পরদিন সকাল বেলা আবার যুদ্ধ শুরু হলো। রাজার। সৈন্য মরতে লাগল কাতারে কাতারে। দুপুর নাগাদ তুরকান শাহর বাহিনী রামপুরের প্রায় কাছাকাছি চলে এল। রাজধানীর পতন হবে যে-কোনও মুহূর্তে। ধৈর্য হারাল না রাজা। অক্ষরে অক্ষরে পালন করল দেবীর নির্দেশ। পশ্চিমাকাশে শকুন। চোখে পড়তেই খড়গ হাতে নিয়ে কালো কুচকুচে মাদী ঘোড়ায় চেপে তুরকান শাহ বাহিনীর কেন্দ্র লক্ষ্য করে ছুটে গেল অংশুদেব। দরবেশের যোদ্ধারা দেখল অন্ধকার ছায়ার মত কী একটা তাদের পাশ কাটিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে যাচ্ছে। তুরকান শাহ তখন রুকুতে। জয় মা মহাকালদেবী বলে খড়গের এক কোপে দরবেশের ধড় আর মাথা আলাদা করে ফেলল তান্ত্রিক রাজা। ঠিক সেই মুহূর্তে শোনা গেল। বজ্রপাতের প্রচণ্ড শব্দ, ঘনিয়ে এল আঁধার। তুরকান শাহর বাহিনী অবাক হয়ে দেখল, দরবেশের মাথা শূন্যে উড়তে উড়তে চলে গেল বহুদূরে। হারিয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে। মহাকালদেবীর জয় বলে ছুটে এল রাজার সৈন্যরা। নতুন মনোবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তুরকান শাহর বাহিনীর ওপর। কচুকাটা হয়ে গেল সব দরবেশ আর নতুন যারা মুসলমান হয়েছে।
যুদ্ধ শেষ হলে রাজার ভাই খেজুরচণ্ড মহাকালদেবীর তান্ত্রিক পুরোহিতদের নিয়ে তুরকান শাহর লাশ উঠিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল। উদ্দেশ্য, দেবীর বেদীতে লাশ উৎসর্গ করা। তবে সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। হাতি দিয়ে টেনেও লাশ ওঠাতে পারেনি তান্ত্রিকেরা। বাধ্য হয়ে গভীর এক গর্ত খুঁড়ে লাশ পুঁতে ফেলে তারা। ওখানেই এখন তুরকান শাহ শহীদের মাজার। এরপর কেটে গেল বহুদিন। তান্ত্রিক রাজা অংশুদেব আর খেজুরচণ্ড ততদিনে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। রাতদিন চলছে মহাকালদেবীর পুজো আর নরবলি। ঠিক সেই সময়ে দেখা দিল আরেক দরবেশ। এঁর নাম শাহ মখদুম রূপস। ইনি সাদা কাপড়ে সব সময় মুখ ঢেকে রাখতেন। তার আসল চেহারা কেউ কখনও দেখেনি। স্বয়ং বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) এঁর পরদাদা। তুরকান শাহ হত্যার প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর শাহ মখদুম। অংশুদেব আর খেজুরচণ্ডের সাথে তার সংঘর্ষ হয়ে উঠল অনিবার্য। তবে রূপস তুরকান শাহের মত ভুল করলেন না। তিনি জানতেন, মহাকালদেবীর পুজো করে করে দেবীর কৃপায় অংশুদেব এক অনন্য শক্তির অধিকারী। এর মুখোমুখি হতে হলে তান্ত্রিকদের বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞান আছে এমন ব্যক্তির পরামর্শ দরকার। ভাগ্য ভাল ছিল দরবেশের। বাংলায় তখন ইসলাম প্রচার করছেন শাহ সুলতান মাহিসওয়ার। তান্ত্রিকের যম এই সুফি দরবেশ। ইনি এদেশে এসেছিলেন পানিপথে। মাছের আকারের এক নৌকোয় করে। লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল দরবেশ মাছের পিঠে চড়ে এসেছেন। তার নাম হয়ে গেল মাহিসওয়ার। চিটাগাং-এ পা রেখেই তিনি জানতে পারেন নোয়াখালির দক্ষিণে সমুদ্রপাড়ে হরিরামনগর বলে এক সমৃদ্ধ নগরী আছে। এখানকার রাজা বলরাম অতি বড় তান্ত্রিক এবং ভয়ানক অত্যাচারী। দরবেশ বুঝলেন, জনগণের মন জয় করতে হলে এই অজেয় রাজাকে যুদ্ধে হারিয়ে আমজনতার সামনে এর শিরচ্ছেদ করতে হবে।
