকা করে ভাবলাম। আসান মামুর মতো ফেরেশতা চরিত্রের লোকটা এর কজাতে পড়ে গেল কী করে? এরা হল বিশ্বপর্যটক। নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে পথিকদের বন্ধুত্ব পাতানোতে এরা বেশ ওস্তাদ।
‘শাহেদাও আপনাকে সালাম বলেছে।’ সে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে বলল।
‘শাহেদা?’
‘হ্যাঁ, আপনার কাজিন। বেনারসে আমি তাদের ওখানে ছিলাম। আর লক্ষ্ণৌতে আপনার ফুফুর বাড়িতে। চাটগাতে গিয়ে থাকব আপনার আঙ্কলের কাছে। আর যদি দাজিলিং যেতে পারি তো আপনার কাজিন তাহেরার ওখানে উঠব।’
সে পকেট থেকে আরো একটা লম্বা লেফাফা বের করল।
‘বসে যাও অটো, চা খাও।‘ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মনে পড়ল সেই দুজন ডাচ পর্যটকের কথা, যারা করাচি এসে হামেদ চাচার ওখানে ঘাঁটি করে বসেছিল। তাদেরও পয়সা-কড়িও শেষ হয়ে গিয়েছিল প্রায়।
‘আমি তুরস্ক এবং ইরান হয়ে এসেছি। জার্মানি থেকে এ-পর্যন্ত মোটর এবং লরিতে। লিফট পেয়েছি। এখন যাব লংকা। তারপর থাইল্যান্ড ইত্যাদি। সেখান থেকে কার্গো বোটে চড়ে জাপান, আমেরিকা। তারপর বাড়ি পৌঁছব। এখানে আমি আওরঙ্গাবাদ থেকে ট্রাকে চড়ে এসেছি।’
‘তোমার এ-সফর বেশ রোমাঞ্চকর দেখছি।’
‘হ্যাঁ, ইস্তাম্বুলে তিনরাত আমি গ্যালাটার পুলের নিচে ছিলাম। আর ইরানে–’
তারপর বিভিন্ন ছোটখাট এডভেঞ্চার শুনিয়ে বলল, ‘আমি কলোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি।
‘সেখানে সবাই আমার সঙ্গে কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে খুব বেশি রকম আলোচনা করে। অথচ এখানে কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের আলোচনা খুব কম হয়। এখানকার আসল সমস্যা হল–’
বলতে গিয়ে সে ভারতের সমস্যাবলি সম্পর্কে বিরাট বক্তৃতা দিয়ে ফেলল। তারপর একটু থেমে শুরু করল–
‘আমি ধনী পর্যটক এবং সাধারণ ইউরোপীয়দের মতো শুধু তাজমহল দেখতে আসিনি। আমি রাতভর দোকানের বারান্দায় শুয়ে থাকি। কৃষকদের ঝুপড়িতে কাটাই, মজুরদের সাথে ভাব করি–যদিও আমি তাদের ভাষা বুঝতে পারি না।
খাওয়ার পর সে বোম্বের মানচিত্র বের করে মেঝেতে রাখল।
‘বেচারি ইংরেজ বোম্বাইয়ের স্থাপত্যরীতিকে ভিকটোরিয়ান গথিক বলে ধরে নিয়েছে। এখানে কী কী দেখবার মতো আছে, বলুন দেখি।’
‘কেন, এলিফ্যান্টা–আপালু বন্দর আর…’
‘এ সব তো গাইড বুকেও আছে।’
সে অধৈর্য হয়ে আমার কথা কাটল এবং ভারতের জীবনব্যবস্থা ও রীতিনীতির ওপর বড় ভারি এবং উদাহরণ সমৃদ্ধ আলোচনা করে শোনাল।
‘অটো, তোমার বয়স কত?’–আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম। ‘একুশ। যখন জার্মানিতে গিয়ে পৌঁছব তখন হবে বাইশ। তার পরের বছর আমি ডকটরেট পাব। আমি জার্মানির গীতিকাব্যের ওপর গবেষণা করছি। জার্মানিতে শুধু ডকটরেট দেয়, যেমন আপনাদের এখানে বি.এ., এম.এ।’
এরপর বহুক্ষণ সে জার্মানির গীতিকাব্য, বিশ্ব রাজনীতি মায় ভারতের শিল্পকলার আলোচনায় মুখর হয়ে উঠল। সে নাকি ছবিও আঁকে। কী রকম ডাকসাইটে ছেলে–আমি মনে-মনে বললাম। জার্মানদের মতোই মার্জিত এবং স্বচ্ছ বুদ্ধিসম্পন্ন সে।
‘আমি রাত্রে শোবার আগে আপনার বইগুলো দেখতে পারি?’
‘অবশ্যই।’
রাতভর বসার ঘরে বাতি জ্বলল। সকাল তিনটায় গোসলখানায় পানি ঝরার শব্দে আমি জেগে উঠলাম। সে নেয়ে-ধুয়ে একদম সাফসাফাই, যাতে তার জন্যে বাড়ির কারো অসুবিধা না-হয়। নাস্তার সময় সে রাতভর পড়ে শেষ করা পুস্তকের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সম্পর্কে নানা মতামত ব্যক্ত করল। তারপর বোম্বের মানচিত্র বের করে বেরিয়ে পড়ল ভ্রমণে।
কামরা ঠিক করার সময় হঠাৎ তার থলেতে আমি চারটি বই দেখলাম : গ্যেটের ফাউস্ট, হাইনের কাব্য, রিলকে, ব্রেশট এবং পবিত্র ইঞ্জিল।
সন্ধ্যায় সে ভারি ক্লান্ত এবং বিবর্ণ হয়ে ফিরলে আমি বললাম, ‘অটো, কাল রাতে তুমি তো খোদার বিরুদ্ধে ছিলে–অথচ ইঞ্জিল সাথে নিয়ে ঘুরছ।’
একথা শুনে অটো খোদার ধ্যানে আবেগ-অন্ধ মানবিক বাধ্যতার ওপর এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়ে ফেলল।
‘অটো, তুমি এলিফ্যান্টা গিয়েছিল? সেখানকার ত্রিমূর্তি আর দেবতা–’
‘আমি কোথাও যাইনি। সারাদিন ভিকটোরিয়া গার্ডেনে বসে ভিড়-জমা মানুষদের দেখেছি। মানুষ–মানুষই সবচে বড় দেবতা।’
‘হ্যাঁ, তা তো বটে। কিন্তু তুমি খেয়েছ কোথায়?’
‘আমি এক ডজন কলা কিনে নিয়েছিলাম।
হঠাৎই আমি খুব লজ্জিত হলাম। যাবার সময় কিছু খাবার দিতে আমার কেন মনে ছিল না ভেবে লজ্জা লাগল। আসান মামুর কথাও মনে পড়ল, সম্ভবত ওর কাছে পয়সা-কড়ি নেই।
খাবার টেবিলে সে বলল, ‘আমি অনেক দিন পর পেটপুরে খাচ্ছি।’
আমি তার সঙ্গে জার্মানির আলোচনা করতে লাগলাম। বার্লিনের প্রাচীরের বর্ণনা দিতে গিয়ে সে জানিয়ে দিল যে, সে পাক্কা এন্টি-কমুনিস্ট।
বাড়িতে আমার মা আমার জন্যে মজার-মজার খাবার তৈরি করে। আপনি মাকে দেখলে খুব খুশি হতেন। মায়ের বয়স এখন বিয়াল্লিশ। নানান বিপদ-আপদ বেচারিকে অকালে বুড়িয়ে ফেলেছে। কিন্তু এখনো মা সুন্দরীদের একজন।
‘তুমি কি তার একমাত্র ছেলে?’
‘হ্যাঁ, আমার পিতা সৈন্যবিভাগের অফিসার ছিলেন। মায়ের বাড়ি প্রসা। মায়ের বয়স যখন সতেরো তখন বাবার সাথে বিয়ে হয় তার; এর কিছুদিন পরই বাবা পোল্যান্ডের যুদ্ধে নিহত হন। তার পরের মাসেই আমার জন্ম। বোমা বিস্ফোরণ থেকে বাঁচবার জন্যে মা আমাকে কাঁধে করে নানা জায়গায় ফিরতেন। আমাকে কোলে নিয়ে, মাথায় রুমালের ফলবুট পরে, সামান্য আসবাবপত্র প্রেম্বুলেটরে এঁটে গ্রামে-গ্রামে ঘুরতেন আর ক্ষেতখামারে লুকিয়ে থাকতেন। মা যখন পোল্যান্ডের এক গ্রামে লুকিয়ে ছিলেন তখন সৈন্যেরা ঘরে আসে। আমার বয়স তখন বছর চারেক। আমার শৈশবের অবিস্মরণীয় স্মৃতি এই ভীষণ রাতটা। ভয়ে আমি পালঙ্কের নিচে লুকালাম। লোকেরা যখন মাকে টেনে নিয়ে গেল আমি জোরে-জোরে কাঁদতে লাগলাম। মাকে ওরা টেনে-হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে গেল। এর পর মা ভয়ে ঝোপে-ঝাড়ে লুকিয়ে থেকে বেশ ক’দিন পর ফিরলেন। এদিকে আমি খালি ঘরে একা। বাইরের গোলাগুলির আওয়াজ ঘরের ভেতর ছমছম করে বেড়াত। বাবুর্চিখানা এবং ভাঁড়ারের আলমারি খুলে আমি খাবার তালাশ করতাম। যা কিছু পেতাম তাই ক্ষুধার জ্বালায় খেয়ে ফেলতাম। আলমারিগুলোর তাক ছিল অনেক উঁচুতে। সেখানে অনেক খাবারও ছিল। কিন্তু আমি নাগাল পেতাম না।’
এতটুকু বলে সে চুপসে গেল। খেতে থাকল নীরবে।
‘চালের খাবার খুব ভালো লাগে। কয়েক মিনিট পর সে আস্তে করে বলল, এই জন্যে পারলে আমি যুদ্ধের ধ্বংসকাহিনী পড়ি না। বড়দের কাছ থেকে শোনা এমনি আরো অসংখ্য বীভৎস কাহিনী শুনেছি। আমার সেই ফরাসি মেয়েটির কথা মনে পড়ছে, যে এই অটোরই স্বজাতি জার্মানদের মৃত্যুলীলার কাহিনী শুনিয়েছে। এই পোল্যান্ডেই যেখানে অটো এবং তার মায়ের এই দুরবস্থা হয়েছিল, নাৎসিরাও রাতদিন সেখানে কাজ করছে। সেখানে রোজ হাজারো ইহুদিদেরকে নিষ্ঠুর মৃত্যুযন্ত্রে নিক্ষেপ করা হত। ব্রিটিশের গোলা-বারুদ এ-অঞ্চলকে করে দিয়েছিল একেবারে ধ্বংসস্তূপ। আমার সেই রুশ বালিকার কাহিনীও মনে পড়ল। কে যেন শুনিয়েছিল কাহিনীটি। নিজের গোটা পরিবারকে জার্মানদের নির্মম মেশিনগানের সামনে আহুতি দিতে দেখে ভয়ে-বিভীষিকায় পলকের মধ্যে তার মাথার সব চুল শাদা হয়ে গিয়েছিল।
অথচ এরা সবাই উনিশ শ পঁয়তাল্লিশোত্তর ইউরোপের নবীন বংশধর।
মানবতার সেবক যিশুর অনুসারী পশ্চিম ইউরোপ তার সন্তানদেরকে উত্তরাধিকার সূত্রে কী দিয়েছে!
‘তোমার মা এখন কী করেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘তিনি এখন হাউস-কিপার। সামরিক বিধবা হিসেবে পেনশন পান। আমাদের দু কামরার ছোট ঘর। আমি সন্ধের শিফটে এক ফ্যাক্টরিতে কাজ করি। আমার মা খুব ভালো। এসট্রলজিতে পূর্ণ বিশ্বাসী, রীতিমতো গির্জায় যান। গত বছর আমি সাইকেলে সারা জার্মানি ভ্রমণ করেছি। জার্মানি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশ।
‘সব দেশই তার বাসিন্দাদের কাছে সুন্দর। কিন্তু তুমি নব্য-নাৎসি যেন না-হয়ে ওঠ।’
‘না আমি নাৎসি হব না। ইহুদিদের প্রতি আমার কোনো ঘৃণা নেই।’
সে সহজে বলল। আমার হাসি পেল।
‘আমার মাতুলরা এখনো পূর্ব জার্মানিতে রয়েছে। যেমন আপনাদের কিছু লোক এখানে, আর কিছু পাকিস্তানে।’ সে ম্যাপ দেখিয়ে বোঝাল।
দ্বিতীয় দিন সে কথা দিয়েছিল শহরের দর্শনীয় সব কিছু দেখবে। কিন্তু সে দিনও সারাক্ষণ সে রানিবাগে বসে কাটাল।
চতুর্থ দিন ছেলেটা ওয়ার্ডেন রোডে ভুলা ভাই দেশাই ইন্সটিটিউটের বারান্দায় বসে লাওস যুদ্ধ সম্পর্কিত প্রবন্ধ পড়ে দিনটা কাটিয়ে দিল।
ভেতরে মেয়েরা নাচ শিখছিল আর হলঘরে হুসেনের নতুন চিত্র প্রদর্শনী হচ্ছিল।
বোম্বের সব দূরত্ব সে পায়ে হেঁটে পার করত। ওয়ার্ডন রোড থেকে ফ্লোরা ফাউন্টেন অবধি সে পায়ে হেঁটে গেছে। আমার মনে হত, জার্মান জাত নিঃসন্দেহে জীন বা দেও জাত-সম্ভূত।
‘আমি আট আনা থেকে এক টাকা পর্যন্ত রোজ খরচ করি। প্রায়ই কলা খেয়ে থাকি। সবখানেই অতিথিপরায়ণ লোক মিলে যায়। কেমন আশ্চর্য দেখুন, মানুষ এককভাবে কত সাদাসিধে এবং নিষ্পাপ, অথচ সমষ্টির আবর্তে সে পশুর মতো।’
সে মুখ উঁচু করে বসল। সেদিন সে এক ট্রাক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে এসেছে। বাঙ্গালোর অবধি সে ট্রাকে চড়ে যাবে। খুব সকালে সে তার বই-পত্র, কাপড়-চোপড়, তাঁবু আর বিছানা দিয়ে থলে দুটি ভরে কাঁধে তুলে নিল। এবং খোদা হাফেজ বলে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির অফিস ফ্লোরা ফাউন্টেনে যাবার উদ্দেশে পায়ে হেঁটে রওনা দিল।
অটো চলে গেছে কয়েক মাস হল। আসান মামুর চিঠি এলে আমি তাকে অভিযোগ করে লিখলাম, অটো এখান থেকে সেই যে গেল আর একটা খবরও দিল না, সে এখন কোথায়-কোথায় ফিরছে। আসান মামুর চিঠি ডাকে দিয়ে ফিরতেই বিকেলের ডাকে অটোর চিঠি এল। খামে লাওসের রাজার ছবি। চিঠিতে লিখেছে–
‘সেই জার্মান ছেলেটি, যে আপনার বাড়িতে দিনকয় ছিল আপনাকে ভুলে যায়নি। আপনি আমার জন্য যথেষ্ট করেছেন। (মাফ করবেন, আমি ইংরেজিতে দুর্বল) আপনি। আমাকে বড় বোনের মতো স্নেহ দিয়েছেন। আমি ভালোবাসায় আস্থাবান। এর কারণ হয়তো আমি এখনো কমবয়সী। কিন্তু আপনি ঠিকই বলেছেন, পৃথিবীতে সে-সব লোকেরাই সুখী, যারা কোনো দিকে না-দেখে, প্রশ্ন না-করে সবকিছু মেনে নেয়। আমরা যতই প্রশ্ন করছি ততই মনে হচ্ছে যে, জীবনটা নিছক অর্থহীন।
লংকায় নিউরেলিয়া থেকে কেনেডি পর্যন্ত এক টুরিস্ট বাসে গিয়েছি। বাসে এক সিংহলি ছাত্রের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। সে আমাকে খাইয়েছে। নাম তার রাজা। সে আমার জন্যে পথ থেকে কিছু ফুলও কিনেছে। বাসে ক’টা ঢোল ছিল। রাজা সেগুলো বাজিয়ে গান গেয়েছে। আমার খুব ভালো লেগেছে সে গান। এক সময় রাজা আমাকে বলল, চল, স্নান করি। অথচ কয়েক মিনিট পরে সে মরে গেল। হঠাৎ পানিতে ডুবে গিয়েছিল। দু’ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর আমরা তার শব একটা বাকের নিচে পেলাম। এসব কী? আমি ভাবতে লাগলাম, এমন হল কেন? আমাদের কেউই রাজাকে বাঁচাতে পারল না। এটা কি ঘটনাচক্রে ঘটল, না এটাই তার ভাগ্য? রাজা মা-বাবার একমাত্র ছেলে। তার বোন এবং ভাইও পাঁচ থেকে পনের বছরের মধ্যে মরেছে। তার বাপ অন্ধ। মা-ও বড় রুগ্ণা, রাজাই তাদের একমাত্র ভরসা ছিল।
মাদ্রাজের এক যুবক কবি আমাকে জানাল, এই পৃথিবীর কারণে সে খুব দুঃখী। মাদ্রাজে আমি রেডিও ইন্টারভিউ দিয়ে কিছু টাকা উপার্জন করেছিলাম। সেখান থেকে আমি এসেছি পেনাং। খুব সুন্দর দ্বীপটা। এখানে অনেক চীনা থাকে।
এক মালগাড়ির শেষ ডাব্বায় চড়ে আমি ব্যাংককে পৌঁছেছি। এখানে এক বৌদ্ধ মন্দিরে থাকি। মন্দিরের যাজকদের সঙ্গে আমি খাবার খাই। দ্বিপ্রহরের সময় সুন্দরী মেয়েরা এবং মহিলারা নানা বেশ-ভূষায় তাদের ভাগ্য এবং ভবিষ্যৎ জানবার জন্যে যাজকের কাছে আসে।
বেশিরভাগ ভিক্ষুই প্রেম-পিয়াসী। দেদার তামাক টানে। কোনো কাজ করে না। ধর্মভীরু বৃদ্ধরা তাদের খাবার এবং পয়সা জোগায়। অনেক ভিক্ষুই মন্দিরে এসেছে পরিশ্রম ভালো লাগে না বলে। লোকগুলো ভারি দুর্বল। তাদের ধর্মে এই হীনতার এক সুস্পষ্ট বৈধতাও বিদ্যমান। এদের অনেকে যথানিয়মে শুচি হয়ে যোগসাধনায়ও বসে। বেশিরভাগ ভিক্ষুই খাওয়া এবং মেয়েদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া বাকি সময় শুয়ে-শুয়ে কাটায়।
নাংকাইতে আমি মেকং নদীতে স্নান করেছি। তারপর চলে এসেছি লাওসে।
দিয়েন ভিয়েন একটা বড় গ্রামের মতো। রৌদ্র বড় কড়া। সড়কগুলো ধুলোয় ধূসর। শুধু রাতগুলো বড় সুন্দর। অন্ধকার সব কদাচার, অত্যাচার, হানাহানি এবং রক্তপাত বুকে লুকিয়ে নেয়। এখানে মশা খুব বেশি।
সুফানা অবধি এক প্লেনে ফ্রি লিফট পেলাম। এখন আমি পাকশাতে আছি। তারপর যাব কম্বোডিয়া। আঙ্কল আহমদের ওখানে মানে চিটাগাংয়ে যেতে পারিনি। বর্মায় প্রবেশ করতে হিমশিম খেয়ে গেছি। আমি লালচীন এবং ভিয়েতনামের ভিসার জন্যে দরখাস্ত করেছি। পিকিং বা হ্যাঁনয়ে গিয়ে জবাব পেয়ে যাব। কাল আমি এখান থেকে দক্ষিণ ভিয়েতনাম যাচ্ছি।
আপনার চিরকৃতজ্ঞ
‘অটো’
.
উনিশ শ তেষট্টির এক বিদেশি পত্রিকার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ভিয়েতনামের অরণ্যপুরী’ শীর্ষক রঙিন সচিত্র প্রবন্ধ ছাপা হয়। তাতে রয়েছে গেরিলা সৈন্যদেরকে গুলি করে মারার দৃশ্য। নৌকায় করে গেরিলা কয়েদিদেরকে মেকং নদী পার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কৃষাণ মেয়েরা তীরে দাঁড়িয়ে দেখছে। ওপারে পৌঁছলে তাদেরকে গুলি করে মারা হবে। প্রবন্ধের শেষ দিকে দু পৃষ্ঠাব্যাপী রঙিন ছবি। তাতে সজীব ধানক্ষেতের দৃশ্য। ধানের শীষ হাওয়ায় দুলছে। প্রান্তসীমায় গাছের লম্বা পাতা দুলছে। সবুজ সতেজ বনানী আর তার পাশে ছলছল করা নদী। বড় মনোরম দৃশ্য। শিল্পী যা দেখে ছবি আঁকে, কবি কবিতা লেখে, আর গাল্পিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পটভূমিকায় গল্প লেখে ঠিক তাই। কিন্তু এ-ছবির শেষদিকে বিস্রস্ত বিবর্ণ অর্ধনগ্ন রক্তাক্ত এক যুবক পড়ে আছে। কিছু দূরে কালো রঙের যুদ্ধবিমান দাঁড়িয়ে আছে ভয়াল দানবের মতো। ছবির নিচে লেখা রয়েছে,
‘মৃত্যুর খামার’
একজন ভিয়েতকং গেরিলা, যাকে মেকং নদীর ধানক্ষেতে মারা হয়েছে, তার সঙ্গীরা একে অপরের সঙ্গে রশি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে এক কোণে। এই রক্তাক্ত খণ্ড-যুদ্ধের সময় এক পর্যটক যুবক মেকং নদী পার হয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনাম যাচ্ছিল। হঠাৎ ফসকে যাওয়া এক গুলি তাকে ভেদ করে যায়। এই সুন্দর দেশে ১৯৪৪ সাল থেকে যুদ্ধ চলে আসছে, এবং…।
সদগতি – প্রেমচন্দ
এক
বাড়ির দরজায় ঝাট দিচ্ছে দুখী চামার। ওর বৌ ঝুরিয়া গোবর দিয়ে ঘর নিকোচ্ছে। দু’জনেরই কাজ সারা হলে ঝুরিয়া দুখীকে বলল, এবার তাহলে তুই গিয়ে পণ্ডিতমশাইকে বলে আয়, উনি আবার অন্য কোথাও বেরিয়ে-টেরিয়ে যান।
দুখী–হ্যাঁ যাচ্ছি, কিন্তু ভেবে দেখ তো উনি বসবেন কিসে?
ঝুরিয়া–কোথাও একটা খাঁটিয়া-ফাটিয়া পাবি না? বামুনপাড়া থেকে না-হয় একটা চেয়ে নিয়ে আসিস।
দুখী–তুই মাঝেমাঝে এমন সব কথা বলিস যে, শুনলে পিত্তি জ্বলে যায়। বামুনপাড়ার ওনারা আমাকে খাঁটিয়া দেবে কেন! একটুকুন আগুন পর্যন্ত বাড়ি থেকে দেয় না, খাঁটিয়া দেবে! কুয়োর ধারে গিয়ে এক ঘটি জল চেয়ে পাই না, আর খাঁটিয়া দেবে! এ কি আমাদের খুঁটে, কঞ্চি, ভূষা কিংবা কাঠ যে, যার যেমন খুশি নিয়ে চলে যাবে। নে, আমাদের খাঁটিয়াটাকেই ধুয়েটুয়ে রেখে দে। গরমের দিন, ঠাকুরমশাই আসতে-আসতে শুকিয়ে যাবে।
ঝুরিয়া–আমাদের খাঁটিয়াতে উনি বসবেন না। দেখিসনি কী রকম আচারে-বিচারে থাকেন।
দুখী একটু চিন্তিত হয়ে বলল, তাও তো বটে। তাহলে মহুয়াপাতা পেড়ে এনে একটা আসন বানিয়ে নিলে হয় না। মহুয়া তো বড়-বড় লোকেরা খায়। মহুয়াপাতা পবিত্তর। দে তো লাঠিটা, ক’টা পাতা পেড়ে আনি।
ঝুরিয়া–পাতা দিয়ে আসন আমি বানিয়ে রাখবখন। তুই যা। আর হ্যাঁ, ঠাকুরমশাইয়ের জন্যে তো সিধেও নিতে হবে। আমাদের থালাটাতে সিধে সাজিয়ে রেখে দেব।
দুখী–কখনো অমন সব্বনাশটি করিস না। তাহলে সিধেও যাবে, থালাখানাও ভাঙা পড়বে। একটান মেরে বাবাঠাকুর থালাখানাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। ওনার বড় তাড়াতাড়ি রাগ চেপে যায়, রাগ চাপলে বামুনমাকেও ছেড়ে কথা কন না; ছেলেটাকে তো এই সেদিন এমন ঠ্যাঙানি ঠেঙিয়েছেন যে, বেচারা আজও ভাঙা হাত নিয়ে ঘুরছে। পাতাতে করেই সিধে দিস। হ্যাঁ, দেখিস তুই কিন্তু কিছু ছুঁস না। গোঁড়ের মেয়েকে ডেকে নিয়ে সাহুর দোকান থেকে সব জিনিস নিয়ে আসিস। সিধেতে সব জিনিস যেন ঠিক থাকে। সেখানেক আটা, আধ সের চাল, পোয়াটাক ডাল, আধপো ঘি, নুন-হলুদ না দিস আর পাতার এক কোণে চার আনা পয়সাও রেখে দিস। গোঁড়ের মেয়েকে না-পেলে তুই ভুর্জিনক হাতে-পায়ে ধরে ডেকে নিয়ে যাস। দেখিস তুই কিন্তু কিছু ঘঁস না, তাহলে সব্বনাশ হয়ে যাবে।
সব কথা ভালো করে বুঝিয়ে-পড়িয়ে দুখী লাঠিটা নিয়ে ঘাসের একটা বড়সড় গাঁটরি মাথায় চাপিয়ে পণ্ডিতমশাইকে খোশামুদি করতে চলল। খালি হাতে বাবাঠাকুরের সামনে যায় কোন মুখে। আর নজরানা বলতে ঘাস ছাড়া ওর কাছে আর কিই-বা আছে। ওকে খালি হাতে দেখলে ঠাকুরমশাই তফাৎ থেকেই যে দূর-দূর করে খেদিয়ে দেবেন।
দুই
পণ্ডিত ঘাসীরাম পরম ঈশ্বরভক্ত। ঘুম থেকে উঠেই পূজার্চনা নিয়ে পড়েন। হাতমুখ ধুতে-ধুতে আটটা বাজে। তারপর শুরু হয় পুজো। পুজোর প্রথম কাজ হল ভাঙ ঘোটা। তারপর আধঘণ্টা ধরে বসে চন্দন ঘষেন, আয়নার সামনে বসে একটা কাঠি দিয়ে কপালে তিলক আঁকেন। চন্দনের দুটো রেখার মাঝখানে সিদুরের লাল ফোঁটা কাটেন। একে-একে বুকে, হাতে, গোল-গোল মুদ্রা আঁকেন চন্দনের। এরপর ঠাকুরের বিগ্রহকে স্নান করান, চন্দন দিয়ে সাজান, সামনে ফুল দেন, আরতি করেন, ঘণ্টা বাজান। দশটা নাগাদ উনি পুজো সেরে ওঠেন। ভাঙের শরবত খেয়ে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। ততক্ষণে দু’-চারজন যজমান এসে পড়ে বাড়িতে। ঠাকুরপুজোর ফল হাতে-হাতে পেয়ে যান। এই হল ওঁর পেশা।
আজ ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে এসে উনি দেখেন দুখী চামার এক গাঁটরি ঘাস নিয়ে বসে আছে। দুখী ওকে দেখেই সাষ্টাঙ্গে দণ্ডবৎ করে জোড়হাতে উঠে দাঁড়ায়। বাবাঠাকুরের তেজোময় মূর্তি দেখে দুখীর হৃদয় শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে! আহা কী দিব্য মূর্তি। ছোটখাট গোলগাল চেহারা, মসৃণ ভাল, প্রসন্ন বদন, ব্রহ্মতেজে প্রদীপ্ত নয়ন। সিঁদুরে আর চন্দনরেখায় দেখাচ্ছে যেন দেবতা!
দুখীকে দেখে শ্রীমুখে বলে ওঠেন, আজ কী মনে করে এলি রে দুখীয়া!
দুখী মাথা হেঁট করে বলে, মেয়েটার বিয়ে দিচ্ছি বাবাঠাকুর! পাঁজিপুঁথি দেখে একটা শুভলগ্ন দেখে দিতে হবে যে। কখন দয়া হবে বাবা?
ঘাসী–আজ তো সময় হবে না রে। ঠিক আছে, না-হয় সন্ধে নাগাদ যাব।
দুখী–না না, বাবাঠাকুর, একটু তাড়াতাড়ি চলুন। আমি সব কিছু ঠিকঠাক করে রেখে এসেছি। এই ঘাসটা কোথায় রাখি?
ঘাসী–এই গরুটার সামনে দিয়ে দে ওটা। আর ঝাড়গাছা নিয়ে বাড়ির দরজাটা একটু ঝটপাট দিয়ে পরিষ্কার করে দে তো। বৈঠকখানাটাও আজ ক’দিন ধরে লেপা-পোঁচা হয়নি। ওটাকে একটু গোবর দিয়ে লেপে দে। আমি ততক্ষণে সেবাটেবা সেরে নিই। তারপর একটুখানি বিশ্রাম নিয়ে যাব। হ্যাঁ, এই কাঠটাকেও একটু চিরে দিস তো। আর শোন, খামারে ঝুড়ি চারেক ভূষি পড়ে আছে, ওগুলোকে নিয়ে এসে ভূষি রাখার ঘরটায় রেখে দিস, কেমন।
দুখী সঙ্গে-সঙ্গে হুকুম তামিল করতে শুরু করে দিল। দরজায় ঝাড় দিল, বৈঠকখানাকে নিকিয়ে দিল গোবর দিয়ে। এসব কাজ সারতে-সারতে বেলা বারোটা বেজে গেল। পণ্ডিতমশাই খেতে যান। দুখী সকাল থেকে কিছু খায়নি। জোর খিদে পেয়েছে ওরও; কিন্তু এখানে কে ওকে খেতে বলেন। বাড়ি এখান থেকে মাইলখানেক দূরে। বাড়ি খেতে গেলে পণ্ডিতমশাই যদি রাগ করেন। বেচারা খিদে চেপে কাঠ চিরতে শুরু করল। মোটা মতন একটা গাঁট, এর ওপর এর আগে কত-না শিষ্য তাদের শক্তি পরীক্ষা করছে। দুখীও একই শক্তি আর দৃঢ়তার সঙ্গে এই কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হল। দুখীর কাজ ঘাস কেটে বাজারে নিয়ে গিয়ে বেচা। কাঠ চোরার অভ্যাস আদৌ নেই তার। ঘাস ওর খুরপির সামনে মাথা নোয়ায়। দুখী ঠিকরে যায়। ঘেমে নেমে ওঠে দুখী, হাঁপাতে থাকে, অবসন্ন হয়ে বসে পড়ে, আবার উঠে দাঁড়ায়। হাত ওঠাতে গিয়ে ওঠাতে পারে না। পা দুটো কাঁপে, কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। চোখে আঁধার ঘনিয়ে আসে, মাথা ঝিমঝিম করে! তবুও সে কাজ করে চলে। ভাবে, এক ছিলিম তামাক যদি টানতে পেতাম হয়তো একটু তাগদ পেতাম। কিন্তু কলকে তামাক এখানে পাব কোথায়? বামুনদের পাড়া। বামুনরা তো আর। আমাদের নিচু জাতের মতন তামাক খায় না। হঠাৎ খেয়াল হয় এ-গাঁয়ে তো এক ঘর গোড়ও আছে। ওর কাছে গেলে ঠিকই কল্কে-তামাক পাওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে দুখী ছোটে ওর বাড়ি। যাক্, পরিশ্রম সার্থক হয় সে তামাক দেয়। কিন্তু আগুন পাওয়া গেল না সেখানে। দুখী বলে, আগুনের জন্য ভেব-না ভাই! আমি যাচ্ছি, পণ্ডিতমশাইয়ের বাড়ি থেকে চেয়ে নেব। ওঁর বাড়িতে তো এই একটু আগেও রান্না হচ্ছিল।
এই বলে জিনিস দুটো নিয়ে দুখী চলে আসে। পণ্ডিতমশাইয়ের বাড়ির দেউড়িতে দাঁড়িয়ে ডাকে, বাবাঠাকুর, একটুন আগুন যদি পেতাম এক ছিলিম তামাক টেনে নিতাম।
পণ্ডিতমশাই খেতে বসেছিল। বামুনগিন্নী জিজ্ঞেস করেন, আগুন চাইছে কে এটা?
পণ্ডিত–আরে ওই শালা দুখিয়া চামার। ওকে বলেছি কাঠটাকে একটু চিরে দিতে। আগুন তো রয়েছে, দাও-না একটু।
বামুনগিন্নী ভুরু কুঁচকে বলে ওঠেন, পুঁথিপত্তরের ফেরে পড়ে ধরম-করম সব কিছুর তো মাথা খেয়ে বসে আছ। চামার হোক, ধোপা হোক, নাপিত হোক, মাথা উঁচু করে একেবারে ভেতরবাড়িতে চলে আসবে! এ যেন হিন্দুর বাড়ি নয়, একটা সরাইখানা। বলে দাও পোড়ারমুখোকে চলে যেতে, না হলে এই পোড়াকাঠ দিয়ে মুখ পুড়িয়ে দেব। আগুন চাইতে এসেছে!
পণ্ডিতমশাই বুঝিয়ে বলেন, ভেতরে চলে এসেছে তো কী হয়েছে? তোমার তো। কোনো কিছু ছোঁয়নি। মাটি হল পবিত্র। একটুখানি আগুন দিয়ে দিচ্ছ-না কেন? কাজটা। তো আমাদেরই করছে। কোনো মজুর লাগিয়ে এই কাঠ চেলাতে গেলে কম করে চার আনা পয়সা তো নিত।
বামুনগিন্নি মুখঝামটা দিয়ে বলেন, ওটা বাড়িতে ঢুকেছে কেন?
হার মেনে বলেন পণ্ডিতমশাই-শালার কপাল খারাপ, এছাড়া আর কী?
বামুনগিন্নী–বেশ, এবারের মতো আগুন দিয়ে দিচ্ছি; কিন্তু আবার যদি এভাবে কোনো ব্যাটা বাড়িতে ঢোকে তো তার মুখে নুড়ো জ্বেলে দেব।
সব কথাই কানে আসে দুখীর। মনে-মনে পস্তাচ্ছে–কেন যে শুধু-শুধু এলাম। সত্যি কথাই তো। বামুনপণ্ডিতের বাড়ির ভেতরে চামার ঢোকে কী করে! বড় পবিত্তর এনারা, তাই তো দুনিয়ার সবাই এত খাতির করে, তাই তো এত মান্যিগন্যি। মুচি-চামার তো নয়। এই গাঁয়েই বুড়ো হলাম। আর এ আক্কেলটুকুন হল-না আমার। তাই বামুনগিন্নী আগুন নিয়ে বেরুলে দুখী যেন হাতে স্বর্গ পায়। জোড় হাত করে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বলে, মা-ঠাকরুণ, বড় ভুল হয়ে গেছে গো। বাড়ির ভেতরে চলে এসেছি। চামারের বুদ্ধি তো মা! এতটা মুখ্যসুখ্য যদি নাই হব, তাহলে লাথিঝেটা খাব কেন?
বামুনগিন্নী চিমটেয় ধরে আগুন এনেছেন। হাতপাঁচেক দূরে দাঁড়িয়ে ঘোমটার আড়াল থেকে আগুনটাকে দুখীর দিকে ছুঁড়ে দিলেন। বড় একটা আগুনের টুকরো এসে দুখীর মাথায় পড়ল। তাড়াতাড়ি পিছু হটে সে মাথা ঝাঁকাল। তার মন বলে উঠল, এ হল গে পবিত্তর বামুনের বাড়িকে অপবিত্তর করার সাজা। ভগবান হাতে-হাতে সাজা দিয়ে দিয়েছেন। এজন্যেই তো সারা দুনিয়া বামুনদের এত ভয় করে। অন্যসব লোকের টাকা-পয়সা মার যায়। কই বামুনদের পয়সা মেরে নিক তো কেউ। গুষ্টিসুষ্ঠু সবার সব্বনাশ হয়ে যাবে না, পা পচে-পড়ে খসে পড়বে-না!
বাইরে এসে সে তামাক খায়, তারপর আবার কুড়ল নিয়ে কাজে লেগে পড়ে। খটাখট আওয়াজ আসতে থাকে।
ওর গায়ে আগুন পড়েছে, তাই বামুনঠাকরুনের একটু মায়া হয় দুখীর ওপর। পণ্ডিতমশাই খেয়ে উঠলে বলেন, চামারটাকে একটু কিছু খেতেটেতে দাও, বেচারা সেই কখন থেকে কাজ করছে, খিদে থাকতেই পারে।
পণ্ডিতমশাই এই প্রস্তাবটার বাস্তব দিকটা উপলব্ধি করে জিজ্ঞেস করেন, রুটি আছে?
পণ্ডিতগিন্নী–দু’চারখানা হয়তো বেঁচে যাবে।
পণ্ডিত দু’চারখানা রুটিতে কী হবে? ব্যাটা চামার, কম করে সেরখানেক তো গিলবে।
পণ্ডিতগিন্নী কানে হাত দিয়ে বলেন, ওরে বাপ রে! সেরখানেক! তাহলে থাকগে।
পণ্ডিতমশাই এবার উল্টো চাপ দেন, বলেন–কিছু ভুষি-টুষি থাকলে আটার সঙ্গে মিশিয়ে দু’খানা মোটা চাপাটি সেঁকে দাও না, শালার পেট ভরে যাবে। ওই পাতলা-পাতলা রুটিতে এসব ছোটলোকের পেট ভরে না। এদের তো জোয়ারের মোটা চাপাটি চাই।
পণ্ডিতগিন্নী বলেন, ছাড়ো তো, এই দুপুর-রোদে কে মরতে যাবে ওসব করে।
তিন
দুখী তামাক খেয়ে আবার কুড়ল নেয়। দম নিয়ে হাতে একটু জোর পায়। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে একনাগাড়ে কুড়ল চালিয়ে যায়। তারপর অবসন্ন হয়ে সেখানে মাথাটা চেপে ধরে বসে পড়ে।
এর মধ্যে গোঁড় এসে পড়ে। বলে–কেন জানটা খোয়াচ্ছ বুড়োদাদা। কোপানিতে এই গাঁট ফাটবে না। শুধু-শুধু হয়রান হচ্ছ।
কপালের ঘাম মুছে দুখী বলে–এখনো একগাড়ি ভুষি বয়ে আনতে হবে রে ভাই।
গোঁড়–খেতে-টেতে কিছু দিয়েছে, না শুধু কাজই করিয়ে চলেছে। গিয়ে চেয়েটেয়ে কিছু নিচ্ছ-না কেন?
দুখী–বলছ কী চিখুরী! বামুনের অন্ন কি আমাদের পেটে হজম হবে?
গোঁড়া–হজম ঠিকই হবে, আগে পাও তো। গোঁফে তা দিয়ে তো ঠিকই খেয়ে নিয়ে তোমাকে কাঠ চেরার হুকুম দিয়ে আরাম করে ঘুমুচ্ছে, জমিদারও তো কিছু না-কিছু খেতে দেন। হাকিমও বেগার খাটালে কিছু না-কিছু মজুরি দেন। ইনি ওঁদেরও ছাড়িয়ে গেছেন। নিজেকে ধাম্মিক বলে জাহির করছেন।
দুখী–আস্তে-আস্তে বল্রে ভাই, শুনে-টুনে ফেললে বিপদ হবে। বলে দুখী আবার কুড়ল চালাতে লাগল। দুখীকে দেখে চিখুরীর দয়া হল। এগিয়ে এসে ওর হাত থেকে কুড়লখানাকে কেড়ে নিয়ে একনাগাড়ে আধঘণ্টা খুব জোরে-জোরে কুড়ল চালাল; কিন্তু গাঁটে একটুখানি ফাটও ধরল না। কুড়লটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে বলতে চাইলে–এ ঘাট চেরা তোমার কম্ম না, জান গেলেও পারবে না।
দুখী ভাবে–বাবাঠাকুর এই গাটটা পেলেন কোথায়, যাকে এত কুপিয়েও চেরা যাচ্ছে না। কোথাও একটুখানি চিড় পর্যন্ত খাচ্ছে না। আমি কতক্ষণ ধরে কোপাব এটাকে? ওদিকে বাড়িতে এখনও শতেক কাজ পড়ে রয়েছে। কাজকম্মের বাড়ি, একটা-না-একটা কাজ তো লেগেই আছে। কিন্তু এতে কার কী মাথাব্যথা! যাই ততক্ষণে না-হয় ভুষিগুলোই নিয়ে আসি। বলব, বাবাঠাকুর, আজ তো কাঠ চিরতে পারলাম না, কাল এসে না-হয় চিরে দেব।
ঝুড়ি মাথায় করে দুখী ভুষি বয়ে আনল। বাড়ি থেকে খামার দুফার্লংয়ের কম নয়। খুব চাপাচাপি করে ঝুড়ি যদি ভরে আনতে পারত তাহলে কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেত বটে, কিন্তু মাথায় তুলে দেবে কে ঝুড়ি। পুরোপুরি ঠাসা ঝুড়িটাকে একা মাথায় তুলতে পারে না। তাই অল্প-অল্প করেই আনে। চারটে নাগাদ ভুষি আনা তার শেষ হয়। পণ্ডিতমশাইয়েরও ঘুম ভাঙে। মুখ-হাত ধুয়ে, পান খেয়ে বাইরে আসেন। দেখেন ঝুড়ির ওপর মাথা রেখে দুখী ঘুমুচ্ছে। জোরে হাঁক দেন–ওরে ও দুখিয়া! বলি, ঘুমুচ্ছিস? কাঠ তো এখনো যেমনকার ঠিক তেমনি পড়ে রয়েছে। এতক্ষণ তুই করছিলি কী? একমুঠো ভূযো আনতেই দিন কাবার করে ফেললি। তার ওপর আবার পড়ে-পড়ে ঘুমুচ্ছিস? নে নে, তোল কুড়ল। কাঠটা চিরে দে! তোকে দিয়ে একটুখানি কাঠ চেরানোও যায় না। লগনও তাহলে তেমনি হবে বুঝলি, আমাকে কিন্তু তখন দুষতে পারবি না। সাধে বলে, ছোট জাতের ঘরে খাবার জুটল তো ব্যস ওদের মতিও পালটে গেল।
দুখী আবার কুড়ল হাতে নিল। যেকথা বলবে বলে ভেবে রেখেছিল, সেসব ভুলে গেল। পেট পিঠে লেগে গেছে। সেই সকাল থেকে জলটুকু পর্যন্ত খায়নি। সময়ই পায়নি। উঠে দাঁড়াতেই কষ্ট হচ্ছে। দেহ বসে যাচ্ছে। তবু মনটাকে শক্ত করে উঠে দাঁড়াল সে। পণ্ডিতমশাই শুভ সময়টা ঠিকমতো যদি না-দেখে দেন, তাহলে হয়তো সব্বনাশ হয়ে যাবে। এজন্যেই তো সংসারে তার এত খাতির, এত মান। শুভ মুহূর্তেরই তো সব খেলা। যাকে ইচ্ছে শেষ করে ফেলতে পারলে ইনি। পণ্ডিতমশাই কাঠটার কাছে এসে দাঁড়ান, আর উৎসাহ দিয়ে যান–মার কষে, আবার মার-কষে মার কী রে, মার। না রে জোরে–তোর হাতে তো যেন জোরই নেই–লাগা কষে, দাঁড়িয়ে ভাবছিস কী! হা হা, ব্যস্ এই তো ফাটল বলে! দে দে, ওই ফাটলতাতেই আবার দে।
দুখীর হুঁশ থাকে না! না-জানি কী এক গুপ্তশক্তি ওর বাহু দুটিতে ভর করেছে। ক্লান্তি, অবসাদ, ক্ষুধা সবই যেন উবে যায়। নিজের বাহুবলে নিজেই অবাক। এক-একটি আঘাত পড়ছে যেন বজ্রের মতো। আধঘণ্টা ধরে উন্মাদের মতো সে কুড়ল চালিয়ে যায়। শেষে কাঠখানাও মাঝখান দিয়ে ফেটে যায়। সেই সঙ্গে দুখীর হাত থেকে কুড়লটাও ছিটকে পড়ে। মাথা ঘুরে পড়ে যায় দুখী। ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় ক্লান্ত অবসন্ন শরীর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
পণ্ডিতমশাই ডাকেন–নে রে, উঠে দু’চার কোপ আরও দিয়ে দে। পাতলা-পাতলা চ্যালা করে দে। দুখী ওঠে না। পণ্ডিতমশাইও ওকে আর এখন বিরক্ত করা উচিত মনে করেন না। ভেতরে গিয়ে ভাঙের শরবত খান, শৌচকর্ম সারেন, স্নান করেন, তারপর পণ্ডিতমশাইয়ের পোশাকে সেজেগুজে বাইরে আসেন। দেখেন দুখী তখনো একইভাবে পড়ে রয়েছে। পণ্ডিতমশাই জোরে ডাক দেন–অ্যাই দুখী, তুই কি শুয়েই থাকবি রে, চল তোর বাড়িতেই যাচ্ছি। সব জিনিসটিনিস ঠিকঠাক জোগাড় করে রেখেছিস তো? দুঃখী কিন্তু তবু ওঠে না।
এবার পণ্ডিতমশাইয়ের মনে ভয় হয়। কাছে গিয়ে দেখেন, দুখী টানটান হয়ে পড়ে আছে। ভড়কে গিয়ে ভেতরে ছোটেন, গিয়ে বামুনগিন্নীকে বলেন, দুখিয়াটা মনে হচ্ছে মরে গেছে।
পণ্ডিতগিন্নী হকচকিয়ে বলেন–তো! এক্ষুণি তো কাঠ চিরছিল!
পণ্ডিত–হ্যাঁ, কাঠ চিরতে-চিরতে মরে গেছে। সর্বনাশ হয়েছে, এখন কী হবে?
পণ্ডিতগিন্নী ঠাণ্ডা গলায় বলেন–কী আবার হবে, চামারবস্তিতে খবর পাঠিয়ে দাও মড়া তুলে নিয়ে যাবে।
কিছুক্ষণের মধ্যে সারা গায়ে খবর রটে যায়। বামুনদেরই ঘর সব। কেবল এক ঘর গোঁড়। ওদিকের রাস্তা দিয়ে হাঁটা সবাই ছেড়ে দেয়। কুয়োতে যাবার রাস্তা ওদিক দিয়েই, জল আনবে কী করে! চামারের মড়ার পাশ দিয়ে জল আনতে যাবে কে? এক বুড়ি গিয়ে পণ্ডিতমশাইকে বলে, এখনো মড়াটা ফেলাচ্ছ না যে। গায়ে কেউ জলটল খাবে-না নাকি!
এদিকে চিখুরী চামারবস্তিতে গিয়ে সবাইকে সাবধান করে দিয়ে আসে–খবরদার, মড়া আনতে কেউ যাবি না। এক্ষুনি পুলিশ আসবে, তদন্ত হবে। মজা পেয়েছ নাকি যে একটি গরিব বেচারাকে এভাবে পরানে মেরে ফেলবে। পণ্ডিতই হন আর যেই হন, সে তো নিজের কাছে। লাশ যদি তোরা আনিস তবে পুলিশ তোদেরও বেঁধে নিয়ে যাবে।
তার কথার পর-পরই পণ্ডিতমশাই গিয়ে পৌঁছান। কিন্তু চামারবস্তির কোনও লোক লাশ তুলে আনতে রাজি হয় না। শুধু দুখীর বউটা আর মেয়েটা হাহাকার করতে-করতে ছুটে যায়। পণ্ডিতমশাইয়ের বাড়ির দরজায় গিয়ে ওরা কপাল চাপড়ে-চাপড়ে ডুকরে কাঁদতে থাকে। ওদের সঙ্গে আরও পাঁচ-দশটা চামার মেয়েছেলে–কেউ কাঁদছে, কেউ-বা ওদের সান্ত্বনা দিচ্ছে। চামার বেটাছেলে নেই কেউ। পণ্ডিতমশাই চামারদের ওপরে খুব চোটপাট করেন, বোঝান, কাকুতি-মিনতি করেন, কিন্তু চামারদের সবার মনে পুলিশের ভয় এতটা ছড়িয়ে পড়েছে যে, একজনও রাজি হয় না। শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে উনি ফিরে আসেন।
চার
মাঝরাত পর্যন্ত কান্নাকাটি চলে। ব্রাহ্মণ দেবতাদের পক্ষে ঘুমোনো মুশকিল হয়ে পড়ে। লাশ নিয়ে যেতে কোনও চামারই আসে না। এদিকে বামুনরাই-বা চামারের মড়া ছোঁবে কী করে। এমন কথাও কি কোনো শাস্ত্ৰ-পুরাণে লেখা আছে? কই, দেখিয়ে দিক তো কেউ!
পণ্ডিতগিন্নী গজর-গজর করেন–এই ডাইনিগুলো তো মাথা খেয়ে ফেললে। এগুলোর গলাও ব্যথা করে না!
পণ্ডিতমশাই বলেন–কাঁদুক পেত্নীগুলো, কতক্ষণ কাঁদবে? যদ্দিন বেঁচে ছিল, কেউ একবার পৌঁছেও নি। মরে গেছে, এখন চিল্লাচিল্লি করতে সবক’টা এসে জুটেছে।
পণ্ডিতগিন্নী–চামারের কান্না অলক্ষুণে নাকি গো?
পণ্ডিত–হ্যাঁ, বড্ড অমঙ্গলের।
পণ্ডিতগিন্নী–এখন থেকেই গন্ধ বেরুচ্ছে।
পণ্ডিত–চামার তো। খাদ্যাখাদ্যের কি কোনও বাছবিচার আছে ওগুলোর?
পণ্ডিতগিন্নী–ওগুলোর ঘেন্নাও করে না।
পণ্ডিত–সবকটা ভ্রষ্ট।
.
রাত তো কাটল কোনও মতে, কিন্তু সকালেও কোনও চামার এল না। চামার মেয়েছেলেরাও কেঁদেকেটে চলে গেছে। একটু-একটু করে ছড়াতে শুরু করেছে দুর্গন্ধ। পণ্ডিতমশাই একগাছি দড়ি নিয়ে আসেন। দড়ির ফাঁস বানিয়ে মড়ার পায়ে ছুঁড়ে দেন। তারপর টান মেরে কষে নেন ফাসটা। আবছা-আবছা অন্ধকার। পণ্ডিতমশাই দড়ি ধরে লাশটাকে টানতে শুরু করেন। টানতে-টানতে গাঁয়ের বাইরে টেনে নিয়ে যান। সেখান থেকে ফিরে এসে স্নান করে নেন চটপট, চণ্ডীপাঠ করেন। তারপর সারা বাড়িতে গঙ্গা জল ছিটিয়ে দেন।
ওদিকে দুখীর লাশটাকে শেয়াল, শকুন, কুকুর আর কাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। তার আজীবন ভক্তি, সেবা আর ধর্মনিষ্ঠার পুরস্কার!
জঞ্জাল-বুড়ো – কৃষণ চন্দর
যখন সে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল, তখন ওর পাদুটো কাঁপছে। ওর সারা শরীর ভেজা তুলোর মতো চুপসে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছিল। ওর মন চলতে চাইছিল না, ওই ফুটপাথে বসে পড়তে চাইছিল।
জেল-হাসপাতালে তার আরো এক মাস থাকা উচিত ছিল, কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওকে ছেড়ে দিলেন। হাসপাতালের প্রাইভেট ওয়ার্ডে সে সাড়ে চার মাস ছিল আর দেড় মাস ছিল জেনারেল ওয়ার্ডে। এই সময়ের মধ্যে তার একটি কিডনি অপারেশন করে বাদ দেয়া হয়েছে, আর অন্ত্রের এক অংশ কেটে দিয়ে তার অন্ত্রের-ক্রিয়া ঠিক করে দেয়া হয়েছে। এখনো তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া স্বাভাবিক হয়নি। তবু হাসপাতাল ছেড়ে ওকে চলে আসতে হল, কারণ তার চেয়েও খারাপ অবস্থার অন্য রোগীরা প্রতীক্ষা করছে।
ডাক্তার তার হাতে এক লম্বা প্রেসক্রিপশন দিয়ে বলেছিল, এই টনিক খেয়ো আর পুষ্টিকর খাদ্য খেয়ো। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে, এখন আর হাসপাতালে থাকার কোনো আবশ্যকতা নেই।’
ডাক্তার সাহেব, আমি আর হাঁটতে পারছি না। সে ক্ষীণকণ্ঠে বলেছিল।
‘ঘরে যাও, কিছুদিন বিবি সেবাযত্ন করবে, বিলকুল ঠিক হয়ে যাবে।’
খুব ধীরে-ধীরে টলমলে পদক্ষেপে ফুটপাত দিয়ে চলতে-চলতে সে ভাবল, ঘর!–কিন্তু আমার ঘর কোথায়?’
কিছুদিন আগেও আমার একটি ঘর নিশ্চয় ছিল–ছিল এক বিবিও; তার এক বাচ্চা হবার কথা ছিল। তারা দুজনে ঐ আগতপ্রায় বাচ্চার কল্পনায় কত খুশি হয়েছিল। দুনিয়ার জনসংখ্যা অনেক হতে পারে, কিন্তু সে তো তাদের দু’জনের প্রথম সন্তান। দুনিয়ায় তাদের প্রথম সন্তান জন্ম নিতে আসছিল।
দুলারি খুব সুন্দর জামা সেলাই করেছিল নিজের বাচ্চার জন্য। হাসপাতালে তা নিয়ে এসে দেখিয়েছিল। আর ওই জামায় হাত বুলিয়ে তার মনে হয়েছিল যে, সে তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করছে।
কিন্তু গত কয়েক মাসের মধ্যে তাকে অনেক কিছুই হারাতে হল। যখন তার কিডনির প্রথম অপারেশন হয় তখন দুলারি নিজের গয়না বেচে দিয়েছিল। কারণ, গয়না তো এই রকম সময়ের জন্যই। লোকে ভাবে গয়না স্ত্রীলোকের সৌন্দর্য বাড়াবার জন্য, কিন্তু আসলে অন্য প্রয়োজন মেটাবার জন্যই তার ব্যবহার হয়। পতির অপারেশন, বাচ্চাদের লেখাপড়া, মেয়ের বিয়ে–এইসব প্রয়োজনের জন্যই স্ত্রীলোকের গয়নার ব্যাংক খালি হয়। স্ত্রীলোক গয়নাগাটি সামলাতে ব্যস্ত থাকে, আর জীবনে বড়জোর-পাঁচ-ছ’বার এই গয়না পরবার সৌভাগ্য লাভ করে।
কিডনির দ্বিতীয় অপারেশনের আগে দুলারির বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেল। তা তো হবেই– দুলারিকে দিনরাত খুব খাটুনি পোয়াতে হচ্ছিল, তার জন্যে এই বিপদ গোড়াতেই জমা ছিল। মনে হয়েছিল যে, দুলারির একহারা উজ্জ্বল শরীর এই কড়া খাটুনির জন্য তৈরি হয়নি। এইজন্য ঐ বুদ্ধিমান বাচ্চা মাঝপথেই সরে পড়েছে। বিরূপ পরিবেশ আর বাপ-মায়ের দুর্দশা আঁচ করতে পেরে সে নিজেই বুঝেছিল জন্ম নেয়া উচিত হবে না। কোনো-কোনো বাচ্চা এরকম বুদ্ধিমান হয়ে থাকে। দুলারি কিছুদিন হাসপাতালে আসতে পারেনি। তারপর যখন এসে সে খবরটা দিল তখন দুলারির স্বামী খুব কেঁদেছিল। যদি তার জানা থাকত যে-ভবিষ্যতে তাকে আরো অনেক কাঁদতে হবে তাহলে এই ঘটনায় কান্নার বদলে সে সন্তোষ প্রকাশ করত।
কিডনির দ্বিতীয় অপারেশনের পর তার চাকরি চলে গেল। দীর্ঘকালীন রোগভোগে এইরকমই হয়, কে আর কতদিন অপেক্ষা করতে পারে। রোগ তো মানুষের নিজস্ব ব্যাপার। এই কারণে যদি সে চায় যে তার চাকরি বজায় থাকবে, তবে তার দীর্ঘদিনের রোগভোগে পড়া ঠিক হবে না। মানুষ যন্ত্রের মতোই। যদি কোনো যন্ত্র দীর্ঘকাল ধরে বিগড়ানো অবস্থায় থাকে, তাহলে তাকে এক ধারে ফেলে রেখে দেয়া হয় আর তার জায়গায় নতুন যন্ত্র এসে যায়। কারণ কাজ থেমে থাকতে পারে না, ব্যবসা বন্ধ হতে পারে না, আর সময় থেমে থাকতে পারে না। কাজেই যখন তার উপলব্ধি হল যে, তার চাকরি চলে যাচ্ছে, তখন দ্বিতীয়বার কিডনি অপারেশনের সময় যে-রকম ধাক্কা লেগেছিল সে-রকমই লাগল। এই ধাক্কায় তার চোখ দিয়ে জলও পড়েনি। সে অনুভব করেছিল, তার হৃদয়ের মধ্যে এক শূন্যতা বিরাজ করছে, পায়ের তলা থেকে সরে যাচ্ছে। মাটি আর নাড়িতে রক্তের বদলে দ্রুত প্রবাহিত হচ্ছে ভয়।
কিছুদিন যাবৎ আগামী দিনগুলোর কথা ভেবে ভয়ে সে ঘুমোতে পারেনি। অনেকদিনের রোগের চিকিৎসায় খরচও হল অনেক। এক-এক করে ঘরের সব দামি জিনিস বিক্রি হয়ে গেল, কিন্তু দুলারি হাল ছাড়েনি। সে তার স্বামীকে সাড়ে চার মাস প্রাইভেট ওয়ার্ডে রেখেছিল, সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা করিয়েছিল সে তার, এক-এক করে নিজের ঘরের সব জিনিস বেচে দিয়েছিল আর শেষ পর্যন্ত চাকরিও নিয়েছিল। দুলারি এক ফার্মে কর্মচারী হয়েছিল। একদিন তাদের ফার্মের মালিককে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিল দুলারি। মালিক এক রোগা-পাতলা বেঁটে মতো লোক, মাঝবয়েসী আর লাজুক। তাকে দেখতে-শুনতে কোনো ফার্মের মালিকের বদলে কোনো দোকানের। মালিক বলে মনে হয়। দুলারিকে ওই ফার্মে দু’শ’ টাকার মাসমাহিনার কর্মচারী হয়ে যেতে হল, কেননা সে খুব বেশি লেখাপড়া জানত না। তার কাজ ছিল খামের উপর ডাকটিকিট লাগানো।
দুলারির স্বামী বলল, ‘এ খুব সহজ কাজ।’
ফার্মের মালিক বললেন, ‘কাজ তো সোজাই, কিন্তু যেদিন পাঁচ-ছশ’ চিঠির খামের উপর টিকিট লাগাতে হয় সেদিন এই খুব সোজা কাজই খুব কঠিন মনে হয়।’
দুলারি মুচকি হেসে বলল, ‘সত্যি খুব হয়রান হয়ে যাই।’
ফার্মের মালিক তাকে বললেন, ‘তুমি সেরে ওঠ, তারপর তুমি তোমার বিবির বদলে খামে টিকিট লাগিয়ো, আমি এই কাজ তোমাকে দেব।’
যখন ফার্মের মালিক চলে যাচ্ছেন তখন দুলারিও তার সঙ্গে চলে গেল। দুলারির স্বামী অনুভব করল যে, আজ দুলারির পদক্ষেপে এক অদ্ভুত আত্মমর্যাদা প্রকাশ পাচ্ছে। দুলারির শরীর কোনো এক ফুলন্ত ডালের মতো নমনীয় হয়ে গেছে। ওয়ার্ডের বাইরে এসে মালিক দুলারির জন্যে এক হাতে দরজা খুলে ধরে দুলারিকে দরজার বাইরে যেতে সাহায্য করতে কিছুটা ঝুঁকে পড়লেন, আর এক মুহূর্তের জন্য তাঁর অপর হাত দুলারির কোমরের ওপর রাখলেন। ফার্মের মালিকের প্রথম হাতের ভঙ্গি দুলারির স্বামীর ভালো লেগেছিল কিন্তু দ্বিতীয় হাতের ভঙ্গি পছন্দ হয়নি। কিন্তু সে আপন মনকে এ-কথা বলে সান্ত্বনা দিয়েছিল যে, কখনো-কখনো এক হাত যা করে তা অপর হাত জানতে পারে না। আবার এ-ও তো হতে পারে যে, তার চোখের নজর ঠিক নেই–কেবল ভ্রম মাত্র– এ-কারণে সে বিশ্বাসের সঙ্গে নিজের চোখ দুটি বন্ধ করে নরম-নরম বালিশের ওপর মাথা রেখে ঘুকোজ ইনজেকশনের প্রতীক্ষা করেছিল।
তার তৃতীয় অপারেশন হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডে হয়েছিল। সে সময় দুলারি ফার্মের মালিকের সঙ্গে দার্জিলিং চলে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত কে আর কতদিন অপেক্ষা করতে পারে! জীবন ক্ষণস্থায়ী আর জীবনের বসন্ত তার চেয়েও ক্ষণস্থায়ী। যখন আবেগ প্রবল হয় আর চোখে নেশা লাগে, যখন আঙুলের ডগায় আগুনের জ্বলুনি অনুভূত হয় আর বুকে মিষ্টি-মিষ্টি বেদনা হতে থাকে, যখন চুম্বন ভ্রমরের মতো ওষ্ঠের পাপড়ির ওপর এসে পড়ে আর বঙ্কিম হংসগ্রীবা কারো গরম-গরম নিঃশ্বাসের মৃদু আঁচে ব্যাকুল হয়, তখন কে কতদিন পর্যন্ত ফিনাইল আর পেচ্ছাবের গন্ধ শুঁকতে পারে, থুতু, পুঁজ আর রক্তের রঙ দেখতে পারে আর মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে-আসা হেঁচকি শুনতে পারে? সহ্য করার একটা সীমা আছে; বিশ বছরের যুবতী সহ্য কি করেনি? যার বিয়ের পর দু’বছরও পেরোয়নি, যে আপন পতির সঙ্গে বিপদ ছাড়া আর কিছুই দেখেনি, সে যদি আপন স্বপ্নে ভর করে দার্জিলিং চলে যায় তবে তাতে কার কী দোষ?
দুলারি যখন বাড়ি থেকে চলে যায় তখন দুলারির স্বামী অন্য কাউকে দোষী বলার মতো অবস্থা থেকে চ্যুত হয়েছিল। তার ওপর একটার পর একটা আঘাত এসে তাকে পাগল করে তুলেছিল। এখন তার বিপদ আর কষ্টে কোনো ভাবনা বা অশ্রু ছিল না। বারবার হাতুড়ির চোট খেয়ে ধাতুর পাতের মতো হয়ে গিয়েছিল তার হৃদয়। এই কারণে আজ সে (দুলারির স্বামী) যখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল তখন সে ডাক্তারের কাছে কোনো মানসিক যন্ত্রণার কথা বলেনি। সে ডাক্তারকে বলেনি, এই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এখন সে কোথায় যাবে? এখন তার নেই কোনো ঘর, নেই বিবি, নেই বাচ্চা, নেই কোনো চাকরি, তার হৃদয় শূন্য, তার পকেট ফাঁকা; তার সামনে এক বিরাট শূন্য ভবিষ্যৎ।
কিন্তু তখন সে কোনো কথাই বলেনি, কেবল বলেছিল, ‘ডাক্তার সাহেব, আমি আর চলতে পারছি না।’
ওই একমাত্র সত্য তখন সে অনুভব করেছিল, বাকি সব কথা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল তার মন থেকে। এ সময় চলতে-চলতে সে কেবল অনুভব করতে পারল যে, তার শরীর ভিজে তুলো দিয়ে তৈরি, তার শিরদাঁড়া কোনো পুরনো ভাঙা চারপাইয়ের মতো খটখট করছে। রোদের তেজ খুব, আলো তীরের মতো চোখে বিধছে, আকাশে এক ময়লা হলুদ রঙের বার্নিশ লেপে দেয়া হয়েছে। সারা পরিবেশ কালো ঘোলাটে আর জড়ো-হওয়া নোংরা মাছির মতো ভনভন করছে। লোকের দৃষ্টি যেন তার গায়ের নোংরা রক্ত ও পুঁজের মতো তার শরীরে সেঁটে যাচ্ছে। তাকে কোথাও পালিয়ে যেতে হবে, দূরে কোথাও, লম্বা। লম্বা তার জড়ানো আলোর থামওয়ালা রাস্তা দিয়ে যেতে হবে, তার মধ্য দিয়ে ঘেঁষাঘেঁষি পথ ধরে পালিয়ে যেতে হবে অনেক দূরে। তার মনে পড়ল মরা মায়ের কথা, মরা বাপের কথা, তার আফ্রিকা চলে-যাওয়া ভাইয়ের কথা। শ-শ-শন্ শব্দ করে একখানা ট্রাম তার কাছ দিয়ে চলে গেল। ট্রামের বিজলির ট্রলি, বিজলির লম্বা তারে ঘষতে-ঘষতে যেন তার শরীরে ঢুকে যেতে লাগল। তার আপন শরীরে পুরো ট্রামটাই ঢুকে যাচ্ছে বলে সে অনুভব করল, মনে হল, সে যেন কোনো মানুষ নয়, যেন এক ক্ষয়ে যাওয়া রাস্তা।
নেকক্ষণ ধরে সে চলছিল, হাঁপিয়ে পড়ছিল আর চলছিল। আন্দাজে, এক অজানা দিকে–যেদিকে কোনো একদিন তার ঘর ছিল। এখন তার মনে হচ্ছে, তার কোনো ঘর নেই। কিন্তু এ কথা জেনেও সে ওই দিকেই চলছিল, ঘরে যাবার তাগিদে অসহায় হয়ে সে পথ চলছিল কেবল। কিন্তু রোদ খুব চড়া, তখন আর সে রাস্তাও ভুলে গেল। শরীরে এমন শক্তি ছিল না যে, সে কোনো পথিকের কাছে রাস্তার খোঁজ নেয়; জেনে নেয় শহরের এটা কোন অঞ্চল। ধীরে-ধীরে তার কানের মধ্যে ট্রাম আর বাসের আওয়াজ বাড়তে লাগল, চোখের সামনে বাঁকা হয়ে যেতে লাগল দেয়াল। বাড়িঘর ভেঙে পড়তে লাগল। বিজলিবাতির থামগুলো ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে যেতে লাগল কেমন। সে তার চোখের সামনে আঁধার আর পায়ের তলায় ভূমিকম্প অনুভব করল। আর হঠাৎই পড়ে গেল মাটিতে।
যখন তার হুশ ফিরে এল, তখন রাত হয়ে গেছে। এক ঠাণ্ডা আঁধার ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। সে চোখ খুলে দেখল, যে-জায়গায় সে পড়ে গিয়েছিল এখন পর্যন্ত সেই জায়গাতেই শুয়ে আছে। এটা ফুটপাথের এমন একটা মোড় যার পেছন দু’দিকে দুই দেয়াল খাড়া হয়ে আছে। এক দেয়াল ফুটপাতের গায়ে-গায়ে সোজা উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। অপর দেয়াল চলে গেছে উত্তর থেকে পশ্চিম দিকে। দুই দেয়ালের জোড়ের মুখে সে শুয়েছিল। এ দুই দেয়াল প্রায় চার ফুট উঁচু আর এই দেয়ালগুলোর পেছনে ছিল বাঁশঝাড় আর ম্যাগনোলিয়া লতার ঝাড়, পেয়ারা আর জামগাছ। ওইসব গাছের পেছনে কী ছিল তা সে দেখতে পায়নি। অন্যদিকে, পশ্চিম দিকের দেয়ালের সামনে পঁচিশ-তিরিশ ফুট ছেড়ে দিয়েছিল এক পুরনো বাড়ির পেছনের অংশ। বাড়িটি তিনতলা; প্রতি তলার পেছন দিকে একটি জানালা আর ছ’টি বড়-বড় পাইপ। পেছন দিকের পাইপ আর পশ্চিম দিকের দেয়ালের মাঝখানে এক পঁচিশ-তিরিশ ফুট চওড়া কানাগলি, তার তিনদিকে দেয়াল আর চতুর্থ দিকে পথ। দূরে কোথায় গির্জার ঘণ্টায় রাত তিনটে বাজল। সে ফুটপাতের উপর শুয়ে-শুয়ে কনুইয়ের ওপর জোর দিয়ে একটু উঁচু হয়ে এদিক-ওদিক দেখতে লাগল। পথ একেবারে খালি। সামনের দোকানগুলো বন্ধ আর ফুটপাথের আঁধারে ছায়ায় কোথাও কোথাও কমজোর বিজলিবাতি ঝলমল করছে। কিছুক্ষণের জন্য এই ঠাণ্ডা আধার তার খুব ভালো লাগল। কিছুক্ষণের জন্য সে নিজের চোখ দুটি বন্ধ করে ভাবল, সে বোধহয় কোনো দয়ার সমুদ্রের জলে ডুবে যাচ্ছে।
কিন্তু এই অনুভূতি দিয়ে সে কেবল নিজেকেই মুহূর্তের জন্য ধোকা দিচ্ছিল, কারণ এখন তার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য আরামদায়ক ঠাণ্ডা উপভোগের পর সে অনুভব করল তার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। তার অন্ত্রের অপারেশন হওয়ার পর থেকে তার খুব ক্ষিদে পায়। সে ভাবল ডাক্তার তার অন্ত্রের কাজ জাগিয়ে দিয়ে তার কোনো রকম উপকার করেননি। পেটের মধ্যে নাড়ি বিচিত্রভাবে পাক খাচ্ছিল আর অন্ত্রের একেবারে ভেতরে মোচড় দিচ্ছিল। এ সময়ে তার নাসিকা সভ্য নাগরিকের নাসিকার মতো কাজ করছিল না, বরং কোনো জংলি পশুর ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের মতো কাজ করছিল। তার নাকে আসছিল নানা বিচিত্র গন্ধ। সুগন্ধের এক ঐকতান তার চেতনায় ছড়িয়ে পড়েছিল। আর আশ্চর্যের কথা এই যে, সে এই সুগন্ধ-ঐকতানের এক-এক সুরের আলাদা-আলাদা অস্তিত্ব চিনে নিতে পারছিল। এই হল জামের গন্ধ, এটা হল পেয়ারার গন্ধ, এটা হল রজনীগন্ধার কলির গন্ধ, আর এ হল তেলেভাজা পুরীর গন্ধ। এটা হল পেঁয়াজ-রসুনে সাঁতলানো আলুর গন্ধ, এটা মুলোর গন্ধ, এটা টমেটোর গন্ধ, এটা হল কোনো পচা ফলের গন্ধ, এটা পেচ্ছাবের গন্ধ, এটা জলে ভেজা মাটির গন্ধ বোধহয় নানা গন্ধের সমাবেশ থেকেই গন্ধগুলো আসছিল। এইসব গন্ধের প্রতিটি রূপ, ধরন, গতি আর উগ্রতা পর্যন্ত সে অনুভব করতে পারছিল। হঠাৎ তার সম্বিৎ হল, আর কী অসম্ভব ক্ষিদে তার সুপ্ত ঘ্রাণশক্তিকে কীভাবে সজাগ করে দিয়েছে তা ভেবে সে চমকে উঠল। কিন্তু এই কথা নিয়ে বেশি ভাবনা-চিন্তা না-করে যেদিক থেকে তেলেভাজা পুরী আর রসুনে-সাঁতলানো আলুর গন্ধ আসছিল সেইদিকে শরীরটাকে ধীরে-ধীরে আঁধার গলির ভেতরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। কারণ নিজের শরীরে হাঁটবার সামর্থ্য সে একেবারেই পাচ্ছিল না। প্রতি মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল যে, সে গভীর জলে ডুবে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল যেন কোনো ধোপা তার পেটের অন্ত্রগুলোকে ধরে মোচড় দিচ্ছে। আবার তার নাসারন্ধ্রে পুরী আর আলুর ক্ষিদে-জাগানো গন্ধ এল। সে অধীর হয়ে আধ-বোজা চোখে নিজের প্রায় নির্জীব শরীরটাকে ঘেঁষে টেনে নিয়ে যেদিক থেকে আলুপুরীর গন্ধ আসছিল সে-দিকে যেতে চেষ্টা করল।
খানিকটা সময় পরে সে ওই স্থানে পৌঁছে দেখল, পশ্চিমের দেয়াল আর তার সামনের ইমারতের পেছন দিকের পাইপগুলোর মাঝখানে পঁচিশ-তিরিশ ফুট ব্যবধানে আবর্জনার একটা খুব বড় খোলা লোহার টব রয়েছে। এই টবটা পনেরো ফুট চওড়া আর তিরিশ ফুট লম্বা। রকমারি আবর্জনায় ভরা। পচাগলা ফলের খোসা, পাউরুটির ময়লা টুকরো, চায়ের পাতা, একটা পুরনো জ্যাকেট, বাচ্চাদের নোংরা ন্যাকড়া, ডিমের খোসা, খবরের কাগজের ভেঁড়া টুকরো, পত্রিকার ছেঁড়া পাতা, রুটির টুকরো, লোহার পাত, প্লাস্টিকের ভাঙা খেলনা, কড়াইশুটির খোসা, পুদিনার পাতা, কলার পাতায় কিছু এঁটো পুরী আর আলুর তরকারি। পুরী আর আলুর তরকারি দেখে তার পেটের মধ্যে। মোচড় দিল। কিছুক্ষণ সে তার অধীর হাতটাকে টেনে নিল, কিন্তু ওইসব সুগন্ধ যখন তার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করল তখন আগের পুরী আর তরকারির ক্ষিদে-জাগিয়ে-দেয়া সুগন্ধ তীব্র হয়ে উঠল। মনে হল ঐকতানের বিশেষ কোনো স্বর হঠাৎ খুব চড়া হয়ে বেজে উঠছে। হঠাৎই তার সংযমের শেষ প্রাচীর ভেঙে পড়ল। তখনি তার কম্পিত অধীর হাত কলার পাতা খাবলে নিল আর অমানুষিক ক্ষুধা অসহায় হয়ে ওই পুরীগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পুরী-তরকারি খেয়ে সে বারবার কলার পাতা চাটল। পাতাখানিকে চেটে এত সাফ করে দিল যে মনে হল তা গাছের নতুন পাতা। কলার পাতা চাটার পর সে নিজের আঙুল চাটল আর লম্বা-লম্বা নখের মধ্যে জমে থাকা আলুর তরকারি জিভের ডগা দিয়ে চেটে নিয়ে খেল। এতেও তার তৃপ্তি হল না। সে হাত বাড়িয়ে আবর্জনারাশি নেড়ে-চেড়ে তার থেকে পুদিনার পাতা বার করে খেল; মূলোর দুটি টুকরো আর আধখানা টমাটো মুখে দিয়ে তার রস খেল আরাম করে। আর সব যখন খাওয়া হয়ে গেল তখন তার সারা শরীরে নেমে এল আলস্যভরা ঘুমের ঢেউ। সে ওই টবের ধারেই ঘুমিয়ে পড়ল।
আট-দশ দিন এভাবেই আলস্যভরা ঘুম আর অর্ধচেতনার মধ্যে কেটে গেল। সে ঘষতে-ঘষতে টবের ধারে যেত। যা খাবার পাওয়া যেত খেয়ে নিত সবই। আর যখন ক্ষিদে-জাগানো গন্ধের তৃপ্তিসাধন হয়ে যেত তখন তা ছাপিয়ে অন্য নোংরা গন্ধ উঠত। তখন সে ঘষতে-ঘষতে টব থেকে দূরে ফুটপাতের মোড়ে চলে গিয়ে পেছনের দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত।
পনেরো-বিশ দিন পর ধীরে-ধীরে তার শরীরে বল ফিরে এল। ক্রমান্বয়ে সে নিজের পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হতে লাগল–জায়গাটা কেমন ভালো, এখানে রোদ নেই, আছে গাছের ছায়া, কখনো-কখনো পেছনের ইমারত থেকে কেউ জানালা খোলে আর। কেউ হাত ঘুরিয়ে নিচের টবে রোজ আবর্জনা ফেলে। এই আবর্জনা ছিল তার অন্নদাতা, তাকে দিনেরাতে আহার জোগাত। এ ছিল তার জীবনরক্ষক। দিনে পথ মুখরিত হয়ে উঠত, খুলত দোকানপাট, লোকজন ঘুরে বেড়াত, বাচ্চারা পাখির মতো কিচকিচ করতে-করতে যেত পথ দিয়ে, স্ত্রীলোকেরা রঙিন ঘুড়ির মতো হেলেদুলে চলে যেত– কিন্তু সে ছিল অন্য এক জগৎ। এই জগতের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না, এই জগতে কেউ ছিল না তার, আর সে-ও কারো ছিল না। এই দুনিয়ার প্রতি তার ছিল সীমাহীন ঘৃণা। এই দুনিয়া থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। শহরের গলি-বাজার-পথ তার কাছে হয়ে গিয়েছিল এক ধোয়াটে ছায়ায় তৈরি জগৎ। বাইরের মাঠ, ক্ষেত আর খোলা আকাশ তার কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক ব্যর্থ কল্পনা। ঘর-সংসার, কাজ-কর্ম, জীবন, সমাজ-সংঘর্ষ–এসব অর্থহীন শব্দ পচে-গলে আবর্জনারাশিতে গিয়ে মিশেছিল। ওই দূরের জগৎ থেকে সে ফিরিয়ে নিয়েছিল তার মুখ। পনের ফুট লম্বা আর তিরিশ ফুট চওড়া ওই টব–এই ছিল তার নিজের জগৎ।
ধীরে-ধীরে মাস আর বছর চলে গেল। সে ওই পথের মোড়ে বসে থাকত, স্মৃতিচিহ্নের মতো। কারোর সঙ্গে কথা বলত না, কাউকে সাহায্য করত না, কারোর কাছে ভিক্ষে চাইত না। কিন্তু যদি কোনোদিন সে উঠে চলে যেত তো সেখানকার প্রতিটি ব্যক্তি এতে বিস্মিত হত, আর বোধহয় কিছুটা দুঃখিতও হত।
সবাই তাকে বলত জঞ্জাল বুড়ো। কারণ সবাই জানত যে, সে কেবল জঞ্জালের টব থেকেই আপন আহার্য সংগ্রহ করে। আর যেদিন তা থেকে কিছু মিলত না, সেদিন সে না-খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ত। বছরের পর বছর ধরে পথিকেরা আর ইরানি রেস্তোরাঁওয়ালারা তার এই স্বভাবের কথা জেনেছিল। তার জন্য যা কিছু দেবার তারা প্রায়ই জঞ্জাল-স্তূপে ফেলে দিত। আবার ইমারতের পেছনের জানালা দিয়ে ময়লা-আবর্জনার অতিরিক্ত অন্য খাবার জিনিসও প্রায়ই লোকে ফেলে দিত। আস্ত-আস্ত পুরী, কাবাব, অনেকটা তরকারি, মাংসের টুকরো, আধখাওয়া আম, চাটনি, কাবাবের টুকরো আর ক্ষীরমাখানো কলাপাতা। খাওয়া-পরার সব ভালোমন্দ জিনিস জঞ্জাল-বুড়ো এই টবের মধ্যেই পেয়ে যেত। কখনো-কখনো ছেঁড়া পাজামা, ফেলে দেয়া জাঙিয়া, ছেঁড়া জামা, প্লাস্টিকের গেলাস। এ কি শুধুই আবর্জনার টব? তার জন্যে এটা ছিল এক খোলা বাজার–সেখানে সে দিনে দুপুরে সকলের চোখের সামনে গালগল্প করত। যে-দোকানে যে-সওদা প্রয়োজন তা সে বিনা পয়সায় পেত। এই বাজারের সে ছিল একমাত্র মালিক। গোড়ায়-গোড়ায় কয়েকটি ক্ষুধার্ত বিড়াল আর ঘেয়ো কুকুর তার সঙ্গে ঝগড়া করেছিল। কিন্তু মারমার করে সে তাদের ভাগিয়ে দিয়েছিল। এখন সে এই টবের একমাত্র অধীশ্বর। সবাই মেনে নিয়েছিল তার অধিকার। মাসে একবার মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা আসত আর এই টব খালি করে দিয়ে চলে যেত। জঞ্জাল-বুড়ো তার বিরোধিতা করত না। কারণ তার জানা ছিল পরদিন থেকেই টব আবার ভর্তি হতে শুরু করবে। তার বিশ্বাস ছিল যে, এই দুনিয়ার মঙ্গল শেষ হয়ে যেতে পারে, প্রেম শেষ হয়ে যেতে পারে, বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু আবর্জনা শেষ হয়ে যাবে না কোনোদিন। সারা দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সে বাঁচবার শেষ উপায় শিখে নিয়েছিল।
কিন্তু কথা এ নয় যে সে বাইরের দুনিয়ার খবর রাখত না। যখন শহরে চিনির দাম বেড়ে যেত তখন মাসের পর মাস আবর্জনার টবে মিঠাইয়ের টুকরোর চেহারা দেখা যেত না। আবার গমের দাম বেড়ে গেলে পাউরুটির একটি টুকরোও মিলত না। অন্যদিকে যখন সিগারেটের দাম বেড়ে যেত তখন এত ছোট সিগারেটের পোড়া টুকরো মিলত যে, তা ধরিয়ে ধূমপান করতে পারত না সে। যখন জমাদারেরা হরতাল করেছিল তখন দু’মাস ধরে টবের কোনো সাফাই হয়নি। আবার বকরিদের দিন যত মাংসের টুকরো মিলত তা অন্যদিন পাওয়া যেত না। দেয়ালীর দিন তো টবের আলাদা-আলাদা কোণে মিঠাইয়ের অনেক টুকরো পাওয়া যেত। বাইরের দুনিয়ার এমন কোনো ঘটনা ছিল না যার সন্ধান সে আবর্জনার টব থেকে না-পেত। গত মহাযুদ্ধ থেকে শুরু করে মেয়েদের গোপন ব্যাধি পর্যন্ত সবকিছুরই সন্ধান পেত সে। যদিও বাইরের দুনিয়ার প্রতি তার কোনো রুচি ছিল না।
পঁচিশ বছর ধরে সে এক আবর্জনার টবের ধারে বসে-বসে আপন জীবন কাটিয়ে দিল। দিনরাত, মাস-বছর তার মাথার উপর দিয়ে বায়ুতরঙ্গের মতো প্রবাহিত হয়ে গেল। তার মাথার চুল শুকিয়ে-শুকিয়ে ঝুলতে লাগল বটগাছের ঝুরির মতো। তার কালো দাড়ি শাদা হয়ে গেল। গায়ের রঙ হল তামাটে। নোংরা চুল, ছেঁড়া ন্যাকড়া আর দুর্গন্ধভরা শরীর নিয়ে পথচারীর কাছে সে নিজেই যেন একটা জঞ্জাল-টবের মতো প্রতিভাত হত। সে ছিল এমন একটা টব যা কখনো-কখনো অঙ্গভঙ্গি করে, আর অন্যের সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গে আর জঞ্জাল-টবের সঙ্গে কথা বলে।
জঞ্জাল-বুড়োকে জঞ্জাল-টবের সঙ্গে কথা বলতে দেখে লোকে আশ্চর্য হয়ে যেত। কিন্তু এতে আশ্চর্যের কী আছে? জঞ্জাল-বুড়ো লোকদের সঙ্গে কোনো কথা বলত না, কিন্তু এদের আশ্চর্য হতে দেখে মনে-মনে নিশ্চয় ভাবত যে, এই সংসারে কে আছে যে, অপরের সঙ্গে কথা বলে। বাস্তবে এই সংসারে যত কথাবার্তা হয় তা মানুষের মধ্যে হয়, হয় কেবল নিজের জাতের সঙ্গে আর তাদের কোনো স্বার্থের মধ্যেই। দুই বন্ধুর মধ্যে যে কথাবার্তা হয় তা বাস্তবে এক প্রকার স্বগত-কথন মাত্র। এই দুনিয়া একটা খুব বড় আবর্জনার স্তূপ। এখানে সব লোক আপন আপন স্বার্থের কোনো টুকরো, ব্যক্তিগত লাভের কোনো খোসা বা মুনাফার কোনো ন্যাকড়া খাবলানোর জন্যে সব সময় তৈরি হয়ে আছে। যারা আমাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বা নীচ মনে করে তারা মনের পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখুন–সেখানে কত-না ময়লা-আবর্জনা রয়েছে। ওই আবর্জনা কেবল যমরাজই উঠিয়ে নিতে যেতে পারে।
এইভাবে দিনের পর দিন যায়, কত দেশ স্বাধীন হল, কত দেশ পরাধীন হল, কত সরকার এল, কত গেল, কিন্তু জঞ্জালের এই টব যেখানে ছিল সেখানেই আছে আর তার কিনারে জঞ্জাল-বুড়ো ওইভাবেই অর্ধচেতনভাবে দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বসে, মনে-মনে বকবক করে, আর জঞ্জালের টব হাতড়ায়।
তারপর এক রাতে ওই আধার গলিতে যখন সে টব থেকে কয়েক ফুট দূরে দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে ছেঁড়া কাপড় গায়ে কুঁজো হয়ে ঘুমোচ্ছিল, তখন সে এক খুব তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে ঘাবড়ে গিয়ে জঞ্জাল-টবের দিকেই দৌড়ে গিয়েছিল। তারই ভেতর থেকে ওই তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা যাচ্ছিল।
জঞ্জালের টবের কাছে গিয়ে সে টব হাতড়াল। তার হাত নরম-নরম মাংসপিণ্ডে ধাক্কা খেল। আরেকবার শুনতে পেল সেই তীক্ষ্ণ চিৎকার। জঞ্জাল-বুড়ো দেখল টবের মধ্যে পাউরুটির টুকরো, চোষা হাড়, পুরনো জুতো, কাঁচের টুকরো, আমের খোসা, বাসি চাটনি আর টেড়াভাঙা বোতলের মাঝখানে এক নবজাত উলঙ্গ শিশু পড়ে আছে। হাত-পা নেড়ে নেড়ে তীক্ষ্ণ চিৎকার করছে সে।
কিছুক্ষণ জঞ্জাল-বুড়ো আশ্চর্য হয়ে এই মানবকটিকে দেখল। বাচ্চাটি নিজের ছোট্ট বুকের সব জোর দিয়ে নিজের আগমন ঘোষণা করছিল। বুড়ো চুপচাপ হতভম্ব হয়ে চোখ বড়-বড় করে এই দৃশ্য দেখতে লাগল। তারপর তাড়াতাড়ি সামনে ঝুঁকে পড়ে জঞ্জালের টব থেকে বাচ্চাকে নিজের বুকে তুলে নিয়ে তাকে ছেঁড়া ন্যাকড়া দিয়ে জড়িয়ে নিল।
কিন্তু বাচ্চা তার কোলে গিয়ে কোনোমতেই চুপ করে না। সে এ জীবনে সদ্য-সদ্য এসেছে, তারস্বরে ঘোষণা করছিল নিজের ক্ষুধা। সে এখনো বোঝেনি দারিদ্র্য কী হতে পারে, মমতা কতটা ভীরু হতে পারে, জীবন বিগড়ে যেতে পারে কীভাবে, জীবনকে কীভাবে ময়লা দুর্গন্ধময় হয়ে জঞ্জালের টবে ফেলে দেয়া যেতে পারে। এখন তার কিছুই জানা নেই। এখন সে কেবল ক্ষুধার্ত। সে কেঁদে-কেঁদে নিজের পেটে হাত। রাখছিল আর পা ছুড়ছিল।
জঞ্জাল-বুড়ো কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, সে কী করে এই বাচ্চাকে চুপ করাবে। তার কাছে কিছুই ছিল নানা দুধ, না চুষিকাঠি। তার তো কোনো ছড়াও জানা নেই। সে অস্থির হয়ে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে চাপড়াতে শুরু করল আর খুব হতাশ হয়ে রাতের আঁধারে চারদিকে চেয়ে দেখল এ সময়ে বাচ্চার জন্যে দুধ কোথায় পাওয়া যাবে। কিন্তু যখন তার মাথায় কিছু এল না তখন সে তাড়াতাড়ি জঞ্জালের টব থেকে একটা আমের আঁটি বার করে নিয়ে তার প্রান্তভাগ বাচ্চার মুখে দিয়ে দিল।
আধ-খাওয়া আমের মিষ্টি-মিষ্টি রস যখন বাচ্চার মুখে যেতে থাকল তখন সে কাঁদতে-কাঁদতে চুপ করে গেল আর চুপ করতে-করতে জঞ্জাল-বুড়োর কোলে ঘুমিয়ে পড়ল। আমের আঁটি পিছলে পড়ে গেল মাটিতে আর বাচ্চা তার কোলে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে রইল। আমের হলুদ-হলুদ রস তখন পর্যন্ত তার কোমল ঠোঁটের উপর লেগে ছিল। তার কচি-কচি হাত দিয়ে সে জঞ্জাল-বুডোর বুড়ো আঙুল খুব জোরে ধরে রেখেছিল।
এ মুহূর্তের জন্য জঞ্জাল-বুড়োর মনে হল বাচ্চাটাকে এখানে ফেলে দিয়ে কোথায় পালিয়ে যায়। ধীরে-ধীরে জঞ্জাল-বুড়ো বাচ্চার হাত থেকে নিজের বুড়ো আঙুল ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু বাচ্চা খুব জোরে ধরে রেখেছে তার হাত। জঞ্জাল-বুড়োর মনে হল, জীবন তাকে ফের ধরে ফেলেছে আর ধীরে-ধীরে ধাক্কা দিয়ে তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসছে। হঠাৎ তার দুলারির কথা মনে পড়ল। আর মনে পড়ল সেই বাচ্চার কথা, যে দুলারির গর্ভেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আর হঠাৎই জঞ্জাল-বুড়ো ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মনে হল, আজ সমুদ্র-জলে এত বুদ্বুদ নেই, যা তার চোখের জলে ছিল। গত পঁচিশ বছরে যত ময়লা আর নোংরা তার মনে জমে ছিল, আজ তা অশ্রুর তুফানে এক ধাক্কায় সাফ হয়ে গেল।
সারা রাত জঞ্জাল-বুড়ো ওই নবজাত শিশুকে নিজের কোলে নিয়ে অস্থির ও অশান্ত হয়ে ফুটপাতে পায়চারি করল। যখন সকাল হল, সূর্যের আলো দেখা দিল তখন লোকে দেখল জঞ্জাল-বুড়ো আজ জঞ্জালের টবের কাছাকাছি বসে নেই, বরং পথের ধারে তৈরি-হওয়া ইমারতের নিচে ইট বইছে, আর এই ইমারতের কাছে এক কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় ফুলের নকশাওলা কাপড়ে শুয়ে এক ছোট্ট শিশু মুখে দুধের চুষিকাঠি নিয়ে হাসছে।
মিথুন – রাজেন্দ্র সিংহ বেদী
বাজার হয়ে উঠেছিল মন্দা অথবা কারবার ছোট। মনে হচ্ছিল পশ্চিম দিকে যেখানে সড়ক কিছুটা উপরে উঠে আকাশকে ছুঁয়েছে আর শেষ পর্যন্ত একেবারে নিচে নেমে গেছে, ওখানেই দুনিয়ার শেষ প্রাপ্ত, সেখান থেকে এক লাফ দিতে হবে, এই জীবনকে বাঁচাবার জন্যেই এবার প্রাণটা দিতে হবে।
সারাদিন মাথা চাপড়ানোর পর মগন টকলা (রকমারি চিজ বিক্রিঅলা) মাত্র দুটো জিনিস হাতে পেল। এক, ফ্লোরেনটিন আর দুই, জেমিনি রায়। ফ্লোরেনটিনের মূর্তি হয়তো কোনো মাথা-মোটা ফিল্ম প্রডিউসার ভাড়া করে নিতে যেতে পারে, কিন্তু জেমিনি রায়? কোনো আপসোস নেই, আজ সে ওটিকে লুকিয়ে রেখে দিলে কাল তার নাতি-পুতিরা তা থেকে কোটি টাকা উপার্জন করবে–যেমন পশ্চিমি দুনিয়ায় আজও কারো কাছ থেকে লিওনার্দোর স্কেচ বেরুলে আর্টের বাজারে তার নিলাম-মূল্য লাখ টাকা পর্যন্ত পৌঁছায়। এই লাখ আর কোটি টাকার চিন্তায় মগন লালের দুচোখে বিজলি চমকায়। সে এ-কথা ভুলে গিয়েছিল যে, তার বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হয়ে গেছে। তাছাড়া তার মাথায় নেই একগাছি চুল, এমনকি তার বিয়েও হয়নি। সে-কারণে নাতি-পুতির কথাই ওঠে না। মগন করেই-বা কী? সে এক সাধারণ হিন্দু। সাধারণত তার চিন্তাগুলো এরকমই। তাছাড়া তার মন থেকে বেনে-ভাব যায়নি। কথায় সে ‘পয়সা-এ-তো মায়া’–এ-কথা বলে তা দূরে ঠেলে দেয়, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে পয়সার প্রতি তার প্রচণ্ড আসক্তি। দুনিয়ায় যদি কেউ পয়সার পূজা করে তো সে হিন্দু। আজ তার সামনে দেওয়ালির দিনের আলোকিত পূজাপাত্র থেকে দুধ-জলে স্নাত, সিঁদুর-চর্চিত টাকা পাওয়া যাবে। দশহরার দিনে তার গাড়ি গাঁদাফুলের মালায় ভরে যাবে আর সব স্ত্রী-পুরুষ মিলে লক্ষ্মী-মন্দিরে পূজা দিতে যাবে। পয়সার জন্যে সে ইউসুফের মতো ভাই আর পদ্মিনীর মতো পত্নীকেও বিক্রি করে দিতে পারে।
তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সিরাজা–ইবজ ব্যাটারির এজেন্ট। সিরাজার দোকান অশ্বথগাছের ঘেরের পেছনে। গরিব ল্যাৎপেতে হিন্দুরা সকালবেলায় অশ্বথের গোড়ায় জল-মেশানো দুধ ঢালত। দোকান আর সড়কের মাঝখানটা তাতে কাদা-কাদা হয়ে থাকত। দেশ-বিভাগের পরে হিন্দুস্থানে থেকে-যাওয়া সিরাজাকে গরিব হিন্দুদের এই থাকে খাতির করে চলতে হত। হ্যাঁ, না-করলে তো সে হয়ে যেত সেইসব বর্ণশংকর কুকুর, যেগুলো সারাদিন ঠ্যাঙ তুলে-তুলে ওই গাছের গায়ে পেচ্ছাব করত। এই গাছ সম্পর্কেই ভগবান বলেছেন, ‘গাছের মধ্যে আমি হলাম অশ্বথ।’ ওই কুকুর নিশ্চয়ই গতজন্মে ছিল মুসলমান–সাতচল্লিশ সনের দাঙ্গায় যে হিন্দুদের হাতে মারা গেছিল।
দেখা যেত সিরাজা হামেশা অশ্বথের ফল খাচ্ছে। তার কারণ মন্দা বাজার নয়, ক্ষুধাও নয়। সিরাজা সব সময় সেই জিনিস খেত যা বীর্যকে গাঢ় করে। হ্যাঁ, তার কাজই হল খাওয়া-দাওয়া আর ভোগ করা। মনের দিক থেকে সে ছিল ফালতু লডুয়ে যাযাবর যারা হিন্দুস্থানে থেকে পাকিস্তানের কথা বলে। আবার পাকিস্তানে থাকে তো বলে, ‘হে মোর প্রভু, আমায় মদিনায় ডেকে নাও।’ তার কোনোকিছুতেই আসক্তি নেই। মগন টকলা এ-নিয়ে কয়েকবার ভেবেছে, সিরাজার আল্লা দুনিয়ায় খুব আরাম করেন। আর মগনের আছে এক ভগবান যিনি নিচের দুনিয়ার বদলে উপরের ত্রিকূট পর্বতের আশপাশে দরবার লাগান। বোধ হয় সিরাজা না-জেনে-শুনেই এক তান্ত্রিক হয়ে বসে আছে, যে বীর্যবক্ষার জন্য কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগায় আর ঊর্ধ্বগামী পথ তৈরি করে। সে গর্বের সঙ্গে নারীসমাজের মাঝে থাকে, কিন্তু কোনোভাবেই জীবনের পরম তত্ত্বকে (অমৃতরূপ বীর্যকে) স্মলিত হতে দেয় না। ইচ্ছামতো উপায়ে মোক্ষপ্রাপ্তিকারী, নারীকে কেবল এক মাধ্যমরূপে ব্যবহারকারী এই ব্যক্তি কখনো ভেবে দেখেছে কি এর ফলে ওই বেচারি নারীদের হাল কী হতে পারে? তাদের অতৃপ্ত রুদ্যমান অস্থির অবস্থায় রেখে কেউ কি এ-ভাবে মোক্ষে পৌঁছতে পারে? আর বীর্য পতিত না-হওয়াতে যে মোক্ষ, তাতে পুরুষের বা নারীর কোনো মুক্তি ঘটবে? স্বাতী নক্ষত্রের জল তো মোতি নয়। ঝিনুকও মোতি নয়। ঝরে-পড়া জল যখন ঝিনুকের মধ্যে মুখবদ্ধ অবস্থায় থাকে, তখনই মোতির জন্ম হতে পারে।
রাত আসে দ্রুতগতিতে। বাইরের দুনিয়া আঁধার। তার সঙ্গে গুঁড়ি মেরে আসে আরো কিছু। রেশমওয়ালা বিলায়তিরাম, কাশ্মিরী বড়শাহ, এখানকার উড়পির চক্রপাণির দোকান পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। হতে পারে, মাসের দ্বিতীয় শনিবার হবার ফলে চক্রপাণির সব ইডলি দোসা, সাম্ভর, রওয়া কেসরি বিক্রি হয়ে গেছে। কেবল খোলা ছিল সিরাজার দোকান। কে জানে সে কোন মতলবে ছিল। বোধহয় এর জন্যে যে ব্যাটারির প্রয়োজন তা তো রাতেই হয়। কিন্তু ঝুটমুট সে সকালেই দোকান খুলে ফেলত–সকাল তো রাতেরই অংশ–তার শেষ অংশ, তা না-হলে সকাল কোথায়-বা কার। বোধহয় সিরাজা ট্যুরিস্ট এজেন্ট মাইকেলের অপেক্ষায় ছিল; ওরা দু’জনে মিলে আগামী কোনোদিনে আগ্রা বা খাজুরাহোর ভ্রমণসূচি তৈরি করে নেবে, আর তাতে কিছু পয়সাও উপায় হবে। না, সিরাজা পয়সার পেছনে দৌড়ত না। সে দৌড়াত পশ্চিমি মেয়েদের পেছনে। অনেক বিয়ে আর তালাকের কারণে ওইসব মেয়েরা ছিল অতৃপ্ত। এখানে এসে মমতাজের প্রেম নিয়ে এখানে-ওখানে কোনো শাহজাহান-চেহারাওয়ালা মরদের ওপর ভাগ্য পরীক্ষা করত। খাজুরাহোর মিথুনমূর্তিকে জীবন্ত করে তুলতে চাইত।
তখনই সিরাজার আওয়াজ মগনলালকে চমকে দিল, ‘হ্যালো সুইটি পাই।’
এমনিতে সিরাজা প্রায় অশিক্ষিত। কিন্তু ট্যুরিস্টের সঙ্গে থেকে থেকে সে এইসব ইংরেজি শব্দ শিখে ফেলেছিল। তার আওয়াজে মগন বুঝে নিল যে কীর্তি এসে গেছে।
সত্যি সত্যিই কীর্তি এসেছিল। বেঁটে, আঁটসাট বাঁধুনি, গভীর ভাঁজযুক্ত দেহ, বিষণ্ণ চেহারার যুবতী। তার রঙ ছিল পাকা। জাম রঙের শাড়ি পরত কীর্তি। সে এলে মনে হল আঁধারের কোনো টুকরো সাকার হয়ে সামনে এসেছে। কীর্তি সচরাচর রাতেই আসত। সে নিজেই নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইত। সিরাজা দাঁড়িয়েছিল তার দোকানের সামনে। কীর্তি প্রায়ই তার দিকে না-তাকিয়ে কথা না-বলে চলে যেত। তা সত্ত্বেও সিটি বাজাত সিরাজা।
কিন্তু কীর্তি কথাই-বা বলত কোথায়। এর সঙ্গে, ওর সঙ্গে, তার সঙ্গে–কারুর সঙ্গেই না। কথা বলার জন্যে সে এমনি সওয়াল গড়েপিটে নিত্য যার জবাব হত হা’ বা না’। কেবল উপর থেকে নিচে অথবা ডাইনে থেকে বায়ে মাথা হেলিয়ে কথা সেরে নিত কীর্তি। তাকে সিরাজার বিরক্ত করা মগনলালের পুরোপুরি অপছন্দ ছিল। সিরাজা কয়েকবার মগনকে বলেছিল–
‘ইয়ার, তুমি প্রেমের গোলকধাঁধায় পড়ে যাওনি তো? যুবতী মেয়েটাকে টেনে নাও। যদি বেশি এদিক-ওদিক কর তো কবুতরের মতো মেয়েটি উড়ে যাবে।’
কিন্তু মগন তাকে ধমকে দিয়েছে।
আসলে মগন টকলার ধান্দা ছিল বড় ঝামেলার। কীর্তি কাঠের কাজ বা মূর্তি তৈরি করে বিক্রির জন্য তার কাছে নিয়ে এলে মগন লাল তাতে অনেক খুঁত বের করত। কখনো বলত, এই ধরনের জিনিসের চাহিদা আজকাল নেই। আবার কখনো বলত, শিল্পকলার কষ্টিপাথরের বিচারে এ কাজ নিখুঁত হয়নি। কীর্তি মুখ আরো নামিয়ে নিত। যদিও এইসব কথায় মগন লালের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল যাতে একশ’ টাকার জিনিস পাঁচ-দশ টাকায় কীর্তি দিয়ে যায় আর তা রেখে দিয়ে সে একশ টাকায় বেচে।
কোনো আর্ট স্কুলে কীর্তি এই কাজ শেখেনি। তার বাপ নারায়ণ ছিল শিল্পী। ভাউ দাজী আর জেমস বর্গের্স প্রভৃতির সঙ্গে সে নেপাল আর হিন্দুস্থানের নানান জায়গায় শিল্প-উত্তরাধিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াত। সেসব শিল্পকীর্তি এখন লন্ডনের যাদুঘর, নিউইয়র্ক আর শিকাগোর অ্যান্টিক-দোকানগুলোকে অলঙ্কৃত করছে। প্রতিবছর আমাদের মন্দির আর মূর্তিঘরের শত-শত মূর্তি গায়েব হয়ে যেত আর হাজার-হাজার মাইল দূরে কিউরিও প্রভৃতির দোকানে দেখা যেত। বিরতিহীন সফরে বিরক্ত হয়ে নারায়ণ ফিরে এসে ঘরে বসেই শিল্পকর্ম নির্মাণ শুরু করে দিল এক সময়। কীর্তি গভীর মনোযোগে তার কাজ দেখত আর কাজের মাঝে হাতে খোদাইযন্ত্র এগিয়ে দিয়ে ‘রাফ ওয়ার্কে সাহায্য করত। ঘরে বসে গিয়ে নারায়ণ ভুলেই গিয়েছিল যে, লুপ্ত প্রাচীন শৈলীর শিল্পকর্ম বেশি দামে বিক্রি হয় আর সেসবের মূল্য দু’গুণ-চৌগুণ নয়, শতগুণ পাওয়া যায়। হয়তো সে তা জানত কিন্তু নারায়ণ ছিল সেই দলের মানুষ যারা পয়সার আশু প্রয়োজনই কেবল বুঝতে পারে, তাকে জীবনের প্রসারিত পটে দেখতে পারে না। সে শিল্পকর্ম তৈরি করে কষ্টে-সৃষ্টে রুটির পয়সা উপার্জন করত। শেষে একদিন রুটির পয়সা জোগাড় করতে-করতেই মৃত্যু হল নারায়ণের। তখন সে জগদম্বার মূর্তি বানাচ্ছিল। সে হঠাৎ ভুল করে তার খোদাইযন্ত্র দিয়ে নিজের হাতে আঘাত করায় তার ধনুষ্টঙ্কার হয়ে যায়। সে মারা যায় কাছেরই সামরিক হাসপাতালে। লোকেরা কানাকানি করত এই বলে যে সে নাকি কুকুরের মতো মরেছে। এইরকম মৃত্যু তার হবে নাই-বা কেন? সে যখন দেবীমূর্তি বানিয়েছে তখন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস দেবীর স্তনযুগল, নিতম্ব আর জঙ্ঘার ওপর-নিচে আটকে থেকেছে। ছোট মূর্তিতে স্তনযুগল শূন্যে ঘূর্ণায়মান লাটুর মতো দেখায়, কিন্তু বড় মূর্তিতে পা আর স্তনযুগল এক রকম ছোট ঘড়ার মতো দেখায়। আসল কথা, দুধের বড়-বড় বাটি যেন বুকের পরে রাখা হয়েছে, আর হস্তিনীর মাথার মতো নিতম্ব, যার নিচে একটি শুড়ের বদলে দুটি শুড় বেরিয়েছে। সে দুর্গামূর্তি বানাচ্ছিল। দুর্গা বড় জাঁকজমকভরা দেবী। এইরকম দেবীর মূর্তি যে বানাতে যাবে সে কুকুরের মতো মরবে না তো কি আমার-আপনার মতো মরবে?
‘কী এনেছ?’ মগন টকলা কীর্তিকে জিজ্ঞেস করল। কীর্তি শাড়ির আঁচল থেকে কাঠের কাজ’ বের করে মগনের সামনে টেবিলের ‘রোল টপে’র উপর ধীরে-ধীরে রাখল। উপরের ল্যাম্পের আলো ওখানেই কেন্দ্রীভূত ছিল বলে রাখল। কাজটা দেখার আগে মগন কীর্তির দিকে এক পুরনো কাজ-করা চেয়ার এগিয়ে দিল, কিন্তু কীর্তি আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইল।
‘তোমার মা কেমন আছে?’
কীর্তি কোনো জবাব দিল না। সে একবার পেছন ফিরে যেখানে সড়ক নিচের দিকে নেমে গেছে, সেদিকে তাকাল। তারপর যখন মগনের দিকে ফিরে দাঁড়াল তখনও তার চোখদুটি আনত।
কীর্তির মা তখন সামরিক হাসপাতালে। সেখানেই তার বাপ নারায়ণ মারা গিয়েছিল। বুড়ির ‘কিডনির রোগ ছিল। তার পেট ঘেঁদা করে নল লাগিয়ে একটা বোতল বেঁধে দেয়া হয়েছিল যাতে করে মলমূত্র নিচে যাবার বদলে ওপরের বোতলে চলে যায়। বোতল কোনো কারণে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এখন অন্য বোতলের জন্য পয়সা চাই। যদি সে মগনকে এ-কথা বলে দিত তো মগন অন্যভাবে কথা শুরু করত, কিন্তু ওই কাঠের কাজ দেখে সে চমকিত হয়ে গেল।
‘আবার ওই জিনিস?’ সে বলল–’আমি তোমাকে কয়েকবার বলেছি আজকাল এইসব জিনিস কেউ পছন্দ করে না… এই শায়িত বিষ্ণু, ওপরে শিষনাগ, আর তার পদসেবারত লক্ষ্মী…।’
কীর্তি বড়-বড় চোখে মগনের দিকে তাকাল–ওই দৃষ্টিতে কৌতূহলী প্রশ্ন–তবে কী বানাব?’
‘ওই সব যা আজকাল হচ্ছে।’
আজকাল কী হচ্ছে?’ কীর্তি শেষ পর্যন্ত মুখ খোলে। তার কণ্ঠস্বর প্রায় শোনাই যায় না, যেমন ক্যানারি পাখি ঠোঁট বাঁকিয়ে ডাকে কিন্তু তার আওয়াজ অস্ফুট।
মগন কথা বলার রাস্তা খুঁজে পেয়ে বলল, ‘আর কিছু না হয় তো গান্ধী বানাও… নেহরু বানাও…। ফের তার যেন কোনো ত্রুটি হয়ে গেছে এ-ভাব কাটিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘কোনো ন্যুড।’
‘ন্যুড?’
‘হ্যাঁ,… আজকাল লোকে ন্যুড পছন্দ করে।’
কীর্তি চুপ করে গেল। কুমারী বলে সে সংকুচিত হতে পারত, লজ্জা পেতে পারত, কিন্তু এইসব লজ্জা-সংকোচ তার মতো মেয়ের কাছে নেহায়েত বিলাসিতা। তার একমাত্র চিন্তা মগন ওই উডওয়ার্ক কিনবে কি-না, পয়সা দেবে কি-না? কিছুটা ভেবেচিন্তে সে বলল
‘আমি ঐ মূর্তি বানাই না…’
তফাত কী এদের মধ্যে?’ মগন টকলা বলল–’দেবীও তো নারী… তুমি ওই মূর্তিই বানাও, কিন্তু ভগবানের দোহাই, কোনো দেবমালা ওর সঙ্গে জুড়ে দিয়ো না… এইসব কারণেই তোমার বাবা ওভাবে মৃত্যুবরণ করেছে… স্বর্গবাসী হয়েছে…।’
কীর্তি নিজের জীবনের দিকে ফিরে তাকাল। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। কোনো এক বিপদাশঙ্কায় তার সারা শরীর কাঁপছিল। সেই বিপদের কথা সে ছাড়া দ্বিতীয় কেউ জানে না। সে চেয়ারে বসেনি। সেটাকে ধরে দাঁড়িয়েছিল। সেদিক থেকে তার শরীরের সুন্দর রেখাগুলো দেখাচ্ছিল এক আকর্ষণীয় ছবির মতো। এ কেমন শিল্প যা উপরের নয়, নিচের নারায়ণ বানিয়েছিলেন। মগনলালের হৃদয়ে তখন পছন্দ আর অপছন্দের দ্বন্দ্ব। সে
জানত-না যে, সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির হৃদয়ে বশ আর বিশের মধ্যে আপসে লড়াই চলছে। কীর্তির মুখখানি শুকিয়ে গিয়েছিল। থুতু গিলে নেবার চেষ্টা করে কীর্তি বলল,
‘আমি?…আমার কাছে তো মডেল নেই…’
মডেল?’ মগন তার কাছে এগিয়ে আসে।
‘শত-শত পাওয়া যায় … আজ কোনো যুবতী সুন্দরী মেয়েকে পয়সার ঝলক দেখাও তো সে একদম…’
কীর্তি কিছু বলেনি কিন্তু মগন শুনল, ‘পয়সা…’ মগন নিজেই বলল– ‘পয়সা খরচ করলে তবে তো পয়সা উপায় করবে…’
এই কথা কীর্তিকে আরো বিষণ্ণ করে তুলল। তার আত্মা জীবনের শক্ত চোয়ালের মধ্যে পড়ে ধড়ফড় করতে লাগল। তার চোখদুটি অশ্রুতে ভিজে উঠল। মেয়েদের এমনি দশা হয় যা দেখে পুরুষের অন্তরে পিতা আর স্বামীকে জাগিয়ে দেয়। সারকথা এই যে, মগনের ইচ্ছে হচ্ছিল হাত বাড়িয়ে তাকে আলিঙ্গন করে বুকে নিয়ে নেয়–
‘আমার প্রাণের পুতুল, তুমি চিন্তা করো না… আমি তো আছি।’
কিন্তু কীর্তি তাকে ধাক্কা দিল। বিব্রত হয়ে গেল মগন। সে এমন ভাব দেখাল যে, কিছুই ঘটেনি। তরুপের তাস তো তারই হাতে। টেবিলের ‘রোলটপ’ থেকে সে ওই ‘উড-ওয়ার্ক’টি তুলে নিল আর কীর্তির দিকে সেটা বাড়িয়ে ধরে বলল–
‘আমার এ-জিনিসের দরকার নেই।’
কীর্তিও কিছু-একটা ভেবে নিয়েছিল। সে প্রথমে নিচের দিকে দেখল তারপর সহসা . মাথা তুলে বলল–
‘আসছে-বার নুডই নিয়ে আসব। এখন তুমি এটাই নিয়ে নাও’…
শর্ত রইল। মগন মুচকি হেসে বলল।
কীর্তির মাথা নিচের দিকে নোয়ানো। মগন টকলা ভেবেছিল যে, কীর্তি হেসে উঠবে, কিন্তু সে আরো কিছুটা গম্ভীর হয়ে গেল। মগন ‘রোলটপ’ তুলে টেবিলের ভেতর থেকে একটা দশ টাকার চকচকে নোট বের করে কীর্তির দিকে বাড়িয়ে ধরল, নাও…’
দশ টাকা…’ কীর্তি বলল।
‘হাঁ, তুমি বলছ তাই, আমার কাছে এ মূর্তি বেকার। আমি আর দিতে পারব না…’
‘এতে তো…’ কীর্তি তার বাক্য শেষ করতে পারল না। তার ভেতরে কথা বলার শক্তি, শব্দ সব রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার অভিপ্রায় ছিল স্পষ্ট। মগন বুঝে নিল।
‘এতে তো ওষুধের বোতলও আসবে না… ওষুধের খরচ পুরো হবে না… রুটিও চলবে না…।’ এই ধরনের কথাই সব অসহায় আর গরিবরা বলে থাকে। তাদের সব কথাই বৃথা। মগন কীর্তির দিকে তাকিয়ে বলল–
‘আমাকে খুশি করে দাও, আমি তোমায় ভালো পয়সা দেব’…
আর এই কথা বলতে গিয়ে সে দু’আঙুল দিয়ে বৃত্ত বানাল। সে চোখ মারল যেমন করে ডোমেরা সজ্জিতা বেশ্যাদের তারিফ করে চোখ মারে।
কীর্তি দাঁতে ঠোঁট চেপে ধরে বাইরে চলে এল। ফেরার সময়ে সর্বদাই কীর্তি উল্টোদিকের পথে যায় যদিও এতে তাকে দেড় মাইল পথ ঘুরে যেতে হয়। সে চাইত না সিরাজার সঙ্গে তার দেখা হোক, কিন্তু আজ সেদিক দিয়েই সে গেল যেন তাতে তার বিপদাশঙ্কা সমাধানের অভিপ্রায় বলবতী হয়। এর মধ্যে মাইকেল চলে এসেছে আর সিরাজার সঙ্গে মিলে কিছু খাচ্ছে। এই সময় কীর্তি মুখ উপরে তুলে নাক ফুলিয়ে তার পাশ দিয়ে চলে গেল। সিরাজা কী একটা কথা বলল যা মগন শুনতে পেল না। কীর্তির মনে এক ধরনের বিদ্রোহের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে সেইসব দুঃখ-পীড়িতদেরই একজন–যাকে দুশমন পরিবৃত অবস্থায় বেঁচে থাকতে হচ্ছে। বোধহয় দুশমন থেকে কোনো উপকার আসতে পারে–অথবা হয়তো-বা নারীপ্রকৃতির এটাই বিশেষত্ব যে, নিজের পেছনে সে এমন একটা পুরুষকে লাগিয়ে রাখবে যার সঙ্গে তার কোনো লন-দেন নেই, তবু সে তা করবে কেবল এ-কারণেই যে, ওই পুরুষ তাকে দেখে একবার ‘সিটি’ বাজাবে আর সে নিজের বুকে হাত রেখে ঠাণ্ডা দীর্ঘশ্বাস ছাড়বে।
সিরাজা নিশ্চয় কোনো আফ্রোডিজিয়া খাচ্ছিল। হতে পারে মাইকেল তার জন্য ওটি নিয়ে এসেছে। হয়তো ওরা দু’জনে মিলে মগন টকলার কাছে এসে তার সঙ্গে ছদ্মব্যঙ্গে কথার ঘাত-প্রতিঘাত চালাত, কিন্তু ঠিক সেই সময় মগন বন্ধ করে নিল দোকান। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সে কীর্তির সেই উড-ওয়ার্কটিকে দেখল। শিল্পীকর্মটি বেশ উঁচু দরের। শেষনাগের নিম্নাংশ খুব সুন্দর, কিন্তু তার উপরাংশের চিত্রিত দেহচর্মে কীর্তি উল্কির ছাপ ও রঙে ভরে দিয়েছিল। বিষ্ণুমূর্তিটির মধ্যে এমন একটা ভাব ফুটে রয়েছে যা যে কোনো রমণী আস্থাবান পুরুষের মধ্যে দেখতে চায়। হ্যাঁ লক্ষ্মী হেলে পড়েছিল, তার শরীরের রেখাগুলোও স্পষ্ট ছিল না। বোধহয় কীর্তি লক্ষ্মীর আর কোনো রূপকে জানত না, যদিও তাকে রুচিগ্রাহ্য রূপে বানানো খুবই সোজা। যখন রমণী পা টেপবার জন্য ঝুঁকে পড়ে তখন তার হাতের বাজু দেখা যায়, শরীর থেকে তা আলাদা হয়ে আসে; ফলে তা রমণীকে তার বিশেষত্ব নিয়ে স্পষ্টরূপে ফুটিয়ে তোলে। আবার পাশের দিকে উপবিষ্টা উপরাসীন রমণীকে নিম্নাসীনার চেয়ে কত তফাত বলে মনে হয়। পুরুষের দৃষ্টিতে নারীশরীর কতই-না উঁচুনিচু রেখাময়। আবার এ-কথাও বলা যায়, কীর্তি নিজে রমণী বলেই হয়তো রমণীর তুলনায় সে পুরুষের প্রতি বেশি আগ্রহী, সে-কারণেই লক্ষ্মীমূর্তি নির্মাণে তার এই ক্রটি। রমণী আপন সৌন্দর্যের ব্যাপারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আত্মরতিতে ডুবে থাকে আর যখন তার এই আত্মরতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন কোনো পুরুষের সহায়তায় তা থেকে মুক্তি পায়।
কীর্তির ঐ ‘উড-ওয়ার্ক’ মগন এক হাতে ধরে অন্য হাতে ছুরি নিয়ে তার উপর ‘সিদ্ধম নমঃ’ অক্ষর খোদাই করে পেছনের ঘরে চলে গেল। সেখানে জমি কাঁচা মাটির। মাটি খুঁড়ে সে তার মধ্যে উড-ওয়ার্ক’টিকে রাখল। মাটির ভেতর থেকে আরেকটি মূর্তি বের করল সে, সেটাও কীর্তির বানানো। গর্তের মধ্যে মাটি দিয়ে তার মধ্যে খয়েরের জল ছিটিয়ে দিল। পুরনো মূর্তির ধুলো ঝেড়ে সে দেখতে পেল তাতে বড়-বড় ফাটা-দাগ হয়ে গেছে আর তা কয়েক শতাব্দীর পুরনো বলে মনে হচ্ছে। পরের দিন যখন সেটিকে নিয়ে মগন ট্যুরিস্টদের কাছে গেল তখন তারা খুশি হল খুব। মগন তাদের জানাল যে এই মূর্তির উল্লেখ কালিদাসের রঘুবংশে আছে। রঘু কোঙ্কণ দেশে ত্রিকূট নামে এক শহর স্থাপন করেছিলেন, সেখান থেকে ওই মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। এ-ধরনের কিছু মূর্তি মহীশূরের চামরাজা ওয়াডিয়ারের কাছে আছে। আর কিছু তার কাছে। এইভাবে মগন টকলা ঐ মূর্তিটিকে সাড়ে পাঁচশ’ টাকায় বেচে দিল। এটার জন্যে সে কীর্তিকে দিয়েছিল মাত্র পাঁচটি টাকা।
এই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে কীর্তি ন্যুড’ নিয়ে এল। তার মুখে আগের মতোই চিন্তার ছাপ। ওর মা অসুস্থ। সে নিজেও অসুস্থ বোধ করছিল। ওর প্রায় নিউমোনিয়া হয়ে গেছে। সে খকখক করে কাশছিল আর বারবার নিজের গলা ধরছিল। তুলোর পট্টি গলায় রেখে তা এক ফাটা-ছেঁড়া কাপড় দিয়ে বেঁধেছিল সে।
কীর্তি অন্যান্য দিনের মতোই মগন টকলার সামনে মূর্তিটি রেখে দিল। এই মূর্তি সে কাঠ দিয়ে নয়, পাথর দিয়ে বানিয়েছিল। আশা আর আশঙ্কার সঙ্গে কীর্তি মগন টকলার দিকে তাকিয়েছিল। মগন যদি অপছন্দ করে তবে তা অমার্জনীয় মিথ্যা কথা হবে। এ-কারণে মগন কেবল তা পছন্দই করেনি, পরন্তু প্রাণভরে তারিফ করেছিল। নিন্দা করেছিল এইমাত্র যে মূর্তিটি খুব ছোট হয়েছে। তার আফসোস এই যে, মূর্তিটি যদি প্রমাণ মানুষের উচ্চতাবিশিষ্ট হতো তবে কেবল কীর্তির নয়, মগনেরও অনেক উপকার হতো।
মগন যক্ষীমূর্তি হাতে নিয়ে সযত্নে দেখছিল। কীর্তি সত্যিসত্যি ন্যুড’ বানাতে পারেনি। মূর্তির মুখের উপর ছিল ভেজা কাপড়। আশ্চর্য ওই কাপড় থেকে এখনো পর্যন্ত জলবিন্দু ঝরে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে। সেই জলবিন্দুর কিছুটা মুখের সঙ্গে লেগে আছে, কিছুটা অন্যান্য জায়গায়। উপর থেকে মুখ ঢাকার চেষ্টায় ওই রমণীর দেহ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
মূর্তি থেকে নজর তুলে নিয়ে মগন টকলা কীর্তির দিকে তাকাতেই হঠাৎ তার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল–’বাহ’। কীর্তি লজ্জিত হয়ে নিজের জামদানি শাড়িটিকে কিছুটা সামনে টানল, কিছুটা দিয়ে পেছন দিকে ঢাকতে লাগল। কিন্তু মগন ঠিক বুঝে নিয়েছিল। যে, আয়নার সামনে নগ্ন হয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে ওই মূর্তি সে বানিয়েছে। এতবার তাকে কাপড় ভিজিয়ে নিজের মুখের উপর রাখতে হয়েছে যার ফলে তার ঠাণ্ডা লেগে গেছে আর সে এখন পর্যন্ত কাশছে। এ কেবল পয়সার কথা নয়। নারীর মধ্যে আত্মপ্রদর্শন আর আত্মসমর্পণের ভাবও তো আছে। মগন সবকিছু বুঝে ফেলেছিল। কিন্তু জেনে-বুঝে না-জানার ভান করে তাকে শুধিয়ে নিল–
মা কেমন আছে?’
এ-কথায় খুব চটে গিয়েছিল কীর্তি। তার কাশির দমক এসেছিল আর নিজেকে সামলাতে তার লেগেছিল বেশখানিকটা সময়। মগন ঘাবড়ে গিয়েছিল, আর লজ্জিতও হয়েছিল। তারপর মাথা হেলিয়ে যে প্রশ্ন সে করেছিল তা-ও জরুরি ছিল না–
‘তা হলে তুমি মডেল পেয়েছিলে?’
কীর্তি প্রথমে দৃষ্টি নত করেছিল, তারপর দোকানের বাইরে তাকিয়ে সেই দিকে দেখেছিল যেদিকে সড়ক আকাশ ছুঁতে গিয়ে হঠাৎ নিচে নেমে গেয়েছে। মগন চেয়েছিল কীর্তির দুর্বলতা ধরে ফেলে আর প্রাপ্য তারিফ তাকে দেয়, আর বোধহয় দিতে চেয়েছিলও। কিন্তু মগন ভাবল এতে মূর্তির দাম বেড়ে যাবে। সে মনে-মনে স্থির করেছিল এবার সে কীর্তিকে একশ’ টাকা দেবে। ওষুধের বোতল আর বাকি জিনিসপত্রের দাম একশ’ টাকা না-হলেও সে একশ’ টাকাই দেবে। ভেতরে-ভেতরে সে ভয় পাচ্ছিল, কীর্তি আরো বেশি টাকা-না চায়।
কী দাম দেব এর জন্য?’ সে হাল্কাভাবে প্রশ্ন করল।
কীর্তি চকিত নজরে তার দিকে দেখল আর বলল, ‘এবার আমি পঞ্চাশ টাকা নেব।’
‘পঞ্চাশ?’
‘হাঁ, এক পাই কম না…’
মগন হতাশভাবে ‘রোলটপ’ তুলল আর চল্লিশ টাকা বের করে কীর্তির সামনে রাখল আর বলল–
যা তুমি বল, কিন্তু এখন আমার কাছে চল্লিশ টাকাই আছে…দশ টাকা পরে নিয়ে যেয়ো…’।
কীর্তি টাকা হাতে নিল আর বলল—
‘আচ্ছা।
সে চলে যাচ্ছিল মগন তাকে থামাল–’শোনো।’
কীর্তি চলার মাঝে থেমে গিয়ে তার দিকে আমাকে সাহায্য কর’ এই ঢঙে। তাকিয়ে দেখল। কীর্তির চেহারায় বিষণ্ণতা, কিন্তু তা যখন ছড়িয়ে যাবার বদলে স্থির হয়ে গেল ঠিক তখনই মগন টকলা শুধাল–এই টাকায় তোমার কাজ হয়ে যাবে তো?
কীর্তি মাথা হেলিয়ে হাত ছড়িয়ে দিয়েছিল, যার অর্থ আর কী করা যায়?’–সে মুখে বলল, ‘মা’র অপারেশন এসে গেল, একশ’ টাকা লাগবে।’
কিছুক্ষণ পর কীর্তি ফের বলল, আমি তো বলেছি’; একটু থেমে বলল, মা যত শীঘ্র মরে যায় ততই ভালো।’ সেখানে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল কীর্তি।
শেষে কীর্তি নিজেই বলে উঠল, ‘এইভাবে ছুটে বেড়ানোর চেয়ে মরণও ভালো।
যতক্ষণ মগন চোখ খুলে না-তাকায় ততক্ষণ কীর্তিকে তার আঠারো-উনিশ বছরের মেয়ের বদলে পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছরের ভরন্ত রমণী বলে মনে হয়, সে জীবনের প্রত্যেক আঘাত নিজের ওপরে নিয়ে তাকে ব্যর্থ করে ফেলে দিচ্ছে।
একটা কথা বলি। টকলা কাছে এসে বলল, ‘তুমি মিথুন বানাও… অপারেশনের সব খরচ আমি দেব।’
‘মিথুন?’ কীর্তি বলে কেঁপে উঠল।
‘হ্যাঁ। ওর খুব চাহিদা আছে। টুরিস্টরা ওগুলোর জন্যে পাগল হয়ে ওঠে।
‘কিন্তু…’
বুঝতে পারছি।’ মগন মাথা হেলিয়ে বলল।
তুমি না-জানো তো একবার খাজুরাহো চলে গিয়ে দেখে এস। আমি তার জন্য তোমাকে রাহা-খরচ নিতে রাজি আছি…’
‘তুমি!’ কীর্তি ঘৃণার সঙ্গে তার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পরে বলল, তুমি তো বলেছ, তোমার কাছে আর পয়সা নেই…’
মগন ঝটপট মিথ্যা তৈরি করে নিল–
আমার কাছে সত্যি পয়সা নেই’, সে বলল, আমি দোকানের ভাড়া দেয়ার জন্য কিছু টাকা আলাদা করে রেখেছিলাম।’
সে ফের টাকা দেয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কীর্তি আপন অহংকারে তা না-নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। মগন টকলা ঘুরে দাঁড়িয়ে যক্ষী-মূর্তিটি দেখল। ছোট হাতুড়ি দিয়ে তার নাক ভেঙে দিল, ঠ্যাং ভেঙে দিল আর মূর্তির শিরের আভরণের উপর লঘুভাবে এমন করে আঘাত করল যাতে কিছু অংশ ভেঙে পড়ে যায়। তারপর ভেতরের ঘরে গিয়ে সে মূর্তিটিকে দড়িদড়া দিয়ে বেঁধে লবণের অ্যাসিড-জলে ডুবিয়ে রাখল। ফলে ধোয়া উড়ল খানিকটা। মগন দড়ি ধরে টেনে যক্ষীকে বার করে জলে ডুবোতে লাগল। তারপর যখন জল থেকে তাকে তুলে নিল তখন যক্ষীর সাজ-আভরণ মলিন হয়ে গেছে। মাঝে-মাঝে কোথাও হঠাৎ দেখা দিয়েছে গর্ত। এখন এই মূর্তি হাজার টাকায় বিক্রির জন্য তৈরি।
এবার কীর্তি যে মূর্তি নিয়ে এল তা মিথুন-মূর্তি। তা ছিল প্রমাণ মানুষের উচ্চতাবিশিষ্ট। মূর্তি একটি বস্তায় বাঁধা অবস্থায় ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে সে নিয়ে এল। কয়েকজন মজুর তা মগন টকলার দোকানে তুলে দিয়ে রেখে মজুরি নিয়ে চলে।
কীর্তি আর নিজেকে একা পেয়ে এক নিঃশ্বাসে মগন টকলা বস্তার দড়িদড়া কেটে ফেলল। কৌতূহলের সঙ্গে খুলে নিল মূর্তির আবরণ। এখন মূর্তিটি তার সামনে। ‘পারফেক্ট’–মগন মূর্তিকে দেখল, শুকিয়ে গেল তার গলা। সে ভেবেছিল যে কীর্তি তাকে নিজের সামনে ওই শিল্পমূর্তিকে দেখতে দেবে না। কিন্তু কীর্তি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তার সামনে, কোনোরকম আবেগ ছাড়াই শিল্পের নারীমূর্তি পূর্ণতাপ্রাপ্ত হল, আর পুরুষমূর্তি আত্মবিস্মৃত হয়ে তার দুই কাধ ধরে দাঁড়িয়ে রইল–মগন টকলা এই যুগলমূর্তিকে যত্নের সঙ্গে দেখল–সে বোধহয় নিভৃত অবসরে মূর্তিটাকে আরো ভালো করে দেখতে চাইছিল।
মগন দ্রুত জিজ্ঞেস করল।
অপারেশনের জন্যে কত টাকা চাই?
অপারেশনের জন্য নয়–নিজের জন্য।
‘নিজের জন্যে? … মা…’
কয়েক সপ্তাহ হল মারা গেছেন।
মগন তার নিজের চেহারায় দুঃখ আর আফসোসের ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিল কিন্তু কীর্তি তা চায়নি। তার দুই ঠোঁট চেপে বসেছিল। ওই রকমই বিষণ্ণভাবে সে বলেছিল, ‘আমি এর জন্যে হাজার টাকা নেব…’
মগন চকিত হয়ে গিয়েছিল। তার কথায় ছিল তোতলামি–এর জন্যে কেউ হাজার টাকা দিতে পারে?
‘হ্যাঁ।’ কীর্তি জবাব দিয়েছিল–’আমি কথা বলে এসেছি… বোধহয় আমি আরো বেশিই পাব … আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম তাই…।
‘আমি তো…আমি তো পাঁচশ’ টাকার বেশি দিতে পারব না।’
না।’ কীর্তি মজুরের সন্ধানে বাইরের দিকে দেখতে লাগল। মগন টকলা তাকে থামাল–’আর দুশ’ নিয়ে নাও।’
‘হাজারের চেয়ে কম এক টাকা নেব না।’
মগন হয়রান হয়ে কীর্তির দিকে তাকিয়ে রইল। আজ কীর্তির মেজাজ অন্যরকমও। ও কি খাজুরাহো গিয়েছিল? দেখা হয়েছিল ট্যুরিস্টদের সঙ্গে? যে-কোনো মূল্যে কলাকারকে তার মার্কেট থেকে দূরে সরিয়ে রাখা দরকার। কিন্তু… কিন্তু… সে ‘রোলটপ’ তুলে আটশ’ টাকার নোট গুণে কীর্তির সামনে রাখল। কীর্তি তাড়াতাড়ি তা গুণে দেখে মগনের মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলল।
‘আমি বলেছি–হাজার টাকার কম নেব না।’
‘আচ্ছা, নয়শ’ টাকা নাও…’
‘না।’
‘সাড়ে নয়শ’… নয়শ’ পঁচাত্তর..।’ কীর্তির দৃষ্টিতে অহংকারের ভাব দেখে সে এক শ’ টাকার দশখানা নোট তার হাতে দিয়ে নেশাগ্রস্তের মতো মিথুন-মূর্তির দিকে এগিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে ছিল কীর্তি। সে তার আপন শিল্পকর্মের তারিফ শোনার জন্য থেমে গিয়েছিল। মগন মিথুন-মূর্তির মধ্যে রমণী-মূর্তির দিকে তাকাল। সে মূর্তি কীর্তি নিজেই। তার চোখে জল কেন? সে কি আত্মতোষের গভীর অনুভূতির ফল অথবা কোনো জীবন-পীড়নের প্রতীক? তা কি দুঃখ আর সুখ, বেদনা আর বেদনা-উপশমের সম্পর্ক-জাত, যা থেকে পুরো সৃষ্টি উপস্থিত? মগন আবার পুরুষ-মূর্তির দিকে তাকাল–যে মূর্তি ওপর থেকে সুন্দর কিন্তু ভেতরে ছিল পুরো অসুন্দর। কীর্তি কেন পুরুষমানুষের কঠোরতার ওপর জোর দিল … এই মূর্তি হল মিথুন-মূর্তি, কিন্তু এ তো সে মিথুন নয় যা পুরুষ আর প্রকৃতির মিলনে হয়… ঠিক আছে … বিপরীত মূর্তিতে বেশি টাকা পাওয়া যাবে…।
মগন টকলা ওপরের দীপদান টেনে এনে পুরুষ-মূর্তির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠল–
‘এই… আমি এই মূর্তিকে কোথায় যেন দেখেছি?
কীর্তি কোনো জবাব দিল না।
‘তুমি।’ মগন যেন সবটাই বুঝে ফেলেছে—
‘তুমি সিরাজার সঙ্গেই বাইরে গিয়েছিলে?’
কীর্তি এগিয়ে এসে মগন টকলার মুখের ওপর সজোরে এক থাপ্পড় মেরে নোটগুলো হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
দুই হাত – ইসমত চুগতাই
রামঅওতার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসছে। বুড়ি মেথরানি চিঠি পড়িয়ে নেয়ার জন্য আব্বা মিঞার কাছে এসেছিল। রামঅওতারের ছুটি হয়ে গেছে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল তো! তাই তিন বছর বাদে রামঅওতার ফিরে আসছে। কৃতজ্ঞতাবশত সে দৌড়ে-দৌড়ে সকলের চরণ স্পর্শ করছে যেন এইসব চরণের মালিকেরাই তার একমাত্র পুত্রকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে জীবিত সুস্থ অবস্থায় ফেরত নিয়ে আসছে।
বুড়ির বয়স পঞ্চাশ বছর হয়েছে; কিন্তু তাকে সত্তর বছরের মতো দেখায়। দশ-বারোটা ছোট-বড় ছেলে জন্ম দিয়েছিল সে। তাদের মধ্যে কেবল রামঅওতারই অনেক মানত-টানত করার ফলে বেঁচে আছে। বিয়ে দেয়ার এক বছর পুরা না-হতেই, রামঅওতারের ডাক’ এসে গিয়েছিল। মেথরানি অনেক আপত্তি করেছিল; কিন্তু কোনো ফল হয়নি। কিন্তু যখন রামঅওতার উর্দি পরে শেষবারের মতো তার চরণ স্পর্শ করতে এল, তখন ছেলের দাপট দেখে বুড়িরও বুক ফুলে উঠেছিল, যেন তার ছেলে কর্নেলই হয়ে গেছে।
পেছনের মহলে চাকর-বাকররা হাসছিল। রামঅওতার ফিরে আসার পর যে ড্রামা হবার সম্ভাবনা, সবাই তা নিয়ে উৎসুক হয়ে বসে আছে। যদিও রামঅওতার যুদ্ধক্ষেত্রে কামান-বন্দুক ছুঁড়তে যায়নি, তবু সিপাহিদের পায়খানা সাফ করতে-করতেও তো তার মধ্যে কিছুটা সিপাহিয়ানা দেখা গেয়েছে। ধূসর উর্দি পরে সেই পুরনো রামঅওতার তো আর সেই লোকটি নেই যে সে গোরীর কার্যকলাপ চুপচাপ শুনবে, তার তরতাজা খুন বদনামির ওপর খেপে না-উঠবে।
বিয়ে করে আনার সময় গৌরীর যৌবন কত মচমচে ছিল। রামঅওতার যতদিন ছিল ততদিন তার ঘোমটা ছিল এক ফুট লম্বা। কেউ তার মুখের রূপ দেখতে পায়নি। যখন পতি বিদেশে গেল তখন সে ভেউ-ভেউ কেঁদেছিল–যেন তার সিথির সিঁদুর চিরকালের মতো মুছে যাচ্ছে। কিছুদিন কাঁদো-কাদো চোখে মাথা ঝুঁকিয়ে সে পায়খানার টব বহন করত। তারপর ধীরে-ধীরে তার ঘোমটার দৈর্ঘ্য কমতে শুরু করেছিল।
কিছু লোকের ধারণা যে, ঐ সময় মেয়েটার শরীরে বসন্ত ভর করেছিল। আর একধাপ এগিয়ে কেউ-কেউ বলেছিল, গোরী একটা ছিনাল। রামঅওতার চলে যাওয়াতেই আপদ এসে জুটেছিল। বদমাশ মেয়ে সব সময় ‘হি-হি’ করত, সব সময় যেন মদমত্তা হয়ে হাঁটত। কোমরে পায়খানার টব বসিয়ে কাঁসার কাকন ছনছ করে যেদিক দিয়ে সে চলে যেত সেদিকে লোকে বেহুঁশ হয়ে তাকিয়ে থাকত। ধোপার হাত থেকে সাবানের বাটি পিছলে চৌবাচ্চায় পড়ে যেত, তাওয়ার উপর ফুলে-ওঠা রুটি থেকে চলে যেত বাবুর্চির দৃষ্টি। ভিস্তির ডোল ডুবে যেত কুয়াতে। চাপরাশিদের ব্যাজ লাগানো পাগড়ি হেলে গিয়ে কাঁধে ঝুলতে থাকত। আর যখন এই আপদের প্রতিমা ঘোমটার আড়াল থেকে নয়ন-বাণ নিক্ষেপ করে চলে যেত তখন সারা পেছন-মহল এক নিষ্প্রাণ দেহের মতো স্থবির হয়ে পড়ত। আবার হঠাৎই চমকে উঠে একে অপরের দুর্গতি নিয়ে বিদ্রূপ করত তারা। ধোপানি প্রচণ্ড রাগে মাড়ের কড়াই উল্টে দিত। চাপরাশিনি বুকে চেপে-রাখা ছেলেকে ধমকে উঠত অকারণে। বাবুর্চির তৃতীয় পক্ষের বিবির হিস্টিরিয়া হয়ে যেত।
নামেই কেবল গোরী কিন্তু বদমাশ মেয়েটা কালো কুটকুটে–যেন উল্টানো তাওয়ার উপর কোনো নষ্ট মেয়ে পরোটা ভেজে চমকে উঠে রেখে দিয়েছে। চওড়া কুঁকদানির মতো নাক, ছড়ানো ঠোঁট। তার সাত পুরুষে দাঁত মাজার ফ্যাশন ছিল না। চোখে বিস্তর কাজল দেয়ার পরেও ডান চোখের টেরাভাব ঢাকা যেত না তার। ঐ টেরা চোখেই সে আবার এমন করে বিষ-মাখানো তীর ছুড়ত যে তা নিশানা ভেদ করত। মোষের চেয়ে চওড়া পা। যে দিক দিয়ে চলে যায় সে দিকে ছড়িয়ে যায় সর্ষের তেলের পচা গন্ধ। হাঁ, কণ্ঠস্বর ছিল আশ্চর্য রকমের মধুর। উৎসব-অনুষ্ঠানে যখন ভাবে বিভোর হয়ে কাজরি গাইত তখন তার কণ্ঠস্বর চলে যেত সবচেয়ে চড়ায়।
বুড়ি মেথরানি ওরফে তার শাশুড়ি, ছেলে চলে যাওয়ার পর গোরীর চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। উঠতে-বসতে তাকে রক্ষার জন্য গালি দিত। তার ওপর নজর রাখার জন্য পেছন-পেছন ঘুরত। কিন্তু এখন বুড়ির স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। চল্লিশ বছর পায়খানা বহন করার ফলে তার কোমর চিরকালের মতো এক দিকে বেঁকে গিয়ে থেকে। গিয়েছিল ওখানেই। সে আমাদের পুরনো মেথরানি। আমাদের জন্মের পরে সে-ই ফুল-নাড়ি ওই মাটিতে পুঁতে দিয়েছিল। মায়ের প্রসববেদনা উঠলে সে এসে বসত চৌকাঠের উপর। আর কখনো কখনো লেডি-ডাক্তারকেও অনেক দরকারি পরামর্শ দিত। টোটকা চিকিৎসার জন্য মন্ত্রপূত তাবিজও নিয়ে বেঁধে দিত পট্টিতে। মেথরানিদের ঘরে সে ছিল গুরুগম্ভীর বয়স্কের মর্যাদায় আসীন।
এমনি জনপ্রিয় মেথরানির পুত্রবধূ হঠাৎ একদিন লোকের চক্ষুশূল হয়ে গেল। চাপরাশিনি আর বাবুর্চিনির তো আরো অভিযোগ ছিল। আমাদের শান্ত-শিষ্ট বউদিদের মাথা তার ঢং দেখে থমকে যেত। আর যে-কামরায় তাদের স্বামীরা আছে সে-কামরা ঝাঁট দিতে যদি সে যেত, তাহলে তারা পড়িমরি করে বুক থেকে দুধের বাচ্চাদের মুখ সরিয়ে দৌড়ত সেখানে যাতে ঐ ডাইনি তাদের স্বামীদের ওপর টোটকা প্রয়োগ না করতে পারে!
গোরী যেন একটা মারকুটে লম্বা শিংওলা ষড়–যা এখানে-ওখানে দিব্যি ছুটে বেড়াত। মেয়েরা তাকে দেখলে নিজ-নিজ কাঁখের বাসন-গামলা দুই হাতে সামলে চেপে ধরত বুকে। আর যখন সে হাল্কা কোমল চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াত তখন পেছন-মহলের মহিলাদের এক হঠাৎ গড়ে-ওঠা প্রতিনিধি-মণ্ডল এসে হাজির হত। মায়ের দরবারে খুব চেঁচামেচি হত, ভাবী বিপদ আর তার সাংঘাতিক ফলাফল নিয়ে হত তর্কবিতর্ক। পতিরক্ষার জন্য এক কমিটি বানানো হয়েছিল তার কারণে, যাতে সব বউদিরা হৈ-চৈ করে ভোট দিল। মাকে দেয়া হয়েছিল ওই সমিতির সম্মানিত প্রধানের পদ। সব মহিলা নিজ-নিজ পদের মর্যাদা অনুযায়ী পিড়ি আর পালঙ্কের কিনারে বসল। পানের দোনা ভাগ করে দেয়া হল তাদের আর ডেকে পাঠানো হল বুড়িকে। বাচ্চাদের মুখে মাই দিয়ে সভায় নিস্তব্ধতা রক্ষা করা হল। পেশ করা হল মোকদ্দমা। আমাদের মা খুব রোয়াবের কণ্ঠে বলেছিলেন, কী রে চুড়েল! তুই বদমাশ বউকে কী এইজন্যে ছেড়ে রেখেছিস যাতে সে আমাদের বুকের উপরে শিল-নোড়া বাটে? তোর মতলবটা কী? মুখে কালি মাখাবি?’
মেথরানিও রেগে উঠল। ফেটে পড়ে বলল, ‘কী করব, বেগম সাহেবান? হারামখোরকে চার লাথি মেরে ছিলাম। রুটিও খেতে দিইনি; কিন্তু রাড়ি তো আমার কজায় নেই…’
.
‘আরে ওর কি রুটির কিছু কমতি আছে?’ বাবুর্চিনি ঢিল ছুড়ল। সাহারানপুরের খানদানি বাবুর্চি ঘরের মেয়ে সে, আবার তৃতীয় পক্ষের বিবি। আল্লার আশ্রয়, কেমন তেজ আর রাগ তার। অন্যদিকে চাপরাশিনি, মালিনী, ধোপানি–সবাই মোকদ্দমাকে আরো সঙিন করে তুলল। বেচারি মেথরানি বসে বসে সকলের লাথি-ঝাঁটা খেতে-খেতে নিজের চুলকানি-ভরা থলথলে গা চুলকাতে লাগল।
‘বেগম সাহেবান, আপনি যেমন বলবেন তেমন করতে দ্বিধা করব না। কিন্তু করব কী, মাগির গলা টিপে দেব?’
টেটিয়াকে শিক্ষা দেবার তীব্র অভিলাষে ঐ মহিলাদের মনে খুশির ঢেউ উঠছিল। আর সকলেরই মনে বুড়ির প্রতি সীমাহীন দরদ তখন…
মা রায় দিয়েছিলেন–মড়াটাকে ধরে বাপের বাড়িতে ছেড়ে দে।’
এ বেগম সাহেবান, এ কি কখনো হতে পারে?
মেথরানি জানিয়েছিল যে, বউ খালি হাতে আসেনি। সারা জীবনের কামাই পুরো দু’শ’ ফেললে তবে এই দামাল মাগী হাতে আসবে। বরং এই টাকায় দুটো গরু কেনা যাবে। অনায়াসে কলসিভরা দুধ দেবে। তখন এই রাড়িকে দুই লাথি দেয়া যাবে হয়তো। আর যদি গোরীকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া যায় তাহলে এর বাপ খুব তাড়াতাড়ি অন্য মেথরের হাতে বেচে দেবে একে। সে তো কেবল ছেলের শয্যা-শোভা নয়। দুই হাতওয়ালা মেয়েমানুষ, যে চারটে পুরুষ মানুষের কাজ করে ফেলে। রামঅওতার। যাওয়ার পর থেকে বুড়ি এত কাজ সামলাতে পারে না। এই বুড়ো বয়সে বউয়ের দুই হাতের সাহায্য নিয়েই চলছে তার।
মহিলারা কেউ অবুঝ নয়। মামলা সামাজিক চালচলন থেকে সরে এসে আর্থিক বাস্তব অবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে গেল তখন। সত্যি কথাই, বুড়ির জন্যে বউটা থাকাই দরকার। কার এমন দিল আছে দু’শ’ টাকা ফেলে দেবে। এই দু’শ টাকা ছাড়াও বিয়েতে বেণের কাছ থেকে নিয়ে খরচ করেছে, লোকজন খাইয়েছে। বেরাদরিকে রাজি করিয়েছে। এই সমস্ত খরচ আসবে কোথা থেকে। রামঅওতার যে বেতন পায় তা তো ধার শুধতেই বেরিয়ে যায়। এমন মোটা-তাজা বউ এখন তো চারশ’ টাকার কমে পাওয়া যায় না। পুরো সাফাইয়ের কাজের পর আশপাশের আরো চার কুঠিতে কাজ করে গোরী। মাগী কাজে চৌকস।
মা শেষ সওয়াল দিয়ে দিলেন–যদি ঐ লুচ্চির জলদি-জলদি কোনো ব্যবস্থা না-কর তো কুঠির হাতায় থাকতে দেওয়া হবে না…’
বুড়ি অনেক চেঁচামেচি করল আর ফিরে গিয়ে প্রাণ ভরে অনেক গালি দিল বউকে। চুল ধরে মারলও। বউ তার কেনা-বউ। সে পিটতে থাকল, হড়বড় করে বকতে থাকল তারপর একদিন সে সব চাকরদের ঘর তছনছ করে দিল প্রতিশোধ হিসেবে। বাবুর্চি, ভিশৃতি, ধোপা আর চাপরাশিরা নিজ-নিজ বউদের ধরে-ধরে খুব পিটল। এবারও মেথরানি বউয়ের মামলায় আমার সভ্যা বউদির দল ও সম্ভ্রান্ত ভাইদের মধ্যে খচাখচি হয়ে গেল আর বউদিদের বাপের বাড়িতে তার পাঠানো হতে থাকল। ফলে বউরা প্রতি ঘরে সই-পাখির কাটা হয়ে গেল।
দু-চারদিন পরে বুড়ি মেথরানির দেওরের ছেলে রতীরাম আপন জেঠিমার সঙ্গে দেখা করতে এসে ওখানেই থেকে গেল। দু’-চারটে কুঠিতে কাজ যা বেড়ে গিয়েছিল তা সে সামলে দিল। নিজের গায়ে তো নিষ্কর্মা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তার বউ এখনো নাবালিকা, এ-কারণে দ্বিরাগমন হয়নি।
রতীরাম আসায় মৌসুম উল্টে-পাল্টে একেবারে বদলে গেল; যেমন হাওয়ার দমকের সঙ্গে ঘন মেঘের দল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বউকে বলে-বলে সবাই চুপ হয়ে গিয়েছিল। কাঁসার কাকন মূক হয়ে গিয়েছিল। যেমন বেলুন থেকে হাওয়া বেরিয়ে গেলে সেটা চুপচাপ ঝুলতে থাকে তেমনভাবে বউয়ের ঘোমটা ঝুলতে-ঝুলতে নিচের দিকে বেড়েই চলল। এখন সে নাকে দড়ি-না-বাধা বলদের বদলে একেবারে লজ্জাবতী বধূ। পেছন-মহলের সব মহিলা সান্ত্বনার নিঃশ্বাস ফেলল। স্টাফের পুরুষরা তাকে খোঁচা দিলে সে লজ্জাবতী লতার মতো নুয়ে থাকত, আর কেউ বেশি চোখ মারলে সে ঘোমটার মধ্যে থেকে অশ্রু-ভেজা চোখের তেরছা নজরে রতীরামের দিকে দেখত, আর দৌড়ে বাহু চুলকাতে-চুলকাতে রতীরামের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যেত।
বুড়ি শান্ত হয়ে দেউড়িতে বসে আধ-খোলা চোখে এই মিলনান্ত নাটক দেখতে দেখতে গুড়গুড়িতে টান দিত। চারদিকেই শীতল শান্তি ছেয়ে গিয়েছিল–যেন সব ফেঁড়া থেকে পুঁজ বেরিয়ে গেছে।
এদিকে বউয়ের বিরুদ্ধে এক নতুন দল তৈরি হল আর তাতে যোগ দিল শার্গিদ-পেশার পুরুষেরা। কথায়-অকথায় যে বাবুর্চি একদিন তার পরোটা ভেজে দিত সে পায়খানার টব সাফ না-করার জন্যে গালি দিতে লাগল। ধোপার অভিযোগ সে মাড় লাগিয়ে কাপড় দড়িতে টাঙিয়ে দেয়, আর এই হারামজাদি ধুলো উড়িয়ে চলে যায়। যে ভিশৃতি তার হাত ধুইয়ে দেবার জন্য মশক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত আজ তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আঙিনায় জল ছিটাবার জন্যে বলে কিন্তু সে শোনে না, ফলে বউ শুকনো জমিতে ঝাড় দিয়ে দিলে চাপরাশি ধুলো ওড়ানোর জন্যে দোষারোপ করে তাকে গালি দিতে থাকে।
সে মাথা ঝুঁকিয়ে সকলের তিরস্কার এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। কে জানে বউ শাশুড়িকে গিয়ে কী বলে দিয়েছিল, ফলে বুড়ি ঠা-া করে সকলের মাথা খেয়ে ফেলত। এখন তার দৃষ্টিতে বউ একেবারে শুদ্ধ আর পুরোপুরি ভালো।
দাড়িওলা দারোগাজি হল সব চাকরদের সর্দার। বাবাকে সে আসল পরামর্শদাতা বলে মানত। সে একদিন বাবার কাছে হাজির হয়ে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে ভয়ানক বদমায়েশি আর শয়তানির কান্না কেঁদে বলল যে বউ আর রতীরাম অনুচিত সম্পর্ক সংস্থাপন করে সারা শার্গিদ-পেশাকে নোংরা করে দিয়েছে। বাবা মামলা সেশনে সোপর্দ করে দিলেন অর্থাৎ এতে লাগিয়ে দিলেন মাকে। মহিলাদের সভা ফের বসল আর বুড়িকে ডেকে আনিয়ে গালাগালি করা হল।
‘আরে হারামজাদি, তুই কি জানিস তোর ছিনাল-বউ কী বদমায়েশি করে বেড়াচ্ছে?’
মেথরানি এমনি ঝাপসাভাবে তাকাল যেন সে বুঝতেই পারছে না কার সম্পর্কে কথা হচ্ছে। আর যখন তাকে স্পষ্টাস্পষ্টি বলা হল যে চোখে-দেখা সাক্ষীদের বক্তব্য এই যে। বউ আর রতীরামের মধ্যে সম্পর্ক অশোভনীয় রকম খারাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে, দু’জনকে খুবই যাচ্ছেতাই অবস্থায় ধরা হয়েছে, তখন তার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষীদের ধন্যবাদ দেয়াই উচিত ছিল বুড়ির। উল্টে বিগড়ে গেল সে। ভারি ঝামেলা লাগিয়ে দিল। রামঅওতার আজ যদি এখানে থাকত তো যারা তার নিষ্কলঙ্ক বউয়ের ওপর কলঙ্ক লেপন করছে তাদের মজা দেখিয়ে দিত। বউ হারামজাদি তো এখন চুপচাপ, রামঅওতাদের কথা মনে করে চোখের জল ফেলছে। প্রাণ দিয়ে কাজকও করছে। কারুর কোনো অভিযোগ থাকতে পারে না। ঠাট্টা তো কেউ করছে না। লোকে নিছক তার দুশমন বনে গেছে। বুড়ি কাঁদতে শুরু করল। তাকে অনেক বোঝানো হল কিন্তু শোক করতে সে নিজেই এমন চোখ বুজে স্থির হয়ে আছে যেন সারা দুনিয়া তার জান নিতে উদ্যোগী হয়েছে। বুড়ি আর তার নিকলঙ্ক বউ লোকের কী ক্ষতিটা করেছে? সে তো কারোর কোনো-কিছুর মধ্যে নেই। বুড়ি নিজে তো সকলের সব রহস্য জানে কিন্তু আজ পর্যন্ত তো কারোর হাটে হাঁড়ি ভাঙেনি। তার কী দরকার কারোর ছিদ্র অন্বেষণ করার? কুঠিবাড়িগুলোর পেছনে কী-না হয়ে থাকে? মেথরানি কারোর ময়লা লুকিয়ে রাখে না। এই দুই বুড়ো হাতে বড়-বড় লোকের কত পাপ সে মাটিচাপা দিয়েছে। এই দুই হাত ইচ্ছে করলে এখন রানীর সিংহাসন উল্টে দিতে পারে। কিন্তু না। কারোর সঙ্গে তার কোনো শত্রুতা নেই। কিন্তু কেউ যদি তার গলায় ছুরি চালায় তো তাহলে সব-কিছু গড়বড় হয়ে যাবে, যেমন-তেমন কারো-না-কারো চাপা রহস্য আপন বুড়া কজে থেকে বের করে দেবার দরকার বোধ করি হবে না।
তার ভ্রুভঙ্গি দেখে শীঘ্রই ছুরি-চালানেওয়ালিদের হাত ঝুলে পড়ল। সব মহিলাই তার পক্ষ নিতে লাগল। বউ যাই করুক-না কেন তাদের নিজ-নিজ কেল্লা তো সুরক্ষিত আছে। তা হলে অভিযোগটা হয় কী করে? এবার কিছুদিনের জন্যে বউয়ের প্রেমটা কমে গেল। মানুষও ভুলে গেল ব্যাপারটা। কিন্তু রহস্যভেদকারীরা ধরে নিয়েছিল যে কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে। বউয়ের ভারিসারি শরীরও বেশিদিন গণ্ডগোল লুকিয়ে রাখতে পারল না। ফলে লোকে বুড়ির কাছে খুব হৈ-চৈ বাধিয়ে দিল। কিন্তু এই নতুন মামলায় বুড়ি বিলকুল হাবিজাবি বকতে লাগল। একেবারে এমনি হয়ে যেত যেন একদম শুনতেই পাচ্ছে না। এখন সে প্রায়ই খাটের উপর শুয়ে থেকে বউ আর রতীরামের ওপর হুকুম চালায়। কখনো কাশে, হাঁচে, বাইরে রোদে গিয়ে বসে। এখন ওরা দু’জনে বুড়ির এমনই দেখাশোনা করে যেন সে কোন পাটরানি।
ভালো-ভালো বউ-ঝিরা তাকে অনেক বুঝিয়েছে। রতীরামের মুখে কালি মাখাও। আর তারও আগে রামঅওতার ফিরে এসে বউয়ের চিকিৎসা করাক। সে তো নিজেই এই কৌশলে খুব নিপুণ। দু’দিনেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু বুড়ি কিছু বুঝতেই চাইল না। এদিকে-ওদিকে সকলের কাছে অভিযোগ করতে লাগল যে, তার হাঁটুতে আগের চেয়ে বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে। তার কারণ এইসব কুঠিবাড়িতে লোকে বেশি পরিমাণে নিষিদ্ধ দ্রব্য খেতে শুরু করেছে। কোনো-না-কোনো কুঠিতে পায়খানা লেগেই আছে। এতে টালমাটাল বুঝানোওয়ালারা জ্বলে-পুড়ে খাক হতে থাকে। মেনে নাও যে বউ মেয়েছেলের জাত, অজ্ঞ, বোকা। বড়-বড় সম্ভ্রান্ত মহিলার পদস্খলন হয়ে যায়, কিন্তু ওই বড়-বড় ঘরের ইজ্জতদার শাশুড়িরা তো কানে তেল দিয়ে বসে থাকে না। কিন্তু কে জানে কেন এই ষাট বছরের বুড়ি যে বিপদকে সে খুব সহজেই কুঠিবাড়ির জঞ্জালের নিচে কবর দিয়ে দিতে পারে, সে নিজেই এখন চোখ বুজে স্থির হয়ে আছে।
রামঅওতারের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় ছিল বুড়ি। সব সময়েই ধমক দিত– ‘রামঅওতারকে আসতে দাও। বলে দেব। তোদের হাড়মাস এক করে দেবে।’
আর এখন যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে রামঅওতার জীবন্ত ফিরে আসছে। সমস্ত পরিবেশটাই দম বন্ধ করে আছে। এক ভয়ংকর হাঙ্গামার অপেক্ষায় আছে লোকে।
কিন্তু লোকেদের খুব রাগ হল যখন বউ একটি ছেলের জন্ম দিল। কিন্তু তাকে বিষ দেবার বদলে বুড়ি খুব খুশি হয়ে উঠল। রামঅওতার চলে যাওয়ার দু’বছর বাদে ছেলে হবার পর বুড়ি একেবারেই চমকিত হয়নি। ঘরে ঘরে ফাটা-ছেঁড়া পুরনো কাপড় আর অভিনন্দন কুড়োতে লাগল সে। তার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষীরা তাকে হিসাব করে অনেক বুঝিয়েছিল যে, এই ছেলে রামঅওতারের হতেই পারে না, কিন্তু বুড়ি সবকিছু বুঝেও সব কথা নস্যাৎ করে দিল। বলল আষাঢ়ে রামঅওতার যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিল–তখন বুড়ি হলুদ কুঠির নয়া ঢঙের ইংরেজি পায়খানার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল, এখন চৈত্রমাস শুরু হয়েছে আর জ্যৈষ্ঠ মাসে বুড়িয়ার লু লেগেছিল কিন্তু খুব জোর বেঁচে গিয়েছিল সে। যখনই তার হাঁটুতে বেদনা বেড়ে যেত, সে বলত–বৈদ্যজি পুরো হারামি। ওষুধের মধ্যে খড়ি মিশিয়ে দেয়। এরপর সে আসল কথা থেকে সরে গিয়ে নষ্ট মেয়েছেলে আর বোকাদের মতো উল্টোপাল্টা বকতে শুরু করত। কারোর-কারো মাথায় এই কথা ঢুকেছিল যে, ওই চালাক বুড়িকে কিছুই বোঝানো যাবে না, কারণ সে না-বোঝার সিদ্ধান্ত করে বসে আছে।
ছেলেটা হবার পর সে রামঅওতারকে চিঠি লিখিয়েছিল। …রামঅওতার সমীপে, চুম্বন ও স্নেহ-সম্ভাষণের পরে অত্র সব কুশল জানিয়ে আর তোমার কুশল জানাইবে আর ভগবানের নিকট তোমার মঙ্গল প্রার্থনা করি আর তোমার ঘরে একটি পুত্রের জন্ম হইয়াছে সে-কারণে তুমি এই পত্রকে ‘তার বলিয়া জানিবে আর শীঘ্র আসিবে।’
লোকে ভেবেছিল রামঅওতার কিছুটা নারাজ হবে। কিন্তু সকলের আশায় ছাই পড়ল যখন রামঅওতারের খুশিতে ভরা পত্রে জানাল যে, সে ছেলের জন্য মোজা বেনিয়ান নিয়ে আসছে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল, এখনই তার আসার কথা। বুড়ি নাতিকে হাঁটুর ওপর শুইয়ে খাটের উপর বসে রাজত্ব করছিল। আচ্ছা, এর চেয়ে সুন্দর বার্ধক্য আর কী হতে পারে! সব কুঠির কাজ হয়ে যাচ্ছে ঝটপট। মহাজনের সুদ সময়মতো কায়দা-মাফিক চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে আর তার নাতি শুয়ে আছে হাঁটুর উপর।
শেষ পর্যন্ত লোকে ভেবে নিল, রামঅওতার যখন আসবে, আসল ব্যাপার বুঝতে পারবে, তখন দেখে নেয়া যাবে। এবার রামঅওতার যুদ্ধ জিতে আসছে। শেষতক ও তো সিপাহি বটে। রক্ত কেন গরম না-হবে? লোকের হৃদয় উৎসাহে ভরে উঠল। পেছনে মহলের বাতাবরণ বউয়ের সংকীর্ণ নজরের কারণে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। দু-চারটে খুন হবার আর নাক কাটবার আশায় জেগে উঠেছিল।
যখন রামঅওতার ফিরে এল তখন ছেলেটার বয়স বছরখানেক। পেছন হলে হৈ-চৈ লেগে গেল। বাবুর্চি হাঁড়িতে অনেক জল ঢেলে দিল, যাতে সে নিশ্চিন্ত হয়ে কচুক করে মজা খাকতে পারে। ধোপারা মাড়ের কড়াই নামিয়ে মাটিতে রেখে দিল আর ভিতি তার ডোল ফেলে দিল কুয়ার ধারে।
রামঅওতারকে দেখার সঙ্গে-সঙ্গেই বুড়ি তার কোমর ধরে চেঁচাতে শুরু করল। কিন্তু পরক্ষণেই দাঁত বের-করা ছেলেটাকে রামঅওতারের কোলে দিয়ে এমনি হাসতে শুরু করে দিল যেন সে কোনোদিন কাঁদেইনি।
রামঅওতার ছেলেটাকে দেখে এমন লজ্জা পেল যেন ছেলেটাই তার বাপ। ঝটপট বাক্স খুলে জিনিসপত্র নামাতে শুরু করেছিল সে। লোকে ভেবেছিল কুরি বা চাকু বের করছে কিন্তু সে যখন তা থেকে লাল বেনিয়ান আর হলদে মোজা বের করল, তখন সব চাকর-বাকরদের পৌরুষের ওপর যেন একটা জোর ঘা পড়ল।
‘ধেততেরিকে। শালা সিপাহি হয়েছে… আপাদমস্তক হিজড়া…।’ ওদিকে বউ সংকোচে এমনভাবে কুঁকড়ে ছিল যেন সে নববিবাহিতা বধূ। সে কাঁসার থালায় জল ভরে রামঅওতারের দুর্গন্ধভরা ফৌজি বুট খুলে নিয়ে পা ধুয়ে জল খেল।
রামঅওতারকে বুঝিয়েছিল লোকে। জ্রিপ করেছিল। তাকে বোকা-বুন্ধু বলেছিল, কিন্তু সে বোকার মতোই দাঁত বের করে থাকত যেন কিছুই সে বুঝতে পারছে না। রতীরামের দ্বিরাগমন হওয়ার কথা ছিল, সে দেরি না-করে চলে গেল।
রামঅওতারের এই কাজে লোকে যতটা আশ্চর্য হয়েছিল তার চেয়ে বেশি হয়েছিল ক্রুদ্ধ। আমাদের বাবা, যিনি সাধারণত চাকর-বাকরদের সম্পর্কে কৌতূহল দেখাতেন না, তিনিও কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলেন। সারা কানুনের জ্ঞান প্রয়োগ করে রামঅওতারকে জব্দ করার জন্যে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন।
‘কী রে, তুই তিন বছর পরে ফিরলি?’
‘হুজুর ঠিক খেয়াল নেই, কিছু কম-বেশি হতে পারে…’
‘আর তোর ছেলের বয়স বছরখানেক হবে।’
‘এতটাই তো মনে হয় হুজুর, কিন্তু শ্বশুর বড় বদমাশ…’
রামঅওতার লজ্জা পেয়েছিল।
‘আরে, তুই এখন হিসাব কর…’
‘হিসাব? কী হিসাব করব হুজুর?’ রামঅওতার মরা-মরা গলায় বলেছিল।
‘উল্লুকের বাচ্চা, এটা কী করে হল?’
‘আমি তা কেমন করে জানব, হুজুর। ভগবানের দান।‘
ভগবানের দান? তোর মাথা… এই ছেলে তোর হতে পারে না’… বাবা তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে জব্দ করতে চাইছিলেন, রামঅওতার ফের মরা-মরা গলায় বেকুবির সঙ্গে বলল–
তা আমি কী করব, হুজুর, হারামজাদিকে আমি খুব মেরেছি…’ ক্রোধভরে ছিটকে গিয়ে সে বলল।
‘আরে, তুই একেবারে উল্লুকের বাচ্চা… বদমায়েশ মাগীটাকে বাইরে বার করে দিসনি কেন?
‘না হুজুর, এ কি কখনো হতে পারে?’ রামঅওতার হে-হে করছিল।
‘কেন রে?’
হুজুর, আড়াইশ’-তিনশ’ টাকা আবার একটা বিয়ের জন্য কোথা থেকে আনব? আর ভাই-বেরাদারিকে খাওয়াতে একশ-দু’শ’ টাকা খরচা হয়ে যাবে…’
‘কেন রে, বেরাদারিকে কেন তোর খাওয়াতে হবে? বউয়ের বদমায়েশির জরিমানা কেন তোকে দিতে হবে?
তা আমি জানি না, হুজুর। আমাদের সমাজে এই রকমই হয়ে থাকে…’
‘কিন্তু ছেলেটা তোর নয়, রামঅওতার … ঐ হারামি রতীরামের।’ বাবা রেগে গিয়ে বোঝালেন।
তাতে কী হয়েছে, হজুর…রতীরাম আমার ভাইয়ের মতো–… অন্য কেউ তো নয়… নিজেরই রক্ত সম্পর্কের…
তুই একেবারে উলুকের বাচ্চা।’ বাবা খচে গিয়েছিল।
হুজুর, ছেলেটা বড় হয়ে আমার কাজ গুছিয়ে নেবে।’
রামঅওতার সবিনয়ে বোঝাল, ‘সে দুহাত লাগাবে, তখন বুড়ো বয়সের ভার কমে যাবে…’
রামঅওতারের মাথা লজ্জায় ঝুঁকে পড়ল। আর কে জানে কেন একদম রামঅওতারের সঙ্গে-সঙ্গে বাবার মাথাও ঝুঁকে গেল–যেন তার কাঠামোর ওপর লাখ-লাখ কোটি-কোটি হাত ছেয়ে গেল…এই হাতগুলো পাপপঙ্কিল নয়, শুদ্ধ। এ তো সেই জয়ী–সংগ্রামী হাত যা দুনিয়ার মুখ থেকে ময়লা ধুয়ে নিচ্ছে। তার বুড়ো বয়সের বোঝা তুলছে।
এই মাটিতে লেগে-থাকা কচি-কচি কালো হাত ধরিত্রীর সিথিতে সিঁদুর লাগিয়ে দিচ্ছে।
খুলে দাও – সাত হাসান মান্টো
অমৃতসর থেকে স্পেশাল ট্রেনটি দুপুর দু’টায় রওনা হয়ে আট ঘণ্টা পর মোঘলপুরা পৌঁছে। পথে কয়েকজন যাত্রী ক্রমাগত ট্রেনে হামলার ফলে প্রাণ হারায়; বহু যাত্রী হতাহত হয়। কিছুলোক দুষ্কৃতকারীদের হামলা থেকে কোনোমতে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে।
পরদিন সকাল ১০টা। আশ্রয়-শিবিরের ভিজে মাটিতে চোখ মেলে সিরাজউদ্দিন। চারদিকে অসংখ্য নারী-পুরুষ-শিশুদের ভিড় আর জনতার সমুদ্র দেখে তার চিন্তাশক্তি আরও শিথিল হয়ে পড়ে। অনেকক্ষণ সে এক-দৃষ্টিতে ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। উদ্বাস্তু শিবিরের হৈ-হল্লা কিছুই সিরাজউদ্দিনের কানে যায় না। তার স্মৃতিশক্তি বিলুপ্ত। কেউ তাকে দেখলে গভীর চিন্তায় মগ্ন বলে মনে করবে কিন্তু আসলে তা নয়; সে চারদিকের কোলাহলময় পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন অথচ সবকিছু যেন শূন্যে খেই হারিয়ে যাচ্ছে।
মেঘলা আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সিরাজউদ্দিন; সূর্যের আলোর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই তার দেহের অনুভূতিগুলো পুনঃসজীব ওঠে আর ফিরে আসে তার স্মৃতিশক্তি। তার চোখের সামনে দাঙ্গা, লুটতরাজ, আগুন, হুড়োহুড়ি, দৌড়, স্টেশন, গোলাগুলি অন্ধকার রাত্রি এবং মেয়ে সকিনা প্রভৃতি চিত্র একের পর এক ভেসে ওঠে। মুহূর্তে সিরাজউদ্দিন উঠে দাঁড়ায় এবং পাগলের মতো চারদিকে ইতস্তত জনতার ভিড়ে ঘুরতে থাকে।
তিন ঘণ্টা যাবৎ ‘সকিনা’ ‘সকিনা’ নাম ধরে ডেকে-ডেকে শিবিরে তোলপাড় করে চষে বেড়ায় সে। কিন্তু একমাত্র কন্যা সকিনার কোনো সন্ধান মেলে না। চারদিকে বিশৃঙ্খলা। কেউ তার সন্তানকে খুঁজছে, কেউ খুঁজছে মা, কেউ স্ত্রী বা কন্যাকে। সিরাজউদ্দিন পরাজিত ও ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে বসে পড়ে। কোথায় সে সকিনাকে হারিয়েছে তা স্মরণ করার চেষ্টা করে। তার স্ত্রীর মৃত্যুর ক্ষণটির কথা মনে পড়ে,–তার পেটের নাড়িভুড়ি বের হয়ে গিয়েছিল। এর বেশি সে ভাবতে পারে না।
সকিনার মা মারা গেছে। সে সিরাজউদ্দিনের চোখের সামনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। কিন্তু সকিনা কোথায়? মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর সকিনার মা মিনতি করেছে, আমার আশা ত্যাগ কর। সকিনাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালিয়ে যাও।’
সকিনা তার সঙ্গেই ছিল। দু’জনেই নগ্নপায়ে প্রাণ হাতে নিয়ে পালাচ্ছিল। সকিনার ওড়না পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। সিরাজউদ্দিন কুড়োতে গেলে সকিনা চিৎকার করে উঠেছিল, আব্বা, ওটা ছেড়ে দিন…।’ কিন্তু সে তবুও তা কুড়িয়ে নিয়ে কোটের পকেটে রেখেছিল। এ-সব কথা ভাবতে গিয়ে সে ধীরে-ধীরে পকেট থেকে সকিনার ওড়নাটা বের করে। এটা সকিনারই ওড়না; কিন্তু সে কোথায়?
সে শ্রান্ত স্মৃতিশক্তির ওপর অনেক চাপ দিয়েও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারল না। সে কি সকিনাকে তার সঙ্গে স্টেশন পর্যন্ত এনেছিল? তারা কি ট্রেনে উঠেছিল একসঙ্গে? পথে ট্রেন থেমেছে? গুণ্ডারা হামলা চালিয়েছে?
