দেশ ত্যাগের পর ষান্মাসিক কাল অতিবাহিত হইতে চলিল। ঋক, সাম, যজুঃ-র কথা স্মৃতিপটে ভাসিয়া ওঠে, ঈশ্বর বলিতে পারেন তাহারা কে কোথায় অবস্থান করিতেছে। এক দিবসে প্রচুর শৈত্য প্রবাহ হইতে লাগিল। আমি পান্থশালার বিশাল চুল্লির অগ্নিকুণ্ডের নিকট বসিয়া আমার পরবর্তী কর্তব্য বিষয়ে চিন্তাক্লিষ্ট ছিলাম। এমতাবস্থায় এক বৃদ্ধ ভিক্ষুনী সে স্থলে প্রবেশ করিল। তাহার সমগ্র পরিচ্ছদ তুষারাবৃত। মুখ মণ্ডল ও হস্তপদ নীলবর্ণ ধারণ করিয়াছে। তাহার চক্ষুদ্বয় ক্লান্ত ও হতাশাপূর্ণ। আমি সেই বৃদ্ধা রমণীকে তাহার জগদ্দল আভরণ হইতে মুক্ত হইতে সহায়তা করিলাম। তাহাকে উষ্ণ বলকারক এক জাতীয় বিশেষ তরল খাদ্যবস্তু (সুপ) ভক্ষণ করাইলাম। বৃদ্ধার হস্তপদ আপন হস্তদ্বারা উত্তমরূপে মর্দন করিয়া দিলাম। খাদ্য গ্রহণের পরপরই ভিক্ষুনী নিদ্রামগ্ন হইল। ভিক্ষুনীর নিদ্রা ভঙ্গ হইলে আমরা একত্রে মধ্যাহ্নের আহার গ্রহণ করিলাম। ভিক্ষুনী আমার প্রতি অত্যন্ত সদয় হইল। সে আমার অত্র দেশে আগমনের হেতু জানিতে চাহিল। আমি অকপটে বৃদ্ধাকে সমস্ত বিষয় অবগত করাইলাম। সব শ্রবণ করিয়া ভিক্ষুনী ক্ষণকাল নিশ্চুপ রহিল। ইহার পর আমাকে আগামী দিবস প্রত্যষে ভ্রমণের নিমিত্তে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করিয়া বাহিরে নির্গত হইল।
আমি তাহার নির্দেশানুযায়ী পর দিবস প্রভাতে ভ্রমণে প্রস্তুত হইয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। কিয়ৎক্ষণ পর ভিক্ষুনী আবির্ভূত হইল। আমি উহাকে অনুসরণ করিয়া নগরীর উত্তর প্রান্তে উপনীত হইলাম। সুগভীর এক গিরিখাতের উভয় পার্শ্বে অতিকায় স্তম্ভের সহিত রঞ্জু সংযোগ করিয়া সেতুর ন্যায় একটি সংযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হইয়াছে। তুষারাবৃত সেই রঞ্জু সেতু তীব্র বায়ু প্রবাহে শূন্যে দোদুল্যমান। ভিক্ষুনী অতি কষ্টে সেই রঞ্জু সেতু অতিক্রম করিল এবং আমাকেও অনুরূপ করিতে আজ্ঞা করিল। আমি ভগবানের নাম স্মরণ করিয়া সেই রঞ্জু সেতু অতিক্রম করিলাম। অতঃপর ক্রমাগত ঊর্ধ্ব মুখে উঠিতে লাগিলাম পর্বত সংলগ্ন একটি অতি সরু সড়ক বাহিয়া। সুতীব্র বাত্যাপ্রবাহ আমাদিগকে শূন্যে উড্ডীন করতঃ অনন্ত গহ্বরে। নিক্ষেপ করিতে চাহিল। দ্বিপ্রহর অতিক্রম হইলে আমরা পর্বতের শীর্ষদেশে উপস্থিত হইলাম। ভিক্ষুনী অঙ্গুলী নির্দেশে দূরবর্তী একটি অঞ্চলে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। নির্দেশিত পথে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া একটি অতি মনোহর বৌদ্ধ মন্দির দেখিতে পাইলাম। উক্ত মন্দিরের কিয়ৎ দূরে একটি কৃষ্ণকায় পর্বত এবং তাহার অদূরে একটি বরাফাচ্ছাদিত পর্বতচূড়া আমার দৃষ্টিগোচর হইল। আমি হৃদয়ে তীব্র শিহরণ অনুভব করিলাম। এইক্ষণে ভিক্ষুনী আমার নিকট হইতে বিদায় লইয়া আপনার পথে যাত্রা করিল। পর্বতের ঈষৎ বক্র পৃষ্ঠদেশ বাহিয়া আমি গুহার পাদদেশে উপস্থিত হইলাম।
