অগ্নি পরীক্ষা

১৯৪২ সাল, ৭ নভেম্বর।

পূর্বোক্ত তারিখে মধ্য আফ্রিকার নগানচু নামে এক ফরাসি উপনিবেশকে কেন্দ্র করে শুরু হচ্ছে আমাদের কাহিনি।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নরমেধ যজ্ঞ চলছে দেশে দেশে। ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার সর্বত্র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সেই আগুন সর্বগ্রাসী দাবানলের মতো। কাফ্রিদের দেশ আফ্রিকাও রণদেবতার কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হল না।

আফ্রিকার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের ওপর ফ্যাসিস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হল দুই মিত্রপক্ষ ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড। জার্মানির ফ্যাসিস্ট বাহিনি তখন ফ্রান্সে পদার্পণ করেছে, কিন্তু আফ্রিকার বুকে ছোটো ছোটো ফরাসি সৈন্যদল যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড উৎসাহে। ইংরেজ ও ফরাসির আর এক বন্ধু আমেরিকা যানবাহন ও কলকবজার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কিছু লোজন পাঠিয়ে যুধ্যমান মিত্রপক্ষকে সাহায্য করেছিল।

যাদের দেশের ওপর এই ভয়াবহ তাণ্ডব চলছিল, সেই নিগ্রো নামধারী কালো মানুষরা কিন্তু কোনো পক্ষেই যোগ দেয়নি। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন দেশের সাদা মানুষরা শোষণ করেছে আর উৎপীড়ন চালিয়েছে হতভাগ্য নিগ্রোদের ওপর, আজ তারা বুঝেছে সাদা মানুষ মাত্রেই কালো চামড়ার শত্রু

অতএব আত্মকলহে দুর্বল সাদা চামড়ার মানুষগুলোকে ঘায়েল করার এই হচ্ছে উপযুক্ত সময়।

নিগ্রোরা ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্বেতাঙ্গদের ওপর।

ইংরেজ, ফরাসি, জার্মান প্রভৃতি কোনো শ্বেতকায় জাতিকেই তারা নিষ্কৃতি দিল না। বিভিন্ন শ্বেতাঙ্গ জাতির ওপর হানা দিয়ে ফিরতে লাগল বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিগ্রো যোদ্ধার দল।

রক্ত আর আগুনের সেই ভয়ংকর পটভূমিকায় ১৯৪২ সালের ৭ নভেম্বর মধ্য আফ্রিকার ফরাসি উপনিবেশ নগানচু নামক স্থানে উত্তোলন করলাম বিস্মৃত ইতিহাসের যবনিকা।

নগানচুতে একটি ফাঁকা মাঠের ওপর যেখানে ফরাসিদের সারি সারি শিবির পড়েছে, সেইখানে খুব সকালেই শিবিরের বাসিন্দাদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য দেখা গেল!

চাঞ্চল্যের কারণ ছিল—

চারজন ফরাসি সৈনিক একটি বন্দিকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে নিকটবর্তী অরণ্যের দিকে!

সেনাবাহিনীর এলাকা ছাড়িয়ে একটি গাছের কাছে তারা স্থির হয়ে দাঁড়াল।

বন্দি জার্মান নয়, স্থানীয় অধিবাসী কৃষ্ণকায় নিগ্রো।

বন্দির অপরাধ গুরুতর; বিগত রাত্রে সেনানিবাসের এক প্রহরীকে সে আক্রমণ করেছিল।

আক্রমণ সফল হয়নি। লোকটি ধরা পড়েছে।

সারারাত্রি সে ছিল বন্দি শিবিরে আজ সকালে তার বিচার।

খুব তাড়াতাড়ি শেষ হল বিচার-পর্ব।

বন্দির দু-খানা হাত কবজি থেকে কেটে ফেলে ফরাসিরা তাকে মুক্তি দিলে। অবশ্য ক্ষতস্থানে ঔষধ প্রয়োগ করে তার রক্তপাত বন্ধ করা হয়েছিল–অতিরিক্ত রক্তপাতে লোকটি যাতে মারা না যায় সেইজন্যই এই ব্যবস্থা।

আহত নিগ্রোর কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল অবরুদ্ধ ক্রন্দনধ্বনি।

স্খলিত-চরণে সে পদচালনা করলে বনের দিকে, কিছুক্ষণের মধ্যেই অরণ্যের অন্তরালে অদৃশ্য হল তার দেহ।

বন্দির হস্তছেদন করেছিলেন মেজর জুভেনাক স্বহস্তে।

রক্তাক্ত তরবারি খাপে ঢুকিয়ে তিনি স্থান ত্যাগ করার উপক্রম করলেন, কিন্তু হঠাৎ অদূরে দণ্ডায়মান তিনটি শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের দিকে আকৃষ্ট হল তার দৃষ্টি।

ওই তিনটি মানুষের মুখের রেখায় রেখায় ফুটে উঠেছে ক্রোধ ও ঘৃণার অভিব্যক্তি!

মেজরের বিচার তাদের পছন্দ হয়নি!

মেজর জুভেনাক ভ্রূকুঞ্চিত করলেন, তোমরা আমেরিকার মানুষ; নিগ্রোদের সম্বন্ধে তোমাদের কোনো ধারণা নেই। লোকটিকে প্রাণদণ্ড দিলে স্থানীয় বাসিন্দারা এই ঘটনা খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যেত। কিন্তু হাতকাটা জাতভাই-এর অবস্থা দেখে ওরা ভয় পাবে, ভবিষ্যতে ফরাসিদের আক্রমণ করতে ওরা সাহস করবে না।

জুভেনাক চলে গেলেন।

নিজের ব্যবহারের জন্য কৈফিয়ত দেওয়ার অভ্যাস মেজরের ছিল না। জুভেনাক অতিশয় দাম্ভিক মানুষ। কিন্তু ওই তিন ব্যক্তি ফরাসি গভর্নমেন্টের বেতনভোগী সৈনিক নয়, ওরা আমেরিকার নৌ-সেনা। নিকটস্থ নদীর ওপর মোটর বোট এবং ছোটো ছোটো জলযানগুলি পরিদর্শন করার মতো উপযুক্ত ইঞ্জিনিয়ার বা কলাকুশলী নগানচু অঞ্চলে ফরাসিদের মধ্যে ছিল না। । তারা আমেরিকার সাহায্য চেয়েছিল।

তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশে জলযানগুলির তত্ত্বাবধান করতে এসেছিল আমেরিকার নৌ-বিভাগের তিনটি সৈনিক।

নৌ-বিভাগের অন্তর্গত তিন ব্যক্তির নাম–মাইক স্টার্ন, ম্যাক কার্থি এবং হ্যারিস।

পূর্ববর্ণিত রক্তাক্ত দৃশ্যের অবতারণা যেখানে হল সেখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল ওই তিনজন নৌ-সেনা। মেজর প্রস্থান করতেই হ্যারিস বন্ধুদের জানিয়ে দিলে জুভেনাকের নিষ্ঠুর আচরণ তার ভালো লাগেনি।

হ্যারিসের অপর দুই বন্ধুও তাকে সমর্থন জানিয়ে বললে যে উক্ত ফরাসি মেজরের সান্নিধ্য তারা পছন্দ করছে না।

তিন বন্ধুর ভাগ্যদেবতা অলক্ষ্যে হাসলেন।

তাদের মনস্কামনা শীঘ্রই পূর্ণ হল বটে কিন্তু জুভেনাকের সান্নিধ্য থেকে মুক্তি পেয়ে তাদের মনের ভাব হয়েছিল–

যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই।
যাহা পাই তাহা চাই না..

হস্তছেদন ঘটিত ভয়াবহ ঘটনার পর একটা দিন কেটে গেল নির্বিবাদে। দ্বিতীয় দিন সকাল বেলা তিন বন্ধু দেখল, ফরাসিরা সাজসরঞ্জাম গুটিয়ে স্থান ত্যাগ করার উপক্রম করছে।

তিন বন্ধু ছুটল মেজরের কাছে ব্যাপারটা কী?

মেজর জুভেনাক জানালেন, তাঁরা এই জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

তিন বন্ধুর জিজ্ঞাস্য, তাদের কী হবে?

জুভেনাক রূঢ়স্বরে জানিয়ে দিলেন, আমেরিকানদের তিনি ব্যক্তিগতভাবে আসতে বলেননি, অতএব তারা কী করবে-না-করবে সে-বিষয়ে চিন্তা করে মস্তিষ্ককে ঘর্মাক্ত করতে তিনি রাজি নন–তারা যা খুশি তাই করতে পারে।

এই প্রয়োজনীয় তথ্য পরিবেশন করে জুভেনাক সসৈন্যে প্রস্থান করলেন। তিন বন্ধু নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলে তাদের অবস্থা মোটেই আনন্দজনক নয়।

মাইক বললে, আমরা ফাঁদে পড়েছি। নদীর বিপরীত দিকে ঘাঁটি নিয়েছে জার্মান সৈন্য আর জঙ্গলের ভিতর ওত পেতে বসে আছে নিগ্রোরা। রক্তপিপাসু ফরাসি মেজর আর শান্তিপ্রিয় আমেরিকার মানুষের মধ্যে নিগ্রো যোদ্ধারা তফাত খোঁজার চেষ্টা করবে না সুযোগ পেলেই ওরা আমাদের হত্যা করবে। অতএব আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে, যেকোনো সময়েই নিগ্রোরা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

ফরাসিদের পরিত্যক্ত শিবিরগুলো পর্যবেক্ষণ করে তারা জানতে পারল যে খাদ্য ও পানীয়ের অভাব তাদের হবে না। প্রচুর পরিমাণে শুকনো খাদ্য জমানো রয়েছে বায়ুশূন্য টিনের পাত্রে।

আর আছে বীয়ার জাতীয় সুরার অসংখ্য বোতল।

অস্ত্রশস্ত্রের অবস্থাও খুব নৈরাশ্যজনক নয়।

কলের কামান প্রভৃতি ভারি অস্ত্র না-থাকলেও রাইফেল ছিল। গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় নেই–অজস্র টোটা রেখে গেছে ফরাসি সৈন্য। তা ছাড়া আছে পিস্তল, রিভলভার ও অনেকগুলো গ্রেনেড বা হাতবোমা।

যে-ঘরটায় খাদ্য ও পানীয় ছিল সেই ঘরে তারা তালা লাগিয়ে দিলে। সন্ধ্যার পর পানাহার শেষ করে তারা আশ্রয় গ্রহণ করলে একটা ঘরের মধ্যে।

বর্তমানে ওই ঘরটাই হল তিন বন্ধুর দুর্গ।

একটা রাত্রি ভালোভাবেই কাটল। কিন্তু পরের দিন সকালেই হানা দিল নিগ্রো যোদ্ধার দল। তিন বন্ধুর রাইফেল সশব্দে অগ্নি-উগার করলে, কয়েকটি নিগ্রোর হত ও আহত দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির ওপর।

নিগ্রোরা পিছিয়ে গেল। একটু পরে ফিরে এসে আহত সঙ্গীদের তুলে নিয়ে আবার আত্মগোপন করল সবুজ অরণ্যের অন্তরালে। মৃত সঙ্গীদের তারা ছুঁড়ে ফেলে দিল নদীর জলে।

গভীর রাত্রে আবার আক্রমণ করলে নিগ্রোরা। সারারাত্রি ধরে বার বার হানা দিল নিগ্রো বাহিনী, ঘরের ভিতর থেকে অনবরত গুলি চালিয়ে আর হাতবোমা ছুঁড়ে অতি কষ্টে তিন বন্ধু তাদের ঠেকিয়ে রাখল।

পূর্বদিকের আকাশে জাগল অস্পষ্ট আলোর আভাস। নিগ্রোরা আবার গা-ঢাকা দিল বনের আড়ালে। এল প্রভাত।

প্রভাতের শীতল বায়ু তপ্ত হয়ে উঠল ধীরে ধীরে, মাথার ওপর জ্বলে উঠল মধ্যাহ্নের প্রখর সূর্য।

একটা ঘরের মধ্যে বড়ো বড়ো টিনের পাত্রে জল জমিয়ে রেখেছিল ফরাসিরা। ওই জলে তিন বন্ধু স্নান করলে, তারপর আহারপর্ব শেষ করে ফেলল চটপট। গতরাত্রে কেউ ঘুমাতে পারেনি। রাত্রি জাগরণ এবং উত্তেজনার ফলে তারা হয়ে পড়েছিল অবসন্ন। মাইককে পাহারায় রেখে হ্যারিস ও ম্যাক কার্থি শয্যা গ্রহণ করলে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল গভীর নিদ্রায়।

ওঠ! ওঠ! তাড়াতাড়ি!

চিৎকার করে উঠল মাইক স্টার্ন।

দুই বন্ধু বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠল, তারপর মাইকের নির্দেশ অনুযায়ী দৃষ্টি সঞ্চালন করতেই তাদের চোখের সামনে ফুটে উঠল এক অপ্রত্যাশিত দৃশ্য।

বাঁকের মুখে নদীর ধারে নোঙর করেছে একটি নৌকা এবং সেই নৌকা থেকে নেমে আসছে দুজন জার্মান সৈনিক!

তিন বন্ধু অবাক হয়ে দেখল একজন জার্মান সৈন্যের হাতে রয়েছে শ্বেত পতাকা! সন্ধির সংকেত!

হতভম্ব হয়ে পড়ল তিন বন্ধু–দুরন্ত জার্মান সৈন্যরা হঠাৎ এমন শান্তিপ্রিয় হয়ে পড়ল কেন, এ-কথাটা তারা বুঝতে পারল না।

মাইক জার্মান ভাষা জানত। সঙ্গীদের ঘরের মধ্যে রেখে সে পিস্তল হাতে এসে দাঁড়াল জার্মানদের সামনে, কিন্তু তার জার্মান ভাষায় কথা বলার প্রয়োজন হল না।

চোস্ত ইংরেজিতে একজন জার্মান আত্মপরিচয় দিল, আমার নাম অটো গ্যটমেয়ার। আমি জার্মান সৈন্যদলের এক লেফটেন্যান্ট।

তারপর অটো যা বললে তার সারমর্ম হচ্ছে এই :

ম্যাঙ্গবেটু জাতীয় নিগ্রোরা এখন আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের নির্বিচারে আক্রমণ করছে–জার্মান, ফরাসি, ইংরেজ, আমেরিকান প্রভৃতি শ্বেতাঙ্গ জাতি তাদের শত্রু এবং অবশ্য বধ্য; অতএব জার্মানি এবং আমেরিকা বৃহত্তর পৃথিবীতে পরস্পরের শত্রু হলেও এই মুহূর্তে সেই শত্রুতা ভুলে এই দুটি ছোটো দল যদি এখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিগ্রোদের বিরুদ্ধে রুখে না-দাঁড়ায়, তাহলে খুব শীঘ্রই নিগ্রোদের আক্রমণে উভয়পক্ষই হবে নিশ্চিহ্ন–জার্মান বা আমেরিকানদের মধ্যে একটি লোকও নিগ্রোদের রোষ থেকে রেহাই পাবে না। তাই নিতান্ত সাময়িকভাবে জার্মানিদের পক্ষ থেকে অটো সন্ধির প্রস্তাব এনেছে। তার দলের আরও চারজন সৈন্য জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে, আমেরিকানরা যদি সন্ধি করতে রাজি হয় তাহলে লেফটেন্যান্টের সঙ্গী তাদের নিয়ে আসবে।

মাইক তার বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে বুঝল যে, জার্মান সেনানায়কের প্রস্তাব মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

সন্ধি হল। লেফটেন্যান্টের সঙ্গী দূর অরণ্যের গোপন স্থান থেকে চারজন জার্মান সেনাকে নিয়ে এল আমেরিকানদের আস্তানায়। আপাতত এই জায়গাটাই উভয়পক্ষের মিলিত শিবির হল।

সন্ধির একটি বিশেষ শর্ত ছিল এই যে, কোনো কারণে যদি অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, তাহলেও একপক্ষ অপর পক্ষকে যুদ্ধবন্দি হিসাবে গণ্য করতে পারবে না।

শর্তটা উভয়পক্ষেরই মনঃপূত হয়েছিল।

সাময়িকভাবে নিজেদের শত্রুতা ভুলে দুই পক্ষ এইবার মিলিতভাবে নিগ্রোদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। সন্ধ্যার আগেই শুরু হল আক্রমণ। নয়টি রাইফেল ঘনঘন গর্জন করে অনেকগুলো কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধার হত ও আহত দেহ শুইয়ে দিল মাটির ওপর।

নিগ্রোরা পিছিয়ে গেল… আবার আক্রমণ করলে… শ্বেতাঙ্গদের আস্তানার উপর এসে পড়ল ঝাঁকে ঝাঁকে বল্লম… রাইফেলের অগ্নিবৃষ্টিও বুঝি আর নিগ্রোদের ঠেকিয়ে রাখতে পারে না…

শ্বেতাঙ্গরা এইবার গ্রেনেড (হাতবোমা) ব্যবহার করলে। নিগ্রো যোদ্ধাদের উপর ছিটকে পড়ল কয়েকটা হাতবোমা, আগুনের ঝলকে ঝলকে ধূম এবং মৃত্যু পরিবেশিত হল চতুর্দিকে, হতাহত সঙ্গীদের ফেলে সভয়ে পলায়ন করলে বর্শাধারী কালো মানুষগুলো বিজ্ঞানের মহিমায় স্তব্ধ হয়ে গেল অরণ্যের বন্য বিক্রম!

কেটে গেল কয়েকটি দিন আর কয়েকটি হাত। এর মধ্যে আবার আক্রমণ করেছে ম্যাঙ্গবেটু নিগ্রোরা, কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের রাইফেলের অগ্নিবৃষ্টির মুখে ব্যর্থ হয়েছে তাদের আক্রমণ। একজন জার্মান সেনা প্রাণ হারিয়েছে বর্শার আঘাতে। চারদিকে হাতবোমার সাহায্যে মাইন পেতে আত্মরক্ষা করতে লাগল জার্মান ও আমেরিকান সৈন্যরা।

সেদিন প্রকাশ্যে দিবালোকে দুজন নিগ্রো জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াল। তাদের মধ্যে একজনের অঙ্গসজ্জা দেখে শ্বেতাঙ্গরা অনুমান করল লোকটি ম্যাঙ্গবেটুদের মধ্যে প্রভাবশালী সর্দার-শ্রেণির মানুষ; অপর ব্যক্তির একহাতে শিকলে বাঁধা পাঁচটি কুকুর, অন্যহাতে একটা চামড়ার থলি। কুকুরগুলো সাগ্রহে চামড়ার থলিটা বার বার শুঁকছে। সর্দারের হাতে একটা লাঠির আগায় সাদা কাপড় বাঁধা–সন্ধির চিহ্ন সাদা নিশান!

অটো তৎক্ষণাৎ তাদের গুলি করতে চাইল, কিন্তু মাইক বলল, দাঁড়াও, আগে ওদের বক্তব্যটা শুনি। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।

মাইনের মৃত্যুফাঁদ থেকে যে পথটা মুক্ত, সেই সরু রাস্তাটার দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে মাইক ম্যাঙ্গবেটুদের কাছে আসতে ইঙ্গিত করল।

সর্দারের মুখে ফুটল ধূর্ত হাসির রেখা, নিশানটা সজোরে মাটির ওপরে বসিয়ে দিয়ে সঙ্গীর থলি থেকে কয়েকটা রক্তাক্ত মাংসের টুকরো বার করে সে ছুঁড়ে দিল সাদা মানুষদের দিকে। সঙ্গীও শিকলের বাঁধন থেকে কুকুরগুলোকে মুক্তি দিল তৎক্ষণাৎ।

জার্মান ও আমেরিকান সৈন্যরা মাটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শয্যাগ্রহণ করল উপুড় হয়ে। প্রায় সঙ্গেসঙ্গে হাতবোমার তারে ধাবমান কুকুরের পা লাগল। একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ–মুহূর্ত পরেই আরও চারটি বোমা ফাটল ভীষণ শব্দে!

শ্বেতাঙ্গরা সম্মুখে দৃষ্টিপাত করল। কুকুরগুলোর মৃতদেহ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। নিগ্রো দুজন মাইকের নির্দিষ্ট নিরাপদ পথ ধরে সতর্ক চরণে এগিয়ে আসছে।

শ্বেতাঙ্গদের সামনে এসে হোমরাচোমরা গোছের লোকটি তার সঙ্গীকে কথা কইতে নির্দেশ দিল।

ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে নিগ্রোটি জানাল তার সঙ্গে এসেছে মহামান্য মবংগো! মবংগো ওই গ্রামের জাদুকর। তার ক্ষমতা অসীম। মবংগো বলছে, সাদা মানুষরা যদি এই ঘাঁটি এখনই ছেড়ে দিতে রাজি থাকে, তাহলে তাদের নিরাপদে যেতে দেওয়া হবে। কথা না-শুনলে মবংগোর আদেশে ম্যাঙ্গবেটুরা সাদা মানুষদের হত্যা করবে। মাটির ওপর ফেটে যাওয়া জিনিসগুলোকে তারা ভয় করে না, ওগুলোকে ফাঁকি দেওয়ার রাস্তা তারা দেখে নিয়েছে।

অটো মাইকের দিকে চাইল, কী বল? ওদের প্রস্তাবে রাজি হব?

অসম্ভব, মাইক বলল, ওরা সুযোগ পেলেই আমাদের খুন করবে। বরং এখানে দাঁড়িয়ে আমরা লড়তে পারব। ঘাঁটি ছেড়ে গেলে আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত।

অটো মাইকের যুক্তি মেনে নিল। তারপর নিগ্রো দোভাষীর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কর্তাকে বলো আমরা এই জায়গাতেই থাকব। কোথাও যাব না।

দোভাষীর মুখ থেকে শ্বেতাঙ্গদের বক্তব্য শুনে দারুণ ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল জাদুকর মবংগো। সে থুথু ছিটিয়ে দিল অটোর মুখে!

মুহূর্তের মধ্যে খাপ থেকে পিস্তল টেনে নিয়ে পর পর দু-বার গুলি ছুড়ল অটো। গুলি লাগল জাদুকরের পেটে। সঙ্গীটি দারুণ আতঙ্কে হাঁ করে চেয়ে রইল সাদা মানুষদের দিকে। তার দিকে তাকিয়ে হিংস্রভাবে দাঁত বার করে গর্জে উঠল অটো, যাও, এই হতভাগাকে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যাও।

মরণাপন্ন জাদুকরকে নিয়ে নিগ্রোটি জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল…

কয়েকটা দিন নিরুপদ্রবে কাটল। কিন্তু শ্বেতাঙ্গরা তাদের পাহারা শিথিল করল না। তারা জানত ম্যাঙ্গবেটুরা সুযোগ খুঁজছে, একটু অসতর্ক হলে আর রক্ষা নেই। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জার্মান আর আমেরিকানরা তাদের শত্রুতা ভুলে গেল। অলস মধ্যাহ্নে তারা তাস খেলে মুখোমুখি বসে, রাতের অন্ধকারে পাহারা দেয় বিনিদ্র নেত্রে।

ছোটোখাটো তুচ্ছ বিষয় থেকে অনেক সময় হয় মারাত্মক বিপদের সূত্রপাত ।

মাইক যদি জানত তার পরিচয়পত্রটি অত বড়ো বিপদ ডেকে আনবে, তাহলে বোধ হয় সে যত্ন করে ওই জিনিসটিকে মালার সঙ্গে আটকে বুকের ওপর ঝুলিয়ে রাখত না।

ওই পরিচয়পত্রের দিকে আকৃষ্ট হল কোহন নামক জনৈক জার্মান সৈনিকের দৃষ্টি।

কোহন জিনিসটা দেখতে চাইল। মালা থেকে পরিচয়পত্রটি খুলে মাইক সেটাকে কোহনের হাতে দিল। কোহনের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল আর একজন জার্মান নাম তার হহেনস্টিন। সঙ্গীর হাত থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে জিনিসটাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল সে, তার দুই চোখে ফুটে উঠল তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষের আভাস!

হহেনস্টিন ক্রুদ্ধস্বরে বললে, আরে, এই লোকটা দেখছি ইহুদি! ওহে কোহন–এই নোংরা শুয়োরটা ইহুদি! ছি! ছি!

(ইহুদিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করত জার্মান জাতি। হিটলারের নির্দেশে এই সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও আক্রোশ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল জার্মান জাতির মধ্যে।)

গালাগালি শুনে চুপ করে থাকার মতো সুবোধ ছেলে নয় মাইক স্টার্ন–সে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল হহেনস্টিনের ওপর!

চোখের পলক ফেলার আগেই শুরু হয়ে গেল মারামারি!

গোলমাল শুনে সেখানে ছুটে এল জার্মান লেফটেন্যান্ট অটো। তার সঙ্গে সঙ্গে এল অন্যান্য জার্মান সৈনিক এবং মাইকের দুই বন্ধু।

মাইককে ছেড়ে দিয়ে অটোর দিকে এগিয়ে এল হহেনস্টিন, স্যার! এই শুয়োরটা ইহুদি! আমি এইমাত্র জেনেছি!

ক্রুদ্ধকণ্ঠে গর্জে উঠল মাইক, হ্যাঁ, আমি ইহুদি তাতে কী হয়েছে?

অটো বিস্মিত স্বরে বললে, তুমি ইহুদি? আশ্চর্য! তোমাকে দেখে তো মনে হয় না যে তুমি ইহুদি!

মাইক রোষরুদ্ধ স্বরে বললে, ইহুদিরা কেমন দেখতে হয়? তারা কি মানুষ নয়? তোমার মতো আমারও দুটো হাত আর দুটো পা আছে।

অটো বললে, তা ঠিক। তবে আমরা শুনেছি ইহুদিরা ভালো লোক নয়।

ভুল শুনেছ, জবাব দিল ম্যাক কার্থি, শয়তান হিটলার তোমাদের যা বুঝিয়েছে তোমরা তাই বুঝেছ। কিন্তু অটো, তোমার তো বেশ বুদ্ধি আছে–তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে,ওই হিটলারটা হচ্ছে পয়লা নম্বরের মিথ্যুক!

এক মুহূর্তে সমস্ত পরিবেশ হয়ে উঠল ভয়ংকর।

জার্মানরা এসে দাঁড়াল অটোর পাশে, তাদের চোখের দৃষ্টি থেকে মুছে গেছে বন্ধুত্বের স্বাক্ষর, চোয়ালের রেখায় রেখায় পাথরের কাঠিন্য।

একজন জার্মান গম্ভীর স্বরে বললে, লেফটেন্যান্ট! হুকুম দাও!

মাইকের দুই পাশে ছড়িয়ে পড়ল দুই বন্ধু।

ম্যাক কার্থি খাপ থেকে পিস্তল টেনে নিল।

রাইফেলের বাঁটের ওপর চেপে বসেছে জার্মান সৈনিকের কঠিন মুষ্টি, ট্রিগারের ওপর সরে এসেছে আঙুল—

আবার প্রশ্ন এল জার্মান ভাষায়, কী হুকুম? লেফটেন্যান্ট?

কিন্তু অটো মুর্খ নয়।

শান্তভাবে চারদিকে চোখ বুলিয়ে সে বললে, লড়াই করার মতো উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে বটে, কিন্তু। আমি লড়াই-এর হুকুম দেব না। ইহুদিরাও মানুষ, হহেনস্টিন অন্যায়। করেছে।

লেফটেন্যান্টের আদেশে হহেনস্টিন ক্ষমা চাইতে বাধ্য হল।দুইপক্ষই আবার। অস্ত্র নামিয়ে নিল।

মেঘ সরে গিয়েছে, ঝড় আর উঠবে না।

অটোর ব্যবস্থা অনুযায়ী প্রতি রাত্রে পালা করে একজন পাহারা দেয়। আজ জার্মান সান্ত্রি বনামিয়েরের পালা! বনামিয়ের তার হাতঘড়ির দিকে তাকাল–এগারোটা বেজে তিরিশ মিনিট হয়েছে।

একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সে আরাম করতে লাগল…

হঠাৎ কার পায়ের তলায় সশব্দে ভেঙে গেল একটা শুকনো গাছের ডাল। চমকে উঠল জার্মান প্রহরী বনামিয়ের।

আবার সেই শব্দ! শুকনো গাছের ডালগুলো ভেঙে যাচ্ছে কাদের পায়ের তলায়?

দুই চোখ পাকিয়ে শব্দ লক্ষ করে দৃষ্টি সঞ্চালিত করতেই, বনামিয়ের দেখল তার চারপাশে অন্ধকারের বুকে ভেসে উঠেছে অনেকগুলো চলমান মনুষ্যদেহ নিগ্রো যোদ্ধার দল!

দারুণ আতঙ্কে জার্মান প্রহরীর বুদ্ধিভ্রংশ হল, রাইফেলটাকে শক্ত মুঠিতে চেপে ধরে সে দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো… কিছুক্ষণ পরে ভয়ের ধাক্কাটা কাটিয়ে নিয়ে বনামিয়ের তার কর্তব্য স্থির করে ফেলল। খুব ধীরে ধীরে সে মাটির উপর বসে পড়ল–অন্ধকারের মধ্যে তার দেহটা এখনও নিগ্রোদের দৃষ্টিগোচর হয়নি।

মাটি থেকে একটা শুকনো গাছের ডাল তুলে নিয়ে বনামিয়ের দূরে ছুঁড়ে দিল। ডালটা সশব্দে মাটির ওপর পড়ল–সঙ্গেসঙ্গে শব্দ লক্ষ করে ছুটে এল চারটে ভূতুড়ে ছায়া গাছের আড়াল থেকে!

বনামিয়ের গুলি ছুড়ল। তারপর পিছন ফিরে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল আস্তানার দিকে। তার ধাবমান দেহের এপাশ দিয়ে ওপাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে উড়ে গেল অনেকগুলো বর্শা। বনামিয়ের একটা ঘরের খুব কাছাকাছি এসে পড়ল আর একটু গেলেই সে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষা করতে পারবে। কিন্তু বেচারার উদ্দেশ্য সফল হল না, তার বাম ঊরুর ওপর বিদ্ধ হল একটি বর্শা বনামিয়ের মাটির ওপর ছিটকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।

ইতিমধ্যে রাইফেলের শব্দে আমেরিকান আর জার্মান সৈন্যদের ঘুম গেছে ভেঙে, চটপট রাইফেল নিয়ে তারা ছুটে এসেছে অকুস্থলে নিকটবর্তী অরণ্যের ভিতর দিয়ে ঝোপঝাড় ভেদ করে আঙুলের চাপে চাপে রাইফেলের মুখ থেকে ছিটকে পড়েছে তপ্ত বুলেট বৃষ্টিধারার মতো!

সেই দারুণ অগ্নিবৃষ্টির মুখে লুটিয়ে পড়ল কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধা, বাকি সবাই তাড়াতাড়ি জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। শ্বেতাঙ্গরা এবার অদৃশ্য শত্রুদের লক্ষ করে হাতবোমা ছুড়ল ঘন জঙ্গল আর ঝোপঝাড়ের ভিতর প্রচণ্ড শব্দে ফাটাতে লাগল বোমাগুলো।

নিগ্রো যোদ্ধারা পিছিয়ে গেল। অন্ধকার অরণ্যের ভিতর তাদের দেহগুলো শ্বেতাঙ্গদের চোখে পড়ল না, কিন্তু দ্রুত ধাবমান পদশব্দ তাদের জানিয়ে দিলে শত্রু এখন প্রাণ নিয়ে সরে পড়ছে।

আহত জার্মান সৈন্যের দেহটাকে ধরাধরি করে তারা একটা ঘরের ভিতর নিয়ে এল। বনামিয়েরের পায়ের হাড় ভেঙে গিয়েছিল, তার ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে বেঁধে দেওয়া হল। বনামিয়ের তখন দারুণ যাতনায় আর্তনাদ করছে, তাকে একটা মরফিয়া ইঞ্জেকশন দিতেই সে ঘুমিয়ে পড়ল–অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্য আঘাতের যন্ত্রণা থেকে সে মুক্তি পেল।

এক সপ্তাহ পরের কথা। রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে স্টার্ন মাইক।

হঠাৎ পায়ের ওপর সে অনুভব করলে তীব্র দংশন!

অস্ফুট স্বরে আফ্রিকার যাবতীয় কীটপতঙ্গকে অভিশাপ দিতে দিতে মাইক তার আহত পায়ের শুশ্রূষা করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল আর সঙ্গেসঙ্গে সে বুঝতে পারল তার হাতের ওপর উঠে পড়েছে অনেকগুলো পতঙ্গ জাতীয় জীব!

মাইক অনুভব করলে তার দুই পায়ের উপরেই কামড় বসাচ্ছে অনেকগুলো পোকা–কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হাতের পোকাগুলোও তাকে কামড়াতে লাগল।

তাড়াতাড়ি রাইফেলের বাঁটের ওপর হাতটাকে সজোরে ঘর্ষণ করে মাইক তার হাতটাকে পোকার কবল থেকে মুক্ত করে নিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিল চাঁদ।

ম্লান জ্যোৎস্নার আলোকধারার মধ্যে মাইকের দৃষ্টিপথে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত দৃশ্য!

বনের ভিতর থেকে ফাঁকা মাঠের ওপর বেরিয়ে এসেছে একদল পিঁপড়ে! সেই বিপুল পিপীলিকা বাহিনীর সংখ্যা অনুমান করা অসম্ভব কারণ মাইকের সামনে যে পিঁপড়ের সারিটা এগিয়ে এসেছে তার পিছন দিকটা এখনও অদৃশ্য রয়েছে অরণ্যের অন্তরালে।

কয়েকটা অগ্রবর্তী দলছাড়া পিঁপড়ে ইতিমধ্যেই তার পায়ের ওপর উঠে কামড় বসিয়েছে। মাইকের প্রায় দশ গজ দূরে এসে পড়েছে আসল দলটা!

মাইক তাদের মিলিটারি ব্যারাকের আস্তানা লক্ষ করে ছুটল। মাঝে মাঝে নীচু হয়ে সে পা থেকে পিঁপড়েগুলোকে ছাড়িয়ে নিচ্ছিল। হাত দিয়ে ঘষে ওই মারাত্মক পোকাগুলোর কবল থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব ছিল না–দু-আঙুলে টিপে ধরে মাইক পিঁপড়েগুলোকে টেনে আনছিল তার পায়ের ওপর থেকে!

জীবজগৎ সম্বন্ধে মাইক যদি কিছু খবর রাখত তাহলে সে জানত যে ওই পিঁপড়েগুলো হচ্ছে। আফ্রিকার মারাত্মক ড্রাইভার অ্যান্ট।

এরা যেখান দিয়ে যায় সেখানে পড়ে থাকে অসংখ্য জানোয়ারের কঙ্কাল সিংহ, লেপার্ড প্রভৃতি হিংস্র পশুও এদের মিলিত আক্রমণের মুখে অসহায়ভাবে প্রাণ বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়।

মাইক তার হাতের রাইফেল আওয়াজ করে নিদ্রিত সঙ্গীদের জাগিয়ে দিলে। সকলে ছুটে এসে দেখল, তাদের আস্তানা আর জঙ্গলের মাঝখানে অবস্থিত ফাঁকা জায়গাটার ওপর দিয়ে এগিয়ে আসছে অসংখ্য পিপীলিকার শ্রেণিবদ্ধ বাহিনী!

শ্বেতাঙ্গরা তাড়াতাড়ি পিঁপড়েগুলোর সামনে গ্যাসোলিন ছড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলে। পিঁপড়েরা নাছোড়বান্দা তারা জ্বলন্ত আগুনের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করতে লাগল। সৈন্যরা এবার পিঁপড়ের দলের ওপর গ্যাসোলিন ছড়িয়ে অগ্নিসংযোগ করলে। অনেকগুলো পিঁপড়ে অগ্নিগর্ভে প্রাণ বিসর্জন দিলে অন্যগুলো এদিক-ওদিক সরে গেল।

আচম্বিতে নিকটবর্তী শিবিরগুলোর একটি ঘর থেকে ভেসে এল এক করুণ আর্তনাদ।

সকলেই বুঝল, ওই কণ্ঠস্বরের মালিক হচ্ছে বনামিয়ের।

কারণ সে ছাড়া ওই সময়ে ঘরের মধ্যে কেউ ছিল না। বনামিয়ের যে ঘরে শুয়েছিল সেই ঘরের দিকে সবাই ছুটল…

বীভৎস দৃশ্য!

খাটের ওপর শুয়ে ছটফট করছে আহত বনামিয়ের, তাকে আক্রমণ করেছে পিঁপড়ের দল। জীবন্ত অবস্থায় তার দেহের মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে ওই ভয়ংকর কীটগুলি, ইতিমধ্যেই পিপীলিকার দংশনে তার চক্ষু হয়েছে অন্ধ–চক্ষুহীন রক্তাক্ত অক্ষিকোটরের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে শুধু পিঁপড়ে আর পিঁপড়ে!

সকলেই বুঝল, বনামিয়ের আর বাঁচবে না–হিংস্র কীটগুলো তার দেহটাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে, তিলে তিলে নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে করতে তার মৃত্যু হবে ধীরে ধীরে।

সৈনিক মাত্রেই মরতে এবং মারতে প্রস্তুত থাকে, মৃত্যু তাদের কাছে অতি সহজ, অতি স্বাভাবিক। কিন্তু ওই বীভৎস দৃশ্য সহ্য করা যায় না।

লেফটেন্যান্ট অটো কোহনের দিকে তাকাল, কিছু একটা করো! লোকটা এভাবে মরবে?

–কী করব! কিছু করার নেই।

–কিছু করার নেই?

না।

অটো রিভলভারটা বনামিয়েরের মাথা লক্ষ করে তুলে ধরলে।

মাইক মুখ ঘুরিয়ে নিলে অন্যদিকে।

গর্জে উঠল অটোর রিভলভার–গুলি বনামিয়েরের মস্তিষ্ক ভেদ করে তাকে অসহ্য যাতনা থেকে নিষ্কৃতি দিল মুহূর্তের মধ্যে।

সকালের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গেসঙ্গে পিপীলিকা বাহিনী সৈন্যদের আস্তানা ছেড়ে জঙ্গলের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল জীবন্ত দুঃস্বপ্নের মতো। সবাই দেখল, পিঁপড়েরা শুধু বনামিয়েরের দেহের মাংস খেয়েই সন্তুষ্ট হয়নি, তার জুতো, রিভলভারের খাপ প্রভৃতি সব কিছুই উদরসাৎ করেছে খুদে রাক্ষসের দল।

বনামিয়েরের মাংসহীন রক্তাক্ত কঙ্কালটাকে সবাই মিলে কবরস্থ করলে।

অটো বললে, এইভাবে আমরা বেশিদিন আত্মরক্ষা করতে পারব না। যদি বাঁচতে হয় তাহলে আমাদের আক্রমণকারী ভূমিকা নিতে হবে।

মাইক বললে, তুমি কী করতে চাও?

অটোর অভিমত হচ্ছে এই যে তারা যদি ম্যাঙ্গবেটু নিগ্রোদের একটি গ্রাম অধিকার করতে পারে তবে স্থানীয় বাসিন্দারা ভীত হয়ে পড়বে, খুব সম্ভব তারা আর লড়াই করতে চাইবে না।

অটোর প্রস্তাবে সম্মত হল মাইক।

একদিন খুব ভোরে ঘন জঙ্গল ভেদ করে জার্মান ও আমেরিকানদের মিলিত বাহিনী নিকটবর্তী নিগ্রো পল্লিতে হানা দিল। এমন অতর্কিত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না গ্রামবাসী।

রাইফেলের ঘন ঘন গর্জন ও হাতবোমার প্রচণ্ড বিস্ফোরণ আতঙ্কের সঞ্চার করল নিগ্রো পল্লির বুকে। ভয়ার্ত নরনারী গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয় নিল শ্বাপদসংকুল অরণ্যের অন্তঃপুরে।

শ্বেতাঙ্গদের মিলিত বাহিনী প্রবেশ করল নির্জন গ্রামের মধ্যে।

দু-দিন পরেই সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে শ্বেতাঙ্গদের সামনে এসে দাঁড়াল ম্যাঙ্গবেটুদের কয়েকজন প্রতিনিধি–তারা শান্তিতে বাস করতে চায়, লড়াই করার আগ্রহ তাদের আর নেই।

শ্বেতাঙ্গরা সম্মত হল। ম্যাঙ্গবেটুদের গ্রামের মধ্যে নিগ্রোদের পাশাপাশি বাস করতে লাগল জার্মান আর আমেরিকান সৈন্যদল! শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের জ্বলন্ত নিদর্শন।

কয়েকদিন পরে এই নাটকীয় বন্ধুত্বের রঙ্গমঞ্চে নেমে এল সমাপ্তির যবনিকা। ম্যাঙ্গবেটুদের গ্রামের কাছে নদীর বুকে আবির্ভূত হল একটি আমেরিকান সী-প্লেন বা উভচর বিমান।

মার্কিন পাইলট জার্মান এবং আমেরিকানদের শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান দেখে বিস্মিত হয়েছিল। মাইকের অনুরোধে বিমানচালক জার্মানদের নিরাপদ অঞ্চলে পৌঁছে দিতে সম্মত হল। স্প্যানিশ গায়নার সীমান্তে একটি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে দুই পক্ষ পরস্পরের কাছে বিদায় গ্রহণ করলে। বিদায়ের আগে মাইকের হাত চেপে ধরেছিল অটো গ্যটমেয়ার–ঘটনাচক্রে দুই শত্রুর মধ্যে গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্বের বন্ধন, ভাগ্য তাদের সেই বন্ধুত্ব যাচাই করে নিয়েছিল অগ্নিপরীক্ষার ভিতর দিয়ে।

বিমানযোগে তিন বন্ধু নিরাপদে ফিরে এল মিত্রপক্ষের আস্তানায়। অটো গ্যটমেয়ার এবং অন্যান্য জার্মানদের সঙ্গে আর কোনোদিন তাদের সাক্ষাৎ হয়নি।

[ফাল্গুন ১৩৭৬]

অসুর বনাম মহিষাসুর

না না, পুরাণে বর্ণিত মহিষাসুরের কাহিনি আজ লিখতে বসিনি, আমি যে জীবটির কথা বলছি সে হচ্ছে আফ্রিকা বনরাজ্যের জীবন্ত বিভীষিকা

নাম তার কেপ-বাফেলো। আফ্রিকার মহিষাসুর!

বন্য মহিষ মাত্রেই হিংস্র ও উগ্র, এমনকী গৃহপালিত মহিষকেও নিতান্ত শান্তশিষ্ট জানোয়ার বলা চলে না। কিন্তু আফ্রিকার কেপ-বাফেলোর মতো এমন ভয়ানক জানোয়ার পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলে মহিষগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায় না।

মহিষ-পরিবারের অন্তর্গত সব জন্তুর প্রধান অস্ত্র শিং এবং খুর। কেপ-বাফেলো ওই দুই মহাস্ত্রে বঞ্চিত নয়, উপরন্তু শিরস্ত্রাণধারী যোদ্ধার মতো তার মাথার উপর থাকে কঠিন হাড়ের স্থূল আবরণ (ইংরেজিতে যাকে বলে Boss of the Horns)।

অস্থিময় এই কঠিন আবরণ ভেদ করে শ্বাপদের নখ দন্ত বা রাইফেলের গুপ্ত বুলেট মহিষাসুরের মস্তকে ক্ষতচিহ্ন সৃষ্টি করতে পারে না।

নিগ্রো শিকারিরা অনেক সময় বর্শা হাতে মহিষকে আক্রমণ করে। অনেকগুলি বর্শার আঘাতে জর্জরিত হয়ে প্রাণত্যাগ করার আগে মহিষ তার শিং ও খুরের সদ্ব্যবহার করতে থাকে বিদ্যুৎবেগে অবশেষে এই ধরনের বন্য নাটকের উপসংহারে দেখা যায় নিহত মহিষের আশেপাশে লম্বমান হয়ে পড়ে আছে কয়েকটি হত ও আহত নিগ্রো শিকারির রক্তাক্ত দেহ।

এই ভয়ানক জন্তুকে হত্যা করার একমাত্র উপযুক্ত অস্ত্র হচ্ছে শক্তিশালী রাইফেল। তবে রাইফেলের অগ্নিবৃষ্টিও সবসময় কেপ-বাফেলোকে জব্দ করতে পারে না–আফ্রিকার অরণ্যে মহিষের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে বহু শ্বেতাঙ্গ শিকারি!

এমন দুর্দান্ত জানোয়ারকে টোনিও নামক নিগ্রো যুবকটি জব্দ করেছিল একখানা বর্শার সাহায্যে!

হ্যাঁ, বন্দুক নয়, রাইফেল নয়, এমনকী মহিষ বা হাতি শিকারের উপযুক্ত দীর্ঘ ফলকবিশিষ্ট বল্লমও তার হাতে ছিল না শুধুমাত্র একটি মাছমারা বর্শার সাহায্যে ক্ষিপ্ত মহিষের আক্রমণ রোধ করেছিল টোনিও নামধারী নিগ্রো যুবক!

কথাটা নিতান্ত অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে–তাই নয় কি?

নিম্নলিখিত কাহিনিটি পড়লেই বোঝা যাবে সত্য ঘটনার চেহারা অনেক সময় গল্পের চেয়ে আশ্চর্য, গল্পের চেয়ে ভয়ংকর…।

সুদান অঞ্চলের পূর্বদিকে অবস্থিত পার্বত্য অঞ্চলে হানা দিয়েছিলেন একজন শ্বেতাঙ্গ শিকারি–নাম তার রে ক্যাথার্লি। শিকারির ভাগ্য খারাপ, তার নিগ্রো পথপ্রদর্শক হঠাৎ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা পড়ল। জিনিসপত্র বহন করার জন্য যে লোকগুলিকে ক্যাথার্লি নিযুক্ত করেছিলেন তারা ছোঁয়াচে অসুখের ভয়ে তল্পিতল্পা ফেলে পালিয়ে গেল।

ক্যাথার্লি বিপদে পড়লেন। শিকারের সরঞ্জামগুলি বহন করার জন্য লোকজন দরকার কিন্তু এই গভীর অরণ্যে তেমন লোক কোথায়? নিরুপায় ক্যাথার্লি শেষ পর্যন্ত মডি জাতীয় নিগ্রোদের সাহায্য নিতে বাধ্য হলেন। মডিরা মৎস্যজীবী অর্থাৎ জেলে, মাছ ধরা তাদের পেশা শিকার-টিকার তারা বোঝে না কিন্তু টাকার মূল্য খুব ভালোভাবেই বুঝতে শিখেছে। টাকার লোভে কয়েকজন মডি জাতীয় ধীবর ক্যাথার্লির মোট বহন করতে রাজি হল।

মডিদের দলের মধ্যে একটি যুবকের দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলেন ক্যাথার্লি ছয় ফুটের উপর লম্বা ওই দীর্ঘকায় মানুষটির প্রশস্ত স্কন্ধ ও পেশিবহুল দেহ যেন অফুরন্ত শক্তির আধার!

শিকারির মনে হল মানবের ছদ্মবেশে তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হয়েছে এক কৃষ্ণকায় দানব!

দানব বুঝল ক্যাথার্লি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন, দন্তবিকাশ করে সে ইংরেজিতে জানিয়ে দিলে তার নাম টোনিও।

ক্যাথার্লি খুশি হলেন–টোনিও কেবল অসাধারণ দেহের অধিকারী নয়, তার মস্তিষ্কও যথেষ্ট উন্নত। মোটবাহকদের দলের মধ্যে টোনিও হচ্ছে একমাত্র লোক যে ইংরেজি ভাষা বুঝতে পারে এবং বলতে পারে।

কিন্তু সবচেয়ে যে বস্তুটি ক্যাথার্লির বিস্মিত দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছিল সেটি হচ্ছে টোনিওর হাতের বর্শা। সাধারণ বর্শার মতো কাষ্ঠদণ্ডের সঙ্গে ধারালো লোহার ফলা আটকে এই অস্ত্রটি তৈরি করা হয়নি–একটি সরল লৌহদণ্ডকে বর্শার মতো ব্যবহার করেছিল টোনিও।

ওই লোহার ডান্ডার মুখটা ছিল সরু আর ধারালো। গুরুভার অস্ত্রটিকে অতি সহজেই বহু দূরে নিক্ষেপ করতে পারত টোনিও এবং তার নিশানাও ছিল পাকা, সহজে সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।

এমন একটি মনুষ্য-রত্ন পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন ক্যাথার্লি, তাঁর প্রধান পথপ্রদর্শকের পদে বহাল হল টোনিও….

কয়েকদিন পরেই ঘটল এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

টোনিওকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাথার্লি গিয়েছিলেন পাহাড়ের দিকে শিকারের সন্ধানে। তাঁবুতে যে কয়জন মোটবাহক ছিল তারা মাছ ধরবার জন্য যাত্রা করেছিল নদীর দিকে। সন্ধ্যার সময়ে ক্যাথার্লি টোনিওকে নিয়ে তাঁবুতে ফিরে দেখলেন তাঁবু শূন্য জনপ্রাণীও সেখানে উপস্থিত নেই।

শিকারি প্রথমে বিশেষ চিন্তিত হননি। কিন্তু ঘড়িতে যখন নয়টা বাজল তখন তিনি বিচলিত হয়ে উঠলেন। আফ্রিকার জঙ্গলে রাত্রি ন-টা পর্যন্ত কেউ তাঁবুর বাইরে থাকে না–অন্ধকারের অন্তরালে শ্বাপদসংকুল অরণ্য তখন মৃত্যুর বিচরণভূমি…

অবশেষে তাঁবুর কাছে যে অগ্নিকুণ্ড জ্বলছিল তারই আলোতে দেখা গেল লোকগুলি ফিরে আসছে।

আসছে বটে তবে স্বাভাবিকভাবে নয়।

মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে তিনটি লোক। চতুর্থ ব্যক্তিকে গাছের ডাল দিয়ে তৈরি একটা বিছানার ওপর শুইয়ে তার তিন সঙ্গী ওই শয্যাটিকে বহন করছে।

কাষ্ঠনির্মিত ওই বিছানা তারা নামিয়ে রাখল ক্যাথার্লির সম্মুখে। শয্যার দিকে দৃষ্টিপাত করে চমকে উঠলেন ক্যাথার্লি

হাড়গোড়ভাঙা অবস্থায় যে রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডটা কাঠের বিছানার ভিতর পড়ে আছে তার সঙ্গে মনুষ্যদেহের কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল! ক্যাথার্লির মনে হল একটা গুরুভার বস্তুর নীচে মানুষটাকে পিষে ফেলা হয়েছে!

মডিদের ভাষা জানতেন না ক্যাথার্লি। টোনিও সঙ্গীদের কাছে সমস্ত ঘটনা শুনল, তারপর কম্পিতকণ্ঠে ইংরেজি ভাষায় যে-কাহিনিটি সে পরিবেশন করল তা হচ্ছে এই

নদী থেকে মাছ ধরে মোটবাহকেরা ফিরে আসছিল। হঠাৎ একটা কেপ-বাফেলোর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়ে যায়। মহিষটা খুব ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসে। ওই সময়ে যদি তারা চুপচাপ সরে পড়ত তাহলে বোধ হয় কোনো দুর্ঘটনা ঘটত না। মহিষ কাছে এসে লোকগুলিকে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছিল। খুব সম্ভব কাছাকাছি এসে কৌতূহল নিবৃত্ত করে সে আবার প্রস্থান করত–বিনা কারণে সাধারণত কেপ-বাফেলো মানুষকে আক্রমণ করে না। দুর্ভাগ্যবশত মডিদের মধ্যে একজন মহিষটাকে লক্ষ করে বর্শা ছুড়ল। লোকটির নিক্ষিপ্ত অস্ত্র লক্ষ্য ভেদ করল বটে কিন্তু মহিষ একটুও কাবু হল না–মডিদের মাছ-মারা বর্শার খোঁচায় ওই দুর্দান্ত জানোয়ারের কী হবে!

লাঙ্গি নামক যে-যুবকটি বর্শা নিক্ষেপ করেছিল আহত মহিষ তার দিকেই তেড়ে এল।

দলের সবাই ছুটে গাছে উঠে পড়ল, কিন্তু লাঙ্গি পালাতে পারল না ক্ষিপ্ত মহিষ শিং-এর আঘাতে তার পেট চিরে ফেলল। রক্তাক্ত ও বিদীর্ণ উদর নিয়ে ধরাশায়ী হল লাঙ্গি।

মহিষের ক্রোধ তবু শান্ত হল না–সে ঝাঁপিয়ে পড়ল শত্রুর দেহের ওপর!

বিপুলবপুমহিষের পায়ের তলায় চূর্ণ হয়ে গেল হতভাগ্যের অস্থিপঞ্জর। অনেকক্ষণ ধরে অভাগার দেহের ওপর চলল মহিষাসুরের তাণ্ডবনৃত্য–অবশেষে ওই দানব অদৃশ্য হল অরণ্যের অন্তরালে…

গাছের ওপর যারা ছিল তারা অনেকক্ষণ নীচে নামতে সাহস করেনি। মহিষের প্রস্থানের পর প্রায় তিন ঘণ্টা পরে গাছ থেকে নেমে এল তিনটি ভয়ার্ত মানুষ এবং গাছের ডাল কেটে একটা বিছানা তৈরি করে মৃত সঙ্গীর দেহটাকে সেই কাষ্ঠনির্মিত শয্যায় শুইয়ে দিলে। তারপর সেই অপরূপ শবাধার বহন করে তারা তাবুতে ফিরে আসে..

পরদিন সকালে গুলিভরা রাইফেল হাতে ক্যাথার্লি ওই খুনি মহিষটার অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। নিহত যুবকের বর্শার আঘাতে আহত হয়েছিল মহিষ–ক্ষতস্থান থেকে নিঃসৃত রক্তের চিহ্ন অনুসরণ করে এগিয়ে চললেন শ্বেতাঙ্গ শিকারি, তাঁর সঙ্গে চলল টোনিও এবং আরও দুজন মডি যুবক।

রক্তের চিহ্ন অনুসরণ করতে করতে নদীর ধারে এসে সকলে দেখল একটা মস্ত বাঁশবনের শেষে ঘন পাপিরাস ঘাসের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে রক্তরেখা–

অর্থাৎ ওই ঘাসঝোপের ভিতর আশ্রয় গ্রহণ করেছে মহিষ।

সকলেই বুঝল ওই ঘন ঘাসঝোপের ভিতর পদার্পণ করলে পৈতৃক প্রাণটিকে ওখানেই রেখে আসতে হবে। ক্যাথার্লি সাহসী শিকারি, কিন্তু তিনি শিকার করতে এসেছিলেন, আত্মহত্যা করতে আসেননি–

বাঁশবনের সামনে ঝোপের মুখোমুখি দাঁড়ালেন শিকারি, তাঁর আদেশে টোনিও এবং তার দুই সঙ্গী পাপিরাস ঝোপে আগুন লাগিয়ে দিলে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল, ঝোপটাকে ঘিরে নেচে উঠল লেলিহান অগ্নিশিখা…।

আচম্বিতে জ্বলন্ত ঝোপ ভেদ করে তিনটি মানুষের সামনে আবির্ভূত হল ক্রুদ্ধ মহিষাসুর!

মহিষ ছুটে এল মানুষগুলির দিকে।

গর্জে উঠল ক্যাথার্লির রাইফেল। দুর্ভাগ্যবশত গুলি লাগল মহিষের মাথায়–ইস্পাতের মতো কঠিন অস্থি-আবরণের ওপর ফেটে গেল রাইফেলের টোটা!

দ্বিগুণ বেগে ধেয়ে এল মহিষ!

একজন মডি সভয়ে আর্তনাদ করে উঠল, তারপর পিছন ফিরে পা চালিয়ে দিলে তিরবেগে। অভাগা জানত না যে ধাবমান শিকারের দিকেই সর্বাগ্রে আকৃষ্ট হয় হিংস্র পশু

মহিষ তৎক্ষণাৎ লোকটিকে অনুসরণ করল।

আবার অগ্নদগার করে গর্জে উঠল ক্যাথার্লির রাইফেল উপরি-উপরি দু-বার।

গুলির আঘাতে মহিষ হাঁটু পেতে বসে পড়ল।

যে-লোকটি ছুটে পালাচ্ছিল সে ততক্ষণে প্রায় বাঁশবনের কাছে এসে পড়েছে পিছন দিকে দৃষ্টিপাত করে সে দেখল মহিষ ভূতলশায়ী, সে থেমে গেল।

সগর্জনে উঠে দাঁড়াল মহিষ, শরীরী ঝটিকার মতো ধেয়ে এল পলাতক শিকারের দিকে। মডি যুবক ছুটতে শুরু করল, বাঁশবনের অন্ধকারের গর্ভে অদৃশ্য হয়ে গেল ধাবমান দ্বিপদ ও চতুস্পদ, শিকার ও শিকারি… ।

রাইফেল বাগিয়ে ক্যাথার্লি ছুটলেন তাদের পিছনে।

একটা বাঁক ঘুরতেই ক্যাথার্লি দেখলেন মহিষ প্রায় লোকটির ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। আবার গুলি চালালেন শিকারি, তার লক্ষ্য ব্যর্থ হল। পরক্ষণেই মহিষের নিষ্ঠুর শিং দুটো লোকটিকে মাটির ওপর ফেলে দিল–ক্যাথার্লি দেখলেন নিগ্রো যুবকের পৃষ্ঠদেশ বিদীর্ণ করে আত্মপ্রকাশ করেছে এক ভয়াবহ ক্ষতচিহ্ন!

একবার আর্তনাদ করেই লোকটি মৃত্যুবরণ করল।

মহিষ এইবার ক্যাথার্লির দিকে ফিরল।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে শিকারি সভয়ে আবিষ্কার করলেন তার রাইফেলে আর একটিও গুলি নেই! কম্পিতহস্তে তিনি তাড়াতাড়ি নূতন টোটা ভরার চেষ্টা করতে লাগলেন…

ক্যাথার্লির সামনে এসে পড়ল মহিষ।

তখনও তিনি টোটা ভরার চেষ্টা করছেন–এখনই বুঝি একজোড়া ধারালো শিং-এর আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় শিকারির দেহ…

অকস্মাৎ একটি দীর্ঘাকার মানুষ লাফ দিয়ে ছুটে এল মহিষের দিকে টোনিও!

পিছন দিকে শরীর দুলিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়ল টোনিও–জীবন্ত বিদ্যুৎরেখার মতো শূন্যে রেখা কেটে ছুটে এল তার হাতের বর্শা এবং মুহূর্তের মধ্যে মহিষের চিবুক ভেদ করে চোয়ালের দুই দিকে ঝুলতে লাগল বর্শার লৌহদণ্ড!

মহিষ ওই আঘাত গ্রাহ্যই করল না, নীচু হয়ে ক্যাথার্লির উদ্দেশে প্রচণ্ডবেগে চালনা করল ভয়ংকর দুই শৃঙ্গ

কিন্তু ব্যর্থ হল তার আক্রমণ।

তার চোয়ালে আবদ্ধ বর্শার দুই প্রান্ত আটকে গেল দু-পাশের বাঁশগাছে।

শিং-এর পরিবর্তে তার মাথাটা ধাক্কা মারল শিকারির দেহে এবং সেই দারুণ ধাক্কায় ছিটকে। মাটির ওপর চিৎপাত হয়ে পড়ে গেলেন ক্যাথার্লি।

মহিষ তার শিং দুটিকে নামিয়ে আবার শিকারির দেহে আঘাত করার চেষ্টা করল।

তার চেষ্টা সফল হল না। চোয়ালে আবদ্ধ সুদীর্ঘ লৌহখণ্ডের দুই প্রান্ত আবার আটকে গেল ধরাশায়ী শিকারির দুই পাশে অবস্থিত ঘনসন্নিবিষ্ট বাঁশগাছের গায়ে।

বার বার সজোরে ঝাঁকানি দিয়েও ক্রুদ্ধ মহিষ বর্শাটাকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারল না, তার চোয়াল বিদ্ধ করে মুখের দু-পাশে কাঁপতে লাগল টোনিওর বর্শা–এদিকে চার ফুট, ওদিকে চার ফুট!

ক্যাথার্লি তখনও প্রাণের মায়া ছাড়েননি, কম্পিত হস্তে তখনও রাইফেলের টোটা ভরতে চেষ্টা করছেন।

কিন্তু তার চেষ্টা বুঝি সফল হয় না–

মহিষ হঠাৎ পিছনের দুই পায়ে উঠে দাঁড়াল, এইবার তার সামনের দুই পা প্রচণ্ড বেগে এসে পড়বে শিকারির বুকের ওপর, সঙ্গেসঙ্গে ভেঙে যাবে শিকারীর বক্ষপঞ্জর

ঠিক সেই মুহূর্তে ছুটে এল টোনিও, তারপর মহিষের মুখের দু-ধারে বিদ্ধ বর্শাদণ্ডের এক প্রান্ত ধরে মারল হাচটা টান!

কী অসীম শক্তি সেই বন্য যুবকের দেহে দারুণ আকর্ষণে ঘুরে গেল মহিষ, আবার ব্যর্থ হল তার আক্রমণ!

ভীষণ আক্রোশে ঘুরে দাঁড়িয়ে নূতন শক্তিকে আক্রমণ করার উপক্রম করল মহিষাসুর, আর সঙ্গেসঙ্গে ক্যাথার্লির রাইফেল সগর্জনে অগ্নিবর্ষণ করল।

কর্ণমূল ভেদ করে রাইফেলের গুলি মহিষের মস্তিষ্কে বিদ্ধ হল, পরমুহূর্তেই মাটির ওপর লুটিয়ে পড়ল সেই ভয়ানক জানোয়ারের প্রাণহীন দেহ।

এতক্ষণ পরে ক্যাথার্লি তার রাইফেলে গুলি ভরতে পেরেছেন!

ক্যাথার্লির মতোই আর একজন সাদা চামড়ার মানুষ স্থানীয় নিগ্রোদের অদ্ভুত সাহসের পরিচয় পেয়ে চমকে গিয়েছিলেন। ওই ভদ্রলোকের নাম কম্যান্ডার এ গন্ডি। তিনি ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একজন সৈনিক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর পূর্বোক্ত সৈনিক কিছুদিন আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছিলেন। সেই সময় আফ্রিকার অ্যাংকোল জাতীয় নিগ্রো শিকারিদের মহিষ শিকারের কৌশল স্বচক্ষে দেখেছিলেন তিনি। মানুষ যে ঠান্ডা মাথায় কতখানি সাহসের পরিচয় দিতে পারে, স্নায়ুর ওপর তার সংযম যে কত প্রবল হতে পারে, তা দেখেছিলেন কম্যান্ডার গন্ডি–ধনুর্বাণধারী এক অ্যাংকোলে শিকারির বীরত্ব তাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।

তদানীন্তন বেলজিয়ান কঙ্গের যে অঞ্চলে অ্যাংকোলে জাতি বাস করত, সেই জায়গাটা প্রধানত বন্য মহিষের বাসভূমি। বামন মহিষ নয়, অতিকায় মহিষাসুর কেপ-বাফেলোর ভয়াবহ উপস্থিতি অরণ্যকে করে তুলেছে বিপজ্জনক। অ্যাংকোলে নিগ্রোদের ভাষায় পূর্বোক্ত অতিকায় মহিষের নাম জোবি। স্থানীয় মানুষ অর্থাৎ অ্যাংকোলে জাতির নিগ্রোরা খুব লম্বা-চওড়া নয়–বেঁটেখাটো, রোগা ও অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির এই মানুষগুলোকে দেখলে অপরিচিত বিদেশির পক্ষে ধারণা করা সম্ভব নয় যে, প্রয়োজন হলে ওই ছোটোখাটো মানুষগুলো কতখানি দুঃসাহসের পরিচয় দিতে পারে। আফ্রিকার অন্যান্য স্থানে নিগ্রোরা ফাঁদ পেতে অথবা মহিষের চলার পথে গর্ত খুঁড়ে মহিষ-শিকারের চেষ্টা করে, কিন্তু অ্যাংকোলে-শিকারি অমন নিরাপদ পন্থায় শিকারকে ঘায়েল করার পক্ষপাতী নয়। কোন বিস্তৃত যুগে অ্যাংকোলে জাতির পূর্বপুরুষ আবিষ্কার করেছিল মহিষ-চরিত্রের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য–মরা মানুষকে মহিষ আঘাত করে না। তারপর থেকেই যুগযুগান্তর ধরে অ্যাংকোলে শিকারিরা যে পদ্ধতিতে মহিষ শিকার করে থাকে, সেই বিপজ্জনক পদ্ধতির অনুসরণ করার সাহস অন্য কোনো জাতিরই নেই। কম্যান্ডার গণ্ডি একবার অ্যাংকোলে জাতির মহিষ-শিকারের কায়দা দেখেছিলেন। সমস্ত ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখার পর তিনি বলেছিলেন, সাদা কিংবা কালো চামড়ার অন্য কোনো জাতির শিকারি ওইভাবে অপঘাত মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে সাহস করবে না। নিজের সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে কম্যান্ডার সাহেব জানিয়েছিলেন, পৃথিবীর সেরা লক্ষ্যভেদী শিকারি যদি কাছেই রাইফেল বাগিয়ে বসে থাকে, তাহলেও অ্যাংকোলে জাতির পদ্ধতিতে মহিষ শিকার করতে তিনি রাজি নন।

ঘটনাটা এইবার বলছি। একটি ছোটোখাটো চেহারার অ্যাংকোলে শিকারি কম্যান্ডার গণ্ডিকে তাদের মহিষ-শিকারের পদ্ধতি দেখাতে রাজি হয়েছিল। অবশ্য লোকটি আগে সাহেবের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিল যে, কোনো কারণেই তিনি উক্ত শিকারিকে বাধা দিতে পারবেন না এবং শোচনীয় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা দেখলেও গুলি চালাবেন না। একটা উঁচু গাছের ওপর কম্যান্ডার সাহেব যখন বসলেন, তখনই অ্যাংকোলে-শিকারি তার কর্তব্যে মনোনিবেশ করল।

মুক্ত প্রান্তরের উপর এখানে-ওখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল ছোটো ছোটো হলুদ রং-এর ঘাসঝোপ। ওইরকম একটি ঘাসঝোপের ভিতর ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটি। অস্ত্রের মধ্যে তার সঙ্গে ছিল তির-ধনুক আর একটা ছোটো ছুরি।

গাছের উপর থেকে খুব মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে সাহেব আবিষ্কার করলেন, দূর প্রান্তরের সীমানায় যেখানে এক সারি সবুজ ঘাস আত্মপ্রকাশ করেছে, সেইখানে বিচরণ করছে অনেকগুলো কৃষ্ণকায় চতুষ্পদ মূর্তি–মহিষ!

প্রান্তরের বুকে তৃণভোজনে ব্যস্ত মহিষযুথের পিছনে বাঁ-দিকে অবস্থান করছে এক ভীষণদর্শন পুরুষ মহিষ। সাহেব বুঝলেন ওই জন্তুটাই হচ্ছে দলের প্রহরী এবং অ্যাংকোলে-শিকারির লক্ষিত জোবি–ওকেই হত্যা করার চেষ্টা করবে ছোটোখাটো মানুষটি।

গাছের ওপর থেকে সাহেব দেখলেন ঘাসঝোপের ভিতর থেকে হঠাৎ মহিষের খুব কাছেই আবির্ভূত হল একটি মনুষ্যমূর্তি–অ্যাংকোলে-শিকারি!

লোকটি হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। গাছের ওপর থেকে তার শরীরটা সাহেবের দৃষ্টিগোচর হলেও মাটিতে দাঁড়িয়ে মহিষের পক্ষে লোকটিকে দেখা সম্ভব ছিল না। লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে চটপট ধনুক থেকে তির নিক্ষেপ করে মাটিতে শুয়ে পড়ল। ধনুকের টংকার-শব্দ সাহেবের কানে এল। সঙ্গেসঙ্গে একটা সংঘাতের আওয়াজ এবং জান্তব কণ্ঠে অস্ফুট ধ্বনি–মহিষের স্কন্ধে বিদ্ধ হয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে একটা তির।

সর্বনাশ, সাহেব মনে মনে বললেন, এইবার তিরবিদ্ধ মহিষ নিশ্চয়ই হাঁক দিয়ে দলকে সংকেত জানাবে। সেই শব্দ শোনামাত্র মহিষের দলটা ছুটে আসবে অ্যাংকোলে-শিকারির দিকে।

সে-রকম কিছু হল না। আহত মহিষ একটা অস্পষ্ট আওয়াজ করল, বিরক্তভাবে দুই-একবার মাথা নাড়ল, মনে হল একটা বিরক্তিকর মাছিকে সে তাড়াতে চেষ্টা করছে–তারপর চারদিকে সঞ্চালিত করল তীক্ষ্ণদৃষ্টি যেন এক গোপন শত্রুকে সে আবিষ্কার করতে চাইছে!

উদবেগজনক কয়েকটি মুহূর্ত… মহিষযূথ সরে যাচ্ছে দূরে… সঙ্গীদের গতিবিধি লক্ষ করছে তিরবিদ্ধ মহিষ। সে এখনও বুঝতে পারছে না সঙ্গীদের অনুসরণ করা উচিত, না তাদের ফিরেআসার জন্য হাঁক দেওয়া উচিত। মহিষ তার কর্তব্য স্থির করার সময় পেল না, আংকোলে শিকারি নি মাটিতে। দ্বিতীয় তিরটা ঘাড়ের ওপর লোকটিকে সে দেখতে পায়নি বটে, তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে আবার বলল তির ছুড়ল, তারপর শুয়ে পড়ল মাটিতে। দ্বিতীয় তিরটা ঘাড়ের ওপর বিঁধতেই খেপে গেল মহিষ। লোকটিকে সে দেখতে পায়নি বটে, কিন্তু শ্রবণেন্দ্রিয়ে ধরা পড়েছে ধনুকের অস্পষ্ট টংকার ধ্বনি–শব্দের দিকনির্ণয় করতেও মহিষের ভুল হল না।

যেদিক থেকে শব্দ এসেছে, সেইদিকেই ছুটল মহিষ… কিন্তু সোজা নয়–বৃত্তের আকারে গোল হয়ে ঘুরে জন্তুটা সঙ্গেসঙ্গে মাথা উঁচুকরে বাতাস থেকে শত্রুর গায়ের গন্ধ পাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। সাহেব যে গাছটার উপর আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই গাছ আরশায়িত নিগ্রো শিকারির মধ্যবর্তী স্থানের মাঝামাঝি এসে মহিষ বোধ হয় মানুষের গায়ের গন্ধ পেল, সে থমকে দাঁড়াল, বার বার বাতাসে ঘ্রাণ গ্রহণ করল তারপর আবার কয়েক পা এগিয়ে বাতাস শুঁকতে লাগল… অবশেষে মানুষটাকে সে আবিষ্কার করে ফেলল। ঠিক যে জায়গায় নিগ্রো শিকারি, সেই দিকেই ছুটল মহিষ। দিকনির্ণয়ে তার একটুও ভুল হয়নি, পদভরে মাটি কাঁপিয়ে সে ধেয়ে এল উল্কাবেগে।

গাছের উপর থেকে সাহেবের মনে হল, ধরাশায়ী মানুষটার ওপর এসে পড়েছে একজোড়া প্রকাণ্ড শিং, এই বুঝি হতভাগ্য শিকারিকে মাটিতে গেঁথে দেয় একজোড়া জান্তব তরবারি। কিন্তু সেই রক্তাক্ত দৃশ্যে সাহেবের দৃষ্টি পীড়াগ্রস্ত হওয়ার আগেই অকুস্থল থেকে একটি ধুলোর মেঘ লাফিয়ে উঠে তার দৃষ্টিশক্তিকে আচ্ছন্ন করল। একটু পরেই জোর বাতাসের ধাক্কায় সরে গেল ধুলো। সাহেব দেখলেন, অ্যাংকোলে-শিকারি অক্ষত অবস্থায় মাটিতে আর তার সামনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে মহিষ। জন্তুটা অস্থিরভাবে মাটিতে পদাঘাত করছে এবং তার নাসিকা ও কণ্ঠ থেকে উদগীর্ণ হচ্ছে অবরুদ্ধ রোষের ভয়াবহ ধ্বনি।

কম্যান্ডার সাহেব স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দেখলেন মহিষ পিছন ফিরল। কিন্তু না–অত সহজে রেহাই দিল না যমদূত ক্ষণিকের জন্য লাফিয়ে সরে গিয়েছিল মহিষ, তৎক্ষণাৎ ঘুরে এসে আবার মানুষটাকে পরীক্ষা করতে লাগল সে।

লোকটি একটুও নড়ছে না, তার ধরাশায়ী দেহে কোথাও জীবনের লক্ষণ নেই। তার সর্বাঙ্গে পড়ছে মহিষের তপ্ত নিশ্বাস, কানে আসছে রক্ত-জল-করা গর্জনধ্বনি, খুরের আঘাতে কাঁপছে তার পাশের মাটি–তবু অ্যাংকোলে-শিকারির দেহ নিস্পন্দ, নিশ্চল!

সাহেব অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, নিজের ওপর কতখানি কর্তৃত্ব থাকলে ওই অবস্থায় মড়ার ভান করে পড়ে থাকা যায়!

অনেকক্ষণ পরীক্ষা করার পর মহিষ ফিরে গেল। লোকটি তখনও ধরাশয্যা ত্যাগ করার চেষ্টা করল না। ভালোই করল, কারণ, একটু দূরে গিয়েই আবার ফিরল মহিষ। আগের মতোই শায়িত মনুষ্যদেহের চারপাশে চলল মহিষাসুরের আস্ফালন, পরীক্ষা-নিরীক্ষণ, তারপর আবার ফিরে অন্য দিকে হাঁটতে শুরু করল জন্তুটা।

সাহেবের সর্বাঙ্গ দিয়ে তখন ঘাম ছুটছে। তিনি এতক্ষণে বুঝেছেন কেন অ্যাংকোলে জাতি এমন বিপজ্জনক পদ্ধতিতে মহিষ শিকার করে। তিরের বিষ মহিষের দেহে প্রবেশ করার অনেক পরে তার মৃত্যু হয়। এক-শো ফুটের বেশি দূর থেকে তির ছুঁড়ে মহিষকে কাবু করা সম্ভব নয়–কারণ, দূরত্ব বেশি হলে নিক্ষিপ্ত তিরের আঘাত করার ক্ষমতা কমে যায়। এক-শো ফুটের মধ্যে গাছে উঠে মহিষকে আঘাত করাও অসম্ভব–তিরের নাগালের মধ্যে আসার আগেই মহিষের দৃষ্টি বৃক্ষে উপবিষ্ট শিকারির দিকে আকৃষ্ট হবে এবং সে সবেগে স্থান ত্যাগ করবে, এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। মাটিতে দাঁড়িয়ে কোনো গোপন স্থান থেকে মহিষকে তিরবিদ্ধ করলে শিকারির মৃত্যু অনিবার্য; মহিষের তিনটি ইন্দ্রিয়ই শক্তিশালী চক্ষু-কর্ণ-নাসিকার ত্র্যহস্পর্শ যোগে মহিষ চটপট শিকারির অস্তিত্ব আবিষ্কার করে তার দিকে ধাবিত হবে এবং তিরের বিষ মহিষের রক্তে সঞ্চারিত হয়ে তার মৃত্যু ঘটানোর আগেই তীক্ষ্ণ শিং আর খুরের আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত এক মাংসপিণ্ডে পরিণত হবে শিকারির দেহ! ছুটে পালানো সম্ভব নয়, মানুষ আর মহিষের দৌড় প্রতিযোগিতায় মানুষের জয়লাভের কোনো আশাই নেই!

মৃতদেহের প্রতি মহিষের অহিংস মনোভাবের সুযোগ গ্রহণ না-করলে অ্যাংকোলে-শিকারির পক্ষে অন্য কোনো উপায়ে মহিষ-মাংস সংগ্রহ করা সম্ভব নয়, সেইজন্যই ধনুর্বাণ-সম্বল অ্যাংকোলে জাতি এমন বিপজ্জনকভাবে মহিষ শিকারে প্রবৃত্ত হয়।

আচ্ছা, এইবার কাহিনির পূর্ব সূত্র ধরে দেখা যাক আমাদের পরিচিত অ্যাংকোলে-শিকারির ভাগ্যে কী ঘটল। মহিষ আরও কয়েকবার শিকারির কাছে এসে ফিরে গেল–পাঁচ-পাঁচ বার ওইভাবে ছুটোছুটি করার পর মহিষ যখন আরও একবার ঘুরে আসছে, সেই সময় সাহেব দেখলেন জন্তুটা হঠাৎ হাঁটু পেতে বসে পড়ল–তারপর এক ডিগবাজি খেয়ে সশব্দে শয্যাগ্রহণ করল মাটির ওপর, আর উঠল না।

সাহেব বুঝলেন মহিষের মৃত্যু হল, এতক্ষণ পরে কার্যকরী হয়েছে তিরের বিষ!

মহিষের মৃতদেহ থেকে প্রায় পনেরো ফুট দূরে শায়িত একটা নিশ্চল মনুষ্যমূর্তি হঠাৎ সচল হয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর দূরবর্তী মহিষফুথের প্রস্থানপথের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সর্বাঙ্গ থেকে ধুলো ঝেড়ে ফেলল এবং শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো টান করে আড়ষ্টভাব কাটিয়ে নিয়ে বাঁ-হাতে আটকানো খাপ থেকে ছুরিটা টেনে নিল। বৃদ্ধাঙ্গুলির উপর একবার ছুরির ধার পরখ করে নিয়ে অ্যাংকোলে-শিকারি তার পরবর্তী কর্মসূচি অনুসরণ করতে উদ্যত হল।

গাছ থেকে নেমে কম্যান্ডার সাহেব যখন লোকটির কাছে এসে পৌঁছালেন, সে তখন অভ্যস্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে জোবির মৃতদেহ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত। লোকটির ভাবভঙ্গি দেখে সাহেবের মনে হল সে যেন খুব সহজভাবে একটা দোকানে বসে কসাই-এর কর্তব্য করছে তার নির্লিপ্ত আচরণ দেখে কে বলবে একটু আগেই তার শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছিল মূর্তিমান মৃত্যুদূত।

লোকটি মাথা না-তুলেই সাহেবের উপস্থিতি অনুভব করল, নিবিষ্ট চিত্তে মৃত পশুর চামড়াতে ছুরি চালাতে চালাতে সে বলল, একটু পরেই আমার পরিবারের সবাই এখানে এসে পড়বে। সূর্য ডুবে যাওয়ার আগেই এই চমৎকার মাংস তারা ঘরে নিয়ে যাবে।

সাহেব বললেন, কিন্তু জোবির বদলে যদি তারা তোমার মরা শরীরটা পড়ে থাকতে দেখত, তাহলে কী হত?

নির্বিকারভাবে শিকারি উত্তর দিল, তাহলে আমার পরিবারের লোকরা ছেঁড়াখোঁড়া শরীরের টুকরোগুলো নিয়ে গ্রামের পিছনে পুঁতে ফেলত। ওইখানে কোনো খারাপ প্রেতাত্মা যায় না।

[বৈশাখ ১৩৭৬]

অস্ট্রেলিয়ার লাল আতঙ্ক

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার ওয়ারুনা উপত্যকার বুকে একদিন প্রভাতের শান্ত নীরবতা ভঙ্গ করে জেগে উঠল মেষশাবকের করুণ আর্তস্বর!