তার অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার সময় কি গুণ্ডারা সকিনাকে নিয়ে গেছে? মনে তার অনেক প্রশ্নের ভিড় জমে; কিন্তু তার কোনো জবাব পায় না সে।
তার সান্ত্বনার দরকার। কিন্তু চারদিকে হাজারো মানুষের প্রয়োজন একটি জিনিস, তা হল সান্ত্বনা। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে? সিরাজউদ্দিন কাঁদতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু হতভাগ্য চোখদুটি তাকে সাহায্য করে না। অশ্রু যেন শুকিয়ে গেছে।
ছয়দিন পর সিরাজের বোধশক্তি কিছুটা ফিরে আসে। এমন কয়েকজন লোকের সঙ্গে দেখা করে সে যারা তাকে সাহায্য করতে পারে; এরা আটজন যুবক। তাদের কাছে বন্দুক ও ট্রাক আছে। সিরাজউদ্দিন তাদের হাজার-হাজার আশীর্বাদ জানিয়ে সকিনার আকৃতি বর্ণনা করে, দেখতে ফর্সা, খুবই সুন্দরী, মায়ের সঙ্গে চেহারার মিল আছে… বয়স সতের’র কাছাকাছি, ডাগর-ডাগর চোখ… ডান গালে বড় একটি তিল… আমার একমাত্র কন্যা। ওকে খুঁজে দিলে খোদা তোমাদের মঙ্গল করবেন।’ তরুণ স্বেচ্ছাসেবকরা আবেগভরে বৃদ্ধকে আশ্বাসবাণী শোনায়, যদি তোমার মেয়ে বেঁচে থাকে, তাহলে কয়েকদিনের মধ্যে তাকে উদ্ধার করে তোমার কাছে হাজির করবই।’
একদিন ওরা অসহায়দের সাহায্যের জন্য অমৃতসর যাচ্ছিল; সড়কের উপর ‘ছেরাট্রার কাছে একটি তরুণীকে দেখতে পেল তারা। ট্রাকের শব্দ শুনে ভীত-সন্ত্রস্ত মেয়েটি পালিয়ে যেতে শুরু করল। স্বেচ্ছাসেবকরা গাড়ি থামিয়ে মেয়েটির পিছু ধাওয়া করল। কিছুদূর যাওয়ার পর মেয়েটাকে পাকড়াও করল একটি ক্ষেত থেকে। মেয়েটি সুন্দরী; ডান গালে মোটা কালো তিল। একজন স্বেচ্ছাসেবী প্রশ্ন করল, ভয় পেয়ো না, তোমার নাম কি সকিনা? মেয়েটির চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একটি বাক্যও তার মুখ দিয়ে বের হল না। স্বেচ্ছাসেবকরা ভরসা দিলে মেয়েটির ভয় দূর হল এবং স্বীকার করল সে সিরাজউদ্দিনের মেয়ে সকিনা।
আটজন স্বেচ্ছাসেবী যুবক তার জন্য অনেক কিছু করল। তাকে দুধ ও রুটি খেতে দিল, ট্রাকে তুলে নিল তারপর। দো-পাট্টার অভাবে সকিনা বারবার বাহু দিয়ে বুক ঢাকবার চেষ্টা করছিল দেখে একজন যুবক কোট খুলে সকিনাকে পরতে দিল।
বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। সিরাজউদ্দিন সকিনার কোনো সংবাদ পায়নি। সারাদিন ক্যাম্পে এবং বিভিন্ন অফিসে ঘুরঘুর করছে সে। কিন্তু কোনো খোঁজই পায়নি মেয়েটির। রাত গম্ভীর হলে সে স্বেচ্ছাসেবক দলটির সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করল। বেঁচে থাকলে তারা তার মেয়েকে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
একদিন সিরাজউদ্দিন স্বেচ্ছাসেবক দলটিকে ট্রাকে দেখতে পেল। ট্রাক তখন ছেড়েই। দিয়েছে; সে দৌড়ে গিয়ে তাদের কাছে জিজ্ঞেসা করল, বাবারা আমার, সকিনার কোনো খোঁজ পেয়েছ?’ তারা ট্রাক থামিয়ে সমস্বরে বলল, ‘চিন্তা কর না। চিন্তা কর না, পাওয়া যাবেই।’ ট্রাক ছেড়ে দিল।
সিরাজউদ্দিন আবার এই যুবকদের সাফল্যের জন্য মোনাজাত করল। এর ফলে তার মনটা অনেকখানি হাল্কা বোধ হল।
ক্যাম্পে সিরাজউদ্দিন বসে ছিল। পাশেই শোনা গেল কিসের হট্টগোল। চার জন লোক কী জানি বহন করে আনছে। জিজ্ঞাসার পর জানতে পারল, রেললাইনের ধারে অজ্ঞান অবস্থায় একটি মেয়ে পাওয়া গেছে। ওরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। সিরাজউদ্দিন তাদের পিছু পিছু হাসপাতালে গিয়ে হাজির হল। লোকগুলো হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে মেয়েটিকে ন্যস্ত করে চলে গেল।
বাইরে লাইটপোস্টে হেলান দিয়ে সিরাজউদ্দিন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধীরে-ধীরে হাসপাতালের ভেতরে গেল; কামরায় কেউ নেই। একটি স্ট্রেচারে মেয়েটির অচৈতন্য দেহ পড়ে আছে। হঠাৎ ঘরের বাতি জ্বলে উঠল। প্রাণহীন বিবর্ণ ডান গালে তিল দেখে সিরাজউদ্দিন চিৎকার করে উঠল সকিনা…।’
যে ডাক্তার ঘরে বাতি জ্বালিয়েছিলেন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার?’ উদ্বেলিত কণ্ঠে সিরাজ বলল, আমি… আমি ওর বাবা।
ডাক্তার স্ট্রেচারে শায়িতা মেয়েটির নাড়ি পরীক্ষা করে দেখলেন এবং সিরাজউদ্দিনকে নির্দেশ দিলেন, জানালা খুলে দাও। স্ট্রেচারে শায়িতা প্রাণহীন দেহ কেঁপে উঠল। কম্পিত হাতে ধীরে-ধীরে সে তার শওয়ারের দড়ির গিট খুলে নিচের দিকে নামিয়ে দিল।
বৃদ্ধ সিরাজউদ্দিন আনন্দে চিৎকার করে উঠল ‘ও বেঁচে আছে… আমার মেয়ে বেঁচে আছে। এই দৃশ্য দেখে ডাক্তারের আপাদমস্তক ঘামে ভিজে একাকার।
সর্দারজি – খাজা আহমদ আব্বাস।
খোদ দিল্লি আর তার আশপাশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চরমে উঠলে মুসলমানদের রক্তের কোনো মূল্য রইল না। আমি ভাবলাম, কী দুর্ভাগ্য! প্রতিবেশী প্রায় সবাই শিখ। ওদের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করব কি নিজের পেটেই কখন ছুরি চেপে বসে সেই ভয়ে সময় কাটতে লাগল। সত্যি কথা বলতে কি, শিখদের আমি খুব ভয় পাই, ঘৃণাও করি কিঞ্চিৎ। আমার মনে হয় ওরা এক অদ্ভুত জানোয়ার। এই মনে হওয়া সেই আমার ছোটবেলা থেকেই। তখন আমার বয়স বছর ছয়েক। একদিন এক শিখকে রোদে বসে চুল আঁচড়াতে দেখে চিৎকার করে উঠেছিলাম, দেখ, দেখ–মেয়েমানুষের মুখে কত লম্বা-লম্বা দাড়ি। বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে এই বোধ কেমন এক ধরনের ঘৃণায় রূপান্তরিত হয়। এই বোধটির অবশ্য পেছনে রয়েছে ১৮৫৭ সালের তিক্ত স্মৃতির স্মরণ। সে-সময় হিন্দু-মুসলমানের যৌথ স্বাধীনতা সংগ্রাম দমন করার জন্য পাঞ্জাবের শিখরাজ আর তাদের সেনাবাহিনী ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। এই কারণে একটা অস্পষ্ট ভীতি ও এক অদ্ভুত ধরনের ঘৃণা কেবল শিখ নয়, ইংরেজদের প্রতিও পোষণ করতাম। তবে শিখ-ঘৃণাটাই ছিল প্রবল; অন্যদিকে ইংরেজদের ভয় পেলেও তাদের প্রতি কিছুটা প্রতিবোধও ছিল আমার। মনে-প্রাণে আমি ইংরেজদের মতো কোর্ট-প্যান্ট পরতে চাইতাম। চাইতাম ওরা যেমন শ্লীলতাবোধশূন্য কথা-বার্তা চালিয়ে যায় সেভাবে। কথাবার্তা বলতে। তাছাড়া ওরা ছিল শাসক, আমিও চাইতাম ছোটখাটো একজন শাসক হতে। ওদের মতো কাটা-ছুরি-চামচ দিয়ে খাবার খাওয়ার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল খুব যাতে পৃথিবীর মানুষ আমাকেও কিছুটা সভ্যভব্য ভাবে। কিন্তু শিখদের যে ভয় করতাম সেটা ছিল অনেকটাই অবজ্ঞা-মিশ্রিত। অদ্ভুত সৃষ্টি এই শিখ–যারা পুরুষ হয়েও চুল রাখে মেয়েমানুষের মতো। ইংরেজি ফ্যাশনের অনুকরণে মাথার চুল ছোট অবশ্য আমি পছন্দ করি না–সেটা ভিন্ন কথা। আব্বা বলতেন, প্রতি শুক্রবার যেন মাথার চুল ছাঁট করি; তাহলে মাথায় খুস্কি হতে পারবে না। কিন্তু আমি সে কথা না-শুনে চুল এমন বড় করে রাখতাম যাতে তা হকি ও ফুটবল খেলার সময় ইংরেজ খেলোয়াড়দের মতো বাতাসে ওড়ে। আব্বা বলতেন, একি! তুই যে মেয়েদের মতো চুল লম্বা রেখেছিস! কিন্তু আব্বা তো পুরনো চিন্তাধারার মানুষ, তার কথা কে শোনে। তিনি তো পারলে ছোটবেলাতেই আমাদের মুখে দাড়ি গজিয়ে দেন। ও হ্যাঁ, মনে পড়ল, শিখদের আর একটা অদ্ভুত নিদর্শন হল তাদের দাড়ি। আমার দাদার দাড়ি ছিল কয়েক ফুট লম্বা। তিনি সে দাড়িতে চিরুনি ব্যবহার করতেন। কিন্তু দাদাজানের ব্যাপার ভিন্নতম। যতকিছুই হোক তিনি আমার দাদাজান, আর শিখরা শিখ।
ম্যাট্রিক পাস করার পর আমাকে পড়ালেখার জন্যে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। কলেজে যে-সব পাঞ্জাবি ছেলে পড়ত আমরা অর্থাৎ দিল্লি ইউপির ছেলেরা তাদেরকে নীচ, মূর্খ এবং বখাটে মনে করতাম। ওরা কথা বলার নিয়মও জানত না। পানাহারের মধ্যেও কোনো রুচিজ্ঞান ছিল না। সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। একগুঁয়ে অভদ্রের একশেষ। লাসসির বড়-বড় গ্লাস সাবাড়কারীরা কেওড়াদার ফালুদা ও সিফটন চায়ের স্বাদ কী বুঝবে! তাদের ভাষা নিতান্ত অমার্জিত। কথা বলার সময় মনে হয় যেন ঝগড়া করছে। কথায়-কথায় তুই-তোকারি এই-সেই। আমি সব সময় এসব পাঞ্জাবিদের এড়িয়ে চলতাম। কিন্তু আমাদের ওয়ার্ডেন সাহেব খোদা তার মঙ্গল করুন–হঠাৎ করেই আমার কামরায় একজন পাঞ্জাবি ছাত্রকে জায়গা। দিলেন। আমি ভাবলাম, কী আর করা, একত্রে যখন থাকতে হবে কিঞ্চিৎ ভাব পাতিয়েই থাকা যাক। এভাবে থাকতে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে তার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতাই গড়ে উঠল। তার নাম গোলাম রসুল। রাওয়ালপিন্ডিতে বাড়ি। বেশ রসিক ছেলে। আমাকে প্রায়ই চুটকি শোনাত।
আপনারা এখন বলবেন, সর্দার সাহেবের কথা শোনাতে গিয়ে আবার এই গোলাম রসুল কোথা থেকে এসে পড়ল। কিন্তু আসলে এ কাহিনীর সঙ্গে গোলাম রসুলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কথা হচ্ছে যে, গোলাম রসুল যে-সব চুটকি শোনাত সেগুলো প্রায়ই শিখদের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেসব চুটকি শুনে-শুনে শিখদের স্বভাব-চরিত্র রুচি-বৈশিষ্ট্য ও সামগ্রিক চরিত্র সম্পর্কে আমি যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করেছিলাম।
যেমন ধরুন গোলাম রসুল বলত, সব শিখই বেকুব এবং বুন্ধু। দুপুর বারোটা বাজলেই তাদের বিবেকবুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। এ-সম্পর্কে অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। যেমন একজন সর্দারজি সাইকেলে আরোহণ করে দুপুর বারোটায় অমৃতসরের হল বাজার দিয়ে যাচ্ছিল। চৌরাস্তায় একজন শিখ কনস্টেবল তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল তোমার সাইকেলের লাইট কোথায়? সাইকেল আরোহী সর্দারজি বিনয়ে বিগলিত কণ্ঠে বলল, জমাদার সাহেব, এই একটু আগে নিভে গেছে। বাড়ি থেকে তো জ্বালিয়েই বেরিয়েছিলাম! কনস্টেবলটি তখন সর্দারজিকে থানায় চালান দেয়ার হুমকি দিল।
অন্য একজন পথচারী শুভ্র-শ্মশ্রু শিখ সর্দারের মধ্যস্থতা করে বললেন, যাও ভাই, গোলমাল কর না। লাইট যদি নিভে গিয়ে থাকে এখন জ্বালিয়ে নাও, ব্যস।
এ ধরনের বহু গল্প গোলাম রসুলের জানা ছিল। পাঞ্জাবি ভাষার সংমিশ্রণে সে যখন এসব গল্প শোনাত তখন হাসতে-হাসতে আমাদের পেটে খিল ধরে যেত। আসলে পাঞ্জাবি ভাষায়ই সে-সব গল্প শুনে মজা পাওয়া যেত। কারণ, শিখদের অদ্ভুত ও উদ্ভট তৎপরতা বর্ণনা করার জন্যে পাঞ্জাবির মতো উটকো ভাষাই ছিল মানানসই।
সে থাকগে। অন্যের চালচলন নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা করে লাভ নেই! কিন্তু শিখদের সবচেয়ে বড় দোষ হল ওরা ঔদ্ধত-হঠকারিতা-মারদাঙ্গা করে মুসলমানদের মোকাবেলা করতে সাহস দেখাত। এখন তো পৃথিবী জেনেই গেছে যে, একজন মুসলমান দশজন হিন্দু বা শিখের সমান। কিন্তু মুসলমানদের এ শক্তিমত্তা তারা স্বীকার করত না। তারা কৃপাণ ঝুলিয়ে গোঁফে এমনকি দাড়িতে তা দিয়ে চলত। গোলাম রসুল বলত, ওদেরকে একদিন আমরা এমন শিক্ষা দেব যে, জীবনভর মনে থাকবে।
কলেজ ছাড়ার পর কয়েক বছর কেটে গেল। ছাত্র থেকে ক্লার্ক, ক্লার্ক থেকে হেড ক্লার্ক পদে উন্নীত হলাম। আলিগড় ছাত্রাবাস ছেড়ে নয়াদিল্লিতে একটা সরকারি কোয়ার্টারে থাকি। বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলে-মেয়েও হয়েছে। রাওয়ালপিন্ডি থেকে বদলি হয়ে আমার মুখোমুখি কোয়ার্টারে একজন শিখ সর্দার এসে উঠলে বহুদিন পর গোলাম রসুলের কথা আমার মনে পড়ল। গোলাম রসুলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী রাওয়ালপিভিতে শিখদের আচ্ছাসে ধোলাই দেয়া হয়েছে। মুজাহিদরা শিখদের নির্মূল অভিযান শুরু করেছিল। শিখরা সেখানে দারুণ দাপট দেখাচ্ছিল, মুসলমানদের সামনে সেসব দাপট টেকেনি। দাড়ি কামিয়ে অনেক শিখকে মুসলমান করা হয়েছে, অনেককে খত্না করিয়ে দেয়া হয়েছে জোর করে। হিন্দুদের সংবাদপত্রে মুসলমানদের দুর্নাম রটানোর জন্যে লেখা হচ্ছিল যে, মুসলমানেরা, শিখ নারী ও শিশুদেরকেও হত্যা করেছে। অথচ এটা ইসলামি ঐতিহ্য পরিপন্থী। মুসলিম মুজাহিদরা কখনো নারী ও শিশুদের ওপর হাত তোলেনি। হিন্দুদের সংবাদপত্রে যেসব শিখ নারী ও শিশুর ছবি ছাপা হয়েছে সেগুলো ছিল হয় জাল ছবি অথবা শিখরা মুসলমানদের দুর্নাম রটানোর জন্যে নিজেরাই নিজেদের নারী ও শিশুকে হত্যা করে পত্রিকায় ছেপেছিল। রাওয়ালপিন্ডি এবং পশ্চিম পাঞ্জাবের মুসলমানদের এ অপবাদও দেয়া হচ্ছিল যে, তারা হিন্দু ও শিখ মেয়েদের অপহরণ করেছে। অথচ ঘটনা এই যে, মুসলমানদের বীরত্ব দেখে শিখ মেয়েরা মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে তাদের সঙ্গে চলে গেছে। এমতাবস্থায় ওরা যদি মুসলমানদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় পালিয়ে যায় তাতে মুসলমানদের দোষটা কোথায়? তারা তো ইসলাম প্রচারের অংশ হিসেবেই সে সব মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছে।
সে যাই হোক, শিখদের তথাকথিত বীরত্বের চেহারা এখন পাল্টে গেছে। এখন কৃপাণ বের করে মুসলমানদের হুমকি দেয়া দূরে থাক রাওয়ালপিন্ডি থেকে পালিয়ে আসা সর্দারের দুরবস্থা দেখে ইসলামের গৌরবে বুক ফুলে উঠল আমার।
আমার প্রতিবেশী সর্দারজির বয়স ষাটের কাছাকাছি। দাড়ি সব শাদা হয়ে গেছে। তিনি মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এসেছেন। ভদ্রলোক সব সময় দাঁত বের করে হাসতেন। তাঁর এ হাসি দেখেই বুঝেছিলাম লোকটা আসলে বেকুব এবং নির্বোধ। প্রথম দিকে তিনি আমার সঙ্গে মিতালি পাতাতে চেয়েছিলেন। যাওয়া-আসার সময় গায়ে পড়ে আলাপ করা শিখদের এক আজব রীতি। সেদিন তো বাসায় প্রসাদের মিষ্টান্নই পাঠিয়ে দিলেন। (আমার স্ত্রী সে মিষ্টান্ত সঙ্গে-সঙ্গে মেথরানিকে দিয়ে দিয়েছে) আমি আর বন্ধুত্বের ফাঁদে ধরা দিইনি, কখনো কিছু জিজ্ঞেস করলে মামুলিভাবে দু-একটা কথা জবাব দিয়ে চুপচাপ কেটে পড়েছি। আমি জানতাম ভালোভাবে কথা বললে এ লোক আমার পিছু নেবে। আজ ভালোভাবে আলাপ করবে, কালই গালাগালি শুরু করবে। আপনারা তো জানেন। যে, গালাগালি শিখদের ডাল-রুটি। এ-ধরনের লোকের সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে কে নিজের মুখ খারাপ করবে? একদিন দুপুরে আমি গিন্নিকে শিখদের নির্বুদ্ধিতার কাহিনী শোনাচ্ছিলাম। বাস্তব প্রমাণ দেয়ার উদ্দেশ্যে আমি ঠিক বারোটায় আমার ভূত্যকে সর্দারজির বাসার ঘড়িতে কটা বাজে জিজ্ঞেস করার জন্যে পাঠালাম। সর্দারজি ভৃত্যকে বললেন, বারোটা দুমিনিট। আমি গিন্নিকে বললাম, দেখলে তো বারোটা বাজার নাম নিতেই ভয় পাচ্ছে। এ-কথা বলে আমি একচোট হাসলাম, গিন্নিও হাসল। আমি মাঝে-মাঝে অপ্রস্তুত করার জন্যে সর্দারজিকে জিজ্ঞেস করতাম, কেমন সর্দারজি, বারোটা বেজে গেছে? তিনি নির্লজ্জভাবে দাঁত বের করে জবাব দিতেন–জ্বী, আমাদের এখানে চব্বিশ ঘণ্টাই বারোটা বেজে থাকে। এ-কথা বলে খুব হাসতেন–যেন বড় একটা রসিকতা করতে পেরেছেন।
শিশুদের ব্যাপারে সব সময় ভয়ে-ভয়ে থাকতাম। একে তো কোনো শিখের ওপরই আস্থা রাখা যায় না। শিশুদের গলায় কখন কৃপাণ চালিয়ে দেবে কে জানে! তাছাড়া এরা রাওয়ালপিন্ডি থেকে এসেছে। মুসলমানদের প্রতি এমনিতেই মনে-মনে নিশ্চয়ই ঘৃণা পোষণ করে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে ওঁত পেতে থেকে সুযোগ খুঁজবে। স্ত্রীকে আমি সতর্ক করে দিয়েছিলাম শিশুদের যেন সর্দারজির কোয়ার্টারের দিকে যেতে দেয়া না হয়। কিন্তু শিশুরা তো শিশুই। ক’দিন পর দেখি, আমার ছেলে-মেয়েরা সর্দারজির ছোট মেয়ে মোহিনী এবং তার নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খেলা করছে। বড়জোর দশ বছর বয়সের মোহিনী আসলেই ছিল মোহিনী। গৌরবর্ণ চমৎকার চেহারা। হতভাগাদের মেয়েরা দারুণ সুন্দরীও হয়। আমার মনে পড়ল, গোলাম রসুল বলত, পাঞ্জাব থেকে শিখ পুরুষরা চলে গিয়ে যদি মেয়েদের রেখে যেত তাহলে হুর-এর সন্ধান করার প্রয়োজন হত না। আমার সন্তানদের সর্দারজির মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খেলতে দেখে আমি ওদের টেনে বাসায় নিয়ে এলাম। তারপর খুব মারলাম। এরপর অন্তত আমার চোখের সামনে কখনো ওদের আর ওদিকে যেতে দেখিনি।
খুব অল্প সময়ে শিখদের আসল চেহারা প্রকাশ হয়ে পড়ল। রাওয়ালপিন্ডি থেকে সুড়সুড় করে পালিয়ে এসে, পাঞ্জাবের মুসলমানদের সংখ্যায় কম পেয়ে তাদের ওপর নৃশংস অত্যাচার শুরু করে দিল। শত-শত এমনকি হাজার-হাজার মুসলমানকে তাদের হাতে শহীদ হতে হল। নদীর স্রোতের মতো প্রবাহিত হল মুসলমানকে রক্ত। হাজার-হাজার মুসলিম মেয়ে ও মহিলাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে মিছিল বের করল ওরা। এ-সব কারণে পূর্ব পাঞ্জাব থেকে বহুসংখ্যক মুসলমান দিল্লিতে আসতে শুরু করল। তার ঢেউ এই দিল্লিতে আমার এখানে এসে পৌঁছান ছিল নিতান্ত স্বাভাবিক। আমার পাকিস্তান যাওয়ার তখনো কয়েক সপ্তাহ বাকি। এ কারণে বড় ভাইয়ের সাথে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের বিমানযোগে করাচি পাঠিয়ে দিয়ে নিজে খোদা ভরসা করে থেকে গিয়েছিলাম। উড়োজাহাজে বেশি জিনিসপত্র নেয়া যায় না। এ-কারণে আমি একটা পুরো ওয়াগন বুক করেছিলাম। কিন্তু যেদিন জিনিসপত্র ওয়াগনে তুলব সেদিনই শুনলাম পাকিস্তানি গাড়িতে হামলা করা হচ্ছে। ফলে ঘরের জিনিসপত্র রইল ঘরেই।
১৫ আগস্ট স্বাধীনতা উৎসব পালন করা হল। কিন্তু এ স্বাধীনতার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি ছুটি পালন করলাম। সারাদিন শুয়ে-শুয়ে ‘ডন’ আর ‘পাকিস্তান টাইমস’ পড়ে কাটালাম। উভয় পত্রিকায় ভারতের এ তথাকথিত স্বাধীনতার তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। প্রমাণ দেয়া হয়েছে কী করে ইংরেজ ও হিন্দুরা যোগসাজশ করে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কেবল কায়েদে আজমের বুদ্ধিমত্তার কারণেই আমরা পাকিস্তান অর্জন করেছি। যদিও হিন্দু ও শিখদের চাপের মুখে ইংরেজরা অমৃতসর ভারতকে দিয়ে দিয়েছে তবু দুনিয়ার সবাই জানে যে-অমৃতসর খাঁটি ইসলামি শহর, এখানকার স্বর্ণ-মসজিদ বিশ্ববিখ্যাত। সেখানে কোনো গুরুদোয়ারা নেই যে, তাকে গোল্ডেন টেম্পল বলা যাবে। মসজিদ তো দিল্লিতেও রয়েছে; শুধু স্বর্ণ মসজিদই নয়, জামে মসজিদ, লালকেল্লা, নিজামুদ্দিন আওলিয়ার মাজার, হুমায়ুনের সমাধিসৌধ, সফদার জঙ্গ-এর মাদ্রাসা রয়েছে এখানে। মোটকথা দিল্লির আনাচে-কানাচে মুসলিম শাসনামলের নিদর্শনে ভরা। তবুও আজ সেই দিল্লি বরং বলা উচিত শাহজাহানাবাদে আজ হিন্দু সাম্রাজ্যবাদের পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে। আমি আবেগরুদ্ধ হৃদয়ে ভাবলাম, এই দিল্লি ছিল এক সময় মুসলমানদের রাজসিংহাসনের জায়গা, সভ্যতা-সংস্কৃতির পাদপীঠ। এই দিল্লি আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। আর আমাদের পাঠানো হচ্ছে পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান প্রভৃতি বিরান, অনুন্নত, অসংস্কৃত অঞ্চলসমূহে জোরপূর্বক। এ-সব এলাকায় মার্জিত উর্দুতে কেউ কথা পর্যন্ত বলতে জানে না। সালোয়ারের মতো হাস্যকর পোশাক পরে সেখানকার মানুষ। হালকা-পাতলা চাপাতির বদলে দু সের ওজনের নানরুটি খায়। এসব ভেবেও নিজের মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম যে, কায়েদে আজম এবং পাকিস্তানের জন্যে এ-ত্যাগ স্বীকার আমাদের করতেই হবে। কিন্তু তবুও দিল্লি হাত ছাড়া হওয়ার চিন্তায় মনটা বিষণ্ণ-বিমর্ষ হয়েই রইল। বিকেলে আমি বাইরে বেরোলাম। সর্দারজি দাঁত বের করে বললেন, কেমন বাবুজি, আজ উৎসব পালন করোনি? আমার ইচ্ছে হল তার দাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিই। শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতা গৌরবচিত্ত শিখদের মনে রং ধরাল। পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আগত উদ্বাস্তুর সংখ্যা হাজারের অঙ্ক ছেড়ে লাখের ঘরে গিয়ে পৌঁছুল। এসব লোক আসলে পাকিস্তানের দুর্নাম রটানোর জন্যে ঘর-বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ওখান থেকে পালিয়ে এসেছে। এখানে এসে সর্বত্র নিজেদের দুঃখের কাহিনী শোনাচ্ছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে কংগ্রেসি প্রোপাগান্ডা জোরেশোরে চলছে। কংগ্রেসিরা কৌশল গ্রহণ করেছে যে কংগ্রেসের নাম না-নিয়ে রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ এবং শহীদী দিল নাম নিয়ে কাজ করতে হবে। অথচ এটা তো সবাই জানে যে, এই হিন্দুরা কংগ্রেসী মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। পৃথিবীর মানুষকে ধোকা দেওয়ার জন্যে তারা প্রয়োজন হলে গান্ধী এবং জওহরলাল নেহরুকে লোক দেখানো গালি দিতেও দ্বিধা করে না।
একদিন সকালে খবর এল যে, দিল্লিতে মুসলিম গণহত্যা শুরু হয়ে গেছে। কুরলবাগ এলাকায় মুসলমানদের বহু বাড়ি-ঘর ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। চাঁদনি চকে মুসলমানদের দোকানপাট লুণ্ঠন করে তাদের পাইকারিভাবে হত্যা করা হয়েছে। এটা। হল কংগ্রেসের হিন্দু-রাজত্বের নমুনা। যাক সে কথা। আমি ভাবলাম নয়াদিল্লি তো বহুকাল ধরে ইংরেজদের শহর ছিল–লর্ড মাউন্টব্যাটেন, কমান্ডার-ইন-চিফ এখানে থাকেন। অন্ততপক্ষে তারা মুসলমানদের ওপর এ-ধরনের অত্যাচার হতে দেবেন না। এটা ভেবে আমি নিজের অফিসের পথে পা বাড়ালাম। সেদিন আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের। হিসাব হওয়ার কথা। আসলে এ-কারণেই আমি পাকিস্তানে যেতে দেরি করছিলাম। গোল মার্কেটের কাছে পৌঁছতেই অফিসের একজন হিন্দু বাবু বললেন, এ কী করছ, যাও, যাও বাসায় যাও, বাইরে বেরিয়ো না। কনট প্লেসে দাঙ্গাকারীরা মুসলমানদের মেরেছে। এ-কথা শুনে আমি বাসায় ফিরে এলাম।
বাসার সামনে আসতেই সর্দারজির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি বললেন, শেখজি, চিন্তা করবেন না। আমি যতক্ষণ সহি-সালামতে আছি, কেউ আপনাকে হাত লাগাতে পারবে না। আমি ভাবলাম, শিখের ওই দাড়ির আড়ালে কত শয়তানি লুকিয়ে আছে কে জানে। মনে-মনে খুব খুশি যে, মুসলমানদের পাইকারিভাবে নিধন করা হচ্ছে অথচ মৌখিক সহানুভূতি দেখিয়ে আমার প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করছে। আসলে আমাকে চটানোর জন্যেই এ-ধরনের কথা বলছে। কেননা এই এলাকায় আমিই একমাত্র মুসলমান।
কিন্তু আমি কাফেরদের কোনো অনুগ্রহের প্রত্যাশী নই। এটা ভেবে নিজের ঘরে এলাম। ভাবলাম যদি মরেও যাই দশ-বিশটাকে মেরে মরব। সোজা কামরায় প্রবেশ করে পালঙ্কের নিচে উঁকি দিলাম–সেখানে আমার দোলা শিকারি বন্দুক রয়েছে। দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর থেকে আমি প্রচুর গুলি ও কার্তুজ সংগ্রহ করে রেখেছি। কিন্তু এ ক! পালঙ্কের নিচে বন্দুক নেই। সব কামরা তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও বন্দুক পাওয়া গেল না।
হুজুর, আপনি কী খুঁজছেন। আমার অনুগত বিশ্বস্ত ভৃত্য মামদো জিজ্ঞেস করল।
আমার বন্দুক কোথায় গেল?
মামদো কোনো জবাব দিল না। কিন্তু তার মুখভাব বলে দিচ্ছিল, সে জানে বন্দুক কোথায় আছে। হয়তো সে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে।
বলছিস-না কেন? আমি ধমক দিয়ে বললাম।
ধমক দেয়ায় জানা গেল–মামদো আমার বন্দুক চুরি করে তার বন্ধুদের দিয়েছে। ওরা দরিয়াগঞ্জে মুসলমানদের হেফাজতের উদ্দেশ্যে অস্ত্র সংগ্রহ করছে।
আমাদের কাছে কয়েকশ’ বন্দুক আছে হুজুর। সাতটি আছে মেশিনগান। দশটি রিভলবার। একটি তোপ। কাফেরদের ভুনা করে ফেলব। ভুনা।
আমি বললাম, দরিয়াগঞ্জে আমার বন্দুক দিয়ে কাফেরদের ভুনা করলে এখানে আমার আত্মরক্ষার উপায় কীভাবে হবে? আমি তো এখানে কাফেরদের দঙ্গলের মধ্যে আটকা পড়ে আছি। এখানে আমাকে ধুনো দেয়া হলে কে দায়ী হবে?
মামদোকে বললাম, কোনো-না-কোনোভাবে চুপিসারে তুমি দরিয়াগঞ্জে যাও। সেখান থেকে আমার জন্যে একটা বন্দুক এবং শ’ দুয়েক কার্তুজ নিয়ে এস।
মামদো চলে যাওয়ার পর আমার স্থির বিশ্বাস হল যে, সে আর ফিরে আসবে না।
এখন আমি বাসায় সম্পূর্ণ একাকী। সামনের কার্নিশে স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের ফটো নীরবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে আমার চোখে পানি এসে গেল। ভাবলাম তাদের সাথে আর দেখা হবে কিনা কে জানে।
পরে এটুকু ভেবে স্বস্তিবোধ করলাম যে, তারা তো অন্তত ভালোয়-ভালোয় পাকিস্তান পৌঁছে গেছে। আমি যদি প্রভিডেন্ট ফান্ডের লোভ না-করে আগেই চলে যেতাম তাহলে কী ভালোই-না হতো! এখন আর আফসোস করে কী হবে?
সাতশ্রী আকাল হর হর মহাদেব!
দূর থেকে কোরাসকণ্ঠের আওয়াজ ক্রমেই নিকটতর হচ্ছিল। এরা দাঙ্গাকারী। আমার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। আহত হরিণের মতো আমি এদিক-ওদিক তাকালাম। সেই আহত হরিণ গুলিবিদ্ধ হয়েছে, তার পেছনে লেগে আছে শিকারি কুকুর। আত্মরক্ষার আর কোনো উপায় নেই। কামরার দরজা পাতলা কাঠের তৈরি। ওপরের দিকে গ্রাস ফিট করা। আমি দরজা বন্ধ করে বসে থাকলেও দু’মিনিটের মধ্যেই দাঙ্গাকারীরা দরজা ভেঙে ভেতরে চলে আসবে।
সাতশ্রী আকাল হর হর মহাদেব–এ-আওয়াজ ক্রমেই নিকটতর হচ্ছিল।
হঠাৎ দরজায় করাঘাত হল। সর্দারজি ভেতরে প্রবেশ করে বললেন, শেখজি, তুমি আমাদের ঘরে চল। তাড়াতাড়ি কর। কিছু চিন্তা-ভাবনা না-করেই সর্দারজিকে অনুসরণ করলাম। পেছনের দিকের বারান্দায় আমাকে লুকিয়ে রাখা হল। মৃত্যুর গুলি শন করে আমার মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। কারণ আমি সর্দারজির ঘরে প্রবেশ করার পর-পরই আমাদের বাসার সামনে এসে থামল একটা লরি। সে লরি থেকে দশ-পনেরো জন যুবক নামল। যুবকদের মধ্যে নেতা-গোছের একজনের হাতে টাইপ করা একটা কাগজে নামের তালিকা রয়েছে। ৮নং কোয়ার্টারে শেখ বোরহান উদ্দিন কাগজের উপর তাকিয়ে যুবনেতা উচ্চারণ করল। উচ্ছখল যুবকরা পরক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার কোয়ার্টারে। আমার চেয়ার, টেবিল, সিন্দুক, বই-পুস্তক ইত্যাদি এমনকি আমার ময়লা জামা-কাপড় সবকিছু লরিতে নিয়ে তোলা হয়।
.
ডাকাত!
লুটেরা!
দস্যু!
ভাবলাম সর্দারজি বাহ্যিক সহানুভূতি দেখিয়ে আমাকে যে এখানে নিয়ে এলেন তিনিই কি কম লুটেরা? তিনি দাঙ্গাকারীদের বললেন, থামো, থামো, এ-ঘরের ওপর আমার অধিকার বেশি রয়েছে। এ-লুণ্ঠনে অংশ নেয়ার অধিকার আমারও পাওয়া দরকার। এ-কথা বলেই তিনি নিজের ছেলে-মেয়েদের ইঙ্গিত করলেন। তারাও লুণ্ঠনে প্রবৃত্ত হল। কেউ প্যান্ট নিয়ে গেল, কেউ স্যুটকেস, কেউ আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের ছবি। এসব গনিমতের মাল সোজা অন্দরমহলে চলে যাচ্ছে।
মনে-মনে ভাবলাম যদি বেঁচে থাকি তবে, ওরে সর্দার, তোর সঙ্গে বোঝাপড়া হবে। কিন্তু এখন তো আমি টু শব্দও করতে পারছি না। সশস্ত্র দাঙ্গাকারীরা আমার কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে। যদি তারা জানতে পারে যে আমি এখানে আছি
‘এস, ভেতরে এস।’ হঠাৎ দেখি সর্দারজি নগ্ন তলোয়ার হাতে নিয়ে আমাকে বাড়ির ভেতরে ডাকছেন। আমি বৃদ্ধের চেহারার দিকে তাকালাম। লুটপাটে অংশ নেয়ার ছুটোছুটিতে তার চেহারা আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তার হাতের চকচক করা কৃপাণ আমাকে মৃত্যুর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
কথা বলার সময় নেই। যদি আমি কিছু বলি এবং দাঙ্গাকারীরা শুনতে পায় তাহলে একটা গুলি আমার বুক ভেদ করে যাবে।
কৃপাণ এবং বন্দুকের মধ্যে যে কোনো একটা বেছে নিতে হবে। দাঙ্গাবাজ দশটি যুবকের চেয়ে একজন বৃদ্ধের কৃপাণ অনেক ভালো। আমি নীরবে কামরায় প্রবেশ করলাম।
ওখানে নয়, ভেতরে এস।
আমি ভেতরের দিকের একটি কামরায় গেলাম। মনে হচ্ছিল, কসাইখানায় করি প্রবেশ করছে। আমার চোখ কৃপাণের তীক্ষ্ণ ধারে ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।
এই নাও তোমার জিনিসপত্র। এ-কথা বলে সর্দারজি নিজে এবং তার ছেলেমেয়েরা মিছেমিছি লুণ্ঠিত দ্রব্যাদি আমার সামনে এনে রাখল।
সর্দার-গিন্নি বললেন, বাবা তোমার কোনো জিনিসই বলতে গেলে রক্ষা করতে পারলাম না।
আমি কোনো কথা বললাম না। হঠাৎ বাইরে ঝনঝন শব্দ শোনা গেলে। সাঙ্গাকারীরা আমার লোহার আলমারি বাইরে বের করে সেটি ভাঙার চেষ্টা করছে।
একজন বলল, এর চাবি পাওয়া গেল সহজে ঝামেলা মিটে যেত। অন্যজন বলল, এর চাবি তো পাকিস্তানে পাওয়া যাবে। ভীরু তো, তাই পালিয়ে গেছে। মুসলমানের বাচ্চা হলে তো মোকাবেলা করত!
ছোট্ট মোহিনী আমার স্ত্রীর কয়েকটি রেশমি কামিজ এবং ঘাঘরা দাঙ্গাকারীদের কবল থেকে কেড়ে নিচ্ছিল। ওদের উক্তি শুনে সে বলল, হু হু! তোমরা বড় বাহাদুর বটে! শেখজি ভীরু হতে যাবেন কেন? তিনি তো পাকিস্তানে যাননি।’
একজন যুবক বলল, যদি না-ও গিয়ে থাকে তবে এখানে কোথাও মুখ কালো করে লুকিয়ে আছে।
মুখ কালো করে লুকোবে কেন, উনি তো আমাদের এখানে।
আমার হৃৎস্পন্দন মুহূর্তের জন্যে থেমে গেল। মোহিনী নিজের ভুল বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে রইল। কিন্তু দাঙ্গাবাজদের জন্যে এটুকু তথ্যই যথেষ্ট।
সর্দারজির মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল। তিনি আমাকে ভেতরের অন্য একটা কামরায় ঢুকিয়ে দিয়ে দরজায় হুক লাগিয়ে দিলেন। তারপর নিজের পুত্রকে কৃপাণ হাতে দরজায় রেখে নিজে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে কী হল আমি তখনো ভালোভাবে বুঝতে পারিনি। তবে চড়-থাপ্পড় এবং পরক্ষণে মোহিনীর কান্না শোনা গেল। তারপর পাঞ্জাবি ভাষায় সর্দারজির মুখ নিঃসৃত অশ্লীল খিস্তি-খেউড়। বুঝতে পারলাম যে, কাকে এবং কেন তিনি গালি দিচ্ছেন। আমি চারদিক থেকে বন্দি ছিলাম, এ কারণে সঠিক কিছু শুনতে পেলাম না।
কিছুক্ষণ পর গুলিবর্ষণের আওয়াজ শোনা গেল। সর্দার-গিন্নি তীব্র আর্তনাদ করে উঠলেন।
লরির ঘরঘর আওয়াজ শোনা গেল ক্ষণিক পরেই। সমগ্র বিল্ডিং এলাকায় নৈঃশব্দ ছেয়ে গেল। আমাকে কক্ষবন্দি অবস্থা থেকে বের করার পর দেখি সর্দারজি পালঙ্কের উপরে পড়ে আছেন, তার বুকের কাছাকাছি জায়গায় সাদা কামিজ ভেদ করে রক্তধারা গড়াচ্ছে। তার পুত্র প্রতিবেশীর বাসা থেকে ডাক্তারকে টেলিফোন করতে গেছে।
সর্দারজি! এ তুমি কী করলে? নিজের অজ্ঞাতেই আমার মুখ থেকে এ-কথা বেরিয়ে এল। আমি স্তব্ধ বিমূঢ় দাঁড়িয়ে রইলাম কেবল। আমার চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি লোপ পেয়ে গেছে তখন।
সর্দারজি, এ তুমি কী করলে?
আমার ঋণ পরিশোধ করলাম, খোকা!
ঋণ!
হ্যাঁ খোকা! রাওয়ালপিভিতে তোমার মতোই একজন মুসলমান নিজের জীবন দিয়ে আমার এবং আমার পরিবারের জীবন ও ইজ্জত রক্ষা করেছে।
তার নাম কী ছিল সর্দারজি?
গোলাম রসুল।
গোলাম রসুল? আমার মনে হল ভাগ্য যেন আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। দেয়ালের ঘড়িতে বারোটা বাজল। এক দুই তিন চার পাঁচ…।
সর্দারজি হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকালেন। তিনি যেন হাসছেন। আমার নিজের দাদার কথা মনে পড়ল। তার মুখে কয়েক ফুট লম্বা দাড়ি ছিল। সর্দারজির চেহারা তার চেহারার সাথে যেন মিলে যাচ্ছে। ছয় সাত আট নয়…।
সর্দারজি যেন হাসছিলেন। তার শাদা দাড়ি এবং খোলা চুল চেহারার চারদিকে একটি আলোক আভা তৈরি করেছে।
দশ এগারো বারো। মনে হল সর্দারজি যেন বলছেনজ্বী হ্যাঁ, আমাদের এখানে চব্বিশ ঘণ্টাই বারোটা বেজে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সর্দারজির দু’চোখ বুজে গেল।
দূর, বহু দূর থেকে যেন গোলাম রসুলের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল : আমি বলেছি না, বারোটা বাজলেই শিখদের বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়? এখন এই সর্দারজিকে দেখ। একজন মুসলমানের জন্যে নিজের জীবন দিলেন।
সর্দারজি সেদিন মারা যাননি, আমিই মরেছি।
প্রতিশোধ – খাজা আহমদ আব্বাস
দুটো রঙের বিভীষিকা। ভয়ঙ্করের প্রেতচ্ছায়া অদৃশ্য কায়াহীন পদসঞ্চারে পিছু নিয়েছে। তার দিনরাত্রির।
লাল, টক্টকে লাল; আর ফ্যাকাশে হলুদ, ভয়াবহ বিবর্ণতা।
লাল। মানুষের তাজা খুন যেন।
হলুদ। মড়ার মুখের রক্তশূন্য পাণ্ডুরতা!
লাল আর হলুদ, হলুদ আর লাল, বাতাসের গায়ে ভেসে বেড়াচ্ছে রঙ দুটোর বুদ্বুদ।
হলুদ আর লাল, লাল আর হলুদ–প্রেতায়িত সূর্যরশ্মির তীব্রতা তার চোখ ভেদ করে সোজা মগজে খোঁচা মারছে; হাজার হাজার অদৃশ্য সূচের মতো লাল আর হলুদ রশ্মির তীক্ষ্ণতা তার সমস্ত দেহ খুঁচিয়ে বিধছে।
দিনে-রাত্তিরে, কি জাগরণে, কি নিদ্রায়–হয়তো হাঁটছে, হয়তো-বা বসে রয়েছে– সবসময়েই চোখের সামনে বিভীষিকার ভয়ঙ্কর আবৃত রঙ দুটোর শিখা নাচতে থাকে নারকীয় দানবের অজস্র লকলকে জিভের মতো। শয়তানের অগ্নৎসবে কাঠের বদলে পোপাড়ানো হচ্ছে অগুণতি মড়া। হাজার শব জ্বলছে এক চিতায়; আর অসংখ্য অদেহী আত্মা চারদিক ঘিরে নাচছে মৃত্যুতাণ্ডবের অদৃশ্য নাচ। তাদের ভীতিসঞ্চারী গর্জনে ধ্বনিত হচ্ছে :
প্রতিশোধ!
প্রতিশোধ!!
প্রতিশোধ!!!
লাল আর হলুদ, হলুদ আর লাল রঙ দুটোর জ্বলন্ত পাবকশিখার তীক্ষ্ণতা বেঁধে ফেলছে তার দেহমন আত্মার সামগ্রিকতাকে। কি প্রভাতের অরুণিমায়, কি সূর্যাস্তের মৃত্যুগরিমায় রঙ দুটোর শিখা তার চোখের সামনে সবসময়েই জ্বলতে থাকে। শিরার ভেতরে প্রবাহিত হতে থাকে জ্বলন্ত আগুনের তরলতা। রক্ত কোথায়? প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে ভেসে আসে অগ্নিদাহের ধোয়ার গন্ধ। মাঝে মাঝে মনে হয় সে বুঝি মানুষী সত্তা হারিয়ে নরকের অদৃশ্য আগুনে প্রেতাত্মায় রূপান্তরিত হয়েছে।
সবাই জানে হরিদাস পাগল হয়ে গেছে। হরিদাসও কথা কয় না কারো সঙ্গে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব–কারো সঙ্গে নয়। এই নির্বাকতাই তার মস্তিষ্কবিকৃতির যথেষ্ট পরিচায়ক। তা নাহলে সে কথা কয় না কেন? রাজ্যের যত মজার মজার মুখরোচক উত্তেজক আলাপ-আলোচনার আসরে তার অমন বোবা ও গোমড়া মুখ কেন? না কারো বিয়ের গল্প, কি সিনেমার গল্প, কি এমনি গালগল্প, কুৎসা, নিন্দা, রাজনীতি, সাহিত্য–না, হরিদাস এইসব কিছুরই চৌহদ্দির বাইরে। এমনকি চোখে-মুখে পর্যন্ত ভাবান্তর নেই, সমাজ-সংসারের বহু ঊর্ধ্বে, একেবারে নির্লিপ্ত। যেন সে পাথর হয়ে গেছে।
কিংবা অন্ধ, বোবা, বধির। কিন্তু একবার শুধু দাঙ্গা আর খুনের গল্প উঠিয়ে দাও, তারপর দেখ–ঘৃণা আর ক্রোধের লেলিহান আগুনের ঝলকে ওর চোখ দুটো উঠেছে জ্বলে। নির্বাক হরিদাসের অগ্নিভয়ঙ্কর চোখজোড়া তখন যেন লড়াইয়ের হাঁক দেয় :
প্রতিশোধ!
প্রতিশোধ!!
প্রতিশোধ!!!
পাঞ্জাব বিভাগের সময় হরিদাস ছিল লায়ালপুরের একজন ডাকসাইটে উকিল। তখন কেবল বিভক্ত পাঞ্জাবের টুকরো দুটোকে নৃশংস ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের অগ্নিশ্রাবী কড়াইয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। লায়ালপুরের বাস্তুত্যাগীরা বলেছে, দাঙ্গায় হরিদাসের গোটা পরিবারটাই খুন হয়ে গেছে। তারপর কেটে গেছে লম্বা দশ মাস। কাল নাকি সর্বদুঃখহরা। সেই মারাত্মক স্মৃতিও ধীরে ধীরে আবছা হয়ে এসেছে। তাছাড়া সঠিক কেউ জানতও না কীভাবে তার স্ত্রী আর কন্যা মারা গেছে। আরও হাজার হাজার জনের মতো নদীতে ঝাঁপ দিয়ে, না গৃহদাহে, না খুনখার ছুরির আঘাতে। হরিদাস কাউকে বলেনি সে-কথা।
হরিদাস পাগল হয়নি; অথচ মাঝে মাঝে পাগল হবার ইচ্ছাই তাকে পেয়ে বসে। তাহলে সবকিছু ভুলে যাওয়া যেত। হৃদয়বিদারী ভয়াবহ স্মৃতির অহর্নিশ নিপীড়ন অসহ্য–কীভাবে বাড়ি লুঠ হল, কীভাবে তার স্ত্রী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরল, কীভাবে প্রতিবেশী-বন্ধুরা নিহত হল–এইসব। সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে কন্যা জানকীর স্মৃতি। উঃ, ঘিলুতে কী যেন কামড়াতে থাকে। মনের পর্দায় মর্মান্তিক ছবিগুলো ভেসে ওঠে বিশৃঙ্খলভাবে।
সেইসব ছবি। সুন্দর ছবি। ভয়ঙ্করও বটে।
জানকী, সতেরো বছরের জানকী। মায়ের বুকের ধন, বাপের চোখের মণি।
গোলাপের পাপড়ির মতো কোমল গায়ের রঙ। আর চোখ, নার্গিস ফুল কোথায় লাগে! ছিপছিপে লতিয়ে ওঠা দেহবল্লরী। ভয় হয় মৃদুতম স্পর্শেই কুঁকড়ে যেতে পারে। গোটা লায়ালপুরে সবচেয়ে সুন্দরী, সবচেয়ে বুদ্ধিমতী মেয়ে জানকী।
মুখখানা কী চমৎকার! সারল্যের প্রলেপ রয়েছে তার ওপরে।
পাশাপাশি আরেকটা ছবি ঝিলিক মেরে ওঠে।
কয়েকটি কুৎসিত ভয়াবহ মুখাবয়ব। চোখে পাশব কামনার সর্বধ্বংসী অগ্নিশিখা। ওষ্ঠের কুঞ্চনে শয়তানের নারকীয় হাসি।
সূর্যালোকে চকচক করছে ছুরির শাণিত ধার। বন্দুকের অদৃশ্য কালো কালো চোখ দ্যুতিময়তায় জ্বলছে। সেই ভয়ঙ্কর মুখগুলো এগিয়ে আসে জানকীর দিকে ভয়ঙ্করের পদক্ষেপ ফেলে।
এখনও, দশমাস পরেও, হরিদাস নিজের অনুনয়-ভারাক্রান্ত কাতর ভিক্ষা প্রার্থনার প্রতিধ্বনি শুনতে পায়।
: মার আমাকে, মেরে ফেল–শুধু–শুধু আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও। ফের এগিয়ে আসে ওরা জানকীর দিকে। বিভীষিকার কালো কালো ছায়া-রঙ ওদের মুখে।
: আমি মুসলমান হতে রাজি আছি। আমার মেয়েও হবে। শুধু দয়া কর, দয়া কর– ওকে বাঁচাও।
নৃশংস বিকট মুখগুলোতে কোনোরকম কারুণ্যের ছায়া নেই। কামনা-ভয়ঙ্কর চোখগুলো জানকীর দিকে এগোতে থাকে। গোখরো সাপ যেন এগোচ্ছে সম্মোহিত শিকারের দিকে।
: আমার মেয়ের কচি বয়স ও সুন্দরী। দেখতেই পাচ্ছ। তোমরা যে কেউ ওকে মুসলমান করে বিয়ে কর, কেবল জীবনটা নিয়ে না।
একটা মুখ। এতগুলো ভয়াবহ মুখের ভেতরে সেটা আরও ভয়ঙ্কর। হলদে ময়লা দাঁত, চোখ-ভরা বিকট কামনা। ক্ষুধার বিশ্বগ্রাসী দাবানল। উল্লাসে আর উত্তেজনায় ঘন কালো দাড়ি কাঁপছে তার। তার মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরেই জানকীর ফুলের মতো সৌন্দর্য। পরমুহূর্তে হরিদাসের দৃষ্টি আবছা হয়ে আসে। প্রেতায়িত কালো মেঘ যেন চাঁদ ঢেকে ফেলেছে। কিন্তু বর্বরের পাশব আক্রমণে জানকী গুঁড়িয়ে যাবার আগেই হরিদাসের দৃষ্টি আটকে যায়।
জানকীর চোখে ছড়িয়ে রয়েছে অদ্ভুত ভীতি-ব্যাকুলতার ছায়া। ভীতি, ঘৃণা, অসহায়তা, নৈরাশ্য, নিষ্ফল করুণা ভিক্ষা–সবকিছু মিশিয়ে। সামনেই বাপকে বাঁধা হয়েছে একটা গাছের সঙ্গে। মেয়ের ইজ্জতহানি স্বচক্ষে দেখবার জন্যেই তাকে রাখা হয়েছে জিইয়ে। বীভৎস সে দৃশ্য। অসহ্য! হরিদাসের চোখের পাতা মুদে আসে।
স্মৃতির পর্দায় দৃশ্যটা ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আপনিই তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। হায়, কান দুটোও যদি একেবারে বধির হয়ে যেত। তাহলে তো ঐ মর্মভেদী বিকট আর্তনাদ শুনতে হত না। শুনতে হত না গায়ের কাপড় নির্দয় হাতে ফড়ফড় করে টেনে ছেঁড়ার শব্দ, শয়তানটার কামার্ত নিঃশ্বাসের ভারি শব্দ, জানকীর মরণ চিৎকার, গোঙানি, কান্না। এখনও সে-সব কানে বাজে।
এমনকি মনের এতগুলো পাতা ডিঙিয়েও সেই ভয়ানক মুখগুলো একটার পর একটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ… পরপর মুখগুলো ভেসে উঠছে যতক্ষণ-না সেই অসহায় কান্নাকে মৃত্যুর স্তব্ধতা শুষে নেয়। এ স্তব্ধতা আরো ভয়ঙ্কর, রক্ত ঘনতায় জমাট বাঁধা আর্তনাদের চেয়েও। তারপর সে চোখ খোলে…
ফুলের মতো জানকীর মুখখানা। ফুলটা যেন মাড়িয়ে নিষ্পিষ্ট করে দেয়া হয়েছে মাটির সঙ্গে। বিবর্ণ, সৌরভ্যুত, প্রাণহীন ফুল। আলুলায়িত কেশসম্ভারে অত্যাচারের বিশৃঙ্খলা। কপোলতটে নৃশংস দংশনের স্পষ্ট গভীরতা। ক্ষতমুখ থেকে রক্ত বেরোচ্ছে ফিনকি দিয়ে।
মৃত পাণ্ডুর মুখে যেন রুজের রক্তিম লালিমা। গারের পাপড়িরাঙা চামড়া কেটে রক্ত বেরোচ্ছে। নিষ্ঠুর ধারাল দাঁতের আঘাত স্পষ্ট। সমস্ত শরীরের ক্ষতমুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। গাল, কান, নাক এমনকি খোলা বুক থেকেও। জন্মের মতো, হ্যাঁ, যতদিন বাঁচবে ততদিনের জন্য হরিদাসের মনের ক্যানভাসে শয়তান রক্তের আখরে এঁকে দিয়েছে এ ছবিখানা। এ ছবি চির-অম্লান। কিছুতেই ভুলবার নয়। অসম্ভব!
নিজের হাতে হরিদাস সাজিয়েছে মেয়ের চিতা। দেখতে দেখতে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে জানকী। অগ্নিদেব তার কোমল, সুন্দর দেহ-নৈবেদ্য গ্রহণ করেছেন। পবিত্র নিষ্পাপ দেহনির্মাল্য। আহত, অপমানিত, ধর্ষিত সে দেহ। হরিদাস এখনও সেই চিতার অগ্নিশিখা দেখতে পায়। শিখাগুলো নাচছে তার চোখের সামনে। লাল আর হলুদ ঊর্ধ্বমুখী শিখা। তার মনে হয়েছিল জানকীর নয়, হিন্দুস্থানের ইজ্জত দাহ করা হচ্ছে। চিতাগ্নিশিখার সঙ্গে মানবতা উবে যাচ্ছে। সৌন্দর্য, দয়াধর্ম আর সহানুভূতি পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।
চিতার আগুন একসময়ে নিভল। কিন্তু প্রতিহিংসার আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল হরিদাসের মনে। এ আগুন নিভবার নয়। না… না… কখনো না… অন্তত… যতদিন-না হরিদাস প্রতিশোধ নিতে পারে একটি মুসলমান মেয়ের নগ্ন বুকে ছুরিকাঘাত করে। তাই হরিদাস বেঁচে রয়েছে এখনো। একবার, শুধু একবার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে তার পরমুহূর্তেই মৃত্যুকে জড়িয়ে ধরবে সে।
প্রতিশোধ!
প্রতিশোধ!!
কোটের নিচে ধারাল ছুরি লুকানো রয়েছে। কিন্তু কোথায় সুন্দরী মুসলমান মেয়ে? জিঘাংসু হরিদাসের অতৃপ্ত আত্মা খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে। দিল্লির মুসলমানদের অনেকে দাঙ্গায় নিহত হয়েছে। কেউ কেউ পাকিস্তানে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে। যারা এখনও রয়ে গেছে, তারা তো পথে বেরাতেই সাহস করে না। কাপুরুষ কোথাকার, ভীতুর দল!
ভাগ্য হরিদাসের সঙ্গে অদ্ভুত খেলা শুরু করেছে। বাস্তুত্যাগী পুনর্বসতি সাহায্য তহবিল থেকে সে তিনশ’ টাকা পেয়েছে। এত টাকা দিয়ে কী করবে? কেউই তো নেই আর–না গৃহ, না পরিবার। আহার-পরিচ্ছদের দরকার নেই। এমনকি বাঁচবার পর্যন্ত ইচ্ছে নেই। কী করবে হরিদাস অত টাকা দিয়ে! ভাবতে ভাবতে নয়াদিল্লি আর পুরনো দিল্লির পথে পথে ঘুরে বেড়াতে থাকে সে।
কনট প্লেস থেকে চাঁদনি চক। চাঁদনি থেকে জামে মসজিদ। মসজিদের সরু সরু মিনার। সাদা গম্বুজের ওপর নজর পড়লে ফের জেগে ওঠে প্রতিহিংসার সঙ্কল্প। মুসলমানদের বিরুদ্ধে, গোটা মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে। জামে মসজিদ থেকে দরিয়াগঞ্জ–তারপর রাজঘাট। এমনকি রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিও তার মন থেকে প্রতিহিংসার অগ্নিশিখা নির্বাপিত করতে পারে না।
গান্ধীজী মহাত্মা ছিলেন। ঋষি। কিন্তু আমি যে সাধারণ লোক। তিনি পারেন শত্রুকে ক্ষমা করতে, আমি পারি না।
সেখান থেকে এডওয়ার্ড পার্ক। পার্কে রাজার পাথরের মূর্তি। ঘোড়ার পিঠে বসে রয়েছে।
: বাহ্, হুজুর বাহ্। চলে তো গেলে, এদিকে আমাদের ঠেলে দিলে এক মৃত্যুঘাতী দুর্দশায়।
ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। ঘুরতে ঘুরতে সে একটা অচেনা জায়গায় এসে পড়ল। তারই মতো অসংখ্য বাস্তুত্যাগী ঘুমোচ্ছে পাকা রাস্তার ওপর। বাতাসের সঙ্গে মিশে রয়েছে ভারি তীব্র গন্ধ। সেন্ট, ঘাম, ভ্যাপসা মাটি, প্রস্রাব, ফুল, ফিনাইল, পেট্রোলের গন্ধ। বাঁ ধারে একসার দোকান। মিঠাইয়ের দোকান, দুধের দোকান। হোটেল এখনও খোলা রয়েছে। বাকিগুলো বন্ধ। প্রতিটি পথিকের দৃষ্টি একতলার আলোকিত ব্যালকনিতে নিবদ্ধ। আলোয় উজ্জ্বল রশ্মিতে আমন্ত্রণের পত্ররেখা। বায়ুতরঙ্গের ছন্দে সঙ্গীত ঝঙ্কার। জায়গাটা?
: বাবুজি!
আচমকা সম্বোধন। একটা লোক, তার তির্যক দৃষ্টিতে প্রশ্ন।
: বাবুজি হুকুম করেন তো খাশা চিজ দেখাতে পারি।
কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে না-পেরে হরিদাস এগোতে থাকে। কিন্তু লোকটা এত সহজে ছাড়বার পাত্র নয়।
: খুশি না-হলে আপনার বখশিসের সব পয়সা হারাম।
কথার আবছা অংশ পরিষ্কার হয়ে গেল তার মুখের ইঙ্গিত থেকে।
: ভাই আমি একজন বাস্তুত্যাগী। হরিদাস বলল।
: আমিও তাই বাবুজি। আমরা তো একই দলের, আসুন-না আমার সাথে, একটা মুসলমান মেয়ে আছে…। পাকিস্তানের খেসারত নেবার এই তো সুযোগ, পাকিস্তানি হুর ভোগ করার সুযোগ।
মুসলমান মেয়ে! পাকিস্তানি হুর!!
প্রতিহিংসার লাল আর হলদে শিখা হরিদাসের চোখের সামনে নাচছে প্রেতায়িত নাচ। যেতে যেতে লোকটা আপনা থেকেই বলতে লাগল, বাবুজি, এমন মেয়ে হাজারেও একটা মেলে না। বয়েস কতই-বা হবে–বড়জোর সতের কি আঠারো।
তারপর এদিক-ওদিক ইতস্তত তাকাতে তাকাতে ফিসফিস করে বলল, আমরা ওকে জলন্ধর থেকে নিয়ে এসেছি। মশহুর লোকের মেয়ে। কী বলব বাবুজি-ওকে রাজি করিয়ে ব্যবসায়ে নামাতে পাক্কা দশ মাস সময় লেগেছে।
জানকীরও কি একই বয়েস ছিল না? জানকীও কি নামজাদা লোকের মেয়ে নয়? তবু সেই বীভৎস ভয়ঙ্কর মুখগুলো একবর্ণ দয়াও দেখায়নি। এক দুই তিন চার পাঁচ…যতক্ষণ পর্যন্ত-না অনাঘ্রাত পবিত্র ফুলটা মাটির সঙ্গে নিষ্পিষ্ট হয়ে গেছে।
: তাহলে আমিই-বা কেন দয়া দেখাতে যাব? হরিদাস ভাবল। তার হাত কোটের ভেতরে রাখা ছুরিটা একবার ছুঁয়ে এল।
বেশ্যাবাড়ির সাধারণ বৈঠকখানা। মেঝেতে ময়লা সাদা চাদর বিছানো। সিলিং থেকে ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে। দেয়ালে শস্তা তৈলচিত্র টাঙানো। ভগবান কৃষ্ণ, রাজা রামচন্দ্র, সতী সীতা, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী আর পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু। দুটো বড় বড় আয়না। ঘরের এককোণে বসে পান তৈরি করছে স্থূলকায়া কুৎসিৎ একটা প্রৌঢ়া। মুখে ব্রণের দাগ। সমস্ত কিছুর ওপরে তার বিচক্ষণ দৃষ্টি। বাজনার যন্ত্র, গায়ক আর বাজনদারদের মাঝখানে রয়েছে সেই পাকিস্তানি হুর। গান গাইছে সে।
হরিদাস হুর দেখেনি কখনো, কিন্তু শুনেছে চেহারার বিবরণ। মেয়েটি হুরই বটে! গায়ের রঙ জানকীর চেয়েও সুন্দর, তবে রক্তহীনতার বিবর্ণতা স্পষ্ট। দেহসৌষ্ঠবে মঞ্জুরিত লতার কৃশতা আর সৌকুমার্য। কালো আয়ত চোখ। তবে এ চোখে সুস্থতার জ্যোতি বা জীবনের ছায়া নেই। যেমনটি জানকীর ছিল। তার বদলে নৈরাশ্যের অন্ধকার প্রকাশমান।
হরিদাস দেখছিল মেয়েটি গাইছে, কিন্তু কানে বিন্দুবিসর্গ গানের বুলিও ঢুকছে না। ঘর বোঝাই শ্রোতা। হরিদাসের চোখ এ জনতার অস্তিত্ব অনুভব করছে। কিন্তু তারা কি ধনী, দরিদ্র, ভদ্রলোক, না বদলোক এ স্তরবিন্যাস বুঝবার মতো দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা চোখে নেই। এক কোণায় ঘুপটি মেরে বসে সে গভীরভাবে তাকিয়ে ছিল পাকিস্তানি হুরটির দিকে। সে দৃষ্টিতে কামনার লাম্পট্য ছিল না। কেবল প্রতিহিংসার লাল আর হলুদ শিখা কাঁপছে।
লোকটা বলেছিল মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তখন ঘর ফাঁকা হয়ে যাবে। গোটা রাতের জন্যে দর ঠিক হয়েছে দু’শ’ টাকা। মাত্র দু’শ’। বাকি টাকা তাহলে কী করবে! বাকি টাকার দরকার আর নেই। পরের দিন বাঁচবার আর কোনো ইচ্ছেই নেই। তার। আজকেরটাই জীবনের শেষ রাত। কাল থেকে সে মুক্ত। সবকিছু থেকে মুক্ত। টাকা-পয়সা, দৌলত, প্রতিশোধ, জীবন, সবকিছু থেকে। দশ টাকা করে একশ’ টাকাই মেয়েটাকে বখশিস দিয়ে দিল। পায়ের কাছ থেকে দশ টাকার নোট কুড়িয়ে নেবার সময় মেয়েটা প্রতিবার তাকে সালাম করল। যাক, এতেও বিক্ষুব্ধ মন কিছুটা অন্তত সান্ত্বনা পাচ্ছে! একটি মুসলমান মেয়েকে এভাবে অপমান করে হরিদাস অন্তত এটুকু ভাবতে পারছে যে তার অপমানিতা মেয়ের প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিন্তু এ তো সামান্য মাত্র!
নিষ্পলক স্থির চোখে হরিদাস মেয়েটির প্রতিটি গতিবিধি লক্ষ করতে লাগল। সে বুঝতে পেরেছিল মেয়েটি জাত ব্যবসায়ী নয়। ওর সব অঙ্গভঙ্গিই যান্ত্রিক। অনুভূতিহীন। নগ্নবাহু দুলিয়ে গানের সঙ্গে অপাঙ্গদৃষ্টি ছুঁড়ে ব্যবসার কায়দা প্রদর্শন ওর অপটুতাই ধরিয়ে দিচ্ছিল। দম-দেয়া ঘড়ির মতো মেয়েটা। হরিদাসের সারা শরীরে একটা ভৌতিক রহস্যময় অনুভূতি কিলবিল করে বয়ে গেল মুহূর্তে। মনে হল, এ জীবন্ত মানুষ নয়। একটা মড়ার দেহ জাদুকরের মায়ায় কেমন করে যেন সাময়িক জীবন পেয়েছে।
আর-একটা জিনিস নজরে পড়ল। টাকা বখশিস দেয়ার অছিলায় যখনই কেউ ওকে ছুঁতে চেষ্টা করছে তখুনি মেয়েটা ছিটকে প্রসারিত হাত সরিয়ে নিচ্ছে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো! আশ্চর্য, মুখে কিন্তু তার এই অনিচ্ছার কোনো ভাবান্তরই নেই। রোষ কি বিরক্তি কিছুই নয় টাকা-নোট যা কিছুই পাচ্ছিল তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সেগুলো ছুঁড়ে দিচ্ছিল ঘরের কোণায়। সেখানে বসেছিল স্থূলকায়া প্রৌঢ়াটি। এ অবহেলা প্রৌঢ়ার মুখে দাগ কাটেনি। কিন্তু টাকাগুলো ছুঁড়ে দেবার সময়কার কব্জির ঝাঁকুনিতে অসহ্য ঘৃণার প্রকাশ স্পষ্ট। মেয়েটি যেন বলতে চাইছিল–
: নাও টাকা, নাও, যে টাকার জন্যে এই বাজারে আমায় বিক্রি করছ। এই নাও, তারপর রেহাই দাও আমাকে। নাও…নাও… খুশি হও।
ওর নিপীড়িত নিরীহতা কেমন করে যেন হরিদাসের মনে ভাবান্তর সৃষ্টি করল। হরিদাসের স্থির বিশ্বাস জন্মাল, মেয়েটির জন্ম ভদ্র, ধনী মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারে। পরিষ্কার সুস্পষ্ট সুরজ্ঞান আর উচ্চারণভঙ্গিতে সুশিক্ষার পরিচয় প্রকাশমান। মোটমাট জানকীর ইজ্জতহানির প্রতিশোধ নেয়ার উপযুক্ত পাত্রই বটে।
রাত দুপুর হল। একে একে সবাই চলে গেল। মেয়েটিও চলে গেল শোবার ঘরে। এমনকি একবারও তাকাল না হরিদাসের দিকে, ওর বাকি রাতের একমাত্র খদ্দের। হরিদাস সেই লোকটাকে দু’শ টাকা দিয়ে ওঠাল। লোকটা টাকাগুলো চালান করল কুৎসিৎ চেহারার প্রৌঢ়া বাড়িউলির কাছে। প্রৌঢ়া টাকাগুলো দেখতে লাগল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলোর নিচে। তারপর খুশি হয়ে দশ টাকার একটা নোট তুলে দিল লোকটার হাতে। লোকটা সালাম করে চলে গেল। ময়লা, পায়োরিয়ায় খাওয়া বিচ্ছিরি দাঁত বের করে প্রৌঢ়া চোখ টিপে হরিদাসকে বলল–
: বাবুজি, এবার যান ভেতরে। তবে একটু সাবধান। মেয়েটা নতুন কি না–আপনি তো জানেন সবকিছু।
পরমুহূর্তে হরিদাস ঢুকে পড়ল ঘরে।
সতর্কতার সঙ্গে ভালো করে দরজার আগল লাগাল সে। দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে মেয়েটি বসেছিল খাটের উপরে চিন্তাকুলভাবে। হরিদাস এগোল সেদিকে। হরিদাসকে দেখেই মেয়েটি সমসহকারে উঠে পড়ল। দৃষ্টি মেঝেয় নিবদ্ধ। তারপর জুতোর ফিতে খুলে দিতে বসল। হয়তো এই হুকুম ছিল বাড়িউলির।
: ছেড়ে দাও–
কর্কশর হরিদাসের কণ্ঠে। পায়ের কাছে নতজানু হয়ে বসা একটা মুসলমান। মেয়েকে দেখে বেশ তৃপ্তি বোধ করছে সে।
: গায়ের কাপড় সরাও—
কম্পিত হাতে মেয়েটি শাড়ি খুলে ফেলল। কেবল রইল পেটিকোট আর ব্লাউজ।
: এগুলোও–
অসহায় লজ্জায় ও দেয়ালের দিকে মুখ ফেরাল। … পেটিকোটটা ঝুপ করে মাটিতে খসে পড়ল। হরিদাসের হাত পকেটের ছুরির ওপর।
: তোমাকে সম্পূর্ণ ন্যাংটো দেখতে চাই। বুঝেছ? … এখানো হয়নি। দু’শ’ টাকা নগদ দিয়েছি তার জন্যে।
মেয়েটি মুখ ফেরাল। চোখে অব্যক্ত ভিক্ষার নিদারুণ কারুণ্য। আশা ঐ মধ্যবয়সী খদ্দেরটার যদি দয়া হয়। হয়তো তার মনে দয়া হতে পারে, ওর সম্পূর্ণ নগ্নতার ওপরে জেদ না-ও করতে পারে।
: জলদি কর হরিদাস গর্জে উঠল নির্দয়ভাবে। আমার সময় নেই।
পকেটের ভেতরে ছুরির ধার পরীক্ষা করছে তার হাত। মেয়েটি সুইচের দিকে এগোবার চেষ্টা করল।
: না–পথরোধ করে দাঁড়াল হরিদাস।
: অন্ধকার নয়–
জানকীর কী হয়েছিল? খোলা রাস্তার ওপরে দিনের আলোয় কি তার ইজ্জতহানি করা হয়নি?
ব্লাউজ খুলল মেয়েটি। সুগঠিত স্তনযুগলের যৌবন-রেখার স্পষ্টতা ঢাকা রয়েছে। কাঁচুলির তলায়।
: এটাও…
ছুরি প্রস্তুত। আবার মেয়েটি তাকাল তার দিকে। চোখে করুণ ভিক্ষার আবেদন।
এইভাবেই জানকী তাকিয়েছিল হৃদয়হীন পশুগুলোর দিকে। কিন্তু তারা কণামাত্র দয়াও দেখায়নি। না, হরিদাসও দেখাবে না।
হাতের আঁজলা দিয়ে মেয়েটি মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল। কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল স্তনের ওপর।
হরিদাসের ডান হাতে ঝকমক করে উঠল ছুরিটা, মৃত্যু আঘাত হানতে উদ্যত। অপর হাতে মেয়েটির হাত দুটো হিঁচড়ে নামাল মুখ থেকে। ও দেখুক হরিদাস কী করতে যাচ্ছে। জানকীও তো দেখেছে। এই মুহূর্তটির জন্যেই তার দীর্ঘ দশ মাসের অধীর প্রতীক্ষা। লাল আর হলুদ শিখা নাচছে উল্লাসভরে।
হরিদাসের এক হাতে উদ্যত ছুরি আর অপর হাত পাশব ভঙিতে বুকের কাঁচুলির দিকে এগিয়ে আসতে দেখেই মেয়েটি আর্তনাদ করে উঠল। করুণ, তীব্র, মরণ আর্তনাদ। চোখে মৃত্যুভীতির গাঢ় ছায়া।
হরিদাস দেখল সে চোখে আরও কিছু আছে-ভীতির সঙ্গে ঘৃণা আছে। করুণা ভিক্ষার আবেদন স্পষ্ট, আর রয়েছে সম্পূর্ণ অসহায়তা। ঠিক জানকীর চোখের দৃষ্টি। কিন্তু তবু সে দৃষ্টি জানকীকে বাঁচাতে পারেনি। বিদ্যুৎচমকের ক্ষিপ্রতায় হরিদাসের বাঁ হাত স্পর্শ করল মেয়েটির কাঁচুলি। এ কি, কাঁচুলি এত ভারি ঠেকছে কেন? তবু হ্যাঁচকা টান মারল কাঁচুলিটায়। আর এর সঙ্গে…
ছুরিটা শূন্যেই উদ্যত হয়ে রইল। লজ্জায় হরিদাস চোখ ফেরাল। মাত্র একটি কথা শব্দ হয়ে ফসকে বেরিয়ে এল তার নিবদ্ধ ঠোঁট দুটোর কাছ থেকে :
‘বেটি!
কাঁচুলির নিচে যেখানে সে ছুরির আঘাত করতে যাচ্ছিল সেখানে দেখল স্তন দুটো নেই। মিলিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। সেখানে কিছুই নেই…কিছুই নেই…
[অনুবাদক : অজ্ঞাত]
মা – কুদরতুল্লাহ শাহাব।
মায়ের জন্মতারিখ সঠিক জানা যায়নি।
যে সময় লায়ালপুর জেলায় নতুন আবাদি বসেছিল, পাঞ্জাবের প্রত্যেক গাঁও থেকে ভূমিহীন লোকেরা জমি পাওয়ার আশায় এই নতুন কলোনির দিকে দলে-দলে ছুটে এসেছিল তখন। সাধারণ লোকেরা তখন লায়ালপুর এবং সারগোদা প্রভৃতি অঞ্চল বার এলাকা নামে চিনত। সে সময়ে মায়ের বয়স ছিল দশ-বারো বছর। এই হিসাবে মায়ের জন্মতারিখ গত শতাব্দীর শেষভাগের দশ-পনেরো বছরের যে-কোনো এক সময়ে হয়ে থাকবে।
মায়ের বাপের বাড়ি আম্বালা জেলার রুপোড় মহলকুমার মেনিলা গ্রামে। সেখানে তাদের কিছু জমি-জমা ছিল। তখন রুপোড়ে শ থেকে সেরহিন্দ খাল খনন করা হচ্ছিল। নানাজির জমি পড়ে গেল সেই খালের মধ্যে। রুপোড়ের ইংরেজ কর্তৃপক্ষের দফতর থেকে এ-সব জমির ক্ষতিপূরণ দেয়া হত। নানাজিও দু’-তিনবার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য শহরে গেলেন; কিন্তু সোজা লোক ছিলেন তো, জানতেন না কর্তার। দফতর কোথায় আর ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হলে কী করতে হয়। শেষে খোদাকে শোকর জানিয়ে চুপ করে বসে রইলেন এবং খাল খননে মজুরের কাজ করতে লাগলেন।
এই সময়ে খবর পাওয়া গেল যে, বার এলাকায় নতুন আবাদি হচ্ছে আর বিনামূল্যে জমি দেয়া হচ্ছে নতুন বসতি স্থাপনকারীদের। নানাজি তাঁর স্ত্রী, দুটো ছোট ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে লায়ালপুর রওনা হলেন। যানবাহনের সংস্থান ছিল না, তাই হেঁটেই চললেন।
পথ চলতে কায়িক পরিশ্রম করে পেট চালাতেন। পথে যেতে-যেতে নানাজি এখানে ওখানে কুলির কাজ করতেন কিংবা কারো কাঠ কেটে দিতেন। নানি আর মা কারো সুতো কেটে দিতেন অথবা বাড়ির উঠান, ঘরের দেয়াল লেপে দিতেন। লায়ালপুরের সোজা পথ কারো জানা ছিল না। তাই ঘুরে-ফিরে জিজ্ঞাসাবাদ করে দিনের পথ সপ্তায় অতিক্রম করে চললেন তারা। অবশেষে দেড়-দু’মাস চলার পর তারা জিরানওয়ালায় পৌঁছলেন। একে পায়ে হেঁটে চলা, তার ওপর দৈহিক পরিশ্রম সব মিলে সকলেরই শরীর নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। পা ফুলে উঠেছিল কারো-কারো। ফলে কয়েক মাস তারা এখানে থাকলেন। নানাজি সারাদিন শস্যের গুদামে বস্তা বইতেন, নানি চরকায় সুতো কেটে বিক্রি করতেন। আর মা চালাতেন সংসার–যে সংসার একটা ছোট কুঁড়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তখন।
বকরা ঈদের উৎসব এল। নানাজির কাছে টাকা জমেছিল কিছু। তিনি মাকে তা থেকে তিন আনা পয়সা দিলেন। ঈদের উপহার। জীবনে মা এই প্রথম হাতে এত পয়সা পেলেন; অনেক ভাবলেন তিনি। কিন্তু এই পয়সা খরচ করার কোনো উপায় বের করতে পারলেন না। দিনে এক-আধটা রুটিনুন-লঙ্কার চাটনি দিয়ে খাবার ব্যবস্থা থাকলে অতিরিক্ত পয়সার আর দরকার কী? এই প্রশ্নের জবাব সারা জীবনেও মা খুঁজে পাননি। মৃত্যুকালে তার বয়স আশি বছরেরও বেশি হয়েছিল। কিন্তু তখনো একশ’ টাকা, দশ টাকা এবং পাঁচ টাকার নোট তিনি ঠিক চিনে উঠতে পারতেন না।
ঈদ উপলক্ষে পাওয়া তিন আনা পয়সা কয়েকদিন পর্যন্ত মায়ের ওড়নার কোণায় বাধা রইল। যেদিন জিরানওয়ালা থেকে বিদায় হলেন সেদিন মা এগারো পয়সার তেল কিনে মসজিদের চেরাগে ঢেলে দিয়ে এলেন। বাকি পয়সাটা রাখলেন নিজের কাছে। এরপর যখনই তাঁর কাছে পুরো এগারো পয়সা হত অমনি তিনি তেল কিনে পাঠিয়ে দিতেন মসজিদে। জীবনভর তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এই নিয়ম পালন করে গেছেন। ক্রমে অনেক মসজিদে বৈদ্যুতিক আলো এল। কিন্তু লাহোর ও করাচির মতো শহরেও কোনো কোনো মসজিদের তেলের প্রদীপ জ্বলত সেকথা জানা ছিল তাঁর। মৃত্যুর রাতেও তার শিয়রে মলমলের রুমালে বাঁধা ছিল কয়েক আনা পয়সা! সম্ভবত এগুলোও তিনি কোনো মসজিদে তেল দেয়ার জন্য রেখেছিলেন। যেহেতু সে রাতও বৃহস্পতিবারের রাত ছিল।
এই কয়েক আনা ছাড়া মায়ের কাছে আর কোনো টাকা-পয়সা বা গয়না ছিল না। সংসারের আসবাবপত্রের মধ্যে যা ছিল তা অতি সামান্য। তিন জোড়া সুতি কাপড়, এক জোড়া দেশি জুতো, এক জোড়া রবারের চপ্পল, একটা চশমা, একটা আংটি–তাতে তিনটে ছোট-ছোট ফিরোজা বসানো, একটা জায়নামাজ, একটা তসবিহ আর বাকি আল্লাহ্ আল্লাহ্।
তিন জোড়া পরিধেয় তিনি বিশেষ যত্নের সঙ্গে রাখতেন সব সময়। এক জোড়া তিনি পরতেন, দ্বিতীয় জোড়া ধুয়ে বালিশের নিচে ভাজ করে রাখতেন, যাতে চাপ খেয়ে ইস্তিরি হয়ে যায়। তৃতীয় জোড়া ধোয়ার জন্য তৈরি থাকত। যদি চতুর্থ জোড়া তার কাছে আসত কখনো–তিনি সেটা গোপনে কাউকে দিয়ে দিতেন। তাই সারাজীবনে তাঁর স্যুটকেসের কোনো প্রয়োজন হয়নি। যত দূরের যাত্রা হোক-না কেন, তার তৈরি হতে কয়েক মিনিটের বেশি সময় লাগত না! কাপড় পুটুলি করে জায়নামাজ দিয়ে পেঁচিয়ে রওনা হয়ে যেতেন। শীতে গরম চাদর আর গ্রীষ্মে মলমলের পাতলা ওড়না–এই নিয়েই যেখানে খুশি যেতেন তিনি। জীবনের শেষ যাত্রাও তিনি সাদাসিদেভাবেই সম্পন্ন করেছেন। ময়লা কাপড় নিজহাতে ধুয়ে বালিশের নিচে রেখেছেন তিনি, নেয়ে-ধুয়ে চুল শুকিয়েছেন এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই জীবনের সবচেয়ে শেষ ও সবচেয়ে লম্বা সফরে রওনা হয়ে গেছেন। যেমন নীরবতার সঙ্গে এই দুনিয়ায় বাস করতেন তেমনি নীরবেই তিনি পরপারে রওনা হয়েছেন। সম্ভবত এজন্যেই তিনি প্রায়ই প্রার্থনা করতেন, ‘আল্লা, হাত-পা সচল থাকতে উঠিয়ে নিও। আন্না, কখনো কারো মুখাপেক্ষী আমায় করো না।’
খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তিনি কাপড়-চোপড়ের চেয়েও সরল ও নিরাসক্ত ছিলেন। তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় খাদ্য ছিল মকাই-এর রুটি ও ধনে বা পুদিনার চাটনি। আর সব খাবারও আনন্দের সঙ্গে খেতেন; প্রায় প্রতি গ্রাসেই তিনি আল্লার শুকরিয়া আদায় করতেন। কেউ ফল খাওয়ানোর জন্য খুব জেদ করলে, তিনি কোনো-কোনো সময় কলার কথা বলতেন। তবে নাশতার সময় দু’পেয়ালা চা এবং বিকেলবেলা এক পেয়ালা লাল চা তার চাই। একবার মাত্র খাবার খেতেন তিনি–তা-ও বেশিরভাগ দুপুরবেলা– রাতের বেলা প্রায় খেতেনই না। গরমের দিনে সাধারণত মাখন-তোলা দুধের হাল্কা লোনা লাচ্ছির সঙ্গে এক-আধটা চাপাতি তার প্রিয় খাদ্য ছিল। কাউকে আগ্রহের সঙ্গে কোনো কিছু খেতে দেখলে খুব খুশি হতেন তিনি। সব সময় দোয়া করতেন। সকলের ভালো হোক–সকলের পরে আমারো ভালো হোক। নিজের জন্য বা নিজের সন্তানের জন্য তিনি সোজাসুজি কোনো প্রার্থনা করতেন না। প্রথমে অপরের জন্য দোয়া করতেন, তারপর খোদার সৃষ্ট জীবসমূহের সুখ-সমৃদ্ধি কামনার মাধ্যমে নিজ সন্তান বা আত্মীয়-স্বজনের মঙ্গল কামনা করতেন। নিজ পুত্র-কন্যাদের তিনি, কখনো আমার ছেলে’ বা ‘আমার মেয়ে’ বলতেন না–সব সময় তাদের বলতেন আল্লাহর দান।
কাউকে দিয়ে কোনো কাজ করানো মায়ের কাছে খুব কঠিন মনে হত। নিজের সব কাজই তিনি নিজ হাতে করতেন–যদি কোনো চাকর-বাকর এসে জবরদস্তি করে তার কাজ করে দিত, তাহলে এক অভূতপূর্ব লজ্জা আর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সমস্ত দিন দোয়া করতেন তাকে।
সরলতা ও তিতিক্ষার এই বৈশিষ্ট্য কিছুটা প্রকৃতিগতভাবেই মায়ের চরিত্রে ছিল, কিছুটা এসেছিল জীবনের ঘাত-সংঘাত থেকে।
জিরানওয়ালায় কিছুদিন অবস্থানের পর তিনি যখন তার বাপ-মা ও ছোট ভাইদের নিয়ে জমির খোঁজে লায়ালপুর রওনা হলেন, তখন তাদের জানা ছিল না যে, তাদের কোথায় যেতে হবে এবং জমি পেতে গেলে কী পন্থা অবলম্বন করতে হবে। মা বলতেন, সেকালে তার মনে কলোনির কল্পনা একজন ফেরেশতা স্বভাবের মহাত্মার চিত্র হয়ে ভেসে উঠত, যিনি উঁচু বেদীর উপর বসে জমি-জিরাত বণ্টন করছেন।
কয়েক সপ্তাহ ধরে এই ছোট্ট কাফেলাটা লায়ালপুর এলাকায় ঘুরে বেড়াল; কিন্তু কোনো পথচারীর চেহারায় কলোনির মহাত্মাসুলভ চিত্র ফুটে উঠল না। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ৩৯২ নম্বর চকে–সে সময় সেখানে নতুন আবাদি বসছিল–ডেরা ফেলল তারা। দলে-দলে লোক এসে সেখানে ঘর বাঁধছিল–নানাজি তার সোজা বুদ্ধিতে বুঝলেন যে, কলোনিতে বসবাস করবার হয়তো এটা একটা নতুন নিয়ম। সুতরাং তিনি খানিকটা জায়গা ঘিরে নিয়ে ঘাসপাতা দিয়ে একটা কুড়ে তৈরি করে ফেললেন এবং পতিত দেখে এক টুকরো জমি খুঁজে নিয়ে চাষ করবার বন্দোবস্ত করতে লাগলেন। সেই সময়ই রাজস্ব বিভাগের একজন কর্মচারী পর্যবেক্ষণের জন্য এসে দেখলেন যে, নানাজির কাছে এলটমেন্টের দলিলপত্র নেই। ফলে তাঁকে চক থেকে বের করে দেয়া হল : অধিকন্তু সরকারি জমিতে বে-আইনিভাবে কুঁড়েঘর বানানোর জন্য তাঁর বাসন-কোসন ও বিছানা-পত্র ক্রোক করা হল। কর্মচারীদের একজন মায়ের কানের দুটো রুপোর বালি খুলে নিয়ে গেল। একটা বালি খুলতে দেরি হওয়ায় সে এমন জোরে টান মারল, যার ফলে মায়ের বা কানের লতিটা সাংঘাতিকভাবে কেটে গেল।
৩৯২নং চক থেকে বিতাড়িত হয়ে যে রাস্তা ধরে সামনে পেলেন সেই রাস্তা বেয়ে চললেন। গরমের দিন তখন–সারাদিন লু-হাওয়া বইছে। পানি রাখবার জন্য একটা মাটির ভাঁড়ও ছিল না তাদের। কোথাও কোনো কুয়া দেখলেই মা তার ওড়না ভিজিয়ে নিতেন, যাতে তৃষ্ণা পেলে ছোট ভাইদের চোষানো যায়। এভাবে চলতে-চলতে তারা ৫০৭ নম্বর চকে পৌঁছলেন। সেখানে একজন চেনাশোনা বসতি স্থাপনকারী নানাজিকে কামলা রাখল। নানাজি হাল বাইতেন, নানি গরু-মোষ চরাতেন, মা ক্ষেত থেকে ঘাস আর চারা কেটে জমিদারের গরু-মোষের খাবার জোগাতেন, তখন তাঁদের এতটুকু সঙ্গতিও ছিল না যা দিয়ে পেটভরে একবেলার খাবার খেতে পারেন। কখনো বুনো ফল খেয়ে থাকতেন সবাই। কখনো খেতেন কুড়িয়ে পাওয়া তরমুজের খোসা। কখনো বা কারো ক্ষেতে পড়ে থাকা টক ফুল কুড়িয়ে এনে তার চাটনি করা হত। একদিন কোত্থেকে যেন কলতা শাক পাওয়া গেল, নানা কাজ-কর্মে ব্যস্ত ছিলেন। মা চুলোয় শাক চাপিয়ে যখন একেবারে সিদ্ধ করে এনেছেন, এবার শাকটা নেড়ে-চেড়ে ঘাঁটতে হবে, সেই সময় হাতা দিয়ে নাড়তে গিয়ে হাড়িতে এত জোরে ঘা লাগল যে হাঁড়ির তলাটা গেল ভেঙে। সব শাক পড়ে গেল চুলোর মধ্যে। নানি এসে মাকে ধমকালেন এবং মারলেনও। সে-রাতে গোটা পরিবার চুলোর ভেতরে পোড়া কাঠে লেগে থাকা শাক কোনোমতে আঙুল দিয়ে চেটে-চেটে খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্তি করল।
৫০৭ নম্বর চকে নানাজির ভাগ্য ফিরে গেল। কয়েক মাস কঠোর পরিশ্রমের পর পুনর্বাসনের সূত্রে সাজে কিস্তিতে তিনিও একখণ্ড জমি পেয়ে গেলেন। আস্তে-আস্তে সুদিন আসতে লাগল এবং দু’তিন বছরের মধ্যেই নানাজি গ্রামের সচ্ছল লোকদের মধ্যে গণ্য হয়ে গেলেন। এমনি দিন-দিন যখন সচ্ছলতা বেড়ে চলল পিতৃভূমির কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। সুতরাং সচ্ছলতার চার-পাঁচ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর সমস্ত পরিবার নিয়ে রেলে চড়ে মেনিলা রওনা হলেন। রেল-ভ্রমণে মা খুব আনন্দ পেলেন। সারা পথ তিনি জানালা দিয়ে মুখ বের করে তাকিয়েছিলেন; এর ফলে বেশ কিছু কয়লার গুঁড়ো তাঁর চোখে পড়ে। কয়েকদিন চোখের পীড়ায় ভুগতে হয় তাকে। এই অভিজ্ঞতার কারণে তিনি সারাজীবনে তার ছেলেদের কোনোদিনই রেলগাড়ির জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে বাইরে দেখবার অনুমতি দেননি। মা রেলের তৃতীয় শ্রেণীতে সফর করতে পারলেই খুব সন্তুষ্ট থাকতেন। সহযাত্রিনী মেয়ে ও ছোট ছেলেদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নিতেন খুব তাড়াতাড়ি। পথের ক্লান্তি আর ধুলোবালিতে তার কোনো অসুবিধা হত না। প্রথম শ্রেণীতে বরং ভ্রমণেই তিনি কষ্ট পেতেন বেশি। দু’একবার যখন তাঁকে এয়ারকন্ডিশন্ড গাড়িতে ভ্রমণে বাধ্য হতে হয়েছিল, তখন তিনি ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছিলেন। মনে হয়েছিল সারাক্ষণ যেন জেলখানার কষ্ট ভোগ করছেন।
মেনিলায় পৌঁছে নানাজি তার পরিত্যক্ত পৈতৃক বাড়ি ঠিকঠাক করলেন। আত্মীয় স্বজনদের নানা উপহার দিলেন, দাওয়াত করে খাওয়ালেন সবাইকে। তারপর মায়ের জন্য বর খোঁজা শুরু করলেন।
সে-যুগে জমিওয়ালাদের প্রভূত সম্মান ছিল। ভাগ্যবান এবং সম্মানিত বলে পরিগণিত হতেন তারা। সুতরাং চারদিক থেকে মায়ের জন্য বিয়ের খবর আসতে লাগল। এমনিতেও মায়ের জাঁকজমক ছিল; তার ওপর বরপক্ষের আকর্ষণ বাড়াবার জন্য নানি তাকে রোজ নতুন-নতুন কাপড় পরিয়ে নতুন বউ-এর মতো সাজিয়ে রাখতেন।
কখনো-কখনো মা স্মৃতিরোমন্থন করতে গিয়ে বলতেন, ‘সে-সময় তো আমার বাড়ি থেকে বের হওয়া মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। যে-পথ দিয়ে আমি যেতাম সে পথের লোকজন আমাকে দেখে হতভম্ব হয়ে যেত এবং পরস্পর বলাবলি করত, ‘ঐ যে, খেয়াল বখৃশ জমিদারের মেয়ে যাচ্ছে। না জানি কোন ভাগ্যবান তাকে বিয়ে করবে।’
‘মা, আপনার নজরে এমন কোনো ভাগ্যবান ছিল না?’ আমরা কৌতূহলী হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করতাম।
‘আরে বাপ, তউবা, তউবা।’ মা হাত দিয়ে কান ঢাকতেন, ‘আমার নজরে কেউ কী করে থাকবে। তবে হ্যাঁ, আমার অন্তরে এই সামান্য আশাটুকু ছিল যে, যেন আমি এমন কাউকে পাই, যে কিছুটা লেখাপড়া জানে–তা হলেই খোদার অপার অনুগ্রহ মনে করব।’
সারাজীবন এই একটি আকাক্ষাই মায়ের মনে তার নিজের জন্য রক্ষিত ছিল; সে আকাক্ষা খোদা এমনভাবে পূর্ণ করলেন যে, সেই বছরেই আবদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে মায়ের বিয়ে হয়ে গেল।
সেকালে ওই অঞ্চলে আব্দুল্লাহ্ সাহেবের খুব নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের একমাত্র সন্তান। কিন্তু পাঁচ-ছ বছর বয়সেই তিনি পিতৃহীন হয়ে পড়েন। অবস্থাও খুব খারাপ হয়ে পড়ে। বাপ মারা যাওয়ার পরই জানা গেল যে, তার সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তি বন্ধক দেয়া আছে। সুতরাং আবদুল্লাহ সাহেব তার মাকে নিয়ে একটা কুঁড়েঘরে আশ্রয় নিলেন। ধন-সম্পদের এই পরিণতি দেখে তিনি এমন এক সম্পদ আহরণ করতে দৃঢ় সংকল্প হলেন, যা কোনো মহাজনের কাছে বন্ধক দেয়া সম্ভব নয়। তাই আবদুল্লাহ্ সাহেব মনপ্রাণ দিয়ে লেখাপড়া করতে লাগলেন। বৃত্তির পর বৃত্তি লাভ করে, দু বছরের পরীক্ষা এক বছরে পাস করে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটিতে ম্যাট্রিকুলেশনে প্রথম হলেন। সেকালে সম্ভবত এই প্রথমবার কোনো মুসলমান ছাত্র ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় রেকর্ড স্থাপন করে।
উড়তে-উড়তে এই খবর স্যার সৈয়দের কানে গিয়ে পৌঁছল। তিনি তখন আলিগড় কলেজ পত্তন করেছেন। তিনি তার একজন বিশিষ্ট কর্মচারীকে গ্রামে পাঠালেন এবং আব্দুল্লাহ্ সাহেবকে বৃত্তি দিয়ে নিয়ে এলেন আলিগড়ে। এখানে এসে আবদুল্লাহ্ সাহেব অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়ে মাত্র উনিশ বছর বয়সে বিএ পাস করে সেখানেই ইংরেজি, আরবি, দর্শন ও অঙ্কের অধ্যাপক নিযুক্ত হলেন।
স্যার সৈয়দের কামনা ছিল মুসলমান যুবকরা অধিকতর সংখ্যায় উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত হোক। তাই তিনি আবদুল্লাহ সাহেবের জন্য বৃত্তি আদায় করে আইসিএস পরীক্ষা দেবার জন্য বিলেত যাবার বন্দোবস্ত করে দিলেন।
গত শতাব্দীর মুরুব্বিরা সাত সমুদ্র পারের যাত্রাকে খুব বিপজ্জনক মনে করতেন। সঙ্গত কারণে আবদুল্লাহ সাহেবের মা-ও তাকে নিষেধ করলেন বিলেত যেতে। আবদুল্লাহ্ সাহেবের ভাগ্য হল অপ্রসন্ন, তিনি বৃত্তি প্রত্যাখ্যান করলেন।
এ-কথা শুনে স্যার সৈয়দের রাগ এবং দুঃখ হল। তিনি অনেক করে বোঝালেন, ভয় দেখালেন, ধমক দিলেন; কিন্তু আবদুল্লাহ সাহেব না’ থেকে ‘হ্যাঁ’-তে এলেন না।
.
তুমি কি জাতীয় স্বার্থের চেয়ে তোমার বুড়ি মা’র কথাকে বড় মনে কর। স্যার সৈয়দ গর্জে উঠলেন।
‘জী হা।’ জবাব দিলেন আবদুল্লাহ সাহেব।
জবাব শুনে স্যার সৈয়দ রাগে আর সংযত রাখতে পারলেন না নিজেকে। কামরার দরজা বন্ধ করে প্রথমে তাকে চড় থাপ্পড় মারলেন। তারপর কলেজের চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দিয়ে বললেন, এখন তুমি এমন জায়গায় গিয়ে মর, যেখান থেকে আমি আর তোমার নামও যেন শুনতে না-পাই।’
আবদুল্লাহ সাহেব যেমন সুবোধ ছেলে ছিলেন, তেমনি ছাত্র হিসেবেও ছিলেন প্রতিভাবান। ম্যাপে তিনি সবচেয়ে দূরে গিলগিট শহর দেখতে পেলেন। সুতরাং, নাক বরাবর চলে গিয়ে সেখানে হাজির হলেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই সেখানে গভর্নর নিযুক্ত হলেন।
.
যে সময়ে মায়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছিল, সে-সময়ে আবদুল্লাহ্ সাহেবও ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন। অদৃষ্টের লেখন ছিল, তাই তার সঙ্গেই বিয়ের বাগদান হয়ে গেল। এক মাস পর বিয়ের তারিখও ঠিক হল, যাতে আবদুল্লাহ সাহেব বউ নিয়ে গিলগিট যেতে পারেন।
বাগদানের পর একদিন মা তার সইদের সঙ্গে নিয়ে পাশের গায়ে এক মেলায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে কিংবা সম্ভবত জ্ঞাতসারে আবদুল্লাহ্ সাহেবও সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
মায়ের সইরা তাঁকে ঘিরে ধরল। সবাই তাঁকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে পাঁচ টাকা করে আদায় করল। আবদুল্লাহ্ সাহেব মাকেও অনেক টাকা দিতে চাইলেন, কিন্তু তিনি নিলেন না। যখন খুব অনুরোধ করা হল, তখন নিরুপায় হয়ে মা এগারো পয়সার ফরমাশ করলেন।
‘এত বড় মেলায় এগারো পয়সা দিয়ে কী করবে?’ আবদুল্লাহ্ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
‘আগামী বৃহস্পতিবারে আপনার নামে মসজিদে তেল পাঠাব।’ মা জবাব দিলেন।
জীবনের মেলায়ও আবদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে মায়ের লেনদেন মাত্র বৃহস্পতিবারের এগারো পয়সার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তার চেয়ে বেশি পয়সা তিনি কোনোদিন চাননি এবং নিজের কাছে রাখেননি।
গিলগিটে আবদুল্লাহ সাহেবের খুব শান-শওকত ছিল। সুন্দর সাজানো বাংলো, প্রশস্ত বাগান, চাকর-বাকর, দরজায় প্রহরী। যখন আবদুল্লাহ্ সাহেব বাইরে টুরে যেতেন বা ফিরে আসতেন, তখন সাতটা তোপধ্বনি করে তাঁকে অভিনন্দন জানানো হত। এমনিতেও গিলগিটের গভর্নর হিসেবে সামাজিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন তিনি কিন্তু মায়ের ওপর এসব ক্ষমতা ও পূর্বের কণামাত্রও প্রভাব পড়েনি। কোনো প্রকারের ছোট-বড় পরিবেশও তাঁকে প্রভাবিত করতে পারত না। বরং মায়ের সরলতা ও আত্মনির্ভরশীলতা প্রত্যেক পরিবেশকেই গাম্ভীর্যমণ্ডিত করে তুলত।
সে সময়ে স্যার ম্যালকন হ্যাঁলি গিলগিটের রুশ ও চীন সীমান্তের ব্রিটিশ পক্ষীয় পলিটিক্যাল এজেন্ট নিযুক্ত হন। একদিন লেডি হ্যাঁলি ও তার কন্যা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাদের পরনে ফ্রক ছিল। হাঁটু থেকে গোড়ালি খোলা। এই নির্লজ্জতা মা পছন্দ করলেন না। তিনি রেডি হ্যাঁলিকে বললেন, ‘তোমার জীবন তো যেভাবে হোক কেটেই গেছে। এখন মেয়েটার জীবনটা তার নষ্ট কর না।’ এ-কথা বলে তিনি মিস্ হ্যাঁলিকে তার কাছে রেখে দিলেন। তাকে রান্না, বাসন মাজা, কাপড় সেলাই করা সব শিখিয়ে তার বাপমায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
যখন রুশ বিপ্লব শুরু হয়, তখন লর্ড কিসেজ গিলগিট সীমান্ত পরিদর্শনে আগমন করেন। তার সম্মানার্থে গভর্নরের পক্ষে থেকে এক ভোজসভার আয়োজন করা হয়। মা নিজের হাতে দশ-বারো রকমের খাবার তৈরি করেন। অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার। খাওয়ার শেষে লর্ড কিসেজ তার বক্তৃতায় বলেন, ‘মিস্টার গভর্নর, যে খানসামা এই খাবার রান্না করেছে অনুগ্রহপূর্বক আপনি আমার তরফ থেকে তার হাত চুম্বন করুন।’
ভোজ শেষে আবদুল্লাহ্ সাহেব খুশি মনে বাড়ি ফিরে দেখলেন মা রান্নাঘরের এক কোণে একটা মাদুর পেতে বসে লবণ ও মরিচের চাটনি দিয়ে মকাই-এর রুটি খাচ্ছেন।
একজন গভর্নরের মতোই আবদুল্লাহ সাহেব মায়ের হাতে চুমু দিলেন এবং বললেন, ‘যদি লর্ড কিসেজ এই আদেশ দিতেন যে, তিনি স্বয়ং খানসামার হস্ত চুম্বন করবেন, তাহলে তুমি কী করতে?’
‘আমি?’ মা ভ্রুকুটি করে বললেন, ‘আমি তার গোঁফ হেচকা টানে ছিঁড়ে নিতাম। তারপর আপনি কী করতেন?’
‘আমি?’ আবদুল্লাহ সাহেব নাটকীয় ভঙিতে বললেন, ‘আমি সেই গোঁফ তুলো দিয়ে বেঁধে ভাইসরস-এর কাছে পাঠিয়ে দিতাম। তারপর পালিয়ে যেতাম তোমাকে নিয়ে। যেমন করে পালিয়ে এসেছি স্যার সৈয়দের কাছ থেকে।’
মা এ-সব কথা গ্রাহ্যও করতেন না। কিন্তু একবার, শুধু একবার তিনিও হিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে মরেছিলেন–যা মেয়েদের একমাত্র উত্তরাধিকার।
গিগিটের আইন সংক্রান্ত আদেশাবলিকে ‘গভর্নরি’ বলা হতো। এ-কথা যখন মায়ের কানে গেল, তখন তিনি আবদুল্লাহ্ সাহেবকে অভিযোগ করলেন :
‘রাজত্ব তো করছেন আপনি; কিন্তু লোকে ‘গভর্নরি’, ‘গভর্নরি’ বলে আমাকে খামোখা মাঝখানে টানাটানি করে কেন?’
আবদুল্লাহ্ সাহেব ছিলেন আলিগড়ের ছাত্র। রসিকতা করবার জন্য মেতে উঠলেন তিনি। সরস কণ্ঠে বললেন : ‘ভাগ্যবতী, এ গভর্নরি তোমার নাম নয়। গভর্নরি হল তোমার সতীনের নাম–যে সব সময় আমার পেছনে ধাওয়া করছে।’
রসিকতার চূড়ান্ত। আবদুল্লাহ্ সাহেব বুঝলেন, কথার সমাপ্তি হয়ে গেল এখানেই। কিন্তু মায়ের মনে দুঃখ দানা বেঁধে গেল। তিনি কথাটা নিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলেন।
কিছুদিন পর কাশ্মীরের মহারাজা প্রতাপ সিং মহারানীকে সঙ্গে নিয়ে গিলগিট বেড়াতে এলেন। মা তার মনের ব্যথা মহারানীকে শোনালেন। মহারানীও ছিলেন অত্যন্ত সরল প্রকৃতির। তিনি উদ্বেলিত কণ্ঠে বললেন : ‘হায়-হায়, আমার রাজ্যে এই অত্যাচার? আমি আজই মহারাজাকে বলব, তিনি আবদুল্লাহ্ সাহেবকে দেখে নেবেন।’
ব্যাপারটা যখন মহারাজার কানে গেল, তিনি আবদুল্লাহ সাহেবকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। আবদুল্লাহ্ সাহেবও স্তম্ভিত হয়ে ভাবলেন এ কী বিপদ। কিন্তু ব্যাপারটা সম্বন্ধে যখন আরো খোঁজ নেয়া হল, তখন উভয়েই খুব করে হাসলেন। দু’জনেই বুদ্ধিমান। সুতরাং মহারাজা আদেশ দিলেন যে, এবার থেকে গিগিটের গভর্নরপত্নীকে ভবিষ্যতে ওজারত ও গভর্নরকে উজিরে ওজারত বলে সম্বোধন করা হবে। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত গিলগিটে এই সরকারি নির্দেশই প্রচলিত ছিল।
এই হুকুমনামা শুনে মহারানী মাকে ডেকে সুসংবাদ দিলেন যে, মহারাজ ‘গভর্নরি’কে দেশ থেকে বহিষ্কার করে দিয়েছেন।
মহারানীর কোনো সন্তান ছিল না। এজন্যে প্রায়ই তিনি মাকে দোয়া করতে বলতেন। মা নিজে অবশ্য বলতেন তাঁর মতো সৌভাগ্যশালী মা পৃথিবীতে কমই আছে। কিন্তু ধৈর্য, তুষ্টি এবং সব কিছু মেনে নেয়ার, সব কিছু সহ্য করার ক্ষমতা, চশমাজোড়া খুলে ফেলে যদি দেখা যেত তা হলে সেই সৌভাগ্যের পর্দার অন্তরালে কত দুঃখ, কত বিষাদ এবং কত আঘাত যে লুকানো ছিল তা প্রকট হয়ে ধরা পড়ত।
আল্লাহতালা মাকে তিনটি মেয়ে ও তিনটি ছেলে দান করেন। দুই মেয়ে বিয়ের কিছুকাল পরে একে-একে মারা যায়। বড় ছেলেও যৌবনের প্রারম্ভে বিলেতে গিয়ে মারা যায়।
মুখে অবশ্য বলতেন যে, আল্লাহ্র মাল, আল্লাহ্ নিয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি কি একা-একা কোনো সময়ই লুকিয়ে তাদের কথা মনে করে অশ্রুপাত করতেন না? যখন আবদুল্লাহ্ সাহেব ইন্তেকাল করেন, তখন তার বয়স ছিল বাষট্টি বছর ও মায়ের বয়স পঞ্চান্ন বছর। আবদুল্লাহ সাহেব দড়ির খাটে রোজকার মতো বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। মা পায়ের কাছে বসে চাকু দিয়ে আখ কেটে-কেটে তাঁকে দিচ্ছিলেন। তখন বিকেল। আবদুল্লাহ্ সাহেব মজা করে আখ চুষছিলেন আর মেতে ছিলেন হাসি-তামাশায়। তারপর অকস্মাৎ তিনি গম্ভীর হয়ে মাকে বললেন, ‘হায় আল্লা, বিয়ের আগে মেলায় তুমি যে আমার কাছ থেকে এগারো পয়সা নিয়েছিলে, তা কি শোধ দেয়ার সময় এখনও হয়নি?’
মা নববধূর মতো মাথা নামিয়ে আখ কাটতে লাগলেন। তাঁর বুকে একসঙ্গে অনেক কথা গুমরে উঠল।
‘সময় এখনো হল কোথায় প্রিয়? বিয়ের আগের এগোরো পয়সার ঋণ তো বইছিই। কিন্তু বিয়ের পরে যেমন করে তুমি আমাকে আদর-যত্ন করেছ সেজন্য তোমার পা ধুয়ে পানি খেতে হয়। আমার গায়ের চামড়া দিয়ে জুতো বানিয়ে তোমাকে পরানো উচিত। আমার। এখনই কি শোধ করবার সেই সময় এসেছে!’
কিন্তু আজরাইলের খাতায় সময় এসে পড়েছিল। মা যখন মাথা তুললেন, তখন আবদুল্লাহ সাহেব আখের টুকরো মুখে নিয়ে পাশবালিশের উপর ঢলে পড়েছেন। মা তাঁকে ডাকলেন, নাড়া দিলেন, সুড়সুড়ি দিলেন; কিন্তু আবদুল্লাহ্ সাহেব এমন ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন যে, তা থেকে জাগানো কিয়ামতের আগে কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
.
মা তাঁর অবশিষ্ট দুই ছেলে ও এক মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিলেন : ‘বাছারা, কেঁদো না–তোমাদের আব্বা যেমন শান্তিতে এই দুনিয়ায় বাস করতেন, তেমনি শান্তিতেই এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। কেঁদো না, কাঁদলে তার আত্মা কষ্ট পাবে।’
মুখে তো মা বললেন, তোমাদের আব্বার কথা মনে করে কেঁদো না, তাহলে তাঁর কষ্ট হবে। কিন্তু তিনি কি তার স্বামীর কথা স্মরণ করে বাকি জীবনে একটুও কাঁদেননি?
যখন তিনি নিজেও বিদায় নিলেন, তখন তার সন্তানদের মনে এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেলেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত তাদের মনের মণিকোঠায় অক্ষয় হয়ে থাকবে।
যদি মায়ের নামে কিছু দান করতে যাই, তাহলে এগারো পয়সার বেশি দিতে সাহস হয় না, অথচ মসজিদের মোল্লা তো বিস্মিত হয়ে বলেন যে, বিজলির রেট বেড়ে যাচ্ছে– তেলের দামও বাড়ছে।
মায়ের নামে যদি ফাতেহা দিতে চাই, তাহলে মকাই-এর রুটি আর লবণ-মরিচের চাটনির কথা মনে পড়ে। যাকে খাওয়াই সে বলে ফাতেহা দরুদে তো পোলাও-জরদা হওয়াই উচিত।
মায়ের কথা মনে এলেই বাঁধ ভেঙে কান্না আসে। কিন্তু যদি কাঁদি তাহলে ভয় হয়, পাছে মায়ের রুহের কষ্ট হয়, আর যদি কান্না দমন করতে যাই–খোদার কসম, কান্না থামানো যায় না।
৩. শ্ৰেষ্ঠ উর্দু গল্প – ৩য় খণ্ড
ভূমিকা
বর্তমানে পাকিস্তান আর ভারত মিলিয়ে উর্দুভাষী জনসংখ্যা ৭ কোটির ওপরে। উর্দু ভাষা এবং সাহিত্যের উৎকর্ষ তাই এই দুদেশের মিলিত প্রয়াসে।
১৯৪৭-পূর্ববর্তী উর্দু ছোটগল্পের প্রধান বিষয়বস্তু মূলত রাজনৈতিক আন্দোলন, সামাজিক জাগরণ কিংবা নারী-পুরুষের মিলন। কিন্তু দেশবিভাগের পরবর্তীতে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটল ছোটগল্পে– সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কিংবা পরাধীন কাশ্মিরের কাহিনীতে মানুষের নীচতা আর নির্যাতনকে ছাপিয়ে মর্মস্পর্শী হয়ে উঠল মানবতাবোধ; বিদ্বেষ বিতৃষ্ণা হতাশা ছাপিয়ে উঠে এল প্রেম আর আশার উচ্চকিত উচ্চারণ। ক্রমশ স্থিরতা এল সমাজ ও মানবজীবনে– প্রতিদিনের তুচ্ছ সাধারণ ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হল অন্তরের বিচিত্র সূক্ষ্ম অনুভূতির অনবদ্য অতলস্পর্শী রূপ।
উর্দু ছোটগল্পের এই সৌন্দর্য পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে ইতোপূর্বে নাতিদীর্ঘ ভূমিকাসহ প্রকাশিত হয়েছে শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্পের দুটি সংকলন। খণ্ড দুটিতে উর্দু সাহিত্যে আধুনিকতার উদ্ভব-পর্ব থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত প্রধান লেখক হিশেবে যাঁরা নিজেদের ভাষা-বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন তাঁদের লেখাই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নির্বাচিত গল্পগুলো লেখকদের প্রতিনিধিত্বকারী ও শ্রেষ্ঠ রচনা, ফলে খণ্ড দুটিকে উর্দু কথাসাহিত্যের প্রামাণ্য বাংলা সংকলন হিশেবে সহজেই চেনা যায়। কিন্তু উর্দু ছোটগল্পের বিপুল ঐশ্বর্যের সামান্য অংশই ধরা সম্ভব হয়েছে খণ্ড দুটির স্বল্প পরিসরে। তাই ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পরবর্তীকাল থেকে এ পর্যন্ত অনূদিত– আশ্চর্যজনক হলেও ১৯৭১-পরবর্তীতে যা গুণগত মানে না হলেও পরিমাণে বিপুলতর– রচনা থেকে বাছাইকৃত সেরা রচনাগুলো দিয়ে আরও তিনটি খণ্ডে (তৃতীয় থেকে পঞ্চম) প্রকাশিত হল শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্প নামে। প্রতিটি খণ্ডেই রয়েছে বিচিত্র স্বাদের অনন্য কিছু গল্প। এখানে অনেক চেনা, নামী লেখকের পাশে স্থান পেয়েছে অজানা কিংবা প্রায়-অনামা লেখকের বিস্ময়কর সাহিত্যগুণসম্পন্ন রচনা; ধরা পড়েছে মানবিকতা, হাস্যরস, মনোবিশ্লেষণ, জীবনবোধ কিংবা প্রতীকী গল্পের মধ্যে দিয়ে উর্দু ছোটগল্পের ঋদ্ধ বিস্তৃত ভুবন।
জাহিদ হাসান
গোঁফ – হামিদ কাশ্মিরি
স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে, ফটক পর্যন্ত এসে দিলাওয়ার খান কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকল। রাস্তায় এত লোক। সবাই তো পায়ে হেঁটে চলেছে। প্রত্যেকটি চলমান লোকের মুখের ওপর সে একবার করে গভীর দৃষ্টি ফেলল। শহরে তার এই প্রথম আসা। তা-ও এত বড় শহর। কাজেই শহর দেখতে যে অদ্ভুত লাগবে, সেরকম একটা ধারণা মনে মনে পোষণ করে রেখেছিল আগেই থেকেই। কিন্তু এ শহর যে এত অদ্ভুত, তা সে আগে কখনো ভাবেনি।
শুধু শহর নয়– শহরের মানুষগুলোও অদ্ভুত। এমন একটা মানুষও তো দিলাওয়ার খান গ্রামে কখনো দেখেনি। এদের পোশাক কেমন বিচিত্র। মাথায় তার মতো কেউই পাগড়ি জড়ায়নি। গ্রামের যারা গরীব লোক, যারা চল্লিশ গজি পাগড়ির পয়সা যোগাতে পারে না, তারাও কখনো মাথা খালি রাখে না। আর কিছু না-হোক একটা লুঙ্গি হলেও তাই মাথায় জড়িয়ে নিয়ে তবে বাড়ির বাইরে বেরোয়। আর, এ শহরের মানুষ টুপিটা পর্যন্ত মাথায় চাপায়নি। সবারই মাথা উলঙ্গ। তার ওপর আবার মর্দানা আর জানানা চেনা দায়। কোনো কোনো মেয়েলোকের চুল পুরুষ মানুষের মতো করে ছাঁটা, আর শরীরের অর্ধেকের বেশি বেআবরু। আবার অনেক পুরুষ জানানা পোশাক পরেছে।
সবচাইতে তাজ্জবের ব্যাপার, কোনো পুরুষেরই মুখে গোঁফ নেই। তার মতো অমন লম্বা-চওড়া গোঁফ দূরের কথা– কারও নাকের নিচে সামান্য গোঁফের রেখাটুকু পর্যন্ত লক্ষ করা যায় না। দুই পাশে তা দিয়ে দিয়ে পাকিয়ে রাখা তার মতো অমন জমকালো গোঁফ তাদের গ্রামের সবারই যে রয়েছে, এমন কথা সে বলতে চায় না। কিন্তু একেবারেই গোঁফ নেই, এমন তো কখনো হতে দেখেনি সে।
দাড়ি কেউ রাখে, কেউ রাখে না; কিন্তু গোঁফ প্রত্যেকেই রাখে যার যার সাধ্য আর সামর্থ্য মতো। যার ছাতিতে যত তাকত, তার গোঁফ তত জমকালো। নিজের গ্রামে দিলাওয়ার খানের গোঁফ সবচাইতে বড় বলেই-না তার এত খাতির। তার গোঁফের খ্যাতি আশপাশের চৌদ্দটা গ্রামের মধ্যেও বিস্তার লাভ করেছে। গোঁফের এই মর্যাদা কোনোদিনও ক্ষুণ্ন হতে দেয়নি সে, তার সাহস আর বীরত্বকে যেমন দেয়নি কখনো ম্লান হতে। গ্রামের সবাই আগে তাকেই সালাম দেয়। তাই বলে সে দাম্ভিক নয়। আগে সে সালাম করতে চাইলেও গ্রামের লোকরাই সে সুযোগ দেয় না কখনো। যাই হোক, এ তার প্রাপ্য সম্মান। এমন সম্মান জুটতে পারে খুব কম লোকের ভাগ্যেই।
শহরের এইসব অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করে দিলাওয়ার খান অবাক হল। তারপর সে লক্ষ করল, তার গোঁফের দিকে যার চোখ পড়ছে, সেই যেন ভয় পেয়ে যাচ্ছে। সেই জন্যই এই গোঁফ দেখছে তারা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে।
তার মধ্যে একটা ছেলে– যার জামাটা মেয়েদের মতো গায়ের সঙ্গে সেঁটে রয়েছে আর সে জামায় ফুল-পাতায় নকশা কাটা– যেন খানিক মশকরার ভঙ্গিতে বেশকিছুটা কাছে থেকে দিলাওয়ার খানের গোঁফ দেখছিল। চাল-চলন, হাব-ভাব দেখে ছেলেটাকে দিব্যি জানানা বলেই বোধ হচ্ছে। এই কারণে তার এইভাবে তাকিয়ে থাকাকে সে গুরুত্ব দিল না। ভাবল, গোঁফ দেখার শখ মিটলেই চলে যাবে সে। কিন্তু ছেলেটা চলে যাওয়া দূরে থাক– এখন তার এক সঙ্গীর কাঁধের উপর কনুই রেখে হেলান দেওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আরও মজা করে দেখতে লাগল, আর দেখার মধ্যে আগের মতো তেমনি মশকরার ভাব। দিলাওয়ার খান আর সহ্য করতে পারল না। তখন সে ঘাড় টান করে দাঁড়াল। এক মুহূর্ত চোখ ফেলল। গোঁফে সামান্য একটু কাঁপুনি দিল। এই গোঁফ নড়ানো দেখেই ছেলেটা তার সঙ্গীকে নিয়ে এমন এক দৌড় মারল যে, আর ফিরেও তাকাল না। মনে মনে মুচকি হেসে আস্তে আস্তে রাস্তায় নেমে পড়ল দিলাওয়ার খান।
রাস্তায় নেমেও সেই এক কাণ্ড! লুকিয়ে লুকিয়ে কিংবা প্রকাশ্যে, আড়চোখে কিংবা পেছন ফিরে, দূরে থেকে কিংবা কাছ থেকে একবার, দুবার, তিনবার করে প্রত্যেকে তার গোঁফ দেখছে। লোকগুলো যেন ভাবছে, রাজ্যের যত গোঁফ সবই দিলাওয়ার খানের নাকের নিচে এসে জড় হয়েছে। দিলাওয়ার খান ভাবল, তার কাছে যেমন শহরটা অদ্ভুত সেও তেমনি অদ্ভুত এই শহুরে লোকগুলোর কাছে।
যাই হোক, সে আনন্দিত যে, সবাই তার আগমন উপলব্ধি করছে। কত লোকই তো এই শহরে প্রতিদিন আসে, কিন্তু কেউ কি তাদের এইরকম ভয়ের চোখে দেখে! গ্রামের লোকরাও তাকে ভয় করে চলে। অবশ্য সেজন্য তাকে যথেষ্ট খাটতে হয়েছে। যথেষ্ট শক্তির পরীক্ষা দিতে হয়েছে। কত ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছে তাকে। কিন্তু শহরে এসে সেরকম কিছুই করতে হল না। বিনা খাটুনিতেই লাভ করল এমন মর্যাদার আসন। সুতরাং, দাঁড়িয়ে পড়ে একবার সে ভালো করে গোঁফে একটা তা দিয়ে নিল। ছাতিটা টান করল। গর্দান উঁচু করল। মনেই থাকল না কোথায় তাকে যেতে হবে। ভুলেই গেল, কেউ তাকে স্টেশনে নিতে আসেনি কেন।
যখন মনে পড়ল, তখন ভারি দুঃখ হল। ভাবল, হয়তো তার চিঠি এখনো পৌঁছায়নি। তারপর নোটবুকে লেখা ঠিকানা দেখে নিল। কিন্তু কেমন করে সেখানে যেতে হবে, তা সে জানে না। সামনের ফুটপাতে মিনমিনে ধরনের একটা লোককে দেখতে পেয়ে তার দিকে এগুলো জিগ্যেস করার জন্য। লোকটা আগে থেকেই তার গোঁফের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে দিলাওয়ার খানকে তার দিকে এগুতে দেখে ভয় পেয়ে এলোপাথাড়ি দৌড় মারতে শুরু করে দিল।
‘আখো, বুদিল।’ লোকটাকে গালি দিল সে কাপুরুষ বলে। তারপর, অন্য একজনের কাছে ঠিকানা জানতে চাইল সে। এবারের লোকটা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল না। দিলাওয়ার খানকে সে বুঝিয়ে দিল যে ওই বাস-স্ট্যান্ডে গিয়ে বাসে চাপলে চৌরঙ্গি পৌঁছানো যাবে, সেখানে থেকে অন্য বাস ধরলে চলে যেতে পারবে গন্তব্যস্থলে।
বাস-স্ট্যান্ডে বিরাট একটা লাইন লেগেছিল। এই লাইনের মর্ম দিলাওয়ার খানের জানা নেই। জানবার চেষ্টাও সে করল না। লাইনের বাইরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চালগোজা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে খেতে লাগল আর বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। সবাই লুকিয়ে লুকিয়ে, আড়চোখে তাকে দেখছে। সামনে এসে দাঁড়ানোর সাহস নেই কারও মনে এইভাবে সর্ববিধ দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হতে পারায় তার মনে যদিও গর্বের অন্ত ছিল না, কিন্তু বাস-স্ট্যান্ডে আসার পর এই দেখার মাত্রা এত বেড়েছে যে, এখন সে বিরক্তি অনুভব করতে আরম্ভ করল। কাজেই ব্যাপারটাকে আর আদৌ আমল না দিয়ে আপন মনে চালগোজা চিবোতে থাকল সে। এমন সময় একটা বাস এল, আর সঙ্গে সঙ্গে সে বাসের দিকে ধাবিত হল। কিন্তু তার পৌঁছানোর আগেই বিরাট লাইনের একটা দিক বাসের ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করে দিয়েছে। এই অবস্থা’ দেখে সে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে থাকল। তারপর যখন বুঝল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে– বাস প্রায় ভরে গেছে। কাজেই আর সময় নষ্ট না করে সামনের দিকে লাইনের এক জায়গায় সে ঢুকে পড়ল। পেছনের লোকরা অস্বস্তি অনুভব করল, কিন্তু কারও সাহস হল না প্রতিবাদ করার।
বাস একদম ভরে গেছে। দিলাওয়ার খান অনেক পরে ঢুকেছে বলে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হল। ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে থেকে কারও কেবল গা দেখা যাচ্ছে, কারো কেবল পা।
গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কন্ডাক্টর টিকিট কাটতে লাগল। নিয়মমতো, একজনের কাছে একবারের জায়গায় পাঁচবার চাইলে তবে টিকিটের পয়সা পাওয়া যায়। কন্ডাক্টর প্রথমে বসে-থাকা লোকদের টিকিট কেটে গেল। তারপর দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের সম্বোধন করতে লাগল তার চিরাচরিত ভাষায় ‘টিকিট।’
‘ও ভাই, টিকিট।’
‘টুপিঅলা ভাই, টিকিট।’
‘গামছাঅলা ভাই, টিকিট!’
‘শেরওয়ানিঅলা ভাই, টিকিট।’
‘ও ভাই, গোঁ-ও-ও-ফ…’
দিলাওয়ার খানের গোঁফ পাশ থেকে সামান্য এক শতাংশ দেখেই সে এই সম্বোধন করতে যাচ্ছিল। কিন্তু যেই পুরো দেখেছে, অমনি তার মুখের মধ্যেই কথাটা আটকে থেকে গেল, বেরুতে পারল না। দিলাওয়ার খানের আগুন ঠিকরানো চোখ দেখে সে রীতিমতো ভড়কে গেল ভয় পেয়ে। ভয়ে তার সর্বশরীর কাঁপতে লাগল থরথর করে। ওদিকে দিলাওয়ার খানও তার সেই ভয়ঙ্কর দৃষ্টি কিছুতেই সরিয়ে নিচ্ছে না কন্ডাক্টরের ওপর থেকে। যারা দেখেছে, তারাও প্রত্যেকে চুপ মেরে গেছে। গোটা বাসে একটা থমথমে নীরবতা। মনে হচ্ছিল, কন্ডাক্টারকে এখনই খুন করে ফেলবে দিলাওয়ার খান। তারই মধ্যে একজন সদাশয় ব্যক্তি বলে উঠলেন, ‘খান সাহেব, যাত্রা মাফ করে দাও ওকে। দেখছ না, ও একটা পাগল, বদ্ধ পাগল। ওকে ছেড়ে দিয়ে আমাকেই না হয় দুটো গাল দিয়ে দাও, খান সাহেব।’
‘আখো, জানানা, মরদের বাচ্চা গাল দেয় না।’ এই বলে সে সত্যি সত্যি মাফ করে দিয়ে অন্য দিকে মুখ ফেরাল।
চৌরঙ্গি পৌঁছে বাস থেকে নেমেই প্রথমে তার চোখ পড়ল একটা চুল-কাটা সেলুনের ওপর। তার মনে পড়ল, তিন দিনের সফরে তার গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজিয়েছে। গালে হাত বুলিয়ে সে তা অনুভব করল। সেলুনে ঢুকে দাড়ি চেঁছে নেবে কিনা, তাই সে ভাবতে লাগল। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, তাছাড়া বাস এসে চলে যেতে পারে মনে করে তাকে ইচ্ছা পালটাতে হল। তাছাড়া, এখানকার নাপিত আনাড়ি হলে গোঁফের গড়ন নষ্ট করে ফেলতে পারে। গ্রামের কালু নাপিত তার দাড়ি কাটতে কাটতে কেমন হাত পাকিয়ে ফেলেছে। এই কারণে প্রতি দফা দাড়ি কাটার পর দিলাওয়ার খান তাকে এক সের আনাজ দিয়ে দেয়। কালু নাপিত এইরকম দাক্ষিণ্য অন্য কারও দাড়ি কেটে কখনো আশাই করতে পারে না।
দাড়ি কাটার ইচ্ছাটা সকাল পর্যন্ত স্থগিত রেখে দিলাওয়ার খান বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। এখানে আগের মতো লাইন করে লোক দাঁড়ায়নি। কিন্তু একটা জিনিস বোঝা গেল যে, বাস বেশ দেরিতে আসে। সুতরাং, সে পায়চারি করে বেড়াতে লাগল ফুটপাতের উপর। এখানেও আগের মতোই পথচারীদের কাছে সে দর্শনীয় বস্তু। কিন্তু গোঁফহীন চেহারা দেখে দেখে সে এই শহরের লোকদের ওপর এত বেশি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে যে, তাদের দিকে চোখ তুলে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করছে না আর। পুরুষ হয়েও গোঁফ নেই। এ শহরের লোকগুলো যেন পুরুষ নয়, হিজড়ে। যে শহরে একসঙ্গে এত হিজড়ে বাস করে, শহরের প্রতি কোনোরকমের আকর্ষণ অনুভব করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সত্যি, তার খুব দুঃখ হতে লাগল এইসব হিজড়ে-মার্কা পুরুষের জন্য।
এইভাবে আরও কত কী সে চিন্তা করছিল, এমন সময় হঠাৎ এই হিজড়ের শহরে সে একটা পুরুষমানুষ দেখে ফেলল। দিলাওয়ার খানের কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে বিরাট স্বাস্থ্যবান এক জোয়ান মর্দ এসে দাঁড়াল। শুধু চেহারা নয়– সেই চেহারায় চটকদার গোঁফও রয়েছে। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে দিলাওয়ার খানের গোঁফের চাইতে কিছু কম হলেও সে গোঁফের বাহার রয়েছে। চোখে চোখ পড়তেই দুজনেই দুজনকে বিস্মিত হয়ে দেখতে লাগল। লোকটা এমনভাবে দিলাওয়ার খানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, যেন এই শহরে এই প্রথম একটা মর্দের মতো মর্দের সন্ধান পেয়েছে। হিজড়ের শহরে এমন একটা মর্দকে পেয়ে দিলাওয়ার খান মনে মনে খুশিই হচ্ছিল; কিন্তু পরক্ষণেই একটা জিনিস লক্ষ করে সে হুঁশিয়ার হয়ে উঠল। মনে হতে লাগল, লোকটা কেবল তাকিয়ে নেই– থাকবে কেন। লোকটা মাঝে মাঝে ডান চোখ বন্ধ করে বাঁ চোখ দিয়ে গুলি ছুড়ছে আর গোঁফের ডগায় থেকে তা দিচ্ছে। দিলাওয়ার খান স্পষ্ট বুঝে ফেলল, লোকটার গোলমাল করার ইচ্ছা রয়েছে।
নতুন শহরে এসে সে একটা অপ্রীতিকর ঘটনার কারণ হতে চায়নি। কিন্তু কেউ তার বাহাদুরিকে টিটকারি দেবে, তাই-বা সে সহ্য করে কেমন করে। সুতরাং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সে নিজেকে যে-কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য প্রস্তুত করে নিল। চ্যালেঞ্জের জবাব চ্যালেঞ্জ। সে-ও আগুন ছুঁড়ে মারতে লাগল, তার চোখ দিয়ে।
চোখের ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই লোকটা দিলাওয়ার খানের দিকে আস্তে আস্তে অগ্রসর হতে লাগল। দিলাওয়ার খান পরিষ্কার দেখল, পালনের পকেটে হাত দিয়ে লোকটা কী একটা খুঁজছে।
ধারালো জিনিস দিলাওয়ার খানের কাছেও রয়েছে। চট করে সে-ও গোপন জায়গায় রক্ষিত ছুরিতে স্পর্শ গ্রহণ করে নিশ্চিন্ত হল। কিন্তু সাব্যস্ত করল, কিছুতেই সে আগে আক্রমণ করবে না।
ওদিকে লোকটা আরও কয়েক পা দিলাওয়ার খানের দিকে এগিয়ে এসেছে। সুতরাং, দিলাওয়ার খান আরও খানিকটা সতর্ক হয়ে শক্তভাবে দাঁড়াল। দেখে মনে হতে লাগল যেন দুই ষাঁড় পরস্পর মুখোমুখি হয়েছে লড়াইয়ের জন্য। দূরত্ব ক্রমেই কমতে লাগল। তারপর, অল্পক্ষণের মধ্যেই লোকটা দিলাওয়ার খানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাতটা তখনো পকেটেই। সেই হাত ছুরিসহ কখন পকেট থেকে বের হয়, তার জন্য দিলাওয়ার খান সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কিছুতেই সে আগে আক্রমণ করবে না। এটা তার নিজের শহর নয়। ভিন জায়গায় এসে কিছুতেই সে কলঙ্কিত হতে চায় না।
কিন্তু কী আশ্চর্য, লোকটার হাত তো কই নড়ল না। তার বদলে নড়ল কেবল ঠোঁট দুটো। সেই ঠোঁট দিলাওয়ার খানের একেবারে কানের কাছে নিয়ে এসে লোকটা জিগ্যেস করল মোলায়েম করে, ‘খান সাহেব, মাল-টাল লাগবে?’
‘আখো! কিসের মাল! কেমন মাল।’ কিছুতেই বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করল দিলাওয়ার। ‘খান সাহেব, যেমন বলবেন, তেমনি মাল। একেবারে টাটকা মাল। কাশ্মিরি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, হিন্দুস্তানি, বাঙালি, পাঠান মাল, পাহাড়ি মাল। একেবারে বেড়ে খাসা মাল।’
দিলওয়ার খানের মনে হল, গোটা একটা বিরাট পাহাড় যেন দেখতে দেখতে ব্যাঙে পরিণত হয়ে গেল। রাগে তার সর্বশরীর কাঁপতে লাগল থরথর করে। সারা শরীরের শিরা-উপশিরা টানটান হল। একটা কথা না বলে সে রাস্তায় এপাশে-ওপাশে তাকাতে লাগল। অমনি চোখে পড়ল চুল-কাটা সেলুনটা। পাগলের মতো হয়ে লাফাতে লাফাতে সেখানে গিয়ে ঢুকে পড়ল। হাঁপাতে হাঁপাতে চেয়ারের উপর গিয়ে বসল। ভয়ে ভয়ে গোঁফের দিকে তাকাতে তাকাতে ক্ষৌরিক দাঁড়াল কাছে এসে। তারপর, সম্ভ্রমে প্রশ্ন করল, ‘বলুন, খানসাহেব, দাড়ি কাটবেন?’
‘আখো! দাড়ি চলে গেছে জাহান্নাম। তুমি আগে আমার গোঁফ মুড়িয়ে দাও। এদিকে শালার কেবল খেমটাউলির ভেড়ুয়ারাই গোঁফ রাখে।’
ক্ষৌরিক ক্ষুর চালাবার আগেই দিলাওয়ার খানের দুচোখ বেয়ে দরদর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু বহু কষ্টে সে সংবরণ করে নিল তার বুক-ভাঙা কান্নার জোয়ার।
মৌন – শফিকুর রহমান
বছরের শেষ দিন। শেষ দিনের শেষ রাত।
ফ্রন্ট থেকে কয়েক শো মাইল দূরে কোনো এক হোটেলে আমরা নাচ দেখছি। আমি, ডন আর নিক। আমরা এই তিনজন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। হোটেলের এক কোনার এই টেবিলটা সবসময় ব্যবহার করি আমরা। এই টেবিল আমাদের পছন্দ, আমাদের খুবই প্রিয়।
চারটা চেয়ারের তিনটায় আমরা বসেছি। একটা খালি পড়ে রয়েছে। ওটা জিফের। জিফ ফ্রন্ট থেকে ফিরে আসেনি। জিফের জাহাজ নিখোঁজ রয়েছে। কিছুদিন আগে জিফকেও নিখোঁজ ঘোষণা করা হয়েছে।
মাত্র কয়েক বছর হল গড়ে উঠেছে আমাদের বন্ধুত্ব। কিন্তু এ বন্ধুত্ব সুদৃঢ়। যুদ্ধের ভয়াবহতা দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ দিয়েছে ঘুচিয়ে। জিফ এখন আমাদের সঙ্গে নেই; কিন্তু আমরা এই চারজন যেন এক সত্তা।
নিউজিল্যান্ডের ডন, ক্যানাডার নিক, আমেরিকার জিফ আর আমি একসঙ্গে চলাফেরা করি, একসঙ্গে খাই এবং যথাসম্ভব একসঙ্গে ছুটি নেওয়ারও চেষ্টা করি। ছুটি পেলেই আমরা এই হোটেলে এসে উঠি। এখানকার নাচ উপভোগ করার জন্য এই নির্দিষ্ট টেবিলটায় বসি। এবারেও বড়দিনের ছুটি পেয়ে আমরা এখানে চলে এসেছি। আর, পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করব বলে এখানে এসে জুটেছি। আমরা সবাই এসেছি, কেবল জিফ আমাদের সঙ্গে নেই।
জিফ আমাদের সঙ্গে নেই। এমন দিনে তার অনুপস্থিতি আমাদের মনে বড় বাজছে। এখানে এসেই নিকের কাছে জিফের খবরটা প্রথম শুনলাম। আমি তার জন্য আমার বরাদ্দ চকোলেট সঞ্চয় করে রেখেছিলাম। সেই চকোলেট আমি সঙ্গে এনেছি। কিন্তু জিফ নেই। জিফ চকোলেট খেতে খুব ভালোবাসে।
বছরের শেষ রাত। একই রাত্রে একটা বছর শেষ হয়ে অন্য বছর শুরু হবে। হোটেল সেই জন্য বিশেষভাবে আলোকসজ্জিত। এত আলো যে, দিন না রাত, বুঝবার উপায় নেই। ইতালীয় বালা মাইক্রোফোনে গান গাচ্ছে। অর্কেস্ট্রায় সুরের ঝঙ্কার। গান শেষ হলে একে একে দেশ-বিদেশের নাচিয়ে মেয়েরা নাচ দেখাচ্ছে। কখনো একা। কখনো একসঙ্গে অনেকে। এত আলো, এত আনন্দ, এত উল্লাস– অল্পক্ষণের জন্য হলেও মানুষ সব দুঃখ-বেদনা নিঃশেষে ভুলে যায়। আজকের গানের সুর ভিন্নতর। আজকের নাচের ছন্দ অনেক বেশি প্রাণ-উচ্ছল।
আজকে নাচ-ঘরে যারা এসেছে, তাদের বেশির ভাগই আমাদের মতো সৈনিক।
ডন বলল, ‘আমাদের কাছে এমন একটা ছবি নেই, যাতে একসঙ্গে আমরা চারজন রয়েছি। কোনোটাতে দুজন, কোনোটাতে তিনজন। জিফকে নিয়ে আমাদের চারজনের একটা গ্রুপ-ফোটো তুলে রাখা উচিত ছিল।’
নিক বলল, ‘আমার মন বলছে, জিফ মরেনি। জিফ বেঁচে থাকার জন্যেই এ দুনিয়াতে এসেছে। জিফ মরবার মতো ছেলে নয়। আমার মন বলছে, জিফ আবার আসবে।’
তারপর, জিফকে নিয়ে আমাদের আলোচনা অনেক দূর গড়িয়ে গেল। এক-এক সময় মনে হতে লাগল, জিফ যেন আমাদের মধ্যেই বসে রয়েছে। তার হাসবার, হাসবার কায়দা, তার কথা বলবার ঢং, তার বাঁধ-ভাঙা প্রাণের জোয়ার, তার নাক-চোখ-মুখ, তার দুর্বার সাহসের কথা– সবই একে একে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ছায়াছবির মতো ভেসে যেতে লাগল।
ডন বলল, ‘জিফকে আমি কোনোবারই কিছু দিতে পারলাম না। একবার দোকানে একটা দামি ঘড়ি দেখে তার খুব লোভ হয়েছিল। কিন্তু তার কাছে অত টাকা নেই। আমার কাছে সে টাকা চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, এত দামি ঘড়ি কেনার কোনো মানে হয় না। আমি তাকে টাকা দিইনি। আজকে আমার মনটা কেমন খচ্খচ্ করছে। আজকে যদি সে এখানে থাকত, ঘড়িটা কিনে আমি তাকে দিয়ে দিতাম বড়দিনের উপহার হিসেবে।’
নিক বলল, ‘জিফের মতো বন্ধু হয় না। কতবার রুষ্ট হয়েছি, কতবার গালাগালি দিয়েছি, কতবার এমন হয়েছে যে, মাসের পর মাস চিঠি লিখিনি, কিন্তু জিফ কখনো তা মনে রাখেনি। দেখা হলেই তেমনি উদার হাসি দিয়ে সে আপায়ন করেছে।– এমনি দিনে কোথাও বসে বসে জিফও হয়তো আমাদের কথা ভাবছে।’
হোটেলের প্রৌঢ় ইংরেজ মালিক আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। আমাদের কুশল জানতে চাইলেন। কিছুক্ষণ কথা বললেন আমাদের সঙ্গে। তারপর, আমাদের টেবিলে বয়কে ডেকে দিয়ে চলে গেলেন।
জাজ্ বাজতে শুরু করেছে। জোড়ায় জোড়ায় নারী-পুরুষ নাচতে আরম্ভ করল।
নিক তার নিজের ইউনিটের কথা শোনাতে লাগল। তাদের ফ্রন্টে প্রত্যেকদিন বোমা পড়েছে। তাদের ইউনিটের একজন অসীম সাহসী তরুণের কথা সে শোনাল। বলল, আমি অমন সাহসী সৈনিক দেখিনি। সবসময় সবার আগে সে। চতুর্দিক থেকে গুলি আসছে, তারই মাঝখান দিয়ে তাকে আমি নিরাপদে বেরিয়ে আসতে দেখেছি। আমি তাকে এমন জায়গায় একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি, সেখানে তার চারপাশে বোমা পড়ছে। সব অবস্থাতে সবসময় তার মুখে হাসিটুকু লেগেই রয়েছে। আমি কোনো সময় তাকে হাসি-ছাড়া পাইনি। তার সম্বন্ধে আমার মনে বদ্ধমূল ধারণা, এই যুদ্ধে কোনো অস্ত্রের আঘাতই তাকে কাবু করতে পারবে না। আমি নিজেকেও তার সঙ্গে থাকলে নিরাপদ মনে করেছি। তার সাহস আমাকেও সাহসী করে তুলেছে। একদিন আমাদের ইউনিটের একটা অংশের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ হয়েছিল। শুনলাম, এই আক্রমণে আমাদের খুব ক্ষতি হয়েছে। দেখতে গেলাম। মৃতদেহ শনাক্ত হচ্ছিল। সেই লাশের স্তূপের মধ্যে আমি তাকে দেখলাম। দেখেও আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। সে মরে গেছে। কিন্তু তার ঠোঁটের কোনায় তেমনি হাসি– অনির্বাণ। মরা মানুষের হাসি আমি জীবনে কোনোদিনও ভুলতে পারব না।’
‘আর একটা জিনিস কখনো লক্ষ করেছ?’ ডন বলল, ‘যখন চারিদিকে বোমা ফাটে কিংবা মুষলধারে গুলি বর্ষে, তখন সারা শরীরে একরকমের উত্তাপ এসে যায়, সমস্ত ভয় মন থেকে দূরে চলে যায়। কিন্তু প্রচণ্ড ভয় লাগে তখন, যখন চারিদিকে ছড়িয়ে থাকে স্তব্ধতা, নীরবতা, মৌনতা, যখন এক দফা ঝড় উঠে থেমে গেছে আর দ্বিতীয় দফা ঝড়ের জন্যে অপেক্ষা করছি। এই স্তব্ধতা কেন এত ভয়াবহ, বলতে পার? বলতে পার, এর এক-একটি মুহূর্ত কেন এক-একটা যুগ বলে মনে হয়?’
হোটেলের মালিক আবার এলেন। এসে বললেন, ‘ছেলেরা, তোমরা এত বিষণ্ণ কেন? আজকের রাত্রে দুঃখ করতে নেই। সবাই নাচছে, আর তোমরা বসে রয়েছ। ওই যে তিনটি মেয়ে, অনেকক্ষণ থেকে একাকী বসে বসে সঙ্গী খুঁজছে। আমি ডেকে দিই?’
হোটেলের মালিক দিল-দরিয়া মানুষ। অনুমতির অপেক্ষা না করেই তিনি চলে গেলেন মেয়েদের ডাকতে।
আমার সঙ্গে যে মেয়েটি নাচল, তার চুল লাল, চোখ লাল, ঠোঁট লাল। দীর্ঘ, লীলায়িত দেহ। সুন্দরী। যৌবনবতী। তার লাল চুল এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত। মুখে মদের গন্ধ। চোখে প্রেমের নেশা টইটম্বুর।
বলল, ‘তুমি যেন বোবা, কথা বলছ না কেন?
কথা বললাম।
আবার বলল, ‘তুমি যেন নিস্তেজ, অত আস্তে আস্তে নাছে কেন?’
জোরে জোরে নাচলাম।
বলল, ‘উফ্, তোমার হাত কী ঠাণ্ডা। চল মদ খেয়ে আসি।’
গেলাম। মেয়েটি মদ খেল। আমি খেলাম না। অনেক পীড়াপীড়ি করল। জানতে
চাইল, কেন খাব না। বললাম এখনো ধরিনি। যখন ধরব তখন থেকে খাওয়া যাবে। তখন আমার ভাগটুকুও নিজেই খেয়ে ফেলল।
এমনি করে কয়েক দফা মেয়েটি আমার সঙ্গে নাচল। প্রতি দফা নাচ শেষ হলে আমাকে নিয়ে মদ খেতে গেল। প্রতি দফা সে আমাকে খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করল। প্রতি দফা আমার ভাগটুকুও নিজেই খেয়ে ফেলল সে।
তারপর, মেয়েটি যখন আর নাচতে পারছিল না, যখন তার পা আর মন আর আদৌ তার বশে নেই, তখন তার কামরায় রেখে আসতে সে আমাকে অনুরোধ করল। সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় তার পা খুব বেশিরকম টলতে লাগল। তখন বলল, ‘আমাকে ধরছ না কেন। আমি যদি পড়ে যাই। তোমাকে আমি সঙ্গে আনলাম তাহলে কী জন্যে।’
আমি তার হাত চেপে ধরলাম। ধরে ধরে উপরে নিয়ে গেলাম।
বলল, ‘তুমি অত ভয়ে ভয়ে আমাকে ধরেছ কেন। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেও আমি কিছুই মনে করব না।
দরজার কাছে পৌঁছে দিয়ে বললাম, ‘আমি তাহলে যাই। এখন তো আর তোমার কোনো অসুবিধে হবে না।’
মেয়েটি দরজার চাবি আমার হাতে দিল। বলল, ‘তোমার কালো চুল আর কালো চোখ আমার খুব ভালো লাগছে। আর তোমার এই ধর্মপরায়ণতা তোমার প্রতি আমার মনকে টেনে নিয়েছে। আমার মন চাইছে তুমি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধর। একজন ভদ্রমহিলার অনুরোধ তুমি রাখবে না?– দরজা খোলো।’
দরজা খুললাম।
বলল, ‘আমাকে খারাপ ভেবো না। তোমাকে আমার ভালো লাগছে, তার মধ্যে কোনো পাপ খুঁজো না। তোমাকে আমার আরও ভালো লাগবে যদি তোমার প্রথম মদের গ্লাস তুমি আমার মুখ থেকে নিয়ে খাও। এস, একটু বস। এই যে আলমারিতে মদের বোতল। এই ফ্লাস্কে বরফ। এস, আমার কাছে একটুখানি বস।’
মেয়েটির আঙুলের আংটির প্রতি আমি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম।
বলল, ‘হ্যাঁ, আমি বাগদত্তা। শিগগিরই আমাদের বিয়ে হবে। আমার বর অন্য মহাদেশে এখন যুদ্ধ করছে। কিন্তু আমরা এই দূরত্বকে দূরত্ব মনে করি না। আমরা ঘন-ঘন চিঠি লিখি। তার ছবি আমার বুকের উপর ঝুলছে। এই দেখ।’
সে আমাকে লকেট বের করে দেখাল। তাতে তার বরের ছোট একটি ছবি। ভারি সুন্দর, সুপুরুষ।
বলল, ‘ওকে আমি খুব ভালোবাসি।’
মেয়েটির ভালোবাসার জয় কামনা করে বললাম, দূর বিদেশে হয়তো কোনো জঙ্গলে বসে এখন সে তোমার কথাই ভাবছে।’
‘হয়তো ভাবছে। যদি ভাববার সময় পায়, তাহলে নিশ্চয় ভাবছে। আর, বড়দিনের ছুটি পেয়ে থাকলে এমনি একটা হোটেলে ঢুকে এমনি আমার মতো প্রচুর মদ খাচ্ছে। হয়তো কোনো মেয়ের কোলে মাথা রেখে পকেট থেকে আমার ছবি বের করে তাকে দেখাচ্ছে। আর বলছে, সে আমাকে খুব ভালোবাসে।’
শুভরাত্রি জানিয়ে আবার বললাম, ‘তোমাদের ভালোবাসা অক্ষয় হোক।’
বলল, ‘না, না। তুমি এখনি যেও না। একটু বস। তোমার কালো চুল আর কালো চোখ আমার খুব ভালো লাগছে। আমার মন চাইছে, তুমি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধর। একজন ভদ্রমহিলা যদি কিছুক্ষণের জন্যে তোমার সঙ্গ চায়, তুমি তার অনুরোধ রাখবে না?’
আমরা তিনজন একত্র হয়ে আবার সেই টেবিলে গিয়ে বসলাম।
ডন সিগারেট ধরাল। একই দিয়াশলাইয়ের আগুনে দ্বিতীয় সিগারেট জ্বালিয়ে সে আগুন নিভিয়ে দিল। এটা তার চিরাচরিত অভ্যাস। তৃতীয় সিগারেটের জন্য সে আরও একটা দিয়াশলাই জ্বালল। ডনের এই স্বভাবকে নিক বলে বোকামি। ডন বলে, এক আগুনে তিনটা সিগারেট ধরানো অশুভ।
সে বলে, আগের বারের যুদ্ধের নাকি ঘটনা এটা। ফ্রন্টে রাত্রির অন্ধকারে তিন সৈনিক সিগারেট ধরাচ্ছিল। প্রথম সিগারেট ধরানোর সময় শত্রু-পক্ষ দূর থেকে আগুন দেখে হুঁশিয়ার হয়ে গেল। দ্বিতীয় সিগারেট ধরানোর সময় তারা তাক্ করল। তৃতীয় সিগারেট ধরানোর সময় তারা গুলি ছুড়ল। এক বন্ধু মারা গেল সেই গুলিতে।
ইতালীয় বালা মাইক্রোফোনে আবার গান গাইছে। গান শেষ হলে নাচ শুরু হচ্ছে। কখনো একসঙ্গে অনেক মেয়ে। কখনো একটা মেয়ে একা নাচছে।
ডন ইঙ্গিতে দেখাল, এক পাশ থাকে পর্দা একটুখানি ফাঁক করে হোটেলের বাবুর্চিখানার একটা কর্মচারী লুকিয়ে লুকিয়ে নাচ দেখছে।
আমরা দেখলাম, দূরে একটা টেবিলে এক বৃদ্ধ অনেক মদ খেয়ে এখন টেবিল পিটিয়ে পিটিয়ে বেতালা সুরে গান গাইছে।
সব টেবিলেই মদ, আনন্দ, উল্লাস। যেন পরাজয় না মানার একটা নকল চেষ্টা। যেন এই সাময়িক কোলাহল দিয়েই শাশ্বত বেদনাকে ঢেকে রাখা যাবে। দুঃখ-ভারাক্রান্ত, পর্যুদস্ত মূল্যবোধের ভারবাহী এই মানুষেরা কেন এত হাস্যাস্পদ হতে চায় নিজেদেরই কাছে। কী কঠিন যাত্রায় রওনা হয়েছে তারা। কী দুর্গম তাদের পথ। কী দুর্লক্ষ্য তাদের মঞ্জিল। কী নিষ্ঠুর তাদের ভাগ্যের লিখন।
নিক বলল, ‘ডন, তুমিই না একবার বলেছিলে, জীবন হচ্ছে একটা মহাশূন্য। এই মহাশূন্যকে কে কতখানি আনন্দ দিয়ে, গান দিয়ে, হাসি দিয়ে ভরে রাখতে পারে, তারই ওপর নির্ভর করছে তার জীবনের সার্থকতা। তুমি বলেছিলে, মৃত্যু জীবনের মতো সত্য। বীমা কোম্পানির দালাল মৃত্যু দিয়ে তার ব্যবসায়ী কথার সূচনা করে। আর, আমরা করি জীবনকে হাওয়ার সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে। আমরা যখন বেঁচে থাকি, মৃত্যুর কথা ভাবি না। আমরা যখন মরে যাই, তখন জীবনের কথা আমাদের মনে থাকে না।’
ডন শূন্য দৃষ্টি সদর দরজার পানে মেলে ধরে বলল, ‘হ্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু আমি জানি না, কেন আমি সৈনিক হয়েছি। আমি এত ভাবপ্রবণ, সৈনিক হওয়া আমার উচিত হয়নি।’
সদর দরজার পর্দা নড়ল। প্রবেশ করল একটা নিগ্রো সৈনিক। কিছুক্ষণ সে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হলটাকে দেখে নিল। তারপর, এককোনায় একলা বসল। বসেই মদ আনিয়ে কয়েক চুমুকে অর্ধেক বোতল খালি করে দিল।
জিফের শূন্য চেয়ারটার ওপর ডনের দৃষ্টি গেল। বলল, নিগ্রোটাকে এখানে এনে বসালে কেমন হয়।
এ প্রস্তাবে কেউ আপত্তি করল না। নিগ্রো সৈনিক জিফের চেয়ারে বসে নিজের পরিচয় দিল, ‘আমার নাম ডার্লিং।’
ডন বলল, ‘বাহ্, চমৎকার নাম তো! মেয়েপুরুষ নির্বিশেষে সবাই তাহলে আপনাকে ‘ডার্লিং’ বলেই ডাকে?’
‘না, তা ডাকবে কেন। মেয়েরা সাধারণত ‘মিস্টার ডার্লিং’ বলে ডাকে। আর, একান্ত আপনজন হলে ‘মিস্টার’ যোগ না করে আমার নামটাকে দুবার উচ্চারণ করে দেয়, ব্যস্। তবে অনেকে ‘ডার্কি’ বলেও ডাকে। তাতে আমি অপরাধ নিই না। গায়ের রংটা তো আর আমার নিজের দেওয়া নয়।’
ডার্লিং জানাল, আজ সন্ধ্যায় তার জাহাজ এখানে ভিড়েছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ছুটি পেয়েছে সে। কাল সকালে আবার ফ্রন্টে চলে যাবে।
বলতে বলতে প্রথম বোতল শেষ করে দ্বিতীয় বোতল আনিয়ে নিল। আমাদেরও খাওয়াতে চাইল। কিন্তু আমরা আপত্তি জানালে কয়েক চুমুকে অর্ধেক বোতল শেষ করে গল্প জুড়ে দিল ডার্লিং।
মাত্র কয়েক বছর হল সে বাহিনীতে ঢুকেছে। এই কয়েক বছরেই দুনিয়ার সমস্ত ছোট-বড় দেশ, বিখ্যাত শহর তার দেখা হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম ভালোই লাগত। নতুন নতুন মহাদেশ, নতুন নতুন শহর, নতুন নতুন মানুষ। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই সাধ পূর্ণ হয়ে গেল। সারা দুনিয়া ঘুরে ডার্লিং দেখতে পেল মাত্র চারটা জিনিস : সমুদ্র, পাহাড়, জঙ্গল আর মাঠ। যেখানেই যাও, ঘুরে-ফিরে সেই একই জিনিস। কোনো শহর একটা থেকে অন্যটা ভিন্ন বলে মনে হয় না। একইরকম রাস্তা, রাস্তায় একইরকম মোটরগাড়ি, গাড়িতে একইরকম মানুষ। সব শহরেই পার্কে, চৌরাস্তায় মরে-যাওয়া মানুষের মূর্তি। সব শহরে একইকরম হোটেল, হোটেলে একইরকম মেয়েলোক, সব মেয়েলোক একই ভাষায় প্রেমনিবেদন করে। একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি দেখে দেখে ডার্লিং-এর মনে ঘেন্না ধরে গেছে। যুদ্ধ থামলেই সে দেশে চলে যাবে– একেবারে নিজের গ্রামে, যে-গ্রামকে আগে সে ঘৃণা করত, অবজ্ঞার চোখে দেখত, যে-গ্রাম থেকে একবার বেরুতে পারলে আর সে কখনো গ্রামে ফিরবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল। এখন সে নতুন করে শপথ নিয়েছে, এই গ্রামে ফিরে যাওয়ার আবার যদি কখনো সুযোগ আসে, তাহলে যতদিন বেঁচে থাকবে, কখনো সে আর গ্রাম ছাড়বে না।
তারপর, হঠাৎ সে প্রশ্ন করে বসল, ‘আমার সম্বন্ধে তোমাদের কিরকম ধারণা হল?’
বললাম, ‘আপনার সম্বন্ধে আমাদের খারাপ ধারণা হওয়ার কোনো হেতু নেই। আপনি চমৎকার লোক।
‘ভুল। সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি মিথ্যেবাদী। আমি কখনো সত্য কথা বলি না। আমি কাপুরুষ। আমি যুদ্ধকে ভয় করি। আমি যুদ্ধকে ভয় করি বলেই পালিয়ে যেতে চাই। গ্রামে ফিরে যেতে চাই।’
ডার্লিং ঘন-ঘন চুমুক দিয়ে বোতলটা শেষ করল। তারপর, আমাদের প্রতি সম্পূর্ণ অমনোযোগী হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। একটি মেয়েকে কাছে ডেকে তার সঙ্গে নাচতে চাইল। তারপর নাচতে চলে গেল ডার্লিং।
যখন ফিরল, হোটেলের প্রৌঢ় মালিক তার সঙ্গে ছিলেন। তিনি অন্য টেবিল থেকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আমাদের সঙ্গে বসলেন। ডার্লিং আরও একটা বোতল আনাল। মালিক বললেন, ‘ডার্লিং-এর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। আমার জ্যাককে ও চেনে। ওরা দুজন একই ইউনিটে একসঙ্গে যুদ্ধ করেছে। জ্যাক আমার একমাত্র সন্তান।’ তারপর ডার্লিংকে প্রশ্ন করলেন, ‘আমার ছেলে এখন কোথায়, কিছুই কি বলতে পার না?’
‘কয়েক মাস থেকে আমি ইউনিটের বাইরে।’
‘জ্যাক আমার একমাত্র ছেলে। কলেজে পড়তে পড়তেই যুদ্ধে চলে গেল। একেবারে ছেলেমানুষ। বাচ্চা। আপনভোলা! জ্যাকের মা আর আমি ওরই জন্যে এখনো বেঁচে রয়েছি। এখন আমার বিশ্রাম নেয়ার সময়। কিন্তু জ্যাকের জন্যেই এখনো খেটে চলেছি। আমি এখানে, আর ওর মা দেশে। দু-বছর আগে একবার সে সামরিক পোশাকে ফিরেছিল ছুটি পেয়ে। আমরা চিনতেই পারিনি। একেবারে জোয়ান হয়ে উঠেছে। কতটুকু ছিল আর এই এক বছরে কত বড়টা হয়েছে। কতরকম সান্ত্বনা-বাক্য দিয়ে সে তার মায়ের কান্না থামাল। বলল, মা, তুমি মোটেও চিন্তা কর না। তোমার দেওয়া বাইবেল আমার বুক-পকেটে সবসময় থাকে। অমন ভালো ছেলে আর হয় না। মা মেরি নিশ্চয় তাকে রক্ষা করবেন।…শেষ কবে তার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল, ডার্লিং?’
‘অনেক দিন আগে। দু-তিন মাস থেকে আমি ইউনিটের বাইরে।’
‘ছোট থেকেই জ্যাক ভারি বুদ্ধিমান, মেধাবী। আজ পর্যন্ত কখনো সে একগুঁয়েমি দেখায়নি, আমাদের সামনে কখনো কড়া কথা বলেনি। আমার কত কাজ সে করে দিয়েছে। সকালে উঠে তার হাসি-মাখা মুখখানি দেখলেই আমি সব দুঃখ ভুলে যেতাম। মনে হত, যেন আমি নতুন সূর্যের আলো দেখলাম। কতবার যে কত দুর্ঘটনা থেকে সে অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে। একবার মোটর সাইকেল থেকে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল। কিন্তু ওর কিছুই হল না। তার আগে একবার খুব ছোটবেলায় সমুদ্রের ধারে জ্যাক হারিয়ে গিয়েছিল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সারারাত তাকে পাওয়া যায়নি। রাত্রে খুব ঠাণ্ডা পড়েছিল আর ঝড় উঠেছিল। পরের দিন সকালবেলায় তাকে একদম ভালো অবস্থায় পাওয়া গেল। এমনি আরও একবার কঠিন একটা মোটর অ্যাক্সিডেন্ট থেকে সে বেঁচে গিয়েছিল। …গত বছর সে তার মা-কে চিঠি লিখেছে, অমুক তারিখ আমি উড়োজাহাজ হাঁকিয়ে তোমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাব। মায়ের সঙ্গে হয়তো এটা তার মশকরা। কিন্তু জ্যাকের মা বেচারি সারাদিন আকাশপানে চেয়ে থাকল। কত জাহাজ এল, গেল, কিন্তু কোনটা যে তার ছেলের জাহাজ, তা সে কিছুতেই ঠাওর করতে পারল না। জ্যাক লিখেছিল, শিগগিরই সে বাড়ি ফিরবে। তার ঘরটা যেন তৈরি রাখা হয়। বাড়ি ফিরে সে রোজ রাত্রে শোয়ার আগে মায়ের হাতের একগ্লাস করে গরম দুধ খাবে আর সকালে উঠে তুলোর তৈরি মোলায়েম স্লিপার পরবে। জ্যাকের মা প্রত্যেকদিন জ্যাকের ঘর সাজিয়ে রাখে। প্রত্যেক রাত্রে দুধ গরম করা থাকে। বিছানার কাছেই রেখে দেওয়া হয় জ্যাকের মোলায়েম স্লিপার। আমাদের পুরনো কুকুরটা মরে গেল। জ্যাকের মা কিছুতেই অন্য একটা কুকুর রাখবে না। বলবে, জ্যাক এলে নতুন কুকুর ওকে বাইরের লোক ভেবে চিৎকার জুড়ে দেবে। জ্যাকের মা বেশিক্ষণের জন্যে বাইরে পর্যন্ত যায় না, পাছে জ্যাককে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।…
ডার্লিং ঘন-ঘন ঘড়ি দেখছিল। ওর বোধহয় ছুটির মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। পকেট থেকে টাকা বের করে বিলের দিকে সে তাকাল।
হোটেলের মালিক বললেন, ‘তুমি জ্যাকের বন্ধু। তুমি তাই আজ আমার অতিথি। তোমার কাছ থেকে আমি টাকা নিতে পারব না। জ্যাকের সঙ্গে দেখা হলে তাকে আমাদের নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিও।’ তিনি চলে গেলেন।
ডার্লিং বলল, ‘দেখেছ, কেমন মিথ্যে বললাম, সারাজীবন আমাকে এমনি মিথ্যে বলে যেতে হবে।’
ডন জিগ্যেস করল, ‘কেন, কেন, কী হয়েছে?’
‘জ্যাক কিছুদিন আগে মারা গেছে। আমরা একসঙ্গেই ছিলাম। গুলি ওর হৃৎপিণ্ড ভেদ করে গেছে। ওর বুক-পকেটে রাখা বাইবেল সুদ্ধ ছ্যাঁদা হয়ে গেছে।’ আর একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ডার্লিং চলে গেল।
পুরনো বছর শেষ হয়ে নতুন বছর শুরু হওয়ার মুহূর্তটি এসে গেল। হৈচৈ পড়ে গেল সারা হল-ঘরে। উন্মাদনা-সৃষ্টিকারী নাচে-গানে-বাজনায় সারা পরিবেশ মুখরিত হয়ে উঠল। নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে লাগল সবাই।
নতুন বছরের মুহূর্তগুলো একে একে কাটতে লাগল। নেশায় ঢুলু-ঢুলু চোখ, টলমল পা– দাঁড়িয়ে থাকার সাধ্য নেই অনেকের। তারা কোনোরকমে টেবিলে বসে ঝিমোচ্ছে। তাদের এক-একটি আচরণ হাস্যকর। আর, সেই হাস্যকর আচরণ দেখে সবাই ঠাট্টা- মশকরায় মেতে উঠেছে। হাততালি দিচ্ছে। পরামর্শ দিচ্ছে আরও এক বোতল মদ খাওয়ার। হঠাৎ একটা টেবিলের দিকে অনেকে অঙ্গুলি-সঙ্কেত করল। সেখানকার তামাশাটা আরও মজার। এত বেশি টেনেছে যে, সব কাণ্ডজ্ঞানই লোপ পেয়েছে লোকটার।
তার প্রতিটি আচরণে সারা হল-ঘর হাসির পটকা ফুটতে লাগল।
লোকটা কফি খাওয়ার চেষ্টা করছে। পরম নিশ্চিন্তে চামচ দিয়ে চিনি তুলে দুধের পটে ঢেলে দিচ্ছে। খালি কাপটা তুলে নিয়ে দুধ ঢালার কায়দায় দুধের পটে উপুড় করছে। চামচ দিয়ে দুধের পট নাড়া দিচ্ছে। তাই দেখে কেউ হাসলে চামচ তুলে নিয়ে টেবিলের উপর রাখছে।
কিছুক্ষণ থেকে আবার দুই চামচ দুধ নিয়ে গ্লাসে দিচ্ছে। সেই গ্লাসে খানিক কফি ঢেলে চামচ খুঁজছে। সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিয়ে উঠছে দর্শকমণ্ডলী। কিছুক্ষণ থেমে লোকটা আবার শুরু করছে। সমস্ত কফি টেবিলের উপর ঢেলে দিচ্ছে। হাসির অট্টরোল উঠলে তাড়াতাড়ি রুমাল বের করে টেবিল মুছবার চেষ্টা করছে।
হঠাৎ লোকটা উঠে দাঁড়াল। শূন্যদৃষ্টি মেলে এদিক-ওদিক চাইল। হৈচৈ একদম থেমে গেল।
লোকটা বলতে শুরু করল, ‘ভাই আমার, বন্ধু আমার, আমাকে মাফ করে দাও… আমি অন্ধ। আমি কিছুই দেখতে পাই না। বোমার টুকরো এসে আমার চোখে লেগেছিল। আমি অন্ধ হয়ে গেছি। আমি কিচ্ছু দেখতে পাই না। নইলে আমি কখনো এমন করতাম না। আমাকে মাফ করে দাও, ভাই আমার… বন্ধু আমার…’
পাশের ঘর থেকে একটা লোক এসে ওর হাত ধরল। ধরে ধরে বাইরে নিয়ে গেল। অর্কেস্ট্রায় আর সুর উঠছে না। নাচের পা আর একটুও নড়ল না। মশকরায় মত্ত লোকগুলোর মুখ হাঁ হয়ে রয়ে গেল। কারও মুখে কোনো কথা ফুটল না।
বহুক্ষণ যাবৎ গোলাগুলি চলার পর হঠাৎ তা থেমে গেলে যেমন হয়, তেমনি নিস্তব্ধতা– ভয়াবহ নিস্তব্ধতা যেন সবাইকে গ্রাস করে ফেলেছে।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
সাহেব গোলাম – রাজিয়া ফসিহ্ আহমদ
নদিম যখন বাংলো ছেড়ে গাড়ির পানে রওনা হল, তখন তার আগে আগে গেল মাত্র একটা হোল্ডল আর একটা স্যুটকেস্। গাড়ির পেছনের সিটে কিছু বই-পুস্তক, পত্রিকা ছড়িয়ে রয়েছে। পুরো বাংলো তার পেছনে পড়ে থাকল খোলা অবস্থায়।
সাহেব কতদিন বাইরে থাকবেন, নানা কারণেই এ কথাটা জেনে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল বেয়ারা। কাজেই কত দূরে সাহেব যাচ্ছেন, তা অনুমান করার জন্য সে কায়দা করে প্রশ্ন করল, ‘সাব, যদি কোনো জরুরি খবর-টবর আসে, তাহলে কোথায় জানাতে হবে?’
‘কোথাও না।’ নদিমের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
চালাকিটা একেবারেই ভেস্তে যাচ্ছে দেখে বেয়ারা মরিয়া হয়ে প্রত্যক্ষভাবেই প্রশ্ন করে বসল, ‘কবে নাগাদ ফিরবেন, সাব?’
‘জানি না।’
‘তা এক মাস, দুমাস লাগতে পারে?’ বেয়ারার এ প্রশ্ন যেন সাহেবকে নয়- নিজেকেই করা।
নদিম কোনো উত্তর দিল না। বিরাট চাকর-বাহিনীর সালাম ঠোকা আরম্ভ হল। নদিম পকেট থেকে মনি-ব্যাগ বের করে একটা করে মুদ্রা তাদের হাতে হাতে ফেলে দিল। তারপর গাড়িতে এসে বসল, আর সঙ্গে সঙ্গে ভোঁ হয়ে গেল।
চাকররা উঁকি মেরে, ছাদে উঠে, রাস্তার মোড় পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে জানবার যথাসাধ্য চেষ্টা করল, সাহেবের গাড়ির গতি কোনদিকে। কিন্তু এর চাইতে বেশি কিছুই জানা গেল না যে, রাস্তাটা রাওয়ালপিণ্ডির দিকে গেছে; আর যে গাড়ি রাওয়ালপিণ্ডি গেল, সে গাড়ি ইচ্ছা করলে পেশাওয়ার পর্যন্তও যেতে পারে।
যাই হোক, সাহেবের চলে যাওয়াটা সুনিশ্চিত। কাজেই চাকররা সবাই একটা করে গভীর স্বস্তির শ্বাস ফেলল। তারপর, সবাই ড্রয়িং-রুমে এসে এলোপাথাড়ি হয়ে সোফার
উপর বসে পড়ল। তাদের এখনকার কর্তব্য, সাহেব কবে নাগাদ ফিরতে পারেন, তাই নিয়ে জরুরি সভায় মিলিত হওয়া।
প্রৌঢ় খানসামা প্রথমে শুরু করল, ‘সাব কয়টা কাপড় নিয়েছে?’ তার এই প্রশ্নের মধ্যে দার্শনিকতার স্পষ্ট আভাস।
‘বললেন, একটা স্যুটকেসে যয়টা কাপড় আঁটে, রেখে দে!’ উত্তর দিল বেয়ারা। ‘তবেই হয়েছে রে।’ ড্রাইভার তার নিজের অভিজ্ঞতার নির্যাস ব্যক্ত করে দিল, ‘মনে হচ্ছে, সায়েব এক হপ্তার মধ্যেই ফিরে আসছে।’
মসলা আর ধুলো-মাটি মাখা পা দুটো সোফার উপর তুলে দিল খানসামা। ড্রাইভারের মত সে সমর্থন করতে পারে না, এমনি একটা ভাব দেখিয়ে প্রশ্ন করল, ‘অন্যান্য বারে কয়টা কাপড় নিয়ে যান?’ তার এই প্রশ্নের অর্থ যেন এই যে, চট্ করে রায় না দিয়ে বরং আরও গবেষণা করা উচিত।
বেয়ারা বলল, ‘তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কেন, মনে পড়ছে না, সেবার এক কাপড়ে গিয়েছিল এক রাত থাকব বলে, তারপর দুই মাস কাটিয়ে এল? সঙ্গে বিছানা ছিল না, কিচ্ছু ছিল না।’
খানসামা আবার তেমনি ভারিক্কি একটা রায় ছাড়ল, ‘আজকাল টাকা থাকলে আর বিছানা লাগে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুমি যা হুকুম করবে, তাই পাবে। কী বলছ বিছানা আর কাপড়ের কথা! ছোঃ! টাকা থাকলে গোটা একটা বালাখানা পাওয়া যায় রেডিমেড বিবি সুদ্ধ।’
এ কথায় গাম্ভীর্যে খানিকটা আনন্দের আমেজ মিশ খেল। যে-যার রসবোধ অনুযায়ী হাসল। বেয়ারা বসে যোগদান দেওয়ার চেষ্টা করে বলল, ‘সেদিন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে শুনছিলাম, সায়েবের দোস্ত সায়েবকে বলছিল, এবারে যখন ফিরবে, একটা বিবি সঙ্গে নিয়ে ফিরো।
‘তাহলেই হয়েছে।’ খানসামা কৃত্রিম আতঙ্ক প্রকাশ করে বলল, ‘সায়েব সত্যি সত্যি যদি বিবি নিয়ে ফেরে, তাহলে বুঝে নিও, আমি আর নেই, বাবা। সব ঘরে তালা পড়বে বুঝেছ? কোর্মা-পোলাও আর খেতে হবে না– তখন কেবল বাইরে বাইরে হাওয়া খেয়ে বেড়িও। আমার একটা রেকট আছে, বুঝলে? যে-ঘরেই চাকরি করতে গিয়েছি, আগে বলেছি, আমি কিচেন আর প্যান্ট্রি দেখব, তারপর কথা। তারপর কোনো আলমারিতে তালা দেখলেই বলে দিয়েছি, কাল থেকে কাজ করতে আসছি। কিন্তু আর আসতে হয়নি। ব্যস্, খতম। বুঝলে?’
সামনে দূরে দাঁড়িয়ে বয় এতক্ষণ চুপ-চাপ শুনছিল। এবারে সে-ও তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে লাগল, ‘আর বল কেন! আমিও এক বেগম সায়েবের পাল্লায় পড়েছিলাম বটে। বেগম সায়েবের ছিল ইঁদুরের মতো ছোট মন। কোনোদিন যদি একটা টেডি পয়সা হাতে ধরে দিয়ে থাকে।
অনেকক্ষণ পরে ড্রাইভার আবার মুখ খুলল, ‘সায়েব বিয়ে করলে আমাকেও নতুন চাকরি খুঁজতে হবে। পার্ট-টাইম চাকরিটা তো আর থাকবে না।’
খানসামা মুরুব্বির চালে জবাব দিল, ‘মুফতের ড্রাইভারি করছ। সবসময় তো সায়েবই গাড়ি চালায়। আর, তুমি করে বেড়াও পার্ট-টাইম। বেগম সায়েব এলে তো আর সেটি চলবে না। এদিকে মিছামিছি পেট্রলের বিল, রিপিয়ার আর এই-সেই করে আরও খানিক কামিয়ে নিচ্ছ।’
‘কী করব বল। গরিব মানুষ, আর আটটা খানেওয়ালা। কিন্তু খানসামা ভাই, তুমিই-বা আর কম যাও কার চাইতে। গোটা ঘিয়ের টিন দু-দিনেই খতম। আর আস্ত আস্ত আটার বস্তা…।’
‘এখন থামাও এসব কথা। আমরা সবাই আল্লার দেওয়া রুজি কামাই করি আর খাই। অন্যের রুজি কি আর একজনে খেতে পারে!’ এই কথা বলে খানসামা এখন সোফার উপরে হাত-পা ছড়িয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর, হাঁক ছাড়ল, ‘বয়, তাড়াতাড়ি চা বানিয়ে আন্। আর, শোন, সেই সঙ্গে কিছু ঘিয়ে-ভাজা পুরি। বুঝলি? তাড়াতাড়ি।’ রীতিমতো সাহেবের অনুকরণ শুরু করে দিল খানসামা।
জমাদার এতক্ষণ মেঝের উপর বসে বসে এইসব শুনছিল। ঝাড়ুটাকে বালিশ বানিয়ে সে-ও লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল ফরাশের উপর।
বেয়ারা কোলের উপর একটা কুশন টেনে নিয়ে বলল, ‘আমার মাথায় একটা ভারি মজার খেয়াল এসেছে।
‘কী, কী! বল, বল!’ সবাই একসঙ্গে আগ্রহ প্রকাশ করল।
‘আমরা সবাই মিলে একটা পার্টি দিই, এস।’
‘পার্টি! ভোজের পার্টি নাকি?’ খানসামা বিস্ময় প্রকাশ করল, ‘তোমার তো সাহস কম নয় হে! তাহলে কেমন পার্টি, বল দেখি, বাপু, শুনি।’
‘হ্যাঁ দোস্ত, ভালোই খেলেছে তোমার মাথাখানা। হয়েই যাক একটা পার্টি।’ ড্রাইভার প্রথম সায় জানাল।
‘কিন্তু সায়েব না থাকলে তো আমাদের রোজই পার্টি চলে, ফুর্তি চলে। তাহলে আর নতুন ব্যাপারটা কী হতে যাচ্ছে?’
বেয়ারা বলল, ‘সেরকম নয়, খানসামা সায়েব। এ হবে স্পেশাল ডিনার-পার্টি। আমরা স্যুট পরব। অনেক মেহমান আসবে। টেবিল জুড়ে থাকবে কোর্মা, পোলাও, জর্দা। রেডিও বাজবে। বক্তিমে হবে।’ কিছুক্ষণ থেমে আবার সে বলল, ‘কিন্তু আমি ভাবছি, পার্টিটা মিক্স হবে, না সিঙ্গেল!’
‘সেটা আবার কী জিনিস?’
‘বুঝলে না? মানে, পার্টিতে শুধু সায়েবরাই থাকবেন না, বেগম সায়েবদেরও আনা হবে?’ ড্রাইভার বলল, ‘না ভাই, বেগম সায়েবদের সঙ্গে করে আনলে আবার নানা ঝামেলা বাধবে। পর্দা কর, এই কর, সেই কর। তার চাইতে আমরা, মানে শুধু সায়েবরাই ঠিক আছি।’
‘তাহলে তো দেখছি, সব ঝক্কি আমাকেই সামলাতে হবে।’ খানসামা আসল কথাটা পেড়ে বসল, ‘তা ঠিক আছে, তোমরা যখন বলছ, তখন করতে হবে বৈকি!’
‘কিন্তু খানসামা সায়েব, মনে থাকে যেন, গণ্যমান্য সব অতিথিরা আসবেন। ভালো খানা হওয়া চাই কিন্তু।’
‘সে আর তোমাকে বলতে হবে না। এমন খানাটাই খাওয়াব যে, জিন্দিগি-ভর মনে থাকবে।’
‘তাহলে একটা দিন-ক্ষণ ঠিক হয়ে যাক।’
‘কাল।’
‘বেশ, কাল রাত্রেই তাহলে হোক। ডিনারের দাওয়াত সব জায়গায় পৌঁছে দাও।’
‘আর শোনো, মেহমানরা সব হুড়দ্দুম যেন ডাইনিং-হলে ঢুকে না পড়ে। সবাই আগে ড্রেসিং-রুমে আসবে, ফিটফাট কাপড় পরবে। তারপর আবার বাইরে যাবে। বাইরে গিয়ে ওই সামনের দিক থেকে এসে ড্রয়িংরুমে ঢুকবে। ড্রয়িংরুম থেকে তারপর ডাইনিং-হল।’
‘আর হ্যাঁ, মালিবাবাকে ডাকো। ওকে বলে দাও, যেন চমৎকার করে কয়েকটা ফুলের তোড়া বানিয়ে রাখে।
এমন সময় বয় ট্রেতে করে চা নিয়ে এল। আর, গরম গরম পুরি ভাজা। বেয়ারা কোথাও থেকে ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেটের টিন নিয়ে এল বের করে। সবাইকে দিল একটা করে। বয় চা পরিবেশন করল। চায়ের পেয়ালায় আরও অনেকক্ষণ ধরে রাজনৈতিক এবং অন্যবিধ আলাপ-আলোচনা চলল। তারপর, সবাই একে একে যে-যার ঘরের দিকে চলে গেল। সাহেবই যখন নেই, তখন কাজেরও কোনো প্রশ্ন ওঠে না। বেয়ারা বয়কে দিয়ে চায়ের পেয়ালা ইত্যাদি সরাল। তারপর, ঘরে তালা লাগিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ল বাইরে।
.
পরদিন সকাল থেকেই ডিনার-পার্টির আয়োজন শুরু হয়ে গেল। আগেই ঠিক হয়েছিল যে, প্রত্যেকে একজন করে ঘনিষ্ঠ, নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য আত্মীয় বা বন্ধুকে দাওয়াত দিতে পারবে। সে এমন হবে, যেন পার্টির কথা একটা তার মুখ থেকে বাইরে না বেরোয়।
খানসামা মহাব্যস্ত। তার চাইতে ব্যস্ত করে রেখেছে সে বয়কে। তাকে সে বাঁদর-নাচ নাচাচ্ছে। বয় আবার খুব করে খাঁটিয়ে নিচ্ছে জমাদারকে। এরাই এখন এ বাড়ির সর্বেসর্বা।
ধোপাকে ডেকে এনে সব কাপড়ে ইস্তিরি করিয়ে নেওয়া হল। তারপর, ধোপাকেও দাওয়াত দেওয়া হল ডিনার খাওয়ার।
মালিবাবা সকাল থেকে ফুলের তোড়া তৈরি করছে নিবিষ্ট মনে
জমাদার সমস্ত ঘর-দোর ঝেড়ে-ঝুড়ে পরিষ্কার, ফিটফাট করে তুলল।
বয় একা পেরে উঠছে না বলে খানসামা আরও একজন অ্যাসিস্টেন্ট নিয়ে এল বাইরে থেকে। বয় আর নতুন অ্যাসিস্টেন্ট মেশিনের মতো কাজ করে যাচ্ছে। একের পর এক মুরগি জবাই করে ওরা দুজন দ্রুত হাত চালিয়ে সেই মুরগি ছাড়িয়ে চলেছে। নতুন অ্যাসিস্টেন্টকেও ডিনার পার্টির দাওয়াত দেওয়া হল।
সন্ধ্যায় মেহমানদের আগমন শুরু হওয়ার আগেই খাবার টেবিলে ধপধপে সাদা কাপড় বিছিয়ে তার উপর ডিনার সেট, চকচকে ছুরি-কাঁটা, সুন্দর করে সাজানো ফুলদানি সাজিয়ে রাখা হল। গ্লাসে গ্লাসে সাদা ন্যাপকিনের সারি লেগে গেল, যা দেখতে মনে হল সারিবদ্ধ বলাকার মতো।
টেবিলের পরিচর্যা শেষ হলে পর সবার আগে বেয়ারা কেতা-দুরস্ত পোশাকে সেজে নিল। সমস্ত মেহমানের জন্যও যার যার পদমর্যাদার দিকে খেয়াল রেখে ওয়ার্ড-রোব থেকে বের করে করে এগিয়ে দেওয়া হল স্যুট, জ্যাকেট, শেরওয়ানি, চুড়িদার ইত্যাদি। বেয়ারা নিজে পরল ডিনার স্যুট– সাদা শার্টের উপর ডিনার-জ্যাকেট, গলায় কালো বো, বুক-পকেটে বের করে রাখা সাদা রুমাল, পায়ে আলো-ঠিকরানো কালো জুতো আর বাটন-হোলে সুইট-পি ফুল গুঁজে যখন সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তখন নিজের কাছেই সে একটা লাটসাহেব বলে বোধ হতে লাগল। আর, তাই দেখে খানসামা মন্তব্য করল, ‘যা না, একবার মালিবাবার কাছে গিয়ে দাঁড়া। তোকে যদি সায়েব মনে করে একটা সালাম না ঠোকে, তো আমায় বলিস।’
সবার যখন মোটামুটি সাজাগোজা শেষ হয়েছে, তখন ড্রেসিং-রুমের জৌলুস দেখে খানসামা একেবারে আত্মহারা। কিন্তু সেই আত্মহারা অবস্থাতেও তার মাথায় একটা বুদ্ধি গজাল। ভাবল, এমন জৌলুস, ছবি তুলে ধরে না রাখলেই নয়। পার্টির শেষ হওয়ার পর সেই ছবি সবাইকে দেখিয়ে বেড়ানো যাবে। চিরকাল সে ছবি হয়ে থাকবে সারাজীবনের একটা মনোরম স্মৃতি। কাজেই খানসামা টেলিফোন করে ফোটোগ্রাফারকে আসার জন্য ডাকতে চলে গেল।
নিজের দৈনন্দিন কাজ শেষ করে মালিবাবাও এসে গেল তৈরি হতে। হাত-পায়ের কাদা ছাড়ানোর জন্য সে গোটা একটা খোশবুদার সাবান ঘষে ঘষে শেষ করল। তারপর গরম আর ঠাণ্ডা পানি মেশানো বাথটাবে শুয়ে থাকল কিছুক্ষণ। মালিবাবার দেরি হচ্ছে দেখে বেয়ারা যখন হাঁক ছাড়ল, তখন মানুষ-সমান লম্বা তোয়ালেতে সারা শরীর ঢেকে সে বাইরে বেরিয়ে এল। চুড়িদার পাজামা আর শেরওয়ানি পরল। মাথার উপর বাঁকা করে জিন্না-টুপি চাপাল। পায়ে দিল সলিম-শাহি পাদুকা। তারপর, আয়নার সামনে যখন দাঁড়াল, তখন তাকে মনে হতে লাগল স্বপ্নপুরীর রাজপুত্র বলে। তাই-না দেখে বেরিয়ে পড়ল তার বত্রিশ-পাটি দাঁত, আর সে দাঁত সারাসন্ধ্যা বেরিয়েই থাকল– কিছুতেই ভেতরে করা গেল না। বারবার শেরওয়ানিতে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে তার মসৃণতা অনুভব করতে লাগল। মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল সেই আল্লার দরবারে, যিনি তাকে একদিনের সুলতান করেছেন।
ড্রাইভার মাথায় একটা সাদা পাগড়ি জড়িয়ে নবাব সাজল।
বেয়ারা মাথায় দিয়েছে তার সাহেবের ফেল্ট হ্যাটটা।
বয় বেচারা সবচাইতে বেঁটে। কোনো কাপড়ই তার গায়ে ফিট্ করে না। যেটাই পরে, সেটাতেই হারিয়ে যায় সে। তখন সবার পরামর্শে তাকে পরানো হল একটা সিল্কের পাঞ্জাবি আর একটা সাদা লুঙ্গি। পাঞ্জাবির আস্তিন খানিকটা গুটিয়ে দেওয়া হল আর লুঙ্গি মাজায় খানিক জড়িয়ে দেওয়া হল তবে গিয়ে সে কিছুটা মানুষ-মানুষ বোধ হতে লাগল।
মুকিল হল জমাদারকে নিয়ে। স্যুট-কোট-হ্যাট তার পছন্দ নয়। শেরওয়ানিও সে পরবে না। তার চোখ সাহেবের স্লিপিং গাউনের দিকে। তার এই ইচ্ছায় বাধা দেওয়া কারো যুক্তিসঙ্গত মনে হল না। কিন্তু মালিবাবার পরামর্শে সেই গাউনের উপর সে আবার যোগ করল একটা নতুন ফ্যাশন। দেড়শো টাকা দামের নতুন শৌখিন কম্বলটা সে জড়িয়ে নিল গাউনের উপর
ডিনার-পার্টিতে বাইরের মেহমানরা তো মেহমানই; কিন্তু ভেতরের যারা, তারাও মেহমান বলে কেউ কাউকে খাবার পরিবেশন করবে না। সুতরাং, খাদ্য-সামগ্রী আগে থেকে টেবিলে সাজিয়ে রাখা হল।
পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে তারা সবাই বাইরে এল। ভেতরে থাকল কেবল বেয়ারা। তারপর, সামনের দরজায় একে একে বেলটিপে এমনভাবে তারা ভেতরে ঢুকল, যেমন ঢোকে যথার্থ মেহমানরা। বেয়ারা এগিয়ে এসে, করমর্দন করে তাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। পকেট থেকে ফাইভ ফিফটি ফাইভের টিন বের করে মেলে ধরল সামনে। কুশল-বিনিময় চলতে লাগল পরিমিত ভাষায়। ব্যাগ্রাউন্ডে রেকর্ড-প্লেয়ার থেকে বাজতে লাগল স্পেনীয় সংগীত।
ডিনার শুরু হয়ে গেল। বেয়ারা বিরাট একটা গামলায় করে গরম গরম সুপ এনে রাখল। যার যার পাত্রে ঢেলে নিয়ে কেউ ঢুঁ মেরে আর কেউ নুলো ডুবিয়ে খেয়ে ফেলল সেই সুপ।
জমাদারকে দেওয়া হল প্রথম খানা তুলবার সম্মান। তারপর, প্রত্যেকে যার যার পাতে খানা তুলে নিল। প্রথম গ্রাস খানা মুখে তুলবার সম্মানও আবার দেওয়া হল জমাদারকেই তখন জমাদার কাঁটা-চামচ টেবিলের মাঝখানে সরিয়ে রাখল। রেখে হাত দিয়েই অতি দ্রুত গোগ্রাসে গিলতে আরম্ভ করে দিল। বেয়ারা মনে করল এটাকে হাভাতেপনা বলে।
ডিনার-পার্টির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা উচিত নয় ভেবে অতি অল্প পরিমাণে প্লেটে খানা নিল সে। কোলের উপর ন্যাপকিন বিছিয়ে নিল, ঠিক যেমন ভদ্রলোকদের নেওয়া উচিত, তেমনি করে। তারপর ফিশ-ফ্রাই-এ ছুরি-কাঁটা চালাতে লাগল আস্তে করে। নির্ভুল কায়দায় সে ছুরি-কাঁটা ধরেছে। কিন্তু অনভ্যস্ততা হেতু মাঝে মাঝে পিছলে যাচ্ছে, আর পিছলে যাওয়ার জন্য মাছের টুকরো পড়ে যাচ্ছে নিচে।
বেয়ারার দেখাদেখি অন্য সবাইও কাঁটা-চামচ ধরল। কিন্তু তাদের কেউ কেউ এমনভাবে ধরল যে, ছুরি নিয়ে যেন শত্রুকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে। কাঁটার ঘায়ে কারও কারও জিবে লাগল খোঁচা। কেউ কেউ মাংসের টুকরো হাত দিয়ে ছিঁড়ে, চামচে রেখে বা কাঁটায় বিঁধিয়ে মুখে ঢোকাল। বলাকার ঝাঁক হয় গ্লাসেই রয়ে গেল, না হয় ছড়িয়ে পড়ল টেবিলের উপর। সারা ডাইনিং-হল জুড়ে বিরাজ করতে লাগল কাঁটা-চামচ-প্লেটের ছন্দহীন ধ্বনি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে চপ্চপ্, সুড়ুৎ-সাড়ুৎ ইত্যাদি শব্দ। সবাই গিলছে গোগ্রাসে, ব্যস্তসমস্ত হয়ে। কথা বলার কারো ফুরসত নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেকে বুঝল, কাঁটা-চামচের ঝকমারি ডিনারের সমস্ত স্বাদ নষ্ট করে ফেলছে। তখন তারা অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করে হাতের সদ্ব্যবহারে মনোযোগী হল। একমাত্র বেয়ারাই শেষ পর্যন্ত কৌলীন্য বজায় রাখল। এই কারণে তাকে বেশ খানিক অতৃপ্ত, অর্ধভুক্ত থাকতে হল।
একটা টানতে গিয়ে অন্যটায় ধাক্কা লেগে যাওয়ায় কিছু প্লাস, প্লেট নিচে পড়ে ভাঙল। অনেক দূরের জিনিস হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়ে জমাদারের কম্বলের কোনা ঝোলের স্বাদ টের পেল।
এইভাবে খাওয়া শেষ হলে ঢেকুর তোলার শব্দ উঠতে লাগল। স্পেনীয় সংগীতের সঙ্গে মিশে সেই শব্দ নতুন এক সুরের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে লাগল। গ্লাসের পানি খেতে গিয়ে ন্যাকিনগুলো টেবিলের তলায় চলে গেছে। কাজেই অনেকে টেবিলের চাদরেই হাত মুছে নিল। কেউ গেল বাথরুমে হাত ধুতে। বাদবাকি সবাই কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে কাজ সম্পন্ন করে নিল।
শেষে বয় চা পরিবেশন করল। সবাই ঠোঁটের কোণায় ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেট ঝোলাল। কেবল খানসামা তার পোশাকের গাম্ভীর্যের দিকে লক্ষ রেখে একটা চুরুট ধরাল।
এমন সময় বেয়ারা দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল, ‘এবার খানসামা সায়েব আমাদের ডিনার-পার্টির ওপর একটা বক্তিমে দেবেন।’
খানসামা চুরুটটা হাতে নিয়ে ঠিক বক্তার মতো পোজ্ করে দাঁড়াল। তারপর একটুও চিন্তা-ভাবনা না করে বলতে শুরু করে দিল, ‘ভাইসব, আমরা বহুত দিন পর আজকে গোলাম থেকে সায়েব হয়েছি। নিজেরাই যা-খুশি রান্না করেছি– নিজেদের হাতে যেমন-করে-খুশি খেয়েছি। আহা, ইংরেজ সায়েবদের কথা আজকে আমার মনে পড়ছে। তেনারা ছিল খাঁটি সায়েব। আজকে যেমন আপনারা সায়েব হয়ে খেয়েছ, ওই সময় আমরা প্রত্যেকদিন সায়েবি খানা খেয়েছি, ভাইসব। এক মাস, দু-মাস মাত্র পরে কোট- পালুন সায়েবরা অমনি দিয়ে দিয়েছেন। মেম-সায়েবরা মুড়ি-ভাজার মতো দুহাতে পয়সা বিলিয়েছে। ফাস্টো ক্লাস বিয়ারের বোতল আমরা সাবাড় করেছি। আয়াদের সঙ্গে কত ঠাট্টা-দিল্লাগি করেছি। তারপর পাকিস্তান হলেন, আমাদের দেশ স্বাধীন হলেন। কিন্তু আমরা গোলাম হয়ে গেলাম, ভাইসব। ইংরেজ সায়েবরা কুত্তারও কত খাতির করতেন। দিশি সায়েবরা মানুষকে কুত্তার অধম ভাবলেন। একটা টেডি পয়সা এদিক-ওদিক হলে ধমক খেতে হচ্ছেন। আপনারা এখন সারা জিন্দেগিতে একদিন ছুটি পাও না। আমাদের সায়েব কিন্তু খারাব লোক নয়। ইংরেজ সায়েবদের মতো আমার সায়েব কুকুর রাখে না, ঘোড়া রাখে না, মেম রাখে না, আর…’
খানসামার বক্তৃতা তখনো চলছে, কিন্তু বেয়ারা তাতে মজা পাচ্ছে না। এসব কথা সে প্রত্যেকদিনই শোনে। এখন তার খেয়াল অন্য দিকে। দুই-দুবার ফোটোগ্রাফারকে টেলিফোন করা হল এখনো সে আসছে না কেন, এই চিন্তায় সে মনে মনে ভারি ব্যস্ত। খানসামার ভাষণ শেষ হয়ে আসছে মনে করে বেয়ারা ইঙ্গিতে তাকে জানিয়ে দিল শেষ না করতে।
ঠিক এমনি সময়ে বাইরে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। বেয়ারা বয়কে ইঙ্গিতে বলে দিল ফোটোগ্রাফারকে তাড়াতাড়ি ভেতরে নিয়ে আসতে। বয় চলে গেল।
খানসামা বেয়ারার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বক্তৃতার উপসংহারটাকে আর একটু লম্বা করল, ‘ভাইসব আমাদের সায়েবের জন্য আমরা দোয়া করি– আল্লা যেন তেনাকে আরও একশো বছর বাঁচিয়ে রাখে। আমাদের সায়েব যে কত ভালো লোক, তা আপনারা আজকের এই খানা-পিনা থেকেই বুঝতে পারছ।…‘
এমন সময় ডাইনিং-হলের দরজার পর্দা নড়ল। খানসামা ফোটোগ্রাফারের জন্য বক্তৃতার পোজটাকে আর একটু আকর্ষণীয় করে নিল। উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলীও যে-যার দৈহিক ও চেহারাগত আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠল। কিন্তু যার যেমন পোজ, তেমনিই থেকে গেল। খানাসামার বক্তৃতার শেষ শব্দটি অর্ধোচ্চারিত রয়ে গেল। মুখ হাঁ হয়েই থাকল, সে হাঁ আর বন্ধ হল না। সবাই যেন পাথরের মূর্তি– কেউ নড়ল না, কেউ নিশ্বাসটুকুও ফেলল না, যেন সবাই জমে গেছে। যে দাঁড়িয়েছিল, সে দাঁড়িয়ে থাকল। যে বসেছিল, সে বসে থাকল। যে চুলকাতে যাচ্ছিল, তার হাত থেমে গেল অর্ধপথে। সবাই স্থবির। কেবল বয় এর ব্যতিক্রম। সে নড়ছিল, থরথর করে কাঁপছিল নদিমের পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
নদিম ভালো করে একবার অবস্থাটা দেখে নিল। হলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত নজর বুলাল। তারপর বলল, আজ থেকে তোমাদের সবারই চাকরি নট্। বলে সে দ্রুত পায়ে শোয়ার ঘরে চলে গেল।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
পুতুল – মমতাজ মুফতি
সাদা বাংলোর অধিবাসীদের সবাইকে যেন ভূতে ধরেছে। অথচ, এ বাড়ির আসবাবপত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি। রেশমের পর্দা আগের মতোই ঝুলছে। গালিচার উজ্জ্বল রং এখনো আগের মতো আলো ঠিকরায়।
সাদা বাংলোর মানুষগুলো সবাই শো-কেসে সাজানো পুতুলের মতো। চাবি ঘুরিয়ে দিলেই সে পুতুল থপথপ্ করে হাঁটে।
কিন্তু সাদা বাংলোর পুতুলগুলো আগে যেমন করে হাসত, কথা বলত, এখন আর তেমন করে পারে না। ওদের সবাইকে যেন ভূতে ধরেছে। সন্ধ্যা হতে-না-হতেই পুতুলদের মুখে তালা-চাবি পড়ে যায়। রাত্রির নিস্তব্ধতা যত বাড়ে, ভৌতিক নীরবতা তত বাড়ে। খুট্ করে একটা কিছুর শব্দ হলেও সবাই একসঙ্গে চমকে ওঠে।
সাদা বাংলোর যে কাউকে গিয়ে জিগ্যেস করুন এর কারণ, কেউ বলবে না, বলতে পারবে না।
কাকে আপনি জিগ্যেস করবেন? ফওজিয়াকে? তার ঘোলাটে চোখ দেখলে আপনারই ভয় করবে। সে নিজেই এর কারণ হলে কী হবে– সে তো জানে না, কী সে কারণ; তাহলে কেমন করে বলবে সে!
নওয়াজিশকে জিগ্যেস করে দেখুন। গোঁফে তা দিয়ে গম্ভীর হয়ে যাবে, কিছুই বলবে না। বেশি পীড়াপীড়ি করলে গাম্ভীর্য আরও বাড়বে। এই গাম্ভীর্যের অর্থ : সে ড্রাইভার হলেও শুধু ড্রাইভার নয়– আরও অনেক কিছু, বরং সবকিছু। আরও পীড়াপীড়ি করলে কিছু একটা হয়তো বলবে, কিন্তু তার অর্থোদ্ধার করা মুশকিল। তারপর যদি বলেন, ‘তারপর?’ তাহলে নওয়াজিশ বলবে, ‘তারপর? রাত-জাগতে হয়, এই আর কি। তাতে আমার তেমন কোনো অসুবিধে নেই। সারাটা জীবনই তো রাত জেগে জেগে কাটালাম।
ফওজিয়ার মাকে জিগ্যেস করে দেখবেন একবার? তিনি ব্যস্তসমস্ত হয়ে পালঙ্ক থেকে নামবেন– যেন শুয়ে থেকে এতক্ষণ তিনি বড় অন্যায় করেছেন। তারপর বলবেন, ‘হ্যাঁ, কিছু একটা হয়েছে বৈকি! কিন্তু কী হয়েছে, তা তো ডাক্তারেই ঠিকমতো বলতে পারে না, তা আমি কেমন করে বলব, বাপু! যাই হোক, আল্লার হাজার শুকর, জান্টা তো বেঁচেছে!’ ডাক্তারকে প্রশ্ন করলে বলবেন, ‘ওয়েল, ওয়েল, শি ইজ অলরাইট। সামান্য একটু শক্ পেয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে।’
ছোট বোন আসিয়াকে জিগ্যেস করলে সে কিছুই বলবে না। দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে সে শুধু কাঁদবে ডুকরে ডুকরে।
তারপর, চাকর-চাকরানিদের জিগ্যেস করে কী লাভ। তারা কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে বোবা বনে যাবে। কিছুই বলবে না, বলতে পারবে না।
মাঝরাত্রে রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে খান-খান হয়ে যায় যখন ফওজিয়ার শয়ন-কক্ষ থেকে চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসে। এমন উলঙ্গ চিৎকার কেউ কখনো শোনেনি। রেশমের কাপড় দিয়ে ঢাকা মরা পুতুল যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। পুতুল চিৎকার করে ডাকছে, ‘নওয়াজিশ, নওয়াজিশ!’ ভদ্রঘরের কোনো মহিলার এইভাবে তারস্বরে ডাকা, তা-ও আবার সে বাড়ির ড্রাইভারের নাম ধরে ধরে– খুবই বেমানান। কিন্তু সেই ডাকে কেন এত কাকুতি, ভিক্ষার সুর।
ফওজিয়ার চিৎকার শুনে মা জেগে যান। মুখে কেবল বলেন, ‘আবার আজকে!’ নিচের ঠোঁটটা কেঁপে ওঠে। বুকের ভেতরটা দুলে ওঠে। কিন্তু একটুও নড়েন না। ফওজিয়ার শোয়ার ঘরে যাওয়ার চেষ্টা করেন না। কারণ তিনি জানেন, এতক্ষণে সেখানে নওয়াজিশ চলে গেছে। মামুলি একটা ড্রাইভার নওয়াজিশ। সেই নওয়াজিশ ফওজিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোঁফে তা দিচ্ছে। উফ্!
