মহারাজ সূর্য অস্ত যাওয়ার পর হইতে সূর্য উদয় পর্যন্ত উপাসনা করেন। মধ্যাহ্নে ও অপরাত্নে নিদ্রা যান। কদাপি গুহা হইতে বাহির হন। প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিশ ক্রোশ পথ হাঁটিয়া আমাকেই সংগ্রহ করিতে হয়। রাত্রিকালে বিশাল কেশযুক্ত কতিপয় অতিকায় তিব্বতী কুক্কুরী গুহামুখ আগলাইয়া রাখে। ইহারা রাত্রি দ্বিপ্রহর হইতে সূর্যোদয় পর্যন্ত অবস্থান করে। ইহাদের চক্ষু হইতে ভীতিকর নীলাভ শিখা বিচ্ছুরিত হয়। ইহাদের সুদীর্ঘ ও শক্তিশালী দন্তসারি দূর হইতে দৃষ্টিগোচর হয়।
এ রূপে ছয়মাস অতিবাহিত হইল। আকাশে চাঁদ ক্ষয়প্রাপ্ত হইতে হইতে বৃষের শিঙের আকার ধারণ করিলে ওই বিশেষ নিশিতে গুরুদেবের মহাপ্রভুর আবির্ভাব হয়। গুরুদেব তখন আভূমি নত হইয়া মহাপ্রভুর চরণ চুম্বন করেন। অতঃপর কক্ষের মধ্যখানে যে ছয়প্রান্ত যুক্ত তারকাটি রহিয়াছে, তাহার কেন্দ্রে মুখমণ্ডল, বক্ষ ও পেট স্থাপন করিয়া পৃষ্ঠদেশ ঊর্ধ্বমুখী রাখেন। সেইক্ষণে তাহার দেহ পাঁচ ভাগে বিভক্ত হইয়া পাঁচটি শ্বেতকায় পেঁচকে রূপান্তরিত হয়। পেঁচকগুলি গুহামুখ অতিক্রম করিয়া শূন্যে মিলাইয়া যায়। সূর্য উদয়ের পূর্বে ওই পেঁচকগুলি পুনরায় গুহায় ফিরিয়া আসে ও তারকাটির উপর উপবেশন করে। অতঃপর উহারা পুনরায় গুরুদেবের দেহ ধারণ করে। গুরুদেবকে একদিন প্রশ্ন করিলাম, পেঁচকের রূপ ধারণ করিয়া গুরুদেব কোথায় গমন করেন? গুরুদেব উত্তর করিলেন, মানবদেহ পাঁচটি বস্তু দ্বারা নির্মিত। উহারা হইল: ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। সুদীর্ঘ সাধনার পর সিদ্ধিলাভ হইলে মানবদেহ এই পাঁচটি ভাগে বিভক্ত হইয়া যে-কোনও রূপ ধারণ করিতে পারে। আমি পেঁচকের রূপ ধারণ করিয়া আরব উপকূলের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে যে স্থলে প্রাচীন উবার নগরী অবস্থিত ছিল, সে স্থানে গমন করি। অত্র দেশে সহস্রাদি পূর্বে সাদ-বিন-আদ নামক জনৈক সম্রাট দেবাদিদেব আহুরার সম্মানে এ জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালের প্রবাহে সেই স্থাপত্য আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হইলেও ইহার ভূগর্ভস্থ উপাসনা গৃহ এখনও অতীত গৌরবে সমুজ্জ্বল। এই গর্ভগৃহেই মহাপ্রভু আহুরা তাঁহার প্রিয় তান্ত্রিক-পূজারীদিগের সহিত মিলিত হন এবং হাস্যরসে কালাতিপাত করেন। অপূর্ব দেহবল্লরীসম্পন্ন রমণীগণ তাহাদিগকে সোমরস পান করান। মহাপ্রভু আহুরা তাহাদিগকে ভূত-ভবিষ্যতের কথা বর্ণনা করেন এবং সপ্ত আকাশের অশ্রুতপূর্ব রহস্যময় বিষয়ে কথা বলেন।
এইরূপে একাদশ মাস অতিক্রান্ত হইল। আরও একমাস অতিবাহিত হইলে আমি বরেন্দ্রের উদ্দেশে যাত্রা করিব। গুরুদেব আমার মনোবাঞ্ছা সম্যক উপলব্ধি করিলেন। তিনি এক দিবসে আমাকে ডাকিয়া বলিলেন: বস, সাধনায় সিদ্ধি লাভ করিতে অন্যূন বিশ বৎসরাধিককাল একাগ্র চিত্তে উপাসনার প্রয়োজন। কাপালিক সাধকেরা নানারূপ অপদেবতার সাধন ভজন করিয়া থাকে। এইসব অপদেবতারা সবাই মহাপ্রভু আহুরার দাসানুদাস। এই সকল দেবদেবী নিচু স্তরের বলিয়া ইহাদের বুদ্ধিবৃত্তিও অতি নীচ। ইহারা প্রায়শই রক্তলোভী হইয়া থাকে। কাপালিকেরা ইহাদের তুষ্টি সাধন লক্ষে নরহত্যা ও অন্যান্য ঘৃণ্য পাপাচারে লিপ্ত হয়। তদু। এইসব কাপালিকেরা মরণশীল এবং মৃত্যুর পর ইহারা ওহ সকল অপদেবতার আজ্ঞাবহ হয়। মহাপ্রভু আহুরার উপাসনায় শীলাদেবী ও তদীয় ভ্রাতা পরশুরাম সিদ্ধিলাভ করিতে পারিবেন না। উহারা বিষয়ভোগী এবং তাঁহাদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটিয়াছে।
