সিধু জ্যাঠা নানান ধরনের তত্ত্বকথাও শোনাতেন। একদিন বললেন, বুঝলি, বেন্দাবন, এই জগৎ সংসার হলো ভাল আর মন্দের যুদ্ধক্ষেত্র, শুম্ভ নিশুম্ভের লড়াই। কে ভাল কে মন্দ সেটি নিয়ন্ত্রণ করে নিয়তি। তোর কথাই ধর। যদি ওই বৌদ্ধ মন্দিরে যেতিস, তুই হতি লোকনাথ বাবার মতন বিরাট সাধু। সেখানে না গিয়ে তুই গেলি চিত্রকূটের গুহায়। বদলে গেল তোর নিয়তি, তোর পথ হলো পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিকের। আমার কথা শোন, এই লাইনে এসেই যখন পড়েছিস, তখন ভাল করে তন্ত্রমন্ত্র শেখ। তবে এজন্যে তোকে সবচেয়ে আগে শিখতে হবে পালি। এ হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের ভাষা। থিরুরা দাবি করে দুনিয়ায় পালির মত নিখুঁত কোনও ভাষা নেই। পৃথিবীর সবকিছু বদলে যেতে পারে, শুধু পরিবর্তন হয় না পালির। দেবতা, অপদেবতা, আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর কেউই মূখের প্রার্থনা পছন্দ করে না। প্রার্থনা হতে হবে সুমধুর, প্রাঞ্জল, হৃদয়গ্রাহী-যার ভাষা হবে নিখুঁত। জানিস তো ইউরোপ আমেরিকায় শয়তানের পুজো করতে ল্যাটিন ভাষা ব্যবহার হয়। আয়, আজ থেকে তোকে পালি শেখাই।
আট
সেই আমার পালি ভাষায় হাতে খড়ি। খুব ধীরে বছরের পর বছর ধরে পালি শিখলাম। তান্ত্রিকদের লেখা পুঁথিও পড়লাম বিস্তর। আদ্যিকালের পুঁথি পাণ্ডুলিপিতে সিধু জ্যাঠার ঘর ভর্তি। এ ছাড়াও অদ্ভুত সব পুরনো জিনিস ছিল তার সংগ্রহে। আপনি আমার বাসায় যে জিনিসগুলো দেখেছিলেন, সেসবই এই সিধু জ্যাঠার কাছ থেকে পাওয়া। অকৃতদার পুরুষ, ছেলেমেয়ে বা তিনকুলে কেউ নেই। আমাকেই সব দিয়ে গেছেন। ভীষণ অভিশপ্ত জিনিস ওগুলো। পিশাচ সাধনায় উপাচার হিসেবে এসব সামগ্রীর গুরুত্ব সীমাহীন।
সিধু জ্যাঠার মৃত্যু হয় ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। ওই সময় হিন্দুপ্রধান রামপুর বোয়ালিয়া খান সেনাদের অন্যতম প্রধান টার্গেট হয়ে দাঁড়ায়। রাতদিন রাজাকার ইনফর্মার আর মিলিটারির আনাগোনা। জ্যাঠার তিরিক্ষি মেজাজের কারণে অনেকেরই রাগ ছিল তার ওপর। যে কোনও দিন হামলা হওয়ার সম্ভাবনা। সাবধানের মার নেই ভেবে একদিন খুব ভোরে বিরাট এক, ট্রাঙ্ক মাথায় করে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হলেন সিধু জ্যাঠা। বোনকে রেখে এসেছেন মামাদের বাড়িতে। বিড়ালদাহর কাছেই দাশুড়িয়া বর্ডার দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে চান। ভারতে যাওয়ার বিষয়টি তখন তত সহজ ছিল না। যাব বললেই যাওয়া যায় না। রাজাকার মিলিটারিদের চোখে ধুলো দিলেও সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার জন্যে পথে-প্রান্তরে ওঁৎ পেতে আছে অজস্র দালাল-চোর-ডাকাত। শরণার্থী পরিবারের সোনাদানা, টাকা-পয়সা সব কেড়ে নিয়ে মা-মেয়েকে সবার সামনে বলাৎকার করার ঘটনা তখন আকছার ঘটছে। যুবতী সুন্দরী মেয়ে দেখলে এরা অনেক সময় তাদের নিজেদের ফুর্তির জন্যে কাছেও রেখে দিত। তাকে বললাম, দাদু, আপনাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এলাকার বিশ্বস্ত কোনও দালালের সাথে দিতে চাই আপনাকে আমি।
তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু কতদিন অপেক্ষা করতে, হবে আমাকে?