পূর্ব দিগন্তে সবেমাত্র আত্মপ্রকাশ করেছে প্রভাতসূর্য, এমন সময়ে পূর্বোক্ত মেষশাবকের আর্তনাদ লক্ষ করে এগিয়ে এল এক অশ্বারোহী মেষরক্ষক।

এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে মেষরক্ষক চতুর্দিক নিরীক্ষণ করল, তারপর ঘোড়া থামিয়ে সে অবতীর্ণ হল মাটির ওপর।

একটি মেষশাবক কাতর স্বরে আর্তনাদ করতে করতে তার দিকে এগিয়ে এল, কিন্তু অশ্বারোহী তার দিকে নজর দিল না–

চতুর্দিকে অবস্থিত মেষপালের দিকেই নিবদ্ধ হয়েছে অশ্বারোহীর দৃষ্টি।

হ্যাঁ, ভেড়ার দলটা সেখানেই ছিল। যে বিস্তীর্ণ তৃণভূমিকে লোহার জাল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে তারই মধ্যে এককোণে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে আছে একদল ভেড়া; হঠাৎ দেখলে মনে হয় কোনো অদৃশ্য মেষপালক জন্তুগুলিকে ওইভাবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।

পূর্বোক্ত তৃণভূমির উপর আরও যে ভেড়াগুলির দিকে অশ্বারোহীর দৃষ্টি পড়েছে তারা কিন্তু এক জায়গায় দণ্ডায়মান নয়! ঘাসজমির উপর এখানে-ওখানে ছড়িয়ে থাকা কুড়িটা ভেড়ার মধ্যে অধিকাংশের দেহেই প্রাণের চিহ্ন নেই, দু-একটা জন্তু কেবল মৃত্যুযাতনায় ছটফট করছে! চারদিকে খালি রক্ত আর রক্ত–অদৃশ্য আততায়ী রাতের অন্ধকারে হত্যালীলা চালিয়ে আবার অন্ধকারেই আত্মগোপন করেছে।

এই রক্তাক্ত ও ভয়াবহ দৃশ্যের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে অশ্বারোহী ঘোড়া ছুটিয়ে চলল তার আস্তানার দিকে…।

দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে একটু পরেই সদলবলে অকুস্থলে উপস্থিত হলেন ওয়ারুনার মেষপালের মালিক। তাঁর নির্দেশে মৃত জন্তুগুলির রোমশ চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে মাংসপিণ্ডগুলিকে অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে সমর্পণ করা হল। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কে বা কারা দায়ী সে-কথা বুঝতে অবশ্য কারো অসুবিধা হয়নি; কারণ অস্ট্রেলিয়ার অরণ্যে একমাত্র বিভীষিকা হচ্ছে ডিংগো (Dingo) নামক একধরনের বুনো কুকুর–বাঘ, ভালুক, সিংহ প্রভৃতি শ্বাপদ এখানে অনুপস্থিত। ডিংগোর আক্রমণে প্রতি বৎসরই বহুসংখ্যক মূল্যবান ভেড়া প্রাণ হারায়, তাই অস্ট্রেলিয়ার মেষপালকরা বাধ্য হয়ে বিস্তীর্ণ তৃণভূমির চারদিক লোহার জাল দিয়ে ঘিরে ভেড়াগুলিকে ওই আবেষ্টনের ভিতর ছেড়ে দেয়। ওয়ারুনার মালিকও ভেড়াগুলিকে লোহার জাল দিয়ে ঘিরে নিশ্চিন্ত ছিলেন। কিন্তু পূর্বোক্ত আবেষ্টনের ভিতর যে ষাঁড়টা ছিল সে একদিন তো মেরে লোহার জালের একস্থানে ছিদ্রের সৃষ্টি করল। ডিংগোটা সেই ফাঁক দিয়ে ভিতরে এসে এক রাতের মধ্যেই তেইশটা স্ত্রীজাতীয় মেষ ও মেষশাবকের প্রাণ হরণ করে। নিহত মেষগুলির দেহ পরীক্ষা করে দেখা গেছে মাত্র চারটি ভেড়ার কিডনি ভক্ষণ করেছে জন্তুটা, অন্য ভেড়াগুলিকে সে হত্যা করেছে কেবল হত্যার আনন্দ চরিতার্থ করার জন্যে।

যে-ষাঁড়টা লোহার জালে ঢুঁ মেরে বেড়া ভেঙে ফেলেছিল এবং যার জন্য এতগুলো মূল্যবান ভেড়ার প্রাণহানি ঘটল, সেই হতভাগা ষাঁড়টাকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হল। তারপর ছিদ্রটাকে ভালো করে মেরামত করিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন ওয়ারুনার মেষপালের মালিক।

কিন্তু ছয় সপ্তাহ পরেই একদিন সকালে জনৈক অশ্বারোহী মেষরক্ষক লোহার জালের গায়ে একটা ফুটো দেখতে পায়। পরীক্ষা করে দেখা গেল ধারালো দাঁতের সাহায্যে লোহার জাল কেটে ওই ছিদ্র সৃষ্টি করা হয়েছে!

অকুস্থলে এসে ছাদাটা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন ওয়ারুনার মালিক। ওই শক্ত লোহার জাল দাঁত দিয়ে কেটে ফেলা ডিংগোর পক্ষে প্রায় অসম্ভব, কিন্তু এই শয়তান ডিংগোটা অসম্ভবকেও সম্ভব করে ফেলেছে!

যে-ডিংগোটা জাল ফুটো করেছে পূর্ববর্তী হত্যাকাণ্ডের জন্য যে সেই জন্তুটাই দায়ী এ-বিষয়ে মালিকের সন্দেহ ছিল না; কারণ ডিংগো-চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যেখানে একবার সে শিকার সংগ্রহ করে সেখানে আবার সে ছয় সপ্তাহের মধ্যে ফিরে আসবেই আসবে। এখানেও দ্বিতীয়বার জন্তুটার আবির্ভাব ঘটেছিল ছয় সপ্তাহের মধ্যে এবং ভিতরে প্রবেশ করার জন্য সে একই উপায় অবলম্বন করেছিল। অতএব অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই অনুমান করতে পারবেন যে একটা জানোয়ার বার বার এখানে হামলা করতে আসছে এবং এই ভয়ানক ডিংগোটার কাছে লোহার জালও দুর্ভেদ্য নয়!

মালিক বুঝলেন, জন্তুটা ভয়ংকর শক্তিশালী, অবিলম্বে এই খুনিটাকে শেষ করতে না-পারলে তাঁর পোষা ভেড়াগুলিকে তিনি রক্ষা করতে পারবেন না।

জালের ফুটো মেরামত না-করে ওয়ারুনার মালিক ফুটোর মুখে একটা ইস্পাতের ফাঁদ সাজিয়ে রাখলেন। শুধু তাই নয়, কয়েকটা নিহত ভেড়ার কিডনিতে বিষ মাখিয়ে সেই বিষাক্ত কিডনিগুলোকে আশেপাশে ছড়িয়ে দেওয়া হল। মালিক সেই রাত্রে নিশ্চিন্ত হয়েই শয্যা আশ্রয় করেছিলেন, পরের দিন সকালে উঠে তিনি যে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ডিংগোটাকে দেখতে পাবেন এ-বিষয়ে তার একটুও সন্দেহ ছিল না।

কিন্তু পরের দিন সকালে ফাঁদের কাছে এসে ওয়ারুনার মালিক হয়ে গেলেন হতভম্ব!

বিষাক্ত কিডনিগুলোকে স্পর্শও করেনি জন্তুটা, কিন্তু ফাঁদের মধ্যে আটকে রয়েছে লালচে-বাদামি রং-এর একটা কুকুরের ঠ্যাং!

ব্যাপারটা কী হয়েছিল খুব সহজেই অনুমান করা যায়–ফাঁদের মধ্যে আটকে গিয়েছিল ডিংগোর একটা পা এবং প্রাণপণ চেষ্টাতেও শ্রীচরণকে ফাঁদের করাল দংশন থেকে মুক্ত করতে না-পেরে দাঁত দিয়ে চিবিয়ে পা-টিকে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে পলায়ন করেছে ডিংগো!

ফাঁদের মধ্যে আটকানো কাটা ঠ্যাংটার লালচে বাদামি রং দেখে স্থানীয় অধিবাসীরা জন্তুটার নাম রাখল রেড কিলার বা লাল খুনি!

কিছুদিন ধরে স্থানীয় মানুষ জন্তুটাকে নিয়ে মাথা ঘামাল; ওই লাল রং-এর খুনি জানোয়ার আবার ভেড়ার দলের উপর হানা দেবে কি না এই নিয়ে মেষরক্ষকদের মধ্যে চলল তুমুল তর্ক ও আলোচনা কিন্তু পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেও যখন কুকুরটা আর আত্মপ্রকাশ করল না তখন সকলে তার কথা ভুলে গেল…

কিন্তু হঠাৎ একদিন স্থানীয় পশুপালক ও মেষরক্ষকদের গতানুগতিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত করে ওয়ারুনা উপত্যকার বুকে আবার হানা দিল মূর্তিমান অভিশাপের মতো রেড কিলার!

..প্রতিদিনের অভ্যাস অনুযায়ী এক ব্যক্তি তার গোরুটাকে দোহন করে দুগ্ধ সংগ্রহ করতে এসেছিল। দুধের বালতি হাতে নিয়ে গোয়ালের দরজাটা সে খুলে ফেলল, সঙ্গেসঙ্গে স্তম্ভিত বিস্ময়ে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল–তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে এক ভয়াবহ দৃশ্য!

রক্তাক্ত দেহে জিভ বার করে অতিকষ্টে নিশ্বাস ফেলছে গোরুটা এবং তার সামনেই প্রাণহীন অবস্থায় পড়ে আছে একটা ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত গো-বৎস!

জমি পরীক্ষা করে দেখা গেল একটা ভীষণ লড়াই হয়েছে। আক্রমণকারীর কবল থেকে গোরুটা তার বাছুরকে রক্ষা করার জন্য খুবই চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার চেষ্টা সফল হয়নি। আক্রমণকারী জীবটি গোরুটার পিছনের পায়ের একটি শিরা কেটে তাকে অকর্মণ্য করে অসহায় বাছুরটাকে হত্যা করেছে। গোরুটা যে শুধু খোঁড়া হয়ে চলৎশক্তি হারিয়েছে তাই নয়, উপরন্তু তীক্ষ্ণ দন্তাঘাতে তার সর্বাঙ্গ হয়েছে রক্তাক্ত এবং লাঙ্গুলের অর্ধ-অংশ হয়েছে বিচ্ছিন্ন! হত্যাকারী বাছুরটার মাংস ভক্ষণ করেনি, কিন্তু নিহত গো-শাবকের হৃৎপিণ্ড উপড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলেছে।

দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও গোয়ালের ভিতর হত্যাকারীর প্রবেশ ঘটল কীভাবে?

অনুসন্ধানের ফলে জানা গেল বেড়ার গায়ে ফুটো করে হত্যাকারী ভিতরে ঢুকেছিল এবং জমির উপর পদচিহ্ন পরীক্ষা করে সকলেই বুঝল, যে হিংস্র শ্বাপদ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী সে মাত্র তিনটি পা-র অধিকারী; অর্থাৎ এবারের হত্যালীলার জন্যও দায়ী হচ্ছে রেড কিলার!

তিনটি মাত্র ঠ্যাং-এর ওপর ভর দিয়েই খুনি জানোয়ারটা আবার হত্যার আসরে আবির্ভূত হয়েছে।

এই ঘটনার পর স্থানীয় পশুপালক ও মেষরক্ষকরা অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়ল।

অস্ট্রেলিয়ার গভর্নমেন্ট হঠাৎ ডিংগো সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠলেন। এই বুনো কুকুরগুলো প্রতি বৎসরই বহু মূল্যবান মেষ হত্যা করে, ফলে পশম রপ্তানি হয় অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত এবং গভর্নমেন্টকেও বেশ কিছুটা আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হয়।

–অস্ট্রেলিয়ার গভর্নমেন্ট এই সময়ে প্রতি ডিংগোর মাথা পিছু তিন পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করলেন। সরকারের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্বে উল্লিখিত ওয়ারুনার পশুপালকও রেড কিলার-এর মাথার উপর পাঁচ পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করলেন। উক্ত পশুপালকের দুই প্রতিবেশীও জানালেন জন্তুটাকে যে হত্যা করতে পারবে তাকে পুরস্কার দিতে তারাও রাজি আছেন।

সব নিয়ে মোট পুরস্কারের অঙ্ক হল পনেরো পাউন্ড। টাকার অঙ্কটা খুব কম নয়।

টাকার লোভে পেশাদার শিকারিরা ডিংগোটাকে হত্যা করতে সচেষ্ট হল। কিন্তু শিকারির ফাঁদ এবং বন্দুকের গুলিকে ফাঁকি দিয়ে অদ্ভুত চাতুর্যের সঙ্গে বুনো কুকুরটা গৃহপালিত পশুদের উপর হামলা চালাতে লাগল, কিছুতেই তাকে জব্দ করা গেল না। বিষাক্ত মাংসের টোপ দিয়েও তাকে প্রলুব্ধ করা যায়নি; রাতের পর রাত জেগে গাছের উপর পাহারা দিয়েছে বন্দুক হাতে শিকারির দল, কিন্তু কুরকুরটা তাদের অনায়াসে ফাঁকি দিয়েছে বারংবার!

রেড কিলার-এর উদ্দেশে পাতা ফাঁদের মধ্যে ধরা পড়ল ক্যাঙারু, ওয়ালবি প্রভৃতি জানোয়ার, এমনকী কয়েকটা ডিংগোও শিকারিদের ফঁদে ধরা পড়েছিল কিন্তু যার জন্য এত আয়োজন সেই তিন-পা-ওয়ালা শয়তানটা কোনো ফাঁদের আলিঙ্গনে বন্দি হল না, একটা পা হারিয়ে জন্তুটা অসম্ভব সতর্ক হয়ে গেছে।

হঠাৎ একদিন গা-ঢাকা দিল অস্ট্রেলিয়ার লাল আতঙ্ক। দীর্ঘদিন ধরে জন্তুটার কোনো খোঁজখবর না-পেয়ে পশুপালকরাও নিশ্চিন্ত হলেন–গোরুভেড়ার অকালমৃত্যুতে তাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আর রইল না।রেড কিলার নামক জন্তুটার কথা লোকে প্রায় ভুলেই গেল…

খুনি জন্তুটা আবার যেদিন নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করল সেই ভয়াবহ দিনটির কথা একটি মানুষের স্মৃতির কোঠায় চিরদিনই বিরাজ করবে ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্নের মতো।

ওয়ারুনার জনৈক অশ্বচালক একদিন ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে একটা মেষ-চারণভূমিতে এসে থামল এবং গাড়ি থেকে নেমে উক্ত ঘাসজমির আগাছা পরিষ্কার করতে শুরু করল।

ঘোড়ায়-টানা গাড়িটার পিছন পিছন লোকটিকে অনুসরণ করে পোষা টেরিয়ার কুকুরটিও সেখানে এসে উপস্থিত হল। কুকুরটাকে তার প্রভু খুবই ভালোবাসত, তাই জন্তুটাও সহজে প্রভুর সান্নিধ্য ত্যাগ করতে চাইত না।

হঠাৎ টেরিয়ার কুকুরটার হিংস্র গর্জন শুনে তার মালিক চমকে উঠল। লোকটি অবাক হয়ে দেখল কুকুরটার গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে এবং তার সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে নিকটবর্তী ঝোপটার দিকে। লোকটি উঠে গিয়ে ঝোপের ভিতরটা দেখে এল, কিন্তু একটা গিরগিটি ছাড়া কুকুরটার ক্রোধের উদ্রেক করতে পারে এমন কোনো জীবের সাক্ষাৎ পেল না। ফিরে এসে লোকটি আবার নিজের কাজে মনোনিবেশ করল।

একটু পরেই আবার টেরিয়ার কুকুরটা সশব্দে মালিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এবার কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে ক্রোধ বা বিরক্তির আভাস ছিল না, দারুণ আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে কুকুরটা আর্তনাদ করছিল রুদ্ধস্বরে!

লোকটি অবাক হয়ে ভাবল ঝোপের ভিতর তো কিছুই নেই, তবে জন্তুটা এত ভয় পেল কেন? একবার ঝোপের ভিতর পর্যবেক্ষণ করে লোকটি কিছুই দেখতে পায়নি, তাই এবার সে কাজ ছেড়ে টেরিয়ার কুকুরটার আতঙ্কের কারণ অনুসন্ধান করতে এগিয়ে গেল না। একটু পরে কাজ শেষ করে সে ঘোড়াগুলোর মুখ ঘুরিয়ে গাড়িটাকে ঘাসজমির অন্য প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার উদযোগ করল আর ঠিক তখনই ঝোপটার দিকে হঠাৎ নজর পড়তেই সে টেরিয়ার কুকুরটার আতঙ্কের কারণটা বুঝতে পারল।

ঝোপের ভিতর থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে একটা অতিকায় ডিংগো! লালচে-বাদামি রং-এর ডিংগোটার জ্বলন্ত দুই চক্ষুর হিংস্র দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে টেরিয়ার কুকুরটার দিকে।

এমন বৃহৎ বপু ডিংগো-কুকুর ইতিপূর্বে অশ্বচালকের দৃষ্টিগোচর হয়নি। প্রায় তিন ফুট উঁচু এই সারমেয়-দানবের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি ডিংগোর মতোই বটে কিন্তু ক্যাঙারু-হাউন্ড নামক অতি বৃহৎ শিকারি কুকুরের সঙ্গেও তার যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে।

অশ্বচালক বুঝল এই বর্ণ সংকর ভয়াবহ জন্তুটার জন্ম হয়েছে ক্যাঙারু-হাউন্ড ও ডিংগোর সংমিশ্রণে!

জন্তুটা তিন পায়ে ভর দিয়ে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এল টেরিয়ারের দিকে। লোকটি দেখল কুকুরটার বাঁ-দিকের পা নেই। কনুই থেকে কাটা ছিন্ন অংশটা এই সারমেয়-দানবের ভয়ানক চেহারাটাকে করে তুলেছে আরও ভয়ানক!

মানুষের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অতিকায় ডিংগোটা টেরিয়ার কুকুরটার কাছে এসে দাঁড়াল এবং ছোটো জন্তুটার দেহের ঘ্রাণ গ্রহণ করতে করতে অকস্মাৎ কামড়ে ধরল তার কণ্ঠদেশ–

পরক্ষণেই ঝাঁকুনির পর ঝাঁকুনি!

কুকুরের মনিব এতক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, এইবার তার সংবিৎ ফিরে এল। লোকটির কাছে স্প্যানার নামক লোহার যন্ত্র ছাড়া কোনো অস্ত্র ছিল না। পোষা কুকুরটাকে বাঁচানোর জন্য এই স্প্যানারটা নিয়েই সে ছুটে এল এবং যন্ত্রটা দিয়ে বারংবার আঘাত হানতে লাগল ডিংগোর মাথার উপর।

স্প্যানারের আঘাতে শয়তান ডিংগোটা কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না, বরং দ্বিগুণ উৎসাহে কামড়াতে কামড়াতে টেরিয়ার কুকুরটাকে সে টুকরা টুকরো করে ফেলল।

হঠাৎ ডিংগোটা যেন মানুষটির অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠল। টেরিয়ারের মৃতদেহটা ফেলে দিয়ে সে লোকটির কণ্ঠদেশ লক্ষ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অশ্বচালক একহাত দিয়ে নিজের গলাটাকে বাঁচাতে লাগল এবং অন্য হাত দিয়ে স্প্যানারটা বাগিয়ে ধরে অনবরত আঘাত হানতে লাগল বুনো কুকুরটার মাথার উপর। অবশেষে ডিংগো পরাজয় স্বীকার করল, লৌহময় স্প্যানারের সুকঠিন অভ্যর্থনা আর সহ্য করতে না-পেরে জন্তুটা ঝোপের ভিতর ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

লোকটির অবস্থাও খুব ভালো ছিল না, ডিংগোর দন্তাঘাতে তার হাত ও মুখের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছিল অনেকগুলো ক্ষতচিহ্ন। চিকিৎসকের কাছে গিয়ে সেই ক্ষতস্থানগুলো সেলাই করিয়ে লোকটি সেযাত্রা রেহাই পায়।

এই ঘটনার ফলে স্থানীয় মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল তীব্র উত্তেজনা। দলে দলে অশ্বারোহী মানুষ রাইফেল হাতে বেরিয়ে পড়ল খুনি জানোয়ারটার সন্ধানে, তাদের মধ্যে অনেকের সঙ্গে ছিল ক্যাঙারু হাউন্ড নামক শক্তিশালী শিকারি-কুকুর। কিন্তু মানুষ ও সারমেয় বাহিনীর সতর্ক দৃষ্টি ডিংগোটাকে আবিষ্কার করতে পারল না, সে হঠাৎ ওয়ারুনা উপত্যকার বুক থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল যেন।

কিছুদিন পরেই আবার একটা ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হল। উক্ত হত্যাকাণ্ডের বিবরণী থেকে জানা গেল শয়তানটা একেবারে নিঃসঙ্গ নয়, কখনো কখনো সে একাজে সঙ্গীর সাহায্য নিয়ে থাকে। ঘটনার বিবরণ নিম্নে বর্ণিত হল।

ভেড়াগুলিকে পানীয় জল সরবরাহ করার জন্য একটা কূপ নির্মাণের কাজ চলছিল। ওই কাজের পরিদর্শন ও পরিচালনার ভার নিয়েছিলেন গেমেস এম ডাউনি নামক জনৈক শ্বেতাঙ্গ। একদিন সকাল বেলা ডাউনি সাহেব ঘোড়ার পিঠে চড়ে তার কর্তব্য করছিলেন, হঠাৎ তার চোখে পড়ল তৃণভূমির উপর অবস্থিত মেষপালের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে অস্বাভাবিক চাঞ্চল্য!

যে ভেড়াগুলো মাঠের উপর চরে বেড়াচ্ছিল সেই জন্তুগুলো হঠাৎ পাগলের মতো ছুটতে শুরু করল এবং মাঠের উপর শুয়ে যে ভেড়াগুলো বিশ্রাম সুখ উপভোগ করছিল তারাও যোগ দিল ধাবমান সঙ্গীদের সাথে!

তাদের উত্তেজনার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রায় আধমাইল দূরে দুটো ডিংগোকে দেখতে পেলেন মি. ডাউনি। জন্তু দুটি লৌহজালের আবেষ্টনের বাইরে ঘোরাঘুরি করছিল। মি. ডাউনি বুঝলেন জালের গায়ে একটা ফুটোফাটা প্রবেশপথ আবিষ্কার করার জন্য তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে ঘোড়া চালিয়ে জন্তু দুটোর দৃষ্টিসীমার বাইরে এসেই তিরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন মি. ডাউনি এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে উপস্থিত হলেন ওয়ারুনার সেই মালিকের কাছে, যাঁর জমির উপর প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিল রেড কিলার।

মি. ডাউনির কাছে সব কথা শুনলেন ওয়ারুনার মালিক, তারপর দুজনে দুটি রাইফেল নিয়ে একটা মোটরে উঠে ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই অকুস্থলে এসে তারা দেখলেন ডিংগো দুটো কোন ফাঁকে ভিতরে ঢুকে পড়েছে এবং মিলিতভাবে একটা ভেড়াকে আক্রমণ করে তাকে মাটিতে পেড়ে ফেলার চেষ্টা করছে।

মি. ডাউনি গুলি চালালেন। দুটো জন্তুর মধ্যে অপেক্ষাকৃত বড়ো কুকুরটা তিনটি মাত্র পা নিয়েই অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে ছুটল লোহার জালের গায়ে অবস্থিত একটা ফোকর লক্ষ করে এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ফুটোটার ভিতর দিয়ে শরীরটা গলিয়ে দিয়ে অপর দিকে লাফিয়ে পড়ল। তবে এই যাত্রা তাকে কিছুটা শাস্তিগ্রহণ করতে হল, ডাউনির রাইফেলের গুলি তাকে মাটির উপর শুইয়ে দিল। মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য জন্তুটার চৈতন্য লোপ পেয়েছিল, তারপরই সে ভূমিশয্যা ছেড়ে তিন পায়ের উপর ভর দিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে শিকারিদের দৃষ্টিসীমার বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল। আসল আসামি হাতছাড়া হয়ে গেল দেখে শিকারিরা এইবার দুনম্বর কুকুরটার দিকে নজর দিলেন।

কুকুরটা তখন তার সঙ্গী যেদিকে গেছে তার বিপরীত দিকে ছুটছে।

দুই নম্বর কুকুরটাকে লক্ষ করে ডাউনির রাইফেল অগ্নিবৃষ্টি করল, কিন্তু অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এঁকেবেঁকে ছুটে জন্তুটা বুলেটের দংশন থেকে আত্মরক্ষা করতে লাগল।

ওয়ারুনার মালিক কিন্তু অন্য উপায় অবলম্বন করেছিলেন। গাড়িটাকে তিনি ধাবমান জন্তুটার গায়ের উপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কয়েকবার ব্যর্থ হওয়ার পর তার চেষ্টা সফল হল–গাড়ির দুটো চাকাই সশব্দে ডিংগোটার দেহের উপর দিয়ে গড়িয়ে গেল। আহত জন্তুটা এইবার হিংস্র আক্রোশে গাড়ির আরোহীদের আক্রমণ করতে উদ্যত হল।

অব্যর্থ নিশানায় গুলি চালিয়ে মি. ডাউনি জন্তুটাকে ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে দিলেন।

কাছে গিয়ে দেখা গেল সদ্যমৃত ডিংগোটা স্ত্রীজাতীয় পশু। এইমাত্র যে তিন-পা-ওয়ালা কুকুরটা শিকারিদের ফাঁকি দিয়েছে মৃত ডিংগোটা যে সেই শয়তান রেড কিলার-এর সঙ্গিনী এ-বিষয়ে কারো সন্দেহ ছিল না কিছুমাত্র।

পরবর্তী ঘটনা থেকে জানা যায় সেইদিনই আর একবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল রেড কিলার, কিন্তু প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বারও সে বিপদকে ফাঁকি দিয়ে পলায়ন করতে সক্ষম হয়েছিল।

ঘটনার বিবরণে প্রকাশ যে, খুনি জানোয়ারটা যখন মি. ডাউনির গুলি খেয়ে আহত অবস্থায় একটা ঝোপের মধ্যে শুয়ে বিশ্রাম করছিল, সেই সময় হঠাৎ সে একটি কৃষকের নজরে পড়ে যায়। এক-ঘোড়ায়-টানা একটি গাড়ি চালিয়ে চলেছিল পূর্বোক্ত কৃষক এবং ধাবমান গাড়িটিকে অনুসরণ করে ছুটছিল কৃষকের পোষা কুকুর।

ঝোপের ভিতর শায়িত ডিংগোটাকে দেখেই কৃষক গাড়ি থামিয়ে দিল।রেড কিলার অবশ্য তৎক্ষণাৎ সরে পড়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কৃষক তাকে এত সহজে ছাড়ল না–পোষা কুকুরটাকে সে লেলিয়ে দিল তিন-পা-ওয়ালা ডিংগোটার দিকে।

কৃষকের পোষা কুকুরটা ছিল শক্তিশালী ক্যাঙারু হাউন্ড, বনচারী ডিংগোর যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রভুর নির্দেশে কুকুরটা ডিংগোকে আক্রমণ করল…

লড়াই চলল কিছুক্ষণ ধরে, তারপর অরণ্যের বন্য বিক্রমের কাছে পরাজয় স্বীকার করল মানুষের গৃহপালিত জীব–কণ্ঠদেশের ওপর সুগভীর দণ্ডাঘাতের চিহ্ন নিয়ে পিছিয়ে এল কৃষকের কুকুর। কৃষক এইবার গাড়িতে-জোতা ঘোড়াটাকে খুলে নিয়ে তার পিঠে উঠে বসল এবং ঘোড়া ছুটিয়ে তেড়ে গেল ডিংগোটার দিকে। কিন্তু ঘন সন্নিবিষ্ট গাছের সারির ভিতর দিয়ে ডিংগোটা কৃষকের ঘোড়াকে ফাঁকি দিয়ে পলায়ন করল…

বেশ কয়েকমাস কাটল নির্বিঘ্নে।

সকলেই নিশ্চিন্ত হল এই ভেবে যে অস্ট্রেলিয়ার লাল আতঙ্ক নিশ্চয়ই পটল তুলেছে।

কিন্তু স্থানীয় অধিবাসীদের এই আনন্দ স্থায়ী হল না, আচম্বিতে এক শরীরী দুঃস্বপ্নের মতো আত্মপ্রকাশ করল রেড কিলার–কয়েকদিনের মধ্যেই খুনি ডিংগোটার কবলে প্রাণ হারাল অনেকগুলো মেষ।

শিকারিরা দলে দলে এসে ভিড় করল, কিন্তু তাদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ভেড়ার দলের উপর হামলা চালাতে লাগল তিন-পা-ওয়ালা খুনি জন্তুটা। রাতের পর রাত চলল এই হত্যাকাণ্ড আর রেড কিলার নামধারী জন্তুটার মাথার উপর পুরস্কারের অঙ্কটাও বেড়ে চলল অবিশ্বাস্যভাবে। পুরস্কারের লোভে আরও অনেক শিকারি এসে জুটল। কিন্তু ওই লাল রং-এর শয়তান জন্তুটার অসাধারণ ধূর্ত স্বভাব ও ক্ষিপ্রতার কাছে সকলেই হার মানতে বাধ্য হল।

ওয়ারুনার মালিক যখন হতাশ হয়ে পড়েছেন, তখন হঠাৎ একদিন অকুস্থলে আবির্ভূত হল এক ওস্তাদ শিকারি। এই লোকটি সাদা-চামড়ার মানুষ নয়, অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসী এক বর্ণসংকর। স্থানীয় শিকারিটির নামডাক ছিল যথেষ্ট, কিন্তু ওয়ারুনার মালিক তখন প্রায় সকলের উপরই আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। তবু স্থানীয় শিকারিটি যখন মালিকের কাছে এসে খুনি কুকুরটাকে মারার প্রস্তাব করল, তখন ওয়ারুনার মালিক তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন না।

মালিককে একটিমাত্র প্রশ্ন করলে স্থানীয় শিকারি গুড় আছে?

মালিক বললেন, আছে।

শিকারি গম্ভীরভাবে বলল, তাহলে আর ভাবনা নেই।রেড কিলার এইবার নির্ঘাত মারা পড়বে।

শিকারির নির্দেশ অনুসারে সেই রাত্রে ভেড়াগুলোকে খোঁয়াড়ের ভিতর না-রেখে প্রান্তরের। উপরই ছেড়ে দেওয়া হল। ওই প্রান্তর বা মেষচারণ ভূমির চারপাশে অবশ্য লৌহজালের বেষ্টনী ছিল, কিন্তু ওই জাল কেটে ভেড়া মারতে রেড কিলার কোনোদিনই অসুবিধা ভোগ করেনি। সেই রাতেও ভেড়াগুলোকে প্রান্তরের উপর রেখে শয্যা আশ্রয় করার আগে ওয়ারুনার মালিক ভেবেছিলেন পরের দিন সকালে উঠে নিশ্চয়ই তিনি কয়েকটা ভেড়ার মৃতদেহ দেখতে পাবেন।

হ্যাঁ, মৃতদেহ তিনি দেখেছিলেন বটে, তবে সেটা ভেড়ার মৃতদেহ নয়।

খুব ভোরেই উঠেছিলেন তিনি।

অনুসন্ধান করতে করতে লোহার-জালে-ঘেরা বেষ্টনীর বাইরে এক জায়গায় একটা ডিংগোর মৃতদেহ তার এবং অন্যান্য অনুসন্ধানকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

কাছে এগিয়ে গিয়ে তারা দেখলেন জন্তুটা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার জান্তব বিভীষিকা রেড কিলার!

শিকারি তার কথা রেখেছে!

বহু শিকারি বহুদিন ধরে চেষ্টা করেও যা করতে পারেনি, স্থানীয় মানুষটি সেই অসাধ্য সাধন করেছে–ওয়ারুনা উপত্যকার বুক থেকে তার চেষ্টাতেই বিদায় নিয়েছে শরীরী মৃত্যুর এক জান্তব অভিশাপ!

স্থানীয় শিকারির কৌশলটিও ছিল অপূর্ব।

লোহার জাল-ঘেরা বেষ্টনীর আশেপাশে অনেকখানি জায়গার উপর সে ছড়িয়ে দিয়েছিল গুড়! এমনভাবে ওই জিনিসটা সে বৃত্তাকারে ছড়িয়েছিল যে ডিংগোটার পক্ষে গুড়ের উপর পদার্পণ না-করে ভেড়ার কাছাকাছি আসার উপায় ছিল না। গুড়ের উপর পা পড়তেই চটচটে গুড় কুকুরটার পায়ে আটকে যায়। কুকুর জাতীয় জীবের স্বভাব-অনুসারে ডিংগোটা জিভ দিয়ে চেটে চেটে ওই বিরক্তিকর পদার্থটিকে পা থেকে তুলে ফেলার চেষ্টা করে। গুড়ের স্বাদ ডিংগোর ভালো লাগে, এবার সে বেশ ভালো করেই চেটে চেটে গুড়ের মিষ্ট স্বাদ গ্রহণ করতে থাকে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যুযাতনায় তার চোখ-মুখ হয়ে যায় বিকৃত!

মৃত্যুর পরেও সেই বিকৃতির চিহ্ন তার মুখ থেকে মিলিয়ে যায়নি!

ওহ হো! একটা কথা বলতে ভুলে গেছি : গুড়ের সঙ্গে শিকারি আর একটি বস্তু মিশিয়ে দিয়েছিল–গ্রাউন্ড সায়ানাইড–তীব্র বিষ!

[জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৯]

আঁধার রাতের পথিক

বুড়ো–একটি নাম। নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আতঙ্কের কালো ছায়া… দল নিয়ে নয়, সম্পূর্ণ এককভাবেই সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে বাস করছিল বুড়ো! দলের প্রয়োজন ছিল না, বুড়ো একাই এক-শো! বৃদ্ধ হলেও তার দেহে ছিল অসাধারণ শক্তি, পায়ে ছিল বিদ্যুতের বেগ!

বুড়োর প্রসঙ্গে গল্পের অবতারণা করতে হলে পাঠক-পাঠিকাদের কাছে পুমা নামক জন্তুটির বিষয়ে কয়েকটি কথা বলা দরকার। দক্ষিণ আমেরিকার অরণ্যময় পার্বত্য অঞ্চলে পুমার প্রিয় বাসভূমি। স্থানীয় বাসিন্দারা পুমাকে বিভিন্ন নামে ডাকে; সবচেয়ে প্রচলিত নামগুলো হচ্ছে–পুমা, কুগার এবং মাউন্টেন লায়ন বা পার্বত্য সিংহ। পুমা অবশ্য সিংহ নয়, যদিও তার চেহারার সঙ্গে কেশরহীন সিংহের কিছু কিছু সাদৃশ্য আছে। পুমার গায়ের রং ধূসর, দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মস্ত বড় একটা বিড়ালের মতো। বিড়ালজাতীয় অন্যান্য জীব অর্থাৎ বাঘ, সিংহ, লেপার্ড বা নিকটস্থ প্রতিবেশী জাগুয়ারের মতো হিংস্র ও ভয়ানক নয় পুমা। নিতান্ত বিপদে পড়লে সে রুখে দাঁড়ায় বটে কিন্তু পলায়নের পথ খোলা থাকলে সে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করে। যুদ্ধবিগ্রহের পক্ষপাতী সে নয়

তাকে নিরীহ আখ্যা দিলে সত্যের বিশেষ অপলাপ হয় না।

মাংসভোজী অন্যান্য শ্বাপদের তুলনায় নিরীহ হলেও পুমা মাংসাশী জীব।

গোরু, ভেড়া, ঘোড়া প্রভৃতি গৃহপালিত পশু তার খাদ্যতালিকার অন্তর্গত। সুযোগ পেলেই স্থানীয় অধিবাসীদের পোষা জানোয়ার মেরে সে শিকারের মাংসে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে। সেইজন্য পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছ মা হচ্ছে চোখের বালির মতোই দুঃসহ।

উপদ্রুত অঞ্চলের পশুপালকরা অনেক সময় পুমাকে দল বেঁধে শিকার করতে সচেষ্ট হয়–প্রয়োজন হলে তারা পুমার পিছনে লেলিয়ে দেয় শিক্ষিত শিকারি কুকুর।

আগেই বলেছি পুমা খুব দুর্দান্ত জন্তু নয়; বরং তাকে শান্তিপ্রিয় ভীরু জানোয়ার বলা যায়।

গৃহপালিত পশুকে সে হত্যা করে উদরের ক্ষুধা শান্ত করবার জন্য কিন্তু শিকারি কুকুরের সাহচর্য সে সভয়ে এড়িয়ে চলে। শিক্ষিত হাউন্ড কুকুর খুব সহজেই পলাতক পুমাকে আবিষ্কার করতে পারে। কুকুরের ঘ্রাণশক্তি অত্যন্ত প্রবল পুমার গায়ের গন্ধ শুঁকে শুঁকে সারমেয় বাহিনী তাকে অনায়োসে গ্রেফতার করে ফেলে। বেচারা পুমা গাছে উঠেও নিস্তার পায় না, কুকুরগুলো গাছের তলায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে শিকারিকে পুমার অস্তিত্ব জানিয়ে দেয়। কুকুরের চিৎকার শুনে অকুস্থলে উপস্থিত হয় বন্দুকধারী শিকারি–পরক্ষণেই গাছের উপর থেকে মাটির উপর ছিটকে পড়ে গুলিবিদ্ধ পুমা প্রাণহীন দেহ।

পুমা অনেক সময় গাছ থেকে নেমে চম্পট দেওয়ার চেষ্টা করে। তৎক্ষণাৎ সারমেয় বাহিনীর আক্রমণে তার দেহ হয়ে যায় ছিন্নভিন্ন দলবদ্ধ শিকারি কুকুরের কবল থেকে কিছুতেই নিস্তার নেই।

কিন্তু ফ্ল্যাটহেড অঞ্চলের বুড়ো হচ্ছে নিয়মের ব্যতিক্রম। কুকুরদের সে ভয় করে না।

ওঃ! বুড়োর পরিচয় তো দেওয়া হয়নি

বুড়ো হচ্ছে আমেরিকার ফ্ল্যাটহেড নামক পার্বত্য অঞ্চলের পুরাতন বাসিন্দা–পূর্ণবয়স্ক একটি পুমা।

ওই এলাকার লোকজন তার নাম রেখেছিল বুড়ো। সমস্ত অঞ্চলটায় আতঙ্কের ছায়া ছড়িয়ে দিয়েছিল বুড়ো নামধারী পুমা। গোশালার ভিতর থেকে লুট করে নিয়ে যেত নধর গো-বৎস, হত্যা করত গোরুগুলোকে।

এলাকার বিভিন্ন গোশালায় মূর্তিমান মৃত্যুর মতো হানা দিয়ে ঘুরত ওই খুনি জানোয়ার। রাতের পর রাত ধরে চলছিল মাংসাশী দস্যুর নির্মম অত্যাচার…

কুকুর লেলিয়ে দিয়েও বুড়োকে জব্দ করা যায়নি। কুকুরের দল তাকে ঘেরাও করলেই উদ্যত নখদন্ত নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ওপর এবং চটপট থাবা চালিয়ে সারমেয় বাহিনীর ন্যূহ ভেদ করে চম্পট দেয় নিরাপদ স্থানে। পশ্চাৎবর্তী শিকারি অকুস্থলে এসে দেখতে পায় তার কুকুরগুলোর মধ্যে অধিকাংশই মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছে আর অন্যগুলো রক্তাক্ত দেহে চিৎকার করছে আর্তস্বরে!

একবার নয়, দু-বার নয়–এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে বারংবার! বুড়োর আরও একটি বদনাম ছিল–সে নাকি নরখাদক! বদনামটা অবশ্য কতদূর সত্যি সেই বিষয়ে কারো কারো সন্দেহ। ছিল পুমা নরমাংস পছন্দ করে না, পারতপক্ষে মানুষকে সে এড়িয়ে চলতে চায়।

কিন্তু ফ্ল্যাটহেড অঞ্চলে এমন একটি ঘটনা ঘটল যে স্থানীয় বাসিন্দারা সকলেই বিশ্বাস করতে বাধ্য হল এই সৃষ্টিছাড়া পুমাটা সুযোগ পেলে মানুষকে হত্যা করে নরমাংস ভক্ষণ করতেও দ্বিধা বোধ করবে না।

ঘটনাটা বলছি—

হারানো গোরুর খোঁজে টহল দিতে দিতে জর্জ টেলর নামে একটি রাখাল হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। প্রতিবেশীরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে সাতদিন বাদে তার মৃতদেহটাকে আবিষ্কার করলে একটা গাছের নীচে। ছিন্নভিন্ন মৃতদেহটার ওপর নজর বুলিয়ে সকলেই বুঝল কোনো মাংসাশী পশু জর্জের দেহটাকে মনের আনন্দে চর্বণ করেছে। আশেপাশে জমির উপর রয়েছে পুমার পায়ের ছাপ।

স্থানীয় অধিবাসীরা বললে জর্জের হত্যাকারী হচ্ছে বুড়ো। অধভুক্ত দেহটা দেখে তারা স্পষ্ট বুঝল বুড়ো একটি ভয়ংকর নরখাদক পুমা।

তারপর থেকে মাঝে মাঝে দু-একটি পথিকের নিরুদ্দেশ হওয়ার সংবাদ আসতে লাগল। সংবাদগুলো হয়তো সম্পূর্ণ সত্য নয়, হয়তো সেগুলো গুজব মাত্র কিন্তু স্থানীয় মানুষগুলির মধ্যে দারুণ আতঙ্কের সৃষ্টি হল।

ইতিমধ্যে ওই এলাকায় আবির্ভূত হল একটি নতুন মানুষ। আগন্তুকের নাম অ্যালেন বর্ডার।  সে বুড়োর কথা শুনল বটে কিন্তু বিশেষ গুরুত্ব দিলে না। মানুষ মেরে মাংস খায় এমন পুমার গল্প তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়–নরখাদক পুমার অস্তিত্বে সে বিশ্বাস করে না।

পরবর্তী জীবনে তিক্ত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে অ্যালেন জেনেছিল নখদন্তে সজ্জিত মাংসাশী শ্বাপদের খাদ্যতালিকার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই–বন্যপশুর স্বভাবচরিত্র বিশ্লেষণ করতে যদি ভুল হয় তবে ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে সেই ভুলের পরিণাম মারাত্মক হতে পারে।

বার-এক্স নামক একটি র‍্যানব বা গোশালায় চাকরি করতে এসেছিল অ্যালেন বর্ডার। বিভিন্ন কাজের মধ্যে হারানো গোরু বাছুরের সন্ধান নেওয়া ছিল তার অন্যতম কর্তব্য।

সেদিন দুপুরবেলা সে এবং গোশালার মালিক ম্যাকবিল ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়েছিল কয়েকটা নিখোঁজ গোরুর সন্ধানে করার জন্য। অনেকক্ষণ ধরে একটা উপত্যকার উপর তারা নিরুদ্দিষ্ট তিনটি গোরুকে দেখতে পেল। ঘোড়ার লাগামে টান মেরে দুজনেই থমকে দাঁড়াল।

গোরু তিনটির কাছে যেতে হলে প্রায় আধমাইল লম্বা দুর্গম পাহাড়ী পথ বেয়ে যাত্রা করতে হবে। রাতের অন্ধকারে নিজের এলাকার মধ্যে গেলে তিনটি গোরুকেই হত্যা করবে বুড়ো শয়তান; অতএব সকালের জন্যে অপেক্ষা করলে চলবে না।

গোরুগুলোকে বাঁচাতে হলে এখনই তাদের উদ্ধার করা দরকার।

ম্যাকগিলকে ঘরে ফিরে যেতে বলে অ্যালেন পাহাড়ি পথের ওপর দিয়ে গোরুগুলোর দিকে অশ্বকে চালনা করলে।

আকাশে দুলে উঠল সন্ধ্যার ধূসর অঞ্চল, পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় গ্রহণ করছে দিনান্তের শেষ আলোকধারা…

আচম্বিতে হল এক বিপদের সূত্রপাত।

অ্যালেনের বন্দুকটা ঘোড়ার পিঠে বাঁধা ছিল–হঠাৎ বন্ধনরঙ্কু আলগা হয়ে সেটা পড়ে গেল মাটির উপর। সঙ্গেসঙ্গে ভরা বন্দুকের গুলি ছুটে গেল; ঘোড়ার পায়ের তলায় বন্দুকের নল থেকে সগর্জনে নির্গত হলে চকিত অগ্নিশিখা!

ঘোড়া চমকে উঠে লাফ মারল এবং টাল সামলাতে না-পেরে ঘোড়ার পিঠ থেকে অ্যালেন সশব্দে অবতীর্ণ হল কঠিন মৃত্তিকার বুকে! ধরাশয্যায় শুয়ে শুয়েই সে শুনতে পেল পাথুরে জমির উপর বেজে উঠেছে ধাবমান অশ্বের পদশব্দ–ঘোড়া পালিয়ে যাচ্ছে।

অ্যালেন উঠে বসল। তার দেহে কোথাও আঘাত লাগেনি। শরীরের কয়েক জায়গা কেটে অল্পবিস্তর রক্তপাত হয়েছে বটে কিন্তু আঘাতগুলো মোটেই মারাত্মক নয়। বন্দুকটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে অ্যালেন পাহাড়ি পথ বেয়ে হাঁটতে লাগল। এই অঞ্চলের পথঘাট তার পরিচিত রাস্তাটা যে ভালোভাবেই চিনতে পেরেছিল।

কয়েক মাইল পথ ভেঙে পাহাড়ের নীচে নামতে পারলেই যে ঢালু জমিটার উপর পৌঁছে যাবে, সেখান থেকে গোশালায় ফিরে যেতে তার অসুবিধা হবে না। গোরুগুলোকে অবশ্য উদ্ধার করা যাবে না; কারণ ততক্ষণে অন্ধকার রাত্রির গর্ভে হারিয়ে যাবে দিবসের শেষ আলোকরশ্মি। ইতিমধ্যেই উপত্যকা আর খাদগুলোর উপর উড়েছে সুদীর্ঘ ছায়ার আবরণ–অন্ধকার হতে আর দেরি নেই।

বন্দুকটা হাতে নিয়ে অ্যালেন পাহাড়ি পথ বেয়ে পদচালনা করলে..

কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যালেনের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে দিলে ঘন অন্ধকার। তারার আলোতে অস্পষ্টভাবে পথ দেখতে দেখতে সে পা ফেলতে লাগল অতি সন্তর্পণে…

হঠাৎ চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল অ্যালেন।

তার পিছন থেকে ভেসে এল একটা তীব্র তীক্ষ্ণ চিৎকার! নারীকণ্ঠের আর্তস্বর!

এক মুহূর্তের জন্য ভুল করেছিল অ্যালেন। না, কোনো রমণীর কণ্ঠস্বর নয়–ওই ভীষণ চিৎকার ভেসে এসেছে পুমার গলা থেকে। নারীকণ্ঠের সঙ্গে পুমার কণ্ঠস্বরের কিছুটা মিল আছে। বটে কিন্তু এমন ভয়াবহ জান্তব ধ্বনি ইতিপূর্বে অ্যালেনের কর্ণগোচর হয়নি।

অ্যালেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।

নির্ভরযোগ্য কোনো অস্ত্র তার হাতে নেই, যে মস্ত ছোরাটা সে সর্বদাই সঙ্গে রাখে সেটাও আজ সে ফেলে এসেছে তার টেবিলের উপর। হাতের বন্দুকে ছিল একটিমাত্র গুলি, একটু আগের দুর্ঘটনায় সেই গুলিটাও ছুটে গেছে। তবু খালি বন্দুকটা শক্ত মুঠিতে চেপে ধরলে অ্যালেন, টোটা না-থাকলেও বন্দুকটাকে মুগুরের মতো ব্যবহার করা যাবে।

আবার! আবার সেই চিৎকার!

অন্ধকার রাত্রির নীরবতা ভঙ্গ করে অ্যালেনের পিছন থেকে ভেসে এল সেই উৎকট শব্দের তরঙ্গ!

দারুণ আতঙ্কে অ্যালেনের ঘাড়ের চুল খাড়া হয়ে উঠল।

নিশ্চিত মৃত্যুর বার্তা বহন করে তার দিকে এগিয়ে আসছে হিংস্র শ্বাপদ!

দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অ্যালেন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। অন্ধকারের মধ্যে সংকীর্ণ গিরিপথটা আর এখন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না, তবু সে একবারও পথের দিকে দৃকপাত করলে না।

আতঙ্কে আত্মহারা হয়ে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল।

আচম্বিতে তার পায়ের তলা থেকে সরে গেল মৃত্তিকার নিরেট স্পর্শ, পাথরের গায়ে ধাক্কা লেগে খসে পড়ল বন্দুকটা তার হাত থেকে।

অ্যালেন অনুভব করলে তার দেহটা শূন্যপথে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে!

অন্ধের মতো দু-হাত বাড়িয়ে দিতেই তার হাতে কয়েকটা গাছের শিকড় লাগল। শক্ত মুঠিতে শিকড়গুলো চেপে ধরে পতনোন্মুখ দেহটাকে সে কোনোরকমে রক্ষা করলে।

তার পায়ের ধাক্কা লেগে কয়েকটা পাথর পাহাড়ের গা বেয়ে নীচের দিকে গড়িয়ে পড়ল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না–তবু বহুদূরে নীচের দিক থেকে স্থলিত প্রস্তরের যে পতন-শব্দ ভেসে এল সেই আওয়াজ থেকেই অ্যালেন বুঝল তার পায়ের তলায় হাঁ করে আছে গভীর খাদ। এখান থেকে পড়ে গেলে বাঁচবার আশা নেই।

অতিকষ্টে একটু একটু করে সে পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে ওঠবার চেষ্টা করতে লাগল। একটু পরে একটা সংকীর্ণ জায়গায় সে পা রাখার মতো অবলম্বন খুঁজে পেল।

হঠাৎ অ্যালেনের সর্বাঙ্গে জাগল অস্বস্তিকর অনুভূতির তীব্র শিহরন। ঘন অন্ধকার ভেদ করে কোনো কিছু দৃষ্টিগোচর হওয়ার উপায় নেই কিন্তু সে অনুভব করলে শয়তান বুড়ো তার খুব কাছেই এসে দাঁড়িয়েছে।

মাথার উপর হিংস্র শ্বাপদ, পায়ের তলায় অতলস্পর্শী খাদ–ভয়াবহ অবস্থা!

অকস্মাৎ দারুণ আক্রোশে পরিপূর্ণ হয়ে গেল অ্যালেনের সমগ্র চেতনা। ভয়ের পরিবর্তে জেগে উঠল ক্রোধ। বিদ্যুৎচমকের মতো তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।

বন্দুকটা তার হাত থেকে খসে পড়েছিল বটে কিন্তু অস্ত্রটা তখনও হাতছাড়া হয়নি। চামড়ার ফিতা দিয়ে বন্দুকটা আটকানো ছিল তার কাঁধের সঙ্গে, হাত থেকে খসে পড়লেও অ্যালেনের দেহলগ্ন চর্মরঙ্কুর বন্ধনে ঝুলছিল বন্দুক।

সে এইবার অস্ত্রটাকে বাগিয়ে ধরে কোট এবং টুপি খুলে ফেলল।

বন্দুকের নলের মুখে সে এমনভাবে কোট আর টুপি বসিয়ে দিল যে উপর থেকে দেখলে নির্ঘাত মনে হবে একটা মানুষ টুপি মাথায় দাঁড়িয়ে আছে।

তারপর টুপি-কোট জড়ানো বন্দুকটাকে সে তুলে ধরলে খাদের মুখে।

আচম্বিতে তার বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল–অন্ধকারের কালো যবনিকা ভেদ করে জ্বলছে একজোড়া প্রদীপ্ত শ্বাপদ চক্ষু!

পরক্ষণেই অন্ধকারের চেয়েও কালো এক অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি ঝাঁপিয়ে পড়ল টুপি-কোট–জড়ানো বন্দুকের উপর! সেই দারুণ সংঘাতে। বন্দুকসমেত অ্যালেনের দেহটা আর একটু হলেই ছিটকে পড়ত। খাদের ভিতর কোনোরকমে টাল সামলে নিয়ে সে দেখল গিরিপথের উপর থেকে ঠিকরে এসে তার পাশেই সংকীর্ণ জায়গাটার উপর ভারসাম্য রেখে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে। একটা চতুষ্পদ জীব! পুমা!

–দারুণ আতঙ্কে অ্যালেনের কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল এক ভয়াবহ চিৎকার, দু-হাতে বন্দুকটা তুলে ধরে সে আঘাত হানতে উদ্যত হল।

কিন্তু প্রয়োজন ছিল না; পুমার নখগুলো পাথরের ওপর ফসকে গেল, জন্তুটা গড়িয়ে পড়তে লাগল নীচের দিকে!

অ্যালেন দেখল পুমা বার বার নখ দিয়ে পাহাড়ের ঢালু জমি আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছে। চেষ্টা সফল হল না।

মহাশূন্যে ছিটকে পড়ে অনেক নীচে অন্ধকারের গর্ভে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই অতিকায় মার্জারের দেহ।

সকাল হল। নীচের দিকে তাকিয়ে ধরাশায়ী জন্তুটাকে দেখতে পেল অ্যালেন।

হ্যাঁ, বুড়োই বটে! জন্তুটা মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে কিন্তু তখনও মরেনি! তার কপিশ-পিঙ্গল চক্ষু দুটি নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অ্যালেনের দিকে!

অ্যালেন সবিস্ময়ে দেখল শ্বাপদের দৃষ্টিতে মৃত্যু-যাতনার চিহ্ন নেই–হিংস্র আক্রোশে দপদপ করে জ্বলছে পুমার দুই প্রদীপ্ত চক্ষু!

অ্যালেন চোখ ফিরিয়ে নিলে অন্যদিকে।

অকস্মাৎ ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো অকুস্থলে উপস্থিত হল অ্যালেনের মনিব ম্যাকগিল এবং দুজন রাখাল। ঘটনাস্থলে তাদের উপস্থিতি খুবই আকস্মিক বটে কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। যে ঘটনার সূত্র ধরে তাদের আবির্ভাব ঘটেছিল তা হচ্ছে এই :

অ্যালেনের ঘোড়া গতরাত্রেই তার আস্তানায় ফিরে গিয়েছিল। আরোহীবিহীন অশ্বের শূন্য পৃষ্ঠদেশ দেখে ম্যাকগিল উদবিগ্ন হয়ে ওঠে কিন্তু রাতের অন্ধকারে অনুসন্ধান চালানো সম্ভব নয় বলেই সে অপেক্ষা করতে থাকে প্রভাতের জন্য।

ভোরের আলো ফুটতেই দুজন রাখালকে নিয়ে ম্যাকগিল খোঁজাখুঁজি শুরু করল এবং তার অভিজ্ঞ চক্ষু কিছুক্ষণের মধ্যেই খুঁজে পেল অ্যালেনের জুতোর দাগ। ওই দাগ ধরে একটু যেতেই তাদের চোখে পড়ল পুমার পায়ের ছাপ। শ্বাপদের পদচিহ্ন বিশ্লেষণ করে তারা যখন বুঝল পদচিহ্নের মালিক হচ্ছে বুড়ো এবং সংকীর্ণ গিরিপথে তার লক্ষিত শিকার হচ্ছে অ্যালেন, তখনই তারা অ্যালনকে জীবন্ত অবস্থায় ফিরে পাওয়ার আশা ত্যাগ করেছিল। অক্ষত অবস্থায় নিখোঁজ মানুষটিকে দেখে তারা যেমন খুশি হয়েছিল তেমনই আশ্চর্য হয়েছিল।

ম্যাকগিল তার রাইফেল তুলে নীচের দিকে নিশানা করলে। পরক্ষণেই অগ্নি উদগার করে গর্জে উঠল রাইফেল।

ম্যাকগিলের সন্ধান অব্যর্থ, গুলি মর্মস্থানে বিদ্ধ হল, নিঃশব্দে মৃত্যুবরণ করলে বুড়ো।

ফ্ল্যাটহেড অঞ্চলে শেষ হল বিভীষিকার রাজত্ব।

[১৩৭৮]

আত্মা ও দুরাত্মা

পৃথিবীতে অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটে যার সঠিক অর্থ বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এই ধরনের একটি কাহিনি আমি সংগ্রহ করেছি প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে।

যে ভদ্রলোক এই ঘটনা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি একজন সম্পন্ন ব্যবসায়ী। ভদ্রলোকের মাতৃভূমি ইংল্যান্ড কিন্তু তার ব্যবসায়ের ক্ষেত্র ছিল আফ্রিকার উগান্ডা নামক স্থানে।

ভদ্রলোকের লিখিত বিবরণী থেকে নিম্নলিখিত কাহিনিটি পরিবেশন করছি—

আমার জমিতে কয়েকজন নিগ্রো শ্রমিক নিযুক্ত করেছিলাম। একদিন শ্রমিকদের দলপতি আমার সঙ্গে দেখা করে জানালে, গত রাত্রে তাদের দলভুক্ত একজন মজুর হঠাৎ মারা পড়েছে। নিগ্রোদের বিশ্বাস ঘরের মধ্যে কোনো লোক মৃত্যুবরণ করলে প্রতিবেশীদের অকল্যাণ হয়। এই জন্য তারা অধিকাংশ সময়ে মুমূর্ষ রোগীকে জঙ্গলের মধ্যে রেখে আসে। রুণ ব্যক্তি বনের মধ্যেই মারা যায়, মৃতদেহের সৎকার হয় না, হায়না প্রভৃতি হিংস্র শ্বাপদ তার দেহের মাংসে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে, নির্দিষ্ট স্থানে পড়ে থাকে শুধু চর্বিত কঙ্কালের স্তূপ।

অসুস্থ মজুরটির সম্বন্ধেও তার সহকর্মীরা পূর্বোক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করতে চেয়েছিল, কিন্তু দলের সর্দার বাধা দেওয়ায় তাদের পরিকল্পনা কার্যে পরিণত হয়নি। বিগত রাত্রে ওই মুমূর্ষ ব্যক্তি তার কুটিরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। মালিক এখন মৃতদেহ সম্বন্ধে কী ব্যবস্থা করবেন সেই কথাই জানতে এসেছে সর্দার।

সর্দারের সঙ্গে গিয়ে মৃতদেহটাকে কুটিরের ভিতর থেকে এনে আমার গাড়িতে রাখলাম, তারপর বেগে গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম হাসপাতালের দিকে। মৃত ব্যক্তির শব ব্যবচ্ছেদ করে তার মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয় করা দরকার–সেইজন্যই আমি হাসপাতালের দিকে যাত্রা করেছিলাম।

কুটিরের মধ্যে আবছা আলো-আঁধারির লীলাখেলা আমার দৃষ্টিকে দুর্বল করে দিয়েছিল, তাই মরা মানুষটাকে তখন খুব ভালো করে দেখতে পাইনি। বাইরে উজ্জ্বল সূর্যালোকে তার মুখ দেখে আমি তাকে চিনতে পারলাম। মাত্র কিছুদিন আগেই লোকটি আমার কাছে মজুরের কাজ করতে এসেছিল। লোকটিকে আমি হালকা কাজ দিয়েছিলাম, কারণ কষ্টসাধ্য কাজ করার মতো উপযুক্ত শরীর তার ছিল না।

তার একটি পা ছিল ভাঙা, একটি চোখ ছিল অন্ধ এবং অজ্ঞাত কোনো দুর্ঘটনার ফলে তার মুখের ওপর থেকে লুপ্ত হয়েছিল নাসিকার অস্তিত্ব, নাকের জায়গায় দৃষ্টিগোচর হত দুটি বৃহৎ ছিদ্র!

তবে লোকটির দেহে বিকৃতি থাকলেও মানুষ হিসাবে সে খারাপ ছিল না। কাজকর্ম সে মন দিয়েই করত। কিন্তু অন্যান্য শ্রমিকরা তাকে এড়িয়ে চলত তাদের ধারণা ছিল বিকৃত দেহের অধিকারী ওই ব্যক্তি একজন জাদুকর!

যাই হোক, সেদিন মৃত ব্যক্তির লাশটা হাসপাতালে জমা করে দিলাম। কর্তৃপক্ষ বললেন, কয়েকদিনের মধ্যেই তার মৃত্যুর কারণ আমাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।

হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ কথা রেখেছিলেন। দিন দুই পরেই তারা আমাকে লোকটির মৃত্যুর কারণ জানিয়ে দিলেন।

উক্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে পেটের গোলমালে। মৃত ব্যক্তির পেটের ভিতর পাওয়া গেছে কয়েকটা লম্বা লম্বা লোহার পেরেক, কাঁচের টুকরো এবং অনেকগুলো পাথর! পৃথিবীতে এত রকম খাদ্য থাকতে লোকটা কাঁচ, লোহা আর পাথর খেয়ে মরতে গেল কেন? খুব সম্ভব জাদুবিদ্যার অনুশীলন করার জন্যই লোকটি ওই অখাদ্য বস্তুগুলিকে ভক্ষণ করেছিল।

তবে লোকটি জাদুকর হলেও খুব উচ্চশ্রেণির জাদুকর নয়, জাদুবিদ্যাকে হজম করতে পারেনি বলেই তার পেটে কাঁচ, লোহা আর পেরেক হজম হল না।

পূর্ববর্ণিত ঘটনার কিছুদিন পরে আমাদের এলাকায় হানা দিল এক অজ্ঞাত আততায়ী।

প্রতি রাত্রেই এলাকার বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ভেড়ার আস্তানাগুলোতে হানা দিয়ে অজ্ঞাত হত্যাকারী যথেচ্ছভাবে হত্যাকাণ্ড চালাতে লাগল। মৃত পশুগুলির দেহে অধিকাংশ সময়ে কোনো ক্ষতচিহ্ন থাকত না, হন্তারক:শুধু ভেড়ার মাথার খুলি ভেঙে ঘিলুটা খেয়ে পালিয়ে যায়।

আমার মজুররা এই হত্যাকাণ্ডের জন্যে নান্দি ভালুক নামে এক অতিকায় ভালুককে দায়ী করলে।

আফ্রিকায় ভল্লুক নেই, নান্দি ভালুক নামক জীবের অস্তিত্ব শুধু নিগ্রোদের কল্পনায়। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে এই কাল্পনিক জন্তুটির কথা নিগ্রোদের মুখে মুখে ফেরে।

বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই।

আমি অনুমান করলাম, এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক হচ্ছে একটি অতিকায় হায়না। মাংসাশী শ্বপদগোষ্ঠীর মধ্যে ভেড়ার মাথার খুলি কামড়ে ভেঙে ফেলার মতো চোয়ালের জোর একমাত্র হায়নারই আছে। চোয়ালে অসাধারণ শক্তি থাকলেও হায়না খুব ভীরু জানোয়ার, তবে দুই একটি হায়না মাঝে মাঝে দুঃসাহসের পরিচয় দেয়।

আমি ঠিক করলাম মেষকুলের হন্তারক এই অজ্ঞাত আততায়ীকে যেমন করেই হোক বধ করতে হবে।

চেষ্টার ত্রুটি হয়নি। ফাঁদ পেতে রেখেছি।

খুনি ফাঁদের ধারে কাছেও আসেনি। বন্দুক হাতে প্রতি রাত্রে টহল দিয়েছি মারা তো দূরের কথা,হত্যাকারীকে চোখেও দেখতে পাইনি। অথচ প্রতিদিন সকালে খবর এসেছে এক বা একাধিক মেষ আততায়ীর কবলে মৃত্যুবরণ করেছে।

তবে চোখে না-দেখলেও হন্তারক যে একটি হায়না সেই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না।

কয়েকদিন পরেই একটি ঘটনায় ২ প্রমাণ হল আমার ধারণা নির্ভুল।

আমার জন্য নির্দিষ্ট বাড়িটা তখনও তৈরি হয়নি। সবেমাত্র নির্মাণকার্য চলছিল। আমি একটা ঘাসের তৈরি কুঁড়েঘরে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিয়েছিলাম।

হঠাৎ একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি নিয়ে ঘুম ভেঙে জেগে উঠলাম। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সংকেত অগ্রাহ্য করে আবার শয্যা গ্রহণ করব কি না ভাবছি, হঠাৎ একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনলাম আমার বিছানার খুব কাছে। বালিশের তলা থেকে টর্চ নিয়ে জ্বেলে দিলাম।

পরক্ষণেই আমার চোখের সামনে তীব্র বৈদ্যুতিক আলোর মধ্যে ভেসে উঠল একটা প্রকাণ্ড হায়নার মূর্তি!

আমি স্তম্ভিত নেত্রে দেখলাম, আমার বিছানা থেকে মাত্র এক গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। জন্তুটা এত বড়ো হায়না ইতিপূর্বে আমার চোখে পড়েনি!

নিজের অজ্ঞাতসারেই আমার গলা থেকে বেরিয়ে এল এক তীব্র চিৎকার ধ্বনি, একলাফে শয্যা ত্যাগ করে ঘরের কোণ থেকে আমি বন্দুকটা টেনে নিলাম। এমনই দুর্ভাগ্য যে শুতে যাওয়ার আগে বন্দুকে গুলি ভরতে ভুলে গিয়েছিলাম। টেবিলের উপর একটা ছোটো বাক্সে টোটাগুলো রেখেছিলাম, হাত বাড়িয়ে বাক্সটা খুঁজছি, এমন সময়ে হল আর এক নূতন বিপদ! সাঁ করে ছুটে এল একটা দমকা হাওয়ার ঝটকা, আর সেই হাওয়ার ধাক্কা লেগে কুঁড়েঘরের নীচের দিকের ঝাঁপটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল!

(উগান্ডার যে অঞ্চলে আমি ছিলাম সেখানকার কুটিরগুলোর দরজায় কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। মেঝের সঙ্গে সমান্তরালভাবে উপর-নীচ লাগানো থাকত দুটি ঝপ বা দরজার পাল্লা।)

ঝাঁপের পাল্লাটা বন্ধ হয়ে যেতেই আমি চমকে উঠলাম। অত্যন্ত সঙ্গিন মুহূর্ত–পালানোর পথ বন্ধ দেখে হায়না হয়তো আমাকে এখনই আক্রমণ করবে। ঝপের নীচের অংশটা সে একলাফে টপকে যেতে পারে বটে কিন্তু পলায়নের ওই সহজ পন্থা তার মগজে ঢুকবে কি না। সন্দেহ।

বুনো জানোয়ার যদি নিজেকে কোণঠাসা মনে করে তাহলে সে সামনে যাকে পায় তার ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়ে।

জন্তুটার বিরাট দেহের দিকে তাকালাম।

সত্যি, এটা একটা অতিকায় হায়না।

যদি এক গুলিতে জন্তুটাকে শুইয়ে দিতে না-পারি তবে বন্ধ ঘরের মধ্যে হায়নার আক্রমণে, আমার মৃত্যু সুনিশ্চিত। খুব সাবধানে যতদূর সম্ভব আমি বন্দুকে গুলি ভরতে লাগলাম।

হঠাৎ বন্ধ ঘরের মধ্যে হল আর এক চতুষ্পদের আবির্ভাব! আমার বুল-টেরিয়ার শ্যাম বোধ হয় দরজার কাছেই ছিল–নীচের দিকের ঝাঁপটা একলাফে ডিঙিয়ে এসে শ্যাম হায়নাকে আক্রমণ করলে!

শ্যাম সাহসী কুকুর, কিন্তু বোকা নয়।

হায়নার ভয়ংকর দাঁত আর শক্তিশালী চোয়াল সম্বন্ধে সে যথেষ্ট সচেতন–চারপাশে ঘুরে ঘুরে আক্রমণ চালিয়ে শত্রুকে সে বিব্রত করে তুলল, কিন্তু হায়নার ঘাড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে নিজের জীবন বিপন্ন করলে না।

হায়নার দংশন অতি ভয়ংকর, এক কামড়েই সে শ্যামের মাথার খুলি ভেঙে দিতে পারে। বুদ্ধিমান কুকুর তাকে সেই সুযোগ দিলে না।

ইতিমধ্যে নিজেকে সামলে আমি এক লাথি মেরে দরজার নীচের অংশটা খুলে দিলাম। তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে হায়নাটা দূরের ঝোপ লক্ষ করে ছুটল।

আমি ততক্ষণে বন্দুকে গুলি ভরে ফেলছি।

জন্তুটাকে লক্ষ করে গুলি ছুড়লাম। নিশানা ব্যর্থ হল।

হায়নার ধাবমান দেহ অদৃশ্য হয়ে গেল অরণ্যের অন্তরালে।

বেশ কয়েকটা দিন কাটল নির্বিবাদে।

আমরা ভাবলাম খুনি বোধ হয় আমাদের আর বিরক্ত করবে না। কিন্তু কয়েকদিন পরেই আবার শুরু হল হত্যাকাণ্ড।

প্রতি রাত্রেই একটি কি দুটি ভেড়া হায়নার কবলে মারা পড়তে লাগল।

আমার জেদ চেপে গেল, জন্তুটাকে মারতেই হবে।

প্রতিদিন শেষরাতে ভোর হওয়ার একটু আগে আমি সমস্ত অঞ্চলটায় টহল দিতে শুরু করলাম। পরপর আটটি রাত কাটল, অবশেষে নবম রাত্রে আমার চেষ্টা সফল হল।

একটু দূরে অবস্থিত উঁচু জমির তলায় ঝোপের ভিতর, একটা কালো ছায়া যেন স্যাৎ করে সরে গেল!

হয়তো চোখের ভুল।

তবু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। না, ভুল হয়নি

হঠাৎ ঝোপের ওপর উঁচু জমির ওপর আত্মপ্রকাশ করল একটা চতুষ্পদ পশু!

নীলাভ-কৃষ্ণ আকাশের পটভূমিকায় উচ্চ ভূমির ওপর দণ্ডায়মান হায়নার দেহটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠল আমার দৃষ্টিপথে–লক্ষ্য স্থির করে গুলি ছুড়লাম।

গুলি লাগল হায়নার পেটে। দারুণ যাতনায় অস্থির হয়ে জন্তুটা নিজের উদর দংশন করতে লাগল। আবার অগ্নিবৃষ্টি করলে আমার বন্দুক, হায়নার মৃতদেহ উপর থেকে আছড়ে পড়ল নীচের জমিতে গুলি এইবার জন্তুটার মস্তিষ্ক ভেদ করেছে।

মৃত হায়নার কাছে এসে তাকে লক্ষ করতে লাগলাম। বিরাট জানোয়ার। জন্তুটার দেহে কিছু খুঁত আছে।

তার পিছনের একটি পা ভাঙা, অজ্ঞাত কোনো দুর্ঘটনার ফলে তার একটি চক্ষু হয়েছে অন্ধ এবং নাসিকার কিছু অংশ লুপ্ত হয়ে গেছে মুখের ওপর থেকে!

বিদ্যুৎচমকের মতো আমার মনে একটা সন্দেহের ছায়া উঁকি মারল, মুহূর্তের জন্য আমার মানসপটে ভেসে উঠল একটি মৃত মানুষের প্রতিমূর্তি!

কিছুদিন আগে যে নিগ্রো মজুরটি মারা গেছে তার সঙ্গে এই জন্তুটা অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে। পূর্বোক্ত মানুষটিরও ছিল একটি পা ভাঙা, একটি চোখ অন্ধ এবং ভূমিশয্যায় শায়িত এই মৃত হায়নার মতো তার মুখের উপরও ছিল না নাসিকার অস্তিত্ব।

আমার সর্বদেহের ভিতর দিয়ে ছুটে গেল আতঙ্কের শীতল স্রোত। পরক্ষণেই নিজের মনকে শাসন করলাম–বিকৃত দেহ মানুষ যদি থাকতে পারে তবে তার মতো একটা হায়নাই-বা থাকবে না কেন? দৈহিক সাদৃশ্যটা নিতান্তই ঘটনাচক্রের যোগাযোগ।

আমি আস্তানায় ফিরে এসে কয়েকজন শ্রমিককে হন্তারকের মৃত্যুসংবাদ দিলাম। তারা বিলক্ষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। আমি জন্তুটাকে মাটির নীচে কবর দিতে বললাম–হায়নার চামড়া কোনো কাজে লাগে না।

পরের দিন সন্ধ্যাবেলা মজুরদের আস্তানা থেকে একটা কোলাহল ধ্বনি আমার কর্ণগোচর হল। গোলমালের কারণ অনুসন্ধান করার জন্য আমি শব্দ লক্ষ করে পা চালিয়ে দিলাম।

নির্দিষ্ট স্থানে এসে দেখলাম, মৃত হায়নার দেহটা সেইখানেই পড়ে আছে। জন্তুটার পেট চিরে ফেলা হয়েছে। মৃত পশুটার থেকে একটু দূরে বসে একদল শ্রমিক গান ধরেছে উচ্চৈঃস্বরে। সঙ্গে সঙ্গে কর্কশ শব্দে বাজছে অনেকগুলো ঢাক!

ওইসঙ্গে আরও এক অদ্ভুত দৃশ্য আমার চোখে পড়ল। ভিড়ের ভিতর থেকে এক একজন এগিয়ে এসে হায়নাটার উপর জোরে জোরে ফুঁ দিচ্ছে আর সঙ্গেসঙ্গে দ্বিগুণ জোরে বেজে উঠছে। ঢাকের বাজনা এবং সমবেত কণ্ঠের ঐকতান!

একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে মজুরদের সর্দার। সর্দারের কাছে এগিয়ে গিয়ে এই অদ্ভুত আচরণের কারণ জানতে চাইলাম।

ওরা হায়নার মৃতদেহ থেকে প্রেতাত্মাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে, সর্দার উত্তর দিলে। এখন হায়নার দেহে আর প্রেত থাকবে না। সে চেষ্টা করবে অন্য কোনো দেহকে আশ্রয় করতে। এখানে উপস্থিত মানুষগুলোর মধ্যে হয়তো কারো ওপর সে ভর করতে পারে।

সেইজন্য তাকে আমরা তাড়িয়ে দিচ্ছি।

মূর্খ। তোমার দলের লোকগুলো তো একেবারেই বোকা, এদের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষা নেই, এরা কুসংস্কারের দাস, কিন্তু

একটু হেসে আমি বললাম, কিন্তু তুমি কিছু কিছু লেখাপড়া করেছ, তুমিও কি এইসব সংস্কারে বিশ্বাস করো?

না, বাওয়ানা, সর্দার বললে, আমার কুসংস্কার নেই। তবে তবে মানে আমি আপনাকে কয়েকটা জিনিস দেখাচ্ছি।

কথা অসমাপ্ত রেখেই সে একটি মজুরকে ইশারা করলে।

মজুরটি এগিয়ে এল।

সর্দার তার হাত থেকে কতকগুলি জিনিস তুলে নিয়ে আমার চোখের সামনে ধরলে।

কয়েকটা লম্বা লম্বা লোহার পেরেক, কয়েকটা পাথর আর ভাঙা কাঁচের টুকরো রয়েছে সর্দারের হাতে!

বাওয়ানা, সর্দার বললে, এই জিনিসগুলো পাওয়া গেছে হায়নার পেটের ভিতর!

আমি কথা বলতে পারলাম না, অনুভব করলাম আমার ঘাড়ের চুল খাড়া হয়ে উঠেছে কাঁটার মতো!

সবই কি ঘটনাচক্র?

একটা পা ভাঙা, একটি চক্ষু অন্ধ, মুখের ওপর ছিন্ন নাসিকার অংশ

সব কিছুই কি শুধু ঘটনাচক্রের যোগাযোগ?

অবশেষে এই পাথর, পেরেক আর কাঁচ?

মৃত মানুষটা কেন ওইসব বস্তু গলাধঃকরণ করেছিল জানি না, কিন্তু এই সৃষ্টিছাড়া হায়নাটাও বিশেষ করে ওই অখাদ্য বস্তুগুলিকে উদরস্থ করলে কেন?

আমি এই ঘটনার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারিনি। তবে অশিক্ষিত আফ্রিকাবাসীর বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে আজ আর আমি কুসংস্কার বলে অবজ্ঞা করতে পারি না।

কাহিনির লেখক কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। তিনি এখানেই সমাপ্তির রেখা টেনে দিয়েছেন।

আফ্রিকার অরণ্যসংকুল প্রদেশে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে যেসব শ্বেতাঙ্গ পর্যটক ও শিকারি ঘুরে বেড়িয়েছেন তাঁদের লিখিত রোজনামচায় অনেক অদ্ভুত ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। বিস্তীর্ণ আফ্রিকার বুকের ওপর ঘুমিয়ে আছে এক রহস্যময় জগৎ।

সভ্য পৃথিবী আজও সেই জাদুপুরীর দরজা খুলতে পারেনি।

পূর্ববর্ণিত ঘটনা-প্রসঙ্গে বলছি প্রেতাত্মার ভিন্ন দেহে আশ্রয় গ্রহণ করার আরও অনেক কাহিনি আফ্রিকাবাসীর মুখে মুখে শোনা যায়। অবশ্য যাবতীয় দুষ্কর্মের জন্য যে সবসময় অলৌকিক শক্তির অধিকারী জাদুকর বা প্রেতাত্মারা দায়ী হয় তা নয়–অনেক সময় পার্থিব জগতের সমাজবিরোধী দুরাত্মার দলও নির্বিচারে নরহত্যা করে অথবা পশুমাংসের লোভে প্রতিবেশীর পালিত পশুকে হত্যা করে বন্য জন্তুর ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়। প্রেত-আশ্রিত পশু ছাড়া । অরণ্যচারী হিংস্র শ্বাপদের আক্রমণও একটি কঠিন সমস্যা। সিংহ, লেপার্ড প্রভৃতি মাংসাশী শ্বাপদ যখন গৃহপালিত পশু হত্যা অথবা নরমাংসের প্রতি আসক্ত হয় তখন আত্মা, দুরাত্মা ও চতুষ্পদ শ্বাপদের ত্র্যহস্পর্শ যোগের ফলে যে বিচিত্র ধাঁধার সৃষ্টি হয় তার থেকে প্রকৃত অপরাধীকে আবিষ্কার করা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। এই বিষয়ে আলোচনা করতে হলে আফ্রিকার চিতামানুষ বা সিংহ মানুষ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলা দরকার।

আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে এক শ্রেণির দুবৃত্ত সিংহের মস্তক ও দেহচর্মের আবরণে আত্মগোপন করে নরহত্যায় প্রবৃত্ত হয়। নির্জন স্থানে অসতর্ক পথিককে দেখতে পেলে তারা হতভাগ্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

নকল সিংহের হাতে আসল সিংহের মতোই বাঁকা বাঁকা নখ বসানো নকল থাবা লাগানো থাকে। নখরযুক্ত ওই নকল থাবা দিয়ে হতভাগ্য মানুষের দেহটাকে ছিন্নভিন্ন করে দুবৃত্তরা তাকে হত্যা করে। কখনো কখনো হত্যাকাণ্ডের জন্য বিশেষ ধরনের ছোরা ব্যবহৃত হয়। নিহত মানুষের দেহে ক্ষতচিহ্ন দেখে মনে হয় বনবাসী সিংহের নখরাঘাতেই তার মৃত্যু হয়েছে।

সিংহের ছদ্মবেশে এইভাবে যারা নরহত্যা করে তাদেরই বলা হয় লায়ন-ম্যান বা সিংহ-মানুষ।

সিংহ-মানুষের মতো চিতা-মানুষও একই উপায়ে নরহত্যা করে। তফাত শুধু এই যে লেপার্ডম্যান বা চিতা-মানুষ সিংহের ছদ্ম আবরণের পরিবর্তে চিতাবাঘের ছদ্মবেশ ধারণ করে।

আফ্রিকাবাসীদের বিশ্বাস এইসব নকল সিংহ-মানুষ বা চিতা-মানুষ ছাড়া এমন লোক আছে যারা ইচ্ছা করলেই নিজের নরদেহকে পরিবর্তিত করে হিংস্র শ্বাপদের রূপ ধারণ করতে পারে।

আফ্রিকার স্থানীয় মানুষের এইরূপ বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে কিছু কিছু ঘটনা দিয়ে বিচার করে হয়তো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব ছিল, কিন্তু আগেই বলেছি, নরখাদক শ্বাপদ, লৌকিক অপরাধী এবং অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী জাদুকরদের গোলকধাঁধার জটিলতা ভেদ করে প্রকৃত রহস্যের সমাধান করা খুব কঠিন কাজ। প্রসঙ্গত আর একটি ঘটনার উল্লেখ করছি।

উল্লিখিত কাহিনিটি বলেছেন ব্রিটিশ সরকারের একজন ইংরেজ কর্মচারী, নাম তার এইচ ডবলিউ টেলর।

টেলর সাহেবের লিখিত বিবরণী থেকে সংক্ষেপে কাহিনিটি বলছি :

ইথিওপিয়ান সোমালিল্যান্ডের সীমানায় সরকারের কার্যে নিযুক্ত হয়েছিলেন টেলর সাহেব। রাজনৈতিক কারণে পূর্বোক্ত অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে টহল দিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ কার্য চালাতেন–ওইটি ছিল তার কর্তব্য কর্ম।

বনচারী হিংস্র পশুরা তাদের রাজ্যে মানুষের অনধিকার প্রবেশ বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে রাজি হয়নি তাই গর্জিত রাইফেল আর উদ্যত নখান্তের সংঘর্ষে বনরাজ্যের শান্তিভঙ্গ হয়েছে বারংবার।

টেলর সাহেবের নিশানা ছিল অব্যর্থ; পশুরাজ সিংহের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বড়ো আনন্দ পেতেন মি. টেলর–তার রাইফেলের গুলি খেয়ে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে স্বর্গের দিকে প্রস্থান করেছিল অনেকগুলো সিংহ।

অন্যান্য হিংস্র জন্তুও তিনি শিকার করেছিলেন কিন্তু বিশেষভাবে তার মন এবং দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করেছিল পশুরাজ সিংহ।

টেলর যে অঞ্চলে সরকারের প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলেন সেই এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব ছড়িয়ে বাস করছিল এক বৃদ্ধ সিংহ। স্থানীয় নিগ্রোরা তার নাম দিয়েছিল লিবা। লিবা নরখাদক। তবে গৃহপালিত পশুর মাংসেও তার অরুচি ছিল না। স্থানীয় মানুষ তাকে ভয় করত যমের মতো।

জন্তুটার পদচিহ্ন দেখে খুব সহজেই তাকে শনাক্ত করা যেত। লিবা নামক সিংহটির বাঁ-দিকের থাবায় একটা আঙুল ছিল না, খুব সম্ভব কোনো ফাঁদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার সময়ে ওই আঙুলটাকে সে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিল।

নিহত গোরু-বাছুরের কাছে লিবার পায়ের চিহ্ন দেখলে স্থানীয় নিগ্রোরা আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে পড়ত। তারা সিংহটাকে কখনো হত্যা করার চেষ্টা করেনি। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে টেলর সাহেবকে খবর দিলে তিনি নিশ্চয়ই রাইফেল হাতে ছুটে আসতেন এবং নিহত শিকারের আশেপাশে লুকিয়ে থেকে লিবাকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করতেন।

মৃত পশুর মাংস খাওয়ার জন্য দ্বিতীয়বার অকুস্থলে আবির্ভূত হলেই লিবা পড়ত সাহেবের রাইফেলের মুখে।

কিন্তু নিগ্রোরা কখনো যথাসময়ে হত্যাকাণ্ডের সংবাদ সরবরাহ করত না। টেলর খবর পেতেন অন্তত দুই কি তিন দিন পরে ততক্ষণে লিবা শিকারের মাংস উদরস্থ করে সরে পড়েছে নির্বিবাদে। অনেক চেষ্টা করেও টেলর লিবার সাক্ষাৎ পাননি।

কিন্তু টেলর সাহেব লিবার সংবাদ না-রাখলেও লিবা নিশ্চয়ই সাহেবের খবর রাখত।

তখন বর্ষাকাল। বিশেষ কাজে টেলর তার দল নিয়ে টহল দিতে বেরিয়েছেন। টেলর গন্তব্যস্থলে উপস্থিত হওয়ার আগেই অরণ্যের বুকে উপস্থিত হল রাত্রির নিবিড় অন্ধকার। পরিশ্রান্ত টেলর তবু তাবু ফেলার আদেশ দিলেন না তিনি ভাবছেন কোনোরকমে সামনে আট মাইল পথ অতিক্রম করতে পারলেই তিনি গ্রামের মধ্যে এসে পড়বেন–তার মানসপটে ভেসে উঠেছে কুটিরের মধ্যে অবস্থিত একটি তপ্ত শয্যার লোভনীয় দৃশ্য।

হঠাৎ পিছন থেকে সশস্ত্র আস্কারিদের সর্দার তাকে জানিয়ে দিলে একটা সিংহ তাদের পিছু নিয়েছে। সাহেব ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না। এখানকার বনে-জঙ্গলে অনেক সিংহ আছে–সিংহকে ভয় করলে আফ্রিকার বনভূমিতে ঘোরাফেরা করা চলে না। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আট মাইল পথ পাড়ি দেওয়ার উৎসাহ আর রইল না–টেলর তাবু খাটাতে বললেন।

সেই রাতেই টেলরের আস্তানায় হল সিংহের আবির্ভাব। গভীর রাত্রে গোরু আর উটের দল দড়ি ছিঁড়ে বেড়া ভেঙে ছুটোছুটি করতে লাগল কয়েকটা জন্তু আবার বন্ধন মুক্ত হয়ে ছুটল জঙ্গলের দিকে… অরণ্যের অন্ধকার কালো যবনিকা ফেলে তাদের দেহগুলিকে ঢেকে ফেলল কিছুক্ষণের মধ্যে।

টেলর অথবা তার দলের লোকজন কোনো বন্য পশুর অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারলেন না, কিন্তু অনুমানে বুঝলেন একটু আগেই এখানে হয়েছিল সিংহের আবির্ভাব। গৃহপালিত জন্তুদের এই ধরনের আতঙ্কের একটিই কারণ থাকতে পারে সিংহ!

