এইবার কাজ এগুতে লাগল চড়চড় করে। ধীরে-ধীরে বসবাসযোগ্য হয়ে উঠল ওই নগরী, সুপেয় হলো জলাশয়। ঠিক সেই সময় ঘটল অদ্ভুত এক ঘটনা। মন্দির চত্বরে সারাদিন হোমের আগুন জ্বেলে বসে থাকত কাপালিক। মাঝে-মাঝে শোনা যেত তার গম্ভীর কণ্ঠস্বর, ওম শিববাশদ্ভু…নমস্ততে…
মন্দিরে সারাদিন কাটালেও রাতে নগরীতে থাকত না কাপালিক। নিয়ম নেই। সে থাকত পাহাড়ের ওপর। গাছতলায়। কখন স্বপ্নের ভেতর নির্দেশ পাঠাবে যক্ষ, কাল কাটাতে লাগল সেই অপেক্ষায়।
ওদিকে কাপালিককে নবাব খুব পছন্দ করে দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরতে লাগল উজির সাহেব। ষড়যন্ত্রের জাল বুনল সে। নবাবের কসাইকে ধরে উপত্যকার গোরস্থান থেকে তুলে আনল সদ্যমৃত এক শিশুর লাশ। ছুরি দিয়ে এমনভাবে লাশটার গলা কাটল যে, দেখে যে কারও মনে হবে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে বাচ্চা ছেলেটাকে। এরপর একটা শুয়োর মেরে পেট চিরে বার করে ফেলল ওটার সব নাড়িভুড়ি। শুয়োরের পেটের ভেতর ছেলেটার লাশটাকে রেখে আবারও পেট সেলাই করে কসাইকে দিয়ে পাঠিয়ে দিল মন্দির চত্বরে ফেলে রাখার জন্যে।
ভোর রাতে কসাই গিয়ে উজিরের নির্দেশ মত মন্দির চত্বরে ফেলে এল শুয়োরের দেহ। খুব ভোরে নামাজ পড়ে উজির-নাজিরসহ শহরের পথে হাঁটতে বেরুত নবাব। মন্দিরের কাছাকাছি এসে তার চোখে পড়ল মৃত শুয়োরের দেহ। ঘটনা কী জানতে কাছে এগিয়ে গেল নবাব। উজির তখন বলল, ধর্মাবতার, লক্ষ করেছেন, এই শুয়োরের পেট চিরে পরে আবার সেলাই করা হয়েছে ওটা! দেখে মনে হচ্ছে শুয়োর মেরে পুজোর ভেট চড়িয়েছে ওই কাপালিক। জঘন্য আর ভয়ানক নাপাক এদের কর্মকাণ্ড! পারলে এরা আস্ত মানুষকেও বলি দিয়ে ফেলে! শুয়োরটার পেট কেটে দেখা দরকার কী আছে ভেতরে, কী বলেন আপনারা? এই কথা বলে সাথের লোকদের দিকে তাকাল উজির।
সবাই বলল, খুবই ঠিক কথা। পেট চিরে দেখতে হবে কী আছে ওখানে।
মুচি ডেকে কাটা হলো শুয়োরের পেট। ভেতরে কাফনে জড়ানো ছোট্ট শিশু
দুফাঁক হয়ে আছে গলা!
বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগল উজির। বলল, ধর্মাবতার, দেখেন এই কাপালিকের অনাচার! মুসলমান শিশুর গলা কেটে শুয়োরের পেটের ভেতর ভরে দেবতার পায়ে অর্ঘ্য নিবেদন করেছে এই পাষণ্ড! এই অনাচার আল্লা সইবেন না! এর বিচার করেন আপনি! এক্ষুণি, এই মুহূর্তে!
দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল ইউসুফ জাই। কী করবে সেইটেই বুঝতে পারছে না। আর ঠিক তখনই ওখানে হাজির হলো কাপালিক। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উজির বলল, নগর কোটাল! গ্রেফতার কর এই বদমাশটাকে।
দুপুরে বিচার শুরু হলো কাপালিকের। সবার এক কথা: গর্দান নামিয়ে দাও ওর। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে কাপালিক বলল, এ এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। এসবের কিছুই জানি আমি।
অবশেষে রায় দিল নবাব। বলল, জঘন্য অপরাধ সঙ্ঘটিত যে হয়েছে এটা ঠিক। তবে একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। সেইটে হলো, কাপালিক যদি নরহত্যা করে শুয়োরের : পেটের ভেতর সেই লাশ পুরে দেবতার উদ্দেশে ভেট চড়িয়েই থাকে, তা হলে শুয়োরের লাশ সবার সামনে ফেলে রাখবে কেন? এই কাজ তো করার কথা সঙ্গোপনে!
উজির তখন বলল, ধর্মাবতার, ওই শয়তান। সঙ্গোপনেই সবকিছু করতে চেয়েছিল। কিন্তু সময়ে কুলোয়নি। জানেন তো, এদের ভেতর লগ্ন-ফগ্ন বলে হাবিজাবি অনেক কিছু আছে।
ইউসুফ জাই বলল, ঠিক আছে, আপনার কথা অনুযায়ী ধরে নিলাম এই লোক দোষী। তবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যাবে না তাকে। আসামী অতীতে আমাদের অনেক সাহায্য সহযোগিতা করেছে। তারপরেও প্রমাণে ফাঁক-ফোকর আছে। এর এক হাত কনুইয়ের নিচ থেকে কেটে ফেলা হবে। তারপর তাড়িয়ে দেয়া হবে এই নগরী থেকে। বিচার এখানেই শেষ আদালত মুলতবী ঘোষণা করা হলো।
উজিরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উঠে গেল নবাব। টেনে-হিঁচড়ে কাপালিককে মন্দির চত্বরে নিয়ে যাওয়া হলো। তলোয়ারের এক কোপে কনুই থেকে কাটা পড়ে গেল বাঁ হাত। এরপর অম্লজারকে ভিজিয়ে বন্ধ করা হলো রক্তঝরা। জখমের জায়গায় কাপড়ের টুকরো বেঁধে সৈন্যেরা নগর-তোরণের বাইরে বার করে দিল তাকে। বলল, আর কখনও এসো না এখানে। নির্বাসনে পাঠানো আসামীরা ফিরে এলে মৃত্যুদণ্ড অবধারিত নবাবও বাঁচাতে পারবে না তখন!
দূরের এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিল কাপালিক। সন্ধের দিকে বেহুশ হয়ে পড়ল প্রচণ্ড জ্বরে। ঠিক এই সময় দেখা দিল গরুমুখী যক্ষ। বলল, বাছা আমার, যে ধন-রত্বের জন্যে নিজের অঙ্গ পর্যন্ত খোয়ালে, তা তো কখনও পাবে না তুমি। চিরস্থায়ীভাবে অভিশপ্ত ওই ধন-রত্ন। তবে একটা বর তোমাকে দেব আমি। তুমি বেঁচে থাকবে শত-শত বছর। এই সময়ে যদি সম্পূর্ণ নির্লোভ এমন কাউকে পাও, আর সে স্বেচ্ছায় ধন-রত্ন তুলে আনতে রাজি হয়, তা হলে কিছুটা হলেও ওই ধন পাবে তুমি। তবে মনে রেখো, এমন লোক খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। আর পেলেও সে এই কাজ করতে রাজি হবে কি না, সেটাও বড় একটা বিষয়!
স্বপ্নের ভেতরই কাপালিক বলল, দেবরাজ, আপনার বর শিরোধার্য! তবুও বলব, এত বড় অন্যায় হলো আমার ওপর! এর বিচার আপনি করেন।
যক্ষ তখন বলল, ওটা নিয়ে ভেবো না। শুধু তোমার তপস্যার কারণেই বাসযোগ্য হয়েছিল ওই নগরী। এইবার চিরদিনের মত ধ্বংস হবে। ওটা হবে প্রেত-যোনী আর নিষ্ঠুর যক্ষের শহর।