একেবারে দিনক্ষণ উল্লেখ করে তো কিছু বলতে পারছি না, দাদু। একদিনও হতে পারে আবার সাতদিনও হতে পারে। রাস্তা-ঘাটের অবস্থা, বর্ডারের পরিস্থিতি সব বুঝে তবেই না ব্যবস্থা।
এসব শুনে খুব একটা খুশি হতে পারলেন না জ্যাঠা। চুপ করে থাকলেন। বললেন, দেখ যা ভাল হয়…
আমাদের পাড়ার কদম রসুল সেই সময় লোক পারাপার করত। জনপ্রতি দুটো টাকা তার রেট। তবে লোক বিশ্বস্ত, সেই ছোটবেলা থেকে আমাদের বাড়িতে এর বাবার আসা যাওয়া। সিধু জ্যাঠা আমার গুরু। তাঁর কাছ থেকে সে কোনও টাকা চায় না। শুধু পথ-খরচা দিলেই হবে। জ্যাঠা ছাড়াও আরও চারজনকে নিয়ে এক বর্ষার রাতে রওনা হলো কদম রসুল। জ্যাঠা তাঁর পাঁচমণি তোরঙ্গ মাথায় করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কদম রসুল হেসে বলল, স্রেফ টাকা-পয়সা ছাড়া আর কিছুই সাথে রাখা যাবে না, বাবু। ওই গন্ধমাদন মাথায় করে যেতে দেখলে আমার আপন ভাইও আপনার গলা ফাঁসিয়ে দেবে। কী আর করা, তোরঙ্গ আমার জিম্মায়। রাখতে হলো তাকে।
বর্ডারে পৌঁছতে হলে পনেরো মাইলটাক হাঁটতে হবে। তবে রাস্তা সহজ নয়। বাঁশঝাড়, খেতের আল, আমবাগান, দিঘির পাড়, বাড়ির আঙিনা এসবের ভেতর দিয়ে যাত্রা। অন্ধকারে নিতান্ত প্রয়োজন না হলে টর্চের আলো ফেলা যাবে না। ডাকাত আর লুটেরার দল হায়েনার মত ওঁৎ পেতে আছে সবখানে। সারারাত হেঁটে ছোট্ট দলটি নদীর কাছে যখন পৌঁছল, তখন ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই। পাড়ের কাছেই লগিতে নৌকো বেঁধে অপেক্ষা করছে কদম রসুলের কন্ট্যাক্ট। একদল রাজাকার রাতের রোদ শেষে ক্যাম্পে ফিরছিল সেই সময়, ভিতুর ডিম রাজাকাররা জ্যাঠাদের দলটাকে মুক্তিযোদ্ধা মনে করে খান সেনাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে দুতিন রাউণ্ড ফায়ার করে বসল। ভয় পেয়ে জ্যাঠার দলের লোকেরা হুড়মুড় করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেউ একজন জ্যাঠাকেও ধাক্কা দিয়ে থাকবে।
ভাল সাঁতার জানতেন সিধু জ্যাঠা। নৌকোয় নিজে তো উঠলেনই, সেই সাথে চুলের মুঠি ধরে আরও দুজনকে উঠিয়ে নিলেন। বাজখাই গলায় মাঝিকে বললেন নাও ছাড়তে। জ্যাঠারা যখন মাঝ গাঙে তখন পাড়ে এসে উপস্থিত হলো মিলিটারি। দুদিন আগে মুক্তিযোদ্ধাদের এক অপারেশনে চারজন জওয়ান হারিয়েছে তারা। আবারও আক্রমণ হতে পারে ভেবে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিল। বর্ষার পদ্মা ভয়ঙ্করী, যেমন খরস্রোতা তেমনই চওড়া। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে খান সেনারা জানত, মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ শেষে নৌকো করে খুব দ্রুত রেঞ্জের আড়ালে চলে যায়। এবার মিলিটারি ন্যূনতম একমাইল রেঞ্জের হেভি মেশিনগান সাথে নিয়ে নদীর পাড়ে এসেছে। নৌকোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে জ্যাঠা। ছেষট্টি ক্যালিবারের হেভি মেটাল বুলেট ছিন্নভিন্ন করে ফেলে তার দেহ। এসবই পরে কদম রসুলের কাছ থেকে শোনা।
নয়
এখন মূল ঘটনায় আসি। আগেই বলেছি নানা কথা বলতেন সিধু জ্যাঠা আমাকে। শীলাদেবীর কথাও উনিই প্রথম আমাকে শোনান। শাহ সুলতান মাহিসওয়ার পুরাজ্যের রাজধানী মহাস্থান গড় দখলের জন্যে বদ্ধপরিকর। তখন এখানকার রাজা ছিল পরশুরাম। তবে আসল ক্ষমতা ছিল পরশুরামের বোন শীলাদেবীর হাতে। শীলাদেবী ছিল সে যুগের সব থেকে বড় তান্ত্রিক। অনিন্দ্যসুন্দরী এই যুবতী পুজো করত জরাসুরের। ভয়ানক নিষ্ঠুর এই যক্ষের চরণে সে নিবেদন করেছিল নিজেকেই। মহাস্থান গড়ের জীয়তকুণ্ড শীলাদেবীকে এই যক্ষই দান করে। এই শীলাদেবী প্রায়ই ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা দেখতে পেত। শীলাদেবী বুঝতে পেরেছিল, মাহিসওয়ার জীয়তকুণ্ড ধ্বংস করবেন এবং পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। এর থেকে মুক্তির উপায় বের করার জন্যে সে এক পরিকল্পনা করে। তার খুব বিশ্বস্ত চারজন অনুচরকে প্রাচীন আর্যদের মূলধারার যে তান্ত্রিকতা সেটির খোঁজে পাঠায়। এই চারজনের ভেতর একজন ছিল অংশুদেবের প্রধান পুরোহিতের বড় ছেলে বজ্ৰযোগী। সিধু জ্যাঠার মতে বজ্রযোগীর মত বড় তান্ত্রিক বঙ্গদেশে অতি বিরল। সিধু জ্যাঠা আমাকে এর বেশি আর কিছু বলেননি।