ছোট বোন আসিয়৷ ধড়ফড় করে জেগে ওঠে। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে আবার সে চোখ বোজে। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে সে শুধু কাঁদে ডুকরে ডুকরে।
নার্স এই চিৎকার শুনে রাত-জাগার উপন্যাস থেকে চোখ তোলে। সেখানে কাগজের চিহ্ন রেখে বইটা বন্ধ করে দেয়। তারপর, পা টিপে টিপে ফওজিয়ার শয়ন-কক্ষের দরজা পর্যন্ত গিয়ে ছিটকিনি খোলে। আবার পা টিপে টিপে চেয়ারে এসে বসে। তারপর, নিশ্চিন্ত মনে আবার উপন্যাস পড়তে আরম্ভ করে দেয়। ফওজিয়ার এই চিৎকারে যেন কোনো অস্বাভাবিকতা নেই– নৈমিত্তিক ব্যাপার।
চিৎকারে নওয়াজিশেরও স্বাভাবিকভাবেই ঘুম ভেঙে যায়। একবার চোখ ঘষে নিয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেয়। ঘন, দীর্ঘ গোঁফের ফাঁকে অদ্ভুতভাবে হাসে। তারপর, ওভারকোটটা ফেলে নেয় কাঁধে। গোঁফে তা দিতে দিতে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলতে থাকে ফওজিয়ার ঘরের দিকে।
শয়ন-কক্ষে ভারিক্কি চালে বেগম সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে নওয়াজিশ। তারপর গুরুগম্ভীর গলায় বলে, চিন্তা করবেন না বেগম সাহেব; নওয়াজিশ আপনার কাছেই আছে; সবসময় থাকবে।’ এইটুকু বলে আবার সে গোঁফে তা দিতে আরম্ভ করে।
নওয়াজিশের কথায় ফওজিয়ার চিৎকার বন্ধ হয়। চাপা গলায় বলতে থাকে, ‘নওয়াজিশ, নওয়াজিশ, ওই যে আসছে, ওরা আসছে।’ এই বলে সে উঠবার চেষ্টা করে।
‘শুয়ে থাকুন, বেগম সাহেব, শুয়ে থাকুন!’ নওয়াজিশের কণ্ঠে এবারে আদেশের সুর। ‘নওয়াজিশ থাকতে আপনার কোনো ভয় নেই। কেউ আপনাকে কিছু বলতে পারবে না।
‘নওয়াজিশ, নওয়াজিশ, নওয়াজিশ…!’ বলতে বলতে ফওজিয়ার গলা নরম হয়ে আসে। আরও কী-যেন সে বলতে চায়– যেন কোনো গোপন কথা– কিন্তু বলতে পারে না। নাম উচ্চারণ করতে করতে চোখ জুড়িয়ে আসে। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে। সাদা বাংলোয় ভূতের নাচ থেমে যায়। আবার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে নীরবতা, নিঃঝুম রাত্রির নিস্তব্ধতা।
নওয়াজিশ আরও কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে যেমন গম্ভীরভাবে এসেছিল, তেমনি গম্ভীরভাবে ফিরে যায়। নার্স পা টিপে টিপে এসে, দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। তারপর, নির্দিষ্ট জায়গায় পা টিপে টিপে ফিরে গিয়ে রাত-জাগবার উপন্যাস পড়তে শুরু করে দেয় আবার।
মা নিজের ঘরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়েন। আসিয়া কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায়। আর, নওয়াজিশ নিজের কামরায় ফিরে গিয়ে লেপের তলায় উপুড় হয়ে শুয়ে সিগারেট ধরায়। দুই আঙুলের ফাঁকে চেপে ধরে, মুঠো বেঁধে, হুঁকো খাওয়ার কায়দায় জোরে জোরে টান দেয় সিগারেটে। বৃদ্ধা আর অনামিকায় চুটকি বাজিয়ে ঘন-ঘন ছাই ফেলতে থাকে, আর বায়স্কোপের গানের একটা কলি, গাইতে থাকে গুনগুন করে, ‘আব্ কওন্ তুঝে সঝায়ে…।’
সাদা বাংলোর প্রত্যেকে চিন্তিত। এমনকি, সাদা বাংলোর বাইরের লোক ডাক্তারও গভীর চিন্তামগ্ন– যদিও তাঁর কথা থেকে সেটা বুঝবার উপায় নেই। ডাক্তারের মুখে ওই এক কথা, ‘শি ইজ্ অল্রাইট। সামান্য একটু শক্ পেয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে।’ তিনি প্রত্যেকদিন আসেন। রুগীর নাড়ি টেপেন। জিবের রং দেখেন। টেথিস্কোপ লাগান। দু-একটা প্রশ্ন করেন। তারপর ইঞ্জেকশন লাগিয়ে দিয়ে, নার্সকে উপদেশ দিয়ে, হাত-বাক্সটা তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন।
বাইরে সবাই দাঁড়িয়ে, অপেক্ষায়। মা সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেন, ‘আজকে কেমন দেখলেন, ডাক্তার সাহেব?’
‘হুঁ।’ ডাক্তার যেন নতুন করে কেইসটা পরীক্ষা করছেন, এইরকম একটা ভঙ্গি। তারপর, মাথা তুলে বলেন, ‘ভালো হয়ে যাবে, ভালো হয়ে যাবে। আপনারা ঘাবড়াবেন না। এখনো শকের ইফেক্ট্ কাটেনি। কাল আবার আসব। খোদা হাফেজ।’
.
এই ঘটনার পাত্র-পাত্রী মাত্র তিনজন। সারা মুখ পাউডার দিয়ে ঢেকে রাখা একটি মেয়ে-পুতুল, নিষ্প্রাণ একটা ছেলে-পুতুল আর সজীব প্রাণবন্ত একটা ড্রাইভার।
পুতুল শুধু পাউডার ঘষে, তাই নয়– কথাও বলে। মল্ রোডের কেনা-কাটায় অহরহ যেমন অনেক পুতুল দেখতে পাওয়া যায়, সে-ও তাদেরই মতো একজন। ঠোঁটে মাখানো থাকে পুরু করে কৃত্রিম লালিমা– যেন অসংখ্য পুতুলের মধ্যে থেকে সে কারো দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। গাড়ি থেকে নীরবে নেমে ভারিক্কি চালে এদিক-ওদিক দেখে নেয়। যারা তার ওপর চোখ ফেলে চোখ সরায় না, তাদের দিকে তাকিয়ে সে নাক-সিটকায় ঘৃণায়। সময় নষ্ট না করে অচিরে মগ্ন হয়ে যায় কেনা-কাটায়। কখনো ভেবে দেখে না, কেন সে এত আকর্ষণ করে লোকজনকে। কেনই-বা ভাববে! স্বামী বিত্তবান। নিজস্ব প্রাসাদতুল্য বাংলো। মূল্যবান আসবাবপত্র দিয়ে সে বাংলো সাজানো। গাড়ি। টেবিলে আপনা-আপনি খাবার লেগে যায়। পার্সে টাকা সবসময় গিজগিজ্ করে। মরা-মরা, ময়লা, নোংরা লোকগুলো কেন যে তার দিকে অমন করে তাকিয়ে থাকে। পাউডার মাখে সে চামড়া নরম রাখার জন্য। চোখে কাজল দেয় চোখের জ্যোতি বাড়ে বলে। ঠোঁটে লালিমা মাখায়– তা সে যে জন্যই হোক, তাতে কার কী! সব কাজেরই যে ব্যাখ্যা দিতে হবে, তেমন কোনো শর্তে সে আবদ্ধ নয় কারো সঙ্গে। তার ইচ্ছা, সে মাখবে।
মল্ রোডের পুতুল শুধু সামাজিকভাবে নয়– মানসিকভাবেও একটা পুতুলই। পুতুল-ঘরের শিক্ষা তার মানসিকতাকে আবদ্ধ করে রেখে দিয়েছে। তার দেহের রূপ আর মনের শিক্ষা শান্ত একটা বিলের মতো– তাতে ঢেউ ওঠে, কিন্তু তরঙ্গ কখনো বিক্ষুব্ধ হয় না।
শো-কেসে সাজিয়ে রাখা পুতুলের মতোই পরিবারের সবাই ওরা উঠেছে, বসেছে, চলা-ফেরা করেছে। ঠিক সময়টিতে যুৎসই কথা বলা, ঠিক সময়ে বাইরে যাওয়া, ঠিক সময়েই পুতুলের মতো শো-কেসে বন্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়া। কখন কোন কথাটুকু বলতে হবে, তা যেন মুখস্থ করা। ঠিক সময়ে, ঠিকমতো সেই মুখস্থ-করা কথা ছেড়ে দিলেই পুতুলের শিক্ষা সম্পূর্ণ হল।
যে পুতুল-ঘরে ফওজিয়া বড় হয়েছে, তার বাইরে দশ পা হেঁটে গেলে জীবন্ত রক্ত-মাংসের মানুষরাও ছিল। কিন্তু পুতুল-ঘরের শিক্ষা তাদের দিকে চোখ তুলে তাকানোর অনুমতি দেয়নি। তারা সব নফর-মানুষ, চৌকিদার-মানুষ, খেটে-খাওয়া মানুষ। তাদের জীবন মনোযোগ দিয়ে দেখবার মতো নয়। ‘মনোযোগ দিয়ে দেখা’ কথাটাই পুতুল-ঘরের শাস্ত্রে নেই। শুধু নফর মানুষ কেন– অন্য কাউকেও, এমনকি নিজের আত্মীয়-স্বজনদেরও মনোযোগ দিয়ে দেখা অভদ্রতা। শাস্ত্রের বাইরে কিছু বললেই সেটা হবে কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ। কাজেই অন্যকে দেখার চাইতে নিজেকে দেখানোর গুরুত্ব পুতুল-ঘরে বেশি। তাই সবসময় চেষ্টা, যেন নিজেকে সুন্দর দেখায়, অন্যের কাছে নিজেকে যেন সুপ্রিয় করে তোলা যায়।
ফওজিয়া জন্ম থেকে এইসব শিক্ষাই পেয়ে এসেছে। সকাল-সকাল টবের মধ্যে গরম পানিতে স্নান করিয়ে চুলে রিবন লাগিয়ে, মুখে পাউডার ঘষে ফিটফাট ফ্রক পরিয়ে তৈরি করে দেওয়া হত। নিজেরই মতো ফুটফুটে একটা পুতুল নিয়ে সে প্যারালেটারে গিয়ে বসত। সেই বাহন ঠেলতে ঠেলতে অন্য একজনে নিয়ে যেত বাগানে। সেখানে গিয়ে বসত বিশেষভাবে তৈরি করা, কুশন-আঁটা একটা বেতের চেয়ারে। মাটিতে কখনো পা ঠেকত না।
ড্রয়িং-রুমে বলার জন্য একরকম ভাষা তাকে শেখানো হয়েছিল। ‘থ্যাঙ্ক ইউ’, ‘হাউ ডু ইউ ডু’, ‘মামি, ড্যাডি’, কিংবা ইংরেজি কোনো কবিতা। ফুরফুরে বাতাসের মতো নরম করে হাঁটা। সারাদিন ভুরভুরে গন্ধ ছড়িয়ে এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যাওয়া। তারপর, রাত হলে মোলায়েম রেশমের শো-কেসে আট্কা পড়া। এই ছিল জীবন পুতুল-ঘরের।
তারপর, যৌবনের পদার্পণেও সে-জীবনে বিশেষ পরিবর্তন আসেনি। পরিবর্তন এসেছে শুধু দেহের ভাঁজে ভাঁজে। শরীর ফুলেছে, ফেঁপেছে। চুল বাঁধার স্টাইল গেছে বদলে। ছক-কাটা ভাষায় কথা বলার সীমানা কিছু প্রসারিত হয়েছে। প্রশস্ত হয়েছে ড্রয়িংরুম। যাতায়াতের পুতুলের সংখ্যাও বেড়েছে। মেয়েদের কাছে আসে পুরুষ-পুতুল, পুরুষদের কাছে যায় মেয়ে-পুতুল। তাদের হাসিতে ছুরিকার ধার।
এইভাবে একদিন এক পুরুষ-পুতুল ফওজিয়াদের ড্রয়িংরুমে এল। ফওজিয়ার দিকে তার সে কী চাহনি! প্রথম প্রথম সে ভয় পেয়েছিল এই দৃষ্টি দেখে। কিন্তু ভয়ের সঙ্গে মেশানো ছিল আনন্দের দোলা। নিরিবিলিতে ডেকে নিয়ে গিয়ে সেই পুতুল এমন সব-কথা বলল, যা এর আগে ফওজিয়া কখনো শোনেনি, শেখেনি। ছকের বাইরে যেন কথাগুলো। ভারি আনন্দের, ভারি মজার। তার সামনে নতুন একটা গোটা জগৎ উন্মোচিত হয়ে গেল।
আরো অনেক পুতুলের আনাগোনা ছিল। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই ফরুখের সঙ্গে ফওজিয়ার বিয়ে হয়ে গেল বলে আরও অনেক নতুন জগৎ উন্মোচিত হতে পারল না। ফররুখের মুখের কথাও অমনি ছক-কাটা পুতুলের মতো। তার দেখাও দেখবার জন্য নয়– দেখানোর জন্য। সে-ও এসব আয়ত্ত করেছে অন্য এক পুতুল-ঘরের পরিমণ্ডলে থেকে।
বিয়ের পরেও ফওজিয়ার পুতুল-জীবনে বিশেষ কোনো পরিবর্তন এল না। পরিবর্তন হল কেবল এটুকুই যে, এক পুতুল-ঘর থেকে অন্য পুতুল-ঘরে গিয়ে নামল সে। সেখানেও রেশমের পর্দা, দামি দামি আসবাবপত্র, ঘুমোনার জন্য শো-কেস্ আর তেমনি বাগান। বিয়ের পরে সে একেবারে একলা হয়ে গেল। আগে যেখানে দাস-দাসীরা তার কাজ করে যেত, এখন সে জায়গায় যোগ হল আরও একজন– ফরুখ। ফরুখ তার জন্য দরজা খুলে দেয়, চেয়ার এগিয়ে দেয়, কোট পরিয়ে দেয়, পার্স তুলে দেয়। ডাক পড়লেই ‘ডার্লিং’ বলে ছুটে আসে। বিয়ের পরে নাম হয়ে গেল বেগম ফওজিয়া। কিন্তু ফররুখ ডাকে ফিজি বলে। আর, সে তার ফিজিকে এমন আগলে আগলে, ঢেকে ঢেকে রাখে, যেন অস্থাবর সম্পত্তি– কেউ টুক করে চুরি করে নিয়ে পালাবে। ফওজিয়া যেন কাঁচের জিনিস– পুট্ করে ভেঙে যাবে, তাই ফররুখ তাকে আলতো করে গাড়িতে চাপায়, আলতো করে গাড়ি থেকে নামায়। যত সাবধানতা, ভেঙে পড়ার আশঙ্কা যে ততই বেশি, সে-বোধ তার মনে জাগেনি কখনো।
নতুন পুতুল-ঘরে এসেই প্রথম ফওজিয়া নওয়াজিশকে দেখেছে। নওয়াজিশকে দেখেছে, সেটা এমন কোনো ঘটনা নয়। নেহাত দেখছে, এই যা। নওয়াজিশ হয়েছে তার কাছে শোফার মাত্র– নওয়াজিশ নয়। সে হচ্ছে নফর মানুষ, খেটে-খাওয়া মানুষ। তার দিকে দেখার মতো করে তাকানো শাস্ত্রে লেখা নেই। যদি থাকত, তাহলে ফওজিয়া দেখতে পেত শোফারকে নয়– নওয়াজিশকে, দীর্ঘ শক্ত যার দেহখানা, প্রশস্ত যার ছাতি, ঘন দীর্ঘ গোঁফের ফাঁকে যার সবসময়ই লেগে থাকে অকৃত্রিম, স্বভাবসিদ্ধ হাসি, আর যার অস্বাভাবিক উজ্জ্বল চোখের গভীরতা থেকে অবিরাম বিচ্ছুরিত হয় বিদ্যুতের ছটা।
সাধারণভাবে নওয়াজিশের সঙ্গে কখনো কথা বলার দরকার হয় না ফওজিয়ার। কারণ, কাজে-অকাজে সবসময় উপস্থিত থাকে ফরুখ। সেই-ই সব কাজ করে দেয় কিংবা করিয়ে দেয়। কিন্তু সম্পত্তির খবরদারি করতে মাঝে মাঝে ফরুখকে যখন করাচি চলে যেতে হয়, তখন ফওজিয়া পুতুল-ঘরে একলা থাকে। নওয়াজিশকে দরকার পড়লে বাইরে পেরির্চে দাঁড়িয়ে ডাক দেয়, ‘শোফা, এ শোফা!’
নওয়াজিশ এই ডাক শুনে ব্যস্ততার কোনো ভাব দেখায় না। ধীরে-সুস্থে সিগারেটে শেষ কয়টা টান দিয়ে নেয়। তারপর ওভারকোটটা কাঁধে ফেলে শিস্ কাটতে কাটতে চলে যায় গ্যারাজের দিকে। গাড়ি নিয়ে পেরির্চে এসে থামায়। অতিরিক্ত কথা দূরে থাক প্রয়োজনীয় কথাও কম বলে। যখন যা হুকুম হয়, তামিল করে যায় নীরবে, ধীরে নিরুদ্বেগে।
নওয়াজিশ স্বভাবগতভাবে ড্রাইভার। কিন্তু চিন্তায় আর মানসিকতায় সবসময় একটা বড়লোকি ভাব। তার হাঁটা দেখলে মনে হবে পবন-দেব মাটিতে নেমেছেন। তার মোটর চালানো দেখলে মনে হবে, এটা গাড়ি নয়– একটা খেলনা। সে কখনো মনে করে না, সে কোনো সাহেবের বা বেগম সাহেবের ড্রাইভার, বরং মনে করে, সে মোটরগাড়ির ড্রাইভার। তার স্বভাবের মধ্যে যে অবাধ্যতার ভাব, তা তার ঘাড় টান করে চলা দেখলেই অনুভব করা যায়। কিন্তু এই অবাধ্যতা দাম্ভিকতা নয়। এ যেন স্বাভাবিক, জন্মগত একটা অধিকার। তাই পুতুল-ঘরের বেগম সাহেবকে সে কখনো মনোযোগ দিয়ে দেখেনি, দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি।
ফওজিয়া তার এই নিরাভরণ অবাধ্য-ভাব লক্ষ করেনি, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কিন্তু লক্ষ যে করেছে, তা সে বুঝতে দেয়নি কখনো। কারণ, বুঝতে দেওয়া মানেই নফর মানুষকে স্বীকৃতি দেওয়া। পুতুলদের শিক্ষায় সে জিনিসের অনুমতি নেই। সে সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছিল। মারমুখো জনতা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আহমদিয়া-বিরোধী ধ্বনি দিতে দিতে। রাত্রে গোলমাল আরও বেড়ে গেল। উত্তেজনাকর ধ্বনি দিয়ে বেড়াচ্ছে দাঙ্গাকারীরা আর ‘মারো মারো, কাটো কাটো’ রব উঠছে। বাহ্যত ভয়ের কোনো কারণ ছিল না, তবু এইসব দেখেশুনে ভয়কে একেবারে মন থেকে তাড়ানোও যাচ্ছিল না। ফররুখ দাঙ্গাকারীদের ‘জংলি, অসভ্য’ ইত্যাদি বলে গালাগালি দিচ্ছিল। বলছিল, ওদের গুলি মেরে উড়িয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু রাত্রে যখন গোলমাল খুব কাছে থেকে শোনা যাচ্ছে, তখন ভয়ে ফরুখের বুক দুরুদুরু কাঁপতে লাগল। ফওজিয়াকে ডেকে বলল, ‘ফিজি, এদিকে এস। আর শোনো, যদি তেমন কিছু হয়, তাহলে আমরা চাকরদের ঘরে চলে যাব, বুঝেছ? ওখানে ওরা আমাদের খুঁজে পাবে না। ধর্মটর্ম কিছু নয়– ওরা তো আসবে লুট করতে। ছোটলোক।’
সে-রাতটা নিরাপদেই কেটে গেল। পরেরদিন জরুরি ডাক এল করাচি যাওয়ার। যাওয়ার আগে ফওজিয়াকে সে অনেক পরামর্শ দিয়ে গেল, ‘ফিজি, এইসব বদমাইশদের ভয় করার কোনো কারণ নেই। ওরা ছোটলোক– নিজেরাই ভীরু। বুঝেছ? ওরা যদি বাড়ির ভেতর পর্যন্ত ঢুকে যায়, তাহলে পুলিশকে ফোন করে দিও। ওদের তেমন সাহস হবে না, তা আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি। বুঝেছ, ফিজি? আর, যদি লুট করার জন্যে ঢুকেই পড়ে, তাহলে চাকরদের ঘরে চলে যেও। আমি ওদের সব বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। চৌকিদার আর শোফার বাংলোর কোনার ঘরটায় শোবে। বুঝেছ, ডার্লিং?’
ফররুখ চলে গেল। সেই রাত্রেই হাঙ্গামা আরও বাড়ল। গোলমাল শুনে ঘুম ভেঙে গেল ফওজিয়ার। আতঙ্কে চিৎকার করে ডাক দিতে লাগল, ‘চৌকিদার, চৌকিদার!’ দাঙ্গাকারীরা আরও যেন বাংলোর কাছে এসে গেছে। আরও বেশি ভয় পেয়ে, পুতুল- ঘরের সমস্ত শিক্ষা ভুলে গিয়ে সে প্রাণপণে চিৎকার করে ডাক দিল, ‘নওয়াজিশ, নওয়াজিশ!’ এই প্রথম সে নওয়াজিশকে নাম ধরে ডাকল।
আগের মতোই তেমনি নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বিগ্ন নওয়াজিশ কাঁধের উপর ওভারকোটটা ফেলে নিয়ে, ধীরে সুস্থে তার সেই নিজস্ব বড়লোকি চালে এসে ঢুকল বেগম সাহেবের শয়নকক্ষে। নওয়াজিশকে দেখতে পেয়ে ফওজিয়া চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই– ওই– ওই যে আসছে, ওরা আসছে।’
‘চেঁচাবেন না, বেগম সাহেব।’ শক্ত গলায় শাসিয়ে উঠল নওয়াজিশ, ‘চেঁচালে ওরা শুনতে পাবে, আর শুনতে পেলে আপনারই বিপদ।’
ধমক খেয়ে আতঙ্কটা ভয়ে রূপান্তরিত হল। ফওজিয়া এখন থিতিয়ে উঠে, সুর নামিয়ে
বলল, ‘ওরা আসছে, ওরা আসছে। আমি যাই, পুলিশকে টেলিফোন করে দিই।’ বলে সে টেলিফোনের দিকে এগুতে লাগল।
নওয়াজিশ পথ আগলে দাঁড়াল। ‘টেলিফোন করতে হবে না। দরকার নেই। তাতে কোনো লাভ হবে না।’
‘কিন্তু–’ ফওজিয়া আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। ‘চুপ করুন, বেগম সাহেব, কথা বলবেন না।’ গর্জন করে উঠল নওয়াজিশ। ‘নওয়াজিশ যতক্ষণ রয়েছে, কেউ আপনার গায়ে হাত তুলতে পারবে না।’
ফওজিয়া ধমক-খাওয়া শিশুর মতো চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ল থপ্ করে। আর, নওয়াজিশ তার সেই বড়লোকি ঢঙে দরজার কাছে গিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াল। সিগারেট ধরিয়ে মুঠোয় মধ্যে চেপে ধরে হুঁকো টানার মতো করে টানতে লাগল। যেন কিছুই হয়নি, এমনি একটা ভাব।
দাঙ্গাকারীরা প্রাচীর টপকে বাংলোর মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তাদের চিৎকারে শয়ন কক্ষের জিনিসপত্র পর্যন্ত কেঁপে উঠল। তবু নওয়াজিশ নিশ্চিন্তে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে ফওজিয়া পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে চাইল। আমি চাকরদের ঘরে চলে যাচ্ছি– ‘
মুখের কথা এখনো শেষ হয়নি, নওয়াজিশ এক লাফে সেখানে গিয়ে ফওজিয়াকে ধরে ফেলল। তারপর বাচ্চা ছেলের মতো করে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। ‘চুপ করে শুয়ে থাকুন, বেগম সাহেব।’ এবারে তার কণ্ঠে প্রচণ্ড ক্রোধ। ‘বললাম, নওয়াজিশ থাকতে ভয় করবেন না। ‘
নওয়াজিশের এই ব্যবহারে কী যেন একটা হয়ে গেল। কোথায় যেন আগুন জ্বলে উঠল। তারপর, এক মুহূর্তে সে আগুন নিভে গেল পানির মধ্যে পড়ে। বিছানায় ফওজিয়া মড়ার মতো আড়ষ্ট হয়ে পড়ে থাকল। একটুও নড়ল না। প্রশান্ত বিলে এতদিন যে ঢেউটুকু ছিল, তা-ও অবশিষ্ট থাকল না আর। এখন আর আতঙ্ক নেই, ভয় নেই। দাঙ্গাকারীরা একেবারে কাছে এসে গেছে– সে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু এ দেখা যেন ঠিক দেখা নয়। নওয়াজিশ তেমনি অটল পাহাড়ের মতো দরজা আগলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। ঘরটাকে আড়াল করে রয়েছে সে পর্দার মতো। আর, সেই পর্দায় বায়স্কোপের ছবির মতো দাঙ্গাকারীরা যেন নড়ছে, ভাসছে। সে যা দেখছে, তা অনুভব করতে পারছে না; যা অনুভব করতে পারছে, তা যেন দেখতে পাচ্ছে না।
এমন সময় হঠাৎ নওয়াজিশ হুঙ্কার দিয়ে উঠল, ‘এখানে কী জন্যে এসেছ, তোমরা? যাও, বেরিয়ে যাও! এখানে কেউ নেই। বেরিয়ে যাও! যাও বলছি এখান থেকে! যাও!’
দাঙ্গাকারীরা চলে গেল। গোটা বাংলোয় ছড়িয়ে পড়ল মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধতা। নওয়াজিশ আর একটা সিগারেট ধরিয়ে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর, দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়িয়ে ফওজিয়ার দিকে না তাকিয়েই বলতে লাগল, ‘বলেছি না, নওয়াজিশ থাকতে আপনার গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না! নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ুন। দরকার পড়লে আমাকে ডাক দেবেন। ছিটকিনি লাগিয়ে নিন।’ কণ্ঠে সেই একই আদেশের সুর। সেই একই বড়লোকি চাল।
বিছানা থেকে উঠে ফওজিয়া ঠিক যেন হুকুম তামিল করার জন্যই ছিটকিনি লাগাতে গেল। বেগম যেন হঠাৎ আজ বাঁদিতে পরিণত হয়েছে।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত বিছানায় পড়ে থাকল ফওজিয়া। ঘুম এল, কি এল না। আস্তে আস্তে রাত গড়িয়ে গেল। সকাল হল। বিছানা থেকে উঠে ফওজিয়া নতুন একটা অচেনা জগৎ বিছিয়ে রয়েছে দেখল তার সামনে। আর, তার পুরনো জগৎ– পুতুলের জগৎকে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকতে দেখল তার চারপাশে। এ কী হল! পুতুলের রাজ্যে এ কী প্রলয় কাণ্ড! মখমল, রেশম, ঝালর, কুশন, পুতুলের শাস্ত্র– সবাই একসঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে কেন?
কিন্তু না, সে ফওজিয়া, সে বেগম সাহেব। হঠাৎ তার চৈতন্য ফিরে এল। ভুলে যেতে চাইল রাত্রির ঘটনা। বাঁচতে হবে। ফিরে পেতে হবে নিজের সত্তাকে। এই তো মখমল, গালিচা। এই তো রেশম, ঝালর, কুশন, শো-কেস্। এই তো পুতুল, শাস্ত্র, পুতুলের শিক্ষা, দীক্ষা, সভ্যতা, ভব্যতা। এই তো ফওজিয়া, এই তো বেগম সাহেব।
ফরুখ ফিরে আসতে আসতে ফওজিয়ার আর কিছুই মনে থাকল না সে রাত্রির ঘটনা। কাজেই সেসব কথা ফরুখকে বলারও প্রয়োজন করছে না। থাকল বাকি নওয়াজিশ। কিন্তু নওয়াজিশ নামের কাউকে সে চেনে না। তবে হ্যাঁ, শোফারের কথা যদি বলেন, শোফার তাদের একটা রয়েছে বটে। কিন্তু এখন তার মোটরে চড়তে ভালো লাগে না। তাহলে আর কিসের শোফার, কেমন শোফার!
.
ছ-মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। পুতুল-ঘরের পুতুলরা আগেই মতোই। তেমনি মাপা মাপা হাসি, মাপা মাপা কথা। তেমনি দরজা খুলে দেওয়া, কোট পরিয়ে দেওয়া, পার্স তুলে দেওয়া।
ছ’মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। ফওজিয়া যেন সত্যি সত্যি ভুলে গেছে নওয়াজিশের কথা।
তারপর, একদিন ফরুখ এসে ফওজিয়াকে বলল, ‘আমরা করাচি যাচ্ছি। তুমিও সঙ্গে যাচ্ছ, ডার্লিং। এবারে অনেকদিন থাকতে হবে। শোফারকেও নিয়ে যেতে হবে।
ফওজিয়া শুনল। কেবল শেষ বাক্যটি শুনতে পেল না। শুনতে চায় না বলে।
পরের দিন তারা সেই মেলগাড়িতে চাপল, যে গাড়ি ঝিম্পিরে সেই বিখ্যাত দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়ে গেল। প্রথম শ্রেণির দুই আসনের একটি ছোট প্রকোষ্ঠে ওরা বসে বসে মাপা মাপা হাসিতে আর মাথা মাপা কথায় সারাটা দিন কাটিয়েছে। তারপর, ওরা ঘুমিয়ে ছিল। হঠাৎ বিস্ফোরণের মতো বিকট এক শব্দে ফওজিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে কি পায়নি–চোখে দেখছে কেবল আগুন আর ধোঁয়া আর ধুলো। সেই আগুনে, ধোঁয়ায় আর ধুলোতে ফররুখের সারা শরীর জড়িয়ে রয়েছে। ফওজিয়া চিৎকার দিতে গেল, কিন্তু পারল না। সে যেন স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু স্বপ্নেও তো চিৎকার দেওয়া যায়। তবু সে কেন পারছে না চেঁচাতে। তার গলা কেন রুদ্ধ হয়ে আসছে। এমন সময় ঝড়ের বেগে ঢুকল নওয়াজিশ। দেখার সঙ্গে সঙ্গে ফওজিয়া চিৎকার করে উঠল, ‘নওয়াজিশ–!’ সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গেল সে।
ফওজিয়াকে ছোট ছেলের মতো করে কোলে তুলে নিয়ে নওয়াজিশ ধ্বংসস্তূপ থেকে ছিটকে বেরিয়ে ছুটে পালাল।
ফওজিয়ার যখন জ্ঞান ফিরে এল, দেখতে পেল, সামনে দাঁড়িয়ে নওয়াজিশ তার গোঁফে তা দিচ্ছে। নওয়াজিশ বলল, ‘কিচ্ছু ভাববেন না, বেগম সাহেব। নওয়াজিশ যতক্ষণ আপনার কাছে রয়েছে, আপনার কোনো ভয় নেই।’ কিন্তু তার মুখে কথা শেষ না হতেই ফওজিয়া অজ্ঞান হয়ে গেল আবার।
দ্বিতীয় দফা যখন তার জ্ঞান ফিরল, তখন সে হাসপাতালে। তখনো নওয়াজিশ কাছে দাঁড়িয়ে গোঁফে তা দিচ্ছিল।
.
মা, বোন, নার্সের উপস্থিতি সত্ত্বেও ফওজিয়া কারও সঙ্গে কথা বলে না। সারাদিন পড়ে থাকে বিছানায়। মস্ত বড় সাদা বাংলোর পুতুল-ঘরে কোন্ পুতুল কী বলছে, তা সে বুঝতে পারে না। সবাই তার কথাই বলছে : কিন্তু সে জানে না, কেন বলছে।
তারপর, রাত যখন গম্ভীর হয়, সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন বিকট চিৎকারে ফওজিয়ার রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান হয়ে যায়। তার চারপাশে ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়ে থাকে রেশমের, ঝালরের, কুশনের, মখমলের, পুতুলের দুনিয়া। পাথরের মতো শক্ত, বাস্তব, কঠোর, নিষ্ঠুর দুনিয়াকে সামনে পাওয়ার জন্য সে চিৎকার করে ডাক দেয়, ‘নওয়াজিশ—।’
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
সাইকেল – পিত্তরাম বোখারি
সেই সাইকেল চেপে শেষ পর্যন্ত রওয়ানা হলাম। প্রথম দফা প্যাডেল ঘোরাতেই বোধ হল যেন একটা কঙ্কাল অসংখ্য কঙ্কালের উপর দিয়ে হেঁটে চলেছে।
কিছু দূর যেতে-না-যেতেই একটা ঢালু রাস্তা পড়ল। তখন আর প্যাডেল করার দরকার হল না– সাইকেল আপনাআপনিই চলতে লাগল। তবু তার গতি ঘন আলকাতরা মাটির উপর ঢেলে দিলে যত হয়, তার চাইতে বেশি নয়।
সাইকেলের বিভিন্ন অংশ থেকে বিবিধ ধ্বনি নির্গত হতে লাগল। এইসব ধ্বনি বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত। গদির নিচে থেকে আর পেছনের চাকা থেকে যে ধ্বনি বেরুচ্ছে তা এই রকম : ‘চিঁ চাঁ চুঁ।’ অন্য গোত্রের ধ্বনি ছিল : ‘খট্ খড়্গ খড়্গ খড়্গ ডু।’ এই গোত্রের নিবাস মাড-গার্ডে। আর এক গোত্র ডেরা গেড়েছে সাইকেলের চেইনে আর প্যাডেলে, যা এইরকম : ‘ছর্-ছরর্ ছর-ছরর্।’ কিন্তু এই শেষোক্ত গোত্রের ধ্বনি আবার বদলে যাচ্ছে যখন আমি জোরে প্যাডেল ঘোরানোর চেষ্টা করছি। তখন হচ্ছে : ‘ছরর্-ছরর্ ছরর্-ছরর্।
পেছনের চাকা কেবল যে ঘুরছে, তাই নয়– সে চাকা দুলছেও। অর্থাৎ, সামনের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে, উপরন্তু একবার ডাইনে আর একবার বাঁয়ে হেলছে। এর ফলে রাস্তার ধুলোর উপর যে ছাপ পড়ছে, তা দেখে যে-কারও মনে হতে পারে, কোনো নেশাখোর সাপ সেদিক দিয়ে চলে গেছে।
কাদা-পানির ছিটে না লাগে, সেই জন্য মাড-গার্ড। কিন্তু আমার সাইকেলের মাড-গার্ড ঠিক জায়গায় অবস্থিত নয়। ফলে, আমি যখন উত্তর দিক দিয়ে চলব আর সূর্য থাকবে পশ্চিমে, তখন সাইকেলের টায়ারে রোদ লাগতে পারবে না।
পেছনের টায়ারে বিরাট একটা ব্যান্ডেজ। ফলে, এক পাক ঘুরে ওই জায়গায় এলেই গোটা সাইকেল পালোয়ানি কায়দায় লম্ফ দিয়ে উঠছে। আপনার চিবুকের নিচে জোরে একটা ঘুসি মারলে যেমন হতে পারে, আমার সাইকেলের অবস্থা ওই সময় ঠিক তেমনি হচ্ছে। প্রতি চক্রেই ওইরকম হচ্ছে। তার মানে, বুঝে নিন, চাকাটা যতবার ঘুরছে, ততবারই আপনার চিবুকের তলায় একটা করে ঘুসি পড়ছে।
সামনের চাকারও নিজস্ব একটা গোত্রগত ধ্বনি রয়েছে; কিন্তু সেটাকে আলাদাভাবে বিশ্লিষ্ট করা কষ্টকর। কাজেই সামনের আর পেছনের মিলিয়ে যে সমষ্টিগত ধ্বনি হচ্ছে, তা এইরকম : ‘চুঁ-চুঁ-ফট্ চুঁ-চুঁ-ফট্।’ ঢালু রাস্তা দিয়ে নামবার সময় গতি যেহেতু আপনাআপনি বেড়ে যাচ্ছে, সেহেতু এই একই ধ্বনি বদলে দ্রুততা লাভ করেছে : চুঁ-চুঁ-ফট্ চুঁ চুঁ-ফট্ চুঁচুঁফট্-চুঁচুঁফট্।’ আফ্রিকার কোনো ভাষায় বাচ্চারা সমস্বরে নামতা পড়লে ধ্বনির সামগ্রিক রূপ এইরকম দাঁড়ায় কিনা কে জানে।
এইসব চিত্র-বিচিত্র ধ্বনি শুনে পথচারীর মনের চিত্র-বিচিত্র প্রতিক্রিয়াও লক্ষণীয়। বিশেষত আমার সাইকেল যখন ঢালু রাস্তা দিয়ে নামছে, তখন যে-সব পার্ট এতক্ষণ নীরব ছিল, তারা আড়িমুড়ি দিয়ে ঘুম ভেঙে জেগে একসঙ্গে সবাই সরব হয়ে উঠছে। পথচারীদের কেউ চমকে ফিরে তাকাচ্ছে আর কেউ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছে। মায়ের কোলের শিশু ভয় পেয়ে বুকের মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে।
এতক্ষণ আমার সাইকেল অস্বাভাবিক গতিসম্পন্ন ছিল বলে তার দুর্বল স্বাস্থ্যের ওপর অচিরে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেল। আর, এই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্য একসঙ্গে দু-দুটো পরিবর্তন সাধিত হল। প্রথমত, সামনের চাকাসহ হ্যান্ডেলটা বেঁকে গেল। ফলে, যখন আমি সোজা যেতে চাইছি, সাইকেল তখন আমাকে বাঁ দিক দিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করছে। দ্বিতীয়ত, সাইকেলের আসন আনুমানিক ছয় ইঞ্চি পরিমাণ নিচে নেমে গেল। ফলে, যখন আমি প্যাডেল ঘোরাচ্ছি, তখন ওঠানামা করার সময় আমার দুই পায়ের হাঁটু একবার করে চিবুক স্পর্শ করে যাচ্ছে। অনুষঙ্গ স্বরূপ, মাজায় আর মাথায় অস্বস্তিকর অনুভূতি পীড়া দিতে লাগল।
আসনের নিচু হয়ে যাওয়াটা সর্বতোভাবেই পীড়াদায়ক হয়ে উঠল। সুতরাং, ওটাকে ঠিক করে নেওয়াই ভালো মনে করলাম। সাইকেল থামিয়ে নিচে নামলাম। সাইকেল থামানোর সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, গোটা দুনিয়া জুড়ে এতক্ষণ যে প্রলয়-কাণ্ড হচ্ছিল, তা এক নিমেষে থেমে গেছে। থলে থেকে যন্ত্রপাতি বের করে আসনটাকে উপরে তুললাম এবং হ্যান্ডেলটাকে অনেকখানি সোজা করে রওয়ানা হয়ে পড়লাম আবার।
সাইকেলের চাকা দশ পাক ঘুরতে-না-ঘুরতেই হ্যান্ডেল নিচে নেমে গেল, ফলে আসনটা রয়ে গেল ইঞ্চি দুয়েক উপরে। এবারে আমার সমস্ত শরীর সামনের দিকে ঝুঁকে থাকল। দেহের সমস্ত ভার হাতের উপর পড়েছে, আর হাতের ভার হ্যাঁন্ডেলের উপরে। আমার অবস্থাটা একবার কল্পনা করুন। পেছনের চাকার সেই ব্যান্ডেজের অন্য আমার শরীরের পেছন দিকটা একবার উঠছে, আর একবার নামছে। আমার এই অবস্থা দূর থেকে দেখলে মনে হবে, কোনো স্ত্রীলোক আটা ছানছে। সত্যি সত্যি লোকে তা ভাবছে কিনা, অনুমান করার জন্য আড়চোখে তাকিয়ে নিলাম ডাইনে-বাঁয়ে। আর, সেই ভাবনা আমার চেহারাখানাকে করে তুলল ঘর্মাক্ত। এখানকার সব লোক আমোদপ্রিয়– বিপদে আমাকে সাহায্য করার কথা কোনো আদম-তনয়ের মনে যে মুহূর্তের জন্যও স্থান লাভ করবে না সে সম্বন্ধে আমি নিঃসন্দেহ।
হ্যান্ডেলের পর এখন আসন আবার নিচের দিকে নামতে লাগল। শেষে অবরোহণের মাত্রা। এমন এক সীমায় গিয়ে পৌঁছাল যে, আমি প্রায় মাটির কাছাকাছি গিয়ে নীত হলাম। একটা বাঁচাল ছেলে বলে উঠল, ‘দেখ, দেখ্, লোকটা কেমন কসরত দেখাচ্ছে!’ আমাকে শেষ পর্যন্ত সার্কাসের ক্লাউন মনে করল ওরা।
সাইকেল থেকে নেমে আমি আবার হ্যান্ডেল আর আসন ঠিক করলাম। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তা আবার যা-কে-তাই। কখন যে আসনটা নিচে নামবে, আর কখন হ্যান্ডেল, তা আগে থেকে অনুমান করা অসম্ভব হয়ে উঠল। হ্যান্ডেল নিচে নেমে যাওয়ার চাইতে আসন নিচে নেমে যাওয়াটা বেশি পীড়াদায়ক। কাজেই আসন যাতে নিচে না নামে, সেজন্য বসবার লোভ সংবরণ করে আসন থেকে দেহের একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলতে লাগলাম। কিন্তু তাতে করে সমস্ত ভার গিয়ে পড়ল হ্যাঁন্ডেলের উপর, আর হ্যান্ডেল তখন উত্তরোত্তর নামতে থাকল আরও নিচের দিকে।
এইভাবে সাকুল্যে যখন দু মাইল মাত্র চলা হয়েছে, তখন ডন টেনে আর উঠ-বোস্ করে আমি একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এই রকম ব্যায়াম করতে করতে আরও চার মাইল অগ্রসর হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তখন সাব্যস্ত করলাম, সাইকেলটাকে একটা দোকানে দিয়ে মেরামত করিয়ে নেব।
সাইকেল মেরামতের দোকানে যত লোক কাজ করছিল, তারা সবাই একসঙ্গে আমার দিকে তাকাল। কিন্তু আমি তাতে একটুও ভয় না পেয়ে বুক ফুলিয়ে বললাম, ‘সাইকেলটা মেরামত করতে হবে।’
একজন এগিয়ে এল। হাতে তার একটা লোহার শিক। সেই শিক দিয়ে সে আমার অবোলা সাইকেলটার বিভিন্ন অঙ্গে নির্মম আঘাত হেনে অবস্থা পরীক্ষা করতে লাগল। এইভাবে অনেকক্ষণ ধরে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ চালিয়ে সে আমাকে প্রশ্ন করল, ‘কোন কোন জায়গা মেরামত করাবেন?’
লোকটার কুমতলব টের পেয়ে আমি আগেই তার কুমতলবের গোড়া মেরে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম। বললাম, ‘তুমি তো বাপু বড় বেয়াদব, দেখছি! তোমার কি চোখ নেই? দেখছ না, শুধু গদিটা আর হ্যান্ডেলটা একটু উঁচু করে টাইট করে দিতে হবে তাড়াতাড়ি ঠিক করে দাও, আর কত দিতে হবে, সে-কথা বল!’
লোকটা বলল, ‘মাড-গার্ডটা তাহলে বাঁকাই থাকবে?’
‘ঠিক আছে, মাড-গার্ডটাও না হয় সোজা করে দাও।’
‘তাছাড়া অন্যান্য জায়গা খুলে ফিট্ করলে ভালো হত।’
‘আচ্ছা, তা-ও না হয় করে দাও– যদি ভালো চলে।’
‘এতে আপনার কিছু সময় লাগবে। তা দশ-পনরো দিন লাগতে পারে। সাইকেলটা দোকানে রেখে যান।’
‘আর খরচ পড়বে কত?’
‘তা ত্রিশ-চল্লিশ টাকা লাগতে পারে।’
বললাম, ‘থাক, অত মেরামতে কাজ নেই। যা বলেছি, এখন তাই করে দাও। বাদ-বাকি পরে দেখা যাবে।’
লোকটা হ্যান্ডেল আর আসন উঁচু করে কষে দিল। তারপর চলে যাচ্ছি, এমন সময় সে আবার একটা ফোড়ন কাটল, ‘কষে দিয়েছি বটে, কিন্তু আপনার স্ক্রু সব ক্ষয়ে গেছে। একটু পরে আবার ঢিলা হয়ে যেতে পারে।’
বললাম, ‘বেয়াদব কোথাকার! তুমি দু আনা পয়সা তাহলে মাংনাই নিলে!’
‘সাইকেলটাও আপনি মাংনায় পাননি কি? এ সাইকেল আমরা চিনি। আপনার বন্ধু মির্জা সাহেব আপনাকে দিয়েছেন। কালু, এদিকে আয়! দেখ্ তো এটা সেই সাইকেল না! সেই যে মির্জা সাহেব গতবছর আমাদের এখানে বেচতে এনেছিলেন। চিনেছিস? তা কম করে একশ বছর বয়েস হবে এ সাইকেলের– কী বলিস?’
এইসব টিটকারি শুনে রাগে সর্বশরীর আমার জ্বলে যাচ্ছিল, ‘মির্জা সাহেবের ছেলে এই সাইকেলে করে কলেজ যেত। তার কলেজ ছাড়ার তো এখন পর্যন্ত পুরো দু-বছরও হয়নি।’
লোকটা বলল, ‘তা ঠিক। কিন্তু তার আগে মির্জা সাহেবও এই সাইকেলে চেপে কলেজ করতেন। তা কত বছর আগের কথা হবে রে, কালু?’ উত্তরটাও সে নিজেই দিয়ে দিল, ‘চল্লিশ বছরের কম হবে না, কী বলিস? তোর তো ব্যাটা তখন জন্মই হয়নি, বলবি কেমন করে!’
চোখ-কান বুজে, সব টিটকারি হজম করে আবার রওয়ানা হলাম। মিস্ত্রি যেরকম ধারণা দিয়েছিল, তার চাইতে অনেক তাড়াতাড়ি হ্যান্ডেল আর আসনের দুর্যোগ আবার আরম্ভ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চলার পর নেমে পড়তে হল আমাকে। কিছুদূর পর্যন্ত ঠেলে ঠেলে নিয়ে গেলাম। কিন্তু তাতে শরীরের ওপর কষ্ট আরও বেড়ে গেল। তখন সাব্যস্ত করলাম, পানির দামে হলেও সাইকেলটাকে বেচে ফেলব। রাস্তায় আরও একটা দোকান পড়ল। সাইকেল নিয়ে উঠলাম সেখানে গিয়ে।
দোকানদার এগিয়ে এল আমার দিকে। কিন্তু আমার মুখে যেন তালা-চাবি লেগে গেছে। চিরকাল কিনতেই অভ্যস্ত, বেচার কৌশল তো কোনোদিন আয়ত্ত করা হয়নি। কাজেই কোন কথা দিয়ে শুরু করব, তা কিছুতেই ঠাওর করতে পারছিলাম না। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর মুখ থেকে কেবল এইটুকু বেরুল, ‘সাইকেল।’ দোকানদার বলল, ‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি।’
আমার আবার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন, ‘নেবে?’
‘মানে?’
‘মানে বেচতে চাই।’
দোকানদার আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ভাবলাম, আমাকে আবার চোর বলে সন্দেহ করছে না তো! সে সাইকেলটা একবার দেখল, তারপর আমাকে দেখল। আবার সে সাইকেলটাকে দেখল, দেখে আবার আমাকে দেখল। তার এই দর্শন দেখে মনে হল, কোনটা সাইকেল, আর কোনটা আমি, তা যেন সে ঠাওর করতে পারছে না। শেষে বলল, ‘ওটাকে বেচে কী করবেন?’
এরকম বিদ্ঘুঁটে প্রশ্নের সঠিক উত্তর কী হওয়া উচিত, তা আল্লাই ভালো জানেন। আমার তা জানা নেই বলে পাল্টা প্রশ্ন করলাম আমি, ‘তুমি কি জানতে চাচ্ছ, সাইকেলটা বিক্রি করে আমি যে টাকা পাব, তা কোথায় খরচ করব?’
‘খরচ আপনি যেখানে খুশি করুন। কিন্তু তার আগে, এ সাইকেল যে কিনবে, সে এটা নিয়ে কী করবে?’
‘কেন, সাইকেলটার উপর চাপবে।’
‘আচ্ছা, না হয় চাপল। তারপর?’
‘তারপর? কেন, তারপর চালাবে।’
‘চালাবে! বেশ। খোদা বখ্শ, এদিকে আয় তো! এই যে এই সাইকেলটা বিক্রি হবে, বুঝেছিস?’
যে ব্যক্তির নাম খোদা বখ্শ, সে একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সাইকেলটা দেখতে লাগল। যেন কাছে এলে আমার সাইকেলটা তাকে কামড়ে দেবে। তারপর, আর একটু এগিয়ে এসে নাসিকা-রন্ধ্রে ঘন ঘন বাতাস ঢুকিয়ে বের করে দিতে লাগল। যেন গন্ধ শুঁকে সে আমার সাইকেলের মর্যাদা আঁচ করতে চায়। তারপর, তারা দুজন নিজেদের মধ্যে ফিসফাস্ আলাপ করল। শেষে খোদা বখ্শ আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনি তাহলে সত্যি সত্যি বেচে ফেলবেন?
আমি ঝাঁঝালো সুরে বললাম, ‘তবে কী? তোমার ধারণা, আমি তোমার সঙ্গে খোশ-গল্প করার জন্যে এখানে এসেছি?’
‘তাহলে কত দিতে হবে, বলুন।’
‘তুমিই বল।’
‘সত্যি করে বলব?’
‘হ্যাঁ, সত্যি করেই বল।’
‘সত্যি করে বলব?’
‘বললাম তো, সত্যি করেই বল। খামোখা কথা বাড়াচ্ছ কেন?’
‘তিন টাকা দিতে পারি।’
আমার রক্ত গরম হয়ে একদম মাথায় চড়ে গেল। রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগল আমার সারা শরীর। বললাম, ‘নীচ, ছোটলোক কথার তুবড়ি ফুটিয়ে তুই আজ আমার যে অপমান করলি, সেজন্যে আমার দুঃখ নেই। কিন্তু এই নিরীহ, অবোলা সাইকেলটার মনে তুই যে কষ্ট দিয়েছিস, সেজন্যে আমি তোকে রোজ-হাশরের দিন পর্যন্ত ক্ষমা করব না।’ এই বলে আমি তাড়াতাড়ি সাইকেলে চেপে, বেপরোয়াভাবে প্যাডেল চালিয়ে ছুটতে লাগলাম।
ততক্ষণে সাইকেল আমার কুড়ি-পঁচিশ পাক ঘুরেছে, কি ঘোরেনি– এমন সময় কেমন যেন একটা কাণ্ড হয়ে গেল। আমি মাটি থেকে পৃথক হয়ে শূন্যে উঠে গেলাম আর আকাশটা আমার দু-পায়ের ফাঁক দিয়ে নেমে গেল নিচে। আর দেখলাম, রাস্তার ধারের বাড়িগুলো পরস্পর জায়গা বলাবলি করছে। কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম, আমি মাটির উপরে বসে রয়েছি। আমার এই বসে থাকা এতই স্বাভাবিক আর নিশ্চিন্ততা-মিশ্রিত যে, এ যেন রাস্তা নয়, বরং আমি বসে রয়েছি আমার বৈঠকখানার বারান্দায়। এমন একটা স্বাভাবিক ব্যাপারের আমি কেন্দ্রবিন্দু, অথচ বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে রয়েছে যারা, তারা হাসছে। হাসির কারণ আবিষ্কার করতে গিয়ে দেখলাম, সাইকেলের সামনের চাকাটা গড়াতে গড়াতে গিয়ে পড়েছে রাস্তার ওই মাথায়, আর বাদ-বাকি আমার কাছেই স্তূপাকারে পড়ে রয়েছে।
আমি তাড়াতাড়ি মাটি থেকে উঠলাম। রাস্তার ওই মাথা থেকে চাকাটা নিয়ে এলাম। স্তূপের মধ্য থেকে বাদ-বাকি অংশ এ-হাতে, ও-হাতে, বগলের তলায়, গলায় ঝুলিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করে দিলাম।
সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দৃষ্টিবাণ আর বাক্যবাণের পরোয়া না করে চলতে লাগলাম মাথা উঁচু করে। যারা হাসছে, তারা হাসুক। এমন বেহুদা লোক শুধু এ দেশে কেন, সব দেশেই পাওয়া যায়।
আমি হাঁটছি, আর তাদের মন্তব্য আমার কানে ভেসে আসছে : ‘রাগ করে আর কী করবেন– হজম করে ফেলুন।’
‘নির্লজ্জ সাইকেল, চল্ তো বাড়ি, তারপর মজাটা টের পাওয়াব!’ একজন পিতা তাঁর পুত্রকে বললেন, ‘দেখেছিস, বাবা– এ হল সার্কাসের সাইকেল। দুই চাকাই আলাদা করা যায়।’
আমার চলতে থাকায় তবু বিরতি নেই। এইভাবে চলতে চলতে জনবসতি শেষ হয়ে পেছনে রয়ে গেল। নদীর উপরের পুলটায় পৌঁছে গেলাম। পরম নিশ্চিন্তে একটা একটা করে আমার সাইকেলের সব অংশ এমনভাবে নদীতে ফেলে দিলাম, যেমন করে কেউ চিঠি ফেলে লেটার-বক্সে।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
কপোতের প্রাণ – আলি আব্বাস হোসাইনি
স্বপ্নও কত বিচিত্র, অদ্ভুত ধরনেরই-না হয়ে থাকে। দেহ পড়ে থাকে বিছানায়, কিন্তু মন চলে যায় অন্য কোথাও। কত জায়গায়-না উড়ে বেড়ায় মন পাখির মতো ডানা মেলে দিয়ে। কত ভীষণদর্শী লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। কত পরী এসে শুনিয়ে যায় মনের কথা। কখনো প্রেম হয় স্বপ্নে। কখনো মনের মিল না হলে ঝগড়া বাধে। রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য– কোনোকিছু বাদ যায় না।
আমিও একদিন এইভাবে মসজিদের মোল্লার সঙ্গে আলাপ করছিলাম। আমি নিজে সবসময় ধর্মকর্ম নিয়ে থাকি, কাজেই আমার স্বপ্নও সেইরকম। কোনো এক কবির কোনো এক কবিতার একটি চরণ আমার মনে পড়ে গেল। সেইটি আমি মোল্লাকে শোনালাম। চরণের মর্ম এইরকম : ‘প্রেমের তরেই সৃষ্টি মানুষের– সেই জিনিসেরই বড় অভাব; এবাদত সবাই করে, যে এবাদতে প্রেম নিরস্তিত্ব।’
মোল্লা তো শুনেই চটে-মটে আগুন। কয়েকবার ‘লা-হওল’ পড়ে যখন তিনি বুকে ফুঁক দিচ্ছিলেন, তখন আমার ঘুম ভেঙে গেল।
ঘুম ভাঙার পর টের পেলাম, মোরগে আজান দিচ্ছে বটে, কিন্তু তখনো ফজরের সময় হয়নি। তখনো কাক ডাকেনি। তখনো সুবহে সাদেকের আলো ছড়িয়ে পড়েনি আল্লার রাজত্বে।
কিছুক্ষণ বিছানায় পড়ে পড়ে এপাশ-ওপাশ করলাম। তখন না ঘুমোনো যায়, না জেগে থেকে কোনো ফায়দা। সিগারেট ধরিয়ে স্বপ্নের সেই কবিতার সঠিক মর্ম উদ্ধারের চেষ্টা করতে লাগলাম। এই চেষ্টার ফলে চোখ জুড়িয়ে আসতে চাইল। ভাবলাম, শয়তান আমার চোখে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। এখন যদি ঘুমিয়ে পড়ি, তাহলে ফজরের নামাজ শিকেয় উঠবে, আর ফজরের নামাজ শিকেয় উঠলে শয়তানেরই লাভ।
সুতরাং, শয়তানকে নিরাশ করা উচিত বলে মনে হল। উঠলাম। উঠে, সময় না হওয়া সত্ত্বেও ওজু করে জায়নামাজে এসে বসলাম।
বসে বসে ‘নিদ্রা অপেক্ষা নামাজ শ্রেয়’ ধ্বনি শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, এমন সময় বাইরের বারান্দার উপরের কার্নিশে ডানা-ঝাঁপটানোর শব্দ শুনলাম। অল্প পরেই একটা সাদা পায়রা বারান্দার খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উড়তে উড়তে, পড়তে পড়তে আমার কোলে এসে নামল। পাখিটি আমার জামার ভেতরে সেঁধতে চাইল। কাপড়ে তার সারা দেহ ঢেকে গেল, কেবল বেরিয়ে থাকল মাথাটুকু। ছোট্ট, গোল গোল চোখ দুটো দিয়ে পিট্ পিট্ করে তাকাতে লাগল। জামার ভেতরেও আমি টের পেলাম, তার সারা শরীর কাঁপছে। ছোট্ট, লাল জিবটা থেকে-থেকে বেরিয়ে পড়ছে। আস্তে করে পায়রাটার পিঠে হাত রাখলাম। এতে সে আরও সঙ্কুচিত হল। আস্তে আস্তে পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলাম। এতে ক্রমে ক্রমে সে শান্ত হল আর ভয়ের ভাব কেটে যেতে লাগল।
তারপর, আমি ভাবতে লাগলাম, এখন কী করি। পায়রাটা নিশ্চয় কোনো বিপদের মুখে পড়েছিল। সে আশ্রয়প্রার্থী। আশ্রয়প্রার্থীকে, বিপন্নকে আশ্রয় দেওয়া আমার ফরজ। কিন্তু আমার ঘরে পায়রা রাখার খুপরি নেই। কিংবা অন্য কোনো ব্যবস্থার কথাও আমার মনে পড়ল না। সুতরাং, আপাতত একটা ঝুড়ির মধ্যে রাখব সাব্যস্ত করলাম।
জায়নামাজ থেকে নিজেকেই উঠতে হল। পাশের ঘরে আমার দুই দুটো জোয়ান ছেলে ঘুমুচ্ছে। তাদের জাগাতে মন সরল না। আমার ধর্মীয় নীতি-জ্ঞান আমাকে এই শিক্ষাই দিয়েছে যে, ঘরের জোয়ান ছেলেকে ফজরের সময় জাগাতে হলে জোরে জোরে আজান দাও বা একামত হাঁকো; তাতে জাগে জাগুক, না জাগে নাই জাগুক। কিন্তু গায়ে হাত দিয়ে ঘুম ভাঙিও না; কেননা তখন সে এমন অবস্থাতে থাকতে পারে, যা দেখলে তাকে লজ্জা পেতে হতে পারে।
সুতরাং, বারান্দায় বেরুলাম ঝুড়ি খুঁজতে। কার্নিশ থেকে ধ্বনি উঠল, ‘ম্যাও ম্যাও।’ ভাবলাম, আলো জ্বেলে বিড়ালটা কোথায় রয়েছে, দেখি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, বিড়ালের এই ডাকের মধ্যেও এক ধরনের কাকুতি রয়েছে, নালিশ রয়েছে। আমি তার শিকার ছিনিয়ে নিয়েছি মুখ থেকে। কারো মুখের আহার কেড়ে নেওয়ার কী অধিকার রয়েছে আমার! বিড়াল সেই নালিশই তো জানাচ্ছে আমার কাছে। দিন কয়েক আগে সে বাচ্চা দিয়েছে। বাচ্চাদের চোখ ফোঁটানোর জন্য সে রোজ কয়েকবার করে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা বয়ে নিয়ে বেড়ায়। নিজের এই ছোট সংসারের তত্ত্বাবধানে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয় তাকে। তার ওপর, এতগুলো বাচ্চাকে নিজের শরীর থেকেই দুধ নিংড়ে বের করে দিতে হয়। সেই দুধ কোত্থেকে আসবে যদি সে দু-বেলা দু-মুঠো খেতে না পায়। আজকে ভারি চমৎকার একটা খাদ্য পেয়েছিল। পুরো একটা পায়রা সে পরম তৃপ্তিসহকারে পেট ভরে খেতে পারত।
নতুন ভাবনার জট পাকিয়ে গেল মনের মধ্যে। আমার ধর্মীয় বিবেক কোনো সমাধান করতে পারল না এ সমস্যার। আল্লাহ্তালা এক জীবকে অন্য জীবের খাদ্য করে সৃষ্টি করেছেন। গরু, মোষ, ছাগল– এরা ঘাস, শাক-সবজি, গাছের নরম নরম, কচি কচি পাতা খেতে খুবই ভালোবাসে। এইসব খেয়ে তারা যে বিষ্ঠা ত্যাগ করে, খাদ্য হিসেবে তা পোকামাকড়ের প্রিয়। পাখিতে আবার পোকামাকড় খেয়ে তৃপ্তি পায়। এইসব চতুষ্পদ জন্তু আর পাখি চলে যায় মানুষের পেটে। যে-সব চতুষ্পদ মানুষে খায় না, তাদেরকে ভক্ষণ করার জন্য অন্য জীবের অভাব নেই। কাউকে খায় বাঘে, না হয় ভল্লুকে, কাউকে খায় চিলে, না হয় শকুনে। বনে-জঙ্গলে কোনো জন্তু মাংসাশী, আবার কেউ-বা নির্ভেজাল নিরামিষাশী। পুরুষ-নারী-নির্বিশেষে এই প্রক্রিয়া অনন্তকাল ধরে চলে আসছে।
আমি এইসব কথা চিন্তা করছি, এদিকে বালবের আলো খুকুমণির ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে লাগল, ওদিকে বিড়াল আমার হাতে পায়রা দেখতে পেয়ে আরও জোরে নালিশ জানাতে লাগল। ‘মিয়াও মিয়াও।’ খুকুমণির ঘুম গেল ভেঙে। খুকুমণি উঠল। উঠে বসল। বসে, আমার হাতে পায়রা দেখে দু-হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আব্বু, আমাতে দাও!’ খুকুমণি এখনো ক বলতে পারে না, বলে ত। তেমনি র-কে বলে ল।
আমি ওকে প্রবোধ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, ‘না, মা-মণি, একটা অন্য লোকের পায়রা– আমি তোমাকে কেমন করে দিই!’
‘তুমি যে বলেছ– এটা আমাল।’
এখন কেমন করে ওকে বোঝাই, ধরলেই কিছু একজনের পায়রা অন্যের হয়ে যায় না। আমার সব সন্তানকেই আমি বরাবর এই শিক্ষা দিয়ে আসছি যে, রাস্তায় কোনো জিনিস কুড়িয়ে পেলেও সেটা তার হয়ে যায় না। তাছাড়া, পায়রাটাকে আমি কুড়িয়ে পাইনি। ধরিওনি। সে তো প্রাণরক্ষার জন্য নিজে থেকে আমার কোলে এসে পড়েছে। ধর্মে বলে, আশ্রয়প্রার্থীকে আশ্রয় দাও। নিজের প্রাণ বিপন্ন করে হলেও বিপন্নকে রক্ষা কর।
এইসব কথা ভাবছি, এমন সময় খুকুমণির বড়টা অর্থাৎ খোকন জেগে উঠল। ঘুমের যখন পরিশিষ্ট দশা, তখন বোধহয় আমাদের কথা সে শুনেছিল। সুতরাং, বিনা ভূমিকায় সে রায় জারি করে দিল, ‘খুকুমণিকে এই পায়রা দিও না, আব্বু। ওর হাত থেকে পালিয়ে যাবে, ধরে রাখতে পারবে না।’
খুকুমণি ঘাড় বাঁকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠল, ‘তেন, পালিয়ে যাবে তেন? আমি যে খুব শক্ত কলে ধলে থাতব।’ এই বলে সে শক্ত করে ধরে থাকার ভঙ্গিটাও দু-হাত জোড়া লাগিয়ে দেখিয়ে দিল।
এ কথায় ফারসি কবিতা আমার মনে পড়ে গেল। আহা কী কবিতা!
‘দিলম্ মানন্দ্ কুঞ্জশ্কে
ব দস্ৎ-এ তিফ্ল্-এ নাদানে
কে আজ্ জাঁ দোসৎ-তর্ দারদ্
ওয়ালেকিন মি-কশদ্ জানে।’
(আমি যেন মূর্খ শিশুর হাতে চড়ুইপাখির মতো। প্রাণের চাইতে প্রিয় ভাবছে বটে, কিন্তু আমার প্রাণটা বেরিয়ে যাচ্ছে।)
খোকন বলল, ‘আব্বু, পায়রাটা আমাকে দাও– আমি মোল্লাজিকে দিয়ে আসব। তিনি পায়রা পোষেন। কতজনের পায়রা যে ধরে ধরে পুষেছেন তিনি।’
‘বলছ কী! আর, যার পায়রা, সে চাইতে আসে না?’
‘হুঁহ্, চাইতে আসবে? কার এত সাহস যে, মোল্লাজির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলে! যদি কেউ চাইতে আসেও, মোল্লাজি এমন ধমকটাই দেবেন যে, পালাতে পথ পাবে না।’
আমি জানি, খোকন বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে খুব ওস্তাদ। ওকে তাই সে সুযোগ দেওয়ার জন্য প্রশ্ন করলাম, ‘তখন কী বলেন মোল্লাজি, একটু শোনাও দেখি!’
‘বলেন, আমি এই পায়রা তোমার ঘর থেকে ধরে আনিনি। এ তোমার ঘরে থাকতে চায় না। তোমার কোনো পায়রার সঙ্গেই এর সম্পর্ক ভালো নয়। সেইজন্য এ আমার ঘরে নিজে থেকেই চলে এসেছে। আমার পায়রাদের সঙ্গে গটরগুঁ-গটরগুঁ করে সুখে-শান্তিতে আছে। এ পায়রা আমার দানা খেয়েছে, আমার পানি খেয়েছে। আমি কেমন করে একে আবার একটা জালেমের হাতে ছেড়ে দিতে পারি। ব্যস্, আপনি এখন আল্লার শুকর আদায় করতে করতে ঘরে ফিরে যান।’
এই কৃত্রিম বক্তৃতা শুনে আমার খুব হাসি পেল। আমি খোকনের কাছে খোকনের বিছানায় গিয়ে বসলাম। এই সুযোগে খুকুমণি চট্ করে পায়রার মাথায় হাত বুলোতে শুরু করে দিল। পায়রা বোধহয় এতে আরাম পেল, তাই সে চোখ বুজল পরম তৃপ্তিতে।
জীব-জন্তু, পশু-পক্ষীর বিষয় নিয়ে গল্প বলে আমি আমার ছেলেমেয়েকে জীবনের এই জটিল পরিস্থিতি সম্বন্ধে কিছু উপদেশ দেব, ভাবছিলাম, এমন সময় বেড়ালটা উপরের কার্নিশ থেকে নেমে নিচের বারান্দায় একেবারে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর, পায়রার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি মেলে বলল, ‘ম্যাও ম্যাও।’
খোকন বেটা-ছেলে বলেই বোধহয় নিষ্ঠুর। তাই সে পরামর্শ দিল, ‘আব্বু, পায়রাটাকে বারান্দায় ছেড়ে দাও। আমরা দেখব, বেড়ালটা ওকে ধরতে পারছে, না পায়রাটা উড়ে পালিয়ে যাচ্ছে।’
কিন্তু খুকুমণি বলল, ‘না, আব্বু, বেলাল তাহলে ওতে খেয়েই ফেলবে।’
শিশুদের নিষ্ঠুরতা আর কারুণ্যের মনস্তত্ত্ব নিয়ে মনের মধ্যে আলোড়ন চলছিল, এমন সময় পাশের বাড়িতে একসঙ্গে অনেক পায়রার ডাক শোনা গেল। আমার প্রতিবেশী একসঙ্গে সব পায়রা ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের আকাশে ওড়া আর ছাদে নামা টের পেলাম। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠলাম। বিড়ালটাও অনুসরণ করল আমাকে। বিড়ালটা সত্যি ক্ষুধার্ত। একবার মনে হল, সে বুঝি আমার হাত থেকে পায়রাটাকে ছিনিয়ে নেবে। আমি একটা ঢিল মেরে বিড়ালটাকে তাড়িয়ে দিলাম। তারপর, প্রতিবেশীর পায়রাগুলো যেই আর এক দফা আকাশে উড়ল, অমনি হাতের পায়রাটাকে জোরে ছুঁড়ে দিলাম বাতাসে। প্রতিবেশীর পায়রাদের সঙ্গে সে অনায়াসে মিশে গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি তাই দেখলাম, আর ভাবতে লাগলাম, না জানি কার পায়রা কার কাছে চলে গেল। তবু সান্ত্বনা, বিড়ালের হাত থেকে সে রক্ষা পেয়েছে।
কিন্তু বিড়ালটাকে তো চুপ করানো গেল না। ‘ম্যাও ম্যাও’ রবে তার বিক্ষোভ আর আর্তনাদ চলতেই থাকল। বিক্ষোভ মুখের আহার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে, আর্তনাদ ক্ষুধার্ত থাকার যন্ত্রণায়।
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামবার সময় মুখে ‘চু চু’ ধ্বনি করে আর ‘পুষি পুষি’ বলে ডেকে তাকে নিচে নামাবার চেষ্টা করলাম। আমার উদ্দেশ্য অসৎ ছিল না। কিন্তু বিড়াল আমাকে বিশ্বাস করতে পারল না। করবেই-বা কেন। একে তো সে আমার পোষা বিড়াল নয়, তার ওপর আমি তার মুখের আহার কেড়ে নিয়েছি। কাজেই আমার সঙ্গে সঙ্গে নিচে নামল না সে। না নেমে কার্নিশ থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলতে লাগল, ‘ম্যাও ম্যাও।’ আমি এই বুলির পরিষ্কার অর্থ করলাম, আমি ক্ষুধার্ত, আমি খাদ্য চাই।
খুকুমণি আমার এই অর্থের যেন প্রতিধ্বনি করেই বলল, ‘আব্বু, ওল ক্ষিধে পেয়েছে। কালকেল দুধ আছে, ওতে থেতে দাও।’
খোকন এই প্রস্তাবের প্রতিবাদ করে উঠল। ‘বা বা, আর আমরা চা খাব কী দিয়ে?’
‘তেন, এথুনি দুধ আসবে না? সেই দুধ দিয়ে আমলা চা থাব।’
আমাদের হৈহুল্লা আর বিড়ালের চিৎকারে খোকা-খুকুর মায়ের বুঝি ঘুম ভেঙে গেল। তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়েই হাঁক ছাড়লেন, ‘সাত-সকালে কিসের এত গোলমাল, শুনি?’
এ প্রশ্নের উত্তর দিল বিড়াল, ম্যাও ম্যাও।’
‘ও বুঝেছি, এই ভোরবেলায় আল্লা-রসুলের নাম না নিয়ে বাপ-বেটিতে বেড়ালকে নিয়ে মশকরা হচ্ছে বুঝি?’
বললাম, ‘না, মশকরা নয়, ও বেচারা খেতে পায়নি কিনা, তাই ‘
‘তা বাসি কিছু থাকলে খেতে দিলেই তো হয়। একগাদা বাচ্চা দিয়েছে, ক্ষিদে তো পাবেই।’ এই বলে মনে হল যেন, তিনি আবার পাশ ফিরে শুলেন।
খুকুমণির অনুরোধের সমর্থন পাওয়া গেল তার মায়ের কাছে। কাজে কাজেই একটা থালায় করে আধ পোয়াটেক দুধ আর তাতে পুরো একটা রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে মেশালাম। মিশিয়ে বিড়ালকে দেখিয়ে দেখিয়ে সিঁড়ির কাছে রেখে এলাম। আর নিজে দাঁড়িয়ে থাকলাম বিড়ালের দৃষ্টির আড়ালে গিয়ে। বিড়াল দ্রুত পায়ে থালার কাছে গিয়ে কয়েক মুহূর্তে সাফ করে দিল থালাটা।
এই দৃশ্য খুকুমণি দেখল খুঁটির আড়াল থেকে।
কিন্তু খেয়ে-দেয়ে বিড়াল আবার শুরু করল, ‘মিয়াও মিয়াও।’
খুকুমণি বলল, ‘ভাগ, ভাগ, দূল হ।’
এমন সময় পেপারঅলা খবরের কাগজ দিয়ে গেল। খোকন দৌড়ে গিয়ে খবরের কাগজ এনে দিল আমার হাতে। প্রথম পৃষ্ঠায় ব্যানার হেডলাইন। তার মর্ম : ইস্রাইল আজরাইল। ইস্রাইলের আজরাইলরা পূর্ব-জর্ডান আর মিসরের ওপর আকস্মিক হামলা চালিয়েছে। হাওয়াই হামলায় শত শত মুসলমান নিহত, বহু গ্রাম ধ্বংসপ্রাপ্ত, হাজার হাজার পরিবার গৃহহারা।
বিড়াল বলল, ‘ম্যাও ম্যাও।’
আমি নিজেকে ডুবিয়ে ফেললাম চিন্তার মহাসমুদ্রে। এই কি সেই আরবজাতি, যাদের ডঙ্কাধ্বনি একদিন সারা দুনিয়ার বুক কাঁপিয়ে তুলেছিল। যারা কাইকাউস, কাইখর দেশ তুড়ি মেরে জিতে নিয়েছিল। যারা একদিন ত্রাসের কারণ ছিল গোটা ইউরোপের কাছে। যারা রোম সাম্রাজ্যের সমস্ত গর্ব ভূলুণ্ঠিত করে দিয়েছিল। যারা আলেকজান্ডারের দেশে পর্যন্ত গিয়ে রাজত্ব করেছিল। যাদের তারেক আর সালাহুদ্দিনের তরবারির কাছে তাবৎ ঈসাই আর ইহুদির মাথা নত হয়ে গিয়েছিল। সেই আরবজাতির বীরত্ব আজ কোথায় গেল?
বিড়াল বলল, ‘ম্যাও ম্যাও।’
মনে হল, দুনিয়াটাই পাল্টে যাচ্ছে। তলওয়ারের যুগ শেষ হয়েছে। এখন বোমার যুগ, রকেটের যুগ, ট্যাঙ্কের যুগ। ঢাল-তলোয়ার, তীর-ধনুক দিয়ে এখন আর যুদ্ধ করা যায় না। রেড-ইন্ডিয়ানরা পারেনি কেন রাইফেলের মুখে টিকে থাকতে। সাহসে কি তারা কম ছিল কোনো অংশে? দক্ষিণ আফ্রিকার জুলুরা বাঘের জাত। তাদের আজ কী অবস্থা? পেরেছে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা টিকে থাকতে? রোডেশিয়ার কৃষ্ণকায়দের আজ কী অবস্থা? মুষ্টিমেয় সাদা চামড়ার প্রভুদের তারা আজ পারছে না কেন উচ্ছেদ করতে? ভিয়েতনামের আজ কী দশা? সর্বত্র সবল দুর্বলকে চিবিয়ে খাচ্ছে।
বিড়াল বলল, ‘ম্যাও ম্যাও।’
আমার ভারি রাগ হল। কমবক্ত চায় কী? এই বাড়িতে যত খাদ্য রয়েছে, সবই খাইয়ে দিতে হবে নাকি তাকে। সাম্রাজ্যলোভী দেশের মতোই বিড়ালটাও লোভী। ওর পেট কোনোদিনও ভরবে না।
বিড়াল আবার বলল, ‘ম্যাও ম্যাও।’
আমি বললাম, ‘চুপ, আজরাইলের বাচ্চা!’ বলেই মনে মনে চমকে উঠলাম। ঠিক হল কি এই গাল দেওয়াটা? বারবার ‘লা-হওল’ পড়তে লাগলাম। পড়তে পড়তে যেতে লাগলাম জায়নামাজের দিকে।
কিন্তু ততক্ষণে সূর্য উঠে গেছে। ফজরের নামাজটা আমার কাজা হয়ে গেল। কাজা নামাজে দাঁড়ানোর পরও বারবার আমার মনোযোগ ছিঁড়েখুঁড়ে গেল এই ভাবনায় : একটা পায়রার প্রাণ রক্ষা করাটা কি আল্লার এবাদত নয়?
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
মিস্ লোভিট – কৃষণ চন্দর
দিন পূর্ণ হল। যেমন জীবনের দিন পূর্ণ হয় অর্থাৎ, শেষ হয়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, আকাশে ষষ্ঠীর চাঁদ ঝুলে রয়েছে নিঃশব্দে– একটা নিঃসঙ্গ শিশুর মতো, যে খোকার সঙ্গী নেই।
শহরের রাতের অনেক রং। কিন্তু পাহাড়ে রাতের মাত্র দুটো রং– জ্যোৎস্না আর অন্ধকার। গিরিকন্দর আঁধারে ছেয়ে থাকে আর পাহাড়ের চূড়ায় চাঁদের ঝলমলে আলো। বন যেন জ্যোৎস্নার চাদর গায়ে ঘুমিয়ে আছে, আঁধারে আর আকাশের প্রান্তদেশে চাঁদের আলো হাসছে। ষষ্ঠীর চাঁদের জ্যোৎস্না কম, অন্ধকার বেশি। আঁধারে বৃক্ষের শাখায় তোরণের মতো চাঁদের আলো এসে পড়ে কখনো কখনো। আর কোনো উঁচু পাথরের উপর বসে চাঁদের আলো কোনো দূরযাত্রী শ্রান্ত পথিকের মতো বসে থাকে। আবার কখনো অন্ধকারে লুকোনো মুখের ঠোঁটের ওপর চাঁদের আলো ছিটকে এসে পড়ে যেন নিয়তি অন্ধকার থেকে মানুষের প্রতি প্রসন্ন হয়ে উঠল।
.
ক্লাবের আধো-ঢাকা আধো-খোলা লাউঞ্জে বসে সকলেই আলো-আঁধারিতে ডুবে আছে। নীরব। কারণ পাহাড়ের চরিত্রই নীরবতাপূর্ণ। ডিনারের আগ পর্যন্ত লাউঞ্জের আলো নিভিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে সবাই অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি লাভ করে। আর আলো- আঁধারির দাবার ছকে সবাই যাতে স্বপ্নের ঘর সাজাতে পারে। আলো নিভতেই আলাপচারীও কমে গেল। অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল আর সেই আঁধারে চাঁদের আলো সসংকোচে আঙুল দিয়ে মানুষ ও বস্তুকে স্পর্শ করতে এল। কারো চোখে পড়তেই সে চোখ কোমল নয়ন হল, কারো চুলে গিয়ে আলো ঝলমল আঁচলে রূপান্তরিত হল। মদের পেয়ালায় গিয়ে স্বপ্নের ঢেউ খেলতে লাগল– রঙিন ঠোঁটে লেগে রক্তিম রুবির রূপ নিল– আংটির পাথরে লেগে হীরের মতো চক্চক্ করতে লাগল– কানের ঝুমকোয় লেগে আলোর ফানুস বানিয়ে দিল।– চাঁদনি যেন বলছে– আমি থাকতে আঁধারের সংকোচ কিসের?
.
আজ চাঁদের আলো মিস্ লোভিটের হৃদয়কেও স্পর্শ করেছে। আর সবার থেকে দূরে একটা সোফার উপর খুবই সংকুচিত হয়ে সে বসে আছে। তার সমস্ত দেহ অন্ধকারে ঢাকা আর হাতের কব্জিটা শুধু টেবিলে রাখা ব্রান্ডির গ্লাস পর্যন্ত প্রসারিত। তার সেই প্রসারিত কব্জিতে পাতলা একটা সোনার কাঁকন– যা তার কুঁচকানো চামড়াকে ছুঁয়ে থরথর করে কাঁপছে। আজ বৃদ্ধা মিস লোভিটের পঁচাত্তর বর্ষপূর্তি। তাই আমার আমন্ত্রণকারী বন্ধু মিস্ লোভিটকে (তার পুরনো গভর্নেস ছিল)– আজ নিমন্ত্রণ করে ক্লাবে নিয়ে এসেছে। মিস্ লোভিটের পোশাক সাদামাটা। তার কাছে যে ধরনের পোশাক আছে– এটা সেগুলোর চেয়ে উত্তম। অনেকদিন পর সে আজ হয়তো ঠোঁটে রং মেখেছে। চুল বাঁধা টানটান করে। যদিও ধনীদের মনে যতগুলো খেয়াল আছে– তার চুলের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি নয়। তবু সে তার এই সামান্যতম চুলের পুঁজিকেই সযত্নে ধুয়ে আঁচড়ে নিয়েছে। গায়ে সুগন্ধিও মেখেছে। তেমনি পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে হাতের কব্জিতে তার একমাত্র অলংকার কাঁকন পরেছে আজ। সে আমার বন্ধুর সঙ্গে ক্লাবে এসেছে। ঘাঁটি থেকে নেমে আমি আবার নতুন করে মিস্ লোভিটকে দেখলাম। তারপর সতর্কতার সঙ্গে আমার স্ত্রীর সঙ্গে যখন চোখাচোখি হল, তখন আমাদের উভয়ের চোখেই এক প্রশ্ন ছিল। বুড়ি ঘুড়ির রঙিন সাজ! আমরা দেড় সপ্তাহ যাবৎ আমাদের বন্ধুর বিরাট বাংলোয় অবস্থান করছি। কালই দিল্লি যাবার কথা। তাই আজ আমাদের সম্মানে আমার বন্ধু এই ডিনার দিচ্ছেন। দৈবাৎ এই ডিনারের সঙ্গে মিস্ লোভিটের পঁচাত্তর বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানও সংযোজিত হয়ে গেছে। এক ঢিলে দু-পাখি মারা সম্ভবত একেই বলে।
এই দু-সপ্তাহে আমি মিস্ লোভিটকে ‘হ্যালো’ ছাড়া আর কোনো কথা বলার সুযোগ পাইনি। মিস্ লোভিট খাঁটি ইংরেজ মহিলা। তাকে স্বর্গীয় মহারাজা– আমার বন্ধুর পিতা– তার স্ত্রী ও সন্তানকে সুশিক্ষা দানের জন্যে গভর্নেস রেখেছিলেন। তখন ইংরেজদের আমল ছিল। তালুকদারদের শানশওকতের যুগ– জীবনের কত সুন্দর অভিজ্ঞতা কত আনন্দঘন মুহূর্ত মিস্ লোভিট উপভোগ করেছেন তা সত্যি অনুমেয়। যারা সেদিনের একটু চমক দেখেছে তারা কিছুটা আঁচ করতে পারে। কিংবা তার অবশেষ আমার ভঙ্গুর প্রাসাদোপম বাংলো দেখেও আঁচ করা যায়। এই বুড়ো বয়সেও মিস্ লোভিটের দিকে তাকালে বোঝা যায়, যৌবনে তিনি কী বিপজ্জনক সুন্দরী ছিলেন। এবং সেকালের ধনী তরুণরা তাঁর জন্যে কত না কী করতে সংকল্প করত। মিস্ লোভিটকে দেখলেই এ কথা মনে হয়। কিন্তু পতনোন্মুখ পুরাকীর্তি দূর থেকে দেখাই উচিত। কারণ একবার দেখলে আর দেখবার আগ্রহ থাকে না। সাহসও হয় না। তাই এতদিন এক বাড়িতে বাস করেও ‘হ্যালো’র বেশি কথা বলতে পারিনি। আমাদের হৈ-হল্লা, কলকাকলিতে আমরা মেতে থাকি, তবু দূর থেকে মিস্ লোভিটের অনুভূতি যেন আমাদের ওপর প্রভাব ফেলে। আর সেই পাণ্ডুরবর্ণ ইংরেজ মহিলার অবস্থিতি আর নিষ্প্রাণ চেহারা যেন কোনো পোকায় কাটা পুরনো বই-এর মতো বাতাসে নড়তে থাকে। মিস্ লোভিট তার কুকুরের পশম আঁচড়ে দিচ্ছে। মিস্ লোভিট একা বসে খেলছে। নিঃসঙ্গ একাকী বিপদক্লিষ্ট, মিইয়ে যাওয়ার মতো মিস্ লোভিটের ছায়া থেমে থেমে কাঁপে, আবার কাঁপতে কাঁপতে থামে। শুধু এদিন আমি এই ছায়ার পাশে সারাক্ষণ বসে থেকে ভীতকণ্ঠে আমার বন্ধুকে জিগ্যেস করেছিলাম। জিগ্যেস করার সময় আমার কণ্ঠে তিক্ততা ছিল বেশ।
.
ইংরেজ যখন চলে গেল, তখন এই মহিলার এখানে পড়ে থাকার আর সার্থকতা কী ছিল? এমন তো নয় যে এখানকার আবহাওয়া তার জন্যে স্বাস্থ্যকর ছিল– কিংবা আমার দেশের মানুষ, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তার আগ্রহ আছে। তার পোশাক-পরিচ্ছদ আলাদা। ইংরেজি কুকুরও পোষে। ইংলিশ ডিশ খায়। থাকেও আলাদা। তার কী দরকার ছিল হিন্দুস্তানে থাকার
আমার বন্ধু বলল, ‘গত ত্রিশ বছর ধরে ইনি আমাদের এখানে আছেন। শৈশবে আমি এঁর কাছেই লেখাপড়া শিখতে শুরু করি। কেননা আমার বিয়ে হয়েছিল বাল্যবয়সে। আমি তখন নিজে কাপড় পরতেও জানতাম না। ইনি আমাকে লেখাপড়া, আদব-কায়দা শিখিয়ে বড় করে তোলেন। ত্রিশ বছর একসঙ্গে থাকতে থাকতে এটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে যে আমিও তাঁকে ছাড়তে চাইনে, তিনিও আমাকে ছাড়তে চান না। যদিও এখন আর আমার গভর্নেস-এর প্রয়োজন নেই। আর যে দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে…’ হঠাৎ সে থামল। তারপর হেসে বলল, ‘হয়তো একদিন আমিই কারো গভর্নেস হয়ে যাব। তবু তাঁকে নিয়েই দিন কাটিয়ে যাচ্ছি।’
কথা বলতে বলতে ক্লাবে এসে গেলাম। ভেতরে গিয়ে বসলাম আমরা।
.
মিস্ লোভিট কম্পিত হস্তে গ্লাস তুলে নিলেন। এবং এক চুমুকেই পুরোটা শেষ করে ফেললেন। তখন হঠাৎ আমার কী যেন মনে হল। আমি বেয়ারার কাছ থেকে এক পাত্র ব্রান্ডি নিয়ে সুদেহী পুরুষ ও সুবেশিনী নারীর দঙ্গল ছেড়ে গ্লাস নিয়ে সেই নিঃসঙ্গ একাকিনী বসা মিস্ লোভিটের কাছে গেলাম। গ্লাসটা তাঁর টেবিলে রেখে সোফায় তাঁর পাশে বসলাম এবং বলতে লাগলাম, ‘আমি আপনার স্বাস্থ্য পান করতে এসেছি।’
‘ওহ্! থ্যাংক ইউ! থ্যাংক ইউ…’
মিস্ লোভিটের কম্পিত কণ্ঠস্বর শুনে মনে হল, এ যেন কান্নার সুর। আমি নীরব হয়ে গেলাম। কিছু বুঝতে পারলাম না। কী বলব, আর কী বলব না। অনেকক্ষণ নীরবেই কাটালাম। আমার মনে হল, যেন আমি কোনো একটা পরিত্যক্ত কামরায় প্রবেশ করেছি এবং একটা পুরনো জানালা খুলে বর্ষণসিক্ত দিনের ইংলিশ মোরল্যান্ডের রঙচটা অনুভূতিহীন দৃশ্য অবলোকন করছি। যদিও বৃষ্টি ছিল না– বৃদ্ধা মুখচ্ছবির ওপর নিঃশব্দে অশ্রু ঝরছিল– এ এমন অশ্রু যার কোনো সাড়াশব্দ ছিল না। যা অদৃশ্যভাবে নির্গত হয় এবং কোনো অতলে গিয়ে প্রবেশ করে।
অবশেষে আমিই বললাম, ‘আপনি কাঁদছেন মিস্ লোভিট?’
তিনি কিছু বললেন না। সমস্ত লাউঞ্জ নীরব। যেন আমরা ক্লাবের বদলে কোনো বনভূমিতে বসে আছি। চারদিকই নিস্তব্ধ। প্রত্যেকেই আত্মচিন্তায় বিভোর। শুধু মাঝে মাঝে গভীর জঙ্গলের মাঝে ঝরনাধারার কলকল ধ্বনির মতো মেয়েদের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটে হঠাৎ মিস্ লোভিট বলে উঠলেন, ‘আমার মার্কোর কথা মনে পড়ছে।
‘মার্কো কে?’ আমি জিগ্যেস করলাম।
‘আমার ভাবী বর ছিল।’
‘সে কি ফরাসি?’
‘না, আধা-ফরাসি আর আধা-ইতালীয়। তার সুগঠিত দেহে দুটো জাতিরই পৌরুষ মিশ্রিত ছিল। তার গায়ের রং ছিল ইতালীয়দের মতো জলপাই রঙের। নাক আর ঠোঁট ছিল ফরাসিদের মতো। কপালটা ইতালীয় আর হাসিটি ছিল ফরাসিদের মতো। আর তেমনি ছিল তার স্পষ্ট ভাষণ। ক্ষণিকেই রেগে আগুন হত– সেই রাগ ইতালীয়দের স্বভাবজাত রাগ। মার্কোর মতো পুরুষ আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। বুকটা ছিল খুব চওড়া– যেন জাহাজের পাল। দেহটা ঠিক মাস্তুলের মতো দীর্ঘ। চোখ দুটোয় দুনিয়ার চাঞ্চল্য আর কৌতূহল ভরা– যেন একটি শিশুর চোখ।’
বলতে বলতে মিস্ লোভিটের কণ্ঠস্বর পাল্টে গেল আর মুখমণ্ডল যেন সৌন্দর্যের প্রত্যাশায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। মনে হল, বৃষ্টি থেমে রোদ এসেছে। আর এই নীরব কক্ষ খোশমেজাজি নারী-পুরুষের আলাপের গুঞ্জনে ভরে গেল।
.
সেটা ছিল বোম্বাইয়ের সমুদ্রতটে উঁচু টিলার উপরকার একটা কক্ষ। সেই দোতলা বাড়ির উপরতলার সমুদ্রের দিকের খোলা জানালা। সেই বাড়িতে মার্থা লোভিট তার বাপ-মা-ভাই-বোনদের সঙ্গে থাকত। মেজর লোভিট আর্কিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের একজন কর্মকর্তা ছিলেন এবং বান্দ্রার উপকূলে বারো কামরার এই বিরাট বাড়িতে সপরিবারে থাকতেন। সেই বাড়িতেই একদিন মার্থা লোভিট মার্কোকে নিয়ে এসেছিল। তার কয়েকদিন আগেই মার্থার সঙ্গে মার্কোর দেখা হয় আর্মি ক্লাবে। ১৯১০ সালের কথা। একটা ইতালীয় জাহাজ ইউরোপীয় পর্যটকদের নিয়ে ভূ-প্রদক্ষিণে বেরিয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে তারা বোম্বে আসে। আর্মি ক্লাবের ব্যবস্থাপকরা সেই জাহাজের সমস্ত ইউরোপীয়কে নিমন্ত্রণ জানায়। সেই জাহাজের একজন নাবিক ছিল মার্কো। সেখানেই মার্থার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ। আর দেখা মাত্রই হৃদয় অর্পণ করে বসে মার্থা। মার্থা ছিল খুবই সুন্দরী আর এই গরম দেশে থেকে মেজাজটা বেশ গরম হয়ে উঠছিল। তাই ইংরেজ সিপাই বা ভদ্রলোকদের শীতল ভদ্রতায় সে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। তাদের প্রেম করার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, এটা প্রেম না– ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করা। তাই মার্থা কোনো ইংরেজ যুবকের কাছে ধরা দেয়নি। কিন্তু মার্কো ছিল তার কাছে ব্যতিক্রম।
.
মার্কোর প্রেমে মার্থা অভিভূত হল। মনে হল, কেউ যেন তাকে দুবাহু ধরে উপরে তুলে ফুলভরা ডালের উপর বসিয়ে ছুঁড়ে ফেলল। সমুদ্রের পানিতে মাছের মতো সে সাঁতার কাটতে লাগল। কে যেন তার হৃদয়ের তন্ত্রীতে সুড়সুড়ি দিয়েছে যার ফলে তার সারা দেহ হাসতে শুরু করল। তারপর হঠাৎ প্রচণ্ড গর্জনে সে ভীত হয়ে চোখ বুজল এবং প্রেমিকের বাহুতে গিয়ে শরণ নিল। জাহাজটা চারদিন ছিল বোম্বে বন্দরে। এই চারদিনে মার্থার আকাশ ও পৃথিবী সম্বন্ধে কোনো খেয়াল ছিল না। সে তার বাড়ি, বা-বাবা, ভাই-বোন- সব ভুলে গেল। ভুলে গেল তার জাতীয়তা, প্রকৃতি, আভিজাত্য, তার রাজকীয় গাম্ভীর্য। সে এখন একটা পুরুষের সঙ্গ চায়। চতুর্থ দিনে মার্থা মার্কোকে নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে আনল। সকলের সঙ্গে পরিচয় করার। মার্কো খুব খুশি হল তাদের সঙ্গে মিলে। কিন্তু তারা মার্কোকে দেখে মোটেও খুশি হল না। মার্কো অতিশয় বাক্-পটু চটপটে আর খোশমেজাজি ছেলে– আর এসবই ইংরেজরা পছন্দ করে না। তাই সাক্ষাৎ ও নিমন্ত্রণ ইংলিশ ডিশের মতোই পানসে আর বিস্বাদ হয়ে রইল। মার্থা বলল– নিমন্ত্রণের পর আমি মার্কোকে সমুদ্রের তীরে নিয়ে গেলাম। বান্দ্রার উপকূলকে পুরোপুরি ভারতীয় উপকূল বলা যায় না, অনেকটা ওয়েল্সের উপকূল বলে মনে হয়। সেই উপকূলে উঁচু টিলার মাঝে একটা গুলমোহর গাছ আছে। এমনি চাঁদনি ছিল সেদিন, ঠিক এমনি নীরব রহস্যময়, সুগন্ধিত রাত। সেই চাঁদনি রাতে গুলমোহর গাছের নিচে মার্কো আমার হাতে চুম্বন দিয়ে বলেছিল– আমার জন্যে অপেক্ষা কর। কেউ যেন তোমাকে স্পর্শ করতে না পারে। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
এর এক বছর পরেই মার্থার বাপ রিটায়ার্ড হলেন, পেনশন নিয়ে ইংল্যান্ড যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু মার্থা কোনোমতেই তাদের সঙ্গে ইংল্যান্ড যেতে রাজি হল না। তার মা-বাপ, ভাই-বোন অনেক সাধ্যসাধনা করল, কিন্তু মার্থা জিদ ছাড়ল না। অবশেষে বিদায়ের ক্ষণ এল। ইংল্যান্ড যাওয়ার জাহাজ নোঙর তুলে চলল। মার্থা অশ্রুসিক্ত নয়নে তীরে দাঁড়িয়ে রুমাল নাড়িয়ে মা-বাপকে বিদায় জানাল। জাহাজ বন্দর ছেড়ে গেল, আর মার্থা একাকিনী পড়ে রইল হিন্দুস্তানে। কারণ সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল– কারো জন্যে প্রতীক্ষা করছিল সে। এ সময়ে বহু ইংরেজ সম্ভ্রান্ত উচ্চপদস্থ লোক তার পাণিপ্রার্থী হয়। কিন্তু মার্থা তাদের সকলের প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করে– সেই ইতালীয় নাবিকের জন্যে। তাই সে আর্কিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টেই একটা চাকরি নিল। আর সেই পরিত্যক্ত বাড়ির খোলা জানালায় বসে সমুদ্রের দিকে নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে অপেক্ষা করত, যে জাহাজ পৃথিবী প্রদক্ষিণ শেষে বোম্বাই বন্দরে আসবে। অবশেষে সে বহু প্রতীক্ষিত জাহাজ ফিরে এল বন্দরে। মার্থা সেদিন বাড়ির সমস্ত জানালা হাট করে খুলে সমুদ্রের দিকে মাথা নুইয়ে দেখল, একজন ইতালীয় নাবিক সেই গুলমোহর গাছের নিচে তার জন্যে অপেক্ষা করছে। আর সুগন্ধভরা কামরা থেকে ‘মার্কো মার্কো’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে সিঁড়ি ভেঙে নিচে দৌড়ে একেবারে সমুদ্রের বালুর উপর এসে দাঁড়াল। তারপর সেই গুলমোহর গাছের নিচে গিয়ে মার্কোর বক্ষলগ্না হল।
মার্কো বলল– আমি তোমাকে কার্নিউ দ্বীপে নিয়ে যাব। সেখানেই আমার বাড়ি। আমরা সমুদ্রে মাছ ধরি। সেখানে আমার মা-বাপ আর সাতটি বোন আছে। দ্বীপটি ক্যাপ্রির চেয়েও সুন্দর। সেখানকার মদ সারা দুনিয়ায় প্রসিদ্ধ। সেখানকার মতো এত সুস্বাদু মাছও নেই কোথাও। ইতালির সব সৎ জেলে সেই দ্বীপে বাস করে। সেই দ্বীপের পাহাড়ে সেন্ট অগাস্টাসের গির্জা। সেই গির্জায় হবে তোমার-আমার বিয়ে।
.
আমি মার্কোর সঙ্গে তার দেশের বাড়ি গেলাম। সত্যি সুন্দর দ্বীপ সেটা। তার নীল সমুদ্রে সাদা পাল তোলা জাহাজ চলে। নাবিকদের বাড়িঘর সাদা রঙের। উপত্যকায় আঙুর, কমলা, জলপাই আর পেয়ারার বাগান। তার পাশাপাশি কত সুন্দর ফুল শোভা পাচ্ছে। সেখানকার লাল রঙের মদের স্বাদ প্রেমের মতোই মধুর। সেখানকার জেলেরা পাহাড় কেটে হাজারটা সিঁড়ি তৈরি করেছে। উপর থেকে তাকালে মনে হয়, গির্জার ক্রশটা যেন আকাশ ও পৃথিবীর সংযোগ সাধন করেছে। এই গির্জার গর্বও করে তারা। হাজার সিঁড়ি ভেঙে আমরা হাত ধরাধরি করে গির্জায় মেরি মাতার মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে দুজনে কসম খেলাম। বিয়ের আগ পর্যন্ত আমরা আমাদের দেহকে অপবিত্র করব না। কারণ কার্নিউ-এর মাটি হিন্দুস্তানের চেয়েও উত্তপ্ত। সেখানে ভালোবাসার মতো ফুল ফোটে। মদের স্বাদ যত মধুর– তত তিক্ত। তাই আমরা এই শপথ নিলাম। আমি মার্কোর ঘরে রইলাম। তার মা-বাপও আমাকে খুব পছন্দ করল। মার্কোর সাতটি বোনই খুব সুন্দরী এবং কুমারী। মার্কোর বাপ আমাকে তার নৌকোয় চড়িয়ে মাছ ধরার কৌশল শেখাতে নিয়ে গেল। রাতে মার্কোর মায়ের সঙ্গে শুয়ে থাকতাম– সে আমাকে মায়ের মতো স্নেহ করত।
কিন্তু বিয়ের কথা পাকাপাকি হচ্ছে না। ওরা নিজেরা কী যেন বলাবলি করে– আমাকে কিছু বলে না। একদিন মার্কো আমাকে তার সাদা পালের নৌকোয় তুলে দূর সমুদ্রে নিয়ে গেল। আশেপাশে আর কোনো পালের নৌকা ছিল না। চারদিকে শুধু পানি আর পানি– আর দ্বীপটি যেন সেই পানির মাঝে পাহাড়ের মতো মাথা উঁচিয়ে আছে। জেলেদের বস্তি নজরে পড়ে না। শুধু উঁচুতে সেই সেন্ট অগাস্টাসের গির্জা দেখা যাচ্ছে। মার্কো নৌকা চালানো বন্ধ করে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি তার এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখে জিগ্যেস করলাম, ‘কী ব্যাপার? অমন করে তাকিয়ে আছ কেন? আর আমাকে এত দূরেই-বা আনলে কেন?
মার্কো বেশ কিছুক্ষণ চিন্তিত থেকে বলল, ‘আমার মা-বাপ পাদরিকে জিগ্যেস করেছে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে।’
‘তারপর।’
‘তিনি অসম্মতি জানিয়েছেন।’
‘কেন?’
‘তোমরা তো ক্যাথলিক নও।’
‘তারপর?’ আমি রাগের সঙ্গে বললাম।
‘তারপর আর কি! মা-বাবা বললেন যে, তুমি ক্যাথলিক হও, তাহলে বিয়ে হবে।’
‘আমি তা হব কেন? বরং তুমিই প্রোটেস্টান্ট হয়ে যাও।’ আমি অকস্মাৎ রেগে উঠলাম আমার কণ্ঠে বিরক্তি দেখে মার্কো বুকে ক্রুশচিহ্ন এঁকে বলল, ‘আমি আমার পৈতৃক ধর্ম কী করে ছাড়ব?’
‘তাহলে আমিই-বা ছাড়ব কেন?’
‘তোমাকে ছাড়তে হবে।’ অন্তত আমার জন্যে।’ মার্কো ক্রোধের সঙ্গে বলল। তার কণ্ঠে নির্দেশের সুর। হঠাৎ সে রেগে গেছে। তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। চোখের মণি
তারার মতো নাচছে।
‘কোনোমতেই তা হতে পারে না।’ আমি হাত মুঠো করে বললাম।
‘বাজে বকো না!’
‘তুমিও বাজে বকো না!’ আমিও মুখোমুখি জওয়াব দিলাম। রাগে আমার গা কাঁপছিল। আমি প্রায় কেঁদে ফেলেছিলাম। মার্কো যদি আমাকে বুকে তুলে নিত, তখন আমি নিশ্চয়ই তাকে জড়িয়ে ধরতাম। তখন রোমান ক্যাথলিক কেন, ইহুদি বা মুসলমান হতেও আমার বাধা ছিল না। কিন্তু রাগে সে দু-হাত বুকে চেপে আমাকে বলল, ‘এই তোমার শেষ সিদ্ধান্ত?’
‘হ্যাঁ, এটাই আমার শেষ কথা।’ হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। একথা আমি রাগের বশেই বলেছিলাম। পরক্ষণেই মনে হল, সে যদি আমার জিবটা সাঁড়াশি দিয়ে তুলে নিত, বা আমাকে দু-হাতে তুলে অথই সাগরে ফেলে দিত তো ভালো হত।
কিন্তু কিছুই হল না। সে বসে বসে ছটফট করল– সময় অতীত হল। তারপর মুখ ফিরিয়ে নৌকা চালাতে লাগল দ্বীপের বিপরীত দিকে, যেখানে থেকে গাড়ি পাওয়া যায় নেসের।
তীরে পৌঁছে মার্কো বলল, ‘আমি তোমাকে এখান থেকে নেস্ আর নে থেকে প্যারিসের টিকেট করে দিচ্ছি। আর টাকাও দিচ্ছি যাতে তুমি প্যারিস থেকে লন্ডন যেতে পার।’
‘আমি লন্ডনে যাব না।’
‘তবে কোথায় যাবে?’ মার্কো আমার দিকে তাকিয়ে বলল।
‘বোম্বে যাব।’
‘বোম্বে?’ মার্কো বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, ‘সেখানে তোমার কে আছে যে সেখানে যাবে?’
‘কেউ নেই। তাই সেখানেই যাব।’
.
‘বোম্বে আসার পর আমি আমার পুরনো ঠিকানায় মার্কোর চিঠি পেলাম। তাতে সে অনুশোচনা প্রকাশ করেছে এবং বলেছে তার সবচেয়ে ছোট বোন যার বয়স এখন দশ বছর– ক্যাথলিক প্রথায় ওদের বিয়ে হয়ে গেলেই সে চিরদিনের জন্যে নিজ বাসভূমি ত্যাগ করবে। আমি তার চিঠির কোনো জওয়াব দিইনি। কিন্তু সে তো একবার নিশ্চয়ই বোম্বে আসবে এবং গুলমোহর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তার প্রেমিকাকে নিশ্চয়ই ডাকবে।
আমি আর কোনো চিঠিরই জওয়াব দিইনি। তবে প্রতিবছরই বড়দিনে তাকে কার্ড পাঠাতাম– যাতে কিছুই লেখা থাকত না। শুধু আমার স্বাক্ষর থাকত তাতে। প্রত্যুত্তরে আমিও একটা কার্ড পেতাম। তাতেও লেখা থাকত তোমার একান্ত– মার্কো। বোম্বে এসে আমি আবার চাকরি নিলাম। এবং সেই পরিত্যক্ত বাড়ির জানালায় বসে মার্কোর প্রতীক্ষা করতাম। প্রথম বছর মনে করলাম যে তার দ্বিতীয় বোনটার বিয়ে হল, দ্বিতীয় বছরে তৃতীয়টির, তৃতীয় বছরে চতুর্থটির– এভাবে আগামী পাঁচ বছরে আমি তার ছ-টি বোনেরই বিয়ে দিয়ে দিলাম। তারপর সাত নম্বরটির বিয়ের জন্যে তিন-চার বছর অপেক্ষা করতে হল। কারণ তার বয়স ছিল কম। এ সময়ে মহামারী রূপে প্লেগ দেখা দেয়। মনে করলাম মার্কোর সাত বোনই বোধহয় প্লেগে মারা গেছে। তারপর ইউরোপব্যাপী ইনফ্লুয়েঞ্জা শুরু হল। তখন মনে করলাম, মার্কোর বোনেরা এবার আর বাঁচবে না। কিন্তু মার্কোর চিঠি আসতে থাকল এবং বারো বছরে বারোটি চিঠি এল। বারোটি আশাবরী সংগীত। তারপর চিঠি আসা বন্ধ হল। কিন্তু প্রতি বছর আমি চিঠি লিখতাম। মার্কোর জন্যে বিশ বছর আমি বোম্বেতে অবস্থান করি। তারপর লখনৌ চলে আসি। তোমার বন্ধুর পিতা মৃত মহারাজা আমাকে তোমার বন্ধুর জন্যে গভর্নেস রাখেন। মহারাজাও মারা যান। তোমাদের দেশ স্বাধীন হল। এক যুগের অবসান হল। যুগের পরিবর্তন হল। কিন্তু মার্কো এল না।’
‘আর আপনি বিয়েও করলেন না?’
‘না।’
‘হয়তো মার্কো মারাও যেতে পারে।’
মিস্ লোভিট সাপের মতো ফুঁসে উঠে বললেন, ‘না, তা হতে পারে না। আমার মার্কো এখনো অবিবাহিত আছে।’
‘হয়তো সে মনে করেছে, অনেক দেরি হয়ে গেছে।’
‘ভালোবাসায় কখনো দেরি হয় না!’
‘হয়তো মার্কো বুড়ো হয়ে গেছে। তার পুত্র-কন্যা আছে, নাতি-নাতনিও হয়েছে– এমনও তো হতে পারে।’
‘মার্কো কোনোদিন বুড়ো হবে না।’ মার্থা লোভিট তিক্তকণ্ঠে বলল, ‘এখনো সে তেমনি যুবক আছে– আমি প্রথমদিন তাকে যেমন দেখেছিলাম ঠিক তেমনি।’ সে জোরে আমার হাত চেপে ধরে বলল। পরক্ষণেই তার কণ্ঠ ধরে এল। আমার হাত ছেড়ে দিল ধীরে ধীরে। তারপর ধরা গলায় বলল, ‘যখন তুমি আমার কাছে এলে তখন আমার সেকথাই মনে হল। আর সামনের এই ঝিলটা যেন সেই সমুদ্র– একটা পালতোলা নৌকা যেন তাতে দুলছে। ওটা যেন মার্কোর নৌকা– মার্কো ‘গান গেয়ে তরি বেয়ে’ এখানে আসবে। নৌকাটা কাঠের গুঁড়িতে বেঁধে আমার কাছে এই ক্লাবে এসে সবার সম্মুখ থেকে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে। যেখানে আমার ঘর, ঠিক সেখানে।
হঠাৎ মার্থার কণ্ঠস্বর নিস্তেজ হয়ে গেল আর আমার চোখ ফেটে পানি বের হল। আমি তার কাঁকন-পরা কম্পিত হাতে চুমু খেয়ে বললাম, ‘মিস্ লোভিট, সীতা-সাবিত্রী শুধু আমার দেশেই নয়– সকল দেশেই তারা আছে।’
.
হঠাৎ ক্লাবে আলো জ্বলে উঠল। ডিনারের সময় হয়ে গেছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং আদরের সঙ্গে মিস্ লোভিটকে সালাম করলাম। তাঁর হাত ধরে ডিনার হলের দিকে চললাম– যেন আমার সঙ্গে পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধা নয়– এক স্বপ্নলোকের রাজকুমারী হেঁটে চলেছেন।
অনুবাদ : কাজী মাসুম
আপা – মমতাজ মুফতি
মাঝে মাঝে আপার কথা মনে হয়। ভাবতে চাইনে তার কথা; তবু মনে পড়ে। মনে পড়ে, আর চকচক করে ওঠে দুটি চোখের পাতা।
পষ্ট মনে পড়ে একটি সন্ধ্যার কথা। রসুইঘরে আমরা তিনজন বসেছিলাম– আমি, আম্মা আর আপা। হঠাৎ বদু সেখানে এসে হাজির ছুটতে ছুটতে। বদুর বয়স ছিল ছয়, কি বড় জোর সাত। বদু এসে আম্মার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, ‘আম্মি, আমাকে একটা বউ দিতে হবে, আমি বিয়ে করব।’
আম্মা হেসে ফেললেন, তারপর সেই হাসিমুখেই বদুকে প্রশ্ন করলেন, ‘এক্ষুনি চাই? বেশ, বদু, তোমাকে তোমার আপার সঙ্গেই বিয়ে দিয়ে দি, কি বল!’
‘ধ্যেৎ!’ বদু মুখ ঝাঁকালো। বলল, ‘না, না, আপা নয়।’
আম্মা তাজ্জব হওয়ার ভান করে বললেন, ‘অ্যা, কেন বদু, আপা নয় কেন? তার দোষ কী?’
বদুর সমস্ত মুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, ‘আমি সাজোঁ বা’জিকে বিয়ে করব।’
আম্মার বোধ করি খুব মজা লাগছিল। আপার দিকে তিনি তাকালেন একটু মৃদু হেসে, তারপর বদুকে লক্ষ করে বললেন, ‘কিন্তু তোমার আপা ভারী ভালো মেয়ে তাই নয় বদু?’
বদু সেকথা কানেই তুলল না। বরং সে বলল, ‘শুনবে আম্মা, আপা কেমন মেয়ে?’ বলেই সে চারদিকে চোখ ফেরাতে লাগল, তারপর হঠাৎ চোখ পড়ল চুলোর পাশে ফেলে-রাখা একটা পোড়া কাঠের দিকে। বদু হঠাৎ একটা আঙুল তুলে সেটা দেখিয়ে বলে ফেলল, ‘এই যে, ঠিক ওটার মতো।’ তার পরেই সে তাকাল উপরের দিকে; মাথার উপর জ্বলছিল বিজলিবাতি। এবার জ্বলন্ত বাল্বটা দেখিয়ে সে বলতে লাগল, ‘সাজো বা’জি হচ্ছে ঠিক ওইরকম, ওই যে।’
সবাই আমরা হো হো করে হাসছি, ঠিক এই মুহূর্তে ঘরে ঢোকেন তাসাদ্দক ভাই। আম্মার ইচ্ছে হল তাসাদ্দক ভাইকেও আমাদের আনন্দের শরিক করে তুলতে; তাই তিনি হাসিমুখে তাঁকে বললেন, ‘তাসাদ্দক, বদুকে জিগ্যেস কর তো, ওর আপা কেমন?’
এদিকে তাসাদ্দক ভাই ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই আপার মুখ ঘুরে গেছে উল্টো দিকে, চুলোর দিকে মুখ ফিরিয়ে হঠাৎ আপা রান্না নিয়ে ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
তাসাদ্দক ভাই বদুকে ডেকে জিগ্যেস করলেন, ‘হ্যাঁ, বল তো, আপার কথা কী বলছিলে?’ বদু তৈরিই ছিল। প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই সে সেই পোড়া কাঠটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘দেখাচ্ছি।’ কিন্তু সেটা হাতে পাওয়ার সুযোগ ঘটল না তার। আপা খপ্ করে তার হাতটা ধরে ফেলে মুখে তার হাতচাপা দিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বলল, ‘ছিঃ বদু, এসব কী?’
অসহায় বদু তখন ছটফট করতে লাগল। আম্মা তখন বলে উঠলেন, ‘কী বোকা ছেলে! সত্যি বদু, ওটাতে হাত দেওয়া ঠিক নয়, বুঝলে? কে জানে, ওর ভেতরে হয়তো আগুন আছে।’
‘হুঁ, সব তো পুড়ে গেছে।’ বদু কান্নার সুরে প্রতিবাদ করল আম্মার কথার। আম্মা নরম সুরে আবার বললেন, ‘না বদু, সবসময় বোঝা যায় না। ওপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে বটে পুড়ে গেছে; কিন্তু ভেতরে অনেক ফুলকি থাকতে পারে।’
আম্মার কথায় বদুর চোখ দুটো একটু বড় হয়ে উঠল বটে, কিন্তু মন তার সায় দিচ্ছিল না তাঁর কথায়। তাই সে আপাকেই এবার জিগ্যেস করল, ‘হ্যাঁ আপা, সত্যি ওর মধ্যে আগুন আছে? বল না!’
আপার ঠোঁট দুটো একটু যেন কেঁপে উঠল। তারপর আস্তে, খুব আস্তে কেবল এইটুকুই বলল, ‘কী করে জানব, বল।’ এইটুকু বলতেই আপা যেন ঘেমে উঠল, গলা তার বুজে এল। হঠাৎ রাশি রাশি কাঠ গুঁজে দিতে লাগল চুলোর ভেতর, যদিও তার দরকার ছিল না কিছু।
.
আজ বুঝতে পারি। বুঝতে পারি আপাকে, তখন বুঝিনি। মাঝে মাঝে বলতাম, ‘আপা, সবসময় তুমি চুলোর পাশে। কেন বসে থাক?’
আপা একটু কেবল হাসত, তারপর এমন করে আমার দিকে তাকাত একবার, যেন বলতে চায়, ‘তুই একটা বোকা।’ পরমুহূর্তে আবার সে রান্নার কাজে মন দিত। সবসময় তাকে মনে হত ভারি ব্যস্ত। ব্যস্ত থাকত ঘর-গেরস্থালীর কাজ নিয়ে। সবাই তাকে কিছু না কিছু করতে দিত। এক-এক করে মেশিনের মতো তাকে সেসব কাজ করে যেতে হত। এদিকে বদু চেঁচাচ্ছে, ‘আপা, আপা, আমার নাশতা-পিরিচটা নিয়ে এসে শিগগির।’ ওদিকে আব্বা বলছেন, ‘মা সাজেদা, চা-টা কি হল না এখনো?’ আবার আম্মা এসে বলছেন, ‘সাজেদা, ধোপাটা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে, কাপড়গুলো দিয়ে দাও তো!’
আপার কিন্তু বিরক্তি নেই। সবকিছুই সে এক-এক করে করে যাচ্ছে। একটা কথা নেই মুখে। আমি ভালো করেই জানতাম, আপার সে ক্ষমতা আছে, সবকিছু সে এমনি গুছিয়ে করে যেতে পারে; করেও। কিন্তু তবু আশ্চর্য, তার দিকে তাকিয়ে কেউই বুঝতে পারত না, সে আদৌ কোনো কাজ করছে। এক-এক সময় আমারই মনে হত, সে বুঝি হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে, অথচ আসলে তা নয়। একদিক থেকে আর-একদিকে চোখ ফেরাতেই তার যেন এক শতাব্দী লেগে যাবে, এমনি মনে হত তার দিকে তাকিয়ে। আপা যখন হাঁটত, মনেই হত না, সে হাঁটছে।
এছাড়া আপাকে কখনো সশব্দে হাসতে দেখিনি। মাঝে মাঝে নীরবে সে হাসত, দুটো ঠোঁটের প্রান্ত একটুখানি খুলে যেত, মৃদু হাসির ঝিলিক লাগত চোখে-মুখে, এদিকে চোখের পাতা আসত বুজে। আশ্চর্য সুন্দর সে হাসি– ছোট্ট নদীর পাড় ছেয়ে লুটিয়ে পড়েছে মৃদু জ্যোৎস্না, আর সেখানে যেন গভীর সুরে বেজে চলেছে সিন্ধি ভৈরোঁ। কিন্তু আমি তখন কিই-বা বুঝতাম জ্যোৎস্নার, সিন্ধি ভৈরোরই-বা কী অর্থ ছিল আমার সে জীবনে। আমার কেবল মনে হত, বোবার মতো বসে থাকা ছাড়া আপা আর কিছুই করতে পারে না; আপা জানে না, কেমন করে হাসতে হয়। মনে হত, কেউ যেন তাকে ধাক্কা মেরে দুনিয়ার বাইরে ফেলে রেখেছে।
আর ওদিকে পাশের বাড়ির সাহেরা! কী চমৎকার নেতিয়ে নেতিয়ে চলে সে। যেন ‘দাদ্রা’ তালে নেচে বেড়াচ্ছে মেয়েটা। তাছাড়া আমার চাচাতো বোন সাজোঁ বাজি! আমারও ইচ্ছে করত, সবসময়ই আমি তার পাশে পাশে থাকি। আহা, সে যখন সুন্দর করে ঘাড় বেঁকিয়ে কাউকে বলে, ‘ইয়েস্ প্লিজ্’ বা কাউকে যখন গানের সুরে সে প্রশ্ন করে, ‘ইজ্ন্ট ইট্ ডার্লিং?’– তখনো শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় তার পায়ে লুটিয়ে পড়তে মন চায়।
সাহেরা আর সুরাইয়া দুই বোন। হাসিতে-হুঁল্লোড়ে ওদের বাড়িটা যেন সবসময় কী মধুর বাজনা বাজিয়ে চলে। এক-এক সময় মনটা একেবারে অস্থির হয়ে উঠত, ভাবতাম, ওহ্ যদি আমাদের বাড়িটাও সবসময় অমনি হাসি-হুঁল্লোড়ে ভরে থাকত! কিন্তু আমাদের বাড়িতে… উহ্, বুড়ির মতো ঘাড় গুঁজে থাকা বোবা মেয়ে আপা, আম্মার অনবরত ফরমায়েশের ঝুক্কি আর আব্বার মুখে হুঁকোর নলে সারাদিন ধরে গড়গড় আওয়াজ, এই ছিল আমাদের আনন্দের উপকরণ। রাগে আমার গা জ্বলছিল, যেদিন আব্বা আম্মাকে বলছিলেন, ‘দেখ সাজেদার মা, আমার মনে হয়, সাহেরাদের বাড়িটা পেয়ালাবাটিতে ভর্তি, সারাদিনই তো ঝন্ঝন্ খখন্ আওয়াজ! আর নয় তো কেবল হাসি আর হাসি! আচ্ছা, বাড়িটাকে কি ওরা একটা মেলা মনে করে?’
‘কী জানি, ওসব অপরের ব্যাপারে আমাদের মাথা গলাবার দরকারটা কী শুনি?’ আম্মা বিরক্ত হয়েছেন তা বোঝা গেল। কিন্তু আব্বা তবু বললেন, ‘না, না, সেকথা আমি বলিনি। আমি বলছিলাম কী, ওরকম বয়সে মেয়েদের একটু শান্ত থাকা দরকার। সারাদিন অত হৈ হৈ করলে বাইরের লোক জানতে পারে, অমুক বাড়িতে যুবতী মেয়ে আছে; আর সেটা কী– বুঝতেই তো পার। তবে হ্যাঁ, আমাদের সাজেদা কিন্তু তেমন মেয়ে নয়, কী বল?’ বলতে বলতে দেখা গেল আব্বার চোখেমুখে গর্বিত পিতার আনন্দোচ্ছ্বাস।
কথাগুলো শুনে অবধি আমার কিন্তু রাগে মাথা খুঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল : ‘হুঁ, তা তো বটেই, একেবারে হেশতের হুর। তাঁরা তো ভাববেনই ওকথা। নিজের মেয়েকে কে আর খারাপ বলে ভাবতে পারে! কিন্তু আমিও তো তাঁদের মেয়ে!’
আমার ইচ্ছে হল এক্ষুনি রান্নাঘরে ছুটে যাই আর সেই হাবা হুরপরীটার সঙ্গে বেশ খানিকটা ঝগড়া করে গায়ের ঝাল মেটাই। সারাদিন কিছু খেলাম না আমি। কারো সামনে যেতেও ইচ্ছে হচ্ছিল না। সেদিন যেন ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলাম : আব্বা কিছুই জানেটানে না, জানে কেবল হুঁকো টানতে, নয় তো বই খুলে বসে থাকতে- যে-সব বইয়ের ছাই এক অক্ষরও বোঝা যায় না।
ভালো লাগত এক তাসাদ্দক ভাইকে। আমাদের বাড়িতে ওই একটা মানুষই থাকতেন, যাঁর কথা শুনতে শুনতে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেতাম; সত্যি, কী সুন্দর করে তাসাদ্দক ভাই কথা বলতেন। আব্বা বাড়ি না থাকলে মাঝে মঝে তিনি গানও গাইতেন। গানের কথাগুলো অবিশ্যি ভালো করে মনে পড়ে না আর। গানটা যেন কোনো একটা মেয়েকে নিয়ে লেখা, যে-মেয়েটি কথা বলত না, মজা লাগত যার ভাবভঙ্গি দেখে– কিন্তু যার চোখ দুটি ছিল ভারী কোমল, যেন আধঘুমে জড়ানো ছিল সে চোখের পাতা, আর সেই পাতায় পাতায় জড়িয়ে ছিল যেন কোনো কাহিনী– হয়তো এমনিই ছিল সে গানের কথাগুলো।
কিন্তু তাসাদ্দক ভাই যখনই গান গাইতেন, আপা তখন মৃদু মৃদু হাসত, যেমন হাসা তার স্বভাব ছিল। যে-হাসি তার মিলিয়ে যেত না সহজে, হাসবার কিছু না পেলে সে তখন বদুকে ধরে গালের উপর দু-একটা টোকা মেরে বলত, ‘হ্যাঁরে বদু, তুই আর চেঁচাচ্ছিস না কেন, আয়, চেঁচাবি?’ বলেই সে আবার হাসতে শুরু করত, সেই অনুচ্চারিত হাসি, তার নিজের জন্যে যে-হাসি।
তাসাদ্দক ভাই ছিলেন আমাদের খালাতো ভাই। হোস্টেলে থেকে তিনি পড়াশুনা করতেন। কিন্তু আম্মা যেদিন খালা-আম্মার কাছে জানতে পেলেন, তাঁর বোনপো হোস্টেলে অখ্যাদ্য খেয়ে খেয়ে শরীর নষ্ট করেছে, সেইদিনই তাসাদ্দক ভাইকে বাক্স-বিছানা গুটিয়ে চলে আসতে হল আমার বাড়িতে। আমরা তাঁকে ডাকতাম ভাইজান বলে।
আমাদের আর বদুকে নিয়ে ভাইজানের কৌতুকের সীমা ছিল না। আমরাও তাঁকে ছাড়া থাকতে পারতাম না আর তিনিও বদুর হাজার জ্বালাতনেও ক্লান্ত হতেন না। কিন্তু মজা হচ্ছে, আপার সামনে পড়লেই ভাইজান কেমন গম্ভীর হয়ে যেতেন। একটা কথাও তিনি যেন বলতে পারতেন না। এদিকে ভাইজানকে দেখলেই আপার দোপাট্টাও নেমে আসত তার মাথা-মুখ ঢেকে একেবারে বুকের উপর। ভাইজান তাতে আরও বেশি ঘাবড়ে যেতেন যেন। নিজের অজ্ঞাতেই যেন আপার হাত দুটো ঘোরাফেরা করছে একাজে ওকাজে, চোখ তার নিজের পায়ের দিকে নামানো। একটা মেশিনের সঙ্গে কথা বলা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
ভাইজান যখন বদুকে পেতেন একা, তখনই আপার কথা জিগ্যেস করতেন, ‘হ্যাঁ বদু, তোমার আপা এখন কী করছে, বল তো?’ বদু লাফিয়ে উঠত, ‘কী ছাই করবে, হয়তো চুপ করে বসে আছে। আমি ডেকে আনছি।’ বলেই বদু হয়তো ছুটতে চাইত।
ভাইজান ঘাবড়ে যেতেন ভীষণ, ‘না, না, না, বদু, সে কী, তার কিছু দরকার নেই; এমনিই আমি জিগ্যেস করছিলাম।’ বলেই তিনি দু-হাতের মধ্যে বদুকে আটকে ফেলতেন। তার পরেই ছোট্ট ছেলের মতো আবদেরে সুরে বলতেন, ‘যাও বদু, তুমি মানুষটা ভালো নও। যা কিছু বলব, তাই নিয়েই ঢাক পেটাতে হবে?’
.
বদুকে ঠাণ্ডা করা এত সহজ ছিল না। সে বলত, ‘কী, তুমি আমাকে ঢাক বললে ভাইজান?’ ভাইজান বলতেন, ‘আরে না, না, তা কখন বললাম? এই দেখ, ঢাক তো এমনি করে বাজে।’ বলেই তিনি টেবিলের উপর দুহাতে আওয়াজ করতেন– ব্যঙ্গ — ব্যস্,– ডস্– ডস্– ‘এই যে এমনি করে তো ঢাক বাজে। তুমি কেন ঢাক হতে যাবে?’ যা-তা আওয়াজ আর কথাবার্তার তোড়ে বদুর প্রতিবাদের ভাষা ভেসে যেত, ডুবে যেত।
এদিকে ভাইজান যখনই বদুকে নিয়ে এইসব কাণ্ড করতেন, আপা তখন পাশের ঘরের দরজায় এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত, ওদের সব কথাবার্তা সে শুনত। তারপর চলে আসত রান্নাঘরে। সেখানে চুলোর পাশে বসে বসে সে হাসত, সেই চাপা মৃদু হাসি। তন্ময়তার ফাঁকে তার দোপাট্টা খসে পড়ত মাথার উপর থেকে ঘাড়ের নিচে, গালের পাশ ঘেঁষে নেমে গেছে একগোছা কালো কোঁকড়া চুল; আর তার চোখের তারা যেন নাচছে চুলোর আগুনের জ্বলন্ত শিখার তালে তালে। ঠোঁট দুটো তার বারবার কেঁপে উঠছে, যেন গানের কলি আস্তে আস্তে নেচে বেড়াচ্ছে সেখানে; কিন্তু একটি শব্দও উচ্চারিত হত না। হঠাৎ আম্মা কিংবা আব্বা এসে পড়লেই তাড়াতাড়ি আপা দোপাট্টা তুলে মাথায় দিয়ে চুলোর কাছে চলে যেত।
একদিন সন্ধ্যায় আমরা লনে বসেছিলাম চুপ করে আমি, আপা আর আম্মা। একটু দূরে ভাইজান আর বদু এসে বসল। তারা টের পায়নি আমরা এদিকে বসে আছি। ভাইজান গল্প শুরু করলেন, ‘জানো বদু, আমি এমন একটি মেয়ে বিয়ে করব, যে নাকি ইংরেজিতে কথা বলতে পারবে, সব বই যে পড়তে পারবে আর যে আমার সঙ্গে দাবা খেলবে, ক্যারম খেলবে আর ব্যাডমিন্টনও খেলবে। তুমি জানো বদু, শাটেল্কক্ কাকে বলে? জানো না? শাটেল্কক্ হচ্ছে পাখির পালকের তৈরি একরকম ছোট্ট বল। র্যাকেটের এক ঘায়ে সেটা উড়তে থাকে আর আওয়াজ হয়—ভর্র্র্– ডিজ্জ্জ্– টিন্ন্ন্–বুঝলে? আর হ্যাঁ, আমি যাকে বিয়ে করব, তার সবচেয়ে বড় গুণ হবে, সে চমৎকার সব রান্না জানবে।’
বদু বোধহয় নিজের বউয়ের কথাই ভাবছিল, সে বলল, ‘আমি সাজোঁ বা’জিকে বিয়ে করব।’
‘ধ্যেৎ!’ ভাইজান তার প্রস্তাবটা তেমন পছন্দ করলেন না বলে মনে হল। এদিকে আম্মা ওদের কথার ফাঁকে আপার মুখের দিকে এক মুহূর্ত চোখ বুলিয়ে নিলেন। আপা কিন্তু দেখেও সেটা না দেখার ভান করল। সে তখন পায়ের আঙুলের নখ খুঁটছে নুয়ে নুয়ে।
ওদিকে বদু ভাইজানকে বলছে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি আমি। আপনি তো আপাকে বিয়ে করবেন, না ভাইজান?’
ভাইজান বললেন, ‘কিন্তু তোমার আপা তো এ-ও জানে না, পুডিংয়ে কতটুকু চিনি লাগে। পুডিংয়ে সবসময় চিনি কম আদৌ ভালো লাগে না।’
‘কিন্তু আব্বা যে চিনি কম চান, তাই তো আপা–।’ বদু ওকালতি করছে আপার হয়ে। ভাইজান বললেন, ‘ও, তাহলে তোমার আপা কেবল আব্বার জন্যেই করেন ওসব, আমাদের জন্যে নয়?’
বদু এবার বিরক্ত হল, ‘আচ্ছা দাঁড়ান, আপাকে আমি সব কথা বলে দেব।’
‘আরে না, না।’ ভাইজান আবার ঘাবড়ে গেলেন, ‘ধ্যেৎ! তুমি দেখছি একটা লাউডস্পিকার। আচ্ছা এস, ঢাক বাজাই– এই যে ব্যঙ্গ ব্যস্– ডগ্ ব্যস্– উহ্ বদু, তোমার বন্ধু হয়ে দেখছি জানের শেষ!’
আপা তার আনন্দের উচ্ছ্বাস আর বোধহয় নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে পারছিল না। হঠাৎ সে উঠে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। আমি ভীষণ হাসছিলাম আর আম্মাও তাঁর সশব্দ হাসি লুকোবার জন্যেই বোধহয় মুখের উপর দোপাট্টার একটা ধার চাপা দিলেন। আমার শোবার ঘরে আমি আর আপা বসে ছিলাম, আমার হাতে একটা বই। হঠাৎ ভাইজান এসে হাজির। জিগ্যেস করলেন, ‘কী পড়ছ জাহিনা?’
সত্যি কথা বলতে কি, জাহিনা নামটা শুনলেই খুশিতে আমার নাচতে ইচ্ছে করত। নূরজাহান নামটা আজকাল তো তৃতীয় শ্রেণির বলেই মনে হবে। তাছাড়া ও-নামটা শুনলেই কোনো বুড়ি দাদি বিবির চেহারাই ভেসে ওঠে চোখের ওপর– ইতিহাসের পুরনো পাতায় ভূতের মতো যে লুকিয়ে আছে। কিন্তু ভাইজান সেই শুকনো বাসি রুটিকে একেবারে তাজা করে তুলেছেন। আমি যে নূরজাহান থেকে জাহিনা হয়েছি, এটা তাঁরই কীর্তি। যখনই ও-নাম তাঁর মুখে শুনতে পাই, নিজেকে মনে হয় ইরানের শাজাদি বলে। ভাইজান আপাকে বলতেন সিজদা, অবশ্যি আপা যখন ছিল এই এতটুকুন। এখন তো ভাইজান আপার আসল নাম অর্থাৎ সাজেদা শব্দটাও উচ্চারণ করতে সাহস পান না। ভাইজানের প্রশ্নের জবাব দিলাম, ‘এই– ঠিক পড়া নয়, পড়বার চেষ্টা করছি।’
ভাইজান আবার প্রশ্ন করলেন, ‘বার্নার্ড শ’ পড়েছ?’
বললাম, ‘না।’
ভাইজান এবার অপাঙ্গে আপার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তা তোমার আপা ‘হার্টব্রেক হাউস’ বইটা পড়েছেন নিশ্চয়ই?’
আপা যেদিকটায় বসেছিল, সেদিক থেকে ছোট্ট অর্ধোস্ফুট একটা ‘না’ ভেসে এল। আপার চোখের পাতা অবশ্যি মেঝের দিকেই নামানো ছিল।
প্রায় উত্তেজিত স্বরে ভাইজান বললেন, ‘ওহ্ জাহিনা, কী বলব তোমাকে, ওটা তো বই নয়, একেবারে পুরোপুরি শরাব। তোমার ওটা নিশ্চয়ই পড়া উচিত। হ্যাঁ, পরীক্ষাটা শেষ করেই পড়বে অবশ্যি, চাও তো আমিই দেবখন– খুশি হয়েই দেব।’
আমি যখন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম তাঁর প্রস্তাবে, তখন ভাইজান আবার আর-এক প্রশ্ন করে বসলেন, ‘আচ্ছা জাহিনা, তোমার আপা ম্যাটরিকের পর আর পড়লেন না কেন?’ এই ধরনের প্রশ্ন আমার কখনো ভালো লাগত না। এবার আমি রেগে গিয়েই বললাম, ‘তার আমি কী জানি, আপাকেই কেন জিগ্যেস করছেন না?’
অবশ্যি আমি জানতাম, আপা কেন কলেজে গেল না– তার মতে কলেজের মেয়েরা পড়াশোনার চাইতে ফ্যাশান-প্রতিযোগিতায়ই মত্ত থাকে বেশি। সেখানে তারা লেখাপড়ার নাম করে আসলে ফ্যাশানের মেলা বসায়। আপার এই সংকীর্ণ মনোভাব আমায় ভীষণ ক্ষেপিয়ে তোলে। আসলে ও আলসে, রান্নাঘরে বসে বসে পাঁচশোরকম রান্না করাতেই ওর আনন্দ বেশি– ফু! ভাইজানকে নিয়ে এই এক জ্বালাতন! সবসময় আমাকে আপার হয়ে কথা বলতে হবে– কেন, আমি কি দোভাষী! ওদিকে শাজাদি তো ভিজে বেড়ালটির মতো চুপ করে বসে থাকবে ঠায় 1
ওইদিন সন্ধ্যায় নাশতা খেতে বসে আব্বা হঠাৎ গর্জন করে উঠলেন। ‘উহ্, একী পুডিং হয়েছে! চিনির জন্যে মুখে দেওয়া যায় না! বলি সাজেদা, চিনি কি খুব সস্তা হয়েছে না-কি?’
অন্য সময় হলে ভয়ে আপার মুখ শুকিয়ে যেত। কিন্তু আশ্চর্য, আজ তার মুখেচোখে ভয়ের কোনো চিহ্ন দেখা গেল না। বরং চোখের মণিতে তার কৌতুকের আভাস। প্রশ্নের জবাবে সে শুধু বলল, ‘তাই বোধহয়।’ বলেই আবার রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।
আব্বা আরো রেগে গজরাতে শুরু করলেন। হঠাৎ আম্মা সেখানে হাজির। বললেন, ‘দেখ, তুমি না হয় চিনি খেতে চাও না, কিন্তু তাই বলে সবাই কেন তোমার জন্যে ভুগবে? আল্লা মেহেরবান, তাই ফেরেশতার মতো একটা সুন্দর জোয়ান ছেলে আমাদের ঘরে বাস করছে, ওর দিকে একটু দেখতে হবে না কি?’
আব্বা হঠাৎ ঢোক গিললেন, ‘তা– তা আমাকে বলতে হবে তো, নইলে– যত সব –হুঁ!’
আব্বা শান্ত হয়ে গেলেন। আম্মা তাঁর পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন– তারপর ফিস্ ফিস্ করে আলাপ শুরু হল।
পাশের বাড়ির সাহেরা প্রায়ই দেয়ালের উপর মাথা উঁচিয়ে, আপার সঙ্গে গল্প করত। আপা দু-এক কথায় জবাব দিয়ে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢুকে পড়ত। বলত, ‘উহ্, কত কাজ পড়ে রয়েছে।’
সেই আপাকে যখন হঠাৎ দেখলাম সাহেরাদের বাড়ি থেকে ফিরে আসতে, আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। তাই তো, কী ব্যাপার! তক্ষুনি ছুটে গেলাম সাহেরার কাছে। জানতে চাইলাম, আপা কেন গিয়েছিল তাদের বাড়ি। সাহেরা নখে পালিশ লাগাতে লাগাতে বলল, ‘এসেছিল একটা বই নিতে– ইয়ে, এই ‘হার্টব্রেক হাউস্’ বইটা নিয়ে গেল।’ আমি তখন অন্য আলাপ জুড়ে দিলাম।
বইটা আপা সবসময় বাক্সে লুকিয়ে রাখত। রাত্রে শুয়ে শুয়ে লক্ষ করত, আমি কখন ঘুমিয়ে পড়ি। আমি ঘুমুলে বোধহয় পড়তে শুরু করত। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একদিন এক মজা করলাম আমি। শুয়ে পড়লাম ঠিক সময়ে কম্বল জড়িয়ে, কিন্তু ঘুমোলাম না। তবে ঘুমের ভান করলাম পুরোপুরি। আপা যখন নিশ্চিন্ত মনে বইটা খুলে পড়তে শুরু করেছে, হঠাৎ আমি মাথা তুলে প্রশ্ন করে ফেললাম, ‘বলি আপা, এসব ‘হার্টব্রেক হাউস্’-ফাউস্ কী ব্যাপার! নিশ্চয়ই আমাদের হাউস?’
আপা চমকে উঠে জবাব দিল, ‘জানিনে।’ তারপর বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শুয়ে পড়ল। একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ ভাইজান আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘জাহিনা, তোমার আপা ফলের সালাদ বানাতে পারে?’ আজও রেগে আমি জবাব দিলাম, ‘আপাকে গিয়ে কেন জিগ্যেস করেন না?’
‘বাপরে!’ ভাইজান চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘মনে হচ্ছে তুমি কারো সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছ।’
‘কী?’ আমি আরো বেশি রেগে গেলাম, ‘আমি কি ষাঁড় নাকি যে যুদ্ধ করব?’
ভাইজান হাসতে হাসতেই বললেন, ‘না, না, ষাঁড় নও নিশ্চয়ই, তবে দেখতে তুমি অ-নে-ক-টা…’
হঠাৎ কেন যেন আমার রাগ পড়ে গেল। ভাইজান বলছেন, ‘দেখ জাহিনা, আমি আবার যুদ্ধটুদ্ধ একটু বেশি পছন্দ করি। আর বিয়েও করব এমন মেয়ে, যে আমার সঙ্গে সারাদিন যুদ্ধ করে কাটাতে পারবে, কখনো ক্লান্ত হবে না।’
ভারি খুশি খুশি লাগছিল আমার। হঠাৎ প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা ভাইজান, ফলের সালাদ কী জিনিস?’
জবাবে তিনি বললেন, ‘এই সাদা, লাল, নীল, কালো সব মিলিয়ে যেটা হয় আর কী। আমার খুব পছন্দ ওটা। কিন্তু তোমাদের এখানে তো দেখছি, জীবনভোর পুডিংই খেতে হবে। খালি পুডিং আর পুডিং।’
পরে বুঝতে পেরেছিলাম, আপা আমাদের সমস্ত কথাবার্তাই কোথাও লুকিয়ে থেকে শুনেছিল। কারণ সেদিন রাত্রে দেখলাম আপার হাতে একটা নতুন বই– বইটা ‘পাকপ্রণালি’। এরপর থেকে রান্নাঘরে প্রায়ই দেখতাম আপার হাতের নাগালে আলাদা করে ঢাকা একটা ট্রে। ট্রেটাতে কী থাকে আন্দাজ করেছিলাম। আপা এখন রোজ ফলের সালাদ বানাবার মহড়া দিচ্ছে। কিন্তু আপাকে ক্ষেপাবার জন্যে একদিন বদুকে লেলিয়ে দিলাম ট্রেটার পেছনে। বদু ট্রেটা লুফে নিয়ে এলে তাকে বললাম ভাইজানের কাছে নিয়ে ওটার নাম জিগ্যেস করতে; সঙ্গে সঙ্গে আপার যে কঠোর দৃষ্টি আমার মুখের ওপর এসে পড়েছিল, এর আগে আর কোনোদিন তার সেরকম দৃষ্টি আমার চোখে পড়েনি। সারাদিন আপা অতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে ছিল– রাত্রে শুয়ে শুয়ে মুখ লুকিয়ে কাঁদছিল। আমার ভারী দুঃখ হচ্ছিল, লজ্জাও হচ্ছিল। কিন্তু আপার কাছে গিয়ে মাফ চাওয়ার সাহস হল না।
কয়েকদিন কেটে গেল। একদিন আমাদের জ্ঞাতি সম্পর্কের চাচাতো বোন সাজিদা, যাকে আমরা সাজোঁ বা’জি বলতাম, সে এল আমাদের বাড়ি বেড়াতে। জানাল, কয়েকদিন এখানে থেকে যাবে সে। আমরা ভারী খুশি হলাম।
সাজোঁ বা’জি দুনিয়ার সমস্ত স্ফূর্তি যেন সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল; পাশের বাড়ির সাহেরা আর সুরাইয়া এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তার সঙ্গে গল্প করে যেত। আমাদের নিষ্প্রাণ বাড়িটাও হাসি-হুঁল্লোড়ে মেতে উঠল। বদুর মুখে সবসময় লেগে আছে– ‘সাজোঁ বা’জি– সাজোঁ বা’জি! আমরা সাজোঁ বা’জিকে বিয়ে করব।’ বা’জিও বদুকে পেয়ে বসল, ‘এই বদু, একবার আয়নার সামনে মুখখানা দেখ তো! শিগগির ভালো করে মুখ-হাত ধুয়ে এস; তারপর আমার সঙ্গে কথা বলবে, যাও।’
বড় মিষ্টি করে বকতে জানত সাজোঁ বা’জি। সাজোঁ বা’জি যখন তখন ভাইজানের দিকেও গলা বাড়াতে লাগল। ‘তাই নয় ভাইজা– আ– ন?’ অথবা– ‘ঠিক বলিনি ভাইজা– আ– ন?’
তাসাদ্দক ভাইকে আপা বলত ভাই সাহেব। বা’জি বলে ভাইজান; আর ‘জানে’র উচ্চারণটা এমন কেঁপেকেঁপে লতিয়ে লতিয়ে একটা ঝঙ্কার তুলে শেষ হত যে, ‘ভাই’টা ইতোমধ্যে তলিয়ে যেত অতলে।
বা’জি আসার পর থেকেই আপা যেন আরো বেশি গম্ভীর হয়ে গেল। বদু ভাইজানকে ছেড়ে দিয়ে বা’জিকে নিয়ে মেতে উঠল; এদিকে বা’জি সবসময় ভাইজানের সঙ্গে ক্যারম্ বা দাবা নিয়ে মত্ত। বা’জি সোজাসুজি বলে ফেলত, ‘আসুন ভাইজা-আ-ন, এক বোর্ড খেলা যাক।’ কিন্তু ভাইজানের স্বভাবই ছিল আলাদা। যখন টের পেতেন, আশেপাশে কাছাকাছি কোথাও রয়েছে বা’জি, তখনই বদুকে বলতেন, ‘এস তো ইয়ং-ম্যান, দাবার আসরে হেরে গিয়ে মুখ ফোলাবার ইচ্ছে যার আছে, এস বসা যাক।’ বা’জি কিন্তু ভাইজানের ইঙ্গিতে সাড়া দিতে ভুলত না! বলত, ‘কাল কে হেরেছিল স্যার, মনে নেই। তাছাড়া মাঝে মাঝে যে হারি, সে তো ইচ্ছে করে আপনার মান বাঁচাই। একটা মেয়ের কাছে হেরে গেলে লজ্জা করবে না? তাই দয়া করে– ‘ বা’জিকে কথায় হারানো অসম্ভব ছিল।
একদিন ভাইজান এক নতুন কাণ্ড করলেন। খাবারঘরে না গিয়ে তিনি এসে খেতে বসলেন রান্নাঘরে। আপা চুলোর পাশেই বসে। সাজোঁ বা’জির দোপাট্টার আঁচল ধরে বদু ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে। বা’জি কথা বলতে শুরু করল, ‘পেয়ারি আপা, ভাইজানকে অতগুলো রুটিই খেতে হবে নাকি? তার ওপর আবার পুডিং আছে। আর হ্যাঁ, না খেয়ে উপায়ই-বা কী? ফেলে রাখলে আবার চাচি-আম্মার বকুনি। ভাইজানকে স্বাস্থ্যবান, ধনী আর বিদ্বান করে তোলা তো চাচি-আম্মার জন্যে ফরজ্ হয়ে গেছে, তাই নয় ভাইজা-আ-ন?’ সবাই হো হো করে হেসে উঠল তার কথায়।
হঠাৎ বা’জি উঠে দাঁড়াল। তারপর চারিদিকে তাকাতে তাকাতে পেয়ে গেল সেই ট্রেটা, যেটাতে ফলের সালাদ রাখা হয়েছে খুব যত্ন করে। আপা কিছু করবার বা বলতে পারার আগেই ট্রের ঢাকনা খুলে বা’জি সেটা তুলে ধরল ভাইজানের সামনে। অতি বিনয়ের ভঙ্গি করে সে বলল, ‘এই যে স্যার নিন; সাজোঁ বা’জি খাবার তৈরিতেও যে ওস্তাদ, সেটাও আপনার জানা দরকার। নিন শুরু করুন।’
ভাইজান কয়েক চামচ তুলে নিলেন। বললেন, ‘চমৎকার! খোদার কসম, এমন চমৎকার সালাদ আমি আর খাইনি। কে করল?’
বা’জি অপাঙ্গে একবার আপার দিকে তাকাল, তারপর বলে ফেলল, ‘গরিব সাজোঁ বা’জি ছাড়া কে আবার?’ বদু হঠাৎ যেন তাজ্জব হয়ে তাকিয়েছিল আপার লাল হয়ে ওঠা মুখখানার দিকে। হঠাৎ সে লাফিয়ে উঠল, ‘আমি বলব ভাইজান, কে করেছে?’
সঙ্গে সঙ্গে আপা পেছন থেকে বদুর মুখে হাতচাপা দিল, তারপর তার একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। বা’জি এদিকে হাসিতে ফেটে পড়ল। হঠাৎ ভাইজানের একটা আশ্চর্য নতুন দৃষ্টি এসে পড়ল বা’জির মুখের ওপর। কেমন একটা ঝোঁকের মাথায় আমিও বেরিয়ে এলাম বাইরে। বাইরে পর্দার পাশে দেখলাম আপা চুপ করে দাঁড়িয়ে। ভেতর থেকে বা’জির গলা শোনা গেল, ‘আহ্ ছাড়ুন, যেতে দিন আমাকে, আহ্!’ তারপর আর কোনো শব্দ নেই।
পরের দিন আমরা সব লনে বসে আছি। ভাইজান তাঁর ঘরে বসে পড়েছিলেন হয়তো। হঠাৎ বা’জির গলা শুনলাম। ভাইজানের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সে বলছে, ‘আসুন স্যার, একটা চাঁটি মারি আপনাকে; কী বলেন? ‘
সঙ্গে সঙ্গে ভাইজান বললেন, ‘সাবধান বাছাধন, একটা কিক্ মাত্র দরকার, এক কিকেই উড়ে যাবে শূন্যপথে!
বোধহয় ভাইজান তার নমুনাটাও দেখাতে শুরু করেছিলেন, বা’জির অস্ফুট আর্তকণ্ঠ ভেসে এল, ‘উহ্, কী অসভ্য! সবসময় ওই গোদা পা দুটো কেন ইউজ করেন, বলুন তো?’
ভাইজানও ছাড়বার পাত্র নন। তিনি বললেন, ‘তাহলে হাতই ইউজ্ করি এবার ‘ বা’জির গলা আবার গুমরে উঠল, ‘হেই, উহ্হ্, না, না, না– মাফ করুন এবারটি।’ সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল দুটো পা আছড়ানোর আওয়াজ। কয়েক সেকেন্ড পরেই আর কোনো শব্দ নেই।
একদিন বদু হঠাৎ ছুটতে ছুটতে এল আপার কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বদু বলছিল, ‘আপা, আপা, দেখ এসে, বা’জি আর ভাইজান কুস্তি লড়ছে। এস না, আহ্ এস শিগগির।
ফ্যাকাশে মুখে আপা একটা নিশ্চল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে দেখে বদু বলল, ‘আম্মা কোথায়, আম্মাকে দেখাব!’ বলেই সে আবার ছুটে যাচ্ছিল। এবার আপা হঠাৎ খপ্ করে তার একটা হাত ধরে ফেলল। বলল, ‘বদু এস, দেখ এসে, কতগুলো টফি রেখেছি তোমার জন্যে। এস নেবে।’ বদু কিছু বুঝতে পারছিল না। সে-ও আপার সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল।
আমার বইয়ের আলমারিতে একদিন দেখা গেল ‘হার্টব্রেক হাউস’ অযত্নে পড়ে আছে। ফলের সালাদের ট্রেটাও দেখা গেল রান্নাঘরের এক কোণে পড়ে, সেটাও খালি। আপা আগের মতোই রান্নাঘরে কাজ করছে, কেবল তার ঠোঁট দুটো দেখলাম জড়ানো, কোনো স্পন্দন নেই সেখানে।
.
সাজোঁ বা’জি আর তাসাদ্দক ভাইয়ের বিয়ের দুবছর পর আর একবার তাঁরা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলেন। বা’জি আর সেই আগের বা’জি ছিল না; হাসিতে তার প্রাণ ছিল না; চেহারায় সেই জ্যোতি ছিল না আর তার সেই উজ্জ্বল চকচকে কপালের উপর কালো কালো রেখা জেগেছে। ভাইজানও যেন দমে গেছেন অনেকখানি।
রাত্রের বেলা আম্মা ছাড়া আর সবাই আমরা রান্নাঘরে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ ভাইজান বদুকে প্রশ্ন করলেন, ‘বদু, সাজোঁ বা’জিকে বিয়ে করবে?’
‘নাহ্।’ বদু সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, ‘আমি ঠিক করেছি, বিয়েই করব না।’
সেই অনেকদিন আগেকার একটি সন্ধ্যা আমার মনে পড়ে গেল। ‘জানেন ভাইজান –আমি হঠাৎ বলতে লাগলাম, ‘অনেকদিন আগের কথা; বদু সেদিন প্রথম বলেছিল, আমি সাজোঁ বা’জিকে বিয়ে করব। আম্মা ওকে বলেছিলেন, আপাকে বিয়ে করতে। উত্তরে বদু বলেছিল, না আপা ভালো নয়। সে হচ্ছে এই পোড়া কাঠটার মতো। আর সাজোঁ বা’জি?… হঠাৎ জ্বলন্ত বাল্বটার দিকে দেখিয়ে বলেছিল, ঠিক ওটার মতো।’
আমি সব কথা শেষ করতে পারিনি, হঠাৎ মাথার উপরকার জ্বলন্ত বাল্বটা নিভে গেল, সমস্ত ঘরটা গেল অন্ধকারে তলিয়ে। ম্লান কণ্ঠে ভাইজান বলে উঠলেন, ‘হুঁ’, মনে আছে আমারো সেকথা।’ তারপর হঠাৎ তিনি বিরক্তির সুরে বললেন, ‘আর ছাই ইলেকট্রিক্ বালবেরও যে কী হয়েছে আজকাল, যখন-তখন ফস্ করে নিভে যায়।
আপা নীরবে একটা পোড়া কাঠ ছাইয়ের গাদায় ঠেলে দিচ্ছিলেন, যাতে ছাই ঢাকা আগুনের ফুলকিগুলো ভালো করে নিভে যায়।
ভাইজান বললেন, ‘উহ্ যা ঠাণ্ডা পড়েছে আজকাল।’ তার স্বরটাও যেন বরফের স্তূপে ঢাকা। ভাইজান হঠাৎ উঠে পড়লেন, তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে বসলেন চুলোর পাশে গিয়ে, যেখানে আপা বসেছিল। ভাইজান তাঁর দুটো হাত মেলে ধরলেন চুলোর উপর, তখনো একটু একটু তাপ আছে চুলোতে। আপা এইমাত্র নেড়েচেড়ে তুলেছে চুলোর ছাইগুলো।
অর্থোস্ফুট অচেনা একরকম স্বরে ভাইজান আবার কথা বললেন, ‘সেদিন খালাম্মাই ঠিক বলেছিলেন, পোড়া কাঠের ভেতরেও অনেক সময় আগুন লুকিয়ে থাকে; যদিও ওপর থেকে দেখা যায় না। তুমি কী বল সিদা?’
আপা নড়েচড়ে উঠল, সে বোধহয় পালাতে চায়। হঠাৎ হিস্ করে একটা আওয়াজ হল, কোথাও জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর এক ফোঁটা পানি পড়ল। আপার চোখের পানি, তা বোঝা গেল। ভাইজান কথা বলবার জন্যে চেষ্টা করছিলেন। অনেক চেষ্টার পরেই বোধহয় একটা আর্ত সুর তাঁর গলা থেকে ভেঙে ভেঙে বেরিয়ে এল, ‘এখনো অনেকগুলো ফুলকি আছে ছাইয়ের ভেতর। মিনতি করছি সিজদে, একেবারে নিবিয়ে দিও না, দিও না। দেখ কী অসহ্য ঠাণ্ডা!’
অনুবাদ : আহ্সান হাবীব
শেকড় – ইস্মত চুগ্তাই
প্রত্যেকটি মানুষের মুখ শুকিয়ে গেছে। বাড়িতে রান্না পর্যন্ত হয়নি। আজ ষষ্ঠ দিন। ছেলেপুলে ইস্কুল ছেড়ে বাড়িতে বসে বসে নিজেদের এবং বাড়ির লোকজনের প্রাণ অতিষ্ঠ করে তুলছে। সেই মারামারি-ধস্তাধস্তি, সেই হুটোপুটি-লাফালাফি। যেন পনেরোই আগস্ট আসেইনি। হতভাগাগুলোর এ খেয়াল পর্যন্ত নেই যে, ইংরেজ চলে গেছে এবং যাওয়ার বেলায় এমন গভীর আঘাত দিয়ে গেছে, যা শুকোতে বহুদিন লেগে যাবে। ভারতবর্ষকে এমন পঙ্গু হাতে আর ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে কাটা হয়েছে যে, হাজার হাজার শিরা ছিঁড়ে গেছে, রক্তের স্রোত রয়ে যাচ্ছে। সেলাই করে দেওয়ার ক্ষমতাটুকুও কারো নেই।
অন্য কোনো সাধারণ দিন হলে হতভাগাগুলোকে বলা যেত, বাইরে গিয়ে হৈ-হল্লা কর। কিন্তু কয়েকদিন যাবৎ শহরের অবস্থা এমন বিশ্রী হয়ে রয়েছে যে, সমস্ত মুসলমান একরকম নজরবন্দিই হয়ে আছে। দরজায় তালা পড়েছে। বাইরে পুলিশের পাহারা। ছেলেপুলেকে তাই বুকের ওপরই দুরমুশ পিটতে দেওয়া হচ্ছে। এমনিতে সিভিল-লাইন্স্ শান্ত– এসব পাড়া সাধারণত যেরকম থাকে। যেখানে পাঁক-কাদা, নোংরামি সেইখানেই বেশি। যেখানে দারিদ্র্য, সেইখানেই অশিক্ষার আঁস্তাকুড়ে ধর্মের নামে জঞ্জাল জমে ভুড়ভুড়ি ওঠে। সেই জঞ্জালই ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়েছে। তার ওপর পাঞ্জাব থেকে আগত শরণার্থীর সংখ্যা দিন-কে-দিন বেড়ে উঠে সংখ্যালঘুদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করছে। জঞ্জালের স্তূপেও আরো ক্ষিপ্র হাত পড়ছে। তারপর দুর্গন্ধ ক্রমশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এলাকায় পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছচ্ছে। দুই-এক জায়গায় খোলাখুলিভাবেই হাঙ্গামা হয়ে গেছে। কিন্তু মারোয়াড়ের হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতি এমনি মিশ্রিত যে, নাম, চেহারা, কি, কাপড়-চোপড় দেখে তাদের আলাদা করে চেনা বাইরের লোকের পক্ষে মুশকিলের ব্যাপার। বাইরের সংস্কৃতির লোক– যাদের সহজেই চেনা যেত– পনেরোই আগস্টের গন্ধ পেয়েই পাকিস্তানে গিয়ে পাড়ি জমিয়েছে। রয়ে গেছে শুধু এ রাজ্যের পুরনো বাসিন্দারা। তাদের না আছে তেমন বুদ্ধি, না আছে তেমন ক্ষমতা যে, হিন্দুস্তান আর পাকিস্তানের জটপাকানো সমস্যাটি কেউ তাদের বুঝিয়ে দেবে। যাদের বুঝবার কথা, তারা বুঝে নিয়েছে। এবং তারা নিরাপদও হয়ে গেছে। বাকি যারা শুনে গিয়েছিল, চার সের গম আর চার আনায় এক হাত লম্বা পাউরুটি পাওয়া যাবে সেখানে, তারা ফিরে আসছে। কারণ, সেখানে গিয়ে তারা এ-কথাও জেনেছে, চার সের গমের জন্যে একটা টাকারও দরকার হয় এবং এক হাত লম্বা পাউরুটির জন্যে গোটা একটা সিকিও দিতে হয়। আর, সে টাকা-সিকি না পাওয়া যায় কোনো দোকানে, না জন্মে কোনো ক্ষেতে। জান বাঁচাতে হলে যেমন কঠিন সংগ্রাম করতে হয়, টাকা-সিকি পেতে হলেও তাই।
সুতরাং বিভিন্ন মহল্লা থেকে যখন খোলাখুলিভাবে সংখ্যালঘুদের বার করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হল, ভারি মুশকিল বাধল তখন। কর্তাব্যক্তিরা পরিষ্কার বলে দিলেন, মশাই, লোকে এমন খিচুরি পাকিয়ে রয়েছে যে, মুসলমান বেছে বার করতে হলে রীতিমতো কর্মচারী লাগাতে হবে। সে একটা অকারণ বাজে খরচ। এমনিতে আপনারা যদি শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্যে জমি কিনতে চান, তাহলে খালি করে দেওয়া যাবে জমি। জানোয়াররা তো রয়েছেই। যখনই বলেন, জঙ্গল খালি করে দেওয়া যাবে।
এবার বাকি রইল শুধু কয়েকটি গোনা-গাঁথা, বাছা-বাছা পরিবার– তারা মহারাজার চেলা-চামুণ্ডা। তাদের যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যারা যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে পড়েছে, তারা বিছানাপত্র বাঁধছে। আমাদের বাড়িও এই দলে। যদ্দিন আজমির থেকে বড় ভাই আসেননি, ততদিন তেমন তাড়াহুড়ো ছিল না; কিন্তু তিনি এসে আমাদের ভড়কে দিয়ে তবে ছাড়লেন। তবু সেকথার কেউ বিশেষ গুরুত্ব দিল না। এমনিতে হয়তো কেউ কানেও তুলত না কথাটা এবং বিছানাপত্রও বাঁধা হত না কোনো কালে। সুতরাং খোদার মর্জি ছাব্বা মিয়ার পাঁয়তারাও চলত না। বড় ভাই তো যাওয়ার জন্য তৈরিই ছিলেন। তিনি বলে বলে হয়রান হয়ে গেছেন। এবার ছাব্বা মিয়া হঠাৎ এক কাণ্ড করে বসলেন– তিনি ইস্কুলের দেয়ালে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ লিখে রেখে এলেন। রূপচাঁদজির ছেলেরা এর প্রতিবাদে কথাটি মুছে ফেলে চট করে ‘অখণ্ড হিন্দুস্তান’ লিখে দিল। অমনি শুরু হয়ে গেল জুতো পেটাপিটি এবং পরস্পর পরস্পরের প্রাণ নেয়ার চেষ্টা। হাঙ্গামা ক্রমশ বেড়ে উঠল। শেষকালে পুলিশ ডাকা হল। যে-কটি মুসলমান বেঁচে ছিল, লরিতে করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল তাদের।
যে মায়েরা গালাগালি দেওয়ার সময় ছেলেমেয়েদের কলেরা-প্লেগের মুখে তুলে দেয়, ছেলেরা বাড়ি আসতেই তারা মমতায় অস্থির হয়ে ছুটে এসে তাদের বুকে চেপে ধরল। অন্য কোনো দিন হলে এবং রূপচাঁদজির ছেলেপুলের সঙ্গে ছাব্বা মারামারি করে এলে নতুন ভাবী তাকে এমনভাবে জুতোপেটা করতেন যে, সে জন্মে ভুলত না। তারপর তাকে উঠিয়ে রূপচাঁদজির বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হত– খাওয়ান ওকে ক্যাস্টর অয়েল আর কুইনাইন। রূপচাঁদজি শুধু আমাদের বাড়ির বাঁধা ডাক্তারই নন, বাবার পুরনো বন্ধুও। বাবার সঙ্গে ডাক্তারবাবুর, আমার ভাইদের সঙ্গে তাঁর ছেলেদের, আমার ভাবীদের সঙ্গে তাঁর বউদের এবং আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়ের সঙ্গে তাঁর নাতি-নাতনির বন্ধুত্ব একেবারে অচ্ছেদ্য। দুই বাড়িরই বর্তমান তিন পুরুষ পরস্পরের সঙ্গে এমনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ যে, সন্দেহমাত্র হত না, ভারত-বিভাগের পর এই ভালোবাসায় ফাটল ধরবে। সে যাই হোক, দুই বাড়িতেই লীগপন্থি, কংগ্রেসি এবং মহাসভাপন্থী লোক ছিল। ধর্ম এবং রাজনীতির তর্কও জোরসে চলত। কিন্তু সে যেন ফুটবল কিংব ক্রিকেট ম্যাচের মতো। এদিকে বাবা যদি কংগ্রেসি হলেন তো ওদিকে ডাক্তারবাবু আর বড় ভাই হলেন লীগপন্থি, আর, জ্ঞানচাঁদজি মহাসভাপন্থী। মেজো ভাই কমিউনিষ্ট, গুলাবচাঁদ সোস্যালিস্ট। এইভাবে বেটাছেলের বউ-ছেলেমেয়েও তাদের পার্টির। সাধারণভাবে হিসাব করলে কংগ্রেসের দল ভারি হয়ে যায়। কমিউনিস্ট, সোস্যালিস্টরাও গালাগালি খায়। কিন্তু তারা কংগ্রেসের দলেই ভিড়ে যায়। বাকি থাকে মহাসভা আর লীগের দল। এই দুটি দল সবসময় একজোট থাকে। ওরা তো পরস্পরের শত্রুই। তবু, দুটিতে মিলে কংগ্রেসের ওপর আক্রমণ চালায়।
কিন্তু এদিকে কয়েক বছর যাবৎ লীগের ক্ষমতা বেড়ে চলছিল, ওদিকে মহাসভারও। কংগ্রেসের তো পতনের যুগ চলছে। দুই-একটি ছাড়া বাড়ির সমস্ত ছেলেপুলে বড় ভাইয়ের নেতৃত্বে নিরপেক্ষ গোছের কংগ্রেসিদের ছেড়ে ন্যাশনাল গার্ডের মতো দল করে ফেলল; ওদিকে জ্ঞানচাঁদের নেতৃত্বে সেবক সংঘের একটা ছোটখাটো দল গড়ে উঠল। কিন্তু ভালোবাসায় তবু ফাটল ধরল না।
মহাসভাপন্থী জ্ঞানচাঁদ মুন্নির লীগপন্থি বাপকে বলে, আমার খোকার বিয়ে তো মুন্নির সাথেই দেব। সোনার পাঁয়জোর দেব আমি
: গিল্টি সোনার মাল যেন চালিয়ে দিও না হে।– অর্থাৎ বড় ভাই জ্ঞানচাঁদের মহাজনির ওপর কটাক্ষ করেন।
এদিকে, ন্যাশনাল গার্ড দেয়ালে দেয়ালে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ লিখে রাখে, সেবক সংঘ সেটা মুছে দিয়ে ‘অখণ্ড হিন্দুস্তান’ লিখে দেয়। এ হল সেই সময়ের কাহিনী, যখন পাকিস্তানের কথা ছিল হাসি-ঠাট্টার বিষয়।
বাবা আর রূপচাঁদজি এইসব শোনেন, আর, মিটমিট করে হাসেন; তারপর সারা এশিয়াকে এক করবার প্ল্যান করেন।
মা আর কাকিমা রাজনীতির আওতার বাইরে ধনে, হলুদ আর মেয়েদের যৌতুকের আলোচনা করেন। বউয়েরা পরস্পরের ফ্যাশন চুরির তাকে থাকে। নুন-লঙ্কার সঙ্গে সঙ্গে এ বাড়িতে ডাক্তার বাবুর ওষুধও কেনা হয়। প্রত্যেকদিন কারো না কারো হাঁচি পড়লেই অমনি ছুটে যাও ডাক্তারবাবুর কাছে। কিংবা যখন কারো অসুখ হল, আর, মা ডাল-ভরা রুটি বা দই-বড়া বানাতে শুরু করলেন, অমনি ডাক্তারবাবুকে বলে পাঠালেন, খেতে হয় তো আসুন।– ডাক্তারবাবু তখন নাতি-নাতনির হাত ধরে পৌঁছে যান।
বেরোবার সময় স্ত্রী বলেন, খেয়ো না যেন, শুনলে?
: হুঁ। তাহলে ফি আদায় করব কেমন করে? দেখ, বাপু, খোকা আর চুনিকেও পাঠিয়ে দিও।
কাকিমা গজর গজর করে বলেন, হায় রাম! লজ্জাও করে না তোমার!
মজা বাধে তখন, যখন মা’র শরীর খারাপ হয়। মা কেঁপে ওঠেন
: না, বাপু, আমি ওই হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাব না।
কিন্তু বাড়ির ডাক্তার ছেড়ে শহরের ডাক্তার আনতে যাবে কে?– সুতরাং ডাক্তারবাবু খবর শুনেই দৌড়ে আসেন। মাকে তাতিয়ে বলেন, একা একা পোলাও-জর্দা ওড়ালে তো অসুখে পড়বেই!
: তুমি যেমন পেটুক, অন্য লোককেও সেইরকম ঠাওরাও।– মা পর্দার আড়াল থেকে ঝনঝনিয়ে ওঠেন।
ডাক্তারবাবু দুষ্টুমি-ভরা চোখে মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, আরে, এ তো হল অসুখের বাহানা। ভাবী, তুমি এমনিই ডেকে পাঠিও, আমি চলে আসব। এসব ঢঙ কর কেন?
মা জ্বলে উঠে হাতখানা টান মেরে সরিয়ে নিয়ে গালাগালি দিতে থাকেন। বাবা মিটমিট করে হাসেন।
এক রোগীকে দেখতে এলে বাড়ির সমস্ত রোগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে– কেউ পেট নিয়ে এগিয়ে আসে, কারো গায়ে ফুসকুড়ি বেরিয়েছে, কারো কান পেকেছে, কারো-বা নাক ফুলেছে।
: কী বিপদ, ডিপ্টি সাহেব! দুই-একটাকে বিষ দিয়ে দিই। আমায় পশু-ডাক্তার ঠাওরেছে নাকি যে, দুনিয়ার যত জানোয়ার ভেঙে পড়ল।– ডাক্তারবাবু রোগী দেখেন আর গজর গজর করতে থাকেন।
ছেলেপুলে হওয়ার আভাস পেলে ডাক্তারবাবু সারা সৃষ্টিকে গালাগালি দিতে শুরু করেন।
: হুঁহ্! মুফতের ডাক্তার! পয়দা করে যাও, হতভাগার বুকের উপর দুরমুশ পিটে বেড়াক।
কিন্তু ব্যথা উঠলেই তিনি নিজের বারান্দা থেকে আমাদের বারান্দা পর্যন্ত টহল দিতে থাকেন, আর চিৎকার করে করে সকলকে অতিষ্ঠ করে তোলেন। পাড়া-পড়শি মেয়েদের আসা মুশকিল হয়ে ওঠে। আসতে-যেতে হবু বাপকে পটাপট চাঁটি বসান, আর, সে নির্বোধের মতো সাহস দেখিয়েছে বলে শাপ-শাপান্ত করেন।
অথচ শিশুর প্রথম আওয়াজ কানে যাওয়া মাত্র তিনি বারান্দা থেকে দরজার সামনে এবং দরজা থেকে ঘরের ভেতরে চলে আসেন। পাগলের মতো হয়ে বাবাও চলে আসেন তাঁর সাথে সাথে। মেয়েরা গালাগালি দিতে দিতে পর্দা করে। তিনি প্রসূতির নাড়ি দেখে নিয়ে তার পিঠ চাপড়ে বলেন, বারে আমার বাঘিনী!– তারপর শিশুর নাড়ি কেটে তাকে গোসল করাতে শুরু করেন। বাবা অপ্রতিভ হয়ে অনভিজ্ঞ নার্সের মতো ব্যবস্থাদি করে দেন।
তারপর মা চেঁচাতে শুরু করেন, নাও, গজব খোদার! কপাল-পোড়া আঁতুড়ঘরে ঢুকে পড়ল!
বেগতিক বুঝে দুজনেই গাল-খাওয়া ছেলেপুলের মতো বাইরে ছুটে পালান।
এরপর, বাবার যখন পক্ষাঘাত হয়, তখন রূপচাঁদজি হাসপাতাল থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর সমস্ত প্র্যাকটিস নিজের আর আমাদের বাড়িতে সীমাবদ্ধ হয়েছে। চিকিৎসা তো আরো কয়েকজন ডাক্তার করছিলেন। কিন্তু নার্স এবং মা-র সাথে সাথে রাত জাগতেন ডাক্তারবাবুই। তারপর, বাবাকে দাফন করে আসার পর থেকে পারিবারিক প্রীতি ছাড়াও দায়িত্ববোধ দেখা গেল তাঁর। ছেলেমেয়েদের ফি মাফ করাতে ইস্কুলে দৌড়ে যান, মেয়েদের যৌতুকের কান-বালির জন্যে জ্ঞানচাঁদের প্রাণ অতিষ্ঠ করে রাখেন। বাড়ির কোনো বিশেষ কাজ ডাক্তারবাবুর মত ছাড়া হয় না। পশ্চিমের উইংটা ভেঙে দুটো কামরা বাড়াবার কথা উঠলে ডাক্তারবাবুর মত অনুসারে সেটা চাপা দিয়ে দেওয়া হল। তিনি রায় দিলেন, এর চাইতে উপরে দুটো কামরা বাড়িয়ে নাও।– তাই করা হল। মজ্জন এফ.এ.-তে সায়েন্স নিতে চাইছিল না। ডাক্তারবাবু জুতো নিয়ে তেড়ে গেলেন, হাঙ্গামার নিষ্পত্তি হয়ে গেল। ফরিদা স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি এসে উঠল। স্বামী ডাক্তারবাবুর কাছে গিয়ে হাজির হল। পরদিনই তার বউ বাড়ি পৌঁছে গেল।
মেজো বউ শীলা ও বাড়িতে এলে দাইয়ের ঝঞ্ঝাটও চুকে গেল। বেচারি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে পালিয়ে আসত। ফিস তো দূরের কথা, উল্টে ছয় দিনের দিন কোর্তা আর টুপি নিয়ে এল।
.
কিন্তু আজকে যখন ছাব্বা মারামারি করে এল, তখন তার সংবর্ধনাটা এমনি হল, যেন গাজি পুরুষ লড়াই জিতে এসেছে। সবাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার বীরত্বের কথা শুনতে লাগল। অনেকগুলো গলার সামনে মা’র গলা চুপ হয়ে রইল। আজ থেকে নয়, পনেরোই আগস্ট থেকে– যেদিন ডাক্তারবাবুর বাড়িতে তিরঙা ঝাণ্ডা, আর, আমাদের বাড়িতে লীগের ঝাণ্ডা ওড়ানো হয়, সেইদিন থেকেই মা’র মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। এই দুটি ঝাণ্ডার মাঝখানে মাইলের পর মাইল প্রসারিত উপসাগর এসে দেখা দিয়েছে। চিন্তিত দৃষ্টিতে তার ভয়ঙ্কর গভীরতাটা দেখে দেখে মা কেঁপে ওঠেন। তারপর এল শরণার্থীর জোয়ার। বড় বউয়ের বাপের বাড়ির লোকজন যখন ভাওয়ালপুর থেকে মালপত্র লুটারুর হাতে খুইয়ে এবং কোনোরকমের প্রাণ বাঁচিয়ে এসে উঠল, তখন উপসাগরের মুখ প্রশস্ত হয়ে গেল। তারপর, রাওয়ালপিণ্ডি থেকে যেদিন নির্মলার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আধমরা অবস্থায় এসে পৌঁছল, সেদিন এই উপসাগরে অজগর ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। ছোট ভাবী ছেলের পেট দেখাতে পাঠালে শীলা বউদি অমনি চাকরকে হাঁকিয়ে দিলেন।
এ ব্যাপার নিয়ে কেউ তর্কবিবাদ করল না। সারা বাড়ির রোগ হঠাৎ সেরে গেল। বড় ভাবি হিস্ট্রিরিয়ার মূর্ছা ভুলে ঝটপট বিছানাপত্র বাঁধাছাঁদা শুরু করে দিলেন।
: আমার ট্রাঙ্কে তোমরা হাত দিও না।– অবশেষে মা’র মুখে কথা ফুটল। সবাই হকচকিয়ে গেল।
বড় ভাই তিক্ত স্বরে বললেন, আপনি যাবেন না নাকি?
: তওবা! আমি সিন্ধুতে মরতে যাব? আল্লার গজব পড়ুক ওদের ওপর। পর্দা-পুশিদার ধারও ধারে না ওরা।
: তাহলে সেজোর কাছে ঢাকায় চলে যান।
সেজো মামি-শাশুড়ি খোঁটা দিলেন, উনি কেন ঢাকায় যাবেন? বললেন, হতচ্ছাড়া বাঙালিরা হাত দিয়ে চটকে চটকে ভাত খায়।
খালা-মা বললেন, তাহলে রাওয়ালপিন্ডি চল ফরিদার ওখানে।
: তওবা! আল্লাহ পাক যেন পাঞ্জাবিদের হাতে কারো গোরের মাটি নাপাক না করায়।
মুখে তো জাহান্নামিদের ভাষা।– আজ স্বল্পবাক মা পটপট করে বলে যান।
: ওপরেও চিতাবাঘ, নিচেও চিতাবাঘ, বোম্বাই তোমার বাড়ি নয়, তোমার তো হল, বুবু, সেই বিত্তান্ত। আরে বোন, এ যে কাঠবেড়ালের মতো খুঁতখুঁতানি! বাদশাহ ডাক দিল তো ‘কী করি, কী করি!’ হাতি পাঠাল তো ‘ছি, ছি, এ যে কালো!’ ঘোড়া পাঠাল তো ‘ছি, ছি, এ তো পিছাড়া মারে!’…
করুণ পরিবেশ। তবু সবাই হো হো করে হেসে উঠল। মা’র মুখখানা আরো গম্ভীর হয়ে গেল।
ন্যাশনাল গার্ডের সর্দারে-আ’লা বললেন, কী ছেলেমানুষের মতো কথা বলছেন! মাথাও নেই, মুণ্ডুও নেই। ইচ্ছেটা কী? এখানে থেকে ছুরি খেয়ে মরবেন?
: তোমরা যাও। আমি এখন কোথায় যাব? আমার শেষ সময়।
: তাহলে শেষ সময়ে কাফেরদের হাতে ধোলাই হবে!– খালা-মা বলেন।
খালা-মা পোঁটলা-পুঁটলি গুণে চলেছেন। পোটলার মধ্যে সোনা-রুপোর গয়নাগাটি থেকে শুরু করে হাড়ের মাজন, শুকনো মেথি এবং মুলতানি মাটি পর্যন্ত রয়েছে। এইসব জিনিস এমনভাবে বুকে ধরে যাচ্ছেন, যেন পাকিস্তানি স্টার্লিং-ব্যালান্স কম হয়ে যাবে এগুলো না গেলে। বড় ভাই তিনবার চটে উঠে তাঁর পুরনো চাদরের পোঁটলাগুলো ফেলে দিলেন। কিন্তু খালা-মা এমনভাবে আর্তনাদ করে উঠলেন, যেন এ দৌলত না গেলে পাকিস্তান গরিব থেকে যাবে। বাধ্য হয়ে ছেলেপুলের পেশাবে-ভেজা গদির তুলোর পোঁটলা বাঁধতে হল, বাসন-কোসন বস্তায় ঢুকল, খাটের পায়া-কাঠামো খুলে খাটেরই দড়ি দিয়ে বেঁধে নেয়া হল। দেখতে দেখতেই সাজানো-গোছানো সংসার বাঁকা-ট্যাড়া গাঁঠরি-বোঁচকায় রূপান্তরিত হয়ে গেল। যেন সমস্ত জিনিস আপনা-আপনি বাঁধাছাঁদা হয়ে নেচে-কুঁদে বেড়াচ্ছে। একটুখানি জিরোতে বসেছে এবার। এক্ষুনি আবার উঠে নাচ শুরু করে দেবে।
কিন্তু মা-র ট্রাঙ্ক যেমন ছিল, তেমনি পড়ে রইল।
শেষে ভাই বললেন, আপনার যদি এখানে মরবার ইচ্ছে থাকে, তাহলে আর কে ঠেকাতে পারে!
সরলদর্শন, আপনভোলা মা শূন্য-দৃষ্টিতে ঘোলাটে আকাশের দিকে চেয়ে রইল। বুঝি-বা নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলেন, কে মারবে? কখন?
মেজো ভাই ফিসফিস করে বললেন, মা’র বুদ্ধিসুদ্ধি শেষ হয়ে গেছে। এ-বয়েসে মাথার ঠিক নেই।
: কাফেররা নির্দোষ মানুষের ওপর আরো বেশি করে অত্যাচার করে। তা উনি কী জানবেন! নিজের দেশ হলে জানমাল নিরাপদ থাকবে।
স্বল্পবাক্ মা’র মুখে যদি জোর থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই বলতেন, নিজের দেশ আবার কোন চিজের নাম? ওগো, তোমরা বল তো, কোথায় সেই নিজের দেশ? যেখানকার মাটিতে জন্ম নিলাম, যেখানে গড়াগড়ি দিয়ে মানুষ হলাম, সেই দেশই যখন নিজের দেশ হল না, তখন যেখানে দুদিনের জন্যে গিয়ে বাস করব, সে নিজের দেশ হবে কী করে? তারপর, ওখান থেকে যে আবার কেউ তাড়িয়ে দেবে না, তাই-বা কে জানে! বলতে থাক তোমরা নতুন দেশ বানানোর কথা। আমি এখানে বসে আছি শেষ রাত্তিরের বাতিটা হয়ে। একটুখানি দমকা বাতাস এলে হয়। ব্যস, দেশের কথা খতম। দেশ ধ্বংস করবার আর বানানোর এই খেলাও তো এমন কিছু মিষ্টি বস্তু নয়। একদিন মোগলরা নিজের দেশ ছেড়ে নতুন দেশে এসে উঠেছিল। আজ আবার চল নতুন দেশে। দেশ তো নয়, পায়ের জুতো। একটু পুরনো হল কি, দাও ছুঁড়ে ফেলে, আর-এক জোড়া পায়ে ঢুকিয়ে নাও।
কিন্তু মা চুপ করে রইলেন। তাঁর মুখখানা আগের থেকে আরো ক্লান্ত দেখাতে লাগল। যেন কত-শত বছর পাতি পাতি করে দেশ খুঁজে বেড়াবার পর ক্লান্ত হয়ে এসে বসে রয়েছেন এবং সেই খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে নিজেকেও হারিয়ে ফেলেছেন।
কত কী এল, গেল। কিন্তু মা নিজের জায়গাটি আঁকড়ে বসে রইলেন। ঠিক যেমন করে বটের শেকড় দাঁড়িয়ে থাকে ঝড়-তুফানের মধ্যে।
কিন্তু যখন ছেলেমেয়ে, বউ-জামাই, নাতি-নাতনির পুরো দলটি বড় ফাটক পার হয়ে পুলিশ-পাহারায় লরিতে উঠতে লাগল, তখন তাঁর বুকখানা খানখান হয়ে গেল। অধীর দৃষ্টিতে অসহায়ভাবে ওপারের দিকে তাকালেন তিনি। দুখানা বাড়ির মাঝখানে শুধু একটি রাস্তার ব্যবধান। কিন্তু ওধারের বাড়িখানা এত দূরে বলে মনে হল, যেন দূর দিগন্তে ভাসমান একফালি মেঘ। রূপচাঁদজির বারান্দা খাঁ খাঁ করছে। দুই-একবার ছেলেপুলে বাইরে এল। কিন্তু হাত ধরে টান দিয়ে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল তাদের। তবু, মা’র ছলছল চোখদুটি দরজার ফাঁক আর চিকের আড়ালের বিষণ্ন চোখগুলো দেখে ফেলল। লরিগুলো যখন দলবল নিয়ে ধুলো উড়িয়ে রওনা হয়ে গেল, তখন বাম দিকের নিষ্প্রাণ চিকটির দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল। দরজা খুলে চোরের মতো দৃষ্টিতে সামনের শূন্য, নিস্তব্ধ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ভারি পায়ে রূপচাঁদজি বেরিয়ে এলেন।। ধুলোর মেঘের মধ্যে হারানো মূর্তিগুলো খুঁজলেন তিনি কিছুক্ষণ। তারপর তাঁর ব্যর্থ দৃষ্টিটা অপরাধীর মতো নিঝুম দেয়ালে প্রত্যাহত হয়ে ফিরে এসে মাটিতে গিয়ে লুটিয়ে পড়ল।
সারাজীবনের সঞ্চয় খোদার দয়া এবং অনুগ্রহের ওপর ছেড়ে দিয়ে মা যখন নিঝুম বারান্দাটায় এসে দাঁড়ালেন, তখন বৃদ্ধ মনটা ছোট্ট শিশুর মতো ভয়ে কুঁকড়ে গেল। যেন চারদিক থেকে ভূত এসে গলা টিপে ধরবে। টলতে টলতে তিনি থাম ধরে নিজেকে সামলে নিলেন। সামনের দিকে চাইতেই প্রাণটা পাঁজরে আছড়ে পড়ল। এই ঘরটিতেই তো তিনি নববধূরূপে স্বামীর স্নেহময় কোলে লাফিয়ে এসে উঠেছিলেন। এইখানেই তো কাঁচা বয়েসের ভীরু-চোখ আপনভোলা বধূর চাঁদের মতো মুখ থেকে ঘোমটা সরিয়ে সারাজীবনের জন্যে দাসখত লিখে দিয়েছিলেন। সামনের দিকের ওই ঘরটায় প্রথম মেয়ের জন্ম হয়েছিল। বড় মেয়ের স্মৃতি অকস্মাৎ তীর হয়ে তাঁর অন্তরে গিয়ে বিঁধল। ওই কোণের দিকটায় তার ফুল পোঁতা রয়েছে। একটি নয়, দশটি। দশটি রুহ এইখানেই প্রথম নিশ্বাস ফেলেছিল। দশটি রক্তমাংসের মূর্তি, দশটি কাহিনী এই পবিত্র ঘরেই জন্ম নিয়েছিল। এই পবিত্র জঠর থেকে, যে-জঠর ছেড়ে আজ ওরা চলে গেছে। যেন তিনি পুরনো খোলস, সে-খোলস কাঁটায় আটকে রেখে তরতর করে সরে গেছে ওরা। গেছে শান্তির সন্ধানে, টাকায় চার সের গমের আশায়। কচি কচি সেই প্রাণগুলোর মধুর কলধ্বনি যেন কামরাটিতে এখনো গুঞ্জরিত হচ্ছে। লাফ দিয়ে তিনি কোল বাড়িয়ে কামরাটির দিকে ছুটে গেলেন। কিন্তু কোল ভরল না। যে-কোল এয়োতিরা ভক্তি ভরে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পেটে হাত ঠেকাত, সে-কোল আজ শূন্য। শূন্য ঘরটা খাঁ খাঁ করছে। আতঙ্কিত হয়ে মা ফিরে এলেন। কিন্তু মনের সন্দেহ আর মেটাতে পারলেন না। টলতে টলতে তিনি অন্য ঘরে চলে গেলেন। এইখানেই তো জীবনের সাথি পঞ্চাশটা বছর কাটিয়ে চোখ বুজেছিল। তার কাফন-পরানো লাশ এইখানেই দরজার সামনে রাখা হয়েছিল। বাড়ির সমস্ত লোক তার চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল। তার নসিবের জোর ছিল, আপনজনদের মাঝখানে গিয়ে পৌঁছেছে। কিন্তু জীবনের সাথিকে সে ফেলে গেছে। জীবনের সাথি তার আজ কাফনহীন লাশের মতো লা-ওয়ারিশ হয়ে পড়ে রয়েছে। পা দুখানা আর চলে না। বাবা যেখানে মারা গিয়েছিলেন, সেইখানটিতেই বসে পড়লেন মা। দশটি বছর তিনি এক কম্পিত হাতে মৃতের জায়গায় শিয়রে বাতি দিয়ে এসেছেন। কিন্তু আজ বাতির তেল ফুরিয়ে গেছে। বাতিও গেছে নিভে।
সামনে রূপচাঁদজি নিজের বাড়ির বারান্দায় জোরে জোরে পায়চারি করে বেড়াচ্ছিলেন। তিনি একবার গালাগালি দেন, তারপর আবার জোরে জোরে পায়চারি করতে থাকেন। সবাইকে গালাগালি দিচ্ছেন তিনি। নিজের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, চাকর-বাকর, সরকার, সামনে প্রসারিত মূক রাস্তাটি, ইট-পাথর, ছুরি-চাকু– এমনকি গোটা সৃষ্টিই তাঁর গালাগালির বোমাবাজির সামনে ভয়ে কুঁকড়ে পড়ে রয়েছে। বিশেষ করে গাল দিচ্ছেন তিনি রাস্তার ওপারের খালি বাড়িটিকে। সে যেন তাঁকে মুখ-ভ্যাঙচানি দিচ্ছে, যেন তিনিই নিজের হাতে এর এক-একখানা ইট ভেঙে ফেলেছেন। কী একটা জিনিস যেন মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন তিনি। সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে তিনি তাকে টেনে বার করে ফেলতে চাইছেন। কিন্তু না পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন। পারিবারিক সম্পর্কের রূপে যে জিনিসটি তাঁর ভেতর দৃঢ়মূল হয়ে বসে গেছে, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তাকে ধরে টানছেন তিনি। কিন্তু সেই সাথে যেন তাঁর মাংসও ছিঁড়ে চলে আসছে, আর, তিনি আর্তনাদ করে উঠে টান ছেড়ে দিচ্ছেন। তারপর হঠাৎ তাঁর গালাগালি বন্ধ হয়ে গেল। মোটর নিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
রাত্তিরে গলির মোড়টা নিস্তব্ধ হয়ে গেলে রূপচাঁদজির স্ত্রী খাবারসুদ্ধ দুখানা থালা ওপরে-নিচে করে সাজিয়ে খিড়কি দরজা দিয়ে চোরের মতো ভেতরে এসে ঢুকলেন। দুই বৃদ্ধাই নির্বাক। দুজনে মুখোমুখি বসে পড়লেন। মুখ বন্ধ রইল, চোখই সবকিছু বলতে আর শুনতে লাগল। থালা দুখানার খাবার যেমন ছিল, তেমনি পড়ে রইল। মেয়েরা কারো নিন্দে করতে বসলে জিভ চলতে থাকে কাঁচির মতো। কিন্তু মনে আবেগ এলেই মুখে তাদের তালা পড়ে যায়।
রাত্রির নিঃসঙ্গতায় দুশ্চিন্তার সীমা রইল না। রাস্তাতেই সব চুকে না যায়। আজকাল তো একটা-দুটো নয়, গোটা রেলগাড়ির সমস্ত লোককেই কেটে ফেলছে। পঞ্চাশ বছর ধরে রক্ত ছেঁচে ছেঁচে ক্ষেত আবাদ করেছে লোকে। আর, আজ তারা দেশ থেকে তাড়া খেয়ে পড়ি-কি-মরি করে নতুন জমির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। এই চারাগুলোর ভাগ্যে নতুন জমি জুটবে কিনা, কে জানে! শুকিয়ে তো যাবে না চারাগুলো! এরা দেশ-কাঙাল। ছোট বউয়ের তো খোদার মর্জি যখন-তখন। কোনো জঙ্গলেই প্রসব হয়ে যায় কিনা, কে জানে! ঘরবাড়ি, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য– সবকিছু ছেড়ে চলে গেছে ওরা। নতুন দেশে চিল-কাকে কিছু রাখলে হয় আবার! নইলে ওদেশের মুখখানা দেখেই ফিরে আসবে। তারপর ফিরে এসে নতুন করে শেকড় গাড়বার সুযোগ পায় কি না পায়। বসন্ত ফিরে আসতে আসতে এই বুড়ো গুঁড়িতে জান থাকবে কিনা, তাই-বা কে বলতে পারে!