পশুরাজ অত্যন্ত ধূর্ত। সে এমনভাবে রজ্জবদ্ধ গোরু-বাছুরের কাছে এসে দাঁড়ায় যে মানুষরা সিংহের উপস্থিতি বুঝতে না-পারলেও জন্তুগুলো গায়ের গন্ধে পশুরাজের অস্তিত্ব বুঝতে পারে।

ভয়ে পাগল হয়ে জন্তুগুলো দড়ি ছিঁড়ে বেড়া ভেঙে ছুটোছুটি করতে থাকে এবং মানুষের নিরাপদ সান্নিধ্য ছেড়ে ছুটতে ছুটতে এসে পড়ে বনজঙ্গলের মধ্যে! এই সুযোগেরই অপেক্ষায় সিংহ পছন্দসই একটা মোটাসোটা গোরু অথবা বাছুরকে বধ করে শিকারের মাংসে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে। এখানেই সেই ব্যাপার।

অকুস্থলে লিবার মার্কামারা পায়ের ছাপ খুঁজে বার করলে আস্কারির দল। সেই রাত্রে লিবার অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল, একটি জন্তুকেও সে বধ করতে পারেনি।

রাত্রির পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা সকলেই খুব সতর্ক থাকল। কিন্তু লিবা দ্বিতীয়বার অকুস্থলে পদার্পণ করলে না।

টেলর সাহেব বিরক্ত হয়েছিলেন। পরদিন সকালে তিনি আস্কারিদের জানালেন, এখন তার কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা নেই। তিন-চার দিন এখানে থেকে তিনি লিবার খোঁজ করবেন।

ওই সময়ের ভিতর অন্তত একবার তিনি নিশ্চয়ই সিংহটাকে রাইফেলের আওতার মধ্যে পাবেন। হতভাগা খোঁড়া সিংহটা এই অঞ্চলে অনেকদিন অত্যাচার করছে, কিন্তু টেলারের দলের ওপর ইতিপূর্বে সে হামলা করেনি। টেলর তাকে ছাড়বেন না।

আগে লিবাকে হত্যা করে তারপর অন্য কাজ।

টেলরের সংকল্প শুনে আস্কারিদের সর্দার কয়েকবার ঢোঁক গিলে বললে, বাওয়ানা! আমরা কর্মচারী আদেশ পালন করতে আমরা বাধ্য। কিন্তু যদি আমাদের কথা শোনেন তবে বলব লিবার পিছনে তাড়া করে কোনো লাভ নেই। ওকে মারতে পারবেন না।

ক্রুদ্ধকণ্ঠে টেলর বললেন, কেন?

কারণ লিবা সত্যি সত্যি সিংহ নয়। ও একটা জাদুকর। মন্ত্রের গুণে মাঝে মাঝে সিংহের দেহ ধারণ করে। আমরা সবাই ওকে জানি।

টেলর সকৌতুকে প্রশ্ন করলেন, ওকে জানো? কী নাম তার?

উত্তরে আস্কারিদের সর্দার বললে, এই অঞ্চলে সবাই তাকে চেনে। সে বায় বাহ জাতীয় নিগ্রো, তার নাম আলি।

টেলর বিস্মিত হলেন। আলি তার অপরিচিত নয়। লোকটি বিচক্ষণ সাহসী ও বুদ্ধিমান। গভীর রাত্রে অনেকবার আলি জঙ্গলের পথ ভেঙে এসেছে তার কাছে আবার অন্ধকারের মধ্যেই ফিরে গেছে। তার হাতে একটা ছোটো লাঠি ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্র থাকত না। গভীর রাত্রে শ্বাপদসংকুল বনভূমির ভিতর দিয়ে অস্ত্র হাতে যাতায়াত করাও বিপজ্জনক নিরস্ত্র অবস্থায় অন্ধকার বনপথে পদার্পণ আত্মহত্যারই নামান্তর। কিন্তু আলি রাতের পর রাত নির্ভয়ে বনের পথে যাতায়াত করত।

সম্বল ছিল তার একটি তুচ্ছ লাঠি!

টেলর আস্কারিদের কথা বিশ্বাস করেননি।

তবে তিনি কথা দিলেন যে লিবাকে হত্যার করার চেষ্টা তিনি করবেন না।

টেলর বুদ্ধিমান মানুষ তিনি জানতেন নিগ্রোদের সংস্কার বা বিশ্বাসে আঘাত দিলে অনেক সময় পরিণাম খুব খারাপ হয়। একটা সিংহের জন্য দলের লোকের কাছে অপ্রীতিভাজন হওয়ার ইচ্ছা তাঁর ছিল না।

এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই দৈবক্রমে হঠাৎ আলির সঙ্গে টেলর সাহেবের দেখা হয়ে গেল। আলি তাকে খুব প্রশংসা জানিয়ে বললে যে মি. টেলর লিবাকে হত্যা করার সংকল্প ত্যাগ করে বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। সাদা চামড়ার মানুষগুলো সাধারণত নির্বোধ হয় কিন্তু মি. টেলর হচ্ছেন নিয়মের ব্যতিক্রম, তার স্বদেশবাসীর মতো তিনি যে মূর্খ নন এই কথা জেনে আলি অতিশয় আনন্দিত হয়েছে।

টেলর সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন, তুমিই কি লিবা?

আলি উত্তর দিলে না। বাঁ-হাতটাকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।

টেলর দেখলেন আলির বাঁ-হাতের একটা আঙুল নেই!

আলি গম্ভীর স্বরে বললে, আমি আপনার কিছু উপকার করব। আমি জানি কিছুদিন আগেও সিংহের মুখে আপনার জীবন বিপন্ন হয়েছিল। তা ছাড়া সিংহের উপদ্রবে আপনি মাঝে মাঝে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এ-কথাও আমার অজানা নয়। আমার আদেশে আজ থেকে এই অঞ্চলের সিংহরা আপনাকে বা আপনার দলভুক্ত লোকজনদের কখনো আক্রমণ করবে না। সিংহের সম্মুখীন হলেও আপনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ থাকবে।

এমন গম্ভীরভাবে সে কথাগুলো বললে যে তার বক্তব্য বিষয়কে টেলর সাহেব লঘু বিদ্রূপ বলে মনে করতে পারলেন না।

টেলর অবরুদ্ধ হাস্য দমন করলেন, তারপর তিনিও গম্ভীর হয়ে বললেন, আমার ঘোড়া, গোরু আর অন্যান্য পোষা জানোয়ারগুলি সম্বন্ধেও আমি নিরাপত্তার দাবি করছি।

তুমি সিংহদের নিষেধ করে দিয়ে তারা যেন আমার পোষা জন্তুগুলিকে রেহাই দেয়।

আলি প্রতিবাদ করে বললে, তা কী করে হবে? ঘোড়া, গোরু প্রভৃতি জন্তু হচ্ছে সিংহের খাদ্য। আমার সিংহরা তাহলে খাবে কী?

টেলর বললেন, পোষা জানোয়ার সিংহের খাদ্য নয়। তারা বুনো জন্তু মেরে খাবে।

অনেক তর্কবিতর্কের পর সাহেবের অনুরোধ রক্ষা করতে রাজি হল আলি, কিন্তু তারও একটা শর্ত ছিল–

টেলর কোনো কারণেই সিংহ শিকার করতে পারবেন না।

আলির প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন টেলর।

আস্কারিরা যখন শুনল সিংহের দলপতি আলির সঙ্গে সাহেবের সন্ধি হয়েছে তখন তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল।

টেলর প্রথমে আলির কথার বিশেষ গুরুত্ব দেননি। কিন্তু কিছুদিন পরেই যখন তিনি লক্ষ করলেন যে সিংহরা তার দলের মানুষ ও পশু সম্বন্ধে হঠাৎ খুব উদাসীন হয়ে পড়েছে তখন আর আলির কথাগুলো তিনি উড়িয়ে দিতে পারলেন না।

সকাল বেলা উঠে অনেকদিনই তাবুর কাছে রজ্জবদ্ধ গোরুর পাল ও অশ্বদলের নিকটবর্তী জমির ওপর তিনি সিংহের পদচিহ্ন দেখেছেন।

পায়ের ছাপগুলো দেখে বোঝা যায়, সিংহরা খুব কাছে এসে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে আবার বনের আড়ালে সরে গেছে! টেলরের দলের মানুষ কিংবা পশুর ওপর তারা হামলা করেনি!

একবার নয়, দু-বার—

বারংবার হয়েছে এই ধরনের বিভিন্ন ঘটনার পুনরাবৃত্তি। টেলরের বিবরণীতে আলির বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য লিখিত নেই। ওই অঞ্চলের সিংহরা হঠাৎ তাঁর দলের মানুষ ও পশু সম্বন্ধে অহিংস হয়ে যাওয়ায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আলির অলৌকিক ক্ষমতায় তিনি বিশ্বাস করেছিলেন কি না জানি না।

তবে তিনি তার শর্ত রক্ষা করেছিলেন। টেলর সাহেব পরবর্তীকালে কখনো সিংহ শিকার। করেননি!

[ফাল্গুন ১৩৮০]

 আমেরিকার সিংহ

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীরা যে বিড়াল-জাতীয় জীবটিকে পার্বত্য-সংহ নামে অভিহিত করে সেই জন্তুটি কিন্তু সিংহ নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন জানোয়ার।

পার্বত্য-সিংহ নামক জন্তুটির আরও কয়েকটি প্রচলিত নাম আছে, যেমন- পুমা, কুগার, প্যান্থার প্রভৃতি। এই নামগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত দুটি নাম হচ্ছে পুমা এবং কুগার।

সিংহের সঙ্গে পুমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কিছুটা সাদৃশ্য আছে, পুমার গায়ের রংও অনেকটা সিংহের মতো। তবে স্বভাব-চরিত্রের দিক থেকে বিচার করলে সিংহের সঙ্গে পুমার বিশেষ মিল নেই। নিতান্ত বিপদে না পড়লে পুমা লড়াই করতে চায় না, বরং পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করে; কিন্তু পশুরাজ সিংহের রাজকীয় মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হলে সে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিদ্বন্দীর বিরুদ্ধে মৃত্যুপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।

সিংহ, বাঘ, লেপার্ড প্রভৃতি বিড়াল-জাতীয় বড়ো বড়ো জানোয়ারের মতো হিংস্র নয় পুমা, তাকে দস্তুরমতো নিরীহ বলা যায়। মানুষকে সে পারতপক্ষে আক্রমণ করে না। তবু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশুপালকরা পুমার সম্বন্ধে অত্যন্ত বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। তার কারণ মানুষকে ভয় করলেও গৃহপালিত পশুর মাংস পুমার প্রিয় খাদ্য। প্রতি বৎসর বহু সংখ্যক গোরু, বাছুর, ভেড়া প্রভৃতি গৃহপালিত পশু পুমার আক্রমণে প্রাণ হারায়। এমনকি ঘোড়ার মতো বলিষ্ঠ জানোয়ারও পুমার কবল থেকে নিষ্কৃতি পায় না। সেইজন্য পশুপালকদের কাছে পুমা হচ্ছে। চোখের বালির মতোই দুঃসহ।

পুমাকে হত্যা করার জন্য শিকারিরা শিক্ষিত কুকুরের সাহায্য গ্রহণ করে। এই হাইল্ড বা শিকারি ককর দলবদ্ধ হয়ে পমাকে অনুসরণ করে এবং পলাতক পমার গায়ের গন্ধ শুঁকে শুঁকে তারা গ্রেপ্তার করে ফেলে, বেচারা পুমা কুকুরের প্রখর ঘ্রাণ ইন্দ্রিয়কে কিছুতেই ফাঁকি দিতে পারে না। কোণঠাসা হলে পুমা সাধারণত গাছে উঠে সারমেয়-বাহিনীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে কুকুরের চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে অকুস্থলে উপস্থিত হয় বন্দুকধারী শিকারি এবং তারপরই গুলিবিদ্ধ পুমার প্রাণহীন দেহ আছড়ে পড়ে মাটির উপর। অনেক সময় শিকারিকে আসতে দেখলে পুমা গাছের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে সারমেয়-বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে ছুটে পালাতে চায়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার চেষ্টা সফল হয় না– দলবদ্ধ শিকারি কুকুরের আক্রমণে পুমার সর্বাঙ্গ হয়ে যায় ছিন্নভিন্ন।

তবে সব নিয়মেরই ব্যতিক্রম আছে। ফ্ল্যাটহেড নামক যুক্তরাষ্ট্রের এক অঞ্চলে হঠাৎ একবার আবির্ভূত হল একটি পুমা এবং কিছুদিনের মধ্যে সে এমন ভয়ংকর স্বভাবের পরিচয় দিল যে শিকারিরা হয়ে গেল স্তম্ভিত, স্থানীয় মানুষ হয়ে পড়ল সন্ত্রস্ত। এই সৃষ্টিছাড়া পুমাটা সারমেয়ে-বাহিনীর কাছে পরাজয় স্বীকার করত না, আক্রান্ত হলেই সে অদ্ভুত সাহস ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে প্রতি-আক্রমণ করে কুকুরের দলকে বিধ্বস্ত করে ফেলত এবং শিকারি অকুস্থলে উপস্থিত হওয়ার আগেই চটপট পা চার্লিয়ে নিরাপদ স্থানে প্রস্থান করত। শিকারি এসে দেখত তার প্রিয় কুকুরদের মধ্যে অধিকাংশের দেহের উপরই রয়েছে পুমার ধারালো নখের রক্তাক্ত স্বাক্ষর, দটি বা একটি কুকুরের প্রাণহীন দেহ হয়েছে ধরাশয্যায় লম্বমান এবং বাকি কুকুরগুলো আতঙ্কে এমন বিহ্বল হয়ে পড়েছে যে তারা আর ওই বিপদজনক বিড়ালের পিছু নিতে রাজি নয়।

বারংবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার ফলে কুকুরের দল ঘাবড়ে গেল, ওই পুমাটার গায়ের গন্ধ পেলে তারা আর শিকারকে অনুসরণ করতে রাজি হত না কিছুতেই।

অনেক চেষ্টা করেও এই জন্তুটাকে কোনো শিকারি হত্যা করতে পারেনি, অবশেষে হঠাৎ এক অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনায় পুমাটার মৃত্যু হয়।

পুমার সম্বন্ধে বিভিন্ন ধরনের পরস্পরবিরোধী মতামত শোনা যায়। অধিকাংশ শিকারি ও প্রাণিতত্ত্ববিদের অভিমত হচ্ছে পুমা নিতান্তই ভীরু জানোয়ার, মানুষকে সে কখনোই আক্রমণ করতে চায় না। কিন্তু দু-একজন শিকারি ভিন্নমত পোষণ করেন; তাঁরা বলেন, সুযোগ পেলে পুমা মানুষকে আক্রমণ করে, এমনকি নরমাংসের আস্বাদ গ্রহণ করতেও নাকি তাদের আপত্তি নেই!

এ বিষয়ে জোর করে কিছু বলা মুশকিল, তবে দু-একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণী পাঠ করে মনে হয় মাংসাশী বন্যপশুর স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়।

উত্তর আমেরিকার এক গভীর অরণ্য থেকে ফিরে এসে জনৈক শিকারি ঘোষণা করল, যে সব বইতে পুমাকে নিরীহ বলে উল্লেখ করা হয় সেই সব বই অবিলম্বে অগ্নিতে সমর্পণ করা উচিত এবং যে-সব বিশেষজ্ঞ ওই জন্তুটিকে হিংস্র নয় বলেছেন, তাঁদের কথাও আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়। উক্ত শিকারির বিবরণী থেকে যে ঘটনা জানা যায় তাতে অবশ্য পুমাকে নিরীহ আখ্যা দেওয়া অসম্ভব। ঘটনাটি নিম্নে বর্ণিত হল :

উত্তর আমেরিকার এক অরণ্য-আবৃত পর্বত-সঙ্কুল অঞ্চলে জনৈক শিকারি হরিণ শিকার করতে যায়। শিকারির নাম হল অ্যান্ড্র এস ফুলার। ছোটোখাটো হরিণের দিকে তার নজর ছিল না, তার প্রার্থিত জীব ছিল এ নামক মহাকায় হরিণ।

ডেভ রোজার্স নামক আর একটি শিকারি ছিল ফুলারের সঙ্গী, তাদের পথ-প্রদর্শক হল এড কেনেডি নামধারী একজন স্থানীয় অধিবাসী। শিকারিরা প্রত্যেকেই ঘোড়ার পিঠে যাত্রা শুরু করেছিল, তা ছাড়া প্রয়োজনীয় মালপত্র বহন করার জন্য তারা আরও তিনটি অতিরিক্ত ঘোড়া সঙ্গে নিয়েছিল।

শিকারিরা প্রথম দিন তাবু ফেলল একটা পাহাড়ের নীচে। জায়গাটা অত্যন্ত নির্জন। একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে একটা মস্ত বড়ো পাথরের মধ্যস্থলে অবস্থিত জমিটার উপর দাঁড়িয়ে শিকারিরা দেখল, পূর্বোক্ত পাথরের ঢালু দেয়াল নেমে গেছে একটা গভীর খাদের মধ্যে এবং সেই সুগভীর খাদের বক্ষ ভেদ করে ছুটে চলেছে এক পার্বত্য-নদীর তীব্র জলস্রোত। উপরে পাহাড়ের মাথায় দেখা যাচ্ছে তুষারের শুভ্র আস্তরণ, নীচের দিকেও যতদূর দেখা যায় চোখে পড়ে শুধু বরফ আর বরফ।

ওইখানেই শিকারিরা আস্তানা পাতল। সন্ধ্যার সময়ে ডেভকে তাবুর পাহারায় রেখে ফুলার ও এড হানা দিল নিকটবর্তী অরণ্যে। একটু পরেই তাদের গুলিতে মারা পড়ল একটা হরিণ। এই জন্তুটা অবশ্য এ হরিণ নয়, তবে মাংসের জন্যই তারা জন্তুটাকে বধ করতে বাধ্য হয়েছিল। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার জন্য তাদের টাটকা খাদ্য অর্থাৎ টাটকা মাংসের প্রয়োজন ছিল।

এল রাত্রি। শিকারিরা মৃত হরিণটাকে একটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিয়ে তাঁবুর ভিতর শয্যাগ্রহণ করল। হরিণের দেহটা তারা তাঁবুর মধ্যে রাখেনি, কারণ মাংসের লোভে হয়তো কোনো বুনো জানোয়ার তাবুতে হানা দিতে পারে, কিন্তু গাছের উপর ঝোলানো মৃগ-মাংসকে শিকারিরা বন্যপশুর নাগালের বাইরে নিরাপদ বলে বিবেচনা করেছিল। পরের দিন সকালে উঠেই শিকারিদের আক্কেলগুড়ুম! গাছের উপর হরিণটা স্বস্থানে আছে বটে কিন্তু সম্পূর্ণ নেই। হরিণের দেহ থেকে বেশ কিছু মাংস হয়েছে অদৃশ্য!

গাছের নীচে জমি পরীক্ষা করে শিকারিরা পুমার পায়ের ছাপ দেখতে পেল। পদচিহ্ন পরীক্ষা করে তারা বুঝল, জন্তুটার ওজন হবে দেড়শো থেকে দুশো পাউন্ড!

হানাদার পুমাটা নেহাত ছোটোখাটো জীব নয়!

ফুলার লক্ষ করল পথ-প্রদর্শক এড কেনেডির মুখে ফুটে উঠেছে দারুণ বিস্ময়ের চিহ্ন, সে যেন হতভম্ব হয়ে পড়েছে।

ফুলার প্রশ্ন করল, কি ভাবছ তুমি?

এড বলল, আমি ভাবছি জন্তুটা গাছে উঠে মাংস নিয়ে গেল অথচ এত কাছে দাঁড়িয়েও ঘোড়াগুলো পুমার উপস্থিতি টের পেল না!

সত্যি কথা। পুমাকে দেখতে পেলে বা তার গায়ের গন্ধ পেলে নিশ্চয়ই ঘোড়াগুলো চিৎকার করে শিকারিদের ঘুম ভাঙিয়ে দিত; কিন্তু এমন নিঃশব্দে, এমন ক্ষিপ্রগতিতে জন্তুটা গাছে উঠে মাংস নিয়ে গেছে যে নিকটবর্তী ঘোড়গুলির সম্মিলিত দৃষ্টিশক্তি, ঘ্রাণশক্তি ও শ্রবণশক্তি শ্বাপদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারেনি।

পুমাটা অসাধারণ চটপটে আর ধূর্ত ছিল সন্দেহ নেই, তবে ঘোড়ার মতো প্রখর অনুভূতি। সম্পন্ন জানোয়ারকে বার বার ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়দ্বিতীয় রাত্রে তীব্র হ্রেষাধ্বনিতে শিকারিদের ঘুম ভেঙে গেল।

এড এবং ডেভ শয্যাত্যাগ করার আগেই ফুলার রাইফেল হাতে তাবুর বাইরে পদার্পণ করল। অগ্নিকুণ্ডের আলোতে অস্পষ্টভাবে পুমার দেহটা ফুলারের চোখে পড়ল, চকিতে রাইফেল তুলে সে গুলি চার্লিয়ে দিল। রাইফেলের যান্ত্রিক গর্জনধ্বনিকে ডুবিয়ে দিয়ে জেগে উঠল জান্তব কণ্ঠের তীব্র ও তীক্ষ্ণ চিৎকার- পরক্ষণেই অন্ধকারের চেয়েও কালো এক চতুস্পদ ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল অন্ধকার অরণ্যের অন্তঃপুরে!

এড আর ডেভ এসে দাঁড়াল ফুলারের পাশে। এড বলল, জন্তুটার চিৎকার শুনে বোঝা যায় সে আহত হয়েছে। তার ধারণা, অবশিষ্ট মৃগ-মাংসের সন্ধানেই পুমাটা আবার তাঁবুর কাছে এসেছিল।

ফুলার কিন্তু সঙ্গীর মন্তব্যে সায় দিল না। তার ধারণা জন্তুটা শিকারির দলকে অনুসরণ করছে।

এড হেসে জানিয়ে দিল ফুলারের সন্দেহ অমূলক, একেবারে কোণঠাসা না হলে পুমা কখনও মানুষকে আক্রমণ করতে চায় না।

ফুলারের গুলিতে পুমাটা আহত হয়েছিল। সকালে উঠে ফুলার জন্তুটার পায়ের ছাপ ধরে সেটাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করল। পুমার একটা থাবা মাটির উপর দিয়ে ঘষে ঘষে গেছে দেখে শিকারিরা বুঝতে পারল ফুলারের গুলি জন্তুটার একটা থাবা জখম করে দিয়েছে।

একটু পরেই ফুলার আবিষ্কার করল এক ভয়াবহ তথ্য! শিকারিরা ঘুরছে পুমার পিছনে, কিন্তু পুমার পায়ের ছাপ দেখে বোঝা যায় বৃত্তাকারে ঘুরে এসে সে শিকারিদের পিছু নিয়েছে।

ফুলার সন্ত্রস্ত্র হয়ে উঠল। তার সঙ্গীরা অবশ্য ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিল না। এড বলল, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, বিড়াল-জাতীয় জানোয়ারের মধ্যে কৌতূহল খুব প্রবল, তাই কৌতূহল চরিতার্থ করার জন্যই পুমা শিকারিদের অনুসরণ করতে উদ্যত হয়েছে।

ফুলারের অস্বস্তি দূর হল না। তার কেবলই মনে হতে লাগল পুমা জানে কে তাকে আঘাত করেছে। তাই প্রতিশোধ নেবার জন্যই জন্তুটা তাকে অনুসরণ করছে।

একটু পরেই তার সন্দেহ আরও দৃঢ় হল। ডান দিকে একটা মস্ত পাথরের উপর পুমার মাথাটা। তার নজরে পড়েছে।

পাথরটার উপর থেকে পুমা নীচের দিকে তাকিয়ে অশ্বারোহী শিকারিদের লক্ষ্য করছিল– জটার ঈষৎ হাঁ করা মুখের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা ধারালো দাঁতগুলো দেখে শিউরে উঠল ফুলার।

এড এবং ডেভ জন্তুটাকে দেখতে পায়নি। ঘোড়ার পিঠ থেকেই পুমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুডল ফুলার। পমার মুখের কাছেই একটা পাথরের উপর তীব্র সংঘাতের শব্দ তুলে গুলিটা ঠিকরে পড়ল, ভয়ার্তকণ্ঠে চিৎকার করে পুমাও গা-ঢাকা দিল তৎক্ষণাৎ!

পুমা যে তাদের অনুসরণ করছে এবং তার উদ্দেশ্য যে ভালো নয় এ বিষয়ে ফুলারের আর সন্দেহ ছিল না। ডেভ ও এড অবশ্য ফুলারের সন্দেহ অমূলক বলে উড়িয়ে দিল। এড আরও বলল যে, কয়েক মাইল দূরে যে কাঠের ঘরটা আছে শীঘ্রই তারা সেখানে পৌঁছে যাবে, কাজেই এ যাত্রায় আর মি, কুগারের সঙ্গে তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

ফুলারের ধারণা অবশ্য অন্যরকম, তবে সে তর্ক না করে ঘোড়া চার্লিয়ে দিল গন্তব্য পথের দিকে…

যে কাঠের ঘরটার কথা এড কেনেডি তার সঙ্গীদের কাছে বলেছিল, সেই ঘরটার সামনে তারা যখন এসে পৌঁছল তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আমেরিকার বনে-জঙ্গলে এই ধরনের কাঠের ঘর দেখা যায়; ঘরগুলি কোনো ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি নয়। ভবঘুরে শিকারিরা এগুলো তৈরি করে ভবঘুরে শিকারিদের জন্যই। এই সব ঘরের দরজা-জানালাও অনেক সময় থাকে না। এই ঘরটা অবশ্য দরজা থেকে তখনও বঞ্চিত হয়নি, তবে দু-দুটো জনালার মধ্যে একটারও পাল্লার বালাই ছিল না! খোলা জানালা দিয়ে ঘরের ভিতর ছুটে আসছিল ঠান্ডা হাওয়া। হরিণের চামড়া দিয়ে জানালা দুটির ফাঁক বন্ধ করে শিকারিরা কনকনে ঠান্ডা বাতাসের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করল। এড আগুন জ্বালিয়ে খাদ্য প্রস্তুত করতে লাগল। শিকারিদের সঙ্গে কিছুটা মৃগমাংস ছিল, সেই মাংসের টুকরোটা তারা ছাদের বরগার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘরের তিনটি কোণে শয্যা প্রস্তুত করে তিন সঙ্গী যখন নিদ্রাদেবীর আরাধনায় মনোনিবেশ করল, বাইরে তখন নেমে এসছে রাত্রির অন্ধকার…

গভীর রাতে হঠাৎ ডেভ-এর ডাকাডাকিতে ফুলারের ঘুম ভেঙে গেল। ডেভ ফুলারকে জানাল বাইরে তাদের ঘোড়াগুলিকে সে বেঁধে রেখেছিল বটে, কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে উত্তেজিত হয়ে দুটি ঘোড়া অন্ধকার অরণ্যের গর্ভে আত্মগোপন করেছে। অতএব এডকে নিয়ে সে এখনই পলাতক অশ্ব দুটিকে গ্রেপ্তার করতে বাইরে যাচ্ছে, ফুলার যেন সাবধানে থাকে।

আচ্ছা, বলেই ফুলার আবার ঘুমিয়ে পড়ল। জেগে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেও সে কৃতকার্য হল না, তার শ্রান্ত ক্লান্ত দেহ তখন বিশ্রাম চাইছে নিদ্রাদেবীর ক্রোড়ে..

আচম্বিতে ঘুম ভেঙে ফুলার সচমকে উঠে বসল, তার শ্রবণ-ইন্দ্রিয়ে প্রবেশ করেছে একটা ঘর্ষণ-শব্দ।

প্রথমে সে ভাবল ঘোড়াগুলো হয়তো পা ঠুকছে, কিন্তু ভালো করে কান পেতে শুনে সে বুঝতে পারল, পাহাড়ের দিকে যে জানালাটা আছে সেই জানালার সঙ্গে ঝোলানো হরিণের চামড়াটার উপর কেউ যেন নখ দিয়ে আঁচড় কাটছে।

নখের আঁচড় কাটার শব্দ!

মোটেই ভালো কথা নয়।

মুহূর্তের মধ্যে ফুলারের ঘুমের ঘোর কেটে গেল, সে শয্যাত্যাগ করার উপক্রম করল।

কিন্তু ফুলার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ানোর আগেই হরিণের চামড়াটা কোনো অদৃশ্য হাতের ধাক্কা খেয়ে ঘরের ভিতর দিকে সরে এল এবং মুক্ত বাতায়ন-পথে মেঝের উপর সশব্দে অবতীর্ণ হল এক অতিকায় মাজারের দেহ পুমা।

দারুণ আতঙ্কে ফুলারের দেহের রক্ত যেন ঠান্ডা হয়ে গেল। পুমা তার দিকে চাইল না, শ্বাপদের জ্বলন্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে সেই দিকে যেখানে ছাদের বরগা থেকে ঝুলছে একখণ্ড মৃগ-মাংস।

পুমা এইবার দৃষ্টি সঞ্চালিত করল ফুলারের দিকে সঙ্গে সঙ্গে তার কণ্ঠে জাগল অবরুদ্ধ গর্জনধ্বনি এবং উন্মুক্ত মুখগহ্বরের ভিতর থেকে উঁকি দিল ভয়ংকর দাঁতের সারি!

ফুলার ঘরের কোণে অবস্থিত রাইফেলটার দিকে সতৃষ্ণনয়নে দৃষ্টিপাত করলে এবং অস্ত্রটাকে হাতের কাছে না রাখার জন্য নিজেকে অভিসম্পাত দিল বারংবার।

পুমা ঘরের মেঝের উপর নীচু হয়ে বসে পড়ল, তার কান দুটো চ্যাপ্টা হয়ে মাথার খুলির সঙ্গে মিশে গেল বিড়াল-জাতীয় পশুর আক্রমণের নিশ্চিন্ত সংকেত। ফুলার একবার ভাবল লাফ মেরে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে চম্পট দেওয়ার চেষ্টা করবে, কিন্তু পরক্ষণেই সে বুঝল, পিছন থেকে আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার কোনো চেষ্টাই সে করতে পারবে না, অতএব পলায়নের কথা ভুলে গিয়ে সে বিছানার পাশে হাত বাড়িয়ে লম্বা ছুরিটা তুলে নিয়ে প্রস্তুত হল যুদ্ধের জন্য…

হিংস্র দন্তবিকাশ করে সগর্জনে লাফ দিল পুমা, বিদ্যুৎবেগে নীচু হয়ে ফুলার শ্বাপদের আক্রমণ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। পুমার ধারালো নখগুলি শত্রুর কাঁধের উপর এঁকে দিল সুগভীর ক্ষতচিহ্ন, তৎক্ষণাৎ শাপদের পাঁজর ভেদ করে বসে গেল শিকারির হাতের শাণিত ছুরিকা!

তীব্র আর্তনাদ করে পুমা ছিটকে পড়ল দেয়ালের উপর এবং সেখান থেকে ঠিকরে এসে মেঝের উপর গড়িয়ে পড়ল। এক লাফে ঘরের অপর প্রান্ত থেকে রাইফেলটা হস্তগত করে ফুলার প্রস্তুত হল চরম মুহূর্তের জন্য।

আহত পুমা আবার তেড়ে এল। ফুলার গুলি চার্লিয়ে দিল জন্তুটার মুখ লক্ষ্য করে। ভীষণ চিৎকারে ঘর কাঁপিয়ে পুমা পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপরই মেঝের উপর ছিটকে পড়ে ছটফট করতে লাগল। ফুলার আরও তিনবার গুলি ছুড়ল, পুমার দেহটা একবার টান হয়েই স্থির হয়ে গেল। ফুলার যখন বুঝল, জন্তুটার দেহে প্রাণ নেই, তখন রাইফেল নামিয়ে সে দেয়ালে পিঠ রেখে বসে পড়ল– দারুণ আতঙ্ক ও উত্তেজনায় তার সর্বশরীর হয়ে পড়েছে।

প্রায় এক ঘণ্টা পরে ডেভ আর এড যখন ঘরে ঢুকল তখন ফুলার কাঁধের ক্ষতটার উপর একটা ব্যান্ডেজ বাঁধার চেষ্টা করছে। ঘরের মধ্যে পুমার মৃতদেহ এবং ফুলারের রক্তাক্ত কাঁধের দিকে তাকিয়ে এড আর ডেভ সহজেই অনুমান করে নিল ব্যাপারটা কি হয়েছে।

দারুণ বিস্ময়ে এড যে শপথ বাক্যাটি উচ্চারণ করল সিধে বাংলায় তার অর্থ হচ্ছে, এ কি দেখছি! পুমা এগিয়ে এসে মানুষকে আক্রমণ করে।

হঠাৎ ফুলারের দৃষ্টি পড়ল ছাদের বরগার সঙ্গে ঝোলানো মৃগ-মাংসের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ফুলারের মনে হল হয়তো ওই মাংসের লোভেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করেছিল পুমা, প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছা তার ছিল না–

মাংস-লোপ ক্ষুধার্ত পুমাকে হয়তো ফুলার প্রতিশোধ পরায়ণ শ্বাপদ বলে ভুল করছে, হয়তো যে সব বিশেষজ্ঞ ও প্রাণিতত্ত্ববিদ পুমার নিরীহ স্বভাবের কথা উল্লেখ করেছেন তাদের কথাই ঠিক, কিন্তু–

হ্যাঁ, তবু একটা কিন্তু থেকে যায়। যে কোনো কারণেই হোক এই পুমাটা মানুষের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে ঘরের ভিতর প্রবেশ করেছিল এবং জানলার খোলা পথে পালানোর উপায় থাকা সত্ত্বেও সে মানুষকে আক্রমণ করতে একটুও ইতস্তত করে নি।

উদভ্রান্ত শিকারি

কর্মোপলক্ষ্যে নিউজিল্যান্ড থেকে ভারতবর্ষের বিহার অঞ্চলে জেমস ইংলিস নামে এক সাহেবের রোমাঞ্চকর একটি শিকারের অভিজ্ঞতা তোমরা কিছুদিন আগে সন্দেশ-এ পড়েছ। এবার তার আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা তোমাদের বলব।

বিশেষ কোনো কারণে কিছুদিনের জন্য মাতৃভূমি নিউজিল্যান্ডে গিয়েছিলেন জেমস ইংলিস। ফিরে এসে তিনি দেখেন তার কাজের জায়গা বদলে গেছে। এবার তাঁকে যেতে হবে অযোধ্যা প্রদেশের উত্তর-অঞ্চলে অবস্থিত বিশাল তৃণভূমিতে। সেখানে তাঁর বাসস্থানটিও নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে।

এলাকাটি ইংলিস সাহেবের সম্পূর্ণ অপরিচিত। ওখানকার মানুষের রীতিনীতিও তার অজানা। তা ছাড়া বাঙালি সংলাপে অভ্যস্ত থাকলেও অযোধ্যার বাসিন্দাদের ভাষা বুঝতে প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হচ্ছিল। আরো এই যে, তার প্রথম বারের জায়গা কুশীনদের তীরে বনভূমির সঙ্গে অযোধ্যার বন্য প্রকৃতির কোনো সাদৃশ্য ছিল না। এখানে শস্যের চেহারা অন্যরকম, চাষবাসের ব্যবস্থা আগের তুলনায় আদিম। বালুকাময় প্রান্তরের মধ্যে সুদীর্ঘ ঘাসজঙ্গলের পরিবর্তে অযোধ্যায় দেখা যায় ছায়া নিবিড় অরণ্যের জটিল সমাবেশ, আর সেই অরণ্যের ফাঁকে ফাঁকে তৃণগুল্মে আবৃত অসংখ্য প্রান্তর বহু দূর প্রশস্ত বিস্তার। কৃষ্ণসার নামে হরিণজাতীয় পশুরা দলে দলে ঘুরে বেড়ায় ওইসব প্রান্তরের বুকে।

বনভূমির সবচেয়ে কাছাকাছি শহর সাজাহানপুর অঞ্চলের দক্ষিণে প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে ওই শহরটির অবস্থান। উত্তরদিকে মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট, নাম সীতাপুর। সীতাপুরের মাঝখানে একটি গ্রাম আর পুলিশ স্টেশন।

ইংলিসের সঙ্গে ছিল একটি হস্তিনী, নাম মতি। সর্দানদীর ধারে জঙ্গল আছে শুনে ঘোড়ায় চড়ে জায়গাটা দেখতে গেলেন জেমস ইংলিস। তার আদেশে ঘোড়ার পিছু পিছু হাতিটাকে চালিয়ে নিয়ে এল সাহেবের ভৃত্যবর্গ। ওই জঙ্গলে শিকারের সম্ভাবনা আছে কিনা দেখার উদ্দেশ্য ছিল ইংলিসের।

জঙ্গলের ভিতর বহু হরিণ আর শুয়োরের পায়ের ছাপ দেখা গেল। শিকারের উপযোগী অন্যান্য জীবেরও অভাব ছিল না সেখানে। তবে বাঘ ভাল্লুকের মতো বড়ো জানোয়ারের কোনো চিহই চোখে পড়ল না। নিতান্ত নিরাশ হয়ে ফিরে আসছিলেন, হঠাৎ বাধা পড়ল। জগরু নামে যে সহিসটি তার সঙ্গ নিয়েছিল, সে জানাল একটু এগিয়ে গেলে বড় শিকারের সন্ধান পাওয়া যাবে বলে তার ধারণা, এমন কি বাঘের খোঁজ পাওয়াও অসম্ভব নয়।

জাগরু শিকারে অভিজ্ঞ। তার কথা উড়িয়ে দিতে পারলেন না ইংলিস সাহেব।

নির্দিষ্ট দিকে জগরুর সঙ্গে এগিয়ে চললেন তিনি। উঁচু বালিজমির উপর অজস্র তিল ও শিমূল গাছের শুকনো ঝোঁপ ভেদ করে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ শিকারিরা এসে পড়লেন সবুজ পত্রপল্লব ও উদ্ভিদে পরিপূর্ণ ঘন অরণ্যের সামনে।

কোনো কারণে উঁচু জমির কিছু অংশ ধসে যাওয়ার ফলে একটা বিরাট গহ্বরের আকার নিয়ে নীচু জমির উপর হঠাৎ জেগে উঠেছে শ্যামল বনভুমি। গাছপালার ফাঁকে নদীর দিকে আকৃষ্ট হল শিকারিদের দৃষ্টি। সূর্যের আলোতে ঝক ঝক করে জ্বলছিল বালুকারাশির উপর প্রবাহিত নদীর জলধারা। বালিতে ভরা শুকনো জমি থেকে অনেক নীচে ওই বনভূমি। সাহেব বুঝলেন ওইখানেই বড়ো শিকারের খোঁজ পাওয়া যাবে। জায়গাটা বাঘের বসবাসের পক্ষে প্রশস্ত।

জগরুর দিকে তাকিয়ে ইংলিস দেখলেন তার ঠোঁটে ফুটে উঠেছে হাসির রেখা। সেই নীরব হাসির মর্ম সাহেবের কাছে স্পষ্ট কি সাহেব! বলেছিলাম কিনা জগরু কেমন দরের লোক এখন বুঝেছ তো?

হাতির সাহায্য ছাড়া ওই বনে শিকারের খোঁজ করা সম্ভব নয়। অতএব ইংলিস সেখানেই অপেক্ষা করতে লাগলেন তাঁর নির্দেশ অনুসারে সহিস জগরু তার ঘোড়ায় চড়ে তিরবেগে ছুটল হাতি আনার জন্য।

পাইপে আগুন ধরিয়ে ইংলিস সাহেব ধূমপানে মনোনিবেশ করলেন। তারই ফাঁকে গ্রামবাসীদের সঙ্গে গল্প-গুজবও চলল। একটি অল্পবয়সী ছোকরা মাটির ঢেলা নিয়ে নীচের জঙ্গলে ছুঁড়ে মারছিল অলস খেয়ালের বশে।

সামান্য ঘটনা থেকে অনেক সময় চমকপ্রদ ঘটনার উদ্ভব হয়। ছেলেটির হাতের তৃতীয় বা চতুর্থ ঢিলটি জঙ্গলের ভিতর পড়তেই হঠাৎ গর্জিত কণ্ঠে প্রবল প্রতিবাদ ভেসে এসে জানিয়ে দিল নীচের জঙ্গলটি বর্তমানে ব্যাঘ্রের বাসভূমি এবং ঢিল ছোঁড়ার ব্যাপারটা বাঘ মশাই মোটেই পছন্দ করছেন না।

যে লোকগুলো সেখানে দাঁড়িয়েছিল তাদের মুখ শুকিয়ে ছাই-এর মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ইংলিস সাহেব একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়েছিলেন কোনোদিকে না তাকিয়ে সেই গাছটা বেয়ে তিনি উপরে উঠে গেলেন বিদ্যুৎ বেগে। তাঁর বন্দুকটা পড়ে রইল গাছের তলায়!

পরক্ষণেই জঙ্গলের আবরণ ভেদ করে আত্মপ্রকাশ করল ক্রুদ্ধ শার্দুল!

বাঘটি অল্প বয়সের জানোয়ার, তবে তাকে একবারে নাবালক বাচ্চা বলা যায় না। বয়স কম হলেও বিক্রম বড়ো কম ছিল না। তার গোঁফ খাড়া হয়ে উঠেছিল, ঘাড়ের লোম শক্ত হয়ে ফুলে উঠেছিল সজারুর কাঁটার মতো, লেজ লোহার ডাণ্ডার মতো কঠিন ও আড়ষ্ট এবং চোখ হিংস্র আক্রোশে জ্বলন্ত!

সেখানে উপস্থিত প্রত্যেকটি মানুষই চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা, এই নীতি অবলম্বন করে দৌড় মারল। যে ছোকরাটি ঢিল ছুঁড়েছিল সেও দ্রুতবেগে পা চালিয়েছিল, কিন্তু ব্যাঘ্রের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে পারল না। দু বার কি তিন বার লাফ মেরে বাঘ একেবারে তার পিঠে এসে পড়ে সজোরে চপেটাঘাত করল। সে কি ধাক্কা, এক থাপ্পড়ে ছেলেটির দেহ শূন্যপথে উড়ে গিয়ে ধরাশায়ী গ্রহণ করল সশব্দে!

বিড়াল যেমন ইঁদুরের পিছনে তাড়া করে ছুটে তেমনি করেই বাঘ ছুটে গেল ধরাশায়ী ছেলেটির দিকে। ভাগ্যক্রমে সে ছেলেটির গায়ে দাঁত কিংবা নখ বসাবার চেষ্টা করল না। ভূপতিত শত্রুর পাশে দাঁড়িয়ে সে তার কাধ আর ঘাড়ের মৃদু সঞ্চালনে রাজকীয় ভঙ্গিতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করল, তার লাঙ্গল পাঁজরের উপর আছড়ে পড়তে লাগল। আক্রোশে তার কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে আসতে লাগল অবরুদ্ধ ক্রোধের চাপা গর্জনধ্বনি।

তরুণ বাঘ তার রাজত্বে অনধিকার প্রবেশকারীর উপর তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করছে সদর্পে ও সগর্জনে!

ততক্ষণে ভয়ের ধাক্কা সামলে নিয়েছেন ইংলিস সাহেব। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে গাছ থেকে নেমে তিনি বন্দুকটাকে হস্তগত করলেন, তারপর চটপট বন্দুকে গুলি ভরে নিয়ে গুলি চালালেন। একটা গুলি লাগল বাঘের পিছনে, আর একটি গুলি তার বুক ভেদ করে চলে গেল। তৎক্ষণাৎ ধরাশয়ী ছেলেটির শরীরের উপর পড়ে গেল গুলিবিদ্ধ ব্যাঘ্রের মৃতদেহ। তাড়াতাড়ি ছেলেটিকে বাঘের তলা থেকে টেনে আনা হল। পরীক্ষা করে দেখা গেল তার পাঁজরের উপর বাঘের নখ লেগে একটি গভীর ক্ষতচিহ্নের সৃষ্টি হয়েছে বটে, তবে আঘাত মারা যাবার মতো নয়।

আচম্বিতে নীচের ঘন জঙ্গলের ভিতর থেকে ভেসে এল আর একটি গম্ভীর গর্জনধ্বনি। ইংলিস সাহেব আবার ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলেন গাছটির দিকে। তবে এবার আর গাছে ওঠার চেষ্টা না করে আগে যেটায় চড়েছিলেন, সেটার আড়ালে আশ্রয় নিলেন। ঘন জঙ্গলের ভিতর থেকে আরও কয়েকটা গর্জন শোনা গেল, তবে সৌভাগ্যবশত কণ্ঠস্বরের মালিক জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করতে চাইল না।

সহেব এবং তাঁর সঙ্গীদল রীতিমত বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। বারবার গর্জন শুনে বাঘের সংখ্যা নির্ণয় করা মুশকিল। জঙ্গলের আড়ালে একাধিক ব্যাঘ্রের অবস্থানের সাংঘাতিক সম্ভাবনা যখন সকলকেই উদবিগ্ন করে তুলেছে, তখন হঠাৎ মুশকিল আসানের মতো দেখা দিল অশ্বারোহী জগরু এবং তার পিছনে হাতির সঙ্গে একদল গ্রামবাসী ও জেমস ইংলিসের ভৃত্যবর্গ।

ওই অঞ্চলের বাঘের মেজাজ-মরজি সম্পর্কে ইংলিস সাহেবের যে অভিজ্ঞতা হল, তাতে তিনি বুঝেছিলেন যথেষ্ট সাবধান না হলে বাঘের কবলে এক বা একাধিক মানুষের হতাহত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। অতএব নীচের জঙ্গলে বাঘ যেখানে আত্মগোপন করেছে, সেই জায়গাটা থেকে যথাসম্ভব দূরে দাঁড়িয়ে তিনি লোকজনদের চেঁচামেচি করে বাঘকে ভয় দেখাতে বললেন। তিনি নিজে জগরুর সঙ্গে মতির পিঠে বসলেন। তাঁর আদেশে মতির মাহুত তাকে জঙ্গলের দিকে নিয়ে চলল। হাতি অবশ্য ব্যাপারটা আদৌ পছন্দ করছিল না।

এবার প্রায় দুই মানুষ উঁচু ঘন উদ্ভিদের মধ্যে প্রবেশ করল হাতি, আর পরমুহূর্তেই গর্জে উঠল বাঘ। তৎক্ষণাৎ জঙ্গল থেকে এক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এল হাতি। তাকে অনেক মারধর, অনেক তোয়াজ করেও কোনো ফল হল না। হাতি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ঘন জঙ্গলের মধ্যে বাঘের সান্নিধ্যে আসতে সে নিতান্তই নারাজ।

বাধ্য হয়ে হাতির পিঠ থেকে মাটিতে নামলেন ইংলিস সাহেব। জগরুকে সঙ্গে নিয়ে অনেক ঘুরে তিনি নদীর ধার দিয়ে একটা খাড়া পাড় বেয়ে সমতল ভূমিতে হাজির হলেন। ওই জায়গাটা থেকে নীচের জঙ্গলের দিকে দৃষ্টি রাখা অনেক সহজ।

গহ্বরের মতো অরণ্য-সঙ্কুল নিম্নভূমি ছিল চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ একরের মতো চওড়া। জায়গাটা অতিশয় দুর্গম। অসমান মাটির উপর হাঁ করে রয়েছে অসংখ্য ফাটল, আর সেই ফেটে যাওয়া মাটির চারপাশে লতাগুল্ম ও শুষ্ক ঝোপের সমাবেশে গড়ে উঠেছে এক দুর্ভেদ্য ন্যূহ। অভিজ্ঞ শিকারি জেমস ইংলিস বুঝলেন একটি মাত্র হাতির সাহয্যে সেই উদ্ভিদের ব্যুহ ভেদ করে বাঘের সম্মুখীন হওয়া অসম্ভব।

সুতরাং তখনকার মতো বাঘের অনুসরণকার্যে ইস্তফা দিলেন জেমস ইংলিস। আশেপাশে একদল লোক মোতায়েন করে তিনি নির্দেশ দিলেন বাঘের গতিবিধির কোনো লক্ষণ দেখলে তারা যেন অবিলম্বে সেই খবর সাহেবকে পাঠিয়ে দেয়। নির্দেশ অনুসারে কাজ করলে প্রচুর পুরস্কারের আশা দিয়ে মৃত বাঘের চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে সাহেব অ্যালেনগঞ্জে চলে গেলেন, আর সেখান থেকে তার ঘোড়ার সাহায্যে অশ্বারোহী দূত পাঠিয়ে দিলেন হাতি সংগ্রহের চেষ্টায়।

পরের দিন সকাল এগারোটার মধ্যে চারটি হাতি এসে হাজির। সঙ্গে এল একদল বলিষ্ঠ গ্রামবাসী তাদের হাতে বর্শা, মুগুর, তলোয়ার প্রভৃতি অস্ত্র। পাঁচটি হাতি সঙ্গে সশস্ত্র সেনাবাহিনী নিয়ে বাঘ শিকারে যাত্রা করলেন জেমস ইংলিস।

ইংলিস সাহেব ছিলেন মতির পিঠে। তাঁর একখানা বন্দুক নিয়ে আর একটি হাতির পিঠে বসেছিল জগরু, অন্যপাশে তিন নম্বর হাতির পিঠে ছিল বন্দুক হাতে জমিদার পুত্র। চতুর্থ ও পঞ্চম হাতির সঙ্গে সমবেত দল নিয়ে এবার জঙ্গল ভেঙে বাঘের অনুসন্ধান শুরু হল।

খোঁজাখুঁজিতে বেশি সময় নষ্ট করার দরকার হয়নি কারণ বাঘ নিজেই এগিয়ে এসে শিকারিদের অভ্যর্থনা জানাল।

অভিযান শুরু হতে না হতেই প্রকাণ্ড বাঘিনী সগর্জনে লাফিয়ে পড়ল একটি হাতির মাথার উপর!

হাতির মাহুত ছিটকে কাঁটাগাছের উপর পড়ে আর্তনাদ করতে লাগল তারস্বরে– আর হাতি তীব্র বৃহন-ধ্বনি চারদিক কাঁপয়ে সোজা ঝাঁপ দিল নদীর জলে। সেখানে চোরাবালির মধ্যে পড়ে তলিয়ে যেতে যেতে কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে চলৎশক্তিরহিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কুঁটো জগন্নাথের মতো! ওদিকে জঙ্গল-বাহিনীর দল অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ছত্রভঙ্গ!

মতি আগের দিন ভয় পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আজ সে যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিল। শুড় আর কান গুটিয়ে আক্রমণকারী বাঘিনীর দিকে অগ্রসর হল। বাহনের আকস্মিক গতিবেগে ভারসাম্য হারিয়ে ইংলিস পড়ে গেলেন, কোনমতে নিজেকে সামলে বন্দুকের নিশানা ঠিক করার আগেই ধূর্ত বাঘিনী আক্রান্ত হাতির মাথার কাছে নখের আঁচড় বসিয়ে আবার জঙ্গলের ভিতর ঢুকে লুকিয়ে পড়ল।

ওই ঘটনার ফলে লোকজন এমন ঘাবড়ে গেল যে, আর জঙ্গলে গিয়ে বাঘিনীকে তাড়া দিতে রাজি হল না। পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি, তিরস্কার এবং সাহেবের প্রচণ্ড ক্রোধ অগ্রাহ্য করে তারা গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নদীর পাড়ে জমির উপর। অগত্যা সাহেব একাই বাঘিনীর মোকাবিলা করতে প্রস্তুত হলেন। তাঁর আদেশে মাহুত হাতিকে চালিয়ে দিল জঙ্গলের মধ্যে।

বেশি দূর যেতে হল না– ভীষণ গর্জনে চারদিক কাঁপিয়ে বাঘিনী ধেয়ে এল হাতির দিকে। সাহেব গুলি করলেন। গুলি সম্ভবত বাঘিনীর পিছনের দিকে লেগেছিল, একবার আর্তনাদ করে উঠল, পরক্ষণেই যুদ্ধের উদ্যম ভঙ্গি করে ঘন উদ্ভিদ আর আগাছার মধ্যে তিরবেগে সরে পড়ে আত্মগোপন করল।

মাথার উপর উচ্চভূমিতে দণ্ডায়মান জনতা মহা সমারোহে চিৎকার করে সাহেবকে জানাল বাঘিনী নদী পার করে পালিয়ে যাচ্ছে। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে নির্বোধের মতো বাঘিনীকে অনুসরণ করলেন! পরবর্তী ঘটনা থেকে বোঝা যায় অজানা জায়গায় ওই হঠকারিতার ফল সাহেবের পক্ষে মোটেই ভালো হয়নি। হাতির মাহুত ছিল এক অনভিজ্ঞ ছোকরা, সে হাতি অঙ্কুশের আঘাত করে আর কানের পিছনে পা দিয়ে মোচড় মেরে জোরে ছুটিয়ে দিল। জল তোলপাড় করে নদী পার হয়ে ছুটল হাতি। বাঘিনীকে দূরে এক জায়গায় দেখতে পেল, তারপরই একটা উঁচু বালির ঢিপি পেরিয়ে সে অগ্রসর হল। সাহেবের মনে হল জন্তুটা দস্তুরমতো ক্লান্ত।

আবার ছুটল হাতি। বালির ঢিপিটা পার হয়ে একবারের জন্য মহারানির দর্শন পেলেন ইংলিস, পরক্ষণেই নদীর পাশে অন্তর্ধান কলেন। বাঘিনীর ক্ষিপ্র গতিবেগ দেখে এবার কিন্তু সাহেবের মনে হল দূর থেকে গুলি করে তাকে বিশেষ কাবু করতে পারে নি।

মাহুত হাতিকে প্রাণপণে ছুটিয়ে দিল। বৃথা চেষ্টা বাঘিনী যেন জীবন্ত বিদ্যুৎশিখা, সাহেবের হাতি কিছুতেই বাঘিনীর কাছে পৌঁছাতে পারল না।

প্রায় দু-তিন মাইল পথ পেরিয়ে এসে ইংলিস বুঝলেন শিকার খুব সহজলভ্য হবে না। হয়তো তিনি সেখানে থেকেই ফিরে যেতেন, কিন্তু হতভাগা মাহুত সোৎসাহে জানাল এখন ফিরে যাওয়া অনুচিত। বিভ্রান্ত সাহেব মাহুতের কথায় সায় দিলেন।

অনেকক্ষণ ছুটোছুটি পর দেখা গেল হাতি অত্যন্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েছে। বাঘিনীর পাত্তা নেই! সে যেন হাওয়ায় মিশে গেছে। দারুণ পিপাসায় ইংলিস সাহেবের প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত। জলের জন্য খোঁজাখুঁজি শুরু হল। কোথায় জল? জায়গাটাকে মরুভূমি বললেও অত্যুক্তি হয় না। কোনো জীবিত প্রাণীর চিহ্ন সেখানে নেই।

দেখতে দেখতে সূর্য অস্ত গেল। এল রাত্রি। আকাশে দেখা গেল পূর্ণচন্দ্র। জ্যোৎস্নার ম্লান আলোতে বালির ঢিপিগুলো দেখে সাহেবের মনে হল প্রেতলোকের কয়েকটা অপচ্ছায়া যেন চাঁদের আলোর সঙ্গে পৃথিবীতে নেমে এসেছে। ভুতুড়ে দৃশ্যটার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই যেন তীব্রকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল একদল শেয়াল। একতান সঙ্গীতের সেই বীভৎস ধ্বনি যেন অপার্থিব আতঙ্কের শিহরণ ছড়িয়ে দিল সাহেব ও তার সঙ্গীর বুকের মধ্যে।

স্বভাবসুলভ বুদ্ধি ও তীক্ষ্ণ ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের সাহায্যে হাতি নিশ্চয় জলের সন্ধান পেতে পারত, কিন্তু মুখ মাহুত হাতিটাকে এদিক-ওদিক চালিয়ে ক্লান্ত করে ফেলল।

অবশেষে হাতিও বিরক্ত হয়ে উঠল। সজোরে ঝাঁকনি মেরে আরোহীদের সে পিঠ থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল বার বার।

একে তৃষ্ণা, তার উপর দারুণ রোদে সারাদিন ছুটোছুটি করার ফলে সাহেবের শরীর অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে উঠেছিল। শ্রান্তদেহে তিনি হাতির পিঠ থেকে পড়ে গেলেন মাটিতে, আর পড়ামাত্র অজ্ঞান।

কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে ইংলিস দেখলেন তিনি সম্পূর্ণ একা, আর তাকে ঘিরে বসে আছে পনেরোকুড়িটা শেয়াল তাদের লুব্ধ চক্ষু ক্ষুধিত আগ্রহে জ্বলছে জ্বলন্ত অঙ্গারখণ্ডের মতো!

দুটি শেয়াল হঠাৎ দাঁত খিঁচিয়ে পরস্পরের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করতে শুরু করল। সঙ্গেসঙ্গে সমস্ত দলটা চিৎকার করে উঠল তীব্র কণ্ঠে। বালুকাময় নির্জন প্রান্তরে সেই চিৎকার যেন চাবুক মেরে সাহেবের আচ্ছন্ন চেতনাকে জাগিয়ে দিল। মনের জোরে কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বন্দুকটা তুলে ধরলেন। তৎক্ষণাৎ তীরবেগে অদৃশ্য হয়ে গেল শেয়ালের দল।

ইংলিস সাহেবের শুকনো জিভ তখন মুখের মধ্যে খর খর করছে, হাঁটু কাঁপছে, শরীর শিউরে উঠছে থেকে থেকে। বন্দুক আঁকড়ে ধরে তিনি এগিয়ে চললেন অন্ধের মতো। কিন্তু বেশি দূর যেতে হল না, কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্বিতীয়বার তাকে সংজ্ঞা হারাতে হল। আবার যখন জ্ঞান হল তখন ভোর হয়ে গেছে, সর্যের আলো ঘন কুয়াশা ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।

শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা, তবু আচ্ছন্ন দৃষ্টিকে প্রাণপণে চালিত করে ইংলিস দেখলেন একটু দূরে অগভীর গর্তের ভিতর থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মিমোসা ঝোপের সারি। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা চিন্তা তার মস্তিষ্কে সাড়া দিল- ওখানে জল নেই তো?

শিকারের নিত্যসঙ্গী হান্টিং নাইফ সঙ্গেই ছিল সেই ধারাল ছোরা দিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় মাটি খুঁড়ে ফেললেন জেমস ইংলিস। ধারণা নির্ভুল! জল রয়েছে বটে! ~-ময়লা ঘোলাটে জলে রুমাল ভিজিয়ে রুমাল বার বার নিংড়ে জলপান করে জেমস কিছুটা স্বস্তি বোধ করলেন।

সাহেব সেখানেই পড়ে রইলেন। মধ্যাহ্নের প্রখর সূর্য তার দেহের উপর অগ্নিবর্ষণ করল সারা দুপুর ধরে। বিকালের দিকে তার সঙ্গীরা যখন তাকে সেই ময়লা জল পরিপূর্ণ গর্তের পাশ থেকে উদ্ধার করল, তখন দারুণ জ্বরের ঝেকে প্রলাপ বকছেন জেমস ইংলিস।

আরোগ্যলাভের পর ইংলিস সাহেব বলেছেন, আমি যে কোথা দিয়ে কেমন করে আমার ফ্যাক্টরিতে ফিরে এসেছিলাম, সে কথা আজও বলতে পারি না।

ক্যারাটে মৃত্যুবাহী

কুস্তি এবং মুষ্টিযুদ্ধ বা বক্সিংকে যদিও খেলা বলেই ধরা হয়, আর কুস্তি ও মুষ্টিযুদ্ধের প্রতিযোগিতার আয়োজনও হয়ে থাকে, তবে এই দুটি খেলা হাতাহাতি লড়াইয়ের পর্যায়ভুক্ত। কিন্তু ক্যারাটে খেলা নয়–এটা সত্যিই লড়াই, নিরস্ত্র যুদ্ধ। জাপানে কেউ ক্যারাটে নামক রণবিদ্যা আয়ত্ত করতে পারলে, অর্থাৎ জাপানের কোনো ক্যারাটে বিদ্যালয় থেকে কোনো ছাত্রকে ক্যারাটে-বিশারদ বলে স্বীকৃতি দিলে জাপানি পুলিশের কাছে উক্ত ছাত্রের নাম রেজিস্ট্রি করতে হয় এবং এই কথা বলে মুচলেকা দিতে হয় যে, উক্ত ক্যারাটে-যোদ্ধা প্রাণ বিপন্ন না হলে কখনো মারামারি করবে না।

তবু মুচলেকা দিলেও সবসময় কি কথা রাখা যায়? আর মুচলেকা তো জাপানি পুলিশের কাছে, যদি কোনো ক্যারাটে-যোদ্ধা জাপানের বাইরে তার বিদ্যাকে হাতেনাতে প্রয়োগ করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা করবে কে?

দক্ষ ক্যারাটে-বিশারদ গুলি ভরতি রাইফেলের মতোই ভয়াবহ। রাইফেলের সেফটি ক্যাচ তুলে ট্রিগার টিপলেই অস্ত্রটি সগর্জনে মৃত্যু পরিবেশন করে। ক্যারাটের নীতিশিক্ষা ওই সেফটি ক্যাচ–ক্যারাটে-যোদ্ধা যদি কখনো নিজের উপর সংযম হারিয়ে তার নীতি ভুলে যায়, তবে রাইফেলের গুলির মতোই নিদারুণ আঘাত এসে পড়ে বিপক্ষের উপর। সেই আঘাতের ফলে আহত ব্যক্তির সাংঘাতিক দৈহিক ক্ষতি হতে পারে। এমনকী মৃত্যু হওয়াও অসম্ভব নয়। অস্ত্রধারী মানুষের চাইতেও ক্যারাটে-বিশারদ অধিকতর বিপজ্জনক ব্যক্তি, কারণ অস্ত্র দেখে লোকে সাবধান হতে পারে কিন্তু ক্যারাটেকে চোখে দেখা যায় না–ক্যারাটে-যোদ্ধা এই প্রাণঘাতী অদৃশ্য অস্ত্রকে বহন করে সর্বাঙ্গে, মুহূর্তের মধ্যে প্রয়োগকারীর মুষ্ট্যাঘাত, পদাঘাত বা আঙুলের খোঁচায় : নির্দয় মৃত্যুর পরোয়ানা নেমে আসতে পারে কলহে নিযুক্ত বিপক্ষের উপর। ক্যারাটে নামক রণবিদ্যা যে আয়ত্ত করেছে, সে কখনো নিজের ওপর সংযম হারিয়ে ফেললে ঘটনার পরিণতি যে কতটা ভয়ানক হতে পারে নিম্নে পরিবেশিত কাহিনিটি তার প্রমাণ :

আমেরিকার এক ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক জাপানের ইয়োকোহামা নামক স্থানে দু-বছরের জন্য কার্যে নিযুক্ত হন। একটি আমেরিকান ব্যবসায়ী সংস্থা জাপান সরকারের সঙ্গে ব্যাবসায়িক চুক্তি করেছিল, ওই সংস্থার পক্ষ থেকে নিয়োগ করা হয়েছিল উল্লিখিত ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোককে। ওই আমেরিকান ভদ্রলোক অবশ্য আমাদের কাহিনির নায়ক নন, নায়কের স্থান অধিকার করেছে তার ছেলে জো লার্কিন। ছোটোবেলা থেকেই জো বেশ শক্তিশালী। কিছুদিন সে মুষ্টিযুদ্ধ অভ্যাস করেছিল। এমনকী মুষ্টিযুদ্ধকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করার কথাও তার মনে হয়েছিল। পেশাদার মুষ্টিযোদ্ধার উপযুক্ত শরীর ছিল তার দৃঢ় পেশি, দ্রুত গতি আর দুরন্ত সাহস। দরকার ছিল শুধু উপযুক্ত শিক্ষা আর নিয়মিত অভ্যাস।

জাপানে এসে জো মুষ্টিযুদ্ধের পরিবর্তে ক্যারাটের প্রতি আকৃষ্ট হল। কঠিন পরিশ্রমের ব্যাপার। হাতের মুঠি পাকিয়ে ঘুসি মারতে এবং তালুর পাশ দিয়ে কাটারির মার অভ্যাস করতে করতে দারুণ ব্যথায় হাত অসাড় হয়ে আসে, ঘণ্টার পর ঘন্টা কঠিন পরিশ্রমে আড়ষ্ট হয়ে যায় বাহুর পেশি, নগ্নপদে কঠিন বস্তুর ওপর লাথি মারতে মারতে ভেঙে যায় পায়ের আঙুল, আর

আর এই কষ্ট সহ্য করে টিকে থাকতে পারলেই অভ্যাসকারীর সাধনায় সিদ্ধিলাভ!

দুই বৎসর কঠিন পরিশ্রমের পর জো লার্কিন ক্যারাটে রণবিদ্যা আয়ত্ত করতে সমর্থ হল। আর তখনই ক্যারাটের বিধিনিষেধ সম্পর্কে তাকে সাবধান করে দেওয়া হল–প্রাণ বিপন্ন না হলে লড়াই করা চলবে না। অপমানিত হলেও অপমান সহ্য করতে হবে। ক্যারাটে বিদ্যালয়ের শিক্ষক তাকে ক্যারাটে-যোদ্ধা বলে স্বীকৃতি দেওয়ার সঙ্গেসঙ্গে জাপানি পুলিশের খাতায় তাকে নাম লেখাতে হয়েছে রাস্তায় বা কোনো দোকানের মধ্যে মারামারি করলে ক্যারাটে-যোদ্ধা আইনত অপরাধী, তাকে শাস্তি দেওয়া হবে সরকার থেকে।

–অপমানিত হলেও সহ্য করতে হবে?

–হ্যাঁ, সেটাই নিয়ম। ক্যারাটে-যোদ্ধার মারামারি করার উপায় নেই। শুধুমাত্র জীবন বিপন্ন হলেই সে লড়াই করতে পারে।

জো লার্কিন তার আত্মজীবনীতে বলেছে, এত সব বিধিনিষেধ আছে জানলে সে ক্যারাটে শিখত কি না সন্দেহ।

তবে জোকে বেশিদিন জাপানে থাকতে হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ আগেই নিজের দেশ আমেরিকায় ফিরে এসেছিল সে। তার বয়স তখন উনিশ। সেই তরুণ বয়সেই জাপানি পুলিশের খাতায় ক্যারাটে-যোদ্ধা বলে তার নাম উঠে গেছে।

দেশে এসে আমেরিকার সেনাবাহিনীতে নাম লেখাল জো। আর্মি ট্রেনিং বা সামরিক শিক্ষা বেশ কঠিন, কিন্তু ক্যারাটে শিক্ষার ভয়ংকর পাঠশালায় পাঠ নেওয়ার পর সামরিক শিক্ষা জোর কাছে বাগান থেকে ফুল ভোলার মতোই সহজ মনে হয়েছিল। অতি অল্পদিনের মধ্যেই সে সার্জেন্ট হল। তারপর তাকে পাঠানো হল সমুদ্র পার হয়ে অন্য দেশে।

এতদিন তার সাংঘাতিক বিদ্যাকে হাতেনাতে প্রয়োগ করার সুযোগ পায়নি জো, এইবার ক্যাসাব্লাংকা নামক ফরাসিদের আস্তানায় সে নিজের ক্ষমতা যাচাই করার সুযোগ পেল। অবশ্য এর আগে ঝগড়া বা মারামারির সম্ভাবনা কখনো হয়নি এমন নয়। প্ররোচনা এসেছে ভীষণভাবে। কিন্তু ইয়াকোহামার প্রফেসর সাতো বার বার সাবধান করে ভয় দেখিয়েছিলেন–খুনের দায়ে পড়ার অনেক ঝামেলা। সেই ঝামেলার ভয়েই অনেক সময় অপমান সহ্য করে সরে এসেছে। জো, অপমানকারীকে আঘাত করার চেষ্টা করেনি কখনো। একবার মারামারি বাধলে মেপে মেপে ওজন বুঝে আঘাত করা সম্ভব নয়। ক্যারাটে মৃত্যুবাহী দেহের দুর্বল স্থানে ক্যারাটের আঘাত মৃত্যুকে ডেকে আনতে পারে মুহূর্তের মধ্যে। এসব কথা খুব ভালোভাবেই জানত জো, তাই ঝগড়ার সূত্রপাত হলে সে সতর্ক হয়ে যেত। সে মিষ্টি কথায় ঝগড়া এড়িয়ে যেতে শিখেছিল; তবু যখন মাথায় রাগ চড়ে যাওয়ার উপক্রম হত, তখন দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখত প্রবল ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে।

তবু মানুষ তো যন্ত্র নয়, সংযমের বাঁধন একদিন ছিঁড়ল। যাকে কেন্দ্র করে ব্যাপারটা ঘটল, সেই লোকটা জাহাজি শ্রমিক, আলজিরিয়ার মানুষ। মানুষটা প্রায় সাড়ে ছয় ফুট উঁচু, বিশাল বুক, চওড়া কাঁধ, মুখের ডান দিকে চোখের তলা থেকে চিবুক পর্যন্ত ছুরিকাঘাতের শুষ্ক ক্ষতচিহ্ন–এক নজর দেখলেই বোঝা যায় সে দাঙ্গাহাঙ্গামায় অভ্যস্ত। আলজিরিয়ানটি পানাগারে মদ্যপান করতে এসেছিল। জো দেখল, সে বেশ মাতাল হয়ে পড়েছে। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে লোকটা গেলাসের পর গেলাস মদ গিলছিল, তখনও পর্যন্ত কোনো গোলমাল করেনি, কিন্তু তার হাত অল্প কাঁপছিল নেশার ঝেকে।

দুর্ভাগ্যক্রমে জো দাঁড়িয়ে ছিল লোকটার খুব কাছেই। হঠাৎ আলজিরিয়ান শ্রমিকটি হাত বাড়িয়ে জো-র হাতের গেলাস ধাক্কা মেরে ফেলে দিল।

তুই একটা শুয়োর, গর্জন করে মাতাল আলজিরিয়ান, তুই একটা দুর্গন্ধ শুয়োর। তোর গাঁ থেকে বিশ্রী গন্ধ বেরোচ্ছে।

ঠিক, ঠিক, একটু হেসে ঝগড়া এড়িয়ে যেতে চাইল জো, তুমি বরং আর এক গেলাস মদ নাও।

মুখে হাসলেও জো-র মাথায় তখন আগুন জ্বলছে। ক্যারাটে না-শিখলে সে নিশ্চয়ই লোকটার চোয়ালে ঘুসি বসিয়ে দিত। কিন্তু ক্যারাটের শিক্ষা তাকে প্রতিরোধ করল না, এখনও তার প্রাণ বিপন্ন হয়নি, এখনও আঘাত হানবার সময় আসেনি। কিন্তু বহুদেশের বহু লোক সেখানে জমায়েত হয়েছে, তাদের সামনে নিজেকে কাপুরুষ ভীরু প্রতিপন্ন করতে জো লার্কিনের খুবই খারাপ লাগছিল–তবু আশ্চর্য সংযমের পরিচয় দিল সে, দুই হাত তাড়াতাড়ি ঢুকিয়ে দিল প্যান্টের পকেটে।

হঠাৎ মাতালটা জো লার্কিনের মুখের ওপর থুথু ছিটিয়ে দিল, তারপর বুনো জানোয়ারের মতো গর্জে উঠে একটা মদের বোতল টেবিলে ঠুকে ভেঙে ফেলল। পলকের মধ্যে বোতলের তলার দিকে আত্মপ্রকাশ করল ধারালো ছুরির মতো অনেকগুলো ভাঙা কাঁচের টুকরো।

সেই ভাঙা বোতলের গলার দিকটা শক্ত মুঠিতে চেপে ধারালো কাঁচগুলো সজোরে জো-র মুখের ওপর বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল মাতাল, কিন্তু জো চটপট সরে যাওয়ায় মাতালের চেষ্টা সফল হল না।

লোকজন তখন চিৎকার করে মাতালের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে, মেয়েরা আর্তনাদ করছে ভীতস্বরে।

দ্বিতীয় বার আঘাত হানল মাতাল। আবার সরে গেল জো। বোতলের ধারালো কাঁচগুলো জো-র মুখের কয়েক ইঞ্চি দূরে শূন্যে ছোবল মারল।

এবার আর জো-র হাত দুটো পকেটের ভিতর নেই, বেরিয়ে এসেছে। এখনও জো আশা করছে কেউ মাতালটাকে ধরে ফেলবে, পকেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা ভয়ংকর হাত দুটো বোধ হয় ব্যবহার করার দরকার হবে না। কিন্তু ভীষণদর্শন মাতাল নিগ্রোটার সামনে কেউ এগোল না, সকলেই নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে একটা রক্তাক্ত দৃশ্যের প্রতীক্ষা করতে লাগল।

জো লার্কিনের সহকর্মী কয়েকটি সৈন্য অবশ্য সেখানে ছিল, তারা ভয় পায়নি, ব্যাপারটা উপভোগ করছিল। জো-র মুখে তারা শুনেছে সে ক্যারাটে-যোদ্ধা, হঠাৎ খুনের দায়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে বলে সে মারামারির মধ্যে যেতে চায় না। অথচ তাদের সামনে জো কার্যকলাপে কোনো প্রমাণ রাখেনি! তাই আজ তারা নিশ্চেষ্ট–শুধু মুখের কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়, তারা দেখতে চায় হাতের কাজ।

পানাগারের ভিতর বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল মাতাল আর জো। কয়েকবার ভাঙা বোতল উঁচিয়ে আঘাত হানতে চেষ্টা করল মাতাল। প্রত্যেকবারই সরে গিয়ে লোকটার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিল জো, ছুরির মতো ধারালো কাঁচগুলো একবারও জোর মুখ স্পর্শ করতে পারল না।

বার বার ব্যর্থ হয়ে লোকটা খেপে গেল। হঠাৎ সে বোতলটা ছুঁড়ে মারল জো-র মুখ লক্ষ করে। এবারও জো সরে গেল, কিন্তু আত্মরক্ষা করতে পারল না বোতলটা তার মাথার ওপর পড়ে ছিটকে গেল অন্যদিকে।

আঘাতের ফলে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল জো… কয়েক মুহূর্তের স্তম্ভিত অনুভূতি… মাথা বেয়ে নামছে তপ্ত তরল একটা ধারা… রক্ত!

জো সামলে ওঠার আগেই মাতাল তাকে আক্রমণ করেছে। এবার তার হাতে ঝকঝক করছে। ধারালো ছুরি।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে জো-র মগজের মধ্যে কী যেন ঘটল..সেফটি ক্যাচ! ক্যারাটে শিক্ষার সেফটি ক্যাচ এখন সরে গেছে, এখন সে আক্রান্ত, তার জীবন এখন বিপন্ন, লড়াই করার অধিকার এখন তার আছে।

উদগ্র ক্রোধ এইবার মুক্তি পেল, জোর কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এল ভয়ংকর চিৎকার!

জোর বাঁ-হাত কাটারির মতো পড়ল শত্রুর ছুরি ধরা পুরোবাহুর (forearm) উপর। অনভ্যাসের ফলে আঘাতের শক্তি কমে গেছে, তাই ছুরিটা মাতালের হাত থেকে খসে পড়ল, কিন্তু হাতটা অবশ হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। সেই কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সামলে নিয়ে জো শত্রুর পরবর্তী আক্রমণের প্রতীক্ষা করতে লাগল।

মাতাল জো-র পেট লক্ষ করে ছুরি চালাল। জো একপাশে সরে গেল, তারপর ডান হাত বাড়িয়ে মাতালের ছুরি ধরা হাতের কবজি চেপে ধরল। পরক্ষণেই তার বাঁ-হাত কাটারির মতো মাতালের বাহুর পেশিতে আঘাত করে ছুরি ধরা হাতটাকে অসাড় করে দিল। ..

এইবার ক্যারাটের খেলা–মাতাল ব্যাপারটা কী হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই তার শত্রু চট করে একপাশে ঘুরে গিয়ে নিজের বাঁ-কাঁধের উপর রাখল, সঙ্গেসঙ্গে পাঁজরের ওপর নিদারুণ কনুইয়ের গুঁতো সেই আঘাত সামলে ওঠার আগেই মাতালের ছুরি সমেত হাতটা সবেগে শূন্যে উঠে প্রবল আকর্ষণে শত্রুর কাঁধের উপর পড়ল, তৎক্ষণাৎ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল কনুইয়ের হাড়!

ক্যারাটের মার–পৃথিবীর কোনো ডাক্তারই সেই হাড়কে আর জোড়া লাগাতে পারবে না!

ছুরিটা অনেক আগেই পড়ে গেছে মেঝের উপর। বিস্ময়-বিস্ফারিত ভীত দৃষ্টিতে মাতাল দেখল, তার ডান হাতটা ভাঙা অবস্থায় নড়বড় করে ঝুলছে!

তবু সে হার মানল না। বুনো জানোয়ারের মতো গর্জন করে সে শত্রুর পেট লক্ষ করে লাথি ছুড়ল। লাথি লাগল না, কিন্তু তার পায়ের গোড়ালি ধরা পড়ল শত্রুর মুঠোর মধ্যে পরক্ষণেই এক হ্যাঁচকা টান এবং মাতাল হল মেঝের উপর লম্বমান!