তান্ত্রিকদের শক্তির অন্যতম প্রধান উৎস হলো তারা যে দেবী মূর্তির পুজো করে, সেই দেবী মূর্তি। যুগের পর যুগ অসংখ্য নরবলি মন্ত্র সাধনা এবং হোম আর পুজোর পরই কেবল ধীরে ধীরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় এসব মূর্তিতে। এরা হয়ে ওঠে জাগ্রত। এসব মূর্তির সামনে রেখে মন্ত্রপূত করা হয় ত্রিশূল কিংবা খড়গ। প্রায় অজেয় হয়ে ওঠে ওই সব বিশেষ অস্ত্রের মালিকেরা। দরবেশরা প্রচুর অর্থের বিনিময়ে কোনও দুর্বল চরিত্রের অর্থলোভী তান্ত্রিক পুরোহিতকে দলে ভেড়াতেন। বলরামের বেলায় বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তার এক মন্ত্রীও। আউলিয়ারা কোরবানি করা বকনা গরুর রক্ত তামার পাত্রে ধরে রাখতেন। দরবেশদের কথামত গোরক্ত দিয়ে দেবীর চরণ ভেজাত দলছুট পুরোহিত। এরপর তারা ওই রক্ত ছিটিয়ে দিত মন্দিরের চারপাশে। মন্ত্রপূত ত্রিশূল বা খড়গ রাখা হত দেবীর পায়ের কাছে। গোরক্ত মাখিয়ে দেয়া হত ওগুলোতেও। এ কাজগুলো সমাধা হওয়ার পরপরই চালানো হত আক্রমণ। তান্ত্রিক রাজারা যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে হতভম্ব হয়ে দেখত, দেবীর কোনও শক্তিই কাজ করছে না আর। মুসলমান যোদ্ধাদের কাছে সম্পূর্ণ অসহায় তারা। যুদ্ধে পরাজিত রাজা আর তার সেনাপতিদের শিরচ্ছেদ করা হত। মন্দিরের সামনেই। তান্ত্রিকতার বিনাশ সুফিবাদের সূচনা।
শাহ মখদুম রূপস মাহিসওয়ারের পরামর্শে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে অংশুদেবের প্রধান পুরোহিতের শ্যালক পঞ্চানন পাণ্ডেকে হাত করলেন। অবশ্য এর পেছনে অন্য ঘটনাও আছে। চল্লিশজন স্ত্রীর গর্ভে অংশুদেবের পঞ্চাশটা ছেলেমেয়ে জন্মেছিল। এদেরই মধ্যে এক মেয়ে ছিল অনন্য সুন্দরী। মেয়েটিকে দেখে হুঁশজ্ঞান হারিয়ে ফেলে পঞ্চানন। প্রেম নিবেদন করে বসে। সাধারণের জন্যে রাজার মেয়েকে বিয়ে করা কিংবা তার সাথে প্রেম করার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। প্রধান পুরোহিতের মুখের দিকে তাকিয়ে অংশুদেব পঞ্চাননকে শূলে চড়াল না বটে, তবে তার নাক-কান কেটে দিল। প্রতিহিংসায় দ্বিতীয়বার হুশ হারাল পঞ্চানন। অংশুদেবকে ঝাড়েবংশে শেষ না করে তার শান্তি নেই। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। শাহ মখদুম রূপসের সাথে যুদ্ধে হেরে গর্দান হারাল অংশুদেব আর তার ভাই খেজুরচণ্ড। রাজার মেয়েটিকে পেতে ছেয়েছিল পঞ্চানন। তবে শাহ মখদুম রূপস তাতে রাজি হননি। ঘটনা জানাজানি হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে টাকা-পয়সা নিয়ে সে পালিয়ে গিয়েছিল বহুদূরের কোশল রাজ্যে। আত্মগোপন করে থাকা রাজার অনুসারী কিছু তান্ত্রিক বিষয়টি আঁচ করতে পেরে একরাতে প্রধান পুরোহিতের বাড়ি আক্রমণ করে ওটাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বহুদিন ওই ভিটে ছিল পরিত্যক্ত। এর অনেকদিন পর ওখানে আবার বাড়ি তৈরি করে ওই পুরোহিতের বংশধরেরা। ওই পুরোহিতেরই নাতির নাতি তস্য নাতি হলো তোদের এই সিধু জ্যাঠা, বুঝলি কিছু রে, বেন্দাবন?