১৯৭৩ সালের দিকে আমাদের এখানে নকশাল আন্দোলন চরমে ওঠে। মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন লোকদের ধরে সর্বহারারা পটাপট মেরে ফেলতে লাগল। এদের কেউ কেউ নানা উপদলে ভাগ হয়ে লুটতরাজ করতেও লেগে গেল। জ্যাঠার ফেলে যাওয়া তোরঙ্গে মূল্যবান কিছু আছে কি দেখার জন্যে একদিন সকালে খুললাম ওটা। তোরঙ্গের ভেতর অনেক কিছুর সাথে ভেড়ার নরম সাদা চামড়ায় শুদ্ধ পালিতে লেখা এই স্কুলটি পেয়েছিলাম। বরেন্দ্র অঞ্চলে মধ্যযুগে পালি ভাষায় যত কিছু লেখা হয়েছে, তার ভেতর একটি অনন্য সাধারণ লেখা এটি। আপনাকে দেখানোর জন্যেই সাথে করে নিয়ে এসেছি আমি। স্ক্রলটি হাতে দিতে যাবে এমন সময় বাবুর্চি এসে খবর দিল খাবার রেডি। বাইরে তাকিয়ে দেখি বৃষ্টি ধরে এসেছে, সেই সাথে কারেন্টও চলে এল। স্ক্রল রয়ে গেল বৃন্দাবন ঘটকের হাতেই। খাওয়া-দাওয়া সেরে পাশাপাশি দুটো বিছানায় শুয়ে পড়লাম আমরা দুজন।
ঘুম ভেঙে দেখলাম সকাল নটা বাজে। পাশের বিছানা খালি, বিদায় হয়েছেন বৃন্দাবন ঘটক। সকালে উঠেই খালি পেটে পানি খাওয়া আমার অনেক দিনের অভ্যেস। বেড সাইড টেবিলে পিরিচে ঢাকা কাঁচের গ্লাসে পানি থাকে। পানির গ্লাস হাতে নিতে যেয়ে দেখি সেই স্ক্রলটি ওখানে। রাখা। পানি খেয়ে বাথরুম সেরে স্ক্রলটা হাতে নিয়ে বসলাম। কালো কালিতে পাখির পালক দিয়ে চিকন হরফে শুদ্ধ পালিতে যে কথাগুলো লেখা, সেটি সরল বাংলায় অনুবাদ করলে এই রকম দাঁড়াবে:
১২২৩ শতাব্দে তিব্বতের নিকট তান্ত্রিক মহাপুরুষ শ্রীমান চিত্রকূট মহাশয়ের সাধন পীঠে বসিয়া আমি বজ্ৰযোগী এই পুঁথি রচনা করিতেছি। ১২২১ শতাব্দে শীলাদেবী পুণ্ড্রনগরী হইতে একদল অনুচরকে তন্ত্রসাধনার বিষয়ে সম্যক অবগত হইবার অভিপ্রায়ে দিকে-দিকে প্রেরণ করেন। ক্রমে এক বৎসরকাল অতিক্রম হইল, অথচ কেহই ফিরিয়া আসিল না। অতঃপর দেবী তাহার একান্ত বিশ্বস্ত দশজন অধ্যক্ষ পুরোহিতের মধ্য হইতে চারজনকে পুনরায় এতদঅভিপ্রায়ে ভারতবর্ষের চতুর্দিকে প্রেরণ করিতে মনস্থ করিলেন। আমাদিগের চারজনকে ঋক, সাম, যজুঃ, অথর্ব এই চারটি সাঙ্কেতিক নামে ভূষিত করা হইল। আমি সর্বকনিষ্ঠ বিধায় আমার নাম হইল অথর্ব। আমাদিগকে চার বৎসরকাল স্বাচ্ছন্দ্যে কাটাইবার নিমিত্তে প্রচুর অর্থ প্রদান করা হইল।
একদিন অতি প্রত্যূষে আমরা চারজন পুণ্ড্রনগরী হইতে যাত্রা করিয়া বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী ঢাকা-ঈশ্বরী মন্দিরে পৌঁছাইলাম। এই স্থলে মাটির গভীরে দশভুজা দেবী সহস্রাদি গুপ্তাবস্থায় ছিলেন। আরাকানের বিতাড়িত মঙ্গত রায় ওরফে রাজা বল্লাল সেন এস্থলে যাত্রাবিরতিকালে দেবী তাহাকে স্বপ্নে দর্শন দেন। বল্লাল সেন আপাদমস্তক স্বর্ণনির্মিত দশভুজাকে উত্থিত করিয়া দেবীর সম্মানে মন্দিরটির নির্মাণ করেন। দশভুজা ঈশ্বরী নামেও পরিচিত লাভ করিয়াছেন। ঈশ্বরী বহুকাল ভূমিতলে গুপ্ত ছিলেন বলিয়া তাঁহাকে ঢাকা-ঈশ্বরী বলা হয়। কিন্তু আমরা দশভুজা দর্শনে এস্থলে আগমন করি নাই। আমরা আসিয়াছি চতুর্ভুজ দেবতা বাসুদেব দর্শনে। বাসুদেব আরাকানী বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের প্রধান উপাস্য দেবতা। যাত্রার পূর্বে তাহার কৃপা লাভ করাই আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য, ইহাই শীলাদেবীর নির্দেশ। পরদিন প্রত্যূষে আহার সমাপনান্তে ঋক আরাকান রাজ্যে গমনের অভিলাষে বুড়িগঙ্গা নদীপথে শাগঙ্গার (বর্তমানে চট্টগ্রাম) উদ্দেশে যাত্রা করিল। সাম কামরূপ রাজ্যে গমনের অভিপ্রায়ে পূর্বদিকে