সুলতানা বেগম বিস্ময়ে যেন বোবা হয়ে যান। সেই সঙ্গে বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে ওঠে। দু’চোখ বেয়ে টপ-টপ করে অশ্রু ঝরতে থাকে। তিনি চোখ মুছতে-মুছতে বুজে আসা গলায় কোনওক্রমে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি তা হলে সেদিন কেন তাড়াতাড়ি এলে না? আর কোনও দিনই তো ফিরে এলে না!’
ইয়াসমিন বেগম আবার আমজাদ হোসেনের গলার স্বরে বলতে থাকেন, ‘বরাবরের মত সেদিনও অফিসের বস সোয়া ন’টার আগে ছাড়লেন না। অফিস থেকে বেরিয়েই মার্কেটে চলে গেলাম তোমার জন্য একটা শাড়ি আর সুমনের জন্য খেলনা কিনতে। কেনা-কাটা শেষে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি দমকা হাওয়া ছেড়েছে। ঘন-ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবে। রাস্তা-ঘাট একেবারে ফাঁকা। যাওয়ার জন্য একটা খালি রিকশা বা বেবি ট্যাক্সি কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না। জোরে-জোরে পা চালিয়ে হাঁটতে শুরু করি। যে করেই হোক ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবার আগে বাসায় পৌঁছতে হবে। কিন্তু পথের মাঝেই হঠাৎ প্রবল ঝড় শুরু হয়ে যায়। রাস্তার সব ধুলো-বালি, পলিথিনের টুকরো, কাগজের টুকরো ঘূর্ণির মত উড়তে শুরু করে। মুহূর্তের জন্য চোখের সামনে কিছুই দেখতে পাই না। একটু নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় দিগ্বিদিক্ হারিয়ে ছুটতে শুরু করি। এসময় উপর থেকে ইলেকট্রিক তার ছিঁড়ে এসে গায়ে পড়ে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃগী রোগীর মত কাঁপতে-কাঁপতে অনুভূতি হারাই।
‘যখন আবার ক্ষণিকের জন্য নিজেকে ফিরে পাই, তখন দেখি আমি এক অন্ধকার কামরায়। আমাকে ঘিরে অদ্ভুত চেহারার তিনজন মানুষ। অনেক লম্বা। লম্বা-লম্বা হাত-পা। জ্বলজ্বলে চোখ।- পিছনে লম্বা লেজ। তাদের গা থেকে সবুজাভ আলোর বিচ্ছুরণ হচ্ছে। তারা আমার পেটটা চিরে ফেলেছে। বুক থেকে নাভির নিচ পর্যন্ত লম্বালম্বিভাবে চিরেছে। মাথার খুলিও কেটে ফেলেছে। আমার পাশে আরও একজন শোয়ানো ছিল। একজন মহিলা। তারও আমার মত বুক থেকে নাভির নিচ পর্যন্ত চিরে ফেলা হয়েছে। মাথার খুলিও কেটে ফেলেছে। সবই দেখছিলাম কিন্তু নড়াচড়া বা কথা বলার মত কোনও ক্ষমতা ছিল না। তারা তিনজন আমাদের দু’জনেরই চেরা পেটের মাঝে হাত ঢুকিয়ে হাতড়াচ্ছিল। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল আমাদের দু’জনের শরীর। ওসব দেখতে-দেখতেই আবার চেতনাশূন্য হয়ে পড়ি। এরপর আর কিছু মনে নেই। সেই থেকে হঠাৎ-হঠাৎ মাঝে-মাঝে নিজেকে খুঁজে পাই, আবার যেন কোথায় হারিয়ে যাই।’
ছয়
সুমনের এক বন্ধু ডা. জাহিদ হাসান। বর্তমানে গৌরীপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার। সুমন তার শাশুড়ি ইয়াসমিন বেগমের মাথা যন্ত্রণার সমস্যা নিয়ে ফোনে জাহিদ হাসানের সঙ্গে কথা বলে। সুমনের বন্ধু জাহিদ হাসান পরামর্শ দেয় প্রফেসর ডা. আতিকুর রহমানকে দেখানোর। তিনি একজন নামকরা নিউরোলজিস্ট। মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নের সময় ডা. আতিকুর রহমান জাহিদ হাসানের শিক্ষক ছিলেন। সেই সুবাদে জাহিদ হাসানের সঙ্গে আতিকুর রহমানের বেশ সুসম্পর্ক রয়েছে। জাহিদ হাসান সুমনকে আশ্বাস দেয়, সে তার স্যর আতিকুর রহমানকে অনুরোধ করবে, তিনি যাতে সুমনের শাশুড়িকে বাড়তি যত্ন নিয়ে দেখেন।
সুমন ইয়াসমিন বেগমকে ডা. আতিকুর রহমানের কাছে নিয়ে যায়। ডা. আতিকুর রহমান ইয়াসমিন বেগমের মাথা ব্যথার সমস্যা বিস্তারিতভাবে শুনে মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান সহ কয়েক ধরনের রক্ত পরীক্ষা করাতে দেন। পরীক্ষাগুলোর রিপোর্ট নিয়ে আবার তাঁর কাছে যেতে বলেন।
মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান এবং রক্ত পরীক্ষাগুলোর রিপোর্ট বেরোবার পর, রিপোর্ট নিয়ে সুমন একা আতিকুর রহমানের চেম্বারে যায়। ডা. আতিকুর রহমান গভীর মনোযোগের সঙ্গে রিপোর্টগুলো উল্টে-পাল্টে দেখেন। বেশ কয়েকবার দেখেন। রিপোর্টগুলো দেখতে-দেখতে তাঁর ভুরু কুঁচকে যেতে থাকে। তাঁকে দেখে মনে হয় তিনি যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। এক পর্যায়ে চিন্তিত গলায় বলেন, ‘সুমন, তোমার মাদার- ইন-ল-র মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান দেখে আমি সাংঘাতিক বিস্মিত। একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মস্তিষ্কের গঠন যে এমন হতে পারে তা আমার কল্পনায়ও ছিল না। যে ডাক্তার তাঁর সিটি স্ক্যান করেছেন, আমি একটু তাঁর সঙ্গে কথা বলে নিতে চাই। এই রিপোর্টটা কি সঠিক, না কোথাও বড় রকমের ভুল হয়েছে?’
