বজ্ৰযোগীর বর্ণনা এখানেই শেষ। এরপর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শুধু বিভিন্ন গাছ-গাছড়া ও ভেষজ উপাদানের নাম ও পরিমাণ ইত্যাদি লেখা। জটিল সব নক্সা আঁকা। বিভিন্ন মাস-দিন তারিখ-গ্রহ-নক্ষত্রের পূর্ণাঙ্গ অপূর্ণাঙ্গ চিত্র এবং প্রাচীন কালের হরফে লেখা অসংখ্য সাঙ্কেতিক চিহ্ন।
স্ক্রলের শেষ পাতার সাথে আটকানো অবস্থায় বৃন্দাবন ঘটকের একটি চিঠি পেলাম।
শুক্রবার। ১৩ আগস্ট
প্রিয়বরেষু শ্রীমান ফারাবী,
আপনার সাথে দেখা হওয়া কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয়। আমি জানতাম আপনি এখানে আসবেন এবং আপনার সাথে দেখা হবে। এজন্যেই পালি ভাষার পাণ্ডুলিপিটা সাথে করে এনেছিলাম। আমি ইতিহাসের অধ্যাপক হলেও আপনার মত এত হাই প্রোফাইল গবেষক নই। আশা করি আপনার গবেষণার কাজে এই পাণ্ডুলিপি সহায়ক হবে।
সেই যে ছোটবেলায় চিত্রকূটের সাথে দেখা হলো, এরপর সে আর কখনও আমাকে ছেড়ে যায়নি। আমাকে সব বিপদ আপদ থেকে রক্ষা তো করেছেই, তার ওপর ভবিষ্যতে কী ঘটবে সেকথাও মাঝে মধ্যে জানিয়েছে। সিধু জ্যাঠা বিশ্বাস করতেন আমিই অতীতের বজ্ৰযোগী।
জীবদ্দশায় বজ্ৰযোগী সিদ্ধি লাভ করতে পারেনি। সে পুণ্ড্রনগরে ফিরে আসার আগেই পরশুরামের পতন ঘটে। করতোয়া নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে শীলাদেবী। কংস সেন তখন পুণ্ড্রনগরের শাসনকর্তা। শীলাদেবীর অনুসারীরা তার প্রাণনাশ করতে পারে এই ভয়ে তটস্থ কংস। সেইসব অনুসারীদের খুঁজে খুঁজে বের করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করছে তার গুপ্তচর বাহিনী। সব দেখেশুনে মুষড়ে পড়ে বজ্ৰযোগী। সে চলে আসে রামপুর বোয়ালিয়ায় তার বাবার কাছে। গাঁয়ের এককোণে ছোট্ট এক বাড়িতে বজ্রযোগীর বাবা তখন মৃত্যু শয্যায়। বাবার ইচ্ছে, ছেলের বিয়ে দিয়ে পুত্রবধূ দেখে যাওয়ার। কনের খোঁজ পাওয়া গেল, লগ্নও নির্দিষ্ট হলো। বিয়ের কেনাকাটা করতে বজ্ৰযোগী গেল পুণ্ড্রনগরে। তখনকার দিনে এই এলাকায় ওটাই ছিল সবচেয়ে বড় বাজার। বজ্ৰযোগীর দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, ওদিনই ছিল কংসের রাজসূয় যজ্ঞ। কংস বেরিয়েছে সাধারণ নাগরিকদের। সুবিধা-অসুবিধার কথা জিজ্ঞেস করতে। নগরীর পথে পথে হেঁটে বেড়াচ্ছে সে। তার নিরাপত্তার বিষয়টি দেখার জন্যে প্রকাশ্য অ-প্রকাশ্য সব বাহিনীর লোকেরা অবস্থান নিয়েছে। শহরের মোড়ে মোড়ে। ভারতের অন্যান্য সব সমৃদ্ধ নগরীর মতই পুণ্ড্রনগরী ছিল অনেক উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। নগরীতে প্রবেশ এবং নির্গমনের গেট একটাই। কেনাকাটা করে মাল সামান নিয়ে বেরুনোর সময় ধরা পড়ে গেল বজ্ৰযোগী। রাজদ্রোহিতার অভিযোগ এনে সাতদিনের ভেতর শিরচ্ছেদ করা হলো তার। বজ্ৰযোগীর সাধনার ইতি সেখানেই।