এইবার জো-র ভারী জুতো সমেত লাথি এসে পড়ল মাতালের তলপেটে, সঙ্গেসঙ্গে লড়াই শেষ। লোকটা হাঁফাতে হাঁফাতে আর্তনাদ করতে লাগল। হঠাৎ এক ঝলক বমি বেরিয়ে এসে তার আর্তকণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিল।

শায়িত শত্রুর দিকে মুহূর্তের জন্য দৃষ্টিপাত করল জো। তার বুকের ভিতর জেগে উঠেছে। রক্তলোভী দানবের হিংস্র উল্লাস–পলকে নীচু হয়ে মাতালের হাতটা চেপে ধরে সে মোচড় দিল, একেবারে চুরমার হয়ে ভেঙে গেল হাতটা। আবার একটা আর্ত চিৎকার। আবার এক ঝলক বমি। তারপরই অজ্ঞান হয়ে গেল লোকটা।

পানশালার মধ্যে অন্তত বারো রকমের বিভিন্ন জাতির লোক ছিল। সবাই নির্বাক, স্তব্ধ, শেষকালে ধরাশায়ী শত্রুর ওপর জো-র অমানুষিক অত্যাচার তাদের বিস্ময় ও আতঙ্কে স্তব্ধ করে দিয়েছে। জো-র সঙ্গীদের মুখেও কথা নেই, তাদের দৃষ্টি আতঙ্কে বিস্ফারিত–তারা যেন চোখের সামনে এক অপার্থিব বিভীষিকা দেখছে।

কেউ একটি কথা বলল না। জো এতক্ষণে নিজেকে বুঝতে পারছে। ক্যারাটে তার ভিতর এক রক্তলোভী হিংস্র দানবের জন্ম দিয়েছে, যে-দানব অপরকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়। ভাঙা হাতটাকে মুচড়ে দিয়ে লোকটাকে যন্ত্রণা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তলপেটে লাথি না-মেরেও সে লোকটাকে কাবু করতে পারত। অবরুদ্ধ হিংসা মুক্তি পেয়েই তার প্রবৃত্তি চরিতার্থ করেছে যথেচ্ছভাবে। হঠাৎ তীব্র বিবমিষা জো-কে অস্থির করে তুলল, কোনোরকমে প্রস্রাব আগারে ঢুকে সে বমি করে ফেলল।

বেরিয়ে এসে জো দেখল, পানাগারের ভিতরে অবস্থা যেন কিছুটা স্বাভাবিক। ভিড়ের মধ্যে কেউ অ্যামবুলেন্স ডেকে পাঠিয়েছে। ফরাসি সাইরেনের উৎকট ধ্বনি কানে এল। পুলিশ আসছ। জো বিশেষ ভয় পেল না। প্রথমে ভাঙা বোতল, পরে ছুরি নিয়ে লোকটা যে তাকে আক্রমণ করেছিল, সেই দৃশ্য বহু লোক দেখেছে। সে যে মারামারি করতে চায়নি বরং এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে সেটাও প্রমাণ করা কঠিন হবে না–বহু মানুষের চোখের সামনে এসব ঘটনা ঘটেছে। না, পুলিশকে নিয়ে সে মাথা ঘামাচ্ছে না, মূৰ্ছিত লোকটির কথাই চিন্তা করছে সে। হঠাৎ পকেট থেকে অনেকগুলো ডলার বার করে সে অচেতন মানুষটার পকেটে গুঁজে দিল। আলজিরিয়ান নিগ্রোর ভাঙা হাড় আর জোড়া লাগানো যাবে না, কিন্তু ওই টাকায় অন্তত ভালোভাবে চিকিৎসা করার সুযোগ সে পাবে।

কয়েকটা দিন কাটল। সেনানিবাসের সকলেই অকুস্থলে উপস্থিত সৈনিকদের মুখ থেকে ব্যাপারটা শুনেছে। হঠাৎ একদিন জো আবিষ্কার করল সে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। কেউ তার সঙ্গে কথা কইতে চায় না। জো নানাভাবে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা জমাতে চেষ্টা করল। বৃথা চেষ্টা। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া তারা তার সঙ্গে কথা বলে না। জমাট তাসের আড্ডায় সে উপস্থিত হলে তাসের আড্ডা ভেঙে যায়। নানা ছুতোয় সকলে স্থান ত্যাগ করে। সিনেমা যাওয়ার আমন্ত্রণ এখন। কেউ তাকে করে না। বন্ধুদের মধ্যে যারা তাকে ক্যারাটের কৌশল শেখাতে অনুরোধ ছেড়ে তোষামোদ পর্যন্ত করত, তারাও এখন তাকে এড়িয়ে চলতে চায়।

ফল হল সাংঘাতিক। জো আবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছিল। হয়তো সে তার মারাত্মক বিদ্যাকে দ্বিতীয় বার প্রয়োগ করত না। কিন্তু সবাই তাকে এড়িয়ে চলছে দেখে সে মনে মনে ভীষণ হিংস্র হয়ে উঠল। তার প্রাণঘাতী আক্রোশকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সে সুযোগের অপেক্ষায় রইল।

সুযোগ এল কিছুদিনের মধ্যেই। ছয়টি সৈন্যের সঙ্গে একদিন জো বেরিয়েছিল টহল দিতে। জো স্বয়ং ছিল দলের নেতা। নিতান্ত অভাবিতভাবেই হঠাৎ একটি জার্মান সৈন্য তাদের সামনে এসে পড়ল। সৈন্যটি তৎক্ষণাৎ আত্মসমর্পণ করল, সে নাকি পথ হারিয়েছে। আমেরিকান সৈন্যরা অস্বস্তি বোধ করতে লাগল–নির্দিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করার জন্য তারা টহল দিতে বেরিয়েছে, এখন বন্দিকে নিয়ে আস্তানায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।

জার্মান সৈন্যটি যখন বুঝল তাকে গুলি করা হবে না, সে আশ্বস্ত হল। দেখা গেল সে ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। জো তাকে কিছু খাদ্য আর সিগারেট দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দেহটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগল–হ্যাঁ, লম্বায়-চওড়ায় জার্মানটি প্রায় তারই মতো, আঁটোসাঁটো শরীরটা দেখলে মনে হয় সে ব্যায়ামে অভ্যস্ত। জো বন্দির সঙ্গে কথা বলছিল। তার সঙ্গীরা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল। বন্দিকে নিয়ে যে-সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, জো যে তার সমাধান করতে চাইছে সেটা তারাও বুঝতে পারছিল। এই ভয়ংকর ক্যারাটে-যোদ্ধাটি যে কেমন করে এই সমস্যার সমাধান করবে সেটাও তারা আন্দাজ করতে পারছিল–তাই বন্দির সঙ্গে কথা বলতে তারা বিশেষ উৎসাহ প্রকাশ করেনি।

জো বন্দিকে প্রশ্ন করল, তুমি কখনো বক্সিং লড়েছ? জার্মান বন্দির বলিষ্ঠ দেহ আর ভাঙা নাকের গড়ন দেখেই জো-র ওই প্রশ্ন। অনুমান নির্ভুল। বন্দি জানাল ১৪ বছর বয়স থেকেই সে বক্সিং লড়ছে। তা ছাড়া ফুটবল খেলার অভ্যাসও তার আছে।

বাঃ! চমৎকার! জো বলল, শোনো, তোমার সঙ্গে একটা চুক্তি করছি। আমরা হাতাহাতি লড়াই করব। যদি আমাকে হারাতে পারো তাহলে তোমায় মুক্তি দেওয়া হবে। ঠিক আছে?

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, জার্মান বন্দি বলল। তার কণ্ঠস্বরে আতঙ্কের আভাস। সে বোধ হয় বুঝেছিল তার বিপদ আসন্ন।

তুমি ঠিকই বুঝেছ, জো বলল, নাও, তৈরি হও। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।

জো জামা খুলে ফেলল। বন্দিও তার উদাহরণ অনুসরণ করল। জো দেখল, বন্দির বুক বেশ চওড়া, হাত-পায়ের কঠিন মাংসপেশি বন্দির দৈহিক শক্তির পরিচয় দিচ্ছে। জো খুশি হল। শক্তিশালী মানুষ না হলে লড়াই করে সুখ নেই।

জো-র সঙ্গীরা নীরব। তারা জানত জো ক্যারাটে-যোদ্ধা, তার ভয়াবহ খ্যাতি তাদের কানেও এসেছে। এখন তারা স্তব্ধ হয়ে জো-র কার্যকলাপ দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।

লড়াইয়ের শুরুতে জার্মান সৈন্যটি বিশেষ উৎসাহ দেখাল না। জো প্রতিরোধের ভঙ্গিতে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ায়নি, মুখ আর শরীর প্রতিদ্বন্দ্বীর সামনে উন্মুক্ত বন্দি তবুও নিশ্চেষ্ট, তার আঘাত হানা উদ্যম নেই কিছুমাত্র।

জো এবার বন্দিকে উত্তেজিত করতে সচেষ্ট হল, সে সজোরে চড় মারল বন্দির গালে, আমি জানি নাজিরা ভীরু, কাপুরুষ। তোমাদের লড়াই করার সাহস নেই। সঙ্গেসঙ্গে গালাগালি।

এবার কাজ হল। বন্দির চোখে-মুখে ফুটল ক্রোধের আভাস। সে এগিয়ে এসে সজোরে ঘুসি ছুঁড়তে লাগল। একটা ঘুসিও অবশ্য জো-কে স্পর্শ করতে পারল না। সুকৌশলে আঘাতগুলো এড়িয়ে গেল জো।

জো এবার কাজ শুরু করল, ডান হাতের বুড়ো আঙুল করতল চেপে রইল, আঙুলগুলো ছুরির মতো আড়ষ্ট, শক্ত–পরক্ষণেই সেই কঠিন আড়ষ্ট আঙুলগুলো দারুণ জোরে ছোবল মারল প্রতিদ্বন্দ্বীর পেটের মাঝখানে। দারুণ যাতনায় জার্মান বন্দির শরীর সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল, তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

আবার শ্বাস টেনে নিজেকে প্রস্তুত করার আগেই জো-র বাঁ-হাতের বজ্রমুষ্টি হাতুড়ির মতো আছড়ে পড়ল বন্দির ওষ্ঠের ওপর। কয়েকটা দাঁত ভেঙে গেল সঙ্গেসঙ্গে। ক্যারাটে-ঘুসি সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে ওই আঘাতেই দাঁতের পরিবর্তে মুখের হাড় ভাঙত, তারপর আর এক ঘুসিতে ভাঙা হাড়গুলো পৌঁছে যেত মগজের মধ্যে। ইচ্ছে করেই ভুল করেছিল জো, ক্যারাটের মরণমার মারতে চায়নি সে। লড়াইটাকে দীর্ঘস্থায়ী করে বন্দিকে যন্ত্রণা দিয়ে ধীরে ধীরে হত্যা করতে চাইছিল সে।

নাজি বন্দিটি ভীষণভাবে আহত হলেও তখন পর্যন্ত মারামারি করার ক্ষমতা হারায়নি। সে বুঝেছিল শত্রুকে পরাস্ত করতে না-পারলে তার মৃত্যু নিশ্চিত, অতএব হিংস্র আক্রোশে সে এবার জো-র ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। জো শান্তভাবে অপেক্ষা করছিল তার ডান হাত তলার দিকে ঝুঁকে পড়েছে আর আঙুলগুলো খুলে ছড়িয়ে রয়েছে উপযুক্ত জায়গায় ছোবল মারার জন্য।

ক্যারাটে শিক্ষায় ওই ভঙ্গিকে বলে নাকিতে–অতি ভয়ংকর ওই খোলা আঙুলের নিষ্ঠুর আঘাত।

জো আঘাত হানল। বন্দির নাকের দু-পাশ দিয়ে সটান দুই চোখে খোঁচা মারল আঙুলগুলো। তৎক্ষণাৎ বন্দির দুই চক্ষু হল রক্তাক্ত, অন্ধ।

ওইভাবে আঘাত হানার কৌশল শিখলেও হাতেনাতে কখনো সেই শিক্ষাকে প্রয়োগ করার সুযোগ পায়নি জো। আঙুলগুলোকে লোহার মতো শক্ত করে নির্ধারিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছে সে ক্যারাটে শিক্ষার বিদ্যালয়ে, কিন্তু আঘাত হানতে পারেনি কারণ, অংশীদার সহকর্মীর বিপদ ঘটতে পারে। এতদিন পরে ওই ভয়ংকর কৌশলকে বাস্তবে বাস্তবায়িত করবার সুযোগ পেল জো।

বন্দির অবস্থা তখন শোচনীয়। জো-র বন্ধুরাও তার নিষ্ঠুরতা দেখে চমকে গেছে। ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে আতঙ্ক-বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে তারা তাকিয়ে আছে জোর দিকে। যাতনাকাতর অন্ধ বন্দি তখন অসহায়ভাবে আর্তনাদ করছে অস্ফুট কণ্ঠে–হিংস্র পশুর মতো জো তার ওপর লাফিয়ে পড়ল। প্রথমে বন্দির বাঁ-হাত, তারপর ডান হাত ভাঙল জো। সঙ্গেসঙ্গে ক্রুদ্ধ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল জো-র সহকর্মী সৈনিক ছয়জন। জো বুঝল, বন্দির উপর আর অত্যাচার করলে সৈন্যরাই খেপে যেতে পারে। ছয়টি রাইফেলধারী মানুষকে উত্তেজিত করা ক্যারাটে–যযাদ্ধার পক্ষেও বিপজ্জনক, অতএব জো হাতের কাজ শেষ করতে সচেষ্ট হল। মৃত্যুবাহী ক্যারাটের এক দারুণ আঘাতে বন্দির নাকের হাড় ভেঙে মগজে প্রবেশ করল, হতভাগ্যের মৃত্যু হল তৎক্ষণাৎ।

ক্যারাটের নিয়ম লঙ্ঘন করেছিল জো। আত্মরক্ষার জন্যই ওই অদ্ভুত প্রাচ্যদেশীয় রণকৌশল শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু জো তার বিদ্যাকে প্রয়োগ করেছিল অন্তরে নিহিত হিংস্র উল্লাস চরিতার্থ করার জন্য। এবং সেইজন্য সে অনুতপ্ত হয়নি কিছুমাত্র।

যথাসময়ে সদরে রিপোর্ট গেল বন্দি নাকি পলায়নের চেষ্টা করেছিল, তাই তাকে হত্যা করা হয়েছে। জো-র সঙ্গীরা চুপ করে রইল। জার্মানদের চাইতেও সার্জেন্ট জো লার্কিন সম্পর্কে তাদের ভীতি ছিল অনেক বেশি।

কিছুদিন পরে আবার ক্যারাটেকে কাজে লাগানোর সুযোগ পেল জো লার্কিন। একটি জার্মান ক্যাপ্টেনকে মার্কিন সেনানিবাসে বন্দি করে আনা হয়েছিল। লোকটা ঝটিকা-বাহিনীর ক্যাপ্টেন, হিটলারের অন্ধ ভক্ত, গোঁড়া নাজি–শত্রুপক্ষের প্রত্যেকটি মানুষ তার কাছে অতিশয় ঘৃণ্য।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ অনুসারে মার্কিন বাহিনীর ক্যাপ্টেন জোন্স ওই নাজি বন্দিকে কয়েকটা প্রশ্ন করে। জোন্স আদর্শ ভদ্রলোক, প্রশ্ন করার আগে বন্দির হাতে সে এক গেলাস মদ তুলে দিয়েছিল। হতভাগা নাজি এমন ভালো ব্যবহারের মূল্য দিল না–গেলাসের মদ জোন্সের মুখে ছিটিয়ে দিয়ে সে সজোরে পদাঘাত করল তার পেটে!

আর কিছু করার আগেই প্রহরীরা তাকে ধরে ফেলল। ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে জোনস আর্তনাদ করছে রুদ্ধস্বরে, তার পেটের নাড়ি ছিঁড়ে গেছে বুটসমেত লাথির আঘাতে।

হাসপাতালে যাওয়ার আগে জো লার্কিনকে ডেকে পাঠাল ক্যাপ্টেন জোন্স। যদিও জোন্স কখনো জো লার্কিনের সঙ্গে ক্যারাটে সম্পর্কে কোনো প্রসঙ্গ তোলেনি, তবু জো সম্পর্কে কিছু গুজব তার কানে এসেছিল নিশ্চয়ই।

জো আসতেই ক্যাপ্টেন জোন্স বলল, বন্দিকে এইবারতুমি প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করবে। তারপর জো-কে কাছে আসতে ইশারা করে জোন্স মৃদুস্বরে বলল, ওই শয়তানটাকে নিয়ে তুমি যা খুশি করতে পারো। পরিণামের কথা ভেবে ভয় পেয়ো না। আমি তোমাদের ক্যাপ্টেন, আমি তোমাকে সবসময়ই সমর্থন করব।

বাঃ! চমৎকার! জো তো এইরকমই চাইছিল। তার অন্তরের অন্তস্থলে এক ঘুমন্ত দানব জেগে উঠল হিংস্র উল্লাসে।

গেস্টাপো নামে কুখ্যাত জার্মান গুপ্ত পুলিশ কাউকে গোপনে খুন করতে হলে মধ্যরাত্রে ঘুম ভাঙিয়ে তাকে নিয়ে আসে–ঠিক সেইভাবেই মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে মার্কিন প্রহরীরা নাজি ক্যাপ্টেনকে একটা ফাঁকা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। বন্দি জার্মানকে তার প্যান্ট পরার সময়ও দেওয়া হয়নি, তার পরনে ছিল শুধু ছোটো হাফ প্যান্ট। ওই অবস্থায়ই তাকে নগ্নপদে হাঁটিয়ে আনা হয়েছে।

ঘরের মধ্যে অপেক্ষা করছিল জো লার্কিন। তার পোশাকে স্ট্রাইপ চিহ্নগুলোর দিকে তাকাল বন্দি, তারপর শুদ্ধ ইংরেজিতে প্রশ্ন করল, এমন অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ কী?

হের ক্যাপিটান, জো তার শার্ট আর প্যান্ট খুলতে খুলতে বলল, তোমার ভারি বদঅভ্যাস, লোকজনকে তুমি লাথি মারো। এটা খুবই অন্যায় আর অভদ্র ব্যবহার। তোমাকে আমি আজ ভদ্রতা শিখিয়ে দেব।

হের ক্যাপিটান সঙ্গেসঙ্গে জো-র কথার আসল মানেটা বুঝতে পারল, ব্যাপারটা তার ভারি মজার মনে হল।

হো হো শব্দে হেসে সে বলল, তুমি?

স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, লোকটা হাতাহাতি মারামারিতে বেশ দক্ষ, নিজের দৈহিক শক্তি সম্পর্কে তার ধারণাও যে খুবই উঁচু সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। জো প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করল–প্রায় ছয় ফুট দু-ইঞ্চির মতো লম্বা, চওড়া বলিষ্ঠ কঁধ, কোমরের দিকটা চাপা, হাতে-পায়ে কঠিন মাংসপেশির স্ফীত বিস্তারের কোথাও এতটুক মেদের চিহ্ন নেই–হ্যাঁ, লোকটা গর্ব করার মতো দেহের অধিকারী বটে। বন্দির গায়ের রং রোদে পোড়া, নিশ্চয়ই ফাঁকা মাঠে ব্যায়াম করার অভ্যাস আছে। জো ভাবল হয়তো কিছু কিছু জুডোর কায়দা লোকটা রপ্ত করেছে।

ততক্ষণে পোশাকের আবরণ থেকে মুক্ত হয়েছে জো। তার পরনে জার্মান বন্দির মতোই একটা ছোটো হাফ প্যান্ট এমনকী পায়ের ভারী বুট দুটো খুলে ফেলা হয়েছে। জুতো পায়ে লাথি মারার সুযোগ নিতে চায় না জো, তার একমাত্র ভরসা মৃত্যুবাহী ক্যারাটে।

ঠিক আছে, মুর্খ আমেরিকান শুয়োর, নাজি গর্জন করে উঠল, আমি ভদ্রতা শেখার জন্য প্রস্তুত।

লোকটার চোখে-মুখে একটা হিংস্র দীপ্তি জ্বলে উঠল, কিন্তু সে এগিয়ে এল না, প্রতিদ্বন্দ্বীর আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। জো একটু অবাক হল, লোকটার মতলব সে বুঝতে পারল না।

আচম্বিতে বিস্ময়ের চমক! ক্যারাটে! এই লোকটাও ক্যারাটে-যোদ্ধা! যেভাবে ডান পায়ের আঙুলগুলো গুটিয়ে নিয়ে সে লাথি চালাল তাতে প্রমাণ হয়ে গেল ক্যারাটের মরণ খেলায় সেও এক খেলোয়াড়।

চিবুকের উপর প্রচণ্ড পদাঘাতে ছিটকে পড়ল জো লার্কিন!

আর একটু হলেই ঘাড় ভাঙত, কোনোরকমে আত্মরক্ষা করে জো উঠে দাঁড়াল। ভালোভাবে টাল সামলে দাঁড়ানোর আগেই সে দেখতে পেল জার্মান বন্দি তাকে আক্রমণ করতে আসছে। চকিতে পিছন ফিরে পায়ের গোড়ালি দিয়ে আঘাত হানল জো। ঠিক জায়গায় সেই আঘাত লাগলে লড়াইয়ের মোড় তখনই ঘুরে যেত, তবে জো-র লাথিটা একেবারে ব্যর্থ হল না–নাজির দম বেরিয়ে গেল, সে থমকে দাঁড়াল মুহূর্তের জন্য।

লোকটা সত্যিই কঠিন ধাতুতে গড়া, আর তেমনি চটপটে। জো ব্যাপারটা কী হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই নাজি তাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে ছুঁড়ে ফেলল যে, জো দস্তুরমতো যন্ত্রণা ভোগ করল। অবশ্য জো মুহূর্তের মধ্যেই উঠে দাঁড়িয়েছিল এবং তলপেট লক্ষ করে প্রাণঘাতী লাথিটা এড়িয়ে গিয়েছিল। ব্যর্থ হয়ে বন্দি আবার জোর চিবুক লক্ষ করে লাথি হাঁকাল আর একটুর জন্য ফসকে গেল। জো ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে, লোকটা ক্যারাটে জানে এবং যথেষ্ট ক্ষিপ্র, তবে সে পাকা খেলোয়াড় নয়।

সেই মুহূর্তে নাজি যেভাবে অবস্থান করছিল, তাতে জো-র পক্ষে তার চিবুকে কনুই দিয়ে আঘাত করার সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত। বলাই বাহুল্য, জো সেই সুযোগ নিতে একটুও দেরি করেনি। নাজি বন্দি চোখে সর্ষে ফুল দেখতে দেখতে বসে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে জো ক্যারাটের বিশেষ পদ্ধতিতে পদাঘাত করল শত্রুর মুখে। জার্মান সৈন্যের নাক ভেঙে গেল তৎক্ষণাৎ।

আহত নাজি সেনা দারুণ আক্রোশে লাফিয়ে উঠল, তারপর ধেয়ে এল জো-কে আক্রমণ করতে। সে কিছু করার আগেই তার কণ্ঠনালীতে হাতের তালু দিয়ে কাটারির মতো আঘাত হানল জো। যন্ত্রণায় জার্মানটির মুখ নীল হয়ে গেল।

লড়াইয়ের পরবর্তী বিবরণ এমন নিষ্ঠুর যে, সেই বর্ণনা পাঠকের মনকে পীড়িত করবে। সংক্ষেপে বলছি, সৈন্যটিকে অসহ্য যন্ত্রণা দিয়ে অবশেষে তাকে হত্যা করেছিল জো। সকালের আলোতে জার্মান সৈন্যটির মৃতদেহের অবস্থা দেখে জো নিজেও শিউরে উঠেছিল।

লড়াইয়ের উন্মাদনা তখন কেটে গেছে, হত্যার নির্দয় লালসা তৃপ্ত হওয়ায় জো লার্কিনের বুকের মধ্যে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে হন্তারক দানব অনুতপ্ত জো ক্যাপ্টেন জোন্সের কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলল। কী অসহ্য যন্ত্রণা দিয়ে লোকটাকে সে হত্যা করেছে, তার বিশদ বিবরণ দিয়েছিল জো। সেই বিবরণ (পাঠকদের কাছে আমি যা বর্ণনা করিনি) শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল ক্যাপ্টেন জোন্স।

পরবর্তীকালে সেনাবিভাগের কাজে ইস্তফা দিয়ে নাগরিকদের জীবন গ্রহণ করল জো লার্কিন। এমন একটা অফিসে সে কাজ নিয়েছিল যেখানে কারো সঙ্গে মারামারি হওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।

জো লার্কিনের সংক্ষিপ্ত কাহিনি এখানেই শেষ। কৌতূহলী পাঠকের মনে এই প্রশ্ন আসতে পারে, ক্যারাটের অভিশাপ থেকে জো কি আজ মুক্ত? জো নিজেও এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সমর্থ নয়। তবে পরিশিষ্ট হিসাবে তার নিজস্ব বক্তব্য তার জবানিতেই পরিবেশন করছি :

পাঠক! একটা কথা বলে আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। আমার প্রকৃত নাম জো লার্কিন নয়। আপনি যদি শক্তিশালী হন আর গায়ের জোর দেখাতে গুন্ডামি করতে ভালোবাসেন, আর সেইজন্যই যদি কোনো রাত্রে কোনো রেস্তরাঁ বা পানাগারের মধ্যে খুব শান্তশিষ্ট একটি লোককে আপনার যাবতীয় অসভ্যতা সহ্য করে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে অত্যন্ত গোবেচারার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন, তবে

তবে বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না। কারণ আমার দৈহিক ক্ষমতা এখনও অটুট, আর একবার মারামারি বাধলে আমি শেষ না-দেখে থাকতে পারি না।

[১৩৮৭]

গল্পের চেয়েও ভয়ংকর

ঘুম ভেঙে গেল..

ঘুম ভেঙে যাওয়া কিছু আশ্চর্য নয়।

সেই বীভৎস চিৎকার কানে গেলে জ্যান্ত মানুষ তো দূরের কথা, বোধ হয় কবরের মড়াও বাপ রে বলে কবরের মধ্যে ধড়মড়িয়ে উঠে বসত…

ঘুমের ঘোর তখনও চোখ থেকে কাটে নি, আমার স্তম্ভিত দৃষ্টির সম্মুখে ফুটে উঠল এক ভয়ংকর দৃশ্য!

ভালো করে চোখ মুছে চাইলুম– না, দুঃস্বপ্ন নয়, নিশ্চিত মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে অনেকগুলি চতুষ্পদ জীব- তাদের রোমশ দেহের সাদা সাদা চামড়ার উপর নাচছে অগ্নিকুণ্ডর রক্তিম আলোকধারা, জ্বলন্ত কয়লার মতো চোখে চোখে জ্বলছে ক্ষুধিত হিংসার নিষ্ঠুর প্রতিচ্ছবি!

কাফাতো হাতের বর্শা বাগিয়ে ধরে একটু ঝুঁকে দাঁড়াল, ঠান্ডা গলায় বললে, মি. ম্যাক, বাঁচার আশা রেখো না, সাদা শয়তানের দল যাকে ঘিরে ধরে তার নিস্তার নেই। তবে মরার আগে মেরে মরব।

পাশের রাইফেলটা তুলে ধরে সেফটি ক্যাচটা সরিয়ে দিলুম। সঙ্গেসঙ্গে একটা জানোয়ার অগ্নিকুণ্ডের খুব কাছে এসে চিৎকার করে উঠল অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় ঝকঝক করে উঠল তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি।

অগ্নিকুণ্ডের কাছে ও দুরে যে চতুষ্পদ জীবগুলি এতক্ষণ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তারা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল।

কাফাতো বললে, মি. ম্যাক, প্রস্তুত হও এবার ওরা আক্রমণ করবে।

রাইফেলের ট্রিগারে আঙুলে রেখে চার পাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলুম। সামনে অগ্নিকুণ্ড, তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে মূর্তিমান যমদূতের দল, আগুনের এধারে আমি আর কাফাতো, পিছন থেকে আমাদের বাঁদিক ও ডানদিক দিয়ে উঠে গেছে খাড়া পাহাড়ের প্রাচীর।

শয়তানের দল সেই পথ বেয়ে তিরবেগে উঠে আসতে লাগল।

আমার কাছে রাইফেলের কার্তুজ খুব বেশি নেই, ভরসা খালি আগুন। কিন্তু আগুনের তেজ কমে এসেছে; জ্বালানি কাঠ, বসার টুল, এমনকি তাঁবুটাকেও আমরা জ্বালিয়ে দিয়েছি আর এমন কিছু নেই যা দিয়ে আগুনটাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় এবার?

কাফাতোর দিকে তাকিয়ে দেখলুম তার কালো পাথরের মতো মুখ সম্পূর্ণ নির্বিকার, শুধু শরীরের মাংসপেশীগুলি যেন এক ভয়ংকর প্রতীক্ষায় ফুলে ফুলে উঠছে…

সামনের জানোয়ারটা আরও কাছে এসে দাঁড়াল, তারপর হঠাৎ এক প্রকাণ্ড লাফ মেরে আগুন ডিঙিয়ে একেবারে আমাদের সামনে এসে পড়ল। তার সঙ্গে সঙ্গে দেখলুম তাকে অনুসরণ করে আরও দুটো জানোয়ার আগুনের বেড়ার উপর দিয়ে শূন্যে লাফ মারল।

আমার হাতের রাইফেল সশব্দে অগ্নি-উদ্গার করলে, সামনের জন্তুটার মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল।

কাফাতো হাতের বর্শা চার্লিয়ে আর-একটা জন্তুকেও মাটিতে পেড়ে ফেলল; কিন্তু তিন নম্বর শয়তানটা তার দেহের উপর এসে পড়ল এবং বিকট হাঁ করে শত্রুর গলায় কামড় বসাবার উপক্রম করলে। ভীষণ আতঙ্কে আমার হাতের আঙুল অবশ হয়ে এল। গুলি চালাবার উপায় নেই, কাফাতোর গায়ে গুলি লাগতে পারে।

আড়ষ্ট দেহে চোখের সামনে এক বিয়োগান্ত নাটকের রক্তাক্ত দৃশ্যের অপেক্ষা করতে লাগলুম।

কিন্তু এত তাড়াতাড়ি নিজের দেহের রক্তমাংস দিয়ে কোনো উপবাসী শ্বাপদের উপবাস ভঙ্গ করাতে কাফাতো রাজি হল না- চটপট মাথা সরিয়ে সে গলটা বাঁচিয়ে নিল, কিন্তু তীক্ষ্ণধার দাঁতগুলি তার বাঁদিকের কাঁধের উপর এঁকে দিল এক গভীর ক্ষতচিহ্ন।

কাফাতোর হাতের বর্শায় আবার বিদ্যুৎ খেলে গেল তীব্র আর্তনাদ করে জন্তুটার রক্তাক্ত দেহ মাটিতে আছড়ে পড়ল– সব শেষ!

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, যাক বাঁচা গেল।

কাফাতোর মুখে শুকনো হাসি খেলে গেল, মি. ম্যাক বাঁচবার আশা রেখো না- ওরা আবার আক্রমণ করবে।

সত্যিই তাই।

পর পর তিনটি সঙ্গীর মৃত্যু দেখে জন্তুগুলো একটু সরে গিয়েছিল কিন্তু একটু পরেই কয়েকটা জানোয়ার আবার আগুনের বেড়া ডিঙিয়ে আক্রমণ করল।

আবার গর্জে উঠল আমার হাতের রাইফেল, রক্তে লাল হয়ে গেল কাফালোর হাতের বর্শা আমাদের সামনে আর অগ্নিকুণ্ডর ওপাশে পড়ে রইল কতকগুলি শ্বেতকায় প্রাণহীন পশুদেহ।

কিন্তু শয়তানের দল পালিয়ে গেল না। কিছুক্ষণ পর পর তারা আক্রমণ করে, মাটিতে পড়ে থাকে কয়েকটা হতাহত জানোয়ার, ওরা পিছিয়ে আবার আক্রমণ করে…।

হঠাৎ সভয়ে দেখলুম রাইফেলের বুলেট ফুরিয়ে গেছে।

অকেজো জিনিসটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কোমরের রিভলভারটা টেনে নিলুম মাত্র ছয়টি বুলেট তাতে ভরা আছে, সঙ্গে আর কার্তুজ নেই!

কাফাতোর নীরস কণ্ঠ শুনতে পেলুম, মি. ম্যাক, ওরা আবার আসছে..।

আহোয়ার সাদা কুকুর সম্পর্কে কোনো কথা আগে শুনিনি। পরে যখন জানতে পারলুম তখন মনে মনে ঠিক করে ফেললুম কয়েকটা সাদা কুকুরের চামড়া জোগাড় করতেই হবে।

আমি জাত শিকারি, শিকার আমার শুধু নেশা নয়- পেশাও বটে। যেসব জানোয়ার সচরাচর দেখা যায় না তেমন বহু জন্তু আমি শিকার করেছি এবং পৃথিবীর বিখ্যাত জাদুঘরগুলি আমার কাছ থেকে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে সেই সব বিরল পশুচর্ম সংগ্রহ করতে কুণ্ঠিত হয়নি। আমার হাতে নিহত সাদা কুকুরগুলি এখন ম্যানিলা, পাপিতি এবং হনলুলুর বিখ্যাত জাদুঘরের শোভাবর্ধন করছে।

তাদের সাদা চামড়ার শোভায় মুগ্ধ হয়ে দর্শকরা প্রায়ই চেঁচিয়ে ওঠে, বাঃ! বাঃ! কী সুন্দর! কী চমৎকার!

চমৎকারই বটে! এই চমৎকার চামড়া জোগাড় করতে গিয়ে আমার গায়ের চামড়াই শরীর-ছাড়া হওয়ার উপক্রম করেছিল। সেই কথাই বলছি…

আহোয়া উপত্যকায় যাওয়ার আগে অবশ্য এই সাদা কুকুরদের সম্বন্ধে আমার বিশেষ কিছুই জানা ছিলনা। পরে জানতে পারলুম হাঙ্গারির কোভাজ জাতের কুকুর থেকেই এদের উৎপত্তি।

এই জাতীয় কুকুরগুলি অত্যন্ত হিংস্র এবং শক্তিশালী হয় এবং এদের দেহের আয়তনও নেকড়ের চাইতে একটুও ছোটো নয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে হিভাওয়া দ্বীপে কোনো এক হতভাগা ইউরোপীয় নাবিক কয়েক জোড়া কোভাজ কুকুর আমদানি করে। হাঙ্গারির কোভাজ বছরের পর বছর এই দ্বীপে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে।

কিন্তু দ্বীপের মাঝখানে মানুষের হাতের তৈরি খাবার কোথা থেকে জুটবে? অতএব ক্ষুধার্ত কুকুরদের চোখ পড়ল পাহাড়ি ছাগল, বুনো মোষ ও গোরুর দিকে হিভাওয়া দ্বীপের উপর শুরু হল এক বিভীষিকার রাজত্ব।

এইভাবে সভ্য জগতের বাইরে হিভাওয়া দ্বীপের ওহিও উপত্যকায় জন্মগ্রহণ করল একদল হিংস্র রক্তলোলুপ শ্বাপদ বিপুল বপু কোভাজ বিপুলতর হয়ে উঠল বন্য প্রকৃতির সংস্পর্শে, ধূসর রঙের ছোঁয়া লাগল তার দুধসাদা চামড়ায়, স্বভাবে তারা হয়ে উঠল আরও হিংস্র, আরও ভয়ংকর।

ইউরোপীয় নাবিকদের সঙ্গে আরও দুটি জানোয়ার এই দ্বীপে পদার্পণ করেছিল–ইঁদুর এবং বিড়াল। সাদা মানুষগুলি এখন আর নেই বটে কিন্তু কুকুর বিড়াল আর ইঁদুর- এরা সবাই আছে।

কুকুরগুলি এখন বিরাটকায় নেকড়ে বাঘের আকার ধারণ করেছে, ইঁদুরগুলি প্রায় ভোঁদড়ের মতো এবং বিড়ালগুলি আমাদের পোষা বিড়ালের চাইতে অনেক বড়ো হয়ে বন্য মার্জারে পরিণত হয়েছে।

ওহিও উপত্যকার বনবিড়াল এখন বুনো ইঁদুর শিকার করে, কুকুরগুলি ইঁদুর বা বিড়াল কাউকেই রেহাই দেয় না।

আর ইঁদুরগুলি কী খায়?

ইঁদুররা সর্বভুক– ফলমূল, পাখি, গিরগিটি, রুণ কুকুর বা বিড়াল তো বটেই, এমনকি সুযোগ পেলে জাতভাই-এর রক্তমাংসে উদরপূরণ করতেও তারা আপত্তি করে না।

যে ইউরোপীয় ভবঘুরের দল এখানে প্রথম এসেছিল তাদের কী হল?

ক্ষুধার জ্বালায় সুসভ্য নরখাদকে পরিণত হল- এখনও এখানকার দেশীয় অধিবাসীদের মধ্যে কিছু কিছু লোক রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়, অনেক খোঁজাখুজি করেও তাদের পাত্তা মেলে না। এখানকার দেশি মানুষদের চেহারা ও আচার ব্যবহারে ইউরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির কোনো চিহ্নই পাওয়া যায় না। মিশনারিদের কল্যাণে তারা সভ্যজগতের নিয়মকানুন কিছুটা শিখেছে বটে কিন্তু মন থেকে মেনে নেয়নি।

কাফাতো ঠিক এদের মতো নয়। তার বাপ ছিল মালয়ের অধিবাসী– সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানোই ছিল তার পেশা। ভবঘুরে নাবিকের রক্ত শরীরে থাকলেও কাফাতো তার দেশ ছেড়ে এদিক ওদিক যেতে চাইত না, বরং বর্শা আর ছুরি হাতে শিকার করতেই সে বেশি ভালোবাসত।

শিকারের হাত তার চমৎকার। কাফাতোর বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ হয়েছিল কিন্তু তার বেতের মতো পাকানো ছোটো শরীরটা বয়সের ভারে একটুও কাবু হয়নি। রক্তারক্তি আর হানাহানিতে তার বড়ো আনন্দ; তাকে ঠিক শিকারি না বলে খুনে বললেই সঠিক আখ্যা দেওয়া হয়।

হিভাওয়া দ্বীপে যেদিন এসে নামলাম সেদিনই কাফাতোর সঙ্গে আমার পরিচয় হল। আমার উদ্দেশ্য জানতে পেরে সে বত্রিশ পাটি দাঁত বার করে হেসে ফেলল, তুমি বুঝি কুকুরের মাংস খুব পছন্দ করো?

মাংস নয়, শুধু চামড়ার জন্য মানুষ এমন বিপদের ঝুঁকি নিতে পারে এ কথা কাফাতোর কাছে অবিশ্বাস্য। তবু যখন অনেক কষ্টে তাকে বোঝাতে পারলাম যে কুকুরের মাংস খাওয়ার লোভ আমার নেই তখন সে গম্ভীরভাবে বললে, ঠিক আছে, চামড়া তোমার মাংস আমার তবে সাদা কুকুরের মাংসের রোস্ট যদি খাও তাহলে জীবনে ভুলতে পারবে না…।

শিকারের অনুমতি নিতে আমায় অনেক ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়েছিল। হিভাওয়া দ্বীপটা ফরাসিরা শাসন করে, আর ফরাসিদের মতো সন্দেহপ্রবণ জাত দুনিয়ায় নেই। অনেক হাঙ্গামা-জুত করার পরে কর্তৃপক্ষ আমাকে দয়া করে দু-সপ্তাহ সময় দিলেন তার মধ্যে আমার কাজ শেষ করে বিদায় নিতে হবে।

এত অল্প সময়ের মধ্যে এক অজানা দ্বীপের অপরিচিত পরিবেশের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারব কিনা এই কথা ভেবে দস্তুরমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলুম, এমন সময় হঠাৎ কাফাতোর সঙ্গে আলাপ হওয়ায় স্বস্তি বোধ করলুম।

পারিশ্রমিকের ব্যাপারে কাফাতো খুব উদার। কুকুরের মাংসের মতো লোভনীয় খাদ্যে আমি কোনো ভাগ বসাব না এতেই সে খুশি চামড়ার মতো অখাদ্য জিনিস নিয়ে তার কী লাভ?

চামড়া তোমার– মাংস আমার, এই তার শর্ত।

শর্তটা আমাদের দুজনেরই খুব ভালো লাগল।

.

সন্ধ্যার ধূসর যবনিকাকে লুপ্ত করে নেমে এল রাত্রির অন্ধকার। ক্যাম্পের সামনে আগুন জ্বালিয়ে আমি চোখ বুজে শুয়ে পড়লুম। ঠিক হল প্রথম রাত আমি নিদ্রাসুখ উপভোগ করব আর কাফাতো পাহারা দেবে, বাকি রাতটা কাফাতোকে ঘুমোবার সুযোগ দিয়ে আমি জেগে থাকব।

ক্লান্ত শরীরে ভরপেট খাওয়ার পরে চোখ বুজতেই ঘুম এসে গেল।

একটা বীভৎস চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। জেগে উঠে যে দৃশ্য চোখে পড়ল তা আগেই বলেছি।

হ্যাঁ, ওরা আসছে আসবেই। এখনই তীক্ষ্ণ দাঁতের আঘাতে টুকরো হয়ে যাবে আমাদের শরীর দুটো। নিশ্চিত মৃত্যু করাল ফঁদ মেলে ছুটে আসছে, ঘিরে ধরছে আমাদের এই ভয়ংকর মরণ-ফঁদ থেকে আমাদের নিস্তার নেই…

কিন্তু আমি এখনও আশা ছাড়িনি।

একটা উপায় আছে শেষ উপায়।

হাতের রিভলভার উঁচিয়ে ধরে উপরি উপরি ছয়বার গুলি ছুড়লাম- চার-চারটে কুকুর মাটির উপর লুটিয়ে পড়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল।

বাকি জন্তুগুলো আবার দূরে দূরে ছড়িয়ে পড়ল।

ফাঁকা রিভলভারটা ফেলে দিয়ে কেরোসিনের বোতল আর টিনটা তুলে নিলুম, চিৎকার করে বললাম, কাফাতো, খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে যাও- আমি পিছনে আসছি।

শুনেছিলাম এই কুকুরগুলির দৃষ্টিশক্তি অতিশয় দুর্বল, এরা নির্ভর করে ঘ্রাণশক্তি ও শ্রবণশক্তির উপর। জ্বলন্ত আগুনের প্রখর আভা এবং রাইফেল ও রিভলভারের অগ্নিবৃষ্টি এদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। কাজেই অন্ধকারের আড়াল দিয়ে আমরা যে পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করেছি এটা তারা বুঝতেই পারেনি। কিন্তু তাদের চোখকে ফাঁকি দিলেও কানকে ফাঁকি দিতে পারলুম না।

খানিক পরেই পাহাড়ের গায়ে আমাদের জুতোর অস্পষ্ট আওয়াজ তাদের কানে এল, পরক্ষণেই হিংস্র গর্জন করে ছুটে এল শ্বেত বিভীষিকার দল পাহাড়ের নীচে

এমন লোভনীয় শিকার হাতছাড়া করতে তারা রাজি নয়!

আমরা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলুম। কুকুরগুলি যখন পাহাড়ের নীচে, আমি আর কাফাতো তখন অন্তত পঞ্চাশ ফিট উপরে উঠে গেছি।

উঁচু-নীচু পাথরের মধ্য দিয়ে সরু একটা পথ উঠে গেছে উপর দিকে পাহাড়ে উঠতে হলে ওই একটি রাস্তা ছাড়া অন্য পথ নেই। শয়তানের দল সেই পথ বেয়ে তিরবেগে উঠে আসতে লাগল। নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করে কয়েকটা কুকুর ছিটকে পড়ল নীচে।

আমি কাফাতোকে ইঙ্গিত করলুম। সে সামনের কুকুরটাকে বর্শা দিয়ে চেপে ধরল পাহাড়ের গায়ে। কুকুরটার রোমশ দেহের উপর এক বোতল কেরোসিন ঢেলে দিয়ে আমি একটা দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে ফেলে দিলুম। বিকট চিৎকার করে জন্তুটা পাহাড়ের উপর দিয়ে গড়াতে গড়াতে নীচে গিয়ে পড়ল।

এইভাবে পর পর ছয়টা কুকুর উঠে এল আমাদের সামনে এবং তারা প্রত্যেকেই অগ্নিদেবের জ্বলন্ত আশীর্বাদ শরীরে বহন করে গড়িয়ে পড়ল পাহাড়ের নীচে।

অবশিষ্ট কেরোসিন পাহাড়ের সরু পথের উপর ঢেলে একটি জ্বলন্ত দেশলাই-এর কাঠি ফেলে দিলুম। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। সেই তরল অগ্নিস্রোতের উপর দিয়ে উঠে আসার ক্ষমতা কোনো প্রাণীর নেই।

আমরা একেবারে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বসে নীচের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলুম।

পাহাড়ের আগুন তখন নিভে এসেছে, কিন্তু দুরে অনেক নীচে কতকগুলি আগুনের গোলা ছুটছে, লাফাচ্ছে, গড়াচ্ছে। যে কুকুরগুলির শরীরে আগুন লেগেছে তারা অসহ্য যন্ত্রণায় দাপাদাপি করছে।

ধীরে ধীরে আগুন নিভে গেল, বাতাসে ভেসে এল দগ্ধ বোম ও মাংসের কটু গন্ধ!

অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় দেখা গেল কয়েকটা সাদা সাদা ভুতুড়ে ছায়া মৃত কুকুরগুলির দেহ নিয়ে টানাটানি করছে ওহিওর সাদা শয়তান জাতভাই-এর মাংস খেতেও আপত্তি করে না।

.

রাত্রি প্রভাত হল।

পাহাড়ের উপর থেকে এতক্ষণ নামতে সাহস হয়নি। দিনের আলোয় যখন ভালো করে দেখলুম আশেপাশে একটিও জ্যান্ত কুকুর নেই তখন সাবধানে নীচে নেমে এলুম। প্রতি মুহূর্তে ভয় হয়েছে এই বুঝি শয়তানের দল তাড়া করে আসে। কিন্তু ভয়ের কোনো কারণ ছিল না। দিনের আলোয় কুকুরগুলি বিশ্রাম নিতে গেছে, এক রাতের অভিজ্ঞতার ধাক্কা সামলাতে তাদেরও বেশ খানিকটা সময় যাবে।

নীচে নেমে দেখলুম এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে অনেকগুলি কুকুরের মৃতদেহ। কতকগুলি কুকুরের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে বুঝলাম তাদের দেহের মাংসে তাদের স্বজাতিরাই উদর পূরণ করেছে। আবার কতকগুলির শরীর আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গেছে।

তবে কয়েকটা চামড়া একেবারেই অটুট পেয়ে গেলুম। শুধু বুলেট এবং বর্শার ক্ষতচিহ্ন ছাড়া ওই চামড়াগুলিতে আর কোনো দাগ পড়েনি।

আমি আর কাফাতো কয়েকটা চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে একটা গ্রামে এসে পৌঁছলুম। আমার সমস্ত শরীর তখন ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে কিন্তু কাফাতোর বেতের মতো পাকানো দেহে অবসাদের কোনো চিহ্ন নেই- একদল লোক নিয়ে সে হই হই করে চলল সেই পাহাড়ের নীচে যেখানে পড়ে আছে কুকুরগুলির মৃতদেহ।

কুকুরের মাংসে সেদিন রাতে এক চমৎকার ভোজ হল ঝলসানো মাংস আমিও একটু চেখে দেখলুম। বললে বিশ্বাস করবে না, কুকুরের মাংসের রোস্ট ঠিক কুকুরের মাংসের মতোই, একটুও অন্যরকম নয়!

 গ্ল্যাডিয়েটরের মৃত্যু নেই

গ্ল্যাডিয়েটরের যুগ শেষ হয়ে গেছে।

হ্যাঁ শেষ হয়ে গেছে, লুপ্ত হয়ে গেছে আজ দুনিয়ার রঙ্গমঞ্চ থেকে সেই বৃষস্কন্ধ শক্তিমান মানুষগুলো অস্ত্রের শাণিত ফলকে, রুধিরের রক্তিম অক্ষরে ইতিহাস যাদের নাম রেখেছে গ্ল্যাডিয়েটর।

একখানা বর্শা বা তরবারি মাত্র সম্বল করে যারা হিংস্র শ্বাপদের সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে একটুও ইতস্তত করত না, যাদের গর্বিত পদক্ষেপে কেঁপে-কেঁপে উঠত রোম এবং গ্রিসের ক্রীড়ামঞ্চ, হাজার হাজার দর্শকের উদগ্রীব দৃষ্টির সম্মুখে যারা বারংবার আলিঙ্গন করত নিশ্চিত মৃত্যুকে গ্ল্যাডিয়েটর নামধারী সেই ভয়ঙ্কর মানুষগুলো আজ দুনিয়ার বুক থেকে মুছে গেছে, শেষ হয়ে গেছে গ্ল্যাডিয়েটরের যুগ…

কিন্তু সত্যিই কি তাই?

অতীতের কবর খুঁড়ে বিদেহী গ্ল্যাডিয়েটরের প্রেতাত্মা কি আজও হানা দেয় না বিংশ শতাব্দীর বুকে?

হ্যাঁ, হানা দেয়। ফিরে আসে গ্ল্যাডিয়েটর ভিন্ন দেহে, ভিন্ন নামে তারা আত্মপ্রকাশ করে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে।

মোরদি হচ্ছে এমনই একটি লোক যাকে আমরা অনায়াসে আখ্যা দিতে পারি আধুনিক গ্ল্যাডিয়েটর।

ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে আমরা জানতে পারি যে প্রাচীন রোমের ক্রীড়ামঞ্চে মাঝে মাঝে শ্বেতাঙ্গ গ্ল্যাডিয়েটরদের সঙ্গে কালো চামড়ার যযাদ্ধারাও মৃত্যু-উৎসবে মেতে উঠত।

আমাদের বর্তমান কাহিনির নায়কও শ্বেতাঙ্গ নয়, নেহাত কালা বাদামি– বিংশ শতাব্দীর কৃষ্ণকায় গ্ল্যাডিয়েটর।

কাহিনি শুরু করার আগে আফ্রিকা সম্বন্ধে কয়েকটা কথা বলা দরকার।

এই মহাদেশের বিস্তীর্ণ তৃণভূমির বুকে বাস করে অ্যান্টিলোপ, জেব্রা, জিরাফ, হস্তী, গণ্ডার, মহিষ প্রভৃতি তৃণভোজী পশু এবং এই তৃণভোজীদের মাংসের লোভে ঘন অরণ্যের ছায়ায় ছায়ায় হানা দিয়ে ফেরে সিংহ, লেপার্ড, হায়না প্রভৃতি হিংস্র জানোয়ার।

বনচারী পশুদের শিং, দাঁত, নখ ও চামড়ার উপর শ্বেতাঙ্গদের লোভ বড়ো বেশি। ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন ভূখণ্ড থেকে আফ্রিকায় এসে শ্বেতাঙ্গরা শিকারের নামে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চার্লিয়ে যায়। হত্যালীলার জন্য অবশ্য কেবলমাত্র সাদা চামড়ার মানুষদের দায়ী করা উচিত নয় আফ্রিকার কালো চামড়ার মানুষগুলোও এজন্য যথেষ্ট দায়ী। এখানকার কৃষ্ণকায় নিগ্রো অধিবাসীরা অতিশয় মাংস প্রিয়। তাদের তীর ধনুক ও বর্শার মুখে নিরীহ অ্যান্টিলোপ প্রভৃতি পশু প্রায়ই মারা পড়ে। শক্তিশালী তৃণভোজীরা কখনো কখনো মাংস-লোলুপ নিগ্রোদের দ্বারা আক্রান্ত হয় বটে কিন্তু মহাকায় হস্তী, খঙ্গধারী গণ্ডার ও ভয়ঙ্কর মহিষাসুরকে আদিম অস্ত্রের সাহায্যে মাঝে মাঝে ঘায়েল করা সম্ভব হলেও একেবারে নির্মূল করা অসম্ভব।

তবে, শ্বেতাঙ্গদের রাইফেল এইসব শক্তিশালী জানোয়ারদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। সিংহ, লেপার্ড প্রভৃতি হিংস্র শ্বাপদের নিরাপত্তাও আজ বিপন্ন। আধুনিক রাইফেলের অগ্নিবৃষ্টির মুখে দন্ত ও নখরের প্রচণ্ড বিক্রম অধিকাংশ সময়েই ব্যর্থ হয়ে যায়।

সভ্য মানুষ এক সময়ে বুঝতে পারল যে এইভাবে শিকারের নামে হত্যাকাণ্ড চললে আফ্রিকার জানোয়ার নির্মূল হয়ে যাবে। তাই বন্য প্রাণীদের রক্ষা করার জন্য এই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপিত হল Sanctuary বা নিরাপত্তা অঞ্চল।

এই অঞ্চলগুলি পরিদর্শন করার জন্য স্থানীয় গভর্মেন্ট থেকে পেশাদার শিকারিদের মোটা মাইনে দিয়ে বনরক্ষকের পদে নিয়োগ করা হয়।

নিম্নলিখিত কাহিনিটি একজন ফরাসি বনরক্ষকের লিখিত বিবরণী থেকে তুলে দেওয়া হল।

লোকটির প্রকৃত নাম আমি উল্লেখ করতে চাই না, কারণ তাতে হয়ত তার শাস্তি হতে পারে। হ্যাঁ, একথা সত্যি যে লোকটি গুরুতরভাবে আইন ভঙ্গ করেছিল। কিন্তু আমি তাকে অপরাধী ভাবতে পারছি না।

আমাদের কাহিনির নায়কের সত্যিকারের নামটা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু যা-হোক একটা নাম তো দরকার– আচ্ছা আমরা বরং তাকে মোরদি নামেই ডাকব।

কঙ্গোর উত্তর দিকে যে ভয়ঙ্কর যোদ্ধা-জাতি বাস করে, যারা কেবলমাত্র বর্শা হাতে নিয়ে উন্মত্ত হস্তীকে আক্রমণ করতে ভয় পায় না মোরদি ছিল সেই জাতিরই লোক। কোনো অজানা কারণে স্বজাতির সাহচর্য ছেড়ে এই লেক এডওয়ার্ড অঞ্চলে সে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল…

আমি একটু অসুবিধায় পড়েছিলাম।

স্থানীয় অধিবাসীরা লেক এডওয়ার্ড অঞ্চলের তৃণভূমি এবং অরণ্যের মধ্যে চিরকাল শিকার করে এসেছে। এখন এই জায়গাটা হঠাৎ নিরাপত্তা অঞ্চলে পরিণত হওয়ায় এখানে পশুবধ নিষিদ্ধ। কিন্তু চিরকাল যা হয়েছে এখন আর তা চলবে না। এই সহজ কথাটা অধিবাসীরা সহজে বুঝতে চায় না। আমি এখানকার সহকারী বনরক্ষক, কাজেই আমার এলাকায় কোনও পশু নিহত হলে আইনত আমিই দায়ী; অথচ এখানকার নিগ্রো বাসিন্দাদের বাধা দেওয়াও খুব কঠিন।

সত্যি সত্যিই বনের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে হত্যাকাণ্ড চলছিল। এই অঞ্চলের কয়েকজন অসৎ ব্যবসায়ী এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলেই আমার বিশ্বাস। হাতির দাঁতের দাম বাজারে খুব বেশি, তাই অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে হস্তী শিকার করে গজদন্তের ব্যবসা চালায়। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধরনের ব্যবসা চালু আছে। একদল অসাধু ব্যবসায়ী এই অঞ্চলের নিগ্রোদের মোটা টাকা দিয়ে এমনভাবে বশ করেছিল যে তারা এখানে সেখানে বর্শার সাহায্যে হাতি মারতে শুরু করলে। এই পাজি ব্যবসায়ীরা নিজেরাও অনেক সময় রাইফেল ব্যবহার করত। শুধু হাতি নয়- খঙ্গধারী গণ্ডারের উপরেও এই শয়তানদের দৃষ্টি পড়েছে।

গণ্ডারের খড়্গ ভারতীয় ব্যবসায়ী মহলে খুব চড়া দামে বিক্রি হয়, তাই গজদন্ত ও খঙ্গের লোভে এই লোকগুলো নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড শুরু করেছে।

আমি প্রায়ই খবর পাই, ছুটে যাই এবং ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি অপরাধীরা চম্পট দিয়েছে, কেবল অকুস্থলে দন্তবিহীন গজরাজের মৃতদেহ অথবা খঙ্গহীন খঙ্গীর প্রাণহীন শরীর রক্তাক্ত মাটির উপর লুটিয়ে পড়ে মানুষের লোভের সাক্ষ্য দিচ্ছে।

এই শয়তানগুলোকে ধরার জন্য আমি দারুণ ছুটোছুটি করছি, স্নানাহার প্রায় বন্ধ এমন সময়ে আরম্ভ হল এক নতুন উৎপাত।

হঠাৎ একদিন শুনলাম নিরাপত্তা-অঞ্চলের এক জায়গায় দেখা গেছে নিহত সিংহের দেহ। অর্থাৎ আর একদল শিকারি এবার লুকিয়ে সিংহ-শিকার শুরু করেছে।

একে মনসা তায় ধুনোর গন্ধ। জিপ গাড়ি নিয়ে ছুটলাম ঠিক করলাম যদি ধরতে পারি লোকগুলোকে এমন ঠ্যাঙানি দেব যে–

কিন্তু ধরব কাকে?

ঘটনাস্থলে গিয়ে কোনও সূত্ৰই খুঁজে পেলাম না। কেবল দেখলাম একটা কেশরধারী সিংহের মৃতদেহ মাটিতে পড়ে আছে। আরও একটা আশ্চর্য ব্যাপার সিংহের চমৎকার চামড়াটা সম্পূর্ণ অক্ষত, শুধু তার দেহটাকে লম্বালম্বিভাবে চিরে দু-ফাঁক করে ফেলা হয়েছে এবং গোঁফগুলিও হত্যাকারী কেটে নিয়েছে। ব্যবসায়ী মহল থেকে কেউ যদি সিংহ শিকার করে তাহলে চামড়াটাকে সে নিশ্চয় ছাড়িয়ে নেবে- আমার ধারণা হল কোনও স্থানীয় জাদুকর ওঝা (witch doctor) এই সিংহটাকে মেরেছে।

সিংহের গোঁফ, হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ প্রভৃতি দিয়ে এই সব ওঝারা নানারকম ক্রিয়াকাণ্ড করে। আমি খানিকটা নিশ্চিন্ত হলাম, ভাবলাম এটা একটা বিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড- এই নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

কিন্তু এক সপ্তাহ পরে যে খবর এল তা শুনেই আমার চোখ কপালে উঠল– জঙ্গলের মধ্যে নাকি আর একটা সিংহের মৃতদেহ দেখা গেছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, সেই একই ব্যাপার।

রক্তাক্ত মাটির উপর পড়ে আছে আর একটা সিংহের প্রাণহীন দেহ দেহটাকে ঠিক আগের মতোই লম্বা করে চিরে ফেলা হয়েছে।…

সেদিন রাতে ঘটল আর এক কাণ্ড।

আমার কয়েকজন আস্কারি (সশস্ত্র রক্ষী) গ্রাম থেকে ফিরে এসে জানাল যে একটা পাগল তাদের সবাইকে বেধড়ক ঠ্যাঙানি দিয়ে তাদের সঙিনগুলো কেড়ে নিয়ে একেবারে গ্রামের বাইরে তাড়িয়ে দিয়েছে।

কৌতূহল হল। চার-চারজন সশস্ত্র রক্ষীকে যে পাগল ধরে মার দিতে পারে সে কেমন পাগল একবার দেখা দরকার!

আমার সার্জেন্টকে ডেকে প্রশ্ন করলাম, ব্যাপারটা কী?

সার্জেন্ট বললে, বাওয়ানা, এ লোকটা সাক্ষাৎ শয়তান! নইলে ভেবে দেখুন, আস্কারিদের গায়ে হাত তুলতে কেউ সাহস পায়!

আরও প্রশ্ন-উত্তরের ফলে সমস্ত ব্যাপারটা জানা গেল। আস্কারিরা গাঁয়ে ঢুকে লোকের জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। আস্কারি হল রাজার লোক, যে কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার তাদের আছে এই হল আফ্রিকার অলিখিত আইন। স্থানীয় অধিবাসীরা আস্কারিদের বাধা দিতে ভয় পায়।

কিন্তু এই লোকটি ভয় পায়নি। সে প্রথমে আস্কারিদের ভালো কথায় বোঝাবার চেষ্টা করে। কিন্তু আস্কারিরা চিরকাল একরকম বুঝে এসেছে, আজ তারা অন্যরকম বুঝতে রাজি হবে কেন?

তখন সবচেয়ে বড়ো এবং আদিম যুক্তির প্রয়োগ শুরু হল বলং বলং বাহু বলং!

বাহুবলের প্রতিযোগিতার পরিণাম আগেই বলেছি।

দারুণ মার খেয়ে আস্কারিরা শেষে আমার কাছে নালিশ করলে। অবশ্য নিজেদের দোষ তারা স্বীকার করলে না, কিন্তু আমার জেরায় সব কিছুই প্রকাশ হয়ে পড়ল।

আমি লোকটিকে খুব দোষ দিতে পারলাম না।

বরং মনে মনে তাকে বাহবা দিলাম– চার-চারটে জোয়ান আস্কারিকে পিটিয়ে যে লোক তাদের হাত থেকে সঙিন কেড়ে নিতে পারে সে আলবৎ মরদ-কি বাচ্চা।

লোকটিকে একবার দেখা দরকার।

আমি গাঁয়ের দিকে যাত্রা করলাম।

গ্রামের মোড়লের সঙ্গে দেখা করে আমি জানতে চাইলাম কোন লোকটি আস্কারিদের গায়ে হাত দিয়েছে।

মোরদি? মোড়ল একগাল হাসলেন, সে এখন ঝোপের মধ্যে শিকারের খোঁজ করছে। হ্যাঁ, লোকটা একটা মানুষের মত মানুষ বটে! তার গায়ে জোর আছে, মাথায় বুদ্ধি আছে আর কলজেতে সাহসের অভাব নেই- মোরদি কাউকে ভয় করে না।

আমি গম্ভীরভাবে বললাম, এখন থেকে তাহলে তাকে ভয় করতে শিখতে হবে। আবার যদি সে আস্কারিদের গায়ে হাত তোলে তাহলে আমি তাকে ছাড়ব না, ঘাড় ধরে সোজা হাজতে ঢুকিয়ে দেব। কথাটা তাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিও। সে ফিরলেই তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে- এইসব অসভ্যতা আমি মোটেই সহ্য করব না।

মোড়ল আমার আদেশ পালন করেছিল।

মোরদি খবর পেয়ে সোজা এল আমার কাছে। ভালো করে লোকটির আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলাম।

অল্পবয়সী জোয়ান। উনিশ কুড়ি বছর বয়স হবে। বিরাট বলিষ্ঠ দেহ, সম্পূর্ণ অনাবৃত, শুধু কটিদেশের আচ্ছাদন হয়ে ঝুলছে একটা রঙিন কাপড়, দুই বাহুর জড়ানো একজোড়া লৌহ অলঙ্কার নীরবে ঘোষণা করছে অলংকারের মালিক একজন যোদ্ধা, এবং তার পেশল বক্ষদেশে আঁকা রয়েছে নানা ধরনের চিত্র-বিচিত্র নকশা।

হ্যাঁ– একটা দেখবার মতো চেহারা বটে!

মোরদির হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না।

সে উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বললে, আস্কারি? কতকগুলো কুকুর? পশুরাজ সিংহের সামনে দাঁড়িয়ে কুকুর যদি ঘেউ ঘেউ করে তাহলে সিংহ তাকে ক্ষমা করে না।

আমি আশ্চর্য হলাম, তার মানে?

তার মানে, সে তেমনি দৃপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলে, আমি কাউকে ভয় করি না। মানুষ কিংবা সিংহ কাউকেই আমি ভয় করি না।

তাই নাকি? আমি নীরস স্বরে বললাম, আর একবার যদি শুনি যে তুমি গভর্মেন্টের পোশাকধারী আস্কারিদের গায়ে হাত দিয়েছ, তাহলে আমিও তোমাকে একটি নতুন ধরনের জিনিস শিখিয়ে দেব।

-বটে! বটে! কী জিনিস শেখাবে?

আমি তোমায় শেখাব কেমন করে জেলখানাকে ভয় করতে হয়। বুঝেছ?

লোকটি স্থির দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চাইল, তারপর ডান হাত তুলে অভিবাদন জানিয়ে বললে, ক্য হরি, বাওয়ানা। অর্থাৎ ঠিক আছে বাওয়ানা।

তারপর গর্বিত পদক্ষেপে সে স্থান ত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমার হঠাৎ মনে হল যে দু-দুটো সিংহের হত্যালীলার সঙ্গে মোরদির একটা যোগসূত্র আছে। অবশ্য তাকে প্রশ্ন করে লাভ নেই একথা বোঝার মতো বুদ্ধি আমার ছিল চুপি চুপি একটি লোককে আমি মোরদিকে অনুসরণ করতে আদেশ দিলাম।

দিন তিনেক পরে আমার গুপ্তচর ফিরে এল।

তার মুখে যে সংবাদ শুনলাম তা যেমন আশ্চর্য তেমনই ভয়ঙ্কর। গুপ্তচর বললে, গ্রামের লোক মোরদিকে সিম্বা (সিংহ) বলে ডাকে। মোরদি নাকি সিংহের মাংস ভক্ষণ করে।

আমার গুপ্তচর দুদিন ধরে তার সম্বন্ধে নানারকম সংবাদ সংগ্রহ করেছে। কেবলমাত্র গত রাত্রিতে সে দূর থেকে মোরদিকে অনুসরণ করে।

চাঁদের আলোতে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বিস্তীর্ণ তৃণভূমির অপরদিকে যেখানে অনেকগুলি মিমোসা গাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে, হালকা ঘাসজমির উপর দিয়ে মোরদি সেইদিকে এগিয়ে গেল। একটা মিমোসা গাছে উঠে সে আত্মগোপন করলে।

আমার গুপ্তচর তখন দুর থেকে মোরদির কার্যকলাপ লক্ষ করছে। গাছের ডালপালার ভিতর লতাপাতার আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে হঠাৎ মোরদি জেব্রার কণ্ঠ অনুকরণ করে চেঁচিয়ে উঠল।

কয়েকটি মুহূর্ত। এবার তার কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল ন্যুর কণ্ঠস্বর।

(ন্য এক ধরনের তৃণভোজী পশু। ন্যুর মাংস সিংহের প্রিয় খাদ্য)

গুপ্তচর সবিস্ময়ে শুনতে লাগল, মোরদি একবার জেব্রার মতো চিৎকার করে উঠছে আবার তারপরেই নুর কণ্ঠ অনুসরণ করে হাঁক দিয়ে উঠছে।

কিছুক্ষণ পরেই দুর জঙ্গল ভেঙে রঙ্গমঞ্চে আত্মপ্রকাশ করলেন পশুরাজ সিংহ। বনের রাজা একা আসেননি, তাঁর সঙ্গে রানিও এসেছেন। পশুরাজ বিন্দুমাত্র ইতস্তত করলে না। যে গাছ থেকে মোরদি চিৎকার করেছিল সিংহ সোজা সেই গাছটার দিকে ছুটে এল। সঙ্গে সঙ্গে একটা বর্শা বিদ্যুৎবেগে ছুটে এসে তার দেহটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলে।

মরণাহত সিংহ ভীষণ কণ্ঠে গর্জন করে উঠল। সিংহী পিছন ফিরে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় মারলে এবং কয়েক মুহূর্ত পরেই তার মস্ত শরীরটা ঘন জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

সিংহ পলায়ন করলে না। যে গাছটায় মোরদি লুকিয়ে ছিল আহত সিংহ বারবার সেই গাছ বেয়ে ওঠার চেষ্টা করতে লাগল। প্রায় একঘণ্টা ধরে চলল বৃক্ষারোহণের ব্যর্থ প্রয়াস, তারপর রক্তপাতে অবসন্ন পশুরাজ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, আর উঠল না।

তখন মোরদি গাছ থেকে নেমে এসে মৃত সিংহের বুকে ছোরা বসিয়ে দেহটাকে চিরে ফেললে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল- ওই ভয়ঙ্কর মানুষ সেই তপ্ত রক্তধারা আকণ্ঠ পান করলে এবং বিদীর্ণ বক্ষপঞ্জর থেকে হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে এনে কচমচ করে চিবিয়ে খেতে লাগল।

সেই পৈশাচিক ভোজ শেষ হলে মোরদি উঠে দাঁড়াল চন্দ্রালোকিত তৃণভূমির উপর শুন্যে বশী আস্ফালন করে উন্মাদের তাণ্ডব-নৃত্যে মত্ত হয়ে উঠল, তীব্র তীক্ষ্ণ স্বরে সে বারংবার ঘোষণা করলে নিজের বীরত্ব কাহিনি। তারপর ঘটনাস্থল ত্যাগ করে গ্রামের দিকে চলে গেল।

সমস্ত ঘটনা শুনে আমি চুপ করে রইলুম।

গুপ্তচর বললে : বাওয়ানা, এই লোকটা নিজের মখে চেঁচিয়ে বলেছে সে আজ পর্যন্ত ছ-টা সিংহের হৃৎপিণ্ড খেয়েছে!

গুপ্তচর তার সংবাদ পরিবেশন করে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমি চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলাম এই ভয়ঙ্কর নাটকের শেষ দৃশ্যটা কি হতে পারে…

কয়েকদিন পরেই অভাবিতভাবে মোরদির সঙ্গে আবার আমার দেখা হল।

একদিন সকালে অকস্মাৎ আমার গৃহে হল মোড়লের আবির্ভাব। ভাঙা ভাঙা ফরাসিতে মোড়ল আমায় যা বললে তার সারমর্ম হচ্ছে, আগের দিন সন্ধ্যায় এক প্রতিবেশীর ছাগল হঠাৎ মোরদির বাগানের মধ্যে অনধিকার প্রবেশ করেছিল। ছাগল যদি অনধিকার প্রবেশ করেই খুশি থাকত তাহলে হয়ত কিছু ঘটত না, কিন্তু ছাগলটা নিতান্তই ছাগল- সে মোরদির বাগানের কয়েকটা গাছ মুড়িয়ে খেয়ে ফেললে।

মোরদি ছাগলটাকে বেঁধে রাখল তার উঠানে।

প্রতিবেশী ছাগল ফেরত চাইতে এল।

মোরদি তাকে ছাগল দিলে না দিলে প্রহার।

প্রতিবেশীটি স্থানীয় লোক নয়, সে একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী নাম রণজিৎ সিং। এই লোকটিও খুব নিরীহ প্রকৃতির মানুষ নয়, বিনা প্রতিবাদে মার খেতে সে রাজি হয়নি– ফলে প্রচণ্ড মারামারি।

মোড়ল এই ব্যাপারে হাত দিতে চাইলে না, সে আমার কাছে বিচার প্রার্থনা করলে।

আমি দুজনকেই ডেকে পাঠালুম।

রণজিৎ সিং খুব মার খেয়েছে, তার মুখে এখনও প্রহারের ক্ষতচিহ্ন বর্তমান। মোরদির মুখে কোনো দাগ নেই, শুধু ডান চোখটা একটু ফুলে উঠেছে।

মোরদি এসেই দম্ভের সঙ্গে জানিয়ে দিলে যে সে হচ্ছে সাক্ষাৎ সিম্বা। তার বিরুদ্ধে লাগলে সে কাউকে রেহাই দেবে না, পশুরাজ সিংহের রক্তপান করে সে সিংহের চেয়েও বলশালী।

রণজিৎ সিং হঠাৎ বলে উঠল, হা হা গাছের উপর থেকে অস্ত্র ছুঁড়ে যে সিংহ বধ করে সে তো মস্ত বীরপুরুষ! তারপর সেই সিংহের রক্তপান করার মতো কঠিন কাজ বীরের পক্ষেই সম্ভব! কিন্তু বাওয়ানা, বীরপুরুষকে আদেশ করুন আমার ছাগলটা যেন সে ফেরত দেয়।

মোরদির মুখ চোখ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। আমি ভাবলুম, এই বুঝি সে রণজিতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

মোরদি সে রকম কিছু করলে না।

ভ্রূকুটি-কুটিল দৃষ্টিতে সে প্রতিপক্ষকে একবার নিরীক্ষণ করল। তারপর শুষ্ক কঠিন স্বরে বললে, ছাগল আমি এখনই দিয়ে দিচ্ছি। তবে জেনে রাখো, মোরদি মাটিতে দাঁড়িয়েও সিংহের মোকাবেলা করতে পারে… আচ্ছা, এখন আমি কিছু বলতে চাই না, তবে…

ভীষণ আক্রোশে মোরদির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল।

রণজিতের দিকে একটা জ্বলন্ত কটাক্ষ নিক্ষেপ করে সে দ্রুত পদক্ষেপে অন্তর্ধান করলে।

মোরদির উদ্দেশ্য বুঝতে আমার একটুও অসুবিধা হয়নি। রণজিতের বিদ্রূপ একেবারে প্রতিপক্ষের মর্মস্থলে আঘাত করেছে। আমি বুঝলাম আজ রাতে মোরদি পশুরাজ সিংহের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হবে।

সিংহের সঙ্গে বোঝাপড়া শেষ করে ফিরে এসেই মোরদি রণজিৎকে ধরে বেধড়ক ধোলাই দেবে এ-কথা বুঝতেও আমার বিশেষ অসুবিধা হয়নি।

কিন্তু সে তো পরের কথা এখন এই উন্মাদ মোরদিকে নিয়ে কী করি? সত্যি-সত্যি যদি সে বর্শা হাতে মাটির উপরে দাঁড়িয়ে সিংহের সম্মুখীন হয় তাহলে তার পরিণাম কি হবে সে বিষয়ে আমার একটুও সন্দেহ ছিল না। বর্শার খোঁচা খেয়ে পশুরাজ মোরদিকে ছেড়ে দেবে না– ক্ষিপ্ত শ্বাপদের আক্রমণে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে তার সর্বাঙ্গ।

আমি একজন গুপ্তচরকে ডেকে গোপনে মোরদির উপর নজর রাখতে আদেশ দিলাম।

রাত তখনও গম্ভীর হয়নি, আমার গুপ্তচর এসে জানালে, মোরদি বর্শা হাতে সিংহের উদ্দেশ্যে বনের দিকে যাত্রা করেছে।

আঃ! জ্বালালে!

এই নির্বোধটাকে বাঁচাবার জন্য বিছানা ছেড়ে এখনই আমায় ছুটতে হবে বনবাদাড়ে।

মোরদির উপর যতই রাগ হোক, জেনে শুনে একটা লোকের অপমৃত্যু ঘটতে দেওয়া যায় না।

দূরবীন এবং রাইফেল নিয়ে কয়েকজন আস্কারির সঙ্গে আমি বেরিয়ে পড়লাম।

বিস্তীর্ণ তৃণভূমির বুকের উপর গলিত রজতধারার মতো জ্বলছে জ্যোৎস্নার আলো, আর সেই রুপালি আলোর চাদরের উপর ফুটে উঠেছে অনেকগুলি কালো কালো সচল বিন্দু।

সচল বিন্দুগুলি আর কিছু নয়– অনেকগুলি ধাবমান মানব দেহ। গাঁয়ের লোক আজ দল বেঁধে মোরদির সঙ্গে সিংহের লড়াই দেখতে এসেছে।

কিন্তু মোরদি কোথায়?

আমি একটা মস্ত ঢিপির উপর উঠে দূরবীনটা চোখে লাগালুম।

ওই যে মোরদি। একটা ঝোপের পাশ দিয়ে হাঁটছে আর হাতের বর্শা উঁচিয়ে ধরে চিৎকার করছে।

খুব সম্ভব তার জাতীয় ভাষায় পশুরাজকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছে।

আমি তখন প্রায় সিকি মাইল দূরে।

তার নাম ধরে চিৎকার করার উপক্রম করছি, এমন সময়ে ভীষণ গর্জনে বন কাঁপয়ে ঝোপের ভিতর থেকে তীরবেগে বেরিয়ে এল এক প্রকাণ্ড সিংহ।

পশুরাজ এক মুহূর্তের জন্যও থামল না, ধনুক-ছাড়া তিরের মত দ্রুতবেগে সে মোদির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

কিন্তু দন্ত ও নখরের আলিঙ্গনে মোরদি ধরা দিলে না, ক্ষিপ্রপদে একপাশে সরে গিয়ে সে পশুরাজের আক্রমণ ব্যর্থ করলে।

পরক্ষণেই বর্শা বাগিয়ে ধরে সে সিংহের দিকে রুখে দাঁড়াল। অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে ঝকঝক করে জ্বলে উঠল বর্শার ধারালো ফলা।

আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলুম। কী করব? গুলি ছুড়লে মোরদির গায়ে লাগতে পারে।

আমার চোখের সামনে মৃত্যুপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হল এক হিংস্র মানব ও এক হিংস্র শ্বাপদ।

মোরদি বর্শাটাকে সঙিনবসানো রাইফেলের মতো বাগিয়ে ধরলে বল্লমের ধারালো ফলাটা নিচু হয়ে ঘুরতে লাগল।

সিংহ বৃত্তাকারে শত্রুকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে, আর বর্শার ফলাটাও তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে যায়।

পশুরাজের থাবাটা বার বার এগিয়ে আসে বর্শা লক্ষ্য করে কিন্তু সেই তীক্ষ্ণ ইস্পাত-ফলক নখের আলিঙ্গনে ধরা দেয় না– সাঁৎ করে সরে যায় আবার সামনে থেকে এবং পরক্ষণেই দস্তভয়াল বিস্ফারিত মুখগহ্বরের সম্মুখে চমকে ওঠে জ্বলন্ত বিদ্যুৎ-শিখার মতো।

মোরদি ওস্তাদ খেলোয়াড়।

আমি দেখলাম মোরদির অধর-ওষ্ঠ কেঁপে উঠল, সে চিৎকার করছে।

চাপা গম্ভীর গর্জনে তার উত্তর এল।

সিংহ জানে ওই চকচকে ঝকঝকে জিনিসটা অতিশয় বিপদজনক। ওটাকে এড়িয়ে যদি সে মানুষটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তাহলে যুদ্ধে তার জয় অনিবার্য।

কিন্তু বর্শার ফলা যেন মোরদির হাতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। চাঁদের আলোয় ঝকঝক করে জ্বলছে শাণিত ইস্পাতফলক–সূচীমুখ অস্ত্র নেচে নেচে উঠছে সিংহের মুখের সামনে নাকের সামনে একটা শাণিত বিদ্রুপের মতো।

আমি বুঝলাম সিংহের ধৈর্য এবার ফুরিয়ে এসেছে। সে এবার আক্রমণ করবে।

ক্ষিপ্ত শ্বাপদ বর্শার শাসন আর মানতে চাইছে না। ঝকড়া কেশর দুলিয়ে সিংহ মাথাটা তুলল, গম্ভীর গর্জনে প্রতিধ্বনি জাগল বন থেকে বনান্তরে।

পরক্ষণেই সিংহ ঝাঁপ দিল শত্রুর দেহ লক্ষ্য করে। মোদি সরে গেল, বর্শার ধারালো ফলা কামড় বসালো সিংহের শরীরে।

যাতনায় আর্তনাদ করে উঠল পশুরাজ, থাবা তুলে শত্রুকে আঘাত করার চেষ্টা করলে।

মোরদির বর্শা এবার সিংহের বক্ষ ভেদ করলে।

সিংহ আবার গর্জে উঠল।

অন্য কোনো জানোয়ার হয়ত ওই আঘাতে মৃত্যুবরণ করত, কিন্তু বিখ্যাত সিংহ-বিক্রম এত সহজে ঠান্ডা হয় না শাণিত ভল্লের তীব্র দংশন উপেক্ষা করে পশুরাজ অন্ধের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল, দুই থাবার আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে শত্রুকে পেড়ে ফেলল মাটির উপর।

মোরদি উঠে দাঁড়াল।

দক্ষ মুষ্ঠিযোদ্ধার মত পাঁয়তাড়া করে সে পিছিয়ে এল। তীক্ষ্ণ বর্শাফলক এবার সঞ্চালিত হল তরবারির মতো হাতের বর্শা দিয়ে পাগলের মতো কোপ মেরে মেরে সে সিংহের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করলে।

আমি লক্ষ্য করলাম বর্শার ফলাটা আর চাঁদের আলোয় জ্বলে জ্বলে উঠছে না, জ্যোৎস্নার আলো-মাখা অন্ধকারে কালো দেখাচ্ছে ইস্পাতের শাণিত ফলক- রক্ত।

মোরদি একটু থামল, গুঁড়ি মেরে বসল; বর্শা বাগিয়ে ধরে সে সিংহের আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না।

সগর্জনে ধেয়ে এল আহত সিংহ তার বিপুল বপুর অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেল মোরদির ক্ষুদ্র নরদেহ।

রাইফেল তুলে আমি ছুটে গেলাম রণস্থলের দিকে। আমি যথাস্থানে উপস্থিত হওয়ার আগেই আবার মোরদি উঠে দাঁড়াল।

সিংহ তখন কাত হয়ে পা ছুড়ছে।

তীক্ষ্ণ বর্শা-ফলক তার ঘাড় ভেদ করে বসে গেছে আর সেই বর্শা-দণ্ডকে দুই হাতে চেপে প্রাণপণ শক্তিতে পশুরাজকে মাটিতে চেপে ধরেছে মোরদি।

আমি সিংহকে আর উঠতে দিলুম না। সামনে এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় রাইফেলের নল ঠেকিয়ে গুলি করলুম। সিংহ তৎক্ষণাৎ মারা পড়ল।

এবার আমি মোরদির দিকে নজর দিলুম।

কি ভীষণ দৃশ্য!

