আবার সামনে এগুলেন, আগের সেই শান্ত, সুন্দর চেহারাটা ফিরে এল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, পাশের টেবিলে রাখলেন ম্যারিয়ট মোমবাতিটা। এবার ঘুমাতে যাবেন। ঠিক এমন সময় দরজায় ধাক্কা দিল কেউ। ভিতরে আসুন, বলার সময় মহিলার ছবিটার দিকে দৃষ্টি দেওয়া এড়াতে পারলেন না।
তবে কোনো ভূত কিংবা প্রেতাত্মা ঢুকল না ঘরে। লর্ড চার্লসের দুই ভাতিজা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে, করিডোরের শেষ মাথার একটা কামরা ভাগাভাগি করছে তারা। সন্ধ্যায় তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে ক্যাপ্টেনের, তখন শিকারী কুকুর আর বন্দুক নিয়ে আলাপ করছিল তারা।
যাক বাবা! আপনি ঘুমিয়ে পড়েননি। বলল কিশোরদের একজন। আপনি কি আমাদের রুমে একবার আসবেন? লণ্ডন থেকে কেনা একটা বন্দুক এই মাত্র খুলেছি। ওটা সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাচ্ছিলাম।
মোমবাতিটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগুলেন ক্যাপ্টেন। মনে হলো যেন ছবির মহিলাটি তাঁর দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটছে। তারপর জোর করে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে রিভলভারটা তুলে নিয়ে বললেন, এটা নেব আমি। ব্রাউন লেডির সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায়!
তিনজন করিডোর ধরে হেঁটে ছেলেদের কামরায় চলে এলেন। ক্যাপ্টেন অস্ত্রটার প্রশংসা করে বললেন, আগামীবার লণ্ডনে গেলে নিজেও এমন একটা কিনবেন। আরও কয়েক মিনিট আলাপের পর ক্যাপ্টেন হাই তুলতে তুলতে বললেন, এখন বিছানায় যেতে হবে আমাকে। আগামীকাল আবার লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে।
আপনাকে বরং আমরা পৌঁছে দিয়ে আসি, হাসতে-হাসতে বলল চার্লসের এক ভাতিজা, ব্রাউন লেডি যদি আবার আপনাকে অপহরণ করে ফেলে।
একসঙ্গে কামরা থেকে বের হয়ে লম্বা, অন্ধকার করিডোরটা ধরে হাঁটা ধরলেন তাঁরা। গোটা বাড়িটাই অন্ধকারে ঢেকে আছে, তাদের পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। মাত্র কয়েক গজ এগিয়েছেন এমন সময় হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন।
দেখো! ফিসফিস করে বললেন তিনি।
করিডোরের অপর পাশ থেকে একটা কাঠামো এগিয়ে আসছে, হাতে লণ্ঠন। একজন মহিলা, হাঁটার সময় তার পোশাকটা খসখস শব্দ করছে। তবে ছায়ায় ঢাকা পড়ায় চেহারাটা দেখা যাচ্ছে না।
তিনি নিশ্চয় মহিলা অতিথিদের একজন, সম্ভবত পথ হারিয়েছেন। ম্যারিয়াট বিড়বিড় করলেন, কিংবা কেউ বাগানের দিকে যাচ্ছেন।
কিন্তু মহিলাটি কে? ছেলেদের একজন বলল, তাকে অতিথিদের কারও মত লাগছে না আমার।
কাঠামোটা তাঁদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তাপমাত্রাটা হঠাৎ করেই বেশ কয়েক ডিগ্রী নেমে গেল, মনে হচ্ছে যেন হঠাৎ করেই শীতকাল চলে এসেছে। তিনজন শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করলেন। হঠাই সামনের একটা খালি কামরার খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে ছেলেদেরও টেনে নিলেন ম্যারিয়াট। তারপর একটু ফাঁক রেখে দোর টেনে দিলেন। এবার এই ফাঁকে চোখ রাখলেন সবাই, হৃৎপিণ্ডে দ্রিম দ্রিম বাড়ি খাচ্ছে।