পাগলের মতো দেয়ালে আর দরজার কোণায় হেলান দিয়ে বসে উলটে-পালটে কত কথাই যে দুজনে বললেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে! তারপর শ্রান্ত হয়ে গা এলিয়ে দিলেন। কিন্তু ঘুম আসে কই? সারারাত জোয়ান ছেলেদের কাটা লাশ, কাঁচা বয়েসী বউদের আহাজারি আর নাতি-নাতনির ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে মা’র জরাগ্রস্ত শরীরটা থরথর করে কাঁপতে লাগল। এরই মধ্যে কখন জানি তন্দ্রা এসে পড়েছিল। হঠাৎ মনে হল, দরজার সামনে সারাদিনের হাঙ্গামা ভেঙে পড়ল বুঝি-বা। প্রাণের মায়া নাই-বা থাক। তবু, তেলহীন প্রদীপও নিভবার আগে একবার কেঁপে ওঠেই। সাদাসিধে মরণই বা কী এমন স্বাদের জিনিস। তার উপর আবার মানুষের প্রেত হয়ে আসে! শুনেছি, বুড়িদেরও চুল ধরে রাস্তার ওপর হেঁচড়ে নিয়ে বেড়ায়। এমনকি, ছাল ছড়ে গিয়ে হাড় বেরিয়ে পড়ে। তারপর যে আজাবের কথায় দোজখের ফেরেশতারও মুখ শুকিয়ে যায়, পথের উপরেই সেই আজাব নেমে আসে।
ঘন ঘন টোকার আওয়াজ উঠছে দরজায়। মালেকুল-মউতের তাড়াতাড়ি পড়েছে যে! তারপর, আপনা-আপনিই সমস্ত ছিটকিনি খুলে গেল, বাতিগুলো জ্বলে উঠল এবং দূরে কোন অতল থেকে কার যেন আওয়াজ এল। বোধহয়, বড় ছেলে ডাকছে। না, এ ছোট্ট সেজো ছেলের ডাক। আর এক জগতের শূন্য কোনো কোণ থেকে ডাক আসছে।
তাহলে পেয়েছে সবাই দেশ? এত শিগগির? এখানে সেজো ছেলে, তারপর ছোটটি। পরিষ্কার দাঁড়িয়ে আছে। কোলে ছেলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বউয়েরা। তারপর হঠাৎ সারা বাড়ি প্রাণ ফিরে পায়। সমস্ত প্রাণ জেগে উঠে দুখিনী মা’র চারপাশে ভিড় করে দাঁড়ায়। ছোট-বড় হাত ভালোবাসায় দুলতে থাকে। সহসা শুকনো ঠোঁটে ছোট ছোট কুঁড়ি ফুটে ওঠে। পরিপূর্ণ আনন্দে সারা চেতনা আত্মহারা হয়ে অন্ধকারে পাক খেতে খেতে তলিয়ে যায়।
চোখ যখন খুলল, কব্জিতে পরিচিত আঙুল নড়ে বেড়াচ্ছে।
: ও ভাবী, আমায় এমনি ডেকে পাঠিও, আমি চলে আসব। এরকম ঢং কর কেন? পর্দার আড়াল থেকে রূপচাঁদজি বলে চলেছেন।– আর, ভাবী, আজ ফি দিয়ে দাও তো। এই দেখ, তোমার কুপুত্তুরদের কলোনি জংশন থেকে ধরে এনেছি। পালাচ্ছিল, বদমাশের দল কোথাকার! পুলিশ-সুপারিন্টেন্ডেন্টকেও বিশ্বাস করছিল না।
আবার জরাগ্রস্ত ঠোঁটে কুঁড়ি ফুটে উঠল। মা উঠে বসলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি। তারপর রূপচাঁদজির লোলচর্ম হাতের উপর দুটি উষ্ণ মুক্তাবিন্দু ঝরে পড়ল।
অনুবাদ : আতোয়ার রহমান
খানবাহাদুর – আয়াজ আস্মি
সায়েবদের প্রতি, সায়েবি ভাষার প্রতি, এমনকি যেসব জিনিস রঙে সাদা, তাদের প্রতি একটা গভীর টান ছিল নুরুল হুদার। বন্ধুরা তাঁকে বলতেন, ‘যেহেতু ওঁর নিজের চামড়ার রং একেবারে নিকষ-কালো, তাই সাদা রঙের এত ভক্ত উনি।’
সায়েবদের প্রতি তাঁর ভালোবাসার হেতু গায়ের রং কালো হওয়া ছাড়া আর কিছু থাক বা না-ই থাক, গাঁয়ের লোকেরা কিন্তু পাকাপাকিভাবে একথাটা জেনে নিয়েছিল যে, চৌধুরী সাদা-চামড়াঅলাদের প্রেমে অন্ধ হয়ে গেছেন। কথা বলতেন তিনি মাতৃভাষাতেই, কিন্তু ঢংটা ছিল সায়েবি। শিক্ষাগত যোগ্যতা ‘শ্যুড্’ ‘উ্যড’-এর সীমানা পেরোতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু কথা বলার সময় ‘ইয়েস’ ‘নো’ ‘থ্যাংকিউ’ ‘সরি’ ইত্যাদি কথার ঘন ঘন প্রয়োগে তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর পড়ার ঘরে ইংরেজ লেখকদের রাশি রাশি বই পরম যত্নে সাজানো থাকত। এগুলোর দিকে নজর পড়লেই নুরু চৌধুরীর ছাতি যেন ফুলে উঠত। এইসব গ্রন্থের রচয়িতা যেন তিনি নিজেই।
নুরু চৌধুরীর শোবার ঘরে বিলিতি লর্ড এবং সম্রাটদের খোদাই করা প্রতিকৃতি আর ছবি ছিল। সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের মস্ত এক মূর্তি তাঁর ঠিক শিয়রের ওপর থাকত। আরেকটা বিরাট ছবির নিচে চমৎকার অক্ষরে লেখা ছিল– ‘গড় সেভ্ দি কিং!’ ছবিটা এমন জায়গায় টাঙানো ছিল যে, সকালে ঘুম ভাঙতেই বিছানার উপর চোখ মেলে নুরু চৌধুরীর দৃষ্টি ঠিক ছবিটার ওপর পড়ত। নুরু চৌধুরী ইংরেজ লেখকদের বহুতর বাণী মাতৃভাষায় তর্জমা করে মুখস্থ করে রেখেছিলেন। আলাপ-আলোচনার সময় এগুলো যুৎসইভাবে প্রয়োগ করতেন তিনি।
নুরু চৌধুরীর এইসব গুণপনা নিয়ে গাঁয়ে প্রায়ই আলোচনা চলত; কিন্তু যেদিন তিনি সদরে হাকিমের কাছে খবর পাঠিয়ে লতিফ আর শব্বিরকে গ্রেফতার করালেন, সেদিন তাঁর নাম প্রতিটি শিশুরও মুখে মুখে ফিরতে লাগল।
গাঁয়ের কিছু লোক পুলিশের আবির্ভাবে চুপসে গেল। কিন্তু কেউ কেউ সাহসে ভর করে নুরু চৌধুরীর বাড়ির দিকে মুখ বাড়িয়ে মাটিতে থুতু ফেলল জোরে জোরে।
সারা গাঁয়ে বেশ কিছুকাল নুরু চৌধুরী লতিফ আর শব্বিরই মূল আলোচনার বিষয় হয়ে রইল–
‘শালা সায়েবদের দালাল নূরু চৌধুরীর এসব কী ধরনের কাণ্ড বল তো?’
‘হ্যাঁ, ভাই, জানো না, ও কত সাদা ঠাকুর নিজের ঘরে জমা করে রেখেছে?’
‘কিন্তু ভাই, বেচারা লতিফ আর শব্বিরের কী হবে?’
‘যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরই না হয়ে বসে আবার! ইংরেজ ওদের ওপর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মানুষকে খ্যাপানোর অভিযোগ আনবে। তারপর পাঠিয়ে দেবে সারাজীবনের মতো।’
‘ওদের ছেলেপিলেরা তাহলে খাবে কী? ‘
‘বাচ্চাগুলোর অভিশাপ পড়বে নুরু চৌধুরীর ওপর।
‘কিন্তু ভাই, নুরু চৌধুরী ওদের সঙ্গে শত্রুতা করতে শুরু করল কেন?
‘কেন জানে! হয়তো লতিফ আর শব্বির নুরু চৌধুরীকে বলেছিল– চাচা, এই ঠাকুরগুলোকে কতদিন আর বুকে করে পুষে রাখবে? এবার তো ওদের পাতাড়ি গুটোবার দিন ঘনিয়ে এল! হয়তো এরই ওপর আরো কথা হয়েছে। লতিফ বলেছে– চাচা, এ শালাদের তল্পি তোলার সময় এসেছে, মনে রেখ। যেসব বীর দেশকে স্বাধীন করার জন্যে জীবন দিয়েছে, এখন বরং ওদের ছবি আর ফটো দিয়ে ঘর সাজাও। হয়তো নুরু চৌধুরীর এসব কথা খুব খারাপ লেগেছে; তখন সে কিছু বলেনি। কিন্তু পরদিন, ভালো করে তখনো সকাল হয়নি, এমন সময় লতিফ শব্বির গ্রেফতার হল।’
.
সময় কাউকে চিরকাল মনে রাখে না। গ্রামবাসীও ক্রমশ লতিফ আর শব্বিরের কথা ভুলে যাচ্ছিল। তাদের মনে নুরু চৌধুরীর প্রতি যে পক্ষপাতিত্ব উবে গিয়েছিল তা ক্রমেই ফিরে আসতে লাগল। কারণ সবাই দেখল, লতিফ আর শব্বিরের বিচারের পর নুরু চৌধুরী গাঁয়ের বহু লোককে জমায়েত করে তাদের কথা দিলেন, সরকার ওদের আট বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে বটে, কিন্তু তিনি ওদের নির্দোষ এবং নিজের ভাই বলে মনে করেন। তিনি ওদের ছেলেপিলের প্রতি বাস্তব সমবেদনার প্রমাণ স্বরূপ খরচ-পত্তরের জন্যে মাসিক পঞ্চাশ টাকা করে মঞ্জুর করে দিলেন। এইভাবে মাসে একশো টাকা খরচ করে নুরু চৌধুরী নিজের সম্পর্কে সারা গাঁয়ের মনোভাবকে দিলেন বদলে।
কিন্তু তবু নুরু চৌধুরী তৃপ্ত হতে পারলেন না। তিনি গ্রামবাসীদের ধারণাই শুধু বদলে দেবার চেষ্টা করলেন না, বরং তাদের মনকেও জয় করে নেবার চেষ্টা করলেন। তিনি নিজের বাড়ির সামনের খালি জমিটুকুতে ছোট একটি পাঠশালা খুলে দিলেন। এছাড়াও গাঁয়ে কয়েকটি কুয়ো খোঁড়ালেন। গাঁয়ের প্রতিটি বিয়ে-শাদিতে, বিপদে-আপদে দেখাশোনা করা, অংশগ্রহণ করা ও সাহায্য করাটা নিজের অভ্যাসে পরিণত করে ফেললেন। আর, এদিকে তাঁর বাড়িতে বই, ছবি আর ঠাকুরেরও সংখ্যা বেড়ে চলল।
সেদিন নুরু চৌধুরীর বাড়ি ছাড়াও গোটা গাঁ-টাকেই আলোর মালায় সাজিয়ে দেওয়া হল। চৌধুরী নুরুল হুদা এবার খানবাহাদুর নুরুল হুদা হলেন। সায়েব-সুবোদের সংবর্ধনার জন্যে যে বিশেষ ঘরটি তৈরি হয়েছিল, সেদিন সেটির ভাগ্য গেল খুলে। এ-দিনটির আনন্দঅনুষ্ঠান সুসম্পাদিত করার জন্যে শহর থেকে অনেক লোক আনা হয়েছিল। সন্ধ্যা হতেই অভ্যাগতদের আবির্ভাব আরম্ভ হল– সবার শেষে এল জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মোটর। খানবাহাদুরের খেতাবপ্রাপ্তিতে তিনি অভিনন্দন জানাতে এসেছিলেন।
ম্যাজিস্ট্রেট যখন তাঁর রাজকীয় ভাষায় বললেন, ‘কাবাহাডুর সায়েব কালা আডমি আছে, টাটে কোনো ক্ষটি নাই, উহার অন্টর আয়নার মটো পরিষ্কার আছে।’– তখন হলটি হাততালির চোটে ফেটে পড়ে আর কি! খানবাহাদুর নুরুল হুদার চেহারাও খুশির চোটে লাল হয়ে উঠল।
ভোজের পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং খানবাহাদুর নুরুল হুদার মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা হল। তারপর ম্যাজিস্ট্রেট চলে গেলেন; তারপরও সারারাত আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে রইল গ্রামখানা
কিন্তু দিন কয়েক পরেই গাঁয়ের আরো কয়জন যুবক গ্রেফতার হল এবং এদের বেলায়ও লোকে সন্দেহ করল, এরাও লতিফ আর শব্বিরের পথের পথিক ছিল।
.
খানবাহাদুর নুরুল হুদার খেতাব পাওয়ার এক বছরও হয়নি, এমন সময় ইংরেজ ঘোষণা করল, তারা ভারত ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু এ গাঁয়ে এ খবর এত দেরিতে পৌঁছল যে, জল তখন অনেকদূর গড়িয়েছে। দেশ জুড়ে দাঙ্গার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। ইংরেজ চলে গেলে খানবাহাদুরের বেশি চিন্তা হল নিজের জীবন নিয়ে। কারণ চারদিকে গুজব রটে গিয়েছিল, গাঁয়ে সকাল-সন্ধ্যা যে-কোনো সময়ে আক্রমণ হতে পারে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে তিনি কয়েকটা চিঠি লিখলেন, কয়েকবার নিজের বিশেষ বার্তাসহ লোক পাঠালেন। কিন্তু তিনি সদরের শান্তি রক্ষা করেই কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না, খানবাহাদুরের আহ্বানে গাঁয়ে আসেন কেমন করে!
কিন্তু অবশেষে একদিন সশস্ত্র সৈন্যের একটা পল্টন খানবাহাদুরের নিরাপত্তার জন্যে শহর থেকে গাঁয়ে এল। সেদিন গাঁয়ের সমস্ত লোকের ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এল এবং সবার মনে খানাবাহাদুর নুরুল হুদার মর্যাদা অনেক বেড়ে গেল।
আসলে ব্যাপারটা অন্যরকম। খানবাহাদুরও এই নতুন খেতাবের মারফতে পাওয়া সম্মানকে আরো খানিকটা দৃঢ় করার জন্যে অনেককিছুই করতে আরম্ভ করেছিলেন। ভাগ্যের জোরে দাঙ্গাও এই সময়ে তাঁকে গ্রামবাসীদের সেবা করার খাসা সুযোগ এনে দিল। গাঁয়ে যে-কোনো কাজই হোক না কেন– শান্তি-কমিটি গঠন কিংবা ‘মিলাদ-মাহফিলে’র অনুষ্ঠান কিংবা সভা-ধর্মসভা– খানবাহাদুর সবখানেই উঁচু আসন পেতেন। খানবাহাদুরের সায়েব-প্রীতি মূর্তি, ছবি আর বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পয়সার জোরে শুধু মর্যাদাই বাড়ে না, বরং এ যুগে পয়সা দিয়ে মানুষ পর্যন্ত কেনা যায়, এ শিক্ষা সম্ভবত তাঁকে এই বোবা বন্ধুরাই দিয়েছিল। এই কারণেই গাঁয়ের এবং আশপাশেরও সম্ভবত এমন কোনো সমিতি মণ্ডলী কিংবা রাজনৈতিক অরাজনৈতিক এমন কোনো প্রতিষ্ঠানই ছিল না যাতে খানবাহাদুরের চাঁদা যেত না।
কোনো সমিতিকে চাঁদা পাঠাতে গিয়ে তিনি বন্ধুদের বিনীত কণ্ঠে বলতেন, ‘কী বল হে– এই সমিতির জন্যে আর্থিক সাহায্যটা কেমন হওয়া উচিত? আমার মনে হয় সমিতি গঠনমূলক কাজই করে যাচ্ছে। গরিব লোক এত ছুটোছুটি করছে, যদি ওদের আর্থিক সাহায্যটুকুর দিকেও খেয়াল না রাখি, তাহলে সমিতির কর্মীদের মন থেকে সেবার অনুপ্রেরণা জুড়িয়ে যাবে যে। তাছাড়া ভাই, এ দুনিয়ায় কে কার! আল্লা যা দিয়েছেন তা সৎ কাজে ব্যয় করাই দরকার।’
খানবাহাদুরের বিগত জীবনের কথা যতদূর জানা যায় এবং গ্রামবাসীরা যতটুকু জানে, তা হচ্ছে, খানবাহাদুরের জন্মের পরই তাঁর বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন। কারণ, তিনি নিজে একেবারে লাল টুকটুকে এবং ফর্সা ছিলেন, আর খানবাহাদুর নুরুল হুদার মতো কালো কিটকিটে শিশু ভূমিষ্ঠ হতে দেখে তাঁর সন্দেহ হয়েছিল যে, এ শিশু তাঁর নয়– অন্য কারো
পিতৃহীন শিশু-খানবাহাদুরের লালন-পালন তাঁর চাচার তত্ত্বাবধানে হতে লাগল। খানবাহাদুরের বয়েস যখন মাত্র দু-বছর, তখন তাঁর মা এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে অবিনশ্বর জগতে যাত্রা করলেন। মা কোনো-এক সময়ে তাঁর বাবা চৌধুরী বদরুদ্দোজার ঘরে দাসীর মতন এসেছিলেন এবং এই ধরনের একটা ধারণাই চৌধুরীর মনের মধ্যে ছেয়ে গিয়েছিল যে, তাঁর স্বামী বাড়ির সক্কলের বিরোধিতা সত্ত্বেও একজন দাসীকে বিয়ে করেছেন।
গাঁয়ে খানবাহাদুরের চাচার অনেক সম্পত্তি ছিল। তাঁকে নিয়ে চাচা গাঁয়ে এলেন। খানবাহাদুর তখন মাত্র আড়াই বছরের। তাঁর যখন জ্ঞানগম্যি হয়েছে, তখন এ সংসারে একমাত্র আপনার যে লোকটি চোখে পড়ল, তিনি হচ্ছেন তাঁর চাচা। চাচার মৃত্যুর পর সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হলেন খানবাহাদুর; এবং খানবাহাদুরের বাপ-চাচার সমস্ত ধন-দৌলত জমেছিল ইংরেজের দান ঠিকাদারির কৃপায়। এই জন্যে স্বাভাবিকভাবেই সায়েবদের সাথে তাঁর একটা সম্পর্ক জমে উঠছিল। এই সম্পর্ক বাড়তে বাড়তে প্ৰশংসা, তারপর পুজোর আকার ধারণ করেছে।
খানবাহাদুরের জীবনে চল্লিশটি বসন্ত পার হয়ে গেছে। কিন্তু বন্ধুবান্ধবেরা অনেক বোঝানো সত্ত্বেও তিনি বিয়ে করেননি। ঘরে ছিল দুজন চাকর। এদের মধ্যে দীনু তাঁর প্রাচীন প্রসাদভোগী। তাঁর বাবার আমল থেকে সে এখানে আছে।
একমাত্র দীনুই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, খানবাহাদুরের বাবা চৌধুরী বদরুদ্দোজা নিছক সন্দেহের ভিত্তিতে আত্মহত্যা করেছেন। নইলে মায়ের গর্ভ তো কুমোরের চাক। দীনু বলে, ‘খানবাহাদুরের মা তাজি বিবিকে আমি ছেলেবেলা থেকেই জানি। বড় ভালো মেয়ে ছিলেন!’ সে কসম খেয়ে বলে, ‘তিনি যদ্দিন বেঁচে ছিলেন, পরপুরুষ তো দূরের কথা, বাড়ির চাকরদের সামনে পর্যন্ত পর্দা করতেন।’
খানবাহাদুরের অতীত জীবন যেমনই হোক-না কেন, গ্রামবাসীদের তাতে কিছুই এসে যায় না। তারা শুধু এটুকুই জানে যে, চৌধুরী নুরুল হুদা যেদিন থেকে খানবাহাদুর হয়েছেন, সেদিন থেকে তাঁর মধ্যে বড় একটা পরিবর্তন এসেছে। তিনি তাঁর টাকার থলে খুলে দিয়েছেন।
দাঙ্গার নামে খানবাহাদুর গদগদ হয়ে ওঠেন। কারণ দাঙ্গা তাঁকে দু-যুগের মতো বিখ্যাত করে দিয়েছে এবং গাঁ তো বটেই, শহরেও কোনো সভা হলে, কোনো সমিতি প্রতিষ্ঠিত হলে, সভাপতিত্বের জন্যে খানবাহাদুরের কাছেই আবেদন আসে।
তারপর দাঙ্গার তামস ঝড়-ঝাপ্টা কেটে গেছে। দূর হয়েছে দাসত্বের অন্ধকারও। ইংরেজ চলে গেছে এবং বেরিয়ে এসেছে স্বাধীনতার প্রোজ্জ্বল সূর্য। ইংরেজদের চলে যাওয়ায় ঘরে ঘরে উৎসব উদ্যাপিত হচ্ছে।
কিন্তু খানবাহাদুর হয়ে পড়লেন উদাস। দীনুর মনে হল, যেদিন তাঁর চাচা মারা যান খানবাহাদুর সেদিনও তো এতখানি উদাস হননি!
স্বাধীনতার সাথে সাথে এ সংবাদও গাঁয়ে এল, যেসব লোক স্বাধীনতা-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে জেলে গিয়েছিল, স্বাধীনতা দিবসে তাদের মুক্তি দেওয়া হবে। লতিফ আর শব্বিরের বিস্মৃত মুখ আবার গ্রামবাসীদের স্মৃতিতে টাকা হয়ে উঠল।
পরদিন দুপুরে যখন বন্ধু-বান্ধব আর সঙ্গী-সাথিদের সাথে মিছিল করে লতিফ আর শব্বির গাঁয়ে এসে পৌঁছল, তখন নেহালচন্দের খামারে সেই শোভাযাত্রার সংবর্ধনাকারীদের মধ্যে খানবাহাদুর নুরুল হুদাও ছিলেন। তিনি নাটকীয়ভাবে এগিয়ে গিয়ে লতিফ আর শব্বিরকে বুকে চেপে ধরলেন।
‘কী চৌধুরী সাহেব, আপনার মূর্তিগুলোর খবর কী?’ হাসতে হাসতে লতিফ খানবাহাদুরকে জিগ্যেস করল।
খানবাহাদুর চুপ মেরে গেলেন। কিন্তু গাঁয়ের মৌমাছিরা লতিফকে জানিয়ে দিল, চৌধুরী খানবাহাদুর বনে গেছেন।
‘বটে! ব্রিটিশ তাহলে যাবার সময় ওঁকে কিছু দিয়ে গেছে! চৌধুরী সাহেবের রাজভক্তি ব্যর্থ হয়নি।
খানবাহাদুর সংবর্ধনা থেকে বাড়ি ফিরে দেখলেন, সদরের কয়েক ব্যক্তি তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছেন। জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট খানবাহাদুরের কাছে স্বাধীনতার অভিনন্দন ও জরুরি সমাচার দিয়ে পাঠিয়েছেন। খানবাহাদুর তাঁদের বিদায় দিলেন। কিন্তু আজ তিনি ভারী উদাস। লতিফের কথা তাঁর মনের ওপর একটা বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে যেন।
‘চৌধুরী সাহেব, আপনার মূর্তিগুলোর খবর কী?’ লতিফের এ কথাটা খানবাহাদুরের মস্তিষ্কে হাতুড়ি ঠুকছে। অনিচ্ছুকভাবে তাঁর দৃষ্টি বার কয়েক ইংরেজ লর্ড আর মূর্তিগুলোর ওপর পড়েছে। ইদানীং এগুলোর ওপর তিনি কালো পর্দা চাপিয়েছেন। সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের বড় ছবিটার ওপরও তাঁর নজর পড়ল। ওটা ছিল তাঁর পালংকের সামনেই টাঙানো। পর্দাটা ইঁদুরে কেটে দিয়েছে। ইঁদুরে কাটা পর্দার ছিদ্র দিয়ে ছবির একটা চোখ উঁকি মারছে। খানবাহাদুরের মনে হল, যেন সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের চোখে একটা গভীর উদাস ঝাপসা ছায়া। ও চোখ যেন খানবাহাদুরের কাছে কিছু চাইছে।
‘দীনু ভাই!’ খানবাহাদুর চোখটির দিকে আর চাইতে না পেরে বললেন, ‘দীনু ভাই, তোমাকে কতবার বললাম, ছবির পর্দাটা পাল্টে দাও। জানো না, এটা বাদশার ছবি!
খানবাহাদুরের কথা শুনে দীনু খুব তাজ্জব বনে গেল। পর্দা বদলাবার কথা তাকে এই প্রথম বলা হল। তার এত অবাক হওয়ার কারণ, ওই যে ছবিটার পর্দা ইঁদুরে কেটে ফেলেছে, ওটাকে বাদশার ছবি বলা হচ্ছে। কিন্তু এমন বাদশা দীনুর চোখে কখনো পড়েনি, যাঁর মুখে দাড়ি এবং হাতে তসবিহ নেই! এক শা-সাহেবের কাছে আবার শুধু দীনুই নয়, তার বাড়ির সবাই মুরিদ হয়েছে কিনা।
দীনু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ কথাই ভাবছিল। খানবাহাদুর আবার বলে উঠলেন, ‘শুনেছ, লতিফ ছাড়া পেয়ে এখানে এসেছে?’
‘জি হ্যাঁ, বড় ভালো লোক।’
হ্যাঁ, আমারো তাই মনে হয়। আমার ইচ্ছে আছে– ওদের ছাড়া পাওয়ার খুশিতে গ্রামবাসীদের একটা বড়রকমের দাওয়াত দেব!’
দীনু আর কথা বলতে পারল না। তার চোখে আজ খানবাহাদুর একজন উঁচু দরের মহৎ ব্যক্তি বলে প্রতিভাত হতে লাগলেন।
.
ভোজের আয়োজন শুরু হল। এ উপলক্ষে কিছু নতুন মানুষ এল গাঁয়ে। খানবাহাদুর এদের নিজের বাড়িতে থাকার জায়গা দিলেন। কথাবার্তা শুনে চাকর-বাকররা জানতে পারল– নতুন মানুষগুলো গোয়েন্দা বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট।
খানবাহাদুরের চাকররা এ তথ্য লুকিয়ে রাখতে পারল না। গাঁয়ের অধিকাংশ লোকই জেনে ফেলল, খানবাহাদুরের কাছে গোয়েন্দা পুলিশের কিছু লোক এসেছে।
‘আরে ভাই, বড় লোকের কারবার। আল্লা দিয়েছেনও অনেক আর জান বাঁচানোর জন্যে সবকিছু তো ওঁকে করতেই হবে!’ কেউ কেউ ভাবল– গোয়েন্দা পুলিশের লোক খানবাহাদুরের জীবন এবং সম্পত্তি রক্ষার জন্যেই এসে থাকবে।
লতিফ, শব্বির আর বিশিষ্ট গ্রামবাসীদের বসবার জন্যে খানবাহাদুর তাঁর খাস কামরায় বন্দোবস্ত করলেন। সায়েবদের সাদা মূর্তিগুলোর উপর কালো পর্দা দেখে লতিফ হেসে উঠল।
‘ঠিক করেছেন, চাচা– শালাদের মুখে কালি লেপে দিয়ে ঠিক করেছেন। আবর্জনাগুলো এখন বাইরে ফেলে দেওয়াই সবচেয়ে ভালো!’
লতিফের কথা শুনে খানবাহাদুরের চোখ সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের ছবির দিকে উঠে গেল। দীনু ওটার পর্দা বদলায়নি। ছবির একটা চোখ তখনো ছিদ্র দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। খানবাহাদুরের সাথে লতিফও ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিল। তাকিয়ে সে হেসে ফেলল।
‘বারে, বাহ্! ইংরেজ চলে গেছে ঠিকই। কিন্তু ওদের একটা চোখ এখনো আমাদের দিকে তাকিয়ে!’
কয়েক কলসি ঘাম যেন খানবাহাদুরকে নাইয়ে দিল।
‘না, না, তা নয়। ইঁদুরে পর্দাটা কেটে দিয়েছে।’
‘ইঁদুর!’ লতিফ বাঁকা হাসি হাসতে হাসতে চুপ হয়ে গেল।
নেমন্তন্ন শেষ হল। এ সময়ের মধ্যে খানবাহাদুর, লতিফ আর শব্বির কোনো কথাই বলেনি। নেমন্তন্ন থেকে ফেরার সময় লতিফ খানবাহাদুরকে জানাল, কাল সকালে সে শহরে যাচ্ছে। শব্বিরও থাকবে সাথে।
কেন জানে, কেন, খানবাহাদুরের মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু তাঁর এ অবস্থা তিনি গোপন করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন।
পরদিন সকালে লতিফ আর শব্বিরকে যারা বিদায় দিল, খানবাহাদুরও তাদের দলে রইলেন।
কিন্তু সেদিন সন্ধ্যাবেলা গাঁয়ে খবর এল– শহরে যাবার পথে লতিফ আর শব্বির গ্রেফতার হয়েছে। খানবাহাদুর তখন গ্রামবাসীদের বোঝাতে লাগলেন, ‘কতবার আমি ওদের বলেছি– এ দেশ আমাদেরই, আমাদেরই এ সরকার। কিন্তু ওরা শুনল কই– নিজেদের ছেলেপিলের ভাবনা পর্যন্ত ওদের নেই!’
‘কিন্তু, চৌধুরী সাহেব!’ গাঁয়ের প্রবীণ গণমান্য পাঁচজনে বললেন (ওঁরা খানবাহাদুরকে বরাবর চৌধুরী বলেন), ‘ওরা দেশের বা সরকারের বিরোধী তো নয়, অবশ্যি ইংরেজদের বিরোধী নিশ্চয়ই।’
‘তোমরা জানো না ভাই এই ছোকরাদের। যাকগে, ওসব কথা বাদ দাও। আমি ওদের ছাড়াবার চেষ্টা করছি। যতদিন ছাড়া না পায়, আমার কাছ থেকে ওদের ছেলেপিলেরা মাসে মাসে পঞ্চাশটা করে টাকা পাবেই। ‘
অনুবাদ : বাশীর আলহেলাল
অনুরোধ – আহমদ নদিম কাসমি
পাড়ার বড় গলির মোড়টায় সবসময় তিন-চারটা টাঙ্গা দাঁড়ানো থাকে। কিন্তু আমি সেদিন মোড়ের কাছে এসে দেখলাম একটা টাঙ্গাও নেই। আমাকে যেতে হবে অনেক দূর আর আমাকে খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছুতে হবে। তাই বসে বসে টাঙ্গার প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে থাকলাম। অনেক টাঙ্গা এ পথে যাওয়া-আসা করছে কিন্তু সবগুলোই যাত্রী বোঝাই। এ সময় হঠাৎ ফিকে কোচওয়ানকে আমার দিকে আসতে দেখে বললাম, ‘ভাই ফিকে, টাঙ্গা কোথায়? টাঙ্গা নিয়ে এস না।’
‘বাবু টাঙ্গা তো আজ জুড়িনি।’ ফিকে জবাব দিল।
দেখলাম যে ফিকা কোচওয়ান বেশ শক্ত সামর্থ্য তাগড়া জোয়ান ছিল– আজ তাকে কেমন নিরীহ নিরীহ মনে হচ্ছে, যেন এ লাইনে সে এই প্রথম এসেছে। সে আজ শেভ করেনি। তার চোখজোড়ায়ও আজ সুরমা পড়েনি এবং পালকহীন পক্ষিশাবকের মতো রক্তিম হয়ে আছে।
‘কী ব্যাপার ফিকা!’ আমি জিগ্যেস করলাম।
সে বলল, –‘বাবু একটা কাজ আছে।’
‘হাঁ হাঁ, বল।’ আমি বললাম।
‘কাজ হল বাবু, আপনি আমার বাবাকে তো চেনেন?’ ফিকে বলল, ‘তার একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেছে।’
‘উহ্’–আমি বড় ব্যথিত হলাম, ‘কী করে নষ্ট হল– কোনো দুর্ঘটনা?’
‘জী না– ‘ ফিকের চেহারায় একটা উদাস নির্লিপ্ততা ফুটে উঠল।
‘লাল তো সবসময়েই থাকে এবং চোখ ফেটে পানিও সবসময়ে গড়িয়ে পড়ে। আপনি তো জানেন। বাবার সাথে কয়েকবার তো আপনি টাঙ্গায়ও বসেছিলেন। তো বাবু কাল হল কী, বাবা মিছরি শহরের পথ দিয়ে আসছিলেন, সেখানে প্রতিদিন যে হাকিমটি সান্ডার তেল বিক্রি করত, সে আজ সুরমা বিক্রি করছিল। বাবা সে সুরমা নিয়ে এলেন। এবং আমাকে বললেন– ‘এতে চোখের লালিমা দূর হবে। হাকিম খোদা এবং রসুলের কসম খেয়ে বলেছে, এবং এ-ও বলেছে যে, যদি লালিমা দূর না হয় তাহলে কেয়ামতের দিন তুমি আমার ঘাড় ধর।’ তা আমিও বললাম, ‘হাকিম যখন খোদা এবং রসুলের কসম খেয়ে বলেছে আপনিও একটু লাগিয়ে দেখুন না।’ আম্মাও এই পরামর্শ দিলেন। তিনি ‘লোকমান হাকিম হেকমতের রাজা’ বলেই চোখে সুরমার শলা ঘুরিয়ে দিলেন। বাস আর যায় কোথা– বাবু কসম খেয়ে বলছি সেই যে চোখ বন্ধ হয়েছে– এবং যে কষ্ট, যেন তার নয় আমার–। বাবুজি, আপনার অসুবিধা হচ্ছে না তো? সিগ্রেটওয়ালার চেয়ারটা আনব নাকি?’
এ-সময় ফিকাকে আমার কাছে মনে হল যেন তার চওড়া বুক কুঁচকে গেছে।
আমি বললাম– ‘তুমিও বড় বাড়াবাড়ি করছ। তারপর কী হল বলে যাও না।’
ফিকার চোখে-মুখে কৃতজ্ঞতার ছায়া প্রকাশিত হল এবং সে বলল– ‘বাস– বাবুজি, খোদা আপনার ভালো করুন। রাত তো যাহোক বাবা কান্নাকাটি করে শেষ করলেন।
পরে সকালে সব কোচওয়ান এসে জড় হল। তাদের মধ্যে থেকে চাচা শায়দে বলল ‘তুলোর কোষ পিষে দিয়ে চোখ পরিষ্কার কর।’ তার কথামতো চোখ পরিষ্কার করলাম কিন্তু বাবা সেই আগের মতো কাতরাতে থাকলেন। আবার একজন বলল, ‘পালক পিষে চোখে বেঁধে দাও।’ তাই বাঁধলাম। পরে চোখ খুললে বাবা বললেন– ‘এত চেষ্টা আর কেন করছ, চোখের জ্যোতি তো চলে গেছে।’
‘তাকে দুটো হাসপাতালে নিয়ে গেলাম কিন্তু একটাতেও জায়গা পেলাম না। দুপুরে, রাজগড়ের এক কোচওয়ান বলল তার শালা নাকি মেও হাসপাতালের চৌকিদার। তার অনুরোধে জায়গা যাহোক একটা পাওয়া গেছে। তবে বারান্দাতে। হোক, তবুও কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু বাবু, সন্ধ্যা হতে চলল অথচ ডাক্তার দূরে থাকুক কোনো নার্সও এ দিকে আসেনি। আপনি তো সাহেব মানুষ, এ দেখুন, দুহাত জোড় করে অনুনয় করছি আমার সাথে চলুন। নিষ্পাপ রুগীটাকে একটু দেখে আসবেন।’
আমি বললাম, ‘ওখানে একজন ডাক্তার আছেন, ডাক্তার আবদুল জব্বার। তাঁকে আমার সালাম বলগে। যাও, কাজ হয়ে যাবে। আর যদি না হয় তাহলে কাল আমি তোমার সাথে যাব। এখন আমাকে একটা দাওয়াতে যেতে হবে। নাম মনে রেখ, ডাক্তার আবদুল জব্বার।’
ফিকা আমার প্রতি অজস্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বিদায় নিল। পরে একটা খালি টাঙ্গা পেয়ে গেলাম। টাঙ্গা মেও হাসপাতাল অতিক্রম করাকালে দেখলাম, ফিকা হাসপাতালের এক চৌকিদারের সাথে কথা বলছে। বোধহয় সে ডাক্তার জব্বারের ঠিকানা জিগ্যেস করে নিচ্ছে।
একবার ভাবলাম, হাসপাতালে গিয়ে জব্বার সাহেবকে বলি কিন্তু তখন টাঙ্গা অনেকদূর চলে এসেছে। তাছাড়া আমার এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।
কিছুদূর গিয়ে ঘোড়া হঠাৎ পা ফসকে পড়ে গেল। প্রায় দশ মিনিটকাল পড়ে থাকল ঘোড়া। পরে উঠে যখন আবার চলতে শুরু করল তখনি দেখলাম, হঠাৎ জব্বার সাহেবের
স্কুটার আমার টাঙ্গার পাশ কেটে চলে গেল।–‘জব্বার সাহেব’–আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম। কিন্তু জব্বার সাহেব আমার চিৎকারের চাইতেও দ্রুত চলে গেলেন।
কোনো চিন্তা নেই, আমি ভাবলাম কাল গিয়ে বলে দেব। কাল প্রথম কাজই করব এটা।
রাতে বাসায় প্রত্যাবর্তন করে শুনলাম, ফিকা কোচওয়ান এসেছিল এবং বলে গেছে, ‘বাবু আসলেই যেন আমাকে খবরটা দেয়।’
আমি ভাবলাম, এ-সময় তাকে আবার কে ডাকে। যদি জব্বার সাহেব হাসপাতালে গিয়ে থাকেন এবং যদি ফিকার কাজ হয়ে থাকে, তাহলে তার কৃতজ্ঞতা সকালেই না হয় কবুল করে নেব। আর যদি কাজ না হয় তাহলে যখনি যে চেষ্টা চালানো দরকার সকালেই চালাব।
সকালে আমি তখনো বিছানা ছাড়িনি– হঠাৎ ফিকা এসে দরজায় নক্ করল।
ফিকা জানাল– ‘রাতে জব্বার সাহেবের ডিউটি ছিল না। আজ দিনেই তাঁর ডিউটি।’
‘অর্থাৎ, তোমার বাবা ডিসেম্বরের এই কনকনে শীতের মধ্যে বারান্দাতেই পড়ে আছে?’ আমার কণ্ঠে দুশ্চিন্তা প্রকাশ পেল।
‘জি হাঁ’– সে বলল– ‘কিন্তু এ আর এমন কী বাবুজি। আপনি তো আমাদের ঘর দেখেননি। দশ বছর থেকে স্যাঁতসেঁতে কুঁড়েঘরে পড়ে আছি।’
‘আর তাঁর চোখ?’ আমি জিগ্যেস করলাম।
‘সে তো চলে গেছে বাবু!’ ফিকা এমনভাবে বলল– যেন বছরখানেক হল তার বাবার চোখ চলে গেছে।
আমি বললাম– ‘চোখ যখন চলেই গেছে তখন কেন খামাখা বেচারা বুড়োকে হাসপাতালে টানাটানি করছ। সময় নষ্ট হবে, টাকা পয়সাও নষ্ট হবে।’
ফিকা বলল– ‘বাবুজি, কে জানে যদি চোখের কোনো অংশে ক্ষীণ একটুখানি দৃষ্টিশক্তি থেকে থাকে। দেখুন বাবুজি উনুন নিবে যায়। কিন্তু অনেকক্ষণ পরেও যদি ছাইয়ে হাত দেয়া না হয় তবে বুঝা যায় না কোনো জ্বলন্ত অঙ্গার অবশিষ্ট আছে কিনা।’
আমি এ কথায় চমকে উঠলাম। এতদিন পর্যন্ত ফিকা আমার সাথে শুধু চালের উচ্চমূল্য এবং আটার ভেতর ভেজাল মিশ্রণ সম্বন্ধেই কথাবার্তা বলত– পরে সে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলল– ‘বাবুজি একটু চলুন না আমার সাথে।
শরীর থেকে তখনো আমার ঘুমের রেশ পুরোপুরি কাটেনি। আরো একটু ঘুমানো দরকার। তার ওপরও শেভ করা, চা-নাস্তা করা– সুতরাং আমি বললাম– ‘আমি তোমাকে নিজের কার্ড দিচ্ছি। তা ডাক্তার জব্বারকে দেখিও। বড় বন্ধুমানুষ, তাড়াতাড়ি কাজ করে দেবে। তোমার বাবা একেবারে ওয়ার্ডে চলে যাবে আর ওষুধ-পত্রের জন্যে তো আমি গিয়েই বলব।’
সে আমার কাছ থেকে কার্ড নিয়ে এমনভাবে চলল যেন পৃথিবীর তাবৎ ধনদৌলত একত্রিত করে নিয়ে যাচ্ছে। আমি কার্ডে লিখে দিয়েছি, ‘জব্বার সাহেব! এর কাজটা করে দেবেন, বেচারা বড় গরিব, দোয়া করবে।’ আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস কাজটা হয়ে যাবে। ডাক্তারদের শুধু এতটাই দেখা– চোখ একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে– না কিছু ঔজ্জ্বল্য বাকি আছে।
আমি সারাটা দিন বাইরে বাইরে ছিলাম আর ফিকা সারাদিন আমার বাড়ির চারদিকে চক্কর দিয়ে ফিরছিল। সন্ধ্যায় সে আমাকে বলল, ‘জব্বার সাহেব চেম্বারে বসেছিলেন, তবে ভেতরে ঢুকতে দিলেন না। বলেন, পালাক্রমে এস। অনেকক্ষণ বসেছিলাম, কিন্তু আমার পালা আসেই না। তাই হাঁটু গেড়ে বসে লুকিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম পালা কীভাবে আসে বাবু।’
ফিকা আরেকবার আমাকে চমকিয়ে দিল। জানি না, পলোয়ান ফিকার ভেতরে এই অনুভূতিশীল ফিকাটা এত বছর কোথায় লুকিয়ে ছিল।
আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, কাল নিশ্চয়ই যাব। এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
পরদিন অতি প্রত্যূষেই আমার হঠাৎ শিখুপুর যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। রাতে প্রত্যাবর্তন করে জানতে পারলাম, ফিকা এসেছিল।
এরপর তিনদিন পর্যন্ত দীর্ঘসময় আমি ঘরেই কাটালাম। কিন্তু ফিকা আসেনি। চতুর্থ দিন আমি গলির মোড়ে এক কোচওয়ানকে জিগ্যেস করে জানতে পারলাম তার বাবা ওয়ার্ডে জায়গা পেয়েছে। এ-সময় ফিকাও আমার সামনে এসে উপস্থিত হল। তাকে দেখেই আমার লজ্জা লাগল। অতএব একটু মিথ্যা বলতে হল ‘কেমন ফিকা, জব্বার সাহেব কাজ করে দিয়েছেন না?’
সে বলল,–‘কিন্তু বাবুজি, তিনি তো আমার সাথে দেখাও করেননি।
আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, ‘আমি তাঁকে ফোন করেছিলাম।’
ফিকার চেহারায় রক্তিমাভা দেখা দিল। এবং তার চোখে-মুখে কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠল– ‘তাই তো আমি বলি, নার্স কেন বারবার শুধু বলেছিল দেখ বুড়োর যেন কোনো কষ্ট না হয়।’
পরে আমি ওখান থেকে চলে এলাম। যদিও আমার পা আস্তে আস্তে চলছিল কিন্তু চিন্তাশক্তি যেন হেরে গিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল।
রাতের প্রশস্ত নিদ্রা আমার লজ্জাভাবের কিছুটা লাঘব করেছে। কিন্তু সকালেই দেখি ফিকা আমার দ্বারে উপস্থিত। বলল– ‘আপনার অনুগ্রহে প্রবেশপত্র পেয়েছিলাম। তা তারা বাবাকে এখন কোটি লাখপতিদের হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এ তো বড় সর্বনাশ হয়ে গেল বাবুজি। আজ আমি মাকে সাথে নিয়ে গেছিলাম দুটা টাকাই মাটি হল। কিছু হয় যদি তো করে দিন।’
আমি বললাম– ‘আমি এক্ষুনি গিয়ে ডাক্তার জব্বারকে ফোন করছি।’
ফোন আমি করেছিলাম। কিন্তু ডাক্তার সাহেবের দেখা পাইনি। পরে কর্মব্যস্ততার ভেতর ডুবে গেলাম আমি। পাঁচ ছ-দিন পর ফিকাকে দেখলাম! ভাবলাম তার দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে অন্য গলিতে ঢুকে যাব এবং সেখান থেকে পালিয়ে বেরিয়ে যাব।
কিন্তু ফিকা হঠাৎ দৌড়ে আমার সামনে উপস্থিত হল। বলল– ‘বাবুজি, আপনার এতসব উপকারের প্রতিদান কী করে দেব বুঝতে পারছি না।’
মিথ্যা আমার লজ্জাভাবকে কান ধরে একদিকে সরিয়ে দিল,– ‘তোমার বাবা ফিরে এসেছে না?’
ফিফা বলল,– ‘ফিরেও এসেছে। এবং অপারেশনও হয়ে গেছে। শুক্রবারে পট্টি খুলবে। দোয়া করবেন।’
আমি বললাম– ‘খোদা রহম করবেন।’
পরে সে শুক্রবার সন্ধ্যায় এল। আমি জিগ্যেস করতেই সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ‘বাবুজি সর্বনাশ হয়ে গেছে। পট্টি খুলে জানা গেল এক চোখ তো আগেই চলে গেছে– এখন বাকিটার ওপরও তার প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। তারা বলল, এখন প্ৰথম অপারেশনের ক্ষত শুকিয়ে গেলে দ্বিতীয়টার অপারেশন করা হবে।’
আমি তাকে সান্ত্বনা দিলাম। এবং সাথে করেই সামনে একটা দোকান থেকে ফোন করলাম ডাক্তার জব্বারকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সে ফোনের কাছে উপস্থিত ছিল না। আমি তাকে কথা দিলাম যে, কাল গিয়ে ডাক্তার জব্বারের সাথে দেখা করব। তাকে হাসপাতালে না পেলে তার বাসায় গিয়ে ধরব।
পরদিন আমি ডাক্তার জব্বারের কাছে যেতে না পারলেও ফোন করেছিলাম। কিন্তু সেদিনও ফোনে পাইনি।
সম্ভবত সপ্তাহ দু-আড়াই পরে দরজায় কড়া নড়ে উঠল, চাকর এসে বলল– ‘ফিকা কোচওয়ান এসেছে।’ আমিও তাকে জানালাপথ দিয়ে দেখেছিলাম। একেবারে সাদা দেখাচ্ছিল তখন তাকে।
আমি চাকরকে জিগ্যেস করলাম ‘তুমি কি তাকে আমি আছি বলেছ?’
‘জ্বি হাঁ’–চাকর বলল– ‘হঠাৎ আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।’
‘বড় বোকা তো তুই’–আমি তাকে ধমক দিয়ে বললাম– ‘যা বলগে কাপড় বদলে আসছেন। ‘
কাপড় তো আমি আগেই বদলে রেখেছিলাম– তবে এখন আমার ভ্রুকুঞ্চন বদলাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। পরে ভাবলাম, কী মিথ্যাবাদী আমি! দুপয়সা বা দুটো টাকা অথবা দুলাখেরও ব্যাপার নয়, শুধু দুটি চোখের ব্যাপার। আর আমি মিথ্যা বলতে যাচ্ছি। আমাকে ফিকার সামনে স্বীকার করে নিতে হবে যে, আমি তোমার জন্য সত্যি কিছু করতে পারিনি। পরে তার সামনে এসব কথা বুঝে শুনে এমনভাবে বলব যাতে সত্য কথাটা প্রকাশ পায় এবং সে-ও দুঃখ না পায়।
আমি বাইরে এসে দাঁড়ালাম। সে ঝরঝরিয়ে কাঁদতে শুরু করল এবং বলল– ‘বাবুজি, কিছুই বুঝে আসছে না যে– কিছুই বুঝে-আসছে না।’ তার গলা বুজে এল। এবং ঝুঁকে পড়ে আমার পা-জোড়া জড়িয়ে ধরল।
আমার মুখস্থ করা বাক্য এক মুহূর্তে গুলিয়ে গেল। কোনোরকম আমি বললাম- ‘ফিকা– কথা হল– ফিকা কথা হল কি
ছোট ছেলের মতো অশ্রুসিক্ত লাল চেহারা নিয়ে সে উঠল। এবং বলল– ‘বাবুজি কিছুই বুঝে আসছে না, আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষাই খুঁজে পাচ্ছি না। আমার বাবা ভালো হয়ে গেছেন। তার দুটো চোখের জ্যোতিই খোদা ফিরিয়ে দিয়েছেন আপনার সহায়তায়। আপনি আমাকে খরিদ করে ফেলেছেন। বাবুজি খোদার কসম আমি সারাজীবন আপনার চাকর হয়ে থাকব।’
এবং আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম– ‘ও কিচ্ছু না ফিকা, ও কিছু না।’
অনুবাদ : আখতার-উন-নবী
কোল্ড ওয়েভ – খাজা আহমদ আব্বাস
বলদেব যেখানটায় বসেছিল তার সামান্য দূরেই ফকিরটি বসে বসে বড় করুণ আর প্রকম্পিত স্বরে বিড়বিড় করতে লাগল– ‘বড় কনকনে ঠাণ্ডা বাবা, গরিবকে একখানা কম্বল দিয়ে যাও; ভগবান তোমার মঙ্গল করবে বাবা।’ এবং যেহেতু ফকিরটি অন্ধ, অতএব সে জানে না রাত তখন গম্ভীর হয়ে গেছে। সমস্ত ক্যানাট প্যালেস নীরব, নিস্তব্ধ, কোথাও একটি পথিকের টিকিটিও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।– ফকিরটি যে শব্দ শুনে কাতর মিনতি জানিয়েছিল ওটা কোনো মানুষের পদশব্দ নয়। হাওয়ায় দোল-খাওয়া ছেঁড়া কাগজ এবং শুকনো পাতার শব্দ।
দমকা হাওয়া একখানা পুরনো খবরের কাগজের পাতা উড়িয়ে নিয়ে এল। আর বলদেব ব্যস্ত হয়ে ওটা ধরে ফেলল। হয়তো-বা কাগজখানা চাদরের কাজ দিতেও পারে নিছক এই খেয়ালে। কোনো এক উপন্যাসে সে যেন পড়েছিল। পড়েছিল শীতবহুল দেশে যেসব গরিবদের গরম জামাকাপড় থাকে না, তারা জামার নিচে বুকের উপর খবরের কাগজ লাগিয়ে নেয়। আজকে হয়তো-বা সেও তাই করবে। কিন্তু যখনি খবরের কাগজখানা হাতে এসে পৌঁছল, সে আশ্চর্য হয়ে দেখল প্রতিটি কলামের কিছু না কিছু অংশ কাটা। অতি সাবধানে যেন ধারালো কাঁচি অথবা ব্লেড দিয়ে বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ খবর এবং বিজ্ঞাপনগুলো কেটে রেখে দিয়েছে। এখন তো এই দুটি পাতায় ডজনেরও বেশি জানালা হাঁ করে আছে। বলদেব ভাবল, এই কাগজের চালুনি তীক্ষ্ণধার ঠাণ্ডা বাতাস কীভাবে রোধ করবে! পত্রিকাটা খুলেই দেখল ওটা দু-তারিখের। প্রথম পৃষ্ঠায় তার চোখে পড়ল– ‘স্থানীয় আবহাওয়া’। কাঁচিচালকের সন্ধানী দৃষ্টি থেকে এ অংশটুকু কীভাবে যে রক্ষা পেয়ে গেছে কে জানে। লাল অংশটুকুর নিচে লেখা,– ‘দিল্লি ৬ জানুয়ারি, মহকুমা আবহাওয়ার সরকারি খবরে প্রকাশ, আগামী দুইদিন পরই দিল্লি এবং তার আশপাশ অঞ্চলে কঠিন ‘কোল্ড ওয়েভ’ অর্থাৎ কনকনে ঠাণ্ডা পড়িবে। কারণ শিমলার পাহাড়গুলোতে বরফ তৈয়ার করা হইতেছে। এই বছর দিল্লিতেও অন্যান্য বৎসরের তুলনায় অধিক ঠাণ্ডা পড়িবে বলিয়া অনুমান করা যাইতেছে। এই জন্য ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং নিউমোনিয়ারও আশঙ্কা করা যাইতেছে।’
এরপরের অংশটুকু পড়ার প্রয়োজন নেই বলদেবের। এ বছর দিল্লির ঠাণ্ডার ওপর সে এর চেয়েও অধিক বিশ্লেষণ করে মর্মস্পর্শী ভাষায় রিপোর্ট লিখতে পারে।
প্রতিদিন টেম্পারাচার নিচের দিকেই নামতে থাকে। রাতে তো এমন বরফ পড়তে শুরু করে যে, সকালে উঠে দেখে কুয়া আর পুকুরের পানির উপর পাতলা বরফ জমে আছে। কিন্তু তার চেয়েও মারাত্মক হচ্ছে হাওয়া– যেগুলো শিমলা থেকে আসছিল। বলদেব ভাবল– আমি জানতাম না হাওয়াও যে বরফের মতো ঠাণ্ডা আর ব্লেডের মতো তীক্ষ্ণধার। আর এত চালাক যে, বারান্দার কোণে, দেয়ালের আড়ালে অথবা সিঁড়ির নিচে লুকোলেও সে ঠিক ধরে ফেলবে এবং বুকের উন্মুক্ত অংশ, কলার এবং আস্তিন দিয়ে প্রবেশ করে চামড়া মাংস ধরে একেবারে হাড়ে গিয়ে পৌঁছে যাবে।– কথাটা বারকয়েক ভাবল বলদেব। ভাবল, এ বছরের শীতকে নিয়ে অর্থাৎ ‘কোল্ড ওয়েভ’কে নিয়ে গোটা কয়েক কবিতা লিখে ফেললে কেমন হয়। বেশ সুন্দর করে– যাতে প্রয়োজনের সময় (অর্থাৎ মৃত্যুর পর) কাজে লাগে। কিন্তু এই কনকনে শীতে রক্ত, মন-মেজাজ উভয় জমে যায়, চিন্তা আর অনুভূতির সূত্র বরফ হয়ে যায় এবং মানুষের ধ্যান-ধারণা চিন্তার পরিবর্তে জড়িয়ে যায়।
সে ভাবল, এভাবেই যদি ঠাণ্ডা পড়তে থাকে তাহলে আমার শিরার সমস্ত রক্ত জমে যাবে। মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। আমার স্মরণশক্তি, অনুভূতি, অন্তর্দৃষ্টি সবকিছুই ঠাণ্ডার কবলে বেকার হয়ে পড়বে। অথচ আমার কিছু করা প্রয়োজন। কিছু বলা প্রয়োজন। এবং যদি না-ও পারি তাহলেও এই অন্ধ ফকিরটির মতো বিড়বিড় করা প্রয়োজন– ‘বড় কনকনে ঠাণ্ডা বাবা, একখানা কম্বলের প্রশ্ন, ভগবান তোমার মঙ্গল করবে।’
কিন্তু না, সে ফকির নয়। একজন কবি, একজন অনুভূতিশীল, বিচক্ষণ, শিক্ষিত যুবক। সে কোনো অন্ধ ফকির নয় যে, প্রকম্পিত স্বরে বিড়বিড় করবে। কিন্তু কে জানে হয়তো-বা আমার স্বরও ঠাণ্ডায় জড়িয়ে গেছে, হয়তো-বা আমার মুখ থেকেও কাঁপা কাঁপা স্বর বেরুবে। কিছু একটা বলে যে পরীক্ষা করা দরকার!– সুতরাং সে বলল, ‘সুরদাসজি, কার কাছে মিনতি করছ। এখানে তো সমস্ত কিছুই এখন ঘুমে অচেতন।’– এবং সে অনুভব করল, ঠাণ্ডার তীব্রতায় তার দাঁত কটাকট করে শব্দ তুলেছে। আর ফকিরের গলার আওয়াজের মতো তার আওয়াজও কম জড়িয়ে যায়নি। সে বেচারা ছিল অন্ধ। অতএব সে দেখতে পায়নি, প্রশ্নকর্তার পরনে ফ্লালিনের পাতলুন, গায়ে রেশমীর জামা এবং প্রশ্নকর্তা একজন শিক্ষিত বিচক্ষণ যুবক। অথচ ফকিরটি ভাবল, এ-ও ফকির। ‘কোনো চক্ষুষ্মান ফকির, আমার আড়ালে বসে আছে। অতএব এখানে আর আমার কিছু পাবার আশা নেই। এদিক থেকে যেই আসবে সব পয়সা সেই নিয়ে নেবে আগে।’ অতএব নিজের লাঠি এবং নিচে পাতানো কাপড়টা তুলে নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। এবং ক্যানাট প্যালেসের কামানের মতো বারান্দায় অনেকক্ষণ পর্যন্ত লাঠির আওয়াজ খট্ খট্ শব্দ তুলে মিলিয়ে গেল, বরং বলা যায় রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে বিলীন হয়ে গেল।
ঠাণ্ডার সাথে সাথে বলদেবকে নিঃসঙ্গতাও আক্রমণ করল। সে ভাবল– নিঃসঙ্গতাও একরকমের ঠাণ্ডা। অথবা ঠাণ্ডাও একরকমের নিঃসঙ্গতা। যেখানে কোনো সঙ্গী থাকে না, আত্মীয়স্বজন, প্রিয়তমা থাকে না এবং থাকে না বাজারের জনকোলাহল– সেখানে নিঃসঙ্গতাও নিজের মধ্যে একরকমের হিমশীতলতা এনে দেয়।–শোনা যায়, একটা নরক হবে– সেখানে পাপীদের আগুনে পোড়ানো হবে না। বরফের শেলের উপর শুইয়ে দেবে। এবং আরেকটা নরক এর চেয়েও ভয়ানক। সে নরকে পাপীদের একটি বদ্ধকক্ষে নিঃসঙ্গ অবস্থায় বছরের পর বছর আবদ্ধ করে রাখবে। আর বলদেব ভাবল, আমি এমন এক নরকে এখন আছি– যেটা ঠাণ্ডাও এবং নিঃসঙ্গও। এবং অনুভূতির প্রবল চাপে নিঃসঙ্গতার কঠিন অনুভব বরফমাখা বিজলির মতো তার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল।
আমার কিছু করা দরকার। সে ভাবল– না হয় ঠাণ্ডা আর নিঃসঙ্গতায় আমি পাগল হয়ে যাব। আমার কিছু বলা দরকার- কিছু ভাবা দরকার– না হয় মস্তিষ্ক বরফের মতো জমে একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে। যেরকম পানির উপর জমে যাওয়া ভারি বরফ ডুবে নষ্ট হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর এ-ও ভুলে যাব যে, আমি কে, আমি কী, আমি কোথায় এবং কেন?
আমি কে? আমি কী?
আমি বলদেবরাজ শর্মা, জাতফাত বিশ্বাস করি না– কিন্তু জন্ম থেকেই ব্রাহ্মণ। মিরাট কলেজের গ্রাজুয়েট। আমার বাবা ওকালতি করে মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকা রোজগার করেন। স্বাধীনতা পাওয়ার আগে রায়বাহাদুর রবণীরাজ শর্মা, বি.এ., এল.এল.বি. অ্যাডভোকেট হাইকোর্ট বলে ডাকত। এখন শুধু পণ্ডিত রবণীরাজ শর্মা বলেই ডাকে। আমি শুধু বাবার ছেলেই নই,– নিজেও কিছু। মানুষের ধারণা রঙ-চেহারা আর শরীরে আমি অদ্বিতীয়। তাছাড়া আমার অধ্যাপকদের বক্তব্য হচ্ছে– আমি তীক্ষ্ণ প্রতিভাসম্পন্ন, যদিও মাত্র দ্বিতীয় বিভাগে বি.এ. পাস করেছি। তবে এর কারণ, আমি কলেজের অন্যান্য অনুষ্ঠানাদিতে অবাধে অংশ নিতাম। ডিবেটিং সোসাইটি, টেনিস ক্লাব, ড্রামেটিক ক্লাব, মিটিং, কবিতা আবৃত্তি প্রভৃতি ছাড়াও আমি নিজেও ছিলাম একজন কবি। আমার ছদ্মনাম ছিল নির্মল। আমাকে আবৃত্তি অনুষ্ঠানে জনাব নির্মল মিরাঠি নামে ডাকত। কোথাও কোথাও পণ্ডিত নির্মলজি বলেও সম্বোধন করত। বলা হত আমার গজল আর কবিতায় প্রেমের বর্ণনা এমন তীব্রতা লাভ করত এবং সৌন্দর্য বর্ণনা এমন পূর্ণতা পেত– যা আমার সমসাময়িক কোনো তরুণ কবিদের কবিতায় পাওয়া যেত না।
আমি কোথায়? এবং কেন?
আমি এখন আমার বাবার সুরম্য প্রাসাদে নেই– যেখানে এখন আমার বেডরুমের আতসদানে হয়তো-বা আগুন জ্বলছে, স্প্রিংয়ের পালঙ্কে নরম কম্বল এবং রেশমি লেপ শোভা পাচ্ছে। হয়তো-বা শিয়রে সিল্কের চীনা স্লিপিং স্যুট ঝুলছে। কাশ্মিরি দর্জির তৈরি রেশমি ড্রেসিং গাউন এবং আলমারিতে মিলটন, বায়রন, কালিদাস ও গালিবের বাঁধানো পুস্তকের পেছনের ব্র্যান্ডির বোতলও আগের মতো হয়তো-বা পড়ে রয়েছে।
আমি এখন রাধার কুঠিতেও নই। সেখানে নৃত্যানুষ্ঠান হয়তো-বা জমকালোভাবে জমে উঠেছে এবং রক্তগরমকরা মদের পালা চলছে। আর একমাত্র আমি ছাড়া মিরাটের অন্যান্য সব শৌখিন মেজাজের অভিজাত যুবকেরা এগিয়ে গিয়ে প্রশংসায় ফেটে পড়ছে। আর রাধা সম্ভবত আমারই রচিত কোনো গজল অথবা আমারই নির্দেশিত কোনো ঠুমরি গেয়ে শুনাচ্ছে। রাধা…! যার সাথে আমার এত প্রণয় ছিল যার দরুন আমি ঘর ছেড়েছি। বাবা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু আমি ভ্রূক্ষেপ করিনি। গায়ের সেই এক জামা এক পাতলুন নিয়েই আমি হন্ হন্ করে চলে এসেছি। আর আমার মা উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়ে পেছনে থেকে আমাকে ডাকতে থাকলেন। কিন্তু আমার কানে তখন রাধার রহস্যময় ঘুত্রুর ছন্ছনানি বাজছিল। আমি সিদ্ধান্ত করে ফেলেছিলাম যে, আমি প্রমাণ করব কবিরা শুধু প্রেমের বর্ণনাই দেয় না, প্রেমও করে এবং মনপ্রাণ ঘরদোর সবকিছুকেই ছাড়তে পারে। রোমিও-জুলিয়েট, লাইলি মজনু, শিরি-ফরহাদ, চারুদত্ত এবং বসন্ত সীতা এরা সব তো শুধুমাত্র কাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু নির্মল ও রাধা, রাধা ও নির্মল সত্যিকার প্রেমের আগুনে পুড়ে এ পৃথিবীকে দেখিয়ে দেবে। অতএব আমি সেই পোশাকেই– পাতলুন আর জামা পরে বাজার হয়ে রাধার কুঠিতে এসে পৌঁছি। তখন আমার কাছে ঠাণ্ডা তেমন অনুভূত হয়নি। তৃতীয় প্রহরে সোনালি রোদে মোড়া ছিল এই বিশ্বপ্রকৃতি, এবং যৌবনের উত্তপ্ত রক্তও বয়ে চলেছিল আমার শিরায় শিরায়। আমার হৃদয় প্রেমরোগে আক্রান্ত এবং আমার বিশ্বাস ছিল (কেননা রাধা আমাকে বিশ্বাস করিয়েছিল) সে-ও আমার মতো প্রেমাগ্নিতে জ্বলছে।
রাধা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আতসদানে নিজের লম্বা ঘন কালো চুল শুকাচ্ছিল। আতসদানের প্রজ্বলিত অঙ্গারের গোলাপি প্রতিচ্ছায়া ফুটে উঠেছে তার রক্তিম গণ্ডদ্বয়ে। আমি ভাবলাম– রাধার ভালোবাসা যার সৌভাগ্যে আছে– তার কাছে তীক্ষ্ণধার ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কোনো ভয় নেই। পৃথিবীর যে-কোনো বিপদের মোকাবেলা করতে পারে।
‘আসুন আসুন নির্মলজি।’ রাধা পেশাগত হাসিতে আমায় অভ্যর্থনা জানাল। কিন্তু সাথে সাথেই নিজের বড় বড় চোখজোড়া তুলে যখন সে আমার দিকে তাকাল– তার মধ্যেও আমি দেখতে পেলাম যেন প্রেমের উষ্ণ মদ টপ্কাচ্ছে।
‘রাধা তোমার জন্য আমি ঘর ছেড়ে দিয়েছি। বাবা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দিয়েছেন। ওঠ, চল আমার সাথে, আমার দিল্লি গিয়ে বিয়ে করে ফেলব…
‘এবং খাব কী?’
‘আমি চাকরি করব। তুমি চাও তো রেডিওতে গাইতেও পার।’
‘নির্মল, তুমি বড্ড ভুল করছ। তুমি বোধহয় জান না সরকারি রেডিওতে কোনো বাইজি গাইতে পারে না। যাও প্রাণনাথ, বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও গে। কেন লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি পা দিয়ে ঠেলে দিচ্ছ!’
‘শুধু এজন্যে যে, আমার কাছে সম্পত্তির চেয়েও প্রিয় তুমি। রাধা, আমি ইস্কুলে মাস্টারি করব, কেরানিগিরি করব, কিন্তু সেই ঘরে আর ফিরে যাব না– যে ঘরে তোমাকে স্ত্রী করে রাখা যাবে না।’
‘তো যাও বাবু, যা ইচ্ছে করগে। কিন্তু আমি এই লাইলি-মজনু নাটকের নায়িকা হতে প্রস্তুত নই।’– পরে সে এমন এক স্বরে বলল– যা বরফের চেয়েও ঠাণ্ডা, তরবারির চেয়েও তীক্ষ্ণধার– ‘তুমি এখন যাও বাবু, আমাকে এখন ড্রেস করতে হবে। কাজের সময় হয়ে এল।’
অগত্যা তার কুঠি থেকে নেমে এলাম। তখন রোদ পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। সম্মুখের পার্কের পাতায় ঠাণ্ডা বাতাস ঈষৎ কাঁপন তুলেছে। আমার শরীরেও সে বাতাস এক অদ্ভুত শিরশির জাগিয়ে তুলল। এবং এই প্রথমবারের মতো আমার মনে পড়ল ঘর থেকে আমি কোট অথবা পুলওভার ছাড়াই বের হয়েছি।
গতকালের ঘটনা মাত্র। কাল– ত্রিশ ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে। আর এখন আমি মিরাট থেকে মাত্র চল্লিশ মাইল দূরে নয়াদিল্লিতে। কিন্তু এই সময়ের ব্যবধান আর দূরত্বের ব্যবধান আমার গোটা পৃথিবীটাই পাল্টে দিয়েছে।
কালকেও আমি ছিলাম এক ধনীপুত্র, একজন নিশ্চিন্ত যুবক। সমাজের স্বীকৃত আর সম্মানিত ব্যক্তি। পিতারা নিজের পুত্রের সামনে আমার বুদ্ধিমত্তা এবং যোগ্যতার প্রশংসা করত। প্রতিটি মা-ই নিজের কন্যাকে আমার কাছে বিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। কলেজের কত মেয়ে আমার নামে পাগল ছিল। দুটো কথা বলার জন্য কত ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিত। আমার আজ–! আজ আমি একজন বেকার, আশ্রয়হীন ভবঘুরে–! যার পকেটে না আছে পয়সা না আছে শরীরে একখণ্ড গরমবস্ত্র। আর যে কিনা ক্যানাটপ্যালেসের বারান্দায় থামের কাছে ঠাণ্ডা পাথরের বিছানায় বসে বসে কাঁপছে। দাঁত কড়কড় করছে। শিরায় শিরায় রক্ত জমে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে জড়িয়ে আসছে… হতেও পারে এটা আমার একগুঁয়েমিরই ফল। ফিরে গিয়ে যদি বাবার পায়ে পড়তাম তাহলে নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমা করে দিতেন। তখন আমিও হয়তো-বা একসময় পশমি ড্রেসিং গাউন পরে আতসদানের কাছে বসে বসে ব্যান্ডি পান করতাম। কিন্তু আতসদানের উষ্ণতার চেয়েও বেশি প্রয়োজন আমার প্রেমের উষ্ণতার। আমি তারই প্রত্যাশী। আমার দেহের চেয়েও বেশি কাঁপছে আমার হৃদয়। কেননা দেহে অন্তত একটা গেঞ্জি এবং একটা জামা আছে। কিন্তু গত ত্রিশ ঘণ্টায় আমার হৃদয় থেকে এক এক করে সমস্ত কাপড় খুলে ফেলেছি। এবং এখন সে স্বভাবতই বস্ত্রহীন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যুগের বরফমাখা বাতাসে কাঁপছে।
মিরাট থাকলে বাবার দুর্নাম বাড়বে, অতএব দিল্লি চলে এলাম। স্টেশনে থার্ডক্লাস ওয়েটিংরুমে রাতটা কোনোরকমে কাটালাম। এবং এই প্রথম অনুভব করলাম গরিব আর সাধারণ মানুষ থার্ডক্লাসে ভ্রমণ করতে গিয়ে কেমন অসুবিধার সম্মুখীন হয়। নিচে মানুষ এমনভাবে পড়ে আছে যেন যুদ্ধের ময়দানে মৃতদেহ পড়ে আছে। পায়খানার দুর্গন্ধে প্ৰাণ ওষ্ঠাগত একাধিক নাসিকা-ধ্বনির সংমিশ্রণে এক অদ্ভুত সংগীতের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু গাড়িতে একনাগাড়ে একঘণ্টা তীব্র ঠাণ্ডা বাতাস খাওয়ার পর ওয়েটিংরুমের এই উষ্ণতা আমার জন্য কত মধুর। মেঝেতে একখানা পুরনো কাগজ পেতে আমি শুয়ে থাকলাম। সারাদিনের উত্তেজনা আর কোলাহলের ভারে পর্যুদস্ত দেহে ঘুমের নামগন্ধও নেই। তবুও আমি আশ্বস্ত; এখানে ঠাণ্ডা নেই। এবং তখনি, ঠিক তখনি আমার মনে পড়ল এখানে কোনো আতসদান নেই, শরীর গরম করার কোনো উপাদানই এখানে নেই। এই সুন্দর উষ্ণতা মানুষের দেহের সংবদ্ধ উত্তাপ– যা এ মুহূর্তে সকলের মৃত প্রাণ সজীব করে তুলছে। আমি ভাবলাম,– এই সুবৃহৎ ওয়েটিংরুমে আমি একা হলে মরেই যেতাম। হয়তো-বা প্রত্যূষে এখান থেকেই আমার মৃতদেহ বেরুত। এই আড়াইশো-তিনশো লোক এই কৃষকের দল, ছোটখাটো বাবু, ভারবাহী, রেলওয়ের ছোট চাকুরে, ফকির, সাধু– এদের সকলেরই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমার প্রাণটা বেঁচে গেছে। তদ্রূপ আমিও নিজের দেহের উত্তাপ দিয়ে তাদের চাঙ্গা করার প্রয়াস পেয়েছি। এবং বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমি ভাবতে থাকলাম, এই ওয়েটিংরুমে, এই যুদ্ধক্ষেত্রে নিশ্চিত-নিদ্রিত মানুষের মধ্যে তাদের এই আকাশফাটা নাসিকা-ধ্বনির মধ্যে, এই সজীব করা উষ্ণতার মধ্যে এমন কী দার্শনিক সূক্ষ্মতা লুকিয়ে আছে! এমন সময় ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজার সময়-সংকেত এসে যুক্ত হল একরাশ নাসিকাধ্বনির মধ্যে। এবং সম্মুখের প্রলম্বিত দুটি ইস্পাতের উপর দিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ তুলে একটি ইঞ্জিন চলে গেল সুদূরের পানে। আর তার চেয়েও এক ভীতিপ্রদ স্বরে হাঁক দিয়ে উঠল স্টেশনের বড়বাবু,– ‘হেই পাহারাদার, মৃত লোকগুলোকে জাগিয়ে দাও। চলাফেরা করার জন্যও একটু জায়গা রাখে না– যেন তাদের বাবার ঘর।’
আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং বেরিয়ে পড়লাম। বাইরের বিশ্বপ্রকৃতি নীরব নিস্তব্ধ। দারুণ ঠাণ্ডা পড়ছে। রাস্তার আলো একটা একটা করে নিভতে শুরু করেছে।
কত বন্ধুর বাড়ি ধরনা দিলাম। প্রথমে রামদয়ালের বাড়ি। রামদয়াল এককালে আমার সাথে পড়ত। চাঁদনিচকে তার বাবার একখানা বড় কাপড়ের দোকান ছিল। আমাকে দেখেই অত্যন্ত হৃদ্যতার সাথে অভিনন্দন জানাল রামদয়াল।
‘এস বন্ধু নির্মল, আগে নাস্তাটা হয়ে যাক। পরে প্রোগ্রাম তৈরি করছি। কী বল নিৰ্মল মর্নিং শো একটা হয়ে যাক। ‘দিল দেকে দেখো’– সম্বন্ধে তোমার কী অভিমত! বন্ধু, ওই যে আশা পারেখ না– আগুন, সাংঘাতিক আগুন! আমি তো ফিল্মটা ইতোমধ্যেই তিনবার দেখে ফেলেছি। আজ তোমার সাথে আবার দেখি, কী বল!’
আমি বল্লাম, ‘বাবার সাথে ঝগড়া করে আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি। তিনি বলেছেন সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবেন। সুতরাং আমি চাকরির খোঁজে দিল্লি এসেছি।’
অকস্মাৎ বন্ধু দমে গেল। নিতান্তই নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল, ‘আচ্ছা ভাই চেষ্টা করব। তুমি বরং এক কাজ কর, পরশু আমার সাথে দেখা কর। আজ আমার একটা জরুরি কাজ আছে। বাবা আজকাল দোকান থেকে উঠতেই দেন না।’
আবার পথে নামলাম আমি। চাঁদনি এসেই দেখি সমস্ত আকাশ মেঘে ছেয়ে ফেলেছে এবং মিউনিসিপ্যাল পার্কের সব গাছপালা ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে।
সেখান থেকে সোজা আমজাদের ওখানে এলাম। তার বাবা জুতোর ব্যবসা করেন। তাদের বাড়ি ছিল হিলিমারান। গিয়ে দেখি দালানে দস্তরখান পাতানো। তাতে পরোটা, তরকারি, গাজরের হালুয়া এবং শুকনো ফল সাজানো। চায়ের কেটলি থেকে গরম গরম ধোঁয়া উড়ছে। আমজাদও এককালে আমার সহপাঠী ছিল। তার সাথে আমার বেশ ভাবও ছিল। প্রথমেই আমি বেশ ডাঁটের সাথে নাস্তা-পর্বটা শেষ করলাম। পরে আমজাদকে বললাম– ‘বন্ধু পঁচিশটা টাকা ধার দে, আট-দশ দিনের মধ্যে দিয়ে দেব।’
সে বলল– ‘হাঁ, হাঁ,… কিন্তু ব্যাপারখানা কী, টাকার এমন কী প্রয়োজন হয়ে পড়ল হঠাৎ!’ পরে যখন সব অবস্থা জানালাম তখন তার কণ্ঠস্বরও মালাইয়ের বরফের মতো মোলায়েম আর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বলল, ‘আজকাল পয়সার একটু টানাটানিতে আছি নির্মল। টাকা-দুটাকা চাস তো দিয়ে দিই!’
পুরনো দিল্লি থেকে নয়াদিল্লি পায়ে হেঁটে রওনা দিলাম। প্রায় দুপুরের দিকে হরবচনের কুঠিতে গিয়ে পৌঁছলাম। হরবচন সিংয়ের পিতা ‘গভর্নর অব ইন্ডিয়া’র ডিপুটি সেক্রেটারি। হরবচন পড়ত দিল্লি কলেজে। কিন্তু টেনিস টুর্নামেন্টেই তার সাথে আমার বেশ হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। ডবল টেনিসে সে আমার পার্টনারও ছিল। আর আমরা বরাবরই জয়লাভ করেছিলাম।
কিন্তু হরবচন ঘরে নেই। বাইরে গেছে। জিগ্যেস করে জানতে পেলাম চিমসফোর্ড ক্লাবে টেনিস প্র্যাকটিস্ করতে গেছে। সুতরাং ক্লাবে গিয়ে দেখি হরবচন টেনিসের বদলে কার্ডরুমে বসে বসে ‘রামি’ প্র্যাটিস্ করছে।
‘হ্যালো নির্মল-বয়।’ সে চেঁচিয়ে উঠল– ‘এস বস, বল কী পান করবে!
আমি বললাম, ‘তোমার সাথে নিরালা কিছু কথা বলতে চাই।
রাউন্ড শেষ করে সে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এল। –‘কেন, কী ব্যাপার!
তাকেও আমি সমস্ত ঘটনাটা জানালাম।
‘Sorry old boy–’সে বলল, –‘তা চাকরি এখানে একদিনের মধ্যে পাওয়া দুষ্কর। সুপারিশের জোরেও অন্তত এক মাস ধরবে গিয়ে। আমি বলি, বরং বাড়ি ফিরে যা। মিরাটের ভাড়ার প্রয়োজন হলে আমিই দিচ্ছি।’
আমি বললাম, ‘নো, থ্যাঙ্কয়ু হরবচন।’
‘আচ্ছা আমি চলি, আমার পার্টনার অপেক্ষা করছে।’
ক্লাব থেকে বেরিয়ে দেখি শুধু মেঘে ছেয়ে ফেলেনি, দু-এক ফোঁটা করে পড়তেও
শুরু করেছে।– সামনে একখানা খালি ট্যাক্সি যচ্ছিল। আমাকে দেখে ড্রাইভার গতি কমিয়ে দিল।
‘ট্যাক্সি বাবুজি!’
‘হাঁ, তা তো চাই!’
‘যাবেন কোথায়!’
‘মিরাট।’
‘এতদূর যাওয়া-আসা পঞ্চাশ টাকা লাগবে।’
আমি বললাম, ‘তা-ও দিয়ে দিতাম, কিন্তু আজ শনিবার, ব্যাংক বোধহয় বন্ধ হয়ে গেছে।’ বলতে বলতে আমি সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
ড্রাইভার তখন তার সঙ্গীকে বলল, ‘বন্ধু গরমে মানুষ পাগল হতে শুনেছি, শীতে পাগল আজই দেখলাম।’
ওখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমি এমপ্লয়মেন্ট একচেঞ্জে এসে পৌঁছলাম। সব অফিস ঘুরলাম। দোকানপাট সব জরিপ করলাম, কিন্তু একজন বি.এ.পাস সুস্থসবল বুদ্ধিদীপ্ত যুবকের জন্য কোনো চাকরি নেই। সন্ধ্যাও ক্রমশ ঘনিয়ে আসতে লাগল, সাথে সথে ঠাণ্ডা ও বাড়তে শুরু করল। টেম্পারেচার নামতে থাকল আর আমার হৃৎকম্প বাড়তে থাকল।
এখন রাত অর্ধেক চলে গেছে। ক্যানাট-প্যালেসে একরাশ নীরবতা জমাট বেঁধে আছে। শিমলা থেকে আগত ঠাণ্ডা হওয়ায় গা শিরশির্ করছে। বলা হয়েছে কোল্ড ওয়েভ (Cold wave ) আসবে। বোধহয় এসে গেছে। ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং নিউমোনিয়ার ভয় আছে। বুকেও একরকমের ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। আমি এবং আমার আত্মা এই বরফমাখা নিস্তব্ধতায় উলঙ্গ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছি, কিন্তু আত্মার তো নিউমোনিয়া হতে পারে না!
‘বাবু–!’
দৃঢ় অথচ চাপা একটা কণ্ঠস্বর বলদেবের চিন্তার সূত্র ছিন্ন ভিন্ন করে দিল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল বারান্দার আরেকটি থামের আড়ালে একটি ভিখারিনি বসে বসে ঠাণ্ডায় কাঁপছে।
‘ম্যাচ আছে বাবু–?‘
বলদেব পাতলুনের পকেটে হাত ঢোকাল। সিগ্রেট তো সেই কখন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ম্যাচ-বাক্সে এখনো গোটা দু-তিনেক কাঠি রয়ে গেছে। ম্যাচটা নিয়ে সে ভিখারিনির দিকে ছুঁড়ে দিল।
ভিখারিণি ম্যাচ জ্বালাল। এক মুহূর্তের জন্য তার চেহারায় আলো চমক মেরে গেল। কুচকুচে কালো, যেন সাপ। সমস্ত দেহে কয় মাসের ময়লার আস্তরণ জমেছে কে জানে। মাথায় একরাশ ধুলো মাখা।– ‘তওবা তওবা, কী বিশ্রী।– বলদেব ভাবল, এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যেতে হয়।
বিড়ির ক্ষীণতম অগ্নিকণা ভিখারিনিটির প্রকম্পিত দেহে যেন নবজীবনের সঞ্চার করল। বলদেব দেখল, এখন সে আর কাঁপছে না। নিশ্চিন্তে একটা টান মেরে ধোঁয়া উদ্গীরণ করতে করতে বলল– ‘বাপরে বাপ, কী ভয়ানক ঠাণ্ডা। কী বল বাবু, বিড়ি খাবে।’
বলদেব ভাবল, না করে দেয়, ভিখারিনির ময়লা ঠোঁট-স্পর্শ-করা বিড়ি।
কিন্তু ভিখারিনিটি আবার তাড়াতাড়ি বলে উঠল ‘এটাই তো সবচাইতে শ্ৰেষ্ঠ প্ৰতিদান বাবু, তোমার ম্যাচ আমার বিড়ি– এ নাও।’– বললেই সে বিড়ির প্যাকেট তার দিকে ছুঁড়ে দিল এবং নিজেও সরে এসে তার পাশে বসল। ম্যাচে আগুন ধরিয়ে সে বলল, ‘নাও, বিড়ি জ্বালাও।’
জ্বলন্ত কাঠি নিয়ে তার হাতখানা বলদেবের চেহারার কাছে এসে থামল। আর আশ্চর্য হয়ে তার চেহারা দেখতে থাকল। সে আশ্চর্য হয়ে ভাবছিল– এই ময়লা অথচ রেশমি জামাপরা লোকটি ভিখারিদের এই বিড়ম্বিত জীবনে কীভাবে এসে পড়ল। এবার বলদেব তার চেহারাখানা অতি নিকট থেকে দেখার সুযোগ পেল। কালো রং, একরাশ ময়লার নিচে এবং তার ছোট ছোট চকচকে চোখজোড়ার নিচে এমন একরকমের চাপা আগুন ছিল– যা ম্যাচের ক্ষীণ আলোয় আরো জ্বলে উঠল। উদ্গতবক্ষে যৌবনের স্বভাবজাত সাক্ষী দুটো ঈষৎ কাঁপছে। এবং তার দেহ থেকে এক অদ্ভুত গন্ধের আমেজ ছড়িয়ে পড়ছে– যার ভেতর ময়লা, ঘাম, দারিদ্র্য, যৌবন, কামনা এবং আমন্ত্রণ সবকিছুই মিশে একাকার হয়ে গেছে–। তারা উভয়ে একে অন্যকে দেখতে থাকল। এমনকি ম্যাচের কাঠি জ্বলতে জ্বলতে ভিখারিনিটির আঙুল পর্যন্ত জ্বালিয়ে দিল। তারা উভয়ে আবার সেই একরাশ কালো অন্ধকারে হারিয়ে গেল। আর বলদেব একটা উষ্ণ নিশ্বাসের তপ্তস্পর্শ অনুভব করল নিজের চেহারায়। কিন্তু পরমুহূর্তে আবার ম্যাচ জ্বলে উঠল এবং বলদেব একটা বিড়ি জ্বালল।
স্ব-স্ব থামে ঠেস দিয়ে তারা বিড়ি ফুঁকতে লাগল। চারিদিকে ছড়ানো কালো অন্ধকারে তাদের বিড়ির ক্ষীণ অগ্নিকণাকে দেখতে মনে হচ্ছিল যেন আকাশের সব নক্ষত্র ডুবে গেছে, শুধুমাত্র দুটি নক্ষত্র একে অন্যের দিকে তাকিয়ে জোনাকির মতো টিম টিম করে যেন ক্ষীণ আলো বিকিরণ করছে। একটা টান দেয়ার জন্য বলদেব হাত উপরে তুলে দেখল আঙুল কাঁপছে। মস্তক স্পর্শ করে দেখল মাথা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। বিড়িতে কষে একটা টান দিয়ে দেখল বুকে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে– নিউমোনিয়া? কথাটা মনে পড়তেই তার সমস্ত দেহ প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠল।
‘বাবু।’
‘উঁ।’
‘তোমার খুব ঠাণ্ডা লাগছে তাই না?’
‘না তো!’
কিন্তু সে মুহূর্তে কে জানে কোথা থেকে বরফমাখা এক ঝটকা বাতাস এসে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এবং তার বুকের ঈষৎ ফাঁক দিয়ে যেন তীক্ষ্ণ চাকুর মতো বিদ্ধ হল।
‘বাবু, তুমি তো ঠাণ্ডায় বেশ কাঁপছ!
‘না, এমন কিছু না।’
কিন্তু কথাটা বলার সময়ও তার ঠোঁটজোড়া কেঁপে উঠল। দাঁত ঠক্ঠক্ করে উঠল।
‘বাবু এ ঠাণ্ডা বড় খারাপ, নিউমোনিয়া হবে যাবে।’
‘হতে দাও।’
এবার ঠাণ্ডা তার শিরায় শিরায় গিয়ে বুকের নিশ্বাস চূর্ণ করতে থাকল। তার জ্ঞানবুদ্ধি এক অদ্ভুত হতাশার মাঝে বিলীন হয়ে যেতে লাগল আস্তে আস্তে। বহু কষ্টে তার ক্ষীণকণ্ঠ বলে উঠল।
‘এখন আর এছাড়া উপায়-বা কী।
‘আমার কাছে চলে এস বাবু।’
বহুকষ্টে চোখজোড়া খুলে সে ভিখারিনির দিকে তার নিষ্প্রভ দৃষ্টি ছেড়ে দিল। ভিখারিনিটি ছেঁড়া শাড়ি জড়িয়ে একটা কাপড়ের পুঁটলির মতো জড়সড় হয়ে পড়ে আছে।
‘তোমার কাছেও তো কম্বল নেই।’
‘কম্বল নেই, তা আমি তো আছি বাবু।’
জ্বর আর বিশীর্ণ পাঁজর– এ মুহূর্তে সে কোনো কিছুর ইশারাই বুঝতে সমর্থ নয়। কিন্তু বিষাক্ত বরফমাখা আরেক ঝট্কা বাতাস এসে তাকে আক্রমণ করল। আর বলদেবের বোধশক্তি এক বিরাট চিৎকারের মাঝে হারিয়ে গেল।
‘কোল্ড ওয়েভ– কোল্ড ওয়েভ– কোল্ড ওয়েভ–’
‘বিষাক্ত ঠাণ্ডার ফণা আসছে– ইনফ্লুয়েঞ্জা– নিউমোনিয়ার ভয়– নিউমোনিয়া, মৃত্যু– ‘
‘কোল্ড ওয়েভ– কোল্ড ওয়েভ কোল্ড ওয়েভ—’
এবং সেই বোধশক্তির মধ্যে আরেকটি বোধশক্তি, কোটি মানুষের নাসিকাধ্বনির চিৎকার, কিন্তু সেই চিৎকারে ঠাণ্ডা নেই। বিষ নেই। আছে ওষুধ, বিশীর্ণতা নেই– আছে জীবন সঞ্জীবনী নিশ্বাসের স্পর্শ।
এবং বলদেব অনুভব করল যেন কোমলতায় ভরা, উষ্ণতার ভরা এবং প্রেমময়তায় ভরা একখানা লেপের ভেতর সে ডুবে যাচ্ছে। এবার আর তার জীবনে কোনো কোল্ড ওয়েভের ভয় নেই।
অনুবাদ : আখতার-উন-নবী
মধুমতী – কৃষণ চন্দর
১
প্রথম থেকেই আমার মনটা ছিল রোমান্টিক এবং সূক্ষ্ম অনুভূতিশীল। উড়ন্ত পাখি, উন্মুক্ত নীল আকাশ, রামধনুর প্রস্ফুটিত রং আমি পছন্দ করতাম। আর পছন্দ করতাম যে-মেয়ে হাসলে গালে টোল পড়ে এবং যে নদী পাথরের সাথে হুমড়ি খেয়ে প্রবাহিত হয়। কিন্তু আমার পিতৃদেব আমার সব আকাঙ্ক্ষায় বাধা দান করলেন। (তাঁর নাম গোবিন্দ রাম) তিনি বললেন, ‘বাবা শ্রীরাম, এ পৃথিবীটা রং-তামাশার ওপর নির্ভর করে চলে না। এটা হচ্ছে বিজ্ঞানের যুগ, এ পৃথিবীটা এখন বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে চলে। তাই তোমাকে কবি নয়, বরং ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে।’
অঙ্কশাস্ত্রের প্রতি বরাবরই আমার বিমুখতা ছিল। প্রায়শ আমি ভাবতাম– হা খোদা, এই দুই আর দুইয়ে চার কেন হয়! পাঁচ কেন হয় না? তিন অথবা আড়াই হয় না কেন? এক হয়ে যায় না কেন? যেরকম কখনো কখনো মানুষ জীবনে এক হয়ে যায়। কিন্তু অঙ্কশাস্ত্রে তা হয় না। কখনো হয় না। আপনি হাজার বার চেষ্টা করে দেখুন, হবে না। কিন্তু যেহেতু আমাকে ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে সুতরাং আমি অঙ্ক শিখতে আমার জীবনের সর্ব ক্ষমতা প্রয়োগ করলাম। ডিপ্লোমা উপাধি নেয়ার সময় আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্টও হলাম। এ খবরে সবচাইতে বেশি খুশি হয়েছিল সারদা– যার সাথে শৈশবে বাগদান হয়েছিল, এবং যাকে আমি খুব ভালোবাসতাম। আমরা একসাথে খেলতাম, একসাথে পড়তাম এবং সাথে সাথে আমরা এ সিদ্ধান্তেও উপনীত হয়েছিলাম যে, আমরা ঘর গড়ব– যেখানে শুধু আমরাই থাকব। সন্তান-সন্ততির সংখ্যা কত হবে এবং তাদের কী কী খাওয়ানো যাবে এবং কী করে গড়ে তোলা যাবে তারও একটা হিসাব ঠিক করে রেখেছিলাম।
কিন্তু যখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ডিপ্লোমা পেলাম তখন একদিন আমার বাবার ডাক পড়ল লালা বিহারীলালের চেম্বারে। তাঁর ফার্মেই বাবা একাউন্টেন্টের পদে বহাল ছিলেন। এঁদের উভয়ের মধ্যেই যেসব কথাবার্তা হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন, আমার বিয়ে সারদার সাথে নয় বরং মধুমতীর সাথেই হবে– যে লালা বিহারীলালের একমাত্র মেয়ে এবং সে বড় সুন্দরীও। এখন আমাকে মধুমতীর হৃদয় জয় করতে নৈনিতালে যেতে হবে। যদি মধুমতীর হৃদয় জয় করতে পারি বা নিদেনপক্ষে মধুমতী আমার বিরোধিতা না করে তাহলে লালা বিহারীলাল আমাকে তাঁর জামাতা বানিয়ে নেবেন।
‘কিন্তু সে হিসাব কষা আমাদের পক্ষে ঠিক হবে না।’ আমি আপত্তি করলাম। আমি আপত্তি করতাম না, কিন্তু সে সময় আমার মানসপটে সারদার লাজনম্র মুখমণ্ডল বারবার উদিত হচ্ছিল। যেন অশ্রুতে তার চোখের কোণ সিক্ত হয়ে গেছে। আমি যে কী বলব– তখন আমরা আমাদের ঘরের পর্দার রং পর্যন্ত প্রায় পছন্দ করে রেখেছিলাম।
তাই আমি জোর দিয়ে বললাম ‘দেখুন বাবা, লালা বিহারীলাল কোটিপতি। তাঁর শান-শওকত এবং তাঁর পদমর্যাদার সাথে খাপ খাইয়ে তিনি আর একজন কোটিপতি বর ঠিক পেয়েই যাবেন। এতে কোনো কষ্ট হবে না তাঁর।’
‘তিনি এরকম জামাতা চান না যার পিতা কোটিপতি।’ বাবা বলতে থাকলেন- ‘অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে কোটিপতি ছেলে শ্বশুরের টাকা বাবার ব্যবসায় জড়িয়ে ফেলে। এতে ব্যাপারটা তালগোল পাকিয়ে যায়। সম্পর্ক, সদ্ভাব নষ্ট হয়। এক বাক্সের টাকা অন্য বাক্সে গিয়ে পৌঁছয়। প্রাণের যে একটা আকর্ষণ থাকে তা জটিল আকার ধারণ করে। লালা বিহারীলাল এরকম জটিলতা চান না। তাই তিনি আগ্রহ প্রকাশ করলেন যেন তুমি আজই নৈনিতাল যাত্রা কর এবং মধুমতীর হৃদয়মন জয় করতে চেষ্টা কর। অবশ্য তোমাকে বেশি চেষ্টা করতে হবে না। লালা বিহারীলাল নিজেও যথেষ্ট চেষ্টা করবেন। এদিকে আবার তিনি আজকাল কনস্ট্রাকশন লাইনেও যাতায়াত করছেন। যদি ঘরের জামাতা ইঞ্জিনিয়ার হয় তাহলে দেখ তো ঠিকাদারিতে কত টাকা উদ্বৃত্ত থেকে যাবে? একটু চিন্তা কর বাবা, এরপর তুমি কী থেকে কী হয়ে যাবে। তাছাড়া আমার বৃদ্ধ অবস্থার দিকেও একটু লক্ষ কর, তোমার মা’র ভগ্ন চেহারাখানার দিকেও একটু তাকাও। আর সে যৌতুকও হিসাব কর– যে যৌতুক তোমার তিনজন অবিবাহিতা বোনকে বিয়ে দিতে খরচ হবে। আর সে মোটা অঙ্কও আনা পাইয়ে হিসাবে কর– যে অঙ্ক তোমার ছোট চার ভাইকে পড়ালেখার বাবদ তোমাকেই খরচ করতে হবে। ঠিকমতো হিসাব মিলিয়ে দেখ বাবা।
আমি ঠিকমতোই হিসাব মিলিয়ে দেখলাম অর্থাৎ নৈতিতালে যাব বলেই স্থির সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমার সিদ্ধান্ত শুনে সারদা অশ্রু বিসর্জন দিল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আমাকে জিগ্যেস করল সে, রামজি, এটা কীরকম হিসাব?’
আমি বললাম– ‘এটাকে হায়ার মেথামেটিক্স (Higher Mathematics) বলে।’
২
সারদার শ্যামল লাজনম্র মুখমণ্ডল মধুমতীর তুলনায় কিছুই না। মধুমতী মালার মতো উজ্জ্বল তেজোদীপ্ত সুন্দর হীরার মতো জ্বলজ্বল করছিল এবং হীরার মতো শক্তও ছিল। তার ঠোঁট যেন পদ্মারাগমণি, চক্ষু নীল, কপোল রক্তিম এবং দাঁত মোতিমালার মতো। সে হাসবার সময় মনে হত বুঝি মুখের চালুনি থেকে পরিষ্কার পুষ্পরাগমণির দানা ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ছে। একদিন সে হাসার সময় আমার ইচ্ছে হল তার মুখের কাছে রুমাল বিছিয়ে দিই এবং পুষ্পরাগমণির সব দানা কুড়িয়ে নিই। কিন্তু পরে এই ভেবে বিরত থাকলাম যে পাছে সে আপত্তি করে এবং আমার হিসাবে গণ্ডগোল হয়ে যায়।
মধুমতাঁকে কলেজজীবন থেকেই চিনতাম আমি। সে রুক্ষ মেজাজ এবং হাকিমানা স্বভাবের ছিল। কখনো কাজ-কাম করত না, পড়ালেখাও তেমন করত না সে। অথচ প্রতি বছর পাস করে যেত। কারণ এ কলেজ তার বাবা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কথায় কথায় অধ্যাপকদের সে হাসি-ঠাট্টা করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলত। একদিন কেমিস্ট্রির এক অধ্যাপক তাকে জিগ্যেস করলেন (তিনি এ কলেজে নতুন যোগ দিয়েছিলেন তাই মধুমতাঁকে চিনতেন না। না হয় তিনি জিগ্যেসও করতেন না।)–
‘ইস্পাত কী দিয়ে তৈরি করে?’
‘লোহা দিয়ে তৈরি করে।’ মধুমতী বলল।
‘হাঁ হাঁ, লোহা দিয়েই তৈরি করে কিন্তু কীভাবে তৈরি করে?’
‘ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করে।’
‘ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করে কিন্তু কীভাবে তৈরি করে?
‘কারখানায় তৈরি করে।’ মধুমতী দুর্বল কণ্ঠে বলল।
‘আর তা তো বুঝলাম, কিন্তু তৈরি কীভাবে করে।’ অধ্যাপক রাগতস্বরে বলে উঠলেন– ‘ কীভাবে?’ জোর দিয়ে জিগ্যেস করলেন।
‘এটা বড় খারাপ কথা অধ্যাপক সাহেব’– মধুমতী বলতে থাকল– ‘আপনার সব প্রশ্নের জবাব এভাবে কেবল আমি দিতেই থাকব? কেমিস্ট্রির অধ্যাপক আপনি, আমি নই।’
কিন্তু তখন আমি মধুমতাঁকে দেখতাম কেবল দূর থেকেই আর এখন তার সাথেই চলাফেরা করছি হাতে হাত মিলিয়ে। দেয়ালের পার্শ্বে ছোট পাহাড়ি রাস্তার উপর চন্দ্রালোক অন্ধকার ছায়ার চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। পরিবেশ তখন একটা কঠিন প্রশ্নের মতো স্তব্ধ হয়ে আছে। এ-সময় মধুমতীর কটিদেশ আমার সঙ্কোচহস্তের নিষ্পেষণে রত। তখন আমাদের যেন এক অদৃশ্য হস্ত চোখের নিমিষে একবিন্দুতে পরিণত করে ফেলেছে।
নৈনিতাল আসার প্রাক্কালে আমি অনেক বছরের পুরনো কীটে-খাওয়া বইগুলো খুললাম এবং শেলি, কিট্স, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, বায়রন এবং ফেলোর কবিতাগুলো জিওমিট্রির মতো মুখস্থ করলাম। প্রেমের ব্যাপারে কোন কবিতার কখন প্রয়োজন হয় তা স্মৃতিপটে সংরক্ষিত রাখাও কষ্টসাধ্য ব্যাপার, না হয় প্রেমের সব স্বাদই যে বিগড়ে যাবে। আজ অন্ধকার রাতের দীর্ঘ ভ্রমণে মধুমতীর মন-মেজাজের পরিবর্তন দেখে সব কবির কবিতা থেকে এক-একটা করে কবিতা পড়লাম– পড়লাম নয়, যেন একত্রিত করলাম। মানুষ যখন এক-একটা সংখ্যাকে নিয়ে একত্রিত করে তখন মনের ভেতর তার একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সব সংখ্যা একত্রিত হয়ে তার একটা শেষ ফলও সংকলিত হয়। তা আমিও যখন এত কবিতার সমাবেশ করলাম তার একটা প্রতিক্রিয়া কেন হবে না! তার একটা শেষ ফল নিশ্চয়ই দেখা দেবে।
কবিতা একত্রিত করার প্রতিক্রিয়া, না লালা বিহারীলালের সুবিস্তৃত চিঠির প্রতিক্রিয়া তা আমি জানি না। তবে এটা ঠিক যে, আজ মধুমতীর অহঙ্কার, অভিমান এবং তার মন-মেজাজ মধুর মতো গলে অতিমাত্রায় তরল হয়ে গেছে। সে বারবার দীর্ঘনিশ্বাস নিচ্ছে, চলার সময় থেমে থেমে আমার কাঁধে হাত রাখছে এবং চলতে চলতে অকস্মাৎ যেন চমকে চমকে উঠছে। তখন আমার মনে হত দেয়ালের অস্পষ্ট ছড়িয়ে থাকা অন্ধকার ছায়ার মধ্যে কে যেন আমার পিছু নিয়েছে। মনে হত বুঝি অন্ধকার ছায়ার ভেতর সে অশ্রুসিক্ত দুটো চোখ আমাকে অনুসরণ করছে এবং শ্যামল লাজনম্র চেহারার কেউ আমার কাছে কোনো অভিযোগ করছে।
চলতে চলতে আমি দু-তিনবার মাথাটা ঝাড়া দিলাম। সে ছায়া আমার মন থেকে দূর করতেই হবে– যাকে আমি দূর করে দিয়েছি। এখন আমার দৃষ্টি এ ছায়ার প্রতিই নিবিষ্ট– যে ছায়ার সাথে আমার ছায়া গ্রথিত হতে পারে।
আমাদের দীর্ঘ ভ্রমণের সময় মধুমতী অনুভব করল যে, সে আসলে আমাকে পছন্দ করে। প্রথমবার সে আমাকে এমন দৃষ্টিতে দেখল, যেন কোনো সুন্দরী যুবতী তার আঙুলের হীরার আংটি গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখছে। আমার ওজন কতদূর আছে সে পরিমাণ করে নিয়েছে তার গভীর দৃষ্টি দিয়ে, তার নতুন দৃষ্টি দিয়ে।
এরপরই সে আমার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল যে, সে কালকেই আমার সাথে একা ‘চায়নাপিকে’ যাবে।
কাল অতি প্রত্যূষেই তার বাংলোতে পৌঁছতে হবে। সে একটা ঘোড়া এবং সহিসও ঠিক করে রাখবে।
‘রাস্তার যদি আমরা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ি তাই ঘোড়ার প্রয়োজন হতে পারে। না হয় আমরা তো হেঁটেই যাব।’ সে আমাকে বলল এবং আমার হাতে জোরে একটা চাপ দিল। সে রাতেই আমি বাবার কাছে একখানা চিঠি লিখলাম। শুধু তিনটা অক্ষরই তাতে লিখেছিলাম,– ‘Q. E. I’
পৃথিবীতে যদি অঙ্কই সব হয়ে থাকে, তাহলে আমার বিশ্বাস বাবা এ চিঠিখানা পেয়ে খুব খুশি হবেন।
৩
দ্বিতীয়দিন তার মুড বড় খারাপ ছিল। তাকে চিন্তান্বিত চেহারায় দেখলাম।
‘আমি আজ তোমার সাথে ‘চায়নাপিকে’ যেতে পারব না।’
‘কেন?’
‘এবং তুমিও যেতে পারবে না।’ সে আমাকে আদেশ করল।
‘কেন!’ আমি পুনরুক্তি করলাম।
কিছুক্ষণ পর জানলাম মধুমতীর এলসেসিয়ান কুকুর বড় মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে। সকালে আয়া তাকে ভ্রমণ করাতে নিয়ে গিয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। পাহাড়ি রাস্তা থেকে পা ফসকে পড়ে গিয়েছিল। তার পেছনের হাঁটুর একটা হাড় ভেঙে গেছে। মধুমতী তাকে বারবার আদর করতে থাকল। কিন্তু কুকুর শেষ পর্যন্ত কুকুরই। প্রভুভক্তির পরও শরীর বলতে একটা জিনিস তার আছে। সে শরীরে যদি শক্ত ব্যথা পায়, তখন আদর-সোহাগ দেখানো কুকুরও শেষ পর্যন্ত আদর দেখানোর পরিবর্তে দংশন করতে দৌড়ে আসে।
‘তুমি তাকে ঘোড়ায় উঠিয়ে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যাও এবং ডাক্তারকে বল তাড়াতাড়ি তার চিকিৎসা করতে।’
নৈনিতালে পশু চিকিৎসালয় কোথায় তা তো আমি জানি না!’ নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।
‘আরে পশু চিকিৎসালয়ে কে যেতে বলছে তোমাকে। নৈনিতাল হাসপাতালে যাও। মানুষের হাসপাতাল।’
‘ডাক্তার তার চিকিৎসা করতে যদি অস্বীকার করে?’
‘কী করে অস্বীকার করবে?’ সে গর্জন করে উঠল, ‘এ হাসপাতাল আমার বাবা প্রতিষ্ঠা করেছে, তুমি যাও। আমি এক্ষুনি ডাক্তারকে ফোনে বলছি।
যে ঘোড়ায় করে মধুমতী আমার সাথে ‘চায়নাপিকে’ যাবার কথা ছিল, সে ঘোড়ার পিঠে এখন আমি তার কুকুরকে তুলে নিলাম। নিজেও একটায় উঠে বসলাম। হাসপাতালের বাইরে বাহকরা কুকুরকে রাখল এবং আমি হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করলাম।
ত্রিকোণ বিশিষ্ট এক বারান্দার মধ্যে একটা লম্বা করিডোর। খানকতক টুলে বিমর্ষ রুগী এবং তাদের সাথি– কেউ-বা রুগীর আত্মীয়, কেউ-বা বন্ধুবান্ধব– বড় অস্থির, বড় অধৈর্যচিত্তে হাসপাতাল খোলার অপেক্ষায় বসে আছে।
‘এখানে অর্ধেক সময় বাকি আছে।’ একজন আর্দালি আমাকে বলল।
‘বড় ডাক্তার কি এখানে নেই?’ সামনের ময়লাযুক্ত দেয়ালের দিকে মালিকসুলভ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমি জিগ্যেস করলাম। তখন আমার গলার স্বর স্বভাবতই চড়া ছিল। তা এ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা যখন মধুমতীর বাবা অর্থাৎ আমার ভাবী শ্বশুর।
আর্দালি আমার গলার স্বর শুনে চমকে উঠল এবং তৎক্ষণাৎ তার বলার ধরন পরিবর্তন করে ঝুঁকে নম্রভাবে বলল– ‘বড় ডাক্তার সাহেব তাঁর কামরায় আছে।’
‘যাও, তাঁকে বলোগে, মধুমতী মেমসাহেবের কুকুরও এসেছে।’
আর্দালি অদৃশ্য হলে আমি করিডোরে পায়চারি করতে করতে রুগীদের অবস্থা পরিদর্শন করতে থাকলাম। দুজন বৃদ্ধ থেমে থেমে পালাক্রমে কাশতে লাগল। একজনের কাশি বন্ধ হলেই অন্য জনের শুরু হয়। তাদের উভয়ের মধ্যে কেমন যেন একটা সমঝোতা মনে হচ্ছিল। ছিপছিপে ধনুকের মতো একটা শিশু মা-র কোলে বসে এক নাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, যেন এ শিশু পৃথিবীতে পদার্পণ করার পর থেকে কিছুই খায়নি। আর বেচারি মা-ও যেন তার ক্ষুধার ওষুধ করতে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। একজন লোক পুরো বেঞ্চের উপর শুয়ে বেদনার জ্বালায় বারবার কেবল ঝাঁকিয়ে উঠছে। তিনজন লোক তাকে সান্ত্বনা দিতে লেগে আছে। তাদের জিগ্যেস করে জানতে পেলাম রাত থেকে লোকটার বেদনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সামনে অগ্রসর হয়ে দেখলাম একটা যুবকের ক্ষত-বিক্ষত দেহ পড়ে আছে। ক্ষতস্থান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। খাটের নিচে রক্ত জমে শক্ত হয়ে গেছে। তাকে জংলি বাঘে আক্রমণ করেছে বলে মনে হল। কাঁচা মাংসপিণ্ড– এবং পায়ের হাঁটু থেকে চামড়া খসে পড়ে গেছে। তার চেহারার রং নীল হয়ে গেছে, চক্ষু মুদ্রিত ছিল। তার স্ত্রী এবং বাবা হতবুদ্ধি হয়ে কখনো এ আর্দালির কাছে কখনো ও আর্দালির কাছে গিয়ে হাতজোড় করতে লাগল। ডাক্তারকে দ্রুত খবর দিতে বারবার অনুনয়-বিনয় করতে লাগল।
এ-সময় হঠাৎ বড় ডাক্তার তাঁর প্রকোষ্ঠ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। দুজন আর্দালি বিনীত চরণে তাঁর পেছনে এল। আর্দালি হাতের ইশারায় আমাকে দেখিয়ে দিলে ডাক্তার তাড়াতাড়ি আমার কাছে এলেন।
‘কই, সমুদ্র কোথায়?’ তিনি আমাকে জিগ্যেস করলেন।
‘সমুদ্র তো বোম্বাইতে।’ আমি জবাব দিলাম– ‘পাহাড়ের উপর হ্রদ হয়, সমুদ্র হয় না।’
পরের বুঝলাম সমুদ্র আসলে মধুমতীর কুকুরের নাম। কুকুরের নামের দিকে এতদিন লক্ষ করিনি বলে আমাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য লজ্জিত হতে হল। এরপর আমি ডাক্তারকে বললাম– ‘সমুদ্র বাইরে আছে। তার দেহের ওজন খুব বেশি। কোলে করে এখানে আনা সম্ভব নয় বলে ওখানে আছে। তাছাড়া বাহকরাও অনেক পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে।’
‘কোনো চিন্তা নেই।’ ডাক্তার সাহেব জোরে আর্দালিকে হুকুম করলেন– ‘স্ট্রেচার বাইরে নিয়ে যাও এবং মধুমতী মেমসাহেবের কুকুরকে এক্ষুনি ভেতরে নিয়ে এস।’
দুজন আর্দালি তখনি স্ট্রেচার নিয়ে বাইরে পা বাড়াল।
বৃদ্ধ বাবার ঠোঁট-জোড়া শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, তার উত্তোলিত হস্তদ্বয় ভয়-ভীতিতে কাঁপছিল। বৃদ্ধ প্রায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগল– ‘ডাক্তার সাহেব, আমার ছেলেকে বাঁচান। তাকে বাঘে আক্রমণ করেছে।
‘এক্ষুনি দেখছি।’ ডাক্তার সাহেব তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন এবং সামনে কয়েক কদম অগ্রসর হয়ে করিডোরের বাইরে যেতে লাগলেন। তখন আর্দালিদের সাবধানতার সাথে স্ট্রেচারে করে কুকুরকে আনতে দেখে থমকে দাঁড়ালেন কয়েক মুহূর্ত এবং পরে ক্ষিপ্রগতিতে ডাক্তার সাহেব স্ট্রেচারের কাছে গিয়ে কুকুরের সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে লাগলেন।
‘হ্যালো সমুদ্র–পুয়র ডাগি, You have been hurt. What a shame! বটে, ডন্ট ওরি… You. We will set. Right in a minute ‘ এবং পরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন– ‘Brave dog! Heirsa!‘
আমি জিগ্যেস করলাম, ‘কুকুর তার মাতৃভাষা বোঝে না?’
ডাক্তার সাহেব গর্বের সাথে বললেন, ‘শুধু ইংরেজি বোঝে।’ তিনি এমন এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন যেন আমি দু-পা বিশিষ্ট কোনো এক নীচু বংশের কুকুর আর কি।
কুকুরের স্ট্রেচার বাঘে আক্রমণ-করা যুবকের খাটের পাশ দিয়ে নিয়ে যাবার সময় যুবকের স্ত্রী ডাক্তারের পা জোড়া ছুঁয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘শুধু এক পলক তাকে দেখুন ডাক্তার সাহেব, ভগবানের দোহাই! শুধু এক পলক।’
‘এক্ষুনি আসছি, এক্ষুনি আসছি।’ ডাক্তার সাহেব ঘাবড়ে গিয়ে পা সরিয়ে নিলেন এবং স্ট্রেচারের সাথে সাথে অপারেশন রুমে প্রবেশ করলেন।
প্রায় এক ঘণ্টা পর আমরা অপারেশন রুম থেকে বেরুলাম। সমুদ্রের সব ক্ষতস্থানে সেলাই করে দেয়া হয়েছে। পায়ের হাড় জোড়া লাগিয়ে প্লাস্টার করে দেয়া হয়েছে।
‘আর কোনো ভয় নেই।’ ডাক্তার সাহেব আমাকে বললেন। পরে তিনি সমুদ্রের থুতনিতে হাত দিয়ে আদরের সাথে বললেন– ‘Brave dog. ‘ .
কুকুর খুব কষ্টে দম ফেলল এবং চোখ মুদে শুয়ে থাকল।
আর্দালিরা আবার কুকুরকে স্ট্রেচারে তুলে সবরকমের সাবধানতা অবলম্বন করে নিয়ে যেতে লাগল। দ্বিতীয়বার আমরা করিডোর দিয়ে গমন করার প্রাক্কালে ডাক্তার সাহেব আমাকে বিদায় সম্ভাষণ দিয়ে যুবকের খাটের দিকে চলে যেতে লাগলেন। আমি আর স্ট্রেচারের সাথে যেতে পারলাম না। ডাক্তারের পেছনে পেছনেই হাঁটতে শুরু করলাম। ডাক্তার সাহেব যুবকের নাড়ি পরীক্ষা করতে লেগে গেলেন।
‘ডাক্তার সাহেব, আমার ছেলে’– বৃদ্ধ বাবা ঝাঁকিয়ে উঠল– ‘যে-কোনোরকমেই হোক আমার বাদলের প্রাণ বাঁচিয়ে দিন।’
‘কিন্তু এ তো মরে গেছে!’ ডাক্তার সাহেব মাথা ঝুঁকিয়ে মৃদৃকণ্ঠে বললেন।
যতদিন আমি এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকব সে বৃদ্ধের চেহারা ভুলতে পারব না। বৃদ্ধ একবার আমার দিকে একবার ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকাতে লাগল। তখন তার চোখ থেকে অশ্রুর প্লাবন বয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে বড় কষ্ট করে অশ্রু রোধ করতে চেষ্টা করল। তার চেহারায় কয়েক দিনের গজিয়ে ওঠা দাড়ি এবং তার চেহারায় এত ফাটল ছিল, যেরকম চাষ করা জমিতে থাকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সেসব ফাটল দিয়ে ঘামের স্রোত বয়ে যেতে লাগল। ঝড়ে পাওয়া পাতার মতো তার চেহারা কাঁপতে লাগল। প্রথম কয়েক মুহূর্ত তার কণ্ঠ থেকে কোনো আওয়াজই বেরুল না। কিছুক্ষণ পরে তার কণ্ঠ থেকে এক আওয়াজ বেরুল– সে আওয়াজ বজ্রের মতো ফেটে পড়ল। সে চিৎকার দিয়ে বলল, ‘কিন্তু একটু আগেও সে জীবিত ছিল ডাক্তার সাহেব! আমার বাদল…।’
ডাক্তার সাহেব কয়েক মুহূর্ত মাথা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে থাকলেন। পরে নিঃশব্দ চরণে তাঁর কামরায় গিয়ে ঢুকলেন।
8
বাসায় প্রত্যাবর্তনের সময় আমি সারা পথ নিশ্চুপ ছিলাম। ঘোড়া সহিসদের আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কারণ ডাক্তার সাহেব সহৃদয় হয়ে কুকুরকে স্ট্রেচারে করেই নিয়ে যেতে হুকুম দিয়েছেন। দুটো আর্দালিও সাথে করে দিলেন। আর্দালিগুলো বড় আমুদে ছিল। সারাপথ নানারকমের গান গেয়ে তারা আমার মনোরঞ্জনের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমি সারা পথ নিশ্চুপ ছিলাম।
মধুমতী খুব খুশি হল। সে আর্দালিদের বিশ টাকা বখশিশ দিয়েছে। আর্দালিরা চলে গেলে সে আমার কপোলে তার কপোল সংযুক্ত করে আমাকে পুরস্কার দিল। পরে সে অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার কুকুরের প্রতি মনোযোগ রাখল। আর আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম, তখন আমার মনের ভেতর তুমুল ঝড় বইছিল।
সে আমাকে উদাস দেখে বলল, ‘তুমি তো এমন গুম হয়ে আছ, যেন আমার সমুদ্র বেঁচে যাওয়াতে তুমি একটুও খুশি হওনি।’
‘না, তা নয়।’ আমি মৃদুস্বরে বললাম।
‘তো কী!’ সে ভয় পেয়ে গেল।
আমি তাকে হাসপাতালের সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম।
ঘটনা শুনে সে হঠাৎ মাথা ঝাঁকি দিয়ে বলল, ‘উন্মাদ হলে নাকি! এ জংলিরা তো হর হামেশা ব্যাঘ্রের শিকারেই পতিত হচ্ছে এবং আরও কত হবে। অতীতে এরকম আরও কত
কেস হয়েছে এবং কত হাজার হাজার লোক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করছে। আর এখন, আমরা কথা বলার এ মুহূর্তেও না জানি এক মিনিটে কত হাজার লোকের মৃত্যু হচ্ছে। এরকম যদি হিসাবই করতে থাক তাহলে পৃথিবীতে কোনোকিছুই করতে পারবে না শ্রীরাম।
এরপর সে আমার হাত ধরে বাইরে বাংলোর বারান্দায় নিয়ে এল। চোখ-জোড়া বিস্ফারিত করে বলল– ‘এস এখানে বসি। এ ঠাণ্ডা হাওয়ায় বসে চা পান করতে করতে তোমার কণ্ঠ থেকে কিটসের প্রেমের কবিতা শুনি। আহ্! কিটসের প্রেমের কবিতা কী নরম আর মোলায়েম। ঠিক আমার কুকুরের লোমের মতো।
আমার মন প্রফুল্ল রাখার জন্য সে অনেকক্ষণ পর্যন্ত একথা সেকথা অনেক কথা বলল। কিন্তু আমার মন তবুও সারাক্ষণ বিষণ্ন হয়েই রইল। মনকে স্বাভাবিক রাখার জন্য অনেক চেষ্টা করলাম। সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে, অবশেষে আমি নিশ্চুপ নির্লিপ্ত অবস্থায় বসে ছিলাম। সে এক আশ্চর্য জড় পদার্থের মতো নীরব, নিথর। সে আমার সমস্ত অনুভূতি শক্তিকে পুরো নিজের আয়ত্তাধীন করে নিয়েছে। আমি না কিছু বলতে পারছি, না কিছু চিন্তা করতে পারছি।
চা এলে সে নিজ হাতে আমার জন্য চা তৈরি করল এবং বিস্কিটের প্যাকেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল– ‘নাও, খাও।’
আমি নীরবে প্রত্যাখ্যান করলাম। সে জোর করে একখানা বিস্কিট আমার মুখে পুরে দিল। বলল, ‘খেতে হবে। খাও।’
অগত্যা বিস্কিট খেতে শুরু করলাম। এ-সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আমি আপন মনেই বিস্কিট খেয়ে যাচ্ছি। আমার চোয়ালও স্বাভাবিকভাবে নড়ছে। বিস্কিট খেতে খেতে হঠাৎ আমার অনুভব হল, যেটা আমি খাচ্ছি সেটা না পানসে, না মিষ্টি। বরং সে বিস্কিট নোনতা বলেও মনে হল না। মনে হল যেন সেটা খসখসে একখণ্ড মাংসের টুকরো।
হঠাৎ জোরে আমার বমি এল এবং আমি ওখান থেকে দ্রুত উঠে চলে এলাম। পেছন থেকে মধুমতী আমাকে শুধু ডাকতেই থাকল।
৫
না না, আপনারা ভুল বুঝেছেন। আমি সারদাকে বিয়ে করিনি, আমি মধুমতাঁকেই বিয়ে করেছি।
এটা তো কত আনন্দের কথা। তখন আমি ছিলাম একজন অনভিজ্ঞ অপরিণামদর্শী যুবক মাত্র। জীবনের হিসাব-নিকাশের খাতায় তখন আমি পাকাপোক্ত ছিলাম না। এখন আমি একজন সাফল্যবান পুরুষ। একজন বড় কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মালিক। এখন যত লোক যেভাবেই মারা যাক-না কেন, আমার বিস্কিটের স্বাদ কিন্তু পরিবর্তন হয় না।
অনুবাদ : আখতার-উন-নবী
ভাড়াটে বাড়ি – ফিকর তওনসভি
ইতিবৃত্তটি বলি, শুনুন। শহরে আমার চাকরির ব্যবস্থা আধপাকা হয়ে গেলে ভদ্দরলোকদের মতো আমিও একটা কামরা ভাড়া নেওয়াই যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করলাম। কামরা ভাড়া নেওয়ার আরও একটি বিশেষ কারণ হল, আমার পৈতৃক ভিটে মাত্র একটি। ইতিহাস এবং রাজনীতির সঙ্গে বাবা-মা’র কোনওরকম সম্পর্ক না-থাকলেও তাঁরা সে বাড়ি হিন্দুস্থানে করেননি, করেছিলেন পাকিস্তানে। এবং পৈতৃক বাড়ি পাকিস্তানে হলে হিন্দুস্থানে কামরা ভাড়া নিতে হবেই, এ তো জানা কথাই।
কিন্তু এ তো হল ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া। ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়াটাও এক আজব চিজ এই দুদিনের দুনিয়ায়। সংক্ষেপে বলি। এ ব্যাপারে একদিন রেল কোম্পানির রিটায়ার্ড গুড্ড্স ক্লার্ক লালা পিন্ডি দাসের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আমার। তিনি আমায় অন্যান্য ভাড়াটেদের সাথে তিনতলায় একটা কামরা দিয়ে দিলেন। ভাড়া মাসে বিশ টাকা। লালা পিন্ডি দাসকে বললাম, আপনি দেবতুল্য মানুষ।
তিনি একটু হেসে বললেন, আপনিও খুব ভদ্রলোক, মনে হচ্ছে।
আমি বললাম, যখন যেমন তখন তেমন
লালা পিন্ডি দাস আমায় প্রথমদিনের অতিথি বিবেচনা করে যথেষ্ট খাতির-যত্ন করলেন আমার। অর্থাৎ, এক গ্লাস জল খাওয়ালেন এবং একটা বিড়ি বাড়িয়ে দিলেন। আর, আমি এই খাতির-যত্নের প্রতিদানে বিশ টাকা ভাড়া অগ্রিম দিয়ে দিলাম। আমাদের সম্পর্ক এমন নিবিড় হয়ে উঠল, যেন বাঘে-ছাগলে এক ঘাটে জল খাচ্ছে।
ভাড়া নেওয়ার সময় লালা পিন্ডি দাস বুঝিয়ে দিলেন, ভাড়াটা তিনি অগ্রিম নিয়ে থাকেন। কারণ, এই হল তাঁর নিয়ম।
আমি বললাম, আপনি যথার্থই বলেছেন। নিয়ম-কানুন যার নেই, তাকে কেউ শ্রদ্ধা করে না।
কথাটা শুনে লালা পিন্ডি দাস ফুলে উঠলেন। তাঁর দাঁত বেরিয়ে পড়ল। দেখলাম, দাঁতগুলো ময়লা। লোকটি যদি আমার দেওয়া বিশটি টাকা থেকে এক টাকার টুথপেস্ট কিনে আনে, তা হলে দাঁতগুলোর উন্নতি ঘটতে পারে। কিন্তু আবার ভাবলাম, অন্যের দাঁতের মধ্যে আমার নাক গলানো উচিত নয়। প্রত্যেকেরই আপন আপন নিয়ম-কানুন আছে।
অতএব, আমার কামরা-বাস শুরু হল। কামরাটা বেশ। অর্থাৎ, আলো-হাওয়া আসে এবং চব্বিশ বর্গইঞ্চি মাপের চতুষ্কোণ একটি জানালাও আছে। শোবার, থাকার, রান্না করবার, কাপড় ধোওয়ার, লেখাপড়া করার এবং মুগুর ভাঁজবার সমস্ত ব্যবস্থা এই একটি কামরার ভেতরেই রয়েছে। একটি ইলেকট্রিক্ বাল্বও লাগানো ছিল। লালা পিন্ডি দাস সেটা সন্ধেবেলায়ই খুলে নিয়ে গেলেন। বললেন, বাল্বটা আগের ভাড়াটের। সে অগ্রিম ভাড়া না-দিয়েই ঘর ছেড়ে দিয়ে গেছে। আপনি যদি বাল্বটা রাখতে চান, তা হলে সাবেক ভাড়াটের ভাড়াটা চুকিয়ে দিন।
কিন্তু আমি ভাবলাম, সে লোকটা ভদ্র, না বদমায়েশ কেমন মানুষ, তা কে জানে। না জেনে-শুনে তার ভাড়া আমি কেমন করে দিই। সুতরাং, লালা পিন্ডি দাসের কথায় রাজি হলাম না। নিজের জন্যে নতুন বাল্ব কিনে নিয়ে এলাম।
লালা পিন্ডি দাস আমার এই বাল্বটি দেখবার জন্যে ঘরে এসে ঢুকলেন, বললেন, কত পাওয়ারের আনলেন?– তার পর, চোখ পাতরে বাল্বটি দেখতে লাগলেন, যাতে আমি মিথ্যে না-বলতে পারি।
আমি কিন্তু সত্যি কথাই বললাম, ষাট পাওয়ারের।
: কথা কি, জানেন, মশাই– আমি এই ইলেক্টরি-ফিলেক্টিরির ব্যাপারে একটু পষ্ট-বক্তা। এটা ষাট পাওয়ারের বাল্ব। বেশি কারেন্ট টানবে।
আমি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম, আজ্ঞে, তা তো নয়। ষাট পাওয়ারই টানবে, বেশি টানবে না।
: তাই যদি হয়, তা হলে তো আপনাকে বাল্ব পিছু এক টাকার জায়গায় দু টাকা দিতে হবে।
আমি মন্তব্য করলাম, আমি কিন্তু এক টাকা দেওয়াই ভালো মনে করি।
: তা হলে আপনাকে তিরিশ পাওয়ারের বাল্ব আনতে হবে।
: কিন্তু লালাজি, পড়াশোনা করা আমার পেশা। এবং পড়াশোনার জন্যে বেশি আলো চাই। নইলে অকালেই অন্ধ হয়ে যেতে হয়।
: তা হলে দু টাকা করে দেবেন। এই সঙ্গে একথাটাও নিবেদন করে রাখি– নটার পর নিচে থেকে ইলেক্টরির মেন সুইচ বন্ধ করে দেওয়া হবে। এটা আমার নিয়ম।
: কিন্তু লালাজি, আমারও একটা নিয়ম আছে। সে হল, আমি রাত একটা পর্যন্ত লেখাপড়া করি। সারাটা জগৎ যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে থাকি। মানে, কবিতা লিখি, গল্প লিখি, আর সারা দুনিয়ার ব্যথা নিজের বুক থেকে বের করে কাগজের উপর ঢেলে দিই। তাই জন্যে―
তাই জন্যে বেশি তর্ক করেও লাভ নেই। আমার নিয়ম অসংগত বলে প্রমাণিত হল, আর লালা পিন্ডি দাসের নিয়মটাকেই মেনে নিতে হল সংগত বলে। তার পর আমি বাজার থেকে একটা কেরোসিনের কুপি কিনে নিয়ে এলাম। পিন্ডি দাসজি আমার বিজলির তার কেটে দিয়ে গেলেন। আর, আমি সুখে-স্বচ্ছন্দে ঘরটায় বাস করতে লাগলাম।
এমনিভাবে হেসে-খেলে চার-পাঁচটা দিন কেটে গেল। ইতোমধ্যে আমার মনে হতে লাগল, লালা পিন্ডি দাস আর আমার সম্পর্ক শুধু ভাড়া দেওয়া-নেওয়াতেই নয়, মানুষ যখন প্রথম কুঁড়েঘর বানিয়ে বাস করতে শেখে, সেই পাথর আর তীর-ধনুকের যুগে পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে সম্পর্কটি।
ঘরে যে জানালাটি ছিল, সেইটির আমার আলো-হাওয়ার অদ্বিতীয় উৎস। সুতরাং, আমি জানালাটা বেশি করে খুলে রাখি। লালা পিন্ডি দাস যখন সেটা পরপর পাঁচ দিন খোলা অবস্থায়ই দেখলেন, তখন একদিন সকালবেলা আমার অফিসে বেরোবার সময় ইশারা করে আমায় ডাক দিলেন। তার পর নসিহত করলেন, জানালাটার সামনে কয়েকজন মানী লোক থাকেন। সুতরাং, আপনার মতো লোকের পক্ষে জানালাটা সবসময় খোলা রাখা উচিত নয়।
আমি বললাম, লালা পিন্ডি দাসজি, দুজন মানী লোকের মধ্যে কখনও ঝগড়া হওয়া সম্ভব নয়। জ্যামিতির হিসাব বলে, দুটো সমান্তরাল রেখা কোনওদিনই পরস্পরের সঙ্গে মিলতে পারে না।
কিন্তু জ্যামিতি বস্তুটি বোধহয় লালা পিন্ডি দাসজির মাথায় একেবারেই ঢোকে না। আমার কথাটা তাই ভালো লাগল না তাঁর। ভাবলাম, ওঁকে বুঝিয়ে বলি, সামনের বাড়িতে কোনও ভদ্রমহিলা থাকেন না, থাকে ষাট বছরের এক বুড়ি। সে রোদ্দুরে বসে উকুন মারে।– কিন্তু লালা পিন্ডি দাসকে একথা বলার অর্থ তো আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে থাকি, এই অভিযোগটা মেনে নেওয়া। সুতরাং আমি নীরব থেকে ষাট বছরের রূপসীর প্রেমের পথটা নিজেই বন্ধ করে ফেললাম। অর্থাৎ জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। অন্যের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করা এমনিতেও আমার স্বভাবের বাইরে। তার ওপর, জানালা বন্ধ করায় লালা পিন্ডি দাসের চোখে আমার যে সম্মান বেড়ে গেল, সেটুকু উপরি লাভ।
জানালা বন্ধ হওয়ায় আলো-হাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। তিন-চার দিন ভয়ানক রাগ হতে লাগল আমার। সে রাগ কমতে কমতে ক্রমে এসে ঠেকল বিস্ময়ে। কয়েকবার ইচ্ছে হল, লালা পিন্ডি দাসকে বলে দিই, জানালা খোলাই থাকবে। আমার যা করতে চান, করুনগে। কিন্তু আবার ভাবলাম, পাড়ার লোকে আমায় ঝগড়াটে ঠাওরাবে। সুতরাং সামনাসামনি লালা পিন্ডি দাসের সঙ্গে লেগে পড়াটা আর উচিত মনে করলাম না। ফলে আলো-হাওয়া ছাড়াই আমি জ্যান্ত থাকবার চেষ্টা করতে লাগলাম। কোনও এক প্রাচীন কবির সেই বিখ্যাত লাইনটি এই অবস্থায় আমায় যথেষ্ট সাহস জোগাতে লাগল– ‘হিম্মত করে ইনসান তো কিয়া হো নেহি সতা!’
সারাটা বাড়িতে মাত্র একটা পায়খানা। জানা গেল, সে পায়খানা শুধু যারা সপরিবারে থাকে, তাদেরই জন্যে রিজার্ভ করা। যাদের বউ নেই, তারা চলে যায় মাঠে। লালা পিন্ডি দাস আমায় কয়েকবার শোনালেন, বাড়িটা তৈরি করবার সময় তাঁর পিতৃদেবের সঙ্গে সপ্তাহের পর সপ্তাহ এই ব্যাপার নিয়ে মিটিং হয়েছিল যে, মাসিক বিশ টাকা তক্ ভাড়াঅলা কামরা শুধু একলা মানুষদের দেওয়া হবে কি না। শেষে যখন কয়েক সপ্তাহের তর্কবিতর্কের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, এসব ঘরে একলা মানুষদেরই রাখা হবে, তখন তাদের জন্যে পায়খানা তৈরি করবার প্রশ্নই আর ওঠেনি।
ভদ্রতার এই স্তরে পৌঁছে লালা পিন্ডি দাস তাই নিতান্তই পিতৃভক্তের মতো জানিয়ে দিলেন, পিতৃদেবের সঙ্গে যে চুক্তি করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে তিনি যেতে পারবেন না।
কিন্তু হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও যুক্তিটা আমার মাথায় ঢুকল না। এর সঙ্গে পিতৃদেবের চুক্তির কী সম্পর্ক আছে, বাবা! এ তো ভাড়াটের প্রয়োজনের প্রশ্ন।
যুক্তিটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না দেখে বেশ কিছুক্ষণ পর লালা পিন্ডি দাস ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, লেখাপড়া শিখেছ, না ঘাস কেটেছ?
আমি উত্তর দিলাম, ঘাস কাটা মনে না-করে এটাকে মানুষের দুর্বলতা ভেবে নিয়ে আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।
সাত-সকালে যখন মাঠে যাই, তখন মনে হতে থাকে, সত্যি সত্যিই ঘাস কাটতে যাচ্ছি। মাঠে যাওয়ার সময় সাবান, তোয়ালে, টুথব্রাশ ইত্যাদিও নিয়ে যেতে হয়। কারণ, বাসা থেকে আধ মাইল দূরে কুয়োও আছে। স্নানটাও সেখান থেকে সেরে আসতে হয় আমায়। কুয়োয় স্নান করতে যাওয়ার শুরুটা হয় এইভাবে :
একদিন লালা পিন্ডি দাসের বাড়িতে নিচের তলা থেকে এক বালতি জল ভরে এনে নিজের ঘরে স্নান করছিলাম। হঠাৎ নিচে থেকে গালাগালি শুনতে পেলাম, অভদ্র কোথাকার! লজ্জাও করে না!
আমি-যে কোনও অভদ্রতা করছিনে, এ তো জানা কথাই। সুতরাং, যথারীতি গুনগুন করে ‘পিয়া মিলন কো জানা’ গানখানা গাইতে গাইতে স্নান করতে লাগলাম। : চিড়িয়াখানা খুলে রেখেছে ওপরতলায়! বলি, তোমরা কি মানুষ, না গাধা? এটা যে গলি, তোমার বাবার ইমারত নয়, এটুকুও মাথায় ঢোকে না?
মনে হল, কথাটা যেন আমার উদ্দেশেই বলা হচ্ছে। জানালা খুলে বাইরের দিকে তাকাতেই দেখি, সাদা কাপড় পরা এক বাবুজি আমার কামরার দিকে ঘাড় উঁচিয়ে গালাগালি দিচ্ছেন। তাঁর সাদা কাপড়-জামা ময়লা জলে যাচ্ছেতাই রকম ভিজে গেছে। দোষটা আমার, না সাদা পোশাকঅলার– এর আশু মীমাংসা করা আমার পক্ষে শক্ত। একটু পরেই লালা পিন্ডি দাস এসে মুশকিল আসান করলেন এবং প্রমাণ করে দিলেন, দোষটা আমারই।
আমি বললাম, আপনার টিনের নালিটা যদি ভাঙা না-হত, তা হলে দোষটা কখনও আমার ঘাড়ে পড়ত না।
লালাজি চণ্ডমূর্তি ধারণ করে বললেন, টিনের নালির কোনও দোষ নেই, দোষ জলের, যে জল আপনার গা থেকে গড়িয়ে ওই সাদা পোশাক-পরা ভদ্রলোকের কাপড়ে গিয়ে পড়েছে। আপনি যদি এখানে স্নান না করতেন, তা হলে জলও–
আমি বুঝিয়ে বললাম, কিন্তু মশাই, কামরাটা–
লালাজি ফোঁস করে উঠলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কামরাটা থাকবার জন্যে, স্নান করবার জন্যে নয়। কারণ, এটা বাথরুম নয়, কামরা।
আমি বললাম, বাথরুমটা কোথায়?
উত্তর পেলাম, বিশ টাকায় বাথরুম পাওয়া যায় না, শুধু একটা কামরা পাওয়া যায়।
: তা হলে স্নান হবে কোথায়?
এই ‘কোথায়’-এর উত্তরে লালা পিন্ডি দাস আমায় কুয়ো দেখিয়ে দিলেন। সে কুয়োর কাছে টিনের নালিও নেই, সাদা পোশাক-পরা লোকের যাতায়াতও নেই। তবু, আমার মাথায় কিছুই ঢুকতে চায় না। টিনের নালি ভেঙে গেলে তা মেরামত করবার দায়িত্ব লালা পিন্ডি দাস ছাড়া আর কার? আবার নালির সঙ্গে যদি লালাজির সম্পর্ক চুকে গিয়ে থাকে, তা হলে কামরার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রয়েছে কী করে?
কিন্তু এসব উদ্ভট কল্পনা। নালির সঙ্গে লালা পিন্ডি দাসের সম্পর্ক নিশ্চয়ই চুকে গেছে। কিন্তু কামরার ছাদ আর দেয়ালের সঙ্গে সম্পর্ক এখনও ভালোমতোই রয়েছে। কামরার প্রতিটি ইটেও তাঁর ভালোবাসার ছাপ আছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম পরে।
মাস দুই-তিন নিরাপদে কেটে যাওয়ার পর আমার মনে হল, বাজারের তন্দুর আর হোটেলের খাবারে আমার স্বাস্থ্যে ঘুণ ধরে যাচ্ছে। সুতরাং, ঠিক করলাম, নিদেনপক্ষে স্ববজি-তরকারিটা আমার বাড়িতেই রান্না করে নেওয়া উচিত। তার পর বাজার থেকে কয়লা আর চুলো কিনে এনে এক সন্ধেয় কাজ শুরু করে দিলাম!
অবাক কাণ্ড! নতুন কিছুর গন্ধ পেলেই লালা পিন্ডি দাসজি চুপচাপ কানে তালা লাগিয়ে ফেলেন। চুলোর ধোঁয়া দেখে তিনি ভাবলেন, আগুন লেগেছে। তার পর বাড়িতে আগুন লাগবার আগেই আমার ঘরে শুভাগমন করে বললেন, এসব কী হচ্ছে?
আমি সোজা কথায় বুঝিয়ে দিলাম, চুলো জ্বলছে।
: তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু বলি, এটা কি বাড়ি, না হোটেল? জানেন, কামরাটা আপনি ভাড়া নিয়েছেন, কিনে নেননি?
শুনুন কথা! কামরাটা আমি কিনে নিয়েছি বলে কখনও দাবি করিনি। জানিনে, লালা পিন্ডি দাসজি এই মিথ্যে অভিযোগ আমার ঘাড়ে কেন চাপাচ্ছেন! অভিযোগটা শুনে ভারি রাগ হল আমার। বললাম, লাল-পিন্ডি দাসজি, বাজারের খাবার খুব ক্ষতি করে। আপনি আমার স্বাস্থ্যটার কথা একটু ভেবে দেখুন।
: খুব দেখেছি ভেবে। চুলো আর ধোঁয়ায় কামরার দেয়ালে আর ছাদে কালি পড়ে যাবে। কামরার তখন দু পয়সার মূল্যও থাকবে না।
: তা হলে বলুন, আমি কোথায় রান্না করব?
: চুলোটা বাইরে গলিতে রেখে দিন। সেইখানেই রান্না করবেন।
প্রস্তাবটা বেশ। সত্যি, কামরার দেয়াল এবং ছাদে কালি পড়লে লোকের কোমল অনুভূতি এবং রুচিবোধে লাগবেই। অথচ, আমি হলাম কি না একজন শিল্পী। এরকম কাজ করবার সময় আমার অন্তত ভেবে দেখা উচিত ছিল। লজ্জায় তাই মাথা নত করে লালা পিন্ডি দাসের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। তার পর, চুলো উঠিয়ে গলিতে নিয়ে গেলাম।
দিনদুয়েক গলিতে হোটেল খুলে দেখলাম, লোক আসতে-যেতে মিটমিট করে হাসে। কয়েকজন মহিলাকে আঙুল তুলে ইশারা করতেও দেখলাম। অতএব, চুলোটা আবার ঘরে এনে রাখলাম। ঠাণ্ডা, উত্তাপহীন চুলো একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে এককোণে চুপসে পড়ে রইল। তার পর থেকে আর লালা পিন্ডি দাসকে জানাইনি, তোমার ঘরের মান বাঁচাবার জন্যে আমি নিজের স্বাস্থ্য বলি দিচ্ছি। এর জন্যে মাঝে মাঝে প্রতিদান দেব কিন্তু।
আস্তে আস্তে আমার মনে হতে লাগল, আমি ঘরটা ভাড়া নিইনি, ঘরটাই আমায় ভাড়া নিয়েছে। কারণ, ক্রমে ক্রমে এমন সব ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে, যার ফলে ঘর আর আমার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হচ্ছে। চৌকিখানায় টান দিলেও ঘরটা কেঁপে ওঠে, আর লালা পিন্ডি দাস তাঁর ঘরের মেঝে থেকে ইট খসে যাওয়ার দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকেন। দরজা বন্ধ করবার সময় ‘মুড’ এসে গেল, একটু-বা জোরেই বন্ধ করে দিলাম। অমনি লালা পিন্ডি দাসের বুকে হাতুড়ির ঘা পড়ল। তার পর, তিনি নিচে থেকেই হাঁক ছাড়লেন: দরজাটা ভাঙছে কে? ক্যালেন্ডার টাঙাবার জন্যে দেয়ালে পেরেক ঠুকতে গেলাম। সে পেরেক গিয়ে ঢুকল যেন লালাজির মাথায়। গরমের দিন এলে ঘুমোনোর জন্যে রাত্তিরে গলিতে যেতে হয়। কারণ, ছাদে ঘুমোন স্ত্রী-পরিবারঅলা মানী লোকেরা। এবং এ নিয়ম চলে আসছে লালা পিন্ডি দাসের পিতৃদেবের আমল থেকে। অতীতের সুস্থ বিধি-নিষেধ অমান্য করতে গেলে আমার নিজেকেই অপরাধী বলে মনে হতে থাকে।
অবশেষে পরিস্থিতি একদিন সংকটজনক হয়ে দাঁড়াল। আমি লালা পিন্ডি দাসের সামনে সকল কথা ঢেলে দিলাম।
ঘটনাটি হল : সেদিন যথারীতি রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরলাম। সদর দরজাও তখন যথারীতি বন্ধ। এবং এই দরজা দিয়ে ঢুকেই আমাকে সিঁড়িতে উঠতে হবে। অতএব, যথারীতি আমি দরজা খুলে দেওয়ার জন্যে লালা পিন্ডি দাসকে ডাক দিলাম। লালাজি বিড়বিড় করতে করতে নিচে নেমে এলেন। কটমট করে আমার দিকে চেয়ে বললেন, এত রাত তক্ কোথায় ছিলেন?
: ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গল্প করছিলাম।
: তা হলে বাউণ্ডুলেপনাও করেন বুঝি!
: আজ্ঞে, না। পুলিশ আজ পর্যন্ত এ অপরাধে গ্রেফতার করেনি।
: কিন্তু এটা ভদ্রলোকের কাজ নয়, এ আমি আপনাকে বলে দিলাম –আমার বাড়িতে এসব চলবে না। দয়া করে আপনি অন্তত নটার মধ্যে ফিরে আসবেন। নইলে দরজা খোলা হবে না। বুঝলেন?
: আজ্ঞে হ্যাঁ। ভবিষ্যতে আর এমন ভুল হবে না। আমার শোবার ব্যবস্থা আমি অন্য জায়গায় করে নেব।
এই স্পষ্ট কথার পর আর আমার নিজের ঘরে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। আমি এক সরাইখানার মালিকের সঙ্গে আলাপ করলাম। সে আমায় রাত প্রতি ছ’আনায় শোবার জায়গা এবং চৌকি দিতে রাজি হয়ে গেল। তার পর বিছানাটা নিজের ঘর থেকে উঠিয়ে সরাইখানায় নিয়ে এলাম।
দুসপ্তাহের মধ্যেই অবস্থা অন্যরকম হয়ে গেল। এখন আমি মাসে একবার করে লালা পিন্ডি দাসের বাড়ি গিয়ে মাসিক বিশ টাকা ভাড়া তাঁর হাতে দিই, আর, নিচে দাঁড়িয়েই করুণ চোখে একবার কামরাটার দিকে তাকিয়ে নিয়ে সরাইখানায় ফিরে আসি। কিন্তু কামরাটি আমি কেন ভাড়া নিয়ে রেখেছি– বিশেষ করে, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক যখন কার্যত প্রায় ঢুকেই গেছে,–একথার মীমাংসা আজও করতে পারলাম না।
এবং মজার ব্যাপার হল, এরপর থেকে লালা পিন্ডি দাস একটিবারও খুঁতখুঁত করেননি আমার কাছে। বরং, দেখা হলেই শুধু বলেন, আপনি ভারি ভদ্র ভাড়াটে।
অনুবাদ : আতোয়ার রহমান
মেয়েলি হিসাব – হাজেরা মস্রূর
গুড্ডু সাহেব এইমাত্র ঘরে ফিরলেন! ভালো চাকরি করেন। কিন্তু পুরনো অভ্যাস সাইকেল চালানোর –সেটা এখনও ছাড়তে পারেননি।
চাকর এসে সাইকেলটা ধরে নিল।
অফিস থেকে বাসা কম হলেও দু মাইলের পথ। তার ওপর যা গরম পড়েছে। এই গরমে এই দু মাইল পথ সাইকেল চালিয়ে আসা মানে রীতিমতো ব্যায়াম করা। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ে। সারা গায়ে ঘাম ছুটে যায়। সে-সময় গুড্ডু সাহেব বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলেন, তখন এক বন্ধু পরামর্শ দিয়েছিল, ‘বিয়ে না করে, বলছি একটা কার কিনে ফ্যালো। আর, যদি কার না-কিনতে চাও, তা হলে মেষ পোষো। এইভাবে সাইকেল চালালে খাঁটি মোষের দুধ খাওয়া দরকার, বুঝেছ?’
কিন্তু গুড্ডু কারও কেনেনি, মোষও পোষেনি। অবশ্য বউ একটা ঘরে তুলেছে। ঘরে ফিরেই তার প্রথম কাজ বউকে খোঁজা
চাকরকে জিগ্যেস করল, ‘ও কোথায়?’
‘ডাক্তারের কাছে গিয়েছে। বলেছেন, আপনি আসার আগেই ফিরবেন।’
‘তা ফিরলেন কই, আমি তো এসেছি।’
‘তাই তো বলে গিয়েছিলেন।’
ক্লান্ত শরীরটাকে সোফার উপর বিছিয়ে দিল গুড্ডু। এই সময় এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করছে। বউয়ের হাতের চা। চাকরের হাতের চা খেয়ে গুড্ডু সাহেব আরাম পান না। ভাবল, হয়তো এখনই এসেই পড়বে।
গুড্ডু ভাবল, এই সুযোগে গোসলটা সেরে নেওয়া যাক। নলের পানির শব্দের সঙ্গে মিশে গেল যেন কারও গলার আওয়াজ। এসেছে বোধহয়। নল বন্ধ করে শুনবার চেষ্টা করল গুড্ডু। না, মনের ভুল। কেউ আসেনি তো।
গোসল সেরে বেরুল। চা রাখা ছিল তেপায়ার উপর। ইভনিং-ইন-প্যারিসের গন্ধ মেখে নিয়ে চায়ের দিকে তাকাল। চা এখনও যথেষ্ট গরম। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে কিছু ক্ষতি নেই। হয়তো ততক্ষণে এসে যাবে। সকালের খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে বিছানায় সটান শুয়ে পড়ল।
পড়তে পড়তে একটা অদ্ভুতদর্শী শিশুর খবরের দিকে নজর গেল তার। কিন্তু বেশিক্ষণ সে-খবর মনটাকে আটকে রাখতে পারল না। এ-পর্যন্ত একটিই ছেলে পেয়েছে সে। তাতেই বউয়ের স্বাস্থ্যটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। অপারেশন করতে হল বলে। নইলে হয়তো এমন হত না।
কে বলেছে সন্তান উৎপন্ন করতে। না হলেই-বা কী ক্ষতি ছিল! স্বাস্থ্যটা তো তা হলে এইভাবে জাহান্নামে যেত না। আর, খবরের কাগজে রোজ রোজ এইরকম খবর। বানরের মতো দেখতে। মাথায় শিং রয়েছে। নাহয়, চারটা হাত, দুটো মাথা নাহয়, পিঠে পিঠে জোড়া লেগে রয়েছে। দুটো বাচ্চা। চারটা হাত, দুটো পা। বিয়ে করলেই এইসব ঝঞ্ঝাট।
আহা, বেগমের কী অবস্থা! হাসপাতালের সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল গুড্ডুর। তিন দিন যাবৎ কেবল চিৎকার করল। শেষে অপারেশন করতে হল। কীরকম আতঙ্কজনক হয়ে উঠেছিল ওর চেহারাটা। হাসপাতাল থেকে যে ফিরল, সে যেন বেগম নয়, বেগমের প্রেতাত্মা। তৌবা। সন্তান জন্ম দেওয়া যেন একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার নয়। যদি মরে যেত, তা হলে! গুড্ডুর দুচোখ আপনা-আপনি ভিজে এল।
কী করছে এতক্ষণ ধরে ডাক্তারের কাছে। নাকি সেখান থেকে আবার অন্য কোথাও গেছে। টাঙায় চাপতে কতদিন নিষেধ করেছে। তাতে শরীর আরও খারাপ হয়ে যায়। ট্যাক্সিতে গেলে শরীরটা আরাম পায়। না, ওই এক বাতিক। পয়সা বাঁচানোর এত ঝোঁক। কী হবে এত টাকা-পয়সা জমিয়ে। জান্ আগে, না পয়সা আগে। আসুক, আজকে ভালোভাবে শুনিয়ে দেবে চাট্টি কথা।
কিন্তু আরও অনেক দেরি করে বেগম যখন ঘরে ফিরল, ওর বিবর্ণ, মলিন মুখ দেখে গুড্ডুর মুখে রা সরল না। বকার কথা একদম ভুলে গেল সে। বাইরে আয়ার কোলে বেবি কাঁদছিল ট্যা-ট্যা করে।
গুড্ডু আদর করে বেগমকে বিছানায় শোয়াতে গেল। কিন্তু বেগম মুখে কোনও কথা না বলে নাক ঝাপ্টা দিয়ে সে আদর প্রত্যাখ্যান করল। সরে বসল গিয়ে সোফার উপর। তার কপালে, নাকের নিচে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। নিঃশ্বাস বয়ে যাচ্ছে জোরে জোরে।
বেগমকে সুন্দরী বলা যায় না। আদৌ না। কিন্তু গুড্ডুর চোখে সে অপরূপা। এতদিন হয়ে গেল, তবু চেয়ে চেয়ে চোখের পিয়াস মেটে না তার। এত যে ভেঙে পড়েছে, যাকে দেখলে এখন তালপাতার সেপাই বলেই মনে হয়, তবু গুড্ডুর কাছে সে স্বর্গের অপ্সরা। গুড্ডু কাছে বসে, মোলায়েম করে হাত ধরে, বেগমের শাড়ির আঁচল দিয়ে তার মুখের ঘাম মুছে দিতে চাইল, কিন্তু বেগম ঝট্কা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল তার। ঝাপ্টা মেরে হাত সরিয়ে দিল গুড্ডুর।
গুড্ডুর খারাপ লাগল না। এইরকম দেখে দেখে তার সয়ে গেছে। এখন কিছু মনে করে না সে এই ব্যবহারকে।
গুড্ডু চা তৈরি করতে শুরু করে দিল। ‘নাও খাও, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
‘না।’
‘কেন?’ গুড্ডু নিজের কাপটাও নামিয়ে রাখল।
‘ভালো লাগছে না।’
‘বেশ, অল্প-একটু খেয়ে নাও, দু চুমুক।’
কয়েক চুমুক খেল বেগম।
‘ডাক্তার কী বললেন?’
‘রক্ত হচ্ছে না।’
গুড্ডুর খুব রাগ হল। ‘রক্ত হবে কোত্থেকে। টনিক-ওষুধ সব ড্রেনে ফেলেছে। দুধ খাবে না, ডিম খাবে না। গোত দেখলে বমি আসে। শাক-শবজির গন্ধ পর্যন্ত সহ্য করতে পারো না। তা আর খাবে কী। একটুখানি চলাফেরা করতে বলব, তা-ও করবে না। তুমি নিজেই মরতে চাও, তা কে কী করবে, বলো রাগ করলে কী হবে, আমার কথার উত্তর দাও। ওষুধ যদি না-খাবে তো ডাক্তারের কাছে রোজ রোজ কীজন্যে যাচ্ছ? সেই-যে বেবি পেটে থাকার সময় ডিম-দুধ-গোশ্ত খাওয়া ছেড়েছ তো ছেড়েছই– এখনও গন্ধ লাগে। মা কি সাধে বলেন, নখ়া কোরো না। আমার কথা নাহয় না-ই শুনলে, কিন্তু মুরুব্বি মানুষের কথা তো শুনতে হয়। বেশি বললে তো আবার কাঁদতে শুরু করে দেবে।
ঘুরে দেখে, বেগম তার বলবার আগেই কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে।
ঠোঁট ঝুলিয়ে বাচ্চাছেলের মতো সে কাঁদছে।
‘ব্যস্, খারাপ লেগে গেল আমার কথা। শহরে আরও তো পাঁচটা মেয়েমানুষ আছে। পাড়া-প্রতিবেশীদের দেখেও তো লোকে শেখে।’
‘হুঁ, আমি বুঝি আর পাঁচটা মেয়েলোকের সমান হলাম। তার চাইতে গরু-মোষের সঙ্গে তুলনা দিলেও তো পারতে। গরু-মোষও মার খেলে শিং দিয়ে গুঁতো মারে।’
‘ও, আমি বুঝি তোমাকে মেরেছি, তাই না? অবাক করলে।’
‘তোমার মুখের কথাই মারের চাইতে কি কম? পুরুষ হয়েও শাশুড়ি-ননদের মতো গালাগালি করতে তোমার মুখে বাধে না! আশ্চর্য।’
‘আশ্চর্য? বেশ, আমার অন্যায় হয়েছে, মাফ করে দাও। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একটু কথাতেই অমনি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠো কেন, বলো তো?’
‘উঁ– বড় এসেছেন মনস্তত্ত্ববিদ্–। শরীরের চিকিৎসা শেষ হয়েছে, এখন মনের চিকিৎসা করবেন।’
‘লক্ষ্মী বেগম, তুমি আমাকে মাফই করে দাও। ঘাট হয়েছে, স্বীকার করছি।’ বকলেও যা, সহানুভূতি জানালেও তাই। ভাবল গুড্ডু।
বেগমের কান্না তবু থামল না। ‘সত্যি বলছি, তোমাকে এখন আমার ঘেন্না করতে ইচ্ছে করছে। আমার কষ্টের কথা তুমি ভাবো না। আমার মনের ভেতরে যে কী হচ্ছে, তা তুমি বোঝো না। আত্মহত্যা করতে মন চাইছে।’
‘শোনো লক্ষ্মীটি, তাই জন্যেই তো বলছি, শরীরটাকে সারিয়ে তোলো। স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে মনও ঠিক থাকবে। কথায় বলে না, স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল।’
‘না, আমি কিছু শুনতে চাই না। তুমি আমার দু চোখের বিষ। তুমি আমার শত্রু। জীবনে আমার ঘেন্না ধরে গেছে। আমি মরব। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। ওয়াক্। আমার বমি আসছে।’
বউকে জোর করে টেনে এনে নিজের কাছে বসাতে চাইল গুড্ডু।
‘উফ্, আমাকে তুমি টেনে-হেঁচড়ে শেষ করে ফেললে। ব্যথা, ব্যথা। উফ্। মলাম, নিষ্ঠুর।’
‘মাফ করে দাও, মাফ করে দাও। অন্যায় হয়েছে। আচ্ছা, এসো। তুমি নিজেই এসো। এসে বোসো। আমার কাছে এসে বোসো। এসো, আমি তোমার মাথা টিপে দিই।’
‘না, না, তুমি আমাকে ছুঁয়ো না। ছুঁলে আমি পাগল হয়ে যাব। স্বার্থপর। নিষ্ঠুর। তোমার কী! আবার মরতে হলে মরব তো আমিই।’
‘দ্যাখো বেগম, তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছ। এত তাড়াতাড়ি ছেলে পেতে কি আমিই চেয়েছিলাম নাকি? তুমিই তো মা হওয়ার জন্যে আল্লার কাছে দোয়া চেয়েছিলে, মনে নেই? তবে যে আমার দোষ দিচ্ছ।’
‘বেশ, বেশ, তোমার কথাই সত্য হল। আমিই চেয়েছিলাম। সব বউই বাচ্চা চায়, তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। আমার ঘাট হয়েছে, স্বীকার করছি। আর আমি চাইনে। এই যে কান ধরছি। তৌবা করছি। অনেক শাস্তি হয়েছে। আর না। ‘
‘আমিই-বা কবে চেয়েছি, না ভবিষ্যতের জন্যে চাচ্ছি। আমিও তৌবা করছি। তৌবা তৌবা। তোমার চাইতে বেশি তৌবা। ডবল তৌবা।’ গুড্ডু ক্লাউনের মতো কান ধরে কয়েকবার ওঠবোস্ করল।
‘বাহ্, কারও জান যাচ্ছে, আর তুমি তাই নিয়ে করছ আমার সঙ্গে ফাজলামি। সারারাত ঘুম আসে না ভয়ে, তা তুমি জানো?’ বেগম একেবারে বাচ্চাছেলের মতো জোরে জোরে কাঁদতে আরম্ভ করে দিল।
‘এই নাও, এখন আবার কী হল? তুমি আমাকে পাগল করে ছাড়বে দেখছি।’ কান্না থামানোর চেষ্টাস্বরূপ গুড্ডু তাকে বুকের কাছে টেনে আনতে গেল।
উফ্, মেরে ফেলল রে, মেরে ফেলল। তোমাকে-না বললাম, আমাকে ছুঁয়ো না। তোমার হাতের ছোঁয়া আমার গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছে। তুমি যদি আমার মনে শান্তি দিতে চাও, তা হলে দোহাই তোমার, তুমি আমাকে ছুঁয়ো না।’
‘আশ্চর্য, তুমি আমাকে শুধু শুধু লজ্জা দিচ্ছ। যাই বলো, আমি যে জানোয়ার নই, এতদিনে অন্তত তোমার তা বোঝা উচিত ছিল। আমি তোমার মনে শান্তিই দিতে চাই। আমি চাই, তুমি সেরে ওঠো, সুস্থ হয়ে ওঠো।’
‘ছাই। তোমাকে আমি চিনি না মনে করেছ! একটুখানি ঢিলা দিলেই হল। তোমার কী। মরব তো আমি। আমার শরীরে একফোঁটা রক্ত নেই। কেমন করে যে বেঁচে রয়েছি, ভাবতেও অবাক লাগে। সারাক্ষণ মাথা ভোঁ ভোঁ করে। উঠতে গেলে ঘুরুনি, বসতে গেলে ঘুরুনি। এখন পর্যন্ত সোজা হয়ে হাঁটতে পারি না। পেটে ছুরির দাগ কোনওদিনও মিটবে না।’ আবার কাঁদতে শুরু করে দিল বেগম।
এমনি সময়ে পাশের ঘরে বেবিরও কান্নার রব শোনা গেল।
বেগম হাঁক ছাড়ল, ‘আয়া, বেবিকে নিয়ে এসো!’
‘আয়া, বেবিকে এনো না।’ তারও চাইতে জোরে বলল গুড্ডু।
‘কেন অত দেমাক দেখাচ্ছ? দুধ দেব না বাচ্চাকে? না-খেয়ে মরবে নাকি? দুধ তো ছাই পায়!’ বিড়বিড় করে চোখ মুছল বেগম।
‘মরুক। মরলেই বাঁচি। বুকের দুধ কেন দেবে। ডাক্তারে বলেনি টিনের দুধ খাওয়াতে?’
‘মুখ সামলে কথা বলো, নইলে ভালো হবে না কিন্তু। আমার বাচ্চা কেন মরবে। যে ওর মৃত্যু চায়, সেই মরুক। অতটুকু বাচ্চার সঙ্গে তোমার এত হিংসামি কেন, শুনি?’
‘অমন বেহুদা ছেলে তো আমি কোথাও দেখিনি। সারারাত কাঁদবে, আর তোমাকে ঘুমোতে দেবে না। সেইজন্যেই তো তোমার মেজাজটা আরও তিরিক্ষি হয়েছে। শুকিয়ে শুকিয়ে কাঠ হচ্ছ।’
‘থাক, অত দরদ দেখাতে হবে না। শত্রু, হাড়-শত্রু, আবার দরদ দেখাচ্ছেন। আমি ওকে ন-মাস পেটে ধরেছি। তুমি কী বুঝবে তার জ্বালা। আর, থাকতে হত যদি হাসপাতালে, পেট কেটে বাচ্চা বের করতে হত যদি, তা হলে বুঝতে।’
‘এইজন্যেই তো বাঁদরটার ওপর আমার এত রাগ। বেটা নচ্ছার, মায়ের পেটে ছিলি কেন– বাপের পেটে থাকতে পারিসনি?’ গুড্ডু হাসি সংবরণ করতে পারছিল না।
‘দেখাও-না রাগ, যত পারো দেখাও। কিন্তু আমার তো ওই একটাই বাচ্চা, একটাই মানিক। এই মানিকটাই আমার জীবনের আশা-ভরসা। আমার চোখের মণি। কিন্তু আর আমি ছেলেমেয়ে চাই না। আবার আমাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে মেরে ফেলতে চাও নাকি? আমি মরলে তোমার আর কী ক্ষতি। আর একটাকে ঘরে তুলবে। তাকে দিয়ে সেপাই-বাহিনী তৈরি করে নিও। যত খুশি।’ আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল বেগম।
গুড্ডু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না, কী ভাষায় সে সমবেদনা জানাবে। সমস্যা হয়তোবা জটিল, কিন্তু তার সমাধান কঠিন নয়। নিজেই সে বিজ্ঞের মতো সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছে নানাভাবে। কিন্তু তার প্রত্যেকটি কথারই উল্টো অর্থ করছে বেগম।
ততক্ষণে চা ঠাণ্ডা পানি হয়ে গেছে। চা আর খাওয়া হল না। কাজেই গুড্ডু একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেটে দ্রুত কয়েকটা টান দিয়ে ভাবতে লাগল। কত সাধ বুকে পুষে অফিস থেকে সে বাসায় ফিরেছিল। কিন্তু বিকেলটা একদম মাটি হয়ে গেল। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে সে নিজের চুলে আঙুল বুলোতে লাগল।
‘ব্যস্, এখন মুখ ভার করে বসে পড়লেন।’ বেগম আবার বাণী বর্ষণ আরম্ভ করে দিল। ‘আমার কথা বুঝবে কেমন করে তুমি। যাক। আমি তোমাকে ঠেকিয়ে রাখতে চাই না। আমি জানি, এই অবস্থায় তুমি আমার ওপর খুশি হতে পারো না। তুমি কেন, কোনও পুরুষই পারবে না। আমার কপাল মন্দ। আমি হতভাগী। তুমি আর একটা বিয়ে করে নাও। আমি তোমার বাড়ির এককোনায় আমার ছেলেকে নিয়ে পড়ে থাকব। তুমি খুশি থাকলেই আমিও খুশি।’ বেগমের রুগ্ণ চেহারায় যেন রাশি রাশি অভিমানের আলো ঝিলিক দিয়ে গেল।
‘শোনো কথা! আশ্চর্য মেয়ে তুমি। তুমি নিজেই নিজেকে কষ্ট দিয়ে কী মজাটা পাচ্ছ! এই সময় আমার আবার বিয়ে করার প্রশ্ন উঠল কেমন করে!’
উঠতে আর বাকিই-বা থাকল কোথায়। ন্যাকা সাজবার চেষ্টা কোরো না। অকেজো একটা বউ নিয়ে তুমি কদিনই-বা ঘর করবে। এ প্রশ্ন আজ না-উঠলেও একদিন উঠবে। তুমি হলে পুরুষজাত। দয়ামায়া বলে কি কোনও জিনিস আছে তোমাদের মধ্যে!’
‘আশ্চর্য, দু বছর আগে যখন বিয়ে করিনি, তখন বুঝি আমি মরে যাচ্ছিলাম।’
‘হুঁহু, তখনকার কথা আর এখনকার কথা এক নাকি?’
‘কেমন করে বোঝাই বলো তোমাকে। বলছি, এসব কথা ভেবো না। রাত-দিন এই চিন্তা করো বলেই তো তোমার রক্ত শুকিয়ে যাচ্ছে।’
‘করব-না চিন্তা! আমার কী অবস্থা, তা আমিই জানি। একদিকে বছর বছর- ইয়ে, আর অন্যদিকে
‘বছর বছর ছেলেমেয়ে কে চেয়েছে। আমি কি চেয়েছি নাকি যে, বারে বারে এককথা শুনিয়ে যাচ্ছ? আমি বলছি, আমি আর ছেলেমেয়ে চাই না, চাই না, চাই না– এখন হয়েছে তো।’
‘তুমি না-চাইলেও ছেলেমেয়ে হতে পারে। আর, আমার তাতেই মৃত্যু। হবে না বললেই হয় না। কোনও গ্যারান্টি নেই। ‘
‘গ্যারান্টি নেই? তা হলে সায়িন্স কীজন্যে এসেছে?’
‘অসম্ভব। তুমি আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা কোরো না।’
‘আচ্ছা, বেশ। এসো, আমরা তা হলে প্রতিজ্ঞা করি। আমরা দু জন বন্ধুর মতো জীবন-যাপন করব। এখন হয়েছে তো?’ যেন স্বর্গীয় প্রকৃতির বাণী ছাড়ল সে, যার ওপর আর কোনও কথা চলতে পারে না। বলেই সে খুব জোরে হাত চেপে ধরল বেগমের
‘আবার! আবার আমাকে ছুঁলে! একটু আগে কী বলেছ?’
‘কেন, বন্ধু বন্ধুকে ছুঁতে পারে না নাকি?’
‘তা হলে থাক, অমন বন্ধুত্বে আমার কাজ নেই। ছোঁয়াছুঁয়ির বন্ধুত্বকে আমার ভয় লাগছে।’
‘নিশ্চিন্ত থাকো বন্ধু, কোনও ভয় নেই। আমরা প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ নই। আজকে ছোঁয়া মানা। কালকে এক ঘরে থাকা মানা। পরশু বলবে, আমি তোমাকে পর্দা করে চলব। আমাকে বিশ্বাস করো, অত সন্দেহপ্রবণ হয়ো না।‘
‘বেশ, তা হলে প্রতিজ্ঞা করো।‘
‘প্রতিজ্ঞা করলাম। তোমাকেও একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে।’
‘কী?’
‘যে, সময়মতো ওষুধ খাব। ভালোভাবে খাওয়াদাওয়া করব। প্রত্যেক দিন তোমার সঙ্গে বেড়াতে বেরুব। কোনও দুশ্চিন্তা করব না। ইত্যাদি ইত্যাদি।’
‘অর্থাৎ, আমি আজকাল পাগল আছি, যেন তাড়াতাড়ি মাথাটা ঠিক হয়ে যায়, তাই না? তার পর যেন বেশ ভালোভাবেই আমাকে নিয়ে
‘না, কক্ষনো না। আর একটা কথা। বেবিকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামিও না। এখন থেকে অত আদর করলে একদম বিগড়ে যাবে। বড় হলে কোনও কাজের ছেলে হবে না।
‘বা বা, এখন তুমি মা-ছেলের ব্যক্তিগত ব্যাপারে অনাবশ্যক অনধিকার চর্চা করছ। আমার ওই একটাই ছেলে। ওর কোন্টা ভালো, কোন্টা মন্দ, তা আমি ভালো করেই জানি।’
‘তা হলে বাপ বুঝি ছেলেকে ভালোবাসে না?’
‘বাসে কি না-বাসে, কে জানে। তবে মায়ের মতো নয় নিশ্চয়। ন’মাস পেটে ধরে যদি ভালোবাসতে পারতে, তবেই হত ভালোবাসা। তোমার কথায় আমার কলজেটা ফেটে যাচ্ছে।’ বেগম আবার ফোঁপাতে আরম্ভ করল।
‘এই নাও, আবার শুরু হয়ে গেল। আমি মাফ চাচ্ছি। যত খুশি আদর করো, ওর বারোটা বাজাও, আমি আর কিছুই বলব না। সত্যিই তো, আমি যখন ন’মাস পেটে ধরিনি, তখন ওকে ভালোবাসার আমার কী অধিকার।’
‘এ-পর্যন্ত ভালোবাসার কী পরিচয় দিয়েছ শুনি। বলেছিলাম, একটা প্যারামবুলেটার কিনে দাও, বেবিকে বেড়াতে নিয়ে যাব। সবসময় কোলে করে নিয়ে বেড়ালে ছেলের অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু দিয়েছ কিনে আজ পর্যন্ত? আজকে নাহয় আয়া আছে। ওর কী ভরসা। কালকে যদি চলে যায়, তখন আমাকেই তো নিয়ে টেনে টেনে বেড়াতে হবে। হবে কি না, বলো?’
‘আমি কি আর দেব না বলেছি, না দিতে চাইনি? এ মাসের বাজেট টাইট। তাছাড়া, সময় পাচ্ছি কোথায়। দশটা-পাঁচটা অফিস করি, তার পর ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরি। কখন কিনব বলো। তা তুমিও তো পারতে একটা প্যারামবুলেটার কিনে আনতে। আনোনি কেন?’
‘হ্যাঁ, একেই বলে ভালোবাসা। সত্যিকারের ভালোবাসা হলে সময়ের অভাব হত না। আমি রুগী মানুষ, আর আমাকেই ঠেলতে চাও বাজারে। হ্যাঁ, শেষপর্যন্ত আমাকেই আজকে যেতে হল বাজারে প্যারামবুলেটার খুঁজতে।’ বেগমের চোখ আবার ভিজে এল।
‘ও, তাই বলো। বাজার গিয়েছিলে, সেইজন্যে ফিরতে এত দেরি। তা প্যারামবুলেটার আনলে না কেন? দেখে রেখে এসেছ বুঝি পছন্দ করে! ঠিক আছে, পয়লা তারিখে গিয়ে নিয়ে আসব, কেমন?’
‘তোমার সব কাজ পয়লা তারিখে।’
বেগমের কথায় আর কান না দিয়ে গুড্ডু হাঁক ছাড়ল, ‘আয়া, বেবিকে নিয়ে এসো, আমি ওকে ভালোবাসব।’ ভালোবাসার যেন অনেক স্টক জমা হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি খালাস করতে চায় সে।
খুশিতে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে আয়া এল একটা প্যারামবুলেটার ঠেলতে ঠেলতে, তার মধ্যে বাচ্চা।
‘আচ্ছা, তাই বলো, কিনে ফেলেছ!’ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গুড্ডু একেবারে দাঁড়িয়েই পড়ল। ‘আহা, এরকম বউ ক-জনের ভাগ্যে জোটে। যার জোটে, তার ঘর স্বর্গতুল্য।’ ছেলেকে কোলে নেওয়ার জন্য সে হাত বাড়াল। কিন্তু বাপের কোলে গিয়ে সে বেজায় চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। তার পর মায়ের কোলে মায়ের গায়ের গন্ধ শুঁকে সে চুপ করল কোঁ-কোঁ করে।
চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে প্যারামবুলেটার দেখতে লাগল গুড্ডু। আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল। হাতল ধরে ঠেলা মেরে দেখল। স্প্রিঙের গতিতে চাপ দিয়ে দেখল।
‘ভারি সুন্দর তো। কত পড়ল?’
যার কাছে জানতে চাওয়া, সে ছেলেকে দুধ খাওয়াচ্ছে তন্ময় হয়ে। কাজেই উত্তর এল আয়ার কাছ থেকে। ‘একশো চল্লিশ টাকার গাড়ি কিনলেন বেগম সায়েব। আমি বললাম, পঞ্চাশ টাকা দিয়ে এই ছোট গাড়িটা নাও। তা উনি বললেন, একদম ছোট্ট চেয়ার বলে মনে হচ্ছে। তখন আমি বললাম, মাঝারি নাও চার কুড়ি টাকা দিয়ে। তা-ও উনার পছন্দ হল না। উনি বললেন, এতেও তো একটামাত্র বাচ্চা বসতে পারবে। দুটো হলে তখন তো দুজনে ঝগড়া বাধবে কি না, বলো। বড়টা জেদ করবে, ছোটটাকে মারতে যাবে, তখন? আমি বললাম, তা ঠিক বলেছ বেগম সায়েব। তার পর, উনি বললেন, বড় দেখে নাও, যেন একসঙ্গে দু-তিনটে বেবি বসতে পারে।’
গুড্ডু প্রথমে অবাক হল। তার পর, সামলে নিয়ে হাসবার চেষ্টা করল। তার পর, ফিফিক্ করে হেসে ফেলল। তার পর, হঠাৎ বিকট জোরে অট্টহাসি জুড়ে দিল ছাদ ফাটিয়ে।
সংযুক্ত কায়দায় বেবিকে দুধ খাওয়াচ্ছিল বেগম। গুড্ডুকে এই প্রথম তার এত অনবদ্য, এত প্রিয়, এত খাঁটি বলে মনে হল –নীল সমুদ্রের কিনারায় একঝাঁক সাদা ফেনার মতো শুভ্র, পবিত্র।
অনুবাদ : নেওয়ামাল বাসির
কালো শালওয়ার – সাদত হাসান মান্টো
দিল্লি আসার আগে সে থাকত আম্বালা ফৌজি ক্যাম্পের কাছে। জনাকয়েক গোরা সৈনিক তার খদ্দের। তাদের সঙ্গে মেলামেশা করে দশ-পনেরোটি ইংরেজি কথা সে আয়ত্ত করতে পেরেছিল। সাধারণ আলাপ-আলোচনায় এসব কথা প্রয়োগ করত না কখনও। কিন্তু দিল্লি এসে অবধি ব্যবসা যখন একেবারেই মন্দা, তখন প্রতিবেশিনী তমন্চা জানকে একদিন সে বলল, ‘দিস্ লাইফ ভেরি ব্যাড।’ অর্থাৎ এ জীবন বড় দুর্বিষহ। কারণ, এখানে পেট ভরার উপায়টুকু পর্যন্ত নেই।
আম্বালা-ক্যাম্পে তার ব্যবসা ভালোই চলত। কষে মদ খেয়ে গোরারা আসত তার কাছে। তিন-চার ঘণ্টার মধ্যেই আট-দশটি গোরার মনোতুষ্টি ঘটিয়ে বিশ-ত্রিশ টাকা উপায় করে নিতে পারত সহজেই। দেশি খদ্দেরের চাইতে গোরারাই বরং ভালো। গোরাদের কথা সুলতানা খুব কমই বুঝত। আর এই না-বুঝতে পারাটাই শাপে বর ছিল তার পক্ষে।
গোরারা কসেশন চাইলে মাথা নাড়িয়ে সে বলে দিত, ‘সায়েব, তোর কথা কিছুই বুঝি-টুঝি না।
আর, বেশিরকম হেস্তনেস্ত করতে চাইলে মাতৃভাষায় খুব খানিক গালাগালি দিত সে। তবু বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকলে বলত, ‘সায়েব, তুই একটা আস্ত প্যাচা, হারামজাদা, শুয়োর। বুঝলি?’
কড়া গলায় না-বলে কথাগুলো বলত খুব নরম করে। আর, তার পরই ফিক্ করে হেসে দিত। তাই-না দেখে হেসে ফেলত গোরারাও। সুলতানার তখন মনে হত, হ্যাঁ, সত্যি সত্যি তারা প্যাঁচাই বটে।
কিন্তু দিল্লি এসে অবধি কেউ তার ছায়া মাড়ায়নি। গোরা না, কেউ না। ভারতের এই বিরাট শহরটিতে তিন মাস হল তার আসা। সুলতানা শুনেছে, এই শহরেই নাকি বড়লাট থাকেন। গ্রীষ্মকালে তিনি যান শিমলায়
একজনও আসেনি, একথা ঠিক নয়। এসেছে। এই তিন মাসে মাত্র ছ’জন। আল্লা সাক্ষী, মিথ্যে নয়– ছয়টি খদ্দেরের কাছে সে কামাই করেছে সাড়ে আঠারোটি টাকা। তিন টাকার বেশিতে কেউ রাজিই হতে চায়নি। সুলতানা প্রথম পাঁচজনকে রেট বলেছিল দশ টাকা। কিন্তু কী আশ্চর্য, তাদের প্রত্যেকেই জবাব দিয়েছে, তিন টাকার বেশি এক পয়সাও দিতে পারবে না।
কেন জানি তাদের সবাই একবাক্যে সুলতানাকে তিন টাকার যোগ্যি বলেই মনে করল। তাই ছয়জনের জন এলে সে নিজেই বলল, ‘দ্যাখো বাপু, এক টাইম থাকতে হলে তিন টাকা লাগবে। এক আধলাও কম হবে না। থাকতে হয় থাকো, নাহয় চলে যাও।’
কথা শুনে লোকটি আর তর্ক না করে মেনেই নিল।
অন্য কামরায় গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে লোকটা কোট খুলছে– সুলতানা তার কাছে হাত পাতল, ‘একটা টাকা দাও দিকিনি দুধের জন্যে।’
বাড়তি এই একটা টাকার দাবি মানল না সে। কিন্তু কী মনে করে পকেট থেকে নতুন রাজার একটা চকচকে আধুলি বের করে দিল। টুপ্ করে আধুলিটা নিয়ে সুলতানা ভাবল, যাগ্ গে, যা এল তাই সই।
পুরো তিন মাসে মাত্র সাড়ে আঠারো টাকা।
বাসাভাড়া মাসে বিশ টাকা। বাসা নয়, মালিকের ভাষায় ওটার নাম ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটের পায়খানাটা চমৎকার। শেকল ধরে একটুখানি টান দিলেই সমস্ত ময়লা ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়। আর, সে কী হড়হড় গড়গড় শব্দ! বাব্বাহ্। প্রথমদিকে সুলতানা রীতিমতো ভয় পেয়ে যেত এই শব্দ শুনে। প্রথম যে দিন সে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে আসে এই পায়খানায়, সেদিন তার মাজায় ভয়ংকর ব্যথা। তাই, ওঠার সময় ঝোলানো শেকলটা ধরে উঠতে গেল। সে ভেবেছিল ওঠার সুবিধের জন্যই বুঝি-বা এই বিশেষ ব্যবস্থাটি করা হয়েছে। উঠতে যাতে কষ্ট না হয়, তার জন্যই বুঝি-বা শেকলের ব্যবস্থা। কিন্তু যেই-না উঠতে যাওয়া, অমনি হঠাৎ উপরে কিসের যেন ভীষণ শব্দ আর সঙ্গে সঙ্গে বেজায় হইচই করে নিচের দিকে পানির বন্যা। ভয়ে আঁতকে উঠে সুলতানা শেষপর্যন্ত চেঁচিয়েই ফেলেছিল।
অন্য কামরায় খোদাবখ্শ ফোটোগ্রাফির যন্ত্রপাতি ঠিক করছিল। একটা পরিষ্কার বোতলে রাখতে যাচ্ছিল হায়ড্রো কুইনিয়ন। এমন সময় সুলতানার চিৎকার শুনে সে ছুটে এল। বাইরে থেকে তাকে শুধোল, ‘বলি হল কী? তুমিই চ্যাঁচাচ্ছ নাকি?’
সুলতানার বুক তখনও ভয়ে দুরুদুরু কাঁপছে। বলল, ‘এটা কি ছাই পায়খানা, না অন্যকিছু? রেলগাড়ির শেকলের মতো এটা আবার কী ঝুলিয়ে রেখেছে? মাজায় ব্যথা, তাই ভাবলাম, এটা ধরেই উঠব। ও মা, উঠব কী, টান পড়তেই সে কী মহা হইচই!’
কাণ্ড দেখে খোদাবখ্শের হাসি যেন থামতেই চায় না। শেষে এখানকার পায়খানার সব রহস্যই উদ্ঘাটিত করে দিয়েছিল সুলতানার কাছে। বলেছিল, ‘শেকলটা আর কিছু না, শুধু ময়লা পরিষ্কার করার জন্যে।’
খোদাবখ্শ আর সুলতানার মধ্যে পরিচয় হওয়ার ব্যাপারটা বেশ একটু লম্বাচওড়া।
খোদাবখ্শের বাড়ি রাওয়ালপিন্ডি। এন্ট্রান্স পাস করার পর সে লরি চালানো শেখে। চার বছর অবধি লরি চালায় রাওয়ালপিন্ডি থেকে কাশ্মির সীমান্তের মধ্যে। কাশ্মিরে আলাপ হয় একটি মেয়ের সঙ্গে। মেয়েটিকে ইলোপ করে সে লাহোর নিয়ে আসে। লাহোরে কোনও কাজকামের খোঁজ না-পাওয়ায় মেয়েটিকে দেহব্যবসায় বসিয়ে দেয় সে। দু-তিন বছর এমনি করে কেটে যায়।
হঠাৎ একদিন মেয়েটি পালিয়ে যায় আর-একজনের সঙ্গে। খোদাবখ্শ টের পায়, সে এখন আম্বালায়। তারই খোঁজে আম্বালা এসে খোদাবখ্শ পেল আর-একটি মেয়ের সন্ধান। সে-ই এই সুলতানা। সুলতানার ভালো লাগল খোদাবখ্শকে। তাই তার সঙ্গে একটা সম্পর্কও গড়ে উঠল অনায়াসেই।
সুলতানার ব্যবসা বেশ জমে উঠল। খোদাবখ্শই যেন এর জন্য দায়ী। মেয়ে মাত্রই একটু সহজবিশ্বাসী। তাই, সুলতানা ভাবতে পারল, খোদাবখ্শ বড় সুলক্ষুনে। খোদাবখ্শ তার কাছে এসেছে বলেই তার আজ এত উন্নতি। তাই ওকে খুব সম্মানের চোখেই দেখতে লাগল সে।
খোদাবখ্শ লোকটাও পরিশ্রমী। বসে খাওয়া তার ধাতে সয় না। তাই একটা ফোটোগ্রাফারের সঙ্গে সে আলাপ করে নেয়। রেলস্টেশনের বাইরে বসে লোকটা মিনিট ক্যামেরায় ফোটো তুলত। তারই কাছে ফোটো তোলা শিখছে খোদাবখ্শ। সুলতানার কাছ থেকে ষাটটা টাকা নিয়ে একটা ক্যামেরাও কিনেছে। তার পর, জোগাড় করেছে একটা পর্দা, দুটো চেয়ার আর ছবি ধোয়ার সব জিনিসপত্তর।
কাজ ভালোই চলছিল। শেষে একদিন আম্বালা ফৌজি ক্যাম্পের ধারে তার দোকান উঠে এল। এখানে ছবি তুলত গোরারা। মাসখানেকের মধ্যেই অনেক কয়জনা গোরার সঙ্গেই তার আলাপ জমে উঠল। তাই সুলতানাকে সে নিয়ে এল সেখানে। খোদাবখশের মাধ্যমেই জনকয়েক গোরা নিয়মিত খদ্দের বনে গেল সুলতানার। তার আয়টাও আগের চাইতে বেড়ে গেল দ্বিগুণ।
কানের দুল আর সাড়ে পাঁচ তোলা ওজনের আটটা কাঁকন বানাল সুলতানা। দশ-পনেরোটা ভালো ভালো শাড়ি, ঘর-সাজানোর মতো ফার্নিচার– তা-ও এল। মোটকথা, আম্বালা ক্যাম্পের ওখানে আরাম-আয়াসের কোনওরকম ত্রুটিই ছিল না।
কিন্তু হঠাৎ করে খোদাবখ্শের মাথায় কী দুর্বুদ্ধি গজাল, দিল্লি আসতে চাইল সে। সুলতানাই-বা আপত্তি করে কেমন করে। খোদাবখ্শই যে তার জীবনের সকল উন্নতির মূলকথা। তাই সে খুশিমনেই রাজি হল দিল্লি আসতে। বরং সে ভাবল, এত বড় শহর– যেখানে কি না লাট সাহেবের বাস সেখানে ব্যবসা নিশ্চয় আরও ভালো জমবে। সখীদের মুখেও দিল্লির খুব প্রশংসা শুনেছে সে। তাছাড়া, দিল্লিতে নেজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগা-শরিফ, মনে-মনে যাঁর প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা। তাই ভারী জিনিসপত্তর বিক্রি করে দিয়ে খোদাবখ্শের সঙ্গে সুলতানা দিল্লি চলে এল।
দিল্লি এসে একটা ছোটমতো ফ্ল্যাট নিল বিশ টাকা ভাড়ায়। ওরা দুজনেই এখন এই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা।
একই ধরনের অনেক বাড়ির লম্বা একটা সারি রাস্তার ঘুরপাকের সঙ্গে তাল রেখে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে। মিউনিসিপ্যাল কমিটি বিশেষভাবে বেশ্যাদের জন্যই তৈরি করে দিয়েছে এগুলো। যেন শহরের যেখানে-সেখানে বিক্ষিপ্তভাবে এই নোংরামি প্রশ্রয় না পায়। নিচের তলায় দোকান, উপরে বাসোপযোগী ফ্ল্যাট।
সবগুলোরই ডিজাইন যেহেতু একইরকমের, তাই গোড়ার দিকে নিজের ফ্ল্যাটখানা খুঁজে বের করতে হিমশিম খেতে হয়েছে সুলতানাকে। কিন্তু লভিটায় নতুন সাইনবোর্ড লাগার পর থেকে নিজের ফ্ল্যাট খুঁজে বের করার একটা উপায় হয়েছে। ‘এখানে ময়লা কাপড় ধোলাই করা হয়’–এই সাইনবোর্ডখানা পড়ে তবে সুলতানা নিজের ফ্ল্যাট খুঁজে বের করে।
ফ্ল্যাট খুঁজে বের করার এমনি আরও অনেক চিহ্ন পাওয়া গেছে, যেমন বড় বড় হরফে লেখা– ‘কয়লার দোকান’, আর এখানেই থাকে তার অন্যতম সখী হিরাবাঈ। হিরাবাঈ মাঝে মাঝে রেডিওতে গান গায়। যেখানটায় লেখা রয়েছে, ‘এখানে ভদ্রমহোদয়গণের উৎকৃষ্ট থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা রহিয়াছে’– সেখানে থাকে তার অন্য সখী মুক্তা। ফিতার কারখানার উপরতলায় থাকে আনওয়ারি। এই কারখানারই মালিক শেঠজির সে ঝি। রাত্রে কারখানাটার ওপর নজর রাখতে হয় বলে শেঠজি আনওয়ারির কাছেই রাত্রিবাসের একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছেন।
এক মাস কেটে যাওয়ার পরেও যখন খদ্দের জোটে না, সুলতানা তখন নানা কথা বুঝিয়ে মনকে সান্ত্বনা দেয়। ভাবে, দোকান খোলার সঙ্গে সঙ্গেই কি আর খদ্দের জোটে! একটু সময় লাগবে বইকি। কিন্তু দেখতে দেখতে আরও এক মাস পেরিয়ে গেল। সুলতানার মনে তখন সংশয়ের কুজ্বটিকা।
একদিন সে বলল, ‘ব্যাপার কী বলো দেখি, খোদাবখ্শ! দু মাস হল আমরা এখানে বাসা বেঁধেছি। একটা মরা মাছিও তো মুখে বসল না। ধরে নিচ্ছি, বাজার আজকাল খুব খারাপ। তাই বলে পুরো দু মাসে একটাও খদ্দের জুটবে না!’
