- বইয়ের নামঃ সংখ্যার নাম চার
- লেখকের নামঃ ময়ূখ চৌধুরী
- প্রকাশনাঃ নিউ বেঙ্গল প্রেস (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী
০১. বজ্রপাতের পূর্বাভাস
এক বিস্মৃত যুগের বিচিত্র কাহিনী
বাঘের মতো ভয়ংকর একটি মানুষের হাতে হাত মিলিয়েছিল দুঃসাহসী এক কিশোর, মহাশক্তিধর এক মল্লযোদ্ধা, এবং লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত এক তীরন্দাজ!
কিন্তু কেন?
কি তাদের উদ্দেশ্য?…
.
০১. বজ্রপাতের পূর্বাভাস
মহারাজ রুদ্রদমনের রাজত্বে প্রজারা সুখে শান্তিতে বাস করত বটে, কিন্তু প্রবাদবাক্য অনুসারে বাঘে-বলদে এক ঘাটে জলপান করত এমন কথা বলা যায় না। কারণ, বাঘের মতো মানুষগুলো সুযোগ পেলেই বলদ-সদৃশ মানুষের ঘাড় ভেঙে হিংস্র আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে সচেষ্ট হত, তাই মাঝে মাঝে শান্তিভঙ্গের ঘটনা ছিল অনিবার্য।
তবে প্রজাদের শুভ-অশুভ ও নিরাপত্তা সম্পর্কে মহারাজ ছিলেন অতিশয় সচেতন। প্রজারা জানত, রুদ্রদমনের রাজত্বে কুকর্মকারী দুৰ্বত্তের নিস্তার নেই। রাজ্যে প্রচলিত প্রবাদ, মহারাজ অন্তর্যামী, রাজ্যে সংঘটিত যে কোনো ঘটনা সম্পর্কে তিনি অবহিত। দেবাশিত মহারাজের অপ্রীতিভাজন হলে দুবৃত্তের মৃত্যু সুনিশ্চিত।
প্রবাদ কখনো সম্পূর্ণ সত্য হয় না, কিন্তু প্রবাদের মূলে কিছু সত্য থাকে। মহারাজ রুদ্রদমন সম্পর্কে ওই ধরনের প্রবাদ প্রচলিত হওয়ার কারণ ছিল।
প্রজাবৃন্দ দেখেছে কোনো দুৰ্বত্তের অত্যাচারে তারা যখন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, রাজকর্মচারী আইনরক্ষকের দল যখন কিছুতেই শান্তিভঙ্গকারীকে গ্রেপ্তার করতে পারে না, শান্তিপ্রিয় মানুষ যখন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং মহারাজের কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ে সেই সময় হঠাৎ একদিন রাজদরবার থেকে ঘোষিত হয় রাজার আদেশ- উ যেন অবিলম্বে কোতোয়ালের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
রাজাদেশ পালন না করলে দেবরাজ ইন্দ্রের রোষে পূর্বোক্ত দুবৃত্তের মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা আছে একথাও জানিয়ে দেয় রাজদরবার। ওই ঘোষণা মৃত্যুদণ্ডের মতোই চরম। কারণ, রাজদরবারের নির্দেশ ঘোষিত হওয়ার পরও অপরাধী যদি আত্মসমর্পণ না করে অথবা দেশান্তরী না হয়, তবে হঠাৎ একদিন রাজ্যের কোনো না কোনো স্থানে তার মৃতদেহ চোখে পড়ে এবং মৃতের ললাটে বা বক্ষে দেখা যায় রক্তাক্ত ক্ষতস্থানে অঙ্কিত রাজচিহ্নের প্রতীক বাণ!