সিংহের ধারালো নখ তার সমস্ত শরীরটাকে ফালা ফালা করে ছিঁড়েছে, কালো দেহের উপর ফুটে উঠেছে লাল রক্তের বীভৎস আলপনা।

রক্তরাঙা দুই চোখ মেলে মোরদি আমার দিকে তাকাল- হত্যাকারীর উন্মত্ত চাহনি।

এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হল, এই বুঝি সে বর্শাটা আমার বুকে বসিয়ে দেয়।

ধীরে ধীরে তার চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে এল। বক্ষ বাহুবন্ধ করে সে গর্বিত ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়াল। উত্তেজিত গ্রামবাসীরা তখন আমাদের ঘিরে ফেলে চিৎকার করছে।

আমি রুক্ষস্বরে বললুম, যাও, এখনই হাসপাতালে চলে যাও। যদি সম্ভব হয় কাল আমার সঙ্গে দেখা কোরো।

না, সম্ভব হয়নি।

আমার সঙ্গে মোরদির আর কোনো দিন দেখা হয়নি।

মোরদি হাসপাতালে গিয়ে প্রাথমিক শুশ্রূষা গ্রহণ করেছিল বটে, কিন্তু সেই রাতেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে সে কোথায় সরে পড়েছে।

ভালোই করেছে; আমিও তার সঙ্গে দেখা করতে চাই না।

নিরাপত্তা অঞ্চলের মধ্যে সিংহ শিকার করে সে আইন ভঙ্গ করেছে, কাজেই আমার সঙ্গে দেখা হলে আইনত আমি তাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য।

কিন্তু আইনই তো সব নয়! এমন সিংহদমন বীরপুরুষকে জেল খাটাবার ইচ্ছে আমার নেই।

এবার আমি যার কথা বলব সে আফ্রিকার বাসিন্দা বটে, কিন্তু আফ্রিকা তার স্বদেশ নয়।

নাম তার চার্লস কটার- আফ্রিকায় এসেছিল সে জীবিকার প্রয়োজনে।

আমেরিকার ওকলাহামা প্রদেশ ছিল কটারের জন্মভূমি।

আফ্রিকাতে আসার আগে সে ছিল ওখানকার শেরিফ।

ওকলাহামা বড়ো বেয়াড়া জায়গা।

কোনো আদর্শ ভদ্রলোক ওকলাহামাকে পছন্দ করবে না।

সেখানকার পথে ঘাটে ও দোকানে বাজারে যে মানুষগুলি ঘুরে বেড়ায় তারা খুব নিরীহ স্বভাবের নয়।

কথায় কথায় সেখানে ঝগড়া বাধে।

ঝগড়া বাধলে মীমাংসার প্রয়োজন।

ওকলাহামার মানুষ বেশি কথাবার্তা পছন্দ করে না, চটপট ঘুসি চার্লিয়ে তারা ঝগড়া বিবাদের মীমাংসা করে নেয়।

অনেকে আবার মুষ্টিবদ্ধ হস্তের পক্ষপাতী নয়- রিভলভারের ঘন-ঘন অগ্নিবৃষ্টির মুখে তারা বিবাদের নিস্পত্তি করতে চায়।

এমন চমৎকার জায়গায় শেরিফ হয়ে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে যেমন মানুষের দরকার ঠিক তেমন মানুষ ছিল চার্লস কটার।

যে-সব মানুষ বৃহৎ দেহের অধিকারী হয় সাধারণত তাদের চালচলন হয় মন্থর এবং শ্লথ, কিন্তু ছ-ফুট চার ইঞ্চি লম্বা এই নরদৈত্য ছিল নিয়মের ব্যতিক্রম।

প্রয়োজন হলে মুহূর্তের মধ্যে কোমর থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে সে অব্যর্থ সন্ধানে লক্ষ্য ভেদ করতে পারত।

শেরিফের কাজ করে কটারের মনের গতি হয়েছিল খুব সহজ আর স্পষ্ট।

কোন মানুষকে সে হয় পছন্দ করবে আর নয় তো পছন্দ করবে না। এই পছন্দ অপছন্দের মাঝামাঝি কিছু নেই।

কাউকে অপছন্দ হলে সে তার উপরে প্রয়োগ করত মুষ্টিবদ্ধ হস্তের মুষ্টিযোগ চার্লস কটারের জীবন-দর্শনে একটুও জটিলতা ছিল না।

কটারের পেশীবহুল হাত দুখানা ছিল বেজায় লম্বা।

সেই অস্বাভাবিক দীর্ঘ দুই হাতে ছিল অমানুষিক শক্তি।

তার উপর তার দক্ষিণ হস্তে সর্বদাই থাকত একটা বেঁটে মোটা বাঁশের লাঠি এবং কোমরে ঝুলত গুলিভরা রিভলভার।

ওকলাহামার দুর্দান্ত গুণ্ডারা বুঝল, চার্লস কটার যতদিন শেরিফ আছে অন্তত সে কয়টা দিন তাদের আইন মেনে চলতে হবে।

কটার যখন স্বদেশের মায়া কাটিয়ে আফ্রিকাতে পাড়ি জমাল তখন নিশ্চয়ই ওকলাহামার গুণ্ডারা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল।

অবশ্য এটা আমার অনুমান কটারের জীবন-ইতিহাসের কোনো পাতায় ওকলাহামার অধিবাসীদের মনস্তত্ত্ব আলোচনা করা হয়নি।

আফ্রিকাতে এসে চার্লস কটার শিকারির পেশা অবলম্বন করলে। যে-সব লোকের শিকারের শখ আছে তারা দক্ষ পেশাদার শিকারির সাহায্য নিয়ে আফ্রিকার অরণ্যে প্রবেশ করে। নিয়োগকারীর সব রকম সুবিধা-অসুবিধা এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয় শিকারি এবং এই কাজের জন্য সে প্রচুর অর্থ পারিশ্রমিক পায়।

এই কাজে অর্থ-উপার্জনের যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও কাজটা অতিশয় বিপদজনক। তবে চার্লস কটারের মতো মানুষের পক্ষে এই ধরনের পেশা পছন্দ হওয়াই স্বাভাবিক।

কটার ছিল বিবাহিত মানুষ। তার পরিবারটিও নেহাত ছোটো ছিল না। ছয়টি কন্যা এবং দুটি পুত্রসন্তান নিয়ে কটার প্রবল পরাক্রমে শিকারির ব্যবসা চার্লিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় এইসব ব্যবসা-সংক্রান্ত কথাবার্তা চলত টেলিগ্রাফের সাহায্যে। অফিসের কেরানিদের মধ্যে একধরনের লোক দেখা যায় যারা আইনের প্যাঁচ লাগিয়ে সাধারণ মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে তোল। এই ধরনের কোনো-কোনো কেরানি যখন চিঠি লিখে চার্লস কটারকে আইন এবং শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে উপদেশ দেবার চেষ্টা করত তখনই তার মেজাজ যেত বিগড়ে বন্দুকের বদলে কলম নিয়ে সে করত যুদ্ধ ঘোষণা।

আগেই বলেছি, চার্লসের জীবন-দর্শন ছিল খুব সহজ ও স্পষ্ট। গভর্মেন্টের বেতনভোগী কর্মচারীর সঙ্গে মারামারি করা যায় না তাই মূল্যবান উপদেশপূর্ণ চিঠিকে বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করে চার্লস কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসত।

তার চিঠির ভাষাও ছিল খুব সহজ—

মহাশয়,
আপনার চিঠিটা এইমাত্র আমার সামনে ছিল। এখন সেটা আমার পিছনে বাজে কাগজের ঝুড়ির মধ্যে অবস্থান করছে।
–চার্লস কটার।

এমন চমৎকার চিঠি পেলে কেউ খুশি হয় না।

পোস্ট অফিসের কেরানিরা এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কটারের উপর খঙ্গহস্ত ছিলেন। বেয়াড়া চিঠিপত্র লেখার জন্য প্রায়ই কটারের উপর আদালতের সমন জারি হত। আদালতে দাঁড়াতে হলেই তার মেজাজ হত খাপ্পা তখনকার মত বিচারকের নির্দেশ পালন করে সে ঘরে ফিরে আসত বটে, কিন্তু মহামান্য আদালত তার চরিত্র একটুও সংশোধন করতে পারেননি। বেয়াড়া চিঠিপত্র লেখার জন্য কটারকে বহুবার আদালতে দাঁড়াতে হয়েছে।

এই উদ্ধত মানুষটি তার জীবনে একাধিকবার লেপার্ডের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইতে নেমেছিল। হিংস্র শ্বাপদের শাণিত নখর তার দেহের বিভিন্ন স্থানে সুগভীর ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল বটে, কিন্তু সেই জীবন-মরণ যুদ্ধে প্রত্যেকবারই বিজয়লক্ষ্মীর বরমাল্য দুলেছে চার্লসের কণ্ঠে।

এই প্রসঙ্গে লেপার্ড নামক জন্তুটির একটু পরিচয় দেওয়া দরকার।

ভারতবর্ষেও লেপার্ড আছে, বাংলায় তাকে চিতাবাঘ বলে ডাকা হয়। কিন্তু আফ্রিকার জঙ্গলে চিতা নামে বিড়াল-জাতীয় যে জানোয়ার বাস করে তার দেহচর্মের সঙ্গে লেপার্ডের কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও দেহের গঠনে ও স্বভাব-চরিত্রে চিতার সঙ্গে লেপার্ডের কোনোই মিল নেই– চিতা এবং লেপার্ড সম্পূর্ণ ভিন্ন জানোয়ার। চিতা লাজুক ও ভীরু প্রকৃতির পশু। লেপার্ড হিংস্র, দুর্দান্ত।

জে. হান্টার, জন মাইকেল প্রভৃতি শিকারি লেপার্ডকে আফ্রিকার সবচেয়ে বিপদজনক জানোয়ার বলেছেন। সিংহের মতো বিপুল দেহ ও প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী না হলেও ধূর্ত লেপার্ডের বিদ্যুৎ-চকিত আক্রমণকে অধিকাংশ শিকারিই সমীহ করে থাকেন।

লেপার্ডের আক্রমণের কায়দা বড়ো বিশ্রী।

লতাপাতা ও ঘাসঝোপের আড়াল থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসে সে যখন বিদ্যুৎবেগে শিকারির ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে তখন আক্রান্ত ব্যক্তি অধিকাংশ সময়েই হাতের অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পায় না। প্রথম আক্রমণেই লেপার্ড তার সামনের দুই থাবার তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে শিকারির চোখ দুটোকে অন্ধ করে দেবার চেষ্টা করে, সঙ্গেসঙ্গে একজোড়া দাঁতালো চোয়ালের মারাত্মক দংশন চেপে বসে শিকারির কাঁধে, আর পিছনের দুই থাবার ধারালো নখগুলি ক্ষিপ্র সঞ্চালনে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায় হতভাগ্যের উদরদেশ।

এই হিংস্র অথচ সুন্দর জানোয়ারকে কটার অত্যন্ত ঘৃণা করত। সে প্রায়ই বলত, আঃ! ব্যাটাদের নখে কি ভীষণ ধার- আঁচড় দিলে মনে হয় যেন খুর চালাচ্ছে! শয়তানের বাচ্চা!

হ্যাঁ, একথা অবশ্য সে বলতে পারে।

তার হাত পায়ের যে অংশগুলি পরিচ্ছদের বাইরে দৃষ্টিগোচর হয় সেদিকে একনজর তাকালেই চোখে পড়ে অজস্র ক্ষতচিহ্ন অভিজ্ঞ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে যে ক্রুদ্ধ লেপার্ডের নখের আঁচড়েই ওই গভীর ক্ষতচিহ্নগুলির সৃষ্টি হয়েছে।

একদিনের ঘটনা বলছি।

বনের মধ্যে একটা গাছের ডালে ঝুলছে মরা কুকুরের টোপ, আর খুব কাছেই ঝোপের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে রাইফেল হাতে অপেক্ষা করছে কটার।

কুকুরের মাংস লেপার্ডের প্রিয় খাদ্য, কটার জানে মরা কুকুরের গন্ধে গন্ধে লেপার্ড আসবেই আসবে।

তা এল। একটু পরেই একটা লেপার্ড এসে উপস্থিত হল ঘটনাস্থলে।

জন্তুটার দিকে তাকিয়ে কটার হতাশ হল– লেপার্ডটা আকারে বেশি বড়ো নয়, তার গায়ের চামড়াটাও চার্লসের কাছে লোভনীয় মনে হল না।

গ্রামের আশেপাশে যে-সব লেপার্ড ঘোরাঘুরি করে তাদের দেহের আকার খুব বড়ো হয়না, গায়ের চামড়া হয় অনুজ্জ্বল, ফ্যাকাশে। কিন্তু ঘন জঙ্গলের মধ্যে যে লেপার্ডগুলি বাস করে সেগুলো সত্যিই বৃহৎ বপুর অধিকারী, তাদের চামড়াগুলি অতিশয় উজ্জ্বল ও সুন্দর। কটার আশা করেছিল একটি বেশ বড়োসড়ো অরণ্যচারী লেপার্ড তার ফাঁদে পা দেবে- এই জন্তুটাকে দেখে তার মেজাজ হয়ে গেল খাপ্পা।

লেপার্ড বড়ো ধূর্ত জানোয়ার।

সে কুকুরের মৃতদেহটাকে ভালো করে লক্ষ করলে, কিন্তু চট করে ভোজের জিনিসে মুখ দিলে না। কিছুক্ষণ পরে তার মনে হল এই ভোজটা বেশ নিরাপদ, এখানে কামড় বসালে বোধহয় বিপদের আশঙ্কা নেই- লেপার্ড নিচু হয়ে বসে পড়ল, এইবার একলাফে গাছে উঠে মরা কুকুরটাকে নামিয়ে আনবে।

চার্লসের মেজাজ আগেই খারাপ হয়েছিল। তবু সে আশা করেছিল জন্তুটা হয়ত চলে যেতে পারে। কিন্তু লেপার্ড যখন লাফ দিতে উদ্যত হল তখন আর তার ধৈর্য বজায় রইল না। ইচ্ছা করলে কটার অনায়াসেই গুলি করে লেপার্ডটাকে হত্যা করতে পারত, কিন্তু হাতের রাইফেল ফেলে দিয়ে সে হঠাৎ দৌড়ে এসে জন্তুটার পিছনে ঠ্যাং দুটো চেপে ধরলে।

পরক্ষণেই দুই সবল বাহুর আকর্ষণে লেপার্ডের শরীরটা শূন্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে সশব্দে ভূমিশয্যায় আছড়ে পড়ল।

লেপার্ডের ঊর্ধ্বতন চোদ্দ পুরুষে কেউ কখনও এমন ব্যবহার সহ্য করেনি। আকারে ছোটো হলেও লেপার্ড হচ্ছে লেপার্ড, তুচ্ছ মানুষের হাতে আছাড় খেয়ে মুখের গ্রাস ফেলে পালিয়ে যেতে সে রাজি হল না–

ভীষণ আক্রোশে গর্জন করে সে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কটারের অস্বাভাবিক লম্বা হাত দুটো এড়িয়ে লেপার্ড শত্রুর দেহে দাঁত বসাতে পারলে না- লোহার মতো শক্ত দু-খানা হাত লেপার্ডের টুটি টিপে ধরলে।

সামনের থাবার ধারালো নখগুলি কটারের হাত দুখানা রক্তাক্ত করে দিলে, তবু লৌহ কঠিন অঙ্গুলির বন্ধন একটুও শিথিল হল না।

ঝটাপটি করতে করতে মানুষ এবং পশু মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। লেপার্ডের পিছনের থাবাদুটিও নিশ্চেষ্ট রইল না, তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কটারের নিম্ন অঙ্গ।

কিন্তু তার অঙ্গুলিগুলি লেপার্ডের গলা থেকে সরে এল না।

অবশেষে কঠিন নিষ্পেষণে রুদ্ধ হয়ে এল জন্তুটার কণ্ঠনালী। উন্মুক্ত মুখ-গহ্বরের ভিতর থেকে উঁকি দিল দীর্ঘ দাঁতের সারি, আর সেই অবস্থায় নিঃশ্বাস নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে লেপার্ড প্রাণত্যাগ করলে।

চার্লস কটারের সর্বাঙ্গ থেকে তখন ঝরঝর ঝরছে গরম রক্তের স্রোত, টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে সেই উষ্ণ তরল ধারা মৃত লেপার্ডের দেহের উপর।

চার্লস কটার এবার কী করবে?

ক্ষতগুলিতে ওষুধ দেবার জন্য এবার ফিরে যাবে বাড়িতে?

পাগল! কটার সে জাতের মানুষই নয়।

রক্তাক্ত ক্ষতগুলিতে মোটামুটি খানিকটা ব্যান্ডেজ লাগিয়ে সে পরবর্তী শিকারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

একটু পরেই সেখানে এসে উপস্থিত হল আর একটি লেপার্ড। এবারের লেপার্ড আকারে খুব বড়ো, তার গায়ের চামড়াটিও খুব সুন্দর। কটার বুঝল এই জানোয়ারটা গভীর অরণ্যের বাসিন্দা নিশানা স্থির করে সে রাইফেলের ঘোড়া টিপল।

অব্যর্থ সন্ধান- একটিমাত্র গুলিতেই লেপার্ডের প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

.

এই ঘটনার পরে কয়েকটা দিন কেটে গেছে।

জঙ্গলের পথ ধরে এগিয়ে চলেছে চার্লস কটার।

আচম্বিতে গাছের উপরে ঘন লতাপাতার আড়াল থেকে তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল দু-দুটো ছোটো জাতের লেপার্ড।

যে জানোয়ারটা কটারের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে নিহত হয়েছিল এই লেপার্ড দুটো তারই পরিবারভুক্ত কি না জানি না, কিন্তু ঘটনাটা শুনলে এটাকে প্রতিশোধের ব্যাপার বলেই মনে হয়।

এমন অভাবিত ও অতর্কিত আক্রমণের জন্য কটার প্রস্তুত ছিল না। সমস্ত ব্যাপারটা সে যখন বুঝতে পারল তখন লেপার্ডের দাঁত ও নখের আঘাতে তার শরীর রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে।

কিন্তু চার্লস কটার হচ্ছে চার্লস কটার।

মুহূর্তের মধ্যে সে কর্তব্য স্থির করে ফেললে।

হাতের রাইফেল আর কাজে লাগবে না বুঝে সে অস্ত্রটাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে আক্রমণের মোকাবেলা করতে রুখে দাঁড়াল।

কটারের দ্রুত প্রতি-আক্রমণের জন্য লেপার্ড দুটো প্রস্তুত ছিল না, তারা ছিটকে গিয়ে শত্রুর পায়ের কাছে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল। সেই সুযোগে কটার চট করে একটা জানোয়ারের গলা চেপে ধরলে। এত জোরে কটার লেপার্ডটার গলা টিপে ধরেছিল যে জন্তুটার চোখে রক্ত জমে গেল।

কটারের শরীরও অক্ষত থাকল না। ধারালো নখের আঘাতে বিদীর্ণ ক্ষতমুখ থেকে ছুটল রক্তের ফোয়ারা- সুদীর্ঘ শ্বাপদ-দন্তের হিংস্র শুভ্রতাকে লাল করে দিয়ে সেই তপ্ত রক্তধারা গড়িয়ে পড়ল আক্রান্ত জন্তুটার হাঁকরা মুখের মধ্যে।

অন্য লেপার্ডটা কটারের খপ্পরে ধরা পড়েনি।

সে এবার পিছন থেকে শত্রুর পৃষ্ঠদেশ লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিলে। কটার তখন প্রথম জানোয়ারটার সঙ্গে মারামারি করতে করতে হঠাৎ ঝুঁকে পড়েছে দুনম্বর লেপার্ডের লাফটা ফসকে গেল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার জন্য সে কটারের পিঠের উপর না পড়ে ছিটকে এসে পড়ল সঙ্গীর পিছনের দুটো পায়ের উপর।

সঙ্গী তখন কটারের কবলের মধ্যে ছটফট করছে আর লাথি ছুড়ছে। সেই সনখ থাবার একটি লাথি এসে লাগল দুনম্বর লেপার্ডের পেটে– সঙ্গে সঙ্গে ধারালো নখের আঁচড়ে বিদীর্ণ হয়ে গেল তার উদরের মাংসপেশী।

কটার সেই মুহূর্তের সুযোগ নিতে ছাড়াল না।

টপ করে হাত বাড়িয়ে সে দ্বিতীয় লেপার্ডটার কণ্ঠনালী চেপে ধরলে।

এইবার সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়ে সে জন্তুটাকে মাটিতে চেপে ধরে গলা টিপে মারবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু লেপার্ডের দেহের মাংসপেশীগুলি শক্তিশালী স্প্রিং-এর মতে- চার্লস কটারের মতো মানুষের পক্ষেও তাদের মাটিতে চেপে রাখা অসম্ভব। জন্তুদুটো জোর করে ঠেলে উঠল, অতএব কটারও সোজা হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হল। কিন্তু প্রতিপক্ষের কণ্ঠনালীর উপরে তার আঙুলের চাপ একটুও শিথিল হল না।

…ধারালো নখের আঘাতে কটারের কাঁধ এবং হাত দিয়ে তখন ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। এত রক্তপাতেও কটার অবসন্ন হল না বরং রক্ত দেখে তার মাথায় খুন চেপে গেল।

ক্রুদ্ধ চার্লস কটার এবার যা করলে তা প্রায় অবিশ্বাস্য।

একটা জন্তুর মাথার সঙ্গে সে আর একটা জন্তুর মাথা সজোরে ঠুকতে লাগল।

লেপার্ড দুটো কিন্তু এমন মার খেয়েও কাবু হলনা।

তারা ক্রমাগত ছটফট করতে করতে কটারের বজ্রমুষ্টি থেকে নিজেদের মুক্ত করার চেষ্টা করছে, আর তাদের থাবার ধারালো নখগুলি সমানে শত্রুর দেহে আঁচড় কেটে যাচ্ছে।

রক্তে লাল হয়ে উঠেছে কটারের সর্বাঙ্গ, লেপার্ড দুটোর শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে লৌহকঠিন আঙুলের নিষ্ঠুর পেষণে।

তবু কোনো পক্ষই পরাজয় স্বীকার করছে না।

কটারের সঙ্গে যে নিগ্রো সঙ্গীরা ছিল তারা প্রথমে পালিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পরে আবার ফিরে এসেছে। বিস্ফারিত চক্ষুর ভীত বিস্মিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে এই আশ্চর্য দৃশ্যের দিকে কিন্তু এখন আর কটারকে সাহায্য করার উপায় নেই, মানুষ ও পশু এমনভাবে পরস্পরকে

জড়িয়ে ধরে মারামারি করছে যে গুলি চালালে কটারও আহত হতে পারে।

অতএব তখন পরিস্থিতি হচ্ছে এই যে, যে পক্ষের সহ্যশক্তি বেশি সে পক্ষই জয়লাভ করবে।

চার্লস কটারের রক্তস্নাত দীর্ঘ দেহ যেন অফুরন্ত শক্তির আধার। সে হঠাৎ বুঝতে পারলে তার দুই শত্রুর দেহ অবশ হয়ে আসছে; তাদের থাবার আঁচড়ে, শরীরের আস্ফালনে আর আগের মতো জোর নেই।

মহা উল্লাসে কটার চিৎকার করে উঠল।

যে লেপার্ডটার উদর সঙ্গীর নখের আঘাতে বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল তার ক্ষতস্থান থেকে তখন অবিরল ধারায় রক্ত ঝরে পড়ছে। কটারের অবস্থা তো আগেই বলেছি।

মানুষ ও পশুর রক্তে পিছল হয়ে উঠল রণভূমির ঘাস-জমি।

কটার যখন বুঝল তার শত্রুরা দুর্বল হয়ে পড়েছে, সে তখন লড়াইয়ের কায়দা বদলে ফেলল। হাতদুটো সোজা করে সে জন্তু দুটোকে এমনভাবে তুলে ধরলে যে তাদের থাবাগুলো আর তার দেহ স্পর্শ করতে পারলে না।

এইবার সে একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে জন্তু দুটোর মাথা ঠুকতে লাগল।

… মাথার উপর পড়ছে প্রচণ্ড আঘাত, কণ্ঠনালীর উপর শ্বাস রোধ করে চেপে বসেছে লৌহকঠিন অঙ্গুলির নিষ্ঠুর বন্ধন

নিস্তেজ হয়ে এল দুই শাপদের হিংস্র আস্ফালন…

মুমূর্য জন্তু দুটোকে মাটির উপর আছড়ে ফেলে চার্লস কটার সোজা হয়ে দাঁড়াল।

সে এক আশ্চর্য দৃশ্য!

মাটির উপর মৃত্যুযাতনায় ছটফট করছে দু-দুটো লেপার্ড, আর তাদের পাশেই ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এক মহাকায় মানুষ।

গল্পের টারজান কি কটারের চেয়েও শক্তিশালী?

কটার এখন কী করবে? বাড়ি ফিরে যাবে? ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে শয্যাগ্রহণ করবে? মোটেই নয়। চার্লস কটার হচ্ছে চার্লস কটার।

ক্ষতস্থানগুলিতে নিগ্রোদের সাহায্যে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে সে আবার সঙ্গীদের নিয়ে পথ চলতে শুরু করলে।

কথায় আছে, ডানপিটের মরণ গাছের আগায়।

চার্লস কটার অবশ্য গাছের আগায় মরেনি, তবে তার মৃত্যু হয়েছিল অত্যন্ত ভয়ানকভাবে। জন্মগ্রহণ করেছিল সে সুসভ্য আমেরিকার ওকলাহাম প্রদেশে, আর তার মৃত্যু হল ঘন বন আবৃত আফ্রিকার অন্তঃপুরে।

একেই বলে নিয়তি।

হ্যাঁ, নিয়তি ছাড়া আর কি বলব।

চার্লসের মৃত্যুকে একটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু বলা চলে না, আর এই দুর্ঘটনার কারণ হল একটি যন্ত্রের যান্ত্রিক ত্রুটি।

না, না, রাইফেল নয়, পিস্তল নয়, একটা ক্যামেরার দোষেই এই দুর্ঘটনা ঘটল– অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, চার্লস কটারের মৃত্যুর জন্য দায়ী একটি ক্যামেরা।

মনে হচ্ছে অবিশ্বাস্য- তাই না?

কিন্তু বাস্তব সত্য অনেক সময়ে কল্পনাকেও অতিক্রম করে যায়। আচ্ছা, ঘটনাটা খুলেই বলছি।

চার্লস কটার একদিন রাইফেলের সঙ্গে ক্যামেরা ঝুলিয়ে বনের পথে যাত্রা করলে।

এই ক্যামেরার view-finder-টা খারাপ ছিল। (ক্যামেরার মধ্যে বসানো স্বচ্ছ কাঁচের মতো যে জিনিসটার ভিতর দিয়ে ক্যামেরাধারী ফোটো তোলার বিষয়বস্তুকে দেখতে পায় সেই অংশটিকে বলে view-finder)

ক্যামেরার সামান্য দোষ-ত্রুটি নিয়ে কটার মাথা ঘামায়নি, আর এইটুকু অন্যমনস্কতার জন্যই তাকে প্রাণ হারাতে হল।

জঙ্গলের পথে অকস্মাৎ কটারের চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করলে একটা মস্ত গণ্ডার।

কটার রাইফেল রেখে নিবিষ্ট চিত্তে গণ্ডারের ফোটো তুলতে লাগল। হতভাগা গণ্ডার।

সে ফটো তুলে দেওয়ার জন্য একটুও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে না, খঙ্গ উঁচিয়ে ধেয়ে এল কটারের দিকে।

আগেই বলেছি ক্যামেরার view-finder খারাপ ছিল। ক্যামেরার যান্ত্রিক চক্ষুর মধ্যে দিয়ে কটার দেখছে জন্তুটা অনেক দূরে আছে, কিন্তু আসলে তখন গণ্ডার খুব কাছে এসে পড়েছে।

কটার যখন তার বিপদ বুঝতে পারলে তখন আর সময় নেই- গণ্ডারের খঙ্গ প্রায় তার দেহ স্পর্শ করেছে।

সশব্দে অগ্নি-উদগার করলে কটারের রাইফেল সঙ্গেসঙ্গে গণ্ডারের সুদীর্ঘ খঙ্গ সেই অতিকায় নরদানবের দেহটাকে বিদীর্ণ করে দিলে।

কটারের মুখ থেকে একটা অস্ফুট আর্তনাদও শোনা গেল না, সে তৎক্ষণাৎ মারা গেল।

চালর্স কটার জীবনে কখনও পরাজয় স্বীকার করেনি, মৃত্যুকালেও জয়লক্ষ্মী তার কণ্ঠে পরিয়ে দিল জয়মাল্য।

মরার আগে কটার একবারই গুলি চালাবার সুযোগ পেয়েছিল, এবং সেই একটিমাত্র গুলির আঘাতেই কটারের আততায়ী মৃত্যুবরণ করলে।

চার্লস কটারের মৃতদেহের পাশেই লুটিয়ে পড়ল গুলিবিদ্ধ গণ্ডারের প্রাণহীন দেহ।

জনতার প্রতিনিধি

একদল হিংস্র নেকড়ের গুহার ভিতর যদি একটা বিড়াল বাচ্চা পথ ভুলে ঢুকে পড়ে তাহলে তার চালচলনটা কেমন হবে?

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা না-থাকলেও অনুমান করা যায় যে মার্জার শাবক যে মুহূর্তে নেকড়েগুলোর অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারবে সেই মুহূর্তে তার দেহের লোম খাড়া হয়ে উঠবে কাটার মতো এবং দুই চোখের ভীত বিস্ফারিত দৃষ্টি সঞ্চালন করে সে যে চটপট চম্পট দেওয়ার সোজা রাস্তাটা খোঁজার চেষ্টা করবে, এ-বিষয়ে ভুল নেই।

স্নেক ডলস সেলুন নামক পানশালার মেঝের ওপর দিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে এসে যে কিশোরটি দোকানির কাছে এক গেলাস ঠান্ডা পানীয় চাইল, তার নির্বিকার মুখ এবং স্বচ্ছন্দ গতিভঙ্গি দেখে মনে হয় না যে এই মুহূর্তে স্থানত্যাগ করার ইচ্ছা তার আছে–

যদিও তার সর্বাঙ্গে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে পানাগারের মধ্যস্থলে দৃষ্টিপাত করলেই নেকড়েবেষ্টিত মার্জার শাবকের কথা মনে পড়বে…

হ্যাঁ, নেকড়ে বই কী

কিংবা নেকড়ের চাইতেও ভয়ংকর মানুষগুলো আড্ডা জমিয়েছে পানাগারের মধ্যে।

পানশালার টেবিলের চারধারে টেবিলে টেবিলে গোল হয়ে বসে যে লোকগুলো তাস খেলছে অথবা পানভোজন করছে তাদের চোখে-মুখে মনুষ্যত্বের চিহ্ন নেই কিছুমাত্র–কঠিন চোয়ালের রেখায় রেখায় জ্বলন্ত চোখের তির্যক চাহনিতে যে বন্য হিংসার ছায়া উঁকি দিচ্ছে সেদিকে তাকালে ক্ষুধার্ত নেকড়ের কথা মনে হওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয়।

এতগুলো সাংঘাতিক মানুষের মাঝখানে একটি নিরীহ চেহারার কিশোরকে দেখলে নেকড়েবেষ্টিত মাজার শাবকের কথাই মনে আসে।

স্নেক ডলস সেলুনের মানুষগুলো সেদিন তাই ভেবেছিল, বিড়ালছানার মতো তুচ্ছ করেছিল তারা ওই ছেলেটিকে। একটু পরেই তাদের ভুল ভাঙল ভয়ংকরভাবে–তপ্ত রক্তধারায় হল তাদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত।

তাই হয়।

রজ্জুতে সর্পভ্রম হলে ক্ষতি নেই, কিন্তু সর্পতে রজ্জ্বভ্রম করলে তার ফল হয় মারাত্মক।

সেই মারাত্মক ভুলের সূচনা জানিয়ে ঘরের কোণ থেকে ভেসে এল এক বিদ্রূপ জড়িত কণ্ঠস্বর, এই ছোঁড়াটা নিশ্চয়ই এখনও মায়ের কোলে শুয়ে দুধ খায়। হা! হা! হা! এই দুধের বাচ্চা হল আমেরিকা যুক্তরাজ্যের ডেপুটি মার্শাল! হো! হো! হো!

খোঁচাখাওয়া সাপ যেমন দ্রুতবেগে আততায়ীর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি বিদ্যুৎচকিত সঞ্চালনে ঘুরে দাঁড়াল কিশোর ছেলেটি চেয়ারে উপবিষ্ট লোকগুলির দিকে। সকলে দেখল তার বাঁ-হাতটা সামনের টেবিলের ওপর চেপে বসেছে আর ডান হাতের সরু সরু আঙুলগুলো বাজপাখির ছোঁ মারার ভঙ্গিতে নেমে এসেছে কোমরের খাপে ঢাকা রিভলভারের খুব কাছাকাছি।

হ্যাঁ, আমি যুক্তরাজ্যের ডেপুটি মার্শাল, কিশোরকণ্ঠে শোনা গেল দর্পিত ঘোষণা, আমার নাম ড্যান ম্যাপল। কারো কিছু জিজ্ঞাস্য আছে? কোনো প্রশ্ন?

না, কারো কিছু জানার নেই।

কেউ কোনো প্রশ্ন করলে না।

যে লোকটি বিদ্রূপ করেছিল সে হাতের গেলাসটিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল খুব মন দিয়ে… আশেপাশে অন্য লোকগুলিও হঠাৎ মৌনব্রত অবলম্বন করলে। একটু আগেও যেখানে হইহই হট্টগোলে কান পাতা যাচ্ছিল না, এখন সেখানে ছুঁচ পড়লে শব্দ শোনা যায়…

কয়েকটা নীরব মুহূর্ত

পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে চেয়ারের উপর যে লোকগুলো বসেছিল তারা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল, অভ্যস্ত হাতগুলো ধীরে ধীরে নেমে এল কোমরের খাপে ঢাকা রিভলভারের দিকে।

ড্যান ম্যাপল ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল।

সে হেসে উঠল, আমার সঙ্গে রিভলভারের খেলা খেলতে পারে এমন কোনো খেলোয়াড় এখানে নেই। আমি তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি তোমরা যদি আরও কিছুদিন দুনিয়ার আলো দেখতে চাও, তবে তোমাদের হাতগুলো রিভলভারের বাঁট থেকে একটু দূরে দূরে রাখো।

ড্যান ম্যাপলের কণ্ঠস্বরে উত্তেজনার স্পর্শ ছিল না, খুব সহজ আর স্বাভাবিক ছিল তার গলার আওয়াজ। কিন্তু তার চোখ দুটি থেকে হারিয়ে গেল কৈশোরের প্রাণচঞ্চল আলোর দীপ্তি–সর্পিল আক্রোশে চোখের তারায় নেমে এল বিষাক্ত হিংসার ছায়া।

স্নেক ডলস সেলুনের খুনি মানুষগুলো ওই চোখের ভাষা বুঝল খুব সহজেই, তাদের হাতগুলো রিভলভারের বিপজ্জনক সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে গেল।

কোলাহলমুখর পানশালার মধ্যে নেমে এল মৃত্যুপুরীর নীরবতা।

ড্যান ম্যাপলের আবির্ভাব অতিশয় নাটকীয় বটে কিন্তু অপ্রত্যাশিত নয়। আমেরিকা যুক্তরাজ্যের তাহলাকুই নামে যে ছোটো শহরটা পার্বত্য অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানকার প্রতিটি বাসিন্দাই খবরটা পেয়েছিল–

খুব শীঘ্রই নাকি ওই অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য একজন ডেপুটি মার্শাল আসবে।

শহরের বাসিন্দারা খবরটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। না-দেওয়াই স্বাভাবিক। আজকের আমেরিকার কথা নয়–১৮৯২ সালে ওইসব অঞ্চলে আইন-টাইন কেউ বড়ো একটা মানত না। বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত ছোটো ছোটো জায়গায় থানা পুলিশের বিরাট ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল গভর্নমেন্টের পক্ষে, তাই শহরের শৃঙ্খলা রক্ষার ভার থাকত টাউন মার্শালদের ওপর। দুর্ধর্ষ গুন্ডারা যে মার্শালদের খুব ভয় করত তা নয়, তবে পারতপক্ষে মার্শালদের সঙ্গে তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হতে চাইত না।

তাহলাকুই শহর কিন্তু নিয়মের ব্যতিক্রম। পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেই পাঁচজন মার্শালকে ওই শহরের গুন্ডারা গুলি করে মেরে ফেলল। শহরের কয়েকজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক গভর্নমেন্টের কাছে আবেদন জানালেন, একজন ডেপুটি মার্শালকে যেন অবিলম্বে তাহলাকুই শহরে পাঠানো হয়। ভদ্রলোক এখানে বাস করতে পারছেন না।

আবেদন গৃহীত হল। তাহলাকুই শহরে আবির্ভূত হল ডেপুটি মার্শাল ড্যান ম্যাপল।

শহরের পানাগার স্নেক ডলস সেলুন-এর ভয়াবহ খ্যাতি ম্যাপলের কানেও পৌঁছেছিল। সে জানত রাত্রিবেলা ওই পানাগারের মধ্যে ঢুকলে সে স্থানীয় গুন্ডাশ্রেণির মানুষগুলোকে দেখতে পাবে, অতএব অকুস্থলে হল ড্যান ম্যাপলের আবির্ভাব।

পরবর্তী ঘটনার কথা তো কাহিনির শুরুতেই বলছি। শুধু দেখতে নয়, কিছু দেখাতেও এসেছিল ম্যাপল। সমবেত গুন্ডাদের উদ্দেশ করে সে যখন সাবধানবাণী উচ্চারণ করলে তখন কেউ সামনে এসে তাকে চ্যালেঞ্জ জানাল না।

না, চ্যালেঞ্জ নয় কিশোর ড্যান ম্যাপলের চোখের দিকে তাকিয়ে তার সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সাহস ছিল না কারো কিন্তু গুন্ডাদের চোখে চোখে ক্রুর ইঙ্গিতে নির্ধারিত হয়ে গেল নূতন ডেপুটি মার্শালের নিয়তি।

একটি দীর্ঘাকার কুৎসিত মানুষ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল নাম তার নেড ক্রিস্টি।

সঙ্গে উঠে দাঁড়াল তার সহকারী–আর্চি উলফ।

নেড আর আর্চি ওই অঞ্চলের দুর্ধর্ষ গুন্ডা। নরহত্যায় তাদের দ্বিধা ছিল না কিছুমাত্র। কত লোক যে তাদের হাতে প্রাণ দিয়েছে তারা নিজেরাও বোধ হয় তার সঠিক হিসাব দিতে পারত না। এই দুই মানিকজোড় এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

পরবর্তী ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকেই শোনা যাক। ১৮৯২ সালে নভেম্বর মাসের তৃতীয় দিবসে ড্যান ম্যাপল নামে যে কিশোরটি স্নেক ডলস সেলুনে পদার্পণ করেছিল তার কীর্তিকলাপ স্বচক্ষে দেখেছিল এক বালক ভৃত্য নাম তার মাইক ম্যাকফিবেন।

কাহিনির পরবর্তী অংশ মাইকের লিখিত বিবরণী থেকে তুলে দিচ্ছি।

পানাগারের পিছন দিকে দরজা দিয়ে অন্তর্ধান করলে আর্চি আর নির্বিকারভাবে ড্যান ম্যাপলের সামনে এগিয়ে এল নেড। আমি তখনই বুঝলাম ব্যাপারটা কী ঘটতে যাচ্ছে। সেলুন-রেস্তরাঁয় পিস্তলবাজ গুন্ডারা যখন কোনো প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করতে চায় তখন তারা ফঁদ পাতে। ফাঁদের নিয়মটা হচ্ছে, দুজনের মধ্যে একজন সামনে এগিয়ে এসে শিকারকে অন্যমনস্ক করে রাখে এবং সেই সুযোগে পিছন থেকে আর একজন তাকে গুলি করে।

আমি বুঝলাম আর্চি দরজার আড়ালেই দাঁড়িয়ে আছে। সুযোগ পেলেই সে গুলি চালাবে। আমার বুক কাঁপতে লাগল। খুব সহজভাবে ম্যাপলকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল নেড, তারপর হঠাৎ একটা টেবিলের ওপর হাত রেখে ঘুরে দাঁড়াল ম্যাপলের দিকে, ওঃ! তুমিই তাহলে নতুন ডেপুটি মার্শাল? রাজ্য সরকার তোমাকেই পাঠিয়েছে?

আমি রুদ্ধ নিশ্বাসে প্রতীক্ষা করতে লাগলুম। এখনই পিছনের দরজার কাছে দণ্ডায়মান আর্চির রিভলভার থেকে গুলি ছুটে এসে ম্যাপলকে শুইয়ে দেবে মেঝের ওপর। শুধু আমি নই, অভিজ্ঞ মানুষগুলো সবাই বুঝেছিল ব্যাপারটা, সকলেরই মুখে-চোখে ফুটে উঠেছিল হিংস্র প্রত্যাশা উদগ্র আগ্রহে সকলেই কান পেতে অপেক্ষা করতে লাগল একটা রিভলভারের গর্জন শোনার জন্য…

হ্যাঁ, গর্জে উঠেছিল রিভলভার। কিন্তু সেটা আর্চির অস্ত্র নয়। আমরা দেখলুম দরজার কাছে। দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করছে আর্চি উলফ, তার হাতের মুঠো থেকে ছিটকে পড়েছে রিভলভার। কখন যে ম্যাপল ডান হাতের দ্রুত সঞ্চালনে কোমর থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে আর্চিকে গুলি করেছে আমরা বুঝতেই পারিনি।

আমরা শুধু শুনলাম রিভলভারের গর্জন এবং আহত আর্চির আর্তনাদ, আমরা শুধু দেখলাম ম্যাপলের ডান হাতের রিভলভারের নল থেকে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া আর তার বাঁ-হাতের রিভলভার উদ্যত হয়েছে নেভ ক্রিস্টির দিকে।

কোণঠাসা নেকড়ের মতো হিংস্র দন্তবিকাশ করে পিছিয়ে গেল নেড। সে কোমরে ঝুলানো রিভলভারে হাত দেওয়ার চেষ্টা করলে না–চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল।

এইবার রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হল ওয়াইল্ড হ্যারি। ওই অঞ্চলের আর একটি কুখ্যাত পিস্তলবাজ গুন্ডা সে। কোমর থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে হ্যারি গুলি করার উপক্রম করলে, সঙ্গেসঙ্গে ক্ষিপ্রহস্তে গুলি চালিয়ে ম্যাপল তাকে মেঝের ওপর পেড়ে ফেলল।

তারপর ঠিক কী হয়েছিল জানি না। ওই রক্তাক্ত নাটকের মধ্যবর্তী অংশে কে কেমন অভিনয় করেছিল বলতে পারব না। কারণ, হ্যারি লুটিয়ে পড়তেই অনেকগুলো রিভলভার একসঙ্গে গর্জে উঠল এবং আমি ঝাঁপ খেলাম একটা টেবিলের নীচে। সেখান থেকে শুয়ে শুয়ে আমি শুনতে পেলাম সগর্জনে ধমকে উঠেছে অনেকগুলো রিভলভার।

প্রায় মিনিট দুই ধরে শুনলাম রিভলভারের গর্জন। তারপর হঠাৎ থেমে গেল সেই শব্দের তরঙ্গ–সব চুপচাপ। খুব সাবধানে টেবিলের তলা থেকে মাথা তুলে দেখলাম স্নেক ডলস সেলুনের মালিক ড্যান ম্যাপলের হাতে তুলে দিচ্ছে একটি পূর্ণ পানপাত্র।

পানশালা শূন্য! গুন্ডার দল সরে পড়েছে!

দোকানের মালিক আর একটা গেলাসে মদ ঢালল, এটাও টেনে নাও। এই গেলাসের দাম দিতে হবে না।

মালিকের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ম্যাপল বললে, হঠাৎ এই অনুগ্রহের কারণ কী?

মালিক বললে, অনুগ্রহ নয়। আমি আইরিশ–আয়ারল্যান্ডের লোক মনে করে মৃত্যুপথযাত্রীকে পানীয় পরিবেশন করলে পুণ্য হয়।

তার মানে? আমি কি মরতে বসেছি নাকি?

–নিশ্চয়। তুমি পাকা খেলোয়াড় তোমার মতো দক্ষ পিস্তলবাজ মানুষ আমি দেখিনি। কিন্তু তোমার আয়ু ফুরিয়েছে। দু-মিনিট কিংবা খুব বেশি হলে মিনিট কুড়ি তুমি বেঁচে থাকতে পারো।

বটে? এক চুমুকে গেলাসের তরল পদার্থ গলায় ঢেলে শূন্য পানপাত্র টেবিলের ওপর রাখল ম্যাপল, আচ্ছা, আজ চলি।

দরজাটা লাথি মেরে খুলে ফেলল ম্যাপল, খাপে ঢাকা রিভলভার দুটির বাঁটের ওপর নেমে এল তার দুই হাত তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে খোলা দরজা দিয়ে সে বেরিয়ে গেল… শহরের অন্ধকার পথের ওপর মিলিয়ে গেল তার দীর্ঘ দেহ।

মাইকের লিখিত বিবরণীতে আরও অনেক কিছু আছে। সব ঘটনা বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করার জায়গা এখানে নেই। খুব অল্প কথায় পরবর্তী ঘটনার বিবৃতি দিচ্ছি।

স্নেক ডলস সেলুনের মালিক যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, তা সফল হয়েছিল বর্ণে বর্ণে। ড্যান ম্যাপল পানশালা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চল্লিশ মিনিটের মধ্যে অজ্ঞাত আততায়ী তাকে আড়াল থেকে রাইফেল ছুঁড়ে হত্যা করেছিল।

ম্যাপলের হত্যাকাহিনি শুনে খেপে গেল তাহলাকুই শহরের সমস্ত মানুষ। এতদিন যারা গুন্ডাদের ভয়ে থরথর করে কাঁপত, তারাই আজ রুখে দাঁড়াল গুন্ডারাজ উচ্ছেদ করার জন্য। দলে দলে শান্তিপ্রিয় মানুষ ছুটে এল শহরের পথে।

হাতে তাদের বিভিন্ন অস্ত্র রাইফেল! পিস্তল! শটগান!

হত্যাকাণ্ডের পরদিনই আমেরিকা যুক্তরাজ্যের একজন ডেপুটি মার্শাল অকুস্থলে এসে পড়ল, নাম তার হেক ব্রুনার। তার সঙ্গে এল দুজন যোগ্য সহকারী। হত্যাকাণ্ড যেখানে ঘটেছিল সেখানে খোঁজাখুঁজি করে তারা আবিষ্কার করলে একটা ব্যবহৃত বুলেটের খোল এবং সেই খোলটার একটু দুরেই পাওয়া গেল একটা লাকি চার্ম বা কবচ জাতীয় বস্তু। স্পষ্টই বোঝা গেল যে রাইফেল। থেকে গুলি চালিয়ে ম্যাপলকে হত্যা করা হয়েছে, ওই বুলেটের খোলটা হচ্ছে উক্ত রাইফেলে ব্যবহৃত অকেজো টোটা।

ওই ধরনের বুলেট অনেকেই ব্যবহার করে, কাজেই সেটা তাকে খুনিকে শনাক্ত করা সম্ভব নয়।

কিন্তু কবৃচটা গোয়েন্দার কাছে মূল্যবান সূত্র।

ব্রুনার তার দুই সহকারীকে বললে, আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসছি। এই কবচের মালিকটিকে যদি আবিষ্কার করতে পারি তাহলেই হত্যাকাণ্ডের সমাধান হয়ে যাবে। আমার মনে হয় খুনি আমার চোখে ধুলো দিতে পারবে না।

ঘোড়া ছুটিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল হেক ব্রুনার। দু-দিন তার পাত্তা পাওয়া গেল না। আর এই দুটো দিন শহরের কোনো জায়গায় কোনো অপরাধ সংঘটিত হল না। তাহলাকুই শহরের ইতিহাসে পরপর দু-দিন কোনো দুর্ঘটনা ঘটল না, এটা একটা আশ্চর্য ঘটনা।

শহরের আশেপাশে পার্বত্য অঞ্চল থেকে বেরিয়ে এসে যেসব গুন্ডা নগরবাসীর ওপর হামলা করত তারা পরপর দু-দিন তাদের আস্তানায় গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে রইল।

ক্ষিপ্ত জনতার সম্মুখীন হওয়ার সাহস তাদের ছিল না, হাওয়া ঘুরে গেছে!

দু-দিন পরেই সকাল বেলা শহরের রাজপথে ঘোড়ার পিঠে আবির্ভূত হল ব্রুনার। এক বিরাট জনতা তাকে ঘিরে দাঁড়াল, খবর কী?

ব্রুনার বললে, কবচের মালিক হচ্ছে নেড ক্রিস্টি। যে বুড়ো রেড-ইন্ডিয়ান এই ধরনের কবচ তৈরি করে তাকে আমি ভালোভাবেই জানি। আমি ওই বুড়োর কাছে গিয়েছিলাম। কবচটা দেখেই সে জিনিসটা শনাক্ত করল–নেড ক্রিস্টি ওই কবচ নিয়েছিল বুড়োর কাছ থেকে। এই তল্লাটে ওই ধরনের কবচ বুড়ো ছাড়া আর কেউ তৈরি করতে পারে না, তাই ওর কথা নিশ্চয়ই বিশ্বাসযোগ্য। বুড়ো আমাকে বলেছিল যে যতগুলো কবচ সে তৈরি করেছিল সবগুলোতেই সে খোদাই করেছিল একটি একটি সাপের ছবি কিন্তু ক্রিস্টির কবচে সে এঁকে দিয়েছিল দু-দুটো সাপ। আমরা যে কবচটা কুড়িয়ে পেয়েছি তাতেও দুটি সাপের ছবি খোদাই করে আঁকা হয়েছে!

জনতার ভিতর থেকে একজন চিৎকার করে উঠল, আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি কেন? চলো–ওই শয়তান নেড ক্রিস্টিকে ধরে তার গলায় একটা দড়ি লাগিয়ে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়া যাক।

সমবেত জনমণ্ডলী বক্তার প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে গর্জে উঠল, ঠিক! ঠিক! নেড ক্রিস্টিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেব! চলো, দেখি কোথায় লুকিয়ে আছে সেই শয়তান।

ব্রুনার কঠোর স্বরে বললে, না। আইন তোমরা নিজেদের হাতে নিতে পারো না। আমরা সরকারের প্রতিনিধি, যা করা কর্তব্য আমরা তাই করব। নেড ক্রিস্টির আস্তানা কোথায় তোমরা জানো?

একাধিক কণ্ঠে উত্তর এল, জানি। র‍্যাবিট ট্র্যাপ।

সেটা আবার কোথায়?

মাইক নামে যে ছোকরা চাকরটি সেলুনের ভিতর ম্যাপলের কীর্তি প্রত্যক্ষ করেছিল সে এগিয়ে এসে জানাল যে র‍্যাবিট ট্র্যাপ জায়গাটা সে চেনে এবং ব্রুনার যদি অনুমতি দেয় তবে সে তার সঙ্গে গিয়ে জায়গাটা দেখিয়ে দিতে পারে।

ছেলেটিকে নিজের ঘোড়ায় তুলে নিয়ে পুলিশ দলের সঙ্গে ব্রুনার ছুটল র‍্যাবিট ট্র্যাপ-এর দিকে।

ঘন জঙ্গল আর কাঁটা ঝোপের ভিতর দিয়ে যথাস্থানে এসে পৌঁছে গেল ব্রুনার এবং তার দল। একটা ছোটো পাহাড়ের ওপর চারদিকে ছড়িয়ে আছে ঘন ঝোপঝাড় এবং তারই মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটি কাষ্ঠনির্মিত ঘর বা কেবিন–ওই হচ্ছে নেড ক্রিস্টির আস্তানা।

ব্রুনারের দল ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। সঙ্গেসঙ্গে গর্জে উঠল একটা রাইফেল। পুলিশ বাহিনীর একজন লোক আহত হয়ে ছিটকে পড়ল মাটির ওপর। অন্যান্য পুলিশরা চটপট ভূমিশয্যায় লম্বমান হয়ে আত্মরক্ষা করলে, কেউ কেউ আশ্রয় নিলে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত ছোটো-বড়ো পাথরের আড়ালে।

ঘরের ভিতর থেকে দু-দুটো রাইফেল সগর্জনে অগ্নিবৃষ্টি করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রুনারের দলের আরও দুজন লোক আহত হল। ব্রুনার বুঝল, ওই ঘরটি হচ্ছে দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো শক্ত কাঠের দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে নেড এবং তার সঙ্গী (খুব সম্ভব আর্চি উলফ) পুলিশদলের নিক্ষিপ্ত বুলেট থেকে সহজেই আত্মরক্ষা করতে পারবে, কিন্তু ফাঁকা জায়গার ওপর দিয়ে গুন্ডাদের রাইফেলের সামনে এগিয়ে যাওয়া পুলিশদের পক্ষে অসম্ভব।

সে দলের মধ্যে দুজনকে ডেকে বললে, এখনই শহর থেকে জনদশেক বন্দুকবাজ মানুষ নিয়ে এসো। তারাই হবে আজ সরকারের অস্থায়ী প্রতিনিধি। এই কয়জন পুলিশ নিয়ে গুন্ডা দুটোকে শায়েস্তা করা যাবে না।

ব্রুনারের দুই সহকারী তাহলাকুই শহরের দিকে তিরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলে। বিকাল বেলার দিকে তাদের সঙ্গে এল দশজন রাইফেলধারী নাগরিক–তাহলাকুই শহরের দশটি লড়িয়ে মানুষ।

পুলিশ ও নাগরিকদের মিলিত বাহিনী এইবার একযোগে গুন্ডাদের আক্রমণ করলে। তিন দিক দিয়ে ঘিরে ফেলে কাঠের ঘরটার ওপর তারা গুলি চালাতে শুরু করলে এবং গুলিবর্ষণের ফাঁকে ফাঁকে হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।

অসম্ভব। গুন্ডাদের নিশানা অব্যর্থ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের কয়েকজন গুলি খেয়ে ধরাশয্যায় লম্বমান হল। কাঠের ঘরটা যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরী–জানালার ফাঁক দিয়ে উড়ন্ত মৃত্যুদূতের মতো ছুটে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি কার সাধ্য সেদিকে যায়?

নাঃ, এভাবে হবে না। ব্রুনার হতাশ হয়ে পড়ল।

টলবার্ট নামক একজন নাগরিক এইবার সামনে এগিয়ে এল, ব্রুনার! ওই কাঠের ঘরটাকে ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিতে হবে। তা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

ব্রুনার বললে, কিন্তু এত দূর থেকে ঘরের ওপর ডিনামাইট ছুঁড়ে মারা সম্ভব নয়। ডিনামাইট ছুঁড়তে হলে ঘরের কাছাকাছি যেতে হবে আর ঘরের কাছে এগিয়ে গেলেই আমরা গুন্ডা দুটোর রাইফেলের সামনে পড়ব। গুলি যদি ডিনামাইটের ওপর লাগে তাহলে আর দেখতে হবে না–আমাদের পুরো দলটাই দড়াম করে উড়ে যাবে স্বর্গের দিকে! আত্মহত্যা করার অনেক ভালো ভালো উপায় আছে টলবার্ট, ডিনামাইটের মুখে প্রাণ দিতে আমি রাজি নই।

টলবার্ট বললে, আমি আর কোপল্যন্ড একটা পরিকল্পনা করেছি। আমার মনে হয় গুন্ডাদের আমরা কাবু করতে পারব।

সারারাত ধরে সবাই মিলে ঘরটাকে পাহারা দিলে কিন্তু ঘরের সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কেউ করলে না। অনর্থক প্রাণ বিপন্ন করার পক্ষপাতী নয় ব্রুনার; টলবার্ট এবং কোপল্যন্ডের উপর ভরসা করে সে রাতটা নিষ্ক্রিয়ভাবে হাত গুটিয়ে বসে রইল–দেখা যাক ওদের পরিকল্পনা কতদূর ফলপ্রসূ হয়।

পরদিন সকালে পরিকল্পনার চেহারা দেখে দলসুদ্ধ মানুষের চক্ষুস্থির! একটা ঘোড়ায়-টানা গাড়ি থেকে ঘোড়া খুলে নিয়ে গাদা গাদা কাঠের টুকরো সাজাল টলবার্ট আর কোপল্যন্ড, তারপর দুই স্যাঙাতে মিলে সেই কাঠবোঝাই গাড়িটাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল গুন্ডাদের আস্তানার দিকে।

এককুড়ি ডিনামাইটের স্টিক! ঘরের ভিতর থেকে বৃষ্টির মতো ছুটে এল গুলির পর গুলি একটা গুলি যদি কোনোরকমে ডিনামাইটের ওপর পড়ে তাহলে গাড়িসুদ্ধ মানুষ দুটো টুকরো টুকরো হয়ে যাবে! দলসুদ্ধ লোকের বুক কাঁপতে লাগল, কিন্তু দুই বন্ধু সম্পূর্ণ নির্বিকার তারা গাড়ি ঠেলছে তো ঠেলছেই।

ফটফট করে উড়ে যেতে লাগল কাঠের টুকরোগুলো গুলির আঘাতে, গাড়ির একটা চাকা থেকে দুটো কাঠের ডান্ডা উড়িয়ে নিলে রাইফেলের বুলেট, কোপল্যন্ডের মাথায় আঁচড় বসিয়ে একটা গুলি তার সমস্ত মুখ রক্তে ভাসিয়ে দিলে, আর একটা গুলি ছোঁ মেরে নিয়ে গেল টলবার্টের টুপি–তবু তারা নির্বিকারভাবে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে চলল!

দুই বন্ধু যেন আত্মহত্যার সংকল্প নিয়েছে।

আচম্বিতে পাহাড়ের বুক কাঁপিয়ে জেগে উঠল এক ভয়াবহ শব্দের তরঙ্গ, প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ফলে কেঁপে উঠল মাটি ধোঁয়া আর ধুলোর ঝড়ে চারদিক আচ্ছন্ন করে পুলিশদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যেতে লাগল বড়ো বড়ো কাঠের টুকরো!

ধোঁয়া কেটে গেলে সবাই দেখল, কাঠের ঘরটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়েছে। একটু দূরেই গাড়ির আড়ালে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে টলবার্ট আর কোপল্যন্ড এবং ভাঙা ঘরের ভগ্নস্তূপের ভিতর রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে নেড ক্রিস্টি!

একটা রাইফেল সগর্জনে অগ্নি-উদগার করলে।

নেড ক্রিস্টির প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির ওপর।

ব্রুনার এসে দাঁড়াল কোপল্যন্ড আর টলবার্টের সামনে। গুলির আঘাতে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে কোপল্যন্ড। টলবার্টও আহত হয়েছে, কিন্তু সে জ্ঞান হারায়নি। মুখ তুলে দুর্বলভাবে সে একবার হাসল, তারপর ব্রুনারকে উদ্দেশ করে বললে–

আমার মাথায় একটা গুলি আঁচড় কেটে চলে গেছে। খুব রক্তপাত হচ্ছে বটে, কিন্তু আমি বিশেষ ভয় পাইনি। তবে ডিনামাইট যখন ফাটছিল তখন সত্যি ভয় পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল এই বুঝি উড়ে গেলাম।

সমস্ত ঘটনাটা পরে জানা গেল। সব কিছু এত দ্রুত ঘটেছিল যে প্রত্যক্ষদর্শীরাও প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। টলবার্ট আর কোপল্যন্ড গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে গুন্ডাদের আস্তানার পনেরো গজের মধ্যে এসে পড়েছিল এবং সেইখান থেকেই ঘরের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছিল ডিনামাইট স্টিকগুলো। বিস্ফোরণের আগে বুকে হেঁটে খানিকটা পিছিয়ে আসতে পেরেছিল বলেই তারা বেঁচে গেছে–কী অসীম সাহস!

হত ও আহত মানুষগুলোকে নিয়ে ব্রুনার শহরে ফিরে এল।

নেড ক্রিস্টি মারা পড়েছিল, কিন্তু আর্চি উলফকে ওখানে পাওয়া যায়নি। খুব সম্ভব কোনো গোপন পথে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে সে সরে পড়েছিল।

তাহলাকুই শহরে আর কখনো গুন্ডার উপদ্রব হয়নি। পুলিশ ও জনতার সম্মিলিত আক্রমণের মুখে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল সমাজবিরোধী গুন্ডার দল।

ভদ্রলোকের বাসযোগ্য হয়ে উঠল তাহলাকুই শহর।

জনতার প্রতিনিধিকে যারা হত্যা করেছিল, ক্ষিপ্ত জনতা তাদের ক্ষমা করেনি।

[পৌষ ১৩৭৬]

জেহাদ

বহুদিন আগেকার কথা। ব্রিটিশশাসিত দক্ষিণ ভারতে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত তালাইনভু নামে গ্রামটির নিকটবর্তী অরণ্যে কয়েকটি গ্রামবাসীর অকারণ নিষ্ঠুর আচরণের ফলে সমগ্র বনাঞ্চলে ভয়াবহ সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু হয়েছিল এবং স্বজাতির পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে প্রাণ হারিয়েছিল কয়েকটি নিরাপরাধ মানুষ

সেই অদ্ভুত এবং ভয়ংকর ঘটনার বিবরণ এখানে পরিবেশিত হল :

উক্ত তালাইনভু গ্রামের ছয়-সাতজন লোক কাবেরী নদীর তীরে বাঁশবন থেকে বাঁশ কাটতে গিয়েছিল। হঠাৎ একটা বাঁশঝাড়ের নীচে তারা তিনটি প্যান্থারের বাচ্চা দেখতে পায়। বাচ্চাগুলো তাদের কোনো ক্ষতি করেনি, সেখান থেকে সরে এলেই আর কোনো ঝামেলা হত না। কিন্তু লোকগুলোর নিতান্ত দুর্মতি, তাদের মধ্যে একজন হাতের ধারালো কাটারি দিয়ে একটা বাচ্চার গায়ে কোপ বসিয়ে দিল। বাচ্চাটা প্রায় দু খানা হয়ে রক্তাক্ত শরীরে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়ল। হত্যাকারীর দৃষ্টান্ত দেখে তার সঙ্গীরা মহা উৎসাহে অন্য বাচ্চা দুটিকে আক্রমণ করল। কাটারির আঘাতে আঘাতে দুটি শ্বাপদ শিশুই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে।

আচম্বিতে বনের মধ্যে জাগল ক্রুদ্ধ হুংকার ধ্বনি–পরক্ষণেই হলুদের উপর কালো কালো ছোপ বসানো একটা অতিকায় বিড়ালের মত জানোয়ার ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকগুলোর মধ্যে

মা-প্যান্থার!

মানুষ সম্পর্কে বন্য পশুর একটা স্বাভাবিক ভীতি আছে। তাই সকলের অলক্ষ্যে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মা-প্যান্থার লোকগুলোকে লক্ষ করছিল, কাছে আসতে সাহস পায়নি। কিন্তু চোখের ওপর তার বাচ্চাদের হত্যাকাণ্ড দেখে দারুণ ক্রোধে তার মন থেকে ভয়ের অনুভূতি লুপ্ত হয়ে গেল, সে ঝাঁপিয়ে পড়ল হন্তারকদের ওপর।

প্রথম ব্যক্তি ব্যাপারটা কী হল বুঝতেই পারল না, কারণ মা-প্যান্থারের থাবার আঘাতে তার দুটো চোখই অন্ধ হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে! লোকটি ছিটকে পড়ল মাটিতে। সঙ্গেসঙ্গে তার ধরাশায়ী দেহ টপকে একলাফে আরেকটি লোকের বুকের উপর কামড় বসাল ক্ষিপ্তা জননী।

প্রথম ব্যক্তির মতো দ্বিতীয় ব্যক্তিও সশব্দে ধরাশায়ী হয়ে আর্তনাদ করতে লাগল।

আহত লোক দুটির সঙ্গীরা বাচ্চা তিনটির ওপর কাটারির ধার পরখ করতে ইতস্তত করেনি, কিন্তু অস্ত্র হাতে মা-প্যান্থারের নখদন্তের সম্মুখীন হওয়ার সাহস তাদের ছিল না–দারুণ আতঙ্কে আর্তনাদ করতে করতে তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে পালাতে লাগল তিরবেগে।

মা-প্যান্থার পলাতকদের অনুসরণ করল না, আহত অবস্থায় যে দুটি লোক মাটিতে পড়ে ছটফট করছিল, তাদের ওপর সে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই নখে দাঁতে তাদের ছিঁড়ে ফেলল টুকরো টুকরো করে।

তারপর বাচ্চা তিনটির মধ্যে যে-জন্তুটার দেহে কম ক্ষত ছিল সেটাকে মুখে তুলে নিয়ে গভীর বনের ভিতর অদৃশ্য হল।

বাঁশ কাটতে যারা গিয়েছিল, তারা গ্রামে গিয়ে বলল একটা প্রকাণ্ড প্যাস্থার সম্পূর্ণ বিনা কারণে তাদের আক্রমণ করে দুটি মানুষকে হত্যা করেছে। তারা যে বাচ্চাগুলোকে খুন করে মা-প্যান্থারকে উত্তেজিত করেছিল, এ-কথা তারা বেমালুম চেপে গেল। পরে অবশ্য আসল ব্যাপারটা জানাজানি হয়েছিল।

কিছুদিন খুব গোলমাল হল। যেখানে ঘটনাটা ঘটেছিল, সেই জায়গাটা এড়িয়ে চলল স্থানীয় মানুষ। নিতান্তই ওই জায়গা দিয়ে যাতায়াত করার দরকার হলে সেখানকার মানুষ দলে ভারী হয়ে অস্ত্র নিয়ে পথ চলত।

কয়েকটা সপ্তাহ কেটে গেল। মা-প্যান্থারকে কেউ আর দেখতে পায়নি। লোকে তার কথা ভুলে গেল।কিন্তু শ্বাপদ জননী তার শাবকদের অপমৃত্যুর কথা ভোলেনি, সে তখন বিদ্বেষ পোষণ করছে। সমগ্র মনুষ্যজাতির ওপর। কিছুদিন পরেই আবার প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ পেল সে।

পূর্বে উল্লিখিত গ্রামটির নিকটবর্তী অরণ্যে এক কুখ্যাত চোর বনরক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে বন থেকে চন্দন কাঠ চুরি করত। অনেক চেষ্টা করেও বন বিভাগের লোকজন এবং পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

এই চোরটি তার ছেলেকে নিয়ে এক চাঁদনি রাতে জঙ্গলে প্রবেশ করল। কিছু চন্দন কাঠ কেটে নিয়ে ডিঙিতে তুলে নদীর উত্তরদিকের তীরে উঠতে পারলে আর মাদ্রাজের কর্তৃপক্ষ তাদের গ্রেপ্তার করতে পারবে না–নদীর ওই দিকটা ছিল মহীশূরাজ্যের অন্তর্গত এবং সেই উদ্দেশ্যেই তারা প্রবেশ করেছিল বনের মধ্যে।

দিনের বেলা এসে একসময় তারা পছন্দমতো গাছগুলো দেখে গিয়েছিল, এখন নির্ধারিত স্থানে এসে তারা কুড়াল দিয়ে গাছ কাটতে শুরু করল। শাবকহারা মা-প্যান্থার ওই শব্দে আকৃষ্ট হয়েছিল সন্দেহ নেই। নিঃশব্দে সে হানা দিল। নরমাংসের লোভ তার ছিল না, নরহত্যাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য।

বাপ বুঝতেই পারেনি ব্যাপারটা কী ঘটল, একবার আর্তনাদ করার সময়ও সে পায়নি। আচম্বিতে পিঠের ওপর একটা গুরুভার দেহের সংঘাতে সে হল ভূমিপৃষ্ঠে লম্ববান, পরক্ষণেই কণ্ঠনালীতে তীক্ষ্ণ দন্তের সাংঘাতিক নিষ্পেষণ। আঠারো বছরের ছেলে তার বাপকে বাঁচানোর চাইতে নিজের প্রাণ বাঁচাতেই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ল, হাতের কুড়াল ফেলে সে পলায়ন করল দ্রুতবেগে।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই হতভাগ্য চোর প্রাণত্যাগ করল প্যান্থারের কবলে। ছেলেটি অবশ্য শ্বাপদকে ফাঁকি দিতে পারল, তিরবেগে ছুটে গিয়ে সে নদীর ধারে রক্ষিত ডিঙির ওপর লাফিয়ে উঠল এবং প্রাণপণে দাঁড় বেয়ে নদী পেরিয়ে ছুটতে ছুটতে প্রবেশ করল তার কুঁড়েঘরে। চোরের বউ স্বামীর ভয়াবহ মৃত্যুসংবাদ পেল ছেলের মুখ থেকে।

গ্রামবাসীরা অনেক আগেই শয্যাগ্রহণ করেছিল। মা আর ছেলের আর্তক্ৰন্দন শুনে তাদের ঘুম ভেঙে গেল। আলো জ্বালিয়ে তারা চোরের কুটিরে এল, তারপর তার ছেলের মুখ থেকে সমস্ত ঘটনার বিবরণ শুনল। কিন্তু সেই রাতে কেউ কিছু করতে রাজি হল না। সকলেই জানত বাপ-ছেলে দুজনেই চোর চোরের মৃতদেহ উদ্ধার করার জন্য রাতের অন্ধকারে হিংস্র শ্বাপদের সম্মুখীন হওয়ার ইচ্ছা তাদের ছিল না।

পরের দিন বেশ বেলা হলে গ্রামবাসীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ছেলেটির সঙ্গে রওনা হল এবং অকুস্থলে গিয়ে চোরের মৃতদেহ দেখতে পেল। লোকটির গলা থেকে পেট পর্যন্ত চিরে ফেলা হয়েছে, সমস্ত শরীর নখদন্তে ছিন্নভিন্ন, জায়গাটা রক্তে ভাসছে। কিন্তু প্যান্থার মৃতদেহের মাংস ভক্ষণ করেনি, হত্যাকাণ্ড সমাধা করে সে চলে গেছে।

আবার কয়েকদিন খুব শোরগোল চলল। লোকজন দল বেঁধে অস্ত্র নিয়ে পথ চলতে শুরু করল। কিন্তু বেশ কিছুদিনের মধ্যেও কোনো হত্যাকাণ্ড যখন অনুষ্ঠিত হল না, তখন স্থানীয় মানুষ আবার স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা শুরু করল। ধীরে ধীরে প্যান্থারের কথা লোকে ভুলে গেল।

কয়েকটা সপ্তাহ কাটল। আবার এল শুক্লপক্ষ। জ্যোৎস্না রাতেই জঙ্গলের মধ্যে দুবৃত্তরা যাবতীয় দুষ্কর্মে প্রবৃত্ত হয়। ওই সময়ে যেখানে হরিণরা নুন চাটতে অথবা জলপান করতে আসে, সেইসব জায়গায় ওত পেতে বসে চোরাই শিকারির দল (poachers) এবং কাঠ চোরের দল। কাঠ চোর চাঁদনি রাতে চন্দন, মাথি, বাঁশ প্রভৃতি কেটে নদীপথে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অথবা গোরুর গাড়িতে বোঝাই করে চোরাই মাল নিয়ে চম্পট দেয়।

এ ছাড়া আছে আর এক ধরনের চোর। তারা চুরি করে মাছ। এরা বঁড়শি বা জাল দিয়ে মাছ ধরে না। ঘরে তৈরি হাতবোমা জলে ফাটিয়ে মাছ ধরে। বিস্ফোরণের ফলে ছোটোবড়ো অসংখ্য মাছ মরে অথবা অজ্ঞান হয়ে জলের উপর ভেসে ওঠে। বাঁশের ডগায় বসানো জলের সাহায্যে বড়ো বড়ো মাছগুলি ধরে চোরের জল নৌকা বোঝাই করে। ছোটো ছোটো মরা মাছগুলো ভেসে যায়, পরে বড়ো মাছ আর কুমিরের খাদ্যে পরিণত হয়।

এই মাছ চুরির জন্য দুটি ডিঙি নৌকা ব্যবহার করা হয়। একটি ডিঙি থেকে বোমা ছোঁড়া হয়, আর একটি শুধু মাছ বোঝাই করার জন্য থাকে। মাছের ভারে ডিঙি যতক্ষণ ডুবে যাওয়ার উপক্রম না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত চোররা মাছ ধরে যায়। জোয়ালের জলে মাইল পাঁচেক ডিঙি ভাসিয়ে একসময়ে তারা ডিঙি থামায়, তারপর মাছগুলোকে থলিতে ভরে রাখে। প্রত্যেক চোর একটা করে থলি বহন করে। ডিঙি দুটোকে উলটো করে ফেলে এক-একটা ডিঙি দুজন করে মানুষ মাথায় তুলে হাঁটতে থাকে সেইদিকে, যেখান থেকে তারা প্রথম ডিঙি ভাসিয়েছিল।

নদীতে জোয়ারের জল ঠেলে ওই গোলাকার চামড়ায় ঢাকা ডিঙি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই এই পরিশ্রম। হালকা দাঁড়গুলো অবশ্য সমস্যা নয়। হাতে হাতে সেগুলো সবাই নিয়ে যায়। অমাপক্ষ হলে চোররা বিশ্রাম নেয়। আবার শুক্লপক্ষের আবির্ভাবে তাদের কাজকর্ম শুরু।

সেই রাতটাও ছিল শুক্লপক্ষের চাঁদনি রাত। একদল চোর চুরি করতে বেরিয়েছিল। ক্রমাগত বোমা মেরে মাছ তুলে তারা ডিঙি বোঝাই করছিল। মাছ বোঝাই করার ডিঙিতে ছিল মাত্র একটি লোক। কারণ, লোক কম হলে সংখ্যায় বেশি মাছ রাখা যায়। প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত মাছ ধরার পর যে ডিঙি থেকে বোমা ছোঁড়া হচ্ছিল, সেই ডিঙির লোকরা হাঁক দিয়ে মাছ-বোঝাই ডিঙির মালিককে বলল, অনেক হয়েছে, এবার ডাঙায় ভেড়াও। কিছু খাওয়া দরকার।

মাছ-বোঝাই ডিঙির নিঃসঙ্গ লোকটি খুশি হল, সে সতর্কভাবে খরস্রোতা নদী বেয়ে ধীরে ধীরে ডিঙিটাকে পাড়ে নিয়ে এল। ডিঙির তলায় বাঁশের সঙ্গে যে-দড়ি বাঁধা থাকে, সেইটা নিয়ে লোকটা একলাফে পাড়ে উঠল। একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে দড়িটাকে বেঁধে ডিঙিটাকে সে দাঁড় করাতে চেয়েছিল। কিন্তু তার সেই উদ্দেশ্য সফল হল না। দুই নম্বর ডিঙি থেকে তার বন্ধুরা দেখল একটা দীর্ঘ ধূসর বস্তু নদীর তীরবর্তী ঝোপ থেকে লাফিয়ে পড়ল। তাদের কানে এল একটা চাপা গর্জন, পরক্ষণেই তারা দেখল তাদের সঙ্গীটি মাটিতে পড়ে যাচ্ছে এবং তার দেহের উপর রয়েছে সেই ধূসর বস্তু!

একটা কান-ফাটানো আর্ত চিৎকার–সঙ্গেসঙ্গে চোরের দল দেখল মাছভরতি ডিঙিটা খরস্রোতা নদীর জলে ছুটে চলেছে এবং তাদের সঙ্গীর হাত থেকে খসে পড়ে মোটা দড়িটাও ছুটছে ডিঙির সঙ্গে!

বোমা ছোঁড়ার ভূমিকায় যে-ডিঙিটা ছিল, সেই ডিঙির মাঝি প্রাণপণে দাঁড় চালিয়ে মাছভরতি ভেসে-যাওয়া ডিঙিটাকে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু তার ডিঙিতে অনেক লোক ছিল বলে সেটা ছিল বেজায় ভারী, তাই মাঝির চেষ্টা সফল হল না। ভেসে-যাওয়া ডিঙিটা মাঝনদীতে ছিটকে এসে কয়েকটা পাথরে ধাক্কা খেয়ে উলটে গেল। সঙ্গেসঙ্গে এত কষ্টে ধরা মাছগুলো অদৃশ্য হল নদীগর্ভে। নিতান্ত দুঃখের সঙ্গে সেই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখল চোরের দল, তারপর তারা তীরের দিকে তাদের ডিঙিটাকে ফেরাল। যে হাঁদা লোকটা হাতের দড়ি ধরে রাখতে পারে না, তাকে এবার আচ্ছা করে ঠেঙানি দিতে হবে এই হল তাদের মনোগত বাসনা। মাছ তো গেলই, ডিঙিটাও গেল ওই ধরনের একটা ডিঙি জোগাড় করতে তাদের অন্তত এক-শো টাকা খরচ হবে, তা ছাড়া মাছের দাম তো আছেই। নির্বোধ সঙ্গীকে বেশ ভালোরকম প্রহার করার সংকল্প নিয়েই তীরে এসে তরী ভেড়াল চোরের দল।

কিন্তু নদীতীরে লোকটার কোনো চিহ্ন নেই তো! তখন হঠাৎ সেই দীর্ঘ ধূসর বর্ণ বস্তুটির কথা তাদের মনে পড়ল। হ্যাঁ, একটা গর্জনও শোনা গিয়েছিল বটে! লোকটাও যেন হঠাৎ মাটিতে পড়ে গিয়েছিল বলে মনে হচ্ছে!