যদি ত্যাগ তিতিক্ষা থাকে, যদি এই জন্যে বাঁচিয়া থাকিতে পার, তাহা হইলে পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সকালে সিদ্ধি লাভ করিবে। অন্যথায় কালের আবর্তে তুমি পুনঃপুনঃ জন্মলাভ করিতে থাকিবে এবং এক সময় পূর্ব জন্মের স্মৃতি জাগরিত হইলে সেই ক্ষণে সিদ্ধি লাভ করিবে।
এক দিবসে গুরুদেব নগরী অভিমুখে যাত্রা করিলেন। আমাকে রাখিয়া গেলেন একাকী গুহায়। মহাপ্রভু আহুরার উদ্দেশে নিয়মিত পূজা-পাঠ করিবার পুনঃপুনঃ কঠোর নির্দেশ দিলেন। গুরুদেবের নির্গমনের পর পঞ্চদশ দিবস অতিক্রান্ত হইল। আমি একাকী গুহায় রহিলাম। রাত্রি দ্বিপ্রহরে কুকুরীসমূহ আসিয়া গুহামুখ আগলাইয়া রাখে। নিদারুণ আতঙ্কের মধ্য দিয়া আমার সময় কাটিতে লাগিল। ষষ্ঠদশ দিবসে বেলা দ্বিপ্রহরে গুরুদেব এক অনন্যসুন্দরী রমণী ও দশজন নেপালী শেরপা সমভিব্যাহারে প্রকাণ্ড একটি সবুজাভ প্রস্তর নির্মিত আধার লইয়া গুহামুখে প্রবেশ করিলেন। এই গুহাটির অদূরে আরও একটি গুহা ছিল। সেই গুহাটিতে সারি সারি সাতটি প্রকোষ্ঠ ছিল। উহার একটিতে গুরুদেব ও অন্যটিতে আমি নিদ্রা যাইতাম। অন্যগুলোতে বস্ত্র এবং আহারের সরঞ্জামাদি ছিল। গুরুদেবের নির্দেশে ইহারই একটি আমি ওই রমণীর জন্য নির্ধারিত করিলাম। ইহার পর গুরুদেব প্রস্তর নির্মিত আধারটির ঢাকনা উত্তোলন করিলে উহার অভ্যন্তরে এক মৃতা তরুণীকে শায়িতাবস্থায় দেখিলাম। মৃতার গাত্রবর্ণ ঘোর কৃষ্ণকায়। গুরুদেব বলিলেন, অপঘাতে মৃত্যু হইয়াছে এমন একজন কুমারী তরুণীর শব ইহা।
অতঃপর গুরুদেব মৃতা তরুণীর শরীরে চন্দন তৈল উত্তমরূপে মালিশ করিলেন। দুর্বোধ্য ভাষায় ক্রমাগত মন্ত্র পাঠ করিতে করিতে গোলাপের নির্যাস জলে মিশ্রিত করিয়া ওই জল দ্বারা শবাধারটি পূর্ণ করিলেন এবং শবাধারটি প্রভু আহুরার পদতলে স্থাপন করিলেন। দেখিতে দেখিতে তরুণীর ঘোর কৃষ্ণবর্ণ দেহ নীলবর্ণ ধারণ করিল। তরুণীর আঁখি পল্লব প্রস্ফুটিত হইল এবং গুরুদেবের সহিত দৃষ্টি বিনিময় ঘটিল। কিয়ৎক্ষণ পরে তরুণীর অক্ষিপট নিমীলিত হইল। যুবতী রমণী ও আমি যুগপৎ গুরুদেবকে তাহার সাধনার কাজে সাহায্য করিতে লাগিলাম। ক্রমে ক্রমে যুবতীর সহিত আমার সখ্য গড়িয়া উঠিল। বাস্তবিক আমি উক্ত রমণীকে প্রাণাধিক প্রণয় করিতাম। এরূপে দ্বাদশ দিবস অতিক্রান্ত হইলে গুরুদেব সন্নিকটে আহ্বান করিয়া মধুর কণ্ঠে কহিলেন, বৎস, এক্ষণে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন কর। শীলাদেবীর পারিষদদিগের হইতে সাবধানে থাকিবে। উহারা তোমার প্রাণনাশের কারণ হইতে পারে। এ স্থলে যাহা দেখিয়াছ, তাহা স্মরণ রাখিয়ো এবং সাক্ষাৎ ঘটিলে শীলাদেবীকে বিধৃত করিয়ো৷ লিখিবার সরঞ্জাম লইয়া আইস। উপাসনার নিমিত্ত সমস্ত খুঁটিনাটি বিধৃত করিতেছি। লিখিয়া লও! আশীর্বাদ করি। তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হোক।