মহিলাটি এখন দরজার কাছাকাছি চলে এসেছেন। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ক্যাপ্টেন। লণ্ঠনের আলোয় চেহারাটা ধরা দিল তাঁর সামনে, পরনে সেই সিল্কের বাদামি পোশাক। সন্দেহ নেই ছবির সেই মহিলা আর ইনি একই ব্যক্তি। করিডোর ধরে আস্তেআস্তে হেঁটে চলেছেন। পোশাক খস খস শব্দ তুললেও পা ফেলার কোনো আওয়াজ হচ্ছে না। লণ্ঠনের আলোয় তার চোখে, মুখে অশুভ কিছু নজর পড়ল না।
দরজার ঠিক উল্টো পাশে যখন চলে এলেন তখন দাঁড়িয়ে পড়লেন। বাতিটা মুখের সামনে ধরলেন। আর তখনই চেহারাটা পাল্টে গেল। চামড়া-মাংস ভেদ করে স্পষ্ট হয়ে উঠল হাড়গুলো। মনে হলো যেন একটা কংকাল হেঁটে যাচ্ছে সামনে দিয়ে। গর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে চোখ জোড়া, ঠোটহীন মুখটাকে লাগছে যেন একটা গোরস্থানের প্রবেশদ্বারের মত।
ধীরে-ধীরে দরজাটা মেললেন ক্যাপ্টেন। ব্রাউন লেডির ভয়ঙ্কর মুখটা আরও পরিষ্কার হয়ে উঠল তাঁদের চোখের সামনে। জোর খাটিয়ে নিজের মনটাকে স্থির করলেন কাপ্টেন। তারপর একেবারে কাছ থেকে গুলি করলেন প্রেতাত্মাটার দিকে।
বদ্ধ জায়গায় শব্দটা কানে তালা লাগিয়ে দিল। যখন ধোঁয়া অদৃশ্য হলো মেঝের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন। আশা করছেন মাটিতে একটা দেহ পড়ে থাকতে দেখবেন। কিন্তু এখানে কিছুই নেই। এমনকী কিছু ছিল তা প্রমাণ করার মত কোনো চিহ্নও না। তিনজন পুরুষ আর বাতাসে ভেসে চলা হালকা ধোঁয়ার রেখা ছাড়া করিডোরে আর কিছুর অস্তিত্ব নেই।
পাগলের মত একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগলেন তারা। এখানে কিছু একটা ছিল, তাই না? আমার চোখ নিশ্চয় বেঈমানি করেনি? বললেন ক্যাপ্টেন। ছেলেদের একজন কাঁপতে-কাপতে বলল, আমি যা দেখেছি আপনিও যদি তা দেখে থাকেন তবে তা ভয়ঙ্কর। তারপর উল্টো পাশের দরজার দিকে ইশারা করে বলল, দেখুন, বুলেটের গর্ত। এখানে যা ছিল বুলেটটা তাকে ভেদ করে গেছে।
এবার ক্যাপ্টেন গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, আমরা যাকে দেখেছি সে কোনো চোরাচালানী বা পোচার নয়, রেইনহ্যামের ব্রাউন লেডি, ছবির থেকে যে জীবন পেয়ে গেছে। তারপরই হঠাৎ একটা চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তার। আমার সঙ্গে চলো। বলে দ্রুত নিজের কামরার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।
দেয়ালের যেখানে বাদামি বর্সনার ছবি ঝুলছে সেখানে চলে এলেন ক্যাপ্টেন। মোমটা উঁচু করে ধরলেন। ব্রাউন লেডি যেন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখটাতে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। আলো পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে বাদামি পোশাকটা। হঠাৎই ক্যাপ্টেনের শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। মহিলার হৃৎপিণ্ডের কাছটায় কি একটু রক্তের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে? আলো পড়ে চিক চিক করছে? নাকি তার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা এটা?