যে-ব্যক্তি ডিঙি চালাচ্ছিল, সে নদীর পাড়ে উঠে নিরুদ্দেশ সঙ্গীর খোঁজ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু সবাই তাকে নিষেধ করল। প্রথমে তারা ভেবেছিল তাদের সঙ্গী কোনো প্রেতাত্মার কবলে পড়েছে। একটু পরেই হঠাৎ তাদের মনে পড়ল প্যান্থারটির কথা। কিছুক্ষণ আলোচনা করে তারা স্থির করল ওই জন্তুটাই তাদের সঙ্গীকে আক্রমণ করেছিল। এতক্ষণে জন্তুটা নিশ্চয়ই লোকটাকে মেরে ফেলেছে এবং অন্ধকার নিরালা জায়গায় বসে শিকারের মাংস ভক্ষণ করছে। এই সিদ্ধান্তে আসতেই তারা যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল সেইদিকে অর্থাৎ স্রোতের বিপরীত দিকে ডিঙি বাইতে শুরু করল। কিন্তু প্রায় আধমাইল যাওয়ার পর আর ওইভাবে ডিঙি চালানো সম্ভব হল না। তখন চোরের দল ডিঙিটাকে পাড়ের ওপর তুলে রেখে যথাসম্ভব দ্রুত পদচালনা করল গ্রামের উদ্দেশ্যে। পথ চলার সময় তারা চিৎকার করে কথা বলছিল, যাতে প্যান্থারটা ভয় পেয়ে তাদের সামনে না-আসে।

পরের দিন সূর্য যখন মাথার উপর আগুন ছড়াচ্ছে, সেই সময় সমগ্র গ্রামের লোক দল বেঁধে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিরুদ্দেশ ব্যক্তির সন্ধানে যাত্রা করল। বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হল না, তাকে পাওয়া গেল নদীর ধারে একটা ঝোপের কাছে। জীবিত নয় মৃত–ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত। অন্যান্য বারের মতো এবারও দেখা গেল প্যান্থার মানুষটিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে বটে, কিন্তু তার মাংস খায়নি।

এরপর শুরু হল হত্যার তাণ্ডবলীলা। আরও কয়েকটি মানুষ প্রাণ দিল প্যান্থারের কবলে। প্যান্থার শুধু হত্যা করে, মাংস খায় না। প্রত্যেকটি মৃতদেহকে জন্তুটা এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত ও বিকৃত করে ফেলে যে, লোকগুলোকে চিনতে পারাই কষ্টকর হয়ে ওঠে। মনে হয় দারুণ আক্রোশে জন্তুটা ক্রমাগত আঘাত করে গেছে, হত্যার পরেও মানুষগুলোর ওপর তার রাগ যায়নি।

এই সময়ে নিতান্তই ঘটনাচক্রে একটি জিপগাড়ি চড়ে অকুস্থলে এসে পড়লেন বিখ্যাত শিকারি কেনেথ অ্যান্ডারসন। প্যান্থারের উপদ্রবের বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না, তিনি এসেছিলেন মাছ ধরতে। সঙ্গে ছিল তার ছেলে ডোনাল্ড ওরফে ডন, ডনের বন্ধু মারওয়ান, সেডন টাইনি নামে এক ওস্তাদ মাছ-শিকারি এবং থাংগুভেলু নামে এক স্থানীয় ব্যক্তি–যে একাধারে শিকার, গাড়ি পরিষ্কার, রন্ধন, পরিবেশন প্রভৃতি সর্ব বিষয়ে সর্ব বিদ্যা বিশারদ।

বাঙ্গালোরে অবস্থিত অ্যান্ডারসন সাহেবের বাড়ি থেকে পাক্কা নিরানব্বই মাইল দূরে কাবেরী নদীর ধারে যেখানে তাদের আস্তানা ফেলা হল, সেই জায়গাটা তালাইনভু গ্রাম থেকে দশ মাইল দূরে। ওইখানেই মাছ ধরা হবে বলে স্থির হল।

রাতের খাওয়া শেষ করে সকলে বনের মধ্যে একটা জায়গা পরিষ্কার করে শুয়ে পড়ল।

ওই অঞ্চলে যে একটি নরঘাতক প্যান্থারের আবির্ভাব হয়েছে সে-কথা আগন্তুকরা জানতেন না, অতএব কারো মনে দুশ্চিন্তা ছিল না। তবে একটা বিপদের সম্ভাবনা ছিল–হাতি। তাই সারা রাত অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে রাখার ব্যবস্থা হল। কিছুক্ষণ গল্প করার পর সকলেই ঘুমিয়ে পড়ল…

হঠাৎ অ্যান্ডারসন সাহেবের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ঘড়ি দেখলেন। তিনটে বেজে কয়েক মিনিট হয়েছে। আগুন প্রায় নিবে এসেছে, অন্ধকার ভেদ করে জ্বলছে কয়েক টুকরো জ্বলন্ত কাঠ। আগুনটাকে সারারাত জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব যার ছিল, সেই থাংগুভেলু গভীর নিদ্রায় মগ্ন। সাহেবের বাঁ-দিকে তার ছেলে ডোনাল্ড নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। ডান দিকে মারওয়ান আর টাইনি রাতের শিশির এবং মশার আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য মাথা-মুখ চাদর ঢাকা দিয়ে ঘুমাচ্ছে।

অ্যান্ডারসন ভাবতে লাগলেন হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেল কেন? জঙ্গলের ভিতর থেকে কোনো সন্দেহজনক শব্দ ভেসে আসছে কি… কিন্তু ছেলে ডোনাল্ডের প্রচণ্ড নাসিকাগৰ্জন ছাড়া আর কিছুই তিনি শুনতে পেলেন না…

হঠাৎ তিনি জানতে পারলেন তার ঘুম ভাঙার কারণ। খুব কাছেই জেগে উঠল করাত চালানোর মতো খসখসে শ্বাপদ কণ্ঠের আওয়াজ হা-আঃ! হা-আঃ! হা-আঃ! ক্ষুধিত প্যান্থারের কণ্ঠস্বর!

সাহেব বুঝলেন নিদ্রিত অবস্থায় তার মগ্নচৈতন্য ওই শব্দে সাড়া দিয়েছে, আর সেইজন্যই তাঁর ঘুম ভেঙে গেছে।

অ্যান্ডারসন ভয় পেলেন না। শিকারি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানতেন প্যান্থার মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক নয়। প্যান্থার মানুষের সান্নিধ্য এড়িয়ে চলে। অবশ্য আহত হলে বা কোনো কারণবশত নরমাংসের প্রতি আকৃষ্ট হলে ভয়ের কথা বটে। তবে নরখাদক প্যান্থার অতিশয় বিরল। মা-প্যান্থারের কাহিনি তখন পর্যন্ত জানতেন না, তাই প্যান্থারের আক্রমণের সম্ভাবনা তাকে উদবিগ্ন করেনি।

আবার জাগল শ্বাপদ কণ্ঠে অবরুদ্ধ গর্জন ধ্বনি। সাহেব শব্দ লক্ষ করে টর্চের আলো ফেললেন। জন্তুটাকে এবার স্পষ্ট দেখা গেল। নিদ্রিত থাংগুভেলুর থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে মাটির ওপর গুঁড়ি মেরে বসে রয়েছে শ্বাপদ। বসার ভঙ্গি দেখে স্পষ্টই বোঝা যায় সে থাংগুভেলুর উপর লাফিয়ে পড়ার উপক্রম করছে।

সাহেব রাইফেলের দিকে হাত বাড়ালেন। অস্ত্রটাতে গুলি ভরে পাশেই রেখে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রাইফেল বাগিয়ে ধরার আগেই হঠাৎ থাংগুভেলু ঘুমের ঘোরে উঠে বসল। তার পায়ের কাছে ছিল জলভরা ডেকচি, পায়ের ধাক্কা লেগে পাত্রটা সশব্দে নড়ে উঠল। সঙ্গেসঙ্গে জন্তুটা একলাফে অদৃশ্য হল অন্ধকার অরণ্যের গর্ভে। থাংগুভেলু অবশ্য ততক্ষণে আবার শুয়ে পড়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।

অ্যান্ডারসন এইবার হইহই করে সকলকে ডেকে তুললেন এবং প্যান্থারের উপস্থিতির কথা বললেন। কেউ তার কথা বিশ্বাস করতে চাইল না। প্রত্যেকেরই বিশ্বাস তিনি ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখেছেন।

অ্যান্ডারসনকে একটু ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে সকলেই আবার নিদ্রাদেবীর আরাধনায় মন দিল। সাহেবের আর ঘুম এল না। বাকি রাতটা তিনি রাইফেল হাতে জেগে রইলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস একটা মানুষখেকো প্যান্থারকেই তিনি দেখেছেন–জন্তুটা থাংগুভেলুকে আক্রমণের উদ্যোগ করছিল।

পরের দিন মাছ ধরার পালা। টাইনি কয়েকটা মাছ ধরল। অ্যান্ডারসন আর তার ছেলে ডোনাল্ড ওরফে ডন অনেকক্ষণ চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাদের ছিপে একটিও মাছ উঠল না। মারওয়ান বলল সে স্নান করতে যাচ্ছে। স্নানের ফলে যাতে মাছ ধরার বিঘ্ন না হয়, সেইজন্য যেখানে মাছ ধরা হচ্ছিল তার থেকে একটু দূরে, নদীস্রোত যেদিক থেকে আসছে, সেইদিকে চলল মারওয়ান কাঁধে একটি তোয়ালে নিয়ে।

অন্য কেউ বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক, গতরাত্রে প্যান্থারের উপস্থিতি সম্পর্কে অ্যান্ডারসন সাহেবের কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না এবং সেটা যে নরখাদক এ-বিষয়েও তিনি ছিলেন নিশ্চিত, অতএব তিনি মারওয়ানকে ডেকে বললেন, দাঁড়াও, আমিও আসছি।

হাতে রাইফেল আর কাঁধে রাইফেল নিয়ে মারওয়ানকে অনুসরণ করলেন কেনেথ অ্যান্ডারসন।

সেদিন বিকালের দিকে নদীর জলে বোমা ফাটার আওয়াজ শুনে অ্যান্ডারসন সাহেব ও তার দলবল শব্দ লক্ষ করে ছুটলেন। নদীর বাঁক ঘুরতেই মাছ চোরদের দুটি ডিঙি তারা দেখতে পেলেন। একটা ডিঙিতৈ মাছ বোঝাই, আর একটাতে কয়েকজন লোক অর্থাৎ চোরের দল। সাহেবদের দেখে চোররা ঘাবড়ে গেল, তাড়াতাড়ি দাঁড় বেয়ে তারা চম্পট দেওয়ার উপক্রম করল। কিন্তু অ্যান্ডারসনের সঙ্গীরা তাদের পালাতে দিল না, বন্দুক উঁচিয়ে ভয় দেখিয়ে তাদের তীরে ডিঙি ভেড়াতে বাধ্য করা হল। তারপর শুরু হল বাগযুদ্ধ। সাহেবের ছেলে ডন তাদের চৌর্যবৃত্তির জন্য তিরস্কার করল। চোরদের বক্তব্য হচ্ছে, মাছগুলো যখন কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, তখন মাছ ধরায় দোষ কী? সাহেবরাই-বা তাদের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছেন কোন অধিকারে? তারা কি সরকারের লোক? থাংগুভেলু এইসব আইনঘটিত প্রসঙ্গে যোগ দিল না, তার বক্তব্য হচ্ছে সবচেয়ে ভালো মাছ দুটি তাদের দিয়ে চোররা যেখানে খুশি যাক, তাদের গন্তব্য বিষয় নিয়ে শিকারিদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই।

অ্যান্ডারসন এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন, এবার বললেন, আচ্ছা, তোমরা বলতে পারো এই এলাকায় কোনো মানুষখেকো প্যান্থার আছে কি না?

বেশ কিছুক্ষণ সকলে স্তব্ধ। তারপর একজন মৃদুস্বরে বলল, হ্যাঁ, ভোরাই, আছে। জন্তুটা অনেক মানুষ মেরেছে। আমাদের দলেই কালু নামে একটি লোক তার কবলে মারা গেছে। কয়েকদিন আগে। আমরা তাই দিনের বেলায় মাছ ধরছি। আমরা চাঁদনি রাতেই মাছ ধরি। কিন্তু এখন সন্ধ্যার পর কেউ ঘরের বাইরে যেতে সাহস পায় না।

লোকটির কথা শুনে সাহেবের ছেলে ডন দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠল, চুলোয় যাক মাছ। আমরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করব না। আমাদের কাছে এই প্যান্থার সম্পর্কে সব কিছু খুলে বলো। আমরা শিকারি, জন্তুটাকে গুলি করে মারতে চেষ্টা করব।

লোকগুলো আশ্বস্ত হয়ে তীরে নামল। তারপর তাদের মুখ থেকে সাহেব এবং তার সঙ্গীরা প্যান্থারটির সম্পর্কে সব কিছু শুনলেন। সেসব কথা আগেই সবিস্তারে বলা হয়েছে, তাই এখানে আর পুনরাবৃত্তি করলাম না।

ঘটনার বিবরণ শুনে শিকারিদের সহানুভূতির সঞ্চার হল মা-প্যান্থারের উপর। বন্য শ্বাপদের এমন প্রতিহিংসা গ্রহণের প্রবৃত্তি বড়ো একটা হয় না। ব্যাঘ্র জাতীয় পশুরা অনেক সময় মানুষের অস্ত্রে আহত হলে নরভুক হয়, কিন্তু তার কারণ স্বতন্ত্র। আহত অবস্থায় দ্রুতগামী বলিষ্ঠ বন্য পশুদের হত্যা করতে অসমর্থ হয়ে বাঘ অথবা প্যান্থার মানুষের মতো দুর্বল শিকারের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেখানে প্রতিশোধ গ্রহণের মনোভাব থাকে না, অতি সহজে ক্ষুধা নিবারণের জন্যই তারা নরখাদকে পরিণত হয়।

কিন্তু এই মেয়ে-প্যান্থারটি মানুষকে হত্যা করে, মাংস খায় না। শুধু প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই সমগ্র মনুষ্যজাতির বিরুদ্ধে সে জেহাদ ঘোষণা করেছে! এমন ঘটনার কথা বড়ো একটা শোনা যায় না।

যাই হোক, মা-প্যান্থারের প্রতি সহানুভূতি থাকলেও শিকারিরা তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। জন্তুটা বেঁচে থাকলে বহু নিরপরাধ মানুষ তার কবলে মারা পড়বে। অতএব মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক ওই পশুকে হত্যা করাই শিকারির কর্তব্য বলে সকলে মনে করলেন।

শিকারিরা বড়ো জানোয়ার মারতে আসেননি, এসেছিলেন মাছ ধরতে। তবে মাছ ধরার সাজসরঞ্জাম ছাড়াও তাদের সঙ্গে দুটি রাইফেল আর দুটি শটগান ছিল। পরামর্শের ফলে স্থির হল টাইনি শটগান নিয়ে নদীর স্রোত অনুসরণ করে নদীতীর ধরে হাঁটবে ঘণ্টা দুই, তারপর ফিরে আসবে শিকারিদের আস্তানায়। মারওয়ান আর একটি শটগান নিয়ে নদীস্রোতের বিপরীত দিকে নদীতীরেই অনুসন্ধান করবে। অ্যান্ডারসন ও তার ছেলে ডন প্যান্থারের সন্ধান করবেন ভিন্ন ভিন্ন দিকে জঙ্গলের মধ্যে, তাদের হাতে থাকবে রাইফেল। থাংগুভেলু একটা গাছে উঠে জিপগাড়ি আর ছড়িয়ে-থাকা সরঞ্জামের উপর নজর রাখবে। স্থির হল, প্রত্যেকেই আস্তানায় ফিরবে বিকাল ৫টার মধ্যে।

ব্যাপারটা অবশ্য খুবই বিপজ্জনক। নদীর ধারে ঝোপঝাড় ও জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থেকে প্যান্থার খুব সহজেই শিকারির গতিবিধি লক্ষ করতে পারবে, কিন্তু শিকারির পক্ষে উদ্ভিদের আবরণ ভেদ করে জন্তুটার অস্তিত্ব আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। জন্তুটা নরহত্যা করতে উগ্রীব, প্রথম আক্রমণের সময়েই তাকে গুলি চালিয়ে বোড়ে ফেলতে না-পারলে শিকারি নিজেই শিকারে পরিণত হবে সন্দেহ নেই। দলের প্রত্যেকেই বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে থাকবে, অর্থাৎ নিজেরাই টোপ হয়ে শ্বাপদকে আকৃষ্ট করবে–অতর্কিত আক্রমণের ফলে বিপন্ন সঙ্গীকে সাহায্যের সুযোগ অন্য শিকারিরা পাবে না, তাই প্রত্যেক শিকারিকেই নির্ভর করতে হবে নিজের ক্ষমতার উপর। ভুল হলে মৃত্যু নিশ্চিত।

আগের রাতে একটা শম্বর হরিণের চিৎকার শুনেছিলেন অ্যান্ডারসন সাহেব। হরিণজাতীয় পশু অনেক সময় মাংসাশী শ্বাপদের অস্তিত্ব বুঝতে পারলে চিৎকার করে বনের অন্যান্য বাসিন্দাদের সাবধান করে দেয়। অতএব যেদিক থেকে বিগত রাত্রে শম্বর হরিণের চিৎকার সাহেবের কানে ভেসে এসেছিল, সেইদিকেই তিনি যাত্রা করলেন প্যান্থারের সন্ধানে।

পার্বত্য পথ বেয়ে এগিয়ে চললেন সাহেব। চারদিকে ছড়ানো বড়ো বড়ো পাথর, ঘন ঝোপঝাড়। ওই পাথর বা ঝোপের আড়ালে প্যান্থার লুকিয়ে থাকতে পারে অনায়াসে। কিছুদূর যাওয়ার পর ছেলে ডন এবং তার সঙ্গীদের নিরাপত্তা সম্পর্কে চিন্তিত হয়ে পড়লেন অ্যান্ডারসন। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই, তিনি আশা করলেন তারাও তাঁর মতোই সতর্কতা অবলম্বন করবে।

চারদিক নিস্তব্ধ। অসহ্য গরম। পাখিদের কলকণ্ঠ সম্পূর্ণ নীরব। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে করতে অগ্রসর হলেন সাহেব। সামনে বড়ো পাথর বা ঝোপঝাড় দেখলে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে কাছে আসছিলেন সাহেব, তবে তিনি জানতেন পিছন থেকেই বিপদের ভয় বেশি–কারণ, বাঘ অথবা প্যান্থার মানুষ মারতে অভ্যস্ত হলেও মানুষকে ভয় পায় এবং সেইজন্যই অধিকাংশ সময়ে তারা মানুষকে পিছন থেকে আক্রমণ করে। অতএব সাহেবকে ক্রমাগত থামতে হচ্ছিল, কখনো সামনে কখনো পিছনে তাকাতে তাকাতে খুব ধীরে ধীরে তিনি অগ্রসর হচ্ছিলেন। বাতাসের ধাক্কায় আন্দোলিত উদ্ভিদ এবং বৃক্ষশাখার মর্মরধ্বনি শুনে মাঝে মাঝে প্যান্থারের অস্তিত্ব কল্পনা করে রাইফেল তুলে ধরেন তিনি, একটু পরেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে আবার অস্ত্র নামিয়ে পদচারণা করেন–এইভাবে কিছুক্ষণ চলার পর অ্যান্ডারসন বুঝলেন তার স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ছে, একেবারে অনভিজ্ঞ নতুন শিকারির মতো আচরণ করছেন তিনি।

এইবার তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠলেন, নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে চললেন সামনে। আরও কিছুক্ষণ কাটল। কিছু ঘটল না। সাহেব মনে করলেন মাছ চোর প্যান্থারের ব্যাপারটা বাড়িয়ে বলেছে। নরঘাতিনী মেয়ে-প্যান্থারের অস্তিত্ব সম্পর্কে তিনি সন্দিহান হয়ে উঠলেন।

একটা পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠছিলেন অ্যান্ডারসন। একটু পরেই পাহাড়ের উপর উঠে তিনি নামতে শুরু করলেন ঘন বাঁশবনে ঘেরা একটি উপত্যকার দিকে…

কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর গাছের পাতা ঘর্ষণের শব্দ সাহেবের কানে এল, পরক্ষণেই গাছের ডাল ভাঙার আওয়াজ! শব্দের কারণ বুঝতে শিকারির কান ভুল করল না–গাছের পাতা আর ডালপালা দিয়ে উদর পূরণ করছে হাতি!

অ্যান্ডারসন থেমে গেলেন, যেদিক থেকে শব্দ আসছে সেইদিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন। ব্যাপারটা জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাতি যদি একক হয়, তাহলে কাছাকাছি মানুষ দেখলে আক্রমণ করতে পারে। একক হস্তী অধিকাংশ সময়ে দলছাড়া গুন্ডা হয়, মানুষ বা অন্য জন্তু দেখলে সে হত্যা করতে চায়। হাতির দল থাকলে বিশেষ ভয় নেই, মানুষ দেখলে তাদের সরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। শব্দ যেদিক থেকে আসছে, সাহেবের চলার পথটা গেছে সেইদিকেই। হাতিকে এড়াতে হলে ঘন বাঁশঝোপ আর কাটাবনে ঢুকতে হয়, আর সে-রকম জায়গায় ক্রুদ্ধ পান্থার বা হাতির সম্মুখীন হলে শিকারির সমূহ বিপদ–তাই সোজা রাস্তা ধরেই এগিয়ে চললেন সাহেব।

সাহেবের পিছন দিক থেকে জোর হাওয়া আসছিল। সামনে গাছের ডালপালা ভাঙার আওয়াজ হঠাৎ থেমে গেল। সাহেব কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। চারদিক স্তব্ধ। অর্থাৎ হাতিও বাতাসে গন্ধ পেয়ে আহারে ক্ষান্ত হয়েছে। এখন হয় সে নিঃশব্দে সরে গেছে, অথবা মানুষটাকে চাক্ষুষ দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।

এই প্রকাণ্ড জন্তুগুলো নিঃশব্দে চলাফেরা করতে পারে, কিন্তু জঙ্গল সেখানে এমন ঘন যে, সেই নিবিড় উদ্ভিদের আবরণের ভিতর দিয়ে চলতে গেলে সামান্য একটু শব্দ হবেই হবে–সাধারণ মানুষের কান সেই তুচ্ছ শব্দের কারণ ধরতে না-পারলেও অভিজ্ঞ শিকারি সেই শব্দ থেকেই গজরাজের চলাচেলের সংবাদ জানতে পারবেন। কোনো শব্দ কানে না-আসায় সাহেব বুঝলেন হাতি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। বাতাস নিশ্চয়ই তার কাছে নিকটবর্তী মানুষের সংবাদ পৌঁছে দিয়েছে হাতির ঘ্রাণশক্তি অতিশয় প্রবল।

আরও দশ মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন সাহেব। হাতি নড়ল না। বোধ হয় ভাবছিল দু-পেয়ে আপদটা বিদায় না-হওয়া পর্যন্ত নিঃশব্দে অপেক্ষা করাই ভালো।

অবশেষে সাহেবের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। হাতিটাকে ভয় দেখানোর জন্য জোরে শিস দিতে দিতে তিনি সামনে এগিয়ে চললেন সামনের পথ ধরে। ফল হল তৎক্ষণাৎ। অবশ্য সাহেব যা আশা করেছিলেন তা হল না–হাতি স্থানত্যাগ করল বটে, কিন্তু পিছন ফিরে পালাল না, ক্রোধে চিৎকার করতে করতে ছুটে এল সাহেবের দিকে! ঘন জঙ্গল ভেদ করে মুহূর্তের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করল একটা প্রকাণ্ড মাথা আর হত্যার আগ্রহে উদ্যত একজোড়া সুদীর্ঘ গজদন্ত!

মহা মুশকিল! ওই এলাকায় কোনো গুন্ডা হাতির অস্তিত্ব সরকার থেকে ঘোষণা করা হয়নি। জন্তুটাকে গুলি করে মারলে বন বিভাগ অ্যান্ডারসনকে নিয়ে টানাটানি করবে আর তার ফলে সাহেবের দুর্গতির সীমা থাকবে না। দৌড়ে পালাতে গেলে মৃত্যু অনিবার্য, কারণ ক্রুদ্ধ হস্তী তাহলে নির্ঘাত সাহেবকে অনুসরণ করে ধরে ফেলবে এবং হত্যা করবে–দৌড়ের প্রতিযোগিতায় মানুষের পক্ষে হাতিকে হারিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য গুলি চালিয়ে হাতির হাঁটু ভেঙে দিয়ে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, কিন্তু তাহলে জন্তুটা দিনের পর দিন অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করবে–অনর্থক জানোয়ারকে কষ্ট দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না অ্যান্ডারসন সাহেব।

হ্যাঁ, আর একটা উপায় আছে, আর সেই উপায়ই অবলম্বন করলেন সাহেব। শূন্যে রাইফেল তুলে আওয়াজ করতেই হাতি চমকে থেমে গেল। তার পায়ের ধাক্কায় রাশি রাশি ঝরাপাতা আর ধুলোর ঝড় উড়ল চারদিকে। সাহেব সামনে এগিয়ে এসে আবার রাইফেলের আওয়াজ করলেন।

এইবার গজরাজ ভয় পেল। ক্রুদ্ধ বৃংহন-ধ্বনির পরিবর্তে তার কণ্ঠে জাগল ভয়ার্ত চিৎকার। ছোট্ট বেঁটে লেজটা পিছনের দুই পায়ের ফাঁকে গুটিয়ে সে দ্রুতবেগে পলায়ন করল।

সব দিক রক্ষা পাওয়ায় খুশি হলেন সাহেব। হাতি বাঁচল, তিনিও বাঁচলেন। কিন্তু নিজের উপর তিনি বিরক্ত। চুপচাপ আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে হাতিটা নিশ্চয়ই চলে যেত। রাইফেলের আওয়াজ শুনে খুনি প্যান্থার আর এদিকে আসবে না। মাত্র আধঘণ্টা হল তিনি আস্তানা ছেড়ে বনের মধ্যে এসেছেন, এখন আর এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে কি? প্যান্থারের সাক্ষাৎ আজ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কিছুক্ষণ চিন্তার পর সাহেব আবার অগ্রসর হলেন। অন্তত মিনিট দশের মধ্যে প্যান্থার, হাতি বা অন্য কোনো হিংস্র জানোয়ারের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই; রাইফেলের শব্দে কাছাকাছি যেসব পশু ছিল, তারা নির্ঘাত দূরে সরে পড়েছে। পদে পদে চারদিকে নজর রাখার দরকার আর ছিল না, তাই খুব কম সময়ের মধ্যেই ঘন বাঁশবন পেরিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় তিনি পৌঁছে গেলেন। এখানে রয়েছে বাবুল, বোরাম, ছোটো ছোটো তেঁতুল গাছ এবং মাটির ওপর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে লম্বা লম্বা ঘাস আর ঘাস। পায়ে চলা যে-পথ ধরে সাহেব এগিয়ে চলছিলেন, সেই পথটা বিস্তীর্ণ ঘাসের সমুদ্রে হারিয়ে গেছে, তার পরিবর্তে এখানে-ওখানে তৃণাবৃত প্রান্তর ভেদ করে আত্মপ্রকাশ করেছে আরও অনেকগুলো ছোটো ছোটো পায়ে-চলা পথ। হরিণদের পায়ে পায়ে ওই পথগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। জায়গাটা পরীক্ষা করে অ্যান্ডারসন বুঝলেন তিনি হরিণদের প্রিয় বাসভূমিতে এসে পড়েছেন। মাংসাশী পশুর প্রিয় খাদ্য হচ্ছে হরিণ–সুতরাং সাহেবের আশা হল এইখানে খুনি প্যান্থার হয়তো হানা দিতে পারে।

সাহেব আরও একটু এগিয়ে গেলেন। হঠাৎ তার কানে এল পাখির ডাকের মতো এক বিচিত্র শব্দ! শব্দের তরঙ্গ আসছে তারই দিকে! না, ওগুলো পাখির ডাক নয়–বুনো কুকুর! একপাল বুনো কুকুর কোনো হতভাগ্য শিকারকে তাড়া করে সাহেবের দিকেই ছুটে আসছে।

সাহেব তাড়াতাড়ি একটা ছোটো তেঁতুল গাছের আড়ালে সরে দাঁড়ালেন।

ভারতীয় বুনো কুকুর অতি ভয়ংকর জীব। বনের সব জানোয়ারই তাকে ভয় পায়। এই কুকুরগুলো দল বেঁধে শিকার করে। কোনো হরিণের পিছনে যদি বুনো কুকুরের দল তাড়া করে, তবে আর রক্ষা নেই। যতই দ্রুতগামী হোক পলাতক হরিণ একসময়ে ধরা পড়বেই, আর কুকুরগুলো তাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে খাবে।

গাছের ডালপালার ওপর শিং-এর ঘষা লাগার আওয়াজ শুনতে পেলেন সাহেব, সঙ্গেসঙ্গে জঙ্গল ভেদ করে তার সামনে আত্মপ্রকাশ করল একটি সুন্দর শম্বর হরিণ। তার মুখ থেকে ফেনা ঝরে পড়ছে, কাঁধের ওপরও জড়িয়ে রয়েছে মুখের ফেনা, আর তার দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেছে দারুণ আতঙ্কে! হরিণটা থামল না, তিরবেগে ছুটে পালাতে লাগল।

আচম্বিতে জাগল বজ্রপাতের মতো ভীষণ গর্জনধ্বনি, পরক্ষণেই ডোরাকাটা একটা শরীর শূন্যপথে উড়ে এসে পড়ল ধাবমান শম্বরের পিঠের উপর!

একটা বাঘ শিকারের খোঁজে হরিণদের বিচরণ ভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সে কুকুরের চিৎকার নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছিল এবং তারা যে শিকার তাড়িয়ে নিয়ে আসছে সেটাও বুঝতে পেরেছিল। সাধারণত বাঘ বুনো কুকুরদের এড়িয়ে চলে, এই বাঘটাও হয়তো তাই করত কিন্তু হরিণটা তার কাছে এসে পড়ায় সে লোভ সামলাতে পারেনি, শিকারের পিঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

বাঘের ঘ্রাণশক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। সে নিশ্চয়ই সাহেবের অনেক আগেই কুকুরগুলোর চিৎকার শুনতে পেয়েছিল এবং উৎকর্ণ হয়ে শব্দের গতি নির্ণয় করছিল, সেইজন্য সাহেবের মৃদু পদধ্বনি তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করেনি।

বাঘের গুরুভার দেহ হঠাৎ পিঠের ওপর পড়তেই শম্বরের পিঠ বেঁকে গেল, তার কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এল ভয়ার্ত চিৎকার, তারপরই দুটি জানোয়ার জড়াজড়ি করে পড়ে গেল মাটির উপর। লম্বা লম্বা ঘাসের আঁড়ালে ভূপতিত পশু দুটিকে আর দেখতে পাচ্ছিলেন না সাহেব কিন্তু মেরুদণ্ড ভাঙার আওয়াজ এবং শক্ত মাটিতে খুরের সংঘাতজনিত শব্দ শুনে বুঝলেন বাঘ তার শিকারকে হত্যা করছে, মাটির ওপর মৃত্যুকালীন আক্ষেপে পা ঠুকছে মরণাহত হরিণ।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে অকুস্থলে উপস্থিত হল একপাল বুনো কুকুর!

সাহেব যেখানে আত্মগোপন করেছিলেন, সেখান থেকে ঘাসের আড়ালে উপবিষ্ট বাঘকে তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না। সে মৃত শিকার আগলে রেখে কুকুরগুলোকে তাড়াবার জন্য ভীষণ গর্জনে বন কাঁপাতে লাগল। সেইসঙ্গে কাঁপতে লাগল সাহেবের বুক। কিন্তু কুকুরের দল নির্বিকার!

অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের চমক সামলে নিয়ে কুকুরগুলো মৃত হরিণ আর বাঘকে ঘিরে ফেলল। সাহেব গুনে দেখলেন দলে রয়েছে নয়টি কুকুর।

হঠাৎ কুকুরগুলোর কণ্ঠস্বর বদলে গেল, পাখির ডাকের মতো তীক্ষ্ণ কলধ্বনির পবির্তে তাদের কণ্ঠে জাগল এক করুণ ও বিলম্বিত শব্দের তরঙ্গ! শিকারি অ্যান্ডারসনের কাছে ওই পরিবর্তিত কণ্ঠস্বরের অর্থ অজানা ছিল না–কুকুরগুলো এখন তারস্বরে সাহায্য চাইছে। জাতভাইদের কাছে।

প্রবল শত্রুর বিরুদ্ধে ওই সাহায্য প্রার্থনা কখনো বিফল হয় না। আশেপাশে অবস্থিত প্রত্যেকটি বুনো কুকুর ওই করুণ কণ্ঠের আহ্বান শুনলেই ছুটে আসবে। অরণ্যের সারমেয় সমাজে এটাই। হল অলিখিত আইন। এই আইন মেনে চলে প্রত্যেকটি বনবাসী কুকুর।

বাঘ এতক্ষণ লম্বা লম্বা ঘাসের আড়ালে গুঁড়ি মেরে পড়ে ছিল, এবার সে উঠে দাঁড়াতেই তার সমগ্র শরীর সাহেবের দৃষ্টিগোচর হল। ধীরে ধীরে দেহ ঘুরিয়ে সে শত্রুপক্ষের সংখ্যা নির্ণয় করল। তার মুখ তখন ক্রোধে বিকৃত হয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, হিংস্র দন্ত বিস্তার করে সে ভীষণ শব্দে গর্জন করছে এবং তার দীর্ঘ লাঙ্গুল পাক খাচ্ছে দেহের দু-পাশে বারংবার! অভিজ্ঞ শিকারি অ্যান্ডারসন লেজ নাড়ানোর ভঙ্গি দেখে বুঝলেন বাঘ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ, কিন্তু সে ভয় পেয়েছে এ-কথাও সত্যি।

কুকুরগুলো বাঘের ভীতি প্রদর্শনে বিচলিত হল না, তারা একটানা বিষণ্ণ স্বরে চিৎকার করে সাহায্য চাইতে লাগল। অরণ্যের বুকে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে বাজতে লাগল ব্যাঘ্রের ভৈরব গর্জন আর সারমেয় বাহিনীর উৎকট ঐকতান!

বাঘ বুঝল যত দেরি হচ্ছে, ততই তার বিপদ বাড়ছে। হঠাৎ দুই লাফে এগিয়ে গিয়ে বাঘ তার সামনে দাঁড়ানো কুকুরটাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হল। আক্রান্ত কুকুর চটপট সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করল। বাঘের পিছনে যে কুকুরগুলো ছিল তারা এগিয়ে এল বাঘকে আক্রমণ করতে। বাঘ এইরকমই অনুমান করেছিল, চকিতে পিছন ফিরে সে ডাইনে-বাঁয়ে থাবা চালাল বিদ্যুদবেগে। কুকুরগুলো তাড়াতাড়ি আর থাবার নাগাল থেকে সরে গেল, শুধু একটি কুকুর একটু দেরি করে ফেলল–

সনখ থাবার প্রচণ্ড আঘাতে কুকুরটা ঠিকরে শূন্যে উঠে গেল এবং তার দেহ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল পিছনের একটি পা!

কুকুরগুলো আবার পিছন থেকে বাঘকে আক্রমণ করল। আবার ঘুরে দাঁড়াল বাঘ, আবার তার সামনে থেকে সরে গেল কুকুরের দল আর বাঘ যখন আক্রমণকারী কুকুরদের সামলাতে ব্যস্ত, সেই সময়ে পিছন থেকে আর দু-পাশ থেকে অন্য কুকুরগুলো ছুটে এল কামড় বসাতে।

বাঘ একপাশে ঘুরল, তারপর আশ্চর্য কৌশলে দিক পরিবর্তন করে পিছন থেকে তেড়ে আসা কুকুরদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শত্রুর এমন অভাবনীয় আচরণের সম্ভাবনা কুকুররা কল্পনা করতে পারেনি। সরে যাওয়ার আগেই বাঘের প্রচণ্ড দুই থাবা দুটো কুকুরকে মাটির উপর পেড়ে ফেলল। একটা আহত কুকুর তার বিদীর্ণ উদর নিয়ে অতিকষ্টে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই বাঘ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দাঁত বসিয়ে দিল।

শত্রুপক্ষকে বাঘ প্রায় বিধ্বস্ত করে এনেছিল, কিন্তু আহত কুকুরটাকে কামড়াতে গিয়েই সে ভুল করল। মুহূর্তের মধ্যে অন্যান্য কুকুরগুলো তাকে পিছন থেকে ও দু-পাশ থেকে ছেকে ধরল এবং কামড়ের পর কামড় বসিয়ে শরীর থেকে মাংস তুলে নিতে লাগল।

বাঘের ঘন ঘন গর্জনে বন কাঁপতে লাগল, কিন্তু এখন তার গর্জনে ভয়ের আভাস ফুটে উঠল

বাঘ হাঁপাচ্ছে। তার নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত। কুকুরের দল বিশ্রামে রাজি নয়। তারা নতুন উদ্যমে আক্রমণ শুরু করল চিৎকার করতে করতে। বাঘ আবার গর্জে উঠল কিন্তু তার গর্জনে তেমন জোর নেই। যুদ্ধের আগ্রহ তার কমে এসেছে। সে এখন দস্তুরমতো শঙ্কিত!

আচম্বিতে ব্যাঘ্র গর্জন আর সারমেয় কণ্ঠের ঐকতান ডুবিয়ে দিয়ে ভেসে এল এক নতুন শব্দের তরঙ্গ! দূর থেকে ভেসে আসছে বহু কুকুরের কণ্ঠস্বর–একদিক থেকে নয়, বিভিন্ন দিক থেকে এবং একইসঙ্গে!

সাহায্যের আশ্বাস! দলে দলে বুনো কুকুর ছুটে আসছে যুদ্ধে যোগদান করতে।

নাজেহাল বাঘ আর দাঁড়াল না। সভয়ে লেজ গুটিয়ে সে দৌড় দিল রণক্ষেত্র ত্যাগ করে। কুকুরগুলো নাছোড়বান্দা ক্লান্ত ও আহত দেহ নিয়েই তারা বাঘের অনুসরণ করল। দেখতে দেখতে সাহেবের চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল পলাতক বাঘ আর অনুসরণকারী ছয়টি কুকুরের দল…

কিছুক্ষণ পরেই সাহায্যকারী কুকুরগুলো অকুস্থলে এসে পড়ল। প্রথমে পাঁচ, পরে আরও বারোটি কুকুর সেইখানে উপস্থিত হল। নিহত তিনটি কুকুরের দেহ থেকে ঘ্রাণ গ্রহণ করতে করতে নবাগত কুকুরের দল হঠাৎ ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, তারপর ছুটে চলল সেই পথে, যে-পথ দিয়ে পালিয়েছে বাঘ এবং তার অনুসরণকারী ছয়টি কুকুর।

সব মিলিয়ে এখন প্রায় চব্বিশটি কুকুর বাঘের পিছু নিয়েছে। সাহেব বুঝলেন বাঘের আর নিস্তার নেই। কুকুরের দল একসময় বাঘকে ধরে ফেলবেই ফেলবে, তারপর সকলে মিলে তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। বাঘকে শেষ করে ফিরে এসে কুকুরগুলো হরিণটাকেও যে খেয়ে ফেলবে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই।

অ্যান্ডারসন তার আস্তানায় ফিরে এসে দেখলেন টাইনি ফিরে এসেছে। একটু পরে এসে পড়ল মারওয়ান। তারা কেউ কিছু দেখেনি বা শোনেনি। বেশ দেরি করে এল সাহেবের ছেলে ডন। সে একটা প্যান্থারের পায়ের ছাপ দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। কিছুক্ষণ বনের পথে চলতে চলতে একটা গুহা তার চোখে পড়ে। গুহার মধ্যে প্যান্থর থাকতে পারে ভেবে সে কয়েকটা ঢিল ছুঁড়ে মারে। তার আশা ছিল ঢিল খেয়ে গুহার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে প্যান্থার। হ্যাঁ, বেরিয়ে এসেছিল বটে কিন্তু প্যান্থার নয়, এক ভল্লুকী! তার পিঠে ছিল দু-দুটো বাচ্চা! ভল্লুকী বাচ্চা নিয়ে অন্ধের মতো ছুটতে ছুটতে অরণ্যগর্ভে অদৃশ্য হল, ডনকে সে দেখতে পায়নি। ভাগ্যিস দেখেনি, মানুষ দেখলে হয়তো সে আক্রমণ করত আর আত্মরক্ষার জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে গুলি করতে বাধ্য হত ডন।

ভল্লুক পরিবারের সঙ্গে প্যান্থারের সহাবস্থান অসম্ভব, অতএব অনুসন্ধানপর্বে ইস্তফা দিয়ে আস্তানায় ফিরে এসেছিল ডোনাল্ড ওরফে ডন।

বনের মধ্যে অ্যান্ডারসন সাহেবের অভিজ্ঞতার কাহিনি শুনে সবাই তো অবাক। বাঘ আর কুকুরের লড়াইয়ের ঘটনা সকলকেই আকৃষ্ট করল। আশ্চর্যের বিষয় হল যে, হাতিকে ভয় দেখানোর জন্যে সাহেবের গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ কেউ শুনতে পায়নি।

রাতে শুতে যাওয়ার আগে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা হল। ঠিক হল দু-ঘণ্টা পর পর পালা কবে সবাই পাহারা দেবে। চটপট রাতের খানা শেষ করে সকলে গল্পগুজব আরম্ভ করল। একসময় কথাবার্তা থেমে গেল, সকলের চোখে নামল তন্দ্রার আবেশ। পালা অনুসারে প্রথম দু-ঘণ্টা পাহারা দেবে থাংগুভেলু, তারপর মারওয়ান, তারপর অ্যান্ডারসন সাহেব স্বয়ং অ্যান্ডারসনের পরে যথাক্রমে ডোনাল্ড আর টাইনি।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে অ্যান্ডারসন শুনতে পেলেন পাহাড়ের উপর থেকে ভেসে আসছে। বাঘের গর্জন। তার মনে হল যে-বাঘটিকে কুকুরের দল তাড়া করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত নিশ্চয়ই হত্যা করেছিল, সেই নিহত বাঘের সঙ্গিনীই পাহাড়ের উপর গর্জন করে ফিরছে…

নির্দিষ্ট সময়ে সাহেবকে ঘুম থেকে তুলে মারওয়ান বলল, একটা প্যান্থারকে সে শিকারিদের আস্তানার পিছনে পাহাড়টার উপর থেকে ডাকতে শুনেছে। আওয়াজ আসছিল অনেক দূর থেকে। হ্যাঁ, আরও একটা কথা তার মনে পড়ছে–একটা পাখি, সম্ভবত বনমোরগ, শিকারিদের শয্যার খুব কাছ থেকে হঠাৎ চিৎকার করতে করতে পাখা ঝটপটিয়ে উড়ে গেছে। ব্যাপাটা এত তুচ্ছ যে, সে ঘটনাটার কথা উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিল।

মারওয়ান শুয়ে পড়ল। অ্যান্ডারসন তাকে কিছু বললেন না, কিন্তু বনমোরগের ব্যাপারটা তার কাছে আদৌ তুচ্ছ মনে হয়নি। পাখিটা হঠাৎ চিৎকার করে অন্ধকারের মধ্যে উড়ে গেল কেন? সে নিশ্চয়ই দিনের আলো থাকতে থাকতে রাতের নিরাপদ আশ্রয় হিসাবে ওই জায়গাটাকে বেছে। নিয়েছিল। কোনো বিপদের সম্ভাবনা না-থাকলে পাখিটা রাতের অন্ধকারে অনিশ্চিত আশ্রয়ের জন্য অন্ধের মতো স্থানত্যাগ করে ছোটাছুটি করবে না। এই বিপদটা হয়তো শিকার-সন্ধানী পাইথন, বনবিড়াল বা ভাম হতে পারে এমনকী ক্ষুধার্ত কোনো প্যান্থারের উপস্থিতি অসম্ভব নয়। হরিণ, শুয়োর প্রভৃতি জানোয়ার প্যান্থারের প্রিয় খাদ্য হলেও পক্ষিমাংসে তার অরুচি নেই।

ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে করতে সাহেবের মনে হল নরঘাতিনী মেয়ে-প্যান্থারটাকে দেখেও পাখিটা ভয় পেয়ে থাকতে পারে। আগের রাতে ওই প্যান্থারটাই যে নিদ্রিত শিকারিদের আস্তানায় হানা দিতে এসেছিল সে-বিষয়ে সাহেবের সন্দেহ ছিল না কিছুমাত্র। জন্তুটার মনুষ্যজাতির ওপর যেরকম বিদ্বেষ, আজ রাতেও নিদ্রিত শিকারিদের উপর তার হামলার সম্ভাবনা আছে বলেই সাহেবের মনে হল। অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে আরও একটা কাঠ তিনি ফেলে দিলেন, আলোটা জোর হলে নজর রাখার সুবিধা হবে। তারপর নদীর ধারে একটা মস্ত গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে রাইফেল বাগিয়ে বসলেন।

পিছনে নদী, পৃষ্ঠরক্ষা করছে গাছের গুঁড়ি–অতএব পিছন থেকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। নিশ্চিন্ত হয়ে পাহারা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন অ্যান্ডারসন…

রাত দুটো বাজল। তখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। পিছন থেকে ভেসে আসছে নদীর কল্লোলধ্বনি। মাঝে মাঝে জলচর জীবের সশব্দ আলোড়ন… মাছ, অথবা কুমির হওয়াটাও বিচিত্র নয়। বিপরীত দিকে নদীকূল থেকে ভেসে এল রাতচরা সারসের বিষণ্ণ চিৎকার। তারার মালায় সাজানো অন্ধকার আকাশের পটে আরও অন্ধকার এক উড়ন্ত ছায়া কয়েক মুহূর্তের জন্য সাহেবের দৃষ্টিপথে ধরা দিয়ে অদৃশ্য হল। অন্ধকারেও ওই উড়ন্ত ছায়ার স্বরূপ নির্ণয় করতে ভুল করেননি শিকারি, ওটা হর্নড় আটল নামক অতিকায় পেঁচা। ওই পাখি রাতের শিকারি, অন্ধকারে খরগোশ ও অন্যান্য ছোটোখাটো জীবজন্তু মেরে খায়।

পেচক অন্তর্ধান করার পরেই কাঠের ওপর করাত চালানোর মতো একটা কর্কশ চাপা আওয়াজ সাহেবের কানে এল। জলকল্লোল ভেদ করে ওই অস্পষ্ট আওয়াজ আলাদা করে ধরার মতো শ্রবণশক্তি এবং ওই শব্দের তাৎপর্য উপলব্ধি করার মতো শিক্ষা সকলের নেই কিন্তু অভিজ্ঞ শিকারি কেনেথ অ্যান্ডারসন বুঝলেন শব্দটা এসেছে প্যান্থারের গলা থেকে! অর্থাৎ মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে ঘাতিনী!

আবার, আবার সেই মৃদু অথচ ভীতিপ্রদ শব্দ। এবারে খুব কাছে। নিদ্রিত মানুষগুলোর পিছনেই একটা ঘন ঝোপ থেকে শব্দ এসেছে। আক্রমণের মুখে সাহস সঞ্চয় করার জন্যই জন্তুটা চাপা গলায় গর্জন করছে। এখনই সে আক্রমণ করবে সন্দেহ নেই। শ্বাপদের উদ্দেশ্য বুঝলেও সাহেব টর্চের বোম টিপলেন না। কারণ সামনের ঝোপটাকে একটা নিরেট অন্ধকারের ভ্রুপের মতো লাগছিল, প্যান্থারকে সাহেব তখনও দেখতে পাচ্ছিলেন না। যদি এই মুহূর্তে সে ঝোপের আড়ালে থাকে, তাহলে আলো জ্বাললেও সাহেব তাকে দেখতে পাবেন না কিন্তু জন্তুটা তাকে দেখেই চম্পট দেবে, তাকে গুলি করার আর সম্ভাবনা থাকবে না। সুতরাং সাহেব আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে চাইলেন।

কিন্তু প্যান্থার অপেক্ষা করতে রাজি হল না। আক্রমণের পূর্ব মুহূর্তে প্যান্থার যেরকম তীব্র ও ছোটো গর্জনে তার অস্তিত্ব জানিয়ে দেয়, ঠিক সেইভাবে গর্জন করে জন্তুটা একলাফে ঝোপ থেকে বেরিয়ে নিদ্রিত শিকারিদের কাছাকাছি এসে পড়ল। আর একটি লাফ দিলেই সে এসে পড়বে মানুষগুলোর ওপর।

ঠিক এই সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন সাহেব। টর্চের আলোকরেখা অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে নির্দিষ্ট নিশানাকে সাহেবের দৃষ্টিগোচর করে দিল–নিক্ষিপ্ত আলোকে জ্বলে উঠল প্যান্থারের দুই চক্ষু!

হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে জন্তুটা থমকে গেল, সাহেব রাইফেলের নিশানা স্থির করে ট্রিগার টিপতে উদ্যত হলেন

আচম্বিতে একটা প্রচণ্ড শব্দ! তারপরই আর একটা!

সঙ্গেসঙ্গে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল সাহেবের ছেলে ডন, জানিয়ে দিল বাবা গুলি ছোঁড়ার আগেই তার রাইফেল ঘাতিনীকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিয়েছে।

জন্তুটা তখনও মরেনি। খুব ধীরে ধীরে সে শ্বাস টানছিল, তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠে প্রকাশ করছিল প্রাণশক্তির শেষ স্পন্দন।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সেই স্পন্দনও স্তব্ধ হয়ে যায়। মৃত্যুবরণ করল ঘাতিনী।

মা-প্যান্থারের মৃত্যুতে খুশি হননি সাহেব। তবে সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে ছেলের কৃতিত্ব তাকে মুগ্ধ করেছিল।

বাস্তবিক, ঘুম-জড়ানো চোখে অন্ধকারের মধ্যে অব্যর্থ সন্ধানে লক্ষ্য ভেদ করার ক্ষমতা কয়জনের থাকে?

[১৩৮৭]

টারজানের প্রতিদ্বন্দ্বী

হুঁ, তুমি! তোমার নাম ম্যাকফারলেন?

মুখ তুলে প্রশ্ন করলেন মি. স্কেটন।

তার সামনে যে অপরূপ মূর্তিটি দাঁড়িয়ে ছিল, তার চেহারাটা সত্যি দর্শনীয় বস্তু। রোগাও নয়, মোটাও নয়, লম্বা একহারা শরীর, মাথা ভরতি আগুনের মতো লাল টকটকে আঁকড়া চুল, চুলের নীচে একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ ছাড়া মুখের কোনো অংশ দৃষ্টিগোচর হয় না, কারণ চোখ দুটি ছাড়া লোকটির সমস্ত মুখের ওপর বাঁধা আছে পুরু কাপড়ের আস্তরণ বা ব্যান্ডেজ।

মি. স্কেটনের প্রশ্নের উত্তরে আগুন্তুক বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার নাম ম্যাকফারলেন।

স্কেটন বললেন, তোমার কথা আমি শুনেছি। তুমি নাকি জেল খেটেছ? যাই হোক, ভালোভাবে যদি বাঁচতে চাও আমি তোমাকে সুযোগ দিতে পারি। হুঁ, আর একটা কথা–পাথর ভাঙার কাজ সম্পর্কে তোমার কোনো অভিজ্ঞতা আছে?

পুরু কাপড়ের তলা থেকে ভেসে এল অস্ফুট হাস্যধ্বনি, আজ্ঞে হ্যাঁ, পাথর ভাঙার কাজই তো করেছি।

ম্যাকফারলেন তার জামা গুটিয়ে ডান হাতখানা তুলে ধরলে মি. স্কেটনের সামনে মি. স্কেটন দেখলেন তার বাহু বেষ্টন করে ফুলে উঠেছে দড়ির মতো পাকানো মাংসপেশি!

স্কেটন মুখে কিছু বললেন না, কিন্তু বুঝলেন ওই হাতের মালিক অসাধারণ শক্তির অধিকারী।

ম্যাকফারলেন বললে, শুধু পাথর ভাঙা নয়, আমি একটু থেমে সে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাইল স্কেটনের দিকে, আমি ভালো লড়াই করতেও জানি।

বেশ, বেশ, স্কেটন বললেন, তোমার মুখখানা দেখে সে-কথাই মনে হচ্ছে আমার। অত বড়ো একটা ব্যান্ডেজ কেন বাঁধতে হয়েছে সে-কথা আমি জানতে চাইব না, আমি শুধু বলব ম্যাকফারলেন! যদি ভালোভাবে বাঁচতে চাও তবে তোমাকে সেই সুযোগ দিতে আমার আপত্তি নেই। তোমাকে আমি কাজে বহাল করলুম। এখন যাও।

ম্যাকফারলেনের দুই চোখ ঝকঝক করে উঠল, হাত তুলে সে মি. স্কেটনকে অভিবাদন জানাল, তারপর তার দীর্ঘ দেহ অদৃশ্য হয়ে গেল তাঁবুর দ্বারপথে।

উত্তর ক্যানাডার দুর্ভেদ্য জঙ্গল ও ঝোপঝাড় ভেঙে তৈরি হচ্ছিল একটা পথ। যে দলটা ওই রাস্তা তৈরির কাজে নিযুক্ত হয়েছিল, মি. স্কেটন সেই দলের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক।

পাথর ভেঙে রাস্তা তৈরির কাজ করতে যে লোকগুলো এগিয়ে এসেছিল, তারা বিলক্ষণ কষ্টসহিষ্ণু–তবে দলের সবাই যে খুব শান্তশিষ্ট ভালোমানুষ ছিল তা নয়। মারপিট দাঙ্গাহাঙ্গামা মাঝে মাঝে লাগত। মি. স্কেটন জানতেন ওটুকু সহ্য করতেই হবে। দারুণ ঠান্ডার মধ্যে পাথর। ভেঙে যারা জীবিকা নির্বাহ করতে এসেছে, তাদের কাছে একেবারে শান্তশিষ্ট ভদ্রলোকের মতো ব্যবহার আশা করা যায় না। তবু যথাসম্ভব গোলমাল এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন মি. স্কেটন। তাই যেদিন তিনি শুনলেন ম্যাকফারলেন নামে একজন জেলখাটা কয়েদি তার কাছে কাজ চাইতে এসেছে, সেদিন তিনি একটু অস্বস্তি বোধ করলেন। অবশ্য মি. স্কেটন জানতেন অপরাধীকে ভালোভাবে বাঁচার সুযোগ দিলে অনেক সময় তার চরিত্র সংশোধিত হয়–স্বভাব-দুবৃত্তদের কথা অবশ্য আলাদা, তারা সুযোগ পেলেই সমাজবিরোধী কাজকর্ম অর্থাৎ চুরি ডাকাতি খুন প্রভৃতি দুষ্কার্যে লিপ্ত হয়। কিন্তু ম্যাকফারলেনের কথাবার্তা শুনে স্কেটনের মনে হল লোকটি স্বভাব-দুবৃত্ত নয়, ভালোভাবে বাঁচার সুযোগ পেলে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে সে কুণ্ঠিত হবে না। সেইজন্যই ম্যাকফারলেনকে কাজে বহাল করলেন মি. স্কেটন।

স্কেটনের অনুমান ঠিক হয়েছিল কিনা জানতে হলে পরবর্তী ঘটনার বিবরণ জানা দরকার। সে-কথাই বলছি…

ম্যাকফারলেন যখন মি. স্কেটনের কাজে বহাল হল, তখন শীতের মাঝামাঝি। আবহাওয়া খুবই কষ্টকর। ক্যানাডা অঞ্চলে শীতকালে ঝড় হয়। ঝড়বৃষ্টির জন্য অনেক সময় সাময়িকভাবে কাজকর্ম বন্ধ রাখা হত। রাস্তা তৈরির কাজে যে লোকগুলো নিযুক্ত হয়েছিল তারা সেই সময় ভিড় করত ব্যায়ামাগারের মধ্যে। ব্যায়ামাগারটি তৈরি করে দিয়েছিলেন মি. স্কেটন দলের লোকদের জন্য। নানা ধরনের খেলা হত সেখানে। তবে দলের লোকদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল বক্সিং বা মুষ্টিযুদ্ধ। স্কেটনের দলভুক্ত শ্রমিক ছাড়া অন্যান্য লোকজনও আসত মুষ্টিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে।

সেদিন রবিবার। ব্যায়ামাগারের মধ্যে মুষ্টিযুদ্ধের আসর জমছে না। লাল পোশাক গায়ে চড়িয়ে দস্তানা পরিহিত দুই হাত তুলে সগর্বে পদচারণা করছে একটি বলিষ্ঠ মানুষ এবং চারপাশে দণ্ডায়মান জনতার দিকে তাকিয়ে গর্বিত কণ্ঠে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে বার বার। কিন্তু তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসছে না কোনো প্রতিযোগী–এর আগে যে কয়জন তার সামনে মোকাবেলা করতে এসেছিল তারা সবাই বেদম মার খেয়ে কাবু হয়ে পড়েছে।

লোকটি শুধু শক্তিশালী নয়, মুষ্টিযুদ্ধের কায়দাও সে ভালোভাবেই আয়ত্ত করেছে সে পাকা বক্সার।

আমি লড়তে রাজি আছি, জনতার ভিড় ঠেলে একটি দীর্ঘকায় মানুষ এগিয়ে এল, তার মাথার ওপর লটপট করছে রাশি রাশি আগুন রাঙা চুল আর ওষ্ঠাধরে মাখানো রয়েছে ক্ষীণ হাসির রেখা–ম্যাকফারলেন!

রক্তকেশী নবাগতকে সোল্লাসে অভ্যর্থনা জানাল সমবেত জনতা—

দস্তানা লাগাও। ওর হাতে মুষ্টিযুদ্ধের দস্তানা পরিয়ে দাও।

ম্যাকফারলেনের উন্মুক্ত পুরোবাহুর (forearm) দিকে দৃষ্টিপাত করলে মুষ্টিযোদ্ধা দড়ির মতো পাকানো মাংসপেশিগুলি তার একটুও ভালো লাগল না।

নীরস কণ্ঠে মুষ্টিবীর জানতে চাইল, ইয়ে–তুমি তুমি কি বলে–মানে, বক্সিং লড়তে জান তো?

না, জানি না, ম্যাকফারলেন উত্তর দিলে, তবে শিখতে দোষ কী? আজ থেকে তোমার কাছেই বক্সিং শিখব।

লড়াই শুরু হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই বুঝল, ম্যাকফারলেন শক্তিশালী মানুষ বটে, কিন্তু মুষ্টিযুদ্ধে সে একেবারেই আনাড়ি। তার প্রতিদ্বন্দ্বীর বজ্রমুষ্টি তার মুখে ও দেহে আছড়ে পড়ল বারংবার কোনোরকমে দুই হাত দিয়ে আত্মরক্ষা করতে লাগল ম্যাকফারলেন। কয়েকটি মার সে বাঁচাল বটে কিন্তু পাকা মুষ্টিযোদ্ধার সব আঘাত সে আটকাতে পারল না। তার মুখের উপর দেহের উপর আছড়ে পড়তে লাগল ঘুসির পর ঘুসি।

জনতা ওই দৃশ্য আর সহ্য করতে পারছিল না, কয়েকজন চিৎকার করে উঠল, ওহে বোকারাম, হাত চালাও, শুধু শুধু দাঁড়িয়ে মার খাও কেন?

জনতার চিৎকারে কর্ণপাত করলে না ম্যাকফারলেন, অন্যান্য মুষ্টিযোদ্ধার মতো সরে গিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টাও সে করলে না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সে দু-হাত দিয়ে ঘুসি আটকাতে লাগল এবং আঘাতের পর আঘাতে হয়ে উঠল জর্জরিত।

আচম্বিতে ম্যাকফারলেনের বাঁ-হাতের মুঠি বিদ্যুদবেগে ছোবল মারল প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখে! প্রতিদ্বন্দ্বী মুষ্টিবীর মাটির ওপর ঠিকরে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল!

একটি ঘুসিতেই লড়াই ফতে!

তীব্র উল্লাসে চিৎকার করে জনতা ম্যাকফারলেনকে অভিনন্দন জানাল। সেই মুহূর্তে তার নূতন নামকরণ করল রেড অর্থাৎ লাল। লাল চুলের জন্যই ওই নাম হয়েছিল তার। আমরাও এখন থেকে ম্যাকফারলেনকে রেড নামেই ডাকব।

সন্ধ্যার পরে নিজের ঘরে বসে ধূমপান করছিলেন মি. স্কেটন। হঠাৎ সেখানে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এল একটি শ্রমিক। শ্রমিকটি জানাল তাদের দলভুক্ত একটি অল্পবয়সি ছেলেকে দলেরই একজন লোক স্নানের চৌবাচ্চার মধ্যে ঠেসে ধরেছিল, ছেলেটি ভয়ে হতবুদ্ধি হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, মি. স্কেটনের এখনই একবার আসা দরকার।

স্কেটন তাড়াতাড়ি ছুটলেন। অকুস্থলে গিয়ে তিনি দেখলেন, একটি অল্পবয়সি কিশোর শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে–তার দেহে কোনো বস্ত্রের আচ্ছাদন নেই, ভয়ে তার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটেছে।

স্কেটন তাড়াতাড়ি ছেলেটিকে বিছানায় শুইয়ে উপযুক্ত শুশ্রূষার ব্যবস্থা করলেন। ছেলেটির নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, স্কেটনের যত্নে সেই যাত্রা বেঁচে গেল।

পূর্বোক্ত ঘটনার চার দিন পরে স্কেটনের ঘরে আবির্ভূত হল এক বিপুলবপু পুরুষ। লোকটির মস্ত বড়ো শরীর ও রুক্ষ মুখচোখ দেখলেই বোঝা যায় মানুষটি খুব শান্তশিষ্ট নয়।

লোকটি স্কেটনের বেতনভোগী শ্রমিক। তার দুর্দান্ত স্বভাবের জন্য স্কেটন তাকে পছন্দ করতেন না।

আগন্তুক কর্কশ স্বরে বললে, মি. স্কেটন, দেখুন হতভাগা রেড আমার কী অবস্থা করেছে।

মি. স্কেটন দেখলেন লোকটির দুই চোখের পাশে ফুটে উঠেছে আঘাতের চিহ্ন।

স্কেটন বললেন, রেড তোমাকে মারল কেন?

খুব মোলায়েম স্বরে লোকটি বললে, আমি কিছু করিনি স্যার। হতভাগা রেড হঠাৎ এসেই আমাকে দু-ঘা বসিয়ে দিল। আমি স্যার ঝগড়াঝাটি পছন্দ করি না। আমি আপনার কাছে নালিশ জানাতে এসেছি।

স্কেটন অবাক হয়ে ভাবলেন যে মানুষ চিরকালই দুর্বিনীত ও দুর্দান্ত স্বভাবের পরিচয় দিয়ে এসেছে, সে হঠাৎ আজ আঘাতের পরিবর্তে আঘাত ফিরিয়ে না-দিয়ে শান্তশিষ্ট ভদ্রলোকের মতো জানাতে এল কেন?

মুখে বিস্ময় প্রকাশ না করে স্কেটন বললেন, তুমি যাও। যদি রেড দোষ করে থাকে আমি তাকে শাস্তি দেব।

অনুসন্ধান করে আসল খবর জানলেন মি. স্কেটন। সমস্ত ঘটনাটা হচ্ছে এই

ওই ঝগড়াঝাটি পছন্দ না-করা লোকটি কয়েকদিন আগে অল্পবয়সি ছেলেটিকে জলের মধ্যে চেপে ধরেছিল। দলের শ্রমিকরা ব্যাপারটা পছন্দ করেনি, কিন্তু সাহস করে কেউ প্রতিবাদ জানাতে পারেনি। ওই লোকটা ছিল পয়লা নম্বরের ঝগড়াটে, আর তার গায়েও ছিল ভীষণ জোর–তাই সবাই তাকে ভয় করত যমের মতো।

অকুস্থলে ম্যাকফারলেন উপস্থিত ছিল না। পরে সমস্ত ঘটনাটা যখন সে সহকর্মীদের মুখ থেকে জানল, তখনই সে ঝগড়াটে লোকটির কাছে কৈফিয়ত চাইল। ফলে মারামারি। রেডের হাতে মার খেয়ে শান্তশিষ্ট ভদ্রলোকটি স্কেটনের কাছে অভিযোগ করতে এসেছিল।

সব শুনে স্কেটন বললেন, রেড যা করেছে, ভালোই করেছে।

এক রাতে স্কেটন যখন শুতে যাওয়ার উদ্যোগ করছেন, সেই সময় তার সামনে কাচুমাচু মুখে এসে দাঁড়াল রেড।

স্কেটন প্রশ্ন করলেন, কী হয়েছে?

রেড একটু হাসল, বোকার মতো ডান হাত দিয়ে বাঁ-কানটা একটু চুলকে নিল, তারপর মুখ নীচু করে বললে, স্যার! ঘুমাতে পারছি না স্যার!

–ঘুমাতে পারছ না! কেন?

–ওরা বড়ো গোলমাল করছে স্যার। স্কেটন কান পেতে শুনলেন। শ্রমিকদের শয়নকক্ষ থেকে ভেসে আসছে তুমুল কোলাহল ধ্বনি।

মি. স্কেটন ঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত্রি গভীর, যেকোনো ভদ্রলোকই এখন শয্যার বুকে আশ্রয় নিতে চাইবে।

মুখ তুলে গম্ভীর স্বরে স্কেটন বললেন, তোমার হাতে তো বেশ জোর আছে শুনেছি তবে তুমি ঘুমাতে পারছ না কেন?

রেড কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে রইল, তারপরই তার চোখে-মুখে খেলে গেল হাসির বিদ্যুৎ। স্যার! স্যার! আপনি কী বলছেন স্যার? আপনি কি

বাধা দিয়ে স্কেটন বললেন, শোনো! তাঁবুর লোকজনদের মধ্যে যাতে নিয়মশৃঙ্খলা বজায় থাকে তুমি সেই চেষ্টাই করবে। আজ থেকে তুমি হলে এই দলের পুলিশম্যান! বুঝেছ?

এক মুহূর্তের মধ্যে যেন রূপান্তর ঘটল মানুষটির। জ্বলজ্বল করে উঠল রেডের দুই চোখ, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে স্কেটনকে সে অভিবাদন জানাল, তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে অদৃশ্য হয়ে গেল মুক্ত দ্বারপথে।

দশ মিনিটের মধ্যেই শ্রমিকদের কোলাহলমুখর শয়নকক্ষ হয়ে গেল নিস্তব্ধ এবং নিবে গেল বৈদ্যুতিক আলোর দীপ্তি।

রেড তার কর্তব্য পালন করেছে!

মি. স্কেটন শয্যাগ্রহণ করার উপক্রম করলেন আর ঠিক সেই সময়ে বেজে উঠল টেলিফোন। যন্ত্রটাকে তুলে নিলেন স্কেটন।

টেলিফোনের তারে এক উদবেগজনক সংবাদ পেলেন স্কেটন। তাঁর আস্তানা থেকে কয়েক মাইল দূরে রাস্তা তৈরির জন্য গড়ে উঠেছিল আর একটা ঘাঁটি। এ ঘাঁটির প্রহরী টেলিফোনে জানিয়ে দিল যে, তাদের ঘাঁটি থেকে একটি অতিশয় ভয়ংকর মানুষ স্কেটনের আস্তানার দিকে যাত্রা করেছে। প্রহরীর মুখ থেকে আরও বিশদ বিবরণ জানা গেল–ওই গুন্ডাপ্রকৃতির লোকটা নাকি তাদের ঘাঁটিতে খুব উপদ্রব শুরু করেছিল, প্রহরী তাকে বাধা দিতে গিয়ে দারুণ মার খেয়েছে।

আবার ভেসে এল টেলিফোনে প্রহরীর কণ্ঠস্বর।লোকটির নাম টারজান। অন্তত ওই নামেই সে নিজের পরিচয় দেয়। বাঘের মতো ভয়ংকর মানুষ ওই টারজান। মি. স্কেটন, আপনি সাবধানে থাকবেন।

আমি সতর্ক থাকব।

স্কেটন টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন।

পরের দিন সকালেই স্কেটনের ঘরে টারজান নামধারী মানুষটির শুভ আগমন ঘটল।

স্কেটন বই পড়ছিলেন। বই থেকে মুখ তুলে তিনি আগন্তুকের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন।

চিতাবাঘের মতো ছিপছিপে পেশিবহুল বলিষ্ঠ দেহ, দুই চোখের দৃষ্টিতে এবং মুখের রেখায় রেখায় নিষ্ঠুর বন্য হিংসার পাশবিক ছায়া–টারজান?

গম্ভীরভাবে স্কেটন বললেন, তুমি টারজান? আগের ঘাঁটির প্রহরীকে তুমি মেরেছ?

স্কেটনের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলে আগন্তুক, কুৎসিত হিংস্র হাস্যে বিভক্ত হয়ে গেল তার ওষ্ঠাধর, হ্যাঁ, আমার থাবাগুলো বড়ো ভয়ানক।

শোনো টারজান, স্কেটন বললেন, ইচ্ছে করলে তুমি এখানে কাজ করতে পারো।

হ্যাঁ?

লোকটি অবাক হয়ে গেল। এত সহজে কাজ পেয়ে যাবে সে ভাবতে পারেনি। স্পষ্টই বোঝা গেল, মালিকের তরফ থেকে এই ধরনের প্রস্তাব আসতে পারে এমন আশা তার ছিল না।

হ্যাঁ, আর একটা কথা বলে দিচ্ছি, স্কেটন বললেন, এখানে গোলমাল করলে বিপদে পড়বে। এই ঘাঁটিতে এমন একটি মানুষ আছে যে তোমাকে ইচ্ছে করলে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলতে পারে।

নীরব হাস্যে ভয়ংকর হয়ে উঠল টারজানের মুখ, ও! ওই লালচুলো মানুষটার কথা বলছেন বুঝি? তার কথা আমার কানে এসেছে। আমি ওই লালচুলোর সঙ্গে একটিবার দেখা করতে চাই।

ভালো কথা। খুব শীঘ্রই তার সঙ্গে তোমার দেখা হবে টারজান।

মি. স্কেটন আবার তার হাতের বইতে মনোনিবেশ করলেন। টারজান কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু স্কেটন একবারও বই থেকে মুখ তুললেন না।

অগত্যা টারজান স্কেটনের ঘর থেকে বেরিয়ে শ্রমিকদের শয়নকক্ষের দিকে পদচালনা করলে।

স্কেটন জানতেন টারজানের সঙ্গে ম্যাকফারলেন ওরফে রেড-এর কলহ অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে তার আশঙ্কা সত্যে পরিণত হবে কে জানত?

স্কেটনের কাছে যেদিন টারজান এসেছিল সেদিন রেড অকুস্থলে উপস্থিত ছিল না। কয়েক মাইল দূরে রাস্তা তৈরির কাজে সে ব্যস্ত ছিল। রাত্রিবেলা যখন সে শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট শয়নকক্ষে উপস্থিত হল, তখন তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত দৃশ্য–

মস্ত বড়ো ঘরটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছে আর চিৎকার করছে টারজান, এইখানে এমন কোনো মানুষ নেই যে আমার সঙ্গে লড়তে পারে।

দরজার কাছে স্থির হয়ে দাঁড়াল রেড।

শয়নকক্ষের মাঝখানে মস্ত বড় থামটার ওপর সজোরে পদাঘাত করে চেঁচিয়ে উঠল টারজান, যেকোনো লোক হ্যাঁ, হ্যাঁ, যেকোনো লোককে আমি মেরে ঠান্ডা করে দিতে পারি।

তাই নাকি? যেকোনো লোককে তুমি মেরে ঠান্ডা করে দিতে পারো? হাসতে হাসতে বললে রেড, কিন্তু আমাকে তুমি ঠান্ডা করতে পারবে না।

কথা বলতে বলতে একহাত দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল রেড, এইবার ক্ষিপ্রহস্তে গায়ের গরম জামাগুলো সে খুলে ফেলল।

শার্টের আস্তিন গুটিয়ে রেড ধীরে ধীরে এগিয়ে এল টারজানের দিকে! চরম মুহূর্ত!

মিষ্টি হাসি হেসে মধু ঢালা ঠান্ডা গলায় রেড বললে, কী হে স্যাঙাত–তুমি তৈরি?

রেড স্কটল্যান্ডের অধিবাসী। সে শক্তিশালী মানুষ। তার লড়াইয়ের অস্ত্র হচ্ছে দুই হাতের বজ্রমুষ্টি।

টারজান বর্ণসংকর–তার বাপ ফরাসি, মা রেড ইন্ডিয়ান। সেও বলিষ্ঠ মানুষ। কিন্তু তার লড়াইয়ের ধরন আলাদা। ছলে-বলে-কৌশলে যেভাবেই হোক শত্রু নিপাত করতে সে অভ্যস্ত; মারি অরি পারি যে কৌশলে, এই হল তার নীতি।

দুই বিচিত্র প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরের সম্মুখীন হল।

টারজান খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। রেড-এর বলিষ্ঠ দুই হাতের কবলে ধরা পড়ার ইচ্ছা তার ছিল না–হঠাৎ বিদ্যুদবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে শত্রুর মাথায় প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাত করলে, প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই অপর হাতখানি সবেগে আঘাত হানল শত্রুর উদরে এবং চোখের পলক ফেলার আগেই ছিটকে সরে গেল প্রতিদ্বন্দ্বীর নাগালের বাইরে।

টারজানের চোখ দুটো এতক্ষণ ক্রোধে ও ঘৃণায় জ্বলছিল জ্বলন্ত অঙ্গারখণ্ডের মতো, কিন্তু এইবার তার বিস্ফারিত চক্ষুতে ফুটে উঠল আতঙ্কের আভাস।

তার একটি আঘাতেও শত্রুর দেহ স্পর্শ করতে পারেনি! রেড আক্রমণ করলে না, স্থির হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল শত্রুর জন্য।

আবার আক্রমণ করল টারজান। চিতাবাঘের মতো দ্রুত ক্ষিপ্রচরণে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল সে, ক্রুদ্ধ সর্পের ছোবল মারার ভঙ্গিতে তার দুই হাত বারংবার আঘাত হানল শত্রুর দেহে, তারপর আবার ছিটকে সরে এসে উপস্থিত হল পরবর্তী আক্রমণের জন্য।

টারজানের চোখে এইবার স্পষ্ট ভয়ের ছায়া। শত্রুর একজোড়া বলিষ্ঠ বাহু তার প্রত্যেকটি আঘাত ব্যর্থ করে দিয়েছে! দু-খানি হাত যেন দুটি লোহার দরজা-ইস্পাত-কঠিন সে-হাত দুটির বাধা এড়িয়ে টারজানের আঘাত রেড-এর শরীর স্পর্শ করতে পারেনি একবারও!

টারজান এইবারে অন্য উপায় অবলম্বন করলে। জ্যা-মুক্ত তিরের মতো তার দেহ ছুটে এল শত্রুর উদর লক্ষ করে। ওই অঞ্চলে নদীর ধারের গুন্ডারা সাধারণত পূর্বোক্ত পদ্ধতিতে লড়াই করে, হাত দিয়ে সেই ভীষণ আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখা যায় না। কিন্তু রেড হুঁশিয়ার মানুষ, সেও অনেক ঘাটের জল খেয়েছে, অন্যান্য বারের মতো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সে শত্রুর আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করল না–সাঁৎ করে একপাশে সরে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীর পায়ে পা লাগিয়ে মারল এক টান!

পরক্ষণেই টারজানের দেহ ডিগবাজি খেয়ে সশব্দে আছড়ে পড়ল বন্ধ দরজার ওপর!

সমবেত জনতার কণ্ঠে জাগল অট্টহাস্য! টারজানের দুর্দশা তারা উপভোগ করছে সকৌতুকে!

টারজান উঠে দাঁড়াল। ভীষণ আক্রোশে সে ধেয়ে গেল প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে, তারপর হঠাৎ শূন্যে লাফিয়ে উঠে রেড-এর মাথায় করলে প্রচণ্ড পদাঘাত।

লাথিটা রেড-এর মাথায় চেপে পড়েনি, মুখের ওপর দিয়ে হড়কে গিয়েছিল–পলকে টারজানের একটি জুতোসুদ্ধ পা ধরে ফেলল রেড। কিন্তু শত্রুকে সে ধরে রাখতে পারল না। মাটির ওপর সশব্দে আছড়ে পড়েই আবার উঠে দাঁড়াল টারজান।

উল্লসিত জনতার চিৎকারে ঘর তখন ফেটে পড়ছে! হ্যাঁ, একটা দেখার মতো লড়াই হচ্ছে। বটে!

তবে দর্শকদের মধ্যে কেউ কেউ বুঝতে পেরেছিল এটা সাধারণ লড়াই নয়। প্রথম প্রথম হয়তো যোদ্ধাদের মধ্যে কিছুটা খেলোয়াড়ি মনোভাব ছিল, কিন্তু এখন তাদের মাথায় চেপেছে খুনের নেশা।

টারজানের জুতোর তলা ছিল লোহা দিয়ে বাঁধানেনা। রেড-এর মুখের ওপর সেই লৌহখণ্ড এঁকে দিয়েছে রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন।

রেড-এর গালের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা, চিবুকটা একপাশে বেঁকে গেছে আঘাতের বেগে।

হর্ষধ্বনি থেমে গেল। রক্তমাখা ক্ষতচিহ্ন এইবার সকলের চোখে পড়েছে।

হঠাৎ সকলের নজর পড়ল টারজানের উপর। প্রায় ২০০ মানুষের দেহের অঙ্গে অঙ্গে ছুটে গেল বিদ্যুৎ-শিহরন টারজানের হাতের মুঠিতে ঝকঝক করছে একটি ধারালো ছোরা!

জনতা নির্বাক। দারুণ আতঙ্কে তাদের কণ্ঠ হয়ে গেছে স্তব্ধ।

নিঃশব্দে বাঘের মতো গুঁড়ি মেরে টারজান এগিয়ে এল শত্রুর দিকে রেড তখন নিবিষ্ট চিত্তে ক্ষতস্থান পরীক্ষা করছে।

ভীষণ চিৎকার করে আক্রমণ করল টারজান। এক মুহূর্তের জন্য দেখা গেল চারটি হাত আর চারটি পায়ের দ্রুত সঞ্চালন, তারপরেই মৃত্যু-আলিঙ্গনে বদ্ধ হয়ে স্থির প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে গেল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী!

একহাত দিয়ে টারজানের ছোরাসুদ্ধ হাত চেপে ধরেছে রেড, অন্য হাতের পাঁচটা আঙুল চেপে বসেছে শত্রুর কণ্ঠদেশে। টারজানও নিশ্চেষ্ট নয়, সে ছোরাসুদ্ধ হাতটি ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে প্রাণপণে এবং অপর হাতের আঙুলগুলো দিয়ে রেড-এর গলা টিপে ধরেছে সজোরে।

ঘরের মধ্যে অতগুলি মানুষ স্তব্ধ নির্বাক। প্রতিদ্বন্দ্বীদের মুখেও কোনো আওয়াজ নেই। নিঃশব্দে চলছে মৃত্যুপণ লড়াই।

হঠাৎ মট করে একটা শব্দ হল–রেড-এর শক্ত মুঠির মধ্যে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল টারজানের কবজির হাড়, অস্ফুট আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল টারজান।

দুই হাত কোমরে রেখে ধরাশায়ী শত্রুর দিকে দৃষ্টিপাত করলে রেড। টারজান উঠল না, সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।

ভগ্নস্বরে রেড বললে, ওকে এবার একটু জল দাও। দেখছ না, মানুষটা যে অজ্ঞান হয়ে গেছে…

মি. স্কেটন ভুল করেননি। ম্যাকফারলেন ওরফে রেড সত্যিই ভালো লোক। পরবর্তী জীবনে ম্যাকফারলেন ভালোভাবে বাঁচার সুযোগ পেয়েছিল এবং সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে সে কুণ্ঠিত হয়নি।

[আষাঢ় ১৩৭৬]

তাইগরেরো

প্রথম পরিচ্ছেদ

প্রথম দর্শনেই তিক্ততার সৃষ্টি!

আর্নস্ট হস্তক্ষেপ না-করলে তখনই শুরু হত মারামারি। দুই পক্ষের মাঝখানে দাঁড়াল আর্নস্ট, ফাভেলকে মিষ্টি কথায় শান্ত করে ছোটোভাইকে সে টেনে নিয়ে গেল একপাশে, তারপর বলল, বহুদিন পরে তোর সঙ্গে দেখা হল আলেক্স। দারুণ ভালো লাগছে।

দীর্ঘকাল পরে দাদার দেখা পেয়ে সাশাও খুব খুশি হয়েছিল, কিন্তু ফাভেল নামে অপরিচিত মানুষটির অভদ্র আচরণ তার মন থেকে সব আনন্দ মুছে দিয়েছিল–ক্রুদ্ধ স্বরে সে প্রশ্ন করল, লোকটা কে?

আর্নস্ট বিব্রত বোধ করল, ওর নাম ফাভেল। লোকটা ব্রেজিলের স্থানীয় বাসিন্দা, আমার সঙ্গে এক কারখানায় কাজ করে।

এমন অভদ্র মানুষের সঙ্গে তুমি কাজ কর?

ইয়ে মানে একেবারে একা নিঃসঙ্গ জীবন কাটানো যায় না। লোকজনের সঙ্গে মিশতেই হয়। এখানে ফাভেলের চাইতেও খারাপ লোক আছে। ফাভেল আমার বন্ধু নয়, সহকর্মী মাত্র। ওকে নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই। তারপর তোর খবর কী?