খোদাবখ্শও অনেকদিন থেকেই ব্যাপারটা ভাবছে। ভেবে কিছুই কূলকিনারা করতে পারেনি বলেই মৌন সে। কিন্তু এখন সুলতানা যখন নিজেই কথাটা পেড়ে বসেছে, তখন আর চুপ থাকা যায় না। বলল, ‘আমিও অনেকদিন থেকেই ভাবছি, সুলতানা। মনে হয়, যুদ্ধের হুজুগে পড়ে সবাই যার যার ভাবনাচিন্তায় ব্যস্ত; তাই এ-মুখো কেউ হতে চায় না। তাছাড়া, এমনও হতে পারে– ‘
কথা শেষ হওয়ার আগেই সিঁড়ি ভাঙার শব্দ ভেসে এল। সচকিত হয়ে উঠল ওরা দুজনেই। একটু পরেই কড়া নড়ে উঠল। খোদাবখ্শ লাফিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। ভেতরে ঢুকল একটি লোক। এই লোকটিই সুলতানার প্রথম খদ্দের। তিন টাকায় তার সঙ্গে ফয়সালা হয়েছে। এরপর এসেছে আরও পাঁচ জন। অর্থাৎ তিন মাসে ছজন। ছয়জনের কাছে সুলতানা পেয়েছে মাত্র সাড়ে আঠারো টাকা।
ফ্ল্যাটের ভাড়া মাসে বিশ টাকা। কিন্তু এছাড়াও খরচ রয়েছে। পানির ট্যাক্স, ইলেকট্রিক বিল, ঘর-সংসারের আরও অনেক টুকিটাকি খরচ। খাওয়া-দাওয়া, কাপড়-চোপড়, ওষুধ-পথ্য– এসব তো রয়েছেই। অথচ, আয় কিছুই নেই। তিন মাসে সাড়ে আঠারো টাকা এসে থাকলে তাকে কি আর আয় বলা যায়!
সুলতানার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। আম্বালায় তৈরি-করা সাড়ে পাঁচ তোলা ওজনের আটটা কাঁকন একে একে খসে গেল। সর্বশেষ কাঁকনটির পালা এলে বলেছিল, ‘আমার একটা কথা রাখবে? চলো, আমরা আবার আম্বালা ফিরে যাই। এখানে থেকে আর কী হবে, বলো? আমার আর মোটেও ভালো লাগছে না। ওখানে তোমার ব্যবসাটা বেশ চলছিল। যাগ গে, যা হবার হয়েছে। এখন আর এখানে থেকে কাজ নেই। এই কাঁকনটা বিক্রি করে দিয়ে এসো। জিনিসপত্তর আমি সব গুছিয়ে রাখছি। আজ রাত্রের গাড়িতেই রওনা হতে চাই।’
সুলতানার হাত থেকে কাঁকনটা নিয়ে খোদাবখ্শ বলল, ‘না, সুলতানা। আমরা আম্বালা ফিরে যাচ্ছিনে। দিল্লিতে থেকেই যা হোক কিছু একটা করতে হবে। দেখে নিও, তোমার সব কাঁকন আবার ফিরে আসবে। আল্লার ওপর ভরসা রেখো। তিনি সব করতে পারেন। আমাদের একটা ব্যবস্থাও নিশ্চয় তিনি করবেন।’
সুলতানা মৌন। এমনি করে শেষ কাঁকনটাও হাত থেকে চলে গেল। গয়নাহীন হাতটার দিকে তাকাতে গিয়ে তার দুঃখ হল খুব। কিন্তু উপায় কী। হাতের চাইতে পেটের পরিচর্যার ব্যবস্থাটাই আগে করতে হবে বইকি।
পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে। ব্যয়ের চেয়ে আয়ের পরিমাণ তখন আরও কমে এসেছে। সুলতানার এখন দুর্ভাবনার পরিসীমা নেই। খোদাবখ্শ এখন সারাদিনমান বাসামুখো হতে চায় না। সে জন্যও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সুলতানা। দু-তিনটি প্রতিবেশিনী অবশ্যি রয়েছে। ইচ্ছে করলেই তাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করা যায়। কিন্তু অষ্টপ্রহর তাদের কাছে গিয়ে বসে থাকাটা কেমন খারাপ লাগে তার। তাই আস্তে আস্তে তাদের সঙ্গে মেলামেশা একেবারেই বন্ধ করে দিতে হয়। সারাদিন নির্জন কামরায় বসে সে মুহূর্ত গোনে। একান্তই কিছু করার না থাকলে বসে বসে সুপুরি কাটে, নাহয় ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে। কখনও-বা বাইরের বারান্দায় রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে রেল-শেডের ইঞ্জিনগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা, উদ্দেশ্যহীনভাবে
রাস্তার অন্য পাশে মাল-গুদাম। এককোনা থেকে আর এককোনা পর্যন্ত বিস্তৃত। ডান দিকে লোহার ছাদের নিচে বিরাট বিরাট গাঁট সবসময়ই পড়ে থাকে। তাছাড়াও রয়েছে নানানরকমের মালপত্তর। বাঁ-দিকে খোলামাঠ। অসংখ্য রেললাইন সেখানে। রোদ পেয়ে রেলের পাটিগুলোকে চিকচিক করতে দেখলে সুলতানা শুধু শুধু নিজের হাতের দিকেও তাকিয়ে নেয় একবার। দেখে, কেমন করে লোহার পাটিগুলোর মতোই তার হাতের নীলচে শিরাগুলোও দাঁত বের করে রয়েছে। খোলা মাঠটার উপর দিয়ে ইঞ্জিন আর বগি হরদম চলছেই। কখনও আসছে, কখনও যাচ্ছে। ইঞ্জিন আর বগির ছিক্ছিক্, ঝিঁঝিক্ শব্দে এ অঞ্চলটা চব্বিশ ঘণ্টা মুখর।
সাতসকালে উঠে বারান্দায় এসে যখন সে দাঁড়ায়, তখন অদ্ভুত লাগে সামনের দৃশ্য। আবছা কুয়াশা ঠেলে ইঞ্জিন থেকে ভক্তক্ করে গাঢ় কালো ধোঁয়া বেরুতে থাকে। তার পর, আকাশটার দিকে মোটা মানুষের মতো হয়ে উঠতে থাকে একটু একটু করে। ইঞ্জিনের নিচের দিক থেকেও এমনি ধোঁয়া বেরোয়। কিন্তু সে ধোঁয়া মিলিয়ে যায় একনিমিষে। মাঝে মাঝে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গিয়ে দু-একটা বগিকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় ইঞ্জিন। তখন সুলতানার মনে হয়, তার অবস্থাও এমনি। কারা যেন তাকে জীবনের পাটিতে টেনে নিয়ে এসে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছে। এখন সে একা-একাই চলছে ঠিক ওই বগিগুলোর মতো। আর সেই ইঞ্জিনগুলো এখন কোথায়, কে জানে। তার পর হয়তো এমন একদিন আসবে, যখন একা-একা চলার এই খাপছাড়া গতি আস্তে আস্তে নিঃশেষিত হয়ে যাবে। হঠাৎ থেমে পড়বে সে। থামবে এমন এক জায়গায়, যেখানে তার ভালোমন্দ জানতে চাইবার মতো কেউই আর থাকবে না।
উদ্দেশ্যহীনভাবে এমনি ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা রেললাইনের দিকে তাকিয়ে থেকে সে শুধু চিন্তা করে। অবশ্যি চিন্তাটা মাঝে মাঝে অন্যদিকেও মোড় নেয়।
আম্বালা-ক্যাম্পে থাকার সময় একেবারে স্টেশনের কাছেই ছিল তার বাসা। কিন্তু রেললাইন, ইঞ্জিন কিংবা ট্রেনের বগি দেখে কখনও এসব ভাবনা তার মনে জাগেনি।
সুলতানা এখন মনে করে, এসব কথা ভাবা আর মাথাটাকে খারাপ করে ফেলা একই কথা। তাই, এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই এখন আর সুলতানা বারান্দায় দাঁড়ায় না। খোদাবখ্শকে সে কয়েকবারই বলেছে, ‘দ্যাখো, আমার ওপর একটু দয়া করো। দিনের বেলায় বাসায় থেকো। রুগীর মতো আর কতক্ষণই-বা একা একা পড়ে থাকি, বলো!’
কিন্তু নানা টালবাহানা করে সুলতানার প্রস্তাব এড়িয়ে গেছে খোদাবখ্শ। সে বলেছে, ‘বাইরে কিছু টাকাপয়সা রোজগারের ধান্দায় সারাদিন ঘুরছি। আল্লা চাহেন তো খুব শিগগিরই একটা হিল্লে লেগে যাবে, দেখো।’
পুরো পাঁচটি মাস গত হয়েছে। এ পর্যন্ত কারুরই হিল্লে লাগেনি– না সুলতানার, না খোদাবখ্শের।
মহরমের মাস এল বলে। কিন্তু কালো কাপড় কেনার মতো পয়সার একান্তই অভাব। মোখতার লেডি-হেমিল্টনের নতুন ডিজাইনের একটা কোর্তা বানিয়েছে। আস্তিন তার কালো জর্জেটের। তারই সঙ্গে খাপ-খাওয়ানোর মতো কালো সাটিনের শালওয়ারও রয়েছে তার কাছে। শালওয়ারখানা কালো কাজলের মতো চিক্মিক্ করে। আনওয়ারি কিনেছে রেশমি জর্জেটের বিরাট একটা সুন্দর ঝকঝকে কালো শাড়ি। সে বলেছে, শাড়ির নিচে পরবে ধপধপে সাদা পেটিকোট। এটা নাকি নতুন ফ্যাশান। এইসঙ্গে আনওয়ারি এনেছে কালো মখমলের একজোড়া নরম জুতো। এতকিছু দেখে সুলতানার মনে বিষাদের ক্লান্তি নেমেছে। মহরম উদযাপনের জন্য এত হরেকরকমের পোশাক খরিদ করার দুঃসাহস পোষণ করতেই পারে না সে।
আনওয়ারি আর মোখতারের কাছে এতসব পোশাকের সমারোহ দেখে বাসায় ফিরে সুলতানা ভাবতে বসে। মনে হয় যেন হৃৎপিণ্ডের মধ্যে ফোঁড়া গজিয়েছে একটা।
সারাটা বাসা আগের মতোই তেমনি নীরব। খোদাবখ্শও অভ্যেসমতো অনুপস্থিত। অনেকক্ষণ অবধি কোলবালিশটা মাথার নিচে দিয়ে শতরঞ্চির উপর সে শুয়ে ছিল। এমনি অনেকক্ষণ একইভাবে শুয়ে থাকায় ঘাড়ে যখন ব্যথা ধরল, তখন আস্তে আস্তে উঠে এসে বারান্দায় দাঁড়াল।
সামনে রেললাইনের উপর শূন্য বগিগুলো বোকার মতো দাঁড়িয়ে। একটাও ইঞ্জিন নেই। সন্ধে হয়-হয়। রাস্তায় একটু আগে পানি ছড়িয়ে গেছে। তাই ধুলো-ধোঁয়ার স্বল্পতা। রাস্তা দিয়ে যারা চলছে, তাদের অনেকেই এখন কাজকর্ম শেষ করে বাড়িমুখো। কিন্তু ওদেরই একজন হঠাৎ চলতে চলতে থমকে দাঁড়িয়ে সুলতানার দিকে ঘাড় উঁচু করে তাকাল। সুলতানা অভ্যেসমতো একবার ব্যবসায়ী-হাসির একটু আমেজ বুলিয়ে নিল ঠোঁটের কোনায়। তার পরই অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কারণ, সামনের লাইনে ততক্ষণে ইঞ্জিন এসে গেছে একটা। নিষ্পলক দৃষ্টিতে সে চেয়ে থাকে ইঞ্জিনটার দিকে। চিন্তা করে, ইঞ্জিনটাও কালো পোশাক পরে রয়েছে। মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। সাত-পাঁচ ভাবনার জঞ্জাল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সে আবার রাস্তার দিকে দৃষ্টি দিল। লোকটাকে তখনও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর মনে আশার আলো জ্বলে উঠল। লোকটি প্রলুব্ধ দৃষ্টিতে তার পানে তাকিয়ে রয়েছে। হাতের ইশারায় তাকে ডাক দিল সুলতানা। লোকটা এদিক-ওদিক একবার সতর্ক দৃষ্টি মেলে নরম করে বলল, ‘কোন্ দিক দিয়ে আসব?’
সুলতানা তাকে রাস্তা বাতলে দিল। একটু ইতস্তত করল সে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই চটপট করে এল উপরে।
শতরঞ্চির উপর তাকে বসতে বলল সুলতানা। বসে পড়ার পর কথাবলার সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই সুলতানা বলল, ‘কেন, আসতে ভয় করছিল নাকি নাগরের?
লোকটা হাসল। তার পর বলল, ‘তুমি কেমন করে বুঝলে? কই, না তো, ভয় করবে কেন?’
‘আমার তো তাই মনে হল। অনেক ভেবেচিন্তে তবে যেন উপরে এলে!’
ভুল বুঝেছ। তা না। আমি দেখছিলাম অন্যকিছু। দেখছিলাম, একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা লোককে কলা দেখাচ্ছে। দৃশ্যটা আমার বেশ ভালোই লাগছিল। একটু পরে বারান্দায় একটা সবুজ বাল্ব জ্বলে উঠল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তাই দেখলাম। সবুজ আলো আমার খুব ভালো লাগে।’
চারপাশে নজর বুলিয়ে লোকটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখছিল। তার পর, উঠে দাঁড়াল হঠাৎ।
সুলতানা জিগ্যেস করল, ‘যাচ্ছ নাকি?’
‘না। তোমার বাসাটা একটু দেখতে চাই। চলো তোমার কামরাগুলো আমাকে দেখিয়ে আনবে।’
সুলতানা ঘুরে ঘুরে তিনটি কামরায়ই দেখাল লোকটাকে। লোকটি চুপচাপ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখে আগের কামরায় আবার ফিরে এল। তার পর হঠাৎ করেই ঘোষণা করল, ‘আমার নাম শঙ্কর।‘
সুলতানা এই প্রথম ভালো করে শঙ্করের দিকে তাকাল। ওর হাবভাব কেমন যেন অদ্ভুত। মাঝারি গোছের শরীরখানা। মুখের আদল সাধারণ। কিন্তু অস্বাভাবিক উজ্জ্বল চোখদুটি। মাঝে মাঝে যেন অতিরিক্তরকম আলো ঠিকরে পড়ছে সে-চোখ থেকে। শক্ত-সমর্থ স্বাস্থ্যবান শরীর। কানের কাছে দু-চারটি চুলে পাক ধরেছে। পরনে ছাইরঙের গরম প্যান্ট। সাদা শার্ট। শার্টের কলার উপর দিকে উঠিয়ে রাখা।
শতরঞ্চির উপর বসে থাকার মধ্যে এমন একটা নিশ্চয়তা, যেন শঙ্করের বদলে সুলতানাই তার খদ্দের। ব্যবসায়ী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটা ক্ষতিকর মনে করে সুলতানা ভাবিত হয়ে উঠল। তাই শঙ্করকে সে বলল, ‘বলো, এখন কী করতে হবে?’
শঙ্কর এতক্ষণ বসেই ছিল, এখন শুয়ে পড়ল, ‘আমি কী বলব, তুমিই বলো না! তুমিই তো আমাকে ডেকেছ।’
সুলতানা অবাক হয়ে গেল কথা শুনে। মুখে তার রা সরল না।
তখন লোকটা আবার উঠে বসল, ‘বুঝেছি। তা হলে আমিই বলছি, শোনো। ধরো আমাদের দুজনের মধ্যেই ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে। তবে, আমার বেলায় অন্য কথা। যারা এখানে এসে কিছু দিয়ে যায়, আমি তাদের দলের নই। ডাক্তারদের মতো আমাকেও ফি দিতে হয়। একবার আমাকে ডেকে কাজ আদায় করে নিলে ফি আমাকে দিতেই হবে।
সুলতানা ঘাবড়ে গেল কথা শুনে। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই সামলে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘তুমি কী কাজ করো?’
শঙ্কর জবাব দিল, ‘তোমরা যা করো, তাই।’
‘কী কাজ সেটা?’
‘তুমি কী করো?’
‘আমি– আমি– আমি তো কিছুই করিনে।’
‘তা হলে আমিও কিছুই করিনে।’
‘এটা একটা কথা হল? একটা কিছু করো নিশ্চয়?’ ‘তুমিও কিছু-একটা করো নিশ্চয়।’
‘হায়-হায় করি।’
‘আমিও হায়-হায় করি।’
‘তা হলে এসো, আমরা দুজনেই এখন হায়-হায় করি।’
‘আমি প্রস্তুত। তবে হায়-হায় করার জন্যে আমি কখনও কাউকে দাম দিই না।’
‘মাথা খারাপ নাকি তোমার? এটা কি লঙ্গরখানা পেয়েছ?’
‘আর আমিও কিন্তু ভলান্টিয়ার নই।’
একটু থেমে সুলতানা বলল, ‘ভলান্টিয়ারটা আবার কী জিনিস?’
‘শুয়োরের ছা।’
‘আমিও তা হলে শুয়োরের ছা নই।’
‘কিন্তু তোমার সঙ্গে খোদাবখ্শ বলে যে লোকটা থাকে, সে নিশ্চয় শুয়োরের ছা।’
‘কেন?’
‘কারণ কয়েকদিন থেকে সে একটা ফকিরের কাছে যাচ্ছে ভাঙা কপালের দাওয়াই আনতে। অথচ সে ব্যাটার নিজের কপালই একেবারে মরচে ধরে যাচ্ছেতাই।’ শঙ্কর হাসল।
সুলতানা বলল, ‘তুমি হিন্দু। তাই আমাদের ফকির-দরবেশদের নিয়ে ঠাট্টা করতে পারছ।’
শঙ্কর আবার হাসল, ‘এখানে বসে হিন্দু-মুসলমানের প্রশ্ন ওঠানোর কোনও মানে হয় না। এটা পতিতালয়। এখানে ঠাকুর-পুরুত, ফকির-দরবেশ সবার মূল্যই সমান।’
‘ওসব বাজে কথা রাখো। থাকবে কি না তাই বলো।’
‘থাকব-না কেন! তবে আগে যা বলছি, সেই শর্তে।’
সুলতানা উঠে দাঁড়াল। দরোজার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘যাও, তবে পথ দ্যাখো!’
শঙ্কর নিশ্চিন্ত মনে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ল। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘প্রায়ই এই রাস্তায় আমাকে দেখতে পাবে। দরকার পড়লে ডেকো। বিশ্বাস করো, আমি খুব কাজের লোক। এতটুকু ফাঁকি পাবে না আমার কাছে।’
শঙ্কর চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার কথাই ভাবল সুলতানা। কালো পোশাকের কথা এখন সে ভুলেই গেছে।
সুলতানার মনের বোঝা অনেকখানি হালকা করে দিয়েছে শঙ্কর। শঙ্কর যদি আম্বালায় আসত, যে আম্বালায় তার সুখ-সমৃদ্ধির অন্ত ছিল না– তা হলে শঙ্করকে সে অন্যদৃষ্টিতে দেখত। কিন্তু এখানে অন্যরকম দিনকাল। এখানে শান্তি নামক পদার্থটি পলাতক। তাই শঙ্করের কথা তার খুব ভালো লেগে গেছে।
সন্ধ্যায় খোদাবখ্শ ফিরে এলে সে বলল, ‘আজকে সারাটা দিন কোথায় ছিলে?’
খোদাবখ্শ ক্লান্তিজড়িত কণ্ঠে জবাব দিল, ‘পুরনো কেল্লার কাছ থেকে আসছি। দিনকয়েক থেকে এক ফকির সেখানে এসে আস্তানা গেড়েছেন। তাঁর কাছে রোজই যাই।’
‘কিছু বলেছেন তিনি?’
‘না। এখনও তিনি মেহেরবানি করেননি। কিন্তু সুলতানা, তুমি দেখে নিও, আমার এত পরিশ্রম বিফল যাবে না। আল্লা চান তো নিশ্চয় সুফল ফলবে।’
কান্নায় ভেঙে পড়ে সুলতানা বলল, ‘সারাটা দিন তুমি পালিয়ে পালিয়ে থাকো, আর আমি থাকি খাঁচায় বন্দি হয়ে। একটুখানি নড়াচড়া করার জোটুকু পর্যন্ত নেই। মহরম এসে গেছে। আমার কালো কাপড়ের কথা কি তুমি একটিবার ভেবেছ? ঘরে একটি কানাকড়ি নেই। কাঁকন কটা একে একে বিক্রি করে দিলাম। তুমি বলো, এখন কী করব। এমনি করে ফকিরের পিছনে আর কতদিন ঘুরে ঘুরে মরবে? দিল্লি এসে অবধি আল্লাতালাও যেন আমাদের ওপর বিরূপ হলেন। আমার কথা শোনো। এক-আধটা ব্যবসা-ট্যাবসা করো। নইলে কেমন করে চলবে, বলো!’
খোদাবখ্শ শতরঞ্চির উপর ক্লান্ত শরীরটাকে বিছিয়ে দিয়ে বলল, ‘কিন্তু তার জন্যেও তো টাকা দরকার। আল্লার দোহাই, তুমি আর অমন করে কান্নাকাটি কোরো না। আমি আর সহ্য করতে পারছিনে। আম্বালা ছেড়ে এসে সত্যিই বড় ভুল করেছি। কিন্তু আল্লার ওপর ভরসা রেখো। তিনি যা করেন, ভালোর জন্যেই করেন। হয়তো আর কিছুদিন কষ্ট করার পরই –‘
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সুলতানা বলল, ‘যাই হোক, একটা কিছু করো! চুরি করে হোক, ডাকাতি করে হোক– আমার জন্যে শালওয়ারের কাপড় কিছুটা এনে দাও। আমার কাছে সাদা কোর্তা আছে একটা। ওটায় কালো রঙ দিয়ে নিলেই হবে। সাদা একটা ওড়নাও রয়েছে। সেই-যে দীপালির দিন এনে দিয়েছিলে। কোর্তার সঙ্গে সেটাও রাঙিয়ে নিলেই চলবে। শুধু একটা শালওয়ারেরই যা অভাব। যেমন করেই পারো জোগাড় করো! আমার জানের কসম, শালওয়ার একটা এনে দাও!’
খোদাবখ্শ উঠে বলল, ‘তুমি শুধুশুধু বিরক্ত করছ। কোত্থেকে আনব বলো? বিষ কিনবার পয়সাও যে এখন আমার কাছে নেই।’
‘তা আমি জানি না। যেখান থেকে হোক, যেমন করে হোক, সাড়ে চার গজ কালো কাপড় আমার চাই।’
‘দোয়া করো, আজ রাত্রেই যেন দু-তিনটি খদ্দের জুটে যায়।
‘তার মানে তুমি কিছুই করতে চাও না। তাই না? অথচ, ইচ্ছে করলে এ-কাজ তুমি সহজেই করতে পারো। কতই-বা আর লাগত! যুদ্ধের আগে বারো আনা ছিল সার্টিনের গজ। এখন বড়জোর পাঁচ সিকে। সাড়ে চার গজ কাপড়ে এমন আর কী বেশি খরচ পড়বে! ত
‘আচ্ছা, দেখছি চেষ্টা করে।’ খোদাবখ্শ উঠে পড়ল, ‘এখন আর মনখারাপ কোরো না। আমি চট করে হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আসছি।’
হোটেল থেকে খাবার এনে দুজনে তাই গিলল কোনওরকমে। তার পর শুয়ে পড়ল।
সকালবেলায় বিছানা থেকে উঠে খোদাবখ্শ রওনা দিল পুরনো কেল্লার দিকে। সুলতানা একলা পড়ে থাকল বিছানায়। কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে আইঢাই করল, কিছুক্ষণ ঘুমাল, কিছুক্ষণ উঠে টহল দিল ইতস্তত।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে কোর্তা আর ওড়নাটা নিয়ে নিচে দিয়ে এল লন্ড্রিতে। ধোলাই ছাড়া কাপড়-রাঙানোর কাজও হয় সেখানে। তার পর ঘরে ফিরে এসে সুলতানা ফিল্মের পত্রিকা পড়তে লাগল। ইতঃপূর্বেই সে দেখেছে, এমন ছবির কাহিনি আর গান রয়েছে তাতে। পড়তে পড়তে আবার ঘুম এল তার। চারটে বাজলে তবে ঘুম ভাঙল। গোসলটা সেরে নিয়ে, একটা গরম চাদর গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। প্রায় এক ঘণ্টা এমনি করে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকল সে।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রাস্তায় আর দোকানে আলো জ্বলেছে। জৌলুশ চারদিকে। একটু একটু শীত পড়েছে। কিন্তু সুলতানার তেমন খারাপ লাগছে না শীতটা। রাস্তায় পায়েহাঁটা লোকজন আর গাড়ি-ঘোড়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। হঠাৎ শঙ্করকে দেখতে পেয়ে সে চমকে উঠল। রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে তেমনি সুলতানার দিকে তাকিয়ে সে হাসছে। সুলতানা অজ্ঞাতসারে হাতটা একবার নাড়ল। শঙ্কর উপরে এসে গেলে সুলতানা চিন্তিত হয়ে পড়ল। কোন্ কথাটা বলবে তার সঙ্গে– চিন্তা এই সমস্যা নিয়ে।
অথচ, সে তাকে ডাকতে চায়নি। শুধুশুধু হাতছানি দেওয়ার কী এমন দরকারটা ছিল!
ওদিকে শঙ্কর নিতান্ত নিশ্চিন্ত। এটা যেন তারই নিজের বাড়ি। প্রথমদিনের মতোই আজও সে কোলবালিশটা মাথার নিচে রেখে শুয়ে পড়ল। নিশ্চিন্ত মনে।
সুলতানাকে কিছুই বলতে না দেখে শঙ্কর নিজেই কথা পাড়ল, ‘হাজার বার এমনি করে তুমি আমায় ডাকতে পারো, আবার হাজার বার ফিরিয়েও দিতে পারো– আমি কিছুই মনে করব না।‘
সুলতানা দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘না, বোসো। আজকে আর আমি তোমাকে ফিরে যেতে বলব না।’
মুখের মধ্যে স্বভাবসিদ্ধ হাসি ফুটিয়ে শঙ্কর বলল, ‘তা হলে আমার শর্ত তুমি মেনে নিচ্ছ বলে মনে করতে পারি।’
সুলতানা হাসল, ‘কিসের শর্ত? কোন্ শর্ত? আমাকে তুমি বিয়ে করতে চাও নাকি?’
‘বিয়ে? কী যে বলো! আমরা কি আর বিয়ে করার লোক! বিয়ে কি আর আমাদের পোষায়! বাদ দাও যতসব বাজে কথা। এখন কিছু কাজের কথা হোক।’
‘তুমিই বলো-না, কী বলব।’
‘তুমি মেয়েমানুষ। এমন কিছু বলো, যাতে মনে একটু ফুর্তি পাই। এই দুনিয়ায় ব্যবসায়ী কথাটাই সবকথা নয়। ব্যবসা ছাড়াও আরও অনেককিছুই রয়েছে বলবার মতো, শুনবার মতো।’
এমন কথা সুলতানা আর কখনও শোনেনি। তাই শঙ্করকে খুব ভালো লেগে যায় তার। সে বলল, ‘আমার কাছে কী চাও তুমি?’
‘সবাই যা চায়, তাই। তার চাইতে বেশি কিছু না।’ শঙ্কর উঠে বসল।
‘তা হলে আর পাঁচজনের সঙ্গে তোমার তফাতটা কোথায়?’
‘অনেক অনেক তফাত –আকাশের সঙ্গে পাতালের যেমন তফাত। তবে, তোমার-আমার মধ্যে কোনও তফাত নেই। তাছাড়া, এমন অনেক কথা আছে, যা বোঝানো যায় না, নিজের থেকেই বুঝে নিতে হয়।’
সুলতানা কিছুক্ষণ চিন্তা করল শঙ্করের কথাটা। তার পর না-বুঝেই বলল, ‘আমি বুঝেছি। ‘
‘তা হলে বলো, এখন কী করতে চাও।’ শঙ্কর উঠে দাঁড়াল। এমনি শুধুশুধু হাসতে থাকল সে। তার পর আবার বলল, ‘আমার নাম শঙ্কর! ভারি অদ্ভুত নাম, তাই না? এসো, ভিতরে যাই।’
শঙ্কর আর সুলতানা শতরঞ্চি-বিছানো কামরাটায় এসে ঢুকল। ওরা দুজনেই হাসছে। কে জানে, কিসের এই কলকণ্ঠ হাসি।…
.
শঙ্কর যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এমন সময় সুলতানা বলল, ‘শঙ্কর, আমার একটা কথা রাখবে?’
শঙ্কর বলল, ‘কথাটাই আগে শুনি।’
‘তুমি হয়তো ভাববে, আমি দাম উশুল করতে চাই। কিন্তু–’
‘বলোই-না, থামলে কেন?’
–তুমি তো জানোই, মহরম এসে গেছে। কিন্তু আমার কাছে এমন পয়সা নেই যে, একটা কালো শালওয়ার তৈরি করতে পারি। আমার পানে কেউ তো মুখ তুলে চাইল না। একটা কোর্তা আর ওড়না ছিল, তাই রঙ করতে দিয়েছি।’
‘মানে, তুমি বলতে চাও, আমার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে শালওয়ার তৈরি করবে, তাই না?’
সুলতানা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘না, না, আমি তা বলতে যাব কেন? সম্ভব হলে তুমিই একটা শালওয়ার যদি এনে দিতে!’
শঙ্কর হাসল, ‘আমার পকেটে পয়সা-কড়ি খুব কমই থাকে। তবু চেষ্টা করব। মহরমের পয়লা তারিখে শালওয়ার পেয়ে যাবে। কেমন, এখন খুশি তো?’
সুলতানার দুলদুটির দিকে তাকিয়ে সে আবার বলল, ‘দুলদুটি আমাকে দিতে পারো, সুলতানা?’
‘এ নিয়ে তুমি কী করবে? চাঁদির মামুলি দুল বৈ তো আর না। বড়জোর টাকা পাঁচেক দাম।’
‘আমি তো তোমার কাছে দুলদুটোই চেয়েছি। দাম শুধোইনি। বলো, দেবে?’
‘এই নাও।’ দুল খুলে শঙ্করকে দিয়ে দিল সুলতানা। দুলদুটি চলে যাওয়ায় মনে-মনে দুঃখ হল তার। কিন্তু শঙ্কর এতক্ষণে চলে গেছে সেখান থেকে।
সুলতানা আদৌ ভাবতে পারেনি, শঙ্কর তার কথা রাখবে। আট দিন পরে, মহরমের ঠিক এক তারিখে, সকাল ন’টায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে সুলতানা দরজা খুলে দেখল, শঙ্কর।
খবরের কাগজের মোড়কটা সুলতানার হাতে তুলে দিয়ে শঙ্কর বলল, ‘সার্টিনের শালওয়ার। এক-আধটু লম্বা হতে পারে। এখন তা হলে চলি, কেমন?
যেমন তাড়াতাড়ি আসা, তেমনি চলে যাওয়া। প্যান্টের ভাঁজ ভেঙে গেছে অনেক জায়গায়। চুলগুলো এলোমেলো ছড়ানো। যেন এখনই বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছে সে। সুলতানা মোড়কটা খুলে ফেলল। সার্টিনের কালো শালওয়ার। আনওয়ারির কাছে যেমনটি দেখে এসেছে।
শঙ্করের কাছে ব্যবসায়ী পরাজয়ের কথা, দুল হারানোর কথা একনিমিষে সে ভুলে গেল। শালওয়ারটা পেয়ে আর শঙ্করের প্রতিশ্রুতি রক্ষা দেখে সুলতানা ভুলে গেল সমস্ত দুঃখ-বেদনার কথা।
দুপুরবেলায় লন্ড্রি থেকে নিয়ে এল রাঙানো কোর্তা আর ওড়নাখানা। কোর্তা, ওড়না, শালওয়ার পরে সবে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় দরজায় আবার খট খট শব্দ।
আনওয়ারি ভেতরে ঢুকে কাপড় তিনটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কোর্তা আর ওড়নাখানা তো রঙ করিয়েছ। কিন্তু শালওয়ারটা দেখছি নতুন। কবে বানালে?’
সুলতানা বলল, ‘আজ সকালেই দিয়ে গেল দরজি।’ আনওয়ারির কানের ওপর চোখ পড়তেই সে আবার বলল, ‘দুলজোড়া কোথায় পেলে?’
আনওয়ারি বলল, ‘আজই আনিয়েছি।’
তার পর, সুলতানা আর আনওয়ারি–দুজনেই চুপ মেরে গেল কিছুক্ষণের জন্য।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
আত্মীয় – গোলাম মোহাম্মদ
রূপসা নদীর ওই পারে নতুন নতুন বাড়ি উঠছে। নারিকেল, খেজুর, সুপারিগাছ– যারা এতদিন আত্মীয়ের মতো জড়াজড়ি করে ছিল, তারা আর নেই। নতুন বাড়ি আরও অনেক তৈরি হচ্ছে। এখানে-সেখানে ইঁটের পাঁজা। শিক আর গৃহনির্মাণের অন্যান্য সামগ্রী স্তূপাকারে পড়ে রয়েছে। কোথাও কোথাও বড় বড় ক্রেনে কাজ চলছে।
পরিবর্তন হয়নি শুধু গোলাকার পাকা চত্বরের কাছের ওই বটগাছটার। ওর অসংখ্য ঝুরি মাটি ফুঁড়ে কাণ্ডে পরিণত হয়েছে। মাটির সঙ্গে ওদের বহুকালের আত্মীয়তা এখনও অটুট রয়েছে আগের মতোই। রশিদের দাদা বলতেন, অমুক সনে তাঁরা যখন আজমগড় থেকে এখানে এসে বসতি করেছিলেন, তখন বটগাছটার উঠতি বয়েস।
রূপসা নদীর সঙ্গে রশিদের আশৈশবের পরিচয়। এখনও এই নদীর পানিতে ঢেউ ওঠে। এখনও এ নদীর বুকে যৌবনের উন্মাদনা। নদীর এই পারে নতুন তিনটা ঘাট হয়েছে বটে, কিন্তু মাঝিরা আগের মতোই উচ্চসুরে গলা চড়িয়ে ভাটিয়ালি গায়, জেলেরা মাছ ধরে।
কতদিন আগের কথা! রশিদ দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল। রূপসাকে কতকাল দেখা হয়নি। এই রূপসার পানিতে সে কত ডুব দিয়েছে, সাঁতার কেটেছে। আহা, এই রূপসা তার জননীর মতো। রূপসার দুই কূলের মাটি তার গায়ের সঙ্গে মিশে রয়েছে। এই মাটি ছেড়ে সে পূর্বপাকিস্তানের কত জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে। এ মাটি তাকে আর চিনতে পারবে না। রশিদের দু গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
নতুন নতুন বাড়ি উঠেছে। এইসব বাড়ি এখানকার চেহারাই পাল্টে দিয়েছে। আরও অনেক নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। এখানে-সেখানে ইটের পাঁজা। লোহার শিক আর অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী স্তূপাকারে পড়ে রয়েছে। আত্মীয়ের মতো জড়াজড়ি করে ছিল যেসব নারিকেল, খেজুর, সুপারিগাছ, তারা আর নেই। রয়েছে শুধু পুরনো বটগাছটা, যার অসংখ্য ঝুরি মাটি ফুঁড়ে কাণ্ডে পরিণত হয়েছে। এই বটগাছ না থাকলে জায়গাটা চেনাই দায় ছিল।
রাস্তাগুলো আগের মতোই এখনও কাঁচা। এই রাস্তা দিয়ে কত ছুটোছুটি করেছে রশিদ। ছুটতে ছুটতে এক রাস্তার শেষ মাথায় ছিল পেয়ারাগাছ। সে গাছের গন্ধ যেন এখনও তার নাকের সঙ্গে সেঁটে রয়েছে। অনেকদিন বাড়ি থেকে রাগ করে সে পালিয়ে গেছে। পালিয়ে গিয়ে বসে থেকেছে ওই পেয়ারাগাছের ডালে। বাবা তাকে খুঁজতে খুঁজতে এসে গেছেন পেয়ারাগাছ পর্যন্ত। বলেছেন, ‘খুলনা যাবা না? নামো, নামো, তাড়াতাড়ি করো।
মনে পড়ছে, ওই রাস্তাতেই খেজুরগাছে মাটির হাঁড়ি বাঁধা থাকত। শীতের সন্ধ্যায় খেলতে খেলতে ওরা সবাই মিলে ছিটকেল দিয়ে হাতের তাক ঠিক করত। কে আগে ভাঙতে পারে রসের হাঁড়ি। বেশির ভাগসময় রশিদই জয়ী হত। হাঁড়ি ভাঙতে পারলে টপটপ করে রস পড়ত। আর, তাই ওরা খেত আকাশপানে মুখ উঁচিয়ে, জিভ বের করে।
ওরা সব কোথায় গেল, কে জানে। হয়তো দেখা পেয়ে যাবে, হয়তো পাবে না। আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল রশিদ। ওই-যে তাদের সেই পুরনো স্কুল। আর একটু এগিয়ে গেলে পড়বে তার বাপ-দাদার ভিটেবাড়ি।
আহা, সেই বাড়ির এই অবস্থা! দেখলে বুক ফেটে যায়। এই বাড়ির জন্যই চাচা ঝগড়া করে লাহোর চলে গিয়েছিলেন। তিনি একাই দাদার সমস্ত সম্পত্তি হাতাতে চেয়েছিলেন। বাবা চুপ থাকতেন, কিছুই বলতেন না। কিন্তু চাচা তবু ঝগড়া বাধাতেন। বাবা বলেছিলেন, এ সম্পত্তিতে তাঁর কোনও লোভ নেই। তিনি সব সম্পত্তি চাচাকে ছেড়ে দিতে পারেন। কিন্তু রহিমা ফুফু বিধবা। তাঁকে বঞ্চিত করা কিছুতেই উচিত হবে না। তার পর চাচা লাহোরে থাকতে থাকতেই রহিমা ফুফু মারা গেলেন। বাবা ছিলেন রেলের ইঞ্জিনিয়ার। রূপসা থেকে তিনি বদলি করিয়ে নিলেন। বহু কষ্টে চাচার ঠিকানা জোগাড় করে লিখলেন: তুমি যদি এই বাড়ি চাও তো রূপসা ফিরে এসো। আমি চলে যাচ্ছি। আমার সমস্ত সম্পত্তি তোমার জন্য ওয়াজেদ আলীর কাছে রেখে গেলাম।
তার পর, ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে। রশিদ জানে না, কী হয়েছে। বাবা আর কোনওদিন ফিরে আসেননি। তিনি কোনওদিন কারও কাছে খোঁজ নেওয়ারও চেষ্টা করেননি।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল রশিদ। আগে এ-বাড়িতে কত লোকজন থাকত, আর এখন একেবারে ফাঁকা ফাঁকা। দরজায় মাড়সার জাল। বোঝা গেল, এ-বাড়িতে লোকজনের যাতায়াত কম। মাথা থেকে মাকড়সার জাল ছাড়াতে ছাড়াতে এগিয়ে গেল আরও কিছুদূর। উড়ে পালাল একটা চামচিকে। দেয়ালের আস্তর খসে গেছে। ফাটল থেকে গজিয়ে উঠেছে পাকুড়গাছ। উঠোনে কয়েকটা গরু বাঁধা। একজন লোক দুধ দোয়াচ্ছিল। বলে, ‘কেডা?’
কী পরিচয় রশিদের, কেমন করে সে জানাবে। বলবে নাকি, আমি পাথর। আমি শিলায়িত ইতিহাসের জঞ্জাল। তুমি আমাকে চিনবে না। আমাকে চেনে ওই বুড়ো বটগাছ। আমাকে চেনে রূপসা নদী। আমার পরিচয় রূপসার দুই কূলের মাটিতে। সে মাটির সোঁদা গন্ধ এখনও আমার শরীরের পরতে পরতে মিশে রয়েছে। সেই মাটিতে একদিন আমার শেকড় ছিল। শেকড় ছিঁড়ে গেছে। মাটির সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্ক যার বিচ্ছিন্ন, সে মৃত। আমি মরে গেছি। আমি শিলায়িত প্রস্তর। আমি ইতিহাসের জঞ্জাল।
হাঁটতে হাঁটতে আবার ফিরে এল রূপসা নদীর ধারে। শহরে শহরে এতদিন সে ঘুরে বেড়িয়েছে। এখানে সে আগন্তুক। এখানকার মানুষ নয় শুধু– এখানকার ধান, পাট, গুল্মলতারাও হয়তো তাকে চেনে না। এখানকার মাঝি-মাল্লার গলায় ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া কতদিন শোনা হয়নি। সে আগন্তুক। এখানকার বাতাসও হয়তো তাকে আর চিনবে না।
অথচ, এখানকার মাটি আর বাতাসের টানেই সে চলে এসেছে। খুলনা এসেছিল সরকারি কাজে। কাজ ফুরোলে রোববারের সকালে নৌকায় করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। রূপসা নদী সোজা এখানে টেনে আনল তাকে। বাপ-দাদার ভিটেমাটি দেখার তার বড় সাধ।
ডাকবাংলোর কাছে পুকুর। সেই পুকুরের ধারে গিয়ে রশিদ বসল। পানিতে ঢিল ফেলল। একইরকম পরিচিত ঢেউয়ের বৃত্ত উঠল, মিলিয়ে গেল।
কারও সঙ্গে দেখা হল না। কোথায় তারা, কে জানে। ফটিক, মানিক, জামাল, রবিউল, পার্বতী। ছোটবেলায় কত তারা একসঙ্গে খেলেছে। ঝগড়া করেছে। পেয়ারাগাছের ডাল ধরে ঝুলেছে। গাছের ডালে বসে কাঁচা কাঁচা পেয়ারা চিবিয়েছে। পার্বতীর যখন সাত বছর বয়েস, তখন তার বাবা বদলি হয়ে গেলেন শান্তিপুর। তার কয়েক বছর পরে দেশ স্বাধীন হল। পার্বতীরা এখন হয়তো ভারতের বাসিন্দা।
ছাব্বিশ বছর পর্যটনের পর আজ এই অবস্থা। ঢাকাতেও ছিল। কিন্তু ঢাকা তার ভালো লাগেনি। ঢাকা যেন ব্যাধিগ্রস্ত। বেদনায় কুঁকড়ে যাওয়া শহর।
বেদনায় কুঁকড়ে গেল রশিদও।
বটগাছের পাতার মতো তার অস্তিত্ব। পাতা ঝরে গেলে তার কথা কেউ মনে রাখে না। বাতাসের ঝাঁপটায় সে এখন পাতার মতোই উড়ে বেড়াচ্ছে।
হাঁটতে হাঁটতে বটতলায় এসে দাঁড়াল রশিদ। আহা, এ গাছের ছায়ায় দাঁড়ালে সমস্ত দুঃখ ধুয়ে মুছে যায়। নাপিত চুল কাটছে। জ্যোতিষী তার পুরনো, ময়লা পুঁথি খুলে বসে রয়েছে ভাগ্যসন্ধানীর অপেক্ষায়। রশিদ তাদের মধ্যে গিয়ে বসে পড়ল।
নাপিতের কাঁচি আর মুখ একসঙ্গে চলছে দ্রুতগতিতে। রাজ্যের যত কথা তার পেট থেকে বেরুচ্ছে। ওদিকে জ্যোতিষীর কথায় ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। কেউ কেউ বটগাছের গুঁড়িতে মাথা রেখে শুয়ে রয়েছে। দুপুরের রোদ প্রচণ্ড উত্তাপ ছড়াচ্ছে। আস্ত জিভটা বের করে দিয়ে হাঁপাচ্ছে একটা কুকুর। বটগাছের নিচে ঠাণ্ডা হাওয়া।
নাপিত বলল, ‘রূপসা নদীর ওপরে একটা পুল হচ্ছে।’
‘হুঁহ্!’ জ্যোতিষীর সংক্ষিপ্ত উত্তর।
‘এঞ্জিনিয়ার আইচিল– নদীর পানি মাপে গেচে।’
‘হ্যাঁ, শুনেছি। খুব শিগগির এই গ্রাম একটা শহর হয়ি যাচ্চে।’
‘এখানে বড় বড় দালান উঠপে।’
‘এখানের রাস্তায় হরদম ভোঁ-ভোঁ মটরগাড়ি চলবে।’
‘শুনেচ কিছু, এখানে নাকি একটা বড় কারখানা হচ্চে?’
‘কোথায়?’ প্রশ্ন করল রশিদ।
নাপিত বলল, ‘তুমি যেখানে বসে রয়েচ।’
‘আর এই বটগাছটা?’
নাপিত বড় নিশ্চিন্ত মনে বলল, ‘বটগাচ? কত বটগাচ কাটা হয়ি গেল। আর এটা কাটা পড়লি কি আর মহাভারত অশুদ্ধ হয়ি যাচ্চে!’
মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে! কী আশ্চর্য! রশিদ ভাবতে লাগল, তার তিনপুরুষের এই বটগাছের শেকড়ও তা হলে নড়বে! রূপসার সঙ্গে তার সম্পর্ক চুকেছে। আত্মীয় নেই, জন নেই– ছিল একমাত্র এই বটগাছ, যে তাকে চিনতে পেরেছে, সুশীতল কোলে দিয়েছে ঠাঁই, সে-ও থাকবে না।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
জুয়াড়ি – গোলাম আব্বাস
পুলিশ এত সাবধানে হানা দিয়েছিল যে, তাদের একজনও পালাতে পারল না। পালাবে কোন্ দিকে? আড্ডায় যাওয়ার একটাই সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি পুলিশ আগে থেকেই দখল করে বসেছিল। বাকি থাকে জানালা। কোনও বাহাদুর জানের পরোয়া না-করে যদি জানালা দিয়ে লাফিয়েও পড়ত, তা হলে প্রথমত, তার হাঁটু আস্ত থাকত না; আর যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, বেশি চোট সে পেল না, তা হলেও পালাবার সুযোগ সে পেত না; কারণ আধ ডজন পুলিশের সিপাই নিচেই বাজারে আড্ডার ঘরটিকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল। অতএব, তারা সব-কজন জুয়াড়ি, সংখ্যায় দশজন — ধরা পড়ে গেল।
ঘটনাক্রমে, সেদিন যেসব জুয়াড়ি আড্ডায় এসেছিল, তাদের মধ্যে দু-একজন পেশাদার জুয়াড়ি বাদে বাকি সবাই কখনও-সখনওর শখের খেলুড়ে। এমনিতে তারা সম্মানি আর অবস্থাপন্ন লোক। তাদের মধ্যে একজন ছিল কন্ট্রাক্টর, একজন সরকারি কর্মচারী, একজন মহাজনের ছেলে, একজন লরি-ড্রাইভার, আর একজন চামড়ার কারবারি।
তাদের মধ্যে দু জন নির্দোষ লোকও ছিল। একজন হচ্ছে মনসুখ পানঅলা। সে কদাচিৎ খেলত বটে, কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় সে ওখানে খেলার উদ্দেশ্য নিয়ে যায়নি আদৌ। দোকানে এক বন্ধুকে বসিয়ে রেখে সে দশটাকার নোটের ভাংতি নিতে এসেছিল। ভাংতি নেওয়া হয়ে গিয়েছিল, তার পর সে চলেও যাচ্ছিল, এমন সময় এক খেলুড়ের পাতির ওপর তার নজর গিয়ে পড়ল। সেই পাতি ছিল অসম্ভবরকমের ভালো। সেই খেলুড়ে কী চাল চালে, তাই দেখার জন্যে সে সামান্য একটু দাঁড়িয়েছিল, আর তখনই পুলিশ এসে হাজির। ব্যস্, আর যায় কোথায়।
অন্যজন এক বৃদ্ধ দলিল-লেখক। সে কন্ট্রাক্টরকে খুঁজতে খুঁজতে আড্ডা পর্যন্ত এসে হাজির। কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে তার অনেক দিনের পরিচয়। সে চাইছিল, কন্ট্রাক্টর তার ছেলেকেও একটা কোনও ছোটখাটো কন্ট্রাক্টারির কাজ জুটিয়ে দিক। দলিল-লেখক কন্ট্রাক্টারকে কদিন থেকে এমন জায়গা নেই, যেখানে খোঁজ করেনি। শেষে যদি তাকে পেল তো এমন জায়গায় যে, সেখানে খেলার মধ্যে না তার সামান্য ফুরসত ছিল, না এত লোকের সামনে মনের কথা খুলে বলার উপায় ছিল। কন্ট্রাক্টর খেলায় একেবারে মশগুল। আর দলিল-লেখক ভাবছিল, আহা, যদি এখন এই খেলা একটুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যায় আর বাকি সবাই উঠে একটু বাইরে চলে যায়! কিন্তু তেমন কোনও সম্ভাবনা সে দেখতে পেল না। আর, ওদিকে কন্ট্রাক্টরও খেলেই চলেছে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা ধরে। শেষে দলিল-লেখক নিরাশ হয়ে চলে যাওয়ার কথাই ভাবছিল। এমন সময় পুলিশ এসে জুয়াড়িদের সঙ্গে তাকেও ধরে নিয়ে গেল।
ওই দু জন নির্দোষ হওয়ার পক্ষে বহু প্রমাণ উপস্থিত করল, কিন্তু কোনও কথাই শুনল না পুলিশ। বাকি সবাই পুলিশের এই আকস্মিক হানায় এমন হতভম্ব হয়ে পড়ল যে, কারও মুখ থেকে একটা রা সরল না। সিপাইরা আগে খুব সাবধানে সবাইকে আড্ডা থেকে নিচে নামাল। তার পর তাদের চারদিকে দেখে পাহারা দিয়ে পায়ে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল থানায়।
অবশ্য, ভাগ্য ভালো, তখন বেশ রাত হয়েছে। কুয়াশার জন্য বেশি লোকের নজর তাদের ওপর পড়েনি। আর, এরা কোটের কলার বা পাগড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে দ্রুত পা চালিয়ে অল্পসময়ে থানায় গিয়ে উঠল। সেখানে দারোগা সাহেবের নির্দেশে সবাইকে বন্ধ করে রাখা হল গারদে।
গারদের নির্জনতায় যখন তারা মজা-দেখা মানুষের বিদ্রূপভরা চোখ, সিপাইদের কড়া দৃষ্টি আর কঠোর ধমক থেকে রেহাই পেল, আর চেনাজানা মানুষের চোখে চোখ পড়ে যাওয়ার ভয় থাকল না, তখন সবার আগে তাদের সবার মনোযোগ আড্ডার মালিকের ওপর গিয়ে পড়ল। সে-ও সবার সঙ্গে গারদে আটকা পড়েছে। প্রত্যেকে তাকেই সর্বনাশের হেতু বলে মনে করতে লাগল। তাই, যত রাগ গিয়ে পড়ল তার ওপর। এই লোকটা যদি সতর্ক থাকত, তার ঘরটাকে অমন হাট করে না-রাখত, জানা নেই শোনা নেই, একে-ওকে-তাকে ঢুকতে না-দিত, আড্ডার বাইরে একজনকে নজর রাখার জন্য বসিয়ে রাখত, তাছাড়া পুলিশের লোকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখত, তা হলে তাদের আজ পড়তে হত না এই কঠিন দুর্দশার মুখে।
আড্ডার মালিকের নাম যে কী ছিল, আল্লাই জানেন। সবাই তাকে ‘নিক্কো’ বলে ডাকে। মাঝারি লম্বা, ক্ষীণ শরীর। বড় বড় চোখে সুর্মা টানা। ছোট ছোট পাকা গোঁফ। মুখে বসন্তের আধো-আধো দাগ। অতিরিক্ত পান খাওয়ার ফলে দাঁত কাঁচে লাল। কোঁকড়া চুল সবসময় আমলা তেলে চোবানো। বাঁ-দিকে টেরি কাটা, ডানদিকের চুল কপালে ভিড় জমানো। গায়ে মখমলের কোর্তা, তাতে সোনার বোতাম। গলায় ছোট একটি সোনার তাবিজ–কালো ডোরে ঝোলানো। তার গায়ের কোর্তা প্রায়শ পরিষ্কারই থাকে, কিন্তু ধুতি থাকে ময়লা, শীতকালে এই পোশাকের উপর থাকে জরি-পাড়ের পুরনো এক লাল দোশালা। তার চলনে-বলনে হুলোবেড়ালের ফুর্তি। একজন পুরনো ঘাগু জুয়াড়ি যতটুকু সময়ে একবার তাস ফেঁটে বেঁটে দিতে পারে, সেই সময়ে সে অন্তত দুবার তাস ফাঁটা-বাঁটা শেষ করে।
এই হানার জন্য নিক্কো আগে থেকেই তৈরি ছিল। পুলিশের হানা দেওয়ার সময় থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত সে দুই ঠোঁট এক করে চুপ মেরে ছিল। এতবড় ঝক্কি-ঝামেলায় তার আচরণ যেন একটা তৃতীয় ব্যক্তির সমান। কিন্তু এবার যখন চারদিক থেকে তার ওপর তীব্রদৃষ্টির আক্রমণ শুরু হল, তখন সে নড়েচড়ে বসে যেন আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে নীরবে একটি মধুর হাসি ছাড়ল। সেই হাসির মধ্যে যেন কিছু গোপন কৌতুক লুকিয়ে রয়েছে। সেই হাসি তার ঠোঁটে লেগে থাকল অনেকক্ষণ ধরে। সে ধীরে-সুস্থে নিশ্চিন্তভাবে সবার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। তার পর গভীর আত্মবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘আপনারা একদম চিন্তা করবেন না। আমি আপনাদের একেবারে ঠিক কথাটি বলছি, আপনাদের মাথার একটি চুলও খসা যাবে না। আমার ওখানে গত পাঁচবছরে এমন কাণ্ড আর কখনও হয়নি। কী বলে, আপনারা এটাকে ঠাট্টা ধরে নিন গো বাবু, ঠাট্টা।
জুয়াড়িরা সবাই নিক্কোর এই কথা শুনল। কিন্তু তাতে কারও রাগ একবিন্দুও পড়ল না। কেউ ঘাড় নাড়ল, কেউ মুখ ঘুরিয়ে নিল।
কন্ট্রাক্টর বলল, ‘হুঁ, ঠাট্টা ধরে নেব –না? আহা, প্রাণ জুড়িয়ে দিলে!’
চামড়ার কারবারি লাফিয়ে উঠে বলল, ‘তোবা তোবা! তুমি তো ভারি মজার লোক হে! এখানে লাখ টাকার ইজ্জত ধুলোয় গড়াগড়ি যাচ্ছে, আর তুমি বলছ কি না ঠাট্টা?’
নিক্কো বলল, ‘শেখজি, রাগ হল কেন। ওই-যে আমি বললাম, আপনাদের একটা চুলও খসা যাবে না। দেখবেন, গোঁফে তা দিতে দিতে বেরিয়ে যাব– হেঁ হেঁ, গোঁফে তা দিতে দিতে বেরিয়ে যাব।’
কন্ট্রাক্টর বলে উঠল, ‘থাম্ ব্যাটা গল্পবাজ কাঁহিকা।’
ক্ষুণ্ণ আওয়াজে নিক্কো বলল, ‘গল্পবাজ? আমি? ঠিক আছে, যা মন চায় বলে নিন। কিন্তু আমি ফের বলছি– আপনাদের একজনেরও গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগবে না।’
সরকারি অফিসের অ্যাকাউন্টেন্ট লোকটি এমনিতে জুয়াকে ভীষণ ঘৃণার চোখেই দেখে। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন তার বউ ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়, তখন ওই জুয়ার আড্ডা ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার থাকে না। অফিস ছুটি হলে সে সোজা ওইদিকে পা বাড়ায়। প্রতিবারই হারে, আর নিজেকে গালাগালি করে। প্রতিজ্ঞা করে, আর কখনও ও-পথে হাঁটবে না। কিন্তু পরদিন আড্ডায় গিয়ে হাজির হয় সেই-ই সবার আগে। এই ভদ্রলোক নিক্কোর কথা শুনে ইনিয়ে-বিনিয়ে বিলাপ শুরু করলেন, ‘আরে ভাই, আমার তো সর্বনাশ হয়ে গেল। আমি সরকারি চাকুরে –আমার আর এক কানাকড়িরও ইজ্জত থাকল না। হায়, আমার বউ-বাচ্চার কী হবে! হায়, নিক্কো আমার সর্বনাশ করে দিল!’
নিক্কো বলল, ‘আহ্ মালেক সাহেব, আমার কথা শোনো…!’
বাধা দিয়ে মালেক সাহেব বলে চললেন, ‘ছাই, শোনার আর কী আছে? হায়, কুক্ষণে আমি তোমার মুখ দেখেছিলাম নিক্কো! ভাই রে, আমি হলাম গিয়ে সরকারি চাকুরে। যদি আমার আপিসের লোকের কানে গিয়ে একবার পড়ে, তো বদনামের একশেষ। আরে, চুলোয় যাক তোমার বদনামি। পনেরো বছরের চাকরি আমার হাতছাড়া হয়ে যাবে। হায়, আমার বিবি-বাচ্চার কী হবে গো!
মহাজনের ছেলে, যে টাকা কামানোর এই সহজ আর মজাদার পদ্ধতি সদ্য আয়ত্ত করেছিল, এতক্ষণ বেশ গম্ভীরভাবে বসেই ছিল। কিন্তু মালেকের এই বিলাপ শুনে এবারে একবারে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিল। তার দিকে মনোযোগী হল সবাই।
নিক্কো বলল, ‘ধৈর্য ধরো, ছোট শাহজি, ধৈর্য ধরো। তুমি যে দেখি ভাই একেবারে মেয়েলোকের মতো কাঁদতে শুরু করলে–অ্যাঁ? মরদের মতো বুকে সাহস আনো। আরে ভাই, তাছাড়া, ব্যাপারও তো এমন কিছু নয়।’
মহাজনের ছেলে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমার বাবা যদি জানতে পারে, তা হলে একেবারে ঘর থেকে বের করে দেবে।
নিক্কো বলল, ‘আরে ভাই, ছাড়ো ওসব কথা– কেউ তোমাকে ঘর থেকে বের করে দেবে না।
মালেক বলে উঠল, ‘নিক্কো, এ কেমনধারা কাজ তোমার বলো দেখি?’
নিক্কো খুব জোর দিয়ে বলতে লাগল, ‘মালেক সায়েব, আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। আপনি আমার কথা বিশ্বাস করুন। আমি আপনাকে বলেছি-না, আপনার গায়ে একটুখানি আঁচড় পর্যন্ত লাগবে না। এমনভাবে কাজ হাসিল করব, যেন মাখনের ভেতর থেকে চুল বের করে আনছি।’
মালেক শোকার্ত কণ্ঠে বলল, ‘হয়েছে ভাই, হয়েছে– এবার থামো। যদি এতই তুমি কাজের লোক, তা হলে পুলিশকে ঢুকতে দিলে কেন?’
নিক্কো বলল, ‘মালেক সাহেব, আমার কথা বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে সত্যি বলছি, আপনার একটি চুলও খসা যাবে না। আসল ব্যাপার কী জানেন, থানার দারোগা আমার আপন লোক। বুঝলেন কিছু? ও আমার খুব খয়ের খাঁ। আপনাদেরও কিছুটি বলবে না। যদি কিছু বলে, তখন আমার মুখের উপর থুতু ছুঁড়ে মারবেন, হ্যাঁ।’
নিক্কোর এই কথা শুনে যত জুয়াড়ি এক মুহূর্ত নীরবে কী ভাবতে লাগল। কেউ কেউ ডুবতে ডুবতে খড়কুটো ধরে বাঁচতে চাওয়ার মতো তার কথা বিশ্বাস করতে চাইল; আবার কারও কারও চেহারা দেখে মনে হল, তারা নিক্কোর কথা বিশ্বাস করা উচিত কি না সে-ব্যাপারে কিছু ঠিক করতে পারছে না। তবে একথা পরিষ্কার বোঝা গেল যে, তাদের রাগ পড়ে আসছে ক্রমশ।
চামড়ার কারবারি শেখজি বলে উঠল, ‘দ্যাখো নিক্কো, এক-আধশো টাকা কিছু নয়– কিন্তু আমার ইজ্জত যেন রক্ষা পায়। এমনিতে ব্যাপার তো এমন কিছুই নয়। আর, খোদ আমার বোনাই হচ্ছে গিয়ে পুলিশের সাব-ইনসপেক্টর। কিন্তু, তোবা তোবা– এটা কাউকে বলার মতোন একটা কথা হল, বলো?’
নিক্কো ভরসা দিয়ে বলল, ‘শেখজি, আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। আমি সেই যে বলেছি না, আপনি এটাকে ঠাট্টাই ধরে নিন। আমার দোস্ত মাঝে মাঝে অমন একাধটুকু দিল্লাগি করেই থাকে।’
‘কে?’ মনসুর পানঅলার মুখ থেকে এই প্রশ্ন সবেগে বেরিয়ে এল। সে তার বিপদে এত বড় বড় সব ব্যক্তিকে সাথিরূপে পেয়ে এতক্ষণ যেন নিজের দুঃখ ভুলেই গিয়েছিল।
‘ওই যে আপনার থানার দারোগা সাহেব বাহাদুর– আর কে।’ ওই কথা বলে নিক্কো হেসে ফেলল।
লরি-ড্রাইভার এককোণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে নিক্কোকে খেয়াল করে দেখছিল। এখন তার একেবারে কাছে এসে, তার চোখে চোখ রেখে অত্যন্ত ভদ্রগলায় বলতে লাগল, ‘দ্যাখো নিক্কো, আমাকে সাতসকালে লরিতে শুকনো ফল বোঝাই করে অনেক দূরে নিয়ে যেতে হবে। ঠিকাদার আমার অপেক্ষায় থাকবে। যদি বাপু তোমার সত্যি এখানে কোনও চেনাজানা থাকে, তো এমন কোনও উপায় করো, যাতে সকাল হওয়ার আগেই আমি এখান থেকে খালাস পাই।’
এমনিতেই জুয়াড়িরা সব শেষপর্যন্ত ধীরে ধীরে নিক্কোর কথায় কান দিতে আরম্ভ করছিল, কিন্তু লরি-ড্রাইভার যে-সুরে নিক্কোর সঙ্গে কথা বলল, তাতে সে স্পষ্টতই নিক্কোর সঙ্গীদের কাছে নিক্কোর কদর বাড়িয়ে দিল। নিক্কোও সেটা অনুভব করল এবং নিজের এই সাফল্যে তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। অবশ্য লরি-ড্রাইভার যে ভদ্রশ্রেণি থেকে আলাদা হয়ে নিজের একার জন্য নিবেদন পেশ করেছে, সেটাকে কেউ ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারল না, বরং সেটাকে লরি-ড্রাইভারের স্বার্থপরতা আর ছোটলোকির পরিচয় বলেই বিবেচনা করল সবাই।
ইতোমধ্যে নিক্কোর গলায় আরও বেশি আত্মবিশ্বাস জমে উঠেছে। সে খুব সম্ভ্রমের সঙ্গে লরি-ড্রাইভারকে বলল, ‘মীর্জাজি, ভাই রে, অত ভেবো না, অত ঘাবড়িয়ো না– তারও ব্যবস্থা হয়ে যাবে।‘
হঠাৎ দলিল-লেখক ফুঁসে উঠে বলল, ‘ব্যবস্থা হবে, না ছাই হবে। মিরজা, তুমিও দেখছি ওই হামবাটার কথায় কান দিতে শুরু করলে। যে ভোগান্তিতে পড়েছ, তাতে বাপু তোমার নিজেকেই ভুগতে হবে।’
নিক্কো দলিল-লেখকের এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণ ক্ষিপ্রভাবে প্রতিরোধ করল। সে খলখলিয়ে হাসতে লাগল। তার পর বলল, ‘নাও, বড়মিয়ার কথা শোনো। উনি বলছেন, ব্যবস্থা নাকি হবে না। আরে বাপু, এখানে যে হর্ মাস মাল-কড়ি খাওয়ানো হচ্ছে, তার কী? ভাইসব, আপনারা শুনুন, আমি আবার বলছি, এটাকে আপনারা ঠাট্টাই ধরে নিন। আমি হিন্দুর মাইরি আর মুসলমানের কসম খেয়ে বলছি, কারও একটা সামান্য চুলও খসা যাবে না। ব্যাপারটা হচ্ছে, থানার দারোগা– আপনাদের আমি আর কী বলব—’
বলতে বলতে সে হেসে ফেলল। তার পর আবার বলল, ‘বলেছি না, উনি আমার আপন লোক? এই– আপনারা আর ছাড়া পেলেন বলে। কিন্তু হ্যাঁ, কাউকে বলবেন-টলবেন না যেন কথাটা। তা হলে কিন্তু সব ফেঁসে যাবে, এই বলে দিলাম। আমাকে কিন্তু তখন দোষ দিতে পারবেন না। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে– মানে– থানার দারোগা– আপনাদের কাছে আর লুকোনো কেন– মানে, আমার সঙ্গে আত্মীয়তা রয়েছে। শুনলেন তো? কী বড়মিয়া, এবার শান্তি হল মনে? এইটুকু বোঝেন না, যদি এইরকম ধারা ব্যাপার না থাকবে, তো গেল পাঁচবছর ধরে এই এতবড় শহরে এতবড় কারবার আমার চলছে কেমন করে?’
নিক্কো চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। ততক্ষণে তার ইজ্জতের ইমারত আগের থেকেও বেশি দৃঢ় হয়ে উঠছে।
এই জুয়াড়িদের মধ্যে একজন ছিল, যার চেহারায় দুঃখ বা চিন্তার কোনও চিহ্ন দেখা যায়নি। এতসব কাণ্ডর মধ্যেও সে চুপচাপ বসে। সে একটা আটাশ বছরের কৃশ, ক্ষীণাঙ্গী যুবক। পোশাক-আশাক আর হাবভাব থেকে তাকে চমৎকার বেপরোয়াই মনে হচ্ছে। অনেকদিন আগে একবার এই লোকটা বোকার মতো চাল চেলে একটা মোটা অঙ্কের টাকা হেরে বসেছিল। ব্যস্, সেইদিন সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যেদিন সেই হেরে যাওয়া টাকা আবার জিতবে, সেদিন থেকে সে আর কখনও জুয়ার নাম মুখে নেবে না। আড্ডায় আসার এক ঘণ্টা আগে সে কোনও পার্কে গিয়ে বসে ভালো করে খেলার পরিকল্পনা ছকে নেয়। নানারকমের চাল পর্যন্ত মনে-মনে ঠিক করে রাখে। খেলেও খুব সাবধানে। কখনও মাথা গরম করে না বা উত্তেজিত হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তার হারা টাকার পরিমাণ প্রতিদিন বেড়েই চলেছে আর সেইসঙ্গে তার ঋণের পরিমাণও।
এই লোকটার মনে জেল, জরিমানা বা অপমানের জন্য চিন্তা একটুও ছিল না। অবশ্য একটা দুশ্চিন্তা তার ছিল। সেটা হচ্ছে, এরা হল গিয়ে সব ভীতুমার্কা লোক– এ যাত্রা বেঁচেই যাক আর ফেঁসেই যাক, হয়তো এরা আর আড্ডামুখো হবে না। আর, আড্ডামুখো না হলে তার হেরে যাওয়া টাকাগুলো আর উশুল হবে না কোনওদিন।
এদিকে নিক্কো অবস্থা সম্পূর্ণ আয়ত্তে এনে ফেলেছে। যদিও রাত কাবার হওয়ার আগে সে যে খালাস পাওয়ার কোনওরকম ব্যবস্থা করতে পেরেছে, এমন নয়; তবু সে প্রত্যেককে কোনও-না-কোনওভাবে বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছে যে, থানার দারোগা তার নিকট না হলেও দূরের কোনও আত্মীয় তো বটেই– তাই সকাল হলেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। সুতরাং, সবাই মেঝের উপর, সিপাইরা যে পুরনো, ছেঁড়া, দুর্গন্ধযুক্ত কম্বল এনে দিয়েছিল, তাই বিছিয়ে শুয়ে পড়ল হাত-পা ছড়িয়ে।
‘ওহো, বিরাট ভুল হয়ে গেছে!’ নিক্কো হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠল। তার পর বিছানা ছেড়ে উঠে বসল।
অন্ধকারে সব জুয়াড়ি জিগ্যেস করল, কী হল, কী হল –কোনও খারাপ খবর নয় তো?
নিক্কো বলল, ‘ভাই, যদি জানতাম এখানে রাত কাটাতে হবে, তা হলে তো সঙ্গে তাস নিয়ে আসতাম আর সারারাত মজা করে খেলতাম। যদি বলেন তো এখনি কোনও সিপাইকে পাঠিয়ে দিয়ে তাস আর মোমবাতি আনিয়ে নি?’
‘না না বাবা, কাজ নেই– থাক্!’ অনেকেই একসঙ্গে আপত্তি করে উঠল।
নিক্কো, একদম বেপরোয়া হয়ে বলতে লাগল, ‘আপনারা জানেন না– তা হলে কিন্তু ভারি জোর তামাশাখানা হত। সকালবেলা যখন থানার দারোগাকে শোনাতাম, সেও খুব হাসত।’
পরদিন বেলা ন’টার কাছাকাছি একজন সিপাই এসে গারদের দরোজার বাইরে ছিদ্রের কাছে দাঁড়িয়ে উঁচুগলায় হাঁক পাড়ল, ‘এ জুয়াড়ি, তোমরা ওঠো! দারোগা সাহেবের সামনে তোমাদের হাজিরা হবে –ওঠো!’
জুয়াড়িয়া অনেকক্ষণ থেকেই এই হুকুমের প্রতীক্ষায় ছিল। সবার দৃষ্টি একসঙ্গে নিক্কোর ওপর গিয়ে পড়ল। নিক্কো চোখ বেঁকিয়ে বিশেষ ঢঙে হাসল।
পাঁচ মিনিট পর এই দশজন মানুষকে থানার ছোট মাঠটিতে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, তার পর আধঘণ্টা পার হয়ে গেল, কিন্তু থানার দারোগা সাহেবের ছায়া পর্যন্ত দেখা গেল না। এই এতক্ষণ ধরে নিক্কো সর্বক্ষণ ইয়ার্কি-মশকরা, রসিকতা আর হাসি-ঠাট্টা দিয়ে তার সাথিদের মশগুল রেখেছিল। কিন্তু এক ঘণ্টা যখন পার হয়ে গেল, অথচ থানার দারোগা সাহেবকে দেখা গেল না, তখন সব জুয়াড়ি ঘাবড়ে গেল। তাদের মুখের হাসি গেল মিলিয়ে। সবার মুখ কালো হয়ে উঠল। একটা দুর্ভাবনা আর সন্দেহের স্রোত তাদের ওপর দিয়ে বয়ে গেল। দুশ্চিন্তায় মুখ কালো করে তারা বারবার নিক্কোর দিকে অনুসন্ধানের দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল –উত্তরে নিক্কো প্রত্যেককে হাত দিয়ে সবুরের ইশারা করতে লাগল। ইতোমধ্যে দু-তিনজন সিপাই জুয়াড়িদের কাছ দিয়ে টহল দিয়ে চলে গেছে আর নিক্কো প্রত্যেককে ‘খানসাহেবজি! খানসাহেবজি!’ বলে ডেকে চেষ্টা করছে দৃষ্টি আকর্ষণের। কিন্তু তারা না নিক্কোর ডাকের জবাব দিয়েছে, না তার দিকে ফিরে তাকিয়েছে।
শেষে যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের দু ঘণ্টা কেটে গেল আর তাদের পা ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইল, তখন একটা কালো গাড়ি থানায় এসে ঢুকল। সেই গাড়ি থেকে থানার দারোগা সাহেব বেরিয়ে এলেন। আর, তাঁর সঙ্গে কয়েকজন সিপাই। দারোগা সাহেবের হাতে কাগজপত্র আর সিপাইদের ঘাড়ে বন্দুক। খালিহাতে তাদের ফিরতে দেখে মনে হল, যে কাজ নিয়ে তারা সাতসকালে বেরিয়েছিল, সে কাজে তারা সফল হয়নি– আর সেই কাজ নিশ্চয়ই খুব জরুরি, জবরদস্ত কাজ। তাই দারোগা সাহেবকে বড় চিন্তিত দেখাচ্ছে।
নিক্কো দূর থেকেই দারোগা সাহেবকে দেখে উছলে উঠল। বলল, ‘ওই-যে এসে গেছে আমার আপন লোক। ব্যস্, আর ভয় নেই– দু-তিন মিনিটেই সব ঝামেলা চুকে যাবে।‘
এইকথা বলে নিক্কো দূর থেকেই থানার দারোগাকে লম্বা একটা সালাম ঠুকল। দারোগা সাহেব হয় তাকে দেখতেই পেলেন না, কিংবা জ্ঞাতসারেই তার দিকে নজর ফেরালেন না। তার পর, তিনি চলে গেলেন পুলিশ-ব্যারাকের দিকে।
দলিল-লেখক বিদ্রূপভরা আওয়াজে বলল, ‘নিক্কো, আমি বুঝতে পারছি, দারোগা তোমাকে দেখতে পাননি, না হলে নিশ্চয় তোমার সালামের জবাব দিতেন।
নিক্কো বলল, ‘আরে, কী যে বলো মিয়া- দারোগা আমার সালামের জবাব দেবেন নাকি? আর বাপু, তিনি এখন রোয়াবে আছেন, রোয়াবে। কী বুঝলে? থানার দারোগাগিরি, কী বলে, তোমার চাট্টিখানি কথা নয়। দেখছ-না, আমাদের সঙ্গে যদি ভদ্রভাবে কথা বলছেন তো সিপাইগুলোকে কেমন তম্বি করছেন। আর এই সিপাই হারামজাদারা যে কী চিজ, সে তো দেখছই। ওরা হচ্ছে ভেল্কিঅলাদের বাঁদর। যতক্ষণ চোখের সামনে লাঠি রয়েছে, ডুগডুগির তালে তালে নাচবে। আর যেই ভেল্কিঅলা একটু ঢিলে দিয়েছে, তো অমনি লেগে যাবে, মুখ ভ্যাঙচাতে তখন বাঁদর মাথায় চড়বে।’
পাঁচ মিনিট পর দারোগা সাহেব কয়েকজন সিপাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এলেন। জুয়াড়িদের পাশ দিয়ে হেঁটে থানার ফটকের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তার পর, সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সিপাইদের সঙ্গে কথায় মগুল হয়ে পড়লেন।
এদিকে থানার অফিসঘরে টেলিফোন বেজে উঠল। একটু পরেই একজন সিপাই ছুটতে ছুটতে দারোগা সাহেবের কাছে গেল। দারোগা সাহেব যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন নিক্কো তাঁকে আর একবার সালাম ঠুকল। দারোগা সাহেব মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালেন, তার পর দ্রুত পা চালিয়ে, চলে গেলেন অফিসের দিকে।
নিক্কো বিজয়ীর ভঙ্গিতে বলল, ‘বলেছিলাম না, আমার সালামের জবাব দেবে না? কী, জবাব দিল?’
সব জুয়াড়ি চুপ করে থাকল।
নিক্কো আবার বলতে লাগল, ‘একদিনের কথা। থানায় শুধু ও আর আমি রয়েছি ধারে-কাছে কোনও সিপাই ছিল না। তখন কী হল, শোনো। এত মজার মজার কথা শোনাল যে, হেসে একেবারে পেট ফুলে গেল।’
প্রায় আধঘণ্টা ধরে থানার দারোগা সাহেব অফিসের ভেতরেই রইলেন। এরা আবার অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। এমন সময় সকালের সেই সিপাই অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা এদের কাছে এসে কঠোর গলায় বলতে শুরু করল, ‘এ জুয়াড়ি, তোমরা শোনো। দারোগা সাহেবের হুকুম, তোমরা সবাই যার যার ধুতি-পাজামা খুলে মাটির উপর এক লাইনে উবু হয়ে শুয়ে পড়ো। তার পর, একদিক থেকে একজন করে উঠে প্রত্যেককে দশ ঘা করে জুতো লাগাও। জুতো লাগানো হলে অন্যদিকে উবু হয়ে শুয়ে পড়ো। মোট কথা, এইভাবে সবাই সবাইকে একে একে দশ ঘা করে জুতো লাগাও।’
দারোগা সাহেবের এই আদেশ এতই অপ্রত্যাশিত যে, সব জুয়াড়ি হতভম্ব হয়ে গেল। তার পর, সেই অবস্থায় তাকিয়ে রইল সিপাইয়ের মুখের দিকে।
‘প্যাচার মতো সব আমার মুখের দিকে দেখছ কী? হুকুম যদি বুঝতে পেরে না-থাকো, তো আর একবার শুনিয়ে দি?’
এইকথা বলে জবাবের অপেক্ষা না করে সেই কথাগুলোই সিপাই আবার বলে গেল। তখন দলিল-লেখক আর মনসুখ পানঅলা পাগলের মতো ছুটে গিয়ে সিপাইয়ের পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তারা সমস্বরে কাকুতি-মিনতি করে বলল, ‘খান সাহেব, আমরা একেবারে নির্দোষ। এরা সবাই সাক্ষী, আমরা একদম কোনও দোষ করিনি। পুলিশ যখন এল, তখন আমরা খেলছিলামও না–আর খেলার মতলবে সেখানে আমরা যাইনি। আমরা নির্দোষ। খোদা জানেন, আমরা বিলকুল নির্দোষ।’
সিপাই বলল, ‘আমার কিছু করার নেই– দারোগা সাহেবের এই হুকুম।’
ওরা আবার বলল, ‘খানসাহেবজি, বড্ড মেহেরবানি হয় যদি আপনি আমাদের তরফ থেকে হুজুরের কাছে একটু হাতজোড় করে বলেন, আমরা দুজনা বিনাদোষে ধরা পড়েছি। এঁরা সবাই তার সাক্ষী।’
সিপাই বলল, ‘আমি সাক্ষী-টাক্ষী বুঝি-না, বাপু –দারোগা সাহেব সক্কলের জন্যে এই হুকুম দিয়েছেন। হ্যাঁ, আর একটা কথা। উনি বলেছেন যদি ওরা রাজি না হয় তা হলে ওদের সবাইকে আবার গারদে পুরতে হবে। দ্যাখো বাপু, দেরি করা চলবে না। আমাকে এক্ষুনি দারোগা সাহেবের সঙ্গে বাইরে যেতে হবে। গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। তোমরা যদি দেরি করো, তা হলে তোমাদের আবার গারদে বন্ধ করে দিয়ে যাব।’
দলিল-লেখক আর মনসুখ দুজনে নিরুপায় হয়ে আবার লাইনে গিয়ে দাঁড়াল। তাদের এই পরিণাম দেখে কোনও জুয়াড়ির আর মুখ-খোলার সাহস হল না। দুশ্চিন্তায় আকুল হয়ে তারা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। কী করা যায়, তাদের মাথায় তা আসছে না। তাদের চোখ বারবার নিক্কোর ওপর পড়ছে। নিক্কো তাদের দিকে তাকিয়েও দেখছে না। তার দৃষ্টি থানার অফিসঘরের দেয়ালের দিকে। সেই দৃষ্টি বুঝি দেয়াল ভেদ করে থানার দারোগাকে খুঁজে বের করতে চাইছে।
সিপাই আবার বলল, ‘দ্যাখো বাপু, তোমরা কিন্তু দেরি করছ। আমাকে বাধ্য হয়ে তোমাদের তা হলে গারদেই বন্ধ করে দিতে হবে।’
এই কথার ওপরও জুয়াড়িরা ইতিউতি করছে, এমন সময় হঠাৎ মাটিতে কারও দড়াম করে পড়ার আওয়াজ শোনা গেল।
সে নিক্কো। নিক্কো ততক্ষণে ধুতি খুলে মাটির উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে। তাকে ওই অবস্থায় দেখে মনসুখও সাহসে বুক বাঁধল। সেও নিক্কোর অনুসরণ করল। অ্যাকাউন্টেন্ট মালেক এদিক-ওদিক দেখছিল, এমন সময় সিপাই এসে পেছন থেকে ঘাড়ে ধরে তাকে জবরদস্তি নিচে বসিয়ে দিল। সে তখন নিরুপায় হয়ে নিজের পাতলুনের বোতাম খুলে ফেলল।
সিপাইয়ের এই ব্যবহার দেখে তখন অন্যান্য জুয়াড়ি আপনাআপনি মাটিতে শুয়ে পড়ল। শুধু চামড়ার কারবারি শেখজি রইলেন দাঁড়িয়ে। তাঁর দুইচোখে অশ্রু টলমল করে উঠল। তাঁর চেহারা দেখে বোঝা গেল, তিনি কী সাংঘাতিক মনঃকষ্ট ভোগ করছেন। তাঁর হাত বারবার কোমরবন্ধে গিয়ে ঠেকছে, কিন্তু গিয়ে আটকে থাকছে সেখানেই।
এইরকম সম্মানিত ও ভদ্র-চেহারার মানুষটিকে এইভাবে শোক করতে দেখে সিপাইজির মনে লাগল। সে সেখান থেকে ইচ্ছা করে সরে গেল। শেখজি মন শক্ত করলেন। পাগড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের চারদিকে দেখলেন। শেষে একান্ত বাধ্য হয়ে তিনিও থানার দারোগার হুকুম তামিল করলেন।
একপ্রান্তে ছিল লরি-ড্রাইভার। সর্বপ্রথম তারই জুতো মারার পালা। সে উঠে দাঁড়ালে নিক্কো জোরে গলা ঝাড়ল। তার পর বলল, ‘মীর্জাজি, সামলে। সবাই বলতে গেলে আপন লোক, হ্যাঁ। দেখে মনে হবে খুব জোরে হাত পড়ছে, কিন্তু — বুঝলে কথা?–’
লরি-ড্রাইভারের মাত্র পাঁচ পর্যন্ত গোনা হয়েছিল, এমন সময় সেই সিপাই থানার অফিসঘর থেকে বেরিয়ে হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিল। কাছে এসে সে বলল, ‘দারোগা সাহেব বলছেন, তোমরা যদি ঠিকভাবে জুতো না-চালাও, তা হলে, আমি আমার সিপাইদের দিয়ে জুতো লাগাব।’
এই কথা বলে আবার চলে গেল।
জুয়াড়িরা ভেবে দেখল, নিজেরা আসে জোরে জোরে জুতো খাওয়াই ভালো। সেই অনুসারে, বিশ মিনিটের মধ্যে প্রত্যেককে প্রত্যেকের দশ জুতো করে মারা হয়ে গেল। তখন তারা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে কাপড় ঝেড়েঝুড়ে পরে নিল। তা করতে করতে সেই সিপাই আবার এসে বলল, ‘যাও, এবারের মতো দারোগা সাহেব তোমাদের মাফ করে দিলেন। যাও, আর কখনও জুয়ো খেলো না।’
এরা সব থানা থেকে এমনভাবে বেরুল, যেন নিজের কোনও অতি নিকট-আত্মীয়কে কবর দিয়ে গোরস্তান থেকে বেরুচ্ছে। থানা থেকে বেরিয়ে তারা চুপচাপ মাথা হেঁট করে একশো গজের মতো হেঁটে গেল। তার পর নিক্কো হঠাৎ খুব জোরে হেসে উঠল। এত জোরে হাসতে লাগল যে, হাসতে হাসতে তার কোমর বেঁকে গেল। তখন সে বলল, ‘কী! দেখলে? না চালান, না মোকদ্দমা, না জেল, না জরিমানা। বলেছিলাম না– এটাকে তোমরা ঠাট্টাই ধরে নাও।’
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
পথে যেতে যেতে – আনওয়ার
কাল আমি যা দেখেছি, তা আমাকে অবাক করে দিয়েছে। পুরো ঘটনাটা আগের কালের কোনও কাহিনি আর নাটকের মতো চোখের সামনে দিয়ে ঘটে গেল। আগের কালের কাহিনি আর নাটকের তিনটি অংশ থাকত : বন্দনা, কাহিনি, উপসংহার। মূল কাহিনির সঙ্গে বন্দনা আর উপসংহারের কোনও সম্পর্ক থাকত না। কেননা, বন্দনায় থাকত স্তব বা প্রশস্তি আর উপসংহারের মধুর পরিণতি। উদাহরণস্বরূপ, ‘হৃদয়ের ক্ষত’ নামক একটি নাটক থেকে তার বন্দনা-অংশটি লক্ষ করুন :
যবনিকা উঠল। সখীরা জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরে হাত-ধরাধরি করে সারবন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখা গেল। (আজকাল তো অভিনেত্রীদেরই দেখা যায়, কিন্তু সেকালে শুধু সখীরাই থাকত। যেসব পুরুষ-অভিনেতা মাথায় পরচুলা বেঁধে আর বুকে ক্রিকেটের বল বেঁধে বালিকার অভিনয় করত, তাদের বলা হত সখী।) সখীদের সমবেত গান শুরু হচ্ছে :
বিশ্বপিতা দীনের দয়াল প্ৰভু হে– এ–এ- এ।
অভাজনে নিবেদনে
ত্যাগ কোরো না কভু হে– এ- এ–।
এবার নাটকের উপসংহার-অংশের পরিচয় লাভ করুন। নায়ক-নায়িকা প্রেমে ব্যর্থকাম হয়ে আত্মঘাতী হয়েছে। কিন্তু তার জন্য আপনার মনঃকষ্টের কোনও কারণ নেই। শেষ দৃশ্যে তাদের আবার জীবিত দেখা যাচ্ছে। প্রেমিক-প্রেমিকা স্বর্গে একে অপরের বক্ষলগ্ন হয়ে বসে রয়েছে। লাল আর সবুজ সব চাঁদের আলোর ঝরনাধারায় তাদের উপর কাগজের পুষ্প বর্ষিত হচ্ছে। দর্শকরা হাততালি দিচ্ছে।
কিন্তু আমি এখানে একটা গল্প শোনাতে বসেছিলাম। আমার উদাহরণ আগের কালের সব কাহিনির সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া চাই। আমি বলছিলাম, পুরো ঘটনাটা আমার সামনে আগের কালের কাহিনি আর নাটকের মতো ঘটে গেল। আসলে কথাটা ঠিক নয়। আগের কালের কাহিনির শুরুতে বন্দনা থাকত। আমার গল্পে কোনও বন্দনা নেই। আমার গল্প শুরু থেকে শুরু হচ্ছে না। আমার গল্প মাঝখান থেকে শুরু হচ্ছে। আমার গল্প হচ্ছে এইটুকু :
সাদা ময়লা বোরকায় আচ্ছন্ন এক বুড়ি এক বাস্টপে নামল। বাস্ ছেড়ে দিল। বুড়ি সেই বাসের পিছু পিছু ছুটতে লাগল।
আগের কালের গল্প কীভাবে শুরু হত? শুরু হত এইভাবে :
এক যে ছিল রাজা। তার ঘোড়াশালে ঘোড়া, হাতিশালে হাতি।
না, আমার গল্প আগের কালের গল্পের মতো নয়। একালে কোথায় রাজা! কোথায় এত হাতি-ঘোড়া! এখন তো লোকে সবাই মিলে নিজেদের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নিয়ে বলে : এসো হে, তুমি আমাদের দেশ, জাতি আর সভ্যতা-সংস্কৃতির রক্ষণাবেক্ষণ করো– আমরা তোমায় মাইনে দেব। আর অমনি সে মাথা হেলিয়ে জনসেবার জন্যে কোমর বাঁধে। রাজা-বাদশার গল্প আর রইল কই। একালের গল্প তো আপনার-আমার সবার গল্প। একালের গল্প বিজ্ঞানী, দার্শনিক, শিল্পী, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, কিষান আর মজদুরের গল্প। গল্প আর একালে দরবারে বা মহলে বন্দি নেই। গল্প একালের পথে-ঘাটে ছড়িয়ে রয়েছে।
পথেই ঘটল আমার নিজের দেখা গল্পটা।
সেই বুড়ি এখনও রাস্তা ধরে দৌড়াচ্ছে।
বাস্ চৌরাস্তার মোড় পার হয়ে চলে গেছে। সিগনালের বাতি লাল হয়ে গেছে। এদিকের ট্রাফিক বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু সেই বুড়ি এখনও ছুটছেই। লোক অবাক হয়ে তাই দেখতে লাগল। মেয়েরা হাসতে শুরু করে দিল। ছেলেরা মজা দেখতে লাগল। আর সেই বুড়ি ছুটেই চলেছে।
এবার সে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তার গতি মন্থর হল। সে বাঁ-হাতের ট্রাফিক বাঁচিয়ে চৌরাস্তা পার হচ্ছে। সে তার বোরকার সামনের অংশ তুলে নিজের মুখ উন্মোচন করে নিল। শেষে এক ট্রাফিক পুলিশের সিপাই তাকে থামাল।
‘বুড়ি-মা, মরার ইচ্ছে হয়েছে?’
বুড়ি-মা করুণ আওয়াজে বলল, ‘আমাকে ছেড়ে দাও, বাছা। ওই বাসে আমার পোঁটলা রয়ে গেছে।’
হুজুগপ্রিয় যত পথিকের ভিড় জমে গিয়েছিল। একজন বলল, ‘বুড়ি-মা, তোমার ধারণা, তুমি ছুটে গিয়ে ওই বাস্ ধরতে পারবে?’
‘আর কী করব, বাবা? আমার বউ তো আমার মাথার আর-একটা চুলও বাকি রাখবে না।’
বুড়ির চেহারায় আর কথায় অসহায়তার গভীর ছাপ। মজা দেখতে যারা ভিড় জমিয়েছিল, তাদের সে বড় করুণ সুরে বলল, ‘বাবারা, বাছারা, তোমাদের মধ্যে কেউ দৌড়ে গিয়ে আমার পোঁটলাটা এনে দাও। ও-ই যে যাচ্ছে বাস্।’
‘মা, তোমার কোথাকার বাস্? কত নম্বর?’
‘মালিরের, বাবা।’
‘কিন্তু ওটা তো নাজিমাবাদের বাস্, মা!’
ট্রাফিক পুলিশের সিপাই বলল, ‘বুড়ি-মা, এবার ক্ষান্তি দাও। পোঁটলা আর কি পাওয়া যায়, মা? পোঁটলায় কী ছিল? তোমার কত লোক্সান হল?’
‘অ্যালুমিনিয়ামের একটা ডিবে– তাতে আমার ছেলের খাবার ছিল। একুশজন ছেলেমেয়ের জামা আর ফ্রকের কাপড় ছিল। আমার বউয়ের একজোড়া জাপানি সিকের কামিজ ছিল। আমার ছেলে বলেছিল : মা, আমার খাবার যখন আনবে, ওই সঙ্গে কাপড়গুলোও এনো– দরজিকে দিয়ে আসব। আমার ছেলে না-খেয়ে মরে যাবে। আর বউ আমার মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলবে
একজন অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, ‘মা, তোমার ছেলের একুশ ছেলেমেয়ে?’
‘না বাবা। এ হতভাগার তো মাত্তর ন’টি ছেলে। তেরোটি ছেলেমেয়ে আমার বড়ছেলের। ওই ছেলে আমার গেল-বছর মারা গেছে। পাঁচ ছেলেমেয়ে আমার মেয়ের। ওই মেয়ে আমার পাগল হয়ে গেছে– সোয়ামি তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এদের মধ্যে একুশটি ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। তাদেরই জামা তৈরি হবে, বাবারা।’
‘তোমার ছেলে কী করে মা?’
‘কার ভাগ্যে কী আছে তাই সে বলে দেয়। এক আনা পয়সা নিয়ে সে তোতা পাখিকে কাগজের একটা টুকরো আনতে বলে। কাগজে ভাগ্যের লিখন লেখা থাকে।’
যারা মজা দেখতে জমা হয়েছিল, তাদের একজন হাসতে হাসতে বলল, ‘হ্যাঁ মা, তোমার ছেলে তোমাকে আজ একথা বলে দেয়নি যে, আজ তোমার কপালে জিনিস-খোয়া যাওয়া লেখা আছে?’
‘না বাবা, সে অমনধারা কথা কাউকেই বলে না। তুমিই বলো, এক আনা পয়সা নিয়ে যদি সে কাউকে ওইরকমের কথা বলে, তা হলে কি আর সে তার মাথা আস্ত রাখবে?’
ট্রাফিক পুলিশের সিপাই বলল, ‘বুড়ি-মা, তোমার ছেলে বড়লোক! অতবড় সংসারের বোঝা যে বয়ে বেড়াচ্ছে, তার কাছে এ আর এমন কী লোকসান! ছেলেমেয়েদের সে আবার জামা বানিয়ে দেবে। যাও, ঘরে গিয়ে আরাম করো।’
‘না বাবা, না। সে যখন জানবে, নিজের মাথায় বাড়ি মারতে শুরু করে দেবে, তার পর আমার মাথায়ও বাড়ি দেবে। আর আমার বউ তো তার রক্ত চুষে খাবে। আর সে হতভাগাকে বড়লোক কে বলবে, বাবা। এই তো চার দিন হচ্ছে, সে তার বাড়ি দেড় হাজার টাকায় বেচে দিয়েছে। কত কষ্টে অ্যালট পেয়েছিল। সেই বাড়ি বেচে এখন আমরা কুঁড়েঘরে গিয়ে উঠেছি। সব ধার-কর্জ শোধ দিয়ে দেড় হাজারের মধ্যে যা বেঁচেছে, তাতে শুধু আধখানা সংসারের কাপড় কেনা গেছে।’
ট্রাফিক পুলিশের সিপাই জিগ্যেস করল, ‘বুড়ি-মা, তোমার কত টাকার লোকসান হয়েছে?’
‘কেমন করে বলি, বাবা। এই ধরো, পঁচিশ-তিরিশ টাকার কাপড় হবে।’
এরপর যে ঘটনা ঘটল, তাতে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
ট্রাফিক পুলিশের সিপাই ওইদিনই মাইনে পেয়েছিল। সে পকেটে হাত চালিয়ে দশ টাকার তিনখানা নোট বের করে বুড়ির সামনে ধরল।
‘বুড়ি-মা, এই নাও, বাচ্চাদের আবার কাপড় কিনে দিও।’
তাই দেখে লোকে তো অবাক। তারা ওই সিপাইকে ভালো করে দেখতে লাগল। তারা যেন দেখছে, লোকটা সত্যি পুলিশের সিপাই, না আর কেউ! লোকে দু রকমের মানুষকে খুব ভয় করে। এক হচ্ছে পকেটমার, আর তার পর পুলিশ। কিন্তু এ কেমনধারা পুলিশ? এ তো, বলতে গেলে, সারামাসের মাইনেই একটা বিপদে পড়া বুড়ির সাহায্যে দান করে বসল। এখন এ নিজেই-বা কী খাবে আর বউ-বাচ্চাকেই-বা কী খাওয়াবে? এরও নিশ্চয় এক বিবি আর অসংখ্য বাচ্চা রয়েছে। গরিবের বাড়ি থাকে না, গাড়ি থাকে না, জমি থাকে না, আয় থাকে না। থাকে কেবল ছেলেমেয়ে। ছেলেমেয়েই গরিবের জমি-জিরেত, ছেলেমেয়েই গরিবের ফসল, ব্যাংক-ব্যালেন্স। ছেলেমেয়ে তার দারিদ্র্যের মালিন্যবিনাশী আশা। এই সিপাইয়েরও নিশ্চয় অসংখ্য ছেলেমেয়ে রয়েছে। এ মাসে তার দিন চলবে কেমন করে?
আমি একটু দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে এইসব দেখছিলাম।
আমি আমার ট্যাকের অনুমতি ছাড়া কাউকে কোনও সাহায্য দেওয়া পছন্দ করি না। আমি যখন আমার ট্যাকের অনুমতি ছাড়া গাড়ি কিনতে পারি না, আমার ট্যাকের অনুমতি ছাড়া সিনেমা যেতে পারি না, আমার ট্যাকের অনুমতি ছাড়া ভালো পোশাক পরতে পারি না, তখন আমার ট্যাকের অনুমতি ছাড়া আমি কেন কারও সাহায্য করতে যাব? বড়লোকদের মধ্যে যাঁরা হাসপাতালে, স্কুলে, কি এতিমখানায় মোটা মোটা চাঁদা দেন, তাঁরা সেই ভালো কাজ তাঁদের ট্যাকের অনুমতি ছাড়া করেন না। কলকারখানার মালিকরা বছর-শেষে আয়-ব্যয়ের জমা-খরচ করে আয়ের সেই অংশটুকুই চাঁদায় ব্যয় করেন, যেটুকু আয়-কর হিসেবে সরকারের পকেটে চলে যাওয়ার কথা।
কিন্তু পুলিশের এই সিপাই বড় সাদা মনের মানুষ। অর্থনীতির দর্শনের ধার ধারে না। তার জীবনের খাতায় বাজেট আর জমা-খরচের হিসাবের ঠাঁই নেই। সে তার আবেগের অমৃত-ভাণ্ডটি নিঃশেষে পান করে নিশ্চিন্তে বসে রয়েছে।
আমি এই দানশীল সিপাইকে ভালো করে দেখার জন্য এগিয়ে গেলাম। আমার ওপর তার নৈকট্যের বড় খারাপ প্রতিক্রিয়া হল। তার দানশীলতা আমার মনের শক্ত-ভাবকে গলিয়ে দিতে লাগল।
আমি দশটাকার ছ-খানা নোট বের করে বুড়ির সামনে ধরে বললাম, ‘বুড়ি-মা এই নাও। এই টাকায় হয়তো তোমার সংসারের অন্যান্য লোকের কাপড়ও হয়ে যাবে।’
আমি এটা কী করলাম! ওই ষাট টাকা আমাকে একজন কৃপণ সম্পাদক একটা গল্পের বিনিময়ে অনেক কষ্টে দিয়েছেন। ওই টাকাটার আমার ভয়ানক দরকার।
মজা দেখতে আসা লোকগুলোর একজন এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আর বুড়ি-মা, এই পাঁচ টাকা আমি দিলাম। একটা খাবারের ডিবে কিনে নিও। আর ছেলের জন্য হোটেল থেকে খাবার নিয়ে নিও।’
ময়লা কাপড় পরা একটা লোক তার বিড়ির কৌটো থেকে একটা আধুলি বের করে বলল, ‘এই যে মা, তোমার মালিরের বাস-ভাড়া।’
তখন বুড়ি-মা’র হাতে নোট আর মুখে দোয়া।
এমন সময় হঠাৎ একটা লোক ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকল। তার পর বুড়িকে উদ্দেশ করে বলল, ‘বুড়ি-মা, এই পোঁটলা তোমার?’
আনন্দে উছলে উঠে বুড়ি বলল, হ্যাঁ বাবা, আমার।’
সামনের স্টপ্ থেকে বাসের কনডাক্টর পাঠিয়েছে।
ভিড়ের ওপর দিয়েও খুশির ঢেউ বয়ে গেল।
বুড়ি ভিড়কে সম্বোধন করে বলল, ‘বাবারা, আল্লা তোমাদের ভালো করুন। তোমরা আমার জন্যে খুব করেছ, অনেক করেছ। এখন তোমরা তোমাদের টাকা নিয়ে নাও। আমার তো আর দরকার নেই।’
দশ টাকার তিনটে নোট সে ট্রাফিক পুলিশের সিপাইয়ের দিকে এগিয়ে দিল।
সিপাই বলল, ‘বুড়ি-মা আমার আর ও-টাকা লাগবে না।’
পাঁচ টাকা যে দিয়েছিল, তার দিকে বুড়ি পাঁচটাকার নোট এগিয়ে দিল।
সে বলল, ‘বুড়ি-মা, আমার ও-টাকা লাগবে না।’
ময়লা কাপড় পরা লোকটাকে সে আট আনা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু সে বলল, ‘বুড়ি-মা, আমার ও-পয়সা লাগবে না।
সে দশটাকার ছ’-খানা নোট আমার দিকে এগিয়ে দিল।
আমি বললাম, ‘বুড়ি-মা, আমার ও-টাকা লাগবে না।’
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
আঘাত – হামিদ কাশ্মিরী
সন্ধ্যার অনেক আগেই আগুন লেগেছিল। কিন্তু সন্ধ্যা হওয়া পর্যন্ত সে-আগুন বাজার ও পাড়াকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলে। আগুনের লেলিহান শিখা দেখে মনে হচ্ছিল আগুন যেন মাটিতে নয় বরং আকাশে লেগেছে। এক হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলময় পরিবেশ তখন দেখা দিয়েছে। চারদিকে ভীতিপ্রদ রব, শিশুদের ক্রন্দন, নারীদের বিলাপ উচ্চতর হয়ে উঠেছে; কিন্তু কেউই কারওর দিকে তাকাবার সময় পাচ্ছে না। বরং কতক সুযোগসন্ধানী ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে বাড়িঘর, দোকানপাট লুঠতরাজ আরম্ভ করে। কয়েক জায়গায় মেয়েছেলের প্রতি উত্ত্যক্ত করার ঘটনাও সংঘটিত হয়। এছাড়া আরও অনেক হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা যায়, যা হয়তো কোনওদিন দূর ভবিষ্যতে আমি ভুলে যেতে পারিও-বা, অথবা সেই আগুনের দৃশ্য আমার মন থেকে মুছে যেতেও পারে, কিন্তু সেই অগ্নিকাণ্ডের ফলে উদ্ভূত মানুষের অসহায়তা ও হট্টগোলের মাঝে যে-আঘাত সেই লোকটি আমায় দিয়ে গেল তা কোনওদিনই ভুলতে পারব না। সেই আঘাত আমার মনে এক অক্ষয়চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। আর এর ফলে এক ব্যথার যন্ত্রণা আমায় সর্বদা সেই লোকটির কথা স্মরণ করিয়ে রাখে। অনেক সময় আমি ব্যাকুল হয়ে শহরের অলিগলিতে তাকে অনুসন্ধান করে বেড়াই; এবং প্রায়ই পথের প্রতিটি ভিড়ের মধ্যে তাকে শনাক্ত করার জন্য আমার দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে ওঠে। কিন্তু কোথাও তার দেখা পাই না। মনে হয় সে আমার অনুসন্ধানের সব খবরই রাখে; তাই সন্ত্রস্ত হয়ে সে কোথাও আত্মগোপন করে আছে। কিন্তু আমিও সংকল্প করেছি সারাজীবন তার অনুসন্ধান চালিয়ে যাব।
তার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল নিচে ফুটপাতের উপর। সেই সময় বাজারে পলায়নের এক সাড়া পড়ে গিয়েছিল। চারদিকে ভীতিপ্রদ রব। আগুনের স্ফুলিঙ্গ ও মানুষের হৃদয়বিদীর্ণকারী চিৎকার ব্যাপকতর হয়ে উঠেছে। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ঠন্ ঠন্ শব্দ করে দ্রুতগতিতে এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করছে। পুলিশের লোকেরা অগ্নি-আক্রান্ত অঞ্চলটিকে ঘিরে লোকগুলোকে টেনে টেনে বাইরে বার করতে আরম্ভ করে দিয়েছে। আর আমি সাহায্যলাভের জন্য অন্যান্য আরও অনেক সাহায্যপ্রার্থীর মতো কোনও লোকের সন্ধানে ব্যস্ত রয়েছি যাতে কিছু জিনিসপত্র ফ্ল্যাট থেকে বার করতে পারি। কিন্তু এমন ভয়াবহ পরিবেশে সাহায্যের লোক পাওয়া খুবই দুরূহ। প্রত্যেকেই নিজ নিজ প্রাণ রক্ষা করতে ব্যস্ত। আমি অবশ্য নিজের প্রাণ রক্ষা করেছিলাম। তাছাড়া ঘর থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসমূহ বার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু মূল্যবান দুটি বড় সিন্দুক বার করতে পারিনি, যা অন্য সব জিনিসপত্রের মতো আগুনে ভস্ম হওয়ার জন্য ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে না। আমার কাছে সেই সিন্দুকদুটি ছিল খুবই মূল্যবান। কারণ মেয়েছেলের জামাকাপড়, গহনাপত্র, নগদ টাকা, এমনকি মরা-বাঁচার সমস্ত জিনিসপত্র সেই সিন্দুকদুটির মধ্যে বন্ধ ছিল। আর সেই সিন্দুকদুটি উদ্ধার করায় একটি পরিবারের সমস্ত পুঁজিপাটা ধ্বংস হওয়া থেকে বেঁচে যেতে পারত। তাই মজুরি দিয়েও যদি কোনও লোক পাওয়া যায় তার সন্ধানে আমি এদিক-সেদিক ছুটাছুটি আরম্ভ করি। অন্যদিকে আমার দৃষ্টি ছিল আগুনের ঝাঁপটা-পরিবৃত আমার ফ্ল্যাটের প্রতি, যাতে কেউ ভেতরে প্রবেশ করে লুটপাট আরম্ভ না-করে দেয়। আমার প্রতিবেশী ভদ্রলোক সৌভাগ্যক্রমে প্রত্যেকবার মোট বহনের জন্য বিশ টাকার চুক্তিতে এক কুলি পেয়েছিলেন। আমি অবশ্য ত্রিশ-চল্লিশ টাকাও দিতে প্রস্তুত ছিলাম, যদি কোনও কুলি পাওয়া যেত। কিন্তু কেউই রাজি হচ্ছিল না।
আমার ফ্ল্যাট সম্পূর্ণরূপে আগুনের গ্রাসের মধ্যে এসে পড়েছিল। এবং তা ছিল উপরতলায়। সুতরাং ত্রিশ-চল্লিশ টাকার জন্য প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করে উপরে উপস্থিত হওয়ার বিপদ কেনার জন্য কেউ রাজি হচ্ছিল না। অবশেষে নিরাশ হয়ে আমি সিদ্ধান্ত করি একাই উপরে গিয়ে দুটি সিন্দুক নিচে ফেলে দেব। যদি কেউ লুটেও নেয়, তাতে কী; কমপক্ষে আগুনে ভস্ম হওয়া থেকে তো রক্ষা পেয়ে যাবে। একথা চিন্তা করে আমি উপরে দৌড়ে যেতে উদ্যত হচ্ছি এমন সময় কানের কাছে এক সহানুভূতিপূর্ণ স্বর শুনতে পেলাম :
‘আপনার কি কুলির দরকার?’
পিছন ফিরে তাকালাম। বাহ্যত একটি সাধারণ প্রকৃতির লোক আমার উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। তার দিকে করুণাপ্রার্থী দুই চোখ তুলে মাথা নাড়লাম। এবং তার সাথে কোনও মজুরির চুক্তি না-করেই উভয়েই দৌড়ে উপরে গেলাম। পুলিশের লোক ছাড়া কতক অন্য লোকও আমাদের উপরে যেতে বাধাদানে চেষ্টা করে; কিন্তু আমরা তাদের দু হাত দিয়ে ধাক্কা দিতে দিতে উপরে পৌঁছে যাই। কয়েকবার আগুনের প্রসারিত শিখা আমাদের পরিধেয় বস্তু এবং শরীরকে প্রায় স্পর্শও করে; কিন্তু সেই শিখাগুলোর সাথে সংগ্রাম করতে করতে আমরা উভয়েই এক-একটি সিন্দুক তুলে নিতে সফল হই। এবং প্রসারিত অগ্নিশিখা থেকে নিজেদের রক্ষা করে দ্রুতবেগে নিচে নেমে আসি। নিচে নেমে দেখলাম কুলির পিঠের কয়েক জায়গায় কাপড় পুড়ে গেছে। জানি না তার শরীর পর্যন্ত আগুনের স্পর্শ লেগেছিল কি না। কিন্তু আমি সেকথা তাকে আর জিগ্যেস করিনি, তাছাড়া সে-ব্যাপারে চিন্তা করার সময়ও ছিল না। রাস্তায় অন্য বাড়িগুলোর দরজা-জানালা- ছাদে আরও ভয়ংকর প্রলয় সৃষ্টি হয়েছে। করুণ বিলাপ ও আর্ত রব পরিবেশকে আরও ভয়াবহ করেছে। কুলিকে উপদেশ দিলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে যেন ভিড় থেকে বেরুবার চেষ্টা করে। নিজেও আমি পূর্ণশক্তিতে ভিড় ঠেলে ঠেলে এগিয়ে চললাম। অনেকক্ষণ সম্মুখে এগিয়ে গেছি, কিন্তু জনতার ধারা আর শেষ হয় না। হঠাৎ এই চিন্তায় আমি চমকে উঠলাম যে, কুলির মাথায় যে সিন্দুকটি আছে তা গয়না ও নগদ টাকায় পূর্ণ রয়েছে। এই চিন্তার সাথে সাথেই আমার একথাও খেয়াল হল যে, কুলিটা চলতে চলতে আমার পেছনে থাকার চেষ্টায় ব্যস্ত রয়েছে। কয়েকবার তাকে আমার আগে চলবার কথা বলেছি, কিন্তু ভিড়ে সুযোগ পেয়ে সে আবার পিছনে হয়ে যাচ্ছে। তার উদ্দেশ্য আমি ভালোরূপে বুঝতে পারলাম। বুঝতে পারলাম যে, সে আমার চোখে ধুলো দিয়ে সিন্দুকটি নিয়ে যেতে চায়। এই ধরনের ঘটনাও কতক লোকের ভাগ্যে ঘটে গেছে। কিন্তু অন্য লোকের কথা থাক, আমি সহজে এই চক্রান্তের মধ্যে যাচ্ছি না। আমি খুব সতর্ক হয়ে গেলাম এবং কঠিন স্বরে বললাম :
‘তুমি পিছনে থাকার চেষ্টা কোরো না।’
সে সন্ত্রস্ত হয়ে নীরবে আমার আগে আগে চলতে লাগল। আমি একথা স্বীকার করছি যে, তার মাথায় যে সিন্দুকটি ছিল তা আমার মাথার সিন্দুকটির চেয়ে দ্বিগুণ ভারী ছিল; এবং তা মাথায় নিয়ে হাঁটতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। আর আমাদের গন্তব্যস্থানও ছিল বেশ দূরে। কারণ অগ্নি-আক্রান্ত অঞ্চলকে পুলিশেরা ঘিরে পাহারা দেওয়ায় ভিতরের পথগুলোতে প্রবেশ নিষেধ হয়ে যায় এবং আমাদের পথের দূরত্বও বেড়ে যায়। এমনিতেও যেখানে আমাদের পরিবারের লোকজন নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছিল তা একটু দূরেই ছিল। ভিড়ের জন্য রাস্তা রুদ্ধ থাকায় এখন আমাদের সোজা পথ ছেড়ে এক দীর্ঘ বাঁকা পথ ঘুরতে হবে। এ বাঁকা পথও পার হওয়া যেত, কিন্তু আমাদের প্রথম কাজ ছিল অগ্নি-আক্রান্ত এলাকা থেকে কোনওপ্রকারে বেরিয়ে বাইরে যাওয়া। আমি সিন্দুকটি মাথা থেকে নামিয়ে কাঁধে রাখলাম। বুকে বল আনলাম, কোমর শক্ত করলাম, ইচ্ছাশক্তিকে সতেজ করে দ্রুতগতিতে লম্বা লম্বা পা ফেলতে লাগলাম। সাথে সাথে কুলিকে বললাম যে, সে যেন আমার সাথে চলে।
হঠাৎ একদিক থেকে জনতার এক উত্তাল তরঙ্গ ঠেলা দিয়ে ওঠে। আমার পা কেঁপে সিন্দুক হাত থেকে ছুটে মাটিতে পড়ে গেল এবং আমি মুখ থুবড়ে মাটির উপর পড়ে গেলাম। তার পর ভূমিকম্পে পতিত গৃহের মতো কতক লোক আমার উপর এসে পড়ল। মনে হল যেন আমি এক ধ্বংসস্তূপের তলায় তলিয়ে গেছি; কিন্তু শিগগিরই আমি চেতনা সামলে উঠি এবং দক্ষ ডুবুরির মতো হাত-পাগুলোকে সক্রিয় করে সিন্দুকটি পুনরায় অধিকারে আনি এবং গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াই। কিন্তু তাকিয়ে দেখি কুলিকে কোথায়ও আর দেখা যায় না। আমি যেন সংবিহারা হয়ে গেলাম। সিন্দুকটি মাথার উপর তুলে আমি পাগলের মতো এপাশ-ওপাশ দৌড়াতে লাগলাম। তাছাড়া সকলেই নিজ নিজ ব্যাপারে এমন ব্যস্ত হয়ে রয়েছে যে, আমার অস্থিরতা কেউ বুঝতেই পারল না। বস্তুত, আমার ধারণা হল এবং একথা বিশ্বাস না-করার কোনও হেতুই রইল না যে, আমি চরম মার খেয়ে গেছি। কিন্তু ঠিক সেই সময় দূর একটি গলিতে মানুষের মাথার উপরে এক সিন্দুক ভাসতে দেখা গেল। বুঝতে পারলাম, ওই সিন্দুকটি আমারই। আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। সিন্দুকটিকে অনুসরণ করে আমি দ্রুতগতিতে সেই গলিতে প্রবেশ করলাম। কুলির দিকে ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম তার গতি খুব দ্রুত হয়েছে, বোধহয় সে আমার মনের কথা বুঝতে পারেনি। আমি কুলির পাশে গিয়ে উপস্থিত হলাম। এই সময় দ্রুত চলার ফলে সে হাঁপাচ্ছিল। তার পাদুটি দুর্বল হয়ে যাওয়ার ফলে কাঁপছিল। আমি পিছন থেকে তার কাঁধে হাত দিয়ে কঠিন স্বরে বললাম :
‘পালিয়ে পালিয়ে যাচ্ছ কোথায়?’
‘কোথাও নয়।’ সে হাঁপাতে হাঁপাতে পিছন ঘুরে বলল : ‘আমি তো আপনাকেই খুঁজছিলাম।’
‘আমাকে খুঁজছিলে? না আমার কাছ থেকে পালাচ্ছিলে? এ চালাকি আমার সাথে চলবে না।’ আমি বুক ফুলিয়ে বললাম।
একথায় সে মনঃক্ষুণ্ণ হল। তার চেহারায় রোষের ছায়া পড়ে; কিন্তু সে কিছুক্ষণ আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখল। যেন কিছু বলবার প্রয়াস পাচ্ছে; কিন্তু তার সাহস হচ্ছে না। তার পর কিছুক্ষণ পরে নিজেই সিন্দুকটি মাথা থেকে নামিয়ে কাঁধের উপর রাখল এবং ধীর স্বরে বলল :
‘আচ্ছা, এখন কোনদিকে যাবেন?’
‘ওই সামনের রোডের দিকে চলো।’ আমিও শান্তস্বর ধারণ করলাম, তার পর তাকে পথ দেখালাম।
‘চলুন।’ সে আমার পিছন হয়ে চলল।
কিন্তু আমিও তো কাঁচা ছেলে নই, যে এতকিছু করার পর তাকে আবার পিছনে ছেড়ে দেব। আমি রেগে গিয়ে নিজের সিন্দুকটা মাটিতে নামালাম, এবং তাকে শেষবার সাবধান করে বললাম :
‘দ্যাখো মিয়া আমি তোমায় সোজা কথা বলে দিচ্ছি, এখানে তুমি কোনও হাতসাফাই করতে পারবে না। যদি কুলিগিরি করতে চাও তো চুপচাপ আমার আগে আগে চলো, না তো সিন্দুক নামিয়ে দাও।’
একথা বলে আমি একটু ভয়ও পেয়ে গেলাম যে, সে সিন্দুকটি নিচে আছাড় দিয়ে না-দেয়। কিন্তু সে একটুক্ষণ কী চিন্তা করে পূর্ণদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল এবং কোনওরূপ তর্ক না-করে নীরবে আমার আগে আগে চলতে লাগল। এরপর থেকে তার সম্পর্কে আমি গভীর সতর্কতা অবলম্বন করি এবং একমুহূর্তের জন্যও তাকে না আর আমার পেছনে ছেড়েছি অথবা আমার দৃষ্টির সম্মুখ থেকে তাকে না আর অদৃশ্য হতে দিয়েছি।
আমরা জনতার মাঝ থেকে পথ করে অগ্নি-আক্রান্ত অঞ্চল থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে এক খোলামেলা বড় রাস্তায় উপস্থিত হই। যদিও আমরা সেই আগুন থেকে বেশ দূরে চলে এসেছিলাম, কিন্তু তবুও মনে হচ্ছিল শেষ সীমা পর্যন্ত অগ্নির লালিমাই দেখা দিচ্ছে। এবং চারদিকে লোকের শঙ্কিত ও নিষ্প্রভ চেহারা যেন আকাশের দিকে মুখ তুলে আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি যতই আগে বেড়ে গেলাম, বিপদগ্রস্ত নারী-পুরুষ-শিশুদের চিৎকার ততই কাছে শোনা গেল। আর যদি সেই প্রলয়ংকর ও হৃদয়বিদারক দৃশ্যে কোনওরূপ প্রভাবিত না-হয়ে সেই কুলিটি শুধু আমায় আঘাত হানার চেষ্টায় ছিল, তাতে কী, আমিও তো এত নির্বোধ ছিলাম না যে, মানুষের বিলাপ-আর্তির দুঃখে বিগলিত হয়ে নিজের সমস্ত ঐশ্বর্য হারিয়ে ফেলব। আমিও তো এক কুলির মাথার উপরের সিন্দুক এবং তার মনের চোরটিকে নিজের চিন্তার কেন্দ্র করে রেখেছিলাম। আমিও কোনও দক্ষ গোয়েন্দার মতো তার কাঁপা পায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। এবং নিজের মন, বুদ্ধি, চতুরতাকে সতর্ক করে সেই কুলির সাথে হেঁটে হেঁটে দীর্ঘ পথযাত্রা নিরাপদে শেষ করলাম। যখন গন্তব্যস্থানে পৌঁছাই– যেখানে আমার পরিবারের অন্যান্য লোকজন সব অবস্থান করছিল– তখন আমার মনে হল যেন আমি এক নতুন পৃথিবী ও এক নতুন জীবন লাভ করেছি। আত্মীয়স্বজন আমায় ও সিন্দুকদুটিকে অক্ষত দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলল। বাড়ির দরজার কাছে উপস্থিত হয়ে কুলিটি একমুহূর্তের জন্য আবার থেমে গেল এবং তিক্তস্বরে বলল :
‘লন সাহেব, এখন তো আপনি আগে গিয়ে রাস্তা দেখাবেন।
তার পর কণ্ঠস্বরে যেন পরাজিতের ভাব দেখা দিল। কিন্তু একথা আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল যে, সে আমায় এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে পরাজিত করার চিন্তায় রয়েছে। আমি তাকে কোনও উত্তর দিলাম না, এবং নীরবে পথ দেখাবার জন্য সম্মুখে এগিয়ে গেলাম। সে আমার পেছনে পেছনে কামরার মধ্যে প্রবেশ করল এবং আমার নির্দেশমতো এককোণায় সিন্দুকটি রেখে দিল। সে যখন সিন্দুকটি মাথা থেকে নামিয়ে রেখে দিল আমি তাকে বাইরে বারান্দায় গিয়ে একটু দাঁড়াতে বলি। সে নীরবে বাইরে চলে গেল। আর আমি গিয়ে তার মজুরি সম্পর্কে চিন্তা করতে লাগলাম।
যখন মোট বহনের জন্য কোনও লোক পাওয়া যাচ্ছিল না তখন আমি চল্লিশ টাকা পর্যন্তও দিতে তৈরি ছিলাম। কিন্তু এখন আমি শান্তমনে চিন্তা করে বুঝতে পারি এত টাকা কোনও কুলিকে এই সামান্য কাজের জন্য দেওয়া বোকামি। কোনও বুদ্ধিমান লোক এত টাকা কোনও কুলিকে কীভাবে দিতে পারে! বাড়ির মেয়েছেলেরা ন্যায্যরূপে পরামর্শ দিল যে, পাঁচ টাকা দেওয়া উচিত। পাঁচ টাকা যদিও ন্যায়সংগত ভাড়া, কিন্তু যেহেতু আমি মৌলিকরূপে করুণ হৃদয়ের অধিকারী সেজন্য নিজের করুণা দেখাবার জন্য তার সঙ্গে আরও পাঁচ টাকা যোগ করলাম। দশটাকার নোট হাতে নিয়ে আমি বাইরে বেরিয়ে আসি। কিন্তু বারান্দায় কুলিটিকে দেখতে পেলাম না।
বাইরের দরজার দিকে দেখলাম, নিচে নেমে উঠানে গেলাম, বাইরে রাস্তায় বহুদূর পর্যন্ত তাকিয়ে দেখলাম, কিন্তু তাকে কোথাও দেখা গেল না। বেশ আশ্চর্য বোধ হচ্ছিল যে, সে ভাড়া না-নিয়ে চলে গেল কোথায়! এমন সময় ঘরের একটি ছোট ছেলে এসে আমায় বলল :
‘ভাইয়া, সে তো অনেকক্ষণ চলে গেছে- বলেছে, সাহেবকে বলে দিও, আমি তো আর কোনও কুলি নই।’
অনুবাদ : বশীর আহমদ
রাজকুমার – কৃষণ চন্দর
সুধাকে সুন্দরী যেমন বলা যায় না, তেমনি কুরূপাও বলা যায় না। এমনি একটা সাধারণ মেয়ে ছিল সে। শ্যামলা রঙের পরিচ্ছন্ন মেয়েটির শান্ত মেজাজ, তবে গৃহকর্মে নিপুণা। রান্নাবান্না, সেলাই-বুননি, লেখাপড়ায় দারুণ ভালো। কিন্তু সুন্দরী ছিল না– চাঞ্চল্যও ছিল না তার। এমনকি পুরুষের মনকে আকর্ষণ করতে পারে এমন কোনও বস্তুই তার অবয়বে ছিল না। সে ছিল একটি লাজুক শান্ত মেয়ে। ছেলেবেলায় একাই খেলা করত, মাটির পুতুল বানাত আর সেই পুতুলের সঙ্গেই কথা বলত। পুতুলটাকে একপাশে বসিয়ে খেলা করত। অন্য কোনও মেয়ে তার কাছে এলেই সে পুতুলের সঙ্গে কথাবলা বন্ধ করত। কোনও দুষ্টু ছেলে তার খেলাঘর ভেঙে দিলে সে নীরবে কাঁদত। একটুপর আপনা-আপনি চুপ করত। আবার নতুন খেলাঘর তৈরি করত।
কলেজেও তার বন্ধুবান্ধব বলতে কেউ ছিল না। তার লাজুক স্বভাব সে এখনও সঙ্গে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তার মাতাপিতার দারিদ্র্য যেন তার লজ্জাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তার পিতা চাঁদনিচকের জীবনরাম নাথুমলের ঘড়ির দোকানে ত্রিশ বছর যাবৎ সেলসম্যানের চাকরি করে আসছে। তার এমন সামর্থ্য ছিল না যে মেয়েকে কলেজে পড়াতে পারে। তা সত্ত্বেও মেয়ের যাতে যোগ্য বর জোটে সেই আশায় সুধাকে সে কলেজে দিয়েছে। তার মনে অনেক সময় আশারও উদয় হত যে কলেজের কোনও ছেলেই হয়তো তার মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবে। কিন্তু যখনই সে সুধার দিকে তাকিয়ে দেখত তখন সুধার ঘাড়-ঝোঁকানো চাল, শুকনো বুক, আর স্থির চোখ ও মৌনভাব দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করত। তার পর আবার সে চুপচাপ হুঁক্কা টানতে শুরু করত।
‘সুধার জন্যে বর ধরে আনতে হবে’, কিন্তু এতে বিপত্তি হল এই যে এ-ধরনের বরেরা অনেক যৌতুক দাবি করে। কিন্তু তার অবস্থা এমন যে, অনেক তো দূরের কথা, কম যৌতুকও দেওয়ার সামর্থ্য নেই। চিন্তায় দোল খেতে-খেতে সে এ-চিন্তাও করেছে– আজকাল ভালোবাসাবাসিতেও তো অনেক বিয়ে হয় আর খুব সস্তায়ই হয়। এই তো মালিকরামের মেয়ে গোপীকেই দ্যাখো না– বাপ তো হেল্থ্ মিনিস্ট্রির তৃতীয় শ্রেণির কেরানি, কিন্তু মেয়ের বিয়ে হল লাখপতি ঠিকাদারের সঙ্গে। ছেলেটা গোপীর সঙ্গে কলেজেই পড়ত। বাপ থাকে সরকারি কোয়ার্টারে আর মেয়ে এয়ারকন্ডিশন্ড গাড়িতে চেপে বাপের বাড়ি বেড়াতে আসে। তবে গোপী তো খুব সুন্দরী মেয়ে। আর আমাদের সুধা! সে তো তার মায়ের মতোই অতিসাধারণ।
ওর জন্যে তো কোনও বর ধরে আনতেই হবে। যেমন সুধার মায়ের জন্যে তার মা আর আত্মীয়স্বজনরা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
সুধার মা দু-এক জায়গায় কথা চালিয়েছিল– কিন্তু তারা আর এগোয়নি। তবে একবার একটু জোরেশোরে ধরা হতেই একটা ছেলে সুধাকে দেখতে এসেছিল। কিন্তু সে সুধাকে পছন্দ করল না। ছেলেই-বা কী সুন্দর ছিল! মুখে বসন্তের দাগ, রোগা টিনটিনে চেহারা। কথা বলতে তোতলায়, রঙ কালোজামের মতো। কিন্তু বউটি চাই সুন্দরী। আর যৌতুক চাই স্কুটার একটা। কিন্তু সুধার বাপ তো একটা সাইকেল দিতেও অপারগ। তাই আর কথা এগোয়নি।
কিন্তু সুধার বাপের তো এটা জানা ছিল না যে, এই রোগাপটকা কুৎসিত লোকটার অপছন্দ হওয়ায় সুধা নিজে কত সুখী হয়েছিল। তার পর দুবছরে আরও দুটো ছেলে সুধাকে দেখে ফিরে গেছে এবং বিয়ে করতে রাজি হয়নি। এতে সুধা খুবই স্বস্তি পেয়েছিল। সুধা ওপরে যতটা শান্ত ছিল, ভেতরে ছিল ততটা উত্তপ্ত। কেউ জানত না সুধার কল্পনার দৌড়। বাইরে থেকে একটা সাদামাটা মেয়ে মনে হলেও সে ভেতরে ভেতরে এক রঙিন স্বপ্নের জীবনে বাস করত। সে জীবন এই সংকীর্ণতা ও অন্ধকারময় বন্ধ জীবন থেকে চাকচিক্যময় ও উজ্জ্বল। এ খবর তার বাপ জীবনরামও জানত না আর তার মা মঘিও খবর রাখত না। কিন্তু সে তার মনের গহনে এক উজ্জ্বল জীবন লুকিয়ে রেখেছিল– যেমন ছিন্নবস্ত্রের অঞ্চলে রত্ন বাঁধা থাকে। আর এটা তো আমাদের ট্রাডিশন যে, একজন নোংরা কাপড় পরা বেনিয়াকে দেখে কেউ কি ধরতে পারে যে তার থলের মধ্যে কতটা সোনা আছে? সুধাও খুব লাজুক মেয়ে ছিল, তাই কাউকে মনের কথা বলত না। লোকে শুনে হাসবে যে! আরও কত কথা সে ভাবত, কলেজের সুন্দরী মেয়েরা যদি তার এই মানসিক ঐশ্বর্যের কথা জানতে পারে, তা হলে তারাও বিস্মিত হবে। আর যেসব যুবক বড় বড় গাড়ি হাঁকিয়ে চলে তারা যদি মনের খোঁজ পায়, তা হলে! তারা তো সুধার দিকে ফিরেও চায় না। আর একথাও সত্যি, হাতে ধোওয়া সালওয়ার, কুঁচকানো কামিজ- এমন মেয়ের দিকে কেউ তাকাবে কেন? আর সুধাই-বা কেন তার মনের অতল সম্পদের কথা তাদের জানাবে?
.
জীবনরাম কখনও কখনও তার স্ত্রীকে বলে, ‘কী মেয়েই-না জন্ম দিয়েছ? সারাদিন চুপ করে থাকে, কোনওদিকে তাকায় না, খালি কাজ আর কাজ। মুখে হাসির লেশও নেই। দ্যাখো না কপুর সাহেবের মেয়েদের? কেমন ফুলের মতো ভুরভুর করে। সারা বাড়ি গুলজার করে রাখে আর তোমার সুধা’… জীবনরাম খবরের কাগজ ছুঁড়ে ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে।
তার স্ত্রী বারো আনা সের দরের চালের ভাত আর পানির মতো পাতলা ডাল স্বামীর খাবার টেবিলে রেখে বলে, ‘ওদের কথা বল না। ওদের বাপ সুপারিন্টেন্ডেন্ট। মাসে চারশো টাকা ঘরে আনে। আমার সুধার মাত্র দুটো কামিজ। কপুর সাহেবের মেয়েরা দিনে দুবার কাপড় বদলায়। এটা কখনও ভেবেছ?’
জীবনরাম দাঁত পিষে চুপ করে থাকে। তার মনে নানা প্রশ্ন জাগে… এই চাল এত মোটা কেন? আর ডাল এত পাতলা কেন? তার স্ত্রী সবসময় খিটমিট করে কেন? তার মেয়েটা কেন চুপ করে থাকে? লোকে যৌতুকে স্কুটার কেন চায়?
এমনি অনেক প্রশ্ন তার পাতলা ডালের দানাগুলোর মতো মগজের মধ্যে কিলবিল করতে লাগল। কিন্তু যখন কোনও প্রশ্নেরই জওয়াব পাওয়া গেল না তখন সে প্রশ্নগুলোকে পাতলা ডালের মতো এক চুমুকে গিলে ফেলাই যুক্তিযুক্ত মনে করল।
.
আই.এ. পাস করিয়ে জীবনরাম সুধাকে কলেজ থেকে ছাড়িয়ে আনল। ‘আমি এফোর্ড করি না’, জীবনরাম তার সঙ্গী তোতারামকে বলল –সে সেবামল দুমল ক্লথ মার্চেন্টের ওখানে চাকরি করত। সে অতিসহজেই বলতে পারত যে কলেজে পড়াবার ক্ষমতা নেই। কিন্তু ক্ষমতা শব্দটা কত স্পষ্ট আর পরিষ্কার। যেন কেউ তার মাথায় গুনে গুনে সাতটা জুতোর বাড়ি মারল–আর ‘এফোর্ড’ শব্দটা কত ব্যাপক। এমনি করে দেশি ভাষার সঙ্গে বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণে অনেকটা আবরু থাকে। যেমন বাড়িতে যখন ঝগড়া হচ্ছে, তখন আগন্তুকের আগমনে তার ওপরও পর্দা পড়ে।
‘তোমার বেলা তো এখনও কলেজে পড়ছে, তাই-না?’ সে তোতারামকে জিগ্যেস করল।
‘হ্যাঁ’, তোতারাম ঠিক তোতাপাখির মতোই ককিয়ে উঠল, ‘আগামী শীতে তার বিয়েও হয়ে যাচ্ছে।
‘ছেলের খোঁজ করেছ?’ জীবনরাম শুষ্ককণ্ঠে বলল।
‘হ্যাঁ’। তোতারাম এবার কোকিলের মতো বলে উঠল, ‘সে নিজেই খোঁজ করে নিয়েছে। একসঙ্গেই পড়ে। ছেলেটা অবস্থাপন্ন।’
তোতারাম যাওয়ার পর সে তোতারামের কণ্ঠস্বরকে ভেংচি কেটে বলল, ‘নিজেই বর খুঁজে নিয়েছে!’ তার পর মাটিতে থুতু ফেলে বলল, ‘হারামজাদা!’
দু বছর অতীত হল। আসিফ আলি রোডের একটা ফার্মে সুধা টাইপিস্ট। সে আগের চেয়ে আরও মৌন, ব্যক্তিত্বশালিনী ও পরিশ্রমী হয়েছে। সংসারের অবস্থাও ভালো হয়েছে আগের চেয়ে। কারণ সুধা মাসে একশো টাকার ওপর রোজগার করছে। অফিসের কাজের শেষে সে স্টেনোর কাজও শিখছে। বি.এ. পরীক্ষা দিতেও ইচ্ছুক সেইসঙ্গে। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য হওয়ায় জীবনরাম ও মঘি ।এবার জোরেশোরে সুধার জন্যে বর খুঁজতে শুরু করল। তারা সুধার রোজগার থেকে স্কুটারের জন্যে পয়সা জমাচ্ছে।
.
অনেক চেষ্টার পর জীবনরাম এক ছেলের বাপকে স্কুটারের লোভ দেখিয়ে আটকাতে সক্ষম হল। আনুষ্ঠানিক খরচ, বিয়ের মূল খরচ, যৌতুক, নগদ টাকা, গয়নাগাঁটি সবকিছু স্থির হওয়ার পর ছেলে তার ভাবী বধূকে দেখতে চাইল। ছেলেটির নাম মোতি। আর দেখতে-শুনতে মোতির (মুক্তো) মতোই সুন্দর ছিল।
যখন দেখতে এল তখন তার পরনে ছিল গাঢ় ব্রাউন রঙের স্যুট। সোনালি গায়ের রঙের ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল খুবই সুন্দর দেখাচ্ছিল। শার্টের আস্তিনের বাইরে তার সবল হাতদুটো দেখা যাচ্ছিল। সে যখন একটু হাসিমুখে সুধার দিকে তাকাল তখন সুধার মনে এতদিনকার জমাট বরফ যেন হঠাৎ গলে গেল। তার হাতের চায়ের কাপটা কেঁপে উঠল। অতিকষ্টে সে মোতিকে চা দিল।
মোতি চা খেয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে অতিশয় বিনয়ের সঙ্গে প্রস্থান করল। সঙ্গে তার বোনেরা ছিল। পরদিন সেই বোনেরাই খবর দিল– মেয়ে পছন্দ হয়নি। সে রাতে সুধার ঘুম হল না। সারারাত মোতির সুন্দর চেহারা, সেই হাসিমুখ, তার হাতের সামান্য ছোঁয়া তাকে যেন সুড়সুড়ি দিয়ে জাগিয়ে রাখল।
‘মেয়ে পছন্দ হয়নি! হুঁ!’ মগ্ঘি কড়াইতে তরকারি চাপিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল, ‘নিজে যেন একেবারে কন্দর্প! গায়ের রঙের দেমাক কত! তবে নিজের নাকটা দেখে না! আর নিগ্রোদের মতো কোঁকড়ানো চুল। আর বোনগুলো কী! একেবারে মেথরানির মতো দেখতে– তার ওপর রঙের পোঁচ। মাথায় চুলগুলো দেখলে মনে হয় মাথায় একটা বস্তা চাপিয়েছে। মেয়ে পছন্দ হয়নি! হুঁ!’ বলেই সে জোরে তরকারি নাড়া দিল। মনে হল যেন তরকারি নয়–ছেলেটাকেই রাঁধছে কড়াইয়ে চাপিয়ে।
বাড়ির লোকেরা বা পাড়া-প্রতিবেশী এবং অফিসের সহকর্মীদের এই ধারণা ছিল যে, সুধার কোনও অনুভূতিই নেই। তাছাড়া অফিসের কাজে সে বেশ দক্ষ। কারও সঙ্গে প্রেমপ্রীতির ভাব ছিল না। ধীর ধীরে তার চোখদুটো মলিন হতে লাগল, ঠোঁট নীরব হয়ে চেহারা ধোঁয়াটে হয়ে চলল। তার চেহারা এমন হয়ে গেল যা দেখলে বরফখণ্ড বলে মনে হত। কেরানিরা পরস্পর বলাবলি করত, সুধাকে যে বিয়ে করবে তাকে আর পাহাড়ে যেতে হবে না।
তাই মোতি যখন তাকে পছন্দ করল না তখন সুধার প্রতিক্রিয়া কী হল, তা কেউ জানতে পারল না। এই প্রথম সে একজনকে মন দিয়েছিল, আর তা কেউ জানত না। জানবেই-বা কী করে? সে কি কাউকে কিছু বলত?–আমাকে যে দেখতে এসেছিল তাকে আমি মন দিয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে পছন্দ করেনি।– আর সবাই তো প্রেমে পড়লে কাঁদে কিন্তু সে বেচারি তো কাউকে কিছু বলে না।
সেদিন অফিসে সুধা ওভারটাইম কাজ করল। সন্ধ্যা হতেই সে অফিস থেকে বের হল এবং তার কালচে রঙের পার্সটা হাতে ঝুলিয়ে কাছেই আসফ আলি পার্কে গিয়ে একটা বেঞ্চে একা একা বসে রইল। পার্কটা দিল্লি-গেটের পাশেই এককোণে অবস্থিত। কয়েকটা গাছ আর কয়েকটা বেঞ্চ ছিল এই পার্কে। কয়েক টুকরো ঘাসের চাতাল– পাশেই ট্রাফিকের হই-হল্লা। আজ অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি নীরব ছিল জায়গাটা। সুধা রোজই এখানে আসত, কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিয়ে তবে বাড়ি যেত। কিছুক্ষণের জন্য সে তার কল্পনার দুনিয়ায় ডুবে যেত। একাকিত্বকে সে ভয় পেত না। এই একাকিত্বই তার একমাত্র আশ্রয় ছিল। অন্ধকারেও সে ভয় পেত না। বরং অন্ধকারই তার প্রিয় বন্ধু ছিল। গুণ্ডাদের ভয়ও সে করত না। তার স্বভাবে কী এমন বৈশিষ্ট্য ছিল যে গুণ্ডারাও দূর থেকে দেখেই সটকে পড়ত। পাশ কাটিয়ে চলে যেত।
আজ অন্ধকার খুব গাঢ় ছিল। গাছের নিচে নীরবতাও বেশি অনুভূত হচ্ছিল। পাথরের বেঞ্চটাও অধিকতর ঠাণ্ডা লাগছিল। সুধা কয়েক মিনিট বেঞ্চের উপর বসে রইল। কিন্তু তার শ্রান্তি দূর না-হওয়ায় একটা গাছের নিচে গিয়ে গুঁড়ির সঙ্গে ঠেস দিয়ে বসে পড়ল। তার চোখ বুজে এল।
.
হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, ‘তুমি এখানে একা বসে কী করছ?’
সুধা চোখ মেলে তাকাল। মোতি পাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। সেই সুন্দর ব্রাউন স্যুট পরা। তেমনি ধবধবে সাদা দাঁতগুলো চকচক করছে।… তার হাতগুলো কী সুন্দর! সুধার গলায় যেন কী আটকে গেল– সে কথা বলতে পারল না।
মোতি তার পাশে এসে বসল। এত কাছে যে তার প্যান্ট সুধার শাড়ি স্পর্শ করল। সে ধীরে ধীরে জিগ্যেস করল, ‘আমি অপছন্দ করায় তুমি রাগ করেছ?’
সুধা আস্তে মাথা নাড়ল। তার চোখে পানি।
‘খুব খারাপ লাগছিল, তাই-না?’
সুধা আবারও মাথা নেড়ে সায় দিল। এবার তার চোখের পানি গাল বেয়ে পড়তে লাগল। সে কাঁদল…।
মোতি তার কোটের পকেট থেকে রুমাল বের করে সুধার চোখ মুছে বলল, ‘এতে কান্নার কী আছে! প্রত্যেক লোকেরই পছন্দ-অপছন্দের অধিকার আছে। তাই না?’
‘কিন্তু তুমি তো আমার কিছু দ্যাখোনি। আমার হাতের ফুলকো লুচি বা মটর-পোলাও তো খাওনি। তুমি কি আমার মনের ব্যথা বুঝবার চেষ্টা করেছিলে? আর সেই অনাগত শিশু– তোমাকে দেখামাত্রই যে আমার গর্ভাশয়ে স্পন্দিত হয়ে উঠেছিল? তুমি সেই হাতটাও দ্যাখোনি যে তোমার পা ধুইয়ে দিত– যে তোমার জামার বোতাম সেলাই করে দিত। তুমি আমার গায়ের রঙ দেখেই ভড়কে গেলে? সেই সুন্দর সোয়েটার –যেটা তোমার জন্যে বুনতাম তার রঙটার কথা চিন্তা করলে না? মোতি! তুমি আমার হাসি দ্যাখোনি, কান্নাও দ্যাখোনি, তোমার মাথার চুলে আমার আঙুলের স্পর্শও পাওনি। আমার কুমারী দেহকে তোমার সুডোল বাহুবন্ধনে কম্পিত হতেও দ্যাখোনি। তবে কী করে তুমি আমাকে অপছন্দ করলে?’
আরে বাপ… এত লম্বা বক্তৃতা সে অনায়াসে কীভাবে দিল! তার শুধু এটুকুই জানা ছিল যে সে কাঁদছে, আর তার মাথাটা মোতির কাঁধে ভর দেওয়া আছে। আর মোতি লজ্জায় মুখ নামিয়ে আস্তে আস্তে তার কাঁধে হাত বোলাচ্ছে।
.
সেদিন খুব দেরিতে সে বাড়ি ফিরল। মা জিগ্যেস করায় সে লাপরোয়াভাবে বলে দিল, ‘অফিসে দেরি হয়েছে।’ তার পর হাতের ব্যাগটা বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে বেশ ভারিক্কি গলায় খাবার চাইল। ফলে তার মা চমকে উঠল, এমনকি বাপও। আজ সুধার কান্নাভেজা চোখের অতলে যেন এক আনন্দের প্রবাহ চলছে– যেন নিবিড় মেঘমালায় অশনি সংকেত।
সুধার মা ঠোঁট কামড়ে তার স্বামীর দিকে বাঁকাচোখে তাকিয়ে রইল যেন সে অনেককিছু বুঝে ফেলেছে। জীবনরামও এক মুহূর্ত মেয়ের দিকে স্নেহাপ্লুত চোখে তাকিয়ে রইল। তার পর খাবারে মন দিল।
নিশ্চয়ই কোনও ব্যাপার আছে। আর যেহেতু সুধা নারী, তাই এই রহস্যের অন্তরালে কোনও পুরুষের অবস্থান অবশ্যম্ভাবী বলেই স্বামী-স্ত্রী আন্দাজ করে নিল।
কিছুদিন পরে সেই সন্দেহ আরও দৃঢ়তর হল। মঘি তার এক বান্ধবীকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়িতে এনেছিল মেয়ে দেখাতে। কিন্তু এবার ছেলেকে ‘না’ বলতে হল না– সুধাই বিয়ে করতে অস্বীকার করে বসল। তখন সুধার মা আরও চমকে উঠল– নিশ্চয়ই সুধার সঙ্গে কারও ব্যাপার-স্যাপার চলছে।
এবার সে মেয়ের জন্যে যৌতুক গোছাতে লাগল আর জীবনরাম হুঁক্কা টানতে টানতে চিন্তা করতে লাগল, কবে সেদিন আসবে যেদিন সুধা এসে তার মাকে খবরটা শোনাবে আর জীবনরাম ক্রোধান্ধ হয়ে সুধাকে ধমক দেবে, গালি দেবে– তোর এত সাহস! আমাদের লুকিয়ে নিজেই বর পছন্দ করেছিস! বাড়ি থেকে বের করে দেব– পিঠের চামড়া তুলে ফেলব। বংশের সুনাম নষ্ট করলি…! তার পর সে স্ত্রীর অনুরোধে শান্ত হয়ে হুঁক্কা টানতে টানতে জিগ্যেস করবে– কে সে? যেই হোক-না সে, সুধা বলা মাত্রই সে তার হাত বাড়িয়ে দেবে। পঁচিশ বছর হয়ে এল, আর কতদিন ঘরে রাখা যায়!
কিন্তু দিন যায়, মাস-বছর পেরিয়ে যায়, সুধা কিছুই বলে না। তারা অপেক্ষা করছে, কিন্তু পোড়ারমুখী কিছুই বলে না। অবশেষে শ্রান্ত হয়ে তারা আবার মেয়ের জন্যে বর খুঁজল, কিন্তু সুধার সেই একই কথা– বিয়ে করব না।
শেষ বরটা তার বাপ খুঁজে এনেছিল –সে হল একজন মিষ্টান্নবিক্রেতা। বয়েস চল্লিশ পেরিয়েছে।
সেদিন গোধূলির পরে আবছা অন্ধকারে গোলাপগন্ধী সন্ধ্যায় সুধা মোতিকে বলল, ‘ওরা আজ একজন বড়ো মিঠাইঅলাকে ধরে এনেছিল আমার জন্যে।’
‘তার পর?’ মোতি জিগ্যেস করল।
‘আমি সোজাসুজি বললাম বিয়ে করব না।’
‘আরে পাগলি, তা বললে কেন? বিয়ে করতে, আর সারাজীবন মিষ্টি-হালুয়া খেতে।’
‘আর তোমাকে ছেড়ে দিতাম?’ সুধা অভিমানভরা চোখে তাকাল মোতির দিকে। মোতি তার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি তো এখনও তোমাকে বিয়ে করিনি। ‘তাতে কী?’ সুধা মোতির মুখে মুখ লাগিয়ে বলল, ‘তুমি তো আমারই। বিয়ের চেয়েও বড়। সবসময় তুমি আমার আয়ত্তে আছ। যেন…’
মোতি হেসে বলল, ‘তা ঠিক। আমি সম্পূর্ণরূপে তোমার মুঠোয়। যখন ইচ্ছে, ডাকলেই চলে আসব।’
‘প্রথমদিকে তো এমন ছিলে না।’ সুধা মোতির চঞ্চল চোখে তাকিয়ে বলল, ‘তখন তো অনেক দেরি করে আসতে।’
‘প্রথমে তো এত গভীর ভালোবাসাও ছিল না। আর কারওর অন্তরকে বুঝতে তো সময়েরও প্রয়োজন আছে।’ মোতি সুধার কানে কানে বলল, আর সুধা আবেশে চোখ বন্ধ করল। পরে যেন তার মুখে মোতির তপ্ত শ্বাস ও চুম্বনের স্পর্শ অনুভূত হল।
‘কাল কোথায় দেখা করবে?’
‘তুমি যেখানে বলো, লাভার্স লেনে।’
‘উঁ হুঁ।
‘কোটলায় ঘোড়দৌড় হচ্ছে এখন।’
‘আমি কি ঘোড়া কিনব নাকি?’ সুধা হাসল।
‘ওল্ড হলে সাহিত্য সম্মেলন হবে।’
‘না, না!’ সুধা কানে হাত দিল।
মোতি চুপ করল এবার।
তার পর সুধা বলল, ‘কাল ছবি দেখব। ‘বসন্ত’ সিনেমায় খুব ভালো ছবি আছে। আমি দুটো টিকেট কিনব। ঠিক পোনে ছ’টায় তুমি এসো।’
‘টিকেট আমিই কিনব।
‘না, এ ছবি তো আমি দেখাচ্ছি। তুমি নাহয় আরেকটা দেখিও। আমি কি মানা করেছি?… কিন্তু ভুলো না। কাল সন্ধ্যা পৌনে ছ’টায় ‘বসন্ত’ সিনেমার সামনে।’
‘বসন্ত’ সিনেমার বাইরে প্রচণ্ড ভিড়। সুধা দুটো টিকেট কিনল। এক প্যাকেট কিশমিশ আর বাদামও কিনল। ছবি দেখার সময় তার কিছু খাওয়ার অভ্যাস আছে। পৌনে ছ’টা বাজল। ক্রমে ছ’টা বাজল। প্রথম শো’র দর্শকরা বেরিয়ে গেল। দ্বিতীয় শো’র দর্শকরা হলে ঢুকল। চারদিকে আলো জ্বলছে। আর দারুণ ভিড়। ফেরিঅলা, রিকশা-টাঙ্গাঅলাদের হাঙ্গামা। মোতি আবার ভিড় ভালোবাসে না। হইচই পছন্দ করে না। সুধা তার মেজাজ চিনে নিয়েছে। সে চায় নীরবতা, অন্ধকার আর একাকিত্ব। মোতি খুবই ভাবপ্রবণ আর রুচিবান।
সোয়া ছ’টায় সে সিনেমাহলে গিয়ে বসল। পাশের সিটের উপর রুমাল রাখল। কিশমিশ ও বাদামের প্যাকেটও শেষ হয়ে চলল। কিন্তু মোতি এল না। তার পর হলের আলো নিভে যেই ছবি শুরু হল, তখনই সুধা অনুভব করল, মোতি তার হাত দিয়ে সুধার হাত ধরেছে। অন্ধকারে নিঃশব্দে সে সুধার পাশে এসে বসেছে। সুধা তার হাতে চাপ দিয়ে বলল, ‘অনেক দেরি করেছ।’
‘সরি!’ মোতির কণ্ঠ বেদনার্ত।
‘তোমার জন্যে বাদাম আর কিশমিশ এনেছি। খাও।’
মোতি কয়েকটা বাদাম ও কিশমিশ হাতে নিয়ে মুখে পুরল। সুধা এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে ছবি দেখতে লাগল। এখন আর কথা বলার সুযোগ ছিল না। তবে অনুভব করছিল, মোতি তার হাত ধরে আছে। আর কখনও কখনও সে মোতির কাঁধে মাথা রেখে মনকে শান্ত করছে।
মোতি তার কানে কানে বলে, ‘আমার কাঁধে মাথা রেখে তুমি কী দেখছ? ছবি তো দেখা যায় না!’
‘যে-ছবি আমি দেখতে পাই, তা আর কারওর নজরে আসে না।’ সুধা আন্তরিকতার সঙ্গে বলল।
.
ধীরে ধীরে সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করল যে সুধার মলিন চোখদুটো ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ভুরুতে কাজল পরলে সে চোখ আরও ধারালো হয়ে যায় তলোয়ারের মতো। বুকের মাংসও ফুলে উঠল, কোমর সরু হতে লাগল আর গতিতে এল অনিন্দ্য ছন্দ। দিনে দিনে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেতে লাগল। কাপড় যদিও কম দামের ছিল, কিন্তু তা অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন এবং দক্ষ দরজির মতো সেলাই-করা। ভালো দরজি দিয়ে কাপড় তৈরি তো তার সাধ্যের বাইরে ছিল– কিন্তু সে নিজেই এ বিদ্যায় নৈপুণ্য অর্জন করল। তাই দেখা যেত, নতুন ডিজাইনের জামা সে প্রতিদিন পরত –যা অন্য কোনও মেয়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু এগুলো সে নিজেই তৈরি করেছে এমন কথা সে কোনও মেয়েকে বলত না। তার অফিসের কোনও মেয়ে জিগ্যেস করলে সে এমন এক দরজির নাম বলত, যেখানে বড়লোক ছাড়া আর কারও পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। অফিসের মেয়েরা একথা শুনে মনে-মনে জ্বালা অনুভব করত। তারা কখনও সুধাকে জিগ্যেস করে, ‘তোর স্বামী কেমন রে?’
‘খুব গোরা রঙ, কোঁকড়া চুল, হাসলে যেন মুক্তো ঝরে।’ সুধা জওয়াব দেয়।
‘কত মাইনে পায় সে?’
‘বারোশো।’
‘বারোশো!’ মেয়েরা বিস্মিত হয়। ‘বারোশো তো আমাদের ফার্মের ম্যানেজার পেয়ে থাকে।
‘সে-ও একটা ফার্মের ম্যানেজার।’ সুধা জওয়াব দেয়।
‘একদিন দেখাবি? আমরা দেখব, কেমন তোর…’
‘তা দেখাব-না কেন? বলিস তো অফিসেই একদিন ডেকে দেখিয়ে দিই।’
এটা তার কথার কথা। সুধা মোতিকে দেখাবার পাত্রীই নয়। মরে গেলেও সে তার মোতিকে দেখাবে না। এসব মেয়েদের বিশ্বাস কী… কিন্তু তা সত্ত্বেও সুধা এমন আত্মনির্ভরতার সঙ্গে অফিসে ডেকে আনার কথা বলে যাতে মেয়েরা আর সাহসই করে না উচ্চবাচ্য করতে। তারা মনে-মনেই বলতে থাকে।
.
সুধার বাপ মনের জ্বালায় ভুগে মরে। কারণ সুধা বিয়ে করল না। পাড়ার লোকে নানা কথা বলে। সে মেয়েকে কিছু বলতেও পারে না। সুধা বড় হয়ে গেছে। তার ব্যক্তিত্ব আছে, তাছাড়া মাসে মাসে দুশো টাকা ঘরে আনে। অবশেষে সুধার বাপ মারা গেল। বাপ মারা যাওয়ার পর তার ভাইয়েরা বিয়ে করে নিজেদের পছন্দমতো ঘর বাঁধতে দূরে দূরে চলে গেল। তার পর তার ছোটবোনেরও বিয়ে হল। সুধার মা তার বড়মেয়ের অবস্থা দেখে আস্তে আস্তে রুগ্ণ হয়ে পড়ল এবং অল্পদিনের মধ্যে সে-ও মারা গেল। আর দুনিয়ার তাবৎ দুঃখ নিয়ে সুধা একাই রয়ে গেল।
শেষে একদিন সে পুরনো বাড়ি ছেড়ে সিভিল লাইনে দোতলা বাড়ির দু-কামরাঅলা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতে লাগল। বাড়িতে আসা-যাওয়ার পথটাও আলাদা ছিল। অতএব এ ব্যাপার সে স্বাধীন ছিল।
এখন তার বয়েস পঁয়ত্রিশ হয়ে গেছে। কিন্তু তাকে অত বয়েসি বলে মনে হয় না। তার ঠোঁটে সদা হাসি লেগেই আছে। চোখে আনন্দের ঝিলিক। তা সত্ত্বেও তাকে দেখা যেত অত্যন্ত ভারিক্কি মেজাজের ব্যক্তিত্বশালিনী মহিলার মতো। এ সময়ের মধ্যে সে বি.এ. পাস করেছে। আর আছে তার বইপড়ার শখ। এখন সে সচ্ছল, সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করে।
কয়েক বছর আগে থেকেই সে সিঁথিতে সিঁদুর পরত আর কপালে দিত সোহাগিনীর টিপ। কিন্তু কেউ জানত না কোথায় এবং কার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। তবে লোকে জানত একটা-কিছু হয়তো আছে। যার সঙ্গে সে সন্ধ্যা অতিবাহিত করে– এটাও জানত, হয়তো এমন কোনও কারণ আছে, যাতে তাদের বিয়ে হয়নি। তবে প্রতি সন্ধ্যায় তারা মিলিত হয়। আর যখন সবাই ঘুমিয়ে যায় কেউ কাউকে দেখতে পায় না– যখন সকলের চোখে ঘুম নেমে আসে সেই তন্দ্রাভরা মুহূর্তে কে যেন নিঃশব্দে এসে সুধার দরজার কড়া ধীরে ধীরে নাড়ে– এবং চুপিসারে ঘরে ঢুকে পড়ে। কেউ তাকে দেখেনি, তবু তারা সুধাকে কিছু বলত না, কারণ সুধা গম্ভীর প্রকৃতির ভদ্রমহিলা। তার মাথায় সিঁদুরের টিপ জ্বলজ্বল করছে। তাকে কোনও কথা বলবেই-বা কী করে!
সুধার বয়স চল্লিশ হল। সেই সন্ধ্যার কথা সুধা ভুলতে পারছে না। সুধা মোতিকে নিয়ে মথুরা রোডে জাপানি গার্ডেনে গেছে। এটা বাগানের চেয়ে নৈসর্গিক উদ্যান বলে ভ্রম হয়। গোধূলি লজ্জাবতী কুমারীর মতো মুখ লুকিয়েছে। রাত তার শ্যামল আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে। আকাশে তারার মেলা। সুধা আজ একেবারে মৌন হয়ে আছে। মোতিও নীরব।
মোতি এখনও তেমনি সুন্দর– যেমন যৌবনে ছিল সে। আজও সে নিত্যকার মতো সেই ব্রাউন স্যুট পরে আসে। তাকে দেখে মনে হয় মোতির জীবনে আসেনি কোনও পরিবর্তন– একমাত্র তার কানের পাশের চুলগুলোতে একটু সাদা ছোপ লাগা ছাড়া। আগের মতোই সে সুন্দর, আকর্ষণীয় আর সহৃদয় ছিল– যাকে দেখামাত্রই সুধার বুকে স্পন্দন শুরু হত। যেমন সেই প্রথমদিনে হয়েছিল।
.
মোতি তাকে বলল, ‘তুমি আমাকে বিয়ে করলে না কেন?’
‘একবার অস্বীকার করবার পর’, সুধা আস্তে আস্তে বলল, ‘তোমাকে বিয়ে করা যেত না– শুধু প্রেম করা যেত। তুমি জানবে কী করে যে যখনই তুমি অমত করলে তখন থেকেই তুমি আমার হয়ে গেলে আর এটা জানতে হলে নারীর মন দরকার।’
‘তুমি চল্লিশ বছরের হয়ে গেলে –এজন্যে দুঃখ হয় না যে তুমি আমাকে বিয়ে করলে না…?’
একথা শুনে সুধাও নীরব হল। দীর্ঘ নীরবতার পর মোতির হয়তো মনে হল, সুধা মনে-মনে কাঁদছে।
সে আস্তে করে ঘাড় দুলিয়ে ডাকল, ‘সুধা!’
সুধাও তেমনি আস্তে বলল, ‘আমি ভাবছিলাম যে তোমাকে বিয়ে না করে আমি কী হারালাম। এমন কোনও সন্ধ্যা তোমায় বিনা কাটিয়েছি কি? মনে করো তো, কোথায় কোথায় না-ঘুরেছি তোমার সঙ্গে? যেখানেই তোমাকে ডেকেছি, সেখানেই তো তুমি হাজির হয়েছ আর যখনই ডেকেছি তখনই কাজকাম ছেড়ে তুমি কি আসতে বাধ্য হওনি? বিয়ের মানে যদি সঙ্গলাভ হয়, তা তো আমি পেয়েছি।’
আবার একটু চিন্তা করে বলল, ‘এই দীর্ঘ সঙ্গলাভে কোনওদিনই তোমার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়নি। বরাবর তোমাকে সেই হাসিমুখেই আমি দেখেছি। বছরের-পর-বছর ধরে তোমার হাতকে আবশ্যক হলেই আমার হাতের মুঠোয় পেয়েছি, তার স্পর্শের উষ্ণতা আমার দেহের প্রতি রোমকূপে অনুভূত হয়েছে। তোমার দেওয়া ফুল আমার খোঁপায় শোভা পেয়েছে। তোমার চুম্বন আমার ওষ্ঠে লেগেছে। তোমার একনিষ্ঠতা আমার অন্তর ভরে দিয়েছে। কোনও মেয়ে প্রেমের বদলে এর চেয়ে বেশি কী পেতে পারে, তুমিই বলো?’
সুধা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সারাদেহ এলিয়ে দিল মোতির বাহুতে। মনে হল, মোতির দু বাহু নয়– চারটি অথবা আটটি– আর সে তার দেহ ও মন দিয়ে অনুভব করল তার উষ্ণতা, সে বাহুলতাকে আকর্ষণ করে তাকে বক্ষলগ্ন করল। সুধা তার সমস্ত সত্তা সেই বাহুবন্ধনে সমর্পণ করে দিল। যেমন চাঁদের আলোয় ফুলের কলি ফোঁটার জন্যে উন্মুখ হয়ে ওঠে– তার দেহও যেন মোতিকে গ্রহণ করার জন্যে তেমনি উন্মুখ হয়ে উঠল। মিটমিটে তারার আলোয় গাছের সবুজ পাতার ঝালরের মাঝখান দিয়ে চাঁদ উঁকি দিল।
চাঁদের আলো তার চুলে, চোখে, ঠোঁটে ও মুখে এসে পড়ল– আর জোছনার লহর যেন তার রক্তে তরঙ্গ তুলল। হায় আমার মোতি– মোতিহার-মোতিচুর- আমার মিষ্টান্ন– আমি তো তোমারই–
একটু পরে যখন সুধা চোখ মেলে তাকাল তখন তার চোখের ঔজ্জ্বল্য ও মদির ভাব দেখে মনে হল মোতি এখনই তাকে ভালোবাসা জানিয়ে গেল।
সেই সন্ধ্যা– সেই রাত –সুধার কাছে ভুলবার নয়। কারণ সে রাতেই সে-পূর্ণতা লাভ করে। এবং তাদের ভয়ের জীবনও পরিপূর্ণ হয়। যেমন সময়, বয়স, চাঁদের আলো ও আবেগ এক বৃন্তে এসে উপনীত হয় এবং আবেগের একটা কণাও যেন ছিটকে বাইরে না-যেতে পারে। এমন মুহূর্ত মানুষের জীবনে কখন কীভাবে আসে, কারই-বা আসে– আর এলেও সে তার প্রভাব রেখে যায়– যা শুধু অনুভবই করা যায়। মনে হয়– এই মুহূর্তটুকুর জন্যেই আমি বেঁচে ছিলাম এতকাল। সম্ভবত সুধাও এ মুহূর্তে তাই অনুভব করল– আর কখনও এমনভাবে অনুভব করেনি সে।
.
এর কয়েকদিন পরই সুধার অফিসের ম্যানেজার বদলি হয়ে গেল– আর তার জায়গায় যে এল তাকে সুধা মোটেও সহ্য করতে পারছিল না। একে তো লোকটা কুৎসিত দর্শন– এককালে হয়তো তার রঙটা ফর্সাই ছিল কিন্তু এখন তো পোড়া তামার মতো হয়েছে। আর নাকটা কী মোটা! তার ওপর অতিরিক্ত মদ খাওয়ার দরুন সেই নাকের ওপর রগগুলো নীল সুতোর জাল বুনেছে। তার নাক দেখেই সুধার মনে হয়, এটা নাক নয়– এটা বড় ডুমুর– হয়তো কথা বলতে বলতে এখনই ফেটে যাবে। থুতনি আর চিবুকের চামড়া ঝুলে পড়েছে। চোখের চারপাশে কালি-লেপা। মাথার চুল ঝরে গেছে। আর কথা বলতে গেলে মনে হয়, যেমন কোনও বুড়ো ব্যাঙ শ্যাওলা-ধরা পুকুরের মাঝে নড়াচড়া করছে। দারুণ ঘৃণা হয় তাকে দেখলে। আরও মুশকিল হল সুধার, এতদিন কাজ করতে করতে সে এখন হেড-স্টেনো হয়ে গেছে। তাকে সবসময়ই থাকতে হয় ম্যানেজারের ঘরে। তার চেয়েও বিপদ হল, এই কুৎসিত চেহারার লোকটাকে সে আরও যেন কোথায় দেখেছে– চেহারাটা চেনা-চেনা। কিন্তু কোথায়? স্মৃতির ওপর জোর দিয়েও সে মনে করতে পারে না।
নিজের মনেও সে ভাবে, এই মড়াটাকে সে হয়তো কনাট প্লেসে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে। কিন্তু যখনই সেই ম্যানেজার ফাইলটা তুলে নিয়ে সুধার টেবিলে রেখে হাত দোলায় তখন সুধার মন চঞ্চল হয়ে পড়ে। সে চিন্তা করে, লোকটা কে? কে এমন করে চলাফেরা করত? আমার মৃত পিতা? অথবা কোনও ভাই? যার কথা আমার মনে পড়ে! চিন্তা করে সে কূল পায় না। পরক্ষণেই নিজের কাজে মন দেয়। কিন্তু সারাদিন মন জ্বলতে থাকে।
.
মাস পয়লায় সবাই মাইনে নিয়ে চলে গেল –ম্যানেজার সুধাকে থাকতে বলল। সুধা ম্যানেজারের ঘরে গেলে ম্যানেজার তাকে একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলল। তার পর ড্রয়ার খুলে হুইস্কির বোতল খুলে বড় একটা পেগ এক নিঃশ্বাসে সাবাড় করল। সুধা তখন রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে আসবার জন্যে উঠল ম্যানেজার তার হাত ধরে বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘রাগ কোরো না। তোমার প্রমোশনের ফাইল আমার টেবিলে আছে। আর আমি জানতে পারলাম যে তুমি এখানকার পুরনো লোক। তোমার নাম তো সুধা, তাই না?’ ম্যানেজার এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল।
সুধা বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে তার দিকে তাকাল। এতদিন কাজ করছে, তবু আমার নাম জানে না! ম্যানেজার আরেকটা পেগ চড়িয়ে বলল, ‘মানে আমি বলছি যে তোমার বাপের নাম জীবনরাম নয়?’
‘হ্যাঁ, তাই। সে তো অফিস-ফাইলেই লেখা আছে। তা আবার জিগ্যেস করে কী লাভ?’ সে আবার উঠতে গেল।
‘বসো বসো।’ ম্যানেজার মিনতির সুরে বলল, ‘তুমি আমাকে চিনতে পারলে না?’ ম্যানেজার সোজাসুজি তার দিকে তাকিয়ে বলল।
‘না!’ সে রাগের সঙ্গে বলল।
‘তোমরা জিন্দান মহল্লায় থাকতে?’
‘হ্যাঁ।’
‘একদিন আমি তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। তোমার সঙ্গে কথাও বলেছিলাম। সেদিন তুমি একটা সাধারণ মেয়ে ছিলে। আজ তুমি একজন মহীয়সী নারী হয়েছ। আমি তোমায় দেখতে গিয়েছিলাম। তখনই তোমার সঙ্গে কথা বলেছিলাম।’ ম্যানেজার বলল।
‘কবে? সে কবে?’ সুধা অস্থিরভাবে প্রশ্ন করল।
বুড়ো ম্যানেজার সুধার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার নাম মোতি।’
সুধার দেহ অবশ হয়ে গেল।
‘আমি খুবই হতভাগা। তাই তোমাকে বিয়ে করিনি। আমি তোমাকে ভালো করে দেখিনি। বুঝিওনি। আর সামান্য সময়ে লোকে কীই-বা জানতে পারে? সৌন্দর্য তো চামড়ার নিচে লুকিয়ে থাকে। আমি যুবক ছিলাম। তাই ফর্সা রঙ আর সম্পদের সন্ধান করতাম। আমি যে স্ত্রী পেলাম– সে ফর্সাও ছিল, সম্পদও এনেছিল আর সেইসঙ্গে এনেছিল অহংকার, নিষ্ঠুরতা, অবাধ্যতা। কয়েক বছরেই আমার পাঁচটি সন্তান জন্মাল। তার কটি যে আমার তা জানিনে। কিন্তু লোকে নানা কথা বলত! আমি শুনতাম আর বারনারী সন্ধানে যেতাম। তার পর আমার সারাদেহে নিষ্ঠুরতা, মদ্যপান, কুৎসিত রোগ ও ব্যর্থতার গ্লানি ফুটে উঠল। তাই বয়স না-হতেই আমি বৃদ্ধ হলাম– নিভে গেলাম। সে এখন মরে গেছে। তাই তার কথা বলে লাভ নেই। আর বলবই-বা কী! দোষ তো আমার। এই চোখ তোমাকে চিনতে পারেনি আমার এই চোখ হীরেকে পাথর মনে করে ফেলে দিয়েছিল। তুমি কি আমাকে কোনও প্রকারেই ক্ষমা করতে পারো না? তুমি কি… তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে পারো না? আমার বয়েস তো তত বেশি নয়। সারাজীবন আমি ভালোবাসা পাইনি। তাই জীবনভর ছটফট করে বেড়িয়েছি।’
.
ম্যানেজার বলছিল আর সুধা বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। একবার তার মনে হল, সে মোতিকে বলবে– এতদিনে তোমার সময় হল আসবার– কুৎসিত, টেকোমাথা বৃদ্ধের রূপ নিয়ে। আর বিপজ্জনক রোগ নিয়ে। এখন তুমি আমাকে বিয়ের কথা বলছ? কিন্তু আমি তো সমস্ত জীবনটাই তোমাকে উৎসর্গ করেছিলাম। তুমি জানো না যে সারাটা যৌবন শুধু তোমার ধ্যানেই অতীত হয়েছে। তোমার চিন্তায়ই জীবনের সবগুলো বসন্ত কাটিয়েছি। যৌবনেরও প্রতিটি আবেগ তোমার একবার প্রেমপূর্ণ চাহনির বদলে বিকিয়ে দিয়েছি। তোমার ছায়াকে অবলম্বন করে সারাটা জীবন একা একা পথ চলেছি। অন্ধকার পার্কে তোমার ধ্যান করেছি একা একা বসে। নিজের পয়সা খরচ করে আমি তোমার কাছ থেকে শাড়ি উপহার নিয়েছি। তোমার দেওয়া গয়না পরেছি– সিনেমা দেখেছি পাশের সিট খালি রেখে। আমার বাপ মারা গেছে, মা মারা গেছে, আমার গর্ভাশয়ের সন্তান দূর থেকেই আমাকে ডাকত কিন্তু আমি কারওর কাছে যাইনি! তোমার ধ্যান করেছি– চল্লিশ বছরের কৌমার্য পালন করে– চোখ, কান ও মুখ বন্ধ করে। আমি কত সুখী ছিলাম– কত মগ্ন ছিলাম ধ্যানে। আমি তোমার কাছ থেকে কিছু চাইনি। বিয়ের চাপও দিইনি। সোহাগরাত পালনের প্রত্যাশাও করিনি। চাইনি একটি নিষ্পাপ শিশুর নির্মল হাসি। শুধু একটা কল্পনা, একটা জ্যোতি, একটা প্রতিবিম্ব– এটাই তোমার কাছ থেকে ধার নিয়েছিলাম। আজ সেটাও তুমি নরকের আগুনে পোড়াতে এখানে এসে পড়েছ!
কিন্তু সুধা এসবের কিছুই বলতে পারল না। টেবিলে মাথা রেখে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল। মোতি তার হাত ধরতে গেলে সে রাগে তার হাত সরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল। মোতি যতই তাকে নিষেধ করল, সে কিছুই শুনতে চাইল না। রাস্তায় অন্ধকার নেমেছে। তবু বিদ্যুতের আলোয় তার চোখের পানি চিকচিক করতে লাগল। কিন্তু সে এসব গ্রাহ্যেই আনল না। কাঁদতে কাঁদতেই সে পথ বেয়ে চলল। আসিফ আলি পার্কের কাছে এসে সে থমকে দাঁড়াল। হঠাৎ তার মনে হল পার্কের ভেতরে গিয়ে সে একটা গাছে ঠেস দিয়ে বসবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে করল, এসব নিরর্থক– আমার কল্পনার রাজকুমার আর আসবে না সেখানে! সে আর কোনওদিনই আসবে না!
একথা মনে করেই সে তার সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেলল। মাথার টিপও মুছে ফেলল এবং পার্কের রেলিঙে ঘা দিয়ে হাতের চুড়িগুলো দৃঢ়তার সঙ্গে জোরে জোরে ভেঙে ফেলল। কারণ তার বদ্ধমূল ধারণা যে সে এবার বিধবা হয়ে গেছে।
অনুবাদ : কাজী মাসুম
একটি সত্যি গল্প – রিয়াজ রউফি
তার নাম কেউ জানে না। তবে নিজেদের সুবিধের জন্যে অনেকে অনেক নাম তার রেখেছে। এবং যখন যা-খুশি তাই বলে ওরা ডাকে। জুম্মন বাবুর্চি তার কদর সবচেয়ে বেশি বোঝে। সে তাকে সবসময় ‘আবে ও হারামি’ বলে ডাকে। হোটেলের মালিকের পাকা চুল-দাড়িঅলা বাবা তাকে ‘চাচাজি’ বলেন। আর মালিক বড় সাহেব ডাকেন ‘মকরানি’ বলে।
এই হোটেলে কয়েকজন বাঁধা খদ্দের এসে বসে প্রত্যেক দিন। তারা বারবার সিঙ্গেল চা খায়, খবরের কাগজ পড়ে, আর নিজেদের জীবনের বিরক্তিকর দৈনন্দিন সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করে। এই দলে রয়েছে দিল্লির মোহাজের কাপড়অলা, যার কেবিনগুলো হোটেলের একটা পাশ ঘিরে রয়েছে। আছেন মুনশিজি, যিনি পোস্ট অফিসের সামনে বসে কার্ড আর টিকিট বিক্রি করেন এবং লোকের চিঠি লিখে দেন। রয়েছেন মির্জাজি, যিনি ‘সিলভারের নিচে তৃতীয় শ্রেণির বই বিক্রি করেন। আর রয়েছে এক পাঠান চৌকিদার, সে বড় বড় দোকান, হোটেল আর সিনেমাঘরে রাত্রে পাহারা দেয়। এ দলটি হোটেলে আসে সস্তা খাবার খেতে, আর ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়ে কল্পনার বেলুন ওড়াতে। এদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এরা তাকে আদর করে ‘আবে ও হারামি’ বলে ডাকে।
দিল্লির দলটি হল যারা দিনে দু-একবার চা খেতে বা গল্পগুজব করতে আসে, তাদের। এই দলে হরেকরকম পেশার লোক দেখা যায়। প্যারিসিয়ান কাফের সামনে লা-লা-লা-লা শব্দ করে নকল দাড়ি-গোঁফ বিক্রি করে যে লোকটি, কফি-হাউসের সামনে যে একপয়সায় ওজন বলে দেয়, কাঠের হ্যাঁঙ্গারে ঝুলিয়ে যে-লোকটা আমেরিকান নেকটাই আর জাপানি রুমাল বেচে, হরেক মাল ইধার দোআনা উধার চার-আনাঅলা, বুট-পালিশ ও গা-মালিশঅলা, চানাচুর-বাদাম- তিলেখাজা-গজাঅলা, প্যারাডাইসের সামনে যে রঙিন মোড়ক দিয়ে ফল আর চকোলেট বিক্রি করে, কাফে ইরমের পিঠা-পকৌড়িঅলা, ক্যাপিটালের গলির আখঅলা, বাসস্ট্যান্ডে একআনা দরে দুটি সান্ধ্য ইংরেজি দৈনিক বিক্রি করে যে হকারটি, ফেরদৌসের সামনের পান-বিড়িঅলা, কাগজের খেলনাঅলা, অন্ধ হাফেজ– যে রোজ সন্ধ্যায় এলফিনস্টোন স্ট্রিট, প্রেডি স্ট্রিট, ভিক্টোরিয়া রোড এবং ক্লার্ক স্ট্রিটে সকলকে কোরান শরিফ শুনিয়ে শুনিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ‘প্রাইড অব পাকিস্তান’ রিকশাঅলা এবং এইরকম ছোট ছোট পেশার লোক রয়েছে এই দলে। এরা তার কাছে বিশেষ ভদ্রতা দেখায় না এবং তাকে ‘মকরানি’ বলেই ডাকে।
মকরানি আজ দু-বৎসর এই হোটেলে কাজ করছে। সে গোটা জাতের মকরানি। তার সাক্ষী তার দেহের মজবুত গড়ন এবং ছোট ছোট কোঁকড়ানো চুল। সে খুব পরিশ্রমী, সকাল পাঁচটা থেকে রাত একটা পর্যন্ত কাজে ব্যস্ত থাকে। সিনেমার সমস্ত গান তার মুখস্থ। চা-দেওয়া আর বাসন-ধোয়ার সময় তার মুখে নতুন গানের গুনগুনানির তালে তালে তার শিরায় শিরায় যেন নাচন জেগে ওঠে। জুম্মন বলে, ‘মকরানি খুব ভালো সিন্ধি নাচ জানে।’ কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ তার নাচ দেখবার জন্যে ফরমাশ করেনি।
লোকের কথা শুনে তখনি তার ওপর টিপ্পনী দেওয়ার রোগ আছে মকরানির। সে অসীম গাম্ভীর্য সহকারে একেবারে নিশ্চুপ থেকে কথাবার্তা শোনে। তার পর হঠাৎ একটা খাপছাড়া কথা বলে ফেলে। লোকে রেগে উঠে তাকে ধমক মারে আর গালাগালি দেয়, আর সে মুচকি হেসে গুনগুন করে কোনও একটা সিনেমার গান গাইতে গাইতে নিতান্তই ঔদাসীন্যভরে কাজে মশগুল হয়ে যায়।
এই হোটেলটা সবচেয়ে সুন্দর এলাকায়। এই এলাকায় সন্ধ্যাবেলা সুবেশ লোকের ভিড়ের চোটে পথচলা মুশকিল হয়ে ওঠে। কিন্তু সে জনতার দৃষ্টি এই হোটেল পর্যন্ত এসে পৌঁছয় না। কারণ, এলাকার বড় বড় আলিশান বাড়িগুলো হোটেলটাকে আড়াল করে রেখেছে; ভিক্টোরিয়া রোডের নতুন তৈরি কাপড়ের কেবিনগুলোর মাঝখান থেকে একটা ছোট্ট গলি বেরিয়ে এই হোটেল পর্যন্ত গেছে। হোটেলের কোনও নাম নেই। গলির মধ্যেকার হোটেলের ভালো নাম রাখা এবং সুন্দর সাইনবোর্ড টাঙানো একদম নিরর্থক– মালিক একথা বোঝেন। ‘৪৮ সালে একজন মালাবারি হোটেলটা তৈরি করেছিল– সেই থেকে আশেপাশে মালাবারি হোটেল নামেই এর পরিচয়, যদিও ইতোমধ্যে কয়েকবার এর মালিক বদল হয়েছে।
পনেরো বর্গফুট জমির উপর কাঠের খুঁটির মাথায় চিড়ের ছাদ দেওয়া এই ঘরটি। দেয়াল কাঠেরই। তার গায়ে মকরানি আর তার বন্ধুরা সিনেমা-তারকা ও আমেরিকান ম্যাগাজিন থেকে অর্ধ-উলঙ্গ মেয়েদের ছবি কেটে লাগিয়ে দিয়েছে।
চাচাজি একটা ছোট চৌকির উপর ময়লা গদি পেতে সামনে কাঠের ক্যাশবাক্স নিয়ে পয়সা উশুল করেন ও মোটা কাঁচের চশমা লাগিয়ে সারাদিন উর্দু খবরের কাগজ পড়েন।
জুম্মন বাবুর্চি এবং মকরানি ছাড়াও এই হোটেলে আরও চাকর-বাকর রয়েছে। শরফু জুম্মনকে সাহায্য করে। তার কাজ হল আটা-মাখা আর রুটি-বানানো। খাবার আর চা দেওয়ার জন্যে মকরানি ছাড়াও বশির নামে একটা ছেলে আছে। আর আছে ষোলো-সতেরো বছরের পাঠান ছেলে জরগুল খাঁ। সে ঠেলাগাড়ি করে চা দিয়ে বেড়ায়।
সেদিন সকালে প্যারাডাইসের চাকর জ্যাকিকে ধরে এনেছিল। সিনেমার টিকেট ব্ল্যাক করবার কাজে জ্যাকির হাত পাকা। আগের রাত্রে তারা অনেক টাকা আয় করেছিল। কিন্তু ভাগ-বাঁটোয়ারার সময় ঝগড়া বেধে গেল। হাসান খাঁ আর মাহমুদ খাঁ পাঠান মীমাংসা করে দিতে চাইছিল। এমন সময় বাইরে থেকে জরগুল খাঁ জোরে জোরে পা ফেলে মকরানির পাশে এসে বসে পড়ল। মকরানি পানির ড্রামের কাছে বসে পেয়ালা ধুচ্ছিল। জরগুল মৃদু হেসে মকরানিকে একটা মজার খবর শোনাল। মকরানি এবার অত্যন্ত অধীর হয়ে উঠল, এই খবর সবার আগে কাকে কাকে শোনানো যায়। জুম্মন বাবুর্চির কাছে গিয়ে রহস্যজনকভাবে মুচকি হেসে বলল, ‘ওস্তাদ, শুনেছ কিছু? খুব গণ্ডগোল বেধেছে। বিস্ রোডে হাঙ্গামা হয়েছে।’
জুম্মন ডেকচিতে চামচ নাড়তে নাড়তে একটু হাসল, ‘হাঙ্গামা হয়েছে? কী বকছিস রে?’ তার পর শরফু’র দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আজ সকালবেলায়ই শালার মাথায় নতুন জিনিস ঢুকেছে। ‘
আমল পেয়ে মকরানির সাহস বেড়ে গেল। এই মজার খবরটা হোটেলে ছড়িয়ে দেওয়া তার পক্ষে এবার জরুরি হয়ে পড়ল। ব্ল্যাকমার্কেটের ঝগড়া জোরসে চলছিল। হাসান খাঁ পাঠানকে উদ্দেশ করে মকরানি বলল, লালা, এখানে কিসের ঝগড়াঝাঁটি করছ? ওদিকে বিস্ রোডে যে লাঠি চলছে!’
এক মুহূর্ত সবাই চুপ করে রইল। হঠাৎ মাহমুদ খাঁ পাঠান চেঁচিয়ে উঠল, ‘হারামজাদা, শুয়োরের বাচ্চা, দূর হ এখান থেকে!’– তার পর সবাই মৃদু হেসে নিজের কথায় মন দিল।
কিছুক্ষণ পর শরীর মালিশঅলা আবদুল্লাহ্ হোটেলে ঢুকে খবরের কাগজ পড়ায় মশগুল চাচাজিকে উদ্দেশ করে বলল, ‘ফিরিয়ার রোডে হাঙ্গামা হয়েছে।’
মকরানি হাসতে হাসতে জুড়ে দিল, ‘অনেক লোকের মাথা ফেটে গেছে।‘
জুম্মন চুলোর কাছ থেকে মকরানিকে ধমক দিয়ে বলল, ‘কী বকছিস তুই!’
চাচাজি জিগ্যেস করলেন, ‘কীরকম হাঙ্গামা? কোথায় হয়েছে?’
আবদুল্লাহ্ উত্তর দেওয়ার আগেই মকরানি বলল, ‘ছেলেরা মারামারি করেছে।’
জুম্মন ধমকে উঠল, ‘চুপ, হারামি! শালা এখানে বসে-বসেই সব জায়গায় মেরে বেড়ায়।’
মালিশঅলা বলল, ‘চাচাজি, ছেলেদের মিছিল বেরিয়েছে। পুলিশ দু জায়গায় থামাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেছে।’
‘প্রাইড অব পাকিস্তান’ রিকশাঅলা ব্যস্ত পায়ে হোটেলে এসে ঢুকল।
: ‘আবে ও মকরানি, এক সিঙ্গেল চা দে! পানি কম, দুধ বেশি। আর, এক গ্লাস পানি। শিগগির আন। লাঠি নিয়ে দু-ট্রাক সেপাই ক্লার্ক স্ট্রিটের দিকে গেল। মিছিল এদিকেই আসছে।’
ব্ল্যাকমার্কেটের ঝগড়া শেষ হয়ে গেল। সব লোক তার দিকে চোখ ফেরাল।
চাচাজি জিগ্যেস করলেন, ‘কীরকম মিছিল? ব্যাপারটা কী?’
মকরানি দুলতে দুলতে বলল, ‘ছেলেদের মিছিল।’
রিকশাঅলা তাড়াতাড়ি গরম চায়ে মুখ দিচ্ছিল। হোটেল থেকে ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সিনেমার চাকররা আর লালা বাইরে চলে গেল। রিকশাঅলা পয়সা দিতে দিতে বলল, ‘ছাত্রদের মিছিল। মাইনে কমাতে চায়। শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ি যাচ্ছে। পুলিশ বাধা দিচ্ছে, কিন্তু তারা থামছে না।’
সবাই মিছিল দেখতে বেরিয়ে গেল। শুধু জুম্মন আর চাচাজি রইলেন। জুম্মন ডেকচিগুলোর পাশে বসে বিড়বিড় করতে লাগল, ‘ঠিকই তো। শালারা মাইনে কী নেয়, মানুষের রক্ত চোষে! আমার মতো গরিব লোক তো ছেলেপিলেকে পড়াতেই পারে না।
.
প্রেডি স্ট্রিটে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। লোকে দোকান থেকে বেরিয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কাণ্ডকারখানা দেখছিল। মকরানি প্রথমে কফি-হাউসের নিচে দাঁড়িয়ে রইল। তার পর পা দুখানা আপনা থেকেই মিছিলের সাথে চলতে লাগল। এগোতে এগোতে দেখে, জরগুল খাঁ দাঁড়িয়ে রয়েছে।
: ‘এই জরগুল, ওখানে কী দেখছিস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? এইমাত্র এদিক থেকে তিন গাড়ি পুলিশ গেছে। সামনে গুলি চলবে। তাদের কাছে বন্দুক আছে।’
ওরা দু জন জোরে হেঁটে এলফিনস্টোন স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে চলল।
এলফিনস্টোন স্ট্রিটে খুব গণ্ডগোল হচ্ছিল। পুলিশ মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জোর চেষ্টা করছিল। আর, ছেলেরা চাইছিল এগিয়ে যেতে। পুলিশ পনেরো-বিশজন ছেলেকে গ্রেফতার করল। ছেলেরা আরও জ্বলে উঠল। আকাশ-বাতাস ‘মুর্দাবাদ’ ধ্বনিতে ভরে গেল। ইতোমধ্যে বন্দুক ছোঁড়ার আওয়াজ এল।
মকরানি চিৎকার করে উঠল, ‘ওই জরগুল, পালা! গুলি চলছে!’
কিন্তু জরগুল খাঁ মকরানির হাতখানা শক্ত করে ধরে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল।
এলফিনস্টোন স্ট্রিটে হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেল। ছেলেরা দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়ল আর গলির মধ্যে পালাতে শুরু করল। শুধু একটাই আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, ‘পানি, পানি!’ দোকানের কলসি খালি হয়ে গেল। হোটেলের চাকররা গেলাস ভরে ভরে ছেলেদের পানি দিতে লাগল। ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা রুমাল ভিজিয়ে ছেলেদের দিকে ছুঁড়ে দিল। ক্যাপিটাল সিনেমার সামনে আখঅলার পুরা পানির বালতি যখন খালি হয়ে গেল, তখন ছেলেরা রুমাল আর কাপড় আখের রসে ভিজিয়ে নিতে শুরু করল। কিন্তু কেউ আখ নিল না। তারা চোখ রগড়াচ্ছে, হাসছে আর ভেজা রুমাল চোখে ধরছে।
এলফিনস্টোন স্টিট চোখের পানি আর কাঁদুনে গ্যাসের ধোঁয়ায় ছেয়ে গিয়েছিল। হাওয়া একটু পরিষ্কার হলে ছেলেরা রাস্তায় বেরিয়ে আবার ‘মুর্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে লাগল। মিছিলও আবার চলতে শুরু করল। পুলিশ কিছুক্ষণ পর আবার গ্যাস ছাড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে লাঠিও চালাল। কারও মাথা ফাটল, কারও আঙুল ভাঙল, কারও পায়ে লাঠি পড়ল, কারও-বা কোমরে চোট লাগল। ছেলেদের কাপড় রক্তে ভরে গেল। তারা গলির ভেতর পালাতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর সব ঠাণ্ডা হয়ে গেল, আবার যানবাহন চলাচল শুরু হল।
.
