তা-ই। ঠিক আছে, উঠে এসো এখন। বসা যাক গাছের নিচে ওই পাথরের চাঙড়টার ওপর, কেমন?
চাঙড়ের ওপর বসলাম দুজনে। কাপালিক বলল, আমার খোঁজে তো কেউ আসে না। তুমি এলে যে বড়?
কী আর বলব, সাধুবাবা? যে গল্প আপনি শোনালেন, তার শেষ না শুনে তো যেতে পারি না। আজকের দিনটাই শুধু আছি, এখানে। কালকেই চলে যাব যুদ্ধে। তারপর কী হবে, কে জানে!
বেশ, শোনো তা হলে। তবে একটা অনুরোধ রাখতে হবে।
কী অনুরোধ?
আমাকে কোনও ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা যাবে না, ঠিক আছে?
আজ্ঞে, বুঝেছি। শুরু করুন এখন। আমাকে আবার সন্ধের আগেই ক্যাম্পে ফিরতে হবে। কড়া নির্দেশ আছে।
ডেমিট্রিয়াস বা ধর্মমিতা হয়তো আরও কিছুদিন থাকত এখানে। তবে সেটা আর সম্ভব হলো না। প্রথমে গুটিবসন্ত, তারপর ওলাওঠা। এই দুই মহামারীতেই উজাড় হয়ে গেল লাখ লাখ নারী-পুরুষ। সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেল ঝর্না, কুয়ো, আর পুকুরের জল। পূতিগন্ধময় হয়ে উঠল বিশাল এই ঐশ্বর্যশালী নগরী। ডেমিট্রিয়াস তো গেলই, সেই সাথে চলে গেল তখনও যারা বেঁচে ছিল। দুএকজন যারা থেকে গিয়েছিল, কী এক বিচিত্র কারণে এক রাতেই মারা পড়ল। চির অভিশপ্ত হয়ে গেল এ শহর। হয়ে উঠল লাখো প্রেতাত্মার এক জান্তব পিশাচ নগরী! রক্তপিপাসু হয়ে উঠল এর প্রতিটা সিঁড়ি, খাম্বা, বারান্দা আর দালান! রাজ্যপাট হারিয়ে অনেক রাজাই পরিবার-পারিষদ নিয়ে এখানে এসে থাকার চেষ্টা যে করেনি, তা না। তবে নগরীতে ঢুকে বাস করতে পারেনি কেউই। প্রথমে তোরণের বাইরেই তাঁবু খাটাত সবাই। ইচ্ছে, ভেতরটা পরিষ্কার করে বাসযোগ্য হলে, পরে ঢুকবে। তবে তারও আগে জল চাই তাদের। শহরের ভেতরের ইঁদারা কিম্বা ঝর্না থেকে স্বচ্ছ জল নিয়ে এসে খেলে পরদিন দেখা যাবে অর্ধেকের বেশি লোক বিছানা থেকে আর উঠতেই পারছে না! কী এক অজানা অসুখে ধরাশায়ী হয়ে গেছে তারা। এভাবেই পেরিয়ে গেল দেড় হাজার বছরেরও বেশি! কোনও-কোনও তান্ত্রিক ধন-রত্নের লোভে পড়ে কুম্ভন যক্ষের মন্দির পর্যন্ত গিয়েছিল। কিন্তু রত্নের চেহারাও কেউ দেখেনি। অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে সব কটার।
শেষমেশ এখানে এসে হাজির হলো নবাব শাহ ইউসুফ জাই। এক লাখ লোক এনে তাঁবু ফেলল উপত্যকায়। শুরুতেই ইঁদারা খুঁড়িয়ে ব্যবস্থা করল পরিষ্কার জলের। এরপর দিনের আলোয় কারিগরদের পাঠাল নগর সাফ সুতরো করে, দালান-কোঠা ঠিক করার জন্যে। খাটতে লাগল হাজার-হাজার লোক। সে এক এলাহী কাণ্ড। কিন্তু যেভাবে ভাবা হয়েছিল, সেভাবে কাজ এগুল না। কিছুক্ষণ কাজ করার পরেই কাহিল হয়ে পড়ছে কারিগরেরা। ওদিকে সারাদিনে যেটুকু পরিষ্কার করা হয়, রাতের বেলা এলোমেলো হয়ে যায় সবকিছু। পরদিন সকালে আবার যে কে সেই! বিরাট ফাঁপরে পড়ল ইউসুফ জাই। পাটনায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। ওখানে সম্রাটের প্রিয় সুবাদার বসে আছে। দিল্লী থেকে ফরমান আনিয়ে ওই জায়গাটাকেই বেছে নিয়েছে সে। কাজেই তার নিজের থাকতে হবে এখানেই। কী করা যায় ভেবে অস্থির। হয়ে গেল সে। ওদিকে দিন-দিন কমে যাচ্ছে কাজের লোক। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এ হলো জিনের শহর। হযরত সুলায়মানের সময় থেকেই এখানে নাকাবন্দি হয়ে আছে শয়তান জিনের দল! মাত্র পনেরো দিনে নেই হয়ে গেল অর্ধেক লোক। চিন্তায় কাহিল ইউসুফ জাই। ঠিক সেই সময় হাজির হলো এক চট পরা নাগা সন্ন্যাসী। অবস্থাপন্ন গৃহস্থ ঘরের ছেলে। লেখাপড়াও শিখেছে। তবে ভবঘুরে ধরনের। বাউণ্ডলে হয়ে সাধু-সন্ন্যাসীর পিছে-পিছে ঘুরে বেড়ানোই এর কাজ। একবার এক বিহারী কাপালিকের সাথে দেখা হয় তার। বৎসরকাল তার পিছে লেগে ছিল ছেলেটা। তার কাছ থেকেই প্রথম জানতে পারে এই নগরী আর এন্তার ধন-রত্নের কথা। তাকে সাধু জানায়, একমাত্র মন্ত্র-সিদ্ধ কাপালিক ছাড়া ওই নগরীতে ঢোকার সাধ্য কারও নেই। ধন-রত্ন খুঁজে পাওয়া তো অনেক পরের কথা।
এরপর ছেলেটা দেখা পেল এক নাগা সন্ন্যাসীর। বহুকাল কাপালিক নাগাদের সাথে হিমালয়ে রয়ে গেল সে। এরপর নেমে এল নিচে, ইচ্ছে যক্ষের ধন-রত্ন বার করে নেয়া যায় কি না দেখা। এ কাজে প্রচুর ঝুঁকি আছে জেনেই এসেছে সে। কাপালিক গুরুর কাছ থেকে জেনেছে এখানকার সব। ঘটনা। এসব কথা অবশ্য ইউসুফ জাইয়ের জানা নেই। নাগা সন্ন্যাসীকে উপত্যকায় হাঁটতে দেখে তাকে ধরে নিয়ে এল। সিপাহীরা। এ রাস্তায় কখনও কাউকে যেতে দেখেনি তারা। এ লোক এখানে এল কী করে, এই তাদের জিজ্ঞাসা। এক কথা দুকথায় ইউসুফ জাইয়ের সাথে ভাব হয়ে গেল কাপালিকের। নবাব বাহাদুরকে সাহায্য করল সে। সাত দিন। উপোস দিয়ে গোমুখী যক্ষের উদ্দেশে বলি দিল জোড়া মাদী মোষ। তারপর কুম্ভন যক্ষকে সন্তুষ্ট করার জন্যে মন্দির চত্বরে লোহার খাঁচায় আটকে রাখল একজোড়া মাদী ঘোড়া। না খেতে পেয়ে ধীরে-ধীরে শুকিয়ে মারা গেল ওগুলো। এরপর ঘোড়ার দেহাবশেষ ঘুঁটের আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে ছড়িয়ে দিল শহরের কোণে-কোণে। মৃত মানুষের চর্বি দিয়ে হোমের আগুন জ্বেলে গোপন মন্ত্র পড়তে-পড়তে মহাযক্ষের পুজো করল পর-পর তিন রাত। দিনের প্রথম প্রহরে আগুনে জল ঢেলে ধোঁয়া ওঠা আধ-ভেজা ছাইয়ের ওপর রাখল তিনটে শ্বেত পদ্ম। তাকিয়ে থাকল এক দৃষ্টিতে ছাইচাপা আগুনের তাপে পদ্মফুলের পাপড়ি কুঁকড়ে যায় কি না দেখার জন্যে। টলটল করতে লাগল কমনীয় পাপড়ি। সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছে সে! এসব করতে-করতে পেরিয়ে গেছে এক মাস। ওদিকে মাঠের ভেতর তাঁবুতে থাকতে-থাকতে প্রায় শেষ হয়ে গেছে ইউসুফ জাইয়ের ধৈর্য। নগরী থেকে বেরিয়ে এসে কাপালিক তাকে বলল, মহারাজ, এইক্ষণে কাজ শুরু করতে বলেন আপনার কারিগরদের।