সাশা জানাল দেশ থেকে, অর্থাৎ রাশিয়া থেকে, চিঠি পেয়ে সে আর্নস্ট সিমেলের বর্তমান ঠিকানা জানতে পেরেছে। অনেক ঝাট-ঝামেলা সহ্য করে পাসসা ফানভো শহরে এই হোটেলের ভিতর দাদাকে সে পাকড়াও করেছে। আর্নস্ট আগে ছিল ব্রেজিলের মাত্তো গ্রসো নামক অরণ্যসংকুল স্থানে, পরে স্থান পরিবর্তন করে উপস্থিত হয়েছে এই পাসো ফানডো শহরে…

আজকের ব্যাপার নয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগেকার কথা। আর্নস্ট সিমেল আর সাশা সিমেল দুই ভাই। জাতে তারা রুশ। কিন্তু জন্মস্থান ল্যাটভিয়া। বড়ো ভাই আর্নস্ট ছোটোবেলা থেকেই কিছুটা খামখেয়ালি আর বেপরোয়া। কোনো বিষয়ে ঝোঁক চাপলে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না-করেই সে এগিয়ে যেত এবং অজানা বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করত না সাশা সিমেল কিছুমাত্র। কোনো এক অশুভ মুহূর্তে তার মনে হল হিরার জন্য বিখ্যাত ব্রেজিলের মাত্তো গ্রসসা নামক বনভূমিতে হিরার সন্ধান পেলে রাতারাতি অগাধ অর্থের মালিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে–সঙ্গেসঙ্গে সে রওনা হল পূর্বোক্ত স্থানের উদ্দেশে। তারপর বেশ কয়েক বছর সে নিরুদ্দেশ… দীর্ঘকাল পরে বাড়িতে তার চিঠি এল জানা গেল আর্নস্ট সিমেল এখন আর মাত্তো গ্রসসাতে নেই, রয়েছে ব্রেজিলেরই পাসো ফানডো নামক শহরে।

বড়ো ভাইকে ছোটোবেলা থেকেই দারুণ ভালোবাসত আশা সিমেল। খামখেয়ালি স্বভাবের বেপরোয়া আর্নস্ট ছিল ছোটোভাই সাশার চোখে মস্ত হিরো! কৈশোর উত্তীর্ণ হয়ে সাশা যখন যৌবনে পা দিয়েছে সেইসময় একটা অবাঞ্ছিত ঘটনায় সমগ্র পৃথিবী সম্পর্কে তিক্ত হয়ে উঠল সে কাজকর্মে ইস্তফা দিয়ে সে পৌঁছে গেল পাসো ফানডো শহরে এবং বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর বড়োভাই আর্নস্টের দেখা পেল সেখানকার একটা হোটেলের মধ্যে। দীর্ঘ অদর্শনের পর মিলনের আনন্দ ভালো করে উপভোগ করতে পারল না দুই ভাই–ফাভেল নামে একটি স্থানীয় মানুষ হঠাৎ অপমান করে বসল ছোটো ভাই সাশাকে। ব্যাপারটা কোনোমতে সামলে নিল আর্নস্ট। মালপত্র একটা হোটেলে রেখে পায়ে হেঁটে দাদার খোঁজে বেরিয়েছিল সাশা, পরের দিন জিনিস নিয়ে চলে এল দাদার আস্তানায়।

কলকবজার কাজ দুই ভাইয়েরই জানা ছিল। ভাঙা যন্ত্রপাতি আর অকেজো অস্ত্র মেরামতে আর্নস্ট ছিল অতিশয় দক্ষ। দাদার মতো পাকা ওস্তাদ না হলেও মোটামুটি কলকবজার কাজ জানত সাশা। দাদার সঙ্গে কথা বলে সাশা জানতে পারল আর্নস্ট এখন হিরার সন্ধান ছেড়ে স্থানীয় একটি জার্মান ব্যবসায়ীর কারখানায় যন্ত্রপাতি মেরামতের কাজ করছে। দাদার খামখেয়ালি স্বভাব সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন থাকলেও হিরার সন্ধান ছেড়ে হঠাৎ একটা অখ্যাত শহরে মিস্ত্রির কাজ নিয়ে দাদাকে জীবিকানির্বাহ করতে দেখে সাশার মনে হল ব্যাপারটা অহেতুক খামখেয়ালি কাণ্ড নয়–এর ভিতর কিছু রহস্য আছে। আর্নস্ট জামা খুলতেই রহস্য কিছুটা পরিষ্কার হল–তার কাঁধের উপর দেখা গেল একটি অর্ধশুষ্ক ক্ষতচিহ্ন! মনে হয়, অস্ত্রাঘাতের ফলেই ওই চিহ্নটার সৃষ্টি হয়েছে। সাশা অনুমান করল মাত্তো গ্রসো নামক স্থানে কারো সঙ্গে বিবাদের ফলেই ওই চিহ্নটার সৃষ্টি এবং সেই সংঘর্ষের জন্যই পরবর্তীকালে হিরার সন্ধান ছেড়ে স্থানত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। আর্নস্ট। তবু ক্ষতচিহ্ন নিয়ে কোনো কৌতূহল প্রকাশ করল না সাশা, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সাশা বুঝেছিল ব্রেজিলের মানুষগুলো বিশেষ শান্তশিষ্ট নয়।ফাভেলের প্রসঙ্গে দাদার কথাটা তার মনে পড়ছিল বার বার এখানে ফাভেলের চাইতেও খারাপ লোক আছে..

আগেই বলেছি দাদার মতো ওস্তাদ মিস্ত্রি না হলেও যন্ত্রপাতির কাজ জানত সাশা। অতএব যে-কারখানায় দাদা কাজ করত, সেখানে কাজ জুটিয়ে নিতে সাশার অসুবিধা প্রবাদপুরুষ।  হল না। মালিকের ব্যবহার ভালো, সে সাশাকে পছন্দও করত, কিন্তু ফাভেলের কুনজরে পড়ে গেল সাশা সিমেল। প্রথম দিনেই যে বিরোধের সূত্রপাত ঘটেছিল, পরবর্তীকালে সেই বিরোধ এগিয়ে চলল এক ভয়াবহ সম্ভাবনার দিকে। সাশা আর আর্নস্ট প্রাণপণে বিরোধ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করত, কিন্তু সহ্য করার একটা সীমা তো আছে–সাশা বুঝতে পারছিল অদূর ভবিষ্যতে একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙবে, মানসিক তিক্ততা সেইদিন গড়িয়ে যাবে রক্তাক্ত সংঘর্ষের দিকে…

এইবার পাঠকদের সঙ্গে বর্তমান কাহিনির অন্যতম প্রধান চরিত্রের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় হয়েছে–ডম কার্লোস! ওই নামটির সঙ্গে জড়িত ছিল পাসো ফানডো শহরের যাবতীয় বাসিন্দার শ্রদ্ধা, বিস্ময় ও আতঙ্ক!

দক্ষিণ আমেরিকা তথা ব্রেজিলের বিভিন্ন অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলার অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। পাসো ফানডো শহরকেও ওই নিয়মের ব্যতিক্রম বলা চলে না। সেই প্রায়-অরাজক শহরে স্বেচ্ছায় শান্তিরক্ষকের কর্তব্য পালন করতে এগিয়ে এসেছিল একটি রেড ইন্ডিয়ান। অবশ্য সেই পবিত্র কর্তব্যপালন করার জন্য সে অর্থগ্রহণ করত জনসাধারণের কাছ থেকে। ডম কার্লোস নামক ওই ব্যক্তি রাজ্য সরকারের কাছ থেকে মাইনে পেত না। শান্তিরক্ষার কাজটাকে সে বেছে নিয়েছিল স্বাধীন পেশা হিসেবে। অত্যন্ত বিপজ্জনক পেশা সন্দেহ নেই তবে ওই পেশার উপযুক্ত মানুষ ছিল ডম কার্লোস বন্দুক, পিস্তল প্রভৃতি আগ্নেয়াস্ত্রে তার নিশানা ছিল অব্যর্থ।

পাসো ফানডো শহরের অত্যাচারিত বা নিহত মানুষের আত্মীয়স্বজন যখন কার্লোসের কাছে। সুবিচারের আশায় উপস্থিত হত, তখনই প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হত ডম কার্লোস। সরকারি বিচারক অপরাধীকে প্রাণদণ্ড দিলে সেই দণ্ড কার্যকরী করে সরকারি জল্লাদ; কিন্তু ডম যখন অপরাধীকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করত, তখন সেই দণ্ড কার্যকরী করার ভার গ্রহণ করত স্বহস্তে। খুনিদের হত্যা করার পর তাদের কানগুলো কেটে রেখে দিত সে। ওগুলো তার যুদ্ধজয়ের স্মৃতিচিহ্ন বা স্মারক।

বন্দুক-পিস্তলের নিশানায় সিদ্ধহস্ত ডম কার্লোসের ভয়ে শহরের সমাজবিরোধী দুবৃত্তরা খুন করার আগে একটু চিন্তা করত। খুন করার পর নিজেরও খুন হয়ে যাওয়ার ভয়াবহ সম্ভাবনাকে ভয় করে না এমন খুনি পাসো ফানডো শহরেও নিতান্ত বিরল। অপরাধীরা অবশ্য আত্মরক্ষার চেষ্টা করত। দুবৃত্তের কবলে একটি চোখ হারিয়েছিল ডম কার্লোস, তবে উক্ত ব্যক্তিকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল প্রাণ দিয়ে। প্রৌঢ়বয়স্ক, একচক্ষু, রোগা চেহারার ডম কার্লোস নামক মানুষটি ছিল চোর-ডাকাত আর খুনিদের কাছে মূর্তিমান দুঃস্বপ্ন। কিন্তু ওই পেশাদার শান্তিরক্ষকটি আর্নস্ট আর সাশাকে খুব ভালোবাসত। মানবচরিত্র সম্পর্কে দস্তুরমতো অভিজ্ঞ ছিল ডম কার্লোস সরল সাদাসিধে স্বভাবের জন্যই তার বিশেষ প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিল দুই ভাই।

ফাভেলের সঙ্গে দৈনন্দিন কলহ যখন চরম পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার উপক্রম করছে, সেইসময় একদিন পরামর্শ ও উপদেশের জন্য ডম কার্লোসের দরজায় উপস্থিত হল সাশা সিমেল…

দূর দিগন্ত থেকে অস্তায়মান সূর্যের রক্তিম রশ্মি ছড়িয়ে পড়ছিল রিও গ্র্যান্ড ডো সাল নামে উদ্ভিদ-আচ্ছন্ন প্রান্তরের বুকে। সেই প্রান্তর ছাড়িয়ে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের ভিতর দিয়ে চলে গেছে বিখ্যাত মাত্তো গ্রুসোর রহস্যময় অরণ্য, যেখানে ঘন উদ্ভিদ ও জলাভূমির বুকে অবস্থান করছে বিভিন্ন ও বিচিত্র মৃত্যুদ–শ্বাপদ, সরীসৃপ, চোরাবালি!

কিন্তু বিশাল প্রান্তর ও দূরবর্তী অরণ্যের নৈসর্গিক সৌন্দর্য বা অস্তায়মান সূর্যের আলোছায়ার খেলা দেখে মুগ্ধ হওয়ার অবকাশ ছিল না সাশার–সে সোজা এসে দাঁড়াল উম কার্লোসের সামনে।

শহরের বাইরে অরণ্য ও নগরের সীমানার উপর ডম কার্লোসের বাড়ি। বাড়িটার মধ্যে বৈশিষ্ট্য কিছুনা-থাকলেও দরজার দিকে তাকালে যেকোনো মানুষের পিলে চমকে যাবে। দরজার উপর সুতোয় বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে সারি সারি মানুষের কান! যে-অপরাধীদের প্রাণদণ্ড দিয়েছে কার্লোস, ওগুলো তাদের মুণ্ড থেকে কর্তিত স্মারকচিহ্ন।বহু যুদ্ধজয়ের নীরব সাক্ষী।

কার্লোসকে ডাকাডাকি করার দরকার হল না। একটা কাঠের টুলের উপর বাড়ির সামনে বসে ছিল সে। পাশে দাঁড়িয়েলোবো নামে কুকুরটা প্রভুর আদর উপভোগ করছিল মহানন্দে। সাশাকে দেখে সাদর অভ্যর্থনা জানাল ডম কার্লোস।

সাশা বিলক্ষণ উত্তেজিত ছিল। বাজে কথায় সময় নষ্ট না-করে তৎক্ষণাৎ ফাভেল-ঘটিত সমস্যার কথা জানিয়ে সে পরামর্শ চাইল ডম কার্লোসের কাছে।

আমাদের এখানে, অর্থাৎ ব্রেজিলে আমরা একটা নীতি অনুসরণ করি, সাশার মুখের উপর একটিমাত্র চক্ষুর তীব্র দৃষ্টি স্থাপন করে ডম কার্লোস বলল, আমরা অন্যের ব্যাপারে নাক গলাই না, গায়ে পড়ে কারো সঙ্গে ঝগড়াও করি না। কিন্তু আমায় যদি কেউ অপমান করে বা আক্রমণ করে, তাহলে তাকে হত্যা করতে আমি কিছুমাত্র দ্বিধা করব না। যে-লোক তোমাকে অপমান বা আক্রমণ করতে পারে, সে হচ্ছে খ্যাপা কুকুরের শামিল–তাকে তোমার খুন করাই উচিত। এই যে লোবো, ও যদি তোমাকে কামড়াতে যায়, তাহলে ওকে মেরে ফেলতে কি তুমি দ্বিধা করবে?

যাকে নিয়ে এই ভয়াবহ মন্তব্য, তার দিকে একবার সস্নেহে দৃষ্টিপাত করল কার্লোস। প্রভুর চোখে চোখ রেখে ঘন ঘন লাঙ্গুল আন্দোলিত করে প্রভুকে সমর্থন জানাল লোবো। যেমন মনিব, তেমনি কুকুর!

লোবোর উপর থেকে চোখ সরিয়ে সাশার মুখের দিকে তাকাল কার্লোস, তবে একটা কথা মনে রেখো। ফাভেলকে খুন করলে আমি আর লোবো তোমাকে অনুসরণ করব। কারণ, ফাভেলের আত্মীয়স্বজন নিশ্চয়ই আমায় টাকা দিয়ে খুনিকে হত্যা করতে বলবে, আর পেশা অনুসারে আমিও তোমাকে বা তোমার ভাইকে অথবা দুজনকেই হত্যা করতে বাধ্য হব। বন্ধুদের কান কেটে নিতে আমার খুবই খারাপ লাগবে, কিন্তু সে-রকম কিছু ঘটলে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই আমার অপ্রীতিকর কর্তব্য পালন করতে হবে। এটাই আমার পেশা যে!

ডম কার্লোসের বক্তব্য শেষ হলে সাশা বলল, তাহলে তুমি আমায় ফাভেলকে এড়িয়ে চলতে বলছ?

না, না, কার্লোস বলল, তোমার বিবেক যা বলবে, তুমি তা-ই করবে।

আমি ওই খুদে ভোঁদড়টাকে এড়িয়ে চলতে পারি না, সাশা বলল, কারণ, আমরা এক জায়গায় কাজ করি। আর আমি ওর ভয়ে পালিয়ে যেতেও চাই না। সেটা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।

না, তুমি ফাভেলকে এড়িয়ে যেতে পারবে না, কার্লোস হাসল, মনে হচ্ছে লোবোকে নিয়ে আমার বন্ধুদের পিছনে আমাকেই তাড়া করতে হবে, আর শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তাদের কানগুলো কেটে আনতে হবে। সিনর সিমেল, তোমায় আমি একটা উপদেশ দিচ্ছি, শোনো। এখন তুমি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছ, প্রতিপক্ষের দম্ভ তুমি সহ্য করতে পারছ না কিন্তু মাত্তো গ্রসোর প্রাকৃতিক পরিবেশ, মানুষ এবং জানোয়ার তোমায় পরিবেশের উপযুক্ত করে তুলবে। সেখানে গেলে তুমি বুঝতে পারবে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা কেমনভাবে করতে হয়।

একটু থেমে ডম কার্লোস আবার বলতে লাগল, রিও সাও লরেংকো নামে যে-জায়গাটা আছে, সেখানে গেলে সম্ভবত তুমি একজন বুড়ো ইন্ডিয়ানের দেখা পাবে। ঠিক কোথায় গেলে তাকে পাওয়া যাবে, সেটা আমি যথাসময়ে তোমাকে জানিয়ে দেব। তার নাম জোকুইম গুয়াতো। লোকটি ওস্তাদ তাইগরেরো। কারো সাহায্য না-নিয়ে বর্শা দিয়ে সে তাইগর মারতে পারে।

দক্ষিণ আমেরিকার জাগুয়ারকে স্থানীয় মানুষ তাইগর বলে। সাশা শুনেছিল রেড ইন্ডিয়ানরা বর্শা দিয়ে জাগুয়ার শিকার করে। অবশ্য তারা দলবদ্ধ হয়ে জাগুয়ারকে আক্রমণ করে। কারো সাহায্য না-নিয়ে সম্পূর্ণ এককভাবে যে নিঃসঙ্গ শিকারি বর্শা দিয়ে জাগুয়ার মারতে পারে, তাকেই তাইগরেরো আখ্যা দেওয়া হয়।

তবে তেমন কোনো মানুষ সাশার চোখে পড়েনি। তাইগরেরোর অস্তিত্ব সম্পর্কে তার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। সন্দেহ অকারণ নয়–তাইগরেরো সম্পর্কে অনেক গালগল্প শোনা যায় বটে, কিন্তু স্বচক্ষে তাইগরেরোকে শিকার করতে দেখেছে, এমন মানুষের সাক্ষাৎ পায়নি সাশা সিমেল। এই প্রথম সে জোকুইম নামে এক তাইগরেরোর কথা শুনল ডম কার্লোসের মুখে।

জোকুইম লোকটা জঙ্গলকে জানে, কার্লোস বলতে লাগল, মানুষ যেমন নিজের বৈঠকখানার প্রত্যেকটি আসবাবপত্র চেনে, ঠিক তেমনিভাবেই জঙ্গলকে চিনেছে জোকুইম গুয়াতো। সে নিজের হাতে পঁয়ত্রিশটা তাইগর বর্শা দিয়ে মেরেছে। শিকারের সময় সে কারো সাহায্য নেয় না। ব্যাপারটা যে কতখানি বিপজ্জনক, সে-বিষয়ে তোমার ধারণা নেই। জঙ্গল সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল না হলে তোমার বন্দুক বা পিস্তল কোনো কাজে লাগবে না। তাইগর তোমাকে মুহূর্তের মধ্যে টুকরো টুকরো করে ফেলবে, হাতের অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগই তুমি পাবে না। আমি নিজেও বন্দুক-পিস্তলের ব্যাপারে নিতান্ত আনাড়ি নই

হঠাৎ কথা থামিয়ে হাতের এক ঝটকায় অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে কোমর থেকে পিস্তল তুলে নিল কার্লোস, কিন্তু পাকা পিস্তলবাজ হলেও জঙ্গলের মধ্যে যে সবসময় আত্মরক্ষা করতে পারব, এমন আস্থা আমার নিজের উপরেও নেই। বন্ধু সিমেল–তোমার বয়স কম, লম্বায় তুমি প্রায় ছ-ফুট হবে, দেখে বোঝা যায় গায়ে বেশ জোর আছে কিন্তু তাইগরের সামনে তোমার এই গায়ের জোর কোনো কাজে লাগবে না। পূর্ণবয়স্ক তাইগর প্রায় নয় ফুট লম্বা, দেহের ওজন চারশো পাউন্ডের কাছাকাছি। তার ধারালো নখ দিয়ে সে তোমার বুক চিরে ফাঁক করে দিতে পারে। তাইগরের দৈহিক শক্তি তোমার চাইতে অনেক বেশি এবং সে দস্তুরমতো বিপজ্জনক। তুমি পারতপক্ষে ফাভেলকে খুন করতে চাইবে না কিন্তু তাইগর তোমার সূক্ষ্ম ন্যায়নীতির ধার ধারে না, সে তোমায় সুযোগ পেলেই হত্যা করবে আর সম্ভবত খেয়েও ফেলবে। সিমেল ভায়া, জীবন সম্বন্ধে তোমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার, না হলে একদিন হয়তো প্রাণ দিয়েই তোমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। আমার মনে হয় আর্নস্টকে নিয়ে এখনই জোকুইম গুয়াতের সঙ্গে তোমার দেখা করা উচিত। তার কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য তোমরা জানতে পারবে, সভ্য মানুষের অভিধানে আজ পর্যন্ত যা লেখা হয়নি।

একটু থেমে লোবোর ঘাড় চুলকে দিল কার্লোস, তারপর আবার বলতে লাগল, কয়েক বছর আগে জোকুইম গুয়াতোকে আমি তাইগর শিকার করতে দেখেছি। সেই সময় জারোয়াস নামে জলাভূমির পূর্বদিকে একটা বিশাল গোশালার রক্ষণাবেক্ষণ করতাম আমি। জায়গাটা রয়েছে রিও আরাগুয়া আর উত্তর প্যারাগুয়ের মাঝখানে। ওই অঞ্চলে বাস করে অসংখ্য তাইগর। তাদের কবলে প্রতি বৎসর হাজার হাজার গোরু-বাছুর মারা পড়ে।

জোকুইম আর আমি একদিন ভোর হওয়ার একটু আগে ঘোড়ায় চড়ে দুটো কুকুর নিয়ে একটা তাইগরের সন্ধানে যাত্রা করেছিলাম। জন্তুটা কিছুদিন ধরে ভীষণ উপদ্রব করছিল। ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গেসঙ্গে কুকুর দুটো তাইগরের পায়ের ছাপ আবিষ্কার করল একটা খাঁড়ির ধারে। পদচিহ্নের আকৃতি ও গভীরতা দেখে বুঝলাম জন্তুটা মস্ত বড়ো, দেহের ওজন সাড়ে তিনশো পাউন্ডের কম হবে না। তাইগর সাঁতার কাটতে ওস্তাদ, জলে নেমে সে কোথায় সরে পড়েছে কে জানে। কিন্তু দুপুরের দিকে কুকুর দুটো একটা দ্বীপের মতো জায়গার উপর তাইগরকে ঘেরাও করে ফেলল। দ্বীপের চারপাশে জল খুব গভীর নয়, কিন্তু কাদায় পিছল জলাভূমির মধ্যে পা রাখাই মুশকিল। জলের উপর এখানে-ওখানে বিচ্ছিন্নভাবে গুচ্ছ গুচ্ছ ঘাস আর বর্শার ফলার মতো ভাঙা গাছের ডাল প্রতিপদে আমাদের বাধা দিচ্ছিল। জলাভূমির পাড়ে ঘোড়া রেখে আমরা জলে নেমেছিলাম। আমার হাতে রাইফেল, জোকুইমের হাতে বর্শা। বর্শার দৈর্ঘ্য ছয় ফুটের মতো, তার মধ্যে ফলাটাই হবে দু-ফুট লম্বা।

জোকুইম একবার হাত নেড়ে আমাকে জলার মধ্যে নামতে বারণ করল। কিন্তু আমি তখন তাইগরটাকে শিকার করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছি, জোকুইমের নিষেধ না-শুনে রাইফেল হাতে এগিয়ে চললাম অগভীর জল ভেঙে দ্বীপটার দিকে। অভিজ্ঞ শিকারির নির্দেশ অমান্য করার ফল পেলাম হাতে হাতে জলের মধ্যে অদৃশ্য লতার ফঁসে পা জড়িয়ে সশব্দে আছড়ে পড়লাম। হাতের রাইফেল ছিটকে পড়ে অদৃশ্য হল জলাভূমির গর্ভে এবং আমার নাকে-মুখে হুড়হুড় করে ঢুকল কাদা-মাখা জল।

কোনোমতে নিজেকে সামলে দ্বীপের কাছে ডাঙার মাটিতে হাত রাখলাম, তারপর মুখ তুলেই দেখতে পেলাম জঙ্গলের রাজা তাইগরকে। একটা মস্ত গাছে পিঠ দিয়ে সে রুখে দাঁড়িয়েছে আর কুকুর দুটো জলের ধারে দাঁড়িয়ে জন্তুটার উদ্দেশে চিৎকার করছে তারস্বরে। তাইগর মাঝে মাঝে এগিয়ে এসে কুকুর দুটোকে লক্ষ করে থাবা চালাচ্ছে, সৌভাগ্যের বিষয় প্রত্যেকবারই ফসকে যাচ্ছে তার থাবার নিশানা।

সেই সময় রাইফেল হাতে থাকলে অনায়াসে জন্তুটাকে গুলি করে মারতে পারতাম। রাইফেলের খোঁজ নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই পায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল অসহ্য যন্ত্রণার শিহরন–গোড়ালি মচকে গেছে, আমার এখন দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই।

সেই অবস্থাতেই জোকুইমকে দেখলাম। সে তাইগরের খুব কাছে প্রায় দশ ফুটের মধ্যে এসে পড়েছে। আমি বুঝলাম জন্তুটা যদি এখন তাকে আক্রমণ করে, তাহলে পিছিয়ে এসে জলাভূমির মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করার সময় সে পাবে না। আমি চেঁচিয়ে তাকে সাবধান করতে গেলাম, কিন্তু কুকুরের চিৎকারে আমার কণ্ঠস্বর ডুবে গেল জোকুইম আমার গলার আওয়াজ শুনতে পেল না…

বাঁ-হাতে বর্শা ধরে ডান হাত দিয়ে একতাল কাদামাটি তুলল জোকুইম, তারপর সেই মাটির তালটাকে ছুঁড়ে মারল তাইগরের মুখে। ফল হল বিস্ময়কর প্রকাণ্ড হাঁ করে জোকুইমের দিকে ফিরল তাইগর, তার গলা থেকে বেরিয়ে এল ভীষণ গর্জনধ্বনি। জন্তুটার ফাঁক-হয়ে-যাওয়া চোয়ালের প্রকাণ্ড হাঁ দেখে আমার মনে হল জোকুইমের পুরো শরীরটাকেই সে বুঝি এক কামড়ে গিলে ফেলবে।

জোকুইম তখন জন্তুটার থেকে প্রায় দশ ফিট দূরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তাইগরের ভয়ংকর বিকৃত মুখের উপর তার দৃষ্টি নেই, সে তাকিয়ে আছে জন্তুটার পায়ের দিকে।

পরে জেনেছিলাম বর্শাধারী শিকারি ওইভাবেই লড়াই করে–কারণ, তাইগর যতই দাঁত খিঁচিয়ে গর্জন করুক না কেন, শিকারিকে নাগালের মধ্যে পেতে হলে প্রথমেই তাকে পা চালাতে হবে, অর্থাৎ লাফ মারতে হবে। তাই শ্বাপদের পায়ের দিকেই নজর রাখে শিকারি, মুখের দিকে নয়।

অরণ্য-সম্রাটকে কাদা ছুঁড়ে অপমান করার পর পাঁচ সেকেন্ডের বেশি সময় যায়নি, এর মধ্যেই দুই হাতে বর্শা বাগিয়ে চরম মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত হয়েছে জোকুইম–মাটির দিকে সামান্য ঝুঁকে আছে বর্শার ধারালো ফলা, ডান দিকের পাঁজর আর কনুইয়ের মাঝখানে চেপে ধরা আছে বর্শার কাষ্ঠদণ্ড।

তাইগর ঝাঁপ দিল চোখের নিমেষে। একটা কালো-হলুদ বিদ্যুৎ যেন চমকে উঠল মুহূর্তের জন্য, পরক্ষণেই কী ঘটল ঠিক বুঝতে পারলাম না শুধু দেখলাম জন্তুটা শূন্যে পাক খেয়ে মাটির উপর ছিটকে পড়ল চিত হয়ে।

আমি দেখলাম, জোকুইমের বর্শা তাইগরের বুকের মধ্যে বসে গেছে এবং সে প্রাণপণ শক্তিতে বর্শার ডান্ডাটা ধরে জন্তুটাকে মাটিতে চেপে রাখার চেষ্টা করছে। তাইগরের ওজন রেড ইন্ডিয়ান শিকারির চাইতে তিনগুণ বেশি, কিন্তু যথাসাধ্য চেষ্টা করেও জন্তুটা জোকুইমকে ঠেলে সরিয়ে নিজেকে মুক্ত করে উঠে দাঁড়াতে পারল না… বর্শার ফলা বুকের মধ্যে আরও গম্ভীর হয়ে ঢুকে যেতে লাগল… অবশেষে রক্তাক্ত দেহে মৃত্যুবরণ করল তাইগর…

সেই ঘটনার কথা আমি জীবনে ভুলতে পারব না। ওটা শিকার নয়, লড়াই। কোনো সাদা চামড়ার মানুষ ওভাবে লড়াই করতে পারে না। ওইভাবে তাইগরকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে বধ করার ক্ষমতা রাখে কয়েকজন রেড ইন্ডিয়ান। তারাও বোধ হয় শেষ হয়ে গেছে। জোকুইম ছাড়া কোনো জীবিত তাইগরের সাক্ষাৎ আমি পাইনি। সাশা, আমার কথা শোনো, যেভাবেই হোক জোকুইমের সঙ্গে দেখা করো। ব্রেজিলের মাটিতে তোমার মতো বিদেশির বেঁচে থাকা কঠিন, এখানে বাঁচার কৌশল তোমায় শেখাতে পারে একমাত্র জোকুইম।

সাশা অবশ্য ডম কার্লোসের উপদেশ শিরোধার্য করে তৎক্ষণাৎ জোকুইমের আস্তানার উদ্দেশে যাত্রা করেনি। কিন্তু কিছুদিন পরেই ফাভেলের সঙ্গে কলহ যখন রক্তাক্ত সংঘর্ষে পরিণত হল, তখন যে-ঘটনাচক্রের আবর্তে সাশা সিমেল একদিন তাইগরের সান্নিধ্যে এসে পড়েছিল এবং ব্রেজিলের জনপদ, অরণ্য ও জলাভূমির বুকে নরঘাতক দ্বিপদের ছুরি, বন্দুক আর নরখাদক শ্বাপদের শানিত নখদন্তকে যেভারে ফাঁকি দিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিল সেইসব চমকপ্রদ বিবরণ পরিবেশিত হয়েছে বর্তমান কাহিনির পরবর্তী অংশের বিভিন্ন পরিচ্ছেদে…

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

খুব ছোটোবেলা থেকেই সাশা সিমেল ছিল দাদা আর্নস্টের অনুরাগী ভক্ত। আর্নস্ট চিরকালই গৃহবিমুখ, যাযাবর। সাশা যখন বারো বছরের বালক, সেইসময় আর্নস্ট গৃহত্যাগ করে দক্ষিণ আমেরিকায় চলে যায়। কিছুকাল পরে সিমেল পরিবারের সকলে জানতে পারল আর্জেন্টিনার নৌসেনাদলে যোগ দিয়েছে আর্নস্ট। তখন থেকেই সাশা ভেবে রেখেছিল বড়ো হয়ে সে দাদার কাছে চলে যাবে। কয়েক বৎসর পরে আর্জেন্টিনার একটা রেলপথ যেখানে তৈরি হচ্ছে, সেখানেই অনেক খোঁজাখুঁজি করে দাদাকে ধরে ফেলল সাশা। তখন আর সাশা নিতান্ত বালক নয়, দস্তুরমতো এক বলিষ্ঠ যুবক। যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করার সামর্থ্য তার হয়েছে।

আর্নস্ট আর সাশা আবার বিচ্ছিন্ন হল। আর্নস্ট চলে গেল উত্তর দিকে ব্রেজিল নামক প্রদেশে হিরার সন্ধানে, আর সাশা যেখানে গেল সেই জায়গাটার নাম হল বুয়েনস এয়ার্স।

এরপর বহুদিন দাদার দেখা পায়নি সাশা। একবার মাত্র একটা চিঠি পেয়েছিল সে দাদার কাছ থেকে। সেই চিঠির সূত্র ধরে পাসো ফানডো শহরে এসে এক জার্মান ইঞ্জিনিয়ারের কাছে অনুসন্ধান করে আর্নস্টের হদিশ পেয়ে গিয়েছিল সাশা।

জার্মানটির নির্দেশ অনুসারে একটি ভোজনাগারে ঢুকেই সাশা তার দাদাকে দেখতে পেল। কিন্তু দুই ভাইয়ের মিলনের আনন্দকে তিক্ত করে দিল ফাভেল নামে একটি লোক। আর্নস্টের সঙ্গে একই টেবিলে বসে পানভোজন করছিল ওই লোকটি। তার চেহারাটা ছোটোখাটো হলেও স্বভাব ছিল অতিশয় উগ্র। প্রথম দর্শনেই সাশাকে সে অপমান করে বসল। আর্নস্ট তৎক্ষণাৎ বাধা না-দিলে নির্ঘাত সাশার ঘুসি পড়ত ফাভেলের মুখে। দৈহিক শক্তিতে ফাভেল কোনোমতেই সাশার সঙ্গে পাল্লা দিতে সমর্থ ছিল না, হয়তো এক ঘুসিতেই সে ঠিকরে পড়ত মাটিতে। কিন্তু সে-রকম কিছু ঘটলে পরবর্তীকালে সাশার জীবন যে বিপন্ন হতে পারে, সে-বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল আর্নস্ট–সেইজন্যই ব্যাপারটাকে মুখোমুখি থেকে হাতাহাতি পর্যন্ত গড়াতে দেয়নি সে।

ভোজনাগার থেকে ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে এল আর্নস্ট এবং কিছুদূর হেঁটে গিয়ে প্রবেশ করল একটি কুঁড়েঘরে। সাশা বুঝল ওই কুটিরটি এখন দাদার আস্তানা।

আলেক্স! আর্নস্ট বলল, মাত্তো গ্রসো জায়গাটাতে ছড়ানো আছে রাজার ঐশ্বর্য! শুধুমাত্র তুলে নেওয়ার অপেক্ষা।

সাশা বলল, তা তো বুঝলাম। কিন্তু তুমি তাহলে ফিরে এলে কেন?

আমার মদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। জঙ্গলে তো মদ পাওয়া যায় না। তাই মদ কিনতে এখানে এসেছিলাম। কিন্তু আমার ঘোড়াটা এখানে এসেই হঠাৎ মারা গেল। গায়ে হেঁটে অতদূর যাওয়া সম্ভব নয়। অথচ ঘোড়া কেনার মতন যথেষ্ট টাকাও আমার কাছে নেই। অতএব এখানেই একটা রুপার দোকানে কাজ নিলাম। তোকেও ওখানে একটা কাজ আমি জুটিয়ে দিতে পারব আলেক্স। তারপর কিছু টাকা হলে দুই ভাই আবার ফিরে যাব মাত্তো গ্রসোর জঙ্গলে বুঝেছিস? সেখানে ছড়িয়ে আছে রাশি রাশি হিরা, যাকে বলে রাজার ঐশ্বর্য।

কিন্তু দাদা, সাশা বলল, ওই জার্মানটা আমায় বলছিল তুমি নাকি অসুস্থ সত্যি?

এমন কিছু গুরুতর ব্যাপার নয়, আর্নস্ট বলল, কাঁধে একটা পুরানো ক্ষত আছে।

আর্নস্ট তার শার্ট খুলে ফেলল। সাশা দেখল দাদার কাঁধে একটা শুষ্ক ক্ষতচিহ্ন ছড়িয়ে আছে।

এটা একটা শয়তানের উপহার। তবে আবার একদিন লোকটার সঙ্গে আমার নিশ্চয়ই দেখা হবে। সে আমাকে যা দিয়েছে, সেইদিনই তাকে সুদে-আসলে তা ফিরিয়ে দেব।

সাশা ভাবতে লাগল মাত্তো গ্রসো নামে জায়গাটা ছেড়ে আসার সঙ্গে ওই ক্ষতচিহ্নটার হয়তো কিছু যোগসূত্র আছে–নিতান্ত অকারণে শুধুমাত্র মদ কেনার জন্য রাজার ঐশ্বর্য ফেলে পাসো ফানডো শহরে চলে আসেনি আর্নস্ট।

অনেকদিন পরে দুই ভাই-এর দেখা কথা বলতে বলতেই রাত শেষ হয়ে গেল। নিজের মালপত্র একটা হোটেলে রেখে দাদার সন্ধানে পথে বেরিয়েছিল সাশা। এবার জিনিসগুলো নিয়ে সে দাদার কুঁড়েঘরে এসে ঢুকল। স্থির হল দুই ভাই এখন এখানেই থাকবে। হের আলবার্ট স্মিথ নামে যে জার্মান রৌপ্য-ব্যবসায়ীর দোকানে আর্নস্ট কাজ করে সেখানেই ছোটো ভাইকে একটা কাজ জুটিয়ে দেবে আর্নস্ট। কিছু টাকা জমাতে পারলেই আবার হিরার সন্ধানে মাত্তো গ্রসোতে হানা দেবে আর্নস্ট-এবার আর একা নয়, সঙ্গে থাকবে ছোটো ভাই সাশা।

পরের দিনই কাজে লেগে গেল সাশা সিমেল।

একটি প্রকাণ্ড রোলার চালিয়ে রুপোর পাতগুলিকে পাতলা চাদরে পরিণত করার জন্য সাশা এবং আরও দুটি লোককে নিযুক্ত করেছিল মালিক। সাশা তার পাশের লোকটির মুখের দিকে তাকায়নি–নিবিষ্টচিত্তে সে মালিকের নির্দেশ অনুসারে কাজ করছিল। হঠাৎ খুব ধীরে মৃদুস্বরে কেউ তাকে উদ্দেশ করে বলল, সিনর সিমেল! তুমি বুঝি মালিককে তোমার গায়ের জোর দেখিয়ে খুশি করতে চাও? তোমার দেশে যে জানোয়ারগুলো ভার বহন করে, তারা বোধ হয় কথা কয় না?

সচমকে কণ্ঠস্বর লক্ষ করে ঘুরে দাঁড়াল সাশা। আবার চমক! কণ্ঠস্বরের মালিক ফাভেল! ভোজনাগারের মধ্যে আগের দিন যার সঙ্গে হাতাহাতির উপক্রম হয়েছিল সেই ব্যক্তি!

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

কেটে গেছে ছয়টি মাস। ওই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে সাশা। রুপোর জিনিস তৈরি করা ছাড়া আরও একটি বিদ্যা রপ্ত হয়েছে তার। সাশা এখন বন্দুক, পিস্তল প্রভৃতি আগ্নেয়াস্ত্র মেরামত করতে পারে। জার্মান মালিকটি শুধু রুপোর কারবার করে না, বিকল আগ্নেয়াস্ত্র মেরামত করার দায়িত্বও সে গ্রহণ করে উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। তার বেতনভোগী কর্মচারীর দল ওই কাজগুলি করে। বলাই বাহুল্য, সাশা এবং তার বড়োভাই আর্নস্ট উক্ত কর্মচারীদের দলভুক্ত। সাশা ভোজনাগারে আড্ডা দিতে না-গেলেও সহকর্মীদের সঙ্গে সে মেলামেশা করত, কাজেই তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে তার অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ফাভেল ছিল একটি ব্যতিক্রম, সাশার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে সে রাজি হল না।

হঠাৎ দুটি ঘটনা ঘটল পর পর। যার ফলে পাসো ফানডো শহরে দুই ভাইয়ের মানমর্যাদা বাড়ল এবং ফাভেলের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটল।

একদিন বিকালে আর্নস্ট তার ছোটোভাইকে জানাল প্যারাগুয়ে থেকে একটি বলবান মানুষ শহরে উপস্থিত হয়েছে। শহর-চত্বরে সে তার অসামান্য দৈহিক শক্তি প্রদর্শন করবে সেইদিনই সন্ধ্যায়। কৌতূহল চরিতার্থ করতে আর্নস্টের সঙ্গে নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হল সাশা।

যথাস্থানে গিয়ে দুই ভাই দেখল সজ্জিত মঞ্চের চারপাশে প্রচুর জনসমাগম ঘটেছে। উক্ত বলবান মানুষটি মঞ্চের উপর ওঠেনি, নীচে দাঁড়িয়ে জনতার সপ্রশংস দৃষ্টি উপভোগ করছে। লোকটির চেহারা সত্যিই প্রশংসা করার মতন এ-কথা একনজর তাকিয়েই মেনে নিল দুই ভাই। লোকটির নামও জানা গেল–সিনর মার্সেলো ক্যাসারাস।

উক্ত মার্সেলোর কাঁধের উপর ছড়ানো ছিল একটা জাগুয়ারের চামড়া এবং ওই চামড়াটা তার কোমরে এসে আবদ্ধ হয়েছে একটা প্রশস্ত কৃষ্ণবর্ণ চর্মবন্ধনী বা বেল্ট দিয়ে। তার পা থেকে অধমাঙ্গ কালো মোজার মতন এক ধরনের আঁটোসাঁটো পোশাকে ঢাকা রয়েছে। পোশাকের ভিতর দিয়েই লোকটির জানু ও পায়ের বৃহৎ পেশিগুলি দৃশ্যমান হয়ে জনতার মুগ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। লোকটির গায়ের রং বাদামি, পেশিস্ফিত শরীরের গঠন বুঝিয়ে দিচ্ছে শরীরের অধিকারী অসাধারণ শক্তিমান। তার চোয়াল প্রকাণ্ড, ওষ্ঠাধর পুরু, নাক বাজপাখির ঠোঁটের মতন বাঁকা। নাকের বাঁকা গড়নের জন্য মনে হয় লোকটি সর্বদাই বিরক্তির সঙ্গে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তবে মুখের গঠন যেমনই হোক না কেন, লোকটি আদৌ বদমেজাজি নয়। কারণ, জনতার অভিনন্দনকে স্বীকৃতি জানিয়ে তার ওষ্ঠাধরে ফুটে উঠেছে নীরব হাসির আভাস।

মার্সেলো হচ্ছে সবচেয়ে বলিষ্ঠ মানুষ,মঞ্চের উপর থেকে হেঁকে বলল একটি বিরলকেশ খর্বকায় ব্যক্তি, এমনকী বনের জাগুয়ারও মার্সেলোকে দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়।

বেঁটেখাটো মানুষটি নিশ্চয়ই সে মার্সেলোর ম্যানেজার আবার হাঁক দিল, ওহে আমার আদরের খোকা, এবার মঞ্চের উপর শুয়ে পড়ো। তোমার অমানুষিক শক্তির পরিচয় দাও সকলের কাছে। ভালোমানুষের ছেলেরা তোমায় দেখতে এসেছে, তাদের হতাশ কোরো না।

জাগুয়ারের চামড়াটা একটানে খুলে ফেলল মার্সেলো, পরক্ষণেই প্রকাণ্ড লাফ মেরে উঠে এল মঞ্চের উপর এবং শুয়ে পড়ল চিত হয়ে।

ম্যানেজারের ইঙ্গিতে বিপুলবপু এক নিগ্রো প্রকাণ্ড এক নেহাই এনে রাখল মার্সেলোর বুকের উপর; তারপর প্রায় এক ইঞ্চি পুরু একটি লোহার ডান্ডা ওই নেহাই-এর উপর রেখে সরে দাঁড়াল।

সিনর! তোমায় দেখে মনে হচ্ছে তুমি বেশ শক্তিমান পুরুষ, বেঁটে ম্যানেজার হঠাৎ ভিড়ের ভিতর দণ্ডায়মান সাশার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল, হাতুড়ি আর ছেনি দিয়ে ওই লোহার ডান্ডাটাকে তুমি ভেঙে ফেলতে পারো?

তৎক্ষণাৎ এক লাফে মঞ্চের উপর উঠে এল সাশা। নীচে যেখানে দাদা দাঁড়িয়ে আছে, সেদিকে তাকাল সে দেখল আর্নস্টের ঠোঁটে কৌতুকের হাসি–অর্থাৎ দাদা তাকে সমর্থন করছে।

বাঃ! সিনর সিমেল, তুমি যোগ্য ব্যক্তিকেই সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছ, ভেসে এল বিদ্রূপশানিত কণ্ঠস্বর, একটা ষাঁড়ের বিরুদ্ধে আর একটা ষাঁড়! বাঃ! চমৎকার!

স্বর লক্ষ করে ঘুরে দাঁড়াতেই সাশা কণ্ঠস্বরের মালিককে দেখতে পেল–ফাভেল!

আরও একজন ফাভেলের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল–আর্নস্ট।

এই রে! এই বুঝি দাদা ঝাঁপিয়ে পড়ে ফাভেলের উপর–সাশা ইশারায় আর্নস্টকে নিষেধ করতে উদ্যত হল। কিন্তু ঠিক সেই সময় ম্যানেজার তার জামার হাত ধরে টানল এবং বুঝিয়ে দিল সাশাকে কী করতে হবে। নেহাই-এর উপর বসানো লোহার ডান্ডার গায়ে ছেনিটাকে ধরে রাখবে বিশালদেহী নিগ্রো ওই ছেনিতে হাতুড়ি মেরে ডান্ডাটাকে ভেঙে দুই খণ্ড করার দুরূহ কর্তব্যটি সম্পন্ন করার দায়িত্ব পড়েছে সাশার উপর।

আমি জোরে আঘাত করে ডান্ডা ভেঙে ফেলতে পারি, সাশা বলল, কিন্তু লোকটা যে তাহলে মারা পড়বে।

মার্সেলোর কিছু হবে না, ক্ষুদ্রকায় ম্যানেজার হাসল, তুমি সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করো।

সোজাসুজি আঘাত করবে ঠিক ছেনির উপর, তলা থেকে ভেসে এল ফাভেলের কণ্ঠস্বর, ষাঁড়েরও কিছু দক্ষতা থাকা দরকার। দেখো, যেন আঘাতটা ফসকে না যায়।

সাশা দাদার দিকে তাকাল আর্নস্ট ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে, এখনই বুঝি সে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফাভেলের ঘাড়ে। হাত নেড়ে দাদাকে কিছু করতে নিষেধ করল সাশা, তারপর মঞ্চের একেবারে কিনারায় এসে দাঁড়াল।

সিনর ফাভেল! তুমি বোধ হয় তোমার গায়ের জোর দেখাতে চাও? সাশা ফাভেলকে উদ্দেশ করে বলল, আমি ঠিক এই কাজটা করতে উৎসুক নই। বেশ তো তুমিই উঠে এসো, দেখ এই হাতুড়িটা যদি তুলতে পারো।

ফাভেলের মুখ বিকৃত হয়ে গেল। দারুণ ক্রোধে তার দুই চোখ জ্বলে উঠল আগুনের মতো পরক্ষণেই হাতের সিগারেট মঞ্চের খুঁটিতে ঘষে নিবিয়ে দিয়ে দ্রুত পদক্ষেপে অদৃশ্য হয়ে গেল জনতার মধ্যে।

সাশা এবার হাতুড়িটা তুলে নিল। পরপর তিনবার সজোরে আঘাত হানল সে। দু-টুকরো হয়ে ছিটকে পড়ল লৌহদণ্ড। মার্সেলো এবার একহাতের বগলে নেহাইটাকে চেপে ধরে উঠে দাঁড়াল। দারুণ উল্লাসে চিৎকার করে তাকে অভিনন্দন জানাতে লাগল সমবেত জনতা। মৃদুহাস্যে জনতাকে অভিবাদন জানাল মার্সেলো।

জনতার উৎসাহ এবার মার্সেলো আর সাশার মধ্যেও খেলোয়াড়ি মনোভাব জাগিয়ে তুলল। সাশাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দাঁতে কামড়ে চেয়ার সমেত সাশাকে শূন্যে তুলে ফেলল মার্সেলো। তারপর একটা মোটরগাড়ি ছুটে এসে মার্সেলোর বুকের উপর দিয়ে চলে গেল। পরপর আরও কয়েকটি খেলা দেখিয়ে দর্শকদের বিস্ময়ে স্তব্ধ করে দিল প্যারাগুয়ের বলিষ্ঠ মানুষ! রাত পর্যন্ত নিবিষ্টচিত্তে সব খেলা দেখল সাশা, তারপর ম্যানেজারকে ডেকে বলল, আমরা যদি একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করি, তাহলে বিশাল এক জনতার সমাবেশ ঘটবে।

বেঁটে ম্যানেজার হঠাৎ সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল, কীরকম প্রতিযোগিতার কথা বলছ তুমি?

কুস্তি, সাশা বলল, ওই বিদ্যাটা আমার ভালোই জানা আছে।

তুমি কেমন পারিশ্রমিক আশা কর? ম্যানেজার জানতে চাইল, অবশ্য যদি পারিশ্রমিকের অর্থ গ্রহণ করার জন্য তুমি জীবিত থাকো।

সাশা বলল, যে জিতবে, সে সমস্ত টাকা পাবে। পাশে দাঁড়িয়ে ছিল দাদা আর্নস্ট, সে সাশার হাত চেপে ধরল। তুমি নিতান্ত নির্বোধ, আলেক্স, আনস্ট বলে উঠল, লোকটা তোমাকে দু-টুকরো করে ভেঙে ফেলবে।

তাহলে টিকিট বিক্রি যে-টাকা উঠবে, সবটাই সে নিয়ে যাবে, সাশা ম্যানেজারের দিকে তাকাল, তুমি কী বল?

মার্সেলো পাশে এসে হাসিমুখে সাশার কথা শুনছিল। ম্যানেজার কিছু বলার আগেই সে বলে উঠল, আমি খুনি নই।

তুমি যদি আমার প্রস্তাবে রাজি না হও, তাহলে স্বীকার করো তুমি ভয় পেয়েছ, সাশা বলল।

মার্সেলোর মুখের হাসি মুছে গেল, ললাটে ফুটল কুঞ্চনরেখা।

মার্সেলো কাউকে ভয় পায় না, ম্যানেজার বলল, তোমার মৃত্যুর জন্য তুমিই দায়ী হবে।

আর্নস্ট ছেটো ভাই সাশার নিরাপত্তার কথা ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়লেও সাশার মনে দুশ্চিন্তা ছিল না একটুও। সাশা জানত মার্সেলো প্রচণ্ড শক্তিশালী পুরুষ, সে যদি চেপে ধরতে পারে, তাহলে সাশার মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলবে অনায়াসে কিন্তু ক্ষিপ্র গতি ও কৌশলের সাহায্যে প্রতিদ্বন্দ্বীকে যে পরাস্ত করা যাবে, এ-বিষয়ে সাশা ছিল নিশ্চিত। মার্সেলো অমানুষিক শক্তির অধিকারী হলেও মল্লযুদ্ধ সম্বন্ধে তার যে কোনো অভিজ্ঞতা নেই, সেটাও বুঝতে পেরেছিল সাশা।

স্থানীয় একটি নাট্যশালায় পূর্বোক্ত প্রতিযোগিতার স্থান নির্ণয় করা হল। আর্নস্ট এবং সাশা ডম কার্লোসের সঙ্গে দেখা করে প্রতিযোগিতার খবর জানিয়েছিল। ডম কার্লোস বলল সে যথাসময়ে যথাস্থানে উপস্থিত থাকবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত টিকিট বিক্রি না হয়, ততক্ষণ সে টিকিটঘরের ভিতর বিক্রেতাদের সঙ্গেই অবস্থান করবে। শুধু তাই নয়–টিকিট বিক্রির সমস্ত টাকা সে নিজের কাছেই রাখবে প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত।

আর্নস্টের দিকে তাকিয়ে ডম কার্লোস বলল, সিনর ফাভেল আর তোমাদের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে এটা আমি লক্ষ করেছি। যাতে কোনো অশান্তি না হয়, সেইজন্যই আমি প্রতিযোগিতা চলার সময়ে উপস্থিত থাকব।

ফাভেল যেন সতর্ক থাকে, চাপা গলায় গর্জে উঠল আনস্ট, আমি ওই ইঁদুরটার অসভ্যতা অনেকদিন সহ্য করেছি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ওকে এবার উচিত শিক্ষা দেব।

নির্দিষ্ট দিনে মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে সাশা দেখল মঞ্চের কিনারায় বসে আছে ফাভেল। সে একা নয়, তার আশেপাশে রয়েছে একদঙ্গল লোক, স্পষ্টই বোঝা যায় ওরা সবাই ফাভেলের স্যাঙাত সকলের মুখেই জ্বলছে সিগারেট, ধোঁয়ার আড়ালে মানুষগুলোর মুখ হয়ে গেছে অস্পষ্ট। মাঝে মাঝে লোকগুলোকে চাপা গলায় কিছু বলছিল ফাভেল। সাশা একটা ষড়যন্ত্রের আভাস পেল।

প্রথম রাউন্ডে বার বার আক্রমণ করল মার্সেলো। প্রত্যেকবারই তার আক্রমণ এড়িয়ে জমিতে-পেতে-রাখা ক্যানভাসের উপর তাকে ফেলে দিল সাশা। মার্সেলো অবশ্য প্রতিবারই লম্ববান অবস্থা থেকে দণ্ডায়মান হয়েছে এবং খ্যাপা ষাঁড়ের মতন তেড়ে গেছে প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে। হঠাৎ একবার মার্সেলোর কোমর জড়িয়ে ধরে কুস্তির এক প্যাঁচে তাকে জমিতে পেড়ে ফেলল সাশা। মার্সেলো তার শরীরটাকে বাঁকিয়ে ফেলল, ঘাড়ের পেশিগুলোর প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগ করে কঁধ দুটোকে জমির উপর তুলে রাখল কিছুতেই সাশা তাকে চিত করতে পারল না। প্রথম রাউন্ডের লড়াই সমান সমান হল।

দ্বিতীয় রাউন্ডে সাশার শ্বাসকষ্ট শুরু হল–ফাভেল ও তার বন্ধুদের সিগারেট উদগিরণ করছে ধূম্রজাল এবং সেই ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে মঞ্চের উপর উঠে এসে বিব্রত করছে সাশাকে। মাঝে মাঝেই ধোঁয়ার আক্রমণে কেশে উঠছে সাশা।

হঠাৎ লড়াই থামিয়ে মঞ্চের ধারে এসে দাঁড়াল সাশা, নীচে ফাভেলের দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, তুমি যেভাবে সিগারেট ফুঁকছ, ওভাবে কেউ সিগারেট টানে না। ধোঁয়ার জন্যে আমাদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। দর্শকরা এখানে এসেছে কুস্তি দেখতে আশা করি তাদের কথা ভেবে তোমরা আর সিগারেট টানবে না। এভাবে ধোঁয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে কাশতে কাশতে কুস্তি লড়া সম্ভব নয়।

ফাভেল হাতের সিগারেট ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে আগুন নিবিয়ে দিল। তার বন্ধুরাও তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করল। তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল লড়াই। কৌশল ও শক্তির যুদ্ধে কৌশলই জয়ী হল। অর্থাৎ সাশার কাছে পরাজিত হল মার্সেলো।

মঞ্চের উপর থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে ফাভেল ও তার বন্ধুদের দেখতে পেল সাশা। ফাভেলের মুখ রক্তহীন বিবর্ণ–সাশা বুঝল ফাভেল মার্সেলোর উপর বাজি ধরেছিল, সেই বাজি সে হেরে গেছে। সাশার শরীর ও মন তখনও উত্তপ্ত, তখনও সে থেকে থেকে কাশছে, ফাভেলকে দেখেই তার মাথায় ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল। দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে এসে সে ফাভেলের সামনে দাঁড়াল।

সিনর ফাভেল! তুমি যদি আমার মুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছড়িয়ে দিতে চাও, সাশা বলল, তাহলে আমি যখন একা থাকব, তখনই ওই কাজটা করো। তুমি আর তোমার বন্ধুরা শুধু আমাকেই বিব্রত করোনি, প্যারাগুয়ে থেকে যে ভদ্রলোক এখানে এসেছেন জনতাকে আনন্দ দিতে তাঁকেও তোমরা যথেষ্ট জ্বালিয়েছ।

ফাভেলের জবাবের জন্য অপেক্ষা না-করে পাশের দরজা দিয়ে মঞ্চের পিছন দিকে চলে গেল সাশা। হঠাৎ কেউ তাকে স্পর্শ করল। ঘুরে দাঁড়িয়ে ডম কার্লোসকে দেখতে পেল সাশা। কার্লোসের পাশে দাদা আর্নস্ট।

এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে চলে এসো, কার্লোস বলল, জামাকাপড় ছাড়ার দরকার নেই। সমস্ত টাকাপয়সা আর তোমার পোশাক পরিচ্ছদ আমার কাছেই রয়েছে। বাইরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে একটা ঘোড়ার গাড়ি। চলে এসো চটপট, এখন আর একটা কথাও নয়।

পথে কোনো কথা হল না। ডম কার্লোস শুধু একবার বলেছিল জনতার মধ্যে অসন্তোষ আর ক্ষোভ সে লক্ষ করেছে। আর্নস্টের কুটিরে পৌঁছে তারা যখন ধূমপান করছে, সেইসময় সাশাকে লক্ষ করে কার্লোস বলল, তুমি ফাভেলকে চটিয়ে কাজটা ভালো করনি। তুমি তাকে অপমান করেছ। ফাভেল বাজি হেরে বেশ কিছু টাকা গচ্চা দিয়েছে। তার উপর তোমার কথায় উপস্থিত সকলেই বুঝেছে ফাভেল বাজি হেরেছে। টাকা আর ইজ্জত, দুটোই সে হারিয়েছে। সেইজন্য তোমাকেই সে দায়ী করবে। কিছুতেই সে তোমাকে ক্ষমা করবে না।

সাশা উদ্ধতভাবে জবাব দিল, ফাভেল আমার ক্ষতি করতে পারবে না। সে যদি আমার সঙ্গে লাগতে আসে, তাহলে সে-ই বিপদে পড়বে।

ডম কার্লোস বলল, আমার কথা তুমি বুঝতে পারছ না। আমাদের রীতিনীতি তোমাদের মতো নয়। আমরা প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য জীবন বিপন্ন করতে পারি, কিন্তু অপমানিত হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না। এইভাবে প্রতি মুহূর্তে ফাভেলকে ছোটো করার চাইতে তাকে খুন করলেও তার প্রতি যথেষ্ট দয়া দেখানো হত।

পূর্বোক্ত ঘটনার পর কয়েকটা মাস অতিবাহিত হল। মার্সেলোকে কুস্তিতে হারিয়ে বেশ মোটা টাকা, পেয়েছিল সাশা আর আর্নস্ট। কিন্তু তারপর যা ঘটল, তার ফলে দুই ভাইয়ের সঙ্গে ফাভেলের বিবাদ আরও জটিল এবং আরও মারাত্মক পরিণতির দিকে এগিয়ে চলল।

ডম কার্লোস একদিন এসে সিমেল ভাইদের জানাল পাসো ফানডো শহরে লিওন বেদুইনোনামে এক দুর্ধর্ষ তুর্কি মল্লযোদ্ধা উপস্থিত হয়েছে। লোকটি সাও পাওলো শহরে যাওয়ার পথে পাসো ফানডোতে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যাবে–উদ্দেশ্য, এই শহরে কুস্তি লড়ে কিছু অর্থ উপার্জন।

খবরদার,ডম কার্লোস সাশাকে বলল, তুমি বেদুইনোর সঙ্গে কুস্তি লড়তে যেয়ো না। ওই লোকটা মাংসপেশির চর্চা করে নিজেকে বলিষ্ঠ বলে প্রচার করে না। কিন্তু ওই তুর্কি মল্লযোদ্ধা ভীষণ শক্তিমান দক্ষিণ অঞ্চলে এক ইংরেজ কুস্তিগিরের সে ঘাড় ভেঙে দিয়েছে। হয়তো মানুষ খুনের অভিযোগে লোকটাকে আমি গ্রেপ্তার করতে পারি। তুমি বেদুইনোর সঙ্গে শক্তিপরীক্ষা করতে গেলে তোমার জীবন বিপন্ন হবে। আমি তোমায় সতর্ক করে দিচ্ছি।

শহর-চত্বরে যেখানে মার্সেলোর সঙ্গে লড়াই করেছিল সাশা, সেইখানেই এক রবিবার সন্ধ্যায় জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করল তুরস্ক-দেশীয় মল্লযোদ্ধা–লিওন বেদুইনো। লোকটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল সাশা যেমন লম্বা, তেমনি চওড়া, বৃষস্কন্ধ, কবাটবক্ষ; শালগাছের গুঁড়ির মতো পেশিস্ফীত দুই বাহুর অধিকারী বেদুইনোকে দেখলেই বোঝা যায় মানুষটা অমিতশক্তিধর। সাশার পূর্বর্তন প্রতিদ্বন্দ্বী মার্সেলো এই মল্লবীরের তুলনায় নিতান্তই তুচ্ছ। দেহের তুলনায় বেদুইনোর মাথাটি খুবই ছোটো, নাকের তলায় বিশাল গোঁফ দুই প্রান্তে সরু হয়ে উঠে গেছে গালের দুই ধারে এবং তার স্থল ওষ্ঠাধরে যে নীরব হাসির রেখা খেলা করছে, তাতে সরল কৌতুকের পরিবর্তে ফুটে উঠেছে নিষ্ঠুর হিংসার আভাস। প্রথম দর্শনেই লোকটিকে অপছন্দ করল সাশা সিমেল।

মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে বেদুইনো চ্যালেঞ্জ জানাল–জনতার মধ্যে যদি কোনো সাহসী মল্লযোদ্ধা থাকে, তাহলে সে তার সঙ্গে কুস্তি লড়তে রাজি।

এইবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে বেদুইনোর সর্বাঙ্গ জরিপ করল সাশা। লোকটার কাধ ও পৃষ্ঠদেশ বিশাল মাংসপেশিতে সমৃদ্ধ। সাশা জানত কাধ আর পিঠের বৃহৎ মাংসপেশি মল্লযুদ্ধ বা কুস্তির পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু ওই ধরনের পেশি বক্সিং মুষ্টিযুদ্ধের পক্ষে অসুবিধাজনক। কারণ, কঁধ ও পিঠের স্থূল মাংসপেশি প্রচণ্ড শক্তির আধার হলেও দ্রুত আঘাত হানতে অপারগ–অতএব যে মাংসপেশির বিস্তার কুস্তির পক্ষে অত্যাবশ্যক, সেই পেশিশক্তি বিদ্যুত্বৎ ক্ষিপ্ত বক্সার বা মুষ্টিযোদ্ধার বিরুদ্ধে একেবারেই অকেজো। সাশা বুঝে নিল কুস্তিতে বেদুইনোকে পরাস্ত করতে না-পারলেও মুষ্টিযুদ্ধে তাকে সে নির্ঘাত হারাতে পারবে।

মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে মল্লবীরকে উদ্দেশ করে সাশা বলল, বেদুইনো, আমার একটি শর্ত যদি মেনে নাও, তাহলেই আমি কাল রাতে তোমার সঙ্গে কুস্তি লড়তে রাজি আছি।

ভ্রূ কুঁচকে বেদুইনো সন্দিগ্ধকণ্ঠে বলল, শর্তটা কী?

কাল রাতে আমি তোমার সঙ্গে কুস্তি লড়ব। কিন্তু তার পরের রাতে আমার সঙ্গে তোমার দশ রাউন্ড বক্সিং লড়তে হবে। রাজি?

কয়েকটি মুহূর্ত চিন্তা করল বেদুইননা, তারপর ঘাড় নেড়ে বলল, আমি রাজি আছি।

সাশার হঠকারিতায় খুব অসন্তুষ্ট হল ডম কার্লোস, কুস্তির দুই রাউন্ড যদি কোনোরকমে আত্মরক্ষা করতে পারো, তাহলে তুমি বেঁচে যাবে সাশা। তবে বেদুইনোকে তুমি কিছুতেই হারাতে পারবে না।

সাশা বলল, কথাটা ঠিক। ওই দু-রাউন্ড আমি কোনোরকমে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখব। তবে ঘুসির লড়াইতে লোকটাকে আমার কাছে হার মানতে হবে এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

মার্সেলোর সঙ্গে লড়াইতে যে নাট্যশালাটিকে নির্বাচন করা হয়েছিল, এবার বেদুইনোর সঙ্গে কুস্তির জন্য সেই জায়গাটাই নির্বাচিত হল।

এক বিশাল জনতার সমাবেশ ঘটেছিল কুস্তি দেখার জন্য। ডম কার্লোস স্বয়ং উপস্থিত ছিল অকুস্থলে, তার সঙ্গে ছিল ছয়জন শান্তিরক্ষক পুলিশ। সাশাকে কার্লোস জানাল সমাগত জনতার মধ্যে বহু লোক এসেছে পিস্তল বা রিভলভার নিয়ে।

সাশা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, কেন?

কার্লোস বলল, পিস্তলধারীদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে ফাভেলের বন্ধুবান্ধব। তবে আমি তোমার বন্ধুদেরও সতর্ক করে দিয়েছি তারাও পিস্তল নিয়ে এসেছে। ফাভেল যদি গুলি চালায়, তাহলে তাকে আমি বাধা দিতে পারব না, কিন্তু ব্যাপারটা যাতে সমানে সমানে হয় সেটা আমি দেখব।

ফাভেলের যে একটি পরিকল্পনা ছিল, সেটা পরে প্রমাণ হল। আর সেই পরিকল্পনা সাশাকে সম্ভাব্য মৃত্যু অথবা গুরুতর জখম হয়ে পঙ্গুত্বের দুর্ভাগ্য থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।

লড়াই শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সাশা বুঝতে পারল বেদুইনো লোকটা মার্সেলের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী। কুস্তির কায়দাকানুনও সে ভালোভাবেই আয়ত্ত করেছে। সাশা তার জীবনে কখনো এমন ভয়ংকর কুস্তিগিরের পাল্লায় পড়েনি। সে বুঝতে পারছিল তুর্কি পালোয়ান যদি তাকে একবার দুই হাতের বাঁধনে বন্দি করতে পারে তাহলে তার পরাজয় অবধারিত–এমনকী হাত-পা ভেঙে পঙ্গু হয়ে যাওয়াও নিতান্ত অসম্ভব নয়। আত্মরক্ষার জন্য মাঝে মাঝে সাশা দড়ির উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ছিল। কুস্তির নিয়ম অনুসারে দড়ি ছেড়ে রিং-এর ভিতরে না-আসা পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপেক্ষা করতে হয় বেদুইনোকেও তাই ওই সময়টুকু আক্রমণ থেকে বিরত থাকতে হচ্ছিল।

একবার যখন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মাথায় মাথা লাগিয়ে পরস্পরকে হাত দিয়ে কাবু করার চেষ্টা করছে, সেইসময় হঠাৎ এক ধাক্কায় সাশার মাথাটা একপাশে কাত হয়ে গেল–সঙ্গেসঙ্গে একটা তীব্র যন্ত্রণার ঢেউ উঠে এল মাথার বাঁ-দিক থেকে! তুরস্কের কুস্তিগির সাশার বাঁ-কান কামড়ে ধরেছে! সাশার ঘাড় বেয়ে গড়িয়ে নামছে লাল রক্তের ধারা!

বেদুইনোর চর্বিবহুল বিশাল উদরে প্রচণ্ড বেগে ঘুসি মারল সাশা। ফল হল তৎক্ষণাৎ দম নেওয়ার জন্য বেদুইনো হাঁ করতেই কানের উপর কামড়টা আলগা হয়ে গেল।

আবার যদি কামড়াতে চেষ্টা করো, দাঁতে দাঁত ঘষে সাশা বলল, এটা তাহলে আর কুস্তি থাকবে না, একেবারে খুনোখুনি হয়ে যাবে।

বেদুইনো চাপা গলায় গর্জন করে কিছু বলল, তার মুখের ভাব হয়ে উঠল ভয়ংকর সে আবার ঝাঁপ দিল সাশাকে লক্ষ করে। আবার দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল; সেইসময় অস্ফুট স্বরে বেদুইনো জানিয়ে দিল একবার যদি সে প্রতিদ্বন্দ্বীর গলাটা নাগালের মধ্যে পায়, তাহলে শ্বাসরোধ করে তাকে সে হত্যা করবে। হত্যার অপরাধে ক্রুদ্ধ জনতা হয়তো তাকে ফাঁসি দিতে পারে, কিন্তু সেই ঝুঁকি নিতে সে প্রস্তুত। সাশা বুঝল লোকটা ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে, এই লড়াই এখন আর প্রতিযোগিতার লড়াই নয়–সাশার পক্ষে এটা এখন প্রাণ বাঁচানোর লড়াই।

আবার বেদুইনের মতো হাত ছাড়িয়ে সরে গেল সাশা। খ্যাপা ষাঁড়ের মতোই তার দিকে আবার তেড়ে এল বেদুইনো। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সাশার কানে এল ফাভেলের তীব্র চিৎকার ওহে তুর্কি যোদ্ধা! এই সাদা চামড়ার মানুষটাকে খুন করো!

সঙ্গেসঙ্গে পিস্তল তুলে শূন্যে গুলি ছুড়ল ফাভেল। তৎক্ষণাৎ চেয়ারের উপর উঠে দাঁড়াল ডম কার্লোস, পরক্ষণেই তার পিস্তল সগর্জনে অগ্নিবর্ষণ করল মাথার উপর ছাতের দিকে। সেই আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আরও কয়েকটা আগ্নেয়াস্ত্র গর্জে উঠল জনতার ভিতর থেকে। বেদুইনো গুলির শব্দ শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর মঞ্চ থেকে নেমে অন্তর্ধান করল বিদ্যুদবেগে!

শূন্যে পিস্তল নাচিয়ে ডম কার্লোস সবাইকে শান্ত হতে বলল। সকলেই জানত কার্লোসের পিস্তল কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না, তাই যারা গুলি ছুঁড়েছিল তারা হাতের অস্ত্র পকেটে লুকিয়ে সুবোধ বালকের মতো শান্ত হয়ে দাঁড়াল। ম্যানেজার জানিয়ে দিল নাট্যশালার ভিতর এমন আচরণ করা অত্যন্ত অন্যায় এবং পরবর্তী রাত্রে মুষ্টিযুদ্ধের প্রতিযোগিতা হবে না। কিন্তু দর্শকরা তখন লড়াইয়ের নেশায় মত্ত, তারা চিৎকার করে আপত্তি জানাতে লাগল।

প্রতিযোগীদের জন্য যে-ঘরটা নির্দিষ্ট ছিল, সেই ঘরে কার্লোসকে নিয়ে প্রবেশ করল সাশা। সেখানে তখন বেদুইনো দ্রুতবেগে গায়ে জামা চড়াচ্ছে, তার চোখ মুখ থেকে মিলিয়ে গেছে হিংস্র আক্রোশের আভাস। সাশাকে দেখেই সে বলে উঠল, আমি পেশাদার কুস্তিগির। আমি মুষ্টিযোদ্ধা নই। বক্সিং আমি লড়তে জানি না। আমি এখনই এই জায়গা থেকে চলে যেতে চাই।

ডম কার্লোস তাকে আশ্বাস দিয়ে জানাল পরের রাতে ওখানে আর গুলি চলবে না। বেদুইনো বলল, টিকিট বিক্রির অর্ধেক টাকা যদি লড়াই শুরু হওয়ার আগেই তাকে দেওয়া হয়, তাহলে সে মুষ্টিযুদ্ধ লড়তে রাজি আছে। সাশা তার প্রস্তাবে সম্মতি জানাল। বেদুইনোর ব্যবহারে সাশা খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছিল, মুষ্টিযুদ্ধের আসরে লোকটাকে ভালো হাতে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই সে প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছিল।

মুষ্টিযুদ্ধ শুরু হল পূর্বোক্ত নাট্যশালায় রাত্রে। দেখা গেল বেদুইনো দক্ষ মল্লযোদ্ধা হলেও মুষ্টিযুদ্ধে সে নিতান্তই আনাড়ি। মুখের উপর কয়েকটা ঘুসি পড়তেই সে হঠাৎ দাঁত দিয়ে তার হাতের দস্তানার ফিতা খুলতে সচেষ্ট হল।

সর্বনাশ! সাশা বুঝল মুষ্টিযুদ্ধের দস্তানা থেকে হাত দুটিকে মুক্ত করতে পারলেই বেদুইনো তাকে আক্রমণ করবে এবং তাহলে সাশার প্রাণসংশয় অবধারিত। শরীর ঝুঁকিয়ে বেদুইনো দাঁত দিয়ে ফিতা খুলছিল, একটা হাত দস্তানা থেকে মুক্ত করে সে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চাইল সাশার দিকে। তৎক্ষণাৎ শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বেদুইনোর চোয়ালে ঘুসি মারল সাশা। বেদুইনো সেই আঘাত সহ্য করতে পারল না, ছিটকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। সাশা এত জোরে ঘুসি চালিয়েছিল যে, তার কবজি প্রায় ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কারো সঙ্গে করমর্দন করার অবস্থাও ছিল না তার।

সাশা জয়লাভ করাতে বিলক্ষণ খুশি হয়েছিল ডম কার্লোস। সে সাশাকে অভিনন্দন জানাতে এল প্রতিযোগীদের জন্য সংরক্ষিত ঘরে। সাশা বলল, লড়াইয়ের আগে বা পরে সে একবারও ফাভেলকে দেখতে পায়নি।

সে ছিল মঞ্চের কাছেই। তুমি তাকে দেখতে পাওনি, কার্লোস বলল, তবে আমি ছিলাম বলে সে এবার তোমায় ঘাঁটাতে সাহস পায়নি। কিন্তু ফাভেল তোমাকে ভবিষ্যতে বিপদে ফেলবে এটা জেনে রাখো। তুমি তাকে লোকের চোখে হেয় করেছ। সে ওই অপমান কখনো ভুলবে না সাশা।

বেদুইনোর সঙ্গে লড়াইতে নেমে সাশা যে-টাকা পেয়েছিল, সেই টাকায় দুটি খচ্চর ও একটি ঘোড়া কিনল সাশা আর আর্নস্ট। কিছু যন্ত্রপাতিও কিনল তারা। আর একটি খচ্চর কিনতে পারলেই দুই ভাই হিরার সন্ধানে মাত্তো গ্রুসোতে রওনা হতে পারে। একটি খচ্চরকে নিজস্ব ব্যবহারের জন্য রাখল সাশা, নাম দিল বেদুইনো!

মার্সেলো আর বেদুইনোর সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে জয়লাভ করে পাসো ফানডো শহরে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠল সাশা। বিশেষ করে রুপার কারখানার সহকর্মী শ্রমিকরা সাশার কৃতিত্বে খুবই খুশি হয়েছিল। তবে ফাভেল যে সাশা সম্পর্কে তীব্র বিদ্বেষ পোষণ করে, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল প্রায়ই। অবশ্য সোজাসুজি সাশার সঙ্গে সে অভদ্র ব্যবহার করেনি একবারও।

কারখানার পিছনে একটা ঘরে শ্রমিকদের খেতে দেওয়া হত; ওই ঘরে একদিন মধ্যাহ্ন ভোজনের সময়ে ভুল করে বসে পড়েছিল সাশা। ফাভেল সাশার ঠিক পিছনেই ছিল, সে হঠাৎ বলে উঠল, সরে যাও, কুত্তার বাচ্চা! এটা আমার জায়গা।

মুহূর্তের মধ্যে ঘর হয়ে গেল স্তব্ধ। সকলেই ভাবছিল এই বুঝি শুরু হয় মারামারি। কিন্তু না সাশা ভুল স্বীকার করে তার নিজের জায়গায় সরে গেল। একবার তার দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে সাশা বুঝল, আর্নস্ট রাগে আগুন হয়ে গেছে, ভাইয়ের আচরণ সে পছন্দ করেনি যেকোনো সময়ে ফাভেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে আর্নস্ট।

যাই হোক, সেদিন আর কিছু ঘটল না। সেই ঘটনার পরেই ডম কার্লোসের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল সাশা। সাক্ষাৎকার হওয়ার পরে তাদের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছিল এবং যে-আলোচনার ফলে জোকুইম গুয়াতে তাইগরেরো সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল সাশা সিমেল–সেইসব কথা সবিস্তারে প্রথম পরিচ্ছদেই বলা হয়েছে, পুনরাবৃত্তি অনাবশ্যক।

ফাভেলের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে চেয়েছিল আর্নস্ট। ছোটোভাই সাশার গা বাঁচিয়ে সরে যাওয়ার ব্যাপারটা তার মোটেই পছন্দ হয়নি। সে নিজেই ফাভেলকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। সাশার অনুরোধে নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে সে স্থানত্যাগ করে চলে যেতে রাজি হল। ডম কার্লোসও দুই ভাইকে স্থানত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছিল, কারণ পাসো ফানডো শহরে থাকলে ফাভেলের সঙ্গে সিমেল-ভাইদের খুনোখুনি ঘটতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। দু-দিন পরে রাত থাকতেই দুই ভাই শয্যাত্যাগ করল। পরিকল্পনা অনুসারে আর্নস্ট একটি ঘোড়া আর দুটি খচ্চর নিয়ে মালপত্র সমেত উত্তর দিকে রওনা দেবে এবং তিনদিনের পথ পার হয়ে রিও উরুগুয়ে ছাড়িয়ে ভাইয়ের জন্য ক্লিভল্যন্ডিয়া নামক স্থানে অপেক্ষা করবে। হের স্মিথের রুপার কারখানার অবশিষ্ট কাজ যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি শেষ করে সাশা তার বেদুইনো নামে খচ্চরটার পিঠে চড়ে যাত্রা করবে এবং দাদার সঙ্গে মিলিত হবে পূর্বনির্দিষ্ট স্থানে।

আর্নস্টকে বিদায় দিয়ে হের স্মিথের কারখানার দিকে চলল সাশা বেদুইনোর পিঠে চড়ে। পথের মধ্যে ডম কার্লোসের সঙ্গে দেখা হল সাশার। একটা প্রকাণ্ড সাদা টুপি মাথায় চড়িয়ে খচ্চরের পিঠে বসেছিল ডম কার্লোস। সাশাকে দেখে হাসিমুখে টুপি খুলে অভিবাদন জানাল কার্লোস, সুপ্রভাত, সিনর সাশা। আজ সকালেই আমার কুকুর লোবো খুব চিৎকার করছিল। খুব শীঘ্রই আমি আর লোবো কোনো অপরাধীর পিছনে তাড়া করব এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। লোবোর চিৎকার হচ্ছে সেই অভিযানের পূর্বসংকেত।

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

কারখানার কাজ শুরু হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে সাশা মালিককে জানিয়ে দিল আর্নস্ট কাজ ছেড়ে চলে গেছে। অসমাপ্ত কাজ যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি শেষ করে সাশা নিজেও কারখানা ছেড়ে চলে যাবে অন্যত্র। দু-দুজন দক্ষ কারিগর তার কারখানা ছেড়ে চলে যাচ্ছে বলে মালিক দুঃখপ্রকাশ করল। ফাভেল কিছু বলল না। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকিয়ে সাশা বুঝল লোকটা খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। হের স্মিথ তার বিদায়ভাষণ জানানোর পর সাশা হঠাৎ এগিয়ে এসে ফাভেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, আমি চিরদিনের মতো বিদায় গ্রহণ করছি, আর কখনো এখানে ফিরে আসব না। আমার উপর কারো রাগ বা বিদ্বেষ থাকলে আমি দুঃখিত হব। সিনর ফাভেল, তুমি কি আমার সঙ্গে করমর্দন করবে না?

অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে নত হয়ে অভিবাদন করল ফাভেল, তারপর সাশার প্রসারিত হাত চেপে ধরল, নিশ্চয়ই সিনর। আমি সানন্দে তোমার হাতে হাত মেলাচ্ছি। তোমার মতো গুণী মানুষের বিচ্ছেদ সমগ্র কারিগর-সম্প্রদায়ের পক্ষেই দুঃখজনক।

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে মালিক হের স্মিথকে উদ্দেশ করে সে বলে উঠল, আমার যন্ত্রপাতিগুলো আমি একবার পরীক্ষা করব, আশা করি কেউ কিছু মনে করবে না।

ইঙ্গিতটা অত্যন্ত অপমানকর। সাশার মনে হল কেউ যেন তাকে সজোরে থাপ্পড় মারল।

হের স্মিথ উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, তুমি ও-কথা বললে কেন? তোমার খুব অন্যায় হয়েছে ফাভেল।

ফাভেল বলল, ও আমার যন্ত্র নিয়ে কাজ করছিল। ও চলে যাওয়ার আগে আমার জিনিসগুলো ঠিক আছে কি না, সেটা আমি দেখে নিতে চাই।

সাশা ফাভেলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। সে বুঝতে পারছিল ফাভেলের দিকে তাকিয়ে থাকলে সে আর রাগ সামলাতে পারবে না। তার মনের যে অবস্থা, তাতে একবার লড়াই শুরু হলে ফাভেলকে খুন না-করে সে থামতে পারবে না। মুখ নামিয়ে সে একমনে কাজ করতে লাগল…

সারাদিন কাজ করেও হাতের কাজ শেষ করতে পারেনি সাশা, তাই রাতেও সে কাজ করছিল। একটা রুপোর তৈরি রেকাব প্রায় শেষ করে এনেছিল সাশা, এইবার শুধু কয়েকটা সূক্ষ্ম কাজ হয়ে গেলেই তার ছুটি। কারখানায় কেউ ছিল না, সাশা একাই কাজ করছিল। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে সাশা ঘুরে দাঁড়াল এবং দেখল তার পিছনেই এসে দাঁড়িয়েছে ফাভেল।

প্রায় সঙ্গেসঙ্গে দরজাটা খুলে গেল, ভিতরে প্রবেশ করল হের স্মিথ। ফাভেলকে দেখে সে প্রশ্ন করল, তুমি এত রাত্রে কীজন্য এখানে এসেছ?