আনুমানিক দুই ক্রোশ পথ চলিবার পর বৌদ্ধ মন্দিরটি যে পর্বতশীর্ষে অবস্থিত, তাহার পাদদেশে পৌঁছিলাম। পশ্চিমাকাশে দিবাবসানের লাল আলোক। বৌদ্ধ মন্দিরে ঢং ঢং শব্দে ঘণ্টা বাজিল। তীব্র বাত্যাপ্রবাহে চতুর্দিকে তুষারকণা ছুটিতেছে। ঠিক সেই পর্বে আমি পর্যবেক্ষণ করিলাম কৃষ্ণ প্রস্তর নির্মিত নিকটবর্তী এক পর্বতের গুহা হইতে অনর্গল ধারায় ধূম্র নির্গত হইতেছে। সেইসব ধূম্রপুঞ্জ বিজাতীয় বীভৎস প্রাণীর রূপ ধরিয়া ঊধ্বাকাশে বিলীন হইয়া যাইতেছে। আমি ধীরে ধীরে উক্ত গুহার দিকে অগ্রসর হইলাম। গুহার সম্মুখভাগ একটি বৃত্তাকার সুড়ঙ্গের ন্যায়। অভ্যন্তরভাগে আগুন জ্বলিতেছে। কিঞ্চিত অগ্রসর হইলাম। বর্তুলাকার একটি প্রকাণ্ড কক্ষের এক প্রান্তে একটি কৃষ্ণকায় সুপুরুষের মূর্তি। কক্ষের মধ্যখানে শুভ্র পট্টবস্ত্র পরিহিত এক বৃদ্ধ বসিয়া অতি গম্ভীর ও মধুর স্বরে মন্ত্র উচ্চারণ করিতেছেন। আমি উপলব্ধি করিলাম, এই পুরুষোত্তমই চিত্রকূট তান্ত্রিক। আমি তাঁহাকে আভূমি নত হইয়া প্রণাম করিলাম। কহিলাম, মহারাজ, আপনি যদি অত্র অধমকে তন্ত্র সাধনা শিক্ষা না দেন, তাহা হইলে এইক্ষণে ইহার বিনাশ সাধন করুন। অতি দূর রাজ্য হইতে আসিয়াছি। রাজ আজ্ঞা: আমাকে এই সাধনা শিখিতে হইবে। আমার উপর করুণা বর্ষণ করুন, মহারাজ।
চিত্রকূট তান্ত্রিক আমাকে শির উত্তোলন করিতে বলিলেন। এই প্রথম আমি তাহাকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলিয়া দর্শন। করিলাম। তাঁহার গাত্র সম্পূর্ণ কেশহীন। পট্টবস্ত্রখানিতে কোথাও কোনও সেলাই বা সচিকর্মের চিহ্ন নাই। উজ্জল গৌরবর্ণ শরীর, শরের ন্যায় আঁখিপটের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। প্রথম দর্শনেই মহারাজকে আমার অত্যন্ত আকর্ষণীয় মানব বলিয়া মনে হইল। তিনি আমাকে স্নানের নির্দেশ ও পট্টবস্ত্র প্রদান। করিলেন। স্নান সমাপন করিয়া আমি উহা পরিধান করিলাম। মহারাজ আমাকে প্রত্যহ অন্ততপক্ষে তিনবার স্নান করিবার। নির্দেশ দিলেন। এই নিমিত্ত আমাকে ছয়টি পট্টবস্ত্র দান করিলেন। প্রতিবার স্নানের সময় বস্ত্রাদি উত্তমরূপে ধৌত করিবার আদেশ করিলেন। বর্তুলাকার কক্ষটিই তাঁহার উপাসনা গৃহ। সর্বদাই কক্ষটিকে ধৌত করতঃ উত্তম রূপে শুষ্ক বস্ত্রখণ্ড সহযোগে মুছিতে হয়। ইহা ছাড়াও আতর ও গোলাপের নির্যাস ছিটাইতে হয়। চন্দন তৈলের প্রদীপ জ্বালিতে হয়। তাহার আরাধ্য দেবতার নাম আহুরা বা পট্রহ এর রাজকুমার। মহারাজ সূর্য উদয় ও সূর্যাস্তের সময় স্বহস্তে দেবমূর্তিটিকে আতর ও গোলাপের জল মিশ্রিত করিয়া উক্ত জল দ্বারা ধৌত করেন। মহারাজ প্রাচীন পারস্য, মিশরীয় ও ইয়াহুদ নামক এক গোত্রের ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছেন। আমি ওই সকল ভাষা অধ্যয়ন করিতে পারি না। বলিয়া তিনি কিছু কিছু মন্ত্র সংস্কৃত ভাষায় লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।