এরপর পেরিয়ে গেল শতাব্দীর পর শতাব্দী। সিধু জ্যাঠার মতে বজ্ৰযোগীর পুনর্জন্ম হলো এবং এ জন্মে সে হলো বৃন্দাবন ঘটক অর্থাৎ আমি। সিধু জ্যাঠা আমাকে তান্ত্রিকতা শিক্ষা দিয়েছেন বছরের পর বছর, প্রস্তুত করেছেন চূড়ান্ত পরিণতির জন্যে। সব থেকে বড় কথা, আমি যে এ জন্মের বজ্ৰযোগী একথা উনি বিশ্বাস করিয়েছেন আমাকে। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, ভবিষ্যই যদি দেখতে পাই, তা হলে সিধু জ্যাঠাকে সাবধান করিনি কেন? সিধু জ্যাঠা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় ওঁকে বলেছিলাম তার সামনে খুব বড় বিপদ, আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে। কিন্তু ওঁকে তখন যমে টানছে, আমার কথা শুনবেন কেন? বিয়ে করতে নিষেধ করেছিলেন সিধু জ্যাঠা। কিন্তু বাবা-মায়ের মুখ চেয়ে আমাকে ওই কাজটি করতে হয়েছিল। অতি দুর্ভাগ্য, আমার স্ত্রীর গর্ভাবস্থায় এক্লেমশিয়ায় মা-শিশু দুজনেরই মৃত্যু হয়। এরপর ও-রাস্তা আর মাড়াইনি কখনও।
আমি নিশ্চিত তিব্বতে গেলে চিত্রকূটের সাধন পীঠ এখনও খুঁজে পাওয়া যাবে। আর যদি সাধনা ঠিকমত করতে পারি, তা হলে সিদ্ধিও লাভ হবে। তান্ত্রিকদের একটি অন্যতম দায়িত্ব হলো যোগ্য একজন অনুসারী রেখে যাওয়া। এই দায়িত্বটি আপনাকেই দিয়ে যেতে চাই। যে কলেজে চাকরি করতাম, সেখানে আমার বাড়িটি দান করে দিয়েছি। আগামী মাস থেকে ওটা ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহার হবে। সাধনার সমস্ত পুঁথিপত্র, উপাচার দুটো ট্রাঙ্কে ভরে কলেজের প্রিন্সিপালের জিম্মায় রাখা আছে। আপনি গিয়ে চাইলেই ওগুলো যাতে আপনাকে দিয়ে দেয়া হয়, এমত নির্দেশ দিয়ে রেখেছি। আপনার কাছে এসব খুবই আজগুবি মনে হতে পারে। তবে আমি নিশ্চিত, আপনি পুরো বিষয়টি একবার হলেও ট্রাই করে দেখবেন। এত নিশ্চিত হলাম কীভাবে সেটা বলি।
আপনার বাঁ হাতের কব্জির নিচে একটি লাল জড়ল আছে, এটি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন। ঠিক এরকমই একটি জড়ল সিধু জ্যাঠার হাতেও দেখেছি। এটিও হয়তো খেয়াল করেছেন যে খুব বড় বিপদ থেকেও অতি সহজেই রক্ষা পেয়ে যান আপনি এবং অদৃশ্য কেউ সবসময় আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসে। প্রথম যেদিন আপনার সাথে দেখা হয়, সেদিনই মনে হয়েছে আপনার মত একজনকেই খুঁজছি আমি। আগ বাড়িয়ে আপনাকে অতকিছু তখন শোনানোর উদ্দেশ্য ওটাই। তখন থেকেই অপেক্ষা করেছি সঠিক সময়ের।
আন্তরিক শুভ কামনা রইল।
ইতি
বৃন্দাবন ঘটক
দশ
চিঠিটা পড়ে বৃন্দাবন ঘটককে অদ্ভুত এক মানসিক রোগী বলে মনে হলো। ছোটবেলা থেকেই সিধু জ্যাঠা না কে তারমধ্যে এক অবসেশনের জন্ম দিয়েছে। বয়েস বাড়ার সাথে-সাথে সেই অবসেশন এখন হয়ে গেছে ম্যানিয়া। তবে একথা ঠিক যে এই পাণ্ডুলিপির অ্যান্টিক ভ্যালু এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসীম। ঠিক এই জিনিসটাই আমাকে ধন্দে ফেলেছে। সেমিনার শেষ হয়েছে, কালকেই ঢাকা ফিরে যাব। আজকে সারাদিন তেমন কোনও কাজও নেই। এখান থেকে বিড়ালদাহ ত্রিশ মাইলের বেশি হবে না। একবার গিয়ে দেখলে হয়। যদি দুটো ট্রাঙ্ক বৃন্দাবন ঘটক সত্যিই রেখে যান, তা হলে ওখানে মধ্যযুগীয় পুঁথিপত্র আরও অনেক থাকতে পারে।