হোটেলে হাসান লালা বন্ধুদের বলল, ‘এ কেমন জোয়ান? ভয়ে পালিয়ে যায়! আমাদের এদিকে এরকম অত্যাচার করলে শালাদের মাথা ফাটিয়ে দিতাম আমরা।’
মকরানি ঠাট্টা করে বলল, ‘অই জন্যেই তো তুমি গলির মধ্যে পালিয়ে ছিলে।’ হাসান খাঁ গর্বভরে বলল, ‘আমি হলাম পাঠান, পাঠান! আমরা ইংরেজের কাছে কখনও মাথা নিচু করিনি।’
জুম্মন বিড়বিড় করে বলল, ‘খুব অত্যাচার হচ্ছে। ছেলেদের লাঠি দিয়ে তাড়া করছে। শালাদের কি লজ্জা নেই?’
রিকশাঅলা হাসতে হাসতে বলতে লাগল, ‘লজ্জা! কিসের লজ্জা! লজ্জা তো এখানে মোহাজের হয়ে গেছে। কায়েদে আজমের মাজারের নিচে ঝুপড়ি বানিয়ে পড়ে রয়েছে।
মুনশিজি বললেন, ‘তা-ও আবার এই তুচ্ছ কথাটুকুর জন্যে। কি না, ছেলেরা বলছে, মাইনে কমিয়ে দাও।’
রিকশাঅলা হাসতে হাসতে বলল, ‘মাইনে কেন কমাবে, সাহেব –যদি সব লোক লেখাপড়া শিখে ফেলে, তা হলে যে রোজ রোজ হাঙ্গামা লাগবে।’
কাপড়অলা বলল, ‘জি হ্যাঁ। আর, শিক্ষার ব্যয় পূরণ হবে কেমন করে? প্রফেসরের খোঁজে ইউরোপ বেড়িয়ে আসাই-বা চলবে কেমন করে!
বইঅলা বলল, ‘এখানকার কাণ্ডই আলাদা। ছয় বচ্ছর কেটে গেল, এ পর্যন্ত ছেলেদের লেখাপড়ার বন্দোবস্ত হল না। এখানে তো কোনও মন্ত্রী সুপারিশ না-করলে ভর্তিই করা হয় না।’
কাপড়অলা বলল, ‘প্রত্যেক বছর কোর্স বদলে দেওয়া হয়। সারাবছর বই পাওয়া যায় না। পড়াশোনা এমনি খরচের ব্যাপার যে, গরিব মানুষে তো ছেলেপিলেকে পড়াতেই পারে না।’
বড় সাহেব এই প্রথম আলাপে যোগ দিয়ে বললেন, ‘একথা সত্যি; কিন্তু বিনা অনুমতিতে মিছিল বের করারই-বা কী দরকারটা ছিল?’
রিকশাঅলা রেগে গিয়ে বলল, ‘জি! আর, লাঠি চালাবারই-বা কী দরকার ছিল? ছেলেরা কি শহর লুট করছিল?’
মুনশিজি বললেন, ‘চার বছর থেকে এই তো অবস্থা। সব লোক চিৎকার করে হয়রান হয়ে গেছে। সব খবরের কাগজে লিখেছে। কিন্তু এখানে কেউ তোয়াক্কা করল না। গরিবের কথা কেউ শোনেই না।’
রিকশাঅলা বলল, ‘ছেলে না কাঁদলে মা-ও দুধ দেয় না।’
সিল্ক মিলের ছাঁটাই হওয়া মজদুর আল্লা বখ্শ এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনছিল। সে এবার রেগে উঠে বলতে লাগল, ‘কথা এভাবে চাপা পড়ছে না আর, বড় সাহেব! এবার শুরু হয়ে গেছে ফ্যাসাদ। অত্যাচারেরও একটা সীমা আছে।’
: ‘আমাদের এখানে যদি এরকম অত্যাচার হত–
হাসান লালা নিজের কথাটা দোহরাতে চাইছিল। কিন্তু তার কথা শেষ না হতেই গফুর কাবাবঅলা খবর দিল, ‘লালা, প্যালেস সিনেমা আর করাচি ক্লাবের কাছে ছেলেদের ওপর আবার লাঠিচার্জ করেছে, আর, গ্যাস ছেড়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ির সামনেও লাঠিচার্জ করেছে। কিন্তু ওরা ঘাবড়ায়নি।’
মকরানি আনন্দে নেচে উঠল, ‘বা রে, আবার বাঘ! লালা, আমিও পাঠান।’- হা হা করে হেসে উঠল সে।– ‘ইংরেজের কাছে কখনও মাথা নিচু করিনি।’
হাসান লালার মুখ আনন্দে লাল হয়ে উঠল। সে মুচকি হেসে বলল, ‘জিন্দাবাদ!’
.
পরদিন সকাল থেকেই লোকে হোটেলে বসে জল্পনা চালাচ্ছিল। গতকাল ছেলেরা প্রচার করে দিয়েছিল, তারা আজ আবার মিছিল বের করে নিজেদের দাবি-দাওয়া প্রধানমন্ত্রীকে জানাবে।
চাচাজি খবরের কাগজ পড়তে পড়তে বললেন, ‘পুলিশ অত্যাচারের চূড়ান্ত করেছে।’
মুনশিজি মন্তব্য করলেন, ‘হ্যাঁ, বড্ড বেশি জুলুম হয়েছে।’
কাপড়অলা বলল, ‘কমপক্ষে বিশটি ছেলে জখম হয়েছে।’
বড় সাহেব জানালেন, ‘কিন্তু রেডিওতে বলেছে, মৃদু লাঠিচার্জ হয়েছে। ফলে কয়েকটি ছেলে সামান্য আঘাত পেয়েছে।’
রিকশাঅলা ক্রুদ্ধভাবে বলল, ‘পাগলামি! ছেলেদের পেছনে শিকারি কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল। প্রত্যেক গলিতে তাদের পিছু পিছু ফিরেছে। জায়গায় জায়গায় গ্যাস ছেড়েছে আর লাঠিচার্জ করেছে।
মুনশিজি বললেন, ‘দেখুন, আজ আবার কী হয়!
চাচাজি মন্তব্য করলেন, ‘আজ কিছু হবে না। এমন বোকামি আর করবে না পুলিশ। কালকের ঘটনায় সবাই ছি ছি করছে। ‘
ধ্বনি শুনে সবাই বেরিয়ে এল। আজকের মিছিল খুব বড় হয়েছে। ভারি উৎসাহ ছেলেদের। প্রাইমারি স্কুলের ছোট ছোট ছেলেরাও মিছিলে যোগ দিয়েছে। ভাইস-চ্যান্সেলার, চিফ কমিশনার এবং পুলিশের উদ্দেশে বিরূপ ধ্বনি দিতে দিতে তারা এসে এলফিনস্টোন স্ট্রিটে ঢুকল।
মিছিল ক্লার্ক স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় পুলিশ আগের মতো কাণ্ডই করে বসল, ধড় ধড় ধড়াস। অমনি দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। সারা এলাকায় গ্যাসের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল। বড় বড় ছেলেরা কালকের পথ ধরল– তারা ছোট ছোট মহল্লার মধ্যে বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির দিকে রওনা হল। কিন্তু মিছিলের বড় অংশটি– এ দলের সবাই স্কুলের, এই এলাকায়ই রয়ে গেল। ছোট ছোট ছেলেরা দোকান, বাড়ি এবং অলিগলিতে ঢুকে পড়ে কাপড় আর রুমাল ভিজিয়ে চোখে দেয়, তার পর আবার রাস্তায় বেরিয়ে এসে পুলিশের উদ্দেশে টিটকারি দেয় : হু-হুঁ-হুঁ, লু-লু-লু, হা-হা-হা, পিথ-পিথ-পিথ! তারা হো হো করে হাসে, নাচে আর বুক দেখিয়ে দেখিয়ে পুলিশকে শাপশাপান্ত করে। পুলিশ লাঠি নিয়ে তাদের তাড়া করে যায়।
লুকোচুরি খেলাটি অনেকক্ষণ যাবৎ চলল। দোকান আর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে লোকে পুলিশের বর্বরতার তামাশা দেখছিল আর হাসছিল। বড় বড় ছেলেরাও প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি থেকে ফিরে এসে তাদের দলে গিয়ে ভিড়ল। যখন কয়েকটি ছোট ছোট ছেলে পুলিশের লাঠিতে জখম হল, তখন হাওয়া বদলে গেল। ছেলেরা এবার পাথর ছুঁড়তে শুরু করল। অমনি বেধে গেল হাঙ্গামা। দোকানের কাঁচ ভাঙতে লাগল। চৌরাস্তায় আর গলিতে গলিতে হাজার হাজার লোক জমা হয়ে গেল। বাড়ির ছাদ থেকেও পুলিশের ওপর পাথর পড়তে শুরু করল। বাজার বন্ধ হয়ে গেল। পুলিশ এত গ্যাসবোমা ছাড়ল যে, আকাশ-বাতাস ধোঁয়ায় ভরে উঠল।
কিন্তু মালাবারি হোটেলের জৌলুশ কমল না। প্রত্যেকেই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নিজের নিজের কথা বলে যাচ্ছে। ভিক্টোরিয়া রোডে আন্ডারগ্রাউন্ড রাস্তা তৈরি হচ্ছে। এখানকার ইট-পাথরের গাদাটা ছেলেরা পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে নিল। মকরানি আর বশির দশ মিনিট পরপর বাইরে এসে পাথর কুড়িয়ে নিচ্ছে আর পুলিশ দেখলেই ছুঁড়ে মারছে। তার পর হোটেলের ভেতর ফিরে গিয়ে রসালো করে নিজের কীর্তি বর্ণনা করছে।
এবার পুলিশ পালাচ্ছে।
ছেলেরা খুব জব্দ করেছে ওদের। পুলিশ আত্মরক্ষার জন্যে ঘাঁটি বেঁধে দাঁড়াল।
জনৈক মন্ত্রীর মোটরে আগুন লাগল।
একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি হল।
এদিকে ভিড় বেড়েই চলেছে।
তার পর যখন খবর এল, পুলিশ গুলি চালাচ্ছে, তখন হোটেলে কিছুক্ষণের জন্য সব নীরব হয়ে গেল। শোরগোলের মধ্যে গুলি-চালানোর স্পষ্ট আওয়াজ শোনা যেতে লাগল। সবাই ভীত হয়ে উঠল এবং আশ্চর্য হয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
চাচাজি ক্রুদ্ধভাবে বললেন, ‘এর মানে কী? কোথায় মকরানি, জরগুল, বশিরঃ কেউ যেন বাইরে না যায়!’
পুলিশ এবার প্যারাডাইসের সামনে দাঁড়িয়ে গুলি চালাচ্ছে। কতকগুলি ছেলে পালিয়ে এসে হোটেলে ঢুকল। তাদের চোখ লাল হয়ে উঠেছে এবং চোখ থেকে পানি পড়ছে। ছেলেগুলো রাগে কাঁপছে। সবারই সহানুভূতি জাগল এদের দেখে। লোকের ইচ্ছা, এদের বসিয়ে পানি খেতে দেয়। কিন্তু গুলির আওয়াজ হতেই তারা সবাই বেরিয়ে গেল।
বড় সাহেব চিন্তিতভাবে হোটেলে ঢুকে বললেন, ‘হাসান খাঁ সাহেবের বুকে গুলি লেগেছে। তিনি ওখানেই পড়ে আছেন।’
সমস্ত ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলেন।
একজন এসে সংবাদ দিল, ‘প্রাইড অব পাকিস্তান রিকশাঅলা মারা গেছে।’
: ‘এলফিনস্টোন স্ট্রিটে দুটো ছেলে মারা গেছে। ‘
: ‘প্যারাডাইসের সামনে তিনটে লাশ পড়ে রয়েছে।’
: ফেরদৌসের কাছে একটা এগারো বছরের ছেলে মরে পড়ে আছে।’
: ‘এলফিনস্টোন স্ট্রিটে একজন লোক একটা আহত ছেলেকে সাহায্য করছিল। পুলিশ তাকেও গুলি করে মেরে ফেলেছে।’
: ‘একটি ছেলে ছাদের উপর থেকে ঢিল ছুড়ছিল। তাকে ওখানেই শেষ করেছে।’ চাচাজি খুব ধৈর্য ধরে এসব খবর শুনছিলেন। তিনি রাগে এবং দুঃখে চিৎকার করে উঠলেন, ‘এসব কী হচ্ছে? গুলি কেন চালাচ্ছে? ওদের বুদ্ধিসুদ্ধি কি একদম লোপ পেয়েছে?’
মুনশিজি বললেন, ‘যদি লোপই না-পাবে, তা হলে এরকম কাণ্ড কেন হবে?’
: ‘কিন্তু এর পরিণামটা কী হবে?’
‘পরিণাম!’– গফুর কাবাবি চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বেঞ্চ থেকে উঠতে উঠতে বলল, ‘আমরা যেদিন এখানে এসেছিলাম, পরিণাম তো সেইদিনই ঠিক হয়ে গেছে।’
বলতে বলতে চাচাজির বাক্সের উপর এক আনা পয়সা রেখে সে বেরিয়ে গেল।
সবাই নীরব। কথাটা তাদের মনে কাঁটার মতো বিঁধছিল। অতীত এবং বর্তমানের কত দৃশ্য মনের সামনে ভিড় করে দাঁড়াচ্ছে। ভবিষ্যৎটা গ্যাসের ধোঁয়া আর গুলির আওয়াজে তলিয়ে গেছে।
লোকে বাইরে গিয়ে হাঙ্গামায় যোগ দেয়। তার পর হোটেলে ফিরে এসে আজব আজব খবর শোনায়।
পুলিশ একটি টাই-পরা কলারঅলা আপ-টু-ডেট বাবুকে ধরে লাথি-ঘুসি মারতে মারতে ট্রাকে তুলে নিয়ে চলে গেল। খবরের কাগজের হকার সামির পায়ে গুলি লেগেছে। খেলনাঅলা সামাদের দিকে পুলিশ নিশানা করেছিল। সে শব্দ শুনেই মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। বোরি বাজারে লোকে পুলিশদের ঘিরে ফেলেছে। তারা বন্দুক নিয়ে একদিকে দৌড়ে যায়, আর পেছন থেকে তাদের ওপর পাথরবৃষ্টি হতে থাকে। ঘুরে অন্যদিকে যায় তো পেছন থেকে আবার পাথর পড়তে শুরু করে। তারা রেগে এদিক-সেদিক দু-চার বার গুলি চালিয়ে শেষে পালিয়ে গেছে।
জরগুল খাঁ অত্যন্ত অন্যমনস্ক হয়ে গলির মধ্যে পানের ঠেলা-দোকানের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। হোটেল থেকে বের হবার সময় মকরানি তাকে খোঁচা দিয়ে বলল, ‘কি বাবা, গুল্লু খাঁ, লুকিয়ে রয়েছ এখন! এসো-না ময়দানে! আরে তুই-না সীমান্তের পাঠান!’
: ‘শালা! হারামি! আমরা গুলি দেখে ভয় করি না। আমাদের কাছে বন্দুক নেই। নইলে শেষ করে দিতাম সবাইকে!’
: ‘বাহ্! বেটা পাঠান! এরা সব তোমার বাপ যে ভয় পেয়ে গেছে!’
বলতে বলতে মকরানি ক্যাপিটাল সিনেমার গলিতে ঢুকে গেল।
হোটেলে গনি হকার অত্যন্ত উত্তেজিত এবং ক্রুদ্ধভাবে বলে চলেছে, ‘এই পাকিস্তান কার জন্যে হয়েছে? কে পাকিস্তানের জন্যে ত্যাগ স্বীকার করেছে? গরিব মুসলমানরা, না যারা ক্লিফ্টনে থাকে, বিলাতে সফর করে বেড়ায়, আর ব্ল্যাকমার্কেট করে, তারা? আমরা ছয় বছর থেকে ফুটপাথে পড়ে আছি, আমাদের জিগ্যেসটি করার লোক নেই। ছেলেপিলের শিক্ষার কোনও ব্যবস্থা হয়নি। আর, তারা মাইনে কমানোর কথা বলেছে বলে পুলিশ গুলি চালাচ্ছে!’
ফলঅলা বলল, ‘আমাদের বিপদ উদ্ধারের কোনও উপায় কি সরকারের হাতে নেই? কোনওই প্রতিকার নেই?’
মুনশিজি বললেন, ‘হ্যাঁ, একটা প্রতিকার আছে। চুপ করে থাকো। মুখ বন্ধ করে রাখো। নইলে নিরাপত্তা আইন, জেলখানা…।’
দিন শেষ হল। ছায়া দীর্ঘ হতে শুরু করল। কোলাহলও সন্ধ্যার অন্ধকারে তলিয়ে গেল। হোটেলে আর লোকজন রইল না। কিন্তু এখনও লোকে দল বেঁধে-বেঁধে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। রক্তের দাগের কাছে যখন ভিড় জমে উঠেছে, তখন প্রচারের গাড়ি থেকে চিৎকার করে বলা হচ্ছে : ‘১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে, চার জনের বেশি লোক এক জায়গায় জমা হওয়া নিষেধ।’
হোটেল আজ শিগগির বন্ধ হয়ে গেল। বড় সাহেব আর চাচাজি আগেই বাড়ি চলে গিয়েছে। রাত ক্রমশ গম্ভীর হয়ে আসছে।
মকরানি, জরগুল আর বশির থালা-বাসন এবং হোটেল পরিষ্কার করার পর বেঞ্চের উপর নিজেদের বিছানা পাড়তে লাগল। মকরানির মনটা ভালো ছিল। সারারাত সে গুনগুন করে চলল, ‘কোই য়েহাঁ গিরা, কোই ওহাঁ গিরা…’, ‘আয় মেরে দিল কাহি আওর্ চল্…’; কিন্তু বশির আর জরগুলের খুব অসুবিধে হচ্ছিল গানে। ওরা বারবার কটমটে চোখে তার দিকে তাকায়, কিন্তু কিছুই বলে না। যখন সে কারও পাথর ছুড়বার বা গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়ার কাহিনি শোনায়, তখন বশির রেগে ছুরি নিয়ে তেড়ে যায়, ‘চুপ হারামি, চুপ করে থাক্! নইলে ছুরি মেরে দেব।’ মকরানি মৃদু হেসে চুপ মেরে যায়। আর, জরগুল তো সন্ধ্যাবেলা থেকেই একেবারে উদাস।
।
সকাল থেকেই শহরের অবস্থা খারাপ। ট্রাম, বাস, ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা– সমস্ত বন্ধ। শহরে পূর্ণ হরতাল। হাজার হাজার লোক রাস্তায় এসেছে। তারা দোকান এবং ঠেলা-দোকান বন্ধ করিয়ে দিচ্ছে। ছোট ছেলের দল মোটর এবং ঘোড়ার গাড়ি থামিয়ে সোয়ারিদের হেঁটে যেতে বাধ্য করছে। পুলিশের প্রচারের গাড়ি রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। কোথাও চারজনের বেশি লোক জমা হওয়া বেআইনি। আইন-ভঙ্গকারীদের গ্রেফতার করা হবে।– অথচ, শত শত লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।
মালাবারি হোটেলের একটা দরজা খোলা। তাতে কালো পর্দা ঝুলছে। ভেতরে বৈঠক খুব জমে উঠেছে।
: ‘আজ কি কোনও খবরের কাগজ বের হয়নি?’ –চাচাজি জুম্মনকে জিগ্যেস করলেন।
মুনশিজি বললেন, ‘আজ খবরের কাগজের হরতাল, আর খবরই-বা এমন কী আছে? আমাদের সামনেই তো সবকিছু হচ্ছে। সারা শহরে একটা হাঙ্গামা সৃষ্টি হয়েছে।’
আখঅলা জানাল, ‘লরেন্স রোডে লোক পুলিশকে গাড়ি থেকে টেনে টেনে নামিয়ে পিটুনি দিয়েছে।’
পিঠাঅলা নজির বলল, ‘সোলজার বাজারে লোকে চারজন সেপাইকে ঘিরে ফেলে তাদের ইউনিফর্ম খুলে নিয়েছে। আর কান ধরে ওঠবোস করিয়েছে।’
মকরানি চট্ করে জুড়ে দিল, ‘আর, তাদের মুখে কালো পালিশও ঘষে দিয়েছে।’
: ‘কাল রাত্রে প্রধানমন্ত্রী রেডিওতে ছাত্রদের উদ্দেশ করে বলেছেন, তোমরা আমার ছেলে।’
চানাচুরঅলা রেগে বলল, ‘জি! এসব প্রথমে মনে হয়নি বাবাজির!’
কাপড়অলা বলল, ‘না-জানি কত ছেলে রক্তে ভেসে গেছে, কত ঘরের বাতি নিভে গেছে। আর এখন বলা হচ্ছে, ছাত্রেরা আমার কজের টুকরো!’
চানাচুরঅলা জবাব দিল, ‘আমাদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়া হচ্ছে।’ দইবড়াঅলা একটা ভয়ংকর সংবাদ নিয়ে এল, ‘রাজা-ম্যানশনের কাছে গুলি চলেছে। একটা মদের দোকানের মালিক দোকান বন্ধ করতে অস্বীকার করায় জনতা দোকান লুট করে। তার পর পুলিশ গুলি চালিয়েছে। তিনজন মারা গেছে।’
মাহমুদ খাঁ পাঠান বলল, ‘ভালো করেছে মদের দোকান লুট করে। শালা! ইসলামি রাজত্ব বলে– এদিকে মদ বেচে!’
একজন এসে খবর দিল, ‘প্লাজা-কোয়ার্টারে গুলি চলেছে। লোকে একটা মদের দোকানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।’
চাচাজি চিৎকার করে বললেন, ‘এসব কী কাণ্ড রে, বাবা! এ আগুন তো সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে!’
কাপড়অলা বলল, ‘সারাদেশে এখন এই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।’ মকরানি দৌড়ে এসে নেচে নেচে বলতে লাগল, ‘ওদিকে পেছনে– ফিরিয়ার রোডের মদের দোকানটা পুড়ে যাচ্ছে।’
সব লোক বেরিয়ে এল। বাইরে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল।
জনকুড়ি সেপাইভর্তি পুলিশের একটা ট্রাক শেজানের দিক থেকে এসে ভিক্টোরিয়া রোডের চৌমাথায় থেমে গেল। সেপাইরা লাঠি নিয়ে লাফ দিয়ে দিয়ে গাড়ি থেকে নামতে লাগল। কে যেন জোরে চিৎকার করে উঠল, ‘মার্ শালাকে!’– তার পর শত শত লোক দাঁড়িয়েছিল বাসস্ট্যান্ড, ভিক্টোরিয়া রোড আর প্রেডি স্ট্রিটে; তারা পাথর, লাঠি আর কাঠ নিয়ে তাদের দিকে ধাওয়া করল। সেপাইরা ভয় পেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে গির্জায় গিয়ে ঢুকল। জনতার উচ্চহাসি শোনা গেল। মকরানি পাথর হাতে করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে একমনে হাসতে লাগল।
আজ জরগুল এক মিনিটের জন্যে হোটেল থেকে বের হয়নি। সে হোটেলেই কাজ করছিল। আজ সে ভারি বিব্রত এবং বিষণ্ন। জুম্মন জিগ্যেস করল, ‘কেন রে, আজ এমন উদাস হয়ে রয়েছিস কেন?’
জরগুল কোনও জবাব দিল না।
শরফু বলল, ‘হাসান খাঁ লালা মারা যাওয়ায় ও দুঃখ পেয়েছে।’
জরগুল শুধু বলল, ‘ওস্তাদ, আরও অনেক লোক মরেছে।’
মুনশিজি, কাপড়অলা, বইঅলা, মির্জাজি এবং গা-মালিশঅলা মদের দোকানের অবস্থা দেখে ফিরে এল। শহরের সমস্ত জায়গায় গোলমাল হচ্ছে। পুলিশ দেখলেই লোকে মারতে ছুটছে। কয়েক জায়গায় গুলি চলেছে। প্রত্যেক মুহূর্তে নতুন নতুন খবর হোটেলে আসছে। অবস্থা ক্রমশ খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়ে চলেছে। বারোটার সময় মকরানি এসে এক খবর দেওয়ায় সবার জান উড়ে গেল। সে বলল, ‘বন্দুকের দোকানগুলো লুট হয়ে গেছে।
জরগুল নিজের জায়গা ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার মুখখানা লাল হয়ে উঠল। সে হনহন করে বেরিয়ে গেল। মকরানি তাকে অনুসরণ করল। ভিক্টোরিয়া রোডে কাপড়ের স্টলগুলোর আড়ালে বারো বছরের একটা ছেলে বন্দুক হাতে করে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বন্দুকটা খোলার চেষ্টা করছিল। জরগুল লুব্ধদৃষ্টিতে নতুন, চকচকে বন্দুকটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নিয়ে আয়। আমাকে দিয়ে দে বন্দুকটা।
ছেলেটা দৃপ্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, ‘না, দেব না!
জরগুল একটু হেসে বলল, ‘নিয়ে আয়, গুলি ভরে দিই।’
ছেলেটি ক্রুদ্ধভাবে জবাব দিল, ‘না, দেব না।’– কিন্তু পরমুহূর্তেই জরগুলকে হাসতে দেখে বন্দুকটা সে তার হাতে দিয়ে দিল।
জরগুল খুশির চোটে বন্দুকটায় চুমো দিয়ে নিল। তার পর খুলে ফেলে বলল, ‘গুলি কোথায়, নিয়ে আয়।’
বিস্মিত ছেলেটা একটা ছোট কার্তুজ বের করে দিল।
: ‘আরে, এটা যে একেবারে ছোট! এতে হবে না।’–জরগুল কার্তুজটা নলের একদিক দিয়ে ভরে অন্যদিক দিয়ে বের করে দিয়ে হাসতে লাগল। কয়েকজন পথিক জমা হয়ে তামাশা দেখতে লাগল।
ছেলেটা পকেট থেকে অনেকগুলো কার্তুজ বের করে দোকানের চৌকির উপর রেখে দিল। জরগুল গুলি ভরে বন্দুকটা ছেলেটাকে দিতে দিতে বলল, ‘ঐ দ্যাখো, ফেরদৌসের কাছে সেপাই দাঁড়িয়ে আছে। মারো!’
ছেলেটা বন্দুক নিয়ে নিল। তার মুখে আনন্দের আভাস দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সমস্ত শরীর কাঁপছে। না-জানি কোনদিকে বা নিশানা করে সে ঘোড়া টিপে দিল। তার পর নিজেই এক ঝটকায় পড়ে গেল এবং বন্দুকটা একদিকে ছিটকে পড়ল। লোকে হো হো করে হেসে উঠল। মকরানি পেট চেপে ধরে চৌকির উপর গড়াগড়ি দিতে লাগল। জরগুল বন্দুক উঠিয়ে নিয়ে চৌকির উপর থেকে কার্তুজগুলো তুলে পকেটে ভরে নিল। তার পর স্টলগুলোর আড়াল দিয়ে প্যারাডাইস সিনেমার দিকে চলে গেল।
ছেলেটি উঠে দাঁড়াল। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল।
: ‘আরে! কাঁদছিস?’– মকরানি হাসতে হাসতে বলল, ‘মা’র কথা মনে পড়েছে? আয় আমার সাথে। এক সিঙ্গেল দুধ খাইয়ে দেব।’
ছেলেটা হু হু করে কাঁদতে লাগল, ‘ওই হারামিরা কাল আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে।’
তার ভাইয়ের সাথে মকরানির আদৌ পরিচয় ছিল না। তবু সে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আরে, ও মরেনি। তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে মোটরে করে। আমি নিজে দেখেছি। তাকে ধরে নিয়ে গেছে। কাল ছাড়া পেয়ে যাবে।’
তবু ছেলেটি কাঁদতে লাগল।
.
হোটেলে বইঅলা অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে বলছিল, ‘ওরা ছয় বছরে কী করেছে আমাদের জন্যে? আমাদের কোন্ দুঃখ-দরদ ঘুচিয়েছে? কোন্ বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে? এখন পর্যন্ত শত শত লোক ফুটপাথে পচছে। শত শত লোক বেকার। রুজি মেলে না। রেশনের দোকানে আটা পাওয়া যায় না। আমাদের কোনও দুঃখের খবর রাখে কি ওরা?’
কাপড়অলা বলল, ‘সারাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। কাপড় আর খাবার জিনিস বাজার থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। তরিতরকারির দাম দুই-তিন গুণ বেড়ে গেছে।’
মুনশিজি দুঃখের সাথে বললেন, ‘আর, একসময় অহংকার করে বলা হত, আমাদের খাবার কখনও কম হবে না।’
বইঅলা বলল, ‘আরে সাহেব, বলে কি না আমাদের টাকার দাম ভারতের পাঁচসিকের সমান। আর বাজারে কেউ দশ আনা দিয়েও পৌঁছে না।’
মুনশিজি বললেন, ‘জি হ্যাঁ। আরও বলা হয়, আমরা স্বাধীন। ব্রিটিশ মহারানির অধীনে—’
বইঅলা বলতে লাগল, ‘বাজার তো চড়েই চলেছে। না আছে রোজগার, না বাড়ি, না খাবার, না কাপড়। আর ছাত্রেরা মাইনে কমাতে চেয়েছে তো দেখুন তার পরিণাম।’
মকরানি ভীতভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘চাচাজি, চাচাজি, জরগুল মারা গেছে।’– তার পর ঝট্ করে আবার বেরিয়ে যেতে উদ্যত হল।
জুম্মন ডাক দিয়ে বলল, ‘আবে এই হারামি! তুই কোথায় মরতে যাচ্ছিস?’
চাচাজি ডাক দিলেন, ‘আরে, এই মকরানি–!’ কিন্তু সে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
তার পর প্রতিমুহূর্তে দুঃসংবাদ আসতে লাগল। চাচাজি, মুনশিজি, কাপড়অলা, মির্জাজি– সবাই মাথা চেপে ধরে এইসব খবর শুনতে লাগলেন। কিন্তু কারও মুখ দিয়ে কথা বের হল না।
আখঅলা মারা গেছে।
গফুর কাবাবি মারা গেছে।
ফলঅলা আহত হয়েছে।
অন্ধ হাফেজ, গনি, হামিদ আর ইলিয়াসকে গ্রেফতার করেছে। খবরের জাগজের হকার আহমদ এবং জাপানি রুমালঅলা আসলাম আহত হয়েছে। আকাশ-বাতাস গ্যাসের ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরপর গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ আসতে লাগল। সবাই চুপ করে বসে রয়েছেন। চাচাজি মাঝে মাঝে রাগে চিৎকার করে উঠছেন, ‘এ সমস্ত কী হচ্ছে? কেন? এর পরিণামই-বা কী হবে?’– কিন্তু কেউ উত্তর দিচ্ছে না।
একখানা মোটরগাড়ি ভিক্টোরিয়া রোডে ঘোষণা করে দিয়ে গেল, ‘পাঁচটার সময় থেকে শহরে কারফিউ চলবে। কোনও লোককে বাড়ির বাইরে দেখা গেলে তাকে গ্রেফতার করা হবে। গুলিও করা যেতে পারে। আপনারা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যান।’
কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় জনতা সেই একইভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
বড় সাহেব জিগ্যেস করলেন, ‘সে হারামি কোথায় গেল?’
জুম্মন উত্তর দিল, ‘কী জানি, একঘণ্টা থেকে তার পাত্তা নেই।
: ‘আর, বশির ‘
: ‘তারও পাত্তা নেই। ‘
শরফু বলল, ‘সে তো সকাল থেকেই নিখোঁজ।’
বড় সাহেব রাগে এবং দুঃখে বললেন, ‘সব শালা মরে গেছে। জুম্মন, তাড়াতাড়ি হোটেল বন্ধ করো! শহর মিলিটারির হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাঁচটা থেকে কারফিউ আরম্ভ হবে। চলো চাচাজি, বাসায় যাই। জুম্মন, তুমি রাত্রে এখানেই শোবে।’
পাঁচটা বাজবার আগেই হোটেল বন্ধ করে দেওয়া হল। সবাই বাড়ি চলে গেল। জুম্মন অনেকক্ষণ একা হোটেলে বসে রইল। যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে লাগল, তখন দরজায় তালা লাগিয়ে সে রাস্তায় বেরিয়ে এল। লোকজন তখন পর্যন্ত দল বেঁধে বেঁধে এদিক-সেদিক ঘুরছিল, আর মিলিটারি সেপাইরা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল; পুলিশের কোথাও পাত্তা পাওয়া গেল না। রাস্তায় পাথরের স্তূপ জমে রয়েছে। আর ফুটপাথে দোকানের কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে আছে। জায়গায় জায়গায় রক্তের ছাপ। লোকে সেইসব দাগের কাছে এসে দাঁড়ালে মিলিটারি সেপাইরা তাদের বোঝাচ্ছে। তখন তারা চুপচাপ এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছে।
অন্ধকার আস্তে আস্তে শহরটাকে ছেয়ে ফেলল। পথঘাট নির্জন হয়ে গেল। কোনও বাড়ি থেকে রেডিও’র শব্দও শোনা যাচ্ছে না। একটা ভয়াবহ নীরবতা সমস্ত শহরটাকে চেপে ধরেছে। তবু মিলিটারি ট্রাক্ বা জিপ দ্রুতবেগে চলে যাওয়ার শব্দ মুহূর্তের জন্যে এই নীরবতা ভেঙে দিচ্ছে। তার পর আবার সব নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে।
.
সকাল সাতটা বাজবার সাথে সাথে লোকে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ট্রাম, বাস চলাচল শুরু হল। আজ প্রত্যেকের মুখ মলিন। ঘাড় নিচু করে চুপচাপ তারা নিজের কাজে চলে যাচ্ছে। বাজার বন্ধ। কিন্তু দু-একটা দোকান খোলা হয়েছে।
মালাবারি হোটেলের কপাল পুড়ে গেছে। কয়েকজন মাত্র লোক হোটেলের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। জুম্মন আর শরফু নিজের কাজে ব্যস্ত রয়েছে। বশির খদ্দেরদের চা দিচ্ছে। সে আজ সকালে কাজে ফিরে এসেছে। মুনশিজি পোস্টকার্ড আর টিকিটের বাক্স নিয়ে এসেছেন, কিন্তু আজ তাঁর দোকান খুলতে ইচ্ছা করছে না। মসজিদের হাফেজ সাহেব দিল্লির কাপড়অলার সাথে আস্তে আস্তে কথা বলছেন।
মাহমুদ খাঁ পাঠান মুনশিজির খোঁজে হোটেলে এসে পৌঁছল, ‘মুনশিজি, একটা চিঠি হাসান খাঁর বাড়ির লোকের কাছে লিখে দাও! ঠিকানা আমি বলে দিচ্ছি। বেচারার তিনটে ছোট ছোট বাচ্চা আছে।’
জুম্মন বলল, ‘হ্যাঁ, মুনশিজি, জরগুলের চাচাকেও একটা চিঠি লিখে দাও। তার বিধবা বুড়ি-মা আছে। সে-ই তার একমাত্র ছেলে।’
জুম্মন মুনশিজির সামনে চায়ের পেয়ালা রাখতে রাখতে বিষণ্নসুরে আস্তে আস্তে বলল, ‘আর মকরানি!’
মুনশিজি চশমার উপর দিয়ে জুম্মনের দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, ‘হ্যাঁ, মকরানি!’
প্রত্যেকেই কেমন জানি উদাস হয়ে গেল। সবার মাথা নুয়ে পড়ল। মুনশিজি জিগ্যেস করলেন, ‘ওর নাম কী ছিল?’
কেউ কোনও জবাব দিল না।
: ‘ওর বাড়ি কোথায়?’
তবু সবাই নীরব।
: ‘ওর মা-বাপ কোথায়?’
এবারও কারও মুখে কথা নেই।
এবং তার পরিণাম যে কী হয়েছে, সে-কথাও কেউ জানে না।
অনুবাদ : মিলি হোসেন
ভৈরবী মন্দির লিমিটেড – কৃষণ চন্দর
সেইসব দিনের কথা, আমার যখন ঈশ্বর ও ধর্মে বিশ্বাস ছিল এবং আমি পাঁচ বছর বেকার ছিলাম।
এই পাঁচ বছরে সবরকমের চেষ্টা করেছি।
বি.সি.এস.-এর পরীক্ষা দিয়েছি। ফেল।
তহশিলদার হওয়ার চেষ্টা করেছি। ফেল।
তহশিলদারের সহকারী হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। ফেল। তাঁর কর্মচারী হওয়ার জন্য দরখাস্ত করেছি। ফেল।
চারিদিক থেকে নিরাশ হওয়ার পর দিল্লিতে দাদার ফার্মের দরজায় গিয়ে হাজির হলাম। এই ফার্মের মালিক আমার দাদা নন। কিন্তু যেহেতু দাদা ফার্মের খাজাঞ্চি, এইজন্য আমরা সকলে বলতাম ‘দাদার ফার্ম’। ফার্মের নাম ছিল ইন্ডিয়া-ইন্ডিয়া। দাদা আমার একটা পছন্দমতো রোজগারের হিল্লা করে দিলেন। ফেল। আবার, জনসন অ্যান্ড টমসন অ্যান্ড কোং, রোলদুরাম ফোলদুরাম খোলদুরাম অ্যান্ড কোং, রায় সাহেব রাম জয়রাম ভায়া সহায়রাম অ্যান্ড ব্রাদার্স ইত্যাদি অন্যান্য ফার্মে চেষ্টা করলেন। তা-ও ফেল।
আমার দাদা দিল্লির বিশহাজারিতে থাকতেন। ভৈরবীর মন্দিরের নিচে। এই মন্দির একটা ছোট পাহাড়ের উপর। অদৃষ্টই বলতে হয়, দিল্লির এক শেঠ তিন-কামরাঅলা পনেরো-বিশটা কোয়ার্টার তৈরি করে রেখেছিলেন। সেখানে কেরানির মাগ-ছেলে মুরগি বেড়াল কুকুর সমেত বাস করতেন। এই কোয়ার্টারের ঠিক সামনে পাহাড়ের উপর ভৈরবীর মন্দির। ডানদিকে একটা গির্জা, বাঁ-দিকে মোটরের গ্যারেজ আর শিখ ডাক্তার সর্বসুখ সহায়ের কুঠি। দাদার সঙ্গে এই ডাক্তারের খুব খাতির ছিল। তিনি আমাকে তাঁর ডাক্তারখানার কম্পাউন্ডারি শেখার জন্য রাখলেন। কিন্তু এখানে আমার আক্কেল বেশিদূর গড়াল না। কারণ, ওষুধের নামগুলো এত বেয়াড়া যে, বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়। তার পর, কোটা বিষ, কোন্টা নয় সেসব আরও মুশকিলের ব্যাপার। কোনও কোনও ওষুধ বিশ ফোঁটা পর্যন্ত বিষ নয়, কিন্তু একুশ ফোঁটা হলেই বিষ হয়ে যায়। বুঝুন এখন। ভুলচুকও তো হতে পারে! বিশেষ জায়গায় একুশ ফোঁটাই যদি পড়ে যায়! রোগী তা হলে আদমের দেশ ছেড়ে সোজা রাস্তা ধরবে। না, বাবা, দরকার নেই কম্পাউন্ডারিতে। আমি ফিরে এলাম।
যখন কোনও কাজ পাওয়া গেল না এবং জীবনের পাঁচটা বছর তল্লাশেই কেটে গেল, দাদার মেজাজ-ব্যারোমিটারের পারদ তখন শেষ সীমানায় এসে পৌঁছল। একদিন গর্জন করে বললেন, ‘চাকরি পাবি, না, ছাই পাবি। না আছে ভগবানের ওপর আস্থা, না আছে ধর্মে বিশ্বাস। এমন নাস্তিক আক্কেলের ছোকরা আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। যখনই দ্যাখো, খবরের কাগজ, সাময়িক পত্রিকা, সোশ্যালিজমের বই নিয়ে বসে আছে। তুই করবি চাকরি! চাকরি করার জন্য মনকে একটু কষ্ট দিতে হয়, দিনরাত ভগবানের আরাধনা করতে হয়। আমার দিকে চেয়ে দ্যাখ্। দিনভর আপিসে কাজ করি, সকাল-সন্ধ্যা আহ্নিক করি, রাত্রে শোবার সময় ফের মালা জপি। সেইজন্যই তো ভগবান চারটি ছেলে দিয়েছেন, ইন্ডিয়া-ইন্ডিয়ার মতো বড় ফার্মের ক্যাশিয়ার করেছেন, দুনিয়ায় ইজ্জত দিয়েছেন, সম্মান দিয়েছেন। ডাক্তার সুখ সহায় পাড়ার একজন কর্তাব্যক্তি, তিনি নিজে নমস্কার জানান। সমস্ত পাড়ায় রোয়াব করে থাকি। আর, তুই –‘
তার পর তিনি আমাকে ভয়ানক ইতর গাল দিলেন একটা। এ-গালি সারাজীবনে আমাকে কেউ দেয়নি। আমি কাঁদতে লাগলাম। বউদি এসে আমার মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। আমি আরও জোরে কেঁদে উঠলাম। বউদি রেগে বললেন, তুমি বেচারার ওপর বোমা ফাটাচ্ছ কেন। এখন তো ছেলেমানুষ। ভগবান করেন তো চাকরি পেয়ে যাবে। ওর দোষ কী?’
‘ওর দোষ নয় তো কার দোষ? ছেলেমানুষই তো! ছাব্বিশ বছর বয়েস ছেলেমানুষের! ওর সাথের পড়ুয়ারা দু-দুবার বিয়ে করেছে। সুপারিন্টেন্ডেন্ট, তহশিলদার, হেডক্লার্ক হয়েছে। আর, এ হল কি না এখন ছেলেমানুষ!’
বলে দাদা আমাকে মারবার জন্য হাত তুললেন।
বউদি মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন, ‘হায়, হায়, কী করছ! ছোটভাইয়ের গায়ে হাত তুলতে লজ্জা হয় না তোমার? আপিসে যাও! আমি ঠিক ওকে বুঝিয়ে বলব।’
দাদা থেমে বললেন, ‘ওকে বলে দাও, যদি বাড়িতে থাকতে চায়, তবে এই গেঁয়োচণ্ডিপনা ছেড়ে দিতে হবে, ভগবানের নাম নিতে হবে, সকাল-সন্ধ্যা মন্দিরে যেতে হবে। আমি কখন বলেছি যে, চাকরি পায়নি, সেটা ওর দোষ? কিন্তু ভগবানের নাম নিলে সব বিপদ থেকে পার পাওয়া যায়। আমার ভাই কী অপরাধ করেছে তুমি দয়া করো, ভগবান!’
বলতে বলতে দাদা ভারি নরম হয়ে গেলেন। আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বুধ (আমার নাম বুধরাজ। তিনি আদর করে ডাকেন, বুধ।), মন্দিরে যাওয়া-আসা করো, ভগবানকে অসন্তুষ্ট করা উচিত নয়। ভগবানকে পাওয়া গেল তো সব পাওয়া গেল। আমাকে কথা দাও, তুমি আমার কথা রাখবে।’
আমি চিরকালের জন্য মার্কসের বই বন্ধ করে ফেললাম এবং নিয়মিত ভৈরবীর মন্দিরে যাতায়াত শুরু করলাম।
ভৈরবীর মন্দিরে তিনজন পূজারি। একজন বৃদ্ধ, দ্বিতীয়জন প্রৌঢ়, তৃতীয়জন যুবক। সবচেয়ে উদার বৃদ্ধ পূজারি, সবচেয়ে নীচ প্রৌঢ় পূজারি। যুবক পূজারি সৌম্যদর্শন, হাসিমুখ। প্রথম পূজারি পাণ্ডিত্যে অগ্রজ, মধ্যম পূজারি কলহপ্রিয়। ছোট পূজারি গায়ত্রী মন্ত্র পর্যন্ত ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারে না। কিন্তু তার হাসিটুকু বড় মিষ্টি, চেহারাটি ভারি সুন্দর। শরীরটা বেশ সুঠাম। সিদ্ধি পানের পর তার চোখ লাল ধুতরার মতো মনে হয়। যখন সে ঢুলুঢুলু চোখে মেয়েদের দিকে তাকায়, হরিণও ভুলে যায় তার পটলচেরা চোখের গর্ব। কিন্তু মধ্যম পূজারি তার ওপর ভয়ানক কড়া নজর রাখে। আর, বৃদ্ধ পূজারি তাকে পেঁয়াজ এবং অন্যান্য গরম জিনিস খেতে মানা করে।
ভৈরবী মন্দিরের মালিক অন্য কোনও ব্যক্তি। বৃদ্ধ পূজারি হলেন এই মঠের গুরু। মঠের একটা মন্দির আছে লাহোরে, একটা রুড়কি আর একটা যোধপুরে। কিন্তু দিল্লির মন্দির সবচেয়ে বড়। এখানে দান সবচেয়ে বেশি পড়ে। তারপরেই লাহোরের মন্দিরের আয়। যোধপুরের মন্দিরের স্থান তার নিচে। রুড়কির মন্দিরের অবস্থা আদৌ ভালো নয়। সেখানকার পূজারির মাইনে এখান থেকে পাঠাতে হয়। বুড়ো পূজারি প্রত্যেক মাসের পয়লা তারিখে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে মনি-অর্ডারযোগে পাঠিয়ে দেয় রুড়কি।
ভৈরবীর মন্দিরের চত্বর খুব প্রশস্ত। মন্দিরটি বড় ছোট। কিন্তু সিদ্ধি তৈরির কামরাটা বেশ বড়। এই কামরার সংলগ্ন তিনটি কামরা। ছোট, ধুলোয় কালো, আরও ছোট দরজা। তার ওপর জানালা নেই। এ-পাশেরটা বৃদ্ধ পূজারির। তার পরের কামরা মধ্যম পূজারির। তার সম্মুখে যুবক পূজারির শোবার ঘর। তার সম্মুখে টিলার উপর ঝোঁপঝাড় এবং কোথাও কোথাও সাধুদের সমাধি-মন্দির চোখে পড়ে। শেষ সমাধি-মন্দির থেকে এক ফার্লং দূর হবে। এখানে বহিরাগত সাধুদের জন্য অতিথিশালা; কেবল মঠের সাধুরাই থাকতে পারে। মন্দির ও অতিথিশালার চারিদিকে দেয়াল।
ভৈরবীর মন্দিরে প্রতিদিন পঞ্চাশ-ষাট টাকা দান পড়ে। সকালে মেয়েদের ভিড় জমে। সন্ধ্যায় কাজকর্ম থেকে অবসর পাওয়ার পর পুরুষেরা আসে ঠাকুর-দর্শনে। কিন্তু মেয়েদের সকালে ঠাকুর দর্শন করতে হয়। এইজন্য তারা ভোরবেলাতেই মন্দিরে আসে। অনেক সময় এমনও ঘটে যে, সকালে এসে তাদের ছোট পূজারিকে ঘুম থেকে জাগাতে হয়। তার পর ঘণ্টাধ্বনি পাহাড়ের মাথায় আঘাত খায়, গর্জন তুলে বিশহাজারির আকাশ ছেয়ে ফেলে। যুবক পূজারি ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। তখন মেয়েরা মৃদু গলায় শোরগোল তোলে। সকালে যুবক পূজারির ওপর ঠাকুরকে জাগানোর ডিউটি পড়লে দর্শনার্থীদের প্রায়ই তাকে বিছানা থেকে টেনে তুলতে হয়। ছোট পূজারির বড় ঘুম। বুড়ো পূজারি তাকে ভর্ৎসনা করে। প্রৌঢ় পূজারি করে গালাগালি। যুবক পূজারির শাস্তি হিসেবেই বোধহয় সকালে ডিউটি পড়ে। ভারি বিরক্ত হয় সে। কিন্তু গুরুর মর্যাদা ও ভবিষ্যতের কথা ভেবে চুপ করে যায়।
যুবক পূজারি খুব শিগগির আমার বন্ধু বনে গেল। মন্দিরের পূজা-পাঠ ইত্যাদির পর আমরা তার কামরায় গিয়ে সারাটা দিন গালগল্প করে কাটাই। সে-ই আমাকে জানাল, মন্দির থেকে আজকাল বৃদ্ধ পূজারির প্রায় লাখ টাকা আমদানি। বৃদ্ধ পূজারি এখন শ্মশানের পথে। এখন তাদের মধ্যে উত্তরাধিকারী নিয়ে ঝগড়া চলছে। সে নিজেই চায় এই গদি। কিন্তু মর্যাদা ও বয়সের দিক থেকে বোধহয় প্রৌঢ় পূজারি উত্তরাধিকারী হবে। ব্যাপারটা ভারি খারাপ দাঁড়াবে। বুড়ো পূজারি প্রথমে তাকে ভালোবাসত, এখন তার মন ঢলেছে মধ্যম পূজারির ওপর। কারণ, তার ধারণা, যুবক পূজারির পূজা-পাঠের প্রাথমিক অধ্যায়ও শিক্ষা হয়নি।
‘এখন তুমি কী করবে?’ আমি হেসে বললাম।
সে ঘরের কোণ থেকে দু-কোষ পেঁয়াজ নিয়ে এল, আগে লুকিয়ে রেখেছিল। আমার দিকে একটা পেঁয়াজ ছুঁড়ে বলল, ‘খাও।’ অন্য পেঁয়াজটা সে নিজেই খেতে লাগল।
‘কচর-মচর– বেশ মজা কিন্তু।’ সে আমাকে বলল, ‘পেঁয়াজ আমার খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে আমি মাংসও খাই। জ্যোতি-সাধুদের সবকিছু খাওয়া উচিত।’
‘কেন?’ বড় কষ্টে কাঁচা পেঁয়াজ খেতে-খেতে আমি প্রশ্ন করলাম।
‘জ্যোতি-সাধুদের মনে কোনও লালসা থাকা উচিত নয়। মাংস খাক, মদ চালাক, বিছানায় মেয়েছেলে নিয়ে রাত কাটাক– সবকিছু করে দুনিয়ার ভোগ-লালসা বের করে দিক মন থেকে। তখন সে ভগবান পেতে পারে।’ সে হাসতে লাগল।
‘হাসছ কেন?’
‘কাউকে বলবে না তো? ভৈরবীর দিব্যি করো!’
ভৈরবী-জ্যোতির দিব্যি।
‘এই-যে প্রৌঢ় পূজারি বাবা পন নাথ– আসলে কিন্তু ভয়ানক বদমাশ। চেহারা দেখে বুঝতে পারো না, কেমন শয়তানি-শয়তানি ভাব। একে সাধু বলে মনে হয়, না, চণ্ডাল?’
‘চণ্ডাল।’ আমি মাথা দুলিয়ে বললাম।
‘চণ্ডাল নিজে নিজেকে সাধু বলে। আমি এর নাড়ি-নক্ষত্র জানি।’
‘নাড়ি-নক্ষত্র?’
‘হ্যাঁ।’ সে অন্য কোণ থেকে এক বোতল মদ তুলে নিয়ে এল। ‘নাও চালাও।’
আমি বললাম, ‘না, আগে তুমি।’
সে বোতলে মুখ দিল। মাত্র দু-চুমুক বাকি রেখে হেসে বলল, ‘না, তুমি খাও। জ্যোতির চরণামৃত।’
‘সহায় হও, গুরুজি।’ আমি দুই চুমুক কণ্ঠনালির নিচে নামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘অমৃতের মজা পেয়েছি, গুরু। হ্যাঁ, তুমি বাবা পন নাথের কথা বলছিলে।’
‘একদম পয়লা নম্বরের হারামি। গুরুজি এখন খুব বুড়ো হয়ে গেছেন– তিনি ধনে নিয়ে বসে থাকেন। আমাকে কিন্তু বলে, পেঁয়াজ খেয়ো না, চোখ তুলে চেয়ো না, দিনরাত ধনে খাও। বাবা পন নাথ আমাকে বড় কড়া চোখে দেখে। মন্দিরে কোনও মেয়ের দিকে তাকাবার উপায় আছে? কিন্তু নিজে– নিজে
‘হ্যাঁ, কী করে?’
যুবক পূজারি ইতিউতি তাকাল। একবার বাইরের দরজা পর্যন্তও গেল। তার পর ফিরে এসে আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলতে লাগল…
আমি চিৎকার করে বললাম, ‘না, না, একথা সত্যি হতে পারে না।’
ভৈরবী-জ্যোতির দিব্যি। আমি নিজের চোখে দেখেছি। ও নিজের বয়েসি মেয়ে খুঁজে বেড়ায়। যুবতী মেয়েদের দিকে ফিরেও তাকায় না। কেউ রোগ-শোক-বিপদে জর্জরিত, কেউ হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত, কারও ছেলেদের দৌরাত্ম্য থেকে হাঁফ ছাড়ার উদ্দেশ্য– নানারকমের মেয়ে আসে, আর বলে, আমাকে ভগবানের সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দাও। তারা দিনরাত মন্দিরে যাতায়াত করে, মানত শোধে, প্রসাদ আনে, মন্দিরের সিঁড়ি নিজের চুল দিয়ে ঝাঁট দিয়ে দেয়, পূজারির পা টেপে, ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা মন্দিরের চত্বরে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকে, আর বাবা পমন নাথের সঙ্গে প্রার্থনা করে, তিনি যেন তাদের ভগবানের সঙ্গে মিলন ঘটিয়ে দেন, একবার ভগবান দেখিয়ে দেন।’
‘তার পর?’
‘ও তাদের ভগবানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়।’ যুবক পূজারি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল। ‘হি হি হি।’ হাসিটা চড়তে লাগল তার। বলল, ‘একবার যে মেয়ে ভগবান দেখেছে, সে না ঘরের, না ঘাটের। ব্যস্, একদম মন্দিরের সম্পত্তি হয়ে যায়।’
.
যোধপুরের মন্দির থেকে তিনজন বাইজি এসেছিল। মন্দিরের দেবদাসী এবং অতিথিদের সঙ্গে তাদের থাকার জায়গা করে দেওয়া হল। তাদের পরনে গেরুয়া রঙের শাড়ি। চুল আলুলায়িত। কপালে চন্দনের তিলক। গৌর রঙ। দেহে যৌবন, অন্তরে ভগবানের জ্যোতি। বিশহাজারির আকাশে-বাতাসে আলোড়ন জাগল। প্রত্যেক মেয়ের এখন উৎসব-রাত্রি। যখন তারা করতাল সহযোগে ‘হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ’ গায়, বিশহাজারির মেয়েদের মন ভাবে গদগদ হয়ে ওঠে। তারা এদের সব আরতিতে যোগ দিতে লাগল। আজকাল ঘরে-ঘরে কেবল এই বাইজিদের কথা। জীবনে যারা মন্দিরে পা দেয়নি, তারা দিনে দু-তিনবার নিশ্চয়ই মন্দিরে আসবে। যদি মন্দিরে ভগবান-দর্শনে মন না-ভরে, তাদের কীর্তনের বায়না দেয় নিজের বাড়িতে। তার পর আর কী! জনসাধারণ বাইজি-দর্শনে আসছে, মেয়েরা প্রসাদ বিতরণ করছে, বাইজিদের জন্য দোশালার অর্ডার দিচ্ছে। প্রত্যেক কীর্তনের আসরে একশো সওয়াশো লোক জমা হয়। বাইজিদের নির্দেশ, সকলের আগে মন্দিরে ষাটটি টাকা এবং দোশালা পৌঁছে দিতে হবে। নচেৎ নাম-কীর্তনের আসর জমবে না। আবার পাড়ার একজন নাম-কীর্তন করাল, তখন অন্যে বাদ যাবে কেন? ঘরে-ঘরে মেয়েরা পালা করে নাম গাওয়াতে লাগল। ষাটটা টাকা, তিনজোড়া শাল আর ভগবানের নাম-গান। এ আর এমন কী! আরে মশায়, সবজি-মণ্ডির মেয়েরা- যারা আগে ঘরে এসে নাম-কীর্তন করত, এর কাছে কোথায় লাগে! তারা পঞ্চাশ টাকার কম স্পর্শ করত না। আর কী চেহারা! কালো পেতনি চিমসে মেয়েমানুষ! এদের ভজন-সভা দেখলে ভগবান নিজে লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলতেন। আর, এই বাইজিদের গানে কী মজা… যেন… বাহ্ বাহ্ বাহ্…
শুনুন একবার এদের নাম-গান! হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ!– বাইজিদের চুল বাতাসে ঢেউয়ের মতো নাচছে। এলোমেলো চূর্ণকুন্তল সাপের মতো দুলছে। কয়েকগাছি এক বাইজির ঠোঁটের উপর এসে পড়েছে। পাতলা-পাতলা ঠোঁটে যেন দংশন করতে চায়। গলার উতরাইয়ে প্রাণস্পন্দন কীরকম, দেখেছেন! এই নরম বুক ভগবানের দর্শনের আশায় যেন তড়পাচ্ছে। চোখে কাজল। আহা, কী চোখ! কান পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। কানের ডালিটাই-বা কী সুন্দর! ইচ্ছে হয়, কাঁচা খেয়ে ফেলি। হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ! এমন বদখেয়াল কেন মনে এল! ভগবান এর বিচার করো। ওই দ্যাখো, গোপিনীরা কদমতলায় গান ধরেছে, আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বাঁশরিতে সুর তুলে তুলে নাচছেন।
বড় বাইজির বয়েস পঁচিশ বছরের বেশি হবে না। কিন্তু যেন মূর্তিমতী রতি। এই চোখে কোনও রঙ নেই। এমন সুডোল হাত, যেন কলি দিয়ে গড়া। আর ওই আলতারাঙা তুলতুলে চরণ কোনও কাঁটার আঘাত পায়নি কোনওদিন। কী মোলায়েম! বড় বাইজির কপোল যেন পাকা আপেল। এখনি গাছ থেকে ছিঁড়ে পড়তে চায়। বুধ, তোমার ঝুলি বাড়িয়ে দাও।
হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ!
মেজ বাইজির দুনিয়া-ঝলসানো দেহের দিকে তাকাও। সে বাইজির দলে সাপের মতো নাচের তালে তালে চমকাচ্ছে। এমন কালো বিষধর কেশপাশ তুমি কোথাও দেখেছ! এমন স্বপ্ন কোথায় দেখেছ তুমি? যেন ঘুমন্ত শিশুর হাসি, ঊষার বুকে শিশিরসিক্ত ফুল, সুন্দর স্বপ্ন দেখার পর চোখ মেলে বিকশিত হচ্ছে। যেন…। আধফোঁটা এই কলির মাধুর্যই অন্যরকম।
করতালের লয় হাজার মূর্ছনায় ফেটে পড়ছে। ছাতির ওপর গ্রীবাসমুদ্রের ঢেউ নাচছে, ভেঙে পড়ে দূরে হারিয়ে যাচ্ছে, আবার ভেঙে পড়ছে, তার পর সব নিস্তব্ধ। এই সুন্দর উপত্যকা, এই টিলা, এই দুধের ঝরনা…
হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ!
বুড়ো পূজারি মারা গেছেন।
মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি কোলাহল তুলেছিল। পূজারি কাঁদছে। মেয়েরা মন্ত্রপাঠ করছে। বাইজিরা থালায় ফুল সাজিয়ে সাধুর সমাধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন কলরব লেগেই থাকে।
এখন রাত্রি।
টিলা সুপ্ত। সাধুরা যার যার সমাধির ভেতর ঘুমিয়ে। বিশহাজারির ছোট-ছোট ঘরের ছোট্ট-ছোট্ট জীবনের কোলাহল ঘুমন্ত। পৃথিবীর কক্ষ-পরিভ্রমণ থেমে গেছে। মন্দিরের চত্বরে যুবক পূজারি একা বসে ছিল। সে আজ সিদ্ধি গিলেছে, চরস খেয়েছে, মদ টেনেছে। তবু তার চেতনায় কোনও বিভ্রাট নেই।
‘গুরু।’ আমি তার কাছে গিয়ে আস্তে করে ডাক দিলাম। তার পর তার গায়ে হাত দিয়ে বসে পড়লাম। সে নিঃশব্দে কাঁদছিল, আর আলগোছে চোখের জল মুছে ফেলছিল।
‘তোমার কিসের দুঃখ, গুরুদেব?’
‘আমি গদি চাই, আমি নারী দেহ চাই, আমি হোটেলে খেতে চাই, আমি আমার আত্মা থেকে সমস্ত ভোগ-লালসা দূর করে দিতে চাই। জানি না, আমি কী চাই।’
‘তুই গদি চাস, হোটেলে খেতে চাস?’ কে যেন তার মাথার উপর থেকে বলল। আমরা দু জনে ঘুরে দেখি, প্রৌঢ় পূজারি অগ্নিদৃষ্টিতে আমাদের দিকে চেয়ে রয়েছে বলছে, ‘এই মন্দিরে লালসার ভিখারিদের জায়গা নেই। দূর হ এখনি এখান থেকে!’
যুবক পূজারি সটান খাড়া হয়ে দাঁড়াল। তার হাতের পেশি উছলে উঠেছে। দাঁত কটমট করছে। দম-আটকানো গলায় সে বলল, ‘এখনি তোকে খতম করে ফেলব। তুই দূর হয়ে যা– ‘
বাবা পন নাথ ভয়ে পালিয়ে গেল।
অতিথিশালায় তখনও আলো জ্বলছিল।
যুবক পূজারি অতিথিশালার দিকে এগোতে লাগল। সে একবার আমার দিকে তাকাল। তার পর মুখ ঘুরিয়ে আবার এগিয়ে চলল সামনের দিকে। আরও, আরও…। আর ফিরে তাকাল না। পূজারির ফুল-সাজানো সমাধি পার হয়ে সে এগিয়ে চলেছে। এবার অতিথিশালার দরজায় পৌঁছল। তার পর ভেতরে ঢুকল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
অতিথিশালার আলোও নিভে গেল।
টিলা সুপ্ত। সাধুরা সমাধির বুকে নিদ্রামগ্ন। বিশহাজারির ছোট-ছোট ঘরের ছোট্ট-ছোট্ট জীবনের স্পন্দন নিভে গেছে। থেমে গেছে পৃথিবীর গতি।
দ্বিতীয় দিন জানা গেল, বাবা পন নাথকে কে যেন খুন করে রেখে গেছে। পুলিশ সন্দেহক্রমে যুবক পূজারি ও বাইজি তিনজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। পরে বাইজিরা ছাড়া পেল। খুনের অভিযোগে মামলা চালানো হল কেবল ছোকরা পূজারির বিরুদ্ধে। কিন্তু সে-ও প্রমাণের অভাবে রেহাই পেয়ে গেল।
খালাস পেয়ে বেরিয়ে এসেই সে সুন্দর করে বাবা পমন নাথের সমাধি তৈরি করে দিল। এখন তিনজন বাইজি প্রতিদিন সেখানে ফুল ছড়ায়।
যোধপুর থেকে বাইজি তিনজনের ফিরে যাওয়ার আদেশ এল। সেখানকার পূজারি লিখেছে। কিন্তু যুবক পূজারি তা গ্রাহ্যই করল না। কেননা, দিল্লিতে ধর্মজ্ঞানের চর্চা এখন খুব বেশিমাত্রায় হওয়া দরকার। যুবক পূজারি জবাবে লিখল, যদি এইরকম বাইজি যোধপুরের মন্দিরে আরও থাকে, তাদের যেন দিল্লি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর যোধপুরের পূজারি চুপ করে গেল।
দৈবক্রমে মঠের রায়মতো নতুন পূজারিই ভৈরবী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত মনোনীত হল। সে গায়ত্রী পাঠ করতে জানে না। তাতে কী। সে এখন বৃদ্ধ পূজারির বিপুল ধনদৌলতের মালিক। বৃদ্ধ পূজারি এ সম্পদ ব্যাংকে রাখেনি, তার কুঠরির ভেতর পুঁতে রেখেছিল।
‘তুমি কেমন করে খবর পেলে?’ আমি জিগ্যেস করলাম।
‘এমনি। শুধু ভগবান আমাকে খবর দিয়েছিল। বুড়ো বাবার কুঠরির ভেতর ঢুকেই আমার খেয়াল এল। তিনি হাত-ইশারায় বলেছিলেন, তাঁর ঘরে কিছু আছে। এটা-সেটা খুঁড়ে দ্যাখো। যদি রাতারাতি না-দেখতাম, এই গুপ্তধন আমার কপালে জুটত না। আমি মামলা চালাতাম কী করে! কী করে হতাম এই গদির মালিক!’
সে গদির মালিক– গর্বভরে কথাটা সে বলছে, ঠিক এমনি সময় আমার চোখে পড়ল একখানা সাক্ষাৎকার কার্ড :
ভৈরবী মন্দির লিমিটেড
শাখা : লাহোর, দিল্লি, যোধপুর, রুড়কি
স্বত্বাধিকারী : বাবা দমন নাথ গোস্বামী
আমি এবার চিৎকার করে বললাম, ‘পেয়েছি, পেয়েছি।’
সাধু ভয় পেয়ে গিয়ে জিগ্যেস করল, ‘কী হল?’
আমি ঘরমুখো ছুটতে ছুটতে বললাম, ‘ভগবান পেয়েছি, ভগবান পেয়েছি, পেয়েছি।’
.
গত পনেরো বছর যাবৎ আমি বোম্বাইয়ে স্থায়ীভাবে বাস করছি। জহুতে আমার নিজস্ব ভৈরবী মন্দির আছে। একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছি সুরাটে, আর একটি আহমদাবাদে। আনন্দপুরে বাইজিদের মঠ খুলেছি। সারা ভারতে কোথাও আপনার চোখে পড়বে না এমন সুতনু সাধন-সঙ্গিনী। বছরে আট মাস এই বাইজিরা ঘুরে-ঘুরে টাকা আর কাপড় সঞ্চয় করে।
হিন্দুস্থান ভাগ হয়ে যাওয়ার পর ভয়ানক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। হাজার হাজার মুসলমান মারা গেল। কিন্তু আমার আমদানি কিছুমাত্র কমেনি।
হ্যাঁ, দিল্লির গুরুজির লাহোরের শাখা-মন্দিরটা ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু গুরুজি দমবার পাত্র নন। তৎক্ষণাৎ দিল্লির একটা মসজিদ তাঁর হস্তগত হল। তিনি সেখানে ভৈরবী-জ্যোতির মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। বোম্বাই, দিল্লি, যোধপুর, আহমদাবাদ ও অন্যান্য শহরে আগত শরণার্থীরা ভিক্ষা চায়। কিন্তু বাইজিরা যা পায়, তার পঞ্চাশ ভাগের এক ভাগও বেচারা শরণার্থীদের কপালে জোটে না। বোধহয় হাজার হাজার মেয়ে আমায় অনুরোধ করেছে ভগবানের সঙ্গে তাদের মিলন ঘটিয়ে দেওয়ার জন্য। যাদের কপাল ভালো, তারা ভগবানকে পেয়েছিল বইকি।
আমার আধ্যাত্মিক সিদ্ধিও বেড়ে গেছে। আমি এখন আমার কারবার বাড়ানোর কথা ভাবছি। এই বছর একটা ফিল্ম-কোম্পানি খোলার ইচ্ছা আছে, আর কলবা দেবী রোডের ওপর গণেশজির এক মন্দির। কলবা দেবী রোডে লাখপতি গুজরাটি ও মাড়োয়ারিদের কারবার চলে। এরা গণেশ ঠাকুরের প্রেমিক। মনে হয়, এই মন্দির জোরসে চলবে। দাদাকে চিঠি লিখেছি। তাঁর রায় এলে কাজ শুরু করব। এখন আমি দাদার অনুমতি ছাড়া কোনও কাজ করি না। তিনিই আমাকে দেখিয়েছেন সত্য জ্ঞানের পথ। যদি নিজের পথে চলতাম, এইরকম বেকার থাকতাম এবং সোশ্যালিজমের অকেজো বাজে বই পড়ে পড়ে নরকে যেতাম।
হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ!
অনুবাদ : শওকত ওসমান
বাবা নূর – আহমদ নদিম কাস্মি
একটি ছেলে বলে, ‘কোথায় যাচ্ছ, বাবা নূর?’
‘এই একটু ডাকঘরে যাচ্ছি।’ অত্যন্ত রাশভারি সুরে উত্তর দিয়ে এগিয়ে যায় বাবা নূর।
ছেলেরা সব খিলখিল করে হেসে ওঠে 1
ওদিক থেকে মৌলবি কুদরতউল্লা আসছিলেন। বললেন, ‘হাসিস নে ছোঁড়ারা! এসব কথায় হাসতে নেই। আল্লা কার বরাতে কী রেখেছে, কে জানে!’
ছেলেরা তখনকার মতো চুপ হয়ে যায়। কিন্তু মৌলবি কুদরতউল্লা চলে গেলে ওরা আবার খিলখিল করে হেসে ওঠে। এ ওর গায়ে ঠেলা মেরে বলতে থাকে, ‘ডাকঘরে যাচ্ছে বাবা নূর।’
মসজিদের মেহ্রাবের কাছে থেমে জুতো খুলে বাবা নূর খালিপায়ে এগিয়ে যায়। হাত দুখানা মোবের উপর রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে ঠোঁট আর চোখ দিয়ে চুমো খায় কয়েকবার। তার পর পিছু হটতে হটতে ফিরে এসে জুতো পরে আবার চলতে থাকে।
বাবা নূর যখন মোবে চুমো খাচ্ছিল, ছেলেরা তখন নীরবে এ-গলি ও-গলি দিয়ে চুপচাপ সরে পড়ে। ভাবখানা এই যে পরস্পরকে দেখে লজ্জা পেয়ে গেছে ওরা।
বাবা নূরের সর্বাঙ্গে ধবধবে সাদা খদ্দরের পোশাক। মাথায় খদ্দরের টুপি। পেছনদিকে সাদা চুলের সঙ্গে মিশে গিয়ে টুপির সবটাই ঘাড় পর্যন্ত নামানো বলে মনে হচ্ছে। সদ্য-আঁচড়ানো সাদা দাড়িগুলো একটা বিশেষ ভঙ্গিতে ছড়িয়ে রয়েছে বুকের উপর। ফর্সা রঙে একটা ফ্যাকাশে ছাপ পড়েছে। ছোট ছোট চোখের মণি দুটো ঘন কালো। দেখলে মনে হয় বুঝিবা চীনেমাটির পুতুলের চোখের মতো নকল চোখ। ফর্সা শরীর, চুল-দাড়ি আর পোশাকের এতসব সাদা রঙের ভেতর ভ্রমরের মতো কালো চোখদুটি সত্যিই অদ্ভুত মনে হয়; কিন্তু এই অদ্ভুত অসামঞ্জস্যই বাবা নূরের চেহারায় ফুটিয়ে তোলে শিশুর সরলতা। বাবা নূরের কাঁধে সবসময়ই পড়ে থাকে সাদা খদ্দরের একটা বড় রুমাল। ছেলেদের ভিড় থেকে মসজিদের মেহরাব পর্যন্ত যেতে রুমালখানা তিন-চার বার কাঁধ বদল করেছে।
একটা দোকানের দরজায় বসা ছোকরা দোকানি জিগ্যেস করে, ‘ডাকঘরে যাচ্ছ, বাবা নূর?’
‘হ্যাঁ বাবা, বেঁচে থাকো!’ বাবা নূর উত্তর দিয়ে রুমালটা ঝট্কা মেরে অন্য কাঁধে রাখে।
কাছেই একটা ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। চট্ করে হাততালি দিয়ে বলে ওঠে, ‘আহা, বাবা নূর ডাকঘরে যাচ্ছে!’
দোকানি ধমকে ওঠে, ‘এই ছোঁড়া, ভাগ্ এখান থেকে!
বাবা নূর কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছিল, পেছন ফিরে বলে, ‘ধমকাচ্ছ কেন ছেলেটাকে ছেলেপিলেদের কি ধমকাতে আছে? ঠিকই তো বলেছে ও। ডাকঘরেই তো আমি যাচ্ছি।’
দূর দূর থেকে ছেলেরা দৌড়ে আসছিল। এপাশ-ওপাশ থেকে খিলখিল করে হেসে ওঠে তারা। বাবা নূরের পেছনে একটা মিছিল খাড়া হবার উপক্রম হয় যেন। কিন্তু আশপাশের কয়েকজন জোয়ান ছেলে তেড়ে আসে। বাবা নূর বাধা দেওয়া সত্ত্বেও ছেলেদের তাড়িয়ে দেয় তারা।
গ্রাম পার হয়ে বাবা নূর এবার মাঠে এসে পড়ে। মেঠো পথ এঁকেবেঁকে আলের উপর দিয়ে যেতে-যেতে হঠাৎ একসময় সবুজে ভরা ক্ষেতের মধ্যে মাথা গুঁজেছে। বাবা নূরের গতি কমে আসে সেখানে। গমের কচি চারাগুলোর পাশ কাটিয়ে অতি সাবধানে হাত-পা বাঁচিয়ে চলতে থাকে সে। কোনও পথচারীর অসাবধানতায় একটা চারা পথের উপর পড়ে আছে দেখতে পেলে সেটাকে অন্য চারার সঙ্গে হেলিয়ে বা জড়িয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়, আর চারাটার যে-জায়গা একটু বেঁকে পড়েছে, সেখানটা এমনভাবে ছোঁয় যেন জখমে হাত বুলোচ্ছে। তার পর আলে উঠে এই দেরিটুকু পুষিয়ে নেওয়ার জন্য চলার গতি বাড়িয়ে দেয়। বাতাসে তার দাড়ি ছড়িয়ে পড়ে, আবার গুটিয়ে যায়, কাঁধের উপর থেকে রুমালখানা উড়ে উড়ে ওঠে, কিন্তু বাবা নূরের চলার বেগ কমে আসে তখন, যখন রাস্তা আবার গমের ক্ষেতে নেমে আসে।
আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে চলে বাবা নূর। সামনে কিছু দূরে কয়েকজন কিষান আলের উপর বসে তামাক টানছে। একটি কিষান মেয়ে কাস্তে দিয়ে এমন কৌশলে ক্ষেত নিড়োচ্ছে যে, সাধ্য কি কোনও একটা গমের চারায় এতটুকুও আঁচড় লাগে। বাবা নূর একটু থেমে মেয়েটিকে দেখতে থাকে। ঘাসের মুঠ কেটে হাত পেছনে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা, আর পিঠের উপর ঝোলানো একটা পোঁটলার ভেতর ঘাস রেখে দিয়ে আবার কাস্তে চালাচ্ছে।
‘আশ্চর্য!’ দূর থেকেই বাবা নূর কিষানদের উদ্দেশে বলে, ‘এ মেয়েটি যে একেবারেই জাদুকর দেখছি! এতবড় একটা কাস্তে চালাচ্ছে, গোছা গোছা গমের চারা ঘন হয়ে গজিয়ে রয়েছে ক্ষেতে, অথচ কাস্তে দিয়ে ঘাস কাটছে, ভুলেও একটি চারা ছুঁয়ে ফেলছে না। কার মেয়ে এ?’
বাবা নূর মেয়েটিকে জিগ্যেস করে, ‘তুমি কার মেয়ে, মা?’
মেয়েটি মৃদু হেসে বাবা নূরের দিকে তাকায়। ওদিক থেকে এক কিষানের গলা শোনা যায়, ‘আমার, বাবা।’
‘তোমার মেয়ে?’ বাবা নূর কিষানদের দিকে এগোতে এগোতে বলে, ‘বড় সেয়ানা মেয়ে তো! খুব ভালো কিষান হয়ে উঠেছে দেখছি! এমন পাকা কাজ আমি শুধু তোমার মেয়েরই দেখলাম। আর দেখেছিলাম আমার ছেলের। আল্লা তার হায়াত
দারাজ করুন!’
ডাকঘরে যাচ্ছ বাবা?’ মেয়েটির বাবা জিগ্যেস করে।
‘হ্যাঁ।’ বাবা নূর বলে, ‘আল্লা তোমার মঙ্গল করুন। ভাবলাম, একবার জিগ্যেস করে আসি। কী জানি কোনও চিঠিপত্র যদি এসে থাকে।’
তিনজন কিষানের মুখই হঠাৎ থমথমে হয়ে ওঠে। একপাশে সরে দাঁড়িয়ে তারা রাস্তা ছেড়ে দেয়। বাবা নূর এগিয়ে যায়।
‘কেন ও-কথা জিগ্যেস করলে তুমি?’ মেয়েটির বাপকে একজন কিষান বলে।
‘জিগ্যেস করা উচিত হয়নি।’ দ্বিতীয় জন বলে।
মেয়েটির বাপ লজ্জিত হয়ে রাস্তার উপর আঙুল দিয়ে আঁচড় কাটতে থাকে। বাবা নূর ক্ষেতের মাথায় পৌঁছে গিয়েছিল, এমন সময় মেয়েটি ডাক দিয়ে ওঠে, ‘লসি খাবে, বাবা নূর?
বাবা নূর ফিরে তাকায়। গ্রাম থেকে বেরোবার পর এই প্রথম তার ঠোঁটে মৃদু হাসির আভা ফুটে ওঠে, ‘খাব, বেটি।’ তার পর একটু থেমে আবার বলে, ‘তেষ্টা নেই বটে, তবে মুসাফিরকে পানি খাইয়ে একটু সওয়াব নিবি, তাতে তোকে বাধা দেব না। দে বেটি, দে!
রুমালখানা এক কাঁধ থেকে আর এক কাঁধে রাখে বাবা নূর। ‘হ্যাঁ, দ্যাখ, একটু শিগগির করে নিয়ে আয়। ডাকপিওন হাওয়ার ঘোড়ায় চড়ে থাকে, চলে না যায় আবার।’
ঘাসের পোঁটলাটা পিঠ থেকে নামিয়ে সেইখানেই ক্ষেতের মধ্যে রেখে দেয় মেয়েটি। তার পর দৌড়ে আলের উপর কুলগাছটার কাছে চলে যায়। গুঁড়ির আড়াল থেকে একটা পাত্র তুলে নিয়ে খুব করে ঝাঁকায়। শেষে অ্যালুমিনিয়মের একটা বাটি ভরে নিয়ে ছুটতে ছুটতে বাবা নূরের কাছে ফিরে আসে।
বাবা নূর একনিঃশ্বাসে বাটিটা খালি করে দিয়ে রুমালে ঠোঁট মুছে বলে, ‘তোর নসিব এই লসির মতোই সাফ হোক, বেটি।’ তার পর আবার ডাকঘরের দিকে এগোতে থাকে সে।
মাদ্রাসার বারান্দায় অনেকগুলো লোকের সাথে বসে ডাক-মুন্সি নিজের প্রাত্যহিক কাজের ‘ফরম’ পূরণ করতে করতে গাঁয়ের লোকদের নতুন নতুন খবর শোনাচ্ছিল : ‘পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহর ছিল লাহোর। এখন লোকে বলে, করাচি নাকি পয়লা নম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমি বলি, লাহোর গুটিয়ে-শুটিয়ে একটা ছোট্ট গ্রাম হয়ে যাক না কেন, তবু সে লাহোরই থাকবে।’
‘সে তো ঠিক কথাই।’ গাঁয়ের লোকদের ভেতর থেকে একজন বলে, ‘আল্লা করাচির বদনাম না-করান– আমার শালা করাচিতে চাপরাশির কাজ করত। যখন ও মারা যায়, তখন আমায় করাচি যেতে হল। আমি বলি কি, মুন্সিজি, করাচিটা একবার দেখেই এসো। হোক-না সে গাধা দিয়ে গাড়ি চালানো। কিন্তু গাড়ি কত! আমাদের গাঁয়ে এত পাখিও নেই। এক এক মোটরে এমন এমন সব মানুষ বসে থাকে যে, কী আর বলব। করাচিতে কেউ কারও ধারও ধারে না। আল্লার কুদরতের কথা মনে পড়ে যায়। নামাজ পড়তে ইচ্ছে করে। এক শেঠ বলছিল, ব্যস্, আর একটা মহাযুদ্ধ বেধে গেলেই করাচি একেবারে বিলেত বনে যাবে।’
‘শেঠের গুষ্টি…।’ মুন্সি একটা অশ্লীল গাল দিয়ে ওঠে।
‘আহা, কথাটা শোনোই-না আগে!’ লোকটি বলে, ‘তুমি খামোখা বেচারাকে গাল দিচ্ছ। সত্যিকথাই তো বলেছে বেচারা। আমায় সে বলল, কতবার যুদ্ধ বাধতে বাধতে থেমে গেছে। যুদ্ধ বাধলে মানুষ মারা পড়বে, এই বলে কেউ-না-কেউ মাঝপথে যাত্রাভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, যুদ্ধ না-লাগলেও তো লোক মরছে। যুদ্ধতে মরবে গোলাগুলির ঘায়ে, আর এমনি মরছে খেতে না-পেয়ে। যুদ্ধ বাধলে তবু যা-হোক চাকরি পাবে মানুষ! ‘
‘ঝাঁটা মারো অমন চাকরির মুখে!’ মুন্সিজি ফরমের উপর ঠক্ করে সিল মেরে বলে। তুমি দেখছি এখানেই যুদ্ধ লাগিয়ে দিলে, মুন্সিজি।’ গাঁয়ের আর সবাই হেসে ওঠে এ-কথায়।
কিন্তু মুন্সি হাসে না। সে এমনভাবে একদৃষ্টে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন তার দৃষ্টি দূরে একটি বিন্দুর উপর স্থির হয়ে গেড়ে বসেছে। মুহূর্তে তার মুখ সাদা হয়ে যায়, ঠোঁটদুটি একেবারে শুকিয়ে ওঠে। স্তিমিত গলায় সে আস্তে করে বলে, ‘বাবা নূর আসছে।’
একসঙ্গে সকলের চোখই বাবা নূরের দিকে ফেরে। সবার মুখই কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
সাদা পোশাক পরনে বাবা নূর, সোজা মাদ্রাসার বারান্দার দিকে চলে আসছে কেমন যেন ঝিম-ধরা অস্বস্তি বোধ করে সবাই। দু-একজন বিব্রত হয়ে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায়।
বাবা নূর তখনও বারান্দার কাছে পৌঁছয়নি। কিন্তু মুন্সিজি আর চুপ করে থাকতে পারে না। চট করে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে, ‘এসো, বাবা নূর, এসো!’
বারান্দার কাছে পৌঁছে বাবা নূর বলে, ‘ডাক এসে গেছে, মুন্সিজি?’
‘এসে গেছে, বাবা নূর।’ মুন্সি উত্তর দেয়।
‘আমার ছেলের চিঠি-টিঠি আসেনি?’ বাবা নূর জিগ্যেস করে।
‘না, বাবা।’ মুন্সি উত্তর দেয়।
‘বড় খেয়ালি ছেলে। চিঠিপত্র একদম লেখে না।’ বাবা নূর বলে।
রুমালখানা এক কাঁধ থেকে নামিয়ে ঝেড়ে নেয় সে, তার পর অন্য কাঁধে ফেলে চুপচাপ ফিরে যায়। শেষে যখন তার মূর্তিটা দূরে গাঁয়ের আঁকাবাঁকা পথে একমুঠো সাদা তুলোর মতো হয়ে আসে, তখন মুন্সিজি বলে, ‘ভাই, কী করি, বলো তো! আজ দশ বছর ধরে বাবা নূর এমনি করে আসে, আর, প্রতিবারে এই একই কথা জিগ্যেস করে, আমিও প্রত্যেক দিন একই উত্তর দিই। সরকারের কাছ থেকে চিঠি এসেছিল, তোমার ছেলে বার্মায় বোমার আঘাতে মারা গেছে। সে চিঠিখানা আমিই তো পড়ে শুনিয়েছিলাম তাকে। বেচারার মনেই নেই সেকথা। চিঠিখানা আসার পর থেকে বেচারার মাথাটা যেন খারাপ হয়ে গেছে। দশ-বিশ দিন পরপরই ছেলের চিঠি নিতে এসে হাজির হয়। কিন্তু কসম খোদার, ভাই, এরপর বাবা নূর ফের যদি চিঠির কথা জিগ্যেস করতে আসে, তা হলে আমাকেও পাগল করে ছাড়বে।’
অনুবাদ : মোয়াজ্জম হোসেন
হাসিতে অশ্রু – হায়াতুল্লাহ আনসারি
‘কেসু তোমাকে যদি আমি পড়াতে চাই, পড়বে?
‘আমাকে পড়াবে বাবু! আমাকে–?’
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত ঝগড়ু চাক্কি থামিয়ে আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকাল।
‘কেন, এতে খারাপের কী আছে।’
‘কিন্তু আগে বলো কী পড়াবে তুমি?’
‘কেন– ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, দেশের বড় বড় লোকদের জীবনকাহিনি এবং তাঁদের মূল্যবান উপদেশাবলি!’
ঝগড়ু হেসে উঠল, উচ্চস্বরে হেসে উঠল।
বেদম হাসির চোটে অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার মুখ বড় একটা পাত্রের মতো হাঁ করে থাকল। আর তার ভেতর দিয়ে উঁচু-নিচু নানান স্বরের হাসি ভেসে আসতে লাগল।
‘কী বললে, ইতিহাস, ভূগোল আর কী– বাবু আমরা তো এখানের সকলেই নিরক্ষর।’
তার এ-কথায় আমি কিছুটা আশ্চর্য হলাম। বললাম– ‘কিন্তু তোমরা প্রয়োজনের সময় তো দেখি দিব্যি একজনের কার্ড আরেকজনের কার্ড থেকে আলাদা করে নিতে পারো।’
‘ওসব কার্ডের উপর তো আমরা বিশেষ চিহ্ন দিয়ে রাখি। এখানে পড়ালেখা কে জানে? ‘ঠিক আছে কোনও চিন্তা নেই, আমি তোমাকে পড়া শেখাব আগে, তার পর লেখা।’
‘শেখাবে আমাকে পড়ালেখা! কিন্তু আমি তো বোকা!’
‘কে বলল তুমি বোকা, তুমি তো সব কথাবার্তায় বেশ চালাক।’
‘কিন্তু বাবু যখনি বই সামনে আসে অমনি আমি বোকা বনে যাই।’
‘তা হলে চলো তোমাকে এমন এক পদ্ধতিতে পড়াব যাতে বইয়ের প্রয়োজন হয় না।’ বারে বারে বাড়ির কথা মনে পড়ত ঝগড়ুর। তাকে আনমনা করে দিত সে-চিন্তায়। সারাক্ষণ সে চিন্তার সায়রে ডুবে থাকত! কিন্তু এরপরও সে আমার কাছে পড়ালেখা করে যেতে লাগল। পিষানো আটার উপর অক্ষর তৈরি করে তার উপর তাকে মক্শ করাতাম। তাকে পড়াবার এটাই ছিল শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি।
খুনের অপরাধে ঝগড়ুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। সে ছিল বড় ঝগড়াটে কয়েদি। আর বোধহয় এ-কারণেই জেলার সাহেব তাকেই দিয়েছে আমার সাথি হিসেবে। কিন্তু আমার সাথে সে কখনও ঝগড়া করেনি, বরং চাক্কি চালাবার সময় সে নিজে গায়ের সব জোর দিয়ে চালায়, আমাকে শুধু বলে– ‘বাবু, তুমি শুধু হাত দিয়ে ধরে রাখো।’
কোর্টের পক্ষ থেকে আমাকে ‘বি’ ক্লাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের জেলার সাহেব রাজবন্দিদের ব্যাপারে বড় তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখেন। তিনি বলতেন– ‘এ’ ক্লাস হোক, চাই ‘বি’ ক্লাস হোক, তাদের কাজ করতেই হবে। নাহয় আবার তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠবে আর খোদ জেলারের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র করবে।
আমি তার সাথে এ-ব্যাপারে কথা-কাটাকাটি করেছিলাম।
তিনি রেগে গিয়ে বললেন– ‘তোমার সমস্ত শক্তি বের করে ছাড়ব। এমন কয়েদির সাথে তোমাকে চাক্কি চালাতে দেব– যে তোমার মেজাজই ঠিক করে দেবে।’
প্রথম প্রথম চাক্কি চালাতে সত্যি আমার কষ্ট হয়েছিল। চাক্কির ভার আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে ঝগড়ু বসে থাকত। কিন্তু যখনি সে জানতে পারল– ‘রাজবন্দি কাদের বলে’- তখনি সে আমার ওপর সহৃদয় হয়ে উঠল এবং চাক্কির সমস্ত ভার নিজে নিতে লাগল।
‘কেমন ভাই, পড়া মুখস্থ হয়েছে তো?’
‘কালকেরটা হয়নি। তার আগের দুদিনের পড়া মুখস্থ হয়েছে।’
‘যা হোক– অন্তত কিছু তো হয়েছে।’
ঝগড়ুর স্থির বিশ্বাস– পড়াটাই আসলে ভালো জিনিস, কিন্তু লেখা শিখে কী করবে। তার আছেই-বা কে যে, একখানা চিঠি লিখবে?’
‘বাড়ির কথা তুমি খুব স্মরণ করো– তাই না?’
‘হাঁ বাবু, খুব।’
‘যাকে স্মরণ করো– তার কাছে লিখবে?
‘না বাবু, তা হয় না।
‘কেন?’
‘কী আর বলব।’
আটার মাঝে অক্ষর এবং অক্ষর থেকে শব্দ গঠন হতে থাকল। আর শব্দ পড়ার সাথে সাথে তার চেহারায় এক অদ্ভুত সজীবতা ফুটে উঠতে লাগল– সাথে একটুখানি আশার ক্ষীণ আভা। পড়ার দিকে তার আকর্ষণ ক্রমশ বেড়েই যেতে লাগল, শব্দের পর বাক্য লিখে যেতে লাগল আটার উপর।
আস্তে আস্তে ঝগড় এসব বাক্যগুলো পড়তে থাকল।
একদিন আমি বললাম– ‘ঝগড়ু ভাই! এবার তুমি চিঠিও পড়তে পারবে।’
ঝগড় হঠাৎ হাত থামিয়ে ফেলল।
‘আমি চিঠি পড়তে পারব?’
‘হ্যাঁ।’
তার কালো বর্ণের শরীরে ঈষৎ রক্তিমাভা খেলে গেল, শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত বইতে শুরু করল এবং হাত কাঁপতে থাকল– ‘আমি চিঠি পড়তে পারব!’
‘হ্যাঁ ঝগড়ু! তুমি চিঠি পড়তে পারবে।’
সে এক আশ্চর্য খুশিভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।
‘দ্যাখো বাবু, ভেবেচিন্তে বলো, পড়তে বসলে আবার আটকে যাব না তো!’
‘না ঝগড়ু, যদি পরিষ্কার লেখা হয় তা হলে নিশ্চয়ই তুমি পড়তে পারবে।’
ঝগড়ু উৎফুল্ল, ভাবনাচিন্তার অতলে ডুবতে থাকল সে এবং ডুবতে ডুবতে একসময় একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল। চাক্কি চলতে থাকল গড় গড় করে স্বাভাবিক গতিতে আর আমিও জোর দেওয়ার তেমন কোনও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম না। কিন্তু ঝগড়ুর চোখজোড়া অতীত চিন্তার গভীর অতলে তলিয়ে গেল– যা দেখে আমি ভয়ে এতটুকুন হয়ে গেলাম।
ঝগড়ুর চেহারার এই অদ্ভুত পরিবর্তন দুপুর থেকে ছ-প্রহর পর্যন্ত থাকল। পরে একসময় সে আমার কাছে এসে বলল– ‘বাবু কিছুক্ষণের জন্য আমাকে ছুটি দাও, এই এক্ষুনি চলে আসব।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাও।’
একটা দেয়ালের আড়ালে চলে গেল ঝগড়ু। আমি পুরোদমে আটা পিষতে থাকলাম। ঠিক সে-সময় ঝগড়ুর কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সে উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলছে, কখনও হাসছে, কখনও-বা জোরে জোরে কাঁদছে। আর তার গলার স্বরও এমন অদ্ভুত যে, আমার ভয় পেয়ে গেল এবং জোরে তার কাছে দৌড়ে এলাম আমি।
ঝগড় তখন হাতে একখানা কাগজের পাতা নিয়ে পড়ছিল। তার ঠোঁটে ঈষৎ হাসি, চোখে অশ্রু –আর তার হাতজোড়া কাঁপছিল।
‘সে মারা গেল, তা সে আমার হয়েই মারা গেল। মরার সময় সে আমারই ছিল এবং এখনও আমার থাকল, হ্যাঁ।’
এবার সে কাঁদতে থাকল এবং ফুটফুট করে কাঁদতে থাকল। আমি অনুভব করলাম এসময় তার কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। তাই দূরেই দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি। ঝগড়ুর কান্নার রেশ কিছুটা কমলে আমি ডাকলাম– ‘ঝগড়ু, ঝগড়।’
কিন্তু ঝগড়ু তেমনি নিজের চিন্তার রাজ্যে ডুবে থাকল। আমি বারবার তাকে ডাকতে থাকলে সে বলল– ‘বাবু তুমি চাক্কি চালাও গে, নাহয় আমাদের উভয়েরই পিঠে কোড়া পড়বে। তোমার বদৌলতে আমার সে-কথা জানা হয়ে গেছে যে-কথা জানার জন্য আমি পাঁচ বছর ধরে অস্থির চিত্তে উন্মুখ ছিলাম। কিন্তু আমাকে কে বলত –।‘
তার এসব কথাবার্তায় আমরা নিশ্চিন্ত হলাম যে, সে পাগল হয়ে যায়নি। পরে এসে আটা পিষতে থাকল সে।
২
পরের দিন ঝগড়ু এলে দেখলাম তার চেহারায় বিষণ্নতাও ছিল, নীরবতাও ছিল এবং একটা ক্ষীণ হাসির ছোঁয়াও ছিল। তবে এখন তার চোখে সেই মৃত-মৃত ভাব নেই– যা প্রায়শ তার মাঝে দেখা যেত।
আমি ঝগড়ুকে জিগ্যেস করলাম– ‘কী ব্যাপার।’
সে কিন্তু কোনও জবাব দিল না। সেদিন বিকেলে যখন সে চলে যাচ্ছিল তখন বড় নম্রভাবে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে গেল। পরের দিন সকালেও তাই করল, সন্ধ্যায়ও। তিন-চার দিন পর ঝগড়ু আমাকে তেমনি পা ছুঁয়ে বলতে লাগল–
‘বাবু তুমি আমার ওপর এমন অনুগ্রহ করেছ যে, সাত জনমেও তার শোধ দিতে পারব না। যদি আমি জেলের বাইরে হতাম তা হলে একটা কাজ নিশ্চয়ই করতাম। তা হল তোমার সব শত্রুদের খুঁজে খুঁজে বের করতাম।’
‘আমার কোনও শত্রু নেই, কিন্তু তোমার হয়েছে কী বলো দিকিনি, তুমি খুশি, না বিষণ্ণ।’
‘আমার নিজেরও বুঝে আসছে না, তোমাকে কী বলব।’
‘আচ্ছা বলো দিকি সেদিন আমার হাতে চাক্কি ছেড়ে দিয়ে গিয়ে কী পড়ছিলে?’ ‘একখানা চিঠি।’
‘কার চিঠি?’
‘আমার স্ত্রীর।’
‘স্ত্রীর! তুমি তো সবসময়ে বলতে তোমার কেউ নেই।’
‘এখন সে কোথায় বাবু– সে তো এখন ভগবানের কাছে।’
‘ভগবানের কাছে? তবে তার চিঠি কীভাবে পেলে তুমি?’
‘এ চিঠি তো পাঁচ বছর আগে এসেছিল।’
‘তা তুমি কারও কাছ থেকে নিশ্চয়ই পড়িয়ে নিয়েছিলে?’
‘না, তা কারও কাছে যাইনি।’
‘কারও কাছে যাওনি?’
‘হ্যাঁ, চিঠিখানি এভাবেই পাঁচ বছর যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম।’
আমি কেঁপে উঠে মনে-মনে বললাম –”পাঁচ বছর, পাঁচ বছর! গত পাঁচ বছরে এ পৃথিবীর কত পরিবর্তন হয়েছে, কত কিছু ঘটেছে।-–”
আমি চাকরি পেয়েছি, বিয়ে করেছি, আমার বড়ছেলে ইশকুলে পড়ছে, চাকরি ছেড়ে দিয়েছি এবং ‘৪৬ সনের আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেলে এসেছি।
এই পাঁচ বছর হিন্দুস্তানে কী তুমুল বিপ্লব সংঘটিত হয়ে গেছে। দেশে কংগ্রেস সরকার গঠিত হয়েছে। অর্থাৎ সেই নেতৃবৃন্দ– যাদের লোক গুণ্ডা বলে মনে করে– তারা শাসক হল। শিক্ষার নিয়মকানুন পরিবর্তিত হল, কৃষকদের উচ্ছেদ করা বন্ধ হল। এতে তাদের জীবনের কাঠামোই বদলে গেল, এবং আরও অনেককিছুই হয়ে গেছে এ পাঁচ বছরে– যখন থেকে এ চিঠিখানা ঝগড়ুর কাছে এমনি পড়ে ছিল।
‘উহ্! পাঁচ বছর।
ঝগড়ু বলতে থাকল, ‘যদি এটা যেই-সেই চিঠি হত তা হলে অবশ্য অন্য কারও কাছ থেকে পড়িয়ে নিতাম। কিন্তু এটা তো অন্যধরনের চিঠি। আমার সবসময় ভয় ছিল– চিঠিতে এমন কোনও কথা নেই তো যদ্দ্বারা সে হেসে দেয়। তা হলে তো নির্ঘাত আমি তার গলা চেপে ধরব। এবং আমার এ-ও ভয় ছিল– চিঠির কথা নিয়ে তারা যদি হাসাহাসি করে তা হলে আমি তাদের মেরে শেষ করে দেব। ভাই আমার রাগকে আমি বড় ভয় করি,–রাগই তো আমাকে এই চার দেয়ালের অভ্যন্তরে নিয়ে এসেছে।
‘আমি তাই চিঠিখানা অন্য কারও কাছ থেকে পড়িয়ে নিইনি। তা সেই চিঠিখানা আমার বুকের উপর রাবারস্ট্যাম্পের মতো লেগেছিল। সবসময় বুকে একধরনের ব্যথা অনুভব করতাম– না-জানি চিঠিখানার ভেতরে কী লেখা আছে। আমি ভেবে রেখেছিলাম জেল থেকে ছাড়া পেয়েই স্টেশনে গিয়ে একজন লোককে দিয়ে তা পড়িয়ে নেব।
‘তা এখন চিঠি পড়েছ তো?’
‘হ্যাঁ বাবু, পড়েছি। এবং পড়ে জানলাম- আমার পত্নী আমার ছিল এবং মরার সময়ও আমার হয়ে মরেছে।’
‘এর ওপর তোমার সন্দেহ হল কেন?’
‘বাবু– দীর্ঘ সাজা কাকে বলে তা তো জানো না। যখন আমার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়– তখন আমি যুবক, আর সে তো ধরতে গেলে একেবারে বাচ্চাই। আমি রায় শুনেই পাঁচজনকে সাক্ষী রেখে বলে দিয়েছি যে, আমার পত্নী যাকে ইচ্ছা বিয়ে করে নিতে পারবে, আমার দিক থেকে সে মুক্ত। পরে সে জেলে আমার সাথে দেখা করতে এলে তাকে একথা আমি নিশ্চয়ই বলতাম– ‘তুই এই যৌবন নিয়ে কী করে বাঁচবি রে মূর্খ? যা কাউকে বিয়ে করে নেগে।’ কিন্তু ভগবান জানেন একথা বলার সময় আমার হৃদয় ফেটে চৌচির হয়ে যেত। আমি নিজের মনকে প্রায়শ বলতাম, তোর হৃদয় ফেটে যায় তো যাবে– কিন্তু এটা তো চিন্তা কর্ এ মেয়েটা যাবজ্জীবন কয়েদির পত্নী হয়ে কী করে থাকবে। তুমি তো জানো যৌবনেরও একটা বয়েস আছে, একটা সময় আছে। সে-বয়সের রঙিন দিনগুলোতেই যদি সে তার প্রেমাস্পদকে না-পেল তা হলে তো বৃথা তার এ জীবন। তবুও সে এল না দেখে মন-মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। শেষমেশ আমিও রেগে গেলাম। মনে মনে বললাম –ঠিক আছে, তুই না-আসিস্ –অন্য কারও ঘরে চলে যা। তা সে এলও না। প্রতিদিন সে আসবে ভেবে ভেবে আমি অস্থির হয়ে উঠতাম, গভীর জলের মাছের মতো চঞ্চল হয়ে উঠতাম। পরে একজনকে দিয়ে খবর পাঠিয়েও তাকে ডাকলাম, তবুও সে এল না। আমার খুব কান্না পেল, আর আমি খুব করে কাঁদলামও। পরে নিজকে নিজে বললাম– ‘মূর্খ, তুই নিজেই তো তাকে আসতে বাধা দিচ্ছিস, অন্যের ঘরে চলে যেতে পরামর্শ দিচ্ছিস। তবুও সে অনেকদিন তোর ঘরে থেকেছে, এখন যদি সে তোর ঘরে না-থাকে…তোর কথামতো অন্যের ঘরে চলে যায়- তাতে তোর কী!– তুই কেন আবার কাঁদছিস?
‘তবুও আমি তার আশা ছাড়িনি। ভাবলাম –যদি কখনও আমার কথা তার মনে পড়ে এবং তার নতুন পুরুষের সাথে চলে আসে?– এমনি আশায় আশায় বেশ কয়েক বছর গড়িয়ে যায়।
শেষে একদিন এই চিঠি পেলাম। চিঠিখানা নিয়ে আমি মুন্সির কাছে ছুটলাম পড়িয়ে নিতে, কিন্তু কিছুদূর গিয়েই ভাবলাম –চিঠিতে কী লিখবে? লিখবে সে অন্যের ঘরে চলে গেছে। এটা পড়ে মুন্সিও দেবে হেসে। ঝগড়ু কি এ হাসি সহ্য করতে পারবে! একথা মনে হতেই রক্ত আমার গরম হতে শুরু করল, পরে ভাবলাম– না-হয় মুন্সি হাসলই না– কিন্তু কথা তো আর গোপন থাকবে না, একদিন-না-একদিন জনসম্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়বে– এবং কয়েদিরা যেখানেই আমাকে দেখবে হাসবে– আর তা আমিও সহ্য করতে পারব না।
‘তা শেষপর্যন্ত চিঠিখানা তেমনি রেখেই দিলাম– চিঠিখানাও তেমনি পড়ে থাকল। এরই মধ্যে একদিন খবর পেলাম তার মৃত্যু হয়েছে।
‘তার মৃত্যুখবরে আমি মুষড়ে পড়েছিলাম– কিন্তু কাঁদতে পারিনি। কান্না আমার আসেনি। কারণ এটুকুই জানতে পারিনি যে, মরার সময় সে কার ছিল।
‘পরে তুমি যখন বললে যে পড়া শিখো– তখনও আমার একথা মনে ছিল না– আমি এতদূর পড়তে পারব বলে, অন্তত চিঠি।
‘আমাদের গাঁয়ে অনেক লোক আছে– যারা পাঠশালায় পড়ালেখা করেছে, তারাও না পারে একটা চিঠি পড়তে, না পারে লিখতে। এ দুটো কাজ তারা অন্যের দ্বারা সারিয়ে নেয়। এবং কখনও তাদের ঘরে এক-একটা চিঠি মাসের-পর-মাসও পড়ে থাকতে দেখা
যায়, তারা শুধু অপেক্ষা করে একজন শিক্ষিত লোকের জন্য।
‘যখন তুমি বললে, ‘তুমি চিঠি পড়তে পারবে’–
তখন আমার বিশ্বাস হয়নি- তাই তোমার কাছ থেকে সরে গিয়ে চুপি চুপি এ চিঠিখানা খুললাম এবং পড়তে শুরু করলাম, আর চিঠিখানা পড়েই তার মৃত্যুর জন্য কেঁদে দিলাম। এবং একথা জেনেই বড় খুশি হলাম যে, সে মরার সময় আমারই ছিল।’
‘তা হলে সে তোমার সাথে দেখা করতে আসেনি কেন?’
‘বাবু তার দুটো পা-ই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল –আসবে কী করে! — জানি না সে কীভাবে বেঁচে ছিল। উপোস থেকে মরে যায়নি তো?’
ঝগড়ু পকেট থেকে চিঠিখানা বের করে দেখতে থাকল। তার চোখে ছিল ব্যথা-মিশ্রিত অশ্রু এবং ঠোঁটে বিজেতার হাসি।
অনুবাদ : আখতার-উন-নবী
সন্ন্যাসী ও গণিকা – সোহেল আজিমাবাদী
মায়া যখন তার শাশুড়ি এবং ননদের সাথে ‘শান্তি আশ্রমে’ পৌঁছল তখন সেখানে আরও কিছু মেয়েছেলে জড়ো হয়েছে। স্বামী চৈতন্যানন্দ মহারাজ প্রার্থনার জন্য এসে উঁচুমতো চত্বরের উপর উপবেশন করেছেন। এখন শুধু তাঁর উপদেশবাণী বর্ষণ বাকি। প্রথমে তার শাশুড়ি কমলা দেবী মহারাজের পদস্পর্শ করে প্রণাম করলেন। মহারাজ সবার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। সবার শেষে মায়া তার পদস্পর্শ করে প্রণাম জানাবার জন্য এগোল, কিন্তু সে পা স্পর্শ করতে উদ্যত হয়ে হাত বাড়াতেই মহারাজ পা গুটিয়ে নিলেন আর তার মস্তক স্পর্শ করা ব্যতিরেকেই ইঙ্গিতে তাকে আশীর্বাদ করলেন এবং কমলা দেবীকে বললেন, ‘দেবী, তোমার বউ তো সত্যি সুন্দরী।’ পরে মায়াকে বললেন, ‘এখন থেকে তুমি…।’
স্বামীজি চুপ করে গেলেন। মায়া মাথা তুলে এক পলকে স্বামীজিকে দেখল। তার উদ্ভাসিত চেহারা চুপসে গেছে। ঠোঁট থর থর করছে। স্বামীজি আরও কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু পারলেন না। মায়া মনে ভীষণ আঘাত পেল। সে মনে গভীর ভক্তি আর বিশ্বাস নিয়ে এখানে এসেছিল। সে শুনেছিল ‘শান্তি আশ্রমে’ এসে মহারাজের দর্শনের পর উপদেশাবলি শুনলে নাকি মনে গভীর শান্তি নেমে আসে। কিন্তু এখানে এসে মহারাজের ব্যবহার দেখে তার মনে হল শান্তি তার যা-ও-বা ছিল তাও শূন্যে বিলীন হয়ে গেছে। মহারাজ কিছু না-বলেও যেন অনেককিছু বলে দিয়েছেন। ‘এখন থেকে তুমি…’ এরপর মায়া নিজেই বাক্য সমাপ্ত করল। বরং কিছু বাক্য তৈরি করে নিল যা মহারাজ বলতে পারতেন, ‘এখন থেকে তুমি ঘরের সম্মান রাখবে। ভদ্রমহিলার মতো জীবনযাপন করবে।’ আরও না-জানি কত কী বলতে চেয়েছিলেন। মহারাজ কী বলতে চেয়েছিলেন বুঝতে মায়ার একটুও বিলম্ব হল না। সে এজাতীয় কথা হাজার বার ঘরে এবং নাটকের সংলাপে বলেছে, যার দুটি মাত্র অক্ষর এইমাত্র তিনি উচ্চারণ করলেন, যাতে শ্রোতা শোনামাত্রই বাক্য সমাপ্ত করে নেয়। স্বামী চৈতন্যানন্দ মহারাজও এটাই বলেছিলেন। মায়া নিজেই বাক্য সমাপ্ত করল। সেই না-বলা এক-একটি শব্দ তীরের মতো তার মনের গভীরে বিদ্ধ হল। সে আসার আগে ভেবেছিল, স্বামীজির দর্শন পাবে, তাঁর পদস্পর্শ করে প্রণাম করবে, তাঁর আশীর্বাদ নেবে, তাঁর উপদেশ শুনবে এবং তাঁর সাথে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করবে। এভাবে সে তার মনের ফিরে পাওয়া শান্তিকে ষোলোকলায় পূর্ণ করবে। কিন্তু স্বামীজির কথায় তার মনে যে শান্তি ছিল তা-ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল– যা সে কয়েক মাসের ভেতর পেয়েছিল। সবার সামনে যেন তাকে চপেটাঘাত করে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হল সে কে, এবং সে যদি নিজেকে ভুলে গিয়ে থাকে তবে বোকামি করেছে। তার জন্য সবচাইতে বুদ্ধিমানের কাজ হল নিজেকে স্মরণ রাখা। তবুও সে নিজেকে দমন করল। ভাবল-এসেছে যখন, তখন উপদেশ শুনে প্রার্থনা করেই যাওয়া উচিত। কিন্তু তার মনে হল ‘শান্তি আশ্রমে’ উপস্থিত কয়টি চোখের দৃষ্টি তার ওপর নিবদ্ধ, তার উদ্দেশ্যে সবকটি ঠোঁট স্পন্দিত এবং যদি সে অবিলম্বে শান্তি আশ্রম ত্যাগ না করে তবে তার শ্বাসপ্রশ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাবে এবং সেখানেই সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করবে। মায়া ঝুঁকে পড়ে শাশুড়ির কানে কিছু বলল এবং আশ্রম থেকে বেরিয়ে পড়ল।
ঘরে পৌঁছে সে মশারি না-ফেলেই বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। চোখের জল তার দুচোখ ছাপিয়ে কূলহারা প্লাবন বইয়ে দিল। স্বামী চৈতন্যানন্দ বড় সন্ন্যাসী। সমস্ত শহরে তাঁর নামডাক। অনেক পাপিষ্ঠ তাঁর দর্শন পেয়ে নিজেকে শুধরে নিয়েছে, অনেক নষ্ট লোক তাদের সৎজীবন ফিরে পেয়েছে। তাঁর কথায় জাদু আছে। তার কথা কারও ওপর প্রভাব বিস্তার করবে না, এ একেবারেই অসম্ভব। মানুষ ব্যাধিগ্রস্ত মন নিয়ে এখানে এসে নিষ্পাপ মন নিয়ে ফিরে যায়।
কিন্তু মায়ার মনে হল — স্বামীজি তার উজ্জ্বল প্রদীপ্ত আত্মাকে কলঙ্কিত করে দিয়েছেন এবং তাকে সেই নরকে নিক্ষেপ করেছেন, যেখানে ছ মাস পূর্বে পর্যন্ত সে দগ্ধ হচ্ছিল। তার মন ছটফট করে উঠল। তার মনে পুরনোদিনের ক্ষয়ে যাওয়া স্মৃতি নতুন করে ধাক্কা মারল যা সে ভুলে গেছে; তার স্বামী, শাশুড়ি, ননদেরা ভুলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু স্বামীজি পারলেন না ভুলিয়ে রাখতে। অথচ তার পূর্বাপর জীবনের সাথে স্বামীজির কোনও সম্পর্কই ছিল না। সে আগে কী ছিল, এখন কী, এ সম্পর্কে স্বামীজির কী! আগামীকাল তার জীবন কেমন হবে এই তো শুধু স্বামীজির চিন্তা করা উচিত। সে তো প্রমাণ করেই দিয়েছে মানুষ যদি সৎভাবে জীবনযাপন করবার সুযোগ পায় তা হলে অতীতের কার্যকলাপ শুধরে নিতে পারে। কিন্তু স্বামীজি এখনও বিস্মৃত হতে পারেননি যে, সে ছ মাস আগে গণিকা ছিল, সে কি না প্রত্যেক রাতে কোনও-না-কোনও পুরুষের কাছে বিক্রি হত। কিন্তু সে চেষ্টা করে তার জীবন শুধরে নিয়েছে এবং অন্যান্য নারীর মতো সে-ও ভদ্রভাবে জীবনযাপন করছে।
হঠাৎ তার চিন্তাধারার গতি পরিবর্তিত হল। সে ভাবল –তপস্যা কে করেছে? স্বামীজি, মহারাজ, না সে? তপস্যার গুণে মুক্তিই-বা কে পেয়েছে? সে না স্বামীজি? তার অনুভূতি মুখর হয়ে উঠল। সে-ই তো মুক্তি পেয়েছে। মহারাজ তো এখনও বিভিন্ন প্রকার বন্ধনের অক্টোপাসে জড়িয়ে আছেন– সেসব বন্ধন থেকে অন্যের মুক্তির জন্য তিনি আশ্রম এবং এ-জাতীয় জাল বিছিয়ে রেখেছেন। অথচ এই বন্ধন থেকে তিনি জীবনে মুক্ত হতে পারবেন না। সেই আশ্রম, দর্শন, উপদেশ এবং প্রার্থনার ধূম্রজালে তিনি সর্বদা জড়িয়ে থাকবেন, কিন্তু তাঁর আত্মা সেই শক্তি কোনওদিনও পাবে না যে-শক্তি দুর্বল এবং অবসাদগ্রস্ত মনের অবলম্বন হতে পারে।
তার মনে বিস্তৃত দিনের স্মৃতি পুনর্জীবন লাভ করল। বিগত দিনের এক-একটি ঘটনা মনে পড়তে লাগল। যদ্দূর তার মনে পড়ছে তাকে কলকাতা এনে বিক্রি করা হয়েছিল। সে শহরের কুখ্যাত একটি মহল্লার একখানা ক্ষুদ্র কক্ষে আটকা পড়ে ছিল। বুড়িমা তাকে লালনপালন করত। মা-বাবার ঘরের জীবনের সাথে এই জীবনের পার্থক্য ছিল প্রচুর। কিন্তু সে কোনও ব্যাপারে কষ্ট পায়নি। বুড়িমা তাকে কখনও কখনও গালিগালাজ করত, কখনও-বা তার ব্যাপারে অন্যান্য মেয়েলোকদের সাথে আলাপ-আলোচনা করত। সে ভাবত, বুড়িমা তাকে বুড়োবয়সের অবলম্বন হিসেবে গড়ে নিচ্ছে। এভাবে সে যতই বড় হচ্ছিল মা’র আনন্দও বেড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে নিজে এ-জীবন পছন্দ করত না। মনের ভেতর তার আগুন ছিল কিন্তু কিছু করতে পারত না। কখনও রাত্রে বালিশে মুখ গুঁজে সে খুব কাঁদত। এভাবে একদিন তার সৌন্দর্য আর যৌবনের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বুড়িমা তাকে একদিন একলা রেখে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল আর তার জীবনের ধারাও বদলে গেল। তাদের মহল্লার অন্য মেয়েদের মতো নিজের পছন্দ হোক বা না-হোক, তাকেও প্রত্যেকদিন আগন্তুক পুরুষের প্রতীক্ষায় বসে থাকতে হত।
একদিন তার কক্ষে মধ্যবয়েসি একজন পুরুষ এল। সে ছিল রূপমহল থিয়েটারের মালিক। তার নাকি অনেক মেয়ের প্রয়োজন। তার সাথে আরও লোকজন ছিল যারা তাকে ‘শেঠ’ সম্বোধন করত। সে মায়াকে থিয়েটারে কাজ করার জন্য বলল। মায়াও রাজি হয়ে কাজ শুরু করে দিল। পরে মায়া বুঝতে পেরেছিল সে নামেই শেঠ, তার থলি শূন্য। সব-কয়টি প্রাণীকে জীবনধারণের মতো কিছু পয়সা দিতে পারত সে। বেশি দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু এতে মায়ার একটা লাভ হয়েছিল, তা হল শহরময় তার অভাবনীয় খ্যাতি। মানুষ তাকে দেখার জন্য আসতে থাকল। এতে তার জীবন আগের চাইতে সুখে এবং স্বস্তিতে চলতে লাগল। কিন্তু তার আত্মার ক্রন্দন দিনদিন বেড়ে চলল। এক-একদিন তার মন একখানা ছোটখাটো ঘর এবং স্বচ্ছন্দ জীবনের জন্য আইঢাই করে উঠত। তার গাঁয়ের সাধারণ মানুষের মতো জীবন! কিন্তু সে-জীবন ছিল অনেক দূরে। প্রত্যেকদিন তার কক্ষে প্রেমিকের ভিড় হত। কিন্তু প্রেম ছিল তার থেকে অনেক দূরে।
হঠাৎ একদিন রাত্রে মেঘাচ্ছন্ন আকাশে চন্দ্রের মতো তার কক্ষে মোহন এসে উপস্থিত হল। বড় একখানা গাড়িতে চড়ে সুন্দর সাজ-পোশাক করে এসেই সে বলল, ‘আরে তুমি এখানে, গোবরে পদ্মফুল।’
মায়া তার দিকে চেয়ে থাকল। এ পর্যন্ত অনেকেই তো তার কক্ষে এসেছে কিন্তু কেউ তো তাকে ‘গোবরে পদ্মফুল’ বলে আখ্যা দেয়নি। মোহন অন্যদের মতো তার সাথে বিকিকিনির কথাও বলেনি, বরং যতক্ষণ সে ছিল তার অভিনীত প্রত্যেকটি নাটকের প্রশংসাই শুধু করেছে। চারদিকে চুপি চুপি চেয়ে একসময় বলল, ‘কী করবে মায়া দেবী, আমাদের দেশে কি শিল্পীর সম্মান আছে?’
মায়ার মনে হল, মোহন যেন তার মনের কথাই বলেছে। মোহনের কথা তার কাছে দূর থেকে আগত সুরের মতো মূর্ছনা সৃষ্টি করল। কিছুক্ষণ পর মোহন অত্যন্ত ধীরে একশো টাকার একখানা নোট তার দিকে বাড়িয়ে দিল আর নিঃশব্দে উঠে চলে গেল। মোহনের চলে যাবার পর সে ভেবে পেল না মোহন এলই-বা কেন আর চায়ই-বা কী। অনেকক্ষণ ভেবে সে সিদ্ধান্তে এল, মদ খেয়ে উন্মত্ত হয়ে এসেছিল সে। কিন্তু এজাতীয় কোনও লক্ষণ তো তার ভেতর ছিল না। বরং তার হুঁশ তো ঠিকই ছিল। যেসব কথা সে বলেছে তা-ও সজ্ঞানেই বলেছে। সে-রাতে সে কিছুই করতে পারল না। তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে বিছানায় আশ্রয় নিল। সে ভাবল, আগামী রাত মোহন নিশ্চয়ই আসবে। তার অন্তর মোহনের জন্য সহানুভূতিতে ভরে গেল। এই যুবক মদ খায় কেন?
দ্বিতীয় রাতে মোহন আবারও এল। সে-রাতে সে একটু বেশি পান করেছিল। তার পা কাঁপছিল। এসেই সে বলল –‘মায়া, আমি চাই তুমি আমার হয়ে যাও।’
মায়া তার দিকে তাকিয়ে রইল। মোহন তার প্রত্যেকটি শব্দের ওপর জোর দিয়ে বলল, ‘আমি চাই তুমি আমার হয়ে যাও, আমি চাই তুমি আমায় বিয়ে করো।’
তার মনের ভিতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। সত্যি সত্যি কি সে বলছে, নাকি মদের নেশায় অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় বলছে!
মোহন তার মনোভাব বুঝে ফেলল এবং বলল –‘মায়া, আমি উন্মত্ত নই। প্রত্যেকটি কথা বুঝে-শুনে বলছি, আমার প্রশ্নের জবাব চাই আমি।’
মায়া বলল, ‘একটি শর্তে।’
মোহন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল– ‘তোমার প্রত্যেকটি শর্ত স্বীকৃত। তোমাকে আপন করে নেবার জন্য যে-কোনও শর্ত আমি মানতে পারব
মায়া বলল –‘মদ খাওয়া ছেড়ে দাও।’
মোহন বলল –‘তাই রাজি।
মায়া তার দিকে চেয়ে থাকল।
মোহন বলল– ‘তুমি আমার হলে-পর পৃথিবীতে কোনওকিছুর প্রয়োজনই আমার হবে না।
মোহন তখুনি তাকে তার সঙ্গে আসতে বলল। কিন্তু মায়া আপত্তি জানাল। কারণ অনেকে তার কাছে অনেক টাকাপয়সা পাবে। মোহন ঋণ শোধ করার জন্য তাকে দু হাজার টাকা দিল। এর পরদিন থেকেই তার জীবনাকাশে নতুন সৃষ্টির অভ্যুদয় ঘটল। আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নতুন বিবর্তন। কখনও কখনও তার মনে হতে লাগল, তার জীবনের সাধ বুঝি-বা পূরণ হবে না, বুঝি-বা তার জীবনের সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। মোহনের বাবা তাকে বধূ হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। মোহনও তাকে ছাড়া ঘরে থাকবে না বলে ঘোষণা করে দিল। তার নিজের আয় বলতে কিছুই নেই। সমস্ত সম্পত্তি বাবার। আর বাবা এরূপ বধূকে ঘরে তুলে সমাজে হেয় হতে মোটেই রাজি নন। মোহন সাধারণ একটা চাকরি নিয়ে যে-কোনও প্রকার দুঃখ স্বীকার করতে প্রস্তুত হয়ে গেল। এরই ভেতর থিয়েটারের অনেকে তাকে প্রলোভন দেখাল। বিভিন্ন লোভে তাকে আত্মসাৎ করতে চাইল, কিন্তু সে নিজের সিদ্ধান্তে পাহাড়ের মতো অবিচল রয়ে গেল। কখনও তার পা পর্যন্ত কাঁপল না। যে বিশ্রী পরিবেশ থেকে সে নিষ্কৃতি পেয়েছে তাতে সে কোনও অবস্থাতেই ফিরে যেতে চাইল না। এবং কোনও মূল্যেই সে মোহনকে পরিত্যাগ করতে রাজি হল না, যে কি না তার জন্য আকাশের নক্ষত্রলোক থেকে ছিটকে পড়ে ধুলোতে গড়াগড়ি দিচ্ছে।
মাত্র দুদিন আগে তার জীবনে আবারও পরিবর্তন এসেছে। মোহনের পিতা অপারগ হয়ে তাকে গ্রহণ করেছেন। সে প্রাসাদোপম অট্টালিকার ধনী মালিকের পুত্রবধূ হয়ে এসেছে! যার মনে যা-ই থাক, সবাই তার সাথে ভালো ব্যবহার করছে। শাশুড়ি এবং ননদেরা এমন কথা আজও বলেনি যা শ্রুতিকটু লাগতে পারে বা যাতে তার মন ছোট হয়ে যেতে পারে। সে-ও প্রমাণ করতে চেষ্টা করছে যে, মোহন গোবর থেকে পদ্মই আহরণ করে এনেছে, এজন্যই মোহনের মা আশ্রমে যাবার সময় তাকে সাথে নিয়েছেন। কিন্তু স্বামীজির কথায় সত্যি তার মন দমে গেল।
সমস্ত কথা চিত্রের মতো তার মগজে জড়ো হল। সে কাঁদতে লাগল। ভাবতে লাগল– মানুষের পাপ কি কোনও দিনও স্খলিত হয় না! এই যদি হয় তবে কি সে জীবনধারা পরিবর্তিত করেও গণিকা থেকে গেল! তবে কি তাকে জীবনভর গণিকাই থেকে যেতে হবে!
হঠাৎ কক্ষে কার পদশব্দ শোনা গেল। সে দেখতে চাইল, কিন্তু পারল না। বুঝতে পারল, কক্ষে মোহন ছাড়া আর কেউ আসেনি। সে তাড়াতাড়ি অশ্রু সংবরণ করতে উদ্যোগী হল আর সঙ্গে সঙ্গে তার কানে এল– ‘স্বামীজি মহারাজের দর্শনের আশ্রমে যাওনি?’
মায়া উঠে দাঁড়াল। তার মুখমণ্ডল অশ্রুসিক্ত।
মোহন ভয় পেয়ে গেল। জিগ্যেস করল– ‘কী ব্যাপার, তুমি কাঁদছ?’
নিজের মস্তক মোহনের পায়ের উপর রেখে মায়া বলল –‘আমি কোথাও যাব না। সবচাইতে বড় সন্ন্যাসী এবং মহাত্মা তুমি– আমার স্বামী, তুমিই আমায় নরক থেকে বের করে স্বর্গে উত্তোলন করেছ। অতএব আমার আর কোনও মহাত্মার প্রয়োজন নেই।’
অনুবাদ : আখতার-উন-নবী
ধান কাটার আগে – দেবেন্দ্র সত্যার্থী
সারিবদ্ধ কামানের মতো বাঙালিদের একটি দল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। ওরা সংখ্যায় হবে খুব সম্ভব সাতজন পুরুষ, দশজন স্ত্রীলোক আর ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। পুরুষদের মধ্যে যুবক-বুড়ো- দুই-ই রয়েছে। সবার অবস্থাই এক– সকলেই ক্ষুধার্ত। কোলের শিশুরা শুকনো মাই চুষছে। অপেক্ষাকৃত বড়রা লাইন ভেঙে লঙ্গরখানার দুয়োরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জেদ ধরেছে। লঙ্গরখানার পরিচালকেরা পুরুষ আর মেয়েদের আলাদা লাইন লাগাবার কতই-না চেষ্টা করেছেন, ওরা কিন্তু তবু ভারি কামানের মতো– যার যার জায়গা ছেড়ে আদপেই নড়তে চায় না।
‘সত্যযুগ– সত্যযুগ!’ কান-ফাটা আওয়াজ আসছে লাইন থেকে।
জয়শ্রী ভাবে– জানি না, সত্যযুগ কবে আসবে। হয়তো আসতে পারে, হয়তো না-ও আসতে পারে। সত্যের পরে ত্রেতা, দ্বাপর, কলি। আবার কলিযুগের পরে সত্যযুগ। সত্যযুগ কত বছরের হবে, কে জানে। কলিযুগের নির্দিষ্ট কালও কেউ বলতে পারে না। হ্যাঁ, স্মরণ হয় বটে, বারো লক্ষ ছিয়ানব্বই বছরে ত্রেতা আর আট লক্ষ চৌষট্টি বছরে দ্বাপর। শাস্ত্র-পুরাণ ঘেঁটে পুরোহিত যা বলেন, তা ঠিকই বলে থাকবেন। কলিযুগের নির্দিষ্ট কালের খবর নাকি শাস্ত্রেও নেই। কে জানে, কলিযুগের অন্ত হবে কিনা। হয়তো কলিযুগ ত্রেতার চেয়েও দীর্ঘ হবে। একটু বুদ্ধিসুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই তো জয়শ্ৰী শুনে আসছে, পাপের বোঝা বেশি হয়ে গিয়েছে, তাই নৌকা এখন ডুবুডুবু।
জয়শ্রীর মানসপটে ভাসে অগণিত শকুনের দৃশ্য। সবগুলো শকুনই যেন একসঙ্গে তার ওপর ঝাঁপটা দিতে উদ্যত। সে বলে– সত্যযুগ আসুক চাই না-আসুক– শকুনগুলো আমাদের মতো কাঙালিদের বুঝি-বা গিলেই ফেলবে। আমরা যে আর বাঁচতে পারব না।… সব সহ্য করছি।
তার এই স্বগতোক্তিতে মনে হচ্ছে যেন তারা সবাই চোখের সামনে শকুন দেখতে পাচ্ছে।
রাখাল তার হাত টেনে বলে– মা, ক্ষিধে পেয়েছে, মা, ক্ষিধেয় প্রাণ যায়।
অন্য কোথাও হলে জয়শ্রী নিশ্চয় পালিয়ে যেত। এখন তার শরীরে আর এক ফোঁটাও শক্তি নেই। জয়শ্রী রাখালের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে ভাবে– আট বছর ধরে আমার কোলে ও মানুষ– এমন তো আর কোনোদিন নজরে পড়েনি। পেটটা একেবারে সেঁধিয়ে গেছে। শরীরের হাড় কটা যেন গোনা যায়। আহা, আজ যদি ওর বাবা বেঁচে থাকত, তাহলে লঙ্গরখানার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে হত না। তার মজুরির কামাইয়ে দিন চলে যেত। আজকেও ডাল-ভাত কপালে জোটে কিনা কে জানে। এমন করে আমরা কি আর বেঁচে থাকব!
চোখের সামনে জয়শ্রী দেখতে পায়, ক্ষুধার্ত শকুনেরা উড়ে বেড়াচ্ছে- শকুনগুলো যেন রাখালের ওপর ঝাঁপটা দেওয়ার সুযোগ খুঁজছে।
রাখাল মায়ের হাত ধরে বলে– আমরা ডাল-ভাত কখন পাব, মা– গরম গরম ডাল-ভাত?
–আমাদের পালা আসতে দাও, তবে তো।
জয়শ্রী রাখালের মুখে চুমু দিতে গিয়ে ভাবে– জানিনে, আমাদের পালা কখন আসবে, পালা আসার আগেই ডাল-ভাত শেষ হয়ে যাবে কিনা। বুঝি-বা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, এক্ষুনি মাথা ঘুরে পড়ে যাব। তারপর অগণিত শকুনের দল ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলবে।… ক্ষিধের জ্বালায় পেটে যেন চিতা জ্বলছে। হায় রাম! এ ক্ষিধে কি আর মিটবে না! আমরা বোকা, আর শকুনগুলোও বোকা– কে কতক্ষণ ধৈর্য ধরে থাকবে! জানি না আর কত দেরি। কিন্তু ডাল-ভাত যে পাওয়া চাই-ই। লঙ্গরখানার মালিকরা কত দয়াবান– মৃত্যুর কবল থেকে ওরা আমাদের বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।…
…জয়শ্রী ও জয়শ্রী…! গ্রাম থেকে বিদায় নেবার সময় তার স্বামী বলেছিল– আমারই আগে মৃত্যু হবে, জয়শ্রী। যতিদন আমি বেঁচে থাকব, যমদূত তোমায় দেখতেও পাবে না।
–এমন কথা মুখেও এনো না, পতিদেব। আমি আগে মরব। তুমি বেঁচে থাক, আমার রাখালও যেন বেঁচে থাকে।…
–রাখালের কথা ভেব না। ওর আমি এতটুকুও কষ্ট হতে দেব না।
জয়শ্রী ভাবে– কলিযুগের মানুষের মুখে এ যেন সত্যযুগের বাণী। হ্যাঁ, স্বামীর ভবিষ্যদ্বাণীই সত্য হয়েছে, সেই আগে মরেছে।… কাঙালি-জীবন কারই-বা পছন্দ হয়! এই কি জীবন! এ জীবন কি কারও কাম্য হতে পারে!… জীবন তো নয়, বোঝা।… জয়শ্রী, তুমি এত শুকিয়ে যাচ্ছ কেন? জয়শ্রী, তুমি গর্ভবতী! জয়শ্রী, সাত মাস পেরিয়ে গেছে, আর মাত্র দুমাস বাকি। বেটা ছেলে জন্ম নেবে। তখন আর কোনো দুঃখ-কষ্টই থাকবে না। কিন্তু যদি মেয়ে জন্মায়? না, না, না, মেয়ে চাই না। মেয়ের জীবনে অনেক কষ্ট। ছেলে চাই, ছেলে। যে ছেলে ক্ষেতে-জমিতে হাল চালাবে, বছর বছর ধান ফলাবে।… হায়রে আকাল!
জয়শ্রী রাখালের হাত ছাড়িয়ে নেয় ঝট্কা মেরে– যেন যত দোষ তারই। পরমুহূর্তেই আবার তার পিঠে হাত বুলোতে শুরু করে। বলে– রাখাল, সোনার চাঁদ ছেলে আমার। এক বুড়ো কাশতে কাশতে বলে– আমরা বড়লোকের দান খাচ্ছি। দান খেতে আমরা বাধ্য।
আরেকজন বলে– এমন আকাল তো সাত জন্মে দেখিনি, বাবা– শুনেছি বলেও তো মনে হয় না।
এক বুড়ি বলে– আগে বিষ্টি না-হলে আকাল হত, ধানের ফলন নষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু এবার এত ফসল ফলল, তবু এত আকাল! হায় ভগবান, এ আকাল কি শেষ হবে না!
একটা মেয়ে বুড়িকে আশ্বাস দিয়ে বলে– আমরা আবার গ্রামে ফিরে যাব, বুড়িমা। অন্য একজন বলে– যারা যাবার, তারা তো চলেই গেল; এখন দেখছি লঙ্গরখানার মালিকরা আমাদের মরতে দেবে না।
বুড়ি এ-কথার প্রতিবাদ করে ওঠে– তুমি যদি বাঁচতে চাও তো বেঁচে থাক, বাছা। ভগবানকে অনেক বলেছি, আমি আর বাঁচতে চাইনে।
জয়শ্রী তন্ময় হয়ে ওদের আলাপ-আলোচনা শোনে। ডান পায়ের ভর বাঁ পায়ের উপর দিয়ে রাখালের চিবুক স্পর্শ করে বলে– তোর বাবা আমাকে ছেড়ে গেছে, রাখাল। এখন তুই-ই আমার ভরসা। তুই আমার সোনার চাঁদ ছেলে, তুই আমার রাজপুত্তুর।…
এক কোণা থেকে একটা মেয়ে হঠাৎ বলে ওঠে– কিন্তু স্বর্গে তো আকাল নেই।
অন্যজন যোগ করে– ক্ষিধেয়, মহামারীতে ভুগে ভুগে আমাদের কত কষ্ট- দেবতাদের সে খবর জানা আছে কি?
চণ্ডিদাস ঠিকই বলেছেন।– বুড়ি তখন গুনগুন করে সুর ধরে গাইতে শুরু করে– সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু, অনলে পুড়িয়া গেল…।
হঠাৎ নিজের বাড়ির কথা মনে পড়ে যায় জয়শ্রীর। বাড়ি নয়, একটা কুঁড়েঘর। অনন্ত অভাবের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেও জয়শ্রী শুনতে পায় শঙ্খধ্বনি। শাঁখ বাজিয়ে কারা যেন দেবতাদের ঘুম ভাঙাচ্ছে। দেবতার বাস স্বর্গে, তবু তাঁর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয় মন্দিরে। রাত্রিবেলা মন্দিরে তাঁরা ঘুমিয়ে থাকেন। সকালে তাঁদের জাগিয়ে তোলা হয়। স্নানের পর নানারকমের ভোজ্য পরিবেশন করা হয় তাঁদের সামনে। জমিদারবাবুর প্রাসাদের কোনো বিশেষ জায়গায় তাঁদের জন্য খাবার রাঁধা হয়। সম্ভবত তাই দেবতারা জমিদারবাবুর ওপর এত খুশি। অন্যদিকে মহাজনেরাও দেবতাদের খুশি রাখে আর আমাদের জমিগুলো আত্মসাৎ করে ক্ষুদে জমিদার হওয়ার চেষ্টা করে।
.
পিছন থেকে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়েছে। জয়শ্রী রাখালকে তাড়াতাড়ি আগলে রাখে। আহা, লোকগুলোর কি লজ্জা-শরমও নেই গো।
কানের পাশ দিয়ে আওয়াজ ভেসে আসে– বলি, দেবে তো এক মুঠো ডাল-ভাত, তা-ও এত দেরি কেন, বাবা, কেন এত শাস্তি দেওয়া!
এ লোকটাও ধাক্কা খেয়েছে বুঝি। কাঁঠালগাছের আড়ালে না-থাকলে তার অর্ধোলঙ্গ শরীরের ওপর সূর্যের কিরণ এসে পড়ত। ছায়ায় দাঁড়িয়ে থেকেও লোকটা ঘামে চুপসে গেছে।
মায়ের হাত শক্ত করে ধরে রেখে রাখাল জয়শ্রীর মুখের দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে।
–রাখাল, তুইও বুঝি ঘামে ভিজে গেছিস? রাজপুত্তুর, সোনার চাঁদ ছেলে আমার, তোর খুব ক্ষিদে পেয়েছে নারে? আজ আমার ভাগটাও তোকে দেব, কেমন?…
জয়শ্রী খুব জোরে জোরে মাথা চুলকাতে শুরু করে। মাথার মধ্যে উকুনগুলো রক্ত চুষছে।
পিছন থেকে বুড়োটা আবার মুখ খোলে– এখন গাঁয়ের অবস্থা কেমন?… আড়াই মাস হল গ্রাম ছেড়েছি। গাঁয়ের চাল নিয়ে এসে শহর ভরেছে। এখন গ্রাম না-ছেড়ে এসে তারা কিই-বা করবে। বুড়ো হয়েছি, অনেক দেখলাম।…
আগের মেয়েটি প্রশ্ন করে– তাহলে তোমরা আর কেউ গাঁয়ে ফিরবে না?
জয়শ্রী রাগ করে বলে– পোড়ামুখোরা এত চাল কোথায় নিয়ে গেল?
— ভগবান, তুমি কি দেখতে পাও না? তোমার কি চোখ নেই?
পিঁপড়ের মতো লাইনগুলো একটু একটু করে সামনে এগোয়। এখনো লঙ্গরখানায় পৌঁছাতে অনেক দেরি। পোয়া ঘণ্টা… আধ ঘণ্টা… এক ঘণ্টা… জয়শ্রী জানে না, কতক্ষণে লঙ্গরখানার দুয়ারে গিয়ে সে পৌঁছাবে। তখনো সে মাথা চুলকাচ্ছে।
মানুষের চিৎকার ক্রমেই বাড়তে থাকে। লঙ্গরখানায় গিয়ে একসঙ্গে সবাই হানা দেবার মতলবে বুঝি ষড়যন্ত্র করছে। পিছন দিকের চিৎকার ছড়াতে ছড়াতে সামনে গিয়ে পড়ে। দু-একজন ধ্বনি তোলে– হায় ডাল, হায় ভাত!… আর সারাটা লাইন দুলতে থাকে, ফুলতে থাকে।
এখানে জয়শ্রীর এইভাবে এমনি করে দাঁড়িয়ে থাকা যেন অপ্রিয় দীর্ঘ একটা দুঃস্বপ্নের মতো। জীবন নয়, ভারি বোঝা। কে জানে, আর কতদিন টেনে বেড়াতে হবে এই ভারি বোঝাটা। জয়শ্রী বুড়োর দিকে চোখ মেলে তাকায়; বুড়ো যেন তাকে বলতে চাচ্ছে আমরা সব মড়া, সবাই আমরা শ্মশান থেকে উঠে এসে এখানে লাইন লাগিয়েছি; চল পাগলি, আবার আমরা শ্মশানে গিয়ে শুয়ে পড়ি।
…ক্ষুধার বন্যা, আকাল, দুর্ভিক্ষ, মহামারী…
রাখাল যেন বানরের মতো লাফ দিয়ে লঙ্গরখানায় ঢুকে পড়তে চায়। সে ভাবে– মায়ের অংশের সবটুকুই আজ সে খেয়ে ফেলবে। আজ তার অনেক ক্ষুধা।
ঘামের তীব্রগন্ধী উগ্রতা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।… জয়শ্রী ভাবছে তার গ্রামের কথা– গ্রামে কি আর কোনোদিন ফিরে যাওয়া চলবে তাদের? স্বামী নেই, কিন্তু রাখাল তো আছে। রাখালের চেষ্টাতে আবার তারা সব ফিরে পাবে। জমিদারের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনবে তাদের জমিজমা। রাস্তার ভিখারিদের সাথে রাখাল আর ঘুরে বেড়াবে না। গ্রামেই ফিরে যেতে হবে, গ্রামে ফিরে যাওয়াই ভালো।
পিছনের মেয়েটি বলে– আমাদের সারাজীবনের ঘাম আজকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে।
বুড়ি বলে– ধনী, গরিব সবার গা থেকেই ঘাম ঝরছে, বাছা।
বুড়ো বলে– কিন্তু কেমন করে ঝরছে? পেটের মধ্যে একফোঁটা অন্ন নেই, জল নেই– তবু ঘাম ঝরছে কেমন করে?
তারপর জয়শ্রীর গায়ে হাত দিয়ে বলে– পাগলি, তুমি কেমন চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছ? তোমার কি কিছুই বলতে সাধ যায় না?
জয়শ্রী একবার বুড়োর দিকে, একবার মেয়েটির দিকে তাকায়। কিন্তু কোনো কথাই বলতে পারে না সে।
সামনের ছোকরাটি ধ্যানস্থ চোখে মেয়েটির দিকে এমনভাবে তাকায় যেন সে নিজে কৃষ্ণ, আর মেয়েটি তার রাধা। জয়শ্রী কিন্তু তাদের দুজনকেই মনে মনে ধ্যান করে রাধা-কৃষ্ণ ভেবে। সে নিজেও তো একদিন কৃষ্ণ পেয়েছিল, যদিও শূন্যপ্রাণ রাধিকা আজকে স্বামীর শেষ কটি দিনের স্মৃতির রোমন্থন ছাড়া আর কিছুই আগলে রাখতে পারছে না। স্বামীর মৃত্যুতে কতই-না কেঁদেছে সে। তারপরেই কান্না থেমেছে, যখন দেখেছে, তার বুকের মতোই বাড়িটাও শূন্য– মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থাটুকুও করা যাচ্ছে না। ভিক্ষা করেনি, ধার করেনি– থালা-বাসন বিক্রি করে তবে মড়া পোড়াবার ব্যবস্থা করেছে। চিতার ছাই এখন বাতাসে বাতাসে উড়ে না-জানি কোন তেপান্তরের মাঠে গিয়ে পড়ছে।…
জয়শ্রীর মন আবার গ্রামের পথে ফিরে যায়।… রাধা-কৃষ্ণের পালা হচ্ছে গ্রামে। গ্রামে যাত্রার দল এসেছে। চণ্ডিদাসের পদাবলির কীর্তন হচ্ছে প্রায়ই। শুকনো মনে কত দোলা লাগে, প্রাণে কত ফুর্তি জাগে। মনে পড়ছে, জয়শ্রীর হাতে টাকা-পয়সা থাকায় এসব আনন্দে অংশ নিতে কত সহজ প্রাণের সাড়া জাগত। মহাজনদের দোকানে সস্তা দরে ধান বিক্রি করে সে নগদ টাকা নিয়ে আসত ঘরে। মশাল জ্বালিয়ে যাত্রা হবে, তাই সে সাততাড়াতাড়ি পয়সা ফেলে দিত। একবার চাঁদা উঠেছিল তিনশো টাকা। পঞ্চাশ টাকা দিয়েছিলেন জমিদারবাবু একাই। কিন্তু… কিন্তু… সে টাকা কাদের! আমাদেরই ঘাম-ঝরানো পয়সা দিয়ে জমিদারের শখের লীলা। ভগবান, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ– ন্যায়-অন্যায়ের এই লীলার তুমিই একমাত্র দর্শক।… তবু মনে কোনো দুঃখ নেই। একটি টাকা চাঁদা দিয়ে জয়শ্রী তো তবু দেখেছে রাধা-কৃষ্ণের যাত্রা-গান। দেখে দেখে মন জুড়িয়েছে।…
দুর্বিষহ দুর্ভিক্ষ। জ্যোতির্ময় রাধা-কৃষ্ণের কথা ভেবে আর দুর্ভিক্ষকে আটকে রাখা যাবে না। আটকে রাখা যাবে না পেটের অনন্ত ক্ষুধাকে।…
ভাবতে ভাবতে জয়শ্রী লঙ্গরখানার দুয়ারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। নিশ্বাসটুকুও পড়তে চায় না, গলার মধ্যে এসে আটকে যায়।
গ্রামের কথা ভাবতে ভাবতে জয়শ্রী আবার তন্ময় হয়ে ওঠে। মনে পড়ছে, চালের দাম যখন হু-হুঁ করে বাড়তে লাগল, গ্রামের লোকেরা তখন ভবিষ্যৎ না ভেবেই অন্ধের মতো তা বিক্রি করতে শুরু করল। মহাজনেরা আল্লাদে আটকানা, কারণ তাদের পোয়াবারো। তারা আরো বেশি করে ধান-চাল বিক্রি করার জন্যে চাষিদের উৎসাহ দিতে থাকে, তাদের বোঝায়– ধান-চালের দর বেশি থাকতে বিক্রি করে ফেল, আবার সস্তার সময় কিনে নেবে।
কিন্তু সস্তার সময়ও আর এল না, তাই কেউ আর ধান-চাল কিনতেও পারল না। যেন চিরস্থায়ী দুর্ভিক্ষের ঘূর্ণিজলে পড়ে তারা হাবুডুবু খেতে লাগল। আর মহাজনেরা এখন বলে– এককণা চাল সোনার চেয়েও দামি। আহা, এ কি কলিযুগ এল, মা গো!
পিছন থেকে বুড়ো আবার জয়শ্রীর গায়ে হাত দিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। জয়শ্রী তার দিকে তাকায়। বুড়োর চোখে ফুটে উঠেছে অপূর্ব ভাষা। সে যেন বলতে চাইছে– দুনিয়া একটা পান্থশালা। পথে পথে, দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে আমরা এখানে ফিরেছি। বেশিক্ষণ এখানে থাকা চলবে না। আবার আমরা বেরিয়ে পড়ব। লঙ্গরখানার ডাল-ভাতই আমাদের সম্বল।
গ্রাম ছাড়ার কিছুদিন আগে জয়শ্রী এক বুড়োকে দেখেছিল বাজারের মধ্যে রাধা-কৃষ্ণের যুগলমিলনের মূর্তি বিক্রি করতে। সে বুড়ো যেন এই বুড়োরই প্রতিধ্বনি। না, প্রতিধ্বনি নয়, বরং খুব সম্ভব এই-ই সেই বুড়ো। পূর্বপুরুষের পুজোর মূর্তি পেটের দায়ে এখন বিক্রি হচ্ছে। জয়শ্রী ভাবে মূর্তি বিক্রি করার কথা বুড়োকে জিগ্যেস করবে কিনা। কিন্তু কী মনে করে বিরত থাকে সে।
জয়শ্রীর চোখের সামনে তারাপদের ছবিটা হঠাৎ ভেসে ওঠে। শহর থেকে যেসব দালালরা এসে মেয়েদের ফুসলিয়ে নিয়ে যেত, তারাপদ তাদের উদ্দেশে রচনা করেছিল ব্যঙ্গ-কবিতা। কবিতায় তাদের সে সম্বোধন করত ‘হারামি, শুয়োরের বাচ্চা, পাজি’ বলে। অথচ কী আশ্চর্য! তারাপদই অবশেষে দালালদের পাল্লায় পড়ে গ্রামের সব-সেরা সুন্দরী মেয়েদের ধরে ধরে বিক্রি করে ফেলত। কে জানে, সেই ‘হারামি, শুয়োরের বাচ্চা, পাজি’ লোকটা এখন কোথায়? তখন পর্যন্ত একটি নয়, দুটি নয়– সাত-সাতটি মেয়ে সে বিক্রি করেছে। কেন, কিসের জন্য?– পেটের জন্য। একমুঠো ভাতের জন্য। কিন্তু শুধু এক-মুঠো ভাত নয়– পেয়েছে সে রসগোল্লা, সন্দেশ আরো কত রকমারি মণ্ডা-মিঠাই। আমাদের মতো কষ্ট করে তাকে আর লঙ্গরখানার লাইনে দাঁড়াতে হয় না। সম্ভবত এখন সে পাকা দালান তুলেছে।…
জয়শ্রী আর রাখাল এখন লঙ্গলখানার দুয়ারের কাছেই পৌঁছে গেছে প্রায়। আহা, রাখালের মুখে আনন্দ আর ধরে না। এখন মায়ের হাত টেনে লঙ্গরখানার দিকে দৌড়াবার আর কোনো প্রয়োজন নেই। এখন গরম গরম ডাল-ভাত সে নিজেই নিয়ে খেতে পারবে। মা যদি তার কাছ থেকে হাজার ক্ষিধের দোহাই দিয়ে এতটুকুও চায়, তবু দেবে না– সবটুকু সে একাই খেয়ে সাবাড় করবে।
জয়শ্রী ভাবে– সাত দিন ধরে পুঁইপাতা খেয়ে বেঁচে থাকা; আর পারি না, পতিদেব। কিন্তু দু’দিন পরে তা-ও কি আর জুটবে! ওই এক টুকরো জমিই তো রেখেছিলাম রাখালের জন্য। মহাজন এসে মাত্র দুই সের চালের বিনিময়ে সেটা চাইল। ভাবলাম, কলিযুগের তো এই শেষ, আমারও শেষ। এরপর সত্যযুগ আসবে, রাখাল আবার জমি ফিরে পাবে।…
ঘোর অন্ধকার যে-রাত্রিতে ওরা পাড়ি দিয়েছিল, মহাজনের গাড়ি-ভর্তি চোরাই ধান-চালগুলোও সেই রাত্রিতেই শহরে এসেছে! সে কিছুই বোঝেনি, তবুও ভেবেছে– ভগবান, এত চাল কোথায় যাবে, কে খাবে।
ইতোমধ্যে ওরা লঙ্গরখানায় এসে পৌঁছে গেছে। জয়শ্রী দেখতে পায়, রাখাল তার নিজের অংশ এরই মধ্যে খেয়ে সাবাড় করে ফেলেছে।
লোভাতুর দৃষ্টিতে মায়ের অংশের দিকে তাকিয়ে রাখাল বলে– মা, একেবারে ঠাণ্ডা।
জয়শ্রী তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে– গরম কোথায় পাবে, বল, বাবা। আজকে এটাই খাও, কালকে আবার দেখা যাবে।
জয়শ্রী আর রাখাল এখন নদীর দিকে এগুতে থাকে। পিছন থেকে সেই মেয়েটি তাড়াতাড়ি এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বলে– একটু আস্তে চল না, দিদি। আমার মাকেও আসতে দাও, ভাই। তা আমরা তো আর এক গাঁয়ের লোক নই; ভগবানের ইচ্ছা, তাই একসঙ্গে মিশেছি।
জয়শ্রী তার হাত ধরে বলে– হ্যাঁ বোন, আমরা যে সবাই দুঃখী।
মেয়েটির মা এসে রাখালের গালে চুমো খায়। বলে– তা বাছা, আমার থেকে ও কিছুটা ভাগ নাও না; বুড়ো হয়েছি, এত কি আর খেতে পারি!
কথা শুনে রাখাল লোলুপ দৃষ্টি মেলে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
জয়শ্রী শিউরে উঠে বলে–না, না, তাই কি হয়! সবাইকেই তো বেঁচে থাকতে হবে।
কিন্তু আপত্তি সত্ত্বেও রাখাল কিছুটা ভাগ পায় আবার। নদীর ধারে পৌঁছে পেট ভরে জল খেয়ে নিয়ে সবাই জিরোতে থাকে। এদিকে অল্পক্ষণের মধ্যেই রাখালের পেট ফাঁপতে শুরু করেছে।
জয়শ্রী ভয়ঙ্কর দুর্ভাবনায় পড়ে। তার মাথাটা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে থাকে। ক্লান্ত, অবসন্ন শরীর নিয়ে লুটিয়ে পড়ে সে মাটিতে।
সেই সঙ্গে রাখালও পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করে। তার মুখের রং ঘন-ঘন বদলাতে থাকে। ক্রমেই সে রং পাংশুটে হয়ে আসে।
ওরা দুজন মা-মেয়ে যতখানি পারে তাদের যত্ন নেয়, সান্ত্বনা দেয়, অভয়বাণী শোনায়। জয়শ্রী উঠে বসে রাখালের পেটে হাত বুলাতে থাকে।
উদ্ভ্রান্তের মতো চোখ মেলে তাকিয়ে জয়শ্রী মেয়েটিকে প্রশ্ন করে– জানিস বোন, সত্যযুগ আসতে আর কত দেরি?
–তা কেমন করে বলি বল। শহর থেকে ঝাণ্ডা হাতে যারা আমাদের গাঁয়ে মিটি করতে এসেছিল, তারাও তো জানে বলে মনে হচ্ছে না।
শুয়ে শুয়ে রাখাল পাশ ফেরে। পাতলা বাহ্যি হয় তার। রাখালকে পরিষ্কার করে নিয়ে জয়শ্রী তাকে অন্যত্র শোয়ায়। মাটি চাপা দিয়ে ময়লা ঢেকে ফেলে। জয়শ্রীর বুক আতঙ্কে তোলপাড় করতে থাকে। রাখালের পেটে মালিশ করতে থাকে সে।
জয়শ্রী প্রশ্ন করে– সত্যযুগ কি তবে আসবে না, বোন?
মেয়েটি বলে– তা কেমন করে বলি বল! তবে শহর থেকে মিটিং করতে এসে তারা বলেছিল, যারা হাল চালাবে, তারাই নাকি জমির মালিক হবে।
–তেমন দিন করে আসবে, বোন?
–ঝাণ্ডাধারীরা বলেছিল, এই যে ডাল-ভাত ওরা আমাদের খাওয়াচ্ছে, এ কিন্তু দয়ার দান নয়, এতে আমাদের অধিকার আছে। আমরা আমাদের পাওনা আদায় করে নিচ্ছি। একদিন আসবে, যখন আমরা আর চেয়ে খাব না, নিজেরাই আমাদের খাবার যোগাড় করে নিতে পারব।
জয়শ্রী তন্ময় হয়ে শোনে আর ভাবতে থাকে শুধু সত্যযুগের কথা। কিন্তু ভাবনার রেশ ছিঁড়ে যায় শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির শব্দ শুনে। যেন এক নতুন যাত্রাদল এসেছে। তীব্র মশাল হাতে নিয়ে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষ এগিয়ে আসছে আর থালায় পয়সা ফেলে দিচ্ছে। কেমন করে মানুষ আজ এত উদারপ্রাণ! তবে কি এ দেশে আর দুর্ভিক্ষ নেই। রাধা… রাধা…! কৃষ্ণ… কৃষ্ণ…!
রাখালের অবস্থা ক্রমেই শোচনীয় হতে থাকে। জয়শ্রীর মনে উৎকণ্ঠার সীমা নেই। রাখালের মাথা কোলে রেখে জয়শ্রী ভাবে– আমার এই শেষ প্রদীপও কি তবে নিভে যাবে! কান্নার উচ্ছ্বাসে ভেঙে পড়ে জয়শ্রী।
মেয়েটি বলে– হতাশ হয়ো না, দিদি– রাখাল সেরে উঠবে।
কিন্তু জয়শ্রী মৃত্যুকে ভয় করে না। তার চোখের সামনে মৃত্যু এসে তাণ্ডব করলেও সে ভয় পাবে না। কিন্তু রাখাল যেন না-মরে। রাখালের বুকে হাত রেখে সে আকাশের দিকে তাকায়, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তির কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছে, নীরব করুণ ভাষায় জীবন ভিক্ষা চাচ্ছে রাখালের।
কিন্তু আবেদন যথাস্থানে পৌঁছাবার অনেক আগেই… জয়শ্রী রাখালের নাড়ি টিপে দেখে, নীরব হয়েছে সবকিছুই। সে ডুকরে কেঁদে উঠে বলে– সব শেষ হয়ে গেছে, বোন– সব শেষ।
.
মেয়েটি শহর থেকে খুঁজেপেতে ঝাণ্ডাধারীদের তিনজনকে নিয়ে আসে। সৎকারের ব্যবস্থার জন্য সে হাতের চুড়ি খুলে দিতে চায়। কিন্তু ওরা তা গ্রহণ করে না। অল্পক্ষণের মধ্যে চিতার কাঠের যোগাড় হয়ে যায়। জয়শ্রী তার বিচিত্র চাদর দিয়ে রাখালকে ঢেকে নেয়। চিতায় তুলে দেওয়া হয় মৃতদেহটাকে।
জয়শ্রী নিজের হাতে তাতে আগুন ধরায়।
গভীর অন্ধকার রাত্রি। জয়শ্রীর ভবিষ্যৎ যেমন অন্ধকার।
চিন্তার আগুন স্ফুলিঙ্গ ছড়ায়। জয়শ্রীর মনের চিতার ফুলিঙ্গ এ যেন।
আলোর চার পাশের অন্ধকার আরো জমাট বেঁধে ওঠে। জয়শ্রীর বর্তমান আর ভবিষ্যৎ যেমন নিরাশায় জমাট বাঁধা।
ঝাণ্ডাধারীরা চলে যায়। জয়শ্রী শ্মশানেই শুয়ে পড়ে। ওরা দুজনাই তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে।
সারারাত্রি জেগে কাটে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জয়শ্রী শ্মশানের ছাই তুলে নিয়ে মাথায় মাখে। সে দেখতে পায়, মাথার উপর দিয়ে যেন অসংখ্য শকুন উড়ে বেড়াচ্ছে। তারাও যেন জয়শ্রীর মতো অনন্তকাল ধরে ক্ষুধার্ত। জীবন্ত মানুষের ওপর ঝাঁপটা দেওয়ার চেষ্টায় তারা হন্যে হয়ে উঠেছে। এবং একদিন-না-একদিন ঝাঁপটা তারা দেবেই।
জয়শ্রী সেখানেই আবার লুটিয়ে পড়ে। ওদের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও সে লঙ্গরখানার দিকে যেতে রাজি হয় না। যেন এখানেই পড়ে থেকে সে রাখালের অনুসারী হবে।
মেয়েটি বলে– তুমি যে পোয়াতি, তোমার একটু সাবধানে থাকা উচিত, বাছা।
মা বলে– বাছা, তোমার কিন্তু ছেলেই হবে।
জয়শ্রী ধড়মড় করে উঠে বসে। সে ভাবে– অনাগত শিশু সত্যযুগের মানুষ; নিজের ভাগ্য সে নিজেই গড়ে নেবে।
জয়শ্রী বলে– সত্যযুগ তাহলে আসবে। আমরা আবার জমি ফিরে পাব। নিজের জমিতে আমারই ছেলে হাল চালাবে। ভিখিরিদের মতো দুয়ারে দুয়ারে আর ঘুরে বেড়াতে হবে না। লঙ্গরখানায় আর লাইন লাগাতে হবে না। পাপের নৌকা এবারে তাহলে ডুববে।
জয়শ্রী মাটিতে আসন পেতে বসে। সাত মাস পূর্ণ হয়েছে, আর মাত্র দুই মাস। তারপর আর কতদিন… আর কতদিন।
কিন্তু… কিন্তু…
কিন্তু কদিন ধরে পেটের মধ্যে বাচ্চাটার কোনো নড়নচড়ন নেই কেন?
তবে কি… তবে কি….
মা বলে– চাঁদের মতো ছেলে হবে, দেখো। তোমার আর ভাবনা কিসের!
.
জয়শ্রীর কানে কানে কে যেন মন্ত্র পড়ে যায়– জয়শ্রী, জয়শ্রী, তোমরা-যে সব জাত- কিষাণ, তোমাদের আর ভাবনা কিসের। যুগ পালটে যাচ্ছে। তোমাদের জমিদার আর কতদিন জমিদারি করবে। তোমাদের জমি তোমরাই আবার ফিরে পাবে। তোমার নতুন রাখাল এসে সে জমির তদারকি করবে। তোমাদের আর ভাবনা কিসের
কিন্তু পেটে এত ব্যথা উঠল কেন। আমি যে মরে যাচ্ছি।
জয়শ্রী পেটের ব্যথায় আর্তনাদ করে চেঁচিয়ে ওঠে। মেয়েটি কোত্থেকে খানিক শর্ষের তেল যোগাড় করে এনে জয়শ্রীর পেটে মালিশ করতে থাকে।
যথাসময়ের দু’মাস আগেই, এই এখানে শুয়ে শুয়েই জয়শ্রী একটি নবশিশুর জন্ম দেয়। জন্ম দেয় একটি মৃত সন্তানের।
মা জয়শ্রীকে সামলে নিয়ে বলে– বাচ্চাটাকে ঢেকে নাও, বাছা; ভাগ্যের লিখন কে খণ্ডাতে পারে।
জয়শ্রী কিন্তু সচেতন হয়ে মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে।
একটুখানি চেতনা ফিরে পেয়েই সে উঠতে চেষ্টা করে। সত্যযুগের সন্তানকে সে দুহাত দিয়ে খুঁজতে থাকে।
মৃত সন্তানের মুখ দেখে আবার সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। জয়শ্রীর চোখ দুটি ঘুমের নেশায় আস্তে আস্তে জুড়িয়ে আসে। কোনোদিনই আর ঘুম ভাঙে না জয়শ্রীর।
অদূর ভবিষ্যতের উজ্জ্বল ইঙ্গিতকে যেন সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেই মেয়েটি বলতে থাকে– জয়শ্রী বলেছিল-না, মা : সত্যযুগ আসবে। পাপের নৌকা ডুবে যাবে। জয়শ্রী তার প্রাণ দিয়ে গেল, আর যাবার আগে কি সে পাপের নৌকা ডুবানোর জন্য শেষ ধাক্কাটা দিয়ে গেল না?
অনুবাদ : নজিরউদ্দীন চৌধুরী
উদোর পিণ্ডি – শওকত থানবী
ব্যক্তিগতভাবে আমি জীবন-সঙ্গিনীকে সফর-সঙ্গিনী করার ঘোরবিরোধী। সুতরাং গতকাল বউ-ছেলেমেয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি আর আজকে আমি একলা যাচ্ছি।
অনেক ছেলেমেয়ের বাবা এবং অনেক বউয়ের স্বামীই হয়তো আমার এই অবস্থাকে আহাম্মকি মনে করবেন। কিন্তু আমার নিজের মত হচ্ছে, সফর করলে সফরই করব– suffer করতে রাজি নই। আর, ট্রেনের সফরে ছেলেমেয়ে সঙ্গে থাকলে তো কথাই নেই। আমি চাপব ট্রেনে আর তাঁরা চাপবেন আমার ঘাড়ে। কয়েকবারের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞান লাভ করেছি এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে সফর করব না কস্মিনকালেও।
এখন কেমন আরাম। একটা বার্থ রিজার্ভ করে নিয়ে একলা যাই, নিরাপদে ঘুমোই, জানালার ফাঁক দিয়ে মুখ বের করে দৃশ্য দেখি, মাটির পেয়ালায় একআনা দামের চা খাই এবং প্রয়োজনবোধে ট্রেনের শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঠুমরি কিংবা দাদরা গাই কেউ কোনোরকমের আপত্তি তুলতে পারে না। গাড়ি থামলে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করি, চানাচুর-বাদামভাজা কিনে আস্তে আস্তে চিবোই, যতক্ষণ খুশি, ডাইনিং-কারে ঝিমোই এবং মেজাজ-মাফিক সহযাত্রী পেলে তাস পিটোই– কারও কিছুই বলার থাকে না। আর, সহযাত্রী মেজাজ-মাফিক না-ও যদি জোটে, সারারাত নাক ডেকে নিদ্রা দিই এবং সারাটা দিন ঘুম-ঘুম ভাব দেখিয়ে চোখ জুড়িয়ে আলতো হয়ে পড়ে থাকি– তাতেই-বা কার কী বলার থাকতে পারে!
অথচ, এমন না-হয়ে যদি বাচ্চাকাচ্চা আর তাদের জননী সঙ্গে থাকেন, তাহলে আর আমিত্ব পাইনে খুঁজে। তখন আমি হই একটা ভারবাহী পশু। আমার আমিত্ব, ব্যক্তিত্ব, আমার নিজস্ব বলতে কিছুই থাকে না অবশিষ্ট।
এইসব কারণে গতকাল বউ-ছেলেমেয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি, আর আজকে আমি নিজে, একলা আমার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আর অবশিষ্ট নিয়ে রওনা হয়েছি।
স্টেশনে পৌঁছে রিজার্ভ করা বার্থের উপর বিছানা পাড়লাম। দীর্ঘ পথে সময় কাটানোর মতো করে পত্রিকা কিনলাম। এক সেট তাসও সঙ্গে নিলাম। গাড়ি ছাড়ার বিলম্বটুকু প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করে কাটাব ভেবে সবেমাত্র একটা পা উঠিয়েছি, এমন সময় …
এমন সময় দেখলাম, আমাদের কুদ্দুস চাচা হাতে একটা ঘটি ঝুলিয়ে ভারি ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে আমার দিকেই ছুটে আসছেন। একটা থামের আড়ালে লুকিয়ে পড়ব ভাবছি, কিন্তু তার আগেই তিনি ‘বাবা জীবন যে…’ বলে মূর্তিময় বিঘ্নস্বরূপ হয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন। নেহাত বাধ্য হয়ে, আদব-কায়দা বজায় রেখে একটা সালাম ঠুকতেই হল। উত্তরে তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে কেটে কেটে বললেন, ‘কোথায় উঠেছ? এই সামনের কামরায়? আচ্ছা।
বললেন এবং সঙ্গে সঙ্গে যেদিক দিয়ে এসেছিলেন, সেই দিকে চলে গেলেন।
বুঝলাম, এখন তিনি লটবহর নিয়ে আসবেন এবং সারাটা পথ আমার ওপর ভর করে থাকবেন। তাঁর যত সব বেয়াড়া কথা শোনাবেন, রোগ-পীড়ার বৃত্তান্ত পাড়বেন এবং বিছানা পেড়ে নেবেন আমাকে দিয়ে। সারাটা পথ ঘুম ভাঙিয়ে জিগ্যেস করবেন, কোন স্টেশন ‘বাবা’ এটা। আমার এত সুন্দর করে সাজানো সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে তো যাবেই, উপরন্তু সিগারেট খেতে হলেও ঢুকতে হবে পায়খানায়। সর্বোপরি, তিনি যা খাবেন, তার বিল পরিশোধ করার জন্যও আমাকেই অনুমতি চাইতে হবে ভদ্রতা করে এবং অনুমতি দিতে তিনি এতটুকু বিলম্ব করবেন না। এত সব করতে হবে। কেননা তিনি হলেন গিয়ে আমার পরলোকগত শ্রদ্ধেয় জনকের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম। সুতরাং তিনিও আমার শ্রদ্ধাভাজন।
এইসব চিন্তা করে, নিতান্ত হতাশ হয়ে পড়ে ভাবলাম বিছানাপত্র গুটিয়ে নিয়ে এই সুযোগে পালিয়ে যাই, অন্য কামরার গিয়ে লুকিয়ে পড়ি। কিন্তু সময় আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। দেখা গেল, অল্পক্ষণের মধ্যেই সেই কামরায় হোল্ডল যাচ্ছে জানালা গলিয়ে, বাক্স-পেটরা ট্রাঙ্ক ঢোকানো হচ্ছে ধাক্কা মেরে মেরে, বিরাট বিরাট কয়েকটা ঝাঁপিও প্রবেশ করল সেগুলোকে অনুসরণ করে এবং সবশেষে এক-দুই-তিন করে কোত্থেকে কাচ্চাবাচ্চারা এসে নিমেষে আসন জুড়ে বসল। তারপর, এক মহিলা তাঁর শেষ সংস্করণটিকে কোলে নিয়ে কামরায় আবির্ভূত হলেন। অবশেষে কুদ্দুস চাচা এক হাতে টিফিন-কেরিয়ার আর এক হাতে ঘটিটা নিয়ে এসে বললেন, ‘বাবা জীবন, ইনি হলেন গিয়ে তোমার বহিন– শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন। এতক্ষণ তো আমি ভেবেই সারা হচ্ছিলাম। এতগুলো ছেলে-মেয়ে আর একলা মানুষ– মেয়ে আমার কেমন করে যাবে! তা বাবা ভালোই হল। তুমি তো আমাদের আপনার মানুষ।’
আমি প্রায় দিশেহারার মতোই বলে ফেললাম। ‘কিন্তু চাচাজান, এখানে তো খুব সম্ভব বার্থ একটাও খালি নেই।’
তিনি বেশ নিশ্চিন্ত মনে জবাব দিলেন, ‘সেসব তোমাকে ভাবতে হবে না, আমি খোঁজ-খবর নিয়েই এসেছি– উপরে একটা বার্থ খালি রয়েছে। তোমার বিছানাটা উপরে করে দাও, আর ও নিচেরটাতেই থাকবে। বড়টাকে তুমি উপরে নিয়ে শুয়ো, আর বাকিগুলোকে ও নিজের সঙ্গেই রাখবে। মাত্র বিশ-বাইশ ঘণ্টারই তো জার্নি, বাবা।’
আমি তবু প্রতিবাদ করব ভাবছিলাম এবং বলতে যাচ্ছিলাম, আমি তো হায়দ্রাবাদেই নামব– এমন সময় হুইসেল বাজল। আর, কুদ্দুস চাচা ‘খোদা হাফেজ’ বলে গাড়ি থেকে নামলেন। তারপর সম্পূর্ণ ট্রেনটা নড়ে উঠল, চলতে লাগল এবং কুদ্দুস চাচা ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে চলতে চলতে তাঁর শেষ বাণী বর্ষণ করতে লাগলেন, ‘বাবা জীবন, একটু লক্ষ রেখো, যেন বাচ্চারা মুখ বাড়িয়ে না থাকে জানালা দিয়ে। হামিদ মিয়া আসবেন লাহোর স্টেশনে ওদের নিতে।…’ এবং এমনি আর কত কী তিনি বলছিলেন আর ছুটছিলেন গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে। শেষ অবধি একটা কুলির সঙ্গে ধাক্কা না লাগলে হয়তো লাহোর পর্যন্ত ছুটতেন এমনি করে।
তা যাই হোক, তখনো শুনছি, তিনি বলে যাচ্ছেন, ‘বাচ্চাদের জন্যে দুধের ব্যবস্থা কোরো জানালা বদ্ধ করে ঘুমিয়ো… জিনিসপত্র গুণে নামিও, ষোলটা আছে, টিকিট নিজের কাছে নিয়ে রেখে দাও, নইলে হারিয়ে ফেলবে… সামনের স্টেশনে কুঁজোতে পানি ভরে নিও– খেও– ঘুমিও– তালা– বিছানা… ‘ এবং তারপর তাঁর কথাগুলো ক্রমেই অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে গেল, আর শোনা গেল না।
অমনি আমার মনে হল, আমি মহা-বিপদে পড়ে গেছি এবং এ বিপদ থেকে উদ্ধারের উপায় হিসাবে চেন টানব কিনা, ভাবছি– এমন সময় একটি ছেলে আমার কোট টেনে টেনে বলতে লাগল, ‘সরো এখান থেকে, আমি এখানে দাঁড়িয়ে দেখব।’
ছেলেটির মা তখন তাকে এই বলে ভদ্রতা শেখাতে লাগলেন, ‘বেয়াদব ছেলে, মামা বলতে পারিসনে!’ তারপর, আমাকে সম্বোধন করলেন এই বলে, ‘ভাইজান, আপনি দরজাটা বন্ধ করে জানালার কাঁচটা নামিয়ে দিন, তাহলে ওরা বাইরে দেখতে পাবে।’
হুকুম তামিল করে, নিজের বিছানা গুটিয়ে উপরে তুললাম। তারপর, কোনোরকমে ঘুমিয়ে পড়তে পারলে বা ঘুমিয়ে পড়ার ভান করতে পারলে আপাতত অনেক ঝক্কি থেকে রেহাই পাব মনে করে একটা ঠ্যাং উপরে তুলেছি, এমন সময় ছেলেদের মা তাঁর নিজস্ব বাণীবর্ষণ শুরু করলেন। ঠ্যাংটা আবার যথাস্থানে ফিরিয়ে এনে তাঁর সেই বাণী শুনতে হল আমাকে, ‘ভাইজান, ছেলেটা তো এখনো ঘুমোল না, তা আপনিই আমাদের বিছানাটা একটু পেতে দিন না– বাক্সগুলো ওখান থেকে নামিয়ে রাখুন।– ঝাঁপিগুলোকে বেঞ্চের নিচে সরিয়ে দিন।– পোঁটলাটা আপনার বিছানার মাথার কাছে থাক—-এর মধ্যে ছেলেদের নতুন জুতো রয়েছে। আরে, আরে, ও-কী করছেন! টিফিন কেরিয়ারটা আমাকে দিন।– বাচ্চাটা কোলে ঘুমোচ্ছে, আমার হাত বন্ধ– আপনিই দয়া করে শব্ মিয়ার নাকটা একটু সাফ করে দিন না।… শ মিয়া, মামার কাছে নাক সাফ করিয়ে নাও!… ‘
নিজের ক্ষেত্রে হলে, আমার ছেলের নাক সাফ করতে যাওয়ার আগে তাকেই পকে সাফ করে দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল; অথবা নিজের বউ যদি বলত এ কাজ করতে তাহলে তাকে তালাক দেওয়ার কথাও চিন্তা করতাম কিনা, বলা যায় না। অথচ, পরের ছেলের নাক সাফ করা নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বে তা-ও করতে হল, হ্যাঁ তা-ও করলাম।
যাক এখন একটু হাঁফ ছাড়ার সময় পাওয়া গেল। কিন্তু না, তা হবার নয়। আর এক ছেলে তার মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বিবিন্ শুরু করল। মুখে কিছু বলে না, শুধু ভঙ্গিতে একটা বিশ্রী অভিব্যক্তি, আর কান্না-কান্না ভাব। মা কয়েকবার প্রশ্ন করলেন, ‘কী ব্যাপার, কী হয়েছে?’ কিন্তু কোনো জবাব না পেয়ে শেষে তার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে বললেন, ‘কমবক্ত, কী হয়েছে, বলবি তবে তো’!
কিন্তু কিছুই বলল না সে। চড় খেয়ে কান্না জুড়ে দিল, ‘ভ্যাঁ-অ্যা-অ্যা…
সুতরাং, আমাকেই ভদ্রতা দেখিয়ে এ জটিল পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করতে হল। না কাঁদলেও যে ছেলের চোখে-মুখে কান্না কান্না ভাব সবসময় লেগে থাকে, কান্নারত সেই ছেলেকে আদর করলাম। তার মায়ের চাইতে বেশি শক্তি প্রয়োগ করে যে ছেলের গালে ঠাস-ঠাস করে অনবরত চড় মারার ইচ্ছা আমারও হচ্ছিল, সেই ছেলেকে উল্টোদিকের অন্য এক ভদ্রলোকের বার্থে নিয়ে গিয়ে সস্নেহে মাথায়-গালে হাত বুলিয়ে বললাম, ‘কী হয়েছে আব্বু, আমায় বল। ক্ষিদে পেয়েছে? পেটে ব্যথা উঠেছে? নানার কথা মনে পড়ছে? পানি খাবে?
খাওয়ার ব্যাপারে পানির চাইতে বড় কিছুর প্রস্তাব করতে সাহস হল না। কেননা, টফি-চকোলেট, আইক্রিম-লেমনেডের প্রস্তাব করলে তখন সে হাতি-ঘোড়াও খেতে চাইতে পারে– আশ্চর্য নয়।
কিন্তু সবকথার উত্তরেই মাথা নেড়ে যখন সে অসম্মতি জানাল এবং কান্নার ভাব আরো তীব্র হল, তখন বাধ্য হয়েই টফি-চকোলেটেরই প্রস্তাব পাড়তে হল আমাকে।
কিন্তু এবারও যখন সে তার নির্বোধ মাথাটাকে উত্তরে-দক্ষিণে ঘুরিয়ে অনিচ্ছা প্রকাশ করল, তখন তার মা পায়ের স্লিপার উঠিয়ে বললেন, ‘কী চাস, বলবি, না দেব বসিয়ে বল্।’ অপরিচিত ভদ্রলোক সভয়ে পাশ কাটালেন। কেননা, মেয়েদের লক্ষ্যভেদ যে কখনো অব্যর্থ হয় না, একথা হয়তো তাঁর জানা ছিল।
আমিও মধ্যে থেকে বাধা দিয়ে বললাম, ‘আপনি থামুন, আমিই ওর কাছ থেকে জেনে নিচ্ছি।’ তারপর, সেই গোঁয়ার অশ্ব-শাবকটিকে আবার জিগ্যেস করতে লাগলাম, ‘বিস্কুট খাবে? পয়সা নেবে? পেট চেপে ধরে কাঁদছ, পেটে নিশ্চয় ব্যথা হচ্ছে, তাই না? পেটে মালিশ করে দেব? ঘুমুবে? কোলে চাপবে? পেচ্ছাব করবে?’
শুকুর আল্লার কাছে। এই শেষ প্রশ্নটিতে উল্লুকটা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। এবং তার মা-ও তাঁর এই গুণধর সন্তানটিকে একটা ধমক দিয়ে বললেন, ‘কমবক্ত, তা এতক্ষণ বলছিলিনে কেন?… ভাইজান, আপনি ওকে একটু বাথরুমে বসিয়ে দিয়ে আসুন।’
সুতরাং, তাই করতে হল। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই সে আবার তার মায়ের সামনে এসে মূর্তিমান প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বোঝা গেল, পায়জামার ফিতেতে গিঁট লেগে গেছে এবং ফাঁস খুলতে গিয়ে সেই-ই এই কাণ্ড ঘটিয়ে এখন আর খুলতে পারছে না। সুতরাং মহিলা নিজেই তাঁর সূক্ষ্ম নখর দিয়ে চেষ্টা চালালেন এবং না-পেরে শেষে দণ্ড প্রয়োগ করলেন। কিন্তু অনেক টানা-হেঁচড়ায় গিঁট এতই শক্ত হয়ে গেছে যে, খোলার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এহেন জটিল পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, ভাবছি– এমন সময় ইডিয়টটা নিজেই সমস্যার সমাধান করে দিল। সম্পূর্ণ ব্যাপারটাতে যথেষ্ট সময় লেগে গেছে; সুতরাং দেখা গেল, গিঁট খোলার আপাতত আর প্রয়োজন নেই। অতি দ্রুত তার পায়জামাটা উপর থেকে নিচে পর্যন্ত ভিজতে আরম্ভ করল এবং সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও কর্তব্যকর্ম বেড়ে গেল। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র সরাতে লাগলাম। কেননা, যে হারে বন্যা নামতে শুরু করেছে, তাতে সবকিছু ভেসে যেতে পারে। মহিলাটির জিনিসপত্রও সরাচ্ছি– তাঁর নিজের এখন ফুরসত নেই। তিনি তখন তাঁর আদরের ছেলেটিকে এমনি ভাষায় সম্বোধন করছেন, ‘খোদার গজব নামুক তোর ওপর। এতে বড় উটটা কিনা কাপড়ের মধ্যেই মুতে ফেলল!’
এই মধুর সম্ভাষণ তখনো শেষ হয়নি, হঠাৎ দেখি, মাত্র এক হাত লম্বা তাঁর সর্বশেষ সংস্করণটিকেও একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসেছেন তিনি। ক্ষুদে উল্লুকটাও তার অগ্রজের ক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করেছে এবং তাতে মহিলার কাপড়-চোপড় ভিজে নাশ হয়েছে।
বাচ্চাটাকে শুইয়ে দিয়ে তার ল্যাঙট খুলতে লাগলেন মহিলা। একদিকে তার বাজখাঁই চিৎকারের বিরাম নেই, অন্যদিকে মায়ের গজর-গজরও চলছে। এমনি সময়ে ট্রেনটা এসে হায়দ্রাবাদ স্টেশনে ভিড়ল।
মহিলা চিৎকাররত বাচ্চাটাকে আমার কোলে চাপিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ভাইজান, একে আপনি একটু প্ল্যাটফর্মে তাজা হাওয়া খাইয়ে নিয়ে আসুন তো, তাহলে থামবে। ততক্ষণে আমি এই ধাড়ি পাঁঠাটার পাজামা বদলে দিই, আর বিছানাটাও ঠিক করি।
এবার আপনারা একটু লক্ষ করুন আমার অবস্থা। আমি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করছি আর তাজা হাওয়া খাওয়াচ্ছি। আমার মতো বদ-মেজাজি অপরিচিতজনকে পেয়ে তার কান্নার মাত্রা চতুর্গুণ হয়েছে, আর আমি তাকে থামাবার জন্য কীরকম সব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলছি, ‘আরে-রে-রে-রে। ওহো-হো-হো-হো। না-না-না! সোনা আমার মানিক আমার, লক্ষ্মী ছেলে, কাঁদে না, চাঁদ মামা, চাঁদ মামা, টিপ দিয়ে যা। ধুত্তোর ছাই, দেব এক পটকানি! না-না-না। কাঁদে না, কাঁদতে নেই। সোনা-মানিক ছেলে। পাজি কোথাকার। হারামজাদার হাড্ডি। না নচ্ছার, এবারে থামবি, না দেব রেল-লাইনে ফেলে।’
বহুক্ষণ যাবৎ এতরকমভাবে আদর-সোহাগ করার পরও সে থামল না এবং গাড়ি হুইসেল দিয়ে দিল। তখন কামরায় ফিরে এসে, যার জিনিস তাঁকে ফেরত দিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম এবং ক্ষুদে উল্লুকটা মায়ের বুকে মুখ গুঁজে চুপ করল।
গাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে, হঠাৎ মহিলাটি সাপে কামড়ানো মানুষের মতো আঁতকে চিৎকার করে উঠলেন। ভাবলাম, কি-বা না জানি হল। কিন্তু না, তেমন কিছু নয়। বললেন যে, হায়দ্রাবাদ স্টেশনে দুধ নেওয়ার কথা ছিল, তা নেওয়া হয়নি। বাচ্চাটা তাহলে না-খেয়েই শুকিয়ে মরবে। এইটুকু কথাও মানুষের মনে থাকল না। এখন কী হবে। সর্বনাশ হয়ে গেল। ইত্যাদি।
অনেক কষ্টে ক্রোধ সংবরণ করতে হল এবং তিনি আর তাঁর পুরো ব্যাটেলিয়নের সেবা করতে গিয়েই যে দুধ নেওয়ার কথা মনে ছিল না, সে-প্রসঙ্গের উল্লেখ না-করে বলতে হল যে, দুধের ব্যবস্থা সামনের স্টেশনে চা-অলাদের কাছ থেকে হোক বা যেমন করেই হোক, করা হবে। তাঁর আদরের সন্তানকে দুধের অভাবে মরতে দেওয়া হবে না, তার আগে এ বান্দাই হারিকিরি করে মরবে। মাঝারি সাইজের ছেলেটা জানালায় ঠেস দিয়ে, গালে হাত রেখে ঝিমোচ্ছিল। বললাম, ‘ওকে একটু শুইয়ে দেন, নইলে মুখ ঠুকে পড়বে।’
বললেন, ‘ওকে বরং আপনার বিছানাতেই শুইয়ে দিন, ও আপনার সঙ্গেই থাকবে।’ বললাম, ‘জি, না, তার চাইতে আমার গোটা বিছানাই দিয়ে দিলাম। আপনার বড় দুটোকেই উপরে শুইয়ে দিন, আর আমি নিচে একটা কিছু পেতে এই দরজার কাছেই শুয়ে পড়ব।
উত্তরে তিনি ভারি খুশি-খুশি ভাব দেখিয়ে বললেন, ‘তা যাই হোক, ভালোই হল। ওদের উপরে শোয়াতে আমারও যেন মন কেমন সরছিল না। ওরা উপরে শুলে পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। এখন আপনি ওদের সবাইকে নিয়ে তাহলে নিচেই শোন।’
ইচ্ছে হল, দরজা খুলে চলন্ত গাড়ি থেকে একটা লাফ মেরে দিই। অবাঞ্ছিত মৃত্যু দিয়ে এই অবাঞ্ছিত জীবনের অবসান ঘটাই। কিন্তু আপনারাই আবার আত্মহত্যাকে কাপুরুষতা বলে অভিহিত করবেন। সুতরাং, সারারাত আমি ধাত্রী-সুলভ পরিচর্যায় রত থাকলাম। ছেলেদের খাওয়ালাম। ধোয়ালাম। মোছালাম, আদর করলাম। সুয়োরানি-দুয়োরানির কেচ্ছা শোনালাম। বেসুরো গলায় ঘুম-পাড়ানি গান গাইলাম সুর করে করে। আর, নিজে নিদ্রাহীন, তন্দ্রাহীন রাত্রি যাপন করলাম। তন্দ্রা মাঝে মাঝে যে না-এসেছে, এমন নয়; কিন্তু তখনই সে তন্দ্রা কেটে গেছে মহিলাটির এমনিধারা সব সম্বোধনে, ‘ছম্মু মিয়ার গায়ে র্যাপারটা একটু টেনে দিন।- কমু মিয়ার মাথাটা সরে গেছে– বালিশের উপর চাপিয়ে দিন… কুঁজো থেকে একটু পানি ঢেলে দিন তো… বাচ্চাটাকে একটু ধরুন দয়া করে, আমি বাথরুম থেকে আসছি।…
Suffer করা কপালে লেখা ছিল, তাই এই সফর। আল্লা-আল্লা করে দুই-ই শেষ হল। এবং লাহোর পৌঁছে প্রথম যে কাজ আমি করলাম, তা হল, নিজের এবং বউ-ছেলেমেয়ে, বাচ্চাকাচ্চা– একসঙ্গে সবার জন্য ফিরতি পথের সিট বুক করে রাখলাম। পিণ্ডি চাপানোই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বুদোর পিণ্ডিই বুদোর ঘাড়ে চাপুক– উদোর পিণ্ডি কেন?
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
মুরগির চাষ – মুশতাক আহমদ ইউসুফি
বললাম, ‘যাই বলুন-না কেন, বাড়িতে মুরগি পালার পক্ষপাতী আমি নই। আমার মতে, মুরগির স্থান কেবল পেটে আর প্লেটে
তিনি বললেন, ‘পেট আর প্লেটের শোভা বর্ধনের জন্যেই তো মুরগি পালা দরকার, ভায়া। তাই তো বলতে এসেছি, কয়েকটা মোরগ-মুরগি পাঠিয়ে দিই তোমার বাড়িতে।’ এই বলে তিনি মুরগি পোষার ফজিলত বয়ান করতে লাগলেন।
আমি অনেক বোঝালাম যে, ক্রমে ক্রমে মুরগির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে আর উৎপাত বাড়বে। আমি হলাম গিয়ে নিরিবিলি প্রকৃতির লোক। এসব ঝঞ্ঝাট সইবে না আমার ধাতে।
তিনি তখন আরম্ভ করলেন, ‘মুরগি সবসময়ই দরকার। ঘরে দু-চারটে মুরগি থাকলে পয়সা বাঁচে। অসময়ে মেহমান এলে বাজারে দৌড়াতে হয় না। তাছাড়া মুরগির ফজিলত শুধু মুরগির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ডিমের কথাই ধর। আমি বলব, ডিম হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। যতক্ষণ তাজা রয়েছে, নিজে খাও, বাচ্চাদের খাওয়াও। তারপরও যদি শেষ না হয়, পচতে দাও। পচলেও ডিমের দাম কম নয়। হোটেলে কিংবা মিটিং ভাঙার জন্যে সাপ্লাই দাও। তাছাড়া, তোমার গিন্নির রান্নায় যেমন হাত– মাশেআল্লা, তিনি তোমাকে ডিম খাওয়াতে গিয়ে কত কিসিমের মারফতি আর কেরামতি যে দেখাবেন, তা তুমি গুনেই শেষ করতে পারবে না। অলেট, পোচ, হাফ-ফ্রাই, খাগ্নি, বানি, কানি, হালুয়া, মোগলাই পরাটা, ডিম-টোস্ট…’
বাধা না দিলে হয়তো এই তালিকা সারাদিনেও ফুরোেত না। বললাম, ‘আপনার কথা না-হয় মেনেই নিলাম যে, ডিমের মতো খাদ্য সারা দুনিয়াতে নেই। কিন্তু মুরগি আমরা যদি একবার খেতে ধরি, তাহলে দরমাকে-দরমা সাবাড় হতে লাগবে তো মাত্র কয়েকদিন। ডিম আসবে কোত্থেকে!’