সড়কপথে যাত্রা করিল। আমি এবং যজুঃ আরও একদিবস ঢাকেশ্বরী মন্দিরে অতিবাহিত করিলাম এবং অপরাহ্বে নদীতীরে ভ্রমণ করিতে বাহির হইলাম। আমরা লক্ষ করিলাম সেই স্থলে একশ্রেণীর তন্তুবায়ের বাস। তাহারা অতি সূক্ষ্ম তন্তু দ্বারা এক বিশেষ শ্রেণীর বস্ত্র উৎপাদনের উপায় উদ্ভাবন করিয়াছে। এই বস্ত্র মসলিন নামে খ্যাত। বোয়াল নামক এক জাতীয় আঁশহীন বৃহৎ মৎস্যের সূক্ষ্ম দাঁতের সারি ব্যবহার করতঃ উক্ত মসলিন বস্ত্রের তন্তু সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর ও মসৃণ করা হয়। এই বস্ত্রশিল্পে নারীদের অবদানই অধিক। মসলিন মহামূল্য বস্ত্র হইলেও ইহার প্রস্তুতকারীরা অত্যন্ত দীনহীন। সুষম খাদ্য ও পুষ্টির অভাবে তাহাদের দেহকাণ্ড ক্ষীণ ও নজ। পরিধেয় বস্ত্র অতি মলিন ও শতচ্ছিন্ন। আমি আরও এক শ্রেণীর কুশলী দেখিতে পাইলাম। উহারা শঙ্খ দ্বারা নানা প্রকার দ্রব্য সামগ্রী এবং অলঙ্কার প্রস্তুত করিতেছে। এই কর্মেও নারীদের অবদানই অধিক। সূর্যাস্তকালীন সময়ে আমরা নগরী পরিভ্রমণ শেষে মন্দিরে ফিরিয়া আসিলাম। মন্দিরে অনেক সেবাদাসী রহিয়াছেন। ইহাদের অধিকাংশই অযোধ্যা ও মহারাষ্ট্র হইতে আগত। এইসব রমণীদের দেহ, সৌন্দর্য যে কাহারও মনোবিকার ঘটাইবে। আগামীকাল প্রত্যূষে এস্থল ত্যাগ করিতে হইবে।
পরদিন যথা সময়ে পশ্চিম দিকে যাত্রা করিলাম এবং দীর্ঘ পথ অতিক্রম করিয়া সূতানাটি গোবিন্দপুর (বর্তমানে কোলকাতা) নামক এক প্রখ্যাত নগরীতে পৌঁছাইলাম। এই নগরী গঙ্গা নদীতীরে অবস্থিত। এই অঞ্চলে ছোট ছোট কুটিরে কলি বাজলজ শামুক হইতে প্রচুর পরিমাণে চুন এবং নারিকেল হইতে কাতা বা রজু উৎপন্ন করা হয়। নগরীতে প্রচুর সংখ্যক পান্থশালা রহিয়াছে। আমরা উহার একটিতে আশ্রয় লইলাম। এই নগরীর অধিবাসীগণ দেবী স্বরস্বতীর বর লাভ করিয়াছেন। তাঁহারা প্রায় সকলেই শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত এবং শিক্ষাক্ষেত্রে খুবই অগ্রগণ্য। পরদিন অপরাহে যজুঃ আমার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণপূর্বক কলিঙ্গ রাজ্যে গমনের লক্ষ্যে দক্ষিণ দিকে যাত্রা করিল। এই ক্ষণে আমি সম্পূর্ণ একাকী বোধ করিলাম। সহচরেরা সকলেই বিদায় লইয়াছে। আমি কোন স্থানে কাহার নিকট যাইব সে সম্পর্কে কিয়ৎ পরিমাণ জ্ঞান নাই। তৎক্ষণে অন্যমনস্ক হইয়া গঙ্গা নদীর তীর দিয়া হটিতে লাগিলাম। গঙ্গার তীর অতীব মনোমুগ্ধকর। এ স্থলে কালক্ষেপণ করিলে হৃদয় ভাবাবেগে পূর্ণ হয়। ক্রমান্বয়ে আমি নগরী হইতে দূরে সরিয়া গেলাম। অরুণাচল অস্তগামী হইল। আমি কিয়ৎক্ষণ বিশ্রামের লক্ষ্যে একটি আশ্রয়স্থল সন্ধান করিতে লাগিলাম। অদূরে একটি বৌদ্ধ মঠ দৃষ্টিগোচর হইল। গঙ্গার তীর ঘেঁষিয়া উহার অবস্থান। লাল ইষ্টক নির্মিত এই মঠটির স্থাপত্যশৈলী অতি মনোরম। ইহার মেঝে কালো কষ্টি পাথরে নির্মিত। একটি আয়তক্ষেত্রের আকৃতি বিশিষ্ট এই মঠটির সম্মুখভাগে একটি কূপ রহিয়াছে। কূপের পাশে কাষ্ঠ নির্মিত একটি পাত্রের সহিত লম্বা রঞ্জু সংযুক্তাবস্থায় দৃষ্টিগোচর হইল। ওই কাষ্ঠ নির্মিত আধারটি কূপে নিক্ষেপ করতঃ জল দ্বারা পূর্ণ করিয়া সেই জল উপরে উত্তোলন কারলাম। জল পান করিয়া আমার প্রাণ জুড়াইয়া গেল। মঠটির চতুর্দিকে কৃষ্ণচূড়া ও কদম্ব বৃক্ষের সারি। আমি মঠটির অভ্যন্তরে পূজা মণ্ডপের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। অথচ বিলক্ষণ উপলব্ধি করিতে পারিলাম কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই অকুস্থলে পূজাপাঠ ইত্যাদি সমাপন হইয়াছে।