দস্যুদল স্তম্ভিত বিস্ময়ে নির্বাক। তাদের মনে হল একটা সিংহ যেন অবরুদ্ধ রোষে গর্জন করে উঠল। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর রবিনহুড বলল, নাইট মহাশয়! আপনি দীর্ঘকাল এখানে ছিলেন না বলছেন। কোথায় ছিলেন তাহলে?
প্যালেস্টাইনে।
প্যালেস্টাইন! যুদ্ধক্ষেত্রে?
–হ্যাঁ। আমি ধর্মযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম। দীর্ঘকাল পরে দেশে ফিরছি।
–নাইট মহাশয়! কিছু না দেখেও বলতে পারি সেখানে বহু মুসলমান সৈন্যই আপনার অস্ত্রাঘাতে মৃত্যুবরণ করেছে.. কিন্তু মধ্যাহ্নভোজনের সময় হয়েছে, আমরাও ক্ষুধার্ত; যদি অনুগ্রহ করে আমাদের সঙ্গে একসঙ্গে ভোজনে বসেন তাহলে অত্যন্ত সুখী হব।
-সানন্দে। আমিও অতিশয় ক্ষুধার্ত।
.
০২. পরীক্ষা
ভোজসভায় যোগ দেওয়ার আগে ব্ল্যাক নাইট তাঁর শিরস্ত্রাণ ও লৌহমুখোশ খুলে ফেললেন।
দস্যুদের চোখের সামনে ভেসে উঠল একজোড়া উজ্জ্বল চক্ষু, তীক্ষ্ণ নাসিকা আর দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠাধর। মাথার উপর সিংহের কেশরের মতো নিবিড় কেশরাশির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মুখের নিম্নভাগে অবস্থান করছে ঘন গোঁফ-দাড়ি সব মিলিয়ে এক আশ্চর্য পৌরুষের দীপ্তি জ্বলছে সেই মুখের উপর…
ভোজনপর্ব শেষ হল। খাদ্যতালিকায় বৈচিত্র্য ছিল না– প্রচুর পরিমাণে হরিণের মাংস আর এল নামক সুর জাতীয় পানীয়। ব্ল্যাক নাইট যে খুবই ক্ষুধার্ত ছিলেন সন্দেহ নেই। যে পরিমাণ মদ্য ও মাংস তিনি উদরস্থ করলেন তা দেখে দস্যুর দল তো চমকে গেলই, এমনকী, ভোজনপটু ফ্রায়ার টাকও মনে মনে স্বীকার করল, লোকটা খেতে পারে বটে!
ভোজনপর্ব সমাধা হলে উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে অভিবাদন জানিয়ে ব্ল্যাক নাইট বললেন, মাস্টার রবিন। এমন একটি চমৎকার ভোজ খাওয়ানোর জন্য তোমাকে আর তোমার সহচরদের আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। রবিনহুড সবিনয়ে বলল, নাইট মহাশয়! আমাদের মতো গরিব মানুষ কি আপনাকে এমনভাবে ভোজ খাওয়াতে পারে? খাওয়ার খরচটা আপনাকেই দিতে হবে।
অত্যন্ত বিমর্ষভাবে ব্ল্যাক নাইট বললেন, কিন্তু আমি যে এখন একেবারেই কপর্দকশূন্য।
রবিনহুড বলল, তাতে কি হয়েছে? আর এক সময় যখন আপনার হাতে টাকা থাকবে, সেই সময় মনে করে এখানে এসে ভোজের খরচটা দিয়ে যাবেন।
কিছুক্ষণ স্থিরভাবে চিন্তা করলেন ব্ল্যাক নাইট, তারপর হঠাৎ তার ওষ্ঠাধরে ফুটল হাসির রেখা, আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না? আমাকে তোমাদের দলে ভর্তি করে নিলে তো আর খাওয়ার খরচটা দিতে হয় না। আর আমিও ঋণশোধের দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাই।
রবিনহুড বলল, আপনার মতো মানুষ যদি দলে আসে, তাহলে সে তো আমাদের সৌভাগ্য। কিন্তু আমরা তো সবাই অ্যাংলো-স্যাক্সন, আর আপনি নর্মান যোদ্ধা। আপনি কি আমাদের দলে আসবেন?