রুদ্রদমনের উপাস্য ইষ্টদেবতার স্থান গ্রহণ করেছেন দেবরাজ ইন্দ্র। ইন্দ্রের হাতে যে বজ্র থাকে, ওই বাণ হচ্ছে তারই প্রতীক এবং সেই জন্যই রাজচিহ্ন বলে স্বীকৃত।
বজ্ৰপাণি ইন্দ্রের অস্ত্রটি সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত। রুদ্রদমনের মতে ওই অস্ত্রটি এক মারাত্মক বাণ- যে বাণ বিদ্যুৎ চমকের মতো ছুটে এসে শত্রুর প্রাণ সংহার করে। রাজশক্তির প্রতীকরূপে তাই শায়ক-চিহ্ন গৃহীত হয়েছিল রুদ্রদমনের রাজ্যে। বজ্রের মতোই সেই প্রতীক চিহ্ন আঘাত হানে রাজশত্রুর বক্ষে বা ললাট-পটে।
সম্প্রতি যাকে লক্ষ্য করে শায়কচিহ্নিত বজ্র উদ্যত হয়েছে, সেই ভয়ংকর মানুষটির নাম পরন্তপ। সে কোথায় থাকে কেউ জানে না। আজ পর্যন্ত প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে তার চেহারার বর্ণনাও পাওয়া যায়নি। গ্রামে বা নগরে যখন সে হানা দেয়, তখন তার মাথায় জড়ানো থাকে প্রকাণ্ড উষ্ণীষ আর সেই উষ্ণীষ-সংলগ্ন কাপড়ে বাঁধা থাকে মুখের নিম্ন ভাগ। আবরণের নীচে পরন্তপের মস্তক ও মুখ সম্পূর্ণ অদৃশ্য থাকে। উক্ত মস্তক কেশের প্রাচুর্যে উর্বর, অথবা বিরলতৃণ মরুভূমির মতো প্রায়-মসৃণ হয়ে ইন্দ্রলুপ্তের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে, বস্ত্রের আবরণ ভেদ করে তা বোঝার উপায় নেই। নাসিকা ও অধর-ওষ্ঠ একই ভাবে আবৃত আক্রান্ত ব্যক্তির দৃষ্টিপথে শুধু ধরা পড়ে রোমশ বৃশ্চিকের মতো একজোড়া জ্বর নিচে একজোড়া তীব্র চক্ষু!
গ্রামে ও নগরে অবাধে লুণ্ঠন চার্লিয়েছে দস্যু পরন্তপ। মাঝে মাঝে রক্ষীদলের সঙ্গে সংঘর্ষও ঘটেছে। দুই এক সময় হত্যাকাণ্ডও সংঘটিত হয়েছে। তার দলভুক্ত দস্যুরা দুই একবার ধরা পড়েনি এমন নয়, কিন্তু পরন্তপ সম্পর্কে বন্দিদের মুখ থেকে কোনো সংবাদ সংগ্রহ করা যায়নি। দস্যু অসম্ভব ধূর্ত। তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ অনুচর অন্যান্য দস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, সে নিজে কোনো সময়েই সাধারণ দস্যুদের কাছে মুখ দেখায় না। দলের লোকেরা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত থাকে। প্রয়োজন হলে তার অন্তরঙ্গ দুতিনটি অনুচর দলের অন্যান্য লোকদের কাছে পৌঁছে দেয় পরন্তপের আহ্বান। নির্দিষ্ট স্থানে সকলে উপস্থিত হলে মুখ ও মাথা উষ্ণীষের আবরণে ঢেকে তাদের সামনে আসে পরন্তপ, পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেয়, তারপর নির্বাচিত স্থানে হানা দিয়ে লুণ্ঠনকার্য সমাধা করে দ্রুতবেগে অদৃশ্য হয়। দলের দস্যুরা আগে থাকতে জানতে পারে না কোথায় হানা দেওয়ার সঙ্কল্প করছে তাদের দলপতি। লুণ্ঠন-অভিযানে যাত্রা করার পূর্ব মুহূর্তে দস্যুদলকে মানব-মৃগয়ার জন্য নির্বাচিত স্থানটি জানিয়ে দেওয়া হয়। কার্য সমাধা করে সরে পড়ার পর অকুস্থল থেকে অনেক দূরে এসে লুণ্ঠিত দ্রব্য ভাগ করে দেয় পরন্তপ, তারপর যে যার বাসস্থানে চলে যায়। যে সব দস্যু ওই অভিযানে যোগ দেয় তাদের দীর্ঘকাল আর ডাকে না পরন্তপ। এর মধ্যে আবার লুঠতরাজের প্রয়োজন হলে সে আর একটি নতুন দলকে নিযুক্ত করে।