‘বলো কী ভায়া!’ অবাক হয়ে চক্ষু বিস্ফারিত করলেন তিনি। ‘মুরগির বংশ কি কখনো ধ্বংস হতে পারে! এই যে সারা দেশে এত রানীক্ষেতের মহামারী। হাজার হাজার লাখ লাখ মুরগি মরে গেল। কিন্তু বাজারে মুরগির কোনোদিন কম্তি দেখেছ? আর, তুমি বলছ কিনা, খেয়েই সাবাড় করবে! দেখ ভায়া, মুরগির বেলায় যোগের অঙ্ক অন্যরকম। দুই-এ দুই-এ চার হয় না– হয় চল্লিশ। বিশ্বাস-না হয়, নিজেই হিসাব করে দেখে লও। ধর, দশটা মুরগি দিয়ে শুরু করলে। ধর, দশটার মধ্যে নয়টাই বাঁজা– একটাতে ডিম দেয়। ভালো জাতের একটা মুরগি বছরে ডিম দেয় দুশো থেকে আড়াইশো। কিন্তু তুমি যেহেতু কনজারভেটিভ লোক, সেহেতু ধরে নিলাম, তোমার মুরগিও কনজারভেটিভ হারে ডিম দিচ্ছে বছরে দেড়শো।’
মাঝপথে বাধা দিয়ে বললাম, ‘আমার কনজারভেটিভ হওয়ার সঙ্গে মুরগির ডিম কম বা বেশি দেওয়ার সম্পর্কটা ঠিক বুঝলাম না।
‘ভায়া, তুমি দেখছি সব কথাতেই ভড়কে যাচ্ছে। বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কম করে ধরলেও মুরগির বংশ কখনো ধ্বংস হয় না। তা বছরে যদি দেড়শো ডিম হয়, তাহলে পরের বছর সেই ডিম থেকে যে মুরগি বেরুবে, তারা পাড়বে বাইশ হাজার পাঁচশো ডিম তৃতীয় বছরে, এইরকম হিসাব করলে দেখতে পাবে, তেত্রিশ লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার মুরগিশাবক তোমার বাড়িটাকে গুলজার করে রেখেছে। এ তো একদম সোজা হিসাব।’
‘তা যেন বুঝলাম। কিন্তু এত মুরগি-শাবককে যদি ঠিকমতো খেতে দিতে হয়, তাহলে আমার নিজের শাবকরাই যে না-খেতে পেয়ে মরবে।’
বললেন, ‘কথায় বলে, রুজির মালিক আল্লাতালা। কিন্তু সেটা হচ্ছে মানুষের বেলায়। মুরগি আর মোল্লার বেলায় রুজির চিন্তা খোদ আল্লাতালাকেও করতে হয় না। এঁরা দুজন যার যার খাদ্য নিজেরাই খুঁজে নেন। তুমি একবার পেলেই দেখ না, ভায়া। দেখবে ঘাস্-বিচালি, পোকা-মাকড়, তরকারির খোসা, রুটির কণা, এঁটো-কাঁটা, কাঁকর, পাথর– এইসব খেয়েই ওরা বেঁচে থাকবে।’
জানতে চাইলাম, ‘মুরগি পালা যদি এতই সহজ আর লাভজনক হয়, তাহলে আপনি নিজের মুরগি আমাকে দিতে চাচ্ছেন কেন?
‘তা এতক্ষণ এতকথা বলিয়ে না নিয়ে প্রথমেই এই প্রশ্নটা করলে না কেন ভায়া? তুমি তো জানোই, আমার বাড়িটা কত ছোট। সেই বাড়ির অর্ধেকে থাকি আমরা, আর অর্ধেক জুড়ে থাকে আমার মুরগিরা। এখন মুশকিল দেখা দিয়েছে একটা। কালকে আমার শ্বশুরবাড়ির কিছু আত্মীয়-কুটুম আসছেন ছুটি কাটাতে।
সুতরাং, পরের দিন তাঁর বাড়িতে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-কুটুমের আর আমার বাড়িতে মুরগির আড্ডা বসল।
মানুষ ভালোবাসার কাঙাল। এইজন্য মানুষ কেবল মানুষকে নয়– জীব-জন্তু, পশু-পক্ষীকেও ভালোবাসে। এই ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ আমরা জীব-জন্তু, পশু-পক্ষী পুষি। ছোট্ট একটি টিয়াপাখি থেকে শুরু করে বিরাট একটা হাতি পর্যন্ত সবাইকেই বশ মানানো যায়, তাদের দিয়ে হুকুম তামিল করানো যায়। মাঝখানে রয়েছে ঘোড়া আর কুকুর– তাদের প্রভুভক্তির কথা সর্বজনবিদিত। ঘোড়া মনিবকে দেখলে হেষা রব তুলে পিঠ পেতে দেয় চড়ার জন্যে। কুকুর যখন পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে লেজ নাড়ে, তখন মালিকের মনে যে অনাবিল আনন্দের উদ্রেক হয়, সে আনন্দ ভাষায় ধরে রাখা শক্ত। সাপ যে সাপ, সে-ও সাপুড়ের নির্দেশে ফণা নামিয়ে নেয়। কিন্তু মুরগির বেলায় আজ পর্যন্ত এমন কখনো দেখা যায়নি যে, কোনো মুরগি মোরগ ছাড়া অন্য কাউকে চেনে। মোরগের বেলায়ও সেইকথা সত্য।
মোরগ-মুরগিকে যতই আপনি আদর করুন, হাতে ধরে ধরে খাওয়ান-না কেন, কিছুতেই পোষ মানাতে পারবেন না, তাদের দিয়ে লেজ নাড়াতে পারবেন না। অবশ্য আমার বলার উদ্দেশ্য আদৌ এ নয় যে, পেলেছি বলেই আমার মোরগ সেই ভেল্কির বানরের মতো তোপ দেগে আমাকে সালাম ঠুকে যাক কিংবা আমার মুরগি ডাক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাছে এসে আমার হাতের উপর একটা ডিম পেড়ে দিয়ে পাছা দোলাতে দোলাতে চলে যাক। কিন্তু কথা নেই, বার্তা নেই, চক্চকে কোনো জিনিস দেখলেই কট্ট্-কটাশ্ রব তুলে গোটা বাড়ি মাথায় তোলার তো কোনো মানে হয় না। স্বীকার করছি, কেবল ছুরি দেখলে তাদের সে-রকম করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। কিন্তু যা চক্চক্ করে, তাই যে ছুরি নয়— সে-কথা তারা কবে শিখবে?
আমার ছেলে-মেয়েরা তবু পোষ মানাবার চেষ্টার ত্রুটি করল না। টুনটুনি, ঝুনঝুরি, ফুলঝুরি, চুনচুনি, ফুলপরী– এইসব আদরের মিষ্টি-মিষ্টি নাম রাখল মুরগিদের। আর, মোরগের নাম রাখা হল পুরনো যত বিখ্যাত নেতা আর আমাদের নিজেদের পূর্বপুরুষদের নামে। এতে কবরের তলা থেকে তাঁরা প্রতিবাদ করে উঠলেন কিনা, জানা গেল না; তবে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মির্জা আবদুল ওদুদ বেগ বললেন, ‘মোরগদের নিয়ে এ কিন্তু বাড়াবাড়ি।
মুরগি তবু একটা থেকে আর একটা চেনা যায়। কিন্তু মোরগের বেলায় একটা থেকে আর একটাকে স্বতন্ত্র করে দেখা আজ পর্যন্ত আমার দ্বারা হয়ে উঠল না। সব মোরগকেই আমার এক বলে মনে হয়। তাদের চলা-ফেরা, আদব-কায়দা, মুখের বুলি– সবই এক! আমার পঞ্চেন্দ্রিয়ের ক্ষমতার অভাব অবশ্য সেজন্য দায়ী হতে পারে।
সাধারণভাবে শিক্ষিত লোকদের মধ্যে এবং বিশেষভাবে উর্দু কবিদের মধ্যে একটা সর্বব্যাপী ধারণা রয়েছে যে, প্রত্যূষে মোরগ আর মোল্লার আজানের উৎপত্তিগত ও ব্যুৎপত্তিগত কারণ একই। আঠারো মাস এই কারণ নিয়ে আমি গবেষণা চালিয়েছি। তাতে দেখা গেছে, আমার ঘুম যখন সবচাইতে গভীর, ঠিক তেমনি সময়ে আমাদের মোরগ আজান দেয়। আমার অভ্যাস এবং আমাদের মোরগের স্বভাব–এ দুটোর কোনোটারই পরিবর্তন হয়নি আজ পর্যন্ত। যাই হোক, রবিবারে অনেক বেলা অবধি ঘুমিয়ে থাকার যে সপ্তাহান্তিক আনন্দ, মুরগি পালার পর থেকে সে আনন্দ আমার জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়ে গেছে। বিশেষত আমাদের মোরগের সকালবেলাকার আজান এতই সময়নিষ্ঠ আর গগন-বিদারী যে, পাড়া-প্রতিবেশীদেরও কেউ সহসা কোনোদিনও আর অ্যালার্ম ঘড়ি কেনার প্রয়োজন বোধ করবেন না।
সত্যি, কোনো কোনো মোরগের আজান এতই হেঁড়ে-ধরনের যে, তা শুনে কবর থেকে কাফন ছিঁড়ে মরা মানুষের আবার বেঁচে ওঠার কথা। আমার কথা অতিশয়োক্তি বলে মনে করবেন না। দেহের আয়তনের তুলনায় এই ধ্বনির আনুপাতিক হার কত হতে পারে আপনিও তা একবার অঙ্ক কষে দেখতে পারেন। আমার মতে, ঘোড়ার হেষা রবের তুলনায় মোরগের আজানধ্বনি একশো গুণ বেশি শক্তিশালী। আল্লাতালা যদি আনুপাতিক হারে ঘোড়ার গলায় এই শক্তি দিতেন, তাহলে প্রাচীনকালের যুদ্ধে প্রয়োজন দেখা দিত না তোপধ্বনি করে শত্রু-পক্ষকে ঘায়েল করার। ঘোড়াকে দিয়েই সে কাজ অনায়াসে সমাধা করা যেত।
একদিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি তখন কাজ থেকে ফিরছিলাম। বাড়ির পৈঠায় পা দিতে দিতে ভিজে চুবচুবে হয়ে গেলাম। ঘরে ঢুকে দেখি, আমার সাদা ধপধপে বিছানার উপর তিনটে মোরগ-মুরগি ঠোঁট দিয়ে দেহের পরিচর্যা করছে। সাদা চাদরের সর্বত্র ময়লা মাখা পায়ের ছাপ। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গিন্নিকে বললাম, ‘তুমি থাকতে এই কাণ্ডটা হল, আর তুমি কিছু বললে না?’
গিন্নি নাক ঝাপ্টা দিয়ে বলে উঠলেন, ‘আমাকে কি মুরগির পাহারাদার ঠাওরেছ?’
‘ও, তাহলে দোষটা আমারই, তাই না?’
গিন্নি এবারে একটু শান্ত হলেন। বললেন, ‘আমি রান্নাঘরে ছিলাম, দেখিনি। বাড়িতে মুরগি থাকলে ওরকম এক-আধটু হয়ই। এত চিৎকার করার কী আছে? তুমি আজকাল মুরগি দেখলেই অ্যালার্জিক হয়ে ওঠ।’
এইকথা শুনে আমার আর মুখ থেকে রা সরল না। মুরগির প্রতিও যে মানুষের মনে অ্যালার্জি বাসা বাঁধতে পারে, সেই অদ্ভুত আবিষ্কার নিয়ে মনের মধ্যে আন্দোলন চলছে, এমন সময় আরো একটা নতুন জিনিস আবিষ্কৃত হল। আমার সাদা ধপধপে বিছানায় শুধু যে মুরগির পায়ের ছাপ পড়েছিল, তাই নয়– তাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে আরো একটা জিনিস তারা ছেড়ে দিয়েছে। ব্যাপার হচ্ছে, মুরগিকে আপনি ডালের কণা না-খাইয়ে যদি সোনা-দানা, মণি-মুক্তোর কণাও খাওয়ান, তবু সে সুযোগ পেলেই পোকা-মাকড়, আরশুলা, মাকড়সা, কেঁচো, পিঁপড়ে, ময়লা, নোংরা, আবর্জনা খাবেই। এইভাবে মুরগি যাই খাক-না কেন, তা হজম হওয়ার পর যে জিনিস সে নির্গত করবে, সর্বক্ষেত্রে তা বড়ই অসহ্য। সেইরকম অসহনীয় বস্তু সেদিন আমার বিছানায় যত্রতত্র, যথেচ্ছভাবে খালাস করা হয়েছে।
আমার মনের কোণায় তখন এই চিন্তা সুড়সুড়ি কাটতে লাগল যে, মুরগির থাকবার জন্য চমৎকার করে দরমা বানিয়ে দিয়েছি, পলই কিনে এনেছি– তা সত্ত্বেও মানুষের শয়নাগারে বা শয্যায় কেন মুরগি আসবে? এই নিয়ে পুরো দেড় বছর গবেষণা চালিয়ে আবিষ্কার করা গেল যে, মুরগি কখনো দরমায় বা পলই-এ থাকে না। এই দুই জায়গায় ছাড়া সর্বত্র আমি মুরগি দেখেছি কিংবা দেখেছি মুরগির ছেড়ে যাওয়া অভ্রান্ত নিদর্শন। এমনকি, ডিম পাড়ার সময়েও তারা দরমায় যায় না। হয় বাথরুমে, না হয় আলনায় চেপে ডিম পেড়ে দেয়। গ্রীষ্মকালে তুলে রাখা লেপ কাঁথার স্তূপ থেকে কুড়ুক-পড়া মুরগি বের হতে আর দরমার ভেতর থেকে দাড়ি-কাটার পেয়ালা বের হতে আমি প্রত্যেক দিন দেখেছি। তাছাড়া, একদিন টেলিফোন বেজে উঠল, আমি রিসিভার তুললাম, কিন্তু ‘হ্যালো’ বলতে পারার আগেই পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে একটা মোরগ বিকট গলায় আজান দিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে তারের অন্য প্রান্ত থেকে শব্দ ভেসে এল, ‘সরি, রং নাম্বার।’ এই কথা বলেই, যিনি অনুগ্রহ করে আমাকে স্মরণ করতে চেয়েছিলেন, তিনি রিসিভার রেখে দিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার আর কথা বলা হল না।
একদিন কাজের থেকে ফিরে দেখি, ইলাহি কাণ্ড। গোটা পাড়ার ছেলেপুলে একত্র হয়েছে। আর, তাদের মাথার উপর অসংখ্য চিল-কাক উড়ে বেড়াচ্ছে। কী ব্যাপার! না, আমাদের ল্যাংড়া মোরগটা ইন্তেকাল করেছে। আমার নতুন ক্যারম বোর্ডের উপর লাশ শুইয়ে রাখা হয়েছে। শব-শোভাযাত্রার পুরোভাগে রয়েছে বড় বড় ছেলে, আর পেছনে ছোটরা। চারজন-চারজন করে কাঁধ বলাবলি করে লাশ নিয়ে যাচ্ছে দাফন করতে। একেবারে পেছনে রয়েছে যারা, তাদের মধ্যে দু-একজন ভালো করে হাঁটতেও শেখেনি। তারা কান্না জুড়ে দিয়েছে এই বলে যে, বড়রা তাদের লাশ বইবার সুযোগ দিচ্ছে না।
এর কয়েকদিন পরে চোখ দুটোকে অবাক করে দিল অন্য এক ঘটনা। আমার ছেলেরা পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে শিন্নি বিলোচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, শাহ্-রুখ নামের মোরগটা আজ প্রথম আজান দিয়েছে। এইরকম বাজে কাজে পয়সা নষ্ট করার জন্য আমি যখন খেদ প্রকাশ করছিলাম, তখন এই বলে আমার খেদ দূর করা হল যে, শিন্নি বিলোনোর জন্যে কোনো কাঁচা পয়সা খরচ করা হয়নি– দশ বছর ধরে বেকার পড়ে-থাকা আমার সার্টিফিকেট আর, আমার প্রথম উপন্যাসের মরচে ধরে-যাওয়া পাণ্ডুলিপি মোটা দামে সের-দরে বিক্রি করে সেই পয়সা দিয়ে এই উৎসব উদযাপন করা হচ্ছে।
আমার গোটা বাড়িটা এখন একটা প্রথম শ্রেণির পোলট্রি ফার্ম। তবে পার্থক্য এটুকুই যে, পোলট্রি ফার্মে কেবল হাঁস-মুরগির চাষ হয়, আর আমার ফার্মে সেই সঙ্গে মানুষের চাষও অব্যাহত রয়েছে।
এই পোল্ট্রি ফার্মের তদারকি করতে গিয়ে সঞ্চিত আমার অভিজ্ঞতার ফসল অফুরন্ত। একদিনে এক বৈঠকে বসে তা বলে শেষ করা যাবে না। তবে, যাঁরা দুনিয়াদারির সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মায়া ত্যাগ করে পারলৌকিক ও পারমার্থিক চিন্তায় নিমগ্ন হওয়ার কথা ভাবছেন, তাঁদের জন্য আমার আপাতত কেবল এই পরামর্শটুকু দেওয়ার রয়েছে যে, তাঁরা মুরগি পালুন। তাহলে তাঁদের জীবনে এমন সব আধিভৌতিক কাণ্ড ঘটবে আর এমন সব বিচিত্র বিদ্ঘুটে সমস্যা, কোলাহল, কলহ ব্যাঙের ছাতার মতো আপনাআপনি গজিয়ে উঠবে যে, তাঁরা সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হবেন এবং লালায়িত হয়ে উঠবেন পূর্বের সাদা-সিধে, হাসি-কান্নার, সুখ-দুঃখের জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য।
নতুন এক জ্বালাময়ী সমস্যার সৃষ্টি হল মোরগে-মোরগে লড়াইয়ের ব্যাপার নিয়ে। প্রথম প্রথম মোরগের সংখ্যা যখন কম ছিল, তখন ছেলেরা মোরগ-লড়াই দেখার জন্য নানাভাবে কসরত করেছে। দুই মোরগের গলায় ঘণ্টি বেঁধে দিয়ে ধরে ধরে সামনাসামনি ঠোকাঠুকি করিয়েছে, কিন্তু অনিচ্ছুক মোরগদের দিয়ে লড়াই বাধানো যায়নি। আর এখন, এই লড়াই অহরহ হচ্ছে। একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড। কিন্তু এই রক্তারক্তি কাণ্ড যদি কেবল নিজের বাড়ির মোরগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে ও কথা ছিল। তা এখন ছড়িয়ে পড়েছে পাড়ার অন্যান্য মোরগের মধ্যেও। আমার মোরগরা সারাদিন যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থেকে সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে যুদ্ধ বাধানোর ব্যবস্থা সম্পন্ন করে অন্য মোরগঅলাদের।
মোরগের লড়াই কেবল মোরগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না। দু-একটা মোরগ মানুষের উপরও আক্রমণ চালাতে লাগল। এই অভিযোগ প্রথম প্রথম আমার বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু অবিরাম পথচারীদের নালিশ শুনতে শুনতে কান যখন আমার ঝালাপালা, তখন নিজেই একদিন এক মোরগের আমি শিকার হলাম। মির্জা আবদুল ওদুদ বেগ এই ঘটনা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চান না। বললেন, ‘কই, আমার উপরে তো কোনো মোরগ কোনোদিন ঝাপ্টা মারেনি!’ শুনে আমি মানুষ-সমান এক আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। দেশে কিছুতেই মনে হল না, আমাকে দেখে কোনো শান্তিপ্রিয় জীবের চোখ রক্তবর্ণ হওয়া উচিত।
যাই হোক, আমার মোরগদের বিরুদ্ধে মানুষের অভিযোগ যখন একেবারে সীমা ছাড়িয়ে গেল, জীবন হয়ে পড়ল অতিষ্ঠ, তখন এক মুরগি-বিশারদের কাছে গিয়ে পরামর্শ চাইলাম। তিনি আমাকে শুধু পরামর্শ নয়– অনেক জ্ঞানও দিলেন। বললেন, ‘মোরগ-মুরগির জাতটা প্রাকৃতিকভাবে শান্তিপ্রিয়। চিল বা বাজপাখির জাত আর মোরগ-মুরগির জাত এক প্রজাতিভুক্ত নয়। প্রথমটা সুবিধাবাদী, স্বার্থপর, হিংসাপরায়ণ; কিন্তু দ্বিতীয়টা শান্তিপ্রিয়, নির্বিবাদী, সেবাপরায়ণ। ‘
এই পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেক্চার শুনতে হয়তো আমার বিশেষ খারাপ লাগছিল না। কিন্তু আমার নিজের মোরগের স্বভাবের ব্যাপার নিয়ে আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। কাজেই তাঁকে বাধা দিতে হল এবং আমার আগমনের কারণটা তাঁকে মনে পড়িয়ে দিতে হল।
বললেন, ‘দেখুন, আপনার মোরগ ঝগড়াটে মাত্র একটা কারণেই হয়ে থাকতে পারে। এই মোরগকে এঁটো মাংস খাওয়ানো হয়েছে।
সূত্র পেয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ালাম বাড়ির দিকে। গিন্নির কাছে তা ব্যক্ত করলাম। শুনে তিনি একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, ‘বুড়ো বয়েসে তোমার ভিমরতি ধরেছে। একটা ভালো ডাক্তারের কাছে না-গিয়ে গিয়েছিলে কোন হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে। বলি, আমরা কি এতই অপবিত্র হয়ে গেছি যে, আমাদের এঁটো খেলে মুরগির অসুখ করবে!
মুরগি পালবার আগে খুব কম লোকেই আমাকে চিনত। কারণ, বাইরে কাজে যাই, আর কাজ ফুরোলে বাসায় ফিরে লেখা-পড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সুতরাং স্বল্প-সংখ্যক যে কয়জন আমাকে চিনতেন, তাঁরা কোণাই-চণ্ডি হিসেবেই চিনতেন। কিন্তু মুরগি পুষবার পর থেকে আমার পরিচয় সর্বব্যাপী হয়ে গেল। এখন কোনো নতুন লোক আমার খোঁজে এলে পাড়ার বাচ্চারাও সহজে আমাকে চিনিয়ে দিতে পারে। বলে, ‘ও, মুরগি-সাহেবকে চান? ওই যে ওইখানে লাল বাড়িটার পাশে মুরগি সাহেব থাকেন।
শুধু তাই নয়– আমাদের পাড়ার কেউ যখন কোনো নিজের লোককে ঠিকানা বোঝাবার চেষ্টা করেন, তখন তা ব্যক্ত করেন এই ভাষায়, ‘ওখানে গিয়ে যে-কাউকে জিগ্যেস করবেন, মুরগি সাহেবের বাড়ি কোনটা। তারপর পশ্চিমের দুটো বাড়ি ছেড়ে ডাইনে ঘুরলেই আমাকে পাবেন। মুরগি সাহেব নামটা মনে রাখবেন কিন্তু।’
যাই হোক, ঝগড়া-প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসা যাক। একটা জিনিস লক্ষ করলাম, পাড়ার তাবৎ লোক আমার কাছেই আসে আমার মোরগ-মুরগির বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে। অথচ, এ পাড়ায় কম হোক, বেশি হোক– মুরগি তো সবাই পোষে। মামুন সাহেব সেদিন বাড়ি-চড়াও হয়ে আমাকে খুব খানিক ভালো-মন্দ শুনিয়ে গেলেন। আমার মুরগিতে নাকি তাঁর পালং শাকের ক্ষেত একেবারে ছাগলের মতো করে মুড়িয়ে দিয়ে এসেছে।
হারুন সাহেবের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক। কিন্তু তাঁর কুকুর দবির সাহেবের একটা মুরগিকে চিবিয়ে রেখে এসেছে, সেজন্যও দবির সাহেব আমারই উপর চড়াও হলেন। হারুন সাহেব বাড়ি নেই, কিন্তু তাঁর বন্ধু আমি রয়েছি, কাজেই তাঁর কুকুরটাকে আমি কেন সামলে রাখিনি।
এত নির্যাতন সহ্য করার পর শেষে আল্লা-আল্লা করে আমারও একদিন দিন এল। ‘খলিল মঞ্জিলে’র খলিল সাহেব খাসি-প্রমাণ একটা লাইট-সাসেক্স মোরগ কিনে এসেছেন। কদিন ধরে তিনি এই মোরগ সবাইকে দেখিয়ে বেড়ালেন আর বলে বেড়ালেন যে, এর ঔরসে যে ডিম হবে, তা তিনি লাহোর পাঠাবেন একজিবিশনে। খলিল সাহেবের দাপট কিছুটা থিতিয়ে এলে আসল দাপট শুরু হল খোদ মোরগটার। গর্দান উঁচিয়ে সে পাড়াময় জৌলুস বিলিয়ে বেড়ায়। তার আজানের হাঁক শুনলে মুরগির বাচ্চারা ভয়ে সেঁধিয়ে যায় মায়ের ডানার তলায়। তারপর, এই মোরগের অত্যাচারে পাড়ার অন্য সব মোরগের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল।
খলিল সাহেবের মোরগ একদিন আমার একটা হুয়াইট লেগ্হর্নের চোখ উপড়ে ফেলল। যখন জানতে পারলাম, তখন অসময়। সারারাত মনে মনে রিহার্সাল চালালাম ঝগড়া করার। এমনকি, দুজনের মুখ থেকে যেসব সংলাপ নির্গত হবে, তা-ও প্রায় আমার মুখস্থ হয়ে গেল। তারপর, দাঁত কটমট করে সকাল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
খলিল সাহেবের বৈঠকখানায় গিয়ে যখন উঠলাম, তখন তিনি হাতের চেটোর উপর একটা ডিম দাঁড় করিয়ে রেখে সমবেত দর্শকমণ্ডলীর কাছে সেই ডিমের মহিমা ব্যাখ্যা করছিলেন। ডিমের প্রশংসায় তিনি এত বেশি পঞ্চমুখ যে, শুনলে মনে হবে, সে ডিম তাঁর কোনো মুরগির নয়– যেন সেটা তিনি নিজেই পেড়েছেন।
এই দৃশ্য দেখে আমার প্রস্তুতি যেন খানিকটা দুর্বল হয়ে গেল। তবু আমি নির্ভাবনায় রিহার্সাল-করা প্রথম সংলাপটা ছেড়ে দিলাম, ‘আমি মুরগি সাহেব, আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’
উত্তর এল, ‘কোনো অসুবিধে নেই।’
‘কালকে আপনার মোরগ আমার মোরগের চোখ খেয়ে ফেলেছে।’
‘ধন্যবাদ। এক চোখ, না দু’চোখ?’
‘এক চোখ।’
‘ডান চোখ, না বাঁ চোখ?’
আমার মুখস্থ-করা সংলাপ কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও ডান চোখ, না বাঁ চোখ, তা মনে করতে পারলাম না। শেষে বললাম, ‘ডান হোক, বাঁ হোক– তাকে কী এসে যায়!’
‘বলেন কী, মুরগি-সাহেব! আপনার কাছে ডান আর বাঁয়ে কোনো পার্থক্য নেই!’
‘কিন্তু আপনার মোরগে যা করেছে, সেটা অন্যায়।’
‘নিশ্চয় অন্যায়। কিন্তু আপনার পর্দানশীন মোরগের বাইরে বেরুনোটা আরো বেশি অন্যায়।’!
‘আপনার মোরগটা বোধহয় রাজহংস?’
‘দেখুন, আপনি আমাকে যা-খুশি বলুন; কিন্তু আমার মোরগকে কিছু বলবেন না। আমার মোরগ রাজহংসই যদি না-হবে তাহলে অমন রাজার মতো শান-শওকত নিয়ে ঘুরে বেড়াবে কেন, বলুন দেখি! আর, আপনার মোরগই-বা কেন আসবে আমার মোরগের কাছে!’
‘মানুষ তো আর নয় যে, ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রাখবে নিজেকে।’
‘আপনি যদি আপনার সুলোচনকে বেঁধে রাখতে না-পারেন, তাহলে আমিই-বা কেমন করে তার ঠোঁটে ঠুলি লাগিয়ে রাখি, বলুন!’
সুতরাং যে-রাগ নিয়ে গিয়েছিলাম, সেই রাগ নিয়েই ফিরে আসতে হল আমাকে। কোনো লাভ হল না। লাভের মধ্যে আমার আরো খানিক মূল্যবান সময় নষ্ট হল।
মহামারি আকারে কত রানীক্ষেত এল, কত মুরগি কুকুরে খেয়ে ফেলল, কত লোপাট করল প্রতিবেশীরা, কিন্তু মুরগির যে বীজ একদিন আমার সেই সদাশয় আত্মীয় বপন করে দিয়ে গিয়েছিলেন, তার গাছ, ডাল-পালা, শাখা-প্রশাখা, পত্র, পল্লব, পুষ্প যেন অমর। এ বংশ কিছুতেই ধ্বংস করা গেল না।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
বোবা চোখ – মির্জা আদিব
সেদিন সারা শহর শেখ খয়রুদ্দিন মরহুমের জন্মবার্ষিকী পালন করছিল।
এই দিনটি উদ্যাপনের জন্য গত ক’সপ্তাহ ধরে খুব তোড়জোড় প্রস্তুতি চলছে। যেমন : বিভিন্ন খবরের কাগজের বিশেষ সংখ্যা ছাপা হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় মরহুমের চিত্রাবলি মুদ্রিত হচ্ছে। এবং রবিবার সন্ধ্যায় পৌরসভার মেয়রের সভাপতিত্বে টাউন-হলে এক বিরাট সাধারণ সভাও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ওই সভায় শহরের ক’জন প্রখ্যাত অনন্য পুরুষ মরহুমের বরেণ্য জীবনের ঘটনাবলির ওপর আলোকপাত করছেন। এই সূত্রে আমাকেও অন্যতম বক্তা নির্বাচিত করা হয়েছে। মরহুমের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত জানাশুনো ছিল। তাছাড়া, সংবাদপত্র, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধাদি অধ্যয়ন করার পর আমার হাতে এত বেশি উপকরণ জমা হয়ে গিয়েছে যে, ওঁর সম্পর্কে একটা কেন, কম-সে-কম দশটা লম্বা-চওড়া বক্তৃতা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু আমি চাইছিলাম, যাই লিখি-না কেন, মরহুমের জীবনের একটি বিশেষ দিককে নিয়েই শুধু লিখব। আর, তার জন্য আমি যে বিষয় নির্বাচন করেছি, তা হচ্ছে : শেখ খয়রুদ্দিন মরহুমের কাছে জনগণের ঋণ। আমার চোখের সামনে উপকরণ ছড়িয়ে পড়ে ছিল– আমার কলম দ্রুতগতিতে সেগুলোকে গুছিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছে–
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, শেখ সাহেব মরহুম শহরের বিখ্যাত ধনবানদের একজন ছিলেন। পৈতৃক ওয়ারিশান সূত্রে তিনি প্রচুর সম্পত্তি লাভ করেছিলেন। তাছাড়া নিজের ব্যক্তিগত চেষ্টায়ও তিনি তাঁর দৌলতের অনেক বৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু যে বিষয়টি আমাদের দেখা দরকার, সেটি হচ্ছে এই যে, তাঁর মরহুম ধন-দৌলত কোথায় কীভাবে খরচ করেছেন এবং মরহুমের হাতে তাঁর পুঁজির আর কত অবশিষ্ট ছিল। শেখ সাহেব ছিলেন নিরাশ্রয়ের আশ্রয় আর পিতৃহীন-মাতৃহীনের ভরসা। সারাজীবন তিনি আল্লার সৃষ্ট জীবের সেবা করে গেছেন। তিনি তাঁর আয়ের একটা বিশেষ অংশ জনকল্যাণের জন্য আলাদা করে রাখতেন। কবিবর জওক্ বলেছেন :
বরণীয় নাম : তিনি কল্যাণের হইলেন হেতু।
কূপ হইল, মসজিদ হইল, হইল পুষ্করিণী, সেতু।।
‘মরহুম এই কবিতার জীবন্ত প্রতীক। আজ কে না জানে ‘খয়রুদ্দিন হাসপাতালে’র নাম। এই হাসপাতালে প্রতিদিন বহু রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে, আর বেশির ভাগ রোগীকেই ওষুধ দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে। মরহুম শুধু হাসপাতাল করেই ক্ষান্ত হননি, একেবারে আপন পকেট থেকে মোটা অঙ্ক ব্যয় করে একটি এতিমখানাও বানিয়ে দিয়েছেন। আজও সেই এতিমখানায় সমাজের কত নিরাশ্রয়, নিঃসম্বল শিশু প্রতিপালিত হচ্ছে। সহায়-সম্বলহীন মানুষের সহায় হওয়াই ছিল তাঁর কাজ।’
‘বাবুজী, একটা চিঠি লিখে দেবেন গো?’
আমার কলম হঠাৎ থেমে গেল। মাথা তুলে সামনে তাকালাম। মেহেরুন গোয়ালিনী ময়লা হাতে একটি খালি খাম নিয়ে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে।
‘দেবেন চিঠি লিখে? ফুরসত আছে?’
আমি জানি, যদি আমার যাবতীয় ভাবনাগুলোকে আমি এখন গুছিয়ে না-নিই, তাহলে পরে আমার বক্তৃতার গাঁথুনি আর ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে যাবে; এবং লেখার যে সহজ কায়দাটিকে আমি এখন আয়ত্ত করেছি, তা আর থাকবে না। কিন্তু কী করি, রাজি না হতেও মন চাইছে না। মেহেরুন গত দশ বছর ধরে পানি না-মিশিয়ে আমাদের দুধের রোজ দিয়ে আসছে। এরজন্য তার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। রাজি। না-হলে এই কৃতজ্ঞতার বরখেলাপ হয়। সুতরাং মাথা নেড়ে ইশারায় তাকে ভেতরে আসতে বলি। মেহেরুন ভেতরে এসে মেঝের উপর হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ল।
‘বাবুজিকে বড্ড কষ্ট দিলাম গো! লিখতে হবে আমার বোনকে, বুঝলে গো? সে থাকে পিণ্ডিতে। গ্রাম–’
‘কী লিখতে হবে আগে বাপু তাই বল। ঠিকানা পরে লিখতে হয়। একটু দাঁড়াও। কাগজ নিই আগে। হ্যাঁ, এবার বল।
লিখে দেন, বিষুদ্বার সাঁঝের বেলা পাহাতুন-মা মারা গেছে– ব্যস্, এই কথা।’
বলতে বলতে তার গলার আওয়াজ কেমন ম্লান হয়ে গেল।
‘ফাতেমাকে পাহাতুন-মা বড় ভালোবাসত। সেই যে সেবার– ফাতেমা তখন আইবুড়ো– ওর পা একটু পুড়ে গিয়েছিল, পাহাতুন সারাদিন ঘুরে ঘুরে, আল্লা জানে কোথা থেকে না-কোথা থেকে মলম নিয়ে এল। এদিকে আবার সারা শহরে সেদিন জব্বর
হরতাল।’
আমি জিগ্যেস করলাম, ‘পাহাতুন-মা– মানে সেই ধোপানি তো?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ– ওই যে গলির শেষে থাকত। আপনার কাপড়ও হয়তো ধুতো। গোটা মহল্লার কাপড় ওই তো ধুতো।’
‘ও, তাই বল। এইজন্য পরশু ওর ঘরের সামনে লোকজন বসেছিল? তাহলে পাহাতুন মারা গেছে?
মেহেরুন প্রশংসার গলায় বলল, ‘আহা, কী যে বুকের পাটা ছিল গো ওই মেয়ের। কাজ করে কেলান্তি নাই। কে বলে মেয়েলোক? সে ছিল মেশিন গো মেশিন।
‘আর জাঁহাবাজ ঝগুড়ে মেয়ে বলেও তার খুব নামডাক ছিল, তাই না? সব সময় ঝগড়া-কাজিয়া করত। পাড়ার লোক তার থেকে দশ হাত দূরে থাকত।’
আমি পাহাতুনের যে বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিলাম, তা সর্বজনবিদিত। ওটা একটা নিত্যনৈমিত্তিক আলোচনার বিষয় ছিল।
‘ঝগড়া তো সে করতই গো নিচ্চয়, আর চেঁচাচেল্লিও করত। তা, সে ঝগড়া করত আপন সোয়ামির সঙ্গে। আল্লা জানে, তার জন্যে লোকে কেন অত বদনাম করত। আমি হক্ কথাটা বলব গো তোমাকে, সে কেমন মেয়েলোক ছিল? বড্ড ভালো। হায় মা, দেখ, তোমার সময় নষ্ট হচ্ছে!’
আমি বক্তৃতার কাগজটার উপর নজর ফেললাম : ‘অসহায় সম্বলহীন লোকদের আশ্রয় দেওয়া মরহুমের কাজ ছিল।’ পরের বাক্যটা ঠিক করার জন্য বাঁ হাতের চেটোর উপর কপাল রেখে চোখ বন্ধ করে আমি ভাবতে লাগলাম।–
‘পৃথিবীতে এমন লোক খুব কমই আছেন, যাঁরা ভাঙা হৃদয় জোড়া দেন, নিপীড়িতকে ঠাঁই দেন এবং অনাথকে আশ্রয় দেন। শেখ সাহেবের খ্যাতির সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে তিনি অনাথ-পতিতের সত্যিকার বন্ধু ছিলেন।’ আমার মাথায় গোটা গোটা বাক্য যথাযথ শব্দ-পরম্পরায় এগিয়ে আসছে। কলমের খোঁজে আমি এদিক-ওদিক তাকাই। মেহেরুন মিটিমিটি চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকে, কী যেন ভাবে। কী সে বলতে চায়? তার নীরব চোখ দুটিতে কেমন এক আবেদনের ভাষা। তাতে এক বিশেষ ইচ্ছার ঝলক। মন চাইল, তার গুটিকয় কথা শুনেই নিই। দু-দশ মিনিট যাবে তাতে। না-হয় তারপরই শেখ সাহেবের জীবনের আরো দু’চারটি ঘটনার কথা লিখে আমার ভাষণ শেষ করব। বললাম, ‘তাহলে ঝগড়াটে ছিল না তোমার পাহাতুন-মা?’
‘হ্যাঁ ছিল, নিশ্চয় ছিল– আমি বলছি, ছিল। আল্লা ভালো করুক। হ্যাঁ, আমার পুরুষের কথাই ধর-না। বিয়ের পর আমি যখন তার সংসারে এলাম, সে বলল, ‘দেখ মেহেরুন-বউ, ওই পাহাতুন থেকে কিন্তু একদম দূরে দূরে থেক। তোমাকে নিয়ে যদি কোনোদিন পড়ে, তো তোমার মাথার একটি চুলও আর বাকি রাখবে না, হ্যাঁ।’
‘আমি বললাম, ‘আমিও কিছু কম নই কারো থেকে, হুঁ। আমার সঙ্গে যদি লড়তে আসে, আমিও খোঁতা মুখ ভোঁতা করে দেব।
‘ওই কথা তো আমি বললাম বড়-মুখ করে, কিন্তু সত্যি বলতে কী, পাহাতুনের কাছে যেতে আমার খুব ডর লাগত। আমাকে বাপু ক-বার ডেকেও ছিল, কিন্তু আমি যে দূরে দূরে, সেই দূরে দূরেই রইলাম। তারপর এই ধরেন গো সেদিনের কথা– আমার পুরুষের মরা তখন একমাসও হয়নি, পাহাতুনের তার সোয়ামি মওলা বখ্শের সঙ্গে এমন কাজিয়া হল– সে আর তোমাকে কী বলব গো বাবুজি! পাহাতুন তো আসমানটাকে একেবারে মাথায় করল। সেদিন আমি একদম পাকাপাকি ঠিক করে ফেললাম, ওরা মুখোমুখি আর হওয়া নয়। জানো বাবুজী, কী নিয়ে সেই কাজিয়া? শোনো তাইলে। পাহাতুন কোথায় শুনেছে, মওলা বখ্শের কোন খেমটাউলির সঙ্গে পিরিত হয়েছে। তার ঘরে যাওয়া-আসা আছে। তাই শুনে তো পাহাতুনের সারা শরীলে-গতরে আগুন ধরে গেল। খেমটাউলিকে সে তো ভালো-মন্দ যা শোনাল, তোবা তোবা, সে আর মুখে আনার লয় গো। কিন্তু অর্ধেক রাত পর্যন্ত সে আর মহল্লার কাউকে ঘুমোতে দেয়নি।– হেই মা, দেখ দেখ, আমি তোমার সময় নষ্ট করে দিলাম কত। দেখ আমার আক্কেল, আমি পাহাতুনের কিস্সা কেমন শুরু করলাম বসে বসে।’ বলতে বলতে মেহেরুন একেবারে অস্থির হয়ে উঠল। আমি তাকে ভরসা দিয়ে বললাম, ‘না না, তুমি বল পাহাতুনের কাজিয়ার কথা।’
‘দু’দিন পর আবার কাজিয়া। মওলা বখ্শ বলল, সে খেমটাউলির ঘরে যাবেই যাবে। ব্যস্, পাহাতুন তো একেবারে যেন কতকাল না-খেয়ে থাকা একটা বাঘিনী হয়ে গেল। সেদিন তার চাচাও এসে রাগের মাথায় মওলা বখশের একটা হাত দিল ভেঙে। তারপর, বুঝি দু’তিন দিন পরের কথা, আমি আমার এক খদ্দেরকে দুধ দিচ্ছি, দেখি পাহাতুন ছোট একটা গেলাস হাতে কখন এসে কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে।’
‘পাহাতুন বলল, ‘বউ, আমাকে একটু দুধ দাও’।
‘আমি ওকে দুধ দিলাম। ভেবেছিলাম, দুধ নিয়ে চলে যাবে; কিন্তু একেবারে ধরনা দিয়ে বসে গেল, তারপর কথা শোনাতে লেগে গেল। পেখম তো বলতে লাগল, মওলা বশের খুব অসুখ, খুব কষ্ট। বেচারা সারারাত তড়পেছে। আর পাহাতুনও দু’রাত দুই চোখের পাতা এক করেনি। তারপর সে নিজের সংসারের হাল শোনাতে লাগল। বাবুজি, ওইদিন আমি বুঝতে পারলাম, পাহাতুনের মন আসলে ভালো। বাবুজি, তুমি তাকে কেমন করে মন্দ বলবে গো। তার সোয়ামি একটা খেমটাউলির সঙ্গে পিরিত চালাচ্ছে। কিন্তু তবু শরীলে জখম নিয়ে সে যখন বাড়ি ফেরে, সে সারারাত জেগে জেগে তার খেজমত করেছে। আর নুলো শাশুড়িটার তো সে সেইদিন থেকে খেজমত করছে, যেদিন তার বিয়ে হয়েছে। তাই দেখে কিন্তু আমার যা সন্দ ছিল, তা চলে গেল। আমি তার বাড়ি যাওয়া-আসা করতে লাগলাম। অসুখে পড়ে মওলা বখ্শ বলেছিল, সে আর খেমটাউলির ঘরে যাবে না। কিন্তু যেই সেরে উঠল, অমনি পাহাতুনের সোনার ক’গাছা চুড়ি চুরি করে পালাল। আর সেই চুড়ি দিল গিয়ে খেমটাউলিকে।
‘পাহাতুনের আপন লোকরা বলেছিল মওলা বখ্শকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু তাতে সে রাজি হয়নি। বাপের বাড়ি চলে গেল। তারপর একমাস পর আবার এল। আল্লা জানে, এমন একটা বদ্ সোয়ামির ওপর তার কিসের অত টান। যদি আমি হতাম, তাইলে, জানো বাবুজি, কী করতাম? ওই লোকের ছায়া মাড়াতাম না– এই একদম সত্যি কথা কয়ে দিলাম, হ্যাঁ। আচ্ছা, তারপর একদিনের কথা। আমি আমার ঘরে বসে রুটি খাচ্ছি। কোথা থেকে একটা মেয়েলোক এসে দাঁড়াল। কয়লার মতো পায়ের রং। জবাফুলের মতো লাল চোখ। আবার গলায় মতির মালা। আমি বললাম, হায় আল্লা, এ আবার কে কোত্থেকে এল! সেই মেয়েলোক মাজা দোলাতে দোলাতে এল। তারপর আমার কাছে মোড়া টেনে নিয়ে বসে পড়ল।
‘আমি বললাম, ‘বহিন, তুমি কোথাকার লোক। তোমার কী চাই?’
‘তাতে সে বলল, ‘আমার নাম দরিয়া। আমি মিসবি শাহ্-তে থাকি। মওলা বখ্শকে একটু ডেকে দাও না।
‘আমি বললাম, ‘হায় মা, তুই তাইলে সেই খেমটাউলি, হ্যাঁ গা? না বাবা, আমি এর মধ্যে নাই। পাহাতুন যদি শোনে তুই এখানে রয়েছিস, তাইলে, আল্লা জানে কী হাল করে সে ছাড়বে তোর, হুঁ। বড় কঠিন মেয়েছেলে সে। গোটা মহল্লা তাকে ডরায়।’
‘তাই শুনে সে বলল, ‘বহিন, আমি এখন কোথায় যাই, কও। আমার ঘরের লোকে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বলে, আমি কলঙ্কিনী হয়েছি। মওলা বখ্শকে একটু ডাক, তারে শুধাই, সেই পাজি আমারে কলঙ্কিনী বানিয়ে কার কাছে ফেলে পালিয়ে এসেছে?’
‘আমি বললাম, ‘আমি কী করে জানব বাছা তুমি কোথায় যাবে। কিন্তু আমি এসবের মধ্যে নাই। পাহাতুনকে তো তুমি দেখনি। যদি তোমাকে সে এখানে দেখে ফেলেছে, তো তোমার হাড্ডি সে একদম গুঁড়ো করে দেবে। এই বলে দিলাম, হ্যাঁ। আল্লার কসম, সে বড় কঠিন মেয়েলোক। চুপচাপ পালাও এখান থেকে। তাতে তোমারই ভালো।’
‘সে বলল, ‘তার সঙ্গে আমাকে দেখা করতেই হবে। কদিন থেকে সে আর ওদিকে পা রাখছে না। আল্লা তাকে কেন আমার কাছে পাঠিয়েছিল। কেন সে আমার ঘরে উঠেছিল! বেশ বহিন, তুমি যদি মওলা বখ্শকে ডেকে না-দাও তো আমিই যাচ্ছি তার বাড়ি।’
‘বাবুজি, সে তো পাহাতুনের বাড়ি যাবেই, শুনবে না। কিন্তু আমি যখন তাকে খুব করে ডর দেখালাম, তখন সে বলতে লাগল, ‘আচ্ছা, বেশ, তাইলে আর কী করি– বেশ, পিণ্ডিতে আমার মামু আছে, তার কাছেই যাই।’
‘সে চলে গেল। গলিটা তখন অন্ধকার হয়েছিল। কোন দিকে গেল, দেখতে পেলাম না। ভাবলাম, এমন ডর ডরিয়েছে, আর পেছন ফিরেও চাইবে না।’
‘কিন্তু ও-মা, সক্কাল বেলা পাহাতুনের বাড়ি গিয়ে যা দেখলাম, তাতে তো নিজের চোখকেই পেত্যয় হয় না। পাহাতুন কাপড় ইস্তিরি করছে, আর সে– আর কে– সেই খেমটাউলি, পাহাতুনের সতীন, মোড়ায় বসে দই দিয়ে বাসি রুটি খাচ্ছে। দেখে তো আমি থ। পাহাতুন বলল, ‘মেহেরুন, জানো, এ কে?’
‘আমি বললাম, ‘না।’ কী করি, মিছে কথাইটা বললাম।
‘সে বলল, ‘সেই নষ্ট ছুঁড়ি– দরিয়া নাচনেউলি।’
‘আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এখানে?’
‘সে বলল, ‘হ্যাঁ বউ, ছুঁড়ি কয়, ঘরের লোকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কয়, আমার আর কেউ নাই– আমি কলঙ্কিনী হয়েছি। আমি কইলাম, আচ্ছা, ঘরের লোকে তোকে তাড়িয়ে দিয়েছে–তা আয়, থাক আমাদের সঙ্গে– শুকনো রুটি আমাদের যা জুটবে, তুইও চাট্টি খাস।’
‘দরিয়া পাহাতুনদের কাছে থাকতে লাগল। পাহাতুনের আত্মীয়-কুটমরা যখন জানতে পারল দরিয়া খেমটাউলি তার বাড়ি এসে থাকছে, তখন যা কাণ্ড হল, তাতে মনে হল, একদল নেকড়েবাঘ বুঝি কেউ ছেড়ে দিয়েছে। সবাই একমুখে বলল, ‘ওকে এক্ষুনি দূর কর!’ কিন্তু পাহাতুন বলল, ‘আমি ওকে ঠাঁই দিয়েছি, আর ওকে তাড়াতে পারি না। বেচারি এখন পথে পথে কোথায় ঘুরে মরবে?’
‘বাবুজি, কী বলব! পাহাতুনের আত্মীয়-কুটুমরা খুব রাগ করল, খুব মেজাজ চড়াল। তার চাচা তো এদ্দূর বলল, ‘এই বেবুশ্যে মাগি যদি এখানে থাকে, আমি কক্ষণো আর তোমার বাড়িমুখো হব না।’ পাহাতুন সব শুনল, কিন্তু আল্লার বান্দা ওই মেয়ে, দরিয়াকে বাড়ি থেকে যেতে বলল না।
‘পাহাতুন আগের মতোই সংসারের সব কাজ করত। দরিয়া কিছু করতে পারে না বললেই হয়। তার পেশা ছিল গান-বাজনা করা। সে কি আর ভাটির কাজ করতে পারে, না ইস্তিরি করতে পারে!
‘যাই হোক, দিন যেমন যায়, তেমনি যেতে লাগল। পাহাতুনের চেনা-জানা সবাই তাকে একঘরে করল। তার বাপ-চাচাও আসা-যাওয়া বন্ধ করল। তাই দেখে দরিয়া বলতে লাগল, ‘বহিন, অনেক হয়েছে, আর না– আমি যাই।’ সে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল। পাহাতুন তার চুলের গোছা ধরে তাকে টেনে-হিঁচড়ে ভিতরে নিয়ে এল। তারপর আর দরিয়া কখনো যাওয়ার কথা মুখে আনেনি।
‘পাঁচ-ছ মাস পর দরিয়ার একটি মেয়ে হল। কমজোর এতটুকু মেয়ে একটা। আমি তো তাকে দেখেই বুঝেছিলাম, বাঁচবে না। কিন্তু কথায় বলে না, রাখে আল্লা মারে কে। মেয়েটা সামলে উঠল, কিন্তু মায়ের হাল গেল খারাপ হয়ে। পাহাতুন তার জন্যে অনেক খরচা করল, লেডি-ডাক্তার আনল, কিন্তু সে বাঁচল না। তখন আয়েশার বয়েস দু-আড়াই মাস।
‘মা গেল মরে, এখন মেয়েকে মানুষ করে কে? দরিয়া মরার সময় মেয়েটিকে পাহাতুনের হাতে সঁপে দিয়ে গিয়েছিল। ব্যস্, আর কোনো কথা নাই। পাহাতুন তাকে বুকে তুলে নিল, তারপর মানুষ করতে লাগল। আল্লা জানে, মেয়েটাকে পাহাতুন কেন অত ভালোবেসে ফেলেছিল। তাকে সে একদণ্ড কোল থেকে নামাত না।’
মেহেরুনের আবার খেয়াল হল, সে আমার অনেক সময় নষ্ট করে দিয়েছে। সুতরাং, উবু হয়ে বসে খালি খামটাকে দেখতে লাগল। খাম সে সঙ্গে এনেছিল এবং সেটা আমার চারপাইয়ের উপর কাগজের স্তূপের সঙ্গে এখন পড়ে ছিল।
আমি জিগ্যেস করলাম, ‘মেয়েটা বেঁচে ছিল?’
মেহেরুন আবার পা ছড়িয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বলতে শুরু করল, ‘হ্যাঁ, বেঁচে বইকি। কিন্তু পাহাতুনের জন্যে সে এক আপদ হয়ে দাঁড়াল। তুমি বলবে, কেমন করে? তবে শোনো বাবুজি। খেমটাউলি যদ্দিন বেঁচে ছিল, লোকে পাহাতুনকে বলত, ‘ও ভ্রষ্ট মেয়ে, ওকে শিগগির তাড়িয়ে দাও।’ সে যখন মরে গেল তো তারা বলতে লাগল, ‘কে বলতে পারে, এ মেয়ে মওলা বখ্শের কিনা। ওকে ওর নানীর কাছে পাঠিয়ে দাও।’শুনছ বাবুজি? মোটকথা ওই মেয়েটাকে নিয়ে সবার সন্দেহ ছিল, তাই একদিন আত্মীয়-কুটুম-পড়শি যত লোক পাহাতুনের বাড়ি জমা হয়ে বলতে লাগল, ‘দেখ পাহাতুন আমরা সবাই আজ পর্যন্ত তোমার মুখ দেখেছি। এখন ভালো যদি চাও, মেয়েটাকে তার নানির কাছে পাঠিয়ে দাও। না-হলে কিন্তু আমরা আর তোমার খাতির করব না।’ সেইকথার ওপর পাহাতুন কী বলল জান বাবুজি? সে ছাতি ফুলিয়ে শুনিয়ে দিল, ‘এইটুকু অবলা মেয়েটা আমি কিছুতেই ছাড়তে পারব না।’
‘তারা বলল, ‘যদি-না ছাড় তো আমরা তোমাকে একঘরে করব।’
‘পাহাতুন তেমনি মুখের ওপর জবাব করল, ‘যা খুশি কর। আমি যখন ওকে বুকে তুলে নিয়েছি, তখন আমার মরণই শুধু ওকে আলাদা করতে পারে।’
মেহেরুনের গলায় তখন উত্তেজনা। এমনভাবে সে বর্ণনা দিচ্ছিল, যেন মনে হচ্ছিল, মঞ্চে সে পাহাতুনের চরিত্রে অভিনয় করছে।
‘তাহলে পাড়া-পড়শি তাকে একঘরে করল?’
‘হ্যাঁ, বাবুজি। আর শেষ পর্যন্ত মওলা বখ্শও তার বিবির খেলাপ হয়ে গেল। পাহাতুনের দুই ছেলে তো আগেই খেমটাউলিকে দেখতে না-পেরে মামা-বাড়ি চলে গিয়েছিল। তারা সেখানেই কাজ-কাম করছিল। আমি যখন দেখলাম পাহাতুন তার জেদের জন্যে বড় লোকান করছে নিজের, তখন একদিন তাকে বললাম, ‘পাহাতুন, তুমি মেয়েটাকে পাঠিয়েই দাও। ওটাকে কাছে রেখে কী ফায়দা বল। সব লোক তোমার শত্রুর হয়ে গেল।’
‘তাই শুনে সে বলল, ‘না রে বউ, তা হয় না। আমি ওর মাকে কড়ার করেছি ওকে বুকে করে রাখব। তাইলে বল্, তাকে কী করে পাঠাই? লোকে শত্তুর হচ্ছে তো হোক– হাজার বার হোক। কাউকে যখন ঠাঁই দিয়েছি, তখন আর লোকের কথায় ডরানো চলে?’
আমি বললাম, ‘তোমার নিজের ছেলেরাও তো তোমার শত্তুর হয়েছে।
‘পাহাতুনের চোখে পানি ভরে এল। সে বলল, ‘লোকে বলে, ছেলে মা-বাপের ডান হাত। কিন্তু আমার ছেলেরা! যাকগে, আল্লা তাদের ভালো করবেন। তারা যা-খুশি তাই করুক। তাদের আমি ডরাই না। আল্লা, যদি বুকে বল দেয় আমার কোনো কাম আটকাবে না।’
‘আর পাহাতুন তার নিজের কাজ-কাম করে যেতে লাগল। আয়েশা বাড়তে লাগল। পাহাতুন দিন-রাত খেটে তার বিয়ের যৌতুক জমা করতে লাগল– তাতে সে তার সব পুঁজি ঢেলে দিল। আয়েশার বিয়ে হয়ে গেলে পাহাতুন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। তার ফরজ সে পুরা করেছে। কিন্তু বাবুজি, আসলে আল্লার ইচ্ছা অন্যরকম। আয়েশার বিয়ে হয়েছিল গুজরাতে। আয়েশার শ্বশুরকে গিয়ে সেখানে কেউ বলে বলে দেয়, আয়েশা খেমটাউলির বেটি। ব্যস্, আর যায় কোথা! শ্বশুরবাড়ির লোকে তাকে মেরেধরে পাহাতুনের বাড়ি পাঠিয়ে দিল। তারপর তালাকের কাগজও পাঠিয়ে দিল। আয়েশা এদিকে তালাক নিয়ে বাড়ি ঢুকল, আর ওদিকে মওলা বখ্শ রক্ত তুলতে লাগল। পাহাতুনের বিপদের ওপর বিপদ। আর কেউ হলে, তো পাগলই হয়ে যেত। কিন্তু পাহাতুন দমবার লোক নয়। একা নুলো শাশুড়ির খেমত করতে লাগল, সোয়ামির অসুখের খরচ চালাতে লাগল, আবার মানুষের কাপড়ও সমান ধুয়ে চলল।
‘পাহাতুনের এক সম্পর্কের ভাইপো ছিল– নাম তার তাজু। মস্ত একটা বাউণ্ডুলে। পাহাতুন তাকে নিজের কাছে এনে রাখল। সেই ছেলে তাকে কাজে-কামে সাহায্য করত। তারপর যখন পাহাতুন দেখল, তাজু ভালো হয়ে গেছে, তার সঙ্গে আয়েশার নিকাহ পড়িয়ে দিল। আল্লা আল্লা করে তার ঘাড় থেকে ওই বোঝা নামল। বাবুজি, তারপর হল কী, মওলা বখ্শ দুই বছর রোগে ভুগে মারা গেল। ক’দিন পর পাহাতুনের নুলো শাশুড়িও চলে গেল। বুড়ি পাহাতুনের বিয়ের পর পুরো এক কুড়ি দশ আর দু’বছর বেঁচে ছিল। এক কুড়ি দশ আর দুই, এই এত বছর পাহাতুন তার খেজ্জ্মত করেছে।
‘একদিন রাত্রে পাহাতুন কাপড় ইস্তিরি করছিল। আল্লা জানে, কী করে ইস্তিরি থেকে আগুন বেরিয়ে তার কাপড়ে পড়ে। তাতে বেচারির হাঁটু পুড়ে যায়। সকাল পর্যন্ত সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। সকালবেলা আয়েশা তাকে ওই অবস্থায় দেখে নিজের মাথায় বাড়ি মারতে লাগল। আমরা ছুটে গিয়ে সবাই তাকে চারপাইয়ে তুলে শুইয়ে দিলাম ডাক্তার ডাকলাম। তার জ্ঞান ফিরে এল। কিন্তু আগের সেই পাহাতুন আর রইল না। বেচারি চারপাই থেকে নামতেই পারত না। মঙ্গলবারের রাতের কথা। পাহাতুন নিচে শুয়ে, আর ছাদের উপরে আয়েশা, তাজু, আর তাদের ছেলে। মাঝরাতে ছেলেটা কাঁদতে লাগল। আল্লা জানে, কেন সে অত কাঁদছিল। আয়েশার হল গিয়ে জোয়ান মানুষের ঘুম। সে বেঘোরে ঘুমোচ্ছিল। পাহাতুন আর থাকতে পারল না। পেখম ডাকাডাকি করল। তাতেও ছেলের কাঁদা থামল না দেখে সে উপরে গেল। আল্লা জানে, কী করে সে উপরে উঠল আর কী করেই-বা ছেলেকে কোলে নিল। আর আয়েশার ঘুম ভাঙাল। আয়েশা খুব রাগ করল। বলল, ‘মা, তোর মরার সাধ হয়েছে!’
‘সেই কথা তার সত্য হল। পাহাতুনের ঠাণ্ডা লেগে গেল। তারপর বৃহস্পতিবারের সন্ধেবেলা সে মরে গেল। সারাজীবন মানুষের খেমত করে আর উপকার করে শেষে মরেই গেল।’
মেহেরুনের গলা বুজে আসে। তার চোখে দুঃখের ছায়া। ওড়নার খুঁটে নাক মুছতে মুছতে সে অন্যদিকে মুখ ফেরাল।
আমি ভাবতে থাকি : পাহাতুন– মা মরে গেছে। এ হল সেই পাতাতুন-মা, যে বত্রিশ বছর নুলো শাশুড়ির সেবা করেছে। নিজের সতিনকে এমন সময় ঠাঁই দিয়েছে, যখন তার নিজের লোকে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তাকে পাথারে ভাসিয়েছে। সেই সতিনের মেয়ে যখন মায়ের বুকের দুধ থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়েছে, তখন তাকে নিজের বুকে তুলে নিয়েছে। দুবছর ধরে অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসার ব্যয় বহন করেছে। এ হল সেই পাহাতুন-মা, সে পঞ্চাশ বছর এই পাড়ায় ছিল, কিন্তু তার সম্পর্কে আমি শুধু এইটুকুই জানতাম যে, সে একজন ধোপানি আর খুব ঝগড়াটে মেয়েলোক।
মেহেরুন ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবুজি, তাইলে লিখে দাও চিঠি।’ আমি কাগজ নিয়ে লেখার জন্য প্রস্তুত হলাম। মেহেরুন চোখ বন্ধ করে ডান হাতের আঙুল দিয়ে চোখ দুটো টিপে ধরল। তার চোখের নিচের উঁচু গালের হাড় সিক্ত হয়ে উঠল। মেহেরুন তর্জনী ঘষে ভেজা গাল শুকিয়ে নিল। তারপর গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘চিঠি লেখা হল বাবুজি?’
‘হ্যাঁ, হল।’
চিঠি শেষ করে আমি ওর হাতে দিয়ে দিলাম। সে উঠে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করল। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আবার জিগ্যেস করল, ‘শহরে আজ এত ঝাণ্ডা কেন ঝোলানো হয়েছে, বাবুজি?’
‘ও, তুমি জান না? শেখ খয়রুদ্দিন মরহুমের আজ জন্মদিন যে।’
‘সত্যি? শেখ খয়রুদ্দিন? আমি তেনাকে দেখেছি। তিনি খুব জবর লোক ছিলেন। পাহাতুন তেনার কাপড় ধুত।’
মেহেরুন চলে গেল। আমি বক্তৃতা শেষ করার জন্য আবার কাগজের উপর ঝুঁকে পড়লাম। কিন্তু আমি তখন চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আমার চোখের সামনে পাহাতুনের বুড়ো মুখটা ভাসতে লাগল। মনে হল যেন তার ওই মুখের উপর শত শতাব্দীর স্বার্থহীন সেবার ধুলো জমা হয়ে আছে। সেই ধুলোর আস্তরণের ভেতর থেকে তার বোবা চোখ আমাকে কী-যেন প্রশ্ন করছে। আর, আমার মগজের ভেতর মেহেরুনের কথাগুলো ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে : ‘খায়রুদ্দিন খুব জবর লোক ছিলেন! পাহাতুন তেনার কাপড় ধুতো।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
হলুদ পাহাড় – গোলামুস্ সাক্লাইন নাক্বি
চৌরাস্তায় এসে পৌঁছাতেই মুহূর্তটা দুই ধারায় ভাগ হয়ে গেল।
দুই ধারা একে অন্যের উল্টো দিকে বইতে লাগল। সৃষ্টির প্রথমদিন থেকে যে-ছবি তার মননের দিগন্তে অঙ্কিত ছিল, সেটা হঠাৎ আলাদা হয়ে গেল এবং হলুদ পাহাড়ে পরিণত হল। একটা ধারা হলুদ পাহাড় থেকে দূরে সরতে লাগল। দ্বিতীয় ধারা তাকে হলুদ পাহাড়ের দিকে টানতে লাগল। আর, ভিড় চৌরাস্তার উপর থমকে দাঁড়িয়েছিল। কেননা সামনে তার পথ আগলে ছিল লাল বাতি।
অকস্মাৎ হলুদ পাহাড়ের চূড়া থেকে আওয়াজ ভেসে এল, ভ্ৰাতঃ! ভ্রাতঃ!’
রাস্তার ওপারে দীর্ঘ বাঁশি বেজে উঠল। সবুজ বাতি জ্বলে উঠল এবং ভিড় বিষম চঞ্চলতায় চৌরাস্তা পার হতে লাগল। তখন দুই ধারা হঠাৎ মিশে গেল। হলুদ পাহাড় তখন চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল। তখন রোদ-মগ্ন হলুদ সব পাথর ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না।
‘দেখতে পাচ্ছেন না, লাল বাতি জ্বলে গেছে?’
এই সতর্কবাণী শুনে সে ঠিক চৌরাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে পিটপিট করে রাস্তার ওপারের দৃশ্য দেখল। উঁচু উঁচু বিস্ময়কর সব অট্টালিকা ভিড়কে গ্রাস করে দাঁড়িয়ে ছিল। যন্ত্রের ঘূর্ণমান চাকার ঘড়ঘড় শব্দ তার কানে এসে লাগলে সে বলল, ‘যদি আমি চৌরাস্তা পার না-হই, তাহলে ফটক বন্ধ হয়ে যাবে– আমি বাইরে রয়ে যাব।’
‘যখন সবুজ সঙ্কেত হল, আপনি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রইলেন, আর লাল সঙ্কেতে চৌরাস্তা পার হতে চাইলেন। আপনার প্রাণের মায়া যদি না-ও থাকে, তবু ট্রাফিক মেনে চলুন।
‘পাগল-টাগল হবে।
‘চেহারা দেখে তো তা মনে হয় না। ‘
‘যখন সবুজ বাতি হল, ও আমার কাছে দাঁড়িয়েছিল।’
‘তারপর কী হল?’
‘হবে আর কী? দেখি, চোখ দিয়ে আকাশ হাতড়ে বেড়াচ্ছে। মনে হয়, দেখা যায় না এমন কিছু ও দেখছিল।’
‘বুঝি সারারাত জেগে কাটিয়েছে। এখন ঠিক চৌরাস্তার উপর ঘুম পেয়ে থাকবে।’
‘না, ও জেগেই ছিল। ওর চোখ খোলা ছিল। ওর চোখ দূর দিগন্তে আটকে ছিল। ও সবকিছুই দেখছিল। অন্তত আমি এইটুকু বলতে পারি, তার দেহখানা এই দুনিয়াতেই ছিল।’
‘কিন্তু তার আত্মা এই দুনিয়ায় ছিল না।’
.
সে একটা রোগা-পটকা মেয়ে। চৌরাস্তার এই দিকে এই ফুটপাতে তাকে প্রায়ই দেখা যায়। ভিড়ের মধ্যে তাকে একটু স্বতন্ত্র বলে মনে হয়। মাথা হেলিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে। তার হাতে একটা ছোট ব্রিফকেস্। ভিড়ের প্রত্যেকটা মানুষ তাকে একনজর অবশ্যই দেখে নেয়। সেইসব নজর থেকে সে এমনভাবে গা-বাঁচিয়ে চলে, যেন সেগুলো বিষ-মাখানো তীর। কিন্তু যারা তাকে দেখে, তাদের না-দেখেও উপায় নেই। তার ফ্যাকাসে অসুস্থ চেহারায় এমন একটা ভাব ফুটে থাকে যে, তা প্রত্যেক দৃষ্টিকেই তার দিকে টানে। তার চেহারা হাজারটা থেকে স্বতন্ত্র। আর, চেহারার ভিড়ে এমন চেহারাও মাঝে মাঝে দেখা যায়, যা সন্ধানী চোখদের নিজের দিকে আকর্ষণ না-করে পারে না।
তারপর, আর একদিন যখন মুহূর্তের ধারা দু’ভাগে ভাগ হতে যাচ্ছিল, সেই সময় সে তার কাছে এসে থেমে গেল। চৌরাস্তার মাথায় ভিড় অস্থিরভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। মুহূর্ত দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। হলুদ পাহাড় প্রকৃতির বুক চিরে বেরিয়ে এল। তার মাথা আকাশে গিয়ে ঠেকল।
তা করতে করতে সেই পাহাড়ের দিক থেকে আওয়াজ ভেসে এল, ‘ভ্ৰাতঃ! ভ্ৰাতঃ!’ প্রত্যেকে ভাবল, ‘ধ্বনির পর্বত’ থেকে তার ডাক এসেছে। চৌরাস্তার সবুজ বাতি জ্বলে উঠলে হলুদ পাহাড়ের গগনস্পর্শী চূড়ার দিকে সবাই রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে লাগল। কিন্তু তাদের পাগুলো মাটির সঙ্গেই লেগে রইল। যতক্ষণ পর্যন্ত-না ধ্বনির পর্বত থেকে ডাক আসে, কারও পা মাটি থেকে মুক্ত হতে পারে না। ভিড় চৌরাস্তা পার হতে হলুদ পাহাড় মিলিয়ে গেল। তখন মুহূর্ত শেষ হয়নি, খুট্ করে লাল বাতি জ্বলে উঠল। সে চলার জন্য পা ফেলতেই ফ্যাকাসে চেহারার অসুস্থ মেয়েটি বলল, ‘দাঁড়ান।
সে দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘মাফ করবেন। এক্ষুনি সবুজ বাতি জ্বলবে। তখন আমরা দুজনে চৌরাস্তা পার হব।’ সেই মেয়ে নত চোখ তুলে তার চেহারার ওপর বুলিয়ে নিল |
তার দুই চোখ ছিল অসুস্থ আর ঘুমে ঢুলু-ঢুলু। কিন্তু তা থেকে সহমর্মিতা আর করুণার যে ধারাবর্ষণ হচ্ছিল, তাতে তার অন্তর ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার, পবিত্র হয়ে উঠেছিল।
তারা দুজনে পাশাপাশি চৌরাস্তা পার হয়ে গেল। যে বিন্দুতে তাদের পথ আলাদা হচ্ছিল, সেখানে সে জিগ্যেস করতে চাইল, ‘আপনিও কি হলুদ পাহাড়ের আওয়াজ শুনতে পান? হলুদ পাহাড়ের রহস্য কি আপনার জানা?’ কিন্তু সে ভাবল, ওই রহস্য আমার নিজে নিজে জানা দরকার।
মেয়েটি নীরবে নিজের পথে চলে গেল।
‘মেয়েটা কে হে?’
‘আমি তো জানি না।’
ফুটপাত ধরে যখন হাঁটে, কারও দিকে তাকায় না।’
‘কেমন অসুস্থ অসুস্থ মনে হয়।’
‘অসুস্থের ওই রূপ আমায় বড় টানে। ওর বড় বড় চোখ কেমন উদাস, তাই না? ওইখানেই তো ওর আকর্ষণের রহস্য হে।’
‘তাহলে যাও, ওর পিছু নাও। অফিসে পৌঁছাতে ওর নিশ্চয় কখনো দেরি হয়, কিংবা ঘরে ফেরার তাড়া থাকে। গাড়িতে লিফটের অফার দিয়ে দেখ।’
‘না, ও ভড়কে যাবে। কোনো কারখানায় বোধহয় ও টাইপিস্ট হবে। খোঁজ কখনো-না কখনো পেয়ে যাবই। আচ্ছা, ওর সঙ্গে আর একজন লোক কে ছিল বটে?’
‘কেন, কালকের সেই দার্শনিক? চিনতে পারেননি?’
‘ঠিক ট্রাফিক-দুর্ঘটনায় পড়বে একদিন, দেখে নিও।’
‘তাতে আপনার কী?’
‘হ্যাঁ, আমার কী?’
.
‘মা, জেগে আছিস?’
‘হ্যাঁ, বাবা।’
‘আমাকে আজ ছাদে নিয়ে যাবি, মা?’
‘তুমি যে অসুস্থ, বাবা। অতগুলো সিঁড়ি ভেঙে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়বে।’
‘কতকাল আমি ধ্বনির পর্বতকে সূর্যের আলোয় জন্ম নিতে দেখিনি।’
‘ধ্বনির পর্বত?’ তার ভরা পেয়ালার মতো দুই চোখ। সেখানে অসুস্থতার পিঙ্গল আলো ঝলমল করছে। বিস্ময়ে সেই চোখ বিস্ফারিত হল।
‘ধ্বনির পর্বত হচ্ছে সেই পর্বত, যার দুর্গের সব দেওয়াল আকাশে গিয়ে ঠেকে রয়েছে। সেখান থেকে আপনাআপনি আওয়াজ আসে। কেউ কেউ তাকে ‘দিনের হলুদ পাহাড়’ বলে। আমি কালের প্রহরী, তবু এখনো তার রহস্যভেদ করতে পারিনি।’
‘বাবা, তুমি আজ এসব কেমনধারা কথা বলছ?’
‘হলুদ পাহাড় থেকে মাঝে মাঝে কারও কারও ডাক আসে। সেই ডাকের আওয়াজ শুনতে পায় সবাই। কিন্তু আমরা তার সঙ্গে যেতে পারি না। সে একলা ওই পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে অদৃশ্য হয়ে যায়। ওপারের অবস্থা কারও জানা নেই, মা। আমায় ছাদে নিয়ে যাবি? হয়তো কালের এই প্রহরীর কাছে আজকেই ধ্বনির পর্বত থেকে ডাক এসে যাবে।’
অসুস্থ যৌবন বার্ধক্যের হাত ধরল। কেননা সেই তার একমাত্র অবলম্বন। অসুস্থ দুই চোখের পক্ষ্ম শিশিরে টইটম্বুর ছিল। ছাদের উপর প্রত্যূষের ঝাপসা আলো। পূর্বাচলের আঁচল কেঁপে উঠল। একটি অগ্নিশর নিক্ষিপ্ত হল, আর পূর্বাচলের আঁচলে আগুন লেগে গেল। তখন সূর্যোদয় হল। বার্ধক্যের ঠোঁট কেঁপে উঠল, ‘আমায় নিচে নিয়ে চল্, মা। এখনো আমার ডাক আসেনি।
অসুস্থ যৌবন বার্ধক্যের হাত ধরে তাকে নিচে নামিয়ে আনল।
‘মা, তুমি যখন সন্ধ্যায় ফেরো, ক্লান্তিতে একেবারে ভেঙে পড়, সেই অবস্থায় আবার তোমায় রাঁধতে যেতে হয়। ছোট ভাইগুলোর দেখাশুনো করতে হয়। তোমার মাইনের পয়সায় দু’বেলা দু’মুঠো জুটে যায় অনেক কষ্টে। বুড়োর বোঝা আর কতকাল বইবি, মা। আমাকে আমার হাতে ছেড়ে দে। নিজের মাইনের অর্ধেকের বেশি যা তুই আমার রোগ-ব্যাধি বার্ধক্যের পেছনে ঢালিস তা নিজের জন্যে খরচ কর।’
‘না বাবা।’
.
‘আপনি আবার থেমে পড়েছিলেন?’ সে জিগ্যেস করল।
‘হ্যাঁ, বড্ড বেশি ভিড়। ভাবলাম, ভিড় কমে যাক, তখন চৌরাস্তা পার হব।’
‘ধ্বনির পর্বত থেকে যে আওয়াজ আসে, আপনিও তা শুনেছেন?’
‘ধ্বনির পর্বত?’ সেই মেয়ে অবাক হয়ে তাকে দেখতে লাগল।
‘হ্যাঁ, দিনের হলুদ পাহাড়। সেই পাহাড় এখনি দিগন্তের কিনারায় মাথা তুলেছিল।’
‘দিনের হলুদ পাহাড়?’ মেয়েটি অবাক হয়ে আবার জিগ্যেস করল।
‘আমি ঠিক মুহূর্তটিতে তাকে প্রত্যেকদিন মাথা তুলতে দেখি।’
‘আপনি সেই আওয়াজ শুনেছেন?’
‘আমি প্রত্যেকদিন সেই আওয়াজ শুনি। প্রত্যেকে শোনে। সবাই ভাবে, সেই আওয়াজ তাকেই ডাকছে। এইজন্যেই তো গোটা ভিড় তার দিকে ছুটে যায়। কে জানে, এত বড় শহরে সেই আওয়াজ এখন কাকে ডেকেছিল, আর কে তারা চূড়ায় পৌঁছে অন্য পারে চলে গিয়েছে। ভিড় ওই পাহাড়ের নিচে গিয়ে দাঁড়ালেই পাহাড় চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে যায়।’
‘আর আপনি?’
‘আমি যখনি আওয়াজ শুনি, লাল বাতি আমার পথরোধ করে। দেখতে দেখতে একদিন আমি আর লাল বাতির তোয়াক্কা করব না। ওপারের ডাক ধীরে ধীরে আমার রক্তে ইচ্ছার আগুন জ্বালছে।’
‘কই, আমি তো ও-পাহাড় দেখতে পাই না। ‘
‘আপনি তাকে প্রত্যেক দিন দেখেন, কিন্তু আপনার চোখের সামনে তা অদৃশ্য থাকে।’
‘আপনার কথা বুঝতে পারলাম না তো।’
‘আগে আমিও বুঝিনি। একটি মুহূর্ত দুই ধারায় ভাগ হয়ে যায়। একটি ধারা ধ্বনির পর্বতের উলটো দিকে চলে যায়, অন্য ধারা তার নিচের দিকে বয়ে যায়। সেই মুহূর্ত যখন আসবে, তখন…’
একটি গাড়ি তাদের কাছে এসে ফুটপাতের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘মহিলা, আপনি এ কোন দার্শনিকের পাল্লায় পড়েছেন?’ একটি অতিরিক্ত ভদ্র আওয়াজ শোনা গেল।
‘আপনি কে?’ মেয়েটি প্রশ্ন করল।
‘আমি পথচারী। ওই দার্শনিককে রোজ ফুটপাতে দেখি। মানুষকে ও পথভ্রষ্ট করে।’
‘আমাকে আমার পথে চলতে দিন। ধন্যবাদ।’
‘আমি দেখতে পাচ্ছি, আপনি অসুস্থ। তবু আপনি বাধ্য হয়ে কাজে যান। আপনার আঙুল দেখে মনে হয়, আপনি টাইপ করেন। টাইপ করলে বুকে দোষ হয়। এমনিতে আপনি ভালো খাদ্যের অভাবে রক্তাল্পতায় ভুগছেন। আমার পরামর্শ… ‘
‘আপনার পরামর্শ আমার লাগবে না। ধন্যবাদ।’
‘তবু যদি কখনো দরকার মনে করেন– আমি ওই সামনের মোড়ে প্রতিদিন গাড়ি দাঁড় করিয়ে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করব। পরামর্শ দেয়ার ব্যাপারে আমি ধৈর্যধারণ করতে অভ্যস্ত।’
সেই মেয়ে দুই হাতে দুই কান চেপে ধরে বলল, ‘না না-আপনার পরামর্শ আমি চাই না।’
‘কে ভদ্রলোক?’ সে মেয়েটিকে জিগ্যেস করল।
‘পথচারী।‘
মনে হচ্ছে ওঁর এখনো হলুদ পাহাড় দেখার ভাগ্য হয়নি।’
‘চলুন, সবুজ বাতি জ্বলেছে।’
‘বাবা, হলুদ পাহাড়ের ওদিকে কী আছে?’ সে হঠাৎ জিগ্যেস করল।
‘সে রহস্য আমার জানা নেই, মা।’
‘সেদিন তুমি বলছিলে, তুমি কালের প্রহরী?’
‘হ্যাঁ, আমি কালের প্রহরী। প্রত্যেক মানুষই কালের প্রহরী। কিন্তু যদ্দিন-না ধ্বনির পর্বত থেকে তার ‘দ্বিতীয় সত্তা’র ডাক আসে, সে তার রহস্য জানতে পারে না।‘
‘দ্বিতীয় সত্তাটা কী, বাবা?’
‘আমি তা জানতে পারিনি।’
‘কেউ কি জানতে পেরেছে?’
‘শোনা যায়, ইয়েমেনের এক শাহ্জাদা হাতেম পেরেছে। ধ্বনির পর্বতের খোঁজে তার পাদদেশে গিয়ে পৌঁছালে সে তার এই দ্বিতীয় সত্তা পেয়েছিল। কাহিনীতে এইরকম বলা হয়েছে : মোটকথা, সেই শহরে হাতেমের ছ’মাস কেটে গেল। আর সেই সময়ের মধ্যে ওইরকম পনেরো জন মানুষ ওই পাহাড়ের দিকে গেল, তারপর আর ফিরল না। ঘটনাক্রমে হাতেম নামে এক ব্যক্তি সেখানে ছিল। হাতেমের সঙ্গে তার খুব বন্ধুত্ব ছিল আর তাদের মধ্যে গভীর প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই কারণে তারা দুজন চব্বিশ ঘণ্টা এক জায়গায় থাকত।’
‘তারপর?’
‘যে হাতেমের দ্বিতীয় সত্তা ছিল, ধ্বনির পর্বত থেকে তার ডাক এল। সে চূড়ার দিকে ছুটল। তখন হাতেম ভাবল, সে-ও ওইদিকে চলে যাবে। সে মনে মনে বলল, দুঃখের বিষয়, ওর সঙ্গে আমার খুব বেশি ভালোবাসা আর ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। এখন সে-ও ছেড়ে যাচ্ছে। না, আমি ওকে কিছুতেই ছাড়ব না। এইকথা বলে সে কষে কোমর বাঁধল। এবং তার হাত ধরে পাহাড়ের দিকে ছুটল। পড়ি-মরি করে দুজনে পাহাড়ের উপর গিয়ে পৌঁছাল।’
তার বাবা থেমে তার দিকে নজর ফেলল। অসুস্থ মেয়ের দুটি চোখের পক্ষ্ম বিস্ময়ের ঝিলে ডুবে ডুবে কাঁপছিল।
‘তারপর কী হল?’ মেয়ে জিগ্যেস করল।
বুড়ো বাপের কানে তার গলা বড় রহস্যময় ঠেকল। সেই আওয়াজ যেন অজানা যাত্রায় পা রেখেছে এমন কোনো যাত্রীর আওয়াজ– যার চোখের সামনে কোনো বিস্ময়কর জগতের একটি জানালা একটু উন্মুক্ত হয়ে গেছে।
‘যেই সেই দুর্গের কাছে গেছে, একটি ছোট দরজা দেখা গেল, এরা দুজন পড়ি-মরি করে তার ভেতর ঢুকে পড়ল। মানুষের চোখের সামনে থেকে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুদূর গেলে পাওয়া গেল নিঝুমপুরী। একটা সবুজ প্রান্তর দেখা গেল– যেন পান্নার চাদর চারদিকে বিছানো রয়েছে। কিন্তু অল্প একটু জায়গা খালি পড়ে ছিল। সেই যুবক সেখানে পা রাখতে গেল। পা রাখতেই জমি ধসে পড়ল, মাটি ফাঁক হয়ে গেল। সে তাতে তলিয়ে গেল। অমনি সেই স্থানটুকুও সবুজ হয়ে উঠল।’
‘হাতেমের দ্বিতীয় সত্তার যখন সবুজ প্রান্তরে ঠাঁই হয়ে গেল, তখন হাতেমের কী হল?’ মেয়ে জিগ্যেস করল। তখন তার আওয়াজে জীবনের দর্শনের আকাশ থেকে অবতীর্ণ একটি আলোকবিন্দু কাঁপছিল।
বৃদ্ধ বাবা বলল, ‘হাতেম সেখান থেকে যাত্রা শুরু করে এক বিরাট সমুচ্চ পর্বতের পাদদেশে গিয়ে পৌঁছাল। সেখানে সে যে-পাথরই ওঠাল, দেখল, রক্ত। বারো দিন পর সেই পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছাল। হাতের কাছে একটা মাঠ দেখা গেল। সেখানে মাটি আর জীব-জন্তু-পাখি কলহ, বিবাদ আর খুনোখুনি করে রক্ত ঝরাচ্ছে। বারো মাইল আরো গিয়ে দেখতে পেল এক রক্তের নদী। বড় দুশ্চিন্তা হল, সেই নদী সে কেমন করে পার হবে।’
নদীটা কি সে পার হতে পেরেছিল?’
‘আসল কথা, দ্বিতীয় সত্তার নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে মানুষ আবার হলুদ পাহাড়ের দিকে ফিরে আসে, সেখানে দিগন্তবিস্তৃত সমতল মাঠ রয়েছে, রক্তের নদীতে ঢেউ উঠছে-পড়ছে, যেখানে পথের দিশা খুঁজে পাওয়া যায় না, যেখানে পানির বা খাদ্যের কোনো চিহ্ন নেই, এমন একটা গাছও নেই যার ছায়ায় মানুষ দুদণ্ড বিশ্রাম নিতে পারে।
মেয়ের ফ্যাকাসে মুখে আশার যে-আলোটুকু মিটমিট করে জ্বলে উঠেছিল, তা আবার নিভে গেল।
মা, যখন ধ্বনির পর্বত থেকে ডাক আসবে, তখন আমি সবুজ প্রান্তরের আকাঙ্ক্ষার পাহাড়ের চূড়া অতিক্রম করে যাব। তারপর সেই রহস্য আমার সঙ্গে সমাহিত হয়ে যাবে। কারণ, সে সময় আমি আর আমি থাকব না। অবশ্য আমি হলুদ পাহাড়ের ওপারের রহস্য পুরোপুরি জেনে যাব।’
‘ওপারের রহস্য কী, বাবা?’
‘ওপারে রয়েছে যন্ত্রের ঘড়ঘড়, ঘামের গন্ধ, অসুস্থ মানুষের ক্ষতের পূতিগন্ধ, গলিত দেহ আর বিক্ষিপ্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, বাসি ঠোঁট আর মথিত ফুল, পোকায়-খাওয়া লাশ…’
‘বাবা–।’ সে হাতে হাত জড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল।
‘আমি একটা পাষণ্ড। হলুদ পাহাড়ের রহস্য কেন তোকে জানালাম আমি। আমার পোকায়-খাওয়া বার্ধক্যের কেন করুণা হল না তারুণ্যের ওপর। আমি এ কী করলাম, কালের প্রহরী হয়ে ধ্বনির পর্বতের রহস্যের যবনিকা আমি কেন তুললাম? সেই অজানা গন্তব্যের দিকে প্রত্যেকেরই তো আপন আপন বোধি অনুসারে নিজে নিজেই এগিয়ে যাওয়া উচিত।’
পরদিন যখন ভোরের আলো ফুটল, সকাল হল, তখন সেই অসুস্থ চেহারার মেয়েটির সামনে হলুদ পাহাড় বুক ফুলিয়ে এসে দাঁড়াল। তার কমল-আঁখি প্রভাতের বিষণ শিশিরের বদলে হলুদ রোদের কাল সাপের ভয়ে আতঙ্কিত হল।
‘মা, আমি বুঝতে পারছি, এবার আমার ডাক আসার সময় হয়েছে।’
‘অমন কথা বোলো না বাবা, অমন কথা তুমি বোলো না!
ভিড় হলুদ পাহাড় থেকে আসা ধ্বনির জন্য অপেক্ষা করছিল, সেই সময় ওরা দুজন ফুটপাতে এসে মিলল।
‘আসুন, চৌরাস্তা পার হই।’ মেয়েটি বলল।
এক-পা বাড়িয়ে সে চকিত আওয়াজে বলল, ‘দাঁড়ান!’
সে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সে জিগ্যেস করল, ‘আচ্ছা, আপনার চোখের সেই কেমন অসুস্থ উদাস ভাব কোথায় গেল?’
‘আমি জানি না।’
‘একটু আগেই আমি আপনার চোখে ভয়ের কাল-সাপকে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে থাকতে দেখেছিলাম। সেটা কি আমার কল্পনামাত্র?’
‘না।’
‘তাহলে বুঝি আপনিও হলুদ পাহাড় দেখতে পেয়েছেন?’ কিছু বলার জন্যে মেয়েটির ঠোঁট ফাঁক হল। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে শব্দ শোনা গেল, ‘ভ্রাতঃ! ভ্ৰাতঃ!’
ভিড় হলুদ পাহাড়ের দিকে ছুটল। মেয়েটির ঠোঁট কেঁপে কেঁপে থেমে গেল।
সে ভয় পেয়ে যুবকের হাত চেপে ধরল। তারপর জিগ্যেস করল, ‘ওই ডাক কার জন্যে, বলুন!’
‘আমি বলতে পারি না। অত বড় ভিড়ের মধ্যে থেকে তাকে আমি কেমন করে চিনব?’
‘ওই ডাক যখন বাজছিল, তখন আমি একটা মূর্তি দেখেছি। সে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। যখন ডাক এল, তার চেহারা লাল হয়ে উঠল। হলুদ পাহাড়ের দিকে সে ছুটে গেল। কে সে? কে সে?’
‘আমি তাকে দেখিনি। হবে কোনো কালের প্রহরী।’
‘কালের প্রহরী? হ্যাঁ, আমি তাকে চিনেছি।’
‘কে?’
‘সে বহুদিন থেকে হলুদ পাহাড়ের চূড়ার ওপারে যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে ছিল। আজ খুব সকালে সে আমাকে বলেছিল : মা, আমি বুঝতে পারছি, আজ ধ্বনির পর্বত থেকে আমার ডাক আসবে।’
‘তাহলে তো ওই ডাক তার জন্যেই ছিল।’
‘হ্যাঁ। মাফ করবেন, আজ আমি আর চৌরাস্তা পার হব না। আপনি যান।’
সেই মেয়ে মুখ ফেরাল। লাল বাতির পর সবুজ বাতি হল। সে চৌরাস্তা পার হওয়ার অনুমতি পেয়েছিল। কিন্তু তার পা এগুতে পারল না। মেয়েটির পেছনে পেছনে সে চলতে লাগল।
.
‘মহিলা, আপনার বড় কষ্ট হচ্ছে।’ ঠিক পেছনে গাড়ি এসে থামল। মেয়েটি কোনো কথা বলল না।
‘আপনার খুব তাড়া। দাঁড়ান।’
‘না। সে মৃদু গলায় বলল।
‘আমায় আপনার সেবার সুযোগ দিন। দেখুন, আমার গাড়ি প্রস্তুত রয়েছে। কড়া রোদ। আপনার ঘরও এখান থেকে অনেক দূর।’
‘দূর তো বটেই।’ তার পায়ের জ্বলন্ত পাতা থেকে যেন কথাটা এল।
‘তাহলে আসুন-না আমার গাড়িতে। আমি আপনাকে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দি।’
‘দাঁড়ান। একটু দাঁ– ড়া– ন!’ দূরে কেউ তাকে ডাকল।
‘ওই দার্শনিকটার কথায় কান দেবেন না, মহিলা– দেবেন না। ও আপনাকে তার কথার ফাঁদে ফেলবে। আপনার গন্তব্যে ও আপনাকে পৌঁছাতে দেবে না। আপনি শ্রান্ত। ফুটপাত তেতে উঠছে। আপনার পায়ের তলা জ্বলছে।’
‘একটু দাঁড়ান! আমি আপনার সঙ্গে যাব। এই যাত্রায় আপনার একজন সঙ্গী দরকার। এখনি এক জনহীন ভয়ঙ্কর মাঠে গিয়ে পড়বেন। সেখানে না-কোনো সবুজের চিহ্ন পাবেন, না-ছায়া। তার ওপর এক রক্তের নদী– তাতে রক্তের ঢেউ।’ দার্শনিক পেছন থেকে বলল। ‘আমার গাড়ি খুব দ্রুত ছোটে। আমি এটাকে একশো মাইল গতিতে চালাতে পারি। এক মিনিটে…।’
মেয়েটি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পড়ল। বড়ই শান্ত কণ্ঠে জিগ্যেস করল, ‘আপনার গাড়ি রক্তের নদী পার হতে পারবে?’
‘অ্যাঁ? কী বললেন আপনি?’
‘হলুদ পাহাড়ের চূড়ার ওদিকে রক্তের যে-নদী আছে, সেই নদী।’
‘আমি কোনো হলুদ পাহাড়ের কথা তো শুনিনি কখনো।’
‘আমি বলেছিলাম-না–এখনো হলুদ পাহাড় দেখার ভাগ্য ওর হয়নি।’
চুপ কর, হাম্বাগ দার্শনিক! এই মেয়েটিকে তুমি ফুলানি দিচ্ছ! মহিলা, আপনি ওর ধোঁকায় পড়বেন না। আমি দেখতে পাচ্ছি, আপনি বড় দুঃখী। অন্যের দুঃখ আমি চট্ করে দেখতে পাই। আমাকে বিশ্বাস করুন। আমি আপনাকে সুখ দিতে পারি।’
‘কিন্তু– রক্তের নদী?’
‘রক্তের নদী? কোথায় রক্তের নদী? ওই দার্শনিকটা আপনার ওপর জাদু চালিয়েছে এখানে রক্তের নদী-টদী কিছুই নেই। আমার বাড়ি পর্যন্ত যে-রাস্তা গেছে, তা একেবারে সোজা, পরিষ্কার। সেই রাস্তার দু’পাশে ইউক্যালিপ্টাসের ছায়া। আমার বাড়ি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সেখানে সবুজ, সতেজ লন রয়েছে। আমার ড্রয়িং-রুমে সুন্দর সুন্দর ছবি। যে-কোনো ক্লান্ত পথিক, যে-কোনো দুঃখী আত্মা সেখানে গিয়ে আরাম আর শান্তিতে মগ্ন না- হয়ে পারে না।
‘কিন্তু আমার গন্তব্য যে হলুদ পাহাড়ের ওপারে। সেখানে রক্তের নদীতে প্রবল ঢেউ। আপনি কি সেখান পর্যন্ত আমাকে সঙ্গ দেবেন?’
‘আমি… না তো… পাগল মনে হচ্ছে। তুমি আমার বড্ড সময় নষ্ট করে দিলে। এই প্রথমবারের মতো আমি বুঝতে পারলাম, আমার দরদ, আমার ব্যথা, আমার আবেগ কেমন এক মুহূর্তে ভেঙে খানখান হয়ে গেল। তবে যাও, গিয়ে রক্তের নদীতে ডুবে মর। আমি– আমি– চললাম।’ ক্রোধান্বিত হয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে সে চলে গেল।
আর, মেয়েটির উদাসীন ভয়ার্ত চোখ প্রদীপের মতো মিটমিট করে জ্বলতে লাগল। তখন উদাসীন চোখে তার দিকে তাকাল, যে ছিল কালের প্রহরী, যে ধ্বনির পর্বতের রহস্য জানার জন্য তার সঙ্গে যেতে প্রস্তুত। এ হচ্ছে সেই ধ্বনির পর্বত, যেখানে থেকে এখনি একজন কালের প্রহরীর ডাক এসেছে আর সে হলুদ পাহাড়ের চূড়া পার হয়ে চলে গেছে। ধ্বনির পর্বতের ওপারে সবুজ প্রান্তর– সেখানকার এক টুকরো শূন্য জমিতে সে তলিয়ে গেছে, তারপর সেই জমিটুকুকে পান্নার মতো সবুজেরা এসে ঢেকে ফেলেছে। আর তার সামনে রক্তের নদী।— মেয়েটির শরীরে কাঁপন লাগল। তার রং ফ্যাকাসে হয়ে গেল। দার্শনিক এগিয়ে এল। মেয়েটির হাত সে ধরতে চাইল, এমন সময় মুহূর্ত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল।
হলুদ পাহাড় আকাশের বুক চিরে মাথা তুলে দাঁড়াল।
সে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘আজকেই আমি আমার যাত্রা শুরু করে দেব। অজানা গন্তব্যের পথে আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন তো?’
মেয়েটি কয়েক মুহূর্ত কোনো জবাব দিল না। তারপর সে হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘এই যাত্রায় সবাইকে একলাই পথ চলতে হয়।
‘না।’
মেয়েটি মন্দ আওয়াজে বলল, ‘না।’
‘এ যাত্রায় একা পথ চলা যায় না। পথ দেখানোর জন্য দ্বিতীয় সত্তার প্রয়োজন।’
‘দ্বিতীয় সত্তা!’
সে মেয়েটির মুখের ওপর তার দৃষ্টিকে স্থাপন করল।
বিষণ্ন চেহারা আস্তে আস্তে আকাশে মিলিয়ে গেল। হলুদ রোদের রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠল। তখন তার মনে হল, ফুটপাতের উপর যেন সে একা দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর মেয়েটির আপাদমস্তক তার আত্মার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। সে চোখ খুলল।
তারা দুজন হাতে হাত রেখে হলুদ পাহাড়ের প্রান্তে দাঁড়িয়েছিল।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
নিখোঁজ – খোদেজা মস্তুর
সে যদি একলা হত, তবু কথা ছিল। পাথরের দেওয়ালে মাথা ঠুকে আবর্জনার মতো তুচ্ছ এই জীবনটাকে শেষ করে দিতে পারত। কিন্তু আরো তিনটি প্রাণী রফিকের জীবনের কণ্ঠহার। কণ্ঠহারে ওরা তিনজন তিনটি মোতির মতো– একটিকেও সে এই মালা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না।
বিয়ের পর তাদের সেই প্রখর যৌবনের দিনে তারা ছিল সন্তানের কাঙাল। আল্লার কাছে কত কাকুতিমিনতি করেছে, কত মোনাজাত করেছে সন্তানের জন্য, কিন্তু তা পূর্ণ হয়নি। তারপর, যৌবন যেন ক্ষণস্থায়ী, তা যখন ফুরিয়ে যাচ্ছে, তখনো তারা নিঃসন্তান। আল্লাকে স্মরণ করার কথাও তখন ভুলে গিয়েছে। পাড়া-প্রতিবেশীরা এই অসহায়তা দেখে বুঝিয়েছে, ‘রফিক মিয়া, দোয়ার জোরে পাথরও গলে যায়– আর তোমার এই সামান্য আরজি আল্লা শুনবেন না, তা কি কখনো হতে পারে। নিরাশ হয়ো না, খাঁটি মন নিয়ে আল্লাকে ডাক। ডাকার মতো করে ডাক, তাহলেই পাবে।’ কিন্তু রফিকের মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। পাড়ার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের খেলতে দেখলে কখনো কোলে তুলে নিতে ইচ্ছা করে, আবার কখনো বিষাক্ত হয়ে ওঠে মন। নিজের একটা সন্তান লাভের ইচ্ছার অপূর্ণতা গোটা বিশ্ব-সংসারের প্রতি তার মনকে করে তোলে বিরূপ। এমনি সময়ে হঠাৎ একদিন রফিকের বউ দাঁতের ডগায় ওড়নার আঁচল চেপে ধরে
লজ্জারাঙা হয়ে বলল, ‘তোমার দোয়া আল্লা কবুল করেছেন।
একটা পেয়েই তাদের আনন্দের সীমা ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয় বছরেই আরো একটা যখন এল, তখনো তারা আল্লার উদ্দেশে মাটিতে মাথা রেখে তাঁর হাজার শুকুর আদায় করল। রফিক নিজেই যেন একটা ছোট শিশু তেমনি শিশুর মতো করেই সে আনন্দ যতই খারাপ হোক– গরিবের আনন্দ প্রকাশ করে বেড়াতে লাগল সর্বত্র। অবস্থা বাঁধনহারা। এ কথাও তার স্মরণ থাকে না যে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ করার শক্তিও ফুরিয়ে এসেছে : অল্পতেই হাত-পা ক্লান্ত হয়ে আসে। এই ক্ষুদ্র দুটি প্রাণকে বড় করে তুলতে এক যুগ সময়ের দরকার। আর, এক যুগ সময় কাটানোর জন্য দরকার অনেক টাকা-পয়সার।
যখন সুদিন ছিল আর গায়ে ছিল জোয়ানির তাকত, তখন মজুর খেটে অনেক পয়সা সে আয় করেছে। তখনকার সঞ্চয় এই বেকারত্বের দিনেও ওরা খরচ করে আসছে। সঞ্চয় এমন কিছু নয়– ভালোভাবে খেলে-পরলে এক বছরের বেশি যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু রফিকের বউ শুকনো রুটি খেয়ে এমনভাবে খরচ চালিয়েছে যে, এতদিন পর্যন্ত তা টেনে আনা গেল। কত কষ্ট স্বীকার করেছে, কিন্তু স্বামীকে একটা কথা বলেনি। কারণ, সে নিজের চোখে দেখছে, কাজের খোঁজে সারাদিন লোকটা কেমন পই পই করে ঘোরে। হাঁটুর ব্যথায় যার চৌ-প্রহর বিছানায় পড়ে থাকার কথা, সে আরাম কাকে বলে জানে না।
কিন্তু আর তো চুপ থাকা যায় না। পানি যখন গলা পর্যন্ত উঠেছিল, তখনো রফিকের বউ কিছুই বলেনি; এখন মাথাটাই ডুবতে বসেছে, কেমন করে চুপ থাকে। খাবার সময় হলে সবাই তো তার কাছেই আসবে। কাজেই তাকে বলতে হল, ‘আজকের দিনটাও কোনোরকমে কাটল, কাল সকালে কিন্তু চুলো জ্বলবে না।’
শুনে রফিকের চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এল। মনে হল, শ্মশান থেকে উঠে আসা একসারি কঙ্কাল তার চোখের সামনে নৃত্য জুড়ে দিয়েছে।
সাত-সকালে উঠে সে বাইরে বেরুল। পাড়া-প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে উনুন জ্বলছে। তারই ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশপানে ছুটছে। এই ধোঁয়া আজ তার রান্নাঘরের চাল থেকে বের হবে না ভাবতেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। ছেলেদের আজ সে কেমন করে খেতে দেবে, চতুর্দিকে একবার করে সে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। এ-পাড়ার সব কুঁড়েঘর তার চেনা। কিন্তু কেমন করে গিয়ে সে বলবে, আজ আমাদের ঘরে উনুন জ্বলেনি। আজ পর্যন্ত কখনো সে হাত পাতেনি কারও কাছে। কোনো দোকানে গিয়ে আটা ডাল ধার চাইবে, সেরকম মনোবলও তো তার নেই।
দোকানের কথা ভাবতেই সামনের মোড়ের মওলা মুদির দোকানের কথা তার স্মরণ হল। তার সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা অনেক দিনের। নিজে লেখাপড়া জানে না, কিন্তু খবরের কাগজে চুরি-ডাকাতি, লোমহর্ষক রাহাজানি, নারী হরণ, বাজার-দর ইত্যাদি খবর শুনতে মওলা মুদির খুব ভালো লাগে। রফিক নিজেও বিশেষ লেখাপড়া জানে না; কিন্তু কোনোরকমে উর্দুটা পড়ে নিতে পারে। প্রত্যেকদিন সকাল বেলায় গিয়ে মওলাকে সে খবরের কাগজ পড়ে শুনিয়ে দিয়ে আসে। এই সুবাদেই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। আর, খবর শোনার নেশা মওলার এত যে, হাড়-কিপটে হলেও খবরের কাগজটা সে রোজ নিজের পয়সা দিয়েই কেনে।
কিন্তু মওলা মুদির দোকান আজ এখনো বন্ধ। হয়তো এখনো সময় হয়নি– রফিক এসে গেছে অনেক সকালে। ওর দৃঢ় বিশ্বাস, কোনোরকমে লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে চাইতে পারলে ধারে জিনিস সে দেবে। খবরের কাগজ পড়ে দেওয়া ছাড়াও সে আরো কত কাজ করে দেয় মওলার। কাজেই সে আশায় বুক বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকল দোকান খোলার অপেক্ষায়।
মওলা মুদি এল খবরের কাগজ বগল-দাবা করে প্রায় দশটা বাজিয়ে। খবরের কাগজ হাতে নিয়ে রফিক গিয়ে বসল তার নির্দিষ্ট ভাঙা চেয়ারটায়। পড়তে শুরু করে দিল। কিন্তু আজ আর পড়ায় মন নিবিষ্ট করতে পারছে না। জানা শব্দও আজ তাকে বানান করতে হচ্ছে। এইভাবে কোনোরকমে দায় সেরে সে মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকল। তার ধারণা, এইরকম গুমটি মেরে বসে থাকলে মওলা কারণ জানতে চাইবে। কিন্তু মওলা মুদি নিজের কাজে ব্যস্ত। ধুলো ঝাড়ার কাজ শেষ করে এখন সে হিসাবের খাতা দেখতে বসে গেল। অনন্যোপায় হয়ে রফিক কথাটা পাড়ল।
শুনে মওলা মুদি খুব ইতস্তত করতে লাগল। তারপর তার কাছে যখন কড়ার করল যে, যেমন করে হোক, আজ সন্ধ্যার মধ্যে দাম দিয়ে দেবে, তখন মওলা তাকে দু’সের আটা আর এক পোয়া ছোলার ডাল ওজন করে দিল।
সওদা নিয়ে রফিক যখন যাওয়ার জন্য প্রস্তত হচ্ছে, মওলা মুদি তখন তাকে আরো একবার বুঝিয়ে দিল যে, ওর এই ছোট দোকান ধারে জিনিস দিলে একেবারেই অচল হয়ে পড়বে; এমনকি দু-চার দিনের জন্যেও সে ধার আটকে রাখতে পারে না।
এ কথা শুনে ওর লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু করার কিছুই নেই। ছেলেদের মুখে রুটি গুঁজে দিতে হবে। গলায় মালার একটা মোতিও সে ছিঁড়তে পারে না। বাড়ি গিয়ে বউ-এর হাতে পোঁটলা দিয়ে চুপচাপ আবার বাইরে বেরিয়ে পড়ল সে।
তিন-চার ঘণ্টা ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়ানোর পর সে অনুভব করল, প্রত্যেকদিন ছেলেদের মুখে রুটি তুলে দেওয়া সহজ নয়। গরিব লোকের জন্য শৌখিন মিষ্টির দোকান কাছে থাকলেও যেমন নাগালের বাইরে, তার জন্যে তেমনি কাজ করে রোজগার করাটা দুঃসাধ্য।
রফিক তবু শব্জি-বাজারে কাজ করে। আধ মাইল দূরে একটা দোকানে চার ঝুড়ি মাল পৌঁছে দিয়ে পেল বারো আনা। শেষ ঝুড়িটা বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মনে হতে লাগল, মাথাটা তার সেই বলদের শিঙের মতো, যার উপর এই দুনিয়াটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। শোনা যায়, এক শিং ক্লান্ত হলে সে অন্য শিঙের উপর দুনিয়ার বোঝা পালটে নেয়, আর তখনই দুনিয়ার কোথাও না-কোথাও ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। কিন্তু রফিকের শিং, অর্থাৎ মাথা তো মাত্র একটাই– বদল করার কোনো জো নেই।
বারো আনার বারো আনাই মওলা মুদিকে দিয়ে সে খালি হাতে বাড়ি ফিরল। বুকটা তখন বড্ড খচখচ করতে লাগল একটা কথা ভেবে। এত খাটল, তবু ছেলেদের জন্য এক আনার লেবুনচুসও আনতে পারল না। আঙিনায় রাখা ছেঁড়া খাঁটিয়ার উপর শুয়ে পড়ল সটান হয়ে। ছেলেরা এই প্রথম বাবাকে সারাদিন দেখতে পায়নি। তাই দুজনেই হইচই শুরু করে দিল। কেউ বুকের উপর, আর কেউ পায়ের উপর লাফাতে লাগল। তারপর, মুখে ঘোড়ার খুরের কৃত্রিম শব্দ তুলে বলল, ‘আমরা ঘোড়ায় চাপব।’
ঘোড়া সাজবার সাধ্য এখন তার নেই। তবু একজন একজন করে ছেলেদের পিঠে চাপিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ সে ঘুরল। এত তাড়াতাড়ি নেমে পড়তে হল বলে অসন্তুষ্ট হল ছেলেরা। রফিক বলল, ‘ঘোড়া এখন বুড়ো হয়েছে। বুড়ো ঘোড়া চলতে পারে না, আরাম করে।
ছেলেরা চলে গেল রাগ করে। আর রফিক আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকল। আকাশে অফুরন্ত আনন্দ নিয়ে পাখির দল এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে চলে যাচ্ছে।
বউ হয়তো সবই বুঝল, কিন্তু কিছুই বলল না। বলার তার কিছুই নেই। চুপচাপ চলে গেল খাবারের আয়োজন করতে।
এদিকে হাঁটুর ব্যথায় রফিক ঝাঁকিয়ে উঠল। পা দুটোকে গুটিয়ে নিল বুকের কাছে। মুখ বিকৃত করে সে পড়ে থাকল চোখ বুঁজে। মোট বইবার কাজ করতে গিয়ে হয়তো, এ ব্যথা এত বেড়েছে।
রাত্রে বিছানায় শুয়ে ঘুমন্ত ছেলে দুটোর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে আপন মনে বলতে লাগল, ‘কাল আমি তোদের জন্যে লেবুনচুস নিয়ে আসব, দুধ-মালাই নিয়ে আসব।’ কী ভেবে আবার নিজের মনেই বলল, ‘না, না, দুধ-মালাই আনতে পারব না– অনেক দাম, তবে লেবুনচুস নিশ্চয়ই আনব।’
হাঁটুর ব্যথায় বড় কষ্ট পাচ্ছে, ঘুম আসছে না। বউ অনেকক্ষণ ধরে পা টিপে দিল। তারপর, আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল– গভীর ঘুম।
সকালে উঠে মওলা মুদির কাছে থেকে আবার আটা-ডাল ধারে আনল। আজকে আর ধার দিতে সে আপত্তি করল না। হয়তো বুঝেছে, এ বাকি রাখার লোক নয়। হলও তাই। শবজিবাজারে দোকানে দোকানে মাল পৌঁছে দিয়ে এক টাকা আয় করল। বারো আনা দিল মুদিকে। এক আনার লেবুনচুস কিনল। আজকে বেশি ঝুড়ি বয়েছে। তাই হাঁটুর ব্যথাও কালকের চাইতে বেশি। কিন্তু ছেলেদের লেবুনচুস খাওয়া দেখে আর ওড়নার খুঁটে বউকে তিন আনা পয়সা বাঁধতে দেখে হাঁটুর ব্যথা ভুলে গেল রফিক। সেই আনন্দের টানে টানে সে ছেলেদের সঙ্গে ঘোড়া-ঘোড়াও খেলল। কিন্তু বেশিক্ষণ পারল না। এত তাড়াতাড়ি নামতে হল বলে ছেলেরা রাগ করল। রফিক বলল, ‘ঘোড়া এখন বুড়ো হয়েছে। বুড়ো ঘোড়া চলতে পারে না, আরাম করে।’
এইরকম চলতে লাগল প্রত্যেকদিন। সকাল বেলায় মওলা মুদির দোকানে গিয়ে চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, লুটতরাজ, দাঙ্গা, নারী হরণের খবর শুনিয়ে আসে। বিনিময়ে ধারে কিনে আনতে পারে আটা-ডাল। তারপর, চলে যায় শবজি-বাজারে মজুর খাটতে। এখন সে তার নিজের শক্তির পরিমাপ গ্রহণ না-করেই ছয়টা পর্যন্ত ঝুড়ি বয়ে নিয়ে যায় দুপুরের প্রখর রোদ অমান্য করে। তারপর বেলা গড়িয়ে বাড়ি ফিরতে পারে।
এইভাবে পনেরো-কুড়ি দিনের বেশি চলা গেল না। লু হাওয়ার গরমে শরীর ঝলসে গেল। সেই সঙ্গে হাঁটুর ব্যথা তীব্রতা লাভ করল আর ছড়িয়ে পড়ল অন্যান্য জোড়ে। ছেঁড়া খাঁটিয়ায় শুয়ে শুয়ে ছটফট করতে লাগল। ব্যথার দোসর হয়ে এল জ্বর। জ্বরের বিকারে সে বকতে লাগল, ঝগড়া করতে লাগল মোট বইবার দরাদরি নিয়ে মালিকের সঙ্গে।
রফিকের বউ কখনো এর-ওর বাড়ি যাওয়া ছাড়া অন্য কোথাও যায়নি। এখন তাকে লম্বা একটা ময়লা বোরকা পরে বাইরে বেরুতে হল। মওলা মুদির দোকানে না-গেলে হাঁড়ি চড়বে না। অবশিষ্ট সময় সে কেবল অঝোর ধারে কাঁদে আর আল্লার কাছে প্রার্থনা করে। ছেলেরা ম্লান মুখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। ঘোড়ায় চাপা তাদের হয় না। খেতে পায় না লেবুনচুস। পনেরো দিন পরে রফিকের জ্বর বাড়ল।
অসুস্থতার কালে মওলা মুদি প্রত্যেকদিন আটা, ডাল, সাগু দিয়েছে ধারে। প্রত্যেকদিন দু আনা, তিন আনা করে এতদিন যা বাঁচিয়েছিল, তাই দিয়ে ওষুধ আর ডাক্তারের খরচ কুলিয়েছে। মরলে গরিব লোকের কাফনের টাকাটা হয়তো চাঁদা করে তোলা যায়, কিন্তু না-মরা পর্যন্ত চিকিৎসার খরচটা গাঁট থেকে না-খসালে চলে না। কিন্তু ঋণের বোঝা এত বেড়েছে যে, তা সারাজীবন মজুর খাটলেও শোধ হওয়ার নয়। ভাবতেও তার সারা শরীর শিউরে ওঠে। রোগমুক্তির পর থেকে সবসময় তার চিন্তা, কেমন করে এই ঋণ শোধ করবে। ব্যথা কিছু কমলেও দুর্বলতার জন্য উঠবার সাধ্য নেই। তবু তার আশা, আরো আট-দশ দিন গেলে হয়তো আবার শবজি-বাজারের দিকে পা বাড়াবার যোগ্য হয়ে উঠবে সে।
জোয়ান বয়স হলে আরোগ্যলাভের পর শক্তি ফিরে পেতে সময় লাগে না বেশি। কিন্তু ওর বয়স প্রৌঢ়ত্বে এসে ঠেকেছে। তার ওপর কর্জের শুকনো রুটি খেয়ে অচিরে সে বুঝে ফেলল, দেহটা একেবারেই অকেজো হয়ে গেছে। মাত্র কিছুক্ষণের জন্য মওলা মুদির দোকানে খবরের কাগজ পড়তে গেলেও পা টলমল করে, মাথা ঘোরে, হাঁটুর ব্যথা বেড়ে যায়। বাড়ি ফিরে একাকী মুখ লুকিয়ে পড়ে থাকে। ছেলেদের দিকে তাকালে আপনি আপনি দুচোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে অঝোর ধারে।
কাজে যেতে না-পারলেও রোজ সকালে মওলার দোকানে ডিউটি দিতে যাওয়া অপরিহার্য। আটা আর ডাল ধার করতে যেতে হয়; তাছাড়া ধার যে সে শোধ করবে, এই মিথ্যা আশ্বাসটাও দিতে যেতে হয়। নিজে না-গিয়ে বড় ছেলেটাকে পাঠালে অসন্তুষ্ট হয় মওলা মুদি। রফিক তার কাছে এখন কৃপণ বেনের ঘিয়ের মতো, যে ঘি খাওয়া যায় না, কেবল আলমারির তাকে সাজিয়ে রাখা যায় সবসময় চোখের তৃপ্তি বাড়ানোর জন্য।
ওদিকে টাকা পাওয়ার জন্য মওলার কোনো তাড়া নেই। সে মনে মনে অন্য এক পাঁয়তারা কষে রেখেছে। কিন্তু রফিক মনে করছে, মওলার মতো বিপদের দিনের বন্ধু আর হয় না। একদিন সেজন্য সে তার ভদ্রতার প্রশংসাও করল। তখন মওলা তাকে বোঝাল, ধার শোধ করার ব্যাপার নিয়ে তাকে আদৌ চিন্তা করতে হবে না। যদি তেমন কিছু হয়, তাহলে রফিক তার কুঁড়েঘরের ওই সামান্য মাটিটুকু মওলাকে দিয়ে দিতে পারবে। বন্ধুত্ব মানেই হচ্ছে বিপদে একজন আর একজনের কাজে আসা।
বন্ধুত্বের এই ব্যাখ্যা শোনার পর থেকে রফিক আরো ঝিমিয়ে পড়ে। তার মনে শান্তি দেওয়ার মতো এখন কোনোকিছুই আর অবশিষ্ট থাকল না। বউ তার রাস্তায় নেমেছে। ছেলেরা আওয়ারা কুকুরের মতো এর-ওর বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করে। আর, এই মাথা গুঁজবার ঠাঁইটুকুও ক’দিন পরে আর তার থাকবে না।
সেদিন সে মওলা মুদিকে খবরের কাগজ পড়ে শোনাচ্ছিল। হঠাৎ তার চোখ পড়ল নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে গিয়ে। লিখেছে, হারিয়ে যাওয়া ছেলেটির সন্ধান দিতে পারলে পাঁচশো টাকা পুরস্কার। তন্ময় হয়ে ভাবতে লাগল রফিক এই ছেলেটিকে খুঁজে পাওয়া কি তার পক্ষে সম্ভব নয়। ভাবতে ভাবতেই মনের মধ্যে অজস্র চিন্তার বেড়াজালে সে নিখোঁজ করে ফেলল নিজেকে। পাঁচশো টাকা। যখন তার সুদিন ছিল, তখন সে এই কুঁড়েঘরটা তুলেছিল। এ তার নিজের ভিটেমাটি। পাঁচশো টাকা পেলে সুদিনের এই স্মৃতিটাকে রক্ষা করতে পারবে সে। তাছাড়া নিজে কিছু ভালো জিনিস খেয়ে গায়ে তাকত আনবে, যেন সে আবার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কাজ করতে পারে। ছি ছি, কী লজ্জার কথা। সে নিজের ছেলেদের কথা আগে ভাবেনি। ওদের জন্য লেবুনচুসের আস্ত একটা টিন কিনে ফেলবে। আর, বউটা খেটে খেটে একেবারে অস্থিচর্মসার– ওর জন্যও অনেক কিছু করতে হবে বইকি। তাছাড়া, পাঁচশো টাকার একটা বাচ্চাতেই তো আর ‘নিখোঁজ’ বিজ্ঞপ্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে না। আরো কতজনের কত আদরের ছেলে বা মেয়ে নিখোঁজ হবে। তারা যদি হাজার টাকা বা পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে বসে, তাহলে তাতেই-বা আর বিস্মিত হওয়ার কী থাকতে পারে। যার অনেক দৌলত, তার কাছে টাকা আগে, না সন্তান আগে? বাড়ি ফিরে খুব রহস্যপূর্ণ ভঙ্গিতে বউকে পুরস্কারের কথা জানাল। আর বলল, আল্লার কাছে, যেন কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করে।
কিন্তু ঘরের কোণায় বসে থাকলে নিখোঁজ শিশুকে পাওয়া যাবে না। সুতরাং, সে রাস্তায় নামল। রাস্তায় রাস্তায়, গলিতে গলিতে, পার্কে-ময়দানে নিখোঁজ শিশুকে খুঁজে বেড়ালো হন্যে হয়ে। দুর্বলতা হেতু মাথা ঘুরলে কিংবা হাঁটুর ব্যথা চাড়া দিয়ে উঠলে এক জায়গায় থপ্ করে বসে পড়ল। বসে বসেই খুঁজতে লাগল নিখোঁজ শিশুকে। বাচ্চা দেখলেই সে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে। কিছু যেন মিল পাওয়া যাচ্ছে! না, এ দেখার ভুল। কোনো ছেলেকে একা একা কাঁদতে দেখলে সে ছুটে যায়। কিন্তু ধরতে পারার আগেই ছেলেটা পালিয়ে যায় কিংবা ঢুকে পড়ে নিজের বাড়িতে। দীর্ঘশ্বাস পড়ে অগোচরে। তবু মনে মনে ভাবে, আশাই এখন সম্বল, হাল ছাড়া উচিত নয়।
ঘুরতে ঘুরতে সে একটা বড় রাস্তায় নামল। অন্য কারও ছেলে নয়– যেন সে নিজেরই কোনো হারানো মানিককে খুঁজছে। সেই মানিক খুঁজতে খুঁজতে শেষে বড় একটা প্রাসাদতুল্য বাড়ির সামনে ভিড় দেখে থামল। সম্ভবত বিয়ে-বাড়ি। সামনের প্রশস্ত উদ্যানে শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। তার নিচে খানা-পিনার আয়োজন। বহু চেয়ার-টেবিল, লোকজন। ব্যান্ড বাজছে। ছেলে-মেয়েরা রং-বেরঙের পোশাক পরে ছুটোছুটি, হুড়োহুড়ি করছে। প্রাসাদের ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসব দেখতে লাগল অনেকক্ষণ ধরে। রফিক ভাবছে, তার ছেলের যখন বিয়ে হবে, তখন ব্যান্ড-পার্টি না আনতে পারুক, সানাই নিশ্চয় বাজবে, মেহমানদের পোলাও-জর্দা খাওয়াবে, আর কনের জন্য খুব দামি না হোক, ভালো পছন্দসই কাপড়-চোপড়, অলঙ্কার কিনে আনবে।… এমনি আরো কত কী চিন্তার মগ্নতা ছিন্ন করে সামনে এসে দাঁড়াল ভৌতিক স্বপ্নের মতো মওলা মুদির প্রলুব্ধ চোখ দুটো। আর, অমনি হাঁটুর ব্যথাটা সে টের পেল। আর, চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল দু’গাল বেয়ে।
তখনো তার চোখের পানি শুকোয়নি। এমন সময় দুটি শিশু ছুটতে ছুটতে ফটকের বাইরে এসে পড়ল। একটা ছেলে তাড়াচ্ছিল একটা মেয়েকে। একেবারে রফিকের সামনে এসে পড়লে ছেলেটা মেয়েটিকে ধরে ফেলল, তারপর বেশ কয়েকটা কিল-চড় মারল। রফিক গিয়ে বাধা দিতে পারার আগেই আরো কয়েকটা কিল-ঘুষি মেরে দিয়ে সে পালিয়ে গেল বাড়ির ভেতরে। ছোট মেয়েটি কাঁদতে লাগল গলা ফাটিয়ে। রফিক তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল। আস্তে আস্তে কান্না থামাল মেয়েটি।
‘নাম কী, মা তোমার?’ আদর করতে করতে প্রশ্ন করল রফিক।
‘তা-তা-তাতি।’ কান্নার রেশ তখনো থামেনি, তার ওপর এত বেশি তোতলাচ্ছে যে, কী সে বলল, তা ভালোমতো বোঝাই গেল না।
রফিক তাকে আরো বেশি আদর করতে লাগল, আর আদর করতে করতেই হঠাৎ তার মাথায় একটা বদ-খেয়াল চেপে গেল। মেয়েটিকে সে চুরি করবে। কিন্তু না, চুরি করা মহা-পাপ। সে কখনো কোনোরকম পাপের পথে পা রাখেনি। কিন্তু মওলা মুদির চোখ দুটোকে কেমন করে তার ভিটেমাটির ওপর থেকে সরাবে সে এইসব ভাবছে আর এদিকে-ওদিক তাকাচ্ছে চোরের মতো– কেউ-না আবার দেখে ফেলে এই অবস্থায়। রাস্তা দিয়ে যত লোক যাচ্ছে, তারা সবাই যেন ওকে সন্দেহের চোখে দেখছে। তারা যদি টের পায় ওর উদ্দেশ্য, তাহলে যে কী অবস্থা হবে তা সে ভাবতেও পারে না। তারপর একসময়, রাস্তায় যখন আর কেউ নেই, তখন মেয়েটিকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে প্রথমে একটা গলিতে ঢুকল; তারপর নানা ঘোরাল পথ, গলি-পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সটান উঠল গিয়ে নিজের বাড়িতে। মেয়েটি কখন কাঁধের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে, তা সে টেরও পায়নি।
বউ ছুটতে ছুটতে কাছে এল। ‘কী ব্যাপার? এ মেয়েকে কুড়িয়ে পেলে? হারিয়ে গিয়েছিল? বড়লোকের মেয়ে মনে হচ্ছে!’
‘হ্যাঁ, হারিয়ে যাওয়া মেয়ে। রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি। খুব বড়লোকের মেয়ে।’ রফিক বউকে মিথ্যা বলল। তারপর হাঁক ছাড়ল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছ কী? পরিষ্কার ওয়াড়অলা বালিশ আনো। আস্তে করে শুইয়ে দাও, যেন কোথাও চোট না লাগে। এয়ারকন্ডিশনে মানুষ– তুমি ওর মাথার কাছে হাত-পাখাটা নিয়ে বসে থেক।’
রফিকের বউ বালিশ এনে মেয়েকে শোয়াল। তারপর, হাত-পাখার বাতাস দিতে লাগল। রফিকের ছেলে দুটো এমন জমকালো পোশাক-পরা মেয়ে দেখে অবাক হয়ে গেছে। তাই দেখে রফিক বলল, ‘আমি তোদের এর চাইতে ভালো জামা বানিয়ে দেব, দেখিস। আর নতুন জুতোও পাবি। তাই পরে হেঁটে বেড়াবি মমশ্ করে।’ ছেলেদের কাছে টেনে নিয়ে খুব খানিক আদর করল, তারপর বউকে বলল, ‘তুমি মা-মণির কাছ থেকে সরে যেও না কিন্তু। একলা আবার ভয় পেয়ে যেতে পারে। আমি ততক্ষণে ওর খাবার ব্যবস্থা দেখি। শুকনো বাসি রুটি তো আর ওর খাওয়ার অভ্যেস নেই।’ এই বলে সে বাইরে চলে গেল তাড়াতাড়ি।
মওলা মুদির কাছে পাঁচ টাকা ধার চাইল। ওর কুঁড়েঘরের দিকে প্রলুব্ধ দৃষ্টি হেনে সে ঠোঁটের কোণায় মিহি করে হাসল। ভাড়াটে বাসায় বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে আরো কতদিন কষ্ট করতে হবে, সে তার হিসাব নিল মনে মনে। তারপর যোগ-বিয়োগের ফলাফল সন্তোষজনক মনে হওয়ায় পাঁচ টাকা ধার দিতে সে আর দেরি করল না। ওই কুঁড়েঘর ভেঙে ওখানে একটা ছোটখাটো বাড়ি তুলবে যেদিন, সেদিন তার বেশি দূরে নয়।
মেয়েকে ক্ষীর খাওয়ানোর মানসে কিনে নিয়ে গেল দুধ, পাটালিগুড় আর খুশবু মিহি চাল। দুপুর গড়িয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ওর বউকে আবার নতুন করে চুলো ধরাতে হল। এদিকে ক্ষীর রান্না হচ্ছে, ওদিকে রফিক দৌড়াতে দৌড়াতে আবার বাজারে গেল। মেয়ের জন্য কিছু মিষ্টান্ন আনা হয়নি। বাড়ি ফিরে দেখে মেয়ে জেগে গেছে। জেগেই কাঁদতে শুরু করে দিল সে। মিষ্টি দিয়ে ভুলিয়ে ভুলিয়ে রফিক তার কান্না থামাল। কিন্তু মিষ্টি ফুরোলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে অপরিচিত পরিবেশ দেখে আবার কাঁদতে আরম্ভ করল। তখন কোলে নিয়ে আদর করতে লাগল রফিক, আর অদ্ভুত অদ্ভুত সব শব্দ করে তার কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল।
ছেলেদের বলল, ‘তোরা দুজন হাততালি দে।’ তাদের হাততালি শুনে মেয়ে থামল। কিন্তু হাততালি থামতে আবার চিৎকার জুড়ে দিল। ততক্ষণে ক্ষীর তৈরি হয়ে গিয়েছিল। রফিক নিজের হাতে ধরে ধরে মেয়েকে ক্ষীর খাওয়াতে আরম্ভ করল। কিন্তু দূরে নিজের ছেলেদের চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বউয়ের ওপর বিগড়ে গেল ভীষণ। ‘তুমি আমার ছেলেদের ক্ষীর দাওনি কেন?’
নিজের ছেলেদের কাছেও পরিবেশন করা হল ক্ষীর। ক্ষীর খেয়ে মেয়ে অনেকক্ষণ চুপ থাকল বটে, কিন্তু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল এখানকার অপরিচিত পরিবেশকে। রফিক বউকে বলল আশ্বস্ত হয়ে, ‘ক্ষিদে পেয়েছিল, সেই জন্যে কাঁদছিল। দেখ, এখন কেমন চুপ করেছে।’
‘হ্যাঁ, তা যেন হল। কিন্তু মা-মণির ক্ষীর পছন্দ হয়েছে কিনা কে জানে!’ বউ বলল। রফিক জানতে চাইল, ‘কী মা-মণি, ক্ষীর তোমার ভালো লেগেছে তো?’
সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল মেয়েটি।
‘তোমার আব্বার নাম কী?’
সংক্ষিপ্ত উত্তর এল, ‘আব্বা।’ ওরা দুজন হেসে ফেলল তাই শুনে
‘তোমার আব্বা কী করেন?
‘লুটি খান।’
‘রুটি খান? আর কিছু করেন না?’
‘বলফের পানি খান। লেডিও শোনেন
ওরা দুজন এই শুনে খুব হাসল। রফিক বউকে বলল, ‘বড়লোকের কাণ্ডই আলাদা। উঠতে খান, বসতে খান, শুতে শুতেও খান।’ আনন্দে রফিক আত্মহারা। আজকে সে হাঁটুর ব্যথার কথাও সম্পূর্ণ ভুলে গেছে। আনন্দের জোয়ার এসেছে তার মনে। সে কোনো কিছুই গুছিয়ে চিন্তা করতে পারছে না। কেবল একটা চিন্তাই তার মাথায় বারবার ঘুর-পাক খাচ্ছে। আর, তা হচ্ছে : দৌলত সে এখনো পেয়ে যদি না-ও গিয়ে থাকে, পেতে বিশেষ আর বিলম্ব নেই।
‘ঘোড়া-ঘোড়া খেলবে, মা-মণি?’
রফিকের এই প্রস্তাব সে সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিল। আর, অমনি রফিক লুঙ্গি গুটিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়ল। তারপর সারা আঙিনায় এবড়ো-খেবড়ো মাটিতে সে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াতে লাগল মেয়েকে পিঠে চাপিয়ে। ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে মেয়ে খুব আনন্দ পেল, আর হাসল খিলখিল করে। তারপর, ক্লান্ত হয়ে যখন সে মেয়েকে পিঠ থেকে নামিয়ে দিল, তখন তার হাঁটু দিয়ে রক্ত ঝরছিল।
বউ সেই রক্ত দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলে রফিক বলল, ‘ও কিছু নয়– আমার একটুও কষ্ট হয়নি।’ তারপর, লুঙ্গি দিয়ে রক্ত মুছে ফেলল।
এইভাবে দিনটা কেটে গেল। কিন্তু সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি আবার কাঁদতে আরম্ভ করে দিল। আবার তাকে মিষ্টি কিনে এনে খাওয়ানো হল, ওর জন্য বিশেষভাবে জর্দা রান্না করে তা-ও খাওয়ানো হল, বউ অনেকক্ষণ পর্যন্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে টহল দিয়ে বেড়াল, কিন্তু কিছুতেই তার কান্না থামানা গেল না। অবশেষে সে নিজে নিজেই ঘুমিয়ে পড়ল ক্লান্ত হয়ে ঘুমুনোর সঙ্গে সঙ্গেই সারাটা ঘর জুড়িয়ে গেল। শোয়ার সময় না-হওয়া সত্ত্বেও নিজের ছেলেদেরও ঘুমিয়ে পড়তে বলল সে। তাদের কলরবে মেয়ে যদি জেগে যায়, তাহলে ভারি বিপদ হবে। রফিকের বউ মাথার কাছে বসে বসে পাখা করতে লাগল। না-জানি, নিজের বাড়িতে সে কত আরামে ঘুমায়। আর, রফিক মনে মনে অস্থির হয়ে মেয়ের চারপাশে ছটফট করে বেড়াতে লাগল। কিছুতেই সে নিশ্চিন্ত হয়ে দু’দণ্ড বসতে পারছে না। কেবলই ভাবছে যে, পুরস্কার যদি অন্তত এক হাজার টাকাও পাওয়া যায়, তাহলেও ওদের অনেক দুঃখ ঘুচবে। এইকথা সে ভাবছে আর কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে। রফিক ফিফিস্ করে বউয়ের কাছে জানতে চাইল, ‘এক হাজার টাকা পেলে তোমার কতদিন চলবে?’
‘তা চাটনি দিয়ে রুটি খেয়ে চালাতে পারলে তো পাঁচ-ছ’বছর যাবেই।’ বউ দিন-মাস-বছরের হিসাব-নিকাশ করেই উত্তরটা দিল। ‘তোমার ছেলেরাও বড় হয়েছে, ততদিনে ওরা কাজ করে তোমাকে খাওয়ানোর যোগ্য হয়ে উঠবে। তোমাকে আর তখন কাজ করতে হবে না।’
‘তা যা বলেছ বউ।’ সে বউয়ের আরো কাছে সরে এল। ‘বর্ষা আসছে; মাথার উপর চাল ফুটো, তা দেখেছ? এ বছর মেরামত না করলে সবসুদ্ধ ভেঙে পড়বে। আর, যদি পুরস্কার বেশি পাওয়া যায়, তাহলে গোটা ঘরটাই নতুন করে তোলা যাবে, কী বল?’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়– ঘর আগে, না পেট আগে। এই ঘরে আমাদের ছেলে-বউরা আসবে একদিন।
‘তাহলে আমি এখনই মিস্ত্রিকে খবর দিয়ে আসি, যেন কাল সকাল থেকে মেরামতের কাজ শুরু করে দেয়। মওলা মুদি দেখলে একেবারে মরমে জ্বলবে।’
‘এখন নয়, কাল সকালে বললেই চলবে’খন।’
‘না, না, এখনই বলে আসি– কাল সকালে তাকে আবার পাওয়া যাবে না।’ রফিক চলে গেল।
মিস্ত্রিকে খবর দিয়ে বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম আসে না। আইচাই করে রাতটা কেটে গেল। সকালবেলায় উঠে দৌড়াল মওলা মুদির দোকানে। দোকান তখনো খোলেনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল দোকান খোলার।
মওলা মুদি যখন এল, তখন তার হাত থেকে খবরের কাগজটা প্রায় কেড়ে নিল রফিক। তাড়াতাড়ি পাতা উল্টে খুঁজতে লাগল ‘নিখোঁজ’-বিজ্ঞাপন। শেষে এক জায়গায় পেয়ে গেল মেয়ে হারানোর খবর। কী আশ্চর্য! হুবহু মিলে যাচ্ছে বর্ণনার সঙ্গে। একেবারে এই মেয়েটিই। না হয়েই যায় না। তার ওপর পুরো ঠিকানাও দেওয়া হয়েছে, কোথায় পৌঁছে দিতে হবে। তারপর, শেষে লিখেছে, ‘সন্ধানকারীকে এনাম দিয়ে খুশি করা হবে।’ রফিকের বুকটা ধড়ফড় করে উঠল এনামের কথা পড়ে।
খবরের কাগজ ফেরত দিয়ে রফিক মওলা মুদির কাছে পুরো পনেরো টাকা চেয়ে বসল। মওলা প্রথমে একটু ভ্রু কুঁচকাল, তারপর দিয়ে দিল টাকাটা। টাকা নিয়ে সে দৌড়াল ঘরের দিকে। বউকে শোনাল বিজ্ঞাপনের কথা।
‘কত টাকা দেবে লিখেছে?’ তার বউও অধৈর্য হয়ে উঠেছে
‘লিখেছে, সন্ধানকারীকে এনাম দিয়ে খুশি করা হবে।’ এই বলে রফিক শূন্যের পানে দু’হাত বিস্তৃত করে দিল। ‘হেই আল্লাহ্, তুমি তাদের খুশি রেখ।’
রফিকের বউ তাড়াতাড়ি মেয়ের জন্য পরোটা-ডিমের নাশ্তা তৈরি করল। তাকে গোসল করিয়ে চুল আঁচড়ে দিল। খাওয়াল। তারপর, কপালে-মুখে চুমু দিয়ে বিদায় করে দিল।
রফিক মেয়েকে কোলে করে বাইরে নিয়ে এল। টাঙা ভাড়া করে তাতে বসল। কোথায় যেতে হবে বলে দিল। আর বলে দিল, রাস্তায় খেলনার দোকান দেখলে যেন গাড়ি থামায়। খেলনার দোকান থেকে খেলনা কিনে ফেলল পুরো দশ টাকার। খেলনা পেয়ে মেয়ে একেবারে আনন্দে আত্মহারা। কেউ যাতে নিয়ে না নেয়, সেজন্য ফ্রকের আঁচলে সে লুকিয়ে রাখল খেলনাগুলো।
বিরাট এক কুঠির সামনে টাঙা এসে থামল। দেখে রফিকের চক্ষু চড়কগাছ। কুঠি নয়– যেন বিরাট এক পানির জাহাজ। জাহাজের মতোই চেহারা-সুরত। আনন্দে তার পা কাঁপতে লাগল। মেয়ে কোলে করেই সে টাঙা থেকে নামল। মেয়ে এতক্ষণে পরিচিত পরিবেশ পেয়ে রফিকের কোল থেকে নামার জন্য ছটফট করতে লাগল। তারপর, কুঠির সদর-দরজা দিয়ে ঢুকতে না-ঢুকতেই মেয়ে একেবারে ছিটকে কোল থেকে নেমে দৌড় দিল ভিতরের দিকে। রফিক তাকে ধরবার অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। মেয়ে ততক্ষণে অন্দরে চলে গিয়ে কোথায় মিলিয়ে গেছে। রফিকের বড় দুঃখ হল। সে চেয়েছিল আঁচল-ভরা খেলনা নিয়ে মেয়েকে কোলে করে সাহেব-বাহাদুরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে, কিন্তু তা আর হল না। কাজেই সিঁড়ির কাছ পর্যন্ত গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল খালি হাতে।
সাদা পোশাক সজ্জিত এক ব্যক্তি এসে তার সামনে দাঁড়াল। ‘তুমিই তামিনাকে এনেছ?’
‘হ্যাঁ হুজুর, আমিই এনেছি।’ রফিক মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করল।
‘সাহেব তোমাকে ভেতরে ডাকছেন– আমি সাহেবের আরদালি।’
‘আচ্ছা আচ্ছা ভাই, ভুল হয়েছে মাফ চাই। আমাকে ভেতরে নিয়ে চল।’
রফিক এখন সাহেব-বাহাদুরের সামনে সশরীরে দাঁড়িয়ে। আহা, কী জৌলুস! এমন ঘর, আর এমন সব আসবাব-পত্র, সাজ-সজ্জা সে কেবল রাজপুত্র আর রাজ-কন্যাদের গল্পতেই শুনেছে। সাহেব-বাহাদুর একবার তাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলেন। রফিক বুঝল, এই ময়লা কাপড় পরে আসা তার উচিত হয়নি। বউটার আক্কেল বলতে যদি কিছু থাকে। এত পারল আর এক আনার সাবান কিনে তার কাপড়টা একটু ধুয়ে দিতে পারল না।
‘মেয়েকে তুমি এনেছ?’ সাহেব-বাহাদুরের তির্যক প্রশ্ন।
‘হ্যাঁ হুজুর, আমি এনেছি। আমি ওকে রাস্তায় পেয়েছি– কাঁদছিল। আর…’
‘আমরা খুব খুশি হয়েছি। তুমি খুব ভালো লোক। বেগম সাহেবের সঙ্গে মেয়ে গিয়েছিল বিয়ে-বাড়িতে। সেখানে থেকেই হারিয়ে যায়। তারপর…’
‘হুজুর, আমি… আমি…’ রফিকের মুখ থেকে আর কথা সরে না। আবেগে, উচ্ছ্বাসে সে ভেঙে পড়ে।
‘হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে মেয়ের বাপ অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে। সে আমাদের হেড-বাবুর্চি। আমাদের খাওয়া-দাওয়ার খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি খুব উপকার করেছ আমাদের। এই নাও, পাঁচ টাকা বখশিশ্ দিলাম তোমাকে।’
পাঁচ টাকার নোট রফিকের হাতে গুঁজে দিয়ে তিনি অন্দরে চলে গেলেন।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
সুলতান – আহমদ নদিম কাস্মি
দাদার বাঁ হাতের পাঞ্জার নিচে সুলতানের মাথা, আর ডানহাতে লাঠি। এই লাঠি পাকা ফুটপাতের উপর ঠুকে ঠুকে সে এলোপাতাড়ি শব্দ সৃষ্টি করছিল।
সুলতান যেই একটু থামল, দাদা অমনি বলতে লাগল, ‘বাবুজি, অন্ধ মিস্কিনকে দুটো পয়সা খয়রাত-‘
‘না, না, দাদা, বাবু নয়।’ সুলতান বলল, ‘ভেল্কির খেল হচ্ছে।’
‘হেঁহ, ভেল্কির খেল হচ্ছে। তোর– ‘ জিবের ডগায় একটা খারাপ কথা এসে গিয়েছিল, কিন্তু ঠিক সেই সময় ফুসফুস থেকে জোর একটা কাশির ধাক্কা ঠেলা দিয়ে উঠল। সুলতানের মাথা থেকে সরিয়ে নিয়ে হাতটাকে বুকে রেখে দীর্ঘ কাশির দমকে ডুবে গেল দাদা।
দাদার শ্বাসনালী পরিষ্কার হতে হতে যে সময়টুকু চলে গেল, সেই সময়ের মধ্যে ভেলকির পুরো একটা খেল দেখে নিতে পারল সুলতান। ঝুড়ির মধ্যে ময়লা ন্যাকড়া রাখা ছিল- ভেল্কিঅলা সেই ন্যাকড়াকে যখন দুই-দুটো মোটা মোটা পায়রা বানিয়ে ফেলল, তখন উপস্থিত দর্শকমণ্ডলী হাততালি দিয়ে উঠল। আত্মহারা, তন্ময় সুলতানও যোগ দিল সেই হাততালিতে।
দাদা আবার বাঁ হাতটা মাথার উপর রাখতে গিয়ে মাথা খুঁজে পেল না। ‘কোথা গেলি রে তুই?’
সুলতান দৌড়ে এসে হাতের নিচে মাথা রাখল। তারপর, আবার চলতে লাগল দাদাকে নিয়ে।
চলতে চলতে একসময় দাদার লাঠিতে বিদ্যুতের খুঁটি বেজে উঠল। সুলতান বলল, ‘শুনেছ, দাদা, থামটা কেমন বেজে উঠল?’
‘হুঁ।’ দাদা থামল। খুঁটির উপর দাদা আর একটা বাড়ি মারল লাঠির। কিন্তু বাড়িটা
বেজায়গায় লেগে ফসকে গেল।
সুলতান বলল, ‘আমাকে দাও।’ সুলতান দাদার হাত থেকে লাঠিটা নিয়ে জোরে জোরে বিদ্যুতের খুঁটির উপর বাড়ি মেরে বাজনা বাজাতে লাগল।
‘দেখেছিস, কেমন বাজনা!’ দাদা ছেলেমানুষি জুড়ে দিল সুলতানের সঙ্গে। ‘যখন আমি তোর মতো ছোট ছিলাম, থামে কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তখন থামের ভেতর থেকে মেম সাহেব ইংরেজিতে কথা বলত। ইউ গুড, ইউ ব্যাড
‘থামের ভেতরে মেম সাহেব কথা বলত?’ সুলতান অবাক হয়ে গেল। ‘তখন না-হয় মেম বলত, আর এখন কে বলে, দাদা?’ তারপর, হঠাৎ সুর পালটে ফিসফিস করে বলল, ‘দাদা, দুজন বাবু আসছে।’
দাদা তাড়াতাড়ি আওড়াতে শুরু করে দিল, ‘ও বাবু, অন্ধ মিস্কিনকে দুটো পয়সা খয়রাত দিয়ে যাও। আল্লা তোমার চাকরিতে তরক্কি দেবেন, বাবা। সকাল থেকে রুটি খাওয়া হয়নি, বাবা। আল্লা তোমাকে ছেলে দেবেন, পোতা দেবেন; তুমি সুখে থাকবে, বাবা। গরিব মিস্কিনকে–‘
এক বাবু অট্টহাসি দিয়ে উঠলেন, ‘বুড়োটা দেখছি পরিবার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে হে।’ তারপর হাসতে হাসতে চলে গেলেন তাঁরা দুজন।
‘চলে গেল।’ সুলতান আস্তে করে বলল কথাটা। কিছুক্ষণ থেমে সে জোরে একটা গাল দিয়ে দিল বাবু দুজনকে।
দাদা সুলতানের মাথায় চাপ দিল বাঁ হাতের। ‘আবার মুখ খারাপ করলি তুই? কাল তোকে কী বলেছিলাম রে, শুয়োর। কেউ যদি শুনে ফেলে, কল্লাটা তোর ছিঁড়ে উল্টোদিকে বসিয়ে দেবে, বুঝেছিস?’
সুলতান চুপচাপ চলতে লাগল। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘আমার মাথায় তোমার বুড়ো আঙুলটা যেখানে আছে না, ঠিক ওইখানকায় একটু চুলকে দাও তো, দাদা।’
দাদা কানের ওপাশ থেকে শুরু করে ওপাশ পর্যন্ত সারা মাথায় জোরে জোরে চুলকে দিল। ‘সুলতান, কী ব্যাপার, আজকে যে তুই থামতেই চাস না। বাবু-টাবু কেউ কি যাচ্ছে না রে?
‘না, দাদা।’
‘বাবুরা সব আজ গেল কোথায়, বলতে পারিস?’
‘মরেছে বোধহয়।’ তারপর, হঠাৎ থেমে পড়ে জিগ্যেস করল, ‘আজকে কী দাদা?’
‘তা আমি কেমন করে বলব রে! তুই মনে করে রাখতে পারিস না? আমার কাছে তো দিন-রাত সব সমান, তা জানিস না নাকি?’ কিছুক্ষণ চিন্তা করে দাদা আবার বলল, ‘পরশু তুই আমায় নীলা মসজিদ নিয়ে গিয়েছিলি না? পরশু জুম্মার দিন ছিল না? তাহলে তো আজকে রোববার রে। রোববারটা দেখছি এক্কেবারে সর্বনেশে দিন রে, সুলতান। বাবুরা আজকে বিবি-বাচ্চাদের নিয়ে বাড়িতে বসে খেলা করছে, বুঝেছিস?’
সুলতান দাঁড়িয়ে থাকল। একটু পরে টিনের বাটিতে টুন করে একটা শব্দ হল।
‘কী পড়ল রে সুলতান? কত?’
‘এক পয়সা, দাদা। টেডি এক পয়সা।’
সুলতানের মাথায় পাঞ্জাটা দাদা ঘোরাল। সুলতানকে নিজের দিকে করে নিয়ে বলল, ‘যা, ওইটা নিয়ে কিছু কিনে খাগে যা। আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকছি।’
‘এক পয়সা দিয়ে কিছুই পাওয়া যায় না, দাদা। কিচ্ছু না। আরো তিন-চারটে হলে হয়তো আখের গোল্লা পাওয়া যেতে পারে।
পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাদা আরো কয়েকটা পয়সা বের করল। ‘এই নে। কিছু কিনে খেয়ে আয়। সকাল থেকে তো কিছুই খাসনি। বাচ্চাদের ক্ষিদে আবার বুড়োদের চাইতে বেশি! যা।’
সুলতান পয়সা নিয়ে দৌড় মারল।
দাদা আবার বলল, ‘তাড়াতাড়ি ফিরিস কিন্তু। আমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি রে সুলতান?’ সুলতান আবার ফিরে এল। ‘আর একটু বাঁ দিকে সরে দাঁড়াও দাদা।’ সুলতান হাত ধরে সরিয়ে দিল দাদাকে। ‘এই থামটার সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাক
সুলতান চলে গেল। আর, দাদা থামের সঙ্গে কান লাগিয়ে কী যেন শোনার চেষ্টা করতে লাগল। শুনে শুনে মুচকে মুচকে হাসল সে। এইভাবে কেটে গেল অনেকক্ষণ। সুলতান আসছে না কেন? দাদা হাঁক ছাড়ল, ‘সুলতান ও সুলতান! ও হারামজাদা শুয়োরের বাচ্চা, মরলি নাকি?’ কোনো জবাব এল না। তারপর, এদিক-ওদিক ঘুরে ঘুরে রাস্তার লোকদের সম্বোধন করল, ‘ও ভাই, ও বাবু, আমার পোতাটা এইদিক দিয়ে গেল কিছু কিনতে। সুলতান নাম। টাঙার নিচে, মটরের নিচে গিয়ে পড়ল না তো হতচ্ছাড়াটা। ও সুলতান, সুলতান!
‘আসছি, দাদা।’ দূর থেকে সুলতানের গলা শোনা গেল।
কিন্তু ঠিক তেমনি সময়ে আবার কাশি উঠল দাদার। কাশির দমক কমলে মুখ ফিরিয়ে যেন সে থামটাকেই জিগ্যেস করল, ‘কোথায় গিয়েছিলি রে মরতে?’
সুলতান নিজে নিজেই দাদার বাঁ-হাতটা নিয়ে তার মাথায় চাপাল। ‘ভেল্কির খেল হচ্ছিল, দাদা?। পেটের ভেতর থেকে গুলি বের করছিল টেনে টেনে। আমার পেট থেকেও একটা বের করল।’
পাঁচ আঙুলের ডগা দিয়ে দাদা সুলতানের মাথাটাকে এমনভাবে টিপে ধরল, যেন সে তাকে উপরে তুলে ফেলবে। ‘চল, ঘরে ফিরে চল। ওখানে গিয়ে তোকে আমি ভালো করে ভেল্কির খেল দেখাব। হারামজাদা, আমি যে দুচোখের কানা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে থেকে পা দুটো যে পাথর হয়ে গেল, তা তোর একটুও মনে থাকল না রে, অ্যাঁ?’
সুলতান কিছুই বলল না, হাঁটতে থাকল।
কিছুক্ষণ পর শান্ত গলায় দাদা বলল, ‘কী খেলি রে, ছোঁড়া?’
‘আখের গোল্লা।’
‘আখের গোল্লা! আখ আবার একটা খাবার জিনিস হল রে, অ্যাঁ! ও তো একদম পানি। ছোলাভাজা কিনে খেতে পারলি না– সারাদিন পেটে থাকত।
সুলতান কিছু বলল না, চুপচাপ হাঁটতে থাকল।
দাদা আবার বলল, ‘বাটিটা হাতে ঝুলিয়ে রেখেছিস নাকি রে, সুলতান?’
‘না, দাদা।’
‘খবরদার, ঝুলিয়ে রাখবি না। উঁচু করে ধরে থাকবি, ঝুলিয়ে রাখলে লোকে ভাববে, ভিখিরি নয়, সওদা করতে যাচ্ছে।’
এ-কথায় স্মৃতি কপচানোর ইচ্ছা হল সুলতানের। মনে আছে-না দাদা, একবার বাটিতে করে তেল আনতে যাচ্ছিলাম দোকানে। বাটিটা তোলা ছিল বলে এক বাবু বাটিতে একটা দুয়ানি ফেলে দিল, না দাদা?’
‘তা দুয়ানিটা কী করলি?’
‘কেন, তোমাকে দিয়ে দিলাম, মনে নাই বুঝি?’
‘হ্যাঁ, পয়সা পেলেই দিয়ে দিবি আমাকে, বুঝেছিস? পয়সা বাজে খরচ করা খুব খারাপ।’
‘দাদা!’
‘কী, বল?’
‘আমার মাথাটা একটু চুলকে দাও তো– ঠিক তোমার বুড়ো আঙুলটার কাছে।’
দাদা থেমে গিয়ে জোরে জোরে সুলতানের মাথা চুলকে দিল। তারপর বলল, ‘ঘরে ফিরে জেবুকে বলব, তোর মাথার উকুন বেছে দেবে। তুইও ওর কোনো কাজ করে দিস, কেমন?’
‘আচ্ছা’।
কিন্তু ঘরে ফিরলে আর উকুন বাছার কথা জেবুকে বলতে মনে থাকে না দাদার। এটা রোজকার ব্যাপার। ঘরে ফিরলে রোজই খাঁটিয়ার উপর বসে দাদা প্রথমে একটু হাঁপ ছাড়বে। লাঠিটাকে খাঁটিয়ার কোণায় পায়ার সঙ্গে ঠেকিয়ে রাখবে।
আর, সুলতানের মাথা থেকে দাদার হাতটা যখন সেদিনের মতো নেমে আসবে, সুলতানের তখন মনে হবে, যেন তার মাথাটা একেবারেই হাল্কা হয়ে গেছে। চুপি চুপি পা টিপে টিপে সে বাইরে বেরিয়ে পড়বে। জেবু খালা যেন দেখতে না-পায়, সেদিকেও তার খেয়াল থাকা চাই। একবার বেরুতে পারলেই হাল্কা মাথা নিয়ে চোঁ চোঁ দৌড়। এক দৌড়েই বাংলো দিয়ে ঘেরা মাঠটায় গিয়ে পৌঁছাবে সে। সেখানে বড়লোকের বাচ্চারা ক্রিকেট খেলে, আর গরিবের বাচ্চারা দূরে চলে-যাওয়া বল কুড়িয়ে এনে দেয়। তারপর, বড়লোকের বাচ্চারা যখন খেলাশেষে মাঠ খালি করে দিয়ে চলে যায়, তখন বেয়ারা, চাপরাসি, খানসামা আর মেথরের বাচ্চারা কাঁচের গুলি খেলতে আরম্ভ করে দেয় সেই মাঠে
সুলতানও একবার চেষ্টা করেছিল এই খেলায় যোগ দিতে। কিন্তু মেথরের বাচ্চা প্রকাশ করে দিয়েছিল, ওটা তো ভিখিরির বাচ্চা। কাজেই সুলতান আর খেলবার সুযোগ পায়নি। কিন্তু কাঁচের গুলি অনেক দূরে চলে গেলে দৌড়ে গিয়ে সে কুড়িয়ে আনে সেটা, আর যার জিনিস তাকে ফেরত দেওয়ার আগে গুলিটাকে সে আঙুলের ডগায় ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখে নেয়।
একদিন সে অনেক কান্নাকাটি করে দাদার কাছ থেকে কয়েকটা পয়সা নিয়ে কাঁচের গুলি কিনেছিল কয়েকটা। কিন্তু সেই গুলি নিয়ে যখন সে বড় সাধ করে মাঠে গেল খেলতে, তখন বেয়ারা, চাপারাসি, খানসামা আর মেথরের বাচ্চারা সুলতানের ওপর চিলের মতো ঝাঁপটা মারল, আর ভিখিরির বাচ্চারা সব গুলি কেড়ে নিয়ে গেল। সুলতান অনেক কাঁদল, কিন্তু গুলি সে ফেরত পেল না আর।
সুলতান তবু ফাঁক ফেলেই ওই মাঠে যায়। মাঠে যাওয়া একটা নেশার মতো। মাঠটা যেন তাকে চুম্বকের মতো টানে।
আর, মাঠে এলে ফিরতে ইচ্ছে করে না সুলতানের। দাদার হাতের পাঞ্জাটাকে সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। সেই হাতে রস নেই, কষ নেই। শক্ত। শুকনো কাঠের মতো। সেই কাঠে কী ধার। সুলতানের মগজের ভেতরে যেন সেটা কেটে বসে যেতে চায়। সুলতান জানে, সকাল হলেই তাকে উঠতে হবে। উঠে মাথার উপর চাপিয়ে নিতে হবে হাতের পাঁচটা আঙুল। আঙুল নয়, যেন লোহার পাঁচটা শলা।
ঘুমিয়ে থাকলেও দাদার হাত মাথার উপর টের পায় সুলতান। হাতটা যেন একটা পিঞ্জর, আর সুলতানের উকুনে-ভরা-মাথাটা একটা পাখি। পিঞ্জর থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই তার।
রাস্তা দিয়ে দাদাকে নিয়ে যখন চলে, তখন মনে হয়, কয়েদ খাটতে যাচ্ছে সে, সেপাই হাত-কড়া দিয়ে চোরকে বেঁধে নিয়ে গেলে চোরের না-গিয়ে যেমন কোনো উপায় থাকে না, সুলতানেরও না-গিয়ে তেমনি কোনো উপায় নেই।
দাদা আখ খেতে নিষেধ করে, কিন্তু আখের দিকেই তার টান বেশি। আখঅলার ঠেলাগাড়ি থেকে দু-একটা গোল্লা গড়িয়ে নালায় পড়লে সে ছুটে গিয়ে কুড়িয়ে এনে মজা করে খায়। দাদাকে নিয়ে পথ চলতে চলতে পায়ের কাছে বাবুদের-ফেলে দেওয়া কলার খোসা চোখে পড়লে কুড়িয়ে নেয়। সেই খোসাতে ইঁদুরের মতো দাঁত বসিয়ে মজ্জা বের করে আনে। বাদামের খোসা পেলে তুলে নিয়ে দেখে, আস্ত, না, ছাড়ানো।
রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে নানাভাবে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা কম করে না সুলতান। কিন্তু সুলতানের মাথায় রাখা আঙুলের ডগা দিয়েই দাদা অনেক আগে টের পেয়ে যায় সুলতানের ফন্দি। কখনো বকে, গাল দেয়। কখনো বোঝায়। বলে, ‘আমি মরলেই তোর ছুটি, তখন তুই যা-খুশি করে বেড়াবি। লোকের হাতে কত মার খাবি। তখন তুই নিজে নিজেই বুঝতে শিখবি, কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ। কিন্তু যদ্দিন না-মরছি, তোকে ছাড়া আমি ভিখ করব কেমন করে, বল। দিন পোয়ালে চারটি গণ্ডা পয়সা জেবুর হাতে তুলে না-দিলে রুটি খাবি কী দিয়ে?’
অনেকদিন আগের কথা, মেথরপট্টির পেছনে বেগু টাঙাঅলার গাড়ির নিচে দাদা-পোতায় জড়াজড়ি করে রাত কাটাত। একদিন সাহেবপাড়া থেকে ভিক্ষা করে ফিরছিল। বেগুর মা জেবু এসে সামনে দাঁড়াল। ‘ফকির বাবা, আল্লার কাছে একটু দোআ করে দাও, আমার বেগুর যেন অসুখ সেরে যায়। এক টাকা মানত করেছি ফকির বাবা, আমি তোমাকে দেব।’
দাদা ওইখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে দোয়া করল।
আবার ক’দিন পর দাদা সুলতানকে নিয়ে ভিক্ষা করে ফিরছিল। জেবু সামনে এসে দাঁড়াল। দাদার হাতে একটা টাকা দিয়ে বলল, ‘ফকির বাবা, তোমরা বাইরে পড়ে থাক আমার ছেলে বলছিল, ওতে আমাদের পাপ হয়। তোমরা আজ থেকে আমার এই কুঁড়েঘরেই থাকবে।’
সেদিন থেকে ওরা জেবুদের কুঁড়েঘরে এক কোণায় জায়গা পেয়ে গেল। ওরা দিনমান ভিক্ষা করে যা পায়, জেবুর হাতে তুলে দেয়। বিনিময়ে জেবু ওদের রুটি খেতে দেয় দু’বেলা!
সুলতান যে কেবল দাদাকে দেখতে পারে না, তাই নয়– জেবু খালাও দু’চাখের বিষ দাদাকে ঘরে তুলে খেলার মাঠে রওনা দেওয়ার সময় ধরা পড়লে পড়তে হয় এক জেবু খালারই হাতে। আর, ধরা পড়লে অমনি জেবু খালা বলবে, ‘দেখেছ, বাবু এখন খেলতে চললেন। বুড়ো, অন্ধ, দাদাটাকে একলা ফেলে রেখে খেলতে যাওয়া– এ কেমনধারা আক্কেল বল দেখিনি?’
তাই শুনে দাদাও হয়তো অমনি বলে বসবে, ‘ওরে সুলতান, যাসনে ভাই। তার চাইতে চল, চৌরঙ্গিতে একটা চক্কর দিয়ে আসি। দুটো পয়সা বেশি পেলে কালকে তোর ছুটি।’
কিন্তু সুলতান জানে, ছুটি সে কোনোদিনই পাবে না। দুটো পয়সা বেশি পাওয়াও হয় না, ছুটিও মেলে না।
তবে ক’দিন থেকে দাদার হাঁপানিটা বেড়েছে। এই হাঁপানি যেদিন মাঝরাত্রে শুরু হয়, সেদিন বেলা উঠলেও শেষ হয় না। কাশতে কাশতে দম আটকে আসে। সেদিন আর ভিক্ষা করতে বের হয় না তারা।
কিন্তু সুলতানের তবু ছুটি নেই। সারাদিন বসে বসে সে দাদার পিঠ আর বুকে মালিশ করে, পাছা আর মাজা টিপে দেয়। তাতে অল্প খানিক আরাম হয় দাদার। সুলতানের হাত থেমে গেলে দাদা কাশির দাপট আটকে রেখে বহু কষ্টে টেনে টেনে বলে, ‘কি সুলতান, মরলি নাকি?’
সুলতান সঙ্গে সঙ্গে আবার টিপতে শুরু করে দিয়ে মনে মনে বলে, তুই মর, দাদা। কী মজাই-না হয় তুই মরলে— খোদার কসম। আল্লা আল্লা করে তুই মর, এখনই মর। তাহলে আমি সাহেবপাড়ায় গিয়ে সারাদিন মাথায় বাতাস লাগিয়ে কাটাতে পারি।
তারপর, দাদা একদিন সত্যি সত্যি মরে গেল। সেদিন হাঁপানির টান খুব বেড়েছিল। সারারাত দুই হাঁটুতে মুখ গুঁজে সে টেনে টেনে কাশল। দাদার পিঠে মালিশ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল সুলতান। আর দাদা কাশতে কাশতে দম আটকে মরে গেল।
সকালবেলায় সুলতান যখন উঠল তখন জেবু কাঁদছিল। জেবু বলল, ‘তোর দাদা মরেছে রে।’
‘সত্যি?’ সুলতানের যেন বিশ্বাসই হতে চায় না। দাদারাও যে মরতে পারে, তা তো কোনোদিন সে শোনেনি। এখন সে শুনল। নিজের চোখে দেখল। দেখে যখন বিশ্বাস হল, দাদা মরেছে, তখন তার মনের বাগানে ফুলঝুরির ফুলকি ছুটল।
বেগু টাঙাঅলা পাড়া-প্রতিবেশীদের ডেকে এনে জড়ো করল। দাদাকে নাইয়ে-ধুইয়ে কবর দিতে নিয়ে গেল তারা।
সারাদিন জেবু খালা কাঁদল আর সুলতানকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলাল। বেগু টাঙাঅলা দাদাকে মাটি দিয়ে যখন ফিরল, সুলতানের হাতে তুলে দিল সে একমুঠো আখের গোল্লা। তাই সে সন্ধ্যা পর্যন্ত চিবোল আর চুষল। মনে মনে বলল, খোদার কসম, দাদা মরলে কত লাভ।
রাত্রেও জেবু খালা সুলতানকে দাদার খাঁটিয়ায় শুতে দিল না। বাচ্চা ছেলে, রাত্রে ঘুম ভেঙে অন্ধকারে একলা ভয় পেতে পারে। সে নিজের কাছে বুকের সঙ্গে সুলতানকে জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়াল।
সকাল হলে জেবু খালা জব্বর নাশতা খাওয়াল সুলতানকে। দইয়ের সঙ্গে গুড় মেশানো; তার সঙ্গে পুরো একটা বাসি রুটি। খেয়েদেয়ে সুলতান মনের ফুর্তিতে বাইরের দিকে পা বাড়াল।
জেবু খালা জিগ্যেস করল, ‘কোথায় চললি, বাপ?’
এই প্রশ্ন অদ্ভুত ঠেকল সুলতানের কানে। যেখানে খুশি যাচ্ছে সে। দাদা তো মরেই গেছে। তবে আবার কোথায় যাচ্ছে, তা জেনে কার কী লাভ?
নীরব দেখে খালা বলল, ‘ছি বাবা, ভিখিরির বাচ্চার খেললে চলে!’ তারপর সে সুলতানের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এল। সেই হাতে তুলে দিল টিনের বাটি। ‘বাটিটাকে ঝুলিয়ে রাখিসনে যেন— উঁচু করে তুলে ধরবি। ঝুলিয়ে রাখলে লোকে ভাববে, ভিখিরি নয়, সওদা করতে যাচ্ছে।’
সুলতান নীরবে তুলে নিল বাটিটা। বাইরে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর, আবার ঘরে ফিরে এল এমনভাবে, যেন কোনো জিনিস নিতে ভুলে গিয়েছে। কিন্তু না। জেবু খালার সামনাসামনি হতেই খালাকে সে জড়িয়ে ধরল। খালার পেটের নিচে মুখ গুঁজে দিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল সুলতান, আর ছটফট করতে থাকল তাকে জড়িয়ে ধরে।
খালা বলল, ‘ভিখিরির বাচ্চা ভিখ না মাংলে খাবি কী? আজকে যদি তুই আট-দশ আনা আনতে পারিস, আমি তোকে খুশবু চালের ক্ষীর খাওয়াব দেখিস। আল্লার নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়, বাছা– দেরি করিসনে।’
কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল সুলতান। কাঁদতে কাঁদতে গাড়ি-ঘোড়ার ভিড়ে বড় রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। কাঁদতে কাঁদতে টিনের বাটি মেলে সামনে। ‘বাবুজি, অন্ধ মিস্কিনকে দুটো পয়সা খয়রাত দিয়ে যাও। বাবুজি–‘ দাদার ভাষা তার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। মুখস্থ বুলিই তার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল আপনা-আপনি।
‘কী বললি? অন্ধ? তুই অন্ধ?’ পথচারী বাবুর কঠোর প্রশ্ন।
সুলতান এই ভুল সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলল। কেবল মাথা নাড়িয়ে জানাল, সে অন্ধ নয়। আর, ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল।
‘মিথ্যে বলছিস, আবার উল্টো কাঁদছিস?’
এ যেন প্রশ্ন নয়– শাসন। এ শাসন বুঝি অনেক বেশি কড়া দাদার শাসনের চাইতে। সুলতান শাসনের কাছে মাথা নত করে দিল। কিছুই সে বলতে পারল না মুখ ফুটে।
‘চাকরি করবি? বাসার কাজ?’
সুলতান কেবল কেঁদেই যাচ্ছে। এসব প্রশ্নের অর্থ জানা নেই তার।
উত্তর না-পেয়ে বাবু চলে গেলেন।
অমনি যেন সম্বিত ফিরে পেল সুলতান। ‘হেই বাবু, দুটো পয়সা দিয়ে যাও। আল্লার রাহে খয়রাত করে যাও, বাবু।’
বাবু আবার ফিরে একবার তাকালেন। তারপর আবার হনহন করে চলে যেতে লাগলেন নিজের কাজে। সুলতান ভাবল, না-জানি আবার কী ভুল কথা বলে ফেলল সে।
‘হেই বাবু, হেই বাবুজি– ‘ সুলতান দৌড়াতে লাগল মরিয়া হয়ে তাঁর পিছু পিছু।
বাবু থামলেন। ‘কি, চাকরি করবি নাকি, বল!’ আরো কিছু লোক জুটে গেল সেখানে।
‘বাবুজি… ‘হাঁপাতে হাঁপাতে সুলতান তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার নিচের ঠোঁটটা ঝুলে পড়ল। ‘বাবুজি, ভিখ চাই না, চাকরি চাই না।’ টিনের বাটিটা সে পটকে দিল রাস্তায়।
‘তাহলে আমাকে ডাকলি কেন?’
অপ্রতিরোধ্য, অজস্র বারিধারা সুলতানের দু’চোখের গহ্বরে ভিড় জমাল। তার ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগল থরথর করে। অনকে কষ্টে কেটে কেটে বলল, ‘বাবুজি, খোদায় আপনার ভালো করবে। আমার মাথায় হাত রেখে খানিকদূর আপনি আমার সঙ্গে চলতে পারবেন?’
‘শোনো কথা।’ চারপাশের ভিড় জমানো লোকদের পানে বোকার মতো চেয়ে
থাকলেন ভদ্রলোক।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
দুশমন – আবুল ফজল সিদ্দিকি
সকাল থেকে ছুটে বেড়াতে বেড়াতে দুপুর হয়ে গেল। বসন্তের রোদ্দুরে রীতিমতো কড়া আমেজ লাগছে এবার। পরনে কাপড়-চোপড় নেহাত কম নয়। তা-ও বোঝা হয়ে উঠছে। সেতারার পা দু’খানাও ভারি হয়ে এসেছে। ক্লান্ত পায়ে হাঁটছে এখন সেতারা। যা অবস্থা, তাতে জানটা এমনিতেই ছুটে বেরিয়ে যেতে চায়। মনে চেপে বসে ক্লান্তির বোঝা। তার ওপরে আবার এদিকে আর-এক কাণ্ড। ভারি চমৎকার সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল একটা কিন্তু সবই ফসকে গেছে। আর তারপর শুরু হয়েছে গরম। গলাটা শুকিয়ে আসছে।
বসন্তের রং-লাগা দূরবিসারী বনরেখাটা স্বচ্ছ নীল আকাশের নিচে নির্বাক আলোর ঝরনায় নেয়ে ঝলমল করছে। বারবার চোখ দুটি দূর দূর প্রান্তে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আশা এই, সঙ্গীদের দেখা পেলে হয়তো কাছাকাছি একটা রাস্তার সন্ধান মিলবে। কিন্তু সামনে আমার বিজন তেপান্তর। যতদূর চোখ যায়, ভেজা, কালো কাদাটে পলির বিস্তার। পথের রেখা পড়াই সম্ভব নয় এ-মাটিতে। সেতারার খুরের ছাপটা পর্যন্ত এই কাদাটে ভেজা মাটিতে পড়তে না-পড়তে ভেঙে-চুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমার ডান পাশ আর পেছন দিক ঘিরে গঙ্গার চকচকে জলধারা। সদ্য-গলা বরফের জলে থই থই করছে নদী। গতিভঙ্গে বসন্তের এক অদ্ভূত মদিরতা মাখানো। বাঁ-দিকে মাইল দুই-তিন দূরে মানুষ-সমান ঝাউ আর ফণিমনসার ঘন জঙ্গল। দেখে বোঝা মুশকিল, কতখানি জায়গা জুড়ে আছে। এদিকে সামনের মাঠখানা দিগন্তের কোলে গিয়ে মিশেছে। কোন দিক দিয়ে এগালে যে উদ্ধার পাব, কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
এহেন অবস্থায় সওয়ারির পক্ষে সবচেয়ে ভালো পন্থা হল সওয়ারের প্রাণীটির প্রকৃতির হাতেই আত্মসমর্পণ করা। আমিও লাগাম ঢিলে করে দিয়েছি। নিশ্চিন্ত আছি, সেতারা সামান্য একটু এগোলেই আস্তানায় পৌঁছে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে এ-আশাও আছে যে, প্রকৃতি এবং ঘ্রাণশক্তির গুণে জঙ্গলে হারিয়ে ফেলা আমার সঙ্গীদের সন্ধান করতে করতেও এগোতে পারবে সে।
জায়গাটা আমার অপরিচিত। জীবনে এই প্রথম বড় সাহস করে শিকারের ছলে একটা কূট উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছি। এমনিতে জায়গাটা আমার এক দূর সম্পর্কের নিঃসন্তান চাচার কাছ থেকে উত্তরাধিকারের সিঁড়ি ভেঙে পাওয়া। এই সঙ্গে উত্তরাধিকার সূত্রে ঝগড়া-বিবাদ এবং মামলাবাজিও পেয়েছি। পথের কাঁটা সিং বাবু। এ-তল্লাটের এক জাঁদরেল গেঁয়ো রাজপুত। নদীর পার বরাবর একটুখানি জমির স্বত্বকে শিখণ্ডী করে তিনি এই এলাকার জবর-দখল নিয়ে জমিয়ে বসেছেন। প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে দেওয়ানি আদালতে একাধিক রায় এবং মাপ-জরিপের দুই-তিনটি প্রস্তাবও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। পুলিশ পর্যন্ত আমাদের সাহায্য করতে বা তাঁকে ভাগাতে পারেনি।
সিং বাবু দল পাকাতে ওস্তাদ এবং খুনি কিসিমের মানুষ। শিকারের বড় ভক্ত। জানে ভয়-ডর এতই কম যে, বে-আইনিভাবে লাইসেন্সহীন হাতিয়ার নিয়ে দিন-দুপুরে শিকার করে বেড়ান। এ-এলাকার আশপাশে বহুদূর তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষী প্রমাণ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। সারা তল্লাটে তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেমন-তেমন সরকারি হুকুমটা প্রচারেরও উপায় নেই। মুশকিলের ব্যাপার হল, জবাবদিহি করতে বা ওজর-আপত্তি জানাতে আদালতেও তিনি কদাচিৎ আসেন। উকিলের মারফত উল্টো-সিধে একটা মামলা রুজু করে দিলেন তো দিলেন। নতুবা রইলেন মওকার অপেক্ষায়। মরহুম চাচাজান কয়েকবার আদালত থেকে আইন মোতাবেক দখল পেয়েছিলেন। কিন্তু সত্যিকারের দখল আর তিনি নিতে পারলেন না। আর এক দফা নালিশ করলেন তিনি এবং আর এক দফা ডিক্রিও পেলেন। কিন্তু ফল যে-কে সেই। এমনি করে করে বারো বছর পার হয়ে গেল এবং এইভাবে জবরদখলই সিং বাবুর স্বত্বের নির্ভর হয়ে উঠল।
চাচাজান মামলা করে যা ফল পেয়েছিলেন, দু’বছর মামলা করে আমিও তাই-ই পেলাম। তিনবার দখল পেলাম, কিন্তু একবারও স্বত্ব ভোগ করতে পারলাম না। শেষকালে আর ফৌজদারি-মারামারি আয়োজন না-করে এক বন্ধুর পরামর্শ মাফিক ধরলাম ভিন্ন পন্থা। এর প্রথম লক্ষ্য হল এলাকার সবচেয়ে উর্বর অংশে পাসিদের (পাখি-শিকারি উপজাতি) একটা গ্রাম বসিয়ে দেওয়া। কাজটা করতে হবে ধীরে ধীরে বিষ দেওয়ার মতো অব্যর্থ উপায়ে, অতি সুন্দর করে এবং ধীরে-সুস্থে। নইলে গ্রাম বসানো দূরে থাক, মহলে আমার লোকজন নিরাপদে আসতেই পারবে না। তাছাড়া, এত সহজে গ্রাম বসাতে তিনি দেবেনই-বা কেন?
কিন্তু পাসিরা আধা-যাযাবর জাত। ওদের অনেকগুলো দলের ওপর শিকারের সূত্রে আমার প্রভাবও আছে। ওদের ঝোঁক শিকার আর বন্য জীবনের দিকেই বেশি। হঠাৎ কখনো চাষ-আবাদের কাজও করে বসে। অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু সাহসী এবং শক্তিধর জাত। একটুখানি উপলক্ষ পেলেই অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে। শিকারে বেরোয় জানপ্রাণ কবুল করে। প্রাণ দেয়া-নেয়াকে মনে করে মামুলি ব্যাপার। এ-পথে আসতে হল আমায় উপায়ান্তর না দেখে। আমার কানে এমন ধরনের গুজবও এসেছিল যে, সিং বাবু আমায় খুন করাবার তাকে আছেন। কাছারিতে দুই-একবার চেষ্টা করেছিলাম, সিং বাবুর মুখখানাও যদি একবার দেখতে পাই। তাছাড়া, একটুখানি কৌতূহল ছিল। আমার মোকাবেলায় তাঁর প্রভাব- প্রতিপত্তির কথা তো ভালো করেই জানি। আরো শুনেছি, তিনি বড় বিলাসী শিকারিও। কিন্তু কাছারিতে, বিশেষ করে, আমার সঙ্গে মামলা চলবার সময় শুনেছি, এক-আধবার এমনিই কিছুক্ষণের জন্য এসেছেন। অথচ আমি তাঁকে দেখতেও পাইনি।
মহলের সবচাইতে উর্বর অংশে জায়গায় জায়গায় প্রতিবছরই নতুন নতুন সম্ভাবনার আভাস পাওয়া যায়। পরিকল্পনা মোতাবেক পাসিদের একটা শক্তিশালী, উদ্যমশীল দল অঞ্চলটা সুকৌশলে দখলে আনার উদ্দেশ্যে ওখানে গিয়ে আস্তানা গাড়ল। সিং বাবুর এতে চমকে ওঠার কোনো কারণ নেই। পরিকল্পনায় ছিল, প্রথম বছরে দখল নেয়া হবে। আর দ্বিতীয় বছরে হবে সিং বাবুকে খুন করা। কাজটা সারতে হবে একেবারে চুপ-চাপ করে। যাতে কাক-পক্ষীটিও টের না পায়। পাসিদের আর কী চাই!
উর্বর জমি আর শিকারের জীব-জানোয়ার, পাখ-পাখালিতে ভরা জঙ্গল। প্রথম বছরেই শীতের সময় আস্তানার চারপাশে গোপনে গোপনে মাটির দেয়াল মাথা তুলে দাঁড়াল। সিং বাবু ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে পারলেন না। গরম পড়বার সঙ্গে সঙ্গে এবং খড়কুটো শুকোতেই চালা উঠে গেল। তারপর সিং বাবুর বিস্ময় কাটতে না-কাটতেই, বর্ষা নামবার সঙ্গে সঙ্গে চালার আশেপাশে মোষের লাঙল চলা শুরু হল। পরের বর্ষাতেই শ্যামল গ্রামখানা পাকাপোক্ত হয়ে উঠতে দেখা গেল।
কিন্তু গ্রাম পাকাপোক্ত হওয়ার পরও সিং বাবু চুপ করে বসে রইলেন। ফসল ওঠার সময় তক্ সবকিছু মুলতবি রাখলেন। কিন্তু যখন ধান আর জোয়ারের ভাগ-বাঁটোয়ারার জন্যে তাঁর লোকজন এসে হাজির হল, তখন পাসিরা তাদের হাঁকিয়ে দিল। এতদিনে তিনি বুঝতে পারলেন, কোন পরিকল্পনা মোতাবেক গ্রাম হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে একথাও বুঝলেন, লড়াইটা সহজ নয়। পাঁচ হাজার বছরের পুরনো কেচ্ছার পুনরাবৃত্তি না-হয় শেষকালে।
পাসিদের সঙ্গে আমার চুক্তি ছিল, প্রথম বছরে যতখানি জায়গা ওরা ভোগদখলে আনতে পারবে তার জন্যে চিরকালের মতো খাজনা মাফ এবং এই দানের কথার মধ্যেই সিং বাবুকে খুন করার ব্যাপারটা গোপনে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল। দু’বছর পার হয়ে তৃতীয় বছর এল। এই তিন বছর ধরে আমি আমার গোয়েন্দা বিভাগটা ক্রমেই সক্রিয় করে তুলেছি। খবরাখবরও বরাবরই পেয়েছি। সিং বাবু আমায় খুন করবার ষড়যন্ত্র করছেন, এমন আভাসও পেয়েছি দুই-একবার। কিন্তু এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এ তো স্বাভাবিক ব্যাপার।
আমি থাকি এখান থেকে একশো-সোয়াশো মাইল দূরে এবং গ্রামে। এ-জায়গাটা থেকে পাকা রাস্তা এবং রেললাইন পনেরো-বিশ মাইল। তবু মাঝে মাঝে একটু গোলমেলে খবর কানে আসে বলে বাড়িতে রাত্রিবেলা আত্মরক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হয়। কিন্তু ‘পাস-গাঁও’ বসবার দু’বছর পর চৈতালি ফসল ওঠার আগে আমার একবার কূট উদ্দেশ্যে মহালে আসতে হল। আমার লোকজন খবর দিয়েছিল, পাসিরা অনেক বেশি জমি আবাদ করে নিয়েছে। এদিকে দু’বছর ফসল হয়েছে প্রচুর। এ কয় বছরের আবাদি জমির খাজনা আদায় করা দরকার এবার। কিন্তু পাসিরা ভাবছে, বাছাধন ভয়ের চোটে এ-এলাকায় ঢুকতে পারছে না। সিং বাবুকেও তাই তারা মেরে ফেলেনি এখনো। তাঁকে মেরে ফেললে তো আমার আর ভয়ের কিছুই থাকবে না। আমি তখন আইন-মাফিক খাজনা উসুল করতে শুরু করে দেব। এমন করলে যা হয়ে থাকে পাসিরা পাস-গাঁওকে স্বাধীন লাখেরাজ রাজ্য করে নিয়েছে। আর, প্রতি বর্ষায় এই রাজ্যের সীমানা বাড়িয়ে চলেছে।
সিং বাবুর ভয়ে আমি মহালে ঢুকতে পারিনে, পারসিদের এই ভুল ধারণাটা ভেঙে দিয়ে যাব, শুধুমাত্র এই উদ্দেশ্যে এখানে আসতে আমার ভালো লাগেনি। যদিচ ধারণাটা না-পাল্টালে আমার একটু বিপদও ছিল। আশঙ্কা করছিলাম, এই পাসিরাই-না শেষটায় চেপে বসে। মাপ-জরিপ, খোঁজ-খবর আর উসুল-পত্তরের নাম করে তাই চলেই এসেছি। এবং থেকেও গেছি কয়েকদিন। জানি, সিং বাবুর পথের সবচেয়ে বড় কাঁটা আমিই এবং এই কাঁটা সরিয়ে তিনি পাসিদের সাজানো-গোছানো গাঁওখানা অতি সহজেই অধিকারে আনতে পারেন। তিনি তো এমনিতেই আমায় সাবড়ে দেওয়ার মতলবে ছিলেন। এখন আবার তার ওপর নতুন প্রলোভন জুটেছে। কিন্তু পাসিদেরও তো খুব বেশি প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। চুক্তি যা ছিল, তাতে দ্বিতীয় বছরের শেষেই খাজনা-পত্তর আদায় করা উচিত ছিল। এখন তো তৃতীয় বছর চলছে। সুতরাং উপায় নেই। প্রাণ বিপন্ন করেও আসতেই হল। ভেবে রেখেছিলাম দু’সপ্তাহ থাকব। মহালের পাসিরা বড় আদর-আপ্যায়ন করল। পরদিনই আমার মন থেকে ভয়ও কেটে গেল।
পাসিরা আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতাটারও খবর রাখে। তিন বছরে স্বভাবটা একটুখানি চাষি-মার্কাও হয়েছে বটে। তারা খুব ভালো করে জানে, আমি শিকারের ভক্ত। হাজার হলেও পুরনো সঙ্গী তো তারা। অত্যন্ত গর্বভরে জানাল, দু’বছরের মধ্যে সিং বাবু আমাদের এলাকায় শিকারেও আসতে পারেননি। তেল ঢেলে ঢেলে তোষামোদের সুরে বলল, আপনি আসবেন, তাই এ-দু’বছর জঙ্গলের মাত্তর বিশেষ বিশেষ এলাকায় পশুপাখি শিকার করে খেয়েছি আমরা। আপনি শিকারে গেলে ভারি চমৎকার হবে।
মহালে আসার দিন তিনেক পরই শিকারের উত্তেজনায় ডুবিয়ে আমায় জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিল তারা। এমনিতে তো আমি জানিও, আমার ‘পিগ্ স্টিকিং’-এর শখ এইখানেই মিটতে পারে। পাঁচ হাজার বছরের পুরনা জিনিস এই ‘পিগ্ স্টিকিং’। মানুষ যখন ঘোড়া আর কুকুরকে পোষ মানিয়েছে, তার সংস্কৃতির কাফেলা যখন পর্বতগুহার আশ্রয় ছেড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে কুঞ্জকুটিরের দিকে ছুটেছে, পশুপালনের মধ্যে যখন দেখা দিচ্ছে অর্থনীতির আদিমতম সূত্র, সেই তখনকার। আজ, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, কৃষ্টি ও সভ্যতার সৃজনের ভিড় থেকে পালিয়ে আমরা মাঝে মাঝে ফ্রি স্টাইল কুস্তি আর ‘পিগ্ স্টিকিং’-এর মতো খেলা শুরু করে দিই। হাল্কা একখানি বর্শা, শিক্ষিত এবং দ্রুতগতির একটা ঘোড়া আর নিজের হাত-পা নিয়ে পাথরের মতো বুনো শুয়োরের সঙ্গে লড়াই জুড়ি। ‘পিগ্ স্টিকিং’ শিকারের জবরদস্তির স্তরের চূড়ান্ত। নির্ভেজাল শিকার।
পাসিরা ফণিমনসা আর ঝাউবনের কয়েক জায়গা থেকে হই-হই করে মাঠের মধ্যে শুয়োর বার করে নিয়ে এল। কিন্তু আমার বরাতে প্রত্যেক বারই ফস্কা গেরো। সকাল ছ’টা থেকে দুপুর বারোটা তক্ ঠায় ঘোড়ার পিঠে বসে থেকে থেকে সর্বাঙ্গ ব্যথা হয়ে গেল। সেতারাও ক্লান্ত হয়ে পড়ল। আর, সেই ক্লান্তির বোঝার উপর শাকের আঁটি হয়ে দাঁড়াল একটা ব্যর্থতা। মাইলের পর মাইল এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করবার পর এখন ফিরে চলেছি। প্রচণ্ড তেষ্টায় মনে হচ্ছে, গলা থেকে পেটের তলা তক্ কাঠের একটা ছুঁচল ডাণ্ডা ঢুকিয়ে রেখেছে যেন কেউ। মাথায় রুমাল বাঁধা কিন্তু তার মধ্যে দিয়েই সুচের ডগার মতো রোদ বিঁধছে যেন মাথায়। পয়লা দিনেই চার-পাঁচটা গুলি ফসকে গেল। এদিকে কতকালের নিঝুম বন এখন সরগরম। কাল যে কিছু হবে সে-আশা বড় কম। সঙ্গীরা কোথায় উধাও হয়ে গেছে। ছুটোছুটি করতে করতে সীমা-সরহদ্দের খেয়ালও রাখিনি।
সেতারার সহজাত প্রবৃত্তির ওপর নিশ্চিন্ত নির্ভর করে তার পিঠে চাপিয়ে দেওয়া বোঝার মতো হয়ে ঢিমে তেতালে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। চোখ তুলে দেখি, চারদিক একেবারে নির্জন। জায়গাটা একান্তই অজানা-অচেনা লাগে যেন। সেতারা আমায় কোথায় নিয়ে চলেছে, কে জানে। আমারই মতো ও-ও তো এই প্রথম এসেছে এখানে। হতভাগা ব্যাধগুলোই-বা কোথায় গায়েব হয়ে গেল?
সকাল থেকে এতক্ষণ অবধি যে-পথে পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, মনে মনে আবার তার একটা নকশা আঁকার চেষ্টা করলাম। সেই সাথে পাস-গাঁওয়ের সঠিক সীমানা-সরহদ্দের একটা আন্দাজও। আশেপাশে দূর-দূরান্তে নজর বুলিয়ে বুলিয়ে ভালো করে দেখে নিলাম জায়গাটা, কিন্তু কোনো তাল-মানই পাওয়া গেল না তবু। এই তেপান্তরে আমি একলা। পরিবেশ অপরিচিত। এবার ভয়-ভয় করতে লাগল আমার। মনের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, কোথায় চলেছি?… তিনি তো এ-অঞ্চলের বাঘ। আমায় নিশ্চয়ই চেনেন। অথচ আমি তাঁকে চিনিও না। তিনি পেছনে-না লাগেন! সারাটা গা শিউরে উঠল আমার।
চোখ দুটি দূর-দূরান্তে ছুটে বেড়াতে লাগল এবার। ডান হাতে ঝোলানো বর্শাখানা আপনা থেকেই শক্ত মুঠোর মধ্যে খাড়া হয়ে উঠল। বাঁ হাতে লাগাম ধরা। কিন্তু কনুইটা হান্টিং কোটের পকেট হাতড়াতে লাগল। পকেটে ন’টা গুলিভরা রিভলবার পড়ে রয়েছে। আবার মনে পড়ল, সিং বাবুও তো শুনেছি পাঁড় শিকারি। এ-এলাকায় সর্বত্র তাঁর বাহাদুরির অপ্রতিহত প্রশংসা। তাঁর সাথে শিকারে নামব, এমন সুযোগ আর পাই কী করে? কিন্তু খোদা বাঁচিয়ে রাখলে একদিন তাঁর সাথে মোকাবেলাই হয়ে যাবে। মনে মনে ভাবতে থাকি, তিনি তো গোঁয়ার আনাড়ি কিসিমের শিকারি। আর আমি রীতিমতো বৈজ্ঞানিক কায়দায় লক্ষ্যভেদ করতে শিখেছি। কিন্তু বন্দুকের মুখোমুখি হওয়াটা বড় খারাপ জিনিস। এ-লড়াইয়ে তাকেই বলা হয় বাহাদুর, যার হাত প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতের আগেই ইঞ্চিটাক উপরে উঠে যায়। তারপর সে-হাত ফেরবার পথে পয়লা চোটেই সামনে যা-ই পাক, তার বুক ফুঁড়ে গুলি পার করে দেয়।
আর একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম। আমার একাকিত্ব আর আশপাশের নির্জনতা আরো ভয়ঙ্কর মনে হল এবার। আচ্ছা, এই ব্যাধ শালারা রয়েছে কী করতে? আজই গিয়ে ঘোষণা করে দেব, দু’বছরের খাজনাই মাফ। শর্ত শুধু এই যে, এবারের ফসল উঠতে উঠতে সিং বাবুকে সাবাড় করে ফেলতে হবে। মহালটা এবার ঘুরে-ফিরে দেখতেও যাচ্ছি। পাসিদের সাহসটা এতে বাড়বে। সিং বাবুকে দেখে এখনো যে এক-আধটু ভয় আছে তাদের, তা-ও কেটে যাবে। খবর পেয়েছি, গোটা মহলে আমার সফরের কথাটা খুব ছড়িয়েছে এবং তাতে করে আমার পথের কাঁটার সম্মানেরও যথেষ্ট হানি হয়েছে।
.
