মঠের একটি স্তম্ভে হেলান দিয়া হস্তপদ ছড়াইয়া অর্ধশায়িতাবস্থায় আমি বৃক্ষসারির মধ্য দিয়া গঙ্গার প্রবাহিত স্রোতধারার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম। অস্তগামী সূর্যদেবের লাল কিরণমালায় সে স্রোতধারার নৈসর্গিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। ক্রমে আমার চেতনা লুপ্ত হইল। আমি গভীর নিদ্রায় আপতিত হইলাম। এবং নিদ্রাকালীন সময়ে অভূতপূর্ব এক স্বপ্ন দর্শন করিলাম। দেখিতে পাইলাম, মঠের প্রধান পুরোহিত এক পকূকেশ বৃদ্ধ আমাকে প্রশ্ন করিলেন কী উদ্দেশে আমি এ স্থলে আগমন করিয়াছি। উত্তর করিলাম, প্রভু, রাজ আজ্ঞা হেতু আমাকে অকুস্থলে আসিতে হইয়াছে। সেই জ্যোতির্ময় পুরুষ কিয়ৎক্ষণ আমার দিকে চাহিয়া উত্তর করিলেন, শীলাদেবী ও তদীয় ভ্রাতা পরশুরামের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটিয়াছে। তাহাদের আর কোনও আশা নাই। তাঁহাদের রাজ্য হারাইতে হইবে। তুমি এই ক্ষণে শীলাদেবীর নিকট প্রত্যাবর্তন কর। আমি উত্তর করিলাম, হে, প্রভু, যে উদ্দেশ্যে দেবী আমাকে প্রভূত অর্থ প্রদান করতঃ প্রেরণ করিয়াছেন, তাহা আমাকে সফল করিতে দিন। পকূকেশ সেই বৃদ্ধ আমাকে সুগভীর দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করিয়া ক্ষণকাল পর উত্তর করিলেন:
হে, বৎস, তোমাকে সুদীর্ঘ পথ পরিক্রম করিতে হইবে। তিব্বতের দুর্গম লাসা নগরীর নিকটে এক পর্বত গুহায় জনৈক সিদ্ধ পুরুষ বাস করেন তাহার নাম চিত্রকুট। স্বীয় সাধনা বলে ওই পুরুষ মোক্ষ লাভ করিয়াছেন। তিনি আঁধার জগতের মহাপ্রভুর সাধনা করেন। তাঁহার সাধন পীঠ এস্থল হইতে ছয় মাসের পথ। লাসা নগরীর নিকটবর্তী হইলে হিমালয়ের বরফ মুণ্ডিত দুইটি চূড়া তোমার দৃষ্টিগোচর হইবে। উক্ত স্থানে একটি বৌদ্ধ মন্দির দেখিতে পাইবে। ইহার অদূরে পর্বত গাত্রে একটি সুড়ঙ্গের ন্যায় গুহা আছে। সূর্যাস্তকালীন সময়ে সেই গুহা হইতে ধূম্র নির্গত হইতে দেখিবে। উহাই চিত্রকূটের সাধন পীঠ। স্মরণ রাখিও, চিত্রকূট কাপালিক নহেন। সুউচ্চ স্তরের তন্ত্র সাধনাই তাহার ব্রত। এই সাধনায় স্বীয় সত্তাকেই অন্ধকার রাজ্যের মহাপ্রভুর নিকট উৎসর্গ করিতে হয়।
আমার নিদ্রাভঙ্গ হইলে দেখিলাম রাত্রির অমানিশা কাটিয়াছে। চতুর্দিকে পক্ষীকুল কুজন করিতেছে। তৎক্ষণাৎ সে স্থল পরিত্যাগপূর্বক আমি পান্থশালায় প্রত্যাবর্তন করিলাম ও আমার ভ্রমণের সরঞ্জামাদি লইয়া তিব্বতাভিমুখে যাত্রা করিলাম। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হইল। অবশেষে আমি এক পার্বত্য জাতি অধ্যুষিত নগরীতে প্রবেশ করিলাম। সুউচ্চ ভূমিতে অবস্থিত সেই নগরীর নাম থিষ্ণু। এই জাতির মধ্যে ব্যভিচার ও অনাচার অতি মাত্রায় অনুপ্রবেশ করিয়াছে। অসম বিবাহ, অতি মাত্রায় সোমরস পান, কুরুচিপূর্ণ অশ্লীল নর্তন কুর্দন ইহাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটাইয়াছে এবং মানবিক