সুমন বলে ওঠে, ‘স্যর, সিরিয়াস কিছু নয় তো?’
ডা. আতিকুর রহমান হতাশ গলায় বলেন, ‘আমি কিছু বুঝতেই পারছি না। সেজন্যেই যে ডাক্তার স্ক্যান করেছেন, তাঁর সঙ্গে আগে কথা বলে নিতে চাই।’
ডা. আতিকুর রহমান ফোনে অনেকক্ষণ কথা বলেন। কথা বলা শেষে তাঁর চেহারাটা কেমন বিধ্বস্ত মনে হয়। তাঁর সামনে পিরিচ দিয়ে ঢাকা এক গ্লাস পানি ছিল। তিনি গ্লাসের উপর থেকে পিরিচটা তুলে এক চুমুকে পানিটুকু শেষ করেন। এরপর চেয়ারে হেলান দিয়ে ধীরে-সুস্থে বলেন, ‘যে ডাক্তার সিটি স্ক্যান করেছেন তিনিও আমার মত স্তম্ভিত। তিনিও প্রথমে মনে করেছিলেন কোথাও বড় রকমের ভুল হচ্ছে। এ কারণে একবারের জায়গায় বেশ কয়েকবার স্ক্যান করেন। কিন্তু প্রতিবারই একই রকম দেখা যায়।’
সুমন বলে ওঠে, ‘স্যর, সমস্যাটা আসলে কী?’
ডা. আতিকুর রহমান বলতে থাকেন, ‘সমস্যাটা কী, তোমাকে ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। বলা যায় ওনার মস্তিষ্কের গঠন মোটেই অন্যসব মানুষের মত নয়। একেবারেই আলাদা। যেন মানুষের মস্তিষ্কের আদলে নাম না জানা ভিন্ন কোনও প্রাণীর মস্তিষ্ক। তাঁর মস্তিষ্কের সেরিব্রাম, থ্যালামাস, হাইপোথ্যালামাস, সেরিবেলাম, পন্স, মেডুলা, মিড ব্রেনের সেরিব্রাল পেডাঙ্কল, কর্পোরা কোয়াড্রিজেমিনা, সেরিব্রাল অ্যাকুইডাক্ট, কিছুই অন্যসব মানুষের মত নয়। নার্ভাস সিস্টেম আর সেনসরি অর্গানও সাধারণ মানুষের চেয়ে ভিন্ন। ক্র্যানিয়াল নার্ভ সাধারণ মানুষের থাকে ১২ জোড়া, তাঁর রয়েছে ২২ জোড়া। সবচেয়ে বড় অস্বাভাবিকতা মস্তিষ্কের সেরিব্রাল আর সেরিবেলামে। মস্তিষ্কের দুটো ভাগ আছে। বাদামের মাঝখান দিয়ে বিভক্ত দুই অংশের মত সমানভাবে দুই দিকে বিভক্ত দুটি অংশ। এই বিভক্ত দুই অংশকে দুই বলয় বলা হয়। ডান বলয়, বাম বলয়। দুই বলয় বিভক্ত থাকলেও স্নায়ুতন্তুর গোছা দ্বারা সংযুক্ত থাকে। যেমন সেরিব্রাল অংশ সংযুক্ত থাকে কপার্স কলোসাম নামে স্নায়ুতন্ত্রর গোছা দ্বারা। মস্তিষ্কের বড় অংশ সেরিব্রাম দুই বলয়ে সংযুক্ত থাকে সাদা স্নায়ুর গোছা দ্বারা। সেরিবেলাম নিউক্লি অংশ সংযুক্ত থাকে ভেরমিস দ্বারা। কিন্তু তাঁর মস্তিষ্কের দুই বলয় সংযোগহীন-একেবারে আলাদা। কোনও ধরনের স্নায়ুতন্তুর গোছা দ্বারাই সংযুক্ত নয়। যেন দুই বলয় স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে। এটা আদৌ সম্ভব কি না মেডিকেল সায়েন্সে এমন কোনও প্রমাণ নেই। তাঁর মস্তিষ্কের এই অস্বাভাবিক গঠন দেখে আমার পুরো মাথা ঘুরে গেছে। এমনটা কী কারণে হয়েছে? এমন কি হতে পারে, শরীরের অন্য কোনও সমস্যার কারণে, মস্তিষ্কে প্রভাব পড়েছে? অথবা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কোনও ভাইরাসের আক্রমণে মস্তিষ্কের গঠনে ওধরনের পরিবর্তন হয়েছে? এক কাজ করি, তাঁর পুরো বড়ির সব ধরনের মেডিকেল চেক-আপ করিয়ে দেখি সমস্যাটা ধরতে পারি কি না।’