একটুখানি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে না-ফেলতেই হঠাৎ সেতারা মোড় ফিরতে শুরু করল। সেতারার দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণু থেকে আগুনের ফুলকি ছিটকে বেরুচ্ছে যেন এবার। চোখ দুটি তেপান্তরের দূর-দূরান্তে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওর চোখ বরাবর চোখ তুলতেই দেখি, অনেক দূরে মাঠের মধ্যে দিয়ে একটা শুয়োর হেঁটে যাচ্ছে। অত্যন্ত নিশ্চিন্ত মনে, ঢিমেতেতালে পা ফেলে ফেলে। দেখেই বোঝা যায়, ‘ইকড়া’ শুয়োর শুয়োর যূথচারী বুনো জানোয়ার। একলা যে থাকে, তাকে অত্যন্ত বিব্রত দেখায়। একা দেখলেই বুঝতে হবে, সে ‘ইকড়া’ শুয়োর। ‘ইকড়া’ সাধারণ শুয়োরের দল থেকে আলাদা হয়ে নিজের জুটি নিয়ে থাকে। তার কাজ দলের শুয়োরের সঙ্গে লড়াই করা, আর সবার খাবারে পোদ্দারি করা। গায়ে তার অসুরের বল, মনে মনে সে স্ফূর্তিবাজ। শিকারিকে সে দেখলেই চিনতে পারে। আর কিছু না-হোক, ষোলো আনা প্রকৃতি তার শুয়োর প্রকৃতির বিপরীত। গ্রামবাসী, জংলি চাষি আর শিকারির ভাষায় তার নাম ‘ইকড়া’। সব জঙ্গলেই দুই-একটা ইকড়া থাকে। সীমানা-বাঁধা এলাকায় তারা একচ্ছত্রাধিপতি। সেখানে আর কারো মাথা গলানোর উপায় নেই।
সেতারার চোখ বারবার ওঠানামা করছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও দেখলাম শুয়োরটাকে। সঙ্গে সঙ্গে আপনা থেকেই সামলে বসে ‘পজিশন’ নিলাম। সেতারার ইতি-উতি ছোটাছুটিতে এখন আর সে-তেজ নেই। চোখ দুটি বারবার ওঠানামা করছে। চোখে তীব্র দৃষ্টি, কিন্তু কোণে কোণে হরিণীর ভয় চিক্ চিক্ করে। লাগামটা একটু ঢিলে করে দিয়ে আমি ‘পজিশন’ নিতেই দেহে তার বিদ্যুতের শিহরণ খেলে যেতে লাগল। ‘পিগ্ স্টিকিং’ আর পোলোর ঘোড়া ভারি বুদ্ধিমান হয়। শিকারে সে সওয়ারের থেকে কম মনোযোগী নয়।
আস্তে আস্তে পিঠ চাপড়াতে লাগলাম সেতারার। সেতারা অত্যন্ত মিষ্টি সুরে হি-হি করে জবাব দিল তার। বর্গাখানি একটু শক্ত হাতে সোজা করে ধরতেই উৎসাহের আতিশয্যে লাফিয়ে উঠল সেতারা। এই বুঝি দৌড় শুরু করে দেয় সে। আমি ক্লান্ত। কিন্তু আমার চেয়েও বেশি ক্লান্ত সেতারা। দুজনেরই সে ক্লান্তি এবার হয়ে উঠল স্ফূর্তি। সকালবেলা প্রথম শিকার দেখে যে জোর আর উৎসাহ এসেছিল সেতারার সেই জোর আর উৎসাহই নেচে উঠল আবার তার দেহের শিরায় শিরায়।
কিন্তু শুয়োরটা এখনো অনেক দূরে। বিপদের গন্ধটুকুও পায়নি শুয়োরটা। এখনো পরম নিশ্চিন্ত মনে হাঁটছে সে। সুতরাং সেতারার লাগামটা টেনে ধর। দস্তুরমতো জোরে অবাধ গতিতে ছুটতে থাকুক সেতারা। মাঠের দুই দিকে নদী। শুয়োরটা আমার উল্টো দিকের পথ দিয়ে মাটি শুঁকতে শুঁকতে আস্তে আস্তে নদীর দিকে এগিয়ে চলেছে। ইঙ্গিত করতেই সিতারা বিদ্যুৎবেগে লাফ দিয়ে কদম তুলে তীরবেগে শুয়োরের দিকে ছুটে চলল।
শুয়োরটাও দৌড় ধরল এবার। কিন্তু সেতারার পায়ে শুয়োরের পায়ের থেকেও তীব্রতরো ঝড়। ব্যবধানটা এক মিনিটে মিলিয়ে গেল। চার পায়ে ভর দিয়ে শুয়োরের মাথায় চড়ে বসল যেন সেতারা। ‘পিগ্ স্টিকিং’-এর ঘোড়া সে। শিকারের সময় শিকারির চেয়ে বেশি রক্তপিপাসু হয়ে ওঠে ওরা। শিকারি তখন ওদের কাছে হাতিয়ারের মতো। আসল শিকারি ওরাই। বর্শার ফলা আর শুয়োরের চাকির ওপর একবার নজর বুলিয়ে নিয়েই গতি নিয়ন্ত্রিত করে চলতে থাকে। তারপর শিকারির একটুখানি ইঙ্গিতের অপেক্ষা মাত্র। ইঙ্গিত পেলেই সে গতি এক ঝটকায় রূপ পালটে ফেলে। সে বড় অদ্ভুত ঝট্কা। চোখের পলকে ছুটতে থাকে তখন ওরা। আবার, চোখের পলকেই দৌড় বন্ধ করে ঢিমে- তেতালে হাঁটতে তাকে। ঝঙ্কার সঙ্গে সঙ্গে বর্শার ফলাখানাও শুয়োরের পাঁজরের মধ্যে বিঁধে কলজে ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। শিকারির মনে হতে থাকে ঘোড়ার সমস্ত শক্তি বুঝি রূপান্তরিত হয়ে তাঁর হাতের মধ্যে এসে জমা হয়েছে। রেকাব, আসন, তাঁর হাত এবং লম্বা বর্শাখানা পর্যন্ত কী যেন যান্ত্রিক কৌশলে ঘোড়ার দেহের অংশ হয়ে যায় তখন। শিকারির ডান পাঁজর থেকে শুরু করে বাহু আর কব্জি হয়ে হাতের মুঠো তক্ মদির শিহরণ বয়ে যায় একটা। তখন একান্তভাবেই মনে হতে থাকে ঘোড়ার ঝট্কা বুঝি তাঁরই হাত থেকে বেরিয়ে আসছে, একেবারে তাঁরই দেহের মধ্যে জেগে উঠছে। শিকারি বা ঘোড়া এর কিছুই বুঝতে পারে না। এ জিনিস বুঝতে পারে শুধুমাত্র জহুরি।
এ-ঝট্কা লক্ষ্যচ্যুত হলে শিকারি মাঝে মাঝে সম্মোহিতের মতো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। তাকিয়ে দেখি, সেই কাণ্ডই। সোয়া তিন-মণি ধূসর শিলা বর্শার ফলার ধাক্কায় ঘোড়ার সামনে থেকে চার-পাঁচ গজ দূরে ছিটকে পড়ল। ঘোড়াকে হয়তো-বা সাবধান করতে ভুলই হয়েছে। দৌড় আর ঝঙ্কার মধ্যে তাল রক্ষা করতে পারল না সেতারা। জানি এমন প্রচণ্ড, এমন মাথা-ঘোরানো দুর্ঘটনায় হালকা বর্শাখানা এত শক্ত করে ধরবার ক্ষমতা শিকারির দুর্বল হাতখানায় থাকে না, যার জোরে তিন মণ ওজনের বস্তুটি ছিটকে গিয়ে পড়বে। এ হল শক্তি আর কৌশলের যাদুমন্ত্র। অমন ভেল্কিবাজি সম্ভব শুধুমাত্র ঘোড়ার শক্তি থেকেই। ঘোড়া যখন আর দৌড়ায় না, অথচ বিশেষ ঝট্কাও দেয় না, তখনই হয়তো-বা এমন কাণ্ড ঘটে।
ট্রেনিং পাওয়া ঘোড়া আক্রমণের জায়গা থেকে লাফ দিয়ে সরে যায় একটুখানি। তারপর চোখের পলকে থমকে দাঁড়িয়ে আক্রণের ফলাফলটা দেখে নেয় একবার। দরকার হলে আবার আক্রমণ করবে সেতারা, কিন্তু ভালো করে দাঁড়াবার অবসরও পেল না সে। তার আগেই দেখে হামলা হয়েছে তার উপর। স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করে বসল শুয়োরটা। একটুখানি বাঁকা হয়ে দাঁড়াল একবার, তারপরই কামানের জ্বলন্ত গোলার মতো লাফিয়ে পড়ল। শুয়োর তো নয়, মৃত্যু। মূর্তিমান যম। পাথরের মতো মুখ আর ধারালো দাঁত খাড়া করে সেতারার সামনের পা দু’খানার ফাঁকে বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল শুয়োরটা।
আর একটু হলে চাকি আর দাঁত দুটো ঝড়ের বেগে বুকে বিঁধে যেত সেতারার। কিন্তু বাহাদুর ঘোড়া বটে সেতারা! চোখের পলকে একেবারে লাঠির মতো খাড়া হয়ে দাঁড়াল। দ্বিতীয় হামলা হল ফিট দুয়েক পিছিয়ে। সেতারা এবার সামনের পায়ে ভর দিয়ে লাথি ঝাড়ল বার দুয়েক। আর একটু হলেই নাড়ি-ভুঁড়ি বেরিয়ে যেত সেতারার। কিন্তু কিছুই হল না। শুধু সেতারার কানের ডগা থেকে লেজ পর্যন্ত বিদ্যুৎ-সৃষ্টের শিহরণ প্রত্যক্ষ হয়ে উঠল একটা। উল্টোমুখো এই ধাক্কার তাল সামলায় কার সাধ্য। ওপরে একটা ডিগবাজি, একটা তলায়। তারপরই আমি একেবারে মাটিতে। দ্বিতীয়বারের ডিগবাজিতে শরীরের খানিকটা ঘোড়ার গায়ে ধাক্কা খেয়ে শুয়োরের উপর এসে পড়ল। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। শুয়োর হয়তো বুঝতেই পারল না, শিকারি এসে পড়েছে ঘাড়ে, না ভূত এসে পড়েছে। আর একটা লাফ দিয়ে ছিটকে উপরে উঠে গেল শুয়োরটা। ভালোয় ভালোয় কেটেছে বটে। জখম সামান্যই। একটা আছাড় খেয়ে উঠেই দে ছুট।
মজার ব্যাপার ঘটল এবার একটা। জীব-জানোয়ার কোনোদিন যা করে না, শুয়োরটা দেখি তাই করেছে। আমি যেদিক থেকে অনুসরণ করেছিলাম, সেই দিকেই ছুটছে। কিন্তু আমিও এক নিমেষে উঠে দাঁড়ালাম। ডিগবাজি খেয়ে যেমন প্রচণ্ড বেগে ছিটকে পড়েছিলাম, বুঝি-বা তেমনি জোরেই। বর্শাখানা পাশেই মাটিতে বিঁধে রয়েছে। সেতারা দৌড়ের ঝোঁকে আমার কাছ থেকে পঞ্চাশ-ষাট গজ দূরে গিয়ে পড়েছে। বর্শা তুলে নিয়ে সেতারার দিকে ছুটলাম। সেতারাও আমার দিকে ছুটতে শুরু করল।
.
সঙ্গিন মুহূর্ত। এইমাত্র একটা প্রচণ্ড দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। কিন্তু শিকারি এখন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। যে-শিকারি আজ এই প্রথম সাফল্য লাভ করেছে। কয়েক সেকেন্ড আগের দুর্ঘটনা থেকে যে বেঁচে বেরিয়েছি, তার গুরুত্বের কোনো ধারণাই মনের ভেতর নেই। ধারণা নেই, ‘পিগ্ স্টিকিং’-এর চেষ্টাটা মূর্খতা। যে-মূর্খতা মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে প্রকাশ করে আসছে। সামনে আধ মাইল দূরে শুয়োরটা পালিয়ে যাচ্ছে। রেকাবেও আর পা ছোঁয়ালাম না আমি। সেতারার কেশরগুলো একটু হাতের মুঠোয় নিয়ে বানরের মতো এক লাফে তার পিঠে উঠে বসলাম।
শুয়োরটাকে ধরে ফেলতে সেতারার দু’মিনিটও লাগল না। বর্ণা বাগিয়ে ঘোড়া নিয়ে ছুটেছি। শুয়োরটা ফার্লং খানিক আরো ছুটল। তারপর বর্শাখানা শুয়োরের কাঁধ লক্ষ্য করে বিশেষ এক তাকে বাগিয়ে ধরে ঘোড়াটাকে হুঁশিয়ার করতে যাচ্ছি। এমন সময় শুয়োরটা আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে হামলা করল। কিন্তু এবার বোধহয় সেতারা আগের থেকেই সজাগও ছিল এবং এমন অবস্থায় চলাও বন্ধ করেনি। দৌড়াচ্ছিল সেতারা। শুয়োরটা পা পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই আশ্চর্য কৌশলে সে দৌড় হয়ে গেল লাফ। চট্পটে খেলোয়াড়ের মতো পাঁয়তারা ভেঁজে একেবারে শুয়োরের পেছন দিকে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেতারা। শিকারিকে কৌশলের ঘাঁটিতে পৌঁছে দিয়ে আবার শিকারের লক্ষ্য ঠিক করে নিতে চাইল বুঝি সে। কিন্তু পড়ে গিয়ে সামলে ওঠারও সময় পেল না। শুয়োরটা সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় আক্রমণের জন্য তৈরি হয়ে দাঁড়াল। সেতারাও এক মুহূর্তেই কাটিয়ে দিল আক্রমণটা।
দুই-তিনটি হামলা তক্ আমার শিকারি স্পিরিট বজায় রইল। প্রতি মুহূর্তেই অপেক্ষা, শুয়োরটা পালাতে গেলেই বর্শা গেঁথে দেব। কিন্তু একবার হামলা হয় আর একবার হামলা কাটাই, এই করতে করতে মনটা কখন যে প্রতিরোধের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, টেরও পেলাম না। সেতারা কিন্তু সাপ-নেউলের খেলা খেলছে। প্রতিটি হামলা সে বাহাদুরের মতো পাঁয়তারা ভেঁজে কাটিয়ে দিচ্ছে। হামলায় তেজ ক্রমশই প্রচণ্ডতরো হয়ে উঠেছে। সেতারা দক্ষ ব্যায়াম-বীরের মতো ডাইনে-বাঁয়ে-পিছনে ঘুরে ঘুরে দশ-বারো মণের শরীরটা লাঠির মতো দুলিয়ে দুলিয়ে এদিক থেকে ওদিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে। পাথরের চাঁইয়ের মতো বিশাল-দেহ ‘ইকড়া’ শুয়োরটাও সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে লাফিয়ে লাফিয়ে কেবলই আক্রমণ করে চলেছে।
এতক্ষণ সেতারা শুধু প্রতিরোধই করেছে। শিকারের কথা যেন আর মনে নেই। গোড়াতেই বুঝেছিলাম, ব্যাপার বড় সুবিধের নয়। শুয়োরটাও জানে, শেষ পর্যন্ত লড়াই না-করলে তার বাঁচোয়া নেই। মিনিট তিন-চার মাত্র সময় গেছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যেন কত যুগ। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে, জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে ধাক্কা খেয়ে বেড়াচ্ছি। হতভাগা শুয়োরটা একটানা হামলা করে চলেছে। ঘোড়াটাকে এক পলকে সামলে নিয়ে মাঠ থেকে পালিয়ে যাব, সে ফাঁকটুকুও পাচ্ছিনে। স্রোতের মতো আক্রমণে ফাঁক যেটুকু পড়ছে, তা-ও একটানা লাফ-ঝাঁপে ভরা। আক্রমণের ফাঁকে-ফাঁকে সেতারা অতি কষ্টে নড়েচড়ে প্রতিরোধের জন্যে তৈরি হচ্ছে। একবার ভাবলাম বর্শা ফেলে দিয়ে রিভলভার বার করি। কিন্তু লাভ নেই তাতে, মাঝখান থেকে বর্শাটাও হাতছাড়া হবে।
আক্রমণের প্রচণ্ডতা বেড়েই চলেছে। প্রতিটি হামলায়ই সেতারা কানের কাছ দিয়ে বেঁচে যাচ্ছে, আর আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে মাটিতে রাশ হয়ে পড়া সেতারার নাড়ি-ভুঁড়ি। সঙ্গে সঙ্গে নিজের পরিণামটাও দেখতে পাচ্ছি যেন ছায়াছবির পর্দায়।
আরো মিনিট তিন-চার কাটল। মৃত্যু এখন মিনিটে দু’বার করে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। সেতারা গুছিয়ে দাঁড়াতে না-দাঁড়াতেই দানবটা হামলার জন্য তৈরি হয়ে যাচ্ছে। মাটিও এখানে শুকনো। শুয়োরের প্রতিটি আক্রমণ আর ঘোড়ার প্রতিটি পাঁয়তারার সাথে সাথে ধুলোর ঝড় উঠছে। কত বালি যে আমার নাক-কান-গলায় ঢুকে গেছে, কে জানে। মাঝে মাঝে বালিতে প্রতিরোধেও প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এবার সেতারাও দমে গেল। সে যেন আর ইতিকর্তব্য খুঁজে পাচ্ছে না। লাফ-ঝাঁপ করছে, দেখছি, অবিবেচকের মতো। শুয়োরটা দুই-একবার ধরেও ফেলতে যাচ্ছিল। কিন্তু কী করে জানি বেঁচে গেল সেতারা। শুয়োরটা যেন গতি আর দৈহিক আক্রমণের স্রোত। আর, সেতারা কেবলই পাঁয়তারা। লাফ-ঝাঁপ আর লাফ-ঝাঁপ। প্রতিটি হামলায় যম হাঁ করে দাঁড়াচ্ছে চোখের সামনে, আর সেতারার প্রতিটি পাঁয়তারার সঙ্গে সঙ্গে নতুন জীবন ফিরে পাচ্ছি। ক্রমে নতুন জীবন লাভের কথাটা মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠার অবসরও আর পাচ্ছে না। তার আগেই আবার মৃত্যুর ছবি ভেসে উঠছে চোখের সামনে।
এমনিতে চোখ সরাবার অবসর নেই। কিন্তু বুঝি-বা কী একটা শব্দ শুনেই আমার অনিচ্ছুক চোখ দু’টি এক মুহূর্তের জন্যে ওপরে উঠল। একটু দূরে ফণিমনসার ঝাড়। এখানে কোথায় জানি মানুষের মতো একটি মূর্তির ওপর গিয়ে পড়ল চোখ দুটি। কানে ভেসে এল একটা উৎসাহের আওয়াজ। চোখ দুটি এবার এক নিমিষে মৃত্যুর জগৎ থেকে বাঁচার পথের সন্ধানে ফিরে এল। কান দু’টি কিন্তু ওই শব্দেই মগ্ন হয়ে রইল। বোধহয় আরো দুই-তিনটে হামলা আর প্রতিরোধের পালা গেল। তারপর দেখি, কে যেন ঝড়ের বেগে আমার দিকে ছুটে আসছে। লম্বামতো একটা মানুষ বর্ণা বাগিয়ে আমাদের লড়াইয়ের মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুয়োরটাকে প্রচণ্ড একটা ধমক দিল লোকটি। সে-গর্জনে সেতারার সাহস ফিরল। আমার বুকখানাও যেন শান্ত হয়ে এল।
এবার শুয়োরটা প্রচণ্ড জোরে লোকটির ওপর হামলা করল। কিন্তু আগন্তুক অতি সংক্ষেপে একটুখানি নড়াচড়া করেই হামলাটা ব্যর্থ করে দিল। লড়াইয়ে এবার সে আধা-শরিক। আমার পালাবার পথ পরিষ্কার! কিন্তু এখন একথা মনে আসাও তো সম্ভব নয়। লোকটির মুখ দেখেই আমার ভাবনা দূর হয়ে গেছে। সে দুই-একবার চিৎকার করে আমায় সঠিক পন্থা বাতলে দিল। দেখা গেল, লোকটি আমায় চেনে। বড্ড চ্যাঁচামেচি করছে লোকটি। ধমকে শুয়োরটার মন তার দিকে ফিরিয়ে নিচ্ছে। বারবার ধমক দিয়ে দিয়ে সেতারাকে পথ বাতলাচ্ছে আর সাহস দিচ্ছে, আর আমায় আক্রমণ আর প্রতিরোধের উপায় শেখাচ্ছে। নিজে আত্মরক্ষা করছে সে নিপুণভাবে, অতি সুন্দর কৌশলে। তাকিয়ে দেখি লোকটির কাঁধে রাইফেল ঝুলছে। কিন্তু এ-অবস্থায় রাইফেলও আমার রিভলভারের মতোই বেকার।
তবু আশ্চর্য কাণ্ড ঘটে গেল একটা শেষ পর্যন্ত। শুয়োরটা আমার ওপর হামলা করছিল। এই সুযোগে লোকটি ঘায়েল করে ফেলল তাকে। কিন্তু বর্শার ফলাটা পড়েছিল শরীরের পেছন দিকে। বর্শার আঘাতে উত্তেজিত শুয়োরটা একটুও বিচলিত হল না। এবার আগুনের শিখার মতো লাফাতে শুরু করল সে। কিন্তু লোকটি তেমনি নিশ্চিন্ত, তেমনি শান্ত। জঙ্গলের দিক মুখে করে বারবার ডাক ছাড়ছে সে। কাকে যেন ডাকছে লোকটি।
দূরে মাঠের মধ্যে একটা বান্ডিলের মতো দেখা গেল। কিন্তু না, বান্ডিল নয়। এক মুহূর্ত পরেই দেখা গেল, একঝাঁক কুকুর। তীর বেগে ছুটে আসছে। লোকটি অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে বাড় দিয়ে উঠল। বাহ্ বেটা! মার ওস্তাদ!
বিশাল দেহ একটি কুকুর বিদ্যুৎবেগে দল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল। নিমেষে কালো কম্বলের মতো মেঘ উড়ে উঠল একবার। তারপরই লাল-সাদা জলের মতো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল কুকুরটা কিন্তু তক্ষুনি আছাড় খেয়ে তেমনি জোরেই লুটোপুটি খেতে লাগল। কুকুরটা সোজাসুজি শুয়োরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। কিন্তু শুয়োরটা দাঁতের ওপর তুলে আছাড় মেরে তার নাড়ি-ভুঁড়ি বার করে দিল। রক্তের গরম আর উৎসাহের আতিশয্যে ওস্তাদ তবু নাড়ি-ভুঁড়ি ঘটাতে ঘটাতেই উঠে গিয়ে শুয়োরের টুটি চেপে ধরল। এদিকে, ওস্তাদ কামড় বসাতে না-বসাতেই বাকি সব ক’টি কুকুর লেলিয়ে-দেওয়া নেকড়ের মতো শুয়োরটার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল। লোকটি এবার এক-একটি কুকুরের নাম ধরে ধরে জোর গলায় উৎসাহ দিয়ে যেতে লাগল। চোখের পলকে চাপা-কলের মধ্যে পড়ে গেল যেন শুয়োরটা। তারপরই এগারটা কুকুরের দাঁতের তলায় পাথরের মতো দেহ তার তুলো-তুলো হয়ে গেল।
.
চারদিকে এবার মৃত্যুর নীরবতা। আরো কয়েকজন লোক এগিয়ে এল। আর এল একটি মাদি ঘোড়া। পৃথিবী বুঝি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে নতুন জীবনে চোখ মেলল একবার। আমি ঘামে নেয়ে উঠেছি। সেতারার গা বেয়েও ঘামের স্রোত বইছে। ওস্তাদের প্রাণ হয়তো প্রথম ধাক্কাতেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কিন্তু উহ্, হিংস্র শিকারি শরীরটা এখনো টুটি কামড়ে যেখানকার সেখানেই পড়ে রয়েছে।
পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখখানা মুছে ফেললাম। সামনে কয়েক হাত দূরেই ওস্তাদের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। দেখে বড় দুঃখ হতে লাগল। ক্লান্তিতে অবশ, ব্যথায়- বেদনায় জীর্ণ শরীরটা হেঁচড়ে ঘোড়া থেকে নেমে, বর্শাখানা ফেলে দিয়ে সোজা লোকটার দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু লোকটি একটু নড়লও না। একবার আমার দিকে চেয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে বর্শাখানা খাড়া করে ধরল সে। চোখে-মুখে ফুটে উঠল অপরিচিতের ভাব। চাল-চলনে কেমন যেন একটা বন্যতার ছাপ।
আরো একটু এগিয়ে সাগ্রহে হাত দু’খানা বাড়িয়ে দিলাম। ভারি ইচ্ছে হচ্ছিল লোকটিকে জড়িয়ে ধরে আদর করি, তার হাতে চুমো খাই। আর খাঁটি শিকারিসুলভ মানসিকতা আর বীরত্বের উদ্দেশ্যে দুটি প্রশংসার কথা উচ্চারণ করি। সামনা-সামনি গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটি সহজ হয়ে এল। বর্শাখানা হাত থেকে ঝুলে পড়ল। কিন্তু আমি হয়তো শিকারি পরিভাষায় কিছু প্রশংসার কথা বলেছিলাম– পরমুহূর্তেই তাচ্ছিল্যভরে সরে দাঁড়াল সে। মুখখানা ঘৃণাভরে ফিরিয়ে নিল যেন। তারপর পেছন ফিরে ঘোড়ায় উঠে রওয়ানা হয়ে পড়ল।
আমি ডাক দিলাম, একটু শুনুন।
কিন্তু লোকটি যেন শুনতে পেল না। আস্তে আস্তে ঘোড়া চালিয়ে ফিরে গেল সে।
বিস্মিত হয়ে ভাবতে লাগলাম, এ-কী করল লোকটা? অ্যাঁ!
আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কিন্তু লোকটা আর ফিরল না।
এদিকে লোকগুলো শুয়োরটার খাল-মাংস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এ লোকটি কে?
: অ্যাঁ! আপনি চেনেন না? উনি তো আপনার গলা শুনেই এসেছিলেন! সিং বাবু।
: সিং বাবু!
কথাটা আমার কানে যেতেই হঠাৎ যেন বিশ্বজগৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। পৃথিবীটা যেন এতক্ষণ জ্বলছিল। এবার আকাশ-বাতাস শিকারি-মানসের মহত্ত্বে ভরে উঠল। তাঁর দিকে ফিরে তাকালাম। মনে হল তিনি যেন ঘোড়া নিয়ে অনেক-দূর এগিয়ে গেছেন। আমি তাঁর ধারে-কাছেও পৌঁছুতে পারব না।
অনুবাদ : আতোয়ার রহমান
সেকালের মেয়ে – রাজিয়া সাজ্জাদ জহির
দূর থেকে ব্যান্ডের শব্দ শোনা যাচ্ছে। বরযাত্রীর দল দরজার কাছে এসে পৌঁছাল বলে। মধ্যের ঘরটায় কাঁদতে কাঁদতে তেরো বছরের কনেটির অবস্থা কাহিল। বাইজি নাচিয়েরা চিৎকার করে, গলা ফাটিয়ে গান জুড়ে দিয়েছে। পানদানির খটখট আর নূপুরের ছমছম আওয়াজে কানে যেন ঝালাপালা লেগে যায়।
এমন সময় হঠাৎ একটা আর্তনাদের আওয়াজ শোনা গেল। ভয়ে আর আশঙ্কায় এদিক-সেদিক ছুটোছুটি শুরু করে দিল সবাই।
শোনা গেল, ঘোড়ার পা গর্তের মধ্যে ঢুকে গিয়ে উনিশ বছরের বর গুরুতর জখম হয়েছে। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেছে ঘাড়খানা। দশ মিনিটের মধ্যে বিয়ে বাড়িতে বিষাদের কালো ছায়া নেমে এল। যত মুখ, তত কথা। নানা জনের নানান মন্তব্য। সবাই কিছু-না-কিছু বলছেই। কিন্তু শুধু একজন ছাড়া। শুধু একজন মৌন-মূক হয়ে বসে। সে বুঝতে পারছিল না, এসব স্বপ্ন, না বাস্তব। বুঝতে পারছিল না সেই অল্প বয়স্কা কনেটি।
এই ঘটনার পঞ্চাশ বছর পরে আমি তাকে ‘নেংড়ি মামি’ বলে জানতে পেরেছি।
গল্পটা নতুন– যদিও এর পটভূমিকা অনেকদিন আগেকার। গল্পের প্রধান চরিত্রও অনেক পুরনো কালের। চরিত্রটি আমার মনের প্রচ্ছদে এমন একটা দাগ কেটে দিয়ে গেছে, যা কখনো মিটবার নয়।
শেষ পর্যন্ত সে বিয়ে আর হয়নি। তাই অনেকে প্রস্তাব দিলেন অন্যত্র বিয়ের ব্যবস্থা দেখতে। কারণ, এখনো সে কুমারী, আদও তো হয়নি– বিয়ে হওয়ায় বাধা কী। কিন্তু নেংড়ি মামি সেই যে বেঁকে বসলেন, তাঁকে আর কেউ রাজি করাতে পারল না।
যৌবনে তাঁর মুখখানা কেমন ছিল, দেখতে তিনি কেমন ছিলেন, সেসব এখন আমার পক্ষে বলা শক্ত। কিন্তু বার্ধক্যে তাঁকে দেখেছি। সে মুখ চন্দনের মতো উজ্জ্বল। রোদে বসলে গোলাপি আভা ফুটে ওঠে তাঁর গাল দুটিতে। এক খিলি পান চিবোলে গলার ভেতর থেকে লালিমা পষ্ট দেখা যায়। ছোটখাটো ছিপছিপে পাতলা লাজুক দেখতে তিনি। পরনে চুড়িদার পাজামা, ঢিলা কোর্তা, সাদা রঙের মোটা মলমলের ওড়না।
তখন আমার বয়েস পাঁচ, কি বড় জোর ছয়। আমরা নানার বাড়ি বেড়াতে এসেছি। জিনিসপত্তর গেট পার করে ভেতর-বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এমন সময় একজন বৃদ্ধা লাঠির ওপর ভর করে ভেতরে ঢুকলেন পেছনের দরজা দিয়ে। মার্কিনের একটা মোটা চাদরে তাঁর আপাদ-মস্তক ঢাকা। কোমরে চাবির গোছা ঝুলছে। হাতে কালো রঙের একটা ঝোলা– তাতে খুব সম্ভব ‘মর্সিয়া’ আর দোয়া-দরুদ লেখা পুঁথিপত্র।
মা তাঁকে দেখেই শ্রদ্ধাভরে ঝুঁকে পড়ে সালাম করেই জড়িয়ে ধরলেন; তারপর একে একে আমাকে এবং আর সব ছেলে-মেয়েদের ধরে ধরে তাঁর সামনে নিয়ে আসা হল। কত দোয়াই-না তিনি করলেন সবাইকে। কোলে নিলেন। তারপরেই মাকে বললেন, তোর মেয়ে তো বেশ সুন্দর হয়েছে রে, রুকুন! আল্লা করুন যেন তুই ডিপ্টি কালেক্টার জামাই পাস্!
আমি সেই চিরাচরিত লজ্জার অনুকরণ করতে চেষ্টা করলাম। আজো মনে পড়ে, আমার টোপা টোপা গালের ওপর তাঁর সাদা শুকনো চিকন সোহাগ-মাখা আঙুলের ছোঁয়া কী ভালোই-না লেগেছিল। মনে পড়ে, ডান হাতের কড়ে আঙুলে রুপোর আঙটিটা ঠাণ্ডা লেগেছিল গালে। আমায় তিনি বললেন, আমাদের বাড়ি আসিস– পুতুল বানিয়ে দেব, বুঝলি?
পরের দিন পুতুলের লোভে সকালেই তাঁর বাড়ি পৌঁছে গেছি।
পেয়ারাবাগানের পাশ কাটিয়ে কিছুদূর গেলেই ইমামবাড়া। তারই গা-লাগা তাঁর ছোট্ট বাড়িখানা। ভেতরে, পেছনের দিকে একটা ছোট কুঠরি, সামনের দিকে একটা বড়। এক ফালি আঙিনার খানিকটা জায়গা জুড়ে ধনে, পুদিনা আর পেঁয়াজ-চারায় ভর্তি সারি দেয়া গাছ। অন্য পাশে একটা কুলগাছ– তাতে দোলনা ঝুলছে। দোলনার দড়ি খানিকটা ছেঁড়া ছেঁড়া। দেয়ালের ওপরে পায়রার খোপ তৈরি করে দেয়া। নিচের মুরগির পানি খাওয়ার মালই বসানো রয়েছে। কুলগাছটায় বাঁধা রয়েছে একটা ছাগল। বড় ঘরের সিঁড়ির কাছে একটি তোতাপাখি– নাম তার মিঠু মিয়া। কাঁচামরিচ কেটে কেটে ছড়িয়ে চলেছে সে। মাঝে মাঝে খাঁচার শিকগুলো ঠোঁট দিয়ে ধরে টানাটানি করছে পাখিটা। তারপর বিরক্ত হয়ে ডাক ছাড়ছে, নেংড়ি মামি, নেংড়ি মামি! নবিজি ভেজো! মিঠুকে রুটি দাও!
বড় ঘরের ভেতরে দেয়ালের গা-লাগা জলচৌকির একপাশে জায়নামাজ গুটোনো রয়েছে। পুরনো মলিন ‘জুজ্দানে’র মধ্যে কোরান শরিফ দেয়ালের ওপর লোহার পেরেকে ঝুলছে। মামি জলচৌকিটায় বসে পাঁচটি মেয়েকে কায়দা-বুগদাদি পড়াচ্ছেন। আমায় দেখেই মুচকি হাসলেন তিনি। বললেন, কে রে, রুকুনের মেয়ে নাকি? আয়, ভেতরে আসছিসনে কেন? দরজায় দাঁড়িয়ে রইলি যে!
ভয়ে ভয়ে ভেতরে গিয়ে ঢুকলাম আমি। মামি বললেন, তুই ততক্ষণে যত পারিস, দোল খা। আমি এদের ‘সবক্’ দিয়েনি। তারপর তোকে পুতুল বানিয়ে দোব’খন, কেমন?
দুর্বল দড়ির দিকে তাকিয়ে অনুযোগের সুরে বললাম, নেংড়ি মামি, দড়িটা যে ছিঁড়ে যাবে!
না রে, না, ছিঁড়বে না। এখনো শক্ত আছে– বোস্ তো তুই!
দোলনা চড়ে দোল খেতে শুরু করে দিলাম আমি। কুলগাছের নরম ডাল দুলতে থাকল। চোঁ চোঁ চর্র্র্―। নেংড়ি মামি পড়াতে লাগলেন, আলিফ জবর আ, বে জবর বা– ছুঁড়ি, পড়তে পারিসনে, খেতে তো পারিস খুব! মুখ দিয়ে কথাই বেরোয় না যে! এত মেহনতের দাম নেই বুঝি! হ্যাঁ, বল– তে জবর তা, জিম জবর জা–!
মামির হাতে একটা ছোট্ট পাখা। পাখাঁটির চারদিকে কালো কাপড় দিয়ে মোড়া। মধ্যিখানে কালো কাপড়েরই একটা পানের নকশা। পানের মধ্যে আবার সুতো দিয়ে ফুল তোলা। সুতোগুলো ছিঁড়ে এদিকে-সেদিকে বেরিয়ে পড়েছে। কখনো কখনো কোনো মেয়ের পিঠের ওপর বর্ষিত হচ্ছে পাখাঁটি।
অবশেষে পড়ানোর কাজ শেষ হল। মেয়েরা বই-পত্তর গুটিয়ে নিয়ে চলতে লাগল।
লাল চুড়িদার পাজামা পরা মেয়েটিকে ডেকে তিনি বললেন, এই, শোন্ তো উমরের মেয়ে! দাঁড়া!
খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরের মধ্যে চলে গেছেন তিনি। ঘর থেকে এক টুকরো ভেলি গুড় আর কাগজের মোড়কের মধ্যে কী যেন নিয়ে ফিরে এলেন। একটা বড় কাগজের মধ্যে জিনিস দুটি মুড়ে মেয়েটি হাতে দিয়ে বললেন, মাকে বলিস, কাগজটা যেন আবার আমাকে ফিরিয়ে দেয়। আমার কাছে আর কাগজ নেই। কালকে তুই নিয়ে আসিস যেন, বুঝলি? আর, ওই ছোঁড়াটার জ্বর ছেড়েছে রে?
মেয়েটি বলল, না। এখনো ছাড়েনি!
দোলনাটা থামিয়ে মেয়েটির নাকে রুপোর ছোট্ট নোলকটা লক্ষ করছিলাম আমি।
তাহলে সাঁঝের বেলা ওষুধ নিয়ে যাস। মগরেবের নামাজের আগে তৈরি করে রাখব’খন।
মেয়েটি চলে গেল। নেংড়ি মামি মিনিটিখানেক মিঠু মিয়াকে আদর করলেন। তারপর, আমার দিকে মন দিলেন, আয়, এখানে বোস্!
দোলনা থেকে নেমে চৌকিতে গিয়ে বসলাম আমি। মামি আবার খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরের ভেতর চলে গেলেন। বাইরে বসে বসে চাবির ঝনঝন আর বাক্স খোলা এবং বন্ধ করার খটখট আওয়াজ শুনতে পেলাম। একটু পরে এক হাতে একটা পোঁটলা আরেক হাতে ছোট্ট একটা প্লেট নিয়ে বের হলেন মামি। বললেন, ততক্ষণে তুই খা দেখিনি এগুলো!
আমার সামনে প্লেটখানা তিনি রেখে দিলেন। তাতে রয়েছে হরেক রকমের খাবার জিনিস। তারপর পোঁটলা খোলা হল। তার ভেতর থেকে বেরুল কাপড়ের একটা সেলাইদানি। সেলাইদানি থেকে বেরুল নানান রঙের কাটা কাপড়। মামি বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে পা ছড়িয়ে বসে কাপড় খুঁজতে খুঁজতে বললেন, তোরা বাবা তো চীনা প্লেটে খায় রে, না? আর আমার প্লেট দিল্লি থেকে আনা। তাই তোর জন্যে বের করে দিলাম।… দেখ তো এত বড় নিবি পুতুল?
হাত দিয়ে মেপে দেখালেন পুতুলের দৈর্ঘ্য। আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। ইয়া হজরত আলি, মুশকিল আসান’ বলে তিনি পুতুল সেলাইয়ে মন দিলেন।
সাত রাজ্যের লোকের সেলাই করেন নেংড়ি মামি। জীবিকার বেশির ভাগই আসে তাঁর সেলাইয়ের কাজ থেকে। রমজানের সারাটা মাস তিনি পাড়ার যত বিধবা আর অনাথদের কাপড় সেলাই করেন বিনা পারিশ্রমিকে। সব কাজই তাঁর হাতে-সেলাই। বাজার থেকে কখনো সুতো কিনতে হয় না তাঁকে। লোকের কাছ থেকে যতরকমের কাপড় আসে, তার থেকে দশ-বিশটা সুতো বের করে পাকিয়ে নিয়ে তাই দিয়ে সেলাইয়ের কাজ চালিয়ে যান তিনি। এই পাকানো সুতো এত মজবুত হয় যে, বাজারের রিলের সুতোকেও হার মানিয়ে দেয়। তাঁর কাছে যতরকমের কাপড় এসেছে সেলাইয়ের জন্যে, সবরকম থেকেই সুতো বের করে নিয়ে পাকিয়ে রেখেছেন। প্রত্যেকটারই একটা করে অন্তত নমুনা তাঁর সেলাইদানিতে খুঁজলে পাওয়া যাবেই।
রেশমের চমকদার এক টুকরো কাপড়ের ওপরে আমার নজর পড়ল। মনটা আনন্দে নেচে উঠল কাপড়টা দেখে। বেশ খানিক অনুনয়ের ভঙ্গিতেই বললাম, নেংড়ি মামি, এটা আমি নিই?
না, না, রেখে দে! ওটা দিয়ে থলে বানাতে হবে যে! আল্লারাখাদের বাড়িতে বিয়ে- সেখানে দরকার। তুই নিয়ে কী করবি, শুনি? ছিঁড়ে ফেলবি তো দুদিন পরেই?
তখন আমার যা রাগ হয়েছিল নেংড়ি মামির ওপর। ভালো কাপড়টা নিজের জন্যে রেখে দিয়ে আমার পুতুলের জন্যে কিনা সত্তরটা তালি মারা আর বাহাত্তরটা সেলাই করা কাপড়। কিন্তু আজকে চিন্তা করলে একথা বুঝতে কষ্ট হয় না, তাঁর মতো একজন গরিব মানুষের পক্ষে এদিক-সেদিক থেকে কাপড় সংগ্রহ করে আল্লারাখাদের বিয়েতে সাতটি থলে আর দুটি জুজ্দান তেরি করে দেয়া কম কৃতিত্বের ব্যাপার নয়। প্রতিদানে যে ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা তিনি পেয়েছিলেন, তার জন্যে তাঁর নির্জন জীবনে শান্তিও কম আসেনি হয়তো।
.
মামির খোঁড়া হওয়ার ব্যাপারটাও একটা গল্পের মতোই। বয়স তখন তাঁর গোটা বিশেক। মহরমের সময়ের কথা। সন্ধের দিকে কোনো বৈঠকে যাচ্ছিলেন নেংড়ি মামি। নির্জন পথ। সেই অঞ্চলেরই একজন তাঁর রূপের নেশায় পাগলের মতো ঘুরত। প্রেম নিবেদনও করেছিল বার কয়েক। প্রথম প্রথম তার চেষ্টা ছিল বিয়ের জন্য তাঁকে কোনোরকমে রাজি করানো। কিন্তু কোনোমতেই সম্মতি দেননি তিনি। তাই সে এতদিন অপেক্ষা করছিল সুযোগের। সেদিন তিন-চারজন সঙ্গী নিয়ে সে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করল। আমবাগানের কাছটায় তারা নেংড়ি মামির ডুলি ঘিরে দাঁড়াল। কাহার ছিল দুজন। লাঠি চলতে লাগল। একটা কাহারের ওপর লাঠি ওঠাতেই নেংড়ি মামি তাদের মাঝে এসে দাঁড়ালেন। লোকটা ছিল বেশ তাগড়া জোয়ান। লাঠির পুরো আঘাতটা গিয়ে পড়ল তাঁর ডান পায়ের ওপর। পা-টা ভেঙেই গেল। অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন তিনি। ইতোমধ্যে চিৎকার শুনে লোকজন জড়ো হল সেখানে। আক্রমণকারীর দল পালিয়ে গেল।
পরেরদিন ইমামবাড়ার পেছনে লোকটির মৃতদেহ পাওয়া গেল। হাত দুটো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছিল সে। হাতে রুমাল জড়ানো। পরে জানা গেল, লোকটি আত্মহত্যা করেছে বিষ খেয়ে। মরার আগে মামির নামে দু-লাইনের একটা চিঠিও লিখে রেখে গেছে। তাতে করজোড়ে ক্ষমা চেয়েছে সে। আর, লিখেছে, কেয়ামতের দিন যেন তার বিরুদ্ধে আল্লার কাছে তিনি কোনো অভিযোগ না-আনেন।
নেংড়ি মামিকে এ ঘটনার কখনো কোনো উল্লেখ করতে শুনিনি। তবু কোনোক্রমে এ প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি কেঁদে ফেলেন। ঠাণ্ডা একটা নিশ্বাস ফেলে শুধু বলেন, সে চলে গেছে ভালো জায়গায়, আর আমি এখানে পড়ে আছি। আল্লা তাকে নিশ্চয় মাফ করবেন। আমি কক্ষনো প্রতিশোধ নিতে চাইব না।
গ্রাম, তা-ও আবার সেকালের অজপাড়া-গাঁ। ভাঙা-পা জোড়া দেয়া তাই আর সম্ভব হয়নি। ফলে আজীবন খোঁড়াই রয়ে গেলেন তিনি। এ ঘটনার পর তাঁর দিকে আর চোখ তুলে চাইবার সাহসটুকুও কারো হতো না।
সারাটা জীবন আশাহত আর নিঃসঙ্গভাবে কাটিয়ে দেয়ার পরেও নেংড়ি মামির চরিত্রে কোমলতা আর রসিকতার ভাবটুকু পুরোপুরিই অটুট রয়েছে। তাঁর প্রতিটি অঙ্গ যেন প্রীতি আর সহানুভূতি দিয়ে গড়া। তারই মিশ্র অভিব্যক্তি তাঁর সারাটা জীবনকে বাঙ্ময় করে তুলেছে।
কারো বিয়ে হলে, নেংড়ি মামিই সেখানে সবার আগে গিয়ে হাজির; দেখা গেল, ঢোল নিয়ে এসে বাজাতে বসে গেলেন তিনি। সবসময়, সব অবস্থাতেই তিনি খুশি এবং সব কাজেই তিনি অগ্রণী। কোথাও নব-দম্পতির মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দিয়েছে, অমনি নেংড়ি মামি ভীষণ ব্যস্ত। এখান থেকে ওখানে যাচ্ছেন, ওখান থেকে এখানে আসছেন। তখন তাঁর একমাত্র কামনা, তাদের পুনর্মিলন সম্ভাবিত হোক। কোনো বিয়েতে গান-বাজনার আয়োজন হলে, দেখা গেল, তিনিও সেখানে গাইছেন। প্রসবের বেলায়ও তিনি উপস্থিত। কখনো কারো জন্যে হয়তো পথ্য তৈরি করছেন, কারো জন্যে অন্য কিছু। অসুখ-বিসুখে কতজনের জন্যেই-না কতরকমের ওষুধ পিষছেন, কুটছেন, ছাঁকছেন, তৈরি করছেন। কেউ সুস্থ হয়ে উঠলে তার জন্যে পথ্য নিয়ে যাচ্ছেন, জানের ‘সকা’ হিসেবে রুটি দিচ্ছেন ফকিরকে। কেউ বিদেশ যাত্রায় বেরুলে তিনি পীর-ইমামদের স্মরণ করছেন। দুঃখীর দুঃখে কাঁদছেন, সুখীর সুখে হাসছেন। সবারই খবর নিয়ে বেড়াচ্ছেন, অথচ নিজের খবরটি জানাচ্ছেন না কাউকে।
যখন আমি ছোট ছিলাম, আমার বোধশক্তি অপরিপক্ক ছিল, তখন তাঁকে বুঝিনি। কিন্তু আজকে কারণে-অকারণে কেবল তাঁর কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে। কত আন্তরিকতার সাথেই-না তিনি মেয়েদের সুখী-সমৃদ্ধিশালী জীবনের জন্যে প্রার্থনা জানাতেন। মনে হত যেন তাঁর জীবনের সমস্ত দুঃখ-বেদনাকে এই প্রার্থনা দিয়ে ধুয়ে নিচ্ছেন তিনি। যেন বলছেন, আমার জীবনে কিছুই পেলাম না, তবু তোমরাই সবকিছু পেয়ে সুখী হও। তোমাদের সুখ দেখলে আমিও সুখী হব।
.
নেংড়ি মামির সাথে কখনো কারো ঝগড়া হত না। একমাত্র ডুলিবাহক কাহার ছাড়া। কখনো কোথাও তিনি পায়ে হেঁটে যেতেন না। দু-পা যেতে হলেও ডুলি নিতেন। ডুলি থেকে নেমে গেট পার হবার সময় কাহার ডাক ছাড়ত, নেংড়ি মামি, আরেক আনা পয়সা পাঠিয়ে দিও। বিশ বছর তোমাকে বয়ে বেড়াচ্ছি।
অমনি তিনি রেগে যেতেন, ভ্যালা জ্বালাতন দেখছি! কিসের এক আনা পয়সা, শুনি! নিমতলার মজলিস থেকে আসছি, সেখানে নিয়েছ একআনা। আবার এক আনা কিসের? বিশ বছর বয়ে বেড়াচ্ছ, তাতে হয়েছে কী? বিশ বছরে কি আমার ওজন বিশ মণ বেড়ে গেছে নাকি?
পাড়া-প্রতিবেশী সবাই তাঁর এই ঝগড়ায় মজা পেত খুব।
এছাড়া, আরো একদল লোকের সাথে তাঁর ঝগড়া হত। এরা তাঁর ছাগলটিকে মার-ধোর করত। ছাগলটিও ছিল যেন বেশ একটা তাগড়া বলদের মতো। যেখানে যখন খুশি ঢুকে পড়ত। লোকে একটুখানি বিড়বিড় করেই চুপ হয়ে যেত। কিংবা চ্যাঁচাতে শুরু করত, উহ্, নেংড়ি মামির ছাগলের জুলুম– আল্লা রে আল্লা, আর সওয়া যায় না। বলি হল তো, ধনেগাছগুলো সব মুড়িয়ে দিলে কমবক্ত। এ ভাই, শিগগির ছাগলটাকে একটু তাড়িয়ে দাও!
ততক্ষণে, সম্পূর্ণ না-হলেও অন্তত অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে। এখন ছাগলটাকে মারেই- বা কে? সারাটা পাড়ার লোকই যে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। প্রত্যেকেরই তো তিনি কিছু না-কিছু উপকার নিশ্চয়ই করেছেন। তবু যদি কেউ তাঁর ছাগলকে ছোঁয়-ও তাহলে সে ম্যা ম্যা করে বাড়ি চলে যায়। কখনো কখনো অনেকে শুধু এই দৃশ্য দেখার জন্যেই ছাগলটিকে মেরে বসে। নেংড়ি মামি ডাল ধোয়া কিংবা কাপড় সেলাই ফেলে ছাগলটির গলা জড়িয়ে ধরেন। তারপর, বিনিয়ে বিনিয়ে বলতে থাকেন, আমার মেয়েকে কারা ধরে মারল গো! আল্লার বে-গোনাহ অবলা জানোয়ার, তাকে কি কখনো মারতে আছে? তুই-ই-বা কেন কমিনাদের বাড়ি যাস্ বল দেখিনি মা! বাড়িতে থাকতে পারিনে? নে, এখন চাট্টি ভুষি খেয়ে নে!
বিড়বিড় করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে মধ্যে ঢুকে মামি ভুষি এনে, ছাগলের সামনে রেখে দেন। ছাগলটি মাথা নড়িয়ে নড়িয়ে ভুষি খেয়ে চলে– ব্যাপারখানা যেন পুরোপুরিই সে আন্দাজ করতে পেরেছে। কখনো-বা ছাগলটির সাথে মামি এমন সব কথাও বলেন, যা আর কারো পক্ষে চিন্তা করাই কঠিন।
আরো একটি ঘটনা যখনই মনে পড়ে যায়, মনের মধ্যে কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি এসে জড়ো হয়।
আমাদের বাড়ির গা-লাগা কয়েকটা ঘরের বস্তি ভিখিরিদের। এক ভিখিরির একটি মেয়ে ছিল। বেশ সুন্দরী মেয়েটি। একজনের সাথে প্রেম করত সে। পাড়ার আরো কয়েকজন লোক তার কাছে ভিড়বার চেষ্টা করত। এদেরই একজন হল গুণ্ডা পালোয়ান শরফু। শরফুকে সবাই ভয় করে চলত তার গুণ্ডামির জন্যে। কিন্তু মেয়েটি মোটেই আমল দিত না তাকে। আর, গোপনে গোপনে প্রণয়ীটির সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করত। একদিন প্রণয়ী বিদেশে চলে গেল। যাবার বেলায় প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেল, অনেক টাকা-কড়ি কামাই করে খুব শিগগিরই ফিরে আসবে সে। কিন্তু যাবার আগে জেনে গেল না, মেয়েটি মা হতে চলেছে।
কিছুদিন পরেই সবাই জেনে ফেলল ব্যাপারটা। এত বড় কথা কি কখনো লুকোনো থাকে, না থাকা সম্ভব? তার পরে যা টিটকারি-গালমন্দের পালা শুরু হল, তা আর নাই-বা বললাম।
বেশ মনে আছে, সেদিন সকাল হতে না-হতেই আমাদের বাড়িতে বিচারের আয়োজন হল। জমিদারবাড়ি বলে সবাই ঝগড়া-বিবাদের ফয়সালা সাধারণত করতে আসত এ বাড়িতেই।
সবাই ততক্ষণে এ সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে পেরেছেন, মেয়েটি নাক কেটে না-দিলেও নিদেনপক্ষে যেন তার মাথা মুড়িয়ে দেয়া হয় এবং সেই সঙ্গে একঘরেও করা হয়। তাছাড়া, পাড়ার মধ্যে সে আর থাকতেও পারবে না, নইলে অন্য লোকের মেয়েও নষ্ট হতে পারে।
এ ধরনের প্রস্তাবে শরফু পালোয়ান সবার আগে সম্মতি জানিয়ে বসল। বাইরে পুরুষ লোক গিজগিজ করছে, ভেতরে মেয়ে। একজন আরেকজনের চেয়ে বেশি জোরে কথা বলার জন্যে যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কেবল একজনকেই দেখা গেল মৌন। সম্পূর্ণ বোবা বনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই অপরাধী মেয়েটি। বেশ মনে পড়ছে, মেয়েটির করুণ নীরবতা আমার কচি মনেও অদ্ভুত অনুভূতি জাগিয়ে দিয়েছিল। আখ চিবাতে চিবোতে একটু একটু করে তার আরো কাছ ঘেঁষতে লাগলাম আমি। মা অমনি বেজায় ধমক দিয়ে উঠলেন, ভাগ এখান থেকে! ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?
কী আর করা যায়! শেষমেশ ঘড়াঞ্চির আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে পড়লাম। হঠাৎ বাইরে থেকে কাহারের ডাক শোনা গেল, সওয়ারি নাবিয়ে নাও!
নেংড়ি মামি মোটা মার্কিনের চাদরে পবিত্র পাতলা দেহটা ঢেকে ডুলি থেকে নেমে পড়লেন। গেট পার হয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে একনজর তাকিয়ে নিলেন মেয়েটির দিকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সে থরথর করে কাঁপছে। তাকে দেখে মামি বললেন, আহা বেচারা, বাছাধন!
তারপর, নানির পালঙের উপর গিয়ে বসলেন তিনি। অনেকক্ষণ ধরে হাসতে হাসতে এদিক-সেদিকের নানান কথা পাড়তে থাকলেন– যেন গুরুত্বপূর্ণ তেমন কিছুই হয়নি। পাঠান বউ এগিয়ে এসে সবকিছু খুলে বলতে চাইল তাঁকে। আমাদের বাড়িতে রান্নার কাজ করে সে। প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় স্বামীকে তালাক দিয়ে এখন তৃতীয় জনের ফিকিরে ঘোরে। নেংড়ি মামি হাতের ইশারায় বাধা দিলেন তাকে। বললেন, থাক, থাক, জানি বাছা, সব জানি।
ব্যস্, এক মিনিটে তার সব উত্তেজনা ঠাণ্ডা। বার থেকে শরফুর গলার আওয়াজ পেয়ে মামি বড় খালাকে জিজ্ঞেস করলেন, কাজু, বাইরে কথা বলছে, ওটা কে? শরফু না?
খালা বেশ আদবের সাথে জবাব দিলেন, জি হ্যাঁ।
তারপর, শরফুর মাথা মুড়িয়ে দেয়ার প্রস্তাবটি তিনি নেংড়ি মামিকে বুঝিয়ে বললেন, আর নিজের সম্মতির কথাটাও সেই সঙ্গে জুড়ে দিলেন।
সবকিছু শোনার পর মামি কোমরবন্ধ থেকে কৌটো খুললেন, একটুখানি দোক্তা বের করে তিনি মুখে পুরে দিলেন। আস্তে করে একবার শুধু বললেন, হুঁ―। তারপর, কৌটো যথাস্থানে বন্ধ করে রাখলেন তিনি। পালঙ থেকে নেমে লাঠিটা নিয়ে চলতে লাগলেন গেটের দিকে। ঘড়াঞ্চির পেছন থেকে সবকিছুই দেখতে পাচ্ছি আমি। মামির প্রতিটি পদক্ষেপে অপরাধী মেয়েটির মুখখানা আরো যেন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। সবাই নীরব। প্রত্যেকের দেহমনে শুধু প্রতীক্ষার উমেদারি। প্রতীক্ষা ফলাফলের। নেংড়ি মামি সদর দরজার আড়ালে গিয়ে ডাক দিলেন, শরফু!
শরফু গেটের বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। সাড়া দিল, জি।
মামি একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলেন, দেখ, শরফু, মরণকালে তোর সাথে ইমান ছাড়া আর কিছুই যাবে না, মনে রাখিস। সত্যি কথাটা ইমানদারের মতোই বলবি– তুই কেন বেচারি অভাগিনীর এত শত্রুতা করছিস? ও তোকে পাত্তা দেয়নি বলেই নয় কি? সবকিছুই আমি জানি কিন্তু বলে দিচ্ছি, শরফু; সেসব কথা বলার জন্যে যেন আমায় আবার মুখ খুলতে না হয়। হুঁ। আর আমি যদি মিথ্যে বলে থাকি, তাহলে হজরত আব্বাসের কসম, তুই বলে দে, কোনটা মিথ্যে বলছি। আমার পাকা চুলের এতটুকুও তোকে খাতির করতে হবে না। হুঁ, বল্!
বাড়ির ভেতরে, বাড়ির বাইরে সবার মুখে যেন তালা-চাবি লেগে গেল। নেংড়ি মামি প্রত্যেকের ওপরে একবার করে নজর বুলিয়ে নিলেন। সবাই চুপ। সত্যি কথাটা কেই-বা অস্বীকার করতে পারে! শরফুর কীর্তির কথা কারো তো আর অজানা নয়। তাই তার সপক্ষেই-বা কার কী বলার থাকবে!
নেংড়ি মামি ঘুরে দাঁড়ালেন। চলতে চলতে বললেন, তুই একবার নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ! এই হতচ্ছাড়াটা তবু একজনের জন্যে মরতে পারল। আর তুই! তোর জন্যে কিই-বা আর বলব, বল। যা, এখন আর বেশি বাড়াবাড়ি করিনে, বলে দিচ্ছি! ডুলিটা ডেকে দিয়ে যা!
শরফু মাথা হেঁট করে সরে পড়ল। যেন দাবার ছক থেকে আস্ত মন্ত্রীটাই সরে গেল, মাত হয়ে গেল পুরো জনতাই। তারপর মেয়েটিকে ডাক দিলেন তিনি, চল্ পোড়ারমুখী আমার সাথে! নিজেও ডুবলি, কপালটাকেও ভাঙলি
নেংড়ি মামি আগে আগে, পেছনে মেয়েটি। মেয়েটির পেছন দিকে জামাটার এক জায়গায় ছেঁড়া। তারই ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ফর্সা পিঠের ওপর সাপের মতো এঁকে বেঁকে পড়ে রয়েছে বেণি-গাঁথা চুলের রাশ। দুজনে ডুলিতে উঠেই সেই মুহূর্তে রওয়ানা হয়ে গেল। এ-ওর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কারো মুখে কোনো কথা ফুটল না।
অবশেষে মামির বাড়িতেই একটি মেয়ে জন্মাল তার। পাড়ার সবাই ঘটা করে দেখতে এল। কারো সাহসই হল না নেংড়ি মামির বাড়িতে এমন দিনে অনুপস্থিত থাকার। ঢোল বাজল। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হল। এমনকি, কিছুদিন পরে মেয়েটির প্রণয়ীও ফিরে এল। যথারীতি বিয়েও হয়ে গেল তাদের। আমরাও তাদের বিয়ের ফুর্তিতে যোগ দিলাম। এককথায়, সবকিছুরই শুভ পরিণতি স্বচক্ষে দেখতে পেলাম আমরা।
.
নেংড়ি মামি যখন মারা গেলেন, আমার বয়েস তখন সতেরো কি আঠারো। মৃত্যুর খবর নিয়ে চিঠি আসার পর বারবার শুধু একথাই ভেবেছি, গ্রামে এখন না-জানি কী ভীষণ নীরবতা নেমে এসেছে। কারণ, আজকে সেখান থেকে একজন সংবেদনশীল এবং হিতৈষী বন্ধু চলে গেছেন। চলে গেছেন একজন পূর্ণবিকশিত মানুষ।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
ওভারকোট – গোলাম আব্বাস
জানুয়ারির কোনো এক শনিবারের সন্ধেয় সুন্দর পোশাক পরা একটি যুবক ডেভিস রোড থেকে বেরিয়ে মল রোডে এসে নামল। তারপর, ফুটপাত ধরে আস্তে আস্তে চেয়ারিং ক্রসের দিকে চলতে লাগল। হাবভাব দেখে তাকে বেশ রুচিশীল ভদ্রলোক বলেই মনে হচ্ছে। লম্বা লম্বা জুল্ফি। ঝক্ঝকে চুল। পাতলা একজোড়া গোঁফ (যেন সুর্মার শলা দিয়ে আঁকা)। গায়ে বাদামি রঙের গরম ওভারকোট (হালকা রঙের দু-একটি ফুটন্ত গোলাপফুলের কাজ করা)। একপাশে বিশেষ কায়দায় কাত করা মাথার ওপর একটি ফেল্ট হ্যাট। সিল্কের সাদা মাফলার গলায় জড়ানো এক হাত ওভারকোটের পকেটে, অন্য হাতে বেতের একটি ছড়ি। মাঝে মাঝে ছড়িটাকে সে ঘুরিয়ে চলেছে।
তীব্র শীতের মরশুম তখন। জোর ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে এসে সুচের মতো বিঁধছে। কিন্তু যুবকটির এসবে বিশেষ কিছু এসে-যাচ্ছে বলে মনে হয় না। আর-সব পথচারী জোরে জোরে পা চালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল– শরীর কিছুটা গরম হবে এই ভরসায়। কিন্তু যুবকটির এসবের যেন কোনো প্রয়োজনই নেই। এই কন্কনে শীতে পায়চারি করে বেড়িয়েই যেন তার তৃপ্তি
দূর থেকে তার চলন দেখেই টাঙাঅলা ভুল করে ঘোড়া ছুটিয়ে কাছে এল। কিন্তু ছড়ির ইশারায় অসম্মতি জানাল সে। একটি খালি ট্যাক্সিও একসময় কাছে এসে থামল। কিন্তু সে শুধু ‘নো, থ্যাংক্স্’ বলেই এগিয়ে গেল সেখান থেকে।
মলের সুসজ্জিত এলাকার দিকে যতই সে এগিয়ে চলল, চলার কায়দা তার ততই ভদ্রোচিত হতে লাগল। শিস কেটে, চলনের মধ্যে একটা ইংরেজি নাচের ঢং ফুটিয়ে তুলল মাঝে মাঝে। দেহের সাথে সাথে পা দুটিও নাচতে লাগল। আশপাশে তাকিয়ে নিয়ে মিছিমিছি বল ছোঁড়ার কায়দার একবার সে ছুটে গেল। সত্যি-সত্যিই ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছে যেন।
চলতে চলতে লরেন্স গার্ডেনসের দিকে যাবার পথ দেখা গেল। কিন্তু সন্ধের অন্ধকার, ঠাণ্ডা বাতাস আর অবিরাম শিশির পড়ার জন্যে বাগান জনশূন্য, তাই সেদিক পানে সে আর এগুলো না। সোজা চেয়ারিং ক্রসের দিকেই চলতে থাকল সে।
রানির মূর্তির কাছে গিয়ে তার গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে এল। পকেটের বদলে আস্তিনের ভাঁজের ভেতর থেকে একখানা রুমাল বের করে আলতোভাবে মুখের ওপর বুলিয়ে নিল একবার। ধুলো জমে থাকলে পরিষ্কার হয়ে যাবে– এই উদ্দেশ্যে।
পাশেই ঘাসের একটি চত্বরে কয়েকটি ইংরেজ-শিশু বল নিয়ে খেলা করছে। খুব মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখতে লাগল তাদের। তার এই উপস্থিতিকে আমল না-দিয়ে ছেলেরা আগের মতোই খেলে যেতে লাগল। কিন্তু লোকটাকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ক্রমেই তারা লজ্জা পেতে লাগল। তারপর, হঠাৎ বলটা উঠিয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে সেখান থেকে তারা সরেই পড়ল অবশেষে
সিমেন্টের একটি খালি বেঞ্চের উপরে গিয়ে যুবকটি বসে পড়ল। সন্ধের অন্ধকার বাড়বার সাথে সাথে ঠাণ্ডাও বেড়ে চলেছে খুব। শীত বেশ তীব্র বটে, কিন্তু লোকে আরাম-প্রীতির তীব্রতা তীব্র শীতেই বেশি করে অনুভব করে। বিশেষ করে একথা সত্যি শহরের যারা আয়েসি, তাদের কাছে। তারা এমন ঠাণ্ডায় কখনো চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। যারা নিতান্তই একা থাকতে ভালোবাসে, তারাও এমন সময় সঙ্গ খোঁজে। ঘরের কোণ থেকে বেরিয়ে, সভা-বৈঠকে গিয়ে গা গরম করার কথা চিন্তা করে। সঙ্গী পাওয়ার আনন্দ তাদের বাইরে বের করে আনে। সাধ্যমতো কেউ রেস্তোরাঁ-কফিখানায়, কেউ নাচশালা-প্রেক্ষালয়ে কিংবা অন্য কোনো আড্ডায় মজলিশে গিয়ে নিরাপদ হতে চায় শীতের হাত থেকে।
মল রোডে মোটর-ট্যাক্সি, টাঙা আর বাই-সাইকেল তো হরদম চলছেই, ফুটপাতের উপর দিয়ে পায়ে-হাঁটা লোকের যাতায়াতেরও কমতি নেই। তাছাড়া, রাস্তার দু-পাশের সারিবদ্ধ দোকানগুলোয় কেনাবেচাও পুরোদমে চলছে। যেসব হতভাগার পয়সা খরচ করে আড্ডা জমানোর বা বাজার-সওদা করে সময় কাটানোর ক্ষমতা নেই, দূর থেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্যদের আড্ডা দেয়া আর দোকানের রং-বেরঙের আলো দেখে নিচ্ছে তারা।
যুবকটি পাকা বেঞ্চের উপর বসে সামনের রাস্তা দিয়ে চলমান মেয়ে-পুরুষের ভিড়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। তাদের মুখের চাইতে পোশাকের দিকেই তার বেশি নজর। হরেক শ্রেণির লোক রয়েছে পথচারীদের মধ্যে– বড় বড় ব্যবসায়ী, সরকারি অফিসার, লিডার, শিল্পী, কলেজের ছাত্র, বেকার কর্মপ্রার্থী, নার্স, খবরের কাগজের রিপোর্টার, অফিসের কেরানি। তাদের বেশিরভাগই ওভারকোট পরা। নানান ধরনের রং-বেরঙের ওভারকোট। অতি মূল্যবান রংচঙে থেকে শুরু করে নিলামে কেনা ছাই-রঙের পুরনো মিলিটারি ওভারকোট পর্যন্ত– সবরকমেরই চোখে পড়ছে।
যুবকের ওভারকোটটি যথেষ্ট পুরনো হলেও এর কাপড় কিন্তু বেশ দামি। তাছাড়া, এটা সেলাই করাও হয়েছে কোনো দক্ষ দর্জির কাছ থেকেই। কোটটি দেখলে সহজেই বোঝা যায়, মালিক এর বেশ যত্ন নেয় এখনো। কড়া ইস্তিরি করা শক্ত কলার। রঙের জৌলুস সর্বত্র স্পষ্ট। কোথাও ভাঁজের চিহ্ন নেই। শিঙের বড় বড় বোতাম চক্চক্ করছে। ওভারকোটটির জন্যে সে যেন খুব গর্বিত বলেও মনে হয়।
পান-বিড়ি-সিগারেটের ডালা গলায় ঝুলিয়ে একটি ছেলে সামনে দিয়ে এগিয়ে গেল।
সে ডাক দিল, ‘ওই পানঅলা!’
‘জি হুজুর?’
‘দশ টাকার চেঞ্জ হবে?’
‘না হুজুর। ভাঙিয়ে আনতে পারি। কী নেবেন?’
‘নোট নিয়ে যদি পালিয়ে যাস?’
‘বা সাহেব! চোর নাকি যে পালিয়ে যাব? বিশ্বাস না-হলে আমার সঙ্গে চলেন। নেবেন কী আপনি?’
‘না, না, আমি নিজেই ভাঙিয়ে আনতে পারব। এই যে এক আনা পয়সা পাওয়া গেছে। একটা গোল্ডফ্লেক দিয়ে যা!’
ছেলেটা চলে যাওয়ার পর আরাম করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে লাগল সে। এমনিতেই তাকে বেশ খুশি দেখাচ্ছিল। কিন্তু গোল্ডফ্লেকের স্বচ্ছ ধোঁয়ার আমেজে সে-খুশি আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেল যেন।
একটি ছোট্ট সাদা বেড়াল ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বেঞ্চের নিচে তার পায়ের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে ম্যাও-ম্যাও করতে লাগল। বেড়ালটির গায়ে হাত বুলোতেই লাফিয়ে সে বেঞ্চের উপর উঠে পড়ল। আদর করে তার পিঠের উপর হাত বুলোতে বুলোতে সে বলল, ‘পুওর সোল!’
বেঞ্চ থেকে উঠে রাস্তা পেরিয়ে রঙিন আলোয় উজ্জ্বল সিনেমাহাউসের দিকে সে এগিয়ে গেল। শো তখন শুরু হয়ে গেছে। সিনেমার বারান্দায় ভিড় নেই। দু-চারজন লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আসছে-হপ্তার ছবিগুলো দেখে নিচ্ছে। ছোট-বড় বোর্ডের গায়ে সেগুলো লাগানো রয়েছে। সিনেমার বিশেষ বিশেষ দৃশ্যের ছবিই কেবল স্থান পেয়েছে তাতে।
তিনটি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান তরুণী গভীর মনোযোগ দিয়ে ছবি দেখছিল। সে-ও নিরাপদ দূরত্বের মধ্যে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত সমঝদার দর্শকের মতো ছবি দেখতে লাগল। মেয়েগুলো নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টায় মত্ত। ফিল্মের ওপরে মন্তব্যও করেছিল কেউ কেউ।
হঠাৎ ওদের মধ্যে থেকে একটি সুন্দরী এবং মুখরা মেয়ে বিকট অট্টহাসি জুড়ে দিল। তারপর, তিনজনেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। যুবকটির ওপর এর কোনো প্রভাব পড়ল বলে মনে হয় না। সে-ও একটু পরেই বেরিয়ে এল সিনেমা হাউস ছেড়ে।
সাতটা বেজে গেছে। মলের ফুটপাতের উপর দিয়ে সে আবার পায়চারি করতে লাগল। একটি রেস্তোরাঁয় অর্কেস্ট্রা বাজছে। ভেতরের চাইতে বাইরেই বেশ ভিড়। বাইরের শ্রোতাদের মধ্যে মোটরের ড্রাইভার আর গাড়ির কোচওয়ানেরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর রয়েছে ফল বিক্রি করে টুরি হাতে বাড়ি-ফেরতা কিছু পথিক, ফেরিঅলা, কিছু ভিখিরি। এরা সব সংগীতের সমঝদার শ্রোতা বলেই কোনোরকম গণ্ডগোল না-করে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অর্কেস্ট্রা শুনছে– যদিও সুর সম্পূর্ণ বিদেশি। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে আবার এগিয়ে গেল যুবকটি।
কিছুদূর যেতেই ইংরেজি বাদ্যযন্ত্রের একটি বড়মতো দোকান চোখে পড়ল। বিনাদ্বিধায় ভেতরে ঢুকল সে। চারদিকে কাঁচের আলমারিতে রকমারি ইংরেজি বাজনার সরঞ্জাম সাজানো। একটি লম্বা টেবিলের উপর পশ্চিমা সংগীতের দুই পৃষ্ঠার কয়েকটি পুস্তিকা রাখা। নতুন গানের স্বরলিপি রয়েছে তাতে। পুস্তিকাগুলোর প্রচ্ছদপট সুন্দর রংচঙে, কিন্তু ভেতরের গানগুলো নিম্নস্তরের। উড়ো উড়ো একনজর সে দেখে নিল সেগুলো। সেখান থেকে সরে এসে যন্ত্রগুলোর ওপর নজর বুলোতে লাগল। খুঁটির সাথে ঝোলানো একটি স্পেনীয় গিটারের দিকে সমালোচকের দৃষ্টিতে তাকাল। গিটারের সাথে লাগানো প্রাইস-টিকেটটা পড়ল। সেখান থেকে সরে গিয়ে একটি জার্মান পিয়ানো আঙুল দিয়ে নেড়ে চেড়ে, বাজিয়ে দেখে নিয়ে, বন্ধ করে রাখল!
দোকানের একজন কর্মচারী তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘গুড ইভ্নিং স্যার। বলুন, আপনার কী চাই?’
‘না, ধন্যবাদ। হ্যাঁ, এ মাসের নতুন গ্রামোফোন রেকর্ডের একটা লিস্ট আমাকে দিতে পারেন
লিস্টখানা ওভারকোটের পকেটে ফেলে রাস্তায় নেমে পড়ল সে। তারপর, আবার চলতে লাগল। রাস্তার ধারে একটি ছোট্ট বুক-স্টলে গিয়ে সে দাঁড়াল। কয়েকটি নতুন পত্রিকার পাতা উল্টে, নেড়েচেড়ে দেখে, আবার যত্ন করে সাজিয়ে রেখে দিল। সেখান থেকে আরো কিছুদূর এগিয়ে যেতেই কার্পেটের একটা দোকান চোখে পড়ল তার। লম্বা চোগা আর মাথায় লম্বা তুর্কি টুপি পরা দোকানের মালিক তাকে বেশ সাদর সম্ভাষণ জানালেন।
‘ইরানি কর্পেটটা দেখার ইচ্ছে ছিল।… ঠিক আছে, নামাতে হবে না। আমি এমনিই দেখে নেব। এটার দাম কত পড়বে?’
‘চোদ্দ শো বত্রিশ টাকা।’
যুবকটি ভ্রু কুঁচকাল– ভাবখানা এই, এত দাম?
‘আপনি আগে পছন্দ করে নিন, তারপর যতটুকু সম্ভব, আপনার কাছ থেকে কম নেবার চেষ্টা করব।’
‘ধন্যবাদ। আমি এখন শুধু একনজর দেখতে এসেছিলাম।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, দেখবেন বইকি। আপনার নিজের জিনিস মনে করে দেখুন, স্যার।’
দু-তিন মিনিট পরে কার্পেটের দোকান থেকেও বেরিয়ে এল সে। ওভারকোটের জায়গায় জায়গায় ফুটন্ত গোলাপফুলের যে কাজ করা রয়েছে, কোথাও কোথাও তার সুতো খুলে গেছে দেখে সেগুলো ঠিক করে দিতে দিতে তার ঠোঁটের কোণায় মৃদু, অথচ অর্থপূর্ণ হাসি ফুটে উঠল। তারপর, আবার ফুটপাতের উপর দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল।
চলতে চলতে এখন সে হাইকোর্টের সামনে এসে পড়েছে। এত হাঁটার পরেও তার মুখের মধ্যে কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই। এক অপরিবর্তনীয় উদ্যম নিয়ে সে হেঁটেই চলেছে। এখন পায়ে-হাঁটা লোকের ভিড় অনেক কমে এসেছে। অনেকক্ষণ পরে পরে দু-একজন লোক ফুটপাতের উপর দিয়ে আসছে-যাচ্ছে। বেতের ছড়িটাকে এক আঙুলে নিয়ে ঘোরাবার চেষ্টা করল সে। পারল না। ঘোরাতে গিয়ে ছড়িটা নিচে পড়ে গেল। ‘ওহ্ সরি’ বলে ছড়িটা উঠিয়ে নিল হাত বাড়িয়ে।
ইতোমধ্যে একজোড়া তরুণ-তরুণী পেছন পেছন আসছিল। পাশ দিয়েই তারা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। ছেলেটা লম্বা স্বাস্থ্যবান। কালো কর্ডের প্যান্ট পরনে। গায়ে চামড়ার জ্যাকেট। মেয়েটির পরনে সার্টিনের ছক-কাটা শালওয়ার আর সবুজ রঙের কোট। তার চলনভঙ্গি বেশকিছুটা গম্ভীর। একটিমাত্র চুলের বেণি পিঠের উপর দিয়ে কোমর পর্যন্ত গড়িয়ে পড়েছে। চলার তালে তালে বেণিটিও সুপুষ্ট দেহের উপর দাপাদাপি করছে।
পেছন থেকে এই দৃশ্যটি যুবকটির কেন জানি উপভোগ্য বলে মনে হল। কিছুদূর নীরবে চলার পর তরুণ-তরুণীর মধ্যে শুরু হল বাক্যালাপ।
ছেলেটির কী কথার জবাবে মেয়েটি হঠাৎ চমকে উঠে বলল, ‘না। না। না। কক্ষনো না। কক্ষনো না।’
‘আমার কথা শোনো লক্ষ্মীটি!’ উপদেশের ভঙ্গিতে ছেলেটি বলল, ‘ডাক্তার আমার বন্ধু লোক। কেউ জানতে পারবে না।’
‘না। না। না।’
‘আমি বলছি, তোমার একটুও কষ্ট হবে না।’
মেয়েটি নিরুত্তর।
‘তোমার বাবা-মা কত দুঃখ পাবেন। তাঁদের মান-ইজ্জতের কথাটাও কি ভাববে না?’
‘চুপ কর, চুপ কর, বলছি! নইলে আমি পাগল হয়ে যাব।’
এতখানি পথ সন্ধের পর থেকে চক্কর দিতে দিতে যত মুখ সে দেখেছে, যত মানুষের কথা শুনেছে– কারুর দিকেই সে আকৃষ্ট হয়নি। হয়নি হয়তো আসলে নিজের ধ্যানেই আগাগোড়া মগ্ন ছিল বলে; না-হয়, তাদের মধ্যে আকর্ষণীয় তেমন কিছু আদৌ পায়নি বলে। কিন্তু উপন্যাসের চরিত্রের মতো অভিব্যক্তিময় তরুণ-তরুণী দুটি তাকে যেন মোহাচ্ছন্ন করে ফেলল। আকর্ষণ অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার ফলে তাদের আরো কথা শোনার, এমনকি সম্ভব হলে কাছে থেকে তাদের মুখ দুটি দেখে নেয়ারও প্রবল ইচ্ছে হতে লাগল তার।
ততক্ষণে জি.পি.ও.-র চৌরাস্তার কাছে পৌঁছে গেছে ছেলে-মেয়ে দুটি। দুজনেই এক মুহূর্তের জন্যে থেমে আবার মেলোড রোডের উপর দিয়ে চলতে লাগল। যুবকটি দাঁড়িয়ে রইল মল রোডের উপরেই। হয়তো সে ভাবল, সঙ্গে সঙ্গে পেছনে গেলে তারা যদি কোনোরকম সন্দেহই করে বসে, তাই কিছুক্ষণ দেরি করে যাওয়াই ভালো।
ছেলে-মেয়ে দুটি একশো গজের মতো আগে চলে যেতেই একলাফে তাড়াতাড়ি গিয়ে সে তাদের ধরতে চাইল। কিন্তু অর্ধেক পথ পেরোতে না-পেরোতেই একটা লরি পেছন থেকে এসে তাকে চাপা দিয়ে মেলোড রোড দিয়ে বেরিয়ে গেল। আহতের চিৎকার শুনে এক নিমেষে ড্রাইভার গতি ঢিমে করল। সহজেই সে আন্দাজ করতে পারল, গাড়ির তলায় কেউ চাপা পড়েছে। রাত্রির অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে ছুটে পালাল সে। দু-তিনজন পথচারী দুর্ঘটনা হতে দেখেই গাড়ির নম্বর দেখার জন্যে চ্যাঁচাতে লাগল। কিন্তু গাড়ি তখন হাওয়ার সঙ্গে মিশে গেছে।
ইতোমধ্যে আরো জনকয়েক লোক ছুটল সেখানে। একজন ট্রাফিক-ইন্সপেক্টর মোটর-সাইকেল চালিয়ে সেদিক দিয়েই যাচ্ছিলেন, তিনিও থামলেন। যুবকের দুটি পা-ই গাড়ির চাকায় পিষে গেছে। অনেক রক্ত বেরিয়েছে, এখনো বেরুচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে চলন্ত একটা গাড়ি ধরে নিয়ে তাতে যেমন-তেমন করে আহতকে চাপিয়ে দিয়ে বড় হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হল। হাসপাতালে পৌঁছানোর পরেও ধিক্ ধিক্ করে প্রাণস্পন্দন দেখা যাচ্ছিল যুবকটির বুকে।
এমারজেন্সিতে তখন ডিউটিতে ছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন মিস্টার খান এবং দুটি তরুণী নার্স মিস শাহ্নাজ আর মিস গিল।
স্ট্রেচারে করে তাকে অপারেশন-রুমের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় নার্স দুটির দৃষ্টি পড়ল তার ওপর। বাদামি রঙের ওভারকোটটি এখনো গায়েই রয়েছে। সাদা সিল্কের মাফলারটিও গলায় জড়ানো। ওভারকোট ও মাফলারের জায়গায় জায়গায় রক্তের দাগ। দয়া করে ফেল্ট হ্যাটখানা তার বুকের উপর আলতো করে রেখে দিয়েছে কেউ।
শাহ্নাজ মিস গিলকে বলল, ‘কোনো ভদ্রঘরের ছেলে বলে মনে হচ্ছে বেচারাকে।’ ফিফিস্ করে গিল বলল, ‘শনিবারে ছুটির সন্ধ্যায় বেশ সেজেগুজেই বেচারা বেরিয়েছিল।
‘ড্রাইভার ধরা পড়েছে কিনা, জানো?’
‘না, পালিয়ে গেছে।’
‘ভারি দুঃখের ব্যাপার।’
অপারেশন-রুমে অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন আর নার্স দুটি নাকের উপর সাদা পটি লাগিয়ে আহতের পরিচর্যায় ব্যস্ত। পাথরের টেবিলের উপর শুইয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। মাথা থেকে তীব্রগন্ধী তেলের ঘ্রাণ একটু একটু ভেসে আসছে। দুর্ঘটনায় তার দুটি পা পিষে গিয়ে থাকলেও মাথার টেরিটা তখনো অটুট রয়েছে। এখন তার সমস্ত কাপড়-চোপড় খোলা হচ্ছে। সবার আগে গলা থেকে সিল্কের সাদা মাফলারটি খোলা হল। সঙ্গে সঙ্গে নার্স দুটি চমকে উঠে একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। তাদের এই আঁতকে ওঠা বিস্ময়কর নয়। মাফলারের নিচে যুবকের গলায় নেক্টাই বা কলার তো নেই-ই, এমনকি শার্ট পর্যন্ত নেই।
ওভারকোট খোলার পর দেখা গেল, ওভারকোটের নিচে রয়েছে পুরনো ছেঁড়া একটা সোয়েটার। সোয়েটারের অজস্র ছিদ্রের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে সোয়েটারটির চেয়েও বেশি পচা আর জীর্ণ একটি গেঞ্জি।
মাফলারটিকে গলার চারপাশে এমনভাবে জড়িয়ে রাখা হয়েছে, যাতে করে তার বুকও ঢেকে গিয়েছে মাফলারে। শরীরে সর্বত্র পুরু হয়ে ময়লা জমে রয়েছে, তীব্র দুর্গন্ধ ভেসে আসছে শরীর থেকে। দু-মাস ধরে সম্ভবত গোসল করেনি সে। অবিশ্যি ঘাড়টুকু এর ব্যতিক্রম– ইতস্তত পাউডার ছড়ানো রয়েছে ঘাড়ে।
সোয়েটার আর গেঞ্জির পরে প্যান্টের পালা আসতেই শাহ্নাজ আর গিল আরেকবার পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।
বেল্টের বদলে প্যান্টটা ছেঁড়া একটা নেক্টাই দিয়ে শক্ত করে বাঁধা রয়েছে কোমরে। বোতাম কিংবা বলেসের কোনো বালাই নেই! দুই হাঁটুর উপর অনেকখানি করে জায়গা জুড়ে কাপড়ই অনুপস্থিত। তাছাড়া, আরো কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। প্রায় সম্পূর্ণ প্যান্টটিই ওভারকোটের নিচে ঢাকা ছিল বলে এগুলো কারো চোখে পড়েনি।
বুট আর মোজা খোলার পালা আসতেই আরো একবার মিস শাহ্নাজ আর মিস গিল একজন আরেকজনের দিকে তাকাল।
বুট দুটি অত্যন্ত পুরনো হওয়া সত্ত্বেও পালিশ লাগিয়ে বেশ চকচকে করে রাখা হয়েছে। কিন্তু এক পায়ের মোজার সাথে অন্য পায়ের মোজার কোনো মিল নেই। তাছাড়া, মোজা দুটি এত বেশি ছেঁড়া যে, যুবকের ময়লা গোড়ালি তার থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে পড়েছে।
.
নিঃসন্দেহে ততক্ষণে মৃত্যু হয়েছে তার। নির্জীব দেহখানা পাথরের টেবিলের উপর পড়ে রয়েছে। টেবিলে শোয়ানোর পর মুখখানা ছাদের দিকে ছিল, কাপড়-চোপড় খুলতে গিয়ে সে-মুখ এখন ঘুরে গেছে দেয়ালের দিকে। দৃশ্যটি দেখে মনে হচ্ছে, যেন দেহের নোংরামির সাথে সাথে আত্মার নোংরামির জন্যেও সে খুব লজ্জিত। তাই সবার কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে রাখতে চায় সে।
যুবকটির ওভারকোটের বিভিন্ন পকেট থেকে যেসব জিনিস পাওয়া গেছে, তার তালিকা নিম্নরূপ :
একটি ছোট্ট কালো চিরুনি, একটি রুমাল, সাড়ে ছয় আনা পয়সা, আধপোড়া একটি গোল্ডফ্লেক সিগারেট, কয়েকজনের নাম-ঠিকানা লেখা একটি ছোট্ট নোট-বই, নতুন গ্রামোফোন রেকর্ডের একটি মাসিক তালিকা, আর কতকগুলো বিজ্ঞাপনের কাগজ।
দুঃখের বিষয়, বেতের ছড়িটি এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সম্ভবত দুর্ঘটনার সময় সেটা কোথাও হারিয়ে গেছে।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির
এক মগ চাল – খাজা আহমদ আব্বাস
সাপের মতো এঁকেবেঁকে, পিঁপড়ের মতো বিড়বিড় করে গুঁড়ি মেরে মেরে, মৌমাছির ঝাঁকের মতো ভনভন করতে করতে দুটি লম্বা লাইন সরকারি রেশনের দোকানের দিকে এগিয়ে চলে। একটি পুরুষের, একটি স্ত্রীলোকের। স্ত্রীলোকের লাইনটা পুরুষের লাইনের চেয়েও লম্বা, প্রায় এক ফার্লং। তার শেষ প্রান্ত রাস্তার মোড় দিয়ে ঘুরে একটি সরু মতো গলিতে গিয়ে ঢুকেছে। যেসব স্ত্রীলোকের আসতে দেরি হচ্ছে, তারা একে অন্যের পেছনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। রেশনের দোকানটা যে দূর থেকে এক ঝলক দেখে নেবে তারা, তা-ও পারছে না। চোখে পড়ছে শুধু যারা সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাদের মাথা।
কয়েকশো স্ত্রীলোক হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, পারসি এবং ইহুদি; মুসলমান মেয়েরা কেউ বোরকা পরে এসেছে, কেউ-বা বোরকা ছাড়াই। চিকন কালো মেছুনিরা এসেছে চুলে ফুল গুঁজে। তাদের কাপড়ের আঁশ-গন্ধের সঙ্গে মিশে সেই ফুলের সুগন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। এসেছে ফ্রক-পরা, হাঁটু-আলগা, চটি পায়ে গরিব দেশের খ্রিস্টান গোয়ানিজ মেয়েরা। এসেছে সস্তা পেন্ট, পাউডার ও সেন্টে চুবড়ানো আর নকল সিল্কের মোজা এবং উঁচু হিলওয়ালা জুতো পরা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে। ফুল-কাটা রেশমি শাল কাঁধে ফেলে এসেছে গৌরাঙ্গি, কৃষ্ণকেশী ইহুদি মেয়েরা। আরো এসেছে সুডোল-দেহ মারাঠি এবং অত্যন্ত কৃশাঙ্গি বা ধুমসো গুজরাটি মেয়ের দল, আর কেরানি, মজুর, সাধারণ শ্রেণির দোকানদার এবং ট্যাকসি-ড্রাইভারের বউয়েরা। কেউ বিয়ে করা বউ। কেউ-বা অবিবাহিত বউ। চারদিকে মোতিয়ার কলি আর আঁউরানো ফুল, পেন্ট আর ঘাম এবং মাছ আর নারকেল তেলের গন্ধ। দুপুরের রোদে এই রকমারি সুগন্ধ আর দুর্গন্ধ মিলে ওপর দিকে বাষ্প ঠেলে উঠছে। মারাঠি, গুজরাটি, হিন্দুস্তানি এবং ইংরেজি ভাষার কথাবার্তার একটা অবোধ্য কোলাহল শোনা যাচ্ছে। যেন লাখখানেক মৌমাছি গুঞ্জন করছে। এদিকে চলে অপেক্ষা। ষাট সেকেন্ডে এক মিনিট…ষাট মিনিটে এক ঘণ্টা… এক ঘণ্টা… দু’ ঘণ্টা… তিন ঘণ্টা… সাপের মতো আঁকাবাঁকা, পিঁপড়ের মতো মন্থরগতি মেয়েদের লম্বা লাইনটা ক্রমে আরো বেড়ে চলে। একজন যতক্ষণে লাইনের মাথা থেকে রেশন নিয়ে বিদায় নেয়, ততক্ষণে আরো দুজন পেছনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। দুশো আড়াইশো, তিনশো, সাড়ে তিনশো– ক্রমে আরো স্ত্রীলোক এসে দাঁড়ায়। ধৈর্য, সাধুতা আর বিশ্বাসের অদ্ভুত দৃশ্য। যেন পূজার্থিনীর দল মন্দিরের দরজা খোলার প্রতীক্ষায় রয়েছে। এ এক নতুন মন্দির, যেখানে হিন্দু, মুসলমান, পারসি, ইহুদি– সব একসাথে পূজা দিতে এসেছে। প্রত্যেকের একই চিন্তা, একই কামনা, একই সাধ– এক মগ চাল।
দুর্গা এসে মেয়েদের লাইনের একেবারে পেছনে দাঁড়িয়ে যায়। সকাল থেকে মাথা, গা এবং পেটে অসহ্য বেদনা হওয়ায় এখানে আসতে তার দেরি হয়ে গেছে। আজ তার শরীরের অবস্থা এমন নয় যে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখানে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু কী করবে! না-এসেও উপায় নেই। ঘরে যে কটি চাল ছিল, সবই শেষ হয়ে গেছে। দুই বেলা বাজার থেকে খাবার কিনে খেয়েছে। কয়েকদিন পর দোকান খুলেছে আজ। চাল যদি সে না নিতে পারে, তাহলে কবে যে বাড়ির খাবার ভাগ্যে জুটবে, কে জানে। আর, এই সময়ের মধ্যে যদি দিন পূর্ণ হয়ে যায় এবং সেই প্রতীক্ষিত লগ্নটি এসে পড়ে, তাহলে তো আরোই মুশকিলে পড়তে হবে।
দুর্গার স্বামী এক কারখানায় কাজ করে। ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে সাঁঝ দেওয়ার পর একসময়। তা-ও আবার সমস্ত দিন মেশিনের মতো হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে। বাজার থেকে সওদা-পত্তর সব দুর্গাকে আনতে হয়। সে মজুর মেয়ে। কাজ করতে তার না আছে কোনো আপত্তি, না আছে সময়-অসময়ের প্রশ্ন। যদ্দিন গাঁয়ে বাপ-মায়ের কাছে ছিল, চাষের কাজে সাহায্য করত, চরকা কাটত, চাকি চালাত, বাপ-ভাইয়ের জন্য রুটি তৈরি করে মাঠে নিয়ে যেত, গরু-বলদের জন্য বিচালি কাটাত, দুধ দু’তো, রাতে শোওয়ার আগে গরুগুলো ডেকে-ডুকে এনে বেঁধে রাখত, এমনি কত কী করেছে। বিয়ের পর শহরে এসে তার নন্দ’র মতো সে-ও কারখানায় কাজ করত। প্রতিদিন দশ ঘণ্টা কাজ করতে হত কারখানায়। তারপর বাড়ি ফিরে আবার চুলোয় ফুঁ পাড়ত। কিন্তু কখনো তার একথা মনে হয়নি যে, সে খুব পরিশ্রম করছে। তার নন্দ’র জন্য সে সবকিছু করতে প্রস্তুত। নন্দ কত ভালো মানুষ। দুর্গাকে বোম্বাই নিয়ে এসে সে কত বেড়িয়ে এনেছে চিড়িয়াখানা, চৌপাটি আর অ্যাপোলো বন্দর থেকে। কয়েকবার সিনেমায়ও নিয়ে গেছে। এমন সব জিনিস দুর্গা গ্রামে দেখতে পেত কী করে? নন্দ তার দিকে খুব খেয়াল রাখে। অন্যান্য শ্রমিকের মতো সে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে না বা বউকে মারধোর করে না। এদিকে, ছয় মাসও যখন পূর্ণ হয়নি, তখন দুর্গার কারখানায় যাওয়া সে বন্ধ করে দিয়েছে।
: তোর এখন বাড়িতে বিশ্রাম করা দরকার। তুই এবার আমার ছেলের মা হতে চলেছিস না?– নন্দ হেসে বলেছিল, দেখ, ছেলে চাই, মেয়ের দরকার নেই আমার।
সাপের মতো এঁকেবেঁকে, পিঁপড়ের গতিতে বিড়বিড় করে মেয়েদের দীর্ঘ লাইনটা রেশনের দোকানের দিকে এগিয়ে চলেছে। এখন দুর্গার পেছনেও আট-দশজন স্ত্রীলোক এসে দাঁড়িয়েছে লাইনে। কোথাও কোথাও পরস্পরের মধ্যে আলোচনা চলছে। একটি পারসি স্ত্রীলোক বাজারে দর বেড়ে যাওয়ার বিশদ বর্ণনা দিচ্ছে। একটা খোঁজা মেয়েছেলে চালের ঘাটতির জন্য কংগ্রেসের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। একজন খ্রিস্টান স্ত্রীলোকের ধারণা এসব মহাত্মা গান্ধীর দোষ। তিনি যদি সরকারের সঙ্গে যেচে হাঙ্গামা না-বাধাতেন, তাহলে সরকারও ভারতীয়দের শাস্তি দেওয়ার জন্য চালের ওপর কন্ট্রোল বসাত না।
একটি গুজরাটি স্ত্রীলোক বলে, কংগ্রেস আর মহাত্মা গান্ধীর দোষ দিচ্ছ কেন? জান না, গরমেন্ট লাখো লাখো মণ গম ইরান, ইরাক আর মিশরে রপ্তানি করেছে!
: অ্যাঁ, গরমেন্ট খাবার বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে?– একজন মারাঠি স্ত্রীলোক বিস্মিত হয়ে বলে, কিন্তু আমরা হিন্দুস্তানিরাই-বা কবে নির্দোষ হলাম। ব্যবসায়ী আর আড়তদাররাই কি বাড়িতে কিছু কম চাল ভরে রেখেছে!
: তা নয় তো কী! আমরা এক মগ চালের জন্য পাঁচ-ছয় ঘণ্টা রোদ্দুরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকি, আর ওদিকে ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার মণ চাল লুকিয়ে রেখে দুই গুণ তিন গুণ দামে বিক্রি করছে!
: এরকম লোকদের ফাঁসি দেওয়া উচিত।
: সে অন্য দেশে হয়। আমাদের দেশে তো এদের রায় বাহাদুর, খান বাহাদুর খেতাব দেওয়া হয়, যুদ্ধের কাজের কনট্রাকটরি দেওয়া হয়। এটা হল হিন্দুস্তান।
আর একদিকে যুদ্ধের খবরের ব্যাখ্যা চলছে।
: আরে, তুমি জানো না, জার্মান আর জাপান একই কম্বলের লোম– জাপান সুযোগ পেলে রাশিয়ার ওপর হামলা না-করে ছাড়বে না।
: তাহলে, বাবা, ধরে নাও, তার বিপদই ঘনিয়ে এসেছে। এ বার্মা আর ফিলিপাইন নয় যে, গিলে ফেললে ঢেকুরটাও উঠবে না। এ হল গিয়ে রাশিয়া।— এটি কোনো সাংবাদিকের বউ, যার স্বামী হয়তো স্বপ্নেও খবরের কাগজের হেডিং পড়ে।
রুশ! রৌদ্রে দুর্গার মাথা ঘুরছিল। কিন্তু তার মনে হল, এই ‘রুশ’ শব্দটি সে কোথায় যেন শুনেছে। হ্যাঁ, তার মনে পড়েছে। নন্দ একবার তাকে সঙ্গে করে একটা সভায় নিয়ে গিয়েছিল। শ্রমিকদের সেই সভায় প্রায় পঁচিশ-তিরিশ হাজার শ্রমিক উপস্থিত ছিল। মেয়েছেলেই তো ছিল কয়েক হাজার। চারদিকে লাল লাল ঝাণ্ডা। মাঝখানে একটি উঁচু জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়ে লোকে বক্তৃতা দিচ্ছিল। দুর্গা দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল– বক্তৃতা হচ্ছে অত দূরে উঁচু জায়গাটায়, কিন্তু আওয়াজ আসছে কাছেরই একটা থামে বাঁধা একটি কালো চোঙা থেকে। অদ্ভুত আওয়াজ। যেন কেউ কুয়োর মধ্যে মুখ বাড়িয়ে কথা বলছে। এই আওয়াজটায় শোনা গেল, ভাই সব, হিটলারের খুনি নেকড়েরা রুশিয়ার ওপর হামলা করেছে। রুশিয়া শ্রমিকদের নিজের দেশ। রুশিয়া শ্রমিকদের নিজেদের সরকার।… পৃথিবীর সমস্ত শ্রমিকের কর্তব্য রুশিয়ার সাহায্যের জন্য তৈরি থাকা।… তারপর, হাজার হাজার গলা থেকে এমনভাবে ধ্বনি বেরুল যে, মনে হল, বুঝি-বা আকাশ ফেটে পড়বে।
কতক্ষণ হয়ে গেল দুর্গার দাঁড়িয়ে থাকা! পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে, ষোল-সতেরো জনের মতো স্ত্রীলোক রয়েছে তার পেছনে। লাইনের সঙ্গে এগোতে এগোতে এবার সে রাস্তার মোড়ে এসে পৌঁছেছে। ঘাড় বার করলে রেশনের দোকানের লাল লাল লেখাওয়ালা সাইনবোর্ডটাও দেখতে পাচ্ছে সে। কিন্তু এখনো কমপক্ষে শ’খানেক স্ত্রীলোক পার হলে তবে সে এক মগ চাল পাবে। একটি ক্লান্ত পা থেকে অন্য ক্লান্ত পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে দুর্গা মনে মনে বলে, দোকানদারটা এত দেরি করছে কেন, বুঝতে পারছিনে তো।– অন্য স্ত্রীলোকরাও কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে পড়েছে। গরম আর নীরবতায় গোটা লাইনটি কাবু হয়ে পড়েছে এখন। নীল উর্দি পরা একটা সেপাই সামনের গাছতলায় ঝিমোচ্ছিল। তাকে ঝিমোতে দেখে দুর্গার সমস্ত ক্লান্তি, পায়ের ব্যথা, পেটের বেদনা– সব তার চোখে এসে জড় হয়। রাস্তার ট্রাম-লাইনে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে তার। পা দুখানা টলে উঠতেই সামনের স্ত্রীলোকটিকে ধরে দাঁড়ায় সে। বুড়ি মতো লোকটি বলে, ও বোন, একটু নিজের পায়েই দাঁড়াও!– বুড়ির কথায় রাগ বা জ্বালা নেই। কিন্তু দুর্গা লজ্জিত হয়ে একটু যেন বিমূঢ় হয়ে পড়ে। অন্যমনস্কভাবে পিছু হটতে গিয়ে এবারে প্রচণ্ড ধমক খায়, কানী, আমার পা-খানা মাড়িয়ে দিল!– এই স্ত্রীলোকটি দুর্গার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য যন্ত্র-চালিতের মতো পিছু হটতেই লাইনের শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষায় গালাগালি আর অভিশাপের উচ্চ রোল ওঠে।
দুর্গা লজ্জায় মরতে মরতে একেবারে মরে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নিয়ে সে দৃষ্টিটা মাটিতে বিঁধিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একবার তার ইচ্ছা হয়, এক মগ চালের আশা ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে, নন্দ সন্ধ্যার সময় শান্ত, ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে কী খাবে? তার বড়-ভালো-মানুষ নন্দ তার জন্য প্রত্যেকদিন কয়েক ঘণ্টা ওভারটাইম করে। আর এখন তো দোকানের কাছেই এসে গেছে। কোনোরকমে এক ঘণ্টা, আধ ঘণ্টা কেটে গেলে তো সে চাল নিয়েই বাড়ি ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু পেটে এত বেদনা হচ্ছে কেন? আর, কোন মানুষ যেন চিৎকার করছে! ব্যথায় ঘেমে নেয়ে ওঠে দুর্গা। মাথাটা আবার ঘুরতে থাকে। পেটের মধ্যে ব্যথার ঢেউ উঠছে, জোয়ার-ভাটা চলছে। মনে হচ্ছে, কোন শত্রু যেন বারবার বর্শা দিয়ে আক্রমণ করছে। একটি আঘাতের জখম সেরে উঠতে না- উঠতেই আবার আঘাত করছে। দিন কি পুরো হয়ে গেল? এতদিন থেকে সে যে দিনটির অপেক্ষা করছে, সেই দিনটি কি এসে গেল? না, তা কী করে হয়! সবেমাত্র তিন দিন হল, দাই বলেছে, এখনো দশ-পনেরো দিন বাকি আছে। এটা হয়তো অন্য কোনো বেদনা।
ব্যথা আর কষ্টের মধ্যে দুর্গা কেমন করে জানি পুরো লাইনের সঙ্গে সঙ্গে আপনা থেকেই দোকানের দরজা পর্যন্ত এসে পৌঁছয়। এখন শুধুমাত্র একটি স্ত্রীলোক রয়েছে তার সামনে। এই স্ত্রীলোকটিও যখন দোকানের ভেতরে চলে যায়, তখন দুর্গা দেখে, তাকে ও সিঁড়ি ভেঙে ভেতরে ঢুকতে হবে। এক ফুট উঁচু উঁচু দুটো ধাপ তার কাছে মনে হয়, তাদের গাঁয়ের সেই মন্দিরের টিলার মতো, যার উপরে পৌঁছতে হলে একশোর ওপর ধাপ পার হয়ে উঠতে হয়। ভগবান! এই নড়বড়ে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে সে কী করে যাবে?
তার সামনের স্ত্রীলোকটি থলেয় এক মগ চাল নিয়ে স্মিতমুখে ঘাম মুছতে মুছতে দোকান থেকে বেরিয়ে আসে। পেছনের স্ত্রীলোকটি দুর্গাকে ধাক্কা দিয়ে বলে, যাও বাপু, যাও। ঘুমোচ্ছ নাকি?
দোকানদারও তার দিকে তাকিয়ে বলে, এস গো, দেরি করছ কেন?– কিন্তু সে দেখে না যে, দুর্গার মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। সিঁড়ি ভাঙবার কথা মনে আসতেই তার পা দুটি থরথর করে কাঁপছে।
: আমাকে… আমাকে… আমাকে এখান থেকেই দিয়ে দাও, ভাই।– দুর্গার ঠোঁট দুটি শুকিয়ে গেছে। কথাও বের হয় কষ্টে।
: তোমার এত গুমর কিসের? নিতে যদি হয়, ভেতরে এসে নাও!
: যাচ্ছ-না কেন?
: না-নিতে হলে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে অন্য লোককে আসতে দাও!
প্রতি পদক্ষেপে দুর্গার মনে হয়, সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। কিন্তু নিজের দেহটাকে কোনোরকমে টেনেহিঁচড়ে দোকানের মধ্যে পৌঁছে দেয় সে; তারপর কম্পিত হাতে থলেটা দোকানদারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে দামটা সামনে রেখে দেয়। পয়সাগুলো চারঘণ্টা ধরে তার হাতের মুঠোয় থেকে থেকে ঘামে ভিজে গেছে। দোকানদার মাপের মগ উঠিয়ে চাল ভরে দুর্গার থলেয় ঢেলে দেয়। তারপর দুর্গার মনে হয়, মোটা দোকানদারটি যেন আপনা-আপনিই ঘুরছে। মাপের মগটাও। চালের থলেও। গোটা দোকানটা ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে গোটা দোকান– চালের বস্তা, ঘিয়ের পিঁপে, দেয়ালে টাঙানো হনুমানজির ছবি– দুর্গার গায়ে ধাক্কা খায়। সে তীব্র আর্তনাদ করে ওঠে।
তারপর দুর্গার মনে হয়, সে যেন চালের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু তার গাঁয়ের উপর থেকে চাল আপনা-আপনিই সরে যায়। হনুমানজি সেই চাল মাপের মগে ভরে ভরে সমস্ত স্ত্রীলোককে বিতরণ করছে– এই নাও এক মগ চাল, এই নাও এক মগ চাল। আনন্দে হনুমানজির লেজটা নামছে। কিন্তু লেজ তো নয়। এ তো সাপ। দুর্গাকে যে গাল দিয়েছিল, সাপটির মুখখানা সেই স্ত্রীলোকটির মুখের মতো। নিশ্বাস টেনে টেনে সাপটি ফুলছে আর বাড়ছে। তারপর দোকান থেকে বেরিয়ে এঁকেবেঁকে গলির মোড় পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছয়। ফোঁস ফোঁস করতে করতে এবার সে দুর্গার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। যে-কোনো মুহূর্তে দুর্গাকে গিলে ফেলবে সে। সাপ নিশ্বাস টানে, দুর্গা ছিটকে তার পেটের মধ্যে চলে যায়।
কিন্তু এটা সাপের পেট নয়, অন্ধকার ঘর। অন্ধকার এবং গরম। বাতাস স্তব্ধ। দুর্গার দম বন্ধ হয়ে আসে। অন্ধকার গহন থেকে কার যেন কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ‘এটা হিন্দুস্তান, হিন্দুস্তান।’ অন্ধকারের মধ্যেই আবার দূর থেকে দুটি লাল আলো ঝলমল করতে থাকে। দুর্গার মনে হয়, কোনো সাপের চোখ জ্বলছে। কিন্তু কাছে এলে দেখে, দুটি লাল পতাকা। ঝাণ্ডা দুটি আপনা-আপনিই হাওয়ায় উড়ছে। এবার চারদিক আলোকিত হয়ে যায়। সহস্র সহস্র, লক্ষ লক্ষ শ্রমিক অদ্ভুত ধরনের কী এক ভাষায় গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চলেছে। একটি কুয়োর ভেতর থেকে আওয়াজ ভেসে আসে। তারপর হঠাৎ মেঘ ঘনিয়ে আসে এবং বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে। দূর থেকে মেঘ গর্জনের আওয়াজ আসে। কিন্তু না, মেঘের গর্জন তো নয়, কামান চলেছে, গোলাবর্ষণ হচ্ছে। যেরকম দুর্গা একদিন সিনেমায় দেখেছিল। একটা বোমা একেবারে তার পাশে এসে পড়ে, টুকরো টুকরো হয়ে বাতাসে উড়ে যায়।
এবার দুর্গার মনে হয়, সে উলঙ্গ হয়ে পড়ে রয়েছে। একেবারে উলঙ্গ। লজ্জায় সে লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু উঠে দাঁড়াবার আগেই একটা ভীষণাকার দৈত্য এসে করাত দিয়ে তার পেট চিরতে শুরু করে। ভালো করে দেখবার পর কিন্তু দুর্গার বিস্ময়ের সীমা থাকে না। এ স্বয়ং তার স্বামী নন্দ। উচ্ছলভাবে সে দুর্গার পেট কাটছে, আর বলছে, ছেলে চাই না, ছেলেমেয়ের দরকার নেই আমার।
চারদিকে হাজার হাজার লোক জমা হয়ে যায়। দুর্গার এই অবস্থা দেখে তারা হাসতে থাকে। একজন বলে, হিন্দুস্তান, হিন্দুস্তান।
এ কথায় ধুমসো গুজরাটি স্ত্রীলোকটি বলে, গান্ধীজিকে কেন দোষ দাও। স্বয়ং ইংরেজরাই তো এদের ক্ষিধেয় মারছে।…
সব লোক অদৃশ্য হয়ে যায়। এবার দুর্গা দেখে, সে মোটা হয়ে গেছে। ওই দোকানদারটার চেয়েও মোটা। আর, একটা হাঁড়ির সমান ভুঁড়ি বেরিয়েছে তার। কে যেন ভুঁড়ির মধ্যে একটা কাঠি ঢুকিয়ে দিয়েছে। পেট থেকে এবার রক্ত বেরোতে থাকে। এত রক্ত বের হয় যে, তার সমস্ত কাপড় ও শরীর রক্তে ভেসে যায়, আর পেটটা সঙ্কুচিত হয়ে কোমরের সঙ্গে লেগে যায়। দুর্গা আবছা চেতনার দুয়ারে কে যেন নাড়া দিতে থাকে। কয়েকজন লোক গল্প-গুজব করছে। দোকানটা ঘুরতে ঘুরতে সংজ্ঞাহীনতার মেঘলোক থেকে বেরিয়ে আসছে। ঘুরতে ঘুরতে আস্তে আস্তে দোকানটা স্থির হয়ে দাঁড়ায়। সামনে হনুমানজির ছবি টাঙানো।
দুর্বলতার জন্য দুর্গা ঘাড়টাও ফেরাতে পারে না। তার মনে হয় দোকানটা যেন মানুষে ভর্তি। তাদের কথার আওয়াজ বেশ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কোনো কোনো শব্দ বোঝা যাচ্ছে না।
: বেচারি… বোধহয়, এই-ই প্রথম…
: কোন মজদুরের… জানিনে, কোথায়…
: যাও, সরো… মুক্তি… বেরিয়ে যাও…
দুর্গার পেট ভীষণ খালি বোধহয়। হাত নাড়বার চেষ্টা করে দেখে, যেন সমস্ত কাপড় জলে না, রক্তে ভিজে সপসপ করছে। হঠাৎ তার মনের মধ্যে একটি ভয়ঙ্কর কথা বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠে– আমি এখানে– সারা দুনিয়ার সামনে ছেলের জন্ম দিলাম? হায় ভগবান, এই বেশরমের কাণ্ডটা কি আমারই কপালে লিখে রেখেছিলে? সাধ্যে কুলোলে সে এখানেই মাটিতে মিশে যেত। এমন অপমানের চেয়ে যে মরণই ভালো ছিল। দুর্বলতার একটি ধাক্কায় চোখ দুটি বন্ধ করে ফেলে সে। মনে মনে বলে, এখান থেকে যাব কী করে এখন? লোকের কাছে মুখ দেখাব কেমন করে? সারা দুনিয়া যে আমার দিকে ইশারা করতে থাকবে!…
কয়েক মিনিট এমনি লজ্জার সমুদ্রে ডুবে থাকে দুর্গা। আবার দুর্বলতা আর সংজ্ঞাহীনতার ধাক্কা আসছিল। ইতোমধ্যে শোনা যায়, ট্যা-অ্যা-অ্যা-
একটি শিশুর কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। একটি শিশু। দুর্গার– নন্দ’র। ছোট্ট আওয়াজটি সমাজের বানানো লজ্জার মধ্যে পবিত্রতার দোলা জাগিয়ে দেয়। দুর্গার মন থেকে দুর্বলতা আর চেতনাহীনতার মেঘ কেটে যায়। কষ্টের ভয় না-করে সে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে, খানকয়েক ময়লা ন্যাকড়ার মধ্যে লাল চাদরের মতো একটি শিশু ছোট্ট মুখটি হাঁ করে কাঁদছে। শিশুটির ক্ষিধে পেয়েছে ভেবে, তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বডিসের ফিতে খুলতে থাকে দুর্গা।
মমতার মান মানুষের কৌতূহলকে ছাপিয়ে ওঠে। সমস্ত লোক মুচকি হাসি হেসে দোকান থেকে বেরিয়ে আসে।
কিছুক্ষণ পর দুর্গা দেওয়াল ধরে ওঠে দাঁড়ায়। তারপর টলতে টলতে কিন্তু বিজয়িনীর ভঙ্গিতে বাইরে চলে আসে। এক হাতে সে নিজের ছেলেকে কোলে করেছে। আর এক হাতে থলে। থলের মধ্যে এক মগ চাল।
অনুবাদ : মিলি হোসেন
বিভ্রান্ত-বৈভব – ইব্রাহিম জলিস
অনেকক্ষণ হল সূর্য অস্ত গেছে। অন্ধকার গম্ভীর হতে গভীরতর হচ্ছে। কিন্তু এ যে শুধু অন্ধকার; রাত কোথায়? করাচি থেকে হাজার মাইল দূরে হংকং-এর রাস্তায় মজিদ খান রাতই খুঁজছে। পুরুষের জীবনে সূর্যাস্তের পর যদি কোনো নারী না থাকে, বা নারীর জীবনে পুরুষ না থাকে তবে সূর্যোদয় পর্যন্ত শুধু অন্ধকারই প্রতীয়মান হয়। তাই তো অন্ধকারে নারী-পুরুষের প্রথম মিলনকে ‘প্রথম রাত’ বলে অভিহিত করা হয়।
প্রথম রাত। ইতোপূর্বে জীবনটা গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল।
নারী হলে অন্ধকার রাত, নারী ছাড়া রাত শুধুই অন্ধকার।
যৌবন-সীমায় পা দেবার পর থেকে আজ পর্যন্ত মজিদ খানের জীবনে এই প্ৰথম সূর্যাস্তের পর রাতের বদলে নিকষ কালো অন্ধকার প্রতীয়মান হয়। কারণ, তার মনোরম রাত– কুলসুম করাচিতে অথচ সে এখানে।
মজিদ খান যতদিন করাচি ছিল ততদিন তার জীবনে কুলসুম ছাড়া আর একটি রাতও উদয় হয়নি। আর তাই মেয়েদের সাথে ব্যবহারে মজিদ খান বেশ ধৈর্য, পারদর্শিতা আর সংযমের পরিচয় দিত, যাতে করে এক কুলসুম ছাড়া শহরের যে-কোনো মহিলা নিৰ্ভয়ে তার সাথে মেলামেশা করতে পারত। কিন্তু একান্ত নীরবে-নিভৃতে মজিদ খানের অন্তরাত্মা বারবার তাকে একটিমাত্র প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলছে– সত্যি কি মেয়েদের ব্যাপারে খুব বেশি নির্লিপ্ত ছিল? আদমের নির্লিপ্ততার পেছনেও একটা বড় কারণ তখন হাওয়া ছাড়া অন্য কোনো নারীই পৃথিবীতে ছিল না। কিন্তু যেই পৃথিবীতে একাধিক নারীর আবির্ভাব ঘটেছে, অমনি মানুষের ভেতরকার বহুদিনের সুপ্ত পাশবিক প্রবৃত্তি আত্মপ্রকাশ করেছে। তাই তো পৃথিবীতে নারীর জন্যেই প্রথম রক্তের বন্যা প্রবাহিত হয়েছিল।
তাহলে আর নির্লিপ্ততা কী? নির্লিপ্ত মনোভাব বা আভিজাত্যের নিজস্ব কোনো অস্তিত্ব নেই। এটা শুধুমাত্র দৈনন্দিন জীবনের পরিচিতির বন্ধন যা মানুষকে অক্টোপাশের মতো বেঁধে রাখে। যেহেতু পরিচিতির বন্ধন সাধারণ দৃষ্টিসীমার ঊর্ধ্বে সেহেতু মানুষকে ‘কয়েদি’ আখ্যা না-দিয়ে অভিজাত আর নির্লিপ্ত বলা হয়। অতএব মানুষের মধ্যে যদি পরিচিতির বন্ধন না-থাকে তো তারা একে অপরের জন্য পশু ছাড়া আর কিছু নয়।
এ জন্য পৃথিবীতে যত পাপ সংঘটিত হয় তা সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যে হয়। কারণ, রাতের অন্ধকারে মানুষ সকল প্রকার পরিচিতির বন্ধন থেকে মুক্ত থাকে। সে সাহসী হয়ে ওঠে। যেমন– এখন আমায় কে দেখছে? বা এখন আমায় কে চিনবে?
মজিদ খানও এমন একজন যুবক হিসেবে পরিচিত যে, আভিজাত্যের ছোঁয়ায় নির্লিপ্ত। কারণ তার দৃষ্টিসীমা ছিল পরিচিতির নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ যা ছিন্ন করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যেদিন সে বুঝল তার আভিজাত্য আর নির্লিপ্ততা বেশ ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে, সেদিন তাকে বাধ্য হয়ে কুলসুমের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হতে হল। তার এ মনোভাবের দরুন পরে তাকে সাধারণ যুবকদের মনোবৃত্তি সংশোধনের উদ্দেশ্যে সংগঠিত আন্দোলনের সভাপতিও মনোনীত করা হয়েছিল। সভাপতি মনোনয়নের পর সাধারণ আলোচনা-সভার বিবরণী সংবাদপত্রে ছবি-সমেত ছাপা হয়। এতে করে সে শুধু শহরেই নয় এবং দেশের প্রতিটি মানুষের পরিচিত হয়ে ওঠে। শেষে মানুষের সাধারণ পরিচিতির বন্ধন এত নিবিড় হয়ে ওঠে যে তার পক্ষে রাতের অন্ধকারেও এ-বন্ধনকে উপেক্ষা করা দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তার আজো মনে আছে– গভীর রাত্রে সে একদা তার এক বন্ধুর সাথে বাড়ি ফিরছিল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে আবছাভাবে একটা গলির ভেতরে তার চোখ পড়ে। দেখে একটা নারী দাঁড়িয়ে আছে। তার বন্ধুটি ওই নারীটির কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছানোর সাথে সাথেই তার অন্তরাত্মা ধুক ধুক শুরু করে দেয়। শীতের ঠাণ্ডা রাতেও তার দেহ হতে দর দর করে ঘাম ছোটে। একটা দারুণ উত্তেজনায় তার পা দুটো থরথর করে কাঁপতে থাকে। তার ভেতর যেন একটা ভয়াবহ দানব নড়েচড়ে ওঠে– যা বছর বছর ধরে সুপ্ত ছিল। সেই বুঝি তাকে উস্কিয়ে দিচ্ছে– ‘ভয় করছ কেন? এমন ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে কে তোমায় চিনবে? কেই-বা তোমায় দেখছে?’
এ মনোভাবই তার পা দুটিকে ওই নারীটির দিকে ঠেলে দিল। ঠিক সে সময় দূর থেকে একখানা গাড়ি অন্য একটা গলি থেকে এদিকে মোড় নেয়। হঠাৎ একটা উজ্জ্বল আলোকে সমস্ত গলি ঝিকমিক করে ওঠে। আলো অত্যন্ত তীব্রগতিতে তার নিকটবর্তী হচ্ছে দেখে সে ভীত কুকুরের ন্যায় লেজ গুটিয়ে অন্য একটা গলিতে ঢুকে পড়ে। ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে। তিনি আলো দেখিয়ে তাকে পাপ থেকে মুক্ত করেছেন। কিন্তু সে-কৃতজ্ঞতার প্রকাশও অনেকটা লজ্জিত বিড়ালের থাম আঁচড়ানোর রূপ পরিগ্রহ করে।
এই একটিমাত্র ঘটনা। অনেকটা দুঃস্বপ্নের মতোই। আসলে মজিদ খানের জীবনে রাতের অন্ধকারে কুলসুম ছাড়া আর কিছুই করাচিতে তথা সমগ্র পাকিস্তানে ছিল না।
নারী যদি থাকে তো শুধু কুলসুম; রাত যদি থাকে তো তা-ও কুলসুম। কিন্তু আজ কুলসুম থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে হংকংয়ের গভীর পাহাড়ের ভেতর যখন সূর্য অস্ত গেল হঠাৎ কুইন্স রোডের উপর একটি হিংস্র অন্ধকার মজিদ খানের সমগ্র সত্তাকে ঘিরে ফেলল।
করাচি বিমানবন্দর থেকে যে-মুহূর্তেই সে হাওয়ায় ভর দিয়ে উঠেছে সেই মুহূর্তেই তার সকল প্রকার পিরীতির বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে। অতএব সে এখন কুইন্স রোডের উপর সম্পূর্ণ মুক্ত। এখানে তাকে বলবার বা জানবার কেউ নেই। অতএব সে যা-খুশি তাই করতে পারে। কোনো বন্দি যেদিন বছর-বছরের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ করে সেদিন তার মনে প্রথম আকাঙ্ক্ষা জাগে কখন সূর্য অস্ত যাবে। বেশ কিছুক্ষণ আগে সূর্য অস্ত গেছে; কিন্তু রাতের তো নাম-নিশানাও নেই। মজিদ খান এই অজ্ঞাত অন্ধকারে ক্ষুধিত পশুর ন্যায় হাত-পা ছুড়ছে যেন। এমনিতে বিদেশির কাছে অন্ধকার বড় পীড়াদায়ক হয়; তা-ও আবার শীতের অন্ধকার। গভীর আর বিস্তৃত, অতএব ভীষণ। তার ওপরে বিদেশ-বিভুঁই, যেখানে মানুষ সকল প্রকার বাধ্যবাধকতা হতে মুক্ত।
তবুও মজিদ খান পাপকে ভয় করে। কারণ?
রাত পাপের জননী। অন্ধকারের গর্ভ হতে পাপের জন্ম হয়। আর সে অন্ধকারই মজিদ খানকে ঘিরে ফেলেছে।
খানিকটা ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হংকংয়ের রাস্তায় মজিদ খান কোনো অবলম্বন খোঁজে। সে ভাবে– কোনো রিকশাওয়ালা, ট্যাক্সি ড্রাইভার বা কোনো রাতের দালালের যদি খোঁজ পাওয়া যায়, বা, স্ট্রিটল্যাম্পের নিচে একটি রাত যদি পাওয়া যায় যাতে ভর দিয়ে এই শীতল আর অজ্ঞাত অন্ধকারের হাত হতে নিষ্কৃতি পাওয়া যেতে পারে।
আলোর নিচে রাত।
মজিদ খান তার এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর মুখে শুনেছিল– সূর্যাস্তের পর হংকংয়ের স্ট্রিট-ল্যাম্পের নিচে অসংখ্য রাত জমায়েত হয়।
রাত্রির শহর হংকং। কারণ পূর্বের হংকং পশ্চিমের কলঙ্কের শেষ নিদর্শন স্বরূপ বিরাজ করছে– প্রাচ্যে ইংরেজের শেষ কলোনি। প্রশান্ত মহাসাগরে ইংরেজের শেষ যুদ্ধঘাঁটি। যার সঙ্গিন আর তোপ প্রথমে জাপানের দিকে উঁচানো ছিল, এখন চীনের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। হংকং চীনের প্রথম বার। এখানে ইংরেজ এবং আমেরিকা পরস্পরের সাহায্যে চীনা কম্যুনিজমকে ঠেকিয়ে রেখেছে। পূর্বে ইংরেজদের সূর্য শুধুমাত্র হংকংয়ের পাহাড়ে উদিত হত। আর অন্যান্য প্রাচ্য দেশে ইংরেজদের সূর্য অনেক আগে গঙ্গায়, ইরাবতিতে আর মেকংয়ে অস্ত গেছে। তাই লাখ লাখ, কোটি কোটি সৈন্য প্ৰশান্ত মহাসাগরের এই পর্বতসঙ্কুল দ্বীপে মাথা খুঁড়ে মরছে– যাতে-না এখানে ইংরেজের শেষ সূর্য প্যারল সাগরে অস্তাচলগামী হয়।
লাখ লাখ, কোটি কোটি সৈন্য নিজ নিজ স্ত্রী, বাগদত্তা বা প্রেয়সীর কাছ থেকে বহুদূরে অথচ মৃত্যুর একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, এরই মাঝখানে পরম কমনীয় নারী।
নারী! পৃথিবীর সবচাইতে বড় লালসা। এই লালসার জালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সৈন্য আর বিভিন্ন দেশের নারী পরস্পরের সাথে একাত্ম হয়ে গেঁথে রয়েছে যেন।
বক্ষে নারী থাকলে পুরুষ মৃত্যুকেও ভয় করে না, তাই তো হংকংয়ে হাজার হাজার সৈন্যের বুকে বসে হাজার হাজার নারী তাদের সাহস আর শক্তি দিচ্ছে। সৈন্য দ্বারা যুদ্ধ জয় করা যায়, আর যুদ্ধ দ্বারা পৃথিবীতে বিচ্ছেদ ছড়িয়ে পড়ে। তবুও সূর্যাস্তের সাথে সাথেই নারী উদিত হয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধই হংকংকে রাত্রির শহরে রূপান্তরিত করেছে।
কুইন্স রোডের উপর দিয়ে বিভিন্ন দেশীয় রাত চলাফেরা করে। কিন্তু মজিদ খান ঠাহর করতে পারে না কোন রাত সুন্দরী। চীনা রাত, জাপানি রাত, মালয়ী রাত, ফিলিপাইনি রাত, শ্যামি রাত, বার্মি রাত, ইংরেজ রাত, অ্যামেরিকান রাত!
কুইন্স রোডের উপর যেসব পুরুষ ঘোরাফেরা করছে মজিদ খানের কাছে সবাইকে অচেনা বলে মনে হয়; কিন্তু কোনো নারীই অচেনা নয়। সে কোনো নারীকেই জানে না, তথাপি ওরা যেন কেউ অচেনা নয়। বিদেশে যত দূরেরই হোক-না কেন পুরুষ প্রথমে নারীকেই চিনে ফেলে। আদম থেকে শুরু করে এই মজিদ খান পর্যন্ত সবারই এক অবস্থা। পৃথিবীতে কোনো পুরুষ কোনো নারীর অচেনা নয়। শুধু তার নাম, জাতিত্ব আর সম্প্রদায় অচেনা হতে পারে।
অতএব ল্যাম্পপোস্টের সাথে মূর্তির মতো দণ্ডায়মান ক্ষীণদেহী একটি নারীও তাকে দেখে চিনে ফেলল, আর মুখ টিপে হেসে কাছে ডাকল। মেয়েটির চেহারা ছোট্ট আর গোলগাল। মজিদ খান নিজের অজ্ঞাতেই যেন অনেকটা মেয়েটির ডাকে আকৃষ্ট হয়ে যন্ত্রচালিতের মতো তার দিকে পা বাড়ায়। কাছে গিয়ে পৌঁছুলে মেয়েটি অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে বলে– টুয়েনটি ডলার্স।
মজিদ খান ইংরেজিতে জবাব দিল– ডলার যা চাও পাবে সে চিন্তা করো না,– কিন্তু—-।
মেয়েটি তাকে মাঝপথে থামিয়ে বলল– নো ইংলিশ, জাপানিজ।
মজিদ খান জাপানি ভাষা জানে না। আর মেয়েটি ইংরেজি ভাষা জানে না। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই আছে, কিন্তু দোকানের ঠিকানা নেই।
সম্ভবত মেয়েটি জাপানি ভাষায় বোঝাতে চাইছে আমি তোমার হোটেলে যাব না। আর মজিদ খান চাইছে তার সাথে মেয়েটিকে হোটেলে যেতে হবে– অথবা সে হোটেলে যেতেই রাজি আছে; মজিদ খান ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কী মেয়েটি বলতে চায়। মজিদ খান আক্ষেপ করে– মানুষ পরস্পরের নিকটে থাকলেও নিষ্ঠুর ভাষা তাদের কত দূরে সরিয়ে রাখে।
মেয়েটি বলল– নো টক– টুয়েন্টি ডলার্স– টু আওয়ারস।
মজিদ খান বলল— এগ্রিড।
ঠিক সে-সময় একখানা ট্যাক্সি এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। ড্রাইভার অদ্ভুত ভঙ্গিতে মজিদ খানের ওপর দৃষ্টি রেখে তাদের কাছে আসে আর বো করতে থাকে। মজিদ খান শুধু একটি শব্দ বুঝতে পারে- অ্যামেরিকান।
মজিদ খান ট্যাক্সির দিকে চায়। একটি অ্যামেরিকান অতিরিক্ত মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পেছনের সিটে বসে আছে। মেয়েটি ট্যাক্সির দিকে চায়; আর অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে বলে- অ্যা, আমেরিকান? মেয়েটি মজিদ খানের দিকে আর ফিরেও তাকায় না। পাকাপাকি কথারও তোয়াক্কা না করে সে ট্যাক্সির দিকে ছুটে যায়। দরজা খুলে মাতাল অ্যামেরিকানটির পাশে বসে পড়েই তার মাথার চুল ধরে তাকে প্রকৃতিস্থ করতে চেষ্টা করে। মজিদ খান রেগে-মেগে ট্যাক্সির দিকে ছোটে কিন্তু ইতোমধ্যেই ট্যাক্সি একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
মজিদ খান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে আজ প্রথমবারের মতো অনুভব করে অ্যামেরিকার তুলনায় পাকিস্তান কত দুর্বল রাষ্ট্র। তার মনের তীব্র অনুভূতি বাঙ্ময় হয়ে বারবার তার সত্তাকে ধিক্কার দেয়– যদি মেয়েটি ইংরেজি জানত তাহলে তাকে বুঝিয়ে দিতে পারত যে, সে জাপানের ইজ্জত তথা এশিয়ার ইজ্জত অ্যামেরিকার কাছে বিক্রি করছে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতর থেকে এ মনোভাবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ উত্থিত হয়। এ কেমনতরো প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আসলে তো এটা ঈর্ষা! তা না-হলে সে তো ভাবতে পারত যে, অ্যামেরিকানটি তো তারই মতো বিদেশি। সে এশিয়ার অধিবাসী হয়েও এশিয়ার ইজ্জত ক্রয় করতে চাইছে না? সে নিজেও কি জাপানের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে তয়ের হয়ে যায়নি?
কিন্তু — সত্যি কি ওই মেয়েটি জাপান বা এশিয়ার ইজ্জতে সওয়াল? যে-নারী নিজের সতীত্বকে অর্থের বিনিময়ে বিলিয়ে দিতে পারে, তার আবার সম্প্রদায় আর জাতিত্ব! যে-নারী নিজের পবিত্রতা নষ্ট করতে পারে, সে তার জাতীয়তাবোধ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারে। একটি শুধুমাত্র দৈহিক কারবার। আর দৈহিক ব্যাপারে পৃথিবীর সব জাতই সমান
জাপানের ইজ্জত! জাপানের ইজ্জত তো এখন টোকিও, নাগাসাকি, হিরোসিমার গৃহে গৃহে নিজ নিজ স্বামীর গভীর আলিঙ্গনে সংরক্ষিত আছে। অতএব এ কী করে এশিয়ার আব্রুর সওয়াল হতে পারে! মজিদ খান হঠাৎ অ্যামেরিকান প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু অসতী নারীর যেমন কোনোপ্রকার জাতীয়তাবোধ আর সাম্প্রদায়িক চেতনা থাকে না তেমনি সূর্যাস্তের পর বিদেশে পুরুষের কোনো আতা-পাতা থাকে না।
সূর্যাস্তের পর বিদেশি পুরুষ অ্যামেরিকান, ইংরেজ বা জার্মান-পাকিস্তানি কিছুই থাকে না। সবাই শুধুই পুরুষ। নেহায়েতই দেহলিপ্সু দানব। কিন্তু এটা কেমনতরো কথা যে, বৃহৎ জাতি আর ক্ষুদ্র জাতির প্রশ্ন শুধু ইউনাইটেড নেশন্সেই নয়, বেশ্যালয়েও এসে পড়বে? মজিদ খান হতাশাভারাক্রান্ত মন নিয়ে ধীরে ধীরে সামনের দিকে পা বাড়ায়। একখানা উড়োজাহাজ কোম্পানির বড় বোর্ডের বিজ্ঞাপনের নিচে একটি ধবধবে সাদা রঙের মেয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। মজিদ খান তার পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু মেয়েটি অন্যদিকে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। মজিদ খান অত্যন্ত সাহস ভরে তার পাশে এসে দাঁড়ায় আর ইংরেজিতে বলে– রাত ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে থাকার জন্য তৈরি হয়নি।
মেয়েটি ভ্রুকুঞ্চিত করে জবাব দেয়– ইউ আর ব্ল্যাক, অ্যান্ড আই ডোন্ট লাইক ব্ল্যাক পিপল। একথা বলেই মেয়েটি হন হন করে প্রস্থান করে।
মজিদ খান বড় দুঃখের সাথে ভাবে পাপের ভেতরও রাজনীতি ঢুকছে। ভারি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা জীবনের!
রাত প্রায় অর্ধেক হয়ে এল। মজিদ খানের মনে হয় হোটেলে গিয়ে গভীর অন্ধকারকে বক্ষে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়াই বরং আফজল হবে।
কিন্তু হংকং হোটেলের নিকট অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ ভেসে আসে। মনে হয় যেন কেউ নিঃশব্দে শিস দিচ্ছে। মজিদ খান ঘাড় ফিরিয়ে দেখে। একখানা বদ্ধ দোকানের শোকেসের আড়ালে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। চেহারা-সুরতে চীনা বলেই মনে হয়। মজিদ খান তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার আর রাতের প্রয়োজন নেই, সে শুধু অন্ধকারই এখন চায়। তাই মজিদ ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তার সামনে দাঁড়ায় আর নিষ্কৃতি পাওয়ার উদ্দেশ্যেই বলে– আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ।
মেয়েটি বিস্মিত হয়ে জিগ্যেস করে– হোয়াই? মজিদ খান বলল– কারণ আমি যা বলতে চাইব তা তুমি বুঝবে না।
মেয়েটি অত্যন্ত দ্রুত ইংরেজিতে বলে– আমি ইংরেজি খুব ভালো জানি। গত যুদ্ধের আগে আমার প্রেমিক ছিল একজন ইংরেজ। সে আমায় লন্ডন নিয়ে গেছিল। আমি তো সেক্সপিয়রের নাটকও পড়তে পারি।
সেক্সপিয়রের ইংরেজি! হায়রে! ইংরেজি কোথা হতে কোথা গিয়ে পৌঁছেছে। বাকিংহাম প্যালেস আর হোয়াইট হাউস হতে শুরু করে পৃথিবীর প্রত্যেকটি গণিকালয় পর্যন্ত শুধু ইংরেজি ভাষাই লেনদেনের একমাত্র মাধ্যম। ইংরেজি ভাষা প্রতিটি মুহূর্তেই আশীর্বাদস্বরূপ। যদিও ইংরাজ-সূর্য শুধুমাত্র টেস্ নদীতে অস্ত যায় তথাপিও ইংরেজি ভাষা পৃথিবীর সর্বত্রই সচল। ইংরাজি না-হলে বিদেশে মানুষ বোবার শামিল।
চীনা মেয়েটি সত্যি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ইংরেজি বলতে পারে। সে একজন ইংরেজের হাতে বিধ্বস্ত, অথচ আজ ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে সে প্রতিরাতে অসংখ্য প্রেমিক খুঁজে বার করছে। মেয়েটি শুধু দশ ডলার দাবি করল। মজিদ খান তার দিকে বিশ ডলার বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু মেয়েটিকে সে ব্যবহার করতে চায় না। বলল– আমি এশিয়াকে বেশ্যা হিসেবে দেখতে চাই না।
মেয়েটি অত্যন্ত আত্মম্ভরিতার সাথে জবাব দেয়– কিন্তু আমি এশিয়াকে ভিখিরি হিসেবে দেখতে চাই না।
মজিদ খান সামনের দিকে পা বাড়ায়। মেয়েটি সম্ভবত ইউরোপ বা অ্যামেরিকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে।
মজিদ খান কাওলন হোটেলে উঠেছে। এই হোটেল চীনের মূল ভূমিতে অবস্থিত। মূল চীন আর হংকংয়ের মাঝে প্রবাহিত নদী পার হবার শেষ লঞ্চ একটায় ছেড়ে যায়। আর তখন প্রায় দুটো বেজে যাচ্ছে।
একটা তীব্র হতাশা মজিদ খানকে ঘিরে বসে। এবার কী হবে? এত রাত, বিদেশ-বিভুঁই, যাবে কোনদিকে, থাকবেই-বা কোথায়?
একটা ট্যাক্সি ড্রাইভার তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ড্রাইভার চীনা কি জাপানি ঠিক বুঝতে পারে না মজিদ খান। তবে তাদেরই মতো ক্ষুদ্রাকৃতি, চক্ষু দুটি কটা, এবড়ো-থেবড়ো চেহারা, সে-ও চমৎকার ইংরেজি বলতে পারে।
ইংরেজি শিখবার এবং জানবার জন্য যেমন উপাদেয় তেমনি বিভিন্ন কাজের ধান্দার জন্যও মূল্যবান।
মজিদ খান কোনো কথা বলার আগেই ড্রাইভারটি বলে ওঠে– বাকি রাত শেষ করতে চাও, এই তো?
মজিদ খান মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়। ড্রাইভার ট্যাক্সির দরজা খুলে দেয়।
ট্যাক্সি উল্কার মতো ছুটে চলে। ট্যাক্সির গতির সাথে ড্রাইভারের মুখেও খই ফুটতে থাকে। সে অত্যন্ত উৎসাহের সাথে হংকংয়ের নারীদের সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে থাকে। পরিশেষে তাকে প্রশ্ন করে বসে, কোন দেশীয় নারী তার পছন্দসই?
মজিদ খান অত্যন্ত সংক্ষেপে তার মনোভাব ব্যক্ত করে। ট্যাক্সি ড্রাইভার পাকা সমঝদারের মতো আধুনিক যুগের এইসব কাণ্ডকীর্তনে আক্ষেপ করতে থাকে আর নিজ মনে বিড়বিড় করে বলে– ফ্রি ওয়ার্লড, ফ্রি ওয়ার্লড– ডেমোক্র্যাসি– ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট– বিগ ফোর– ইউ এন ও– স্মল নেশন্স্– মেগাটন বম!
কীসব যে বকে যাচ্ছে হয়তো-বা তা সে নিজেও জানে না। মজিদ খানের মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় চিৎকার দিয়ে তাকে এসব বকাঝকা বন্ধ করতে বলে। কোথায় ‘ফ্রি ওয়ার্লড’! পাপের সমুদ্রে ডুবতে ডুবতেও মানুষ ভুলতে পারেনি রঙ, আভিজাত্য, জাতীয়তাবোধ আর বড়-ছোট’র মধ্যে পার্থক্য। পাপের বন্ধনের সাথে এসব চিন্তাধারাও মানুষকে দিন দিন বিচ্ছিন্ন আর বিক্ষিপ্ত করে দিচ্ছে। এসময় তুমি কি ‘ফ্রি ওয়ার্লড’ ‘ফ্রি ওয়ার্লড’ বলে চিৎকার দিচ্ছ?
কিন্তু মজিদ খানকে একটা তীব্র হতাশা ঘিরে ফেলে। সে কিছু বলে না, শুধু গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করে– আর কদ্দুর নিয়ে যাবে আমায়?
ট্যাক্সি ড্রাইভার অত্যন্ত অভিজ্ঞ দোকানির মতো বলে– তুমি বোধহয় খুব অস্বস্তি বোধ করছ। যাও, সে জায়গাটাও এসে পড়েছে। তোমায় এমন জায়গায় নিয়ে এসেছি যে, বুঝে উঠতে পারবে না তুমি ভারতে না আর কোথাও আছ। হি হি হি। আমি প্রথমেই বুঝেছিলাম তুমি ভারতে যেতে চাও– হি হি হি।
সে মজিদ খানকে ভারতীয় মনে করেছে। মজিদ খানও তাকে বোঝাতে চায় না যে, সে ভারতীয় নয়। একটা ছোট্ট গলির ভেতরে গিয়ে ট্যাক্সি থেমে যায়। সম্মুখে সমুদ্রের জলকল্লোল স্থানটিতে মুখরিত করে তুলেছে।
একখানা তিনতলা দালান। দালানের দ্বিতলের একখানা ফ্ল্যাট হতে উজ্জ্বল আলো জানালা দিয়ে ঠিকরে বাইরের দিকে বেরিয়ে আসছে। বাকি অট্টালিকা গভীর রাতের অন্ধকারে প্রেতের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
ট্যাক্সি ড্রাইভার উদ্ধত ভঙ্গিতে বলল– আমার পিছু পিছু এস।
মজিদ খান তার পিছু পিছু সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উজ্জ্বল ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছয়। উজ্জ্বল আলোতে মনে হয় ভেতরে হয়তো-বা কোনো নারী জেগে আছে।
ড্রাইভার দরজায় মৃদু করাঘাত করে। অল্পক্ষণ পর দরজা খুলে যায়। একটি বর্মি বা মালয়ি বৃদ্ধা দরজা থেকে তাদের অভ্যর্থনা করে ভেতরে নিয়ে যায়।
ছোট্ট একখানা কক্ষ। এটাকে বরং ড্রয়িংরুমই বলা সমীচীন! ভেতরে ছোট এক সেট সোফা। কোণের দিকে একটা রেডিও সেটের উপর মহাত্মা গৌতম বুদ্ধের কালো কাষ্ঠনির্মিত প্রতিমূর্তি। দেওয়ালে খান কতেক অর্ধ-উলঙ্গ ছবি ছাড়াও গান্ধীজির একখানা বড় ছবি টাঙানো। ড্রাইভার মজিদ খানকে সোফার উপর বসিয়ে পাশের কক্ষে ঢোকে। খানিক পর মুখ টিপে হেসে বেরিয়ে আসতে আসতে বলে– অলরাইট, আমি এবার আসি। মজিদ খান পকেট থেকে বিশ ডলার বের করে তার হাতে দিয়ে জিগ্যেস করে– এনাফ?
ড্রাইভার দাঁত বের করে হেসে ওঠে আর বলে– ওহ্ টুমাচ, টুমাচ, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ অ্যান্ড গুডনাইট। সে তিন বার মস্তকভঙ্গি করে বেরিয়ে যায়।
বৃদ্ধাটিও ভেতর চলে যায়। মজিদ খান গভীর মনোনিবেশ সহকারে গৌতম বুদ্ধের প্রতিকৃতি দেখে। কপিলাবস্তু থেকে কলম্বো, রেঙ্গুন, ব্যাঙ্কক আর হংকং পর্যন্ত প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে প্রতিটি স্থানে গৌতম বুদ্ধের প্রতিকৃতি দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু বুদ্ধের জীবন-দর্শন আজ কোথাও নেই। শুধু পাথরের বা কাঠের মূর্তি।
খানিক পরে তার মনে হয় যেন কক্ষে প্যারিসের সন্ধ্যা ভেসে বেড়াচ্ছে হালকা বাতাসে ভর দিয়ে। সে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে। সোফার পাশে একটি যুবতী রমণী দাঁড়িয়ে। তার নিটোল, সুশ্রী আর সুঠাম দেহে যেন যৌবনের হিল্লোল প্রবাহিত হচ্ছে। পরনে সেলোয়ার আর কামিজ। কিন্তু তার গলায় বা মাথায় কোনো কাপড় নেই। অবশ্য ওটার তার দরকারই-বা কী! মেয়েদের মাথায় উত্তরীয় তখনি দরকার হয় যখন তার জীবনে একটিমাত্র পুরুষের আবির্ভাব ঘটে।
যুবতীটি বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকে। মনে হয় যেন সে এই প্রথম কোনো ভারতীয়কে দেখল বা অনেকদিন পর নিজের রঙের সাথে সুসামঞ্জস্য নিজের মাটির মানুষ দেখল। একটা তীব্র উত্তেজনার ছাপ তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে। কিন্তু সে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে রীতিমতো ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে বলল– ড্রাইভারকে আমি ত্রিশ ডলারের কথা বলেছি।
মজিদ খান একথার কোনো জবাব দেয় না। পকেট থেকে ত্রিশ ডলার বের করে তার দিকে এগিয়ে দেয়। স্ত্রীলোকটি মুচকি হেসে ত্রিশ ডলারের নোট তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে গ্রহণ করে বলে– কিছু পান করবে?
মজিদ খান উত্তর দিল– না, পানের অভ্যেস নেই।
মেয়েলোকটি প্রশ্ন করে– হিন্দু না মুসলমান?
একথা মজিদ খানের অন্তরে তীব্র এক ধাক্কা মারে– গণিকালয়েও সাম্প্রদায়িক বিষ ঢুকে গেছে! সে বলল– হিন্দুও না মুসলমানও না। মানুষ যখন পাপের পথে পা বাড়ায় তখন ধর্ম তাকে চরম ঘৃণাভরে পদদলিত করে পালিয়ে যায়।
একথায় রমণীটির মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সে লজ্জিত হয়ে পড়ে আর বিস্মিতভাবে মজিদ খানকে নিরিখ করতে থাকে। মেয়েলোকটি সম্পর্কে একটু বিভ্রান্তি বোধ করে মজিদ খান। সে জিজ্ঞেস করে– তুমি কে?
মজিদ খানের অনুমানই সত্য। রমণীটি তাকে ভারতীয় হিন্দু মনে করছে। সে বলল– মুসলমান, আমার নাম কুলসুম।
কুলসুমের নাম শুনে মজিদ খানের চমকে ওঠার কথা কিন্তু সে অত্যন্ত অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বুদ্ধের প্রতিকৃতি আর গান্ধীর ছবির দিকে চেয়ে বলল– খুব দূরদর্শী দোকানি তো তুমি। তুমি এটাও জান যে, শত্রুর মেয়ে দেখলে পাপীর রসনা ক্ষুধার্ত শকুনির মতো লক্ লক্ করে ওঠে। কিন্তু আমিও যাগু গ্রাহক। কোনো দোকানদার আজো আমায় ঠকাতে পারেনি, অতএব তুমিও নিজেকে মুসলমান-কুলসুম যাই বল-না কেন আমায় ধোঁকা দিতে পারবে না।
মেয়েলোকটি একথায় থতমত খেয়ে যায়। মিথ্যাবাদীর মিথ্যা কথা ধরে ফেলার ফলে মানুষের যে-করুণ অবস্থা দাঁড়ায় তারও তাই হয়। সে অত্যন্ত অপ্রসন্ন স্বরে অস্ফুটে উচ্চারণ করল– ভারি অদ্ভুত মানুষ তো! পরিশেষে নিজের অবগতির জন্য সে মজিদ খানের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে– তুমি কে?
মজিদ খান বলল– আমি মিথ্যা বলি না– আমি মুসলমান।
একথাটা যেন স্ত্রীলোকটির সমগ্র সত্তায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সে তড়াক করে উঠে পড়ে আর বলে– আমি মুসলমানকে ঘৃণা করি। তুমি এখনি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও। আহত নাগিনীর ন্যায় একটি অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে ওঠে সে।
মজিদ খান প্রত্যুত্তরে শান্ত স্বরে বলল– তুমি বললে অবশ্যই চলে যাব। তুমি জান আমি মিথ্যা কথা বলি না। অতএব তুমি আমার ওপর আস্থা রাখতে পার যে, আমি তোমার ‘দেহের’ জন্য এখানে আসিনি, শুধু বিছানার জন্য এসেছি। আচ্ছা তাহলে উঠি 1
মজিদ খান সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে। স্ত্রীলোকটি মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকে– দেহের জন্য নয়, বিছানার জন্য এসেছি!
মজিদ খান তার পাশে গিয়ে বলে– তোমার কাছে হয়তো-বা একথা নতুন ঠেকতে পারে কিন্তু পুরুষ আর নারীর মাঝখানে যদি গৌতম বুদ্ধের প্রতিকৃতি থাকতে পারে তো বিছানা আর দেহের মধ্যে কিছু ফারাক থাকে বইকি!
মেয়েটি একথা বুঝতে পারে না। মজিদ খান দরজার দিকে পা বাড়ায়। মেয়েটি বিস্মিত দৃষ্টিতে দরজার দিকে চেয়ে থাকে। কে জানে কেন! হয়তো-বা আজ সে প্রথমবারের মতোই বুঝতে পারছে তার দেহ আর যাই হোক-না কেন কোনো বিছানা নয়। তার মন ভেতরে ভেতরে একটা অব্যক্ত বেদনায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেতে চাইছে। তার চক্ষু দুটি হঠাৎ কেন জানি সজল হয়ে ওঠে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে সে মজিদ খানের অপসৃয়মাণ মূর্তির দিকে চেয়ে থাকে।
মজিদ খান প্রায় দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ রমণীটি করুণ স্বরে ডাকল– শোন।
মজিদ খান থমকে দাঁড়ায়। শুধু মুখ ফিরিয়ে তার দিকে চেয়ে থাকে, কিছু বলে না।
মেয়েলোকটি ধীরে ধীরে তার কাছে এসে দাঁড়ায়। ছলছল নেত্রে তার দিকে চেয়ে আর্দ্রকণ্ঠে বললে– এখন তুমি কোথায় যাবে?
মজিদ খান বলল– জানি না কোথায় যাব। সম্পূর্ণ অপরিচিত বিদেশি আমি। তিন-চার দিন হংকংয়ে থেকে করাচি চলে যাব ভেবেছি।
মেয়েলোকটি হঠাৎ চিৎকার করে বলল– কী বললে! করাচি? সে নিজের অজ্ঞাতে শক্ত করে মজিদ খানের কাঁধে হাত রেখে একটা তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে খুশিতে চিৎকার দিয়ে ওঠে– করাচি, করাচি– করাচি।
সে অত্যন্ত জোরে শব্দ করে বলে ওঠে– তুমি করাচি থেকে এসেছ একথা প্রথমে বললে না কেন? আমি সত্যি লজ্জিত, তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। এস ভেতরে এস, এস এস। স্ত্রীলোকটি আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাকে হাত ধরে টেনে-হিঁচড়ে ভেতরে এনে সোফার গায়ে নিক্ষেপ করে। এবার সে একেবারে শান্ত দুটি চোখ জানালার বাইরে দূর নীলিমায় তুলে ধরে। তার দৃষ্টি দূরে বহুদূরে হয়তো-বা করাচি পর্যন্ত অবলোকন করছে। সে নিজ মনে বলে চলে– গঙ্গারাম বিল্ডিং– বন্দর রোড– স্বামী নারায়ণের মন্দির– ডেঙ্গু হল– লক্ষ্মী বিল্ডিং– গোবর্ধন দাস মার্কেট।
মজিদ খান মুখে দুষ্টুমিভরা হাসি টেনে তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে বলল– লক্ষ্মী বিল্ডিং আর গোবর্ধন মার্কেটের মধ্যবর্তী নিউ মেমন মসজিদের কথা বাদ দিলে কেন?
মজিদ খানের একথায় রমণীটি চমকে ওঠে। সে করাচি থেকে আবার হংকং ফিরে আসে। ফিক্ করে হেসে বলে সে– আচ্ছা ওখানে আসানমল ওঝা রোড, গঙ্গারাম বিল্ডিং আজো আছে?
মজিদ খান বলল– সব আজো আছে, শুধু তুমি নেই।
এবার স্ত্রীলোকটি একটু লজ্জিত হয়। হঠাৎ তড়াক করে উঠে সে তীব্রবেগে কক্ষান্তরে প্রবেশ করে। খানিক পরে সে ফিরে আসে। তার মাথায় তখন একখণ্ড উত্তরীয় শোভা পাচ্ছে আর হাতে একমুঠো চামেলি ফুল।
মজিদ খানের সামনে এসে তার পায়ের কাছে বসে পড়ে সে, আর সবকয়টি ফুল তার পায়ে ছড়িয়ে দেয়।
মজিদ খান তাড়াতাড়ি নিজের পা গুটিয়ে নিতে নিতে বলে– তুমি ভুলে যাচ্ছ যে আমি মুসলমান।
কিন্তু রমণীটি শক্ত করে মজিদ খানের পা জড়িয়ে ধরে বলে– তুমি মুসলমান নও, তুমি করাচি। করাচি– যেখানে গঙ্গারাম বিল্ডিং অবস্থিত; গঙ্গারাম বিল্ডিং যেখানে ত্রিশ বছর আগে কমলাজ্ঞান চন্দনি জন্মগ্রহণ করেছিল, যে কমলাজ্ঞান চন্দনি হংকং এসে আত্মহত্যা করেছে। একথা বলে সে তার মাথা মজিদ খানের হাঁটুর উপরে ঝুলিয়ে রাখে।
মজিদ খান অত্যন্ত আদরের সাথে দু’হাত দিয়ে কমলাজ্ঞান চন্দনির মুখ উপরের দিকে তুলে ধরে। তার দু’চোখ বন্ধ। কিন্তু মজিদ খানের মনে হয়– করাচির বিস্তৃত বক্ষে এসে কমলাজ্ঞান চন্দনি পুনর্জন্ম লাভ করেছে।
অনুবাদ : আখতার-উন-নবী
পলাতকা – গোলাম আব্বাস
প্রথম প্রথম তার বিশ্বাসই হল না, সে অনুভবই করতে পারল না যে তার স্ত্রী পালিয়ে গেছে। কিন্তু যখনি সে অনুভব করল তার স্ত্রী সত্যি পালিয়ে গেছে, তখন সে একরাশ চিন্তার সাগরে ডুবে গেল। তার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। কী আশ্চর্য, বিয়ের প্রথম বছরেই এ ব্যাপার! মন যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু বারবার যখন দেখল স্ত্রীর সব জিনিসপত্র উধাও, এমনকি তার ছোটকালের ছবিটা যেটায় একটা সাদা কবুতরকে নিজের ছোট ছোট হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাসছিল। সে ছবিটাও নেই। নিয়ে গেছে, অতএব তার আর সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকল না। সত্যি তার স্ত্রী পালিয়ে গেছে।
কয়েকদিন নীরব নিস্তব্ধতার মাঝে কাটিয়ে দিল সে। না কোথাও গেল, না চাকরটাকেও জানার সুযোগ দিল। পরে আস্তে আস্তে যখন সব বদনামির ভয় তার মন থেকে মুছে যেতে লাগল এবং তার ফিরে আসার ক্ষীণতম আশাও মন থেকে উঠে গেল, তখন সে স্থির মস্তিষ্কে ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করার দিকে মনোনিবেশ করল। একটা ভাবনা বারবার তার মনে এসে তাকে বড় বিব্রত করে তুলল।
এবং সে অস্থির হয়ে উঠল যখন ভাবল– ‘আমি মেয়েটাকে খাঁটি প্রাণেই চেয়েছি। সবদিকেই তাকে খুশি করার চেষ্টা করেছি। তার এমন কী আকাঙ্ক্ষা ছিল যা আমি পূরণ করিনি? আর এই কি তার প্রতিদান– যে কাউকে কিছু না বলে, ছোট এক টুকরো কাগজও লিখে না-রেখে চোরের মতো চুপে চুপে পালিয়ে গেল।
ভাবনাটা তাকে পাগল করে তুলল। আর সাথে সাথেই সে ভবিষ্যতের নিঃসঙ্গতার কথা চিন্তা করতে থাকল। এবং তার মন বারবার কেঁপে উঠল।
যৌবনের প্রথম থেকেই সে নিঃসঙ্গতার সাথে পরিচিত। গরিব মা-বাবার সন্তান সে। তারা নিজেদের প্রয়োজনমতো সামান্য লেখাপড়া শিখিয়ে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিল। দারিদ্র্য, অসহায়তার দরুন কারো সাথে মেলামেশা করার সুযোগ হয়নি তার। নিঃসঙ্গই থেকেছে সে যৌবনের প্রারম্ভ থেকে, নিঃসঙ্গতাকেই সে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে মেনে নিয়েছিল। যৌবনের অনেক অংশ জীবিকার সাথে যুদ্ধ করতে করতেই শেষ হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত যখন তার অবস্থার পরিবর্তন হল এবং জনসমক্ষে তাকেও একটা মূল্যবান হিসেবে প্রতীয়মান হতে লাগল– তখন সে নিজের নিঃসঙ্গ জীবনের সাথে এমনভাবে অভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল যে, তার আর যে-কোনো বিপুল মূল্যের বিনিময়েও ছাড়ার জন্য প্রস্তুত নয় সে। তা অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে তার আত্মীয়স্বজনদের উদ্ভব হতে লাগল এবং তার নিঃসঙ্গতার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে লাগল।
‘ভাই, তুমি কি আজীবন কুমার থেকে যাবে!’ তারা প্রায় সময় এসে তাকে বলত– ‘তুমি মানো বা না-মানো আমরা কিন্তু চাঁদের মতো বউ একটা ঘরে তুলবই।’
এক শ্রদ্ধেয়– যে আত্মীয়তার অনেক দূর দিয়ে তার মামা হয়– বলত– দূরে যাব কেন, খান্দানের মধ্যেও মাশাল্লা কত সুন্দরী মেয়ে আছে।’
প্রত্যেকবারই তার অস্বীকৃতি হালকা হতে থাকল। এবং শেষ পর্যন্ত একদিন তার আত্মীয়ের মধ্যেই সামান্য লেখাপড়া জানা একটি মেয়ের সাথে তাকে বিয়ে দেয়া হল।
পাঠ্যাবস্থায় তার ভ্রমণের শখ ছিল। প্রায়শ সঙ্গীদের সাথে তিন-চার দলে ভাগ হয়ে তারা চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ত বিভিন্ন গ্রাম-শহরের দিকে। সে কিন্তু সঙ্গীদের কাছ থেকে সবসময় দূরে দূরে থাকত এবং মনেপ্রাণে তাদের ঘৃণা করত। বন্ধু-বান্ধবীরা তার সাথে মেলামেশা করত না। কিন্তু এখন সে বিভিন্ন যুবতীর সংস্রবে এসে ভাবল– এরও একটা আনন্দ আছে এবং এই প্রথমবারের মতো সে অনুভব করল কত নিষ্ফল, কত অর্থহীন জীবনই-না যাপন করে আসছে সে এতদিন ধরে।
বিয়ের পর স্বামী হিসেবে তার করণীয় কর্তব্যের ব্যাপারে সে পূর্ণ সজাগ ছিল। স্ত্রীর ভালোবাসা তাকে এমনভাবে প্রভাবান্বিত করে ফেলেছিল যে, সে অন্যান্য ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন হয়ে গেছিল। সে স্ত্রী ছাড়া কোনো পার্টি-নিমন্ত্রণে যেত না। একাকী কারো সাথে সাক্ষাত্ত করত না। স্ত্রীসঙ্গ ছাড়া থাকা তার পক্ষে এত কঠিন ছিল যে, অফিসের সময় কাটানোও তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ত। বারবার ঘড়ির দিকে তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ত– কখন সময় শেষ হবে, কখন ঘরের দিকে পা বাড়াবে।
অফিস থেকে ফেরার পথে কখনো যদি হঠাৎ কোনো পুরনো কালের হাস্যরসিক বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যায় এবং সে-বন্ধু যদি ক্ষণিক আনন্দ করার জন্য কোথাও যেতে আমন্ত্রণ জানায় তাহলে সে বড় নিষ্প্রাণ কণ্ঠে জবাব দিত, ‘না সাহেব, আমাকে ক্ষমা করতে হয়। এ সময়টার মালিক আমার স্ত্রী– যে সারাদিন আমার আশায় একাকী ঘরে বসে আছে।’
আবার কখনো বলত– ‘আমি এরকম কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারি না, যেখানে আমার স্ত্রী যেতে অসমর্থ।’
‘এবং এসব সেই অকৃতজ্ঞ মেয়েটার জন্য’ সে উভয় হাতের মধ্যখানে মাথা রাখতে রাখতে বিড়বিড় করে বলল– ‘যার প্রেম নিছক একটা ধোঁকা।’
হঠাৎ তার স্ত্রীর ওপর রাগে, ঘৃণায় মন ভরে উঠল। তার নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত বইতে শুরু করল। সে কল্পনায় দেখল, নিজের শক্ত হাত দিয়ে স্ত্রীর গলা টিপে ধরেছে, তার ভীতিগ্রস্ত চক্ষুযুগল করুণা আর ক্ষমা প্রত্যাশী। কিন্তু এ অকৃতজ্ঞ মেয়েটার জন্য তার প্রাণে কোনো দয়ামায়া নেই, কোনো ক্ষমা নেই, সে তার গলা টিপেই ধরে আছে। জোরে, আরো জোরে– এমনকি তার গৌরবর্ণের চেহারা কালচে হয়ে গেছে এবং তার বড় বড় সুন্দর চক্ষুযুগল দুটি রক্তের মাংসপিণ্ড হয়ে বেরিয়ে এসেছে… আর সে তার মৃতদেহকে মাটিতে ফেলে দিল।
কিন্তু যতই দিন অতিবাহিত হতে লাগল– প্রতিশোধের দৃঢ় সংকল্প, উন্মাদের প্রলাপ ধিমা হয়ে যেতে যেতে একটা উপহাসে পরিণত হয়ে যেতে থাকল। এমনকি তার কাছে নিজের প্রেম, তার চেয়ে উত্তম স্ত্রীর অকৃতজ্ঞতা এবং তার ওপর নিজের রাগ-ক্রোধকেও কেমন যেন হাস্যাস্পদ মনে হতে লাগল এবং একদিন তার কাছে নিজের এ অবস্থার জন্য হাসি পেল।
সে মনে মনে বলল– ‘আমি কী ধরনের বোকা যে, একটা মেয়েকে এরকম গুরুত্ব দিচ্ছি। মেয়েদের ব্যাপারে গুরুত্বসহকারে চিন্তা করাটাই বোকামি। তাদের দৃষ্টান্ত অনেকটা ছোট ছেলেদের মতো। খেলনা দিয়ে যতক্ষণ ভুলানো যায় ভোলাও! কিন্তু যখন আর খেলনায় কাজ দেবে না– কান্না জুড়ে দেবে, দুষ্টুমি শুরু করে দেবে– তখন সব চাইতে উত্তম পন্থা হবে কারো হাতে সোপর্দ করে দেয়া। প্রেম আর-কৃতজ্ঞতা, এসব ব্যাপার তো এদের জন্যে প্রতারণা মাত্র।’
একদিন সে অফিস থেকে বাসায় প্রত্যাবর্তন করছিল। পথে তার শৈশবকালের সেই হাস্যরসিক বন্ধু– যে একদা সুখ আর আনন্দ দানে উৎসাহ প্রদান করত– তাকে আসতে দেখা গেল। সে অন্য পথে মোড় নেয়ার কথা ভাবল একমুহূর্ত। কিন্তু বন্ধু তাকে দেখে ফেলেছিল। নিরুপায় হয়ে তাকেও থামতে হল। তার স্ত্রীর অন্তর্ধানের খবর বন্ধু জানত না। বন্ধু পুরনো অভ্যেস মাফিক ঈষৎ হেসে বলতে লাগল, ‘আজ ভাবী যা ইচ্ছে বলুক, তোমাকে কিন্তু সাথে না-নিয়ে আজ কিছুতেই ছাড়ব না।’
বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে তার চেহারা দেখতে থাকল সে। পরে একটা পবিত্র হাসি এসে তার ক্রোধকে দূর করে দিল। এবং সে বলে উঠল– ‘বেশ চল; কিন্তু কোথায় যাবে?’
বন্ধু আশ্চর্য হয়ে গেল।
তখনো রাতের অন্ধকার ভালো করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েনি। তারা সময় কাটাবার জন্য এদিক-সেদিক ঘুরতে লাগল। যখন রাত আর তার অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠল বন্ধু তাকে নিয়ে এক রূপোপজীবিনীর প্রকোষ্ঠে গিয়ে হাজির হল। জীবনের এটাই তার প্রথম অভিজ্ঞতা। সুতরাং ভয়, লজ্জা, সঙ্কোচ আর অনুতাপের মর্মপীড়ায় সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। কারণ যে জীবন থেকে সে আজ পর্যন্ত পূত পবিত্র ছিল– এখন সে পূত পবিত্রতার ওপর কালো দাগ পড়ে যাবে। আর এ কালো দাগ নিছক সেই অকৃতজ্ঞ মেয়েটার বদৌলতেই। কিন্তু এ মর্মপীড়া আর দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হল না। মদ্যপান করার সাথে সাথেই লজ্জার যে একটা ক্ষীণ অংশ বাকি ছিল তা-ও এক নিমিষে উড়ে গেল। এবং সেই রূপোপজীবিনীর হাস্যোজ্জ্বল চেহারা আর নৃত্যে বিভোর হয়ে থাকল সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
এরপরই তার জীবনযাপন প্রণালির আর-একটা নতুন দিক শুরু হল। প্রথম প্রথম সে তার সেই আকাঙ্ক্ষিত স্থানে যাবার জন্য বন্ধুর সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত। কিন্তু পরে মনে হতে লাগল যেন বন্ধু তার জন্য একটা বাধা স্বরূপ। এবং সে একা একাই যাওয়া-আসা শুরু করল।
প্রথমে সারা মেন্ডি শহর ঘুরে-ফিরে বাজার যাচাই করত, মালামাল পরীক্ষা করত– পরে নিজের পছন্দ করা জিনিস শৌখিন মেজাজের কোনো ধনীপুত্রের মতো খরিদ করে নিত।
আনন্দোল্লাস তাকে এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে, অফিস থেকে বেরিয়ে সে খুব কম দিনই ঘরে ফিরে যেত। আজ এ-কোঠা তো কাল ও-অট্টালিকা, এবং সমস্ত অট্টালিকাময় হন্যে হয়ে ঘুরত। মিথ্যা প্রেম দেখানো এবং নিজেও সে প্রেম থেকে স্বাদ গ্রহণ করা– এই ছিল তার কাজ।
এসব কথা আগে তার কাছে স্বপ্ন বলে মনে হত। নতুন রাত আসত এবং নতুন করে রূপ আর প্রেমের পৃথিবী গড়ে তোলার ধ্যানে নিমগ্ন থাকত। সে মনে মনে এই নীতি পোষণ করত যে, মেয়েদের সাথে নিছক সময় আর লেনদেনের সম্পর্ক থাকা চাই এবং অন্যান্য জিনিসের মতো এদের ব্যাপারেও সবরকমের ছলনা বৈধ।
সে অফিস থেকে যা বেতন পায় তাতে একটি ছোট পরিবার স্বচ্ছন্দে সম্মানের সাথে কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তাতে আজেবাজে খরচ করার কোনো অবকাশ থাকে না। বিয়ের আগে তার খরচ হত নেহাত নামমাত্র,… তাই এ থেকে সে বেশ একটা মোটা অঙ্ক জমিয়ে রেখেছিল। বিয়ের পর স্ত্রীর জন্য কিছু মূল্যবান উপহারাদি খরিদ করার পরও জমা টাকা তেমন কমেনি। কিন্তু এখন দিন দিন যেভাবে মোটা মোটা অঙ্ক খরচ হতে লাগল তাতে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এ দেউলিয়াত্বে জন্য সে চিন্তান্বিত হল। পাছে আবার একেবারে দেউলিয়া হয়ে যায়। তাহলে তো সেই রূপো-জীবিনীর কাছেও যেতে পারব না।
পরপর রাত জাগার দরুন স্বাস্থ্য তার ভেঙে গেছে, ফলে তার যাতায়াতও অনেক কমে গেছে। আগে যেখানে মাসের মধ্যে বড়জোর দু’চার দিন অনুপস্থিত হত সেখানে এখন সপ্তাহের মধ্যে তিন-চার দিন অনুপস্থিত থাকতে লাগল।
একদিন সকালে সে অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হঠাৎ কে যেন তার কামরার
দরজায় করাঘাত করল আস্তে করে।
‘কে?’
কোনো উত্তর না-পেয়ে সে উঠে দাঁড়াল। দরজা খুলে সে চমকে উঠে স্তব্ধ হয়ে গেল– তার পলায়িতা স্ত্রী পাগলের বেশে মাথা ঝুঁকিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে। তার কাপড়ে-চোপড়ে একরাশ ময়লা, উস্কো-খুস্কো চুল। চেহারা রোদে পোড়া তামাটে এবং কোটরাগত চোখ। তাকে এ অবস্থায় দেখেই হঠাৎ তার মনে হল যেন একটা কুকুরি একরাশ নরম কাদার ভেতর আরেকটা কুকুরের সাথে আলিঙ্গন করে এইমাত্র উঠে এসেছে।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে সে নিশ্চুপ থাকল। পরে হঠাৎ তার পায়ের নিচে উপুড় হয়ে পড়ল এবং পা-জোড়া গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকল।
তার পা-জোড়া ছাড়িয়ে নেয়ার একটুও চেষ্টা করল না সে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। ‘ক্ষমা কর, আমাকে ক্ষমা কর।’ তার স্ত্রী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলতে লাগল– ‘আমি জানি তুমি এখন আমাকে ঘৃণা করবে। আমার চেহারা দেখার মতো উদারতাও তুমি দেখাবে না। কিন্তু তোমার কাছ থেকে আমি ভালোবাসা চাইছি না। সে আশা আমি করতে পারি না। আর আমি ভালোবাসার উপযুক্তও নই। শুধু তোমার দয়া চাই। আমার প্রতি শুধু একটু অনুগ্রহ কর। তোমার ঘরে একটু আশ্রয় দাও। এর বেশি আমি আর কিছু চাই না। আহ্, আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা কর। তোমার সাথে সাংঘাতিক প্রতারণা করে গেছি…।’
স্ত্রীর বিরুদ্ধে ক্রোধ আর ঘৃণার যে অগ্নি প্রথম প্রথম তার হৃদয়ে ধিকি ধিকি করে জ্বলেছিল তার কিছুটা দীর্ঘ সময় এবং কিছুটা নিজের কৃতকর্মে ঠাণ্ডা করে দিয়েছিল। এবং কিঞ্চিৎ পরিমাণ রাগ যা-ও অবশিষ্ট ছিল– এখন তার এই বিপদগ্রস্ত অবস্থা দেখে তা-ও চলে গেছে। অবশ্য তার এ অবস্থা দেখে তার মনে দয়ার উদ্রেক করছে না, বরং তার কাছে বিরক্ত লাগছে।
সে পালিয়ে যাবার পর থেকেই তার দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল সেই ভাগ্যবানটি কে, যার ভালোবাসার পুরস্কার তাকে দিয়েছে। হতে পারে সে তার বন্ধুদের একজন। অথবা কোনো আগন্তুক। কিন্তু এখন তাকে এ অবস্থায় দেখে আর সেরকম অনুসন্ধানের কোনো ইচ্ছা তার মনে উদয় হল না। সে সমস্ত ব্যাপারটাকে বিরক্তিকর বলে মনে করছে। তার ইচ্ছা অতিদ্রুত এ মেয়েটি তার সঙ্গ ত্যাগ করুক।
সে বলে যেতে লাগল– ‘তোমার ভদ্রতা এবং নিষ্পাপ হৃদয়তার ওপর আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে, তুমি নিশ্চয় আমাকে তোমার ঘর থেকে তাড়িয়ে দেবে না। এ ঘর ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর অন্য কোনো আশ্রয় নেই। এ ঘর থেকে চলে গিয়ে আমি বড় কষ্ট করেছিলাম। তুমি আমার ওপর চাকরানির মতো ব্যবহারে কর! আহ্! আমি তারই উপযুক্ত।’
‘এত জোরে চেঁচিও না, চাকর শুনে ফেলবে।
অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছিল। সে জোর করে নিজের পা-জোড়া ছাড়িয়ে নিল। অতি মোলায়েমভাবে যাতে মেয়েটির কোনো চোট না-লাগে। টুপিটা হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
অফিসে তার স্ত্রীর সেই কান্নার অবস্থাটা বারবার তার মনের আনাচে-কানাচে ফিরতে লাগল। তার কাছে বড় আশ্চর্য লাগছে। একি শৈশবকালের সেই চঞ্চল সুন্দরী মেয়েটি– যার সাথে ছ’মাস আগে তার প্রেম ছিল? একি সেই তন্বী প্ৰিয়তমা যে সুরভীর প্রেমে সে পাগল ছিল! সে নিজের দেহে সামান্য ধুলোও সহ্য করতে পারত না! এবং যার সাথে বাগানের ছোট পথ দিয়ে ভ্রমণ করার সময় গৌরবে নিজের বুক ফুলে যেত!
‘অগত্যা সে যদি আমার সাথে থাকতেই চায়।’ সে মনে মনে বলল– ‘তাহলে এমনিই থাকুক। আমি এত নীচ নই যে তাকে সামান্য রুটি আর কাপড় থেকে বঞ্চিত করব। তবে একথা সত্য যে, তার সাথে আমি কোনো সম্পর্ক রাখব না। আমি জানি, অবশ্য আমার একান্ত ইচ্ছাও সে আমার অমনোযোগিতা, অবহেলায় দুঃখ পেয়ে বিষণ্ন বদনে অথবা আমার ভর্ৎসনা সহ্য করতে না-পেরে একসময় তাড়াতাড়ি আবার পালিয়ে যাবে।’
তার স্ত্রী ফিরে আসার পর প্রায় দু’সপ্তাহ অতিবাহিত হয়ে গেছে। অথচ সে একটি বারের জন্যও তার দিকে ফিরে তাকায়নি। যেন ঘরে সে নেই-ই। এদিকে কিন্তু তার স্ত্রী তার সামান্য সান্নিধ্যের জন্য উন্মুখ। কিন্তু তার উপস্থিতি মনের কল্পনায় জিইয়ে রেখেই সে দিন কাটিয়ে দিতে লাগল।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে শিয়রে তেপায়ার উপর রাখা ফুলদানির ওপর। ফুলদানিতে সুন্দর সুন্দর সতেজ ফুল যত্নের সাথে সাজানো থাকে। সে তখন মাত্র বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় কাগজ নিয়ে বসে, ঠিক তখনি চাকর চা নিয়ে আসে। সুন্দর করে কাটা আগুনে-সেঁকা টোস্ট। আর চা– যা প্রথম প্রথম বিয়ের সময় তার ভাগ্যে জুটত। সে বাথরুম থেকে এসে ড্রয়িংরুমে যেতে যেতে দেখে সব জিনিস থরে থরে সাজানো। শার্ট বা স্যুটের সাথে ম্যাচ করা নেকটাই এবং রুমাল। পালিশ করা জুতো।– দুপুরে চাপরাসি বাসা থেকে খাবার নিয়ে যায়। তখন তার প্রিয় শবজি এমন সুস্বাদুভাবে পাকানো থাকত যে, জিহ্বা চুক্ চুক্ করে আওয়াজ দিয়ে ওঠে।
এসব কাণ্ডকারখানায় তার অধরপ্রান্তে এক টুকরো দুঃখের হাসি ফোটে এবং সে মনে মনে বলে– ‘এসব আদর-যত্ন করছে নেহাত আমাকে দ্বিতীয়বার বাধ্য করার জন্যে। কিন্তু এ বান্দা আর এসব চমকে ভুলবে না।’
সে প্রায় সন্ধ্যায় ঘর থেকে বেরিয়ে যায় এবং রাত একটা-দুটোর আগে খুব কম সময়ই ফিরে আসে। কোনো সময় সমস্ত রাতই বাইরে কাটিয়ে দেয়। কিন্তু তাতে বাধা দেয়ার বা অনুসন্ধান করার কেউ নেই। অতএব তার এ আরাম-আয়েশের কোনো ঘাটতি দেখা যায় না।
এভাবেই ধীরে ধীরে তিন মাস অতিবাহিত হয়ে গেল।
বর্ষাকাল। অতএব একদিন সমস্ত আকাশ মেঘে ছেয়ে ফেলেছে এবং কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। সে অফিসে একটা মোটা অঙ্কের চেক কেটে চাপরাসিকে দিয়ে বড় উদ্বিগ্নচিত্তে সময় কাটাতে লাগল। গত আট দিন একটা রাতও সে ঘর থেকে বের হয়নি। দীর্ঘক্লান্তির অবসাদ, কখনো-বা আলসে করে অনেকক্ষণ পর্যন্ত অফিসে বসে থেকেছে। কখনো-বা মন চায়নি তাই সব দিনের আরাম সুদে-আসলে আজকে উসুল করে নেবে।
কিছুক্ষণ পর চাপরাসি খালি হাতে ফিরে এল। তার চেক ফিরিয়ে দিয়েছে। কারণ তার হিসাবে আর মাত্র কয়েক টাকা আর আনা পাই ছাড়া কিছুই বাকি নেই।
তার এ পরিণতি সম্বন্ধে সে-ও সচেতন ছিল। কিন্তু পরিণতিটা যে এত সকালে এসে যাবে তা সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। কারো কাছ থেকে ধার নেয়ার কথা ভাবল সে এবং সঙ্কোচচিত্তে দু’একজনের কাছে ফোনে নিজের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল। কিন্তু মাসের শেষ অতএব এখন এত টাকা কোথায়!
হঠাৎ মনে পড়ল তার বাক্সে একটা সোনার আংটি পড়ে আছে— যার উপর দামি একটা পাথর বসানো। এটা তার স্ত্রী উপহার দিয়েছিল তাকে। যখন স্ত্রীর সাথে আত্মীয় সম্পর্কই ছিন্ন হয়ে গেছে তখন এই স্মৃতিটাই-বা আর রাখে কেন?
যে-বাসনার আগুন একটু আগে ধিমা হয়ে গিয়েছিল এ মুহূর্তে আবার জ্বলে উঠল। সে ভাবল ‘আংটি নিয়ে আমাকে সন্ধ্যার আগেই জুয়েলারির কাছে গিয়ে পৌঁছনো চাই।’ তৃতীয় প্রহরে সে বাক্স থেকে আংটি বের করে বাইরে পা দিল। আঙিনা অতিক্রম করতেই সে দেখল বেগুনি রঙের শাড়িতে আপাদমস্তক ঢেকে বাতাসে এক অপূর্ব মাদকতা ছড়িয়ে একটি নারীমূর্তি হঠাৎ তার সামনে দিয়ে চলে গেল। নারীটি তাকে দেখেনি। কিন্তু সে তাকে একনজর দেখে নিয়েছে। এ দেখাটা নেহাত সামান্য হলেও তাকে আশ্চর্য করে দেয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
নারীমূর্তিটি আর কেউ নয় তার সেই পলায়িতা স্ত্রী। যাকে তিন মাস আগে হঠাৎ দেখে ভেবেছিল গোর থেকে বেরিয়ে এসেছে। দু’বেলা ভালো খাবার খেয়ে, ভালো ভালো সাবান, ক্রিম এবং আরো নানান প্রসাধনী দ্রব্য ব্যবহার করার দরুন তার খোয়ানো রঙ রূপ আবার ফিরে এসেছে। নরম মাংসে গাল অনেক পুরে গছে এবং চোখজোড়া আবার নব জীবনের আলোয় চমকাচ্ছে। তার বর্তমান রূপযৌবন– যেন বিয়ের প্রথম রাতের রূপযৌবন; প্রভেদ শুধু প্রথম তার চেহারায় একরাশ পবিত্রতা উঁকি দিয়েছিল। কিন্তু এখন সেই পবিত্রতা, সেই নিষ্পাপতার জায়গায় একটা সূক্ষ্ম গাম্ভীর্যতা, একটা হৃদয়গ্রাহী অনুতপ্ততা বিরাজিত।
তখনো সন্ধ্যা উতরোয়নি। জুয়েলারির দোকানের কাছে এসে পৌঁছল সে। বিভিন্ন দোকানে তখন লেনদেন, বেচাকেনা চলেছে পুরাদস্তুর। গ্রাহক ছাড়া একটা দোকানও খালি নেই। এর আগে আর কোনো জিনিস বিক্রি করার সুযোগ তার হয়নি– তাই সে দোকানে ঢুকবে কি ঢুকবে না ইতস্তত করছিল, কিন্তু লোকের এ ভিড় দেখে সে আরো ঘাবড়ে গেল। এত লোকের সামনে আংটি বিক্রির কথা কী করে বলা যায়। মানুষ আবার না জানি কী মনে করে বসে।
সে প্রায় ঘণ্টাখানেকের মতো ঘুরতে থাকল বিভিন্ন দোকানের আশপাশে। গ্রাহক দু’চার জন বেরিয়ে গেলে পরমুহূর্তে আবার দু’চার জন এসে ঢোকে। এ ভিড় আগের মতোই। শেষ পর্যন্ত একটা দোকানে সে দেখল গ্রাহক অপেক্ষাকৃত কম। এবং অনেক সাহসের ভর করে সে ওখানে ঢুকে পড়ল।
‘বলুন,– আপনার কী প্রয়োজন?’– জহুরি জিজ্ঞেস করল।
‘আমি–আমি কানের দুল দেখতে চাই’– সে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল। পরে জহুরি দুলের বাক্সের ভিড় জমিয়ে তুলল।
‘এ জোড়ার দাম কত?’ অগত্যা একজোড়া দুল পছন্দ করে বলল সে।
‘পঁয়ষট্টি টাকা।’
‘বাস, এটাই ঠিক। কিন্তু মাফ করবেন– সাথে টাকা আনতে ভুলে গেছি আমি, আপনি এ জোড়া আলাদা করে রাখুন। কালকে এসেই নিয়ে যাব।’
‘ঠিক আছে, ও কিছু না– ও কিছু না।’– জহুরি বাক্সগুলো তুলতে তুলতে নিস্পৃহ গলায় বলল।
দোকান থেকে বেরিয়ে সে লম্বা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
রাত তখন অনেক হয়ে গেছে। সে ভাবল আজকের প্রোগ্রামটা বাতিল করে দিতে হয়। কাল কোনো কর্মচারী দিয়েই বরং আংটিটা পাঠাব। অথবা কালকে কোনো একটা উপলক্ষে টাকা কিছু পেয়েও যেতে পারি।
প্রতি পদক্ষেপে তার আকাঙ্ক্ষার পরাজয় ঘটতে লাগল। এবং চলতে চলতে সে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু মন তার দুঃখে ভারাক্রান্ত নয়। বরং তার মন-মেজাজ এক অদ্ভুত উৎফুল্লতায় সক্রিয়। সেই রূপোপজীবিনীর প্রকোষ্ঠ এখান থেকে সামান্য দূরে। হঠাৎ সেই বেশ্যার কথা তার মানসপটে ভেসে উঠল। তার কাছে না গেলেও অন্তত দূর থেকে হলেও তার রংঢং দেখার ইচ্ছে জাগল তার মনে।
অন্যান্য দিনের মতো আজকেও সেই পল্লিটা ঝকঝক করছে। আর পুরুষ পরওয়ানার মতো আলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কোনো কোনো প্রকোষ্ঠের খোলা বাতায়ন দিয়ে হালকা নীল আলো বাইরে অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়ছে। কোনো কোনো ঘর থেকে নরনারীর সম্মিলিত কলহাস্যের ফাঁকে ফাঁকে সারেঙ্গির তারের ঈষৎ ঝংকার বাতাসের সাথে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
সে ধীর পদবিক্ষেপে হাঁটছে। হাঁটছে প্রতিটি ঘরের সামনে দিয়ে। এবং প্রতিটি বেশ্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখানকার প্রায় বেশ্যার সাথে সে পরিচিত। এবং অনেকের প্রকোষ্ঠেই তার পদধূলি পড়ে। কিন্তু আজ সে খুব জোরে জোরে হেঁটে চলে যাচ্ছে।
নিষিদ্ধ পল্লির শেষ প্রান্তে এসেই হঠাৎ তার স্ত্রীর কথা মনে পড়ল। এবং তার পরনের সেই বেগুনি রঙের নকশাযুক্ত শাড়িটিও। নেহাত অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেই বেশ্যাদের সাথে তার স্ত্রীর তুলনায় লেগে গেল তার মন।
এ পর্যন্ত সে যত মেয়ে দেখেছে প্রত্যেকের রংঢং নাটকের নায়িকাদের মতো মনে হয়েছে তার। ওদের যত বেশি দূর থেকেই দেখেছে তত বেশি প্রবঞ্চক বলে মনে হয়েছে। কিন্তু তাদের তুলনায় তার কাছে মনে হয়েছে তার স্ত্রী অনন্যা। তাদের মুখের কৃত্রিম তিলকের ছড়াছড়ি হয়তো তার স্ত্রীর মধ্যে নেই, কিন্তু তাই বলে তার মুখের লাবণ্য তাতে এতটুকুও ম্লান নয়। এবং সে শিক্ষাপ্রাপ্ত মেয়েদের বেহায়াপনা আচরণ তার স্ত্রীর মধ্যে নেই। আর তাদের সাজসজ্জার প্রতিও তার মনে ঘৃণার উদ্রেক করে। কেউ-বা চেহারায় একরাশ পাউডারের প্রলেপ লাগিয়ে রাখে, কেউ-বা তেরছি সিঁথি বের করে রাখে, চুলের মধ্যে ডজনে ডজনে ক্লিপ আর পিন গেঁথে রাখে। অবশ্য দু’একখানা সুন্দর চেহারা যে নেই তা নয়। কিন্তু তাদের পোশাক-পরিচ্ছদের না আছে কোনো রীতি-নীতি, না আছে রঙ-পছন্দে গভীর আন্তরিকতা। সব আজেবাজে রঙের সমাবেশ। কেউ কেউ তো গ্রাম্য মেয়েদের মতো একরাশ অলংকারে ভারি হয়ে থাকে।
হৃদয়ে ভাসমান স্ত্রীর ছবি নিয়েই সে বাড়ির দিকে এগুচ্ছিল। হঠাৎ বিয়ের প্রথম জীবনের কথা তার চোখের সামনে যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল। কী অদ্ভুত মাদকতায় ভরা সেই জীবন! যখন দাম্পত্য-জীবনের আনন্দ প্রথমবার তার সমস্ত হৃদয়মনে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং হৃদয় তার ঝড়ে-পাওয়া পাতার মতো কেঁপে উঠেছিল। সেই রাতের বিলম্বিত মুহূর্তে পরস্পরের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করেই কাটিয়ে দেয়ার মুহূর্ত। ভাবনার অতলে তলিয়ে যেতে যেতে সে পথ চলতে থাকল।
ঘর যতই সামনে আসছে তার চলার গতি ততই দ্রুত হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সে ঘরের সামনে এসে পৌঁছল। এবং তার মুখে একটা উপহাসের হাসি ছড়িয়ে পড়ল। সে মনে মনে বলল– ‘অবশ্য আমার স্ত্রীও পবিত্র নয়, কিন্তু সেই মেয়েগুলোই-বা কোথাকার সতী হয়ে গেল– যার পেছনে ঘুরে ঘুরে মরছি, এবং যাদের সান্নিধ্যের লোভে আজও মাথা কুটে মরছি।’
তার স্ত্রী ছাদের খোলা আকাশের নিচে খাটের উপর একরাশ সুগন্ধে সুরভিত হয়ে অনেকটা ঘুম ঘুম পরিবেশে বসে ছিল। আচানক খটাখট শব্দ শুনে চমকে উঠল। উৎকর্ণ হয়ে শব্দটা শুনতে লাগল। তার মনে হল কে যেন ধীর পদবিক্ষেপে সিঁড়ি দিয়ে উপরে তার কাছে আসছে।
অনুবাদ : আখতার-উন-নবী