গুণাবলীর ধ্বংস সাধন করিয়াছে। এ স্থলে আসিয়া আমি রাত্রি যাপনের নিমিত্তে একটি পান্থশালায় আশ্রয় গ্রহণ করিলাম। সন্ধ্যা পরবর্তী সময়ে সংক্ষিপ্ত বস্ত্রে আচ্ছাদিত বারবণিতারা আমাকে বিপর্যস্ত করিয়া ফেলিল। ইহাদের মধ্যে আমি একটি বালিকাকে দেখিতে পাইলাম। উক্ত বালিকা সকলের পশ্চাতে দণ্ডায়মান ছিল। দীনহীন বালিকাটিকে দেখিয়া আমার হৃদয় আর্দ্র হইল। চল্লিশোর্ধ্ব জনৈক বারবণিতাকে কিঞ্চিত অর্থ প্রদান করিয়া তাহার সহযোগিতায় উক্ত বালিকাটিকে আমার কক্ষে প্রবেশ করাইয়া দ্বার রুদ্ধ করিলাম।
বালিকাটি ভীতা হরিণ শাবকের ন্যায় আমার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল। আমি লক্ষ করিলাম, তাহার দেহ প্রকম্পিত হইতেছে। বালিকাটিকে আমার শয্যার উপর উপবেশন করিতে অনুরোধ করিলাম। অতঃপর উহাকে অভয় দান পূর্বক তাহার পরিচয় ইত্যাদি জ্ঞাপন করিতে বলিলাম। বালিকাটির পিতা দীর্ঘদিন হইল নিরুদ্দেশ হইয়াছে। তাহার মাতা নগরীর শাসকদের মনোরঞ্জন করিত। বর্তমানে তাহার স্বাস্থ্য ভগ্ন হইয়াছে এবং সে জটিল রোগে অতিশয় পীড়িতা। বালিকাটি অনন্যোপায় হইয়া অর্থোপার্জনের লক্ষ্যে বারবণিতাদের সহিত যুক্ত হইয়াছে। ইতিপূর্বে বিকৃতরুচিপূর্ণ একজন প্রৌঢ় তাহাকে এক পান্থশালায় বিগত রজনী হইতে অদ্য দ্বিপ্রহর অবধি নির্যাতন করিয়াছে। বালিকাটির বাহু, কপোল এবং গলদেশে অত্যাচারের চিহ্ন বিদ্যমান। দ্বিপ্রহরে প্রৌঢ় ব্যক্তিটি আহার সংগ্রহে বাহির হইলে বালিকাটি উক্ত পান্থশালা হইতে সবেগে প্রস্থান করিয়াছে। সে ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত। তাহার মাতা ও ছোট একটি ভ্রাতা পথ চাহিয়া আছে। শূন্য হাতে সে ফিরিবে কী প্রকারে?
অতঃপর আমি বালিকা সমভিব্যাহারে উহার মাতার পর্ণ কুটিরে উপস্থিত হইলাম ও বালিকার বাটীতে সপ্ত দিবস অতিবাহিত করিয়া তাহার মাতার চিকিৎসার ব্যবস্থা করিলাম। ইত্যবসরে বালিকার মাধ্যমে ঔষধপত্র, আহার ও বস্ত্রের ব্যবস্থা সম্পন্ন করিয়াছি। কুটির হইতে আমি কদাপি বাহির হইয়াছি। তাহার কারণ এই নগরীর নাগরিকেরা আদর্শহীন কপট শ্রেণীর। আমাকে অসহায় ভিনদেশী মনে করিয়া সর্বস্ব হরণ করিতে পারে। বালিকার মাতার সহিত আমার আলাপচারিতা হইয়াছে। উক্ত রমণীর পিতার আবাস লাসা নগরীর সন্নিকটে। তিব্বত গমনের অতি সহজ পথ নির্দেশ তাহার নিকট হইতে লাভ করিয়াছি। ইহাদের একরূপ ব্যবস্থা হইয়াছে বিধায় অষ্টম দিবসে অতি প্রত্যূষে বালিকাটির শিয়রে কিঞ্চিৎ অর্থ রাখিয়া তিব্বতের পথে নির্গত হইলাম। আমার নির্গমন সম্বন্ধে বাটীর কেহই কিছু জানিতে পারিল না। সুদীর্ঘ দুর্গম পথ পরিক্রম করিয়া অবশেষে আমি লাসা নগরীতে উপস্থিত হইলাম। লাসার নাগরিকদের নিকট প্রশ্ন করিয়া নির্দেশিত স্থানের কোনও হদিশ পাইলাম না। পঞ্চদশ দিবসে নগরীর চতুর্দিকে ক্রমাগত পরিভ্রমণ করিলাম। অথচ কোনও স্থলে ওই বিশেষ বৌদ্ধ মন্দির বা পর্বত শঙ্খ দৃষ্টিগোচর হইল না।