তীব্রস্বরে উত্তর দিল ফাভেল–সাশাকে শোনানোর জন্যই সে চেঁচিয়ে উঠেছিল, আমার যন্ত্রপাতিগুলো যথাস্থানে আছে কি না দেখতে এসেছি।

সাশা তার হাতের দিকে তাকাল। যে-ফাইলটা নিয়ে সে কাজ করছিল, সাধারণত সেইটা দিয়েই ফাভেল কাজ করে। তবে কারখানার যন্ত্রপাতিগুলোর মালিক হচ্ছে হের স্মিথ। সে ছাড়া

অপর কেউ কোনো যন্ত্রের মালিকানা দাবি করতে পারে না। . সাশা তার জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গেসঙ্গে একটা ভারী লোহার যন্ত্র তুলে নিল ফাভেল। তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সাশা র্যাক থেকে তার টুপি আর কোট তুলে নিল এবং হের স্টিথকে উদ্দেশ করে বলল, বিদায় সিনর! আমার কাজ শেষ করে গেলাম। পারিশ্রমিক আমি আগেই পেয়ে গেছি। সুতরাং আমাদের মধ্যে দেনাপাওনার ব্যাপারটাও মিটে গেল।

সাশা বেরিয়ে গেল, কিন্তু জায়গাটা ছেড়ে চলে গেল না। কারখানা থেকে একটু দূরে একটা গাছের ছায়ায় অন্ধকারের মধ্যে আত্মগোপন করে সে ফাভেলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। যাই হোক, কারখানার মধ্যে হের স্মিথকে সাক্ষী রেখে সে কিছু করতে ইচ্ছুক ছিল না। আজকের অপমান সহ্য করা যায় না–ফাভেলকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে শিকার-সন্ধানী শ্বাপদের মতো অপেক্ষা করতে লাগল সাশা।

একটু পরে হের স্মিথের অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে। ফাভেলকে গুড নাইট জানিয়ে বিদায় নিচ্ছে মালিক। তারপরেই হঠাৎ নিবে গেল কারখানার আলো। দরজা বন্ধ করে ফাভেল বাইরে এসে দাঁড়াল। এইবার এগিয়ে এল সাশা, ডাকল, ফাভেল!

কণ্ঠস্বর লক্ষ করে ঘুরে দাঁড়াল ফাভেল, পরক্ষণেই চিৎকার করে উঠল, ডাকাত! ডাকাত!

সাশা ছুটে এল ফাভেলের দিকে। গোলমাল শুনে যেকোনো সময়ে অকুস্থলে চলে আসতে পারে হের স্মিথ। না, এখন এখানে মালিকের উপস্থিতি চায় না সাশা। ইতিমধ্যে একটা পিস্তল বার করে ফেলেছে ফাভেল, কিন্তু অস্ত্রটা ব্যবহার করার সুযোগ পেল না সে মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটাকে ছিনিয়ে নিল সাশা। ফাভেল একহাতে সাশার মুখে নখ দিয়ে আঁচড় কাটছিল আর অন্য হাত দিয়ে চেষ্টা করছিল পিস্তলটা আবার হস্তগত করতে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল একটা দুর্বোধ্য জান্তব ধ্বনি!

কারখানার পার্শ্ববর্তী যে-বাড়িটায় হের স্মিথ বাস করে, সেখান থেকে হঠাৎ ভেসে এল তার গলার আওয়াজ, ফাভেল! কী হয়েছে? কীসের গোলমাল শুনছি ওখানে?

এখনই এখানে হের স্মিথ ছুটে আসবে–লড়াই চটপট শেষ করার জন্য অস্থির হয়ে উঠল সাশা, পিস্তলের বাঁট দিয়ে সজোরে হাতুড়ির মতো আঘাত হানল ফাভেলের মাথায়। একটা ভোঁতা ধাতব শব্দ এবং ফাভেল হল ধরাশয্যায় লম্বমান। সাশা ঝুঁকে দেখল ফাভেলের মুখ চাঁদের আলোতে ফ্যাকাশে সাদা মনে হচ্ছে, রক্তহীন সেই বিবর্ণ মুখে প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই।

সাশা সোজা হয়ে দাঁড়াল। এবার পালাতে হবে। সে ফাভেলকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিল, খুন করতে চায়নি। তবে খুন যখন হয়েই গেছে, তখন পালানো ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু সে স্থানত্যাগ করার আগেই নিকটবর্তী ঝোপ থেকে একটা মূর্তি উঠে দাঁড়াল–তার মাথার উপর সাদা টুপিটা দেখেই মানুষটাকে চিনতে পারল সাশা। ডম কার্লোস!

শেষ পর্যন্ত এই কাণ্ডটা ঘটালে? কার্লোস বলল, তুমি আমার কথামতো শহর ছেড়ে চলে গেলে না কেন? তাহলে এই ব্যাপারটা ঘটত না।

ধরাশায়ী ফাভেলের দিকে সে তাকাল, একবার পা দিয়ে নিস্পন্দ দেহটাকে স্পর্শ করল।

লোকটা আমায় চোর বলেছিল, সাশা বলল, ওর কাছে কৈফিয়ত না-নিয়ে আমি চলে যেতে পারি না।

চোর বলার জন্য আবার কৈফিয়ত কীসের? কার্লোস বলল, হয় তুমি চুরি করেছ, নয়তো চুরি করনি। এক্ষেত্রে আমি ধরে নিচ্ছি তুমি চুরি করনি।

আলবত আমি চুরি করিনি। সাশা ক্রুদ্ধস্বরে বলল, মুখটাকে আমি সেই কথাটাই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।

তুমি বেশ ভালোভাবেই সে-কথা বুঝিয়ে দিয়েছ, কার্লোস বলল, এখন আমাকে বুঝতে হবে লোকটা এখনও বেঁচে আছে কি না। তুমি এখন এখান থেকে চটপট সরে পড়ো। হের স্মিথ এখানে এসে পড়বে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে।

বাক্যব্যয় না-করে তৎক্ষণাৎ স্থানত্যাগ করল সাশা। বেদুইনোর পিঠে দীর্ঘ বনপথ অতিক্রম করে সে যখন একটা নদীর ধারে এসে পৌঁছাল, তখন ভোরের আলো দেখা দিয়েছে। নদী পার হয়ে উত্তর দিকের রাস্তা ধরে অগ্রসর হল সাশা। হঠাৎ পিস্তলের আওয়াজ পেয়ে সে চমকে উঠল। শব্দ লক্ষ করে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতেই তার চোখে পড়ল নদীর অপর তীরে উচ্চভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে ডম কার্লোস। সাশার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় ঘটতেই মাথা থেকে কার্লোস সাদা টুপিটা খুলে ফেলল এবং পিস্তল তুলে আকাশের দিকে গুলি ছুড়ল।

সাশা বুঝল কার্লোস ইচ্ছা করলে পথের মধ্যেই তাকে ধরে ফেলতে পারত। মনে মনে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাশা বেদুইনোকে ছুটিয়ে দিল নির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখে।

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পাসো ফানডোর চাইতে অনেক ছোটো শহর ক্লিভল্যন্ডিয়া। সেখানে পৌঁছে একটা ক্যান্টিনের ভিতর দাদা আর্নস্টকে খুব সহজেই খুঁজে পেল সাশা। ওই শহরে সব মিলিয়ে প্রায় ছ-শো নরনারী বাস করে। এখানে দুপুর মানেই দিবানিদ্রার সময়। ক্যান্টিনে যখন সাশা প্রবেশ করল, তখন সেখানে বসে ছিল আর্নস্ট একা, দ্বিতীয় কোনো প্রাণী সেখানে উপস্থিত ছিল না।

সাশার মুখের দিকে তাকিয়েই আর্নস্ট বুঝতে পারল একটা কিছু গোলমাল হয়েছে।

তোর নিশ্চয়ই বিপদ হয়েছিল? আর্নস্টের প্রশ্ন।

সাশা মাথা নেড়ে সায় দিল। তারপর সমস্ত ঘটনা খুলে বলল।

লোকটা যে মারা গেছে, সে-বিষয়ে তুই কি নিশ্চিত?

আমার মনে হয় ফাভেল মারা গেছে। না হলে ডম কার্লোস আমার পিছনে নদী পর্যন্ত ধাওয়া করত না।

ডম কার্লোস যেমন ধূর্ত, তেমনই বিচক্ষণ, আর্নস্ট বলল, খুব সম্ভব তুমি ওই এলাকা ছেড়ে চলে গেছ কি না সে-বিষয়ে সে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল। মুখে সে যা-ই বলুক, তোমার পিছনে তাড়া করার ইচ্ছা তার কখনোই ছিল না।

কয়েক বছর পরে সাশা জানতে পেরেছিল তার দাদার অনুমান নির্ভুল। পাসোফানডো ছেড়ে ডম কার্লোস যখন সাশাকে অনুসরণ করেছিল, সেইসময় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল ফাভেল মারা যায়নি। দু-দিন ধরে সাশাকে অনুসরণ করেছিল ডম কার্লোস। তার কারণ, সাশা যে উক্ত প্রদেশ ত্যাগ করেছে সে-বিষয়ে সে সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ হতে চেয়েছিল। অবশ্য তখন সাশা জানত না যে, ফাভেল বেঁচে আছে। সে ধরে নিয়েছিল ফাভেলের হন্তারক হিসেবে পুলিশ তাকে খুঁজছে। অতএব ক্লিভল্যন্ডিয়া ছেড়ে তাড়াতাড়ি সরে পড়ার জন্য সাশা ব্যস্ত হয়ে উঠল। পরের দিন সকালেই দুই ভাই ক্লিভল্যান্ডিয়া ছেড়ে মাত্তো গ্রসোর পথে উত্তর দিকে রওনা হল।

হিরা যেখানে পাওয়া যায়, সোজাসুজি সেই জায়গাটার দিকে অগ্রসর হতে সাহস পেল না দুই ভাই। কারণ, পথ অতিশয় দুর্গম, অজস্র জলাভূমির মাঝখানে পথের দিশা হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা তো আছেই, তার উপর বনবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের কবলে পড়ার ভয় রয়েছে। তাদের খপ্পরে পড়লে সশরীরে ফিরে আসার সম্ভাবনা অতিশয় ক্ষীণ। কাজেই দেরি হলেও ঘোরাপথে–যে-পথে জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে লোকালয় দেখা যায় সেই পথে যাওয়াই নিরাপদ।

আরও একটি বিষয় সাশার মনে ঝড় তুলেছিল। জোকুইম গুয়াতো নামে যে-লোকটির কথা ডম কার্লোস তাকে বলেছিল–বাস্তবে সত্যিই তার অস্তিত্ব আছে কি না জানার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল সাশা। সে জানত মাত্তো গ্রসোর মালভূমিতে যে হিরা পাওয়া যায়, তার সন্ধান পাওয়ার জন্যই উগ্রীব হয়ে রয়েছে তার দাদা। কিন্তু হিরা নয়–জোকুইম নামক অসাধারণ মানুষটি সম্পর্কেই অধিকতর কৌতূহলী ছিল সাশা। যদি সত্যিই বাস্তবে ওই লোকটির অস্তিত্ব থাকে, তাহলে মার্সেলো আর বেদুইনোর সঙ্গে লড়াইয়ের চাইতেও অনেক বেশি ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে চলেছে সাশা।

দাদার কাছে মনের গোপন ইচ্ছা খুলে বলল না সে, শুধু সাও লরেংকোর দিকে যে বনপথ চলে গেছে, সেই পথ ধরতে দাদাকে পরামর্শ দিল। কার্লোসের কাহিনি যদি সত্য হয়, তাহলে ওই পথে গেলেই জোকুইমের সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে।

.

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

কয়েক সপ্তাহ ধরে পূর্ব প্যারাগুয়ের আবাদ করা জমির উপর দিয়ে অশ্ব ও অশ্বতর চালিয়ে ভ্রমণ করল দুই ভাই। মাতে বা ব্রেজিলের চা এখানেই জন্মায়। যেসব জায়গায় আবাদ করা হয়নি, সেইসব জায়গাতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে নিবিড় অরণ্য। পথ চলতে চলতে যেখানে লোকালয় পাওয়া গেছে, সেইখানেই বিশ্রাম নিয়েছে আর্নস্ট আর সাশা। লোকালয় থেকে তারা খাদ্য সংগ্রহ করেছে তো বটেই, অধিকন্তু টাকা রোজগার যা করেছে, তা-ও পরিমাণে নেহাত কম নয়। ব্রেজিলের ওইসব অরণ্যবেষ্টিত স্থানে যেসব মানুষ থাকে, তারা বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র রাখলেও ওইসব অস্ত্রের যত্ন নিতে জানে না। ফলে বন্দুক, পিস্তল প্রভৃতি অস্ত্র প্রায়ই অকেজো হয়ে যায়। দুই ভাই ওই অকেজো অস্ত্রের মেরামতির কাজে খুবই দক্ষ হয়ে উঠেছিল এবং তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন গ্রামে ও শহরে। তাদের সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় না-থাকলেও ভ্রাম্যমাণ পথিকের মুখে দক্ষ মিস্ত্রি হিসাবে তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দূরদূরান্তে।

একদিন একটা ছোটো জনবসতির মধ্যে যখন তারা ঘোড়া আর খচ্চর চালিয়ে এসে পড়েছে, সেইসময় একটি প্রবীণ পুরুষ তাদের অভিবাদন জানিয়ে বলল, আমি এই এলাকার মেয়র। আমার নাম ইউসেবিও। আমি বোধহয় দুই বিখ্যাত রুশ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কথা বলছি, যারা অকেজো বন্দুক-পিস্তল মেরামত করতে জানে এবং অসুস্থ রোগীকে সুস্থ করে তোলে?

গভীর অরণ্যের মধ্যেও যে তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে সে-কথা জেনে দুজনেই খুব আশ্চর্য হল, খুশিও হল। সাশা মেয়রকে বলল নানা ধরনের ওষুধ তারা সঙ্গে রাখে বটে, রোগ সারানোর চেষ্টা করে এ-কথাও মিথ্যা নয় তবে সেজন্য তারা পারিশ্রমিক গ্রহণ করে না।

জনবসতির এক পাশে বাঁশ আর পাতা দিয়ে একটা গির্জা তৈরি করা হয়েছে। গির্জার পিছন দিয়ে বয়ে চলেছে একটা অগভীর নদী। ওই নদীর ধারে বয়স্ক মানুষটির নির্দেশ অনুসারে ঘোড়া আর খচ্চরদের নিয়ে গেল আর্নস্ট। উদ্দেশ্য জন্তুগুলোর পিঠ থেকে মালপত্র খুলে তাদের ভারমুক্ত করা এবং নদীর জলে তাদের তৃষ্ণা নিবারণের সুযোগ দেওয়া।

কয়েকদিনের জন্য যদি একটা ঘর ভাড়া পাওয়া যায়, তাহলে আমাদের সুবিধা হয়, সাশা  বলল, যে কয়দিন আমরা থাকব, সেই কটা দিন আমরা চুপচাপ বসে থাকব না যেসব অকেজো বন্দুক-পিস্তল আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে, সেগুলোকে আমরা আবার ব্যবহারের উপযুক্ত করে দেব।

বয়স্ক মানুষটি জানাল থাকার ব্যবস্থা করতে তার অসুবিধা হবে না। তারপর সে বলল, প্রথমেই একটা গুরুতর ব্যাপারে আমি তোমাদের সাহায্য চাইব। আমার বাড়িতে একজন অতিথি আছে। তার দুই পায়ে ঘা হয়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে, লোকটা আর হাঁটাচলা করতে পারছে না।

আর্নস্ট গেল তাদের বহনকার্যে নিযুক্ত পশুগুলোর পরিচর‍্যা করতে নদীর ধারে, আর সাশা গেল ইউসেবিও নামে বয়স্ক মানুষটির সঙ্গে তার অতিথিকে দেখতে।

একটি কুঁড়েঘরের ভিতর শায়িত অবস্থায় লোকটিকে দেখতে পেল সাশা। লোকটি ব্রেজিলের অধিবাসী, কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। সাময়িকভাবে কোনো কার্যে নিযুক্ত হলে সেই কাজ সম্পন্ন করে এবং পরবর্তী কাজের সন্ধান করতে থাকে। বর্তমানে এই অঞ্চলে এসে বিপদে পড়েছে পোকার কামড়ে তার দুই পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে এমনভাবে বিষিয়ে উঠেছে যে, তার এখন চলাফেরা করার ক্ষমতা নেই। লোকটির নাম অ্যাপারিসিও। সে জানাল যদি তার পা দুটোকে যথাযথ চিকিৎসা করে তাকে কেউ সম্পূর্ণ সুস্থ করে দিতে পারে, তবে উক্ত চিকিৎসককে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে সন্তুষ্ট করতে সে প্রস্তুত।

গ্যারাপাটা নামক পোড়ার কামড় খুব মারাত্মক। পূর্বোক্ত পোকার কামড়েই অ্যাপারিসিওর পা দুটির অবস্থা হয়েছে অতিশয় শোচনীয়। পচনক্রিয়া প্রায় শুরু হয়ে গেছে। অক্লান্ত সেবা আর উপযুক্ত ঔষধ প্রয়োগ করে তিন সপ্তাহের মধ্যেই লোকটিকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলল সাশা। কথাবার্তার মধ্য দিয়ে ওই সময়ের ভিতর লোকটির সঙ্গে সাশার বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। কথায় কথায় সাশা জানাতে পারল সাও লরেংকো নামে জায়গাটার কাছাকাছি একজন তাইগরেরো থাকে বলে শুনেছে অ্যাপারিসিও। তবে কথাটা কতটা সত্যি তা বলতে পারল না সে। বনাঞ্চলে সত্যমিথ্যা জড়িয়ে নানা ধরনের রটনা শোনা যায় স্থানীয় অধিবাসীদের মুখে। অ্যাপারিসিও জানাল। লরেংকোর কাছে অবস্থিত তাইগরেরা সম্পর্কে খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে বাস্তবে ওইরকম। কোনো শিকারির অস্তিত্ব নেই–সমস্তটাই বাজে গুজব। কিন্তু সাশা মনে মনে স্থির করল সত্যমিথ্যা সে যাচাই করবে নিজের চোখে; সেই কাজটা করতে হলে অ্যাপারিসিওকে নিয়ে তাকে যাত্রা করতে হবে নির্দিষ্ট স্থান অভিমুখে।

সাশা জানত তার দাদা কিছুতেই জঙ্গলের মধ্যে তাদের পথচলার সঙ্গী হতে চাইবে না। তাই সে আর্নস্টকে বলল তুমি এখন কোক্সিম শহরে থাকো। আমি আর অ্যাপারিসিও যাব উত্তর দিকে। তারপর পছন্দমতো একটা শহরে আবার আমরা মিলিত হব।

আর্নস্ট খুবই বিরক্ত হল, আমি জানি তুমি সেই বুড়ো ইন্ডিয়ান শিকারির খোঁজ করতে চলেছ। বেশ, যাও আমি জঙ্গলের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে রাজি নই। আমি চাই মানুষের সাহচর্য–শহর কিংবা গ্রাম, যেখানে মানুষের বসতি আছে, আমি সেখানে থাকতে চাই।

তখন স্থির হল এখন আর্নস্ট থাকবে কোক্সিম শহরে, তারপর ভাইয়ের কাছে খবর পেলে অন্য কোথাও খুব সম্ভব কুয়ারাশহরে অপেক্ষা করবে সাশার সঙ্গে আবার মিলিত হওয়ার জন্য। ইতিমধ্যে সাশা আর অ্যাপারিসিও অগ্রসর হবে বনজঙ্গল ভেদ করে সাও লরেংকো নামে জায়গাটার দিকে।

যাত্রা শুরু করার আগে বড়ো ভাই আর্নস্টের আপত্তি সত্ত্বেও তাদের পাসো ফানডো শহর ত্যাগ করার আসল কারণ, অর্থাৎ ফাভেল-ঘটিত দুর্ঘটনার বিবরণ সাশা খুলে বলল অ্যাপারিসিওর কাছে। সব শুনে অ্যাপারিসিও বলল, আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেই মাত্তো গ্রসোতে এসব ব্যাপার নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। পাসো ফানডোর পুলিশ তাদের এলাকার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অপরাধীদের নিয়ে এতই বিব্রত যে, অন্য এলাকায় গিয়ে আসামিকে পাকড়াও করার সময় বা ইচ্ছা কোনোটাই তাদের নেই। অতএব ফাভেলের ব্যাপারে তোমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।

পরের দিন তিনজন যাত্রা করল উত্তর দিকে অবস্থিত কোক্সিম শহরের দিকে।

.

সপ্তম পরিচ্ছেদ

আর্নস্ট রইল কোক্সিম শহরে। সাশা ও অ্যাপারিসিও উত্তর-পশ্চিম দিকে দুর্গম বনজঙ্গল আর জলাভূমি পেরিয়ে অগ্রসর হল সাও লরেংকো নামে জায়গাটার দিকে। সাশা শুনেছিল এইসব অঞ্চল তাইগরের প্রিয় বাসস্থান। সতর্ক হয়ে যাতায়াত না-করলে হিংস্র শ্বাপদের আক্রমণে যেকোনো সময়ে পথিকের মৃত্যু ঘটতে পারে।

একদিন সন্ধ্যায় একটা আধ-শুকনো জলাশয়ের ধারে অভিযাত্রীদের তাবু পড়ল। অ্যাপারিসিও একটা হরিণকে গুলি চালিয়ে মেরেছিল। মৃতদেহটাকে তাঁবুর কাছেই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের কাছাকাছি একটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা হল–উদ্দেশ্য ছিল, পরের দিন ওই মাংস দিয়েই উদরের ক্ষুধাকে তৃপ্ত করা হবে।

গাছের ডালে দোলনার মতো হ্যামক টাঙিয়ে তার মধ্যে শুয়ে পড়ল সাশা আর অ্যাপারিসিও। গভীর রাত্রে হঠাৎ সাশার ঘুম ভেঙে গেল। অগ্নিকুণ্ডের আগুন প্রায় নিবে এসেছে, অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে জ্বলছে একটা গোলাপি আভা। মাথার উপর রাতের আকাশে জ্বলছে অসংখ্য তারা, নীচে অরণ্যের বুকে রাজত্ব করছে ঘনীভূত অন্ধকার।

হঠাৎ ঘুম ভাঙার কী কারণ থাকতে পারে ভাবছিল সাশা নিশ্চয়ই কোনো শব্দ তন্দ্রার আচ্ছন্নতা ভেদ করে তাকে চেতনার জগতে ফিরিয়ে এনেছে।

সাশা যখন ঘুম ভাঙার কারণটা নির্ণয় করার চেষ্টা করছে, সেইসময় একটা অত্যন্ত স্পষ্ট ও ভয়ংকর শব্দ তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করল–

হাড় ভাঙার আওয়াজ!

দাঁতের চাপে হাড় ভাঙার ক্ষমতা রাখে ওই অঞ্চলে একটি মাত্র জানোয়ার

তাইগর!

দারুণ আতঙ্কে সাশার শরীরের রক্ত হিম হয়ে এল। প্রথমে সে ভেবেছিল তাইগরের শিকার হয়েছে অ্যাপারিসিও, কিন্তু একটু দূরে আর একটি গাছের ডালে ঝোলানো হ্যামকের মধ্যে অ্যাপারিসিওর উপবিষ্ট দেহ অন্ধকারের মধ্যেও অস্পষ্টভাবে সাশার দৃষ্টিগোচর হল। সে বুঝতে পারল গাছের ডালে ঝোলানো হরিণের মৃতদেহটাকে মাটিতে টেনে নামিয়ে সেটাকে ভক্ষণ করছে একটি তাইগর। হরিণের হাড়গুলো কড়মড় শব্দে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে তাইগরের শক্তিশালী দুই দাঁতালো চোয়ালের চাপে…

হাড় ভাঙার আওয়াজ থামল একটু পরে। তারপর শোনা গেল ঘাসের উপর দিয়ে কোনো গুরুভার বস্তু টেনে নিয়ে যাওয়ার শব্দ এবং কিছুক্ষণ পরে সেই শব্দও গেল মিলিয়ে। সাশা বুঝল মৃত হরিণের দেহটাকে বনের মধ্যে নিয়ে গেল তাইগর অবশিষ্ট মাংস পরবর্তীকালে কাজে লাগবে বলে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ, তারপর অ্যাপারিসিওর মৃদু কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সাশা, সিনর–জেগে আছ?

মাথার কাছে গাছের ডালে চামড়ার ফিতায় আটকানো খাপ থেকে পিস্তলটা হস্তগত করে নেমে এল সাশা। অ্যাপারিসিও তার ফ্ল্যাশলাইট জ্বালল–যেখানে হরিণটা ঝুলছিল, সেখানে এখন কিছুই নেই। দুজনে সারারাত্রি জেগে কাটিয়ে দিল–বলা তো যায় না, আরও একটি ক্ষুধার্ত তাইগরের আবির্ভাব যদি ঘটে এবং মৃগমাংসের অভাবে নরমাংস দিয়েই যদি উক্ত শ্বাপদ উদরের ক্ষুধাকে তৃপ্ত করতে চায়, তাহলে নিদ্রিত মানুষের পক্ষে তাকে বাধা দেওয়া অসম্ভব নিদ্রা যেখানে চিরনিদ্রায় পরিণত হতে পারে, সেখানে রাত্রি জাগরণের কষ্ট নিতান্তই তুচ্ছ…

সকালের আলোতে মধ্যরাতের অতিথির পদচিহ্ন চোখে পড়ল; হরিণটাকে গাছের ডাল থেকে টেনে নামানোর সময়ে তার নখের চিহ্ন গম্ভীর হয়ে মাটিতে বসে গেছে!

সেই রাতের অভিজ্ঞতা দুজনকেই ভীত ও সতর্ক করে দিল। তারা বুঝল নিশ্চিন্তে নিদ্রা গেলে যেকোনো মুহূর্তে সেই নিদ্রা চিরনিদ্রায় পরিণত হতে পারে। পূর্বোক্ত অভিজ্ঞতার পর থেকে রাত্রে তারা পালা করে জেগে থাকত–একজন যখন নিদ্রাসুখ উপভোগ করত, অপর ব্যক্তি তখন জাগ্রত অতন্দ্র প্রহরায়।

একদিন অপরাহ্নে ঘোড়া আর খচ্চর চালিয়ে ঢালু জমি দিয়ে যখন তারা অগ্রসর হচ্ছে, সেইসময় সবুজ জঙ্গলের ভিতর কুণ্ডলী-পাকানো ধোঁয়া তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ওই ধোঁয়া লক্ষ করে এগিয়ে গিয়ে একটা লোকালয়ের সন্ধান পেল তারা। জনৈক স্থানীয় অধিবাসীকে প্রশ্ন করে তারা জানল এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলটি গোচারণের জন্য সংরক্ষিত; মালিকের নাম ডম জুয়ায়ো কাজাংগো। একটা সাদা বাড়ির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে স্থানীয় লোকটি জানিয়ে দিল ওই বাড়িতেই বাস করেন মালিক মহাশয়।

নির্দিষ্ট সাদা বাড়িতে গিয়ে দুজনেই মালিকের সঙ্গে পরিচিত হল। ডম জুয়ায়ো বয়স্ক ব্যক্তি, তার চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেছে, কিন্তু সে এখনও যুবকের মতো শক্তসমর্থ। নিজেদের পরিচয় দিয়ে সাশা জানাল সে একজন ভ্রাম্যমাণ মিস্ত্রি, সঙ্গী অ্যাপারিসিও তার সহকারী। বন্দুক, পিস্তল থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের যন্ত্রপাতি তারা মেরামত করতে পারে সিনর জুয়ায়ো কাজ দিলেই তাদের দক্ষতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হতে পারবেন।

সিনর জুয়ায়োর বাড়িতে অচল হয়ে পড়ে ছিল ছয়টি সেলাইয়ের কল। ওইগুলো মেরামতের জন্য পারিশ্রমিকের অঙ্ক স্থির করতে গিয়েই সাশা বুঝল লোকটি অতিশয় কৃপণ। জুয়ায়োর পোষা গোরুর সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ হাজার, পার্শ্ববর্তী অরণ্যভূমি থেকে শুরু করে গয়াজ প্রদেশ পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ জমি তার অধিকৃত, কিন্তু একটি পয়সা খরচ করতে গেলে তার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ে!

সাশার ক্যামেরাটি জুয়ায়োর মনে কৌতূহলের সৃষ্টি করল, সে জানতে চাইল এই হতচ্ছাড়া জায়গা থেকে কোন ধরনের ছবি তুলতে চায় সশা? উত্তরে সাশা জানাল তার সহকারী অ্যাপারিসিওর কাছে সে শুনেছে এই জায়গাটা তাইগারদের প্রিয় বাসস্থান, তাই সে ক্যামেরা এনেছে তাইগরের ফটো তোলার জন্য।

আমার অনেকগুলো গোয়ালের মধ্যে একটি গোয়ালে এখন একটা তাইগর আছে, ডম জুয়ায়ো বলল, তুমি ইচ্ছা করলে তার ফটো নিতে পারো।

গোয়ালের মধ্যে তাইগর! সাশা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, জানোয়ারটা কী জীবিত?

অবশ্যই না। ওটা মরে গেছে। ওর শরীর থেকে দুর্গন্ধ বার হচ্ছে। তবে ফটোতে তো আর গন্ধ পাওয়া যাবে না। ফটো তোলার জন্য আমি তোমার কাছে টাকাপয়সা চাইব না।

সাশা জানাল মালিক মহাশয়ের উদারতায় সে অভিভূত, কিন্তু সেই উদারতার সুযোগ নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়–কারণ, মৃত নয়, জীবন্ত তাইগরের ফটো তুলতেই সে উৎসুক।

উত্তরে জুয়ায়ো জানাল জীবন্ত তাইগরের ফটো তোলার জন্য যে-ব্যক্তি নিজের প্রাণ বিপন্ন করে, সে নিরেট মুখ।

সাশা অবশ্য গোয়ালে অবস্থিত মৃত তাইগরের ফটো তুলে নিজেকে বুদ্ধিমান প্রমাণ করতে সচেষ্ট হল না। অতএব প্রসঙ্গটা ওখানেই চাপা পড়ে গেল।

কয়েকদিন পরের কথা–সাশা পূর্বোক্ত সেলাই-এর কলগুলোকে মেরামত করার চেষ্টা করছে, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে সেখানে উপস্থিত হল ডম জুয়ায়ো।

আমার দুই ছেলে কাল পশ্চিম দিকে শিকার করতে যাবে,জুয়ায়ো বলল, একটা তাইগর ভীষণ উৎপাত করছে। আমার অনেকগুলো গোরু জন্তুটার কবলে মারা পড়েছে। সেটাকে মারার জন্যই যাবে আমার দুই ছেলে। ইচ্ছে করলে তুমিও যেতে পারো ওদের সঙ্গে। হয়তো জ্যান্ত তাইগরের ছবি তোলার সুযোগ পাবে তুমি।

বলাই বাহুল্য, এমন সুযোগ হাতছাড়া করল না সাশা। জর্জ আর বার্নারদো নামে মালিকের দুই ছেলের সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে সাশা যাত্রা করল তাইগর শিকারের উদ্দেশে। তাদের সঙ্গে চলল একদল শিকারি কুকুর। মাটিতে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে কুকুরের পাল এগিয়ে যাচ্ছিল, তাদের অনুসরণ করছিল অশ্বারোহী দুই ভাই। খুব মনোযোগের সঙ্গে ব্যাপারটা লক্ষ করছিল সাশা পিছন থেকে। তার দুই সঙ্গী কুকুরের সাহায্যে শিকার করতে অভ্যস্ত হলেও ওই ধরনের শিকারে সাশা ছিল অনভিজ্ঞ।

কয়েক মিনিট ঘোড়ার পিঠেই চতুষ্পদ ও দ্বিপদ শিকারিদের অনুসরণ করতে চেষ্টা করল সাশা, কিন্তু কিছুক্ষণ পরে ঘন ঝোপ আর লতার বেড়াজাল ভেদ করে ঘোড়া চালানো অসম্ভব হয়ে উঠল। তখন ঘোড়াটাকে একটা গাছে বেঁধে রেখে সাশা দৌড়াতে শুরু করল। বড়ো ভাই জর্জও ঘোড়া থেকে ছেড়ে পায়ে হেঁটেই অগ্রসর হচ্ছিল। একটু পরে তাকে আর কুকুরের দলটাকে দেখতে পেল সাশা। কুকুরগুলো একটা মস্ত গর্তের সামনে তখন বৃত্তাকারে ঘুরছিল।

জর্জ গর্তটাকে দেখিয়ে ফিসফিস করে বলল, কায়তেতু! অর্থাৎ শুয়োর!

যাচ্চলে! তাইগরের পরিবর্তে শুয়োর! কুকুরগুলো প্রথমে তাইগরের পিছু নিয়ে পরে শুয়োরের গন্ধে আকৃষ্ট হয়েছিল, অথবা প্রথম থেকেই কুকুরদের চালচলন বুঝতে ভুল করেছিল দুই ভাই–সেটা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারল না সাশা। তবে তাইগরের পরিবর্তে শুয়োর শিকারের সম্ভাবনা তাকে আদৌ উৎসাহিত করতে পারেনি। কিন্তু জর্জ আর বার্নারডো শূকরমাংস ভোজনের আশায় উৎফুল্ল হয়ে উঠল, মহা উৎসাহে তারা আগুন ধরিয়ে দিল গর্তের মুখে। কিছুক্ষণ পরেই গর্তের ভিতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে একটা শুয়োর দৌড় দিল ঘন জঙ্গলের দিকে। তৎক্ষণাৎ গর্জে উঠল রাইফেল, লুটিয়ে পড়ল বুলেট-বিদ্ধ শূকরের মৃতদেহ।

সেই রাতে সুস্বাদুবরাহমাংস দিয়ে নৈশভোজন সমাপ্ত করল তিন শিকারি। তিনজন একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লে বিপদ ঘটতে পারে, তাই রাত্রে পালা করে জেগে থাকাই উচিত বলে বিবেচনা করল জর্জ আর সাশা। বার্নারদো বয়সে ছোটো বলে তাকে রাত জেগে পাহারা দেওয়ার কর্তব্য থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল।

পরের দিন খুব ভোরে উঠে আবার কুকুর নিয়ে তাইগরের সন্ধানে ছুটল তিন শিকারি। কিছুক্ষণ পরেই অগ্রবর্তী সারমেয়-বাহিনীর দলপতির কণ্ঠে জাগল গভীর গর্জন! কুকুরের ভাষা বুঝতে পারত জর্জ আর বার্নারদো–দলপতির কণ্ঠস্বর শুনেই তারা বুঝে নিল সারমেয়-বাহিনী এইবার তাইগরের সন্ধান পেয়েছে। শব্দ লক্ষ করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল জর্জ, অন্য দুজন তাকে অনুসরণ করল।

কিছুদূর যাওয়ার পর কর্দৰ্মাক্ত জমির উপর তাইগরের থাবার চওড়া দাগ তাদের চোখে পড়ল। পদচিহ্ন যেখানে রয়েছে, সেখানে এক ইঞ্চি গভীর কয়েকটি গর্তের সৃষ্টি করেছে তাইগরের ভয়ংকর নখগুলো!

জন্তুটা লাফ দিতে প্রস্তুত হয়েছিল, জর্জ মৃদুস্বরে বলল, না হলে মাটিতে নখের দাগ দেখাই যেত না।

এতক্ষণ পর্যন্ত সাশার কল্পনাতেই ছিল তাইগরের অবস্থান, কিন্তু এইবার সে জন্তুটার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হল এবং সঙ্গেসঙ্গে তার ধমনীতে রক্তস্রোত চঞ্চল হয়ে সর্বাঙ্গে জাগিয়ে তুলল উত্তেজনার শিহরন!

কুকুরগুলো ছুটতে শুরু করল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্তর্ধান করল শিকারিদের দৃষ্টিসীমার অন্তরালে। সবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে কুকুরগুলোকে অনুসরণ করতে সচেষ্ট হল তিন শিকারি। শিকারকে তাড়া করার আগে ক্যামেরাটাকে বার্নারদোর হাতে তুলে দিয়েছিল সাশা।

আচম্বিতে ভয়ংকর শব্দে বেজে উঠল কুকুরের তীব্র কণ্ঠস্বর! ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে শব্দ লক্ষ করে ছুটল জর্জ আর সাশা। সামনেই একটা ঝোপ, সেটা পার হতেই সাশার চোখে পড়ল একটা ভয়াবহ দৃশ্য–ঝোপের পরেই যে ফাঁকা জায়গাটা রয়েছে, সেখানে মাটির উপর শুয়ে রক্তাক্ত শরীরে ছটফট করছে একটা কুকুর, তার বিদীর্ণ উদর থেকে বেরিয়ে এসেছে ভিতরের নাড়িভুঁড়ি! জন্তুটাকে যন্ত্রণা থেকে আশু মুক্তি দিতে তার মাথা লক্ষ করে গুলি ছুড়ল সাশা–সব শেষ।

ঠিক সেইসময় সামনের বনভূমির দিকে সাশার দৃষ্টি আকর্ষণ করল জর্জ। জর্জের ইঙ্গিত অনুসারে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতেই যে-দৃশ্যটি সাশার চোখের সামনে ফুটে উঠল–পরবর্তীকালে সেইরকম দৃশ্য বহুবার দর্শন করলেও প্রথম দিনের সেই অভিজ্ঞতা সাশা কোনোদিনই ভুলতে পারবে না

মাটি থেকে প্রায় বিশ ফুট উপরে একটা গাছের ডালে বসে শিকারিদের নিবিষ্টচিত্তে নিরীক্ষণ করছে তাইগর!

তার চোখের দৃষ্টিতে ভয় বা ক্রোধের চিহ্ন নেই, আছে শুধু কৌতূহলের আভাস!

সাশা পরে জানতে পেরেছিল বনবাসী পশুদের মধ্যে তাইগরকে ভয় করে না একটিমাত্র জানোয়ার পেকারি! ওই জন্তুটা হচ্ছে একধরনের বুনো শুয়োর; আকারে ছোটো, স্বভাবে ভয়ংকর। পেকারিরা সর্বভুক, আমিষ বা নিরামিষ কোনো খাদ্যেই তাদের আপত্তি নেই। তাইগরকে দেখলেই পেকারিরা দল বেঁধে আক্রমণ করে। দলের মধ্যে পড়ে গেলে তাইগরের আর রক্ষা নেই, কয়েকটি শত্রুকে হত্যা করলেও দলবদ্ধ পেকারির আক্রমণে মৃত্যু তার অবধারিত। তাই পেকারির দল তাইগরকে আক্রমণ করলেই সে চটপট গাছে উঠে পড়ে। গাছের তলায় অনেকক্ষণ আস্ফালন করার পর পেকারিরা যখন বুঝতে পারে তাইগরকে তারা আর ধরতে পারবে না, তখন তারা দল বেঁধে স্থানত্যাগ করে। এতক্ষণ গাছের উপর বসে সাগ্রহে দলটাকে লক্ষ করছিল তাইগর, এইবার হঠাৎ ঝাঁপ দিয়ে দলছুট একটা পেকারিকে মুখে তুলে নিয়ে সে বিদ্যুদবেগে সরে পড়ে দলটার নাগালের বাইরে। এই তাইগরটাও বোধ হয় কুকুর আর মানুষের মিলিত দলটাকে পেকারি-জাতীয় জীব ভেবে নিয়ে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছিল।

সাশা এইবার তাইগরের দিক থেকে ফিরে জর্জের দিকে চাইল। সে আশা করেছিল জর্জ গুলি চালানোর জন্য প্রস্তুত হবে, কিন্তু তার মুখের দিকে তাকিয়েই সাশা বুঝতে পারল ছেলেটি ভীষণ ভয় পেয়েছে নিদারুণ আতঙ্কে তার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটেছে।

ফিসফিস করে অত্যন্ত মৃদুস্বরে সাশা বলল, যাও, বার্নারদোকে ডেকে নিয়ে এসো। তার কাছে আমার ক্যামেরা রয়েছে।

–জর্জ ধীরে ধীরে পা ফেলে অকুস্থল থেকে অদৃশ্য হল এবং একটু পরেই ছোটো ভাই বার্নারদোকে নিয়ে ফিরে এল যথাস্থানে। বার্নারদের হাত থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে নিজের রাইফেলটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল সাশা, রাইফেলটা ধরো। আমি যখন ছবি তুলব, তখন যদি জন্তুটা আক্রমণ করে, তাহলে তুমি ওকে লক্ষ করে গুলি চালাবে।

তাইগরকে দেখে বার্নারদো দাদার মতোই ঘাবড়ে গিয়েছিল, তবে রাইফেলটা সে হাত বাড়িয়ে নিতে ভুলল না।

সাশা ক্যামেরার ফোকাস ঠিক করে শাটার টিপে দিল। একটা অস্পষ্ট শব্দ উঠল। ঠিক সেই মুহূর্তেই কুকুরগুলো হঠাৎ নীরব হয়ে পড়েছিল–শাটার টেপার ক্ষীণ শব্দ তাইগরের কানে যেতেই সে হঠাৎ ঘুরে বসে সাশার উপর তার দুই চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টি স্থাপন করল।

রাইফেলটা আমার হাতে দাও, ফিসফিস করে বার্নারদোকে বলল সাশা। সে একবারও তাইগরের দিক থেকে চোখ সরায়নি। যখন রাইফেলের বাঁট তার হাত স্পর্শ করল, ঠিক সেই মুহূর্তে এক লাফ মেরে বিশ ফুট উঁচু বৃক্ষশাখা থেকে মাটির উপর এসে পড়ল তাইগর! কুকুরগুলো তৎক্ষণাৎ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তাইগরের ভয়ংকর থাবার নাগাল থেকে দূরে সরে গেল; আর হঠাৎ ভীষণ আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল বার্নারদো।

কুকুরগুলো আবার মিলিতভাবে আক্রমণ করতে ছুটে এল তাইগরের দু-পাশে। কিন্তু কুকুরদের দিকে ফিরেও তাকাল না অতিকায় মার্জার, তার জ্বলন্ত দৃষ্টি এখন নিবদ্ধ হয়েছে। বার্নারদোর উপর। একটি হাতের মুঠি সজোরে মুখের উপর চেপে ধরেছে বার্নারদো, যেন ভিতর থেকে ঠেলে-ওঠা একটা আর্ত-চিৎকার সে রুখে দিতে চাইছে প্রাণপণে এবং বিস্ফারিত দুই চক্ষের ভয়ার্ত দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছে অদূরবর্তী তাইগরকে।

বার্নারদোকে লক্ষ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাইগর, সঙ্গেসঙ্গে অগ্নি-উদ্গার করে গর্জে উঠল সাশার রাইফেল। সাশা দেখল একটা প্রকাণ্ড থাবা বাতাস কেটে ছুটে এল, পরক্ষণেই মাটিতে ছিটকে পড়ল বার্নারদো। আবার গুলি ছুড়ল সাশা তাইগরকে লক্ষ করে। সাশার উলটোদিক থেকে তাইগরের মাথায় গুলি চালাল জর্জ। একসঙ্গে দুটি বুলেটের আঘাতে প্রকাণ্ড জন্তুটা কুণ্ডলী পাকিয়ে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে পড়ল।

বার্নারদো তখন হাঁটু পেতে বসে পড়েছে। সাশা দেখল তার শার্ট অনেকটা জায়গা নিয়ে লম্বালম্বিভাবে ছিঁড়ে গেছে। প্রথমে সাশা ভেবেছিল তাইগরের ধারালো নখ বার্নারদোর পাঁজর বিদীর্ণ করেছে–পরে দেখা গেল তা নয়, তাইগরের থাবার তালু সজোরে আঘাত করে ছেলেটিকে মাটিতে ফেলে দিয়েছে এবং সেই আঘাতের ফলেই ছিঁড়ে গেছে শার্ট–ভয়ংকর নখগুলো বার্নারদোর শরীর স্পর্শ করতে পারেনি, সে ছিল সম্পূর্ণ অক্ষত।

ওই ঘটনার পর বহু তাইগর শিকার করেছে সাশা। ত্রিশটি বছর কাটিয়েছে সে দক্ষিণ আমেরিকার বনে জঙ্গলে। ওই সময়ের মধ্যে তিনশো তাইগর মেরেছে সে। নিহত জন্তুগুলোর মধ্যে অন্তত তিরিশটি পশুর সম্মুখীন হয়েছিল সে বর্শা হাতে। তবে দক্ষিণ আমেরিকার বনরাজ্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্রাট তাইগরকে সে কখনো ঘৃণা করতে পারেনি ভয়াল সুন্দর ওই হিংস্র জীবটি সম্পর্কে সে পোষণ করত শ্রদ্ধামিশ্রিত এক অদ্ভুত ভালোবাসা!

.

অষ্টম পরিচ্ছেদ

তাইগর শিকারের পর কেটে গেল দুটি সপ্তাহ। ওই সময়ের মধ্যে যেসব বিকল যন্ত্র মেরামতের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল সাশা, সেই যন্ত্রগুলোকে সে সারিয়ে ব্যবহারের উপযুক্ত করে দিল। তারপর পারিশ্রমিকের অর্থ গ্রহণ করে ডম জুয়ায়োকে বিদায় জানিয়ে সাও লরেংকোর পথে রওনা হল সাশা। বলাই বাহুল্য, সঙ্গে ছিল পথের দিশারী অ্যাপারিসিও।

প্রায় মাস দুই ধরে বনজঙ্গল আর বিপজ্জনক জলাভূমি অতিক্রম করে সাও লরেংকোর কাছাকাছি সিনর শিকো পিন্টো নামে এক ভূস্বামীর গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করল সাশা ও অ্যাপারিসিও।

ওই সময়ের মধ্যে দাদা আর্নস্টের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কোনো উপায় ছিল না সাশার। বনের পথে সরকারি ডাকবিভাগ সম্পূর্ণ অচল, স্থানীয় মানুষ সম্পূর্ণ নির্ভর করে বেসরকারি ব্যবস্থার ওপর। এখানে আসার আগে এক র‍্যাঞ্চ মালিকের অতিথি হয়েছিল সাশা। সেখানে সে শুনল খুব শীঘ্রই একটি লোক স্থানীয় অধিবাসীদের চিঠিপত্র নিয়ে রওনা দেবে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত আত্মীয়স্বজনের কাছে ওই চিঠিগুলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য। পূর্বোক্ত পত্রবাহকের হাতে চিঠি দিয়ে কোক্সিমে দাদা আর্নস্টকে খবর পাঠাল সাশা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কুয়াবা শহরে এসে দাদা আর্নস্টের সঙ্গে দেখা করবে সে।

সিনর শিকো পিন্টো নামে যে ভূস্বামীর আতিথ্য গ্রহণ করেছিল সাশা, সে ছিল ওই অঞ্চলের একজন চিনির কারবারি। সাশা আর অ্যাপারিসিওর সাময়িক বাসস্থান হিসাবে বরাদ্দ ছিল একটি মাটির কুঁড়েঘর। সিনর শিকোকে দুজনেই কথা দিয়েছিল চিনির কারখানার যন্ত্রপাতিগুলো তারা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করবে এবং ওই কাজ শেষ না-করে তারা স্থানত্যাগ করবে না।

ডম কার্লোসের তাইগরেরো কাহিনির সত্যাসত্য নির্ণয় করার জন্য এখন বদ্ধপরিকর হল সাশা। এবার সে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসবে। না হলে এই ব্যাপারটা নিয়ে সে আর মস্তিষ্ককে ঘর্মাক্ত করবে না।

এক রাতে সে সিনর শিকোকে প্রশ্ন করল, সিনর শিকো, আপনি কি এই অঞ্চলে জোকুইম গুয়াতো নামে কোনো রেড ইন্ডিয়ান শিকারিকে জানেন? শুনেছি, ওই লোকটা শুধুমাত্র বর্শা দিয়ে তাইগর শিকার করে?

জোকুইম? সিনর শিকো একটু চিন্তা করল, হ্যাঁ, এই নামে একটি লোক আছে বটে। গুয়াতে হচ্ছে রেড ইন্ডিয়ান জাতির একটি শাখার নাম। অর্থাৎ জোকুইম ওই গুয়াতো শাখার অন্তর্গত একটি মানুষ। লোকটা আমার কাছে মাঝে মাঝে কাজ করে। কিন্তু গ্রীষ্মকালে যখন তাইগররা গোরুবাছুরের উপর হামলা করে, সেইসময় ফাজেন্দা আলেগর নামে যে বিশাল র‍্যাঞ্চ বা গোচারণ-ভূমি বহমান নদীর উত্তরদিকে কুয়াবা শহর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে সেই র‍্যঞ্চের হয়ে ভাড়াটে শিকারি হিসাবে কাজ করে জোকুইম গুয়াতো।

আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর সাশা সিনর শিকোর কাছে জানতে পারল যে, প্রায় তিরিশ বছর আগে জোকুইম এই অঞ্চলে আসে। শোনা যায় সে কুড়িটা হিংস্র তাইগরকে বর্শা দিয়ে শিকার করেছে। লোকটি কারো সাহায্য নেয় না, একাই শিকার করে অবশ্য কুকুরের দল তাকে তাইগর শিকারে সহায়তা করে।

সাশা জানতে চাইল রেড ইন্ডিয়ান জাতি কি কারো সাহায্য না-নিয়ে একা শিকার করতে অভ্যস্ত?

উত্তরে সিনর শিকো জানাল তারা এককভাবে তাইগরের মুখোমুখি হতে চায় না। তারা দল বেঁধে শিকার করে। তাদের হাতে থাকে তিরধনুক আর জাগায়া (বর্শা)। তবে রেড ইন্ডিয়ান জাতির মধ্যে দু-একজন নিঃসঙ্গ তাইগর-শিকারির কথা মাঝে মাঝে শোনা যায় বটে। কিন্তু বর্তমানে জোকুইম গুয়াতো হচ্ছে একমাত্র শিকারি যে সম্পূর্ণ এককভাবে বর্শা হাতে তাইগরের বিদ্যুত্বৎ ক্ষিপ্র আক্রমণের সম্মুখীন হওয়ার সাহস রাখে। লম্বা লম্বা ঘাস আর জলাভূমির মধ্যে রাইফেল নিয়ে লক্ষ্য স্থির রাখা অসম্ভব, সেখানে বর্শা হচ্ছে একমাত্র নির্ভরযোগ্য অস্ত্র।

জোকুইম বর্শাধারী শিকারি, সিনর শিকো বলল, তার মতন নির্ভীক মানুষ আমি আর একটিও দেখিনি।

সিনর শিকো আরও বলল, আমার মনে হয় বনবাসী তাইগারদের মধ্যেও জোকুইমের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। বর্শাধারী তাইগরেরো এখন অত্যন্ত বিরল, তাদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে।

কয়েকদিন পরের কথা… সিনর শিকোর নির্দেশ অনুসারে নদীর পশ্চিমদিকে অশ্বারোহণে যাত্রা করল সাশা, সঙ্গে অপরিহার্য সঙ্গী অ্যাপারিসিও। কিছুদূর যাওয়ার পরে একটা ভাঙাচোরা কুঁড়েঘর তাদের চোখে পড়ল। কাছে গিয়ে তারা দেখল অধভগ্ন ও বিধ্বস্ত কুটিরের দরজাটা চামড়ার বাঁধনে আটকে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের ভিতরটা অন্ধকার, সেখানে কোনো মানুষ বাস করে বলে মনে হয় না।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সাশা হাঁক দিল, ভিতরে কেউ আছে?

দরজা ঠেলে একটি রেড ইন্ডিয়ান বাইরের উজ্জ্বল সূর্যালোকে আত্মপ্রকাশ করল। লোকটির সঠিক বয়স অনুমান করা অসম্ভব মনে হয় ষাট হবে কিন্তু তার গায়ের চামড়া এখনও টান টান, কুঁচকে যায়নি একটুও। লোকটির পরনে নীল প্যান্ট আর খাকি শার্ট শার্টের হাতা কনুইয়ের কাছে ছিঁড়ে উড়ে গেছে–পা নগ্ন, জুতো নেই।

লোকটিকে দেখেই সাশা বুঝতে পারল সে মদ্যপান করে নেশাগ্রস্ত হয়েছে। সাশার মনটা খারাপ হয়ে গেল তার দাদা আর্নস্টের কথাই সঠিক প্রমাণিত হল–বনজঙ্গল ভেঙে এত কষ্ট করে এত দূরে এসে সে আবিষ্কার করল একটি নেশাখোর মাতাল বুড়ো রেড ইন্ডিয়ানকে! কী আফশোস!

যাই হোক গাছের সঙ্গে ঘোড়া বেঁধে লোকটির ইঙ্গিতে সঙ্গীকে নিয়ে কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করল সাশা। কুঁড়েঘরের ভিতরটা খুব নোংরা আর দুর্গন্ধে পরিপূর্ণ। বেশ বোঝা যায় লোকটি এখানে একলাই বাস করে। ছোটো ঘরটার একধারে একটা ছেঁড়াখোঁড়া তাপ্লিমারা হ্যামক টাঙানো আছে। হ্যামকের তলায় একটা জাগ কাত হয়ে পড়ে ঘরের মালিকের বর্তমান অবস্থার কারণ নির্দেশ করছে!

সাশা বিনীতভাবে বলল, তুমিই কি সেই বিখ্যাত তাইগরেরো, যার কথা আমি শুনেছি?

লোকটির কালো চোখ দুটিতে বিদ্যুতের মতো জ্বলে উঠল বুদ্ধির দীপ্তি, কিন্তু তার মুখের ভাব রইল আগের মতোই অসাড়, সেখানে অনুভূতির কোনো চিহ্ন নেই। সাশা ঘরের ভিতরটা খুঁটিয়ে দেখল–কয়েকটা তির আর ধনুক ছাড়া একটা প্রকাণ্ড বর্শা তার চোখে পড়ল। বর্শাটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করল সাশা চওড়া একটা লোহার ফলা কাষ্ঠদণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ফলার দুই পাশ কোনো বস্তুকে কেটে ফেলার উপযুক্ত করা হলেও জিনিসটা তেমন ধারালো হয়নি।

বুড়ো রেড ইন্ডিয়ান সাশার সামনে এসে দাঁড়াল, তুমি আমার মনিব সিনর শিকো পিন্টোর কাছ থেকে আসছ?

সাশা জানাল বর্তমানে সে পূর্বোক্ত সিনর শিকোর কাছ থেকেই আসছে বটে; কিন্তু অনেক দূরবর্তী যে-অঞ্চলে তাইগর-শিকারি হিসাবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে, সেই রিও গ্র্যান্ড দো সাল নামে জায়গাটা থেকেই সে এসেছে কেবলমাত্র খ্যাতনামা তাইগরেরোর সঙ্গে আলাপ করতে।

আমার মনিবের কাছ থেকে তুমি কি কোনো প্রস্তাব এনেছ? বুড়ো বলল, নদীর কাছাকাছি নীচু জমিতে এখন তাইগরের দেখা পাওয়া যাবে। বর্ষা শুরু হলে তারা এই উঁচু জমির উপর উঠে আসবে। এখন এই জায়গাটাতে যে-জন্তুটার তুমি দেখা পাবে, তার নাম সাকুয়ারানা।

ব্রেজিলের স্থানীয় ভাষায় সাকুয়ারানা বলতে বোঝায় পুমা বা কুগার। তাইগরের মতোই পুমাও বিড়াল-জাতীয় পশু, তবে আকারে ছোটো এবং স্বভাবও তাইগরের মতো ভয়ংকর নয়।

জোকুইম হঠাৎ দরজার বাইরে এসে হাঁক দিল, দ্রাগাও! কয়েক মুহূর্ত পরেই একটা লালচে-বাদামি রং-এর কুকুর দৌড়ে এল সেখানে। জোকুইম কুকুরটাকে আদর করতেই সে সজোরে গা ঘষতে লাগল লোকটার দুই পায়ে।

সাও লরেংকোর মধ্যে আমার দ্রাগাও হচ্ছে সবচেয়ে পাকা শিকারি, জোকুইম বলল, সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটাকে সাদরে চুম্বন করল সে, তারপর সাশার দিকে ফিরে তাকাল সে, তুমি দ্রাগাও আর আমার সঙ্গে শিকার করতে চাও, সিনর? বেশ তো, কাল সকালেই আমরা শিকারের সন্ধানে যাত্রা করব।

জোকুইম আবার তার কুটিরের মধ্যে অন্তর্ধান করল। সাশা আর অ্যাপারিসিও ঘোড়ায় চড়ে ফিরল তাদের আস্তানার দিকে। সাশা যে খুব বিরক্ত ও হতাশ হয়েছে, তার হাবভাব দেখেই বুঝতে পেরেছিল অ্যাপারিসিও। সে সাশাকে বলল, ওই বুড়ো রেড ইন্ডিয়ান সম্পর্কে চট করে কিছু ভেবে নিয়ো না। তাহলে ঠকবে।

.

নবম পরিচ্ছেদ

পরের দিন খুব ভোরে, তখনও দিনের আলো ভালোভাবে ফুটে ওঠেনি সাশা শুনতে পেল তার দরজায় কেউ ধাক্কা মারছে। দরজা খুলে সাশা দেখল সামনে দাঁড়িয়ে আছে জোকুইম। তার ঊর্ধ্বাঙ্গ নগ্ন, নিম্নাঙ্গে একটা নীল প্যান্ট, প্যান্টের তলার দিকটা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রকাণ্ড একজোড়া বুটজুতোর ভিতর। লোকটির চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার, হাবভাবে নেশার চিহ্নমাত্র নেই।

দ্রাগাও আর আমি প্রস্তুত। জোকুইম বলল, তুমি তৈরি হলেই আমরা যাত্রা করতে পারি।

পরক্ষণেই অন্ধকারের মধ্যে চলন্ত ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল সে!…

এমন অনাড়ম্বর শিকার অভিযান আগে কখনো সাশার চোখে পড়েনি। সাধারণত শিকারে যাওয়ার আগে শিকারিরা গরম কফি অথবা মাতে (চা) পান করে, তারপর একটি সরলরেখায় সারিবদ্ধ হয়ে তারা প্রবেশ করে বনের মধ্যে। এখানে সেসব কিছুই হল না। সাশা পোশাক পরে রাইফেল হাতে ঘরের বাইরে আসতেই হঠাৎ অন্ধকার যুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়াল জোকুইম, এবার আমরা যাচ্ছি।

কথাটা বলেই সে চলতে শুরু করল। পিছনে অনুসরণরত সাশার দিকে সে ফিরেও চাইল না।

ঘর থেকে বেরিয়ে জোকুইমের সঙ্গে চলে আসার আগে অ্যাপারিসিওর ঘুম ভাঙিয়ে তাকে সঙ্গে আনেনি সাশা। পরে বুঝল কাজটা সে ভালোই করেছিল। বুড়ো জোকুইমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে সাশা যখন হাঁফিয়ে পড়ছিল, সেইসময় তার মনে হল দুর্বলতার সাক্ষী হিসাবে অ্যাপারিসিওর উপস্থিতি তার ভালো লাগত না।

কিছুক্ষণ চলার পর তারা জোকুইমের কুঁড়েঘরের সামনে এসে পড়ল। একবারও না-থেমে চলন্ত অবস্থাতেই সজোরে লাথি মেরে বুট দুটোকে জোকুইম ঘরের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলল এবং নগ্ন পদেই হাঁটতে শুরু করল নিকটবর্তী অরণ্যের দিকে…।

ঘন জঙ্গলের সবুজ শ্যামলিমার বুকে রক্তাভ বিদ্যুতের মতন চমকে উঠছিল দ্রাগাওর লালচে বাদামি শরীর, পরক্ষণেই আবার অন্তর্ধান করছিল শিকারিদের দৃষ্টির অন্তরালে অরণ্যের গর্ভে। দ্রাগাওকে আর দেখতে না-পেলেও ঝোপঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে জোকুইমের পিঠ আর মাথা দেখতে পাচ্ছিল সাশা। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল জোকুইম, সামনের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, সাকুয়ারানা।

সাশা তাকিয়ে দেখল একটা মস্ত গাছের তলায় ঊর্ধ্বমুখে দাঁড়িয়ে সারমেয় ভাষায় চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে দ্রাগাও, তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে পূর্বোক্ত গাছের ডালে উপবিষ্ট একটি পুমার দিকে।

পুমা সাধারণত মানুষকে আক্রমণ করে না। কিন্তু কোণঠাসা হলে যেকোনো জানোয়ারই হিংস্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। গাছের উপর পুমার অবস্থাও সেইরকমই। যেকোনো মুহূর্তে অরণ্যের শান্তিভঙ্গ হতে পারে রক্তাক্ত যুদ্ধে। সময় থাকতে পুমার একটা ছবি তুলে না-রাখলে পরে হয়তো সেই সুযোগ আর পাওয়া যাবে না–অতএব ক্যামেরাকে বন্ধনমুক্ত করে পুমার ফটো তুলল সাশা।

জোকুইম আন্দাজেই বুঝল ক্যামেরার কাজ হয়ে গেছে, সে হাত বাড়িয়ে রাইফেলের দিকে ইশারা করল। সাশা বুঝল তাকেই এখন গুলি চালাতে হবে। সে রাইফেল তুলল, সঙ্গেসঙ্গে শূন্যে একটি নিখুঁত অর্ধবৃত্ত রচনা করে লাফ দিল পুমা এবং এসে পড়ল মাটি থেকে কয়েক ফুট মাত্র উঁচু একটা ডালের উপর। দ্রাগাও তীব্রকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল। লক্ষ্য স্থির করে গুলি ছুড়ল সাশা। তৎক্ষণাৎ আবার লাফ মারল পুমা। গুলি লাগল তার বুকে।

মরণাহত পুমা মাটিতে পড়ল, কিন্তু তখনও তার লড়াইয়ের উদ্যম শেষ হয়নি। সে এবার ঝাঁপ দিল সাশার দিকে। একইসঙ্গে আক্রমণ করল জোকুইম আর দ্রাগাও। জোকুইমের বর্শা এবং দ্রাগাও একইসঙ্গে ছুটল পুমার কণ্ঠ লক্ষ করে বর্শা, দ্রাগাও আর পুমা মিলিত হল শূন্যপথে। দ্রাগাওর কণ্ঠভেদ করে বর্শাফলক বিদ্ধ হল পুমার কাঁধের ঠিক পিছনে। পুমার দেহ যখন মাটিতে ছিটকে পড়ল, তখন সে প্রাণহীন মৃত। তবু সাশা কোনো ঝুঁকি নিতে চাইল না, জন্তুটার মৃত্যু–সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে আবার গুলি ছুড়ল।

বর্শা ফেলে দিয়ে মরণাপন্ন দ্রাগাওকে জড়িয়ে ধরল জোকুইম। কিছুক্ষণ পরে জোকুইমের আলিঙ্গনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করল দ্রাগাও। শোকবিহ্বল জোকুইমের দিকে তাকিয়ে সাশা বুঝল এখানে তার উপস্থিতি অনাবশ্যক। ক্যামেরাটাকে মাটি থেকে তুলে নিয়ে সে নিঃশব্দে স্থানত্যাগ করল…

পরের দিন সকালেই জোকুইম হাজির সাশার কুটিরে, সঙ্গে শিকলে বাঁধা দুটি কুকুর। একটি কুকুর আকারে ছোটো, কিন্তু দেহের গঠনে বোঝা যায় যে দস্তুরমতো শক্তিশালী পশু। অন্য কুকুরটি সঙ্গীর চাইতে দৈহিক আয়তনে বড়ো, দেখলে মনে হয় এই জন্তুটাও শরীরে যথেষ্ট শক্তি রাখে।

জোকুইম বলল, যতদিন আবার চাঁদ না-উঠছে, ততদিন আমি আর শিকারে যাব না। এই দুটি কুকুরের মধ্যে একটিকে তুমি রাখতে পারো, এরা দুজনেই শিকারে ওস্তাদ। অবশ্য দ্রাগাওর সঙ্গে ওদের তুলনা চলে না, কিন্তু ও-রকম কুকুর তো একটাই হয়।

জোকুইম বড়ো কুকুরটিকে দেখিয়ে বলল, ও শিকারের পিছনে তাড়া করার সময়ে মুখ দিয়ে একটুও আওয়াজ করে না। ওর সঙ্গে শিকারে গেলে ওকে ভালো করে জানা দরকার। ছোটোটার নাম ভ্যালেন্ট। আমার মনে হয় ছোটো কুকুরটি তোমার উপযুক্ত সঙ্গী হবে।

সাশা বলল, বেশ ছোটো কুকুরটিকেই আমি নিলাম। জোকুইম তার কথা রেখেছিল। সাশা যতদিন চিনির কারখানায় ছিল ততদিন সে শিকারে বার হয়নি। তবে সাশার মনে ক্ষোভ বা দুঃখ ছিল না, সে দস্তুরমতো খুশি–ডম কার্লোস তাকে যা বলেছিল, তা নিশ্চিত সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। সে অবশ্য জোকুইমকে তাইগর শিকার করতে দেখেনি। তাইগর বা জাগুয়ারের সঙ্গে পুমার যথেষ্ট তফাত–কিন্তু সাশা বুঝেছিল জোকুইমের পক্ষে বর্শার সাহায্যে জাগুয়ার শিকার আদৌ অসম্ভব নয়।

কিছুদিন পর সিনর শিকোর কাছে বিদায় নিয়ে সাশা বেরিয়ে পড়ল কুয়াবা অভিমুখে, যেখানে দাদা আর্নস্ট তার জন্য অপেক্ষা করছে। সঙ্গে ছিল বিশ্বস্ত সহচর অ্যাপারিসিও।

জঙ্গলের পথে পথে সারা শীতকালটা কেটে গেল, গ্রীষ্ম যখন শুরু হচ্ছে, সেইসময় একদিন তারা এসে পৌঁছাল কুয়াবা শহরের দ্বারে। তখন সন্ধ্যা আগত, তাই শহরে না-ঢুকে প্রান্তসীমায় তাঁবু খাঁটিয়ে তারা রাত কাটাল এবং পরের দিন সকালে প্রবেশ করল কুয়াবা শহরের মধ্যে। শহর চত্বরে একটি বলিতো (ক্যান্টিন) নামক বিপণিতে তারা আর্নস্টকে দেখতে পেল। সে একটা টেবিলের সামনে বসে ছিল, ভাইকে দেখে হাত তুলে অভ্যর্থনা জানাল।

সাশা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আর্নস্টকে পর্যবেক্ষণ করল। সে একইরকম আছে–সোনালি দাড়ি, বিশাল বক্ষ, দৃঢ় পেশিবদ্ধ বলিষ্ঠ বাহু–কিন্তু দেহে নয়, মনের দিক থেকে দাদা যেন বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

কয়েকটা কথা বলার পর আর্নস্ট যা বলল, তা শুনে দাদার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ পেল না সাশা।

আর্নস্ট বলল, আমরা যখন কোক্সিমে ছিলাম, তখন সেখানকার পুলিশ জানিয়েছিল একটি ছোটোখাটো চেহারার লোক আমাদের খোঁজ করেছিল। আমরা লোকটা সন্ধান পাইনি। ব্যাপারটা তোর মনে আছে সাশা?

তার কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি বললে তাই মনে পড়ল। তা সেই লোকটার তুমি সন্ধান পেয়েছ?

মাথা নেড়ে গম্ভীরভাবে আর্নস্ট বলল, আমি তাকে শুধু খুঁজে পাইনি, স্বচক্ষে দেখেছি এই শহরে। লোকটির নাম সিনর ফাভেল!

.

দশম পরিচ্ছেদ

আর্নস্টের কথা শুনে প্রথমে খুবই আনন্দিত হয়েছিল সাশা–ফাভেল তাহলে বেঁচে আছে! খুনের দায় থেকে তাহলে সাশা অব্যাহতি পেয়েছে। যদিও ফাভেলের মতো মানুষের খুন হওয়াই উচিত।

কিন্তু একটু পরেই আনন্দের পরিবর্তে জাগল প্রচণ্ড ক্রোধ–ফাভেল তাহলে দূরদূরান্ত পেরিয়ে তাদের ধাওয়া করছে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য! সাশা স্থির করল এবার দেখা হলে ফাভেলকে সে জেনেশুনে ঠান্ডা মাথায় খুন করবে। আর্নস্টও ফাভেলকে মেরে নিশ্চিন্ত হতে চায়–তবে সাশার পরিবর্তে সে নিজেই হতে চায় হন্তারক

দুই ভাই বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেও ফাভেলকে কোথাও দেখতে পেল না। প্রথম তাকে দেখেছিল আর্নস্ট, তার সঙ্গে ছিল কয়েকটি লোক সম্ভবত বন্ধুবান্ধব। অত লোকের সামনে দোকানের মধ্যে ফাভেলের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করতে পারেনি আর্নস্ট, সে ফাভেলকে একা পেতে চেয়েছিল, কিন্তু প্রথম দর্শনের পর আর কোনোদিনই আর্নস্ট ফাভেলের সাক্ষাৎ পায়নি।

কিছুদিন কুয়াবা শহরে কাটিয়ে আগের পরিকল্পনা অনুসারে হিরার সন্ধানে যাত্রা করল দুই ভাই। তখনও অ্যাপারিসিও ছিল তাদের সঙ্গে। মাত্তো গ্রসোর বনভূমিতে হিরার লোভে ছুটেছিল আরও বহু মানুষ। শুধু স্থানীয় মানুষ নয় অনেক বিদেশিও এসে ভিড় করেছিল মাত্তো গ্রসোর খাঁড়ির ধারে ধারে হিরার লোভে।

সেই হীরক-অভিযানে বারংবার বিপদে পড়েছে দুই ভাই এবং ভাগ্যের আশীর্বাদে মরতে মরতে বেঁচে গেছে অনেকবার। সেসব কাহিনি সবিস্তারে বলার জায়গা এখানে নেই–তাই সংক্ষেপে বলছি উক্ত অভিযানে তারা সফল হয়েছিল, বেশ কিছু অর্থের মালিক হয়েছিল দুই ভাই–তারপর একদিন এই ভবঘুরে জীবনে বিরক্ত হয়ে বড়ো ভাই আর্নস্ট একটি স্থানীয় মেয়েকে বিবাহ করে সংসারী হল এবং ছোটো ভাই সাশা তার বেদুইনো নামক অশ্বতরটির পিঠে চেপে ভ্যালেন্টো নামে কুকুরটিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অরণ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য।

আসলে দুই ভাইয়ের চরিত্র ছিল দুধরনের। আর্নস্ট ছিল ঘরমুখো, বনজঙ্গল ছিল তার দুই চোখের বিষ। সাশার মন ছিল বহির্মুখী–অরণ্যের স্নিগ্ধ শ্যামলিমা এবং বিপজ্জনক পরিবেশ তাকে আকর্ষণ করত সর্বদা তাই সুযোগ পেলেই ঘর ছেড়ে সে ছুটত বনের দিকে।

বেশ কয়েকমাস ধরে বন থেকে বনে আর গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে সাশা এসে উপস্থিত হল তার পুরাতন আস্তানা সিনর শিকো পিন্টো নামে চিনির কারবারির গৃহে। সিনর শিকো সাদর অভ্যর্থনা জানাল সাশাকে। অ্যাপারিসিও তখন সিনর শিকোর বাসস্থান থেকে কয়েক মাইল দূরে সিনর পেসো নামে এক ভূস্বামীর কাছে কিছু কাজের দায়িত্ব নিয়েছিল। সাশা তাকে বলেছিল চিনির কলে তার কিছু কাজ বাকি আছে, সেই কাজগুলো সারা হয়ে গেলে সে এসে দেখা করবে অ্যাপারিসিওর সঙ্গে পরবর্তী কর্তব্য তারা স্থির করবে দুজনে মিলে। কিন্তু কোনো কাজেই মন দিতে পারছিল না সাশা, সে ছটফট করছিল তাইগরেরো জোকুইম গুয়াতের সঙ্গে দেখা করার জন্য। জোকুইমের সঙ্গে আরও একবার শিকারে যাওয়ার ইচ্ছাটা তাকে অস্থির করে তুলেছিল।

ইতিপূর্বে যে-কুটিরে সাশা আশ্রয় নিয়েছিল, এইবারও সে কুঁড়েঘরটিকেই সে সাময়িক অবস্থান বলে গ্রহণ করল। সিনর শিকোর কাছে সাশা জানতে চাইল জোকুইম এখন এই অঞ্চলে আছে কি না। সিনোর শিকো বলল সে বর্তমানে এখানে না-থাকলেও আশা করা যায় দিন দুই পরেই সে উপস্থিত হবে তার নিজস্ব আস্তানায়।

নির্ভুল অনুমান ঠিক দু-দিন পরেই দুটি কুকুর নিয়ে সাশার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল জোকুইম। তখনও দেখা গেল কুকুরের আশ্চর্য স্মরণশক্তি ভ্যালেন্টো নামে যে-কুকুরটাকে জোকুইম উপহার দিয়েছিল, সেই কুকুরটা মহা উৎসাহে অভ্যর্থনা জানাল তার পুরানো মনিবকে।

চিনির কারখানাকে ঘিরে চারপাশে যে ঘন জঙ্গল অবস্থান করছিল, সেইদিকে তাকিয়ে জোকুইম বলল, তাইগররা নীচু জমি ছেড়ে এখন উঁচু জমিতে উঠে আসছে। বর্ষা নামলে তারা নীচু জমিতে থাকে না। আগামী দিনটা বাদ দিয়ে পরশুদিন খুব ভোরে আমি আসব। তুমি প্রস্তুত থেকো সিনর সাশা–আমরা দুজনে আবার একসঙ্গে শিকার করতে যাব।

নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে চারটি প্রকাণ্ড কুকুর নিয়ে জোকুইম হাজির হল সাশার দরজায়। কিন্তু কুকুরদের দলপতি হিসাবে ছোটোখাটো ভ্যালেন্টকেই সে নির্বাচন করল।

দ্রাগাওর পরে ভ্যালেন্টই হচ্ছে সবচেয়ে সেরা কুকুর, জোকুইম বলল, সে কখনো ভুল করে না। অন্য কুকুরগুলো ভুল করে তোমাকে অন্যপথে চালনা করতে পারে।

এখানে বলে রাখা ভালো কুকুরদের দলপতি বলতে কী বোঝায়। সারমেয়-বাহিনীর মধ্যে দলপতি ছাড়া অন্যান্য কুকুরগুলো শিকল-বাঁধা অবস্থায় শিকারিদের সঙ্গে থাকে। দলপতি শিকারের গন্ধ বা পদচিহ্ন অনুসরণ করে অগ্রসর হয়। তার গলার শিকল সেইসময় খুলে দেয় শিকারি। দলপতির পিছনে অন্যান্য কুকুরদের শিকল ধরে শিকারি চলতে থাকে। একেবারে শেষ মুহূর্তে শিকারের কাছাকাছি এসে সব কয়টি কুকুরের গলার শিকল খুলে শিকারি তাদের ছেড়ে দেয় এবং সারমেয়-বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করে শিকারের সম্মুখীন হয়ে যথাকৰ্তব্য স্থির করে। সুতরাং শিকার-অভিযানে কুকুরদের দলপতির ভূমিকা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। শিকারের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করতে পারে একমাত্র দলপতি।

তিনঘণ্টা ধরে বনের পথে ছুটে চলার পর একটা জাগুয়ারের (তাইগর) পায়ের ছাপ দেখতে পেল শিকারিরা। ভ্যালেন্টোর সঙ্গে অন্যান্য কুকুরগুলোকেও শিকারিরা মুক্তি দিল–তৎক্ষণাৎ দলপতি ভ্যালেন্টোকে অনুসরণ করে তিরবেগে বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল কুকুরদের দল…

হঠাৎ তীব্র হয়ে বেজে উঠল কুকুরের উল্লসিত চিৎকার। সাশা বুঝল কুকুরগুলো তাইগরকে দেখতে পেয়েছে। জোকুইমের সঙ্গে সে ঊধ্বশ্বাসে ছুটল শব্দ লক্ষ করে…

একটু পরেই তারা কুকুরগুলোকে দেখতে পেল। একটা ঘন ঝোপের বাইরে দাঁড়িয়ে তারা তারস্বরে চিৎকার করছে। সাশা বুঝতে পারল ওই ঝোপের ভিতরেই লুকিয়ে আছে তাইগর।

আচম্বিতে হলুদ আর কালো ফোঁটাফোঁটা একটা দেহ বিদ্যুতের মতো ছিটকে এল ঝোপের বাইরে–ক্রুদ্ধ জাগুয়ার এতক্ষণে শত্রুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, এতক্ষণে অতিক্রম করেছে তার ধৈর্যের সীমা শত্রুর আস্ফালন শুনে আর নিশ্চেষ্ট থাকতে রাজি নয় অরণ্য-সম্রাট!

কুকুরগুলো তাইগরকে অর্ধবৃত্তাকারে ঘিরে ধরে কামড় বসানোর উপক্রম করেছিল, কিন্তু তীক্ষ্ণ নখরযুক্ত থাবার নাগালের মধ্যে এগিয়ে গিয়ে কামড়াতে সাহস পাচ্ছিল না। তারা জানে খুব বলিষ্ঠ কুকুরও তাইগরের নখের থাবার প্রচণ্ড চপেটাঘাত সহ্য করে বেঁচে থাকতে পারে না–তাই তাইগর থাবা চালালেই তারা ছিটকে সরে যাচ্ছিল তার নাগালের বাইরে।

জোকুইম এসে পৌঁছাল ক্রুদ্ধ তাইগরের প্রায় বিশ গজ দূরত্বের মধ্যে। জন্তুটার চেহারা তখন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। যে-পুমাটাকে মেরেছিল জোকুইম, অথবা যে-জাগুয়ারটাকে বার্নারদো আর জর্জের সঙ্গে শিকার করেছিল সাশা, এই জন্তুটা একেবারেই তাদের মতন নয়–এটা যেমন হিংস্র, তেমনই নির্ভীক। অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে সে কুকুরগুলোকে আক্রমণ করার চেষ্টা করছে, সেইসঙ্গে তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছে রুদ্ধ রোষের চাপা গর্জনধ্বনি।

জোকুইম ততক্ষণে পৌঁছে গেছে তাইগরের দশ গজের ভিতর। নতুন শত্রুর আবির্ভাব হতেই তার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল তাইগর, তার দুই চোখ হিংস্র আক্রোশে জ্বলে উঠল দু-টুকরো জ্বলন্ত কয়লার মতো। সে বুঝল এই হচ্ছে তার আসল শত্রু, একে নিপাত করতে পারলেই আজকের যুদ্ধে তার জয় নিশ্চিত। জোকুইমও স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাইগরের দিকে দুই হাতের শক্ত মুঠিতে বর্শাদণ্ড জমির সঙ্গে সমান্তরাল, বর্শার ফলা জমি থেকে দু-ফুট উপরে স্থির হয়ে রয়েছে।

হঠাৎ জোকুইমের একটা পা মাটির উপর ধাক্কা মেরে এগিয়ে এল। একটা শুকনো মাটির ঢেলা ছিটকে এসে আঘাত করল তাইগরের মুখে। সঙ্গেসঙ্গে তাইগর ঝাঁপ দিল জোকুইমকে লক্ষ করে। শানিত বর্শাফলক চমকে উঠল, পশুর দেহ বিদ্ধ করল, পিছিয়ে গিয়ে আবার আঘাত হানল। দ্বিতীয়বারের আঘাত তাইগরকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল। উদ্যত রাইফেল তুলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল সাশা, কিন্তু ধরাশায়ী দেহটার মধ্যে প্রাণের স্পন্দন দেখতে না-পেয়ে অস্ত্রটা নামিয়ে নিল। এই লড়াইতে অংশগ্রহণ করেনি সাশা, অরণ্যসম্রাটের সঙ্গে জোকুইমের দ্বন্দ্বযুদ্ধে সে ছিল নীরব দর্শক।

মুগ্ধ দৃষ্টিতে জোকুইমের দিকে তাকিয়ে সাশা বলল, রিও গ্র্যান্ড সাল থেকে আমার বন্ধুরা যে-দৃশ্য দেখার সম্ভাবনা আছে বলে আমায় উৎসাহিত করেছিল, সেই দৃশ্যই আজ দেখার সৌভাগ্য হল আমার। তুমি তাহলে একজন তাইগরেরো!

জোকুইম বলল, আজকের দিনের স্মৃতি হিসাবে মরা জন্তুটার চামড়া তুমি ছাড়িয়ে নিয়ে যাও। এর পরে তুমি নিজের হাতেই তাইগর শিকার করে তার চামড়া ছাড়িয়ে নিতে পারবে।

পনেরো দিন পরে আবার জোকুইমের সঙ্গে কুকুরের দল নিয়ে শিকার করতে গেল সাশা। সেদিন আর রাইফেল ছিল না সাশার হাতে, ছিল একটা মজবুত জায়াগা (বর্শা) আর কোমরের খাপে ছিল পিস্তল। সেদিন শিকারিদের বেশিক্ষণ ছুটোছুটি করতে হল না। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা শিকারের সন্ধান পেল। কুকুরগুলো একটা অল্পবয়সি পুরুষ তাইগরকে ঘিরে ফেলেছিল। জন্তুটা বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে কুকুরগুলোকে আক্রমণ করতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু মানুষ দুটিকে দেখেই কুকুরদের ছেড়ে সে দ্বিপদ শত্রুদের দিকে আকৃষ্ট হল। প্রায় তিরিশ গজ দূর থেকে সে    ঝড়ের মতো ছুটে এল সাশার দিকে। জোকুইম যেভাবে শিখিয়েছিল, ঠিক সেইভাবেই বর্শাটাকে দুই হাতে শক্ত করে ধরেছিল সাশা, বর্শাফলক ছিল জমির দিকে নীচু হয়ে। জন্তুটা লাফ দিলেই তলা থেকে বর্শা চটপট