-কেন আসব না? তোমরা অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করছ। নর্ম্যান জাতির বিরুদ্ধে তোমরা তো অস্ত্রধারণ করোনি। নাইটের কর্তব্য হচ্ছে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। তাই তোমাদের দলে এলে আমি কতর্ব্য পালনের সুযোগ পাব ভালোভাবেই।
ঠিক কথা। আমাদের রাজা রিচার্ডও নর্মান বংশের মানুষ। তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগই নেই। আমরা লড়াই করছি কয়েকজন অত্যাচারী জমিদার, শেরিফ প্রভৃতি অত্যাচারী নৰ্মানদের বিরুদ্ধে। বর্তমানে রিচার্ডের পরিবর্তে যিনি ইংল্যান্ডের সিংহাসন অধিকার করেছেন, সেই জনকেও আমরা পছন্দ করি না।
–মাস্টার রবিন! তোমার মতে তাহলে রাজা রিচার্ডই এখন ইংল্যান্ডের সিংহাসনের যোগ্য অধিকারী!
-নিশ্চয়।
আমিও তোমাদের সঙ্গে একমত। তাহলে আমাকে এইবার তোমাদের দলে ভর্তি করে নাও।
আমাদের দলে ভর্তি হতে হলে আপনাকে পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে নিশ্চয়ই আপনাকে দলভুক্ত করা হবে।
-তোমার দলে আসতে হলে পরীক্ষা দিতে হয়?
-হয় বৈকি, নাইট মহাশয়। তা না হলে যত রাজ্যের চোর, ডাকাত আর ভিখারির দল এসে আমার দলে ভিড় করত। সেই জন্যই পরীক্ষার ব্যবস্থা। দক্ষ যোদ্ধা না হলে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কঠিন। অবশ্য আপনি যে সসম্মানে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, তবু নিয়ম পালন তো করতেই হবে- কি বলেন?
-অবশ্যই। তা পরীক্ষাটা কি ভাবে হবে?
-তিরধনুক নিয়ে লক্ষ্যভেদের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা আছে। সেটা পছন্দ না হলে লাঠি অথবা খেঁটে, অর্থাৎ ছোটো লাঠি দিয়েও দ্বন্দ্বযুদ্ধে শক্তির পরীক্ষা করা যায়।
–প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে কে?
আমিই অথবা আমার দলের যে-কোনো লোককে আপনি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে নির্বাচন করতে পারেন।
–তিরধনুক, লাঠি বা খেটে নিয়ে আমি লড়াই করতে ভালোবাসি না। তোমাদের দলে কি এমন কেউ নেই, যে ব্যক্তি রণকুঠার, ভল্ল বা কটাবসানো লোহার গদা নিয়ে লড়াই করতে পারে?
-নাইট মহাশয়! আপনি যে অস্ত্রগুলির কথা বললেন, ওইসব অস্ত্র নিয়ে আপনার সঙ্গে যে-যোদ্ধা লড়াই করতে নামবে, সে আর পরের দিনের সূর্যোদয় দেখতে পাবে না বলেই আমার বিশ্বাস। আমরা হত্যাকাণ্ড দেখতে চাই না। সেই জন্যই তিরধনুকে নিশানার পরীক্ষা, অথবা লাঠি আর খেঁটের লড়াই-এর ব্যবস্থা করেছি।
ব্ল্যাক নাইট কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, রবিনহুডের লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা সম্পর্কে যে-সব কথা আমার কানে এসেছে, তাতে তিরধনুক নিয়ে তার সঙ্গে লক্ষ্যভেদের প্রতিযোগিতায় নামতে আমার সাহস হয় না। লাঠি নিয়ে পেটাপেটি করা নৰ্মান যোদ্ধার পক্ষে সম্মানজনক নয়। তবে গেঁটে বা ছোটো লাঠি নিয়ে লড়াইটা হতে পারে। তলোয়ারের খেলা শেখার সময়ে নর্ম্যান যোদ্ধাদের ওই ছোটো লাঠির খেলা শিখতে হয়। বাল্যকালে ও কৈশোরে অসিযুদ্ধ শেখার সময়ে আমিও ছোটো লাঠির লড়াইটা শিখেছিলাম। অনভ্যাসে হাত একটু আড়ষ্ট হলেও একরকম কাজ চালিয়ে নিতে পারব বলে মনে হয়। মাস্টার রবিন! তোমার দলের মধ্যে যে-কোনো ব্যক্তি আমার সঙ্গে ছোটো লাঠি নিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামতে পারে আমি প্রস্তুত।